(দৈনিক প্রতিদিন পত্রিকার উত্তর সম্পাদকীয় স্তম্ভে ২২ এপ্রিল ২০২৪, পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যর
এই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আমরা তা পুনর্মুদ্রণ করলাম (শিরোনাম আমাদের)।
- সম্পাদকমন্ডলী, আজকের দেশব্রতী)
দশ বছর ধরে ট্রেলার চললে আসল পিকচার এবার কেমন হবে?
সাত দফা নির্বাচনের প্রথম দফা সম্পন্ন। পাঁচ বছর আগের নির্বাচনের তুলনায় এবার প্রথম দফায় ভোটের হার বেশ কম। অশান্ত মণিপুর আবার জ্বলে উঠেছে, নাগাল্যান্ডের অন্তত চার লক্ষ ভোটারের বুথে একটিও ভোট পড়েনি, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, রাজস্থানে ভোট পড়েছে বেশ কম। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ভাষায় নিস্তরঙ্গ নির্বাচনের সংকেত। দেশজুড়ে শাসক দলের প্রচার ঝড় জনমানসে কেন ঢেউ তুলতে পারছে না? মোদীর ‘চারশ পার’ আহ্বানে কেন বুথে বুথে ভোটারদের ঢল নামল না? এর একটা জবাব অনুমান করা যায় সিএসডিএস-লোকনীতি প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা থেকে।
উনিশটি রাজ্যের দশ হাজার ভোটারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এবারের নির্বাচনে তাঁদের বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী। মার্চের শেষ ও এপ্রিলের গোড়ায় অনুষ্ঠিত এই সমীক্ষায় ২৭ শতাংশের জবাব বেকারত্ব। ২৩ শতাংশের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন মূল্যবৃদ্ধি। এর বিপরীতে শাসক দলের দাবি করা সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব রাম মন্দিরে উৎসাহ দেখিয়েছেন ৮ শতাংশ। মাত্র ২ শতাংশ উত্তরদাতা ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির উন্নতি ঘটার প্রচারে বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন।
জনগণের এই চিন্তাভাবনা সাম্প্রতিক বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা ও অধ্যয়নেও ধরা পড়ে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের কর্মসংস্থান সংক্রান্ত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ভারতে কর্মহীনদের ৮০ শতাংশেরও বেশি যুব প্রজন্মের। শিক্ষিত বেকারের হার ক্রমবর্ধমান — উচ্চশিক্ষা ও বেকারত্বের সম্ভাবনা বলতে গেলে সমানুপাতিক। কলেজ পেরোনোর পর ২৯ শতাংশ বেকার। মুম্বই আইআইটি’র সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান বলছে ৩৬ শতাংশ এখনও কাজ পায়নি। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাজনিত লাভ কথাটা একসময় খুব চালু হয়ে গিয়েছিল। ভারতের জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে। কিন্তু সেই জনসংখ্যার বড় অংশ যদি কর্মহীনতার শিকার হয়ে পড়ে তাহলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পর্যবসিত হবে জনসংখ্যাজনিত বিপর্যয়ে। ব্যাপক কর্মহীনতা, বাস্তবিক মজুরি সংকোচন এবং ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির ত্রিমুখী আঘাতে শ্রমজীবী সমাজের বড় অংশ আজ ভীষণভাবে নাজেহাল।
এই পরিস্থিতির সঙ্গে বিজেপির এবারের ম্যানিফেস্টোর আদৌ কি কোনো সামঞ্জস্য আছে? দশ বছর আগে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সেসব প্রতিশ্রুতিকে কিছুদিনের মধ্যেই অমিত শাহ বলেছিলেন জুমলা। ভারতের রাজনীতিতে জুমলা শব্দের সঙ্গে সম্ভবত ব্যাপক জনগণের এই প্রথম পরিচয়। এর কিছুদিন পরেই এল ২০২২ সালকে ঘিরে এক প্রস্থ লক্ষ্য — সকলের জন্য পাকা বাড়ি, জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা, চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ, কৃষকের দ্বিগুণ আয়, একশটি স্মার্ট সিটি, দশটি বিশ্বস্তরীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। দশ বছর পেরিয়ে দেশ ভেবেছিল এবার এই লক্ষ্য অর্জনের সমীক্ষা নিয়ে নির্বাচনে হিসেব হবে। কিন্তু এবার গোলপোস্ট আরও পঁচিশ বছর এগিয়ে দেওয়া হল — ২০৪৭ সালে বিকশিত ভারত। দায়িত্বশীল আমলাদের দিয়ে বলানো হচ্ছে বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধি শাশ্বত সমস্যা এবং সরকারের এ’ব্যাপারে তেমন কিছু করণীয় নেই। জুমলার নতুন প্রতিশব্দ ‘মোদীর গ্যারান্টি’ এ’ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব।
অর্থনীতির ব্যাপারে সরকারের মূল প্রচার হল ভারত এখন পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু প্রতিব্যক্তি আয়ের নিরিখে আমরা যে পৃথিবীর একেবারে শেষের সারিতে, প্রতিবেশী সমস্ত দেশের পেছনে, সে কথা ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ কায়দায় গোপন রাখা হয়। ভারতের আর্থিক বৈষম্য আজ যে ঔপনিবেশিক জমানাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে, গোপন রাখা হয় সে কথাও। সর্বোচ্চ এক শতাংশ ধনকুবেরদের হাতে দেশের ৪০ শতাংশ সম্পত্তি এবং ২২ শতাংশ বার্ষিক আয় — সরকারের চোখে এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। কোভিডকালে ভারতের বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে, বর্তমানে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুশো — সরকারের চোখে এটাই হলো ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
সরকারের নীতি আয়োগের দাবি দেশে দারিদ্র্য বিরাটভাবে কমে গেছে। আজ মাত্র ৫ শতাংশ ভারতীয়কে নাকি গরিব বলা যায়। একই সাথে মোদী সরকার বিনামূল্যে আশি কোটি ভারতীয়কে মাসে পাঁচ কিলো খাদ্যশস্য বিতরণের কৃতিত্ব দাবি করে। এই দুই পরিসংখ্যানকে একমাত্র মোদী সরকারের প্রবক্তা এবং নীতি আয়োগের পক্ষেই মেলানো সম্ভব। মোদীর ঘোষণা একশ চল্লিশ কোটি ভারতীয়র আকাঙ্ক্ষা পূরণ করাই তাঁর লক্ষ্য। এই হল মোদী মিশন। আশি কোটি ভারতীয়র কি তাহলে কোনোরকমে পাঁচ কিলো রেশন পেয়ে বেঁচে থাকাটাই একমাত্র আকাঙ্ক্ষা?
পশ্চিমবঙ্গের এক নির্বাচনী সভায় মোদী বললেন গত দশ বছরে যা হয়েছে তা শুধুই ট্রেলার। আসল পিকচার এখনও বাকি। অন্য এক সমাবেশে মোদীর বক্তব্য, দশ বছরে শুধু স্টার্টার পরিবেশন করা হয়েছে। এবার মেইন কোর্সের পালা। মোদীর ঘোষিত ম্যানিফেস্টো বা তথাকথিত গ্যারান্টিকে ছাপিয়ে এই অঘোষিত আসল পিকচার বা মেইন কোর্স সংক্রান্ত ইশারাই এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় রহস্য।
এই ইশারা বুঝে ওঠা খুব কঠিন কাজ নয়। গত দশ বছরের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে মোদী সরকার সংবিধান ও সংবিধান-প্রদত্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি বা বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থার ভূমিকা সম্পর্কে কোনো তোয়াক্কা করে না। দেশের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে একটি ছোট চক্রের হাতে কুক্ষিগত করা এবং অর্থব্যবস্থা ও যাবতীয় সম্পদ থেকে যথেচ্ছ মুনাফা অর্জনের ছাড় আদানি-আম্বানির মতো গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া — গত দশবছর ধরে, বিশেষত বিগত পাঁচ বছরে, এই অভিযান চলতে চলতে দেশ এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যাকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এক নির্বাচনী নিরঙ্কুশ তন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করেছেন।
অনন্ত কুমার হেগড়ে, রাজস্থানের জ্যোতি মির্ধা বা উত্তরপ্রদেশের লল্লু সিং ও অরুণ গোভিলের মতো বিজেপি নেতা ও প্রার্থীরা খোলাখুলিভাবেই বলতে শুরু করেছেন যে সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধানের জন্যই মোদীর চারশোর বেশি আসন জেতার আহ্বান। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে থাকবে স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা বিবেক দেবরায় খবরের কাগজে রীতিমতো নিবন্ধ লিখে নতুন সংবিধানের ওকালতি করেছিলেন। আম্বেদকারের সংবিধানকে ঔপনিবেশিক সংবিধান বা বিদেশী সংবিধান হিসেবে অভিহিত করাটাও সংঘ পরিবারের চিরকালের প্রচার। সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় আরএসএস মুখপত্র অর্গানাইজার সম্পাদকীয় লিখে মনুস্মৃতিকে ভারতের প্রকৃত সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
সংবিধানের পক্ষে ব্যাপক ভারতীয় জনগণকে সমাবেশিত হতে দেখে মোদী এবং শাহ উঠে পড়ে সংবিধান সম্পর্কে গ্যারান্টি দিতে শুরু করেছেন। নরেন্দ্র মোদী তো রাজস্থানের এক সভায় এমন কথাও বললেন যে স্বয়ং আম্বেদকার এলেও সংবিধানকে ধ্বংস করতে পারবেন না। কী অদ্ভুত অহঙ্কারী কথা! সংবিধান নির্মাতা আম্বেদকার আসবেন সংবিধানকে ধ্বংস করতে? মোদী যদি সত্যিই জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাইতেন তাহলে আম্বেদকারের বদলে গুরু গোলওয়ালকারের নাম নিতেন। আম্বেদকার তো জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন সংবিধানবিরোধী শাসকদের সম্পর্কে! এবারের নির্বাচন প্রকৃতই সংবিধানকে বাঁচানোর নির্বাচন। সাত দশকের নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় এমন নির্বাচন আগে আসেনি। সংবিধান ও গণতন্ত্র স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় ফসল, এই ফসলকে বাঁচাতেই হবে।
গত ৩০ বছরের মধ্যে এবারে সবচেয়ে বিষাক্ত, বিভেদকামী বিদ্বেষপূর্ণ নির্বাচনী ভাষণ দিলেন নরেন্দ্র মোদী, রাজস্থানের বাঁশওয়ারায়। যিনি এই ক’দিন আগে পর্যন্ত বুক ঠুকে বলে আসছিলেন ‘আবকি বার, চারশো পার’, সেই মোদী এই প্রথম বললেন, “কংগ্রেস যদি ক্ষমতায় ফিরে আসে তবে সবার ধনসম্পত্তি, মা-বোনেদের ধনসম্পত্তি বা মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিয়ে যারা অনুপ্রবেশকারী (পড়ুন মুসলিম) ও অনেকগুলো বাচ্চা কাচ্চা আছে, তাদের মধ্যে বিলি করে দেবে।”
২০০২ সালে সংখ্যালঘুদের নিকেশ করতে মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময় গুজরাটে যে গণহত্যা সংগঠিত হয় তখন আক্রান্ত, ঘরবাড়ি জ্বলে পুড়ে যাওয়া মুসলিমদের জন্য আলাদা আশ্রয়স্থল তৈরি করার দাবি ওঠে। তখন মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে তিনি বলেছিলেন, “আমি চাই না ওই আশ্রয়স্থলগুলো সেই সম্প্রদায়ের সন্তান উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে উঠুক, যারা বিশ্বাস করে হাম দো, হামারা পঁচিশ (আমরা দুই, আমাদের পঁচিশ)”। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি এত তীব্র ঘৃণা সযত্নে লালন পালন করে চলেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, যা অকল্পনীয়, অভূতপূর্ব।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে উদ্ধব ঠাকরেকে নোটিশ পাঠিয়ে জানানো হয়, তিনি যেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ‘হিন্দু’ ও ‘জয় ভবানী’ শব্দবন্ধগুলো ব্যবহার না করেন। তিনি সরাসরি ওই প্রস্তাবকে খারিজ করে জানান, এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম মোদীর হাতে নোটিশ ধরানো হোক। আরও উল্লেখ্য, মোদীর ওই ঘৃণা ভাষণের পর একাধিক সংবাদমাধ্যম এ’প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনারকে ফোন করে প্রতিক্রিয়া জানতে চায়। তারা সরাসরি জানান, এনিয়ে কোনো উত্তর দেবেন না।
ভারতবর্ষে সংখ্যালঘুদের বৃহত্তম সম্প্রদায়কে নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি না দিয়ে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে দাগানো, গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘যৌন পিপাসু, গাদা গাদা সন্তান উৎপাদনকারী’ বলে চিহ্নিত করে উগ্র মুসলিম বিদ্বেষকে ইন্ধন দেওয়া — এটাই হল বিজেপি-আরএসএস’এর শতাব্দী ব্যাপী ঘৃণ্য ছক। মোদী নির্বাচনের প্রাক্কালে তা আবার উস্কে দিলেন।
