সাম্প্রতিক বাংলাদেশ: বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির চোখে
revolutionary-works-party

হাসিনা সরকার বিরোধী আন্দোলন, সেই সূত্রে সরকারের পতন, নতুন তদারকি সরকারের চরিত্র ও ভবিষ্যৎ কার্যপ্রণালীর মতো কয়েকটি মূল বিষয়ে আমাদের অবস্থান আপনারা আপনাদের পাঠানো চিঠির মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলেন। আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে সেগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি।

১) ছাত্র জনতার এই অভূতপূর্ব গণজাগরণ

গণঅভ্যুত্থান আকস্মিক ঘটনা ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দেশের জনগণের বহুমাত্রিক পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ছাত্র জনতার এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। চরম দমন নিপীড়ন মোকাবিলা করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি নৃশংস ফ্যাসিবাদী শাসনকে বিদায় করতে যে জোরদার লড়াই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে শিক্ষার্থীরা শেষে তাকে মরনপণ লড়াইয়ে পরিণত করেছে; হাসিনা সরকারকে উৎখাত করেছে। ছাত্র জনতা সমগ্র সশস্ত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থার মোকাবিলা করে কার্যত রাষ্ট্রকে অচল করে দিয়েছে।

ছাত্রদের সঙ্গে এই গণঅভ্যুত্থানে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে শহরের শ্রমজীবী মেহনতি সাধারণ মানুষ। যে এক/দেড় হাজার (সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি) মানুষ শহীদ হয়েছেন তার মধ্যে শহরাঞ্চলের সর্বহারা আধা-সর্বহারা মানুষের সংখ্যাই বেশি।

হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিদায়ের দিন ৫ আগস্টকে অনেকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মতো বিজয় হিসাবেও দেখছেন।

এই অভ্যুত্থান সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে নতুন এক গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জমি তৈরি করে দিয়েছে।

এই অভ্যুত্থানের পরিণতিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আপাতত নির্দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে একটি অন্তর্বতী সরকার গঠিত হয়েছে। তারা এখন সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণের সমর্থন পাচ্ছে।

এই সরকারের সামনে গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে আছে রাজনৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, অর্থনীতির চাকা সচল করা, উপর থেকে নীচ পর্যন্ত গণহত্যার অপরাধীসহ ফ্যাসিবাদের সকল হোতাদের গ্রেফতার ও বিচার করা, রাষ্ট্র ও সরকারের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ব্যাপারে জাতীয় সমঝোতা তৈরি করা এবং সর্বোপরি একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা।

কিন্তু এই সরকারের যদি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ দেখা দেয় (সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা) তাহলে রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে সরকারের বিরোধ দেখা দেবে।

২) এই সরকারের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা

ছাত্র জনতার অধিকার ও মুক্তির গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ধারণ করবে, তাকে সম্মান দেখাবে। তারা হাসিনার গণসমর্থনহীন সরকারের আবর্জনা পরিষ্কার করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তাদেরকে অনতিবিলম্বে সকল মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও আমলাতন্ত্রসহ রাষ্ট্রের সকল স্তর থেকে হাসিনা সরকারের দোসরদের অপসারণ, সকল অগণতান্ত্রিক কালো আইন বাতিল, সমগ্র নির্বাচনী ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একইভাবে গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদদের উপযুক্ত মর্যাদা, নিহত ও আহতদের পরিবারসমূহকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩) এই গণজাগরণ প্রসঙ্গে

গণঅভ্যুত্থানে শহর ও শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক সহ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জেলা উপজেলা স্তরে শেষ দিকে কোথাও কোথাও গ্রামের কৃষক মজুরদেরও ভূমিকা নিতে দেখা গেছে।

তাদের প্রত্যাশা এই সরকার শ্রমিক, কৃষক ও গ্রামের গরীবদের বাঁচার আশু দাবিসমূহ পূরণ করবে; বন্ধ কলকারখানা চালু করার উদ্যোগ নেবে।

৪) আদিবাসীসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রত্যাশা

আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের প্রত্যাশা সকল ধরনের বৈষম্যের বিলোপ হবে। তাদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে।

৫) বর্তমান পরিস্থিতি

এখনও রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতি ফিরে আসেনি, এটা আসতে সময় নেবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে দেশের ভিতরে বাইরে বহু ধরনের তৎপরতা রয়েছে। অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতারও আশংকাও রয়েছে। সরকারের অনেকগুলো জরুরি চ্যালেঞ্জ আছে। ভারত ছাত্র জনতার গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় ও বিজেপির বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানিমূলক তৎপরতায় দেশের মানুষের প্রচন্ড বিক্ষোভ রয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থনে এই সরকার কতদিন থাকবে, তাদের নিজেদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে কিনা, থাকলে কি — এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের এখনও পরিষ্কার কোনও উত্তর নেই। এই সরকারের উপর মার্কিনী প্রভাব কতখানি তা নিয়েও আলোচনা আছে।

৬) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা

আমাদের বার্তা হচ্ছে আমরা আমাদের এই গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা চাই। আমরা হাসিনা সরকারের হাতে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তার নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে ইতিমধ্যে জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়েছি।

ভারতের ব্যাপারে আমাদের বিশেষ বার্তা হচ্ছে ভারত কোনভাবেই আর যেন পতিত স্বৈরতন্ত্রী ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সহযোগী না হয়। ভারত যদি হাসিনা সরকারকে একরোখা সমর্থন না যোগাতো তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতি এড়ানোর সুযোগ থাকতো।

ভারতের সাথে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমরা আমাদের সকল দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধানও করতে চাই।

৭) বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিষয়ে

আমরা মনে করি প্রশ্নটা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা নয়, প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারী দলের দখলদারিত্ব, দলবাজি, সন্ত্রাস, মাস্তানি, গুন্ডামী, জিম্মি দশার অবসান ঘটানো। মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। আর আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতার সূতিকাগার। এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যা করছে তা এখন পুরোটাই রাজনৈতিক চরিত্রের।

৮) বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রধান রক্ষাকবচ তার জনগণের ঐক্য। বাংলাদেশকে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের বাইরেই তার জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ যাতে কোনো পরাশক্তির লীলাক্ষেত্র না হয় তা আমাদের একটি বিশেষ মনোযোগের বিষয়।

- সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

খণ্ড-26