আজকের দেশব্রতী : ১৬ মে ২০২৪ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-16-may-issuemodi-magic-has-reached-the-endmodi-magic-has-reached

চার দফা নির্বাচনের পর ক্রমেই এটা স্পষ্ট হচ্ছে, মোদী ম্যাজিকের সেই ‘অলৌকিকতা’ এবারের নির্বাচনে ভূভারত থেকে উধাও। কর্পোরেট সংস্থাগুলো বেসরকারি ভাবে যে একজিট পোল করিয়েছে, তাতেই তারা বুঝে গেছে তৃতীয়বারের জন্য মোদীর ফিরে আসা রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়েছে। আর তাই মে মাসের প্রথম দশ দিনের মাথায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতের শেয়ার বাজার থেকে এক লপ্তে তুলে নিল ১৭,০০০ কোটি টাকা, রাজনৈতিক অস্থিরতার আঁচ পেয়ে!

এখন দেশ জুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত মোদীর অসহায়তা ও মানসিক অস্থিরতা। মোদী গ্যারান্টি, বিকশিত ভারত, বিশ্বের দ্রুততম বিকাশশীল অর্থব্যবস্থা যা ভারতকে নিয়ে যাবে তিন নম্বরে — প্রভৃতি সমস্ত কিছুই আম জনতার কাছে মিথ্যা রসিকতায় পর্যবসিত হওয়ার পর মরিয়া মোদী আরএসএসের চিরাচরিত মেরুকরণের হীন রাজনীতির কোলে আশ্রয় নিলেন। আজ পর্যন্ত দেশের কোনও প্রধানমন্ত্রী সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষকে এতো নিচুতে নামিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ময়দানে নামেননি। আর কখনোই খোজা প্রহরীর মতো গলায় বকলশ পরা জাতীয় নির্বাচন কমিশন শাসক দলের পক্ষে দাঁড়িয়ে এইভাবে খোলাখুলি খেলতে নামেনি। আর কোনোদিনই একাধিক বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীকে জেলে পাঠিয়ে গোটা দেশকে প্রকাণ্ড একটা কারাগারে রূপান্তরিত করে লোকসভা নির্বাচন হয়নি। কী অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে এবারের লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে আজ তা সারা বিশ্ব দেখছে।

এই প্রথম বার মোদী পরোক্ষে স্বীকার করলেন, নোটবন্দি কালো টাকা রুখতে পারেনি। আদানি আম্বানির টেম্পো ভর্তি কালো টাকার উল্লেখ একই সাথে আরও একটা প্রশ্ন তুলে দিল — কেন সেই কালো টাকা উদ্ধারে ইডি বা কেন্দ্রীয় এজেন্সি হাত গুটিয়ে বসে থাকল! দেশের চৌকিদার কেন নিজ কর্তব্য পালনে এই চরম গাফিলতির জন্য জবাবদিহি করবেন না? সন্দেশখালির একের পর এক স্টিং অপারেশন দেখিয়ে দিল, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করতে বিজেপি অর্থবল, অস্ত্রবলের উপরই শুধু নয়, নারীর সম্ভ্রমকে হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে কত নিচে নামতে পারে। যে ভিডিও নিয়ে বিজেপি নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, তাদের জানিয়ে দেওয়া দরকার যে জেএনইউ’তে আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে কানহাইয়া কুমার, অনির্বাণ ভট্টাচার্যদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসাতে কীভাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির ঘনিষ্ঠ এক নেত্রী ভুয়ো ভিডিও তৈরি করে, যা পরবর্তীতে আদালতে প্রমাণিত হয়। কীভাবে ভীমা কোরেগাঁও’এর মিথ্যা মামলা সাজাতে প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের পেগাসাসের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে ভুয়ো তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

মুসলিম বিদ্বেষকে কল্পনাতীত কর্দযতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই নির্বাচন পর্বে। উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকিতে বিজেপির নেতা রঞ্জিত বাহাদুর শ্রীবাস্তব এক নির্বাচনী সভায় বলেন, “গত পাঁচ বছর ধরে মোদী মুসলমানদের মনোবল ভেঙে চুরমার করার কাজে নেমেছেন। যদি মুসলমানদের নির্বংশ করতে হয়, তবে মোদীকে ভোট দিন। আর না দিলে তার ঠেলা সামলাতে আপনারা প্রস্তুত থাকুন।” এই সমস্ত ঘৃণা ভাষণ নির্বাচন কমিশনের কানে ঢোকে না!

বিবিধের মাঝে মহান ভারতের এটাই ঐতিহ্য, এবারের নির্বাচনে মেরুকরণের ঘৃণ্য রাজনীতিকে পেছনে ফেলে আবার বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে রক্ষা করার অ্যাজেন্ডাই সামনে চলে আসছে, মোদী ম্যাজিকের কাল্পনিক যাদুকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করে।

মোদীর ফ্যাসিবাদী জমানার নিশ্চিত পরাজয় এখন আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ দূরে!

defeat-hate-dethronedethrone-the-modi-regime

২০২৪’র প্রলম্বিত নির্বাচন এখন মধ‍্যপর্বে। বিজেপি তার ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’এর বাগাড়ম্বরটুকুও বিসর্জন দিয়ে সরাসরি মুসলিম বিদ্বেষী ঘৃণাপ্রচারকে তাদের নির্বাচনী প্রচারের মূলমন্ত্র করে তুলেছে। বিরোধীপক্ষ সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদী ও অন‍্যন‍্য বরিষ্ঠ বিজেপি নেতাদের ছুঁড়ে দেওয়া অভিযোগগুলি আরো বেশি বিষাক্ত ও নির্লজ্জ হয়ে উঠছে। শুরু করেছিল এই অভিযোগ দিয়ে যে কংগ্রেস নাকি সাধারণ মানুষের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে — মহিলাদের বিয়ের মঙ্গলসূত্র, বাড়িঘর, গরুমোষ সবকিছু — এবং তা মুসলমানদের মধ‍্যে বিলিবণ্টন করে দেবে। এরপর এল আরেক শয়তানি অপপ্রচার যে, এসসি/এসটি/ওবিসি কোটার সব সুযোগ মুসলমানদের দিয়ে দেওয়া হবে। এবং এখন ওরা ভোটারদের বোঝানোর চেষ্টা করছে যে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার ফিরে এলে তা পাকিস্তানের জন‍্য কত খুশির বিষয় হবে।

পাকিস্তান টেনে প্রচার অবশ‍্য বিজেপির চিরাচরিত পদ্ধতি। গুজরাটে মোদী ২০০২ সাল থেকে প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে পাকিস্তানের ধুয়ো তুলে প্রচার করেছেন। বিহারে ২০১৫’র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যখন নীতীশ কুমারের জেডিইউ’এর সমর্থন ছাড়াই ভোট লড়েছিল তখন ২৪৩ আসনের বিধানসভায় মাত্র ৫৩ আসন জিততে পেরেছিল। সেই নির্বাচনে অমিত শাহ বিহারের মানুষকে পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে সন্ত্রস্ত করার সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সব সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের দিয়ে দেওয়া হবে বলে সাধারণ হিন্দু জনতাকে ভয় দেখানোর এমন মোটা দাগের আকাট প্রচার মোদী ও বিজেপি আগে কখনও করেনি। এবং মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী, এদেশে ঢুকে জনসংখ‍্যা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেশ দখল করতে চাইছে — খোদ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক একটার পর একটা ভাষণে এইভাবে দেশের মুসলমান সমাজকে আক্রমণের নিশানা বানানো মারাত্মক ও চরম আপত্তিকর।

মোদী বুঝতে পেরেছেন যে সংরক্ষণ বিষয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ভারতের সংবিধানের ভবিষ‍্যৎ বিষয়ক কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। সংরক্ষণ বিতর্ককে বিরোধীপক্ষ হিসেবে ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতার নানান পরিসরে দেশের বিবিধ সামাজিক গোষ্ঠীর যথাযথ মাত্রার প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে উত্তরিত করতে পেরেছে। বিহারে জাত জনগণনা সম্পন্ন হওয়া এবং তার ফলশ্রুতিতে সংরক্ষণের সীমা ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রসারিত করা (ইডব্লুএস কোটার ১০ শতাংশকে হিসেবের বাইরে রেখে) সারা দেশের জন‍্য একটা কার্যমাণক হাজির করেছে। বিহারে এই জাত জনগণনাকে বিরোধিতা করার অবস্থা বিজেপির ছিল না, কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে জাত জনগণনার চরম বিরোধী বিজেপি। তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে এসসি/এসটি/ওবিসি জনতাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে সংরক্ষণ প্রশ্নটিকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে।

ওবিসি কোটা মুসলিমদের দিকে চালান করে দেওয়া হচ্ছে বলার থেকে অসত‍্য ও শয়তানি আর কিছু হতে পারে না। গুজরাট সহ দেশের দশটিরও বেশি রাজ‍্যে বহুদিন ধরে মুসলমানদের মধ‍্যেকার বেশ কিছু জাত ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আছে। তাঁরা মুসলমান হিসেবে সংরক্ষণ পান না, তাঁরা সংরক্ষণ পান তাঁদের পেশাগত, সামাজিক ও শিক্ষাগত পশ্চাদপদতার মাপকাঠিতে ওবিসি হিসেবে স্বীকৃতির কারণে। মুসলমানদের মধ‍্যে এরকম জাতের তালিকাটা সবচেয়ে দীর্ঘ সম্ভবত গুজরাট রাজ‍্যে এবং এএনআই সংবাদ সংস্থাকে ২০২২ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নরেন্দ্র মোদীকে দেখা যাচ্ছে গুজরাটে ৭০টি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ওবিসি’র সুযোগ দেওয়ার জন‍্য কৃতিত্ব জাহির করতে। বিহারে মুসলমানদের ওবিসি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেই কর্পূরী ঠাকুরের সময়ে, ১৯৯০ সালে ভি পি সিং সরকার কর্তৃক মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ লাগু করার ঘোষণারও আগে। ভি পি সিং সরকারও বেশ কিছু মুসলমান জাতকে ওবিসি ক‍্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সুপ্রিম কোর্টের ৯ সদস‍্য বিশিষ্ট সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৯২ সালে তার ঐতিহাসিক রায়ে ওবিসি সংরক্ষণের বৈধতা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।

সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপি স্বয়ং খুব চেষ্টা করেছে ‘পাশমান্দা’ (পশ্চাদপদ, বঞ্চিত) মুসলমানদের জন‍্য প্রচারাভিযান সংগঠিত করে এবং ‘সুফি সংবাদ’ (সুফি বার্তালাপ) কর্মসূচি চালিয়ে নিজের ‘সকলকে নিয়ে চলা’ (সবকে সাথ সবকে বিকাশ) ভাবমূর্তি তৈরি করতে। এই দলটির এটাও ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে ২০১৪ ও ২০১৯-এ তাদের প্রাপ্ত ভোট বহুলাংশে তাদের নিজস্ব জনভিত্তি পেরিয়ে অন‍্যান‍্য অংশ থেকে এসেছিল, যথাক্রমে দুর্নীতি ও জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্ন ঐ দুই নির্বাচনে প্রাধান‍্যকারী বিষয় হয়ে ওঠায়। এবারের নির্বাচনে বিজেপি মরিয়া হয়ে উঠেছে তার নিজস্ব জনভিত্তিকে চাগিয়ে দিতে কারণ বিজেপি এবারে তার ‘সকলকে নিয়ে চলা’, ‘বিকাশ ও সুশাসনের’ মুখোশটাও ঝেড়ে ফেলে নির্লজ্জভাবে মুসলমান-বিরোধী ঘৃণাপ্রচারের আশ্রয় নিয়েছে। গুজরাটে এই ফর্মুলা কাজে এসেছিল। ২০২৪ নির্বাচন এই ঘৃণা ও বিভাজনের ফর্মুলা প্রত‍্যাখ‍্যান করে সাংবিধানিক ভিত্তিমূল, সাংস্কৃতিক বিবিধতা এবং সম-নাগরিকত্বে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান হাজির করেছে।

বিজেপি অযোধ‍্যার রাম মন্দিরকে ২০২৪’র নির্বাচনে তাদের সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড বানাতে চেয়েছে। ২২ জানুয়ারি অযোধ‍্যায় অসম্পূর্ণ মন্দিরের উদ্বোধনকে এক চোখ ধাঁধানো দৃশ‍্য হিসেবে সাজানো হয়েছিল যে দৃশ‍্য নির্বাচনকে ছাপিয়ে ব‍্যাপ্ত হবে। ‘যো রাম কো লায়ে হ‍্যায় হম উনকো লায়েঙ্গে’ (যারা রামকে এনেছে আমরা তাদের আনব) গানটি ২০২৪’র নির্বাচনী সংগীত হয়ে উঠবে এমনটাই ভেবেছিল ওরা। কিন্তু মন্দিরের রাজনীতিকরণের এই অপচেষ্টা, একে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে ফয়দা লাভের অপচেষ্টা এই নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়েছে বলেই মনে হয়। তৃতীয় দফা ভোটের আগে মোদীর অযোধ‍্যা রোড-শো এবং ঠারেঠোরে বলা যে এসপি ও কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মন্দিরটিকে হাসপাতাল বানিয়ে দেবে — বিজেপির ক্রমবর্ধমান হতাশাকে দেখিয়ে দেয়। তৃতীয় দফার পর এখন মোট ৫৪৩ আসনের অর্ধেকে মতদান সম্পন্ন হয়েছে। শুরুর দফাগুলি ইন্ডিয়া জোটের নিশ্চিত এগিয়ে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে, আগামী চার পর্ব জুড়ে এই প্রবণতাকে এক নির্ধারক সংখ‍্যাগরিষ্ঠতায় দৃঢ়বদ্ধ করতে হবে স্বৈরতান্ত্রিক মোদী জমানার বিপর্যয়কর শাসনের অবসান ঘটাতে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৩ মে ২০২৪

interim-bail-of-delhi-chief-ministerchief-minister-arvind-kejriwal

১০ মে ২০২৪: ইডির তীব্র বিরোধতা সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট যে অবশেষে দিল্লীর মুখ‍্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ১ জুন ২০২৪ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করল তাকে স্বাগত।

বিজেপি পেছন থেকে সবরকম কলাকৌশল খাটিয়েছে — বিরোধী দলগুলির ওপর এবং তাদের নির্বাচনী প্রচারের ওপর ইডি, সিবিআই ও আইটি ডিপার্টমেন্টকে লেলিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু। বিহারে সিপিআই(এমএল)-এর আগিআও এমএলএ মনোজ মঞ্জিল ও আরো ২২ জন কমরেডকে এক রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্যপূর্ণ মামলার ধোঁয়াশাপূর্ণ ভিত্তিতে সাজা দেওয়া হয় এবং কমরেড মনোজ মঞ্জিলকে জেলে পুরে এমএলএ পদ থেকে ডিসকোয়ালিফাই করা হয়।

কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারি রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্য প্রণোদিত এবং ইন্ডিয়া জোটের নির্বাচনী প্রচারে ব‍্যাঘাত ঘটাতেই গ্রেপ্তারির জ‍ন‍্য ওই সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে — জনমানসে এই ধারণা সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায় সঠিক বলেই প্রমাণ করল। এবং সে কারণে আমরা ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ‍্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনেরও অবিলম্বে মুক্তি দাবি করছি।

সিপিআই(এমএল) জনগণকে ডাক দিচ্ছে, সংবিধান ও সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর ফ‍্যাসিস্ট হামলাকারী এই মোদী সরকারকে নির্বাচনে শায়েস্তা করার।

the-press-club-of-indiaetter-to-the Election-commission

প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া দাবি করেছে যে প্রত্যেক পর্বের ভোটদান সম্পন্ন হওয়ার পর নির্বাচন কমিশন সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত তথ্য জানাক। মোট কত ভোট পড়ল, কত শতাংশ ভোট পড়ল ইত্যাদি তথ্য ভোটের পরদিনই সকলকে জানাক নির্বাচন কমিশন। এগুলো জানা নাগরিকদের অধিকার।

১১ মে ২০২৪ ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া দিল্লীর পক্ষ থেকে বলা হয়, এযাবৎ সমস্ত নির্বাচনেই প্রত্যেক দফা ভোটগ্রহণের পর সংবাদ সম্মেলন করা সাধারণ নিয়ম হিসেবে অনুশীলিত হয়ে এসেছে। নির্বাচন কমিশনের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশের মানুষ নির্বাচনের হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে অবহিত থাকতে পারেন এবং সাংবাদিকেরাও নানা প্রশ্নোত্তরে সন্দেহ নিরসন করতে পারেন।

চলতি লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হার ঘোষণা করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের বিলম্ব হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার চিঠিতে বলা হয় যে তারা “বিস্মিত ও আহত যে গত তিনটি দফায় ‘মোট কত সংখ্যক ভোট পড়েছে’ তা নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করছে না। এর আগের কোনও নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। এর ফলে জনগণের মনে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ জেগেছে।”

নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা ছাড়া নির্বাচনী গণতন্ত্র যে প্রহসনে পর্যবসিত হবে তা বলা বাহুল্য। মোদী সরকার ইতিমধ্যে কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কুক্ষিগত করেছে এবং মোদী ও বিজেপি নেতাদের একের পর এক সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক ও শাস্তিযোগ্য ভাষণ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। মোদী-বিজেপি দেশের নির্বাচিনী গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার চিঠি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

programs-in-howrahtwo-program

১২ মে ২০২৪ হাওড়া জেলার বালি গ্রামাঞ্চল এলাকা জুড়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে ‘বিজেপি হারাও, দেশ বাঁচাও , সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’ প্রচার কর্মসূচি চলে। একটি মিছিল সাহেব বাগান নতুন বাজার মাকালতলা রাজচন্দ্রপুর নিশ্চিন্দা ঘোষপাড়া বাজার বালি হল্ট পঞ্চানন্দতলা হয়ে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে বিজয় সঙ্ঘ ক্লাবের সামনে শেষ হয়। এলাকা জুড়ে প্রচার কর্মসূচি চলার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে বক্তারা বক্তব্য রাখেন।

একই দিনে বিকেলে গ্রামীণ হাওড়ার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র বাগনান স্টেশন চত্বরে ‘বিজেপি হারাও, সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ সভা সংগঠিত হয় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে। সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির স্থানীয় সংগঠক দিলীপ দে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী মঞ্চের মেহবুব আহমেদ, আইসা সর্বভারতীয় সভাপতি নীলাশিস বসু, এআইসিসিটইউ রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু ও জেলানেতা এন এন ব্যানার্জী। সমগ্র সভাটি পরিচালনা করেন পার্টির জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত। পার্টির সদস্য সমর্থকরা ছাড়াও বহু স্থানীয় মানুষও সভার চারপাশে ভীড় করে বক্তব্য শোনেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু মানুষও উৎসাহ নিয়ে সভায় উপস্থিত ছিলেন।

indian-citizens-into-modern-slavescitizens-into-modern-slaves

এ’বছরের জানুয়ারিতে, প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের যুদ্ধ একশ দিনের মাথায় যখন পড়ল, ঠিক সেদিনই উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানার রাজ্য প্রশাসন ইজরায়েল থেকে আগত ব্যবসায়ীদের ১৫ জনের এক প্রতিনিধিদলের সাথে সাক্ষাৎ করে। ইজরায়েলের কাজে মোটা বেতনের আশায় প্রায় ১০,০০০ শ্রমিক প্রবল ঠান্ডার মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেদিন লাইন দিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়েছিলেন, নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতে।

এপ্রিলের প্রথম দিকেই ৬৪ জন ভারতীয় শ্রমিককে ইজরায়েলে পাঠানো হয় উভয় দেশের মধ্যে এক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে, কারণ ইজরায়েল প্রবল শ্রমিক সঙ্কটে ভুগছে। ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ইজরায়েলে নিক্ষিপ্ত ইরানের মিসাইল হানার পর ভারতের বিদেশমন্ত্রক ইজরায়েলে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকদের জন্য এক নির্দেশিকায় জানায়, তাঁরা দ্রুতই ওখানকার ভারতীয় দূতাবাসে নিজেদের নাম যেন নথিভুক্ত করেন এবং নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া যেন ওই দেশে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিজেদের যাতায়াত সীমাবদ্ধ রাখেন। কিন্তু ইজরায়েলে এখন কর্মরত ১৮,০০০ ভারতীয় শ্রমিকদের পক্ষে এই শর্ত মেনে চলা সম্ভব ছিল না।

২০২৩ সালে ভারত থেকে ইজরায়েলে ৪২,০০০ শ্রমিক পাঠানোর চুক্তি কার্যকর হতে শুরু করে। ২০২৩’র ডিসেম্বরে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার দু’মাসের মাথায়, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মোদীকে ফোন মারফত ওই সংখ্যার দ্বিগুণ শ্রমিক পাঠাতে অনুরোধ করেন। মোটা বেতনের আশায় দেশের দরিদ্রতম অঞ্চল থেকে দলে দলে শ্রমিক ইজরায়েলে পাড়ি দিতে শুরু করেন। কিন্তু, ওখানে গিয়ে তাঁরা দেখলেন, তাঁদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা পুরোপুরি মিথ্যা।

ইজরায়েলই একমাত্র দেশ নয় যেখানে বিপজ্জনক অবস্থায় ভারতীয় শ্রমিকরা কাজ করছেন। সিঙ্গাপুর বা উপসাগরীয় দেশগুলোতে মধ্যযুগীয় প্রথায় ভারতীয় শ্রমিকদের নিয়োগ করার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই নানান মহল থেকে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। সার্বিয়ায় কর্মরত ভারতীয় শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি না পেয়ে সেখানে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন। ইতালিতে এক পাঞ্জাবি, শ্রমিক-প্রতারক ঠিকাদারের পাল্লায় পড়ে রক্তচোষা এক নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ করতে গিয়ে দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে আত্মঘাতী হন। স্পেন, পর্তুগালে এই ধরনের মর্মান্তিক অনেক ঘটনা রয়েছে।

