আজকের দেশব্রতী : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-21-sept-23reservation-of-seats-for-women-should-be-implementedimplemented-immediately

লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির অন্তত ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করার দাবি বহু দিনের। ১৯৯৬ সালে প্রথম এই বিষয়ক একটি আইন প্রস্তাবনা লোকসভায় পেশ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পাশ হয়নি। পরবর্তীতে ২০১০ সালে আবার এই বিল পেশ হয় এবং রাজ্যসভায় পাশও হয়ে যায়। কিন্তু লোকসভায় পাশ না হওয়ায় বিলটি নির্দিষ্ট সময়সীমার পর বাতিল হয়ে যায়। রাজনৈতিক পরিসরে নারী ও পুরুষ প্রতিনিধিত্বের সমতার লক্ষ্যে আসন সংরক্ষণের আইন প্রণয়নের প্রশ্নে থেকে বহু আলোচনা চলেছে। এই আইন পাশ করার দাবিতে দেশের নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে দীর্ঘ আন্দোলন চলেছে। এখন দুই দফা পূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি সরকার নাটকীয়ভাবে এই বিষয়ক নতুন বিল হাজির করেছে। সংসদের বাদল অধিবেশন শেষ হওয়ার পরপরই হঠাৎ আবার বিশেষ অধিবেশন ডেকে এই আইন প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়। লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলিতে ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকার কথা বলা হয়েছে আইন প্রস্তাবে। এই সংরক্ষিত আসনগুলির তিনভাগের এক ভাগ এসসি ও এসটি মহিলাদের জন্য নির্ধারিত। ওবিসি মহিলাদের কথা বলা হয়নি। এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হল, আইন প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছে, জনগণনা সম্পন্ন হওয়ার পর নতুন করে নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলির পুনর্বিন্যাস বা ডিলিমিটেশন হয়ে গেলে তবেই এই আইন কার্যকর হবে। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, সারা ভারত মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর জারি করা যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে,

“মহিলা সংগঠনগুলি ২৫ বছর ধরে এই বিল পাশের দাবি জানিয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ছাড়পত্র পাওয়া বিলটির খসড়া অনুযায়ী মনে হচ্ছে মহিলা সংরক্ষণ সেই ২০২৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে কার্যকর হবে না। জাতীয় মহিলা সংগঠনগুলির স্পষ্ট উপলব্ধি, বিজেপি সরকার যদি সত্যিই সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলিতে মহিলাদের আসন সংরক্ষণকে যথার্থ গুরুত্ব দিত তাহলে ২০১৪ সালেই এটা পাশ করাতে পারতো।”

১৯ সেপ্টেম্বর সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বিবৃতি জারি করে বলেন,

“মোদী সরকার আমাদের বিশ্বাস করাতে চাইছে, মহিলা সংরক্ষণের ব্যাপারে তারা এতটাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে বিলটি পাশ করার জন্যই তাদের সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকতে হয়েছে। কিন্তু এই তাড়াহুড়োর পেছনে যে ভণ্ডামিটা আছে তা বুঝতে কারো বাকি নেই। এই আইন কার্যকর করাকে জনগণনা শেষ হওয়া এবং সেই অনুযায়ী ডিলিমিটেশন হওয়ার সাপেক্ষ করে তোলা হল। এখনই, কোনও বিলম্ব না করে, কেন এই আইন কার্যকর করা হবে না? কোথায় আটকাচ্ছে?

“ভারতবর্ষের ইতিহাসে মোদী সরকারই একমাত্র সরকার যারা প্রত্যেক দশকে জনগণনা চালানোর নিয়মিত কর্তব্যটি সমাধা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোভিড সত্ত্বেও, চিন, গ্রেট ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুতর কোভিড-আক্রান্ত দেশগুলোও জনগণনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে, কিন্তু মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত ব্যর্থ হয়েছে। মহিলা আসন সংরক্ষণের উদ্দেশ্য হল আইনসভার পরিসরে মহিলাদের অপর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বের তীব্র সমস্যাটির প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং এই গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি সংশোধন করা। সমস্যাটির গুরুত্ব নতুন করে খতিয়ে দেখা এবং সমাধানের জন্যে আরেকটি জনগণনা সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি না আমরা।

“এরকম একটি চূড়ান্ত গুরুত্ববহ আইন প্রস্তাবনা যে ধরণের আইনি পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে রূপ পাওয়া দরকার ছিল তা নেওয়া হয়নি, অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে খসড়াটি প্রস্তুত করে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় এবং তা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যা সংসদীয় গণতন্ত্রের কর্মপদ্ধতিকে হেয় করেছে। এইরকম একটি অত্যন্ত জরুরি আইন বাস্তবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে এত বিলম্ব করার নিদানটি আমাদের গান্ধীর এক বিখ্যাত মন্তব্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। রাজ্যের মর্যাদা নিয়ে ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবকে তিনি অভিহিত করেছিলেন, “ফেল করতে চলা ব্যাংকের পোস্ট-ডেটেড চেক” বলে। একটি আইন প্রস্তাবনা, যা নিয়ে দেশের মহিলারা কয়েক দশক ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, যার পিছনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির এক বিস্তৃত পরিসরের সমর্থন অব্যাহত আছে, তাকে আরেকটি নির্বাচনী চমকে পর্যবসিত হতে দেওয়া যাবে না।”

industrial-modelmodel-in-spain

আবার মৃত্যু হল এ রাজ্যের চারজন পরিযায়ী শ্রমিকের। একই পরিবারের। আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রামের সংকোশ চা বাগানের নেপালি লাইনে এই শ্রমিক পরিবারটির বাড়ি। বোঝাই যাচ্ছে, চা বাগিচার নিতান্ত অল্প মজুরিতে দিন গুজরান করতে না পেরে এই পরিবারটি পাড়ি দেন বেঙ্গালুরুর এক পোল্ট্রি ফার্মে। সেখানেই মৃত্যু হয় দুর্ঘটনায়। কয়েকমাস ধরেই ভিন রাজ্যে একের পর এক পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিল এ রাজ্যে কর্মহীনতার ধারাবাহিক সংকটকে প্রকট রূপে আবার সামনে আনল।

দুয়ারে সরকারের যে কর্মসূচি চলছে, সরকারি তথ্য অনুযায়ী তাতে এখন পর্যন্ত ১২.১৫ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক তাঁদের নাম নথিভুক্ত করেছেন। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই নথিভুক্তিকরণের কাজটি চলবে। এই রাজ্য থেকে কত সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে ছুটছেন, তার এক তথ্য ভান্ডার তৈরি করতে রাজ্য সরকার সম্প্রতি এক উদ্যোগ নিয়েছে। নথিভুক্ত পরিযায়ীদের মৃত্যু বা দুর্ঘটনায় আহত হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, মৃত পরিযায়ী শ্রমিকের স্ত্রীকে সরকারের প্রতিনিধি ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে তিনি প্রশ্ন করেন, “টাকা চাই না, চাকরি দিন”। অযুত-নিযুত পরিযায়ী শ্রমিকদের মনের কথা কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে যেন গোটা রাজ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল তাঁর মাধ্যমে।

২০১১-র সর্বশেষ সেন্সাস অনুয়ায়ী এ রাজ্য থেকে ভিন রাজ্যে চলে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ৫.৮ লক্ষ। এতদিনে এই সংখ্যা যে বহুগুণ বেড়েছে, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র সচিবের দেওয়া তথ্যেই তার প্রমাণ মেলে। লক্ষ্য করার বিষয়, রাজ্যের সমস্ত জেলা থেকেই দলে দলে শ্রমিক অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। কাজের অভাবের জন্যই যে অন্যত্র তাঁরা চলে যাচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। এরাজ্যে একেবারে নিচের দিকে অসংগঠিত শ্রমের মজুরি এতই কম, যে এমনকি রং পালিশ, ইঁট ভাটার কাজের খোঁজেও তাঁরা রাজ্যের বাইরে চলে যাচ্ছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যই দেখাল, এরাজ্যে দিন মজুরদের মজুরি জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশ খানিকটা কম। এছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে এরাজ্যে একশ দিনের কাজ বন্ধ হওয়ার ফলে ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেমে আসা সংকট এই প্রবণতাকে অনেক বাড়িয়ে তুলেছে।

১২ দিনের জন্য স্পেন ও সংযুক্ত আমিরশাহী সফরে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। সফর সঙ্গী হিসাবে ছিলেন মুখ্য সচিব, মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্ণধার, এবং বার্সালোনায় তাঁর সাথে যোগ দেন সৌরভ গাঙ্গুলি। সংবাদে প্রকাশ, বার্সালোনায় স্পানিশ বনিক সংস্থাগুলোর সাথে তিনি সভাও করেছেন। সেখানে শিল্পপতিদের সামনে এ রাজ্যে পুঁজি বিনিয়োগের অনুকূলে যে পাঁচটি ‘অ্যাডভান্টেজ’এর কথা মমতা শুনিয়েছেন তার মধ্যে দু’টি হল দক্ষ মেধাসম্পন্ন সস্তা শ্রম এবং ‘এরাজ্যে ধর্মঘট করতে দেওয়া হয়না’-র ঔদ্ধত্যপূর্ণ বিজ্ঞাপন। দক্ষ মেধা সম্পন্ন শ্রমিকদের এরাজ্যে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করার পেছনে যে রাজ্য সরকারের প্রশ্রয় রয়েছে আর সরকার তাঁদের শিল্প গণতন্ত্র (ধর্মঘট করার অধিকার) হরণ করেছে, খোদ মমতাই এই দু’টি শর্তকে বিজ্ঞাপিত করে উন্মোচিত করলেন তাঁর শ্রমিক বিরোধী ভাবমূর্তি। যখন গোটা পৃথিবী জুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে উঠছে তখন “এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা ক্ষেত্র ডেউচা পাচামিকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের” উৎস হিসাবে চিহ্নিত করে বুঝিয়ে দিলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটকে প্রশমিত করতে তাঁর কোনও দায় নেই, তিনি বিন্দুমাত্রও চিন্তিত নন।

বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের স্থায়ী সরকার বা পরবর্তীতে তৃণমূলের ১২ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শাসনকাল কিন্তু রাজ্যে গ্রামীণ বা শিল্প অর্থনীতির কোনও উন্নয়ন ঘটাতে পারল না। এটা আরেকবার প্রমাণ করল, রাজনৈতিক ক্ষমতার স্থায়ী কেন্দ্র উন্নয়নের সোপান নয়। সমস্ত রাজ্যের (এমনকি গুজরাটও) তুলনায় একমাত্র মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ সেই পর্বে হয়, যখন ওই রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতায় সবচেয়ে বেশি টানাপোড়েন চলছিল।

শোভন কাজ, ভদ্রস্থ মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, ঝুঁকিবিহীন সুরক্ষিত কর্মস্থল, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সম্মত বাসস্থান — অত্যন্ত মৌলিক এই শর্তগুলোকে পূরণ করাই হল এরাজ্যে শিল্পায়নের আরম্ভবিন্দু।

reality-check-and-case-of-missing-prioritiesg20-new-delhi-summit

ভারতের বিস্তীর্ণ ও বহুবিচিত্র শহরগুলির একটা থেকে অন‍্যটায় ঘুরে ঘুরে জি-২০র দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা কর্মসূচীর সমাপনী সম্পন্ন হল দিল্লিতে গত ৮-১০ সেপ্টেম্বর অষ্টাদশ জি-২০ বৈঠকে। ১৯৮৩ সালের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলন এবং ২০১০ সালের কমনওয়েলথ গেমসের পর যেহেতু এটাই ছিল ভারতের আতিথেয়তায় সংগঠিত প্রথম একটা এত বড় আন্তর্জাতিক কর্মসূচি, তাই, বলাই বাহুল‍্য, একে ঘিরে মানুষের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে, শুধু ভারতে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেই।

জি-২০ মোটেই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলির আয়েসী ক্লাব জি৭-এর মতো কোনো গোষ্ঠী নয়। এতে আছে বেশ কয়েকটি বিকাশমান দেশ, অথবা বৈশ্বিক দক্ষিণের কিছু উদীয়মান অর্থনীতি। ৫৫টি আফ্রিকী দেশের এক মহাদেশীয় জোট আফ্রিকী সংঘের অন্তর্ভুক্তির মধ‍্যে দিয়ে জি-২০ প্রসারিত হয়ে জি-২১ রূপ নেওয়ায় আন্তর্মহাদেশীয় মঞ্চটিতে বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রতিনিধিত্ব কার্যত অনেকখানি বাড়ল এই দিল্লি বৈঠকে এসে। ভারত নিজেকে প্রায়শই বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতৃত্বকারী কন্ঠস্বর হিসেবে তুলে ধরে। দিল্লি বৈঠক সুতরাং বৈশ্বিক দক্ষিণের মূল মূল সমস‍্যাগুলিকে সামনে নিয়ে আসবে এমনটাই প্রত‍্যাশিত ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেরকম কোনো ফোকাস দেখা গেল না।

প্রকৃতপক্ষে ভারতের নিজের দারিদ্র লুকাতেই চরম কসরৎ চালালো মোদি সরকার। দিল্লি ও তার আসপাশে এক ব‍্যাপক গরিব-বিরোধী অভিযান উন্মুক্ত করল এই বৈঠক। সরকার সম্ভবত এটাই বিশ্বাস করে যে শহুরে দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের অস্তিত্বটাই এক চক্ষুপীড়া যাকে যেকোনো আন্তর্জাতিক বৈঠকের সময় বা বিদেশী মেহমানের পরিদর্শনকালে ঢেকে-ঢুকে অদৃশ‍্য করে রাখা দরকার, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তার পশ্চিমা সহযোগিদের দৃষ্টি থেকে। কোভিড-১৯ মহামারী ছড়াতে শুরু করার সময় ট্রাম্পের আগমনকালে আহমদাবাদের বস্তিগুলিকে যেভাবে দেয়াল তুলে আড়াল করা হয়েছিল তেমনই এবারও দিল্লির গরিবদের ঠেলে দেওয়া হল লোকচক্ষুর আড়ালে, বেশ কিছু বসতিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে, রাস্তার হকারদের তাড়িয়ে দিয়ে এবং রাস্তা বরাবর পর্দার দেওয়াল তুলে। রাস্তার কুকুরদেরও নিষ্ঠুরভাবে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হল অনেক দূরের আস্তানায়। গণপরিবহন থামিয়ে দেওয়া হল। এবং শেষ পর্যন্ত গোটা দিল্লিকেই, জি-২০ মিটিঙের সমগ্র সময়টা জুড়ে, একেবারে বন্ধই করে দেওয়া হল।

missing-priorities

সাধারণ নাগরিকদের বলপূর্বক অপসারণের পরিপূরক হিসেবে ছিল রাজতান্ত্রিক যুগের জাঁকজমকের দাম্ভিক পুনঃপ্রদর্শন। ভারতীয় পরম্পরার বিলাসী নৈশাহারের নামে সোনা ও রুপার কাজ করা বিশেষ টেবিলঢাকা ডিজাইন করা হয়েছিল জি-২০র অতিথিদের আপ‍্যায়ন করতে। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ‍্যমের প্রতিনিধিদের সুযোগ দেওয়া হল খুব সামান‍্যই। সংবাদ সম্মেলন না করার এবং কেবল “মন কি বাত” প্রসব করার স্বভাবসিদ্ধ হীনতা বজায় রেখে শুধুমাত্র একক ভাষণ ও বাছাই করা প্রশ্ন ও পূর্বনির্ধারিত ছকে ইন্টারভিউ দিয়ে নরেন্দ্র মোদি আন্তর্জাতিক এই কর্মসূচিকে একটি একমুখী বার্তায় পর্যবসিত করলেন। এটা হল ভারতকে বিশ্ব দরবারে “দ‍্য মাদার অব ডেমক্রেসি” হিসেবে তুলে ধরার গল্প। অন‍্যদিকে, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বিদেশ দপ্তর থেকে বারংবার আবেদন জানানো সত্ত্বেও লাইভ মিডিয়া ইনটার‍্যাকশন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আর, জি-২০ প্রতিনিধিদের দেখানো হয় নরেন্দ্র মোদির বিকট আত্মপ্রচারণার কিছু কিছু ঝলক, যে প্রচারণা মোদি শাসনের সবচেয়ে প্রকট পরিচিতি হয়ে উঠেছে।

