আজকের দেশব্রতী : ২৪ আগস্ট ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati_24-aug-23jadavpur-students-take-to-the-streetsjustice-for-swapan's-murder

স্বপ্নদীপের জীবন ব্যর্থ হতে দেব না আমরা। স্বপ্নদীপের ঝরে যাওয়া জীবন সবলে ধাক্কা দিক সমাজে গভীর র‍্যাগিং সংস্কৃতিকে।

স্বপ্নদীপের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই গড়ে তুলেছে সুবিচারের দাবিতে। র‍্যাগিং-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই লড়ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী শিক্ষার্থী সংগঠনগুলি। এখন বিভিন্ন ধারার সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এই সংগ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও কর্মচারীদের সংগঠনও যোগ দিয়েছে। কিন্তু শাসক ও মিডিয়ার বড় অংশ এক নজিরবিহীন আক্রমণ নামিয়ে আনছে সামগ্রিকভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরেই। বাংলার সেরা ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ধ্বংস করে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি-আরএসএস।

যাদবপুরের উপর লাগাতার আক্রমণে বিজেপি-আরএসএস

বিভিন্ন দিক থেকে এই আক্রমণ নামছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতিমধ্যেই শুকিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্র সরকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্পগুলি অর্থাভাবে ধুঁকছে অথবা বন্ধ হয়ে গেছে, গবেষকদের বৃত্তি বন্ধ, প্রাপ্য টাকাও পাচ্ছেন না অনেকে। নতুন যন্ত্রপাতির অভাবে বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাও থমকে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে লোকজন নিয়ে গিয়ে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন “উপড়ে ফেলব”, “তুলে ফেলে দেব” বলে। র‍্যাগিং সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলা বা তুলে ফেলে দেওয়ার কথা বলছেন না তিনি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও তার ঐতিহ্যকে নিকেশ করে দেওয়ার কথা বলছেন। এবং এই জিঘাংসাপূর্ণ ভাষণের কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর দেহরক্ষী দলকে লেলিয়ে দিলেন প্রতিবাদরত ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে। দেহরক্ষী সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান আর বিজেপি যুব মোর্চার ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী মিলে কীরকম নৃশংসভাবে দুজন ছাত্র-ছাত্রীকে রাস্তায় ফেলে মারল সেই চিত্র আপনারা দেখেছেন! রাজ্যের বিরোধী দলনেতা যখন এরকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তখন অন্যদিকে বিজেপি সাংসদ তথা আরএসএস নেতা দিলীপ ঘোষ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের “মাথা থেঁতো করে দেওয়া হবে” বলে প্রকাশ্য হুমকিসহ ঘোষণা দিলেন, “বিজেপি ক্ষমতায় এলে যাদবপুরে জয় শ্রীরাম শ্লোগান হবে”। এবং এগুলো নিছক মৌখিক আস্ফালন নয়, বাস্তবিকই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করতে সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওরা। বামপন্থী শিক্ষার্থী সংগঠনগুলিকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য আদালতে মামলা করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। অন্যদিকে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপগুলিও খবু প্রকট। এরকম একটি মর্মান্তিক ঘটনার পর রাজ্য সরকারকে এড়িয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ আলাদা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়লেন, শোকস্তব্ধ জেইউ কমিউনিটির পাশে দাঁড়াতে নয়, বরং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের “কোর্ট”-এর বৈঠক ডাকলেন নিজের দরবারে এবং শেষে রাজ্য সরকারকে অন্ধকারের সম্পূর্ণ স্বৈরাচারীভাবে আরএসএসের শিক্ষক-নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ করলেন। আরএসএসের শিক্ষক সংগঠনের এই নেতাটি তাঁর ফেসবুক পোস্টে প্রায়শই এসসি-এসটি-ওবিসিদের সংরক্ষণের অধিকারকে ব্যঙ্গ করেন, মেয়েদের প্রতি পিতৃতান্ত্রিক ও নারী-বিদ্বেষী মন্তব্য করেন। আশার কথা হল, রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রাজ্যপালের দ্বারা এরকম একতরফাভাবে উপাচার্য নিয়োগ করাকে সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে।

বিজেপি-আরএসএস নেতারা জেএনইউ-এর উদাহরণ টেনে প্রকাশ্যেই বলছেন, “জেএনইউ-কে যেভাবে ঠাণ্ডা করা হয়েছে সেভাবেই বুটের তলায় পিষে যাদবপুরকে ঠাণ্ডা করা হবে”। জেএনইউ-তে এই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের কদর্য রূপ দেশের মানুষ দেখেছে। মিথ্যা ভিডিও বানিয়ে ধারাবাহিক ব্যাপক কুৎসা, আরএসএস-এর গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে হস্টেলে প্রাণঘাতী হামলা, ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও বহিষ্কার এবং আরএসএস কর্মীকে উপাচার্য পদে নিয়োগের কথা আমরা সকলেই জানি। এখন এই আরএসএস উপাচার্য যথারীতি প্রাক্তন এবিভিপি নেতা তথা কুখ্যাত সঙ্ঘী হিসেবে পরিচিত অধ্যাপকদের বিভিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্রে বসাচ্ছেন। এরকমই এক নেতা সৌরভ শর্মা, ব্রহ্মপুত্র হস্টেলের ওয়ার্ডেন, তিনজন অ-ছাত্র বহিরাগতকে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে হস্টেলের রুম দিয়ে রেখেছিল, ধরা পড়ায় এদের একজন কাঁচি দিয়ে হামলা চালায় হস্টেলের গার্ডের ওপর। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিরোধে শেষ পর্যন্ত এই তিনজনকে বহিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এবং এটা কোনো একক ঘটনা নয়। বয়েজ হস্টেলগুলিতে নতুন ছাত্রদের জায়গা না পাওয়ার যে সমস্যা জেএনইউ-তে সামনে এসেছে তার অন্যতম কারণ এবিভিপির বাহুবলীদের দ্বারা অনেক রুম দখল করে থাকা। বস্তুত কেবল জেএনইউ নয়, সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকেই বুটের তলায় ঠাণ্ডা রাখতে চায় বিজেপি-আরএসএস, তা সে নাজিব আহমেদের ক্যাম্পাস জেএনইউ হোক, রোহিত ভেমুলার ক্যাম্পাস এইচসিইউ হোক বা স্বপ্নদীপের ক্যাম্পাস যাদবপুর।

মুখ্যমন্ত্রীর “আতঙ্কপুর” বক্তব্য ও দায়িত্বহীন সংকীর্ণ রাজনীতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর এরকম সার্বিক আক্রমণের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর “আতঙ্কপুর” বক্তব্য অত্যন্ত দায়িত্বহীন সংকীর্ণ রাজনীতির পরিচায়ক। এবং তা সমাজের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। অত্যন্ত সংকীর্ণ অবস্থান নিয়ে তিনি “আগমার্কা মার্ক্সবাদী”-দের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়েছেন। সিপিএমের সাথে সাথে এক নিঃশ্বাসে তিনি কংগ্রেস ও বিজেপিকে যুক্ত করে দিলেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তাঁর এই বিষোদ্গার বিজেপি-আরএসএস-কে সুযোগ করে দিয়েছে দাঁতনখ খিচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার। অন্যদিকে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি কলকাতায় এক ধরনের সামাজিক হিংসাও প্ররোচিত করেছে তাঁর বক্তব্য। ইতিমধ্যে প্রথম বর্ষের অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে ঘরভাড়া দিতে অস্বীকার করা এবং রাস্তায় জেইউ স্টুডেন্টদের হেনস্থা করার খবরও সামনে এসেছে।

jadavpur-students-take-to-the-streets
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পর্ধার ঐতিহ্য

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পর্ধা এবং আনুগত্য-না-মানার মানসিকতাকে সব শাসকদল বরাবর ভয় পেয়ে এসেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বদেশী ধারায়, ব্রিটিশ সরকারের ওপর নির্ভরশীলতার ও আনুগত্যের আওতার বাইরে, ১৯০৬ সালে বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের মধ্যে দিয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পথ চলা শুরু। নকশালবাড়ি অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ও সাম্প্রতিক দিল্লী-ঘেরা কৃষক আন্দোলন পর্যন্ত কৃষক বিদ্রোহের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কৃষকের পাশে থেকেছে সর্বশক্তি নিয়ে। নব্বই দশক থেকে শুরু হওয়া শিক্ষার ব্যবসায়ীকরণ ও বেসরকারিকরণের প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এরাজ্যে প্রতিরোধের মূল ঘাঁটি থেকেছে যাদবপুর। সেই কারণেই এখানে অন্যান্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় টিউশন ফি সহ পড়াশোনার অন্যান্য খরচ অনেক অনেক কম, যে কারণে যাদবপুরই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে সাধারণ পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসে, আসতে পারে। এরাজ্যে বিগত সরকারের শেষ দিকে গণতন্ত্রের প্রশ্নে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এই ক্যাম্পাসেরই ‘লাঠির মুখে গানের সুর’ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। ২০১২ সালে দিল্লীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্থিত নারীর নির্ভয় স্বাধীনতার বার্তা ২০১৪ সালের ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে, ‘প্যাডস এগেইনস্ট সেক্সিজম’ এবং ‘ভালোবাসার চুম্বন’ নিয়ে হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্টদের নীতি-পুলিশগিরির বিরুদ্ধে বারবার রাস্তায় নামে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৪ সালে মণিপুরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাড়া জাগানো আন্দোলনের সময় হোক বা ইদানিং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ওপর হামলা-গণতান্ত্রিক প্রশ্নে যাদবপুর সর্বদাই সজাগ রেখেছে প্রতিরোধের মশাল। এনআরসির বিরুদ্ধে, সমান নাগরিকত্বের দাবিতে গড়ে ওঠা গণ আন্দোলনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যাদবপুর। শুধু সংগঠনের সদস্যরা নয়, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বেশ বড় অংশ বিভিন্ন প্রতিরোধে অংশ নিয়েছে। লকডাউনের পর্বে দুই বছর ধরে দক্ষিণ কোলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকার গরিব মানুষের মধ্যে প্রত্যহ রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়েছে, আম্ফান বিধ্বস্ত অঞ্চলে একটানা ও বিপুল ত্রাণকার্য সংগঠিত করেছে এবং এসবেরও বহু আগে থেকে এরাজ্যের বন্যাকবলিত এলাকাগুলিতে হোক বা উড়িষ্যার সুপার সাইক্লোন বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতেই হোক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বড় বড় টিম বারবার গেছে। একদিকে ছাত্রস্বার্থ ও গণতন্ত্রের প্রতিটি প্রশ্নে শাসকের চোখে চোখ রেখে লড়াই চালানো, অন্যদিকে গরিব খেটে খাওয়া দেশবাসীর প্রতি ভালোবাসায় একাত্ম হওয়া — শাসকেরা এই ঐতিহ্যকে ভয় পায়। একে দমন করতে চায়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও দক্ষিণপন্থী ক্ষমতাতন্ত্র

এরকম জোরালো প্রগতিশীল ঐতিহ্যবাহী একটি প্রতিষ্ঠানে স্বপ্নদীপের হত্যার মতো এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যাওয়াটা দেখিয়ে দেয় যে সমাজের কত গভীরে রাগিং-সংস্কৃতি ঢুকে আছে। এরকম একটি প্রতিষ্ঠানের হস্টেলে র‍্যাগিং-এর ভয়াবহ ছবি সামনে এসেছে বলেই বোধহয় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে তা অধিক নাড়া দিয়েছে। আমরাও অত্যন্ত মর্মাহত বোধ করেছি। যেখানকার ছাত্র-রাজনীতিতে মূলত বিভিন্ন ধারার বামপন্থী আন্দোলন প্রাধান্যকারী জায়গায় আছে সেখানে কীভাবে ভেতরে ভেতরে এমন এক পশ্চাদপদ ও দমনমূলক চিন্তা-চেতনা কার্যকর থাকতে পারে! এই প্রশ্নে নিশ্চয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষার্থী সংগঠনসহ শিক্ষক ও গবেষক সংগঠনগুলির সার্বিক আত্মসমীক্ষা করা দরকার এবং সেরকম যে শুরুও হয়েছে তার বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কাঠামোতে ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠনগুলির ভাগিদারী বাস্তবে খুবই কম। আগে যেটুকুছিল সেটুকুও কেড়ে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস দলটি সরকারে এসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট ও এক্সেকিউটিভ কাউন্সিলে নির্বাচিত ছাত্র-ছাত্রী প্রতিনিধিত্ব তুলে দেওয়া হয়। ইউনিয়ন ইলেকশনটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলি ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে কোনোদিনই জায়গা পায়নি। কিন্তু প্রকাশ্যে না করতে পারলেও ‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চগুলির মধ্যে ঢুকে থেকে তারা দক্ষিণপন্থী ক্ষমতাতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার কাজ বরাবরই করে এসেছে। এই ধরনের অরাজনৈতিক মঞ্চগুলি মেইন হস্টেলে সম্পূর্ণ প্রাধান্যকারী জায়গায় আছে। কর্তৃপক্ষ এদের মদত দেয় যাতে মেইন হস্টেলে বামপন্থী সংগঠনগুলি প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। কর্তৃপক্ষ ও ‘অরাজনৈতিক’ জোটের আঁতাতের ফলে মেইন হস্টেল চত্বরে কোনো সংগঠনের একটা পোস্টার লাগানো বা প্রচারপত্র বিলি করা কার্যত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ আজ বহু বছর ধরে। কেন্দ্রে বিজেপি-আরএসএসের ক্ষমতা দখলের পর থেকে সমগ্র সমাজে বিভিন্ন ধরনের বিভাজন, জাতবাদী সবর্ণ ঘৃণা ও অবজ্ঞা, পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, পৌরুষের আস্ফালন, বিদ্বেষ ও জিঘাংসা উত্তরোত্তর বেড়েছে যা এই ধরনের হত্যাগুলির মূল চালিকাশক্তি। রোহিত ভেমুলা, পায়েল তাড়বি, দর্শণ শোলাঙ্কি, ফয়জান আহমেদ — দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এরকম অসংখ্য উদাহরণ সামনে আছে।

swapan's-murder
র‍্যাগিং ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অপদার্থতা