মোদী-অমিত শাহ আবার এই ধর্মীয় মেরুকরণে মরিয়া হয়ে ময়দানে নামলেন কেন? প্রথম পর্বের নির্বাচনের শেষে দেখা যাচ্ছে জীবন-জীবিকা, বেকারত্ব মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি জ্বলন্ত বিষয়গুলোই ক্রমে প্রধান ইস্যু হয়ে সামনে উঠে আসছে। দেখা যাচ্ছে, প্রথম দফার নির্বাচনে গো-বলয়ে বিশেষ করে এনডিএ শাসিত বিহার-উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং পশ্চিম মহারাষ্ট্রে দলের পক্ষে ভোট কম পড়ায় নড়ে চড়ে বসেছে বিজেপি নেতৃত্ব। প্রবল দাবদাহকে উপেক্ষা করে সংঘবদ্ধভাবে মুসলিম সম্প্রদায় যেভাবে ভোট দিতে বেরিয়েছিলেন, তুলনায় সেই উৎসাহ অনুপস্থিত ছিল হিন্দু সমাজের মধ্যে। দলীয় নেতৃত্ব মনে করছে, কর্মীদের বড় অংশের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রবল অনীহা লক্ষ্য করা গেছে, যা মোদী-অমিত শাহকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। দক্ষিণে তো বটেই, উত্তর ভারতেও রামমন্দিরের আবেগের কোনো তরঙ্গ সেইভাবে চোখে পড়ছে না। বহু ঢাক পেটানো ‘মোদী গ্যারান্টি’র লম্বা ফিরিস্তি থেকে তাই সরে এসে চিরাচরিত ধর্মীয় মেরুকরণের রাস্তায় মোদী হাঁটা শুরু করলেন।
নির্বাচনী আদর্শ আচরণ বিধিকে এই ভাবে দুই পায়ে মাড়িয়ে দেওয়ার পরও জাতীয় নির্বাচন কমিশন এখনও পর্যন্ত কোনো নোটিশ মোদীকে ধরালো না। বাম দলগুলি দিল্লীর মন্দির মার্গ থানায় নালিশ দায়ের করলে তা গ্রহণ না করে পরামর্শ দেওয়া হয় দিল্লীর পুলিশ কমিশনারের কাছে তা দায়ের করতে। ওই ঘৃণা ভাষণের পরই ২২ এপ্রিল ২২,০০০ নাগরিক জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে গণনালিশ পাঠান, যা নজিরবিহীন।
কিন্তু, গলায় বকলশ লাগানো জাতীয় নির্বাচন কমিশন এখনো মোদীর বিরুদ্ধে একটা সাদামাটা কারণ দর্শনোর নোটিশ পর্যন্ত পাঠালো না। সাংবিধানিক এই সংস্থাটির এমন অপমৃত্যুই আজ মোদী শাসিত ভারতবর্ষের আসল ছবি — যেখানে অস্তাচলে পাঠানো হয়েছে সমস্ত গণতান্ত্রিক, সংবিধান স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলিকে।
এবারের জাতীয় নির্বাচন সেই গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের নির্বাচন। সংবিধান, ভারতবর্ষের বহুত্ব, সংসদকে বাঁচানোর নির্বাচন। আপামর ভারতবাসী সেই অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলেছেন।
রাজস্থানের বাঁসওয়ারায় সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ দায়ের করল সিপিআই(এমএল)
সিমিআই(এমএল) লিবারেশন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩(৩ক) ধারার ও আদর্শ নির্বাচন বিধির চরম লঙ্ঘন এবং ধর্মের ভিত্তিতে শত্রুতা ও ঘৃণা প্রচার করার দায়ে।
গত ২১ এপ্রিল ২০২৪ রাজস্থানের বাঁসওয়ারায় কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নির্লজ্জ মিথ্যার আশ্রয় নেন এবং অত্যন্ত মোটা দাগে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কথা বলেন যা জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১ এবং আদর্শ নির্বাচনী বিধিকে ভঙ্গ করেছে।
তাঁর ভাষণে মোদী কটাক্ষ করে বলেন যে কংগ্রেস সাধারণ মানুষের সোনা রূপা সহ সব সম্পদের হিসেব নিয়ে তা মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করে দিতে চায়।
২১ এপ্রিল ২০২৪ রাজস্থানের বাঁসওয়ারায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই ভাষণ জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩(৩ক) ধারা ভঙ্গ করেছে যে ধারায় স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তার ইলেকশন এজেন্ট এবং প্রার্থী বা তার এজেন্টের অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি ঐ প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা বাড়াতে বা অন্য প্রার্থীর সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে ভারতের নাগরিকদের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, জাত, সম্প্রদায় বা ভাষার ভিত্তিতে কোনো ধরনের শত্রুতা বা ঘৃণার মনোভাব জাগানোর লক্ষ্যে কোনোরকম প্রচার চালাতে পারবেন না বা সেই লক্ষ্যে কোনোরকম উদ্যোগ নিতে পারবেন না। মোদীর ভাষণ আদর্শ নির্বাচনী বিধি এবং ২০২৪’র ১ মার্চ জারি করা “নির্বাচনী প্রচারে জনচর্চা পরিসরের গুণগত স্তর উন্নত রাখার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি নির্দেশিকা”রও চরম উল্লঙ্ঘন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই ভাষণ তাঁর একের পর এক অনুরূপ ভাষণের পথ বেয়েই এসেছে (রাজস্থানের আজমেরে ৬ এপ্রিল, বিহারের নওয়াদায় ৭ এপ্রিল এবং উত্তরপ্রদেশের পিলিভিটে ৯ এপ্রিলের ভাষণ) যে ভাষণগুলিতে তিনি বারবার অযোধ্যার রামমন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উল্লেখ করছেন। এইসব ভাষণের বিরুদ্ধে অনেকগুলি অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা পড়ে আছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে ধরণের ভাষণের আশ্রয় নিয়েছেন তা প্রধানমন্ত্রীর পদের সাথে মোটেই মানানসই নয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছে স্বচ্ছ ও অবাধ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন সমাপন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার। আদর্শ নির্বাচনী বিধি কঠোরভাবে বলবৎ করে নরেন্দ্র মোদীর এই অত্যন্ত বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ ও ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারতের নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা খাড়া করা ও ভোটের আবহকে বিষিয়ে দিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর ভাষণের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে সিপিআই(এমএল)।
দার্জিলিং : ২২ এপ্রিল পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস ও মহামতি লেনিনের জন্ম বার্ষিকীতে দার্জিলিং জেলার ফাঁসিদেওয়া-নকশালবাড়ী ব্লকের সীমান্তে রাঙ্গাপানিতে কর্মসূচি পালিত হয়। শুরুতে ফাঁসিদেওয়া ব্লক কার্যালয়ের সামনে পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়। শহীদ বেদিতে নেতৃবৃন্দের পুস্পার্ঘ্য অর্পণের পর রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার আজকের পরিস্থিতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন। পরবর্তীতে বিজেপি’কে পরাস্ত করার আহ্বান জানিয়ে রাঙ্গাপানি বাজারে স্কোয়াড মিছিল পরিক্রমা করে। সবশেষে এনআরএল মোড়ে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। পথসভায় সমস্ত বক্তারা আগামী ২৬ এপ্রিল দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি’কে হারানোর আহ্বান জানান। সভায় বক্তব্য রাখেন অভিজিৎ মজুমদার, বাসুদেব বসু, পঞ্চা বর্মন, জলপাইগুড়ি জেলা কমিটি সদস্য ও আয়ারলা নেতা শ্যামল ভৌমিক। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ। শরৎ সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, দীনবন্ধু দাস প্রমুখ জেলা নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন।
জলপাইগুড়ি : ২২শে এপ্রিল ২০২৪ কমরেড লেনিনের ১৫৫তম জন্ম দিবস এবং পার্টি প্রতিষ্ঠার ৫৫তম বার্ষিকী পালন করা হয় জলপাইগুড়ি জেলা পার্টি অফিসে। লাল পতাকা উত্তোলন করেন জেলা কমিটি সদস্যা মহিলা নেত্রী রেবা দাস। শহীদ বেদীতে পুষ্প অর্পণ করেন জেলা কমিটি সদস্য শ্যমল ভৌমিক, মুকুল চক্রবর্তী, সুভাষ দত্ত। বক্তব্য রাখেন সুভাষ দত্ত ও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন মিহির সেন। উপস্থিত থাকেন জলপাইগুড়ি শহর লোকাল কমিটির সদস্যরা। সভাস্থলে পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবসে কেন্দ্রীয় কমিটির অঙ্গীকার বার্তা পাঠ করা হয়।
জলপাইগুড়ি
উত্তর ২৪ পরগণা : গাইঘাটা-বনগাঁ এরিয়া লিডিং টিমের পক্ষ থেকে চাঁদপাড়া অঞ্চলের ঢাকুরিয়া পার্টি অফিসে ২২ এপ্রিল পার্টির ৫৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ও ওই একই দিনে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পুরোধা কমরেড লেনিনের ১৫৫তম জন্মদিন পালন করা হয়। পার্টির পতাকা উত্তোলন, পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কমরেড চারু মজুমদার ও কমরেড লেনিনের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন উপস্থিত পার্টির সদস্যগণ। তারপর বক্তাগণ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে এই দিনটি পালনের অঙ্গীকারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ‘বিজেপি হারাও, দেশ বাঁচাও’, ‘ইন্ডিয়াকে জেতাও’ বিষয়কে কেন্দ্র করে বক্তব্য রাখেন। নাগরিক করার নামে মতুয়া সমাজের মানুষ’কে বে-নাগরিক করার বিজেপির ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন। বক্তব্য রাখেন কৃষ্ণপদ প্রামাণিক, অজয় বসাক, নির্মল ঘোষ ও সঞ্জীব চক্রবর্তী। সভা পরিচালনা করেন অমরেশ বিশ্বাস।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা : মহান লেনিনের ১৫৫তম জন্মজয়ন্তী ও সিপিআই(এমএল)-এর ৫৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা অফিসে কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, মাল্যদান করেন বজবজ শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক অঞ্জন ঘোষ, জেলা সদস্যা দেবযানী গোস্বামী ও আরো অনেকে। তারপর শহীদদের উদ্দেশে নীরবতা পালন করা হয়। জেলা সম্পাদক আহ্বান রাখেন বিশ্বব্যাপী লেনিনের স্বপ্ন সফল করতে এবং ভারতবর্ষে শ্রমজীবী মানুষকে শোষণমুক্ত করতে ও গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ গড়ে তুলতে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী বিজেপি’কে পরাজিত করতে শপথ নিতে হবে এবং জনগণকে সামিল করিয়ে ভোটদানে উৎসাহিত করতে হবে। বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির নেতৃত্বে বাখরাহাট স্কুল মোড়ে কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন জেলা কমিটি সদস্য দিলীপ পাল। মাল্যদান করেন নিখিলেশ পাল, শুভদীপ পাল, স্মৃতিময় মাইতি, সন্দীপ ধাড়া, পূর্ণিমা হালদার, মেহেবুব জমাদার ও আরো অনেকে। তারপর শহীদদের উদ্দেশ্যে নীরবতা পালনের পর কেন্দ্রীয় কমিটির সংকল্প পাঠ করা হয়।
হাওড়া : জেলা জুড়ে পালিত হলো পার্টির ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস ও আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’কে পরাস্ত করার আহ্বান নিয়ে পথসভা — আড়ুপাড়া-জগাছা লোকাল কমিটি ২২ এপ্রিল পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করে এবং বিজেপি হারাও, দেশ বাঁচাও কর্মসূচি পথসভার মাধ্যমে পালিত হয়। পতাকা উত্তোলন করেন এন এন ব্যানার্জী। সভায় দেবব্রত ভক্ত দিল্লীর ফ্যাসীবাদী সরকারের থেকে বাঁচতে জনগণকে বিজেপি’কে ভোট না দিতে আহ্বান জানান। এন এন ব্যানার্জী শ্রমিক, কৃষক, বেকার বিরোধী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নকারী সরকারকে ভোট না দিতে জনগণকে সজাগ করলেন। মধ্য হাওড়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে এমসি ঘোষ লেন ও হালদার পাড়ায় পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা হয়। দুটি জায়গাতেই শহীদ বেদীতে মাল্যদান করা হয় ও সংক্ষিপ্ত পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। পার্টির সংগ্রামী ঐতিহ্য ও বর্তমান ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে পার্টির ভুমিকা তুলে ধরে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি’কে পরাস্ত করার আহ্বান জানানো হয়। পার্টির জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত ও জেলা কমিটি সদস্য প্রণব মন্ডল বক্তব্য রাখেন ও সভা পরিচালনা করেন।
