আজকের দেশব্রতী : ৬ জুলাই ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-06-july-2023restore-democracy_0restore-democracy

জলঙ্গী নদীর তীর ধরে এক লড়াইয়ের ইতিহাসের জন্ম হচ্ছে। তৃণমূলী গুন্ডা, সমাজবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের থেকে নিজেদের পঞ্চায়েত, নিজেদের গ্রাম পুনরুদ্ধারের লড়াই চালাচ্ছেন ধুবুলিয়ার নোয়াপাড়া-২ অঞ্চলের মেহনতি মানুষ। সিপিআই(এমএল)-এর নেতৃত্বে চরমহৎপুর, পাথরাদহ, সোনাতলা, কালীনগর অঞ্চলের ক্ষেতমজুর, ছোটো কৃষক পরিবারগুলি এক অসম লড়াই চালাচ্ছেন তৃণমূল-বিজেপি শূন্য পঞ্চায়েত গঠনের লক্ষ্যে। কিছু অঞ্চলে তৃণমূলের সন্ত্রাসের সাথে সাথে আঞ্চলিক স্তরে মোকাবিলা করতে হচ্ছে কংগ্রেসের অপপ্রচারের। গ্রামগুলিতে মূলত ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং পিছিয়ে পড়া বর্গের মানুষের বসতি। বর্তমান সরকার সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া জাতির মানুষের ব্যাপক উন্নয়নের কথা বললেও এই অঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি বরং তার উল্টো কথাই জানান দেয়। বিগত পাঁচ বছরে উন্নয়নের ধাক্কায় সব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জনজীবন। একশো দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা বা এমনকি রাস্তাঘাট নির্মানের জন্যে বরাদ্দ অর্থ — সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির নজিরবিহীন রেকর্ড রয়েছে তৃণমূলের।

দীর্ঘদিনের জমি সংস্কার ও পুনর্বণ্টনের আন্দোলনের কেন্দ্র এই অঞ্চলগুলিতে পূর্বে পার্টির প্রতিনিধিরাই বারংবার নির্বাচিত হয়েছেন এবং শুষ্ঠভাবে পঞ্চায়েত পরিচালনা করেছেন বেশ কয়েকবার। পার্টি পতাকা ঊর্দ্ধে তুলে জনগণের অধিকার রক্ষায় শহীদ হয়েছেন এই অঞ্চলের লড়াকু নেতৃত্ব কমরেড জালাল, ইউসুফ মোল্লা-সহ বহু কমরেড। সংগ্রামী জনতা সেই ঐতিহ্যকে সামনে রেখে বর্তমানে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আবারো পঞ্চায়েতে লিবারেশনকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে। এই লড়াইয়ের নির্বাচনী ফলাফল যাই হোক না কেন, এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রচার হোক বা প্রার্থী বা মিছিলে মিটিংয়ে জনতার উদ্যমী অংশগ্রহণ — টাকা নির্ভর ক্ষমতার রাজনীতির পরিবর্তে এক বিকল্প রাজনৈতিক অনুশীলন শাসকশ্রেণীর রাজনীতিকে এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।

নির্বাচনে পার্টি মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে যেমন রয়েছেন পার্টির আঞ্চলিক নেতৃত্ব এবং পূর্বে পঞ্চায়েত পরিচালনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আনসারুলদা, সালিমাদি, ছবিদি-সহ আরোও অনেকেই। অন্যদিকে রয়েছেন এমন অনেকেই যারা প্রথমবার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছেন। তবে বয়স, কর্ম ও অন্যান্য বিভিন্নতার মধ্যেও প্রত্যেক প্রার্থীই একটি সূত্রে সংযুক্ত — প্রত্যেকেই মেহনতি পরিবারের সদস্য যারা পার্টি মতাদর্শের ধারক ও বাহক, এলাকায় জনতার আন্দোলনের সংগঠক।

to-restore-democracy

পঞ্চায়েত নির্বাচনে সোনাতলা অঞ্চলে কমরেডদের এই লড়াইয়ে অংশীদার হিসাবে প্রচারাভিযানে যুক্ত থেকেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বর্ষা, রাজীব, সাগ্নিকরা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন শিক্ষা ও সম্মানজনক জীবিকার দাবিতে তাদের লড়াইয়ের কথা। তারা প্রচার করেছেন কমরেড রঞ্জুর হয়ে — রঞ্জু সোনাতলার ৩৭নং বুথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। রঞ্জু পশ্চিমবাংলার লাখ লাখ বেকার যুবকদের একজন যিনি উচ্চশিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে মরিয়া চেষ্টা করছেন জীবনধারনের জন্য একটা চাকরি পাওয়ার। বাড়িতে লক্ষ লক্ষ টাকা নেই নেতাদের দেওয়ার জন্যে, তাই চাকরির স্বপ্ন অধরা। তিনি তাই অনেকদিন ধরেই লড়াই করে চলেছেন এলাকার দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিরুদ্ধে। এলাকার প্রার্থীরা লড়াই করছেন যুবকরা যাতে সরকারী প্রকল্পে কাজ পান, অঞ্চলের বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পুনরায় চালু করা যায়, কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্য দাম আদায় করতে পারেন তার জন্য। তাই যাদবপুর সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবার শিক্ষা এবং শিক্ষান্তে কাজের দাবিতে আন্দোলনের এক সংযোগ স্থাপিত হয়েছে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে। তাই ছাত্রছাত্রীরাও উদ্যমের সাথে প্রার্থীদের হয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরেছেন এলাকার মানুষের সমস্যা শুনতে। তারা আসন্ন পঞ্চায়েতে এলাকার প্রাথমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলিকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষার বেসরকারিকরণ সহ অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এলাকার ছাত্রযুবদের সাথে। ছাত্রছাত্রীদের দুই দফার এই প্রচার এলাকার ছাত্রযুবদের উপর এক সদর্থক প্রভাব বিস্তার করেছে। অনেকে নিজের থেকেই এগিয়ে এসে শুনেছেন কথা, বলেছেন নিজেদের সমস্যার কথা। আবার অনেকেই স্বতঃস্ফুর্তভাবে যোগ দিয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের প্রচার টিমের সাথে, সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন নিজেদের আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি – “চলুন ওদেরকে গিয়েও আপনাদের কথা বলুন।”

fighting-to-restore-democracy_0

গ্রামবাংলার এই পরিস্থিতি অবশ্যই দিন বদলের এক ইঙ্গিত দিচ্ছে। সোশাল মিডিয়ায় শুধু নয় বরং বাস্তব পরিস্থিতিতে গ্রাম-শহরের দূরত্ব সরিয়ে মানুষ একত্রিত হচ্ছেন ফ্যাসিবাদী এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। খাদ্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে দাবিতে শ্রমজীবী মানুষ ছাত্র যুবদের সংগ্রামী ঐক্য ভবিষ্যতের বিকল্প।

- ঋতম মাজি

fire-in-the-grain-marketthe-government-is-silent

দেশজুড়ে আগুন লেগেছে কাঁচা সব্জির বাজারে। কয়েকমাস আগে যে টমেটো চাষিরা দাম না পেয়ে তাঁদেরই উৎপাদিত পণ্যকে রাস্তায় ফেলে নষ্ট করলেন সরকারের নজর কাড়তে, সেই টমেটোই এখন দেশের বিভিন্ন বাজারে বিকোচ্ছে কোথাও কেজি প্রতি ১০০ কোথাও বা ১৩০ টাকায়। বহুদিন ধরেই আটা, ভোজ্য তেল সহ সমস্ত ধরনের ডালের দাম চড়া। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম অনেকটা কমা সত্ত্বেও সাধারণ গ্রাহকেরা তার সুফল পেলেন না। রান্নার গ্যাসের আকাশ ছোঁয়া দাম কমার কোনো লক্ষণই নেই। এবার নুনেরও দাম উঠতে শুরু করেছে। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, তীব্র দাবদাহ বা এল-নিনোর ভ্রুকুটির জন্য বর্ষার খামতি, কোথাও বা অতিবৃষ্টিকে এই দামবৃদ্ধির কারণ হিসাবে ঠাওরানো হচ্ছে। এমন একাধিক খলনায়কের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।

এই আগুন ঝড়ানো মূল্যবৃদ্ধির পেছনে প্রকৃতিকে দুয়োরানি হিসাবে সামনে খাড়া করে নিজেদের দায়িত্ব ও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে আড়াল করছে সরকার — তা কেন্দ্রই হোক বা রাজ্য। বিশ্বে ফল ও আনাজ ফলনে চীনের পরই ভারতের স্থান। বহু বৈচিত্র্যময় ফল সব্জি আমাদের মতো বিশাল দেশে সারা বছর ধরেই বিভিন্ন মরশুমে উৎপাদিত হয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার কারণে কোনো অঞ্চলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্য অঞ্চলের উৎপাদিত ফসল থেকে তা সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু তা করতে গেলে দরকার কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা, ফলনের পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা, হিমঘর বা তা সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক আধুনিক ব্যবস্থা — যার কোনটাই সরকারের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি। এই নয় যে এই প্রথম দেশজুড়ে আনাজ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে আগুন লাগল। প্রকৃতির দোহাই দিয়ে ফড়ে ব্যবসায়ী, মজুতদার অশুভ আড়তদার ফি বছরই এই সমস্ত সংকট থেকে বিপুল মুনাফা তোলে। উৎপাদনের বিন্দু থেকে বাজারে ফসল আসার সমগ্র প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রিত হয় মধ্যসত্ত্বভোগীদের নানা স্তরের মাধ্যমে, লাভের গুড় তারা মাঝখান থেকে খেয়ে নেয়। দরিদ্র চাষির অবস্থা যে তিমিরি ছিল তাই থাকে। আমজনতারও কোনো সুরাহা হয় না।

আম জনতার ক্রয়ক্ষমতা দিনের পর দিন কমছে, যার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়েছে। আইএমএফ’এর পরিসংখ্যান দেখিয়েছে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে মাথা পিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারত সবচেয়ে নিচে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশের গরিমা নিয়ে চললেও, বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্যই দেখিয়েছে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারত লজ্জাজনক ভাবে অ্যাঙ্গোলা ও আইভরি কোস্টের থেকেও নিচে রয়েছে। এই অবস্থায় বাজারে আনাজ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দামে নাজেহাল সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। এদিকে, সিএমআইই’র সাম্প্রতিকতম তথ্য জানাচ্ছে, জুন মাসে বেকারত্ব ৮.৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে।

গভীর সংকটে জর্জর ভারতীয় অর্থনীতি। আর্থিক বৃদ্ধির অর্ধসত্য পরিসংখ্যানে কপট উল্লাসে মাতোয়ারা প্রবঞ্চকদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশবাসী সমুচিত জবাব দেবে অনাগত দিনে।

true-colours-of-his-regime-before-the-whole-worldthe-whole-world

সামনে ২০২৪’এ লোকসভা নির্বাচন। কিন্তু দেশে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত কমছে। সেই ক্ষয়কে ঠেকাতে তিনি আরেকবার তার ‘বিশ্বগুরু’ ইমেজের ওপর ভরসা রাখলেন। তিনি নরেন্দ্র মোদী। যদিও মে মাসের গোড়া থেকে মণিপুর জ্বলছে, ১০০-র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, ২০০র বেশি চার্চ পুড়ে গেছে, ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ গৃহহারা হয়ে ত্রাণ শিবিরে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই চালাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী সংকট-দীর্ণ রাজ্যটিকে চরম বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে উড়ে গেলেন আমেরিকায় — ‘রাষ্ট্রীয় সফরে’। ন'বছরে এটা ছিল তার ষষ্ঠ মার্কিন সফর। মোদী সরকারের, নির্বাচনের আগে মার্কিন মুলুকে রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য এই চরম কাঙালপনাকে বাইডেন প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়েছে। কীভাবে? ভারতকে ঘিরে আমেরিকার রণকৌশলগত কব্জাকে আরও কঠোর করার উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করে।

রাজনৈতিক ভাবমূর্তি এবং মোদী সরকার ও গোদী মিডিয়ার আত্মগরিমায় প্রচার থেকে সরে এসে, এই সফরের আসল অন্তর্বস্তুকে বোঝারতে চেষ্টা করতে হবে। সে জন্য আমাদের নজর ফেলতে হবে বাইডেন মোদীর যৌথ বিবৃতিতে। ৫৮ অনুচ্ছেদের দীর্ঘ বিবৃতিতে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে ভূ-ভারতের সমস্ত বিষয়, কিন্তু মূল নজর নিবদ্ধ- প্রতিরক্ষা বন্ধনকে আরও গভীর, আরও সম্প্রসারিত করা। যার একমাত্র অর্থ হল, আমেরিকার ওপর ভারতের আরও বেশি রণকৌশলগত নির্ভরতা এবং তার ফলশ্রুতিতে ভারতের রণকৌশলগত স্বশাসনের সীমাবদ্ধ হওয়া! ভারতকে ইতিমধ্যেই কোয়াড (আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া জাপান এবং ভারতকে নিয়ে) ১২ইউ-২ (ইজরায়েল, ভারত, আমেরিকা, ইউএই)-র মতো জোটে টেনে নেওয়া হয়েছে। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল — চিনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ও তাকে ঘিরে ফেলার এবং মার্কিন-ইজরায়েল আঁতাতকে আরও সুদৃঢ় করার মার্কিন নীতিকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করা।

ভারতের মহাকাশ, প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমেরিকা যে তার রণকৌশলগত অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ফেলেছে তার খুব স্পষ্ট ছাপ ধরা পড়েছে এই যৌথ বিবৃতিতে। ভারতীয় নৌবাহিনী ও নৌবাহিনীর সম্পদের ক্ষেত্রে আমেরিকার নাক গলানোর সুযোগ অনেক বেড়ে গেল। আর সেই সূত্রেই ভারতকে মাত্রাতিরিক্ত ও অযৌক্তিক উচ্চমূল্যে ৩১টি প্রিডেটর (হানাদার) ড্রোন ৩.১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কেনার ব্যাপারে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। রাফায়েল কেলেঙ্কারির মতো সমস্ত ফাঁদ রয়েছে এই চুক্তিতেও। ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রেও যৌথ সহযোগিতার কিছু প্রস্তাব রয়েছে; যেমন এফ-৪১৪ জেট ইঞ্জিন তৈরির ব্যাপারে জেনারেল ইলেকট্রিক এবং হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড-এর মধ্যে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। গুজরাতে একটি সেমিকন্ডাক্টর যন্ত্রাংশ জোড়া দেওয়ার ও পরীক্ষা করার কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই বহন করতে হবে ভারতকে। আর একমাত্র সময়ই বলতে পারবে ভারত প্রযুক্তির এই তাৎপর্যপূর্ণ হস্তান্তর থেকে আদৌ লাভবান হবে কিনা।

