পার্টির হুগলী জেলা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলার গ্রাম ও শহরাঞ্চলে শুরু হয়েছে ‘বিজেপিকে পরাস্ত করুন’ প্রচারাভিযান।
গত ৫ এপ্রিল ধনেখালিতে বিজেপি হারাও কর্মসূচি সংগঠিত হয়। ধনেখালির কলেজ মোড় থেকে শুরু হয়ে হাটতলা সিনেমাতলা ঘুরে দেড় ঘণ্টার পদযাত্রা শেষ হয় মদনমোহনতলায়। সেখানে পথসভায় বক্তব্য রাখেন জেলানেতা মুকুল কুমার। এই কর্মসূচির মূল শক্তি ছিলেন স্থানীয় আদিবাসী ও ক্ষেতমজুর, বর্গাদার সাথীরা, যাঁরা জীবনযাত্রার বিভিন্ন পদক্ষেপে নিপীড়িত হয়েছেন রাজ্যের শাসকদলের দ্বারা, কিন্তু আজকের সময়ের রাজনৈতিক অনিবার্যতাকে অনুধাবন করে তাঁরা ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার অধিকারে, ঋণমুক্তির দাবিতে, চোর ধরার অজুহাতে মানুষের একশো দিনের কাজের টাকা আটকে রাখার বেয়াদবির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াকে অগ্রাধিকারে রাখছেন।
জেলার দ্বিতীয় বড় কর্মসূচিটি সংগঠিত হয়েছে উত্তরপাড়া বিধানসভা এলাকায়। ইলেক্টোরাল বন্ডে ৬০৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎকারী স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি ও কর্পোরেট আদানি-আম্বানির দালাল মোদী সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার বার্তা নিয়ে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে একটিও ভোট না দিয়ে পরাজিত করার আহ্বানকে জনগণের সামনে রেখে গত ৭ এপ্রিল কোন্নগর, নবগ্রাম, হিন্দমোটর ও উত্তরপাড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ট্যাবলো সহ সাইকেল মিছিল সংগঠিত করলো পার্টির উত্তরপাড়া জোন এরিয়া কমিটি। এই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন পার্টির হুগলী জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার, এরিয়া সম্পাদক অপূর্ব ঘোষ, কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্যা চৈতালী সেন ও রাজ্য কমিটি সদস্য সজল অধিকারী, সাংবাদিক ও অধিকার আন্দোলনের সংগঠক রূপম চট্টোপাধ্যায় সহ অনেক কর্মী সমর্থক। মহিলা, ছাত্র-যুব, মিল ও নির্মাণ শ্রমিক সাথীদের অংশগ্রহণ ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। এই অঞ্চলে বেশ কিছুদিন ধরে দেওয়াল লিখনও চলছে। এছাড়া পোলবা-দাদপুর ব্লকের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চল হারিট বাজারে দল বেঁধে লিফলেট বিতরণ ও পোস্টারিং করেন কমরেডরা। বলাগড় ব্লকেও শুরু হয়েছে পোস্টারিং।
“সোনার ফসল ফলায় যে তার দুই বেলা জোটে না আহার …”
যে দিকে তাকানো যায় সবুজ ক্ষেত খামার। পূর্বস্থলী ব্লকের গঙ্গা তীরবর্তী উর্বরা জমিতে শস্য বৈচিত্র চোখে পড়ার মতো। ধান, পাট, আলু পিঁয়াজ, রশুন, ফুলচাষ, রকমারী সব্জি কী নেই! কিন্তু এই সোনার ফসল ফলায় যারা সেই ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিরা, ভাগচাষি, চুক্তি চাষিরা, যারা গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ। সকাল থেকে সন্ধ্যা ১২ /১৪ ঘণ্টা কাজ করেও তাঁদের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা এ সব কিছুর সংস্থান করতে নাভিশ্বাস উঠছে। সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর এই এলাকায় কোন ফসলের চাষে খরচ কম প্রধানত সেটা বিবেচনা করেই শস্য ফলান চাষিরা। এ কারণে এই এলাকায় আলুর বদলে পিঁয়াজ চাষ কয়েকবছর ধরে বেড়েছে। চাষিদের নিজস্ব তাগিদেই ঘটছে শস্য বৈচিত্র! কৃষি সংকট সমাধানে সরকারের অন্যতম দাওয়াই হচ্ছে শস্যবৈচিত্র! কিন্তু সেটা কেবলমাত্র তখনই ফলপ্রসূ হতে পারে যদি চাষিরা ফসলের লাভজনক দাম পায়। সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনে। কিন্তু হায়! “আশায় মরে চাষা”। বাস্তবে ফসলের দামের কোনো গ্যারান্টি নেই! পিয়াজের দাম কখনও ২০ টাকা তো কখনও বা ৬ টাকা! সব্জির দামও এমনই ওঠানামা করে। হিমঘর না থাকায় প্রায় ৪০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এই সমগ্র প্রশ্নে রাজ্য সরকারের কোনো ভূমিকাই নেই। সবটাই ফড়ে মহাজনরা নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরদিকে উৎপাদন উপকরণ তথা সার বীজ কীটনাশক জল বিদ্যুৎ প্রভৃতির দামের বিপুল বৃদ্ধি ঘটছে। পুঁজির জন্য আজকের নয়া মহাজন মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির চড়া সূদে ঋণের উপর নির্ভর হয়ে পড়ছে মানুষ। এই প্রেক্ষাপটে ঘটছে আলু চাষির আত্মহত্যার ঘটনা। দুই মাস আগে এই ব্লকে অকাল বর্ষণে আলু নষ্ট হয়ে যাওয়া পর দেনার দায়ে এক যুবক চাষি গলায় দড়ি দিয়েছে। এই নির্মম বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে মোদীর গ্যারান্টি চাষিদের কাছে স্রেফ ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয়! চাষির আয় দ্বিগুণ বেড়েছে বলে মোদী যে প্রচার করছে সেটা এক নির্মম রসিকতা! এই ব্লকে দারিদ্র্যসীমার নীচে রয়েছে ৪৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার। যাদের আয় মাসিক ৩০০০ হাজার টাকার কম! এটা ২০১১ সালে সরকারি তথ্য। এখন সরকার সব রকম তথ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে৷ তবুও নিশ্চিত বলা যায় বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়েছে বই কমেনি। সব মিলিয়ে গ্রামীণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুবেলা খাবার জোটানো দায়! কৃষি কাজে মজুরি গড়ে ২০০-২৫০ টাকা। দুই বছর হয়ে গেল ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। সম্প্রতি ১০০ দিনের কাজে মজুরি ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। তাতে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মজুরি সরকার নির্ধারিত মজুরির থেকেও কম। অর্থাৎ সরকার চাইছে বেকাররা কাজ না পেয়ে এবং মজুরির নিম্ন হারের কারণ পরিযায়ী হয়ে যাক। এ সবের ফলে গ্রামাঞ্চলে দলে দলে যুব শক্তি চলে যাচ্ছে বাইরে পরিযায়ী হয়ে। এই এলাকার অধিকাংশ যুবকরা যাচ্ছেন কেরালায়। যেখানে মজুরী কিছুটা বেশি। এই বিষয়গুলিকে তুলে ধরে গত ৬ এপ্রিল পূর্ব বর্ধমান কেন্দ্রের পূর্বস্থলী এলাকায় এক প্রচার পরিক্রমা করা হয়। তাতে ৮০ জন কর্মী সহ প্রার্থী সজল কুমার দে অংশগ্রহণ করেন। এলাকা সংগঠনের কর্মীরা উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে নির্বাচনী কর্মকান্ডে যুক্ত হয়েছেন। কৃষি সংকটের জবাব কৃষক আন্দোলন, যুব সমাজের স্বচ্ছ নিয়োগ ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে এই রাজ্যে এবং দেশ জুড়ে আন্দোলন। সেই আন্দোলনের একমাত্র প্রতিনিধি সিপিআই(এমএল) প্রার্থীকে পতাকায় তিন তারা চিহ্নে ভোট দিন - এই বার্তা তুলে ধরে প্রায় ৪০ কিমি রাস্তা ১৫টি টোটো গাড়িতে তিন তারা লাল পতাকায় সুসজ্জিত প্রচার পরিক্রমা ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিভিন্ন বাজার গঞ্জ জনবহুল এলাকায় মিছিল করা হয়। সকাল ৯ টায় শুরু হয়ে দুপুরে কিছুটা বিরতি দিয়ে বিকেল ৫ টায় ফলেয়া রেল বাজারে এক পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন রাজ্য ও জেলা নেতৃবৃন্দ যথা, সজল পাল, ইন্দ্রানী দত্ত, বাবলু ব্যানার্জি, অশোক চৌধুরী, রণজয় সেনগুপ্ত জয়তু দেশমুখ প্রমূখ।
প্রচারে কেন্দ্রের মোদী সরকারের সর্বনাশা নীতিগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণের পাশাপাশি রাজ্যের তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও বঞ্চনা প্রতারণার বিরুদ্ধে বক্তারা সোচ্চার হন। যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় তা হল —
মোদীর রাজত্বে চাষির আয় তো বাড়েইনি উল্টে খরচ চারগুন বেড়েছে। কৃষিতে ব্যয় বরাদ্দ সরকারি ভর্তুকি ক্রমাগত কমছে। এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৬.১ লক্ষ কোটি টাকা। আর কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে ১.২৭ লক্ষ কোটি টাকা। যে প্রধানমন্ত্রী দু’বছরের মধ্যে চাষিদের উৎপাদন দ্বিগুণ করার কথা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা সর্বনিম্ন বরাদ্দ করছেন কৃষিতে। কৃষি উপকরণের বিপুল মূল্যবৃদ্ধির একটা তথ্য দেখা যায়। সার কারখানার নাম বিভিএফসি। সে ইউরিয়া তৈরি করেনা, শুধু প্যাকেজিং ও মার্কেটিং করে। ৪৫ কেজির দাম ২৬৬ টাকা ৮০ পয়সা। অথচ মোদী সরকার এই সার আমদানি করেছে ৩ হাজার ৩৭৫ টাকায়। ২০২০-তে এক বস্তা (৫০ কেজি) পটাশের দাম ছিল ৮০০ টাকা। এখন তার দাম ২০০০ টাকা। সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য কোনো সরকারি ঋণ সহায়তা নেই। প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে ছোট ভাগচাষি ও চুক্তিচাষিরা চাষাবাদ করে থাকে। এদের কৃষক স্বীকৃতি নেই। কোনোরকম সরকারি সহায়তা এরা পায় না। ফসল কেনার সরকারি ব্যবস্থাপনা নেই! গালভরা নাম দিয়ে ব্লক দপ্তরের লাগোয়া একটা কৃষক বাজারের বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে সরকারি গুদাম আছে, অকশন বা নিলাম শেড আছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোনো প্রতিনিধি সেখানে ফসল কেনে না। এমন কী তাতে হিমঘরও নেই। সুলভে কৃষি ঋণ সহায়তা, ন্যায্যমূল্যে সার বীজ নেই। বিগত বছরগুলিতে নদীর জল উত্তোলন প্রকল্প বা সেচের কোনো ব্যবস্থাই হয়নি। ১০০ দিনের কাজ ধাপে ধাপে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত চালাচ্ছে মোদী সরকার। গত বছরের তুলনায় তিনভাগের এক ভাগ টাকা বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে ওরা।এছাড়া স্থানীয় কয়েকটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় যথা — আমাদের পার্টির নেতৃত্বে এই এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামে খাস ও চরের জমি দখল করা হয়েছিল। সেখানে গরিবরা সারা বছর চাষ করলেও আজও তারা কেউ পাট্টা পায়নি। ফলে তারা সরকারের কোনো প্রকল্পের সাহায্য পায় না। তাই পাট্টা ও পরচার দাবিতে নতুন ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলছে। গঙ্গার চরে দেবনগর গ্রাম যেখানে এবার আমাদের পার্টি প্রতিনিধি পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতেছে। সেই গ্রামের পার্শ্ববর্তী চরের মাটি প্রশাসনের মদতে মাটি মাফিয়ারা মাটি তুলে বিক্রি করে দিচ্ছে। এর ফলে চাষের যেমন ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তেমনি অদূর ভবিষ্যতে দেবনগর গ্রামটাই গঙ্গায় তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। এই মাটিমাফিয়া ও প্রশাসনের যোগসাজসের বিরুদ্ধে আন্দোলন এর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মেড়তলা থেকে কমলনগর একসময় তাঁতের রমরমা ছিল। সরকারের উদাসীনতা ও বঞ্চনার কারণে তাঁত আজ মৃতপ্রায়। করোনার পর শয়ে শয়ে মানুষ মজুরে পরিণত হয়ে পড়েছে। এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য আমাদের পার্টির বলিষ্ঠ ভূমিকা আজও এক উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে রয়েছে। একে পাথেয় করে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসীবাদকে পরাস্ত করা এবং সিপিআই(এমএল)-এর সংগ্রামী ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রচারাভিযান চলছে।
- জয়তু দেশমুখ
আইএলও এবং ইনস্টিটিউট ফর হিউমান ডেভেলপমেন্ট অন লেবার এমপ্লয়মেন্ট প্রকাশ করল ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট, ২০২৪। এই রিপোর্ট বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত তথ্য পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি করেছে পূর্ণাঙ্গ এক নথি। মোদীর ভারতবর্ষে কর্মহীনতা, বেতন ও মজুরি সহ গ্রাম-শহরের শ্রমবাজারে বৈশিষ্ট্য সমূহ, মজুরির ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য প্রভৃতি বিস্তৃত ক্ষেত্র জুড়ে গভীরে গিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে যে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে, তা মোদী শাসনকালে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে বিরাট সংকট, অবক্ষয় ও দারিদ্রকে প্রতিবিম্বিত করেছে ছত্রে ছত্রে।
