আজকের দেশব্রতী : ১৩ জুলাই ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-13-july-23the-post-election-situationpost-election-situation

১২ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অভিজিত মজুমদার এক প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে আবেদনে জানান — দশম পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন পেশ থেকে ভোটদান ও গণনা পর্ব পর্যন্ত শাসকদল তৃণমূলের পরিকল্পিত রিগিং, বিরোধীদের শারীরিকভাবে আক্রমণ, হত্যা ও সর্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজ্যবাসী তীব্রভাবে সোচ্চার হোন।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পেশের প্রথমদিন থেকে ভোট গণনার দিন অবধি এই একমাস সময়সীমায় রাজ্যে নির্বাচনী হিংসার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন সহনাগরিক। প্রাণ হারিয়েছেন হতদরিদ্র গ্রামীণ মানুষেরা। রাজ্যবাসী অসহায়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন পঞ্চায়েত স্তরে চলমান পাহাড়প্রমান দুর্নীতি, স্বজনপোষন ও তৃণমূলের বাহুবলীদের দ্বারা সামাজিক সন্ত্রাসকে নিরঙ্কুশ রাখতে বিরোধী দলের কর্মী ও প্রার্থীদের ওপর যুথবদ্ধ শারীরিক আক্রমণ, খুন, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, পুলিশের সহযোগিতায় গণনাকেন্দ্র দখল করে ফলাফল পাল্টে দেওয়ার নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশ। তৃণমূলী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক প্রার্থীদের সমর্থনে দলীয় কর্মী ও গ্রামবাসীদের প্রতিস্পর্ধায় কতকগুলি কেন্দ্রে শাসক অনুগত দুষ্কৃতিরা পিছু হটেছে। কিন্তু রাজ্যের সর্বত্র মাত্রাছাড়া সন্ত্রাসকে অব্যাহত রাখতে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ইন্ধন, নির্বাচন কমিশনারের শাসকের তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবস্থান করা এবং পুলিশ প্রশাসনকে দলীয় কর্মীর ভূমিকায় রাখতে সফল হয়েছে শাসকদল।

ভোট গণনাকেন্দ্রে বিরোধীদলগুলির গণনাকারীদের ভয় দেখিয়ে হটিয়ে দেওয়া থেকে শারীরিক নিগ্রহে সক্রিয় থেকেছে তৃণমূলী গুণ্ডারা। এমনকি গণনা শেষে বিরোধী দলের বিজয়ীদের তৃণমূলে যোগদান করার জন্য নানান অন্যায্য, অসাধু কৌশল ও ভীতি প্রদর্শনের রাস্তা নেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রী আগেই এই মর্মে বিবৃতি দিয়েছিলেন।

সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে জানা যাচ্ছে গণনা চলাকালীন গতকাল গভীর রাতে ভাঙড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন দু’জন আইএসএফ কর্মী। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ র‍্যাফের পোষাকে তৃণমূলের খুনে বাহিনী এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। এখনও এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের প্রকৃত পরিচয় জানা যায়নি।

আমরা এই হত্যাকাণ্ডের উচ্চস্তরীয় তদন্ত, খুনিদের কঠোর শাস্তি ও নিহতদের পরিবারগুলিকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবি জানাই।

নির্বাচনী অঙ্গনকে শুধু প্রহসন নয়, বরং এক সর্বব্যাপী বধ্যভূমিতে রূপান্তর ঘটিয়েছে মমতা ব্যানার্জী পরিচালিত সরকার ও শাসকদল।

রাজ্যবাসীর কাছে আমাদের আবেদন কেবলমাত্র ধিক্কার জানানোই যথেষ্ট নয়, আসুন এই ভক্ষক ও খুনি শাসকের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ সংগঠিত করি।

rigging-in-counting-in-panchayat-electionscounting-in-panchayat-elections

১৩ জুলাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে অভিজিত মজুমদার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার সিনহার কাছে এক স্মারকলিপিতে জানান — আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে আপনাকে অবহিত করছি, এবারে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন এক অভূতপূর্ব সন্ত্রাসের চালচিত্র হাজির করেছে। সমগ্র দেশে এই ছবি বিরল।

নির্বাচনের ঘোষণা, মনোনয়ন পত্র দাখিলে অব্যবস্থা, মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারে বিরোধী প্রার্থীদের জোরজবরদস্তি নাম প্রত্যাহার করানো, নির্বাচনের দিন ভয়ংকর সন্ত্রাস, কেন্দ্রীয় বাহিনী-রাজ্য পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, পক্ষপাতিত্ব, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, প্রাণহানি ইত্যাদি ঘটেছে।

গণনার দিন গণনা কেন্দ্র থেকে বিরোধী দলের প্রার্থী, এজেন্টদের অপহরণ করা থেকে শুরু করে মারধর, কাউন্টিং এজেন্টদের গণনা কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া, গণনা কেন্দ্রের ভিতরেই নতুন করে ছাপ্পা দেওয়া, ব্যালট লুট, জয়ী প্রার্থীর শংসাপত্র ছিঁড়ে দিয়ে শাসকদলের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা ইত্যাদি সবই স্থানীয় প্রশাসনিক আধিকারিকদের উপস্থিতিতে ঘটেছে, যা নিরপেক্ষ নির্বাচন, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী। পরিশেষে দক্ষিণ ২৪ পরগণার স্পর্শকাতর ভাঙর-২ নং ব্লকের কাঁঠালিয়া জেলা পরিষদ আসনে আইএসএফ প্রার্থীর জয়লাভ ঘোষণা, পরবর্তীতে শাসকদলের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা নির্বাচনী বিধি অবজ্ঞার এক ভয়ংকর নিদর্শন। ঘটনার জেরে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, গুলিতে ৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা হাড় হিম করা সন্ত্রাসের বাস্তবতাকে প্রমান করে।

আমরা নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন, ভোট গণনার দিন জেলাগুলোর বিশেষ পর্যবেক্ষক, ব্লক পর্যবেক্ষক ও আপনার দপ্তরকে বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় অভিযোগপত্রের মাধ্যমে বারবার অবহিত করেছি। আমরা কয়েকটি জেলার কয়েকটি ব্লকের ঘটনা জানিয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

১। হুগলি জেলার ধনেখালি ব্লকে আমাদের প্রার্থীদের গণনাকক্ষ থেকে বলপ্রয়োগ করে বের করে দেওয়া হয়, একজন প্রার্থীকে শারীরীকভাবে নিগ্রহ করা হয় ও অন্যান্য কাউন্টিং এজেন্টদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

২। পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা ও মন্তেশ্বর ব্লকে ভোটগ্রহণের দিন আমাদের প্রার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয় ও গণনার দিন এজেন্টদের বাধা দেওয়া হয়েছে।

৩। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে, ঠাকুরপুকুর মহেশতলা ব্লকের রসপুঞ্জ পঞ্চায়েতে আমাদের প্রার্থীকে গণনাকক্ষে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সমস্ত ঘটনাই শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দ্বারা সংগঠিত হয়েছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দাবি —

১। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গ্রাম বাংলায় চলমান সন্ত্রাস অবিলম্বে বন্ধ করতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

২। কাউন্টিংয়ের দিন ভাঙর সহ সমস্ত সন্ত্রাসের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।                 
৩। নিবার্চন পর্বে সমস্ত মৃত ব্যক্তির পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে সরকারকে যথাযথ সুপারিশ করতে হবে।

৪। কাউন্টিংয়ের ক্ষেত্রে বিজয়ী প্রার্থীর শংসাপত্র পরিবর্তনের জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক আধিকারিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে

আশা করি, গুরুত্বের সাথে সমস্ত ঘটনাবলীর নিরপেক্ষ তদন্ত করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

happiness-is-not-i-wanti-want-to-win-win

ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নের উত্তরে দুর্যোধন বলেছিলেন, “সুখ চাহি নাহি মহারাজ। জয়, জয় চেয়েছিনু আমি”।

আজ তিনি জয়ী। জয় তিনি চেয়েছিলেন, একছত্র নিরঙ্কুশ জয়। নীতি, নৈতিকতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সোপানতলে তরতাজা সহনাগরিকদের হত্যা করে গ্রামীণ ক্ষমতাপাটে আসীন হয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুঝি দুর্যোধনের কথাগুলোকেই প্রতিধ্বনিত করলেন! তিনি চেয়েছিলেন জয়। নিরঙ্কুশ জয় ও বিরোধী পরিসরকে সংকুচিত করার দাপট ছিল তাঁর অভিষ্ঠ লক্ষ্য। সাথে ক্ষমতা প্রদর্শনের কুৎসিত উচ্ছাস। কত প্রাণের বিনিময়ে, কত রক্তস্রোতে, কত স্বজনহারার আর্ত কান্নার পথ ধরে সেই জয় আসবে, তার জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।

নিহত মানুষদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকার ‘ক্ষতিপূরণ’, হোমগার্ডে ‘চাকরি’র মতো কিছু খুঁদকুড়ো ছড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী পাপস্খলন করার জন্য কিছু সরকারি ঘোষণা করলেন মাত্র।

মৃতের সংখ্যা নিয়ে তরজা শুরু হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরে খুনোখুনি কম না বেশি তা নিয়ে চলছে নির্লজ্জ বাছবিচার। আর এর মধ্যেই নির্বাচনী চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে মামলা ও কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে গোটা বিষয়টাই চলে গেল পরবর্তী রায় ঘোষণার উপর — এককথায় যা নজীরবিহীন!

আগামী বছরে লোকসভা নির্বাচনের আগে গ্রাম বাংলায় কার রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় থাকবে — এই শক্ত চ্যালেঞ্জ ছিল শাসক দলের কাছে। দুর্নীতির নানা অভিযোগে বিদ্ধ রাজ্যের শাসক দলের ডাকাবুকো নেতা, শিক্ষা জগতের একের পর এক অধিকর্তা যখন জেলে, অত্যন্ত সক্রিয় কেন্দ্রীয় এজেন্সি শকুনের চোখ দিয়ে নজরদারি ও হস্তক্ষেপ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে, অতি তৎপর আদালতের একের পর রায় যখন রাজ্য সরকার পর্যুদস্ত, ১০০ দিনের প্রকল্পে বিরাট মজুরি বকেয়া — আর, নানান ঘটনায় রাজ্যে শাসকের ভাবমূর্তি যখন তলানিতে, এই রাজনৈতিক আবহে পঞ্চায়েত নির্বাচন এক বিরাট গুরুত্ব নিয়ে এ রাজ্যে হাজির হয়। আজ্ঞাবহ এক নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে তড়িঘড়ি নির্বাচনী নির্ঘণ্ট প্রকাশ করে বিরোধী দলগুলোকে বেকায়দায় ফেলা থেকে শুরু করে প্রথম থেকেই রাজ্য সরকারের নানা পদক্ষেপ উত্তেজনার পারদ বাড়াতে যথেষ্ট রসদ জুগিয়েছিল। যত দিন গেছে, ততই উলঙ্গ হতে শুরু করে নির্বাচন কমিশনের তথাকথিত নিরপেক্ষ ভূমিকার শেষ কৌপিনটুকুও।

সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের অনুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ এখনও অনেক বাকি। কিন্তু যে বার্তাটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল তা হল, রাজ্যের তৃণমূল-বিজেপি-র তৈরি করা দিত্ব বা বাইনারির ভাষ্যের বাইরেও আরেকটি পরিসর গড়ে উঠছে। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ সহ তৃতীয় এক শিবির, তৃণমূলের বিরুদ্ধে যারা অনেক জায়গায় গড়ে তুলেছেন শক্ত প্রতিরোধ। নিহত সহনাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে তরুণ সংখ্যালঘু যুবক, যা বুঝিয়ে দিচ্ছে সংখ্যালঘুদের মধ্যে থেকেই কিছু প্রতিরোধ শুরু হয়েছে রাজ্যের শাসকের বিরুদ্ধে — যে সামাজিক অংশটি এতদিন ছিল তৃণমূলের শক্ত পোক্ত ভিত্তি। তৃণমূলের দু’জন সংখ্যালঘু বিধায়ক এবার প্রথম থেকেই দলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। জনজাতি, মতুয়া, রাজবংশীদের মধ্যে বিজেপি-র ফাটল ধরা শুরু হয়েছে। ২০১৮-তে একতরফা যে বিপুল মাত্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃণমূল জিতেছিল, এবার সেখানে রাশ টানা গেছে।

রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক কৃষকের জমি হারানো ও তারই হাত ধরে দ্রুত গতিতে কৃষকদের সর্বহারাকরণ, কৃষিকাজে আগ্রহ হারানো তরুণ গ্রামীণ যুবকের এক বিরাট অংশ রুটি রুজির সন্ধানে পরিযায়ী হওয়া, কৃষি অর্থনীতির প্রধান স্থান দখল করে নেওয়া অ-কৃষিকাজ, মুখ থুবড়ে পড়া একশ দিনের কাজ, এই সমস্ত প্রবণতার পাশাপাশি খুঁজতে হবে কোন রাজনৈতিক শ্রেণিটি গ্রামবাংলায় আজ পঞ্চায়েতকে কুক্ষিগত করেছে, আর ঠিক কোন আর্থিক রাজনৈতিক স্বার্থকে ধরে রাখতে এত মরিয়া, বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তারা। তাদের বিরুদ্ধেই বা লড়াই হবে কিভাবে।

ভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক মেরুকরণকে বামপন্থার ইতিবাচক লক্ষে পরিচালিত করাই এখন সামনের দিনের দাবি।

maharashtra-exposes-the-farce-of-modimodi’s-anti-corruption-diatribes

শিবসেনায় ‘দলত্যাগের’ ভাঙন-চাতুরির ঠিক এক বছরের মাথায় এবার মোদী-শাহ রাজের নিশানায় ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি। মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার আরও একবার উপ মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন। রবিবাসরীয় এই আচমকা অভ্যুত্থান বিশেষভাবে চর্চায় এল কেন? কারণ এটা ঘটলো প্রধানমন্ত্রী মোদীর মধ্যপ্রদেশে ‘প্রতিশ্রুতি’ ভাষণ দিয়ে আসার বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে! সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদী অতিনাটকীয়ভাবে ঘোষণা করেন যে, বিরোধীরা যদি দুর্নীতির গ্যারান্টি দেয়, তিনি দুর্নীতিগ্রস্তের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের গ্যারান্টি দিয়ে গেলেন! ঐ ভাষণে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে অন্তত ৭০,০০০ কোটি টাকার ঘোটালার জন্য এনসিপি-কে অভিযুক্ত করেন। অজিত পাওয়ার শিবির থেকে যে ন’জন মন্ত্রী মহারাষ্ট্রের ক্যাবিনেটের জন্য শপথ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন ইডি’র নজরে আছেন কয়েক বছর ধরে। এইভাবে মহারাষ্ট্র আরও একবার মোদীর দুর্নীতি-বিরোধী বাগাড়ম্বরের ‘অলীক কুনাট্য’ তথা মিথ্যাচারের পর্দাফাঁস করে দিল।