কিন্তু, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের রক্ষা করার প্রশ্নে ভারতীয় রাষ্ট্রের ভূমিকা খুবই উদ্বেগজনক। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ইরাকে কর্মরত ৪০ জন ভারতীয় নির্মাণ শ্রমিককে অপহরণ করা হয় ২০১৪ সালে। গত মাসে এমনও রিপোর্ট আসে যে রুশ দেশে কাজ করতে পাঠানোর নামে বেশ কিছু ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিককে রুশ সরকার ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পাঠায়। সিবিআই অনুসন্ধান করে জানিয়েছে, অন্তত ৩৫ জন ভারতীয়কে প্রশিক্ষিত করে ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়। গতবছর আর্মেনিয়াতে দু’জন ভারতীয় গুলিতে গুরুতরভাবে জখম হন।

ইজরায়েলের কৃষি ও নির্মাণ শিল্প প্যালেস্তিনি শ্রমিকদের উপর অত্যধিক মাত্রায় নির্ভরশীল। ইজরায়েল গাজায় হামলা চালানোর পর ইজরায়েল সরকার ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ১,৫০,০০০ এবং গাজা ভূখন্ডে ১৮,৫০০ শ্রমিকের ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে দেয়। তারপর থেকেই ইজরায়েল গুরুতর শ্রম সংকটে পড়ে।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে কাজ করতে গেলে ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের ই-মাইগ্রেট পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করাতে হয় শ্রমিক নিরাপত্তার স্বার্থে। কিন্তু, ইজরায়েল, রাশিয়া, আর্মেনিয়া ওই পোর্টালে অন্তর্ভুক্ত নয়। আরও বিচিত্র ব্যাপার হল, ইজরায়েলে ভারতীয় শ্রমিকরা কাজ করতে গেলে এই মর্মে স্বাক্ষর করতে হয় যে তাঁরা ন্যূনতম এক বছর কাজ করবেন, কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তাঁদের কাজের ও ওখানে থাকার সর্বোচ্চ সীমার মেয়াদ করে দেওয়া হয় ৬৩ মাস।

মোটা বেতনের হাতছানিতে প্রলুব্ধ হয়ে বিশেষ করে ভারতের নির্মাণ শ্রমিকরা ইজরায়েল সহ যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোতে পাড়ি দেওয়ার পর দেখেন যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার ধারে কাছেও তাঁদের বেতন দেওয়া হয় না। যে চুক্তির ভিত্তিতে তাঁরা আসেন, নিয়োগকর্তারা তা অমান্য করে। যে কাজের জন্য তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়, দেখা যায় তার থেকে অনেক নিম্নমানের কাজ ও বাজে পরিবেশে তাঁদের নিয়োগ করা হচ্ছে, শ্রমসাধ্য ১২ ঘণ্টার কাজ করানো হচ্ছে, পাচ্ছেন না নিয়মিত বেতন বা মজুরি।

ছুটে আসা মিসাইল পরিযায়ী শ্রমিকদের সামনে বড় একটা বিপদ। গত দশকে প্রায় ৬ জন শ্রমিক মিসাইল হানায় মারা যান। মিসাইল হানার আগাম খবর পেতে একটা অ্যাপ রয়েছে, যা কেবলমাত্র ইজরায়েলে নির্মিত ফোনেই ডাউনলোড করা যায়। ভারতীয় শ্রমিকরা এ প্রশ্নেও অসুরক্ষিত।

পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি বিন্দুমাত্র দায় নেই আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের। তাই, তাঁদের নিরাপত্তা, বিদেশে সুরক্ষিত কর্মস্থল নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোন দায়ভার নিচ্ছে না।

- দ্য টেলিগ্রাফ, ৭ মে ২০২৪

the-state-of-the-economyeconomy-now-2

আমাদের দেশে এখন কাজের জগতে নানা গোলমাল ঘটে চলেছে। অনেকেই এই সমস্যা বুঝতে পারছে। অনেকে বুঝতে পারছে না।

এই লেখাটা সেই বিষয়টাকে না-জানা, না-বোঝাকে যতটা পারা যায় জানানো, বোঝানোর চেষ্টায়।

খুব যে একটা গুছিয়ে খোলসা করে এক, দুই করে বলে যেতে পারবো তা নয়। একটার সাথে আরেকটা জড়িয়ে আছে, জট পাকিয়ে আছে। দেখা যাক জটটা কতটা খোলা যায়।

প্রথমে একটা জরুরি কথা বলে নেওয়া।

আমরা এতদিন ‘কাজ’, ‘কাজ পাওয়া’, ‘কাজ করা’, ‘কাজের জন্য রোজগার’, ‘কাজের অধিকার’, ‘কাজের জায়গায় অধিকার’ — এসব বলতে যা দেখেছি, যা বুঝে এসেছি তা বদলে যাচ্ছে, বদলে দেওয়া হচ্ছে।

১) প্রথমে বলা যাক ‘কাজ না-পাওয়ার’ কথা। ‘কাজ না-পাওয়া’র দলে এখন সবচেয়ে বেশি রয়েছে যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর।

২) এদের মাঝে আবার ছেলেদের থেকে মেয়েদের হাল বেশি খারাপ।

আমাদের দেশে জনসংখ্যায় ১৫ থেকে ২৯ বয়সীদের সংখ্যা সব থেকে বেশি। তাদের কাজ না-পাওয়ার মানে — দেশের উন্নতি ঠিকঠাক না হওয়া।

৩) কাজ না-পাওয়ার দলে যারা লেখাপড়া করেনি তাদের থেকে যারা লেখাপড়া করেছে তাদের সংখ্যা বেশি। এমন একটা অবস্থা তৈরি হচ্ছে — যারা লেখাপড়া করছে তারা কাজ পাচ্ছে কম।

৪) এই বিষয়টাকে আমরা আরেকভাবে দেখতে বা বুঝতে চাইছি — যারা লেখাপড়া করে তারা খানিকটা হলেও ‘কাজের অধিকার’ বিষয়টা জানে, বোঝে। আর এক পা এগোনো যাক। যারা লেখাপড়া করে, বোঝে তারা খানিকটা হলেও জানে, জানতে পারে — ‘কাজের অধিকার’। কাজের অধিকার থেকে ‘কাজের দাবি’। অন্য দিক থেকে ভাবি। যারা ‘অধিকার’ নিয়ে ভাবতে পারে, দাবি করতে পারে, তারাই বেকার, তাদেরকেই বেকার করে রাখা।

৫) তার মানে আবার এটা নয় যে, যারা লেখাপড়া করেনি বা অল্প লেখাপড়া করেছে, তারা সবাই পুরোপুরি (ধরা যাক ৮ ঘণ্টার) কাজ পাচ্ছে, তাদের সুবিধা মতন কাজ পাচ্ছে। তা নয়।

৬) অথচ সরকারের বানানো কাজের হিসেবের মধ্যে তাদের ঢুকিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে — এই তো এদের কাজ আছে। 

কাজের সরকারি হিসেবে কারচুপি।

the-economy-now

৭) এই বিষয়টা — এই যে কাজ না-পাওয়া, ঠিকঠাক কাজ না-পাওয়া — এই বিষয়টাকে একটা বড়ো কথায়, বড়ো জায়গায় নিয়ে গিয়ে এই রকম ভাবে বলা যেতে পারে — ঠিকঠাক দেশ গড়তে গেলে দেশের মানুষকে ঠিকঠাক ভাবে কাজে লাগাতে হয়। আর যেহেতু আমাদের দেশের মানুষকে ঠিকঠাক কাজ দেওয়া হচ্ছে না, অতএব ঠিকঠাক ‘দেশ গড়া’ও হচ্ছে না।

৮) কাজের সাথে দেশগড়ার যোগাযোগের কথাটাকে আরেকভাবে ভাবা যায়। কম লেখাপড়া করে বা না-লেখাপড়া করে যদি কাজ বেশি পাওয়া যায় তাহলে দেশের মানুষ আর লেখাপড়া করতে যাবে না, যাচ্ছে না। লেখাপড়া করা দরকার মনে করবে না। দেশে লেখাপড়া না-করা লোকের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়বে।

৯) লেখাপড়ার সাথেই তো জড়িয়ে থাকে ভাবনা, চেতনা। যার একটা ‘অধিকার চেতনা’। লেখাপড়া না করলে অধিকার নিয়ে ভাবনা কমবে। কাজ পাবার অধিকারের, লেখাপড়া করার, লেখাপড়া করার সুযোগ পাবার ‘অধিকার’এর দাবি কমতে থাকবে।

১০) এর ফলে লাভ হচ্ছে যারা ক্ষমতায় আছে, ক্ষমতায় যেতে চায়, ক্ষমতায় থাকতে চায় তাদের।

১১) সব মিলিয়ে কী দেখা যাচ্ছে?

‘কাজের অধিকার’ — এ যা লেখা আছে — সেই অধিকার পাওয়া দেশবাসীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তাদের আয় কমে যাচ্ছে। আমাদের আগের লেখায় বলা হয়েছিল — তলায় রেখে দেওয়া মানুষের আয় যত কমবে, উপরে থেকে যাওয়া, থেকে যেতে চাওয়া লোকেদের আয় ততো বাড়বে। আমাদের দেশে তাই ঘটছে, ঘটে চলেছে।

১২) আমরা বলতে চাইছি — পড়াশোনা করলে  — কাজ পাওয়ার দাবি বিষয়ে সচেতনা বাড়ে — সচেতনা বাড়লে — ঠিকঠাক রাজনীতিক ভাবনা বাড়ে —ঠিকঠাক রাজনীতিক ভাবনা বাড়লে — ঠিকঠাক প্রতিবাদ বাড়ে — এই সম্পর্কটাকে ভেঙ্গে দেওয়া চলছে।

১৩) আগে শ্রমিকদের হয়তো স্কুলের শিক্ষা ছিল না, কিন্তু সচেতনা ছিল। নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার সচেতনা ছিল — এটা এসেছিল শ্রমিক রাজনীতি থেকে। এখন তো সেই রাজনীতিটাও নেই। ফলে এখন অধিকার চেতনা থাকা শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, গেছে।

আসলে তো শ্রমিকদের কাজের স্থায়ী জায়গা, স্থায়ী কাজ, স্থায়ী মজুরি, স্থায়ী অধিকার — এসবই তো ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে, পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

১৪) শ্রমিকদের জানা বোঝার আর একটা জায়গা — ঠিকঠাক ট্রেড ইউনিয়ন। সেটাই তো আগের মতো নেই।

