সারা দেশ যখন নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণার অপেক্ষায় তখন একের পর এক বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনা সামনে আসছে। ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি ও ভাঙানোর প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলী জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর এসবিআই’র আবেদন সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দিয়েছে। নির্বাচন না মেটা পর্যন্ত ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য গোপন রাখতে মোদি সরকার ও এসবিআই’র মরিয়া প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং এখন ইলেকশন কমিশন কর্তৃক সেই তথ্য প্রকাশের অপেক্ষায় আছে দেশ।
দ্বিতীয় বড় বিষয় হল নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েলের রহস্যজনক পদত্যাগ, যিনি ২০২২-এর নভেম্বরে প্রথাবহির্ভূতভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং যার পদের মেয়াদ ছিল ২০২৭ পর্যন্ত। নতুন আনা ‘নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন’-এর বলে এখন নতুন কমিশন গঠনের মঞ্চ প্রস্তুত। নির্বাচন কমিশন দ্বারা ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য জনসমক্ষে আনার জন্য যে দিন ধার্য করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, সেই ১৫ মার্চেই নরেন্দ্র মোদি তাঁর ইচ্ছে মাফিক ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।
১১ মার্চ সারা দেশ যখন ইলেক্টোরাল বন্ড তথ্যাবলী জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর এসবিআই’র আবেদন প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় ছিল তখন মোদি সরকার নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ২০১৯-এর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রুলসের বিজ্ঞপ্তি জারি করল। ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর এই আইন পাস হয়েছিল এবং তার রুলস বিবৃত করতে মোদি সরকারের লেগে গেল একান্ন মাস! বুঝতে বাকি থাকে না যে সরকার ২০২৪-এর নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এটা তুলে রেখেছিল। নির্বাচক মণ্ডলীকে সাম্প্রদায়িক লাইনে মেরুকরণের উদ্দেশ্যে। এবং যে ইস্যুতে সরকার সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়ে পড়েছে তা থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে।
লোকসভা নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে মনোহর লাল খট্টরকে সরিয়ে নায়ব সিং সাইনিকে বসানোর বিস্ময়কর ঘটনা এবং বিহারে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন একসাথে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিহার বিধানসভা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত হইচই চালানো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে আগামী দিনে আরো নতুন নতুন ষড়যন্ত্রমূলক কারসাজি সামনে আসতে পারে। এইসব মরিয়া পদক্ষেপ ও কারসাজি স্পষ্টতই দেখায় যে ৪০০ আসন জেতার লম্বাচওড়া ভাষণবাজির আড়ালে আসলে ক্রমবর্ধমান গণক্ষোভে টলোমলো মোদি সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সবরকম অপকৌশল কাজে লাগানোর মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
ইলেক্টোরাল বন্ড কে কাকে দিয়েছে সেই দাতা-প্রাপক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে বিশেষজ্ঞ ও তদন্তমুখী সাংবাদিকদের হয়তো কিছুটা সময় লাগবে কিন্তু এসবিআই যে ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য লুকিয়ে রাখতে সর্বৈব চেষ্টা চালালো এবং সুপ্রিম কোর্ট তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা শুরু করার হুমকি দেওয়ার পরই যে তারা তথ্য জমা করল এই সত্যই তো বিজেপির এই সময়ের অন্যতম বিরাটাকার দুর্নীতিকে প্রকট করে দিল। ফলত, কায়েমী রাজনৈতিক স্বার্থ ও কর্পরেট স্বার্থবাহীরা যে এই তথ্য প্রকাশে ইসিআইকে এখনও বাধা দিয়ে যাচ্ছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মোদি-আদানি আঁতাতকে যে এমপি ও সাংবাদিকরা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ও উন্মোচিত করেছেন তাঁদের ওপর উৎপীড়ন চালানো থেকে শুরু করে ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকাশের সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে অমান্য করার প্রচেষ্টা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে মোদি সরকার বিপুল আর্থিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
সিএএ প্রশ্নে বিজেপি আরো একবার জনতাকে বিপথে চালনা করছে একে ‘নাগরিকত্ব প্রদানের আইন, কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার হাতিয়ার নয়’ বলে প্রচার চালিয়ে। এর থেকে নির্জলা মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না। চার বছর আগে সিএএ পাস করার সময় অমিত শাহ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে সিএএ হল দেশজুড়ে এনআরসির পূর্বসূরী। আসামে এনআরসির অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই ভাষা ও ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে গরিব ও যথেষ্ট কাগজপত্র না থাকা মানুষদের এনআরসি পরীক্ষার বিপন্নতাকে দেখিয়ে দিয়েছে। একইসাথে সিএএ হল নাগরিকত্বের এক বিদ্বেষপূর্ণ সাম্প্রদায়িককরণ যা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির মূলে আঘাত করে। এই বিষয়টা বুঝেই সিএএ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শাহীনবাগের সমনাগরিকত্ব আন্দোলন দেশজুড়ে ব্যাপক ভিত্তিক সমর্থন পেতে শুরু করেছিল এবং কোভিড মহামারী এসে পড়ার পর বিজেপি দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসা সংগঠিত করে এই আন্দোলনকে দমন করতে এবং আন্দোলনের বেশ কয়েকজন অগ্রণী নেতানেত্রীকে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে গ্রেপ্তার করতে সফল হয়।
বিজেপির মেরুকরণের প্রচেষ্টা এবং সিএএ-কে ধরে মানুষকে বিপথে চালিত করার প্রচারকে আমাদের যোগ্য জবাব দিতে হবে এবং সিএএ-এনআরসি প্যাকেজের বিপর্যয়কর পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করতে হবে। যে মানুষদের সিএএ’র আওতায় নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে তাঁদের তো নিজেদেরকে আগে বেআইনি অভিবাসী বলে স্বীকার করে নিতে হবে এবং নাগরিকত্বের এই প্রহেলিকাময় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করার সিএএ পরীক্ষায় খুব অল্প সংখ্যক মানুষই প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা দিতে পারবেন। এটা আরেকটি নিষ্ঠুর মোদি জুমলা; বাধ্য হয়ে ভারতে এসেছেন এবং বহু বাধাবিঘ্ন ও দুর্দশা সহ্য করে নতুন করে আবার জীবনের আশালতা বাঁচিয়ে তুলেছেন এরকম মানুষদের আশা আকাঙ্খা ও সেন্টিমেন্টের সাথে মোদির নিষ্ঠুর খেলা। ন্যায় প্রদানের নামে সিএএ তাঁদের জীবনকে আরো ছিন্নভিন্নই করে দেবে এবং আবার এক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার জগতে ছুঁড়ে দেবে।
ভারতের জনগণ একের পর এক মোদি জুমলাকে সাফল্যের সাথে পেরিয়ে, নোটবন্দী থেকে শুরু করে লকডাউন পর্যন্ত একের পর এক মোদি চালিত বিপর্যয় মোকাবিলা করে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। সেই সব আন্দোলনকে, এমএসপির আইনি স্বীকৃতির জন্য কৃষকদের সংগ্রাম, পুরনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনতে কর্মচারিদের আন্দোলন, বেসরকারিকরণ ও অস্থায়িকরণের বিরুদ্ধে যুব আন্দোলন, শ্রমিক-স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরির জন্য প্রকল্পকর্মীদের আন্দোলন, জাত জনগণনা ও সম্প্রসারিত সংরক্ষণ ব্যবস্থার দবিতে দলিত-বহুজন আন্দোলন – এই সমস্ত আন্দোলনকেই সিএএ-এনআরসির মেরুকরণের ছক প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সংঘ ব্রিগেডের প্রতিটি ষড়যন্ত্রমূলক কারসাজিকে পরাস্ত করা এবং একেকটি ভোট হিসেবে এনে মোদি সরকারকে ছুঁড়ে ফেলার সময় এসে গেছে।
এমএল আপডেট সম্পাদকীয়
১২ - ১৮ মার্চ ২০২৪
সুপ্রিম কোর্টের ধমকে ও তার নির্দেশ অনুযায়ী ৩০ ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচনী বন্ড নিয়ে যাবতীয় তথ্য স্টেট ব্যাঙ্ক জমা দিল নির্বাচন কমিশনের কাছে। কিন্তু, কোন কোন কর্পোরেট কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা অর্থ সাহায্য করেছে, সেই তথ্য স্টেট ব্যাঙ্ক নির্বাচন কমিশনের কাছে সরাসরি জমা করেনি। যেটুকু তথ্য উঠে এসেছে তাতে জানা যায়, স্টেট ব্যাঙ্ক একেবারেই ‘র’ ডেটা (কাঁচা তথ্য) মোদীর একান্ত আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে যা ঠিক ঠাক সাজিয়ে গুছিয়ে ওয়েবসাইটে তোলার কাজটা বেশ কঠিনই হবে। নাগরিকদের যে সমস্ত তথ্য জানার অধিকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার প্রশ্ন চিহ্ন তুলেছিল, শীর্ষ আদালত সেই আপত্তি উড়িয়ে তথ্য জানার অধিকারকে সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেও দিনের শেষে সেই সমস্ত তথ্য কতটা প্রকাশিত হবে দেশবাসীর কাছে, তা এখনও অনিশ্চিত। সিবিআই-ইডি-সিএজি-নির্বাচন কমিশনের পর ভারতের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্কও মোদী সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে উঠল।
আর, এখান থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি ঘোরাতে এবার মোদী সরকার নিয়ে এল সেই বিতর্কিত বিভাজন সৃষ্টিকারী ২০১৯-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)-এর গেজেট বিজ্ঞপ্তি, ঠিক পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার দিনে। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেই সিএএ পাশ করায় মোদী সরকার। আগে বলা হয়েছিল বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো দেশ থেকে সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি ও খ্রিস্টান) ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে যদি ২০১৫ সালের আগে এ দেশে আশ্রয় নিয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব দেবে ভারত। তখন মোদী সরকারের দাবি ছিল, ভারতে আসার তারিখ জানালেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু এই যে নতুন গেজেট বিজ্ঞপ্তি বেরোলো, তাতে জানানো হয়েছে নাগরিকত্বের জন্য একাধিক নথি অনলাইনে জমা দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। আবেদনকারীকে ছবি, দাবির পক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজ ও একাধিক হলফনামা দিতে হবে। আবেদনকারী ও তাঁর পরিবার সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য ফর্মে দিতে হবে। আর, আইন এটাও জানিয়েছে, আবেদনকারী নিজের, পরিবার সম্পর্কে সঠিক তথ্য জমা দিয়েছেন কি না তারও আলাদা এক হলফনামা জমা দিতে হবে। এছাড়া দিতে হবে ওই ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কে স্থানীয় কোনো ভারতীয় নাগরিকের হলফনামা। অনেক কমিটির হাত ঘুরে, যাচাই-নজরদারির বিস্তর পথ বেয়ে আমলাতন্ত্রের মর্জি জয় করার পর হয়তো বা নাগরিকত্বের শিকে ছিঁড়তে পারে।
নির্বাচনের ঠিক আগে মেরুকরণ ঘটানোর ফন্দি নিয়ে আনা হল নতুন এই বিজ্ঞপ্তি। মুহূর্তের মধ্যে এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। আসামে ১৬টি বিরোধী দলের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ হরতাল ডাকল। আর, নজিরবিহীনভাবে এই হরতালের বিরুদ্ধে আসাম পুলিশ বিরোধীদের হুমকি দিল, জারি করল ‘আইনানুগ’ ব্যবস্থা নেওয়ার ফরমান। পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার শেষ শুক্রবার দিল্লির বুকে নামাজিদের উপর দিল্লি পুলিশের আক্রমণ, কর্নাটকের সাংসদ অনন্ত হেগড়ের বক্তব্য যে ৪০০ আসনে বিজেপিকে জয়ী করলে সংবিধান বদলে তারা হিন্দু রাষ্ট্র বানাবেন, আর তার অব্যবহিত পরেই সিএএ-বিজ্ঞপ্তি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণের লক্ষ্যে তা একসূত্রে বাঁধা।
ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান ভারতের সংবিধানের উপর এক সরাসরি হামলা। এর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষকে পথে নেমেই প্রতিরোধ করতে হবে। আরএসএস-র শতবর্ষে হিন্দু ভারতের অভিমুখে আমাদের দেশকে নিয়ে যাওয়ার যে লক্ষ্য নিয়ে মোদী সরকার এগিয়ে চলেছে দুরন্ত গতিতে তা ব্যর্থ করতেই হবে ভারতবাসীকে। ভারতের জাতীয় পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে সংখ্যালঘু মেয়েরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শাহিনবাগ তৈরি করে এই বেনাগরিক বানানোর দানবীয় আইনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে ‘হম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’ রণহুংকারে রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন। আজ, আবার ফিরে আসুক সেই রণদামামা — আসমুদ্রহিমাচল!