বুঝতে কারো বাকি নেই যে হঠাৎ ঘোষিত বিশেষ সংসদ অধিবেশনের মতোই এই জি-২০ বৈঠকটিও যতটা না অর্থপূর্ণ আন্তর্জাতিক কূটনীতি তার থেকে অনেক বেশি আসন্ন বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশীয় দর্শকের সামনে তুলে ধরা ফানুস বিশেষ। চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুপস্থিতি এই কর্মসূচিকে এমনিতেই অনেকটা ম্লান করে দিয়েছিল, এবং একটি সম্মিলিত যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। শেষমেস এক ঐকমত‍্যে পৌঁছানো যায়। ‘জি২০ নেতৃত্বের ৮৩ পয়েন্ট ঘোষণা’ গৃহীত হয়। এবং তা, যা আশঙ্কা ছিল, সাধারণ কিছু গোলগোল কথাতে ভর্তি।

জি-২০ ঘোষিতভাবেই অর্থনীতিকে ফোকাসে রাখা একটি ফোরাম। বৈশ্বিক দক্ষিণ বর্তমানে যে অন‍্যতম প্রধান অর্থনৈতিক সমস‍্যাটির সম্মুখীন তা হল ঋণ সংকট, যে সংকট মহামারীর অর্থনৈতিক ধাক্কায় গভীরতর হয়ে উঠেছে। ভারতের দক্ষিণ দিকের প্রতিবেশি শ্রীলঙ্কা এই ঋণ সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ নজির। অথচ জি-২০র ঘোষণায় কোনো দিশাই দেওয়া হয়নি যাকে ওরা সাধারণত বলে থাকেন “বৈশ্বিক ঋণদৌর্বল‍্য সামাল দেওয়া” তা করতে। এই গ্রহের অস্তিত্বের সামনে জলবায়ু সংকট আজ ব‍্যাপক স্বীকৃত এক বিপদ। শক্তিউৎস হিসেবে কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানো এবং জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসাটাই এখন মূল চ‍্যালেঞ্জ। প্রাণ বিনাশি এই বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় কোনোরকম তৎপরতার বোধ বা ন‍্যূনতম দায়বদ্ধতা এই ঘোষণায় পাওয়া গেল না।

আঠারো মাসের বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাচ্ছে রাশিয়া। এত বড় একটা ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষের কোনো উল্লেখই ঘোষণায় থাকবে না এমন তো হতে পারে না। বালিতে গতবারের জি-২০ বৈঠকে গৃহীত ঘোষণায় ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে জোরালো ভাষায় ধিক্কার জানানো হয়েছিল। কিন্তু দিল্লি ঘোষণা এই ধিক্কারকে লঘু করে দিয়ে “ইউক্রেনে যুদ্ধ” সম্পর্কে কেবল এক সাধারণ উদ্বেগ, ভূখণ্ড দখলে বলপ্রয়োগ বিষয়ে সাধারণ অননুমোদন এবং আবছা কিছু শান্তির কথা দিয়ে এক বাক‍্যের একটি প‍্যারাগ্রাফ (১৪নং পয়েন্ট) লিখে দেওয়াতেই ঐকমত‍্য অর্জন করেছে : “আজকের যুগ কোনোভাবেই যুদ্ধের যুগ হতে পারে না”। একইভাবে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা অস্বীকারের বিরুদ্ধে, সাধারণ কিছু মামুলি কথা বলেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়গুলিতে আরো নির্দিষ্টভাবে কিছু বললে জি-২০ ভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশের, সবচেয়ে বেশি ব‍্যবস্থাপক দেশটির, ব‍্যাপক উল্লঙ্ঘনের বাস্তবতা কিছুটা স্বীকার করা হত।

জি-২১এর সভাপতিত্ব এবার ব্রাজিলের ওপর অর্পন করা হল। সঙ্ঘ পরিবারের জি-২০র উল্লাস এবার দেশের অভ্যন্তরের কঠোর বাস্তবতার সম্মুখীন হবে। কয়েক ঘন্টার ভারী বৃষ্টিতে ‘ভারত মণ্ডপম’ জলমগ্ন হয়ে যাওয়াটা উন্নয়ন প্রশ্নে মোদি সরকারের লম্বা চওড়া বাতেলার পেছনকার প্রকৃত বাস্তবতার এক প্রতীকি ছবি হাজির করেছে। ৫ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচনের ফলাফলে এনডিএ’র ঊর্ধ্বে ইণ্ডিয়ার উঠে আসা, যার সবচেয়ে জোরালো অভিব‍্যক্তি মোদি-শাহ-যোগির ‘ডাবল ইঞ্জিন’ চালিত ইউপি থেকেই এল, সেটাও নির্বাচনী ক্ষেত্রে প্রকৃত বাস্তবতার আরেক স্পষ্ট ইঙ্গিত। দেশ এখন সংসদের রহস‍্যময় বিশেষ অধিবেশনের অপেক্ষা করছে। এবং সংঘ-বিজেপির কায়েমী ক্ষমতা সেখানে যা এজেন্ডা নিয়েই আসুক না কেন, ক্ষমতা ধরে রাখার জন‍্য ওরা যত মরিয়া পদক্ষেপই নিক না কেন, উই দ‍্যা পিপল অব ইন্ডিয়া, দ‍্যাট ইজ ভারত – আমরা সেই ষড়যন্ত্র ব‍্যর্থ করতে সদা প্রস্তুত থাকব এবং মোদি সরকারের বিপর্যয়কর শাসনের অবসান ঘটাব।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১২-১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ‍্যা, ভাষান্তর: দেশব্রতী

conference-of-all-india-federation-for-social-justicefederation-for-social-justice

পার্টির পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এই বার্তা তুলে ধরেন

সম্মেলনের সভাপতি, বক্তাগণ ও সামাজিক ন্যায়ের লড়াইয়ের সমস্ত বন্ধুরা,

দ্বিতীয় সম্মেলন সংগঠিত করার জন্য আপনাদের অভিনন্দন। ভারতীয় জনগণের সামনে থাকা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজেণ্ডায় সংগঠিত এই সম্মেলনে আমাদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এত দিনে সামাজিক ন্যায় ভারতীয় গণতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান দিক হয়ে ওঠার কথা ছিল। জনগণের জন্য এই গ্যারান্টিটুকু থাকা দরকার ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, সামাজিক ন্যায়ের ধারণা ও মূল্যবোধের প্রতিই ক্রমশ বেড়ে চলা বিরোধিতা ও শত্রুতার এক পরিবেশ বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি।

আর সেই কারণেই সকলে মিলে গণতন্ত্র ও সংবিধান সুরক্ষিত রাখার লড়াই করা এবং ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের কবল থেকে ভারতকে মুক্ত করতে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নকে জনপ্রিয় সমাবেশ ও গণ আন্দোলনের মঞ্চ হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা আজ আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সামাজিক ন্যায়ের ওপর আজ বহু দিক থেকে আক্রমণ চলতে দেখছি আমরা। প্রথমত, যে সংবিধান সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিস্বরূপ তা সুব্যবস্থিত হামলার মুখে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক তলে আমরা দেখছি তীব্রতর কর্পোরেট আগ্রাসন যা জনগণের অধিকার ও সংসাধনের সুযোগ লুটে নিচ্ছে।

২০১৪ সালে মোদি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে, এবং আরো বেশি শেষ কয়েক বছরে, সামাজিক ন্যায়ে সুব্যবস্থিত অন্তর্ঘাত চালাতে আমরা দেখছি, এমনকি অতি সীমায়িত অর্থে যে সংরক্ষণের ধারণা ছিল তার ওপরও।

একদিকে আমরা দেখলাম ‘ই ডব্লু এস’ সংরক্ষণ যা সংরক্ষণের সাংবিধানিক ধারণাটিতেই অন্তর্ঘাত চালালো, এবং এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘বিশ্বকর্মা যোজনা’-র মধ্যে দিয়ে মানুষকে পরম্পরাগত জাতভিত্তিক পেশায় আবদ্ধ রাখার অপচেষ্টা।

সুতরাং আমরা একদমই নিশ্চিত যে, লড়াইটা আমাদের লড়তে হবে বিভিন্ন তলে একই সাথে। সংবিধান তার প্রস্তাবনায় সামগ্রিক ন্যায়ের কথা বলেছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়। এবং সামাজিক ন্যায়ের লড়াইকে শক্তিশালী করতে আমাদের অর্থনৈতিক ন্যায় দরকার, রাজনৈতিক ন্যায় দরকার। আম্বেদকর সর্বদাই স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতিকে অবিচ্ছেদ্য সমগ্র হিসেবে জোর দিয়েছেন এবং সমতাকেও হতে হবে একই সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিক।

আজ আমরা যখন অর্থনৈতিক অসাম্য এবং আমাদের নাগরিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের অবক্ষয় ক্রমশ বেড়ে চলতে দেখছি, যখন নাগরিকদের পর্যবসিত করতে চাওয়া হচ্ছে প্রজাতে, যেন আমরা কোনো রাজতন্ত্রে বাস করছি, তখন সামাজিক ন্যায় যে খর্ব হতে থাকবে তা স্বাভাবিক।  আমাদের লড়াইটা হল নাগরিকত্বের সমস্ত রকম অধিকারের ও সমস্ত রকম সাংবিধানিক অধিকারের লড়াই, যাতে আমরা সামাজিক ন্যায়ের জন্য এক উন্নত পরিবেশ ও ভিত্তি পেতে পারি।

আমরা জাত-জনগণনা বা কাস্ট সেন্সাসের দাবি তুলেছি এবং দাবি তুলেছি আরো প্রসারিত সংরক্ষণের। সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রসারন বলতে আমরা বোঝাচ্ছি সংরক্ষণের শতাংশ বৃদ্ধি এবং একই সাথে প্রাইভেট সেক্টরেও সংরক্ষণ চালু করাকে, যাতে সংরক্ষণ প্রকৃতই অর্থবহ হয়ে ওঠে।  কিন্তু সংরক্ষণ নিজে, তা এক অ্যাফার্মেটিভ একশান হওয়া সত্ত্বেও, খুবই সীমিত কার্যকারিতার। যা দরকার তা হল সামাজিক গতিময়তাকে বাড়িয়ে তোলা এবং মানুষের অধিকারের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করা। আমাদের পক্ষ থেকে এটা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে সামাজিক ন্যায়ের লড়াই সামাজিক তলেই লড়া হবে, এবং আমরা নিশ্চিত যে অ-বিজেপি বহুবিধ দলের, বিশেষত সামাজিক ন্যায়, সামাজিক সমতা, নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতি দায়বদ্ধ দলগুলির, একত্রে আসাটা এই লড়াইকে অবশ্যই শক্তিশালী করবে।

শেষে আরেকবার এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের সংগঠকদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমরা নিশ্চিত যে এই সম্মেলনের বার্তা ভারতের জনগণের সমস্ত অংশের কাছেই পৌঁছবে এবং যারা একবিংশ শতকে একধরণের রাজতন্ত্রের পথে মনুস্মৃতির লাইনে ভারতকে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে সেই ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির নাগপাশ থেকে ভারতকে মুক্ত করার স্বপ্ন সফল করতে, সামাজিক ন্যায়ের স্বপ্ন বাস্তব করতে, আমরা পরস্পরের হাত ধরে এগিয়ে যেতে পারব।

আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল্যবোধ ও সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্য পোষণ করি তারা সকলে মিলে এই ধ্বংস, অন্যায় ও বৈষম্যের শক্তিকে পরাস্ত করে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।

সকলকে অনেক ধন্যবাদ।

fascist-militarisation-of-hindutvahindutva-continues-in-up

উত্তরপ্রদেশ বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্য থেকে প্রথম সেরা বাছাই করা ২৭০ জনের একটা অংশকে নিয়োগ করা হচ্ছে আজ ২০ সেপ্টেম্বর থেকে অযোধ্যায় নির্মীয়মান রামমন্দিরের নিরাপত্তার কাজে। এরা ঘিরে থাকবে মন্দিরের লাগোয়া ১০৮ একর এলাকা জুড়ে চত্বর, যে অংশকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘রেড জোন’।

এছাড়া সিআরপিএফ এবং উত্তরপ্রদেশ পুলিশের প্রাদেশিক বাহিনী সশস্ত্র কনস্টেবুলারির বাছাই করা অংশ যেমন রামলালার নির্মীয়মান মন্দিরের মূল এলাকার নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিযুক্ত রয়েছে তেমনটা থাকছেই।

