আজকের দেশব্রতী : ২২ জুন ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-vol-30-no-20-june-22-2023wb panchayet electionbuild-janata-panchayat

আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন আবার রাজ্য রাজনীতিতে গ্রামীণ অ্যাজেন্ডাকে সামনে তুলে ধরল। প্রতিষ্ঠান হিসাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সংবিধানে বর্ণিত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কতটা অর্জন করতে পারল, জনগণের ক্ষমতার কেন্দ্র হিসাবে উঠে আসতে পারল কিনা তা আরো একবার আতস কাঁচের নিচে রেখে বিচার বিশ্লেষনের দাবি রাখে। একথা অনস্বীকার্য, জনগণের হাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের এই পঞ্চায়েতী রাজ বহুদিন যাবত আমলাতন্ত্র ও বাস্তু ঘুঘুদের বাসা হয়ে দাঁড়িয়ে তার শাখাপ্রশাখা বহুদূর ছড়িয়েছে, ক্ষমতাসীন দলীয় গ্রামীণ মাতব্বরের আঁতাত বিপুল অর্থ ও স্থানীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জন করে শাসক পার্টির রাজনৈতিক আধিপত্যকে গ্রামীণ রাজনীতিতে পরিব্যাপ্ত করেছে।

রাজ্য রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জন করা সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলায় যেমন আর্থিক উন্নয়নের ছিঁটেফোটা অগ্রগতি দেখা গেল না ২০১১ সাল থেকে তৃণমূলের নিরবচ্ছিন্ন স্বৈর শাসনে, পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করেও গ্রামীণ অর্থনীতির কোনো ইতিবাচক বদল ঘটল না। ২০১৮’র সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচনে তৃণমূল ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেলায় নিজের পকেটে পুরে ফেলে, ১৯ জেলা পরিষদের ৯৪.৮৪ শতাংশ আসন, পঞ্চায়েত সমিতির ৮০ শতাংশ আসন এবং গ্রামসভার ৬৬ শতাংশ আসন কব্জা করে। বিজেপিকে বহুদুরে ঠেলে, দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে গ্রাম বাংলায় এই প্রথমবার তাদের আসতে দেখা গেল পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে — তার পকেটে গেল ৩.৫৪ শতাংশ জেলা পরিষদের আসন, ১২.৫৪ শতাংশ পঞ্চায়েত সমিতির আসন এবং ১৮.০৬ শতাংশ গ্রাম সভার আসন। সবচেয়ে করুণ অবস্থা হল বামদের। যারা ২০০৮ পর্যন্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাপিয়ে বেড়াতো, তারা রাজনৈতিক ভাবে মারাত্মক ধাক্কা খেল, এমনকি ‘নির্দল’দের তুলনায় কম ভোট পেল।

তৃণমূলের সর্বাত্মক দাপট সত্ত্বেও গ্রামীণ অর্থনীতি বরং আরও সংকটাপন্ন হল। ১০০ দিনের কাজে এরাজ্যে কমবেশি ১.৪ কোটি কার্ড হোল্ডার রয়েছেন। মোদী সরকারের দাবি, এরমধ্যে ১৫ লক্ষ বা, প্রায় ১০ শতাংশের কার্ড ভুয়ো। এই যুক্তিতে মোদী মজুরি বকেয়া রেখেছে, যা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও বটে। গ্রামীণ শিক্ষিত বেকারবাহিনী হুহু করে বাড়ছে — বেকারত্ব আজ গ্রাম বাংলার এক দুঃসহ পরিঘটনা।

দুর্বিষহ দারিদ্র, থমকে থাকা ১০০ দিনের কাজ, মজুরদের বকেয়া ১০০ দিনের মজুরি, অত্যন্ত নিম্নহারে কৃষি মজুরি, নিজ গ্রামে বা রাজ্যে পর্যাপ্ত মজুরির কাজ না পেয়ে ভিনরাজ্যে পরিযানের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি, গ্রামীণ মহিলাদের কাজের বাজার থেকে নির্মমভাবে উৎখাত হয়ে যাওয়া, কল্পনাতীত হারে জমি খোয়ানো, গ্রাম বাংলার মর্মান্তিক রূঢ় বাস্তব। কৃষকদের আয় তিনগুণ করার মুখ্যমন্ত্রীর দাবি আজ বিকট এক পরিহাস যা গ্রাম বাংলায় বোবা কান্না হয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ১০০ দিনের কাজ বন্ধ হওয়াটাই এই রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে সংকটের প্রধান উৎস নয়। এই প্রকল্পে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ যখন পয়লা নম্বরে ছিল, তখনও গ্রামীণ দারিদ্র আষ্ঠেপৃষ্ঠে গ্রাস করে রেখেছিল গ্রামীণ জনগণকে। নাবার্ড তার এক রিপোর্টে দেখিয়েছে এরাজ্যে কৃষিজীবী পরিবারে গড় মাসিক আয় মাত্র ৭,৫৭৩ টাকা! অন্ধ্রপ্রদেশ-বিহার-ঝাড়খন্ড-ওড়িষ্যা-ত্রিপুরা ও উত্তরপ্রদেশের মতো কৃষিকাজে নিম্ন আয়সম্পন্ন রাজ্যের তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। হেক্টর পিছু কৃষিজমির জন্য কৃষি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এরাজ্য রয়েছে পনেরো নম্বরে! দলে দলে চা-বাগিচার মহিলা শ্রমিকরা পাড়ি দিচ্ছেন অন্য রাজ্যে, উচ্চ মজুরির খোঁজে। প্রতিবছর এরাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এমনকি শস্যগোলা হিসাবে পরিচিত বর্ধমান, বা হুগলির মতো জেলাগুলো থেকেও বিপুল হারে তরুণ যুব বাহিনী (যারা বেশিরভাগই সংখ্যালঘু বা তপশিলি জাতি উপজাতি ভুক্ত) অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন। সেই কাজ যে উন্নত মানের তাও নয়, করমন্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় নিহত বা গুরুতরভাবে আহত যাত্রীদের মধ্যে দেখা গেল যে, ট্রাক চালক, জরির কাজ, ফল প্যাকিং, রং মিস্ত্রির কাজ করতেও বাংলার যুবকরা ভিনরাজ্যে ছুটছে। দুর্ঘটনার মুখে পড়া করমন্ডল এক্সপ্রেসে সবচেয়ে বেশি নিহত বা আহত পরিযায়ী শ্রমিকরা হলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার। একটি গোটা পরিবারের তিন যুব সন্তানই প্রাণ হারান ওই রেল দুর্ঘটনায়। যে ছ’জন যুব সুন্দরবনের একটি গ্রাম থেকে ভিনরাজ্যে যাচ্ছিলেন কাজের খোঁজে, তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের কফিন বন্দি দেহ গ্রামে ফিরে এল, ষষ্ঠ যুবক নিখোঁজ।

unite-to-build-janata-panchayat

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত তথ্য, হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিস্টিকস্ অন ইন্ডিয়ান স্টেটস, ২০২০-২১ থেকে জানা যায় এই রাজ্যে গ্রামীণ দিনমজুরদের দৈনিক মজুরি জাতীয় গড় মজুরির থেকে কম। এই রাজ্যে দৈনিক মজুরি হল ২৮৮.৬০ টাকা, যখন জাতীয় মজুরির গড় হার ৩০৯.৯০ টাকা। ২০১৯-২০’র আর্থিক বছরে কৃষিকাজের সাথে যুক্ত দৈনিক মজুরি ২৬৭.৫০’রও কম ছিল।

বাংলার কৃষির নিদারুণ বৈশিষ্ট্য হল, যত দিন গড়াচ্ছে, রাজ্যের গ্রামীণ পরিবারগুলো চরম সংকটের আবর্তে জর্জরিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে নিজেদের জমি হারাচ্ছে। সর্বশেষ ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫’র সমীক্ষায় উঠে আসছে রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ গ্রামীণ পরিবারের হাতে (৬৫.২ শতাংশ) কোনো জমি নেই। উপার্জনের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যা নামমাত্র। হাতে গোনা যেটুকু অংশ এখনও কৃষির উপর নির্ভর করেন কিছু উপার্জন করতে, তাঁদের আয়ও দিনের পর দিন সংকুচিত হচ্ছে এই কারণে যে অত কম পরিমাণ জমির উপর নির্ভর করে তাকে লাভজনক করা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ কৃষিজমির আয়তন ০.৫ হেক্টারেরও কম। এত কম আয়তনের জমির উপর নির্ভর করে এমনকি ন্যুনতম দৈনিন্দন প্রয়োজনকেও মেটানো যাচ্ছে না। ফলে, সিংহভাগ গ্রামীণ জনগণ, ৮০ শতাংশেরও বেশি, অকৃষি কাজের মাধ্যমেই তাঁদের জীবন নির্বাহের রসদ খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, গ্রামীণ জনগণের নিচুতলার প্রান্তিক কৃষকদের সর্বহারাকরণ ঘটছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।

গ্রামাঞ্চলে তরুণ প্রজন্ম নতুন করে কৃষিকাজে আর যুক্ত হচ্ছেন না। অকৃষি ক্ষেত্রে, উপার্জনের খোঁজে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। অনর্গল স্রোতের মতো বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ভিনরাজ্যে যাচ্ছে — যার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতে এতদিন পর রাজ্য শ্রমদপ্তর পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থে একটি পোর্টাল খুলেছে।

গ্রাম বাংলায় যেন হাহাকার লেগেছে। দ্রুততালে কৃষি জমি খোয়ানো, অত্যন্ত স্বল্প মজুরি নিয়ে, বিপুল সংখ্যক স্বনিযুক্ত অনিয়মিত কৃষিমজুরই গ্রামীণ শ্রমবাজারের প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলো শুধু দুর্নীতির আখড়াই নয়, ক্ষমতাসীন দলগুলোর দাপট ফলানোর কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামীণ জনতা এর বিরুদ্ধে কতটা রুখে দাঁড়াতে পারবে তা নির্বাচনী ফলাফলই বলবে। বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে এর বিরুদ্ধেই লড়তে হবে ইতিবাচক মোড় পরিবর্তনের লক্ষ্যে।

- অতনু চক্রবর্তী

terrorism-becomes-an-election-strategyan-election-strategy

ক্ষমতার চোখ রাঙানি দেখেছে রাজ্যের আপামর জনতা। এবার দেখল অসংযত ভাষায় কান্ডজ্ঞানহীন মুখ্যমন্ত্রীর হুমকি। তিনি খোলাখুলি তাঁর দলের কর্মীবাহিনীকে ‘প্রতিরোধ’ করার ডাক ছাড়লেন আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে। বোঝাই যাচ্ছে, ‘প্রতিরোধ’এর নামে বিরোধী দলের কর্মীদের প্রতি কী ধরনের রাজনৈতিক আচরণ করতে হবে, তার একটা ইঙ্গিত দিলেন মাত্র। রাজ্যবাসী এবার দেখলেন, ক্ষমতার হিংস্র দাপট কাকে বলে।

কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে তরজার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী আরেকটা ডাক দিলেন। কাকদ্বীপের এক জনসভায় মহিলাদের কাছে আবেদন রাখলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে হাতা খুন্তি নিয়ে যেন আলুভাজা ভাত আলুসেদ্ধ খাওয়ানো হয়। সেই একই তৃণমূলী শব্দবন্ধ, যারজন্য কুখ্যাতি কুড়িয়েছিলেন অধুনা তিহাড় জেলে বন্দি অনুব্রত মন্ডল। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তাঁর সেই সমস্ত হুমকি মেশানো মন্তব্য — উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, চড়াম চড়াম, গুড় বাতাসা ইত্যাদির সাথে এবার সংযোজিত হল মুখ্যমন্ত্রীর শব্দবন্ধ — হাতা খুন্তি, আলুভাজা ভাত আলুসেদ্ধ।

যারা রয়েছেন রাজ্য ক্ষমতার কেন্দ্রভূমিতে, যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় রাজ্য পুলিশ প্রশাসন-রাজ্য নির্বাচন কমিশন, সেই শাসক পার্টি যখন প্রতিরোধের ডাক দেয় তখন তার পরিণাম যে কী হবে তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। ক’টা লাশ কটা বুথে পড়লে তবেই বলা যাবে যে রাজ্য সন্ত্রাস দীর্ণ হয়ে উঠেছে, এই যুক্তির ধারা নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজ্যকে যে ঠেলে দেবে না বধ্যভূমিতে তার নিশ্চয়তা কি দেবেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী? রাজ্যজুড়ে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করতে কতজনকে খুন করা হল সেই সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয়, মনোনয়ন চলাকালীন দু-একটা খুন সাধারণ প্রার্থীদের মধ্যে এমন এক সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে দেয় যে বুক চিতিয়ে অনেকেই তার মোকাবিলা করতে না পেরে নীরবে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেন। সন্ত্রাস এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে এক অস্ত্র হিসাবে, রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে। বিরোধীদের ভয় দেখিয়ে ঠান্ডা করে রাখতে।

দেখা গেল, ইতিমধ্যেই অনেক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক পার্টি তার জয় হাসিল করেছে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর বহু জায়গায় প্রত্যাহারের জন্য লাগাতার হুমকি দেওয়া হচ্ছে শাসক পার্টির তরফ থেকে। নির্বাচনের দিনে, তৃণমূলের তল্পিবাহক পুলিশ প্রশাসন কতটা আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারবে তা নিয়ে গোটা রাজ্যবাসী সন্দিহান।

রাজ্য সরকারের ক্রীড়নক নির্বাচন কমিশন তড়িঘড়ি নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা করল। আইনের কেতাবী নিয়ম অনুযায়ী এই নির্ঘন্ট প্রকাশ করা হয়েছে তা যতই বলুক না কেন কমিশন, এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যই ছিল বিরোধীদের অপ্রস্তুতে ফেলা। তৃণমূল এবার নতুন কৌশল নিয়ে কদিন পরে এক-দুদিনেই হাজার হাজার মনোনয়ন দাখিল করতে গিয়ে কার্যত মনোনয়ন কেন্দ্রগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। এর পর শুরু হল হুমকি। মনোনয়ন তুলে নেওয়ার। নির্বাচন সাঙ্গ হওয়ার পরের কুনাট্য দেখার অপেক্ষায় এখন রাজ্যবাসী।

সুপ্রিম কোর্ট কলকাতা হাইকোর্টের কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়নের পক্ষেই রায় বহাল রাখল। রাজ্য পুলিশ প্রশাসনের উপর অনাস্থাজনিত কারণ থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী বা বিচারবিভাগের উপর মুখাপেক্ষীতা রাজ্য প্রশাসনের পক্ষে খুবই অশনি সংকেত। দুর্নীতির অভিযোগে আপাদমস্তক ক্ষত বিক্ষত রাজ্য সরকার, তাবড়তাবড় নেতা- মন্ত্রী জেলখানায়, নানা গোষ্ঠী কোন্দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত তৃণমূল যে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে সংগঠিত এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রাম বাংলায় নিজেদের ঘাঁটি ধরে রাখতে যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

the-twin-maladies-of-corporate-loot-and-communal-venomcorporate-loot-and-communal-venom

২০১৪ থেকে আমরা বিজেপির নির্বাচনী সভা সমাবেশে প্রায়ই একটা কথা শুনি, ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’। মোদী-শাহ’র এটা সবচেয়ে পছন্দের এক উপমা। কেন্দ্রের ক্ষমতা বিজেপির নিয়ন্ত্রণে। তার ভিত্তিতেই তাই রাজ্যে ভোট চাইতে গিয়ে এই শব্দবন্ধ তারা হরদম ব্যবহার করেন। এবার অর্থনীতির বর্ণনা দিতে গিয়ে মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিমান চালনা সংক্রান্ত একটা শব্দের আমদানি করেছেন। সিইএ ভি অনন্ত নাগেশ্বরনের মতে ভারতীয় অর্থনীতি এখন ‘অটো-পাইলট মোডে’ আছে এবং ২০৩০ পর্যন্ত ৬.৫-৭ শতাংশ হারে অর্থনীতির বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে! মোদী সরকারের নয় বছরের বেশিরভাগ সময়েই আমরা দেখেছি, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি থমকে গেছে এবং মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি ও লকডাউনের তিন ধাক্কায় এবং বেসরকারিকরণ, কর্মীসংকোচন ও ঠিকাপ্রথার নীতির জন্য বেকারত্ব এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সর্বকালীন রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কিন্তু এখন চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের আগে আমাদের বলা হচ্ছে, অর্থনীতি অটো-পাইলট মোডে নিরাপদে উড়ে চলেছে, সরকারের এখানে কিচ্ছুটি করার নেই!