কাশ্মীরের জনগণের উদ্দেশ্যে কিছু বার্তা দিতেই নরেন্দ্র মোদী গত ৭ মার্চ কাশ্মীর সফর করেননি, ঐ সফরের কিছু গূঢ় উদ্দেশ্যও ছিল। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা বিলোপ, কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা হরণ ও রাজ্যটাকে ভেঙে দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার প্রায় পাঁচ বছর পর প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীর সফরে যেতে মনস্থ করলেন। সেদিন শ্রীনগর সফরে তাঁর সভার অনুষ্ঠান নির্ধারিত হয়েছিল বকসি ফুটবল স্টেডিয়াম। সভা উপলক্ষে স্টেডিয়ামের সব আসন ভরে গিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাষণে বলেন, “আমি জানতে পেরেছি ২৮৪টি ব্লকের ১ লক্ষ মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।…” তবে, ঐ স্টেডিয়াম সম্পর্কে অবহিত মানুষরা জানিয়েছেন, সেখানে খুব বেশি হলে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ ধরতে পারে। স্টেডিয়ামে ভিড় নিশ্চিত করতে লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা ও তাঁর অধীনস্থরা প্রচেষ্টায় কোনো ঘাটতি রাখেননি এবং সেই প্রচেষ্টার একটা অঙ্গ অবশ্যই ছিল হুমকি ও জোরজবরদস্তি। সমস্ত সরকারি কর্মীদের যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সরকারি প্রকল্পে কর্মরত দিন মজুরদেরও সভায় যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। একেবারে ভোরে অনেক দূর থেকে বাসে করে আনা হয়েছিল বিজেপি সমর্থকদের। ঠিকাদারের কাজ করেন আইজাজ নামে জনৈক ব্যক্তি বলেছেন, “আমার আসার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। আমার মনে হল আমাকে জোর করে বাড়ি থেকে বার করা হয়েছে। আমাকে সোজাসাপ্টা বলা হয়েছিল, জনসভায় না গেলে আমার বরাত বাতিল হয়ে যাবে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আমরা যারা এখানে এসেছি তাদের ৯০ শতাংশকেই জোর করে আনা হয়েছে।...” (মকতুব মিডিয়া ডট কম-এ গাফিরা কাদরির প্রতিবেদন থেকে) সেদিনের জনসভায় নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, কাশ্মীরের জনগণের “হৃদয় জয় করার জন্য” তিনি কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। তবে, কাশ্মীরের জনগণের অধিকার হরণের তাঁর সরকারের পদক্ষেপ সেখানকার জনগণের কাছে হৃদয়স্পর্শী না হৃদয়বিদারক হয়েছে, ঠিকাদার আইজাজ-এর বক্তব্যে সে বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ বোধকরি থাকেনি।
৩৭০ ধারা বাতিলের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী সভায় বলেন, কাশ্মীরের কাছে ৩৭০ ধারা ছিল একটা শৃঙ্খল। সেই ধারার অপসারণে কাশ্মীরের জনগণ এখন “স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে পারছেন”। তিনি আরও বলেন, ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মীরে “শান্তি ও উন্নয়নের” এক নতুন যুগের শুরু হয়েছ – “এই নতুন জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য আমরা দশকের পর দশক অপেক্ষা করছিলাম।”
“নতুন ভারতে” এই “নতুন কাশ্মীর” কাশ্মীরের জনগণের কাছে কতটা উপভোগ্য হয়েছে তা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। প্রায় ছ-বছর হয়ে গেল কাশ্মীরে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই। ২০১৮ সালে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার পর সরকার সেখানে এখনও নির্বাচন করে উঠতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্ট ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচন করতে হবে বলে নির্দেশ দিলেও মোদী সে সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য এখনও করেননি। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর নির্বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের ধরপাকড় চলে। মিছিল-মিটিং এবং জনসভা অনুষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ এখনও পুরোদমে বহাল। ইন্টারনেট বন্ধ থাকে মাসের পর মাস। সংবাদ মাধ্যম কঠোর নিষেধাজ্ঞার কবলে – সরকারের সমালোচনা হলেই সাংবাদিকদের কাছে কৈফিয়ত দাবি করা হচ্ছে ও তাদের জেলে পোরা হচ্ছে। বিচার ছাড়াই আটক রাখার জন্য ব্যাপক হারে প্রয়োগ হয়ে চলেছে কুখ্যাত ও দানবীয় জনসুরক্ষা আইন। একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য (‘রাজ্য’ অভিধা এখন অবশ্য নেই) কাশ্মীরে হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী বসানোর আরএসএস-বিজেপির দুরভিসন্ধি সমানভাবে সক্রিয় রয়েছে। এই লক্ষ্যে তাদের কুটিল কৌশলের অন্যতম হল বিধানসভা ও লোকসভা আসনগুলোর এলাকার পুনর্বিন্যাস। এই পুনর্বিন্যাসে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু অঞ্চলের আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে ছটি, আর কাশ্মীরের জনসংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আসন বেড়েছে মাত্র একটি। হিন্দু অধ্যুষিত রাজৌরি ও পুঞ্চের এলাকা অনন্তনাগ সংসদীয় ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত করে বিজেপির লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো করা হয়েছে। গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস ওঠা এই পরিস্থিতি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের কাঙ্খিত হতে পারে, এর জন্য আরএসএস-বিজেপি ‘দশকের পর দশক’ অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কাশ্মীরের জনগণ কতটা স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারেন?
নরেন্দ্র মোদীর শ্রীনগর সফরকে কেন্দ্র করে শহরকে সেনা নিরাপত্তায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। ৫০ মিটার অন্তর সেনা প্রহরা বসানো হয়েছিল। শহর দিয়ে বহমান ঝিলাম নদীতে মোটর বোটে প্রহরা জারি রেখেছিল নৌ-সেনারা। শ্রীনগরকে “সাময়িক লাল এলাকা” বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। অনুমতি পাওয়া ছাড়া অন্যান্য গাড়ির চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। শ্রীনগর আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল দুর্ভেদ্য দুর্গ। নরেন্দ্র মোদীর মতে কাশ্মীরের পরিস্থিতি এখন “স্বাভাবিক”, আর অমিত শাহ বলেছিলেন কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তার রাজ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কাশ্মীর এখনও কেন্দ্রের শাসনাধীন এবং কি বিধানসভা নির্বাচন কি রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া — নরেন্দ্র মোদীদের মুখে এখনও কুলুপ। নরেন্দ্র মোদী শ্রীনগর সফরে গিয়েছিলেন কাশ্মীরের জনগণকে কোনো বার্তা দিতে নয়। তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল লোকসভা নির্বাচনের আগে সংখ্যাগুরুবাদে আসক্ত হিন্দু জনগণের কাছে ৩৭০ ধারা বিলোপকে আরএসএস-বিজেপির এক জয় হিসাবে জাহির করতে, কাশ্মীরকে কেন্দ্রের পদানত হিসাবে তুলে ধরতে।
মেয়েদের কাছে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এ বছরের নারী দিবস। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন ও প্যালেস্টাইনে বহু নারী ও শিশু নিহত, আহত, সর্বস্বান্ত হয়েছেন, হয়ে চলেছেন। আমাদের দেশে ফ্যাসিস্ট বিজেপি-র শোষণ ও বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িক হিংসা, নারী-নিপীড়ন, ধর্ষণ, খুন এবং অপরাধীদের আড়াল করার, এমনকি সম্মানিত করার প্রবণতা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষার আঙিনায় ও কাজের বাজারে লিঙ্গ-বৈষম্য — মেয়েদের বঞ্চনা।
এই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমাদের আন্দোলন কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব এ নিয়ে আলোচনার জন্য হুগলি জেলায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জেলা শাখা ১০ মার্চ ব্যান্ডেলে দুর্গা লজে নারী দিবস উপলক্ষে এক সভার আয়োজন করে।
আমরা জানি, নারী দিবস শুরু হয়েছিল আন্তর্জতিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসেবে। এখনও মূলগতভাবে তাই আছে, তবে বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমস্ত নারীর অধিকার, মর্যাদা ও স্বাধীনতার আরও বহু ইস্যু। এই সভাতেও সেটাই দেখা গেল। মিডডে মিল রন্ধন কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, শিক্ষিকা, চাকরিজীবী, কৃষি শ্রমিক — সংখ্যায় এরাই ছিলেন। সব মিলিয়ে শতাধিক সংগ্রামী নারী এতে অংশ নিয়েছিলেন।
সভার শুরুতে জেলা সম্পাদিকা শিপ্রা চ্যাটার্জি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে বলেন। রাজ্য ও জাতীয় পরিস্থিতি এবং আমাদের কর্তব্য প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন জেলার কার্যকরী সভানেত্রী চৈতালি সেন। প্রকল্প কর্মীদের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি সার্বিক নারী নির্যাতনের প্রতিবাদেও আমাদের সোচ্চার হতে হবে — বলেন সমিতির জেলা সংগঠক ও অঙ্গনওয়াড়ি শিক্ষিকা রুমা আহিরী। এআইসিসিটিইউ-র জেলা নেতা ভিয়েত ব্যানার্জি নারী শ্রমিকদের প্রতি অন্যায় ও বঞ্চনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনকে আরও জোরদার করার আহ্বান রাখেন।
এছাড়াও নিজের নিজের সংগ্রামী অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন ধনিয়াখালির নেত্রী রূপা শীট, রন্ধন কর্মী কল্পনা মালিক, পম্পা আদক, উমাতারা পাকিরা, ভিটে থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত কৃষি শ্রমিক সুমিতা মুর্মু এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী তুলিকা শী। আগামী ১৬ মার্চ এআইসিসিটিইউ-র “বিজেপি হঠাও শ্রমিক বাঁচাও” কনভেনশনে অংশ নেওয়ার আহ্বান রাখেন চৈতালি সেন। এতে কমরেডদের সাড়াও মেলে।
নারী দিবস উপলক্ষে চন্দ্রানী ব্যানার্জির মন ছুঁয়ে যাওয়া কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। শিপ্রা চ্যাটার্জি, অঙ্গনা বসাক কবিতা পাঠ করেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করেন রিতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে “ভোরাই” সংগীত সংস্থার টিম। ষোলো থেকে ষাট বছর বয়সের আদিবাসী মেয়েরা নৃত্য পরিবেশন করেন। সমগ্র সভাটি পরিচালনা করেন সুদীপ্তা বসু।
উদ্দীপ্ত শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে আলোচনা সভা শেষ হলে ব্যান্ডেল চার্চের মোড়ে পথসভা করা হয়। বক্তব্য রাখেন জেলা সভানেত্রী শোভা ব্যানার্জি, চৈতালি সেন ও রুমা আহিরী। তাঁরা আওয়াজ তোলেন সম্প্রতি দিল্লিতে নামাজিদের ওপর পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে। মানুষের কাছে আহ্বান জানান — সংখ্যালঘু-বিদ্বেষী, দাঙ্গাবাজ, নারী নিপীড়নকারী বিজেপিকে একটি ভোটও নয়। বিজেপি হটাও সংবিধান বাঁচাও। একই সঙ্গে দাবি তোলা হয়, সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনকারী জমি মাফিয়াদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