আর, সেইসঙ্গে উত্তরপ্রদেশের সমস্ত হিন্দু ধর্মস্থান ও তার সন্নিহিত এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাজ্যের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী থেকে ঝাড়া-বাছা করে একটা ব্যাচকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য যে, এই বাহিনী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে প্রথম ও প্রধানতম মানদন্ড করা হয়ে থাকবে প্রবল ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি ও সমাজনীতিতে উন্মত্ত জঙ্গী হিন্দুত্বকে। অর্থাৎ ভারতীয় সেনা ও আধা সেনার মধ্যে গোপনে হিন্দুত্বের ফ্যাসিবাদী সামরিকীকরণের যে কাজ, প্রস্তুতি এবং সেকথা কখনো কখনো প্রকাশ্যেও হুঙ্কার দিয়ে চালিয়ে আসার প্রকল্প রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার দৌলতে বিজেপি করতে পারছে, যা কিনা চূড়ান্ত বিচারে ওপরে নানারঙের উর্দি পরা থাকলেও ভেতরে ভেতরে আরএসএস-এর সংঘ বাহিনীর সাম্প্রদায়িক সেনার পরিপূরক ভূমিকাই পালন করায় নিযোজিত থাকবে। এভাবে অযোধ্যায় একদা ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার অন্যতম প্রতীক (যা সামাজিক বহুত্বের ও সহাবস্থানের অধিকার স্বীকৃত) বাবরি মসজিদকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘বিতর্কিত’ করে তুলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ফেলা হয়েছে তিন দশক আগে। আর, সেই স্থানে হিন্দুধর্মরাষ্ট্রের এক প্রতীক নির্মাণের মহড়া শুরু করে দেওয়া হয়েছে আরএসএস সমন্বয়ে পুষ্ট বিজেপির ক্ষমতাসীন যোগীরাজের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে। এই সুবাদে হিন্দুত্বের সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার রূপায়ণের জন্য প্রথম পরীক্ষাগার বানানো হচ্ছে উত্তরপ্রদেশকে।

unemployment-dayacross-the-country

১৭ সেপ্টেম্বর বিপ্লবী যুব অ্যাসোশিয়েশন(আরওয়াইএ) সারা দেশ জুড়ে “জাতীয় বেরোজগার দিবস” কর্মসূচি নিয়েছিল। মশাল মিছিল ও মোদির কুশপুতুল পুড়িয়ে মোদি জমানার তীব্র বেকারত্বকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। দাবি তোলা হয়, মোদি সরকার গত ৯ বছরে কত যুবকে কর্মসংস্থান দিয়েছে তার তালিকা বের করুক। মোদি ক্ষমতায় আসার আগে ঘোষণা করেছিল বছরে ২ লক্ষ যুবক কর্মসংস্থান পাবে। কর্মসংস্থান পাওয়া তো দূরের কথা বরং কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত ক্ষেত্রে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে, কাজের সুযোগ ক্রমাগত সংকুচিত ও অ-নিরাপদ করে দেওয়া হয়েছে। যুবকরা যখন হয়রানির শিকার হয়ে রাস্তায় আন্দোলন করতে লাগলো তখন সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য কেন্দ্র সরকার নতুন এক প্রকল্প আনে “অগ্নিবীর” নামে যার মেয়াদ চার বছর, তারপর ছাঁটাই। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুবকদের একটা বড় অংশ বেকার। তাই বিপ্লবী যুব অ্যাসোশিয়েশন-এর পক্ষ থেকে মোদির জন্ম দিনে “জাতীয় বেরোজগার দিবস” কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। সারা দেশের সাথে এরাজ্যে হুগলি ও পূর্ব বর্ধমান জেলায় কর্মসূচি সংগঠিত হয়।

sanitation-workers-marchworkers-march

“দায়িত্বের থেকে অনেক বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার সময় বলে লোকের অভাব, আর যখন তখন ছাঁটাই করে দেয় অত লোক দরকার নাই বলে!” জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফাই কর্মচারীরা এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে বেশ কিছু বছর ধরে লড়াই চালাচ্ছেন, সংগঠিত হচ্ছেন। দেশ জুড়ে বিভিন্ন পুরসভা, রেলস্টেশন ও ক্যাম্পাস সহ বহু প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে শোষিত ও সামাজিকভাবে নিপীড়িত এই শ্রমিকদের সংগঠিত লড়াই গড়ে তোলা বিশেষ জরুরি।

from-the-constitution

নতুন সংসদ ভবনে প্রবেশের আগে সমস্ত সাংসদদের হাতে যে সংবিধান গ্রন্থটি তুলে দেয় মোদি সরকার সেখানে “ধর্মনিরপেক্ষ” ও “সমাজতান্ত্রিক” শব্দ দুটিকে মুছে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে ভারতকে বর্ণনা করা হয়েছে “সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র” হিসেবে। কিন্তু বিজেপি সরকার ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক শব্দ দুটি বাদ দিয়ে সংবিধান গ্রন্থটি ছেপে সংবিধান বিকৃত করল। বলাই বাহুল্য বিজেপি সমাজতন্ত্র তো বটেই ধর্মনিরপেক্ষতাও চায় না। সংবিধানের সমস্ত মৌলিক দিকের ওপরই হামলা চালাচ্ছে তারা। সংবিধান বর্ণিত সামাজিক ন্যায়ের ধারণাকেও ইতিমধ্যেই খর্ব করতে শুরু করেছে তারা। যেভাবে বিকৃত সংবিধান ছেপে বিতরণ করল তা সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ওপর আরেক নির্লজ্জ হামলা।

central-trade-unions-of-chatkalchatkal-including-aicctu

আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে সংবাদপত্রের একটি খবর দেখলাম যেখানে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার চটকলের ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে বস্তার চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে আমরা আশঙ্কা করছি যে চট শিল্পে বিরাট সংকট ঘনিয়ে আসবে। ‘আইজেএমএ’ও  জানিয়েছে, বোনাস তারা দিতে পারবেন না,  বেতন সংকোচন করবেন, বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হবে এবং এর ফলে উৎসবের মরশুমে গোটা রাজ্যজুড়ে বড় ধরনের অশান্তি সৃষ্টি হবে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে ২.৫ লক্ষ চটকল শ্রমিক এবং ৪০ লক্ষ পাটচাষি ব্যাপকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এই সর্বনাশা সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। আমরা সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন তার তীব্র বিরোধিতা করছি এবং অবিলম্বে দাবি জানাচ্ছি যে বস্তার ক্ষেত্রে খাদ্যশস্যের একশ শতাংশ এবং চিনির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ ব্যবহারের যেন কোনো নড়চড় না হয়। পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে এই ধরনের যে আক্রমণ কেন্দ্রের মোদি সরকার নামিয়েছে, আমরা তার তীব্র বিরোধিতা করছি এবং আগেকার যে সমস্ত অর্ডার এতদিন চলে আসছিল সেটা যেন আবার পুনর্বহাল থাকে। আমরা মনে করছি যে মোদি সরকার এভাবেই আমাদের রাজ্যে আবার একটা অশান্তি সৃষ্টি করার চক্রান্ত করছে। শ্রমজীবী মানুষ, চটকল শ্রমিক, পাটচাষি সকলের উপর যে আক্রমণ নেমে এসেছে, এর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ, শ্রমিক এবং কৃষক সকলকে সমবেত হয়ে বিরোধিতা করতে হবে, প্রয়োজনে আমরা দিল্লি গিয়েও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবো। এর প্রতিবাদে আমরা সর্বস্তরের ব্যাপক বিক্ষোভ প্রতিবাদ সংগঠিত করব।

rail-strike-martyrs-in-kanchraparamartyrs-in-kanchrapara

১৯৬৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর একদিনের রেল ধর্মঘটে ১৫ জন রেল শ্রমিক শহীদ হয়েছিলেন। সেই শহীদদের স্মরণে ইআরইডব্লু এবং এআইআরইসি-র কাঁচরাপাড়া শাখা লোকো গেটে স্মরণসভার আয়োজন করে। সকাল সাড়ে এগারোটায় শহীদ বেদীতে মাল্যদান করে সভার কাজ শুরু হয়। কমরেড রবি সেন তাঁর ভাষণে ১৯৬৮ সালের ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন এবং আজকের দিনে মোদি সরকারের বেসরকারিকরণ ও কর্পোরেটের কাছে দেশকে বিকিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করেই এগিয়ে চলার আবেদন রাখেন। নয়া পেনশন স্কিমের মাধ্যমে শ্রমিক কর্মচারি ও সরকারের অর্থ আদানি আম্বানিদের মতো কর্পোরেট ঘরানার হাতে বাজারে খাটবে। তিনি আরো বলেন দেশজুড়ে এনএমওপিএস এবং এফএএনপিএসআর যে পুরনো পেনশন বহাল করার আন্দোলন করে চলেছে তার ফলেই ৭টি রাজ্যে তা চালু হচ্ছে। আগামী ১ অক্টোবর দিল্লির রামলীলা ময়দানে সর্বস্তরে ওল্ড পেনশন স্কিম চালু করার দাবিতে যে ঐতিহাসিক সমাবেশ হতে চলেছে, সেখানে সকলকে অংশগ্রহণ করার আবেদন রাখেন।

এআইআরইসি-র কাঁচরাপাড়া শাখার পক্ষ থেকে কমরেড অসিত সরকার বলেন, আজ যে বোনাস, মহার্ঘ ভাতা পাওয়া যাচ্ছে তা সবই ১৯৬০, ৬৮, ও ৭৪ সালের লড়াই ও শহীদদের অবদান। আমরা ৭৪ সালের ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের সময়ে সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংসতা দেখেছি। আজ আবার নতুন লড়াইয়ের সময় এসেছে।

ইআরইইউ কাঁচরাপাড়া শাখার পক্ষ থেকে কমরেড উত্তম সাহা বলেন, আজকের দিনে যখন বেসরকারি হাতে রেলকে পৌঁছে দেওয়াই বর্তমান সরকারের মূল এজেন্ডা তখন রেলে চাকরিরত যুবদের যারা এনপিএস-এর আওতায় আছেন তাদেরকেই বেশি বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে নতুন ধরনের সংগ্রাম। তাহলেই এই প্রশাসনিক হামলা থেকে রেলকে তথা সরকারের এই কর্পোরেটাইজেশনকে রোখা সম্ভব, এছাড়াও তিনি বর্তমান অবস্থায় শূন্য পদ পূরণের বিশেষ করে সেফটি ক্যাটাগরিতে শূন্য পদ পূরণের দাবিকে তুলে ধরেন। সকলেই আগামী ১ অক্টোবর দিল্লির জমায়েতকে সফল করার আবেদন রাখেন।

১৯৬৮ সালের রেল ধর্মঘট

১৯৬৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কনফেডারেশন অফ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ, অল ইন্ডিয়া ডিফেন্স ফেডারেশন এবং এআইআরএফ-কে নিয়ে কাউন্সিল অফ জয়েন্ট অ্যাকশন গঠিত হয়, সভাপতি নির্বাচিত হন এম এন যোশি। কমিটির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ১৯ সেপ্টেম্বর ১ দিনের জন্য ধর্মঘটের নোটিশ জমা দেওয়া হয়। ধর্মঘটের দাবিগুল ছিল,

১) মহার্ঘ ভাতা কে বেতন হিসাবে মান্যতা দিতে হবে,         
২) প্রয়োজন ভিত্তিক নূন্যতম বেতন দিতে হবে,         
৩) মূল্যবৃদ্ধির সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে,         
৪) পঞ্চাশ বছরে বাধ্যতামূলক অবসরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

সরকার এসমো জারি করে ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করে। (উল্লেখ্য যে সরকার এই এসমোকেই ১৯৭৪ সালের ধর্মঘট দমন করার জন্য এসমা-তে পাল্টে নেয়, অর্থাৎ অর্ডিন্যান্স টা আইনে পরিবর্তন করে) ধর্মঘটে অংশগ্রহণের জন্য ৬ মাস থেকে ১ বছরের জেল অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা একসাথে উভয় শাস্তি প্রয়োগ হবে — এই ধারা এসমো-তে যুক্ত করা হয়। ধর্মঘট সরকারের নৃশংস আক্রমণের শিকার হয়। পুলিশের আক্রমণে ১৫ জন শহীদ হন। এবং দশ হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, হাজার হাজার কর্মী সাময়িক বরখাস্ত হন। উপযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়াই এই ধর্মঘট শুরু করা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।

প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক বি ভি করোণিক তাঁর “ইন্ডিয়ান লেবার : প্রব্লেমস অ্যান্ড প্রসপেক্টস” বইয়ে উল্লেখ করেন যে ধর্মঘট সংঘটিত করার আকাঙ্ক্ষার তুলনায় ধর্মঘটে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করায় দিকটিই প্রাধান্য মূলক অবস্থানে ছিল।

চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী এনএফআইআর এবং আইএনটিইউসি অনুমোদিত বিভাগীয় সংগঠনগুলি ধর্মঘট ভাঙার সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। রেল বোর্ড এআইআরএফ-এর মান্যতা প্রত্যাহার করে নেয়, যে সমস্ত এআইআরএফ অনুমোদিত সংগঠন ধর্মঘটে যোগ দেয়নি তাদের মান্যতা বজায় থাকে। অবশ্য পরবর্তীতে এআইআরএফ মান্যতা পুনরুদ্ধার করে।

এই ধর্মঘট ১৯৭৪-এর ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের পটভূমিকা তৈরি করেছিল এবং এই ৬৮ সালের ১ দিনের ধর্মঘটের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪-এর ২৯ দিনের ঐতিহাসিক ধর্মঘট সংগঠিত হয়েছিল যা তৎকালীন সরকারের পতনের অন্যতম কারণ হয়েছিল।

১৯৬৮-র ১৯ সেপ্টেম্বর ধর্মঘটের ৯ জন শহীদের তালিকা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন -- (১) পরেশ সান্যাল (উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেল), (২) রমেন আচার্য (উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেল), (৩) কিষেন গোপাল (উত্তর রেল), (৪) লক্ষণ সাহ (উত্তর রেল), (৫) রাজ বাহাদুর (উত্তর রেল), (৬) দেবরাজ (উত্তর রেল), (৭) গুরদীপ সিং (উত্তর রেল), (৮) গামা (উত্তর রেল), (৯) অর্জুন সিং (সিপিডব্লুডি, নয়া দিল্লি)

entered-the-age-of-the-boiling-worldage-of-the-boiling-world

“অতিমারী ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর এবার আমরা প্রবেশ করলাম বৈশ্বিক জলবায়ু মহাসংকটে।” ২৬ জুলাই নিউইয়র্কের একটি ভাষণে জলবায়ু পরিবর্তনের মহাসংকটময় অবস্থা দেখে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরাস বলেছেন, “আমরা এখন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের স্তর পার হয়ে ফুটন্ত বিশ্বের (গ্লোবাল বয়লিং) এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি।” সমগ্র উত্তর গোলার্ধের মাত্রা ছাড়া উষ্ণায়নকে ‘নির্মম গ্রীষ্ম’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন “এটা গোটা গ্রহের জন্য বিরাট মাপের এক বিপর্যয়। আগামী যে দিনগুলো আসতে চলেছে তাতে এবার এত বছরের সব রেকর্ড ভেঙে যাবে। ভয়ঙ্কর এক বিপদের আমরা সম্মুখীন। পৃথিবীর আগামী পরিণতি দুঃখজনক। বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগ শেষ হয়েছে। আমরা এখন প্রবেশ করেছি ফুটন্ত বিশ্বের যুগে।”

এর আগে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’ বলেছিল, এই জুলাই মাসে গোটা ধরিত্রী যেভাবে অগ্নি গোলক হয়ে উঠেছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি। রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ইউরোপের বিভিন্ন আবহাওয়া সংস্থা এর আগেও জানিয়েছে যে বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে আমাদের ধরিত্রী কখনই এতোটা নজীরবিহীন মাত্রায় উষ্ণ হয়ে ওঠেনি। জুলাই মাসে অগ্নিবর্ষী উত্তাপ ইউরোপের নানান প্রান্ত, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকাকে ঝলসে দিয়েছে, দাবানল কানাডা ও দক্ষিণ ইউরোপের বেশ কিছু এলাকাকে করেছে ছাড়খার। প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ জলস্রোত এল নিনোর জন্য এবছর সমুদ্র পৃষ্ঠে তাপমাত্রা বেড়েছে হুহু করে। ক্যালিফর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিতে তাপমাত্রা ছুঁয়েছে ৫৪ ডিগ্রি, চিনের চেংড়ু, ঝিজিয়াং, নানজিং ও ইয়াংঝি নদীর দ্বীপ অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে।

বিগত ছয় দশক ধরে দুনিয়া জুড়ে বিরাট অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের হাত ধরে যেমন বেড়েছে জনসংখ্যা, তেমনই সেই উল্লম্ফনের জন্য বিরাট মূল্য চোকাতে হচ্ছে জলবায়ুকে। এই পর্যায়ে মাথা পিছু বৈশ্বিক জিডিপি একদিকে বেড়েছে তিন গুণ, ঠিক তেমনি এর বিপরীতে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ বৃদ্ধি পেয়েছে চারগুণ!