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মেইন হস্টেলের র‍্যাগিং-এর বিষয়ে কিছু জানত না এমনটা নয়। অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা) বরাবর র‍্যাগিং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কখনো কখনো এই লড়াই সংঘাতপুর্ণও হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনই এই লড়াইয়ে পাশে এশে দাঁড়ায়নি। ২০১৫ সালে এই এ-ওয়ান-এ-টু ব্লকেই র‍্যাগিং-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য দুজন সিনিয়র আইসা কর্মী জাহাঙ্গীর হোসেইন ও পার্থ মালকে মেরে হষ্টেল থেকে বের করে দিয়েছিল রেগার জোট। এর বিরুদ্ধে আইসার আন্দোলন চলেছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এফআইআর করা হয়েছিল, মামলা এখনো চলছে। অন্যদিকে লিঙ্গসাম্যের প্রশ্নে, “জেণ্ডার জাস্ট ক্যাম্পাস”-এর দাবিতে আন্দোলনও আইসার নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ২০০২ সালে আর্টস ফ্যাকাল্টির এক প্রথম বর্ষের ছাত্রীর যৌন হেনস্থার সুবিচারের দাবিতে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে, এবং পরবর্তীতে হোক কলরবের পরেও বেশ কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই লড়াই চলেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনই এ প্রশ্নে দায়বদ্ধতা ও বিচক্ষণতা দেখায়নি।

অন্যদিকে সমগ্র ক্যাম্পাসে যেখানে ন্যূনতম ৩৮০ জন নিরাপত্তা কর্মী লাগে, সেখানে এখন আছে মাত্র ৮০ জন। প্রতি দিন অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে একাংশ ছুটি নিলে মোটামুটি জনা ষাটেককে দিয়ে ৩৮০ জনের কাজ করিয়ে নিতে হয়। যা আসলে হয় না। হস্টেলে সুপারিন্টেনডেন্ট আগে কোনো শিক্ষককে করা হত। তাঁর একটা অথরিটি থাকত। কিন্তু এখন বাইরের প্রাইভেট সিকিউরিটি সংস্থা থেকে সুপুার নিয়োগ করা হয়।

যাদবপুর ও মিডিয়া ট্রায়াল

এখন রাজ্যের শাসকদল সুযোগ খুঁজছে স্বপ্নদীপের মৃত্যুকে কাজে লাগিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থীদের সরিয়ে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সেই সংকীর্ণ স্বার্থের প্রতিফলন। সেই লক্ষ্যেই বাইরে থেকে মোবিলাইজ করে আক্রমণ হানতে চাইছে তারা। এই হামলাকে প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু টিএমসির এই দখলদারির সংকীর্ণ পন্থার থেকেও অনেক গভীর ও মতাদর্শগত হামলা নামছে হিন্দুত্ববাদী দিক থেকে। মিডিয়ার বড় অংশ তার দোসর। শুভেন্দু অধিকারি, দিলীপ ঘোষ ও রাজ্যপালের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কাঠামোগত হামলার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত মিডিয়ার এই অপপ্রচার। এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন একমাত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই র‍্যাগিংয়ের ও ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী ভারতবর্ষে প্রতি ৪২ মিনিটে একজন ছাত্রের আত্মহননের ঘটনা ঘটে। গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র আইআইটি, এনআইটি ও আইআইএমএসে ছাত্র আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি যার মধ্যে অধিকাংশই র‍্যাগিং-জনিত কারণে। ইউজিসি-র তথ্য অনযুায়ী গত ৫ বছরে রাগিংয়ের কারণেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এমন পড়ুয়ার সংখ্যা ২৫ জন। গোটা দেশ জুড়ে গত ৯ বছর ধরে আরএসএস-বিজেপি যে ঘৃণার রাজনীতির চাষ করে চলেছে তার ফলেই এইভাবে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলামেলা পরিবেশ ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে আক্রমণ করা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ছকে। মেয়েদের নির্ভয় বিচরণের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে মিডিয়া হাউসগুলি। কে ধূমপান করছে, কারা প্রেম করছে তা দেখাতে ওঁৎ পেতে আছে ওরা! যে বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে আদিবাসীদের গায়ে পেচ্ছাপ করে দিয়ে আনন্দ পায়, যারা গুজরাট, মুজফ্ফরনগর, দিল্লী, মণিপুর, হরিয়ানায় দাঙ্গা সংগঠিত করে দেশকে বিভাজিত করতে চায়, যারা সংগঠিত ভিড় হত্যাকে উৎসবের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, নৃশংস হত্যা ও অত্যাচারকে দৃশ্য-শ্রাব্য উপভোগের বিষয় বানিয়ে ফেলতে চাইছে, যারা নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি এনেছে জেএনইউ বা জেইউ-এর মতো সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে শুকিয়ে মেরে আদানি-আম্বানিদের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ব্যবসা সুগম করতে, তাদের কাছে যাদবপুরের প্রতিবাদ বিশেষ বাধাস্বরূপ। মিডিয়ার অপপ্রচারের মাধ্যমে ওরা জনমানসে যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস করে দিতে চায়। সম্পূর্ণ বিষয়টিকে নীতিপুলিশগিরির গ্রহণযোগ্যতার দিকে চালিত করতে চায়।

প্রসঙ্গ সিসিটিভি

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই এই প্রচারের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। র‍্যাগিং বন্ধের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না নিয়ে সিসিটিভি (ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন) ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। প্রথমত এটা সকলেই বুঝবেন যে ক্যামেরা অপরাধ সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর শনাক্তকরণের কাজে পুলিশকে সাহায্য করতে পারে মাত্র। সিসি ক্যামেরা না থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কিন্তু স্বপ্নদীপের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে পেরেছে। চাইলে পুলিশ তা পারে, ক্যামেরার জন্য তা আটকায় না।

অন্যদিকে ফায়জান আহমেদের হত্যার মামলাটি দেখনু। গত বছর অক্টোবর মাসে খড়গপুর আইআইটির হস্টেলে এই উজ্জ্বল মেধাবী ছাত্রের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আইআইটি কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে এটা আত্মহত্যা। পুলিশও চুপচাপ থেকে যায়। ফয়জানের গরিব মা আদালতে গেলে ঘটনার সাত মাস পর আদালতের রায়ে দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেম হলে ঘটনাটি হত্যা বলে চিহ্নিত হয়েছে। তাহলে নজরদারি ক্যামেরায় মোড়া আইআইটি ক্যাম্পাসেও র‍্যাগিং ও হত্যা সম্পূর্ণ চেপে যেতে পারে কর্তৃপক্ষ। মুম্বাই আইআইটির হস্টেলের বারো তলা থেকে ছুঁড়ে দর্শন শোলাঙ্কিকে মেরে ফেলারও কোনো বিচার বা শাস্তি এখনও হয়নি। বস্তুত বহু প্রতিষ্ঠানকে সিসি ক্যামেরায় মুড়ে দেওয়া সত্ত্বেও গত এক বছরে এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে এই ধরনের প্রায় শ’খানেক মৃত্যু/হত্যার ঘটনা সামনে এসেছে। অন্যদিকে নজরদারি ক্যামেরায় ওঠা ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের ব্ল্যাকমেইল করার সম্ভাবনাও প্রবল, নজিরও আছে। এবং বিজেপি-আরএসএসের প্রত্যক্ষ উসকানিতে ক্যামেরার সামনে নৃশংস অত্যাচার ও খুন করে সেই ভিডিও ভাইরাল করার দৃশ্য-শ্রাব্য উল্লাসের ধারা তো আমরা সকলেই দেখছি।

হোস্টেল বিভাজন

দ্বিতীয় যে পদক্ষেপটি নিয়েছে কর্তৃপক্ষ তা হল প্রথম বর্ষের বোর্ডারদের আলাদা হস্টেলে রাখা। আপৎকালীন সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে এটা সঠিক মনে হলেও এই হস্টেল বিভাজন নতুন সমস্যার জন্ম দিতে পারে। যাদবপুরে এখন প্রথম বর্ষকে কর্তৃপক্ষ সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তাতে একধরনের স্থায়ী সন্দেহ ও বৈরিতার ভিত্তি তৈরি হতে পারে। শিবপুর আইআইইএসটি-তে যেমন এই হস্টেল বিভাজনের ফলে এমনকি এক বর্ষের ছাত্রদের সঙ্গে অন্য বর্ষের ছাত্রদের দলবদ্ধ সংঘাতের ঘটনাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ

ক্যাম্পাসে বাইরের মানুষের ঢোকার ক্ষেত্রেও কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। এটাও ক্যাম্পাসকে বিচ্ছিন্ন করে সমস্যা বাড়াবে। র‍্যাগিং সমস্যা ভেতরের বিষয়, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন মানুষের স্বাভাবিক আনোগোনা আটকানো তার সমাধান নয় মোটেই, যে মেইন হস্টেলে র‍্যাগিং চলে বলে প্রকাশ পেয়েছে সেটা যাদবপুর ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থিত। আমরা এর আগেও দেখেছি যখনই যাদবপুরে আন্দোলন হয়েছে, শাসকদল কর্তৃক তাকে বহিরাগত আখ্যা দিয়ে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সিতে ক্লাস ও সেমিনারে যোগ দেওয়ার যে রীতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, তাকে বন্ধ করতে চায় শাসক দল। এমনকি ক্যাম্পাসের ভিতরে তর্কবিতর্ক-মুক্ত চিন্তার যে পরিবেশ বর্তমান, ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ তার প্রতিবন্ধকস্বরূপ। র‍্যাগিং সংক্রান্ত মূল সমস্যার সমাধান না করে মিডিয়ার একাংশ দ্বারা ‘বহিরাগত’ প্রশ্নটাকে মূল ইস্যু করে তোলা স্বপ্নদীপের হত্যার বিচারের লড়াইকে দুর্বল করছে।

streets-demanding-justice
‘স্বপ্ন’ হত্যার বিচারের দাবিতে আইসা

স্বপ্নদীপের হত্যার বিচার চেয়ে এবং র‍্যাগিং সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্রছাত্রী সংগঠনগুলিই লড়াই করছে। ১০ আগস্ট সকালে স্বপ্নদীপের মৃত্যুর খবর সামনে আসতেই আইসার দশম জাতীয় সম্মেলনের (কোলকাতার ইজেডসিসি সভাঘরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল) সর্বভারতীয় মঞ্চ থেকে স্বপ্নদীপের জন্য শোক প্রকাশ ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে বার্তা দেওয়া হয়। একদিন বাদেই আইসার নেতৃত্বে যাদবপুরে লাগাতার অবস্থান শুরু হয়। দু-একদিনের মধ্যেই ক্যাম্পাসে কর্মরত সাতটি শিক্ষার্থী সংগঠন, কর্মচারী সংগঠন ও গবেষকদের সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়। স্বপ্নদীপ হত্যার সুবিচারের বিভিন্ন দিকের দাবি ছাড়াও তারা মূলত যে কাঠামোগত দাবিগুলি তুলে ধরেছে তা হল : ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে অ্যান্টি-র‍্যাগিং কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে; লিঙ্গসাম্য বিষয়ক সংবেদনশীলতা জাগানো ও যৌন হয়রানি নিবারণে একই রকম সেল গঠন করতে হবে; এবং এই কমিটি বা সেলগুলির তত্ত্বাবধানে নিয়মিত কর্মশালার মাধ্যমে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ধারাবাহিক সচেতনতা অভিযান ছাড়া র‍্যাগিং সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

ইতিমধ্যেই বহু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ রাগিং বিরোধিতার সাথে সাথে যাদবপুরের ওপর সামগ্রিক আক্রমণের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন। এই কণ্ঠস্বরগুলিকে আরো বাড়িয়ে তোলা দরকার। যে যাদবপুর বারবার কৃষকের পাশে সর্বস্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছে, আজ কৃষক সমাজকে জোরালোভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যাদবপুরের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ কৃষক ঘরের ছেলে-মেয়েরা যাতে পড়াশোনা করতে যেতে পারে সেজন্যও আজ তার পাশে থাকা জরুরি। বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্ন হোক বা শিক্ষার অধিকারের প্রশ্ন, যাদবপুর শাসকের আক্রমণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে। আজ তাই সমস্ত ছাত্র সমাজ ও আপামর দায়িত্বশীল নাগরিকদের দায়িত্ব যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।

(আইসার পুস্তিকা থেকে)

gujarat-modelskeletal-face

যে গুজরাট মডেলকে সম্বল করে মোদী শুরু করেছিলেন তাঁর স্বপ্নের উড়ান, গোটা কর্পোরেট জগত যাকে দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মহাকাশে মহিমামন্ডিত করে বিকাশের প্রকৃত রাস্তা হিসাবে ফানুস উড়িয়েছিল, সেই গুজরাট সংস্করণ নিয়েই এবার বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিল প্রধানমন্ত্রীরই বড় পেয়ারের নীতি আয়োগ। এই জুলাইয়ে নীতি আয়োগ কর্তৃক প্রকাশিত জাতীয় বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক (ন্যাশনাল মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স) অনুসারে গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে ৪৪.৪৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ২৮.৯৭ শতাংশ মানুষ তীব্র অপুষ্টির শিকার!

