আজকের দেশব্রতী : ১৭ আগস্ট ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-17-08-23left-wing-student-organisations-in-jadavpura-ragging-free-campus

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হস্টেলে প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপের মর্মান্তিক মৃত্যু সকলকে নাড়া দিয়েছে। ঘটনার অভিঘাতে বহু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান সমাজ-মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছে যেগুলি থেকে এ’কথা সকলের সামনে স্পষ্ট যে মেইন হস্টেলে, এবং বিশেষত তার A1-A2 ব্লকে, উত্তরোত্তর তীব্রতর মাত্রার র‍্যাগিং বিগত বেশ কয়েক বছর যাবৎ চলছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে বলেই হয়তো শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে বিষয়টা আরো বেশি ভাবিয়েছে, যে ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীরা ধারাবাহিকভাবে প্রগতিশীল ভূমিকা রেখেছে সেখানে এরকম র‍্যাগিং কীভাবে চলতে পারে! সকলে যখন, নির্দিষ্টভাবে এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের শাস্তির সাথে সাথে ক্যাম্পাসকে র‍্যাগিং-মুক্ত করার প্রতিকার খুঁজছেন, তখন শাসক দল ও ক্ষমতাধারী সংবাদ মাধ্যম সামগ্রিকভাবে যাদবপুরের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারার ওপরই আঘাত হানতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে লাগাতার ধর্ণা ও প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে আইসার জেইউ ইউনিট সেক্রেটরি বর্ষা বরাল বলেন, “এই র‍্যাগিং কালচার প্রত্যেকটা ইউনিভার্সিটি, কলেজ এবং স্কুলের সমস্যা। এটা একটা সামাজিক নির্মিতি বা সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট। একে কীভাবে কাউন্টার করা যায় মূল প্রশ্নটা সেখানেই এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মিডিয়া ও শাসকদল তা নিয়ে কথা বলছে না। এই যে আইআইটি থেকে এনআইটি সারা জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো, চারিদিকে এত রেস্ট্রিকশন, এত সার্ভিলেন্স, তার পরও প্রত্যেক বছর এত এত ছাত্র-ছাত্রীকে কেন সুইসাইড করতে হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো উঠে আসছে, সরকার তার দায় এড়াতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ নিজের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। এই সময়ে আমরা যখন এরকম একটা পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছি তখন এসব নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার”।

স্বপ্ন-হত্যার সুবিচার চেয়ে, হোস্টেল ও ক্যাম্পাস বাঁচাতে, ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক পরিসরকে রক্ষা করা এবং অবিলম্বে নির্বাচিত ছাত্র-ছাত্রী প্রতিনিধিদের নিয়ে অ্যান্টি-র‍্যাগিং সেল পুনর্গঠন করার দাবিতে আইসার লাগাতার অবস্থান প্রতিবাদের প্রচারপত্রে বলা হয়েছে,

“পরিসংখ্যান বলছে বিগত ৫ বছরে শতাধিক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা সামনে এসেছে। আইআইটি, মেডিক্যাল কলেজ-সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে। কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন। বিগত বছরে শুধু ৫১১-র উপরে র‍্যাগিংএর অভিযোগ জমা পড়েছে ইউজিসি-র কাছে। র‍্যাগিংএর ঘটনায় শীর্ষে রয়েছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি। কিন্তু এগুলো হল শুধু জানা ‘তথ্য’। এর বাইরেও অজানা কাহিনী রয়েছে অসংখ্য। র‍্যাগিং-এর ভয়াবহতা এই রাজ্যের অন্যান্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও কান পাতলে স্পষ্টভাবে শোনা যায়। যাদবপুরের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা নয়।

সার্বিকভাবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতার একটা তন্ত্র বিদ্যমান যা এই র‍্যাগিং-এর ঘটনাগুলিকে ঘটিয়ে চলেছে। এটা মানসিক বিকারের ব‍্যাপার না, বরং ক্ষমতাতন্ত্রের ব‍্যাপার। কিছু ক্ষমতাশীল ছাত্র, তারা জানেন যে যদি সমাজের প্রান্তিক অংশ থেকে উঠে আসা প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের উপর এই অত্যাচার চালানো যায় তাহলে অপরাধ করেও পার পাওয়া যাবে, বা তারা সরাসরি শাসকশ্রেণীর মদতপুষ্ট, তাই এই ঘটনা ঘটানোর সাহস করেন। এই অভ্যাস মুলত দক্ষিণপন্থার; সমাজে যে ব্রাহ্মণ্যবাদী-সামন্তবাদী ক্ষমতার আগ্রাসন রয়েছে তার প্রতিফলন।

র‍্যাগিং বিষয়ে কর্তৃপক্ষ এই প্রথম জানছে এমন তো নয়! আইসা বিভিন্ন সময়েই র‍্যাগিং-এর বিরুদ্ধে হস্টেলে ও ক্যাম্পাসে লড়ছে, কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। ২০১৫ সালে র‍্যাগিং-এর বিরোধিতা করায় আইসার দুই কর্মীকে মেরে বের করে দিয়েছিল র‍্যাগাররা। অভিযোগ জানানোর পরেও নিশ্চুপ ছিল কর্তৃপক্ষ। কেন? কারণ ক্ষমতাশীল দাদাদের অনেকেরই ওঠা-বসা ছিল তৎকালীন নেতা মন্ত্রীদের সাথে।

ক্যাম্পাসের অ্যান্টি র‍্যাগিং সেল কী করে? কিছুই না। ক্যাম্পাসে প্রতিবছর কয়েকটি হোর্ডিং টাঙায় আর ভর্তির সময় একটা ফর্মে সই করতে হয় যেখানে র‍্যাগিং না করার কথা লেখা থাকে। এছাড়া এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের আর কোনও সম্পর্ক নেই পড়ুয়াদের সাথে। নেই কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধি। অর্থাৎ সচেতনতা তৈরির প্রয়াস শুন্য। আজকে তার ফল ভুগতে হল স্বপ্নদীপকে। যেহেতু আজ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে কোনওরকম অ‍্যান্টি র‍্যাগিং সেল নির্বাচন হয়নি তাই এ কথা সহজেই বলা যায় যে কর্তৃপক্ষ র‍্যাগিং-এর বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে উদাসীন। স্বপ্নদীপকে হারানোর পরও কি এই উদাসীনতা কাটবে?”

স্বপ্নদীপের মৃত্যুর খবর সামনে আসার সাথে সাথে শাসকদলের ছাত্রনেতা তথা মিডিয়া-মুখ যাদবপুরের বামপন্থী সংগঠনগুলিকে অপরাধী বলে ঘোষণা করে দেন। এই প্রসঙ্গে প্রশ্নের উত্তরে বর্ষা বলেন, “একটা কথা খুব পরিষ্কার। যবে থেকে এই ঘটনা সামনে এসেছে তবে থেকে আমরা ক্যাম্পাসেই আছি। এই যে দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলো, টিএমসি হোক বা বিজেপি, এরকম একটা নির্মম ঘটনা নিয়ে তাদের কোনওরকম কথা নাই, তারা নিজেদের প্রোপাগান্ডা সার্ভ করতে ব্যস্ত। এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তারা তেমন জায়গা পায়নি। ‘হোক কলরব’ আন্দোলনে এরাই ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। আনীস খানের খুনই বা কারা করেছিল? যাদবপুরকে এভাবে চ্যানেলাইজ করে দেখানো হচ্ছে, বামপন্থী আন্দোলনকে আক্রমণের নিশানা করে। যেমনভাবে যাদবপুরকে সামগ্রিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তা ঠিক নয়। এটা প্রচণ্ডভাবে এক দক্ষিণপন্থী প্রপাগাণ্ডা। যাদবপুর অ্যাজ-এ-হোল এই প্রপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে এবং আগামীতেও থাকবে।”

justice-for-swapnadeep's-death

বাস্তবিকই, যাদবপুরের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে থেকেই প্রতিবাদ উঠে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নং গেটের সামনে প্রাক্তনীদের সভায় চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবলীনা বলেন, “র‍্যাগিং-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাথে সাথে এই যাদবপুরের ওপর সামগ্রিক আঘাত হানার বিরুদ্ধেও আমরা রুখে দাঁড়াচ্ছি।” এক বছর আগে এই রাজ্যেরই আইআইটি ক্যাম্পাসের হস্টেলে র‍্যাগিংএর ফলে একই রকমভাবে এক ছাত্রের মৃত্যু/হত্যার মামলা হাইকোর্টে চলছে। এই ঘটনাটি নিয়ে কিন্তু তেমন চর্চা হয়নি, আর আইআইটির অভ্যন্তর থেকেও কোনও প্রতিবাদ উঠে আসতে দেখা যায়নি।

সিপিআই(এমএল) কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী ১৪ আগষ্ট এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, “এই মর্মন্তুদ ঘটনার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ততা কেড়ে নেওয়ার ফন্দি আঁটছে”। রাজ্যপালের অতি সক্রিয়তা ও রাজনৈতিক উদেশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোর্ট’-কে নিজের দরবারে ডেকে মিটিং করার অধিকার তাঁর নেই – এই প্রশ্ন উঠেছে।

গত ১৫ আগষ্ট এক প্রেস বিবৃতিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে “দায়িত্বজ্ঞানহীন, সংকীর্ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে নিন্দা করেন। স্বপ্নদীপের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এবং স্বপ্নদীপের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে এই বিবৃতিতে আরো বলা হয়,

“এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের অপদার্থতার নিন্দা না করে, শিক্ষামন্ত্রীর নিঃসীম নির্লিপ্ততা চিহ্নিত না করে, মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন, অনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘আতঙ্কপুর’ আখ্যা দিয়েছেন। প্রণালীবদ্ধ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে দেশের শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষকে কলঙ্কিত করার প্রয়াস নিয়েছেন। নির্বাচিত ছাত্র সংসদ, ঐতিহ্যশালী বাম ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করতে মুখ্যমন্ত্রীর এই অনীতিনিষ্ঠ ও সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্তব্যের আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।

অন্যদিকে, আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে যাদবপুরকে পরিকল্পিতভাবে উপাচার্যহীন রাখার অপকৌশল নিয়েছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে রাজ্যপাল পঠন-পাঠনের উৎকর্ষ রক্ষা, পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বকেয়া কেন্দ্রীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদানে বিন্দুমাত্র উদ্যোগ না নিয়ে, ছাত্র মৃত্যুর পর ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়কে অভিব্যক্ত করলেন। এখন কেন্দ্রীয় সংস্থা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, ইউজিসি ও রাজভবন যেন সিবিআই আর ইডি-র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শুধুমাত্র যাদবপুর নয়, বাংলার ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের মান্যতা ও ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকার হরণ করতে এবং নিরঙ্কুশ দক্ষিণপন্থী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।”

death-and-a-ragging-free-campus

আইসার পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছে যে, স্বপ্নদীপের মৃত্যুর সাথে যৌন হেনস্থার দিক জড়িত থাকার প্রবল সম্ভাবনা আছে। ক্যাম্পাসে বর্তমানে কোনো লিঙ্গ-সাম্য সচেতনতা কমিটি না থাকার দরুন কোনো ঘটনার কোনো সুরাহা করতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ। ২০১২ সাল থেকে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার এই ধরনের কমিটি নির্বাচনের দাবী জানান হয়। স্বপ্নদীপের মৃত্যু এর পেছনে লুকিয়ে থাকা লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক চেতনাকে তুলে ধরে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসকে আরও সচেতন এবং সংবেদনশীল গড়ে তোলার জন্য কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে GSCASH নির্বাচন করতে হবে।

কলকাতায় আইসার দশম জাতীয় সম্মেলন চলাকালীনই স্বপ্নদীপের ঘটনার খবর পেয়ে গভীর রাতেই আইসার জেইউ কমরেডরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন। পর দিন জাতীয় সম্মেলনের মঞ্চ থেকে স্বপ্নদীপের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয় ও তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা ব্যক্ত করা হয়। এর পর জেইউ ইউনিট লাগাতের প্রতিবাদ শুরু করে। ১৬ আগস্ট, আইসার পক্ষ থেকে তিন দিন লাগাতার অবস্থান প্রতিবাদ চলার পর, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত সংগ্রামী ছাত্র-ছাত্রী সংগঠন, গবেষকদের সংগঠন ও কর্মচারীদের সংগঠন একত্রিত হয়ে সাধারণ সভা সংগঠিত করে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে এই লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের দরজায় চলা এই সাধারণ সভা চলাকালীনই টিএমসিপি বাইরে থেকে সমাবেশিত করে সাধারণ সভাকে মাড়িয়ে ভবনে প্রবেশ করার জন্য গা-জোয়ারি করে, শেষে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় এবং আন্দোলনকারীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে মারামারির অভিযোগে যাদবপুর থানায় জিডি করে। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে যাদবপুর টিএমসি ইউনিটের অধিকার আছে এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার, কিন্তু শাসন ক্ষমতাকে হাতিয়ার করে, বাইরে থেকে সমাবেশিত করে, উস্কানিমূলক ভাষণ দিয়ে গণ্ডগোল বাধানোর অপচেষ্টাকে কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না।

governance-and-democratic-spacedemocratic-space-should-be-maintained

রাজ্যের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাদবপুর এখন উত্তাল। প্রথম বর্ষের নবাগত এক ছাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার মাত্র চারদিনের মাথায় প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার শিকার হলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং’এর রূপ ধরে যে ক্ষমতাতন্ত্র বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গভীরে শেকড় গেঁড়েছে, তার পরিণাম আজ দেখা যাচ্ছে মারাত্মক রূপে। শারীরিক মানসিক নানা অত্যাচার শুধু নবাগতদের উপরই নয়, সমাজের প্রান্তসীমা থেকে উঠে আসা ছাত্রছাত্রীরা এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে দিনের পর দিন কল্পনাতীত অত্যাচারের শিকার হন তার অনেক খবর আজ প্রকাশিত।

কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট ও সংসদে এ’নিয়ে পেশ করা তথ্য থেকেই প্রমাণ মেলে যে দেশের উৎকর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইআইটি-আইআইএমএস থেকে ২০১৮-২৩ পর্যন্ত ১৯,০০০ শিক্ষার্থী ড্রপআউট হয়েছে যারা ওবিসি-তফশিলি জাতি-তফশিলি উপজাতি থেকে আগত। আরেকটি তথ্য হল, আইআইটি’তে গত পাঁচ বছরে ৩৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ২০১৪-২১ এই পর্বের মধ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১২২ জন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে, যাদের মধ্যে ২৮ জন তফশিলি উপজাতি এবং ৪১ জন ওবিসি। আইআইটি, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, আইআইএমে ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত মোট ৬১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, যতজন আত্মহত্যা করেছে, তার থেকেও অনেক বেশি শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার কথা ভাবে, এমনকি চেষ্টাও করে তা কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট বলছে।