আত্মপ্রশংসামূলক প্রচার সাধারণত দাঁড়িয়ে থাকে দু’টি খুঁটির উপর ভর দিয়ে — জিডিপি’তে পরিমিত বৃদ্ধির অস্থায়ী পরিসংখ্যান আর জিএসটি সংগ্রহের বৃদ্ধি। সংখ্যাগুলো এখনও অস্থায়ী। কিন্তু সরকার আর তার সুরে সুর মিলিয়ে চলা মিডিয়া ইতিমধ্যেই ঢাকে কাঠি দিয়ে ফেলেছে। প্রথম যে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে, এখন যে ৬.৫-৭ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি করা হচ্ছে, তার ঠিক আগে কোভিড অতিমারির সময়ে জিডিপি বিরাট মাত্রায় সংকুচিত হয়েছিল। তার মানে, ভারত এখন কেবল সেই অতিমারীর সময়কার পতনকে সামলে উঠছে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান বৃদ্ধি এখনও স্থিতিশীল নয় বরং খুবই অসম। বিভিন্ন সেক্টরের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে এই বৃদ্ধি কেন্দ্রীভূত হয়েছে মাত্র তিনটি ক্ষেত্রে — পরিষেবা, নির্মাণ এবং পর্যটনে। আয় বন্ধনীর দিক থেকে উপরতলার ২০ শতাংশ বৃদ্ধিকে চালিত করছে আর নিচেরতলার ৮০ শতাংশ মানুষ ক্রমশ আরো দারিদ্র্যে ডুবে যাচ্ছে। আর্থিক পুনরুদ্ধারের এই অসম প্যাটার্নের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে ইংরেজি বর্ণমালার কে অক্ষরটির সঙ্গে।

অক্সফ্যামের রিপোর্ট ‘ধনীদের বেঁচে থাকা’ (বোধ হয় ‘ধনীদের মহোৎসব’ নাম দিলে আরও ভালো হয়) আমাদের সামনে এই অসম বৃদ্ধির এক মারাত্মক ছবি এবছরের গোড়ায় তুলে ধরেছিল। বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা খাড়াভাবে বেড়ে ২০২০-তে ১০২ থেকে ২০২২-এ হয়েছে ১৬৬। ভারতে ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সৃষ্ট সম্পদের ৪০ শতাংশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের হাতে। আর মাত্র তিন শতাংশ সম্পদ রয়েছে নিচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে। ব্যক্তিগত ভোগব্যয়, বিশেষ করে অত্যাবশ্যক পণ্য ও পরিষেবার গণ উপভোগ স্তরের আগের অবস্থায় ফেরা সম্ভব হয়নি মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং ক্রয়ক্ষমতার ক্ষয়ের জন্য। দু’চাকার গাড়ি এবং এন্ট্রি লেভেল যাত্রীবাহী গাড়ির বিক্রি কমে গেছে কিন্তু ব্যয়বহুল গাড়ি ও অন্যান্য বিলাসবহুল ভোগসামগ্রীর বিক্রি বেড়ে গেছে।

সম্পদ বন্টনের চূড়ান্ত অসম ব্যবস্থাটি আরও জোরালো করে তুলেছে বিত্তবানদের অনুকূল কর ব্যবস্থা ও ব্যাঙ্ক পরিষেবা। ভারতে কোনো সম্পদ বা উত্তরাধিকার কর নেই, ওদিকে কার্যকর কর্পোরেট করের হার ক্রমশ কমছে। ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ক্রমাগত আরও বেশি করে ধনীদের স্বার্থে চালিত হচ্ছে। বড় বড় ঋণ খেলাপী, ঋণ ‘রাইট অফ’ বা মুছে ফেলা, এবং সমস্ত বেল আউট প্যাকেজ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাটাকে অতি-ধনীদের হাতে সমস্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার এক হাতিয়ারে রূপান্তরিত করেছে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য জনসাধারণের টাকার কীরকম অপব্যবহার হয়, আদানি গোষ্ঠীর উত্থান ও সংকট তার এক ‘চোখ খুলে দেওয়া’ দৃষ্টান্ত। আদানি গোষ্ঠীর ঝড়ের গতিতে নজর কাড়া উত্থানের নেপথ্যে রয়েছে সমান্তরাল আরেক প্রক্রিয়া — ভারতের পরিকাঠামোগত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাত থেকে আদানি গোষ্ঠীর হাতে চলে যাওয়া! আর এখন, হিন্ডেনবার্গের রিপোর্টে আদানি গোষ্ঠী রীতিমত ধরাশায়ী হওয়ার পর, আমাদের আবারও সাক্ষী থাকতে হল আরেক কলঙ্কজনক ঘটনার — এলআইসিআই এবং এসবিআই’এর মত সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বলি দেওয়া হল আদানি গোষ্ঠীকে বাঁচাতে!

ভারত যখন অনেক বড় বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, মোদী সরকার কঠোর অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। তাই, ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীক্ষ্ণতর করে এবং সংখ্যালঘুদের ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়ে, সেই বাস্তব সত্যকে চাপা দিতে চাইছে। বিহারে ‘হিন্দুরাষ্ট্রের’ প্রচার চালানোর জন্য এক ‘অলৌকিক বাবার’ আমদানি হয়েছিল। মহারাষ্ট্রে মুসলিম-বিরোধী হিংসাকে ইন্ধন যোগাতে টিপু সুলতান এবং অওরঙ্গজেবের মত ঐতিহাসিক চরিত্র দু’টিকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। এমনকি এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ারকে ‘নব কলেবরে অওরঙ্গজেব’ বলে কুৎসা ও অপমান করা হচ্ছে। উত্তরাখণ্ড, যেখানে বিজেপি সরকারকে যোশীমঠ সংকট, চাকরি-প্রতারণা ও অঙ্কিতা ভাণ্ডারী নামে এক তরুণীর নৃশংস হত্যা — এসবের জন্য জনসাধারণের ঘৃণা ও রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে, সেখানে সঙ্ঘ বাহিনী পুরো মাত্রায় জাতিগত নিধনের আশ্রয় নিয়েছে। মুসলিমদের দোকান পাট বন্ধ করে দেওয়া ও তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হিংস্র প্রচার চালাচ্ছে, ‘লাভ জিহাদ’ আর ‘জমি জিহাদ’এর উৎপাতকে নতুন করে চাঙ্গা করে তুলছে আর ‘দেবভূমি’কে তথাকথিত ‘জিহাদীদের’ হাত থেকে বাঁচানোর ডাক দিচ্ছে। শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌভ্রাত্রকেই ধ্বংস করছে না এই বিষাক্ত রাজনীতি, ভারতের অর্থনৈতিক সংকটকেও ঘনীভূত করে তুলছে এবং সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে ভারতের জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলছে। কর্ণাটক গত মে মাসের নির্বাচনে এই ছককে পরাস্ত করেছিল। গোটা ভারতকে আজ এই ফ্যাসিবাদী অ্যাজেন্ডাকে পরাস্ত করার জন্য তৈরি থাকতে হবে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৯ জুন ২০২৩

mass-retrenchmentcentral-government-agencies

ক্ষমতার অলিন্দে সুবিধাভোগী অর্থনীতিবিদরা যখন সাম্প্রতিক জিডিপি বৃদ্ধির পরিসংখ্যানে আহ্লাদে আটখানা হয়ে দাবি করছেন যে অতিমারীর প্রভাবমুক্ত হয়ে ভারতীয় অর্থনীতির নবজীবন শুরু হয়েছে গোটা দুনিয়াকে চমকে দিয়ে, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর এক সমীক্ষা প্রকাশ করল কিভাবে সংকুচিত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থায় কর্মসংস্থানের হার। পরিহাস এটাই, বেকারত্বের আতঙ্কজনক ছবি আর্থিক বৃদ্ধির তুলনামূলক বিচারে কখনই আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে না সরকারি নীতিকারদের কাছে।

আলোচ্য সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বিগত দশকে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোতে একদিকে ব্যাপক হারে কমেছে কর্মীবাহিনী, অন্যদিকে লাফ দিয়ে বেড়েছে ঠিকা বা কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের সংখ্যা।

২০১২-১৩ থেকে ২০২১-২২’র পর্যায়ে কিভাবে কমানো হয়েছে শ্রমশক্তি তা প্রকাশ পেয়েছে ওই সমীক্ষায়। কেন্দ্রীয় সরকারের ৫০ শতাংশের বেশি অংশীদারিত্ব রয়েছে যে সমস্ত সংস্থায়, এমন সমস্ত বিধিবদ্ধ কর্পোরেশনে শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা ২০১২’র মার্চে ছিল ১৭.৩ লক্ষ, যা মার্চ ২০২২এ সংকুচিত হয়ে নেমে এসেছে ১৪.৬ লক্ষে! ৩৮৯টি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থায় এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে, যার মধ্যে ২৪৮টি কার্যকরী রয়েছে।

২.৭ লক্ষ কর্মী সংকোচনের বিপরীতে কর্মী নিয়োগের ধরনের মধ্যে আনা হয়েছে বড়সড় বদল। মার্চ ২০১৩তে ১.৭ লক্ষ কর্মীর মধ্যে ১৭ শতাংশ ছিলেন ঠিকা শ্রমিক আর ২.৫ শতাংশকে নিয়োগ করা হয় ক্যাজুয়াল/দৈনিক মজুর হিসাবে। কিন্তু ২০২২ সালের মধ্যে ঠিকা কর্মীদের সংখ্যা হুহু করে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ শতাংশে আর ক্যাজুয়াল/দৈনিক মজুরের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ৬.৬ শতাংশ। সামগ্রিক হিসাবে, মার্চ ২০২২’র মধ্যে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোতে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে ৪২.৫ শতাংশ কন্ট্রাক্ট বা ক্যাজুয়াল কর্মী রইলেন, ২০১৩’র মার্চে যে সংখ্যাটা ছিল ১৯ শতাংশ!

সংস্থাভিত্তিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মোট সাতটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থায় গত দশবছরে ২০,০০০’রও বেশি কর্মী সংকোচন হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মী ছাঁটা হয়েছে বিএসএনএল’এ, যার সংখ্যা হল প্রায় ১.৮ লক্ষ। এরপর রয়েছে স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া বা সেল এবং এমটিএনএল। উভয় সংস্থাই এই পর্বে কমিয়েছে ৩০,০০০ কর্মী।

মজার ব্যাপার হল, কর্মী ছাঁটাই হয়েছে লাভজনক ও অলাভজনক উভয় ধরনের সংস্থা থেকে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১-২২-এ প্রথম দশটি অলাভজনক সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএসএনএল এবং এমটিএনএল আর এয়ার ইন্ডিয়াকে তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি সংস্থার হাতে। এই তালিকায় রয়েছে বিপুল লাভ করা সেল এবং ওএনজিসি’র নাম — কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোর মধ্যে ২০২১-২২এ যারা সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে। ফলে এটা সহজেই অনুমেয় যে, অলাভজনক হয়ে পড়াটাই কর্মী সংকোচনের একমাত্র যুক্তি নয়।

যে রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলো সবচেয়ে বেশি কর্মী নিয়োগ করেছে তারমধ্যে এক নম্বরে রয়েছে ইন্ডিয়ান অয়েল যারা গত দশবছরে ৮০,০০০ কর্মী নিয়োগ করেছে। দশটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার প্রতিটি ওই পর্যায়ে ১০,০০০’র বেশি কর্মী নিয়োগ করেছে, এদিকে ১৩টি সংস্থার প্রতিটি ১০,০০০ করে কমিয়েছে কর্মীবাহিনী।

লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো ২.৬ লক্ষ কোটি টাকা মুনাফা কামিয়েছে, যা নসাৎ করে বহুল প্রচারিত সেই শয়তানি ভাষ্য যে বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাই পরিণত হয়েছে শ্বেত হস্তিতে।

(সূত্রঃ টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১৬ জুন ২০২৩)

manipur-is-burningmanipur-is-burning

[ মে মাসের গোড়াতে মনিপুরে একদিকে মেইতেই এবং অন্যদিকে কুকি-নাগা-চিন ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হওয়া সংঘাতে যতি পড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উভয় দিক থেকেই হিংসা ও ক্রূরতার নারকীয় ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে। হিংসার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, ৪০০ জন আহত, ৬০,০০০ মানুষ ঘরছাড়া ও ২০০টি গ্রামের ৫০০০ বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সরকারি অস্ত্রাগার থেকে লুট হয়েছে বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং কুকিদের ২০০টি চার্চ ভস্মীভূত হয়েছে। মনিপুরের ১০ জন বিধায়ক (যারমধ্যে ৭ জন বিজেপির) পৃথক শাসনাঞ্চলের দাবি তুলেছেন। মনিপুরের এই হিংসাদীর্ণ ও সংকটজনক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুখে কুলুপ এঁটেছেন, মনিপুর নিয়ে একটি ট্যুইটও করেননি, মন-কি-বাত মনিপুর প্রসঙ্গকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে এবং মনিপুরের প্রতিনিধি গোষ্ঠীকে সাক্ষাতের সময়ও তিনি দেননি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ হিংসা শুরু হওয়ার ২৬ দিন পর ২৯ মে থেকে ১ জুন মনিপুর সফর করলেও শান্তি ফেরার লক্ষণ সেখানে সম্পূর্ণরূপেই অনুপস্থিত। ভারতের নাগরিকরা তাই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি মনিপুর নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে, যাতে স্বাক্ষর করেছেন ৫৫০’রও বেশি নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি, বিদ্বজ্জন, আমলা ও আইনজীবী। সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে পিইউসিএল, সহেলি উইমেনস রিসার্চ সেন্টার, ন্যাশনাল এলায়েন্স অব পিপলস মুভমেন্টস, এআইডিডব্লিউএ, উইমেন এগেনস্ট সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স, ইন্ডিয়ান ক্রিশ্চিয়ান উইমেন্স মুভমেন্ট ও অন্যান্যরা। বিবৃতিটিতে মনিপুরের সংঘাতময় পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ধরা পড়েছে, এবং সেটির গুরুত্ব বিবেচনা করে তার ভাষান্তর আমরা এখানে রাখছি। - সম্পাদকমণ্ডলী ]

মনিপুরে মেইতেই জনগোষ্ঠী এবং জনজাতি কুকি ও জো সম্প্রদায়ের মধ্যে অব্যাহত জাতিগত হিংসায় আমরা গভীর উদ্বিগ্ন। আমরা এই হিংসা অবিলম্বে থামানোর দাবি জানাচ্ছি, যে হিংসা জীবন, জীবিকা ও সম্পদের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে আরও সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে।

এই হিংসা সূত্রপাতের আশু কারণ ছিল মেইতেই জনগোষ্ঠীকে তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে মনিপুর হাইকোর্টের ২০২৩’র এপ্রিলের এক পরামর্শ (মেইতেই সদস্যরা অবশ্য ওবিসি এবং কিছু ক্ষেত্রে তফসিলি জাতির মর্যাদা পেয়ে থাকে)। আর সেটা হলে মেইতেই জনগোষ্ঠী সেই সমস্ত জমিও অধিকার করতে পারবে, যে জমিগুলো জনজাতি সম্প্রদায়গুলোর জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। মে মাস জুড়ে সংঘটিত হল হিংসার বহু ঘটনা এবং উভয় পক্ষই সশস্ত্র হওয়ায় গৃহযুদ্ধের এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, আইন ও শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে পড়ল। তারপর থেকে আমরা নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে অভূতপূর্ব মাত্রার পৈশাচিকতা ও ব্যাপক আকারের নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করে চলেছি।

