আমরা, নিম্ন স্বাক্ষরিত ২৬টি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব, আমাদের সংবিধানে বিধৃত ভারতের ধারণাকে রক্ষা করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করছি। আমাদের সাধারণতন্ত্রের চরিত্রের ওপর বিজেপি সুব্যবস্থিত ভাবে মারাত্মক আক্রমণ হানছে। আমরা আমাদের জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। ভারতের সংবিধানের ভিত্তি-স্তম্ভগুলিকে — ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, সামাজিক ন্যায় ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে — পদ্ধতিবদ্ধ ও ভয়ানকভাবে খর্ব করা হচ্ছে।
যে মানবতা সংকট আজ মণিপুরকে ধ্বংস করে দিচ্ছে আমরা তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা আঘাতপ্রদ ও নজিরবিহীন। মণিপুরকে আবার শান্তি ও মিলনের পথে ফেরানো আশু ও জরুরি কর্তব্য।
সংবিধান এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির সাংবিধানিক অধিকারের ওপর যে লাগাতার হামলা চলছে তার মোকাবিলা করার জন্য আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের শাসনব্যবস্থার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটিকে দুর্বল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপচেষ্টা চলছে। অ-বিজেপি দল শাসিত রাজ্যগুলিতে গভর্নর ও লেফটেনান্ট গভর্নরের ভূমিকা যাবতীয় সাংবিধানিক নিয়মনীতিকে লঙ্ঘন করেছে। বিভিন্ন এজেন্সিগুলিকে বিজেপি যেরকম নির্লজ্জের মতো অপব্যবহার করছে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে তা আমাদের গণতন্ত্রকে খাটো করে দিচ্ছে। অ-বিজেপি দল শাসিত রাজ্যগুলির আইনসঙ্গত বৈধ চাহিদা, জরুরি প্রয়োজন ও ন্যায্য প্রাপ্যগুলিকে কেন্দ্র উঠেপড়ে লেগে নাকচ করে দিচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চির-বর্ধমান মূল্য আর রেকর্ড মাত্রার বেকারত্বের যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে তাকে মোকাবিলা করতে আমাদের অঙ্গীকার পুনরায় জোরালো করছি আমরা। বিমুদ্রাকরণ এমএসএমই ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে অবর্ণনীয় দুর্দশা এনেছিল যা আমাদের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক মাত্রার বেকারত্ব তৈরি করে। জাতির সম্পদকে বিশেষ সুবিধাভোগী বন্ধুদের কাছে বেপরোয়াভাবে বেচে দেওয়ার বিরোধিতা করি আমরা। শক্তিশালী ও রণনৈতিক গুরুত্ববহ সরকারি ক্ষেত্র এবং তার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক ও বৃদ্ধিশীল বেসরকারি ক্ষেত্র যেখানে উদ্যমী সংস্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রসারের সমস্ত সুযোগ তৈরি করা হবে — এই নিয়ে এক ন্যায়সঙ্গত অর্থনীতি আমাদের গড়ে তুলতেই হবে। সর্বদা কৃষক ও খেতমজুরের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আমরা একসাথে এসেছি — সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা ও সহিংসতা উৎপন্ন করা হচ্ছে তাকে পরাস্ত করতে; মহিলা, দলিত, আদিবাসী এবং কাশ্মীরী পণ্ডিতদের ওপর বেড়ে চলা নানান অপরাধকে বন্ধ করতে; সমস্ত রকম সামাজিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের যথাযোগ্য শুনানির দাবিতে; এবং, প্রথম ধাপ হিসেবে, কাস্ট সেন্সাস লাগু করতে।
আমাদের সহ-ভারতীয়দের টার্গেট করে দমন ও উৎপীড়ন চালানোর যে ব্যবস্থাগত ষড়যন্ত্র বিজেপি চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার নিচ্ছি আমরা। যারাই শাসকদল ও তার বিভেদকামী মতাদর্শের বিরোধী অবস্থান নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই ওদের বিষাক্ত ঘৃণা অভিযান মারাত্মক হিংসার দিকে দেশকে নিয়ে গেছে। এই আক্রমণ যে কেবল সাংবিধানিক অধিকার ও স্বাধীনতাকেই লঙ্ঘন করছে তা নয়, ভারতীয় সাধারণতন্ত্র যে বুনিয়াদি মূল্যবোধগুলির ওপর দাঁড়িয়ে আছে — সমতা, স্বাধীনতা ও সংহতি এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় — সেগুলিকেই ক্ষয় করে দিচ্ছে। ভারতীয় ইতিহাসকে নতুন নতুন উদ্ভাবন আর নতুন করে লেখার মধ্যে দিয়ে বিজেপি যেভাবে বারংবার গণচর্চাকে বিষিয়ে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে তা দেশের সামাজিক সদ্ভাবনার চরম অপমান।
আমরা জাতির সামনে এক বিকল্প রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক এজেণ্ডা হাজির করার অঙ্গীকার করছি। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি শাসনকার্যের ধরন ও অন্তর্বস্তু উভয়কেই বদলে দেওয়ার, যা হবে আরও মতামতভিত্তিক, গণতান্ত্রিক এবং সহভাগী।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (আইএনসি),
অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি),
দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগম (ডিএমকে),
আম আদমি পার্টি (এএপি),
জনতা দল (ইউনাইটেড),
রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি),
ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম),
জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) - শরদ পাওয়ার গোষ্ঠী,
শিবসেনা (ইউবিটি),
সমাজবাদী পার্টি (এসপি),
রাষ্ট্রীয় লোক দল (আরএলডি),
আপনা দল (কামেরওয়াড়ি),
জম্মু ও কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি),
পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি),
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী),
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই),
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন,
বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল (আরএসপি),
অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক,
মারুমালারচি দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগাম (এমডিএমকে),
বিড়ুথালাই চিরুথাইগাল কাচি (ভিসিকে),
কোঙ্গুনাডু মাক্কাল দেশিয়া কাচি (কেএমডিকে),
মানিথানেয়া মক্কাল কাচি (এমএমকে),
ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ (আইইউএমএল),
কেরালা কংগ্রেস (এম),
কেরালা কংগ্রেস (জোসেফ)
বেঙ্গালুরুতে বিরোধী দলগুলির দ্বিতীয় সফল মন্ত্রণাসভা ও INDIA আদ্যাক্ষরনামে এক নতুন জোটের উদয় স্পষ্টতই মোদী শাসনকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ওই একই দিনে দিল্লীতে একটা পাল্টা ‘জোট’-এর ছবি খাড়া করার মরিয়া প্রচেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন কোণ থেকে নতুন নতুন দল আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করাটা এই শাসনের বাড়তে থাকা স্নায়ুচাপকে দেখিয়ে দিচ্ছে।
আগামী ৫০ বছর ধরে অপরাজেয়ভাবে ভারত শাসন করার বিজেপির আত্মম্ভরি হুঙ্কার এক লহমায় চুপসে গেল। বছর খানেক আগে পাটনায় জেপি নাড্ডার সেই দম্ভভরা মন্তব্য মনে আছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে ভারতের আঞ্চলিক দলগুলির দিন ফুরিয়েছে? এ’বছর ৯ ফেব্রুয়ারি রাজ্যসভায় নরেন্দ্র মোদীর সেই ‘এক একেলা’ দম্ভ মনে আছে, যখন তিনি বলেছিলেন যে এই দেশের বহু মানুষের সম্মিলিত শক্তির থেকেও একটা ব্যক্তি অনেক বেশি ওজনদার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে?
আত্মম্ভরী ক্ষমতা-মদমত্ত বিজেপি আজ মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে সুপ্তলুপ্ত NDA ব্যানারকে ২০২৪’র নির্বাচনের আগে আবার জাগিয়ে তোলার। এদের আত্মম্ভরিতা শিবসেনা, আকালি দল বা জেডিইউ’র মতো বেশ কিছু প্রাক্তন দীর্ঘকালীন জোটসঙ্গীকে বিজেপির সাথে সম্পর্কে ত্যাগে বাধ্য করেছে। সেই বিজেপিই এখন এই দলগুলিকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং সেই ছররা গোষ্ঠিগুলিকে নিজেদের জোটসঙ্গী হিসেবে মানিয়ে নিচ্ছে। রামবিলাস পাসোয়ানের প্রয়াণের পর এরা এলজেপি পার্টিটাকে ভাঙ্গার কারিগরি করেছে, আর এখন পূর্বতন একক দলটির দুই টুকরোকে নিয়ে দুইটি নতুন জোটসঙ্গী পাওয়ার অঙ্ক খেলছে!
আতঙ্কিত মোদী শিবির এখন ইণ্ডিয়াকে ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাইছে। এটা করে সে ভারতের সংবিধানের প্রতি তার অবজ্ঞাকে আরও একবার প্রকাশিত করে দিল। “ইণ্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত, শ্যাল বি আ ইউনিয়ন অব স্টেটস”, বলেছে ভারতের সংবিধানের একদম শুরুর লাইনটাই। মোদী সরকার ইণ্ডিয়া ও ভারতের মধ্যে গজাল ঠুকে দিতে চায় এবং ভারতের রাজ্যগুলিকে এক অতিকেন্দ্রীক ইউনিয়ন গভর্মেন্টের উপনিবেশের দশায় নামিয়ে আনতে চায়।
শাসনকার্যের কেবল একটিই মডেল জানে মোদী সরকার। ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে, ভারতের গণতন্ত্রের সাংবিধানিক বনিয়াদ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে, তার সামাজিক বুনটের বৈচিত্র্য ও সমন্বিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, ভারতের নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং ভারতের কোটি কোটি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অস্তিত্ব ও মর্যাদার বিরুদ্ধে এক নিরন্তর যুদ্ধ না চালিয়ে মোদী মডেলের শাসনকার্য চলে না। এই বিপর্যয়কে, যে বিপর্যয় সম্পর্কে ডক্টর আম্বেদকর সংবিধান গৃহিত হওয়ার সময়েই সতর্ক করে গেছিলেন, মোকাবিলা করতে ভারতকে তার সমস্ত শক্তিকে ডাক পাঠাতে হবে। সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্রের সাংবিধানিক দিশাকে অবশ্যই জীবন্ত রাখতে হবে সর্বব্যাপী নৈরাজ্য ও সঙ্কটের দুঃস্বপ্নের ঊর্ধ্বে যে দুঃস্বপ্ন আজ মোদী জমানা দেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
পাটনা ও বেঙ্গালুরুর বার্তা ভারতের প্রতিটি কোণে প্রতিটি প্রান্তে সমস্ত মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আসন্ন নির্বাচন লড়তে হবে বিজেপিকে পরাস্ত করার এক শক্তিশালী জনআন্দোলন রূপে। যুদ্ধটা সবে শুরু হয়েছে। আমরা লড়ব! আমরা জিতব।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ক্রমেই বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছচ্ছে। ৩ জুলাই ২০২৩ থেকে যে সপ্তাহটা শুরু হয়, সেই সপ্তাহে ভিন্ন ভিন্ন তিন দিনে বৈশ্বিক তাপমাত্রার দৈনিক গড় এতো বেশি ছিল, যে আজ পর্যন্ত তা বিশ্বে কখনও দেখা যায়নি। এই প্রথম, ৩ জুলাই ২০২৩, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি পার করল — যবে থেকে তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরু হয়, তবে থেকে এই তাপমাত্রা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি! আরও চিন্তায় ফেলে ঠিক তার পরের দিন মঙ্গলবার, ৪ জুলাই’এ এই তাপমাত্রা আরও বাড়ল। আর ঠিক একদিন পর, বৃহষ্পতিবার, ৬ জুলাই বৈশ্বিক তাপমাত্রা ছুঁলো তার সর্বোচ্চ শিখরে। এক প্রবীন আবহাওয়া বিজ্ঞানী বলেছেন, “বি
গত ১ লক্ষ বছরের মধ্যে এই তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ”।
অনেক বিজ্ঞানী বেশ কয়েক বছর যাবত লাগাতার বৈশ্বিক উষ্ণায়নের যে বিপদের সংকেত দিয়ে আসছিলেন, এবার তার সাক্ষাৎ প্রমাণ মিলল। এই বছরটি যে উষ্ণতম বছর হবে, তার পূর্বাভাস আগে থেকেই ছিল। কিন্তু গোটা বিশ্ব যে এত দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে তা আগে কল্পনাও করা যায়নি। এই উষ্ণায়নের হাত ধরে আবির্ভূত এল নিনো বর্তমান আবহাওয়া সংকটকে আরও গতি প্রদান করে আরও বেশি উষ্ণ করে তুলেছে। অতিবৃষ্টি, মাঝে মধ্যেই দু’কূল প্লাবী বন্যা ও তীব্র খরা, বিধ্বংসী অরণ্য ধ্বংসকারী দাবানল, বিশ্বের নানা প্রান্তে একই সময়ে ঘটে চলেছে। সাময়িক কিছু পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ঠ সরকারগুলো নিচ্ছে বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী কোনো পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও দক্ষিণাঞ্চল এই জুন মাসে তীব্রতম তাপপ্রবাহ ও তার সাথে আদ্রতার কবলে পড়ে। ক্রমে বেড়ে চলা তাপমাত্রায় মেক্সিকোতে মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ১১২ জন মানুষের মৃত্যু হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবল বৃষ্টিতে বহু মানুষের মৃত্যু হল। চীনও তীব্রতম দাবদাহের শিকার হয়, সবচেয়ে বেশি দগ্ধ দিনের সম্মুখীন হল চীন, এ’বছরে। ১৮৮৪ থেকে যুক্তরাজ্য তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা শুরু করে। দেখা যাচ্ছে, আগেকার গড় তাপমাত্রা ০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে টপকে গিয়ে এই জুন মাসে তাপমাত্রার গড় হল ১৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে, রাজধানী দিল্লী বন্যার কবলে। ঘুমিয়ে থাকা যমুনা পঁয়তাল্লিশ বছরের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে বিপদসীমার তিন মিটার ওপর দিয়ে বইছে। মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন, লালকেল্লা, সুপ্রিম কোর্ট জলমগ্ন। সমস্ত