ওয়ার্কশপে যোগ দিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ওরা সবাই চল এসেছিলেন। কেউ হেঁশেল ঠেলে, কেউ ঘরের রান্না সেরে আবার মিড ডে মিলের সহকর্মীকে গুছিয়ে দিয়ে, কেউ আবার খেতের কাজে ছুটি করে বা স্বনিযুক্তির কাজ ফেলে রেখে। কেউ উপবাস নিয়েও এসেছিলেন। মাসুদা বিবি, ফিরদৌসী বিবি, প্রমীলা অধিকারী, কার্মী কিস্কু, জাহানারা খাতুন, রিজিয়া বিবি, সাধনারা। এসেছিলেন গৌরীপুর জুট মিলের বর্ষীয়সী ডলিদি, রেবাদি, বেলাদি সহ আরও অনেকে।
বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গোটা দেশবাসীর সঙ্গে বিশেষ করে মেয়েদের উপর নানা নির্যাতন নামিয়ে এনেছে, মুখে সশক্তিকরণের কথা বললেও মেয়েদের স্বাধীনতা-স্বাধিকার কেড়ে নিচ্ছে, ধর্ষকদের মদত দিচ্ছে। তাই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মোদী সরকারকে পরাস্ত করার আহ্বান রেখেই হালিশহর সাংস্কৃতিক সংস্থার ঘরে গত ৯ মার্চ’ ২০২৪ একটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করে আইপোয়ার উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটি।
হালিশহর, নৈহাটি শহর, শিবদাসপুর, জগদ্দল, খড়দহ, অশোকনগর সহ জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৫০ জন মহিলা এই ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন।
প্রথমে আইপোয়ার উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভানেত্রী অর্চনা ঘটক সংক্ষেপে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস তুলে ধরেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় আজকের ভারতীয় মহিলাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও রণধ্বনিকে তুলে ধরেন সংগঠনের সম্পাদিকা মিতালি বিশ্বাস। অন্যান্য বক্তারা মোদীর ‘নারীশক্তি বন্দনার’ আসল অভিসন্ধি, মোদী জমানায় বিদ্বেষ বিভাজনের রাজনীতি, ধর্ষণ সংস্কৃতি, হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা তথা দলিত মুসলিম আদিবাসী ও নারীদের প্রতি বিদ্বেষ এবং নৃশংসতাকে তুলে ধরেন। মোদীর এই বাংলায় শুধু সন্দেশখালির ন্যক্কারজনক ঘটনাকে নির্বাচনী প্রচারের মর্মবস্তু করে, তুলনাহীন বেকারত্ব, নারীর হাতের কাজ কেড়ে নেওয়া, প্রকল্পকর্মীদের নিষ্ঠুর শোষণ বঞ্চনা, শিশুপুষ্টিকে নস্যাৎ করা আর দেশ লুঠকে আড়াল করার ঘৃণ্য অপচেষ্টাকেও তীব্র নিন্দা করা হয়। এইসব বক্তব্যের মাঝেই অংশগ্রহণকারী মহিলারা মোদী জমানার মিথ্যাচার নিয়ে তাদের উষ্মা ও ক্ষোভ উগরে দেন। কেউ বললেন, মূল্যবৃদ্ধি ভয়ঙ্কর স্তরে পৌঁছে গেছে আর নির্বাচনের আগে গ্যাসের দাম দু’একশো টাকা কমিয়ে তারা মহিলাভোট পেতে চান। তারা নারীদের এতই ‘মূর্খ’ ভাবেন! তারা বলেন, দাঙ্গাবাজ মোদী সরকার শান্তি চায় না। নানাভাবে মানুষের পকেট কাটছে, পেটে লাথি মারছে আর সবসময় মানুষকে একটা ভয়ের মধ্যে রাখছে, লাইনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। নয়া শিক্ষানীতির জনবিরোধী রূপ, যুব সমাজের বেকারত্ব, স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বিজেপি সরকারকে তুলোধোনা করেন বক্তারা গৌরীপুর জুট মিলের আশু দাবি ও আন্দোলনের প্রসঙ্গেও বক্তব্য রাখা হয়। বক্তারা ছিলেন রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত, দেশব্রতী পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য জয়ন্তী দাশগুপ্ত, মহিলা সংগঠক অনন্যা চক্রবর্তী, জেলা নেত্রী রীনা মজুমদার, কার্মী কিস্কু, রিজিয়া বিবি, রেবা সর্দার, জাহানারা বিবি, মেহুলি। মোদী-জুমলার বিরুদ্ধে গোটা সময়টাই সভার এ কোণ ও কোণ থেকে নানা মন্তব্যে সভা ছিল রীতিমত সরগরম।
সভা পরিচালনা করেন অর্চনা ঘটক। সভা শুরু হয়েছিল মেহুলি, মিঠু, তপতী, মন্দিরা, অনন্যার গলায় “আমার মুক্তি আলোয় আলোয় ...” গানটি দিয়ে, শেষ হয় গণসংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক গণশিল্পী সরিৎ চক্রবর্তীর গলায় “লড়াই করো, লড়াই করো যতদিন না বিজয়ী হও ...” গানে-সবাইকে উদ্বেল করে। ‘বিজেপি হারাও, দেশ বাঁচাও’ স্লোগানে মুখরিত হয় সভাঘর। আগামী ৩১ মার্চ বারাসাতে জেলা সমাবেশে মিলিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ হয়।
লোকসভা নির্বাচন দুয়ারে এসে দাঁড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে প্রচার আন্দোলনকে জোরদার করতে পার্টির উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির তরফে বিভিন্ন এলাকায় কর্মীসভাগুলি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত রবিবার, ১০ মার্চ ২০২৪ এমন একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হল বেলঘরিয়াতে। বেলঘরিয়া কামারহাটি লোকাল কমিটি আয়োজিত সভাটিতে উপস্থিত পার্টিকর্মীরা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খোলামেলা মত বিনিময় করেন। সভাটি পরিচালনা করেন বেলঘরিয়া আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক অশোক সাহা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাজ্য কমিটির স্ট্যান্ডিং বডির সদস্য নবেন্দু দাশগুপ্ত এবং জেলা নেতৃবৃন্দ।
লোকসভা নির্বাচনে পার্টি বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণের যে আহ্বান রেখেছে সেই বিষয়টি বিশেষভাবে চর্চায় আসে। এরই পাশাপাশি উঠে আসে বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য নির্দিষ্ট ভূমিকা গ্রহণের বিষয়টি। উপস্থিত পার্টিকর্মীদের অনেকেই জানতে চান বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য এ রাজ্যে জোটের বিষয়টি। অনেক রাজ্যে নানা বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে ইন্ডিয়া জোট শেষপর্যন্ত একটা সক্রিয় চেহারা নিলেও পশ্চিমবঙ্গে তা হয়নি। যেদিন পার্টির এই কর্মীসভা হয়েছে, সেইদিনই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভা থেকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল এই রাজ্যের ৪২টি আসনের সবকটিতেই নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করে দেয়। ফলে কিছুক্ষণ আগের এই সংবাদটিও পার্টি কর্মীদের চর্চায় উঠে আসে। এই রাজ্যে তৃণমূল ও জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে আসন সমঝোতা তথা ইন্ডিয়া জোট যে ফলপ্রসু হয়ে হচ্ছে না, তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিজেপিকে হারাতে ঠিক কোথায় কোনে দলকে নির্দিষ্টভাবে ভোট দিতে বলা হবে, বা আদৌ এরকম কিছু না বলে সাধারণভাবে বিজেপি বিরোধী শক্তিকে ভোট দেবার কথা বলা হবে কীনা – সে সব উপস্থিত পার্টি কর্মীরা জানতে চান। উপস্থিত রাজ্য ও জেলা নেতৃত্ব জানান বিষয়টি পার্টির চর্চার মধ্যে আছে। আগামী দু-একটি বৈঠকে আলাপ আলোচনা করেই বিষয়টি নিয়ে পার্টি নেতৃত্ব তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানিয়ে দেবে বলে উপস্থিত পার্টিকর্মীদের আশ্বস্ত করা হয়। এই বিষয়ে পার্টি কর্মীরা যে সমস্ত পর্যবেক্ষণ ও অভিমত পেশ করেছেন, তাও রাজ্য পার্টি নেতৃত্বকে জানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান রাজ্য কমিটির উপস্থিত নেতৃত্ব।
আলাপ আলোচনায় উঠে আসে বিজেপি বিরোধী প্রচারকে জোরদার করার পদ্ধতি প্রকরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলিও। লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাবার পর সভা সমাবেশ করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের বিধিনিয়ম মেনে চলার বিষয়টি বলবৎ হয়ে যাবে। যে সব আসনে পার্টি নির্বাচনে প্রার্থী দিচ্ছে না, সে সব আসনে প্রচার করার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য পদ্ধতিগুলি খতিয়ে দেখতে হবে। বড় আকারের সভা সমাবেশের বাইরে ঘরোয়া আলাপে, ট্রামে, বাসে, ট্রেনে, বাজারে, পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় – যেভাবে যেভাবে সম্ভব সেখানেই বিজেপি কতটা ভয়ংকর শক্তি তা নানাভাবে মানুষের কাছে নিয়ে যাবার বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়।
মার্চ মাসে থাকা দুটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সফল করে তোলার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। একটি হল ১৬ মার্চ মৌলালি যুব কেন্দ্রের ‘শ্রমিক বাঁচাও বিজেপি হঠাও’ কনভেনশন। অন্যটি হল ৩১ মার্চ বারাসাতে পার্টির উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটি আয়োজিত রাজনৈতিক প্রচারসভা। এলাকার সমস্ত কমরেড যেন এই কর্মসূচি দুটিতে উপস্থিত থাকেন, সেই বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়।
সৌভিক ঘোষাল
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বার্তা নির্ভয় স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরে গত ১২ মার্চ ধুবুলিয়া নেতাজি পার্কে সংগঠিত হল সারা ভারত প্রগ্রতিশীল মহিলা সমিতির প্রচার সভা। সভায় বক্তব্য রাখেন সংগঠনের জেলা সম্পাদিকা অপু কবিরাজ ও রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রানী দত্ত। সংগীত পরিবেশন করেন মল্লিকা সরকার। আবৃত্তি করে শোনান শিবানী মন্ডল। সভায় রন্ধনকর্মী ও বিড়ি শ্রমিক কয়েকজন মহিলারা অংশগ্রহণ করেন। সভা থেকে স্লোগান তুলে ধরা হয়, সন্দেশখালিতে নারী নিগ্রহকারীদের কঠোর শাস্তি চাই! বিজেপির সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হোন। বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের জেলবন্দী করো। নারী নির্যাতনকারীদের সরকারি মদত দেওয়া চলবে না। মেয়েদের বিনামূল্যে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা চাই! মহিলাদের সমকাজে সমমজুরির গ্যারান্টি চাই! বিড়ি শ্রমিক, তাঁত শিল্পী সহ শ্রমজীবী মহিলাদের সম্মানজনক মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা চাই! বিধবা ও প্রতিবন্ধী মহিলাদের ভাতা ৩০০০ টাকা করতে হবে, মহিলা কুস্তিগীরদের নিগ্রহকারী ব্রিজ ভূষণের শাস্তি চাই! অবিলম্বে তার সাংসদ পদ বাতিল কর।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইন জারি হওয়ার পর থেকে নদীয়া জেলার মতুয়া সমাজের মধ্যে আনন্দ উৎসবের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও আবির খেলা হচ্ছে, কোথাও বা লাড্ডু বিলি হচ্ছে। কিন্তু জেলার সীমান্তবর্তী তেহট্টের বেতাই এলাকা কিংবা ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তু অধ্যূষিত এলাকায় মানুষের মধ্য থেকে প্রাথমিক যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে তারা পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মারপ্যাঁচ বা সাতকাহন তাঁদের কাছে আদৌ স্পষ্ট নয়। সর্বোপরি তাঁদেরকে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে লিখিত কাগজ দিতে হবে শুনে তারা খুবই আশঙ্কিত! আপনারা কি বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে এদেশে এসেছেন? এর উত্তরে সকলেই বলছেন – না! বেশিরভাগই বলছেন, রুটি রুজির তাগিদে একটু উন্নত জীবনযাত্রার জন্য আমরা এবার বাংলায় এসেছি। আমাদের বহু আত্মীয়-স্বজন এখনো বাংলাদেশে রয়ে গেছে। তাহলে নাগরিকত্বের জন্য আপনাদের হলফনামায় লিখতে হবে যে আপনারা ধর্মীয় কারণে বাড়িঘর ছেড়ে এসেছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তারা সকলেই নীরবতা পালন করছেন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বিজেপির লোকজনেরাই উৎসবের নামে মতুয়াদের ভুল বুঝিয়ে হইচই করে চলেছে। যে ঘটনা ঘটেনি সেটাকেও লিখে দেওয়ার জন্য মানুষকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এইভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষাক্ত মানসিকতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করিয়ে চলেছে ওরা। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষেরা এই চক্রান্ত বুঝতে পারছেন। এনআরসি চালু করার সময়কালের অভিজ্ঞতা সকলের রয়েছে। যে সরকার কাজ দিতে পারছে না, খাদ্য দিতে পারছে না, চাষির ফসলের দাম নেই। তারা এখন নাগরিকত্বের নামে মানুষকে ধাপ্পা দিচ্ছে, সংবিধানের মৌলিক চরিত্রকে লঙ্ঘন করছে। এই বার্তা তুলে ধরে গত ১২ মার্চ কৃষ্ণনগর শহরে অনুষ্ঠিত হল এক প্রচার কর্মসূচি। শহরের পোস্ট অফিস মোড় থেকে শুরু করে এক দৃপ্ত মিছিল সদর মোড় আসে। দুই জায়গাতে সভা করা হয়। বক্তব্য রাখেন জীবন কবিরাজ, বিজয় সাহা,জয়তু দেশমুখ প্রমূখ।