ভারতের ক্রমশ বেশি বেশি করে মার্কিন-কেন্দ্রিক হয়ে ওঠা বিদেশ নীতির কারণে শুধু যে অন্যায় আর্থিক মূল্য বহন করতে হচ্ছে তা-ই নয়, বরং আরও গুরুত্বপূর্ণ হল এর প্রতিকূল কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য। ভারতের নিজের জাতীয় স্বার্থে, তার প্রয়োজন এই অঞ্চলে শান্তি এবং সমস্ত পড়শী দেশগুলোর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। চিনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত-বিরোধ নিয়ে চাই কূটনৈতিক সমাধান। কিন্তু ভারত যদি চিনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রটিকে ঘিরে ফেলার মার্কিন রণকৌশলগত পরিকল্পনা রূপায়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠে, তাতে চিনের সঙ্গে ভারতের বিরোধ আরও বাড়বে, আরও ঘনীভূত হবে। ভারত যত মার্কিন-ইজরায়েল শিবিরের দিকে ঘেঁষবে, তত তার ঘরের পাশের পড়শী দেশগুলোর সঙ্গেই শুধু নয়, উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গেও দূরত্ব বেড়ে যাবে। ফলে চিনের পক্ষে প্রভাব বিস্তার আরও সহজ হয়ে যাবে। নতুন সংসদ ভবনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র ইতিমধ্যেই নেপালসহ ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোকে ভারতের কল্পনালালিত সম্প্রসারণবাদী আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে শঙ্কিত করে তুলেছে।

আমেরিকার সংবাদমাধ্যম এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত বা ভারতীয়-আমেরিকান সম্প্রদায়সহ জনমতের একটা বিরাট অংশের কাছে মোদীর সফর মানে ভারতীয় গণতন্ত্রের সংকট সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ ব্যক্ত করার একটা অবকাশ। মোদীর ভারতে, প্রতিবাদী, ভিন্নমতের মানুষদের নির্যাতন, বেড়ে চলা হিংসা, ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা ও তাদের প্রতি বৈষম্য, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিপজ্জনক ক্ষয় সম্পর্কে জানতে চাওয়ার একটা অবকাশ। আইন পরিষদের ৭৫ জন সদস্য তাদের উদ্বেগ ব্যক্ত করে রাষ্ট্রপতি বাইডেনকে চিঠি লিখেছিলেন। কয়েকজন মোদীর ভাষণ বয়কট করেছেন। আমেরিকার রাস্তায় নেমে কয়েকশো মানুষ প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছেন। মোদীকে যখন হোয়াইট হাউসে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য তার সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ওবামাও প্রকাশ্যেই এসব প্রশ্ন তুলে তার দুর্ভাবনা প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিকের প্রশ্নের মুখে পড়ে মোদী ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের উত্তর দিতে গিয়ে অর্থহীন পুনরুক্তি করেছেন মাত্র। যেকোনো রকম বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং এটা করতে গিয়ে ভারতের সংবিধানকেও টেনে এনেছেন। বলেছেন ওসব হতেই পারে না, কারণ ভারত সাংবিধানিকভাবে ঘোষিত একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। কিন্তু ওবামা-র মন্তব্য ও সাংবাদিক সম্মেলনের প্রশ্নের যে রাগী প্রতিক্রিয়া এল বিজেপি’র ট্রোলবাহিনী এবং বরিষ্ঠ বিজেপি নেতাদের থেকে, তা আরও একবার প্রকৃত সত্যের পর্দাফাঁস করে দিল!

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাব্রিনা সিদ্দিকী, যিনি ভারতে গণতন্ত্রের ক্ষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, সমাজমাধ্যমে ‘পাকিস্তানী এজেন্ট’ হিসেবে সমানে হেনস্থার শিকার হয়ে চলেছেন। হোয়াইট হাউস এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিক মহল শ্রীমতী সিদ্দিকীর এই হেনস্থার তীব্র নিন্দা করেছে। এমনকি বারাক ওবামাও বিজেপি নেতাদের দ্বারা সমাজমাধ্যমে ‘হুসেন ওবামা’ নামে ট্রোলড হচ্ছেন! তাকে ‘মুসলিম’ আর সে কারণেই ‘ভারত-বিদ্বেষী’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। অত্যন্ত লজ্জার কথা, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ট্যুইটারে এক সাংবাদিককে দেওয়া এক কদর্য উত্তরে বলেছেন অসম পুলিশ আগে ভারতে ‘হুসেন ওবামা’দের ঢিট করবে, তারপর ‘আমেরিকান ওবামা’র ব্যাপারটা দেখা যাবে! অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংও ওবামা সম্পর্কে যা খুশি তাই অর্থহীন কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন, তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন মুসলিম দেশগুলোর বোমা বর্ষণের জন্য। এক্ষেত্রে তারা খুব ঠাণ্ডামাথায় এড়িয়ে গেলেন এই সত্যটা যে মোদী সরকার মুসলিম দেশগুলোর ক্ষেত্রে মার্কিন বিদেশ নীতির এক কট্টর সমর্থকই রয়েছে!

মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনেও মোদীর ভাষণ অনুধাবনযোগ্য — যদিও তার টেলিপ্রম্পটারের টেক্সট-এর ভুল পাঠের জন্য নয়! (টেলিপ্রম্পটারের টেক্সট-এ ছিল ‘ইনভেস্টিং ইন দি গার্ল চাইল্ড’ তিনি ভুল করে পড়েন ‘ইনভেস্টিগেটিং ইন দি গার্ল চাইল্ড’। আবার ‘লেয়িং অব থাউজ্যান্ডস অব মাইলস অব অপটিক্যাল ফাইবার’-এ ভুল করে পড়লেন ‘পলিটিক্যাল ফাইবার’! চরম বিভ্রাট!)

ঐ টেক্সট অর্থাৎ ভাষণের বিষয়বস্তু আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ভাষণ বা তার বাচনভঙ্গি নয়। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী নিয়ে বলতে গিয়ে মোদী আরও একবার হাজার বছরের বিদেশী শাসনের কথা বলে ফেললেন। আর ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে হাজার বছরকে খারিজ করে দেওয়ার বিষয়টিই রয়েছে হিন্দু আধিপত্যকামী সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের বিষাক্ত ন্যারেটিভ-এর মূলে, এই ‘খারিজ’ তত্ত্বই ভারতীয় মুসলিমদের হানাদার আক্রমণকারী ও ‘আভ্যন্তরীণ শত্রু’ হিসেবে তুলে ধরেছে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসার অবিরাম প্রচারের জন্য মতাদর্শগত সাফাই যুগিয়েছে। এই ‘খারিজ’ এখন একের পর এক রাজ্যে মুসলিমদের পণ্য বয়কট ও বিতাড়নের আওয়াজ তুলে কার্যত সম্প্রদায়টিকে গণনিধনের হুমকি দিচ্ছে।

ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন মোদী তার যুক্তরাষ্ট্র সফরকে ট্রাম্পের প্রচার মঞ্চ বানিয়ে ফেলেছিলেন; তার সেই চওড়া উচ্ছ্বাস ‘আবকি বার ট্রাম্প সরকার’ (এক বিরাট ঠাট্টার মতো) সেই কথাই বলছে! আমেরিকান ভোটাররা, যাদের মধ্যে সেদিন মোদীর শ্রোতৃমণ্ডলীতে উপস্থিত থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের অনেকেও আছেন — যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। কেন? ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরানোর জন্য চীয়ার লীডার মোদীর হর্ষোৎফুল্ল উচ্ছ্বাসের হট্টগোল ভরা আবেদনে তারা বিভ্রান্ত হননি! প্রাক-নির্বাচনী রাষ্ট্রীয় সফর এবং তার প্রচারে মোদীকে অনুগৃহীত করে বাইডেন প্রশাসন একটা বিষয়কে সুনিশ্চিত করেছে। সেটা হল — গোটা বিশ্বের সামনে মোদী রাজের আসল চরিত্রটা একেবারে নগ্ন করে ফেলা! আমেরিকান ভোটাররা যেমন ট্রাম্পের নতুন করে জয়ের সমর্থনে মোদীর বাগাড়ম্বরকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আমাদের আশা, ঠিক সেভাবেই ভারতীয় নির্বাচকরা মোদীর ‘বিশ্বগুরু’র দাবির ডাহা মিথ্যেটাকে বোঝার ও তাকে খারিজ করার মতো পরিণতবোধের পরিচয় দেবেন। মোদী রাজ যে চরম বিপর্যয়কে আবাহন করে এনেছে, তাকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আর কোনো সুযোগ তারা পাবে না — ভারতবাসীকে এটাই নিশ্চিত করতে হবে!

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৭ জুন ২০২৩)

fakdaibari-in-the-vote-warin-the-vote-war

পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে যখন রাজ্য জুড়ে হইচই, উত্তরের তথাকথিত প্রাণকেন্দ্র শিলিগুড়ি শহর বা দার্জিলিং জেলা তখন খানিক চুপচাপে শহর সংলগ্ন জলপাইগুড়ি জেলার অংশের গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোট প্রচারের উত্তাপ নিতে ব্যস্ত। শিলিগুড়ি শহর সংলগ্ন বেশ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত যেগুলো জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্ভুক্ত সেগুলোতে ভোট হচ্ছে। স্বভাবতই উঠে আসছে স্বজনপোষন, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রশ্ন। মানুষ গণতন্ত্রের উৎসবে সামিল হওয়ার আগে শেষ সময়ের পড়া ঝালিয়ে নেওয়ার মতো বুঝে নিতে চাইছেন তাদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থান। তবে স্বাভাবিকভাবেই পঞ্চায়েতে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবথেকে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় গ্রামগুলির স্থানীয় সমস্যা, জল নিকাশি, রাস্তা, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যোগাযোগ ব্যবস্থা সর্বোপরি বর্তমানে দুর্নীতিতে প্রায় পিএইচডি করে ফেলা তৃণমূলের লুঠ ও স্বজনপোষনের অভিযোগ। ডাবগ্রাম-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ফকদইবাড়ি ২৬নং আসনে সিপিআই(এমএল) পার্টির এবারের একমাত্র প্রার্থী ময়না সূত্রধর। আমাদের ময়নাদি।

ছোট্টখাট্টো চেহারার সবসময়ই হাসিমুখের ময়নাদি পার্টির সঙ্গে আছেন অনেকদিন। হাতিয়াডাঙাতে উনি আছেন কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে। ফলত এলাকার বেড়ে ওঠার সঙ্গে তিনি অনেকটাই পরিচিত। বলা যায় তিনি সামনে থেকে দেখেছেন। মূলত শ্রমজীবী মানুষদের বসবাস এই এলাকায়। শাসক তৃণমূলের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির দাপাদাপিও এখানে কম নয়। পার্টি দীর্ঘদিন ধরে এলাকার সমস্যা, শাহু নদীর বাঁধ নির্মাণ, পানীয় জলের সমস্যা, এলাকার মানুষদের অধিকারের প্রশ্নে সরব থেকেছে। এলাকার বেশ ভালো সংখ্যক মানুষদের একত্রিত করে রাজগঞ্জে বিডিও ডেপুটেশন থেকে পঞ্চায়েত ঘেরাও ইত্যাদি একাধিকবার সংঘটিত হয়েছে পার্টির নেতৃত্বে। কমরেড ময়না সূত্রধর (ময়নাদি) সব ক্ষেত্রেই থেকেছেন সামনের সারিতে। দিন প্রতিদিনের জীবনের লড়াইতেও তিনি যাপন করেছেন, এবং করছেন। করতে শিখিয়েছেন। এই ময়না সূত্রধর শহরে এসে গৃহ পরিচারিকার কাজ করে ফিরে গিয়ে কাঁধে তুলে নিচ্ছেন তিনতারার লাল পতাকা, পৌঁছে যাচ্ছেন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি। নিজের মতো করে বলছেন কেন এবার সকলে ময়নাদিকে ভোট দেবে।

northern-fakdaibari

এরমধ্যেই বৃষ্টি পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে। জল কাদা পেরিয়ে ময়নাদি কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল। কখনও কাজে যাওয়া আসার পথে চা দোকানে, মুদি দোকানে, হাটে লিফলেট দিয়ে নিজের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে আছেন দীনবন্ধু দাস, রীতা দাস, লক্ষ্মীদির মতো কমরেডরা। আছে ময়নাদির মেয়েরা। এলাকার মানুষ বলছেন বর্ষা এলেই প্রতিবারের নোংরা জমা জলের দুর্গতি আর যন্ত্রণা তারা আর মেনে নিতে চাইছেন না, চাইছেন নিকাশি ব্যবস্থার সুষ্ঠু সমাধান, গ্রামের বাচ্চাদের জন্য অন্তত একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুল, চাইছেন পরিস্রুত পানীয় জল। তারা চান এমন একজন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য এবার হোক, যে তাদেরই একজন; তাদের দাবি, তাদের কথা সে পৌঁছে দিক সঠিক জায়গায়। তাই গ্রামবাসীরা, গ্রামের মহিলারা ভরসা করতে শুরু করেছেন পতাকায় তিনতারাকে। তাদের ময়নাদিকে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতো পোস্টার, ব্যানারে ছয়লাপ করার ক্ষমতা বা তাগিদ পার্টির কোনদিনই ছিলো না। পার্টির বিশ্বাস মানুষের ওপর। তাইতো জনগনণের প্রতিনিধি এবারে সিপিআই(এমএল)-এর কালো ঘোড়া নিজেদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছেন নিজেদের সেরাটা দেওয়ার জন্য। কোনও প্রতিশ্রুতি নয়। ভোটের ফলাফল যাইহোক, মানুষের সঙ্গে থাকার অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তো এক এবং একমাত্র হাতিয়ার মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তোলার জন্য। কারণ মানুষই তফাত গড়ে দেয় শেষ পর্যন্ত। নকশালবাড়ি তার অন্যতম উদাহরণ বা উপাদান।

