আজকের দেশব্রতী : ০৯ মে ২০২৪ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-09-may-2024against-cancellation-of-jobsagainst-cancellation-of-jobs

শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় পঁচিশ হাজার শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বাতিল প্রসঙ্গে কলকাতার মৌলালি মোড়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উদ্যোগে এক সভা হয়। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রোগ্রেসিভ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক অজয় বসাক। বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক অমিত দাশগুপ্ত, শিক্ষক সজল অধিকারী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বর্ষা বড়াল, শিক্ষক আনারুল ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সামসুল আলম মহাশয়।

সভার মূল দাবিগুলি ছিল,

১) স্বচ্ছভাবে চাকুরিপ্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরি ও সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে৷

২) শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিগ্রস্তদের কঠোর শাস্তি চাই।

৩) স্বচ্ছভাবেনিযুক্তদের তালিকা এসএসসি, পর্ষদ ও রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে সর্বোচ্চ আদালতের হাতে তুলে দিতে হবে।

৪) শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে বিজেপির নৈরাজ্য সৃষ্টির চক্রান্তকে ব্যর্থ করুন।

সভা চলাকালীন উপস্থিত দর্শক ও পথচলতি মানুষদের মধ্যে পিটিএবি, আইসা, আর ওয়াই এ কর্তৃক যৌথভাবে প্রকাশিত একটি লিফলেট বিলি করে এই প্রসঙ্গে সংগঠনগুলির বক্তব্য প্রচার করা হয়।

======

jobs-of-transparently-appointed-employeesagainst-cancellation-of-jobs-

কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের ফলে ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা তাঁদের চাকরি খুইয়েছিলেন। এই অভূতপূর্ব বিপর্যয়কারী রায়দানে মুষড়ে না পড়ে, যোগ্য প্রার্থীরা উপযুক্ত নেতৃত্বে বাংলা জুড়ে বঞ্চিত, অপমানিত শিক্ষকদের সংঘবদ্ধ উদ্যোগে অপদার্থ ও অভিযুক্ত স্কুল সার্ভিস কমিশনের দপ্তরের সামনে একদিকে যেমন তুমুল বিক্ষোভ সংগঠিত করেছেন, তেমনি অন্যদিকে তাঁদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালতে ন্যায়সঙ্গত অধিকার ফিরে পেতে হাইকোর্টের অনৈতিক রায়ের বিরুদ্ধে বুক ঠুকে সওয়াল হাজির করতে দ্বিরুক্তি করেননি।

আজ হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ হয়েছে। ১৬ জুলাই পরের শুনানি। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছে আইনি ও বেআইনিভাবে চাকরীপ্রাপ্তদের আলাদা তালিকা করা হবে। যাদের বেআইনি কার্যকলাপের সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের আজ থেকে রায় বেরোনো পর্যন্ত বেতন ফেরত দিতে হবে। রায়ে আরো বলা হয়েছে, সুপার নিউমেরারি পদ অনুমোদনের বিষয়ে তদন্তে পূর্বের স্থগিতাদেশ পুনর্বহাল করা হয়েছে।

আমরা সুপ্রিম কোর্টের এই অন্তর্বর্তীকালীন রায়কে স্বাগত জানাই এবং আশা রাখি পরবর্তী শুনানিতে লড়াকু শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা হাইকোর্টের এক শ্রেণীর স্বার্থবাহী আইনজীবীর কুৎসিত উল্লাস, শাসকদলগুলির প্রতিরোধ ও সামাজিক অপমানের ঘেরাবন্দী থেকে নিজেদের মুক্ত করে আবার শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর স্বমর্যাদায় পুনর্নিয়োজিত হবেন। সর্বোচ্চ আদালতের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপে বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও উপযুক্ত পঠনপাঠনের সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসুক — আমরা এমনটাই চাই।

- অভিজিৎ মজুমদার, রাজ্য সম্পাদক,
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন

demonstration-at-raj-bhavandemonstration-at-raj-bhavan

মাননীয়া রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতি ভবন, নয়াদিল্লী মাননীয়া, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধে যৌনহেনস্থার অভিযোগ এনেছেন রাজভবনে কর্মরতা এক মহিলা। কর্মসূত্রে তিনি রাজভবনের কোয়ার্টারে থাকেন। সংবাদসূত্রে জানা যায় মহিলা তাঁর অভিযোগে জানিয়েছেন যে গত ২৪ এপ্রিল ২০২৪ রাজ্যপাল তাঁকে বায়োডাটা নিয়ে দেখা করতে বলেন, যৌনহেনস্থা মূলক প্রস্তাব দেন ও শরীর স্পর্শ করেন। সেইদিন মহিলাটি সেইখান থেকে কোনক্রমে হাত ছাড়িয়ে চলে আসেন। আবার গত ২ মে রাজ্যপাল তাঁকে ডেকে পাঠান। এইবার মহিলাটি তার সুপারভাইজারকে সাথে করে নিয়ে রাজ্যপালের কাছে দেখা করতে গেলে, রাজ্যপাল সুপারভাইজারকে বাইরে চলে যেতে বলেন এবং মহিলাটিকে চাকরিতে স্থায়ী করে দেবার প্রলোভন দেখিয়ে কথাবার্তা চালান। মহিলা প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় রাজ্যপাল অভব্য আচরণ করেন ও খারাপ উদ্দেশ্যে তাঁকে স্পর্শ করেন। মহিলা পুরো ঘটনা জানিয়ে প্রথমে রাজ্যভবন থানায় ওসির কাছে অভিযোগ দায়ের করেন, পরে তাকে হেয়ার স্ট্রীট থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেছেন আজ যদি তিনি মুখ না খোলেন তাহলে অন্য মেয়েদের উপরও এরকম যৌনহেনস্থা ঘটবে। সম্প্রতি ভোট সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগ শুনতেই নাকি রাজ্যপাল পিসরুম খুলেছেন রাজভবনে। অভিযোগ সেই পিসরুমের কর্মরতা মহিলার উপর‌ই যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটলো। এই ঘটনার তদন্ত এড়াতে রাজ্যপাল রাজভবনের মধ্যে পুলিশ ঢোকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী কোনো মহিলা শ্লীলতাহানির অভিযোগ করলে তার অভিযোগকে সত্য ধরেই তদন্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। রাজ্যপাল পদ কোনো সুবিচারের অন্তরায় হতে পারেনা। তাই আপনার কাছে আমাদের দাবি অভিযোগকারিণীর সুবিচার পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করতে অবিলম্বে আপনি সি ভি আনন্দ বোসকে রাজ্যপাল পদ থেকে অপসারিত করুন ও তাঁকে তদন্তের মুখোমুখি দাঁড় করান। এর পাশাপাশি অভিযোগকারিণীর চাকরী সহ সমস্ত নিরাপত্তা যাতে সুনিশ্চিত থাকে তার জন্য‌ও আপনার নজরদারি ও পদক্ষেপ জরুরি।

নির্বাচনী প্রচারের জন্য রাজ্যে প্রতিনিয়ত যাওয়া আসা করছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি রাজভবনে রাত্রি যাপন‌ও করছেন। শ্লীলতাহানির অভিযোগে অভিযুক্ত রাজ্যপালের আতিথ্য গ্রহণ প্রধানমন্ত্রীর পদের প্রতি সুবিচার হচ্ছেনা বলেই আমরা মনে করি। তিনি এই ধরনের কাজ থেকে যাতে বিরত থাকেন তার জন্য আপনার হস্তক্ষেপ‌ও দাবি করছি। 

ধন্যবাদ সহ,
- ইন্দ্রাণী দত্ত, রাজ্য সম্পাদিকা,
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি

financial-inequality-came-upinequality-came-up-as-the-agenda

পুনর্বন্টনের ধারণার মূলেই এবার খোদ মোদী আঘাত নামালেন চলমান নির্বাচনী প্রচার অভিযানে।

সরকার কর্তৃক সাধারণ মানুষের জন্য আইনত নানান বরাদ্দকে কটাক্ষ করা কিন্তু অতি ধনী কর্পোরেটদের জন্য লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক ছাড়কে ইন্সেনটিভের তকমা দেওয়া, কর্পোরেটদের সম্পদ সৃষ্টিকারী হিসাবে চিহ্নিত করা মোদী জমানায় এক দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মোদীর জমানায় আর্থিক ও আয়ের নিরিখে ভারতবর্ষবিশ্বের সবচেয়ে অসম দেশ হিসাবে জগৎ সভায় উঠে এসেছে, যেখানে দেশের এক শতাংশ অতি ধনীর কব্জায় চলে গেছে দেশের ৪০ শতাংশেরও বেশি আয় ও সম্পদ! এতো উৎকট অসাম্য বিশ্বের আর কোথাও নেই। ভারত স্বাধীন হওয়ার সময়ে এক শতাংশ অতি ধনীর হাতে ছিল দেশের মোট সম্পদের পনেরো শতাংশ। আজ তা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। ব্রিটিশ রাজের থেকেও ভারতের বর্তমান অবস্থা যে কত বেশি খারাপ তা দেখিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ল্যাব রিপোর্ট। ওই সমীক্ষাই বলেছে, যদি এদেশের ১৬৭ অতি ধনী পরিবারের রোজগারের উপর মাত্র দু’শতাংশ কর ধার্য করা যায়, তা হলে তা থেকে ০.৫ শতাংশ জাতীয় আয়ের সমতুল টাকা পাবে সরকার, আর তা দিয়ে স্বাস্থ্য-শিক্ষা আর পুষ্টি এই তিনটি খাতে বেশ খানিকটা সরকারি বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে।

অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) জানাচ্ছে সমস্ত দেশেই সম্পত্তি (প্রপার্টি) কর রয়েছে, বেশিরভাগ দেশেই রয়েছে উত্তরাধিকার কর, আর কিছু কিছু দেশে আছে সম্পদ কর। আমাদের দেশে নাম কা ওয়াস্তে সম্পত্তি কর আছে। এছাড়া, সবচেয়ে উঁচু স্তরে রয়েছে তুলনামূলক কম হারে (৩০ শতাংশ) আয়কর। আর দেশের অতি ধনীরা বিরাট মাত্রায় ভর্তুকি ভোগ করে থাকেন। পুনর্বন্টন পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতিতে খুবই প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবস্থাপনা যেখানে আয় ও সম্পদ নিজের নিয়মে পরিচালিত হয়। ওইসিডি সঠিক ভাবেই বলেছে, “মুনাফার থেকে অর্জিত সম্পদের আহরণ নিজের নিয়মেই ক্রমাগত বেড়ে চলে। সম্পদ কর এই প্রক্রিয়াকে থামাতে পারবেনা, কিন্তু কিছুটা মন্থর করে দেয়।” নির্বাচনের সময়, তা বিধানসভা বা লোকসভা হোক না কেন, কিছু জনমুখী প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে, যেমন মনরেগা অথবা জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন।

অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক কৌশিক বসুও ভারতের উৎকট আয় ও আর্থিক অসাম্য নিয়ে অনেক নিবন্ধ লিখেছেন। তিনিও দেখিয়েছেন অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বে দ্রুততম বিকাশশীল দেশ, পঞ্চম বৃহৎ অর্থব্যবস্থা এই ভারতে বহুল প্রচারিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি রোজগার ও কর্মসংস্থান দিতে পারছে না, খাদ্যপণ্যের চড়া মূল্যস্ফীতি (৮.৫ শতাংশ) আম জনতার প্রকৃত আয়ের উপর থাবা বসিয়েছে, কমেছে ব্যাপক ক্রয় ক্ষমতা, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র ও ঋণের বোঝায় ২০২২ সালে ১১,২৯০ জন চাষি আত্মঘাতী হয়েছেন। আজ ভারতের কর্মহীনতা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কোভিড-উত্তর দুনিয়া যখন বিশ্বজুড়েই বিরাট এক আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হল, বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ যখন রুটি রুজি হারিয়ে দারিদ্রের খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে, তখন সরকারগুলির সংকটাপন্ন রাজকোষ ভরাতে অতি ধনীদের উপর সম্পদ, সম্পত্তি প্রভৃতি কর বসানোর এক জোরালো বয়ান সামনে আসে দুনিয়া জুড়ে। আমাদের দেশেও কোভিড কালে আদানি আম্বানি কী বিপুল সম্পদ কুক্ষিগত করে তা সেই সময় ব্যাপক চর্চিত হয়।

কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে কয়েকটা প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। যেমন, প্রতিটি গরিব পরিবারকে বছরে এক লক্ষ টাকা নগদ তাঁদের অ্যাকাউন্টে পাঠানো, যা ২০১৯’র ন্যূনতম আয় যোজনারই আরেকটা সংস্করণ। এর পাশাপাশি শহরে কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প, সমস্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রভৃতি। মোদী সচেতন ভাবেই এই পদক্ষেপগুলোকে সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে ডাহা মিথ্যা প্রচার শুরু করেছে।

ভারতবর্ষের কুৎসিত কদর্য অসাম্য আজ রীতিমতো আলোচ্যবিষয় হয়ে উঠেছে। আয় ও সম্পদের পুনর্বন্টনের দাবি সমাজের ভেতর থেকে, অর্থনীতিবিদদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের ও উদারপন্থী মহল থেকে উঠে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে কিছুটা সংযত ও ভারসাম্য ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’এর মধ্যে দিয়ে চলার জন্য ওই ধরনের সংস্কারের দাবি ভেতর থেকেই উঠে আসে।

আমাদের দেশে যথাসময়ে এই উৎকট আর্থিক অসাম্য উঠে এল আলোচ্যসূচিতে। নির্বাচনী ফলাফল যাই হোক না কেন, আগামী দিনে এই বিষয়টাকে ধরেই রাজনৈতিক আন্দোলনের সলতে পাকানো দরকার।

dictator-is-down-throw-himthe-dictator-is-down

লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় যে প্রবণতাগুলি প্রকাশ হতে শুরু করেছিল দ্বিতীয় দফায় সেগুলি আরো জোরালো ও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে — বিজেপির ভোটারদের মধ্যে ক্লান্তি ও মোহভঙ্গ এবং সঙ্ঘ-বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে ক্রমবর্ধমান হতাশা। সারা দেশে প্রায় দুই শত আসনে ভোটদান পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। তামিলনাড়ু, কেরালা, রাজস্থান ও উত্তরাখণ্ডের মত রাজ্য ইতিমধ্যে জোরালো বার্তা দিয়ে দিয়েছে যে প্রত্যাশা মত ‘দক্ষিণে সাফ, উত্তরে হাফ’ (দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে এনডিএ’কে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দাও, আর উত্তরের রাজ্যগুলিতে অর্ধেকে নামিয়ে আনো) ফর্মুলা মোতাবেক ২০২৪’র নির্বাচনী ফলাফল এগোচ্ছে। কিন্তু ভোটদানের হার ও ফলাফলের ভবিষ্যৎবাণীর ঊর্ধ্বে যে বিষয়টি আমাদের অধিক মনোযোগ দাবি করে তা হল এই প্রলম্বিত নির্বাচনী সংগ্রামে সামনে আসা বিতর্ক ও চর্চা।