মোদীর দুর্নীতিগ্রস্তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের ‘গ্যারান্টি’র মানেটা এখন মানুষের কাছে জলের মত পরিষ্কার। সেটা হচ্ছে, রাজনীতিবিদরা বিরোধী শিবিরে থাকলে শিকার হবেন নির্যাতন ও প্রতিহিংসার, আর তারা বিজেপি-শিবিরে ভিড়ে গেলে সব অভিযোগ থেকে মিলবে অব্যাহতি, তার সঙ্গে ‘ক্ষমতা’। মোদী যখন বলেন ‘দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো রাজনীতিককে ছাড়া হবে না’ তার আসল মানে তার সরকার সেই সব লোককে বিজেপি’তে ভেড়ানোর জন্য বলপ্রয়োগসহ সব রকম চেষ্টা করবে। বিজেপি হল সব রকম অপরাধে অভিযুক্ত সেই সব লোকেদের ‘শেষ সাফাইয়ের মেশিন’ — যে অপরাধের মধ্যে আছে, আর্থিক তছরূপ থেকে যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণ থেকে সমস্ত ধরণের বিদ্বেষ ও হিংসামূলক অপরাধ। অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং পশ্চিমবঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী থেকে এখন মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার ও ছগন ভুজবল, বিজেপি শিবিরে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত ঘোটালা-অভিযুক্তদের তালিকা দিনের পর দিন আরও দীর্ঘ হয়ে চলেছে।

মোদীর এই বাচিক আগ্রাসন যেখানে তিনি বিরোধীদের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের পরম্পরা’ বলে তোপ দেগেছেন, সেটা স্পষ্টতই একটা ভয় থেকে। তার আশঙ্কা, বিভিন্ন বিরোধীদলগুলোর মধ্যে ক্রমশ বেড়ে ওঠা নির্বাচনী সমঝোতা আমজনতাকে উদ্দীপ্ত করে মোদী রাজের প্রতি তাদের ক্রোধকে আগামী নির্বাচনগুলোতে বিজেপি’র চূড়ান্ত পরাজয়ের অভিমুখে চালিত করবে। এমনকি, কোনো বিরোধী ঐক্য ছাড়াই কংগ্রেস হিমাচলপ্রদেশ এবং কর্ণাটকে বিজেপি’কে যথেষ্ট জোরালো আঘাত হেনে পরাস্ত করতে পেরেছে। আশাবাদী কংগ্রেস এখন নতুন উদ্যমে পরবর্তী পর্যায়ের বিধানসভা নির্বাচনগুলোতে ফিরে আসার এক প্রলম্বিত সম্ভাবনা নিয়ে সমুপস্থিত; যেমন মধ্যপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় ক্ষমতা দখলের, আর ছত্তীশগড় এবং সম্ভবত রাজস্থানেও ক্ষমতা ধরে রাখার উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই কংগ্রেস নির্বাচন লড়বে। নির্বাচনী গুরুত্বের প্রেক্ষিতে, ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য মহারাষ্ট্র যেটি লোকসভায় ৪৮ জন সাংসদ পাঠায়। তাই নিঃসন্দেহে বিজেপি’র কাছে এই রাজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

বিজেপি, একনাথ শিণ্ডে-দেবেন্দ্র ফড়নবীশ সরকারের অন্তর্নিহিত অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্ক (বেশ সপ্রতিভ একটি নাম দেওয়া হয়েছে এই সরকারের — ‘ইডি’ সরকার!)। কারণ একনাথ শিণ্ডে এবং তার সহকর্মীদের মাথার ওপর ঝুলছে ‘অযোগ্যতার’ খাঁড়া যেহেতু অদূর ভবিষ্যতে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ মহারাষ্ট্র-সংকটের বিষয়টি ফিরে দেখবে। তাৎক্ষণিক প্রেক্ষিতে, দলত্যাগী এনসিপি বিধায়কদের অন্তর্ভুক্তি হয়তো শিণ্ডে ও তার সহকর্মীদের সম্ভাব্য অযোগ্যতার কারণে যে কোন সংখ্যার ঘাটতি পূরণ করবে, এই আশায়। কিন্তু এখন এটা পরিষ্কার যে অজিত পাওয়ারের সঙ্গে এখনও প্রয়োজনীয় সংখ্যা নেই এবং বেশ কিছু দলত্যাগী সদস্যের শারদ পাওয়ার শিবিরে ফিরে আসার সম্ভাবনাও রয়েছে যার ফলশ্রুতিতে হয়তো শারদ পাওয়ার আবার জনতার কাছে ফিরে যাবেন পার্টি পুনর্গঠনের জন্য। ইতিমধ্যে এনসিপি অজিত এবং অন্য বিধায়ক যারা শিণ্ডের মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছেন তাদের ‘অযোগ্যতার’ আবেদনও জানিয়ে রেখেছে এবং বিদ্রোহী সাংসদদের বহিষ্কার করেছে। এই ভাবেই লড়াইটা শুরু হয়েছে মাত্র এবং পরিস্থিতি অমীমাংসিতই থাকছে, এমনকি সাময়িক ভিত্তিতেও নিষ্পত্তি অধরা।

ভারত জুড়ে মোদী সরকার ‘গুজরাট মডেল’-এর জন্য চিহ্নিত। যদিও গুজরাটের আধিপত্যের ধারণাকে প্রশমিত করতে মোদী-শাহ বন্ধনীতে যোগী আদিত্যনাথকে জুড়ে দেওয়া এবং নরেন্দ্র মোদীকে লোকসভায় বারাণসীর প্রতিনিধিত্বে রাখা হয়েছে, চারটি গুজরাটি হাতে ক্ষমতা ও সম্পদের অভূতপূর্ব কেন্দ্রীভবন কারও নজর এড়াতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বিষয়টি ভীষণভাবে অনুরণিত শুধু কাশ্মীরে নয়, যে রাজ্যটি তার সাংবিধানিক অধিকারগুলি হারিয়েছে, বা শুধু দিল্লীতে নয়, যেখানে একটি নির্বাচিত রাজ্য সরকারের সাংবিধানিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে এক আক্রমণাত্মক কার্যনির্বাহী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে। অথবা তামিলনাড়ু এবং দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্য যেগুলি ভাষা ও সংস্কৃতিগতভাবে স্বতন্ত্র্যচিহ্নিত, শুধু সেখানেই নয়। ঠিক এই মুহূর্তে সেই প্রতিধ্বনি স্পষ্ট হচ্ছে ভারতীয় পুঁজিবাদের ‘প্রাণকেন্দ্র’ মহারাষ্ট্রে! একদিকে যেমন বহু প্রজেক্ট, অফিস এবং প্রাতিষ্ঠানিক সম্পদ স্থানান্তরিত হয়ে বা গতিমুখ পাল্টে মহারাষ্ট্র থেকে গুজরাতে চলে যাওয়া, অন্যদিকে মহারাষ্ট্র-কেন্দ্রিক আঞ্চলিক পরিচিতি সম্পন্ন দুই রাজনৈতিক দল শিবসেনা ও এনসিপি'র ওপর জোরালো রাজনৈতিক আক্রমণ, গুজরাট মডেলের আধিপত্যের নিচে থাকা মহারাষ্ট্রকে অস্থির অশান্ত করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা তাই আজ বেশি জরুরি চর্চার বিষয় মহারাষ্ট্র রাজনীতিতে।

গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা ফাটলের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডার উঠে আসাই ছিল তার পরিণাম স্বরূপ শিবসেনা ও বিজেপি’র মধ্যে বিচ্ছেদের অন্তর্নিহিত কারণ।

গত তিন দশক ধরে হিন্দুত্বের উত্থানের সময় এই দুই দলের মধ্যে ছিল মতাদর্শগত ঘনিষ্ঠতম অন্তরঙ্গতা। অন্তর্নিহিত হিন্দুত্বের বন্ধন সত্ত্বেও, যদি বা গুজরাট মডেলের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের কারণে শিবসেনা-বিজেপি’র বন্ধুত্ব টিঁকতে না পারে, এনসিপি বিজেপি’র সঙ্গে প্রকৃত অর্থে মতাদর্শগতভাবে কখনোই যুক্ত ছিল না, সম্ভবত একমাত্র আর্থিক ও বিদেশ নীতিসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া। নিগ্রহের ভয় এবং ক্ষমতার লোভ শিবসেনা এবং এখন এনসিপি’রও বেশিরভাগ বিধায়ককে বিজেপি’র ছাতার তলায় ভিড়তে বাধ্য করেছে। কিন্তু উপনির্বাচন ও এপিএমসি নির্বাচনের ফলাফল এবং উদ্ধব ঠাকরে’র শিবসেনা ও শরদ পাওয়ারের এনসিপি’র নিচুতলার সমর্থন পরিষ্কার একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে — শিবসেনা এবং এনসিপি'র যেসব বিধায়ক বিজেপি’র কাছে মাথা মুড়িয়েছেন তারা তাদের সংশ্লিষ্ট গণভিত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।

ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে, ক্ষমতা ধরে রাখতে মোদী সরকার এখন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, রাজনৈতিক বলপ্রয়োগ এবং যে কোনো মতবিরোধের নির্মম কণ্ঠরোধের ওপর বেপরোয়াভাবে নির্ভর করছে। মাটির মানুষের দৈনন্দিন জীবনের উদ্বেগ-ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন এই সরকারের ক্ষমতামত্ত ঔদ্ধত্য এখন মহারাষ্ট্র থেকে মণিপুরে ভয়ানক প্রকট হয়ে পড়েছে। বিরোধীদের এই সরকারের বিবেকহীন ক্ষমতার খেলায় বাধা পেয়ে থামলে চলবে না, জনসংযোগ গড়ে তুলে নতুন শক্তি আর উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। মোদীর মহারাষ্ট্র নিয়ে জুয়া খেলা অবশ্যই বুমেরাং হয়ে তার দিকেই ফিরে আসবে আর তার পতনকে ত্বরান্বিত করবে!

এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৪ জুলাই, ২০২৩

সারা ভারত নির্মাণ শ্রমিকদের চতুর্থ সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল কন্যাকুমারীতে
https://www.ba.cpiml.net/deshabrati/2023/07/results-of-the-recently-concluded-panchayat-elections-a-brief-observationelections-a-brief-observation

শাসক দলের বেলাগাম সন্ত্রাস, নির্বাচন কমিশনের নির্লজ্জ নিষ্ক্রিয়তা ও রাজ্য সরকার পরিচালিত পুলিশ বাহিনীর পুরোপুরি শাসকের আজ্ঞাবহ সন্ত্রাসের সহচরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে দশম পঞ্চায়েত নির্বাচন। চরম অরাজকতা ও বহমান সন্ত্রাসের অনুষঙ্গে ভোট গণনাপর্বও সাঙ্গ হয়েছে। অদ্যাবধি প্রাপ্ত হিসেব অনুযায়ী শাসক তৃণমূল কংগ্রেস মোট ভোটের ৫২.২২%, বিজেপি ২২.৬৯%, সিপিএম ১২.৫৪%, কংগ্রেস ১৩.৯৩% ও নির্দল প্রার্থীরা ৪.৭১% সংগ্রহ করেছেন। এই ভোটপ্রাপ্তির শতাংশের হিসেব চূড়ান্ত না হলেও এই তুলনামূলক সাফল্যের খতিয়ানের অদলবদল ঘটার সম্ভাবনা নেই। ভোট গণনার দিন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ভাঙড়ে পুলিশ, তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনীর তাণ্ডবে আইএসএফের দু’জন (অসমর্থিত হিসাবে ৩ জন) কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন বহু কেন্দ্রে পক্ষপাতদুষ্ট ফলাফল প্রকাশ করেছে, এই অভিযোগে কলকাতা হাইকোর্টে রীট পিটিশনের সূত্রে আদালত জয়ী প্রার্থীদের বৈধতা খতিয়ে দেখার কথা বলে আগামী ২০ জুলাই অবধি নির্বাচনী ফলাফলের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করায় রাজ্য রাজনীতির পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আদালতের সাহায্য নিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে উদ্যোগী।