বিজেপি এবং কেন্দ্রে ও রাজ্যে তাদের সরকার বিভেদকামী রাজনীতি চালানোর জন্যই মনিপুরের এক বড় অংশ আজ জ্বলছে। আরো অনেক জনজীবন ধ্বংস হওয়ার আগেই চলমান এই গৃহযুদ্ধ থামানোর দায়টা তাদের ওপরই বর্তাচ্ছে। এই হিংসায় পুরুষ, নারী ও শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ৩০০’র বেশি উদ্বাস্তু শিবিরে ৫০,০০০’রও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন এবং লক্ষাধিক মানুষ ঘরছাড়া।

বাস্তবিকই, এ’বছরের জানুয়ারি থেকেই পরিস্থিতি শোচনীয় হতে শুরু করে যখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ অপসারিত করতে থাকে, যারা তাদের কথামতোই ১৯৭০’র দশক থেকেই মনিপুরে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছে। রাজ্য সরকার বনে বসবাসকারী জনজাতিদের ‘অবৈধ দখলদার’ বলে ঘোষণা করে চুড়াচাঁদপুর, কাংপোকপি ও টেংগানৌপাল জেলায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে।

বিজেপি সারা দেশেই যা করে থাকে সেই ধারাতেই নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেকার জাতিগত উত্তেজনাকে আরও একবার বাড়িয়ে তুলছে। স্পষ্টতই, বলপ্রয়োগ করে ও জোর খাটিয়ে রাজ্যে নিজের অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্যেই রয়েছে বিজেপির ভূমিকা। সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনায় উৎসাহ দেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত না চালিয়ে বিজেপি উভয় জনগোষ্ঠীরই মিত্র হওয়ার ভাণ করে তাদের মধ্যেকার ঐতিহাসিক উত্তেজনার গভীরতাকে আরও প্রসারিত করছে।

কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই সাংবিধানিক সংস্থানগুলোকে হাতিয়ার করে গণতান্ত্রিক আলোচনা ধারা, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও মানবাধিকারের সুরক্ষার ধারণাগুলোকে ধ্বংস করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কুকিদের বিরুদ্ধে চালিত নিকৃষ্টতম হিংসায় স্থায়ী রূপ দিয়েছে আরামবাই টেংগল ও মেইতেই লীপুন’এর মতো মেইতেই সংখ্যাগুরুবাদী গোষ্ঠীগুলো, আর তার সাথেই চলেছে গণহত্যার ঘৃণাভাষণ এবং শাস্তি থেকে অব্যাহতির কর্তৃত্ববাদী প্রদর্শনী। এই দুটির প্রথমটি হল একটি পুনর্জাগরণ গোষ্ঠী যারা মেইতেইদের সনমাহি ঐতিহ্যে ‘প্রত্যাবর্তন’ ঘটাতে চাইছে; আর দ্বিতীয়টির স্পষ্টতই রয়েছে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদী দিশা। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং এই গোষ্ঠী দুটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। উভয় গোষ্ঠীই কুকি জনগোষ্ঠীকে ‘অবৈধ বহিরাগত’ এবং ‘মাদক সন্ত্রাসবাদী’ বলে কলঙ্কিত করে। মেইতেই লীপুন প্রধান এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে সর্বসমক্ষে এটা বলতে দ্বিধা দেখাননি যে, মেইতেইদের আপত্তি জানানো স্থানগুলো থেকে কুকিদের “নিশ্চিহ্ন করা হবে”। তিনি কুকি জনগোষ্ঠীকে অভিহিত করেন ‘অবৈধ’, ‘বহিরাগত’ রূপে; ‘পরিবারের অংশ না হওয়া’ রূপে; ‘মনিপুরের দেশজ নয়’ এবং মনিপুরের ‘ভাড়াটে বসবাসকারী’ হিসাবে। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এক কুকি মানবাধিকার কর্মীকে ‘মায়ানমারের লোক’ বলে অভিহিত করেছিলেন; এটা ছিল সেই প্রচারের প্রতিই সমর্থন যা বলে থাকে যে মেইতেই জনগোষ্ঠী অশান্ত মায়ানমার থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে জনসংখ্যাগত বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। এই উদ্বাস্তুরা যেহেতু মনিপুরে যে জনজাতিরা থাকে সেই জনজাতিরই মানুষ, মেইতেই সংখ্যাগুরুবাদী গোষ্ঠীগুলো তাই এই জুজুকেই উস্কিয়ে তোলে যে সংখ্যার দিক থেকে জনজাতিদের বৃদ্ধি ঘটায় তারা সংখ্যাগুরু মেইতেইদের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ‘অবৈধ’ অভিহিত করে অমানবিকিকরণ ঘটানোর যে ভাষা সেটা অসমে এনআরসি চলার সময় ব্যবহার করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং অসমের মুখ্যমন্ত্রী। সেই ভাষাই এখন উত্তর-পূর্বের আর একটা রাজ্যে সম্প্রসারিত হয়েছে, আর বিজেপি ঘৃণা, হিংসা বিদেশী ভয়ের অগ্নিশিখাকে উস্কিয়ে তুলছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ২০২২’র বিধানসভা নির্বাচনে কুকি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিজেপিকে ভোট দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল, এবং মনিপুর বিধানসভায় দশ কুকি বিধায়কের মধ্যে সাত জনই বিজেপির। কুকি গোষ্ঠীগুলোও বিজেপির অনুকরণেই তাদের প্রচার চালায়, এবং কুকি নেতারা যে সময় ভারতীয় রাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন সেই দৃষ্টান্তকে জাহির করে মেইতেইদের ভারত-বিরোধী বলে দেগে দেয়। প্রাপ্ত রিপোর্ট জানাচ্ছে, চলমান হিংসায় নিহতদের ব্যাপক সংখ্যাধিকই হলো কুকি সম্প্রদায়ের। প্রাপ্ত খবর থেকে জানা গেছে যে কুকিদের ২০০টা চার্চ ভস্মীভূত হয়েছে, এবং তার সাথেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে স্কুল, শস্যাগার এবং ঘরবাড়ি।

এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে আজ যাকে ভুয়ো খবর বলা হয়, সেটা আসলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা গুজবেরই কৌশলগত ব্যবহার যাকে কাজে লাগিয়ে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সংঘাতকে উস্কিয়ে তোলা হয় এবং তাতে সবচেয়ে অসহায় হয়ে পড়ে নারীরা। প্রাপ্ত সংবাদ জানাচ্ছে, সংখ্যাগুরুবাদী মেইতেই গোষ্ঠীগুলো কুকিদের হাতে মেইতেই মহিলাদের ধর্ষণের ভুয়ো খবর ছড়ায়, এবং সেটাই কুকি-জো নারীদের গণপ্রহার এবং ধর্ষণের ওজর হয়ে ওঠে। নতুন পাওয়া রিপোর্ট জানাচ্ছে, উন্মত্ত দাঙ্গাবাজ জনতা নাকি নারীদের আক্রমণ করার সময় চিৎকার করে বলছে, “ওকে ধর্ষণ কর, ওর ওপর উৎপীড়ন চালাও”, তবে, এর সত্যতা যাচাই করা দরকার। আমরা যেমন হিংসার অব্যাহত তান্ডব অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি, তার সাথে এই প্রয়োজনটাও উঠে আসছে যে, হিংসা থামলেই নাগরিক সমাজের স্বাধীন, কোনো দলের অনুগামী নয় এমন সদস্যদের হিংসায় বেঁচে যাওয়া ও শোকার্ত মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে হবে; হত্যা ও ধর্ষণের রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করতে হবে; এবং প্রিয়জন, ঘরবাড়ি ও চার্চ হারানোয় মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের সংহতি জানাতে হবে এবং সম্ভাব্য সমস্ত ধরনের সহায়তার হাতও বাড়িয়ে দিতে হবে।

সারা দেশের উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসাবে আমরা দাবি জানাচ্ছি যে,

১) প্রধানমন্ত্রীকে নীরবতা ভঙ্গ করে মনিপুরের বর্তমান পরিস্থিতির দায় নিতে হবে।

২) উস্কিয়ে তোলা বিভেদ ও ঘৃণা প্রশমনের জন্য আদালতের তত্ত্বাবধানে একটা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে যা তথ্যগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি প্রস্তুত করবে এবং প্রস্তুত করবে মনিপুরের জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার কারণ স্বরূপ গভীর যে ক্ষত তার নিরাময়ের ভিত্তি।

৩) ভার্মা কমিশন সুপারিশ করেছিল যে ‘সংঘর্ষ প্রবণ এলাকায় যৌন হিংসার জন্য দায়ী ব্যক্তিবর্গকে’ সাধারণ অপরাধ আইনের অধীনেই বিচার করতে হবে, এবং সেই অনুসারে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং রাষ্ট্রশক্তির বাইরে লোকেদের হাতে ঘটা যৌন হিংসার সমস্ত ঘটনার বিচারের জন্য একটা ফাস্ট ট্র্যাক আদালত তৈরি করতে হবে।

৪) যে সমস্ত মানুষ ঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন তাদের জন্য সরকারকে ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিজ নিজ গ্রামে যাতে তারা ফিরে আসতে পারে তা সুনিশ্চিত করতে হবে; তাদের ঘর ও জীবন নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। যারা নিকটজনদের হারিয়েছে, আহত হয়েছে এবং ঘরবাড়ি, শস্য, গবাদি পশু ও অন্যান্য সামগ্রী হারিয়েছে তাদের জন্য এককালীন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরে ফেরা, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের এই প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করবে এলাকার সঙ্গে সুপরিচিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের একটা দল, যাদের নিয়োগ সম্ভবত করবে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট।

asha-workers-in-biharcontinuous-strike

৯ দফা দাবির ভিত্তিতে বিহারের আশা কর্মীরা ১২ জুলাই ২০২৩ থেকে অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। এরমধ্যে এমন কিছু দাবি রয়েছে, বিহার সরকার যেগুলো আগেই মেনে নেওয়া সত্ত্বেও কার্যকর করেনি।

আশা সংযুক্ত সংঘর্ষ মঞ্চের নেত্রী শশী যাদব এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, সারা বিহার জুড়ে সমস্ত জেলায় ধর্মঘটের নোটিশ সংশ্লিষ্ঠ আধিকারিকদের ইতিমধ্যেই পেশ করা হয়েছে আর সমস্ত জেলার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সামনে ২২ জুন প্রতিবাদী বিক্ষোভ দেখানো হবে।

তিনি বলেন, বিগত ১৭ বছর যাবত আশা কর্মীদের অবদানের ফলেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রভুত উন্নতি হয়েছে, বিশেষত, প্রসবকালীন মৃত্যু অনেক কমানো গেছে, টিকাকরণের জাতীয় পরিসংখ্যানে বিহার এখন অনেকটাই এগিয়ে। অতিমারির সময়ে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আশা কর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করেন, এমনকি অনেকেই মারা যান। কিন্তু রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের পরিবারগুলোকে এক কানাকড়িও ক্ষতিপূরণ দেয়নি।

আশা কর্মীদের অবদান নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পাটনা হাইকোর্টও প্রশংসাসূচক কথাবার্তা বলে, কিন্তু দুর্ভাগ্য এটাই যে, তাদের বুনিয়াদি দাবিগুলো আজও অমীমাংশিত থেকে গেছে।

আশা কর্মীদের সামনে তাই ধর্মঘট ছাড়া আর অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই। তারা রাজ্যজুড়ে লাগাতার ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যতদিন না পর্যন্ত দাবিগুলো আদায় হয়। ২২ জুন রাজ্যের সমস্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সামনে এবং ৪ জুলাই জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকদের দপ্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

bihar-are-on-a-continuous-strike
আশা কর্মীদের মূল মূল দাবি

১) রাজ্য সরকার প্রতি মাসে আশা কর্মীদের ‘পুরস্কার’ স্বরূপ যে ১০০০ টাকা দেয় তা রীতিমতো অপমানকর। এই অর্থ প্রদানের নামকরণ বদলিয়ে নিয়মিত মাসিক ভাতায় তা রূপান্তরিত করতে হবে। এই মাসিক ভাতাকে বৃদ্ধি করে ১০,০০০ টাকা করতে হবে।

২) মাসিক ওই ১,০০০ টাকাও এপ্রিল ২০১৯ থেকে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত প্রদান করা হয়নি, যা অবিলম্বে প্রদান করতে হবে।

৩) আশা কর্মীদের ভাতা ইত্যাদি প্রদানের সময় কোন ধরনের উৎকোচ/কমিশন আদায় করা বন্ধ করতে হবে।

৪) একটা শাড়ির পরিবর্তে আশা কর্মীদের পুরো ইউনিফর্ম দিতে হবে। ব্লাউজ, পেটিকোট ও শীতকালীন পোষাক সরবরাহ করতে হবে।

৫) আশা ফেসিলিটেটারদেরও সরকারি খরচে সমস্ত পোষাক পরিচ্ছদ দিতে হবে। তাঁদের প্রতি মাসে ন্যূনতম ৫০০ টাকা হারে যাতায়াতের খরচ দিতে হবে।

৬) বহুকাল আগে বিভিন্ন কাজের জন্য আশা কর্মীদের যে সমস্ত রেট স্থির করা হয়েছিল, তা সংশোধন করতে হবে।

৭) আশা এবং ফেসিলিটেটারদের নিয়মিতকরণ ও রাজ্য সরকারি কর্মীর স্ট্যাটাস দিতে হবে।

৮) অতিমারীর মধ্যে কাজ করতে গিয়ে যাদের মৃত্যু হয়, তাঁদের ক্ষতিপূরণ বাবদ রাজ্য সেস থেকে ৪ লক্ষ টাকা এবং কেন্দ্রীয় বিমা থেকে ৫০ লক্ষ টাকা দিতে হবে।

৯) আশা কর্মী ও ফেসিলিটেটারদের সমস্ত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের অধীনে আনতে হবে। তাঁদের পেনশন দিতে হবে। যতদিন পর্যন্ত না তা কার্যকর হচ্ছে, ততদিন অবসরকালীন প্রকল্প হিসাবে ১০ লক্ষ টাকা দিতে হবে।

১০) ২০১৯’র জানুয়ারিতে আশা ইউনিয়নের সাথে সরকারের যে চুক্তি হয়, তা কার্যকর করতে হবে।

women-wrestlers-movementa-shining-example

ন্যায়বিচার লাভের লক্ষ্যে কুস্তি ফেডারেশনের অপসারিত প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর গ্রেপ্তারির জন্য মহিলা কুস্তিগিররা কয়েকমাস ব্যাপী যে আন্দোলন চালিয়েছেন, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও তার কার্যত সমাপ্তি ঘটেছে। কুস্তিগিররা রেল দপ্তরে তাঁদের কাজে যোগ দিয়েছেন এবং কেউ কেউ আসন্ন এশিয়ান গেমসে প্রতিযোগী হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে অনুশীলনেও নেমেছেন। ব্রিজভূষণ গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার যে অঙ্গীকার তাঁরা করেছিলেন, সেই আন্দোলন থেমে যাওয়ায় ন্যায়বিচার লাভের প্রক্রিয়ার কি সমাপ্তি ঘটল? ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্ৰহের জোরালো ও বিশদ অভিযোগ দায়ের হলেও তিনি গ্রেপ্তারিকে এড়িয়ে যেতে পারলেন কেমন করে? গোড়ায় আমরা বরং এই দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করি, এই আন্দোলন কী প্রভাব রেখে গেল তার মূল্যায়নে বরং পরে আসা হবে।