বিশ্বে ডলারের সাপেক্ষে দ্রুততম বিকাশশীল পঞ্চম বৃহত্তম অর্থব্যবস্থার তকমা পাওয়া এই দেশটির অন্যান্য দিকগুলো রীতিমতো চিন্তাজনক। জি-২০ দেশগুলোর মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারত সবচেয়ে নীচে, দেশের অভ্যন্তরের আর্থিক বিকাশ খুবই অসম। ২০২১-এ মাথাপিছু রাজ্য জিডিপি’র ক্ষেত্রে দিল্লীর অবস্থান বিহার-উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান-ঝাড়খন্ড-মণিপুর-মেঘালয়-আসাম এবং পশ্চিম দক্ষিণ ও উত্তরের রাজ্যগুলোর তুলনায় আটগুণ বেশি! শ্রমবাজারে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ইনফর্মাল ক্ষেত্রে কর্মরত, যা ভারতকে সাব সাহারা দেশগুলোর দলে ফেলেছে, নিম্ন-মধ্য আয়সম্পন্ন দেশগুলোর সাথে একাসনে রেখেছে। আইএলও’র মানদন্ডে ইনফর্মাল ক্ষেত্র তাকেই বলে যেখানে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার লেশমাত্র থাকে না। এমনকি, এই রিপোর্ট দেখিয়েছে, সংগঠিত ক্ষেত্রেও নিয়মিত কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন বিপুল সংখ্যক ইনফর্মাল শ্রমিক। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার জৌলুশ নিয়ে মোদী যতই বিজ্ঞাপন করুক না কেন, আলোচিত রিপোর্ট দেখিয়েছে, ভারতের শ্রমবাজারে রয়েছে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বরোজগেরে যা পশ্চাদপদ অর্থব্যবস্থারই বৈশিষ্ট্য। শ্রমশক্তিতে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও ভারতের স্থান বিশ্বের যে গড় রয়েছে, তার নীচে — ২৫ শতাংশ, যা লিঙ্গ অসাম্যের ছবিকেই ফুটিয়ে তোলে।
আরেকটা ক্ষেত্রে মোদীর ভারত রেকর্ড করেছে — শিক্ষিত যুবদের মধ্যে বেকারত্বের হারে। দেশে অনেক বেশি শিক্ষিত তরুণ তরুণী রয়েছেন, কিন্তু তাদের নিয়োগ করার মতো কাজ নেই। আইএলও’র রিপোর্ট জানিয়েছে, এ প্রশ্নে ভারত কয়েক দশক ধরে রয়েছে শীর্ষে! ২০০০ সালে এই কর্মহীনতার হার ছিল ৫.৬ শতাংশ, ২০১২-তে তা বেড়ে হয় ৬.২ শতাংশ, ২০১৮তে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে এসে দাঁড়ায় প্রায় ১৮ শতাংশে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, গত এক দশকের মধ্যে নিয়মিত বেতনভুক, স্বরোজগেরেদের গড় মাসিক আয় ক্রমাগত কমেছে। এটাও রিপোর্টে প্রকাশিত যে সর্বভারতীয় স্তরে ৪০.৮ শতাংশ নিয়মিত শ্রমিক এবং ৫১.৯ শতাংশ ক্যাজুয়াল শ্রমিক কৃষিক্ষেত্রে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি পাননি। আর, নির্মাণ ক্ষেত্রেও ৩৯.৩ শতাংশ নিয়মিত শ্রমিক এবং ৬৯.৫ শতাংশ ক্যাজুয়াল শ্রমিক ওই ক্ষেত্রের নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
ভারতের শ্রমবাজারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, কাজের নিম্নমান, বিপজ্জনক কর্মস্থল ও অত্যন্ত কম মজুরি। বিরাট ঢাক পেটানো আর্থিক বৃদ্ধি কাজের বাজারে নতুন কর্মনিয়োগে পুরোপুরি ব্যর্থ। অন্যান্য বিকাশমান দেশগুলো আর্থিক বৃদ্ধির যে পথমানচিত্র অনুসরণ করে তা হল কৃষির উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিকে উৎপাদন শিল্পে স্থানান্তরকরণ। কিন্তু ভারত নিয়েছে ভিন্ন পথ। এখানে নির্মাণের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্র ও গ্রামাঞ্চলের অকৃষি পরিষেবা ক্ষেত্রেই, অর্থাৎ যেখানে পুঁজির গঠন নিম্নমানের, সেখানেই স্থানান্তরিত হয়েছে কৃষির উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি — যা ভারতীয় অর্থব্যবস্থার অনুন্নয়নকেই সূচিত করে।
মোদীরাজ তছনছ করেছে দেশের অর্থনীতি। অকল্পনীয় গতিতে চওড়া হয়েছে আর্থিক অসাম্য। সংকুচিত হয়েছে মজুরি, বেতন। এই অন্যায়, অন্যায্য অত্যাচারী রাজকে আসন্ন নির্বাচনে নির্বাসনে পাঠাতে হবে ভারতীয় জনগণকে।
দেরীতে হলেও সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনী বন্ড বাতিল এবং অর্থদাতা ও গ্রহীতাদের নাম প্রকাশ্যে আনার ঘোষণা মোদী সরকারকে অস্বস্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিজেপি ঘনিষ্ঠ উকিলরা ক্রমাগত মুখ্য বিচারপতিকে হেনস্থা করে বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই হেনস্থাকার্যের পিছনে নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা অপরিসীম কারণ তিনি শুধুমাত্র এই সন্দেহজনক উকিলগোষ্ঠীর আবেদনপত্রটি প্রচারই করছেন না, সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী বন্ড, যেটিকে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করেছে, সেটির ক্রমাগত সাফাইও গেয়ে চলেছেন। যে সরকার সুপ্রিম কোর্টে বলে যে, দেশের জনগণের কোনো অধিকার নেই নির্বাচনী বন্ড নিয়ে প্রশ্ন করার, যে পার্টি নির্বাচন কমিশনকে জানায় যে, নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত কোনো তথ্যই তাদের কাছে নেই, তারাই এখন কর্পোরেট অনুদানের স্বচ্ছতার প্রশ্নে নির্বাচনী বন্ডের গুণগান গাইছে।
যখন স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসক হিসেবে মোদী সরকারের নাম উঠে আসছে, সেই সময় বিজেপি ক্ষমতার ভাষায় উন্মত্ত হয়ে বিরোধী জোটকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। নির্বাচনী বন্ডের এই দুর্নীতি এতটাই জটিল যে সরকার ভেবেছিল জনগণের কাছে এই সত্যি কখনও প্রকাশ পাবে না। আমরা এখন জানছি যে বেশ কিছু সংস্থা যেমন এই স্কিম ব্যবহার করে ঘুষ দিয়ে সরকারি চুক্তি আদায় করেছে, আবার তেমনই বেশ কিছু সংস্থা আইনের হাত থেকে বাঁচতে পার্টিকে অনুদান দিয়েছে। বেশ কিছু সংস্থা আবার সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে বিরোধী দলগুলিকে এই দুর্নীতিতে জড়িয়ে ফেলার চক্রান্ত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে হওয়া দিল্লী লিকার পলিসি কেসে আমরা এই ঘটনার নিদর্শন দেখেছি যেখানে ইডি এবং সিবিআই-কে একযোগে ব্যবহার করা হয়েছে একটি বিরোধী দলকে আক্রমণ করার জন্য।
আজকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সহ আম আদমি পার্টির সামনের সারির নেতারা যখন জেলে বন্দী তখনই সেই দিল্লী লিকার পলিসি কেসেরই অন্য দুই অভিযুক্ত পি সারাথ রেড্ডি এবং রাঘব মাগুন্তা রেড্ডি কিন্তু জামিনে মুক্ত। দ্বিতীয়জন আবার তার বাবা মাগুন্তা শ্রীনিভাসুলু রেড্ডির হয়ে, যিনি এনডিএ’র অন্তর্গত টিডিপি’র পক্ষে ওঙ্গল কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছেন, দিব্যি প্রচার চালাচ্ছেন। প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্টকে হাতিয়ার করে ইডি ক্রমাগত বিরোধী দলের নেতাদের জামিন অযোগ্য ধারায় জেলে বন্দী করার চেষ্টা করছে। দিল্লী সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন গত দু’বছর ধরে জেলে বন্দী, শিক্ষামন্ত্রী মনীশ শিশোদিয়া গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে আটক রয়েছেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির ঘটনায় অবশ্য গোটা দেশজুড়ে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে এবং বিদেশেও মোদী সরকারের শাসনকালে ন্যায়ের অনুপস্থিতি নিয়ে তীব্র সমালোচনার সুর শোনা যাচ্ছে। আম আদমি পার্টির রাজ্যসভা সাংসদ সঞ্জয় সিং শেষমেশ সুপ্রিম কোর্টের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের জন্য জামিন পেয়েছেন এবং ইডিও সেই জামিনের রায়কে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখায়নি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজেপির লড়াই যে আদতে প্রহসন তা আজ স্পষ্ট। হেমন্ত বিশ্বশর্মা, শুভেন্দু অধিকারী, অজিত পাওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল, নবীন জিন্দাল — এরা প্রত্যেকেই একসময় বিজেপির কাছে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে গণ্য হলেও আজকে বিজেপির সাথেই সসম্মানে কাজ করে চলেছেন। এমনকি এখন গোদি মিডিয়া পর্যন্ত এই প্রশ্নগুলি বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের উদ্দ্যেশে করতে বাধ্য হচ্ছে। সম্প্রতি টাইমস নাউতে একটি সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নভীকা কুমারের সামনে অকপটে স্বীকার করেছেন যে, সমস্ত কালিমালিপ্ত নেতা মন্ত্রীরাই বিজেপির দরবারে স্বাগত। মধ্যপ্রদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা অবশ্য কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যুক্ত নেতাদের আবর্জনা হিসেবে ভূষিত করেছেন।
সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদীত ‘সিট’ (SIT) গঠনের দাবিও জোরালোভাবে উঠে আসছে। জাস্টিস বি ভি নাগারত্ন, যিনি বিমুদ্রাকরণ সম্পর্কিত সুপ্রিম কোর্টের ৪-১ রায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, সম্প্রতি জানিয়েছেন বিমুদ্রকরণের মাধ্যমে কালো টাকা তেমনভাবে সাদা হয়ইনি। সমগ্র মুদ্রার ৮৬ শতাংশ ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করার মাধ্যমে বিমুদ্রিত এবং সেই অর্থের ৯৮ শতাংশ ব্যাঙ্কে জমা এবং পরিবর্তিত হয়। যদি নগদ কালো টাকা সত্যিই থাকত, তাহলে কোন তদন্ত বা আইনি পদক্ষেপ ছাড়াই সেটি সাদা হয়ে যাওয়ার কথা। ঠিক এইভাবেই লোকসানে চলা বা বন্ধ হয়ে যাওয়া যে কোনো সংস্থাকে নির্বাচনী বন্ড ক্রয় ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া আদতে অর্থের বেআইনি লেনদেন এবং নিয়মমাফিক দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করে। এই কারণেই নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত সকল তথ্য প্রকাশ্যে আসা উচিত যাতে ক্ষমতায় থাকা পার্টিগুলির বিশেষ করে বিজেপির বেআইনি শ্রীবৃদ্ধির শিকড়ে পৌঁছনো যায়।
উনিশ শতকে ইংরেজিতে প্রচলিত একটি কথা, ‘ক্ষমতা ডেকে আনে ভ্রষ্টাচার, আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ডেকে আনে চূড়ান্ত ভ্রষ্টাচার’, মোদীর আমলে ভারতবর্ষে অদ্ভুত ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের হাতে যেভাবে সকল ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়েছে, যার ফলস্বরূপ বিমুদ্রাকরণ এবং নির্বাচনী বন্ডের মতো সিদ্ধান্ত লাগু হয়েছে, তা আদতে প্রকাশ্যে সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির পথই প্রশস্ত করে। বিভিন্ন অসংবিধানিক সিদ্ধান্ত এবং তার ভয়াবহ ফলাফলগুলিকে নিরাময় করার দায়িত্ব জনগণকে তাদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে নিতে হবে। মোদী সরকারের অসাংবিধানিক স্বৈরাচারের মুখোমুখি জনগণের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং ক্ষমতার আদর্শকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। সময় বদলাচ্ছে, অত্যাচারের দিনও ঘনিয়ে এসেছে।
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২ এপ্রিল ২০২৪
প্রিয় দেশবাসী,
ভারতের সংবিধানকে, সংবিধান নির্দেশিত বহুদলীয় গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে এতদিন ধরে আমরা স্বতঃসিদ্ধ ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলাম। ২০২৪’র নির্বাচন যে চেহারা নিচ্ছে তাতে আর সে উপায় থাকছে না। মোদী সরকার ভারতকে একদলীয় রাষ্ট্রে পর্যবসিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। দিল্লীর ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী সহ দু’জন মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নির্বাচনের প্রাক্কালে, এবং ভারতের প্রধান বিচারপতিকে হেনস্থা করা হচ্ছে অসাংবিধানিক ইলেক্টোরাল বন্ডকে খারিজ করে দেওয়ার জন্য, যে বন্ড ব্যবস্থা দুর্নীতিকে আইনি বৈধতা দিয়েছিল।
