আজকের দেশব্রতী : ২১ মার্চ ২০২৪ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-21-march-2024labor-convention_blabor-convention_0

মোদী হটাও, শ্রমিক বাঁচাও — এই আহ্বান রেখে ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হল এআইসিসিটিইউ-র শ্রমিক কনভেনশন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইউনিয়নের নির্মাণ, চটকল, স্কিম কর্মী, সরকারি ও বেসরকারি পরিবহন, ইঁট ভাটা, কন্ট্রাক্ট শ্রমিক, ট্রেক্সটাইল, রেল, প্রতিরক্ষা প্রভৃতি শিল্প সংস্থার শ্রমিক কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।

ওই দিন সকালে প্রয়াত বালি অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সাথী রঘুপতি গাঙ্গুলী, কল্যাণীর সদ্য প্রয়াত কমরেড অমিতাভ রায় সহ আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া কমরেডদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও নীতীশ রায়-এর উদ্বোধনী সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে কনভেনশন শুরু হয়। এআইসিসিটিইউ-র সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু প্রথমেই এক রাজনৈতিক প্রতিবেদন পেশ করে কনভেনশেনের মূল সুর বেঁধে দেন। তিনি বলেন, আমরা আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই এই কনভেনশন করছি, স্বাধীনতা পরবর্তীতে যে নির্বাচন আগে কখনও এতো গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে সামনে আসেনি। ভারতের সংবিধান, দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বিরোধী দল, থাকবে কী থাকবে না, ভবিষ্যতে আদৌ নির্বাচন হবে কী হবে না তা আজ বিরাট এক প্রশ্ন। ২০২৫-এ আরএসএসএর শতবর্ষে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার যে লক্ষ্য রয়েছে, মোদী আবার ফিরে এলে দ্রুত আমাদের দেশ সেই দিকেই এগোবে, সংখ্যালঘুরা এ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবেন। এই বিরাট বিপদ, এই বিপর্যয়, সার্বিক ধ্বংস থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করার দায়িত্ব শ্রমিকশ্রেণিকে নিতে হবে মোদীকে নির্বাচনে হারিয়ে। শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যকে ভাঙতে বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক তাস খেলছে, সিএএ জারি করে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার যে সংবিধান বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান রাখছে এই কনভেনশন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের শ্রমিকশ্রেণি যে সমস্ত অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিল, মোদী সরকার তা আজ ছিনিয়ে নিল চার শ্রম-কোডের মাধ্যমে। দেশের সংবিধানে শ্রম বিষয়টি রাজ্য ও কেন্দ্রের যুগ্ম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মোদী সরকার রাজ্যগুলোর সাথে কোনো পরামর্শ ছাড়াই একতরফা শ্রমকোডগুলো আনল, কোভিডের সময় যখন সংসদের অধিবেশন চলতে পারছিল না, তখন বিস্তারিত আলাপ আলোচনা ছাড়াই কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবগুলো কোড পাশ করিয়ে নেয়। ভারতের দুশো বছরের পুরাতন প্রতিরক্ষা শিল্পকে বেসরকারি করার লক্ষ্যে কর্পোরেশন বানালো, সেই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যখন দেশব্যাপী ধর্মঘটের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল শ্রমিক-কর্মচারীরা তখন নামানো হল দানবীয় এডসা (এসেনশিয়াল ডিফেন্স সার্ভিস অ্যাক্ট), যার মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হল ধর্মঘট, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, সমস্ত ধরনের আন্দোলনই আজ নিষিদ্ধ এই শিল্প ক্ষেত্রে।

মোদীর ১০ বছরের শাসনকালে আদানি-আম্বানির মতো হাতে গোনা কয়েকজনের সম্পদ আকাশ ছুঁয়েছে, আর বিপরীতে দেশের শ্রমিক সহ শ্রমজীবী মানুষের আয় থেকে গেছে একই জায়গায়। ২০১৪-১৫ ও ২০২১-২২’র পর্যায়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় প্রতি বছর বাড়ার বদলে কমেছে এক শতাংশ হারে, নির্মাণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কমেছে ০.২ শতাংশ। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত ৯১ শতাংশ শ্রমিকের নেই সামাজিক সুরক্ষা। পৃথিবীতে দ্রুততম আর্থিক বিকাশ হচ্ছে বলে মোদী নিজের পিঠ চাপড়ালেও আর কোনো জি-২০ দেশে এত বিপুল পরিমাণে শ্রমিক ইনফর্মাল সেক্টারে নেই।

নেই শ্রম আইনের রক্ষাকবচ। লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিকদের দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় আশা অঙ্গনওয়াড়ি মিডডেমিল-এর কাজ করালেও নেই শ্রমিক হিসাবে তাঁদের স্বীকৃতি, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা। ভারতে ৯.৫ কোটি নারী বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। সরকার এগুলোকে রোজগার হিসাবে দেখালেও আইএলও তার মান্যতা দেয় না। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বেলাগাম বেসরকারিকরণ, বিলগ্নীকরণ, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া প্রায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মুকুব, কর্পোরেট ট্যাক্সে ঢালাও ছাড় — নানা দিক থেকে এত সুযোগ সুবিধা পেলেও বেসরকারি সংস্থাগুলো খুব কম বিনিয়োগ করছে দেশের শিল্প ক্ষেত্রে।

labor-convention_1

আমাদের রাজ্যেও সরকারি ক্ষেত্রগুলোতে মাত্রাছাড়া ইনফর্মাল কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে। খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে বাড়ছে ন্যূনতম মজুরি। শুধুমাত্র নতুন কলকারখানার অভাবের জন্যই নয়, আমাদের রাজ্যে সমস্ত কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত নিম্ন হারের মজুরির কারণে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয় রুটি রুজির সন্ধানে। রাষ্ট্রীয় পরিবহনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা বিধিবদ্ধ অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, ওই সংস্থায় সরকার বিরোধী ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। শিল্প সংস্থাকে খুশি করতে এ রাজ্যে ধর্মঘটকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, ধর্মঘটের জন্য শ্রমদিবস নষ্ট হওয়া শূন্যে ঠেকলেও, লক আউটের ফলে শ্রমদিবস নষ্ট হয়েছে একশ শতাংশ!

সম্প্রতি চটকল শ্রমিকরা তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি সনদের মিমাংসা করেছে। এই চুক্তি রূপায়ন করাটা চটকল শ্রমিকদের কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ। বহু বঞ্চনা, উপেক্ষার পর রাজ্যের স্কিম কর্মীরাও তাঁদের পাওনা বুঝে নিতে শুরু করেছেন। ন্যায় সংহিতার যে ধারাগুলো পরিবহন শ্রমিকদের সর্বনাশ ডেকে আনত, তার বিরুদ্ধে তাঁদের আচমকা দেশব্যাপী ধর্মঘটে কেন্দ্রীয় সরকার পিছু হটেছে।

দেশ জুড়ে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনই এখন প্রধান প্রবণতা। বারে বারে শ্রম-কোডের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের ফলে উদ্ধত মোদী সরকার এখনো তা লাগু করতে পারছে না। একমাত্র মোদী সরকারকে নির্বাচনে হারিয়েই চার শ্রম-কোডকে নিক্ষিপ্ত করা যাবে আস্তাকুঁড়ে।

তাই, দেশ বাঁচাতে, সংবিধান রক্ষা করতে, সামনের নির্বাচনে আমাদের স্লোগান বিজেপি হারাও, দেশ বাঁচাও, বিজেপি হারাও শ্রমিক বাঁচাও।

পার্টি রাজ্য কমিটির সম্পাদক অভিজিত মজুমদার মোদী সরকারের নামিয়ে আনা ফ্যাসিবাদী রাজের নানান দিককে উন্মোচন করে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি সরকারকে হারানোর ডাক দেন।

চটকলের সাম্প্রতিক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি, বেশ কয়েক দশক পর তাদের ঘরভাড়া বৃদ্ধি সহ অন্যান্য কিছু অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া সহ যা অর্জিত হয়েছে, তা রক্ষা করা, ঐক্যবদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে মজবুত করার জোর দেন বিসিএমএফ এর রাজ্য সভাপতি নবেন্দু দাশগুপ্ত।

স্কিম কর্মীদের দীর্ঘ বঞ্চনা, উপেক্ষা ও শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি না দেওয়া, সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারী শ্রমকে মর্যাদা না দিয়ে তাকে বেগার শ্রম হিসাবে গণ্য করা, এলাহাবাদের ইতিবাচক রায়কে বাস্তবায়িত না করে আজ পর্যন্ত স্কিম কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা না করা বিষয়কে তুলে ধরেন সারা ভারত স্কিম ফেডারেশন-এর নেত্রী জয়শ্রী দাস।

প্রতিরক্ষা শিল্পের জয়দেব দে উন্মোচিত করেন কীভাবে মোদী সরকার প্রতিরক্ষা, রেল, বিমা সহ রাষ্ট্রায়ত্ব ও সরকারি সংস্থায় ঢালাও বেসরকারিকরণ, বিলগ্নিকরণ করে এতদিন ধরে গড়ে ওঠা সমগ্র রাষ্ট্রীয় সেক্টারকেই কী ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, মনিটাইজেশন পাইপলাইনের মাধ্যমে কর্পোরেটদের কাছে বেচে দিচ্ছে জাতীয় সম্পদ।

কনভেনশেনের শেষ বক্তা ছিলেন রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী। নতুন শ্রম-কোড কিভাবে কেড়ে নিল সামাজিক সুরক্ষার এতদিনের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা, কিভাবে শ্রমিকশ্রেণির ধর্মঘটের হাতিয়ারকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিল মোদী সরকার, ট্রেড ইউনিয়নের দর কষাকষির ক্ষমতা ও অধিকারকে হরণ করা হল, তা ব্যাখ্যা করেন। বিগত দিনে কৃষক আন্দোলনকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য দেশে ডাক-কর্মীদের বহু পুরাতন স্বীকৃত সর্বভারতীয় ইউনিয়নের স্বীকৃতি বাতিল করা, সমস্ত স্তরের শ্রমিকদের মজুরি বা বেতনে সংকোচন, বিপুল অসংগঠিত শ্রমিকদের উপর নেমে আসা দুর্দশাকে উল্লেখ করে বলেন, আসন্ন নির্বাচনে শ্রমিক শ্রেণিকে আংশিক, ক্ষুদ্র পেশাগত, আর্থিক দাবিদাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে পালন করতে হবে দেশপ্রেমের কর্তব্য। আর তা হল, সংবিধান বিপন্নকারী, গণতন্ত্র ধ্বংসকারী, সমস্ত দিক থেকে সর্বনাশের পথে দেশ ও দেশবাসীকে ঠেলে দেওয়ার জন্য যে ফ্যাসিবাদী মোদী সরকার দায়ী, সেই বিজেপিকে হারাতে হবে আসন্ন নির্বাচনে।

উদ্দীপনার সাথে স্লোগান ধ্বনির মাধ্যমে শেষ হয় শ্রমিক কনভেনশন।

how-much-will-kolkata-people-pay_bhow-much-will-kolkata-people-pay

আবার মহানগরে বেআইনি বহুতল নির্মাণ ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো। কেড়ে নিল গরিব বস্তিবাসীর প্রাণ। আবার সেই পুরাতন অভিযোগ — এই বেআইনি কর্মকাণ্ড চলছিল গত একবছর ধরে, স্থানীয় কাউন্সিলার, পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায়। শাসক পার্টির অনুগামী প্রোমোটার এই বেআইনি বহুতল নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন জলাশয় বুজিয়ে। দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরেই এলাকায় তীব্র ক্ষোভের মুখে পুলিশ প্রোমোটারকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। ধরানো হয় তিন পৌর ইঞ্জিনিয়ারকেও কারণ দর্শনোর নোটিশ। গার্ডেনরিচের ফতেপুর ব্যানার্জিপাড়া লেনে ঝুপড়ির ওপর ভেঙে পড়ায় এ পর্যন্ত প্রায় ১০ জন গরিব, ঝুপড়িবাসীর প্রাণ গেছে। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আহত হয়েছেন অনেকে। এখনও চলছে উদ্ধার কাজ।

খোদ মেয়রের খাসতালুকে পুর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবাধে পুকুর ভরাট করে, বা নির্মাণ কাজের অন্যান্য বিধিকে অমান্য করে ওই এলাকায় একের পর এক গজিয়ে ওঠে বহুতল, যার দায় মেয়র অস্বীকার করতে পারেন না। এই বিষয়টা যে কলকাতা পৌরসভার সর্বোচ্চ স্তরে, বা বিভিন্ন দপ্তরের অজানা ছিল, তাও নয়। এক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীন দলের সাথে অভিযুক্ত প্রোমোটার ও স্থানীয় কাউন্সিলার-প্রশাসনের অশুভ আঁতাত থাকায় ওই সমস্ত বেআইনি কাজকর্মগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। বিগত বাম জমানা থেকেই কলকাতায় জলা জমি বুজিয়ে, পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিকে লঙ্ঘন করে পরিকল্পনাহীন, অবৈজ্ঞানিক ও অবৈধ রিয়াল এস্টেট ব্যবসা যে প্রোমোটার চক্র চালিয়ে আসছে, তার উপর আজও লাগাম টানা গেল না। রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে সাথে ওই প্রোমোটার বাহিনী নিজেদের রঙ পালটায়, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত ওই দুষ্টচক্র ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এখন পুরসভার কর্তাব্যক্তিরা এই ঘটনায় একে অপরের উপর দায় ঠেলে দিচ্ছেন। সমস্ত অন্যায় অপরাধের জন্য বিগত বাম জমানাকে দায়ী করে মেয়র নিজের হাত ধুয়ে ফেলার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