স্কুল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। বিভিন্ন অফিস বাড়ি থেকে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। হিমাচল ও উত্তরাখন্ডে বৃষ্টি জনিত বিপর্যয় যে মাত্রায় গেছে তা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। হিমাচলের বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের পেশ করা তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২২’র মধ্যে প্রায় দু’হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন শুধুমাত্র বৃষ্টি বিপর্যয়ের কারণে। আমরা ভুলে যাইনি, বেশ কয়েকমাসে তুমুল বৃষ্টিতে ভারতের সিলিকন ভ্যালি হিসাবে পরিচিত বেঙ্গালুরুর অশেষ দুর্ভোগের কথা। অতিবৃষ্টিতে জলমগ্ন শহরের উচ্চবিত্ত আবাসনগুলোর বাসিন্দাদের আশ্রয় নিতে হয়েছিল হোটেলে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অতি মুনাফা লাভের আশায় উন্মত্তের মতো যত্রতত্র বহুতল নির্মাণ, নিকাশী ব্যবস্থার প্রতি বিন্দুমাত্র নজর না দেওয়া — আজ এনে দাঁড় করিয়েছে ধ্বংসের কিনারে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভোপালে বুথস্তরের বিজেপি কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। সেখানে তিনি অভিন্ন দেওয়ানী বিধি নিয়ে শোরগোলের মাত্রাটা সবে চড়িয়েছেন — ঐ রাজ্য থেকেই এক ভিডিও ‘ভাইরাল’ হয়ে উঠল যেখানে ক্ষমতা-মত্ত এক বিজেপি যুবনেতা প্রভেশ শুক্লাকে এক আদিবাসী শ্রমিক দশমত রাওয়াতের গায়ে মূত্রত্যাগ করতে দেখা যাচ্ছে। এই ভিডিওটি আসলে প্রায় দু’দশক ধরে বিজেপি রাজত্বে থাকা মধ্যপ্রদেশের মাটিতে কী ধরনের (অ)সভ্য বিধি চালু রয়েছে তারই এক কুৎসিত কদর্য প্রতিচ্ছবি! পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের প্রায় সবকটি বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই প্রান্তিক করে তোলা এবং নিপীড়িত সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি এই ধরনের বর্বর নিষ্ঠুরতা চলে অবাধে, বিনা শাস্তিতে — এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। মনুস্মৃতিতে জাতি ও লিঙ্গবৈষম্য ও হিংসার চরম নমুনাগুলোর সামাজিক অনুমোদন আছে, আর সঙ্ঘ বাহিনী তো এটিকেই তাদের আসল সংবিধানের মান্যতা দেয়।
তফসিলী জাতি ও উপজাতি (নির্যাতন প্রতিরোধ) আইন, ১৯৮৯তে জাতি হিংসার এই কুৎসিত সমাজ বাস্তবতার কথা মেনে নিয়ে তার নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোরতর আইনি সংস্থানের কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি ও তার আক্রমণাত্মক হিন্দুত্বের রাজনীতির উত্থানের পর, এই আইনটি তার কার্যকারিতা হারিয়েছে শুধু তাই নয়, এটিকে আরও লঘু, এমনকি বাতিল করার জন্য চেঁচামেচি ক্রমশ বাড়ছে। একই সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিদ্বেষমূলক অপরাধ বিরাটভাবে বেড়ে গেছে। মোদী জমানায় সামাজিক পরিসরে বিকেন্দ্রীকৃত ব্যক্তিগত হিংস্রতার এক নয়া নমুনা হিসেবে ভীড়হিংসার উদ্ভব হয়েছে। আর বুলডোজার হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের, বিচারবিভাগের পরোয়া না করে প্রতিহিংসা ও সন্ত্রাসমূলক কাজের চরিতার্থ তার এক নয়া প্রতীক। সাম্প্রদায়িক হিংসা, জাতিগত উৎপীড়ন এবং লিঙ্গ হিংসা যেন একে অন্যের ‘প্ররোচনা’ হয়ে যুগপৎ বেড়ে চলেছে। প্রভাবশালী মিডিয়া কিন্তু প্রায়ই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে অপরাধকে লঘু করে দেখিয়ে, এমনকি তাকে বৈধতা পর্যন্ত দিয়ে কার্যত এইসব দুষ্কর্মের সহযোগী হয়ে উঠছে।
সামনেই নির্বাচন আর মধ্যপ্রদেশ নির্বাচনে আদিবাসী ভোটের যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে, তাই শিবরাজ সিং চৌহান সরকার মরিয়া হয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করছে। মুখ্যমন্ত্রী এক ‘প্রায়শ্চিত্ত’ ভিডিও প্রচার করেছেন যেখানে তাকে দেখা যাচ্ছে এক অনুষ্ঠানে তিনি দশমত রাওয়াতের পা ধুইয়ে দিচ্ছেন, তাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ওদিকে প্রভেশ শুক্লার বাড়ির একাংশ ভাঙার জন্য বুলডোজার পাঠানো হল এবং আরেকটি প্রচারিত ভিডিও’তে দেখানো হয়েছে, পুলিশ ভ্যানে প্রভেশকে তাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। যদি (অত্যাচারের) ভিডিও’টি ভাইরাল না হত এবং নির্বাচন আসন্ন না হত, এসব কিছুই ঘটতো না — এটা একদম পরিষ্কার। এটাও পরিষ্কার — প্রচারে আসা প্রতিটি ঘটনা পিছু এরকম আরও অন্তত এক ডজন ঘটনা ঘটে গেছে যা কখনও গ্রাহ্যই করা হয়নি। এমনকি ভীত সন্ত্রস্ত দশমতকে তার ওপর অত্যাচারকারী প্রভেশকে ‘ক্ষমা’ করার আবেদন জানাতে দেখা গেলেও, ভাইরাল হওয়া আরেকটি নতুন ভিডিও’তে ইন্দোরে দুই আদিবাসী তরুণের ওপর নৃশংস অত্যাচার হতে দেখা গেছে।
সামাজিক বৈষম্য আর অত্যাচার, ঘৃণা ও হিংসা এবং উৎপীড়নকারীদের রাজনৈতিক মদত ও সব অপরাধ থেকে অব্যাহতি যেখানে অবাধে চলে, একমাত্র যদি না মধ্যপ্রদেশের প্রাসঙ্গিক উপাখ্যানে প্রভেশ শুক্লার মতো কোনো উৎপীড়ক নির্বাচনী দায় হয়ে পড়ে — এমন একটি ব্যবস্থায়, মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের প্রাতিষ্ঠানিক অস্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে আমরা অভিন্ন দেওয়ানী বিধির বিষয়টিকে কীভাবে দেখব? ২২তম ল’কমিশন, কী ধরনের অভিন্ন বিধি চাপানো হবে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা না দিয়েই এই বিষয়ে একমাসের মধ্যে জনমত জানতে চেয়েছে। ইতিহাস আমাদের বলে, এই বিষয়ে এক তীব্র বিতর্কের পর গণপরিষদ এটিকে সংবিধানে ‘রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতি’র অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, সংজ্ঞা অনুসারে যা আইনগতভাবে বলবৎযোগ্য নয় বা আদালতের বিচার্য নয়। বাবাসাহেব আম্বেদকর অভিন্ন দেওয়ানী বিধির ভাবনাটিকে নাগরিকদের জন্য ‘ঐচ্ছিক’ হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন। বস্তুত ২১তম ল’কমিশন অভিন্ন দেওয়ানী বিধিকে, এই বর্তমান সংকট মুহূর্তে, ‘প্রয়োজনীয়’ বা ‘সম্ভবপর’ বলে মনে করেনি। বরং সমস্ত পার্সোনাল ল’এর চৌহদ্দির মধ্যে লিঙ্গন্যায় ও লিঙ্গ সমতাকে সুনিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত আইনি সংস্কারের কথা বলেছিল। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে ২২তম ল’কমিশনের এই বিষয়ে নজর কেন্দ্রীভূত করার এত তাড়া পড়ে গেল!
অভিন্ন দেওয়ানী বিধির ভাবনা নিয়ে সরকার এখনও পর্যন্ত কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখতে পারেনি অথচ সঙ্ঘ-বিজেপি প্রচারকরা ইতিমধ্যেই মুসলিম সম্প্রদায়ের কুৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং অভিন্ন দেওয়ানী বিধির ভাবনার যেকোনো বিরোধিতাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্ররোচনা বা তোষণ বলে চিত্রিত করছে। বাস্তবে আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি, গভীর আশঙ্কা ও বিরোধিতার স্বর উঠে এসেছে, মুসলিম সম্প্রদায়ের থেকে ততটা নয়, যতটা মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডের মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো এবং গোটা ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের থেকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং আইন বিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান সুশীল মোদী ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে খৃস্টান সম্প্রদায় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে অভিন্ন দেওয়ানী বিধির আওতা থেকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। ঠিক এই কারণেই সংবিধানের রূপকাররা ইউসিসি’র ভাবনাকে নির্দেশাত্মক নীতির মধ্যে রেখেছিলেন। এমনকি, এতকাল পর ২০১৮তেও, ২১তম ল’কমিশন ইউসিসি’কে ‘প্রয়োজনীয়’ বা ‘সম্ভবপর’ কোনোটাই মনে করেনি। বস্তুত পার্সোনাল ল’(ব্যক্তিগত আইন)-এ রীতিনীতি আচার আচরণ প্রথার বৈচিত্র্য হিন্দুদের নিজেদেরই ভাবনার কারণ হতে পারে যেহেতু তাদেরও বিভিন্ন অঞ্চলে প্রথাগত বৈচিত্র্য বিপুল ও ব্যাপক, অ-হিন্দু ধর্ম ও সম্প্রদায়গুলির মতোই।
২১তম ল’কমিশন, একতার নামে ‘অভিন্নতা’ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার পরিবর্তে সমতার সঙ্গে বৈচিত্র্যের সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে সঠিক কাজ করেছিল। বেশ আশ্চর্যের বিষয়, এমনকি আরএসএস প্রধান গোলওয়ালকারও, ভারতের মতো একটি বিশাল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি চাপিয়ে দেওয়ার ভাবনার বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছিলেন। ভারতের ঐক্যের জন্য অভিন্নতা নয়, বরং সম্প্রীতির, সমন্বয়ের (হারমোনি) প্রয়োজন — ১৯৭১-এ আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গ্যানাইজার’এর সম্পাদক কে আর মালকানিকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বলছিলেন স্বয়ং গোলওয়ালকার। তবে মোদী সরকারের আজ বড় তাড়া তাদের নিজেদের মতাদর্শগত ও প্রশাসনিক পূর্বসূরীর সতর্কীকরণকে পরিত্যাগ করার, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তারা আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে কোনো বাধা, কোনো সংযমকে তাদের মান্যতা দেওয়ার দরকার নেই। তারা আরও মনে করে, এই ইউসিসি হল বিভ্রান্তি তৈরি করে আজকের জনজীবনকে পিষে দেওয়া সমস্যাগুলো থেকে মানুষের মনোযোগ সরানো এবং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারতের মেরুকরণ করার জন্য এক শ্রেষ্ঠ বাজি।
সমতা ও ন্যায়কে সুনিশ্চিত করার জন্য আইনি সংস্কার একটি স্থায়ী অ্যাজেন্ডা এবং সংবিধানের ৪৪নং অনুচ্ছেদের (আর্টিকেল) নির্দেশক্রমে রাষ্ট্রের উচিত সমস্ত সম্প্রদায়ের মহিলাদের জন্য লিঙ্গন্যায় সংক্রান্ত আইনগুলি সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে লাগাতার সচেষ্ট থাকা। এবং ৪৪নং অনুচ্ছেদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে সমস্ত অংশভাগীদের (স্টেহোল্ডারদের) যৌথ অংশগ্রহণ ও সহমতের ভিত্তিতেই তা করতে হবে। তাছাড়াও, মোদী সরকার যদি রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতির রূপায়নকে ত্বরান্বিত করতে চায়, তাহলে একই রকম মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ অন্য নির্দেশাবলী, যেগুলি সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৩৬ থেকে ৫১’র অধীনে সংশ্লিষ্ট ধারায় আছে, সেগুলিকে উপেক্ষা করে, বেছে বেছে শুধু ৪৪নং অনুচ্ছেদে গুরুত্ব দিলে হবে না। কারণ উল্লিখিত ঐ ধারাগুলিতে রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে — কাজের সার্বজনীন অধিকার ও জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে হবে। আয়ের বৈষম্য ও মাত্র কয়েকটি হাতে সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণের কেন্দ্রীভবন হ্রাসকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
ইউসিসি কার্যকর করার ব্যাপারে বিজেপির এই সাম্প্রতিক গুরুত্বের সঙ্গে লিঙ্গন্যায়কে সুনিশ্চিত করা বা রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতির চেতনায় প্রাণিত হওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমরা মনে করতে পারছি না। বাস্তবে, ইউসিসি অ্যাজেন্ডাকে সামনে নিয়ে আসাটা হল বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘দানবীয়’ চেহারায় উপস্থাপিত করার বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের একটা অংশ মাত্র! ‘লাভ জিহাদ’এর বিদ্বেষভরা অলীক কল্পকাহিনির সঙ্গে ‘মুসলিমরা সংখ্যায় হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে’ — এই অযৌক্তিক ভুল ন্যারেটিভের নির্লজ্জ আশ্রয় নিয়ে (এবং সেটাও প্রায় প্রকাশ্যেই) ইউসিসি’র ভাবনাকে তুলে ধরা হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ওপর বহুবিবাহের প্রভাব নিয়ে মোদীর কুখ্যাত এবং অর্বাচীন ভুল দাবির সারাৎসার হল ঐ নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ ন্যারেটিভ! বিরোধীদের অবশ্যই এই অভিসন্ধিকে ব্যর্থ করতে হবে, ক্রমশ বেড়ে চলা জীবনধারণের সংকট ও বেকারত্বের সমস্যার ওপর নজর কেন্দ্রীভূত করতে হবে, আর ভারতীয় সংবিধানের এক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের দূরদর্শী স্বপ্নকে রক্ষা করতে হবে। আর এটা করতে হবে সামাজিক অত্যাচার ও হিংস্রতার সংহিতা মনুস্মৃতিকে সর্বজনীন করে দেশকে পিছনে ঠেলার প্রতিটি অপচেষ্টাকে প্রতিহত করেই। লিঙ্গন্যায় ও লিঙ্গসাম্যকে স্বাগত! ইউসিসি’র নামে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও মুসলিমদের কুৎসিত অপবাদ দেওয়ার রাজনীতির ঠাঁই নেই!
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১১ জুলাই ২০২৩
স্বাধীনতা! সমতা! সংহতি!