মোদী শাসনের দশ বছরে সংসদীয় গণতন্ত্রকে খর্ব করার চেষ্টা বিপজ্জনক মাত্রা নিয়েছে। এখন সরকার সংবিধানে আরও মারাত্মক আঘাত হানতে ৪০০+ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরির লক্ষ্য নিয়েছে। পরপর তৃতীয়বারের জন্য এবারেও মোদী সরকার ক্ষমতায় এলে তা সংবিধান ও সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে চরম বিপর্যয় ঘটবে। বিপন্ন হবে আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও প্রতিদিনের বেঁচে থাকা।
সরকার নানা রকম অসাংবিধানিক পথ নিচ্ছে এবং স্যাঙাতি কর্পোরেট ও গোদী মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় নির্লজ্জ নীতিহীন অপকৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে। আমরা ভারতের জনগণ, আমাদের ভোট দেওয়ার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই বিপর্যয়কর রাজত্বের অবসান ঘটাব এবং ভারতকে এক সুস্থ সবল গণতন্ত্র হিসেবে পুনর্গঠিত করব। অনুগ্রহ করে আপনার ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন। প্রতিটি ভোট যুক্ত হোক ভবিষ্যৎ ভারতের এই নির্ধারক সংগ্রামে, স্বৈরতন্ত্রকে পরাস্ত করে গণতন্ত্রের বিজয়ের লক্ষ্যে।
কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন নিম্নলিখিত সনদের জন্য লড়াই করবে, সংসদের ভিতরে ও বাইরে। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্যতম শরিক হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি যে এই পরিবর্তনগুলি ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম করে তুলবে।
১। ভোট অবশ্যই হতে হবে কাগজের ব্যালটে। ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে যথেচ্ছ কারচুপি করা যায়, তাই ইভিএমে ভোট বন্ধ করতে হবে।
২। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগ, চাকুরির শর্ত ও কার্যকালের মেয়াদ) আইন, ২০২৩ বাতিল করতে হবে এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশানুযায়ী সিলেকশন কমিটিতে ভারতের প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতাকে রেখে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করতে হবে।
৩। রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী খরচের ওপর একটি কার্যকরী সীমা আরোপ করতে হবে।
৪। নির্বাচকমণ্ডলীকে প্রয়োজনে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার অধিকার দিতে হবে।
৫। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দলত্যাগ করলে নির্বাচিত সংস্থা থেকে তৎক্ষণাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে।
১। কর্মনিযুক্তি, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও আবাসের অধিকারকে অবশ্যই মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
২। বৈষম্যমূলক সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বাতিল করতে হবে।
৩। ইউনিফর্ম সিভিল কোডের (অভিন্ন দেওয়ানি বিধির) যে কোনও ধারণা খারিজ করতে হবে।
৪। ‘আধার’ ও অন্যান্য বায়োমেট্রিক সংযুক্ত চিহ্নিতকরণ পত্র ও প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। সমস্ত কল্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধা যাতে সবাই পেতে পারে তার সংস্থান রাখতে হবে।
৫। বৈষম্য-বিরোধী একটি আইন লাগু করতে হবে যা যৌন প্রবণতা, লিঙ্গ পরিচিতি, অক্ষমতা, জাত ও ধর্ম ভিত্তিক সমস্ত বৈষম্য নিষিদ্ধ করবে।
৬। ভারতীয় অভিবাসীদের উৎপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ওসিআই’এর ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
১। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন, সরকারি কোম্পানি ও সরকার-অধিগৃহীত সংস্থায়, সংরক্ষিত পদ সহ সমস্ত শূন্যপদ অবিলম্বে পূরণ করতে হবে।
২। চাকরি বা কাজ নেই এমন সকলের জন্য বেকার ভাতা দিতে হবে।
৩। বেসরকারি ক্ষেত্রেও প্রান্তিক জাতি ও জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে অবশ্যই সংরক্ষণ চালু করতে হবে।
৪। সেনাবাহিনীতে ‘অগ্নিপথ প্রকল্প’ বাতিল করতে হবে।
১। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি অবশ্যই মাসিক ৩৫,০০০ টাকা হতে হবে।
২। শ্রমিক-বিরোধী চার শ্রমকোড বাতিল করতে হবে।
৩। পুরোনো পেনশন স্কিম ফিরিয়ে আনতে হবে।
৪। অসংগঠিত ও অনিয়মিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার সুযোগের (স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবসরকালীন সুযোগ সহ) আওতায় আনতে হবে। যে কোনও ক্ষেত্রে, ভিডিএ (পরিবর্তনশীল মহার্ঘ ভাতা) সংযুক্ত ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা মাসিক পেনশন চাই।
৫। প্রকল্প, চুক্তি, আউটসোর্স ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক সহ সমস্ত চুক্তিভিত্তিক ও সাময়িক পদের নিয়মিতকরণ করতে হবে।
৬। সমস্ত কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি এবং শিশু-পরিচর্যার ব্যবস্থা আবশ্যিকভাবে চালু করতে হবে। নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে সব ধরনের লিঙ্গবৈষম্যমূলক নীতির অবসান ঘটাতে হবে।
১। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে সমস্ত ধরনের ফসলের জন্য অবশ্যই সি২+৫০ শতাংশ ফর্মুলায় ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ‘এমএসপি’র আইনি গ্যারান্টি চাই।
২। কৃষক ও গ্রামীণ মজুরদের সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া সমস্ত ঋণ মকুব করতে হবে
৩। কৃষি অনুদান সুনিশ্চিত করতে হবে এবং সার ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সুলভ মূল্যে সহজলভ্য করতে হবে।
৪। সমস্ত ভাগচাষিকে নথিভুক্ত করে কৃষক হিসেবে তাঁদের অধিকারগুলি সুনিশ্চিত করতে হবে; সিলিং-উদ্বৃত্ত জমি, বাস্তু জমি, ভূদান জমি, মঠ মন্দিরের জমি এবং পতিত জমি অবশ্যই ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।
৫। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা আইন (এনআরইজিএ) অনুযায়ী কর্ম-প্রত্যাশী সকলের জন্য দৈনিক ন্যূনতম ৬০০ টাকা মজুরি ও বছরে ২০০ দিন কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
১। আবাসন, পানীয় জল, জনস্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ করে পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সমস্ত শহর ও নগরবাসীর জন্য অবশ্যই সুলভে সমানভাবে লভ্য হতে হবে।
২। ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান এখনই বন্ধ করতে হবে এবং বস্তিবাসীদের অবশ্যই সুরক্ষিত করতে হবে। উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের একই এলাকা বা স্বাভাবিক বাসযোগ্য স্থানে (ইন-সিটু) পুনর্বাসন দেওয়াকেই ‘নিয়ম’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৩। সমস্ত শহরবাসীর জন্য চাই সুলভ গণপরিবহন ব্যবস্থা।
৪। একটি পৌর কর্মনিশ্চয়তা আইন অবিলম্বে প্রণয়ন করতে হবে শহরের কর্মপ্রার্থীদের চাহিদা মেটাতে।
১। একটি ‘সর্বভারতীয় জাতি জনগণনা’ পরিচালনা করতে হবে এবং তার ভিত্তিতে সংরক্ষণের পরিধি প্রসারিত করতে হবে।
২। গ্রাম ও শহরের সমস্ত গৃহহীন পরিবারের জন্য বিনামূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা।
৩। প্রতিটি পরিবারকে মাসে ৫০ কেজি খাদ্যশস্য ও তার সাথে চিনি, দুধ, ডাল ও ভোজ্য তেল সরবরাহের উদ্দেশ্যে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় গণবন্টন ব্যবস্থাকে সার্বজনীন করে তোলা আজ অত্যন্ত জরুরি।
৪। সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবার মূল্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৫। এসসি/এসটি সাবপ্ল্যান আইন, ২০১৩; এসসি/এসটি নিপীড়ণ নিবারণ আইন, ১৯৮৯/১৯৯৫; এবং ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারস (হাতে করে বর্জ্য সংগ্রহকারী) আইন, ২০১৩, অবশ্যই কঠোরভাবে বলবৎ করতে হবে এবং বিষয়টি নিয়মিত নজরদারিতে রাখতে হবে।
৬। বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের (পিডব্লুডি) সমস্ত জনপরিসরে ও পরিবহনে সমান প্রবেশাধিকার চাই। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে ৫ শতাংশ আসন তাঁদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে; তাঁদের উপার্জনের ওপর কোন কর আরোপ করা চলবে না; তাঁদের ব্যবহার্য সহায়তাকারী প্রযুক্তি ও যন্ত্রাদির জন্য সরকারি অর্থানুকূল্যের পর্যাপ্ত সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৭। প্রবীণ নাগরিক, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি এবং বিধবাদের মাসে ১০,০০০ টাকা পেনশনের নিশ্চয়তা দিতে হবে যা মাহার্ঘ ভাতা ‘ডিএ’র সাথে সংযুক্ত থাকবে।
৮। সাচার কমিটি ও রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশগুলির সার্থক ও সময়ানুগ রূপায়ণ চাই।
১। সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলিতে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ (ওবিসি কোটার প্রবিধান সহ) অবিলম্বে লাগু করতে হবে। তদুপরি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলিতে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত রাখতে হবে।
২। যৌন নিপীড়ন, গার্হস্থ্য হিংসা, ‘সম্মানরক্ষার’ নামে অপরাধের শিকার এবং হিংসার সম্মুখীন ভিন্ জাত ও ভিন্ ধর্মের প্রেমিক প্রেমিকাযুগল — এদের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় অনুদানপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা, কার্যকরী হেল্পলাইন ও সহযোগিতা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে।
৩। পার্সোনাল ল’গুলির সংস্কার যেন মহিলাদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকারগুলির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়।
৪। রূপান্তরকামী গোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জন্য নালসা (এনএএলএসএ) রায়-নির্দেশিত সমস্ত ধরনের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও কল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলি নিশ্চিত করতে হবে।
৫। এলজিবিটিকিউআইএ+ ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত আইনি সুরক্ষা ও সহায়ক ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। ‘সিভিল ইউনিয়ন’ সম্পর্কে আবদ্ধ হতে ইচ্ছুক যে কোনো দুটি মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্যে যৌন প্রবণতা ও লিঙ্গ পরিচিতিগত বৈষম্যহীন একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে। (সিভিল ইউনিয়ন = সমকামী যুগলের জন্য একটি আইনি মর্যাদা যার সুবাদে ঐ দম্পতি বিষমকামী কোনো দম্পতির মতোই আইনি অধিকার ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন। এই আইনি মর্যাদার সঙ্গে কর্মসংস্থান, উত্তরাধিকার, সম্পত্তি, পিতা-মাতার অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলিও যুক্ত।)
৬। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের হেনস্থা বন্ধ করতে বিশাখা গাইডলাইন কঠোরভাবে বলবৎ করতে হবে। জাস্টিস ভার্মা কমিটির রিপোর্টের সমস্ত সুপারিশ কার্যকর করতে হবে।
১। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ অবশ্যই বাতিল করতে হবে। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে জিডিপি’র ১০ শতাংশ করতে হবে।
২। স্কুল শিক্ষার সমস্ত স্তরে চাই মাতৃভাষায় অবৈতনিক শিক্ষা। সংস্কৃত বা অন্য কোনও ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।