১৫) আরেকভাবে শ্রমিকদের কাজের জায়গাটায় বদল আনা হয়েছে। আগে শ্রমিকদের দক্ষতা পাওয়া, দক্ষতা বাড়ানোর জায়গা ছিল সরকারি পলিটেকনিক স্কুলগুলো। এখন সে সব নেই বললেই চলে।

১৬) ফলে দক্ষতা ছাড়া শ্রমিক, জোরদার ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া শ্রমিক, রাজনীতিক সচেতনা ছাড়া শ্রমিক তার ঠিকঠাক পাওনা দাবি করতে পারে না — তাতে তার আয় কমছে।

১৭) আমাদের দেশে, সরকারি হিসেবে ‘কাজ পাওয়া’, ‘কাজ করা’র মাপ হল — ‘কিছু না কিছু’ করছে। অথচ আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন, ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন ‘আইএলও’র লিখিত নির্দেশে ‘কাজ’ বলতে বোঝায় — এমন কাজ বা শ্রম, যা কিছু উৎপাদন করে, যে কাজ থেকে ঠিকঠাক বেঁচে থাকার মতো মজুরি পাওয়া যায়, কাজের জায়গায় নানা নিশ্চয়তা এবং সামাজিক সুরক্ষা পাওয়া যায়।

যদি এই মাপ দিয়ে মাপা যায় — তাহলে ভারতে ‘কাজ’ পাওয়া বা ‘কাজ’ করার হিসেব অনেক নিচে নেমে যাবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘আইএলও’র মতে কাজের জায়গায় মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক অধিকারের মান্যতাও দরকার।

১৮) আমাদের দেশে ‘কাজ’ কথাটার ঠিকঠাক ‘মানে’ই বানানো হয়নি। এখানে ‘কাজ’ বলতে বোঝায় — ‘কিছু না কিছু একটা করছে’ — যেদিন সরকার থেকে তথ্য জোগাড় করতে যাওয়া হয়েছিল, সেদিন কিছু না কিছু একটা কাজ করছিল — ফলে কাজ পাওয়া, কাজ করার হিসেবেই গণ্ডগোল।

১৯) এর সাথে যোগ করা যাক ছোটদের কাজ করার হিসেব। সে হিসেব তো সরকার দেয় না, ছোটোদের কাজ করাটা বেআইনি বলে।

২০) আর এক দিক দিয়ে বিষয়টাকে ভাবা যাক, দেখা যাক কম — কাজ পাওয়া + যতটুকু কাজ পাওয়া তাতে কম মজুরি পাওয়া — মানে কম খাওয়া (এর সাথে যোগ করা যাক খাবারের দাম বাড়ছে) — কাজ করা ও কম খাওয়া মানে — শরীর খারাপ হওয়া শরীর খারাপ হলে — ওষুধ খেতে হবে — ওষুধের দাম বেড়েছে — ওষুধ খেতে গেলে বেশি খরচ হবে — খরচ বেড়ে যাবে — আয় কমে যাবে — আয় কমে গেলে — পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমে যাবে — আরও বেশি অসুখ হবে — আরও কাজ করা কমে যাবে — আয় আরও কমে যাবে — এটা যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে কে জানে।

২১) কাজের জায়গা বদলাচ্ছে + কাজের ধরন বদলাচ্ছে — নিয়মিত কাজের বদলে অল্প দিনের চুক্তির কাজ + নিজের কাজ নিজেই খুঁজে নিয়ে করা  — এই সব কাজে সরকারের কোনো দায় নেই।

যত এ ধরনের কাজের পরিসর বাড়বে, যা কিনা বাড়ছে  সরকারের দায় তত কমবে।  এই ধরনের কাজে থাকা শ্রমিকদের কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই + কোনো সুযোগ সুবিধা পাওয়া নেই + কোনো অধিকার নেই।

২২) তাহলে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে এই রকম,
ক) সরকারি সুরক্ষা ব্যবস্থায় কতজন কাজ করে?
খ) কাদের স্থায়ী চাকরির লিখিত চুক্তি আছে?
গ) কতজন নিয়মিত, আগে থেকে ঠিক করা, মজুরি পাচ্ছে?
ঘ) এই ধরনের শ্রমিকদের কি কি অধিকার আছে?

২৩) লেখাটার আপাতত শেষে এসে কয়েকটি কথা অন্য দিক দিয়ে বোঝা দরকার। মজদুরদের সাথে মালিকের কোনো লিখিত চুক্তি নেই — ফলে মালিকের সরকারি আইন মানার দরকার নেই  — ফলে মজদুরদের ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হচ্ছে — একজন মজদুরের ৮ ঘণ্টার বেশি ১ ঘণ্টা কাজ করা মানে আর একজন মজদুরের ১ ঘণ্টা কাজের সুযোগ কেড়ে নেওয়া হল — মজদুরদের বিপরীতে মজদুরদের, কর্মীদের বিপরীতে কর্মীদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল — শ্রমিকদের ঐক্যের বদলে শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ — লাভ মালিকদের — লাভ পুঁজির — লাভ পুঁজির পাশে থাকা সরকারের।

- বিশ্বজিৎ ধর এবং শুভেন্দু দাশগুপ্ত, নাগরিক মঞ্চ

so-naked-so-aggressivenaked-so-aggressive

বিয়ে নিয়ে ইদানিং তুঙ্গে চর্চা। সমাজ বহুদিন আগেই সমস্ত সম্পর্কের ‘বৈধতাকে’ স্বীকৃতি দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বিয়ের প্রচলন করেছে। রাষ্ট্র যেহেতু পুরুষতন্ত্রের পরিপূরক তাই তার বিবিধ আইনি জায়গা, সামাজিক সুরক্ষার জায়গাগুলোতেও বিয়ে একটা বেশ বড়সড় সুরক্ষা ফ্যাক্টর। এবং সেই বিয়ে অবশ্যই এবং একমাত্র গ্রাহ্য হবে ‘পুরুষ’ ও ‘নারী’র মধ্যে। অন্য যৌনতা ও নন-বাইনারির (যারা নিজেদের ছেলে/মেয়ে এই সাদা কালো দেওয়াল বিভাজিকার মধ্যে ফেলেন না) মানুষের বিয়ে তো বাদ দিন — আইন হোক বা সমাজ, কোনখানেই স্বীকৃতি নেই। আর দেশে যখন ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদী শক্তির শাসন চলে এই বেড়িগুলো আরও শক্ত হয়। ফ্যাসিস্ট শক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো দেশের বিচারব্যবস্থাকে পুরোপুরি অকেজো করে দেওয়া এবং তার গেরুয়াকরণ ঘটিয়ে গোঁড়া ভাবধারাকে শুধু সামাজিকভাবেই নয়, আইনি ভাবেও প্রতিষ্ঠা করা। দেশের হাইকোর্ট হোক বা উচ্চতর ন্যায়ালয় সুপ্রিম কোর্ট — একের পর এক যে মহিলাবিরোধী রায় দিচ্ছে তা বিজেপির মনুবাদী নারীবিরোধী সমাজব্যবস্থার পক্ষে। সদ্য একটি রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে হিন্দু বিবাহে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানই সব এবং প্রধান। আমরা এও জানি এযাবৎ কাল কিভাবে বারবার আঘাত হানা হচ্ছে স্পেশ্যাল ম্যারেজ আইন (যারা ধর্মীয় পরিচয় চান না, ধর্মনিরপেক্ষভাবে একসাথে থাকতে চান, ভিন্ন ধর্মী মানুষজন সহ অন্যান্য) সহ সমস্ত রকমের স্বতন্ত্র বিবাহ পদ্ধতিকে। অর্থাৎ প্রথমত সমস্ত রকমের বৈচিত্র্য ও অধিকারের জায়গা ধ্বংস করে হিন্দু বিবাহ আইনকেই একমাত্র স্বীকৃত বৈধ হিসেবে তুলে ধরা, তারপর আইনি জায়গা থেকে একমাত্র হিন্দু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকেই বিয়ের মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরা! বুঝতে খুব অসুবিধা বোধহয় হয় না। সামাজিক জ্যাঠামি আর হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতাবান পুরুষদের হাতেই থাকবে মেয়েদের জীবন, যাপন, নিজের শরীরের উপর অধিকার সহ সমস্ত ক্ষমতা। মেয়েরা এতদিন লড়াই করে একটু একটু করে যেটুকুও স্বাধিকারের জায়গা অর্জন করতে পেরেছে সেগুলোকে নস্যাৎ করে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিচ্ছে — হিন্দু বিয়ে একটি সংস্কার, ভারতীয় সমাজে এর গভীর মূল্যবোধ আছে। কী মূল্যবোধ? কিসের মূল্যবোধ! বুঝতে খুব অসুবিধা হয়না মনুবাদী সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িকতা, এক ধর্ম এক দেশ — প্রতিষ্ঠার নোংরা প্রচেষ্টাকে। মানে হিন্দু আচার বিচার, নিয়ম কানুন সর্বোপরি হিন্দু ধর্মকে একচেটিয়াভাবে ভারতবর্ষের এক এবং অদ্বিতীয়ম মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠার আর একটি পদক্ষেপ। নইলে বিবিধ সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র ভারতবর্ষে একটি বিশেষ ধর্মের আচারকে এত গুরুত্ব দিয়ে তুলে আনা কেন? তাও বারংবার? কখনও রায় আসছে স্ত্রী মঙ্গলসূত্র পরছেন না মানে স্বামীর প্রতি সহিংসতা করছেন, কখনও রায় আসছে বিয়ের পর স্বামীর অস্বাভাবিক যৌন আকাঙ্ক্ষাও স্বাভাবিক, ‘রেপ’ নয় সেটা... খুব স্পষ্ট হয়ে যায় দেশের বিচারব্যবস্থার গেরুয়াকরণ এবং চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় এই গেরুয়াকরণ কতটা নারী বিদ্বেষী।

প্রথমত একটা স্বাধীন দেশে একজন মানুষের কোনও ‘স্বামী’ বা ‘পতি’ তথা মালিক থাকতে পারে না। গবাদি পশুর মালিক হয়, মানুষের হয় না। কিন্তু মহিলাদের থাকে। আর ওই বিয়ে, আচার অনুষ্ঠান, নেমন্তন্ন করে লোক খাওয়ানো ওটাও এমনি এমনি নয়, সর্বসমক্ষে মেয়ে নামক সম্পত্তির বাবার হাত থেকে পতি বা আর এক মালিকের কাছে হস্তান্তর হওয়ার সামাজিক ঘোষণা, যে এরপর থেকে ‘ইহা ব্যবহারের অধিকার আমার হইল’, সঙ্গে থাপ্পা হিসেবে কপালের সিঁদুর আর শাঁখা পলা। আর রাষ্ট্র যখন সেটাকেই মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, তা সর্বতোভাবে ভয়ঙ্কর।

