২৮ জুলাই ২০২৩ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড চারু মজুমদারের ৫২তম শহিদ দিবস। একই সাথে দিনটি ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে নেমে আসা তীব্র দমন ও ধাক্কার পর পার্টিকে পুনরায় সংগঠিত করার ৪৯তম বার্ষিকীও। আমরা এই উপলক্ষ্যে আমাদের সমস্ত শহিদ এবং প্রয়াত নেতা ও কমরেডদের প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা ব্যক্ত করছি। আমরা এই বছরটা শুরু করেছিলাম পাটনায় পার্টির সফল একাদশ কংগ্রেস সংগঠিত করার মধ্যে দিয়ে। পার্টি কংগ্রেসে আমরা যে “গণতন্ত্র বাঁচাও, ভারত বাঁচাও” ধ্বনি সোচ্চারে তুলেছিলাম তা আজ সারা দেশে অনুরণন তুলছে। আজকের জ্বলন্ত ইস্যুগুলিতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিশালী প্রতিবাদ ও সংগ্রাম ফেটে পড়ছে। বিরোধী দলগুলির এক ব্যাপক ভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া আমাদের পার্টি কংগ্রেস থেকে শুরু হয়েছিল তা গতি পেতে শুরু করেছে।
অনেকগুলি বিরোধী দলের দুই রাউণ্ড মিটিঙের পর একটা বিস্তৃত জোট আকার নিয়েছে ‘INDIA’ নামে — ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলাপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’। বহু ধরনের অ-বিজেপি দলের সাথে আমাদের পার্টিও এই জোটের এক দায়বদ্ধ শরিক। এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের প্রচেষ্টা তীব্রতর করতে হবে এবং সমস্ত ফ্রন্টে আমাদের ভূমিকা প্রসারিত করতে হবে।
আমাদের রাজনৈতিক উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করে প্রাথমিকভাবে আমাদের সাংগঠনিক শক্তির ওপর, নিপীড়িত জনগণ ও বুদ্ধিজীবী মহলের সাথে আমাদের সংযুক্তির ওপর, এবং আমাদের সমস্ত কাজের ক্ষেত্রগুলিতে এক সংগ্রামী রাজনৈতিক শক্তিরূপে উঠে দাঁড়ানোর ওপর। তৃণমূল স্তরের পার্টি কাঠামো — পার্টি ব্রাঞ্চ ও লোকাল কমিটির — নির্মাণ ও পরিচালনার উপর জোর বজায় রাখতে হবে এবং আমাদের সামনে হাজির হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনী সংগ্রামে এক প্রাণবন্ত ও সর্বাত্মক সমাবেশ ঘটাতে সেগুলিকে মূল যোগসূত্র হিসেবে নিতে হবে।
ভারতের জনগণ মোদী শাসনের গত নয়টি বছর অবর্ণনীয় দুর্দশা ভোগ করেছেন। রাষ্ট্রের নামানো জনবিরোধী নীতি আর নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ এবং সংঘ-বিজেপি বাহিনীর বিদ্বেষ অভিযানে উৎসাহিত ঘাতক দল ও খুনি জটলার নামানো ঘৃণা, হিংসা ও আতঙ্কের রাজত্ব দেশকে এক অভূতপূর্ব সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীরে আগস্ট ২০১৯ থেকে যা ঘটে চলেছে আর মণিপুরে মে ২০২৩ থেকে যা ঘটছে সেগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত নয়; বিজেপির শাসন আরো কিছু সময় চললে ভারত জুড়ে কী হতে চলেছে তার কয়েকটা ঝলক আমরা দেখছি।
আমাদের তাই অতি অবশ্যই আমাদের সমগ্র শক্তি ও সামর্থ্য, সাহস ও সংকল্প একত্রিত করতে হবে বিজেপিকে পরাস্ত করতে, এবং আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মোদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। এই পথে আমাদের অবশ্যই জনআন্দোলনের এক শক্তিশালী কন্ঠস্বর রূপে এবং ভারতের রাজনৈতিক রণমঞ্চে এক অগ্রণী বাম শক্তি হিসেবে উঠে আসতে হবে। আসুন এই লক্ষ্য সফল করতে আমরা প্রত্যেকে আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ও উদ্যোম নিয়োগ করার সংকল্প নিই।
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক, সিপিআই(এমএল) দীর্ঘজীবি হোক।
“প্রাণে বাঁচতে চাস্ তো কাপড় খোল্!” পরাক্রমশালী ‘পৌরুষের’ এই ভাষা অশ্রুত নয়। যুগ যুগ ধরে বর্বর বিজয়োল্লাস প্রথম আছড়ে পড়েছে সেই সহজ শিকার প্রতিপক্ষের নারীর ‘পেলব’ ‘কোমল’ শরীরের ওপর। ক্ষমতা এইভাবেই বার বার নগ্ন করেছে নারীকে, উলঙ্গ করেছে নিজেকে, কলঙ্কিত করেছে সভ্যতাকে। সেই দেহ ছিন্ন ভিন্ন করে বিকট উল্লাসে উন্মত্ত নৃশংসতায় প্রতিপক্ষের ঘর বাড়ি খামার শস্যগোলা উপাসনাস্থল জ্বালিয়ে দেওয়া, নরমুণ্ড শিকার করা হয়েছে গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের পরস্পর সংঘাতে, পররাজ্য দখলের ক্ষেত্রে। — কিন্তু সভ্যতা কী ক্রমশ পিছনে হাঁটছে! — হ্যাঁ, ঠিক এমনটাই ঘটেছিল দু'দশক আগে গুজরাটে। আবারও ঘটলো স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির ‘অমৃতকালে’ – ‘রত্ন ভূমি’ মণিপুরে। কন্যা, বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় এগিয়ে আসা পিতাকে, ১৯ বছরের ভাইকে স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলে হাজার জনতার উল্লাসধ্বনির মধ্যে একুশ আর চুয়াল্লিশের দুই কুকি নারীকে নগ্ন করে হাঁটানো হয়েছ, যথেচ্ছ নির্যাতন আর গণধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। মাঝবয়সী নির্যাতিতার অভিযোগ, পুলিশ রক্ষা করতে তো আসেইনি, বরং ওদের হাতে তুলে দিয়েছে। তার অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী স্বামীর মর্মান্তিক আক্ষেপ, “দেশের মান বাঁচিয়েছি, কিন্তু স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করতে পারলাম না!” নিজের গ্রাম, চির চেনা পরিবেশ এখন তার কাছে যুদ্ধক্ষেত্রের থেকেও ভয়ঙ্কর। তিনি নিজের পোড়া বাড়ির ভিটেয় আর ফিরতে চান না। ১৮ মে তিনি প্রথম এফআইআর দায়ের করেন।
সেই নির্যাতনের ভিডিও দীর্ঘ আড়াই মাস পর সংবাদমাধ্যমে এলে গোটা দেশ শিউড়ে ওঠে বীভৎসতায়, ক্রোধে ঘৃণায় ফেটে পড়ে। মণিপুরের কাংপোকপি’র এই ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পর পরই আরও বহু ঘটনা সামনে আসে। ঐ ৪ মে-তেই কাংপোকপি’র থেকে ৪০ কিমি দূরে কর্মস্থল থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করে দুই কুকি তরুণীকে বন্ধ ঘরে গণধর্ষণ করে খুন করে রক্তাপ্লুত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। তাদের দেহ এখনও মর্গে। ১৬ মে নিহত তরুণীদের একজনের মা এফআইআর দায়ের করেন। ২৮ মে কাকচিং জেলায় সেরু গ্রামে এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর অশীতিপর বিধবা স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নংপোক সেকমাই থানাকে ২০২০-তে দেশের ‘সেরা থানা’ ঘোষণা করা হয়েছিল। তার ৮৫০ মিটারের মধ্যেই ঘটেছিল সেই ‘নগ্ন প্যারেড’! পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং জানান – এরকম শ’য়ে শ’য়ে ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ কোনদিকে যাবে? নিজের অক্ষমতার নির্লজ্জ স্বীকারোক্তি! ৪ মে এক তরুণ কুকি কলেজছাত্র সরকারের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্ট করায় পুলিশ যখন তাকে ধরে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল, উন্মত্ত জনতা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এই গণ হিস্টিরিয়ার (সঙ্গে রাজ্য পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার) বলি এ পর্যন্ত প্রায় দুশো প্রাণ। লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত। আপাতত ৫০,০০০ মানুষ ৩০০ ত্রাণ শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন। ২৫০র বেশি গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য গণধর্ষণ, নারীনির্যাতন, খুন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ সংক্রান্ত ৬০০০ এফআইআর এপর্যন্ত দায়ের হয়েছে যার বেশিরভাগ কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ করেছেন। বেশ ক’টি সরকারি অস্ত্রাগার লুঠ হয়েছে। মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও কুকি ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকদের ওপরও হামলা চালানো হয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। ২ মে থেকে শুরু হওয়া জাতি দাঙ্গার আগুনে আজ তিন মাস ধরে জ্বলছে মণিপুর। ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’ আশ্চর্য নির্বিকার! সুপ্রিম কোর্ট ভিডিও প্রকাশের পর এবং অন্য একটি মামলা প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্লিপ্ততাকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছে। যদিও দীর্ঘ আড়াই মাসে এত প্রাণবলি, এত সম্পত্তি হানির ঘটনায় মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হওয়ার সময় শীর্ষ আদালতের প্রত্যাশিত কার্যকরী পদক্ষেপ না দেখে হতাশাও জেগেছিল।
সুন্দরী মণিপুর। উজ্জ্বল নীল আকাশের নিচে সবুজ পাহাড় ঘেরা উপত্যকার কোলে ছোট্ট রাজ্য। মাটির নিচে তার অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভার। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শিল্প সংস্কৃতির বহুবর্ণ ঐতিহ্য যুগে যুগে মানুষের মন কেড়েছে। ৩২ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ৩৬টি জনজাতি। উপত্যকার সমতলে সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় ৫৩%) মেইতেই আর পাহাড়ে সংখ্যালঘু কুকিদের বাস। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ বহুকালের। কিন্তু সেটা এমন রক্তক্ষয়ী বিধ্বংসী হয়ে উঠলো কেন? কীভাবে? কোন প্ররোচনায়? কেন আজ মণিপুর সরাসরি দু’ভাগ হয়ে গেল? এমনকি বিজেপি বিধায়করাও কুকি-অধ্যূষিত অঞ্চলগুলির জন্য আজ আলাদা প্রশাসন, আলাদা রাজ্য দাবি করছেন!
চিত্রাঙ্গদার উত্তরসূরী মণিপুরের নারীরা চির প্রতিবাদী। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বর্বরতার বিরুদ্ধে তাদের সেই অনন্য দৃপ্ত প্রতিবাদ গোটা বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সেখানে মেইতেই-কুকি একসঙ্গেই ছিলেন। আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে ইরম শর্মিলা চানুর টানা ষোল বছর অনশনে থাকার একক লড়াই — তাও ফিকে হয়ে যায়নি। গোলমাল শুরুর মুহূর্তে মেইতেই-কুকি মহিলারা একসঙ্গে মানববন্ধন করে শান্তির আবেদন জানিয়েছিলেন। কোন প্ররোচনায় তাহলে আজ মেইতেই মহিলারা ধর্ষণকারীদের রুখে দিতে পারলেন না? পারলেন না রক্ষা করতে কুকি মা-বোনেদের যারা সমাজে পরিবারে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে থাকেন? কোন বিষ কে প্রয়োগ করলো তাদের মনে?