৩। শিক্ষায় সংরক্ষণের প্রশ্নে চালু আইনি প্রবিধানগুলি কঠোরভাবে লাগু করতে হবে। এই প্রবিধানগুলি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যও প্রযোজ্য হবে।
৪। জাত ও লিঙ্গবৈষম্য নির্মূল করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। ‘রোহিত ভেমুলা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে এবং সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন হয়রানি বিরোধী লিঙ্গ সংবেদনশীলতা কমিটি (জিএসক্যাশ)’ গঠন করতে হবে।
৫। স্কুলের মিড-ডে-মিল প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যাহ্ন ভোজনে ডিম ও মাংস দিতে হবে।
৬। নীট (এনইইটি) ও সিউয়েট (সিইউইটি) প্রত্যাহার করতে হবে।
১। বিনামূল্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা এবং সুলভ মূল্যের ওষুধ সকলের জন্য নিশ্চিত করতে হবে।
২। সরকারি হাসপাতাল ও পিএইচসি ক্লিনিকের সংখ্যা অতি অবশ্যই বাড়াতে হবে এবং সেগুলির গুণগত মান উন্নত করতে হবে।
১। সমস্ত কর্পোরেটমুখী নীতি ও অরণ্য/পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের বিভিন্ন সংশোধনীকে অবশ্যই বাতিল করতে হবে। যে সব শিল্প পরিবেশকে দূষিত করছে তাদের কঠোরভাবে শাস্তি দিতে হবে।
২। বনাধিকার আইন (এফআরএ) কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বনের জমি ও বনসম্পদের ওপর বনের অধিবাসীদের অধিকার তিলমাত্র খর্ব করা চলবে না। অরণ্য থেকে এবং তাদের জমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা চলবে না, হাসদেও অরণ্যে আদানির প্রজেক্ট অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
৩। হিমালয় ও অন্যান্য বাস্তুতন্ত্র সংবেদী অঞ্চলে বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্প নিষিদ্ধ করতে হবে। যোশিমঠের বিপর্যয় বিপন্ন মানুষদের জন্য বিশেষ পুনর্বাসন, পুনর্গঠন ও সুস্থিতির প্যাকেজ আনতে হবে।
১। অতি ধনীদের সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারের ওপর ১ শতাংশ হারে বাধ্যতামূলক কর আরোপ করতে হবে এবং কর্পোরেটদের করের হার বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি থেকে কর্পোরেটদের নেওয়া যে সব ঋণ জমা-খরচের খাতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে (রিটন্ অফ) বা যেগুলির পরিশোধ দীর্ঘ দিন ধরে বকেয়া পড়ে আছে (নন পারফর্মিং অ্যাসেট), সেগুলি অবশ্যই কর্পোরেট কোম্পানিগুলি থেকে উদ্ধার করতে হবে।
২। কর্পোরেট দায়বদ্ধতা সংক্রান্ত সার্বিক সুসমন্বিত একটি আইন আনতে হবে যার মধ্যে, কোম্পানির পরিচালন বোর্ডে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব, আর্থিক স্বচ্ছতা, পার্টিকে চাঁদা দেওয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ, কর ফাঁকি নিবারণ ও কর্মক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
৩। বুনিয়াদি পরিকাঠামো ও বিত্তীয় ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। সরকারি ক্ষেত্রের ইউনিটগুলিকে এবং মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলিকে পুনরুজ্জীবিত ও শক্তিশালী করা দরকার। ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন বাতিল করতে হবে।
৪। অরণ্য ভূমি, উপকূল এলাকা ও পরম্পরাগতভাবে মাছ ধরার এলাকাগুলির বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে।
৫। জিএসটি প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং পণ্য ও পরিষেবার ওপর প্রগতিশীল (ক্রমবর্ধমান হারে) করা রোপ নীতি লাগু করতে হবে।
১। তথ্যের অধিকার আইনকে শক্তিশালী করতে হবে।
২। জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান ঘটাতে, পুলিশ প্রশাসন ও কারার সংস্কার এক অতীব জরুরি প্রয়োজন হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রশাসনে অধিকতর স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার শুরু করা দরকার।
৩। সমস্ত দমনমূলক আইন, যেমন আনল’ফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ইউএপিএ), আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (আফস্পা), এবং তিনটি ক্রিমিনাল কোড প্রত্যাহার করতে হবে। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
৪। জাতিগত ও সম্প্রদায়গত গণনিধনের মতো অপরাধ এবং বিচারবহির্ভূতভাবে মেরে ফেলার মতো অপরাধগুলির বিচারের জন্য অবশ্যই বিশেষ আদালত (ট্রাইব্যুনাল) গঠন করতে হবে।
৫। আরাধনাস্থল (বিশেষ প্রবিধান) আইন, ১৯৯১, কঠোরভাবে বলবৎ করতে হবে।
৬। আমীর দাস কমিশনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে এবং বিহারের নিষিদ্ধ রণবীর সেনার (ভূস্বামীদের নিজস্ব বাহিনী) রাজনৈতিক যোগসূত্রগুলি খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করতে হবে।
১। যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিমালা জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। রাজ্যগুলির বকেয়া প্রাপ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মিটিয়ে দিতে হবে। রাজ্যপাল পদটি তুলে দিতে হবে।
২। আঞ্চলিক অসাম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলিকে ‘বিশেষ মর্যাদা’ দেওয়ার মাধ্যমে বিশেষ সহযোগিতা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
৩। জম্মু ও কাশ্মীর, দিল্লী এবং পুদুচেরিকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দিতে হবে। লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলভূক্ত করতে হবে।
৪। উত্তর পূর্বাঞ্চলের স্বায়ত্তশাসিত জেলা কাউন্সিলগুলিকে অধিকতর স্বাধীনতা দিতে হবে। অসমের কার্বি আংলং অঞ্চলকে স্বশাসিত রাজ্যের মর্যাদা প্রদানের জন্য অবশ্যই অনুচ্ছেদ ২৪৪(ক) বলবৎ করতে হবে।
১। ভারতকে অবশ্যই তার প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের অনুশীলন করতে হবে। জোট নিরপেক্ষতার নীতি বজায় রাখতে হবে এবং শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের নিজেদের জন্য এমন একটি বিদেশ নীতি সুনিশ্চিত করতে হবে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী শক্তিগুলির স্বার্থ ও অগ্রাধিকারগুলি থেকে মুক্ত থাকবে।
২। সকল ভারতীয় যুবক, যাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে এবং রাশিয়া ও অন্যান্য দেশে ভাড়াটে সৈন্য বা সেনার সহকারী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, তাদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
৩। বর্ণবিদ্বেষী, গণহত্যাকারী ইজরায়েল রাষ্ট্রের সাথে সমস্ত সামরিক, অর্থনৈতিক এবং শ্রম সংক্রান্ত চুক্তি বাতিল করতে হবে। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করার জন্য ভারতকে উদ্যোগী হতে হবে।
পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে সৌভিকের লেখা পড়লাম। এখন অ্যাকাডেমিক লেখার সময় নয়। অমৃতা রায় বলেছেন, “মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিলেন। এটা না করলে সনাতন ধর্ম বিলুপ্ত হত। সিরাজ অত্যাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। ... জগৎ শেঠ ও অন্যান্য রাজারাও ব্রিটিশকে সমর্থন করাতেই সফলতা আসে।”
এ মুহূর্তে বিজেপি “ব্রিটিশকে ক্ষমতায় বসানোকে সফলতা” বলতে চাইছে। বেশ, অত্যাচারী মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের বিতারিত/পদানত করে তোমরা হিন্দু রাষ্ট্র কায়েমের চেষ্টা কর। জনগণ সে প্রয়াসের মোকাবিলা করবে। কিন্তু যে মুখে তোমরা ব্রিটিশের জয়গান গাইছ, খবরদার, সেই মুখে ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা, বিনয়-বাদল-দীনেশ, ভগৎ সিং, নেতাজির নাম উচ্চারণ করবে না। কারণ তাঁরা সকলেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জীবন উৎসর্গ করেছেন। সিরাজ কেমন লোক ছিলেন, সেযুগের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমনতর ছিল — সেসব ব্যাখ্যায় বিজেপিকে কুপোকাত করা যাবে না। সৌভিক সেই পথে হাঁটেননি। এই সময় এ ধরনের লেখা দেশব্রতীতে না ছাপানোই সঠিক হত।
- মুকুল কুমার
চটকলের ত্রিপাক্ষিক চুক্তির তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল চুক্তির পর থেকেই ইউনিয়নগুলোর অভ্যন্তরে চুক্তি কার্যকর করার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। মিল কর্তৃপক্ষ এটাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে চুক্তি কার্যকর করতে অনীহা দেখাচ্ছে। এরই মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়েছে এবং ইউনিয়নগুলো নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে।
মিল কর্তৃপক্ষ প্রথমে অল্প সংখ্যক শ্রমিককে ১৫ দিনের মধ্যে ১২ দিন কাজ করলে উৎসাহ ভাতা হিসেবে প্রতিদিন আতিরিক্ত ২০ টাকা করে দেওয়া শুরু করে। ফলে বেশিরভাগ শ্রমিকের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়। ইউনিয়নগুলো শ্রমমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানায় ইংরেজি ভাষার যে ফাঁক ফোঁকর আছে মিল কর্তৃপক্ষ তা কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে নিজেদের মতো করে চুক্তির ব্যাখ্যা করছেন। অতিরিক্ত শ্রম সচিব তা মেনে নিয়ে ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে সংশোধনী দেন। তিনি লেখেন ৩ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে স্বাক্ষরিত চটকলে শিল্পব্যাপী ত্রিপাক্ষিক চুক্তি চূড়ান্ত করার সময়, টাইপে ভুল হয়েছে। ৩ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে উপস্থিত সব পক্ষ সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে হাজিরা ভাতা, মজুরি বোর্ডের অধীনে থাকা কর্মীরা বাদে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত এন্ট্রি-লেভেল কর্মী সহ সমস্ত কর্মীরা এক পাক্ষিকে ১২ দিন কাজ করলে প্রতিদিন ২০ টাকা করে অতিরিক্ত ভাতা পাবেন। এই চিঠি প্রকাশের পরে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ কিছুটা স্তিমিত হয়।
১৪ মার্চ ২০২৪ তারিখে চটকলের মনিটরিং কমিটির প্রথম মিটিং হয়। এই বৈঠকে উঠে আসে – বেশ কয়েকটি চটকলের কর্তৃপক্ষ এখনও ত্রিপাক্ষিক চুক্তি মানছে না। মনিটরিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে ১১৩টি মিলকে অতিরিক্ত শ্রম সচিব এক কড়া চিঠিতে লেখেন – “চটকলে ৩ জানুয়ারি ২০২৪ সর্বশেষ শিল্পব্যাপী ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল এবং পরবর্তী সংশোধনী ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ সহ পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত অপারেটিং জুট মিল (বড় বা ছোট) এবং যে কোনো নতুন চটকলের জন্য প্রযোজ্য হবে। এই চুক্তি কোনভাবে লঙ্ঘিত হলে, রাজ্য সরকার সেই সব মিলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এবং চটের ব্যাগের পরবর্তী বরাত দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য জুট কমিশনারকে জানাবেন”।