দীর্ঘদিন ধরে জীবাশ্ম জ্বালানির কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণে রাশ টানতে নানা আন্তর্জাতিক চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও বিশেষ করে ধনী দেশগুলো এ ব্যাপারে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নিচ্ছে না। নতুন সমীক্ষা থেকে উঠে আসা তথ্য দেখাচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু এই সংকটের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দায়ী ৪০ শতাংশ, গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৯ শতাংশ আর সমগ্র বিশ্বের উত্তর ভাগ ৯২ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। আজ থেকে ১৪ বছর আগে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করতে যে পরিমাণ আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আমেরিকা সহ উন্নত দেশগুলো করেছিল, সে পথে তারা পা মাড়ায়নি। এবার দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা হল, ২০৩০-এর মধ্যে পুনর্নবীকরণ যোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকাঠামো এখনকার তুলনায় তিন গুণ বাড়ানো, গ্রিন হাইড্রোজেন ইনোভেশন সেন্টার ও গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্স তৈরি করা যাতে আরও সবুজ জ্বালানির সন্ধান পাওয়া যায়।

অত্যন্ত ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর লাগামছাড়া কার্বন নিঃসরণের ফল জলবায়ুর উপর বিপজ্জনক প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন দেশে খরার প্রকোপ বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠে জলস্তর বেড়ে যাওয়া, বন্যা, বিধ্বংসী ঝড়, সাইক্লোন, আর তার দরুণ ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি, প্রাণহানি — যেমন কিছুদিন আগে দেখা গেল লিবিয়ার মরু শহর ডারনায় বন্যার অভূতপূর্ব থাবা কুড়ি হাজারেরও বেশি জীবন কেড়ে নিল, শহরটা প্রায় মুছে গেল। এই ধরনের বিরাট মাপের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বিভীষিকা আজ পৃথিবীর বুকে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা এগুলোকে “বায়ুমন্ডলীয় উপনিবেশবাদ বা অ্যাটমসফেরিক কলোনাইজেশন” আখ্যা দিয়েছেন। গবেষণালব্ধ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, “দক্ষিণ বিশ্ব থেকে শ্রমশক্তি ও নানান সম্পদ লুন্ঠন করে উত্তর বিশ্ব নিজেদের আর্থিক বিকাশ ঘটাচ্ছে, আর এর সাথে শুধু শ্রম শক্তি ও সম্পদেরই নয়, দক্ষিণ বিশ্বের জলবায়ুকেও প্রবলভাবে দূষিত করে চলেছে, যার ক্ষতিপূরণটুকুও ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশ বা মহাদেশকে দেয়না।” গবেষক হিকেল, যিনি গোল্ডস্মিথ, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেছেন, “যদি বাংলাদেশ জলের তলায় চলে যায়, তবে কে তার জন্য দায়ী? প্রতি তিনটির মধ্যে একটা করে জীববৈচিত্র যদি অবিরাম গতিতে লুপ্ত হতে থাকে তবে কার দিকে আঙুল তোলা হবে? এই সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতির জন্য কারা দেবে ক্ষতিপূরণ?” হিসাব কষে তিনি দেখিয়েছেন, ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের ফলে যে ক্ষয় ক্ষতি হচ্ছে তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাৎসরিক ৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ ধ্বংস করছে, যা ক্ষতিপূরণ হিসাবে তাদের দেওয়া উচিত।

সম্পদ, শক্তি বা এনার্জি ব্যবহার, পণ্য ও পরিষেবা ভোগ করা — এই সমস্ত ক্ষেত্রগুলোতে গোটা বিশ্বজুড়েই উৎকট বৈষম্য নজরে আসে। এমনকি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণও এর বাইরে নেই। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির সর্বশেষ প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বৈশ্বিক সমাজে অতি ধনী সদস্যরা গরিবদের তুলনায় বহুগুণ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ী — নিচুতলার ১ শতাংশের তুলনায় তারা নিঃসরণ করে হাজার গুণ বেশি গ্রিন হাউস গ্যাস। গোটা বিশ্ব জুড়ে একদম উপরের দিকে ১০ শতাংশ নির্গমণকারী দেশগুলো ২০২১-এ সমগ্র কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণের অর্ধেকেরও বেশি নির্গমন করেছে, এদিকে একদম নিচের সারিতে যে দেশগুলো রয়েছে তাদের পরিমাণ মাত্র ০.২ শতাংশ!

entered-the-age-of-the-boiling-world

সমস্ত মহাদেশ জুড়েই রয়েছে এই ১০ শতাংশ নির্গমণকারী দেশগুলো। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ উন্নত অর্থনৈতিক দেশগুলো রয়েছে, যাদের মধ্যে আছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জাপান, কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং চিন। এর পরে রয়েছে মধ্য প্রাচ্য, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দেশগুলোতে আয় বৈষম্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের তফাত আছে জীবন যাপন ও সামাজিক ধারার সমস্ত দিক থেকে। নিচের ১০ শতাংশ নিঃসরণকারী দেশগুলো রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে যেখানে তারা তুলনামূলকভাবে অনেক কম পণ্য পরিষেবার এবং বহু ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যসম্মত রান্না করার বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

সমাজের সবচেয়ে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিত্তশালীরা প্রতি বছর মাথা পিছু ৫৫ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোর তুলনায় ভূতল পরিবহন বেশ উচ্চমাত্রায় কার্বন নিগর্মণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সবচেয়ে বিত্তশালী অংশটি বছরে মাথা পিছু নির্গমণ করে ২৪ টন কার্বন ডাই অক্সাইড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে কম।

জলবায়ু ধর্মঘট :

বিশ্ব জুড়ে এবার ১৫ ও ১৭ সেপ্টেম্বর পালিত হল জলবায়ু ধর্মঘট। এ নিয়ে এই ধর্মঘট ৫ম বার্ষিকীতে পা দিল। সুইডেনের গ্রেটা থানবার্গ আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এই আন্দোলন শুরু করেন। জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেটা ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার গ্রুপ গঠন করে এই আন্দোলন শুরু করেন যা আজ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আন্দোলনে বিশ্বজুড়েই তরুণ প্রজন্মের বিপুল অংশগ্রহণ সবচেয়ে নজর কেড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে লাগাম টানা, জীবাশ্ম জ্বালানির উপর চড়া কার্বন কর আরোপ করা, প্রভৃতি দাবিতে দেশে দেশে প্রতিবাদীরা সোচ্চার হয়েছেন।

ভয়াবহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আজ সমগ্র মানবজাতি। আমাদের ধরিত্রী আজ হয়ে উঠেছে অগ্নিগোলক। নতুন প্রজন্ম অস্তিত্বের সংকটে। যে গুরুত্ব ও গভীরতার সাথে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, সে ব্যাপারে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলি এখনও যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। জলবায়ু রক্ষা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার আন্দোলন শুধুমাত্র পরিবেশ কর্মীদের উপর ছাড়লে চলবে না — এর বিরুদ্ধে দরকার বিরাট মাপের রাজনৈতিক আন্দোলন। আর, নবীন প্রজন্মকেই এই আন্দোলনে নিতে হবে কান্ডারির ভূমিকা।

অতনু চক্রবর্তী


বজবজে উদ্যোগ

গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বজুড়ে জলবায়ু ধর্মঘটকে সফল করতে বজবজে সকাল ও বিকালে বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন হল। বজবজের পিকে হাইস্কুল, গার্লস হাই স্কুল, বজবজ উর্দু স্কুলের ছাত্রী-ছাত্র সহ বজবজ মহেশতলা নেচার স্টাডি সেন্টার, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, বজবজ চলার পথে গণসাংস্কৃতিক সংস্থা এই কর্মসূচি পালন করে।

governor-vs-state-governmentyou-are-a-cat-or-i-am-a-cat

গত কয়েকমাস যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর কর্তৃত্ব নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে লড়াই চলছে তাতে ওই পুরোনো সনাতনী প্রবাদ ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’ মনে পড়ছে, অবশ্য এক্ষেত্রে ভাগের মা, উচ্চশিক্ষা, গঙ্গাযাত্রা করেছে। সারা দেশজুড়েই বিজেপি তাদের রাজ্যপাল দিয়ে অবিজেপি রাজ্য সরকারের কাজে নাক গলাচ্ছে, সে কেরালা, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ যেখানেই হোক না কেন। দিল্লীতে নির্বাচিত সরকারকে মোটামুটি মিউনিসিপ্যালিটির নিম্নস্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেরলে আরিফ খান, তামিলনাড়ুতে সি টি রবি রাজ্য সরকারের বিধানসভায় পাশ করা কোনো বিলেই অনুমোদন দিচ্ছেন না, পশ্চিমবঙ্গেও পূর্বে ধনখড় ও পরে আনন্দ বোস মহাশয় একই রাস্তায় হাঁটছেন।

অন্য রাজ্যের রাজ্য সরকারগুলির তুলনায় এ’রাজ্যের সরকারের সমস্যা কিছুটা ভিন্নতর। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালিত হয় নির্বাচিত কোর্ট-কাউন্সিল, সেনেট-সিন্ডিকেট দ্বারা। সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হন উপাচার্য মহাশয়। এরাজ্যের রাজ্য সরকারের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হন রাজ্যপাল। রাজ্য সরকার সেই আইন পাল্টে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য হিসেবে নিযুক্ত করতে চাইছেন। কিন্তু পূর্বতন ও বর্তমান রাজ্যপাল তাতে স্বাক্ষর করেননি।

আইনমাফিক গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে ও সুপারিশক্রমে আচার্য উপাচার্যকে নিযুক্ত করেন। সার্চ কমিটিতে আচার্যর একজন প্রতিনিধি থাকতেন, একজন ইউজিসি’র প্রতিনিধি থাকতেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি থাকতেন। পরবর্তীতে বর্তমান রাজ্য সরকার ইউজিসি’র প্রতিনিধিকে বাদ দিয়ে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি রাখার বন্দোবস্ত করেন। আদালতের রায়ের ফলে ইউজিসি’র প্রতিনিধিকে রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। রাজ্য সরকারের পছন্দমাফিক উপাচার্য নিয়োগও বাঁধাপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, কারণ ইউজিসি এবং আচার্যের প্রতিনিধি প্রকারান্তরে বিজেপির নিয়ন্ত্রণে থাকবেন। এমতাবস্থায় রাজ্য সরকার অর্ডিনান্স জারি করে উপাচার্য নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটিকে ৫ সদস্যে রূপান্তরিত করে, আচার্যের, ইউজিসি’র, রাজ্য উচ্চশিক্ষা দফতর, রাজ্য উচ্চশিক্ষা পর্ষদ এবং মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি। পরবর্তীতে অর্ডিনান্সের বদলে আইন পেশ করা হয়। ওই আইন বলবত হলে ৫ সদস্যের মধ্যে ৩ জন রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও সেই বিলে রাজ্যপাল সই করেননি। ফলে সার্চ কমিটি গঠন ও উপাচার্য নিয়োগ বিশ বাঁও জলে। ওদিকে রাজ্য সরকার যে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করেছিল, আচার্যের সম্মতি বা নিয়োগ ব্যতিরেকেই, সেগুলি বেআইনি বলে আদালত রায় দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চলছিল উপাচার্য ছাড়াই। প্রথমে আচার্যই উপাচার্য নিয়োগ করবেন রাজ্য সরকারের সাঙ্গে পরামর্শ করে এমনটা ঠিক হয়েছিল। রাজ্যপালের সঙ্গে ভাবভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির রাজ্যপাল তাদের দলের কথা না শুনে অন্য কারুর কথায় চলবেন এমনটা ভাবা অন্যায়। তাছাড়া বয়স হলেও তো রাজ্যপালের একটা ভবিষ্যত আছে। তাই রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের শিক্ষা দফতরের দেওয়া তালিকাকে পাত্তা না দিয়ে নিজে থেকেই এ্যাক্টিং উপাচার্য নিয়োগ শুরু করে দিয়েছেন। সেইসব উপাচার্য যে বিজেপির লোক হবে তা বলাই বাহুল্য। যারা ছিলেন না তাঁরা পদত্যাগও করেছেন। অপরদিকে যাদবপুর বা বর্ধমানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে খোদ আরএসএস শিক্ষা সেলের নেতাদের নিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁদের উপাচার্য হওয়ার নির্ধারিত যোগ্যতা থাক বা নাই থাক।

ইতিমধ্যে রাজ্যপাল, থুড়ি আচার্য মহাশয় ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনিই উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ ওই এক দেশ এক ভাষা এক ধর্ম এক নির্বাচন... ... অনুসরণ করে এক রাজ্য এক আচার্য এক উপাচার্য। তিনিই ছাত্রদের শংসাপত্রে সই করবেন বললেন, এবং ছাত্রদের অভাব অভিযোগ শোনার ও সমাধানের জন্য রাজভবনের দ্বার উন্মুক্ত বলে জানালেন। তার পরেই অবশ্য ধাই ধপাধপ সকাল বিকেল মাঝরাতে গন্ডা গন্ডা উপাচার্য নিযুক্ত করা শুরু হল। প্রাক্তন বিচারপতি, সেনাবাহিনির প্রাক্তন আমলা সমেত আঙুলে কড় গুনে শেষ করা যাবে না এত এত উপাচার্য, সবগুলিই এ্যাক্টিং, নিযুক্ত হয়েছে। এমনকি কারুর কারুর হাতে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিদারি ন্যস্ত হয়েছে, পূর্বে যেমন রাজারা সামন্তদের জাগির বা জমিদারি দিতেন তেমনি আর কী। আচার্য বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাকে তিনি উত্তম করেই তুলবেন। বোঝা যাচ্ছে যে, শিক্ষা প্রশাসনে শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ আচার্যের মতে, শিক্ষা একটি অত্যন্ত অপেশাদারি বিষয়, যেকোনো পেশা থেকে আসা কর্তারাই শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম।

অপর প্রান্তে রয়েছে তৃণমূল শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে যে দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজকতা শুরু করা হয়েছিল তার পরিণাম রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্র ভুগেই চলেছে। যারা শুরুতে তাদের সঙ্গে ছিল তাদের অনেকে ঘাসফুলে পানি না পেয়ে পদ্মফুলে গিয়েছেন। যেমন তৎকালীন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নেতা শঙ্কুদেব বা স্কুল সার্ভিস কমিশনের সভাপতি চিত্তরঞ্জন মন্ডল। অস্থায়ী উপাচার্যের রাস্তাটা রাজ্য সরকারই দেখিয়েছে। স্থায়ী উপাচার্যের পদ খালি হলে সেখানে নিজ দলের নিয়ন্ত্রানাধীন ব্যক্তিকে স্থায়ী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে আচার্যের সঙ্গে দ্বৈরথের সম্ভাবনায় সরকারের শিক্ষা দফতর একতরফাভাবে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করতে থাকে। আচার্য রাজ্যপাল যেমন উপাচার্য পদের জন্য নিয়মবিধি অনুযায়ী যোগ্য অধ্যাপক খুঁজে (?) না পাওয়ায় একই ব্যক্তিকে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করে পদটির গুরুত্বকেই জলাঞ্জলি দিচ্ছেন, তেমনি তৃণমূল সরকারও একই ব্যক্তিকে কলেজের অধ্যক্ষ ও সহ-উপাচার্য করেছিল, একই ব্যক্তিকে অধ্যক্ষ ও উপাচার্য বা উপাচার্য ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের সভাপতি, উপাচার্য ও কলেজ সার্ভিস কমিশনের সভাপতি এরকম অভাবনীয় সব কাজ করেছিল। তাঁবেদার অধ্যাপকদেরই উপাচার্য করতে হবে, যারা অনায়াসে জার্সি বদল করতে পারেন এবং জানেন যে রুটির কোন দিকটায় মাখন লাগানো আছে।