হাওড়া জেলার বালি গ্রামাঞ্চলে সিপিআই(এমএল)-এর ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবস এবং কমরেড লেনিনের ১৫৫তম জন্মদিন পালন করা হয় একটি পথসভার মধ্য দিয়ে। সভার শুরুতে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন পার্টির বর্ষীয়ান নেতা বাবলু গুহ এবং শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন। উপস্থিত সকলে শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের শিল্পী বন্ধুরা ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে জোট বাঁধার আহ্বান রেখে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। বিজেপি হারাও, দেশ বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও স্লোগান’কে সামনে রেখে বক্তব্য রাখেন প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিক পার্থ সারথি মিত্র, বালি গ্রামাঞ্চলের পার্টি নেতৃত্ব দীপক চক্রবর্তী, বাবলু গুহ এবং মাধব মুখার্জী। বালির শহরাঞ্চলে পালিত হয় পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস। জোড়া অশ্বত্থতলা শহীদবেদীতে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন পার্টির বর্ষীয়ান কমরেড দিলীপ ঘোষ। শহীদবেদীতে মাল্যদান করেন মনোরঞ্জন ব্যানার্জী। বিজেপি’কে আসন্ন লোকসভায় পরাজিত করার আহ্বান নিয়ে সংগঠিত হয় পথসভা। সভা শেষে সাধারণ পথচলতি মানুষের মধ্যে লিফলেট বিলি করা হয় ও বিজেপি’কে পরাস্ত করার আবেদন জানানো হয়। সাঁতরাগাছি লোকাল লিডিং টিমের উদ্দ্যোগে ৫৫তম পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা হয় ইউনিয়ন অফিসে। শহীদ বেদীতে মাল্যদান এবং শহীদ ও প্রয়াতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করা হয়। এন এন ব্যানার্জ্জী আজকের পরিস্থিতিতে ২২ এপ্রিলের তাৎপর্য ও লোকসভা নির্বাচনে আমাদের অবস্থান বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। এছাড়া দেবব্রত ভক্ত বক্তব্য রাখেন। পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা হয় পার্টির ঘোড়াঘাটা লোকালের উদ্যোগেও। পতাকা উত্তোলন করেন গুলজার আলি। শহীদস্মরণ কর্মসূচির পরে বিজেপি’কে পরাস্ত করার আহ্বান নিয়ে সংগঠিত হয় সংক্ষিপ্ত পথসভা।
কলকাতা : পার্টির ৫৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও মহান লেনিনের ১৫৫তম জন্মদিবসে কলকাতায় যাদবপুর, বেহালায় তা পালিত হয়। সকালে ধর্মতলায় লেনিন মূর্তির পাদদেশে মাল্যদান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় জেলা পার্টি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে। তারপর পার্টির রাজ্য সদর দপ্তরের শহিদ স্তম্ভে মাল্যদান ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। যাদবপুরের গাঙ্গুলিপুকুর পার্টি অফিস, পালবাজার, গড়ফা স্কুল মোড়, দাসপাড়া ও সার্ভে পার্ক ১০৯ ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকেও এই অনুষ্ঠান হয়। বেহালায় কালিতলা পার্টি অফিস, মদনমোহনতলায় পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়।
কর্মসূচিগুলোতে আসন্ন নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে পরাজিত করার, দেশের সাংবিধানিক গণতন্ত্রকে রক্ষা করার শপথ নেওয়া হয়।
নদীয়া : ২২ এপ্রিল মহান লেনিনের ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী এবং সিপিআই(এমএল)’এর ৫৬তম প্রতিষ্ঠা দিবসে কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিসের মোড়ে অনুষ্ঠিত হলো এক প্রচারসভা, যার মূল ব্যানার ছিল — “বিজেপি হারাও দেশ বাঁচাও। শহরের জনবহুল স্থানে অনুষ্ঠিত এই প্রচার সভা বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিজেপির ফ্যাসিস্ট চরিত্র উদঘাটিত করে ব্যানার পোস্টারে সুসজ্জিত এই সভায় ভালো সংখ্যক পার্টি কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। বক্তারা দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদী বিপর্যয়ের বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরেন। পাশাপাশি তারা বলেন, বিজেপি কৃষ্ণনগরে রাজতন্ত্রকে গৌরবান্বিত করার লক্ষ্যে প্রার্থী নির্বাচন করেছে। এর মাধ্যমে আসলে এক নক্কারজনক সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে ওরা ছড়িয়ে দিতে চাইছে। এটা এখানকার মানুষ মেনে নেবে না। নাগরিকত্ব আইন মতুয়া সমাজকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এই কেন্দ্রের সাংসদ মহুয়া মৈত্রর সাংসদ পদ বাতিল সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কর্পোরেট বিজেপি আঁতাত ও শাসকের একবগ্গা স্বৈরাচারী মনোভাবকে আরও স্পষ্ট করেছে। ফ্যাসিস্টরা এ রাজ্যের সরকার বিরোধী গণক্ষোভকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। দেশব্যাপী ফ্যাসীবাদের বিপদকে এ রাজ্যে লঘু করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই ফ্যাসিবাদ বিরোধী একনিষ্ঠ ও দায়বদ্ধ শক্তি হিসাবে ওদের মুখোশ খোলার কাজ এই মুহূর্তে আমাদের সামনে এক জরুরি কর্তব্য হয়ে উঠেছে। সভায় “কমরেড লেনিনের আহ্বান” গণসংগীত পরিবেশন করেন মল্লিকা সরকার। বক্তব্য রাখেন মল্লার মৈত্র, পরিক্ষিৎ পাল, জীবন কবিরাজ ও জয়তু দেশমুখ।
১৯ এপ্রিল থেকে পয়লা জুন — এই সাত দফায় ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। বিশ্বে ১৪৩ কোটির সর্বাধিক জনবহুল দেশ এই ভারতবর্ষ আগামী নির্বাচন মারফত নির্বাচিত করবে পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারকে। তাই সুবিবেচনা করেই আপামর ভারতবাসী প্রয়োগ করবেন তাঁদের গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার, যার মধ্য দিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে অর্থ ও বাহুবলের বিপরীতে জনতার শক্তি।
দেশের বিপুল শ্রমজীবী জনতার কাছে গত দশ বছরের মোদী শাসনকাল ছিল মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। সংসদের ভেতরে তার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে বিজেপি ব্যবহার করেছে কর্পোরেটদের আরও বেশি মুনাফা লোটার লক্ষ্যে, আপামর জনতার আর্থিক দুর্দশা ও অধিকার হরণের বিনিময়ে। শ্রমিকদের আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হল সংসদে শ্রমকোড পাশ করিয়ে। মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব আকাশছোঁয়া, উল্টো দিকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রকৃত আয় দিনের পর দিন মুখ থুবড়ে পড়ছে। নিজেদের বাসস্থান ও রুজি থেকে মানুষকে উৎখাত ও উচ্ছেদ করতে মোদী জমানার প্রতীক হয়ে উঠেছে বুলডোজার। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো জানাচ্ছে, ভারতে অসংগঠিত বা ইনফর্মাল শ্রমিকরা হলেন ৯৪ শতাংশ। নিয়োগকর্তারা এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের খাতায় কলমে তো নিয়োগই করেনি, এরা যে কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত। ভারতের শ্রমিকশ্রেণির চরম বিপন্নতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল অতিমারীর সময়ে লকডাউন চলাকালীন। সম্পদসৃষ্টিকারী যে শ্রেণিটি দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে, সংকটের প্রথম আঘাতে, লকডাউন ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথেই তাঁরা হয়ে যান নেই-রাজ্যের বাসিন্দা। মুহূর্তের মধ্যে তাঁদের রোজগারে কোপ পড়ে। রুটি রুজি খুইয়ে চাল-চুলোহীন অযুত নিযুত শ্রমিকরা নিজ বাসভূমে বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেন পায়ে হেঁটে। তাঁদের জন্য সরকার কোন বিকল্প ব্যবস্থা, কোনো রকম সুরক্ষা দিতে পারল না। আর, গোটা দেশে নেমে আসা অতিমারীর সেই ঘোর দুঃসময়ে চরম শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোডগুলোকে পাস করিয়ে নেওয়ার জন্যই যেন ওৎ পেতে বসে ছিল মোদী সরকার। এই সরকারের নগ্ন কর্পোরেট প্রীতি, শ্রমিক বিরোধী মনোভাব এইভাবেই প্রকট হয়ে বেআব্রু হল।
লোকসভা নির্বাচন এখন দোরগোড়ায়। গত দশ বছর ধরে যে শ্রমিকশ্রেণিকে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী নীতিগুলোর সাথে যুঝতে হয়েছে, এখন সময় এসেছে, এর বিরুদ্ধে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার, সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবন-জীবিকার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার।
শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড ফিরিয়ে নাও
২০২০’র সেপ্টেম্বরে গোটা দেশ যখন অতিমারীর আক্রমণে বিপর্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে মোদী সরকার ৪৪টি শ্রম আইনকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করে তৈরি করল চারটি শ্রমকোড — শতাব্দীব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে অর্জিত অধিকারগুলোকে পুরোপুরি ছিনিয়ে নিয়ে।
মজুরি কোডে এমন সমস্ত বিধি রয়েছে যা নিয়োগকর্তাকে ন্যূনতম মজুরি প্রদানের বাধ্যকতা থেকে ছাড় দিয়েছে। এই কোড ফ্লোর লেভেল মজুরির ধারণা হাজির করেছে, যা ন্যূনতম মজুরির থেকে বেশ অনেকটাই কম। ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার যে বাধ্যতা ছিল, মজুরি কোড তার অবসান ঘটাল। আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের আন্তর্জাতিক সনদকে এই নতুন কোড অমান্য করেছে। অতিরিক্ত কাজ করলে ওভারটাইম মজুরি পাওয়ার যে নিয়ম ছিল, এই কোড তাও ছিনিয়ে নিয়েছে।
শিল্প সম্পর্ক কোড শ্রমিকদের আগাম নোটিশ ছাড়াই ছাঁটাই করার, সেই পদক্ষেপের পেছনে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজনকে খারিজ করেছে। নিয়োগ কর, ছাঁটাই কর — এই জমানাকেই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে শিল্প গণতন্ত্রকেই কণ্ঠরুদ্ধ করল। ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট চালু করে ভারতের শ্রমিকশ্রেণির জন্য স্থায়ী চরিত্র সম্পন্ন কাজগুলি লোপাট হওয়ার রাস্তা পরিষ্কার করল। ইউনিয়ন গঠন করা, শ্রমিকদের অধিকার ও স্বার্থে নিয়োগকর্তার সাথে দরকষাকষি করার এযাবত সুযোগ ও অধিকারগুলো খুবই দুর্বল করল এই কোড। শ্রমিকদের অধিকার হরণ হলে সেই বিরোধ মীমাংসার পদ্ধতি খুবই দুর্বল করেছে এই কোড। এই কোড শ্রম আদালতগুলোকে তুলে দিয়েছে, শ্রম ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে উল্টে দেওয়ার প্রভূত ক্ষমতা সরকারের হাতে দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে শ্রমিকদের যেটুকু সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ রয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা কোড তার উপর বড় ধরনের হামলা নামিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ এখন যে সমস্ত সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ সুবিধা রয়েছে, যেমন — পিএফ, ইএসআই, গ্রাচ্যুইটি, পেনশন, মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধা বা অন্যান্য তা এবার থেকে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তির উপরই নির্ভরশীল হবে। সামাজিক সুরক্ষার ব্যয় এবার থেকে শ্রমিকদেরই বহন করতে হবে। নিয়োগকর্তাকে এই দায় থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের পরিবেশগত কোড হল এমনই এক বিধান যা সম্ভবত পেশাগত নিরাপত্তার সমস্ত বিদ্যমান ধারা উপধারাকে দারুণভাবে শিথিল করেছে। এই কোড শুধুমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সংজ্ঞাকেই শিথিল করেনি, বরং প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমশক্তিকে এর আওতার বাইরে রেখেছে। কর্মরত শ্রমিকদের যথাযথ কাজের পরিবেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আর কোন বাধ্যতা থাকল না নতুন এই কোডের, ক্রেশ’এর বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাও এই কোড রাখল না।