৪০০’র অধিক আসন জেতার প্রত্যয়ী দাবি সামনে রেখে বিজেপি তার প্রচারের এক আগ্রাসী সুর বেঁধে দেয় এবং ‘পরিবারবাদ’ ও ‘ভ্রষ্টাচার’এর ধুয়ো তুলে বিরোধীপক্ষের ওপর আক্রমণ নামায়। কিন্তু নির্বাচনের এক সপ্তাহ শেষ হতে না হতেই এইসব শ্লোগান হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সঙ্ঘ পরিবারের রণনীতিবিদেরা বুঝে গেলেন যে এইসব শ্লোগান আর তেমন অনুরণন তুলছে না। গণচর্চার পরিসরটা বদলে গেছে বিজেপির প্রত্যাশিত পতন এবং বিজেপির ছাতার তলায় সব ধরণের ভ্রষ্টাচারী পরিবারের রাজত্বের সমাহার বিষয়ক আলোচনায়। মরিয়া মোদী তাই তার চিরাচরিত ও পরীক্ষিত হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের এজেন্ডায় ফিরে যায়।

কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোটের বিরুদ্ধে ‘মুসলমান তোষণ’এর দুইটি নির্লজ্জ অভিযোগ আনা হচ্ছে — হিন্দুদের সম্পত্তি এমনকি বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের গলার মঙ্গলসূত্র পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করে মুসলমানদের মাঝে বিতরণ করে দেওয়া হবে, এবং ওবিসি সংরক্ষণ কমিয়ে দিয়ে তার জায়গায় ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ চালু করা হবে। যোগী আদিত্যনাথ দুটি নতুন অভিসন্ধিমূলক অভিযোগ যুক্ত করেছেন — সারা দেশে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ তথা শরিয়া আইন লাগু হবে এবং দেশজুড়ে বেলাগাম গোহত্যা প্রোমোট করা হবে। ৪০০ প্লাস আসন পাওয়ার প্রত্যয়ী ঘোষণা দিয়ে যে প্রচার শুরু হয়েছিল তা পর্যবসিত হল এরকম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কে দেওয়া এবং বিরোধী দলগুলির ক্ষমতায় আসা সম্পর্কে এরকম ভয় ছড়িয়ে দেওয়ায়।

এই সমস্ত অবাস্তব অভিযোগ কেবলমাত্র বিজেপি শিবিরের ক্রমবর্ধমান হতাশাকে দেখিয়ে দেয়। আসলে বিজেপির এই ঔদ্ধত্য তার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে আরো বাড়িয়ে দেওয়ারই কথা। ভারতের খেটে খাওয়া মানুষের রুটিরুজিকে যে দলটি একাই ব্যাপক ধ্বংস করেছে, লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত পরিবারের উপার্জন, সঞ্চয় ও সামাজিক সুরক্ষা ক্ষয়ে যাওয়ার জন্য যে দলটি সম্পূর্ণভাবে দায়ী, সেই দলটি গরিব মানুষের কথাবলে কুমিরের কান্না কাঁদছে — এর থেক বড় শয়তানি আর কী হতে পারে। ওবিসি কোটা মুসলমানেরা নিয়ে নিচ্ছে বলে দেখিয়ে ওবিসিদের এইভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়াটা সম্পূর্ণত তথ্যবিকৃতির ওপর দাঁড়িয়ে হচ্ছে। মুসলমানদের একটা অংশ বর্তমানে সংরক্ষণ পান সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে নয়, পেশা ও জাতের ভিত্তিতে এবং বেশিরভাগ রাজ্যে মুসলিম ওবিসি/ইবিসি জাতকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য সামগ্রিক কোটা বাড়ানো হয়েছে।

বস্তুত সংরক্ষণ প্রশ্নে আজকের সময়ের মূল উদ্বেগের বিষয় হল মোদী রাজত্বে সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে ধারাবাহিক ও সুপরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে খর্ব করা হয়েছে। অর্থনেতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের নির্বিচার বেসরকারিকরণ এবং সর্বত্র চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে সংরক্ষণ ব‍্যবস্থার সুযোগ বহুলাংশে সীমিত এবং প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। সমাজের যে অংশ এযাবৎকাল বহিষ্কৃত ছিল, জনসংখ্যার অনুপাতে যাদের ভাগিদারী ছিল নগণ্য, তাদের যথাযথ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার হাতিয়ার হিসেবেই যে সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রণয়ন সেই ধারণাকেই পরিত্যাগ করে ও পাশ কাটিয়ে আমলাতন্ত্রের উর্ধ্বতন স্তরে ল্যাটেরাল এন্ট্রির বন্দোবস্ত অনেক বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টি থেকে যে বাস্তব দাবি বর্তমানে উঠে এসেছে তা হল জাতজনগণনা করে সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রসার ঘটানো, বিহারে যেমনটা হয়েছে। বিজেপি এর চরম বিরোধী। এবং তাদের এই চরম বিরোধিতাকে আড়াল করতে, তাদের সংরক্ষণ বিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে এই ওবিসি বনাম মুসলমানের ধূয়ো তুলছে বিজেপি।

সামাজিক ন্যায় ও সংরক্ষণের ধারণার প্রতি আরএসএসের ঐতিহাসিক বিরোধিতা ভারতে কোনো গোপন বিষয় নয়। ১৯৯০ সালে ভি পি সিং সরকার থেকে বিজেপি তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল মূলত মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ওবিসি সংরক্ষণ চালু করার ভি পি সিং সরকারের ঘোষণায় বিজেপির বিরোধের কারণে। ২০১৪ সালে মোদীর বিজয়লাভের পর আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত স্বয়ং প্রস্তাব আনেন ভারতে বিদ্যমান সংরক্ষণ ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করে দেখার। আজ সেই একই মোহন ভাগবত বলতে শুরু করেছেন গত দুই সহস্র বছর জাতের নিপীড়ন থাকার কারণে আগামী আরো দুইশত বছর সংরক্ষণকে ‘সহ্য করা’র কথা! এবং মোদীর এমন ঔদ্ধত্য তিনি এসসি/এসটিদের ভয় দেখান যে বিরোধীপক্ষ জিতলে এসসি/এসটিদের সংরক্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে।

ভারতে এখন জনগণের মূল উদ্বেগের বিষয় নিছক সংরক্ষণে আটকে নেই। ভারতের সংবিধানের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েই দুশ্চিন্তার নানা কারণ হাজির হয়েছে। আম্বেদকরের সংবিধানের সাথে গোলওয়ালকরের আরএসএসের মৌলিক ঐতিহাসিক বিরোধকে আজ অবহেলা করলে তা আধুনিক ভারতের পক্ষে সর্বনাশের কারণ হবে। ভারতের সংবিধান গ্রহণের সময়ই আরএসএস প্রকাশ্যে মনুস্মৃতিকে ভারতের আদর্শ সংবিধান হিসেবে তুলে ধরেছিল। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও বাজপেয়ি ও আডবাণীর নেতৃত্বে চলা এনডিএ সরকার সংবিধানের কার্যকারিতা খতিয়ে দেখতে কমিশন গঠন করতে পিছপা হয়নি। ইতিমধ্যে গত দশ বছরে মোদী সরকার দেশের সংবিধানের শরীরে সহস্র কোপ মেরে দিয়েছে, যে কোনো সুযোগে সংবিধানের মূল সুর ও নীতিমালায় অন্তর্ঘাত চালিয়ে এমনকি তার বুনিয়াদি কাঠামোকেও পাল্টে দিয়ে।

স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে মোদীর প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিবেক দেবরায় একটি নিবন্ধ লিখে একটি নতুন সংবিধান রচনার পক্ষে সওয়াল করেন যে সংবিধান মোদী রাজত্বের নীতিসমূহের ‘সম্পূর্ণ সম্ভাবনা’ বাস্তবায়িত করতে পারে। সঙ্ঘ পরিবারের কিছু কিছু মার্গদর্শকের এতটাই ঔদ্ধত্য যে তাঁরা আম্বেদকরের সংবিধানকে ঔপনিবেশিক দস্তাবেজ বলে অভিহিত করে ‘বি-উপনিবেশকরণ’এর নামে নতুন সংবিধান রচনার কথা বলেন। ফলত, সংবিধান গ্রহণের প্রাক্কালে বাবাসাহেব আম্বেদকর যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন তা আজ ভারতের স্মরণ করার সময় এসেছে। আম্বেদকরের সংবিধানের সার বস্তু — সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা, এর তদারকি এবং সন্তুলনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপনাসমূহ, আলাদা আলাদা ক্ষমতার বন্টন এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো — এই সবই এখন বড় ধরণের বিপদের মুখে আছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাই এখন প্রশ্নের মুখে আছে বিজেপির ‘অপারেশন লোটাস’ অভিযানের ফলে। এই অভিযানে এখন তারা নতুন মডেলও সামনে এনেছে — চণ্ডিগড় ও খাজুরাহ থেকে সুরাট, ইন্দোর ও অরুণাচল প্রদেশ — নমিনেশন থেকে শুরু করে ভোট গণনা অবধি নির্বাচনের বিভিন্ন স্তরে।

মোদী, শাহ ও ভাগবত যখন ভারতকে গ্যারান্টি দেওয়া শুরু করেছে সংবিধানের স্থায়িত্ব ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা বিষয়ে তখন এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই ক্ষমতাসীনেরা তাদের নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে মিথ্যা বলতে শুরু করেছে। প্রথম দুই পর্ব এই নির্বাচনের মূল সুর ও অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছে, আমরা ভারতের জনগণ এখন অবশ্যই একে আগামী পাঁচ পর্বের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাব ইণ্ডিয়া জোটের নির্ধারক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন তথা সুস্পষ্ট বিজয়ের লক্ষ্যে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৬ মে ২০২৪

justice-for-rohit-vemulajustice-for-rohit

২০১৬’র ১৭ জানুয়ারি রোহিত ভেমুলার যে মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল তার আরেক বেদনাদায়ক দিক আজ সামনে এল। এবিভিপি আর মোদী সরকারের সাথে এইচসিইউ কর্তৃপক্ষের যোগসাজসে রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার আট বছর পর তেলাঙ্গানা পুলিশ এক পরস্পরবিরোধী ও বিভ্রান্তিপূর্ণ তদন্ত রিপোর্ট জমা করে ‘প্রমাণের অভাব’ দেখিয়ে মামলাটি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছে। এটা করতে গিয়ে তেলাঙ্গানা পুলিশ বিজেপির নেতানেত্রী স্মৃতি ইরাণি, বান্দারু দত্তাত্রেয়, এন রামচন্দর রাও এবং হায়দারবাদ ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন উপাচার্য আপ্পা রাও পোডাইলকে ‘ক্লিন চিট’ দিয়েছে।

একথা অস্বীকার করার তো কোনো উপায় নেই যে বিজ্ঞানী গবেষক তথা আন্দোলনকর্মী রোহিত ভেমুলাকে কোনঠাসা করে হতাশায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল, যেমনটা ওই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এবিভিপি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের চাপে দলিত ছাত্র আন্দোলনের সব কর্মীদের সাথে করা হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নামিয়ে আনা একের পর এক হয়রানি ও শাস্তি এবং তা করার ক্ষেত্রে এবিভিপি ও বিজেপি নেতাদের হস্তক্ষেপের কথা চূড়ান্ত রিপোর্টে স্বীকার করে নিয়েও, সকলকে সকল অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তেলাঙ্গানা পুলিশ এটাও দাবি করেছে যে রোহিত ভেমুলা দলিত সমাজের ছিলেন না এবং রোহিত ভেমুলার পরিবার এসসি সার্টিফিকেট জাল করেছিল। রিপোর্ট এই বলে উপসংহার যে প্রকৃত জাত পরিচিতি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা। এই উপসংহার অত্যন্ত অবমাননাকর। কারণ, রাধিকা ভেমুলার মা মারা যাওয়ার আগে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে গেছেন যে রাধিকা এসসি অন্তর্ভুক্ত মালা সম্প্রদায়ের মেয়ে ছিলেন, পালিত কন্যা হিসেবে বড় হওয়ার পর ওবিসি অন্তর্ভুক্ত ভদ্দেরা সম্প্রদায়ে বিবাহ হয় এবং তাঁর দলিত জন্ম পরিচয় জানার পর তাঁর স্বামী তাঁকে পরিত্যাগ করে। পুলিশ রিপোর্টে এই তথ্য সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এবং এই বিষয়টিকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে তুলে ধরাটা সম্পুর্ণভিত্তিহীন ও অসৎ পন্থা।

তেলাঙ্গানা পুলিশের এই কাজ কেবলমাত্র এই প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকে আড়াল করাই নয় একই সাথে রোহিত ভেমুলা ও তাঁর মা রাধিকা ভেমুলার চরিত্র হনন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন একে ধিক্কার জানাচ্ছে।

সামন্ততান্ত্রিক ও জাতবিদ্বেষী পুলিশী কার্যকলাপের আরেক উদাহরণ এটা। এর জন্য ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সিপিআই(এমএল) পুনরায় জোর দিয়ে বলতে চায় যে এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা যেখানে এক মেধাবী দলিত ছাত্রকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। সিপিআই(এমএল) দাবি করছে যে তেলাঙ্গানার কংগ্রেস সরকার পুনর্তদন্ত করে চার্জশিট দাখিল করুক।

