আজকের দেশব্রতী : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-07-09-2023undermine-the-essence-of-democracydemocracy-and-federalism

(সম্প্রতি আরো একবার কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ‘এক দেশ, এক ভোট’ চালু করার প্রস্তাব তুলে হৈচৈ শুরু করেছে। এর আগেও দু’বার তারা এই এজেন্ডাকে সামনে এনেছিল। গত বছর ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইন কমিশন এই প্রস্তাবনা পাঠিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে মতামত চেয়েছিল। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বিস্তারিত উত্তর পাঠিয়েছিলেন। এই উত্তরের মূল বিন্দুগুলি তুলে ধরে পার্টির পক্ষ থেকে ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ যে বিবৃতি জারি করে তা এখানে দেওয়া হল)

লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভাগুলির নির্বাচন একসাথে করা প্রসঙ্গে আইন কমিশনের চিঠির উত্তরে সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক এই প্রস্তাবটির তীব্র বিরোধিতা করেন এবং এই পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক বলে অভিহিত করেন। যুগপৎ নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার মৃত্যুঘণ্টা। যুগপৎ নির্বাচনকে বৈধতা দিতে যে সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব আনা হচ্ছে তা আক্ষরিক অর্থেই সংবিধান পুনর্লিখনের নামান্তর এবং সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামোর লঙ্ঘন।

২৩ ডিসেম্বর ২০২২ দিনাঙ্কিত একটি চিঠির মাধ্যমে আইন কমিশন বিভিন্ন স্বার্থজড়িত পক্ষের মতামত চেয়ে পাঠায়, যদিও ২০১৮ সালে একই অনুশীলন চলেছিল এবং তখন অনেক রাজনৈতিক দলই একে অগণতান্ত্রিক গণ্য করে বিরোধিতা ব্যক্ত করেছিল। নতুন করে আবার এই যুগপৎ নির্বাচনকে, বা বলা ভালো, বিজেপির দীর্ঘ লালিত আইডিয়া ‘এক দেশ, এক ভোট’ এজেন্ডাকে, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তৎপরতা সংবিধানের জীবনীশক্তি গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার মূল সত্তাকে খর্ব করে। আজ ‘এক দেশ, এক ভোট’-এর নামে বিজেপি রাজনৈতিক গতির চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে এবং সংবিধান সংশোধনের মধ্যে দিয়ে সমগ্র রাজনীতির এককেন্দ্রীকরণ করতে চাইছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, মনে হচ্ছে আইন কমিশন বিজেপির এজেন্ডায় ভেসে যাচ্ছে।

এক পার্টি আধিপত্য তৈরির প্রচেষ্টা

আইন কমিশনের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ [২০১৮র “যুগপৎ নির্বাচন”-এর খসড়া প্রতিবেদনে] দেখাচ্ছে যে “তখন পর্যন্ত [১৯৬০ দশকের মধ্যভাগ] একসাথে নির্বাচনের মূল কারণ ছিল একটি মাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দলের আধিপত্য ও শাসন এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির প্রভাব ও প্রতিপত্তি না থাকা”। পঞ্চাশ বছর আগে কংগ্রেস দলটি যে নির্বাচনী প্রাধান্য ভোগ করত এখন বিজেপি তা অর্জন করেছে বলেই তা সংবিধান সংশোধন করার এবং ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে না। বিজেপি আগামী পঞ্চাশ বছর ভারতের শাসক দল, একমাত্র শাসক দল, থাকার ইচ্ছা প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করে থাকে। কিন্তু শাসক দলের রাজনৈতিক আকাঙ্খা চরিতার্থ করতে তো সংবিধানটাই বদলে দেওয়া চলে না।

গণতন্ত্রকে রসদ/খরচ সংক্রান্ত সুবিধা অসুবিধার অধীনস্থ বানিয়ে দেওয়া যায় না

বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের নিজ নিজ বিশিষ্ট প্রেক্ষিত আছে। পঞ্চায়েত ও পৌর নির্বাচনগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রসদ বা খরচ সংক্রান্ত বিবেচনা থেকে এইসব নির্বাচনগুলিকে একই বন্ধনীর মধ্যে এনে ফেলার অর্থ হল বিধানসভা নির্বাচনের স্বায়ত্ত ক্ষেত্রকে কেড়ে নেওয়া এবং তাকে কেন্দ্রীয় প্রেক্ষিতের অধীনস্থ করে দেওয়া। যুগপৎ নির্বাচন হলে রসদ সংক্রান্ত সুবিধা পাওয়া যাবে এবং অর্থনিয়োগ কম করতে হবে – এরকম পূর্বসিদ্ধান্ত কোনো বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষা দ্বারা পুষ্ট নয় বা এযাবৎ কালের নির্বাচনী ব্যয় ও রসদ ব‍ন্দোবস্তের বিশ্লেষণ দ্বারা সমর্থিত নয় (আইন কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনেও এটা মেনে নেওয়া হয়েছে)। ফলত আর্থিক বিষয়-আশয়ে আইন কমিশনের টানা সিদ্ধান্ত প্রশ্নের মুখে পড়ে।

তাছাড়া, আইন কমিশনের খসড়া প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৪’র নির্বাচনগুলিতে ভারতের নির্বাচন কমিশন ৩৫৮৬ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা বলেছে (প্যারা ২.১০)। বিষয়টিকে প্রেক্ষাপটে স্থাপন করতে বলা যায়, বিজেপি ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ইউনিয়ন সরকার ৩২৬০.৭৯ কোটি টাকা খরচ করেছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে এবং ৩২৩০.৭৭ কোটি টাকা খরচ করেছে ছাপা মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে। সত্যি যদি টাকা বাঁচানোটাই প্রশ্ন হয় তাহলে স্পষ্টতই নজরটা অন্যত্র পড়ার কথা। খরচের প্রশ্নটা কখনই গণতন্ত্রের মূল নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না।

undermine-the-essence-of-democracy
আদর্শ আচরণ বিধির ক্ষেত্রে কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্রের কেন্দ্রে জনতার থাকার ধারণার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

যুগপৎ নির্বাচনের প্রস্তাবের যথার্থতা প্রমাণ করতে আইন কমিশন খানিক অসৎ একটি যুক্তির অবতারণা করেছে আদর্শ আচরণ বিধিকে ঘিরে। আদর্শ আচরণ বিধি উন্নয়নকে ব্যাহত করে না বা শ্লথ করে দেয় না; তা সরকারের ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে মাত্র যাতে সরকার নতুন প্রকল্প বা পলিসি ঘোষণার মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করতে না পারে। নির্বাচন জনগণকে সক্ষম করে সরকার বা তার তথাকথিত উন্নয়নের কার্যকলাপকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বা সে সম্পর্কে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে। আচরণবিধিকে উন্নয়নের পথের বাধা হিসেবে দেখানোটা গণতন্ত্রে জনগণের কেন্দ্রীয়তার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে শাসনব্যস্থার সাথে প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার জনগণের অধিকারের, যে কোনো সরকার সম্পর্কে, সরকারের কাজ সম্পর্কে, বা তার তথাকথিত উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণের মতামত দেওয়ার অধিকারের, এক কৃত্রিম বিরোধ খাড়া করে।

সাংবিধানিক নৈতিকতাকে ও সংবিধানের বনিয়াদকে লঙ্ঘন করছে

আইন কমিশন বুনিয়াদি কাঠামো সংক্রান্ত অনুশাসনের ভুল আইনি ব্যাখ্যার আশ্রয় নিচ্ছে এর প্রয়োগক্ষেত্রকে সংকুচিত করার উদ্দেশ্যে যাতে একটা সমস্যাজনক ও গ্রহণ-অযোগ্য যুক্তিকে মান্যতা দিয়ে বলা যায় যে সংবিধান পুনর্লিখন হলেই তা মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘন নয়।

কোনো গণতন্ত্রে পরিবর্তনশীল সাংবিধানিকতা এই বাধ্যবাধকতা তৈরি করে যে, যে কোনো সংবিধান সংশোধনীকে মৌলিক কাঠামোর নিরিখ ছাড়াও সাংবিধানিক নৈতিকতা, সাংবিধানিক শাসন ও সাংবিধানিক বস্তুগততার নিরিখেও অবশ্যই পরীক্ষিত হতে হবে। অবশ্য, বিদ্যমান সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থাকে কার্যত প্রতিস্থাপন করে দেবে এমন সব ব্যাপক-বিস্তৃত সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও সমগ্র খসড়া প্রতিবেদনে ‘সাংবিধানিক নৈতিকতার’ ধারণাটিই সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত।

যুগপৎ নির্বাচনের রাস্তা পরিষ্কার করার লক্ষ্যে ব্যাপক-বিস্তৃত সংবিধান সংশোধনীসমূহকে যথার্থতা দিতে আইন কমিশন ভারতীয় বিচারশাস্ত্রের ভোটাধিকার ও নির্বাচিত করার অধিকারকেই অযথা খাটো করতে চেয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র, বহুদলীয় ব্যবস্থা এবং অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন – এগুলো সবই সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামোর অঙ্গ। সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলির যুগপৎ নির্বাচনকে বাধ্যতামূলক করা যে কোনো সংবিধান-সংশোধনী সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামাকেই আঘাত করবে এবং সংবিধানের জীবনশক্তি যে গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তা তার মূল সত্তাকেই খর্ব করবে।

আমরা তাই আইন কমিশনের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে তারা এই অবাঞ্ছিত ও বিপর্যয়সম্ভব কার্যভাবনা থেকে সরে আসুক।

modis-rockefeller_gmodis-rockefeller_0

কর্পোরেট জগতের বিশ্বস্ত মুখপত্র ‘ফাইনান্সিয়াল টাইমস্’ সেই ১৩ নভেম্বর ২০২০ সালেই ‘মোদীস্ রকফেলার : গৌতম আদানি অ্যান্ড দ্য কনসেন্ট্রেশন অফ পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’ শিরোনামে এক নিবন্ধ প্রকাশ করে। তাতেই মোদীর আমলে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু আদানি’র উল্কাগতিতে উত্থানের নেপথ্যে কীভাবে কেন্দ্রীয় সরকার ও তার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দরাজ হাত ছিল, তা তুলে ধরে। কিভাবেই বা সরকারি বদান্যতায়, সমস্ত নিয়ম কানুনকে দুমড়ে মুছড়ে, রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করে, কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ২০১৮-তে রাতারাতি আদানি ছ’ছটা বিমান বন্দরের মালিকানা হাতিয়ে নিল, তার বর্ণনাও রয়েছে। সেই আদানিকে নিয়ে বিতর্কের আর শেষ নেই। ক’দিন যাবত, ভারতের রাজনীতি আবার সরগরম হয়ে উঠল সেবি কিভাবে আদানির সমস্ত আর্থিক অপরাধকে ধামা চাপা দিয়েছে, বা দেখেও না দেখার ভান করেছে। আর যার আমলে এই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল, সেবি’র সেই কর্ণধার এখন আদানি’র দখলে থাকা এনডিটিভি’র এক স্বাধীন ডিরেক্টর!

এবার, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিও সরগরম হয়ে উঠল আদানিকে কেন্দ্র করে। ঘটনার শুরু ২০২২’র জুন। সিলন (শ্রীলঙ্কার পূর্বতন নাম) ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের কর্ণধার ফার্ডিনান্ডো শ্রীলঙ্কার পাবলিক এন্টারপ্রাইজ কমিটির কাছে জানান যে ২০২১ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষ তাঁকে বলেন, প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্পটি যেন ভারতের আদানিই পায়, কারণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ওই প্রকল্পটির বরাত যেন আদানিকে দেওয়া হয়। প্রবল রাজনৈতিক চাপের মুখে, ঠিক তার তিনদিন পর ফার্ডিনান্ডো নিজের মন্তব্যকে সরকারিভাবে প্রত্যাহার করে পদত্যাগ করেন, যা নিয়ে সেই সময় শ্রীলঙ্কার ঘরোয়া রাজনীতি আলোড়িত হয়।

এবার, কলম্বো’স্থিত শ্রীলঙ্কার প্রথম সারির সংবাদপত্র ‘সান্ডে টাইমস্’ ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ একটি খবর প্রকাশ করে জানায় যে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের যে বিনিয়োগের ভিত্তিতে ভারতের আদানি গ্রীণ এনার্জি লিমিটেডকে ৫০০ মেগাওয়াটের বরাত বরাদ্দ করেছিল, তা এবার ভারত সরকার ও শ্রীলঙ্কা সরকারের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ প্রকল্প হিসাবে বিবেচিত হবে।

কিন্তু কেন? কারণ, শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎ আইন অনুযায়ী কোনো বেসরকারি সংস্থাকে বিদ্যুৎ প্রকল্পে বরাত সরাসরি দেওয়া যাবেনা। অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে, প্রতিযোগিতামূলক খোলা টেন্ডারে যে সংস্থা যোগ্যতাবলে তা অর্জন করবে, সেই প্রকল্প পাবে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘ইচ্ছাপূরণ’ করতে গিয়ে সেই আইন লঙ্ঘন করতে হল। তাই, টেন্ডার ছাড়াই আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্পকে আইনি জামা পরাতে ‘দুই সরকারের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে’ আদানি এবার পেয়ে যাচ্ছেন বিপুল বিনিয়োগের সেই শাঁসালো শ্রীলঙ্কার প্রকল্প! সেখানে বিরোধীরা সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, বেসরকারি সংস্থা আদানি’র প্রকল্পকে কোন যুক্তিতে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে?