ভোটের ফলাফলে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে যে তা অনস্বীকার্য। এতৎসত্ত্বেও নির্বাচনের সামগ্রিক ফলাফল প্রমাণ করেছে যে গ্রামবাংলায় শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য এখনও শাসক তৃণমূলের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাচনী পরিসরে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিজেপির ভোট প্রায় ১৫% হ্রাস পেয়েছে। রাজ্যে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে সাফল্যের সূচকে ‘বিজেপির গড়’ হিসাবে বিজ্ঞাপিত উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলে বিজেপির মোক্ষম শক্তিক্ষয় ঘটেছে। রাজবংশী জনজাতি ও আদিবাসীদের ভোট বিজেপির থেকে সরে গিয়ে তৃণমূলের বাক্সে জমা হয়েছে। ব্যাপক সন্ত্রাস, ভোট লুট, নির্বাচনী হিংসা ও হত্যার মহাভারত রচনা করলেও, মূলত তৃণমূল সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভান্ডার, দুয়ারে সরকার, দুয়ারে রেশন প্রভৃতি জনতোষিনী সামাজিক প্রকল্পগুলি নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম ধারক হিসাবে মান্যতা পেয়েছে। অন্যদিকে রাজ্যের কয়েকটি প্রান্তে কংগ্রেস-আইএসএফ জোট বাধায় ভোটপ্রাপ্তির শতাংশ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বামফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিএম সহ অন্যান্য বাম গণতান্ত্রিক দলগুলি শাসকের তুমুল সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে কেন্দ্রগুলিতে সাহসী প্রতিরোধ গড়তে সমর্থ হয়েছে, সেখানে বামেরা জনগণের সমর্থনে জয়ী হতে পেরেছে। লক্ষণীয় পরিবর্তন এই যে গ্রাম পঞ্চায়েতস্তরে শাসক তৃণমূলকে হারাতে বাম ও রামের অলিখিত জোটের যে অনৈতিক নজির আমরা পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলিতে দেখেছি, এবারে এই অপকৌশল থেকে সিপিএমের গ্রামীণ নেতৃত্ব সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। মুর্শিদাবাদ বা মালদা জেলায় বেগ পেতে হলেও সংখ্যালঘু ভোটের অধিকাংশ নিজেদের পক্ষে টানতে তৃণমূল সফল হয়েছে। মহিলা ও আদিবাসীদের বৃহদাংশ তৃণমূলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনী ফলাফলের অন্যতম ইতিবাচক প্রাপ্তি হল বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বামেদের প্রতিরোধী প্রত্যয়ের মধ্যে দিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উঠে আসার শর্ত তৈরি হয়েছে। বামেদের পক্ষে কিছুটা রাজনৈতিক পরিসর তৈরি হয়েছে। পক্ষান্তরে বিজেপির পায়ের নীচের মাটি অনেকটা আলগা হতে শুরু করেছে। রাজ্য জুড়ে একক ও যৌথ প্রচার ও নিরবচ্ছিন্ন গণআন্দোলনের অঙ্গনে কেবলমাত্র শাসকের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরোধীতাই নয়; গুরুত্বের সঙ্গে কৃষির সঙ্কট, প্রসারমান কর্মহীনতা, খাদ্য ও অপরিহার্য পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক অধিকাচ্যূতির মানচিত্রে জনতার জীবন, জীবিকা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বুনিয়াদি বামপন্থার সদর্প আত্মঘোষনার মাধ্যমে পালাবদলের লক্ষ্যে আমাদের কর্মীবাহিনীকে উদ্দীপিত ও উজ্জীবিত করার চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হবে। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে স্বৈরাচারী তৃণমূল ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিজেপি-আরএসএসের বিরুদ্ধে ব্যাপকতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে রাস্তার লড়াইকে তীব্রতা দিতে হবে। আর এই লক্ষ্যে উপনীত হতে পার্টি সংগঠনকে জড়তা কাটিয়ে শক্তিশালী করার কঠিন কাজে আমাদের নেমে পড়াই এখন একমাত্র কর্তব্য।

- অভিজিত মজুমদার

elections-and-empowerment-of-women

empowerment-of-womenপান্ডুয়া ব্লকের তিন্না গ্রামসভার প্রার্থী ছিলেন প্রবীণ কমরেড ময়না কিস্কু। তিনি আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ এবং সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেত্রী। এলাকায় তাঁর পাশে অন্য কোনো পার্টির সদস্য বা সমর্থক নেই। (যদিও তাঁর জনসংযোগ আছে) তাই জেলার মহিলা সমিতির সদস্যরা এখানে জোর দেয়। নির্বাচনেও তাঁর এই প্রথম অংশগ্রহণ। মনোনয়নের পরই সিপিএম বিরোধিতা করে। তাতে ময়নাদি বেশখানিকটা বিচলিত হয়েছিলেন। প্রচারে বেরোতেও দ্বিধাবোধ করছিলেন। তবে কিছুটা আলোচনার পর দ্বিধা কাটিয়ে ওঠেন। প্রচার করতে গিয়ে দেখা গেল, উনি এলাকায় বেশ পরিচিত। মানুষের সাড়াও পাচ্ছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি উৎসাহিত হন এবং পরবর্তীতে নিজেই কোন কোন এলাকায় প্রচার করা হবে তার পরিকল্পনা করেন। প্রচার দেখে সিপিএম সদস্যরা তাঁর বাড়িতে এসে বলেন, বেশি ভালো প্রচার করতে হবে না, দাঁড়ানোর যদি ইচ্ছা ছিল, তাহলে আমাদের পার্টির হয়ে দাঁড়াতে পারতেন। ময়নাদি ঠান্ডা মাথায়ে জবাব দেন, আপনারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তো একজন আদিবাসী মহিলাকে দাঁড় করানোর কথা ভাবেননি। এই এলাকায় ঋণ মুক্তির বড় আন্দোলন হল, তখনও তো আমাদের পাশে দাঁড়াননি। এর উত্তরে তাঁরা আর কিছু বলতে পারেনি। পার্টির সাধ্যমত ওই এলাকায় দেওয়াল লিখন, পোস্টারিং, রিফলেটিং, টোটো প্রচার ইত্যাদি হয়। ময়নাদি উৎসাহের সঙ্গে সমস্ত রকম প্রচার‌ কাজে সামিল হন। এসবের মধ্যে দিয়ে কমরেডের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও দৃঢ়তা আরো বেড়েছে।

পান্ডুয়া ব্লকে দ্বারবাসিনী দক্ষিণ পাড়ায় গ্রামসভার প্রার্থী শিপ্রা চট্টোপাধ্যায়। তিনি জেলা পার্টি কমিটির সদস্য ও মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা। নির্ভীক কমরেড শিপ্রা পতাকায় তিন তারা ঝান্ডা কাঁধে প্রতিদিন দলমত নির্বিশেষে ঘরে ঘরে প্রচার করেছেন। সারা বছর আন্দোলনের মধ্যে থাকার সুবাদে গ্রামের মানুষের কাছে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। পথ সভায় প্রার্থী হিসেবে তাঁর তীব্র, তীক্ষ্ণ বক্তব্য এলাকার মানুষকে আকৃষ্ট করে।

রাজনীতিতে পোড় খাওয়া কমরেড রূপা শীট ধনিয়াখালিতে পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী ছিলেন। অঞ্চলে সিপিআই (এমএল)-এর সংগ্রামী সদস্য হিসেবেই পরিচিত। পার্টি সর্বস্ব তাঁর জীবন। সিপিএমের সন্ত্রাস মোকাবিলা করেছেন। এখন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই জারি আছে। খেটে খাওয়া মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন তিনি। নির্বাচনের তিন দিন আগে শাসক দল রুপাদিকে প্রার্থী পদ তুলে নেওয়ার জন্য টাকার প্রস্তাব দেয়। কমরেড সঙ্গে সঙ্গে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, আমার কোনো অভাব নেই। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নির্বাচনে দাঁড়াইনি। যতদিন বাঁচব সিপিআই(এমএল)-ই করে যাব। গরিব মানুষের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। কমরেড রূপা শীট নির্বাচন পুরো পর্বে তিন তারা ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে লড়ে গেলেন।

বলাগড় ব্লকে গুপ্তিপাড়ার মেহনতি পরিবারের কমরেড জ্যোৎস্না বিদ্যান্ত গ্রামসভার প্রার্থী ছিলেন। তিনি বলাগড় লোকাল কমিটির ও জেলা মহিলা সমিতির সদস্য। এলাকায় পার্টির দুর্বল অবস্থা, কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, লোকবলও তেমন নেই — এসব নিয়ে কোনো দ্বিধা কোনো সময় তাঁর মধ্যে কাজ করেনি। সংসারের সমস্ত কাজ সামলে নিয়মিত প্রচার কাজ চালিয়েছেন। পড়াশোনা বেশি না জানলেও, পার্টি শিক্ষা ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। এবং সেটা সম্বল করেই কেন আমাদের পার্টিকে ভোট দেবেন তা নিয়ে মানুষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছেন।

ধনিয়াখালি ব্লকে তালবোনা অঞ্চলে গ্রামসভার প্রার্থী ছিলেন লড়াকু সেনানী রুমা আহিরি। পার্টি, গ্রামীণ কৃষি মজুর সমিতি ও মহিলা সমিতির স্থানীয় সংগঠক। তিনি পার্টিতে এসেছেন ঋণ মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। সংসার, অঙ্গনওয়াড়ি সব কাজ সামলে হাসিমুখে উৎসাহের সঙ্গে গোটা গ্রামে কমরেডদের সঙ্গে বিরামহীন প্রচার করেছেন। নিজের গ্রাম ছাড়াও ওই ব্লকের অন্যান্য প্রার্থীদের সমর্থনেও প্রচারে অংশ নিয়েছেন। আন্দোলনের ময়দানে থাকার কারণে এলাকায় কমরেড রুমার বেশ পরিচিতি রয়েছে। একই বুথে গ্রাম সভায় সিপিএম প্রার্থী দিয়েও তুলে নেয়। রুমা কিন্তু লড়ে গেছেন। নিজের উদ্যোগে পোস্টার, ব্যানার, ঝাণ্ডায় এলাকাকে সজ্জিত করেছিলেন। ফলে এখানে পার্টির উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ছিল। ভোটের দিন সকাল থেকেই তিনি পোলিং বুথে বসে ছিলেন। বিকেল তিনটে নাগাদ তৃণমূলের মস্তানরা বলে অনেক হয়েছে, এবার চলে যান। না হলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। রুমা সঙ্গে সঙ্গে রুখে দাঁড়ান। বলেন, পরিস্থিতি যা হবে দেখে নেবো। আমি শেষ পর্যন্ত থাকবো। তখনই অবজার্ভারকে খবর দেওয়া হয়। তিনি পুলিশ সমেত সেখানে আসেন এবং রুমাকে বলেন, আপনি এখানেই থাকবেন। ইতিমধ্যে সিপিএমের জেলা পরিষদের প্রার্থী মস্তানদের হুমকিতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই রুমা ওই প্রার্থীর (পাড়ার সম্পর্কে মামা) হাত ধরে বলেন আজ যদি চলে যান তাহলে আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। রুমার কথায় সাহস ফিরে পেয়ে ওই প্রার্থী শেষ পর্যন্ত বুথে থাকেন। মস্তানরা নিরাশ হয়ে ফিরে ‌যায়। ‌‌নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় কমরেড রুমা খুবই উৎসাহিত আগামীতে এলাকায় পার্টির কাজকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছেন।

এছাড়া ধনিয়াখালি, পান্ডুয়া, বলাগড়, পোলবা ব্লকের কমরেড তনুশ্রী দে, চাঁপা টুডু, শ্রাবণী মালিক, সুকুমনি মান্ডি, রেখা মাঝি সহ আরো বেশ কিছু মহিলা প্রার্থী যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। প্রার্থীরা ছাড়াও জেলা মহিলা সমিতি এবং মিড-ডে মিল রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের সদস্যরাও সাবলীলভাবে প্রচারে সামিল হয়েছিলেন। মহিলা সমিতির জেলা কমিটির পক্ষ থেকে প্রার্থীদের সমর্থনে প্রচার পত্র প্রকাশ করা হয়।

- চৈতালী সেন

experience-of-some-regions-of-burdwansome-regions-of-burdwan-district

পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সময় থেকে আমরা দেখেছি বিরোধী প্রার্থীদের ওপর হুমকি অত‍্যাচার। একটা ভয়ের পরিবেশ। এর থেকে রেহাই পায়নি মহিলা পার্থীরাও। তাই মহিলা পার্থীদের প্রচার করতে যাওয়ার সময় প্রথমে একটু দ্বিধাতেই ছিলাম যে মহিলা প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত প্রচার করতে বেরোতে পারবে কিনা। ইতিমধ্যে খবর আসতে থাকে যে কিছু কিছু জেলায় পার্টির মহিলা প্রার্থীরা শাসক দলের ও পরিবারের চাপে নমিনেশন দিতে ভয় পাচ্ছে।

কালনা ২নং ব্লকে দুটি গ্রামে আমাদের মহিলা প্রার্থী দাঁড়ায়। আগ্রাদহ জিকরা গ্রাম পঞ্চায়েতে রানি মুর্মু ও বাজিতপুর তেহট্টতে উর্মিলা মুর্মু। অকালপৌষ পঞ্চায়েত সমিতিতে সুমি মজুমদার, এবং জেলা পরিষদে চিন্তামণি মুর্মু। এই অঞ্চলে বেশিরভাগ প্রার্থীই আদিবাসী, এই বিষয়টা উল্লেখ করলাম এই জন্য যে সিটগুলো কিন্তু সব এসটি রিজার্ভড নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে কেবল সংরক্ষিত আসনেই এসটি আদিবাসী প্রার্থীরা দাঁড়ান। এই অঞ্চলে প্রচার করতে গিয়ে দেখতে পাই যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ আর আদিবাসী মানুষ পাশাপাশি ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করেন, চায়ের দোকানে একই সঙ্গে মিলেমিশে আড্ডা মারেন।

রানি মুর্মু আগেও এই গ্রামে জিতেছিলেন। তাই মানুষ তাঁকে চেনে। এবং তিনি যখন সদস্য ছিলেন তখন রাস্তার উন্নতি করেছেন, মানুষের পাশ থেকেছেন। গ্রামের মানুষ তা জানে। তাই তিনি সাবলীলভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাঁওতালি ভাষায় গ্রামের মানুষদের বোঝাতে পেরেছেন যে তিনি গরিব মানুষের হয়ে লড়বেন। তিনি নিজেও তো আসলে গরীব খেটে খাওয়া মানুষ।

ঊর্মিলা মুর্মু শিক্ষিত, পেশায় একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে নার্স, ছুটি নিয়ে প্রচার করছেন। বাড়ি বাড়ি প্রচারে গিয়ে নিজের ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনকে ভোট দেবে আদিবাসী মানুষ। আমরা দেখি অনেক সময় মেয়েরা রাজনীতির আঙ্গিনায় আসতে চায় না। স্বামীরা রাজনীতি করেন তাই মহিলা সিট হলে তাদের স্ত্রীদের দাঁড় করান। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ঊর্মিলা পার্টির সঙ্গে যুক্ত এবং প্রচারে মাঝে মাঝে তাঁর স্বামী ও শ্বশুরও উপস্থিত হন। যদিও একই পাড়াতে শাসক দলের হয়ে দাঁড়িয়েছে তারই শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়। সেই প্রতিকুলতাকে কাটিয়ে প্রতিদিন প্রচারে বেরোনো মোটেই সহজ বিষয় নয়।

সুমি মজুমদার সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির এবং বর্ধমান জেলার পার্টির নেত্রী। পঞ্চায়েত সমিতিতে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিদিন বাড়ির কাজকর্ম সামলে, মেয়েকে কোলে নিয়ে প্রচারে যেতেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করেন পার্টির প্রচার গড়ে তোলার জন্য। রাজনীতিতে মেয়েদের ভুমিকা রাখার বিষয়টা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝা যায় রাজনেতিক এই ধরনের প্রচারে গেলে। রাজনীতির আঙ্গিনায় যত মেয়েরা প্রবেশ করে ততই মেয়েরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, ক্ষমতায়ন হয়।