গত ৭ মার্চ জলপাইগুড়ি শহরে চা শ্রমিকদের যুক্ত সংগঠন জয়েন্ট ফোরামের পক্ষ থেকে জমির পাট্টার দাবিতে বিএলআরও দপ্তর অভিযান হয়। পুলিশ প্রথমে দপ্তরের সামনে আসার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। মিছিল দপ্তরের কাছে পৌঁছায়। জমায়েত থেকে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল স্মারকলিপি পেশ করে। জমির পাট্টার বিষয়ে সরকার থেকে নোটিফিকেশন করে শিবির খুলে পাট্টার কাগজ দিতে হবে। এই দাবির পাশাপাশি চা শ্রমিকরা যেখানে বসবাস করেন সেই আয়তনের পাট্টা দিতে হবে। প্রতিনিধি দলে এআইসিসিটিইউ’র পক্ষে বাসুদেব বসু, সিটুর পক্ষে জিয়াউল আলম সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন। জমায়েতে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ জেলা নেতা প্রদীপ গোস্বামী। শ্যামল ভৌমিক, প্রদীপ দেবগুপ্ত, মুকুল চক্রবর্তী, গোপাল রায় প্রমুখ জেলা নেতৃত্ব উপস্থিত থাকেন।
রাজ্যের বুকে নগরায়নের নামে গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করার চক্রান্ত চলছে। তাঁদের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে উচ্ছেদের খাঁড়া। এমনটাই ঘটে চলেছে কল্যাণী পার্শ্ববর্তী গয়েশপুর পৌরসভার অন্তর্গত এলাকায়। সেখানকার সাঁতরাপাড়া সহ ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের এক হাজারেরও বেশি সংখ্যক পরিবার আজও বাস্তু এবং কৃষি জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত। অথচ দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে তাঁরা এই জমিতে চাষাবাদ করছেন, বসতি স্থাপন করে কয়েক প্রজন্ম পরম্পরায় বসবাস করছেন। এই জমির পরিমাণ প্রায় এক হাজার একর। অতীতে এই জমি ব্রিটিশ সরকার সামরিক বাহিনীর জন্য অধিগ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে জমির একটা অংশ বিড়লা কোম্পানির পিঞ্জারাপোল সোসাইটি দখল করে নেয়। ৬০’র দশকের শেষভাগে ওই জমি বাস্তুহীন ভূমিহীন গরিব মানুষেরা দখল করেন এবং আজও তাঁরা দখলে রেখেছেন। ‘৭৯ সালে চাকদা বিএলএলআরও দপ্তরের পক্ষ থেকে ওই জমি জরিপ করে পাট্টা দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি নগরায়নের নামে কোনোরকম পুনর্বাসন ছাড়াই গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করবার চক্রান্ত চলছে। স্টেডিয়াম ও সড়ক নির্মাণ, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর স্থাপন, কখনো বা জঞ্জালের ভ্যাট তৈরি করা সর্বোপরি সরকারী “ল্যান্ড ব্যাংক”-এর নামে পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করার চক্রান্ত চলছে। অথচ এই জমিতে পৌরসভার ও সরকারী আবাস যোজনায় তিন শতাধিক ঘর তৈরি হয়েছে।
গত ১১ মার্চ এই এলাকার শতাধিক গরিব মানুষ চাকদা বিএলএলআরও দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশন কর্মসূচি সংগঠিত করেন। কৃষি ও বাস্তু জমি রক্ষা কমিটি গঠন করে তাঁরা সরকারি অবহেলা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে এগিয়ে এসেছেন। চাকদা চৌমাথা থেকে এক দৃপ্ত মিছিল ব্লক দপ্তরে আসে। সেখানে ভূমি দপ্তরের কাছে তাঁদের ডেপুটেশনের প্রধান দাবি ছিল অবিলম্বে দখলিকৃত কৃষি ও বাস্তু জমির মালিকানা দলিল দিতে হবে। এলাকার চাষিদের কৃষক বন্ধু সহ সমস্ত সরকারি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, ইতিপূর্বে সরকারি কাজে অধিগৃহীত জমির ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে প্রভৃতি। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন কৃষি ও বাস্তু জমি অধিকার রক্ষা কমিটি গয়েশপুর সংগঠনের পক্ষে সেখ আতাবুর, টিনা দাস সহ অন্যান্যরা। সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে ছিলেন বিজয় সাহা, শেখর চৌধুরী। ব্লক ভূমি দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয় পৌরসভা এলাকায় বাস্তু জমির পাট্টা সংক্রান্ত বিষয়ে জেলা দপ্তরে যোগাযোগ করতে হবে। কৃষি জমির অধিকার সংক্রান্ত বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। সংগঠনের পক্ষ থেকে আগামী দিনে আন্দোলনকে আরো ব্যাপক ও তীব্রতর করার আহ্বান জানানো হয়।
১৩ মার্চ আড়ুপাড়া ২নং রেলগটের সামনে সিএএ-এনআরসি লাগু করার বিরুদ্ধে এবং দিল্লীতে নামাজীদের প্রতি পুলিশের বর্বরতার বিরুদ্বে প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য রাখেন এন এন ব্যানার্জ্জী ও দেবব্রত ভক্ত।
সভা শেষে সিএএ রুলসের প্রতিলিপি পোড়ানো হয়, মোদি সরকারের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে দৃপ্ত শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে কর্মসূচি শেষ করা হয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের সিএএ লাগু করার বিরুদ্ধে এবং দিল্লীতে নামাজীদের প্রতি পুলিশী বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১২ মার্চ সন্ধ্যায় হাওড়া জেলার বালি গ্রামাঞ্চলের দুর্গাপুর এলাকায় এক বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন কমরেড দীপক চক্রবর্তী, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষে কমরেড কল্যাণী গোস্বামী আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য তুলে ধরেন এবং কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট সরকারকে পরাজিত করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। সিপিআইএমএল লিবারেশনের প্রবীন নেতা কমরেড বাবলু গুহ তাঁর বক্তব্যে জনগণের সঙ্গে মোদী সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার কথা উল্লেখ করেন জনগণকে মোদী সরকারের জনবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ জোরালো করার এবং মোদী হটাও দেশ বাঁচাও আওয়াজ তোলেন। সভা শেষে নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। মোদী সরকারের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে দৃপ্ত স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
এ’দিন উত্তর চব্বিশ পরগণার অশোকনগর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া হুগলি সহ বিভিন্ন জেলার নানা স্থানে সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়।
১১ মার্চ ‘দিন প্রতিদিনে আজকের নারী ও শ্রমের ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক আলোচনা সভাতে শিলিগুড়ি ২নং লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে মূলত লোকাল কমিটির চালিকা শক্তি শ্রমজীবী মহিলাদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি বানারহাট গার্লস হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা জয়ীতা গাঙ্গুলীর সহজ উপস্থাপনা অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ের তীব্র দাবিকে আরও একবার জোরালো করে তুললো। আলোচনা শেষে, দিল্লিতে নামাজের সময় মুসলিম নাগরিকদের উপর পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমনের বিরুদ্ধে, পোষ্টার নিয়ে শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়।
আশ্রয়হীন দরিদ্র পরিবারগুলো পাটনার ফতুয়া বিধানসভা ক্ষেত্রে ২০ বিঘা বা ৫ একর জায়গায় যে প্রায় ৬০০ কুঁড়েঘর বানিয়েছিলেন, ১০ মার্চ রাতে সেগুলো আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। আগুনে পুড়ে অন্তত একজন মারা গেছেন এবং বেশ কয়েকজন শিশু অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। যে সমস্ত পরিবারের কাছে এই ৬০০ কুঁড়েঘর ছিল তাদের বাসভূমি, সেই পরিবারগুলোর জীবন ও জীবিকার অত্যাবশ্যকীয় সমস্ত বস্তু পুড়ে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।
সিপিআই(এমএল)-এর ফতুয়া কমিটির নেতৃত্বে ২০২৩-এর নভেম্বরে এই কুঁড়েঘরগুলো তৈরি হয়। জনপ্রিয় সিপিআই(এমএল) নেতা সুরেশ বিন্দ ওরফে আজাদের নামে এই কলোনির নামকরণ করা হয় আজাদ নগর; ১৯৯৮-এর লোকসভা নির্বাচনের দিন নিজের ভোট দেওয়ার পর স্থানীয় সাম্প্রদায়িক-দুর্বৃত্ত গাঁটছড়া তাকে হত্যা করে। আজাদের নেতৃত্বেই এলাকার ভূমিহীন দরিদ্ররা সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণ থেকে সিলিং বহির্ভূত ও বেনামি জমিগুলোকে মুক্ত করে সেখানে সমবেতভাবে চাষাবাদ ও বসত বাড়ি নির্মাণের দাবি জানায়।
নীতীশ কুমারের সাম্প্রতিক ডিগবাজির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতায় বিজেপির প্রত্যাবর্তনে সারা বিহারেই সাম্প্রদায়িক-মাফিয়া শক্তিগুলো স্পর্ধিত হয়ে উঠেছে। জমি মাফিয়ারা দরিদ্রদের উচ্ছেদের হুমকি দিচ্ছে। আজাদ নগরের জনগণ উচ্ছেদের হুমকি পেতে শুরু করেছেন। গত ৩ মার্চ আজাদ নগর থেকে পাঁচ বাস ভর্তি জনগণ পাটনার গান্ধি ময়দানে অনুষ্ঠিত জন বিশ্বাস মহাসমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। সিপিআই(এমএল) নেতা কমরেড সন্দীপ সৌরভ গ্রামীণ পাটনার যে বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক, সেই পালিগঞ্জে অমিত শাহ ৯ মার্চ একটি সভা করেন এবং সেই সভা থেকে তিনি জমি দখলদারদের পা ওপর দিকে আর মাথা নীচু করে ঝোলানোর হুমকি দেন, আর তার পরদিনই আজাদ নগর আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।
সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সিপিআই(এমএল) সদস্যদের নিয়ে গড়া একটি দলের সঙ্গে ১১ মার্চ ভস্মীভূত স্থল পরিদর্শন করেন। আগুনের ঐ গ্রাস আজাদ নগরের বাসিন্দাদের জীবনে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে, তবে তা কিন্তু তাদের লড়াকু মানসিকতা ও পরাক্রমকে দুর্বল করতে পারেনি। বাঁচা, ন্যায়বিচার ও পুনর্বাসন লাভের লড়াইয়ে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন। ত্রাণ সরবরাহের ব্যবস্থা যাতে দ্রুত সম্পন্ন হয় তার জন্য এখন জেলা প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
একজন ফরাসী দার্শনিক বলেছিলেন, হোয়েন অর্ডার ইজ ইনজাস্টিস দেন ডিসঅর্ডার ইজ দ্যা বিগিনিং অব জাস্টিস। আমরা ভারতবাসীরা আজ যখন সমস্ত রকমের ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত তখন ঐ দার্শনিকের কথাটাই মনে পড়ছে।
সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা!