জলাশয় বুজিয়ে, পরিবেশ ও নির্মাণ বিধি অমান্য করে শুধু বহুতল বানানোই নয়, নগরায়ণের যে মডেল অনুসৃত হচ্ছে তা গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষকে ক্রমে ক্রমেই এই মহানগর থেকে নীরবে উৎখাত করে দিচ্ছে। জলস্তর ক্রমেই নীচে নেমে যাচ্ছে, আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বেঙ্গালুরুর মতো আধুনিক এক প্রযুক্তি নিবিড় শহরকে সম্প্রতি নজিরবিহীন যে জলসংকট গ্রাস করেছে, তা আগামী দিনে সমস্ত শহরের ক্ষেত্রে বিরাট এক বিপদের বার্তা বহন করে।

এই শহরকে রক্ষা করার জন্য কলকাতাবাসীকে গড়ে তুলতে হবে এক নাগরিক আন্দোলন। গরিব-নিম্নবিত্ত মানুষকে স্থানচ্যুত করে ধনী, অত্যন্ত বিত্তবানের কব্জায় কলকাতার চলে যাওয়া ঠেকাতে হবে। ক্রমে লুপ্ত হওয়া সবুজকে ফিরিয়ে কলকাতার দূষণ ও পরিবেশ প্রশ্নে নাগরিক সচেতনতার কাজও শুরু করা দরকার। সমস্ত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই শহরটিকে ক্ষমতাসীন দলের মদতপুষ্ট প্রোমোটারদের অবাধ মৃগয়া ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হতে দেওয়া চলবে না।

build-an-all-out-campaign_bbuild-an-all-out-campaign_0

কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করেছেন। ঘোষণার সাথে সাথেই নির্বাচনী বিধি লাগু হয়ে গেছে দেশ জুড়ে। পশ্চিমবঙ্গে ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন – এই সময়সীমার মধ্যে ৭টি দফায় ভোটপর্ব সমাধা হওয়ার কথা।

এবারের নির্বাচন ভারতের সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্রের কাঠামো ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রক্ষার দায়বদ্ধতার প্রশ্নকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। বিগত দশ বছরের নিরঙ্কুশ আধিপত্যে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন মোদী-শাহ-নাড্ডা পরিচালিত বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের বাহিরি কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে তার অন্তর্বস্তুকে দুর্বল করে তুলতে একের পর এক অন্তর্ঘাতমূলক নীতিমালা গ্রহণ করেছে। আরএসএস সহ সংঘ পরিবারভূক্ত ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলির ঈপ্সিত হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যকে পাখির চোখ করে দেশের নাগরিকদের সমস্ত গণতান্ত্রিক আকাঙ্খাকে বুলডোজারের নীচে গুঁড়িয়ে দিতে সচেষ্ট মোদী সরকার। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ, বাবরি মসজিদের বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির গঠন ও অভিন্ন দেওয়ানী বিধি লাগু করার মাধ্যমে তাদের সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডাগুলিকে জনগনের মাথায় চাপিয়ে দিতে তারা সমর্থ হয়েছে। অন্যদিকে দেশের আর্থিক মেরুদন্ডকে দুমড়ে ফেলে স্যাঙাৎ কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে দেশের প্রাকৃতিক ও শ্রমসম্পদকে বিলিয়ে দেওয়ার নীতি নিয়েছে। কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটকরণের লক্ষ্যে কৃষক বিরোধী আইন প্রবর্তন, বনআইন ও খনি আইনের আমূল পরিবর্তন, শ্রমকোডের মাধ্যমে শ্রমদাসত্ব চালু করা, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলমান নাগরিকদের রাষ্ট্রহীন করে তোলার প্রচেষ্টা – এসবই ‘বিশ্বগুরু’, ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ মোদীজি, অধুনা যিনি রামের অবতারের ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের নজিরবিহীন ‘সাফল্যের’ খতিয়ান।

উপরন্তু ভারতের প্রতিষ্ঠিত বিদেশনীতি’র জোট নিরপেক্ষতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী জনতার ওপর সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী জায়োনিস্ট ইজরায়েলের নির্মম হামলাকে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকার এক ভুবনব্যাপী ধিকৃত অবস্থান গ্রহণ করেছে।

পেল্লায় মাপের দুর্নীতিতে এই সরকার জগতজুড়ে প্রায় প্রথম স্থানে ‘সমাদৃত’। অতীতে মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম নিয়োগ দুর্নীতি, রেড্ডি ভার্তৃদ্বয় ও কর্ণাটকের তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পার পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, অধুনা দিল্লীতে দ্বারকা এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি পেরিয়ে এখন গদী মিডিয়ার বাইরে থাকা সামান্য অংশের সাংবাদিক ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের তৎপরতায় নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ‘কুইড প্রো কো’ নীতি ( কোনো কিছুর বিনিময়ে অন্য কিছু সুবিধা প্রত্যর্পন) গ্রহন করা হয়েছে। অর্থাৎ যেনতেন প্রকারেন ভীতি প্রদর্শন বা উৎকোচের বিনিময়ে অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনা করার ছাড়পত্র প্রদান ও বিনিময়ে বিজেপির অর্থকোষকে প্রবলভাবে পরিপুষ্ট করতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে কাজে লাগানোর কারসাজি আজ প্রকাশ্যে এসেছে।

এই সাধারণ নির্বাচনে বিজেপিকে সর্বৈবভাবে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে প্রচার ও প্রত্যয়ের শিথিলতার অর্থ হল ভারতের স্বাধীনতা, জনতার সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষিত আদর্শকে ধ্বংসকারী ক্ষমতার মদমত্ততাকে আরও বেশি সর্বনাশী, বিপর্যয়কারী ভূমিকায় দেখতে পাওয়া।

বিজেপিকে পরাস্ত করতে তাই গণতন্ত্রপ্রেমি, শ্রমজীবী, মেধাজীবী, পেশাজীবী, ছাত্র-যুব, কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে বিজেপি-আরএসএসের সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক প্রকল্পের সারবস্তু সহজভাবে তুলে ধরাই এখন আমাদের একমাত্র কাজ হিসাবে দ্ব্যর্থহীন প্রত্যয়ে গ্রহন করতে হবে।

বাংলার এখনকার রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে বিরোধী ও শাসক রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দূর অস্ত্। বরং শাসক তৃণমূলের বাহুবলীদের সাম্প্রতিকতম দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী দাপটের ভূমিকাগুলি বাংলার ভোটারদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাম্প্রতিক সময়ে সন্দেশখালিতে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের জমি-ভেড়ি দখলদারি, নারী নিপীড়ন ও প্রশাসনের প্রশ্রয়ে নিরঙ্কুশ সন্ত্রাস অব্যাহত রাখা, গার্ডেনরিচে তৃণমূল আশ্রিত প্রোমোটারের নির্মীয়মান বহুতলের ভেঙে পড়া অংশের নীচে চাপা পড়ে বস্তিবাসী গরিব মানুষদের প্রাণহানির ঘটনা এবং এই সমস্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূলকে কোনোমতেই ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়। আবার গোদী মিডিয়ার একপেশে প্রচার বিজেপির জনবিরোধী চরিত্রকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে বহুলাংশেই সমর্থ।

পক্ষান্তরে, সিপিএম সহ বাম শিবিরের একপেশে তৃণমূল বিরোধিতা শুধু নয়, সেই সঙ্গে দিদি-মোদী আঁতাতের বস্তাপচা তত্ত্বপ্রচারের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাম ভোটারদের কাছে শাসক তৃণমূলের অত্যাচারের বিপক্ষে বিজেপির সক্ষমতাকে পরোক্ষে মান্যতা প্রদর্শনের নীতি অপর এক বিভ্রান্তিকর অবস্থানকে সূচিত করছে।

এমতাবস্থায় বাংলার অন্যত্র সিপিএম বা বামফ্রন্টের অন্যান্য শরিকদলগুলির প্রার্থীদের ঢালাও সমর্থনের এই মুহূর্তে কোনো বাস্তবতা নেই।

এমন একটি সঙ্কটপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে বিপ্লবী বামপন্থী কর্মীবাহিনীকে নীতিনিষ্ঠভাবে জনগণের কর্মিষ্ঠ ও গণতান্ত্রিক অংশকে বিজেপি বিরোধিতায় উদ্দীপ্ত করে তোলা ও ভোটারদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপর নির্ভরশীল থেকেই নির্বাচনী প্রচারকে সর্বত্র তুঙ্গে তুলে ধরতে হবে। বিজেপিকে পরাস্ত করা যখন দেশের সামনে এক কেন্দ্রীয় কর্তব্য হয়ে উঠছে তখন তাকে পালন করতে আমরা বাংলার মানুষের বিচার বিবেচনার ওপর ভরসা রাখি।

regarding-the-common-citizenshipregarding-the-common-citizenship-movement_0

ভারতের নাগরিকত্ব আইন বদলে ফেলে সকল ভারতবাসীর নাগরিকত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া হয় ২০০৩ সালের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের পাস করা ২০০৩ সালের এই নতুন আইনে তিনটি পরিবর্তন আনে বিজেপি-আরএসএস। প্রথমত, এই আইনে দেশ জুড়ে একটি নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার কথা বলা হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক ভারতবাসীকে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ দাখিল করে নিজেকে ভারতের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করে তালিকায় নাম তুলে নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র নিতে হবে। এর নাম ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব ইন্ডিয়ান সিটিজেনস’ আদ্যাক্ষরে এনআরআইসি, প্রচলিত ভাষায় এনআরসি।

দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তি নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন তখনই যখন তাঁর এদেশে জন্মানোর প্রমাণ থাকবে এবং তাঁর জন্মের সময়ে তাঁর বাবা ও মা উভয়েই যে ভারতের নাগরিক ছিলেন তার প্রমাণ থাকবে। স্বাধীন ভারতে নাগরিকত্বের আদি আইনে (১৯৫৫) জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব স্বীকৃত ছিল, উত্তরাধিকার সূত্র ছিল অপ্রয়োজনীয়।

তৃতীয় যে পরিবর্তনটি ২০০৩-এর এই আইনের মাধ্যমে আনে বিজেপি সরকার তা বিপুল সংখ্যক মানুষকে এক কথায় বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বানিয়ে দেয়। নতুন সংজ্ঞার মাধ্যমে স্পষ্টত বলে দেওয়া হয়, অন্য দেশ থেকে এদেশে এসে পাকাপাকিভাবে যারা থেকে গেছেন তাঁরা সকলেই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য হবেন এবং তাঁরা ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতেও পারবেন না।

২০০৩ সালে আনা এই ভয়ঙ্কর আইনি পরিবর্তন প্রায় নিঃশব্দেই ঘটে যায়। সবচেয়ে আশঙ্কিত ও সচকিত হয়ে পথে নামেন কেবল নমশুদ্র জনগোষ্ঠির মানুষেরা। স্বাধীনতাকালে দেশভাগের সময় থেকে শুরু করে একান্নর ভাষা আন্দোলন ও শেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ – ওপার বাংলা থেকে যে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীরা এপারে এসেছেন তাঁদের মধ্যে বড় অংশ নমশুদ্র জনগোষ্ঠির। এবং পালিয়ে আসার বাস্তবতা না থাকলেও উন্নততর সুযোগসুবিধার আশায় এপারে চলে আসার গতি পরবর্তীতে কখনই সম্পূর্ণ থেমে যায়নি। এবং পশ্চিমবাংলার পূর্বদিক বরাবর জেলাগুলির কৃষি ও ব্যবসার উন্নতিতে এঁদের শ্রম ও উদ্যম বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ২০০৩ সালে বিজেপি সরকারের আনা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে এই মানুষেরা চরম বিপন্নতায় পড়েন। এই আইন বাতিলের দাবিতে তখন থেকেই তাঁরা নানারূপে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।

এনআরসি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ সচকিত হয়ে আলোচনা শুরু করেন আসামের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সামনে আসার পর। আসামের এনআরসি এসেছিল সেখানকার নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে। নাগরিকত্বের প্রমাণ হাজির করতে কোটি কোটি মানুষের চরম হয়রানি, আতঙ্ক, জমিজায়গা বেচতে বাধ্য হওয়া, বহু মানুষের আত্মহত্যা, ডিটেনশন ক্যাম্পের বিভীষিকা, জাতি ধর্মভাষা নির্বিশেষে ১৯ লক্ষ মানুষের বেনাগরিক হয়ে যাওয়া, শরণার্থীদের প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের “উইপোকো” উক্তি – সব মিলিয়ে মানুষের কাছে দ্রুত স্পষ্ট হয়ে যায় এনআরসির ফলাফল। এনআরসির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধের মেজাজ সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় মোদি-শাহ সামনে আনেন নাগরিকত্ব আইনের নবতর সংশোধনী।

২০১৯-এর সিএএ-কে বিজেপি তুলে ধরে ২০০৩-এর সিএএ’র ভুল শুধরানোর ভঙ্গীমার আবরণে। বাস্তবে সিএএ-২০০৩ ও সিএএ-২০১৯ একই সূত্রে বাঁধা। নমশুদ্র জনগোষ্ঠির নাগরিকত্বের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার নামে সিএএ-২০১৯-এর মাধ্যমে বিজেপি-আরএসএস ভারতের সংবিধানে হিন্দুরাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। নাগরিকত্বের অধিকারে ধর্মীয় পরিচিতি বিচার স্বীকৃত হয় এই আইনে। ধর্মীয় পরিচিতিতে মুসলমান হলে ভারতে নাগরিকত্বের আবেদন জানানোর অধিকার থাকবে না। সংখ্যার জোরে সিএএ-২০১৯ পাশ করালেও সুপ্রিম কোর্টে এর বিরুদ্ধে ২০০-র অধিক আবেদন শুনানির অপেক্ষায় আছে এবং বহু আইনজ্ঞ একে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছেন। সংবিধানের ১৪ নং ধারায় ভারতে বসবাসকারী যে কোনও ব্যক্তিকে আইনের চোখে সমান হিসেবে দেখার নির্দেশকে উল্লঙ্ঘন, অন্যান্য সমস্ত ধরণের নিপীড়নকে বাদ দিয়ে কেবল ধর্মীয় কারণে হওয়া নিপীড়নকেই নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য গণ্য করা, ধর্মীয় পরিচিতিগুলির মধ্যেও বিশেষ কয়েকটিকে মান্যতা দিয়ে বাকিগুলিকে বাইরে ফেলা ইত্যাদি সুস্পষ্ট কারণে সিএএ সংবিধান বিরোধী। উৎপীড়িত শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার মানবিক উদ্দেশ্যের লেশমাত্র থাকলে মোদি-বিজেপি সরকার তো বিপন্ন নিরাশ্রয় রোহিঙ্গ্যাদের আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবত!