মূল কথা হল, এই চারটে কোড লাগু হলে নিয়োগকর্তা ও কর্পোরেট ঘরানাগুলো ন্যায্য মজুরি দেওয়ার প্রশ্নে আর বাধ্য থাকবে না, সামাজিক সুরক্ষা বা শোভন কাজের পরিবেশ বজায় রাখার দায় থেকেও মুক্ত হবে।
মাসিক ৩৫,০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি সুনিশ্চিত কর
পাঁচ বছর অন্তর ন্যূনতম মজুরি সংশোধন করার যে কেন্দ্রীয় আইন রয়েছে, খোদ সরকারই তা অমান্য করেছে। বর্তমানে ভারতের শ্রমিক শ্রেণির জীবনযাত্রার মানকে মাথায় রেখে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি যেভাবে হচ্ছে তাতে মাসিক ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত ৩৫,০০০ টাকা। স্কিম, প্ল্যাটফর্ম, গৃহ সহায়িকা, সমস্ত ধরনের ইনফর্মাল শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনা দরকার।
পুরোনো পেনশন স্কিম ফিরিয়ে আনো
অবসরের ঠিক আগে শেষ প্রাপ্য বেতনের ৫০ শতাংশ অবসরকালীন পেনশন হিসাবে প্রদানের যে স্কিম ছিল, ২০০৪ সালে বিজেপি সরকার তা প্রত্যাহার করে। নয়া পেনশন প্রকল্পে অবসরগ্রহণের পর নিশ্চিত অঙ্কের পেনশন পাওয়ার সুযোগ নেই। নয়া পেনশন প্রকল্প অবসরকালীন সময়ে পেনশনকে বাজারের অনিশ্চয়তার উপর ছেড়ে দিয়েছে, পেনশনের টাকাও নাম কা ওয়াস্তে। শ্রমিকদের ভবিষ্যত জীবন মর্যাদাপূর্ণ ও সুরক্ষিত করার অধিকারই সরকারের বুনিয়াদি নীতি হওয়া উচিত। সমস্ত বেতনভুক কর্মীদের ক্ষেত্রে পুরোনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যান্য সমস্ত শ্রমিকদের জন্য, এমনকি যারা ইপিএস-৯৫’র আওতায় রয়েছেন, তাঁদের সকলের ক্ষেত্রে মাসিক পেনশন ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা করতে হবে, যা যুক্ত করতে হবে মহার্ঘ ভাতার সঙ্গে।
সমস্ত শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য বিমা এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড সুনিশ্চিত করতে হবে
অসংগঠিত ও ইনফর্মাল ক্ষেত্রে শ্রমিক সহ সমস্ত শ্রমিকদের ইএসআই’এর মতো সরকারি স্বাস্থ্য বিমার আওতায় নিয়ে আসা সুনিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে, অসংগঠিত ও ইনফর্মাল শ্রমিক সহ সমস্ত শ্রমিকদের পিএফ ও অবসরকালীন সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।
মর্যাদাপূর্ণ কাজ হল মৌলিক অধিকার
দেশের কর্মরত সমস্ত ভারতীয় নাগরিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি, শোভন ও সুরক্ষিত কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক সুরক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। শহর কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প প্রবর্তন করতে হবে, মনরেগার কাজকে বছরে ২০০ দিন ও দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে। দেশে আতঙ্কজনক বেকারত্বের পরিস্থিতিতে সরকার কখনই চোখ কান বন্ধ রাখতে পারে না।
উচ্ছেদ বন্ধ কর, বাসস্থানের অধিকারকে স্বীকৃতি দাও
সকলের জন্য বাসযোগ্য আবাস নিশ্চিত করতে হবে। সংলগ্ন এলাকায় যথাযথ পুনর্বাসন না দিয়ে ঘর বাড়ি ভেঙে দেওয়াটা নতুন সরকারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি কর্মীদের উপযুক্ত থাকার ব্যবস্থা বা আবাসনের বন্দোবস্ত করতে হবে।
জাতীয় মনিটাইজেশন পাইপলাইন নীতি প্রত্যাহার কর, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি বন্ধ কর
গত ১০ বছর ধরে মোদী সরকার দেশের পরিকাঠামো ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে নির্বিচারে বিক্রি করার অভিযানে নেমেছে, কয়েক দশক ধরে যার উপর দাঁড়িয়ে আমরা এক স্বাধীন আত্মনির্ভর দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করি। এই সমস্ত কিছুই বেচে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাছে। রেল, প্রতিরক্ষা, রাস্তা, বিদ্যুৎ ক্ষেত্র গোটা মনিটাইজেশন প্রকল্পের ৬৬ শতাংশ। এটা সকলেরই জানা আছে যে এই ক্ষেত্রগুলোতেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়। অন্যান্য আর যে সমস্ত ক্ষেত্রগুলো বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তা হল, টেলিকম, বিমানবন্দর, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম পণ্য, স্টেডিয়াম প্রভৃতি। কর্মসংস্থানের এই ক্ষেত্রগুলো বিক্রি করে মোদী সরকার যে কর্পোরেটদের হাতেই মুনাফা লোটার ব্যবস্থা করছে তাই নয়, দেশের যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের এই ক্ষেত্রগুলোর দরজাও চিরদিনের মতো বন্ধ করে দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি রেল সহ অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্রে শূন্যস্থান পূরণের জন্য যুবসমাজের ব্যাপক আন্দোলন।
জাতীয় মনিটাইজেশন পাইপলাইনের হাত ধরে কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর নির্বিচার বিলগ্নীকরণ করছে। এই যথেচ্ছ বিলগ্নীকরণ পদক্ষেপ দেশের যুবকদের মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের সমস্ত সুযোগই কেড়ে নিচ্ছে। বর্তমান জমানার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র আদানিকে দেশের কয়লা উৎপাদনের অনুমতি দিয়ে এতদিন যে সমস্ত বিধিনিষেধ ছিল, তা শিথিল করা হল।
জাতীয় মনিটাইজেশন পাইপলাইন, বিলগ্নীকরণের নীতি থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। প্রতিরক্ষা সহ সমস্ত ক্ষেত্রে এফডিআই’এর অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। দেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন শিল্প ও পরিকাঠামোগত সম্পদ সরকারকেই পরিচালনা করতে হবে। দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি, মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের দায়িত্ব মুনাফাখোর কর্পোরেটদের হাতে না পাচার করে সরকারকেই প্রধান ভূমিকায় আসতে হবে।
স্কিম কর্মী, গৃহ সহায়িকা, প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি
আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা দিতে হবে
প্রাথমিক শিক্ষা-স্বাস্থ্য-শিশুপরিচর্যা এবং পুষ্টির জন্য সরকারের প্রধান প্রধান স্কিমগুলো সচল রেখেছেন এক কোটির উপর স্কিম কর্মী। দেশব্যাপী বিরাট পরিধি জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার এই বিপুল সংখ্যক স্কিম কর্মীদের ‘শ্রমিক’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। তাঁদের নেই কোনো আইনি অধিকার। একইভাবে গৃহসহায়িকা, প্ল্যাটফর্ম কর্মীদেরও নেই কোনো আইনি অধিকার। এই সমস্ত শ্রমিকরা নয়া সামাজিক সুরক্ষা কোডের আওতায় থাকবেন বলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রচার করলেও বাস্তবে এদের মধ্যে নিয়োগকর্তা-কর্মী সম্পর্কটাকেই অস্বীকার করা হয়, ন্যূনতম মজুরি-স্বাস্থ্য বিমা-সামাজিক সুরক্ষার মতো বুনিয়াদি অধিকারগুলোকেই সরকার দিতে প্রস্তুত নয়। স্কিম কর্মীদের সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে, সরকারি কর্মচারীদের সমহারে তাঁদের মজুরি, অন্যান্য সুবিধা দিতে হবে। গৃহসহায়িকা ও প্ল্যাটফর্ম কর্মীদেরও ন্যূনতম মজুরি, ইএসআই, পিএফ, পেনশন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।
সমস্ত সরকারি শূন্যপদ পূরণ কর, কন্ট্রাক্ট প্রথা বাতিল কর
সাম্প্রতিক রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে ৩০ লক্ষ সরকারি শূন্যপদ রয়েছে। বিগত দশ বছরে মোদী সরকার পরিকল্পিতভাবে নানাবিধ প্রক্রিয়ায় কর্মসংস্থানের উপর কোপ চালিয়েছে, বিভিন্ন সরকারি পদ অবলুপ্ত করেছে, বিলম্বিত করেছে শূন্য সরকারি পদ পূরণে। আকছার দুর্নীতি, নিয়োগ পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস এই জমানায় সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত সেনাবাহিনীতেও অগ্নিপথের মতো প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট হল আরেকটা রাস্তা যার মাধ্যমে নিরাপত্তাহীন কাজ তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে নিয়োগ কর-ছাঁটাই কর হল একমাত্র দস্তুর।
সমস্ত সরকারি শূন্যপদ ভর্তি করতে হবে, ঠিকা প্রথায় নিযুক্ত সমস্ত ঠিকা কর্মীদের নিয়মিত করতে হবে। যে কোনো শিল্পে স্থায়ী ও অনিয়মিত শ্রমিকদের অনুপাত নির্দিষ্ট করতে হবে।
ভারতের শ্রমিকদের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোতে রপ্তানী করা হচ্ছে কেন?
বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের শ্রমিকদের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ, যেমন ইজরায়েলে রপ্তানি করা হচ্ছে কর্মসংস্থানের অজুহাতে। আর এই মর্মে উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
মোদী সরকারের এই পদক্ষেপকে দেশের শ্রমিকশ্রেণিকে তীব্রভাবে বিরোধিতা করতে হবে।
ইউএপিএ বাতিল কর — শ্রমিকদের অপরাধী হিসাবে দাগানো বন্ধ কর
সমস্ত ধরনের গণতান্ত্রিক স্বরকে মোদী সরকার নির্মমভাবে কণ্ঠরুদ্ধ করছে। নয়া শ্রমকোড ইউএপিএ’র মতো দমনমূলক ফৌজদারী আইনকে শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। গাড়ির চালকদের সাত বছর জেলে পোরার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিরোধ ও ধর্মঘটের মুখে মোদী সরকার পিছু হটে ও সেই দানবীয় ধারাটি স্থগিত রাখে। এখন এটা জানা নেই যে নির্বাচনের মুখেই যা করা হল তা আবার পরে ফিরে আসবে কিনা। মুম্বাইয়ে রিল্যায়েন্স বিদ্যুৎ সংস্থায় কিছু শ্রমিককে ইউএপিএ ধারায় জেলে আটক করা হয়। এটা নিশ্চিত আগামী দিনে ওই সমস্ত নতুন ফৌজদারী আইন শ্রমিকদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হবে।
ইউএপিএ সহ সমস্ত দানবীয় ফৌজদারী আইনগুলোকে প্রত্যাহার করতে হবে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজ ও ঘৃণা সৃষ্টিকারীদের কঠোর সাজা দিতে হবে
গত দশ বছরে আমরা দেখেছি মুসলিমদের নিশানা করে কিভাবে ঘৃণা ভাষণ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। বহু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও মূক বধির হয়ে থাকে এমনকি দাঙ্গাবাজ ও ঘৃণা সৃষ্টিকারীদের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র নিজেই ঘৃণা ছড়ানোর রাজনীতি করছে। যে সরকারটি শ্রমিকশ্রেণির বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারগুলোকে লাগাতারভাবে ছিনিয়ে নিচ্ছে, সেই সরকারই শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে ধর্ম, জাতপাত, খাদ্যাভাস, ধর্মীয় উৎসবকে কাজে লাগাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের রক্ষা করা থেকে সরকারকে নিবৃত্ত থাকতে হবে, যারা ঘৃণা ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
২০২৪’র লোকসভা নির্বাচন হয়ে উঠুক শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক সুযোগ, জনগণের শত্রুদের কাছ থেকে জবাবদিহি চাওয়ার এক মাধ্যম।
গণতন্ত্র বাঁচাও
সংবিধান বাঁচাও
শ্রমিক বাঁচাও
মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে হারাও
২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনে বাম গণতান্ত্রিক কণ্ঠকে শক্তিশালী কর