গণতন্ত্রের এই সোচ্চার ঘোষণায় প্রাণিত হয়ে ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের জনতা ঘৃণিত রাজতন্ত্রী নিপীড়নের কেন্দ্রস্থলে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিল। প্যারিসের বাস্তিল কারাগার তছনছ করে গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের আধুনিক যুগে ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রার রাস্তা খুলে দিয়েছিল। একশ ষাট বছর পর, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে ভারতীয় হাতে যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা ন্যস্ত হয়, তখন সেই মুক্তিকামী ভাবধারাই ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের মূল সুর হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের চরম পরিহাসে আজ, যখন অত্যাচারী মোদী শাসনে সেই সংবিধানকে পদদলিত করা হচ্ছে তখন, ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রধান সংহারককে এ’বছরের বাস্তিল দিবসের ফরাসি উদযাপনের সম্মানীয় অতিথি হিসেবে বরণ করা হচ্ছে। সুপরিচিত ফরাসি খবরের কাগজ ‘লা মন্দে’ তাদের সম্পাদকীয়তে এই পরিহাসকে বাস্তব রাজনীতির বিজয় হিসেবে অভিহিত করেছে।
এই বাস্তব রাজনীতি বর্তমান ফ্রান্স ও ভারতের ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের রণনৈতিক সমাপতনকে প্রতিফলিত করে। ২০১৭-তে এমানুয়েল মাক্রঁর ক্ষমতারোহনের পর এই চতুর্থবার এবং ২০১৪-তে নিজের জয়লাভের পর সপ্তম বার মোদীর এই ফ্রান্স সফর ভারত ও ফ্রান্সের রণনৈতিক অংশীদারিত্বের পঁচিশ বছরকে সূচিত করছে। এবং অংশিদারিত্ব গভীরতর হওয়ার মান দাঁড়িয়ছে ফ্রান্সের কাছ থেকে ভারতের আরো বেশি বেশি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়। ২০১৮ ও ২০২৩’র মধ্যে ফ্রান্স ছিল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র জোগানদার। ভারতের মোট অস্ত্র আমদানির ২৯ শতাংশ। বাস্তিল দিবসের কুচকাওয়াজ ফরাসি ও ভারতীয় ফৌজের যৌথ অংশিদারীত্ব দেখেছিল ফ্রান্সের কাছ থেকে ভারতের বিতর্কিত রাফাল জেট খরিদের সাথে সাথে। ফ্রান্সের সরকার চালিত টিভি নেটওয়ার্ক ‘ফ্রান্স ২৪’ সঠিক পর্যবেক্ষণ জানিয়ে বলে “মাক্রঁর মোদী বরণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নয় অস্ত্রের কুচকাওয়াজ”।
২০১৫ সালের রাফাল ক্রয়চুক্তি নিয়ে বিতর্ক এখনও মোদীকে তাড়া করে ফিরলেও — ভারতে মোদী সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে ‘বন্ধ খামে’ বার্তাযোগের পর তদন্ত থেমে আছে, কিন্তু এই চুক্তির বেনিয়ম নিয়ে ফ্রান্সে এখনও তদন্ত চলছে এবং সত্য সামনে আসছে — মোদীর বর্তমান সফরে ভারত নতুন করে আরো কেনার ঘোষণা দিয়েছে। খবর অনুযায়ী মূল দুটি চুক্তির মাধ্যমে মোট প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ভারত আরো ২টি রাফাল জেট এবং ৩টি স্করপিন শ্রেণীর ডুবোজাহাজ কিনবে ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য। এই বৃহৎ প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলিই ভারতের অনেক ঢাকঢোল পেটানো রণনৈতিক অংশিদারীত্বের আসল বিষয়, তা সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইজরায়েলের সাথেই হোক বা বর্তমানে ক্রমবর্ধমান হারে ফ্রান্সের সাথে। এই তো কদিন আগে জুন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোদীর সরকারি সফরের সময় আমরা মোদীকে ইউএস’এর সাথে অতিরিক্ত চড়া মূল্যের শিকারি ড্রোন ক্রয়চুক্তিতে সীলমোহর দিতে দেখলাম।
এই ইউএস সফরের মতোই পিএম মোদীর ফ্রান্স সফরও ভারতে গণতন্ত্রের ওপর মোদী সরকারের সুসংগঠিত হামলার বিরুদ্ধে জোরালো আন্তর্জাতিক ধিক্কারে নিন্দিত হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তহীনতা, প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দমন পীড়ন, ঘৃণা ও আতঙ্কের রাজত্ব এবং সন্ত্রাস ও হিংসা ছড়ানো সশস্ত্র ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে সবরকম ছাড় দেওয়া আর সবরকম অপরাধ সংগঠিত করে বিজেপি নেতাদের পার পেয়ে যাওয়া — এই সমস্ত দিকগুলি সঠিকভাবেই আন্তর্জাতিক জনমত তথা ভারতীয় গণতন্ত্রের শুভাকাঙ্খীদের দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফ্রান্সের অনেক জনমুখী বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত কণ্ঠস্বর “নাগরিক সমাজের ওপর দমন বন্ধ করতে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ও ধর্মীয় স্বাধীকার সুরক্ষিত রাখতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উৎসাহ প্রদান করার” কথা মাক্রঁকে বলেছেন। স্পষ্টতই সিএনএন’এ ওবামার মন্তব্য এবং ওয়ার্ল্ড সোশ্যালিস্ট জার্নালের সাংবাদিক সাবিনা সিদ্দিকির মোদীকে করা প্রশ্ন ফ্রান্সের বুকেও অনুরণন তুলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন সেনেটর তাঁদের প্রতিবাদ নথিভূক্ত করেছেন সম্মিলিথ ইউএস কংগ্রেসে মোদীর ভাষণ বয়কট করে। মোদীর ফ্রান্স সফর চলাকালীনই ৭০৫ সদস্যের ইউরোপীয় সংসদ একটি রেজল্যুশন আলোচনা করে পাস করেছে। সংসদের পাঁচটি অংশের আইন প্রণেতা সদস্যদের ৮০ শতাংশ এই রেজল্যুশনটি উত্থাপন করে। এই রেজল্যুশন মণিপুরে চলমান হিংসায় বিপজ্জনক মাত্রার গণউচ্ছেদ এবং ঘরবাড়ি ও উপাসনাস্থল, বিশেষত চার্চগুলি ধ্বংসের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এই নিন্দার জবাবে মোদী সরকার “ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হস্তক্ষেপ”এর সেই ফাটা কাঁসরটাই আবার বাজিয়েছে যা আমরা বিবিসি ভিডিও বা ওবামার মন্তব্য ও ইউএস মিডিয়ার প্রশ্নের সময়ও শুনেছিলাম। পরিহাসের বিষয় হল, জম্মু কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর হামলা চালানোর পর এই মোদী সরকারই নিজেদের পছন্দসই ইউরোপীয় সাংসদদের একটা ছোট্ট দলকে এক সন্দেহজনক সফরে এনেছিল, কিন্তু ভারতের নিজস্ব বিরোধী দলের সাংসদ ও রাজনৈতিক নেতাদের এই আর্ত রাজ্যের মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে দেয়নি।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে, মোদী সরকারের সর্বাত্মক ব্যর্থতা ও প্রতারণার ট্র্যাক রেকর্ডে, জনতার যে ক্রমবর্ধমান মোহভঙ্গ ও ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে তাকে প্রতিহত করার মরিয়া প্রচেষ্টায় বিজেপি এখন মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে বিশ্বস্তরে ভারতের বিশাল ভাবমূর্তী বাড়ার এক মিথ্যা ধারণা ছড়িয়ে দিতে চাইছে। মোদীর অস্ট্রেলিয়া, ইউএস ও ফ্রান্স ভ্রমণ ও জি-২০ সভাপতিত্ব নিয়ে এইসব হইচইয়ের সবটাকেই ব্যবহার করা হবে এই মিথ্যা বয়ান নির্মাণের কাজে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, বিপুল জনশক্তি ও ব্যাপক বিস্তৃত বাজার সম্পন্ন ও বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে ভারত নিশ্চিতরূপেই অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে তার বড় ভূমিকাও রাখার আছে। কিন্তু এই সুবিধাজনক দিকগুলিকে উত্তোলিত করে ভারতকে বিশ্বজুড়ে ন্যায়, শান্তি ও গ্রহের অস্তিত্বের সপক্ষে এক প্রভাবশালী কণ্ঠস্বরের শক্তিশালী গণতন্ত্র ও জনতা-কেন্দ্রীক অর্থনীতিরূপে বিকশিত করা তো দূর অস্ত, মোদী সরকার আদতে ভারতকে ঠেলে দিচ্ছে ইউএস ও তার পশ্চিমা দোসরদের ওপর রণনৈতিক নির্ভরশীলতার দুর্দশায় এবং নিজের ঘরের পাশের প্রতিবেশীদের সাথে ক্রমপ্রসারমান বিচ্ছিন্নতা ও বৈরিতায়। তদুপরি, আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের মর্যাদা দেশের অভ্যন্তরের গণতন্ত্রের অবস্থা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক বুনটচিত্রের সাথে সম্পর্কে বাঁধা। যে সরকার গৃহাভ্যন্তরে সর্বদিকে ক্রমাগত বিপর্যয় ডেকে আনছে তা আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চেও এক আপদরূপে প্রতিভাত হতে বাধ্য।
এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৮ জুলাই ২০২৩
গত ৮-৯ জুলাই ২০২৩ AICWF’র ৪র্থ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে। শহরটা দেওয়াল লিখন, রক্তপতাকা ও হোর্ডিং দিয়ে সাজানো ছিল। দীর্ঘ যাত্রায় ৫ থেকে ১০ ঘন্টা ট্রেন লেট করার পরে বেশিরভাগ প্রতিনিধিরা ৮ তারিখ ভোরে সম্মেলন স্থলে পৌঁছান এবং দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার ক্লান্তিকে উপেক্ষা করেই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। রক্তপতাকা উত্তোলন করেন AICWF’র সর্বভারতীয় সভাপতি বালা সুব্রমনিয়ান। শহীদবেদীতে মাল্যদান করেন বালা সুব্রমনিয়ান, AICCTU সর্বভারতীয় সভাপতি ভি শংকর, সর্বভারতীয় সম্পাদক রাজীব ডিমরি ও উপস্থিত প্রতিনিধিগণ।
সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছিলেন। যেমন — কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, উরিষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, গুজরাট, আসাম, কার্বিআঙ্গলং, ঝাড়খণ্ড, পদুচেরি ইত্যাদি।
উদ্বোধনী ভাষণ দেন ভি শংকর, সম্মেলনকে সম্বোধন করে বিশেষ বক্তব্য রাখেন রাজীব ডিমরি। সম্মেলনের খোলা অধিবেশনে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের তরফ থেকে বক্তব্য রাখেন কে পি পেরুমল (রাজ্য সভাপতি, cwfi-citu, তামিলনাড়ু), এন সেলভারাজ (সারা ভারত কোষাধ্যক্ষ aicbcw-aituc), কে পারারিভাল্লান (তামিলনাড়ু কল্যাণ পর্ষদের সদস্য), পাঝা আসাইথম্বি (সিপিআইএমএল, লিবারেশন রাজ্য সম্পাদক, তামিলনাড়ু), বিরেন্দ্র গুপ্তা (বিধায়ক, বিহার), শংকর পান্ডিয়ান (এআইসিসিটিইউ রাজ্য সভাপতি, তামিলনাড়ু)। প্রতিনিধি সম্মেলনে প্রত্যেক রাজ্য থেকেই খসড়া প্রতিবেদনের ওপর বক্তব্য রাখা হয় এবং আলোচনা জীবন্ত হয়ে ওঠে। ৯ জুলাই প্রতিনিধিদের বক্তব্য শেষে বিদায়ী সর্বভারতীয় সম্পাদক এস কে শর্মার জবাবী ভাষণের পর প্রতিবেদন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
সম্মেলনে ১৫ জনের কার্যনির্বাহী কমিটি ও ৩৬ জনের কার্যকরী কমিটি নির্বাচিত হয়। সর্বভারতীয় সভাপতি ও সম্পাদক হিসাবে পুর্ননির্বাচিত হন বালা সুব্রমনিয়ান ও এস কে শর্মা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সর্বভারতীয় সহ সভাপতিমন্ডলীতে প্রবীর দাস ও সম্পাদকমন্ডলীতে কিশোর সরকার এবং কার্যকরী কমিটিতে প্রদীপ সরকার, দেবব্রত বিশ্বাস, নারায়ন রায় (খোকা) নির্বাচিত হন। বিভিন্ন ভাষায় শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে সম্মেলন শেষ হয়।
এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সফরে প্রধানমন্ত্রী মোদী মাইক্রনের সাথে এক চুক্তি করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। বিশেষ করে ভক্তের দল তো এই বাণিজ্যিক চুক্তিকে বিরাট এক সাফল্যের জন্য স্বঘোষিত বিশ্বগুরুকে অনেক উচ্চাসনে বসিয়েছে। মাইক্রন হচ্ছে সেমি-কন্ডাক্টার সেক্টরে আমেরিকার এক দৈত্যাকার সংস্থা, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছে। তাদের সাথে চুক্তি করে ভারতে চিপ তৈরি শিল্পে ‘নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হবে’ গোদী মিডিয়ার সাথে ভক্তকুল এইজন্য আকুল।
মাইক্রন হল মেমোরি চিপস্’এর এক গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদক, আর এই ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিশ্বে সেমি-কন্ডাকটার শিল্পে প্রথম সারির এক সংস্থা হিসাবে মাইক্রন আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু, মাইক্রন মোদীর রাজ্যে ঠিক কি করতে চলেছে? যে চুক্তি নিয়ে এত সোরগোল, তার আসল স্বরূপ কী?
মাইক্রন গুজরাটে একটা প্ল্যান্ট বানাবে যা শুধুমাত্র ‘অ্যাসেম্বলিং-প্যাকেজ-টেস্ট’ করবে, যেগুলো এই সংস্থাটি অন্য কোথাও ফ্যাব্রিকেট করাবে। এই চিপ ফ্যাব্রিকেশনের প্ল্যান্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে রয়েছে, যেখান থেকে উৎপাদিত পণ্য ভারতে পাঠানো হবে পরীক্ষা করার জন্য। অর্থাৎ, চিপ তৈরি যদি ভারতের অভিষ্ঠ লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে সেই অভিপ্রায়ের গুড়ে বালি। কারণ, মাইক্রনের সাথে চিপ তৈরির কোনো চুক্তি মোদীর হয়নি। মোদী যা আদায় করেছে তা হল, চিপ তৈরি প্রযুক্তির সবচেয়ে নিম্নতর প্রযুক্তি, অ্যাসেমব্লিং ও চিপগুলোর টেস্টিং, যেগুলো অন্যত্র তৈরি হচ্ছে। এ’ক্ষেত্রে আমেরিকা, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ভারত কিন্তু প্রতিযোগিতা করবে না, করবে মালয়েশিয়ার সাথে। তবে ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া এই প্রশ্নে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে — এই ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৩ শতাংশ বাজার এখন তার দখলে। মাইক্রনের মতো মার্কিন বহুজাতিকগুলো ব্যবসায়িক ঝুঁকি এড়াতে প্রথমে মালয়েশিয়া, পরে ভারতকে খুঁজে নিচ্ছে চিপ তৈরির নিম্নতর উৎপাদনকে স্থানান্তরিত করতে আর উন্নতমানের প্রযুক্তি সম্পন্ন চিপ — ফ্যাব্রিকেশনের উৎপাদনের জন্য বেছে নিচ্ছে আমেরিকা, যেমন, মাইক্রনের ১০০ বিলিয়ন ডলারের সংস্থাটি হচ্ছে ওয়াশিংটনের ক্লে’তে।
যে চুক্তি নিয়ে এত ঢক্কানিনাদ, তাতে ভারত কতটা খরচ করছে নিজের গ্যাঁটের কড়ি? আর মাইক্রনই বা কতটা দিচ্ছে তার পকেট থেকে?