হিন্ডেনবার্গ আদানিকে আখ্যা দিয়েছে, “এযাবৎ কর্পোরেট জগতের সবচেয়ে বড় জোচ্চোর” হিসাবে। ক্যাগ রিপোর্টও প্রশ্ন করেছে, সড়ক তৈরির কোনো ধরনের যোগ্যতা আদানি ট্রান্সপোর্টের না থাকা সত্ত্বেও তেলেঙ্গানায় সূর্যপেট থেকে খাম্মাম পর্যন্ত ২৫০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের বরাত কি করে তারা পেল। শুধু তাই নয়, ক্যাগ রিপোর্ট এই অভিযোগও তুলেছে যে প্রকৃত খরচের তুলনায় প্রকল্পটির খরচ অনেক বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।

মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার ছলনাময় স্লোগানকে বাস্তবায়িত করতে আদানিও দেশগঠন, দেশপ্রেমের মোড়কে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহ নানা সংস্থার মদত নিয়ে অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে দৈতাকার এক সাম্রাজ্যের কর্ণধার হয়ে উঠেন। বিজেপির স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ খোলাখুলি আদানির পক্ষ নিয়ে যুক্তিজাল বুনেছে।

হিন্দুত্ব-দেশপ্রেম-আদানি-দেশের আর্থিক আত্মনির্ভরতা একাকার হয়ে মোদী ফ্যাসিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ক্রোনি পুঁজিবাদ আজ চরম বর্বর রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।

আসন্ন দিনগুলোতে এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি আবার এক বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝড় তৈরি করবে।

indian-classroom-turns-into-horror-chamberindian-classroom-turns-into-horror-chamber

চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান-৩’র সফল আলতো অবতরণ নিঃসন্দেহে ইসরোর এক ঐতিহাসিক সাফল্য সূচিত করেছে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এই প্রথম কোনো চন্দ্রাভিযান সম্পন্ন হল যা চাঁদের বাস্তবতা নিরীক্ষণ করার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে বলে প্রত্যাশা। ভারতের এ’ধরনের বৈজ্ঞানিক পরাক্রম সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও কারিগরির জগতে এবং নির্দিষ্টভাবে মহাকাশ গবেষণায় ভারতের সামগ্রিক অগ্রযাত্রাকে অনুপ্রাণিত করবে। মাত্র ৬০০ কোটি টাকার বেশ কমসম বাজেটেই এরকম সাফল্য অর্জনের দিকটিও সন্তোষজনক, বিশেষত ভারতের সড়ক নির্মাণের ওপর প্রকাশিত সর্বশেষ ক্যাগ (সিএজি) রিপোর্টে যেখানে দেখা যাচ্ছে যে এই চন্দ্রাভিযানের খরচ দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রতি তিন কিলোমিটারের খরচের থেকে কম। চন্দ্রযান-৩ অভিযানের সমস্ত সদস্য এবং ইসরো ও অন্যান্য সংস্থার যে সমস্ত কর্মীরা এই সাফল্যে অবদান রেখেছেন তাঁদের সকলেরই আন্তরিক অভিনন্দন প্রাপ্য।

মোদী সরকার চন্দ্রযান-৩ অভিযানের কৃতিত্ব নিতে ব্যস্ত। কিন্তু একটু গভীরে দেখলেই দেখা যাবে যে সরকারের অবহেলা অতিক্রম করেই এই মিশন সফল হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাঁচির হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (এইচইসি), যারা চন্দ্রযান-৩’র চলমান উৎক্ষেপণ চাতালটি নির্মাণ করে এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই তা সম্পূর্ণ করে প্রদান করে, গত আঠারো মাস ধরে মাইনে পাচ্ছে না। ভারতের সরকারি ক্ষেত্রের ইস্পাত কারখানাগুলি নির্মাণেও এই এচইসির অবদান বিরাট। বর্তমানে মোদী সরকার এই সংস্থার প্রয়োজনীয় কার্য-পুঁজির জোগান দিতে, এমনকি কর্মীদের বেতন পর্যন্ত দিতে অস্বীকার করে একে রুগ্নদশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ, এখন যখন মিশন সফল হয়েছে, যখন কোটি কোটি ভারতবাসী তাঁদের মোবাইল ফোন কম্পিউটার বা টিভির সাথে সেঁটে আছেন চাঁদে ভারতের অবতরণের ঐতিহাসিক মুহূর্ত অবলোকন করতে, তখনই নরেন্দ্র মোদী গোটা টিভিস্ক্রীন জুড়ে হাজির হয়েছেন ভাষণ দিয়ে সমস্ত প্রচারের আলো কেড়ে নিতে।

রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডা ও নির্বাচনী ফায়দার স্বার্থে চন্দ্র অভিযানকে দোহন করার মরিয়া প্রচেষ্টায় মোদী সরকার যে একে কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর আত্মপ্রচারের মঞ্চই বানাচ্ছে তা নয়, এমনকি ধর্মীয় কুসংস্কার ও আধুনিক বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি তৈরি করছে। চন্দ্র অভিযানকে বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের প্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করার বদলে সর্বতোভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে ধর্মীয় কুসংস্কারের সাথে যুক্ত করার। ল্যাণ্ডার বিক্রমের (ভারতের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠার প্রেরণা বিক্রম সারাভাইয়ের নামানুসারে) চাঁদে অবতরণবিন্দুকে মোদী তড়িঘড়ি ‘শিবশক্তি বিন্দু’ নামে ঘোষিত করলেন, স্পষ্টতই হিন্দু ধর্মীয় অভিঘাত যুক্ত করতে। মোদীর শিবভজনা শেষ হতে না হতেই সেই সূত্র ধরে হিন্দু মহাসভার এক নেতা দাবি তুললেন শিবশক্তি বিন্দুকে রাজধানী করে চাঁদকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করার! এটাকে যদি একটু বেশিই চরম ব্যাপার বলে মনে হয় তাহলে নজর করে দেখুন, চন্দ্র অভিযানে যুক্ত বিজ্ঞানী নারীদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে কীভাবে পিঠ চাপড়ানো হল এবং কীভাবে তাঁদের ‘আদর্শ ভারতীয় নারী’ বলে দেখানো হল যাদের কাছে বিজ্ঞান ধর্মের সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত, যুক্ত নয় শুধু, ধর্মেই প্রতিষ্ঠিত।

ইসরো যে ব্রেকথ্রু করল তা কয়েক দশকের গবেষণা ও অধ্যবসায়ের ফল। সব অভিযানই সাফল্য পায়নি। বিজ্ঞানিরা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। চন্দ্রযান-২’র ব্যর্থ অভিযান চন্দ্রযান-৩’র সাফল্যের পথ প্রশস্ত করেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েক দশক ধরে আধুনিক ভারতে সরকারী অর্থানুকুল্যে যে শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থা গড়ে উঠছিল ইসরোর বিজ্ঞানী গোষ্ঠির অধিকাংশই তার ফসল। অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্রের মতো সরকারি অর্থানুকুল্যে চলা শিক্ষাব্যবস্থাকেও এখন সুব্যবস্থিত কায়দায় দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে শিক্ষা ও গবেষণাকে বেসরকারিকরণের দিকে ঠেলে দিয়ে। এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রায় সমস্ত ক্ষেত্র ও স্তর জুড়ে অনুসন্ধিৎসা, বিদ্যাচর্চার স্বাধীনতা ও বিদ্যায়তনের গণতন্ত্রকে খর্ব করে কুসংস্কার, চাটুকারিতা, ভীতি ও নীরবতার আবহ তৈরি করা হচ্ছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে বিজ্ঞানমনস্কতাকে বলি দেওয়া হচ্ছে ধর্মান্ধতা ও বিদ্বেষের বেদিতলে, এবং তার মারাত্মক পরিণতি আমাদের চোখের সামনে প্রকট।

মুজফ্ফরনগরের শ্রেণিকক্ষের ভিডিওতে প্রাইমারি স্কুলের প্রিন্সিপালকে দেখা যাচ্ছে নিজে সাধারণভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গালি দিতে দিতে একের পর এক ছাত্রকে নির্দেশ দিচ্ছেন একটি সাত বছর বয়সী মুসলমান সহপাঠীকে পেটাতে। এই ভিডিও আমাদের এটাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে কীভাবে হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে ক্লাসরুমের মধ্যে ইহুদি পড়ুয়াদের হেনস্থা করা ও শাস্তি দেওয়া হত। চলন্ত ট্রেন থেকে শুরু করে রাস্তা, রাস্তা থেকে টেলিভিশনের স্টুডিও এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষ বা শিক্ষায়তনগুলি — ঘৃণা যেন স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পর সমগ্র ভারতকে গ্রাস করার হুমকি দিচ্ছে। মুজফ্ফরনগর ছিল ‘লাভ জিহাদ’ মোকাবিলার নামে সংঘ বাহিনীর দ্বারা ২০১৩’র সুসমন্বিত দাঙ্গার অভিকেন্দ্র। কৃষক আন্দোলন সেই ঘৃণা ও বিভাজনের অভিযানকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়েছিল নতুন করে ঐক্য ও সংহতির বন্ধন জাগিয়ে। আজ আরো একবার বিদ্বেষ ও জিঘাংসার শক্তিগুলি সেই ঐক্যকে ধ্বংস করতে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কৃষক আন্দোলন এবং শান্তি ও সুবিচারকামী সমস্ত শক্তিকে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ প্রতিরোধ খাড়া করতে হবে।

বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যেই এই ঘৃণা ও অত্যাচারের মঞ্চ হয়ে ওঠা স্কুলের অপরাধী প্রিন্সিপাল তৃপ্তা ত্যাগির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। স্কুলটিকে এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং পড়ুয়াদের অন্য স্কুলে ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। অত্যাচারীত ও আহত ছাত্রটির পরিবার আধিপত্যকারী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলির দিক থেকে আইনি বিচার ও শাস্তি এড়িয়ে মিটমাট করে নেওয়ার চাপের মুখে রয়েছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল কিছু সন্দেহজনক কৃষক নেতার দিক থেকেও এই চাপ এসেছে। এই ধরনের বিষয়ে মিটমাট একমাত্র সত্য ও সুবিচারের ওপর দাঁড়িয়েই অর্জিত হতে পারে, সেগুলিকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। ঘৃণার প্রচারক ও হিংসার কুশিলবরা সুরক্ষা পাচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর ঘটনায় জনতার নজর আকর্ষণের জন্য সত্য-পরখকারী মোহাম্মদ জুবেইরকে আবার একবার নিশানা বানানো হচ্ছে।

আমাদের বুঝতে হবে যে, যে শিশুদের এই হিংসায় উৎসাহিত করা হল বা তা দেখতে বাধ্য করা হল তারাও যে শিশুটি এই অত্যাচারী ও আঘাতের মধ্যে দিয়ে গেল তার মতই এই ফ্যাসিবাদী বিভীষিকার শিকার। ফ্যাসিস্ট প্রচারকদের দ্বারা দৈনন্দিন ভিত্তিতে যে ঘৃণা অভিযান চালানো হচ্ছে, তা সে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যে কোনো ছত্রছায়াতেই হোক, অথবা টিভি সঞ্চালক বা বিবিধ সামাজিক গণমাধ্যমের মতামত-নির্মাতা ও প্রভাব বিস্তারকারীদের মাধ্যমেই হোক, এখন তা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের অভ‍্যন্তরে চলে এসেছে ভারতের শিশুদের কিশলয় মনকে কলুষিত করতে। এই বিপজ্জনক সংকেতকে অগ্রাহ্য করলে আরো অনেক বড় বিপর্যয় আগামী দিনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।

এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৯ আগস্ট – ৪ সেপ্টেম্বর সংখ্যা

call-for-dalit-meeting-join-the-parliament-campaigncampaign-on-december-4

হায়দ্রাবাদে ২৬ ও ২৭ আগস্ট ২০২৩ অনুষ্ঠিত হল দলিত শীর্ষ বৈঠক। সিপিআই(এমএল) বিধায়ক এবং আয়ারলার জাতীয় সভাপতি সত্যদেও রামের নেতৃত্বে আয়ারলার এক প্রতিনিধি দল ঐ বৈঠকে যোগ দেয়। প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন আয়ারলার সহ-সভাপতি মনোজ মঞ্জিল, সাধারণ সম্পাদক ধীরেন্দ্র ঝা, সাম্মানিক সভাপতি শ্রীরাম চৌধুরী।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দলিতদের উপর নিপীড়ন যখন বেড়ে চলেছে তখন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রগতিশীল শক্তিগুলি — আম্বেদকরপন্থী সমূহ-বাম সংগঠনগুলি এবং নাগরিক সংগঠনগুলিকে এক ছাতার তলায় আনাটা জরুরি এবং তাকে রূপায়িত করতে এই ধরনের শীর্ষ বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দলিতদের অসমতার দূরীকরণে ও উন্নয়নের লক্ষ্যে স্কলারশিপের মাধ্যমে সরকারের সহায়তা ভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিহার্য। বৈষম্য দূরীকরণে এবং জাতপাতবাদী ও অস্পৃশ্যতার ইস্যুতে জনগণকে সংবেদনশীল করতে একটা আইনের প্রয়োজনীয়তাও আবশ্যক হয়ে উঠেছে।

এই ইস্যুতে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বিভিন্ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে এবং এক কোটি স্বাক্ষর সংগ্ৰহ করে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হবে, এবং আন্দোলনের এই প্রক্রিয়া সমাপ্ত হবে ৪ ডিসেম্বর ২০২৩ সংসদ অভিযানের মধ্যে দিয়ে। হায়দ্রাবাদের দলিত শীর্ষ বৈঠকে আন্দোলনের যে সংগঠনগুলো সমবেত হয়েছিল তারা আগামী মাসগুলোতে জাতপ্রথা বিলোপের বিপ্লবী স্পিরিটকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং দলিতদের ন্যায়বিচার লাভকে সুনিশ্চিত করতে সক্রিয় হবে।

মণিপুরে শান্তি এবং জনগণের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতাকে ধিক্কার জানিয়ে বৈঠকে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। বৈঠকে গণকবিয়াল গদ্দরের অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।

এই বৈঠক শেষ হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পূর্বতন চেয়ারপার্সন ও জেএনইউ’র অধ্যাপক সুখদেব থোরাটের বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল দলিতদের মুক্তির জন্য শিক্ষার গুরুত্ব। তিনি বলেন, অস্পৃশ্যতা ও জাতপ্রথার বিলুপ্তির জন্য জাতপাতবাদ ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকারের সংগঠনগুলোর আন্দোলন অপরিহার্য।

শীর্ষ বৈঠক ১০ সদস্যের এক কমিটিকে নির্বাচিত করে যে কমিটি ২০২৩’র ৪ ডিসেম্বর দলিতদের সংসদ অভিযানের প্রচারে নেতৃত্ব দেবে এবং ২০২৪’র দলিত আন্দোলনের এজেন্ডাকেও নির্ধারণ করবে। নির্বাচিত কমিটির সদস্যরা হলেন মাল্লেপাল্লি লক্সমাইয়া, রামচন্দ্র ডোম, নির্মল, ধীরেন্দ্র ঝা, গুলজার সিং গড়িয়া, বিক্রম সিং, কার্ণেল সিং, বীণা পাল্লিকল, এন সাই বালাজি ও বি ভেঙ্কট। নির্বাচিত কমিটি ২০২৪’র দলিত এজেন্ডা নির্ধারণে উদ্দীপনার সৃষ্টি করবে, এবং তার লক্ষ্য হবে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষাকারী ও সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে পরাস্ত করা ও সংবিধানকে রক্ষা করা।

declaration-from-joint-conference-of-workers-and-farmersworkers-and-farmers-in-delhi

সংযুক্ত কিষান মোর্চা এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন/ফেডারেশন সমূহের মঞ্চ যৌথভাবে জাতীয় স্তরের এই সম্মেলনের আহ্বান জানিয়েছিল। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে গত ২৪ আগস্ট হাজার-হাজার শ্রমিক ও কৃষক নয়া দিল্লীর তালকোটরা স্টেডিয়ামে সমবেত হয়ে ঐক্য ও অঙ্গীকারের এক অনন্য নজির স্থাপন করে। মোদী সরকারের যে অনিষ্টকর কর্পোরেটপন্থী নীতিমালা দেশের অর্থনীতির বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এবং সংবিধানের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর আঘাত হানছে, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে তীব্রতর করে তোলার শপথ সম্মেলনে গৃহীত হয়। সম্মেলন দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে, “এই ধরনের নির্মম সরকার জাতীয় স্বার্থের বিরোধী, ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার তার নেই, একে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে।”