দিনের পর দিন চোরাস্রোতের মতো এই মারণ প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে এমনকি উৎকর্ষ শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেও বিস্তারলাভ করেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তার ব্যতিক্রম নয়। মোদীর শাসনকালে প্রান্তসীমায় নিক্ষিপ্ত ওবিসি-তফশিলি জাতি-উপজাতিদের অস্তিত্ব কি আতঙ্কজনক মাত্রায় বিপন্ন, অপরায়নের বুলডোজার যে প্রবল বেগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে শুরু করে অনেকের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। সেই ২০০৭ সালে, ইউপিএ’র আমলে এইমসে প্রান্তিক ছাত্রদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের নালিশ আসার পর কেন্দ্রীয় সরকার এক কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি পরবর্তীতে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে, ‘রিপোর্ট অফ দ্য কমিটি টু ইনকোয়ার ইন্টু দ্য অ্যালিগেশন অফ ডিফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট অফ এসসি/এসটি স্টুডেন্টস ইন এইমস্’। সেই রিপোর্ট জানিয়েছে যে শুধু ছাত্ররাই নন, বরং সমাজের প্রান্তিক স্তর থেকে উঠে আসা আবাসিক ডাক্তার এমনকি এইমসের ফ্যাকাল্টি সদস্যরা পর্যন্ত হরেক রকমের বৈষম্যের শিকার। যা তাঁদের মানসিক জগতকেও প্রতিনিয়ত আলোড়িত করে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের রয়েছে এক চমৎকার গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য, যা বাম মতাদর্শে বিশেষ ভাবেই প্রভাবিত। এমনকি অধ্যাপকদের মধ্যেও রয়েছে এই প্রগতিশীলতার প্রভাব। এক মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৃণমূল ও বিজেপি — এই উভয় দলই বাম মনোভাবাপন্ন ছাত্র রাজনীতিকে আক্রমণ করার ফন্দি এঁটেছে। মুখ্যমন্ত্রী আজ ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে গেছেন, আসানসোলে দাঙ্গা বাধানোর পেছনে যে বাবুল সুপ্রিয় মূল পাণ্ডা হিসাবে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিল, সেই দাঙ্গাবাজকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে ঠেকিয়েছিল এই ছাত্রসমাজ। আর, তিনিই আজ তারই মন্ত্রীসভায় সেই দাঙ্গাবাজকে মন্ত্রী করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের রুখে যারা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন, তাঁদেরকেই আজ মুখ্যমন্ত্রী শাপ শাপন্ত করে বুঝিয়ে দিলেন বিজেপি বিরোধী তাঁর অবস্থান কত ভঙ্গুর ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে চরম নৈরাজ্যে ঠেলে, দীর্ঘদিন একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়কে উপাচার্যহীন রেখে এক অরাজক পরিস্থিতি খোদ মুখ্যমন্ত্রী তৈরি করে রেখেছেন। আর, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুচর রাজ্যপাল যেকোনো সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বিরাটভাবেই বাড়িয়ে তুলছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জটিল পরিস্থিতিকে সুষ্ঠভাবে সমাধান করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিসরকে আরও প্রসারিত করা, র‍্যাগিং-বিরোধী কমিটিতে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি রাখা, নবাগত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা সুরক্ষিত হস্টেলের ব্যবস্থা করা, প্রাক্তনীদের হস্টেল দখল রাখা থেকে মুক্ত করা, প্রভৃতি একগুচ্ছ পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। সিসিটিভি লাগালেই যে হস্টেলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়না তার উদাহরণ হল জেএনইউ হস্টেলে নাজিব ঘটনা। সমস্ত ‘ব্যবস্থা’ থাকা সত্ত্বেও নাজিব বেমালুম ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত সেই গভীর ‘রহস্যের’ কিনারা হল না।

রাজ্যপাল এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনকেই বিপন্ন করে তুলছে। হস্টেলগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রাক্তন সেনাদের হাতে তুলে দেওয়ার যে প্রস্তাব রেজিস্ট্রার নিতে চলেছেন, তা পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলবে। এদিকে, টিএমসি’র বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে, আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর হামলা, মিথ্যা এফআইআর করে ক্যাম্পাস দখলের লক্ষ্যে এক অরাজক অবস্থা তৈরি করছে। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বজ্ঞান উক্তির পরই দেখা গেল ওই কান্ড ঘটল।

এখনও প্রকৃত দোষী ধরা পড়েনি। ক্যাম্পাসে একটা চাপা প্রচার রয়েছে, কোনো প্রভাবশালী নেতার সুরক্ষা বলয়ে নাকি তারা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এখনও এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি যা আস্থা সৃষ্টি করতে পারে। এই ঘটনা অনেকগুলো সমস্যাকে সামনে নিয়ে এল, যা এতদিন ছিল আড়ালে। দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ, সমগ্র ছাত্রসমাজের আস্থা ফিরিয়ে আনা, প্রকৃত দোষীদের শাস্তি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নিয়েই আজকের এই অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।

a-partial-setback-to-the-modi-regimeon-the-ground

মোদী পদবীর মানহানি মামলায় রাহুল গান্ধীর দণ্ডাজ্ঞায় সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ, ভারতের ক্রম প্রকাশমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হয়ে দেখা দিয়েছে। মোদী সরকার চমৎকারভাবে একটা জিনিস আয়ত্ত করে নিয়েছে। সেটা হল সংবিধানের ওপর তার নিরন্তর হামলা আর গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরার প্রতিটি পদক্ষেপকে সংসদ ও বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে ‘বৈধ’ বলে দাবি করা ও বিচারবিভাগীয় অনুমোদনের শীলমোহর আদায় করে নেওয়া! তথাকথিত মোদী পদবীর মানহানি মামলার চিত্রনাট্যও, সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত সেই একই অশুভ পথ ধরেই এগোচ্ছিল। ২০১৯-এ কর্ণাটকে এক নির্বাচনী সমাবশে দেওয়া ভাষণের জন্য গুজরাটে দায়ের হওয়া এক মানহানি মামলায়, ২৩ মার্চ ২০২৩ রাহুলকে সম্ভবপর সর্বোচ্চ সাজার ঘোষণা শোনানো হয় এবং গত ৪ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট শেষ পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দেওয়ার আগে পর্যন্ত, গুজরাটে বিচার বিভাগের সর্বস্তরে ঐ রায়ই বহাল থাকে।

শীর্ষ আদালত সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছে যেটি গুজরাট হাইকোর্ট এবং নিম্ন আদালতগুলির জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। দু’বছরের কারাদণ্ড হল একটা ফৌজদারি মানহানির মামলায় সম্ভবপর সর্বোচ্চ সাজা। এ’ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণার কী যুক্তি আছে? প্রশ্নটি আরও প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে কারাদণ্ডের মেয়াদ যদি মাত্র একটা দিনও কম হত তাহলে সাংসদ হিসেবে রাহুল গান্ধীর ‘অযোগ্যতা’র প্রশ্নই উঠতো না। দণ্ডাদেশের এই মৌলিক দিকটি বিচার করা দূরস্থান, গুজরাটের আদালতগুলি, বিশেষ করে হাইকোর্ট, রাহুল গান্ধীকে ‘নিয়মিত অপরাধে অভ্যস্ত সাধারণ অপরাধী’ এবং মানহানির অভিযোগকে ‘নৈতিক চরিত্রহীনতা’ হিসেবে দেখানোর জন্য আইনগতভাবে অসমর্থনীয় কিছু যুক্তির আশ্রয় নিয়েছিল। ঠিক তার আগেই সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট হাইকোর্টের অ্যাক্টিভিস্ট তিস্তা শেতলবাদের জামিন না মঞ্জুরের রায়কে খারিজ করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের চোখে, গুজরাট হাইকোর্টের রায়ের যথেষ্ট অসঙ্গতি ও স্ববিরোধিতাগুলো ধরা পড়েছিল। মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীর দণ্ডাদেশে স্থগিতাদেশ দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট হাইকোর্টের ইদানীং কালের সন্দেহজনক রায়গুলোর স্পষ্ট উল্লেখ করে বলে, গুজরাট হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়গুলোর পর্যবেক্ষণ বেশ ‘কৌতূহলোদ্দীপক’!

মানহানি আইনটি অতি ধনী ও ক্ষমতাশালীদের নিজেদের ক্ষমতা ও বিশেষ সুযোগ সুবিধাগুলো সুরক্ষিত রাখা এবং সমালোচক ও বিরোধীদের নিশানা করার জন্য এক চমৎকার হাতিয়ার। মোদী জমানায় এটা বিরোধীদের নিশানা করার জন্য সরকারের একটা রাজনৈতিক হাতিয়ারও হয়ে উঠেছে। মোদী পদবীর মানহানি মামলায়, কেসটি ফাইল করা হয়েছিল সেই ২০১৯ সালে। একটা পর্যায়ে আবেদনকারী নিজেই, তার কাছে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ নেই বলে, শুনানিপর্বে স্থগিতাদেশ চেয়েছিলেন ও পেয়েও ছিলেন! আদানি গোষ্ঠীর কর্পোরেট জালিয়াতি নিয়ে হিন্ডেলবার্গ নিবন্ধ প্রকাশের পর এবং সংসদে মোদী-আদানি আঁতাতের প্রশ্ন তুলে রাহুল গান্ধীর ভাষণের পর পরই কেসটিকে খুঁচিয়ে তুলে ঝটিতি সুরাট সিজেএম আদালতের হাতে সঁপে দেওয়া হল! আর লোকসভার সচিবালয় অভূতপূর্ব উদ্দীপনায় রাহুলকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণার পদক্ষেপ নিতে একদিনও সময় নেয়নি এবং তাঁর সরকারি বাসভবন থেকে তাঁকে উৎখাত করতে একমাসও সময় নেয়নি। মোদী সরকার রাহুল গান্ধীর দণ্ডাদেশের ওপর সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের তাৎপর্যকে যতই গুরুত্বহীন হিসেবে দেখাতে চাক, জনপরিসরে কিন্তু এটাকে ঐ সরকারের কুৎসিত এবং অশুভ ষড়যন্ত্রের এক ‘ধাক্কা’ বলেই মনে করা হচ্ছে।

ওয়েনাডের সাংসদ হিসাবে রাহুল গান্ধীর পুনর্বহাল হওয়ায় অবশ্য বিজেপির গণতন্ত্রের সংসদীয় ব্যবস্থার ওপর নিরন্তর হামলার এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলি ও সাংবিধানিক আইনের শাসনের নীতিগুলির অপব্যবহারের তীব্রতা এতটুকু কমেনি। এমনকি, চারমাস ‘অনুপযুক্ত’ থাকার পর, রাহুল গান্ধী সংসদে ফেরা মাত্র, লোকসভার সচিবালয় উত্তরপ্রদেশের এটাওয়ার অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদকে তড়িঘড়ি সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় অনুমোদন করল যাতে তিনি দণ্ডাদেশের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে কোনো ছেদ ছাড়াই তার সাংসদ পদে বহাল থাকতে পারেন। কী অদ্ভুত পরিহাস, রাহুল গান্ধী যেদিন সংসদে ফিরলেন, ঠিক সেদিনই মোদী সরকার দিল্লীর নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া সেই দানবীয় বিলটিকে রাজ্যসভায় পাস করিয়ে নিল। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও, মোদী সরকার বিজেডি, ওয়াইএসআরসিপি এবং টিডিপি’র মতো আঞ্চলিক দলগুলিকে কখনও স্তোক বাক্যে ভুলিয়ে, কখনও হুমকি দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে গণতন্ত্র বিরোধী, সংবিধান বিরোধী এই বিলকে সমর্থন করতে বাধ্য করে প্রয়োজনীয় সংখ্যা আদায় করে নিয়েছে। এই আম আদমি পার্টি, যেটি মোদী সরকারের জম্মু এবং কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার এবং এমনকি রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার দানবীয় পদক্ষেপকে সমর্থন করতে ছুটে গিয়েছিল, আজ বড় কঠিনভাবে বুঝতে পারছে, কাশ্মীরের ওপর আক্রমণ বস্তুত ছিল দিল্লীকে আঘাত হানার আগাম ইঙ্গিত। আক্ষেপ হয়, এখনও যেসব আঞ্চলিক দল মোদী রাজকে সমর্থন করে যাচ্ছে, তারা অচিরেই বুঝতে পারবে যে তারা দেশের সাংবিধানিক গণতান্ত্রের অংশীদারিত্ব ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কত বড় ক্ষতি করে চলেছে। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে রাজ্যসভার সাংসদ রঞ্জন গগৈ বিলটিকে সমর্থন করতে গিয়ে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠলেন যে সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’টিকেই ‘বিতর্কসাপেক্ষ’ বলে দিলেন! এখানেই এক অশুভ পূর্বসূচনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

গণতন্ত্র, তার সাংবিধানিক ভিত্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আক্রমণ শুধুমাত্র রাষ্ট্র দ্বারা বা প্রাতিষ্ঠানিক অপব্যবহার বা আইনি ও রাজনৈতিক কৌশলের দ্বারা সংঘটিত হয় না। গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিটি সামাজিক ক্ষেত্রেই একযোগে নিরন্তর হিংসা-তাণ্ডব চলেছে। তিনমাসের ওপর মণিপুর জ্বলছে, প্রধানমন্ত্রী এমনকি সংসদেও এ’ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। দিল্লীতে ২০২০তে এবং তারও আগে ২০১৩তে মুজফ্ফরনগরে মুসলিম-বিরোধী হিংসার পুনরাবৃত্তিতে, আমরা দেখতে পাচ্ছি হরিয়ানার মেওয়াত অঞ্চলের ঘটনাটিকে বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার আরেকটি পরীক্ষাগারে পরিণত করার চেষ্টা করছে। হিন্দুত্ববাদী জনতা সুপরিকল্পিতভাবে একযোগে যে ‘দাঙ্গা’ শুরু করেছিল তাকে এখনও জারি রেখেছে সরকারি ‘বুলডোজার’ চলছে সবকিছু গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা আদালত সেই অভিযান থামানোর নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু তার আগেই, খাট্টার সরকার ‘জবরদখল উচ্ছেদ’এর নামে নুহ’তে মুসলিমদের কয়েক ডজন ঘরবাড়ি, দোকানপাট গুঁড়িয়ে দিয়েছে। নিরাপত্তাহীনতা ক্রমশ বাড়তে থাকায় বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকরা ইতিমধ্যেই বাধ্য হয়েছেন হরিয়ানা ছেড়ে নিজেদের রাজ্যে ফিরে আসতে।