৭৬ বছরের স্বাধীন ভারতবর্ষে স্বাধীন সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার সারবত্তাকে রক্ষা করার দায় আজ যেন জনপ্রতিনিধিদের কর্তব্য কর্মে সচেতনভাবেই পরিত্যাজ্য। আমাদের দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের আচার আচরণ সাধারণ জনমানসে বহু প্রশ্ন চিহ্নকে হাজির করেছে। আমরা দেখলাম নতুন সংসদ ভবনে প্রজাতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী সেঙ্গল (রাজদণ্ড) হাতে প্রবেশ করলেন, নারকেল ফাটালেন, সাধু-সন্তদের নিয়ে যজ্ঞ করলেন। বহু ধর্মের মানুষের মিলন ভূমি ভারতবর্ষের সংসদ ভবন নির্দিষ্ট ধর্মাচারে জারিত হল! সংবিধানিক সভাকক্ষকে বিশেষ ধর্মের নিজস্ব সম্পদে পরিণত করা হল।
আমরা আবার অবাক হয়ে দেখলাম দেশের সাংবিধানিক রাষ্ট্র প্রধানরা ২২ জানুয়ারী রাম মন্দির উদ্বোধনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক অভিসন্ধির কাজে ব্যবহার করলেন।
সংবিধানে উল্লিখিত ন্যায় বিচার আজ রাম মন্দিরের তলায় শ্বাসরুদ্ধ। স্বাধীনতার পর এই প্রথম একটা বিচার হল শুধুমাত্র একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিতে। ভারতীয় সাক্ষ্য বিধি (ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট) কার্যকর করা হলো না। এই প্রথম নিদর্শন হয়ে থাকল যে, এই বিচারের লিখিত রায়ে কোনো বিচারকেরই সাক্ষর দেখা গেল না। সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে অকার্যকর করার ক্ষেত্রেও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে একতরফাভাবে অমান্য করা হল।
গান্ধীজির ১৫০ তম জন্মবার্ষিকীতে “আজাদী কা অমৃত মহোৎসব” পালিত হচ্ছে। “হর ঘর তিরাঙ্গা”-র আহ্বানে যখন আকাশ বাতাস মুখরিত, লাল কেল্লা থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণে শোনা যাচ্ছে “নারী শক্তি”-র কথা, সেই স্বাধীনতা দিবসের দিনই গুজরাটের বিজেপি সরকার গোধরা জেল থেকে মুক্তি দিল ১১ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কুখ্যাত ধর্ষক খুনি অপরাধীদের। দেখা গেল ঐ ১১ জন ধর্ষক-খুনিদেরকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কার্যালয়ে মালা দিয়ে বরণ করল। অপরাধীদের সম্বর্ধনা দেওয়া হল। মাথায় তিলক কেটে, গলায় মালা পরিয়ে, মিষ্টিমুখ করানো হল। বিজেপি-র একজন বিধায়ক সি কে রাউলজি (অভিযুক্তদের মুক্তির সুপারিশ যে কমিটি করেছিল তার অন্যতম সদস্য) জানালো “ওরা সকলেই ব্রাহ্মণ সন্তান। ব্রাহ্মণরা খুব সংস্কারী হয়। মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ।” শোনা গেল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নির্লজ্জ অহংকার।
আবার দেখা গেল একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মহিলাদের অধিকার আদায়ের অজুহাতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হল। বলা হল এই আইনটি অত্যন্ত জরুরি কারণ এটা সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতির (ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপলস অব স্টেট পলিসি) ৪৪ নাম্বার ধারায় লিপিবদ্ধ আছে। আমরা জানি, সংবিধানে ৩৬ থেকে ৫১ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতির ধারা আছে। এর মধ্যে কয়েকটি ধারা উল্লেখ করছি যে ধারাগুলির জন্য আইন প্রবর্তন অত্যন্ত জরুরি হলেও মোদীজির কাছে তাগুরুত্বই পেল না। যেমন –
৩৯ এর (খ) এবং (গ) ধারায় বলা আছে – রাষ্ট্র এমনভাবে তার নীতি পরিচালনা করবে যাতে সর্বসাধারণের হিতার্থে দেশের পার্থিব সম্পদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ বণ্টিত হয় এবং ধনসম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণসমূহ কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়।
৩৯(ক) ধারায় - স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ভারতে প্রত্যেক নাগরিকের উপযুক্ত জীবিকা অর্জনের অধিকার।
৩৯ (চ)(ছ) ধারায় বলা আছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার।
৪১ ধারায় কর্মের অধিকার। বেকার অবস্থায়, বার্ধক্যে, অসুস্থতায় ও অভাবে সরকারি সাহায্য পাওয়ার অধিকার।
৪৭ ধারায় বলা আছে - রাষ্ট্র পুষ্টির ও জীবনযাত্রার মানের স্তর উন্নীত করার এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করবে।
৪৩ ধারায় - গ্রামাঞ্চলে ব্যক্তিগত বা সমবায়ের মাধ্যমে কুটির শিল্পের উন্নতি করা। কর্মীদের জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত মজুরি এবং উন্নত জীবনযাত্রার মান যাতে সুনিশ্চিত হয় এমন কাজের অধিকার।
৪৩(ক) ধারায় শিল্প পরিচালনায় কর্মীদের অংশগ্রহণের অধিকার।
এরকম বহু নীতি, আদর্শ, নির্দেশ, অধিকারের কথা রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশ মূলক নীতিতে থাকলেও হঠাৎ করে ৪৪ নাম্বার ধারার বিষয়টিকে এই মুহূর্তে মোদীজির আইনে রূপ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে কিসের তাগিদে?
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ‘নারী শক্তি’-র ‘বন্দনা’ শোনা যাচ্ছে। ভারতবর্ষের নারীদের গড় দৈনিক মজুরি পুরুষ শ্রমিকদের দৈনিক গড় মজুরির প্রায় অর্ধেক। ১৯৭৬ সালে ভারতবর্ষে সম কাজে সম মজুরি আইন তৈরি হয়েছিল। আজও বৈষম্য রয়েই গেছে। কেরলে একজন পুরুষ শ্রমিকের গড় মজুরি ৮৪২ টাকা, সেখানে মহিলা শ্রমিকের গড় মজুরি ৪৩৪ টাকা। পশ্চিম বাংলায় পুরুষ শ্রমিকের গড় মজুরি ৩৪২ টাকা, সেখানে মহিলা শ্রমিকের গড় মজুরি মাত্র ২১৯ টাকা। এমনকি যখন দেশের শ্রমজীবী মানুষের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার দাবি উঠল তখন কেন্দ্রের সরকার ফ্লোর লেবেল দৈনিক মজুরি ঘোষণা করল যা মাত্র ১৭৮ টাকা! এই দৈনিক মজুরিতে একটা শ্রমিকের পরিবারের খরচ চলবে? সব চাইতে লজ্জাজনক মহারাষ্ট্রের আখ চাষিদের মধ্যে ৩০ হাজার মহিলা শ্রমিক তাঁদের জরায়ু অপারেশন করে বাদ দিয়েছেন কারণ তাঁরা ঋতুচক্র চলাকালীন অসুস্থতার কারণে কাজে না গেলে মজুরি পাবেন না। এমনকি ২০১৩ সালে মহিলাদের যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে আইন পাশ হলেও আজও তার কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। যার ফল স্বরূপ ভারতবর্ষে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণের মত অপরাধ ক্রমবর্ধমান।
সাম্প্রদায়িক, জাতি, বর্ণ ঘৃণা আজ মানুষকে উন্মাদে পরিণত করেছে। ধর্মীয় সংখ্যা লঘু হত্যা, দলিতদের হত্যা, জাতি দাঙ্গা এমনকি মহিলাদের উলঙ্গ করে রাস্তায় হাঁটানোর মতো ঘটনা আজ বহু ধর্ম, জাতি, বর্ণের মিলন ভূমি ভারতবর্ষের সংবিধানে উল্লিখিত ‘ভ্রাতৃত্ব’ -র সারবত্তাকে কলঙ্কিত করে চলেছে।
সিএএ-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা উঠে আসছে। খুব স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করা হচ্ছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান বা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা সব ধর্মের (হিন্দু, বৌদ্ধ, পার্সী, জৈন, খৃষ্টান) মানুষকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ বাদে। প্রথমত, ভারতের সংবিধানের ২৫ ও ২৬ ধারায় ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ১৫, ১৬, ২৯, ৩২৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না। তৃতীয়ত, ২৭ ও ২৮ ধারাকে বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, ভারতে কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই; এবং চতুর্থত, ধর্মের প্রসারের জন্য রাষ্ট্র কোনো পৃষ্ঠপোষকতা করে না। ভারতবর্ষের সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ না থাকলেও সংবিধান বিরোধী আইনটি পাশ করানো হয়েছে শুধুমাত্র একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে।
বৃটিশ আমলের আইন বাতিল করে স্বাধীন দেশের আইন তৈরি করার নামে জনগণের অধিকার খর্ব করে নতুন করে শৃঙ্খলিত করার কৌশল চলছে। আমরা দেখেছি ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করায় একের পর এক প্রতিষ্ঠিত সমাজকর্মী, আইনজীবী, প্রফেসর, রাজনৈতিক কর্মীদের দানবীয় আইনে (১২৪ এর ক ধারা) আটক করে বছরের পর বছর কারা অন্তরালে পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যে ফাদার স্ট্যান স্বামীকে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ২০২২ সালে ১২৪(ক) ধারায় এফআইআর নিষিদ্ধ করায় নতুন ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ১৫০ নাম্বার ধারা আনা হয়েছে। ‘রাজদ্রোহী’ শব্দটাকে বাতিল করে যে বিষয়গুলিকে এই আইনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে তা আরও মারাত্মক। সেখানে বলা হচ্ছে ‘কেউ যদি উদ্দেশ্যমুলক ভাবে বা জেনেবুঝে, লিখিত শব্দে বা বলার মাধ্যমে, বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বা আর্থিক উপায়ে, বা দৃশ্যমান কোনো আকার ইঙ্গিতে, অথবা অন্য কোনোভাবে, সশস্ত্র বিদ্রোহ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের ভাবনাকে উৎসাহিত করে বা উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করে বা ভারতের সার্বভৌমত্ব বা ঐক্য বা অখন্ডতা বিপন্ন করে বা এরকম কোনো কাজে যুক্ত থাকে তাহলে শাস্তি হবে আজীবন কারাদণ্ড অথবা ৭ বছর পর্যন্ত কারাবাস এবং জরিমানা।’ — এই সকল কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা না থাকলেও সরকারের মনে হওয়াটাই শেষ কথা। আগের আইনে ‘আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে’ ষড়যন্ত্রমুলক কর্মকান্ড সংক্রান্ত বিষয়ে লেখা ছিল। নতুন আইনে ‘সরকারের প্রশাসনিক বা অন্য কোনো পদক্ষেপের ন্যায্যতার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করা সেই সব মন্তব্য যা এই ধারায় বর্ণিত কার্যকলাপগুলি উস্কে দিয়ে অথবা উস্কানি না দিয়ে আইনসম্মতভাবে সরকারের সেই পদক্ষেপগুলি বদলে দিতে চায়’— এই সবই ঐ নতুন ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত হবে।