নীতি আয়োগের রিপোর্ট দেখিয়েছে, গুজরাটের তুলনায় পশ্চাদপদ রাজ্য ছত্তিসগড়-মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান-উত্তরপ্রদেশ এই ক্ষেত্রে গুজরাট থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে। নীতি আয়োগের রিপোর্ট আরও দেখিয়েছে, বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা সম্পন্ন শিশুদের মধ্যে গুজরাট চার নম্বরে রয়েছে জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা বা ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে অনুযায়ী। বয়সের তুলনায় ৩৯ শতাংশ শিশুর ওজন কম। সমীক্ষা আরও দেখিয়েছে, খুবই ক্ষীণদেহ ও কম ওজনের শিশুর সংখ্যার দিক থেকে গুজরাট রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে, যথাক্রমে ২৫.১ ও ৩৯.৭ শতাংশ হারে। শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক মাপকাঠিতে গুজরাট যে কত নীচে নেমেছে, তা এই পরিসংখ্যানই দেখিয়ে দেয়। বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমেদাবাদের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক বলেছেন, “অপুষ্টি গুজরাটে এক উদ্বেগজনক ক্ষেত্র। গুজরাট ও পশ্চিমবাংলাকে পাশাপাশি তুলনা করলে দেখা যাবে, ২০১৬ সালে পশ্চিমবাংলার ৩৩.৬ শতাংশ পরিবার এবং গুজরাটের ৪১.৩৭ শতাংশ পরিবারের মধ্যে অন্তত একজন সদস্য অপুষ্টিতে আক্রান্ত ছিলেন। ২০২১ পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে তা কমে ২৭.৩ শতাংশ হলেও গুজরাটে তা কমে দাঁড়ায় ৩৮.৯ শতাংশ।”

আবাসের ক্ষেত্রেও গুজরাটের রেকর্ড ভালো নয়। নীতি আয়োগ জানিয়েছে, গুজরাটে ২৩.৩ শতাংশ জনসংখ্যার কোনো আবাস নেই। গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে অবস্থা আরও শোচনীয়। গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে ৩৫.৫ শতাংশ মানুষের কোনো বাসস্থানই নেই, যা হরিয়ানা-পাঞ্জাব-কেরল ও তামিলনাড়ু থেকে অনেকটাই বেশি। বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক থেকে এটা স্পষ্ট যে, গুজরাটে আর্থিক বৃদ্ধি খুবই অসম ও বিক্ষিপ্ত। হাতে গোনা কয়েকটি শহর বা শহর সংলগ্ন অঞ্চলে (যেমন, আমেদাবাদ-সুরাট-ভাদোদরা-রাজকোট) তার সুফল লক্ষ করা গেলেও, গ্রামাঞ্চল সেখান থেকে বহু যোজন দূরে।

এই গুজরাট মডেলের কার্যকারিতা নিয়ে বারবার অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিস্তর বিতর্ক হয়। এ’নিয়ে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন ও ভগবতীর বিতর্ক প্রণিধানযোগ্য। ২০০২-০৩ থেকে ২০১১-১২ মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বের আমলে গুজরাটে শিল্প বিকাশের হাত ধরে যে আর্থিক বিকাশ হয় তা নিয়ে তখন থেকেই বিতর্ক দানা বাঁধে। গুজরাটের আর্থিক বৃদ্ধি কখনই সামাজিক বৃদ্ধির সূচককে প্রতিফলিত করতে পারেনি। কর্পোরেট বান্ধব শিল্পায়নের নগ্ন নব্য উদারবাদী পথরেখা মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে শিল্প সহায়ক পরিকাঠামোর ঝাঁ চকচকে উন্নয়ন ঘটায়। ক্রোনি কর্পোরেটদের ঢালাও রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির প্রশ্নে তদানিন্তন রাজ্য সরকার দিলদরিয়া হলেও সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে ব্যয় বরাদ্দে ব্যাপক কাটছাঁট ছিল এই বহু ঢক্কানিনাদিত মডেলের নির্মম পরিণতি। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবেশ-কর্মসংস্থান — এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্র নিদারুণ অবহেলার শিকার হয়। গুজরাট শিক্ষায় ২ শতাংশ ব্যয় করে, আর তারজন্য গুজরাটের শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশই অশিক্ষিত বা মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। গুজরাট সরকার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে মাত্র ০.৮ শতাংশ। সেখানে প্রায় ৯৪ শতাংশ শ্রমিক ইনফর্মাল, যাদের মজুরি ভারতের অন্যান্য এগিয়ে থাকা রাজ্যের তুলনায় অনেক কম, সামাজিক সুরক্ষা সেখানে নাম-কা-ওয়াস্তে।

সংখ্যালঘু নিকেষের শাসন প্রণালী, ত্রাসের শাসন, মুষ্ঠিমেয় কর্পোরেটদের ঢালাও আর্থিক উপঢৌকন, সামাজিক ক্ষেত্রগুলোকে অবজ্ঞা অবহেলা, সীমাহীন বেকারত্ব ও দারিদ্র — এই হল গুজরাট মডেলের আসল চেহারা।

আজ ক্ষমতার অলিন্দ থেকেই গুজরাট মডেলের কঙ্কালসার চেহারার কুৎসিত মুখ উঁকি দিয়ে উঠল।

foil-the-conspiracy-to-subvert-the-constitution-of-indiaconstitution-of-india

ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লালকেল্লা থেকে তার দশম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণকে আরেকটি নির্বাচনী বক্তৃতা করে তুললেন, বেপরোয়া ঔদ্ধত্যে! কিন্তু তার সেই চর্বিতচর্বণ, সেই দুর্নীতি আর রাজবংশের রাজনীতি নিয়ে জীর্ণ বাগজাল, শুধু তার ভয়কেই প্রকাশ করে ফেলল! তার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ফুঁসে ওঠা ক্রোধ আর রাজনৈতিক একতার ক্রম উদ্ভাসে তার বেড়ে চলা ভয়কে! তিনি ঘোষণা করলেন পরবর্তী নির্বাচনের পর তিনি সেই সব প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন যেগুলোর শিলান্যাস তিনি ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন। এমনকি তার সেই দাম্ভিক দাবিও তার সেই ভয়কে অজান্তেই ফাঁস করে ফেলল যে প্রতিদিন তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে! ‘আমরা, ভারতের জনগণ’এর কাছে এর (এই ভাষণের) একটাই অর্থ — আগামী দিনগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তি ও ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ সামাজিক বুনন-কাঠামোর ওপর আরও নিলর্জ্জ, আরও উদ্ধত আক্রমণের সাক্ষী হতে চলেছে।

হামলা তীব্রতর হতে চলেছে। তার লক্ষণ একেবারে স্পষ্ট। সংসদের গোটা বাদল অধিবেশন সাক্ষী থাকলো মোদী-রাজের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি চরম তাচ্ছিল্য এবং ভারতকে ক্রমশ এক ‘আইনসম্মত স্বৈরতন্ত্রের’ অধীনে অন্ধকার বন্দিদশার দিকে ঠেলে দেওয়ার। প্রধানমন্ত্রীর আচার-আচরণ ক্রমশ হয়ে উঠছে এক মহামহিম সম্রাটের মতো, তিনি সংসদকে মনে করেন তার ‘রাজ দরবার’ — যেখানে বিজেপি সাংসদরা ‘মোদী-মোদী’ জয়ধ্বনিতে তাকে অভিবাদন জানিয়ে থাকেন। যেভাবে প্রধানমন্ত্রী সংসদভবন এবং তার কাছাকাছি থেকেও সংসদকে এড়িয়ে যাচ্ছেন, তা এক পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে আনার জন্য বিরোধীদের যে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হল — এটাকে সংসদীয় গণতন্ত্রের এক অভূতপূর্ব সংকট হিসেবেই দেখতে হবে।

‘প্রতীকীয়তা’ ছেড়ে, আমাদের অবশ্যই সংসদে পেশ করা ও পাস হওয়া বিলগুলোর সারমর্মে নজর দিতে হবে হবে। দিল্লী বিল, যেটি রাজ্যসভায় পাস হতে পারল শুধুমাত্র দু’টি আঞ্চলিক দল, ওড়িশার বিজেডি আর অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআরসিপি’র সরকারের পক্ষ নেওয়ায় — যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর এক নৃশংস হামলা। যে আঞ্চলিক দলগুলো এই বিলটিকে এক বিশেষ দিল্লী-নির্দিষ্ট বিল মনে করে সমর্থন করেছিল, তারা ঠিক একই ভুলটা করল যেটা আপ করেছিল ২০১৯’র আগস্টে। আপ যখন জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার প্রত্যাহারের বিষয়টিকে একটি ‘বিশেষ ব্যাপার’ মনে করে সমর্থন করেছিল, তার জানা ছিলনা যে সেই আঘাতটাই তারজন্যে ফিরছে চার বছর বাদে!

এই অধিবেশনে শুধু দিল্লী বিল পাস করিয়ে যে সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়কে লঙ্ঘন করা হয়েছে, তা নয়। এই বছর মার্চে, সুপ্রিম কোর্ট মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের নিয়োগ সম্পর্কে একটি আদেশ দিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের স্বশাসন ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে, যা আবার গোটা নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার একটি পূর্বশর্ত, সুপ্রিম কোর্ট তিন সদস্যের এক নির্বাচন কমিটি গড়ার আদেশ দিয়েছিল যার মধ্যে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা বা বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতা এবং ভারতের প্রধান বিচারপতি। মোদী সরকার ঐ কমিটিতে ভারতের প্রধান বিচারপতির জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে রাখার জন্য একটি বিল এনেছে! অর্থাৎ, নির্বাচন কমিশনের মতো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্থার নিয়োগে কার্যনির্বাহী প্রশাসনের হাতেই থাকবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা!

দেশের আইনী কাঠামোর ওপর ভয়ঙ্করতম আঘাতটা এল বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে। সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রচলিত ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (১৮৬০), ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড (১৯৭৪) এবং ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট (১৮৭২)’কে প্রতিস্থাপিত করার জন্যে তিনটি বিল আনলেন যেগুলোকে সরকারি পছন্দে বলা যেতে পারে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা এবং ভারতীয় সাক্ষ্য বিল। মাত্র কয়েকমাস আগে স্বরাষ্ট্র বিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছিলেন আইনী সংস্কারের বিষয়টি দেখার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি তার সুপারিশ চূড়ান্ত করার আগে সমস্ত অংশীদারদের সঙ্গে ব্যাপক স্তরে আলাপ-আলোচনা চালাবে আর সেইজন্যেই গোটা প্রক্রিয়াটা বেশ সময় নেবে। সেই অংশীদারদের মধ্যে থাকবেন সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নরবৃন্দ, ভারতের প্রধান বিচারপতি এবং হাইকোর্টগুলির প্রধান বিচারপতি, সমস্ত বার কাউন্সিল, বিশ্ববিদ্যালয় ও ল’কলেজগুলি, সংসদের সমস্ত সদস্য। অথচ সেই প্রতিশ্রুত বিশদ ‘আলাপ-আলোচনা’র কোন পাবলিক রেকর্ড ছাড়াই সরকার সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর দাবিসহ ঝটতি নির্বিচার ও বিপর্যয়কর সংস্কারের প্রস্তাব রেখে তিনটি বিলই পেশ করেছে।

সরকার আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে নতুন কোডগুলি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ও মানসিকতায় ইতি টানবে এবং দণ্ডবিধানে ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু একটু নিবিড় চোখে বিলগুলোর অনুবিধি খুঁটিয়ে দেখলেই ঐ দাবি নস্যাৎ হয়ে যায় এবং পরিষ্কার বোঝা যায় আসল ভাবনাটি হল নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকারকে দুর্বল করার জন্য রাষ্ট্রকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় বলীয়ান করা, এবং সরকারের নীতিসমূহ নিয়ে প্রশ্ন ও বিরোধিতা করার ও পরিবর্তন এবং ন্যায়ের জন্য লড়াই করার অধিকার, যা গণতন্ত্রের প্রাণশক্তিস্বরূপ — তাকে নিঃশেষ করা। যেমন শুধু দু’টো উদাহরণ দেওয়া যাক — পুলিশ হেফাজতের মেয়াদ এখন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ১৫ দিন থেকে অনকটা বেড়ে ৬০ থেকে ৯০ দিন হবে। আর ‘রাজদ্রোহ’ (সিডিশন) শব্দটা বাদ দেওয়া হয়েছে কার্যত, মতবিরোধের প্রতিটি ধরণকে ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’ বলে অপরাধীকরণের সম্ভাব্যতা আরও বাড়িয়ে তোলার জন্য।

কার্যনির্বাহী প্রশাসনের হাতে সমস্ত ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভবন চলছে। এর দ্বারা সরকার প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সাংবিধানিক সংস্থাগুলির স্বশাসনকে তথা কার্যনির্বাহী প্রশাসন, আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যকে দুর্বল করে চলেছে। এখন ঐ প্রস্তাবিত বিলগুলোর মাধ্যমে নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকারের সেই বিশেষ চেতনা ও বোধকে কেড়ে নেওয়া হবে। কথান্তরে, সংঘ বাহিনীর লালিত হিন্দুরাষ্ট্র শুধু মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পর্যবসিত করবে না, স্বাধীন নাগরিকবৃন্দের ধারণাটিরও মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেবে। আর সংবিধানগতভাবে বলীয়ান নাগরিকত্বকে ঔপনিবেশিক যুগের প্রজার অস্তিত্বে পরিণত করবে। আর এ’সবই হবে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, পরম্পরাকে শেষ করার নামে! এই জন্যই বাবাসাহেব আম্বেদকর ‘রাজনীতিতে ভক্তি’কে একনায়কতন্ত্রে পৌঁছানোর নিশ্চিততম পথ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি ‘হিন্দু রাজ’কে দেশের ভয়ঙ্করতম বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করে ভারতে তার বাস্তব হয়ে ওঠার বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করেছিলেন।

নরেন্দ্র মোদী মসৃণ সাবলীলতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভীষণ মুখর এবং নিজের সরকারকে ‘ঘোটালা-মুক্ত সরকার’ বলে থাকেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা ক্যাগ রিপোর্ট পেয়ে দেখছি, কার্যত তার সরকারের প্রতিটি দপ্তর ‘ঘোটালা’য় জড়িত! দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের খরচ বেড়ে গেছে ১৪ গুণ — কিলোমিটার পিছু অনুমোদিত অনুমিত ব্যয় ১৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০ কোটি টাকা! প্রচুর ঢাক-ঢোল পেটানো ‘আয়ুষ্মান ভারতের’ দুর্নীতি-জর্জরিত চেহারাটাও উন্মোচিত হয়েছে এই রিপোর্টে। একটিই মোবাইল নম্বর ‘9999999999’এ ৭,৫০,০০০ জনের বিপুল সংখ্যক উপকারভোগীর নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে; আর মৃত রোগী ও ভুয়ো হাসপাতালের নামে বিশাল পরিমাণ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বার্ধক্য ভাতার তহবিলের টাকা খরচ করা হয়েছে মোদী সরকারের প্রচার-বিজ্ঞাপনে। অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পে আবারও বেনিয়ম সামনে এসেছে, স্বদেশ দর্শন তীর্থযাত্রা প্রকল্পের নামে কন্ট্রাক্টররা প্রচুর মুনাফা লুটেছে।

আমরা মোদী সরকারের দশম বর্ষে রয়েছি। এই দশ বছরে শাসন প্রক্রিয়ার সমস্ত ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। সেই ক্ষতি ভারতের এতটাই সর্বনাশ করেছে, ভারতকে এতটাই পিছিয়ে দিয়েছে যে তা যেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্নের প্রতি, সংবিধানের নীতির প্রতি এবং ১৪০ কোটি ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অধিকারের প্রতি এক বিরাট বিদ্রুপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মণিপুর থেকে হরিয়ানা — আইনের শাসন রাষ্ট্র পোষিত জাতি-নিধন অভিযান ও নিশানাবদ্ধ বুলডোজিং’এর রাস্তা করে দিয়েছে। মোদী-রাজের বেলাগাম ধারাবাহিক বিপর্যয়গুলোকে রুখে দিতে ও ভারতকে ফ্যাসিবাদী ধ্বংস থেকে মুক্ত করতে আজ ভারতকে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শক্তি ও অনুপ্রেরণা পেতে হবে!