চুক্তির পর থেকে হাতে গোনা কয়েকটা মিল ছাড়া বেশিরভাগ মিল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী চুক্তির ব্যাখ্যা দিতে থাকে। সেই অনুযায়ী ফ্লোরে তা কার্যকর করার চেষ্টা চালায়, ফলে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। একাধিক মিলে বিক্ষোভ, ধর্ণা ও কর্মবিরতি শুরু হয়। ম্যানেজমেন্ট কয়েকটি মিলে সাস্পেনশন অফ ওয়ার্ক বা লক আউট ঘোষণা করেছে। ভিক্টোরিয়া জুট মিলে ৬ এপ্রিল থেকে লক আউট ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে চার হাজার শ্রমিক কর্মহারা হলেন। নর্থ শ্যামনগর মিলে বেশ কয়েকদিন লড়াই চালানোর পর ১ এপ্রিল থেকে সাস্পেনশন অফ ওয়ার্ক জেলা শ্রম দপ্তরের মধ্যস্থতায় প্রত্যাহার করা হয়। চুক্তিতে চটকল আধুনিকীকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের ধাপে ধাপে তা কার্যকর করার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ম্যানেজমেন্ট একতরফাভাবে বাছবিচার ছাড়াই শ্রমিকদের বিভিন্ন বিভাগে ট্রান্সফার করছে। বিশেষ করে তাঁত ডিপার্টমেন্ট থেকে অন্য বিভাগে। পুরনো তাঁত তুলে দিয়ে তার জায়গায় এস ৪ লুম (চায়না লুম নামে খ্যাত) বসাচ্ছে। যেখানে পুরোনো তাঁতে একজন তাঁতিকে দুটো তাঁত চালাতে হোত, মিল কর্তৃপক্ষ একজন তাঁতিকে কোথাও ৬টা বা তার বেশি তাঁত চালানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছে। এই চায়না লুমে উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। যেখানে চুক্তিতে বলা হয়েছে প্রডাক্টিভিটি কাউন্সিল বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে ম্যান- মেশিন রেশিও এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করবে, সেখানে কর্তৃপক্ষ আগেই চুক্তিতে আধুনিকীকরণের বিষয়টি তাদের নিজেদের স্বার্থে নিজেদের ইচ্ছামতো একতরফাভাবে লাগু করছে। কোথাও স্ট্রেট ডিউটি, কোথাও মহিলাদের রাতে কাজ করানো ইত্যাদি যা সব ইউনিয়নের সহমতের ভিত্তিতে হওয়ার কথা, তা মানা হচ্ছে না। বিপরীতে শ্রমিকদের স্বার্থে স্থায়ীকরণ করা, হাজিরা ভাতা দেওয়া, ঠিকা ও ভাউচার প্রথা তুলে দেওয়া, বকেয়া গ্র্যাচুইটি প্রদানের ব্যবস্থা করা, নতুন শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি ইন্সিওরেন্সের সাথে যুক্ত করা, মহিলা শ্রমিকদের যৌন হয়রানি রোধে আইসিসি গঠন প্রভৃতি বিষয় কার্যকর করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কোনো হেলদোল নেই। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের উপর নতুন নতুন কায়দায় আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে।
অর্ডারের অভাব দেখিয়ে মিলে কাজের সময় ও দিনের সংখ্যা কমানো হচ্ছে। আইন অনুযায়ী খাদ্যশস্য রাখার জন্য চটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কেন্দ্রীয় খাদ্য নিগম সেই মতো চটকলগুলোকে বরাত দেয়। চটকল মালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ গত রবি মরসুমে সেপ্টেম্বর – অক্টোবর যত বরাত দেয়া হয়েছিল, নেওয়া হয়েছে তার থেকে কম। আইজেএমএ-এর তথ্য অনুযায়ী, “২২.৮৬ লক্ষ বেল চটের বস্তা (১ বেল মানে ৫০০ বস্তা) কিনবে। কিন্তু বাস্তবে তারা কিনেছে ১৪.৫২ লক্ষ বেল। ৮.৩৪ লক্ষ বেল কম কিনেছে। এর ফলেই চটকলগুলি বস্তার উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে” (সূত্র আনন্দবাজার)।
চটকলে উৎপাদন কমানোর ফলে কাঁচা পাটের চাহিদা কমেছে। ফলে পাট চাষিরা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকেও কুইন্টাল প্রতি ৮০০-১০০০ টাকা কমে কাঁচা পাট বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
আইজেএমএ-র চেয়ারম্যান রাঘবেন্দ্র গুপ্ত বলেন, “বরাতের অভাবে ইতিমধ্যেই চটকল বন্ধ হতে শুরু করেছে। অনেক কলে সপ্তাহে ৪-৫ দিনের বেশি কাজ হচ্ছে না। শিফট কমেছে। প্রায় ৫০,০০০ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তক্ষেপের জন্য আর্জি জানিয়েছি আমরা।” (সুত্র আনন্দবাজার)
জুট এন্ড টেক্সটাইল ডিপার্টমেন্ট জানাচ্ছে বরাতের পরিমাণে কোনো ঘাটতি নেই। তথ্য অনুযায়ী তারা জানাচ্ছে মার্চ মাসে বরাতের পরিমাণ ৫৫৮২৪৪ যা বরাতের ১০০ শতাংশ। বরং বেশ কিছু মিল বরাত অনুযায়ী চটের ব্যাগ সরবারহ করতে পারেনি। রাজ্য শ্রম দপ্তরকে কেন্দ্রীয় টেক্সটাইল মন্ত্রকের তথ্য এবং আইজেএম-এর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই কর জরুরি। কেন্দ্রীয় সরকারের বরাত এবং কাঁচাপাটের সহায়ক মূল্য বাড়ানোর জন্য রাজ্য সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নির্বাচনের সময় কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকারের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের পালা চলছে। তার শিকার হচ্ছেন সাধারণ শ্রমিকরা। অনেকেই বলছেন এস ৪ লুম (চায়না লুম) দিয়ে অধিক উৎপাদন করানোর ফল হল কাজের সময় ও দিন কমানো এবং একই মজুরিতে শ্রমিকদের অতিরিক্ত খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অধিক উৎপাদনের জন্যে শ্রমিকরা অতিরিক্ত উৎপাদন ভাতা পাচ্ছেন না। এমন কী দিন বা সময় কমানোর জন্য কর্তৃপক্ষ চটকলের স্ট্যান্ডিং অর্ডারের নিয়ম অনুযায়ী লে-অফ দিচ্ছে না। স্ট্যান্ডিং অর্ডারের ১২ নং ধারা অনুযায়ী শ্রমিকরা লে-অফ পাওয়ার অধিকারী। ১২ নং ধারার (ক) নিয়োগকর্তা, যে কোনো সময়, আগুন, বিপর্যয়, যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে যাওয়া বা বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হওয়া, মহামারী, নাগরিক গোলযোগ, কয়লা বা কাঁচামাল বা আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রীর সরবারহের ঘাটতি, উৎপাদনের লাইনের পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণের অতীত অন্যান্য কারণে, কোনও বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই যে কোনও এক বা একাধিক সময় পর্যায়ের জন্য, আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠানের কোনও একটি বা একাধিক বিভাগ বন্ধ করে দিতে পারে। (খ) এইভাবে কাজ বন্ধ করার ক্ষেত্রে, একজন শ্রমিক বা কর্মী শিল্প বিরোধ আইনের বিধান অনুযায়ী, মজুরি পাওয়ার অধিকারী।
কিন্তু এই ধারা অনুযায়ী শ্রমিকদের লে-অফ দেওয়া হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ইউনিয়ন ছাড়াই শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভে সামিল হচ্ছেন। রাজ্য শ্রম দপ্তর এই প্রশ্নে অদ্ভুতভাবে বধির, নিষ্ক্রিয় ও নিরুত্তর। বিসিএমএফ ইতিমধ্যে রাজ্য শ্রমমন্ত্রীকে ২ এপ্রিল চিঠি দিয়ে আবেদন করেছে চটকলের বর্তমান অবস্থায় হস্থক্ষেপ কারার জন্য। শ্রমমন্ত্রীকে লেখা বিসিএমএফ-এর চিঠি — “বেশ কিছু চটকল কর্তৃপক্ষ অপর্যাপ্ত অর্ডারের অজুহাতে শিফট ও কর্মদিবস কমিয়ে দিচ্ছে। এতে হাজার হাজার শ্রমিক গভীর আর্থিক সংকটে পড়ছেন। মিল মালিকদের এই স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত পবিত্র রমজান মাস ও সাধারণ নির্বাচনের সময়, স্পষ্টতই শিল্পে অশান্তি সৃষ্টি করছে এবং শিল্প-সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আমরা মিলে স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে এবং শিল্পে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য এবং অবিলম্বে এই বিষয়টির সমাধানের উদ্দেশ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক আহ্বান করার জন্য আপনাকে একান্ত অনুরোধ করছি”।
অন্যান্য ইউনিয়নগুলোর সাথেও যোগাযোগ করা হচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে মিল কর্তৃপক্ষ ও সরকারের উপর চাপ বাড়ানো জন্য। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, নির্বাচনের আগেই কিছু একটা করতেই হবে। অন্যথায় ২.৫ লক্ষ চটকল শ্রমিক ও ৪০ লক্ষ পাট চাষির মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে যার প্রতিফলন ঘটতে পারে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে। শেষ বিচারে শ্রমিকদের আইনি অধিকার ও কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী হবে।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত
১১ এপ্রিল মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে জন্ম জয়ন্তী। ভারতকে ব্রাক্ষণ্যবাদের গোলামী থেকে মুক্ত করার আধুনিক রাজনীতির পথিকৃৎ তিনি। অর্থনৈতিক শোষণ আর সাংস্কৃতিক আধিপত্য যে পরস্পর সংযুক্ত সে সমাচার তিনি সেই উনবিংশ শতকেই তুলে ধরেছিলেন। ‘শুদ্র-অতিশুদ্র-স্ত্রী’ এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করে তিনি জাত ব্যবস্থা ও পিতৃতন্ত্রকে অবিচ্ছেদ্য হিসেবে দেখতে শিখিয়েছেন। ভারতের পুরান ও কিংবদন্তির বর্ণবাদী বয়ানকে ছিন্নভিন্ন করে তিনি সমগ্র ইতিহাসকে নিপীড়িত জনসাধারণের অবস্থান থেকে দেখতে শিখিয়েছিলেন। ভারতের সমাজকে শোষক ও শোষিতের এক “দ্বিবর্ণ” ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্লেষণ করেছেন। ইতিহাস বুঝিয়েছেন শোষক ও শোষিতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৈতিক সংঘাতের রাজনীতি হিসেবে। এবং এই যা কিছু তত্ত্বতালাশ তার সবকিছুকে বাল্য বয়স থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গণসংগ্রামের ময়দানে আর নিজস্ব যাপনে পালন করেছেন ফুলে যুগল — জ্যোতি ও সাবিত্রী, যথাক্রমে মাত্র ১৩ ও ১০ বছর বয়সকালে দুজনে মিলিত হওয়ার পর থেকে।
পশ্চিম ভারতে যখন জ্যোতিরাও ফুলে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “গোলামগিরি” রচনা করছেন, ঠিক তখনই পূর্ব ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব সামাজিক ধর্মঘট সংগঠিত হচ্ছিল, ১৮৭২ সালে, শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ভাবান্দোলনের পথ ধরে, কোনোরকম আর্থিক দাবি ব্যতিরেকে কেবলমাত্র সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে গ্রামীণ শ্রমজীবী শ্রেণীর প্রায় ছয় মাস ধরে চলা কাজ বয়কট আন্দোলন।
ফুলে যুগলের শিক্ষা ও আন্দোলনকে বিস্তারিত করেন বাবাসাহেব আম্বেদকর। জাতের বিনাশ, নারীমুক্তি, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং মনুবাদী রাজনীতিকে পরাস্ত করা ছিল তাঁর জীবন ও সংগ্রামের মূল কথা। ফ্যাসিবাদকে নিছক ইউরোপের বিষয় হিসেবে না দেখে মনুবাদের সাথে তার গভীর মতাদর্শগত যোগসূত্রকে দেখিয়েছিলেন আম্বেদকর। হিন্দুরাজকে দেশের গণতন্ত্রের চরম বিপর্যয় বলে সতর্ক করে তাকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করার আহ্বান রেখেছিলেন। ১৪ এপ্রিল আম্বেদকর জয়ন্তী।
১৯৬৯ সাল ৮ এপ্রিল সকাল ৭টা ৩২ মিনিট ৫ জন শ্রমিক মৃত্যুঞ্জয় কুন্ডু, হরপ্রসাদ আইচ, সৌমেন্দ্রনাথ রাউৎ, অমল ঘোষ ও ফৌজদার পাশোয়ানের তাজা রক্তে ভেসে গিয়েছিল কারখানার প্রবেশ পথ। কারখানা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সশস্ত্র রক্ষীবাহিনীর গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিল ৪ জন শ্রমিক, ৫ম জনের মৃত্যু রহস্য জনক, জনশ্রুতি রক্ষীবাহিনী পিটিয়ে মেরেছে।
১৯৬৮ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর সারা দেশে রেল, ডাক, প্রতিরক্ষা সহ কেন্দ্রীয় সরকারি শ্রমিক কর্মচারীদের একদিনের সফল ও সর্বাত্মক ধর্মঘট হয়েছিল। এই ধর্মঘটে তিনটি দাবি ছিল।
১) চাকুরীরত অবস্থায় মৃতের একজন পোষ্যের চাকরি, ২) প্রয়োজন ভিত্তিক ন্যুনতম মজুরি, ও ৩) তৃতীয় বেতন কমিশন গঠন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শ্রমিক কর্মচারীদের ওপর বরখাস্ত, চাকরিছেদ সহ অন্যান্য শাস্তি নামিয়ে এনেছিল। গান-এন্ড-শেল ফ্যাক্টরির শ্রমিক কর্মচারীরাও এর থেকে বাদ ছিলেন না। সেই অন্যায় ভাবে ছাঁটাই শ্রমিকদের পুনর্বহাল ও অন্যান্য শাস্তি প্রাপ্তদের শাস্তি মুকুবের দাবিতে কারখানায় কারখানায় আন্দোলন চলছিল।
সেদিন ৮ এপ্রিল ১৯৬৯ গান-এন্ড-শেল ফ্যাক্টরির অবিভক্ত মজদুর ইউনিয়নের নেতৃত্বে গেট মিটিং ছিল। মিটিং শেষে শ্রমিকরা যখন কারখানায় ঢুকছিলেন সেই সময় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী নিরপরাধ শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ করেছিল। তৎক্ষণাৎ ৪ জন শ্রমিকের রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে গিয়েছিল কারখানার গেটে, অসংখ্য শ্রমিক আহত হয়েছিলেন, বাকিরা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিলেন। স্থানীয় মানুষ জনের সহায়তায় আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। ইতিমধ্যে আরও একজন শ্রমিকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, জনশ্রুতি আছে ওকে রক্ষীরা পিটিয়ে মেরেছিল।