বর্ধমানের ১নং অঞ্চলের বন্দুল বাজারে কামারপিতা গ্রামে একই পরিবারের স্বামী ও স্ত্রী দাঁড়িয়েছেন। পার্টির সংগঠনও সেখানে দুর্বল। আমাদের প্রচার শুরু হওয়ার আগের দিনই সেখানে অন‍্য বিরোধী দলের প্রার্থীকে শাসকদল মারধোর করেছে বলে খবর ছিল। ভয়ের পরিবেশ ছিল। অনেকে ভয়ে প্রচারে আসেনি এবং নমিনেশনও দেয়নি। কিন্তু এই সবকে অতিক্রম করেই আমাদের কমরেড যুগল নমিনেশন জমা করেন। প্রথম প্রথম চাঁপা হাজরা প্রচারে নামতে খানিক লজ্জা পাচ্ছিলেন। তেমন সঙ্গীসাথি নেই তাঁর গ্রামে। এভাবে বেরোনোর অভ্যাসও ছিল না বোঝা যায়। কিন্তু একবার বেরিয়ে পড়ার পর তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই সহজ ভাবে মহিলাদের কাছে গিয়ে প্রচার শুরু করেন। বাড়ির লাগোয়া দোকানে বসেও প্রচার জারি রাখেন।

বর্ধমানের ভাতার থানার অন্তর্গত আমারুন গ্রামে ছিলেন সীমা দাস। সিপিআই(এমএল)-এর আন্দোলনের পুরোনো জায়গা। আদিবাসীদের জমি রক্ষার আন্দোলন, চাষের জলের আন্দোলন, আরো অনেক আন্দোলনের সাক্ষী এই অঞ্চল। তাই মানুষ আমাদের কথা ঘিরে ধরে শুনছিলেন যখন আমরা সেখানে প্রচারে যাই।

পঞ্চায়েতে মহিলাদের ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ অনেক লড়াই করেই পেয়েছে। তাই যখন দেখি যে শাসকদলের শত হুমকি সত্বেও এই পার্টির, যাদের ক্যাম্পেইনের পয়সা নেই, যাদের লড়াইটা ক্ষমতাশীল নিপীড়ক শ্রেণীর বিরুদ্ধে, বাহুবলীদের বিরুদ্ধে, সেই পার্টির হয়ে মেয়েরা লড়ে যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের শৃঙ্খলকে তুচ্ছ করে, তখন আমাদের ভরসা জাগে।

- চন্দ্রাস্মিতা

another-poll-diary

“নকশালরা ছাপ্পা ভোট মারছে”

আজগুবি এই ধুয়ো তুলে ভোটের শেষ বেলায় তৃণমূল বাহিনী বুথে হামলা চালাতে যায়। ইতিমধ্যে দিনভর ভোটের রকম-সকম দেখে এলাকায় রটে গেছে এবার নকশালরা অঞ্চলে মেম্বার পাঠাচ্ছে। বুথের মধ্যে ঢুকে হামলাকারীরা ব্যালট বাক্স ভেঙ্গে দেওয়া হবে বলে টানাটানি শুরু করে। আমাদের কর্মীরা রুখে দাঁড়ায়। বাক্স আগলে রাখে। একজন মাত্র পুলিশ। ভোট কর্মীরা ভয়ে জড়সড়। দেখা যায় ঘরের ভেতর সিসি ক্যামেরা শুইয়ে রাখা হয়েছে। তিনি নিদ্রা গিয়েছেন! ঘটনাস্থল নদীয়ার গাছা শালিগ্রাম পশ্চিমপাড়া।

সর্বশেষ ভোটদাতা আমাদের সক্রিয় কর্মী আলাই সাহেব বলিষ্ঠভাবে সরকারী কর্মীদের বলেন এক্ষুনি আপনারা বাক্স সিল করুন। কত ভোট হল লিখিত কাগজ দিন।

ভোট কেন্দ্রের বাইরে তখন আমাদের কর্মীরা সহ শতাধিক মানুষ মারমুখী। দিনভর বিরতিহীন মানুষকে ভোট কেন্দ্রে পৌছানোর কাজ করেও তারা শেষরক্ষায় গড়ে তুলেছে মরিয়া প্রতিরোধ। সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন রাত ৯টা। বেগতিক বুঝে অচিরেই তৃণমূল বাহিনী রণে ভঙ্গ দেয়। প্রিসাইডিং অফিসার বাক্স সিল করেন। গাড়ি করে ব্যালট বক্স সেক্টরের দিকে রওনা দেয়। পিছনে পিছনে পার্টি কর্মীরা যায়। মাঝপথে হঠাৎ গাড়ি থেমে যায়। অন্য আশঙ্কা করে পুলিশকে ফোন করা হয়। কারণ পার্শবর্তী দুটো বুথে ছাপ্পা মেরে তৃণমূল বাহিনী বেলা ১২টাতেই ভোট শেষ করে ফেলেছে। ফোন পেয়ে পুলিশ আসার পর গাড়ি রওনা দেয়। অবশেষে স্ট্রং রুমে বাক্স ঢোকানোর কাজ পর্যবেক্ষণ করে পার্টি কর্মীরা রাত ১২টায় বাড়ি ফিরে আসে। এবার শুরু হয়েছে ১১ তারিখ গণনার লড়াইয়ের প্রস্তুতি। কবে হবে এ কাহিনি হাজার!

protest-meeting-in-deshpriyanagarmeeting-in-deshpriyanagar

১২ জুলাই, বেলঘরিয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনে নজিরবিহীন সন্ত্রাস, প্রাণহানি, গণনা কেন্দ্রে কারচুপি এবং পার্টি নেতৃত্ব, প্রার্থী ও কর্মীদের উপর হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করা হয়। বক্তরা বলেন শাসক দল তৃণমূল নির্বাচনের দিন ঘোষণা থেকে ভোট চলাকালীন পর্যন্ত বিরোধী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৫০ জনের মতো মানুষ খুন হয়েছেন। শাসকদল পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। টিএমসি-র এই সন্ত্রাস শেষ পর্যন্ত বিজেপির পালে হাওয়া দিয়েছে। ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের মডেলের পরিবর্তে, স্বৈরাচারী মডেল প্রতিষ্ঠা হলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই দুর্বল হবে। কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে সাথে বাংলায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

বক্তব্য রাখেন মিতালি বিশ্বাস, নবেন্দু দাশগুপ্ত, শিবশঙ্কর গুহরায় ও অর্চনা ঘটক। সঞ্চালনায় ছিলেন অশোক সাহা।

সভায় দাবি করা হয় -

“রক্তাক্ত পশ্চিমবঙ্গ চাই না”          
“গণতন্ত্রের উপর প্রতিটি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হোন!”          
“প্রতিটি হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।”          
“নিহতদের পরিবারের জন্য আর্থিক সাহায্য তথা আর্থিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।”

if-you-stop-you-can-stop

হাটুরিয়া ২নং পঞ্চায়েতের হারোপ গ্রামের ১১নং বুথে এবারই প্রথম আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি। এখানে আমাদের প্রার্থী কমরেড সেখ তপন আলি। ভোটের আগে থেকেই, কমরেড তপন আলিকে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করে তৃণমূল। মনোনয়ন যাতে তিনি জমা না দেন, তার জন্য চাপ দেওয়া হয় বিভিন্ন মহল থেকে, এমনকি পারিবারিক বিভাজন তৈরি করেও চেষ্টা হয় তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া থেকে আটকানোর। কিন্তু কমরেড তপন আলিকে কোনও কিছুই টলাতে পারেনি। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরে বারবার বিভিন্নভাবে উস্কানি দেওয়া ও প্ররোচনা চালানো হয় ভোটের আগের রাত পর্যন্ত। ভোটের দিন সকাল থেকেই ওই কেন্দ্রের সিপিআইএম ও বিজেপি’র লোকেরা কার্যত ময়দানে ছিল না। সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে তৃণমূল। বুথের ভিতর ঢুকে বিভিন্ন ভোটারের ভোটে সহায়তার নাম করে কার্যত ছাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করে তৃণমূল। রুখে দাঁড়ান কমরেড তপন আলি। যার ভোট সে দেবে, অসুস্থ ব্যক্তিকে সহায়তা করতে দায়িত্বশীল ভোটকর্মীরা। তৃণমূলের ওখানে ৮-৯ জন বুথের সামনে জড়ো হলে, তিনি তাদের ওখান থেকে চলে যেতে বলেন। না চলে গেলে যা হওয়ার হবে, যদি ওরা ঝামেলা করার চেষ্টা করে, দশটা মারলে, আমরাও অন্তত কয়েক ঘা দেবো, এটা উনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন। তাঁর দৃঢ় মনোভাবের সামনে পিছু হটে তৃণমূল বাহিনী। তারপর মাঝে মাঝে বিভিন্ন ভোটারদের এনে, তাদের ভোটে সহায়তার কথা বলে চাপ দিতে থাকে তৃণমূল। সিপিআইএম ও বিজেপি’র পোলিং এজেন্টরা নীরব দর্শকের ভূমিকা নেয়। প্রতিবারই রুখে দাঁড়ান কমরেড তপন আলি। আমাদের কয়েকজন ভোটারের ভোটও দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তপন আলি সহ আমাদের কমরেডরা রুখে দাঁড়ান। তৃণমূল আবারও পিছু হটে। রাত ৯টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলাকালীন বারবার তৃণমূল এই ট্রায়াল দিয়ে যায় এবং তপন আলি সহ আমাদের কমরেডদের দৃঢ়তার সামনে রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। কমরেড তপন আলি বলে দিয়েছিলেন, বুথ ছাড়বেন না, শেষ পর্যন্ত লড়বেন। এই লড়াইটাই তার জয়। মানুষ যাতে ভোট দিতে পারেন সেটা নিশ্চিত করবেন। ২০১৮’র পুনরাবৃত্তি হতে দেবেন না। শেষ পর্যন্ত বুথ আগলে থেকে কার্যত একাই রুখে দিয়েছেন বারবার তৃণমূল বাহিনীকে। জনগণের পক্ষে রুখে দাঁড়ালে, জনবিরোধীদের রুখে দেওয়া যায়।

story-of-dhanekhali-block-panchayat-electioncounting-of-votes

অতীতের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত। তবুও ১১ জুলাই, মঙ্গলবার সাতসকালেই ধনেখালিতে টিম সিপিআই(এমএল) সদস্য প্রত্যেকে হাজির গণনা কেন্দ্রে। আমরা তিনটি ঘরে ছড়িয়ে পরলাম। ৮টায় গণনা শুরু করার নির্দেশ ছিল। প্রায় সাড়ে ৯টাতেও এই কাজ শুরু হল না; তখনও ব্যালট বাক্স আসেনি; অধিকাংশ প্রিসাইডিং-এর দেখা নেই! ব্যাপার কি! বোঝা গেল একটু পরেই।

হঠাৎ শুরু হল সমস্বরে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। এসেছিস কেন, বেড়িয়ে যা, মার, বের করে দে — নানা কোণ থেকে গলা ফাটানো হুমকি ভেসে আসতে থাকল!

এখানে আসার সময় গণনাকেন্দ্রের প্রবেশপথে দেখেছি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরাট প্রদর্শন! কঠোর নিরাপত্তা! একবার রাজ্য পুলিশ আর একবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের তল্লাশিতে পাস করলে তবেই সম্ভব ভিতরে প্রবেশ করা। মূল গণনাকেন্দ্রে শোভাবর্ধন করছে সিসি টিভি, গেটের সামনে জনাকয়েক বন্দুকধারী শান্তিরক্ষক, কয়েকশো কাউন্টিং অফিসার্স, টেবিলে-টেবিলে প্রতীক্ষারত বিভিন্ন দলের প্রার্থী সহ কাউন্টিং এজেন্টরা।

পৌনে দশটা নাগাদ টিএমসির গুণ্ডাবাহিনী খেলা শুরু করল। আগের দিন বিডিওতে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বসেও যে কার্ড ‘দরকার নেই’ বলে বিরোধী দলের কাউকেই দেওয়া হয়নি, এখন সেই কার্ডের খোঁজ করতে এল শাসকদলের দুষ্কৃতিরা। আমরা সহ সমস্ত বিরোধীরা তখন কাউন্টিং টেবিলে। শুরু হল একের পর এক বিরোধী প্রার্থী/এজেন্টদের টেবিল থেকে, হল থেকে বের করে দেওয়া। সিপিএম ও বিজেপির সকলে বিনা প্রতিবাদে বেড়িয়ে গেল। আমাদের পালা আসতে ঐ ঘরে উপস্থিত আমাদের জয়দেব বাগ, রুমা আহিরী ও নন্দলাল মাহেলীরা দৃঢ়তার সাথে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাঁরা হল ছেড়ে যাবেন না। এরপরও হুমকি দিতে থাকে ওরা। খবর পেয়ে পাশের ঘর থেকে আমরা পৌঁছালাম। ওদের সাথে তীব্র বাদানুবাদ হল। বাদানুবাদ চলতে থাকলে ঐ ঘরে বাধ্য হয়ে মুখ দেখালেন ওসি ইলেকশন। তাঁকে চেপে ধরা হলে তিনি আমতা আমতা স্বরে বললেন, প্রার্থীর আলাদা কার্ড লাগবে না। প্রার্থী ঐ কার্ডেই থাকতে পারবেন!

কিন্তু এই লুম্পেনসি, এই সংগঠিত ক্রাইম কে ঠেকাবে এই ঘেরাটোপের মধ্যে!

ততক্ষণে এ ঘরে কেবল আমাদের কয়েকজন ছাড়া বিরোধীরা সব ফাঁকা! হলের পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে ‘জয় বাংলা’র দুষ্কৃতীরা!

ওদের অপারেশন এরপর শুরু হল পাশের হলে। একইভাবে জোরজুলুম, টানাহেঁচড়া চলল। আমরা আবার বাধা দিলাম। বিডিও আসুক, কেন এমন হবে — চিৎকার করতে লাগলাম। ওরা মরিয়া।

‘একে আগে বার কর’ — এই কথা বলে এখন ওরা ধাক্কা দিতে দিতে আমাকে হল থেকে বার করতে চেষ্টা চালাল। সাথে একজন উপদেশ দিতে থাকল, “চলে যান! এই টানাহেঁচড়া! এতে কি আপনার সম্মান বাড়ছে? এতোগুলো মেয়ে, বয়স্ক মানুষ নিয়ে এখানে এসেছেন কোন আক্কেলে?”