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয় — ২২ এপ্রিল ২০২৪ মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এক বিপর্যয়কারী রায় ঘোষণা করেছেন। এই রায়ের সূত্রে চাকরি হারাবেন ২০১৬’র এসএসসি প্যানেলভূক্ত ২৩,৭৫৩ জন কর্মরত শিক্ষক, গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি শিক্ষাকর্মী। সবমিলিয়ে প্রায় ২৫,০০০ শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্ত মানুষ। বাংলায় চলমান লোকসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বের সমাপ্তির অব্যবহিত পরে এই রায়দান কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নচিহ্নের জন্ম দিয়েছে। তার প্রধানতম কারণ গতকাল রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতার পদে থাকা রাজনীতিকের এহেন কোনো রাজনৈতিক ‘বোমা ফাটানোর’
সদম্ভ ভবিষ্যতবাণী।
রাজ্যে ক্ষমতাসীন দুর্নীতিপরায়ণ তৃণমূল সরকারের অপদার্থতা নিঃসন্দেহে এই নিয়োগ দুর্নীতির কান্ডারি। কিন্তু রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি নিরসন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উচ্চ আদালতের এই রায়ের নেপথ্যে সিবিআইয়ের প্রলম্বিত, অথচ অসম্পূর্ণ তদন্ত প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার আগেই এমন একটি ভয়ঙ্কর শাস্তিমূলক নিদান দোষী ও নির্দোষ বাছবিচার ব্যতিরেকেই দন্ডাদেশে পর্যাবসিত হয়েছে। বস্তুত এই রায় যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের আত্মহননের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আমরা আশঙ্কিত।
ন্যায়বিচারের স্বার্থে ও যোগ্য শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের চাকরি সুরক্ষার লক্ষ্যে আমরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে এই রায়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাই এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে অপরাধীদের শাস্তি এবং নিরপরাধ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরির নিরাপত্তার দাবি জানাই।
২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশন আয়োজিত নিয়োগ পরীক্ষায় মারাত্মক রকমের দুর্নীতি হয়েছিল। সেই সংক্রান্ত মামলাগুলির বিচার প্রসঙ্গে ২২ এপ্রিল ২০২৪ হাইকোর্টের ডিভিশান বেঞ্চ যে রায় দিয়েছে, তা বাংলার সমাজ রাজনীতিতে প্রবল আলোড়ন ফেলেছে। এই রায়ে অন্তত তিনটি বড়সড় ঘোষণা আছে।
রায়ের যে দিকটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন ফেলেছে তা হল কলমের এক খোঁচায় প্রায় পঁচিশ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল করে দেওয়া ও এরফলে তাঁদের জীবন জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়া। নিয়োগ সংক্রান্ত পুরো প্যানেলটিই বাতিল করে দেওয়া হয়েছে ও নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে বলা হয়েছে।
রায়ের এই দিকটি আমাদের কাছে তীব্র আপত্তিকর, অমানবিক ও বাতিলযোগ্য বলে মনে হয়েছে। আমাদের সংবিধান সহ পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশের আধুনিক আইনবিধি স্পষ্টভাবে বলেছে যে, কোনও পরিস্থিতিতেই কোনও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পান, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অথচ এই রায়ে মানবাধিকারের সেই মৌলিক দিকটি লঙ্ঘিত হল। যারা অপরাধী নন, যারা দুর্নীতি করেছেন বলে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যোগ্যতার সঙ্গে যারা বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুলে পাঠদানের দায়িত্বভার সামলে আসছেন, তেমন হাজার হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীকে এই রায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করার এক ভয়াবহ নিদান দিল। আমরা চাই উচ্চতর আদালত নির্দোষ শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মীদের কাজে পুনর্বহালের ঘোষণা করুন। তাঁদের জীবন, জীবিকা ও সম্মান ফিরে আসুক। আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে এই সমস্ত মানুষদের আন্দোলনের পাশে থাকার অঙ্গীকার করছি।
এই রায়ে এছাড়াও বলা হয়েছে যাদের দুর্নীতির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদের শুধু যে চাকরি যাবে তাই নয়, চাকরিকালীন পাওয়া যাবতীয় বেতনের টাকা সুদসহ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরৎ দিতে হবে। না দিলে জেলাশাসক ব্যবস্থা নেবেন। এই দুর্নীতির প্রমাণের মধ্যে আছে সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পাওয়া, প্যানেলে নাম না থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাওয়া ইত্যাদি। রায়ের এই অংশটি নিয়ে যে প্রশ্নটি দানা বেঁধেছে সেটি শ্রমের মূল্য সংক্রান্ত। যারা এত বছর শ্রম দিলেন, সেই শ্রমের মূল্য হিসেবে যে বেতন পেলেন, তা দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন চালালেন অন্য কোনও জীবিকায় যুক্ত না হয়ে, সেই শ্রমের মূল্যে পাওয়া বেতন কেন তাঁদের ফেরৎ দিতে হবে।
এছাড়াও এই রায়ে বলা হয়েছে দুর্নীতির স্পষ্ট প্রমাণ সামনে আসার পরেও বিদ্যমান সার্ভিস রুল অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্তদের চাকরি বাতিল করে শূন্যপদ তৈরি করা হয়নি। তার পরিবর্তে প্যানেলভুক্ত চাকরি না পাওয়া বঞ্চিত ও আন্দোলনরতদের চাকরি দিতে সুপার নিউমেরিক পোস্ট সৃষ্টি করা হয়েছে। এটিকে আদালত দুর্নীতিকে মদত দেওয়া বলে মনে করেছে ও যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের আইনসভায় সুপার নিউমেরিক পোস্ট বানিয়েছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে সিবিআই’কে তদন্ত শুরু করতে বলেছে। তদন্তের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের হেফাজতে নেবার কথাও বলা হয়েছে।
এই রায় লোকসভা নির্বাচনের যে উত্তুঙ্গ সময়ে প্রকাশিত হল তা নানা প্রশ্ন তৈরি করছে। যে সময়ে দেশের নানা প্রান্তে বিরোধী নেতাদের হরেক মিথ্যা মামলা ও অভিযোগে গ্রেপ্তার ও হেনস্থা করে চলেছে ইডি, সিবিআই সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি, সেই সময়েই এসেছে এই রায়। এই রায় প্রকাশের ঠিক আগে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা যখন রাজনৈতিক বোমা ফাটার পূর্বাভাস করেন, তখন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এই সংক্রান্ত মামলার পূর্বতন বিচারক বিচারকাজ ছেড়ে এখন বিজেপির লোকসভার প্রার্থী হয়েছেন, এই তথ্য স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান রায়টি নিয়েও নানা জল্পনাকে উসকে দিচ্ছে।
তবে আদালতের রায় ও তা প্রকাশের সময় নিয়ে যে সব প্রশ্ন বা আপত্তিই থাকুক না কেন, নিয়োগে যে মারাত্মক রকম দুর্নীতি হয়েছে এবং তাতে রাজ্য সরকার, এসএসসি, পর্ষদ, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীদের যে প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে, সেই সম্পর্কে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে সব অসঙ্গতি ও দুর্নীতির কথা এসেছে তা এরকম,
১) নাইসা নামক সংস্থাকে OMR স্ক্যানের বরাত দেওয়া।
২) নাইসার তরফে অন্য একটি সংস্থাকে আবার কিছু কাজ আউটসোর্স করে দেওয়া।
৩) OMR’র অরিজিনাল কপি ধ্বংস করে দেওয়া।
৪) স্ক্যান করা OMR সংক্রান্ত তথ্য SSC’র ডেটাবেস থেকে সরিয়ে দেওয়া।
৫) প্যানেলে নাম না থাকা ব্যক্তিদের প্রচুর পরিমাণে নিয়োগ করা।
৬) সাদা খাতা জমা দেওয়াদের প্রচুর পরিমাণে প্যানেলে অন্তর্ভুক্তি।
৭) প্যানেলের মেয়াদ শেষ হবার পরেও অনেককে চাকরি দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
যারা এই দুর্নীতির মূল কাণ্ডারী উচ্চ আদালতে যোগ্য প্রার্থীদের সসম্মান পুনর্বহালের পাশাপাশি তাদেরও যথাযোগ্য শাস্তি হওয়া দরকার।
বে-আব্রু হয়ে যাওয়া রাজ্য সরকারের উচিত দুর্নীতির বিষয়গুলি আর আড়াল করার চেষ্টা না করে যা যা দুর্নীতি হয়েছে তা খোলাখুলি স্বীকার করে নেওয়া। কারা দুর্নীতি করেছেন ও কারা স্বচ্ছভাবে চাকরি পেয়েছেন তা সরকার ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের তরফে এখনই স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার। দুর্নীতিগ্রস্তদের বাঁচানোর চেষ্টা না করে স্বচ্ছভাবে চাকরি প্রাপ্তদের পাশে দাঁড়ানোটাই এখন মূল কাজ। যোগ্যদের চাকরির যাতে কোনওরকম ক্ষতি না হয় তা নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব সরকার, তদন্তকারী সংস্থা ও আদালতকে নিতে হবে।
- সৌভিক ঘোষাল
নবম-দশম দুর্নীতির অভিযোগ ৮.৫ শতাংশ এবং একাদশ-দ্বাদশ ১৪.১৪ শতাংশ! অথচ কোর্টের পর্যবেক্ষণ — এত পরিমাণ বেআইনি নিয়োগ হয়েছে যে, কে ‘আসল’ আর কে ‘বেআইনি’ নিয়োগ পেয়েছে তা পৃথক করা দুঃসাধ্য। অর্থাৎ, বেআইনিভাবে ঠিক কতজন বা কে কে চাকরি পেয়েছে সেটা কোর্টের কাছে পরিষ্কার নয়। অতএব প্যানেল পুরোপুরি ক্যান্সেল। এ তো এক অদ্ভুত ব্যাপার! ঠগ বাছতে গাঁ উজার! কোর্টের পর্যবেক্ষণেই পরিষ্কার ‘আসল’ নিয়োগ হয়েছে। ‘আসল’দের চাকরি কোর্ট এভাবে বাতিল করতে পারে? ‘আসল’ চাকরি প্রাপক ও তাদের পরিবারকে আগামী দিনগুলোতে যে দুর্বিষহ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তার দায় কে নেবে? ভারতীয় আইন ব্যবস্থার মূল স্পিরিট দোষী ছাড়া পেলেও কোনভাবেই যেন একজনও নির্দোষ সাজা না পায়। এই রায়ে সেই স্পিরিট কি রক্ষিত হল?
প্রশিক্ষিত সিবিআই, ইডি যে দুর্নীতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ, ডিএম’রা কিভাবে সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের খুঁজে বার করে সুদ সমেত মাইনে ফেরতের ব্যবস্থা করবেন? বা যে পদ্ধতিতে চার সপ্তাহের মধ্যে খুঁজে বার করবেন প্যানেল ক্যান্সেল না করে সেই পদ্ধতি অবলম্বন করলে কী ক্ষতি হতো? এই প্যানেল ক্যান্সেল পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর কি কোন বিরূপ প্রভাব ফেলবে নাতো? চার সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ লক্ষ টাকা ফেরত দেবে কিভাবে? এটা সম্ভব কি? নাকি তারা আত্মহত্যা করবে?
সমস্ত দায় ওই বেকার যুবকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া, কী ধরনের বিচার?
হ্যাঁ, দুর্নীতি একটা তো নিশ্চয়ই হয়েছে। এবং এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরী লড়াইয়ের শরীক তো আমরাই। কিন্তু দুর্নীতির কারণে যারা বঞ্চিত হয়ে দীর্ঘদিন অমানুষিক কষ্ট সহ্য করলেন তাদের নিয়োগের কী হল? তারা কেন আজও ন্যায়বিচার পেল না? কেন তাদের এবং প্যানেল ক্যান্সেল হওয়া প্যানেলের যোগ্য ছেলেমেয়েদের চাকরির নিশ্চয়তার জন্য আরো পাঁচ/দশ বা সুপ্রিম কোর্টে এই নিয়োগ মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সমস্যার সমাধান তো আগেই হয়ে যেতে পারত যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকত, আইন ব্যবসায়ীরা প্রকৃত দায়িত্ব পালন করতেন বা বিচারকরা যদি বিচারের আসনে বসে রাজনীতি না করতেন।
বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীসহ প্যানেল ভুক্ত যোগ্য শিক্ষকরা আজ বিচার ব্যবস্থা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নোংরা গোপন বোঝাপড়া এবং সরকারি দলের সাথে তাদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের শিকার এবং এই দ্বন্দ্বের ফলে একদল যোগ্য প্রার্থী ২০১৯ সাল থেকে বঞ্চিত। প্যানেল ক্যান্সেলের পর তাদের সাথে যুক্ত হল আরো এক দল যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা মন্ডলী। আপনারা কী ভাবতে পারছেন যদি এই ১৭/১৮ হাজার শিক্ষককে একলপ্তে বসিয়ে দেওয়া হয়, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার কী হাল হবে! গরিব বাড়ির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কী হবে? প্রথম দফার নির্বাচনের পর এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয় তো?