বহু চর্চিত কুখ্যাত ইউএপিএ আইনে অপরাধের তালিকার সাথে সংযোজন ঘটিয়ে নতুন ন্যায় সংহিতার ১১১ নাম্বার ধারা নিয়ে আসা হয়েছে। যেমন ‘বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এমন পরিকঠামো নষ্ট করা, অত্যন্ত জরুরি ব্যবস্থাপনাকে ব্যাহত করা, সরকার, বা তার সংস্থাকে ভয় দেখানো, সরকারি অফিসারদের মৃত্যু বা আহত করার সম্ভাবনা তৈরি করা, সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা বা দেশের কাঠামোকে অস্থির করে তোলা’ ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতের ঐক্য, অখন্ডতা ও সুরক্ষা বিঘ্নিত করা এই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে যে কোনো আন্দোলনকে সহজেই সন্ত্রাসবাদী অপরাধের ধারায় দমন কারার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হবে। এছাড়াও এমন বহু ধারা এই ভারতীয় ন্যায় সংহিতায়, নাগরিক সুরক্ষা সংহিতায় এবং ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম সংহিতায় আনা হয়েছে যেখানে ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারকগুলিকে একদিকে যেমন খর্ব করা হয়েছে অপরদিকে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারের এবং পরিশেষে দেশের পুলিশের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে।
বহু ধরনের শ্রম আইনকে সহজ সরল এবং একত্রিত করার নামে চারটে শ্রম কোড চালু করা হল। যার মধ্য দিয়ে মালিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা হল এবং শ্রমজীবী মানুষকে নতুনভাবে দাসে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হল।
আমরা জানি ভারতবর্ষের প্রায় পঞ্চাশভাগ মানুষ একবেলার খাবার জোগাড় করতে পারলেও অন্য বেলার খাবার জোগাড় করতে পারবেন কিনা জানেন না। ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে’র তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। সেই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে বিগত নয় বছরে (মোদী জমানায়) বিশ্বের ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১ তম। অপরদিকে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা ৬০, নেপাল ৬৯, বাংলাদেশ ৮১ এবং পাকিস্তান ১০২ তম স্থানে এগিয়ে আছে। আগামী পাঁচ বছরে হয়ত ভারতবর্ষ ১২৫ তম স্থানটিই দখল করে (অধঃপতন) নেবে। তবুও মোদী “বিশ্ব গুরু”(?) বলে চলেছেন “সবকা সাথ সবকা বিকাশ”, দেশ এগিয়ে চলেছে। যাইহোক, এই পরিমান দারিদ্রতায় যে দেশ নিমজ্জিত সেখানে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন সংসদ ভবন তৈরি করা হল। দেশের দারিদ্রতার সমাধান করা, চুক্তিভিত্তিক চাকরির পরিবর্তে স্থায়ী চাকরির সংস্থান করা, ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতিকে হ্রাস করা, দেশের মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বা সাংবিধানিক অধিকার — এই বিষয়গুলি আজ চরম ভাবে অবহেলিত হওয়ায় মানুষের জীবন জীবিকা স্তব্ধ হয়ে আসছে।
শেষ করব আর একজন সমাজবিজ্ঞানী দার্শনিকের উক্তি দিয়ে ‘পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করাটাই শেষ কথা না, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানোটাই আজকের কর্তব্য।’
- দিবাকর ভট্টাচার্য
[‘উইমেনস ভয়েস’-এর পক্ষ থেকে কমরেড রাধিকা মেনন সারা ভারত প্রকল্পকর্মী ফেডারেশন (এআইএসডব্লুএফ)-এর সাধারণ সম্পাদক এবং বিহার রাজ্য আশা কর্মকর্তা সংঘের সভানেত্রী কমরেড শশী যাদবের এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে উঠে এসেছে আশা কর্মীদের বহু সমস্যা, তাদের কাজের বিশেষ ধরন, তাদের চাহিদার প্রকৃতি, তাদের সংগঠন গড়ে তোলার অনন্য নজির, অতিমারীর চ্যালেঞ্জ, তাঁরা আগামী লোকসভা নির্বাচন, ২০২৪-এর নির্বাচনী ইশতেহারে কী দেখতে চান – এমন বহু কথা। শশী বিহার রাজ্য বিধান পরিষদে সিপিআইএমএল লিবারেশন-এর নব নির্বাচিত প্রথম মহিলা সদস্যও বটেন। এই লড়াকু নেত্রীকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে আমরা সেই মূল্যবান সাক্ষাৎকারটির বঙ্গানুবাদ ‘আজকের দেশব্রতী’র পাঠকদের হাতে তুলে দিলাম।
- সম্পাদকমণ্ডলী]
প্রকল্পকর্মীরা আজকের ভারতে কর্মী মহিলাদের সংগ্রামে প্রথম সারিতে উঠে এসেছেন। তাঁরা বিশেষ করে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়িত করে চলেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আশাকর্মী (অ্যাক্রিডিটেড সোশ্যাল হেল্থ অ্যাক্টিভিস্ট) এবং ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশন কর্মসূচির ‘মমতা’রা, আইসিডিএস কর্মসূচির আওতাভুক্ত অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা এবং মিড ডে মিল (এমডিএম) কর্মীরা। তারা ফ্রন্টলাইন কর্মী হিসাবে জনসমাজের গভীরে গিয়ে সরকারের ‘মুখ’ হয়ে কাজ করেন। প্রকল্প কর্মীদের ৯৫% এর বেশি হলেন মহিলা। তাদের বেশিরভাগই শ্রমশক্তিতে প্রথম যোগ দিয়ে গভীর মর্মবেদনায় বুঝলেন সরকার তাদর শ্রমকে ‘কাজ’ হিসেবেই স্বীকার করে না! তাদের শ্রমিকের অধিকার নেই, নেই সম্মানজনক মজুরি, নেই চাকরির সুরক্ষা! নয়া উদারবাদী রাষ্ট্র - পরিকল্পিত এবং ধারাবাহিক ভাবে মেয়েদের পরিচর্যার কাজকে, মজুরিবিহীন গার্হস্থ্য কাজ থেকে বিনামজুরির সরকারি কাজ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাচ্ছে!
প্রকল্প কর্মীরা তাই আজ বিপুল জমায়েত আর ধর্মঘটের মাধ্যমে তাদের শ্রমিকের মর্যাদা আর ন্যায্য মজুরির দাবির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রতিবাদ সংগঠিত করছেন।
রাধিকা: শ্রমিকের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যে প্রকল্প কর্মীরা লড়েছেন। সরকার তার নিয়মিত কর্মীদের তুলনায় প্রকল্প কর্মীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে চলেছে। সারা ভারত প্রকল্প কর্মী ইউনিয়ন এবং তাদের লড়াইয়ের নেত্রী হিসেবে আপনি যদি এ ব্যাপারে আমাদের আরও কিছু বলেন?
শশী যাদব : কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পে নিযুক্ত আছেন ১০ মিলিয়ন(১০০লক্ষ) কর্মী। স্বাস্থ্য দপ্তরে আছেন আশা ও আশা ফ্যাসিলিটেটররা (সহায়তাকারী কর্মীরা)। তারা জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। সমস্ত আশাকর্মীই মহিলা। স্কুলে কাজ করছেন মিড ডে মিল কর্মীরা। তাদের ৯৫%ই মহিলা। এছাড়া আছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। তারা সকলেই মহিলা। তারা শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের খাদ্যশস্য, পুষ্টি সম্পূরক নানা খাদ্যসামগ্রী এবং প্রাথমিক পরিচর্যা দিয়ে থাকেন। তারা বিভিন্ন রাজ্য দপ্তরে কাজ করছেন। তারা কর্তব্য পরায়ণ, নিজেদের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ, কিন্তু যে কথাটা সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য – সংশ্লিষ্ট রাজ্য দপ্তরগুলো এদের শ্রমিক বা কর্মচারী, কোনোটাই মনে করে না। তাই তাদের বেতন বা ন্যূনতম মজুরি – কোনোটাই দেওয়া হয় না। তাদের জন্যে নেই কোনো সামাজিক সুরক্ষা বিধি।
এগুলো সবই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প – জাতীয় স্তরে পরিচালিত হয়। কিন্ত তাদের প্রাথমিক অধিকারগুলোও নেই আর মোদী সরকার এদের জন্য ব্যয়বরাদ্দও ছাঁটাই করেছে। তারা কাজটা করেন সরকারি কর্মচারীর, কিন্তু সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা তাদের দেওয়া হয়না। কেন? কারণ তারা নাকি ‘প্রকল্পকর্মী’ হিসেবে নিযুক্ত! এটাই হচ্ছে আধুনি যুগের ক্রীতদাস প্রথা আর নয়া উদারবাদী রাষ্ট্রের ন্যায্য মজুরি চুরির কায়দা!
গড়ে একজন আশাকর্মী পান ৩০০০-৪০০০ টাকা। তারা কোনো মজুরি বা সাম্মানিক পান না, শুধু উৎসাহ ভাতা। ধরুন, তাদের তদারকি ও পরিচর্যায় থাকা কোনো গর্ভবতীর সফল প্রসবের পর, দীর্ঘ কয়েক মাস কাজের বিনিময়ে তারা পাবেন ৬০০ টাকা। একজন আশা ফ্যাসিলিটেটর পান মাসিক ৭০০০ টাকা সাম্মানিক। একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীও পান ৭০০০ টাকা। বিহারে একজন মিড ডে মিল কর্মী একমাস কাজ করে পান মাত্র ১৬৫০ টাকা। একজন মিড ডে মিল কর্মী যা পান তাতে কেন্দ্রীয় সরকার দেয় মাত্র ১০০০ টাকা। একইভাবে, আশা কর্মীদের ইন্সেনটিভ-এর ৬০% দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, ৪০% দেয় রাজ্য সরকার, তবে বিভিন্ন রাজ্যে তার ফারাক আছে। প্রকল্প কর্মীদের, কেন্দ্র এবং রাজ্য – উভয় সরকারের বিরুদ্ধেই লড়তে হয়। বিহারে দীর্ঘ লাগাতার সংগ্রামের পর আশাকর্মীরা প্রতিশ্রুতিমত টাকা পাচ্ছেন।
রাধিকা : প্রকল্প ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমশক্তিতে নারীরাই বিপুল অংশ; তাদের যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, দাবিগুলোতে কি তার প্রতিফলন ঘটছে? ইউনিয়ন কী ধরণের ইস্যুগুলো তুলে ধরেছে? আপনি কি এই দাবিগুলোকে ‘নারীবাদী’ মনে করেন?