সিএএ-২০১৯ -এর সাম্প্রদায়িক বিভাজনকামী উদ্দেশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ১১ মার্চ রুলস জারি করার সাথে সাথে এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তার বিরোধিতা করে যখন বলেন যে এই আইন নতুন কিছুই দেবে না বরং এতদিন যাদের নানাই নাগরিক অধিকার ছিল সেগুলিকেই কেড়ে নেওয়ার সম্ভাবনা থাকছে, তখন অমিত শাহ মুখ্যমন্ত্রীকে হুমকি দিয়ে বলেন যে শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। স্পষ্টতই তিনি হিন্দুদের সরণার্থী ও মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখার নির্দেশ দিচ্ছেন। তাঁর কথারই অনুরণন তুলে বিজেপি নেতা তথাগত রায় দাবি করেন যে নাগরিকত্বের আবেদনকারীর শিস্ন পরীক্ষাও করতে হবে।

সিএএ-২০১৯ পাকিস্তান বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বললেও তা লাগু করার নিয়ম বা রুলস কিছুতেই সামনে আনছিল না মোদি সরকার। বাংলার নমশুদ্র জনগোষ্ঠি এই রুলসের অপেক্ষায় ছিলেন। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই বিজেপি তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিত। কিন্তু রুলস আসত না। অবশেষে একান্ন মাস ধরে মোট ন’বার পিছিয়ে, ২০২৪এর সাধারণ নির্বাচন ঘোষণার পাঁচ দিন আগে, গত ১১ মার্চ সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট রুলস বা সিএআর-২০২৪ জারি হল। এই ঘোষণায় নমশুদ্র সম্প্রদায়ের একাংশ প্রাথমিকভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও তা অতিদ্রুত থিতিয়ে যায় এবং গভীরতর ক্ষোভ ও হতাশা সামনে আসতে শুরু করে। বস্তুত সিএআর-২০২৪ অনুযায়ি নাগরিকত্বের আবেদন জানানোর অর্থ নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ঘোষণা করে এযাবৎ পাওয়া সমস্ত আইনি অধিকার খুইয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পন করে আবেদন মঞ্জুরির জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা।

এর সাথে সর্বদাই মাথার ওপর ঝোলানো আছে এনআরসির খাঁড়া। কিছুদিন আগে একলপ্তে বেশ কয়েক লক্ষ আধার একাউন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়ে মোদি-বিজেপি এক ভীতির আবহ তৈরি করেছে। অমিত শাহ ক্রনোলজি বুঝিয়েই রেখেছেন, সিএএ’র পর এনআরসি। ভোটের আগে সিএএ হল, ভোটের পরেই আসছে এনআরসি। সেখানে হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, সাঁওতাল সকলকেই নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে চোদ্দ পুরুষের নথি জমা করে। বলাই বাহুল্য, ধর্ম জাতি ভাষা নির্বিশেষে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ বাকি সব অধিকার ছেড়ে দিশাহারা হয়ে ছুটে বেড়াবে নিজের ও পরিবারের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে, আর আদানি-আম্বানিদের নিয়ে মোদি-শাহ মহানন্দে লুটের রাজত্ব বাড়িয়ে চলবে।

– মলয় তেওয়ারি

modi-letter-code-of-conductmodi's-letter-code-of-conduct_0

সকলের ফোনে ফোনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজ্ঞাপন পৌঁছে যেতে দেখা গেল। নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর সরকারি খরচে নিজের এই প্রচার চালালেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথেই আদর্শ আচরণ বিধি লাগু হয়ে যায়। নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে সরকার আর ভোটারদের প্রভাবিত করার কোনোরকম প্রচার করতে বা প্রকল্প ঘোষণা করতে পারে না। নিজের ঢাক পেটানো চিঠি কোটি কোটি ভোটারের ফোনে ফোনে পাঠিয়ে আদর্শ আচরণ বিধি ভঙ্গ করলেন এখনো পদে থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চণ্ডিগড়ের এক ব্যক্তির দায়ের করা অভিযোগ খতিয়ে দেখে চণ্ডিগড়ের নির্বাচন কমিশনার মোদির চিঠিকে বিধি ভঙ্গ বলে সাব্যস্ত করে ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে সোপর্দ করেছেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। নির্বাচন কমিশন কি আদৌ সত্য বলার সাহস দেখাবে?

ভারতে গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রসারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে নির্বাচনী ব্যবস্থা অশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। ভারতের গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি নির্বাচন। সেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার মূল সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা নির্বাচন কমিশন। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন সংগঠিত হয়েছিল জাত-ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অবাধ ও সার্বিক ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিতকরণের মধ্যে দিয়ে এবং তা করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও বিপুল সক্রিয়তার ভূমিকা পালন করেছিল ভারতের নির্বাচন কমিশন। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের জন্য ভারতের বহু কোটি সর্বসাধারণকে প্রস্তুত করার কাজ সংগঠিত করেছিল। পরবর্তী ছয় দশক ধরে নির্বাচন কমিশনের এই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা সামগ্রিকভাবে বজায় ছিল। সরকারি ও বিরোধী – সমস্ত দলের কাছেই এক বিশ্বাসযোগ্য ও মান্য অবস্থান নির্বাচন কমিশনের ছিল এবং বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতিবাচক ভূমিকার সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করতেও তাকে দেখা গেছে।

নির্বাচন কমিশনের এই গৌরবময় যাত্রা উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার আসার পর থেকে। শাসক দল বিজেপি নির্বাচন কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এবং গত বছর নতুন আইন এনে এই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পাকাপোক্ত করে ফেলেছেন মোদি। নতুন আইন অনুযায়ি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ ও তাদের বেতন সংক্রান্ত চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনজন নির্বাচন কমিশনারের অন্যতম অরুণ গোয়েলের অকস্মাৎ পদত্যাগের পর এখন শুধুমাত্র একজন কমিশনারই পুরোটা চালাচ্ছেন, বাকি পদ পুরণের ক্ষমতা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হাতে। ফলত বিধি ভেঙ্গে ফোনে ফোনে এভাবে প্রচার চালানোকে নিষিদ্ধ করার সৎসাহস কমিশনের হবে কী না সে প্রশ্ন উঠেছে।

আরেকটা প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী কি এভাবে কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত ফোন নাম্বারে মেসেজ পাঠাতে পারেন? কীভাবে ওই মেসেজিং সংস্থা আমাদের ফোন নাম্বার পেল? বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার আমাদের ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার সংগ্রহ করতেই পারে। কিন্তু এক উদ্দেশ্যে নেওয়া কোনও ব্যক্তিগত তথ্য অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অধিকার সরকারের নেই। করলে তা দেশবাসীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করা, বেআইনি।

গত দশ বছরের মোদি-বিজেপি শাসনে আমাদের বহু অধিকারের ওপরই ক্রমাগত আক্রমণ নেমেছে। আদিবাসীদের ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি ও অরণ্যের অধিকার, দলিত এসসি- এসটিদের নিপীড়ন নিবারণ আইন, সংবিধান স্বীকৃত সংরক্ষণ ব্যবস্থা, নারীর স্বাধীন ইচ্ছা ও সমানাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যকাজের অধিকার, কৃষকের ফসলের দাম আর শ্রমিকের মজুরি ও জোট বাঁধার অধিকার — এই সবই মোদি জমানায় বিপন্ন। এমনকি সমস্ত অধিকার পাওয়ার মূলে আছে যে সম নাগরিকত্বের স্বীকৃতি তার ওপরই প্রবল আঘাত হানছে বিজেপি। সিএএ-এনআরসি প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নাগরিকত্বকেই নাকচ করে দিচ্ছে মোদি-বিজেপি সরকার।

attack-on-worshiperspolice-attack-on-worshipers_0

সিএএ লাগু করার বিরুদ্ধে এবং দিল্লীতে নামাজীদের প্রতি পুলিশের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গত ১৪ মার্চ বালী জোড়া অশ্বথতলা মোড়ে বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআইএমএল-এর পক্ষ থেকে কার্তিক পান্ডে ও আইসার পক্ষ থেকে সৌভিক বণিক। সভা শেষে সিএএ বিলের প্রতিলিপি পোড়ানো হয়, মোদি সরকারের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে দৃপ্ত শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে প্রতীকী পথ অবরোধ করে কর্মসূচি শেষ করা হয়।

subhash-chandra-bose-comment-on-hindu-rajcomment-on-hindu-raj

“সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের হিন্দু মহাসভা ত্রিশূল হাতে ভোটভিক্ষায় পাঠিয়েছে। ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলে হিন্দুমাত্রেই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন। তাঁদের কথা কেউ শুনবেন না। আমরা চাই দেশের স্বাধীনতাপ্রেমী নরনারী একপ্রাণ হয়ে দেশের সেবা করুন।... হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া হিন্দুরাজের ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ পৃথক ইহার চেয়ে মিথ্যা বাক্য আর কিছু হতে পারে না। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মড়ক ইত্যাদি বিপর্যয় তো কাউকে রেহাই দেয় না।”

– সুভাষচন্দ্র বসু, ১২ মে, ১৯৪০, ঝাড়গ্রাম জনসভা

hate-speech-during-bjp-era

hate-speech-during-bjp-era_0

  • ২০২৩ সালে দেশে মোট নথিভুক্ত ঘৃণাভাষণের সংখ্যা - ৬৬৮
  • ৭৫% ঘটেছে বিজেপি শাসিত রাজ্য, কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল এবং দিল্লিতে
  • আগস্ট-নভেম্বর - রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ছত্তীশগড়ে বিধান সভা নির্বাচনের সময়-সবচেয়ে বেশি
  • ৬৩% - সরাসরি বা ইঙ্গিতে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উল্লেখ (লাভ জেহাদ, ল্যান্ড জেহাদ, হালাল জেহাদ, জনসংখ্যা জেহাদ ইত্যাদি)
  • ৩৬% - সরাসরি ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ হিংসা’র ঘোষণা
  • ১৬৯টিতে - মসজিদ বা মুসলিম প্রার্থনাস্থলকে লক্ষ্য করে উস্কানি
  • এ ছাড়াও-হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বয়কট, সংখ্যালঘু মহিলাদের ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষণ ও অশ্রাব্য বিশেষণ ব্যবহার
  • ঘৃণাভাষণের মূল কাণ্ডারী ও ভাণ্ডারী - বিজেপি নেতা ও নানা হিন্দু ধর্মনেতা ও গুরু
  • ৪৬% ঘৃণাভাষণের অনুষ্ঠান মঞ্চের আয়োজক - সঙ্ঘ পরিবার: বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, গোরক্ষা দল ইত্যাদি

– সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

fiscal-growth-is-the-lowestfiscal-growth-is-the-lowest

হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন ভূতপূর্ব আর্থিক সচিব সুভাস চন্দ্র গর্গ। তিনি জানালেন, মোদীর দ্বিতীয় পর্বের শাসনকালে আর্থিক বৃদ্ধি সবচেয়ে নীচে গিয়ে ঠেকেছে, যা তিন দশকে কখনো ঘটেনি।

‘দ্যা প্রিন্ট’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গর্গ বলেন, মোদী সরকারের দ্বিতীয় পর্বের শাসনকালের সম্পূর্ণ পরিসংখ্যান এখন হাতের কাছেই রয়েছে। তাতেই দেখা যাচ্ছে, বিগত পাঁচ বছরে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩- ২৪ পর্যন্ত যে আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে তা সর্বনিম্ন। এই বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৪ থেকে ৪.১ শতাংশ! ১৯৯১-এর আর্থিক সংস্কারের পর থেকে এত কম বৃদ্ধি আর কখনও দেখা যায়নি।

according-to-the-world-bank-most-people-in-india-are-poor_bpeople-in-india-are-poor

বিশ্ব ব্যাঙ্কের তৈরি করা দারিদ্রের বৈশ্বিক মাপকাঠিতে ভারতের অধিকাংশ মানুষই গরিব!