এই বিয়ে নামক পুরো ব্যবস্থাটার পিছনে আসলে একটা সুনিশ্চয়তার ধারণাও কাজ করে। আমাদের মাঝে মধ্যেই শুনতে হয়, “একা থাকিস, একটা কিছু হয়ে গেলে? মরে পড়ে থাকবি তো!” বা “বিয়েটা করলি ঠিকই একটা ছেলে হলো না! মেয়ে আর কি দেখবে, বুড়ো বয়সে ছেলে একটা না থাকলে কে দেখবে!” আমাদের বুঝতে হবে একা থাকা মানেই অসহায়তা, বিপন্নতা বা আতঙ্ক নয়। বিয়ে করেও যেকোনো সময় যা কিছুই হতে পারে! সন্তান, সঙ্গী সবসময় থাকবেই এটা ধরেই নেওয়াও আসলে এই সমাজেরই স্থাপন করা ভাবনা। আর বিয়েই একমাত্র সন্তান তৈরির (বৈধ) মাধ্যম এটাও এই ভাবনারই অংশ! আশেপাশে অনেক সিঙ্গল মা আছেন যারা দিব্যি আছেন, বাঁচছেন, সমাজের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই। এরজন্য বিয়ের প্রয়োজন পড়বে কেন? মানুষের জীবনের বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতাকে অস্বীকার করে নজরদারি চালানো ও অধীনতা প্রতিষ্ঠা করার এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তাই ভীষণ ভাবেই সরব হওয়া প্রয়োজন।

সর্ম্পক হোক উন্মুক্ত। ভালবাসতে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি, ধর্মীয় আচার, সামাজিক স্বীকৃতির প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় মন, মানবিকতা আর অবশ্যই পারস্পরিক সম্মতির।

- সৌমি জানা

the-people-of-the-border-region-are-not-residentsnot-residents-of-the-same-state

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবাসীরা দেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার, আইনের শাসনের কাঁটাতারের সীমানার বাইরে মরে বেঁচে আছেন। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল আজ কেন্দ্রীয় সরকারের বিএসএফ, রাজ্য সরকারের পুলিশ-প্রশাসন এবং শাসক দলের লুম্পেনদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। ভোট আসে ভোট যায়, কেন্দ্র-রাজ্যের সরকার পাল্টায় কিন্তু সীমান্তবাসীদের উপর প্রতিদিন ঘটে চলা বেআইনি, অমানবিক, অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের অবসান হয় না।

সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা বলতেই বেশীরভাগ মানুষের ধারণা ওরা চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। ঘটনাটা সত্যি না হলেও এটা ঠিক যে, বিএসএফ-পুলিশ প্রশাসন এবং শাসক দলের গুন্ডার পক্ষ থেকে ঐ এলাকার মানুষদের অনেককে চোরা কারবারে নামতে বাধ্য করা হয়। এর পেছনে চলে এক নিরন্তর প্রক্রিয়া। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, অসম্মানকে উপেক্ষা করে সততার সাথে বাঁচতে চাইলেও তাঁদেরকে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিবাদ করতে গেলে হয় মেরে লাশ গুম করে দেওয়া হয়, না হয় মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হয়।

মানবাধিকার সংগঠন ‘মাসুম’এর সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে ঐ সকল সীমান্তবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা নিয়ে কাজ করে আসছেন। অনতি অতীতে তাঁরা কলকাতা প্রেসক্লাবে ও ত্রিপুরা হিতসাধনি হলে সীমান্তবাসীদের নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের জীবন যন্ত্রণার কথা শোনাতে। অল ইন্ডিয়া ল’ ইয়ার্স এ্যাসোশিয়েশন ফর সোশ্যাল জাস্টিস ‘আইলাজ’কে সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সীমান্তবাসীদের নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা শুনে আঁতকে উঠতে হয়, ৭৬ বছরের স্বাধীন ভারতবর্ষে এমনটাও হয়?

সীমান্ত

ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত ৪০৯৬ কিলোমিটার বিস্তৃত। এরমধ্যে বেশিরভাগটাই আছে পশ্চিমবাংলায়, যার পরিমাণ ২২১৭ কিলোমিটার। আসাম বাংলাদেশ সীমান্ত ২৬২ কিলোমিটার। মিজোরাম বাংলাদেশ সীমান্ত ৩১৮ কিলোমিটার। ত্রিপুরা বাংলাদেশ সীমান্ত ৮৫৬ কিলোমিটার। মেঘালয় বাংলাদেশ সীমান্ত ৪৪৩ কিলোমিটার। পশ্চিমবাংলার সীমান্ত এলাকার ভারতীয় নাগরিকরা বেশিরভাগই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। মুসলিম, তপশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত। মুর্শিদাবাদের রাণীনগর, লালগোলা; নদীয়ার বানপুর, করিমপুর, ধানতলা; উত্তর চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, গাইঘাটা; মালদার পঞ্চানন্দপুর, কালিয়াচক; কোচবিহারের দিনহাটা, সিতাই, শীতলকুচি হলদিবাড়ি; দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট বা হিলি; উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ বা গোয়ালপোখর; জলপাইগুড়ির বেড়ুবাড়ি অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষেরা মনে করেন তারা ভারতবর্ষে থেকেও বিদেশি। সংবিধানের মৌলিক অধিকার, প্রশাসনের পরিকাঠামো, সরকারি কার্যকলাপ, জীবন-জীবিকা, পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য — কোনও কিছুই এদের জন্য না। এরা যেন এক নেই সাম্রাজ্যের বাসিন্দা। অথচ নেপাল, ভুটানও তো ভারতের প্রতিবেশী দেশ, সেখানকার সীমান্তে এই হিংস্রতা চোখে পড়ে না। সেখানকার সীমান্তে বিএসএফ নেই, সেখানে সীমান্ত প্রহরার দায়িত্বে আছে সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি)। এই প্রতিবেশী দেশগুলিতে যাতায়াতের জন্য পাসপোর্ট, ভিসারও কোন প্রয়োজন হয় না। এই দেশগুলির মানুষ অবাধে আসা যাওয়া করছেন, ব্যবসা বাণিজ্য করছেন। সেই সব সীমান্তে বিএসএফ, পুলিশ প্রশাসন বা শাসক দলের গুন্ডাদের দাপাদাপি লক্ষ্য করা যায় না। ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বলেই ঘোষিত। তা সত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটা কেন হচ্ছে তার কোন সদুত্তর নেই।

আমরা বেশিরভাগ মানুষই মনে করি সীমান্তে কাঁটাতারের ওপারেই বাংলাদেশ। আসলে তা নয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কাঁটাতার হওয়া উচিত প্রকৃত সীমান্তের International Border pillar (IBP) থেকে ১৫০ গজের মধ্যে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশ সীমান্তে খুব কম জায়গা আছে যেখানে সীমান্ত থেকে কাঁটাতারের দূরত্ব ১৫০ গজ। অনেক জায়গাতেই দেখা যায় ৫০০ মিটার থেকে ১ কিলোমিটার, এমনকি ৫ কিলোমিটার থেকে ১০ কিলোমিটারও অতিক্রম করেছে। ফলে কাঁটাতারের ওপাশে হাজার হাজার ভারতীয় সীমান্তবাসীর জায়গা জমি রয়েছে। এমনকি হাজার হাজার মানুষের ঘর বাড়িও রয়েছে। আনুমানিক ৫০ হাজারেরও বেশী পরিবার এরকম এলাকায় থাকেন। কাঁটাতার বসানোর আগে তাঁদের কথা ভাবা হয়নি, নেওয়া হয়নি তাঁদের মতামত। কাঁটাতার বসানোর সময় বলা হয়েছিল সীমান্তবাসীদের যাতায়াতের জন্য ১২ ঘণ্টা গেট খুলে রাখা হবে। জমিতে চাষের বা যাতায়াতের কোন অসুবিধা হবে না। গরীব চাষিরা সেসময় সেসব কথায় বিশ্বাস করেছিলেন।

সীমান্তবাসীদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছিল কাঁটাতার বসানোর জন্য। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমি দাতারা land losser হিসাবে নথিভুক্ত হন। এই জমি দাতাদের প্রদত্ত জমির সমমূল্যের ক্ষতিপূরণ দান করা এবং সরকারি চাকরি পাওয়ার বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা করা হয় (পশ্চিমবঙ্গ সরকার শ্রমদপ্তর বিজ্ঞপ্তি নাম্বার 301-EMP/IM-10/2000, Para- 3, point number 3[2])। কিন্তু তা আজও সার্বিক ভাবে বাস্তবায়িত হয়নি, বহু মানুষ আজও সরকারি দপ্তরে মাথা খুঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

the-people-of-the-border-region

বিএসএফের দৌরাত্ম

সীমানার গেট ১২ ঘণ্টা খুলে রাখা হবে, কাঁটাতার বসানোর সময়কার এই প্রতিশ্রুতিকে উপেক্ষা করে কিছুদিন পর থেকে শুরু হল নয়া রুটিন। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টের মধ্যে দিনে তিনবার এক ঘণ্টা করে গেট খুলে রাখা হল। সকাল ৭টা থেকে ৮টা, দুপুর ১২টা থেকে ১টা, বিকেল ৩টে থেকে ৪টে — অর্থাৎ ১২ঘণ্টার জায়গায় খেপে খেপে মোট ৩ঘণ্টা। কাঁটাতারের ওপারের মানুষদের বাজারহাট, ডাক্তার দেখানো, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যাতায়াত — সবই ঐ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হয়। আপৎকালীন অসুস্থতার জরুরি প্রয়োজনেও কোনও ছাড় নেই, সে সময়েও গেট খোলা হয় না। ঐ সব এলাকায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের যাওয়া আসার ক্ষেত্রেও বিএসএফের পক্ষ থেকে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে তাঁরাও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আর এরফলে ঐ সকল অঞ্চলের প্রসূতি মায়েদের এবং শিশুদের সুচিকিৎসা বা দেখভালের বিষয়টা অত্যন্ত অবহেলিত থেকেই যাচ্ছে। এমনই অবস্থা যে, ঐ সকল অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কাঁটাতারের এপারের বাসিন্দাদের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক পর্যন্ত হয় না। কারণ ঐ যাতায়াতের বিধিনিষেধ। ঐ অঞ্চলে বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানের নেমন্তন্নে গেলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে হয়, কারা যাচ্ছে তার নামের তালিকা বিএসএফ’কে জানাতে হয়।