বাংলা সহ সারা দেশের শ্রমিক কর্মচারীরা সেই বর্বর ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ৯ এপ্রিল ১৯৬৯ স্থানীয়ভাবে বন্ধ পালিত হয়েছিল। ১০ এপ্রিল ১৯৬৯ সর্বাত্মক বাংলা বন্ধ হয় এই ঘটনার প্রতিবাদে।
তার পর থেকে এই দিনটি গান-এন্ড-শেল ফ্যাক্টরির শ্রমিক কর্মচারীদের কাছে এক স্মরণীয় দিন হয়ে আছে। এই দিনটি, শ্রমিক ঐক্য আরও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে ১৯৭০ সাল থেকে। শ্রমিক কর্মচারীদের লড়াইয়ের ফল স্বরূপ গান-এন্ড-শেল ফ্যাক্টরি কতৃপক্ষ এই দিনটি (৮ এপ্রিল) প্রতি বছর ছুটি ঘোষণা করে অন্য দিন কাজের পরিবর্তে।
গত ৮ এপ্রিল ২০২৪ গান-এন্ড-শেল ফ্যাক্টরির শ্রমিক কর্মচারীরা সকাল ৭টায় শহীদ বেদীর সামনে সমবেত হন। অবসর প্রাপ্ত শ্রমিক কর্মচারীরাও এসেছিলেন। ৭টা ৩২ মিনিটে শহীদদের প্রতি এক মিনিট নীরবতা পালন ও শপথ বাক্য পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর সমস্ত ফেডারেশন, সেন্ট্রাল ট্রেড ইউনিয়ন, কারখানার ইউনিয়ন ও এ্যাসোসিয়েশন নেতৃত্ব শহীদ বেদীতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে বেনু ঘটক, এনপিডিইএফ’এর পক্ষ থেকে শেখর সরকার ও ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ইউনিয়নের সম্পাদক সুবীর কুমার বোস মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
সুসজ্জিত মৌনমিছিল স্থানীয় এলাকা পরিক্রমা করে পুনরায় শহীদ বেদীতে ফিরে আসে। শহীদ স্মরণে, আপন মরণে, রক্ত ঋণ শোধ কর। শহীদের রক্ত, হবে নাকো ব্যর্থ। পঞ্চ শহীদ অমর রহে... ধ্বনিতে সভার সমাপ্তি হয়।
আমৃত্যু কমিউনিস্ট তথা সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের অন্যতম সংগঠক কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলী গত ১৬ মার্চ ২০২৪ প্রয়াত হন।
পার্টির পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উদ্যোগে তিনি ছিলেন বালি অঞ্চলের পরিচিত মুখ। কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলী পার্টির হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন দীর্ঘকাল এবং আমৃত্যু ছিলেন বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির সদস্য।
আমাদের প্রিয় সাথী প্রয়াত কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলীর অমলিন স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে এবং তার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে গত ৬ এপ্রিল ২০২৪ শনিবার বালি আশুতোষ গ্রন্থাগার (তরুণ সংঘ)-এ আয়োজিত হল তাঁর স্মরণসভা।
যদিও এই স্মরণসভা আদতে শপথসভায় পর্যবসিত হল স্বাভাবিকভাবেই। শপথ, প্রিয় কমরেডের স্বপ্নের ভারত গড়ার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার! শপথ, তাঁর জীবনবোধ ও পার্টির প্রতি নিষ্ঠার থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে শুধরে নেওয়ার! শপথ, তাঁর যুথবদ্ধতার চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার।
দুপুরের তীব্র দাবদাহ’কে অগ্রাহ্য করে পার্টির বিভিন্ন স্তরের কর্মী সমর্থক থেকে শুরু করে নেতৃত্বরা উপস্থিত হয়েছিলেন। উপস্থিত হয়েছিলেন বালি এলাকার বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথীরা যাদের সাথে নিবিড়ভাবে মিশেছিলেন কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলী। বালি সিনে গিল্ড, বালি উৎসব কমিটি, বালি সাধারণ গ্রন্থাগার কর্মী সংঘ এবং অন্যান্য বিভিন্ন ক্লাব সংগঠন ও ক্রীড়া জগৎের ব্যাক্তিরা। এসেছিলেন বালি অঞ্চলে আমাদের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী ও কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলীর বন্ধুপ্রতিম রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুনন্দা সিকদার।
এসেছিলেন প্রয়াত কমরেডের পরিবারের ব্যক্তিবর্গ ও তার বোনেরা।
সভার শুরুতে মাল্যদান করেন পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য তথা রাজ্যনেতা কার্তিক পাল, বাবুদা, দেশব্রতী সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী, জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, আইসা’র জাতীয় সভাপতি নিলাশিস বসু, মহিলা সমিতি তথা পার্টির জেলানেত্রী কল্যাণী গেস্বামী সহ বিভিন্ন সাথীরা। পার্টি ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও মাল্যদান করেন। মাল্যদান করেন কমঃ রঘুপতি গাঙ্গুলীর সহপাঠী ও পরিবারের ব্যক্তিরা। মাল্যদান শেষে তাঁর স্মৃতিতে নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় মূল স্মরণসভা।
প্রথমেই পার্টির হাওড়া জেলা কমিটির পক্ষ থেকে একটি স্মরণিকা পাঠ করেন জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত।
উদ্বোধনী সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী ও কবিয়াল কমরেড নীতীশ রায়। এরপরেই পার্টি, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা তাদের স্মৃতিচারণায় তুলে ধরেন কমঃ রঘুপতি গাঙ্গুলীর জীবনের নানান অজানা অধ্যায়।
এই সামগ্রিক আলাপচারিতায় শ্রোতাদের কাছে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল কমঃ রঘুপতি গাঙ্গুলীর পার্টি জীবন ও তাঁর সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন। মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল মিছিলে কমরেডের দেওয়া স্লোগান এবং তাঁর নাট্যমঞ্চের সংলাপ।
এমনই সেতু ছিলেন কমঃ রঘুপতি গাঙ্গুলী!
জলে যেমন মাছ মিশে থাকে, কমিউনিস্ট নকশালপন্থী রঘুপতি গাঙ্গুলী সেরকমই মিশে থাকতেন সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের সাথে।
বালির সংযোগ ও ইঙ্গিত সাংস্কৃতিক সংস্থার সাথীরা পরিবেশন করেন গণসঙ্গীত এবং শেষে আন্তর্জাতিকের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় স্মরণসভা। যদিও এক নতুন অধ্যায় শুরুর শপথ নিয়ে পথচলা শুরু তবুও আমরা জানি কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলী অমর হয়ে থাকবেন আমাদের প্রত্যেকটি মিছিলে, প্রত্যেকটি স্লোগানে।
কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলী লাল সেলাম।
ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করলেও সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি তুলে দেননি। কিন্তু কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদী সরকার আগামী লোকসভায় নির্বাচনে ৪০০ বেশি আসন জিততে চায়। দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা ও দেশের সংবিধানকেও পাল্টিয়ে দিতে চায়। এমনই অভিযোগ তুললেন বিভিন্ন নকশালপন্থী নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা। তারা বলেন, বিজেপি হিন্দু মন তৈরি করতে চাইলেও কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছে পাল্টা প্রতিরোধ। গত ২৫ মার্চ সিপিআই(এমএল)-এর ভূতপূর্ব নদীয়া জেলা সম্পাদক সমর পাল চৌধুরীর ৪৫তম শহীদ দিবসে ফুলিয়া ও বয়ড়া গ্রামে মিলিত হন বামপন্থী নেতা, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ ও শহীদদের পরিবার। সেখানে অনুষ্ঠিত সভা থেকে অভিযোগ ওঠে — কেন্দ্রে বিরাজ করছে একটা ফ্যাসিস্ট সরকার।
ইন্ডিয়া জোটের শরিক সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতা বাসুদেব বোস বলেন, “মহুয়া মৈত্র কোন দলের সংসদ এটা বড় কথা নয়। তিনি সংসদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছিলেন। তারজন্য তাকে বহিস্কার হতে হল। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হলেন। ফ্যাসিবাদ দরজায় কড়া নাড়ছে। সংবিধান পদদলিত। বিজেপিকে সরকার থেকে সরাতে পারলে বা তারা ক্ষমতায় না থাকলে তাদের নখ, দাঁত কিছুটা তো দুর্বল হবেই।” অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক ও একটি ক্ষুদ্র পত্রিকার সম্পাদক বৈদ্যনাথ সেনগুপ্ত বলেন, “নির্বাচনে বিজেপি হারলেও হিন্দুত্ববাদীদের থাবা হিন্দু মন তৈরির ফ্যাসিবাদী ধারা চালিয়ে যাবে। নেতিবাচক মানসিকতা হিসাবে রাম মন্দিরের পাল্টা জগন্নাথ ও হনুমান মন্দির তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে দিল্লী, হরিয়ানা সহ গোটা উত্তর ভারত জুড়ে কৃষকদের প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছে।” তিনি সিপিআই, সিপিএমের মতো বামেদের সমালোচনা করে বলেন, “ওদের নেতিবাচক ভূমিকায় আরএসএস-বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে।”
বিজেপি জনবিরোধী প্রকল্প হিসাবে হিন্দু-মুসলিম ভাগ করে ক্যা, এনআরসি চালু করতে চায়। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করেছে। ভাঙরে পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলন ও নবগঠিত সিপিআই(এমএল) মাস লাইনের নেতা অলীক চক্রবর্তী বলেন, “বুর্জোয়াদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সন্ত্রাসবাদী শাসন ফ্যাসিবাদ, এনআরসি ও ক্যা’র মাধ্যমে মুসলিমদের আরও দাবিয়ে রাখতে বিভাজনের রাজনীতির করছে বিজেপি। নাগরিকত্বের নামে ভাঁওতা দেওয়া হচ্ছে। ভারতের বাজার দখলই আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের লক্ষ্য। সার্ভার আমেরিকার হাতে। আমেরিকার অস্ত্রের ক্রেতা ভারত, পাকিস্তান। এটা মনে করার কারণ নেই ভারতকে বিশ্বের মধ্যে এরা শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে চায়।” প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ অসিত চক্রবর্তী ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন লক্ষণ তুলে ধরে বলেন, “যোগীর রাজ্যে দোষী মনে হলেই এনকাউন্টারে মেরে দেওয়া হয়। বুদ্ধিজীবীদের চাপে রাখা, ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের গাঁটছড়া, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা, এগুলো সবই ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। গোলওয়ালকার তাঁর বইতে লেখেন, পাকিস্তানকে ধ্বংস করাই একজন হিন্দুর মহান কর্তব্য। হিটলারের জার্মানির মতোই এখানে এক দেশ, এক বিধান, এক প্রধানকে তুলে ধরা হচ্ছে।” সিপিআই(এমএল) এনডি’র নেতা আশীষ দাশগুপ্ত বলেন, “চারু মজুমদার ও সরোজ দত্ত’কে রাষ্ট্রশক্তি হত্যা করেছে। এই ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মোকাবিলা করেই কমিউনিস্ট ও লাল ঝান্ডাধারীদের এগিয়ে যেতে হবে।”
অনুষ্ঠানে ১৯৭২ সালে শহীদ মহিউদ্দিনের পরিবারের সদস্য শিশুশিল্পী মাহীর গাইল, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। মহিউদ্দিনের ভাইঝি শিক্ষিকা মিরাজী আবৃত্তি করলেন আর বললেন, “আমার ছোট ছেলে মাহীর স্কুলে যেতে চায় না, কারণ বন্ধুরা বলেছে মিশবে না। আমরা মুসলিম।” দেশপ্রেমের কোলাজ আবৃত্তি করে সমবেতভাবে শিশুশিল্পী মাহীর, জেনিফার, সবনাজ, রাইনা, রায়ান। গণসঙ্গীতে মাতিয়ে দিলেন প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী নীতীশ রায়। গান গাইলেন শহীদ মহিউদ্দিনের ভাই হেসামউদ্দিন। এদিন সমর পালচৌধুরীর সঙ্গে ১৯৭২’র শহীদ গণেশ ঘোষ এবং ১৯৭৯-তে শহীদ বাচ্চু ঘোষ সহ অমর শহীদদের স্মরণ করা হয়।
- রথীন পাল চৌধুরী
কেন্দ্রে সমাসীন সরকারের ধারণা মনে হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিত্য মূল্যবৃদ্ধি সহ্য হয়ে গিয়েছে জনসাধারণের। তা না হলে ক্রমাগত খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে থাকলেও দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী ভাষণে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় না করে কেবল ধর্ম ও দুর্নীতির বাগাড়ম্বরে ভোট চাইতে পারেন?
সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ’বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সমস্ত ভোগ্যপণ্যগুলির, যার মধ্যে খাদ্য-পানীয়-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-ওষুধ-পরিবহণ এগুলি অন্তর্ভুক্ত, দাম বেড়েছে ৫ শতাংশের বেশি (৫.১ শতাংশ)। কিন্তু ওই সময়কালে খাদ্য ভোগ্যপণ্য সূচকের নিরিখে খাদ্য ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৯ শতাংশ। খাদ্য ভোগ্যপণ্যের মধ্যে যে সমস্ত পণ্য সাধারণ ভোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, চালের দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ, দানা শস্যের বেড়েছে ৮ শতাংশ, ডিমের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, সব্জির ৩৫ শতাংশ, মশলাপাতির ১৪ শতাংশ। ওই সময়কালে বিদ্যুতের মাশুল বেড়েছে ১০ শতাংশ, কেরোসিনের ১১ শতাংশ।
উপরেই বলা হয়েছে, ভোগ্যপণ্য সূচক অনুসারে ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.১ শতাংশ। সারা দেশে সেই হার সমান নয়। মণিপুরে সব থেকে বেশি ১১ শতাংশ, ওড়িশায় ৭.৬ শতাংশ, তেলেঙ্গানায় ৬.৭ শতাংশ, হরিয়ানায় ৬.৩ শতাংশ, আসাম ৬ শতাংশ, ঝাড়খন্ড ৫.৯ শতাংশ, কর্ণাটক ৫.৭ শতাংশ, অন্ধ্রপ্রদেশ ৫.৭ শতাংশ, গুজরাট ৫.৪ শতাংশ, রাজস্থান ৫.৩ শতাংশ, উত্তরপ্রদেশ ৫.৩ শতাংশ, পাঞ্জাব ৫.২ শতাংশ। উক্ত ১৩টি রাজ্যের মুদ্রাস্ফীতির হার বার্ষিক হারের থেকে বেশি। ৩০টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ওই হারের নিরিখে ২৩তম, ৪.৪ শতাংশ।
মোদী সরকার ভারতীয় অর্থনীতিতে মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলে সরকারে এসেছিল। গত ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে বলে কৃতিত্বও নিয়েছিল। অতএব, যদি মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত থাকে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই ৫ বছরে, ২০১৪ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত হিসেব করলে সমস্ত ভোগ্যপণ্যগুলির দাম বেড়েছিল বার্ষিক ৪.৮ শতাংশ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেই বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ। খাদ্য ভোগ্যপণ্য সূচকের নিরিখে খাদ্য ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছিল, ২০১৪ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত হিসেব করলে, বার্ষিক ৩.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেই বৃদ্ধির হার বার্ষিক ৮.১ শতাংশ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ বছরে দানাশস্যের দাম বেড়েছে বার্ষিক ৮.২ শতাংশ (বার্ষিক ৩.৩ শতাংশ আগের ৫ বছরে), মাছ মাংসের দাম বেড়েছে বার্ষিক ৯.৪ শতাংশ (৬.৮ শতাংশ), ডিমের দাম বেড়েছে বার্ষিক ৯.৪ শতাংশ (৪.১ শতাংশ), শাকসব্জির দাম বেড়েছে বার্ষিক ১০.৮ শতাংশ (৩.৪ শতাংশ), ডালের দাম বেড়েছে বার্ষিক ১৩.৮ শতাংশ (২.৮ শতাংশ), মশলাপাতির দাম বেড়েছে বার্ষিক ১৪.২ শতাংশ (৫.৪ শতাংশ)। ফলে এটা দেখা যাচ্ছে যে, মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফায় সাধারণ ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সর্বক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বাভিমুখী। (এই অনুচ্ছেদে বন্ধনীর মধ্যে সংখ্যাগুলি মে ২০১৪ থেকে মে ২০১৯ পর্যন্ত মোদী সরকারের প্রথম ৫ বছরের মূল্যবৃদ্ধির বার্ষিক হার)
সরকারি স্তরে প্রদত্ত মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা মেলে না। চাল ডাল তেল নুন আটা ময়দা মাছ মাংস ইত্যাদি দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্য যেভাবে মহার্ঘ হয়ে উঠেছে তাতে খাদ্য ভোগ্যপণ্যের দাম গত ৫ বছরে বার্ষিক ৮.১ শতাংশের সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে মেলে না। কোভিড পরবর্তী ৩ বছরে গণপরিবহনের ক্ষেত্রে এক বিপুল ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে। কলকাতা শহরে বা রাজ্যজুড়ে বাসের ভাড়া সরকার নির্ধারিত পূর্বতন ভাড়ার তুলনায় বহু ক্ষেত্রে দেড়গুণ হয়েছে। একইভাবে এ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সিগুলির ভাড়াও বহুলাংশে বেড়েছে, যা অনেক সময়ই সরকার নির্ধারিত ট্যাক্সির কিমি প্রতি ভাড়ার দ্বিগুণ বা তিনগুণ। এমনকি ট্যাক্সির ক্ষেত্রেও সরকারিভাবে এ্যাপের বন্দোবস্ত করা হয়েছে, দ্বিগুণের বেশি ভাড়ায়। কিন্তু পরিবহণের এই চরম ব্যয়বৃদ্ধি কিন্তু ভোগ্যপণ্য মূল্যসূচকে প্রতিফলিত হয়নি।
সাধারণভাবে ব্যক্তিগত ভোগব্যয় সংক্রান্ত পরিসংখ্যান এমনটা দেখাচ্ছে না যে ভোগচাহিদার বৃদ্ধি জনিত কারণে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। ফলে চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে বলা যাবে না। অপরদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য যোগানের দিকে সঙ্কট এসেছে এমনটাও দেখা যায়নি। তাই ভারতের মুদ্রাস্ফীতির কারণ দেশের আভ্যন্তরীণ যোগান জনিত সমস্যা। অধিক মুনাফার জন্য ৫টি বৃহৎ পুঁজিপতি ঘরানার বোঝাপড়াকে দায়ী করেছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পূর্বতন ডেপুটি গভর্নর ভিরাল আচার্য। তাকে সরকারি স্তরে অবশ্য নাকচ করা হয়েছে। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বারবার বাড়িয়েও মুদ্রাস্ফীতিকে কাবু করতে পারছে না। ২০২২ সালের এপ্রিলের গোড়া থেকে ৬ বার হার বাড়নোর ফলে সেই হার (রেপো হার) ৪ শতাংশ থেকে ৬.৫ শতাংশে পৌঁছায়। অপরদিকে ব্যাঙ্কগুলি গৃহঋণ সমেত বিভিন্ন ঋণের উপর সুদের হার বাড়ানোর ফলে মধ্যবিত্তের উপরে চাপ বাড়ে, স্বল্প ও মাঝারি মূল্যের আবাসনের বিক্রি কমে। একইসঙ্গে ক্ষুদ্রশিল্পগুলির উপরে সুদের হার বাড়ার ফলে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বৃহৎ পুঁজির মালিকদের মুনাফা কিন্তু কমেনি। যার ফলে দেশে অসাম্যের তীব্রতা বেড়েছে। অক্সফ্যাম বা গ্লোবাল ইনইকোয়ালিটি ল্যাবের রিপোর্টে তা প্রতিফলিত হয়েছে।
অর্থনীতির সূত্র অনুসারে মুদ্রাস্ফীতির হার ও কর্মহীনতার হারের মধ্যে সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে কর্মহীনতা কমে। এক্ষেত্রেও ভারতের অর্থনীতি অন্য নিদর্শন রাখছে। মুদ্রাস্ফীতির হার উচ্চ অবস্থানে থাকলেও বেকারি কমছে না। বরং শিক্ষিত যুবকদের বেকারি বেড়েছে। অন্য একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। তা হল শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান। শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান বাড়ে তখনই যখন তাঁদের প্রকৃত মজুরি বাড়ে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ন্যুনতম মজুরিকে প্রকৃত মজুরির সূচক হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিগত বছরগুলিতে প্রকৃত ন্যুনতম মজুরি বাড়েনি। ফলে ধরেই নেওয়া যায় শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে মোদী সরকার সমর্থ হয়নি।
- অমিত দাশগুপ্ত
রাজস্থানের করৌলি জেলার এক ধর্ষিতা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়েছিলেন বয়ান নথিবদ্ধ করতে। বয়ান নথিবদ্ধ হল, কিন্তু হিন্দাউন কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটের মনে হল তাঁর আরও কিছু করার আছে। গমনোদ্যত তরুণীকে তিনি আবার ডাকলেন। বন্ধ ঘরে ধর্ষিতাকে বললেন বিবস্ত্র হতে, অছিলা, তিনি তার দেহের আঘাত খুঁটিয়ে দেখবেন। ধর্ষিতা তাঁর জামা-কাপড় খুলতে অস্বীকার করলেন। তিনি দেখলেন, বিচার বিভাগের যে দায়িত্বশীলের কাছ থেকে সহানুভূতিশীল আচরণ প্রত্যাশিত তিনিই তাঁর শ্লীলতাহানিতে উদ্যত।
ধর্ষণের ঘটনাটা ঘটে ১৯ মার্চ ২০২৪। ১৮ বছরের দলিত তরুণীর বাবা-মা ও অন্যান্য সদস্যরা ঘরে ছিলেন না। তিন যুবক তাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে। এই ঘটনায় এফআইআর দায়ের হয় ২৭ মার্চ। ধর্ষণ বিচার প্রক্রিয়ার অঙ্গ হল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বয়ান নথিবদ্ধ করা, যার উদ্দেশ্য পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতির সঙ্গে ঐ বয়ানকে মিলিয়ে দেখা, পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতি সঠিক কিনা তা পরখ করা। তরুণী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বয়ান নথিবদ্ধ করতে যায় ৩০ মার্চ। এবং এই প্রক্রিয়ার নিয়ম অনুসারেই তরুণীর সঙ্গে যায় এক মহিলা পুলিশ এবং বাড়ির সদস্যরা। মহিলা পুলিশ কর্মী এবং বাড়ির সদস্যদের নিজের চেম্বারের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধ ঘরে তরুণীকে বিবস্ত্র হতে বলেন। তরুণী ম্যাজিস্ট্রেটের কথায় সায় না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিবস্ত্র হতে বলার কথা মা এবং ভাইকে জানান। তাঁরা চলে যান হিন্দাউনের এসপির কাছে, অভিযোগ দায়ের করেন ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে। ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে তাঁর অভিযোগে তরুণী জানায়, “আমাকে পুনরায় ডাকা হয় এবং জামা-কাপড় খুলতে বলা হয় যাতে তিনি আমার আঘাত দেখতে পারেন। আমি বললাম, “কি করে আমি আপনাকে আমার আঘাত দেখাতে পারি? কোনো মহিলা থাকলে জামা-কাপড় খোলা আমার পক্ষে স্বস্তিদায়ক হতো, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট জোরাজুরি করতে থাকলেন। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাটা কাউকে বলতে বারণ করলেন। এই ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।” অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে রাজস্থান হাইকোর্টের ভিজিল্যান্স রেজিস্ট্রার অজয় চৌধরী হিন্দাউন গিয়ে ঐ ম্যাজিস্ট্রেটকে তিন ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৪৫ ধারা (বেআইনি আটক) এবং দলিত নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে এফআইআর দায়ের করে। ধর্ষণের পর পুলিশ তরুণীর মেডিক্যাল পরীক্ষা করিয়েছিল। তরুণীর আঘাত আবার পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন কি ম্যাজিস্ট্রেটের ছিল? যৌন আকাঙ্খা তাড়িত হয়েই কি তিনি তরুণীকে বিবস্ত্র হতে বলেননি? তরুণী দলিত বলেই কি বিবস্ত্র হতে বলার কুণ্ঠাবোধ তেমন জাগেনি?