দিল্লী পুলিশ প্রথমে কুস্তিগিরদের অভিযোগ নিতে না চাইলেও সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তারা ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দুটি এফআইআর দায়ের করতে বাধ্য হয়। তারমধ্যে একটি ছিল পকসো আইনে এক নাবালিকার এবং অন্যটি ছিল ছয় প্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরের যৌন নিগ্ৰহ ঘটার অভিযোগ। পকসো আইনে অভিযোগ দায়ের হলে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করাটাই রীতি, যাতে অভিযুক্ত অভিযোগকারী এবং সাক্ষীদের ওপর চাপ তৈরি করতে না পারে। পুলিশ কিন্তু ব্রিজভূষণকে গ্রেপ্তার করল না। মোদী সরকার, তার মন্ত্রী, পুলিশ ও প্রশাসন সবাই ন্যায় প্রদানের বিপরীতে অভিযুক্ত ব্রিজভূষণকে বাঁচাতেই সক্রিয় হলো। নাবালিকা ১০ মে ম্যাজিস্ট্রেটের সমনে তার বয়ানে বলেছিল, এক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জেতার পর একসাথে ছবি তোলার অছিলায় ব্রিজভূষণ তার যৌন হেনস্থা ঘটান। নিজের ঘরে নাবালিকাকে ডেকেও তার যৌন নিগ্ৰহে উদ্যত হন। ব্রিজভূষণকে গ্রেপ্তারের জন্য এই অভিযোগই যথেষ্ট ছিল। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মদন বি লকুরও সম্প্রতি বলেছেন, “অনেক আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল, কিন্তু সে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বিবৃতি দিচ্ছে এবং তার ঘনিষ্ঠ লোকজন সাক্ষীদের হুমকি দিচ্ছে।” কিন্তু গ্রেপ্তার না করে সময় অতিবাহিত হতে দিয়ে পকসো আইন থেকে ব্রিজভূষণের নিস্তারের পথ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পুলিশ ও প্রশাসন। নাবালিকার দ্বারা যৌন নিগ্ৰহের অভিযোগের প্রত্যাহারই সেই কৌশল রূপে দেখা দিল। আর নাবালিকার বাবা ও তাদের পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই তা সম্ভবপর হতে পারে। এবং হলোও তাই। নাবালিকার বাবা ৫ জুন আদালতে গিয়ে যৌন নিগ্ৰহের আগের বয়ানকে পাল্টালেন। বললেন, প্রতিযোগিতায় মেয়ের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হয়েছিল। কুস্তি রেফারি মেয়েকে পয়েন্ট দেননি, ফলে এক প্রতিযোগিতায় যোগদান তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই ফেডারেশনের বিরুদ্ধে রাগের বশে তিনি যৌন নিগ্ৰহের অভিযোগ এনেছিলেন। তাঁর মেয়ের ওপর কোনো যৌন নিগ্ৰহ ঘটানো হয়নি।

পুলিশ তাদের অভিপ্রেত হাতিয়ার পেয়ে গেল। নাবালিকার বাবার পরিবর্তিত বয়ান নিয়ে তারা দৌড়ল পাতিয়ালা হাউস কোর্টে। সেখানে বলল, তাদের তদন্তে পকসো আইনে অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা খুঁজে পায়নি! অতএব, ঐ অভিযোগকে বাতিল করা হোক। পুলিশের ডেপুটি কমিশনার প্রণব তয়াল বললেন, নাবালিকা ও তার বাবার বয়ানের ভিত্তিতে তদন্ত শেষ হওয়ার পরই পুলিশ পকসো আইনে মামলা বাতিল করার রিপোর্ট আদালতের কাছে জমা করেছে।

তবে, নাবালিকার বাবার ওপর সৃষ্ট চাপের পরিণামেই যে বয়ানের বদল ঘটেছে সংবাদপত্রে তাও প্রকাশিত হয়েছে। দ্য হিন্দু পত্রিকার ৮ জুন সংস্করণ নাবালিকার বাবার এই বিবৃতির উল্লেখ করেছে যে, “আমি আদালতে আমার বয়ান পরিবর্তন করেছি কেননা আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।… আমার পরিবার, আমার মেয়ে এবং নিজের সম্পর্কেও আতঙ্কিত।… আমার পরিবার নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।” তিনি আরও জানিয়েছেন, যে ব্যক্তিরা তাঁকে হুমকি দিয়েছে তাদের নাম তিনি প্রকাশ করতে পারবেন না। অতএব, যারা তাঁকে শাসিয়ে, ভয় দেখিয়ে বয়ান পরিবর্তনে বাধ্য করেছে, তারা যেই হোক — রক্তের সম্পর্কের মানুষজন বা ব্রিজভূষণের অনুচরই হোক — তাদের লক্ষ্য যে পকসো আইনের আওতা থেকে ব্রিজভূষণকে বার করে আনাই ছিল, তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। আদালত ৪ জুলাই পকসো আইনে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের পুলিশের আবেদনের বিচার করবে। আদালতের বিচারপতি কি পুলিশের রিপোর্টের ওপরই সম্পূর্ণ রূপে নির্ভর করবেন, নাকি চাপ সৃষ্টির পরিণামেই অভিযোগের বয়ানে বদল এসেছে বলে সংবাদপত্রে যে রিপোর্ট বেরিয়েছে, সেটিও তাঁর বিবেচ্য হবে? মোদী জমানায় আদালতের ভেতর থেকে বহু ক্ষেত্রেই যে শাসক অনুগামী স্বর উঠে আসছে তাতে বয়ান বদলের পিছনে থাকা আসল কারণ বিচারপতির কাছে খুব একটা গুরুত্ব পাবে বলে মনে হয় না।

women-wrestlers-movement

ছয় প্রাপ্তবয়স্ক কুস্তিগিরের অভিযোগের কারণে যে এফআইআর হয়েছিল তার ভিত্তিতে পুলিশ — এবং তাদের দাবি অনুযায়ী তদন্তের পর — ব্রিজভূষণ এবং তার সহযোগী বিনোদ তোমরের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে। সেই চার্জশিটে দন্ডবিধির যে ধারাগুলোর প্রয়োগ হয়েছে সেগুলো হল ৩৫৪ (শ্লীলতাহানি), ৩৫৪এ (যৌন ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য) এবং ৩৫৪ডি (স্টকিং বা চুপিসারে পিছু নেওয়া)। এই ধারাগুলোর কোনোটাতেই শাস্তি হিসাবে কারাবাসের মেয়াদ পাঁচ বছরের বেশি নয়, ফলে, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ব্রিজভূষণের গ্রেপ্তারির সম্ভাবনা নেই। এবং ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি অনুসারে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হবে বলেই মনে হয়। অতএব, ব্রিজভূষণ তার কাজকারবার যথারীতি চালিয়ে যেতে পারবে, নিজের ঘনিষ্ঠ লোকজন দিয়ে কুস্তিগিরদের হুমকি দিয়ে যেতে থাকবে এবং নির্বাচনে দাঁড়াতে ও বিজেপির হয়ে প্রচার করতেও তার অসুবিধা হবে না।

ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ সিং ঠাকুরের সঙ্গে ৭ জুন কুস্তিগিরদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে ক্রীড়ামন্ত্রী কুস্তিগিরদের কিছু প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন যে পুলিশ ১৫ জুন চার্জশিট পেশ করবে। এরথেকে এই অনুমান অস্বাভাবিক নয় যে, পুলিশ তদন্ত করে কী চার্জশিট দেবে এবং কবে দেবে তা বিজেপির লোকজনই ঠিক করে দিয়েছে! যাই হোক, ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর কুস্তিগিররা ১৫ জুন পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন, এবং আন্দোলন আবার শুরু হতে পারে এমন কোনো লক্ষণ নেই। তবে কুস্তিগিরদের আন্দোলন থেমে গেলেও জনগণের মধ্যে ব্রিজভূষণ ও বিজেপি বিরোধী ক্ষোভে ও ন্যায়বিচার লাভের প্রত্যাশায় কোনো ছেদ পড়েনি। গত ১৪ জুন কুস্তিগিরদের সমর্থনে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয় মহিলা পঞ্চায়েত। এআইডিডব্লিউএ, এআইপিডব্লিউএ, সারা ভারত মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন, সেন্টার ফর স্ট্রাগলিং উইমেন সহ ১২টা মহিলা সংগঠন ছিল ঐ মহিলা পঞ্চায়েতের উদ্যোক্তা। সেদিনের ঐ অনুষ্ঠানে অনেক মহিলা বুদ্ধিজীবীও অংশ নেন যাদের মধ্যে ছিলেন জয়া হাসান, উমা চক্রবর্তী, মৃদুলা মুখার্জী, সইদা হামিদ, নিবেদিতা মেনন ও অন্যান্যরা। ঐ অনুষ্ঠান থেকে বেশ কিছু দাবি উঠে আসে যেগুলোর মধ্যে কয়েকটা ছিল,

১) ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।

২) মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন নিগ্ৰহে যথোচিত ব্যবস্থা গ্ৰহণে ব্যর্থতার জন্য ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ সিং ঠাকুরকে পদত্যাগ করতে হবে।

৩) ভারতীয় দন্ডবিধির ১১৬এ ধারায় সেই সমস্ত পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে হবে যারা প্রথমে এফআইআর নিতে চায়নি এবং পকসো আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়নি।

৪) সাক্ষীগণ ও তাদের পরিবারের ওপর হুমকি প্রদানের বহু রিপোর্ট আসার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে প্রতিবাদকারী কুস্তিগিরদের পেশ করা অভিযোগের তদন্ত করতে হবে।

ঐ মহিলা পঞ্চায়েতে কুস্তিগির সাক্ষী মালিকের মা সুদেশ মালিক সহ হরিয়ানার বহু মহিলা, দিল্লী ও রাজস্থানের মহিলা আন্দোলনের কর্মীরা যোগ দেন। প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কুস্তিগিরদের কঠিন লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানানো হয় এবং পঞ্চায়েতে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যে সংগ্রামী ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথাও উঠে আসে।

কুস্তিগিরদের এই আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করতে এবং যৌন নিগ্ৰহ সমর্থনের বিজেপির কলঙ্ককে মুছে দিতে সমবেতভাবে সুকৌশলী এই প্রচার চালানো হচ্ছে যে, এটা যত না মহিলা কুস্তিগিরদের ন্যায়বিচার ও মানমর্যাদা লাভের লক্ষ্যে আন্দোলন, এরমধ্যে তার চেয়ে বেশি রয়েছে রাজনৈতিক অভিপ্রায়। কংগ্রেস ও অন্যান্য বিজেপি-বিরোধী শক্তিই এই আন্দোলনের পিছনে মদত হিসাবে রয়েছে ও প্ররোচনা জুগিয়েছে। তবে এই প্রচার তেমন আমল পায়নি, বিপরীতে নানা দিক থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির কপটাচার ও শঠতাকে সর্বসমক্ষে প্রকট করে দিয়েছে। কুস্তিগিরদের যৌন নিগ্ৰহ বিরোধী আন্দোলনের গোটা পর্যায়ে নীরব থেকে এবং নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিন ২৮ মে কুস্তিগিরদের টেনে-হিঁচড়ে জেলে নিয়ে গিয়ে ও যন্তরমন্তরে তাদের আন্দোলন মঞ্চ ভেঙে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রতিপন্ন করলেন যে, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বেটি বাঁচাও-বেটি পড়াও’এর তাঁর বাগজাল আসলে শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতি। তাঁর কাছ থেকে নারীদের ন্যায়বিচার লাভের প্রত্যাশা দুরাকাঙ্খা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। এই আন্দোলন দেখিয়েছে, লিঙ্গন্যায় বিজেপির চরিত্রে সম্পূর্ণ রূপে অনুপস্থিত। এই আন্দোলন আরও দেখিয়েছে, সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে এসে স্বেচ্ছাচারীভাবে চালানোর মতো ক্রীড়াক্ষেত্রকেও বিজেপি তাদের স্বেচ্ছাচারের মুলুক বলে জ্ঞান করে, ব্রিজভূষণ যেমন কুস্তি ফেডারেশনকে নিজের জমিদারি করে তুলেছিলেন। ন্যায়বিচার লাভের যে লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় তার অর্জনের আশু সম্ভাবনা না থাকলেও জন আদালতে ব্রিজভূষণ অবশ্যই যৌন নিগ্ৰহকারী ও পীড়ক বলেই গণ্য হবেন। শুরু থেকেই এই আন্দোলন ছিল এক চরম অসম আন্দোলন, গোটা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে কৃষক জনগণের এক অংশের সমর্থনের ভিত্তিতে যৌন নিগ্ৰহের শিকার মহিলা কুস্তিগিরদের আন্দোলন। কিন্তু এই আন্দোলনের ন্যায়পরায়ণতা ও দৃঢ়তা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, মোদী সরকার ও বিজেপির মতো প্রতাপশালী ও ধড়িবাজ শক্তিকেও তা হিমশিম খাইয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থার সমর্থনও লাভ করেছে, এমনকি বিজেপির সামাজিক ভিত্তিতেও ফাটল ধরিয়েছে। মহিলা কুস্তিগিরদের এই আন্দোলন নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা হয়েই থেকে যাবে।

- জয়দীপ মিত্র       
fight-for-government-recognitiondomestic-worker-be-strengthened

গত ১৬ই জুন আমরা আরও একটা আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস পেরিয়ে এলাম। ভারতে বহু নারীই গৃহশ্রমিক হিসাবে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন। গৃহশ্রমিক সেই ব্যক্তি যিনি অন্যের বাড়িতে মজুরির বিনিময়ে বাড়ির কাজ অর্থাৎ গৃহকর্ম করেন। NSS ২০০৫’র সমীক্ষা অনুযায়ি ভারতে ৪৭ লক্ষ গৃহশ্রমিক আছেন যদিও স্বাভাবিক নিয়মে এবং অনান্য কর্মক্ষেত্রে নারীর ধারাবাহিক সংখ্যালঘুত্ব বর্তমানে নারী গৃহশ্রমিকদের সংখ্যা কয়েকগুন বৃদ্ধি করেছে। বিভিন্ন গবেষক ও সংগঠকদের হিসাব মতে বর্তমানে দেশে গৃহশ্রমিকের সংখ্যা ৯ কোটি। তবে সরকারী তথ্য এবং গবেষণা সংস্থাগুলির সাংখ্যিক দরাদরির বাইরে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সারা দেশে ৫ কোটিরও বেশি গৃহশ্রমিক আছেন এবং এদের মধ্যে অধিকাংশই নারী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। প্রচলিত ভাষায় গৃহশ্রমিকদের ‘কাজের মেয়ে’, গৃহ পরিচারিকা ইত্যাদি বলা হয়। বিভিন্ন রাজ্যে তাদের বিভিন্ন স্থানীয় নামেও ডাকা হয়, শ্রমিক পরিচয়টিকে স্বীকৃতি দিতে আমরা গৃহশ্রমিক শব্দটি ব্যবহার করি এবং সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এখন এই শ্রমিক পরিচয়ের অর্থ, সরকারের কাছ থেকে শ্রমিকের সম্মান আদায় করা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতি ও নিশ্চয়তার অধিকার দাবি করা। কিন্তু ভারতে গৃহশ্রমিকদের জন্য কোনও বিশেষ আইন নেই। তবে গৃহশ্রমিকরা অবশ্যই কয়েকটি আইনের আওতায় পড়েন যেমন অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা আইন (২০০৮) আর কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থা আইন (২০১৩)। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে আছে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা (২০১৭)। কর্ণাটক, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু, বিহার, রাজস্থান, মেঘালয় ইত্যাদি রাজ্যে ন্যূনতম মজুরি সম্বন্ধে নোটিস জারি হয়েছে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যদিও মাসকয়েক আগে গৃহশ্রমিকদের জন্য নুন্যতম বেতন কাঠামো ঠিক করবেন বলেছিলেন, কিন্তু সেটা তার অনান্য কথার মতই আখেরে জনমোহিনী বাগাড়ম্বর কিনা তা নিয়ে খোদ গৃহশ্রমিকরাই ধন্দে আছেন। কারণ সরকার অন্ততপক্ষে একজন গৃহশ্রমিককে রাজ্য শ্রম দপ্তরের নির্দেশ অনুযায়ী (সিরিয়াল নম্বর ২৮, মেমো নং ১২২/Stat/৫/RW/১২/২০২২/LCS/JLC, তারিখ ২৭ ডিসেম্বর ২০২২) ঘর পরিস্কার ইত্যাদি কাজের জন্য নুন্যতম ৩৭৬ টাকা প্রতি দিন অর্থাৎ ৪৭ টাকা প্রতিঘণ্টা মজুরি দেওয়ার নিয়মে কেন জোর দেয়না কিম্বা সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পে গৃহশ্রমিকদের জন্য বিশেষ সংরক্ষন চালু করে না সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।