এই মন্তব্য করেছেন, জেএন ইউ-এর অবসরপ্রাপ্ত অর্থনীতির অধ্যাপক অরুণ কুমার। নীতি আয়োগের মুখ্য কার্যকরী অফিসার বি ভি আর সুব্রহ্মণ্যম ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন যে ভারতের জনসংখ্যার সাপেক্ষে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫ শতাংশের নীচে নেমে গেছে।

কোন হিসাবের ভিত্তিতে সুব্রহ্মণ্যম এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, তা তিনি খোলসা করেননি। হতে পারে, মূল্যস্ফীতির সাপেক্ষে সুরেশ তেন্দুলকার কমিটি ২০০৫ সালে দারিদ্র সীমার যে মাপকাঠি তৈরি করেন, তার উপর দাঁড়িয়ে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা দপ্তর যে পরিবারপিছু ভোগব্যয় সমীক্ষা ২০২২-২৩-এ প্রকাশ করে তার ভিত্তিতেই এই উপসংহারে এসেছেন।

অনেক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন যে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, তা অতীতের থেকে ভিন্ন। তাই, তেন্দুলকার কমিটির ফর্মূলা এ ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না।

অরুণ কুমার জানিয়েছেন, দারিদ্রসীমা যা আগে নির্ধারিত হয়, তা কোন ধ্রুবক হতে পারে না। স্থান, কাল ও সময়ের বদলের সাথে তা পাল্টাবে। তাই, সময়ানুসারে তা পরিবর্তন করা দরকার। যেমন, আধুনিক সময়ে মোবাইল ফোন এমনকি গরিব মানুষের ক্ষেত্রেও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। একজন সব্জি বিক্রেতা, রিক্সাচালকের কাছেও তা জরুরি এক মাধ্যম, কয়েক দশক আগে যা ভাবাই যেত না।

তাঁর মতে, “ন্যূনতম সামাজিক প্রয়োজনীয় ভোগব্যয়”-এর উপরই তা নির্ধারণ করতে হবে। যেমন, সুষম আহার, সন্তানদের জন্য উন্নত শিক্ষার সুযোগ, উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা, পরিচ্ছন্ন পোষাক, ভালো বাসস্থান, পরিশ্রুত পানীয় জল, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। যাঁরা এই সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাঁদের গরিব বলা চলে।”

অরুণ কুমার বলেন, বিশ্ব ব্যাঙ্কের দারিদ্র সীমা অনুযায়ী, যাঁরা দৈনিক ২.১৫ ডলারের কম খরচ করেন তাঁরা গরিব। পাঁচ সদস্যের পরিবারে তা মাসিক ৩২২ ডলার বা ২৬, ৬৭৭ টাকা হয়। যদিও ক্রয় ক্ষমতার দিক থেকে তার প্রকৃত মূল্য মাসে ১০,০০০ টাকা হয়। তিনি আরও জানিয়েছেন, ২০২৩-এ কেন্দ্রীয় শ্রম দপ্তরের ই- শ্রম পোর্টালে ৮.৪ কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্রের ৯৪ শতাংশ নথিভুক্ত শ্রমজীবী জানিয়েছেন, তাঁদের মাসিক আয় ১০,০০০ টাকা।

তাঁর মতে, সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে তাঁদের পরিবারে ৫ জন সদস্য রয়েছেন। তাই বিশ্ব ব্যাঙ্কের দারিদ্র সীমার নিরিখে তাঁরা যদি চূড়ান্ত গরিব নাও বা হন, নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তাঁরা গরিব।

যেহেতু তেন্দুলকার কমিটির রিপোর্ট এখন সেকেলে হয়ে পড়েছে, সরকারও নতুন কোনো দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করেনি, তাই বিশ্ব ব্যাঙ্কের সূত্রায়িত দারিদ্রসীমাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য, জানালেন অরুণ কুমার।

– সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ, ১১ মার্চ

1-and-half--lakh-houses-were-demolishedlakh-houses-were-demolished_0

প্রায় ৭.৪ লক্ষ মানুষকে গ্রাম ও শহর থেকে উৎখাত করেছে রাষ্ট্র ২০২২-২৩ পর্যায়ে, আর তা হয়েছে স্থানীয়, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের মাধ্যমে। ওই একই সময়ে দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ১.৫৩ লক্ষ ঘর ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। সমীক্ষা চালিয়ে এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে হাউসিং অ্যান্ড ল্যাণ্ড রাইটস্ নেটওয়ার্ক (এইচএলআরএন)।

উল্লিখিত সংস্থাটি ২৩টি রাজ্য ও চারটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল থেকে সরকারি তথ্য সংগ্রহ করে এই রিপোর্ট তৈরি করেছে, কিন্তু তাদের অভিমত, এর থেকেও অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, নথিভুক্ত সমস্ত উচ্ছেদের ঘটনায় রাষ্ট্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড অনুসরণ করেনি, যার জন্য নির্দ্বিধায় বলা চলে যে তা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। বহু জায়গায় উচ্ছেদ পর্বে চরম নির্মমতা প্রদর্শন করা হয়েছে রাষ্ট্রের তরফ থেকে। আগের বারের তুলনায় পরের বার তা আরো অনেক বেশি হিংস্র চেহারা নিয়েছে, এই কথাগুলো রিপোর্ট ব্যক্ত করেছে।

“২০২২ ও ২০২৩-এ ভারতে বলপূর্বক উচ্ছেদ” (ফোর্সড এভিকশন ইন ইন্ডিয়া ২০২২-২০২৩) শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্ট আরও দেখিয়েছে যে, আদালতের আদেশবলে এই উচ্ছেদ সংক্রান্ত ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে আর তা কার্যকর করতে প্রশাসনও বিশেষ তৎপরতা দেখাচ্ছে। রিপোর্ট দেখিয়েছে, ২০২২-২৩-এ আদালতের আদেশবলে ৩ লক্ষ মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ২০২২-এ আদালতের আদেশে উচ্ছেদ হয়েছে ৩৩,৩৬০ জন, আর ২০২৩-এ এই সংখ্যাটা প্রায় ২.৬ লক্ষ হয়েছে।

সুদামা সিং বনাম দিল্লি সরকার এবং অজয় মাকেন বনাম কেন্দ্রীর সরকারের মামলায় শীর্ষ আদালত স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে যে “বলপূর্বক উচ্ছেদের আগে সমীক্ষা চালানো ও পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করাটা কর্তৃপক্ষের অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।” কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যে সমস্ত উচ্ছেদ হয়েছে, বিশেষত দিল্লিতে, সেখানে এই আদেশ পুরোপুরি লঙ্ঘন করা হয়েছে। গত সাত বছরে ২০২৩ সালে উচ্ছেদের সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে।

সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় যে সমস্ত অঞ্চলে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, তা হল, দিল্লির তুঘলাকাবাদ, আমেদাবাদের রামা পির নো টেকরো, ফৈজাবাদ ও অযোধ্যার নয়া ঘাটে। এছাড়া, গুড়গাঁ, দিল্লি, আমেদাবাদ, অযোধ্যা, সুরাট, নবি মুম্বাইয়ের শহর ও শহর সংলগ্ন মেগাসিটি, ছোট শহরে, গ্রামে গরিব, বিশেষত সংখ্যালঘু মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

গত দু’বছরে ৫৯ শতাংশ মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ‘বস্তি ভেঙে, দখলদারি’ হটানোর অজুহাতে, সৌন্দর্যায়নের নামে। কোনো কারণ না দর্শিয়েই চালানো হয়েছে এই সমস্ত উচ্ছেদ অভিযান। প্রায় ৭২ শতাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের বিকল্প ব্যাবস্থা ছাড়াই চলেছে উচ্ছেদ অভিযান।

– তথ্যসূত্র : দ্য ওয়্যায়ার

nagorik-manch-handed-over-the-responsibilityresponsibility-to-the-newcomers

সরকারি বেসরকারি কোনো সাহায্য না নিয়ে ৩৫ বছর ধরে সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে ও ডোনেশনে নাগরিক মঞ্চ শ্রম ও পরিবেশের উপর কাজ করে চলেছে। শ্রমজীবীদের অধিকারের লড়াইয়ে পাশে থাকার সংকল্পে নাগরিক মঞ্চ গঠিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। সেই সংগঠন কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে নাগরিকদের আধিকারের লড়াইয়ের পাশে যেমন থেকেছে একইসঙ্গে শ্রমিকদের অধিকারের লড়াই, পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই সহ বহু আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়েছে, সহায়তাও দিয়েছে। কলকাতার অদূরে সায়েন্স সিটি থেকে দশ কিলোমিটার দূরে বাসন্তী হাইওয়ের পাশে জলপথে নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সভায় নব দত্ত শুরুর বক্তৃতায় সংগঠন গড়ে ওঠা ও ৩৫ বছর ধরে পথ চলার বিবরণ দিলেন ১০ মার্চ ২০০২৪-এ। এই দিন প্রায় ৫০ জন সদস্য সহযোগী সদস্য সহ অন্যান্য বন্ধুদের উপস্থিতিতে সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৪-৩০ পর্যন্ত নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সাধারণ সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত, সঙ্গে ছিলেন দীপঙ্কর বসু ও নব দত্ত। প্রায় ১১ জন সভ্য ও দরদী এই দিন সাধারণ সভায় বক্তব্য রাখেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অঞ্জন চক্রবর্তী ও জেএনইউ’র অর্থনীতির অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর দু’জনেই দেশের অর্থনীতির বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেন। অঞ্জন চক্রবর্তীর অভিমত, দেশে এক কাঠামোগত বদল ঘটে গিয়েছে পুঁজির বৈশ্বিক রূপান্তরের সঙ্গে। শাসকদল শ্রমিক শ্রেণিকে বিভাজন করার পদ্ধতিও পাল্টে ফেলেছে। তিনি বলেন ৩০ বছর আগে চালু হওয়া নব্য বিশ্বায়ন, বৈশ্বিক ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে। এর সঙ্গে ভারতবর্ষে নতুন এক অক্ষ যুক্ত হয়েছে — রাষ্ট্র নিজের চরিত্রও পরিবর্তন করে নিয়ে ধর্মীয় রাষ্ট্রের রূপ নিয়ে আসতে চাইছে। আগামী দিনে শ্রমিকশ্রেণি বলে কিছু কি থাকবে? এই পরিস্থিতিতে নাগরিক মঞ্চকে চেতনা জাগরণের কাজ করতে হবে। ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ফারাক করতে পারে নাগরিক মঞ্চ। শ্রম ও পুঁজি, শ্রম ও পরিবেশের সম্পর্ক সম্বন্ধেও নাগরিক মঞ্চকে ভাবতে হবে। কারণ পুঁজির পরিবর্তন যেমন হয়েছে, শ্রমিকশ্রেণিরও পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। এর মধ্যে নাগরিক মঞ্চ কিভাবে কাজ করবে সেটি ভাবতে অনুরোধ করেন অঞ্জন চক্রবর্তী।

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর বলেন শ্রমিকদের সংজ্ঞাটাই পাল্টে গিয়েছে। ওলা-উবের-অ্যামাজনে যারা কাজ করেন তাঁরা সেল্ফ এমপ্লয়েড। ইণ্ডিয়ান ফেডারেশন অব ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যাচ্ছে ওলা, উবের ও অ্যামাজন উভয় ক্ষেত্রে ৫০০০ জন করে ছিল সেল্ফ এমপ্লয়েড, এখন তাঁরা ওয়ার্কর্স। দ্বিতীয় অশনি সংকেত হল শ্রমিকরা কোথাও হারিয়ে যাচ্ছেন। দেশে তৈরি হয়েছে ডোল ইকনমি, ৮১ কোটি লোককে বিনামূল্যে খাদ্য দেওয়া হবে আগামী পাঁচ বছর মানে ৬০ শতাংশ মানুষ ডোলের উপর নির্ভরশীল। মানুষ তাঁর মর্যাদা হারাচ্ছেন, বৃদ্ধি পাচ্ছে অপুষ্টি যা প্রায় ৮০ শতাংশ। অধিকারের লড়াই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শ্রম অধিকারের জায়গায় আনা হয়েছে লেবার কোড। পুঁজির দরকার নমনীয় পরিসর। ফর্মাল ওয়ার্কাররা এখন ইনফর্মাল হয়ে যাচ্ছে। সরকারি চাকরি কনট্রাক্টচুয়াল এবং কনট্রাক্টার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আগামী লোকসভার ৪০০ আসন বর্তমান সরকার পেয়ে গেলে সংবিধান সংশোধন করে নেবে যেখানে কোনও অধিকার নাগরিকদের আর থাকবে না। রাজা প্রজার সম্পর্কে প্রজারই কর্তব্য থাকবে রাজার প্রতি, রাজার কোনো কর্তব্য থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন বিশ্বজিৎ ধর। বিশ্বজিৎ ধর আরও বলেন গরিবের বৈষম্য বেড়েছে। পরিসংখ্যানের কারসাজি করে বলা হচ্ছে দেশে এখন মাত্র ৩ শতাংশ কর্মহীন। বলা হচ্ছে আমরা এখন ভাল আছি। সরকার জানাচ্ছে না বর্তমানে বেকার কত।