কয়েক মিনিট পর দেখা গেল, এখানেও হল ফাঁকা! কেবল বেলমুড়ির কাউন্টিং-এ উপস্থিত আমরা কয়েকজন। বোঝা গেল, এতে কোন লাভ হবে না।

আমরা বেড়িয়ে এলাম হলের বাইরে। সেখানে তখন সমস্ত বিরোধীরা অসহায় দাঁড়িয়ে আছে। সকলকে এক করার চেষ্টা চলল। শুরু হল আমাদের শ্লোগান ‘এই জোরজুলুম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে’, ‘বিডিওকে অবিলম্বে বিরোধী দলের লোকজনদের কাউন্টিং এ ফিরিয়ে নিতে হবে’! ‘জুলুমবাজি বন্ধ কর’। দেখলাম, শ্লোগান তুলছেন কমরেড সজল দে, শ্রাবণী মালিকও। সিপিএমের একাংশ সহ বিরোধীরা অনেকেই গলা মেলাতে লাগল। কিন্তু বোঝা গেল, সিপিএম নেতারা আত্মসমর্পণ করে বসে আছে।

কমরেড বিকাশ মুদি জানালেন, বিজেপির নেতারা বলাবলি করছে, ‘সিপিআই(এমএল) উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে। এখান থেকে চলে যেতে হবে’।

বিজেপি এরপরে সেখান থেকে বের হয়ে গেল। জানা গেল, ওদের উপরের নেত্রী লকেট চ্যাটার্জি বাইরে এসেছে। সেখানে ওরা চলে গেল। পরে জানা গেল, আধাঘন্টা পথ অবরোধ করে, এজেন্টদের যে যার এলাকায় ফিরিয়ে দিয়েছে ওদের নেতৃত্ব।

কিছু পরে সিপিএমও চলে গেল। শুনলাম, সিপিএম বের হওয়ার সময় ভালোই মারধোর খেয়েছে।        
আমরা ভিতরে। কেবলমাত্র আমরা!!

কী করা যায়? স্হির করলাম, সকলে মিলে হলে না ঢুকে আমরা কয়েকজন (কমরেড সজল, শ্রাবণী, শ্যামদা এবং আমি) ঢুকি। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূল। কোনো কিছুই দেখে নেওয়া সম্ভব নয়। তবুও প্রহসনের সাক্ষী থাকতে হল আমাদের।

ওদিকে হল ৫-এ আছেন জয়দেব, রুমাদি, নন্দলাল। পরে রুমাদির মুখে শুনলাম, সেখানে কমরেড জয়দেবকে সরাতে ওরা ৫/৬ জন ব্যাপক মারধোর, টানাহেঁচড়া করেছে। কমরেড তবুও ঘরের জাল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। জালের ওপারে কাউণ্টিং টেবিলে অন্যদের সাথে ছিলেন এক মহিলা অফিসার। জয়দেবের হেনস্থা দেখে ঐ মহিলার চোখে জল এসে গেছে! কিন্তু কিছু বলার নেই।

এই অবস্থায় কেমন হবে কাউণ্টিং!! কে দেখবে সিল! কে দেখবে ব্যালট স্বাক্ষর! কে মেলাবে সবটা! কে দেখবে অব্যবহৃত ব্যালট!

কোথায় রিটার্নিং অফিসার? কোথায় অবজারভার!?

ভিতরে কারো কাছে ফোন নেই। নিয়ে আসতে দেয়নি ওরা, নিরাপত্তা রক্ষকরা! ভোট চুরি যাতে রেকর্ডভুক্ত না হয়, তার জন্য এই নিপুণ ব্যবস্থাপণা ওদের!

৮নং হল থেকে বের হয়ে কমরেড জয়দেবের কাছে গেলাম। ওখানে পাশাপাশি তখনও ছিলেন কমরেড রুমাদি। বললেন, জয়দেবের উপর নেমে আসা জুলুমের কথা। কমরেড রুমাদিকে বের করে দিয়ে যখন একটু পরে জয়দেবের নিয়ে বাইরে আসছি, সেসময় বোসো বুথে জয়দেবের বিরোধী প্রার্থী টিএমসির বিদ্যুৎ মালিক আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়দেবের উপর। আমার গায়ে হাত দিল। জয়দেবকে আবারও মারধোর করল বিদ্যুৎ মালিক।

হেনস্থা, হেনস্থা আর হেনস্থা!

মূল গেটের সামনে সেন্ট্রাল ফোর্স, পিছনে কাউন্টিং হলের সামনে সেন্ট্রাল ফোর্স!

কেউ দেখার নেই!! পরে ওদের যখন বলা হল, ওরা জানালেন, গেটটুকু দেখাটাই ওদের উপর নির্দেশ… অন্য কোনো দিকে ওঁরা নজর দিতে পারবেন না!

এভাবে ভোট করতে হয় কেন? ধনেখালি জুড়ে মানুষের সঙ্গত প্রশ্ন।

এমন অভিজ্ঞতায় স্বৈরাচারের পতন চাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

মানুষ, কেবলমাত্র মানুষই শেষ কথা বলে।

জবাব চাইবার মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

fight-for-social-gender-equalitycommunal-definitions-of-uniformity

এনডিএ সরকার এবং ল কমিশন ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ ও ব‍্যক্তিগত আইন সংস্কারের ইস‍্যুটিকে যেরকম চেহারা দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যে তাঁরা লিঙ্গ ন‍্যায়ের প্রশ্নগুলিকে যথাযথভাবে মোকাবিলা করার বদলে বরং দেশের সংখ‍্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িকভাবে সংজ্ঞায়িত এক ইউনিফর্মিটি অর্থাৎ সমরূপতা চাপিয়ে দিতেই বিশেষ আগ্রহী। বিতর্কটিকে সাম্প্রদায়িক আকার দেওয়ার ফলে লিঙ্গ সমতার জরুরি প্রশ্নগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে।

বিজেপি ও আরএসএসের ‘এক জাতি এক আইন’ প্রচারণাটি ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র‍্যের সাংবিধানিক স্ব-ভাবের ওপর প্রত‍্যক্ষ আঘাত। এই প্রচারণার অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, কেবলমাত্র সংখ‍্যালঘু সম্প্রদায়ের — বিশেষ করে মুসলমান সংখ‍্যালঘুদের — ব‍্যক্তিগত আইনগুলির সংস্কারসাধন জরুরি এবং ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ আদতে মুসলমান ও খ্রিস্টান ব‍্যক্তিগত আইনকে ‘হিন্দু ব‍্যক্তিগত আইন’-এর খাপে ঢুকিয়ে দেওয়ার বিষয়।

বাস্তবে, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সম্পত্তির অধিকার ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ ব‍্যক্তিগত আইনগুলির বেশিরভাগেরই সংস্কার জরুরি সেগুলিকে লিঙ্গ সমতা ও লিঙ্গ ন‍্যায়ের সাংবিধানিক নীতির সাথে সাজুয‍্যপূর্ণ করতে। উদাহরণস্বরূপ, সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত ‘হিন্দু’ আইনে পারিবারিক সম্পত্তির ওপর কন‍্যা সন্তানের অধিকারকে মান‍্যতা দেওয়া সংশোধনীটি এখনও প্রবল বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হয় এবং তার বাস্তব প্রয়োগ ব‍্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়, কন‍্যাসন্তানদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে কোনো আইনি রক্ষাকবচ নেই।

হিন্দু বিবাহ আইনে বিচ্ছেদ প্রাপ্ত কোনো পুরুষ তার প্রাক্তন স্ত্রীকে খোরপোষ দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে যদি সে ‘অসতী’ হয় বা অন‍্য ধর্ম গ্রহণ করে। এই ধারা খোরপোষের বিষয়টিকে মেয়েদের অধিকারের বদলে পিতৃতান্ত্রিক নৈতিক বিধি ও ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে জুড়ে দিয়েছে। হিন্দু বিবাহ আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে ‘নিষ্ঠুরতা’-র যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা খুব শিথিল ধরনের — নিষ্ঠুরতাকে পিতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞায় ইচ্ছেমতো ব‍্যাখ‍্যা করার যথেষ্ট জায়গা ছাড়া আছে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক এক রায় এই প্রসঙ্গে এক আঘাতপ্রদ উদাহরণ। সেখানে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কোনো স্ত্রী তাঁর স্বামীকে নিয়ে শ্বশুড় বাড়ি থেকে ভিন্ন হতে চাইলে তা ‘নিষ্ঠুরতা’ এবং তা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে।

ধর্মনিরপেক্ষ বিবাহ আইনে এক মাস আগে নোটিশ দেওয়ার যে বিধান রয়েছে তারও সংস্কার জরুরি। কারণ, এই লম্বা অপেক্ষার কাল বাপ-মা এবং সাম্প্রদায়িক ও জাতবাদী ঠ‍্যাঙাড়ে দলগুলিকে ভিনজাত ও ভিনধর্মের যুগলের ওপর হিংস্রতা সংগঠিত করার সুযোগ করে দেয়। মুসলমান ব‍্যক্তিগত আইনে বহুগামিতা স্বীকৃত। আবার, গুজরাটে ‘মৈত্রী কারার’ (বন্ধুত্বের চুক্তি) প্রথা দ্বিগামিতাকে বৈধতা দেয়। ব‍্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়ই ‘বিশেষ’ ছাড়ের মজা লোটে — এই ধারণা সম্পূর্ণত এক সাম্প্রদায়িক গালগল্প মাত্র। প্রকৃত পক্ষে, ‘হিন্দু অবিভক্ত পরিবার’ বিশেষ কর ছাড় পেয়ে থাকে, এমনকি হিন্দু যুগল স্পেশাল ম‍্যারেজ অ‍্যাক্টে বিয়ে করলেও এই বিশেষ ছাড় প্রযোজ‍্য হয়।

মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিতর থেকেই বহুদিন ধরে দাবি উঠেছে মুসলমান ব‍্যক্তিগত আইনে বিধৃত তিন তালাক ও হালাল প্রথা বাতিল করার।

দুর্ভাগ‍্যবশত, ভারতীয় রাষ্ট্র ও শাসক দলগুলি নারীর অধিকার ও সংখ‍্যালঘুর অধিকার — এই উভয় বিষয়েই নিজেদের দায়দায়িত্বের প্রশ্নে নীতিনিষ্ঠ নয়, উন্নাসিক ও সুবিধাবাদী। শাহ বানো মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে একটা কংগ্রেসী সরকার উল্টে দেয় মুসলমান সম্প্রদায়ের গোঁড়া রক্ষণশীল নেতাদের প্রীতিতুষ্ট করতে, আর সেই সরকারই আবার হিন্দুত্বের সাথে ব‍্যাভিচারে লিপ্ত হয় বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে। বিজেপি ইউনিফর্ম সিভিল কোডের দাবিটিকে এক সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক রং ও সুর দিয়েছে। ফলত অধিকাংশ নারী আন্দোলনের গ্রুপগুলিকে এ’কথা আবার জোরের সাথে তুলে ধরতে হচ্ছে যে তাঁরা বিভিন্ন ব‍্যক্তিগত আইনগুলির লিঙ্গন‍্যায় সঙ্গত সংস্কার দাবি করে আসছেন — বাঞ্ছনীয় হল, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিতর থেকেই উঠে আসা সংস্কার — হিন্দুত্বে রাঙানো ইউনিফর্মিটি চাপিয়ে দেওয়া নয়।

২০১৫ সালে, হিন্দু মহিলাদের উত্তরাধিকারের অধিকার প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলাকালীন, মুসলমান মহিলাদের প্রতি বৈষম‍্যের প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। এর প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দেয় ‘মুসলমান মহিলাদের সমতার আকাঙ্খা’ প্রশ্নে পিআইএল দায়ের করার। তৎপরবর্তী অনেকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান মেয়েরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন তিন তালাক ও হালাল প্রথাকে অসাংবিধানিক বিধায় বাতিল করার আবেদন নিয়ে। ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’ (এআইএমপিএলবি) আদালতে এইসব আবেদনের জবাবে যুক্তি দেয় যে, আদালত ব‍্যক্তিগত আইনের চৌহদ্দিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ইতমধ‍্যে ল কমিশন একটি প্রশ্নমালা জারি করে ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ বিতর্ককে পুনরায় সামনে আনতে — এবং মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে একে বিভিন্ন ব‍্যক্তিগত আইন খর্ব করে ইউনিফর্মিটি চাপিয়ে দেওয়ার বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার অঙ্গ বলে অভিহিত করে।

ল কমিশনের প্রশ্নমালার ফরম‍্যাটটি নিঃসন্দেহেই ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট এবং এর আসল উদ্দেশ‍্য ও কুফল সম্পর্কে আশঙ্কারও জোরালো ভিত্তি আছে। ইউনিফর্ম সিভিল কোডের ইস‍্যুকে নতুন করে ফিরিয়ে এনে এবং সমগ্র আলোচনাকে ‘ইউসিসির পক্ষে না বিপক্ষে’ এই দুই মেরুতে বিভাজিত করে ল কমিশন আদতে শাসক দলের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে বিজেপি মুসলমান মেয়েদের প্রতি বৈষম‍্যে কাতর হয়ে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছে, সেই বিজেপিই আবার সাম্প্রদায়িক হিংস্রতায় মুসলমান মহিলাদের ধর্ষণ ও খুনে সামিল হচ্ছে গুজরাটে বা সাম্প্রতিক মুজফ্ফরনগরে।

ব‍্যক্তিগত আইনে সংস্কার চেয়ে মুসলমান মহিলাদের বেশ কিছু গ্রুপ ও ব‍্যক্তি নারী তীব্র সোচ্চারের দাবি অত‍্যন্ত আশাপ্রদ বিকাশ। এই গ্রুপগুলি (যেমন ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন, বেবাক কালেক্টিভ ও অন‍্যান‍্য) এবং বিভিন্ন ব‍্যক্তি নারী এই সাম্প্রদায়িক বিজেপি আর পিতৃতান্ত্রিক এআইএমপিএলবি — উভয়কেই নিশানায় রেখেছে। তাঁরা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তাঁরা তাঁদের সমতা ও ন‍্যায়ের দাবির সুরাহায় আর বিলম্ব সহ‍্য করতে রাজি নন। মুসলমান ব‍্যক্তিগত আইনের স্বঘোষিত পাহারাদাররা পরিবর্তনের দাবি কানে নিতে যখন অনিচ্ছুক, তখন মেয়েরা সুবিচার চেয়ে আদালত ও রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়ার অধিকার বলবৎ করছে।

