সমতা বনাম আরএসএস : আধুনিক ভারতের ধারণাগুলির মধ্যে বুনিয়াদি সংগ্রাম
undamental-battle-of-ideas

“জাতিপ্রথা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং যিনি জাতিপ্রথাকে আক্রমণ করেন তিনি ভারতের শত্রু।” এমন মন্তব্য করা হয়েছে আরএসএসের হিন্দি মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’র সম্পাদকীয়তে। জাতিপ্রথাকে এমন খোলাখুলিভাবে গৌরবান্বিত করাটা সাম্প্রতিককালে আর দেখা যায়নি। ভারতের স্বাধীনতার ৭৭তম বার্ষিকীর ঠিক আগেই যে প্রকাশিত হল এই সম্পাদকীয় এবং আজকের ভারতের ‘সরকারি মতাদর্শের’ অভিভাবক যে আরএসএস সামনের বছর তাদের শতবার্ষিকী উদযাপন করবে, এগুলো আমাদের জানাচ্ছে কেন এটাকে দক্ষিণপন্থী পশ্চাদমুখী বিক্ষিপ্ত জিগির বলে উপেক্ষা করা যাবে না।

এটা সুবিদিত যে আরএসএসের ভারত বীক্ষা আর ভরতের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিকশিত হওয়া এবং বাবা সাহেব আম্বেদকরের সভাপতিত্বে রচিত ভারতের সংবিধান অনুমোদিত ভারতের বীক্ষা — এই দুই বীক্ষা সর্বদাই পরস্পরের বৈপরীত্যমূলক হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর ঐ সংগঠনের কব্জা থেকে জন্ম নেওয়া ঔদ্ধত্য ও শাস্তি থেকে অব্যাহতি লাভের বোধ থেকেই এই ধরনের রাখঢাক না রাখা কথা আসতে পারে। এই সেদিনই আমরা দেখলাম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সার্কুলার জারি করে আরএসএস সংগঠনে ও তাদের কার্যকলাপে সরকারি কর্মচারীদের যোগদানের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞাকে তুলে নিল।

তার গড়ে ওঠার বছরগুলোতে আরএসএস তাত্ত্বিকরা কখনই তাঁদের মতামতকে গোপন করার চেষ্টা করেননি এবং মনুস্মৃতিকে ভারতের সামাজিক আচরণবিধি রূপে গ্ৰহণ করা এবং মুসোলিনি ও হিটলারের ধারণা ও নীতিসমূহকে অনুকরণ করার কথা খোলাখুলিভাবেই ব্যক্ত করেন। তবে, স্বাধীন ভারতে তার আইনি মর্যাদাকে বজায় রাখার জন্য আরএসএস’কে সংবিধান অনুসারী এক আখ্যানের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এরপর আবার ক্ষমতা অর্জন করা ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের জন্য তাকে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গেও খাপ খাওয়াতে হয়েছিল। আরএসএসের ব্রাহ্মণ্যবাদী কেন্দ্র আজ নিপুণভাবে রপ্ত করেছে এসসি/এসটি/ওবিসি বান্ধব হওয়ার প্রতারণামূলক কৌশলকে।

এই প্রক্রিয়ায় এগোনোর সাথে আরএসএস জাতপ্রথা ও তার সাথে সংরক্ষণ প্রশ্নের মোকাবিলায় এক বহুমুখী কৌশলের উদ্ভব ঘটিয়েছে। তিন দশক আগে ভি পি সিং সরকার যখন মণ্ডল কমিশনের কিছু সুপারিশ রূপায়ণের কথা প্রথম ঘোষণা করে আরএসএস তখন উগ্ৰ সংরক্ষণ-বিরোধী অবস্থানের জন্যই পরিচিত ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্ঘ বাহিনী সংরক্ষণ বিরোধিতার নিরর্থকতার বিষয়টা উপলব্ধি করল, এবং তার পরিবর্তে ওবিসিদের একটা অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে জাতপ্রথাকে বিভেদ সৃষ্টিকারী সামাজিক বিন্যাস ঘটানোর হাতিয়ার রূপে ব্যবহারে বিশারদ হয়ে উঠতে লাগল। ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে আমরা শুনলাম, নিম্নবর্ণের জনগণ ২০০০ বছর ধরে যে বৈষম্য ভোগ করেছেন তার অবসানের জন্য মোহন ভাগবত ২০০ বছর ধরে সংরক্ষণকে মেনে নেওয়ার জন্য উচ্চবর্ণের ভারতীয়দের বোঝানোর চেষ্টা করছেন।