- কেন্দ্রীয় কমিটি,
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, ৬ মে ২০২৪

dalit-organizations-in-maharashtrasupported-the-india-alliance

মহারাষ্ট্রে প্রায় পঞ্চাশটি দলিত আম্বেদকরবাদী সংগঠন একত্রিত হয়ে ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থিদের প্রতি জোরালো সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। একটি দলিত সংগঠন মহারাষ্ট্রের সবকটি আসনে প্রার্থি দেওয়ার ঘোষণা করার পর তার বিরোধিতা করে প্রায় পঞ্চাশটি দলিত আম্বেদকরবাদী সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে জানায় যে আম্বেদকর প্রণীত সংবিধান তথা ভারতের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে বিজেপিকে পরাস্ত করা এই মুহূর্তের মূল কর্তব্য। এজন্য দলিত সমাজের ভোটকে এককাট্টা করতে হবে। আম্বেদকরবাদী এই সংগঠনগুলি ‘প্রগ্রেসিভ রিপাব্লিকান পার্টি’ গঠন করে এই ঘোষণা করার পর আরো বহু দলিত সংগঠন ইন্ডিয়া জোটকে সমর্থন জানায়। যে সংগঠনটি একাই ভোটে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের প্রার্থিরাও নাম তুলে নিতে শুরু করে। সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় মহারাষ্ট্রের দলিতদের প্রায় সবকটি সংগঠনের এই ঐক্যবদ্ধ ও জোরালো ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ববহন করছে।

may-day-celebration-24may-day-celebration_0may-day-celebration_1

১ মে জেলা সদর চুঁচুড়ার বাস টার্মিনাসে এআইসিসিটিইউ-র সদস্য পরিবহন শ্রমিকরা সকালে লাল পতাকা উত্তোলন করে অন্যান্য শ্রমিকদের সকলকে মে দিবসের ব্যাজ পরান। রিষড়ার জয়শ্রী টেক্সটাইল কারখানার গেটে এআইসিসিটিইউ-র তরফ থেকে পতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণ করা হয়, উপস্থিত ছিলেন বেশ ভালো সংখ্যক শ্রমিক, যাঁদের অধিকাংশই তরুণ। যেভাবে মোদী সরকার নতুন শ্রমকোড এনে শ্রমিকদের সুরক্ষিত জীবিকা, ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে তাতে এই বিজেপি আবার ক্ষমতায় ফিরলে এনআরসি করে নাগরিকত্বটাই আর রাখবেনা, তাই এবারের মে দিবসে শপথ হোক ‘বিজেপি হারাও’ -- এ’বিষয়ে আলোচনা হয়। কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড অজয় মিশ্র, শ্যাম সিং সহ অন্যান্য সাথীরা। ভদ্রেশ্বর শিল্পাঞ্চলে অ্যাঙ্গাস জুট মিল গেটে পতাকা উত্তোলন ও শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন শ্রমিক সাথীরা, অসুস্থ শরীরেও উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দেন কমরেড সুদর্শন প্রসাদ সিং। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ জেলা সম্পাদক কমরেড বটকৃষ্ণ দাস ও পার্টির জেলা সম্পাদক কমরেড প্রবীর হালদার। এখানে জুট শ্রমিকরা দীর্ঘ সময় ধরে কারখানা সংলগ্ন মহল্লায় শ্রমজীবী মানুষকে ব্যাজ পরান। নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে হিন্দমোটর ইটখোলা মোড়ে মে দিবসের পতাকা উত্তোলন ও হে মার্কেটের শহীদদের স্মরণ করে ‘বিজেপি হারাও’ স্লোগান ওঠে, স্থানীয় রিকশা স্ট্যান্ডের চালক সাথীদেরকেও ব্যাজ পরানো হয়। ব্যান্ডেল নেতাজি পার্কে কমরেড ভিয়েত ব্যানার্জি ও সুদর্শন বসুর নেতৃত্বে অন্যান্য কমরেডরা শহীদ স্মরণের পাশাপাশি পথচলতি মানুষকে মে দিবসের ব্যাজ পরান এবং ‘বিজেপি হারাও, দেশ বাঁচাও’ প্রচারপত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করেন, মতবিনিময় করেন।

গ্রামাঞ্চলে পাণ্ডুয়ার সাঁচিতাড়া পার্টি ব্রাঞ্চে পতাকা উত্তোলন করেন বর্ষীয়ান ক্ষেতমজুর কমরেড গৌড় বাউলদাস, শহীদদের স্মরণ করা হয়। বৈঁচিতে পার্টি কার্যালয়ে মে দিবস পালন করা হয়, যেখানে পার্টির বর্ষীয়ান নেতৃত্বকারী সাথীরা উপস্থিত ছিলেন। পোলবা-দাদপুরের কোচোয়ান মোড় এলাকায় ঘরোয়া বৈঠকের মধ্য দিয়ে মে দিবস পালন করেন হুগলি জেলার রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের সাথীরা যেখানে সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসী মহিলাদের উপস্থিতি ছিল সিংহভাগ। মে দিবসের তাৎপর্যনিয়ে আলোচনা করেন কমরেড চৈতালি সেন। পার্টির ধনেখালি- পোলবা-দাদপুর এরিয়া কমিটি অফিসেও মে দিবস পালিত হয়। মে দিবসের পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড শুভাশীষ চ্যাটার্জি।

may-day-celebration_s-24-pgs

may-day-celebration_2
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে দেশব্যাপী পরাজিত করার জন্য ইন্ডিয়া জোট গড়ে প্রচার আন্দোলন চলছে। একই সাথে পঃ বাংলায় বিজেপি হারাও দেশ বাঁচাও এই শিরোনামে লাগাতার প্রচার চলছে। এই প্রচারের অঙ্গ হিসাবে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন ও এআইসিসিটিইউ বিষ্ণুপুরসাতগাছিয়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ১ লা মে বাখরাহাটের বুড়িরপোল মোড়ে সভার আয়োজন করেন। এই সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, জেলা সদস্য দিলীপ পাল, নবকুমার বিশ্বাস, শুভদীপ পাল প্রমুখ। ছোট ছোট বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে সমগ্র সভাটি পরিচালনা করেন লোকাল কমিটির সদস্য স্মৃতিময় মাইতি।

এছাড়াও হরিহরপুর লাঙ্গলবেড়িয়া রিক্সা ইউনিয়ন বারুইপুরের পেটোর মোড়ে রিক্সা স্ট্যান্ডে মে দিবস উদযাপন করে। নেতৃত্ব দেন স্বপন ব্যানার্জি, মনসুর আলি ও শিশির চ্যাটার্জি।

বজবজের পার্টি জেলা অফিসে সুসজ্জিতভাবে মে দিবস পালিত হয়। এই কর্মসূচিতে অংশ নেন তেল কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক, চটকল শ্রমিক, অসংগঠিত শ্রমিক ও শ্রমজীবী মহিলারা।

may-day-celebration_raiganj

may-day-celebration_3
সারা দেশের সাথে উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ শহরের চন্ডীতলাতে আন্তর্জাতিক মে- দিবস পালিত হল। পতাকা উত্তোলন করেন এআইসিসিটিইউ জেলা সম্পাদক গনেশ সরকার। শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন পার্টির জেলা সম্পাদক ব্রজেন সরকার। এছাড়া শহীদদের স্মরণ করেন যথাক্রমে কমরেড খগেন্দ্র নাথ রায়, দুলাল পাল, সিদ্দিক আলি, মানোয়ার হুসেন, ননীগোপাল দেবনাথ, নিতাই রায়, রুবিনা সোরেন সহ উপস্থিত সদস্যবৃন্দ। এখানে মে-দিবসের তাৎপর্যব্যাখ্যা রাখেন গনেশ সরকার। তিনি মোদী সরকারের শ্রম কোড নিয়ে তার ফ্যাসিস্ট চরিত্র তুলে ধরার সাথেই মমতা সরকারের শ্রমিকবিরোধী ভূমিকাকে ব্যাখ্যা করেন।

দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটি হয় পঃবঃ রাজ্য সরকারী কর্মচারী দপ্তরে। এখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে ও ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর একমিনিট নিরবতা পালন করে দ্বিতীয় কার্যসূচী আজীবন বামপন্থী ৮৪-বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মী এবং এআইসিসিটিইউ এর ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা কমরেড শান্তি কিশোর শুর এর স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন পার্টির বর্ষীয়ান কমরেড মানব ভৌমিক। সমিতির দপ্তরে আয়োজিত এই সভাতে তিল ধারনের জায়গা ছিলনা। তাঁর জীবিত সহকর্মীরা সহ পুত্র- পুত্রবধু ও প্রপৌত্র বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন। শেষ লগ্নে সভাপতি সরকারী কর্মচারী হয়েও কীভাবে সরকারের শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলা ও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অতীত এবং বর্তমান নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রাখেন এবং ফ্যাসিস্ট শক্তিকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তার ওপরে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ হয়।

bjp-hatao-desh-bachaodesh-bachao-rally-in-bally

গত ৩ মে সন্ধ্যায় হাওড়া জেলার বালি গ্রামাঞ্চলের দুর্গাপুর পঞ্চাননতলায় ‘বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও’ , ‘সংবিধান বাঁচাও দেশ বাঁচাও গণতন্ত্র বাঁচাও’ স্লোগান সামনে রেখে ‘সংবিধান বাঁচাও গণতন্ত্র বাঁচাও মঞ্চ’-এর আহ্বানে একটি ফ্যাসিস্ট বিরোধী সভার আয়োজন করা হয়।

সভার শুরুতে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের শিল্পীরা গণসংগীত পরিবেশন করেন। ফ্যাসিস্ট বিজেপি’কে লোকসভা নির্বাচনে পরাস্ত করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কমরেড দীপক চক্রবর্তী, কমরেড পার্থসারথি মিত্র ও বর্ষীয়ান নেতা কমরেড বাবলু গুহ। কবিতা পাঠে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন মোহন মান্না। প্রাণবন্ত সভাটি সঞ্চালনা করেন কমরেড মাধব মুখার্জি ।

contract-labor-convention-at-uluberia

৩রা মে হাওড়ার উলুবেড়িয়াতে অনুষ্ঠিত হল ফ্যাসিস্ট বিজেপি বিরোধী রেল শ্রমিক কনভেনশন। আহ্বায়ক ছিল দক্ষিণ-পূর্বরেল মজদুর ইউনিয়ন ও ঠিকা মজদর ইউনিয়ন। কনভেনশনে রেল শ্রমিক ও ঠিকা মজদুরদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। এই কনভেনশানের সভাপতিত্ব করেন রেল শ্রমিক সংগঠনের অন্যতম সংগঠক কমরেড এনএন ব্যানার্জি। সভায় উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ হাওড়া জেলা সভাপতি দেবব্রত ভক্ত সহ অন্যান্য নেতৃত্ব।

রেলের ব্যাপক বেসরকারিকরণ ও স্থায়ী পদ হ্রাসের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা মোদী সরকারের তীব্র বিরোধিতার সিদ্ধান্ত নেন এবং এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করার সংকল্প নেন।

leaving-does-not-mean-leavingleaving-does-not-mean

এক শোকার্ত পরিবেশে হুগলির বলাগড় ব্লকের গুপ্তিপাড়ার বন্দনালয় লজে অনুষ্ঠিত হল অকাল প্রয়াত পার্টি সদস্য কমরেড হেনা সুলতানার স্মরণসভা। এই ব্লকের বেশ কয়েকটি গ্রামের ক্ষেতমজুর পরিবারে সংগঠনের কাজে যাতায়াত শুরু করেছিলেন হেনা, দেশব্রতী পত্রিকা পৌঁছে দিতেন বামপন্থী মানুষজনকে। সেইরকম একজন সিপিআই(এম)-এর সাধন ভট্টাচার্য। হেনাকে কন্যাসমা ও ‘কমরেড’ বলে উল্লেখ করে তিনি মর্মস্পর্শী এক বক্তব্য রাখেন। মহিলাদের সন্তান প্রসবকালীন যে লড়াই, মহিলাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সামাজিক ও পারিবারিক যে উদাসীনতা, হেনার অকাল জীবনাবসানে সেই মৌলিক প্রশ্নগুলিই উঠে আসে বক্তাদের কথায়। এক মুসলিম মেয়ের এই অসময়ে চলে যাওয়ায় পার্টির অপূরণীয় ক্ষতি ও ‘হেনা’দের পার্টিতে নিয়ে আসার নিরলস চেষ্টা চালানোর অঙ্গীকারের কথাও বলেন বক্তারা। এই স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন পার্টি ও মহিলা সংগঠনের নেত্রী চৈতালি সেন, সজল অধিকারী, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, অজয় বসাক, মুকুল কুমার। জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার বলেন হেনার জীবনে গোলাম কুদ্দুসের উপন্যাসের নায়িকা মারিয়মের মতোই উত্তরণ ঘটছিল, যেখানে ভালোবাসা পার্টি কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। হেনার জীবনসঙ্গী আনারুল শোনান হেনার পার্টির প্রতি ভালোবাসার অনেক অজানা কথা। এই স্মরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বলাগড় ব্লকে গড়ে ওঠার মুখে থাকা রন্ধনকর্মী সংগঠনের মহিলারা, প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও ক্ষেতমজুর সংগঠনের সহযোদ্ধা রুমা আহিরী, শিপ্রা চ্যাটার্জী, মহাদেব মন্ডল, সুকুলাল মান্ডি, স্থানীয় আব্দুস সাত্তার, হেনার পরিজন ও প্রিয়জনেরা। সভা সঞ্চালনা করেন শোভাব্যানার্জি ও ভিয়েত।

a-sad-picture-of-social-justicesocial-justice-in-the-bjp-era

সংবিধান গৃহীত হওয়ার পঁচাত্তর বছর পার হওয়ার পরও সমতা ভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রক্রিয়াটা রীতিমতো এক বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ২০১৩-১৪ সালে সর্বোচ্চ আয়কর দাতাদের এক শতাংশ দেশে সমগ্র আয়ের ১৭ শতাংশ দখল করে রাখে, যা ২০২১-২২ বেড়ে সমগ্র আয়ের ২৩ শতাংশ হয়। আবার, এটা দেখা যাচ্ছে, মধ্যবিত্তদের তুলনায় অতি ধনীদের আয় অনেক দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৩-১৪ থেকে ২০২১-২২’র মধ্যে ওই এক শতাংশ সর্বোচ্চ আয়কর দাতাদের আয় ১৩ শতাংশ বেড়েছে, যা সবচেয়ে নিচে থাকা ২৫ শতাংশ আয়কর দাতাদের আয়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ দ্রুত বেগে বৃদ্ধি। দেশের গভীরে প্রোথিত জাতপাত ব্যবস্থার ভিত্তির উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এই অসাম্য। আম্বেদকর পাঠচক্র ও বহুত্ব কর্নাটক নামে এক নাগরিক সংগঠন বিভিন্ন সামাজিক খাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দের নানা প্রকল্প, সাফাই শ্রমিকদের নিয়ে অনুসন্ধান ও সমীক্ষা চালিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতেই উঠে এসেছে ওই পরিসংখ্যান।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, আমাদের সমাজে ক্ষমতারবিভিন্ন স্তরেও এই অসাম্যের ছাপ প্রকট রূপেই দেখা যায়।

উল্লিখিত সংস্থা ২০১৯ থেকে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে যে, দেশের কর্পোরেট জগতে পরিচালক মন্ডলীর ৯৪ শতাংশই অগ্রসর জাতপাত থেকে আগত। সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির এক রিপোর্ট উদ্ধৃত করে তারা দেখিয়েছে, ২০১৮’র পর হাইকোর্টগুলোতে মাত্র ৩ শতাংশ তপশিলি জাতি এবং ১.৫ শতাংশ উপজাতি বিচারপতি হয়েছেন।

২০১৯ সালের অক্সফামের এক সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, ১২১টি সংবাদ সংস্থার পরিচালকদের মধ্যে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি যারা এসসি/এসটি থেকে আগত। ৩১ মার্চ ২০২২এ এমএসএমই’র ডেভেলপমেন্ট কমিশনারের দপ্তর থেকে প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে দেশের ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি সংস্থাগুলোর মালিকদের ৬১.৮ শতাংশই সাধারণ ক্যাটেগরি থেকে আগত। মাত্র ৬.৮ শতাংশ ইউনিটের পরিচালক তপশিলি জাতির থেকে এবং ২.১ শতাংশ উপজাতির থেকে আগত।

কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান থেকেই দেখা যাচ্ছে, বিজেপির শাসনাধীনে তপশিলি জাতি উপজাতিদের উপর অত্যাচারের ঘটনা বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। শুধুমাত্র ২০২২ সালেই নথিভুক্ত অত্যাচারের ঘটনা ছিল ৬৭,৬৪৬ অর্থাৎ দৈনিক ১৮৮। ২০১৫-২০১৯’র মধ্যে দলিত মহিলাদের উপর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ৪৯.৮৭ শতাংশ!