প্রসঙ্গত ২০১১ সালে ILO ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স কনভেনশন (১৮৯ নং) প্রচলন করে। এই কনভেনশনটিকে সাধারণতঃ ILO C১৮৯ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। বহু দেশ এবং তাতে ভারতও আছে যারা এখনও এই কনভেনশনটিকে নিজের আইনের কাঠামোয় কার্যকরী করার অঙ্গিকার নেয়নি। ILO C১৮৯এ গৃহশ্রমিকদের মজুরি, ওভারটাইম, কাজের সময়, বিশ্রাম, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে নির্দেশ দেওয়া আছে। পরিযায়ী গৃহশ্রমিকদের কথাও বিশেষভাবে বলা আছে। ILO C১৮৯’র উদ্দেশ্য গৃহশ্রমিকরাও অন্যান্য সব শ্রমিকদের মতই যেন অধিকার ও সুযোগ সুবিধা পায়। ভারতরাষ্ট্র এই আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্রে এখনও সম্মতি দেয়নি যদিও ভারতে এখনও গৃহশ্রমিকদের মজুরি, কাজের সময়, ছুটি, অসুখবিসুখের জন্য সহায়তা, কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে কোনও নিয়মনীতি নেই। অধিকাংশ গৃহশ্রমিকরাই নিরক্ষর অথবা স্বল্প সাক্ষর এবং তাদের কাজের চুক্তি নিয়োগকারির সঙ্গে মৌখিকভাবেই হয়। বেশিরভাগ নিয়োগকারিই গৃহশ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহে একটি করে ছুটি দিতে নারাজ। মনে রাখতে হবে যে অধিকাংশ গৃহশ্রমিকরা দলিত অথবা আদিবাসি সমাজ থেকে আসেন। এখনও গৃহশ্রমিকদের প্রতি ব্যবহারে জাতিবিদ্বেষ ও বৈষম্য দেখা যায়। অনেকেই গৃহশ্রমিকদের ভাঙা, রংচটা বাসনে খেতে দেন, নিয়োগকারির পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট বাসনে গৃহশ্রমিকদের খেতে দেওয়া হয়না, নিয়োগকারিদের শৌচালয় ও স্নানের ঘরও গৃহশ্রমিকদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয়না। উচ্চবর্ণের হিন্দু নিয়োগকারিরা মুসলমান গৃহশ্রমিকদের কাজ দিতে চান না। ভারতের বহু শহরেই এখন বিলাসবহুল আবাসন তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। বহু জায়গায় এই ধরনের আধুনিক ব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে যে আবাসনের বাসিন্দা ও তাঁদের আত্মীয় বন্ধুদের জন্য সংরক্ষিত লিফটে গৃহশ্রমিক ও সেই আবাসনে অন্যান্য পরিষেবা দিতে আসা শ্রমিকদের ওঠার নিয়ম নেই।

ভারতবর্ষে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে নারীবাদী অধিকার আন্দোলনের কর্মী অঞ্চিতা ঘটক বলেছেন

“গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করতে করতে আমার সহকর্মীরা ও আমি দেখেছি যে তাঁরা বেশিরভাগই খুব কম মজুরি পান। কলকাতা শহরে বহু গৃহশ্রমিক আছেন যারা চার পাঁচটা বাড়িতে কাজ করেও মাসে ১০,০০০ টাকার কম উপার্জন করেন। এছাড়া জাতিবিদ্বেষ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং চলমান সব ধরণের অচলাবস্থার প্রভাবে গৃহশ্রমিকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন।”

অতিমারীর সময় অধিকাংশ গৃহশ্রমিক ও তাদের পরিবারের নিদারুণ ক্ষতি হয়েছে। ২০২০ সালের ২৪ মার্চ যখন প্রথম লকডাউন ঘোষিত হল তখন দেখা গেল যে গৃহশ্রমিকদের কাজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কলকাতায় দেখা গেল যে বেশিরভাগ নিয়োগকারীরাই মার্চ মাসের মাইনে দিতে উদ্যোগ নিলেন। মনে রাখতে হবে যে মার্চ মাসে গৃহশ্রমিকরা প্রায় পুরো মাসটাই কাজ করেছিলেন। এপ্রিল মাস শেষ হতেই দেখা গেল যে চিত্রটা অন্য। যদিও তখন লকডাউন পুরোমাত্রায় জারি এবং সকলেরই বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ তবুও বহু নিয়োগকারিরা আর গৃহশ্রমিকদের মজুরি দিতে রাজি হলেন না। মনে রাখতে হবে যে এই সময়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহু শ্রমিকেরই রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গৃহশ্রমিকদের পরিবারের অন্যান্যরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেই রোজগার করেন।

অতিমারীর সময় খুবই স্পষ্টভাবে দেখা গেল যে কোনও রকম সরকারি সুযোগ সুবিধা না থাকার ফলে গৃহশ্রমিক এবং অন্যান্য বহু শ্রমিকই খুবই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়লেন। আমরা জানতে পারলাম যে বহু পরিযায়ী শ্রমিকেরা হাজার হাজার কিলোমিটার হেঁটে অতিক্রম করলেন, কারণ যানবাহন চলছিল না। অতিমারীর মধ্যে — লকডাউন পরবর্তী সময়েও — দেখা গেছে যে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা নিয়মিতভাবে গৃহশ্রমিক ও অন্যান্য গরিব মানুষদের কাছে পৌঁছোয় না। যেমন রেশন ব্যবস্থায় যা পাওয়ার কথা তার চেয়ে তাঁরা অনেক কম পান। রোজগারে টান পড়া এবং দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হওয়ার ফলে সরকারি পরিষেবার বিকল্প খোঁজাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় এইটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তাঁদের পরিস্থিতির জন্য নিয়োগকারীরাই দায়ী। নিয়োগকারীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কয়েকটি জায়গা আমি এই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। গৃহশ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি করতে হলে এবং তাঁদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকার যদি ILO C১৮৯-কে নিজের আইনের কাঠামোয় কার্যকরী করার অঙ্গিকার করে (যাকে র‍্যাটিফাই করা বলে) তাহলে গৃহশ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গৃহশ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারকে আইন এবং বিভিন্ন নিয়ম প্রচলন করতে হবে যার ফলে গৃহশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন অধিকার যেমন মজুরি, কাজের সময়, ছুটি, স্বাস্থ্য, কাজে নিয়োগ করার নিয়ম ইত্যাদি রক্ষা করা যাবে বলে আশা করা যায়।

গৃহশ্রমিকরা নিরন্তর বাঁচার লড়াই লড়ছেন। সরকারের উপরে তো অবশ্যই দায়িত্ব পড়ে গৃহশ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করার। আইন প্রণয়ন করার সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট আর্থিক বরাদ্দও করতে হবে যাতে আইনগুলি কার্যকরী করা যায়। তাছাড়া নিয়মনীতিগুলি লাগু করার সদিচ্ছা তো অবশ্যই থাকতে হবে। নিয়োগকারীরাও গৃহশ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণি ভূমিকা নিতে পারেন যেমন তাঁদের উচিত মজুরি দেওয়া, সাপ্তাহিক ছুটি দেওয়া, মাতৃত্বকালিন ছুটির ব্যবস্থা করা, বৈষম্যমূলক আচরণ ত্যাগ করা ইত্যাদি। সরকারের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে গৃহশ্রমিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া যেমন প্রয়োজন, একই সঙ্গে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার ও পরিষেবা যাতে প্রত্যেকটি গরিব মানুষের কাছে সহজেই পৌঁছোয় তারও ব্যবস্থা নিতে হবে।

- সংগ্রাম মণ্ডল

(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অঞ্চিতা ঘটক)

in-the-skylove-in-the-sky

[ “ও দাদা, পা-টা তোলো” — প্রভাতী দৈনিক বা মোবাইল মগ্ন ‘দাদা’র (দিদি, বৌদি, ভাই বা অন্য কেউও হতে পারেন) কানে সেই মৃদুস্বর হয়তো পৌঁছালো না। তার খেয়ালই নেই যে একটি ঝাঁটা বা ন্যাতা ধরা হাত তার চটিপরা পায়ের তলার মেঝেটা পরিষ্কারের জন্য অপেক্ষমান। ওদিকে উচ্ছিষ্ট সমেত ডাঁইকরা বাসন কলতলায় পড়ে আছে। এঁটো শুকিয়ে কড়কড়ে বাসনে জল ঢেলে আসতে হয়েছে। না হলে মাজা যাবে না।

হ্যাঁ, কাকভোরে উঠে সকাল থেকে এগুলোই করতে হয় সবজান বা সবিতাদের। সব কাজের বাড়ি যে তাদের প্রতি একই রকম নির্লিপ্ত বা অবিবেচক বা অমানবিক — এমনটা নয়। তবুও সাধারণ ভাবে মাসান্তে মাইনের কটা টাকার সঙ্গে মাসভর তাচ্ছিল্য বা কখনও কখনও অসম্মানও প্রাপ্য।

গত ১৬ জুন ‘আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস’ পালিত হয়েছে। সবজান-সবিতাদের হয়তো তা জানা ছিল না।

সমাজে অত্যাবশ্যক পরিষেবা দিয়ে চলেছে যারা তাদের চরম অবহেলিত নিপীড়িত জীবনে রোজকার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও আনুষঙ্গিক অনেক যুদ্ধ। সেইসব লড়াই লড়তে লড়তে তারা কীভাবে বহমান জীবনস্রোতের এক এক দক্ষ ‘নাইয়া’ হয়ে ওঠে, নিজেদের ক্লীন্ন জীবনের গ্লানি মুছে কখনও কখনও ‘অসামান্যা’ হয়ে ওঠে, তারই কয়েকটা মুহূর্ত তুলে ধরছি।

না, গল্প নয়। ১০০ শতাংশ সত্যি। এই প্রতিবেদনের ‘সবজান’ এক জীবন্ত মানুষ। বাবা ঘরামির কাজ করতেন। ওরা দু’বোন খুব ছোট্ট বয়েস থেকে মায়ের সঙ্গে রাস্তায় কয়লা বাছতো। থাকতো বস্তির এক ঘুপচি ভাড়া ঘরে। দশ বছরে বিয়ে হয়ে যায়। বরের হাতে নিত্য মার খাওয়া সেই মেয়ে এখন অনেক কিছুর বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াতে জানে। ]

সবজান বিবির মনের মধ্যে এক নাবাল জমি আছে। সেখানে কচি ঘাসে জল ফড়িং নেচে বেড়ায়। ছোট্ট পাখিরা শিস দিয়ে গান গায়। সেই গান শুনে ছোট্ট ফুলখুকিরা বাতাসে দুলে দুলে হাসাহাসি করে। হ্যাঁ, নির্ঘাত তার বুকের মধ্যে এক ভালোবাসার চরভূমি আছে! কেন? সে বৃত্তান্তই বলছি!

ছ’বাড়ি ঠিকে কাজ। ঘরে ফিরতে সূয্যি পাটে বসে। তখন এঁদো পুকুরে গা ডুবিয়ে চান। বাসি পান্তা দিয়ে খাওয়া সেরে একটু গা এলিয়ে আবার রাতের রান্না। কোনো কোনো দিন ভাত গেঁজিয়ে ওঠে। তখন দু’টো শুকনো মুড়ি চিবিয়ে জল খাওয়া। সব কাজের বাড়িতে তো আর খেতে দেয় না। দু’টো বাড়ি থেকে চা রুটি তরকারি দেয়। ঐটুকুর জোরে চার তলা ঠেঙানো। এখন অবশ্য বৌমা ঘরে আসায় কাঠের জ্বালে সে’ই সকালে রান্না করে। তাই কাজ থেকে ফিরে দু’টি সাজো ভাত পায়। যাক সে কথা, ফুল্লরার বারোমাস্যা।

সতেরো না পুরতেই যখন বড় ছেলে বিয়ে করবে বলে বায়না ধরলো, সবজানের খুব রাগ হয়েছিল। তারপর অবশ্য মতো দিয়েছে। কচি বৌমা যেন মাচার ঢলঢলে লাউডগাটি। গাড়ি থেকে নেমেই গলা জড়িয়ে বলেছিল “আমি তোমার আরেকটা মেয়ে গো মামণি”!

বৌয়ের বাপের ভাড়া ঘরে আছে শুধু বাপ আর পঙ্গু মা। মেয়ের জন্মের দেড়বছর পর থেকে কী কাল ব্যাধি ধরেছে, নড়াচড়া করতে পারে না। সবজানের ধারণা নার্ভের রোগ। (ও নিজের মহল্লায় অন্তত দু’টো কেসে পরিবারের লোকদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। তাদের চিকিৎসা চলছে। বাড়ির লোকজন ওঝা বৈদ্য ‘বাবার থানে’ ছুটছিল।) চৌকির ওপর তালগোল পাকানো দেহটা পড়ে থাকে। নিজে ভাতটুকু মেখে মুখে দিতে পারে না। দেখে শুনে বেয়াই বেয়ান দু’জনের জন্যেই প্রাণ কেঁদেছিল সবজানের। পুরুষ মানুষ, হাত পুড়িয়ে রেঁধে খেতে হয়। পড়ে থাকা মানুষটার গু’মুত কাছাতে হয়। আবার বেয়ানেরও কত কষ্ট। কথা বলার ক্ষমতাও নেই। কখন দুটো খেতে পাবে, পরিষ্কার হবে বলে হাপিত্যেশ করে থাকে বেচারা।

সবজান আগে আগে বেয়াইকে বলতো, “দাদা, এত কাচে হাসপাতাল, একবারটি দেকিয়ে এসো না মানুষটাকে! কত কষ্ট পাচ্চে”। টেরি বাগানো রং করা চুলে ছোকরাদের মতো আঙুল চালাতে চালাতে লোকটা বলেছিল, “তুমার বুনের কিছু হবার লয় গো; বদ নসীব। আমি কম জ্বালাতনে আচি গো।” সবজান আর কিছু বলেনি। ছেলেকে দিয়ে বলিয়েছিল যে ওরাই হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তাতেও লোকটা রাজি না। সেও তো আজ ক’বছর হয়ে গেল।

এই সেদিন বৌমার বাপ এসে মেয়েকে বললে, “তোর আম্মির সারা গায়ে ঘা হয়ে গেচে। একটু চান করিয়ে দিয়ে আসিস তো মা।”

বৌমা মায়ের কাছ থেকে ফিরে আছড়ে পড়ল কান্নায়, “আমার বাপটা মা-টারে মেরেই ফেললো গো! আমারে একদিন বলেছিলো — এই তোর মায়েরে ঘরে ঢুকোলাম। আর মলে ঘর থেকে একবারে বার করবো। মা আর বাঁচবে নি।” তার সারা গা পচে গেছে। কাঁথাকানি সব পূঁজ রক্তে ভরে গেছে।

শুনেই সবজানের ভীষণ রাগ হল। বলল, “আমি ওরে হাসপাতালে নে’যাব। দেকি কী কত্তে পারি।” বিকেলে কাজ থেকে ফিরে মহল্লার আরও দুই মহিলাকে নিয়ে বেয়াই বাড়ি চলল। ও সবার বিপদে আপদে সবার আগে দৌড়ে যায়। তাই ওকে কেউ না করে না। ছেলেকে দিয়ে প্লাস্টিক কিনিয়েছিল। সেটা সঙ্গে নিল।

পৌঁছে দেখলো ঘরে শেকল তোলা। শেকল খুলে ঢুকে দেখে পাখা বন্ধ। বেচারা দরদর করে ঘামছে। এমন সময়ে বেয়াই ঢুকতে সবজান রাগে ফেটে পড়ে বলল, “তুমি কেমন ধারার মানুষ গো! পাখা বন্ধ করে শেকল তুলে চলে গেছ!” বেয়াই বলে, “এই চায়ের দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে ছিলুম। পাখা চালিয়ে গেলে কত বিল উঠবে বলোতো?” সবজানের কথা বলতে ঘেন্না হচ্ছিল। কী অমানুষ! আর দুই সঙ্গিনীর সাথে প্লাস্টিক জড়ানো মানুষটাকে পাঁজাকোলা করে অটোয় উঠল। পড়শিরা কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। দূর থেকে নাকে কাপড় চাপা দিয়ে যেন তামাশা দেখছে।

এমার্জেন্সিতে দেখে ইঞ্জেকশন দিয়ে ওষুধ লিখে দিল। কীভাবে ঘা পরিষ্কার করতে হবে বুঝিয়ে দিল। কিন্তু ভর্তি রাখলো না। সবজান নিয়ে এল নিজের ঘরে।

মহল্লার সবাই ভীড় করে এল। সবজান বিজয়িনীর মতো বলল, “ওরে আমি আমার কাছে রেখে চিকিচ্ছে করাব। ঘা’টা সারলে ওরে নার্ভের চিকিচ্ছে করাতে হবে। দেখবে ও ভালো হয়ে উঠবে। জানো আজ কতদিন পর ওর মুখে কতা ফুটেচে! দুধ খেতে চেয়েচে নিজমুখে!”