দীর্ঘ তিন মাসব্যাপী ঘটনাপরম্পরা থেকে অবধারিতভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই হয় যে এই জাতি-দাঙ্গা, যা এই মুহূর্তে অনিবার্য ছিল না, তা ‘ডবল ইঞ্জিন সরকারের’ পূর্ব পরিকল্পিত। কেন, তা একটু খতিয়ে দেখা যাক। ‘শুট অ্যাট সাইট’ জারি করে, ইন্টারনেট বন্ধ করেও হিংসা ক্রমাগত বেড়েই গেছে কারণ বীরেন সিং সরকারের প্রত্যক্ষ মদত আছে এতে। এক বিজেপি বিধায়ক বীরেনকে ‘বিভাজনের কারিগর’ বলে অভিহিত করেছেন। বীরেন সিং সরকারের মেইতেই সম্প্রদায়ের প্রতি নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব এবং দীর্ঘ অবহেলিত কুকি জনজাতির সুদীর্ঘ বঞ্চনা ও ক্ষোভের প্রতি উদাসীনতা এই আগুনে ঘি ঢেলেছে। বীরেন এখানেই থেমে থাকেননি। মেইতেই নাগরিক সমাজের কাছে, কুকিদের, যারা মণিপুরের বহু শতাব্দীর অধিবাসী, তাদের ‘মায়ানমারের বহিরাগত’, ‘নার্কো টেররিস্ট’, ‘অবৈধ আফিম চাষকারী’ ইত্যাকার নানা অপবাদ দিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। পেটোয়া চ্যানেলগুলোও কুকি প্রসঙ্গে একই ধুয়ো তুলে গেছে। যেন অস্ত্র, আফিম আর ড্রাগ-সন্ত্রাস কুকি-জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ।
মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় এক বিরাট ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে (৪০টি আসন) মেইতেইরা রাজ্যের ব্যয়বরাদ্দের একটা বড় অংশ নিজেদের অনুকূলে টেনে নেয়। বিভিন্ন নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তাদেরই আধিপত্য। আর সম্পদের এই অন্যায় আত্মসাতের ওপর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাগুলোকেও অকেজো করে রাখা হয়েছে। যেমন হিল এরিয়া কমিটিগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে — তাদের সাংবিধানিক কাজ বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই। ডিলিমিটেশন কমিশনের রিপোর্ট মুলতুবি রাখা হয়েছে কারণ তারা রাজ্যে লোকসংখ্যাবৃদ্ধির অনুপাত বিচার করে আদিবাসী আসন সংখ্যা বাড়াতে বলেছিল। আদিবাসীদের জমিগুলোকে পরিবেশ উন্নয়নের নামে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা সুরক্ষিত বনাঞ্চল বলে ঘোষণা করে তাদের উৎখাত করা হচ্ছে। যে লুঠ সারা ভারত জুড়েই চলছে। সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষণ কে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে। এই বহুমাত্রিক বঞ্চনা জনিত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে কুকিদের মধ্যে।
মেইতেইদের প্রতি বীরেন সিং সরকার তথা আরএসএস-বিজেপি’র পক্ষপাত কেন? কারণ এই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুরা আছেন এবং বিধানসভায় এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। নির্বাচনে এরা বিজেপি’র বড় ভরসা। হিন্দুরাষ্ট্র গঠণের বৃহত্তর অ্যাজেন্ডায় এরা একটা নিশ্চিত শক্তি। এদের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা কুকিসহ অন্যান্য আদিবাসী নিধন অভিযানে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে, সেই মেইতেই লীপুন, আরামবাই তেংগোলের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর খুবই সুসম্পর্ক। এদের পূর্ণ সহযোগিতায় এবং এদের সামনে রেখেই কুকি-জো সহ আদিবাসী বনবস্তিগুলি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূতভাবে। কারণ ঐ পাহাড়ী অঞ্চলেই মাটির নিচে আছে নিকেল, প্ল্যাটিনামসহ বিভিন্ন খনিজ যা কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে মোদী সরকার দায়বদ্ধ। ৩৭১নং ধারার অধীনে ঐ আদিবাসী অরণ্যভূমি সংরক্ষিত এবং মেইতেই সহ অন্য কারও সে জমি কেনার অধিকার নেই।
গত ১০ মার্চ, সংরক্ষিত বনভূমি সম্প্রসারণের নামে যথেচ্ছভাবে কুকিদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের উৎখাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ইন্ডিজেনাস ট্রাইবাল লীডার্স ফোরাম-এর নেতৃত্বে কুকি নাগরিক সমাজ বিভিন্ন পাহাড়ি জেলাগুলোয় শান্তিপূর্ণ মিছিল সংগঠিত করে। এটা ছিল রাজ্যব্যাপী অহিংস প্রতিবাদ। এই মিছিলের সঙ্গে সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কোনো সংযোগ ছিল না। নিতান্তই নাগরিক উদ্যোগ। কিন্তু বীরেন সিং সরকার কুকি নাগরিক সমাজের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসা দূরে থাক, উল্টে ১৪৪ ধারা জারি করে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করল। সরকার তো বটেই, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং মেইতেই নাগরিক সমাজকে বোঝাতে বসলেন — এই কুকিদের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠীর সরাসরি যোগ আছে এবং ‘নার্কো টেররিস্ট’দের উৎখাতের জন্যই সরকার বনাঞ্চল অভিযান চালাচ্ছে!
এরপর ১৯ এপ্রিল এল মণিপুর হাইকোর্টের সেই আদেশ — সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের তফসিলি উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারে মণিপুর সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যস। দীর্ঘ বঞ্চনা আর ক্ষোভের বারুদে ফুলকি পড়ল। জ্বলে উঠল দাউ দাউ আগুন। বীরেন সরকার তথা কেন্দ্রীয় সরকার যে এটাই চেয়েছিল সেটা দৃঢ়মূল হয় ‘ডবল ইঞ্জিনের’ অদ্ভুত নিষ্ক্রিয়তা তথা নীরবতা তথা নির্লিপ্ততা দেখে। দুই সম্প্রদায়কে জাতি দাঙ্গার আগুনে ছুঁড়ে দিল তাদের ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতি — আদিবাসী কুকিদের উৎখাতের ‘এথনিক ক্লীনজিং’-এর নিশানায়। এসটি মর্যাদা পেলে মেইতেইদের আদিবাসী জমি কেনায় আর কোনো বাধা থাকবে না যা তাদের আরও সমৃদ্ধ, আরও লাভবান করবে। তাই তারা মরিয়া আশায় সেই আগুনে ঝাঁপ দিল। আর অনন্যোপায় কুকিরা পুঞ্জীভূত বঞ্চনা আর অবহেলা থেকে মুক্তি চেয়েছিল।
পাহাড়ী রাজ্য পুড়ে খাক হচ্ছে। জাতি-দাঙ্গার সেই আগুনে হাত সেঁকছেন মোদী-শাহ। মেইতেইদের বকলমে শেষপর্যন্ত আদিবাসী জমির মালিক হবে কর্পোরেটরা। কিন্তু আগুন নিয়ে খেলার বিপদ কি তারা জানেন না? জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে অস্ত্র যোগানোর ভয়ঙ্কর পরিণাম তারা বোঝেন না?
মণিপুরের প্রতিবেশী মিজোরামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মিজোরা মণিপুরের কুকি-জোমিদের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে আত্মিক বন্ধনে জড়িয়ে আছেন। তারা কুকি বোনেদের লাঞ্ছনা অপমানে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ, বেদনার্ত। পাশের রাজ্যের ভাই বোনেদের দুঃখের অংশীদার হতে, সংহতির বার্তা পৌঁছাতে আর প্রতিবাদ জানাতে জনজাতিরা গত মঙ্গলবার আইজলে এক বিশাল মিছিল করেছেন। পুরোভাগে ছিলেন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও বিধায়করা। রাজ্যের সব দল ও সংগঠন সেখানে পা মিলিয়েছে। সেখান থেকে মণিপুর ভেঙে আলাদা কুকি রাজ্যের দাবি উঠেছে। ছাত্রীদের হাতে প্ল্যাকার্ড “আমাদের শরীর তোমাদের যুদ্ধক্ষেত্র নয়!”
সেই কাংপোকপি-র নির্যাতিতার প্রেমিক তার ট্রমা কাটানোর জন্য পরম যত্নে তাকে আগলে রেখেছে। গির্জায় অনাড়ম্বরভাবে বিয়েও সেরে নিয়েছে। মূল অভিযুক্তের বাড়ি ভেঙে দিয়েচেন মেইতেই মহিলারাই। বিজেপি-আরএসএস-এর ঘৃণার রাজনীতির বিষক্রিয়া একদিন কেটে যাবে। সাধারণ মানুষের রোজকার বেঁচে থাকার লড়াই সেই বিষ কাটিয়ে দেবে। এমন স্বপ্ন হয়তো দিবা স্বপ্ন হবে না যে কুকি-ভাইয়ের দগ্ধ ঘর নতুন করে গড়ে দিতে হাত লাগাবেন তার মেইতেই প্রতিবেশী।
কিন্তু উত্তর-পূর্বে যে ক্ষোভের আগুন জ্বলতে শুরু করেছে তার দাবানল থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবেন তো মোদী-শাহ?
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
ক্ষতবিক্ষত মণিপুর। বিধ্বস্ত মণিপুর। জাতি হিংসায় বিদীর্ণ মণিপুর।
৩ মে থেকে ৩২.২ লক্ষ জনসংখ্যার ছোট্ট উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুর আজও দাউদাউ করে জ্বলছে। কোনো বিরোধী শাসিত রাজ্যে এমন ঘটনা ঘটলে ‘বিশ্বগুরু’ কী বলতেন, কীই বা করতেন তা সকলেই অনুমান করতে পারছেন। আর, বহু বিজ্ঞাপিত ‘ডবল ইঞ্জিন’ চালিত সরকার যে আজও কেন মণিপুরকে শান্ত করতে পারল না, তা স্পষ্ট নয়।
এই অস্পষ্ট ধূসর প্রান্তরে হঠাৎ কিছুটা আলোকসম্পাত করলেন মণিপুরেরই বিজেপি বিধায়ক পাওলিয়েনলাল হাওকিপ। তিনি ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সরাসরি চিঠি লিখে বলেছেন, কয়েকমাস ধরে চলতে থাকা এই মর্মান্তিক মানবতার ট্রাজেডির আগুন নিরন্তর জ্বলছে, কারণ এই আগুন জ্বালিয়ে রাখার পেছনে রয়েছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে কদর্য রাষ্ট্রীয় হিংসার খোলখুলি মদত। মেইতেই জঙ্গীবাহিনীর সাথে সরকারের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর যৌথ মদতে ইম্ফল উপত্যকায় পাহাড়ের পাদদেশে কুকি-জো’দের একের পর বসবাসস্থলকে জ্বালিয়ে, তাদের হত্যা করা হল। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এই সশস্ত্র অভিযানকে ‘ড্রাগ-সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যুদ্ধ হিসাবে গৌরবান্বিত করেছিলেন। মণিপুরে আইনসভা, প্রশাসন, বিচারবিভাগ সংখ্যাগুরু মেইতেইদের প্রতি নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব নিয়ে চলে এসেছে আবাহমান কাল ধরে। এই হিংসার আগুনে কত মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, কত শত নারীকে ধর্ষণ, রাষ্ট্রীয় হিংসার কবলে পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই।
মে মাসে, দু’টি মেয়েকে বিবস্ত্র করে উন্মত্ত ভিড় প্রকাশ্য রাস্তায় প্যারেড করিয়ে একজন মেয়ের বাবা ও ভাইকে খুন করার পর গণধর্ষণ করে। আর সেই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাওয়া আপামর জনগণের বিবেক আলোড়িত হয়। ঘুম থেকে উঠে শীর্ষ আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত হস্তক্ষেপের পর অত্যন্ত ধূর্ত প্রধানমন্ত্রী দু’চার বাক্যে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে মণিপুরের সাথে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলোকে একই বন্ধনিতে ফেলে পুরো বিষয়টাকেই লঘু করে দিলেন। মালদার একটি চরম নিন্দিত ঘটনাকে সামনে এনে মণিপুর-মালদাকে একই বন্ধনিতে ফেলে রাজ্যে বিজেপি হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। মণিপুরে একটি নির্দিষ্ট জাতি ‘কুকি জো’কে নিকেষ করার বিজেপির বৃহৎ ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিত থেকে কাটছাঁট করে ওই ঘটনাকে শুধুমাত্র নারী নির্যাতনেই সীমাবদ্ধ রাখার শয়তানি তত্ত্ব বাজারে ফেরি করা শুরু হল, যাতে বামপন্থীদের একটি অংশও প্রভাবিত হলেন।
গুজরাট মডেল, উত্তরপ্রদেশে যোগী মডেল আর হালে মণিপুর মডেল হল সংখ্যালঘুদের নিকেষ করার, বিদ্বেষ-বিভাজনের এক হীন কুচক্রী রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিস্ট ষড়যন্ত্র। যেখানে নারী ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমনটা হয়েছিল গুজরাটে ২০০২ সালের দাঙ্গায়। এরসাথে মালদা বা বিরোধী শাসিত অন্য রাজ্যের কোনো তুলনাই টানা যায় না। মোদীর সুরে সুর মিলিয়ে এখন বিজেপি জঘন্য খেলায় নেমেছে। উত্তাল হয়ে উঠেছে সংসদ। মণিপুর নিয়ে মোদীর বিবৃতির দাবিতে ‘ইন্ডিয়া’ ঐক্যবদ্ধ। যুদ্ধরেখা টানা হয়ে গেছে। এখন সম্মুখ সমর!
“মনিপুর ভবন চলো! মনিপুরের গণধর্ষণ ও সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে সোচ্চার হও! মণিপুরের জাতিদাঙ্গায় ইন্ধনকারী আরএসএস-বিজেপিকে ধিক্কার!” এই স্লোগানগুলোকে পোস্টার ও ব্যানারে লিখে আইপোয়া সহ বিভিন্ন নারী সংগঠন, শিক্ষার্থী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, গণ সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের যৌথ প্রতিবাদ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয় গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপো থেকে মণিপুর ভবন পর্যন্ত মিছিল করে। মণিপুর ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয় এবং ৫ জনের এক প্রতিনিধি দল মণিপুর সরকারের আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি জমা দেয়। প্রতিনিধিরা জানতে চান, মণিপুরে যে ঘটনায় কুকি সম্প্রদায়ের দুই মহিলাকে প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করে ঘোরানোর যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে এবং ইতিমধ্যে ১৫৭'র বেশি এফআইআর মণিপুরের বিভিন্ন পুলিশ স্টেশনে নথিভুক্ত করা হয়েছে, এই যে ভয়াবহ জাতি দাঙ্গা চলছে সে বিষয় তিনি কী মনে করছেন?