যা হচ্ছে তা অন্যায়, প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কেবলমাত্র নোংরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচারববস্থাকে পিছন থেকে পরিচালনা করার এই ট্রেন্ডের বিরুদ্ধে আমাদের এক জোট হতেই হবে। শুভেন্দু অধিকারীরা রায় ঘোষণার আগেই কিভাবে জেনে যায়? মনে প্রশ্ন জাগে না? প্রাক্তন তৃণমূলী শুভেন্দু কি সরকারি নিয়োগে দুর্নীতির সাথে যুক্ত নয়? যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তাদের সাজা হোক কিন্তু কারো কারো নোংরা রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যোগ্য ছেলেমেয়েদের এভাবে যন্ত্রণাময় অন্ধকার জীবনে নিক্ষেপ করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের সহযোদ্ধা হিসাবে দুর্নীতির কারণে যারা বঞ্চিত এবং প্যানেল ক্যান্সেল হওয়ার জন্য প্যানেলভুক্ত যোগ্য, যারা আবার নতুন করে বঞ্চিত হলেন তাদের সকলের লড়াইয়ের পাশে বিগত দিনে যেমন ছিলাম আগামীতেও থাকবো। বর্ধমান পূর্ব কেন্দ্র সহ পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের প্রতি আমার আহ্বান এধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক জোট হোন, অন্যায়ের শিকার এই যুবক-যুবতীদের পাশে দাঁড়ান। সংগ্রামী অভিনন্দন সহ।
- সজল কুমার দে
(বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের সহযোদ্ধা এবং বর্ধমান পূর্ব (তপঃ) লোকসভা কেন্দ্রের
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন মনোনীত প্রার্থী)
প্রিয় কমরেড,
একটি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আমরা বিজ্ঞান নিষ্ঠ শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করব এটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত। তবুও আমাদের ভাবনাচিন্তায় উপযুক্ত সচেতনতার অভাবে আমরা প্রায়শই আমাদের লেখায় ভুল শব্দ ও ধারণার প্রকাশ ঘটিয়ে বসি। যেমন, আমাদের কোনো সহযোদ্ধা মারা গেলে আমরা আমাদের লেখায় “তিনি মারা গেছেন” বা “শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন”, “তাঁর জীবনের অবসান ঘটেছে” বলতে কেমন একটা সংকোচ অনুভব করি। তার পরিবর্তে আমরা অনেকেই একটি সংস্কৃত শব্দ “প্রয়াত” অর্থাৎ “প্রকৃষ্টলোকে (?) গত” ব্যবহার করে থাকি। পত্রিকার ১১ এপ্রিল ২০২৪ সংখ্যায় আমরা “কমরেড ফুলমণি মন্ডি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরতরে না ফেরার দেশে” বা “আজীবন (?) সদস্য কমরেড...”, “আমৃত্যু (?) কমিউনিস্ট...” শব্দরাজির ব্যবহার দেখতে পেয়েছি, যার প্রত্যেকটি ভাববাদ আশ্রিত। এছাড়া, আমাদের কোনো কমরেড মারা গেলে তাঁকে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবার সময় আমরা অনেক সময়েই “কমরেড ... অমর রহে, অমর রহে” শ্লোগানে দিক কাঁপিয়ে পথ চলি, যে ‘অমরতা’ একটি ভাববাদী ধারণার ফলপরিণতি। সারা দুনিয়ার কমিউনিস্টরা বলে long live বা জিন্দাবাদ। জিন্দাবাদ শব্দের অর্থ ‘দীর্ঘজীবী হোক’, ‘অমর হোক’ নয়। আমরা এসময় অনায়াসে বলতে পারি “কমরেড ... এর সংগ্রামী জীবনের স্মৃতি দীর্ঘজীবী হোক”, “অমর হোক” নয়।
আমার ধারণায় কোনো ভুল থাকলে সে ভুল ধরিয়ে দিয়ে সহযোদ্ধা সুলভ সহযোগিতা করবেন।
- সৃজন সেন
বিজেপি হারাও, দেশ বাঁচাও স্লোগান’কে সামনে রেখে মহান লেনিনের ১৫৫তম জন্মদিবস এবং সিপিআই(এমএল) পার্টির ৫৫তম প্রতিষ্ঠা দিবসে অনুষ্ঠিত হল রায়গঞ্জ শহর লোকাল কমিটি ও রায়গঞ্জ উত্তর লোকাল কমিটির সম্মেলন। কমরেড কলসরিয়া রায় ও কমরেড চিত্তরঞ্জন মন্ডল মঞ্চ এবং কমরেড ভবেশ চন্দ্র বর্মন নগর (সাংবাদিক ভবন, সুপার মার্কেট, রায়গঞ্জ)। সম্মেলনের প্রারম্ভে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন জেলা সম্পাদক ব্রজেন সরকার। এরপর শহীদ বেদীতে মাল্যদাল করেন শহর লোকাল সম্পাদক রাধাগোবিন্দ পাল। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা জানানোর পর কমরেড লেনিনের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির বার্তা পাঠ করে শোনান গণেশ সরকার। ঐ বার্তা পাঠ আশেপাশের দোকানদার বন্ধুরাও মনযোগ দিয়ে শোনেন। এরপর সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন চন্ডিতলা শাখার মহিলা নেত্রী সুমিত্রা বিশ্বাসের পুত্র অঞ্জন বিশ্বাস। বর্ষীয়ান কমরেড মানব ভৌমিকের সভাপতিত্বে শহীদদের প্রতি এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়েই সভার কাজ শুরু হয়।
প্রথমে সভাপতির উদ্বোধনী ভাষণ, তরপর জেলা সম্পাদক, মহিলা নেত্রী সুশীলা রায় বক্তব্য রাখার পর সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী সম্পাদক রাধাগোবিন্দ পাল। হিসাব পেশ করেন গণেশ সরকার। বিস্তারিত আলোচনার পর প্রতিবেদন ও হিসাব সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়। এরপর গণেশ সরকার আগামী কর্মসূচির খসড়া প্রস্তাব রাখেন। হাত তুলে সবাই সেই প্রস্তাবে সমর্থন দেন। এছাড়া দুটো লোকাল’কে একত্রিত করে একটি এরিয়া কমিটি এবং ১৫ জন সদস্যের নাম প্রস্তাব করলে সভায় তা গৃহীত হয়। গণেশ সরকার রায়গঞ্জ এরিয়া কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যনেতা তসলিম আলি। সভাপতির সমাপ্তি ভাষণের মধ্য দিয়ে সভার কাজ শেষ হলে ‘আন্তর্জাতিক সঙ্গীত’ ও স্লোগান দিয়ে সভা শেষ হয়।
দেশের পরিবারভিত্তিক ঋণ ২০২৩’র ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ শিখর ছুয়েছে — যা জিডিপি’র ৪০ শতাংশ, বিপরীতে নিট পরিবারভিত্তিক আর্থিক সঞ্চয় সর্বনিম্নে ঠেকেছে, যা জিডিপির মাত্র ৫ শতাংশ। দেশজুড়ে চলতে থাকা নাছোড় আর্থিক দুর্দশার এই ছবি আবার উঠে এল প্রথম সারির এক ফাইনান্সিয়াল সংস্থা মোতিলাল অসওয়ালের তৈরি করা এক সমীক্ষায়।
২০২৩’র সেপ্টেম্বর মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানায়, ২০২২-২৩-এ দেশে পরিবারভিত্তিক নিট আর্থিক সঞ্চয় জিডিপি’র ৫.১ শতাংশে মুখ থুবড়ে পড়েছে, যা গত ৪৭ বছরে সবচেয়ে কম! এই পরিসংখ্যান প্রকাশিত হওয়ার পর রে রে করে তেড়ে এলো কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক। তারা দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কের এই রিপোর্টকে ফুৎকারে উড়িয়ে গান গাইতে লাগল যে এই তথ্য আর্থিক দুর্দশার ছবি নয়। অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, গৃহস্থলিগুলো অর্থ সঞ্চয়ের বদলে অন্যান্য স্থাবর সম্পদের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। আবাসন, গাড়ি প্রভৃতি কেনাকাটার প্রবণতা বেশি বেড়েছে, যা অতীতে দেখা যেত না। ফলে, এটা আর্থিক দুর্দশার ছবি নয়। বরং, আগামী দিনগুলোতে তাঁদের আর্থিক সমৃদ্ধি ও পেশায় সুস্থায়িত্বরই ইঙ্গিতবাহী।
এই ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ২০২২-২৩’র প্রথম সংশোধিত জাতীয় আয় গৃহস্থালিগুলোর আনুমানিক নিট আর্থিক সঞ্চয় হিসাবে চিহ্নিত করে জিডিপি’র ৫.৩ শতাংশ, যা গত ৪৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন! ২০১১-১২ থেকে ২০১৯-২০’র মধ্যে নথিভুক্ত ৭.৬ শতাংশ গড় জিডিপি’র সাপেক্ষে খুবই দুর্বল। ২০২২-২৩এ সংশোধিত গৃহস্থলীর সঞ্চয় জিডিপি’র সাপেক্ষে ৩৮ শতাংশ দেখিয়েছে যা ২০২০-২১এ অতিমারি বিধ্বস্ত বছরে ছিল জিডিপি’র ৩৯.১ শতাংশ, যা অতিমারির পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক আম জনতার এই ক্রমবর্ধমান আর্থিক দুর্দশা কিছুতেই স্বীকার করবে না, যদিও সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই সমস্ত পরিসংখ্যান দিয়ে চলেছে বেশ কয়েকমাস ধরে।
পার্বতী দেবী চটকলের এক ঠিকা শ্রমিক। সত্তরের দশকের শেষে হাওড়ার বেঙ্গল জুট মিলে ঢোকেন। শ্রীপুরের মিলেও কাজ করেছেন। তীব্র অভাবের সংসারে নিরুপায় হয়েই কাজে ঢোকা। ঠিকা শ্রমিক হিসেবে একেবারে শূন্য হাতে অবসর নেওয়ার পর এখন বাড়ির কাছের জুটমিলে ঢুকেছেন। সেই ঠিকা শ্রমিক হিসেবেই। ছ’বছর ধরে কাজ করছেন ফিনিশিং ডিপার্টমেন্টে। প্রায় সাড়ে চার দশক আগে কাজের শুরুতে, পঁচিশ বস্তার বান্ডিল বাঁধার কাজে বান্ডিল পিছু আট আনা পেতেন। বললেন, এখন অনেকটা ভালো পাই। কত? বান্ডিল পিছু ৩ টাকা! ইএসআই, পিএফ, গ্র্যাচুইটি — সারাজীবন এসব কিছুই পাননি। পাওয়ার কথা হয়তো ভাবেনওনি।
এখন ওনার ডিপার্টমেন্টে উনি একাই মহিলা। বেশ কয়েক জন পুরুষ আছেন। তারা ঠিকা নন, কোম্পানির শ্রমিক। তারা আট ঘণ্টায় ১৪৫ বান্ডিল দিলে যা পান তা পার্বতীর থেকে অনেকটাই বেশি। এছাড়াও অন্য প্রাপ্যগুলো আছে। কিন্তু এই ডিপার্টমেন্টে কোম্পানির মহিলা শ্রমিক নেই কেন? বললেন, মহিলাদের তো কোম্পানি অনেকদিন আগে থেকেই ছাঁটাই শুরু করেছে। প্রথম যে মিলে ঢুকেছিলাম, সেখানে কোম্পানির অনেক মেয়ে লেবার ছিল। কিন্তু কিছুদিন বাদে তাদের ছাঁটাই করে দিল। মেয়েরা আছে, কিন্তু বেশিরভাগ ফুরোনে। কেন এটা হচ্ছে? মেয়েদের দিয়ে অনেক কম পয়সায় কাজ করানো যায়, তাই ফুরোনে হিসেবেই রাখা হয়। (তার জলজ্যান্ত প্রমাণ অবশ্য উনি নিজেই, ৪৫ বছর কাজের পরও ‘ঠিকা শ্রমিক’)
সম্ভবত আশির দশকের মাঝামঝি এই ছাঁটাই শুরু হয়েছে। নয়া উদারীকরণের হাওয়ায় তা আরও তেজী হয়েছে। এই ছাঁটাইয়ের কতটা বিরোধিতা হয়েছিল? চটকলের এই মহিলা শ্রমিকরা ‘মহিলা’ বলেই কি ব্রাত্য ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন পরিসরে? কন্ট্রাক্টরের অধীনে থাকা যে মহিলারা বছরের পর বছর শোষিত, বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের কথাও শ্রমিক আন্দোলনের পরিসরে উঠে আসেনি কেন সেভাবে?
পার্বতীর বিয়ে হয় বাহাত্তর সালে। তারপর একে একে চারটি সন্তান। বিহারের মানুষ। কিন্তু তিনি এখন এখানকার মানুষই হয়ে গেছেন। একচিলতে জমিতে পাকা ঘর। লীজ দলিলও পেয়েছেন।
ছোট বাচ্চাদের রেখে সকালবেলা বেরিয়ে যেতে হত কাজে। ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটাও হয়ে যেত কোনো কোনো দিন। বাসে হাওড়া, তারপর লঞ্চে গঙ্গা পেরোনো। সামনে দাঁড়ানো ছেলেকে দেখিয়ে বললেন, ওকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে বেরিয়ে যেতাম। ফিরতাম যখন, তখন ও ঘুমিয়ে পড়তো। দিনের পর দিন ও আমাকে দেখতে পেত না। এক হাঁড়ি বার্লি বানিয়ে রেখে বেরিয়ে যেতাম। সারাদিন ঐ খেত। বড় মেয়ে জলে বিস্কুট ভিজিয়ে খাইয়ে দিত। এইভাবেই সন্তানরা বড় হয়েছে। সেই সন্তানদের একটি অকালে চলে গেছে। জোয়ান ছেলে। করোনায় কন্যাতুল্য দেওরঝিও মারা গেছে। এইসব শোক তাপ নিয়ে নাতি-নাতনির মুখ দেখে বেঁচে আছেন। নিজের শরীর খাটিয়ে এখনও যে স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে পারছেন, এটাই তাঁর ভালো লাগে।
ভোট কাকে দিচ্ছেন? বিজেপিকে? সটান উত্তর, কেন, বিজেপি কী দিয়েছে আমাদের? যা চাল দেয় তা অখাদ্য। তবে? রামমন্দির করেছে বলে? রাম ছিলেন না আমাদের? না কি তাঁর মন্দির ছিল না? কোটি কোটি টাকা খরচ করে মন্দির। কী, না রামের নানা, দাদা, নানী, মাসি সবাই নাকি টাকা দিয়েছে। তা এত টাকা দিয়ে কটা কারখানা বানানো যেত না দেশে? বেকার ছেলেপুলের চাকরি হত, পেটে খেয়ে বাঁচত! রাম তাতে অনেক বেশি খুশি হতেন! কী না বল! আমি রাজনীতি বুঝি না, তবে নিজের জীবন থেকে বুঝেছি, আগে পেটের ভাত, তারপর সব কিছু! আর সবচেয়ে বড় কথা — রাম নিয়ে রাজনীতি কেন? মন্দিরে রাজনীতি ঢুকিয়েছে কেন?