দেশে সাফাই কাজে কায়িক শ্রমের চির অবসানের জন্য ২০২৩’র আগস্ট’কে লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত দেশের ৭৬৬ জেলায় কায়িক শ্রমের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় প্রথায় সাফাই কাজ করানো হচ্ছে।

সামাজিক ন্যায় ও সশক্তিকরণ মন্ত্রকের কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী রামদাস অটওয়াল লোকসভায় এক প্রশ্নোত্তরে জানান, ২০১৮ থেকে নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ৪৪৩ জন সাফাই কর্মী নিকাশি নালার ভেতর ঢুকে সাফাই করতে গিয়ে মারা যান, কিন্তু আরেকটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্টথেকে জানা যায় যে এই সংখ্যাটি তার অনেক বেশি — তা হল ১,৭৬০!

- ব্যাঙ্গালোর মিরর, ৪ মে ২০২৪

some-candidates-were-withdrawnintimidation-in-gandhinagar

১১ এপ্রিল ২০২৪। ঠিক সন্ধ্যেবেলায় সামাজিক মাধ্যমগুলিতে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে উঠল। ভেসে উঠল ৩৯ বছরের জীতেন্দ্র চৌহানের মুখ। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন অমিত শাহ’র লোকজন তাঁকে ‘অপহরণ’ করে গান্ধীনগর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বলপূর্বক প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করাতে বাধ্য করে। “তারা আমাকে খুন করার হুমকিও দেয়। আমি সারা দেশ ও দেশবাসীর কাছে আবেদন করছি, দেশকে বাঁচান। আমাদের দেশ আজ বিরাট বিপদের মুখে।”

ঠিক পরেরদিন চৌহান তাঁরপ্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেন। এই হুমকি, প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের জন্য চাপ এসেছিল আমেদাবাদের বাপুনগরের বিজেপি বিধায়ক দীনেশ সিং খুসওয়াহ’র তরফ থেকে।

গান্ধীনগর হল বিজেপির ঘাঁটি। ১৯৮৯ থেকেই ওই আসনে বিজেপি জিতে আসছে।

মিত শাহ ওই আসন থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। বিজেপির লক্ষ্য গুজরাটের ২৬ আসনেই জেতা। আরও দুজন প্রার্থী স্ক্রোল সংবাদ পোর্টালকে জানিয়েছেন গুজরাট পুলিশের তরফ থেকেই তাঁদের প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের চাপ আসে। বিজেপির পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। স্ক্রোল’এর পক্ষ থেকে গুজরাট পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল’কেও প্রশ্ন পাঠানো হয়, যার উত্তর আসেনি।

চৌহানকেনিয়ে মোট ১৬ জন তাঁদেরপ্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেন। এদের মধ্যে ১২ জন নির্দল।

সুরাটের পর এবার গান্ধীনগর। ভয়ভীতি দেখিয়ে লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের ঘটনা কখনও ঘটেছিল কিনা জানানেই।

খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসনে এই ঘটনা প্রমাণ করে আগামীদিনে নির্বাচনকে কিভাবে প্রহসনে পরিণত করবে এই বিজেপি ফের ক্ষমতায় আসলে।

- স্ক্রোল ডটইন, ৩ মে ২০২৪

not-be-imposed-on-the-medianot-be-imposed-on-the-media

( ইউটিউবে সম্প্রচারিত কিছু চ্যানেল সরকারের নির্দেশে ব্লক হওয়ায় প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেই বিবৃতিটি আসলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সেটির গুরুত্ব বিবেচনা করে তাতে পেশ করা বিষয়গুলোকে আমরা এখানে রাখছি। বিবৃতিটিতে সাক্ষর করেছেন প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী, সাধারণ সম্পাদক নীরজ ঠাকুর এবং প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছায়াকান্ত নায়ক। শিরোনামটি আমাদের। - সম্পাদক মণ্ডলী, আজকের দেশব্রতী )

কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের নির্দেশে ইউটিউব দুটি হিন্দি চ্যানেল ‘বোলতা হিন্দুস্তান’ ও ‘ন্যাশনাল দস্তক’এর সম্প্রচার আটকে দিয়েছে। ‘প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া’ ও ‘প্রেস অ্যাসোসিয়েশন’ সরকারের এই পদক্ষেপকে জাতীয় নির্বাচন শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে সংবাদমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ চাপানো ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ বলে গণ্য করে এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

ইউটিউবে স্বাধীনভাবে চ্যানেল চালানো দুই সাংবাদিক মেঘনাদ ও সোনিত মিশ্রও তাঁদের চ্যানেল কেন বন্ধ করা হবে না সে সম্পর্কে জবাবদিহির নোটিশ পেয়েছেন। তাঁদের অপরাধ তাঁরা তাঁদের চ্যানেলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ও ভিভিপ্যাটনিয়ে উদ্বেগের বিভিন্নবিষয়কে তুলে ধরেছিলেন। উল্লেখ্য যে, সুপ্রিম কোর্টও ইভিএম ও ভিভিপ্যাট ইস্যুটিকে গুরুত্বপূর্ণবিবেচনা করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছে।

এর আগে কৃষক প্রতিবাদ নিয়ে রিপোর্ট করা কয়েকজন সাংবাদিকের এক্স হ্যান্ডেলকেও (আগে যা টুইটার বলে পরিচিত ছিল) ব্লক করা হয়েছিল। দু’মাসেরও বেশি সম্প্রচার বন্ধ থাকার পর ঐ এক্স হ্যান্ডেলগুলো কয়েকদিন আগে খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রেস ক্লাবের বিবৃতিটিতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পক্ষকে বক্তব্য জানানোর সুযোগ না দিয়ে বিষয়বস্তুর সম্প্রচারকে আটকানোর যে নির্দেশ কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতর দিচ্ছে তা সেন্সরশিপ চাপানো ছাড়া অন্য কিছু নয়।

প্রেস ক্লাবের বিবৃতিটিতে দাবি জানানো হয়েছে, ইউটিউবে সম্প্রচারিত হওয়া চ্যানেলগুলোকে ব্লক করার কারণ অনুরাগ সিং ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রককে জানাতে হবে। ঐ চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করে রাখার নির্দেশকে অবিলম্বে তুলে নেওয়ার দাবি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। এই ইস্যুতে ‘এডিটার্সগিল্ড অব ইন্ডিয়া’ এবং ‘ডিজিপাব’ যে অবস্থান নিয়েছে, বিবৃতিটিতে তার প্রতিও অনুমোদন ও সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়েছে।

suspension-of-ramdas-prini-sivanandanthe-suspension-of-ramdas-prini

রামদাস প্রিণি শিভনন্দন মেধাবী ছাত্র। টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস (টিস) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সে এখন গবেষণা করছে। ইউজিসি নেট পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায় মন্ত্রক তাকে দলিত ছাত্রদের দেয় বৃত্তিও প্রদান করেছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের চোখে সে অপরাধ প্রবণও ছিল — প্রগ্রেসিভ স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় সে ছিল বাম মানসিকতা সম্পন্ন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ছাত্র অধিকারকে সে দ্ব্যর্থহীনভাবেই তুলে ধরত, ন্যায়ের ইস্যুগুলোর প্রতিও তার থাকত অবিচল মদত। টিস কর্তৃপক্ষ গত ১৮ এপ্রিল তার কাছে নোটিশ পাঠিয়ে বলল তার কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে সে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে — কারণ, সে ভগৎ সিং স্মৃতি বক্তৃতার আয়োজনে এমন বক্তাদের এনেছিল যাদের উপস্থিতি এই প্রতিষ্ঠানে অভিপ্রেত ছিল না। সে ডাইরেক্টরের বাংলোর বাইরে রাতে জোরে জোরে শ্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। এছাড়া প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন ২৬ জানুয়ারি সে আনন্দ পট্টবর্ধনের তৈরি তথ্যচিত্র ‘রাম কে নাম’এর প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করেছিল। কর্তৃপক্ষের চোখে এই তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী অযোধ্যায় রামলালার মূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি অসম্মান ও প্রতিবাদ। পাঠানো নোটিশে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হলো যে, “তোমার কার্যকলাপ জাতির স্বার্থের অনুকূল নয়। রাষ্ট্রের অধীনস্থ এক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় টিস তার ছাত্রছাত্রীদের এমন সমস্ত কাজে অনুমোদন দিতে বা সেগুলোকে বরদাস্ত করতে পারেনা যেগুলো দেশদ্রোহী এবং দেশের সম্মানের হানি ঘটায়। এই সমস্ত কার্যকলাপ তাই ফৌজদারি অপরাধের মধ্যেই পড়ে।”

গেরুয়া মতাদর্শের প্রতি এই অনুরাগ কি টিস’এর ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? শিক্ষা, গবেষণা ও সামাজিক সমীক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসাবে টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের যথেষ্ট খ্যাতিই ছিল। বিভিন্ন ধারার স্বরের প্রকাশে সেখানে কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু যে গেরুয়া সরকার সমস্ত প্রতিষ্ঠানকেই নিজেদের মতাদর্শের ধারায় পরিচালিত করতে উন্মুখ, সেই মোদী সরকার সেই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শাসক বিরোধী গণতান্ত্রিক স্বর ওঠাকে স্তব্ধ করতে পদক্ষেপ গ্রহণের দিকে এগিয়ে গেল যেগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ভালো পরিমাণ আর্থিক সাহায্য পায়। গতবছরের মাঝামাঝি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত আইন সংশোধন করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি আর্থিক সহায়তা পাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে মোদী সরকার এই নিয়ম নিয়ে এল যে, সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক প্রধান নির্ধারণ করবে কেন্দ্রীয় সরকারই। টিস কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি আর্থিক সহায়তা পাওয়ায় তার প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে গেরুয়া ধ্যানধারণার অনুগামী ব্যক্তির মনোনীত হওয়ার পথে কোনো বাধা রইল না এবং যে কোনো ন্যায়কামী ও বিরোধী স্বরকেই অপরাধ বলে দেগে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ হতে থাকল। রামদাসের কার্যকলাপ প্রতিষ্ঠানের অনুসরণীয় বিধি ভঙ্গ করেছিল কিনা তার বিবেচনায় তৈরি করা কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, সে অন্যায্য কার্যকলাপ সংগঠিত করে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাহানি ঘটিয়েছিল এবং কমিটি সুপারিশ করে যে, রামদাসকে সাসপেন্ড করতে হবে এবং মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, গুয়াহাটি ও তুলজাপুরে টিস’এর যে ক্যাম্পাস আছে সেখানে তাকে দু’বছর ঢুকতে দেওয়া হবে না।

রামদাসকে সাসপেন্ড করা ও টিস’এর যে কোনো শাখার দরজা তার কাছে দু’বছরের জন্য বন্ধ করার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ছাত্র ইউনিয়নই প্রতিবাদ জানিয়েছে। ছাত্র সংগঠন এআইএসএ বলেছে, রামদাসের বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা দেখাচ্ছে যে, বিজেপি সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামোকে আরএসএস’এর শাখায় পরিণত করতে কোমর বেঁধেলেগেছে। রামদাসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এআইএসএ তাদের বিবৃতিতে বলেছে, “টিস আমাদের আন্দোলনের সহকর্মী রামদাসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপের আশ্রয় নিয়ে যে কর্তৃত্ববাদের পরিচয় দিয়েছে আমরা তার নিন্দা করছি। আমরা রামদাসকে পাঠানো নোটিশ অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। সমস্ত ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, আরএসএস এবং বিজেপির মতো ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করার জন্য সাধ্যমত বৃহত্তম আকারের ঐক্য গড়ে তুলুন।”

mafia-modi-ka-familyeconomic-inequality

যেদিন প্রথমে ‘মোদী কা পরিবার’ কথাটা শুনলাম, মনে হল, কোথায় জানি এরকম রক্তের সম্পর্ক ছাড়া বৃহৎ পরিবারের কথা শুনেছি, যেখানে সকলে পরিবারের কর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে একনিষ্ঠ থাকে, সে কর্তা যে দুষ্কর্মই করুক না কেন। ভাবতে ভাবতে ‘গডফাদার’ চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ল। হ্যাঁ, সেখানেই তো মাফিয়াদের সমস্ত সাঙ্গোপাঙ্গকে মাফিয়া পরিবারের সদস্য বলা হত। যদিও মাফিয়া কর্তা তাদের অধিকাংশকেই চিনত না। মাফিয়ারাও তাদের সাম্রাজ্য তৈরি করত আইনের চোখে ধুলো দিয়ে, আইন বাঁচিয়ে, আইনকে প্রভাবিত করে। এখনেও যেমন মোদী রাজত্বের বিস্তার ঘটছে নির্বাচনী বন্ডের টাকায়, সমবায় দুর্নীতি, বিমান দুর্নীতি, আবাসন দুর্নীতি, কয়লা দুর্নীতির মাফিয়াদের আশ্রয় দিয়ে।