সম্মেলনে বক্তারা জানান, সরকারের কর্পোরেটপন্থী কৃষকস্বার্থ-বিরোধী নীতিমালা কৃষি সংকটকে গভীরতর করে তুলছে, এবং তার পরিণামে কৃষকের আয় হ্রাস পাচ্ছে, ঋণগ্ৰস্ততা বাড়ছে এবং কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে চলেছে। দিল্লি-ঘিরে ১৩ মাস ধরে চলা ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রামের উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, বিজেপি সরকারের চালানো নিপীড়ন এবং ভুয়ো সংবাদ ও মিথ্যা প্রচার সত্ত্বেও কৃষকেরা ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকারে একনিষ্ঠ থেকে আন্দোলনকে সফল করে তুলেছিলেন। মোদী সরকার কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য চালু করা এবং বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ পর্যন্ত চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে। কৃষক-শ্রমিকের যৌথ সম্মেলন তাকে ধিক্কার জানায়। তীব্র বেকারি, নিরাপত্তাহীন কাজ এবং মূল্যবৃদ্ধির ইস্যুগুলোতেও সোচ্চার হয়। শ্রমিকদের জন্য মোদী সরকার যে চারটি শ্রম বিধি এনেছে সেগুলিকে ‘শ্রমজীবী জনগণের দাসত্বের আধুনিক বিধি’ বলে অভিহিত করে সেগুলির তীব্র বিরোধিতা করা হয়। ভারতের শ্রমিকেরা কঠোর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হয়ে এখন সঙ্গিন পরিস্থিতিতে জীবনধারণে বাধ্য হচ্ছেন।

শিক্ষা ও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা-সহ অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেরই বেসরকারিকরণ ঘটানোর যে নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে সম্মেলন তার তীব্র বিরোধিতা করে। সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থাকে খর্ব করা এবং সাধারণ জনগণের ওপর গুরুভার করের বোঝা চাপানো দেশকে পশ্চাৎমুখী করে তুলছে আর বড় বড় কর্পোরেটরা পাচ্ছে নানান ছাড় ও দেদার মাগনা উপহার। মোদী সরকার বিভেদমূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চালানোর সাথে ধারাবাহিকভাবে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত হানছে, এবং বিরোধী কণ্ঠস্বরের ওপর ক্রমবর্ধমান দমন চালিয়ে যাচ্ছে।

পেশা এবং অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নানান যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সম্মেলন সেগুলিকে স্বাগত জানায় এবং আরও শক্তি ও সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে সেগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে। সম্মেলন একটি দাবি সনদ পাশ করে যেগুলির মধ্যে রয়েছে : মোদী সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে শস্য কেনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার আইনি নিশ্চয়তা দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনাকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের মাধ্যমে শস্য বীমা প্রকল্প চালু করতে হবে, কৃষকদের দেয় সমস্ত ঋণ মুকুব করতে হবে, মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ওপর থেকে জিএসটি প্রত্যাহার করতে হবে, খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে, সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নীতি গ্ৰহণ করতে হবে, জাতীয় ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি চালু করতে হবে, বেসরকারিকরণের নীতি বাতিল করতে হবে, সমস্ত শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনতে হবে, ইত্যাদি।

আগামী কয়েক মাস ধরে নিম্নলিখিত কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়ে সম্মেলন শেষ হয় : 

১) ২০২৩-এর ৩ অক্টোবর অন্ধকার দিবস হিসাবে পালন করে (২০২১-এর এই দিনেই লখিমপুর খেরিতে কৃষক হত্যা হয়েছিল) এবং মূল চক্রী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে বরখাস্ত করা ও তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার দাবি তুলতে হবে।

২) সারা দেশে ২৬ থেকে ২৮ নভেম্বর রাজ্যে রাজ্যে রাজভবনগুলির সামনে দিন ও রাতের ‘মহাসমাবেশ’ আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে।

৩) ২০২৩-এর ডিসেম্বর ও ২০২৪-এর জানুয়ারি মাস ধরে সারা দেশেই সুদৃঢ় ও বৃহৎ আকারে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে।

united-kisan-morcha-west-bengalannouncement-of-united-kisan-morcha

সংযুক্ত কিষান মোর্চার পশ্চিমবঙ্গ শাখার পক্ষে আহ্বায়ক অমল হালদার ও সচিব কার্তিক পালের জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে,

গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ কলকাতার হরেকৃষ্ণ কোঙার ভবনে অনুষ্ঠিত সংযুক্ত কিষান মোর্চার পশ্চিমবঙ্গ শাখার বৈঠকে আলোচিত বিষয়গুলি এবং গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ -

১) বর্তমান জাতীয় ও রাজ্যের কৃষি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার আগামী কর্মসূচিগুলি এ রাজ্যে রূপায়িত হবে। আগামী ১ মাস ব্যাপী রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় নিবিড় প্রচার চালিয়ে নিম্নলিখিত কর্মসূচিগুলিকে সফল করে তুলতে হবে। গত ২৪ আগস্ট দিল্লীর তালকোটরা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত “কিষান মজদুর কনভেনশন” থেকে এই কর্মসূচিগুলি গৃহীত হয়েছে, যাতে সংযুক্ত কিষান মোর্চার অন্তর্ভুক্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষক সংগঠন, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলি অংশগ্রহণ করে।

২) আগামী ৩ অক্টোবর দমন-বিরোধী দিবস। এই উপলক্ষে সমস্ত জেলার ব্লকে/অঞ্চলে সভা মিছিল প্রভৃতি করতে হবে। গণআন্দোলনের উপর এবং প্রতিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সরকারের নামিয়ে আনা দমনপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এই দিন লখিমপুর খেরিতে কৃষক হত্যা সংগঠিত হয়েছিল। এ জন্য দায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি তুলে ধরা হবে।

৩) আগামী ২৬ - ২৮ নভেম্বর সারা দেশে রাজভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি হবে। ২৭ নভেম্বর কলকাতার বুকে বৃহত্তর সমাবেশ কর্মসূচিতে রাজ্যের সমগ্র শক্তিকে সমাবেশিত করতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন সহ অন্যান্য গণসংগঠন গুলির সাথে যৌথভাবে এই কর্মসূচি পালিত হবে। স্থান সময় প্রভৃতি বিস্তারিত বিষয়গুলি সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলির সাথে আলোচনা করে পরে জানানো হচ্ছে।

৪) সংযুক্ত কিষান মোর্চার রাজ্য কনভেনশন অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে কলকাতায় কেন্দ্রীয়ভাবে করা হবে। সম্ভাব্য স্থান – সুবর্ণ বণিক সভাগৃহ। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি পৃথকভাবে কনভেনশন করার প্রচেষ্টা চালাবে।

৫) বর্তমান পরিস্থিতির যে মূল মূল দিকগুলি নিয়ে আমরা প্রচার অভিযান সংগঠিত করবো তা হল – সারা দেশ জুড়ে কৃষক ও কৃষি সংকট এ রাজ্যের বু্কে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের চাপে মোদী সরকার তিন কৃষি আইন স্থগিত রাখতে বাধ্য হলেও কৃষির কর্পোরেটমুখী পুনর্গঠন জোরালো হয়ে চলেছে। এমএসপি গ্যারান্টি আইন, ঋণমুক্তি, শস্যবীমা, ফসলের ক্ষতিপূরণ সহ কৃষক আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলিকে কোনো মান্যতাই দেওয়া হচ্ছে না। উল্টে কৃষিতে বরাদ্দ অর্থের পরিমান কমিয়ে দিয়ে কর্পোরেটদের বিপুল পরিমানে কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি কৃষি পণ্যের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা কৃষকের স্বার্থবাহী নয়, বরং দেশের বুকে কোম্পানি বানিজ্য ও মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত।

৬) এ রাজ্যে অনাবৃষ্টির কারণে ফসলের বিপুল ক্ষতি ও বিপর্যয়ের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। অবাধে চলছে সারের কালোবাজারি মজুতদারী। বিদ্যুৎ এর মাশুল বৃদ্ধি, ভূপৃষ্ঠ সেচের কোনো পরিকল্পনা না থাকা চাষিদের সংকট তীব্রতর করে তুলেছে। ফসলের কোনো ক্ষতিপূরণ চাষিরা পায় না। এই রাজ্যে এমএসপি আইন প্রনয়নের প্রস্তাব সরকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলেছে। জমির রেকর্ড নিয়ে কারচুপি ও অবৈধ কার্যকলাপ ভূমি দপ্তরের মদতে ঘটে চলেছে। লাগাতার কৃষি জমির পরিমান হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে চলেছে। রাজ্যের সিংহভাগ কৃষি জমিতে চাষাবাদ করছে ছোট ভাগ ও লিজ চাষিরা, এদের সরকারী স্বীকৃতি ও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি, পাশাপাশি ফসলের লাভজনক দাম ও সরকারি ক্রয়ের দাবিগুলি খুবই জ্বলন্ত। ১০০ দিনের কাজ নিয়ে কেন্দ্র রাজ্য কাজিয়া ও টালবাহানায় বঞ্চিত হয়ে চলেছেন কর্মহীনতায় আক্রান্ত গ্রামীণ মজুরেরা।

৭) মোদী সরকার তার সার্বিক সংকট মোচনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চক্রান্ত করে চলেছে। এই  ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সাফল্যের সাথে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়টাকে আমাদের প্রচারে তুলে ধরতে হবে এবং পাল্টা প্রস্তুতি গড়ে তুলতে হবে।

9th-national-conference-of-all-india-progressive-womens-associationall-india-progressive-womens-association

দিল্লী : ৩০ সেপ্টেম্বর – ১ অক্টোবর ২০২৩

আইপোয়ার নবম জাতীয় সম্মেলন অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে আয়োজিত হচ্ছে। দেশজুড়ে এখন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আওয়াজকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্মম চেষ্টা চলছে। মেয়েরা যখনই জীবন, জীবিকা, অধিকার, সমতা ও ন্যায়বিচারের আওয়াজ তোলে তখনই বিজেপি সরকার এবং তার অনুগত সাম্প্রদায়িক বাহিনী আর সরকারের তাঁবেদারি করা সুবিধাভোগী প্রভাবশালী ধর্মীয়-সামাজিক শ্রেণী নিষ্ঠুরভাবে মেয়েদের প্রতিবাদী স্বর দমিয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সামন্ততান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী মূল্যবোধে আটকে থাকা পরিবার ও সমাজ নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।

মহিলা কুস্তিগিরদের উপর বছরের পর বছর যৌনহেনস্থা চালানো বিজেপি সাংসদের শাস্তি হয়না, প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের ওপরই অকথ্য পুলিশি অত্যাচার নামায় মোদী-শাহ। মনিপুরে কুকি সম্প্রদায়ের দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো, মহিলাদের হত্যা ও গণধর্ষণ চলে বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে। গুজরাট দাঙ্গার সময়ে বিজেপির যেসব সাম্প্রদায়িক গুন্ডারা বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ করেছিল ও তাঁর পরিবারের সকলকে খুন করেছিল সেই জঘন্য অপরাধীদের ‘সংস্কারী’ আখ্যা দিয়ে মুক্ত করে ফুল-মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেয় বিজেপি। এই হল বিজেপির ‘বেটি বাঁচাও’ শ্লোগানের আসল চিত্র। আর, ‘বেটি পড়াও’! সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে এতটাই ব্যয়বহুল করে দেওয়া হয়েছে যে সাধারণ পরিবারের মেয়েদের উন্নত মানের শিক্ষার স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে। মুসলিম মেয়েদের হিজাবের অজুহাতে স্কুলে আসা বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে আবার মুসলিম মেয়েদের অধিকারের জন্য মায়াকান্না কেঁদে ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা বলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করছে। অন্যদিকে আরএসএস-বিজেপি নেতারা বহুভাবে প্রতিনিয়িত বলে চলেছে যে মেয়েদের স্থান ঘরের ভেতর। মনুস্মৃতিকে ওরা সংবিধান বানাতে চাইছে, যে মনুস্মৃতি নারী ও শূদ্রকে সমস্ত মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিধান দেয়। মেয়েদের ব্যক্তিগত পছন্দের স্বাধীনতা এবং নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার হিংস্রভাবে দমন করা হচ্ছে। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল রন্ধনকর্মীদের সাম্মানিকের নামে শোষণ করা হচ্ছে। দরিদ্র মহিলাদের জন্য আবাস যোজনায় বাড়ি, একশো দিনের কাজ ও সরকারি হাসপাতালে সুচিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই।

ধর্ম ও ঐতিহ্যের নামে কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় স্বঘোষিত ধর্মগুরুরা খোলাখুলি লিঙ্গ-বিদ্বেষী বক্তব্য ও বিধান দিচ্ছে। সারা দেশে চলে পণের জন্য নিগ্রহ, অনার কিলিং, দলিত ও আদিবাসী মহিলাদের ওপর অত্যাচার, কন্যাভ্রুণ হত্যা, ধর্ষণ ও ডাইনি সন্দেহে হত্যা। নতুন রূপে অপরাধমূলক কার্যকলাপও বেড়ে চলেছে। যেমন, সাইবার ব্ল্যাকমেলিং, অনলাইনে ভয় দেখানো, ট্রল করা, সাইবার পর্নোগ্রাফি, বিকৃত ভিডিওর মাধ্যমে মেয়েদের হেনস্থা করা ইত্যাদি। বিজেপি-আরএসএসের মদতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হিন্দুত্ববাদী দলেরা ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার নামে এই ধরনের লিঙ্গ-বিদ্বেষী ও সমাজ-বিরোধী হিংসা সংগঠিত করছে। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার নামে সমলিঙ্গ বিবাহ আইন প্রস্তাবের সক্রিয় বিরোধিতা করছে। প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের জীবিকা ও সামাজিক সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার বদলে, বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা এঁদের প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখছে।

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি তার জন্মলগ্ন থেকে নারীমুক্তির লড়াই লড়ে আসছে। আমরা ভারতের নারী, সাবিত্রীবাই ফুলে-ফতেমা শেখের বৈপ্লবিক চেতনার উত্তরাধীকারী। আমরা ঘোষণা করছি যে নারীদের ও প্রান্তিক যৌনলিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের অধিকারের উপর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ আমরা মেনে নেব না। লিঙ্গসাম্যের আন্দোলন ও ন্যায়ের পক্ষে থাকা নাগরিকদের প্রতি আইপোয়ার পক্ষ থেকে আহ্বান : “লিঙ্গসাম্যের পক্ষে, নারী স্বাধীনতার সমর্থনে, আরএসএস-বিজেপি’র বিরুদ্ধে আইপোয়ার ৯ম জাতীয় সম্মেলন সফল করুন”।

আমাদের করণীয়, আমাদের দাবি

১) সংবিধান ও ধর্ম-নিরপেক্ষতার বুনিয়াদী মর্মকে ধ্বংস করার চক্রান্ত মানছি না। লিঙ্গ, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর সমান নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

২) অবিলম্বে ২০১৪ সালে ‘মহিলাদের অবস্থা’ (স্ট্যাটাস অফ উইমেন)-র উপর ভিত্তি করে রাখা উচ্চস্তরীয় কমিটির সুপারিশগুলি লাগু করতে হবে।

৩) ব্যক্তিগত বিবাহ আইন ও বিশেষ বিবাহ আইনের পরিভাষায় ন্যায় ও সমতার বিধানগুলি সুস্পষ্ট ও সুনিশ্চিত করতে হবে।