তাই ময়নাদি এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে — মানুষের ভরসা, ভালোবাসাকে পাথেয় করে।

charge-of-bar-council-members-from-law-examination-studentsmemorandum-demanding-correct-enrollment-fee-by-bar-council

সর্বভারতীয় আইনজীবী সংগঠন (আইলাজ)-এর পক্ষ থেকে রাজ্য সম্পাদক দিবাকর ভট্টাচার্য এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, আমরা জানি Advocate’s Act 1961 section 24(1) F-এ নির্দিষ্টভাবে বলা আছে এনরোলমেন্ট ফি বাবদ ৭৫০ টাকা জমা নেওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখছি বিভিন্ন রাজ্যের বার কাউন্সিল তাদের ইচ্ছামতো এনরোলমেন্ট ফি বাড়িয়ে চলেছে। যা ক্রমশ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, আর্থিক দিক থেকে দুর্বল শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে বহন করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আমরা দেখছি — পশ্চিমবঙ্গ - ১৪০০০ টাকা, তামিলনাড়ু - ১৪১০০ টাকা, অন্ধ্রপ্রদেশ - ১২৫০০ টাকা, কর্ণাটক - ১৫৯০০ টাকা, আসাম - ১৭৩৫০ টাকা, দিল্লি - ১৫৪৫০ টাকা, কেরালা - ২০৫০০ টাকা, উত্তরপ্রদেশ - ১৭৮০০ টাকা, ওড়িশা - ৪২৬০০ টাকা, ঝাড়খন্ড - ২৯০০০ টাকা, ছাত্রিশগড় - ২৮০০০ টাকা, বিহার - ২১৪৬০ টাকা ইত্যাদি যে যেরকম পারছে নিচ্ছে, যেটা সম্পূর্ণ বেআইনি।

তিনি আরও বলেন, “অল ইন্ডিয়া ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর জাস্টিস”-এর পক্ষ থেকে ২৬ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশ জুড়ে প্রচার চলেছে Advocate’s Act 1961 section 24(1) F অনুযায়ী ৭৫০ টাকার বেশি এনরোলমেন্ট ফি নেওয়ার বিরুদ্ধে। আজ ৩০ জুন বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া এবং সমস্ত রাজ্যের বার কাউন্সিলকে দাবিপত্র দেওয়া হয়েছে।

আমাদের রাজ্যেও ‘পশ্চিমবঙ্গ বার কাউন্সিল’কে সর্বভারতীয় সংগঠন আইলাজ-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে এনরোলমেন্ট ফি ৭৫০ টাকার বেশি নেওয়া বন্ধ করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।

asha movement in bihar
বিহারে আশা কর্মীদের ধর্মঘট

আগামী ১২ জুলাই ২০২৩ থেকে বিহারে আশা কর্মীদের অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘট শুরু হচ্ছে । তার আগে, ধর্মঘটের সমর্থনে ৪ জুলাই সিভিল সার্জনের দপ্তরের সামনে আশা সংযুক্ত সংঘর্ষ মঞ্চের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হচ্ছে।

bulldozer-crushed-the-housesbulldozer-crushed-the-houses-of-the-poor

যে বুলডোজার হয়ে উঠেছে ভারতের হিন্দু-আধিপত্যবাদী ফ্যাসিবাদের একটা প্রতীক, তা মূলত মুসলিমদের বিরুদ্ধে চালিত হলেও দলিত ও অন্যান্য দরিদ্রদেরও তার নির্মম অভিযান থেকে রেহাই মিলছে না। অতি সম্প্রতি গত ৬ জুন যোগী আদিত্যনাথের বুলডোজার গুঁড়িয়ে দিল উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর সদর তহশিলের কোটওয়া পান্ডে গ্রামের ৩০০টা ঘর। বুলডোজারের সহিংস হানাদারি নিয়ে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে যোগী আদিত্যনাথ ২০২২’র এপ্রিলে বলেছিলেন, “দরিদ্রদের কুঁড়ে ঘর ও দোকানের বিরুদ্ধে বুলডোজারকে ব্যবহার করা হবে না। শুধু দুর্বৃত্ত মাফিয়াদের অবৈধ পথে অর্জিত অর্থের বিরুদ্ধেই একে প্রয়োগ করতে হবে। …” কিন্তু ৬ জুন ২০২৩ কোটওয়া পান্ডে গ্রামে বুলডোজার যাদের ঘর ধূলিসাৎ করল তারা সবাই দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ের মানুষ। যোগী আদিত্যনাথের পাশবিকতা থেকে তারাও রেহাই পেল না।

দরিদ্রদের ঘরগুলো ধূলিসাৎ করার একদিন আগে সিপিআই(এমএল)-এর এক প্রতিনিধি দল জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করে চরম পদক্ষেপ নেওয়া থেকে প্রশাসনকে বিরত থাকতে বলেছিলেন। জেলাশাসক রাজিও হয়েছিলেন, মৌখিক প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন — যথাযথ পুনর্বাসন ছাড়া কাউকেই উচ্ছেদ করা হবে না। কিন্তু যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে প্রশাসন ঠিক করে রেখেছিল, তারসঙ্গে জেলা শাসকের মুখের কথার মিল ছিল না। এই বুলডোজার অভিযানের ফলে শিশু-নারী-সহ কয়েকশ মানুষ এখন আশ্রয়হীন অবস্থায় একরকম রাস্তাতেই দিন কাটাচ্ছেন। ঘরের জিনিসপত্র সব ধ্বংস করা হয়েছে। এই অভিযান চালাতে বিশাল পুলিশ বাহিনীকেও নামানো হয়। স্থানীয় যে জনগণ ঐ অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সিপিআই(এমএল)-এর যে নেতারা, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।

উল্লেখ্য যে, উচ্ছেদ হওয়া জনগণের অনেকই সাত দশক ধরে ঐ স্থানে বসবাস করছিলেন। সিপিআই(এমএল)-এর উত্তরপ্রদেশ শাখার রাজ্য সম্পাদক সুধাকর যাদব জানিয়েছেন, ঐ স্থানে বসবাসকারী পরিবারগুলোর অনেকেই সেচ দপ্তরের কাছ থেকে পাট্টা পেয়েছিলেন এবং সরকারকে জমির খাজনাও দিয়ে চলেছিলেন। এই পাট্টাগুলোর নবীকরণ একটা নিয়মিত ব্যাপার হলেও প্রশাসন সম্প্রতি তা করেনি। পরিবারগুলো যেহেতু অত্যন্ত দরিদ্র এবং জমি কেনার সামর্থ্য তাদের নেই, তাঁরা তাই প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছিলেন যে তাঁদের জন্য যেন বিকল্প স্থানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত না করে প্রশাসন চরম পদক্ষেপের পথেই গেল। সুধাকর যাদব আরও জানিয়েছেন, চন্দৌলি জেলাতেও বুলডোজার দিয়ে দরিদ্রদের উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং লখিমপুর খেরিতেও ৫৪টা গ্রামের বাসিন্দারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, কেননা, তাঁদেরও উচ্ছেদের নোটিশ ধরানো হয়েছে।

সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষে বিন্ধ্যাচল অঞ্চলের কমিশনার এবং জেলা শাসককে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে — যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে এবং যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের পুনর্বাসন দিতে হবে। এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ৮ জুন ২০২৩ উত্তরপ্রদেশের বহু জেলাতেই প্রতিবাদ সংগঠিত হয়।

intelligence-is-more-ruthless-to-womenmore-ruthless-to-women

গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করে তুলেছে কৃত্রিম মেধা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে কর্মী সংকোচনের বিপদ নিয়ে হাজির সাক্ষাৎ এই দৈত্য। আতঙ্ক সৃষ্টিকারী এই কৃত্রিম মেধার নানা সংস্করণ এখন শুধু বাজারে নয়, বিভিন্ন সংস্থা ব্যবহার করতে শুরু করায় বিশ্বজুড়েই শ্রম দুনিয়ায়, কাজের বাজারে এমনকি রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর মধ্যেও সংশয় ও দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে।

এই কৃত্রিম মেধাও দেখা যাচ্ছে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের উপর বেশি নির্দয়। গোল্ডম্যান স্যাস্ এক সমীক্ষা চালায় ‘দ্য পোটেনশিয়ালি লার্জ এফেক্টস্ অফ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স অন ইকনমিক গ্রোথ’। তাতে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ জনের মধ্যে ৮ জন মহিলা এই কৃত্রিম মেধার প্রকোপে মারাত্মকভাবে নিজ নিজ পেশায় বিপন্ন হয়ে পড়েছেন, আর ১০ জনের মধ্যে ৬ জন পুরুষ এই বিপন্নতার সম্মুখীন। দেখা যাচ্ছে, ১৫টি পেশা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে এই নতুন প্রযুক্তিতে যেখানে মহিলা কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।

২০২৭’র মধ্যে, এই সমীক্ষার মতে, আমেরিকায় এই কৃত্রিম মেধা ৪৯ লক্ষ কাজের ক্ষেত্রে বিরাট বদল আনবে, আর চ্যাটজিপিটি’র মতো কৃত্রিম মেধার আধুনিকতম প্রযুক্তি কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ইউনিভার্সিটি ইফ নর্থ ক্যারোলিনাস্ কেনান-ফ্ল্যাগলার বিজনেস স্কুলের মতে মহিলারা যে সমস্ত পেশায় কর্মরত, তার ৮০ শতাংশই বিরাটভাবে বিপন্নতার মুখে দাঁড়িয়ে, কারণ কৃত্রিম মেধার প্রবর্তনের ফলে ওই কাজগুলোই লুপ্ত হয়ে যাবে। আরো দেখা যাচ্ছে, যে কৃষ্ণবর্ণের মহিলারাই যে সমস্ত পেশা ও কাজের সাথে যুক্ত, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।

সমীক্ষা দেখিয়েছে, এই কৃত্রিম মেধার দৌলতে নতুন করে নতুন কিছু কাজের ক্ষেত্রও তৈরি হবে, তবে তা অত্যন্ত দক্ষতা সম্পন্ন কাজ বা পেশার ক্ষেত্রেই দেখা যাবে। ভারতের মতো দেশগুলোতে মহিলাদের নিয়োগ করা হচ্ছে ইনফর্মাল, নীচু মানের খুবই অদক্ষ কাজে। তাঁদের প্রশিক্ষিত করার কোনো ভাবনা বা পদক্ষেপই কোনো স্তরেই সরকারগুলোর পক্ষ থেকে দেখা যায় না। তাই এটা বলাই যায় যে এই কাজ কেড়ে নেওয়ার নতুন প্রযুক্তি শ্রম বাজারে, কাজের দুনিয়ায় বিরাট বড় পরিবর্তন আনতে চলেছে, কর্মক্ষেত্রে উচ্চতর স্তরে মহিলা কর্মীরা এরফলে নতুন করে কর্মচ্যুত হওয়ার জন্য দিন গুনছেন।

modi-spends-rs-2.05-crore-daily2.05-crore-daily-on-advertisement

বিজ্ঞাপন প্রিয়তা মোদী সরকারকে আপাদমস্তক এমনভাবেই গ্রাস করেছে, যে তারজন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মুড়ি মুড়কির মতো অকাতরে ব্যয় করতে সে বিন্দুমাত্র কসুর করছে না।

দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-তে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার পর মোদী সরকার ২০২২’র ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করেছে ২.০৫ কোটি টাকা। আর, ২০১৪ থেকে ৭ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত এই খাতে ব্যয় হয়েছে ৬৪৯১.৫৬ কোটি টাকা — বছরে, গড়ে ৭৫০ কোটি টাকা।

এই সমস্ত বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে প্রিন্ট মিডিয়া ও বৈদ্যুতিন প্রচার মাধ্যমে, যা, সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ কমিউনিকেশন’এর মাধ্যমে যায়। তাদেরই ওয়েবসাইট থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। সেই তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ বছর ৮ মাসে মোদী সরকার প্রিন্ট মিডিয়ায় ৩২৩০.৭৭ কোটি টাকা, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ৩২৬০.৭৯ কোটি টাকা খরচ করেছে অর্থাৎ ব্যয় হয়েছে মোট ৬৪৯১.৫৬ কোটি টাকা।

একদিকে আমজনতা ক্রমেই অভাবে, কর্মহীনতার ফাঁসে তলিয়ে যাচ্ছে নিচে, আর অন্যদিকে সরকার নিজের ঢাক পেটাতে দু’হাতে খরচ করছে জনগণ থেকে আদায়কৃত করের টাকা! 