ফলে ঝগড়া বেশ পেঁকে উঠেছে। কোনো রীতিনীতি সভ্যতা ভদ্রতার ধার ধারছে না কেউ। মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বন্ধের হুমকি দিচ্ছেন। জানি না রাজ্যপালের হাতে কোনো তহবিল আছে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য। একথা মনে রাখতে হবে যে, জনগণ যে দলকে নির্বাচিত করেছে তারাই শাসন করে থাকে। মানুষ তার বিরুদ্ধে বলতে পারে, রাস্তায় নামতে পারে। শিক্ষা যৌথ তালিকায় থাকলেও রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মূলত রাজ্য সরকারি টাকায় চলে। ফলে স্বশাসন থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপরে ঘুরপথে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে, যেমন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপরে থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ। যেহেতু সেই সরকার নিরঙ্কুশ ভাবে ক্ষমতাশালী তাই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিজেপি আরএসএসের তাঁবেদার নিয়োগ বহাল তবিয়তে চলছে, কোনো সমস্যা নেই। ইউজিসি’তে জেএনইউ’র কুখ্যাত ভিসি জগদীশ কুমার, বিশ্বভারতীতে নিম্নমানের ভিসি বিদ্যুত চক্রবর্তী, আইআইটি মান্ডির ডিরেক্টর লক্ষ্মীনারায়ণ বেহেরা (যিনি মাংস খাওয়াকে হিমাচল প্রদেশের ভয়ঙ্কর বন্যার জন্য দায়ী করেন বা কোনো ফ্ল্যাটে ভুত আছে বিশ্বাস করে ভুত তাড়াতে যান।) নামগুলি স্মরণ করা যেতে পারে। কিন্তু যাই হোক না কেন, বিজেপিকে যখন রাষ্ট্র (জনগণ!) ক্ষমতায় এনেছে তখন এই অপকর্মগুলি সইতে হচ্ছে। ঠিক তেমনই তৃণমূলকে রাজ্যের মানুষ ক্ষমতায় রেখেছেন তাদের শত অপকর্ম সত্ত্বেও। তৃণমূল একইভাবে বিজেপির মত নিজদলের তাঁবেদার খুঁজছে উপাচার্য পদে নিযুক্ত করার জন্য। অপরদিকে রাজ্যে ভোটে পরাস্ত হলেও বিজেপি-আরএসএস তাদের তস্কর মানসিকতার কারণে পিছনের দরজা দিয়ে রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, যার প্রতিফলন হরেক কেন্দ্রীয় এজেন্সির অতিসক্রিয় কাজে হচ্ছে, এরাজ্যে ও অন্যত্র। ঠিক এভাবেই উচ্চশিক্ষায় রাজ্যপাল তথা আচার্য একটি কেন্দ্রীয় এজেন্সির ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। এই সমস্যার সমাধান কেবলমাত্র স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করার বন্দোবস্ত করেই করা যেতে পারে। বলা হচ্ছে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাবিত নতুন আইনে রাজ্য সরকারের হাতেই উপাচার্য নিযুক্তি ক্ষমতা থাকছে, এবং সেটা সত্যি। কিন্তু বিকল্প তো মনে হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সেই নিয়ন্ত্রণ থাকা যেখানে সার্চ কমিটিতে আচার্য (বিজেপি নিয়োজিত রাজ্যপাল) ও ইউজিসি (কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত)র প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ট হবে। অন্যতর কোনো গণতান্ত্রিক বিকল্প রাজ্য সরকারকেই খুঁজতে হবে। মনে রাখা দরকার আমাদের পছন্দ অপছন্দ যাই থাক না কেন রাজ্য সরকারটি নির্বাচিত সরকার, কিন্তু রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত, তিনি বিজেপি আরএসএসের এজেন্ডা রূপায়িত করতে চাইবেন। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নির্বাচিত রাজ্য সরকারের যদিওবা নিজ এজেন্ডা রূপায়িত করার অধিকার থাকে, নির্বাচনে পরাজিত কেন্দ্রীয় শাসক দলের সেটা থাকতে পারে না।

তবে গত কয়েক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির প্রকাশে ও স্বদলপোষণের কারণে রাজ্য সরকার শিক্ষা প্রশাসনে হস্তক্ষেপের নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে বললেই চলে। সেই দুর্বলতাকেই রাজ্যপালের মতো বিজেপি আরএসএসের তাঁবেদার কাজে লাগাতে চাইছে। সেই তুই বেড়াল আর মুই বেড়ালের ঝগড়া চলছে। শেষে না পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষার ল্যাজের ডগাটাই পড়ে থাকে। এই লেখার দিনটিতে (সেপ্টেম্বর ১০) সুকুমার রায় মারা গিয়েছিলেন। তার সেই ছড়াটি দিয়েই শেষ করি।

খিল্‌‌খিল্লির মুল্লুকেতে থাকত নাকি দুই বেড়াল,       
একটা শুধায় আরেকটাকে, “তুই বেড়াল না মুই বেড়াল?”       
তাই থেকে হয় তর্ক শুরু, চিৎ‌কারে তার ভূত পালায়,       
আঁচড় কামড় চর্কিবাজি ধাঁই চটাপট চড় চালায়       
খাম্‌‌চা খাবল ডাইনে বাঁয়ে হুড়মুড়িয়ে হুলোর মতো,       
উড়ল রোঁয়া চারদিকেতে রাম্-ধুনুরীর তুলোর মতো       
তর্ক যখন শান্ত হল, ক্ষান্ত হল আঁচড় দাগা,       
থাকত দুটো আস্ত বেড়াল, র‌‌ইল দুটো ল্যাজের ডগা।

- অমিত দাশগুপ্ত

manipur-cm-keen-to-punishto-punish-journalists

মণিপুরে বীরেন সিং-এর বিজেপি সরকার কুকি নারীদের যৌন নিগ্ৰহে নিষ্ক্রিয় থেকেছে, কুকি নারীদের লাঞ্ছনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একটুও তৎপরতা দেখায়নি। সেই সরকারই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে কী ভয়ঙ্কর সক্রিয়তার নিদর্শন রাখল। এডিটার্স গিল্ড অব ইন্ডিয়ার কাছে অভিযোগ আসে যে, মণিপুরের সংবাদমাধ্যম নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না, তারা মেইতেইদের দিকে ঝুঁকে একতরফা সংবাদ পরিবেশন করছে। সেনা বাহিনীও রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অসুবিধার মুখে পড়ে অভিযোগ জানায়, সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশন “উত্তেজনা উস্কিয়ে তুলে স্থায়ী শান্তি আসতে দিচ্ছে না।” এই অভিযোগের তদন্ত তাদের দায়িত্ব বিবেচনা করে গিল্ড মণিপুরের সংবাদপত্রগুলোর সংবাদ পরিবেশনের ধরনের তদন্তে তিন সদস্যের এক দল গড়ে দেয়। ঐ দলে যে সাংবাদিকরা ছিলেন তাঁরা হলেন সীমা গুহ, ভরত ভূষণ ও সঞ্জয় কাপুর। গিল্ডের এই সাংবাদিকরা মণিপুর ঘুরে এবং হিংসার শিকার আর রাষ্ট্রীয় ও মেইতেই সশস্ত্র বাহিনীর পীড়নকে প্রত্যক্ষ করা মানুষদের সাথে কথা বলে গত ২ সেপ্টেম্বর ২৪ পাতার এক রিপোর্ট প্রকাশ করেন। ঐ রিপোর্টে বলা হয়, ইম্ফল ভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলো নিজেদের “মেইতেই মিডিয়া”তে রূপান্তরিত করেছে এবং “পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট” প্রকাশ করেছে, এবং তার উদ্দেশ্য হল মেইতেইদের পক্ষে এক অভিন্ন জাতিগত ভাষ্য তৈরি করা। সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত রিপোর্টে সেনা সংগঠনগুলোর গায়েও কালি ছেটানো হয়, বিশেষভাবে আসাম রাইফেলস-এর বিরুদ্ধে চালানো হয় “লাগাতার প্রচার”। রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর চুড়াচাঁদপুর, কাংপোকপি ও টেংনৌপল-এর মতো কুকি অধ্যুষিত জেলাগুলো থেকে সরেজমিন রিপোর্ট আসা বন্ধ হয়ে গেছে। গিল্ডের রিপোর্টে ইম্ফল থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের ১০টা রিপোর্টকে নির্দিষ্ট করে দেখানো হয়, সেগুলোতে ভুয়ো সংবাদ পরিবেশন করা এবং বিকৃত তথ্য ছড়ানো হয়েছে। মণিপুরের মিডিয়া পরিবেশিত সংবাদকে কটাক্ষ করে বলা হয়, “এখন সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, ভুয়ো সংবাদের মাধ্যমে জাতিগত বিভেদ গভীরতর হয়ে উঠেছে, যে সংবাদের স্থান হয় একমাত্র ইম্ফল মিডিয়াতেই।” গিল্ডের এই রিপোর্টের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়, “গিল্ড পুনরায় এটা বলতে চায় যে এই রিপোর্টের মূল লক্ষ্য হলো এই ধরনের সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মিডিয়াকে তার আচরণ সম্পর্কে আত্মবিশ্লেষণে ও বিবেচনায় সক্ষম করে তোলা।” রিপোর্টে বিজেপিপন্থী মিডিয়া এবং বীরেন সিং সরকারের গ্লানিকর ভূমিকার দিকে আঙুল তোলা হয় বলে বীরেন সিং সরকার গিল্ডের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ পদক্ষেপ গ্রহণে উঠেপড়ে লাগে। প্রসঙ্গত, গোদি মিডিয়া এখন একটা সর্বভারতীয় পরিঘটনা এবং মণিপুরে তার অস্তিত্ব থাকবে না এমন ভাবার কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না।

বিজেপি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা তাদের পছন্দের একটা কৌশল এ ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করল, এনগাঙ্গম শরৎ সিং ও সরোখাইবাম থৌবাল সঙ্গীতা নামে দুই ব্যক্তিকে দিয়ে গিল্ডের রিপোর্টের বিরুদ্ধে দায়ের করালো অভিযোগ। অভিযোগগুলোতে বলা হল, মণিপুরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই গিল্ডের রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। সম্প্রদায়গত আবেগ উস্কিয়ে তোলাও ঐ রিপোর্টের উদ্দেশ্য। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং নিজেও বললেন গিল্ডের রিপোর্ট “পক্ষপাতদুষ্ট, বানানো এবং কারো কথায় তৈরি।” আরও বললেন, “ওরা (সাংবাদিকরা) রাষ্ট্র-বিরোধী, দেশদ্রোহী এবং সরকার-বিরোধী, ওরা এসেছিল বিদ্বেষ ঢালতে। আগে জানলে ওদের ঢোকার অনুমতিই দিতাম না।” অভিযোগ জানানোর সঙ্গে-সঙ্গেই তিন সাংবাদিক এবং গিল্ডের সভাপতি সীমা মুস্তাফার বিরুদ্ধে দুটো এফআইআর দায়ের হলো। গিল্ড ও তার সাংবাদিকদের শিক্ষা দিতে, তাদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নিতে নিজের তৎপরতায় কোনো খামতি বীরেন সিং রাখলেন না। তবে গিল্ডের পক্ষে দ্রুতই সুপ্রিম কোর্টে এফআইআর-এর বিরুদ্ধে আবেদন জানানো হলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ শুনানির সময় দুই অভিযোগকারীর আইনজীবী গুরু কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখলেন, “আমাদের বলুন তাদের রিপোর্ট থেকে এই অভিযোগগুলো কী ভাবে প্রমাণ হচ্ছে।… যে অপরাধ ঘটেইনি, তা নিয়ে এফআইআর হয়ে গেল।” গিল্ডের পক্ষে আইনজীবী শ্যাম ডিভান বিচারপতিদের জানালেন, “বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরির পরিবর্তে তাদের সম্প্রদায়ের (মেইতেইদের) মতামত প্রচারের জন্য সাংবাদিকদের ওপর প্রভূত চাপ রয়েছে।” বিচারপতিরা মণিপুর সরকারকে দু-সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দিয়ে বলতে বলেছেন, কেন গিল্ডের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ও দায়ের করা এফআইআর বাতিল করা হবে না। আর এই দু-সপ্তাহ সরকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনও দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে না বলেও বিচারপতিরা নির্দেশ দিয়েছেন।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের সাথে মেরুকরণকেও আরও তীব্র করে তোলা হতে থাকল। মণিপুরে মেরুকরণ এতটাই পূর্ণ যে ইম্ফল উপত্যকা ও সংলগ্ন অঞ্চলের বাইরে মেইতেইদের সন্ধান পাওয়া যাবে না, আর কুকিদেরও অবস্থান একমাত্র পার্বত্য জেলাগুলোতেই। এরপরও ইম্ফল উপত্যকায় কোনো কুকির সন্ধান পাওয়া গেলে সরকারের বাহিনীই তাদের স্থানান্তরিত করে পার্বত্য জেলাগুলোতে, যেমনটা করল গত ২ সেপ্টেম্বর। প্রবল হানাহানি এবং মেইতেইদের সম্ভাব্য হামলার মধ্যেও দশটা কুকি পরিবার ইম্ফলের নিউ লাম্বুলেন ছেড়ে যাননি, চরম বিপদ সংকেতকে উপেক্ষা করে এবং অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে উপত্যকা অঞ্চলেই থাকছিলেন। কিন্তু গত ২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হল পার্বত্য জেলা কাংপোকপির মটরবাঙে। ঐ দশটা পরিবারে ছিল ২৪ জন সদস্য। তাদেরই একজন, কুকি স্বেচ্ছাসেবক এস প্রিম ভাইপেই জানিয়েছেন, “আমাদের ২৪ জনকে জিনিসপত্র গোছগাছের সময়টুকু পর্যন্ত দেওয়া হলো না, এবং যে জামাকাপড় পরেছিলাম সেগুলো গায়ে থাকা অবস্থাতেই গরু খেদানো করে গাড়িতে তুলে দেওয়া হল।”