ভাবছি, একজন শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে সারাজীবন আর্থিক ভাবে প্রতারিত হয়েছেন। কিন্তু সেই বঞ্চনা, কষ্ট ছাপিয়েও এই শ্রমিকের জীবন তাঁকে দিয়েছে এক জীবন বীক্ষা যা ভাত আর ইজ্জতের দাম তাঁকে বুঝতে শিখিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে ধর্ম আর রাজনীতির ফারাকটা।
শুধু পার্বতী নন, দেশজুড়ে অসংখ্য পার্বতী ক্রমশ জাগছেন। নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে চাইছেন। তাই তো রাজনৈতিক পরিসরে তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর আড়াল করে রাখা যাচ্ছে না! আর সেই জাগরণের ঢেউ কুলপ্লাবী হয়ে সমস্ত সত্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, এটাও নিশ্চিত!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
(২২ এপ্রিল লেনিনের জন্মদিন। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা প্রতিটি মানুষ লেনিনের সংগ্রাম ও তত্ত্বকে বুঝতে চান। সেই দিকটিকে মনে রেখে এই লেখাটি দেশব্রতী পত্রিকায় প্রকাশিত হল।
১
১৯০৫’র বিপ্লবকে লেনিন ও বলশেভিকরা চিহ্নিত করেছিলেন চরিত্রগতভাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে। তার লক্ষ্য ছিল ভূমিদাসপ্রথার বিলোপ, জারতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার লাভ। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা মনে করেন প্রলেতারিয়েতের স্বার্থ হল বুর্জোয়া বিপ্লবের পরিপূর্ণ বিজয়, কারণ এর মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম সন্নিকট ও লঘুভার হবে। সেইসঙ্গে এও তাঁরা মনে করেছিলেন এটি চরিত্রগতভাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হলেও এর চালিকাশক্তি ও নেতা হতে হবে প্রলেতারিয়েতকেই। কারণ রাশিয়ার বুর্জোয়ারা ছিল প্রলেতারিয়েতের ভয়ে ভীত এবং সেই জায়গা থেকে জারতন্ত্রের সংরক্ষণের পক্ষে। বলশেভিকরা বললেন কৃষকদের সহযোগিতায় প্রলেতারিয়েতদের বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং জনগণের কাছ থেকে বুর্জোয়াদের বিচ্ছিন্ন ও একঘরে করতে হবে। মর্মবস্তুর দিক থেকে এটি বুর্জোয়া বিপ্লব হলেও সংগ্রাম পদ্ধতির দিক থেকে এটি তাই প্রলেতারিয় নির্ভর। এই দ্বান্দ্বিকতাকে মেনশেভিকরা আয়ত্ত করতে পারেনি এবং তারা সরলভাবে মনে করেছিল যেহেতু এটি চরিত্রগতভাবে বুর্জোয়া বিপ্লব, তাই তার পুরোভাগে থাকবে বুর্জোয়ারাই। শ্রমিক শ্রেণির কর্তব্য কেবল বুর্জোয়াদের সাহায্য ও সমর্থন করা। লেনিন দেখান মেনশেভিকদের এই মূল্যায়ন প্রলেতারিয়েতের রাজনীতিকে বুর্জোয়াদের অধীনস্থ করে তুলছে এবং তা মার্কসবাদের বিপ্লবী চরিত্রকে বিকৃত করছে।
লেনিন একইসঙ্গে এও বলেছিলেন কৃষকদের সাথে মৈত্রীর ভিত্তিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ সমাধা করেই প্রলেতারিয়েতের কাজ শেষ হয়ে যাবে না। সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তার অর্জিত শক্তিকে ব্যবহার করে সে আঘাত হানবে পুঁজিবাদের ওপর। এইভাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এগিয়ে চলবে সমাজতান্ত্রিক বিজয়ের দিকে। ‘টু ট্যাকটিক্স অব সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ বইতে যে সূত্রায়ন করেন তা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত সমস্ত মানুষের কাছেই এক অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
২
১৯০৫ সালের বিপ্লবের জোয়ার থিতিয়ে এলে জারতন্ত্র তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনে। হাজার হাজার বিপ্লবীর কারাবাস হয়¸ অনেককে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। পুলিশ শ্রমিক সংগঠনগুলি ভেঙে দিতে থাকে। ফলে পার্টির সভ্যসংখ্যা কমে যায়। সংগঠনগুলির আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পার্টি পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে বাধ্য হয়। বিপদ একদিকে যেমন জারের হামলার মধ্যে দিয়ে আসছিল, তেমনি আসছিল মতাদর্শগত হামলার মধ্যে দিয়ে। মেনিশেভিকরা এই পিছু হটার পর্বে নানারকম মতবাদ নিয়ে আসে যা পার্টিকর্মীদের বিদ্যমান ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণের পথ দেখায়, এমনকী সমগ্র সংগঠনের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে। লেনিন ও বলশেভিকরা বলেছিলেন হামলার মুখে পশ্চাদপসরণ করতে হলেও তা করা দরকার সুশৃঙ্খলভাবে, বাহিনী অটুট রেখে। বিপ্লবের জন্য তুচ্ছতম সব মামুলী কাজও গুরুত্বের সাথে করে যাওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় দ্যুমা বা পার্লামেন্টে বক্তৃতা দেবার যে কোনও সুযোগের সদব্যবহার করে নিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন, বীমা তহবিল, সমবায়, শ্রমিক ক্লাবগুলোতে নিয়মিত কাজ করা দরকার। লেনিন আইনি পদ্ধতিতে কাজ ও বেআইনি কাজের মধ্যে উপযুক্ত মেলবন্ধনের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন।
অন্যদিকে মেনশেভিকরা হাজির করে দমনের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পার্টির কর্মসূচি ও বৈপ্লবিক ধ্বনি পরিহার করার লাইন। বিপ্লবে আস্থা ছেড়ে বুর্জোয়াদের সাথে আপোষ করে নেওয়ার কথা ছড়াতে থাকে তারা। এই প্রবণতাকে লেনিন চিহ্নিত করেন লিকুইডেশনইজম বা বিলোপবাদ বলে। অর্থাৎ প্রলেতারিয়েতের পার্টি সংগঠন ও আদর্শকেই বিলোপবাদীরা লুপ্ত করে দিতে চায়।
৩
ধর্ম ও ভাববাদের দিক থেকেও মার্কসীয় মতাদর্শকে বিপথে চালিত করার বেশ কিছু প্রবণতা এই সময়ে দেখা যায়। এমনকী মার্কসবাদকে ধর্মের একটা নতুন রূপ হিসেবে কল্পনা করে কোনও কোনও মহল থেকে লেখা হতে থাকে। এইসমস্ত বিতর্কের প্রেক্ষিতে বস্তুবাদী দর্শনিক প্রস্থানকে সবলে সামনে আনা ও কুহেলিকার জাল ছেঁড়ার প্রয়োজনে দর্শন শাস্ত্রের আঙিনায় পদার্পণ করেন লেনিন। প্রচুর পঠন, বিশ্লেষণ, অধ্যাবসায়ের ফল হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ বিচারবাদ’ নামে তাঁর একেবারে অন্য ধরনের একটি বই। ১৯০৯ সালে প্যারিসে আয়োজিত হয় রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির পঞ্চম কংগ্রেস। বিলোপবাদী ও প্রত্যাহারপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন লেনিন এবং সম্মেলনে এ অবস্থান স্বীকৃতি পায়।
স্থিতাবস্থার এই পর্বে লেনিন বলশেভিকদের কৃষি-কর্মসূচির দিকটি নিয়ে বিশেষ পরিশ্রম করেন। ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কৃষি কর্মসূচি’ বইটিতে তার প্রমাণ আছে।
৪
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরেই প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে পিছু হটার একটা পর্ব শুরু হয়। ইউরোপের বিভিন্ন সমাজ গণতান্ত্রিক দলগুলো নিজ নিজ দেশের যুদ্ধস্বার্থ তথা জাতীয় বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কার্যত ভেঙে যায়। কেননা শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন দল নিজ নিজ দেশের পুঁজির স্বার্থে পরস্পরের শত্রু শিবিরে দাঁড়িয়ে যায়। ফ্রান্স, ইংল্যন্ড এবং বেলজিয়ামে সোশালিস্টরা সরাসরি সরকারে যোগ দেয়। জার্মানীতে সরকারে যোগ না দিলেও যুদ্ধ চালানোর জন্য ব্যয়বরাদ্দের পক্ষে তারা ভোট দেয়। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে থাকা বেশিরভাগ দল প্রচার করে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, সমস্ত দেশের শ্রমিকদের শ্রেণি ঐক্য, তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ হল শান্তিকালীন সময়ের ব্যাপার। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নিজ দেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তাদের ভুলতে হবে। সব কিছুকে হতে হবে যুদ্ধের অধীন। রাশিয়ায় প্লেখানভের মতো সম্মানীয় মার্কসবাদীও এই ভুল পথ নেন। বলশেভিক পার্টি ও তার নেতা লেনিনের নেতৃত্ব এই নিরিখে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছিল। লেনিন ও বলশেভিকরা যুদ্ধের প্রথম থেকেই দ্বিধাহীনভাবে এই যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে বর্ণনা করেন ও এটা স্পষ্ট করে দেন যে জাতীয়তাবাদের নামে নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়াদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে মদত দেওয়া শ্রমিকদের কাজ নয়।দেশ বিদেশের প্রতিকুল স্রোত এবং অজস্র ধরপাকড় অত্যাচার নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েও বলশেভিকরা তাদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থানে অটুট থাকে। লেনিনের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কর। তিনি বললেন অপর দেশের যে সমস্ত মজুরি দাসেরা আমাদের ভাই তাদের বিরুদ্ধে নয়, অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরতে হবে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের সময়েও প্রলেতারিয় বিপ্লবের আহ্বানকে ভুলে যাওয়া চলে না। লেনিন আহ্বান রাখলেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করার পক্ষে, যা সংগঠিত হবে নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি জনতার বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে। ‘ইউরোপীয় যুদ্ধে বিপ্লবী সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কর্তব্য’, ‘সমাজতন্ত্র ও যুদ্ধ’ প্রভৃতি বইতে লেনিনের এই সমস্ত চিন্তা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
৫
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের যে নতুন সময়ে দুনিয়া প্রবেশ করল তাকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে লেনিন লেখেন ‘ইম্পিরিয়ালইজম : দ্য হায়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম’ (সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়) নামক ক্লাসিকটি। এই বইতে লেনিন দেখান সাম্রাজ্যবাদের আমলে দেখা দেয় বড় বড় একচেটিয়া কারবার ও পুঁজিপতিদের জোট। এই সাম্রাজ্যবাদকে তাই লেনিন বলেন একচেটিয়া পুঁজিবাদ। বিশ্বের কাঁচামালের উৎস, পণ্যোৎপাদন ও বাজারের একটা বৃহৎ অংশ দখল করে নেয় একচেটিয়া মালিকেরা। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রভুত্ব করতে থাকে তারা, সরকারগুলির ওপর নিজেদের অভিপ্রায়কে চাপিয়ে দেয়। মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদী দেশ নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেয় প্রায় সারা বিশ্বকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের অসমতা বৃদ্ধি পায়। মুনাফার তাড়নায় সাম্রাজ্যবাদীরা শ্রমিক ও সমস্ত মেহনতিদের শোষণ বাড়িয়ে তোলে, তাদের অবস্থা হয়ে ওঠে অসহ্য। বিপ্লবের আবশ্যিকতা বুঝতে শুরু করে প্রলেতারিয়েত¸ সেই সঙ্গে মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদী দেশের দ্বারা নিপীড়িত যে উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশে কোটি কোটি লোকের বাস তাদের সঙ্গে বিরোধ প্রখর হয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির। লেনিন দেখান কীভাবে পুঁজিবাদ ক্রমশ হয়ে উঠেছে প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজের বিকাশের পথে এক মহা বিঘ্ন। মানবসমাজের সামনে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটা অথবা উপনিবেশ, একচেটিয়াদের বিশেষ সুবিধা, সব ধরনের পীড়নে অভ্যস্ত হয়ে পড়া। সাম্রাজ্যবাদ মানবসমাজকে এক বিশেষ অর্থে সমাজতন্ত্রের কাছাকাছি নিয়ে আসে।
৬
১৯১৭’র ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের পতনের পর যে বুর্জোয়া সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় তা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিলেও যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিল না। অক্টোব্রিস্ট এবং কাদেতদের সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে সোশ্যাল রিভোলিউশনারি ও মেনশেভিকরাও। তারা তখনো সমাজতন্ত্রের দিকে হাঁটতে রাজি ছিল না। তাদের বক্তব্য ছিল জারতন্ত্রের পতনের পর বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার, কারণ রাশিয়া তখনো সমাজতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়। লেনিন এই পরিস্থিতিতে বলশেভিকদের কার্যপ্রণালী নির্ধারণের জন্য বিকশিত ও বিকাশমান দিকগুলির বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন বিপ্লবের প্রথম পর্যায়টিই কেবল সমাপ্ত হয়েছে এবং তার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা গেছে বুর্জোয়াদের হাতে। তিনি স্লোগান তুললেন সোভিয়েতগুলির হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দেবার জন্য। বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্তকে কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য লেনিন দীর্ঘদিন পর অনেক ঝুঁকি নিয়ে চলে এলেন রাশিয়ায়। পেত্রোগাদে তাঁকে ১৬ এপ্রিল ১৯১৭-তে অভ্যর্থনা জানাল হাজার হাজার শ্রমিক। এর পরের দিনই লেনিন বলশেভিকদের সভায় প্রলেতারিয়েতের কর্তব্য নির্দেশ করে একটি বক্তৃতা দেন। এটি ‘এপ্রিল থিসিস’ নামে বিখ্যাত। নতুন পরিস্থিতির বিশ্লেষণ ও কার্যাবলী নির্ধারণে এই থিসিসের গুরুত্ব ছিল বিরাট। এখানে বুর্জোয়াদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব তা থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সংগ্রামের প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা হাজির করলেন লেনিন। বললেন ক্ষমতা যাওয়া চাই শ্রমিক শ্রেণি ও গরীব কৃষকের হাতে। সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে, সাময়িক সরকারকে কোনও সমর্থন নয় — এর রণধ্বনি তিনি স্থির করেন। তিনি বোঝালেন কেবল সোভিয়েতগুলির রাজই পারে জনগণের জন্য শান্তি, কৃষকদের জমি এবং ক্ষুদিতদের রুটি দিতে। সেইসঙ্গে তিনি এও সতর্ক করে দিলেন এখনই সাময়িক সরকারকে উচ্ছেদের ডাক না দিতে, কারণ তাদের সমর্থন করছে সোভিয়েতগুলি, আর তাদের বিশ্বাস করে জনগণ। লেগে থেকে ধৈর্য সহকারে মেহনতিদের স্বপক্ষে টানতে হবে বলশেভিকদের। সোভিয়েতগুলিতে সংখ্যাধিক্য অর্জন করে সেগুলিকে বলশেভিক সোভিয়েত করে তুলতে হবে। এইসব কাজগুলিই নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের ভিত্তি রচনা করেছিল।
- সৌভিক ঘোষাল
প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাসে মার্কসবাদকে এমন দুই অথবা তিনটি সংকটের পর্যায় পার হতে হয়েছে যেখানে তার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন হাজির করা হয়েছিল। প্রতি ক্ষেত্রেই মার্কসবাদ সে সব কিছুকে কাটিয়ে উঠেছে এবং নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে আরও এগিয়ে গিয়েছে। আজ বিংশ শতাব্দীর একেবারে অন্তিমলগ্নে তাকে আর একবার মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের সংকট সত্যিই খুব গভীর হয়েছে কারণ তার সঙ্গে যুক্ত প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক দেশ, লেনিনের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। সোভিয়েত মডেল মার্কসবাদের সত্যিকারের মূর্তরূপ বলে চিহ্নিত হয়ে এসেছে আর সে কারণেই তার পতন পুরোনো বিতর্কগুলিকে আর একবার সামনে হাজির করে দিয়েছে। বিকল্প হিসাবে দাবি জানাত যে চীনা মডেল তাও নানা কারণেই অনেকাংশে তার জৌলুষ হারিয়েছে আর অবশিষ্ট ছোটোখাটো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিও তেমন আস্থা জাগাতে পারছে না।
এখন প্রথম যে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত তা হল, পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বসমূহকে বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াতেই মার্কসবাদ উদ্ভূত হয়েছে এবং একমাত্র মার্কসবাদই পুঁজিবাদের সর্বাঙ্গীন সুগভীর সমালোচনাকে উপস্থাপিত করেছে। শ্রেণীসংগ্রামের এক মতবাদ হিসাবে মার্কসবাদ শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজে অবশ্যই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তা পুঁজিবাদী দুনিয়ার রূপান্তর ঘটানোর জন্য এবং সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন সম্ভাবনাকে ঘিরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রে পথ নির্দেশক মতাদর্শ হিসাবেই বিরাজ করবে। একটি বিশেষ অর্থে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বাস্তবিকই একটি ইতিহাসের পরিসমাপ্তিকে সূচিত করে কিন্তু একই সাথে প্রতিটি সমাপ্তিই নতুন এক সূচনারও প্রতীক হয়ে ওঠে, আর এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই মার্কসবাদের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা সংকল্পবদ্ধ।
এই জুনে গেরুয়া বাহিনীর উৎখাতকে নিশ্চিত করতেই হবে, আর সে জন্যে আমাদের সকলের, কম বেশি সম্ভবপর সমস্ত উদ্যোগ নিতে হবে। দিনকয়েক আগে কথাটা বলেছিলেন আমার এক বন্ধু। করতে হবে এমন কিছু ‘কাজ’ যা মানুষ দেখতে পাবে, লিখতে বা বলতে হবে এমন কিছু ‘শব্দ’ যা মানুষ পড়তে বা শুনতে পাবে, যা আরও অনেক অনেক মানুষকে ভাবিয়ে তুলবে, এই ভাবেই তাদেরও কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করবে! একে অপরকে ভাবিয়ে তোল!