কাঁটাতারের এপারের বহু মানুষের চাষের জমি ঐ অঞ্চলে আছে। তাঁদেরও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাষ আবাদ করে ফিরে আসতে হয়। তাঁরা কী ধরনের ফসল ফলাবেন সেটাও ঠিক করে দেয় বিএসএফ’রা। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড থাকলেও বিএসএফ আলাদাভাবে পরিচয়পত্র দিচ্ছে যা নিয়ে চলা ফেরা করতে হয়। ভারতীয় সংবিধানের ১৯ ও ২১নং অনুচ্ছেদ ভারতীয় নাগরিকদের দেশের যেখানে ইচ্ছা যাওয়ার স্বাধীনতা বা অধিকার দিলেও সীমান্তবাসীদের ক্ষেত্রে তাকে মান্যতা দেওয়া হয় না। ওখানে বিএসএফ’ই শেষ কথা। সেইসব জমি তাঁরা অভাবের তাড়নায় বেচতেও পারেন না। কারণ কেউ সেই জমি কেনে না। কেউই সীমান্তের জমি কিনে নিজের লোকসান বাড়াতে চান না। তাহলে তাঁরা করবেন কী? খাবেন কী? বাঁচবেন কীভাবে? তাই অনেকে সীমান্ত এলাকা থেকে অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে যাচ্ছেন। গ্রামে মহিলা, শিশু আর বৃদ্ধ বৃদ্ধারাই পড়ে থাকেন আর তাদের উপর চলে বিএসএফের নির্যাতন। মানুষদের অকারণে মারধোর করা, চলাচলে বাধা দেওয়া, গালাগাল দেওয়া, মহিলাদের শ্লীলতাহানি করা, ঘরদোর ভাঙ্গা — এসব ঐ অঞ্চলের প্রতিদিনকার ঘটনা।

চোরা কারবার প্রসঙ্গে

সীমান্তে যদি চোরা কারবার বা পাচার বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সব চাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএসএফ, পুলিশ-প্রশাসন ও শাসক দলের লুম্পেনরা। একটা বড় নেক্সাস বা পারস্পরিক অসুভ আঁতাতের মাধ্যমে এই চক্র প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার তোলা তুলছে। তার ভাগ নীচ থেকে ওপর — নানা সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে। এই পাচারের জন্য বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গা আছে, যেখান দিয়ে টাকার বিনিময়ে দিনের আলোয় গরু, মানুষ পাচার চলছে। ১০/১২ বছরের মেয়েদের দালাল মারফত ভারতে নিয়ে এসে দিল্লী, মুম্বাই, পুনের নিষিদ্ধ পল্লীগুলিতে পাচার করা হচ্ছে। এপারের বিএসএফ আর ওপারের বিজিবি দুটো বাহিনীই দুর্নীতিগ্রস্ত। ৫ ফুট উচ্চতার গরু পার হয়ে যায় — কেউই নাকি দেখতে পায় না। এই সকল গরুগুলি এ’রাজ্যেরও না। এদেরকে আনা হচ্ছে রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকে। এই হাজার হাজার গরু বড় বড় লরি বা ট্রাকের মাধ্যমে এতগুলো রাজ্যের চেক পোস্ট পার করে এ’রাজ্যের সীমান্তে পৌঁছে যাচ্ছে — এগুলো পুলিশ প্রশাসনের চোখে পড়ে না! আসলে এই পাচারের সাথে যুক্ত প্রতিটি রাজ্যের পুলিশের ডিজি, জেলাগুলির এসপি, থানাগুলির ওসি এবং রাজনৈতিক দলের নেতা মন্ত্রীরা। শুধুমাত্র গরু পাচারের ফলে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা কাটমানি হিসেবে আয় হচ্ছে — যার বখরা কলকাতা থেকে দিল্লী পর্যন্ত যাচ্ছে।

মাঝে মধ্যে সীমান্ত রক্ষীবাহিনীকে ‘কঠোর’ প্রহরার কাজ দেখাতেই হয়। সীমান্তের গরিব মানুষদের দিয়ে দৈনিক ৩০০ বা ৪০০ টাকার বিনিময়ে পাচার করানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। কে নিজের ইচ্ছায় এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে চায়? কিন্তু তাও কেউ কেউ পেটের তাড়নায় বাধ্য হয়ে সেই কাজকে পেশা বলে গ্রহণ করছে। এর কারণ, সীমান্ত এলাকাগুলির ভয়াবহ দারিদ্র। সরকারি প্রকল্পের কোনও সুযোগ এদের জন্য নেই। সীমান্ত এলাকায় বেশিরভাগ মানুষের বাড়িতে শৌচালয় পর্যন্ত নেই। রাজ্য সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্প, খাদ্যসাথী প্রকল্প, নিজ ভূমে নিজ গৃহ প্রকল্প, কর্মসাথী প্রকল্প, নিজশ্রী হাউজিং প্রকল্প, স্নেহালয় প্রকল্প, সুফল বাংলা প্রকল্প, উৎকর্ষ বাংলা প্রকল্প, যুবশ্রী প্রকল্প পশ্চিমবাংলার সীমান্তে কাজ করে না। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের আরো গুচ্ছ গুচ্ছ প্রকল্প আছে। তাতে কোটি কোটি টাকাও আছে। শুধু সীমান্তে এইসব প্রকল্প কার্যকরী হয় না। হলেও বিশেষ কিছু মানুষের জন্য হয়। রাস্তা নেই, বিদ্যুৎ নেই, স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই, চাকরী নেই, উন্নয়ন নেই। আছে বলতে বিএসএফের নির্যাতন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, প্রশাসনের অন্ধত্ব, পরনির্ভরতা। আর বাঁচার রাস্তা একমাত্র যেন চোরাকারবার। তাদের কয়েকজনকে মাঝে মধ্যে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। পরদিন সংবাদ মাধ্যমে ছোট খবর হয় ‘সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতে পাচারকারী হত’। ব্যাস, এর কোনো তদন্তও হয় না। পুলিশ, গ্রামের মানুষের অভিযোগ বা এফআইআর নিতে চায় না। আর যদিও বা মৃত পরিবারের চাপে বা মানবাধিকার সংগঠনের চাপে তদন্ত হয় তাহলে দেখা যাবে যারা হত্যা করেছে তাদেরকেই তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে। ফলে তদন্তের পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়। গ্রামবাসীর তথ্য অনুযায়ী এইসব অঞ্চলে বছরে প্রায় ২০০ মানুষকে হত্যা বা গুম করা হয়। আরো ভয়ঙ্কর বিষয় সীমান্তবাসীরা এইসব অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ জানালে বিএসএফ বাহিনী পরের দিন থেকেই অভিযোগকারীদের বাড়ি বাড়ি হামলা চালায়। হুমকি দেওয়া হয় NDPS (Narcotics Drugs Psycotropic Substance) কেসে ফাঁসিয়ে জেলে ভরে দেওয়ার।

বাস্তবে সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলিতে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা কিছু নেই বললেই চলে। এই এলাকাগুলিতে মানুষের জীবন-জীবিকা, শান্তি, আইনশৃঙ্খলা, খেলাধুলা সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে বিএসএফ। ১৯৭৩ সালের পঞ্চায়েত আইনের ১৬খ ধারা অনুযায়ী নিয়মিত গ্রামসভার মিটিং হওয়ার কথা। কিন্তু সীমান্ত এলাকায় তা হয় না। পঞ্চায়েত আইনের ১৯/২ঘ ধারায় নির্দিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে সকল রাস্তাঘাট, তার রক্ষণাবেক্ষণ এবং চলাচলের বাঁধা অপসারণ করা পঞ্চায়েতের দায়িত্ব। কিন্তু সীমান্তবর্তী পঞ্চায়েত এলাকায় একমাত্র পাকা রাস্তাটি বিএসএফের দখলে। এই সকল বিষয়ে সাধারণ মানুষের প্রচুর অভিযোগ আছে। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়না। এমনও দেখা গেছে সীমান্ত এলাকায় পঞ্চায়েত কোন কাজ করতে গেলে সেখানেও তাদের সীমান্তরক্ষী দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হতে হয়। কেউ যদি এইসব বাধার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে বলা হয় ১৪৪ ধারা জারি আছে। এই ১৪৪ ধারা জারি করছে জেলা শাসক বা কোথাও কোথাও মহকুমা শাসকও। ফৌজদারী আইনের ১৪৪ ধারায় পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করে বলা আছে এই আইন টানা ৬০ দিনের বেশী প্রয়োগ করা যাবে না, কিন্তু সীমান্ত এলাকায় প্রতি ৫৯ দিনের মাথায় পরবর্তী আরো ৬০ দিনের জন্য এই আইন প্রণয়নের নির্দেশ জেলাশাসক বা মহকুমা শাসকের দপ্তর থেকে এসে যাচ্ছে। এই বিষয়ে আবার সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট নির্দেশিকা জারী করেছে। কোনভাবেই কোন এলাকায় লাগাতার এই ধারা প্রয়োগ করা যাবে না। মানুষের চলাফেরা, মত প্রকাশের অধিকার — এগুলি সাংবিধানিক অধিকার; কেবলমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতে এই ধারা স্বল্পকালের জন্য প্রয়োগ করা যেতে পারে। সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আদেশ আমাদের দেশের আইন। সরকার এবং জনসাধারণ সকলেরই তা মান্য করা উচিত। অথচ যারা এই নির্দেশ দিচ্ছেন তারা একবারও সেই সীমান্ত এলাকার মানুষদের সাথে আলোচনা করছেন না। তাদের সমস্যার কথা জানার চেষ্টা করছেন না। দিল্লীর নর্থ ব্লক বা পশ্চিমবঙ্গের নবান্ন থেকে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য প্রতিবছর যে লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হয় তা দেশের সীমান্তে পৌঁছানোর আগেই ফুরিয়ে যায়।

border-region

বিএসএফের এক্তিয়ার সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার বাড়ানো হল

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে গত ১১ অক্টোবর ২০২১ তারিখে একটি নির্দেশনামায় ঘোষণা করা হয় যে, পশ্চিমবঙ্গ অসম ও পাঞ্জাবের সীমান্তে বিএসএফের কর্মক্ষেত্র সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার বাড়ানো হল। এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হল না। এমনিতেই সীমান্ত (IBP) থেকে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিএসএফের দখলে দৌরাত্ম্য চলে বা এই এলাকাগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। এই ঘোষণার ফলে একদিকে যেমন বিএসএফের দৌরাত্ম্যের — যাকে খুশি মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা, তল্লাশির নামে বাড়ীঘর ভাঙ্গচুর করা, মালপত্র আটক করা, মহিলাদের শ্লীলতাহানি করা ইত্যাদি — এলাকা প্রসারিত হবে, অন্যদিকে রাজ্যের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। মনে রাখা দরকার পশ্চিমবঙ্গের ভুখন্ডের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এর মধ্যে পড়ছে। এই ৫০ কিলোমিটার বাড়ানোর পিছনে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আছে। এটা এই পুরো এলাকাটাকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করার পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। ৫০ কিলোমিটার বাড়ানোর ফলে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুর, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা জেলার অধিকাংশ, মালদা, মুর্শিদাবাদ জেলার বেশীরভাগ অংশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আওতায় পড়ছে। ফলে এরপর থেকে শুধুমাত্র সীমান্তবাসী নয়, শহরাঞ্চলের মানুষকেও বিএসএফের বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। যদিও ইতিবাচক যে, ইতিমধ্যে পাঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঐ ঘোষণাকে মান্যতা দেবে না বলে তাদের সরকারি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে।