সবজানের কথা শুনে কেউ কেউ মুখ চাওয়া চাউয়ি করছিল। কী বলে ও! নিজে কিছু দিন আগে বিরাট অসুখ থেকে উঠেছে। একখানা প্লাস্টিক ছাওয়া ঘরে পাঁচ ছ’জনে গাদাগাদি করে এই গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে রাত কাটায়। দিনের পর দিন ভাতে ভাত খেয়ে থাকে। সে এই রোগীকে, যার সব্বাঙ্গ খসে পড়ছে, তাকে ঘরে রেখে চিকিচ্ছে করাবে!

মহল্লার এক বুড়ো মানুষ এগিয়ে এসে বলল, “তুমি যেকালে সাহস করে এই দায়িত্ব নিয়েচো, আমরাও তোমার সঙ্গে আছি”। সবাই যেন এবার ঘোর কাটিয়ে বলে ওঠে, “হ্যাঁগো, আমরাও আচি”।

বৌমাকে ওষুধপত্তর সব বুঝিয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে সবজান এবার খোলা আকাশের নিচে বসে। কতদিন পর যেন আকাশটা দেখে। আকাশে আজ তারার মেলা। ঝিরি ঝিরি হাওয়া দিচ্ছে। চোখ দু’টো আপনা থেকে জড়িয়ে আসে।

পরদিন। বিকেল হব হব। কাজ শেষে ঘাম মুছতে মুছতে রাস্তা পেরোতেই দেখে ছোট ছেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। সঙ্গে আরও ক’টা বাচ্চা। দম ফেলে কোন মতে বলে, “উ আর লেই গো। এক্কুনি মরে গেল।” সবজান ছুটতে ছুটতে এসে দেখে দমচাপা গলিটা লোকে লোকারণ্য। বৌমা ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “মরার আগে মা আজ কত কতা বলল। নাতিকে আদর কল্ল। আমার হাতে পানি খেল, আমার মুকে হাত বুলিয়ে দেল। চলে গেল। কেন এসেছিল? মা, মাগো”। বৌমার বুক ভাঙা কান্নায় সবজানেরও কান্না পায়। শুধু বিড় বিড় করে বলে, “কেন যে আগে ওরে আনিনি, থা’লে মানুষটা বাঁচত”।

সেই বয়স্কা মহিলা যে ওর সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিল, বলল, “দুঃখু করিসনে বোন। কটা বচ্ছর তো কোন আদর যত্ন পায়নি, পশুর মতো বেঁচে ছিল। তোদের আদর যত্ন ভালোবাসা পেল। একটা দিন মানুষের মত বাঁচার সোয়াদ পেল। তোর বাড়ির ভালোবাসা নিয়েই চলে গেল।”

সবজানের বুকের সেই ভালোবাসার চরভূমিতে ভীষণ ঝড় উঠেছে। মানুষকে কেন এত কষ্ট পেতে হয়? কেন?

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

guarantee-the-sale-of-cropsminimum-subsidized-price

পঞ্চায়েত ভোটে পেশীশক্তির আস্ফালন, তার মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে তা নিয়ে আইনি লড়াই — এসব নিয়েই এখন সংবাদমাধ্যম সরগরম হয়ে আছে। শান্তিপূর্ণ রক্তপাতহীন মনোয়নন ও নির্বাচন যে গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত — তা নিয়ে অবশ্যই কোনও সন্দেহ নেই। এই গণতান্ত্রিক লড়াই আমাদের অবশ্যই জোরকদমে লড়তে হবে। পাশাপাশি লড়তে হবে রুটি রুজির মৌলিক দাবিগুলো নিয়েও। এই লেখা এরকমই একটি মৌলিক দাবি — এমএসপি (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস) বা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) হল উচ্চ ফলনশীল শস্যের ন্যূনতম দাম যা সরকার স্থির করে এবং ওই দামে চাষীদের কাছ থেকে শস্য কেনে। তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে যে দেশজোড়া বিরাট কৃষি আন্দোলন হল ও শেষমেষ সরকার পিছু হটে সেই আইন তিনটিকে বাতিল করতে বাধ্য হল, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যর প্রশ্নে সরকার ও কৃষকদের বিরোধ ছিল তার একটি।

বিক্ষোভকারী বিভিন্ন কৃষক সংগঠন অন্যান্য সমালোচকরা দাবি করেন যে, নতুন কৃষি সংস্কার আইনের ফলে বর্তমান এপিএমসি চালিত মান্ডিগুলি অবান্তর হয়ে পড়বে ও কর্পোরেট বা বড় কোম্পানিগুলির প্রভাব বিস্তার করার পথ প্রশস্ত হবে। কৃষকদের কাছে আজকের সুবিধেজনক ও স্থিতিশীল মূল্য ব্যবস্থা বানচাল হয়ে যাবে।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কী ও কীভাবে তা ঠিক করা হয় প্রথমে সেই কথায় আসা যাক।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করে সরকার। সেটা হল ন্যূনতম দাম যা দিয়ে সরকার চাষির পণ্য কেনে। সরকারের তরফ থেকে, ওই ঘোষিত দামের কমে পণ্য কেনা হয় না। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হল, চাষীর মুনাফা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে অতি ফলনের মরশুমে। এটাকে সরকারের দিক থেকে এক ধরনের হস্তক্ষেপ বলা যেতে পারে। যাতে অতি ফলনের সময় দাম পড়ে গেলেও, সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে পণ্য কিনে ক্ষতির হাত থেকে চাষিকে বাঁচাতে পারে। আবার, একই সঙ্গে, ওই কেনা শস্য সরকার গণবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে সরবরাহ করে।

কৃষি মন্ত্রকের কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস অ্যাণ্ড প্রাইসেসের (সিএপিসি) পরামর্শের ভিত্তিতে, মরশুমের শুরুতেই, নির্বাচিত ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে সরকার। বর্তমানে সিএপিসি ২৩টি কৃষিজাত পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে ৭ রকমের শস্য (ধান, গম, ভুট্টা, জোয়ার, বাজরা, বার্লি, রাগি), ৫ ধরনের ডাল (ছোলা, তুর, মুগ, উড়াদ, মসুর), ৭ ধরনের তৈল বীজ (চিনে বাদাম, রেপসিড, সরষে, সোয়াবিন, তিল, সূর্যমুখী, নাইজার বীজ, সানফ্লাওয়ার), ও ৪ ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য (নারকেলের ছোবড়া, আখ, তুলো, কাঁচা পাট)।

এগুলির মধ্যে ১৪ রকমের খরিফ শস্য বা বর্ষাকালীন ফসল হল সাধারণ এবং গ্রেড-এ ধান, শঙ্কর ও মালডান্ডি প্রজাতির জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, রাগী, অরহড় ডাল, মুগ ডাল, বিউলির ডাল, খোসা সুদ্ধ বাদাম, সয়াবিন, সূর্যমুখী, তিল, নাইজের বীজ, মাঝারি ও বড় আঁশ যুক্ত কাপাস। ৬ রকমের রবিশস্য হল — গম, বার্লি, দানাশস্য, মশুরডাল, রেপসিড ও সর্ষে, সূর্যমুখী। এছাড়া দুরকমের বাণিজ্যিক ফসল — পাট ও নারকেলের শুষ্ক শীষেরও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষিত হয়েছে।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এমন ভাবে ঠিক করা হয় যাতে চাষ উৎপাদনের খরচ মিটিয়ে লাভ করতে পারে। ২০১৮-১৯’র কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার সময়, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ঘোষণা করেছিলেন যে, ন্যুনতম সহায়ক মূল্য হবে উৎপাদন খরচের ১.৫ গুণ।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঠিক হয়ে গেলে, কেন্দ্রের ক্রেতা, খাদ্য ও গণবন্টন মন্ত্রকের অধীনে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া ও রাজ্যের সংস্থাগুলি, ওই দামে পণ্য কিনতে শুরু করে। বর্তমানে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কেনার ব্যবস্থা কেবল গম আর ধানের ক্ষেত্রেই চালু আছে।

কী পরিমাণ শস্য কেনা হবে, তা নির্ভর করে লক্ষ্যমাত্রার ওপর। আর সেই কারণে, পরিমাণটা বিভিন্ন রাজ্যে আলাদা হয়। এক্ষেত্রে পঞ্জাবের অবস্থান অন্য সব রাজ্য থেকে আলাদা। এ কারণেই কৃষক আন্দোলনের ভরকেন্দ্র ছিল এই রাজ্যটি।

ভারতে ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের পরেই পঞ্জাবের স্থান। দেশের ধান উৎপাদনের ১১.৫ শতাংশ হয় পাঞ্জাবে। এবং গমের ক্ষেত্রে, উত্তরপ্রদেশের পরেই আছে পঞ্জাব। দেশে গম উৎপাদনের ১৭.৯ শতাংশ আসে ওই রাজ্য থেকে। কিন্তু সরকারের কেনা ধানের ৬২ শতাংশ আর গমের ৩২.৬ শতাংশ আসে পঞ্জাব থেকে।

২০২০-২১ সালের রবি শস্যের মরসুমে, কেন্দ্রের গম কেনার ক্ষেত্রে, মধ্যপ্রদেশের অবদান ছিল ৩৩.২ শতাংশ। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কার্যকর করা ও সরকারের শস্য কেনার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির মধ্যে তারতম্য ঘটে। যেখানে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে প্রচুর পরিমাণে ধান ও গম কেনে সরকার, সেখানে খোলা বাজারেও দাম ওই সহায়ক মূল্যের কাছাকাছি থাকে (যেমন, পঞ্জাব ও হরিয়ানায়)। কিন্তু যেখানে সরকার অল্প পরিমাণে কেনে বা কেনেই না, সেখানে বাজারে দাম ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অনেক নীচে থাকে।

ফলে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও সেই সঙ্গে সরকারি ক্রয় সাধারণত কৃষকদের সুবিধে করে দেয়। কারণ, বেসরকারি ক্রেতাদেরও সহায়ক মূল্যের কাছাকাছি দাম দিতে হয়।

সরকার যে তিনটি কৃষি আইন এনেছিল তার একটি আইন ছিল ‘কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন আইন ২০২০’। এই আইন এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেট কমিটির (এপিএমসি) বাজারের বাইরেও বাজার স্থাপন করার অনুমতি দেয়। এরকম আইন হলে শস্য কেনাবেচার জন্য নতুন বাজার তৈরি হবে এবং সেখানে কৃষক ও ক্রেতাদের ওপর কোনও কর চাপাতে পারবে না রাজ্য। যেমনটা এখন করা হয় এপিএমসি মান্ডিগুলিতে।

বিক্ষোভরত চাষিদের আশঙ্কা যে, দু’টি বাজারে ভিন্ন কর ব্যবস্থা চালু হলে (এপিএমসি করযুক্ত, নতুন বাজার করমুক্ত), স্বাভাবিক ভাবেই করমুক্ত বাজার ব্যবসা দখল করে নেবে। এবং এপিএমসি বাজারে লেনদেন কমে যাওয়ার ফলে, সেখান থেকে কর বাবদ রাজ্যের যথেষ্ট আয় না হলে, হয়তো এপিএমসি ব্যবস্থাটাকেই তুলে দেওয়ার দিকে এগোবে রাজ্য।

the-government-should-guarantee-the-sale-of-crops

গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর একজন বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক পি সাইনাথ, ইন্ডিয়া টুডে’তে রাজদীপ সারদেশাইয়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, বিশেষ করে পঞ্জাব ও হরিয়ানাতে কৃষক বিক্ষোভ বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। কারণ, তিনি বলেন, কৃষকরা আশঙ্কা করছেন যে, এই নতুন আইন, বর্তমান মান্ডি ব্যবস্থা ও রাজ্য দ্বারা ক্রয়ের নিশ্চয়তাকে খর্ব করবে। তাছাড়া, সরকারের সংঘাতপূর্ণ মনোভাব পরিস্থিতিকে আরও ঘোরাল করে তুলেছে। উনি আরও বলেন যে, “কেনার নিশ্চয়তা না থাকলে, সহায়ক মূল্য বাড়ানোটা অর্থহীন হয়ে পড়ে”।

সহায়ক মূল্যে সরকার যদি শস্য কেনা বন্ধ করে দেয়, তা হলে গণবন্টন ব্যবস্থাও সঙ্কটে পড়তে পারে। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩ অনুযায়ী, জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ মানুষকে কম দামে খাদ্যশস্য (চাল, গম, বাজরা) দেওয়ার কথা সরকারের। ক্ষুধা সূচক সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতের অবস্থান ভালো নয়। গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্সে ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪ (বছর বছর কিছু আগুপিছু হলেও মোটের ওপর চিত্রটি বরাবরই বেদনাবহ)। অথচ, ভারত একটি খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ।

কৃষি আইন প্রত্যাহারের পরে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়ানো ও সেই মূল্যে সরকারের ফসল কেনা নিশ্চিত করাটাই এখন কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি।

কৃষি সঙ্কটের এই যুগে বেশি লাভ হোক না হোক, অন্তত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যতে যাতে ফসল বিক্রি করা যায়, তা ভারতের প্রায় সমস্ত কৃষকেরই এক সাধারণ চাহিদা। তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করার পরও এই নিয়ে কৃষকদের ধারাবাহিক দাবিদাওয়ার কথা বিভিন্ন কৃষক সংগঠন নিয়মিত জানিয়ে যাচ্ছে। সরকার এই নিয়ে কী ভাবছে ও পদক্ষেপ নিচ্ছে এই লেখায় সেটা প্রথমে দেখে নেওয়া যাক।

মনে রাখতে হবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সার্বিকভাবে সারা দেশের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা রাজ্যের কথা ভাবা হয় না। ফলে বাংলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফসল — যেমন আলু — এই তালিকায় নেই।

প্রতি কৃষি মরসুমেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বদলানোর দরকার পড়ে। কারণ উৎপাদন ব্যয় বদলায় বাজারের পরিস্থিতি বদলায়। সরকার দাবি করেছে কৃষকদের ন্যায্য দাম পাওয়ার বিষয়টি সুনিশ্চিত করতেই তারা ২০২২-২৩ রবি বিপণন মরশুমে রবি শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি করেছে। গতবছরের তুলনায় এবার মুসুর ডাল, রাই সরষে এবং সরষের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে সর্বোচ্চ ক্যুইন্টাল প্রতি ৪০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে, ছোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ক্যুইন্টাল প্রতি ১৩০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। কুসুম ফলের ক্ষেত্রে গতবছরের তুলনায় এবার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ক্যুইন্টাল প্রতি ১১৪ টাকা বেড়েছে। একইভাবে, গমের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গতবছরের ক্যুইন্টাল প্রতি ১ হাজার ৯৭৫ টাকা থেকে বেড়ে এবার ২০১৫ টাকা হয়েছে। বার্লির ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবার ক্যুইন্টাল প্রতি আরও ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৬৩৫ টাকা করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্থনীতি বিষয়ক কমিটি ২০২২-২৩ বিপণন বর্ষে বিভিন্ন খরিফ শস্যের জন্য যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য অনুমোদন করেছে সেগুলো দেখা যাক।

সাধারণ ধানের জন্য উৎপাদনে ব্যায় হয়েছে কুইন্টাল প্রতি ১ হাজার ৩৬০ টাকা। এই হিসেবে ২০২২-২৩ বিপণন মরশুমে সাধারণ ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারিত হয়েছে কুইন্টাল প্রতি ২০৪০ টাকা। এ গ্রেডের ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ২০৬০ টাকা।