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২১ আগস্ট ২০২৩

workers-conferencest-workers-conference

রাজনৈতিক দিশাকে সংহত করে, সাংগঠনিক বিকাশ ঘটিয়ে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে পূর্ণশক্তি নিয়োগের ডাক দিল রাজ্য কর্মী সম্মেলন।

যখন ফ্যাসিবাদ ভারতকে ধ্বংস করা এবং আমাদের পেছন দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন জনগণের শক্তি ও উদ্যমকে অবারিত করে একে প্রতিরোধ করা ও পরাস্ত করার আহ্বান ছিল সিপিআই(এমএল)-এর ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ অনুষ্ঠিত একাদশ পার্টি কংগ্রেসে। পার্টি কংগ্রেসের পর জাতীয় স্তরে একটি বড়সড় রাজনৈতিক অগ্রগতি ঘটেছে। ভারতের নানা মত ও পথের বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির এক জোট তৈরি হয়েছে, যা ‘ইন্ডিয়া’ নাম নিয়ে সামনে এসেছে। এই জোটের অন্যতম শরিক সিপিআই(এমএল)। ভারতের বিভিন্ন শহরে জোটের বৈঠকগুলি হচ্ছে ও তা ভারতের সংসদ থেকে চা দোকান বাজারে জনগণের আলোচনা — সর্বত্র প্রবল প্রভাব ফেলছে।

এই নতুন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নানা রাজ্যে নানারকম প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। পশ্চিমবঙ্গে এই সময়কালেই পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে এবং সেখানে পশ্চিমবঙ্গে রক্তক্ষয়ী নির্বাচনের ধারা ও রাজ্যের শাসক দলের সন্ত্রাস, গণতান্ত্রিক পরিসরের ওপর হামলা অব্যাহত থেকেছে। আমাদের পার্টি কিছু আসনে বিজয়ী ও কিছু আসনে ভালো ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান পেলেও সামগ্রিকভাবে আমাদের অংশগ্রহণ, প্রচার, ভোট প্রাপ্তি সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। শাসকের হামলা ছাড়াও নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা এর কারণ। ২০২৪’র লোকসভা ভোটে বিজেপি বিরোধী, ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে দেশের অন্যান্য জায়গার মতো পশ্চিমবঙ্গেও পার্টিকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলি দ্রুত মেরামত করে পার্টির বিস্তার ঘটানো। রাজনৈতিক প্রশ্নে গোটা পার্টির বোঝাপড়াকে আরো উন্নত ও ঐক্যবদ্ধ করেই একাজে এগোতে হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ২০ অগস্ট কলকাতার মৌলালি যুবকেন্দ্রে পার্টির এক কর্মী বৈঠক আয়োজিত হয়। এতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা, গণসংগঠন ও পার্টি বিভাগের দায়িত্বশীলরা অংশগ্রহণ করেন। উপস্থিত ছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। পার্টির রাজ্য কমিটির স্ট্যান্ডিং বডি এই কর্মীসভাটি পরিচালনা করে। বৈঠকের শুরুতে, মাঝে ও শেষে সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের কর্মী নীতীশ রায়, বাবুনি মজুমদার ও অন্যান্যরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

কর্মী বৈঠক শুরু হয় পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদারের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে। যেখানে তিনি কেন এই কর্মী বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে তা তুলে ধরেন ও পার্টির রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পেশ করেন।

জাতীয় স্তরে ফ্যাসিবাদী হামলার সাম্প্রতিক নিদর্শন হিসেবে মণিপুরে মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে পরিকল্পিত বিভাজন ও পারস্পরিক হিংসার বীজ ছড়িয়ে দেওয়া, ট্রেনে এক জওয়ানের সংখ্যালঘু মানুষদের হত্যা করা, ইডি বা সিবিআই’এর পাশাপাশি এনআইএ’র মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে গণতন্ত্রের ওপর হামলার মতো ঘটনাগুলির পাশাপাশি এই প্রতিবেদনে ছিল রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন ও সেখানে গণতন্ত্রহরণের মতো বিষয়গুলি। বিজেপি কেন্দ্রীয় এজেন্সী দিয়ে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরির চেষ্টা করেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিশেষ কিছু করে করতে পারেনি, বরং তার ভোট অনেক কমেছে। বিজেপির ক্ষয়ের পাশাপাশি ইতিবাচক দিক বামেদের ভোট ও আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি। তৃণমূলের দাপট ও বাহুবলের নানা প্রকাশ ছাড়াও এই নির্বাচনে আমাদের অংশগ্রহণ ও ফলাফল যে সন্তোষজনক হয়নি, ছোট স্তরে আমাদের সংগঠন ও কাজের পরিধি আটকে থাকাকে তার অন্যতম কারণ হিসেবে এই প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়।

conference wb

এই সমস্যার সমাধানে ও বিস্তারের লক্ষ্যে কিছু অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তার কথা রাজ্য সম্পাদক উল্লেখ করেন। এছাড়াও যে সমস্ত বিষয়ে জোর দেওয়ার কথা হয় সেগুলি হল — ব্রাঞ্চ ও লোকাল কমিটির পুনর্গঠন, সমস্ত সদস্যকে কাঠামোর মধ্যে আনা, এজন্য জেলা, ব্লক ও এলাকা স্তরে উদ্যোগ গ্রহণ করা। যে সমস্ত পদক্ষেপ নেবার কথা রাজ্য সম্পাদকের প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয় তারমধ্যে রয়েছে স্থানীয় নেতা ও ইস্যু নির্ধারণ, ফ্যাসিবিরোধী ব্যূহ তৈরি, নিষ্ক্রিয় পার্টি ব্রাঞ্চকে সক্রিয় করা, নতুন ব্রাঞ্চ তৈরি করা ইত্যাদি। পঞ্চায়েত ভিত্তিক লোকাল কমিটি গঠনের কথা ও দেশব্রতীর প্রচার সংখ্যা বাড়ানোর ওপরে জোর দেওয়ার প্রয়োজনিয়তার কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়। গণ উদ্যোগ বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে গণসংগঠনগুলির বকেয়া সম্মেলনসমূহ সম্পন্ন করার ওপর জোর দেওয়া হয়। পার্টি কংগ্রেসের দলিল নিয়ে অধ্যয়নের ব্যবস্থা জেলা কমিটিগুলিকে করতে হবে। এজন্য রাজ্য শিক্ষা সেলের সদস্যরা প্রয়োজনে সাহায্য করবেন। সেই সেলটি গঠনের কাজ চলছে।

২০২৪’র আসন্ন লোকসভা নির্বাচন ও সেখানে বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোট নিয়েও কিছু পর্যবেক্ষণ রাজ্য সম্পাদকের প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়। জোটের অনেক দল বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী মনে করেনা। এই জোটে বামেরা বা সিপিআই(এমএল) নির্ণায়ক শক্তি নয়। জোটের কার্যক্রম কোনপথে এগোবে তা তাই আমাদের ইচ্ছানুসারে নির্ধারিত হবেনা। কিন্তু বিজেপি বিরোধী সমস্ত উদ্যোগে সারা দেশের মতো এ’রাজ্যেও আমরা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করব।

এই প্রতিবেদনের ওপর এরপর বিভিন্ন জেলা ও গণসংগঠনের নেতৃত্ব তাঁদের মতামত পেশ করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রনেতা বর্ষা বড়াল ও সায়নী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিকতম পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তাঁদের পর্যবেক্ষণ সভায় পেশ করেন। বর্ষা বলেন আইসা র‍্যাগিং ও তার ফলে ছাত্রমৃত্যুর দুঃখজনক ও নন্দনীয় ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে অবস্থান চালাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। এই আলোড়নের পর্বে অন্যান্য নানা প্রতিষ্ঠান থেকেও র‍্যাগিং’এর খবর আসছে। পরিস্থিতির জটিলতাকে দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলো কাজে লাগানোর প্রবল চেষ্টা করছে। বিজেপি, তৃণমূল এখানে দখলদারি নিতে চাইছে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিজেপি নিজেদের কর্মকর্তাদের ঢুকিয়ে দিয়ে সেগুলিকে নিজেদের মতো করে চালানোর চেষ্টা করছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। আমাদের রাজ্যের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তার একটি উদাহরণ। যাদবপুরেও রাজ্যপাল এমন একজনকেই সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর দায়িত্ব দিলেন।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ধ্বংস করার জন্য মিডিয়া ট্রায়াল চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে অস্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বর্ষা বলেন এর বিরুদ্ধে শিক্ষক সমাজের সাহায্য দরকার। তাঁরা যেন প্রগতিশীল শিক্ষা পরিবেশের পক্ষে দাঁড়ান, সেই আবেদন নিয়ে শিক্ষকদের কাছে যেতে হবে।

প্রতিনিধিদের আলোচনার পর রাজনৈতিক দিশা ও সাংগঠনিক বিষয়গুলি নিয়ে বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। যাদবপুর প্রসঙ্গ দিয়ে আলোচনা শুরু করে তিনি বলেন যে র‍্যাগিংকে কাজে লাগিয়ে যাদবপুরকে দখল করতে চাইছে আরএসএস। একারণেই তাদের পছন্দমতো ভিসিকে পদে বসানো হয়েছে। যাদবপুরের পরিবেশকে কলুষিত করার জন্য নানা মহল থেকে চেষ্টা চলছে। আমাদের যাদবপুরের পাশে দাঁড়াতে হবে। নাগরিক উদ্যোগ সংগঠিত করতে হবে। এরপর সাধারণ সম্পাদক নবগঠিত ইন্ডিয়া জোট ও তার প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে এটা ঠিকই যে এই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অনেকেই ফ্যাসিবাদ বিরোধী জায়গা থেকে বিজেপি বিরোধী নন। তারা অনেকে হয়ত মনে করেন না বিজেপি ফ্যাসিবাদী। কিন্তু তারা এটা বোঝেন যে বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে অন্য কোনও দলের আর রাজনৈতিক জমি থাকবে না।

কোনও কোনও রাজ্যে কেউ কেউ বিজেপিকে হারাতে পারলেও জাতীয় স্তরে বিজেপিকে হারানো দূরে থাক, কেউ বিজেপির কাছাকাছিও আসতে পারছে না। ভোটপ্রাপ্তির শতাংশ থেকে আসনসংখ্যা — সবেতেই বিজেপির সঙ্গে বাকীদের অনেকটা ব্যবধান। কিন্তু বিরোধী ভোটকে এক জায়গায় আনলে বিজেপিকে ঠেকানো যাবে, এরকম একটা অঙ্কের হিসেব আছে। ইন্ডিয়া জোট তৈরিতে এটা প্রভাব ফেলেছে।

এই জোটে বামেরা দুর্বল। চিনে মাও’এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট কুয়োমিনটাং’এর জোটের থেকে এটা আলাদা, কারণ চিনে বামেরা সেসময় শক্তিশালী অবস্থান থেকে লড়েছিলেন। এখানে পরিস্থিতিটা আলাদা। এখন এখানে রাজনৈতিক ভারসাম্য তাঁদের দিকে হেলে নেই। আমরা এই জোটকে নিয়ন্ত্রণের জায়গায় নেই। এমনও নয় যে নির্বাচনে বিজেপিকে হারাতে পারলে ফ্যাসিবাদকে নির্ণায়কভাবে হারানো যাবে। কিন্তু এটাও ঠিক নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক লড়াই এবং এই লড়াইতে আমাদের সমস্ত শক্তিকে বিজেপিকে হারানোর চেষ্টায় নিয়োজিত করতে হবে। গণআন্দোলন, গণসংগ্রামের ময়দানে আমাদের লড়াই চলবে। নিজেদের সংগঠন ও বাম ঐক্যকে আরো শক্তিশালী করার চেষ্টায় আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। শ্রমিক, কৃষক, সংখ্যালঘু, প্রান্তিক পরিচিতির মানুষদের জীবন, জীবিকা, সম্মান, অধিকারের লড়াইতে রাস্তার আন্দোলনে আমাদের সক্রিয়তাকে বাড়িয়ে যেতে হবে। এসবের পাশাপাশিই বিভিন্ন মত ও পথের নানা রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে তৈরি ইন্ডিয়া জোট এবং তারমধ্যে দিয়ে নির্বাচনী লড়াইতে বিজেপিকে পরাস্ত করার চেষ্টাতেও আমরা সক্রিয় থাকব। গোটা দেশের মতো এই রাজ্যেও আমরা সক্রিয়ভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইকে আমাদের মূল নিশানা করে লড়াই আন্দোলন জারি রাখব। বিজেপি সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রকে শেষ করতে চায়। তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের জোটে যে আমরা আছি সেটা আমাদের সামাজিক স্বীকৃতি, রাজনৈতিক পরিচিতিকে বাড়িয়েছে। এর সুযোগটা আমাদের নিতে হবে।

বিজেপি আরএসএস কীভাবে আমাদের দেশটাকে পালটে দিতে চাইছে, ভারতের বুকে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চাইছে তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বিশদে চর্চা করেছি। আমরা দেখতে পাই নরেন্দ্র মোদী দীর্ঘদিন ধরেই হাজার বছর ধরে পরাধীন থাকার কথা বলেন। এটা ব্রিটিশ সরকারের শাসন নয়, মুসলিম শাসনের সময়কালটা হিসেবের মধ্যে ধরে বলা হয়। বিজেপি আরএসএস বলার চেষ্টা করে হাজার বছর পরাধীনতার পর আগামী হাজার বছরের জন্য মোদী এখন কাজ করছেন। মোদীকে ভগবানের স্তরে নিয়ে গিয়ে বলা হয় ভগবানের কাছে যেমন ছোটখাটো জিনিস নয়, বড় কিছু চাইতে হয়, তেমনি মোদী শাসনের বিচার রামরাজত্ব তথা হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপণ ইত্যাদি দিয়ে দেখতে হবে। বেকারের চাকরী, জিনিসপত্রের দাম ইত্যাদি ‘তুলনায় গৌণ ছোটখাটো জাগতিক বিষয়’ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা যাবে না।

সংবিধানকে বদলে ফেলার কথা আরো একবার জোরের সাথে বলতে শুরু করেছে বিজেপি-আরএসএস শিবির। ভারতের এই সংবিধানকে ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকারজাত বলে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ১৯৩৫’র ভারত শাসনের আইনের উত্তরাধিকার নিয়ে এই সংবিধান তৈরি। এটার মূল কাঠামো তাই বদলানো দরকার। এটা সংবিধানের ছোটখাটো রদবদলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বর্তমান সাংসদ রঞ্জন গগৈ সংবিধানের মূল কাঠামো বদলানোর কথা বলেছেন সংসদে। মিন্ট কাগজে এ’বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন জাতীয় অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিবেক দেবরায়।

হিন্দুরাষ্ট্র গঠন থেকে সংবিধানকে পালটে দেবার এই সমস্ত প্রচেষ্টাকে আমাদের রুখতে হবে। এজন্য সাংগঠনিক শক্তি ও ব্যক্তির সাহস — সবকিছুই দরকার। ব্যক্তির সাহসের বিকল্প নেই। ফাদার স্ট্যানস্বামী সহ অনেকের লড়াই যার গৌরবোজ্জ্বল উদাহরণ। পাশাপাশি দরকার নির্বাচনী জোট। ইন্ডিয়া জোট নিয়ে, তার নাম সংক্ষেপ নিয়ে বিজেপির অস্বস্তি আছে। সেটা তাদের নানা কথায় বারবার সামনে চলে আসছে।