মণিপুর সরকারের তরফ থেকে যে আধিকারিক উপস্থিত ছিলেন তিনি প্রতিনিধি দলকে জানান যে তিনি ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে বিষয়টা জানতেন না, কিন্তু জানার পর তিনি বিষয়টা ভালো চোখে দেখছেন না।
গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপো থেকে যে উদ্দীপ্ত মিছিল সংগঠিত হয় তাতে স্লোগান ওঠে, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বিরেন সিংকে সরাতে হবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে পদত্যাগ করতে হবে।
মণিপুরে দীর্ঘ দু’মাসের বেশি ধরে চলা জাতি সংঘর্ষ এবং রাষ্ট্রীয় মদতে উপজাতি/জনজাতিদের ওপরে হওয়া নির্মম অত্যাচারের চূড়ান্ত নিদর্শন চলছে। তারই মধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে মহিলাদের উপরে হওয়া অবর্ণনীয় পাশবিকতার ঘটনা।
এর বিরুদ্ধে বিজেপি শাসিত মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অবিলম্বে পদত্যাগ এবং সমস্ত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গত ২৩ জুলাই ২০২৩ হাওড়ার কামারডাঙা এলাকায় সংগঠিত হল সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিক্ষোভ সভা।
সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত এবং রাজ্য কমিটি সদস্য তথা মধ্য হাওড়া লোকাল সম্পাদক পরিতোষ ব্যানার্জী।
উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় পার্টি সদস্য ও সমর্থকেরা।
অবিলম্বে মণিপুরে শান্তি ফিরিয়ে আনার ও দোষীদের শাস্তির দাবীতে শেষ হয় সভা।
৮০ দিনের বেশি হয়ে গেল মণিপুর জ্বলছে, জাতিদাঙ্গার চরমতম রূপ সামনে আসছে। সম্প্রতি মণিপুরে দুই কুকি সম্প্রদায়ের মেয়েকে নগ্ন করে প্যারেড এবং গণধর্ষণের ঘটনা দেখিয়ে দিল মেয়েদের শরীরকে বদলার রাজনীতিতে ব্যবহার করার নৃশংস রুপ। মে মাস থেকে এই ভয়াবহতা চলছে, অথচ বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকার একে বন্ধ করার বদলে ক্রমশ এই দাঙ্গায় ইন্ধন জুগিয়ে চলছে। মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং মেইতি সম্প্রদায়ের লোক। তিনি কুকি ও মেইতি এই দুই জাতির পুরানো দ্বন্দকে কাজে লাগিয়ে এক উন্মন্ত ধংসলীলায় মেতেছেন যেখানে প্রাণ যাচ্ছে দুই জনজাতির মানুষেরই। চুরাচন্দ্রপুর জেলায় ৩২টা কুকি গ্রামে বীরেন সিং রীতিমতো সন্ত্রাস তৈরি করেছেন। সেখানে লাগাতার যৌন নিপীড়নের ঘটনা, গির্জা পোড়ানোর ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে। ডবল ইঞ্জিন সরকারের এই পরিকল্পনা মাফিক হিংসা সৃষ্টির বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে আন্দোলনে নেমেছে বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও আইসার পক্ষ থেকে গত ২১ জুলাই অশোকনগরে এবং ২৩ জুলাই বারাসাতে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ সভা সংঘটিত হয়। দু’টি সভায় যুক্ত হন রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের কর্মীরাও। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা নেতৃত্ব।
আইসা-আইপোয়া-সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বক্তারা আওয়াজ তোলেন অবিলম্বে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং’কে বরখাস্ত করতে হবে। কুকি ও মেইতি সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনা করে সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। এবং দখলদারির রাজনীতির স্বার্থে মেয়েদের শরীরকে যুদ্ধক্ষত্র বানানো বন্ধ করতে হবে।
গত ২৬ জুলাই অল ইণ্ডয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা)-র পক্ষ থেকে রাজ্য সভাপতি নীলাশিস বসু ও রাজ্য সম্পাদক স্বর্ণেন্দু মিত্র এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন — ১৮ জুলাই কোচবিহার জেলার খাপাইডাঙার শাহজাহান উদ্দীন হাইস্কুলের নবম শ্রেণির এক নাবালিকা ছাত্রীকে বাড়ি ফেরার পথে দুষ্কৃতিরা তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে ও ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন করে। ওই নির্যাতিতা ছাত্রী আজ কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আমরা অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ওই গণধর্ষণকারী হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। এই বর্বরোচিত ঘটনার বিরুদ্ধে ২৭ জুলাই বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের ডাকে কোচবিহার জেলা ছাত্র ধর্মঘটের যে ডাক দেওয়া হয়েছে, আমরা তাকেও পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি।
বিহারে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প রূপায়ণকে অছিলা করে দরিদ্র ও দলিত পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এই বলপূর্বক উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আয়ারলা এবং এমএনআরইজিএ মজদুর সভা ১১ জুলাই ২০২৩ সারা বিহারেই প্রতিবাদ সংগঠিত করে। আয়ারলা নেতা এবং সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরো সদস্য ধীরেন্দ্র ঝা বলেন, বিহারে দরিদ্রদের ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ করতে বুলডোজারকে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, এখন বরং এমন একটা আইন রচনার সময় যার বলে সবার জন্য বাসস্থানের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বরাদ্দকে বাড়িয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা করার দাবিও তোলেন।
সেদিন শত শত ব্লকে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। প্রতিবাদের সমস্থ স্থান থেকেই দাবি ওঠে — যে সমস্ত দরিদ্রের বাসস্থান বা ঝুপড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের সবার জন্যই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আরও দাবি ওঠে, বিহার জুড়ে সমস্ত বাসস্থানের সমীক্ষা করা হোক যাতে বাসস্থান বা পুনর্বাসনের প্রয়োজন এমন দরিদ্রের চিহ্নিত করা যায়। হাজার হাজার প্রতিবাদী জনগণ সেদিন মহাগাঠবন্ধন সরকারের উদ্দেশ্যে আর্জি রাখেন — সমস্ত জেলায় উচ্ছেদের যে নোটিস দেওয়া হয়েছে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং সবার জন্য বাসস্থান সুনিশ্চিত করার কর্মনীতি গ্ৰহণ করতে হবে। আর এই লক্ষ্যে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া না হলে সারা বিহারেই গ্রামীণ ক্ষেত্রের শ্রমিকরা ১ আগস্ট ২০২৩ ধর্মঘট সংগঠিত করবেন বলে ঘোষণা করা হয়।
আয়ারলা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিহারে প্রায় এক কোটি জনগণের বাসস্থানের কোনো মালিকানা বা পাট্টা নেই, যার ফলে তারা উচ্ছেদের নোটিশের অসহায় শিকার হয়ে পড়ে এবং তাদের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়।
সিপিআই(এমএল)-এর বিধায়করা বিধানসভার ভিতরে এই বিষয়টি উত্থাপন করেছেন, তাঁরা দারিদ্রপীড়িত পরিবারগুলি চিহ্নিত করার জন্য একটি সমীক্ষা করার কথা বলেছেন। এবং আদালতে একটি হলফনামা দেওয়ার প্রস্তাব সরকারের কাছে রেখেছেন যাতে বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপে কায়েমী স্বার্থরা কোনো উচ্ছেদ সংঘটিত করতে না পারে। রাজ্য সরকার এর আগে বলেছিল যে যথাযথ পুনর্বাসন ছাড়া কোনো দরিদ্র পরিবারকেই উচ্ছেদ করা হবে না, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি সরকার রাখেনি। আয়ারলা নেতা শত্রুঘ্ন সাহানির পরিচালনায় মুজাফ্ফরপুরে এক বড় আকারের প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বরাদ্দ হ্রাস করার জন্য মোদী সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন, যদিও গ্রামাঞ্চলে আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি এবং খরচ বেড়ে চলার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধিরই প্রয়োজন। তিনি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বরাদ্দ বাড়িয়ে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ টাকা করার দাবি রাখেন।
এই প্রতিবাদগুলোর মধ্যে দিয়ে অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ১০০ দিনের কাজের মজুরি বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির স্তরে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দাবিটিও তোলা হয়। মোদী সরকার ১০০ দিনের কাজের মজুরিকে বেঁধে রেখেছে একেবারেই শোষণমূলক স্তরে। ঐ মজুরিকে নির্ধারিত করতে হবে প্রতিদিন ৪২৯ টাকায়, যেটা হল অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য বিদ্যমান মজুরির হার।
দেশের সুপ্রিম কোর্ট গত ৬ জুলাই ২০২৩ জাতিবৈষম্য জনিত এক মামলায় ইউজিসি’কে (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) এক নির্দেশ দিয়েছে, অবিলম্বে শিক্ষাকেন্দ্রে জাতিবৈষম্য যাতে আর চলতে না পারে তারজন্য নিয়মরীতি যা যা তৈরি করার ও কার্যকরী করার তা করা হোক। গত বেশ কয়েকবছর যাবত শুরু শিক্ষাকেন্দ্রে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে, তা সে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বা গবেষণা ক্ষেত্র হোক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এসসি-এসটি ছাত্রী-ছাত্রদের জাতিবৈষম্যের শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রীদের উপরন্তু লিঙ্গগত বৈষম্যের পীড়নের মুখে পড়তে লক্ষ করা গেছে। নির্যাতন মানসিক ও শারীরিক উভয়তই ঘটেছে। সোজা কথায়, নিচু জাতের ছেলে-মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় পঠন-পাঠনে শোভা দেয় না — এই জাতীয় অবজ্ঞা-অপমানে জর্জরিত হতে হয়েছে, এমনকি ইউজিসি’র অর্থবরাদ্দ পাওয়ার প্রশ্নেও একই রকমের বৈষম্যজাত বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। তার দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেকক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ছাত্রী-ছাত্ররা নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চরম পন্থা নিয়ে ফেলেন। কারণ, কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক সাহারা অনুভব করতে পারেন না। এক অবসাদগ্রস্ততা গ্রাস করে, অতলে নিয়ে যায়। বাঁচার ইচ্ছেটাই মরে যায়। কিন্তু এই পরিণাম আপাতঅর্থে আত্মহনন মনে হলেও চূড়ান্তঅর্থে জাতিবৈষম্যগত হত্যা বললে অত্যুক্তি হয় না।
সুপ্রিম কোর্টের এক ডিভিশন বেঞ্চ সম্প্রতি যে রায় দিয়েছে তা পিএইচডি স্কলারশিপ ছাত্র প্রয়াত রোহিত ভেমূলার মা রাধিকা ভেমুলা ও মেডিক্যাল পড়ুয়া পায়েল তদভির মা আবেদা তদভির করা জয়েন্ট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে। রোহিত ও পায়েল দুজনেই জাতিবৈষম্যের শিকার হন যতাক্রমে ২০১৬ ও ২০১৯ সালে। এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে লাগাতার আন্দোলন হয় শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজপথে। তার পরেও জাতিবৈষম্যের পীড়ন বন্ধ হয়নি, বরং সম্প্রতি বিভিন্ন উচ্চশিক্ষার ইন্সটিটিউটে তার শিকার হয়েছেন আরও কয়েকজন ছাত্র। তাই সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ইউজিসি’কে নির্দেশ দিয়েছে জাতিবৈষম্যের মোকাবিলায় কী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ করা হচ্ছে তা অবিলম্বে কোর্টকে জানাতে হবে। এই বিষয়ে ২০১২ সালে ইউজিসি কিছু নিয়মনীতি প্রণয়ন করেছিল তা কেমন মেনে চলা হচ্ছে, তার প্রতিক্রিয়াই বা কী, সেই সবকিছুই কোর্টকে অবগত করতে হবে। প্রত্যুত্তরে ইউজিসি’র কৌসুলী আদালতে কথা দিয়েছেন ২০১২ সালে প্রণীত নিয়মকানুন মোতাবেক সমস্ত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সার্কুলার পাঠানো হবে এবং তার চেক-আপ করা হবে। শহীদ রোহিত ভেমুলা ও পায়েল তদভির মায়েরা তাদের পিটিশনে দাবি করেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতিবৈষম্যের অবসান হোক। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন ও আন্দোলনের এক অন্যতম দাবিও তাই।