শঙ্কর প্রজাতির জোয়ারের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ধার্য হয়েছে ২০৯৭০ টাকা। কুইন্টাল প্রতি মালডান্ডি জোয়ারের ক্ষেত্রে ২০৯৯০ টাকা, বাজরার ২০৩৫০ টাকা, রাগি ৩৫৭৮ টাকা, ভুট্টা ১৯৬২ টাকা, অড়হরের ডাল ৬৬০০ টাকা, মুগ ৭৭৫৫ টাকা, বিউলির ডাল ৬৬০০ টাকা, চিনাবাদাম ৫৮৫০ টাকা, সূর্যমুখীর বীজ ৬৪০০ টাকা, হলুদ সোয়াবিন ৪৩০০ টাকা, তিল ৭৮৩০ টাকা, নাইজার বীজ ৭২৮৭ টাকা, মাঝারি আঁশযুক্ত তুলো ৬০৮০ টাকা এবং লম্বা আঁশযুক্ত তুলোর জন্য ৬০৮০ টাকা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারিত হয়েছে। সরকার তার এক বিবৃতিতে জানায় যে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের বাজেট পেশের সময় গৃহীত নীতি — ফসল উৎপাদনের মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশ বেশি হারে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা হবে — অনুযায়ীই ২০২২-২৩ কৃষি বিপণন মরশুমে খরিফ শস্যের এই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

সেইসঙ্গে এও জানানো হয় যে বাজরা, অড়হর, বিউলির ডাল, সূর্যমুখীর বীজ, সোয়াবিন এবং চিনাবাদামের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কৃষি কাজে ব্যয়ের থেকে যথাক্রমে ৮৫ শতাংশ, ৬০ শতাংশ, ৫৯ শতাংশ, ৫৬ শতাংশ, ৫৩ শতাংশ এবং ৫১ শতাংশ বেশি ধার্য হয়েছে।

সরকারের দাবি বিগত কয়েক বছর ধরে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের পরিমাণ ক্রমশ বৃ্দ্ধি করা হচ্ছে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী শস্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিকাজে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। এসবের ফলে দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে বলে সরকার দাবি করেছে। সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে ২০২১-২২ সময়কালের তৃতীয় মূল্যায়ণ অনুযায়ী দেশে শস্য উৎপাদন হয়েছে ৩১ কোটি ৪৫ লক্ষ ১০ হাজার টন। ২০২১-২২ সময়কালের তুলনায় যা ৩৭ লক্ষ ৭০ হাজার টন বেশি। ২০২১-২২ সময়কালে আগের ৫টি অর্থবর্ষের সময়কালের গড় হিসেবে ২ কোটি ৩৮ লক্ষ টন শস্য বেশি উৎপাদিত হয়েছে।

বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে কৃষকদের দাবির ভিত্তিতে সরকার যেন ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনে এবং এই সংক্রান্ত হয়রানি রুখতে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যেন সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে সেই দাবিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ময়দানকে মুখরিত করে তুলতে হবে।

- সৌভিক ঘোষাল

loan-defaultsencourage-loan-defaults

দু’দফা মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ন’বছরেরও বেশি শাসন যদি সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে থাকে, তবে সেই শাসনের আর একটা অবিসংবাদী পরিণাম হয়েছে কর্পোরেট লুটেরাদের প্রতি মদত ও সেই লুটেরাদের সুরক্ষা জোগানো। এমনকি দেশের বিচারকে এড়ানো সম্ভব করতে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতেও সহায়তা করা। বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সিদের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কের অর্থ লুট করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে সেসময় দেশে যথেষ্ট আলোড়ন হয়েছিল, এবং ব্যাঙ্কের, অর্থাৎ ভারতীয় জনগণের অর্থ লুট প্রতিরোধের দাবি জোরালো হয়ে সামনে এসেছিল। কিন্তু মোদী জমানা যত এগিয়েছে অনুৎপাদক সম্পদের রূপে প্রকট হওয়া ব্যাঙ্ক অর্থের লুটে কোনো নিয়ন্ত্রণ আসেনি। এরথেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ব্যাঙ্ক অর্থের এই লুটেরারা বেপরোয়া এবং ক্ষমতার অলিন্দই তাদের স্পর্ধার সবচেয়ে বড় উৎস। সম্প্রতি আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমন একটা নির্দেশিকা জারি করল যা ব্যাঙ্ক লুটেরাদের ঋণ অপরিশোধ জনিত অপরাধ থেকে অব্যাহতি পাওয়ারই একটা অবলম্বন হয়ে দেখা দিচ্ছে।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গত ৮ জুন বার করল ‘আপসে রফা ও পারিভাষিক রাইট-অফ’এর কাঠামো’ সম্পর্কিত নির্দেশিকা। এই নির্দেশিকার সারকথা — ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে যারা শোধ করেনি, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে আপসের মাধ্যমে সেই বকেয়া ঋণের কিছুটা অন্তত আদায়ের চেষ্টা করবে। এই ঋণ খেলাপিদের দুটো বর্গের কথা বলা হয়েছে — ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য সত্ত্বেও যারা ঋণ পরিশোধ করেনি সেই ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারী এবং প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাঙ্ক অর্থ হাতিয়ে নিয়ে শোধ না করা জালিয়াতরা। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এই সমস্ত অপরিশোধকারী এবং জালিয়াতির রূপকারদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বকেয়া অর্থের কিছুটা অন্তত তাদের দিতে বলবে। আর, যে সমস্ত অপরিশোধিত ঋণ অনুৎপাদক সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোকে ব্যাঙ্কের ঋণের খাতা থেকে রাইট-অফ করা বা মুছে দেওয়া হবে, তারপরও যদিও সেই বকেয়া অর্থ আদায়ের অধিকার ব্যাঙ্কের থাকবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আপস-আলোচনা চালানোর জন্য ব্যাঙ্কগুলোর বোর্ডকে নীতি তৈরি করতে বলেছে এবং ব্যাঙ্কগুলো পরিচালন বোর্ডের সম্মতি নিয়ে এ ধরনের আপস আলোচনায় অংশ নিতে পারবে। এই নীতি প্রবর্তনের পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো — ব্যাঙ্কের প্রচুর অর্থই অনাদায়ী হয়ে পড়ে আছে; কাজেই, আপসের মাধ্যমে সেই অর্থের কিছুটা আদায় হলেও ব্যাঙ্কের লাভ। কিন্তু সাধারণ জনগণের ধারণায় এবং ভাষ্যকারদের মতে — রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই নির্দেশিকার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারী এবং জালিয়াতির কারবারীদের কাছে উৎসাহের সংকেত এবং সৎ ঋণগ্ৰহীতাদের কাছে হতাশজনক বার্তাই পৌঁছাবে।

ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারী হল সেই সমস্ত ব্যক্তি বা সংস্থা পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা ঋণ পরিশোধ করেনি। এই সমস্ত সংস্থা বা ব্যক্তিদের মাথায় হাত বুলিয়ে কতটুকু অর্থ আদায় সম্ভব? পরিশোধ না করার দুরভিসন্ধি থেকেই কি তারা ঋণ কব্জা করেনি? দয়াদাক্ষিণ্য দেখিয়ে তারা ছিটেফোঁটা হয়ত শোধ করবে। আর এটুকু নিয়েই ব্যাঙ্ক সন্তুষ্ট হয়ে তাদের অপরাধ থেকে, পরিশোধের দায় থেকে মুক্ত করবে? সরকার যেমন বলছে, অনুৎপাদক সম্পদ রূপে অনাদায়ী যে অর্থকে ব্যাঙ্ক ঋণের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে সেই অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সেই আদায়ের পরিমাণ কতটা? গত চার বছরে, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২’র মধ্যে ব্যাঙ্ক ঋণের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে ১০ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু মুছে দেওয়ার পর এই অর্থ আদায় করা গেছে মাত্র ১৩ শতাংশ। হিসেব অনুসারে যা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে — ৮ টাকা ঋণ নিলে তার থেকে শোধ হচ্ছে মাত্র ১ টাকা। এটাই কি সরকার এবং ব্যাঙ্কগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য? ঋণ আদায়ের অমোঘ ভবিতব্য? ব্যাঙ্ক ইউনিয়নগুলোর দুই সংস্থা এআইবিওসি এবং এআইবিইএ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকার বিরোধিতা করে বলেছে, এই পদক্ষেপ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার ন্যায়পরায়ণতাকেই সংকটাপন্ন এবং ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারীদের মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে তুলবে। এই নির্দেশিকা কার্যকরী হলে তা নীতিজ্ঞানরহিত ঋণ গ্ৰহীতাদেরই শুধু লাভ এনে দেবে না, যাঁরা বহু কষ্ট স্বীকার করেও ঋণ পরিশোধ করে চলেছেন তাদের কাছে অসন্তোষের এক বার্তাও পাঠাবে। সৎ ঋণ পরিশোধকারীরা ভাবতেই পারেন, ঋণ পরিশোধ করাটা কি তাঁদের অপরাধ হচ্ছে? শোধ না করলে ঐ ঘোড়েল ও ধড়িবাজ অপরিশোধকারীদের মতো সুবিধাও কি তাঁরা পেতেন না? ব্যাঙ্ক ইউনিয়নগুলোর দুই সংস্থা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “এই ধরনের নরম পদক্ষেপ নীতি পালন না করার প্রবণতা, নীতিভ্রষ্টতাকেই স্থায়ী করে, ক্ষতির মূল ধাক্কাটা ব্যাঙ্ক ও তার কর্মীদেরই বহন করতে হয়।” এবং বিবৃতিতে তারা আরবিআই’এর নির্দেশিকা প্রত্যাহারের দাবিও জানিয়েছে।

আরবিআই’এর ঐ নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, আপস আলোচনার মাধ্যমে ঋণের কিছু টাকা শোধ করা ব্যক্তিদের একবছরের আগে আর ঋণ দেওয়া যাবেনা। এর গূঢ় অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, কিছু টাকা শোধ করে দায়মুক্ত হওয়ার একবছর পর তারা আবার ঋণ পাবে। এবং তার পরের সম্ভাবনা এই যে, ঐ ঋণও পুরো শোধ হবে না এবং আপসের মাধ্যমে কিছু টাকা শোধ করে পুরো দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা হবে। দ্য ওয়্যার ওয়েব পত্রিকায় প্রকাশিত এআইবিওসি’র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক টমাস ফ্র্যাঙ্কোর লেখা এক নিবন্ধে ব্যক্ত অভিমত হলো, “মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আমানতকারীদের আমানতকে কাজে লাগিয়ে সামান্য কিছু অর্থ পুনরুদ্ধারের ভিত্তিতে ঋণ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হবে। আর অপরাধীরা আবার ঋণ নিতে পারবে!”

খুব সঙ্গত ভাবেই এই প্রশ্নটা উঠছে যে — এই সময়েই, ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যখন আর এক বছরও বাকি নেই, সে সময় আরবিআই এই নির্দেশিকা জারি করল কেন? বিশেষত, ২০১৯ সালের ৭ জুন তারিখে জারি করা তাদের বিজ্ঞপ্তিকে খারিজ করতে আরবিআই এত সক্রিয় হলো কেন? ঐ বিজ্ঞপ্তিতে আরবিআই জানিয়েছিল, “যে সমস্ত ঋণ গ্ৰহীতা জালিয়াতি/অবৈধ কাজ/স্বেচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি করেছে তারা পুনর্বিন্যাসের অমনোনয়নযোগ্য হবে।” অর্থাৎ, তাদের নেওয়া ঋণের অর্থ ও পরিশোধের সময় কোনোভাবেই রদবদল করা যাবে না। এরপর এই নতুন নির্দেশিকা কি সন্দেহ জাগায় না? সংবিধান সম্মত সমস্ত প্রতিষ্ঠান কাগজে-কলমে ‘স্বাধীন’ হলেও সবই চলে মোদী সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও নির্দেশে। এই নির্দেশিকার পিছনেও আরবিআই’এর ওপর মোদী সরকারের চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ওপরে টমাস ফ্র্যাঙ্কোর যে নিবন্ধের উল্লেখ করা হলো, তাতে তিনি এই সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছেন যে — বিজয় মাল্য, মেহুল চোক্সি, নীরব মোদীর মতো ব্যাঙ্ক তথা সাধারণ জনগণের অর্থের যে লুটেরারা দেশের বিচারকে ফাঁকি দিতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ছিল, তারা এবার দেশে ফিরে আসতে পারবে। অনাদায়ী ঋণের অল্প কিছু অর্থ শোধ করে পরিশোধহীনতার সম্পূর্ণ দায় থেকে মুক্ত হতে সমর্থ হবে। আরবিআই একবার ৫০ জন স্বেচ্ছাকৃত অপরিশোধকারীর যে তালিকা তৈরি করেছিল তার প্রথম দিকেই ছিল এবিজে শিপইয়ার্ড (ঋষি আগরওয়াল), উইনসাম ডায়মন্ড (যতীন মেহতা) ও অন্যান্য নাম যারা মোদী ও বিজেপি ঘনিষ্ঠ। টমাস ফ্র্যাঙ্কো বলেছেন, যে এবিজে শিপইয়ার্ড ২৮টা ব্যাঙ্কের সঙ্গে ২৩,০০০ কোটি টাকার প্রতারণা করেছে, তারা এবার আপস মীমাংসায় গিয়ে গৃহীত ঋণের সামান্য কিছু শোধ করে অপরাধ থেকে পুরোপুরি দায়মুক্ত হতে পারবে!

আজকের ভারতে ঋণ অপরিশোধের পরিণামে ঘটা ব্যাঙ্ক সংকটের পিছনে মূল কারণ হয়ে রয়েছে ক্রোনি ক্যাপিট্যালইজম বা স্যাঙাতি পুঁজিতন্ত্র। মোদী সরকার তাদের ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের নানা বৈধ-অবৈধ সুবিধা দেয়, আবার ঐ পুঁজিপতিরাও ইলেক্টোরাল বন্ড এবং অর্থ প্রদানের অন্যান্য রূপে বিজেপির ভাঁড়ারে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢালেন। আদানি সম্পর্কে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টেও বলা হয়েছে যে, “কার্যত কোনো ধরনের আর্থিক নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতির কারণেই” মরিশাসের মতো করের বিপুল সুবিধা থাকা দেশগুলো থেকে অনামি কোম্পানিগুলো আদানির কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ ঘটিয়ে সেগুলোর শেয়ারের দামকে বাড়িয়ে তুলেছে, ২৫ শতাংশ শেয়ার কোম্পানি ও তাদের মালিকদের পরিবারের বাইরে রাখার নীতির লঙ্ঘন ঘটিয়েছে। এই পুঁজিপতি-রাজনীতি গাঁটছড়ার মধ্যেই, সারা ভারতে গুজরাট মডেল প্রয়োগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ব্যাঙ্কের অর্থ লুন্ঠনের নির্ধারক শর্ত। মোদী সরকার ক্ষমতায় থাকবে আর বিজেপি ঘনিষ্ঠ ঋণগ্ৰহীতারা ঋণ পরিশোধে তৎপর হয়ে উঠবে তা নিছকই আকাশকুসুম কল্পনা। কিছুদিন আগে জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক দুর্নীতি সম্পর্কে মোদীর মনোভাব নিয়ে একটা কথা বলেছিলেন — নিজেকে দুর্নীতি-বিরোধী যোদ্ধা রূপে জাহির করার চেষ্টা করলেও মোদী দুর্নীতিকে প্রকৃতই ঘৃণা করেন না। দুর্নীতিতে বিজেপির নেতারা জড়িত থাকলে চোখ ফিরিয়ে রাখাতেই তিনি অভ্যস্ত। আরবিআই’এর এই নির্দেশিকার ভিত্তিতে যে সমস্ত ঋণ খেলাপি বকেয়া ঋণের সামান্য অর্থ শোধ করে ঋণ পুরো পরিশোধ না করার অপরাধ থেকে মুক্ত হবেন, তাদের পরিশোধ না করা ঋণের একটা অংশ যে বিজেপির তহবিলে যাবে না, সে কথা কেউই হলফ করে বলতে পারবেন না! 

nation-wantsnation-wants-to-know

রাত নটার প্রাইম টাইমে কেন্দ্রের শাসক দলের এক পেটোয়া সঞ্চালক একটি বিশেষ ইংরাজি টিভি চ্যানেলে অতীতের রাজা বাদশাদের মতো এক মধ্যযুগীয় দরবারের আয়োজন করেন। তিনি তাঁবেদার সাঙ্গপাঙ্গদের সহযোগিতায় পলকের মধ্যে একটি হিংস্র গ্যাং তৈরি করেন, মাঝেমধে হুঙ্কার ছাড়েন ‘দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো’ এবং বিরোধী স্বরকে ব্যক্ত করার কোন সুযোগ না দিয়ে সেগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেন। এই ধরনের সার্কাসে যে কথাগুলি উল্লসিতভাবে শ্রোতাদের শোনানো হয় তা হল ভারত হচ্ছে ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’ এবং বলাই বাহুল্য সেখানে বাক স্বাধীনতা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।