রাজ্যে ইন্ডিয়া জোট নিয়ে যে জটিলতা আছে, সেই ধরনের নানা জটিলতা নানা জায়গায় আছে। আমাদের উদ্যোগ বাড়িয়ে, সংগঠনকে শক্তিশালী করে এই রাজ্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। একইদিনে একসঙ্গে অনেক জায়গায় সভা করা, স্থানীয় স্তরে শক্তি বাড়ানো এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ। পার্টি পত্রিকাকে শক্তিশালী করাটা সংগঠনের শক্তি ও সক্রিয়তা বাড়ানোর জন্য অপরিহার্য। সেদিকে বিশেষ নজর বাড়াতে হবে।

সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পরে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুব্রত সেনগুপ্ত। সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য আগামী একমাসব্যাপী পার্টি যে নিবিড় অভিযানের ডাক দিয়েছে, সেগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে তিনি কথা বলেন। এই বিষয়ে ও সামগ্রিকভাবে আরো কিছু পরামর্শ দেন পার্টির বর্ষীয়ান নেতা পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গান ‘আমরা করব জয়’ দিয়ে রাজ্য কর্মী সম্মেলন উৎসাহের সঙ্গে সমাপ্ত হয়।

kaun-banaya-hindustanbharat-ke-mazdoor-kisan

আজ দিল্লীর তালকোটরা স্টেডিয়ামে কিষাণ ও মজদুর সংগঠনের সংযুক্ত সম্মেলন চলছে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ও কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহ - ফেডারেশনগুলি র যৌথ উদ্যোগে। উপস্থিত আছেন এআইকেএম এর শতাধিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। মঞ্চে আছেন এআইকেএম-এর সর্বভারতীয় সম্পাদক রাজারাম সিং প্রমূখ।

সম্প্রতি কৃষিক্ষেত্রে আদানী আম্বানিদের দখলদারী ও লুন্ঠনকে কায়েম করতে মোদী সরকারের চক্রান্ত “রিপোর্টার কালেকটিভ”-এর রিপোর্ট উন্মোচিত করে দিয়েছে। পিঁয়াজ চাষিদের সংকট তীব্রতর হয়ে উঠেছে। নতুন করে এমএসপি-র বাস্তব রূপায়নের এজেন্ডা সামনে এসেছে। বিভিন্ন রাজ্যে ফসলের ক্ষতিপূরণ-বীমার দাবিতে কিষাণ আন্দোলনের উপর নামিয়ে আনা হয়েছে তীব্র দমন পীড়ন। বাস্তবে আইনসঙ্গতভাবেই আন্দোলনের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে মোদী সরকার। তালকোটরা স্টেডিয়ামে এই বিষয়গুলি এবং অন্যান্য জরুরি প্রশ্নগুলি আলোচ্য হয়ে উঠবে,গৃহীত হবে মজদুর কিষাণ সম্মিলিত দুর্বার প্রতিরোধের কর্মসূচি।

tragic-2tragic_0

চন্দ্রাভিযানের সাফল্যের দিনে যখন দেশবাসী আনন্দে উদ্বেল, ঠিক সেই দিনেই মিজোরামের রাজধানী থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে সেতু ভেঙে এ’রাজ্যের মালদহের ২৩ জন সহ ২৫ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হল। এখনও নিখোঁজ অনেকে।

খবরে প্রকাশ, বৈরবী ও সাইরাংয়ের মাঝখান দিয়ে বইতে থাকা কুরুং নদীর উপর সংযোগকারী রেলসেতুর নিমার্ণ কাজ চলছিল। পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় নিখোঁজদের উদ্ধার করতে তল্লাশি চলছে।

আমরা এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য তাঁর পরিবার পরিজনদের কাছে গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। এই ঘটনা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এ’রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের অশেষ দুর্দশার ছবি, কাজহীন পশ্চিমবাংলা থেকে যারা রুটি-রুজির সন্ধানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চরম বিপজ্জনক পেশায় বাধ্য হয়ে কাজ করছেন।

preliminary-reportchopra-incident-in-north-dinajpur

উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার আমবাড়ি-লোধাবাড়িতে চা বাগানের জমির দখল নিয়ে আদিবাসী চা শ্রমিকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা ও তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় আহত হয় ১৪ জন মানুষ। হামলাকারীদের ছররা গুলিতে আহত ১২ জন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসিত ছিল। গতকাল এদের মধ্যে ৯ জন বাড়ি ফিরেছেন। বাকি তিনজন গুরুতর আহত অবস্থায় এখনও হাসপাতালে আছেন। এদের মধ্যে একজনের নিম্নাঙ্গ অসাড় হয়ে আছে।

আজ অর্থাৎ ২৩ আগস্ট পার্টির রাজ্য সদস্য পবিত্র সিংহের নেতৃত্বে তিনজনের একটি তথ্য অনুসন্ধানকারী দল মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে আহতদের বয়ান নথীভূক্ত করে। অনুসন্ধানকারী দলের অন্য দু'জন সদস্য হলেন দার্জিলিং জেলা কমিটির শরৎ সিংহ ও পৈসাঞ্জু সিংহ।

আহত ব্যক্তিরা জানান ২১ তারিখ সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টা নাগাদ অধুনা বন্ধ এই চা বাগানের জমিতে ঘর বানিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাসকারী আদিবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই তখন অন্য বাগানে কাজে গেছেন। এই সময় বহিরাগত (সংলগ্ন গ্রামের অনেকেই, যার মধ্যে আদিবাসী সেঙ্গেলের জমি মাফিয়াদের পক্ষধর দলছুট নেতা, স্থানীয় রাজবংশী মানুষ ও সংখ্যালঘু নাগরিক) প্রায় ১৫০ জনের একটি সশস্ত্র দল শ্রমিকবস্তীতে হামলা চালায়। এরা একতরফা বাড়িতে থেকে যাওয়া পুরুষদের ওপর ছররাগুলি চালায়, ৫০টির মতো বাড়ি ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করে। আহত ব্যক্তিরা জানান এই চা বাগানটি ১০০ একরের মতো ভেস্ট জমি ও ৩০ একর রেকর্ডেড জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছিল। বিগত কয়েক বছর আগে বাগানটির ‘মালিকানা’ হস্তান্তর হয়। ইতিমধ্যে বাগানটি বন্ধ হয়ে থাকায় জমি মাফিয়ারা ওই জমির অনেকটাই প্লটে প্লটে ভাগ করে বিক্রি করে আসছে। এর মূলত নতুন মালিকের সঙ্গে টাকার যোগসূত্রে জড়িত। বাগানটিতে দীর্ঘ সময়ের কর্মরত শ্রমিকেরা তাদের কাজ চলে যাওয়ার পর চাটিবাটি রক্ষা করতে বাগানের জমিতে কোনরকমে কিছু বাড়িঘর তৈরি করে বাস করতে শুরু করে এবং অচিরেই এদের ঠাঁইনাড়া করতে তৎপর হয় মালিকের পক্ষের কুখ্যাত ভূ-মাফিয়ারা। কারণটি সহজ। ১০০ একর সরকারী লীজপ্রাপ্ত জমি বেআইনিভাবে হস্তান্তর ঘটিয়ে বিপুল অর্থ বাগিয়ে নেওয়া, যার অংশভাগ হল বাগানের নতুন ফাটকাবাজ মালিক কর্তৃপক্ষ। এই জমির দখল নিয়ে বচসা-বিবাদ নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে পর্যায়ক্রমে প্রশাসনিক ‘হস্তক্ষেপ’ করেও সমাধানে পৌঁছনো যায়নি। বাগানটির পাশেই পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও তাদের চোখের সামনেই নির্বিচারে গুলি ও হামলা চালিয়ে চলে জমি-মাফিয়াদের বাহিনী। আহতরা বলছেন আক্রমণকারীরা শাসকদল তৃণমূলের আশ্রিত পরিচিত দুস্কৃতি। অভিযোগের তীর চোপড়ায় সংখ্যাগুরু মুসলমানদের বিরুদ্ধেই বেশি। ইতিমধ্যেই বিজেপি'র দার্জিলিং জেলার কিছু স্থানীয় নেতাকর্মীদের আহতদের ‘দেখভালের’ দায়িত্ব নিতে দেখা যাচ্ছে। ‘জমি নিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামায় এখন সাম্প্রদায়িক রঙ লাগাতে ব্যস্ত সংঘীরা’। এলাকায় প্রচুর পুলিশ ও RAF নামানো হয়েছে। বাইরে থেকে ধেয়ে যাওয়া মানুষজনকে অকুস্থলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি মোটেই সুবিধের নয়। যে কোনো সময় বিজেপি-আরএসএস এই সংঘাতের ঘটনাটিকে দাড়িভিটের মডেলে পাল্টে ফেলতে পারে বলে অনুমান।

- অনুসন্ধানকারী দলের পক্ষে পবিত্র সিংহ

vibrant-asha-workers-achieve-inspiring-victoryamid-prolonged-strike

বিহারের ধর্মঘটী আশা কর্মীদের কাছে ২০২৩’র ১২ আগস্ট এক ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন হিসাবেই চিহ্নিত হল। প্রতি মাসে তাঁদের যে মাসোহারা দেওয়া হত, সরকার সেদিন সেই অর্থের ১৫০০ টাকা বৃদ্ধি ঘোষণা করল এবং প্রদেয় ঐ অর্থকে যে ‘পারিতোষিক’ বলে অভিহিত করা হত সেই অভিধা পাল্টে তার নামকরণ করা হল ‘অনারারিয়াম’ বা ‘সম্মানদক্ষিণা’। এক লক্ষ আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের অনির্দিষ্টকালের যে ধর্মঘট শুরু হয় ১২ আগস্ট এবং যা চলে ৩১ দিন তা সংগঠিত হয় আশা সংযুক্ত সংঘর্ষ মঞ্চর পতাকাতলে। এই ধর্মঘট আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল বিহার রাজ্য আশা কার্যকর্তা সংঘ (গোপ গোষ্ঠী, এআইসিসিটিইউ) এবং আশা ও আশা সহায়ক ইউনিয়ন। বিহার রাজ্য আশা কার্যকর্তা, গোপ গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদিকা শশী যাদব বলেন, আশাকর্মীদের ধর্মঘটই ছিল বিহারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নারীদের সর্ববৃহত আন্দোলন যাতে হাজার হাজার আশাকর্মী ঐক্যবদ্ধ হন।

বিহারের সব জেলার প্রায় সমস্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সামাজিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও রেফারেল হাসপাতালগুলোতে ৩১ দিন ধরে ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোই আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের সমাবেশ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ধর্মঘট চলার সময় আশাকর্মীরা এটা সুনিশ্চিত করেন যে জরুরি কাজগুলো এবং শিশু জন্মের বিষয়গুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শশী যাদব বলেন, “এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় বিজয়টি হল এই যে, সরকার আশাকর্মীদের ‘পারিতোষিক’এর বদলে ‘সম্মানদক্ষিণা’ দিতে সম্মত হয়েছে। তাঁদের কাজের জন্য প্রদত্ত অর্থকে ‘পারিতোষিক’ বলাটা ছিল মর্যাদাহানিকর এবং তা আশাকর্মীদের শ্রমকে হীন প্রতিপন্ন করে; প্রদেয় অর্থকে ‘সম্মানদক্ষিণা’ বলাটা আশাদের কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।”

স্বাস্থ্য পরিষেবার পুরোভাগে থাকা আশারা হলেন দেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্য এবং বিশাল আকারের সংক্রমণ প্রতিরোধ কর্মসূচির প্রধান ভরসাস্থল এবং জনগণের স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভে ও কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রতিরোধে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। কিন্তু বিহারে এবং সারা দেশেই নামমাত্র অর্থেই তাঁদের কাজ করতে হয়; এমন নজিরও রয়েছে যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য আশাদের গ্রামের কয়েক কিলোমিটার খানাখন্দ ভরা রাস্তা পায়ে হেঁটে পেরোতেও হয়। শশী যাদব আরও বলেন, “আমরা যা দাবি করেছিলাম ১৫০০ টাকার এই বৃদ্ধি তার চেয়ে কম হলেও আমরা এটাকে আশা কর্মীদের অধিকারের জন্য সংগ্রামের প্রথম বিজয় বলে গণ্য করি।” আশারা এবং আশা সহায়করা এখন থেকে সরকারের কাছ থেকে মাসে পাবেন সুনির্দিষ্ট পরিমাণের ২৫০০ টাকা এবং কেন্দ্রীয় অবদান বাবদ ২০০০ টাকা, এরসাথে বিভিন্ন কাজ ভিত্তিক উৎসাহ ভাতাও থাকবে।

সরকারের সাথে আলোচনার সময় এই বোঝাপড়াতেও পৌঁছানো হয় যে, এই প্রকল্পে উৎসাহ ভাতার হারের বৃদ্ধির যে দাবি জানানো হয়েছে তার ভিত্তিতে একটি সুপারিশ বিহার রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাবে। এই প্রকল্পে বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য আশাদের যে উৎসাহ ভাতা দেওয়া হয় তা কয়েক দশক ধরে একই পরিমাণে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এবং আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে সেই হারকে জরুরি ভিত্তিতে সংশোধন করে তার কমপক্ষে ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। অতিমারীর পর থেকে যে পর্যায়ের পাওনা এখনও বাকি আছে সরকার তা মিটিয়ে দেবে। ন’দফা দাবি সনদের অন্যান্য যে বিষয়গুলো রয়েছে সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সেগুলোর সমাধান করা হবে। এছাড়া, এই ধর্মঘটের পর্যায়ে আশা কর্মীদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ দায়ের হয়েছে সেগুলো তুলে নেওয়া হবে।