সীমান্তবাসীদের আক্ষেপ যে এই লক্ষ কোটি মানুষের প্রতিদিনকার এই ভয়ঙ্কর সমস্যা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলই এজেন্ডা করে না। নতুন নতুন সরকার আসে যায় কিন্তু তাঁদের জীবনে কাটে না আঁধার, আসে না নতুন ভোর।

আশার আলো, এই সমস্ত রকমের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সীমান্তবাসীরা বিভিন্ন জেলায় নিজেদেরকে সংগঠিত করছেন ‘আমরা সীমান্তবাসী’ সংগঠন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। আমাদেরও উচিত সাধ্যমত তাঁদের পাশে দাঁড়ানো।

(তথ্য সূত্রঃ ‘মাসুম’ কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা ও ‘আমরা সীমান্তবাসী’র সংগঠকদের সাথে কথোপকথন)

- দিবাকর ভট্টাচার্য্য

analysis-of-the-religious-populationthe-prime-ministers-advisers

কথায় আছে, “রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ”। প্রধানমন্ত্রী যখন সাজিয়ে গুছিয়ে হয়কে নয়, আর নয়কে হয় করে চলেছেন রোজ, তখন তাঁর অর্থনীতিবিদ পারিষদরা যে সেসব মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গবেষণাপত্র পেশ করবেন তাতে আশ্চর্যের কী আছে? অতি সম্প্রতি প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পর্ষদের ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অংশ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে, যা নিয়ে বিজেপি-আরএসএস হৈ-চৈ লাগিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করেছে দেখেছ, ১৯৫০ থেকে ২০১৫, এই ৬৫ বছরে ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে ৪৩ শতাংশ, আর হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে ৮ শতাংশ। যদিও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভারতের জনসংখ্যায় হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত হ্রাসের হার ৭.৮২ শতাংশ (৮৪.৬৮ শতাংশ থেকে কমে ৭৮.০৬ শতাংশ হওয়া যা মূলত ৬.৬২ শতাংশ, কিন্তু অঙ্কের আর একটু জটিল হিসেবে তা (৮৪.৬৮ - ৭৮.০৬)/৮৪.৬৮ = ৭.৮২ শতাংশ)। মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত বৃদ্ধির হার ৪৩.১৫ শতাংশ (৯.৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪.০৯ শতাংশ হওয়া যা মূলত ৪.২৫ শতাংশ, কিন্তু অঙ্কের আর একটু জটিল হিসেবে তা (১৪.০৯ - ৯.৮৪)/৯.৮৪ = ৪৩.১৫ শতাংশ)।

উপরের ওই জটিল হিসেব কেউ বুঝতে চাইবেন বলে মনে হয় না। ফলে মোদীজি-শাহজি-যোগীজি-রাজনাথজি-শুভেন্দুজি-সুকান্তজি (তিনি নাকি আবার পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক) স্বভাবসিদ্ধ ঢং’এ মিথ্যা বলে যাবেন যে দেখেছ, হিন্দু জনসংখ্যা কমছে, মুসলমান জনসংখ্যা বাড়ছে। আদতে কী হচ্ছে, হয়েছে? মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত অবশ্যই বেড়েছে। তবে মোট হিন্দু জনসংখ্যা ১৯৫১ সালের জনগণনার সময়ে ছিল ৩০.৩৭ কোটি, ২০১১ সালে তা হয়েছে ৯৬.৬৩ কোটি। অর্থাৎ মোট বেড়েছে ৬৬.২৬ কোটি। সমসময়ে মুসলিম জনসংখ্যা ৩.৫৪ কোটি থেকে ১৩.৬৯ কোটি বেড়ে ১৭.২৩ কোটি হয়েছে। ফলে গড়ে ৫ জন হিন্দু বাড়লে ১ জন মুসলিম বেড়েছে।

কিন্তু পরিসংখ্যানকে এভাবে দেখবে কে, যেখানে শাসক দলের প্রধান, দেশের প্রধানমন্ত্রী মুসলিমদের নিকৃষ্ট দেখানোর জন্য রোজ বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং তাঁর সাগরেদরা যথোচিত সঙ্গত করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার (সার্ক) ৯টি দেশ নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করেছেন। সেখানে ওই ৬৫ বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাচরণকারীদের মোট জনসংখ্যায় অনুপাতের শতকরা বৃদ্ধি বা হ্রাস (-) দেখানো হয়েছে। যেসব দেশে ওই অনুপাতের হ্রাস বেশি সেখানে সংখ্যালঘুদের ওই অনুপাতের বৃদ্ধি অবশ্যই বেশি। উপদেষ্টাদের (অবশ্যই তাঁরা জ্ঞানীগুণী বিদ্বজ্জন) মতে যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাচরণকারীদের মোট জনসংখ্যায় অনুপাতের শতকরা হ্রাস যত বেশি সেখানে সংখ্যালঘুরা ভালো আছে। তার ফলেই সংখ্যালঘুদের ওই অনুপাতের বৃদ্ধি ঘটেছে। জনসংখ্যার অনুপাতের বৃদ্ধির এই চমকপ্রদ ব্যাখ্যা অবশ্যই সঙ্ঘী বুদ্ধিজীবী সুলভ। এই মোদীর উপদেষ্টা বুদ্ধিজীবীদের দেখে পুরন্দর ভাটের সেই পদ্য মনে পড়ছে, “কী নির্জীব কী নির্জীব নির্ঘাত ওটা বুদ্ধিজীব!”

ওই ব্যাখ্যায় সংখ্যাগুরু বৌদ্ধধর্মের দেশ মায়ানমার তাদের সংখ্যালঘুদের সর্বোত্তম রেখেছে কারণ বৌদ্ধধর্মাচরণকারীদের অনুপাত হ্রাস সেখানে সর্বাধিক। ওই উপদেষ্টারা মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপরে অত্যাচারের ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন কি? আরো বৃহৎ সমস্যা হল, তেমনটা যখন ঘটছে বিজেপির বহুল প্রচারিত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের গল্পটার কী হবে? একই মানদন্ডে আফগানিস্তানে সংখ্যাগুরুবাদ প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ সেখানে সংখ্যাগুরু ধর্মাবলম্বীদের অনুপাত বৃদ্ধির হার নগণ্য। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তেমনটাই বলা চলে। ওই একই যুক্তিতে ভূটান, যেখানে ধর্মীয় বিভাজনের তেমন কোনো উদাহরণ নেই সেখানেও সংখ্যাগুরুবাদ বিপজ্জনক স্তরে রয়েছে। কারণ তালিকা অনুসারে ভূটানে ওই অনুপাত বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ। এমন চমৎকার বিশ্লেষণ ওই উপদেষ্টাদের যুক্তি অনুসরণ করলে পাওয়া যায়। ওনারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ভারতে সংখ্যাগুরুবাদ নেই, সেটা অবশ্য প্রকাশ্য উদ্দেশ্য। তবে যে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তা করতে চেয়েছেন তা হাস্যকর সিদ্ধান্তসমূহে পৌঁছে দিচ্ছে।

তবে ওটা সামনের দরজার উদ্দেশ্য হলেও ভিতরের ঘরে উঁকি দিলেই ভিন্ন উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। নির্বাচন চলাকালীন হঠাৎ জনসংখ্যার অনুপাত নিয়ে এত আগ্রহ কেন হল উপদেষ্টাদের? দেশের মুদ্রাস্ফীতি, বৈষম্য, কর্মহীনতা ইত্যাদি সমস্যাগুলির সমাধান করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দেওয়ার কাজটা কি চলে গেছে, নাকি সেগুলি অত গুরুত্বের নয়? তাঁদের কি অজানা যে, যে ধর্মাবলম্বীদের অর্থনৈতিক অবস্থা যত সঙ্গীন তাদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে কম হারে হ্রাস পায়? ওই যে মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত বাড়ছে কারণ মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমলেও তা হিন্দু জনসংখ্যার কর্মহ্রাসমান বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম কেন না, মুসলিমদের অর্থনৈতিক অবস্থা হিন্দুদের তুলনায় বেশি সঙ্গীন। ফলে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যার অনুপাতের পরিবর্তনের ধনাত্মক উচ্চহার আসলে তাঁদের খারাপ অবস্থার প্রতিফলন।

১৯৫০-২০১৫: সার্ক দেশগুলির সংখ্যাগুরু ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যার অনুপাতের পরিবর্তন
db table_1

অপরদিকে, উপদেষ্টাদের এই প্রতিবেদন মনে হয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের অভিপ্রেত অস্ত্র তুলে দেওয়ার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। তারা ওখান থেকে উদ্দিষ্ট তথ্যটিকে সংগ্রহ করেছেন, অবশ্যই অসত্য মোড়কে জড়িয়ে। তারা প্রচার করতে শুরু করেছে, দেখেছ মুসলমান জনসংখ্যা ৪৩.১৫ শতাংশ বেড়েছে, হিন্দুদের যেখানে ৭.৮২ শতাংশ কমেছে। বলতে থাকছে, এভাবে চললে ভারতে হিন্দুরা অচিরেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা কি জানেন না যে, কোনো দেশের কোনো নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা অপর কোনো ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যাকের টপকাবে কিনা, বা টপকালেও কত দ্রুত টপকাবে তা নির্ভর করে মহিলাদের সামগ্রিক গর্ভধারণের হার ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেট’এর উপরে। এদেশে জনসংখ্যা বাড়লেও টিএফআর ক্রমাগত কমছে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা ‘এনএফএইচএস’র প্রতিবেদন থেকে তা একদম পরিস্কার।

বিভিন্ন জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী মহিলাদের সামগ্রিক গর্ভধারণের হার(টিএফআর)
db table_2

উপরের তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীদের টিএফআর ক্রমাগত কমছে। গত প্রায় তিন দশকে তা কমছে। মুসলমানদের কমার হার (৪৬.৫ শতাংশ) হিন্দুদের কমার হারের (৪১.২ শতাংশ) থেকে বেশি। এমনকি সাম্প্রতিক দুটি সমীক্ষার, এনএফএইচএস৪ (২০১৫-১৬) ও এনএফএইচএস৫ (২০১৯-২১), ক্ষেত্রেও মুসলমানদের কমার হার (৯.৯ শতাংশ) হিন্দুদের কমার হারের (৮.৯ শতাংশ) থেকে বেশি। এমনটা যদি চলতে থাকে অচিরেই দুটি হার সমস্তরে পৌঁছে যাবে।

তবে যেদিকে উপদেষ্টাদের দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল যে, টিএফআর রিপ্লেসমেন্ট লেভেল বা প্রতিস্থাপন হারের, অর্থাৎ ২.১’র নীচে নেমে গেছে, যা জনবিন্যাসে ক্রমাগত তুলনামূলকভাবে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের অনুপাত বাড়াবে, সেই সমস্যাকে কী ভাবে সামলানো যাবে তার কথা ভাবা। কিন্তু কী আর করা যাবে, রাজার পারিষদদের রাজত্ব টেকানোর গুরুদায়িত্ব রয়েছে তারা দেশের স্থিতিশীলতার দায়িত্ব নেবেন কেন?