অন্যান্যরাও নাগরিক মঞ্চের নানা দিক দিয়ে কাজ নিয়ে কথা বলেন। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা নবেন্দু দাশগুপ্ত, কুশল দেবনাথ, কলকাতা রাজপথে সাইকেল চালানোর দাবিতে আন্দোলনরত রঘু জানা, জলাভূমি সম্পদ হিসাবে ব্যবহার নিয়ে আন্দোলনের সংগঠক মনীন্দ্র মুখার্জি, ডাঃ শোভন পান্ডা, পবন মুখার্জি, অসীম ঘোষ, আইনজীবী শুভদীপ মুখার্জি, সংযুক্তা সেনগুপ্তা, সন্দীপ সিনহা রায়, দেবাশিস পাল প্রমুখ আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কথা জানান। অসীম মুখার্জি জানান গত ৩৫ বছরে নাগরিক মঞ্চ ১৪০টি বই প্রকাশ করেছে, সেগুলি ডিজিটাল করা হচ্ছে।

সভার শেষে আগামী দুবছরের জন্য সভার সবার সম্মতিক্রমে নাগরিক মঞ্চের ১০ জনের কার্যকরী কমিটি ও ১৭ জনের একজিকিউটিভ কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি শুভেন্দু দাশগুপ্ত, সহ সভাপতি মনীন্দ্র নাথ মুখার্জি, লোকেন্দ্র বহুগুনা, স্বাতী গুপ্তা এবং সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন নব দত্ত।

bjp-disgraced-in-electoral-bond-scambjpdisgraced-in-electoral-bond-scam_0

প্রথমে নির্বাচনি বন্ড বিষয়টা একটু বুঝে নেওয়া যাক। একটা রাজনৈতিক দলের দৈনন্দিন কার্যকলাপ, সভা-সমিতি, বিক্ষোভ মিছিল, এবং অবশ্যই নির্বাচন ইত্যাদির জন্য টাকার প্রয়োজন হয়। এর জন্য দলগুলিকে মানুষের থেকে চাঁদা তুলতে হয়। ইতিপূর্বে নিয়ম ছিল কুড়ি হাজার টাকা অবধি কেউ নগদে চাঁদা দিলে তাঁর নাম প্রকাশ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এছাড়া কোনো কোম্পানি তিন বছরের গড় লাভের ওপর ৭.৫% চাঁদা দিতে পারত। ২০১৩ সালে কংগ্রেস ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট গঠন করার নিয়ম চালু করেছিল যাতে দাতাদের নাম প্রকাশ করার ব্যবস্থা ছিল। ঘটনা হচ্ছে আমাদের দেশে নির্বাচন এতো ব্যয়বহুল এতো করেও নির্বাচনে কালো টাকার প্লাবন রোধ করা যাচ্ছিল না। সুচতুর বিজেপি সরকার কালো টাকা রোধ করা এবং ভোট ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার অজুহাত করে ২০১৭-১৮র বাজেটে নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক পার্টিকে চাঁদা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করল। এটা এমন এক ব্যবস্থা যাতে যে ব্যক্তি বা কোম্পানি টাকা দিচ্ছে এবং যে দল টাকা পাচ্ছে তারা ছাড়া আর কেউ এই লেনদেন সম্পর্কে কিছুই জানতে পারে না। স্বচ্ছতার পরিবর্তে এটা হয়ে দাঁড়ায় পুরোপুরি একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন, অভেদ্য ব্যবস্থা।

শুরু থেকেই রিজার্ভব্যাঙ্ক এবং নির্বাচন কমিশন বেনামে চাঁদা তোলার এই রেওয়াজের বিরোধিতা করে। ‘এ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রিফর্মস’ (এডিআর) এবং অন্যান্য সংগঠন এই ব্যবস্থা রদ করার জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করে। পাঁচ বছর আগে ২০১৯-এ সুপ্রীম কোর্ট যদিও স্বীকার করে যে এই নির্বাচনি বন্ড নির্বাচন ব্যবস্থাকে বিপুল ভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে এবং এর ওপর বিস্তারিত শুনানি হওয়া উচিত, তবুও তাঁরা এর বিরুদ্ধে স্টে জারি করতে অস্বীকার করেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৌ’র নেতৃত্বে বেঞ্চ কোন রাজনৈতিক দল কত চাঁদা পেয়েছে তার যাবতীয় তথ্য নির্বাচন কমিশনকে জানানোর নির্দেশ দেন। শীর্ষ আদালত ‘বিস্তারিত শুনানি’র জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও পাঁচ বছর ধরে তারা এটা নিয়ে প্রায় নিশ্চুপ ছিল। আমরা শুধু এটা অনুমানই করতে পারি যে এটা শুধুমাত্র বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা না কি কেন্দ্রের শাসক দলকে মোটা তহবিল গড়ার সুযোগ করে দেওয়া? অবশেষে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আদালত তথ্যের অধিকার ও সংবিধানের ধারা ১৯(১) এ লঙ্ঘন করার কারণে নির্বাচনি বন্ডকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে। তারা স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়া (এসবিআই), যাদের মাধ্যমে বন্ডসংক্রান্ত যাবতীয় লেনদেন হয়েছে, তাদের সম্পূর্ণ তথ্য নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে বলে। ব্যাঙ্ক এটা নিয়ে বহু টালবাহানা করে। অবশেষে দুটি আলাদা ফাইলে তারা তথ্য জমা দেয় — একটি ফাইলে আছে যে কোম্পানি বা ব্যক্তিরা বন্ড কিনেছেন তাঁদের নাম, আরেকটিতে আছে যে দলগুলি বন্ড পেয়েছে তাদের নাম। তাদের এই জমা দেওয়া তথ্য অসম্পূর্ণ, ভুলে ভরা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটি বন্ডের একটি আলাদা ইউনিক নম্বর আছে যেটা জানা গেলে তবেই কোন শিল্পপতি কোন রাজনৈতিক দলকে টাকা দিয়েছে তা জানা যাবে। এই লেখা হওয়া অবধি স্টেট ব্যাঙ্ক সেই নম্বর আদালতে জমা দেয়নি, সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আগামী বৃহস্পতিবার, ২১ তারিখ তাদের এই তথ্য জমা দেওয়ার কথা। এরপরেও মোট লেনদেনের পরিমাণ, কোন কোম্পানি কত টাকা দিয়েছে, কারা কত টাকা পেয়েছে তা একেক মিডিয়া বা সংবাদপত্রে একেক রকম; সংখ্যায় বিরাট কোন ফারাক নেই আবার সংখ্যার কোন মিলও নেই। এই লেখা মূলত দুটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে।

১২ এপ্রিল, ২০১৯ থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪-এর মধ্যে মোট বন্ড বিক্রি হয়েছে ১২৭৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৬০৬১ কোটি (৪৭.৪৬%), তৃণমূল ১৬১০ কোটি (১২.৬%) এবং কংগ্রেস ১৪২২ কোটি (১১.১৪%) ইত্যাদি। ১৭ ফেব্রুয়ারি আরও কিছু তথ্য প্রকাশ্যে আসে যার ফলে ওই তিনটি দলের প্রাপ্য অর্থ হয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮৪৫১.৪১, ১৯৫০.৯০ এবং ১৭০৭.৮১ কোটি। সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিয়েছে স্যান্টিয়াগো মার্টিন নামক এক ব্যক্তি যিনি ‘লটারি কিং’ নামে পরিচিত, তাঁর ‘ফিউচার গেমিং এন্ড হোটেল সার্ভিসেস’ – ১৩৬৮ কোটি টাকা। এরপর আছে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (৯৬৬ কোটি), কুইক সাপ্লাই চেন (৪১০ কোটি) ইত্যাদি। পশ্চিমবাংলার হলদিয়া এনার্জি কোম্পানি (৩৭৭ কোটি) আছে চতুর্থ নম্বরে। সিইএসসি অধীনস্থ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০১৫ সালে চালু হয়। বলাই বাহুল্য নির্বাচনী বন্ড দ্বারা সবচেয়ে লাভবান কেন্দ্রের শাসক দল। মার্চ, ২০১৮-তে বন্ড বিক্রি শুরু হওয়ার প্রথম পাঁচ দিনেই তারা রেকর্ড ২১০ কোটি চাঁদা পায় এবং ২২ মে’র মধ্যে তারা ৩৯৪১.৫৭ কোটি চাঁদা তুলে নেয়। এই বিপুল অর্থভান্ডার তাদের ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন জিততে কীভাবে সাহায্য করেছে তা বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল মার্চ ও এপ্রিল মাসে; ওই দুই মাসে বিজেপি বিভিন্ন কোম্পানির থেকে চাঁদা তুলেছে যথাক্রমে ১৫৭২.৯৩ এবং ৭০৭.৭০ কোটি টাকা।

বিভিন্ন কোম্পানি নেহাত ভালোবেসে বা করুণাবশত বা হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনায় মোহিত হয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই টাকা বিজেপিকে দেয়নি। কখনো তারা হাত মুচড়ে টাকা আদায় করেছে, কখনো মূলোটা-কলাটা লোভ দেখিয়েছে, কখনো স্রেফ হুমকি দিয়ে বাধ্য করেছে টাকা জমা দিতে। পাঁচ বছর ধরে বন্ড কেনাবেচার মধ্যে দিয়ে কী কী প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে তা আমরা বোঝার চেষ্টা করব।

ভয় দেখিয়ে চাঁদা নেওয়া

মোট ১২৬০টি কোম্পানি বন্ড কিনেছে। (ভারতে প্রায় ১৬ লাখ কোম্পানি আছে, এটা দেখিয়ে দেয় অর্থনৈতিক ক্ষমতা কত কুক্ষিগত)। এর মধ্যে যে ৩০টি কোম্পানি সর্বোচ্চ বন্ড ক্রয় করেছে তাদের মধ্যে ১৪টিতে ইডি, আইটি বা সিবিআই রেইড হয়েছে। কয়েকটা উদাহরণ দেখা যেতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে এগুলি সবই অনুমানভিত্তিক; অর্থাৎ রেইড হয়েছে বলেই তারা টাকা দিয়েছে এটা আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। ফিউচার গেমিংয়ের মার্টিন অতীতে বালি পাচারের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ৩২টি লটারি জালিয়াতির কেস চলছে। ২০১৫-য় তাঁর পুত্র বিজেপিতে যোগদান করেন। দোসরা এপ্রিল, ২০২২ তাঁর বাড়ি অফিসে ইডি হানা দেয়। এর মাত্র পাঁচ দিন বাদে তিনি ১০০ কোটি টাকার বন্ড খরিদ করেন। ইডি কারা নিয়ন্ত্রণ করে আমরা জানি, সুতরাং এই ১০০ কোটি মার্টিন কোন পার্টিকে খুশি করতে দিয়েছেন তা সহজেই বোঝা যায়। করোনার সময়ে হায়দ্রাবাদের যশোদা হাসপাতালে ইনকাম ট্যাক্স বিভাগ হানা দেয়; তাঁরা অক্টোবর ২০২২-এ ১২২ কোটি টাকা বন্ড খরিদ করেন। হিরো মোটোর্সে আইটি হানা দেয় ২০২২-এর মার্চে, অক্টোবরে তাঁরা ২০ কোটি টাকার বন্ড খরিদ করেন। একই ভাবে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং, বেদান্ত (কুখ্যাত খনন কোম্পানি যাদের বিরুদ্ধে ওড়িশা ও ছত্তিশগড়ে আদিবাসীরা সংগ্রাম করছেন), জিন্দাল স্টিল (এদের বিরুদ্ধেও ওড়িশার জগৎসিংপুরে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার অভিযোগ আছে), ডিএলএফ ডেভেলপার্স (২০০৮-১২, এরা আইপি এলের স্পনসর ছিল), আইএফবি এগ্রো ইত্যাদি কোম্পানির অফিসে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা রেইড করার পর তারাও বন্ড কিনে শাসক দলকে খুশি করতে বাধ্য হয়। এইভাবে ইডি, আইটিকে দিয়ে কোম্পানির অফিসে হানা করিয়ে চাঁদা তোলার পদ্ধতিকে নিন্দুকেরা ‘তোলাবাজি’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

বেনামি কোম্পানি বা ‘শেল’ কোম্পানি

এই ১২৬০টি কোম্পানির মধ্যেবেশ কিছু আছে যাদের কোনো ওয়েবসাইট নেই অথচ তারা কোটি কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। যেমন কুইক সাপ্লাই চেন প্রাইভেট লিমিটেড। দেখা গেছে এদের শেয়ারহোল্ডার কোম্পানির ডিরেক্টররা একই সাথে রিলায়েন্স কোম্পানির বর্তমান বা ভূতপূর্ব আধিকারিক। এদের লাভের ৩৭৭ গুণ বেশি এরা বন্ড কিনেছে, তাই সন্দেহ এরা রিলায়েন্সের ‘ফ্রন্ট’ কোম্পানি। একইভাবে হলদিয়া এনার্জি কোম্পানির লাভের ৬৩৫ গুণ বন্ড কিনেছে। মদনলাল লিমিটেড নামক কোম্পানি তাদের লাভের ১৮৬৪ গুণ বেশি বন্ড খরিদ করেছে। এর মালিক কলকাতার মহেন্দ্র কে জালানের মোট চারটে ফার্ম ৬১৬.৯২ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। অন্য তিনটি কোম্পানি হল কেভেন্টার ফুড পার্ক, এমকেজে এন্টারপ্রাইজেস, সাসমল ইনফ্রাস্ট্রাকচার। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের প্রথিতযশা অর্বুদপতিরা এই শেল কোম্পানিগুলির মাধ্যমেই বন্ড কিনে শাসক দলকে খুশি রেখেছে, তাই তাঁদের নাম তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে না। আশ্চর্যজনকভাবে ইনফসিস ছাড়া (কর্ণাটকের জেডিএস দলকে তারা চাঁদা দিয়েছে) কোনো আইটি কোম্পানির নামও তালিকায় নেই। তারাও কি শেল কোম্পানির মাধ্যমে শাসককে তোয়াজ করেছে?