গুজরাটে মাইক্রনের জন্য প্ল্যান্ট তৈরি করতে খরচ হবে ২.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৫০ শতাংশ দেবে ভারত সরকার আর গুজরাট সরকার দেবে ২০ শতাংশ। সমগ্র বিনিয়োগকৃত পুঁজির মাত্র ৩০ শতাংশ দেবে মাইক্রন। অর্থাৎ, প্ল্যান্ট স্থাপনের সমগ্র খরচ হবে ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে মাইক্রনের ভাগ থাকবে মাত্র ৮২৫ মিলিয়ন ডলার! অর্থাৎ, ওই সামান্য পুঁজি বিনিয়োগ করে মাইক্রন ওই প্ল্যান্টের ১০০ শতাংশ মালিকানার অধিকারী হবে। ইউরোপের শিল্পমহলের রিপোর্ট ইইনিউজ এ’নিয়ে মন্তব্য করেছে যে, “এটা হল ঢালাও ভর্তুকি প্রদানের এক চরমতম উদাহরণ”। আমেরিকার এক বিপুলাকার কর্পোরেট সংস্থার অ্যাসেম্বলিং, টেস্টিং’এর এত নিম্নতর প্রযুক্তির জন্য ভারত সরকার নিজের রাজকোষ থেকে ঢালাও ভর্তুকি দিচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনও বিরাট পরিমাণে ভর্তুকি দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সুলভে চিপ উৎপাদন ও তারই আনুসাঙ্গিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য ৫২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। চীনেরও রয়েছে ৭৩ বিলিয়ন ডলারের এক জাতীয় তহবিল যা চিপ তৈরির উৎপাদন শিল্পের জন্য বরাদ্দ।
কিন্তু তফাৎ হল, এই উভয় দেশই খুবই আধুনিক, অগ্রগামী, ও উচ্চপ্রযুক্তি সম্পম্ন চিপ, লিথোগ্রাফিক মেশিনের মতো উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের লক্ষ্যেই এই খরচ করে, অ্যাসেম্বলিং বা টেস্টিং মতো নিম্নতর ক্ষেত্রে নয়। যদি একেবারেই নিম্নতর (লোয়ার এন্ড) প্রযুক্তির জন্য টাকা খরচ করতে হয়, তবে তাও যৎসামান্য। মোট তহবিলের বড় জোর ৫ শতাংশ।
মোদীর মতো বাইডেনেরও কিছুদিন পর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার রাজনৈতিক বাধ্যকতা রয়েছে। উভয়ের কাছেই রয়েছে মার্কিন-ভারতের সম্পর্ককে পুনর্বিন্যস্ত করার বাধ্যতা। গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টরের জন্য প্রযুক্তি আমদানির মাধ্যমে নিজের ভাবমূর্তিকে ঘষা মাজা করতে মোদীর যেমন রয়েছে রাজনৈতিক প্রয়োজন, অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকাকে টক্কর দিয়ে শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া চীনকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলতে মার্কিন শিল্প সংস্থাগুলোকে ভারতে স্থানান্তরিত করার পেছনে রয়েছে বাইডেনেরও রাজনৈতিক চাল। আর তা করতে গিয়ে মোদী মার্কিন বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাটির শিল্প স্থাপন ভারতে (নিজের রাজ্য গুজরাটে) করে দিতে দু’হাত উপুড় করে দিল। ১০০ শতাংশ মার্কিন মালিকানাধীন সংস্থাটির জন্য মোদী সরকার দিচ্ছে ৭০ শতাংশ তহবিল, সস্তা শ্রম, জলের দরে জমি। আর, গুজরাটে এমনই এক পণ্যের কারখানা হতে চলেছে, যে ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ইতিমধ্যেই অনেকটা বাজার দখল করে রেখেছে।
সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে জাতীয় তহবিলের বিপুল অপচয় করে মোদী এমনই এক শিল্পায়নের রাস্তা দেখাল, যা দেশবাসীর কল্যাণে নয়, ডেকে আনবে আরও অমঙ্গল।
- অতনু চক্রবর্তী
(লিবারেশনে অক্টোবর ২০২২-এ প্রকাশিত এই প্রবন্ধের সময় সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মুক্তি পাওয়া সত্ত্বেও শর্তসাপেক্ষে কারারুদ্ধ ছিলেন। অবশেষে, তাঁর জামিন মঞ্জুর হয়, তিনি এখন জেলের বাইরে। - সম্পাদকমন্ডলী, দেশব্রতী)
সিদ্দিক কাপ্পান ৭১১ দিন আটক থাকার পর, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ তার অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর হয়। তিনি এখনও কারাগারে রয়েছেন, কারণ তার বিরুদ্ধে আরও একটি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সিদ্দিক কাপ্পান এখনও জামিন পাননি। পেশায় কাপ্পান একজন সাংবাদিক। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে এক দলিত মহিলার গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা কভার করতে যাওয়ার পথে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ কাপ্পানকে চড় মারে। রাতারাতি দেশবিরোধীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় তার গায়ে এবং ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে সত্যি কথা বলার জন্য গেরুয়া শিবিরের পক্ষ থেকে তাকে নিন্দা করা হয়। কাপ্পান অনেকের কাছে একটি পরিচিত গল্পের ছবি প্রতিফলিত করে; যারা তার মতো ভারতে ক্রমে বেড়ে চলা ‘রাজনৈতিক বন্দী’ নামক একদল মানুষের একজন।
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে, মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে আইনজীবী, সাংবাদিক, ছাত্ররা নির্যাতিত হয়েছে তাদের আদর্শের জন্য এবং মানুষের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল অধিকারের লড়াইতে বিশ্বাস রেখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এই নির্যাতনের হার। ২০১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁও সম্পর্কিত গ্রেপ্তার থেকে শুরু করে এবং ২০২০ সালে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন থেকে সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদের গ্রেপ্তার এবং সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়েরের গ্রেপ্তার প্রমাণ করে যে, দেশের শাসক দল এমন যে কোনো ব্যক্তিকে কারাগারে বন্দী করতে উন্মুখ যারা অস্বস্তিকর সত্য কথা বলে এবং হিন্দুত্ববাদী-ব্রাহ্মণ্যবাদী বিজেপি সরকারের আসল রূপ সাধারণ মানুষের সামনে নিয়ে আসে! দিল্লী দাঙ্গার ঘটনায় অপরাধমূলক মিথ্যে অভিযোগে উমর খালিদ এবং অন্যান্য সিএএ-বিরোধী অনেক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আনন্দ তেলতুম্বে, অধ্যাপক হ্যানি বাবু, গৌতম নাভলাখা এবং অন্যান্যদের গ্রেপ্তার করার পেছনে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল — বিরোধী স্বরের উপর দমনমূলক আইন প্রয়োগ করছে কেন্দ্রের মসনদে বসে থাকা বিজেপি সরকার। ইউএপিএ ১৯৬৭’র অধীনে জামিন একটি বিরল সম্ভাবনা। মাত্র কয়েকদিন আগে প্রফেসর হ্যানি বাবুর জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয় বোম্বে হাইকোর্ট। ভারাভারা রাওকে সুপ্রিম কোর্ট মেডিক্যাল বেল দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একইসময় ফাদার স্ট্যানস্বামী জেল হেফাজতে মৃত্যুর সাথে লড়ছিলেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ইউএপিএ’র অধীনে অভিযুক্তদের যারা জামিন পেলেন, তাদের ৯৭.২ শতাংশ নির্দোষ। এনসিআরবি তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি একটি পিইউসিএল রিপোর্টে দেখা যায় যে, ইউএপিএ’র অধীনে গ্রেপ্তার হওয়া ৮,৩৭১ জনের মধ্যে মাত্র ২৩৫ জনকে ২০১৫-২০ সালের মধ্যে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
দীর্ঘকাল ধরে বলা হচ্ছে যে, ভারতে কাশ্মীরের উপর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের হার সর্বাধিক। ফলত কাশ্মীরে বিরোধী কণ্ঠস্বরের বিচার হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের মদতে, নিখুঁতভাবে তাদের বিরুদ্ধে কেস সাজানো হয় এবং তারপর সরাসরি মৃত্যুদন্ডের ব্যবস্থা করা হয়। রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেও তাই। মোদী সরকারের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার সিদ্ধান্তের পর ৫,০০০ জনের অধিক কাশ্মীরী জনগণকে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। উপত্যকা জুড়ে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী এবং সাংবাদিকদের বহু দূরের জেলে পাঠানো হয় অথবা গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ২০২১ সালের নভেম্বরে, জম্মু কাশ্মীর কোয়ালিশন অফ সিভিল সোসাইটি (জেকেসিসিএস) — শ্রীনগরের একটি দল যা কাশ্মীর উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই দলের একজন সদস্য, প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী খুররম পারভেজকে আর্থিক মদতের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) দায়িত্ব নেওয়ায় তাকে কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে গ্রেফতার করা হয়, ফলে তার জামিন পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই বছরের শুরুর দিকে কাশ্মীরী সাংবাদিক ফাহাদ শাহকে জম্মু ও কাশ্মীর জননিরাপত্তা আইন ‘PSA’এর অধীনে আটক করা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি সরকার এবং সরকারের নীতির বিরুদ্ধে মিথ্যে খবর প্রচার করে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন!
রাষ্ট্রের কর্পোরেট স্বার্থবাহী নয়া-উদারবাদী নীতিগুলি বড় কর্পোরেট হাউসগুলিকে আদিবাসী এবং অন্যান্য দুর্বল সম্প্রদায়গুলিকে অপসারণ ও বাস্তুচ্যুত করে প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করার অবাধ ছাড়পত্র দিয়েছে। এই সম্প্রদায়গুলির প্রতিরোধকে রাষ্ট্র হুমকি হিসাবে দেখে। নিপীড়িতদের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে অপরাধ হিসাবে দাগিয়ে দমনমূলক আইনের মাধ্যমে তার টুঁটি টিপে ধরে। কর্পোরেট লুট ও দখলের বিরুদ্ধে ঝাড়খন্ডের আদিবাসী জনজাতির সংগ্রাম পথলগাধি আন্দোলনের আকারে পরিণত হওয়ায় সম্মিলিত শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিল। এই আন্দোলনে উপস্থিত ১০,০০০ জনেরও বেশি আদিবাসীকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এই বছরের শুরুর দিকে, ওডিশার জগৎসিংহপুর জেলার ঝিনকিয়া গ্রামে জেএসডব্লিউ’এর মেগা স্টিল প্ল্যান্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য অসংখ্য গ্রামবাসী এবং কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ এই আদর্শ নিয়েই শাসক দল দেশ চালাচ্ছে। মানুষের মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে তাদের প্রতিবাদ দমন করতে ফৌজদারি আইনকে সর্বশক্তি দিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। ওদের সাজানো ছক সহজবোধ্য। সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামাটাই শুধু নয়, সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করার যে কোন চিন্তার বহিঃপ্রকাশকেই অপরাধ হিসাবে দাগিয়ে দিচ্ছে সরকার। রাষ্ট্র উন্মত্তের মতো তদন্ত প্রক্রিয়াকে হাতিয়ার করে চরম অন্যায্য ফৌজদারি আইন দিয়ে প্রতিবাদী জনগণকে আটকে রাখার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। এইভাবে, দিল্লী দাঙ্গার তথাকথিত তদন্ত সিএএ-বিরোধী কর্মীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ও দলিত বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্যবস্তু করে ফেলা হয়েছে। মোদী জামানা যে কতদূর যেতে পারে তা সম্ভবত আসাম পুলিশের দ্বারা গুজরাট থেকে জিগনেশ মেভানিকে গ্রেপ্তার করা এবং একটি নিছক পাবলিক ট্যুইট প্রকাশের জন্য সাংবাদিক জুবায়েরের ল্যাপটপ পুনরুদ্ধার করতে দিল্লী পুলিশ তাকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে যাওয়ার মতো পদক্ষেপ আমাদের কাছে জলের মতো পরিস্কার করে দেয়।
বর্তমানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চালানোর জন্য কঠোর আইন এবং একটি মাজাভাঙা বিচার বিভাগ ফ্যাসিস্ট শাসকের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসাবে কাজ করছে। যে সমস্ত মামলাগুলোতে ফাঁসানো হয়েছে তার সবগুলোই সাজানো হয়েছে মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। শাসন চালানোর কেতাবে মামলা আদালতে প্রমাণ করার মধ্যে নয়, বন্দীদের দীর্ঘস্থায়ী ও নিষ্ঠুর অপরাধমূলক প্রক্রিয়ায় জড়ানোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রের সাফল্য। ভীমা কোরেগাঁওয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলির কাছে প্রমাণ ছিল যে, পুণে পুলিশ দুই রাজনৈতিক বন্দীর ডিভাইসে মিথ্যা ও জাল তথ্য ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপরও পুলিশকে এরজন্য দায়বদ্ধ করা হল না, মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্তদের মুক্তি দেওয়া হল না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখনও বিচার শুরু হয়নি, রাজনৈতিক বন্দীরা — যাদের মধ্যে অনেকেই বয়স্ক — জেল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ভীষণ দুর্ব্যবহারের শিকার হচ্ছেন। এমনকি তারা মশারি এবং টেলিফোনের মতো মামুলি সুবিধাগুলিও জেলের ভেতর পাচ্ছেন না। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে স্ট্যানস্বামী হলেন অন্যতম। তাঁকে গতবছর কারাগারে সময়মতো চিকিৎসা করা হয়নি। তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার শিকার হন। আজ, ভার্নন গনসালভেস, জিএন সাইবাবা এবং গৌতম নাভলাখার মতো অন্যরা একইভাবে তাদের সুস্থতার জন্য লড়াই করছেন। তবু এ’বিষয়ে রাষ্ট্রের ভাবার অবকাশ নেই।