প্রতি বছরের মতো এবারও ধর্মতলায় ২১ জুলাই শহীদদের স্মরণে জনসমাবেশ করল তৃণমূল কংগ্রেস। ৩০তম শহীদ দিবসেও যে উত্তরটা অজানা থেকে গেল, ‘গণহত্যার তদন্ত’ রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হল না কেন? আমাদের দেশে এটাই যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের টাকায় কখনো সখনো গণহত্যার তদন্ত হবে, কিন্তু তা জনসমক্ষে আসবে না।
এবারের জনসমাবেশে ভিড় অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি বা কম ছিল কিনা এ’তুলনা অর্থহীন। বরং যে প্রশ্নটা আড়ালে আবডালে ঘোরাঘুরি করছিল, ২০২৩’র ২২ জুলাই কী হবে? ২০২২’র ২১ জুলাই সমাবেশের পরদিন, বস্তুত ২৪ ঘন্টার মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব তথা মন্ত্রীসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি তথা শিক্ষামন্ত্রীর দুর্ণীতির অভিযোগে গ্রেফতার ও পরবর্তী ঘটনাবলী তৃণমূল কংগ্রেসকে যথেষ্ট কোণঠাসা করে দিয়েছে। এ’বছরের ২২ জুলাই এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং সদ্য সমাপ্ত ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুল জয়ের উচ্ছ্বাস নিয়ে কর্মীবাহিনী ও সমর্থকরা সমাবেশে হাজির হয়েছিল। যুব তৃণমূল কংগ্রেসের ডাকা এই সমাবেশে দু’জনের বক্তব্যই রাজনৈতিক মহলে চর্চায় আসে। বাকিদের বক্তব্য ও উপস্থিতি ক্ষমতার বৃত্তে তারা এখনও আছেন কিনা সেটুকু জানান দেয়। তাদের সম্মিলিত বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যাচ্ছিল, মুখ্য বক্তাদের বক্তব্যের অভিমুখ কোন দিকে হতে পারে।
তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ‘প্রকাশ্যে দুঃখ’ প্রকাশ করে তাঁর ৪১ মিনিট ২৩ সেকেন্ড বক্তব্যের সূত্রপাত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই দুঃখ প্রকাশে তথ্য পরিসংখ্যানে শুধু ভুল ছিল এমন নয়, আন্তরিকতা আদৌ ছিল কিনা, এ’প্রশ্ন সংগত কারণেই উঠেছে।
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, বিরোধীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে। কখনো ১৯ জন, কখনো ২৯ জনের মৃত্যু/খুনের কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, এর বেশিরভাগই তাঁর দলের কর্মী। অথচ বিরোধী দলগুলি শুধু নয়, সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৫ থেকে ৬২ জন বলা হচ্ছে। মৃত্যুর বিষয়টি শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে হিসাব নিকাশ হবে? এবং কিছুটা ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নিতে হবে? ২০০৩ ও ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মৃত্যুর সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করে এবারের নির্বাচন অনেক বেশি ‘গণতান্ত্রিক’ হয়েছে, এটা হাস্যকর বলেই মনে হয়। এর থেকে বরং যুক্তিযুক্ত হতো ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে। সেবার ৩৪-৩৬ শতাংশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছিল, এবার ১২-১৮ শতাংশ আনুমানিক। সেদিক থেকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক! তবে মুখ্যমন্ত্রীকে একটু ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ, ২০০৮এ শাসন ক্ষমতায় থাকা দলটি দেওয়ালের লিখন পড়তে পারেনি। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী দেওয়ালের লিখন পড়তে শিখুন।
মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কুৎসিত তুলনা করার রীতি তখনই বন্ধ হবে যখন নির্বাচকমণ্ডলী বিনা বাধায় তার প্রতিনিধি নির্বাচন করার জন্য ভোট দিতে পারবেন।
মমতা ব্যানার্জী তাঁর ভাষণ অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক উপস্থিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী ‘জগাই, মাধাই গদাই’কে সম্বোধন করে সাধারণত তাঁর ভাষণ শুরু করেন। এবার কংগ্রেস দলের নাম (মুখ্যমন্ত্রীর জগাই) একবারও উচ্চারিত হয়নি, মাধাই অর্থাৎ সিপিএমের কথা একবারই মাত্র এসেছে, উভয় শাসনে পঞ্চায়েত নির্বাচন ও মৃত্যুর তুলনা করার সময়। মমতা ব্যানার্জীর এবারের ২১ জুলাই ভাষণ কেন্দ্রিত ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। সেটাই স্বাভাবিক ও যুক্তি সংগত। দেশজুড়ে বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, আবহাওয়া ও জোটের সম্ভাবনা পাটনা ও বেঙ্গালুরু কনভেনশনে মূর্ত হয়ে উঠেছে, তার অন্যতম শরিক হিসেবে নিজেকে দেশব্যাপী তুলে ধরার চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি এরাজ্যে বিজেপি বিরোধী প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসকে তুলে ধরা। পশ্চিমবাংলায় ২০২১’র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী যে মনোভাব/জনাদেশ নজরে এসেছে, তাকে একশ শতাংশ কাজে লাগাতে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ ব্যবহার করলেন মমতা ব্যানার্জী। তাই তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো বেঙ্গালুরু বৈঠকে সদ্য গড়ে উঠা ‘ইন্ডিয়া’ (INDIA) নামে শ্লোগান তুললেন। ৪১ মিনিট ভাষণের সিংহভাগ সময় এই লক্ষে ব্যয় করলেন।
পশ্চিমবাংলায় শাসনক্ষমতায় থাকার সুবাদে বিজেপিকে উদ্ঘাটিত করার সর্বতোভাবে চেষ্টা তিনি করেছেন। তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থান থেকে জোটের কোনো পদ বা মন্ত্রীত্ব চাই না বলে ঘোষণা করলেন। জোটের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে তিনি ভাবিত নন। তিনি শুধু সৈনিক। রাজনীতির অ আ ক খ জানা মানুষ জানেন এসব কথার কথা। শুধু বললেন, চাই “বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে হটাতে”। এরাজ্যে INDIA বনাম NDA নির্বাচনী লড়াইয়ের রাশ নিজের হাতে রাখতে ভাষণের একটা বড় অংশ মণিপুরের জাতিদাঙ্গা, বীভৎস নারী নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। দেশ আজ উত্তাল। বিরোধী পক্ষের কোনো রাজনৈতিক দল তা এড়িয়ে যেতে পারে না। রাজ্যবাসীর অভিমতকেই তুলে ধরেছেন। মমতা ব্যানার্জীর ভাষণের পরিপূরক হিসেবে বিরোধী পক্ষের রাজনীতির পরিসর তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে ধরে রাখার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক ব্যানার্জী দিল্লী অভিযানের ডাক দিলেন।
১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রের বকেয়া টাকা ও আনুষঙ্গিক কিছু দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। যুবনেতা আরও একধাপ এগিয়ে বিজেপির বুথস্তরের নেতাকর্মীদের বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী সে অভিযানের সীমানা বুথস্তর থেকে ব্লকস্তরে সরিয়ে নিলেন এবং সাথে এও ঘোষণা করলেন ঘেরাও কর্মসূচি ১০০ মিটার দূরে প্রতীকী চরিত্রের হবে। শাসক দলের এই ধরনের কর্মসূচি নৈরাজ্য ও রক্তপাতের কারণ হতে পারে। প্রসাশনের কোনো পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। বাংলার মাঠে ঘাটে কারখানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও যুক্ত সমস্ত বামপন্থী সংগঠন ও কর্মীবাহিনীকে ভারতের জনগণের প্রধান শত্রু বিজেপি আরএসএসের ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে হটিয়ে দেওয়ার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। দেশ ও রাজ্য পরিস্থিতির এক জটিল সন্ধিক্ষণে এরাজ্যে বামপন্থী-গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগোতে হবে। ব্যাটেল লাইন ইজ ড্রন (যুদ্ধরেখা টানা হয়ে গেছে)। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের নেতৃত্ব বামপন্থীরা অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না। জনগণের সংগ্রামী ঐক্যকে শক্তিশালী করার সাথে সাথে বামপন্থী নেতৃত্বকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে জনবিরোধী সমস্ত সরকারের জনবিরোধী সমস্ত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। একথা মাথায় রাখতে হবে, জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ।
- পার্থ ঘোষ
নরেন্দ্র মোদী জমানায় অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা সাঙাতি পুঁজিবাদ বস্তুত মোদী ও বিজেপি ঘনিষ্ঠ গুটিকয়েক পুঁজিপতি তোষণেরই নামান্তর। সরকারি ক্ষমতার প্রয়োগে এই পুঁজিপতিদের বিশেষ সুবিধা ও বরাত পাইয়ে দেওয়াটাই রীতি হয়ে উঠেছে এবং বেসরকারি হাতে সরকারি পরিকাঠামোর হস্তান্তরে সম্পদ এদের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় তারা ফুলেফেঁপে উঠছে। আর মোদীও বিজেপি ঘনিষ্ঠ এই সাঙাতদের তালিকার এক নম্বরে যে গৌতম আদানি রয়েছেন তা এক সর্বজনবিদিত তথ্য। কেন্দ্রীয় ও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির প্রশাসনিক অলিন্দে আদানি-প্রীতি এতটাই পরিব্যাপ্ত যে আদানি তোষণের কোনো সুযোগকেই শাসক বিজেপি নেতারা হাতছাড়া হতে দেন না। অতি সম্প্রতি তেমনটাই প্রতিপন্ন হল মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তির পুনর্গঠন প্রকল্পের বরাত আদানি প্রপার্টিজ’এর হতে তুলে দেওয়ার ঘটনায়। মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রি দেবেন্দ্র ফড়ণবীস আবাসন দপ্তর ছেড়ে দেওয়ার ঠিক একদিন আগে ১৩ জুলাই ২০২৩ আদানির সংস্থাকে নিয়োগ করলেন ধারাভি বস্তির পুনর্গঠনের যৌথ উদ্যোগের প্রধান অংশীদার হিসেবে। ধারাভি বস্তির পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার একটা পর্যায় শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে, এবং সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত টেন্ডার বা দরপত্র ডাকা এবং তার নিষ্পত্তির দিকে দৃষ্টিপাত করলে এই ধারণা পোষণ অস্বাভাবিক হবেনা যে, আদানি ছাড়া অন্য কোনো গোষ্ঠী যেন বস্তি পুনর্গঠনের বরাত না পায় সেই লক্ষ্যেই কোমর বেঁধেছিল বিজেপি ও শিবসেনা নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্রের সরকার।
ধারাভি বস্তি পুনর্গঠন প্রকল্পের জন্য ২০১৮ সালে যে দরপত্র ডাকা হয় তাতে কয়েকটি সংস্থা অংশ নিয়েছিল — আদানি যেমন দরপত্র দিয়েছিল, তারসাথেই দরপত্র দিয়েছিল দুবাইয়ের সেকলিঙ্ক টেকনোলজি কর্পোরেশন। দরপত্রে তারা জমির দাম দেয় ৭২০০ কোটি টাকা, এবং ঐ দর আদানিদের দেওয়া ৪৫৩৯ কোটি টাকার দরের থেকে যথেষ্ট বেশি ছিল। দরপত্রে সবচেয়ে বেশি দাম দেওয়ায় সেকলিঙ্ক গোষ্ঠীই ২০১৯’র ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের বরাত জয়ী বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু এরপরই একটা বিতর্ককে খুঁচিয়ে তোলা হল। প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকার রেলের কাছ থেকে ৮০০ কোটি টাকায় ৪৬ একর জমি কেনে। জমি কেনার জন্য ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ায় রাজ্য সরকার অ্যাডভোকেট জেনারেলের কাছ থেকে পরামর্শ চায় (এটা কি আদৌ জরুরি ছিল?) এবং তিনি আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র ডাকার পরামর্শ দেন। উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র বিকাশ আগাদি সরকার ২০২০’র অক্টোবরে আগের ডাকা দরপত্র বাতিল করে দেয়। এবং উদ্ধব ঠাকরে সরকারের পতনের পর শিবসেনা-বিজেপি সরকার ২০২২’র ১ অক্টোবর নতুন দরপত্র ডাকে। সেই দরপত্রে অংশ নেয় তিনটে সংস্থা — আদানি প্রপার্টিজ, ডিএলএফ ও নমন ডেভেলেপার্স। আদানিরা ৫০৬৯ কোটি টাকা দরে দিয়ে সর্বোচ্চ দামের প্রস্তাবক হয়ে বস্তি পুনর্গঠন প্রকল্পের বরাত লাভ করে। উল্লেখ্য যে, আদানিদের দেওয়া এই দর সেকলিঙ্ক গোষ্ঠীর দেওয়া দরের থেকে ২১৩২ কোটি টাকা কম হওয়ায় শিন্ডে-বিজেপি সরকারের কোনও স্তরেই কোনও উচ্চবাচ্য হয়নি। আদানিদের সুবিধার জন্য সরকারি তহবিলের এই ক্ষতি বোধ হয় সরকারের পরিচালকদের কাছে বিবেচনার কোনও বিষয়ই নয়!