দেশের বাম ও প্রগতিশীল শক্তিকে, সাম্প্রদায়িক ছকের ইউনিফর্ম সিভিল কোড বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার দৃঢ় বিরোধিতা গড়ে তোলার সাথে সাথে, নারীর সমতা ও মর্যাদাক প্রাধান‍্য দেওয়া ব‍্যক্তিগত আইনের দাবিতে চলমান নারী আন্দোলনকে অবশ‍্যই দৃঢ় সমর্থন যোগাতে হবে।

২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর এমএল আপডেট সম্পাদকীয়

about-uniform-civil-codefew-words-and-some-questions

গত ১৪ জুন ২০২৩, ভারতের ২২তম আইন কমিশন উইনিফর্ম সিভিল কোডের (অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা UCC) উপর একটা পাবলিক নোটিশ জারি করেছে। যার মধ্য দিয়ে অভিন্ন কোড সম্পর্কে ব্যক্তি এবং সংস্থার মতামত এবং ধারণা জানতে চেয়েছে।

উইনিফর্ম সিভিল কোড (UCC) সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে পরামর্শ/আলোচনা/কাগজপত্রের আকারে মতামত ইমেল, অনলাইনে জমা বা চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে পাঠানো যেতে পারে। এই সম্পর্কিত মতামত পাঠাতে হবে ১৪ জুলাই ২০২৩’র মধ্যে।

এটাই বোধহয় ভারতবর্ষে প্রথম নিদর্শন হয়ে থাকবে আইন কমিশন নিজে কোনো খসড়া প্রস্তুত না করে দেশের ব্যক্তি বা সংস্থার মতামত জানানোর জন্য নোটিশ জারি করল। দেওয়ানি বিধির বহু দিক আছে। ইতিমধ্যে বেশকিছু অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুও আছে। যেমন — চুক্তি আইন, দেওয়ানি কার্য বিধি, পণ্য বিক্রয় আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, অংশীদারি আইন, এভিডেন্স আইন ইত্যাদি। তাহলে বাকি থাকছে ব্যক্তিগত বা ধর্ম বা সম্প্রদায় বা জাতি উপজাতি, আদিবাসীদের নিজস্ব আইন বা প্রচলিত সংস্কৃতি বা প্রথা সম্পর্কিত আইন। আমরা জানি উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে প্রায় ২০০-র বেশি জনজাতির নিজস্ব আইন আছে। সংবিধান নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজরাম-এর নিজস্ব স্থানীয় বিধিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি হিন্দু আইনের বেশকিছু নিজস্ব বিধিও স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে বলা যায় সংবিধানের কাঠামো নির্মাতাদের যদি সারা দেশে এক আইন লাগু করার ভাবনা থাকত তাহলে ব্যক্তিগত আইনের বিষয়টি নিয়ে সংসদকে একাধিক ক্ষমতা দেওয়া থাকত। আমরা জানি অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদে রাখা নিয়ে গণ পরিষদে মতবিরোধ হয়েছিল। ভোটের মাধ্যমে এর মীমাংসা হয়েছিল। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন সাব কমিটি ৫-৪ ভোটে জেতে এবং সিদ্ধান্ত হয় ইউনিফর্ম সিভিল কোডকে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের বাইরে রাখা হবে। যে কারণে এই বিষয়টি সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশ মূলক নীতিতে (Directive principles of State Policy) ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদে রাখা হয়েছে। আমরা এটাও জানি সংবিধানের ২৫, ২৬(বি) এবং ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তির ধর্মীয় মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন তো থাকছেই, তাহলে আইন কমিশন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ঠিক কোন বিষয়ের উপর মতামত চাইছে তা স্পষ্ট নয়।

এটা প্রথম না, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৬ সালে জাস্টিস বি সি চৌহানের চেয়ারম্যানে গঠিত ২১তম আইন কমিশনকে বিষয়টি দেখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আইন কমিশন সরাসরি কমিশনের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল (যার মধ্যে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট, দ্য প্রটেকশন অফ ডোমেস্টিক ভাওলেন্স অ্যাক্ট ইত্যাদি ধর্ম নিরপেক্ষ আইনগুলিকে শক্তিশালী করা এবং তার ব্যাপকতা বাড়ানো সহ বিভিন্ন ধর্মের মহিলাদের আধিকার বিষয়ক) যেগুলি নিয়ে পরবর্তীতে আর কোন আলোচনাই করা হয়নি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে তাঁদের মতামত সংগ্রহ করাই যেত।

আমরা দেখলাম কিছুদিন আগে মধ্যপ্রদেশের ভুপালের এক সভায় মোদীজি এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার প্রস্তাবটি আনলেন। জাস্টিস রিতু রাজ অয়াস্থির চেয়ারম্যানশিপে ২২তম আইন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হল। আইন কমিশন তড়িঘড়ি নোটিশ জারি করল ১৪ জুলাই ’২৩-এর মধ্যে মতামত জানাতে। এখন শোনা যাচ্ছে এই বাদল অধিবেশনেই বিলটি আনা হবে এবং আইন প্রণয়ন করা হবে। এটাও শোনা যাচ্ছে মোদীজি মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন।

প্রশ্ন তো উঠবেই, মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন মোদী সাহেবকে দেখা গেল ২০০২ সালে বিলকিস বানুকে গণধর্ষণ করেছিল এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছিল যে ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত আসামী তাদেরকে বেকসুর খালাস করে দিতে। সম্প্রতি বিজেপি সাংসদ ব্রীজ ভূষণ দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার মহিলা কুস্তিগিরদের উপর নামিয়ে আনা হল নির্মম পাশবিক আক্রমণ। এছাড়াও তো আছে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিতা মহিলাদের আর্ত চিৎকার — যা মোদীজি শুনতেই পান না। তিনি কেন মহিলাদের অধিকার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন?

আবার বলা হচ্ছে এই আইনটি অত্যন্ত জরুরি কারণ এটা সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতির (Directive Principles of State Policy)  ৪৪ নম্বর ধারায় লিপিবদ্ধ আছে।

আমরা জানি, সংবিধানে ৩৬ থেকে ৫১ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতির (Directive Principles of State Policy) ধারা আছে। এর মধ্যে কয়েকটি ধারা উল্লেখ করছি যে ধারাগুলির জন্য আইন প্রবর্তন মোদীজির কাছে গুরুত্বই পেল না। যেমন — ৩৯-এর (খ) এবং (গ) ধারায় বলা আছে — রাষ্ট্র এমনভাবে তার নীতি পরিচালনা করবে যাতে সর্বসাধারণের হিতার্থে দেশের পার্থিব সম্পদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ বণ্টিত হয় এবং ধনসম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণসমূহ কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়।

৩৯(ক) ধারায় — স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ভারতে প্রত্যেক নাগরিকের উপযুক্ত জীবিকা অর্জনের অধিকার।

৩৯(চ)(ছ) ধারায় বলা আছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার।

৪১ ধারায় কর্মের অধিকার। বেকার অবস্থায়, বার্ধক্যে, অসুস্থতায় ও অভাবে সরকারি সাহায্য পাওয়ার অধিকার।

৪৭ ধারায় বলা আছে — রাষ্ট্র পুষ্টি ও জীবনযাত্রার মানের স্তর উন্নীত করার এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করবে।

৪৩ ধারায় — গ্রামাঞ্চলে ব্যক্তিগত বা সমবায়ের মাধ্যমে কুঠির শিল্পের উন্নতি করা। কর্মীদের জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত মজুরি এবং উন্নত জীবনযাত্রার মান যাতে সুনিশ্চিত হয় এমন কাজের অধিকার।

৪৩(ক) ধারায় — শিল্প পরিচালনায় কর্মীদের অংশগ্রহণের অধিকার।

এরকম বহু আদর্শ, নির্দেশ, অধিকারের কথা রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশ মূলক নীতিতে (Directive principles of State Policy) থাকলেও এই সকল বিষয়ে আদালতে যাওয়া যাবে না। সরকার এই বিষয়গুলির উপর আইন প্রণয়ন করলে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদে যুক্ত হবে। এরপর তা আদালত গ্রাহ্য হবে। এত ধারার মধ্যে ৪৪ নম্বর ধারার বিষয়টিকে এই মুহূর্তে মোদীজির আইনে রূপ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পরেছে। এটাই আজ চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে তাহলে কী ভারতবর্ষে আগামীদিনে সকল ধর্মের মানুষের, জনজাতি, আদিবাসীদের [পার্সোনাল] ল, সংস্কৃতি, অভ্যাস ও প্রথাগুলির বিলোপ ঘটবে? এছাড়াও সব ধর্মের ব্যক্তিগত আইনের মধ্যেও আছে ভিন্নতা। আদিবাসী সমাজ চলে ঐতিহ্য ও প্রথার ভিত্তিতে। ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন, সাঁওতাল পরগনা প্রজাস্বত্ব আইন, SPT আইন, PESA আইন যা আদিবাসীদের জমির প্রশ্নে বিশেষ অধিকার দিয়েছে। এ সবের কী হবে?

আসলে ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে বিজেপি-আরএসএস-এর পক্ষ থেকে সুকৌশলে নতুন একটা এজেন্ডা দেশবাসীর চর্চায় আনতে চাইছে। দেশের জনগণকে সম্প্রদায়গত বিভাজন করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে। অযোধ্যায় রাম মন্দির হয়ে গেছে, সংবিধানের ৩৭০ ধারা অকার্যকর করা হয়ে গেছে, আসামে এনআরসি চালু করতে গিয়ে মুসলিমদের থেকে হিন্দুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাই আপাতত এনআরসি স্থগিত। চাই নতুন এজেন্ডা। সংখ্যালঘুদের নাম না করে বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং মহিলাদের সমানাধিকারের জন্যই নাকি এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।

বহু ধর্ম, সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মিলন ক্ষেত্র আমাদের ভারতবর্ষ। নিজেদের ব্যক্তিগত আইন, সংস্কৃতি, অভ্যাস, আচার বিচার, প্রথা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যতই ভিন্নতা থাকুক না কেন তাঁরা ভারতবর্ষের সংবিধানের মুল প্রস্তাবনার সার্বভৌমত্ব, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র ধারণার সাথে নিজেদের একাত্ম করতে অভিন্ন থেকেছেন। এই সংবিধানের মাধ্যমেই দেশের জনগণ যাতে ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সমতা, ভাতৃত্ববোধ অর্জন করতে পারেন তারজন্য অভিন্ন ঐতিহাসিক আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছেন প্রতিদিন। সেখানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল যদি সংসদে সংখ্যা গরিষ্ঠের জোরে পাশ করানো হয় তাহলে তার পরিণতি বিগত দিনের কৃষক আইন, শ্রম কোডের মতো হবে। যা প্রত্যাহার করতে বা স্থগিত রাখতে বাধ্য করেছেন ভারতের অভিন্ন জনগণ।

- দিবাকর ভট্টাচার্য

nidhiram-sardar-the-name-of-womenwomen-in-empowerment

একটি ছবিতে তিনটি নারী। দিদিমা, মা ও শিশুকন্যা। একটি রান্নার গ্যাস সিলিণ্ডারকে জড়িয়ে ধরে হাস্যমুখে বসে আছে। “প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা গ্যাস যোজনা প্রকল্প”-এর পোস্টার এটা। ওই বালিকাটির জীবনও কী তার মা দিদিমার মতো আঁতুড়ঘর আর রান্নঘরের সীমানায় বাঁধা থাকবে! অবিকল মনু সংহিতার চিত্রায়ন। তাহলে মহিলাদের ক্ষমতায়নের কী হবে? হ্যাঁ ক্ষমতায়ন তো হয়েছে। অলিম্পিকজয়ী সাক্ষী মালিককে “বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও” প্রকল্পের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার করা হয়েছে। ক্ষমতাবান সেই নারীর উপর পুলিশের তাণ্ডব দেখে শিহরিত সারা দেশ।

সারা পৃথিবী জুড়ে নারীর ক্ষমতায়নের দাবি উঠেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণা অনুসারে ভারতকেও সেই দাবি পূরণ করতে হবে। ৮০’র দশকের মাঝামাঝি দেশের উন্নয়ন ভাবনায় ‘ক্ষমতায়ন’ শব্দটি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ক্ষমতা হল সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক। এর জন্য প্রয়োজন নারীর সুস্থ থাকা। বুদ্ধি বিকাশে দরকার শিক্ষা। আর সদিচ্ছার জন্য চাই একটি আদর্শগত ভিত্তি। এভাবে নারীরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠবে। আর্থনীতি হবে সচল। আর রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব করে তারা নিজেদের কথা নিজেরাই বলবে। সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। ২০১৪-তে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে মহিলাদের “ক্ষমতায়ন”-এর কথা ছিল। বিগত ৯ বছরে মহিলারা ক্ষমতার স্বাদ কতটুকু পেয়েছে? বরং রক্ষণশীল হিন্দু আধিপত্যবাদ তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে।

বাস্তবিকই মহিলাদের যা কিছু উন্নয়নের বিষয় তা পুরুষতান্ত্রিকতাকতার পায়ের নিচে রেখেই এগিয়ে চলেছে এই বিজেপি সরকার। বিজেপির সমর্থকরা বলে থাকেন, পুলওয়ামা বা বালাকোট ঘটনার সময় নির্মলা সীতারামনের তেমন ভূমিকা খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু ক্ষমতার শীর্ষে আসীন পুরুষ মানুষ তাঁর পেশী প্রদর্শন করেছিলেন, যা আমরা সবাই দেখেছি। বিজেপির সমর্থক পুরুষরা চিৎকার করে বলেন, “মহিলাদের খুঁজে কী হবে? আমরা পুরুষ চাই। কারণ আমরা দাঙ্গা চাই।” সংঘীরা শুধু পুরুষ নয়, বিশেষ পুরুষ চায়। সে হবে আর্যদের মতো রূপবান, বাহুবলী এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তাহলে আপনাদের বেটি বাঁচানোর কী হবে, সাধুগণ? উত্তর দিচ্ছে মোদি স্বয়ং।