বলা হয় যে, গণতন্ত্র কেবলমাত্র শূন্যগর্ভ স্বপ্ন নয়, এটি এক অর্থপূর্ণ ধারণা যার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলি সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই বলা হয়েছে; ন্যায়বিচার, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক; চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং মর্যাদা ও সুযোগের সমতা। এই শাসন ব্যবস্থা জানে যে গণতন্ত্রকে বাদ দেওয়া যাবে না, বরং গণতন্ত্রকে সবচেয়ে নিষ্ঠুরভাবে নিঃশেষ করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করার মাধ্যমে, সাধারণের চিন্তা-মতপ্রকাশ-ধর্ম পালনের স্বাধীনতাকে সে খর্ব করে। সর্বোপরি, সমাজে সমতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে।
গণতন্ত্র এবং ভিন্নমতের যেকোনও কণ্ঠস্বরকে প্রতিহিংসামূলকভাবে দমন করা ভারতীয় ছাঁচের ফ্যাসিবাদের একটি অপরিহার্য্য বৈশিষ্ট্য। যারা কারাগারে বন্দী তাদের কেবল ‘রাজনৈতিক বন্দী’ বলা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, গণতন্ত্র, ভিন্নমতের অধিকার এবং বাকস্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের উপর অবিরাম আক্রমণ চলছে। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অপরাধীকরণ এবং দমনমূলক আইন ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদী নিয়মনীতির বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হচ্ছেন, তাদেরকে যেকোনো মর্মে সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে দিচ্ছে বিজেপি সরকার।
এই প্রেক্ষাপটে মনে রাখা দরকার যে, ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক বন্দীরা তাদের আলাদা পরিচয়ের স্বীকৃতি চেয়েছেন। কারাগারের কয়েদিদের থেকে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য নয়, বরং সংগ্রাম বা বিশ্বাসের বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য। রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের বিরুদ্ধে শক্তি বাড়িয়ে গর্জে উঠবে বলে! স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যেমন ভগৎ সিং এবং অন্যান্য বিপ্লবীরা এই উদ্দেশ্যে কারাগারে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে অনশন কর্মসূচি পালন করতেন, তেমনই আজকেও রাজনৈতিক আদর্শ এবং সক্রিয়তার জন্য কারাগারে বন্দীরা প্রকৃতপক্ষে ‘রাজনৈতিক বন্দী’।
আমাদের অবশ্যই পাল্টা লড়াই দিতে হবে। আমাদের অবশ্যই লড়তে হবে সেই চেতনা এবং মূল্যবোধের জন্য যা এই বন্দীদের মুক্ত করে এবং একইসাথে গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য লড়াই করতে হবে। যে সমাজ তার ভিন্নমতকে কারারুদ্ধ করে, সেই সমাজ প্রগতিকেও রুদ্ধ করে। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য একটানা লড়াইয়ের জন্য আমাদের তাঁদের সাথে একাত্ম হতে হবে। দীর্ঘ সময়ের জন্য এই একাত্মতার বন্ধনকে শক্তিশালী করতে হবে। তাঁদের আশা দিতে হবে যে, কারাগারের বাইরে একদল প্রতিবাদী মানুষ আছেন, তাঁরা প্রত্যেক রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে লড়াই জারি রেখেছেন।
আমাদের কর্তব্য বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক বন্দীদের এবং তাদের পরিবারের জন্য অবিরাম লড়াই চালিয়ে যাওয়া এবং চলমান আন্দোলনে সামিল থাকা।
রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি এখন আলোচনার উপরিভাগে থাকার মতো একটি বিষয়। নিম্নলিখিত দাবিগুলিকে আমাদের প্রচারাভিযানের মাধ্যমে আরও বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে দিতে হবে।
• অবিলম্বে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চাই।
• ইউএপিএ, এনএসএ, আফস্পা, এবং সমস্ত রাষ্ট্রীয় দমনমূলক আইন বাতিল করতে হবে।
• ভার্নন গনসালভেস, জিএন সাইবাবা এবং গৌতম নাভলাখা সহ সকল রাজনৈতিক বন্দীদের অবিলম্বে সঠিক মানের চিকিৎসা ও যথাযথ সেবা প্রদান করতে হবে।
লিবারেশন, অক্টোবর ২০২২
(ভাষান্তরঃ ত্রিয়াশা লাহিড়ী)
ডক্টর সন্দীপ কে লুইস চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। বিষয়টা রাজনৈতিক। গত ১৫ মে ২০২৩ তিনি যে ফেসবুক পোস্ট করেন তার শাস্তি হিসেবেই তাঁর ওপর এই আঘাত। এই পোস্টে তিনি দেশের বেশ কিছু অগ্রগণ্য চিত্রশিল্পীদের সমালোচনা করেছিলেন কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট সরকারের একসারি প্রচার কর্মসূচিতে তাঁদের যোগ দেওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রধানমন্ত্রীর মাসিক মন-কি-বাত সম্প্রচারকে সেলিব্রেট করতে দিল্লীস্থিত সরকারি ‘ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট (এনজিএমএ)’তে ‘জনশক্তি’ শিরোনামে আয়োজিত এক শিল্প প্রদর্শনীর মূল পরামর্শদাতা ছিলেন কিরণ নাদার, যিনি দিল্লীর বিখ্যাত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘কিরণ নাদার মিউজিয়াম অব আর্ট (কেএনএমএ)’এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পকলামহলে একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী নাম। সন্দীপ একজন শিল্পালোচক, গবেষক ও শিক্ষক। তিনি আম্বেদকর ও অ্যামিটি ইউনিভার্সিটি-সহ আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আংশিক সময়ের শিক্ষকতার কাজ করেছেন। এবং এই সমালোচনা লেখার সময়কালে তিনি কিরণ নাদার আর্ট মিউজিয়ামে একজন গবেষক কর্মী হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। সন্দীপ তাঁর পোস্টে কিরণের সমালোচনা করেছিলেন। সন্দীপের এই সমালোচনা কয়েকটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, অনেকেই সহমত জ্ঞাপন করতে থাকেন।
কাফিলা ডট অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সন্দীপের লেখাটি ভাষান্তর করে আমরা এখানে দিচ্ছি।
“কিছুদিন যাবৎ নির্দিষ্ট কিছু ভিডিও ও ফটো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। সেগুলিতে বিশ্বের এক-ষষ্ঠাংশ জনসংখ্যার দেশের সর্বোচ্চ স্বৈরতান্ত্রিক শাসক নরেন্দ্র মোদীকে দেখা যাচ্ছে এনজিএমএ’তে ‘জনশক্তিঃ এ কালেকটিভ পাওয়ার’ শিরোনামের নতুন প্রদর্শনী দেখতে আসছেন, যে প্রদর্শনীকে উৎসর্গ করা হয়েছে তাঁরই প্রচারসর্বস্ব রেডিও সম্প্রচার ‘মন-কি-বাত’এর উদযাপনে।
সপ্তাহ খানেক আগে যখন অলকা পাণ্ডের অতিথি-তত্ত্বাবধায়কতায় এই প্রদর্শনীটি জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয়, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিক্ষিপ্তভাবে একটা জনরোল ছড়িয়ে পড়েছিল। জনরোলের কারণ, উদ্ঘাটন কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়েছিলেন ভারতের শিল্পকলা জগতের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বদের কয়েকজন। তাঁদের নামগুলি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কারণ ইতিহাসের নির্লজ্জ নামজাদাদের কলঙ্ক তালিকায় নথিভুক্ত থাকবে এই নামগুলি — অতুল দোদিয়া, বিভা গলহোত্রা, রিয়াস কমু, অসীম পুরকায়স্থ, জি আর ইরানা, টুকরাল ও টাগ্রা, মঞ্জুনাথ কামাত, জগন্নাথ পাণ্ডা এবং ‘পরামর্শদাতা’ ভূমিকায় থাকা কিরণ নাদার। এইসব আলোকদাতা বা ‘টপ আর্টিস্টরা’ (যেভাবে খবরে বলা বা লেখা হয়) প্রায় সকলেই পুনরায় আবির্ভূত হন যখন প্রধানমন্ত্রী এই প্রদর্শনী দেখতে আসেন তখন এবং গর্বের সাথে পোজ দেন তাঁর সাথে ফটোশেসনে।
কেউ কেউ চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন যে প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া প্রত্যেক শিল্পীর কাজের থিম নির্দিষ্ট করা হয়েছিল বর্তমান সরকারের মতাদর্গত দিশা এবং তার বিবিধ প্রশাসনিক স্কিম তুলে ধরার দিকে লক্ষ্য রেখে এবং এইভাবে এই শিল্পীরা একটি সংখ্যাগুরুবাদী রাষ্ট্রের মতাদর্শগত দিশাকে কার্যত মহিমান্বিত করেছেন। এই ধরণের পর্যবেক্ষণকে সমর্থন জানিয়েই আমি বর্তমানের প্রতিচ্ছবিতে একটা ভিন্নতর চিত্র হাজির করতে চাই।
বর্তমানে শিল্পকলা জগতের যেকোনো ধরনের ক্রিয়াকর্মে অপরিহার্য হয়ে ওঠা তথা শিল্পসেবায় নিবেদিত ব্যক্তিত্ব বা ‘দ্য আর্ট ফিলানথ্রোফিস্ট’এর ওপর এবং তার চারপাশে জমে থাকে বা সেই ব্যক্তিত্বকে সমর্থ করে যে শ্রম নামক ‘ডার্ক ম্যাটার’ তার ওপর নজর কেন্দ্রীভূত করে আমি এই চিত্র হাজির করতে চাই। ‘চিত্তাকর্ষক ফ্যাসিবাদ’এর সর্বগ্রাসী ক্ষমতার বিপ্রতীপে সবকিছুই খণ্ডিত, ক্লান্তিকর রকম সাময়িক ও গতানুগতিক।
এইভাবে ফোকাস সরিয়ে আনাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ শিল্পকলা জগতের আমরা সকলেই এখনও কোনও না কোনওভাবে একটা ‘সিন্ডলার্স লিস্ট’এ বিশ্বাস রাখি — ঝাপসা কিন্তু মোলায়েম এক ঘুমপারানি গল্পে, যেখানে এক ধূর্ত কিন্তু ভালো শিল্পপতি তাঁর পছন্দের মানুষদের একটা তালিকা বানিয়ে রাখছেন যাদের তিনি আসন্ন জনহত্যার (সাংস্কৃতিক বা অন্যরকম) হাত থেকে রক্ষা করবেন। এখানে সেই সিন্ডলারটি হলেন নাদার। কিন্তু তিনি হতে পারতেন কোনো এক টাটা, বদেরা, আম্বানি বা এমনকি আদানি (শেষজন দৃশ্যতই দিল্লীতে সমাগত সেরেন্ডিপিটি কমপ্লেক্সের ট্রাস্টি)। এবং অরিজিনাল সিন্ডলারের মতো একা এক দুঃসাহসীর বদলে এখন এই ব্যক্তিত্বকে বুঝতে হবে এক সম্মিলিত সত্ত্বা হিসেবে — কেবল এক পারিবারিক নাম পদবি বা তার প্রচারে লিপ্ত একটা পরিবারকে দিয়ে নয়, বরং বিভিন্ন পরিবার ও এন্টারপ্রাইজের মধ্যেকার অন্তর্জালের গ্রন্থি হিসেবেও বুঝতে হবে, যেখানে আপোসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার থেকে সহ-অস্তিত্ব ও সহ-বিবর্তন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দায়বদ্ধতার ব্যবস্থাপনা একদম নীচের তলা থেকে স্থাপন না করা পর্যন্ত লব্ধি মেগা-প্রতিষ্ঠানগুলি এই উপমহাদেশীয় শিল্প দশায় নতুন অলিগার্কির শুরুয়াৎ হয়ে উঠতে পারে। তাদের সমঝোতা করে নেওয়ার প্রতিটি দৃষ্টান্তকে, তা সে এনজিএমএ প্রদর্শনী হোক বা মুম্বাইয়ের গালায় নিতা মুকেশ আম্বানি কালচারাল সেন্টার ‘এনএমএসিসি’এ হিন্দু সাধুদের হাজিরাই হোক, দেখা যেতে পারে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক জরুরি প্রয়োজনবাদ ও কূটনীতি হিসেবে যার তাৎক্ষণিক কুফলকে পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে মেরামত করা বা ঘুরিয়ে নেওয়া যাবে। অথবা, কেউ এই অস্বস্তিকর সিদ্ধান্তেও পৌঁছতে পারে যে যা আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা আসলে ভারতীয় শিল্পকলায় নয়া উদারবাদের যে লং মার্চ তারই শেষ লপ্ত, যা এখন তার চূড়ান্ত দশায় পৌঁছাচ্ছে ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ/কেন্দ্রীভূতকরণে — যে ক্ষমতা আকাধারে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক।
কিন্তু ক্ষমতার এই নতুন দৃশ্যপট, এনএমএসিসি উদ্ঘাটনে সবচেয়ে কদর্য রূপে যা সামনে এল, এহ বাহ্য। এই কেন্দ্রীভূত/একচেটিয়া ক্ষমতার ছবির নীচে আমরা যা পাই তা হল ভেঙেচুরে যাওয়ার আর অস্থিরতার সংকেত — খোলা মনে গ্রহণ করতে পারে এমন যৌথতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক অনুশীলনকারীদের ফেস করা সমস্যা, কর্মক্ষেত্রে ইউনিয়ন গড়ে তুলতে পারার অক্ষমতা, নিঃশঙ্ক চিত্তে আইডিয়া ও তথ্য আদানপ্রদানযোগ্য মুক্ত জনমঞ্চের অনুপস্থিতি, শ্রম ও যৌনশোষণ আলোচনায় আনার যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব, ইত্যাদি। এই হল শিল্প জগতের নিঃশেষিত ও দলিত ‘ডার্ক ম্যাটার’ (গ্রেগরি শোলেটের অভিব্যক্তি টেনে বললে), ভেতরে থেকে অদৃশ্যভাবে এই শিল্পদুনিয়ার চকচকে জেল্লার দৃশ্যপটকে সমর্থন যুগিয়ে চলা।
এনজিএমএ’তে আমরা যা দেখলাম তা এই সময়কার চলতি ভারতীয় শিল্পকলা জগতের এক বিস্ফোরক সংকোচন যেখানে টুকরাল ও টাগ্রা, দোদিয়া, ও কামু নামগুলি, যারা তাঁদের ‘সাবভার্সিভ’ আর্টের জন্য সমালোচনাখ্যাত, এবারে ‘সুপারফিসিয়াল’ পরেশ মাইতি, অঞ্জলি এলা মেনন ও অলকা পাণ্ডেদের সাথে এক সারিতে চলে আসবে। এটাই সমকালীন শিল্পের সমকালীনতা যেখানে প্রত্যেকেই, নিন্দিত ও নন্দিত উভয়েই, একই স্থান ও কাল ভাগ করে নেয় কোনও ফারাক না রেখে, এক কল্পিত চতুর্মাত্রিক স্থান-কাল ঘনক যার উপরিতল ও গভীরতার কোনও সহজ ভেদ নাই। তাঁদের বিশ্বাসঘাতকতার (অথবা হতে পারে, শেষ পর্যন্ত নিজেদের পশ্চাদগামী রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে আসার ধৃষ্টতা) পেছনের কারণটা খুব সহজ। মহাপ্রলয় ও সাফাই-ধোলাইয়ের কালপর্ব যেহেতু এগিয়ে আসছে, কেউ কেউ মরিয়া হয়ে সবরকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে নয়া শিল্প দুনিয়ার অলিগার্কদের বানানো পছন্দের তালিকায় জায়গা পেয়ে যেকোনো মূল্যে মোদীর নৌকায় ওঠার। যারা পেছনে পড়ে থাকবে তারা হয়তো চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। না কি, আমাদের নিজেদের ছোটো ছোটো ডিঙিনৌকাগুলো বানাতে হবে, যত বেশি বেশি সম্ভব, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ঘুমপারানি গল্পের সিন্ডলারই হয়ত প্রকৃত জুজু।”