৪) জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ও গণহত্যার সময় মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসাকে তোল্লাই দেওয়ার রাজনীতিকে কড়া হাতে দমন করতে হবে। ভার্মা কমিশনের সুপারিশ (সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যৌন অপরাধের জন্য দোষী ব্যক্তিদের সাধারণ ফৌজদারি আইনের অধীনে বিচার নিশ্চিত করা) লাগু কর।

৫) মহিলাদের উপর যৌনহিংসার ঘটনা প্রতিরোধ করতে ও যৌনহেনস্থায় অভিযুক্তদের ক্ষমতা ও পদমর্যাদার অপব্যবহার বন্ধ করতে প্রতিটি সংগঠিত ও অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় ইন্টারনাল কমপ্লেইন্টস কমিটি ও লোকাল কমপ্লেইন্টস কমিটি গঠন করতে হবে। প্রতিটি কলেজে ও ক্যাম্পাসে নির্বাচিত পড়ুয়া প্রতিনিধিদের নিয়ে যৌনহেনস্থা বিরোধী সচেতনতামূলক সেল গড়ে তুলতে হবে। এই সেলে দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, রুপান্তরকামী ও প্রান্তিক যৌন পরিচয়ের নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

৬) মহিলা ও প্রান্তিক যৌনলিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের উপর নীতিপুলিশি ও সামাজিক শোষণ বন্ধ করতে হবে। নারী ও প্রান্তিক যৌনলিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের শরীর ও মনের উপর স্বায়ত্ত্ব অধিকার সুনিশ্চিত করতে সরকারকে লিঙ্গসাম্যের লক্ষ্যে কাজ করা সংগঠনগুলির সাহায্যে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

৭) মহিলাদের শ্রম লুট করা বন্ধ কর। অবিলম্বে মহিলাদের প্রাপ্য ন্যায্য মজুরি দাও এবং নারী ও শ্রমিক বিরোধী চারটি লেবার কোড বাতিল কর।

৮) প্রকল্প কর্মীদের স্থায়ীকরণ চাই। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অন্তর্গত মহিলাদের জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে। অসংগঠিত শ্রমিক মহিলাদের বিভিন্ন শ্রমিকের অধিকারগুলো দিতে হবে।

৯) ধর্মীয় গুরুদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অবিলম্বে বন্ধ কর। এহেন ধর্মীয় গুরুদের রাজনৈতিক সমর্থন কুড়ানোর জন্য ব্যবহার করা বন্ধ কর।

১০) অবিলম্বে সংসদে মহিলাদের ৩৩ শতাংশ আসন নিশ্চিত করতে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করো। এই বিলে দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, রুপান্তরকামী ও প্রান্তিক যৌন পরিচয়ের নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত কর।

১১) অবিলম্বে মানব পাচার প্রতিরোধ করার জন্য কার্যকরী একটি আইন পাশ কর এবং সেটি লাগু কর।

১২) যৌনহিংসা, লিঙ্গবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার নারী ও প্রান্তিক যৌনলিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত কর।

১৩) স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেসরকারীকরণ মানছি না। প্রতি ৫০০০ জনসংখ্যায় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সহ সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র গঠন করো।

১৪) বেটি পড়ানোর মেকী স্লোগান দেওয়ার বদলে স্নাতকস্তর অবধি মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান কর। শ্রেণী, জাতি, ধর্ম, ভাষা নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি কর।

১৫) রান্নার গ্যাসের দাম ৫০০ টাকা ধার্য কর।

১৬) প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও বিধবা মহিলাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ও সম্মান সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা নাও।

১৭) প্রতিটি পরিবারের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত কর।

১৮) সমলিঙ্গ বিবাহের আইনি স্বীকৃতি চাই। প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষদের জীবিকা ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

১৯) সোমা সেন, গুলফিশা, ফতিমা সহ সব রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি চাই।

a-judicial-inquiry-should-be-conductedkosba-school-student
স্কুল কর্তৃপক্ষ ও রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের উপদেষ্টার সর্বৈব মিথ্যা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যকে ধিক্কার

আইসা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে থেকে নীলাশিস বসু এবং স্বর্ণেন্দু মিত্র একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, কসবার রথতলার সিলভার পয়েন্ট নামক একটি বেসরকারি স্কুলে শান শেখ নামে দশম শ্রেণীর এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আইসা ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে একটি টিম আজ সেই ছাত্রের বাড়িতে পৌঁছায় এবং পরিবার ও প্রতিবেশিদের সাথে কথা বলে। পরিবারটি কসবা রথতলার মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা। ছাত্রের বাবা সেলাইয়ের কাজ করেন ও মা একজন আশা কর্মী। গতকাল স্কুলে মাধ্যমিকের প্রজেক্ট জমা দিতে বাকি সকল পড়ুয়ার সাথে শান’ও উপস্থিত ছিল। দুপুরবেলা স্কুলের দুই শিক্ষিকা তাঁকে পাঁচতলার টিচার্স রুমে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে, পাঁচতলা থেকে একজন নীচে পড়ছে দেখে ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ছেলেটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় স্কুলের সামনে পাওয়া যায়। তাঁর মুখে বেশ কিছু ক্ষতচিহ্নও মিলেছে। তার সহপাঠী ও পরিবারের মতে ছেলেটির উপর পূর্ব ক্ষোভের বদলা নিয়েছে স্কুল।

পরিবারের বক্তব্য অনুযায়ী, লকডাউন পরবর্তী সময়ে, ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এই স্কুলে আন্দোলন গড়ে ওঠে। মৃত ছাত্রের বাবা সেই আন্দোলনে সামনের সারিতে অংশগ্রহণ করেন। সেই থেকেই স্কুল অথোরিটির তরফ থেকে ক্ষোভের শিকার হয় ছাত্রটি। এই ঘটনার পরবর্তী সময়ে স্কুলের তরফ থেকে পুলিশ কিংবা বাড়িতে কোনোরকম খবর দেওয়া হয়নি। সহপাঠীদেরও দাবি, বহু সময় পরে বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখতে পাই, স্কুল থেকে উক্ত ছাত্রের বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি নয়। বাড়ির লোককে তার মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কেও ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ছাত্রটির সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে।

আজ শিশু সুরক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তী স্কুলে পৌঁছে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ছেলেটি অবসাদগ্রস্ত ছিল। তার মা ছোটবেলায় ছেড়ে চলে যায়, বাবার সাথেও পড়ুয়ার সম্পর্ক ভালো ছিল না ইত্যাদি। আমাদের কাছে মৃত ছাত্রের পরিবার জানায়, এই তথ্য সম্পূর্ণ ভুয়ো। আমরা আইসা রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে ধিক্কার জানাই শিশু সুরক্ষা কমিশনের এই মিথ্যাচারের মাধ্যমে তদন্তকে দিকভ্রান্ত করার প্রচেষ্টাকে। একই মিথ্যাচার করতে দেখা যায় স্কুল কর্তৃপক্ষকেও। ঘটনার পরে একদিন কেটে গেলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এখনো পাওয়া যায়নি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট।

আমরা কিছুদিন আগেই দেখেছি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে কিভাবে মারা গেছে এক ছাত্র। অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে দরিদ্র, সংখ্যালঘু পরিবার থেকে উঠে আসা প্রথম প্রজন্মের এক ছাত্রের এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় আজ গোটা রাজ্যের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ গভীরভাবে চিন্তিত। আমরা শান শেখের মৃত্যুর ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাই। দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।

টিমে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে বাবুন চ্যাটার্জি, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, আইসার পক্ষ থেকে স্বর্ণেন্দু মিত্র ও অনন্যা।

first-all-india-conference-of-scheme-workersscheme-workers

অল ইন্ডিয়া স্কীম ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের প্রথম জাতীয় সম্মেলন ৯-১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, পাটনায় অনুষ্ঠিত হবে। তারই সমর্থনে ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ গড়িয়া মোড়ে এক পথসভার আয়োজন করা হয়।

এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত এই সংগঠন আওয়াজ তুলছে,

প্রকল্প কর্মীদের (মিড-ডে-মিল, আশা, অঙ্গনওয়ারী) সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি, সম্মানজনক মজুরি ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে হবে।

এনআরএইচএম, মিড-ডে-মিল, আইসিডিএস প্রভৃতি প্রকল্পগুলোকে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া চলবে না।          
কর্মস্থলে যৌনহেনস্থা রোধী সেল সুনিশ্চিত করতে হবে।

শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড বাতিল কর।

এছাড়াও বিভিন্ন দাবি নিয়ে দেশজুড়ে যে প্রচার কর্মসূচি চলছে তারই অঙ্গ হিসাবে এই পথসভা হয়। সভায় জেলা ট্রেড ইউনিয়নের কর্মী ছাড়াও, আইসিডিএস, মিড-ডে-মিল কর্মী ও ঊষা কারখানার শ্রমিকরাও উপস্থিত ছিলেন।

সভা শুরু হয় গণসংস্কৃতি পরিষদের গণকবিয়াল নীতিশ রায়ের গানের মধ্য দিয়ে। বক্তব্য রাখেন স্কীম ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের রাজ্য প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক জয়শ্রী দাস, রাজ্য প্রস্তুতি কমিটির সদস্য শীলা দে সরকার, শ্রমজীবী মহিলা ও স্কিম কর্মী ঐক্যমঞ্চের স্নিগ্ধা বসু, স্বপ্না চক্রবর্তী, শঙ্করী চ্যাটার্জি, রমা রায় এবং এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু।

সমগ্র সভাটি পরিচালনা করেন এআইসিসিটিইউ জেলা কমিটি নেতা এবং বাঘা যতীন-গড়িয়া-বাশঁদ্রোণী আঞ্চলিক টীমের সম্পাদক তরুণ সরকার।

workers-in-medinipur-municipalitymedinipur-municipality

মেদিনীপুর পুরসভার প্রায় ১৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী’রা ধর্মঘট সহ দীর্ঘ ও লাগাতার লড়াই-এর মাধ্যমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। আন্দোলনের সমগ্র পর্যায়ে মণিপুরে রাষ্ট্রীয় মদতে জাতিদাঙ্গা, হরিয়ানার নূহ’তে বিজেপি, ভিএইচপি, বজরং দলের দ্বারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়েছে। একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গে সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদল ও তাদের পুলিশের দ্বারা ভাঙড়-সহ সর্বত্র যে হত্যাকান্ড ও লাগামহীন সন্ত্রাস চালানো হয়েছে, তারও তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

মেদিনীপুরের পুর শ্রমিকদের লড়াই পুর কর্তৃপক্ষ-কে বাধ্য করেছে WBSUES বা FUND কর্মীদের বেতন দুটি স্ল্যাবে বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। যারা ১ বছর থেকে ৬ বছর পর্যন্ত কাজ করেছে, তাদের দৈনিক বেতন ২২৬ টাকা’র বদলে ২৫০ টাকা হবে। আর যারা ৬ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছে, তাদের দৈনিক বেতন ২২৬ টাকা’র বদলে ২৭৫ টাকা হবে।

যে সকল কর্মীরা অস্থায়ী ও ঠিকা প্রথায় মাসে ২৫ দিন হিসেবে কাজ করতেন, তাদের মধ্যে যারা ৬ বছরের বেশি কাজ করছেন তারা মাস্টাররোলের অন্তর্ভুক্ত হবে, অর্থাৎ প্রতি মাসের সবকটা কর্মদিবসেই কাজ পাবে এবং স্থায়ী কর্মীদের মতন হাজিরা পাবে।

আর যারা ১০ বছর পূর্ণ করেছেন, তারা মাসের ছুটির দিনগুলো সহ সব দিনের সবেতন হাজিরা পাবে। এছাড়াও তারা প্রতি বছরে অতিরিক্ত ৩০ দিনের ছুটি পাবেন।

যারা ২০ বছরের বেশি কাজ করছেন, তাদের বেতন ২০২২-এর মার্চ মাসে যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, সেই পরিমাণে আবার বৃদ্ধি পাবে।

এগুলো ছাড়া ইউনিয়ন দ্বারা নির্বাচিত ২০ জন বেকার নতুন করে কাজ পাবে এবং একইভাবে, ৮ জন ড্রাইভার’ও কাজ পাবে।

আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে শ্রমিকেরা বোনাস পাবে। গত বছর যে ২৬০ জন ঠিকাকর্মী দু’হাজার টাকা করে বোনাস পেয়েছে, তারা এবার সম্পূর্ণ বোনাস পাবে। কারন, এর আগেই আমাদের লড়াইয়ের ফলে পৌরসভাকে ঠিকাপ্রথা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে, এবং এই সকল কর্মীরা বর্তমানে অফিস কর্মীর স্বীকৃতি পেয়েছেন। এছাড়া, ফান্ড  কর্মীরাও বোনাস পাবেন।

মেদিনীপুর পুরসভার ২৫টি ওয়ার্ড জুড়ে সাফাইকর্মী’রা ডেঙ্গু প্রতিরোধের কাজ করে থাকেন। এই কাজের জন্য বছরে ২ থেকে ৩ বার সরকারী ভাতা প্রদান করা হয়। ইউনিয়নের উদ্যোগে এই ভাতা সকল শ্রমিকদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হয়। দুর্গাপূজার আগে একবার এবং নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে আর একবার এই ভাতা দেওয়া হয়ে থাকে। 

জানুয়ারি ২০২৪ থেকে উপরোক্ত সিদ্ধান্তসমূহ লাগু করার দিকে শ্রমিকদের লাগাতার ও তীক্ষ্ণ নজর নিবদ্ধ থাকবে। মেদিনীপুর পুরশ্রমিকদের লাগাতার লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত এই সাফল্য মণিপুরের জাতিদাঙ্গায় নিহত ও আক্রান্ত, হরিয়ানায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত ও আক্রান্ত এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাঙড় সহ সর্বত্র পঞ্চায়েত নির্বাচনে শহীদ-দের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হচ্ছে।

24-parganas-district-womens-associationwomens-association-meeting

৩১ আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার পর দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা অফিসে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর মহিলা সমিতির জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে একটি কর্মী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সম্মেলনের শ্লোগান এবং গোটা দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদের যে আগ্ৰাসন মহিলাদের উপর নামানো হচ্ছে তারই বিরুদ্ধে এক প্রাণবন্ত আলোচনা হয়। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যনেত্রী মিতালী বিশ্বাস। কর্মীরা উৎসাহ ও আগ্রহের সঙ্গে শোনেন। উপস্থিতিও ছিল বেশ ভালো। এই ধরনের আলোচনা মাঝে মধ্যে করার দাবিও উঠে আসে। সমগ্র সভার আয়োজন করেন দেবযানী ও মমতাজ। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন জেলানেত্রী কাজল দত্ত।

protest-in-silsakko-assamprotest-in-silsakko-assam
হেমন্ত বিশ্ব শর্মাকে অবিলম্বে উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে !

প্রকাশ্যে পোশাক খুলতে নারীদের যে পরিমাণ যন্ত্রণা, অসহায়ত্ব ও হতাশার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা কল্পনাতীত। হিন্দুত্ববাদী আইকন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা শাসিত রাজ্য আসামের সিলসাকোর আদিবাসী মহিলারা পোশাক খুলে প্রতিবাদে সামিল হতে বাধ্য হলেন। গত কয়েকদিন ধরে, গুয়াহাটির সিলসাকো এলাকার আদিবাসীরা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। সরকার তাদের দাবিতে কর্ণপাত করেনি। একই এলাকায় টাটার জিঞ্জার হোটেল ভাঙার সাহস সরকারের নেই। বুলডোজার চালানো হচ্ছে আসামের আদিবাসীদের ঘরবাড়ি নিশানা করে। এটাই বিজেপি সরকারের নীতি। সিপিআই(এমএল) এই ঘটনার জন্য হেমন্ত বিশ্ব শর্মার পদত্যাগ এবং অবিলম্বে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে।

ndia-74-percent-of-people-are-malnourishedpeople-are-malnourished

অর্থনৈতিকভাবে দ্রুততম বিকাশশীল দেশের শিরোপা ও এই অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৭.৮ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধির উচ্ছ্বাসে যখন মোদীর ভক্তকুল আকুল, ঠিক তখনই রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট এই বিজ্ঞাপনের গালে সজোরে চপেটাঘাত করল।

স্টেট অফ ফুড সিকুউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (এসওএফআই), ২০২৩, গত মাসে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে ভারতে পুষ্টিকর খাদ্যের দাম বাড়লেও ব্রিকস্ দেশগুলোর মধ্যে (এমনকি নতুন যে ৬টি দেশ যুক্ত হয়েছে) এবং প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে তা বেশ খানিকটা কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ৭৪ শতাংশ ভারতীয় এই পুষ্টিকর খাদ্য কিনতে পারেনা দুর্বল ক্রয় ক্ষমতার জন্য। উল্লিখিত দেশগুলোর মধ্যে ভারতের স্থান সবার নীচে — অর্থাৎ, দেশের ৭৪ শতাংশই মানুষই অপুষ্টির শিকার।

মুম্বাইকে একটা উদাহরণ হিসাবে বেছে নিয়ে দেখানো হয়েছে যে গত পাঁচ বছরে খাদ্যদ্রব্যের দাম ওই রাজ্যে ৬৫ শতাংশ বাড়লেও বেতন বা মজুরি বেড়েছে মাত্র ২৮ থেকে ৩৭ শতাংশ! মুম্বাইকে এজন্য তারা বেছে নিয়েছেন, কারণ ওই সংস্থার মতে সেখানে পরিসংখ্যান পাওয়ার এক ধারাবাহিক রেওয়াজ রয়েছে।

যথারীতি, মোদী সরকার এসওএফআই’র এই রিপোর্ট ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে খারিজ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার উক্ত সংস্থার সমীক্ষার পদ্ধতি, উদ্দেশ্য এবং তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। এই সংস্থাটি বিশ্বজুড়েই সমীক্ষা চালিয়েছে নির্দিষ্ট সূচককে ধরে। তিন বছরের গড় ধরে এই সমীক্ষা তারা চালায়। সেই অনুযায়ী, ২০২০-২২-এ ভারতে ছিল ২৩ কোটি ৩৯ লক্ষ মানুষ যারা অপুষ্টিতে ভুগছেন, আর এশিয়ার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন এই ভারতবর্ষে। ভারতে বেড়ে চলা অসাম্যের জন্যই বাড়ছে এই অপুষ্টি, উল্লিখিত সংস্থার এই পর্যবেক্ষণ ভারত সরকার খারিজ করে দিয়েছে। এদিকে, শেষবারের মতো তৈরি করা মাথাপিছু ভোগ বা কনসামশন এবং ব্যয় সংক্রান্ত সমীক্ষাটি কেন্দ্রীয় সরকার এখনও প্রকাশ করল না। কোন যুক্তির ভিত্তিতে, বা কোন ভিন্ন একগুচ্ছ সূচকের উপর কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে তার কোনো উল্লেখ নেই।

74-percent-of-people-are-malnourished

২০১৯-২০২১’র মধ্যে অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল এশিয় মহাদেশে, আর তারপরই ছিল আফ্রিকা — পুষ্টিকর খাদ্য কেনার সামর্থ যাদের ছিল না। এই দুই মহাদেশের সম্মিলিত যোগফল বৈশ্বিক অপুষ্টির হার বৃদ্ধি করেছে ৯২ শতাংশ! এশিয়া মহাদেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াতেই জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি (১০০ কোটি ৪০ লক্ষ), যাদের মধ্যে ৭২ শতাংশ মানুষের পুষ্টিকর খাবার কেনার সামর্থ নেই। আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষের বসবাস (৭১ কোটি ২০ লক্ষ) আর তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ মানুষ পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারেন না।

আন্তর্জাতিক এই সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১৯’র পর নতুন করে আরও ১২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার কবলে পড়েছেন, যার পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক সংকট। সমীক্ষা আরও জানিয়েছে, ২০১৯-এ ক্ষুধার কবলে ছিল ৬১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ, যা বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৭৩ কোটি ৫০ লক্ষ!

এই সমীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হল, খাদ্য নিরাপত্তা এখন আর শুধু গ্রামীণ সমস্যা নয়। এই সমস্যা এখন গ্রাম শহর নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়েছে। মহিলারা তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যায় অপুষ্টি ও ক্ষুধার কবলে পড়েছেন। বর্তমানে, ২০০ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ, গ্রামীণ মহিলা সহ ২০২২ সালে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত খাদ্য থেকে বঞ্চিত।

দেখা যাচ্ছে, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ বাদে বিশ্বজুড়ে অধিকাংশ মানুষই পুষ্টিকর খাবার কিনে খেতে পারেন না। দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকায় খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির কারণে পুষ্টিকর খাদ্য কেনাকাটা ক্রমেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এরফলে বাড়ছে অপুষ্টি, বয়সের তুলনায় শারীরিক উচ্চতা ও ওজন বাড়ছে না, সদ্যজাত শিশুদের ওজন খুবই কম হচ্ছে।

বৈশ্বিক অসাম্য আজ এক রূঢ় বাস্তব। আমাদের দেশেও এই ফারাক প্রবল বেগে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুষ্ঠিমেয় সুবিধাভোগীরা কুক্ষিগত করেছে দেশের বিপুল সম্পদ, আর জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ক্রমেই দারিদ্র, দুর্দশা অপুষ্টি, অনাহারে তলিয়ে যাচ্ছে।

- অতনু চক্রবর্তী

ripped-open-hidden-investors-exposedopen-hidden-investors-exposed

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ-এর রিপোর্টৈর পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট সেবিকে যে তদন্তের নির্দেশ দেয় সেবি তার আংশিক রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছে গত ২৫ আগস্ট। সেবি তাদের রিপোর্টৈ জানিয়েছে – তারা ২৪টা বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে ২২টা বিষয়ে তদন্ত শেষ করলেও দুটো বিষয়ে তদন্তে যথাযথ অগ্ৰগতি এখনও ঘটাতে পারেনি। তারা ১৩টা লগ্নিকারীর সন্ধান পেয়েছে যারা আদানিদের বিভিন্ন সংস্থায় লগ্নি করেছে। কিন্তু এরা আদানি সরকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিনা তার কিনারা তারা করে উঠতে পারেনি। কিন্তু সেবি কানাগলিতে আটকে গেলেও আদানিদের অস্বচ্ছ বিনিয়োগ জালের রহস্যভেদে সক্ষম হয়েছে বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানকারী সাংবাদিকদের গোষ্ঠী অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)। ওসিসিআরপি-র রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের দুই প্রথিতযশা সংবাদপত্র ফিনান্সিয়াল টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ানে। প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে তদন্তকারী সাংবাদিকরা মরিশাসের মতো কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্যে থাকা বিভিন্ন ফাইল, চুক্তিপত্র, কর্পোরেট রেকর্ড, আদানি গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ই-মেইল, ইত্যাদি পরখ করে আদানিদের সংস্থাগুলোতে বিনিয়োগ করা বিদেশী লগ্নিকারীদের প্রকৃত পরিচয় উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। রিপোর্ট জানিয়েছে, “বিদেশে অস্বচ্ছ কাঠামোয় থাকা অর্থ কেমনভাবে গোপনে ভারতের শেয়ার বাজারে নথিবদ্ধ কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ধাবিত হতে পারে, এই নথিগুলো তাতে আলোকপাত করে।” এই সমস্ত নথির ভিত্তিতে তদন্ত যে লগ্নিকারীদের ওপর থেকে পর্দাটাকে সরিয়ে তাদের প্রকৃত পরিচয়কে উদঘাটিত করল, তারা কারা?

ওসিসিআরপি-র রিপোর্ট যে দুই লগ্নিকারীর উন্মোচন ঘটালো তারা হল সংযুক্ত আরব আমিরশাহির নাসের আলি শাবান আহলি এবং তাইওয়ানের চ্যাং চুং-লিং। এই দুই ব্যক্তিই আদানি পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, তাদের সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর ছিল দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। এদের পরিচালনা করতেন গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানি এবং তাঁরা বিনোদ আদানির সংস্থার ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছেন, আবার ঐ সমস্ত সংস্থার কিছু শেয়ারও কিনেছিলেন। এদের মাধ্যমে ২০১৩ থেকে ২০১৮-র মধ্যে কোটি-কোটি ডলার লগ্নি হয়েছে আদানি গোষ্ঠীর চারটে সংস্থায়।

প্রকাশিত রিপোর্ট জানিয়েছে, আহলি এবং চ্যাং এমার্জিং ইন্ডিয়া ফোকাস ফান্ডস (ইআইএফএফ) এবং ই এম রিসার্জেন্ট ফান্ড (ইএমআরএফ) নামে মরিশাসের দুটো লগ্নি তহবিলে প্রচুর অর্থ পাঠায়। এই অর্থ পাঠানো হয়েছিল পাঁচটা সংস্থার মাধ্যমে। এদের মধ্যে চারটে কোম্পানি হল ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের লিঙ্গো ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড যার মালিক চ্যাং; সংযুক্ত আরব আমিরশাহির গাল্ফ আরিজ ট্রেডিং এফজেডই যার মালিক আহলি; মরিশাসের মিড ইস্ট ওসেন ট্রেড যার মালিক আহলি; এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের গাল্ফ এশিয়া ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড যার “নিয়ন্ত্রক ব্যক্তি” ছিলেন আহলি; আর পঞ্চম সংস্থাটি ছিল বারমুডার লগ্নি তহবিল গ্লোবাল অপরচুনিটিজ ফান্ড (জিওএফ)। ইআইএফএফ এবং ইএমআরএফ-এ জড়ো করা অর্থ বিনিয়োগ করা হলো আদানিদের সংস্থা আদানি এন্টারপ্রাইজেস, আদানি পাওয়ার, আদানি পোর্টস ও আদানি ট্রান্সমিশনে। এই বিনিয়োগের ফল কী হল? রিপোর্ট জানাচ্ছে, “নথি দেখাচ্ছে যে তাদের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ মাত্রায় আহলি ও চ্যাং ইআইএফএফ ও ইএমআরএফ-এর মাধ্যমে আদানি গোষ্ঠীর চারটে কোম্পানির সাধারণের অধিগ্ৰহণের (অর্থাৎ, কোম্পানি ও তাদের পরিবারের বাইরে) ৮ শতাংশ ও ১৩.৫ শতাংশ শেয়ার অধিগ্ৰহণ করেছিল। তাদের হস্তগত শেয়ারকে যদি বিনোদ আদানির প্রতিনিধি নিয়ন্ত্রিত বলে চিহ্নিত করা হতো তবে আদানি গোষ্ঠীর প্রমোটারের অধীনে থাকা শেয়ার ৭৫ শতাংশের সীমা ছাড়িয়ে যেতে।” অর্থাৎ, সেবি আইনের ১৯এ ধারার লঙ্ঘন যে হয়েছিল, আদানি গোষ্ঠী তাদের কোম্পানিগুলোর ৭৫ শতাংশের বেশি শেয়ার যে নিজেদের অধীনে রেখেছিল তা সুস্পষ্ট।

তবে, আহলি ও চ্যাং-এর অর্থ আদানিদেরই পাচার করা অর্থ কিনা তা রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে বলা নেই। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, “আদানি গোষ্ঠীতে চ্যাং ও আহলির অর্থ আদানি পরিবার থেকে এসেছে এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। এই তহবিলের উৎস অজানাই থেকে গেছে।” কিন্তু অনেক এই অভিযোগ করে থাকেন যে – অবশ্যই কিছু নথির ভিত্তিতে – আদানিদের ১০০ কোটি ডলার অর্থ কর ফাঁকির স্বর্গরাজ্যে পাচার হয়ে ঘুরপথে ফিরে এসে লগ্নি হয়েছে আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোতেই। এবং এই বিনিয়োগই আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলোর শেয়ার মূল্যের বহুগুণ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। উল্লেখ্য যে, নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গোপনীয়তায় মোড়া মরিশাসের তহবিলগুলোর মাধ্যমে বিনিয়োগ বেড়ে চলে এবং ২০০১৭-র মার্চ মাসে চ্যাং ও আহলির বিদেশী কোম্পানির আদানিদের সংস্থাগুলোয় লগ্নি দাঁড়ায় ৪৩০ মিলিয়ন ডলার।

যে প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানে ওঠে তা হল – ওসিসিআরপি যদি আদানিদের কোম্পানিগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রকৃত পরিচয় উদঘাটিত করতে পারে, যদি তারা নথির ভিত্তিতে দেখাতে সক্ষম হয় যে ইআইএফএফ, ইএমআরএফ ও গ্লোবাল অপরচুনিটি ফান্ড ছিল পর্দার আড়াল দেওয়া সেই তহবিল যেগুলোর মাধ্যমে বিনোদ আদানি বিপুল পরিমাণ পুঁজি ঢেলেছেন আদানিদের সংস্থাগুলোয়, তবে সেবি এই বিষয়ে নির্দিষ্ট অগ্ৰগতি ঘটাতে পারছে না কেন? সেবি কি সত্য উদঘাটনে সত্যিই আন্তরিক? সম্প্রতি চর্চিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৪-র জানুয়ারিতে রেভিনিউ ইনটেলিজেন্স-এর ডিরেক্টর নাজিব শাহ তৎকালীন সেবি প্রধান উপেন্দ্র কুমার সিনহাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, “এমন লক্ষণ রয়েছে যে, (আদানিদের) অর্থ লগ্নি এবং বিলগ্নিকরণে খাটতে ভারতের শেয়ার বাজারে পৌঁছে থাকতে পারে।” তাঁর এই চিঠি লেখার কারণ হিসাবে নাজিব শাহ সেবি প্রধানকে জানিয়েছিলেন, সেবি “শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর লেনদেন নিয়ে তদন্ত করছে বলে ধারণা হয়েছিল।” দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, “ওসিসিআরপি উদঘাটিত এবং দ্য গার্ডিয়ানের নজরে আসা একটা চিঠি অনুযায়ী ২০১৪র গোড়ায় শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠীর সন্দেহজনক কার্যকলাপের তথ্যপ্রমাণ সেবির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল – কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে মোদী নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারি নিয়ন্ত্রক আগ্ৰহচ্যুত হয়ে যায় বলেই মনে হয়।” সেবি এখন ঐ সময় আদানিদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ নিয়ে তদন্তের কথা অস্বীকার করছে। আর গৌতম আদানি সে সময়ের সেবি প্রধান উপেন্দ্র সিনহাকে পুরস্কৃত করে এনডি টিভির ডিরেক্টর বানিয়ে দিয়েছেন!