(তথ্যসূত্রঃ দ্য ডিস্প্যাচ, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২)

can-the-question-be-prevented-by-locking-the-house

by-locking-the-house-with-pawns

ছোটবেলা থেকে অনেকেই হয়তো এই কথাটা শুনে এসেছেন, “লোকে যাঁরে বড় বলে, বড় সেই হয়, নিজে যাঁরে বড় বলে, বড় সেই নয়”। আজকের সময়ে কথাটা হয়তো খুব বেশি প্রযোজ্য নয়, আজকের সময়টাই প্রচারের সময়, নিজের ঢাক নিজে পেটানোর সময়। আজকের সময়টা নিজস্বী তোলার সময়, জানান দেওয়ার সময়, আমিও ছিলাম। ঘটনাচক্রে যেদিন থেকে এই আধুনিক মুঠোফোন চালু হয়েছে, সেদিন থেকেই এই নিজস্বী তোলাটাও চালু হয়েছে কি না, তা জানা না গেলেও, আজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী যে এই বিষয়ে পথিকৃৎ তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, কীভাবে নিজের প্রচার আরও বেশি বেশি করে করা যায়, সেই বিষয়েও তাঁর থেকেই শিখতে হয়। তিনি তাঁর নিজস্ব ক্যামেরাম্যান, নিজস্ব পোষাক পরিচ্ছদ সহকারে এমনভাবে নিজেকে দেশের মানুষের সামনে আনতে চান, যাতে দেশের মানুষও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং অন্যান্য জরুরি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করার কথাও মানুষ ভুলে যায়।

এদিকে দু’মাস হয়ে গেল, ভারতের উত্তর পূর্বের একটি ছোট অঙ্গরাজ্য, মণিপুর, জাতিগত হিংসায় জ্বলছে। যে প্রধানমন্ত্রী ছোটখাট বিষয় নিয়েও ট্যুইট করে থাকেন, যে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ করে থাকেন, সেই প্রধানমন্ত্রী মণিপুর নিয়ে এখনও অবধি মুখে কুলুপ এঁটেছেন। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি মণিপুর নিয়ে চিন্তিত, প্রতিদিনকার ঘটনাবলির দিকে তিনি নাকি নজর রাখছেন, ওদিকে বিদেশ সফর থেকে ফিরে তিনি প্রশ্ন করে বসছেন, দেশে এখন কী চলছে? ঘটনাচক্রে সেটাও খবর হচ্ছে। তার পরের দিন দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠক করছেন, তাতে কী বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা জানা না গেলেও, পরের দিন থেকে প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড দেখে বোঝা যাচ্ছে সেদিনের মন্ত্রীসভার বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আরও বেশি করে নরেন্দ্র মোদীর মুখকে সামনে রেখে আগামী লোকসভা ভোটের প্রচার করবে শাসক বিজেপি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে একটি অনুষ্ঠান হবে সেখানে প্রধানমন্ত্রী যাবেন, বক্তব্য রাখবেন, প্রথম থেকে শেষ অবধি তা প্রচার করা হবে, পৌঁছে যাবে, দেশের কোনায় কোনায়, প্রধানমন্ত্রীর স্থির ছবি, চলমান ছবি, মানুষ অবাক চোখে দেখবে, তাঁদের স্বপ্নের সওদাগরকে।

সকাল থেকে সেই মতো প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। যে কোনও সময়ে ভারতের মতো প্রধানমন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি করেই হয়তো যেতে পারতেন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু সেটা করলে তো প্রচার করা যাবে না, যে তিনিও একজন সাধারণ মানুষ, তিনিও দিল্লীর সাধারণ মানুষের মতো সরকারি যানবাহনে চলাফেরা করেন। তাই ঠিক হয়, তিনি দিল্লীর মেট্রো রেলে চড়ে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। সেইমতো প্রস্তুতি নেওয়া হয়, দিল্লী মেট্রো রেল সকাল থেকে খালি রাখা হয়। স্টেশন চত্বর খালি রাখা হয়। যদিও নিরাপত্তার কারণেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত ক্যামেরাম্যান এবং কিছু মানুষকে প্রস্তুত রাখা হয়, যাতে তাঁরা পরবর্তী স্টেশন থেকে ঐ একই মেট্রো রেলে ওঠেন, এবং দেখেন যে প্রধানমন্ত্রী বসে আছেন সেই ট্রেনে। তারপর তাঁদের সঙ্গে খানিক কথাবার্তা হবে, সেটাও আগে থেকে ঠিক করে রাখা বিষয়ে। এই সমস্ত প্রক্রিয়ার ছবি তোলা এবং তাঁর পেটোয়া সংবাদমাধ্যমের মদতে যাতে, সেই ছবি এবং ভিডিও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে, তার ব্যবস্থাও আগে থেকে করে রাখা হয়।

can-the-question-be-prevented

এই পর্যন্ত সব কিছু, সমস্ত ঘটনা, পরিকল্পনা মাফিক হলেও, কিছু কিছু বিষয় এরপর সামনে চলে আসে, যা প্রধানমন্ত্রীর এই প্রচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। খবর আসতে থাকে, যে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ছাত্রনেতাদের ঘরবন্দী করে রেখেছে, দিল্লী পুলিশ। অভিজ্ঞান ও দিল্লী আইসার সম্পাদক অঞ্জলি ট্যুইট করেন, প্রধানমন্ত্রীকে যাতে কোনও ছাত্র কোনও অপ্রীতিকর প্রশ্ন না করে, সেই জন্যেই কি তাঁদের গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে? ধীরে ধীরে আরও বেশ কিছু খবর পাওয়া যায়, যে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ নাকি, তাঁদের সঙ্গে সংযুক্ত হিন্দু কলেজ, ভীম রাও আম্বেদকর কলেজ সহ বেশ কিছু কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর এই অনুষ্ঠানটি দেখা বাধ্যতামূলক করেছে, বলা হয়েছে, এই অনুষ্ঠানে যদি তাঁরা উপস্থিত হন, তাহলে তাঁদের পাঁচটা অতিরিক্ত হাজিরা দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, তাঁদের নাকি বলা হয়েছে, তাঁরা যেন কেউ কালো রঙের পোষাক পরে না আসেন, তাঁরা যেন কেউ প্রধানমন্ত্রীকে দেশের চলমান কোনও বিষয় নিয়ে প্রশ্ন না করেন। আরও শোনা গেছে, অদ্যাপকদের জামা কাপড় খুলে অবধি তল্লাশি করা হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নকে এড়ানোর জন্য, প্রধানমন্ত্রী এতো কিছু করলেন, সেই প্রশ্ন করা কি আটকানো যায়? এই ছাত্ররা একযোগে সামাজিক মাধ্যমে এই প্রশ্নগুলোই তুলে ধরলেন, যা আরও বেশি পরিমাণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। সকলে যে যার বাড়ি থেকেই পোষ্টার তুলে ধরলেন, মণিপুর নিয়ে কেন প্রধানমন্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটেছেন? কেন, ভারতীয় মহিলা কুস্তিগিরদের যৌনহেনস্থা করেও বিজেপির সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে এখনও গ্রেপ্তার করা হল না? সেই পোষ্টার কিন্তু আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। প্রধানমন্ত্রী যা আটকাতে চেয়েছিলেন, তা কি তিনি পারলেন?

এরপরেও কিছু কথা থেকে যায়। প্রধানমন্ত্রী বারংবার নিজেকে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনি বলে প্রচার করে থাকেন, তিনি নাকি ‘সমগ্র রাষ্ট্র বিজ্ঞানে’ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, কিন্তু এই শতবর্ষের অনুষ্ঠানে তাঁর সমসাময়িক একজন ছাত্রকে খুঁজে পাওয়া গেল না কেন? আজকের সময়ে সকাল থেকে বিকেল অবধি অনেকেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুকে গালাগালি দিয়ে থাকেন, কিন্তু সেই নেহেরুর একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন, যা আজকের ঘটনার সঙ্গে হয়তো সম্পর্কযুক্ত। অধ্যাপক হরদয়াল আইএসআই কলকাতায় একটি ঘরোয়া আলোচনায় জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নেহরু রোজ সকালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাঁটতে যেতেন। বলতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঁটলে একটু যদি বিদ্বজ্জনদের ও বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের হাওয়া গায়ে লেগে বিদ্যাবুদ্ধি বিকশিত হয়। অধ্যাপক হরদয়াল আরও বলেছিলেন, ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর সেক্রেটারিকে একবার বলেন যে, তিনি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে চান, সেক্রেটারি সাহেব যেন মাননীয় উপাচার্যের সেক্রেটারির সাথে কথা বলে উপাচার্য মহাশয়ের সময় অনুযায়ী সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করেন। ওই সেক্রেটারি বলেন যে, এর কী দরকার? বরং উপাচার্য মহাশয়কে জানালে তিনিই দেখা করতে আসবেন। মৌলানা আজাদ বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রীর তাঁর কাছে যাওয়া উচিত এবং তিনি তাই যাবেন। আজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার নামে যেভাবে শুধু নিজের প্রচারের ব্যবস্থা করলেন, তাতে এই পুরোনো কথাগুলো আবারও মনে করিয়ে দিতে হল। আসলে আজকের প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন পছন্দ করেন না, তিনি শুধু নিজের প্রচার চান, আর সেইজন্যেই তিনি শিক্ষাকে আরও গুরুত্বহীন করে দিতে চান। তিনিও হয়তো সেই কথাটাই বিশ্বাস করেন, “ওঁরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে”। তিনি চান প্রশ্নহীন আনুগত্য। কিন্তু আজকের পড়াশুনা জানা যে কোনও ছাত্র তো প্রশ্ন করবেই, পেয়াদা দিয়ে ঘরবন্দী করে রেখে কি সেই প্রশ্ন করা আটকানো যাবে?

- সুমন সেনগুপ্ত

new-military-mou-on-modi's-us-visitnew-military-mou

মোদীর সাম্প্রতিক মার্কিন সফরে সম্পন্ন হল ভারতের সামরিক ক্ষেত্রের জন্য নতুন ‘মউ’। বলাবাহুল্য, ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রকে শক্তিশালী করার নামে। প্রস্তাবটি মোদী সরকারের, তাতে সাড়া দিয়েছে মার্কিন পক্ষ।

বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা, দারিদ্র, বৈষম্য ও বেকারির জ্বালা! ভারত-মার্কিন দু’দেশেই কিছু কমবেশি একই দুরাবস্থা! বিশেষত বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনসংখ্যার দেশ ভারতে অভাবী অবস্থা পৌঁছেছে বর্ণনাতীত চরমে। লোকসংখ্যা ১৫০ কোটিতে পৌঁছে যাওয়া আমাদের দেশে এবছর এপর্যন্ত (জুন ২০২৩) বেকারি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৪৫ শতাংশে। চলতি বছরে মার্চ ও মে মাসে কিঞ্চিৎ কমার ব্যতিক্রমের বিপরীতে গত ছ’মাস যাবত কর্মহীনতা বৃদ্ধির ধারা লেগেই আছে। সর্বোপরি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির বিভীষিকা, মারাত্মক প্রভাব ফেলছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এই সময়কালে, যখন বিশ্বের দেশে দেশে মানবতাবাদী কন্ঠে নিনাদ উঠছে “যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই, বাঁচার জন্য যা যা অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন তার সবকিছু পেয়ে বাঁচতে চাই”; যখন ভারতের জনজীবনের জরুরি চাহিদাগুলি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ততোধিক তৎপরতায় সমাধানের দাবি রাখে, তখন মোদীর মার্কিন সফরে এক অত্যন্ত অবাঞ্ছিত ঘটনা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের সামরিক সম্ভারের বরাত দেওয়া। অন্যদিকে আরও একবার দৃশ্যমান হল, ট্রাম্প বিদায় নেওয়ায় বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় বসলেও মার্কিন রয়েছে তার পূর্বাপর অবস্থানেই। মুখিয়ে আছে ভারতের ‘প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে’ সম্প্রসারণ আরও বাড়াতে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র সংক্রান্ত ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আগে থেকেই যথেষ্ট ঘনিষ্ট, তার ওপর নতুন পরত দিতে ‘মউ’ করা হল।

এবারের দ্বিপাক্ষিক বোঝাবুঝি অনুসারে মোদী সরকার কথা দিয়েছে আমেরিকার কাছ থেকে ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ৩১টি ড্রোন কিনবে। ১৫টি ভারতীয় নৌবাহিনীর সামুদ্রিক পাহারাদারী চালাতে, আর ৮টি করে স্থলবাহিনী ও বিমানবাহিনীর আকাশপথে নজরদারী চালানোর জন্য। যাতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন ও পাকিস্তান সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বহু দূর থেকে গোয়েন্দাগিরি, নজরদারী ও বিপক্ষ শক্তির উপস্থিতি জরীপ করা এবং প্রয়োজনে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানা যায়। তাছাড়া, ভারত-মার্কিন উভয় কর্তৃপক্ষ এই আশা পোষণ করে, ভারতে জিইএফ-৪১৪ আইএনএস-৬ টার্বো-ফ্যান ইঞ্জিন একসাথে তৈরি করতে পারলে তা ভারতীয় ‘তেজস মার্ক-২’ যুদ্ধবিমানকে আরও শক্তি যোগাবে। এখন যেখানে ‘তেজস মার্ক-১’ জেট তৈরি হচ্ছে মার্কিন থেকে কোনোরকম প্রযুক্তি হস্তান্তর ছাড়াই। ‘তেজস মার্ক-২’ জেট উৎপাদন শুরু হলে পরে দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতায় এদেশে এক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা-শিল্পক্ষেত্র গড়ে তোলার জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও পদক্ষেপ করার দরজা খুলে যেতে পারে। এহেন জেট ইঞ্জিন ও ড্রোনের হাতিয়ার উপরন্তু ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্দ্ধমান আগ্রাসী চ্যালেঞ্জকে প্রতিহত করতে ভারত-মার্কিন রণনীতিগত সম্পর্ককে অভিন্ন কেন্দ্রাভিমুখী করে তুলতে সহায়ক হবে। এই ‘চুক্তি’ হয়েছে মার্কিন কোম্পানি জেনারেল ইলেকট্রিক ও ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের অন্তর্গত হিন্দুস্থান এ্যারোনেটিক্সের মধ্যে।

উপরোক্ত ‘মউ’ করার নেপথ্যে মার্কিনের অন্যতম আরও এক উদ্দেশ্য হল, সামরিক সরঞ্জাম কেনার প্রশ্নে ভারতকে রাশিয়ার ওপর ব্যাপক নির্ভর করা থেকে ক্রমশ সরিয়ে নিয়ে আসা। বিগত ১৫ বছরে ভারত থেকে রীতিমতো লোভনীয় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক রসদ লেনদেন হাসিল করার পর এখন মার্কিন পক্ষ চাইছে এই ক্রেতা-বিক্রেতার সামরিক সম্পর্ককে আরও বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে।

মোদী সরকারের বড়গলায় বোলচাল আছে যে, সামরিক ক্ষেত্রের সমস্ত ব্যাপারেই ভারত নাকি স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার রণনৈতিক স্বায়ত্ততা অর্জনের তালাশ করে চলছে! কেন্দ্রের সরকারি ভাষ্যে অবিরাম হৈ হল্লা চালানো হয় — ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীরা অন্তর্ঘাত হানতে চোরাপথে এদেশে অস্ত্র ঢুকিয়ে বোঝাই করছে! কিন্তু প্রকৃত বাস্তবে ভারত আজও সরকারিভাবে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। এবং এই সর্বনাশা পথে দেশকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সর্বোপরি কোন পরিস্থিতিতে, কোন সময়ে? ক্ষুধার ভারতে, বৈষম্যের ভারতে, দারিদ্রের ভারতে, কর্মহীনতা বৃদ্ধির ভারতে।

- অনিমেষ চক্রবর্তী

opposite-side-of-the-diamond-shine-is-the-panchali-of-miserythe-panchali-of-misery

কৃত্রিম হীরা! সিন্থেটিক হীরা!