সিটু এবং আশা সহায়কদের নেতা বিশ্বনাথ সিং আশাদের প্রাপ্য অর্থের বৃদ্ধিকে এক বিজয় হিসাবে ঘোষণা করেও বলেছেন যে, সরকার যেহেতু দাবি অনুযায়ী সম্মানদক্ষিণা ১০,০০০ টাকা দিতে অস্বীকার করেছে, এই আন্দোলন তাই চলতে থাকবে। আশা নেত্রী সুধা সুমন বলেন, “পেনশন ও অবসর গ্ৰহণের পর প্রাপ্য আর্থিক সুবিধার দাবিও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে”। কর্মচারী ফেডারেশন ‘গোপ’এর সাম্মানিক সভাপতি রাম বলি প্রসাদ এবং এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক রণবিজয় কুমার উল্লেখ করেন, আশা কর্মীরা যে দাবিগুলো তুলে ধরেছেন সেগুলো ২০২০’র বিধানসভা নির্বাচনের সময় মহাগাঠবন্ধনের ইস্তাহারেরই অংশ ছিল।

asha-workers-achieve-inspiring-victory
আঘাতের চরম মুহূর্ত — ৩ আগস্টের জনসমাবেশ

ধর্মঘট চতুর্থ সপ্তাহে প্রবেশ করার পর ৩ আগস্ট হাজার হাজার আশাকর্মী এবং আশা সহায়করা তাঁদের দাবিগুলো নিয়ে সমবেত হলেন পাটনার গরদানিবাগে। এই বিপুল সমাবেশে গারদানিবাগের রাস্তাগুলো আশাদের পোশাকের রং গোলাপিতে রঞ্জিত হয়ে উঠল এবং মর্যাদা, সম্মান ও অধিকারের দাবি প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। সরকারের সঙ্গে দু’দফা আলোচনা নিষ্ফলা হয়েছিল, বিপরীতে তাদের ছাঁটাইয়ের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল এবং ধর্মঘটে নেতৃত্বদায়ী কর্মীদের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলাও দায়ের হয়েছিল। স্বাস্থ্য দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন উপ-মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, এবং তিনি মাসে প্রদেয় অর্থকে পারিতোষিক থেকে সম্মানদক্ষিণায় পরিবর্তিত করতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু বারবার তাগাদা ও স্মারকলিপি দেওয়া সত্ত্বেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ছিল যে, সংগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে চলা এবং আশাকর্মীদের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকলেও রাজ্য সরকার দাবির সমাধানে কোনো সক্রিয়তাই দেখায়নি। প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার সময় সিওয়ানের এক আশাকর্মী সরস্বতী দেবী মারা যান।

সিপিআই(এমএল)-এর বিহার রাজ্য সম্পাদক কমরেড কুনাল বললেন, “আশাকর্মীদের প্রতিবাদী জমায়েত এই আন্দলনের চরম আঘাতের মুহূর্ত হয়ে উঠেছিল।” আশাকর্মীদের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখে পড়ে এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা থেমে যাওয়ায় সরকার অবশেষে আশাকর্মীদের সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় উপনীত হয়। ইউনিয়নগুলো রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে, কেননা, সরকার দাবিগুলোকে অবজ্ঞা করার সাথে সাথে কূটকৌশল অবলম্বনের হুমকিও দিয়েছিল; ইউনিয়নগুলো বলল — সরকার ২০১৯’র জানুয়ারি মাসে আশাকর্মীদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল তা তাদের মানতে হবে, বাজেট অধিবেশনের সময় বিহার বিধানসভায় দেওয়া তাদের নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিকে রক্ষা করতে হবে এবং আশাকর্মীদের মূল দাবিগুলো নিয়ে অবিলম্বে তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে। বিভিন্ন বাম নেতৃবৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের ব্যক্তিত্ব আশাকর্মীদের সমাবেশে সংহতি জানান; এআইপিডব্লিউএ’র সাধারণ সম্পাদিকা মীনা তেওয়ারি, সরোজ চৌবের সঙ্গে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল)-এর মেহবুব আলম, সত্যদেব রাম, গোপাল রবিদাস, রাম বলি সিং যাদব, অমরজিৎ কুশওয়া এবং সিপিআই(এম)-এর অজয় কুমার ও সত্যেন্দ্র যাদব।

দেশব্যাপী আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাওয়া

শশী যাদব বললেন, “এই বিজয় অর্জন আশাকর্মীদের অধিকার, সম্মান ও মর্যাদার জন্য আমাদের সংগ্রামকে আরও জোরালো করে তুলবে। এই আন্দোলনকে আমরা এখন নিয়ে যাব দিল্লীর দরবারে, এক জাতীয় লড়াইয়ের অভিমুখে। আগামী ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর পাটনায় সারা ভারত প্রকল্প কর্মী ফেডারেশন আয়োজিত যে সারা ভারত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে তাতে এটাও একটা আলোচনার বিষয় হবে। ঐ সম্মেলনে ন্যূনতম মজুরি এবং সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের ‘শ্রমিক’এর স্বীকৃতি প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। তিনি এই বিষয়েরও উল্লেখ করেন যে, আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল কর্মীদের অত্যন্ত নিকৃষ্ট পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয় এবং তাঁরা পারিশ্রমিকও পান যৎসামান্য, আর সামাজিক নিরাপত্তা থেকেও সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত।”

গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং অতিমারীর সময় তাঁদের কাজের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, পাটনা হাইকোর্ট এবং অন্যান্য নানান প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন আশাকর্মীদের প্রশংসা করেছেন। এ’সত্ত্বেও তাঁরা কিন্তু মোদী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অবহেলাই পেয়েছেন। কমরেড কুনাল বলেছেন, “পাটনায় সারা ভারত প্রকল্প কর্মী ফেডারেশনের যে সম্মেলন হবে তা প্রকল্প কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবিগুলির সমাধানের লক্ষ্যে সারা ভারতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে।”

শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার ও মর্যাদা অর্জনের জন্য আশাকর্মীদের আন্দোলন দেড় দশক ধরে চলছে। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে তাঁদের প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকেই আশারা তাঁদের শ্রমের জন্য শ্রমিকের মর্যাদা এবং তফশিল অনুসারে মজুরির দাবি জানিয়ে আসছেন।

দাবি সনদ 
• আশাকর্মী ও আশা সহায়কদের যে পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে তাকে ‘পারিতোষিক’এর পরিবর্তে ‘সম্মানদক্ষিণা’র স্বীকৃতি দিতে হবে এবং প্রদেয় অর্থের পরিমাণ মাসে ১০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০,০০০ টাকা করতে হবে। 
• ২০১৯’র এপ্রিল থেকে ২০২০’র নভেম্বর পর্যন্ত এই বিষয়ে যে বকেয়া রয়েছে তা অবিলম্বে সম্পূর্ণরূপে মিটিয়ে দিতে হবে। 
• অনলাইন পোর্টাল চালু হওয়ার আগের যে পর্যায়ের বকেয়া রয়েছে তা পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে হবে। 
• বকেয়া অর্থ প্রদান করতে হবে স্বচ্ছ ও অভিন্ন প্রক্রিয়ায়।       
• আশাদের অর্থ প্রদানের সময় দুর্নীতি ও উৎকোচ আদায়ের অভ্যাসকে বন্ধ করতে হবে। 
• কোভিড-১৯’র সময় কাজ করার জন্য আশাকর্মী ও আশা সহায়কদের ১০,০০০ টাকা অতিমারী ভাতা দিতে হবে। 
• শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ, শায়া, সোয়েটার সহ পুরো পোশাক আশাদের দিতে হবে। 
• আশা সহায়কদের সরকারি খরচে ইউনিফর্ম দিতে হবে। 
• আশা সহায়কদের দিনপ্রতি ৫০০ টাকা হারে মসের সমস্ত দিনের জন্য পরিবহণ ভাতা দিতে হবে। 
• বিভিন্ন কাজের জন্য যে পারিতোষিক/সম্মানদক্ষিণা দেওয়া হয় তা দীর্ঘদিন বাড়েনি। এগুলির হার বাড়ানোর প্রস্তাব রাজ্য সরকারকে পাঠাতে হবে। • আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি দিতে হবে।

কোভিড অতিমারির সময় যে আশাকর্মী এবং আশা সহায়করা মারা গেছেন (যেগুলির খবর হয়েছে এবং যেগুলি নিয়ে কোনো খবর হয়নি উভয় ক্ষেত্রেই) তাদের পরিবারকে রাজ্য সরকার ঘোষিত ৪ লক্ষ এবং কেন্দ্রীয় বিমা প্রকল্প অনুসারে ৫০ লক্ষ টাকা দিতে হবে।

আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং পেনশনের সুবিধা দিতে হবে, এবং এই দাবি যতদিন না মানা হচ্ছে ততদিন অবসর গ্ৰহণের পর এককালীন ১০ লক্ষ টাকা অবসর ভাতা দিতে হবে।

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে আশাকর্মী এবং আশা সহায়কদের সঙ্গে যে চুক্তি করা হয়েছিল তার পূর্ণাঙ্গ রূপায়ন ঘটাতে হবে এবং আশাকর্মী ও আশা সহায়কদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত মামলা দায়ের হয়েছে সেগুলি তুলে নিতে হবে।

west-burdwan-district-conferencemahila-samiti

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পশ্চিম বর্ধমান ৩য় জেলা সম্মেলন গত ৬ আগস্ট ২০২৩ আসানসোল বার এসোশিয়েশন হলে অনুষ্ঠিত হল। সম্মেলনে শতাধিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। পতাকা উত্তোলন, মাল্যদান, শহীদদদের স্মৃতিতে নীরবতা পালন থেকে নতুন জেলা কমিটি গঠন — এই গোটা প্রক্রিয়ায় সমস্ত সদস্যাদের উপস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

প্রতিনিধিরা নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতা এবং অধিকারের বিষয়গুলিকে তুলে ধরেন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন্ত ছিল। মদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তারা রাখেন। নতুন সরকারের সমর্থনে যারা সক্রিয়ভাবে একসময় ভূমিকা নিয়েছিলেন, তারা এই সরকারের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সম্মেলনে সোচ্চার হন। তারা ভালো রাস্তা‌, আলো, জল এবং বাসস্থানের অধিকারের দাবি রাখেন।

সম্মেলন শুরু হয় কবিতা পাঠের মাধ্যমে। ৬ জনের সভাপতিমন্ডলি তৈরি হয়। মনিকা ঠাকুর সম্মেলন পরিচালনা করেন। প্রতিনিধিরা ছাড়াও বক্তব্য রাখেন AICCTU’এর প্রদীপ ব্যনার্জী ও সিপিআই(এমএল)-এর স্বদেশ চ্যাটার্জী। পরিশেষে ১১ জনের নতুন কমিটি নির্বাচিত হয়। সভানেত্রি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন আম্বা দাস ও সন্ধা দাস। রাজ্যকমিটির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন অর্চনা ঘটক। সম্মেলনে তার বক্তব্য প্রতিনিধিদের উৎসাহিত করে।

kurnishkurnish_0

দিনে বার বার পোষাক না পাল্টে, প্রচার ও বিজ্ঞাপনের চোখ ধাঁধানো আলো থেকে বহু যোজন দূরে নীরবে, নিরলসভাবে, দিনরাত এক করে প্রচারবিমুখ করতালিবিহীন ইসরো’র একঝাঁক বিজ্ঞানী, অসংখ্য কর্মী মহাকাশ গবেষণায় নতুন এক অধ্যায় সূচিত করলেন। ২৩ আগস্টের সন্ধ্যায়, ছ’টা বেজে ৩ মিনিটে চাঁদের রহস্যে ঢাকা দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইসরোর চন্দ্রযান-৩’র ল্যান্ডার বিক্রম। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সারা বিশ্বে এই প্রথম ভারতই এই কীর্তির মুকুট পরল। দিন কয়েক আগে অল্পের জন্য ব্যর্থ হয় রুশ চন্দ্রযান লুনা-২৫। বেশ কয়েক দশক ধরে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের নানা শাখা প্রশাখায় বিশ্বমানের অসংখ্য অবদান রেখে চলেছেন। যাঁদের হাত ধরে দেশের মহাকাশ অভিযানে এই সফলতা এসেছে, তাঁদের কুর্নিশ।

আগে থেকেই ইসরো জানিয়ে দিয়েছিল সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ চন্দ্রযান-৩’র অবতরণ হবে। ওই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতে প্রায় একঘন্টা আগে থেকেই দেশবাসী আবেগে উদ্বেল, উৎকন্ঠা ও উদ্বেগ নিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে নিরাপদ অবতরণের মাহেন্দ্রক্ষণটি দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু, দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণরত প্রধানমন্ত্রী জোহেন্সবার্গ থেকে সেই মুহূর্তের সাক্ষী থাকবেন বলে আগে থেকেই সমস্ত বন্দোবস্ত হয়ে গেছিল। তাই, চন্দ্রপৃষ্ঠে বিক্রমের নিরাপদ অবতরণের দৃশ্য দেখার সুযোগ দেশবাসী পেলেন না। অবতরণের তোড়জোড় শুরু হতেই জোহেন্সবার্গ থেকে মোদীর হাততালি দেওয়া ছবি টিভি’র পর্দা জুড়ে প্রচার হতে থাকল। হাতে জাতীয় পতাকা। সঙ্গে ভাষণ। বিজ্ঞানীদের এই সম্মিলিত সাফল্যকে সংকীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে নিজের জমানার সাফল্য হিসাবে পকেটে পোরার উৎকট প্রচার শুরু হল অনতিবিলম্বে। তার মাশুল গুনতে হল দেশবাসীকে। তাঁরা বঞ্চিত হলেন চাক্ষুষ ওই ঘটনার সাক্ষী হতে।

চন্দ্রপৃষ্ঠে এই অবতরণের সাফল্যের নেপথ্যে অসংখ্য যে সমস্ত বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত মেধা বিরাট অবদান রেখেছে, তারমধ্যে কিন্তু রয়েছে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ‘আতঙ্কপুর’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘দেশবিরোধীদের আখড়া’ বলে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা বিধানসভায় দাগিয়ে দেন, বিজেপির এক অসভ্য নেতা, যিনি গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের সুশীল সমাজকে ‘রগড়ে’ দেওয়ার আস্ফালন করেন, তিনিই এবার যাদবপুরের কৃতি, মেধাবী, দেশের ও রাজ্যের গর্ব ছাত্রসমাজের ‘মাথা ভেঙে গুড়িয়ে’ দেওয়ার নিদান দেন, আর যে উস্কানিমূলক উক্তির জন্য মাননীয়া ন্যূনতম কোন আইনী প্রক্রিয়া শুরু করতে পারলেন না।

যাদবপুর (মুখ্যমন্ত্রীর আতঙ্কপুর) বিশ্ববিদ্যালয়ের একসারি প্রাক্তনী, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক, গবেষক, স্নাতকোত্তর, স্নাতক স্তরের পড়ুয়া — এক পরিবারের সদস্য হয়ে কাজ করেছিলেন আড়ালে থেকে এই সমগ্র চন্দ্রাভিযানকে সফল করতে।