মোদী দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও একবার গলা চড়িয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর বলেছেন – স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তিতে দেশে দুর্নীতি, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। তাঁর দার্শনিক(!) অভিমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনি বলেন, “ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে তা আমাদের কর্মকাণ্ড ও দর্শনের উপর অনেকটাই নির্ভর করছে।” প্রচার দিয়ে বাজিমাতের যে প্রবৃত্তি তাঁর অধিগত, এই বক্তব্যেও সেই প্রয়াস পরিলক্ষিত। দুর্নীতি রোধে তিনি কি সত্যিই আন্তরিক? তাই যদি হয় তবে আদানির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে তিনি সায় দিচ্ছেন না কেন? মানি লণ্ডারিং তথা বিদেশে টাকা পাচার ও ঘুরপথে সেই টাকা ফিরিয়ে এনে তাঁর কোম্পানিতে বিনিয়োগের অভিযোগ যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না কেন? ক্যাগ-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে আদানিদের দুর্নীতির আর একটা নিদর্শন সামনে এসেছে – তারা যোগ্য না হয়েও, রাস্তা নির্মাণের পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও জাতীয় সড়ক কতৃপক্ষ তেলেঙ্গানায় তাদের ২৫০ কিমি রাস্তা নির্মাণের বরাত দিয়েছে। মোদী কি এই অভিযোগের তদন্তে সক্রিয়তা দেখাবেন? সেবি তাদের তদন্তে ব্যর্থ হলে তিনি যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্তে সম্মতি দিচ্ছেন না কেন? তিনি যথার্থই বলেছেন যে তাঁদের “কর্মকাণ্ড ও দর্শন”-এর উপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ ভারতের বিশিষ্টতা। আদানিদের দুর্নীতি এইভাবে প্রশ্রয় পেলে, স্যাঙাতি পুঁজিতন্ত্র অবাধ গতিতে এগিয়ে চললে অর্থনীতির ওপর দুর্নীতিই আধিপত্য করবে, তাঁদের “দর্শন”-এর পরিণামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও সংখ্যাগুরুবাদী স্বৈরতাই দেশে কর্তৃত্ব করবে!

- জয়দীপ মিত্র

impact-of-a-new-set-of-national-lawsnew-set-of-national-laws

নতুন তৈরি একগুচ্ছ জাতীয় আইনের প্রভাব পড়বে অর্থনীতি, পরিবেশ ও নাগরিক অধিকারের মতো নানা বিষয়ে।

ভারতীয় সংসদের সদ্য সমাপ্ত বর্ষাকালীন অধিবেশনে আমরা একের পর এক বিল উত্থাপন করতে দেখেছি মোদী সরকারকে। ২৩ দিনের অধিবেশন পর্বে লোকসভায় ২০টি ও রাজ্যসভায় ৫টি বিল মিলিয়ে মোট ২৫টি বিল উত্থাপিত হয়েছে এই অধিবেশন পর্বে। তারমধ্যে নতুন পুরনো বিল মিলিয়ে লোকসভায় ২২টি বিল আর রাজ্যসভায় ২৫টি বিল পাশ হয়ে গিয়েছে। ২৩টি বিল বিজ্ঞপ্তি জারীর মধ্যে দিয়ে ইতোমধ্যেই আইনে পরিণত হয়েছে। যে সমস্ত বিল সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে তড়িঘড়ি পাশ করানো হয়েছে, সেগুলি এরকম,

  • জীব বৈচিত্র্য (সংশোধন) বিল, ২০২১। এর উদ্দেশ্য বনাঞ্চলের জমি অধিগ্রহণের সময় বনবাসীদের সম্মতির গুরুত্বকে কমিয়ে দেওয়া।

  • মাল্টিস্টেট কো-অপারেটিভ সোসাইটি বিল, ২০২৩। এর উদ্দেশ্য কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়মাবলী তৈরি।

  • তফসিলি উপজাতি আদেশ (পঞ্চম সংশোধন) বিল, ২০২২। ছত্তিশগড়ের তালিকায় আরো কিছু গোষ্ঠীকে উপজাতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা এর উদ্দেশ্য।

  • তফসিলি উপজাতি আদেশ (তৃতীয় সংশোধন) বিল, ২০২২ বন (সংরক্ষণ) সংশোধনী বিল, ২০২৩। এর উদ্দেশ্য বনভূমির জমি অধিগ্রহণের নিয়মাবলীকে শিথিল করা। বনভূমিতে প্রথাগতকাজের বাইরে কিছু অন্যরকম কার্যকলাপকে স্বীকৃতি দেওয়া।

  • জন বিশ্বাস বিল, ২০২২। এর উদ্দেশ্য ব্যবসা করার সুবিধে বাড়াতে ৪২টি আইনের ১৮৩টি নিয়মকে অপরাধমুক্ত করা।

  • খনি ও খনিজ (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) সংশোধনী বিল, ২০২৩। এর উদ্দেশ্য নিলামের মাধ্যমে খনির বন্টন ব্যবস্থাকে প্রসারিত করা।

  • জাতীয় নার্সিং এবং মিড ওয়াইফারি কমিশন বিল, ২০২৩। এর উদ্দেশ্য নার্সিং শিক্ষা ও পরিষেবার মান উন্নত করা।

  • জাতীয় ডেন্টাল কমিশন বিল, ২০২৩। এর উদ্দেশ্য দন্তচিকিত্সার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় ডেন্টাল কমিশন এবং বোর্ড গঠন।

  • সিনেমাটোগ্রাফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৩। এর উদ্দেশ্য অনলাইন ফিল্ম পাইরেসির সমস্যা দূর করা।

  • উপকূলবর্তী এলাকার খনিজ (উন্নয়নও নিয়ন্ত্রণ) সংশোধনী বিল, ২০২৩। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান ও বাণিজ্যিক ব্যবহার এর উদ্দেশ্য।

  • সংবিধান (তফসিলি জাতি) আদেশ (সংশোধন) বিল, ২০২৩।

  • মধ্যস্থতা (মিডিয়েশন) বিল, ২০২১। আদালতের দারস্থ হবার আগে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যেকার বিতর্ক মেটানোর উদ্দেশ্যে এই বিলটি তৈরি। দু’টি মীমাংসা সভার পরে কেউ সন্তুষ্ট না হলে তারপর কোনও পক্ষ আদালতে যেতে পারবে। প্রাক আদালত মীমাংসা বিতর্কের পর্বটি ১৮০ দিনের মধ্যে মেটাতে হবে।

  • জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন (সংশোধনী) বিল, ২০২৩। রাজ্য ও জাতীয় স্তরে জন্ম-মৃত্যুর হিসাব নিকাশ রাখার উদ্দেশ্যে এই বিলটি তৈরি। 

  • অ্যাডভোকেটস (সংশোধনী) বিল, ২০২৩। এই বিলটি বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষকে দালালচক্রর তালিকা প্রকাশ করার ক্ষমতা দেয়।

  • দিল্লীর ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি গভর্নমেন্ট (সংশোধন) বিল, ২০২৩। দিল্লী সরকারের আধিকারিকদের নিয়োগ ও বদলির ওপর দিল্লীর নির্বাচিত সরকারের বদলে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর লক্ষ্যে এই বিলটি তৈরি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য দিল্লীর কেজরীওয়ালের সরকারের করা এই সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টে এই সংক্রান্ত মামলায় কেন্দ্রীয় সরকার হেরে যায়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে উলটে দিয়ে নিজেদের মর্জিমত দিল্লীর নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে চালানোর জন্য কেন্দ্র এই আইন করে। এর বিরুদ্ধে কংগ্রেস সহ ইন্ডিয়া জোটের সব দল একত্রে মোদী সরকারকে ভোট দেয় লোকসভা ও রাজ্যসভায়। রাজ্যসভায় বিজেপির নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বিজু জনতা দল ইত্যাদির সমর্থনে এই বিলটি মোদী সরকার সেখানে পাশ করিয়ে নিতে সমর্থ হয়।

  • দ্য ইন্টার সার্ভিসেস অর্গানাইজেশনস্ (কমান্ড কন্ট্রোল ডিসিপ্লিন) বিল ২০২৩। এই আইন অফিসার-ইন-কমান্ডকে সমস্ত শৃঙ্খলামূলক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা দেয়।

  • দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যামেনমেন্ড বিল, ২০২৩। এটি রাষ্ট্রপতিকে ‘IIM’গুলির কার্যকারিতা নিরীক্ষা করার ক্ষমতা দেয়।

  • দ্য ডিজিটাল পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশান বিল, ২০২৩। বৈদ্যুতিন তথ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে এই বিলটি তৈরি।

  • দ্য ফার্মেসি অ্যামেনমেন্ট বিল, ২০২৩। জম্মু ও কাশ্মীর ফার্মেসি অ্যাক্ট, ২০২১’র অধীনে নিবন্ধিত বা যোগ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কিত একটি বিশেষ বিধান রয়েছে এই বিলটিতে।

  • দ্য কোস্টাল অ্যাকোয়া কালচার অথরিটি (অ্যামেনমেন্ট) বিল ২০২৩। একাধিক সংস্থার কাছ থেকে CRZ ছাড়পত্র পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে যেতে ছোট মাছচাষিদের সাহায্য করতে এই আইনটি সাহায্য করবে বলে কেন্দ্রের দাবি।

  • দ্য অনুসন্ধান ন্যাশানাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন বিল, ২০২৩। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য এবং কৃষিতে গবেষণা এবং উদ্ভাবনের জন্য কৌশলগত দিকনির্দেশ প্রদানের দিকে লক্ষ্য রেখে এই বিলটি তৈরি করা হয়।

দ্য রিপিলিং অ্যান্ড অ্যামেন্ডিং বিল, ২০২২ লোকসভায় পাশ হয়েছে, কিন্তু রাজ্যসভায় এখনো পাশ হয়নি। দ্য প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ পিরিওডিকাল বিল, ২০২৩ রাজ্যসভায় পাশ হয়েছে ৩ অগস্ট ২০২৩, কিন্তু লোকসভায় এখনো পাশ হয়নি।

যে বিলগুলি সংসদে উত্থাপিত হয়েছে কিন্তু এখনো পাশ হয়নি তারমধ্যে আছে জম্মু কাশ্মীর সংক্রান্ত চারটি বিল। সেগুলি হল — জম্মু ও কাশ্মীর সংরক্ষণ (সংশোধন) বিল, ২০২৩; জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন (সংশোধন) বিল, ২০২৩; জম্মু ও কাশ্মীর তফসিলি জাতি আদেশ (সংশোধন) বিল, ২০২৩; জম্মু ও কাশ্মীর তফসিলি উপজাতি আদেশ (সংশোধন) বিল, ২০২৩। এছাড়াও দুটি বিল — প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগের শর্তাবলী এবং অফিসের মেয়াদ) বিল, ২০২৩; পোস্ট অফিস বিল, ২০২৩ — সংসদে উত্থাপিত হয়েছে, কিন্তু কোনও কক্ষেই এখনো পাশ হয়নি।

অর্থনীতি, পরিবেশ, নাগরিক অধিকারের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিছু দিককে এই নতুন আইনগুলি প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে। সেজন্য এই বিলগুলি নিয়ে তাড়াহুড়ো না করে ধৈর্য ধরে গভীরভাবে আলোচনা করা দরকার ছিল বলে বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক নেতা থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন। কিন্তু সেটা করা হয়নি।

- সৌভিক ঘোষাল

Do-not-give-up-fight_juDo-not-give-up-fight_0

বিগত ৯ আগস্ট মধ্যরাত্রে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা যাদবপুরের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারী সবাইকেই স্তব্ধ করে দিয়েছে প্রায়। রেগিংয়ের ভয়াবহতা অন্যান্য ক্যাম্পাসের মতোই যাদবপুরেও যে প্রচণ্ডভাবে বিদ্যমান, যা এক শিক্ষার্থীর জীবনকে যে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দিতে পারে এটা অনেকেই হয়তো ভেবে উঠতে পারছিলেন না। তথাকথিত গণতান্ত্রিক পরিসর, আলোচনার মাধ্যমে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে অনুশীলন যাদবপুরের ছাত্র রাজনীতিতে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছিল, তা যে পড়ুয়াদেরকে নিজের অভিজ্ঞতা, কোনও অবিচার হলে তার কথা সবার সামনে বলার ক্ষমতা জুগিয়েছে তা নিয়ে হয়তো আমরাও কিছুটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। হয়তো সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি সেই লক্ষ্য, অনুশীলনে কিছুটা খামতি রয়ে গিয়েছিল। তার মূল্য দিতে হল একটা জীবন দিয়ে।

তবে তার পরবর্তী সময়ে যে ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল চলেছে এবং ৯ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে জনচেতনার মধ্যে যাদবপুর সম্বন্ধে যে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে তা আসলেই ক্ষতিকারক। কারণ আক্রমণ ‘রেগিং’-এর উপর নয় বরং ক্যাম্পাস গণতন্ত্র, ঐক্যবদ্ধতা এবং সার্বিকভাবে সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রের উপরে পড়ছে যা বহু সাধারণ পরিবারের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে!

রেগিংয়ের সমস্যা 

বিভিন্নি সুত্রে দেখা যাচ্ছে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৫১১টি রেগিংয়ের ঘটনার রিপোর্ট জমা পড়েছে ইউজিসি-র কাছে। সংখ্যাটা প্রথমে খুব কম লাগলেও মনে রাখতে হবে যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের জানাই থাকে না যে কিভাবে অভিযোগ নথিভুক্ত  করতে হয় বা কর্তৃপক্ষের তরফে তা চেপে দেওয়া হয়। অন্যদিকে আমরা এও দেখি যে কিভাবে রেগিংয়ের ঘটনাকে বা তার কারণে মৃত্যু হলে সেটাকে খুব সুপরিকল্পিতভাবে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়। যাদবপুরের ছাত্র হত্যার ঘটনা সামনে আসার সাথে সাথেই আমরা দেখতে পেলাম কিভাবে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়-আইআইটি খড়গপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগিংয়ের ঘটনা সামনে আসছে। আইআইটি খড়গপুরের ফায়জান আহমেদ-র মৃত্যুকেও কর্তৃপক্ষ সুপরিকল্পিতভাবে আত্মহত্যা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে।

তাই স্বপ্নদীপের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘যাদবপুরের’ ঘটনা হিসেবে বারবার বিভিন্নভাবে বলে আসলেই তো ‘রেগিং’-য়ের ভয়াবহতা সার্বিকভাবে যে ক্যাম্পাসগুলোতে বিদ্যমান তা আড়াল করার একটা চেষ্টা চলছে। তাই আজকে শুধু স্বপ্নদীপের মৃত্যুর বিচার আমরা যদি বলি এবং ফায়জানের মতো শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর বিচারের কথা না বলি তাহলে কোথাও বিচার আংশিক রয়ে যায়। রেগিং বিরোধী জনমত তৈরি করতে গেলে এই পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ঘটে চলা ঘটনার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

কেন হোস্টেল?