নুহ তাণ্ডবে, গুরুগ্রামের মসজিদ আক্রমণ, তরুণ ইমাম মৌলানা সাদের বর্বরোচিত হত্যা, বুলডোজার-চালিত ধ্বংস পর্ব এবং নিগ্রহ অভিযানের লক্ষ্য — অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরবর্তী পর্যায়ের নির্বাচনগুলির ঠিক আগে, সন্ত্রাসের রাজত্বকে তীব্রতর করা এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে তীক্ষ্ণতর করা। বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় মধ্যপ্রদেশে এক প্রচার ভাষণে সেটা খুব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। বিজয়বর্গীয়র হুঁশিয়ারি, ‘ভারত মাতা’র বিরুদ্ধে যারা কিছু বলবে, তাদের হত্যা করতে বিজেপি বিন্দুমাত্র ইতস্তত করবে না! এটা, সংঘ বাহিনী যাদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেবে, তাদের বিরুদ্ধে পরিষ্কার এক গণনিধনের হুঁশিয়ারি! নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পর, সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান এখন বিপজ্জনক মাত্রায় উদ্ধত ও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এটা আরও বেড়ে গেছে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এবং গণতন্ত্র ও জনগণের বিরুদ্ধে তার স্বভাব ঘৃণায়।

রাজ্যসভায় দিল্লী-বিল পাশ করানোর উদ্দেশ্য, সম্ভবত শুধুই মোদীরাজের ক্ষমতার দম্ভকে বাড়িয়ে তোলা। ঐক্যবদ্ধ বিরোধীশক্তিকেই একে সমূলে পরাস্ত করতে হবে। আর সেজন্য এই শক্তিকে উৎপীড়িত ও নিগৃহীত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং আগামী নির্বাচনগুলিতে উদ্ধত সংঘ-বিজেপি বাহিনীর বিরুদ্ধে যোগ্য প্রত্যাঘাত হানতে মানুষকে সমাবেশিত করতে হবে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৪ আগস্ট ২০২৩

martyrs-of-kashipur-baranagar-massacrekashipur-baranagar-massacre

১৯৭১ সালের ১২-১৩ আগস্ট কাশীপুর বরানগর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। আজ ৫২ বছর হয়ে গেল, আজও কোনো শহীদ পরিবার সুবিচার পায়নি।

১৯৭১ সালের ১২-১৩ আগস্ট প্রায় দু’দিন ধরে চলেছিল সেই ভয়ংকর গণহত্যার তান্ডব। এই হত্যার সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০’র কাছাকাছি। প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। একটা প্রজন্মকে নিকেষ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের আজও কোনো বিচার হয়নি। তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি।

এই গণহত্যার বিচার চেয়ে প্রতিবারের মতো এবারও সিঁথির মোড়ে শহীদ বেদীতে ১৩ আগস্ট শহীদদের স্মরণে কর্মসূচি পালিত হয়। শহীদ বেদীতে কেন্দ্রীয় নেতা কার্তিক পাল, পার্থ ঘোষ, জয়তু দেশমুখ, ইন্দ্রাণী দত্ত সহ রাজ্য ও জেলা নেতৃত্ব মাল্যদান করেন। সিপিআই(এমএল) নিউ ডেমোক্রেসির পক্ষে বাপী গোস্বামী শ্রদ্ধা জানান। শহীদদের স্মরণে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার। সমগ্র সভা পরিচালনা করেন বাসুদেব বসু।

poet-sukanta's-birth-anniversarypoet-sukanta

১৬ আগস্ট, যাদবপুরের ‘সংযোগ’ থেকে যাদবপুর টিবি হাসপাতালে বিপ্লবী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করা হয় কবির ৯৭তম জন্মদিবসে।

এই ভাবগম্ভীর সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের সবচেয়ে ভালো দিক হল, টিবি হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট, সিস্টার-ইন-চার্জ সহ সমস্ত নার্স, ওয়ার্ড মাস্টারের সক্রিয় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।

আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করেন সুপারিন্টেনডেন্ট ডাঃ শংকরলাল ঘোষ, ডাঃ মির্ধা, সিস্টার-ইন-চার্জ ম্যাডাম বাগ, সাথী অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, নিত্যানন্দ ঘোষ, স্বপ্না চক্রবর্তী, সুব্রত ভট্টাচার্য, নীতীশ রায়, বাবুন চ্যাটার্জী, ওয়ার্ড মাস্টার তুষার বাবু, প্রতাপগড় প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার পরিমল হালদার, চিন্ময় ও অতনু চক্রবর্তী। মাল্যদানের পর সুপারিন্টেনডেন্ট সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন, নীতীশ রায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন কবি সুকান্তের কবিতা ‘আঠারো আসুক নেমে’। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন স্বপ্না চক্রবর্তী ও সুব্রত ভট্টাচার্য।

এরপর যাওয়া হল হাসপাতালের ১০নং রুমে, যেখানে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শোনা গেল, বেড থেকে নীচে মেঝেতে কবির নিথর মরদেহ পড়ে ছিল রক্ত বমি’র মাঝে! ওই বেডের সামনে নার্স সুজাতা নস্কর কবির বিখ্যাত কবিতা ‘ছাড়পত্র’ আবৃতি করেন।

চরম অনাদরে অবহেলায় এই ঐতিহ্যবাহী টিবি হাসপাতাল আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে শত সরকারি বঞ্চনার মধ্যেও। কবির অন্তিম শয়ন কক্ষটি যেন এক পরিত্যক্ত, ভূতুরে ভাঙাচোরা বিন্ডিং। সুপারিন্টেনডেন্ট জানালেন এখন মাত্র ১৩ জন পেশেন্ট রয়েছেন। তিনি এই হাসপাতালকে বাঁচাতে নাগরিকদের এগিয়ে আসার আন্তরিক আবেদন জানান।

manipur-presspress-conference

১৬ আগস্ট ২০২৩, কলকাতা প্রেস ক্লাব, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন

সিপিআই(এমএল), সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও অল ইণ্ডিয়া লইয়ার্স ফর জাস্টিস সংগঠনগুলির আটজনের একটি তথ‍্যানুসন্ধানী দল মণিপুর পরিদর্শন করে।

তথ‍্যানুসন্ধানী দলের উপলব্ধি, মণিপুরের বীরেন সিং সরকার ও কেন্দ্র সরকারের যোগসাজস মণিপুরে সাংবিধানিক ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ার জন‍্য দায়ী যা মণিপুরে এক অভুতপূর্ব মানব দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে।

কার্বি আংলং’এর সিপিআই(এমএল) নেত্রী এবং আইপোয়ার সহ-সভাপতি প্রতিমা এঙ্গিপি, আসামের সিপিআই(এমএল) নেতা বিবেক দাস, দিল্লীর সিপিআই(এমএল) নেত্রী সুচেতা দে, কর্নাটকের সিপিআই(এমএল) নেতা ক্লিফটন ডি রোজারিও, কর্নাটকের সিপিআই(এমএল) নেতা অবনি চোক্সি, আইপোয়া নেত্রী কৃষ্ণাবেণী, আইনজীবী সমিতির সদস্য মধুরিমা টি এবং কর্নাটকের দলিত ও নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী ডু সরস্বতী — এই আটজনের পরিদর্শক দল গত ১০ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত মণিপুর পরিদর্শন করেন। বিজেপির ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার সেখানে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তা প্রত‍্যক্ষ করেছে পরিদর্শকদল। প্রতিনিধিদল ইম্ফল উপত‍্যকা, কাংপোকপি ও চুড়াচাঁদপুর জেলার শরণার্থি শিবিরগুলি পরিদর্শন করেন। তাঁরা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্ত‍ৃপক্ষ এবং ‘মেইরা পাইবি’ ও ‘ইণ্ডিজেনাস ট্রাইবাল লিডার্স ফোরাম’ সহ ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠিগুলির বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলেন।

পরিদর্শকদলের উপলব্ধি

১) উপত‍্যকা ও পাহাড়, দুই এলাকায় যথাক্রমে মেইতেই ও কুকি দুই জাতিগোষ্ঠিকে এরকম সম্পূর্ণ আলাদা আলাদাভাগে বিভাজিত করে ফেলাটা ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে দেশকে বিজেপির দেওয়া উপহার। ভারতের ইতিহাসে এরআগে কখনই এরকম কোনও সরকার আসেনি যারা নিজের হাতে এভাবে সমাজের সামাজিক বুনটকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার কাজ করেছে। একটা রাজ‍্যে একসাথে বসবাসকারী দুটি জাতিগোষ্ঠিকে রাজ‍্যের দুটি পৃথক পৃথক এলাকায় সম্পূর্ণরূপে আলাদা ও আবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকার এরকম বিভাজন সৃষ্টি করেছে এমন এক রাজ‍্যে যেখানে এই দুই জাতিগোষ্ঠি, আগেকার কিছু সংঘর্ষের ঘটনা সত্ত্বেও, পরস্পর মিটমাট করে একসাথে বসবাস করতে স্বচ্ছন্দ ও সক্ষম ছিল।

২) এ’কথা উল্লেখ না করলেও চলবে যে, জাতিগোষ্ঠিগুলোর মধ্যে বগত তিনমাস ধরে যে বিভাজন, আবদ্ধকরণ ও হিংসা চলছে তা বিজেপি সরকারের নেওয়া পদক্ষেপেরই পরিণাম। একদিকে দেখা গেল যে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং হিংসার নিরসনে অক্ষম ও অনাগ্ৰহী, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে মণিপুরের সমস্যার চেয়ে ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরই অগ্রাধিকার পেল। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে যে নিকৃষ্ট ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তা এই সংকটের সর্বাঙ্গীণ রাজনৈতিক সমাধান প্রদানে তাঁদের দেউলিয়াপণাকেই উন্মোচিত করেছে।

৩) ত্রাণ শিবিরগুলোর অবস্থা শোচনীয়। উপত্যকা এবং পার্বত্য অঞ্চলে উচ্ছেদ ও স্থানান্তরিত হাজার হাজার মানুষ অত্যন্ত দুরাবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বুনিয়াদি পরিষেবার ব্যবস্থাই নেই। সরকার হাত ধুয়ে ফেলেছে, দুর্দশাগ্ৰস্ত জনগণের দায়দায়িত্ব নিচ্ছে না।

বাস্তুচ্যুত মেইতেইদের জন্য উপত্যকার ত্রাণ শিবিরগুলোর অবস্থা একেবারেই নিকৃষ্ট। জানা গেল, ইম্ফলের কেন্দ্রস্থলে শ্যামাসাক্ষী হাইস্কুলে চালিত ত্রাণ শিবিরে রাজ্য সরকার কিছু চাল ও ডাল ছাড়া শিবিরে থাকা মানুষদের জন্য মাথাপিছু ৮০ টাকা করে দেয়, যেটা একেবারেই অপর্যাপ্ত। পরিদর্শক দলের সদস্যরা এটাও জানতে পারলেন যে, বর্তমানে এক বাজারে অবস্থিত মৈরাং’এর ত্রাণ শিবিরেও যথাযথ সুযোগসুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। ঐ শিবিরে থাকা ব্যক্তিদের আজ পর্যন্ত মাথাপিছু মাত্র ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আকামপটের স্কুল প্রাঙ্গণে যে ত্রাণ শিবির চলছে সেখানে ভিড় অত্যন্ত বেশি এবং বুনিয়াদি পরিষেবাও অপ্রতুল।

পাহাড়ে কুকিদের জন্য যে ত্রাণশিবির চলছে তার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। চুড়াচাঁদপুরের যুব হস্টেলে স্বেচ্ছাসেবকদের পরিচালনায় যে ত্রাণশিবির চলছে সেখানে ঘরগুলো জনাকীর্ণ এবং সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত ছড়াচ্ছে। ঐ শিবিরে হাম, জল বসন্ত এবং ভাইরাস ঘটিত জ্বর প্রতিদিনের ব্যাপার। দলের সদস্যরা যে শিবিরগুলো পরিদর্শন করেছেন সেখানে জঞ্জাল সাফাই ব্যবস্থা খুবই খারাপ, প্রতিটি ঘরে প্রায় ৫০০ ঘরছাড়া মানুষ থাকেন এবং শৌচাগার ব্যবস্থা শোচনীয়। অধিকাংশ ত্রাণ শিবিরেই বাসিন্দারা পুষ্টিকর খাবার পান না এবং দিনে দুবারই ভাত ও ডাল দেওয়া হয়। কাংপোকপির ত্রাণ শিবিরগুলোর অবস্থাও একই রকম এবং পুষ্টিকর খাবার ও শৌচাগারের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। ঐ জেলায় একটাই হাসপাতাল রয়েছে যেটাকে জেলা হাসপাতালের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং ওষুধের ব্যবস্থা নগন্য।

৪) উপত্যকা এবং পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে সীমানা বিভাজন এবং অঘোষিত অবরোধের ফলে পার্বত্য জেলাগুলোর ত্রাণ শিবিরে থাকা ঘরছাড়া কুকিদের কাছে বুনিয়াদি খাবারসামগ্রী, ওষুধের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের পরিবহণ পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এরজন্য আবার উপত্যকার বাইরে মেইতেইদের যাওয়াটাও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে।

৫) চলমান হিংসা এবং জীবনহানি ও আক্রান্ত জনগণের সম্পত্তি নাশের জন্য সরকারকেই সরাসরি দায়বদ্ধ করতে হবে। এটা অত্যন্ত লজ্জার যে এই সমস্ত অমানবিক ও প্রকট অপরাধগুলোর তদন্তে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সুনিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টকেই হস্তক্ষেপ করতে হল।

মানবতার এই সংকটের সম্ভবপর রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপটা হতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বীরেন সিং’এর পদত্যাগ। আমরা যুযুধান সমস্ত সম্প্রদায়ের কাছেই বৈরিতা বন্ধের আবেদন জানাচ্ছি যাতে ত্রাণ শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া দুর্দশা পীড়িত জনগণের পরিচর্যা করা সম্ভব হয় এবং সেটা যেন চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে অতিক্রম করে বর্তমান অচলাবস্থা অবসানের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার এক সংকেত হয়েও দেখা দিতে পারে।