এরই পাশাপাশি ডবল ইঞ্জিন সরকারের মদতে চলে কুকিদের বসবাসের পার্বত্য জেলাগুলোতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। যার একটা নিদর্শন দেখা গেল গত ১২ সেপ্টেম্বর, যেদিন সকালে সশস্ত্র মেইতেই জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হলো তিন কুকি গ্রামবাসী। এক অসুস্থ কুকি ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য জিপসিতে করে গ্রাম থেকে পার্বত্য জেলা কাংপোকপির সদরে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল আরও দুই কুকি। পশ্চিম ইম্ফল এবং কাংপোকপি জেলার সীমানা থেকে তিন কিলোমিটার ভিতরে গ্রামের মধ্যে এই হামলা চালানো হয়। নয়জন হামলাকারীর পরনে ছিল মণিপুর পুলিশের উর্দি এবং তারা ছিল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত। বাফার জোন বা সংঘাত প্রবণ দুই এলাকার মাঝের নিরপেক্ষ বা অসামরিক চরিত্রের অঞ্চল পেরিয়ে মেইতেই জঙ্গিরা পার্বত্য এলাকার ভিতরে ঢুকল কী করে তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। এই বাফার জোন পাহারা দেয় সেনা বাহিনী, এবং কোথাও-কোথাও মণিপুর পুলিশ। সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ জানাচ্ছে, যে পুলিশ বাহিনীতে এখন মেইতেই ছাড়া অন্য কোনো সম্প্রদায়ের লোকজনের অস্তিত্ব বিরল, সেই বাহিনীর সহায়তা ছাড়া মেইতেই জঙ্গিদের পার্বত্য অঞ্চলে ঢোকা সম্ভব ছিল না। হামলার এই রকম আরও দুটো উদ্যোগ মেইতেইরা নিয়েছিল গত ৬ ও ৮ সেপ্টেম্বর। সে সময় সেনারা তাদের বাধা দিয়েছিল এবং সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েকজন মারাও গিয়েছিল।

কিন্তু নিপীড়নের এই পদক্ষেপগুলোকে চেপে রাখা যায় না, এবং সেগুলো সারা বিশ্বেই চাউর হয়। জুলাই মাসের মাঝামাঝি মোদীর ফ্রান্স সফরের সময় ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট স্ট্রাসবুর্গের সভায় মণিপুরে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে প্রস্তাব গ্ৰহণ করে জাতিগত ও ধর্মীয় হিংসা অবিলম্বে বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। সম্প্রতি আবার রাষ্ট্রপুঞ্জের ১৮ জন বিশেষজ্ঞ মণিপুরের পরিস্থিতি সম্পর্কে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, “সব বয়সের, বিশেষভাবে কুকি সংখ্যালঘু জাতির শত-শত নারী ও বালিকাদের নিশানা বানানো লিঙ্গ ভিত্তিক হিংসার রিপোর্ট ও ছবি আমাদের মর্মাহত করেছে। বিবৃত হিংসাগুলোর মধ্যে রয়েছে গণধর্ষণ, নারীদের নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটানো, প্রবল প্রহারে ঘটানো মৃত্যু, এবং তাদের জীবন্ত অবস্থায় দগ্ধ করা বা পুড়িয়ে মারা।” এই বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার বলেছে এই ধরনের মন্তব্য “অসমর্থনীয়, অনুমান সাপেক্ষ এবং বিভ্রান্তিজনক।” কিন্তু বিবৃতি দিয়েই কি সত্যকে চাপা দেওয়া যায়? রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষজ্ঞদের বিবৃতির শেষে এই আশা পোষণ করা হয়েছে যে, যে সরকারি কর্তাব্যক্তিরা মণিপুরের ন্যক্কারজনক পরিস্থিতিতে ইন্ধন জুগিয়েছেন, পরিস্থিতিকে অরাজকতার দিকে নিয়ে গেছেন, তাদের দায়বদ্ধ করা হবে। মণিপুরের বাস্তব পরিস্থিতি কি এই প্রত্যাশা পূরণের অনুকূল? নরেন্দ্র মোদী কি এখনও মণিপুর সফরকে পরিহার করে চলবেন, পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তুলতে কোনো সক্রিয়তা দেখাবেন না? জি-২০ বৈঠকে বিদেশী রাষ্ট্রনায়কদের সামনে গণতন্ত্রের বড়াই কি আদৌ বিশ্বাস উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে? আর তা যদি না হয়ে থাকে তবে ‘গণতন্ত্রের জননীর’ সন্তানেরা পরিস্থিতির বিপন্নতায় শুধুই বিলাপ করবেন না, তাকে পাল্টাতেও প্রণোদিত হবেন।

- জয়দীপ মিত্র

less-discussed-aspects-of-the-cagthe-cag-report

ইতিমধ্যেই আমাদের সামনে ক্যাগ রিপোর্ট এসেছে, সেখানে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির কথা আমরা জেনেছি। টাকার অঙ্কটা বিশাল — সাড়ে সাত লক্ষ কোটি! রাস্তাঘাট তৈরি, বা অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি। এই লেখার বিষয় সেগুলো নয়, বরং আরো যেসব বিষয় উঠে এসেছে ক্যাগের রিপোর্টে সেগুলি। আশা করি এখান থেকে বিজেপি সরকারের এই আর্থিক দুর্নীতি তথা ক্যাগ রিপোর্টের অন্তর্নিহিত ভয়াবহতা সম্পর্কে আরো একটু স্পষ্ট ধারণা হবে।

ক্যাগের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আয়ুষ্মান ভারত (প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা) প্রকল্পের প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ উপভোক্তার নাম একটাইমাত্র মোবাইল নাম্বারে নথিবদ্ধ ‘৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯’। সঠিক করে বললে সংখ্যাটা ৭,৪৯,৮২০ জন। এবং এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এরকম উদাহরণ আরও আছে। ১.৩৯ লক্ষ থেকে বেশি সংখ্যক উপভোক্তার নাম নথিবদ্ধ আছে ‘৮৮৮৮৮৮৮৮৮৮’ মোবাইল নম্বরের সাথে। ৯৬,০০০ সংখ্যক উপভোক্তার নামের সাথে আছে ‘৯০০০০০০০০০’ মোবাইল নম্বর। স্কুলে বাংলার শিক্ষা পোর্টালে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক স্টুডেন্টের মোবাইল নম্বর নেই, কিন্তু মোবাইল নম্বরের ফিল্ডটা যেহেতু ম্যানডেটরি, তাই যাখুশি নম্বর একটা না দিলে হয়না। কিন্তু তা বলে লাখ লাখ লোকের! এছাড়াও ক্যাগের রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে এরকম আরও ২০টা নম্বরে ১০,০০০ থেকে ৫০,০০০ উপভোক্তার নাম নথিবদ্ধ করা আছে। ক্যাগ তাদের রিপোর্টে এটাও উল্লেখ করেছে যে এই প্রকল্পে মোবাইল নম্বরের গুরুত্ব কতখানি। যদি কেউ তার পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলে, তাহলে তা পুনরায় ইস্যু করার জন্য মোবাইল ফোন নম্বরই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

ক্যাগ রিপোর্টে বলেছে যে ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি তার এই পর্যবেক্ষণ মেনে নিয়েছে এবং বলেছে যে এইসব অসংগতি পরেরবার যখন বেনিফিশিয়ারি আইডেনটিফিকেশন সিষ্টেম ২.০ চালু করা হবে, তার মধ্যে মিটিয়ে ফেলা হবে। যদিও সেটা কীভাবে সম্ভব কেউ জানে না। হেলথ অথরিটির কথায়, “বিআইএস ২.০ ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পরিবার ছাড়া আর কেউ একই মোবাইল নম্বর ব্যবহার করতে না পারে।”

ক্যাগের ওই রিপোর্টেই পর্যবেক্ষণ রয়েছে যে কয়েক হাজার পরিবারের ক্ষেত্রে অবাস্তব সদস্যসংখ্যা দেখানো হয়েছে। ৪৩,১৯৭টা পরিবারের সদস্যসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১১ থেকে ২০১ জনের মধ্যে। এই ক্ষেত্রেও ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি ক্যাগের এই পর্যবেক্ষণকে মেনে নিয়েছে। তারা বলেছে যে তারা এমন একটা নীতি তৈরি করছে যাতে ডাটাবেসে একটা পরিবারের সর্বোচ্চ সদস্যসংখ্যা কোনোমতেই উপভোক্তা কোনো পরিবারের ক্ষেত্রে ১৫ জনের বেশি সদস্যকে যুক্ত হতে দেবে না।

ক্যাগ তার রিপোর্টে দেখিয়েছে যে ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামে ২০১৭ থেকে ২০২১’র মধ্যে ২,১০৩ জন এমন ব্যক্তিকে পেনশন দেওয়া হয়েছে যারা মৃত। এই ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম হল এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা বৃদ্ধ, বিধবা আর প্রতিবন্ধীদের পেনশন দেওয়া হয়। রিপোর্টে আরো দেখানো হয়েছে যে এই যে ব্যক্তিরা মারা গেছেন, সেই মারা যাওয়ার ঘটনা সময়মত সেই সেই অঞ্চলের পঞ্চায়েত বা পৌরসভা রিপোর্ট করেনি। এই তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নাম (৪৫৩ জন)। তারপর গুজরাত (৪১৩ জন), আর তারপর ত্রিপুরা (২৫০ জন)।

আয়ুষ্মান ভারত (প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা) প্রকল্প চালু হয় ২০১৮ সালে। এই প্রকল্পে এখনো পর্যন্ত মোট ৬.৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এমন ৩,৪৪৬ জন রোগীর পেছনে, যারা আগেই মৃত ঘোষিত। ক্যাগের রিপোর্টে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। এই আয়ুষ্মান ভারত বা পিএমজেএওয়াই হল এমন একটা প্রকল্প যেটা তৈরি করা হয়েছিল একটা ফ্ল্যাগশিপ স্কিম হিসাবে। এটা প্রকৃতপক্ষে গরিব মানুষদের জন্য পরিবার পিছু বছরে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত একটা সরকারি হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রকল্প। এই প্রকল্পের পারফরম্যান্স অডিট করার সময় ক্যাগ নজরে এনেছে যে এর ট্রান্সঅ্যাকশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে আগেই যাদের মৃত হিসাবে দেখানো হয়েছিল, তারা নিয়মিত এই প্রকল্পের আওতায় চিকিৎসা পেয়ে এসেছে। এবং এমন ক্লেইমের সংখ্যা ৩,৯০৩টা, যা কিনা মোট ৩,৪৪৬টা পরিবারের। এই রিপোর্ট অনুযায়ী এই মৃত রোগীর সংখ্যা কেরালাতে সবচেয়ে বেশি, ৯৬৬ জন। এরজন্য সেখানে ব্যয় হয়েছে ২.৬০ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে মধ্যপ্রদেশ। সেখানে এমন পরিবারের সংখ্যা ৪০৩। সেখানে খরচ দেখানো হয়েছে ১.১২ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে ছত্তিসগড়। সেখানে সংখ্যাগুলো যথাক্রমে ৩৬৫টা ও ৩৩.৭০ লক্ষ টাকা।

ক্যাগের মত অনুযায়ী তারা ২০২০ সালেই ন্যাশনাল হেল্থ অথরিটিকে মৃত রোগী রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টা জানিয়েছিল। এনএইচএ বা ন্যাশনাল হেল্থ অথরিটি ক্যাগের এই বক্তব্য মেনে নিয়ে বলেছে যে, ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল তারা এই ব্যপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেছে এবং এটা নিশ্চিত করেছে যাতে মৃত কোন ব্যক্তির আইডি সিস্টেমে অকার্যকর করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও মৃত হিসাবে চিহ্নিত আইডিগুলোয় কিভাবে টাকা ঢুকেছে সেটা নিয়ে ক্যাগ আলাদা করে মন্তব্য করেছে। তারা তাদের রিপোর্টে দেখিয়েছে যে এনএইচএ ২০২২’র আগস্ট মাসে ‘অপারেশনাল রিজন’ দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তির জন্য ব্যাকডেটকে মান্যতা দিয়েছে।

ক্যাগের রিপোর্ট থেকে আরো একটা ভয়ানক তথ্য উঠে এসেছে — কেন্দ্র ২.৩৮ কোটি টাকার তহবিল নিজের নানা উদ্যোগের প্রচারে ব্যয় করে ফেলেছে। এই ২.৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল নানা পেনশন প্রকল্পের জন্য। ২০১৭ সালে দুই ভাগে, জুন আর আগস্ট মাসে এই খরচ করা হয়েছে। ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১’র পারফরম্যান্স অডিট রিপোর্টে এই তথ্য সামনে এসেছে।

এই ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় রয়েছে তিনটে পেনশন প্রকল্প — একটা বয়স্ক নাগরিকদের জন্য, একটা প্রতিবন্ধীদের জন্য, আর আরেকটা বিধবাদের জন্য। এছাড়াও আরো দুটো প্রকল্প রয়েছে এই প্রোগ্রামের আওতায় — যার একটা বৃদ্ধদের খাদ্যসুরক্ষা প্রদান করার জন্য, আরেকটা যদি কোনো পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু হয়, সেই পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য।

ক্যাগের রিপোর্টের বক্তব্য অনুযায়ী, “এই প্রোগ্রামের প্রশাসনিক ব্যয়ের জন্য একটা রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ ছিল তহবিলের সর্বমোট ৩ শতাংশ অংশ। অডিট করার সময় ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের তহবিল থেকেও (অর্থাৎ এই ৩ শতাংশের বাইরে) টাকা অন্য খাতে ব্যয় করার উদাহরণ পাওয়া গেছে।” 

ক্যাগের পাওয়া তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক নানা পেনশন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ টাকা থেকে ৩৯.১৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছে শুধুমাত্র এই মন্ত্রকের নানারকম পাবলিসিটি ক্যাম্পেনের প্রচার বাবদ। একইভাবে ২০১৭’র আগস্টে এই তহবিল থেকে ২.৪৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল একদিকে ‘গ্রাম সমৃদ্ধি’, ‘স্বচ্ছ ভারত পাখওয়ারা’ প্রভৃতির প্রচারের জন্য, অন্যদিকে এই মন্ত্রকের আরো নানান স্কিম, প্রকল্প ইত্যাদির প্রচারের জন্য ১৯টা রাজ্যের প্রত্যেকটা জেলায় ৫টা করে হোর্ডিং দেওয়ার জন্য।

ক্যাগের এই রিপোর্টে আরো উল্লেখ রয়েছে যে, এই যে এত এত টাকা তহবিল থেকে সরানো হয়েছে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের জন্য, তার বরাত দেওয়া হয়েছিল ডাইরেক্টরেট অফ অ্যাডভার্টাইজিং অ্যাণ্ড ভিজ্যুয়াল পাব্লিসিটি ‘ডিএভিপি’কে। কিন্তু সেই বরাত বা ওয়ার্ক অর্ডারে ন্যাশনাল সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের উল্লেখমাত্র ছিল না। শুধুমাত্র উল্লেখ ছিল ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনা’ আর ‘দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রামীণ কৌশল্যা যোজনা’র।

এছাড়াও ক্যাগ তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, ডিএভিপি’র এই ক্যাম্পেনগুলো মন্ত্রককে বিস্তারিত সব জানিয়ে করার কথা। কিন্তু শেষপর্যন্ত কর্ম সম্পাদন বা ওয়ার্ক এক্সিকিউশনের কনফারমেশন ছাড়াই ডিএভিপি’কে টাকা দেওয়া হয় মন্ত্রকের তরফ থেকে।

অডিটরের প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রক ডিসেম্বর মাসে জানায় যে এই বিষয়টা দেখার জন্য তারা তাদের তথ্য, সম্প্রচার ও শিক্ষা বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে।