সন্দীপের লড়াই অগ্রণী শিল্পীদের জগতে ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের দিকে আঙ্গুল তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘গোদি মিডিয়ার পর কি এবার তাহলে গোদি আর্ট’? সন্দীপের পাশে দাঁড়িয়ে কয়েক শত শিল্পী, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। তীব্র ধিক্কার জানিয়ে কেএনএমএ’তে সন্দীপের পুনর্বহাল দাবি করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে,
“… প্রদর্শনীটি কার্যত শিল্পী ও শিল্পকে হাতিয়ার করেছে আমাদের সময়ের ভূমিস্তরের বাস্তবতাকে আড়াল করার কাজে। একজন গবেষক আর শিল্পালোচক হিসেবে ব্যক্তিগত অধিকারে সন্দীপ সামাজিক মাধ্যমে চলমান আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। মিউজিয়মের চাকুরে হিসেবে নয়, একজন চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে, যিনি আধিপত্য ও শোষণের ব্যবস্থাকে দেখতে ও দেখাতে পারেন, যে ব্যবস্থা শিল্প ও রাজনীতিতে ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি ও তার সৃষ্ট মিথ্যার জালে জড়ানো। এর প্রতিক্রিয়ায় সন্দীপকে শোকজ নোটিশ ধরানো হয় এবং শেষে সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ কায়দায় সেই মিউজিয়াম থেকে বরখাস্ত করা হয় যেখানে তিনি চাকরি করতেন...।
… একথা উল্লেখ করাও জরুরি যে মিস নাদার যে সাংস্কৃতিক পুঁজি সঞ্চিত করেছেন তা তাঁর নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠান ‘কিরণ নাদার মিউজিয়ম অব আর্টস’এ দৃষ্টির আড়ালে কাজ করে চলা বহু ব্যক্তিবর্গের কঠোর শ্রমের মধ্যে দিয়েই এসেছে…।
বর্তমানে যখন আমরা এক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখানে সরকার চালিত শিল্পকলা প্রতিষ্ঠানগুলি সমালোচনামূলক মননকেন্দ্র হওয়ার বদলে রাষ্ট্র নির্দেশিত প্রচারণার হাতিয়ারে পর্যবসিত হয়েছে, তখন এটা আরও জরুরি হয়ে ওঠে যে এক জীবন্ত প্রাণবন্ত শিল্পজগৎকে শক্তি জোগানোর সামর্থ যাদের আছে তাঁরা শিল্পকে বরাবরের মতো নিছক আরেকটা ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে না দেখে বরং তার পরিবর্তনকারী ক্ষমতাকে অনুধাবন করবেন। আমরা তাই এমনকি প্রাইভেট মিউজিয়মগুলির কাছেও প্রত্যাশা করি যে তারা ধনকুবেরদের ব্যক্তিগত জায়গিরে পর্যবসিত না হয়ে জনতার স্বার্থবাহী সংস্থারূপে কাজ করবে...।”
এইসব শিল্পীরা যখন সরকারকে খুশি করার ছবি এঁকে মন-কি-বাতের শততম শো’তে প্রদর্শিত করছেন তখন এই ফরমানি প্রদর্শনীর পাশাপাশি সাক্ষী দেবে সেইসব সত্য ঘটনার নিদর্শনগুলিও যেখানে সরকারের অবহেলায় যমুনা নদী দূষণে ধুঁকছে, হাথরাসে ধর্ষিত মেয়েটিকে পুলিশ জ্বালিয়ে দিচ্ছে, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক পথ হাঁটছে হাজার মাইল, তাদের উপর নির্বিচারে স্প্রে করা হচ্ছে কীটনাশক, স্বচ্ছ ভারতের নামে দিল্লীর শ্রমিক বস্তির উপর চলছে মোদী-যোগীর বুলডোজার। এই সরকারের কর্মকাণ্ডের জেরে যোশীমঠ সমেত আরও অসংখ্য পরিবেশ ধ্বংসের ঘটনা, কৃষক আত্মহত্যার কথা, কৃষক আন্দোলনের কথা, ক্রমবর্ধমান জাতিবিদ্বেষ মূলক ঘটনার কথা, রামদেব থেকে শুরু করে এই সময়ের ভন্ড গুরুদের কথা, একের পর এক গবেষণা কেন্দ্রগুলিতে রিসার্চ ফান্ডিং’এর অভাব ও ব্রাহ্মণ্যবাদী নিপীড়নে গবেষকদের মৃত্যুর কথা, সরকারের এমন অসংখ্য অত্যাচার ও হিংস্রতার কথা রয়ে যাবে। থাকবে স্ট্যানস্বামীকে জেলে হত্যার ঘটনা। বিনা বিচারে রাজনৈতিক বন্দীদের আটকে রাখার কথা। ইতিহাসে থাকবে ধর্ম আর জাতির নামে এই সময়কালের হীনতার সব থেকে নির্মম ঘটনাগুলি, সমস্ত জনমাধ্যম দখল করে নিয়ে দিবারাত্রি প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সমগ্র দেশের মস্তিষ্কে ঘৃণা আর বিদ্বেষের বীজ বপন করার একের পর এক নমুনাগুলি।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার ও চিত্রশিল্পী শহিদুল আলম প্রতিবাদে সামিল হয়ে কিরণ নাদাল মিউজিয়মে তাঁর আসন্ন প্রদর্শনী বয়কট করে নাম তুলে নিয়েছেন।
ডক্টর সন্দীপ লুইস শিল্পী মহলে মোটামুটি পরিচিত নাম, তাই তাঁর অন্তত এটুকু লড়াইয়ের জায়গা আছে যে তিনি নিজের ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’ ও ‘রাইট টু ওয়ার্ক’এর বিষয়ে আওয়াজ তুলতে সক্ষম। এইসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন কত অসংখ্য মানুষকে কাজ হারাতে হয়, যাদের কাজের নিরাপত্তা তো দূরের কথা, স্বাধীন অভিব্যক্তির ন্যূনতম জায়গাটুকুও নেই। সন্দীপের হয়ে কিছু সচেতন শিল্পী ও শিক্ষা জগতের মানুষ এগিয়ে এসেছেন একটা বড় প্রশ্নকে সামনে রেখে — এত সহজেই কারোর চাকরি কেড়ে নেওয়া যায় না, দেশের সাংবিধানিক অধিকারের জায়গা থেকে অন্তত। এটা হয়তো একটা অসম লড়াই; এটুকু অন্তত প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া, যে এই রাষ্ট্রে অভিব্যক্তির কারণে কাজ খোয়ানো আসলে এক ধরণের ফ্যাসিবাদী দমন। বৃহত্তর এই গণতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্রীয় ও অর্থ ক্ষমতায় বলিয়ান মানুষেরা যা খুশি তাই করতে পারে না। ক্ষমতার বিরুদ্ধে অনেক ভাষা উঠে আসবেই নানা রূপে, নানান স্তর থেকে। আর এই ছোট ছোট লড়াইগুলোও ক্রমে একসাথে দানা বেঁধে একদিন নিশ্চয় এই ফ্যাসিস্ট মানসিকতার বদল আনবে।
- আনখ সমুদ্দুর ও মলয় তেওয়ারি
আনন্দ তেলতুম্বড়ের ভূমিকাসমৃদ্ধ গ্রন্থটির আলোচনায় প্রফেসর চমনলাল
২০ আগস্ট ২০১৮
ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকর তাঁর সমগ্র লেখাপত্রে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার সাথে নিরন্তর কথোপকথনে ছিলেন, অন্তত মতাদর্শগত স্তরে। মার্ক্সবাদী ও আম্বেদকরবাদী — এই উভয় পক্ষের কিছু স্বার্থান্বেষী অংশ অনেক সামাজিক প্রশ্নে সমঝোতার চেয়ে বিরোধকেই বড় করে দেখাতে চায়। দুই চিন্তাধারার মধ্যে সংলাপকে আরও সাধারণ ভিত্তির ওপর স্থাপন করার কাজ খুব কম পণ্ডিত ও কর্মীরাই করছেন, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের উত্থান এবং ২০১৪ সালে হিদুত্ববাদীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে। জেএনইউ বা হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা চেন্নাই এবং খড়গপুর আইআইটি’র কিছু কিছু শিক্ষার্থি সংগঠন মার্ক্সবাদী বিপ্লবী ভগৎ সিং এবং ডঃ আম্বেদকর, পেরিয়ার ও মহাত্মা ফুলের মত দলিত মুক্তি চিন্তাবিদদের অভিন্ন ভিত্তির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
আনন্দ তেলতুম্বড়ে নিজস্ব পরিচিতিতেই পণ্ডিত হিসেবে স্বীকৃত। আম্বেদকর পরিবারের সাথেও যিনি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তিনি ডক্টর আম্বেদকরের কিছু অসম্পূর্ণ লেখা সম্পাদনা করেছেন, ‘ভারত এবং কমিউনিজম’ শিরোনামে নিজের সুলিখিত ভূমিকা সহ। এই সংকলনে ‘প্রকাশকের কথা’ উল্লেখ করেছে যে, ডক্টর আম্বেদকর তাঁর কাগজপত্রে একটি নোট রেখে গেছেন যে তিনি ‘ভারত এবং কমিউনিজম’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করতে চেয়েছিলেন। এমনকি তিনি সেই গ্রন্থের সূচিপত্রের খসড়াও তৈরি করেছিলেন।
এরকম,
অংশ ১) সাম্যবাদের পূর্বশর্ত
• অধ্যায় ১) সাম্যবাদের জন্মস্থান
• অধ্যায় ২) সাম্যবাদ ও গণতন্ত্র
• অধ্যায় ৩) সাম্যবাদ ও সামাজিক ব্যবস্থা
অংশ ২) ভারত এবং কমিউনিজমের পূর্বশর্ত
• অধ্যায় ৪) হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থা
• অধ্যায় ৫) হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি
• অধ্যায় ৬) সামাজিক ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত কমিউনিজমের প্রতিবন্ধকতা
অংশ ৩) তাহলে আমরা কী করব?
• অধ্যায় ১) মার্ক্স এবং ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থা
• অধ্যায় ২) মনু এবং হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা
ডঃ আম্বেদকর তাঁর এই পরিকল্পিত গ্রন্থের সামান্য অংশই সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন, ৪ ও ৫ অধ্যায় দুটি টাইপ করা ৩৩ পৃষ্ঠা সহ। কাগজপত্রের একই ভাঁজে আরেকটি বইয়ের রূপরেখা ছিল — ‘আমি কি হিন্দু হতে পারি?’ এবং এর অংশ হিসেবে ‘হিন্দু ধর্মের প্রতীকসমূহ’। এই কাগজগুলো সম্ভবত ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে টাইপ করা হয়েছিল।
এইভাবে আনন্দ তেলতুম্বড়ের ভূমিকা ও ডক্টর আম্বেদকরের অজানা কাগজপত্র আম্বেদকর-চিন্তার নতুন ও অধিকতর যুক্তিবদ্ধ উপলব্ধি সামনে নিয়ে আসে।
বইটির প্রথম পাতায় ডক্টর আম্বেদকরের ১৯৩৬ সালের মূল লেখা ‘জাতের বিলুপ্তি’ থেকে একটি উদ্ধৃতি রয়েছে।
“সমাজতন্ত্রীরা যদি সমাজতন্ত্রকে একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবে পরিণত করতে চান, তবে তাঁদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে সমাজ সংস্কারের সমস্যাটি মৌলিক এবং তাঁরা একে এড়িয়ে পরিত্রাণ পাবেন না।”
প্রথম যখন এই কথাগুলি লেখা হয়েছিল তার ৮১ বছর পর দাঁড়িয়ে এখন এই বিবৃতিটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারেন যে ভারতীয় সমাজ কতটা জটিল এবং সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আরও কত তীব্র হয়ে উঠেছে। আর, এমনকি ১৯৩৬ সাল থেকে শুরু করে এই মধ্যবর্তী সময়টিতে সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্টরা এই কাজে কতটা ব্যর্থ হয়েছে, এবং যে সমাজকে একসময় তাঁরা নেতৃত্ব দিতেন সেই সমাজেই এখন তাঁরা প্রায় প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন।
আনন্দ তেলতুম্বড়েও তাঁর ভূমিকা শুরু করেছেন র্যাডিকাল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান চিন্তাবিদ ম্যালকম এক্স’এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে, “আমাদের নিজেদের জন্য স্বাধীনতা অর্জন করার একমাত্র উপায় হল বিশ্বের প্রতিটি নিপীড়িত মানুষের সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করা”। (পৃষ্ঠা ৯)। আনন্দ তেলতুম্বড়ের প্রথম কথা হল, যারা আম্বেদকরকে কমিউনিস্ট বিরোধী বা মার্ক্সবাদ বিরোধী হিসাবে প্রজেক্ট করেন তাঁরা চরমভাবে পক্ষপাতদুষ্ট, যদিও তিনি সহমত যে মার্ক্সবাদের কিছু তাত্ত্বিক নীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আম্বেদকরের গুরুতর ভিন্নমত ছিল।
আনন্দ তেলতুম্বড়ে অত্যন্ত কঠোরভাবে এই সত্যটিতে নজরটান দিয়েছেন যে, আম্বেদকর-পরবর্তী সমগ্র দলিত আন্দোলন মার্ক্সবাদীদের শত্রু হিসাবে বিবেচনা করার এক আচ্ছন্নতায় ভোগে। এটা দলিত ‘নেতাদের’ শাসকের সাথে গা ঘেঁসাঘেঁসিতে মগ্ন থাকার আত্ম-অনুমোদন ও সুযোগ-সন্ধান দিয়েছে, যদিও তাঁরা এখনও নিজেদেরকে ‘আম্বেদকরবাদী’ বলে অভিহিত করছেন। (পৃষ্ঠা ১১)। তিনি এমনকি রিপাবলিকান পার্টি অফ ইন্ডিয়া (আরপিআই)’র কিছু গ্রুপের নামও দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে, আনন্দ দুঃখের সাথে উল্লেখ করেছেন যে এমনকি দলিত প্যান্থাররা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক প্যান্থারদের আদলে গঠিত র্যাডিকালরাও, আরপিআই’এর মতো একই প্যাটার্নে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে রামবিলাস পাসওয়ান, উদিত রাজ এবং রামদাস আঠাভেলের মতো উল্লেখযোগ্য দলিত নেতারা কীভাবে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণ্যবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি ‘বিজেপি’তে চলে গেছেন কিন্তু ভুলেও কমিউনিস্টদের কাছে ঘেঁষেননি! এই সুবিধাবাদী নেতারা বিজেপির সম্পূর্ণ আম্বেদকর-বিরোধী চিন্তাধারা সাথে নিয়ে চলতেও প্রস্তুত, কিন্তু ডক্টর আম্বেদকরের নিজের নাতি প্রকাশ আম্বেদকরকে, যিনি সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টদের সাথে অভিন্ন ফ্রন্টের পক্ষে, ‘আম্বেদকর-বিরোধী’ এমনকি ‘মাওবাদী সহানুভূতিশীল’ হিসাবে আক্রমণ করতে ছাড়েন না!
আনন্দ তেলতুম্বড়ে মার্ক্সবাদের সাথে ডক্টর আম্বেদকরের সম্পর্ককে ‘ধাঁধাপূর্ণ (এনিগ্ম্যাটিক)’ বলে বর্ণনা করেছেন। আম্বেদকর মার্ক্সবাদী ছিলেন না, কিন্তু তিনি নিজেকে ‘সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন!