তবে, আদানিদের হাতে প্রকল্পের ভার তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে দরপত্রের নিষ্পত্তির এই বিলম্বই এই প্রকল্পে বরাত প্রক্রিয়ার একমাত্র মৌলিক বৈশিষ্ট্য নয়। সেকলিঙ্ক গোষ্ঠী যাতে দরপত্রে আর অংশ নিতে না পারে তারজন্য একটা চাতুরির আশ্রয়ও নেওয়া হয়। দরপত্রে অংশ নেওয়া সংস্থার সম্পদের ন্যূনতম পরিমাণ আগে নির্ধারিত হয়েছিল ১০,০০০ কোটি টাকা, সেটাকে বাড়িয়ে করা হল ২০,০০০ কোটি টাকা যাতে আদানিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে আমাদের বিমানবন্দর বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার কথা মনে না পড়ে পারে না। ২০১৮ সালে ছটা বিমানবন্দর বেসরকারিকরণ করতে গিয়ে মোদী সরকার সিদ্ধান্ত নিল — বিমানবন্দর পরিচালনায় কোনও পুর্ব অভিজ্ঞতা যাদের নেই তারাও দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। বিমানবন্দর পরিচালনায় কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও আদানিরা টেন্ডারে অংশ নিয়েছিল, এবং ছটা বিমানবন্দরের পরিচালনভারই তাদের হস্তগত হয়েছিল। শুধু এই নয়, হিন্ডেনবার্গ সংস্থার পেশ করা অভিযোগের পর আদানিদের কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ধ্বস নামে এবং তারা কিছুটা আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে। তাদের আর্থিক সুবিধা করে দিতে দরপত্রে উল্লিখিত অর্থ একসাথে না দিয়ে কিস্তিতে শোধ করার সুবিধা প্রদানও করা হয়। যে জমিতে বস্তি পুনর্গঠন হওয়ার কথা তা মুম্বইয়ের সরেস অঞ্চলের জমি। সেই জমির মূল্যায়ন না করেই ন্যায্য মূল্যের অনেক কমে প্রকল্পের স্বত্বের অধিকার আদানিদের দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
ধারাভি এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি। প্রায় ৬০০ একর জমিতে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তৈরি হবে আবাসন, বাণিজ্যিক পরিসর, অফিস, মল ইত্যাদি। অতএব, হকদার আবাসিকদের বাসস্থান বণ্টনের পরও জমি-বাড়ি বিক্রির সুযোগ তাদের থাকবে, আর তাই এই প্রকল্পে লাভের সম্ভাবনা ২০-২৫ হাজার কোটি পর্যন্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান। তবে, এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে একটা প্রশ্নও কিন্তু মাথাচাড়া দিচ্ছে। প্রকল্প রূপায়ণের আনুমানিক ব্যয় ২৭,০০০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিকূলতার মুখে পড়া আদানিদের পক্ষে বাজার থেকে এই পরিমাণ অর্থ জোগাড় করা কি সম্ভব হবে? আর তাতে তারা ব্যর্থ হলে আবাসনের দাবিদার অন্তত ৯,০০,০০০ জনগণ এবং বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সংস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তখন কি সরকারই আদানিদের রক্ষাকর্তা হয়ে দেখা দেবে? হালে যেমন দেখা গেছে, এলআইসি’র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের আর্থিক সংস্থাকে তাদের উদ্ধারে লাগানো হবে? আর একটা বিষয়ের উল্লেখও জরুরি। দরপত্রে সর্বোচ্চ দাম দেখানো সত্ত্বেও ধারাভি বস্তি পুনর্গঠন প্রকল্পের বরাত থেকে তাদের বঞ্চিত করায় সেকলিঙ্ক গোষ্ঠী বোম্বে হাইকোর্টে বস্তি পুনর্গঠন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সেই মামলার রায়ের দিকেও নজর রাখতে হবে। তবে, বিভিন্ন আদালতে শাসকের স্বরের যে প্রতিধ্বনি এখন শোনা যাচ্ছে তাতে শাসকের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিহিত কতটা হবে তা অবশ্যই সংশয়ের।
আদানির মতো কর্পোরেট সাঙাতদের ঐশ্বর্যশালী করে তোলাটা দান-প্রতিদানের এক সম্পর্কে আবদ্ধ। এই কর্পোরেটদের ভাঁড়ার ভরলে তার কিছু অংশ পৃষ্ঠপোষকদের ভাঁড়ারেও ঢোকে। মোদী জমানায় রাজনৈতিক দল, বিশেষভাবে বিজেপির ভাঁড়ারে কর্পোরেটদের কালো অর্থ জমা হওয়ার একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোদীর চালু করা ইলক্টোরাল বন্ড প্রকল্প, এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করে থাকেন ভাষ্যকারগণ। নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বসার পরপরই বলেছিলেন তাঁর জেহাদ হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, নিজেরা খাবেন না, কাউকে খেতেও দেবেন না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর ন’বছরের শাসন এর বিপরীতের সাক্ষ্যই বহন করছে — দুর্নীতি আড়ে-বহরে বেড়েছে, বিজেপি হয়ে উঠেছে দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের আশ্রয়স্থল, দুর্নীতির ওয়াশিং মেশিন রূপে অভিহিত হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের বিজেপি। কংগ্রেসি মুখপাত্র পবন খেরা যখন প্রধানমন্ত্রীকে ‘নরেন্দ্র গৌতমদাস মোদী’ বলে অভিহিত করেন, তারমধ্যে প্রকটিত হচ্ছে এক অমোঘ সত্য — মোদী আদানিদের মতো ভ্রষ্টাচারী কর্পোরেটদের মহা মদদদাতা এবং তাঁর দুর্নীতি-বিরোধী জেহাদ এক মেকি আস্ফালন!
ভারতের ৫টি অতিকায় কর্পোরেটের সমষ্টিকে ভেঙে ফেলার ডাক এসেছে। না, কোনো নৈরাজ্যবাদী সংগঠনের তরফ থেকে নয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য এই আলোড়নকারী প্রস্তাব দিয়েছেন।
কয়েকমাস আগে, একটি পেপারে তিনি লেখেন, দেশের ৫টি অতিকায় কর্পোরেটের হাতে বিপুল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওই ৫টি কর্পোরেট হল রিলায়েন্স গ্রুপ, আদানি, টাটা, আদিত্য বিড়লা গ্রুপ ও সুনীল মিত্তালের ভারতী টেলিকম গ্রুপ। তিনি লিখেছেন, বেছে বেছে ওই ৫টি কর্পোরেটের হাতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রগুলোকে তুলে দেওয়া হচ্ছে অতি মুনাফা কামানোর লক্ষ্যে। ক্ষেত্রগুলো হল — সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেটাল ও নন-মেটাল খনিজ পদার্থ, কেমিক্যাল, পেট্রোলিয়াম, কাঠের উৎপাদিত পণ্য, খুচরো বাজার, টেলিকম। এই প্রথম, তথ্যভিত্তিক একগুচ্ছ পরিসংখ্যান তিনি দিয়েছেন যা দেখিয়ে দেয় ভারতবর্ষে ক্রোনি পুঁজিবাদ মোদীর স্নেহছায়ায় কিভাবে পল্লবিত হয়ে বিরাট এক মহিরূহে পরিণত হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় মোদী ২০১৫-১৬-তে আসার পর থেকেই ক্ষমতার ভারসাম্যে এই বদল শুরু হয়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও নির্মাণ ক্ষেত্রে ওই ৫টি অতিবৃহৎ কর্পোরেটের বাজারে মোট অংশীদারিত্ব ২০১৬-তে যা ছিল ৩১ শতাংশ, তা ২০২১-এ লাফ দিয়ে বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। ওই একই সময়কালে টেলিকমিউনিকেশনে ৬৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৪ শতাংশ আর খুচরো ব্যবসায় ৪৪ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম ও কোকের উৎপাদিত ক্ষেত্র থেকে এই ৫টি অতিবৃহৎ কর্পোরেটের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ লাফ দিয়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ, আর মৌলিক ধাতুর ক্ষেত্রে ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
শুধুমাত্র উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতেই নয়, এই ৫টি কর্পোরেট এবার ৪০টি অর্থনৈতিক বহির্ভূত ক্ষেত্রেও (নন ফাইনান্সিয়াল) পা রেখেছে। গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোর ক্ষেত্রেও হাত বাড়িয়েছে, যেমন, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ সংবহন, শহরের গ্যাস বণ্টন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি এমনকি ট্রেনের টিকিট কাটা। অর্থনীতির মূল ধমনী, সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোকে নিজেদের মুঠোয় এনে এই কর্পোরেটগুলো প্রতিযোগিতাকে গিলে খেয়ে নিজেদের শর্তে দামকে নিয়ন্ত্রণ করছে, যা অর্থনৈতিক জগতে জঘন্য এক বাণিজ্যিক কৌশল। ফলে, উপভোক্তাদের ওই পাঁচটি কর্পোরেটের দয়ার উপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বী বিমান সংস্থাগুলো পরিষেবার ক্ষেত্রে মাশুল অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিযোগিতার অভাবে এবং ৫জি পরিষেবা প্রবর্তনের পর টেলিকমের মাশুলও বেড়ে চলেছে অস্বাভাবিক হারে।
মোদীর শাসনকালে এই ৫টি কর্পোরেটকে কেন্দ্র করে দেশের এই চূড়ান্ত শিল্পীয় কেন্দ্রীভবন প্রতিযোগিতাকে অবলুপ্ত করেছে, যা পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মবিরুদ্ধ। এই গুটিকয় সংস্থাগুলো সমগ্র শিল্পক্ষেত্রের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করছে। সেগুলোর সমস্ত উৎপাদিত পণ্য পরিষেবার দাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার অগাধ ক্ষমতা এরা ভোগ করে থাকে। এরাই নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে যা উপভোক্তারা দিতে বাধ্য হন। প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য দেখিয়েছেন, দেশে লাগামছাড়া কোর ইনফ্লেশনের জন্য এই ৫টি সংস্থাই দায়ী। অর্থনৈতিক পরিভাষায় কোর ইনফ্লেশন হল সেই মুল্যস্ফীতি যা উপভোক্তা মূল্যসূচকের (কনজিউমার প্রাইস ইন্ডেক্স) উপর ভিত্তিশীল। খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানির অত্যন্ত গতিশীল দাম এরমধ্যে ধরা হয় না। এই ইনফ্লেশনের মধ্যে চলে আসে সমস্ত ধরনের পণ্য ও পরিষেবার দাম বা মূল্য।
বিগত কয়েক বছর যাবত, কোভিড-উত্তরকাল, ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভৃতির কারণে বিশ্ব জোগান শৃঙ্খল রীতিমতো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আবহে আমাদের দেশেও মূল্যস্ফীতি মাথা তুলেছে। পরিসংখ্যানই বলছে, ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.৪ শতাংশ, যা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটাই বেশি, আরবিআই’এর ৬ শতাংশ সহনসীমাকেও ছাড়িয়ে যায়। প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নরের মতে, “সচেতন ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার তার শিল্পনীতির এমন এক অভিমুখ তৈরি করেছে, যার লক্ষ্যই হল জাতীয়ক্ষেত্রে এদের ‘চ্যাম্পিয়ান’ বানানো, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্যামসঙ’এর মতো দৈতাকৃতি সংস্থার সমকক্ষ করা” আর এর ফলাফলও আর্থিক দিক থেকে ভয়াবহ হচ্ছে। বেশ কিছু পণ্যের আমদানির উপর কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল মাশুল ধার্য করে অনেক বিদেশি সংস্থাকে ভারতের বাজারে ঢোকার পথে বাধা তৈরি করেছে যাতে ওই ৫টি সংস্থাই জাতীয় ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ান হয়ে ওঠে। আর এই সুযোগে তারাও সেই সমস্ত পণ্য পরিষেবার দাম ও মাশুল ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বা দেশীয় বাজারে বেশ কিছু পণ্য পরিষেবার ইনপুট খরচ কমা সত্ত্বেও দেশের উপভোক্তারা তার কোনো সুফল পান না। গতবছর আন্তর্জাতিক জোগান শৃঙ্খল অনেকটা স্বাভাবিক হলেও ভারতীয় উপভোক্তাদের অনেক বেশি দামে তা ওই ৫টি কর্পোরেটদের কাছ থেকে কিনতে হয়েছে। আর এরই হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে কোর ইনফ্লেশন। একটানা প্রায় ১৭ মাস ধরে তা বেড়েছে। এই অতিবৃহৎ ৫টি সংস্থার সার্থে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ঢালাও ঋণ দিচ্ছে পরিশোধের আশা ছেড়ে, বন্ড মার্কেট তার নিয়মনীতিকে শিথিল করছে, বিভিন্ন সরকারি বরাত পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে খিড়কি দরজা দিয়ে অনেক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, আমদানি-রপ্তানি নীতি এই কর্পোরেটদের স্বার্থেই তৈরি হচ্ছে। ফলস্বরূপ ব্যাঙ্কগুলোর অনাদায়ী পুঁজির পাহাড় ক্রমেই পুঞ্জিভূত হচ্ছে। খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্কই দিন কয়েক আগে জানিয়েছে, গত দশ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো ১৫.৩১ লক্ষ কোটি টাকার বকেয়া বা অনাদায়ী পুঁজি মুছে ফেলেছে। শুধুমাত্র ২০২২-২৩-এ ব্যাঙ্কগুলো মুছে দিয়েছে কর্পোরেট জগতের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্যের ২.০৯ লক্ষ কোটি টাকা। পারিবারিক সদস্যকে সংস্থার শীর্ষপদে বসিয়ে রাখায় এদের আর্থিক-ব্যবসায়িক স্বচ্ছতা থাকে না। পরিচালন পদ্ধতিও খুবই জটিল। এই সমস্ত কারণেই বিরল আচার্য ৫টি কর্পোরেট সংস্থাকে নিয়ে গড়ে তোলা শিল্পীয় কেন্দ্রীভবনকে ভেঙে ফেলার প্রয়োজন বলে জোরালো সওয়াল করেছেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ নৌরিয়েল রৌবিনি, যিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ণ স্কুল অফ বিজনেস’এর এমেরিটাস অধ্যাপক, সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেই বসেছেন যে ভারত এক বিপজ্জক বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনিও ওই ৫টি কর্পোরেট সংস্থার দিকে আঙুল তুলে বলেছেন যে এরাই নীতি প্রণয়নকে প্রভাবিত করছে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে। তারাই ভারতের শিল্পক্ষেত্রে যেকোনো নতুন উদ্ভাবনকে গলা টিপে মারছে, একদম প্রথমাবস্থায় স্টার্টআপগুলোকে হত্যা করছে, তাদের এক্তিয়ারভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রে নতুন কোনো দেশীয় শিল্পের অনুপ্রবেশকে আটকে দিচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচীকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করছে, রক্ষণশীল ও নিজেদের স্বার্থে সুরক্ষা কবচমূলক নীতি প্রণয়নে পরিচালিত করছে।