সারা দেশের মানুষ পরিচিত হলেন ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা কৃত্রিম হীরার সঙ্গে, যখন ফলাও করে খবরে প্রকাশ পেল দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর আমেরিকার রাষ্ট্রীয় সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির স্ত্রী জিল বাইডেনকে উপহার দিচ্ছেন ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা অভিনভ সবুজ রং’এর ৭.৫ ক্যারাটের এক হীরা। আর, এই বিশেষ উপহার দেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনিই হয়ে উঠলেন ওই হীরার প্রথম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর।

কিন্তু, এই কৃত্রিম হীরার উল্টো পিঠে যে হাহাকার, কান্না, আত্মঘাতী হওয়ার করুণ কাহিনী নীরবে লেখা হচ্ছে লোকচক্ষুর অন্তরালে, তা আজ ক্রমশ ভারী হয়ে আকাশে বাতাসে অনুরণিত হয়ে চলেছে।

গুজরাতের সুরাটে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ হীরা শিল্প। ভারত থেকে ৯০ শতাংশ হীরা রপ্তানি হয় এখান থেকে, আর ৮০ শতাংশ পালিশ করা হীরা সারা বিশ্বে যায়। এই শিল্পটি পুরোপুরি রপ্তানি নির্ভর, কারণ এর আভ্যন্তরীণ বাজার নেই বললেই চলে। রপ্তানি নির্ভরতার কারণে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপরই এই শিল্পের ভাগ্য জড়িয়ে রয়েছে। সম্প্রতি, এই হীরা শিল্প বড় ধরনের এক সংকটের শিকার। কর্মচ্যুত কর্মীদের আত্মঘাতী হওয়া, বেঁচে বর্তে থাকতে বাধ্যতামূলকভাবে বেতন সংকোচন মেনে নেওয়া, বিনা বেতনে ‘ছুটি’তে চলে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক হারে এই শিল্পে চলছে কর্মী সংকোচন। বর্তমানে, অজানা অচেনা নতুন এক প্রতিদ্বন্দ্বীর পাল্লায় পড়ে ভারতের সবচেয়ে পুরাতন হীরা শহরটিতে খেলার নিয়ম কানুনই আজ বদলে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। আর, নতুন এই প্রতিদ্বন্দ্বী হল সিন্থেটিক হীরা, বা ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত হীরা। এই নতুন ‘জাতের’ হীরাকে কেটে ডিজাইন করতে শ্রম সময় ও শ্রমিক সংখ্যা একই লাগলেও বাজারে এর মূল্য আসল হীরার থেকে অনেক অনেক কম। আর এইজন্য, গোটা শিল্পটাই এখন নতুন ও পুরাতনে বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে। জিল বাইডেনকে মোদীর কৃত্রিম হীরা উপহার স্বরূপ দেওয়ার পরপরই এই রত্নালঙ্কারের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই এই হীরার বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বাজার হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউনাইটেড আরব এমিরেটস (ইউএই) ও চীন। ২০১৮ থেকেই এই কৃত্রিম হীরার বাজার চনমনে হতে শুরু করে। তারপর এর বাজার সাত গুণ বৃদ্ধি পায়। অতিমারির সময়ে রপ্তানিতে ধাক্কা নামলেও তার প্রকোপ কেটে গেলে ভারত ২০২১-২২এ ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হীরা রপ্তানি করে ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে, যা ২০২০-২১’র সাপেক্ষে ১০৬.৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি। কিন্তু ভারতীয় বাজারে এর চাহিদা নেই বললেই চলে। সুরাটের গ্রিন ল্যাব ডায়মন্ড’এর কর্ণধার সঙ্কেত পাটেল, মনে করেন, “আজকাল মানুষ বুঝে শুনে খরচ করে, আর এই কৃত্রিম হীরা হল তাঁদের কাছে এক বিকল্প। যেহেতু কৃত্রিম হীরা আর আসল হীরা দেখতে অবিকল এক, তাই কেউ এখন আর এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না, যে কোনটা আসল আর কোনটা ল্যাবে তৈরি করা।”

মস্কো থেকে নিউ ইয়র্ক, বেলজিয়াম থেকে বেজিং — হীরা আর সুরাট একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হোত। কিন্তু, সাত লক্ষের আশপাশে কর্মরত হীরা শ্রমিক, যারা বিশ্বের ৮০ শতাংশ হীরা কেটে পালিশ করেন, তাঁদের জীবনে, দিনযাপনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। গত তিন মাসের মধ্যে আটজন হীরা শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন, ১৫,০০০ শ্রমিক কাজ খুইয়েছেন, আর বিগত পাঁচ বছরে এই শিল্পটি বছরে ১৫-২০ শতাংশ লোকসানের মুখোমুখি হয়েছে। ২০১৮ থেকেই সংকটের কালো মেঘ ঘনিয়ে ওঠে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান ল্যাবরেটারিতে তৈরি কৃত্রিম হীরা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বাণিজ্যিক টানাপোড়েন, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি প্রভৃতি কারণগুলো এই শিল্প জুড়েই বড় ধরনের সংকট ডেকে এনেছে। এ’বছর এপ্রিল থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্ততপক্ষে ৮ জন শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন তীব্র অভাবের সাথে যুঝতে না পেরে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকারী ভাবে জানা যাচ্ছে না ঠিক কতজন শ্রমিক আত্মঘাতী হয়েছেন, কতজনই বা পড়েছেন ছাঁটাইয়ের কবলে। সম্প্রতি, জি-৭’র বৈঠকগুলোতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সংকট আরও ঘনীভূত হল। কারণ এই দেশটি ভারতের হীরার এক বেশ বড় খরিদ্দার। বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিকরা দৈনিক মজুর হিসাবে কাজ করেন, যাদের মজুরি ঘণ্টা পিছু।

শিল্পের চলমান সংকটের জন্য মালিকরা কাজের সময় কমিয়ে দেওয়ায় তাঁদের মজুরিও সংকুচিত হচ্ছে। কিছু কিছু কারখানার মালিকরাই স্বীকার করেছেন যে এরফলে যারা আগে ২৫,০০০ টাকা রোজগার করত, তাঁদের মজুরি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকায়। এই হ্রাসপ্রাপ্ত মজুরির ফলে শ্রমিকরা তাঁদের সন্তানদের স্কুলের মাইনে দিতে পারছেন না, বকেয়া হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের বিল, রোজকার দু’বেলা খাওয়া দাওয়ায় টান পড়ে যাচ্ছে। অভাবের তাড়নায় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চহারে সুদ সহ ঋণ নেওয়া, পরিশোধ করতে না পেরে আত্মঘাতী হওয়া — এই পাপচক্রেই তাঁদের জীবন আবর্তিত হচ্ছে। বেশ কিছু কারখানায় মালিক পক্ষ ছাঁটাই না করে শ্রমিকদের বিনা বেতনে মাসের পর মাস ‘ছুটিতে’ পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই সংখ্যাটা প্রায় ৩ লক্ষ। নিম্ন আয় সম্পন্ন ও বড় সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকদের আধিক্য রয়েছে এই শিল্পে। গুজরাট শ্রম দপ্তরের পক্ষ থেকে হাজারে হাজারে আক্রান্ত শ্রমিকদের স্বার্থে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিপুল মুনাফা অর্জনকারী এই শিল্পের শ্রমিকদের বড় একটা অংশই সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচ থেকে বঞ্চিত।

যে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির অন্যতম এক ইঞ্জিন হিসাবে মনে করে কর ছাড় থেকে শুরু করে শ্রম আইনের আওতার বাইরে নিয়ে আসা হয়, তারই অন্যতম এই হীরা শিল্পে নেমে আসা ঘোর দুর্দশায় সম্পদ সৃষ্টিকারী শ্রমিকরাই আজ নেইরাজ্যের বাসিন্দায় নিক্ষিপ্ত। মোদী-অমিত শাহ’র হীরক তৈরির রাজ্যে শ্রমিকরা কবে যে দড়ি ধরে মারবে টান, তার অপেক্ষায় থাকুক ভারতবাসী।

- অতনু চক্রবর্তী      
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ দ্য প্রিন্ট.ইন, ২৫ জুন ২০২৩)

political-importance-of-rural-non-agricultural-activities-increasinggradual-expansion-and-diversification

কৃষিক্ষেত্রের পাশাপাশি গ্রামীণ জনগণের একটা বড় অংশ নিযুক্ত রয়েছেন অকৃষি বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডে। এই ক্ষেত্রটি সংখ্যার দিক থেকে শুধু যে বিকাশমান তাই নয়, নানা বৈচিত্র্যেও নিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এই ক্ষেত্রটির গ্রামীণ রাজনীতিতে অবদান কী, তার সামগ্রিক ও এলাকাভিত্তিক সমীক্ষা ও হস্তক্ষেপ গ্রামীণ রাজনীতিতে প্রভাব সঞ্চারের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় বলেই মনে করা হয়। কৃষিপ্রধান অঞ্চলে লালিত পালিত হলেও জীবিকাগত বিশিষ্টতার কারণে গ্রামীণ এই অংশটির এক ভিন্ন পরিচিতি সত্তা রয়েছে, সে পরিচিতিও আবার প্রায়ই সমসত্ত্ব কিছু নয়। গ্রামীণ রাজনীতিতে এই অংশটির ভূমিকা বুঝে ওঠার জন্য তাদের সাধারণ ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিবিড় সংযোগের প্রয়োজন, প্রয়োজন এই ক্ষেত্রটি সম্পর্কে এক সামগ্রিক চেতনা।

২০০৫ সালের জাতীয় আর্থিক গণনা দেখিয়েছিল সে সময় অকৃষি গ্রামীণ অর্থনীতি ক্ষেত্রে প্রায় ৪ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ সংযুক্ত ছিলেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে এই ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৫৬ শতাংশ। বিভিন্ন তথ্য থেকে প্রকাশ পরবর্তীকালেও এই বৃদ্ধিহার বজায় আছে। সেই হিসেবে বলা যায় বর্তমানে এই ক্ষেত্রে নিযুক্ত আছেন প্রায় ৫ কোটি ৭৫ লক্ষ মানুষ। এরমধ্যে রয়েছেন নানারকমের কারখানা, হস্তশিল্প, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প, মেরামতি, নির্মাণ, খনি ও খাদান, পরিবহণ, ব্যবসা, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিষেবা ইত্যাদিতে যুক্ত মানুষেরা। বিভিন্ন ধরনের গ্রামীণ অকৃষি কর্মকাণ্ডের কোন কোন ক্ষেত্রে কত শতাংশ মানুষ যুক্ত রয়েছেন ভারত সরকারের ২০০৫ সালের আর্থিক সমীক্ষা তার একটা ছবি তুলে ধরেছে।

উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে অকৃষি কাজের মধ্যে খুচরো ব্যবসায় যুক্ত মানুষের সংখ্যা সর্বাধিক — ৩৯ শতাংশ, অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায় যুক্ত ২ শতাংশ মানুষ। ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে যুক্ত আছেন ২৬ শতাংশ মানুষ, গোষ্ঠীগত, সামাজিক ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন পরিষেবায় যুক্ত আছেন ৮ শতাংশ মানুষ। পরিবহণ ক্ষেত্রে যুক্ত আছেন ৪ শতাংশ মানুষ, হোটেল ও রেস্তোরাতেও ৪ শতাংশ। শিক্ষাক্ষেত্রে ৫ শতাংশ মানুষ যুক্ত, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কাজে যুক্ত আছেন ২ শতাংশ মানুষ। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ২ শতাংশ মানুষ, ডাক ও তার বিভাগে ২ শতাংশ, রিয়েল এস্টেটে ২ শতাংশ মানুষ যুক্ত আছেন। ১ শতাংশ মানুষ যুক্ত লগ্নি সংক্রান্ত কারবারে। গ্রামীণ নির্মাণকাজে ১ শতাংশ মানুষ যুক্ত। মোটরগাড়ির বিক্রি, সারাই এর কাজেও ১ শতাংশ মানুষ যুক্ত আছেন। খনি ও খাদানের কাজে ০.৩ শতাংশ এবং গ্যাস, জল, বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজে ০.২ শতাংশ মানুষ যুক্ত।