দেশজোড়া অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে যে মাফিয়া পরিবারের কথা বলতে হচ্ছে তা ধান ভাঙতে শিবের গীতের মত শোনালেও সে দুটি যে মোটেই একে অপরের সম্পর্করহিত নয় তা খানিক পরেই বোঝা যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্য বিষয়ে যে সকল প্রতিবেদন এসেছে তার প্রত্যেকটিই এ’দেশের নিম্ন আয়ের নাগরিকদের সম্পর্কে এক দুর্বিষহ অবস্থান নির্দেশ করেছে। বিজেপির মত ভোটের জন্য কেবল মিথ্যে কথার চাষ করা উচিত হবে না। গত দুই দশকে সারা পৃথিবীতেই দারিদ্র কমেছে, অন্তত পরিসংখ্যানে। ভারত তার বাইরে নেই। ১৯৮১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় চরম দারিদ্রের মধ্যে থাকা জনসংখ্যার হার ৫৮ শতাংশ থেকে কমে ৯ শতাংশ হয়েছে। পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় তা ৮৩ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নেমে এসেছে। ওই সময়কালে চরম দারিদ্রের আওতায় থাকা জনসংখ্যার অনুপাত ভারতে ৬০ শতাংশের বেশি থেকে কমে ১০ শতাংশে পৌঁছেছিল, চিনে তা ১৯৮১ সালে প্রায় ৯০ শতাংশ থেকে কমে ২০১৯ সালে নগণ্যে উপনীত হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতে দারিদ্রের হার সব থেকে দ্রুত হ্রাস পেয়েছে ২০০৬ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে। বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকের পরিমাপে ২০২১এ ভারতের ১৫ শতাংশের থেকে খানিক বেশি, ২২ কোটি মানুষ দরিদ্র। (ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ, চিন পূর্ব এশিয়ার। চরম দরিদ্র বলতে দৈনন্দিন ২.১৫ ডলার মাথাপিছু আয়ের নীচে থাকা মানুষদের বোঝায়। বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক বলতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মানের ভিত্তিতে গঠিত সূচককে বোঝায়)। ২০২১ সালে সমগ্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকের ভিত্তিতে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ দরিদ্র ছিল, তার মধ্যে ২২ কোটি (৪৪ শতাংশই) ভারতে। ফলে ভারতের দারিদ্রের পরিসংখ্যান নিয়ে গর্ব করার মত তেমন কিছুই নেই, যদিও সমগ্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দারিদ্র দ্রুত কমছে, ভারতেও কমছে। (প্রসঙ্গত, উপরের তথ্যগুলি ২০২৪ সালের ইউএনডিপি’র ২০২৪ সালের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের থেকে পাওয়া গেছে।)

ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ল্যাবের প্রতিবেদন অনুসারে ২০২২-২৩ সালে ভারতে আয়বৈষম্য এমন জায়গায় পৌঁছেছে যা ভয়ঙ্কর। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী যদি ভারতের দারিদ্র টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় তাহলে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা উপরের ভারতীয় দারিদ্রের যে ১৫ শতাংশ অনুপাতকে নস্যাৎ করে দেবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ল্যাবের প্রতিবেদনকে ভিত্তি করে দারিদ্র পরিমাপ করলে দেখা যায় যে, নিম্ন আয়ের অন্তর্ভুক্ত ৫০ শতাংশের অধিকাংশই দারিদ্র সীমার নীচে অবস্থান করে (পরিশিষ্ট দেখুন)।

স্বাধীনতার সময় থেকেই ভারতে আয় ও সম্পদ বৈষম্য ছিল। উচ্চ আয় সম্পন্ন ১০ শতাংশের আয় ছিল দেশের সামগ্রিক আয়ের ৩৫.২ শতাংশ (উপরের ১ শতাংশ আয় করত ১১.৭ শতাংশ), নীচের ৫০ শতাংশের ভাগ ছিল ২১.৯ শতাংশ। মধ্যের ৪০ শতাংশ আয় করত ৪২.৯ শতাংশ। ১৯৮১ সাল নাগাদ উচ্চ আয় সম্পন্ন ১০ শতাংশের আয় ছিল দেশের সামগ্রিক আয়ের ৩১.৬ শতাংশ (উপরের ১ শতাংশ আয় করত ৬.৭ শতাংশ), নীচের ৫০ শতাংশের ভাগ ছিল ২১.৪ শতাংশ। মধ্যের ৪০ শতাংশ আয় করত ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ জাতীয় অর্থনীতিতে অতি উচ্চ আয়ের মানুষের ভাগ কমেছিল, বেড়েছিল মধ্যবিত্তের ভাগ। বৈষম্য বাড়তে বাড়তে ২০১৪ সাল নাগাদ উচ্চ আয় সম্পন্ন ১০ শতাংশের আয় ছিল দেশের সামগ্রিক আয়ের ৫৭.১ শতাংশ (উপরের ১ শতাংশ আয় করত ২১.৭ শতাংশ), নীচের ৫০ শতাংশের ভাগ ছিল ১৩.১ শতাংশ। মধ্যের ৪০ শতাংশ আয় করত ২৯.৮ শতাংশ। ফলে দেশের অর্থনীতির যে উন্নয়নের কথা বলা হত তার লাভ অতি ধনীদের হাতেই জমা হচ্ছিল। ২০২২- ২৩ সালে সেই আয় বৈষম্য কমে তো নিই বরং আরো বেড়েছে। মধ্যবিত্তদের অর্থাৎ মাঝের ৪০ শতাংশের অনুপাত কমে ২৭.৩ শতাংশ হয়েছে, উপরের ১০ শতাংশের আয়ের অনুপাত হয়েছে ৫৭.৭ শতাংশ। কেবল তাই নয়, তার মধ্যে থাকা অতি অতি উচ্চ ধনীদের আয়ের অনুপাত হয়েছে ২২.৭ শতাংশ। নীচের ৫০ শতাংশের অনুপাত ১৫ শতাংশ হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে মধ্যবিত্তরা ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, অন্তত আপেক্ষিক ভাবে। কিন্তু রাজনীতির কারিগররা এমন ঢাক পেটায় যেন, মধ্যবিত্তরাই অর্থনৈতিক নীতির ফলে সব থেকে বেশি লাভবান হয়েছে। আদতে সেই লাভ হয়েছে উপরের ১০ শতাংশের মধ্যে থাকা জনতার, যাদের গড় আয় পরিবার পিছু বার্ষিক ৫০ লক্ষ টাকার বেশি।

সম্পদের হিসেবে এই বৈষম্য আরো গভীর। ১৯৮১ সালে ধনী ১০ শতাংশের সম্পদ ছিল দেশের মোট সম্পদের ৪৫ শতাংশ (সর্বোচ্চ ১ শতাংশের ছিল ১২.৫ শতাংশ)। মাঝের ৪০ শতাংশের কাছে ছিল ৪৫ শতাংশ, নীচের ৫০ শতাংশের কাছে মাত্র ১০ শতাংশ। ২০১৪ সালে ওই সংখ্যাগুলি শতাংশের হিসেবে দাঁড়িয়েছিল ৬৩.৯ (৩১.৭), ৩০ ও ৬.১। ২০২২- ২৩ সালে ধনী ১০ শতাংশের সম্পদ ছিল দেশের মোট সম্পদের ৬৫ শতাংশ (সর্বোচ্চ ১ শতাংশের ছিল ৪০.১ শতাংশ)। মাঝের ৪০ শতাংশের কাছে ছিল ২৮.৬ শতাংশ, নীচের ৫০ শতাংশের কাছে মাত্র ৬.৪ শতাংশ।

অন্যরকম ভাবে বললে ধনী ৯,২২৩ জন গড়ে বার্ষিক আয় করে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা, নীচের ৯২ কোটির বেশি মানুষ গড়ে বার্ষিক আয় করে ৭১ হাজার টাকার সামান্য বেশি, যা প্রথমোক্তদের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার ভাগে ১ ভাগ। ভারতের অতি অতি অতি অতি ধনী ২১ জন পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের কাছে প্রায় ৮০ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ আছে যা দেশের ৭০ কোটি নিম্ন সম্পদশালী মানুষের কাছে থাকা মোট সম্পদের থেকে বেশি। অতি অতি অতি ধনী ৯২২৩ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের কাছে থাকা গড় সম্পদের পরিমাণ ২২৬১ কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে নীচের ৪৬ কোটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের গড় সম্পদ তার ১ লক্ষ ভাগের ১ ভাগের থেকেও কম। অতি ধনী পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা ৯২ লক্ষ ২৩ হাজার যাদের গড় সম্পদ ৫ কোটি টাকার বেশি। যাদের তুলনায় নীচের ৪৬ কোটি ১১ লক্ষ ৭২ হাজার পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের গড় সম্পদের অনুপাত ১ হাজার ভাগের ৩ ভাগ। ধনী ১০ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের গড় সম্পদ ৪৬ কোটির বেশি, পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের গড় সম্পদের ৬৫ গুণ।

যে অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে গত ৩ দশক ধরে, তা ক্রমাগত সম্পদের বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলেছে। আয়ের বৈষম্যও বাড়ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের সঞ্চয় করে সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষমতাই নেই। উচ্চ আয়ের ধনীরা আয়ের বিপুল অংশ সঞ্চয় করে বিলাস বহুল জীবনযাপনের পরেও। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্পদশালী তাই ১৩০০ কোটি টাকা খরচ করেন তাঁর সন্তানের প্রাক বিবাহ অনুষ্ঠানে, যা উপরে আলোচিত ৫০ শতাংশ নিম্ন আয়বর্গের গড় আয়সম্পন্ন প্রায় ২ লক্ষ বয়স্ক মানুষের সামগ্রিক বার্ষিক আয়ের সমান। পাত্রের মা’য়ের নেকলেসের দাম ৪১৫ কোটি টাকা, যা ৫০ শতাংশ নিম্ন সম্পদশালীর গড় সম্পদ সম্পন্ন ২৫ হাজার ব্যক্তির সামগ্রিক সম্পদের সমান।

প্রশ্ন হচ্ছে এই অপরিসীম অসাম্যকে সহ্য করা হবে না দূর করার জন্য নীতি গ্রহণ করা হবে। এই বৈষম্য যেমন সমাজে গরিব মানুষদের অমর্যাদার জীবনে ঠেলে দিচ্ছে যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলছেন আমি ৮০ কোটি মানুষকে বিনে পয়সায় আনাজ দেওয়ার গ্যারান্টি দিচ্ছি তাই আমাকে ভোট দাও; মুখ্যমন্ত্রী বলছেন আমি লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা বাড়িয়েছি তাই ভোট দাও এ’রকম সব কথা, তেমনি এই বৈষম্য অসাম্য বজায় রাখার জন্য অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। প্রভূত বিত্তবানের ঘরে জন্ম হওয়া সন্তান বিত্তহীনের তুলনায় কয়েক লক্ষ যোজন পিছিয়ে দৌড় শুরু করে। জাতপাতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজ বর্ণের আধারেই নিম্ন বর্ণের জন্য প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেছে তার সঙ্গে আর্থিক বৈষম্য যুক্ত হয়ে পুরো বৈষম্যের ব্যবস্থাকে আরো শক্তপোক্ত করে। তাই সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যে উচ্চবর্ণের মানুষজন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলে, তারাই এই বৈষম্যকে সমর্থন করে, বৈষম্য কমানোর জন্য কোনো ধরণের পুনর্বন্টনের কথা উঠলেই সেই পুনর্বন্টন কত ক্ষতিকর তার তত্ত্ব তৈরি করে।

অপরদিকে যে মাফিয়ারাজ দিয়ে মাফিয়া পরিবার দিয়ে কথাটা শুরু করেছিলাম সেই মাফিয়ারাজও পাকাপোক্ত হতে থাকে। আপাতভাবে গণতন্ত্রের আবরণ থাকলেও অর্থবানের হাতে ক্ষমতার চাবিকাঠি চলে যায়। নির্বাচনী বন্ডের মত দুর্নীতিময় বন্দোবস্ত চালু হয়। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে জ্ঞাত প্রচার মাধ্যম অনায়াসে চলে যায় ওই কতিপয় অতি অতি অতি অতি ধনীদের খপ্পরে। তাদের পছন্দ ও সুবিধে মত খবর প্রচারিত হয়। অতি অতি অতি অতি ধনীদের অন্যায়গুলিকে আইনসম্মত করে তোলার আইন তৈরি হয়। ফলে তারা আইন সম্মতভাবে দুর্নীতি করে আরো সম্পদ জমাতে পারে। যারা তাদের জন্য তেমন আইন প্রণয়ন করবে তাদের তহবিলে প্রভূত অর্থদিয়ে, নিজস্ব প্রচার মাধ্যমে তাদের হয়ে প্রচার করে ক্ষমতার গদিতে তাদের বসাতে বা টিকিয়ে রাখতে চাইবে। দেশের শাসন অলিগার্কিক বা গোষ্ঠীশাসনে রূপান্তরিত হবে। প্রকারান্তরে মাফিয়া পরিবার দ্বারাই দেশ শাসন হবে। এদেশে তেমনটাই খানিকটা হয়েছে। বাকিটা হওয়ার জন্য মোদীজি ও তার মাফিয়া পরিবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

যদি গণতন্ত্রকে সত্যিই টিকিয়ে রাখতে হয়, যদি গণতন্ত্রকে পূর্ণ মাত্রায় বিকশিত করতে হয় তাহলে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য নীতি প্রণয়নে সরকারকে বাধ্য করার জন্য লড়াই চালানো আবশ্যিক।