আনন্দ তেলতুম্বড়ে নিশ্চিত নন যে ডক্টর আম্বেদকর কার্ল মার্ক্সের ২৫ জুন ১৮৫৩’র ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধটি পড়েছেন কিনা। নিউইয়র্ক ডেইলিতে যা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে মার্ক্স ভারতীয় জাতব্যবস্থাকে “ভারতের অগ্রগতি এবং ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে নির্ধারক বাধা” হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আম্বেদকর কখনই এই ধারণাকে খারিজ করেননি যে “জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ”। (পৃষ্ঠা ১৯)। সামাজিক-ধর্মীয় দিকগুলি বাদ দিয়ে কমিউনিস্টরা যে শ্রেণীকে নিছক ‘অর্থনৈতিক’ ক্যাটেগরি হিসাবে দেখছে তা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন আম্বেদকর। আনন্দ তেলতুম্বড়ে আরও উল্লেখ করেছেন যে যদিও আম্বেদকর মার্ক্সীয় শ্রেণির ধারণাকে গ্রহণ করেননি, তবুও তিনি নিজে জাতবর্ণকে শ্রেণী হিসাবে বিবেচনা করতেন, “জাত হল এক আবদ্ধ শ্রেণী”। আনন্দের মতে, আম্বেদকরের শ্রেণী সম্পর্কিত ধারণাটি কার্ল মার্ক্সের চেয়ে বেশি ম্যাক্স ওয়েবারের মতো ছিল। আম্বেদকর ১৯৩৬ সালের আগস্টে ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি (আইএলপি) হিসাবে তাঁর প্রথম রাজনৈতিক দলটি গঠন করেন, যাকে ক্রিস্টোফার জেফ্রেলট ‘ভারতের প্রথম বামপন্থী দল’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, কারণ কমিউনিস্ট পার্টি তখনও হয় আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল বা কংগ্রেস পার্টির ছত্রছায়াতেই কাজ করছিল। আইএলপি দলটি সিএসপি ‘কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি’র সাথে ১৯৩৮ সালে ২০,০০০ কৃষকের বিশাল মিছিলের আয়োজন করেছিল এবং নিজেদের অনুশীলনে ‘জাত ও শ্রেণী’কে একীভূত করার পথ দেখিয়েছিল। ১৯৩৮ সালেই আইএলপি এবং এআইটিইউসি (সিপিআই অনুমোদিত অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস) মিলে এক বিরাট ধর্মঘট সংগঠিত করেছিল ১৯২৯ সালের ‘ট্রেড ডিসপিউটস্ অ্যাক্ট’এর বিরুদ্ধে, যে ধর্মঘটে এক লক্ষ শ্রমিক যোগ দেয়। এই অ্যাক্টের বিরুদ্ধে ভগত সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে সেন্ট্রাল এসেম্বলিতে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। আনন্দের মতে, আম্বেদকর ১৯৩০’র দশকে তাঁর জীবনের সেরা র্যাডিকাল ফর্মে ছিলেন। আম্বেদকর ১৯৪৩ সালে আইএলপি তুলে দেন এবং অল ইন্ডিয়া শিডিউলড্ কাস্ট ফেডারেশন (এআইএসসিএফ) গঠন করে এই পর্বটি সমাপ্ত করেছিলেন।
আনন্দ তেলতুম্বড়ে বইটির ভূমিকায় লক্ষ্য করেছেন যে ১৯৩০’র দশক পর্যন্ত কমিউনিজমের প্রতি আম্বেদকর মোটেই বিরূপ ছিলেন না। শুধুমাত্র বোম্বাইয়ের কমিউনিস্টদের সাথে তাঁর সম্পর্কের অভিজ্ঞতাই কমিউনিস্টদের বিষয়ে তাঁর মনকে তিক্ত করে তুলেছিল। আম্বেদকর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা স্তালিনের প্রতি নরম মনোভাবাপন্ন ছিলেন, স্তালিন মুচির ছেলে ছিলেন বলে। এমনকি স্তালিনের মৃত্যুতে উপবাস পর্যন্ত করেছিলেন আম্বেদকর।
আনন্দ তেলতুম্বড়ের মতে ডঃ আম্বেদকর এবং তাঁর সময়ের কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে মূল মতপার্থক্য ছিল ‘ভিত্তি ও উপরকাঠামো’ সম্পর্ক বিষয়ে কমিউনিস্ট ধারণার কারণে, যে ধারণায় শ্রেণী হিসাবে দলিতদের অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তির প্রশ্নটি শোষণের অর্থনৈতিক জোয়াল থেকে মুক্ত হওয়ার সাথে যুক্ত, আর তাদের ‘জাতগত বৈষম্যের প্রশ্নটি’ ‘উপরিকাঠামোর’ অংশ যা সমাজের ‘ভিত্তি’ পরিবর্তনের সাথে সাথে খতম হয়ে যাবে। সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে কমিউনিস্ট পার্টি দলিত ব্যাকগ্রাউন্ডের অনেক কমরেডকে দলিতদের জন্য নিজেদের উদ্বেগের ‘শো-পিস’ হিসাবে ব্যবহার করেছিল। অনুশীলন বিপ্লবী গোষ্ঠির পটভূমি থেকে আসা জীবন ধুপিকে ১৯৪৬ সালে এগারো বছর জেল খেটে মুক্তি পাওয়ার পরই একমাত্র, সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে তপশিলি জাতির যোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করে, সিপিআইয়ের কেন্দ্রীয় কমটিতে নেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, একজন সিনিয়র সিপিআই নেতা কে এন জোগেলকারের বহু বছর ধরে ‘ব্রাহ্মণ সভার’ সদস্য থাকাকেও পার্টির পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয়নি।
যদিও আম্বেদকর বহু বছর ধরে সিপিআই’এর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন, তবু ব্যক্তিগত স্তরে তিনি সিপিআই’এ যোগদানকারী আর বি মোরের সাথে তাঁর উষ্ণ বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন।
আনন্দের মতে, জাতীয়তাবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের ইস্যুতে, আম্বেদকর এবং সিপিআই ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধিতে ছিল। সিপিআই কংগ্রেস পার্টিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং জাতীয়তাবাদী বলে মনে করেছিল এবং তার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়েছিল, আর আম্বেদকরের সমালোচনা করেছিল। আম্বেদকরের কাছে দলিতদের স্বার্থ ছিল প্রাথমিক, যারা শিক্ষা এবং কিছু চাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। আম্বেদকর ব্রিটিশ-পরবর্তী ভারতে দলিতদের স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং তারজন্য গান্ধী বা কংগ্রেস দলের ওপর ভরসা রাখেননি।
যদিও আজ আরএএসএস অনুপ্রাণিত বিজেপি ক্ষমতায় আসার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডঃ আম্বেদকর প্রণীত ভারতীয় সংবিধানকে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার আরএসএস-প্রকল্পের বিরুদ্ধে এক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে দেখা হচ্ছে, আনন্দ তেলতুম্বড়ে কিন্তু ডক্টর আম্বেদকরের উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে ডঃ আম্বেদকর নিজেই এই সংবিধান সম্পর্কে কতটা হতাশ ছিলেন। আনন্দ আম্বেদকরকে উদ্ধৃত করেছেন, “আমি তো এক ভাড়াটে মাত্র ছিলাম, আমাকে যা করতে বলা হয়েছিল আমি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার অনেক কিছু করেছি… কিন্তু আমি এখন এ’কথা বলতে প্রস্তুত যে আমিই সবার আগে এটা পুড়িয়ে ফেলব। আমি এটা চাই না। এটা কারো সাথেই খাপ খায় না।” (পৃষ্ঠা ৬৮, রাজ্যসভা থেকে উদ্ধৃত, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩)। মজার বিষয় হল, আজ যে সংবিধানকে আদর্শায়িত করা হচ্ছে তা যে মূলত শাসক ধনকুবের গোষ্ঠির স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে রচিত শ্রেণী-সংবিধান, শ্রমিক ও দলিত শ্রেণীর জন্য নয়, সে বিষয়ে আম্বেদকর বেশ স্পষ্ট ছিলেন, কিন্তু আমাদের আজকের বামপন্থী এবং আম্বেদকরবাদী উভয়েই সেই সংবিধানের প্রশংসা করছেন যা আম্বেদকর, তার রচয়িতা হওয়া সত্ত্বেও, নিজেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন!
ডক্টর আম্বেদকরের অসম্পূর্ণ প্রকল্প উপস্থাপন করতে গিয়ে আনন্দ তেলতুম্বড়ে মত প্রকাশ করেন যে, যদিও আম্বেদকর মনে করেছিলেন কমিউনিজম একটি মুক্তির দর্শন এবং মেহনতি জনসাধারণের কাছে এর বিপুল আকর্ষণ রয়েছে, তবুও নিপীড়নমূলক সামাজিক কাঠামো থেকে পরিত্রাণ পেতে দলিতদের দেওয়ার মতো খুব বেশি কিছু এতে ছিল না। আনন্দ তেলতুম্বড়ের মতে সিপিআই’র প্রথম দিককার মতবাদ প্রকরণ আম্বেদকরের মতো চিন্তাবিদদের মার্ক্সবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। এই ধরনের মতবাদের প্রকরণ পদ্ধতি প্রসঙ্গে তিনি মার্ক্সকে উদ্ধৃত করে বলেন, “যদি এটা মার্ক্সবাদ হয় তাহলে তিনি নিজে মার্ক্সবাদী না!”
বর্তমান পরিস্থিতিতে আনন্দ তেলতুম্বড়ে মনে করেন যে শুধু জাত পরিচয়ের রাজনীতি দলিত মুক্তিকে কোনও গন্তব্যে পৌঁছে দেবে না, বরং তাদের আরও বিভক্ত করবে। তিনি বিপ্লবের পথে এগোনোর জন্য শ্রেণী ও জাতের সমাকলনের পক্ষপাতী এবং আশা করেন যে আম্বেদকরের অসম্পূর্ণ লেখার প্রকাশনা “দলিত এবং কমিউনিস্টদের ভারতের এবং বিশ্বের ভবিষ্যত নির্মাণের বিলম্বিত কাজটি সম্পূর্ণ করতে অনুপ্রাণিত করবে।” (পৃষ্ঠা ৭৮)।
দলিত-বাম ঐক্যের আনন্দের এই প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব কিনা সে বিষয়ে আম্বেদকরের এই অসম্পূর্ণ গ্রন্থের দুটি অধ্যায় এবং অন্য কিছু লেখার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।
‘হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থাঃ তার অপরিহার্য নীতিসমূহ’ অধ্যায়ে আম্বেদকর মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার দুটি মৌলিক বিষয়ের উপর আলোকপাত দিয়ে শুরু করছেন।
১) ব্যক্তি নিজেই চূড়ান্ত অভীষ্ট, এবং
২) সামাজিক শৃঙ্খলা অবশ্যই স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে — ফরাসি বিপ্লবে উদ্ভাসিত ত্রিনীতি।
ডঃ আম্বেদকর এই নীতিগুলির অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন এবং হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থা ‘মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার’ এই মৌলিক নীতিগুলি অনুসরণ করে কিনা তা পরখ করেন; এবং তিনি দেখতে পান হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা এই অপরিহার্য নীতিগুলি অনুসরণ করতে সার্বিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আলোচনায় ডঃ আম্বেদকর হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সবচেয়ে বিভক্ত ও বৈষম্যমূলক দিকগুলোকে তুলে ধরেছেন। তিনি তখনকার সময়ের কেবল পাঞ্জাবের উদাহরণ টেনে বলেন যে সেখানকার প্রধান ব্রাহ্মণ জাতের দেড় কোটি মানুষের মধ্যেই আবার ১৮৮৬টি উপজাত আছে!