২০১৪-এ বেনারসের জনসভায় তিনি বলেন, “যদি ১০০০ জন পুরুষ প্রতি ৮০০ জন মহিলা হয়, তাহলে ২০০ জন পুরুষের বিয়ে হবে কী করে?” বিজেপির ছোটোবড় নেতাদের কেউ বলছে, একজন নারীকে ৪টে করে, কেউ বলছে ১০টি করে সন্তান উৎপাদন করতে হবে। আর ক্ষমতায়ন মানে, মোদিই বলছে, “কন্যা না জন্মালে পুরুষদের জন্য রুটি কে বানাবে?” মহাভারতের মহারাজা দ্রুপদ যজ্ঞ করে পুত্র সন্তান পেলেন। কিন্তু একটি কন্যা না নিলে সেই পুত্র তিনি পাবেন না। এভাবেই যজ্ঞের আগুন থেকে যাজ্ঞসেনী তথা দ্রৌপদীকে স্বীকার করতে হল। এটাই আসলে প্রকৃতিক সাম্য। যেটা সংঘীদের দর্শন অস্বীকার করছে। আবার তাদের কর্পোরেট পরিষেবাও দিতে হয়। অর্থাৎ নারী ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু কাজ করার পরিবেশ থাকবে প্রতিকূল। ফলে তাদের প্রকল্পের মধ্যে যেমন থাকবে চমক তেমনই থাকবে ধমক।

ধমকটা কেমন? ওরা মহিলাদের কীভাবে সম্বোধন করে? মাতাওঁ, বেহেনাওঁ, বেটিওঁ। অর্থাৎ তুমি যেই হও, তুমি আমারই কেউ। তুমি কোনো স্বাধীন ব্যক্তি হতে পারো না। তাই আমার তুমিকে আমি মাথায় কাটবো না লেজে কাটবো, সেটা একমাত্র আমার ব্যাপার। এই ভাবনাটিই রূপ গ্রহণ করে ব্রীজভূষণ শরন সিংহ হয়ে দেখা দিল। বুক চিতিয়ে সে বলছে, “আরে ইয়ে তো ছুঁয়াছুঁয়ি কা মামলা হ্যায়। ‘নয়া অছ্যুৎ নীতি’ চালু কর দিয়া কেয়া?’’ অপরিচিত উন্নাও ভারতের মানচিত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠল “ধর্ষকদের গ্রাম” নামে। কাশ্মীরের কাঠুয়াতে বিজেপির মন্ত্রী তেরঙা পতাকা উড়িয়ে মার্চ করল, আসিফার উপর গণধর্ষণকারী বীরপুরুষদের সমর্থনে। ওদিকে যোগী আদিত্য নারীদের সর্বনাশ করা লোকদের নাম দিল “রোমিও স্কোয়াড”। মহিলাদের উপর ঘটা যৌন হেনস্তাকে এভাবেই উপেক্ষা করে ওরা।

আর চমকটা কেমন? মহিলাদের কর্মস্থলে যৌন হয়রানি রুখতে ইন্টারনাল কমপ্লেইন্ট কমিটি তৈরি হল যার চেয়ারম্যান ও অর্ধেকের বেশি সদস্য মহিলা। কিন্তু অভিযুক্তর পাশে তার পুরুষ সহকর্মী বা সিনিয়ররা দাঁড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে সাধারণত কোনো সাক্ষী থাকে না। মহিলা জাতীয় কমিশনের হাতে শাস্তি ঘোষণার চূড়ান্ত ক্ষমতাও দেওয়া হয়নি। তারা শুধু মাত্র প্রস্তাব করতে পারে। এইরকম নিধিরাম সর্দার হয়ে কী করবে এই মহিলারা?

২০১৫ সালে ভারত পেয়েছে “বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও” প্রকল্প। উদ্দেশ্য লিঙ্গভিত্তিক সমতা সৃষ্টি করা। এবং শিক্ষিত করে ক্ষমতায়ন বাড়ানো। এই প্রকল্প মূলত হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, দিল্লী ও উত্তরাখণ্ডকে লক্ষ্য করে নামানো হয়। কিন্তু কন্ট্রোলার ও অডিটর জেনারেল এই প্রকল্পকে ব্যর্থ বলে ঘোষণা করে। কারণ তারা দেখেছে ২১টি রাজ্যের মধ্যে ১৭টি রাজ্যে এই রেশিও আরও কমে গেছে। ৪৩ কোটি টাকার মাত্র ৫ কোটি টাকা দেওয়া হয় ২০১৬-১৭ এই একবছরের জন্য। যার ৫৬% প্রচারে ও ২৪% বিভিন্ন রাজ্যে ও জেলায় গেছে। আর বাকি ২৫% ব্যবহৃতই হয়নি। বেটিরা পড়াশুনা কেমন করছে? গ্রামীণ মেয়েদের ৩৮%-ই স্কুলের সাতবছর পার করতে পারে না। স্বভাবতই উচ্চ শিক্ষার হারে মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে। তাই দেখা যায় ৪৮.৭% মেয়েরা যখন উচ্চশিক্ষিত সেখানে ছেলেরা ৫১.৩%। কিন্তু মেয়েরা কেনো স্কুলে যায় না? দারিদ্র এর প্রধান কারণ। ৩০% উপর বালিকারা ছোট্ট বয়স থেকেই ঘরের কাজে লেগে যায়। পড়া তৈরি হয় না। অপমানিত হওয়ার ভয়ে স্কুলে যেতে চায় না। ওদিকে স্কুলে বাথরুমও নেই। বয়ঃসন্ধির বিষয়গুলো সামলানো মুশকিল। আর এখন তো নতুন শিক্ষানীতি চালু হয়ে গেছে। পাকাপোক্ত সর্বনাশের ব্যবস্থা হয়ে গেছে গরিব মানুষের পড়াশুনোর। ক্ষমতায়ন শুরুতেই শেষ।

সুরক্ষার জন্য ১৮১ নম্বর ডায়াল করতে বলা হয়েছিল। হ্যাঁ, ডায়ালও কিছু হয়েছে হয়ত। কিন্তু মহিলাদের উপর অত্যাচার কমেনি। বরং বেড়ে গেছে। ২০২২-এ জাতীয় মহিলা কমিশন এমনটাই বলেছে। ২১-২২ এই একবছরে এই অপরাধ বেড়েছে ৩০%। ২০২২ সালে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা রেকর্ড করেছে। প্রায় ৩৪ হাজার কেস নথিভুক্ত হয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে যে, ৫০% ক্ষেত্রেই পুলিশ কেস নেয়নি। সভ্যতার সংকটেও পড়েছে মেয়েরা। ২০২২-এ সাইবার অপরাধ রেকর্ড হয়েছে ৫৬ হাজারেরও বেশি। কিন্তু পুলিশ মাত্র ৯টি ক্ষেত্রে এফআইআর করেছে। নামহীন অভিযোগ — এই কারণেই সমস্যা, এই বলে পুলিশ দায় এড়াচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল ভারতে নির্মাতারা কেনো এই ডিজিটাল ঠেকাতে অন্য কোনো ডিজিটাল উদ্যোগ নিচ্ছে না?

ক্ষমতায়নের জন্য আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কাজের বাজারে মহিলা কোথায়? ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ২০২২-এর রিপোর্ট অনুযায়ী মহিলা কর্মশক্তি হল মাত্র ২৩.৯%। এদের বেশিরভাগই কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। কিন্তু সেখানে কাজের বা মজুরির সমতা কোনোটাই নেই। ডিজিটাল ভারতের বেশ কিছু অংশে লাঙলে গরুদের মতো জুতে দেওয়া হয় মহিলাদের। আর পিছন থেকে লাঙল ঠেলে পুরুষ চাষিরা। ১০০ দিনের কাজেও মহিলাদের দেখা যায়। কিন্তু তা এখন বন্ধ। প্যানডেমিক পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে নির্দিষ্ট মাইনের কাজ থেকে তারা সরে গেছে। সেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে মেয়েদের নিয়ে অনেক কঠিন ও বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে বেআইনিভাবে। সেখানে কোনো ভদ্র চুক্তিও করা হচ্ছে না। ফলে আগে যারা সেখানে কাজ করত তারা এখন প্রতিদিন কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। হ্যাঁ অনেক মহিলারা নিজেরা ব্যবসা করছেন। কিন্তু ভারতের মত অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় তাদের সংখ্যা সবথেকে কম। যে সমস্ত ক্ষেত্রে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ঘটে সেখানে তো মেয়েদের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ। যেমন, আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, পরিকাঠামো, ওষুধ শিল্প, ডিজিটাল মার্কেটিং, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, শক্তি উৎপাদন, রিটেলিং, ইত্যাদি। ভারতের আর্থিক বিকাশ এভাবেই পুরুষতান্ত্রিক ভাবনায় আচ্ছন্ন।

রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বেও কি একই অবস্থা? বছরের পর বছর ধরে ধুলো জমছে ৩৩% সংরক্ষণের দাবিতে। বিগত ৯টি বছরে আমরা এর কোনো উচ্চবাচ্য শুনিনি৷ ২০১৪-তে সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ১১%। আর ২০১৯ সে তা হয়েছে ১২.৪৫%৷ লম্বাচওড়া স্বপ্ন দেখায় মোদির দল। সেই বিজেপিই ২০১৪ ও ২০১৯-এ বিজেপি যথাক্রমে মাত্র ৮% ও ১২% মহিলাকে প্রার্থী করেছিল।

ভারতের মহিলারা কিন্তু সরকারি ক্ষমতায়নের আশায় বসে নেই। তারা তাদের মত কাজ করে চলেছে। মহিলাদের উপর যে কোনো হিংসাতে যেমন তারা পথে নামছে, তেমন বৃহত্তর মানুষের দাবিতেও তারা এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে কৃষক মহিলাদের বিদ্রোহী রূপ দেখেছে দেশ ও সরকার। তারও আগে এনআরসির বিরুদ্ধে মুসলমান মহিলাদের শাহীনবাগ আন্দোলন ইতিহাস হয়ে গেছে। মণিপুরে শিশু বুকে জড়িয়ে আহত হচ্ছে তারা। আজ সাক্ষী মালিকদের পিছনে গোটা ভারত। আজ সবাই মানছেন যে, মহিলাদের ক্ষমতায়ন শুধু ভোটের প্রচারে মুখ দেখানোর একটা বিষয় মাত্র। যেমন উজ্জ্বলা গ্যাস জোযনায় ৯৯.৮% সংযোগ দেওয়া হয়েছে বলে এবার প্রচার করবে। কিন্তু তাদের ৫৬.৫% যে চারবারের পর আর সিলিন্ডার নেয়নি। সে কথাটা মোদি বলবে তো! লোকে বলে, “বিজেপি কি কথনি, বিজেপি কি করনি।” কথায় আর কাজে তার এতটাই ফারাক।

মোদি, তোর আয়না কোথায়?

- বর্ণালী রায়

is-it a-crime-not-to-stand-upnational-anthem

এই প্রশ্নটি মাঝে মধ্যেই ঘুরে ফিরে আসছে। এবার আবার এই বিতর্কটা সামনে এল কাশ্মীরের একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

ইতিহাসবিদ্ অধ্যাপক সুগত বসু-র একটি লেখা থেকে জানা যায়, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী জাতীয় সঙ্গীতের সময় কখনই উঠে দাঁড়াতেন না, কারণ তিনি মনে করতেন এটা এক ঔপনিবেশিক সময়ের রেওয়াজ। কিন্তু, এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক থেকেই গেছে।

২৫ জুন শ্রীনগরে একটি অনুষ্ঠানে জম্মু কাশ্মীরের উপ রাজ্যপাল মনোজ সিংহ-র উপস্থিতিতে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে ১১ জন কাশ্মীরী জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন উঠে না দাঁড়ানোয় শ্রীনগরের পুলিশ তাঁদের নিজেদের হেফাজতে নেয়। পরে, শ্রীনগরের একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তাঁদের সাত দিনের জন্য জেলে পাঠিয়ে ফৌজদারি আইনের ১০৭/১৫১ ধারায় মামলা চালাবার জন্য নির্দেশ দেন। নির্দেশ দেওয়ার সময় এই মন্তব্য করা হয় যে “শান্তি শৃঙ্গলা ভঙ্গের খুবই সম্ভাবনা ছিল তাঁদের ওই কার্যকলাপের মধ্যে”।

জাতীয় সঙ্গীতকে অসম্মান করা সংক্রান্ত একটি মামলা হয়, যার উপর সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮৬-তে একটি রায় দেয়। বিজৈ এম্যানুয়াল ও অন্যান্য বনাম কেরল রাজ্য ও অন্যান্যর যে মামলা চলে, তার উপর শীর্ষ আদালত এক রায় দেয়। বিজৈ এম্যানুয়াল, বিনু এবং বিন্দু — এই তিনজন যথাক্রমে ক্লাস ১০, ক্লাস ৯ এবং ক্লাস ৫ এর এক হিন্দু সংগঠন নায়ের সার্ভিস সোসাইটির পড়ুয়া ছিলেন। স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত যখন শুরু হয়, তখন ওই তিনজন তাতে অংশ নেয়নি। এই ‘অপরাধে’ ওই তিনজন পড়ুয়াকে স্কুল কর্তৃপক্ষ বহিষ্কার করেন। তাঁদের অভিভাবক হাইকোর্টে আবেদন করেন যে তাঁরা মিলেরিয়ান ক্রিশ্চান ধর্মের এক অত্যন্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জিহোভা উইটনেস ভুক্ত। তাঁদের ধর্মমতে তাঁরা একমাত্র জিহোভাকেই (ঈশ্বরের হেব্রু নামকরণ) আরাধনা করতে পারেন। যেহেতু জাতীয় সঙ্গীত আরাধনার পর্যায়ে পড়ে, তাঁদের সন্তান সেই সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু গলা মেলায়নি। কিন্তু কেরল হাইকোর্ট অভিভাবকদের আবেদন খারিজ করে স্কুল কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকেই শিলমোহর দেয়। এর বিরুদ্ধে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যান।

সুপ্রিম কোর্ট কেরল হাইকোর্টের রায়কে খারিজ করে পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ায়। ১১ আগস্ট, ১৯৮৬-র ওই আদেশে শীর্ষ আদালত জানায়, সংবিধানের ২৫নং ধারায় নিজ নিজ ধর্মমতকে অনুসরণ, তার প্রচার করার মৌলিক অধিকার বিধৃত রয়েছে। কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় যতই প্রান্তিক, অপাঙতেয় ও ক্ষুদ্র হোক না কেন, নিজ নিজ ধর্মীয় পরিচিতি ও স্বাতন্ত্র্যকে বজায় রাখার অধিকার সংবিধান তাঁদের দিয়েছে। যেহেতু জাতীয় সঙ্গীতের সময় পড়ুয়ারা শ্রদ্ধার সাথে উঠে দাঁড়ায় কিন্তু গলা মেলাননি, তাই এটা সাব্যস্থ হচ্ছে যে কোনো গোলমাল বা অশান্তি সৃষ্টি করা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁরা কাউকে তাঁদের মতো অনুসরনে বাধাদান করেনি। উল্টে, নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে, নিজ নিজ ধর্মাচরণকে পালন করার জন্য তাঁদের যেভাবে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হল, তা ধর্মীয় স্বাধীনতা অনুসরনের বিরুদ্ধে, মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধেই গেছে।