শশী : এই সব প্রকল্পে মহিলারাই শ্রমশক্তির মূল যোগানদার, কিন্তু মহিলাকর্মীদের সম্পর্কে সরকারগুলোর মনোভাব ভীষণ সন্দহজনক। তারা মনে করে মেয়েদের শ্রম আর দক্ষতা ডাহা সস্তা আর ব্যবহারের পর ইচ্ছেমতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায়। এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায় সরকারের মনোভাব কতটা পিতৃতান্ত্রিক তথা সামন্ততান্ত্রিক! তাই প্রথমে এটার মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই মনোভাবই সরকারকে মহিলাদের, এমনকি শ্রমিকের প্রাথমিক অধিকারগুলো থেকেও বঞ্চিত করার প্ররোচনা দেয়। আমাদের ইউনিয়ন এই মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। শুরু থেকেই আমরা আশাকর্মীদের জন্য হাসপাতালে আলাদা বিশ্রামের ঘর, পিরিয়ড লিভ (ঋতুকালীন ছুটি)-এর ব্যবস্থা, যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর কমিটি, অন্যান্য অভিযোগের প্রতিকারের ব্যবস্থা ইত্যাদি ইস্যুগুলোকে তুলে ধরেছি। এছাড়াও রয়েছে কর্মরত অবস্থায় কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার প্রয়োজনের বিষয়টি।
মহিলাদের কেন শুধু সাম্মানিক দেওয়া হবে, কেন বেতন নয়? প্রকল্প কর্মীরা সরকারের জন্যে কাজ করেন কিন্তু তাদের এত কম পয়সা দেওয়া হয় যে তাদের পরিশ্রমকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয় না। এটা তাদের সময় ও মজুরি চুরি করা। সরকার তাদের দেশের জন্যে স্বার্থ ত্যাগ করতে বলছে, কিন্তু কেন সবসময় শুধু মহিলাদের, বিশেষ করে গরিব মহিলাদের স্বার্থত্যাগ করতে বলা হয়? প্রকল্প কর্মীদের ফেডারেশন এবং আমাদের ইউনিয়নগুলো এই প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। আমাদের বেতন আর সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতির দাবি এই বোঝাপড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে মহিলাদের কাজকে ন্যায্য মজুরিসহ স্বীকৃতি দিতে হবে। লিঙ্গ সাম্যের জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের উচিত সাম্মানিকের নামে নামমাত্র পারিশ্রমিক দিয়ে মহিলাদের কাজকে খারিজ করার বদলে, (যেমনটা সমাজ করে), তাদের সম নজরে দেখে লিঙ্গ সাম্যের পথ দেখানো। এইগুলো নারীবাদী ইস্যু। স্বাধীনতা আর মুক্তির স্বার্থে, একজন প্রকল্প কর্মীর মজুরি ও শ্রম অধিকারগুলি পাওয়া উচিত। অনেক আশাকর্মীকেই তাদের ঐ সামান্য উপার্জন দিয়েই সংসার চালাতে হয়। এটা তাদের একটা বিরাট মাথাব্যথার কারণ। মহিলাদের প্রশ্নটিকে তাদের জীবনের পরিস্থিতির মধ্যে রেখে ভাবতে হবে।
রাধিকা: প্রকল্প কর্মীদের গ্রামীণ দরিদ্রমানুষের প্রাথমিক পুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রয়োজনগুলি নিয়ে কাজ করতে হয়। লক্ষ্যণীয়ভাবে, যদিও তাদের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের সেবা করতে হয়, তাদের নিজেদেরও তো আর্থ-সামাজিক ভাবে প্রতিবন্ধী এক পটভূমি থেকে উঠে আসতে হয়েছে। তাদর ভাতা কি সেই দারিদ্র্য থেকে তাদের রেহাই দিতে পারে?
শশী : না! প্রকল্প কর্মীদের অনেক ক্ষেত্রে নিজেদেরই নিষ্ঠুর দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে। তাদের ভাতা এই বিপুল মুদ্রাস্ফীতির বাজারে কিছুই না। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাদের মজুরি বাড়ে না। বেশ কয়েক বছর ধরে, তাদের ভাতা বা সাম্মানিকের কোনও বৃদ্ধি ঘটেনি।
রাধিকা: মহিলারা কীভাবে তাদের কাজ আর প্রকল্পে তাদের ভূমিকাকে উপলব্ধি করেন?
শশী : এরা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী মহিলা, নিজেদের দায়িত্ব ও সমাজের প্রতি ভীষণ আন্তরিক। সম্প্রতি আশাকর্মীরা ফাইলেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রচার অভিযানে গেলে, মানুষজন তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, কারণ বাচ্চাদের বয়স এবং উচ্চতা অনুযায়ী ওষুধের মাত্রা নির্দিষ্ট করতে না পারলে কখনও কখনও ওরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের তাদের সঙ্গে থাকার কথা। কিন্তু অনেক সময়েই ডাক্তাররা যান না, আশাকর্মীদের ওপরই কাজটা ছেড়ে দেন। গালাগাল সত্ত্বেও আশাকর্মীরা দমেন না, কারণ এটা সারা বছরে মাত্র একবারের কর্মসূচি আর ওষুধের ডোজ কোনভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না! প্রসবের ব্যাপারগুলোতে দিনে রাতে যে কোন মুহূর্তে ছোটার জন্যে তারা তৈরি থাকে। এরা গরিব মহিলা, প্রসবের সময়টা যদি না যেতে পারে তো তাদের ন’মাসের পুরো কাজটাই বরবাদ হয়ে যাবে। যে মানুষগুলোর তারা সেবা করে, তাদের সঙ্গে আবেগের বন্ধনেও জড়িয়ে থাকেন তারা। আশাকর্মীদের ছাড়া ডাক্তার রোগীকে না-ও দেখতে পারেন, তাই তারা রোগীর সঙ্গে ছোটেন যাতে স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত না হতে হয়। এমনকি কোভিড-এর সময়ে তারা যদি নিভৃত বাস, ভ্যাকসিনেশন, ওষুধ বিতরণ – এই প্রত্যেকটি ব্যাপারে সঙ্গে না থাকতেন – আমাদের মতো দেশে অতিমারিকে সামলানো অসম্ভব হত। অনেক আশাকর্মীর বাড়ি বলতে একটাই ঘর। তাই ফিল্ড থেকে ঘরে ফিরে তাদের সারা রাত ঘরের বাইরেই কাটাতে হয়েছে যাতে বাচ্চাদের মধ্যে সংক্রমণ না ছড়ায়।
এই সব কিছুর জন্য চাই একাগ্রতা, নিষ্ঠা, আত্মোৎসর্গের মানসিকতা। প্রত্যেক পেশার মতো এক্ষেত্রেও কিছু কর্মীর মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আছে, কিন্তু সেটা খুবই কম।
রাধিকা : প্রকল্পকর্মীরা কাজের সময় পেশাগত চ্যালেঞ্জ, নিরাপত্তাহীনতা বা যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছেন কখনও? এ সবের প্রতিকারের জন্যে কী ব্যবস্থা আছে?
শশী : অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সেন্টারে যেতে হয়। সেখানে তাদের হেনস্থা ও অসম্মানের ঘটনা ঘটেছে। মিড ডে মিলের কর্মীদের উপরতলার বেশ কয়েক জনের তদারকিতে কাজ করতে হয়, কিন্তু অভিযোগ জানানোর কোনো ফোরাম নেই। আশাকর্মীদের কাজের কোনো বাঁধাধরা সময় নেই। এমন অনেক ঘটনাই আছে, যখন রাত দুপুরে কোনো পরিবারের ডাক পেয়ে যেতে হয়েছে এবং আক্রান্ত হতে হয়েছে। একটি ধর্ষণের ঘটনা আছে, যে ক্ষেত্রে কাজের নাম করে রাতে আশাকর্মীকে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। এ সব ক্ষেত্রে প্রতিকারের কোন যথাযথ ব্যবস্থা নেই।
বিহারে আমরা বিশাখা গাইডলাইনের রূপায়ণ দাবি করেছিলাম। আমাদের দাবিতে স্বাস্থ্য দপ্তর এই মর্মে একটা বিজ্ঞপ্তি জারি করতে বাধ্য হয়েছিল যে হেনস্থার কোনো ঘটনা ঘটলে আশাকর্মীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ইন-চার্জের (দায়িত্বশীলের) কাছে জানাবেন যিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। ইন-চার্জ নিজেই হেনস্থা করলে, অভিযোগ যাবে জেলা শাসকের কাছে। একমাত্র ইউনিয়ন থাকলে তবেই এ সব কার্যকর হতে পারে।
পেশাগত অন্যান্য সমস্যাও আছে। আশাকর্মীদের কোনো নির্দিষ্ট কাজের জায়গা বা সেন্টার নেই। তাদের কাজ ফীল্ড-ভিত্তিক। যখন তারা হাসপাতালে পেশেন্ট নিয়ে যান, তাদের রাতে সেখানে থাকতে হয়, বারান্দায় ঘুমাতে হয়। কোন শৌচাগার নেই – স্টাফ নার্সরা তাদের রেস্টরুম ব্যবহার করতে দেন না। আমরা বিহারে এ প্রশ্নে লড়েছি এবং শেষবারের ধর্মঘটের পর সরকার আশ্বাস দিয়েছে যে আশাকর্মীদের জন্যেও হাসপাতালে রেস্টরুম থাকবে, সেখানে মশারিসহ বিছানা থাকবে। প্রায় ১৫০-১৯০টা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমরা এটা করাতে পেরেছি। যে সব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ইউনিয়ন আছে, একমাত্র সেগুলোতেই এটা নিশ্চিত করা গেছে।
রাধিকা : প্রকল্প কর্মীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কী কী চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল? এই কাজটা একেবারেই অসংগঠিত চরিত্রের এবং ভৌগোলিকভাবেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের ইউনিয়নে সংগঠনবদ্ধ করা এবং প্রাথমিক দাবিগুলো তুলে আনার ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি নেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে যদি সবিস্তারে একটু বলেন?