পরিদর্শকদল মণিপুরের বর্তমান রাজ্যপাল শ্রীমতী অনুসুয়া উইকেইয়ের সাথেও দেখা করেন এবং তাঁকে মণিপুরের বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। ত্রাণশিবিরগুলির জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে বিশেষ আবেদন জানানো হয়। এবং রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং’এর পদত্যাগ দাবি করা হয়।

- পরিদর্শক দলের পক্ষে সুচেতা দে এবং ক্লিফটন ডি রোজারিও এবং সিপিআই(এমএল) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে কার্তিক পাল

general-meeting-of-west-bengalculinary-workers-union

পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের ডাকে গত ১৩ আগস্ট ২০২৩ বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরে পৌরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলির রন্ধন কর্মীদের এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সূচনা করেন ফারহান খান। রন্ধন কর্মীদের শ্রমিকের স্বীকৃতি, নূন্যতম মজুরি ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দাবি নিয়ে রাজ্যব্যাপী আন্দোলনে বাঁকুড়া জেলার কর্মীদের সামিল হবার আবেদন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের রাজ্য সহ-সভাপতি অজয় বসাক। এছাড়াও আসন্ন প্রকল্প কর্মীদের জাতীয় সম্মেলন সফল করতে প্রচার ও অর্থ সংগ্রহের আবেদন রাখা হয়। সভায় উপস্থিত সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্যনেত্রী চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী মহিলা কর্মী হিসেবে তাদের উপর এই বিশেষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমগ্র মহিলা সমাজের সাথেও আন্দোলনে সামিল হবারও আবেদন রাখেন। সভার সঞ্চালক শ্রমজীবী মহিলা আন্দোলনের নেত্রী তিতাস দাশগুপ্ত বলেন, এলাকার শুধু নয়, জেলার সমস্ত ব্লকের কর্মীদের সংগঠনে এনে আমাদের দাবি আদায়ে শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। প্রায় শতাধিক কর্মীর উপস্থিতিতে ৮৫ জন সদস্য হন। বৈঠক থেকে ২৫ জনের প্রস্তুতি কমিটি গঠন হয়।

on-the-evening-of-august-15a-rally-in-bali-rural-area

১৫ আগস্ট স্বাধীনতার ৭৭তম দিবসে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং ভারতের বর্তমান ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বক্তব্য তুলে ধরতে বালি গ্রামাঞ্চলে দুর্গাপুর হেল্থ সেন্টারের সামনে একটি পথসভার আয়োজন করা হয়। পথসভার শুরুতে শহীদদের প্রতি পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন এবং সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের শিল্পী বন্ধুরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ছাত্রনেতা সৌভিক বণিক ছাত্র আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্বপ্নদীপের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার উল্লেখ করে দোষীদের শাস্তি এবং বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন। মানসিক ত্রাস ও ভীতির পরিবর্তে সুস্থ সৌহার্দ্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাসের প্রশ্নে জোরালো বক্তব্য রাখেন আইসার হাওড়া জেলা সম্পাদক সৌভিক বণিক। যাদবপুরে চলমান আইসার অনির্দিষ্টকালীন অবস্থানে আজ হাওড়া থেকে সৌভিক উপস্থিত ছিলেন। তার বক্তব্যে উঠে আসে সেই অভিজ্ঞতার কথাও। লিঙ্গ সংবেদনশীলতা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে আইসার ধারাবাহিক ও জোরালো অবস্থানের কথাও তিনি তুলে ধরেন।

দীপক চক্রবর্তী জণগনের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের ফ্যাসিস্ট আক্রমনের কথা উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটির সদস্য, হাওড়া জেলা এআইসিসিটিইউ সম্পাদক পরিতোষ ব্যানার্জী (পার্থ)। তিনি তার বক্তব্যে আমরা যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছি, সাধারণ মানুষ কিভাবে মোদীর ফ্যাসিস্ট সরকার দ্বারা প্রত্যেক মুহূর্তে প্রতারিত হচ্ছেন এবং দেশের সম্পদ‌ লুঠ হচ্ছে, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে প্রতিবেশীর মধ্যে দাঙ্গা লাগলো হচ্ছে তার উল্লেখ করেন। পার্থ সারথী মিত্র ভারতীয় সম্প্রীতির সংস্কৃতিকে আরএসএস এবং বিজেপি কিভাবে ধ্বংস করে এক অরাজকতা সৃষ্টি করছে অন্ধকার কুসংস্কারের দিকে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন। শিল্পী বন্ধুদের গান এবং মোহন মান্নার কবিতা, ফ্যাসিস্ট বিরোধী দীপ্ত স্লোগানের মধ্য দিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সমগ্র সভাটি সঞ্চালনা করেন বালি গ্রামাঞ্চল লিডিং টিমের সদস্য মাধব মুখার্জী।

working-women-and-scheme-workers-unitycelebrates-independence-day

এআইসিসিটিইউ কলকাতা জেলা কমিটির পক্ষ থেকে গড়ে তোলা শ্রমজীবী মহিলা ও স্কীম কর্মী ঐক্যমঞ্চ’র সদস্যরা বেশ কয়েক মাস যাবত অচেনা অজানা শ্রমজীবী মহিলাদেরকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে কলকাতার নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। নতুন ধরনের এক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আজ ধীরে ধীরে (তৃণমূল অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও) কয়েকটি এলাকায় লেগে পড়ে থাকার পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছেন। এরই মাঝে ১৫ আগস্ট, স্বাধীনতা দিবস একটা বাড়তি সুযোগ এনে দিল। দুটো পকেটে স্বাধীনতা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে এলাকায় শিকড় প্রোথিত করার সুযোগকে মঞ্চের সদস্যরা হাতছাড়া করেননি। সকাল ৬টা থেকে প্রস্তুতি নিয়ে একটা পকেটে সকাল ৮টায় এবং আর একটা পকেটে দুপুর ১২টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। চারিদিকে তৃণমূলের কর্মসূচি চলছে তার মধ্যেই এলাকার শ্রমজীবী মহিলারা ও তাঁদের পরিবারের পুরুষেরা, বাচ্চারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মঞ্চের ব্যানার টাঙ্গিয়ে কর্মসূচিকে সফল করেছেন। মঞ্চের লিফলেট বিলি করেছেন, যার হেডলাইন ছিল স্বাধীনতার ৭৭ বছর চলছে আমরা শ্রমজীবী মহিলারা আজও কেন বঞ্চিত?

১৫ আগস্ট ২০২৩। আকাশ একরাশ ঝলমলে সোনালি রোদ্দুর ছড়িয়ে দিয়েছে। আমরা টিমের সদস্যরা স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানটি পালন করার জন্য সকাল ৮টায় আমাদের কাজের একটি এলাকায় গিয়ে পৌঁছলাম। একাদশী, প্রিয়াঙ্কা, কল্পনা, রূপা, রোজিনাবিবি, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা, সবাই এগিয়ে এসে, হাতেহাত মিলিয়ে ব্যানার টাঙানো, বেদি তৈরি করা, পতাকা লাগানো, ফুল দিয়ে সাজানো খুবই উৎসাহের সাথে করতে লাগলো। বাড়ির পুরুষেররা উঁচু জায়গায় পতাকার চেন লাগাতে শুরু করলেন।

প্রথমেই পতাকা উত্তোলন করলেন এলাকার বয়স্কা মহিলা রোজিনা বিবি, তারপর একে একে সকলেই মাল্যদান ও পুষ্পার্ঘ নিবেদন করেন। পরবর্তীতে, শ্রমজীবী মহিলা ও স্কীম কর্মী ঐক্যমঞ্চ’র পক্ষ থেকে স্নিগ্ধা বসু স্বাধীনতা দিবস ও সংবিধান নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কবিতা আবৃতি করে। এদের মধ্যে একজন একাদশী হালদার ছোট্ট করে বক্তব্যও রাখেন। নিজের থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘মুক্তির মন্দিরে’ গানটি শুরু করেন। শহীদ স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সকলে মিলে জনগণমন গানটি গেয়ে অনুষ্ঠানটি সমাপ্ত করা হয়। সবশেষে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কেক ও চকলেট দেওয়া হয় ।

আরেকটি এলাকা দুপুরের দিকে, মেঘের আড়ালে সূর্য মুখ লুকিয়ে ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। মঞ্চের সদস্যরা বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পরে অন্য একটি এলাকার দিকে। এই অঞ্চলের মহিলারা কাজ থেকে ফিরে এসে স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বলে আগেই জানিয়ে ছিলেন। বাইরে অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টির হচ্ছে তারই মধ্যে দুপুর ১২টা নাগাদ লক্ষী, পূজা, কাকলি, শম্পা — ছোটবড় ছেলেমেয়েরা প্রথমেই এসে পৌঁছে যায়। এখানেও সবাই মিলে হাতে হাত লাগিয়ে পতাকা ও ফুল মালা দিয়ে সাজিয়ে তুললো। প্রথমেই পতাকা উত্তোলন করেন এলাকার বয়স্কা মহিলা লক্ষী মিস্ত্রি, তারপর একে একে সকলেই মাল্যদান করেন। পরবর্তীতে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। স্বাধীনতা দিবস ও সংবিধান নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন মঞ্চের পক্ষে শঙ্করী চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তীতে কবিতা, পূজা, ঈশিতা, ঝুম্পা কবিতা পাঠ করে। এখানেও সকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গান শুরু করল। আমরাও গানের সাথে সাথে গলা মেলালাম। পরিশেষে সকলে মিলে জনগণমন গানটি গেয়ে অনুষ্ঠানটি সমাপ্ত করি। সবশেষে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কেক ও চকলেট দেওয়া হয়।

- স্নিগ্ধা বসু


স্বাধীনতা দিবস উদযাপন

এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত বিরসূল হাট লেদার হকার্স ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় বিরসূল হাটে পতাকা উত্তলন করা হয়।

পতাকা উত্তলন করেন ইউনিয়ন নেতা মহঃ রুসতম। পূর্ব মধ্য কলকাতা আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে অশোক সেনগুপ্ত, খোকন ঘোষ, মহঃ আমিন, মহঃ সাত্তার, মহঃ সামিম, মহঃ কলিম, মহঃ মনসুর সহ প্রায় ৩৫/৪০ জন হকার উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রাখেন মহঃ ইউনুস এবং দিবাকর ভট্টাচার্য্য। অনুষ্ঠান শেষে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

এছাড়াও বিদ্যাসাগর মঞ্চের ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবারের ন্যায় এবারও এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়নকে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানেও ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করা হয়। সেখানে দিবাকর ভট্টাচার্য্য বক্তব্য রাখেন।


state-conference-of-bcmfconference-of-bcmf

গত ১৫ আগস্ট উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁকিনাড়া শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম ‘বিসিএমএফ’এর ৮ম রাজ্য সম্মেলন। সম্মেলনের সভামঞ্চের নামকরণ করা হয় বেলুড় মহাদেও জুটমিলের প্রয়াত কমরেড তথা বিসিএমএফের অগ্রণী কমরেড রাজেন্দ্র সাউ (গুপ্তা)-এর স্মৃতিতে।

সম্মেলনের শুরুতেই কাঁকিনাড়া স্টেশন থেকে মজদুর সাথীদের দৃপ্ত মিছিল সম্মেলন স্থল (ফিঙেপাড়া গার্লস স্কুল) পর্যন্ত স্লোগান সহযোগে পৌছায়। চারিদিকে ১৫ আগস্টের আড়ম্বরপূর্ণ উদযাপনের মাঝে মজদুরদের লালঝান্ডা হাতে হকের দাবিতে ভরা স্লোগানে নিমেষে ওই এলাকার পরিবেশ বদলে দেয়। সম্মেলনের প্রথমেই জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় এবং পরবর্তীতে বিসিএমএফ-এর পতাকা উত্তোলন ও শহীদ স্মরণ কর্মসূচি পালিত হয়।

সম্মেলনের অধিবেশন পর্বের সঞ্চালনার জন্যে পাঁচ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর গঠন হয়। বিদায়ী কমিটির পক্ষ থেকে খসড়া প্রতিবেদন পাঠ করেন ওমপ্রকাশ রাজভর। পরবর্তীতে রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের নেত্রী তথা এই সম্মলনের অতিথি জয়শ্রী দাস সরলভাবে বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেন এবং সম্মেলনকে সম্বোধিত করেন।

সম্মেলনের মূল পর্বে খসড়া প্রতিবেদনের ওপরে বক্তব্য রাখেন ১ জন মহিলা সহ মোট ১৩ জন প্রতিনিধি। রাজ্যর বিভিন্ন জুটমিলে কর্মরত প্রতিনিধিরা তাদের সমস্যা ও সাংগঠনিক বিভিন্ন পরামর্শ তুলে ধরেন তাদের ভাষণে। মিলের শ্রমিকরা ছাড়াও রেল, প্রতিরক্ষা সহ অন্য ক্ষেত্রের সাথীরাও তাদের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন সাথীদের সঙ্গে।

নরেন্দ্র মোদী সরকারের শ্রমিকঘাতী শ্রম আইন সংশোধন এবং পরিকল্পিতভাবে জুট সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলোকে ধ্বংস করার চক্রান্তের বিরুদ্ধ সমস্বরে বৃহত্তর প্রতিরোধের ডাক দেয় এই সম্মেলন। সম্মলনে উপস্থিত আইসার ছাত্র প্রতিনিধি সুরত্ন’র মনোগ্রাহী বক্তব্য সকলেরই নজর কাড়ে।

এছারাও সম্মেলনের শেষ বেলায় এপিডিআর-এর প্রতিনিধি সাথী দেবাশিষ পালের বক্তব্য সম্মেলনকে সমৃদ্ধ করে। এআইসিটিইউ’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু তার বক্তব্যে সংগঠনের আশু কর্তব্য ও কাজের দিশার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। সম্মলনের খসড়া প্রতিবেদনের ওপরে বক্তব্যের জবাবী ভাষন দেন বিদায়ী সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী।

সম্মেলন থেকে সর্বসম্মত ভাবে একজন অতিথি সহ মোট ৪৪ জনের রাজ্য কাউন্সিল, ২৭ জনের কার্যনির্বাহী কমিটি ও ১৫ জনের অফিস বেয়ারার নির্বাচিত হন। অতনু চক্রবর্তী রাজ্য সাধারণ সম্পাদক, নবেন্দু দাশগুপ্ত রাজ্য সভাপতি এবং দেবব্রত ভক্ত অর্গানাইজিং সেক্রেটারি পদে নির্বাচিত হন। সম্মেলনে মোট আগত প্রতিনিধি সংখ্যা ছিল ১২৭ জন।