মোহন ভাগবতের মুখে ২০০০ বছর ধরে জাতভিত্তিক বৈষম্যর কথা শোনাটা দশক দশক ধরে অস্বীকারের পর বিলম্বিত স্বীকৃতি বলেই শোনালো। ক্ষমতায় থেকে বিজেপির হাতে এখন সংরক্ষণকে কাটছাঁট করা ও অগ্রাহ্য করার অনেক উপায় রয়েছে — সংরক্ষণকে সরাসরি বাতিল করার পরিবর্তে সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে অবিবেচকের মতো ব্যবহার করা।

অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য কোটার নামে শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণের প্রবর্তন, যোগ্য প্রার্থী খুঁজে না পাওয়ার ভুয়ো ও তুচ্ছ অজুহাতের অবাধ প্রয়োগে এসসি/এসটি/ওবিসি কোটাকে অপূর্ণ রাখা, ‘সরাসরি নিয়োগ’ ব্যবস্থা এবং বেসরকারিকরণকে যথেচ্ছভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে সংরক্ষণকে পুরোপুরি নাকচ করা — এই সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থাটাকেই বানচাল করার বহু উপায় মোদী সরকার ছকেছে।

এ সত্ত্বেও জাতগণনার দাবিটা আরএসএস’কে কিছুটা বিপাকে ফেলেছে বলেই মনে হয়। জাতগণনা হলে তা যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে ন্যায্য প্রতিনিধিত্বের দাবির জন্ম দেবে সেই বিষয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠে সঙ্ঘ বাহিনী জাতগণনার ধারণাটারই মর্যাদাহানি ঘটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ‘পাঞ্চজন্য’র সম্পাদকীয় বলছে, জাতপ্রথা হল হিন্দু ধর্ম, জাতপ্রথা ভারতীয় জাতি এবং সমস্ত জাত এক সৌহার্দ্যপূর্ণ বিন্যাসে ঐক্যবদ্ধ। জাতপ্রথা যদি অমন কেন্দ্রীয় বিষয় এবং সর্বত্র বিরাজমানই হয় তা হলে একেবারে হালফিলের জাতগণনা নিয়ে আরএসএসের এত ভয় কেন? কারণ, জাতপ্রথা এবং তার সাথে লিঙ্গ হল ভারতে সামাজিক অসাম্য ও অসামঞ্জস্যের সবচেয়ে বড় নির্দেশক। সঙ্ঘের প্রচার যেমন ভারতীয় অর্থনীতির সার্বিক আকার দেখিয়ে ভারতের কলঙ্কজনক অর্থনৈতিক অসাম্যকে আড়াল করতে চায়, একইভাবে তারা জাতপ্রথার সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সমন্বয় বিশিষ্ট সামাজিক বিন্যাসের ভিত্তি হওয়ার কল্পকথাকে ছড়িয়ে সামাজিক প্রতিনিধিত্বের চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক ধরনটিকেও ধামাচাপা দিতে চায়।