(পরিশিষ্ট: ২০২৪ সালের ইউএনডিপি’র ২০২৪ সালের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের থেকে ভারতের দারিদ্র সংক্রান্ত তথ্য নেওয়া হয়েছে। সেখানে চরম দারিদ্রের উপরে থাকার জন্য ক্রয়মূল্যে সমতার নিরিখে (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি বা পিপিপি) অন্তত মাথাপিছু ২.১৫ ডলার আয় ধরা হয়েছে। যা টাকার অঙ্কে ৫২.১৪ টাকা (১ ডলার = ২৪.২৫ টাকা ধরে) মত। ভারতের পরিবারের গড় আয়তন ৪.৪৪ জন। যদিও নিম্ন আয়ের মানুষজনের পরিবারের আয়তন বেশি হয়, তবুও ওই গড়কেই পরিবারের আয়তন হিসেবে ধরলে বার্ষিক দারিদ্র সীমা দাঁড়ায় ৩৬৫ (দিন) x ৪.৪৪ (জন) x ৫২.১৪ টাকা = ৮৪,৫০০ টাকা। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ল্যাবের প্রতিবেদন অনুসারে ২০২২-২৩ সালে ভারতে সর্বনিম্ন আয়ের ৫০ শতাংশ বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৪৬,১১,৭২,৪১৬ ও তাদের গড় মাথাপিছু আয় ৭১,১৬৩। ফলে ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মোট আয় ৪৬,১১,৭২,৪১৬ x ৭১,১৬৩ টাকা = ৩,২৮,১৮,৪১,২৬,৩৯,৮০৮ টাকা। ওই ৫০ শতাংশ মানুষের পরিবারের জনসংখ্যা দেশের ৫০ শতাংশ ধরা যেতে পারে (যদিও গরিবদের জনসংখ্যা বেশি হয়, তাও রক্ষণশীল ভাবেই ধরা হল) ফলে নীচের দিকের আয়ের ৬৭ কোটি মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৪৮,৯৮২ টাকা, ধরা যাক ৪৯,০০০ টাকা। যা পিপিপি ভিত্তিতে নির্ধারিত দারিদ্র সীমার বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৭৫,০০০ টাকার থেকে প্রায় ৩৫ শতাংশ কম। যা ইঙ্গিত করে যে নিম্ন আয়ের অন্তর্ভুক্ত ৫০ শতাংশের অধিকাংশই দারিদ্র সীমার নীচে অবস্থান করে।)

- অমিত দাশগুপ্ত

trust-in-their-responsible-passion-for-democracyesponsible-passion-for-democracy

[ সম্প্রতি মেনস্ট্রিম পত্রিকার সাংবাদিক পাপড়ি শ্রী রামন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের একটি সাক্ষাৎকার নেন। এর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর কাটাছেঁড়া। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই আলোচনা আমরা ‘আজকের দেশব্রতী’র পাঠকদের সামনে তুলে ধরলাম। শিরোনাম আমাদের। - সম্পাদকমণ্ডলী ]

প্রশ্নঃ দ্রুত পরিবর্তনশীল একটি দেশ, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলি এখন ‘বুনিয়াদি শ্রেণি সংগ্রামের’ লড়াই হয়তো লড়ছে না, সেখানে আপনার রাজনৈতিক পরিক্রমা নিয়ে যদি কিছু বলেন?

উত্তরঃ আমার মনে হয়, ভারতবর্ষে ‘শ্রেণি সংগ্রামের’ ধারণাটি নিয়ে বেশ ভুল বোঝাবুঝি আছে। আধিপত্যকারী শ্রেণি ক্ষমতা রাষ্ট্রকে, অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ভাবনার জগতেও আধিপত্য করে। এই আধিপত্যকারী শ্রেণি ক্ষমতার বিরুদ্ধে শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণিগুলির সংগ্রামই হল শ্রেণি সংগ্রাম। ভারতে আধিপত্যকারী শ্রেণি ক্ষমতার মূল দুটি স্তম্ভ হল জাত ব্যবস্থা এবং পিতৃতন্ত্র। এই ‘ক্ষমতা’ যদি সামাজিক জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে, তখন তার বিরুদ্ধে লড়াইটাকেও আধিপত্যের প্রতিটি অভিমুখের বিরুদ্ধে চালিয়ে যেতে হবে।

আমরা রাজনীতিকে সাধারণ ভাবে তিন বা চারটি বড় ভাগে ভাগ করতে পারি। আধিপত্যকারী রাজনীতি হল ‘খবরদারির রাজনীতি’ (পলিটিক্স অব ম্যানেজমেন্ট), যা বর্তমান ব্যবস্থাটাকে টিঁকিয়ে রাখছে। এক স্বৈর প্রশাসনিক বিধির আওতায়, এই ব্যবস্থাপনা সর্বাত্মক দমনের মাধ্যমে, গণতন্ত্রের ক্ষয় ও ধ্বংসসাধনের মাধ্যমে, জায়গা করে নেয়। ঠিক এটাই আজ আমরা দেখছি মোদীর ভারতে।

এই খবরদারি বা ব্যবস্থাপনার রাজনীতির বিরুদ্ধে, আমরা তুলে ধরছি, যাকে বলতে পারেন, রূপান্তরণের, পরিবর্তনের রাজনীতি। এছাড়াও আছে প্রতিনিধিত্বের লোকপ্রিয় রাজনীতি। ভারতের মত একটি বিশাল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে, এবং আমাদের মত একটি সমাজে, যেখানে রয়েছে গভীরে প্রোথিত একটি জাত ব্যবস্থা যার ফলশ্রুতিতে রয়েছে সামাজিক বহিষ্কার, প্রান্তিকীকরণ এবং উৎপীড়ন — সেখানে প্রতিনিধিত্বের রাজনীতিও আয়ত্ত করে নেয় রূপান্তরগত একটি অভিমুখ (ট্রান্সফরমেশনাল আসপেক্ট)।

এই গতিশীল এবং জীবন্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই শ্রেণিসংগ্রামকে আয়ত্ত করতে হবে এবং তা চালিয়ে যেতে হবে। মার্কসবাদ কখনোই শ্রেণিসংগ্রামকে শুধু অর্থনৈতিক লড়াই হিসেবে দেখেনি। রাজনীতি শেষ বিচারে অর্থনীতির ঘনীভূত রূপ। কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামের প্রশ্নে, মার্কসবাদ রাজনীতিকেই অগ্রাধিকারে রাখে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের এইসব বহবিচিত্র উপাদান ও মাত্রাকে শ্রেণিসংগ্রামের এক অখণ্ড পরিকাঠামোয় সংযুক্ত করে।

প্রশ্নঃ বিগত এই পঞ্চাশ বছরে পার্টি কীভাবে এগিয়েছে? একটা উন্নয়নশীল দেশে পঞ্চাশ বছর অনেকটা সময়, আপনাদের মত একটি ছোটবাম দলকে প্রধান কী কী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং হচ্ছে, যখন আপনাদের পথ চলার শুরুতে কংগ্রেসী রাজনীতির (কংগ্রেসিজম) বিরোধিতা ছিল অন্যতম অ্যাজেন্ডা?

উত্তরঃ আমরা প্রথম দুটি দশক নির্বাচন থেকে দূরে ছিলাম। ১৯৮০’র দশকের শেষার্ধে আমরা উপলব্ধি করি, প্রাপ্ত বয়স্ক সার্বজনীন ভোটাধিকারের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা সত্ত্বেও ভূমিহীন দরিদ্র এবং সামাজিক ভাবে নিপীড়িত মানুষজন কার্যত ভোটাধিকারে বঞ্চিতই থেকে গেছেন। ঐ অধিকার অর্জন করা ও ব্যবহার করা, ‘বয়কট’ করার থেকে বেশি যুক্তিযুক্ত। যেটা আপনার আদৌ নেই, সেটা সত্যিই আপনি ‘বয়কট’ করতে পারেন না। এতে অবশ্য ভয়ঙ্কর সামন্তী প্রতিক্রিয়া হল। ভীষণ নৃশংস হয়ে উঠল ভূস্বামীরা। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিহার ও ঝাড়খণ্ডে আমাদের যে সব সামন্তী হিংসা ও রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তার বেশিরভাগের কেন্দ্রেই রয়েছে এই ‘ভোটের অধিকার’।

মিথ্যে মামলাই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা যার ভুক্তভোগী আমাদের কমরেডরা প্রায় সর্বত্র, জনে জনে। কয়েকটা উদাহরণ দিই আপনাকে। ২০০০ বিহার বিধানসভা নির্বাচনে কমরেড শাহ চাঁদ, আরওয়ালে ভাদাসি পঞ্চায়েতের এক জনপ্রিয় মুখিয়া, আরওয়াল বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাত্র প্রায় ২০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত হলেন। ঠিক তারপরেই আরও ১৩ জন কমরেডের সঙ্গে তাঁকে টাডা মামলায় গ্রেফতার করে দোষী সাব্যস্ত করা হল ২০০৩-এ। জেল হেফাজতেই কমরেড শাহ চাঁদ সহ ৬ জন কমরেডের মৃত্যু হয়েছে।

২০১৫ সালে, বিহারে কমরেড সত্যদেও এবং অমরজিৎ কুশওয়াকে জেলে বসেই দারাউলি (এসসি আসন) এবং সিওয়ান জেলার জীরাদেই আসন থেকে নির্বাচন লড়তে হয়েছিল। কমরেড সত্যদেও জিতলেন এবং দু’বছর পর জামিন পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এলেন। কমরেড অমরজিৎ খুব সামান্য ব্যবধানে হারলেন, আর তার কারাযন্ত্রণা অব্যাহতই রইলো। ২০২০’র বিহার বিধানসভা নির্বাচনে দু’জনেই আবার লড়লেন, কমরেড অমরজিৎ অবশ্য সেই জেল থেকেই। এবার দুই কমরেডই জিতলেন। এখন, দশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সব কমরেড মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু কমরেড অমরজিতের ততদিনে সাত বছর জেল খাটা হয়ে গেছে।

আরেকটি দৃষ্টান্ত — মনোজ মঞ্জিল ২০১৫-তে ভোজপুরের আগিয়াওঁ (এসসি) আসনে জেল থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সামান্য ব্যবধানে তৃতীয় হন। ২০২০-তে ঐ একই আসন থেকে আবার লড়ে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে তিনি জেতেন। কিন্তু সেই একই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় কমরেড মনোজ এবং অন্য ২২ জন কমরেডকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল। ফলে মনোজকে আবার নতুন করে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁর বিধানসভার সদস্যপদ খারিজ করা হয়। আমাদের আগাগোড়াই চরম প্রতিকূল সংঘাত বিদ্বেষের পরিবেশে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। বর্তমানে ফ্যাসিস্ত আগ্রাসনের এই পর্যায়ে সেটা আরও অনেকটাই বেড়ে গেছে।

প্রশ্নঃ গৈরিক অ্যাজেন্ডাকে যে দ্রুততায় আমরা সামনে হাজির হতে দেখেছি — সব বাম দলগুলি কি এটা মেনে নিতে প্রস্তুত যে বাম দলগুলির থেকে বৃহত্তর একটি পার্টির প্রয়োজন আছে, যা সমস্ত বিজেপি বিরোধী জোটের প্রধান মুখ হয়ে উঠবে?

উত্তরঃ গৈরিক অ্যাজেন্ডা প্রায় চার দশক ধরে ক্রমশ প্রকট করেছে নিজেকে। ১৯৯০’র দশকের গোড়ায় ভারতের অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্র নীতির অবস্থানগত পরিবর্তন এই উত্থানকে শুধু আরও সাহায্যই করেছে। আজ সঙ্ঘ বাহিনী শুধু যে হিন্দুত্বের এক আগ্রাসী ধ্বজাধারী হিসেবে সামনে এসেছে তাই’ই নয়, কর্পোরেট শক্তি এবং মার্কিন ও ইজরায়েলমুখী বৈদেশিক নীতির বিশ্বস্ত একনিষ্ঠতম সমর্থকও হয়ে উঠেছে। ২০১৪ থেকে এটি হঠাৎ পাওয়া দৈবধনের মত অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক লাভের ফসল নিজের গোলায় তুলছে। কারণ এই সময়ে অ-বিজেপি প্রায় সব ধারা এবং দলগুলি নানা কারণে নিজেদের শক্তি হারিয়ে দুর্বলতম অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল যা বিজেপির সামনে তৈরি করে দিয়েছিল অত্যন্ত অনুকূল, একচ্ছত্র আধিপত্যের এক মৃগয়াভূমি।

চরম দক্ষিণপন্থী আক্রমণকে প্রতিহত করতে আমাদের নিশ্চয়ই চাই ব্যাপক-ভিত্তিক ঐক্য। কৃষক আন্দোলন (২০২১-২০২২) আমাদের সামনে সেই ঐক্যের আদর্শ তুলে ধরেছে। ইন্ডিয়া জোটও পরিস্থিতির চাহিদার প্রতি এক ইতিবাচক সাড়া। ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বা স্বাধীনতা-উত্তর দশকগুলিতে স্বাভাবিক নিয়মে বেড়ে ওঠা কোন একটি দল বা একটি মতাদর্শ স্বাধীনভাবে একক উদ্যোগে এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে পরাস্ত করার অবস্থানে নেই। আমাদের চাই একটি কার্যকরী এবং গতিশীল যুক্তফ্রন্ট। সমস্ত প্রধান মতাদর্শগত ধারা ও রাজনৈতিক প্রবণতাকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার উপযুক্ত পথ খুঁজে বার করতে হবে ও চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে হবে। আমরা গণতন্ত্রের সকল অংশভাগী, অংশীদারকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি গতিশীল এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ জনতার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রশ্নঃ ১৯৮৯-তে পার্টি তার প্রথম লোকসভা আসনটি অর্জন করে। দল তখন সদ্য তরুণ, সেই তুলনায় এই সাফল্য তাড়াতাড়িই এসেছিল। ১৯৯১-এ এল পার্টির দ্বিতীয় লোকসভা আসন। এখন বিজেপি অসমকে পুরোপুরি দখলে নিয়েছে। ১৯৯৯ সালেও পার্টি অসমের আসন জিতেছিল। ২০০৪এ ধাক্কা এল। ২০০০ থেকে এখন পর্যন্ত মাঝের এই সময়টাতে কী ঘটেছিল? ২০২০ থেকে বিধানসভা নির্বাচনের সাম্প্রতিক সাফল্য কি আপনাকে আশান্বিত করেছে?

উত্তরঃ ১৯৮৯-এ আরা থেকে জয়ের ব্যাপারটা সত্যিই ছিল বিশেষ এবং ঐতিহাসিক। আমরা বহু-কৌণিক এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিলাম আর আমাদের বিপুল সংখ্যক ভোটার সেবার জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু ভোটের দিন সন্ধ্যায় এক নৃশংস গণহত্যা ঘটেছিল, জনতাকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করার জন্য দিতে হল এক বিরাট মূল্য!