প্রতিটি ক্ষেত্রকে যেসব এলাকায় খুঁজে পাওয়া যাবে তা নয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলিতে সাধারণভাবে অন্যান্য সব জায়গার মতোই বিপুল সংখ্যক খুচরো ব্যবসার কারবারিকে পাওয়া যাবে। এই ক্ষেত্রটি আবশ্যিকভাবেই গ্রামের সাধারণ অর্থনীতির বিকাশ পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত। গ্রামীণ এই ক্ষেত্রটিতে সংগঠিত বৃহৎ পুঁজি ঢুকতে চাইছে। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে ইতোমধ্যেই কোথাও কোথাও ভালো মাত্রায় ‘ই চৌপল’ জাতীয় ক্ষেত্রের বিকাশ ঘটছে, যারা একদিকে কৃষকের ফসল কিনছেন, অন্যদিকে সেই চৌপলের অন্য অংশ থেকে সেই ফসলের দামের একাংশ দিয়ে গৃহস্থালির জিনিস সংগ্রহ করছেন কৃষকরা। প্রথম দিকে আকর্ষণীয় মনে হলেও পরে ফসল সংগ্রহের নীতিটা কৃষকের পক্ষে আর আকর্ষণীয় থাকছে না, কৃষি অর্থনীতির ওপর তা সরাসরি আঘাত হানছে। এই প্রবণতা ইতস্তত সর্বত্রই বিকাশমান। খুচরো ব্যবসার অসংগঠিত ধরনকে আত্মসাৎ করে একচেটিয়া বড় পুঁজির এই ক্ষেত্রে প্রবেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচারের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে। বিশেষত ভারতের প্রধান শাসক দলকে উন্মোচনের অনেক হাতিয়ারের এটা অন্যতম। এছাড়া সার, বীজ, কীটনাশক ব্যবসার যে কালোবাজারির ঘটনা মাঝেমাঝেই সামনে আসে, তার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলা গ্রামীণ রাজনৈতিক কাজের অন্যতম অঙ্গ বলেই বিবেচ্য।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন পরিষেবা মূলক গ্রামীণ কাজে যে অংশটি গ্রামে যুক্ত আছেন, তার একটা ভালো পরিমাণ ঠিকাকরণ অর্থনীতির সামগ্রিক ঠিকাকরণ প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গেই ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে — মিড-ডে-মিল, আশা, অঙ্গনওয়ারী কর্মী বা পার্শ্বশিক্ষকদের যে সামান্য সম্মান দক্ষিণার নামে শোষণ করা হয়, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গ্রামীণ রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব রাখে। এর বাইরেও শিক্ষ ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে স্থায়ী যে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মী বা চিকিৎসাকর্মীরা আছেন, তারা গ্রামীণ রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব রাখেন। গ্রামীণ ক্ষেত্রে প্রথাগত শিক্ষায় সাধারণভাবে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা এই অংশটি সংখ্যায় কম হলেও গ্রামীণ রাজনীতিকে যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে প্রভাবিত করেন সবচেয়ে বেশি। বামফ্রন্ট আমলে এই গোষ্ঠীটি তাদের গ্রামীণ রাজনীতিতে মজবুত জোরের অন্যতম শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই অংশটির সাথে সাধারণভাবে গোষ্ঠী হিসেবে এবং ব্যক্তিগত স্তরেও রাজনৈতিক সংযোগ স্থাপন করাটা বিশেষ জরুরি।

the-political-importance

বিভিন্ন ধরনের পোলট্রি, ভেড়ি, ডেয়ারী পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। ভেড়িগুলির মধ্য দিয়ে প্রচুর টাকার লেনদেন হয় এবং প্রাধান্যকারী রাজনৈতিক শক্তি এগুলির ওপর সবসময়েই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে চায়। ভেড়ির নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠী সংঘর্ষ গ্রামীণ রাজনীতির এক নিয়মিত ঘটনা। ভেড়ির অধিকার সংক্রান্ত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের উত্তেজনা অনেক সময়েই সাধারণ নির্বাচনের উত্তেজনার কাছাকাছি পৌঁছোয়। এই সংক্রান্ত ক্ষেত্রে দুর্নীতিও মারাত্মক। এই ধরনের দুর্নীতিকে উন্মুক্ত করে এই ক্ষেত্রের স্বাভাবিকীকরণের যে দাবি সাধারণভাবে গ্রামের মানুষের থাকে, সেই আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণে সম্ভব মতো সচেষ্ট হওয়া দরকার। পাশাপাশি এই ক্ষেত্রে সতকর্তা না থাকলে কায়েমী স্বার্থর দ্বারা আত্মসাৎ হওয়ার সম্ভাবনাও মারাত্মক। তবে বর্তমান রাজনীতির ভারসাম্যের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র ছেড়ে দিলে এই সংক্রান্ত প্রচার আন্দোলনই সাধারণভাবে আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের বিষয় হতে পারে।

গ্রামীণ ক্ষেত্রে সরকারি পরিবহনের উপস্থিতি নামমাত্র এবং গ্রামীণ জনগণের একটা ভালো অংশ পরিবহণ ব্যবসার সাথে যুক্ত। এদের ওপর নানা সময়েই নানারকম সরকারি বা আইনি ফতোয়া আসে এবং তার বিরুদ্ধে তাদের দ্রুত সংগঠিত হওয়ার একটা প্রবণতাও দেখা যায়। আমরাও কোথাও কোথাও এ'বিষয়ে কিছু সাফল্য পেয়েছি আর একে বিস্তৃত করার অনেক অবকাশই আছে।

খাদানের বিষয়টি বিশেষ করে পাথর খাদান বীরভূম এবং সংলগ্ন বর্ধমানের কিছু অঞ্চলে ভালো মাত্রায় প্রভাব সঞ্চারী। মজুরি অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় খাদানের কাজ ছেড়ে এসব জায়গায় এনআরইজিএ প্রকল্পে কাজ করার প্রবণতা বেশ কম। কিন্তু তুলনামূলক বেশি মজুরির পাশাপাশি এখানে স্বাস্থ্যগত সমস্যা মারাত্মক। এখানে কাজ করার সময় অনবরত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাথরকণা শরীরে প্রবেশ করে, উপযুক্ত পোষাক বা আবরণী তো নেই-ই, এমনকী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং জটিল অসুখে আক্রান্তদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা করার আগ্রহ সরকার বা খাদান মালিক কোনও পক্ষেরই নেই। উপরন্তু খাদানগুলির অনেকগুলিই অবৈধ এবং ভালো মাত্রায় মাফিয়া শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে। এখানকার কোনও শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করতে মাফিয়া রাজের সক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন সময়ে শাসন ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলি ভালো পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে মাফিয়া রাজকে মদত দেয়।

কয়লা এবং বিভিন্ন খনি থেকে আকর তোলার পর তাকে বালি ইত্যাদি দিয়ে বুজিয়ে দেওয়ার যে নিরাপত্তা জনিত বিধি আছে, তাকে নিয়ম করে ভাঙাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, আর এই অভ্যাস মারাত্মক সব দুর্ঘটনা ডেকে আনে। খনি ও খাদানের দুর্নীতি, মাফিয়ারাজ এবং এখানকার শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি পরিবেশগত সমস্যা যা স্থানীয় বাসিন্দাদের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ — তা নিয়েও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার দরকার। খনি ও খাদান অধ্যুষিত অঞ্চলে অর্থনৈতিক তাকত সমৃদ্ধ এই ক্ষেত্রটির রাজনৈতিক প্রভাবের দিকটি বিশেষভাবে মাথায় রাখা দরকার।

non-agricultural-activities-i-increasing-with-the-gradual-expansion-and-diversification

বীরভূম ও বর্ধমানের একাংশে খনি ও খাদানের যেমন বিশেষ প্রভাব আছে, তেমনি মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ার একাংশে বিড়ি ও জরির কাজ বিশেষ প্রভাব রাখে। বহু মহিলা বিশেষ করে এই কাজে যুক্ত। ঘরে ঘরে বিড়ি তৈরির কাজ যেমন হয়, তেমনি এক্ষেত্রে পতাকা বিড়ির মতো সংগঠিত বড় ক্ষেত্রও বর্তমান। বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি নেহাৎই কম, তা নিয়ে আন্দোলনের সুযোগ যথেষ্ট। অতীতে ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে কেন্দুপাতা তোলার শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের প্রভাবসঞ্চারী দিকটির কথা আমাদের সবারই জানা। বিড়ি, জরি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের কম মজুরিপ্রাপ্ত শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলনের সুযোগ বরাবরই যথেষ্ট। উত্তরবঙ্গে চা পাতা তোলার কাজে যে সমস্ত মহিলারা যুক্ত আছেন, তাদের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।

গ্রামীণ অকৃষি ক্ষেত্রে খুচরো ব্যবসার পরেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ যুক্ত আছেন ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে। তার নানা বিভাগ। ক্ষেতমজুরদের পাশাপাশি এরাই গ্রামীণ প্রলেতারিয়েতের বৃহত্তম বাহিনী। তাদের নিয়ে আলাদা করেই বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন, এখানে সে প্রসঙ্গে তাই আর বিশেষ কিছু বলা হল না।

গ্রামীণ অকৃষি ক্ষেত্রে দু’একটি ক্ষেত্র ছাড়া পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের অংশগ্রহণ এখনো বেশ কম। বিড়ি শ্রমিক বা চা পাতা তোলার শ্রমিক হিসেবে মহিলাদের ভূমিকা বেশি। এছাড়া পোলট্রি এবং বিশেষ করে ডেয়ারীগুলি অনেক সময়েই সমবায় বা গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হয় এবং ভালো সংখ্যক মহিলা তার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এগুলির মধ্যে বিশেষত ডেয়ারীর ক্ষেত্রে এক বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে, আমুলের উত্থান যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। দারিদ্র জর্জরিত গ্রাম বাংলায় এরকম কোনও গ্রামীণ প্রকল্প নেওয়ার জন্য সরকারকে উদ্যোগী করতে সামাজিক আন্দোলন শুরু করা যায় কিনা, তার বিচার বিশ্লেষণের অবকাশ আছে। চলতি রাজনীতিক বৃত্তে ঘোরাফেরা করা প্রতিক্রিয়ার রাজনীতির বাইরে নির্মাণের রাজনীতির এক নতুন পরিসরকে তুলে ধরে গ্রামীণ সমাজে নতুন কোনও জোয়ার আনার চেষ্টা বিপ্লবী শক্তিকে অবশ্যই করতে হবে। কোথায় কোথায় তার কী ধরনের অবকাশ আছে, সেটার বিবেচনা জরুরি।

- সৌভিক ঘোষাল

9-years-9-blows-unveiling-the-central-government's-attackattack-on -the-working-class

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সুপরিকল্পিত হামলা ও হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদকে ওকালতি করার যে ফ্যাসিবাদী প্রকল্প বিজেপির রয়েছে, তার আরও একটা সংযোজন ও চরিত্রলক্ষণ হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে শাসক বর্গের খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা। নব্য উদারবাদের বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদের এই পর্যায়টি মাথা চাড়া দিয়েছে, যেখানে পুঁজি চলে এসেছে আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে। এতদিন ধরে শ্রমিক আন্দোলন যে সমস্ত সাফল্য অর্জন করেছিল, তা সে কেড়ে নিতে শুরু করেছে, জনপরিসরে যে সকল সম্পদগুলো ছিল তা কব্জা করতে চলছে বেসরকারিকরণ, জমি লুঠ, এবং পরিবেশ ধ্বংসসাধনের লক্ষ্যে জোরালো প্রচারাভিযান। শ্রমিকশ্রেণিকে দুর্দশাগ্রস্থ করে তুলতে নব্য উদারবাদী নীতিসমহের হাত ধরে গত ন’বছরে মোদী জমানার ৯টি হামলা যুক্ত হয়েছে।

১) শ্রমিকশ্রেণির প্রতি ঘৃণা — কর্পোরেটদের ভক্তি

পুঁজিবাদি শ্রেণির প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে মোদী জমানা শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি তার চূড়ান্ত অবজ্ঞা প্রকাশ করেছে। আদানি-আম্বানির হুকুম তালিম করতে গিয়ে মোদী শ্রমিক শ্রেণীকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছে ‘সহজে ব্যবসা-বাণিজ্য করার’ স্লোগানের আড়ালে। তার সরকার ‘গরিবদের প্রতি যত্নশীল’ বলে নিজের পিঠ চাপড়ালেও মোদীর জমানা সন্দেহাতীতভাবে ভারতের সবচেয়ে বেশি কর্পোরেট স্বার্থবাহী ও জনবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।

কথায় ও কাজে মোদীর সমস্ত প্রচেষ্টাগুলোই হচ্ছে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকদের মধ্যকার সম্পর্ককে ক্রীতদাস ও আনুগত্যের উপর দাঁড় করানো। খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে মোদী ঘোষণা করেছিলেন যে দেশে মাত্র দু’টো জাত রয়েছে — একটা হল গরিব, আর আরেকটা হল তারা, যারা গরিবদের দারিদ্র থেকে টেনে উপরে তোলার চেষ্টা করছেন। ২০১৯’র স্বাধীনতা দিবসের সময় তাঁর দেওয়া ভাষণে মোদী দেশবাসীর কাছে আবেদন করেন ওই সমস্ত ‘সম্পদ সৃষ্টিকারী’দের স্বীকৃতি ও যথাযথ সম্মান দিতে। অযথা তাঁদের ‘সন্দেহের’ চোখে না দেখতে। সম্পদ যে শ্রমশক্তির ফসল, এই বুনিয়াদি সত্যটা মোদী অস্বীকার করে পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতি তাঁর ভক্তি প্রকাশ করেন। এদিকে, অক্সফাম’এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, কর্পোরেট কর কমিয়ে ও কোম্পানিগুলোকে নানান আর্থিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে ২০২০-২১-এ সরকারের রাজস্বে ক্ষতি হয়েছে ১.০৩ লক্ষ কোটি টাকা যা সেই বছরে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের সমগ্র বরাদ্দের থেকে বেশি।

সাঙাতী পুজিবাদকে জনপ্রিয় ভাষায় আদানি-আম্বানির কোম্পানি রাজ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করলে মোদী সরকারের আসল চরিত্রকে সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যে সরকারটি হল, অতি ধনীদের জন্য, অতিধনীদের দ্বারা পরিচালিত এবং অতি ধনীদের স্বার্থে কাজ করা।

২) আর্থিক ন্যায়ের উপর হামলা : ভারতীয় সমাজে অসাম্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া

মোদী সরকারের আর্থিক ও শ্রমনীতি দেশে উদ্বেগজনক হারে সামাজিক ও আর্থিক অসাম্য তৈরি করেছে। গত তিন দশক ধরে ভুবনীকরণ, উদারবাদ ও বেসরকারিকরণের নীতি বিরাট মাত্রায় অসাম্য ডেকে এনেছে, কিন্তু গত ন’বছরে এই বৈষম্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, আজ ভারতবর্ষ অসাম্যের দিক থেকে রয়েছে সবার উপরে।

সম্পদের কেন্দ্রীভবন পৌঁছে গেছে মারাত্মক জায়গায়। অক্সফাম রিপোর্ট ‘ভারতে অতিধনীদের টিকে থাকা : ভারতীয় অধ্যায়’ দেখিয়েছে সবচেয়ে উপরতলার ৩০ শতাংশ মানুষ সমগ্র সম্পদের ৯০ শতাংশ নিজেদের হাতের মুঠোয় রেখেছে, আর, নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে সমগ্র সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ! প্রত্যক্ষ কর, কর্পোরেট কর হ্রাস করার ফলে লাফ দিয়ে বেড়েছে অপ্রত্যক্ষ কর। দেখা যাচ্ছে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষ উপর তলার ১০ শতাংশ মানুষের থেকে নিজেদের উপার্জনের ছ’গুণ বেশি অপ্রতক্ষ কর কেন্দ্রীয় সরকারকে দেন। এই বৈষম্য ৭০ শতাংশ ভারতীয়কে এতই দুর্দশাগ্রস্থ করে তুলেছে যে তার প্রভাব পড়েছে খাদ্য কেনার ক্ষেত্রে, ফলে ভারত এখন বিশ্বে অন্যতম এক ক্ষুধাতুর দেশ। ২০২২’র বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭।