শশী : প্রকল্পকর্মীরা বিভিন্ন সময়ে নিযুক্ত হয়েছেন। তাদের কাজও আলাদা আলাদা জনগোষ্ঠীর (কম্যুনিটির) মধ্যে। তারা যেহেতু বিক্ষিপ্তভাবে নথিভুক্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কোনো গোষ্ঠী বা যৌথ চেতনা ছিল না। তারা তাদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন না। নিয়মিত জমায়েত করতে হয়েছে, বার বার বুঝিয়ে উৎসাহিত করতে হয়েছে, তারপর তারা ইউনিয়নের ক্ষমতাকে মানতে পেরেছেন। তার আগে নয়! আশাকর্মীদের কাছে পৌঁছাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোই হয়ে উঠেছিল কেন্দ্র বিন্দু (ফোকাল পয়েন্ট)। ওপর থেকে আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সেটাই ইউনিয়ন গঠনে সহায়ক হয়েছিল। লাগাতার প্রচার চালিয়ে কর্মীদের উৎসাহিত করে তোলা হয়েছিল। আশাকর্মীদের ধর্মঘটগুলো হয়ে উঠেছে প্রকল্পকর্মী সংগঠনের সমাবেশ স্থল। ধর্মঘটের সাফল্য এবং প্রচারাভিযানগুলি আমাদের ইউনিয়নকে বড় করে তুলেছে, আর এখন সেটা হয়ে উঠেছে বিহারে প্রকল্পকর্মীদের বৃহত্তম সংগঠন। আমরা ১৩টি জেলা এবং ১০০টি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে আমাদের সংগঠন শুরু করেছিলাম।
আমরা আশাকর্মীদের মর্যাদার জন্য লড়াই দিয়ে শুরু করেছিলাম। আগে ডাক্তার, ম্যানেজার এবং সরকারি কর্মচারীরা সংগঠনে বাধা দেওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন, হুমকি দিতেন। লাগাতার সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আশা আন্দোলনকর্মীরা ক্রমশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। সাংগঠনিক কাজে দক্ষতাও বেড়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে যে নেতৃত্বের ধারাবাহিক, দৃঢ়, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ ভূমিকা আমাদের সংগঠনের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নেত্রীরা সবসময়েই কর্মীদের পাশে আছেন।
রাধিকা : কোভিড-এর সময় প্রকল্প কর্মীরা বিশেষ করে আশাদিদিরা একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেছেন, সামাল দিয়েছেন। তাঁদের সেই কাজের গুরুত্ব কি যথাযথ স্বীকৃতি পেয়েছে?
শশী : অতিমারীর সময় প্রকল্প কর্মীরা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। নিজেদের জীবনের বিরাট ঝুঁকি নিয়েও তারা প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ স্থান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা সুনিশ্চিত করেছেন। কিছু কিছু জায়গায় কাজ করতে গিয়ে তাদের আক্রান্ত হতে হয়েছে, মানুষের থেকে দুর্ব্যবহার পেতে হয়েছে। কিন্তু তার জন্য মোদী সরকারের থেকে কোনো প্রতিদান মেলেনি, শুধু অর্থহীন বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। সরকার প্রকল্পকর্মীদের কৃতিত্ব আত্মসাৎ করে নিজের সাফল্য বলে চালিয়েছে। কিন্তু কর্মীদের দীর্ঘ দিনের বকেয়া দাবিগুলো উপেক্ষিতই থেকেছে। এই হৃদয়হীনতা, এই অবজ্ঞা প্রচণ্ড ক্রোধের জন্ম দিয়েছে যার প্রকাশ ঘটেছে পর পর কয়েকটি আন্দোলনে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, কর্ণাটক এবং অন্যান্য রাজ্যে বিশাল বিশাল জমায়েত হয়েছে।
(মানবাধিকার ফোরামের বিবৃতি)
আদানি সম্প্রতি ইজরায়েলের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদিত করেছে এবং ঐ চুক্তির ভিত্তিতে সে ইজরায়েলের কাছে অত্যাধুনিক ড্রোন পাঠাচ্ছে যে ড্রোনগুলোকে গাজায় প্যালেস্তিনীয়দের চলমান গণহত্যায় কাজে লাগানোর সুস্পষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। মানবাধিকার ফোরাম এই সিদ্ধান্তকে তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে। আমরা ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পাদিত ঐ সমস্ত চুক্তিকে অবিলম্বে বাতিল করা হোক। আমরা প্রতিদিনই স্বেচ্ছাকৃতভাবে প্যালেস্তিনীয়দের গণহত্যা সংঘটিত হতে দেখছি, যে নিহতদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও থাকছে। নৈতিকভাবে অধঃপতিত ইজরায়েল ৩০০০০-এরও বেশি প্যালেস্তিনীয়র প্রাণসংহার করেছে, যাদের ব্যাপক সংখ্যকই অসামরিক নাগরিক। এই বিবৃতি যখন লেখা হচ্ছে সেই সময় প্যালেস্তিনীয় শিশুরা অনাহারগ্ৰস্ত অবস্থায় রয়েছে, এবং গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘনীভূত হচ্ছে।
হায়দ্রাবাদে অবস্থিত আদানি-এলবিট অ্যডভান্সড সিস্টেমস ইন্ডিয়া লিমিটেড হলো আদানি ডিফেন্স ও অ্যরোস্পেস এবং ইজরায়েলের এলবিট সিস্টেমসের এক যৌথ সংস্থা যারা অত্যাধুনিক ড্রোন নির্মাণ করে। এই ড্রোনগুলোর একেবারে সাম্প্রতিক সংস্করণটি হল হার্মেস ৯০০। ইজরায়েলের বাইরে এটিই হলো হার্মেস নির্মাণের একমাত্র সংস্থা। সম্প্রতি তেলেঙ্গানা সরকার এবং আদানি গোষ্ঠীর মধ্যে একটি মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে যার ভিত্তিতে ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে ‘একটি সর্বাঙ্গীণ ইকোসিস্টেম স্থাপন করা হবে যা হায়দ্রাবাদের আদানি অ্যারোস্পেস পার্কে ড্রোন প্রতিরোধী ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার গবেষণা, বিকাশ, নকশা, নির্মাণ ও একীকরণকে চালিয়ে নিয়ে যাবে।’
অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের জন্য ইজরায়েল ওয়েপন ইন্ডাস্ট্রিজ (আই ডব্লিউ আই) ও আদানি এন্টারপ্রাইজেস-এর মধ্যে পার্টনারশিপ সংস্থা হলো পি এল আর সিস্টেমস প্রাঃ লিঃ। কোম্পানির ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে এটা হল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই লোলুপ শিল্পপতি ইতিহাসে ইজরায়েল-ভারত-এর মধ্যে বৃহত্তম চুক্তিগুলোর একটা সম্পাদন করে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তারা ইজরায়েলের হাইফা বন্দরের একটা অংশের অধিকার পায়। গাজায় ইজরায়েলের হাতে প্যালেস্তিনীয়দের হত্যা যখন অব্যাহত রয়েছে আদানি এলবিট সংস্থা তখন ইজরায়েলের সামরিক বাহিনীকে ২০টা হার্মেস ৯০০ ড্রোন দিয়েছে। প্যালেস্তিনীয়দের পৈশাচিক গণহত্যা অব্যাহত থাকায় বেশ কিছু দেশই যখন ইজরায়েলের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, আদানি তখন ঐ গণহত্যা থেকে মুনাফা কামাচ্ছে, রক্তে রঞ্জিত টাকায় পকেট ভরাচ্ছে।
প্যালেস্তাইন হয়ে রয়েছে যুদ্ধে ব্যবহৃত প্রযুক্তির একটা পরীক্ষাগার, আর ইজরায়েল গণহত্যার এই ‘সাফল্যকে’ সারা দুনিয়ার বাজারগুলোতে পাচার করছে। ব্যাপক হারে ধ্বংসসাধন এবং বেশি সংখ্যায় হত্যা সংঘটনের জন্য ইজরায়েলি ড্রোন ও নজরদারি প্রযুক্তি আক্রমণ হানে জন-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে, স্কুল, হাসপাতাল এবং এমনকি এক-একটা বসত বাড়িতেও।
ভারতকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহকারী দেশগুলোর অন্যতম হল ইজরায়েল, আর কৃষকদের সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিবাদকে বানচাল করতে ভারত ইজরায়েলের কাছ থেকেই ‘ড্রোন কসরত’ ধার নিয়েছে। এলবিট সিস্টেম হলো ইজরায়েলের বৃহত্তম অস্ত্র নির্মাণ কোম্পানি এবং তারা ইজরায়েলি ড্রোনের প্রায় ৮১ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। হার্মেস ৯০০ হল মানবহীন বায়ু শকট যার বহন ক্ষমতা ৩০০ কেজির মতো এবং একনাগারে কাজ করতে পারে ৩০ ঘণ্টা। এলবিট সিস্টেম এর নাম দিয়েছে আইএসটিএআর, এই আদ্যক্ষরগুলো দিয়ে বোঝানো হচ্ছে ইনটেলিজেন্স অর্থাৎ মেধা, সারভাইভাল্যান্স অর্থাৎ নজরদারীর ক্ষমতা, টার্গেটেড অ্যাকুইজিশন অর্থাৎ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো এবং রিকনিসন্স বা শত্রুর অবস্থান নিরীক্ষণ। এই ড্রোনগুলো উচ্চ-বিশ্লষণ ক্ষমতায় বস্তুকে নির্দিষ্ট করতে পারে, লেসার ডেসিগনেটরের সাহায্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বোমা বর্ষণ করতে পারে (এমনকি ঘন বসতিপূর্ণ এলাকাতেও) এবং বিস্তৃতভাবে নজরদারি চালাতে পারে। হার্মেস ৯০০র মতো মানবহীন বায়ু শকটগুলোকে পরিচালিত করা হয় ভূমি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে যেগুলোর অবস্থান হয় লক্ষ্যবস্তু থেকে বহু মাইল দূরে, ফলে হত্যাকাণ্ড থেকে দূরত্ব এবং সংযোগহীনতা তৈরি হয়। মানবহীন বায়ু শকটগুলোর কাজ এমন হয় মনস্তত্ত্ববিদরা যেটাকে বলেন ‘ক্রীড়া ক্ষেত্রের মানসিকতা’, কেননা, তা বলতে গেলে ভিডিও গেম-এর মতনই। সেনা এবং তাদের কাজের পরিণামের মধ্যে এই নিদারুণ বিচ্ছিন্নতা প্যালেস্তিনীয় জনগণের গণহত্যায় ভারতের সচেতন ও স্বেচ্ছাকৃত অজ্ঞতা ও যোগসাজশকেই প্রতিধ্বনিত করে।
দক্ষিণ আফ্রিকা ২০২৩-এর ২৯ ডিসেম্বর ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে ১৯৪৮-এর গণহত্যা সম্পর্কিত কনভেনশন লঙ্ঘনের যে অভিযোগ দায়ের করেছিল, আদালত সে সম্পর্কে ২০২৪-এর ২৬ জানুয়ারি কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপের কথা বলে। আদালত দক্ষিণ আফ্রিকার আনা অভিযোগকে গণহত্যার যুক্তিগ্রাহ্য দাবি বলে অনুমোদন করে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত তাদের রায়ে ইজরায়েলকে প্যালেস্তিনীয়দের হত্যা করা অথবা দৈহিক বা মানসিক আঘাত প্রদান থেকে নিবৃত্ত হতে বলে। তারা ইজরায়েলের প্রতি এই নির্দেশও দেয় যে, ইজরায়েলেকে “অবিলম্বে এবং ফলদায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে জরুরি প্রয়োজনীয় মৌলিক পরিষেবা ও মানবতাবাদী সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়।” এই ঐতিহাসিক নির্দেশ ভারত-সহ আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের অন্যান্য দেশ ও গণহত্যা সম্পর্কিত কনভেনশনের স্বাক্ষরকারীদের ওপর একটা নৈতিক ও আইনি দায়বদ্ধতা অর্পণ করেছে যা হলো ইজরায়েলের সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপে অর্থ জোগানো থেকে নিবৃত্ত হতে হবে অথবা কোনোভাবেই তাতে সহায়তা করা যাবে না। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের রায়কে ইজরায়েল এখনও পর্যন্ত উপেক্ষা করেই এসেছে এবং গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে যার পরিণাম হচ্ছে সর্বনাশা।
বেআইনি ঘোষিত প্যালেস্তিনীয় শ্রমিকদের অপসারিত করতে ইজরায়েলে ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়োগে ভারত যে গুরুত্ব দিচ্ছে আমরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ইজরায়েলি হানাদারিতে সহযোগিতা ছাড়াও দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের আধা-বেকার ও দরিদ্র সম্পূর্ণ বেকারদের নিরাপদ, সুরক্ষিত ও ভদ্রগোছের আয়ের কাজ প্রদানের দায়িত্বকে ভারত সরকার পরিত্যাগ করছে।
===000===