- সুমন্ত নারায়ন, স্কুল শিক্ষক ও আন্দোলনকর্মী

repeal-of-amended-forest-conservation-act

forest-conservation-act

বনভূমিতে বাস করা জনগণের কাছে ২০২৩ সাল হাজির হয়েছে ২০০৬-এর তুলনায় অনেক ফারাক নিয়ে। ইউপিএ জমানায় ২০০৬ সালে তৈরি বনাধিকার আইনের বলে বনবাসীরা নিজেদের বনভূমিকে সুরক্ষিত রাখতে ও তার তত্ত্বাবধান করতে পারতেন, কাঠ ছাড়া বনে উৎপাদিত অন্যান্য দ্রব্যসমূহ সংগ্ৰহ করে নিজেদের প্রয়োজনে লাগাতে এমনকি বিক্রি করতেও পারতেন, বনভূমিতে পশু চরাতে পারতেন এবং সেখানের জলাশয়গুলিকে ব্যবহারের অধিকারও তাঁদের ছিল। এই আইনের বলেই বনভূমিতে শিল্প স্থাপনের জন্য গ্রামসভার সম্মতি অপরিহার্য ছিল, এবং প্রকৃতির সুরক্ষায় সরকার ও কর্পোরেট প্রস্তাবিত শিল্প প্রকল্পকে বাতিল করার ক্ষমতাও গ্রামসভার ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বন সংরক্ষণ আইনে আনা মোদী সরকারের সংশোধনী বনভূমিতে শিল্প স্থাপনে গ্রামসভার সম্মতিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাকচ করেছে, বনভূমি হাতানোর কর্পোরেট অভিপ্রায়ের সিদ্ধিকে অনেক অনায়াস করেছে, ‘উন্নয়ন’-এর নামে প্রকৃতি ধ্বংসের পথকেও প্রশস্ত করা হয়েছে। সংশোধিত আইনে বন বলে বিজ্ঞাপিত নয় এমন বনভূমিকে (যেগুলোর পরিমাণ মোট বনভূমির তিন চতুর্থাংশ) লিজ দেওয়ার জন্য গ্রামসভার সম্মতি এখন পরিহার্য। অথচ, ২০০৬ সালের আইনই নির্দিষ্ট পরিবেশে শিল্প স্থাপনের যুক্তিসিদ্ধতা নির্ধারণের অধিকার বনাঞ্চলের গ্রামবাসীদের দিয়েছিল, এই ক্ষমতার বলেই তাঁরা বেদান্তর মতো সরকার ঘনিষ্ঠ অতীব ক্ষমতাশালী কর্পোরেটকে নিয়ামগিরি পাহাড়ে বক্সাইট খনন প্রকল্প স্থাপন থেকে দীর্ঘদিন দূরে রাখতে পেরেছিলেন, প্রকৃতিকে বিপর্যস্ত হতে না দেওয়ার লক্ষ্য পূরণে কর্পোরেটদের মতো ক্ষমতাশালী সংস্থার সঙ্গে লড়াইয়ের আইনি সামর্থ্য তাঁরা পেয়েছিলেন।

যে ওড়িশায় বনবাসীদের বেদান্ত-বিরোধী ঐতিহাসিক লড়াই দেখা গিয়েছিল সেই ওড়িশাতেই এখন সংশোধিত বন সংরক্ষণ আইনের বলে বনাঞ্চল সংলগ্ন গ্রামবাসীদের মতামত উপেক্ষা করে সরকার ঘনিষ্ঠ করপোরেটদের লিজ দেওয়া হচ্ছে বনভূমি। বক্সাইট খননের জন্য আদানিদের লিজ দেওয়া হয়েছে রায়গড়া ও কালাহান্ডি জেলার মধ্যবর্তী কুটরুমালি পর্বত, বেদান্ত গোষ্ঠী পাচ্ছে রায়গড়া জেলার সিজমালি পার্বত্য অঞ্চল, আর হিন্দালকো গোষ্ঠীর বক্সাইট খনন প্রকল্প হচ্ছে কোরাপুট জেলার পতঙ্গ ব্লকের মালিপর্বত এলাকায়। এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন হলে নিজেদের বসবাসের জমি থেকে উচ্ছেদের এবং জীবনধারণের উপায় থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা যেমন অনিবার্য, সেরকমই অমোঘ হলো যে প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের আত্মিক সম্পর্ক তার ধ্বংসের অবশ্যম্ভাবিতা। তাঁরা তাই দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রকল্পগুলোর বিরোধিতায়, সেগুলির প্রতিরোধে সক্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাগুলো যেমন কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারেরই মদত পেয়ে থাকে, তেমনি তারা প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত জনগণের বিরুদ্ধে ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনীকেও লাগায়। এই গুণ্ডাবাহিনী বেশ কয়েকজন প্রকল্প-বিরোধী আন্দোলনকারীকে অপহরণ করেছে। এরা আবার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে পুলিশকে, এবং পুলিশও তাদের কথায় আন্দোলনকারীদের ও আন্দোলনের নেতৃবর্গকে গ্রেপ্তার করে। গত তিন সপ্তাহে পুলিশ অন্তত ২৫ জন প্রতিবাদী জনগণকে গ্রেপ্তার করেছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর সোমবার জনজাতি অধিকার সংগঠন প্রকল্পগুলো এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে দেওয়া লিজ বাতিল করার দাবি জানায়, এবং প্রতিবাদকারী যুবকদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন বন্ধে সোচ্চার হয়। বনবাসীদের সংগঠন মূলনিবাসি সমাজসেবক সংঘ দিল্লীতে সাংবাদিক সম্মেলন করে সংশোধিত আইন প্রত্যাহারের দাবি তোলে। মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী ও আইনজীবী বিশ্বপ্রিয় কানুনগো দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে জানিয়েছেন, “৯৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যার চেষ্টার মামলা রুজু হয়েছে এবং আরও ২০০ জন নাম অনুল্লেখিত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে।” গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৯ জনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছে দানবীয় আইন ইউএপিএ। প্রতিবাদকারী জনগণের বিরুদ্ধে নিপীড়নের এক শঙ্কাজনক নিদর্শন দেখা গেল গত ২৬ আগস্ট। সেদিন সাদা পোশাক পরিহিত কয়েকজন মোটরবাইকে এসে কোরাপুটের মালি পর্বত সুরক্ষা সমিতির দুই কর্মকর্তা অভি সোডি ও দাস খাড়াকে তুলে নিয়ে যায়। কালাহান্ডি জেলার নিয়ামগিরি এবং রায়গড়া জেলার সিজমালি ও কুটরুমালি এলাকাতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে ৫ ও ১৬ আগস্ট। যারা এইভাবে তুলে নিয়ে যায় তাদের সাদা পোশাকের পুলিশ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। পুলিশ হোক বা করপোরেটদের লাগানো দুর্বৃত্তই হোক, এটা যে সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে চালোনো নির্ভেজাল নিপীড়ন তা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না।

amended-forest-conservation-act

ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক সরকার এনডিএ ঘেঁষা এবং মোদী সরকারের কর্পোরেটপন্থী নীতিমালার অনুগামী। কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষায় নবীন পট্টনায়ক সমস্ত ধরনের সহায়তা জুগিয়ে থাকেন। মূলনিবাসি সমাজ সংঘের নেতা মধু অভিযোগ করেছেন– ওড়িশা সরকার আদানি ও বেদান্ত গোষ্ঠীকে বক্সাইট খননের বনজমি লিজ দেয় এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। বন আইন তখনও সংশোধিত হয়নি। আইন সংশোধনের আভাস তিনি সম্ভবত পেয়েছিলেন, আর তাই এই বেআইনি কাজটা করতে, গ্রামসভার সম্মতি না নিয়েই জমি লিজ দিতে তিনি একটুও দ্বিধা করেননি। মধু আরও জানিয়েছেন, আদানি ও বেদান্তর খনি প্রকল্পের বাস্তবায়নে ১৮০টা গ্রাম অস্তিত্বহীন হবে এবং ২ লক্ষ জনগণ বাস্তুচ্যুত হবেন।

বনাঞ্চলে খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের বিরোধিতা ও তাদের দাবিগুলো সম্পর্কে ওড়িশার ইস্পাত ও খনি মন্ত্রী প্রফুল্ল কুমার মালিককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমরা ওদের দাবিগুলো সম্পর্কে অবহিত নাই। ওরা দাবিগুলো তুলে ধরলে আমরা বিবেচনা করব।” নবীন পট্টনায়ক সরকার প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন নামিয়েছে, বেশ কিছু আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধেও হত্যার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে, কারো-কারো বিরুদ্ধে ইউএপিএ পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়েছে। এর পরও মন্ত্রী যখন বলেন যে তিনি আন্দোলনরত জনগণের দাবি সম্পর্কে অবগত নন, তখন তাঁর মন্তব্যের সত্যতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। এবং ওড়িশা সরকার যে মাত্রায় কর্পোরেটদের মদত জোগাচ্ছে তাতে তাঁদের বিবেচনা কতটা প্রতিবাদকারী জনগণের স্বার্থের অনুকূল হবে তা যে কেউই অনুমান করে নিতে পারবেন।

ওড়িশার বনাঞ্চলে বসবাসকারী গ্রামবাসীরা দীর্ঘদিন ধরেই সরকার-কর্পোরেট যৌথ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন নামাতে সরকার তাঁদের কখনও ‘মাওবাদী’, কখনও বা ‘উন্নয়ন বিরোধী’ বলে ছাপ মেরে দেয়। এই দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রক্রিয়াতেই নিয়ামগিরি সুরক্ষা সমিতির সভাপতি লাড়া সিককা ২০১৮র এপ্রিলে বলেছিলেন, “বলা হচ্ছে যে আমরা উন্নয়ন-বিরোধী। আমাদের কাছে নিয়ামগিরির বাস্তুতন্ত্রই অগ্রাধিকারে রয়েছে। আমরা এর বন, নদী, বৃক্ষরাজিকে রক্ষা করতে চাই। আমরা একই সঙ্গে চাই আমাদের ভাষায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, এবং আমাদের উৎপাদিত বনভিত্তিক দ্রব্যগুলি বাজারে বিক্রির জন্য সরকারি সহায়তা। আমাদের যা কিছু প্রয়োজন সবই বন থেকে পাই, আমরা রাস্তা চাই না যদি তা বোঝায় যে এখানে কোম্পানিকে খনন কাজ চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে।” এই অবস্থান বনবাসীদের জীবনধারার সঙ্গে আজও একশ শতাংশ সংগতিপূর্ণ। আর এর জন্য তাঁদের যে সরকার-কর্পোরেট গাঁটছড়ার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে তা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন। তাঁরা আরো জানেন, মোদী সরকারের “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ”-এর সাধু ঘোষণা পরিণতি পেয়েছে “কর্পোরেটকা বিকাশে”। তাঁদের উপলব্ধি হল, সরকারের কাছ থেকে সুবিচার তাঁরা পাবেন না, লড়াই করেই তাঁদের ন্যায় আদায় করে নিতে হবে। আর কর্পোরেটদের বনজমি হাতানোকে সম্ভবপর করতেই বন সংরক্ষণ আইনে সংশোধন আনা হয়েছে বলে যে কথা মুখে-মুখে ফিরছে, সংশোধিত বন সংরক্ষণ আইন বাতিলের যে দাবি সামনে এসেছে তাকে ওঠাতে হবে আরও সোচ্চারে।

- জয়দীপ মিত্র

an-unspoken-sighunspoken-sigh

এক ঐতিহাসিক দিন। সেন্ট্রাল হলে শেষ দিন। তিনি প্রথম বক্তা। সূচপতন নিস্তব্ধতায় প্রাচীনতমা সাংসদের লিখিত ভাষণ পাঠ শুনছে ভরা সংসদ। সবুজাভ এক স্নিগ্ধতা নিয়ে তিনি যখন মঞ্চে, তখন তাঁর পাঠে বিকীরিত হচ্ছিল তাঁর বৈদগ্ধ্য, মেধা ও ধীশক্তি, কয়েক দশকের সাংসদ পদের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বিচক্ষণতা। অনন্য তার শব্দচয়ন। অপূর্ব তার গ্রন্থন। আকর্ষণীয় সেই ভাষণের সপ্রতিভ সুললিত প্রতিটি উচ্চারণ স্তম্ভিত বিস্ময়ে শেষবারের মতো শুনছিল সেন্ট্রাল হল – হ্যাঁ, সেন্ট্রাল হল! তার বোধ হয় অন্য প্রত্যাশা ছিল প্রাচীনতমার কছে। মূঢ় প্রত্যাশা! তার দীর্ঘশ্বাসপতনের শব্দ তো শোনা যায় না!

ভাষণে উল্লিখিত তাঁর দেখা সপ্তম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী নাকি সমাজে গভীর-প্রোথিত বৈসাদৃশ্য দূরীকরণে তথা ভবিষ্যৎ ভারতে সকল নারীর জন্য সমান অংশ সুনিশ্চিত করতে সচেষ্ট। সত্যি? তবে কেন তিনি দেশের মহিলা রাষ্ট্রপতিকে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন না? ঠিক যেমন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে ঘটেছিল? যেমনটা আবারও ঘটেছে নতুন ভবনে প্রথম আনুষ্ঠানিক অধিবেশনের দিনেও? তিনি আদিবাসী জনজাতির মানুষ বলে?

‘হিন্দুহৃদয় সম্রাট’ এখন দেশের ‘রাজাধিরাজ’, তিনি নিজের পছন্দমতো দরবারকক্ষ সাজিয়ে নিয়েছেন, যেখানে নাকি ঐতিহ্য, পরম্পরা আর আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে। ঐতিহ্যময় ‘পুরোনো’ সংসদ ভবন এখন হবে ‘জাদুঘর’। এই সেন্ট্রাল হলের সঙ্গে তাঁর ৩৫ বছরের সম্পর্ক। যখন প্রথম সাংসদ হিসেবে শপথ নেন তখন তিনি এক দৃপ্ত তরুণী (অবশ্য এখনও বাহ্যত তাই!)। কত পরিবর্তনের সাক্ষী তিনি! এই যে ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত সেঙ্গোল-ভারতে রূপান্তরিত হতে চলেছে, সে ব্যাপারে তাঁর বিবেক মুহূর্তের জন্যও কি পীড়িত হয়নি? যাক সে কথা।

ভাষণে তাঁর অভিজাত উচ্চারণ মান্যতা পেলেও, দাবিগুলো তো মেনে নেওয়া যাবে না! কোভিড১৯-এ মোদি সরকারের ঔদাসীন্যে আর অবহেলায় গঙ্গায় ভেসে গেছে শ’য়ে শ’য়ে লাশ। মারা গিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। যে মৃত্যু এড়ানো যেত।

শিশুশ্রম বন্ধ তো হয়ইনি, বরং বাড়ছে, চায়ের দোকানে, রেস্তোরাঁয় গ্যারেজে, নির্মাণে, চাষের কাজে, সোনার কাজে— কোভিড-এর পর থেকে অনেকে সপরিবার ভিন রাজ্যে কাজে লেগে যাচ্ছে। স্কুলছুটের সংখ্যাও বাড়ছে।

ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে? ভারতে তৈরি কাশির ওষুধ আফ্রিকার শতাধিক শিশুর প্রাণ কেড়েছে। গরিব মানুষ নিতান্ত দরকার না হলে ডাক্তার দেখায় না, ওষুধ কেনার পয়সা নেই বলে। ওষুধের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

‘বেটি বাঁচাও বেটি পঢ়াও’ এক নিষ্ঠুর বিদ্রুপ! প্রতিদিন অসংখ্য মেয়ে ঘরে বাইরে নিগৃহীতা হচ্ছে, খুন হচ্ছে, এমনকি বিচারের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারছে না। পৌঁছালেও দাম্ভিক প্রশাসন সেই রায়কে ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছে। মনুস্মৃতির প্রচ্ছন্ন প্রভাবে বিজেপি নেতা সাংসদ বিধায়করা নারী নিগ্রহকে ‘বীরের’ কাজ মনে করছেন। এমনকি নেত্রীরাও! তাই ধর্ষক-খুনীদের ‘সংস্কারী’ বলে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের নিয়ে মিছিল করা হয়, ফুল-মালা-মিষ্টি দিয়ে বরণ করা হয়। যখন তখন প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। আর কঠিন মেধা পরিশ্রম অধ্যবসায়ে যারা দেশের জন্য পদক জিতে এনে দেশবাসীর গৌরব বাড়িয়েছেন, সেই সোনার মেয়েদের নিগ্রহকারী সাজা তো পায়ই না, বীর দর্পে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়! উল্টে বিচার চাওয়ার অপরাধে সেই সোনার ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে নৃশংস নির্যাতন করা হয়! মহিলাদের নগ্ন করে জনতার মাঝে হাঁটানো হয়, তারপর গণধর্ষণ করা হয়! খুন করা হয়! তাদের অপরাধ – তারা অন্য সম্প্রদায়ের, অন্য জনজাতির মানুষ! এসব কিছুর জন্য লজ্জিত নন প্রাচীনতমা সাংসদ! উল্টে দাবি করছেন, দু’বছরের মধ্যে দেশের মানসিকতা পাল্টে দেওয়া গেছে! হ্যাঁ, ঠিকই। সমাজে দলিত সংখ্যালঘু, আদিবাসী, গরিব শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে যেমন তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে মানুষের মনকে বিষিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমনই নারীদের প্রতি ঘৃণা আর বিদ্বেষ এমন উগ্র আর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে তাদের প্রশ্রয়ে, অনলস প্ররোচনায়।

অন্যদিকে, অভাবের কারণে, কুসংস্কারের প্রভাবে মেয়েদের পড়াশুনোয় ইতি পড়ে যাচ্ছে। বাল্যবিবাহ বাড়ছে। নয়া শিক্ষানীতি শুধু উচ্চবিত্তের জন্য শিক্ষাঙ্গন খোলা রেখেছে। দরিদ্র নিম্নমধ্যবিত্তের সেখানে জায়গা নেই!