জাতপ্রথার মতোই ভারতের সাঙাতি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্পর্কেও সঙ্ঘ-বিজেপি একইরকম রক্ষণাত্মক অবস্থানে রয়েছে। আদানির চোখধাঁধানো উত্থান ও সুবিশাল কর্পোরেট জালিয়াতি এবং আদানি গোষ্ঠীর হাতে অপরিমেয় ধনসম্পত্তি ও সরকারি সম্পদের কেন্দ্রীভবনের মূলে মোদী-আদানি দোস্তির মুখ্য ভূমিকা নিয়ে যে কোনো প্রশ্নকেই ভারত-বিরোধী ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আদানি-আম্বানিদের নিয়ে কাহিনিগুলো মূলত হল রাষ্ট্রীয় মদতে আগ্রাসী পথে সম্পদের পুঞ্জীভবন এবং বৈভবের অশ্লীল প্রদর্শন; এ সত্ত্বেও সঙ্ঘ তাদের আলোচনায় এগুলোকে মহান জাতীয় কীর্তি রূপে উদযাপন করে এবং এই ঘটনাটাকে আড়াল করতেই সেগুলোকে তুলে ধরে যে, ধনীতমদের পাঁচ শতাংশকে বাদ দিলে ভারতের মাথাপিছু আয় পৃথিবীর দরিদ্রতম কয়েকটি দেশের সমতুল্য হয়েই দেখা দেবে। এটা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে যে, জাতপ্রথা ও সাঙাতি পুঁজিবাদের পথেই অনিবার্যভাবে এসেছে ভারতের সুতীব্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য; কিন্তু সঙ্ঘের ভারত বীক্ষায় এগুলো হলো ভারতের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দুটি স্তম্ভ।

সঙ্ঘের যে বীক্ষায় অসাম্যকে ভারতের সাফল্যের আখ্যায়িকা রূপে উদযাপন করা হয় তা কিন্তু আম্বেদকরের সর্বজনীন সমানাধিকার ভিত্তিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ভারত বীক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত, যে ভারতের ভিত্তি হবে স্বাধীনতা, সমতা ও সৌভ্রাতৃত্বের নীতি, যে তিন নীতি এক অখণ্ড সমগ্ৰকে গঠন করবে। আম্বেদকর মনে করতেন ‘এক ভোট, অভিন্ন মূল্য’র রাজনৈতিক সমতার প্রতি সবচেয়ে বড় বিপদটা রয়েছে ভারতের গভীরে শিকড় চাড়ানো সামাজিক অসাম্য ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে, এবং ঐক্যবদ্ধ আধুনিক জাতি রূপে ভারতের বিকাশে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল জাতপ্রথা। আর ভারতে যে আরএসএসের উপস্থিতি তারা জাতপ্রথাকে ভারতের স্থিতিশীলতা ও শক্তির বুনিয়াদি উৎস রূপে গণ্য করে।

মোদী মুখে যতই সংবিধানের প্রতি আনুগত্য দেখান না কেন, আরএসএসের বিশ্ববীক্ষা ন্যায়বিচার ও সমতা ভিত্তিক সাংবিধানিক বীক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত, যেগুলি ছাড়া ঐক্যবদ্ধ আধুনিক ভারত হতে পারে না। কলকাতায় এক যুবতী ডাক্তারের বীভৎস ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে সারা পশ্চিমবাংলা যেভাবে ক্রোধে ফেটে পড়ল এবং সারা দেশও সংহতি জানালো, স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে ‘রাতের দখল নাও’এর বহু প্রতিবাদ সমাবেশ এবং ‘আমরা সুবিচার চাই’ গর্জনের মধ্যে দিয়ে অভূতপূর্ব মাত্রায় নারী স্বাধীনতার সমবেত আত্মঘোষণার উদযাপন হল, তা যথেষ্ট অনুপ্রেরণা সঞ্চার করল। আজ স্বাধীনতা দিবস অতীত স্মরণের ক্ষণ নয়, তা সাংবিধানিক অভীষ্ট ও অধিকারের সুরক্ষায় লড়াইয়ের দিন এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য ভারতকে আরএসএসের অভিপ্রায়ের সামগ্রিক পরাজয়কে সুনিশ্চিত করতে হবে।

- লিবারেশন পত্রিকা, সেপ্টেম্বর ২০২৪

খণ্ড-26