ধর্ষণের পর নারীরা যে চরম মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যান সে কথা বিবেচনা করে প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থার দায়িত্বশীলদের ধর্ষিতার প্রতি যথেষ্ঠ সংবেদনশীল হওয়ারই কথা। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতি, সামাজিক প্রতিপত্তি, অর্থনৈতিক প্রতাপ এবং এমনকি জাত বিচারও প্রাধান্য পাওয়ায় ন্যায়বিচার উপেক্ষিত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। উন্নাও, হাথরস, পার্কস্ট্রিট, কামদুনি — এরকম বহু নজিরই রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় সে সময়ের প্রধান বিচারপতি শারদ অরবিন্দ বোবদের কথা, যিনি ২০২১ সালের মার্চে এক ধর্ষককে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সে যেন ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে বিয়ে করে, অন্যথায় তাকে বাঁচানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কর্মী মোহিত সুভাষ চবনকে তিনি বলেছিলেন, “তুমি যদি ওকে বিয়ে করতে চাও আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি। আর তা না হলে তুমি চাকরি খোয়াবে আর জেলে যাবে।” ধর্ষকের অপরাধ, মেয়েটির সংকটজনক মানসিক পরিস্থিতি, তার সম্মান-মর্যাদা প্রধান বিচারপতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল না। এক সরকারি কর্মচারীকে বাঁচানোর স্পৃহার কাছে সঁপে দেওয়া হলো ন্যায়বিচারকে। আলোচ্য ঘটনাটিতেও ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার পরিবর্তে তার নগ্ন দেহ ও যৌনাঙ্গ দর্শনের মাধ্যমে নিজের কাম চরিতার্থতায় অভিলাষী হলেন ম্যাজিস্ট্রেট। বিচার ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যাঁরা বিচারকে প্রহসনে পরিণত করতে প্রয়াসী হন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই তাঁদের প্রাপ্য। আলোচ্য ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হলেও তাতে তাঁর নাম উল্লেখিত হয়নি। একমাত্র জনগণের নজরদারিই পারবে ম্যাজিস্ট্রেটের অপরাধের জন্য তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিকে সুনিশ্চিত করতে।
- জয়দীপ মিত্র
ভিত্তিহীন ও গুরুতর নয় এমন অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর করে সরকারের সমালোচকদের গ্রেপ্তার করা ও তাদের দীর্ঘদিন আটক রাখাটা মোদী জমানায় এক ধারাবাহিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। এই ধরনের গ্রেপ্তারি ও আটক যে ক্ষমতার অপব্যবহার, আদালত সে কথা বলার পরও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর হানাদারি ও শাসক-বিরোধীদের গ্রেপ্তারিতে ছেদ পড়েনি। কাশ্মীরের সাংবাদিক সাজেদ আহমেদ’এর আটক রাখার নির্দেশকে খারিজ করতে গিয়ে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ হাইকোর্ট সুস্পষ্টভাবেই বলেছিল, সরকারের সমালোচকদের আটক রাখাটা “নিবর্তনমূলক আটক আইনের অপব্যবহার”। তবে, শুধু এই ধরনের বেআইনি আটকই নয়, আটকের নির্দেশ আদালতে খারিজ হয়ে যাওয়ার পরও জেলবন্দি ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে প্রশাসনের অনেক ক্ষেত্রেই অনীহা দেখা যায়। যেমন ঘটেছে কাশ্মীরের জেলবন্দি মুনিব রসুল শেরওয়ারির ক্ষেত্রে। শেরওয়ারির বিরুদ্ধে ২০২০ সালে এই অভিযোগ দায়ের হয় যে, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে সে বিপজ্জনক। গ্রেপ্তার করে তাকে পাঠানো হয় উত্তরপ্রদেশের জেলে। তবে, অভিযোগ প্রমাণিত হয় না এবং বারমুলার বিশেষ এনআইএ আদালতের বিচারক তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেন ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ। কিন্তু বন্দির মুক্তি মেলে না। হাইকোর্ট ২০২৩ সালের ২৩ ডিসেম্বরের রায়ে বলে, বন্দিকে যে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সে বিষয়টায় জেল কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। আদালত দ্বিধাহীনভাবে বলেছিল, এটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনা বোধের অভাবকেই প্রতীয়মান করছে এবং “বন্দির আটক থাকাটা অন্যায্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে।” কিন্তু আদালত মুক্তিদানের মতো সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত করা সত্ত্বেও শেরওয়ারিকে মুক্তি দেওয়া হল না। ফলে বন্দির হয়ে আদালতে আবার আবেদন জানাতে হল শেরওয়ারির মাকে। হাইকোর্টের বিচারপতি রাহুল ভারতি জেলা শাসক ও পুলিশ কর্তৃপক্ষকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তদের উপস্থিতিতেই বিচারপতি বলেন, কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই আবেদনকারীকে নিবর্তনমূলক আটক আইনে বন্দি থাকতে হয়েছে। তার জীবনের মূল্যবান ৭৯টা দিন হারিয়ে গেছে এবং আদালতের কাছে সেটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। তিনি আটক আবেদনকারীকে অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দিলেন মার্চ মাসের শেষে।
তবে, অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েও জেলে আটক থাকার ব্যাপারটা শুধু জম্মু ও কাশ্মীরেই ঘটছে না। কেরল, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ সহ ভারতের বহু রাজ্যেই এমন নজির অনেক রয়েছে। শাসকের সুনজরে না থাকলে আদালত মুক্তির নির্দেশ দিলেও মুক্তি বিলম্বিত হওয়াটা অভাবনীয় ব্যাপার নয়। আবার মুক্তিলাভকে আটকাতে নতুন অভিযোগ দায়েরকেও শাসক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। মুক্তির পরই নতুন অভিযোগের ভিত্তিতে পুনরায় গ্রেপ্তারির বহু দৃষ্টান্তই রয়েছে। গুজরাটে ২০১৮ সালে জানুয়ারি মাসের একটা ঘটনায় জামিন লাভের পরও সরকার আটক ব্যক্তিকে মুক্তি না দেওয়ায় আদালত রাজ্য সরকারকে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা করে। সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার চরিতার্থতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগের মূল বিষয় হয়ে থাকে অভিযুক্ত ব্যক্তি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী, দেশদ্রোহী, আইন-শৃঙ্খলার পক্ষে বিপজ্জনক। সরকারের বিরোধীদের আটক করতে দেশে যে দানবীয় আইনগুলো চালু রয়েছে ও যেগুলোর প্রয়োগ হয়ে চলেছে সেগুলোর কয়েকটা হল — জম্মু ও কাশ্মীরের জনসুরক্ষা আইন, ইউপিএ, গুজরাটের সমাজবিরোধী কার্যকলাপ দমন আইন; এছাড়াও রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর গুণ্ডা দমন আইন, ইত্যাদি। সব আইনেই জামিন লাভকে অত্যন্ত কঠোর করে তোলা হয়েছে এবং অভিযুক্তদের মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিনাবিচারে আটক থাকতে হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট নিবর্তনমূলক আটক আইনগুলোকে দানবীয় ও ভীতিজনক বললেও সেগুলো অসাংবিধানিক নয় বলে অভিমত প্রকাশ করেছে। তবে, একই সাথে স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে সংবিধানে সুরক্ষার যে বিধান রয়েছে, ব্যক্তি স্বাধীনতার যে রক্ষাকবচ রয়েছে সেগুলোকেও ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বলেছে, এই সমস্ত আইনের প্রয়োগে সেই অধিকারগুলো লঙ্ঘিত হতে পারে না। আলোচ্য মুনিব রসুল শেরওয়ারি মামলাতেও বিচারপতি রাহুল ভারতি কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনকে সতর্ক করে বলেছেন, “এই আদালত আশা করে যে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না; জেলে বন্দির নিবর্তনমূলক আটক বাতিল হয়ে গেলেই জম্মু ও কাশ্মীরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকারকে যথাযথ দ্রুততায় ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে অসংগত সময় হানি না ঘটিয়েই হেফাজত থেকে আটক ব্যক্তির মুক্তি লাভ সম্ভব হয়।” বিচারপতির এই নির্দেশ শুধু জম্মু ও কাশ্মীরে নয়, সারা দেশে প্রযোজ্য হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কেন্দ্রের ও বিভিন্ন রাজ্যের শাসকরা কি এই কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা দেখাবেন? মোদী জমানায় ৩৭০ ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সিএএ বিরোধী আন্দোলন, যৌননিগ্ৰহের বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীরদের আন্দোলন, কৃষকদের আন্দোলনের মতো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদও যখন রাষ্ট্রের নিপীড়নের মুখে পড়ে, সেই জমানায় মানবাধিকারের সুরক্ষা কতটা প্রত্যাশিত ও সম্ভাব্য হতে পারে!
৩০ মার্চ ২০২৪ সকালে কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড ফুলমণি মাণ্ডি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরতরে না ফেরার দেশে। গত চারমাস ধরে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। হুগলীর বলাগড় ব্লকের বাকুলিয়া ধোবাপাড়া পঞ্চায়েতের ইছাপুর গ্রামে একাই থাকতেন। নব্বই’এর দশকের মাঝামাঝি যোগ দেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনে। পার্টির বলাগড় ব্লক কমিটির সদস্যা ছিলেন। ছিলেন সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি ‘আয়ারলা’র বলাগড় ব্লকের নেত্রী। প্রথাগত শিক্ষার বদলে শ্রেণি সংগ্রামের শিক্ষায় নিজেকে গড়েপিটে তুলেছিলেন। নিজে ছিলেন একজন ক্ষেতমজুর। তাই ক্ষেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন আনায়াসে। তাঁদের সামাজিক ন্যায়ের দাবিগুলিকে ধরে খুব সহজে পৌঁছে যেতেন শ্রেণির মানুষের কাছে। গ্রামে বাড়ি বাড়ি প্রচারের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন ক্ষেতমজুর মেহনতি মানুষদের সাথে। তাঁদের সংগঠিত করতেন। ফুলমণি মাণ্ডি হয়ে উঠেছিলেন গ্রামীণ সর্বহারা শ্রেণির কণ্ঠস্বর। পার্টিকে ভালবাসতেন অন্তর দিয়ে। পার্টির যেকোনো কাজে থাকতেন সামনের সরিতে। পার্টির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। পার্টির ডাকে তিনি গিয়েছিলেন দিল্লী (১০০ দিনের কাজ চালুর দাবিতে), গিয়েছেন পাটনা, রাঁচি, ভুবনেশ্বর ‘আয়ারলা’ জাতীয় সম্মেলনের সমাবেশে। ২০০৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনি গ্রামসভায় লড়াই করেছেন। সেই সময় তাঁকে দেখেছিলাম এক অন্য ভূমিকায়। কত সহজে গরিব মানুষের দাবিগুলিকে তুলে ধরছেন একটা ছবির মতো করে। গরিব মানুষ ফুলমানিকে দেখতেন অন্য চোখে। গ্রামের মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন ফুলমণি মাসি। হয়ে উঠেছিলেন একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী।
তাঁর মৃত্যু সর্বহারা শ্রেণির কাছে এক অপূরণীয় ক্ষতি। কমরেড ফুলমণিরা মরে না। রয়ে যায় মেহনতি মানুষের হৃদয়ে, তাঁদের লড়াইয়ের ময়দানে। কমরেড তোমার কাজকে সম্পূর্ণ করার সংকল্প ঘোষণা করছি।
কমরেড ফুলমণি মাণ্ডি অমর রহে।
কমরেড ফুলমণি মাণ্ডি তোমায় জানাই লাল সেলাম।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, অশোকনগর লোকাল কমিটির সদস্য, আজীবন বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী কমরেড জ্যোতির্ময় বিশ্বাস (নারু) গত ৬ এপ্রিল ২০২৪ মাত্র ৬৫ বছর বয়সে প্রয়াত হন। ১৯৮২ সালে অশোকনগর মানিকতলা এলাকার বাসিন্দা কমরেড জ্যোতির্ময় বিশ্বাস সিপিআই(এম) ছেড়ে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই(এমএল) দলে যোগদান করেন। প্রথম দিকে নিজের বসবাসের জায়গায় সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৮৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানিকতলা গ্রামে আইপিএফ’এর পতাকা তলে প্রার্থী দিয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তারপর ধীরে ধীরে পার্টির বড়ো জায়গা জুড়ে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বেড়াবেড়ি অঞ্চলে কৃষক ক্ষেতমজুরদের মধ্যে পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। সেক্ষেত্রে কিছু সফলতাও অর্জন করেন। তিনি লোকাল কমিটি সদস্য ছিলেন। মাঝে লোকাল কমিটি সম্পাদক হিসেবে কিছু সময় কাজ করেন এবং জেলা কমিটি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। চাকরি জীবনে স্থান বদল হওয়ার কারণে গ্রামাঞ্চলের সাংগঠনিক কাজে কিছুটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। তবে শহরের সংগঠনের সাথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। মৃত্যুকালেও পার্টির মাসিক লেভি দিয়ে যেতে ভোলেননি। শুধু নিজে নয়, তার জীবনসঙ্গীকেও পার্টি পরিবারের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। একমাত্র পুত্র, পুত্রবধূ, আদরের নাতনি ও অসুস্থ স্ত্রী এবং পার্টি কমরেডদের রেখে চির বিদায় নিলেন কমরেড জ্যোতির্ময়।
লাল সেলাম কমরেড জ্যোতির্ময়।
===000===