চাঁদার বদলে ধান্ধা

অভিযোগ, কিছু কোম্পানি সরকারকে বন্ডের মাধ্যমে উৎকোচ দিয়ে বড় বড় সরকারি কন্ট্রাক্ট পেয়েছে, যেটাকে ইংরাজিতে বলা হয় ‘কুইদ প্রো কুও’ — গিভ অ্যান্ড টেক, বা ‘দেয়া নেয়া’। যেমন ২০২২এর ১৮ অগস্ট সরকারকে চাঁদা দেওয়ার চার দিন বাদেই এক ওষুধের কোম্পানি করোনার টিকার বরাত পায়। এই টিকা দেশে প্রভূত জনপ্রিয় করে সরকার। বন্ড ক্রেতাদের তালিকায় দ্বিতীয় নম্বরে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং। এরা ৯৬৬ কোটি টাকার বন্ড খরিদ করেছে; এদের সহায়ক কোম্পানি ‘ওয়েস্টার্ন ইউপি পাওয়ার ট্র্যান্সমিশন’ খরিদ করেছে ২২০ কোটি টাকা। এরা বিপুল সব প্রকল্পের বরাত পেয়েছে, যেমন শ্রীনগর ও লাদাকের মধ্যে জোজি লা সুড়ঙ্গ, চারধাম টানেল, মুম্বাইয়ে থানে-বোরিভালি সুড়ঙ্গ, বুলেট ট্রেনের জন্য বান্দ্রা-কুরলা কমপ্লেক্স স্টেশন। এই কোম্পানি টিভি ৯ চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করে। দেখা গেছে বিভিন্ন মন্ত্রী এই কোম্পানির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। উত্তরাখন্ডের সিল্কয়ারা টানেল যা কয়েক মাস পূর্বে ধসে যাওয়ার কারণে ৪০ জন শ্রমিক আটকে পড়ে, সেটির নির্মাতা নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিং ৫৫ কোটি টাকা বন্ড কিনে চাঁদা দিয়েছে।

বন্ড ক্রেতার একটি বড় অংশ কয়েকটি শিল্পে সীমাবদ্ধ, যেমন — পরিকাঠামো, সিমেন্ট, খনন এবং ওষুধ। পরিকাঠামো শিল্পের খেলুড়েদের বদান্যতার কারণে কীভাবে শাসকের তহবিল ভরে উঠেছে তার কিছু উদাহরণ আমরা ওপরে দেখেছি। সিমেন্টের কোম্পানিগুলি মোট ২৩৩ কোটি টাকার বন্ড ক্রয় করেছে। পরিবেশ রক্ষায় বেদান্তরা একেবারেই দায়িত্বশীল নয় তবুও এই কোম্পানি দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ও গভীর বনাঞ্চলে বিভিন্ন প্রকল্পের বরাত পেয়ে থাকে। এটা অবাক করে না যখন দেখা যায় যে তারা ৩৭৬ কোটি টাকার বন্ড কিনে শাসকদের তুষ্ট করেছে। মাত্র ৩০টি ওষুধের কোম্পানি ৯০০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। এদের মধ্যে যশোদা হাসপাতাল ছাড়াও আছে ডক্টর রেড্ডিজ ল্যাবরেটরি (৮০ কোটি), টরেন্ট ফার্মা (৭৭.৫ কোটি), সিপ্লা (৩৯.২ কোটি) ইত্যাদি। ওষুধের কোম্পানিগুলিকে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ, কর ফাঁকি ইত্যাদির জন্য ভয় দেখানো সহজ। তিরিশটির মধ্যে অন্তত সাতটি কোম্পানির ওষুধের মান খারাপ হওয়ার কারণে তদন্ত চলছিল। এদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা এক সাথে একই সময়ে বন্ড খরিদ করেছে! মার্চ, ২০২২’এ বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে কর ফাঁকি দেওয়ার তদন্ত শুরু হয়। ১০ নভেম্বর সিপ্লা, ডক্টর রেড্ডিস, ইপকা ল্যাব ৫০ কোটি টাকার বন্ড কেনে। পরের কয়েক দিনে গ্লেনমার্ক, পিরামাল, আলেম্বিক ফার্মা ক্রয় করে আরও প্রায় ৫০ কোটি টাকার বন্ড।

রাজ্যের শাসক দল, তৃণমূল কংগ্রেস চাঁদা প্রাপকদের তালিকায় দুনম্বরে, জাতীয় দল কংগ্রেসেরও ঊর্ধ্বে! আজ অবধি তারা এই বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় নীরব। অথচ ডিএমকে, এসপি, আপ, এনসিপি সহ অন্তত দশটি দল কোন কোম্পানির থেকে চাঁদা পেয়েছে তা জানিয়ে দিয়েছে। ২০২১-এ পুনরায় সরকার গঠন করার পর এরা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চাঁদা পেয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস জানিয়েছে তাদের যাঁরা চাঁদা দিয়েছেন তাঁরা নাম জানাতে অনিচ্ছুক। দল যত বন্ড পেয়েছে তার বেশির ভাগ তাদের অফিসে পাঠানো হয়েছে বা ড্রপ বাক্সে ফেলা হয়েছে। এছাড়া কিছু ব্যক্তি যাঁরা পার্টিকে সমর্থন করেন তাঁরা কারো মাধ্যমে বন্ড পাঠিয়েছেন। এই কারণে ক্রেতাদের নাম তাদের কাছে নেই। ভাবতে অবাক লাগে দেশে আজও এতো নিঃস্বার্থ কোম্পানি/ব্যক্তি আছেন! আগেই আমরা দেখেছি বিজেপি ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন কি বিপুল অর্থ চাঁদা পেয়েছে। বেআইনি পয়সায় নির্মিত সরকার কি বেআইনি নয়? প্রশ্ন ওঠে দীর্ঘ পাঁচ বছর আগে এডিআর নির্বাচনি বন্ডের বিরুদ্ধে মামলা করা সত্ত্বেও শীর্ষ আদালত কেন জরুরি ভিত্তিতে সেই মামলার শুনানির ব্যবস্থা করেনি! এটাতো বিজেপিকে পাহাড়প্রমাণ অর্থভান্ডার গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই অর্থব্যবহার করে তারা নির্বাচন জিতেছে, বিভিন্ন রাজ্যে জনপ্রতিনিধি (ঘোড়া!) কেনাবেচা করে বিরোধী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। গোটা তিরিশেক সাঙাতের বেআইনি পয়সায় আজ নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হচ্ছে, গণতন্ত্র আজ এই শাসক দলের চেলা-চামুন্ডাদের কুক্ষিগত হয়ে গেছে।

– সোমনাথ গুহ

give-and-take_bbgive-and-take_0

না না, আমি সেই পুরোনো বাংলা সিনেমার কথা বলছি না। এ হল আচার্য প্রমোদ কৃষ্ণাণ আর প্রধানমন্ত্রীর মোদির দেয়া নেয়ার কথা। এতদিনে সবাই জেনে গেছেন যে রামমন্দির উদ্বোধনে না যাবার জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বকে আচ্ছা করে ঠুকেছেন আচার্য। তিনি একসময় প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর উত্তর প্রদেশ সামাল দেবার উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন। ২০১৯-এ দাঁড়িয়েছিলেন লাখনৌ থেকে কংগ্রেসের টিকিটে। হেরেছিলেন। তার আগেও ২০১৪-তে হেরেছিলেন আরেকটি কেন্দ্র সম্ভালাতে দাঁড়িয়ে। এবারে কি টিকিটের এবং বিজয়ের দিকে তাক করেই সম্ভালাতে কল্কির মন্দির উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ডাকলেন? উত্তর সময় দেবে।

কিন্তু আমাদের দেয়া নেয়ার কথাটা এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। তিনি উদ্বোধন করতে এসে সাম্প্রতিক ইলেকটোরাল বন্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে খুবই তাৎপর্যময় উক্তি করেছেন। তিনি যা বলেছেন সেকথা আগে লিখি। আচার্য কৃষ্ণাণ বলেছেন, সবারই কিছু না কিছু দেবার থাকে। কিন্তু তাঁর আবেগ ছাড়া কিছু দেবার নেই। যেমন আবেগে এর আগে তিনি কংগ্রেসের রামমন্দিরের উদ্বোধনে অংশগ্রহণ না করার সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, রাম আর রাষ্ট্র এই দুই ক্ষেত্রে কোনো সমঝোতা করা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর রামলালার মন্দির উন্মোচনের ভাষণ মনে করিয়ে দিয়ে। তেমন আবেগ আর কী। প্রধানমন্ত্রী কথাটা শুনে খুব খুশী হয়েছেন। তিনি আচার্যকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তাঁর আবেগ ছাড়া কিছুই দেবার নেই শুনে। কেন?

কারণ এ এমন এক পাপী সময় যে কৃষ্ণকে এখন যদি সুদামা তিন মুষ্টি চাল দিতেন এবং কৃষ্ণ তা নিচ্ছেন ভিডিও করা থাকত তাহলেই কেউ পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন করে দিত সুপ্রিম কোর্টে। কোর্টরায় দিত কৃষ্ণকে কিছু দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি প্রণোদিত হয়ে, কৃষ্ণ-ও নিয়ে দুর্নীতি করেছেন।

এখানে আমাদের অনেকগুলো ভাবার কথা আছে। সে সব কথায় যাবার আগে আমরা কৃষ্ণ-সুদামার এই পৌরাণিক গল্পটা জেনে নিই একটু ছোট করে। গল্পটা ভাগবতে আছে। কৃষ্ণ-সুদামা প্রাণের বন্ধু ছিলেন। একসঙ্গে পড়েছেন গুরুর কাছে। তারপরে দুজনের পথ দুইদিকে চলে গিয়েছে। কৃষ্ণ যখন দ্বারকাধীশ তখন ব্রাহ্মণ সুদামা অত্যন্ত দরিদ্র। তিনি ভগবৎ চিন্তায় মত্ত থাকেন ইত্যাদি। তাঁর স্ত্রী একদিন সুদামার দারিদ্রে ভেঙে যাওয়া শরীর দেখে তাঁকে বললেন কৃষ্ণের কাছে যেতে সাহায্য চাইতে। তিনদিন উপবাসে থেকে তিন মুঠো চাল বাঁচিয়ে কৃষ্ণের কাছে চললেন তিনি। দেখা হল কষ্ট করে অনেক। দেখা হতে কৃষ্ণ তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন রাজকীয় চালে। আর সুদামা খুব কুন্ঠায় সেই চাল দিলেন। কৃষ্ণ তার থেকে তৃপ্তিভরে দুই মুঠো আহার করতেই রুক্মিনী তাঁকে থামালেন। বাকীদের জন্যও রাখতে বললেন।

যাই হোক, সাক্ষাৎ এবং অভ্যর্থনা পেয়ে তৃপ্ত সুদামা চললেন তাঁর কুঁড়ের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখলেন সে কুঁড়ে প্রাসাদ হয়ে গেছে। সেই প্রাসাদ সারাক্ষণ আনন্দে পূর্ণ, যেমন কৃষ্ণের প্রাসাদ। অজস্র দাসদাসী, অতুল সম্পদ ইত্যাদি সবই সুদামাকে দিয়েছেন কৃষ্ণ বন্ধুর দারিদ্রের কথা বুঝতে পেরে। ভক্তিমানেরা বলেন এই হল ভক্তের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক।

প্রধানমন্ত্রী এর মধ্যে আলতো করে ভিডিও শব্দটি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যদি সুদামা চাল দিচ্ছে ভিডিও করা থাকত? তবেই না পিআইএল হত কোর্টে! ভিডিও নেই, অতএব কোর্টেগিয়ে বিচার চাওয়ার কিছু নেই। কোর্টও বলবে না দুর্নীতি হয়েছে। অর্থাৎ প্রমাণ থাকা চাই যে দুর্নীতি হয়েছে। ভাবনাটা কি তাহলে ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে? ঐ যে বলে না কার মন যেন বোঁচকার দিকে থাকে?