অসমের পার্বত্য জেলাগুলি থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯-তে পর পর চারটি নির্বাচনে জয় এসেছিল। সংবিধানের ২৪৪ক ধারায় প্রতিশ্রুত, একটি স্বশাসিত রাজ্যের দাবিতে এক জনপ্রিয় আন্দোলন এই জয় এনে দিয়েছিল।

উত্তর পূর্বাঞ্চলে এই আন্দোলন ছিল এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগানো ঘটনা। আঞ্চলিক ঐক্যের ভিত্তিতে এক শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সামাজিক সত্তার মানুষ। কিন্তু বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) সরকারের আমলে ভারতীয় রাষ্ট্র এই ঐক্য ভাঙার উদ্দেশ্যে সেখানে সশস্ত্র বিদ্রোহের বীজ বুনে দিতে সক্ষম হয়েছিল যা আন্দোলনে ভাঙন ধরায়; ক্রমশ নিজস্ব শক্তি হারিয়ে ফেলে এই আন্দোলন।

প্রশ্নঃ বর্ধমান আসন নিয়ে আপনার বিবৃতি। যেখান থেকে সবকিছু শুরু হয়েছিল — কেউ ভাবতে পারে, পার্টি আর আসনটি নিয়ে তত জোরালোভাবে ভাবছে না। আপনার মতে সাতটি আসনের মধ্যে কোনটির প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবচেয়ে কঠিন? এবং কেন?

উত্তরঃ পশ্চিমবঙ্গে ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের মধ্যে ভোটের আগে কোন আসন ভাগাভাগি হয়নি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, একজন প্রার্থী দেওয়ার এবং গোটা রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর, নির্দিষ্টভাবে কোন দলের প্রতি সমর্থন ব্যতিরেকেই।

এই নির্বাচনগুলিতে আমরা সবচেয়ে কম সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি — ইন্ডিয়া জোটের অংশ হিসেবে বিহার ও ঝাড়খণ্ডে চারটি এবং পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশে (স্বাধীনভাবে) একটি করে আসনে। বিহারে (আরা, কারাকাট এবং নালন্দা) এবং ঝাড়খণ্ডে (কোডারমা) আসনগুলির সবকটিই বর্তমানে এনডিএ’র দখলে, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বেশিরভাগ অন্য আসনগুলির মত। কিন্তু স্রোত ঘুরছে, আমরা যদি স্বৈরাচারী এবং বিপর্যয়কর মোদী-শাহ রাজত্বের অবসান ঘটাতে নির্বাচনকে একটি দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ জনতার আন্দোলনে পরিণত করতে পারি, তাহলে ২০১৯’র ফলকে উল্টে দেওয়া নিশ্চিত ভাবে সম্ভব হবে। ঝাড়খণ্ডে ২০১৯’র বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২০’র বিহার বিধানসভা নির্বাচন ইতিমধ্যেই সেই অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে। এই শক্তি ও সম্ভাবনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হচ্ছে এই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ!

প্রশ্নঃ বেশ কয়েকটি রাজ্যে আপনার বিপুল সংখ্যক অনুগামীরা আছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, মার্কসবাদী পাঠচক্রে আছেন অনুরাগী তরুণ তরুণীরা। আপনার নিজের (রাজনৈতিক) বিকাশ ঘটেছিল পার্টি স্তরে নির্বাচনী রাজনীতির মাধ্যমে। ভারতে নির্বাচনী রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী, যখন বিজেপি বলছে, ৪০০+ আসনে জয়লাভ করবে?

উত্তরঃ একটি বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র এবং পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনের মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য একটি ট্র্যাক রেকর্ড — ভারতের ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আম্বেদকর সেইসব বিরোধ বা অসঙ্গতিগুলো খুব স্পষ্ট ভাবেই নির্দেশ করেছেন যা বারে বারেই ভারতীয় সংবিধানকে বিপন্ন করতে পারে — যেমন, নাগরিক পিছু একটি করে ভোটের সমতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বিপুল বৈষম্য — এর মধ্যেকার বিরোধ বা অসঙ্গতি। একটা পর্যায়ের পরে এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক পাহাড় প্রমাণ বৈষম্য নির্বাচনী সমতাকে অর্থহীন করে তুলবে।

ভারতে, এমনকি নির্বাচনী ব্যবস্থাও তার যথাযথ কার্যকারিতা হারাতে শুরু করেছে। শাসক-অনুগত, নিরপেক্ষতাহীন নির্বাচন কমিশন, অস্বচ্ছ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অবাধ কর্পোরেট ফান্ডিং, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের অস্বচ্ছ ব্যবস্থা এবং সরকারের ঢাক পেটানো মিডিয়া — এই সবকিছু মিলে ভারতীয় নির্বাচনগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা বিপুল পরিমাণে ক্ষয় করে ফেলেছে।

এই নির্বাচনগুলিই হয়তো গণতান্ত্রিক ভারতের নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার অধোগতিকে রোখার শেষ সুযোগ, ভারতীয় জনতার কাছে!

প্রশ্নঃ গত দুটি লোকসভায় কোন বিরোধী দলনেতা ছিলেন না। আচ্ছা, একটি উদারপন্থী (লেফ্ট অব সেন্টার) অথবা সমাজবাদী জোট কি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পরিমিত ভারসাম্য (মোডিকাম অব ব্যালান্স) আনতে পারে?

উত্তরঃ মানুষের ওপর আস্থা রাখুন! গণতন্ত্রের প্রতি সেই জনতার নিষ্ঠা, অনুরাগের ওপর বিশ্বাস রাখুন! ভারত স্বাধীনতার জন্য এক দীর্ঘলড়াই লড়েছে এবং সংবিধান ও গণতন্ত্র অর্জন করেছে যা স্বাধীন ভারতের অচ্ছেদ্য দুটি বৈশিষ্ট্য। আমরা সেগুলিকে স্বতঃসিদ্ধের মত স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলাম যতক্ষণ না জরুরি অবস্থা আমাদের প্রথম রূঢ় আঘাতটা হেনেছিল।

জরুরি অবস্থা-উত্তর কালে, গণতন্ত্র আবার নবজীবন পেল। পঞ্চায়েতী রাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও হস্তান্তর হল। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশের বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ’পর্যন্ত সমাজের যে অংশের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব ছিল না, তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ল। আর এসব কিছুর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছিল। ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারতীয় জনমতকে ব্যাপকভাবে আশ্বস্ত করেছিল।

২০১৪ থেকে, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের উপর সবচেয়ে ভয়ংকর এবং লাগাতার আক্রমণ হয়ে চলেছে। আর এই হুমকির মুখে আরও বেশি বেশি মানুষ জেগে উঠছেন। জনতার এই উপলব্ধি আর সংকল্প যখন দানা বাঁধবে, তখন তা যে শুধু হারিয়ে যাওয়া ভারসাম্যকে পুনরুদ্ধার করবে তাই নয়, ভারতকে আরও সবল এক গণতন্ত্র এবং সাম্যবাদী এক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

data-says-that-gold-has-been-lostdata-says-that-gold-has-been-lost

দু’দফা নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে, তৃতীয় দফা নির্বাচন পর্বমিটতেও আর বেশী দিন নেই, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। যাঁদের দায়িত্ব ছিল, স্বচ্ছ একটি নির্বাচন পরিচালনা করার, তাঁরা মোটামুটি নিজেদের শাসকদলের কাছে, বিশেষতঃ তাঁদের প্রথম সারির নেতাদের কাছে সঁপে দিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহার পড়ে, শাসক বিজেপির মোটামুটি রাতের ঘুম উড়ে গেছে। যেদিন থেকে কংগ্রেসের এই ন্যায়পত্র প্রকাশিত হয়েছে, সেদিন থেকেই নির্বাচনী আচরণবিধির তোয়াক্কা না করে, নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধ্যকতার সুযোগ নিয়ে, প্রধানমন্ত্রী থেকে বিজেপির তাবড় নেতানেত্রীরা কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ শুরু করেছেন।

একটি দেশের নির্বাচনে বিরোধী দলের নির্বাচনী ইস্তেহার যে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, তা এবারের লোকসভা নির্বাচন পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে। অনেকদিন ধরেই অনেক অর্থনীতিবিদ এবং নানান গণনাসংস্থা একটা কথা বলে চলেছেন — দেশে সম্পদ ক্রমশ আরো বেশি বেশি করে কুক্ষিগত হচ্ছে ধনী এবং অতিধনীদের হাতে। তারা যেমন আরো বড়োলোক হচ্ছে, তেমনি আরো গরীব হচ্ছে বাকি জনতা। সাম্প্রতিক ২০২৪ সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে অসমতার তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি এবং অন্যান্যরা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে — অর্থনৈতিকভাবে ধনীতর এক শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে দেশের চল্লিশ শতাংশ সম্পদ। এবং এক শতাংশের হাতে প্রতি বছর জমা হচ্ছে দেশের মোট বার্ষিক আয়ের বাইশ শতাংশ।

এখান থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। কংগ্রেস তাঁদের ন্যায়পত্রে ঘোষণা করেছে, যে তাঁরা এবং তাঁদের ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় আসলে, ভারতে অতিধনীদের সম্পত্তির একাংশের পুনর্বন্টন করা হবে। এই কথা প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তাঁদের দলের বড়, মেজ সেজ সব ধরনের নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, এবং ক্রমাগত নানান নির্বাচনী সভা থেকে তাঁরা মানুষদের ভুল বোঝানো শুরু করেছেন। গত দশ বছরে, যাঁদের হাতে মূলত অর্থ, প্রতিপত্তি এবং বিত্ত কুক্ষিগত হয়েছে, তাঁরাই যে কংগ্রেসের এবং ইন্ডিয়া জোটের মূল লক্ষ্য, তা বোঝা গেলেও, বিজেপি এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন, মধ্যবিত্তের দিকে। এমন প্রচার করছেন, যাতে মনে হচ্ছে, মধ্যবিত্ত এবং একটু উচ্চ মধ্যবিত্তের থেকে টাকা, সম্পত্তি এবং সোনাদানা যেন কংগ্রেস কেড়ে নিতে চাইছে। শুধু তাই নয়, কেড়ে নিয়ে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াটাই যেন কংগ্রেসের উদ্দেশ্য। যে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল, ধনী এবং অতিধনীদের সম্পত্তির পূণর্বন্টন করে কী করে সার্বজনিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, বাসস্থান ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করা যায়, তার বদলে আলোচনা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে কংগ্রেস হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে, মুসলমানদের, যাঁদের বেশী সন্তান, তাঁদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। এমন একটা ধারণা তৈরী করার চেষ্টা হচ্ছে, যে গত দশ বছরে যেন মধ্যবিত্তের সঞ্চয় বিশালাকারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কংগ্রেস এবং তাঁদের সহযোগী দলেরা যদি ক্ষমতায় আসে সেই সঞ্চয়ে টান পড়বে, জমিয়ে রাখা সোনার গয়না অবধি কেড়ে নেওয়া হবে।

অথচ তথ্য কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কথা বলে। কিছুদিন আগে কলকাতায় একটি সভায় বক্তব্য রাখতে এসে অর্থনীতিবিদ পারাকালা প্রভাকর বলছিলেন, গত দশ বছরে মধ্যবিত্তের সঞ্চয় কিন্তু শুধু কমেছে এমনটা নয়, তাঁদের দেনা অর্থাৎ গার্হস্থ্য ঋণ বেড়েছে। এই তথ্য কিন্তু শুধু তিনি বলছেন এমনটা নয়, অর্থনৈতিক নানান যে সমীক্ষা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে তাতেও কিন্তু একই তথ্য উঠে এসেছে। যতই প্রধানমন্ত্রী বলুন না কেন, কংগ্রেস মধ্যবিত্তদের জমানো সোনা এবং টাকা মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে, যতই টাকা পয়সা দিয়ে গালগোটিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংগঠিত করা হোক না কেন, গত দশ বছরে, মানুষ কিন্তু অর্থনৈতিক বাধ্যবাধ্যকতার কারণে সবচেয়ে বেশী ঋণ নিয়েছেন সোনা বন্ধক রেখে। যদি তা না হতো, মুথুট ফাইন্যান্স, মনপ্পুরম গোল্ড লোন ইত্যাদি সংস্থারা এত দৃশ্যমাণ হতো না এবং তাঁদের বিজ্ঞাপণে অমিতাভ বচ্চন সহ অন্যান্যদের নেওয়া হতো না। আগেও যে বন্ধকী কারবার ছিল না এমনটা নয়, শহর থেকে মফস্বল এবং গ্রামে গঞ্জেও এই সুদখোর বন্ধকীদের দেখা যেত। ছোট ছোট সোনার দোকানের ব্যবসায়ীরা এই কাজটাই করতেন। কিন্তু তা ধীরে ধীরে কমে আসছিল, কিন্তু গত দশ বছরে, তা শুধু বাড়েনি, বরঞ্চ অনেক বেশী প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, শুধুমাত্র ২০২৩- ২৪ সালেই সোনা বন্ধক রেখে এক লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় এই ঋণের পরিমাণ প্রায় পাঁচ গুণ বেশী। এত দ্রুতগতিতে এই ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি যথেষ্টই আশঙ্কাজনক বলে রিজার্ভব্যাঙ্ক জানিয়েছে।

নোটবন্দী থেকে জিএসটি এই প্রতিটি পদক্ষেপ যে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে, তা আজকে আর নতুন করে বোধহয় কাউকে বলে দিতে হবে না, কিন্তু একটি পরিবার যখন তাঁদের শেষ সঞ্চয় বাড়ির গয়না বিক্রি বা বন্ধক রাখতে বাধ্য হয় এবং সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে বাধ্য হয়, তখন বোঝা যায় অবস্থা যথেষ্ট বেহাল। মোট ব্যক্তিগত ঋণের মধ্যে ২০১৯ সালে এই সোনা বন্ধক দিয়ে ঋণের পরিমাণ ছিল এক শতাংশ। কোভিডের সময়ে সেই ঋণ বেড়ে হয় ২.৫ শতাংশ। তার পরের বছরে তা কমে ২ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও এই ঋণের পরিমাণ ২ শতাংশের নীচে নামেনি। অর্থাৎ নোটবন্দী থেকে যে অর্থনীতির নিম্নগামী যাত্রা শুরু হয়েছে, তা ২০২৪ সালে এসে এতোটুকু কমেনি বই বেড়েছে। অর্থাৎ মোদী এবং তাঁর চেলা চামুন্ডারা যতই বলুক ভারত আগামী পাঁচ বছরে, বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসবে, দেশের অর্থনীতি পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে, তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোনও সম্পর্কনেই। দেশের মানুষ রোজদিন অর্থনৈতিকভাবে মারা যাচ্ছেন বা তা থেকে বাঁচার জন্য ঋণের জালে জর্জরিত হচ্ছেন। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার সমান কত টাকা, বা সেই সংখ্যায় কতগুলো শূন্য থাকে, তা বোঝার মতো ক্ষমতা কিন্তু সাধারণ মানুষের নেই।