জাতীয় সঙ্গীত সংক্রান্ত আরেকটা মামলা হয় ৩০ নভেম্বর, ২০১৬ সালে। শ্যাম নারায়ণ চোকস্কি বনাম কেন্দ্রীয় সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এক অন্তর্বর্তী আদেশে বলে, “ভারতের সমস্ত সিনেমা হলগুলো চিত্র প্রদর্শনী শুরু করার আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজাবে এবং উপস্থিত সমস্ত দর্শকদের উঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।” আদালত আরও বলে, “জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় হলের সমস্ত প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণপথ বন্ধ রাখতে হবে, আর জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকাকেও পর্দায় দেখাতে হবে”। কিন্তু, ৯ জানুয়ারি, ২০১৮-তে শীর্ষ আদালত তার আগেকার অন্তর্বর্তী আদেশের কিছু পরিমার্জন করে।

পরিমার্জিত আদেশে সুপ্রিম কোর্ট বলে, “চিত্র প্রদর্শনীর আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো সিনেমা হলগুলোর কাছে ঐচ্ছিক, তা বাধ্যতামূলক নয়।”

২০১৬-র আদালতের অন্তর্বতীকালীন রায়কে পরিমার্জিত করার পেছনে ছিল সরকারি এক সিদ্ধান্তের ঘোষণা। তাতে জানানো হয়, সরকার এক ১২ সদস্য বিশিষ্ঠ আন্তঃমন্ত্রক কমিটি গঠন করেছে, যার কাজ হল, বিভিন্ন হল ঘরে বা অনুষ্ঠানগুলোতে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো বা গাওয়ার সময় কি গাইডলাইন অনুসরণ করা হবে, তা সূত্রবদ্ধ করা।

(সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮ জুলাই)

gangajal-businessbusiness-from-the-post-office

মোদী সরকার এবার ডাকঘরের পচিমবঙ্গ সার্কলে গঙ্গাজল বিক্রির কাউন্টার খুলল! বলা-কওয়া নেই, কবে কখন সরকার বাহাদুর এই পলিসি নিয়েছে। নাগরিক জনতা হয় ভালো করে নজর করেনি, নয় নজর করেছে, গুরুত্ব দেয়নি। যাই হোক, কপাল ভালো যে সুকুমার রায় বেঁচে নেই, থাকলে এসব দেখে মোদী জমানার গঙ্গাযাত্রা নিশ্চিত করতে নিশ্চয়ই আস্ত একটা ছড়া লিখে ফেলতেন। দেশকে যারা ভালোবাসেন তারা কেন্দ্রের সরকারকে দেখছেন একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ইউনিটগুলি গুটিয়ে ফেলতে, বেচে দিতে। কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে বছরের পর বছর লোকসানে চলা সরকারি শাখাপ্রশাখা আর টানা যাচ্ছে না। তাই বিলগ্নীকরণ, বেসরকারীকরণ অনিবার্য ভবিতব্য। কোন কোন ক্ষেত্রে গল্প জুড়ে দেওয়া হয় ‘অত্যাধুনিক পুনর্গঠনের’। আর সময়ের সাথে সাথে সেই গল্প যে প্রতিশ্রুতির প্রতারণার সেটা ধরা পড়ে।

কিন্তু ডাকঘর থেকে গঙ্গাজল বেচা শুরু করার যুক্তি জাহির করতে অন্যান্য সমস্ত পরিষেবা দেওয়ার বিনিময়ে তো কোনও ‘লোকসানের গল্প’ নেই। জিপিও’র মাথার ওপরকার খোদ পশ্চিমবঙ্গ সার্কল কর্তৃপক্ষের মুখের খবর অন্তত সেটাই বলছে।

ই সার্কলের পিএমজি’ (পোস্টাল মেইল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট) ও পিএমজি (কলকাতা)-র বক্তব্য হল, গত আর্থিক বছরে (২০২১-২২) ডাকঘরের সমস্ত পরিষেবা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সার্কলের আয় হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে আয় ছিল ১৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আয়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে (৩০০ কোটি টাকা) রয়েছে আধার, পাসপোর্ট তৈরি, গঙ্গাজল ও বিভিন্ন জৈব পণ্য তৈরি ও বিক্রি বাবদ আয়ের ৩১ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ২৬৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে পোস্টাল বিভিন্ন আইটেম থেকে। এই ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তো একবারও বলেননি, ডাকঘরের পশ্চিমবঙ্গ সার্কেল ইউনিট লোকসানে চলছে। ডাকঘর কর্মচারিদের বেতন ও প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন খরচ বাবদ মোট ব্যয় যেমন উল্লেখ করা হয়নি, তেমনি (অন্যান্য বিষয়গত প্রসঙ্গ থাক) গঙ্গাজল বেচায় নামতে হল কেন তার কারণ দর্শানোর জন্য কোনও লোকসানের চাপ সামলানোর গল্প শোনানো হয়নি। অথচ এইতালে গঙ্গাজল বিকিকিনির কাউন্টার খুলে বসা হল কেন? প্রশ্নের মুখ বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষ ডাকঘরের এই নতুন জানালা খোলার লাভজনক দিকটি উল্লেখ করতে ভোলেননি। গত আর্থিক বছরে (২০২১-২২) গঙ্গোত্রী, হরিদ্বার ও ঋষিকেশের প্রায় ৪ লক্ষেরও বেশি গঙ্গাজলের বোতল ডাকঘর থেকে বিক্রি করে সার্কল আয় করেছিল আনুমানিক ১৭ লক্ষ টাকা। এবার কলকাতার জিপিও’তে এর কাউন্টার প্রথমে খোলা হল। এরপর ক্রমশ রাজ্যের ৪৮টি প্রধান ডাকঘরে তা চালু করা হবে, চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রায় থাকবে ১১০০টি ছোট ডাকঘর।

তবে কলকাতার জিপিও সহ সমস্ত শাখায় এবং রাজ্যের যেখানেই হোক নাগরিক-নজরদারিতে বড়-ছোট ডাকঘর ব্যবস্থার মূল সমস্যা হল — যে কোন পরিষেবা পেতে নাজেহাল হতে হয়, হয়রানির শেষ থাকে না। রেজিস্ট্রি, স্পিড পোস্ট, পার্সেল, বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্প, আধার কার্ড তৈরি ইত্যাদি যে কোনো দরকারে ঢোকা হোক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়। কাউন্টারের বাইরে লাইনে যত ভীড়, ভিতরে তত স্টাফ কম। একজন স্টাফকে দিয়ে একাধিক রকমের কাজ করানো হয়। কোনো আইটেমের কাজ টিফিন টাইমের পরে আর হয় না। কোথাও বা সঞ্চয় প্রকল্পের আপ-ডেট কেবল সপ্তাহের শেষ দিনে হয়। কর্মচারি পদ তুলে দেওয়ার পলিসিই প্রধানত চলছে, অবসরগ্রহণের পর সেইসব পদে নতুন নিয়োগ হয় নামেমাত্র। তার মধ্যে আবার বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক বেতনে বা দৈনিক মজুরিতে। এভাবে পরিষেবা দেওয়ার আগ্রহ কত আর থাকে। কত আর দক্ষতা অর্জন করার ইচ্ছা জাগে। এই সবকিছুর যোগফলে ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে ডাক পরিষেবা প্রদানের মান আদৌ সন্তোষজনক নয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এসব কিছুই স্বীকার করেন না, তারা কাজের মানের মূল্যায়ন করেন নিজেদের মতো করে, নাগরিকের চোখ দিয়ে নয়।

আসা যাক আলোচনার শেষ ও মূল পয়েন্টে। এতকিছু থাকতে গঙ্গাজল ব্যবসা চালু করা হল কেন? প্রশ্নটা সরাসরি মোদী সরকারকে তাক করে। সাফ কথা হল, এক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে তুষ্ট করার ইচ্ছাই ধরা পড়ছে। কারণটা সবার জানা। জাত-বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু সম্প্রদায়ের যে কোনও পূজা পাঠ, গৃহপ্রবেশ থেকে শুরু করে শেষকৃত্যে এবং নানা শুদ্ধি-পবিত্রতা উপলক্ষে ছেঁটাতে গঙ্গাজল লাগে। আর, পরোক্ষে এই ভাবের আবেগে হিন্দুত্বের সুড়সুড়ি দিতেই ‘গঙ্গোত্রী’-‘ঋষিকেশ’-‘হরিদ্বার’ নানা ব্র্যান্ডের বোতলে পোরা গঙ্গাজল বিক্রির ফন্দি আঁটা। গঙ্গাভাঙনে, গঙ্গাদূষণে, গঙ্গার অবরুদ্ধতায় যে মোদী সরকারের সহসা ঘুম ছোটে না, সেসবের প্রতিকার ব্যবস্থা নেওয়ার নামে কেন্দ্রীয় বাজেটে যেখানে বরাদ্দ হয় ছিটেফোঁটা মাত্র, যা নিয়ে বেশিরভাগই লুটপাট ভাগ বাটোয়ারার দুর্নীতি চলে মন্ত্রী-আমলা-ঠিকেদারদের যোগসাজশে, তারাই তৎপর হয়েছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ডাকঘর ব্যবস্থার মাধ্যমে গঙ্গাজল বোতলে পুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছে বেচতে। এতে আখেরে প্রত্যক্ষভাবে রাজকোষে কিছু অর্থ আসার সাথে সাথে পরোক্ষে সমাজের সংখ্যাগুরু অংশকে হিন্দুত্বের রাজনীতির জালে টেনে নেওয়া সম্ভব হলেও হতে পারে। এটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য বিশেষ লক্ষ্য ও পরিকল্পনা। এখনই নিশ্চিত বোঝা সম্ভব নয় এরও আবার বেদখল বেসরকারি হাতে যাবে কিনা! এটাও দেখতে হবে কিনা ‘কাচ্চি ঘানি সর্ষের তেলে’র মতো ‘পাক্কি শুদ্ধ্ গঙ্গা পানি’র প্যাক করা বোতলের কর্পোরেট হাতছানি!

(সমাপ্ত)

pablo-nehruda_0nehruda

কবি পাবলো নেরুদা (জন্ম ১২ জুলাই, ১৯০৪ প্রয়াণ ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩) ছিলেন চিলিয়ান কবি ও রাজনীতিবিদ। তার প্রকৃত নাম ছিল নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। পাবলো নেরুদা প্রথমে তার ছদ্মনাম হলেও পরে নামটি আইনি বৈধতা পায়। কৈশোরে তিনি এই ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। ছদ্মনাম গ্রহণের পশ্চাতে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ছদ্মনাম গ্রহণ ছিল সে যুগের জনপ্রিয় রীতি; দ্বিতীয়ত, এই নামের আড়ালে তিনি তার কবিতাগুলি নিজের পিতার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেন। তার পিতা ছিলেন কঠোর মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। তিনি চাইতেন তার পুত্র কোনো “ব্যবহারিক” পেশা গ্রহণ করুক। নেরুদা নামটির উৎস চেক লেখক জান নেরুদা এবং পাবলো নামটির সম্ভাব্য উৎস হলেন পল ভারলেইন। পাবলো নেরুদাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী লেখক মনে করা হয়। তার রচনা অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়।

নেরুদার সাহিত্যকর্মে বিভিন্ন প্রকাশ শৈলী ও ধারার সমাবেশ ঘটেছে। একদিকে তিনি যেমন লিখেছেন টোয়েন্টি পোয়েমস অফ লাভ অ্যান্ড আ সং অফ ডেসপায়ার-এর মতো কামোদ্দীপনামূলক কবিতা সংকলন, তেমনই রচনা করেছেন পরাবাস্তববাদী কবিতা, ঐতিহাসিক মহাকাব্য, এমনকি প্রকাশ্য রাজনৈতিক ইস্তাহারও। ১৯৭১ সালে নেরুদাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে এই পুরস্কার প্রদান নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একদা নেরুদাকে “বিংশ শতাব্দীর সকল ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি” বলে বর্ণনা করেন। ১৯৪৫ সালের ১৫ জুলাই, ব্রাজিলের সাও পাওলোর পাকিম্বু স্টেডিয়ামে কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা লুইস কার্লোস প্রেস্টেসের সম্মানে ১০০,০০০ লোকের সামনে ভাষণ দেন নেরুদা। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার পর চিলিতে ফিরলে সালভাদর আলেন্দে এস্ত্যাদিও ন্যাশোনালে ৭০,০০০ লোকের সামনে ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান।

জীবদ্দশায় নেরুদা একাধিক কূটনৈতিক পদে বৃত হয়েছিলেন। একসময় তিনি চিলিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সেনেটর হিসেবেও কার্যভার সামলেছেন। কনজারভেটিভ চিলিয়ান রাষ্ট্রপতি গঞ্জালেস ভিদেলা চিলি থেকে কমিউনিজমকে উচ্ছেদ করার পর নেরুদার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে তার বন্ধুরা তাকে চিলির বন্দর ভালপারাইসোর একটি বাড়ির বেসমেন্টে কয়েক মাসের জন্য লুকিয়ে রাখেন। পরে গ্রেফতারি এড়িয়ে মাইহু হ্রদের পার্বত্য গিরিপথ ধরে তিনি পালিয়ে যান আর্জেন্টিনায়। কয়েক বছর পরে নেরুদা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দের এক ঘনিষ্ঠ সহকারীতে পরিণত হন।

চিলিতে অগাস্তো পিনোচেটের নেতৃত্বাধীন সামরিক অভ্যুত্থানের সময়েই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন নেরুদা। তিন দিন পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার। জীবন্ত কিংবদন্তি নেরুদার মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পিনোচেট নেরুদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে জনসমক্ষে অনুষ্ঠিত করার অনুমতি দেননি। যদিও হাজারে হাজারে শোকাহত চিলিয়ান সেদিন কার্ফ্যু ভেঙে পথে ভিড় জমান। পাবলো নেরুদার অন্ত্যেষ্টি পরিণত হয় চিলির সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম গণপ্রতিবাদে।

+++++++++++++ 
+++++++++++

খণ্ড-30
সংখ্যা-23