সমগ্র এই গবেষক বাহিনীকে ফের কুর্নিশ।

active-in-haryanaactive-in-haryana

সুপ্রিম কোর্ট ঘৃণা ভাষণ না দেওয়ার শর্তে বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে দিল্লীতে মিছিলের অনুমতি দিয়েছিল। ঘৃণা ভাষণ রুখতে কেন্দ্রকে কমিটি গড়ার নির্দেশও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু কী সুপ্রিম কোর্ট, কী পুলিশ প্রশাসন কারুরই তোয়াক্কা না করে ঘৃণা ভাষণের পথে, মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষ ছড়ানোর পথেই অবিচল রইল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। রবিবার ১৩ আগস্ট হরিয়ানার নুহ সংলগ্ন পালিওয়ালের পোন্ডোরি গ্রামে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো আয়োজিত ‘সর্ব জাতীয় মহাপঞ্চায়েত’ থেকে হিন্দুদের জন্য বন্দুকের লাইসেন্সের দাবি ওঠানো হল, সমর্থন জানানো হল হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টরের ‘বুলডোজার অভিযানকে’। প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই নুহতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্রিজমন্ডল জলাভিষেক যাত্রাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হলে মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর বুলডোজার নামিয়ে মুসলিমদের শত শত ঝুপড়ি, বাড়ি, দোকানপাট ধূলিসাৎ করেন। রবিবার পালিওয়ালের পোন্ডোরি গ্রামের মহাপঞ্চায়েতে এক বক্তা মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বললেন, “ওরা আমাদের দিকে আঙুল তুললে আমরা হাতই কেটে ফেলব”। হরিয়ানা গো রক্ষক দলের প্রধান আজাদ শাস্ত্রী বলেন, “প্রত্যেকটা হিন্দু গ্রামে ১০০টা আগ্নেয়াস্ত্র চাই।… অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে, এফআইআর নিয়ে ভয় পেলে চলবে না।” নুহর বিধায়ক আফতাব আহমদ এই সমস্ত ঘৃণা ভাষণের বিরোধিতা করে বলেন, “ওরা যা বলেছে সেগুলো শুধু ঘৃণা ভাষণই নয়, বরং দাঙ্গা উস্কিয়ে তোলারই শামিল।… এই ধরনের জমায়েতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি আমরা জানাচ্ছি।” উল্লেখ্য যে, এই সমস্ত ঘৃণা ভাষণ পুলিশের উপস্থিতিতেই ব্যক্ত হলেও পুলিশ কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি।

কেন্দ্রে এবং রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার থাকার জন্যই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ও তাদের নেতৃবৃন্দ পুলিশ প্রশাসন এবং এমনকি সুপ্রিম কোর্টকেও উপেক্ষা করার ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছিল। গত ৩১ জুলাইয়ের জলাভিষেক যাত্রা থেকে শুরু করে ১০ আগস্টের মহাপঞ্চায়েত পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদীদের সমস্ত উদ্যোগের লক্ষ্যই যে ছিল সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণ ঘটানো তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। এই ধরনের এক পরিমণ্ডলের বিদ্যমানতাই এই মুহূর্তে বিজেপির পরম কাঙ্খিত। ২০২৪’র সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর কয়েক মাসের মধ্যেই, এবং সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণ যথার্থ রূপ পেলে বিজেপির ভোটের ভাঁড়ারও উপছে পরবে।

তবে, পরিস্থিতি সব সময় অভিলাষীর কামনার অনুসারী হয় না, এবং পরিস্থিতি বিকাশ লাভ করে তার নিজস্ব গতিক ও শর্ত মোতাবেক। হরিয়ানায় শাসক বিজেপি সরকার ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো যদি সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণের প্রয়াসী হয়ে থাকে তবে এক ভিন্ন স্বর, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিরোধী ও মুসলিম সম্প্রীতির এক জোরালো স্বরও অনুরণিত হল হরিয়ানার বেশ কিছু জেলায় যা জানালো যে, হরিয়ানার গোটা রাজ্য বিজেপির অভিলষিত পথের অনুগামী হতে একেবারেই রাজি নয়। সেই সমস্ত জেলাতে শুধু হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির আকাঙ্খাই মূর্ত হলো না, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের মতো মুসলিম-বিদ্বেষী ও হিংসাশ্রয়ী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার দাবিও সোচ্চারে ঘোষিত হল।

মনোহরলাল খট্টরের বিজেপি সরকারের বুলডোজার অভিযান যখন চলছে, তার মধ্যেই গত ৫ আগস্ট হরিয়ানার জিন্দে অনুষ্ঠিত হল এক ‘সর্ব ধর্ম সম্মেলন’। এই সম্মেলনে অংশ নেন খাপ পঞ্চায়েতের প্রধানরা, কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। মাজরা, উঝানা, নারাওয়ানা, থাওয়া, চাহাল, মোর, দাহারান প্রভৃতি খাপের প্রধান ও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতারা এবং অখিল ভারতীয় কিষাণ সভার নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলনে অংশ নেন। এই সম্মেলন থেকে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও ঐক্য স্থাপনের আকাঙ্খা যেমন ব্যক্ত হয়, তেমনই আরএসএস, বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সম্পর্কিত প্রস্তাবও পাশ হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ফিরোজ খান বলেন, অগ্নিদগ্ধ হওয়া থেকে হরিয়ানাকে বাঁচিয়েছে খাপগুলো, কেননা, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের এজেন্ডাকে তারা সমস্ত স্থানে সক্রিয় হতে দেয়নি।

এর চারদিন পর হিসার জেলার বাস গ্রামে ৯ আগস্ট ভারতীয় কিষাণ মজদুর ইউনিয়নের উদ্যোগে সংগঠিত হয় এক মহাপঞ্চায়েত। হিন্দু, মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০০ কৃষক মহাপঞ্চায়েতে অংশ নেন। মহাপঞ্চায়েতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বকে শক্তিশালী করে তোলার আহ্বান জানানো হয়। মহাপঞ্চায়েতে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয় — “সরকারকে ঘটনার (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার) নিরপেক্ষ তদন্ত করতে ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। যারা সমাজমাধ্যমে প্ররোচনামূলক বক্তব্য ও ভিডিও পোস্ট করে সমাজে দাঙ্গা উস্কিয়ে তুলেছে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে ও তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে।”

মহাপঞ্চায়েত থেকে মনু মানেসার ও বিট্টু বজরঙ্গির গ্রেপ্তারির দাবি জোরালোভাবেই ওঠে। এই দুজন বজরং দলের নেতা এবং দুজনেই ৩১ জুলাই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলের আগে মুসলিম-বিরোধী উস্কানিমূলক ভিডিও সমাজমাধ্যমে তোলেন, প্ররোচনামূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে এমন উত্তেজনাময় করে তোলেন যার ফলে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। আর মনু মানেসর জুনাইড ও নাসির নামে দুই মুসলিমকে গাড়ির মধ্যে পুড়িয়ে মারায় মূল অভিযুক্ত। আরএসএসের দুই সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল যেহেতু সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির সুপরিকল্পিত প্রয়াস সমানে চালিয়ে যাচ্ছে, হরিয়ানার সমস্ত গ্রামেই দুই সংগঠনের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করার দাবি মহাপঞ্চায়েত থেকে প্রবলভাবেই ওঠে। মহাপঞ্চায়েতে অংশগ্রহণকারী সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতা সুরেশ কোঠ ঘোষণা করেন, “জাত ও ধর্মের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির জন্য হরিয়ানার মাটিকে আমরা ব্যবহৃত হতে দেব না।”

মুসলিম বিদ্বেষের ওপর ভিত্তি করে সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণ ঘটাতে গেলে বিজেপি-আরএসএসের একটা সামাজিক ভিত্তির প্রয়োজন হয়। এই সামাজিক ভিত্তি অনেক স্থানেই তাদের থাকলেও কিছু পুরনো সামাজিক ভিত্তি আবার তাদের কাছ থেকে সরে এসেছে। হরিয়ানার নুহ ও গুরুগ্রামে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গার পাশাপাশি মুসলমানদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের যে আকাঙ্খা ব্যক্ত হল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার যে আওয়াজ উঠল, তাতে কিন্তু সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছে জাট সম্প্রদায়। এই জাট সম্প্রদায়ই কিন্তু একটা সময়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষকে ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটনের সামাজিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল। ২০১৪’র সাধারণ নির্বাচনের আগে ২০১৩’র মুজাফ্ফরনগরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অমিত শাহর পরিকল্পনায় জাট সম্প্রদায়কেই বিজেপি ব্যবহার করেছিল। আজ কিন্তু জাট সম্প্রদায়ই উত্তর ভারতে বিজেপি-বিরোধী প্রতিরোধের অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে। মোদী সরকারের তৈরি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, হরিয়ানার মহিলা কুস্তিগিরদের যৌননিগ্ৰহ বা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বর্জনের স্পৃহা, যে কারণই জাটদের বিজেপি বিরোধিতায় সক্রিয় করুক না কেন তা আজ এক অবিসংবাদী বাস্তবতা এবং মোদী-শাহদের মতো অতি ক্ষমতাধর নেতাদের পক্ষেও তাদের পুরনো সামাজিক ভিত্তির পুনরুদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না। এই সামাজিক ভিত্তি থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ও বিদ্বেষের অবসানের যে আওয়াজ উঠেছে তা আরও সম্প্রসারিত হয়ে হরিয়ানায় শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ডাবল ইঞ্জিন সরকারের অপসারণের পথ প্রশস্ত করুক।

- জয়ন্ত মিত্র

all-democratic-institutions-have-become-meaninglessmeaninglessly-irrelevant

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর নেমে এল বিরাট হামলা

গত সপ্তাহে সংসদে পাস হওয়া প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ পিরিয়ডিক বিলস্ ২০২৩, সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ার উপর নামিয়ে আনা বিরাট এক হামলা। এই বিলটি আগেকার প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ বুকস্ ১৮৬৭’র ঔপনিবেশিক আইনকে বাতিল করল, যা ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, সিপাহী বিদ্রোহের পর লাগু হয়েছিল। সেই সময় হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্রকে বশে রাখতেই ওই আইন আনা হয়।

ঔপনিবেশিক আইনকে বদলানোর অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে, কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে ওই আইন কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু নতুন মোড়কে যেটি আনা হচ্ছে তা পুরাতনের থেকেও আরও বিপজ্জনক।

বিজ্ঞানভিত্তিক ও বিদ্যাচর্চার জার্নালগুলোকে এই আইনের আওতায় বাইরে রাখা হয়েছে, রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়াকেও সহজসরল করার সুপারিশ রয়েছে। ভুলবশত কোনো তথ্য দিলে আগের আইন যাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল, এই আইন সেটাকে ছাড় দিয়েছে। কিন্তু, আগের আইনের তুলনায় এই বিলটিতে যে ভয়ংকরতম বিধি নিয়ে আসা হচ্ছে, যা এই বিলটিকে চরম দমনমূলক করে তুলবে তা হল রেজিস্ট্রার জেনারেলের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তুলে দেওয়া।

এই রেজিস্ট্রার জেনারেল (আরজি) হবেন নিয়ন্ত্রক। তিনি সরকার কর্তৃক মনোনীত। তিনি অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। ‘সন্ত্রাসবাদী বা বেআইনি’ কার্যকলাপের সাথে অথবা এমন কোনো কাজে লিপ্ত যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক এমন অভিযোগে দুষ্ট কোনো প্রকাশনার মালিক বা প্রকাশকের ছাপানো বই, বা সংবাদপত্রের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে বা তা প্রকাশ করার উপর আরোপ করা হবে নিষেধাজ্ঞা — আরজি’র নির্দেশে।

আরজি যদি মনে করেন কোনো এক প্রকাশনা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতির বিরুদ্ধে গেছে তবে সেই প্রকাশনার রেজিস্ট্রেশন বাতিল হবে, তার মালিক, বা প্রকাশক বা তার সহযোগীদের আটক করা হবে, তাদের জেল হবে, তাদের জামিন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও থাকবে না। এই আইনে সরকার বিরোধী যেকোনো সাংবাদিক বা প্রকাশককে যেকোনো সময়ে ফাঁসানোর অবাধ সুযোগ থাকছে।

নতুন এই আইন আরজি’কে এই ক্ষমতা দিয়েছে যার মাধ্যমে তিনি রেজিস্ট্রেশন যাচাই করতে যেকোনো সময়ে ওই পত্রিকা বা প্রকাশনার দোরে অবাধ প্রবেশ করতে পারবেন, এমনকি একজন আধিকারিককে নিয়োগ করতে পারবেন যিনি প্রকাশনার গোটা প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই আধিকারিক একজন গেজেটেড অফিসার হলেই চলবে। তিনি পুলিশ বিভাগের বা ওই ধরনের কোনো বিভাগের আধিকারিকও হতে পারেন। এই বিল সরকারকে সংবাদ প্রকাশনার স্বার্থে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে। এই আইন বলে সরকার যেকোনো অনলাইন সংবাদকেও তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে।

ইতিমধ্যেই এডিটার গিল্ড এবং অন্যান্য মিডিয়া এ সম্পর্কে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। তারা মনে করছেন এই বিল আইনের রূপ নিলে তা হবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতার উপর বড় ধরনের হামলা। যা সংবাদের উপর সেন্সারশিপ চালু করবে।

এই প্রস্তাবিত আইনে অপরাধকে হুবহু প্রিভেনশন অফ মানি ল্যন্ডারিং অ্যাক্ট ‘পিএমএলএ’এর দানবীয় আইনের আদলে তৈরি করা হয়েছে।

নতুন বন সংরক্ষণ আইন ডেকে আনছে বিরাট সর্বনাশ

মণিপুরের ধারাবাহিক হিংসা, নারী নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সংসদ যখন উত্তাল, এরকমই এক আবহে, বাদল অধিবেশনের পঞ্চম দিনে বিতর্কিত বন সংরক্ষণ (সংশোধনী) বিল মোদী সরকার লোকসভায় পাশ করিয়ে নিল।

বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার অরণ্যভূমি তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই নজিরবিহীন দ্রুততায় নয়া বন সংরক্ষণ আইন কার্যকর করতে সক্রিয় হয়েছে কেন্দ্র। নয়া বিলটি জানিয়েছে যে এটা সংশোধন আজ পরিস্থিতির দাবি। কারণ, “বন সংরক্ষণ আইনের সামনে জীববৈচিত্র, সামাজিক ও পরিবেশগত বিকাশের চ্যালেঞ্জ রয়েছে” আর সেই জন্য বিপুল পরিমাণে অরণ্যভূমিকে সংরক্ষণের আওতা থেকে মুক্ত করে তার রূপান্তর ঘটিয়ে অরণ্য বহির্ভূত ব্যবহারে যাতে কাজে লাগানো যায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন কর্পোরেশনের স্বার্থে রূপান্তরিত করা যায় তার সুযোগ নতুন সংশোধনীতে রাখা হয়েছে।