শ্রমকোড বাতিল সহ একাধিক দাবিতে স্লোগানের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে সম্মেলনের।

parts-of-the-state-circularthe-state-circular

গত ২৬-২৭ জুলাই ২০২৩ মৌলালী যুবকেন্দ্রে রাজ‍্য কমিটির বৈঠকের শুরুতে বিগত সময়ে প্রয়াতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। যথা বিশিষ্ট কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা সনৎ রায়চৌধুরী, গণবিজ্ঞান আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব সমর বাগচী, হুগলী জেলার পার্টি কর্মী দিনেশ দাস, হাওড়া জেলার পার্টি কর্মী সুপ্রভা বেরা, জলপাইগুড়ি জেলার দীর্ঘদিনের পার্টি কর্মী রূপেশ্বর রায়, নাট্যকর্মী ও পার্টি দরদী সুমিত বিশ্বাস (গোপ), মহিনের ঘোড়াগুলির বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী তাপস দাস।

পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রসঙ্গে

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচন শাসক তৃণমূলের প্রবল সন্ত্রাস, পুলিশ ও দলীয় দুস্কৃতিদের দ্বারা হত্যাকান্ড, অপহরণ সব মিলিয়ে তৃণমূলস্তরে গণতন্ত্র হরণ ও হিংসার ঘটনাবলীকে সামনে নিয়ে এনেছে। যদিও কিছু এলাকায় মানুষের পাল্টা প্রতিরোধের দিকগুলিও দেখা গেছে। কিছু জেলায় আমাদের কর্মীরা তীব্র সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রবল প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করায় লড়াকু কর্মীবাহিনীকে রাজ্য কমিটি সংগ্রামী অভিনন্দন জানায়।

কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে ব্যবহার করে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকাকে বাড়িয়ে, বিভাজন ও হিংসার রাজনীতি ফেরি করে, অর্থের বিপুল ব্যবহার করেও বিজেপির নির্বাচনী ফল মোটেই তাদের আশানুরূপ হয়নি। বরং তাদের প্রাপ্ত ভোট ৩৯ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশ হয়েছে। বিজেপির এই অধোগতি স্পষ্ট। তাঁদের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার দাপট বা রাজ্যের বেশ কয়েকটি স্থানে দাঙ্গা লাগানোর পরিকল্পিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ বা বিভিন্ন পরিচিতি সত্তাকে সপক্ষে নেওয়ার অপকৌশল তেমন সাফল্য লাভ করেনি। সব মিলিয়ে গ্রামবাংলার এই গণরায়ে বিজেপি বিরোধীতার দিকটা আগের তুলনায় বেড়েছে। বামপন্থীদের ‌ভোট বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।

অন্যদিকে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের বর্তমান বাস্তবতায় রাজ্য সরকারের কিছু জনমোহিনী প্রকল্প ও ব্যাপক প্রচার ফলাফলে ছাপ রেখেছে।

সীমাবদ্ধ স্বশাসিত সংস্থা রূপে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং গ্রামসংসদ তথা জনগণের অংশগ্রহণকে জলাঞ্জলি দিয়ে তৃণমূল দলীয় ও সরকারি আমলাতন্ত্র কায়েম করেছে। গ্রামাঞ্চলে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের পরিপ্রেক্ষিতে কাজের প্রশ্নে বা কৃষি সহায়তা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সীমাহীন লুঠতন্ত্র চালিয়েছে। নির্বাচনে আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মোট পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে আমরা জয়লাভ করি, আরো ১৫টি আসনে আমরা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছি। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীতে আমাদের কাজের ধারা এবং পরিবর্তনশীল গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমীক্ষা অনুসন্ধানের কাজ হাতে নিতে হবে। অনুশীলনের ইতিবাচক দিককে রক্ষা করা ও তাকে ছড়িয়ে দিয়ে কাজের বিস্তারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রামীণ ক্যাডার গড়ে তোলা, ছাত্র-যুবদের নতুন করে গ্রামে চলো অভিযান সংগঠিত করা এবং এই প্রক্রিয়ায় বাংলার গ্রামাঞ্চলে আমাদের কাজের ধারায় আমূল পরিবর্তনের দিশায় এগিয়ে যেতে হবে।

‘ইণ্ডিয়া’ জোট প্রসঙ্গে

২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রাকপর্বে পাটনায় প্রথম বৈঠক ও পরে বেঙ্গালুরুতে দ্বিতীয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বহুপ্রত্যাশিত বিজেপি-আরএসএস বিরোধী নবগঠিত জোট ‘ইন্ডিয়া’র আমরা শরিক। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রেক্ষিতে রাজ্যস্তরে যথেষ্ট জটিলতা বিদ্যমান। তবে এরাজ্যে সিপিআই(এম) বা বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির ঘোষিত কৌশলের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থানের ভিন্নতা থাকছে। রাজ্য বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পক্ষে আমরা নিষ্ক্রিয় নয়, সক্রিয় ভূমিকায় থাকবো। বামদলগুলি এবং বিভিন্ন বাম ও গণতান্ত্রিক গোষ্ঠী ও ফ্যাসিবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলির সঙ্গে কথা বলার উদ্যোগ নেবো।

সাম্প্রতিকতম জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা ও হস্তক্ষেপের রূপরেখা এবং পশ্চিমবঙ্গের জটিল রাজনৈতিক আবর্তে ফ্যাসি-বিরোধী লড়াইয়ের নির্দিষ্ট গতিপথ সম্পর্কে আমাদের বর্তমান অবস্থান বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বোঝাপড়ার লক্ষ্যে আগামী ২০ আগস্ট মৌলালী যুবকেন্দ্রের সভাগৃহে অনুষ্ঠিত হবে রাজ্যভিত্তিক কর্মীসভা।

সাংগঠনিক অভিযান প্রসঙ্গে

পলিটব্যুরোর আহ্বানে দেশব্যাপী ব্রাঞ্চ ও লোকাল কমিটি পুনর্নবীকরণ/পুনর্গঠন অভিযান আমাদের রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের কারণে বিলম্বিত হয়েছে। ২৮ জুলাই থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর, এই দু’মাস সময়কালের মধ্যে এই অভিযানকে কার্যকরী করতে হবে।

আইপোয়ার জাতীয় সম্মেলন

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জাতীয় সম্মেলন আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর ২০২৩ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হবে। এ’রাজ্যের সংগঠন ৪০ হাজার সদস্য সংগ্রহ করে এই সম্মেলনে যোগ দেবে। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ভালো মাত্রায় দেখা গেছে। সদস্য ও অর্থসংগ্রহে মহিলা কর্মীদের টিমকে উদ্যোগ নিতে হবে, রাজনৈতিকভাবে তাঁদের সংগঠিত করতে হবে।

সারা ভারত স্কীম ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা সম্মেলন

আগামী ৯-১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পাটনায় সারা ভারত স্কীম ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের রাজ্যে প্রধানত মিড-ডে-মিল কর্মীরাই এই সম্মেলনে যোগ দেবেন। সম্প্রতি রাজ্যে রন্ধনকর্মীদের কাজ হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র জেলা থেকে বেরিয়ে মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলায় শুরু হয়েছে, যা ইতিবাচক। এ’রাজ‍্য থেকে ৪ হাজার সদস্য সংগ্রহ করে সম্মেলনে যোগ দেওয়া হবে।

এআইসিসিটিইউ রাজ‍্য সম্মেলন

আগামী ২ অক্টোবর ২০২৩ মৌলালী যুবকেন্দ্রে এআইসিসিটিইউ’র রাজ‍্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বেশ কিছু জেলায় ইতিমধ্যে জেলা সম্মেলন সংগঠিত হয়েছে। বাকি জেলাগুলিতে হচ্ছে। মোট ২৫ হাজার সদস্য নিয়ে রাজ‍্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

পার্টি দলিল অধ‍্যয়ন

একাদশ পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত দলিলগুলির বাংলা তর্জমার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। জাতীয় পরিস্থিতি ও ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করার কর্মকৌশল সংক্রান্ত দলিল ছাপা হয়েছে। জেলা কমিটিগুলির নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দলিলগুলির যৌথ অধ্যয়নের সময়সূচি স্থির করতে হবে। রাজ্যস্তরে শিক্ষক হিসাবে কিছু নেতৃস্থানীয় কমরেডদের নাম নির্ধারিত হয়েছে। এঁরা জেলা শিক্ষা শিবির পরিচালনায় সহযোগিতা করবেন।

দেশব্রতী পত্রিকা

দেশব্রতী পত্রিকার বকেয়া অবিলম্বে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য জেলাগুলিকে জরুরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেইসঙ্গে পত্রিকা বণ্টন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে প্রতিটি জেলা কমিটি নির্দিষ্টভাবে একজন জেলা সদস্যকে পার্টি মুখপত্রের গ্রাহক সংগ্রহ, সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দায়বদ্ধ করবে এবং সেই সদস্যর নাম দেশব্রতী প্রকাশনা দপ্তরে নথিভুক্ত করবে। দেশব্রতী সম্পাদকমণ্ডলির পক্ষ থেকেও সরাসরি তদারকি থাকবে।

continues-doors-must-be-openeddoors-must-be-opened

এরাজ্যে প্রায় দু’বছর হতে চলল বছরকার একশ দিনের কাজ নেই। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ অর্থ আটকে দিয়েছে। ফলে এমএনআরইজিএ প্রকল্পের কাজ ফের কবে শুরু হতে পারে সেটা অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। কেবল তা নয়, বিশাল পরিমাণ মজুরির টাকাও বকেয়া। কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে মজুরি বাবদ দেয় ছিল ২০২১-২২ আর্থিক বছরে ১৯১৬ কোটি টাকা, ২০২২-২৩-এ ৮৩২ কোটি টাকা। রাজ্যের দাবি পাওনার অঙ্ক আরও বেশি। এনিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে চলে আসছে দীর্ঘ তরজা। মাঝখান থেকে বঞ্চনার জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে গ্রামবাংলার ব্যাপক কর্মক্ষম বেকারবাহিনী, যন্ত্রণার শেষ নেই। এই দুর্দশা চলতে দেখে বাংলার গণতান্ত্রিক বিবেকও তিতিবিরক্ত।

কেন্দ্রের অভিযোগ হল, এবিষয়ে রাজ্যের পেশ করা আর্থিক হিসাবের রিপোর্টে স্বচ্ছতা নেই, রয়েছে বিস্তর গরমিল, কারচুপি করে আত্মসাৎ করা হয়েছে বড় অঙ্কের অর্থ, ঘটেছে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি। তাই কেন্দ্র এমএনআরইজি আইনের ২৭ ধারায় অর্থ আটকে দিয়েছে। কেন্দ্রের ফরমান হল, রাজ্য সরকারকে আগে স্বচ্ছ হিসাবের রিপোর্ট দিতে হবে, হাতিয়ে নেওয়া টাকা উদ্ধার করে প্রকৃত মজুরি প্রাপকদের বকেয়া মিটিয়ে দিতে হবে, তারপর কেন্দ্র আটকে রাখা পরবর্তী কিস্তির বরাদ্দ অর্থ রিলিজ করবে।

পক্ষান্তরে, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সময়কার বিভিন্ন সূত্রের কথায়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আর্থিক হিসাব পেশে কিছু এদিক-ওদিক হয়ে থাকতে পারে, ওসব তেমন গুরুতর ত্রুটি নয়, রাজ্য সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে, তিলকে তাল করে যে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়, বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিজেপি ২০২১-এ এরাজ্যে ক্ষমতায় আসতে না পেরে নানা ছুতোয় এই সেই ঝামেলা পাকাতে কেন্দ্রকে ব্যবহার করছে। তারই এক নিকৃষ্ট প্রকাশ হল, ১০০ দিনের কাজের শ্রমজীবীদের শুকিয়ে মারতে চাইছে, রাজ্য সরকারকে বেকায়দায় ফেলে টাইট দিতে চাইছে।

মোদী সরকার প্রাসঙ্গিক বরাদ্দ অর্থ দেওয়া না দেওয়ার পূর্বশর্তের ব্যাপারে নিজের আইনগত অজুহাতে অনড়। তবে আইনের প্রসঙ্গ যখন উঠেই গেছে, তখন এই আইনে কাজ ও কাজের মজুরি দেওয়ার ব্যাপারে কী কী বলা আছে, আর সেই আইনকে মান্যতা দিয়ে চলার প্রশ্নে কেন্দ্রের অবস্থানটি মূলগতভাবে কেমন, একনজরে ফিরে তাকানো যাক সে’কথায়। ২০০৫ সালে কেন্দ্রে ইউপিএ আমলে তৈরি হয়েছে এমএনআরইজিএ (আইনে)। আর তাতে পরিষ্কার বলা আছে, এই সরকারি প্রকল্পে বছরে ন্যূনতম একশ দিনের কাজের বাধ্যতামূলক সংস্থান করে দিতে হবে। প্রত্যেক পরিবারে কাজ করতে সক্ষম এমন পূর্ণবয়স্ক যে’কেউ আবেদন করলে তাঁকে জবকার্ড দিতে হবে। প্রত্যেক জবকার্ড পাওয়া লোকদের কাজ দিতে হবে, না দিতে পারলে আবেদনের পনের দিনের মধ্যে বেকার ভাতা দিতে হবে। এছাড়া ঐ আইনে অতিরিক্ত পঞ্চাশ দিনের কর্মসংস্থানের কথা উল্লেখ করা আছে গ্রামাঞ্চলে খরা-বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ার ক্ষেত্রে। সংশ্লিষ্ট আইনে তাছাড়া বলা রয়েছে যে, এর বাইরে রাজ্য সরকারগুলি চাইলে অতিরিক্ত কর্মদিবস সৃষ্টি করতে পারে, তবে তারজন্য কেন্দ্রের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করা যাবে না, তা করতে হলে করতে হবে রাজ্য সরকারের নিজস্ব আর্থিক সংস্থান থেকে। কেন্দ্রের কাছ থেকে পাওনার মোট বরাদ্দে থাকবে মূলধনী ও মজুরি বাবদ নির্ধারিত অনুপাতে দু’রকম খরচের টাকা।