তিনি বলেছেন মোদিজী এক অনন্য রাষ্ট্রপ্রধান যিনি পরিসংখ্যানকে অতিক্রম করে ব্যক্তিমানুষের কাছে পৌঁছে যান, তাদের সুখ দুঃখের ভাগ নিতে। ঠিকই, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘সযত্নে বাছাই করা’ অতি ভাগ্যবান ক’টি পরিবার এই ন’বছরে মোদিজীর ‘মন কী বাতে’ ঠাঁই পেয়েছেন বটে! আর ঐ যে বললেন, তিনি মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছেন, পাকা বাড়ি, বিদ্যুৎ, নলের জলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, রান্নার গ্যাস দিয়েছেন বিনামূল্যে – সে তো কয়েক হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপনে! রাস্তাার মোড়ে মোড়ে টাঙানো হোর্ডিং-এ! ভারতের কোটি কোটি মহিলা শহরে গ্রামে কাজের সুযোগ না পেয়ে অশেষ কষ্টে আছেন। পুষ্টির অভাব, নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয়, পানীয় জল বিদ্যুৎ তো দূরের কথা। লক্ষ লক্ষ স্কীম ওয়ার্কার মহিলা – দেশের দরিদ্র প্রসূতি মা-শিশুর স্বাস্থ্য পুষ্টি নিরাপত্তা যাদের কাঁধে – যারা দেশকে পোলিওমুক্ত করেছেন, কোভিদে জীবন দিয়েও দায়িত্ব পালন করে গেছেন – তাদের সরকার বছরের পর বছর ‘পারিতোষিক’, ‘সম্মান দক্ষিণার’ নামে চরম নিষ্ঠুরভাবে শোষণ করে চলেছে। তাদের ন্যূনতম মজুরি, শ্রমিকের মর্যাদা, সামাজিক সুরক্ষার জন্য আজ পথের আন্দোলনে ঠেলে দিয়েছে ‘মহামহিম’ মোদী সরকার। ক’জন উজ্জ্বলা যোজনার গ্যাস সিলিন্ডার পেয়েছেন? ক’জন দুর্মূল্যের গ্যাস পরবর্তীতে কিনতে পেরেছেন? কতজন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে পেরেছেন জন ধন যোজনায়? তাহলে মাইক্রোফিনান্সের বাউন্সারদের দ্বারা নিঃস্ব, নিগৃহীত হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আত্মহত্যা করছেন কেন এত মহিলা? পুরুষ? পশ্চিমবঙ্গ সহ অ-বিজেপি কয়েকটি রাজ্যে একশো দিনের টাকা বন্ধ করে কেন্দ্রীয় সরকার তো গরিব শ্রমজীবী মহিলাদের পেটের ভাত কাড়ছে! এসব সযত্নে এড়িয়ে যান তিনি, তাঁরা!

আসলে তারা তো অন্য ভারতের বাসিন্দা যে ভারত বৈভবের, ঐশ্বর্যের, চটকদারির, মিথ্যাচারের; যে ভারত মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের কৃপাধন্য! তাই তারা ঐ বিলিয়নেয়ারদের মৃগয়াক্ষেত্র অন্য ভারত, শোষিত, বঞ্চিত, ক্রমশ দারিদ্র্য সীমার নিচে নামতে থাকা ভারতের কথা বলবেন কেন তাদের ‘উৎসব’ মুহূর্তে?

কিন্তু মানুষ সব দেখছে!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

jeetega-indiajudega-bharat

বিজেপি পারেও বটে। বাজপেয়ী আদবানি রামশিলা মানে ইটপূজোর কথা বললেন, তবেই না আমরা রামকে জানলাম! বাপ, চোদ্দ পুরুষের আমল থেকে রামকানাই, রামগোপাল, রামমোহন — এমনতর রামময় নাম তো আমাদের চিরচেনা। তবে ‘রাম জনমভূমি’ নিয়ে বিজেপি যে ধামাকা সৃষ্টি করল, হিংসা ও বিভেদের যে তান্ডব নাচ দেখিয়ে চলল, তাতে আমাদের চিরকালের সাদাসিধে গাঁয়ের রামেরা হারিয়ে গেল। রহিমের কাঁধে হাত দিয়ে চলা সরলমনা রামকে ডান্ডা পিটিয়ে করে দেওয়া হল বিজেপির প্রাইভেট প্রপার্টি।

রামের ঘাড়ে চেপে দিল্লীর গদিতে বেশ পাকাপোক্ত ভাবেই বসেছেন বিজেপির দ্বিতীয় প্রজন্মের শাহেনশা নরেন্দ্র মোদি। রামমন্দির প্রায় তৈরিই হয়ে গেছে। মাস দু-তিনের মধ্যেই, ’২৪ এর ভোটের ঠিক আগে আগে মোদিজি মন্দির উদ্বোধনে এমন জনতরঙ্গ সৃষ্টি করবেন যে তার ঢেউয়ে যেটুকু বিরোধী শক্তি আছে তা খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। তবু মোদিজি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। একটু রিস্ক ফ্যাক্টর যে থেকেই যাচ্ছে। বিভেদপন্থী, দেশবিরোধী, টুকরে টুকরে গ্যাং সবাই মিলে মহঙ্গাই আর বে-রোজগারি নিয়ে জল কম ঘোলা করছেনা! কোথা থেকে এক “ইন্ডিয়া” বানিয়ে তাঁর সাধের ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’কে প্রায় দিল চৌপট করে। সুতরাং শুধু রামনামে বোধহয় পুরোপুরি কার্যসিদ্ধি হবে না। কিন্তু কোনমতেই তো মোদিজির ব্যাটারি ডাউন হতে দেওয়া চলবেনা। তাঁর ব্যাটারি রিচার্জের জন্য আরএসএস তাই “ভারত” অ্যাপসকে সামনে আনছে।

ভারতকে আমরা এত দিন কেউ জানতাম না! মোদিজিই তো সারা বিশ্বের কাছে ভারতকে চিনিয়ে দিচ্ছেন। জি-২০’র সম্মেলনে দুনিয়ার তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের “প্রেসিডেন্ট অফ ভারত” মহাভোজ দিলেন। প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া নয়, ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। কারণ ইন্ডিয়া নামটা নাকি ব্রিটিশের দেওয়া। ব্রিটিশের গোলামির চিহ্ন ভারত বইবে কেন? এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে! যারা কোনোদিন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি, উলটে ইংরেজ শাসকদের ‘ভাগ করে শাসন করার’ নীতিকে দুহাত তুলে সমর্থন করেছে তারাই আজ ‘ব্রিটিশের দেওয়া’ ইন্ডিয়া নামকে মুছে ফেলতে চাইছে। তাদের হঠাৎ এই ‘ভারত’ নিয়ে আবেগ সৃষ্টির পিছনে যে ছলনা ও মিথ্যাচার তা ধোপে টিকবে না। জিতেগা ইন্ডিয়া, জোড়েগা ভারত। সাথে সাথে এটাও জানিয়ে দিতে হবে, ইন্ডিয়া নাম ব্রিটিশের দেওয়া নয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে আলেকজান্ডার যখন সিন্ধু নদ পার হয়ে ভারত (পাঞ্জাব) আক্রমণ করেন তখন গ্রীকরা সিন্ধুকে (সিন্দ) নিজেদের উচ্চারণে ইন্দু(ইন্দাস) বলে আনত। সিন্ধ, হিন্দ, ইন্ডাস, ইন্ড সবই সেই সিন্ধু উপত্যকা বা ইন্দাস ভ্যালির উচ্চারণ যা কালক্রমে আন্তর্জাতিক স্তরে ইন্ডিয়া নামে স্থিত হয়। আরও নির্দিষ্টভাবে বলা চলে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বকালে গ্রীক পর্যটক তথা লেখক মেগাস্থিনিস মগধ তথা উত্তর ভারত ভ্রমণের পর “ইন্ডিকা” নামক যে গ্রন্থ লেখেন (২৯০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) তা থেকেই ইন্ডিয়া নামের প্রচলন।

ব্রিটিশ বিরোধী আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামকে গোটা দুনিয়া ‘ফ্রিডম স্ট্রাগল অফ ইন্ডিয়া’ বলে স্যালুট করে। আমরা গর্বভরে বলি, ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম।’ মোদি সাহেব, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনাদের কোনো অবদান ছিল না। আপনারা ‘ভারত’ নিয়ে এতদিন মাথা ঘামাননি। জোর করে কিছু একটা চাপিয়ে দেওয়ার স্বভাব আপনাদের মজ্জায় মজ্জায়। মাঝে “হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান” বলে হৈ চৈ করলেন। সে শ্লোগানও মাঠে মারা গেল। এখন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে ভারত, ভারত বলে চিৎকার করছেন। ভারতবর্ষের প্রতি ভালোবাসা বা আবেগ থেকে দেশের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব এলে মানুষ নিশ্চয় ভেবে দেখত। সংসদে আপনাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। সংসদের অধিবেশন ডেকে, দেশের নাম বদলে দিয়ে ‘ভারত’ নামের আপনারা ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর হয়ে যাবেন? এত সহজ? দেশের নাম ইন্ডিয়া থাকবে, না ভারত হবে – এটা কোনো বিতর্কের বিষয়ই নয়। সংবিধানে বলা আছে, “ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত”। নাম পরিবর্তনের জন্য দেশবাসীর হৃদয় থেকে কোনো আকাঙ্খা উৎসারিত হয়নি। মানুষ সরকারের কাছে খাদ্য-বস্ত্র-আবাসন-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের পর্যাপ্ত সুযোগ সহ মর্যাদাপূর্ণ জীবন চায়। এসবের গ্যারান্টি না দিতে পেরে এখন দেশভক্তির এমন সস্তা নাটকের আশ্রয় নিচ্ছেন? আর দেশের নাম পরিবর্তনের যদি একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাহলে তা প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে চাপিয়ে দেওয়া যাবেনা। দেশবাসীর সমস্ত অংশের সাথে পর্যাপ্ত আলোচনা, মত বিনিময়ের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়েই এমন এক সংবেদনশীল প্রশ্নের ফয়সালা হতে পারে। ক্ষমতার দম্ভ দিয়ে দেশপ্রেমের মালিক হওয়া যায় কি? যাবে না।

- মুকুল কুমার

rajat-banerjeerajat-banerjee-passes-away

২০ সেপ্টেম্বর উত্তরপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভোরবেলা প্রয়াত হন বালির কমরেড রজত ব্যানার্জী (রাজা)। কমরেড রাজা ছিলেন হাওড়া জেলার প্রথম জেলা কমিটি ও পরবর্তীতে বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির প্রাক্তন সদস্য। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

১৯৮৯-এ পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ গঠনকালে যারা উদ্যোগী ছিলেন তাঁদের মধ্যে কমরেড রাজা ছিলেন অন্যতম। কলকাতায় পরিষদের কেন্দ্রীয় কাজে কবি কমলেশ সেন, প্রবীর বল ইত্যাদির সাথে কমরেড রাজা বহু বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। পার্টির পঞ্চম কংগ্রেসের সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীরা ক’দিন আগে এসে উঠেছিলেন কমরেড রাজার ব্যবস্থা করা ধর্মতলার এক বাড়িতে। সেখানে চলেছিল গানের ওয়ার্কশপ এবং সেখানেই অনুবাদ হয়েছিল ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি’, ‘কমিউনিস্ট আমরা, আমরা কমিউনিস্ট’ গানগুলি।

শুরুতে কমরেড রাজা ছিলেন পরিষদের কোষাধ্যক্ষ এবং পরবর্তীতে নবান্ন পত্রিকার কর্মসচিব। এইরকম বহুমুখী ভূমিকায় কমরেড রাজাকে আমরা দেখেছি। বিগত বেশ কিছু বছর যাবৎ সুগার ও স্নায়ুর সমস্যায় ভুগছিলেন, তবে প্রতিবছর বালির শারদীয়া বুকস্টলে তাঁর বিশেষ উদ্যোগ ও অংশগ্রহণ থাকতো।

২০ সেপ্টেম্বরে তাঁর মরদেহ বালী জোড়া অশ্বত্থতলা শহীদ বেদীর সামনে আনা হয়। পতাকা অর্ধনমিত রেখে কমরেড রজত ব্যানার্জীকে লাল সেলাম ধ্বনিতে শেষ শ্রদ্ধা জানায় বালি গ্রামাঞ্চল ও বালি বেলুড় লোকালের সাথীরা। হাওড়া জেলা পার্টির পক্ষ থেকে অঙ্কিত এবং রাজ্য পার্টির পক্ষ থেকে তপন বটব্যাল মাল্যদান করেন।

গণ সংস্কৃতি পরিষদের পক্ষে মাধব মুখার্জী মাল্যদান করেন। রক্তপতাকা দিয়ে তাঁর মরদেহকে বিদায় জানান বালির কমরেড তপন ঘোষ।

এই শোকের আবহে আসুন আমরা সকলে মিলে কমরেড রজত ব্যানার্জীর অসম্পূর্ণ কাজকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাই।

কমরেড রাজা অমর রহে। কমরেড রজত ব্যানার্জী লাল সেলাম।

===000===

খণ্ড-30
সংখ্যা-33