তবে প্রশ্নে যখন যাদবপুর রয়েছে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলগুলি নিয়েও কিছু কথা বলা প্রয়োজন রয়েছে – বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদবপুর ক্যাম্পাসের ভেতরে এবং যাদবপুর থানা সংলগ্ন মেইন হোস্টেল মিলিয়ে ১৩টি ব্লক রয়েছে যেখানে প্রায় ২০০০-এরও বেশি ছাত্রছাত্রীরা বোর্ডার এবং গেস্ট হিসেবে থাকেন। সল্টলেক ক্যাম্পাসেও রয়েছে আরও কয়েকশো ছাত্রছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা। কারা থাকেন এই হোস্টেলগুলিতে? মূলত দারিদ্র সীমার আশেপাশে থাকা তথা কৃষিজীবী-শ্রমজীবী পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরা যারা জীবনের সাথে এক অসম সংঘর্ষ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসেন। ন্যূনতম টাকার বিনিময়ে হোস্টেলগুলিতে থাকা যায় এবং তার থেকেও কম খরচে পড়াশোনা করা যায়। তবে এই টাকাও প্রতিবছর অনেকে জোগাড় করে উঠতে পারেন না; তাদের জন্যে রয়েছে স্কলারশিপ-আন্দোলনের ফসল। প্রায় কয়েক দশকের উপর সময় ধরে বারবার হোস্টেল ফি/কোর্স ফি বাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ কিন্তু পারেনি; কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্র আন্দোলন এবং তার ফলে আজকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন কৃতী ছাত্রছাত্রীরা যারা বিভিন্নভাবে সমাজকে দিয়ে চলেছেন অনেককিছু। সাম্প্রতিক চন্দ্রযান অভিযানে যুক্ত বিজ্ঞানীরাও এই ব্যবস্থারই ফলাফল।

মিডিয়া ট্রায়ালে বারবার প্রশ্ন উঠেছে যে প্রাক্তনীরা যাদবপুরে কিভাবে গেস্ট হিসেবে থাকেন? প্রচণ্ড চাপের মুখে কর্তৃপক্ষ নোটিশ জারি করে সমস্ত গেস্টদের বের করে দিল হোস্টেল থেকে। সত্যটা কী? পাশ করার পর তারা কয়েকমাস থাকেন কারণ একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীরাই এই হস্টেলগুলিতে থেকে চাকরীর পরীক্ষা বা অন্যান্য পরীক্ষার প্রস্তুতি চালান এবং হোস্টেল থেকে বেরিয়ে গেলে তাদের ওইটুকু সামর্থ্য নেই যে শহরাঞ্চলে টিকে থাকবেন।

হোস্টেলে কি সবাই রেগিং করেন? স্পষ্ট উত্তরটা না। তাই মুষ্টিমেয়র দোষের ভাগীদার সবাইকে করে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা আসলেই অনেকের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে কেড়ে নিচ্ছি কিনা সেটাও ভেবে দ্যাখার দরকার রয়েছে।

কর্তৃপক্ষকে দায় নিতে হবে!

অন্যদিকে বারবার প্রশ্ন উঠেছে যে এতদিন ধরে রেগিং বিরোধী প্রচারাভিযান কেন চলেনি ক্যাম্পাসে? অভিযোগটা মিথ্যে। রেগিং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বারবার লড়াইয়ে নেমেছে আইসা। ২০০২ সালের থেকে সংগঠনের কর্মীরা বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছে; এর ফলে অনেককে বের করে দেওয়া হয়েছে হোস্টেল থেকে যারা লড়াই করেছেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ চুপ থেকেছে বা তদন্ত এগোয়নি। ২০১৩ সালে রেগিংয়ের প্রতিবাদ করায় চাপের মুখে পড়তে হয় আইসার কর্মীদের। ২০১৫ সালে আইসা-র দুই কর্মীকে রেগিংয়ের বিরোধীতা করার কারণে তাদের সাধারণ সভা ডেকে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি বের করে দেয় হোস্টেল থেকে; কর্তৃপক্ষ তখনও চুপ থেকেছে।

অ্যান্টি রেগিং সেল-এর যে কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তাতে কারা রয়েছেন এটা কেউ কয়েকদিন আগে অব্দিও জানতো না কারণ তার কোনও কাজ মূলত ক্যাম্পাসে ছিল না। আইসিসি-র কমিটির মতোই সেটিও বিকল বছরের পর বছর। অ্যান্টি রেগিং সেলের অন্যতম কাজ হল রেগিং-বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তার জন্যে প্রয়োজন নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই প্রচার নিয়ে যাওয়া, হোস্টেলগুলিতে আলোচনার পরিসর গড়ে তোলা। বিগত সময়ে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সেই প্রচেষ্টা ছিল ‘শূন্য’। তাই এই ঘটনা হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নয় বরং পরিকাঠামোহীনতা এবং কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকেই তা সামনে আনে। স্বপ্নের মৃত্যুর দায় তাদেরকে নিতেই হবে!

মিডিয়া ট্রায়াল ও সিসিটিভি বিতর্ক

স্বপ্ন-র মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে মিডিয়া ট্রায়াল চলেছে তা অচিরেই ‘রেগিং’ থেকে ‘যাদবপুর’-এ সরে গিয়েছে। অর্থাৎ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ‘যাদবপুরের বামপন্থী’,’সিসিটিভি’, ‘সিকিউরিটি’, ‘যাদবপুরের সংস্কৃতি’ এরকম আরও কিছু শব্দ। মিডিয়া অ্যাঙ্কররা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরকে ডেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালিয়েছেন জেরা। বড় বিশারদ এবং তার থেকেও বড় তাদের জ্ঞানের ভার। সব কিছুর সোজা উত্তর – ‘সিসিটিভি’। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায় যে ‘সিসিটিভি’ ও ‘বায়োমেট্রিক’ রেগিং সমস্যা সমাধানের একমাত্র রাস্তা তাহলে প্রতিনিয়ত আইআইটি, মেডিক্যাল কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রেগিংয়ের ঘটনাগুলি বেড়ে চলে কিভাবে? এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্যাম্পাসেই সিসিটিভি, বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা রয়েছে!

কথায় আসছে ইউজিসি-র গাইডলাইন - একবার চোখ বোলালেই দ্যাখা যাবে ২০২২ সালের পরিবর্তিত গাইডলাইনে ইউজিসি মূলত রাস্তা, লাইব্রেরী, গেট এবং এমন অংশ যেখানে জনগণের অনুপ্রবেশের বিষয় রয়েছে সেখানে সিসিটিভি বসাতে বলেছে এবং বায়োমেট্রিকের মূল উদ্দেশ্য ছাত্রছাত্রীদের উপর বর্ধিত নজরদারি, তারা কতদিন ক্লাসে আসেন এই সমস্ত বিষয়। কিন্তু এই ইউজিসি-র গাইডলাইনে রেগিং বিরোধী সচেতনতা নিয়ে রয়েছে ন্যূনতম কিছু বিধান যা খাতায় কলমেও দেখানো সম্ভব। যাদবপুরের মতো ক্যাম্পাসে যেখানে হোস্টেল ছাড়াও রয়েছে আবাসন, কর্মচারীদের থাকার জায়গা, শিক্ষকদের কোয়ার্টার, সেখানে হঠাৎ করে আইকার্ড দেখতে চাওয়াটাও সৃষ্টি করতে পারে নতুন সমস্যা এবং পর্যাপ্ত পরিকাঠামো ছাড়া তা কখনই সম্ভব নয়।

স্বাভাবিকভাবেই তাই ‘সিসিটিভি’ বা অন্যান্য বক্তব্য আসলে রেগিংকে রোখার সক্রিয় প্রচেষ্টার বিষয়ের সাথে যুক্ত নয় অর্থাৎ ‘সিসিটিভি’, ‘বায়োমেট্রিক’ বা ‘আইডি কার্ড’ কোনোভাবেই রেগিংয়ের সমস্যাকে সমাধানের লক্ষ্যে নয়। সংবাদমাধ্যমগুলির কাছে শাসকশ্রেণীর নির্দেশও হয়তো অন্যরকম বলে অনুমান করা যায়। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সিসিটিভি’, ‘বায়োমেট্রিক’ বা ‘আইডি কার্ড’ এসবের ব্যবস্থার কথার সাথে যোগ রয়েছে অন্য এক বিষয়ের – সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিকে আঘাতপ্রাপ্ত করার চেষ্টা; ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক পরিসরকে শেষ করে দিয়ে সোজাসুজি শাসকদল পরিচালিত কর্তৃপক্ষের শাসনের অধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা। জেএনইউ, জামিয়া সহ এই রাজ্যের বিশ্বভারতী বা প্রেসিডেন্সীর ছাত্র আন্দোলনের উপর সরাসরি আক্রমণ তা জানান দেয় যে আসল লক্ষ্যটা কি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিটিভি বসবে কি বসবে না বা কিভাবে তা পরিচালিত হবে এই আলোচনার আগে প্রয়োজন রয়েছে। মিডিয়া ঠিক করে দেবে না যে ক্যাম্পাসে কী হবে আর কী হবে না। বরং তার জন্যে ক্যাম্পাসের সমস্ত অংশীদারদের অর্থাৎ শিক্ষার্থী-গবেষক-শিক্ষক ও কর্মচারীদের ঐকমত্যে আসার প্রয়োজন রয়েছে।

এই মিডিয়া ট্রায়ালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল যাদবপুরের মধ্যে দিয়ে আসলে সার্বিকভাবে সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিরোধী এক জনমত গড়ে তোলা। আর তাতে আখেরে সুবিধা কাদের? গত কয়েকদিন ধরে দৈনিক কাগজগুলি খুললে দেখতে পাবেন যে বেসরকারি কলেজের বিজ্ঞাপন – ‘রেগিংমুক্ত ক্যাম্পাস’! আর যা উহ্য তা হল – টাকা থাকলে পড়তে আসুন।

সুযোগের সদ্ব্যবহার 

যখন এই লেখাটা লেখা হচ্ছে তখন আচার্য তথা গভর্নর সমস্ত আইনকানুনকে অগ্রাহ্য করে দিয়ে মূলত বিজেপি-র শিক্ষক সংগঠনের একের পর এক কর্মীদের উপাচার্য পদে নিয়োগ করে নিয়েছেন। আবার নিজেকে উপাচার্য হিসেবেও দাবি করছেন।

বিগত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহকে যদি একটু বিশ্লেষণ করা যায় তো দেখা যাবে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিজেপি একদিকে যেমন তাদের বামপন্থা বিরোধী প্রচার আরও জোরদার করেছে সেরকমই রাজ্যপালের তরফ থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অস্থায়ী উপাচার্যের নিয়োগ হয়েছে। বিজেপি-র শিক্ষক সংগঠনের অন্যতম সদস্য হওয়ার কারণেই এই নিয়োগ। উপাচার্য দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই প্রথমে ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলতে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অংশীদারদের নিয়ে আলোচনায় বসতে তিনি অস্বীকার করেন। অর্থাৎ বিষয়টা খুব স্পষ্ট যে মৃত্যুর ঘটনাকে ব্যবহার করে যাদবপুরের গণতান্ত্রিক পরিসর, স্বায়ত্ততা নস্যাৎ করে দেওয়ার এই সুযোগকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছে কেন্দ্রের শাসক দল এবং তাদের সামনে কার্যত নতিস্বীকার করে নিয়েছে তৃণমূল। রাজশাসনকে রুখে দেওয়ার স্পর্ধা যে তাদেরও চক্ষুশূল আর তাই মুখ্যমন্ত্রী যাদবপুরকে আখ্যায়িত করলেন ‘আতঙ্কপুর’ নামে। অথচ এই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই দেশীয় শিক্ষাক্ষেত্রে রাজ্যের নাম উজ্জ্বল!

বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

তদন্তের রিপোর্ট যাতে দ্রুততার সাথে প্রকাশ করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি-সহ অ্যান্টি রেগিং সেল পুনর্গঠনের দাবিতে যে অবস্থান আইসা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করে তার ৩৬৮ ঘণ্টা অবস্থান চলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী কমিটি একটি রিপোর্ট জমা করলেও কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা এবং রেগিং বিরোধী প্রচারভিযানের বিষয়ে কোনও মিটিং করতে রাজি ছিল না। নবনিযুক্ত উপাচার্য ভেবেছিলেন কারুর তোয়াক্কা না করেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন এবং উল্টে হুমকির সুরে বারবার প্রাক্তন সেনা অফিসার নিয়োগের কথা বলে গিয়েছেন। তাই তিনি প্রায় ১৬ দিন ছাত্রছাত্রীদের সাথে দ্যাখা করতে অস্বীকার করেন এবং শেষ অব্দি ঘেরাও-বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে বাধ্য হন ১ সেপ্টেম্বর স্টেকহোল্ডারস মিটিং ডাকতে।

সেই বৈঠকে তিনটে ছাত্র ইউনিয়ন, অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা, শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা এবং গবেষক সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আইসা-র পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানানো হয় যে অবিলম্বে অ্যান্টি রেগিং স্কোয়াড গঠন এবং হোস্টেল সহ ক্যাম্পাসে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে প্রচার চালাতে হবে। ক্যাম্পাসের সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্থায়ী এবং অস্থায়ী সুরক্ষাকর্মীদের বাড়তি ক্ষমতা দিতে হবে। এছাড়াও আইসা উক্ত বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি কাউন্সিলের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন, জিএসক্যাশ ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানায়। সাংগঠনিকভাবে আমাদের কর্মীরা এদিনের বৈঠকে জোর দেন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে শুরু করার জন্যে কারণ এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একদিকে রেগিং ও যৌন হেনস্থা বিরোধী সচেতনতার বিষয়কে যেমন শিক্ষার্থীদের আলোচনার পরিসরে নিয়ে আসা যায় সেরকম এক সচল কাঠামো গঠন করা সম্ভব যা যেকোনো বৈষম্যের ঘটনার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। ভাবার বিষয় এটাই যে উপরিউক্ত দাবিগুলির কোনোটার বিষয়েই কর্তৃপক্ষ কোনও নির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারেনি বরং তারা বারবার এড়িয়ে যেতে চেয়েছে বিষয়গুলি।

ক্যাম্পাসের সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলিকে সচল করার লক্ষ্যে উপরিউক্ত দাবি সহ অন্যান্য আরও কিছু দাবি নিয়ে আইসার এই পর্যায়ের প্রচারাভিযান চলছে। এর সাথে সাথেই বিজেপি-আরএসএস প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ততার উপরে যে আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তার বিরুদ্ধে আগামীতে লড়াইয়ের চলছে প্রস্তুতি। সারাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখেই ক্যাম্পাসেও বিজেপি-আরএসএস বিরোধী জনমতকে শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠা করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই কর্মীরা কাজ করে চলেছেন বৃহত্তর আন্দোলনের পরিসর তৈরির।

শেষ বিচারে এটাই বলার যে এই যাদবপুর স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ফ্যাসিবাদী-দক্ষিণপন্থী শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে চালিয়ে এসেছে সেই ঐতিহ্যকে সামনে রেখেই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা ব্যরিকেড করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। ৭০-র দশকের রাজনৈতিক সংগ্রামে ছাত্রদের যোগদানের কথা শত চেষ্টা করেও ভুলিয়ে দিতে পারেনি শাসকশ্রেণি, এখনো যাদবপুর আশু-তিমিরের। তাই এবারও ফ্যাসিবাদীদের, দক্ষিণপন্থিদের বিরুদ্ধে চলবে হার না মানা লড়াই-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ততা, গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই, চলবে সবার শিক্ষার অধিকারকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।

নো পাসারান!

