লাফ দিয়ে ক্রমাগত বেড়ে চলা উন্নত মানের আলুর বীজের দাম, আর বিপরীতে কম ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, এই গোলকধাঁধায় বাংলার আলু চাষিরা ঘুরপাক খাচ্ছেন। বাংলার আলু চাষিরা পাঞ্জাব থেকে জীবাণুুমুক্ত উন্নত মানের বীজ পছন্দ করেন, কারণ তাতে উৎপাদন অনেকটাই বেশি হয়। গতবছরে ব্যাগ পিছু ওই বীজের দাম ছিল ৩,০০০ টাকা, যা এ’বছর বেড়ে হয়েছে ৫,০০০ থেকে ৫,২০০ টাকা।
ডাউন-টু-আর্থ পোর্টালে এক সাক্ষাৎকারে হুগলির এক চাষি মানিক চৌধুরি জানিয়েছেন, এক বিঘার জন্য অন্তত তিন ব্যাগ বীজের প্রয়োজন। অর্থাৎ, শুধু বীজের খাতে ১৫,০০০ টাকা খরচ করতে হয়। এর বাইরে রয়েছে সার, কীটনাশক, শ্রমের মূল্য, ক্ষেতে পর্যাপ্ত জল সরবরাহের জন্য মাশুল, হিমঘরে নিয়ে যাওয়ার পরিবহন খরচ ইত্যাদি। আরেকজন চাষি, শেখ আশরাফ আলি বলেন, বিঘা প্রতি ৭৫-৮০ ব্যাগ আলুর ফলন হয়। আর এমএসপি’র নির্ধারিত দামে বিক্রি করলে আলু চাষিরা বড়জোর ২৪,০০০ টাকা পান। কিন্তু, ইতিমধ্যেই চাষিরা বিঘা পিছু ৩০,০০০-৩২,০০০ টাকা খরচ করে ফেলেছেন।
আলি জানান, বার বার সরকারের কাছে এমএসপি বাড়াবার দাবি করলেও সরকার তার কোন আমলই দেয়নি।
আলু চাষিদের একাংশ বলেন, এক ধরনের পোকা আলু চাষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, ফলে তাদের লোকসানের বহর বেড়ে যায়। কারুর কারুর ক্ষেত্রে ফলনের প্রায় অর্ধেকই নষ্ট হয়। তাই বেশি দাম দিয়ে উন্নত বীজ কেনেন আর তার জন্য গতবছর তাঁদের ফলন বেশি হয়, লাভও হয় যথেষ্ট। গতবছর আলুর দামও উঁচুতে ছিল ফলে তাদের লাভও হয়। তখন সার ও বীজের দামও কম ছিল।
গতবছর এ’রাজ্যে আলুর উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি টন আর এবার তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১.২ কোটি টনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছে অনুকূল প্রাকৃতিক আবহাওয়াগত কারণে। রাজ্যে ৪ লক্ষ একর জমিতে আলু চাষ হয় আর আনুমানিক ১০ লক্ষ চাষি ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত আলু চাষে যুক্ত থাকেন। “উৎপাদনের পাশাপাশি, আমাদের অন্যান্য খরচও বহন করতে হয়”, জানালেন আশরাফ আলি, “মজুরের মাথা পিছু দৈনিক ২৫০ টাকা দিতে হয়, কমপক্ষে ১০ জন মজুর লাগে বীজ রোপন ও ফলন তোলার সময়ে”।
হিমঘরের মালিকদের বক্তব্য, একবারের জন্যই বস্তা পিছু ৮৫ টাকা নেওয়া হয় ভাড়া বাবদ, কিন্তু বাজারে আলুর দাম যখন কম থাকে তখন তাঁরা তা বিক্রি করে না, দাম বাড়ার অপেক্ষায় থাকে। অন্যান্য রাজ্যে আলুর রপ্তানি হয়, আর অন্য রাজ্যে আলুর ফলন কম হলে বাংলার আলুর চাহিদা বেড়ে যায়।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ও রাজ্য সরকারের কৃষি বিষয়ক পরামর্শদাতা প্রদীপ মজুমদার আলু চাষিদের বক্তব্যকে খারিজ করে বলেন, কেজি প্রতি ৬ টাকা এমএসপি’তে লোকসান ঠেকানো যায়। কিন্তু চাষিরা কেজি প্রতি ৯ টাকা করে বিক্রি করছেন, ফলে তাঁদের লোকসান হওয়ার কথা নয়। আলুর দাম বস্তা পিছু ১৯০-২২৫ টাকায় যখন নেমে যায়, তখন এমএসপি ঘোষণা করা হয়। তিনি আরও দাবি করেছেন, অভাবি বিক্রি ঠেকাতে রাজ্য সরকার এই নিয়ে গত দশ বছরে চতুর্থ বারের জন্য এমএসপি ঘোষণা করেছে।
২০১৯-এ শেষবার বস্তা পিছু ২৫০ টাকা হিসাবে এমএসপি ঘোষণা করা হয়। যদিও তিনি স্বীকার করেন, ক্রমবর্ধমান বীজের দাম এ’রাজ্যে আলু চাষিদের কাছে রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়, আর পাঞ্জাবের বীজ ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
- ডাউন-টু-আর্থ