অধ্যাপক ১৯৮০-১৯৯০-এ এশিয় শার্দুলদের অভিজ্ঞতা সামনে এনে বলেছেন, সেই সময়ে উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানির উপর মূল জোর দেওয়ার মডেল অনুসরণ করে ওই দেশগুলোর বিরাট আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে মুখ থুবড়ে পড়া ওই মডেল এই শিক্ষা দিল যে ক্রোনি পুঁজিবাদ যদি অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করতে শুরু করে তবে সুস্থ প্রতিযোগিতার অভাবে দেশীয় অর্থনীতির উৎপাদনশীল বিকাশ রুদ্ধ হবে, বৈষম্য ক্রমেই চওড়া হবে, সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাবে দেশের অর্থনীতি।
মোদীর শাসনকালে সাঙাতি পুঁজিবাদ বা ক্রোনি পুঁজিবাদকে রাষ্ট্রীয় মদতে চরম সীমায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শিল্প অর্থনীতির এই চূড়ান্ত আর্থিক কেন্দ্রীভবনের উপর ভিত্তি করেই উত্থান হয়েছে ভারতীয় ফ্যাসিবাদ — মোদী সরকার যার ইউনিক প্রতিনিধি।
- অতনু চক্রবর্তী
(পুর্ব প্রকাশিতের পর)
মোদীর ন’বছরের ভারতে বিচারবিভাগের হালচাল।
“প্রতিবিপ্লবের কেন্দ্রে ছিল বিচারবিভাগ। সুবিধা ও উপযোগিতার বিবেচনার উপর নির্ভরশীল প্রশাসনিক ক্রিয়ার বিপরীতে বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল হয় আইনের, অর্থাৎ, ন্যায় ও অন্যায়ের উপর, এবং এগুলো সর্বদাই প্রচারের আলোয় থাকে। রাজনৈতিক সংগ্রামের সমস্ত হাতিয়ারের মধ্যে আইন সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ংকর, তা মূলত ন্যায় ও সুবিচারের ধারণাকে ঘিরে থাকা গৌরবজ্যোতির জন্য।” – ফ্রাঞ্জ নিউম্যান, বেহেমথ
বিচারবিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের বুনিয়াদি বিষয় এবং ক্রিয়াশীল গণতন্ত্রের কাছে অতীব গুরুত্বের। এটা ক্ষমতা বিভাজনের তত্ত্বের এক অপরিহার্য অঙ্গ, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোর সাহায্যে অন্যান্য অঙ্গের বাড়াবাড়িগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হয়। প্রশাসনিক বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আদালতের, বিশেষভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের লক্ষ্য হলো সংবিধানকে রক্ষা করা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনকে প্রতিহত করা — জবাবদিহির বাধ্যবাধকতাকে সুনিশ্চিত করা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা। বিভাজন কাঠামোর প্রতিটি অঙ্গেরই — আইনসভা, প্রশাসন ও বিচারবিভাগের আবার থাকে আধিপত্যের অভীপ্সা। জরুরি অবস্থার সময় প্রশাসনিক মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী বিচারপতিদের দমনের পর থেকে ভারতীয় বিচারবিভাগ বেশ কিছু রায়ের মধ্যে দিয়ে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে, এবং সরকারগুলিকে কিছু মাত্রায় জবাবদিহিতে বাধ্য করা হয়। তবে, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় মোদীর অধিষ্ঠানের পর থেকে গত ন’বছরে আমরা এক আপোসপন্থী বিচারবিভাগকেই দেখতে পাচ্ছি।
রায়দান এবং বিচারকে এড়িয়ে যাওয়া
সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালের পর যে রায়গুলো দিয়েছে সেগুলোতে মোদী সরকারের এজেন্ডার প্রতি বিচারবিভাগীয় সমর্থনের জোরালো প্রবণতাই প্রকটিত হয়; কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে (যে রায়গুলোতে নারীর অধিকার, এলজিবিটিকিউআইএ’র অধিকার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে কেন্দ্র করে সাংবিধানিক আইনি মূল্যায়নের বিকাশ ঘটেছে)।
আয়কর দপ্তর বিড়লা ও সাহারাদের কিছু কলঙ্কিত নথি বাজেয়াপ্ত করায় কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদের মোদীর দাবি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, এই নথিগুলোতে উৎকোচ ও দুর্নীতির উন্মোচনের সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয় এবং সেগুলোতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের নিয়মিত অর্থ প্রদানের উল্লেখও থাকে। এই নথির ভিত্তিতে অ-সরকারি সংস্থা কমন কজ সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে আবেদন রাখে যে, একটা অপরাধের মামলা চালু করা হোক এবং তদন্ত সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে পরিচালিত হোক। এক বিস্ময়কর নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট মামলাটাকে শুধু খারিজই করে না, আদালত ঘোষণা করে যে, “আলোচ্য নথিগুলো এমন যথাযথ নয় যার ভিত্তিতে এফআইআর দায়েরের নির্দেশ দেওয়ার মতো অপরাধ খাড়া করা যায়।” এবং এইভাবে বিড়লা ও সাহারা নথিতে থাকা উৎকোচের বিস্ফোরক দাবির তদন্তকে ভেস্তে দেওয়া হয়। রাফাল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের পরিণতিও একই হয়েছিল, ক্রয়চুক্তিকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নজরদারিতে তদন্তের যে আবেদন উঠেছিল, তাকে খারিজ করা হয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া সবচেয়ে বিতর্কিত রায়গুলির অন্যতমটি সম্ভবত হল বিচারপতি লোয়ার মৃত্যু সম্পর্কিত তদন্তের আবেদনের রায়। বিচারপতি বি এইচ লোয়া ২০০৫ সালে সোহরাবুদ্দিন শেখ’এর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হত্যার মামলাটি শুনছিলেন, এবং রহস্যজনক পরিস্থিতিতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের আবেদন জানিয়ে মামলা দায়ের করা হয়। উল্লেখ্য যে, বিচারপতি লোয়ার পরিবারও রহস্যজনক পরিস্থিতিতে তাঁর মৃত্যুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে, এবং অভিযোগ করে যে অভিযুক্ত অমিত শাহর অনুকূলে রায় দেওয়ার জন্য তাঁকে ১০০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে চাওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় রচিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ তদন্তের আবেদনকে এক ক্ষুদ্র বিচারে পরিণত করে এবং বিচারপতি লোয়ার স্বাভাবিক কারণে মৃত্যু হওয়ার রায় দিয়ে আবেদনটিকে খারিজ করে দেয়। দিল্লী হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং ভারতের আইন কমিশনের পূর্বতন চেয়ারম্যান এ পি শাহ রায়টিকে “চূড়ান্ত ন্যায়বিরুদ্ধ এবং নানা দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ” বলে আখ্যায়িত করে ধিক্কার জানান।
আরেকটি যথেষ্ট গুরুত্বের রায় হল ভীমা কোরেগাঁও মামলার রায়, যাতে অভিযুক্ত ছিলেন সুপরিচিত মানবাধিকার কর্মীরা যাঁদের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সংগঠন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)র সদস্য হওয়া এবং ভীমা কোরেগাঁওতে হিংসা উস্কিয়ে তোলার অভিযোগ এনে ১৯৬৭ সালের অবৈধ কার্যকলাপ (নিরোধক) আইনে (ইউএপিএ) গ্রেফতার করা হয়েছিল। তথ্যপ্রমাণ অনির্ভরযোগ্য এবং সরকার পক্ষের বক্তব্য স্পষ্টতই সাজানো কাহিনী হওয়া সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা অভিযোগের তদন্তের জন্য বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের আর্জিকে প্রত্যাখ্যান করেন। ঐ বেঞ্চের বিরোধী মত পোষণকারী বিচারপতি চন্দ্রচূড় এই অভিমত পোষণ করেন যে, তখন পর্যন্ত যে তদন্ত চালানো হয়েছিল তা ছিল মনগড়া। এছাড়া, এই রায় ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক রাখতেও সহায়ক হয়েছে, আটকের পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার এখনও শুরুই হয়নি। বেশ কয়েকজন সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদকারীদের দীর্ঘ সময় ধরে জেলে আটক রাখার মধ্যে দিয়ে নাগরিক স্বাধীনতার সংকোচনও প্রতিপন্ন হচ্ছে।
বাবরি মসজিদ মামলায় সাংবিধানিক বেঞ্চ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে বাবরি মসজিদের ধ্বংস ছিল “আইনের শাসনের শোচনীয় লঙ্ঘন”; এ’সত্ত্বেও তারা মসজিদের জমিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতেই তুলে দিয়েছিল, তাদের সিদ্ধান্তে অবৈধ ধ্বংসের অপরাধজনক ক্রিয়ার তুলনায় অগ্রাধিকার পেয়েছিল তথাকথিত বিশ্বাস। সুপ্রিম কোর্ট মন্দির নির্মাণের জন্য সমস্ত জমিই দিয়ে দিয়েছে এবং সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে মসজিদ স্থানান্তরিত করার পরামর্শ দিয়েছে — এই ঘটনাটা তথ্য এবং ন্যায়ের নীতির চেয়ে বিশ্বাসের দাবির ওপরই বিশেষ অধিকার প্রদান করেছে, এবং এইভাবে সাম্প্রদায়িক প্রচারেও প্ররোচনা জুগিয়েছে।
অতিমারীর সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের সমর্থনে দাঁড়াতে সুপ্রিম কোর্টের ব্যর্থতা বিচারবিভাগের এক অগৌরবজনক মুহূর্ত হয়েই রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোপাল গৌড়া এটাকে “চরম ব্যর্থতা বলেই অভিহিত করেছেন”।
জাকিয়া জাফরি মামলায় ২০০২’র গুজরাটের সুপরিকল্পিত গণহত্যায় সিট’এর মোদীকে ক্লিনচিট দেওয়াটাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হলে সুপ্রিম কোর্ট তাকে খারিজ করায় সর্বোচ্চ আদালতের গায়ে আরও একবার কলঙ্কের কালি লাগে। সুপ্রিম কোর্ট জাকিয়া জাফরির যন্ত্রণাকে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগানোর অভিযোগেই শুধু তিস্তা শেতলবাদকে অভিযুক্ত করে না, তারা এও বলে যে, তিস্তা এবং অন্যান্য যারা গুজরাট পুলিশের দেওয়া ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেছে তারজন্য তাদের ‘বিচার করতে’ হবে। এই রায়ের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই গুজরাট সন্ত্রাস দমন স্কোয়াড তিস্তা শেতলবাদ, আর বি শ্রীকুমার এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে তাদের গ্রেপ্তার করে। সমাজ আন্দোলনের গান্ধীবাদী কর্মী হিমাংশু কুমার ছত্তিশগড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আদিবাসীদের হত্যায় নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিলেন, এবং সুপ্রিম কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার নিদান দেয়। সুপ্রিম কোর্ট অন্যায়ভাবে তাঁকে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করে যে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন এবং তাঁকে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়।