ঋতম মাজি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

shameless-profundityshameless-profundity_0

ভারতীয় নারীর রাজনৈতিক আত্মঘোষণা রাষ্ট্রের চক্ষুশূল! যেমনটা আমরা দেখেছি শাহীনবাগে। ভারতীয় নারীর স্বাধীনতা, স্বায়ত্ততা, সমানাধিকার- লিঙ্গ-বৈষম্য দীর্ণ সমাজের শিরঃপীড়া! যেমনটা গৈরিক শাসনের ভারতে উত্তরোত্তর বাড়তে দেখছি। কিন্তু সেই নারীই আজ ভোট-রাজনীতির আঙিনায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আর প্রাসঙ্গিক; বিরোধী জোট-রাজনীতির মতোই বড় উৎকণ্ঠা তাকে ঘিরেও! তার ‘মন’ পাওয়া নিয়ে! কারণ? ভোটবাক্স! জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এই ‘অর্ধেক আকাশ’কে আর উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। তাই নির্বাচনী ইস্তাহারে তার জন্য রাজ্যে রাজ্যে হরেক রাজনৈতিক দলের হরেক জনমোহিনী প্রকল্পের মনমোহিনী পসরা!  সেখানে আমাদের ‘বিশ্বগুরু’ পিছিয়ে থাকবেন, এটা হতে পারে? তাই, যে তিনি জাতি-দাঙ্গার আগুনে ৪ মাস ধরে জ্বলতে থাকা ‘ডবল ইঞ্জিনের’ মণিপুরে নারীর চরম লাঞ্ছনায় তিন মাস ‘মৌনীবাবা’ ছিলেন, সেই তিনিই ভীষণ দিলখোলা হয়ে ‘ভারতীয় বোনেদের জন্য রাখির উপহার’ ঘোষণা করলেন!

হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য! যে গার্হস্থ্য এলপিজি সিলিন্ডার ২০১৪-র ঠিক আগে প্রায় ৪০০ টাকা ছিল, লাগাতার বাড়তে বাড়তে (বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমার সময়েও) আজ তার দাম ১১৫০ টাকা হয়েছে। জ্বালানির জ্বলনে ভারতীয় মহিলা সমাজ কতবার ছ্যাঁকা খেলেন এই ন’বছরে। উজ্জ্বলা যোজনার কত ‘বোন’ আবার ফিরে গেছেন সেই চোখ জ্বালা করা ঘুঁটে-কাঠ-কয়লায়। অনেকে সিলিন্ডার বিক্রি করে দিয়েছেন। যোজনার বাইরেও অনেক রান্নাঘরে সিলিন্ডার নির্বাসিত। না, তখন আমাদের স্বভাব-অভিনেতা প্রধানমন্ত্রীর প্রাণ এতটুকু গলেনি, সিল্কের রুমালে চোখের কোণ মুছতেও দেখা যায়নি। সেই তিনিই আসন্ন পাঁচটি বিধানসভা তথা ২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে, হঠাৎ সিলিন্ডার পিছু দাম ২০০ টাকা (১৮%) কমিয়ে দিলেন, যোজনার ‘বোনেদের’ জন্য ৪০০ টাকা ছাড়। ভোট বড় বালাই!

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন এই খাতে চলতি অর্থবর্ষে নাকি সরকারের অতিরিক্ত ৭৬৮০ টাকা খরচ হবে। তবে সংবাদসংস্থাসূত্রে জানা যাচ্ছে, সম্ভবত এর সব দায়ভার বহন করতে হবে কেন্দ্রকে নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণনকারী সংস্থাগুলোকেই। তারা (ইন্ডিয়ান অয়েল, হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম, ভারত পেট্রোলিয়াম) বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম ৫ মাসে বিপুল আয় করেছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজি-র দাম কমার জন্য তারা এই ব্যয় বহন করতে পারবে। প্রসঙ্গত সৌদি কন্ট্রাক্ট প্রাইস (যার ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় এলপিজি-র দাম নির্ধারিত হয়) গত মার্চে ছিল প্রতি টন ৭৩২ ডলার, জুলাইয়ে তা কমে হয় ৩৮৫ ইউ এস ডলার। আগস্টে কিছু বেড়ে তা ৪৬৪ ডলার হলেও, একথা বলাই যায়, অপরিশোধিত তেলের আমদানি খরচ গত বছরের তুলনায় অনেকটাই কমেছে। সুতরাং এর সুফল দেশবাসীর নাগরিক হিসাবে অবশ্যই ‘প্রাপ্য’, এটা কোনো ‘দাক্ষিণ্য’ বা ‘উপহার’ নয়!

সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই প্রাপ্য আরও অনেক আগে হাতে পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মেলেনি! মূল্যস্তর কবে থেকে গ্যাস বেলুনের মতো আকাশে উঠে বসে আছে। এই বেলাগাম ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকার চরম ব্যর্থ। আনাজ ও  খাদ্যপণ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে জুলাই মাসে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি পৌঁছেছে ৭.৪৪%-এ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর যতই আশ্বাস দিন, এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে আগামী আরও কয়েক মাস। এমনটাই জানিয়েছে এম আর অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংস। সামনে উৎসব। কিন্তু বহু মানুষ আজ আধপেটা খেয়ে কোনক্রমে বেঁচে আছেন। পুষ্টির মুখ শ্রমজীবী পরিবারগুলো বহুদিন দেখে না। কোভিড-এর সময় থেকে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, হারাচ্ছেন। মজুরি-বেতন বাড়ার পরিবর্তে ক্রমশ কমছে। স্বভাবতই ক্রয়ক্ষমতাও তাই নিম্নমুখী। এই অবস্থায় ঐ ২০০ টাকা কর্পূরের মতো উবে যাবে।

ভোটের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে মহিলাদের দাক্ষিণ্য দেখাতে রাজনৈতিক দলগুলো উৎসুক, প্রতিযোগিতামূলকভাবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৬তম বর্ষে, এই বিপুল জনসংখ্যাকে কেন দাক্ষিণ্যনির্ভর ক্ষুদ-কুঁড়োয় বেঁচে থাকতে হবে? কেন তাদের জন্য নাগরিক হিসাবে প্রাপ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থায় এত অবহেলা?

সাধারণ ঘরের মেয়েদের ক্ষেত্রে অতি ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষার দ্বার ক্রমশ বন্ধ হচ্ছে। মোদী সরকারের সৌজন্যে এখন গবেষণাও কর্পোরেট-অনুদান নির্ভর হয়ে পড়বে। মহিলাদের কর্মসংস্থানও সংকুচিত হয়ে চলেছে। জনসংখ্যার প্রায় ৪৯% মহিলা, কিন্তু বর্তমানে জাতীয় উৎপাদনে তাদের অংশগ্রহণ মাত্র ১৮%। তার জন্য দায়ী সরকারের উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনার অভাব, লিঙ্গ বৈষম্য, সমাজের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ও কুসংস্কার। উচ্চশিক্ষিত মহিলারা উপযুক্ত কাজ ও নিরাপত্তার অভাবে এবং লিঙ্গ বৈষম্যের দরুণ কাজে যোগদানে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। পরোক্ষে তাদের এইভাবেই শ্রমশক্তি থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। আর যাদের পছন্দের কোন সুযোগ নেই, সেই দরিদ্র শ্রমজীবী মহিলাদের অত্যন্ত কম মজুরিতে, চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিকৃষ্ট ধরনের কাজে যোগ দিতে হচ্ছে। যাদের ওপর দেশের শিশু ও মায়ের পুষ্টি নির্ভর করছে, বলতে গেলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অনেকাংশে দাঁড়িয়ে আছে, সেই আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল কর্মীরা কী নৃশংসভাবে সরকারের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন! প্রসঙ্গত বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য সূচকে ভারত বর্তমানে ১৩৫তম অবস্থানে আছে। এর দায় সরকার নেবে না?

ভারতের জিডিপি ৩.৭ লক্ষ কোটি ডলার। কিন্তু মাথাপিছু আয়ে কেন আমরা ১৮১টা দেশের মধ্যে ১৪১তম? বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে কেন আমরা ১২১টি দেশের মধ্যে ১০৭তম? কেন ১% ধনকুবেরের হাতে কেন্দ্রীভূত দেশের ৪০% সম্পদ? জবাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী? তিনি আদিবাসী জনজাতিদের উচ্ছেদ করে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়ে জল জঙ্গল  জমি পাহাড় নদী খেত খামার সমস্ত কিছু ‘নজরানা’ হিসেবে তুলে দিচ্ছেন কর্পোরেটদের হাতে। আর সব কেড়ে নেওয়া দেশবাসীকে তার প্রাপ্যটাই ‘উপহার’ দিচ্ছেন! সীমাহীন নির্লজ্জতা!

ভারতীয় মহিলারা কি সুবিচার পাচ্ছেন? গুজরাত গণনিধনের অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিচার পাননি জাকিয়া জাফরিসহ অন্যান্যরা। ইসরত জাহানের হত্যাকারীরা সাজা পায়নি। বিলকিস বানোর ধর্ষক তথা তার পরিজনদের হত্যাকারীদের সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। মহিলা মানবাধিকার কর্মীদের বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিং এর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তিনি বহাল তবিয়তে সংসদে রয়েছেন। মণিপুরে নারীনিগ্রহের ঘটনায় সারা পৃথিবীর কাছে দেশের মাথা হেঁট হয়ে গেছে অথচ তিনি মামুলি দুঃখপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করেননি। নুহ্-তে এখনও দুষ্কৃতীরা পরিযায়ী শ্রমিকদের মহল্লা ছাড়ার, মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে। প্রশাসন উল্টে বলছে ‘সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব না’। এসব কোনো ব্যাপারে তার মুখে টুঁ-শব্দ নেই। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ভারতীয় নারীর মনে এত ক্ষোভের আগুন জ্বেলে এখন ঐ সামান্য ‘উপহারে’ কি ভোলানো যাবে তাদের?

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

rajaram-lal-salamcomrade-rajaram-lal-salam_0

১ সেপ্টেম্বর কমরেড রাজারাম পাটনার পিএমসিএইচ হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি বিহারের রাজ্য স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ছিলেন এবং ১৯৭৪ সালের আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক ছিলেন। প্রায় আড়াই দশক পর্যন্ত তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং দু-বারের জন্য পার্টি কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

তিনি কাশি জ্বর ও মূত্রনালির সংক্রমণ নিয়ে ভুগছিলেন, কিন্তু আকস্মিক তার চলে যাওয়াটা সকলের কাছে বিরাট এক ধাক্কা। ২৭ অগস্ট তাঁকে পাটনা মেডিকাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দীর্ঘদিন ধরেই  তিনি হাঁপানি ও উচ্চরক্ত চাপ নিয়ে ভুগছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাঁকে ইন্টেন্সিভ কেয়ার থেকে জেনেরাল বেডে স্থানান্তরিত করা হয়। সন্ধ্যায় হাল্কা কিছু খাবার খাওয়ার পর হঠাৎ কমরেডদের সাথে কথোপকথন বন্ধ হয়ে যায়।

তাঁর মৃত্যুর পর বহু সংখ্যক মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও নেতা শ্রদ্ধা জানাতে ছগ্গুবাগে বিধায়কের আবাসে উপস্থিত হন। ৩ সেপ্টেম্বর এক সংক্ষিপ্ত স্মরণ অনুষ্ঠানে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, স্বদেশ ভট্টাচার্জ ও অন্যান্য বক্তারা বক্তব্য রাখার পর অন্তিম যাত্রায় হাজারো মানুষ শোকমিছিলে সামিল হন। বাম দল ও মহাগঠবন্ধনের নেতারাও তাঁকে শ্রদ্ধা জানান।

কমরেড রাজারাম বিপ্লবের জন্য ছিলেন এক উৎসর্গীকৃত প্রাণ, যিনি ছিলেন একজন আদর্শ কমিউনিস্ট। পাটনার এক ছোট শহরতলী ফাতুয়া থেকে তিনি তাঁর জীবন শুরু করেন এবং বিহার, ঝাড়খন্ড, ছত্তিসগড় সহ অনেক রাজ্যেই পার্টির সম্প্রসারণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। পার্টির দিল্লি সদর দপ্তরেও তিনি অনেক বছর দায়িত্ব পালন করেন। সাদামাটা জীবন যাপন ও আদর্শের প্রতি অবিচলতা ছিল তাঁর প্রধান গুণাবলী যা তরুণদের কাছে অনুসরণযোগ্য হয়ে ওঠে। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন এবং বাম আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে বিহার থেকে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন।

comrade-rajaram-lal-salam_1

কমরেড রাজারাম সিপিআই(এম) ছেড়ে ৭০ এর গোড়ার দিকে  এ কে রায় এর সাথে যুক্ত হন। জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সিপিআই(এমএল)-এর সাথে যুক্ত হন, আইপিএফ গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখেন, এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবী গণতন্ত্রের বার্তা ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। এর পর পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে তিনি বিহার ঝাড়খন্ড ও ছত্তিসগড়ে পার্টিকে নেতৃত্ব দেন।

বহু সংখ্যক কর্মী, বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ, ঝাড়খন্ড-উত্তরপ্রদেশ দিল্লির নেতারা তাঁর অন্তিম যাত্রায় উপস্থিত ছিলেন। পার্টির নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর জীবন সাথী সঙ্গীতা ও পুত্র অভিষেকও পাশে ছিলেন। সিপিআই’র রাজ্য সম্পাদক রামনরেশ পান্ডে, সিপিআই(এম)’র অরুণ মিশ্র, আরজেডির নেতা ও বিহার বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার উদয় নারায়ণ চৌধুরি, কংগ্রেস নেতা মোহন শর্মা, প্রখ্যাত সাংবাদিক শ্রীকান্ত সহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ শেষ যাত্রায় সামিল হন। বর্ষীয়ান কমরেড কেডি যাদব প্রয়াত কমরেডের সাথে তাঁর ৫২ বছরের একসাথে চলার স্মৃতি তুলে ধরেন, পার্টির বিরাট এক স্তম্ভ হিসাবে বর্ণনা করেন। ১৯৮২ সালে আইপিএফ এর প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন।

পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁর প্রয়াণে গভীর শোক জ্ঞাপন করছে, তাঁর বিপ্লবী আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গোটা পার্টির কাছে আবেদন জানাচ্ছে।

কমরেড রাজারাম লাল সেলাম।

=== end ===

খণ্ড-30
সংখ্যা-31