৩) সামাজিক ন্যায়ের উপর হামলা : জাতপাত, সামন্তী ও পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোগুলোকে আরও মজবুত করা

কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান আর্থিক নীতিগুলো জাতপাত ও পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোগুলোকে টিকিয়ে রাখাই শুধু নয় তাকে করেছে অনেক বেশি মজবুত। সমাজের গভীরে তার শেকড়কে আরো গভীরে প্রোথিত করেছে।

উদাহরণস্বরূপ, নয়া লেবার কোড সেই সমস্ত পেশায় কন্ট্রাক্ট শ্রম ব্যবস্থাকে বজায় রেখেছে যেগুলো জাতপাতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, যেমন নিকাশী, গৃহকর্মের কাজ। দলিত শ্রমিকরা নিরাপত্তাহীনতার পাপচক্রে ঘুরপাক খায়, সামাজিক সুরক্ষা ও কাজের নিশ্চয়তা ছাড়াই।

মহিলা শ্রমিকদের বেলায় একই কথা খাটে। অক্সফাম ইন্ডিয়ার বৈষম্য রিপোর্ট দেখিয়েছে, ভারতে মহিলা শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ২০০৪-০৫-এ ছিল ৪২.৭ শতাংশ যা ২০২১-এ দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশে। মজুরি ও সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেই এই বৈষম্য বড় মাত্রায় গড়ে উঠেছে। ৯৭ শতাংশ মহিলা শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন ঠিকা শ্রমিক, স্কিম কর্মী প্রভৃতি পেশায় যেখানে কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই, নেই কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা। আশা, মিড-ডে-মিলে কর্মরত বিপুল সংখ্যক মহিলা কর্মী এমনকি শ্রমিক হিসাবেও স্বীকৃতি পান না। যে শ্রমকোড তৈরি করা হয়েছে তা সরাসরি লিঙ্গ সাম্যের উপর আঘাত নামিয়েছে, যা সমমজুরি ও কাজের শর্তগুলোর উপরও হামলা।

৪) বেকারত্ব এবং ক্রমবর্ধমান ইনফর্মাল করণ — কর্মসংকোচন থেকে কর্মহীন বৃদ্ধি 

গত ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্ব শীর্ষস্থানে উঠেছে, কর্মহীনতা শ্রমিকশ্রেণির গোটা অংশকেই, বিশেষ করে প্রান্তিক ও নিপীড়িত স্তর থেকে আসা মানুষদের নিক্ষিপ্ত করেছে দারিদ্র, ঋণের ফাঁদ, অনাহার এবং আরও বেশি করে ঠেলে দিয়েছে প্রান্তসীমায়। দু’কোটি চাকরি দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি মোদী ২০১৪-তে দিয়েছিলেন, তা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ও শ্রমনীতি নতুন কোন কাজের সুযোগ তো তৈরি করছে না, বরং তা কেড়ে নিচ্ছে সেই কাজগুলোকে যা এখনও টিকে রয়েছে, ফর্মাল সেক্টরকে আরও ইনফর্মাল করছে, যার দরুণ বেকারত্ব আরও তীব্র হচ্ছে, শ্রমিকদের ঠেলে দিচ্ছে নিরাপত্তাহীন কাজের জগতে। এমনকি সেনাবাহিনীকেও ঠিকাকরণের হাত থেকে রেহাই দেওয়া হল না। অগ্নিপথ প্রকল্প হল তারই প্রকাশ।

আজ অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিপুল ৯৩ শতাংশ হল অসংগঠিত শ্রমিক যারা জিডিপি’তে ৬৫ শতাংশ অবদান রাখেন। তাঁরাই আজ কাজের জগতে, মজুরির বা সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার শিকার। এই সমস্ত শ্রমিকরাই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিক্ষিপ্ত, ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক সম্প্রদায় থেকে আগত। তাঁদের অধিকার যে কি মাত্রায় খর্ব করা হচ্ছে তা বোঝা যায় এই তথ্য থেকে যে ২০১৯-২০২০’র মধ্যে দিন মজুরদের সামাজিক স্তরটি সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী হয়েছেন।

৫) শ্রমিক শ্রেণির উপর সার্জিকাল স্ট্রাইক — নোট বন্দি, জিএসটি এবং কোভিড কালীন লকডাউন

শ্রমিকশ্রেণির উপর এই তিনটের আঘাত বিপর্যয়কারী। নোটবন্দী দেশের ইনফর্মাল অর্থনীতিকে ভেঙে তছনছ করে দেয়। লক্ষ লক্ষ কাজ উধাও হয়ে যায়। সিএমআইই-সিপিএইচএস’এর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৭’র প্রথম চার মাসে ১৫ লক্ষ কাজ চলে যায়। নোটবন্দীর কয়েকমাসের মধ্যেই চালু করে দেওয়া হল জিএসটি, যা আবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াল।

কোভিড লকডাউন আরও বড় ধাক্কা দিয়ে সংকটকে তীব্র করল। ২৪ মার্চ চার ঘণ্টার নোটিশে দেশব্যাপী লকডাউন শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারগুলোকে চরম দুর্দশা, বুভুক্ষা, কাজ হারানোর নিদারুণ অবস্থায় ফেলে দিল। কাজ হারিয়ে ক্ষুধার্ত-ক্লান্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে নিজভূমে ফেরার পথে চরম লাঞ্ছনার শিকার হলেন। সুরাটে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে লাঠি চালায় এমনকি গ্রেপ্তারও করে। যে সমস্ত শ্রমিক লকডাউনের সময়ে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরে, তাঁদের সাইকেল বাজেয়াপ্ত করে বেচে দিয়ে ২১ লক্ষ টাকা তুলে নেয়। বাড়ি ফেরার পর শ্রমিকরা খাদ্য ও কাজের দাবিতে বিক্ষোভও দেখান।

প্রথম পর্বে লাখে লাখে যে সমস্ত কাজগুলো খোয়া যায়, তা আর কোনোদিন ফিরে এল না। যারা ফের কাজ ফিরে পেলেন, দেখলেন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাঁদের নিয়োগ করা হচ্ছে। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্ট ‘স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া’ দেখিয়েছে, যারা কাজে ফিরে এসেছেন তাঁরা আরও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় ইনফর্মাল কাজের ধরনে নিযুক্ত হলেন। ২০১৯-২০’র মধ্যে ফর্মাল ক্ষেত্রের প্রায় অর্ধেক বেতনভুক কর্মী যুক্ত হলেন ইনফর্মাল কাজে — হয় স্বনিযুক্ত হিসাবে অথবা ইনফর্মাল কর্মী হয়ে। অতিমারীর দ্বিতীয় তরঙ্গ এবং ২০২১’র দ্বিতীয় লকডাউন পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলল। সরকার শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে একচুল উদ্যোগও নিল না। উল্টে, অতিমারীর সুযোগে নিয়ে এল শ্রমিক বিরোধী আইন। অতিমারীর গোটা পর্যায়ে বিজেপি যে কাজটা করেছে তা নাওমি ক্লেইন’এর ভাষায় ‘ঝাঁকানি দেওয়ার তত্ত্ব’। যার অর্থ হল, সমষ্ঠিগতভাবে জনগণ যখন যুদ্ধ, ক্যু বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় দিগভ্রান্ত থাকে, তখন সেই সুযোগে নির্মম কৌশল নিয়ে কর্পোরেট স্বার্থবাহী নীতিগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। শ্রম সংক্রান্ত আইন, কৃষি, জমির মালিকানা, শিল্পের জন্য জমির অধিগ্রহণ — এই সমস্ত কিছুই সংশোধন করেছিল বিজেপি সরকার। ২০২০’র ৫ মে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক সমস্ত রাজ্য সরকারের কাছে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, “অতিমারী যে সমস্ত চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আনল তা মোকাবিলা করতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যেন শ্রম সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হয়।” স্ব-শংসাপত্র প্রদান, পরিদর্শনের ব্যবস্থাকে কমিয়ে আনা, আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের আইনের রক্ষাকবচের বাইরে এনে ফেলা, এই সবকিছুই কয়েকটা উদাহরণ মাত্র।

৬) বর্তমান শ্রম আইনের রক্ষাকবচগুলোকে ভেঙে ফেলা

৪৪টি শ্রম আইনকে বাতিল করে তার জায়গায় ৪টি শ্রমকোড নিয়ে আসা আসলে শ্রমিক শ্রেণির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর।

শ্রমিকদের কষ্টার্জিত অধিকারগুলোকে খারিজ করে শ্রমকোড ক্রমবর্ধমান বেসরকারিকরণ, ঠিকাকরণ ও ইনফর্মাল ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করতেই এক আইনী ছাড়পত্র দিয়ে বসল। ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের উপর আক্রমণ শানিয়ে শ্রমিক শ্রেণির যেকোনো সংঘবদ্ধ কার্যকলাপ, যেমন ধর্মঘটকে কঠোর শাস্তি ও বেআইনি হিসাবে চিহ্নিত করাটাই এর মূল উদ্দেশ্য। লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে আইনি পরিসরের বাইরে রেখে, বর্তমানের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থাগুলোকে ভেঙে খান খান করে, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকারের উপর হামলা নামানো হয়েছে। মহিলা শ্রমিকদের জন্য বেশ কয়েকটি সুরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রত্যাহার করে কন্ট্রাক্ট প্রথাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে, জাতপাত ও লিঙ্গ নিপীড়নকেই কর্মস্থলে আইনসিদ্ধ করা হল।

সংবিধানে বিধৃত শ্রমিকদের অধিকারের উপরও আক্রমণ হল এই শ্রমকোড। সংবিধান যখন ন্যায্য মজুরি (লিভিং ওয়েজ)-এর কথা বলছে, তখন শ্রমকোড ‘অনাহারে দিন কাটানোর জন্য মজুরি’ বা স্টারভেশন ওয়েজ নির্ণয় করছে। সংবিধান যখন ম্যানেজমেন্টে শ্রমিকদের অংশগ্রহণের পলিসিকে অনুসরণ করাটা বাধ্যতামূলক করছে, কোড তখন ব্যক্তি নিয়োগকর্তার একচ্ছত্র দাপট কায়েম করার অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক করে দিচ্ছে।

৭) গ্রামীণ গরিবদের উপর আক্রমণ

একশ দিনের কাজের প্রকল্পকে ক্ষয়প্রাপ্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতে কৃষি সংকটকে আরও তীব্র করে তুলল। ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে, ২০১৫ সালে মোদী মস্করা করে বলেছিলেন মনরেগা হল কংগ্রেসের ব্যর্থতার এক জীবন্ত স্মারক। আর তারপর থেকেই এই প্রকল্পকে হেয় করতে সংগঠিত প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়।

এই প্রকল্পের চাহিদা দিনের পর দিন বাড়তে থাকলেও কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ হ্রাসপ্রাপ্ত হতে থাকে আর ২০২৩-এ এই খাতে বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁট করা হয় ৩৩ শতাংশ।

ত্রিমুখী পন্থায় সরকার মনরেগার উপর হামলা নামিয়েছে, যা জ্যাঁ দ্রেজ দেখিয়েছেন। প্রথমটা হল, নিজেদের উপস্থিতির প্রমাণ স্বরূপ ডিজিটাল অ্যাপ চালু করা হয়েছে যা শ্রমিকদের দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কারণ ডিজিটাল স্বাক্ষরতা তাঁদের মধ্যে নেই, এছাড়া সংযোগ বা কানেক্টিভিটির সমস্যাও গ্রামগুলোতে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আধার লিঙ্কের সাথে মজুরি প্রদান নির্ভরশীল। আর তৃতীয়ত, মনরেগার মজুরি থমকে রয়েছে। আধার ভিত্তিক মজুরি প্রদান ব্যবস্থা হওয়ায় যাদের এই ব্যবস্থা থাকবে না তাঁরা মজুরি থেকে বঞ্চিত হবেন। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, মাত্র ৪৩ শতাংশ মজুর এই ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত হতে পেরেছেন।

৮) সরকারি চাকরিগুলোকে অবলুপ্ত করা

পরিকল্পিত বেসরকারিকরণ এবং রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোকে বেচে দেওয়া, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ও ‘ন্যাশনাল মনেটাইজেশন পাইপলাইন’এর আড়ালে গোটা অর্থনীতিকেই বিদেশি পুঁজির কাছে খুলে দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় সম্পত্তিকে কর্পোরেটদের কাছে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি কর্পোরেটদের কব্জায় যে বিপুল সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটেছে তার ফলাফল মারাত্মক হবে। শ্রমিকরা কর্মচ্যুত হবেন, দলিত ও জনজাতি মানুষদের অধিকার ও সুযোগ সুবিধাকে সুরক্ষিত করতে সংরক্ষণের নীতিও বাতিল হয়ে যাবে।

রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের সম্পত্তিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া যেমন চলছে জোর কদমে, তেমনি শূন্যপদে নিয়োগ প্রথাও বন্ধ হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি তথ্য বলছে (ডিপার্টমেন্ট অফ এক্সপেন্ডিচার, পে রিসার্চ ইউনিট) ৯.৮৩ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি পদ খালি হয়ে পড়ে রয়েছে যা সমগ্র অনুমোদিত পদের ২৪.২৯ শতাংশ।

৯) শ্রমিকশ্রেণিকে দাঁড় করিয়েছে অপরাধীর কাঠগড়ায়

গত ৯ বছর ধরে মোদী সরকার শ্রমিকশ্রেণি ও তাঁদের আন্দোলনকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।