টাকা নয়ছয় প্রতিরোধ আইনের (পিএমএলএ) রায়ের মধ্যে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট নাগরিক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ অব্যাহত ভাবে চালিয়ে যায়, ঐ রায়ে সুপ্রিম কোর্ট পিএমএলএ’র বেশ কিছু দানবীয় সংস্থানে অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে জামিন লাভের দুটি পরীক্ষা যেগুলিকে অসাংবিধানিক বলে আগে খারিজ করা হয়েছিল; এরই সাথে প্রমাণ করার দায়কেও পাল্টে দেওয়া হয় এবং অভিযুক্তকে ইসিআইআর’এর প্রতিলিপি (যা এফআইআর’এর সমতুল্য) না দেওয়া-সহ এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের লাগামহীন ক্ষমতাকে মঞ্জুর করা হয় এবং জেরার সময় অভিযুক্তর কাছ থেকে আদায় করা বিবৃতিকে তথ্যপ্রমাণ রূপে ব্যবহারের অনুমোদনও দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য (ইডব্লিউএস) ১০ শতাংশের কোটাতে অনুমোদন দেওয়ার সুপ্রিম কোর্টের রায় উচ্চশ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের সংস্থান করেছে, ফলে অন্যান্য দুর্বল শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের সাংবিধানিক নীতি কার্যত যথেষ্ট লঘু হয়ে পড়েছে। সামাজিক দিক থেকে পশ্চাদপদ যে শ্রেণীগুলি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, সংরক্ষণ লাভ করার কোনও সুযোগ তাদের নেই। সুযোগ লাভের নির্ধারিত মানদণ্ডে মাসিক আয়কে করা হয়েছে ৬৭,০০০ টাকার কম যা নিপীড়িত সম্প্রদায়গুলির প্রকৃত দারিদ্রকে পরিহাসই করে।
এই রায়গুলো আদালতের মানসিকতার আভাস দিয়ে জানাচ্ছে যে, আদালত শাসক গোষ্ঠীর পছন্দের নীতিমালা ও রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রতি সহমত জ্ঞাপনই করছে।
সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়গুলোর কথা আমরা যেমন বলছি, তেমনি যে মামলাগুলোর বিচারকে এড়িয়ে চলা হয়েছে সেগুলোর কথাও আমাদের বলতে হবে, সাংবিধানিক আইনজীবী গৌতম ভাটিয়া যেগুলোকে বলেছেন ‘বিচারবিভাগীয় পরিহার’, যেগুলির ক্ষেত্রে সময়ের গুরুত্ব নিহিত থাকলেও সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয় যতক্ষণ না রাষ্ট্রীয় নীতি অবিসংবাদী বিষয় হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে একটা বিষয় হল মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরিধানের পুনর্বিবেচনা যাতে কর্নাটকের বিজেপি সরকারের মুসলিম মেয়ে শিক্ষার্থীদের হিজাব পরিধান নিষিদ্ধকরণকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে; সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনকে যা ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের ভিন্ন অধিকার প্রদান করে, ৩৭০ ধারা বাতিলকেও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে যার ভিত্তিতে পৈশাচিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে স্বায়ত্ত্বতা প্রদান ছাড়াই দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়, ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পকেও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে যে প্রকল্পের মাধ্যমে কর্পোরেট সংস্থাগুলো পরিচয় গোপন রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ জোগান দেয়; এছাড়া আরও অনেক মামলাকেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে আর বিজেপি অসাংবিধানিক পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে সুবিধা কুড়িয়ে চলেছে। বিমুদ্রাকরণের ক্ষেত্রে বিষয়টা নিছক কেতাবি আলোচনার বিষয় না হয়ে ওঠা পর্যন্ত আদালত তার গুণাগুণের বিচারে যায়নি, এবং বিচারের জন্য গ্ৰহণ করার পর আদালত গোটা প্রক্রিয়াটাতেই সমর্থন জানায়, এবং বিমুদ্রাকরণের ঘটানো বিপুল বিপর্যয়কে পুরোপুরি অবজ্ঞা করা হয়।
এত অজস্র মানুষ তাঁর চলে যাবার পর অশ্রু সজল কলমে তাঁকে প্রণতি জানিয়েছেন তার লেখাজোখা হয় না। সত্যিই আক্ষরিক অর্থেই তিনি কতশত বিষয়ে তাঁর স্বাক্ষর রেখে গেছেন, এই ছোট পরিসরে তা ধরার ক্ষমতাই এই প্রতিবেদকের নেই। প্রায় একানব্বই বছরের এই যুবক এই সেদিনও ৬ ডিসেম্বর, বাবরি ধংসের কালো দিনটিতে মেধা পাটকরের আহ্বানে হাজরা পার্কের সামনে শাসকদের প্রতি দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সাথে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছেন, দেশ বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও। আবার তিনিই গ্রেটা থুনবার্গের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বিশাল মিছিলে পা মিলিয়েছেন জলঙ্গী নদী বাঁচাতে কলকাতায়। প্রয়াত এই অক্লান্ত উদ্যমী নানা রঙের মানুষটি অন্ধকার সময়ে আমাদের বাতিঘর। তিনি আর কেউ নন। তিনি সমর বাগচী, বিহারের মুঙ্গেরে জন্মানো প্রতিবেশী সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোড়াই চরিত মানসের এক চরিত্র। যার প্রয়াণে চোখের জলে ভাসছে শহর কলকাতা। কী প্রখর ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি : এনএপিএম’এর পুরী সম্মেলন শেষ করে যখন ফিরে এলাম তখন তিনি জানতে চাইলেন কীরকম হোল? আমাদের এক সাথী পুরনো আমলের একটা গান গেয়ে উত্তর দিলেন ওয়াক্ত কি আওয়াজ হ্যায় মিল কে চলো। সঙ্গে সঙ্গে গানের গীতিকারের নাম বলে দিলেন। তাঁর অনেক কবিতা মুখস্ত শুনেছি। কবি অরুণ মিত্রের কবিতা ভালবাসতেন। উদাত্ত কণ্ঠে তিনি ধরলেন, বৃক্ষমূলে আমার গভীরতম কথা আমি রেখে দিয়েছি।
আরও পুরনো একটা গল্প বললে সমর বাগচীর চরিত্রের একটা দিক উন্মোচিত হবে। যখন তিনি বিড়লা মিউজিয়ামের অধিকর্তা ছিলেন, তখন একটা পেট লাইব্রেরী করেছিলেন, ছোটরা সেখান থেকে কিছু দিনের পোষ্য পশু-পাখি বাড়ি নিয়ে যেতে পারত। আবার মেয়াদ ফুরোলে ফেরৎ দিতে হতো। একবার এভাবে নেওয়া একটি বিরল প্রজাতির পাখি এক সদস্যের খাঁচা থেকে উড়ে যায়। বাচ্চাটির মা ও বাবা সারা কলকাতা চষে ফেলেও তেমন পাখি কিনতে না পেরে সমরবাবুর কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে জানতে চান কত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সমরবাবু বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করেন — ওকি উড়ে গেছে না তুমি উড়িয়ে দিয়েছো? ছেলেটি নিশ্চুপ হয়ে আছে দেখে উনি ওকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে জানতে চান, তুমি এ’কাজ কেন করলে? ছেলেটি বলে, ওর তো খাঁচায় খুব কষ্ট হতো! এই উত্তর শুনে সমরবাবু ওর মা বাবাকে এসে জানান, আপনাদের ক্ষতিপূরণ তো দিতে হবেই না, বরং এতোদিনে আমার এই প্রজেক্ট সফল হল। ছোটদের মধ্যে পশু-পাখিদের সম্পর্কে ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতেই তো এই লাইব্রেরী চালু করা!
এইরকম মানসিকতার একজন প্রাকৃতিক মানুষ যখন এই দুনিয়ার খাঁচা ছেড়ে উড়ে যান তখন কষ্ট হয় বৈকি!
ডঃ সমর বাগচী বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার বিষয়ে যত পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন তার বেশির ভাগ তিনি শুরু করেছিলেন মিউজিয়ামে থাকাকালিন। ১৯৬২ সালে তিনি যোগ দেন, ১৯৮৪ সালে অধিকর্তা হন এবং ১৯৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন সেখান থেকে। অবসর নেবার পর তাঁর কর্মকাণ্ড তীব্র গতি নেয়। বিজ্ঞানকে পড়ুয়াদের মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্য রাজ্যজুড়ে বিজ্ঞান মডেল প্রতিযোগিতা, অগুনতি সেমিনার ও বিজ্ঞান মেলায় তিনি সক্রিয় অংশ নিতেন। সারা রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে তিনি ছুটে বেরিয়েছেন। হাতেকলমে বিজ্ঞান নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। দূরদর্শনে কোয়েস্ট বলে অভিনব বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ তিনি সুত্রপাত করেন। তাঁর অনুরাগীরা এখনো এই প্রকল্প গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। একবার তাঁর সঙ্গে হঠাৎ দেখা শান্তিনিকেতনের অদূরে খঞ্জনপুর গ্রামে যেটা কোড়া বলে আদিবাসীদের গ্রাম। তাদের সঙ্গে কাজ করতেন রাহুল নামে এক উৎসাহী যুবক এবং তাঁর ইংরেজ স্ত্রী কার্স্টি। এখন এই কোড়ারা প্রায় সাঁওতালদের মতো একই ভাষায় কথা বলে। উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের সঙ্গে প্রায় একই ভাষায় কথা বলে। সাঁওতালদের কাছাকাছি আরও অনেক ভাষাগোষ্ঠী আছে যেমন হো, বীরহড়, মুন্ডা ইত্যাদি। এই সাদৃশ্যের বিষয়ে তিনি অপার আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন। রাহুল কার্স্টি দম্পতি ডঃ বাগচীর পরামর্শে স্থানীয়দের সাহায্যে অনেক পাঠ্য বই প্রকাশ করতেন। নিজেদের ভাষায় পাঠদানও করা হত। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য মৈত্রেয়ী দেবীর প্রতিষ্ঠিত সাঁওতাল মেয়েদের নিয়ে শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান খেলাঘর, কলকাতার অদূরে বাদুতে, এর কথা মনে পড়ে গেল। সেখান ডঃ বাগচী ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। কী অপূর্ব দক্ষতায় তারা রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নাচ, গান, নাটক পরিবেশন করে। যখন তাদের ভাষা নিয়ে কেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না বলা হয়েছিল, মনে আছে ডঃ বাগচী গভীর মনোযোগের সঙ্গে বিতর্কটি নিয়ে ভেবেছিলেন। পরে প্রতিবেদককে জানান। আগ্রহী পাঠক ইউটিউবে তাঁর অনেক হাতে কলমে কঠিন বিজ্ঞান শিক্ষার নমুনা দেখতে পাবেন।
এবার দর্শনে আসা যাক। মার্ক্স, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী ছিল তাঁর বিচরণ ভূমি। ফলে তিনি প্রগতি শিবিরেই ছিলেন। মানবাধিকারের পক্ষেই সবসময় কথা বলেছেন। নর্মদা আন্দোলন থেকেই তিনি তাঁর অনেক প্রেরণার সঞ্চার পেয়েছেন। ফলে সমাজকর্মী মেধা পাটকর এবং তাঁর সাথীরা ছিলেন তাঁর ন্যাচারাল মিত্র। বাংলার এনএপিএম’এর তিনি উপদেষ্টা ছিলেন। যদিও এককালে এখানেও সংগঠন যথেষ্ট মজবুত ছিল। ভবিষ্যতের ইতিহাস তাঁকে শুধু অপবিজ্ঞানের আবহে গণবিজ্ঞানের চেতনাবাহী নিবেদিত প্রাণ মানুষ বলেই মনে রাখবে তাই নয়। তিনি একটা যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর মধ্যে এক পথসেনাকে আমরা খুঁজে পাই যিনি জীবনের কর্মচাঞ্চল্যে বলিয়ান হয়ে আমাদের হাল না ছেড়ে কণ্ঠ ছাড়তে শিখিয়েছেন। তিনি বাংলার মাঠঘাট, পথ প্রান্তরে এক অশান্ত যুবকের মতো পদচারণা করেই চলবেন তাঁর জীবন ও কাজ চর্চার মধ্য দিয়ে। আপনার ভাঙ্গা পাঁজরে যত দুঃখ জমে আছে তার নিরাময় করবে আগামী সময়।
– অসিত টুডু
লুডভিগ যখন কলেজে পড়ত তখন তার এক বান্ধবী তাকে বলেছিল আশাবাদী তরুণেরা মার্কসবাদ থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে ক্রমশ সমৃদ্ধ করতে থাকে। লুডভিগ রসিকতা করে সেই বান্ধবীকে এর জবাবে লিখেছিল যে আশাবাদ মানবজাতিকে আফিমের নেশায় বুঁদ করে রাখে। ট্রটস্কি দীর্ঘজীবী হোন — এমন কথাও ছিল সেখানে। “Optimism is the opium of mankind! A healthy spirit stinks of stupidity! Long live Trotsky!” সেই বান্ধবীর থেকে এই কথাটা ক্রমশ নানা জায়গায় ছড়াল।
সেটা ১৯৫০’র দশক। বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮-এ চেকস্লোভাকিয়া এসেছে কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে। এই ধরনের রঙ্গতামাসা কর্তৃপক্ষ খুব একটা পছন্দ করলেন না। তারা লুডভিগকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তো তাড়ালেনই। তাড়িয়ে দিলেন কলেজ থেকেও। লুডভিগকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে হল। যেতে হল লেবার ক্যাম্পে। খনিতে কঠোর পরিশ্রমের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল।
অনেক বছর পরে লুডভিগ মোরাভিয়াতে ফেরে। তার নিজের শহরে। ততদিনে সে সফল এক বিজ্ঞানী। যদিও অতীতের নানা অভিজ্ঞতায় তার মন তিক্ত। এক রসিকতার জন্য তার তারুণ্যের দিনগুলো কীভাবে তিক্ত হয়ে গিয়েছিল সেটা সে ভুলতে পারে না। জেমেনেক বলে যে তাকে পার্টি-বিরোধী অবস্থানের জন্য দেওয়া শাস্তির অন্যতম হোতা ছিল, তাকে লুডভিগ নানাভাবে শাস্তি দিতে চায়। জেমেনেকের স্ত্রী হেলেনার সঙ্গে সে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে, তাকে জেমেনেকের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু জেমেনেকের কাছে এটা শাস্তি না হয়ে সুবিধে হিসেবে দেখা দেয়। হেলেনা ডিভোর্স নিয়ে নেওয়ায় সে তার প্রেমিকার সঙ্গে নির্বিঘ্নে দিনযাপন শুরু করে।