নয়া বিলে সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত বনভূমি ধ্বংসের বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে। তাতে ইউপিএ আমলে চালু করা ‘অরণ্য অধিকার আইন’ লঙ্ঘিত হবে। অবাধে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের খনি ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভাগ বসানোর পাশাপাশি চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক এবং ইকো ট্যুরিজমের অছিলায় কর্পোরেটগুলোকে সহজেই সরকারি ব্যবস্থাপনার কাজে লাগিয়ে অরণ্যবাসী জনজাতিদের উৎখাত করতে পারবে। কিন্তু, ১৯৮০’র বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী অরণ্য এলাকায় কোনও অন্য ধরনের কাজ করা যাবে না। এবার, আইনে সংশোধন এনে ‘জাতীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রকল্প ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রকল্পে’র ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হচ্ছে। এরফলে অরণ্যের অধিকার আইন নির্বিচারে লঙ্ঘনের পথ তৈরি হবে। এতদিন জঙ্গলে যাঁদের অধিকার আইনত প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেই আদিবাসীদের গৃহচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেল।

এই হল মোদীর ফ্যাসিবাদী হামলা যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রচন্ড দ্রুততায় অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন করে নিছক এক প্রসাধনী মোড়কে তার কঙ্কালসার কাঠামোকে সাজিয়েই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখার ঢাক পেটাচ্ছে। 
স্বাধীনোত্তর ভারত এযাবত এত বড় হামলা দেখেনি।

(সমাপ্ত)

- অতনু চক্রবর্তী

cag-report-exposes-corruptioncorruption-in-modi-government

নরেন্দ্র মোদীর ‘দুর্নীতি বিরোধী জেহাদ’ ক্রমেই বেশি করে চালিত হতে থেকেছে বিরোধী নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে এবং দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিবর্গের ৯৫ শতাংশই বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ। বিরোধীদের বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডি’কে লেলিয়ে দেওয়ার একটা উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে বিরোধী পক্ষকে মাথা তুলতে না দেওয়া, অন্য মতলবটা তবে অনস্বীকার্যভাবেই হল বিজেপিকে দুর্নীতি মুক্ত রূপে জাহির করা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর যাবতীয় কসরত সত্ত্বেও বিজেপির চালানো দুর্নীতিকে চেপে রাখা সম্ভব হয়নি এবং বারেবারেই সেগুলোর উন্মোচন ঘটতে থেকেছে। অতি সম্প্রতি প্রকাশ পেল কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল’এর (ক্যাগ) রিপোর্ট যাতে নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। সেই রিপোর্টৈ উল্লেখিত দুর্নীতিগুলোর দিকে তাকানো যাক।

ক্যাগ রিপোর্টে বড় ধরনের দুর্নীতির সংকেত রয়েছে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক গৃহীত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ‘ভারতমালা পরিযোজনা’ প্রকল্পে ৩৪,৮০০ কিমি সড়ক তৈরিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা বরাদ্দ করেছিল ৫,৩৫,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিবহণ মন্ত্রক ২৬,০০০ কিমি সড়ক নির্মাণের জন্য বরাত দেয় ৮,৪৬,৫৮৮ কোটি টাকার। অর্থাৎ, বরাদ্দ করা অর্থের চেয়ে বরাত দেওয়া বা ব্যয় হওয়া অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি। বরাদ্দ করা অর্থ যেখানে ছিল কিমি প্রতি ১৫.৩৭ কোটি টাকা, সেখানে প্রতি কিমি রাস্তা নির্মাণের জন্য বরাত দেওয়া হয়েছে ৩২.৫৬ কোটি টাকার, যা বরাদ্দের দ্বিগুণেরও বেশি। এই প্রকল্পেরই অধীন দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ব্যয় হওয়া অর্থ গিয়ে দাঁড়িয়েছে বরাদ্দ করা অর্থের একেবারে ১৪ গুণ! দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে ২৯ কিমি দীর্ঘ ১৪ লেনের এক রাস্তা যা দিল্লী থেকে শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে গুরুগ্রামে। সড়কের দিল্লীর দিকের দৈর্ঘ্য ১০.১ কিমি, এবং গুরুগ্রামের দিকের দৈর্ঘ্য ১৮.৯ কিমি। বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ যেখানে ছিল কিমি পিছু ১৮.২ কোটি টাকা, প্রকৃত খরচ সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কিমি পিছু ২৫১ কোটি টাকায়! হরিয়ানার দিকের রাস্তাকে ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ বা উড়াল পথ রূপে নির্মাণের জন্যই প্রকৃত খরচ বরাদ্দ অর্থের ১৪ গুণে দাঁড়িয়েছে বলে কেন্দ্রীয় পরিবহণ মন্ত্রকের অভিমত। উড়াল পথ নির্মাণের যৌক্তিকতাকে খণ্ডন করে ক্যাগ আবার এই অভিমত প্রকাশ করেছে যে, উড়াল রাস্তা তৈরির কোনো প্রয়োজন আদৌ ছিল না। মাটির ওপর দিয়ে ১৪ লেনের রাস্তা তৈরির জন্য যথেষ্ট জমি পাওয়া যেত। হরিয়ানার দিকের রাস্তাকে উড়াল রাস্তায় পরিণত করার সিদ্ধান্ত অতএব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। এবং এই প্রশ্নও খুব স্বাভাবিকভাবেই উঠবে যে, সড়ক নির্মাণের প্রকৃত ব্যয়ের যে বিপুল বৃদ্ধি ঘটল, সেই অতিরিক্ত অর্থ কি শুধু ঠিকাদাররাই পেয়েছিল, নাকি, তার লাভ উড়াল রাস্তার পরিকল্পনাকারীদের পকেটেও গিয়েছিল?

ভারতমালা প্রকল্পে বরাত দানের প্রক্রিয়াতেই যথেষ্ট বেনিয়মের সন্ধান ক্যাগ পেয়েছে। এরই ভিত্তিতে এই অভিযোগ সামনে এসেছে যে, যাদের বরাত দেওয়া হয়েছে তারা নিলামের শর্ত ঠিকঠাক পূরণ করেনি, নকল নথির ভিত্তিতে এবং এমনকি প্রকল্প বিশদ রূপে পেশ না হওয়া সত্ত্বেও সড়ক নির্মাণের বরাত প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মোদী ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানি কেরল, ছত্তিসগড়, তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবাংলা, গুজরাট ও অন্যান্য রাজ্যে ভারতমালা প্রকল্পের অধীনে রাস্তা নির্মাণের বরাত পেয়ে থাকেন এবং রাস্তা নির্মাণও করেন। নিয়ম না মানা প্রক্রিয়ায় প্রদত্ত বরাত থেকে আদানিরাই ‘সবচেয়ে বেশি লাভবান’ বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। কেন্দ্র পরিচালিত স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রও দুর্নীতি জর্জরিত। প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনার একটা অংশ হল আয়ুষ্মান ভারত। ক্যাগ’এর রিপোর্ট জানিয়েছে, এই প্রকল্পে দুর্নীতির বহর কম নয়। এই প্রকল্পে সুবিধাপ্রাপকরা মোবাইল ফোনের একটা নম্বরে যুক্ত থাকেন। ক্যাগ রিপোর্টকে উল্লেখ করে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ জানিয়েছেন, “মাত্র ১৮৬৮৫৮টা মোবাইল নম্বরে ১.২৪ কোটি ডুয়ো সুবিধাপ্রাপককে যুক্ত করা হয়েছিল।” ক্যাগ রিপোর্ট আরও জানিয়েছে, ‘৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯’ এবং ‘৮৮৮৮৮৮৮৮৮৮’ এই দুটো নম্বরে নথিভুক্ত করা হয়েছিল যথাক্রমে ৭.৫ লক্ষ ও ১.৪ লক্ষ সুবিধাপ্রাপককে। একই মোবাইল নম্বরে বহু ব্যক্তিকে সংযুক্ত করার অর্থ তাদের জন্য চিকিৎসা ব্যয় দেখিয়ে সেই অর্থকে আত্মসাৎ করা। এছাড়া, মৃত ব্যক্তিদের জন্যও বহু চিকিৎসা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ‘দ্য ওয়্যার ওয়েব’ পত্রিকার ১০ আগস্টের এক নিবন্ধে ক্যাগ রিপোর্টকে উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, ৮৮,৭৬০ জন রোগী চিকিৎসা চলাকালীন মারা যান। এ’সত্ত্বেও এই সমস্ত মৃত ব্যক্তিদের ‘পুনরায় চিকিৎসার’ জন্য ২১,৪৯২৩টি ক্ষেত্রে দাবি করা অর্থ মেটানো হয়েছে! এমনকি ২.২৫ লক্ষ ব্যক্তির এমন দিনে শল্য চিকিৎসা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে যে দিনগুলো হাসপাতাল থেকে রোগী ছেড়ে দেওয়ার পরের! এমন সমস্ত হাসপাতালের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে যে হাসপাতালগুলোর অস্তিত্ব নেই।

কেন্দ্রীয় সরকারের একটা প্রকল্প রয়েছে যেটার নাম ‘স্বদেশ দর্শন তীর্থযাত্রা’। এই প্রকল্পের অধীনে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পে ঠিকাদারদের ২০ কোটি টাকার অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নজির রয়েছে বলে ক্যাগ রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছে। প্রবীণদের জন্য নির্ধারিত পেনশনের অর্থ মোদী সরকারের প্রচারে ব্যয়িত হয়েছে বলেও ক্যাগ রিপোর্ট জানিয়েছে।

ক্যাগ’এর এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতা দিবসের আগেই। স্বাধীনতা দিবসে তাঁর বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদী ফের দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে বিরোধীদের বিরুদ্ধে তোপ দেখেছেন। কিন্তু ক্যাগ রিপোর্ট নিয়ে নীরবই থেকেছেন। ক্যাগ রিপোর্টে উঠে আসা দুর্নীতির বিষয়গুলো নিয়ে ইডি বা সিবিআই কি তদন্ত চালাবে? এর উত্তর সবারই জানা এবং তার উল্লেখ নিষ্প্রোয়জন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকৃত ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযান চালাতে গেলে তার নিশানা যে বিরোধী রাজনীতিবিদদের বদলে কর্পোরেট চালিত কালো অর্থনীতিকেই হতে হবে তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। অথচ, বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের সম্পর্ক অতীব ঘনিষ্ঠ এবং তারা মোদী সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট মদতই পায়। হিন্ডেনবার্গ’এর রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী আদানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে মুখ খোলেননি এবং ঐ রিপোর্টে তুলে ধরা আদানির চালানো কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগগুলো নিয়ে তদন্তে কোনো আগ্রহও দেখাননি। মোদী যত বলেছেন যে কোনও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদকেই তিনি রেহাই দেবেন না, ততই আরও বেশি সংখ্যক ইডি-সিবিআই’এর নজরে থাকা রাজনীতিবিদ বিজেপিতে ভিড়েছেন। হিমন্ত বিশ্বশর্মা, শুভেন্দু অধিকারীদের মতো বহু নিদর্শন আগেই ছিল। কিছুদিন আগে বিজেপির ‘ওয়াশিং মেশিন’ আরও যাদের পরিশুদ্ধ করে বিজেপিতে ভেড়ালো তাঁরা হলেন শারদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ার, ছগন ভুজবাল ও সম্প্রদায়। ক্যাগ রিপোর্ট আরও একবার প্রমাণ করল যে বিজেপি আগাপাশতলা দুর্নীতিতে লিপ্ত এবং কর্পোরেট অর্থের বখরাতেই তাদের অর্থের ভাঁড়ার উপছে পড়ে। ক্যাগ’এর রিপোর্ট নরেন্দ্র মোদীর দুর্নীতি বিরোধী জেহাদের কপটতাকে আরও একবার প্রকট করল এবং প্রত্যয়িত হল নরেন্দ্র মোদীর নিয়োগ করা জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের অভিমত — দুর্নীতি নরেন্দ্র মোদীর তেমন অপছন্দের বিষয় নয়!

- পর্যবেক্ষক

make-the-first-conferencefederation-a-success

সকল স্কিম কর্মীদের (আশা, মিড-ডে-মিল, অঙ্গনওয়াড়ি ও অন্যান্য) শ্রমিক শ্রেণির অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে নির্মম শোষন-নিপীড়ন বন্ধ কর; মাসিক বেতন, নিয়মিতকরণ ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত কর; সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও কোম্পানি রাজের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন; সম্মানজনক কাজের দাবিতে লড়াইকে তীব্র করুন; সর্বভারতীয় স্কিম কর্মী ফেডারেশনের (এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত) প্রথম সম্মেলন সফল করুন।

সাথী,

৯-১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পাটনার বুকে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সারা ভারত স্কিম কর্মী ফেডারেশনের প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্কিম কর্মীদের ইউনিয়নবদ্ধ হয়ে একরোখা লড়াই চালানোর মধ্য দিয়েই এই ইউনিয়নটি আত্মপ্রকাশ করেছে।

আমরা জানি এনআরএইচএম, এনএইচএম, মিড-ডে-মিল ও আইসিডিএস’এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ভিত্তিক পেশায় স্কিম কর্মীরা মেরুদন্ড শক্তি। টিকাকরণ, শিশু সুরক্ষা, স্কুল পড়ুয়াদের পুষ্টি প্রদান, স্কুলে স্কুলে ভর্তির অনুপাত বজায় রাখা, প্রাতিষ্ঠানিক পরিষেবা, শিশু মৃত্যুর হার ঠেকানো, প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলো তাঁদের হাড় ভাঙা পরিশ্রমের দরুন এখনো বজায় রয়েছে।

কিন্তু নির্মম বাস্তব হল, এই পেশায় কর্মরত ৯৫ শতাংশ মহিলা কর্মীদের ভারত সরকার শ্রমিক হিসাবেই গণ্য করে না।

  • স্কিম কর্মীরা মাসিক বেতন পান না। তাঁদের স্বেচ্ছাসেবক গণ্য করে অনেক রাজ্যে মাসিক ১০০০ বা ২০০০ টাকা ভাতা বা ইন্সেনটিভ খাতে টাকা দেওয়া হয়।

  • শ্রমিক শ্রেণির অন্যান্য যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা থাকে, যেমন ইএসআই-পিএফ-পেনশন বা অন্য কোন সামাজিক সুরক্ষা, তা থেকে স্কিম কর্মীরা বঞ্চিত।

  • এনআরএইচএম, মিড-ডে-মিল, আইসিডিএস প্রভৃতি প্রকল্পগুলোকে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া চলবেনা।

  • কর্মস্থলে যৌনহেনস্থা রোধী সেল সুনিশ্চিত করতে হবে।

  • কোভিডের সময় পরিষেবা দিতে গিয়ে যে সমস্ত কর্মীদের মৃত্যু হয়, তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা অবিলম্বে কার্যকরী করতে হবে।

  • শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড বাতিল কর।

- সারা ভারত স্কিম কর্মী ফেডারেশন (এআইসিসিটিইউ)

MMNNDJJDHSKLLDLLE

খণ্ড-30
সংখ্যা-29