নতুন আরম্ভের লক্ষ্যে জাগ্রত জনপদ রাজপথ
aims-for-a-new-beginning

লেনিন একবার বলেছিলেন, “দেয়ার আর ডিকেডস্ হোয়েন নথিং হ্যাপেন্স, দেয়ার আর উইকস্ হোয়েন ডিকেড হ্যাপেন্স”। অর্থাৎ, কখনও কখনও নিস্তরঙ্গ ঘটনাবিহীন কয়েকটা দশক কেটে যায়, আবার এমনও হয় যখন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রবেশ করে একাধিক আন্দোলিত উত্তাল দশক। আজ এ’রাজ্য যেন সেই ঘটনাবহুল পর্বকালের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হচ্ছে।

ক্ষমতার লাল চোখকে পরোয়া না করে এমনকি বিভিন্ন প্রান্তে এবার স্কুল পড়ুয়ারাও পথে নামছে। বিভিন্ন বর্গের, স্তরের, স্বরের, মতের নাগরিকরা এক পক্ষকাল ব্যাপী তুমুল বিক্ষোভ, প্রতিবাদে রাজপথকে কাঁপাচ্ছে একটাই স্লোগানে — আরজিকর চায় ন্যায়বিচার! এদিকে, দু’সপ্তাহের বেশি সময় পার হল, এখনও চিকিৎসক খুনের রহস্য কাটল না। উত্তর মিলল না রাশি রাশি প্রশ্নের। মৃতার মা একই প্রশ্ন তুলেছেন। যে সিবিআই’কে বিরোধী নেতানেত্রীদের ধড়পাকড় করতে এত সক্রিয় ও তৎপর দেখা যেত, তারা আজও অন্ধকারে। আন্দোলনরত ডাক্তাররা সিবিআই দপ্তরে এই সব প্রশ্ন নিয়ে গেলে তাঁদেরও হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়।

খুন ধর্ষণের হাত ধরে আরজিকর কাণ্ডে প্রকাণ্ড এক দুর্নীতির অভিযোগ আসতে শুরু করেছে, যার মূল পান্ডাই হলেন সন্দীপ ঘোষ। বেওয়ারিশ লাশ পাচার, বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য বিক্রি, দরপত্র ও আর্থিক অনিয়মের ভুরি ভুরি অভিযোগ যে আজ সামনে আসছে, তা নয়। ভূতপূর্ব ডেপুটি সুপার তা নিয়ে রাজ্য ভিজিল্যান্স কমিশনের কাছে অভিযোগ করেন, তদন্তেও তা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্ত কেন ছাড় পেয়ে যায়, তা আজও রহস্যাবৃত। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট জানাচ্ছে, আরজিকরে অন্য বর্জ্যের থেকে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্যের পৃথকীকরণ ব্যবস্থার দশা ছিল শোচনীয়। একবার স্যালাইন বোতল ব্যবহার করার পর তা পরিত্যাগ করার বদলে পুনরায় ব্যবহার করা হোত। শুধু আরজিকর নয়, কলকাতার একাধিক সরকারি হাসপাতালে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মর্মান্তিক চিত্রও ফুটে ওঠে। জাতীয় পরিবেশ আদালতও ভর্ৎসনা করে মন্তব্য করে, শহরের প্রধান সরকারি হাসপাতালগুলো জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষাকে বিপন্ন করে তুলছে। এ নিয়ে ২০১৫-২১ পর্যন্ত যে মামলা চলে, তার মোট ৩০টি শুনানিতেই আদালত নিজের বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার উপরে। আরজিকর হাসপাতালে চলতে থাকা অব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় সন্দীপ ঘোষ।

সংবাদমাধ্যমে এটাও উঠে এসেছে, শাসকদলের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করলে পরীক্ষা সহ বিভিন্ন বিষয়ে সুবিধা মিলবে, নয়তো উত্তরবঙ্গে বদলি করা হবে। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা, রেশন ব্যবস্থার পর চিকিৎসা ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্রকে দুর্নীতির গভীর পাঁকে ডুবিয়ে সন্দীপ ঘোষের মতো জনতার আদালতে সাব্যস্ত অপরাধীরা ক্ষমতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রভাবের ছত্রছায়ায় অবাধে তৈরি করেছিল এক বাস্তু ঘুঘুর বাসা।

আজ আরজিকর ইস্যুতে দুকূলপ্লাবি ন্যায়বিচার আন্দোলন এই বিরাট অন্যায় অবিচারকে সমূলে উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে পরিচালিত করার উপরই জোর দিতে হবে। ‘রাত দখলের’ ডাক দেওয়া মেয়েরা সমগ্র ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতির সিন্ডিকেট ভাঙা, কাজের জায়গা ও জনপরিসরে নারী ও রূপান্তরকামীদের নিরাপত্তার আর্জি, সর্বব্যাপী পিতৃতন্ত্রের ও ধর্ষণ মানসিকতার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ প্রতিরোধের মশাল জ্বেলেছেন আর যার সাথে কণ্ঠ মিলিয়েছেন হাজার হাজার সর্বস্তরের নাগরিক, তার প্রতি রাজ্য সরকারের কোনো ইতিবাচক মনোভাব আজ পর্যন্ত দেখা গেল না।

এই চরম উদ্ধত, অসংবেদী দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের মাধ্যমে আঘাতের পর আঘাত হেনেই দাবি আদায় করতে হবে। পিতৃতান্ত্রিকতা ও ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্ষকদের প্রশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে, ভয়মুক্ত এক নতুন আরম্ভের লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছে জাগ্রত জনতার মিছিল।

খণ্ড-26