আমার দুঃখ হল, ‘গৈরিক’ এমন সুন্দর একটা রং, দস্যুবাহিনীর হাতে পড়ে সমস্ত গৌরব আর উজ্জ্বলতা হারালো!
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রকে রক্ষা করার লড়াই কখনও এত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। এতখানি জীবন-মরণের প্রশ্নও হয়ে ওঠেনি। এই ‘বাঁচানো’র লড়াইয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ — ভারতীয় সংবিধান; যাকে প্রতিটি নাগরিক এখনও পর্যন্ত স্বতঃসিদ্ধের মতো নিশ্চিত বলেই ধরে নেন এবং মনের অবচেতনে বিশ্বাস করেন, আমাদের সভ্য, স্বাভাবিক প্রাত্যহিক জীবনে যে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি ভোগ করি সেগুলি সংবিধানে সুরক্ষিত রয়েছে।
আজ সংবিধানের মধ্যে সযত্ন-রক্ষিত প্রতিটি গণতান্ত্রিক অধিকার আক্রান্ত। কথা বলার অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার, সমাবেশিত হওয়ার অধিকার, ভাষণের অধিকার, লেখার অধিকার, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার, ভ্রমণের অধিকার, অ-গৈরিক কোনো ধর্মে বিশ্বাস রাখা ও তা অনুশীলনের অধিকার — সবক’টিই আজ আক্রান্ত। গেরুয়া ছাড়া আর সব রং-ই আজ কালো!
গোদী মিডিয়া রয়েছে ষাঁড় দৌড়ের উন্মত্ত প্রতিযোগিতায়। বিচারব্যবস্থাও কখনও কখনও গোদী মিডিয়ার দিকেই ঝুঁকে পড়ছে। আইন বলবৎকারী সংস্থাগুলো আছে ‘ডাইনি খোঁজ’-এর উন্মত্ততায়।
চাবুকধারী বুল মাস্টারকে এবার থামাতে হবে! একদিকে বহু মানুষ যখন নিজেদের মতো করে প্রতিবাদ জানাতে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে বেছে নিয়েছেন রাস্তাকে, এবার সময় এসেছে ব্যালটের ‘কথা বলার’, যে ‘কথা’, ‘যেভাবে’ কখনও বলা হয়নি! না হলে, আর কোনো ব্যালটই হয়তো থাকবে না আগামীদিনে! লক্ষ লক্ষ মানুষ ভোট দেবেন, নিজেদের মত জানাবেন। লক্ষ লক্ষ ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক’রা ভোট দেবে না। কিন্তু তাদের পরিণত মন ও শক্তি আছে পরিবর্তনকে প্রভাবিত করার। তারাই দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ভোটের মাধ্যমে এক মোক্ষম ‘‘না’’ বলতে, তারাই অনুপ্রাণিত করতে পারে তাদের বাবা মা, ভাই বোন, তুতো ভাই বোন, ভাগ্নে ভাইপো, কাকা কাকিমা, জ্যেঠু জ্যেঠিমা, মামা মাসি, ঠাকুর্দা ঠাকুমা, দাদু দিদাকে!
- তপন সেন
আজকের ভারতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর সম্পর্ক কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় লাভ-হেট বা ভালোবাসা ও ঘৃণার সম্পর্ক। আজ এই বিষয়টা সম্পর্কে সকলেই একরকম অবহিত যে, মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের এক বড় অংশই পরিণত হয়েছে সরকারের অনুগত প্রতিষ্ঠানে, আজকের জনপ্রিয় ভাষায় যা মোদী ঘনিষ্ঠ বৃহৎ পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন গোদি মিডিয়া বলেই পরিচিত। সরকারের কাজ নিয়ে তার কাছে অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলার চেয়ে সরকারের গুণকীর্তনই এই সংবাদমাধ্যমের কাছে অভিপ্রেত হয়। এমনকি আরএসএস’এর মতাদর্শ প্রচারেও এরা কুণ্ঠিত নয়। এই মিডিয়া মোদীর কাছে অতএব একান্তই কাম্য। তবে, সরকারের সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিডিয়ার একটা অংশকে এখনও বশীভূত করা যায়নি। তারা সরকারের কাজ নিয়ে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, মোদী ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের বিশেষ সুবিধা দান ও অন্যায্য পথে বরাত দানের উন্মোচন ঘটায়, ধর্মীয় বিভাজন ভিত্তিক সামাজিক মেরুকরণের শাসকের উদ্যোগকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। ডিজিটাল ও সামাজিকমাধ্যমেই এই মিডিয়া বেশি সক্রিয়। এই মিডিয়ার বিরুদ্ধে মোদী সরকার সহজাতভাবেই অসন্তুষ্ট ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। এদের নিয়ন্ত্রণে আইন তৈরি হয়, অ-বশীভূত সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করে জেলে পোরা হয়, সরকারের সমালোচক সংবাদমাধ্যমের অফিসে ও ডিরেক্টরদের বাড়িতে তদন্তকারী সংস্থা দিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। আর মোদী শাসনের এক দশকে এটাও পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, সাংবাদিকদের কাছে নিজের সরকারের কাজের জবাবদিহি মোদীর ধাতে একেবারেই নেই। কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার পর থেকে নরেন্দ্র মোদী তাই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়াকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। তাঁর পূর্বসূরী মনমোহন সিং ‘মৌন’ বলে অভিযুক্ত হলেও এক দশকের শাসনকালে তিনি নয় নয় করে ১১৭টা সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন।
সরকারের খবরের প্রকাশকে যথাসম্ভব সীমিত করতে সরকারের মন্ত্রী, কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকেও মোদী সরকার অনুমতি নির্ভর করল। মোদী জমানা শুরু হওয়ার কয়েক বছর পর থেকে, বিশেষভাবে ২০১৯’র নির্বাচনে জয়ের পর দ্বিতীয় দফায় নিয়ম বলবৎ হল যে, অনুমতি পাওয়া গেলে তবেই মন্ত্রী ও আমলাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎ হতে পারবে। সাংবাদিকদের সংসদে প্রবেশও অবাধ রইল না। ভারতে এসে বিদেশি সাংবাদিকদের কাজ করার, বিশেষভাবে আসাম ও কাশ্মীর থেকে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিদেশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুমতি লাভকে বাধ্যতামূলক করা হলো। বিদেশি সাংবাদিকদের ভারত থেকে কাজ করার ভিসা, পারমিটের আবেদন প্রায়শই প্রত্যাখ্যাত হতে থাকল।
মোদী সরকার ২০২১’র মার্চে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে নতুন বিধি নিয়ে আসে। সেই বিধিতে এমন সংস্থান রয়েছে যার ভিত্তিতে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ সম্ভব। ঐ বিধির বলে সরকার দেশের যে কোনো স্থানে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদকে ব্লক করতে, মুছে দিতে বা পাল্টে দিতে পারবে। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে সরকার গত তিন বছরে যে আইনগুলো নামিয়েছে সেগুলো হলো : ওপরে উল্লেখিত ২০২১’র মার্চের তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের বিধি ছাড়াও ইন্ডিয়ান টেলি কমিউনিকেশন বিল ২০২২; ডিজিটাল ব্যক্তিগত তথ্য পরিসংখ্যান আইন ২০২৩; সংবাদপত্র ও পত্রিকা নথিবদ্ধকরণ বিল; এবং ডিজিটাল ইন্ডিয়া বিল। এই আইনগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ক্যারাভান পত্রিকায় ২০২৩’র ২ ডিসেম্বর প্রকাশিত অনন্ত নাথের লেখা ‘কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখা’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়েছে, “এই আইনগুলোর মধ্যে দিয়ে সরকার অরওয়েলীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এমন কাঠামো তৈরি করবে যা ক্ষমতা বণ্টিত করে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করবে, বিষয়বস্তুকে সেন্সর করবে এবং সরকারের সমালোচক কণ্ঠস্বরগুলোকে নিশানা বানাবে।...”
মোদী জমানায় সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তাও বিপন্ন হয়েছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট বা সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করে চলা কমিটির প্রকাশ করা তথ্য জানাচ্ছে — মোদী জমানায় ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৩৬ জন সাংবাদিককে কারারুদ্ধ করা হয়েছে, মনমোহন সিং’এর ইউপিএ জমানায় এক দশকে যে সংখ্যাটা ছিল মাত্র আট। এখানে উল্লেখ জরুরি যে, যোগী আদিত্যনাথ শাসিত উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত তরুণীর গণধর্ষণ ও নিহত হওয়ার খবর সংগ্রহ করতে যাওয়ার সময় সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে গ্রেপ্তার করে যোগীর পুলিশ এবং জামিনে মুক্তিলাভের আগে তাঁকে ৮৫০ দিন কারাবাস ভোগ করতে হয়। লব্ধ তথ্য আরও জানাচ্ছে, ২০১৪ থেকে ২০২৩’র মধ্যে ২৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, ১৬ জনের বিরুদ্ধে দানবীয় ইউএপিএ প্রয়োগ হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৭ জন সাংবাদিক কাশ্মীরের। সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি বেড়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে নজরদারি যন্ত্রের প্রয়োগও হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগকে গুরুতর করে তুলতে ইজরায়েলি নজরদারি প্রযুক্তির মাধ্যমে অভিযুক্তদের মোবাইল ফোনে ডুয়ো তথ্য ঢোকানোর অভিযোগের কথা। সামাজিকমাধ্যমে, ফেসবুক ও এক্স হ্যান্ডেলের (পূর্বের টুইটার) ওপর নজরদারি প্রবলতর হয়েছে।
স্থানাভাবে সাংবাদিক ও সংবাদ প্রতিষ্ঠানের ওপর হানাদারি ও তল্লাশির গুটিকয়েক ঘটনার উল্লেখই আমরা এখানে করব। ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করার জন্য মনিপুরের সাংবাদিক কিশোর চন্দ্র ওয়াংখেমকে প্রায় তিন বছরের ব্যবধানে তিনবার গ্রেপ্তার করা হয়। কাশ্মীরে ২০২২’র ২২ নভেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত ১৭ জন সাংবাদিকের বাড়িতে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে দিয়ে তল্লাশি চালানো হয়েছে। বৈদ্যুতিন ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রকের নির্দেশে ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট তদন্ত-ভিত্তিক সংবাদ পরিবেশনকারী সংস্থা কাশ্মীরওয়ালার সাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফেসবুক পেজ ও এক্স-সংযুক্ত (পূর্বের টুইটার) অ্যাকাউন্টও বন্ধ করা হয়। এর পাঁচদিন পরই বন্ধ করা হয় সামাজিক মাধ্যমের চ্যানেল গাঁও সবেরাকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকদের প্রতিবাদের খবর প্রচারের জন্য। এই দুই চ্যানেলের ওপর হামলার পর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়নে নিযুক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার বলে, “কাশ্মীরওয়ালা ও গাঁও সবেরা নরেন্দ্র মোদী সরকারের অনলাইন ইকোসিস্টেমের আরও বেশি নিয়ন্ত্রণের নীতির শিকার ...।”
ডিজিটাল সংবাদ প্রতিষ্ঠান নিউজক্লিক’এর কার্যালয়ে ও ডিরেক্টরদের বাড়িতে আয়কর দপ্তর তল্লাশি চালায় ২০২৩’র ৩ অক্টোবর সকালে। তল্লাশি এই অভিযোগের ভিত্তিতে চালানো হয়েছিল যে ঐ সংবাদ প্রতিষ্ঠানে ঘুরপথে চীনা বিনিয়োগ হচ্ছিল এবং সংস্থাটি জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত ছিল। ঐ হানাদারির পর দ্য হিন্দু সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, “কোনো সরকারই শুধুমাত্র বিনিয়োগ সম্পর্কে সন্দেহের বশবর্তী হয়েই সাংবাদিকদের নিশানা বানাতে পারে না এবং সেই সূত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে না, যে অধিকারটি সংবিধানে সুনিশ্চিত করা হয়েছে।”
জনসংখ্যার নিরিখে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের কাছে তার চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র যে একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয় সেই অভিমতের যথার্থতা প্রশ্নাতীত। বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে সমীক্ষা চালায় যে আন্তর্জাতিক সংস্থা, সেই ভি-ডেম’এর মূল্যায়নে ভারত এখন “নির্বাচন ভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র”। নরেন্দ্র মোদী ভারতকে অভিহিত করেছেন “গণতন্ত্রের জননী” রূপে। সেই জননীর দশা এখন এমনই যে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সেখানে হাঁসফাঁস করছে। এর মধ্যেই মিডিয়ার যে অংশ নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথে অবিচল থাকছে, প্রশাসনিক অনাচারের বাস্তবতার মুখে সরকারকে দাঁড় করাচ্ছে, মিডিয়ার সেই অংশকে উৎসাহিত করে, মদত জুগিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ভারতের জনগণকেই।
- জয়দীপ মিত্র
===xxx===