১৯৬৫ সালেই লুডভিগ বলে চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে মিলান কুন্দেরা তাঁর ‘দ্য জোক’ উপন্যাসটি লিখে ফেলেছিলেন। তবে রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপের আওতায় তা তখন প্রকাশিত হয়নি। ১৯৬৭ সালে সেটি প্রকাশিত হল। অনতি পরেই অবশ্য সেটি আবার নিষিদ্ধ হয়ে যায় চেকস্লোভাকিয়ায়। পরবর্তীকালে মিলান কুন্দেরাকে দেশও ছাড়তে হয়। আশ্রয় নিতে হয় প্যারিসে। আমৃত্যু সেটাই ছিল তাঁর শহর। একসময় তিনি চেক ভাষায় লেখালিখিও ছেড়ে দেন। লেখার ভাষা হিসেবে বেছে নেন ফরাসী।
চেক কমিউনিজম ও কুন্দেরার সম্পর্ক নানা পর্বে ওঠানামা করেছে। যে কুন্দেরা কমিউনিস্টরা চেকস্লোভাকিয়ায় ক্ষমতায় আসার আগেই নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ, কমিউনিস্টদের চেকস্লোভাকিয়ার ক্ষমতা দখলের লড়াইতে ছিলেন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী, তিনি অচিরেই এর বিরোধী হয়ে উঠলেন। এতটাই কড়া সমালোচনা শুরু করলেন কমিউনিস্ট পার্টির, যে ১৯৫০ সালেই তাঁকে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হতে হল। ১৯৫৬ সালে আবার তাঁকে পার্টিতে ফেরানো হল। ১৯৬৭-৬৮’র পালাবদলের সময়ে তিনি হয়ে উঠলেন পার্টির এক প্রধান বুদ্ধিজীবী লেখক। তৎকালীন সংস্কার কর্মসূচির পক্ষে চলল তাঁর সওয়াল ও লেখালিখি। কিন্তু সংস্কারকে আবার আটকানো হল, কুন্দেরাও চলে গেলেন কালো তালিকায়। তাঁকে আবার কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হতে হল। নিষিদ্ধ হল তাঁর উপন্যাসও। এর কেন্দ্রে থাকল ১৯৬৮-র প্রাগ বসন্ত। প্রাগ বসন্তের ইতিহাস বাদ দিয়ে কুন্দেরা, তাঁর লেখালিখি পড়াই সম্ভব নয়। বোঝা সম্ভব নয় কুন্দেরার রাজনৈতিক দর্শনকেও।
প্রাগ বসন্তর সময়কালটা ১৯৬৮। ১৯৬৮ সালের ৫ জানুয়ারি চেক কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে নোভৎনিনের স্থলাভিষিক্ত হলেন দুবচেক। চেকস্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি বেছে নিলেন লুদভিক সাবোদাকে। প্রাগ বসন্তের মূল কারিগর এই দুবচেকই। এই সময়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দুবচেক নোভৎনিনের অনেক নীতির বিরুদ্ধে খোলাখুলি কথা বললেন। নীতি বদলের কথা বলে তরুণ সমাজকে স্বপ্ন দেখালেন গণতন্ত্র আর খোলা বাজার অর্থনীতির। নতুন চেকস্লোভাক সরকার বেশ কিছু নীতি পরিবর্তনের দিকে হাঁটার কথা বলল। এর নাম দেওয়া হল ‘মানবিক মুখের সমাজতন্ত্র’, ‘সোশ্যালিজম উইথ এ হিউম্যান ফেস’। এই নীতিমালার মধ্যে থাকল সংবাদমাধ্যমের আরো অনেক বেশি স্বাধীনতার কথা। থাকল বাক স্বাধীনতার কথা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকারের কথা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কথা বলা হল। তার অন্যতম ভোগ্যপণ্য তৈরির ক্ষেত্রে জোর বাড়ানো। চেক ও স্লোভাক — চেকস্লোভাকিয়ার দুই অংশকে সায়ত্তশাসন দেবার নীতিও গৃহীত হয়।
নীতি বদলের যে দিকটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তৈরি হয় তা হল আগামী দশ বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে কিছু পরিবর্তন এনে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও নির্বাচনের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নির্বাচন আর হয়নি চেকস্লোভাকিয়ায়। কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলি রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে পারেনি। দুবচেকের আমলে একদিকে যেমন সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা এল, নানা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনা শুরু করতে শুরু করল অপেক্ষাকৃত স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলি, তেমনি ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি — এদেরও পুনরুত্থানের ইঙ্গিৎ দেখা গেল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার বন্ধুরাষ্ট্রগুলি চেকস্লোভাকিয়ার এইসব পরিবর্তন, বিশেষ করে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কথাবার্তাকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখল। চেকস্লাভ সংবাদমাধ্যম নতুন পরিস্থিতিতে যে ধরনের লেখালিখি করছে তার উসকানিতে ১৯৫৬’র অক্টোবর নভেম্বরে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত প্রভাবাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করে যেমন হয়েছিল, তেমন ধরনের ‘প্রতিবিপ্লবের পরিস্থিতি’ তৈরি হতে পারে ভেবেও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান থেকে চেক সমাজতন্ত্রকে রক্ষা করার কথা বলে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশভুক্ত জোটের সেনাবাহিনী চেক প্রজাতন্ত্রে পৌঁছলো ২০ অগস্ট ১৯৬৮’র মধ্যরাতে। সেনার সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখেরও বেশি। সঙ্গে কামান, ট্যাঙ্ক, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। পরের দিনই সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সেনা চেক কমিউনিস্ট পার্টির সদর দফতর সহ প্রাগ শহরের দখল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল। চেক রেডিওতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব জনগণকে সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে কোনও আগ্রাসী নীতি না নিয়ে শান্ত থাকার পরামর্শ দিলেন। দুবচেক গ্রেপ্তার হলেন। তাঁকে মস্কোয় নিয়ে আসা হল। সোভিয়েতের দেওয়া মস্কো প্রোটোকলের সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে সইসাবুদ করার পরেই তিনি ফিরতে পারলেন চেকস্লোভাকিয়ায়। এরপরের কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার দুবচেককে মস্কোয় হাজিরা দিতে হয়েছে। সোভিয়েত নেতৃত্ব না খুশি হতে পারছিলেন দুবচেক সরকারের ওপর, না তাঁদের ওপর আস্থা রাখতে পারছিলেন। দুবচেকের পক্ষেও পরিস্থিতি ছিল বেশ কঠিন। একদিকে পুরনো পথে চলার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরন্তর চাপ, অন্যদিকে দেশের ভেতরে পুরনো কট্টরপন্থী ও নতুন পরিবর্তন পন্থীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। এসবের মাঝে সমাধানসূত্র বের করা দুবচেকের পক্ষে ক্রমেই অসম্ভব হতে থাকে। ১৯৬৯’র এপ্রিলে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকের পদ থেকে দুবচেক পদত্যাগ করেন। নতুন সম্পাদক হন গুস্তাভ হুসাক। সোভিয়েত চাপের কাছে নত হয়ে হুসাকের নেতৃত্বে চেকস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকার প্রাগ বসন্তের ঘোষণাগুলি থেকে সরে এসে প্রাক-দুবচেক আমলের নীতিতে চলতে শুরু করে।
প্রাগ বসন্তের দিনকাল নিয়ে কুন্দেরা ১৯৮২ সালে লেখেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’। এর প্রধান চরিত্র পাত্ররা হল টমাস, তার স্ত্রী টেরেজা, টমাসের প্রেয়সী সাবিনা, সাবিনার আর এক প্রেমিক ফ্রানজ। শুধু এই চরিত্র পরিচয়গুলো থেকেই আঁচ করা যায় বিবাহ সম্পর্কের বাইরের খোলামেলা দিকটি এই উপন্যাসে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। প্রধান চরিত্র টমাস সত্যিই মনে করে স্ত্রী টেরেজার প্রতি তার ভালোবাসা এবং অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে শরীরী সম্পর্ক তৈরি করার মধ্যে কোনও স্ববিরোধ নেই। দুটিই একইসঙ্গে সম্ভব। টেরেজাও স্বামীর বহুগামিতার কথা জানে। সে এই বহুগামিতার জন্য চিন্তিত নয়। তার শুধু ভয় সেও না স্বামীর কাছে ভালোবাসার মানুষের বদলে কোনওদিন শুধু এক নারী শরীর হয়ে ওঠে। উপন্যাসের আর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সাবিনা একইসঙ্গে ভালোবাসে টমাস এবং ফ্রানজকে। সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নীতিমালার গণ্ডীকে সে কিছুতেই মানতে রাজি নয়। কমিউনিস্ট অনুশাসনের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদের ভাষাকে সে রূপ দেয় তার আঁকা ছবিতে। অন্যদিকে টেরেজাও প্রাগ বসন্তের দিনগুলিতে ঝুঁকি নিয়ে চিত্র সাংবাদিকতার কাজ করে যায়। ক্যামেরায় ধরে রাখে সোভিয়েত সেনার আগ্রাসনের মুহূর্তগুলো। উপন্যাসের আর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ফ্রানজ লেখালিখি এবং পড়াশুনোর জগতের লোক। কিন্তু সমাজ রাষ্ট্রের ক্ষতচিহ্নগুলোর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে সে প্রতিবাদ করে। তা সে দেশের ভেতরেই হোক বা বাইরে। ব্যাঙ্ককে এমন এক পরিস্থিতিতেই সে প্রাণাত্মক আঘাত পায়।
উপন্যাসের নায়ক টমাস পেশায় একজন শল্য চিকিৎসক। প্রাগ বসন্তের পরিপ্রেক্ষিতে চেকস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ গোষ্ঠীর সেনাবাহিনী হানা দিলে সে তার স্ত্রী টেরেজাকে নিয়ে সুইজারল্যাণ্ডের রাজধানী জুরিখে চলে যায়। টেরেজা অবশ্য বিদেশের পরিবেশে ক্লান্তিবোধ করতে থাকে ও ফিরে আসে প্রাগে। কিছুদিন পর টমাস দেখে স্ত্রীকে ছেড়ে তারও প্রবাসে ভালো লাগছে না। সেও প্রাগে ফেরে। ততদিনে প্রাগ বসন্তের সমাপ্তি ঘটেছে। দুবচেক’দের বদলে শুরু হয়েছে গুস্তাভ হুসাকের জমানা। এসেছে কঠোর দমনমূলক ব্যাটন আইন। চলছে পার্টি সদস্যদের গণহারে বহিষ্কার। সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দেশিকায় ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলছে প্রাগের চেকস্লোভাক সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টি। এই অবস্থায় প্রাগের জীবন অসহ্য বোধ করে প্রাগ ছেড়ে চেকস্লোভাকিয়ার গ্রামাঞ্চলেই চলে যান টমাস টেরিজা দম্পতি। সেখানে তারা সুখের অন্য মানে খুঁজে পান। টমাস বেরিয়ে আসেন এক নারী থেকে অন্য নারীতে শরীরী গমনের অভ্যাস থেকে।
এই উপন্যাসের পরিণতি অংশ পড়তে পড়তে আমাদের কৌতূহল তৈরি হয় এই নিয়ে যে অভিবাসী জীবনে কুন্দেরা নিজেও কি যন্ত্রণাদগ্ধ ছিলেন? তাঁর উপন্যাসের নায়ক নায়িকা টমাস টেরিজার মতো? এই জল্পনা আরো বাড়ে যখন ২০০০ সালে সত্তর পেরনো অভিবাসী কুন্দেরা লেখেন তাঁর ইগনোরেন্স উপন্যাসটি। উপন্যাসটির কেন্দ্রে আছে আটষট্টির প্রাগ বসন্তের সময় চেকস্লোভাকিয়া থেকে দেশান্তরী হওয়া দু’জন মানুষ। আছে তাঁদের নতুন করে জীবনকে দেখা, আছে ফেলে আসা জীবনের জন্য মায়া ও যন্ত্রণা। কিন্তু উপন্যাসে অভিবাসী জীবনের যে যন্ত্রণাই থাকুক না কেন, বাস্তবে কুন্দেরা যে এর দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন, এমন কোনও প্রমাণ নেই। তিনি আজীবন প্যারিসেই থেকে গেলেন। এমনকী নব্বইয়ে সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য সব দেশের মতো যখন চেকস্লোভাকিয়াতেও কমিউনিস্ট জমানার অবসান হল, তখনও তিনি ফিরলেন না দেশে। শুধু তাই নয় লেখালিখির ভাষা হিসেবেও ত্যাগ করলেন মাতৃভাষা চেককে। শেষদিকে লিখে গেলেন কেবল ফরাসীতে।
ইউরো আমেরিকান দুনিয়া ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কালে সব সময়েই কমিউনিস্ট দেশগুলির সেইসব মানুষজনকে আলোকবৃত্তে আনতে চেয়েছে যাঁরা কমিউনিস্ট জমানায় গণতন্ত্রের অভাব নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। বরিস পাস্তেরনাক, আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন, মিখাইল বুলগাকভ, ইসমাইল কাদারে, দানিলো কিশ, চেসোয়াভ মিউজদের এই তালিকার অন্যতম প্রধান নাম অবশ্যই মিলান কুন্দেরা। নিঃসন্দেহে তাঁর ঔপন্যাসিক দক্ষতা অসামান্য। যে সোভিয়েত আগ্রাসন ও প্রাগ বসন্তের দমন নিয়ে তিনি কথা বলেন, তাও কমিউনিস্ট জমানার প্রবল সমালোচনাযোগ্য দিক। কিন্তু কুন্দেরা কখনো তথাকথিত পশ্চিমী উদার গণতন্ত্রের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র নিয়ে, ইউরো মার্কিন ন্যাটো অক্ষ নিয়ে সমালোচনামুখর হননি — এই আক্ষেপ আমাদের থেকেই যায়।
- সৌভিক ঘোষাল