কাজের আইনগত অধিকারের এই সরকারি প্রকল্পটির সার কথা হল, এটি ‘কাজের চাহিদা নির্ভর’ প্রকল্প, সেই অনুসারেই বাজেটে মোট অর্থ বরাদ্দ করতে হবে, উল্টোভাবে নয়। অর্থাৎ একে বাজেটে বরাদ্দ-নির্ভর কাজ পাওয়ার প্রকল্পে পরিণত করলে চলবে না। কিন্তু কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পর থেকে একে ক্রমাগত বরাদ্দ ভিত্তিক প্রকল্পে পরিণত করে আসছে। বাজেট যেমন, প্রকল্প তেমন — এরকমটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে পলিসি। গোড়াতেই গলদ। এভাবে প্রথমে আইন অনুসারে না চলার পন্থা নিয়েছে কেন্দ্রই। আর ফিবছর বরাদ্দ কমে আসছে। সেইমতো জবকার্ড ছাঁটাই থেকে শুরু করে কর্মদিবস সংকোচন, মূল্যবৃদ্ধি অনুপাতে মজুরি বৃদ্ধি না করা, রাজ্যে রাজ্যে মজুরি সমতা না রাখা, বরাদ্দ অর্থ পাঠানোয় দেরী করা এবং এই সবকিছুকেই রীতি বানিয়ে চলা, ফলতঃ খুবই কম সময়ের মধ্যে মোট কর্মদিবসের সম্পূর্ণ সদ্বব্যবহার করা সম্ভব না হওয়ার চাপের প্যাঁচে ফেলা, প্রকল্প রূপায়ণ কার্যত অসম্পূর্ণ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকতে বাধ্য করা, সেই অজুহাতে পরের কিস্তির বরাদ্দ অর্থ মঞ্জুর করতে যথারীতি বহু বিলম্ব করা — এভাবেই কেন্দ্র খেলে আসছে তার হাতের তাস। ফলে বছরে মাথাপিছু কর্মদিবস সৃষ্টি হতে থাকে বড়জোর বিশ/তিরিশ/চল্লিশ দিন মাত্র। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেটে এই খাতে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ ধার্য হয়েছে ৬০,০০০ কোটি টাকা, যা কিনা গত আর্থিক বছরের (২০২২-২৩) বরাদ্দের তুলনায় ১৮ শতাংশ কম। গতবছর বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৭৩,০০০ কোটি টাকা। আর, বেকার ভাতার দেখা সহজে মেলে না। বিগত দু’বছর যাবত বকেয়া মজুরি ও বেকার ভাতার যোগফলে জমে উঠেছে পাওনার পাহাড়। এবছরের (২০২৩) গোড়ার দিককার কেন্দ্রের সূত্রে প্রাপ্ত হিসাব অনুসারে, এই প্রকল্প বাবদ ১৪টি রাজ্যে (যার মধ্যে ৮টি রাজ্য বিরোধী দল শাসিত) কেন্দ্রের অদেয় মোট অর্থের পরিমাণ ৬,১৫৭ কোটি টাকা। পাশাপাশি, ‘ভূয়ো’ কারণ দেখিয়ে, সারা দেশে জবকার্ড ছাঁটাই করা হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ৫ কোটির বেশি। যা তার আগের বছরের (২০২১-২২) তুলনায় ২৪৭ শতাংশের বেশি। পশ্চিমবঙ্গে জবকার্ড বাতিল করা হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ১,৫৭,৩০৯টি, আর ২০২২-২৩এ ৮৩,৩৬,১১৫টি। বাজেটে বরাদ্দের হার যত হ্রাস পাচ্ছে, ততো কমছে কর্মদিবসের হার, কর্মদিবসের হার যত হ্রাস পাচ্ছে, ততো বাড়ছে জবকার্ড ছাঁটাইয়ের হার। মজুরি বৃদ্ধির কোনও নতুন বিধি-বন্দোবস্ত করার নাম-গন্ধ নেই, পরন্তু রাজ্যে রাজ্যে বড় মাত্রায় রয়েছে মজুরি অসমতা। তা দিবসপ্রতি হরিয়ানায় ৩৫৭ টাকা তো, কেরলে ৩৩৩, কর্ণাটকে ৩১৬, ঝাড়খন্ডে ২২৬, মধ্যপ্রদেশ-ছত্তিশগড়ে গড়ে ২২১, আর পশ্চিমবঙ্গে কাজ বন্ধ হওয়ার আগের মুহূর্তে মজুরি ২১৩ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ২২৩ টাকা। ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এই সামান্য পরিমাণ অর্থ দিয়ে পরিবারে ন্যূনতম রসদের সংস্থান হতে পারে? খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা কতটুকু মিলতে পারে? তাই পরিবর্তনকামী আন্দোলনকারী শক্তিগুলি দাবি তুলেছে, বছরে মাথাপিছু ২০০ দিনের কাজ ও দিনপ্রতি ৬০০ টাকা মজুরি চাই।

কেন্দ্র পরিষ্কার হিসাব না পাওয়ার কথা তুলে, বরাদ্দ অর্থ আটকে রেখে ছড়ি ঘোড়াচ্ছে। রাজ্যের শাসকদের চেয়ে বেশি ন্যায়-নীতি-আইন ভাঙছে কেন্দ্রের শাসকরা। একশ দিনের কাজের জন্য দেয় অর্থ আটকে দিয়ে শেষবিচারে চূড়ান্ত আঘাতটা নামাচ্ছে বেকারিতে জর্জরিত গ্রামীণ গোটা গরিবশ্রেণীর উপর।

কেন্দ্রের অন্যায়-অনাচার-আইন ভাঙাভাঙি যথেচ্ছ হলেও রাজ্যের তৃণমূল সরকার ধোয়া তুলসীপাতা নয়। তার বিরুদ্ধে ওঠা গুচ্ছের অভিযোগের সারবত্তা আছে যথেষ্ট। প্রধানত উঠেছে দুর্নীতির অভিযোগ। একশ দিনের কাজের প্রকল্পে শাসকদল ও আমলাচক্রের আঁতাত যে পাহাড় সমান দুর্নীতি করেছে এটা সত্য। এর প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় তৃণমূলের তীব্র গোষ্ঠী সংঘাতে — খুনোখুনিতে, অন্যদিকে বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক কৈফিয়ত তলবে ও তদন্তে, এমনকি ২০২৩’র পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিট বিলির ক্ষেত্রে ওপর থেকে সরাসরি বড় আকারে হস্তক্ষেপ ও পরিবর্তন করার মধ্যে। প্রথম ও তৃতীয় ধরণটির তথ্য-পরিসংখ্যান অতি চেনা। অজানা থাকতে পারে হয়ত প্রশাসনিক অন্দর থেকে পাওয়া খবরাখবর। প্রসঙ্গত খবরে প্রকাশ, দুর্নীতির টাকা উদ্ধার হওয়ার জেলাগত শীর্ষ তিন স্থানে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগণা (১৯.১২ লক্ষ টাকা), উত্তর দিনাজপুর (১০.৫৮ লক্ষ টাকা) এবং পূর্ব মেদিনীপুর (৯.৭১ লক্ষ টাকা)। আর, শতাধিক সরকারি কর্মচারিদের তলব করে, তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ ধরিয়ে, তথ্য সংগ্রহ ও নির্দিষ্ট অভিযোগ দাঁড় করানোর ভিত্তিতে দুর্নীতির ছবিগুলি প্রকাশ্যে এসেছে। ২০১৯-২১ দু’বছরে কেন্দ্র নাকি প্রায় ২৫০ লক্ষ টাকা নয়ছয় হওয়ার মোট অভিযোগ পেয়েছিল ৩,৩৫৮টি এবং রাজ্য সরকার নাকি চাপে পড়ে তার মধ্যে ৫২.৩ লক্ষ টাকা উদ্ধার করেছিল মাত্র। প্রকৃত সত্যমিথ্যা বোঝা এখনও বহুদূরের বিষয়, যা কিছু জানা গেছে তা দৃশ্যমান শিলাখন্ড মাত্র। আর, দুর্নীতির দুর্গন্ধ পাওয়া গেছে শুধু একশ দিনের কাজ বাবদ নয়, আবাস যোজনায় গরিব মানুষের পাকা বাড়ি তৈরির টাকা আত্মসাৎ করা, এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির তথ্য মিলেছে পর্বত সমান।

কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা তৃণমূল বহুদিন যাবত বলে আসছে, কিন্তু কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকরী টক্কর রাজ্যের শাসকদলটি দেখাতে পারছে কোথায়? নিজেরা দুর্নীতির পাঁকে ডুবে সে আর কিভাবে সম্ভব! বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না। অগত্যা অতি সম্প্রতি তৃণমূলের দলীয় এক দিবস পালনের মঞ্চ থেকে দুটি কর্মসূচির ঘোষণা শোনা গেল। এক, একশ দিনের কাজের পাওনাগন্ডা বুঝে নেওয়ার দাবিতে ‘দিল্লী চলো’ অভিযান; দুই, রাজ্য সরকারের টাকায় এমএনআরইজিএ কাজ শুরু করা হবে। ‘দিল্লী চলো’ প্রধানত রাজনৈতিক অভিযান, পরে এরসাথে জুড়েছে এরাজ্য থেকে সংগৃহীত জিএসটি বাবদ ১ লক্ষ ১৭ হাজার টাকা বঞ্চনার প্রসঙ্গ। এইসব আদায়ে তাদের দৌড় কতদূর তা সময় চলে যাওয়ার সাথে সাথে বুঝে নেওয়া যাবে। আর, প্রশ্ন জাগে শেষোক্ত ঘোষণাটি প্রসঙ্গে। এই ভাবনা ভাবতে দু’বছর লেগে গেল কেন? এরকম স্বতন্ত্র এ্যক্তিয়ারের সহাবস্থানের কথা তো এমএনআরইজিএ’তে স্বীকৃত রয়েছেই। আজ দাবি করা হচ্ছে, শুধু তাই নয়, রাজ্য সরকার আবাস যোজনা প্রকল্পে ১১ লক্ষ ‘বাংলার বাড়ি’ বানিয়ে দেবে। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন হল, এই চৈতন্যের উদয় হতে এতদিন লাগল কেন? এসবের টাকার সংস্থান কোথা থেকে হবে সেটা খোলসা করে বলা হয়নি। আজ যদি তা মসৃণভাবে সম্ভব হয় তবে এতদিন হয়নি কেন? বিশেষ করে কোভিড পরিস্থিতির পর যেখানে বেকারি ছেয়ে যায় আরও, তখনও (ক্লাব, কার্নিভাল ইত্যাদিতে অনেক অর্থ ঢাললেও) গ্রামের গরিবদের হাতে কাজ আর মাথার ওপর ছাদ করে দেওয়ার চিন্তা অগ্রাধিকার পায়নি কেন? অন্যদিকে প্রধানত কেন্দ্রের কাছ থেকে সমস্ত বকেয়া আদায়ের সংঘাত যা তুঙ্গে তোলার, তাও তোলা হয়নি কেন? কোভিডকালীন জীবন-মরণ সংকটের তাড়নায় ভিনরাজ্যে পরিযায়ী হওয়া অগুন্তি শ্রমিকরা নিজেদের রাজ্যে ফিরে আসেন। ফলে কাজের খোঁজে দেখা দেয় হাহাকার অবস্থা। কোভিডোত্তর পরিস্থিতিতেও যখন একশ দিনের কাজের সুযোগ তেমন তৈরি হল না, তখন গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে দলে দলে বেকার যুব মেহনতিরা আবার ভিনরাজ্যে কাজের খোঁজে পরিযায়ী হতে থাকে, সেই ধারা চলছে এখনও। তাদের গন্তব্য প্রধানত দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্য — তামিলনাড়ু, কেরল, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা। ঐসব রাজ্যে দিনমজুরি গড়ে ৭০০-৮০০ টাকা। আর এখানে? কাজ ও মজুরি অনেক কম। এরকম দুঃসহ অবস্থায় দীর্ঘ সময় যাবত একশ দিনের কাজে বিকল্প আর্থিক উদ্যোগ গ্রহণের ভাবনা মাথায় এল না কেন? এই জিজ্ঞাসা তো তৃণমূল সরকারকে তাড়িয়ে নিয়ে চলবেই। প্রত্যক্ষ করা যাবে কত টাকায় কত মজুরিতে কতদিনের কাজ হচ্ছে, গরিবদের কেমন পাকা বাড়ি তৈরি হচ্ছে।

গ্রামবাংলার গরিব জনতা অনেক সহ্য করেছে অর্থহীন অন্তহীন কেন্দ্র-রাজ্য তরজা। এবার যেভাবে হোক, খুলতেই হবে বন্ধ একশ দিনের কাজের দরজা, মিটিয়ে দিতে হবে সমস্ত বকেয়া মজুরি, আর আবাস যোজনায় হকের পাওনা পাকা বাড়ি।

– অনিমেষ চক্রবর্তী

all-democratic-institutions-have-become-meaninglesslymeaninglessly-irrelevant

২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের গলায় আরও মজবুত বকলশ লাগাতে ১০ আগস্ট ২০২৩ রাজ্যসভায় মোদী সরকার এক বিল পেশ করল। এই বিলের মাধ্যমে মূখ্য নির্বাচন কমিশনার সহ নির্বাচন কমিশনারদের মনোনীত করতে যে নির্বাচক কমিটি ছিল, এই বিলে ওই কমিটি থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে সেখানে আনা হচ্ছে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। এরফলে, এরপর থেকে নির্বাচন কমিশনের প্যানেলগুলোতে সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের লাগাম আরও শক্ত হল।

এই বছরের মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশ দেয় যার মর্মার্থ ছিল যতদিন পর্যন্ত নতুন কোন আইন সংসদে গৃহীত না হচ্ছে, ততদিন তিন সদস্যের এক প্যানেল দেশের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনগুলো মনোনীত করবে। এই প্যানেলে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও সংসদে প্রধান বিরোধী দলের নেতা। কার্যনির্বাহী সংস্থা যাতে নির্বাচন কমিশনগুলোকে তার আজ্ঞাবহ এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে না পারে, তারই এক রক্ষাকবচ হিসাবে এই ধরনের এক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে শীর্ষ আদালত। নতুন বিলে প্রধান বিচারপতির স্থানে প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত কোনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে রাখার প্রস্তাব রয়েছে।

কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের মধ্যে প্রথম শূন্যপদ তৈরি হবে ২০২৪’র ফেব্রুয়ারি মাসে, যেদিন নির্বাচন কমিশনার অনুপ পান্ডে অবসর নেবেন। আগামী বছরেই ঘোষিত হবে ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনের দিনপঞ্জি। তাই এখন থেকে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে নিজের পোষ মানা এক সংস্থায় পরিণত করতে মোদী সরকারের এই পদক্ষেপ ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের প্রধান বিচারপতি কেএম জোসেফ (এখন অবসরপ্রাপ্ত) নির্বাচক কমিটির মধ্যে প্রধান বিচারপতিকে যুক্ত করেন। এটা তিনি করেন কেন্দ্রীয় সরকারেরই গঠিত ১৯৯০এ তদানিন্তন আইনমন্ত্রী দীনেশ গোস্বামীর কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে, যার উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনী সংস্কারের লক্ষ্যে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বশাসিত এক স্বাধীন সংস্থায় পরিণত করে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত করা। সেই সময় গোস্বামী কমিটি তার রিপোর্টে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে একাধিক সদস্যবিশিষ্ঠ এক সংস্থা হিসাবে সুপারিশ করে এবং জানায় যে মূখ্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করবে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি ও বিরোধী দলের প্রধানের সাথে পরামর্শক্রমে (আর, যদি ঘটনাচক্রে বিরোধী দলের প্রধান না থাকেন তবে লোকসভায় বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতা)। গোস্বামী কমিটির সুপারিশগুলি ভারতের আইন কমিশন গ্রহণ করে ১২ মার্চ ২০১৫ সালে তার ২৫৫তম রিপোর্টে। আইন কমিশন সেই সুপারিশগুলো গ্রহণ করার সময় বলে, “ভারতের নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলার অপরিসীম গুরুত্ব এবং কার্যনির্বাহী সংস্থার নাক গলানো থেকে রক্ষা করতে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের প্রক্রিয়া পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমেই হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।” গোস্বামী কমিটির সুপারিশকে আইন কমিশন কিছুটা পরিমার্জন করে জানায় যে মূখ্য নির্বাচন কমিশনার সহ সমস্ত নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ হবে তিন সদস্য বিশিষ্ঠ এক কলেজিয়াম বা নির্বাচক কমিটি মারফত, যেখানে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলের নেতা এবং প্রধান বিচারপতি।

মোদী আজ কেন্দ্রীয় সরকারের আইন কমিশনের মোতাবেক শীর্ষ আদালতের রায়কেই পুরোপুরি উল্টে দিল। সাংবিধানিক সংস্থার প্রতি এই অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য ও অবমাননা স্বাধীন ভারতবর্ষে এর আগে এত নগ্নভাবে আর কখনও হয়নি।

ভারতের সর্বোচ্চ আদালতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আগামী বছরের গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে নিজের আজ্ঞাবহ কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন তৈরি করতে তাই মোদী সরকার বদ্ধপরিকর।

রাজদ্রোহ বা সিডিশন আইনকে বাতিল করে আনা হচ্ছে আরও মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহ আইন

১১ আগস্ট লোকসভার শেষ দিনে অনাস্থা প্রস্তাব সংক্রান্ত বিতর্ক শেষ হওয়ার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পেশ করলেন নতুন তিনটি বিল — ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ২০২৩, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা ও ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম। বিরোধীশূন্য লোকসভায় ওই বিলগুলো পেশ করেই তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন অমিত শাহ, যা অচিরেই ধ্বনিভোটে পাশ হয়ে যায়। আগামী দিনে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ঘুরে ওই বিল সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হলেই তবে আইন হবে। অমিত শাহ জানালেন, সংসদে ওই বিলটি পাশ হলেই নতুন ও বিচারাধীন মামলা ওই আইনের আওতায় চলে আসবে। নতুন বিল এতদিনকার ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (ভারতীয় দন্ডবিধি) ১৮৬০, ক্রিমিনাল প্রসিজিয়র কোড (ফৌজদারি দন্ডবিধি) ১৮৯৮, ১৯৭৩ এবং এভিডেন্স অ্যাক্ট — এই ব্রিটিশ আমলের শতাব্দী প্রাচীন আইনগুলোকে বদলে, “ভারতীয় দণ্ডবিধি থেকে ব্রিটিশ প্রভাব ও দাসত্বের মানসিকতা দূর করতেই নতুন করে ভারতীয় দন্ডবিধি ঢেলে সাজানোর” পরিকল্পনা নিয়েছে মোদী সরকার। আর, এটাও ঘোষণা করলেন যে, আইপিসি’র ১২৪এ ধারায় রাজদ্রোহ আইন বাতিল করা হবে। কিন্তু, সেটা বাতিল করে আনা হচ্ছে ১৫০ ধারাঃ যাতে বলা হয়েছে, “যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা জেনেশুনে, শব্দ, চিহ্ন কিংবা দৃশ্যমান উপস্থাপনা দ্বারা অথবা মৌখিক বা লিখিতভাবে কিংবা বৈদ্যুতিন যোগাযোগের মাধ্যমে বা আর্থিক উপায় ব্যবহার করে বা অন্য কোনও ভাবে উত্তেজিত করে বা উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা করে, বিচ্ছিন্নতা বা সশস্ত্র বিদ্রোহ বা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের অনুভূতিকে উৎসাহিত করে বা সংঘটিত করে, বা ভারতের সার্বভৌমত্ব বা একতা ও অখন্ডতাকে বিপন্ন করে অথবা এই ধরনের কোনো কাজ করে বা সংঘঠিত করে, তা হলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং জরিমানাও দিতে হবে।”

গতবছর ১১ মে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর নির্দেশ দেয় যেন এরপর থেকে সিডিশন আইনে কাউকে যেন আর অভিযুক্ত করা না হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাই এই আইন বাতিল করা ছাড়া আর অন্য কোনো রাস্তা ছিল না।

প্রস্তাবিত নতুন আইনে মহিলাদের উপর হওয়া যে কোনও অপরাধের ক্ষেত্রে কড়া শাস্তির প্রস্তাব রয়েছে। আঠারো বছরের কম বয়সি মহিলাদের ধর্ষণের অভিযোগে মৃত্যুদন্ড বা আজীবন কারাবাসের সাজার কথা বলা হয়েছে আইনে। একই সুপারিশ করা হয়েছে গণপিটুনির ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। এই ক্ষেত্রেই প্রশ্ন উঠছে যে স্বঘোষিত গোরক্ষকরা গোরক্ষার নাম করে বা উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা লাভ জিহাদের আওয়াজ তুলে যদি কাউকে পিটিয়ে মারে তা হলে শাস্তি হবে কিনা এ’ব্যাপারে রীতিমতো সন্দেহ রয়েছে। বর্তমান আইনেই এই সমস্ত অপরাধ বা অপরাধীদের শাস্তির বিধান থাকলেও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে তারা যে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায় তা গোটা দেশের মানুষ দেখেছে। দেখেছে, কিভাবে এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সুপারিশেই বিলকিস বানোর উপর গণধর্ষণে অভিযুক্ত দাগি অপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হল, যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত ব্রিজভূষনের এখনও কোনো শাস্তি হল না।

বোঝাই যাচ্ছে, অত্যন্ত কঠোর আইনের মাধ্যমে প্রশাসন নিজের মর্জিমাফিক বিরোধীদলের বা সরকারের সমালোচক যে কাউকে এর বিস্তৃত ধারায় কারারুদ্ধ করার সমস্ত রাস্তাই খোলা রাখল। রাজদ্রোহ আইনকে বাতিল করার পর নতুন মোড়কে আরও দানবীয় আইন আনতে চলেছে মোদী সরকার আগামী দিনে।

(ক্রমশ)

- অতনু চক্রবর্তী

in-memory-and-meditationsanat-roy-chowdhury-in-memory

“জন্মিলে মরিতে হবে রে জানে তো সবাই/ তবু মরণে মরণে অনেক ফারাক আছে ভাই রে, সব মরণ নয় সমান…”

বহু সংগ্রামের সাক্ষী ও বিভিন্ন গণআন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা সাথী সনৎ রায়চৌধুরী, আমাদের সকলের প্রিয় ‘সনৎদা’ দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে ১ জুলাই ২০২৩ চুঁচুড়ায় নিজ বাসভবনে প্রয়াত হন। গত ৮ আগস্ট শিয়ালদহ জর্জ ভবনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কলকাতা জেলা কমিটির ডাকে সনৎ রায়চৌধুরী’র স্মরণসভায় শুরুতেই নীতীশ রায়ের গলায় এই গান সভার মূল সুরটি বেঁধে দেয়। প্রথমেই সনৎ রায়চৌধুরী’র প্রতিকৃতে মাল্যদান ও নীরবতা পালন করে সভার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। সনৎদা জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালে যুক্তবঙ্গের রংপুর জেলায়। মাতা শান্তিলতা রায়চৌধুরী ও পিতা গৌরী শঙ্কর রায়চৌধুরীর সাত সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। সভাকক্ষে সনৎদা’র সংক্ষিপ্ত পরিচয় সহ শোক প্রস্তাব পাঠ করেন ইন্দ্রাণী দত্ত। এরপরে সঞ্চালক অতনু চক্রবর্তী সনৎদা’র দীর্ঘদিনের সাথী নিত্যানন্দ ঘোষকে ডেকে নেন। রংপুর জেলা থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গ হয়ে চুঁচুড়া পর্যন্ত সনৎদা’র ব্যাপক বিস্তৃত সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন তিনি। রংপুরে স্কুল ও কলেজ জীবনে ছাত্র আন্দোলন, পাঁচের দশকের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে সনৎদা কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন ও পার্টি সদস্যপদ লাভ করেন। স্বাধীনতার ১২ বছর পরে ১৯৫৯’র শেষে তিনি উত্তরবঙ্গে এসে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে চুঁচুড়ায় দাদা অজিত রায় চৌধুরীর কাছে চলে এসে দেশবন্ধু মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, সঙ্গে চলে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। পরে তিনি সুগন্ধ্যা জুনিয়র হাই স্কুলে যোগ দেন। চুঁচুড়ায় থাকাকালীনই তিনি হুগলী-চন্দননগর-ভদ্রেশ্বর সিপিআই(এম) লোকাল কমিটির সম্পাদক হন। বসন্তের বজ্র নির্ঘোষে সাড়া দিয়ে সনৎদা নকশালবাড়ি আন্দোলনে সামিল হন ও ১৯৭০ সালে ২০ অক্টোবর কারারুদ্ধ হন। আশির দশকের শুরুতে ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট গঠিত হলে তিনি সেই সেই সংগঠনে যুক্ত হন ও পরবর্তীতে তাঁর জাতীয় সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনে যুক্ত হন কমরেড ধূর্জটি বক্সী’র উদ্যোগে। পার্টি কংগ্রেসেও প্রতিনিধিত্ব করেন। পরবর্তীতে পার্টি সদস্য হিসেবে না থাকলেও সংগঠনের নানা কর্মসূচিতে যুক্ত থাকেন। সনৎদা ছিলেন এক মুক্ত মনের মানুষ, যেকোনো ব্যক্তিকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল। সারাজীবন তিনি বিজ্ঞান আন্দোলন, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য আন্দোলন, নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন সহ নানা সামাজিক আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরস্থিতিতে তাঁর মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি।

সনৎ রায়চৌধুরী’র ভাই অজয় রায়চৌধুরী তাঁর দাদার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সনৎদার মৃত্যুর পর এটি নবম স্মরণসভা যেখানে তিনি বলছেন। সনৎদার জীবন ও আদর্শ গড়ে ওঠার পিছনে তিনি তাঁদের পরিবার ও বিশেষ করে তাঁর মায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বাড়িতে মায়ের কমিউনিস্ট আদর্শের প্রেরণায় ও তেভাগা আন্দোলনের আবহেই সনৎদার বেড়ে ওঠা। অঞ্চলের মহিলা আত্মরক্ষা বাহিনীর সম্পাদিকা হিসেবেও কাজ করেছিলেন তাঁর মা শান্তিলতা রায়চৌধুরী। তাঁর পরিবারের কেউ কখনো দক্ষিনপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হননি। শেষ দিন পর্যন্ত দাদাও ছিলেন একজন কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থাশীল এক মানুষ। এক সময়ে, পরিবারের দুই দাদা আত্মগোপন করে ও সনৎদা সহ পরিবারের তিনজন জেলখানায় বন্দীদশায় কাটিয়েছেন। ১৯৭২ সালে আগস্ট মাসে কারামুক্ত হয়ে তিনি নানা সামাজিক রাজনৈতিক কাজে যুক্ত হন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বন্দীমুক্তি আন্দোলন, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলন, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য আন্দোলন। পাড়া-প্রতিবেশী, খেলার মাঠ থেকে শুরু চায়ের দোকান সর্বত্র সর্বস্তরের মানুষের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের পরপ্রেক্ষিতে গণআন্দোলন ও ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বারবার বলতেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কমরেডদের সাথে সবসময় তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছেন। চুঁচুড়া শহরে বহিরাগত হলেও, যেভাবে পুরো চুঁচুড়া শহরের মানুষের মনে সনৎদা এক চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন তা অত্যন্ত গর্বের। তাঁর বর্ণময় জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সঙ্কলন প্রকাশের পরিকল্পনার কথাও তিনি বলেন।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল বলেন কিভাবে সনৎদা কনিষ্ঠ সবাইকে ‘তুই’ সম্বোধনের মধ্যে দিয়ে আপন করে নিতেন। তাঁর বৈচিত্রময় জীবনে সমস্ত নকশালপন্থী, বামপন্থী, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল সংগঠনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল। শেষ দেখা হওয়ার সময়ে পাটনায় পার্টি কংগ্রেসের বিস্তারিত রিপোর্ট শুনে তিনি অত্যন্ত উৎসাহিত হন ও ফ্যাসিবাদী হামলার মোকাবেলায় পার্টির ভূমিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা দেন। রাজনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগের ভূমিকার গুরুত্বের কথাও তিনি বারবার বলতেন। সনৎদার আদর্শ, সংগ্রামী জীবন ও বৈশিষ্ট আমাদের চলার পথের পাথেয়।

সনৎ রায়চৌধুরী’র একমাত্র ভাগ্নে শুভ্র সেন তাঁর ‘মণিমামা’র কথা বলতে গিয়ে তাঁর দুটি বিশেষ উপলব্ধির কথা বলেন; সনৎ রায়চৌধুরী’র মৃত্যুর পরে তাঁর সাথীদের কথা শুনে তাঁকে নতুন করে চিনলাম, তাঁর কাজের ব্যাপ্তিকে জানলাম। আরও বলেন, জন্ম থেকে কে কমিউনিস্ট হতে পারে জানা নেই, কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত যে কিভাবে কমিউনিস্ট থাকা যায় তা সনৎ রায়চৌধুরী’কে দেখে শিখলাম। সনৎদা’র সাদামাটা জীবনযাপন, মানবিক গুণ, মাটির কাছাকাছি থাকা মুক্ত মনের কথাও তিনি বলেন।

পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার বলেন এক বিশেষ সামাজিক রাজনৈতিক সময়ে সনৎদা’র বেড়ে ওঠা। ৪২’র ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ৪৩’র মন্বন্তর, ৪৫’র ভয়ানক ম্যালেরিয়া, ৪৬-৪৮-এ তেভাগা আন্দোলন, স্বাধীনতা, দেশভাগের অভিঘাত এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে তিনি ও তাঁর পরিবার গেছে। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান, তারমধ্যে বিতর্ক ও বিপ্লবী ধারাকে বেছে নেওয়া এই সবই তাঁর বিপ্লবী মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যাকে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বহন করেন। সনৎদা’র কাছে থেকে শিখতে হবে কমিউনিস্টদের সমাজ জীবন বা যেভাবে তারা সামাজিক সম্পর্কগুলিকে লালন করতেন, আজ যার খানিকটা খামতি দেখা যাচ্ছে। সামাজিক সম্পর্কগুলি ক্ষীণ বা দুর্বল হওয়ার কারণে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দূর অব্দি চারিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে যা অবশ্যই আমাদের পার হতে হবে। উত্তরবঙ্গে আবারো যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তিনি বারবার জানিয়েছিলেন কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।

ফ্যাসিবাদী শক্তি ২০২৪’র নির্বাচনকে ধরে বড় আঘাত নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, ধর্ম-জাতকে ব্যবহার করে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে হরিয়ানা থেকে মনিপুরে। জাতীয় স্তরে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক হিসেবে আজকের পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরী। পশ্চিমবঙ্গের বিগত বিধানসভা নির্বাচন ও শেষ কর্ণাটক নির্বাচনেও বিজেপিকে পরাস্ত করতে বিভিন্ন নাগরিক-গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এই নাগরিক সমাজের সাথে যুক্ত হওয়া, বিভিন্ন উদ্যোগ গড়ে তোলা, গণআন্দোলনে ভূমিকা রাখা, সমাজ সম্পর্কগুলিকে প্রশস্ত ও নিবিড় করার ক্ষেত্রে সনৎদা’র থেকে আমাদের বহু কিছু শেখার রয়েছে।

সাথী প্রেমাংশু সনৎদা’র সাথে তাঁর দীর্ঘ পরিচয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন হতাশার সময়েও তিনি মানুষের কাছে যাওয়ার কথা, গণআন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে অনুপ্রাণিত করতেন। মানুষের আস্থা অর্জনের এক বিরল দৃষ্টান্ত তিনি দেখিয়েছিলেন যেখানে মৃত ছাত্রীর নাবালক সন্তানের সম্পত্তি দিদিমা সনৎদা’র হাতে দিয়ে গেছিলেন, সাবালক হওয়া পর্যন্ত যার দেখভাল তিনি করেন। পৃথিবী জুড়ে তাঁর অনেক কৃতি ছাত্রছাত্রী ছড়িয়ে রয়েছেন। মিথ্যা আর আত্মপ্রচারের পৃথিবীতে মেধা ও হৃদয়ের মিশেলে তিনি ছিলেন এক সম্পূর্ণ মানুষ।

দেবজ্যোতি মজুমদার হুগলীতে তৈরি হওয়া ‘মিনিমাম ডিমান্ডস কমিটি অফ সিটিজেনস’এর চুঁচুড়া হাসপাতালকে মেডিক্যাল কলেজ বানানোর দাবিতে আন্দোলনের সূত্রে সনৎদা’র সাথে পরিচয়ের কথা বলেন। আইপিএফ’এ যুক্ত হওয়া ও পরবর্তী সময়েও তাঁর ভূমিকা থেকে শিক্ষণীয় যে কিভাবে নিজেদের খাঁচাটাকে, হৃদয়কে বড় করা যায়। আজকের পরিস্থিতিতে বিশেষ করে পাটনা কংগ্রেস থেকে যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি সনৎদা’র শিক্ষা আমাদের সেই পথে চলতে সাহায্য করবে।

বাসুদেব বসু বলেন, ৮০’র দশকে চেতলায় পার্টির গোপন আস্তানায় বিনোদ মিশ্র ও ধূর্জটি বক্সীর থেকে সনৎদা’র কথা শোনেন। পরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আইপিএফ’এর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সব কর্মসূচিতে থাকতেন। মানবাধিকার আন্দোলনের বিশিষ্ট মুখ সনৎদা ছিলেন একাধারে অভিভাবক ও রক্ষক। মানবাধিকার সংগঠনের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে তিনি একই রকম আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। বিহার নির্বাচনে পার্টির সাফল্যে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে দার্জিলিঙে পার্টির প্রার্থী চা বাগান আন্দোলনের সুমন্তি এক্কা’র কথা শুনেও বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন।

পরিশেষে পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, সনৎদা মানেই তরতাজা একজন মানুষ, এক বিরাট অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, এক দীর্ঘ পথ চলার ইতিহাস। সাধারণভাবে আমাদের অভিজ্ঞতা যখন খুব বেশি হয়, তার ভারে আমরা খানিকটা ঝুঁকে যাই। সনৎদা একেবারেই তা ছিলেন না। চলার পথের এই ব্যাপক অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে হয়তো কিছুটা বলতেন, কিন্তু কখনই অতীতচর্চা, অতীতজীবী বা অতীতমুখী মানুষ তিনি ছিলেন না। সবাই বলছেন সনৎদর থেকে শেখা যায় কিভাবে নিজেদের সম্প্রসারণ করতে হবে; সেটা যে হতে পেরেছিল তার একটা বড় কারণ সনৎদা ভীষণ রকম বর্তমানে বাঁচতেন। দ্বিতীয়ত, এখন পশ্চিমবঙ্গে আমরা বড্ড বেশি বাঙালি হয়ে যাচ্ছি। একটা সময়ে হয়তো খুব আন্তর্জাতিক ছিলাম, এখন খুব বাঙালি হয়ে গেছি। দেশে কোথায় কী হচ্ছে তা বাংলার খবরের কাগজে পাওয়া যাবে না, টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা যাবে না, সাধারণ ভাবে বাংলার মানুষের মধ্যে আলাপ আলোচনা চর্চায় এগুলো কিছু পাওয়া যাবে না। বাংলাতেই শুরু বাংলাতেই শেষ। এই অর্থে, সনৎদা খুব ভারতীয় ছিলেন। দেখা হলেই বিহার, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, পাঞ্জাব কোথায় কী হচ্ছে বিভিন্ন খবর জানতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। শুধু নির্বাচনের বিষয়ে নয়, চলমান আন্দোলনের বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন। ভাষা আন্দোলন, পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলন, নকশালবাড়ি, বন্দীমুক্তি আন্দোলন, আইপিএফ, এপিডিআর এগুলো প্রত্যেকটা একেকটা বিশাল অধ্যায়। আইপিএফ মানেই একদিকে নাগভূষণ পট্টনায়েক, মহেন্দ্র সিং, অন্যদিকে অরিজিত মিত্র, সনৎদা। এই প্রতিটা অধ্যায়েই সনৎদা অত্যন্ত গভীরে ঢুকে ছিলেন। এতো বড় যাত্রাপথে একজন অখণ্ড কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার এটাই চারিত্রিক বৈশিষ্ট, কোনো একটা জিনিসে তিনি আটকে থাকেননি। বিভিন্ন টুকরো টুকরো ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলনের সাথে সাথে নতুন সমাজ নির্মাণের বৃহৎ অখণ্ড চেতনার মধ্যে কিভাবে অবগাহন করা যায় তা সনৎদা আমাদের দেখিয়ে গেছেন। আজকের রাজনৈতিক সময়ে তাই সনৎদার মতো মানুষ, তাঁর মতো জীবনযাপন আরও বেশি দরকার। তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় শিক্ষক যার স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে। অনেক শিক্ষকই প্রভাবিত করেন, কিন্তু স্পষ্ট রাজনৈতিক চেতনা সবার থাকে না। এ এক বিশাল সামাজিক অনুশীলন। মানুষ গড়ার কারিগর, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বা সামাজিক মূল্যবোধ গেঁথে দেওয়া। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক চেতনার মানে মানবিক মূল্যবোধ আছে কী নেই। এই যে বুলডোজার চলছে, ধর্মীয় উন্মাদনা, দাঙ্গা, মনিপুর-হরিয়ানার মতো সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছি, কী পারছি না। মনুষ্যত্ব কেড়ে নেওয়ার এই সময়ে মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলেও আজ তারজন্য বিরাটভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সনৎদার মধ্যে বিরাটভাবে সেই মানবিক মূল্যবোধগুলো ছিল, তাগিদ ছিল। তাই সমস্ত আন্দোলন, মানুষের প্রতিরোধের মধ্যে তিনি জড়িয়ে থাকতেন। এই সব অভিজ্ঞতা, ইতিহাস একে একে চলে যাচ্ছে। এগুলোকে কতটা আমরা ধরে রাখতে পারবো, বাঁচিয়ে রাখতে পারবো, শিখতে পারবো সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

আজ গোটা দেশজুড়ে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এই ব্যাপক গভীর সঙ্কট আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই খণ্ডিত করে দিচ্ছে। মণিপুরের মতো জায়গায় আজ যে তীব্র মেরুকরণ তা সেখানকার বামপন্থীদেরও খণ্ডিত করে দিচ্ছে কিনা জানা নেই। মণিপুর-হরিয়ানা সহ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে শুধু সাম্প্রদায়িক বা সামাজিক মেরুকরণ নয়, মানুষদেরও টুকরো করে দেওয়া হচ্ছে। আজ এই ধ্বংসাত্মক ফ্যাসিবাদের হাত থেকে গণতন্ত্রকে বাঁচানো তাই বড় চ্যালেঞ্জ। ইতালিতে যখন ফ্যাসিবাদ এসেছিল, সেই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক গ্রামসির শুরুর দিকের লেখা পড়ে মনে হয়, তিনি ভাবছিলেন এটা একটা সাময়িক পরিস্থিতি। সংশয় ছিল যে এই ফ্যাসিবাদ হয়তো একটা agrarian reaction। অর্থাৎ ইতালির যে শিল্প বুর্জোয়া তারা কি এতো ধ্বংসের মধ্যে নেমে পরবে? কোথাও না কোথাও একটা ধারণা কাজ করছিল যে এটা বোধ হয় গ্রামাঞ্চলে পুরনো কুলাক ভিত্তি বা জমিদারদের প্রতিক্রিয়া, যা হয়তো বেশি দূর যাবে না। বাস্তবে দেখা গেলো, যখন ধ্বংস যজ্ঞ শুরু হল তখন কে কুলাক আর কে পুঁজিপতি, কে পুরনোপন্থী আর কে আধুনিক সব এক জায়গায় চলে গেল। জার্মানিতে তা আরও বেশি হল। ভারতে আমরা যে স্তরে আছি, যে মাত্রায় ধ্বংস হচ্ছে, ২০২৪-এ যদি এই শক্তি নির্বাচনে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তাহলে আর কিছুই পরে থাকবে না। রাজ্যসভায় দিল্লী অর্ডিন্যান্স বিল পাস হওয়ার সময়ে, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে রাজ্যসভা সাংসদ রঞ্জন গগৈ বলেন, “সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নিয়েই অনেক বিতর্ক আছে”। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও যদি বলে দেওয়া যায় এরমধ্যে কোনো মৌলিকত্ব নেই, তাহলে তো সহজেই কিছু সাংবিধানিক ধারাকে ভেঙ্গে বা ছেঁটে ফেলা যায়। আগামী দিনে এই আক্রমণ আরো বড় আকারে নামবে। এটা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়, তবে তা কোথায় যাবে বা কত দূর পর্যন্ত যাবে তা আমরা কেউ বলতে পারবো না। এখনও পর্যন্ত যেটুকু গণতন্ত্র আছে, সেখানে আগামী নির্বাচনে যদি এই শক্তিকে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়, এর গতিকে কিছুটা মন্থর করে দেওয়া যায়, এর ধারকে খানিক ভোঁতা করে দেওয়া যায় তবে সেটাও কম নয়। তাই আজকের দিনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে সার্বিক প্রতিরোধ তা এক বহুমাত্রিক অনুশীলন। সেই অখণ্ড পরিকল্পনার মধ্যে নির্বাচন, গণআন্দোলন, মতাদর্শ, ব্যক্তি, সংগঠন সবই আছে। যে যেখানে আছেন লড়ে যাওয়া। এই লড়ে যাওয়ার স্পিরিটের মধ্যেই সনৎদা রয়েছেন। এই নকশালবাড়ির প্রজন্ম যারা বিপ্লব দ্রুত সম্পন্ন করতে আহ্বান রেখেছিলেন, সেই প্রজন্মকে আজ এক বিশাল পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এক বিরাট প্রতিবিপ্লবের মুখে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী সার্বিক লড়াই কিভাবে লড়া যায় এবং তার যেকোনো উপাদান যেকোনো কর্মসূচিকে সেই একই আগ্রহ, উৎসাহ, সাহস, অঙ্গীকার নিয়ে করা যায়, সেখানে সনৎদার স্মৃতি আমাদের বারেবারে অনুপ্রাণিত করবে। সনৎদার মতো আরও অনেক মানুষ এখনও আছেন। সনৎদার স্মৃতিকে নিয়ে সেই পুরনো মানুষ এবং তাঁদের সাহচর্যে যে নতুন প্রজন্মরা গড়ে উঠছেন তাঁদের সংগঠিত করা আজ জরুরি। শিক্ষা, জ্ঞান, সামাজিক কাজের জগতে বিভিন্ন অনুশীলনে যারা আছেন তাদের সবাইকে নিয়ে আগামী দিনের কঠিন সময়ে লড়ার জন্য সনৎদার উৎসাহ স্নেহ আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। তাঁর বিরাট চেতনা, ব্যক্তিত্ব, কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও তার সাথে দৈনন্দিন কাজ, এরমধ্যে যোগসূত্র ধরে রেখেছিলেন সনৎদা। আমরাও যদি এই যোগসূত্র ধরে রাখতে পারি তবে সেটাই তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানো হবে। সনৎদার আদর্শ ও প্রেরণা বাংলা তথা ভারতের কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাক।

কমরেড সনৎ রায়চৌধুরী লাল সেলাম!

w barddhaman aipwa conference

পশ্চিম বর্ধমানে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির তৃ তীয় জেলা সম্মেলন সংগঠিত হল

খণ্ড-30
সংখ্যা-28