লকডাউনের সময়, সুরাটে পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, তখন তাঁদের উপর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়, লাঠি চার্জ করে গ্রেপ্তারও করা হয়। মুম্বাইয়ে রিলায়েন্স এনার্জি লিমিটেডের কন্ট্রাক্ট শ্রমিক, মুম্বাই ইলেক্ট্রিক কর্মী ইউনিয়নের কর্মচারীরা যখন কর্মস্থলের জঘন্য পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে শ্রমিকদের বুনিয়াদি দাবিগুলোতে সোচ্চার হন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে ইউএপিএ’তে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়।

নব্য উদারবাদী রাষ্ট্র শ্রমিকদের পরিকল্পিতভাবে প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করছে, কন্ট্রাক্ট প্রথায় কাজ ও ইনফর্মালকরণকে মদত দিচ্ছে, যা শেষ বিচারে নিরাপত্তাহীন কাজকেই উৎসাহিত করে। শোভন কাজের দাবিতে শ্রমিকদের যেকোনো আন্দোলনকেই ঘৃণাভরে বিরোধিতা করা হয়। কর্পোরট সেক্টর রাষ্ট্রযন্ত্রকে, পুলিশ বাহিনীকে নিজের পোষা বাহিনী বলেই মনে করে। এই সমস্ত আন্দোলন সংগঠিত হলেই তাকে দমন করা হয়।

প্রতিরোধের ৯ বছর

বিগত ৯ বছর ধরে শ্রমিক শ্রেণি মোদী সরকারের হামলার মুখে ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে প্রতিরোধ করে চলেছে। এর ভালো উদাহরণ হল বেঙ্গালুরুতে হাজার হাজার পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট। ২০১৬-তে কেন্দ্রীয় সরকার পিএফ’এর কিছু বিধিনিয়ম সংশোধন করতে উদ্যত হলে এই ধর্মঘট হয়, যার চাপে সরকার পিছু হটে ও সংশোধনী প্রত্যাহার করে নেয়।

কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রমকোডের বিরুদ্ধে প্রতিবছর ধর্মঘট পালন করে, যার ফলশ্রুতিতে সরকার এখনও তা লাগু করতে পারল না। আশা কর্মী, সাফাই শ্রমিক, অঙ্গনওয়াড়ির শ্রমিকদের উদ্দীপ্ত লড়াই সরকারকে বাধ্য করেছে উন্নত কাজের পরিবেশ ও শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করতে।

শ্রমিকশ্রেণির কাছে এই লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ন্যায্যতাপূর্ণ সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যা আগামীদিনে ভূমিকা রাখতে পারবে।

- মৈত্রেয়ী ক্রিশনান, অবনী চোকস্কি ও ক্লিফটন ডি’রোজারিও   
(জুন ২০২৩ লিবারেশনে প্রকাশিত)

in-response-to-nahel's-death-violent-protestscountry-of-poetry-country-of-pictures

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের নানতেরে এলাকায় নাহেল এম নামের এক তরুণ গত মঙ্গলবার ২৭ জুন ২০২৩, পুলিশের হাতে খুন হয়েছেন। গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় ট্রাফিক পুলিশ তাকে থামতে বলে। সে না থামলে পুলিশ খুব কাছে থেকে তাকে গুলি করে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, একজন পুলিশ অফিসার একটি গাড়ির চালকের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। এরপর একটি গুলির শব্দ শোনা যায় এবং তারপর গাড়িটি থেমে যায়। বুকে গুলিবিদ্ধ হবার পর নাহেলকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। গুলিবর্ষণকারী অফিসারকে হত্যার অভিযোগে আটকও করা হয়। ফরাসী মিডিয়ায় বলা হয়, পুলিশ প্রথমে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে তরুণটি তাদের দিকেই গাড়িটি চালিয়ে দিয়ে পুলিশদের আহত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে বোঝা যায় যে প্রকৃত ঘটনা ছিল একেবারেই আলাদা।

নাহেলের মৃত্যুর পরেই ফরাসী সংবাদ মাধ্যম তার সম্পর্কে নানা তথ্য জোগাড় করে প্রচার করেছে। তা থেকে জানা যাচ্ছে যে প্যারিসের নানতেরে শহরেই বেড়ে ওঠেন ১৭ বছর বয়সী নাহেল এম। তিনি খাবার ডেলিভারির কাজ করতেন এবং রাগবি লিগে খেলতেন। একমাত্র সন্তান নাহেলকে বড় করেছেন তার মা। নাহেলের লেখাপড়া ছিল কিছুটা অবিন্যস্ত। প্রথাগত পড়াশুনোর বদলে ইলেকট্রিশিয়ান হতে চেয়েছিল সে। আর সেজন্যে যে এলাকায় সে থাকত, তার কাছেই সুরেসনেসের একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে। যারা নাহেলকে চেনেন, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী নাহেল ভালো ছেলে ছিল এবং সবাই তাকে ভালোবাসতো। নাহেল ও তার মা মোনিয়া আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত, তবে নাহেলের বাবা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি।

নাহেলের মৃত্যু ফ্রান্সে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে ক্ষোভ উস্কে দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পুরো ফ্রান্স বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। ২৭ জুনের রাত থেকেই প্যারিস ও অন্য আরো কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। গাড়ি ও বাসস্টপে আগুন দিয়ে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা। কিছু রাস্তায় ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়, আক্রান্ত হয় পুলিশ স্টেশনও। দাঙ্গা প্রতিরোধী পুলিশ বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দিতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। শনিবার বিকেল থেকেই মার্সেই শহরের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে মার্সেইয়ের কেন্দ্রস্থল লা ক্যানেবিয়েরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ফরাসি মিডিয়াগুলোর খবর অনুযায়ী ওই এলাকায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে লড়াই চলে। নাহেল হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক তরুণ তাদের ক্ষোভের উৎস ব্যাখ্যা করে বলেন যে পুলিশের হিংসা দমন এখান প্রতিদিনের ঘটনা। আরব বা কৃষ্ণাঙ্গ হলে এই দমনপীড়ন বাড়ে।

বিক্ষোভ থামাতে ফ্রান্সের পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র দপ্তর সক্রিয় হয়ে উঠেছে ও বিক্ষোভকারীদের ওপর দমনপীড়ন চালাচ্ছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে শনিবারেই ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে প্রায় ৪৫,০০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই এক ট্যুইট বার্তায় জানিয়েছেন যে গত শনিবার অর্থাৎ ১ জুলাইয়ের রাতে অন্তত ৪২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি পুলিশকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন আর বলেছেন যে তাদের পদক্ষেপের জন্যই শনিবার রাতের পরিস্থিতি শান্ত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এর ঠিক আগে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শনিবারই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল যে বিক্ষোভ শুরু হবার পর থেকে প্রথম চার দিনে অন্তত ২,৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার মধ্যে শুক্রবার অর্থাৎ ৩০ জুন রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় ১,৩১১ জনকে। ফ্রান্সের বিচারমন্ত্রী জানিয়েছেন গ্রেপ্তার হওয়া ফরাসীদের মধ্যে ৩০ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের কম। বোঝাই যাচ্ছে ফ্রান্সের নাগরিকরা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম বর্ণবাদ, সংখ্যালঘু নিপীড়ণ, বাড়তে থাকা নানা দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক প্রবণতাকে নীরবে মেনে নিতে প্রস্তুত নন। গোটা ইউরোপ জুড়ে দক্ষিণপন্থা ও প্রগতিশীল মতাদর্শের মধ্যে যে তীব্র লড়াই চলছে এখন, ফ্রান্সের এই ঘটনাবলীতেও তার ছাপ স্পষ্ট।

sanat-roychowdhury-a-ceaseless-warriora-ceaseless-warrior-of-the-movement

আমাদের সকলের প্রিয় সনৎদা (সনৎ রায়চৌধুরী) গত ১ জুলাই ২০২৩ প্রয়াত হন, মারণ রোগ ক্যান্সার বাসা বেঁধেছিল তাঁর যকৃতে। এই মানব দরদী পরিব্রাজকের কিশোর বয়সে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদানের মধ্যে দিয়ে যে পথচলা শুরু হয়েছিল, বাম গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার আন্দোলনে উজ্জ্বল পদচিহ্ন রেখে তা সাঙ্গ হল এই মারণ ব্যাধিতে।

সনৎদা বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেছিলেন, প্রত্যক্ষ করেছিলেন রংপুরের তেভাগা আন্দোলন। সনৎদার মুখেই শোনা, বালক অবস্থায় বন্ধুদের সাথে দেখতে গিয়েছিলেন বন্দী হওয়া তেভাগা আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেত্রী ইলা মিত্রকে। মৌলানা ভাসানীর কথাও তিনি উৎসাহভরে বলতেন। দেশভাগের পরবর্তীতে প্রথমে উত্তরবঙ্গ ও পরে নিজের দাদা, যিনি কর্মসূত্রে তখন চুঁচুড়া থাকতেন, সেখানে চলে আসেন। সেই সময়কার রীতি অনুযায়ী তাঁর পার্টি সদস্যপদ ভারতে স্থানান্তরিত হয়। তাঁর কমিউনিস্ট জীবনের যাত্রাপথ ছিল সিপিআই থেকে সিপিআই(এম) এবং পরিশেষে সিপিআই(এমএল)-এ যোগদানে। সিপিআই(এম)-এ থাকাকালীন বাঁশবেড়িয়া থেকে উত্তর চন্দননগর পর্যন্ত বিস্তৃত লোকাল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। নকশালবাড়ির ঘটনার পর তিনি সিপিআই(এম)-র সদস্যপদ ত্যাগের চিঠি দিলে, জেলা কমিটি বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়, তৎকালীন জেলা সম্পাদক বিজয় মোদক এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, “সনৎ’কে আমরা বহিষ্কার করতে পারি না!” নকশালবাড়ি আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে কারাবরণ করেন। জেল থেকে বেড়িয়ে এসে ৭৭ সালে বন্দী মুক্তি আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন, উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন কারাগার ঘুরে ঘুরে বন্দী যুবকদের তালিকা তৈরি করে সরকারের কাছে তাদের মুক্ত করার দাবি তোলেন। আটের দশকে ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট গঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভাপতি হিসেবে বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, এই সময়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাওয়া অনেক মানুষকে আবার রাজনীতির আঙিনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সনৎদাকে আমরা দেখেছি বিজ্ঞান মঞ্চ গঠনে সহায়তা করতে, ভাষা শহিদ দিবস পালনের অন্যতম প্রধান মুখ হিসেবে, শ্রমজীবী হাসপাতাল গড়ে তোলার শুরুর সময়ে ও চুঁচুড়ায় ঐ হাসপাতালের বহির্বিভাগ গড়ে তোলার অন্যতম স্থপতি হিসেবে, দেখেছি দুস্থ ছাত্রছাত্রীদের পাশে, অগুন্তি সামাজিক কাজে। মানবাধিকার আন্দোলনে এপিডিআরের গুরত্বপূর্ণ সংগঠক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়।

গণিতের শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রী মহলে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। এতো কাজের মধ্যেও এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ নতুন করে না নিলেও বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পুণরায় তার জোরালো আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহ ও আশাবাদী। একাদশ পার্টি কংগ্রেসের ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভূমিকায় তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। স্থানীয় জেলা এবং সারা দেশে পার্টির অগ্রগতি ও আন্দোলন সম্পর্কে সবসময় অনুসন্ধিৎসু থাকতেন। পার্টি ও তার বিভিন্ন গণসংগঠনের পত্রিকা যেমন গণসংস্কৃতি পরিষদের মুখপত্র নবান্ন পত্রিকার তিনি ছিলেন নিয়মিত পাঠক আর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত দেশব্রতী, লিবারেশনের গ্রাহক। মেহনতি মানুষের লড়াই সবসময় তাঁকে অনুপ্রাণিত করত। মনে পড়ে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে জেলা তহবিলে অর্থ সাহায্য করার সাথে সাথে সীমন্তি এক্কার কেন্দ্রের জন্য তিনি আলাদা ভাবে অর্থ পাঠান। অসুস্থ অবস্থাতেও ভারভারা রাওয়ের মুক্তির দাবিতে, স্ট্যানস্বামীর হত্যার প্রতিবাদে, গণতন্ত্রের ওপর যেকোনো হামলার প্রতিবাদে চুঁচুড়ায় পার্টির প্রতিটি কর্মসূচিতে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল নিশ্চিত।

গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে তাঁর শহর চুঁচুড়ায় ভাষা আন্দোলনের শহিদ স্মারক স্তম্ভের মাথার ওপর রয়েছে যে অশত্থ গাছ, তার গোড়ায় শান বাঁধানো গোল চাতালে এসে বসে অনেক রকম মানুষ — স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া, বেকার, অভাবি রিক্সা চালক, পাশের মাঠে খেলতে খেলতে ক্লান্ত ছেলে পিলে, প্রেমিক যুগল, উঠতি কবি, রাজনৈতিক দলের কর্মী। সবার কথা যেন মন দিয়ে শোনে বয়োঃবৃদ্ধ পিপল গাছ। এই মহীরুহর বেড়ে ওঠার পিছনেও রয়ে গেছে অনেক সংগ্রাম, যা শুধু সেই গাছের ইতিহাস নয় একটা গোটা ভূমন্ডলের ইতিহাস। পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা নদী জানে সেই ইতিহাস। আসলে গঙ্গা তো নয়, সেতো ভাগ হয়ে গেছে অনেক আগে, সেই ভাগের স্মৃতি চিহ্ন বহতি নদীর মতো গাছের বুকেও থেকে যায়। এপারে কাকদ্বীপ আর ওপারের রংপুর সেই এক ইতিহাসের অংশ। তেভাগা যেমন সেই ইতিহাসের এক আলেখ্য, তেমনি উত্তরবঙ্গের এক ছোট জনপদ নকশালবাড়ির থেকে আসা ঝড়ো হাওয়া এসে লেখে আরেক গল্প। মৌলানা ভাসানী আর চারু মজুমদার, তেভাগা আর নকশালবাড়ি, নদী ভাগ হয় কিন্তু বহমানতার বিরতি ঘটে না। বৃক্ষের মতো, নদীর মতো এই বহমানতার জীবন্ত নিদর্শন ছিলেন সনৎ রায়চৌধুরী।

কমরেড সনৎ রায়চৌধুরী লাল সেলাম!

===-0-===

খণ্ড-30
সংখ্যা-22