এর সঙ্গে যদি সোনা কেনার প্রবণতাকে যুক্ত করে দেখা যায়, তাহলে কি সেক্ষেত্রেও বিরাট কিছু উলম্ফন ঘটেছে? সেই দিক থেকে দেখলেও কি বড় কোনও পরিবর্তন দেখা গেছে? তথ্য কিন্তু তা বলছে না। একদিকে সোনার দাম বেড়েছে, অন্যদিকে মানুষের আয় কমেছে, ফলত এক দশক আগেও মানুষজন যেভাবে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সোনা কিনে রাখতেন, তা কি দেখা যাচ্ছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর, এককথায়, না। উল্টে দেখা যাচ্ছে, সোনা আমদানিও গত পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ শতাংশ কমেছে। অনেকে বলতে পারেন, আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। ভারতের বহু মধ্যবিত্ত মানুষের আয় গত দশ বছরে এতোটাই কমেছে, যে তাঁরা সোনা কেনার কথা আর ভাবতেই পারছেন না। যতই ধনতেরাসের মতো উৎসব আসুক না কেন, মানুষ সোনা কেনার মতো উদবৃত্ত আয় করছেন নাবা সঞ্চয় করতে পারছেন না এটাই বাস্তব তথ্য। নরেন্দ্র মোদী তাঁর নির্বাচনী ভাষণ থেকে যতই তাঁর পূর্বসূরী প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করুন না কেন, যতই নির্বাচন কমিশনের আচরণ বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রচার করুন না কেন, যতই মধ্যবিত্তদের মধ্যে ভয় সঞ্চার করার চেষ্টা করুন না কেন, যে তাঁদের পরিবারের সোনার গয়না এমনকি মহিলাদের বিবাহের চিহ্ন মঙ্গলসূত্র কংগ্রেস কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিলি করে দেবে, সত্যিটা কিন্তু এটাই ভারতীয়রা এই দশ বছরে সবচেয়ে বেশী সোনা বিক্রি বা বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছে। যত জোরেই প্রচার করা হোক না কেন, শাক দিয়ে কিন্তু আর মাছ ঢাকা যাচ্ছে না। মানুষ কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে অর্থনৈতিকভাবে খুব ভালো নেই, আর সেই ভালো না থাকার বিষয়টা আর কেউ না বুঝুক, নরেন্দ্র মোদী বিলক্ষণ বোঝেন। বোঝেন বলেই, তিনি ভীত এবং সন্ত্রস্ত এবং সেইজন্যেই তিনি সারাক্ষণ হিন্দু মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতি করছেন কারণ তিনি এটা জানেন, মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং তাঁর দেওয়া ভাঁওতাগুলো বুঝতে শুরু করে, তাহলে সামনের দিন ভয়ঙ্কর। সেইজন্যেই তিনি ইদানিং আর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ বলছেন না। তাঁর ন্যারেটিভ এখন সম্পুর্ণমেরুকরণের ন্যারেটিভ, কারণ তিনি জানেন। জিততে হলে তাঁকে হিন্দুদের ভোটেই জিততে হবে। কিন্তু শেষ প্রশ্নটা থেকেই যায়, সমস্ত হিন্দুরা, যাঁরা বাধ্য হয়ে তাঁদের পরিবারের শেষ সম্বল বিক্রি বা বন্ধক দিয়েছেন, তাঁরা সবাই নরেন্দ্র মোদীর আজকের কথাগুলোকে বিশ্বাস করছেন তো?

- সুমন সেনগুপ্ত

organizers-diary_0organizers-diary

‘পুরো প্যানেল বাতিল হলে তার অভিঘাত অস্বীকার করতে পারে না আদালত’ - বলছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তিনি যখন এই পর্যবেক্ষণ রাখছিলেন, সেসময় চোখের সামনে ভেসে উঠছিল কয়েকদিন আগে, ৩রা মে- র আশ্চর্যলড়াই এর টুকরো টুকরো ছবিগুলি। সেদিন কলকাতার রাজপথ অচল করে দিয়েছিলেন হাজার হাজার শিক্ষক, সদ্য চাকরিহারা তাঁরা। তাঁদের অতিসংগত ক্ষোভ, তাঁদের অসন্তোষ আছড়ে পড়েছিল নিয়োগ কর্তৃপক্ষ এসএসসির সদর দপ্তর আচার্যভবনে। ন্যায় বিচারের দাবিতে উত্তাল সেই ক্ষোভের সামনে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল পুলিশ প্রশাসন। মাইকে পুলিশের দায়িত্বশীলরা তারস্বরে ঘোষণা করে চলেছেন, উত্তেজিত না হওয়ার জন্য, কিন্তু কীভাবে থামানো যায় সমবেত এই ১০/১২ হাজার সদ্য কাজহারা শিক্ষকের আছড়ে পরা সুবিশাল গণরোষ, স্পষ্টতই তাঁরাও দিশেহারা।

৩০ এপ্রিল শহীদ মিনার মাঠের ধারে বসে কাজহারা শিক্ষকদের পক্ষ থেকে নিজেদের বৈঠকে যখন আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল, তখন কোন সাংবাদিক বৈঠক হয়নি। স্রেফ হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এই আহ্বান যে শিক্ষকদের সামনে আর অন্য কোন পথ নেই। কারণ হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পরেও এসএসসি চেয়ারম্যান সাংবাদিক বৈঠক করে সবটা ঘেঁটে দিয়ে বলেছেন, ৫ হাজারের বাইরে অর্থাৎ বাকি ১৯ হাজারের মধ্যেও অযোগ্য আছে কিনা, তিনি হলফ করে বলতে পারছেন না। এই কথাই যদি নিয়োগ কর্তৃপক্ষ এসএসসি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টেও বলেন, তবে হার অবধারিত। অতএব এসএসসি থেকে সেগ্রিগেশন বা বাছাই এর দাবিতে, যোগ্য -অযোগ্য বিভাজনের দাবিতে আচার্য ভবন ঘেরাও, ডেপুটেশন করতে হবে।

কাজহারাদের মরিয়া এই আহ্বান সময়োপযোগী ও যথার্থছিল, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করেছে।

সূদূর উঃবঙ্গ, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ;কলকাতা সংলগ্ন প্রত্যেকটি জেলা থেকে ১২টার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা, হাজারে-হাজারে।

ন্যায় বিচারের দাবিতে এই ক্ষোভকে বিপথে চালিত করতে , ভোটের মরশুমে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত করতে ভিড়ের মধ্যে প্রচেষ্টা চলেছিল, কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত এই গণবিস্ফোরণকে শক্তিশালী গণপ্রতিরোধে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হলেন। বিকেল প্রায় ৫টা পর্যন্ত অচল হয়ে গিয়েছিল করুণাময়ী । চেয়ারম্যান শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিলেন বিক্ষোভরত চাকরিহারাদের প্রতিনিধিদের সামনে হাজির হতে এবং তাঁদের দাবি মেনে শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে এই কথা নিজের মুখে বলতে যে এসএসসি সর্বোচ্চ আদালতে জানাবে প্যানেলে যোগ্য -অযোগ্য বিভাজন করা সম্ভব।

হাইকোর্টের রায়ে কর্মচ্যুত শিক্ষকদের এই ঐতিহাসিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে কার্যত অস্বীকার করল মেইনস্ট্রিম মিডিয়া! পরদিন মিডিয়া প্রচার করল, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী সভামঞ্চ থেকে চাকরিহারাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করলে এসএসসি চেয়ারম্যান বাধ্য হয়ে ‘ডিগবাজি’ খেয়েছেন, যোগ্য-অযোগ্য বিভাজনের অঙ্গীকার করেছেন।

একই কথা ওরা আজও বলতে চেষ্টা করল। শুভেন্দু অধিকারী বলল, কোর্টে এই জয় এসেছে প্রধানমন্ত্রী পাশে থাকার জন্যই! কিন্তু কাজ হারা শিক্ষকরা জানেন, তাঁদের লড়াই, তাঁদের আজকের জয় এনে দিয়েছে, ভবিষ্যতে চূড়ান্ত জয় নিজেরা লড়েই আদায় করতে হবে।

৩ তারিখ প্রকাশ্য রাজপথে কমপক্ষে ১০হাজার শিক্ষকের মরিয়া বিক্ষোভ দেখেও সংবাদমাধ্যমগুলি সেভাবে তুলে ধরে নি। বলেছে , প্রধানমন্ত্রীর চাপে এসএসসির অবস্হান বদল!পরদিন আনন্দবাজার একে হাজার খানেক শিক্ষকের বিক্ষোভ বলে উল্লেখ করেছে! এর একটা বড় কারণ সম্ভবত এই যে ঘোলাজলে মাছ ধরতে শিক্ষকদের বলি দিয়ে ভোটের মরশুমে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে বিজেপি সহ অন্যান্য কিছু বিরোধী শক্তি যে পরিকল্পনা করেছিল, সেদিন করুণাময়ীর জমায়েত সেই ফাঁদে পা দেয়নি। সেদিন ঐ জমায়েত থেকে বারবার গদি মিডিয়া সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করা হয়েছে। এমনকি এটাও দেখা গেছে যে একটি চ্যানেল কাজহারা শিক্ষকের ইন্টারভিউ নিতে নিতে তাকে বিজেপি অভিমুখী করতে চাইলে যিনি এতক্ষণ ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ গদি মিডিয়া বলে ফুঁসে উঠেছেন।

আজকের রায়ে এটাই পর্যবেক্ষণের মূল বিষয় যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এইভাবে দুর্নীতির দায়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের একটি সম্পূর্ণ প্যানেলকে বাতিল করতে একমত হয়নি এমন ধরণের রায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অভিঘাতকে মাথায় রেখেও। আদালত এই অভিঘাতের কথা মাথায় রেখেই সম্ভবত অযোগ্যদের থেকে ১২% সুদ সহ বেতন ফেরৎ নেওয়ার পূর্ববর্তী রায়েও স্হগিতাদেশ দিয়েছে।

হাইকোর্ট রায় ঘোষণার পর এই দুটি প্রশ্ন ব্যাপক সামাজিক চর্চার বিষয় হয়েছিল।

প্রশ্ন উঠেছিল

১) যোগ্য-অযোগ্য বিভাজন আদালত কেন করল না! যোগ্যরা কেন অকারণে শাস্তি পাবে?

২) ১২% শতাংশ সুদ সহ অযোগ্যদের থেকে এতদিনকার বেতন ফেরৎ নেওয়ার যৌক্তিকতাও যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। সমাজের সর্বত্র বারবার এই প্রসঙ্গে সামনে এসেছিল ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার এই দার্শনিক ভিত্তিভাবনা, যা বলে কোন নিরপরাধী যেন শাস্তি না পায়, তা সুনিশ্চিত করতে হবে। এমনকি এরজন্য যদি অপরাধী ছাড়া পায়, তবুও। তবে এ কেমন রায়, যা যোগ্য -অযোগ্য বিভাজন করতে পারে না!

এমনকি রাজ্য সরকার ও এসএসসি যে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি করেছে,তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট থাকার পরেও মানুষ কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মানতে পারেনি।

বিকাশবাবুরা পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াই বেআইনি বলে ৭ মে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেছেন। তারপরেও মাননীয় বিচারপতিরা একমত না হয়ে একাধিক স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। একথা এই কারণেও গুরুত্বপূর্ণযে ৭ মে বিচারপতিরা রাজ্য সরকার ও এসএসসির বক্তব্য এবং বিকাশরঞ্জনদের বক্তব্যই মূলত শুনেছেন, অন্যরা সেভাবেবলার সুযোগ পাননি; তারপরেও এসেছে এইসব স্হগিতাদেশ।

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজ্য সরকার ও এসএসসি যে ব্যাপক দুর্নীতি করেছে, তা আজ মানুষের কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আর এই দুর্নীতিকে হাতিয়ার করেই ষড়যন্ত্রের গভীর জাল বুনেছে বিজেপি। তৃণমূল সরকারের প্রতি অন্ধ ক্রোধের কারণে কার্যত বিজেপির পরিকল্পনার অঙ্গ হয়ে গেছেন বিকাশবাবুরা। এই জটিল পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে লোকসভা নির্বাচনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ফ্যাসিস্টদের পরিকল্পনা চলমান সংকটকে গভীরতর করতে সেভাবে সক্ষম হতে পারল না মূলত কাজহারা শিক্ষকদের সামাজিক -রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে, রাস্তায় নেমে গড়ে তোলা তাঁদের গণপ্রতিরোধের কারণে, শুধুমাত্র আদালত মুখাপেক্ষী না থেকে একইসাথে রাস্তার লড়াইকেও সমান অগ্রাধিকারে রাখার কারণে। এই কারণেই বিজেপি প্রভাবিত সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই সংকটকে বিজেপির অনুকূলে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হল। এমনকি নিজেরাও কোন দাগ কাটতে ব্যর্থ, এখনও পর্যন্ত।

এই লড়াইয়ে আমাদের কিছু কমরেডের সচেতন হস্তক্ষেপ, পাশে থাকা, আন্তরিক সহযোগিতা নিশ্চিতভাবেই যথেষ্ট ইতিবাচক। এই আঘাতপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এক বিরাট অংশ একটি অধিকার মঞ্চকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। চলমান ঘটনাবলী, বাস্তব বিকাশ তাঁদের সামনে অনেক কিছুই স্পষ্ট করে দিচ্ছে। একদিকে বিজেপি, অন্যদিকে বিকাশবাবুদের ভূমিকা অনেক কিছু উন্মোচিত করেছে। আজকের এমন এক সময়ে বৃহত্তর শিক্ষক সমাজের মধ্যে পার্টির প্রভাব বিস্তার করতে ‘অধিকার মঞ্চ’ ধরনের অন্তর্বর্তী সাংগঠনিক ধাঁচা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা, নিয়মিত ও দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক তৎপরতা।

দুর্নীতি, আদালতের একপেশে বিচার, শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকট, শিক্ষকদের নির্বিচার কাজ হারানো, ঘোলাজলে মাছ ধরতে ফ্যাসিস্ট সহ বিরোধী শিবিরের চক্রান্ত ইত্যাদি ঘটনাবলী রাজ্যের জনজীবনে ইতিমধ্যে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে।

সমাজের এই যথেষ্ট সংবেদনশীল অংশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করার আপাতত একটি সুযোগ এসেছে। পার্টিকে সেভাবে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।

- সজল অধিকারি

000=000

খণ্ড-31
সংখ্যা-17