manipur-stands-after-a-yearwhere-manipur

গত ৩ মে ২০২৪ কুকিদের বসবাসের এলাকা পাহাড়গুলোতে উদযাপিত হলো কালা দিবস, পালিত হলো বন্ধ, সব কুকি বাড়িতে উড়ল কালো পতাকা। সমস্ত গির্জায় অনুষ্ঠিত হলো গণপ্রার্থনা, গণকবরে জানানো হল হিংসায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা, কুকি বাড়িগুলোতে জ্বালানো হলো মোমবাতি। মেইতেইদের বিদ্বেষ-প্রসূত অভিধায় কুকিরা হল ‘মাদক সন্ত্রাসবাদী’, আর তাই ৩ মে উপত্যকায় তারা উদযাপন করল মাদক সন্ত্রাসবাদীদের মণিপুর আক্রমণের বর্ষপূর্তি দিবস। দাবি তুলল, মাদক সন্ত্রাসবাদকে স্বীকৃতি দিয়ে কুকিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, কুকি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির নবীকরণ করা চলবে না। কুকিরা মণিপুরের আদি বাসিন্দা নয়, এই উদ্ভট যুক্তি হাজির করে কুকিদের মণিপুরের জনজাতি তালিকা থেকে অপসারণের উদ্যোগও সক্রিয় হয়েছে। মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে সহিংস সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল ২০২৩’র ৩ মে। তার বর্ষপূর্তি যে ধারায় মণিপুরের দুই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চল উপত্যকা ও পাহাড়ে উদযাপিত হলো তার থেকে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই রইল না যে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পারিক বিভেদ ও বিদ্বেষের গভীরতায় প্রশমন তো একটুও হয়নি, বরং তা গভীরতরই হয়েছে।

দশক দশক ধরে পাহাড়ে কুকিদের মধ্যে অনেক মেইতেই মানুষও থাকতেন, আবার উপত্যকায়, বিশেষভাবে ইম্ফলে মেইতেইদের মধ্যে কুকিদের বাসও অস্বাভাবিক বা নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু ২০২৩ সালের ৩ মে’র পর থেকে উপত্যকায় কোনো কুকির অস্তিত্ব অভাবনীয়, আবার পাহাড়ে কোনো মেইতেই মানুষের দেখা মেলাটা একইরকম অচিন্তনীয়। বসবাস দূরে থাক, এমনকি পরস্পরের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়া এলাকায় অপরের যাওয়াটাও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কুকি এলাকায় চিকিৎসার প্রয়োজন না মিটলে কুকিরা ভিনরাজ্য মিজোরামে যাবেন, কিন্তু রাজ্য রাজধানী ইম্ফলে গিয়ে চিকিৎসা পরিষেবা নেওয়ার কথা ভাবতে পারবেন না। বিমান ধরতেও রাজ্যের একমাত্র বিমানবন্দর ইম্ফলে যাওয়াও তাদের হবে না। মেইতেইদের কাছেও পাহাড়ে পদার্পণ একইরকম বিপদজনক। উপত্যকার জেলা বিষ্ণুপুর ও পাহাড়ি জেলা চুড়াচাঁদপুর, উপত্যকার পশ্চিম ইম্ফল ও পাহাড়ের কাংপোকপি’র মধ্যে বিভাজনের অদৃশ্য সীমারেখাই আজ বলতে গেলে বিরাজ করছে। সরকারি কর্মী ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যেও এই বিভাজন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে — কুকি কর্মীকে উপত্যকায় পাওয়া এবং পাহাড়ে মেইতেই কর্মীর সন্ধান আক্ষরিক অর্থেই অকল্পনীয়। রাজ্যে কুকি বিধায়কদের সংখ্যা ৭ বিজেপি বিধায়ক সহ ১০, এদের মধ্যে দুজন আবার রাজ্যের মন্ত্রী। কিন্তু গত এক বছরে এদের সঙ্গে সরকার বা মন্ত্রীসভার কোনো সম্পর্ক থাকেনি। অতএব যদি বলা হয় যে, ২০২৩ সালের ৩ মে মণিপুর বিভাজিত হয়ে দুই মণিপুরের অস্তিত্বকে সামনে এনেছিল তার মধ্যে অতিশয়োক্তি বোধকরি থাকবে না।

where-manipur-stands-after-a-year_0

এক বছরের পারস্পরিক সংঘর্ষে উভয় পক্ষই প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। দুই সম্প্রদায় মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ২২৫’র বেশি, ২০,০০০ শিশু-কিশোর সহ ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সংখ্যা ৭০,০০০, ত্রাণ শিবিরগুলোতে এখনও থাকতে হচ্ছে ৫০,০০০ মানুষকে। ত্রাণ শিবিরগুলোর অবস্থাও শোচনীয় — খাওয়া ও চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই সন্তোষজনক নয়। ধ্বংস হয়েছে প্রচুর বাড়ি ও বাণিজ্যিক ভবন, ভস্মীভূত হয়েছে কয়েকশত চার্চ ও কিছু মন্দির। মাসের পর মাস ইম্ফলের মর্গে পড়ে থাকা কুকি মৃতদেহগুলোকে সড়ক পথে পাহাড়ে আনা যায়নি, আনতে হয়েছে আকাশ পথে। ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হয়ে বহু মানুষের ঠাঁই নিজ রাজ্যে হয়নি, তাদের চলে যেতে হয়েছে মেঘালয়-মিজোরাম-আসামের মতো পার্শ্ববর্তী ভিনরাজ্যে। বীরেন সিং’এর নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার মেইতেইপন্থী, এ নিয়ে প্রশ্নের বিশেষ অবকাশ না থাকায় এটাও স্বাভাবিক যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার অনেক বেশি হতে হয়েছে কুকিদেরই। নিহতের সংখ্যা, নারীদের যৌননিগ্ৰহ, জীবিকা হারানো, সম্পত্তি ধ্বংস — এই সমস্ত বিষয়েই মেইতেইদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে কুকিদেরই।

বীরেন সিং সরকারের কাছ থেকে নিরাপত্তা পাওয়া মণিপুরের জনগণের কাছে দুরূহ ব্যাপার হয়েই দাঁড়িয়েছে। এর অনিবার্য পরিণাম স্বরূপ মেইতেই ও কুকি উভয় এলাকাতেই গড়ে উঠেছে সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী, যাদের ঘোষিত লক্ষ্য জনগণকে নিরাপত্তা প্রদান। এরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পালা করে পাহাড়া দেয়, এবং কখনও কখনও বিপক্ষ বাহিনী এবং এমনকি রাজ্যের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গেও সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য মেইতেইদের সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আরাম্বাই টেঙ্গল’এর বাড়বাড়ন্তের কথা। মণিপুরে হিন্দু সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বিজেপি সাংসদ এল সানওয়াজ গড়ে তোলেন এই বাহিনী; আর বীরেন সিং সরকারও এদের মদত জুগিয়ে চলে যে মদতকে প্রচ্ছন্ন বললে ভুল বলাই হবে। এরা বহুবারই থানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করেছে, এবং তা করতে গিয়ে বিশেষ বাধার মুখে তাদের পড়তে হয়নি। সশস্ত্র ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে এদের ঔদ্ধত্য এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে এরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও করণীয় কাজের নির্দেশ দেয়। মণিপুরের পুলিশ বাহিনীও এখন অভিযোগ করে থাকে যে আরাম্বাই টেঙ্গল তাদেরও হুমকি দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর কে রঞ্জন এবং বিজেপি রাজ্য সভাপতি সারদা দেবীর ইম্ফলের সরকারি আবাসনের আবাসও এদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি। জঙ্গি বাহিনীর সক্রিয়তা মাথাচাড়া দিয়েছে, কোথাও পরিস্থিতি এমন হলে সেখানে সেনা নামিয়ে তাদের দমন এবং এমনকি পাইকারি হারে হত্যাই মোদী সরকারের দস্তুর বলেই ভারতবাসী জানে। কিন্তু আরাম্বাই টেঙ্গল’এর বিরুদ্ধে মোদী সরকারের নিষ্ক্রিয়তা অত্যন্ত প্রকট। প্রতিপক্ষ বিশেষভাবে সংখ্যালঘুদের দমনে আরএসএস যে নানা বাহিনী তৈরি ও মজুত করেছে বলে জানা যায়, আরাম্বাই টেঙ্গলও তাদের সমগোত্রীয় রূপেই দেখা দিচ্ছে।

মণিপুরের পরিস্থিতি থেকে যে প্রশ্নগুলো স্বাভাবিকভাবেই মাথাচাড়া দিচ্ছে তা হল — মণিপুরের জন্য কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে? দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক বৈরিতা কি এতটাই অতিমাত্রিক যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কোনো সুযোগ আর নেই? সমস্যার সমাধান সম্ভব হলে কোন পথে তা বাঞ্ছনীয়? সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে কুকিরা স্বতন্ত্র প্রশাসনিক এলাকার দাবি জানিয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন, মণিপুরে ২০১৭ ও ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কুকিদের বিজেপিকে সমর্থনের পিছনে এই প্রত্যাশা ছিল যে, নির্বাচিত বিজেপি সরকার তাদের এই আকাঙ্খা পূরণ করবে। কিন্তু বীরেন সিং’এর বিজেপি সরকার কুকিদের ঐ দাবির বিরোধিতাতেই শুধু দাঁড়ায়নি, তাদের দমনে ও পদে-পদে প্রতিকূলতা সৃষ্টিতেও তৎপর হয়েছে। মণিপুরে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে অমিত শাহও মেইতেইদের দাবির প্রতিধ্বনি করে বলেছেন — মণিপুরকে অখণ্ড রাখতে হবে। নরেন্দ্র মোদীর দশ বছরের শাসনে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিযান জনজাতিদের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলতে উদ্যত হয়েছে, সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রান্তিক অবস্থানই তাদের অবধারিত নিয়তি হয়েছে ও হচ্ছে। মণিপুর হাইকোর্টের যে রায় মেইতেইদের জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ কেন্দ্রের কাছে করতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল, এবং যে রায়কে কেন্দ্র করেই এক বছর আগে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটেছিল, সেই রায়ের অভিমুখও এই নিয়তির অনুসারী বলেই কুকিদের চেতনায় ধরা দিয়েছিল। প্রান্তিকতায় পর্যবসিত জনগণ ও সম্প্রদায়ের অধিকারের প্রতিষ্ঠা, পোশাক-ভাষা-খাদ্যাভাস ইত্যাদির ভিন্নতা সহ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সুরক্ষা, পছন্দের ধর্ম অনুসরণকে অবাধ করা — এর আন্তরিক বাস্তবায়নই হতে পারে মণিপুর সহ ভারতের সামাজিক ঐক্যের, সম্প্রদায়গত বিভেদ দূরিকরণের নির্ধারক শর্ত।

XXXXX

খণ্ড-31
সংখ্যা-18