ডক্টর আম্বেদকর স্পষ্ট করে দেন যে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার প্রাথমিক এবং মৌলিক নীতি হল গ্রেডেড ইনইক্যুয়ালিটি বা ‘স্তরবিন্যস্ত অসমতা’। তিনি তাঁর বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য ‘মনুস্মৃতি’ থেকে দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, যা সাত ধরনের দাস চিহ্নিত করে দেখিয়ে দেয় এবং দেখায় যে হিন্দু বিধান দাসপ্রথাকে ‘বৈধ প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে! (পৃষ্ঠা ৯৮)। হিন্দু বিধিবদ্ধ আইন থেকে অসংখ্য উদাহরণ টেনে ডক্টর আম্বেদকর ‘ব্যাভিচার’ ইত্যাদির মতো বিভিন্ন আইনের নৃশংসতাকে দেখিয়ে দেন। ডঃ আম্বেদকর হিন্দুদের দ্বিতীয় নীতি হিসাবে “প্রতিটি শ্রেণীর জন্য পেশা নির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং বংশগতির দ্বারা তার ধারাবাহিকতা”কে চিহ্নিত করেছেন। হিন্দু সামজিক শৃঙ্খলার তৃতীয় নীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে “নিজস্ব শ্রেণীর অভ্যন্তরেই মানুষকে আবদ্ধ করে দেওয়া”। ডক্টর আম্বেদকর আরও উল্লেখ করেছেন যে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা “হিন্দু সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে অবাধ আদান-প্রদান এবং মেলামেশার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আন্তঃভোজন এবং আন্তঃবিবাহের বিরুদ্ধে রয়েছে বাধার প্রাচীর”। (পৃষ্ঠা ১০৮)।
আরেকটি অধ্যায়ে — ‘হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থাঃ এর অনন্য বৈশিষ্ট্য’, ডঃ আম্বেদকর হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে — ‘সুপারম্যানের উপাসনা’! আম্বেদকরের নিজের কথায়, “হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থা আদতে নিটশে কথিত সমাচারকে বাস্তবায়িত করা ছাড়া আর কিছু নয়”! (পৃষ্ঠা ১১১)। আম্বেদকর মনে করেন যে ব্রাহ্মণ হল হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সুপারম্যান, যিনি বিশেষ সুযোগের অধিকারী, হত্যার অপরাধে অপরাধী হলেও যাকে, মনুস্মৃতি অনুসারে, ফাঁসি দেওয়া যায়না। ডক্টর আম্বেদকর হিন্দু সমাজ ব্যবস্থাকে আরও ব্যাখ্যা করে বলছেন — “সাধারণ মানুষের উত্থান সুপারম্যানের আধিপত্যের বিরোধী… সাধারণ মানুষ এক চিরস্থায়ী অবমাননার অবস্থায় রয়েছে...”। (পৃষ্ঠা ১১৯)।
ডক্টর আম্বেদকরের অত্যন্ত দৃঢ় মত হল, “হিন্দুরাই পৃথিবীর একমাত্র জনতা যাদের সামাজিক ব্যবস্থায় — মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে ধর্ম দ্বারা পূতপবিত্র, শাশ্বত এবং অলঙ্ঘনীয় করা হয়েছে।” তিনি এই অধ্যায়টির উপসংহার টানেন এই বলে যে, “কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা হিন্দুদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং তার ফলে তা জোরদার ভাবে চলছে”। (পৃষ্ঠা ১৩০)।
আরেকটি অধ্যায়ে, ‘হিন্দুধর্মের প্রতীকগুলি’, আম্বেদকর ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিরে যান গ্রীক রাজা সেলিউকোসের রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিসের দৃষ্টির উপর ভর করে। হিন্দুদের সামাজিক সংগঠনটি অদ্ভুত ধরণের ছিল। মেগাস্থিনিস ভারতীয় জনসাধারণকে সাত ভাগে বিভক্ত করতে দেখেছিলেন। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আম্বেদকর চলে আসেন ১০৩০ খ্রীষ্টাব্দে। ভারতে আলবেরুনির ভ্রমণ বিবরণ উল্লেখ করেন, যিনি হিন্দুদের চারটি প্রধান জাত বা বর্ণ দেখেছিলেন, ব্রাহ্মণরা সবচেয়ে ওপরের থাকে। আম্বেদকর আরও উল্লেখ করেন যে পর্তুগিজ কর্মকর্তা ডুয়ার্তে বারবোসা ১৫০০-১৫৭১ সালে ভারতে ছিলেন, যিনি ভারতীয় জাতগুলির বিশদ বিশ্লেষণ দিয়েছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালপর্বে পাঞ্জাবের জাতগুলি সম্পর্কে ডেনজিল ইবেটসন লিখেছিলেন বলে উল্লেখ করেন আম্বেদকর। সম্পাদক আনন্দ তেলতুম্বড়ে তাঁকে “ভারতের আদমশুমারির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী আমলা” হিসেবে বিবেচনা করেছেন। (পৃষ্ঠা ১৪৭)। প্রকৃতপক্ষে ডেনজিল ইবেটসনের বই ‘পাঞ্জাব কাস্টস’ এখনও পাঞ্জাব সরকার তার পুরো নাম এবং পদবি ‘স্যার ডেনজিল চার্লস জেল্ফ ইবেটসন কেসিএসআই’ সহ ছাপে পাঞ্জাবের জাতগুলির তথ্যের প্রধান আকর হিসেবে।
ডঃ আম্বেদকর ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় জাত ও শ্রেণীকে পরস্পর সংযুক্ত হিসেবে দেখেন। ডাঃ আম্বেদকর জাতকে ‘বর্ণ’এর পরিণতি হিসেবে দেখার ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। বরং তিনি বলেছেন যে ‘জাত হল বর্ণের বিকৃতি’। ডঃ আম্বেদকর ‘সবর্ণ’ হিন্দুদের প্রশ্নটিও ছুঁয়েছেন। সবর্ণ মানে যারা চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে রয়েছে — ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এবং ‘অবর্ণ’ হিন্দু মানে যারা বর্ণ ব্যবস্থার বাইরে, যাদের ‘অন্ত্যজ’ও বলা হয়, মানে শূদ্রদের চেয়েও খারাপ! ডক্টর আম্বেদকরের পাণ্ডুলিপিটি এই শব্দগুলি দিয়ে শুরু হয় — ‘অবর্ণ হিন্দুরা গঠিত হয় তিনটি...।
সাধারণভাবে ভারতীয় সমাজ অধ্যয়ন এবং বিশেষ করে, দলিতদের জন্য যা সবচেয়ে নিপীড়ক ভূমিকা নেয় সেই হিন্দু ধর্মের জাত কাঠামোর উপর জোর দিয়ে হিন্দু সমাজকে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ডক্টর আম্বেদকরের পাণ্ডিত্য নিয়ে কেউই সন্দেহ প্রকাশ করতে পারবে না। মহাত্মা গান্ধী এবং অন্যদের মতো সংস্কারকরা হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সংস্কারের চেষ্টা করেছিলেন হিন্দু ব্যবস্থার মধ্যেই কোনোভাবে দলিতদের জন্য কিছু মর্যাদার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়ে, কিন্তু সমতা স্থাপন করে নয়। সেখানে ডঃ আম্বেদকর হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার অভ্যন্তরে দলিতদের জন্য সমতার কোনো সুযোগ খুঁজে পান না, তাই তিনি হিন্দু সমাজ ব্যবস্থাকেই ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সহ-দলিতদেরও একই কাজ করার আহ্বান জানান। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পর জীবনে খুব অল্প সময়ই তিনি পেয়েছিলেন। দলিতদের হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা থেকে বের করে এক নতুন স্বাধীনতা, সাম্য ও সংহতি ভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করার তাঁর পরিকল্পনাকে তাঁর অনুসারীরাও আর এগিয়ে নিয়ে যায়নি। এমনকি মায়াবতীর নেতৃত্বাধীন বহুজন সমাজ পার্টিও তা করেনি। এর আগে রিপাবলিকান পার্টির বিভিন্ন গোষ্ঠীও এটা করেনি। এবং এখন তাদের সকলকেই আরএসএস-হিন্দুত্ব ভিত্তিক দল বিজেপির করুণার পাত্রে পর্যবসিত হতে দেখা যাচ্ছে।
ডক্টর আম্বেদকরের লেখা এইসব কাগজপত্রগুলির এরকম এক আলোকিত ভূমিকা রচনার মাধ্যমে আনন্দ তেলতুম্বড়ে বামপন্থী ও আম্বেদকরপন্থীদের জন্য বিতর্কের এক নতুন বাতায়ন উন্মুক্ত করে দিয়েছেন যেখানে প্রবেশ করে তাঁরা উভয়েই এক সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পেতে পারেন ভারতকে আরএসএস-হিন্দুত্ব হিন্দু সামাজিক শৃঙ্খলার গ্রাসে পতনের ভবিতব্য থেকে বাঁচাতে, ডক্টর আম্বেদকর যে সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এত আবেগঘন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। আম্বেদকর যেমন ব্যাখ্যা করেছিলেন সেরকম সুপারম্যান হয়ে উঠছে নরেন্দ্র মোদী এই হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায়, যার সাথে দলিতদের কোনওরকম মিলমিশ থাকতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে বামপন্থী শক্তিগুলিই বোধহয় আম্বেদকর কল্পিত স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ জোটসঙ্গী হতে পারে। কিন্তু এই উভয় পক্ষই কি এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করবে? জার্মানির সর্বসেরা বাম/কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক রোজা লুক্সেমবার্গ ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার এক সোচ্চার আহ্বান রেখেছিলেন পরিস্থিতিকে এই বলে ব্যাখ্যা করে যে “সমাজতন্ত্র, অথবা বর্বরতা”! ভারত বোধহয় এখন সেই অবস্থাতেই আছে যেখানে ‘সমাজতন্ত্র অথবা বর্বরতা’ বেছে নিতে হবে! সমাজতন্ত্র, তা সে হতে পারে আম্বেদকর ধরনের বা ভগৎ সিং/চে গেভারা ধরনের, অথবা অন্য আরো কোনও ধরনের যেমনটা আজ লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে হচ্ছে, কিন্তু হিন্দুত্ব সামাজিক শৃঙ্খলার বর্বরতা কখনই একটা চয়েস হতে পারে না!
আশা রাখি আনন্দ তেলতুম্বড়ে বা প্রকাশ আম্বেদকরের মত আম্বেদকরপন্থী চিন্তাবিদরা এবং বিভিন্ন বামপন্থী গোষ্ঠি ও দলগুলি এক সাধারণ ভিত্তি খুঁজে পাবে; যেমন, আইআইটি চেন্নাই বা আরো বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা ‘ভগত সিং-আম্বেদকর-পেরিয়ার-ফুলে’ গ্রুপ গঠন করছে। হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট গাড্ডা থেকে দেশকে বের করে আনবে। কেন্দ্র ও বেশ কিছু রাজ্যে ক্ষমতায় এসে এবং ‘গো-রক্ষক’, শ্রীরামসেনা বা হিন্দু জাগরণ মঞ্চের মত অসংখ্য বাহিনী গড়ে, যারা দাবলকর-পানসারে-কালবুর্গি-গৌরি লঙ্কেশের মতো যুক্তিবাদীদের এবং আখলাক-জুনেইদদের হত্যা করছে, এই হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলি এই মুহূর্তে অত্যন্ত বলশালী হয়ে উঠেছে। ইতিহাস বিকৃত করে মিথ্যার জাল বুনে ধর্মোন্মত্ত জিগির তৈরি করছে ১৯৩০’র জার্মানির হিটলার ও ইটালির মুসোলিনিদের মতো, যার মূল্য তখন শুধু ওই দু’টি দেশকে নয় সারা পৃথিবীকেই চোকাতে হয়েছিল। আজও একইরকম বিশ্ব পরিস্থিতি, দু’টি বিপুল জনসংখ্যার দেশে ট্রাম্প ও মোদীর মতো শাসক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত!
আশা করি ভারতীয় ও মার্কিন জনতা ইতিহাস থেকে কিছু শিক্ষা নেবে এবং এর পুনরাবৃত্তি হতে দেবে না, হলে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের থেকেও বহুগুণ ধ্বংসাত্মক হবে। ডক্টর আম্বেদকরের অসমাপ্ত গ্রন্থটি এই শিক্ষা লাভ করার পথ দেখাতে পারে।
(চমনলাল জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। অবসরপ্রাপ্ত। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভগৎ সিং’ এবং অন্যান্য বেশ কিছু দলিত সাহিত্যের রচয়িতা। বুক রিভিউ রূপে এই নিবন্ধটি কাউন্টার কারেন্টস ডট অর্গে প্রথম প্রকাশিত হয়। ভাষান্তরঃ মলয় তেওয়ারি)
মুর্শিদাবাদে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুবাদে কিছু উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমাদের মূল কাজের এলাকা খড়গ্রামের ঝিল্লি অঞ্চলে কিছুটা গণভিত্তি থাকায় এই অঞ্চলে কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই অঞ্চলে অতীতে বেশ কয়েকজন কমরেড শহীদ হয়েছেন। তাদেরই রক্ত পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন হায়দার শেখের নেতৃত্বে হাসান, সাদ্দাম, নিজারুল শেখ সহ যুবশক্তি ও প্রবীন কমরেডরা। ঝিল্লি পঞ্চয়েতে আমরা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে আমরা ৫/৬ গ্রাম সভায় শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে বিরাজ করছি। এবারের নির্বাচনে কেলাই (২) গ্রাম সভায় আমাদের মহিলা প্রার্থী বুল্টি বিবি তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন। শুধু তাই নয়, পাশের সিয়াটা গ্রামসভায় আমাদের প্রার্থী মাত্র তিন ভোটে ও ধ্বনি গ্রামে মাত্র ৯ ভোটে তৃণমূলের কাছে পরাজিত হয়েছেন। সিপিআই(এম) প্রথমে কথা দেয় যে তারা আমাদের সমর্থন করবে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আমাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়। ওইখানে পঞ্চায়েত সমিতির ভোটে আমাদের প্রার্থী তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। আরেকজন প্রার্থী, সার্জিনা বিবি ৭০০’র কাছাকাছি ভোট পান। জেলা পরিষদের প্রার্থী প্রদীপ অধিকারী ২১৪০ ভোট পান। বহরমপুরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কাশীমবাজারের মনীন্দ্রনগর গ্রাম পঞ্চায়েতে সুন্দর কলোনি গ্রাম সভাটি শ্রমজীবী অঞ্চল। এখানকার ৯৫ শতাংশ মানুষ শ্রমজীবী। আমাদের প্রার্থীও একজন শ্রমজীবী। মানুষের মধ্যে পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। স্থানীয় মানুষের, বিশেষ করে মহিলা ও যুবকদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। আগামীদিনে পার্টি সংগঠনের বিস্তারের সম্ভাবনা যথেষ্ঠই রয়েছে। বেলডাঙা পঞ্চায়েতে এবার আমরা প্রথম দাঁড়িয়েছি। এলাকায় কমরেডরা প্রার্থীর সমর্থনে ভালো প্রচার করেন। কিন্তু, এখানে তৃণমূলের তীব্র সন্ত্রাস, বিশেষ করে নির্বাচনের দিনে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে, সমস্ত বিরোধীদলের এজেন্টদের বলপূর্বক বার করে একতরফা ছাপ্পা ভোট দেয়। এতদ্বসত্তেও, জেলা পরিষদে আমাদের প্রার্থী ১১৪০ ভোট পান। মুর্শিদাবাদে আগামীদিনে আমাদের পার্টি বিস্তারের ভালই সম্ভাবনা রয়েছে।
- ধীরেশ গোস্বামী
ঘনিষ্ঠ সাথী কমরেড শ্রীকৃষ্ণ পাল ১৫ জুলাই ২০২৩ সকালে প্রয়াত হন। তিনি হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় নকশালবাড়ি আন্দোলন ও পরবর্তীকালে আইপিএফের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন। তিনি কৃষ্ণাদা নামেই পরিচিত ছিলেন। তিনি ডানলপের শ্রমিক ছিলেন, আটের দশকে ডানলপে যে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক ধর্মঘট হয় কৃষ্ণাদা তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। তিনি বাঁশবেড়িয়া উইন্ডো গ্লাস কারখানায় মহিলাদের নিয়ে ইউনিয়ন গড়ে তোলেন। বন্ধ ডানলপ কারখানার শ্রমিকদের বকেয়া প্রদানের দাবিতে এখনও তিনি ছিলেন সক্রিয়।
কৃষ্ণাদার স্ত্রী আইপিএফের হয়ে বাঁশবেড়িয়া পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কৃষ্ণাদা মানবাধিকার সংগঠনের সাথেও যুক্ত ছিলেন।
নকশালবাড়ির ৫০ বর্ষে তিনি পার্টি কর্মসূচিতে শিলিগুড়ি গিয়েছিলেন।
কমরেড শ্রীকৃষ্ণ পাল লাল সেলাম!
গত ১৭ জুলাই ২০২৩ সকাল ১০টা নাগাদ যাদবপুর কেপিসি হাসপাতালে প্রয়াত হলেন কমরেড সুপ্রভা বেরা। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। দীর্ঘদিন শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন তিনি।
বালিতে পার্টির গোপন সময়ের অন্যতম শেল্টার ছিল কমরেড সুপ্রভা বেরার বাড়ি। দীর্ঘদিন লিবারেশন পত্রিকা গোপনে এই বাড়িতেই তৈরি হয়েছে। পার্টির বহু নেতৃত্বের নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল ছিল এই বাড়ি। রাতবিরেতে যখন প্রয়োজন পড়েছে কমরেডরা নির্ধিদায় পৌঁছে যেতেন এই শেল্টারে এবং প্রতিবারই অবিভাবক সুলভ স্নেহে কমরেড সুপ্রভাদি আগলে রাখতেন তাঁদেরকে।
বালির প্রথমদিকের মহিলা সমিতি তৈরির সময়েও কমরেডের ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। আমৃত্যু পার্টির সদস্যা ছিলেন কমরেড সুপ্রভা বেরা।
রেখে গেলেন তাঁর কমরেড তথা জীবনসঙ্গী কমরেড গোপাল বেরা এবং তার দুই সন্তান ও পার্টির শোকমগ্ন পরিবারকে।
কমরেড সুপ্রভা বেরার শেষ যাত্রায় উপস্থিত ছিলেন পার্টির নেতা কমরেড কার্তিক পাল, প্রবীর হালদার, জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, কল্যাণী গোস্বামী সহ স্থানীয় পার্টি ও ছাত্র নেতৃত্ব।
কমরেড সুপ্রভা বেরা লাল সেলাম!
কমরেড সুপ্রভা বেরা অমর রহে!
====000====