ইলেকটোরাল বন্ডের যে তথ্য এসবিআই দিয়েছে তাতে এখনো সরাসরি কোন দল কার থেকে কত টাকা নিয়েছে তার প্রমাণ জুটছে না। পরোক্ষ প্রমাণ জুটছে। বিশেষজ্ঞরা সেই সব প্রমাণ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কয়েকটা কথা আমাদের জন্য উদ্ধার করেছেন। আমরা সেই প্রমাণের দিকে যাব না। বরং আমরা একটু ভক্ত, ভগবান আর ধনী-দরিদ্রের সম্পর্কটাকে দেখে নিই। ঐ কৃষ্ণসুদামা গল্প দিয়েই।

সুদামা চাল দিলেন নিজে না খেয়ে থেকে। কেন? তাঁর প্রাণপ্রিয় বন্ধু এবং ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি এবং প্রীতির জন্য। আচ্ছা, ভক্তের হৃদয়ের যে সুষমা তা যথেষ্ট নয় তাহলে ভগবানের জন্য? যাক সে কথাও না হয় থাক, প্রশ্ন হচ্ছে অমন ভগবানের রাজত্বে দরিদ্র থাকে কেন? কেন সবার পেটে খাবার, মাথার উপর ভাল ছাদ, পরার মতো পোশাক ইত্যাদি থাকে না? এ কেমন ভগবান আর ভক্তের দেশ যেখানে এত এত বৈষম্য?

উত্তর দেবার জন্য প্রাচীন গল্পকারেরা আরেকটা গল্প বানিয়েছেন। কর্মফলের গল্প। এসব সুখ-দুঃখ ধন-দারিদ্র যার যার পূর্বজন্মের কর্মফল। ভগবানের সেখানে হাত দেবার দায় নেই। কিন্তু ভগবানই যদি কর্মের কারণও হয় তাহলে যে কর্মের কারণে দুঃখ বা দারিদ্র সেই কর্ম করতে দিয়েছিলেন কেন? এইখানে প্রাচীন গল্পকারের পুঁথি যায় বন্ধ হয়ে। প্রশ্নকারীকে নাস্তিক কিম্বা পাষণ্ড বলে তিনি আসর থেকে উঠে পড়েন।

ভিডিও-র প্রমাণের তো দরকার নেই এ দেশের দারিদ্র দেখার জন্য। প্রধানমন্ত্রী জানেন না নাকি? এত এত দরিদ্র কেন? উত্তরটা প্রধানমন্ত্রী দেবেন না। কারণ যা হচ্ছে তা মোদির এবং মোদিদের নীতির দৌলতে। ইলেকটোরাল বন্ডে টাকা যারা ঢেলেছে তাদের মধ্যে লটারি কোম্পানিও আছে। যাদের কাজ হল দরিদ্র মানুষের সম্পদ লাভের ইচ্ছা নিয়ে খেলাধুলা করা। তাদের সম্পদ উবিয়ে দিয়ে নিজেদের সম্পদ বাড়ানো। তারাই দিয়েছে সবচেয়ে বেশি টাকা। ইডি, সিবিআই ইত্যাদি রেইড হলেও টাকা গিয়েছে কেন্দ্রের শাসকদলে। মানে চাল হাতে করে না আনলে আপনাদের ব্যবস্থা হাতকড়ির। যদি চাল দিয়ে দেয় আপনাদের তাহলেই হাতকড়ি ভ্যানিশ! আরো কত বেড়াল বেরোনো বাকি আছে এখনো। এবং সবচেয়ে বড় ঝুলিটা তো এখনো খোলেইনি। পিএম কেয়ারস ফান্ড, যার তথ্য নাগরিক জানতে পারবে না এমনই আইন।

এই সব আইন করেন কেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল। আপনাদের স্বচ্ছ ভারতে থাকার জন্য স্বচ্ছ ভাবমূর্তির দরকার হয় না কেন? মুখে বলেন না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা, কাজে মানেন কি না লোক জানতে চাইবে না? তারা তো দেখছে যে দেশের সব সম্পদ কয়েকটি ধনী পরিবারের হাতে চলে যাচ্ছে। আর সাধারণ নাগরিক এখন সুদামার চাইতেও অসহায়। তার জীবন-জীবিকার কোনোরকম নিশ্চয়তা আর নেই। যে কোোন জিনিসের দাম এমন জায়গাতে ঠেকেছে মানুষ নাভিশ্বাস খাচ্ছে। ধর্মের নামে এক সম্প্রদায়কে অন্যের বিরুদ্ধে হিংস্র করে তুলে ভাবছেন তার আড়ালেই সব চাপা দিয়ে দেবেন?

ভিডিও-তে নাই বা ধরা থাকল আপনাদের সন্ত্রাসের কামাই-এর কথা, লোক কিন্তু বুঝছেই। বুঝছে বলে আপনার অস্বস্তি হচ্ছে এত। চারশো পার হওয়ার স্বপ্নটা অতটা শক্তপোক্ত লাগছে না। কারণ আপনি দেখছেন আওয়াজ একটা উঠতে শুরু করেছে ‘চৌকিদারই চোর’ বলে। ইলেকটোরাল বন্ড সে আওয়াজকে জোরদার করছে। তাই আপনি কৃষ্ণ নাম জপছেন। এহে, বাংলায় আরেকটাও প্রবাদ আছে। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। মনে পড়ে গেল।

– শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ, সহমন ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত

in-a-mood-of-hatredin-a-mood-of-hatred_0

ইয়াজান। যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজার এক শিশু। কঙ্কালসার ছোট্ট দেহটিতে গভীর কালো চোখদু’টি কী বাঙ্ময়। সেখানে যেন বিস্ময়ভরা অনুনয়, ‘কেন এমন হয়ে গেল সব? কেন সব কেড়ে নিলে আমাদের?’

বাচ্চাটি এ মাসের গোড়ায় মারা গেছে। স্রেফ না খেতে পেয়ে। রাফার এক স্কুলের শরণার্থী শিবিরে। আরও হাজার হাজার শিশু এভাবেই অনাহারে, তৃষ্ণায়, মহামারিতে মারা যাবে গাজায় - রাষ্ট্রসংঘের আশঙ্কা।

এই শিশুরা, তাদের বাবা-মায়েরা এক উদ্ধত রাষ্ট্রনায়কের ঘৃণার শিকার। ইজরায়েলের দাম্ভিক শাসক গাজাবাসীর গণনিধনে বদ্ধপরিকর। সারা পৃথিবীর প্রতিবাদেও তার ঔদ্ধত্য এতটুকু চিড় খায় না! যেমনটা রাশিয়ার পুতিন।

ভারতেও এই মুহূর্তে ৬৭ লক্ষ শিশু ২৪ ঘণ্টা অনাহারে থাকে, যাদের বয়েস দু’বছরের মধ্যে। তারাও ঘৃণার শিকার — ভারতের কর্পোরেট প্রভুরা আর তাদের সেবাদাসেরা গরিব দলিত আদিবাসী সংখ্যালঘুদের ঘৃণা করে। সীমাহীন নির্লজ্জ বিবেকহীন বৈষম্যে সেই ঘৃণা প্রতিফলিত। (তবুও অনাহারের এই পৃথিবীতে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ‘স্পেসভিআইপি’র ভাসমান রেস্তোরাঁয় পাঁচ লক্ষ ডলারে ভোজ খাওয়ার লোকের অভাব হবে না! ভারতীয় ধনকুবেরের ছেলের বিয়েতে ১০০০ কোটি টাকা খরচ হয়!)

ক্ষুধার পৃথিবীকে অপ্রাসঙ্গিক করে ক্রমশ প্রকট হচ্ছে ঘৃণার পৃথিবী। এই ঘৃণা বহুস্তরীয়। কোথাও তা বর্ণবিদ্বেষ — মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে গত আড়াই মাসে আট জন ভারতীয়কে হত্যা করা হয়েছে, বেশিরভাগই ছাত্র। তারা বর্ণবিদ্বেষের শিকার হলেও হতে পারে। কোথাও জাতিবিদ্বেষ — ভারতের এক ছোট্ট প্রদেশ মণিপুর গত প্রায় একবছর ধরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে সেই আগুনে। আর সারা ভারতকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে ধর্ম আধারিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে। যার ভয়াল চেহারা দেখেছি গুজরাট গণহত্যায়, দু’দশক আগে।

ভারতের বর্তমান শাসকদল বিজেপি-আরএসএস, সংখ্যাগুরু হিন্দুত্বের আধিপত্যকামিতায় সংবিধান সহ গোটা রাষ্ট্রের খোল নলচে পাল্টাতে চায়। সেই উদ্দেশ্যে তাদের তূণীর থেকে একেক সময়ে একেক অস্ত্র বার করে চলেছে। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক হিংসার আবহে সংখ্যালঘু মানুষকে সব সময় সন্ত্রস্ত রাখা। (ঠিক যেমন নানা অর্থহীন আর্থিক বিধি নিষেধের মারপ্যাঁচে গরিব সাধারণ মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখা যাতে তারা নাগরিক অধিকার দাবি না করতে পারেন।)

ভিড়হিংসা, ধর্মীয় শ্লোগানের রণহুঙ্কার, ঘৃণাভাষণ এমনকি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মাধ্যমে নানা অসত্য, অর্ধসত্য বিকৃত বিষাক্ত প্রচারের মধ্য দিয়ে সেই হিংসা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার পরিণতিতে ধারাবাহিক ভাবে সংখ্যালঘু মানুষের হেনস্থা, শারীরিক নিগ্রহ, সম্পত্তিহানি এমনকি হত্যার অসংখ্য ঘটনা দেশ দেখেছে, দেখে চলেছে। নিকট অতীতে আমরা দেখেছি কীভাবে চলন্ত ট্রেনের কামরায় এক সামরিক কর্মী তার আধিকারিক সহ চার মুসলিম নাগরিককে বিনা প্ররোচনায় সার্ভিস রিভলবার থেকে হত্যা করেছে। কতটা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভিতরে থাকলে এটা সম্ভব! আর তার সাম্প্রতিক চরম আগ্রাসী রূপ-বুলডোজার রাজ। এ তো হচ্ছে দেশবাসীর সঙ্গে। কিন্তু ক’দিন আগে গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ছাত্রদের ওপর যে হামলা হল তাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রক যথেষ্ট বেকায়দায়।

গত ১৬ মার্চ রাতে আহমেদাবাদে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের ঘরে পাঁচ বিদেশি ছাত্র রমজানের নামাজ পড়ছিলেন। তারা উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কা থেকে আগত। এর মধ্যেই নিরাপত্তারক্ষীকে ধাক্কা মেরে ২০-২৫ জন দুষ্কৃতী ধর্মীয় শ্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাসে ঢুকে সোজা হস্টেলের ঘরে গিয়ে তাদের নমাজ পড়তে বারণ করে, “জয় শ্রীরাম” শ্লোগান দিতে বলে এবং বেধড়ক মারধর করে। শুধু তাই নয়, তাদের মোবাইল, ল্যাপটপ, বাইক ভাঙচুর করে। ৫ জনকেই হাসপাতালে নিতে হয়, দু’জনের চোট গুরুতর। অমুসলিম অন্য বিদেশি ছাত্ররা বাঁচাতে এলে তাদেরও মারধর করা হয়।

এই ঘটনার পর ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, ‘যে হেতু এই ছাত্ররা সকলেই বিদেশি, তাই তাদের ভারতীয় ‘সংস্কৃতির সংবেদনশীলতা’ সম্পর্কে জানা বোঝা উচিত’। বটেই তো! কিন্তু ধর্মীয় বিদ্বেষপুষ্ট যে ‘নিগ্রহের সংস্কৃতি’র সঙ্গে তাদের পরিচিত হতে হল, এরপর আর সেই ‘জানা বোঝার’ উৎসাহ তাদের থাকবে? আর প্রধানমন্ত্রীর সযত্নপ্রসাধিত ও প্রচার-চর্চিত ‘বিশ্বগুরু’ ইমেজ কি একটু হলেও ম্লান হল না এই দুষ্কৃতী তাণ্ডবে!

আসলে বাঁধনহারা লাগামছাড়া ঘৃণাভাষণে, (সুপ্রিম - তিরস্কার সত্ত্বেও) কেউই কম যান না! কিন্তু ছোট বড় মন্ত্রী, নেতা, কর্মী, ধর্মগুরু - সবাই পার পেয়ে যান। কারণ তারা সংখ্যাগুরু। সংসদে বসে অপর সাংসদকে বেনজির কুৎসিত আক্রমণ করলেও, কোনও শাস্তি হয় না! ‘গোলি মারো শালোঁকো’ বলে গলার শির ফুলিয়েছিলেন একজন, এখন তিনি নাকে চশমা এঁটে অধ্যাপক সুলভ গাম্ভীর্যেবঙ্গবাসীকে ‘ভদ্র’ ‘সভ্য’ হওয়ার জ্ঞান বিতরণ করে যান!

কিন্তু উমর খালিদ সমান নাগরিকত্বের সমর্থনে ভাষণ দেওয়ায় ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে গেলেন! অন্ধকারান্তরালে তাঁর যৌবনের অমূল্য দিনগুলো কাটিয়ে যাচ্ছেন! সংখ্যালঘু কিনা!

এই ঘৃণার আবহ ভারতবর্ষে এত তীব্র, এত ব্যাপক তো ছিল না! ঘৃণার কারবারিরা যবে থেকে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তখন থেকে সেই সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রকাশ্য হতে থাকে। আমাদের বাংলায় রামনবমী নিয়ে আগে কখনও সশস্ত্র মিছিল বেরোয়নি। উদ্বেগের প্রহরও গুনতে হত না, এখন হয়! কেন?

কিন্তু যতই প্ররোচনা থাক, ২০১৮-র ২৯ মার্চ আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম রশিদের কথাগুলো আমরা মনে রাখব। এক সদ্য পুত্রহারা পিতা কীভাবে সমস্ত ক্ষোভ, যন্ত্রণা, কষ্টকে সংবরণ করে একজন আদর্শ নাগরিক শুধু নয়, এক মহৎ ‘মানুষ’ হয়ে উঠেছিলেন তা কিংবদন্তি হয়ে থাকবে।

ঘৃণার কারবারিরা যাবে তাদের অমোঘ গন্তব্যে - ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। যেমন গেছে হিটলার, মুসোলিনিরা...। মানুষ তাদের সেখানে পাঠাবে।

– জয়ন্তী দাশগুপ্ত

raghupathi-ganguly-passed-away0raghupathi-ganguly-passed-away

বালির দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ পার্টিকর্মী তথা সংগঠক কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলী গত ১৬ মার্চ সকাল ৬.৩০ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন, মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। কমরেড রঘুপতি গাঙ্গুলীর বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘ কর্মজীবন শুরু হয় ৬০এর দশকের শুরুর দিকে। তখন তিনি সিপিএমের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তিতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি ঐ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ঐ অগ্নিগর্ভ সময় পেরিয়ে জরুরি অবস্থার সময় গোপন পার্টির ব্যবস্থায় পার্টিকে রক্ষা করা, পার্টির গোপন পরিকাঠামোর অঙ্গীভূত হয়ে কষ্টসাধ্য ত্যাগের মধ্য দিয়ে পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। তাঁর পরিবার এই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে একাধিক বার জেলে যেতে হয়েছিল। পরবর্তীতে এলাকার কাজে তাঁর ধারাবাহিক অংশগ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগ্রহণ পার্টিকে সমৃদ্ধ করে। শ্রমিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন মহিলা সংগঠন গড়ে তুলতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

তিনি দীর্ঘদিন হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন কিছু বছর, এবং পার্টির বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির সদস্য ছিলেন আমৃত্যু।

অজাতশত্রু এই মানুষটির সততা ও আদর্শবাদী সাধারণ জীবন যাপনের জন্য দলমত নির্বিশেষে মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করত। একই সাথে রাজনৈতিক কর্মী, নাট্যকর্মী এবং সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে তাঁর বহু বিস্তৃত কর্মজীবন আমাদের প্রত্যেকের কাছে চিরদিনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এরই পাশাপাশি স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। বালির বিভিন্ন গ্রন্থাগার, বালি উৎসব কমিটি, বালি সিনে গিল্ড ও বিভিন্ন নাট্য সংস্থায় তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ।

বাড়িতে পড়ে গিয়ে বেশ কিছু দিন শয্যাশায়ী হয়ে থাকার পরে হঠাৎ ১৬ তারিখ ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।

১৬ তারিখ বেলা বাড়তেই বহু মানুষ ও পার্টির নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকে বালির জোড়া অশ্বত্থতলা পার্টি অফিসে। আজীবন কমিউনিস্ট কমরেড রঘুদার শেষ ইচ্ছানুসারে মরণোত্তর ক্ষুদান করা হয় বালী এ্যপেক্স ক্লাবের সহযোগিতায়। পরবর্তীতে তাঁর মরদেহ তাঁর পুরনো বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিপিআইএম-এর সংগঠন থেকে মাল্যদানের মধ্য দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সিনেগিল্ড, বালি উৎসব কমিটি ও নাট্যদল থেকে মাল্যদান করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়।

এর পরে পার্টির সাথীরা তাঁদের প্রিয় কমরেডের মরদেহ বালি পার্টি অফিসে নিয়ে আসা হলে সেখানে রাজ্য পার্টির সম্পাদক কমরেড অভিজিৎ মজুমদার মরদেহে রক্তপতাকা ও মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পার্টির অনান্য রাজ্য ও জেলা নেতৃবৃন্দ ও পার্টি কর্মীরা মালা দিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সম্পাদক কমরেড অভিজিৎ মজুমদার, কমরেড কার্তিক পাল, হুগলী জেলা সম্পাদক কমরেড প্রবীর হালদার, হাওড়া জেলা সম্পাদক কমরেড দেবব্রত ভক্ত ও এলাকার কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। কমরেড অভিজিৎ মজুমদার বলেন যে সারাজীবন ধরে রঘুপতি গাঙ্গুলীর আত্মত্যাগ আমাদের কাছে প্রেরণা স্বরূপ।

কমরেড কার্তিক পাল বলেন যে রঘুপতি গাঙ্গুলী ছিলেন নীরব কর্মী। তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলি সম্পন্ন করতেন সেগুলি প্রচারবিহীন ভাবেই থাকত। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

পরবর্তীতে তাঁর মরদেহ আন্তর্জাতিক গানে মুখরিত মিছিলে পৌঁছোয় বালি সাধারণ গ্রন্থাগারে। সেখানে তাঁকে গ্রন্থাগারের সাথীরা শ্রদ্ধা জানান এবং শেষে বালী পাঠক ঘাট শ্মশানে তাঁর মরদেহ দাহ করা হয়।

কমরেড রঘুদা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন চিরকাল তাঁর অমলিন হাসিমুখ নিয়ে এবং তাঁর সাথে দেখা হবে বারবার প্রত্যয়ী প্রতিস্পর্ধী মিছিলে। কমরেড রঘুদা লাল সেলাম। কমরেড রঘুদা অমর রহে।

----

নীরব বিদায়

একান্ত নীরবে একেবারের জন্যে বিদায় নিয়ে চলে গেল রঘুপতি গাঙ্গুলী গত ১৪ তারিখ সকালে। এখন তার সম্পদ বলতে ছিল বার্ধক্যে জীর্ণ অশক্ত একটি দেহ যা নিয়ে সে টুকটুক করে হেঁটে চলে বেড়াত বালির রাস্তায় অফুরন্ত প্রাণশক্তি ভর করে, কুশল বিনিময় করতো পরিচিতদের সঙ্গে, সেই রঘুপতিকে আর দেখা যাবেনা কাঁধে ঝোলা নিয়ে বই-এর দোকানে, খবরের কাগজ ও পত্র পত্রিকার দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতে।

রঘুপতি বরাবরই বামপন্থী রাজনীতির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল বালিতে। সিপিআই করতো কিনা জানা নেই তবে একটা সময় সিপিআইএম করতো এবং জেল খেটেছিল, পরে ১৯৬৯এ সিপিআইএমএল তৈরি হলে আশু বিপ্লব কামনায় চলে আসে নকশালবাড়ি পন্থী রাজনীতিতে। রাজনীতির কারণে বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করে কাটিয়েছে বহুদিন। সত্তরের মাঝামাঝি পার্টি অনেক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হলে খোলা সংগঠন ইন্ডিয়ান পিপলস্ ফ্রন্ট এ যুক্ত হয়, আইপিএফ ব্যানারে বালি পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করে। এই সময়ে বালিতে তৈরি হয় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংস্থা, রঘুপতি ছিল এর অন্যতম সংগঠক তবে যোগ ছিল গোপন লিবারেশন গোষ্ঠীর সঙ্গে। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে সিপিআইএমএল (লিবারেশন) গোপনীয়তা ঝেড়ে খোলা কাজ করতে শুরু করে তখন থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই দলের কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছে রঘুপতি। লোকাল কমিটির সম্পাদক ও হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে রঘুপতি একটা সময় দলের কর্মীদের অতি প্রিয় হয়ে ওঠে। এতো গেলো রঘুপতির রাজনৈতিক চেতনার একটা ছবি, এবার দেখা যাক তার অন্য ভাবনার আরেক দিক। রঘুপতি গাঙ্গুলি একজন বইপাঠক, বালি শিশু সমিতি ও বালি সাধারণ গ্রন্থাগারের দীর্ঘদিনের পুরনো সদস্য আমাদের রঘুপতি, লাইব্রেরি এলে শুধু বই পাল্টানো নয় অনেকটা সময় কাটিয়ে যেত, বালি সাধারণ গ্রন্থাগার কর্মীসংঘের আজীবন সদস্যও ছিল সে। ভালোবাসতো গান নাটক, একটা সময় অভিনয় করেছে শিশু সমিতি ও অভিনেয়-র নাটকে। বালির প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতো, সিনেগিল্ডপ বালি ও বালি উৎসব সমিতির উৎসাহী সদস্য ছিল। বালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি বরাবরই প্রগাঢ় শ্রদ্ধা দেখিয়ে গেছে রঘুপতি। বহু পুরনো লিফলেট, হলুদ হয়ে যাওয়া খবরের কাগজের কাটিং, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পাতলা পত্রিকা পরম মমতায় আশ্রয় পেতো রঘুপতির ঝোলায়। পুরনো দিনের যে কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে রঘুপতির সাহায্য নিতেই হোতো, রঘুপতি ছিল যেন বালির মহাফেজখানার এক ক্ষুদ্র নমুনা। রঘুপতি নম্র, রঘুপতি বিনয়ী, রঘুপতি জানতো ভালোবাসতে, জানতো মানুষকে শ্রদ্ধা করতে, ঐতিহ্যকে সম্মান করতে। আর সেজন্যই রঘুপতি বিপ্লবী, রঘুপতি কমিউনিস্ট। রঘুপতি গাঙ্গুলির প্রয়াণ আমাদের অনেককেই বিষন্ন করে দিয়ে গেল।

– অঞ্জন মুখার্জী

in-memory-of-comrade-hena-sultana_Ain-memory-of-comrade-hena-sultana_0

মন ভালো করা সকালটাকে, মন খারাপের বিকেলে – এভাবেও ডুবে যেতে হয়! মিষ্টি, সরল, প্রাণচঞ্চল – ভবিষ্যতের উজ্বলতাকে, এভাবেও চির বিলীন হতে হয়! মাতৃত্বের চির আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতায় সদ্যজাত আত্মজকে ছেড়ে, এভাবেও মহাশূন্যর পথে পাড়ি দিতে হয়! অশ্রু সজল ঝাপসা চোখের জানালায় দেখা – তারাদের মাঝে একটা তারার নাম হয়ে গেলকমরেড হেনা!

– শুভাশিস চ্যাটার্জি

গত ১৭ মার্চ ভোরবেলা হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের রামপুর গ্রামের হেনা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বয়স হয়েছিল মাত্র ৩১। পি জি হাসপাতালে সন্তান প্রসবের পর হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে ওঠায় সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালো সব সময় হাসি মুখে থাকা হেনা সুলতানা।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পী গল্পের মদন তাঁতির গামছা বোনার মতোই অসম্ভব ছিল হেনার গোমড়া মুখ। তবে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন হেনা। ভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে এসে কমিউনিস্ট মতাদর্শকে অনুধাবন করা, তাকে জীবনধারার সাথে সম্পৃক্ত করে তোলার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবেন হেনা।

যে হেনা কমরেডদের সাথে দীর্ঘফোনালাপ কালে খিলখিল করে হেসেই যেতেন তাকেই দেখা যেত পার্টি বৈঠকে একদম সামনের সারিতে বসে মনোযোগ সহকারে পার্টির বক্তব্যগুলো অনুধাবন করতে। হেনার কমরেড-ইন-আর্মস আনারুলের স্মৃতিচারণে: ২০১৮ সালে বিবাহের এক বছরের মধ্যে পার্টির কাজে যুক্ত হযন। শুরুতে মহিলা সমিতির নানা কর্মসূচিতে অংশ নিত। পরে ধীরে ধীরে বলাগড়ের বিভিন্ন ক্ষেতমজুর গ্রামে আমার সাথে ঘুরত। ও বলত মহিলা সমিতির থেকে ক্ষেতমজুর সমিতি ওর বেশি ভালো লাগে। ক্রমে পার্টির রাজনীতির সাথে আর‌ও ঘনিষ্ঠ হতে লাগল। ২০২৩-এ পার্টি সদস্যপদ পায়। যেদিন ওর হাতে লাল কার্ড দিলাম সেদিন ওকে কত খুশি দেখেছিলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল - “এবার থেকে তোমরা আমাকে কমরেড বলে ডাকবে বল”? বলেছিলাম “অবশ্যই কমরেড”!

হেনার বাড়িতে জেলা কমিটির মিটিং হলেই উৎসাহের সাথে সেই দায়িত্বভার সামলেছেন। মনে পড়ে ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে লাল ঝান্ডা কাঁধে করে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ভোট চাইতে যাওয়া, টোটো প্রচারে থাকা, পোস্টারিং, ভোটের গণনার দিন‌ও গণনা কেন্দ্রের বাইরে কমরেডদের সাথে উপস্থিত থাকা।

দুঃখ-খুশি, বিষণ্ণতা-উদ্দীপনার এই আটপৌরে জীবনকে নিজস্বতায় গড়ে তুলছিলেন হেনা, ডিএলএড সম্পন্ন করে, টেট লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ব্যক্তি সমাজ, পার্টিহেনার জীবনে অভিন্ন হয়ে উঠছিল। এক প্রাণকে ভূমিষ্ঠ করে আর অনেক স্বপ্নকে আমাদের জন্য রেখে গেলেন কমরেড হেনা।

প্রয়াত কমরেড হেনা লাল সেলাম !

– ভিয়েত

===0===

খণ্ড-31
সংখ্যা-10