মে ২০২১, ট্যুইটার অফিস দিল্লী, গুরগাঁও। দিল্লী পুলিশ কোম্পানির দুটি অফিসে হানা দেয়। তাদের অভিযোগ ঐ টেক প্ল্যাটফর্ম কংগ্রেস দল সম্পর্কে বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্রর একটি ট্যুইটকে ‘ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া’ বলে চিহ্নিত করেছে। মোদী সরকার কোম্পানিকে ঐ লেবেল সরানোর হুমকি দেওয়ার দু’দিন বাদেই তাদের অফিসে পুলিশ হানা দেয়। জুন, ২০২৩ ব্রেকিং পয়েন্ট নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলে ট্যুইটারের ভুতপূর্ব সিইও জ্যাক ডরসির অভিযোগ : কৃষক আন্দোলন চলাকালীন ভারত সরকার ঐ আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন, মিডিয়ার ট্যুইট আটকে (ব্লক) দেওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অন্যথা ভারতে ট্যুইটার বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। এও বলা হয় অফিসে তালা লাগানো হবে, কর্মচারীদের বাড়ি পুলিশ হানা দেবে। ট্যুইটার ব্যবসা, মুনাফা বোঝে, ভারতের বৃহৎ বাজারের জন্য তারা লালায়িত। ঘটনা হচ্ছে তারা সরকারের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে এবং আন্দোলনরত কৃষকদের সমর্থনে বহু ট্যুইটার একাউন্টকে ব্লক করতে বাধ্য হয়। মন্ত্রীমহোদয় রাজীব চন্দ্রশেখর ডরসির বক্তব্যকে ভারত-বিরোধী চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ঘুরিয়ে তাঁর বক্তব্য সমর্থন করে বসেন যখন তিনি অভিযোগ করেন ঐ ট্যুইটার হ্যান্ডেলগুলি থেকে নাকি ভুয়ো খবর ছড়ানো হচ্ছিল, এমনকি গণহত্যার হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল।

গত দশ বছরে মোদী সরকার দেশের মূলধারার (মেইনস্ট্রিম) মিডিয়াকে নিজেদের তাঁবেদারে পরিণত করেছে। এইসব সংবাদ মাধ্যম এতোটাই বশংবদ যে লজ্জাজনক ভাবে দেশের আজ প্রায় সব প্রধান সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল গোদি মিডিয়া নামে কলঙ্কিত। কিন্তু এতো করেও তারা বিরোধী স্বরকে আটকে রাখতে পারছে না। ফেসবুক, ট্যুইটারের মতো অতিকায় টেক কোম্পানিগুলোকে তারা ধমকে চমকে দাবিয়ে রাখছে। কিন্তু ইউটিউবাররা তো ধামাকা লাগিয়ে দিয়েছে। গ্রাহক সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায় যে এঁদের জনপ্রিয়তা উর্ধ্বগামী। (ধ্রুব রাঠির গ্রাহক ১১৪ লক্ষ, রাভিশ কুমার ৬৩ লক্ষ, করন থাপার ৪৬ লক্ষ, অজিত অঞ্জুম ৩৮ লক্ষ)। শাসকের কাছে এরা ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আছে ওয়্যার, নিউজলন্ড্রি, নিউজক্লিকের মতো নানা সরকার-বিরোধী অনলাইন সংবাদ প্ল্যাটফর্ম। তাই শুধু মূলধারার মিডিয়াকে পকেটস্থ করলেই হচ্ছে না, সব ধরনের সোশ্যাল মিডিয়াকে পদানত করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। চুলোয় যাক বাক স্বাধীনতা! তাই আজ শ্রোতাদের পাল্টা প্রশ্ন করা আবশ্যক, দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো, কেন বিরোধী স্বরকে দমন করা হচ্ছে, কেন সরকারের কোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করলেই তাদের অফিসে ইডি, আইটি হানা হচ্ছে, কেন প্রতিবাদী সাংবাদিকদের হেনস্থা, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, কেন দেশের সমস্ত সংবাদ মাধ্যমকে নানা ছলচাতুরি করে শাসকের কুক্ষিগত করা হচ্ছে, এসবের উত্তর দেশ আজ জানতে চায়।

এই সমস্ত সমাজমাধ্যমগুলিকে দমন করার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার করোনাকাল থেকে সলতে পাকানো শুরু করেছে। মহামারির প্রকোপে যখন রাশি রাশি লাশ গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে ঠিক তখনই এরা চুপিসারে বেশ কিছু জনবিরোধি আইন প্রণয়ন করেছে। এরমধ্যে একটি ছিল ইনফরমেশন টেকনোলজি রুলস, ২০২১। এর প্রধান ধারাগুলি হচ্ছে

১) যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ (৫০ লক্ষের ওপর ব্যবহারকারী) মিডিয়াকে চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার নিয়োগ করতে হবে যিনি তাঁর সংগঠন যাতে আইন মেনে চলে সেটা নিশ্চিত করবেন। তাঁর প্ল্যাটফর্মে যদি তথাকথিত দেশবিরোধী কোনো বিষয় বা ঘৃণা মন্তব্য পোস্ট হয়ে থাকে সেটার জন্য তিনিই দায়ী হবেন।

২) এই ধরনের সংগঠন সরকার বা তার কোনো এজেন্সিকে যেকোনো মেসেজের উৎস জানাতে বাধ্য থাকবে।

৩) আদালত বা কোনো সরকারি এজেন্সির যদি নির্দেশ থাকে তাহলে যেকোনো ‘বেআইনি’ মেসেজ ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে মুছে বা সরিয়ে ফেলতে হবে বা সেটা উপলব্ধ করা আটকে দিতে হবে।

প্রথমেই হোয়াটস অ্যাপ মেসেজের উৎস জানানোর নিয়মটির তীব্র বিরোধিতা করে এবং আদালতের দ্বারস্ত হয়। এই নিয়ম মানতে হলে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন (এমন একটি ব্যবস্থা যাতে অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া অন্যরা মেসেজ পড়তে পারবে না) তুলে দিতে হবে যা ব্যবহারকারীর ব্যক্তি-স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। প্রবল বিরোধিতার কারণে সরকার পিছু হটে। তৎকালীন আইটি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের মন্তব্যে মিটমাট করে নেওয়ার সুর শোনা যায়। তিনি বলেন ‘সাধারণ’ ব্যবহারকারীদের জন্য এনক্রিপশন সরানোর প্রয়োজন নেই, সাধারণ বলতে তিনি কাদের বোঝাচ্ছেন সেটা পরিস্কার নয়। এছাড়া কে নির্ধারণ করবে কোন মেসেজ বেআইনি? মৌলালিতে জমায়েত করার জন্য ফেসবুকে যদি পোস্ট করা হয় সরকার সেটাকে বেআইনি বলে দেগে দিতে পারে। সংবিধান এরকম একতরফাভাবে বেআইনি দেগে দেওয়ার অধিকার সরকারকে দেয়নি। অথচ সরকার ঠিক এটাই করছে। সম্পূর্ণ গাজোয়ারি ভাবে তারা বিবিসির তথ্যচিত্র, ‘দ্য মোদী কোশ্চেন’ দেখানো বন্ধ করে দিয়েছে। সমস্ত সমাজমাধ্যমে ছবিটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে এমনকি প্রাইভেট স্ক্রিনিংয়েও পুলিশ বা গেরুয়া গুণ্ডারা হামলা করেছে।

ডিজিটাল নিউজ পাব্লিশার্স উপরোক্ত আইনের তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন, ব্যতিক্রমী কিছু জনবিরোধি পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও, প্রেস কাউন্সিল, ন্যাশানাল ব্রডকাস্টিং স্ট্যান্ডার্ড অথারিটি সংবাদ মাধ্যমকে পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করার কাজ বহু বছর ধরে দক্ষতার সাথে করে আসছে। নজরদারি করার জন্য নতুন কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। তাঁদের অভিযোগ নতুন আইন সংবিধান ও ২০০০ সালের আইটি আইন লঙ্ঘন করছে। সরকার সম্পূর্ণ একতরফাভাবে ঐ আইন প্রণয়ন করেছে। অন্য হিস্যাদারদের সাথে কথা বলার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। এটা অভুতপূর্ব! অতীতে কোনো সরকার এরকম একতরফাভাবে কোনো আইন প্রণয়ন করেনি।

সরকার সমস্ত ধরনের বিরোধিতা উপেক্ষা করে এবং শুধু এটাই নয় ২০২২’র অক্টোবরে উপরোক্ত আইন আরও কঠোর করে। নতুন সংশোধন অনুযায়ী সরকার ফেসবুক, ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি কোম্পানিগুলিকে যেকোনো একাউন্ট সাসপেন্ড, ব্লক, সরিয়ে ফেলার জন্য নির্দেশ দিতে পারে। এছাড়া ব্যবহারকারীদের যেকোনো অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এখন তিন সদস্যের একটি গ্রিভ্যান্স এপিলেট কমিটি গঠন করেছে। এই সদস্যরা সকলেই সরকার দ্বারা নির্বাচিত। যেকোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে এই কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং টেক কোম্পানিগুলি তা মানতে বাধ্য। অর্থাৎ শেষ কথা এখন থেকে সরকারই বলবে।

ট্যুইটারের নতুন সিইও এলন মাস্কের দেয়াল লিখন পড়তে অসুবিধা হয়নি। ভারতে তাঁদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় দু-কোটি। তিনি বলেই দিয়েছেন ভারত সরকারের নির্দেশ তিনি মেনে চলবেন কারণ তিনি চান না যে তাঁর কর্মচারীদের কারাবাস করতে হয়। চতুর মাস্ক মোদ্দা যে কারণ, বাজারের কথাটা চেপে গেছেন। এটা ধরেই নেওয়া যায় যে মাঝেমধ্যে কিছু খটাখটি হলেও আন্তর্জাতিক টেক সংস্থাগুলি বাক-স্বাধীনতা নিয়ে বাগাড়ম্বর করবে, কিন্তু আইন মান্য করে সরকারকে সন্তুষ্ট রাখবে। বিজেপির আইটি সেল তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভুয়ো খবর বা ঘৃণা ভাষণের সুনামি সৃষ্টি করলেও তারা না দেখার, না জানার ভান করবে। ফেসবুক ইন্ডিয়ার প্রধান আঁখি দাসের ভূমিকা স্মরণ করুন।

কিন্তু এই নতুন আইনের কারণে দেশের ইউটিউবার, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিকে উত্তরোত্তর কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। স্বাধীন সাংবাদিকদের হেনস্থা করা হচ্ছে। সরকার-বিরোধি মিডিয়া সংস্থাগুলির অফিসে ইডি, আইটি, সিবিআই নিয়মিত হানা দিচ্ছে। এমনিতে মোদী জমানায় প্রেসের স্বাধীনতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ২০২৩’র গ্লোবাল প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুযায়ী ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জানাচ্ছে সাংবাদিকদের সুরক্ষার নিরিখে ভারত বিশ্বের পাঁচটি সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের মধ্যে একটি। তুচ্ছ কারণে সাংবাদিকদের যত্রতত্র হেনস্থা করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ এই ক্ষেত্রে অনন্য। একটি স্কুলে মিড-ডে-মিলে রুটি আর নুন দেওয়া নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে পবন জয়সয়াল নামে সাংবাদিককে পুলিশ বিভিন্ন ধারায় অভিযুক্ত করে। ঐ রাজ্যেই সঞ্জয় রাণা’কে গ্রেপ্তার করা হয় কারণ তিনি মাধ্যমিক শিক্ষামন্ত্রী গুলাব দেবিকে তাঁর নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে প্রশ্ন করার জন্য দৈনিক ভাস্করের সাংবাদিকের চাকরি চলে যায়। সিদ্দিক কাপ্পানের কেস তো আমরা জানিই, বিনা অপরাধে তাঁকে দু’বছরের অধিক কারাবাস যাপন করতে হয়। রাজ্য সরকারের কোভিড পলিসির সমালোচনা করার জন্য গুজারাটের একটি ওয়েবসাইটের সম্পাদক ধবল প্যাটেলকে সিডিশন আইনে অভিযুক্ত করা হয়। মণিপুরের সাংবাদিক কিশোরচন্দ্র ওয়াংখেমকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এনএসএ-তে অভিযুক্ত করা হয়, কারণ তিনি লিখেছিলেন যে গোবর দিয়ে কোভিডের চিকিৎসা করা যায় না। একজন আন্দোলনকারী কৃষকের মৃত্যু রিপোর্ট করার কারণে ওয়্যার, ক্যারাভ্যান ইত্যাদি সংস্থার সম্পাদকদের সিডিশন আইনে অভিযুক্ত করা হয়। কাশ্মীরে তো সাংবাদিকতা শুধুমাত্র আবহাওয়ার হালহকিকত নিয়ে লেখার স্তরে নেমে এসেছে। বহু বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।

মনে রাখতে হবে ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন। সংবাদ মাধ্যমগুলিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে। মে মাসে হয়ে যাওয়া তুরস্কের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। ভারতের মতো তুরস্কের মূলধারার মিডিয়া পুরোপুরি সরকারের তল্পিবাহক, ৮৫ শতাংশ প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নিয়ন্ত্রণে। সেখানেও দেশের অন্যতম বৃহৎ মিডিয়া গ্রুপ এরদোগানের ঘনিষ্ঠ ধনকুবের নানা ছলচাতুরি করে করায়ত্ত করে নিয়েছে, ঠিক যেভাবে এখানে আদানি এনডিটিভিকে প্রায় জবরদস্তি দখল করে নিয়েছে। দেখা গেছে পয়লা এপ্রিল থেকে পয়লা মে’র মধ্যে ঐ দেশের সরকারি মিডিয়া টিআরটি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নির্বাচনী প্রচারের জন্য তাঁর প্রধান বিরোধী কেমাল কিরিচদারোগলুর চেয়ে ৬০ গুণ বেশি সময় দিয়েছে। নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগে ঐ মিডিয়ায় এরদোগান তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেড় ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রবল আক্রমণ করে কিন্তু কিরিচদারোগলুকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না। নিরুপায় হয়ে বিরোধী প্রার্থিরা সোশ্যাল মিডিয়ার শরণাপন্ন হয়। কিন্তু দেখা গেছে ট্যুইটার, ফেসবুক, ইউটিউব পুরোপুরি সরকারি প্রচার চালানোতে সাহায্য করেছে। ইন্টারনেটের ওপর তুরস্ক সরকারের প্রায় একছত্র ক্ষমতা। গতবছর আইটি আইন সংশোধন করে সেই ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’এর তুরস্ক প্রতিনিধি এরল অন্দেরগ্লুর মতে তুরস্কের নির্বাচনে মিডিয়ার সাহায্যে ব্যাপক রিগিং করা হয়েছে যার ফলে মানুষ কোনো গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।

ভারতের সাথে কী অদ্ভুত মিল পাওয়া যাচ্ছে না? মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব করে এমন যে কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, তারস্বরে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করতে হবে, দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো। সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়াকে যেকোনো উপায়ে শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে হবে। 

- সোমনাথ গুহ

out-from-yourselffrom-yourself

১৮ জুন সুভাষগ্রামের দেবীবরণ হলে অনুষ্ঠিত হল এক পরিপূর্ণ স্মরণসভা। অবিভক্ত বাংলার বগুড়া শহরে জন্মে সুভাষগ্রামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ৯১ বছরের কমরেড বাণী ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন সমস্ত পার্টির কাছে মাসীমা। এই মা ছিলেন সারা জীবন ধরে একটা ব্যাঙ্কের মত যার কাছে সবাই অনুভূতি, আবেগ, সম্মান ও দুঃখ কষ্ট জমা রাখত, এবং বিনিময়ে পেত তাঁর অফুরান ভালবাসা। এ সম্পদ কোনোদিন ফুরোবার নয়। পূর্ণ সভাগৃহে সেদিন কে আসেননি? সুভাষগ্রামের প্রতিবেশীরা থেকে শুরু করে আত্মীয় পরিজনেরা, পুত্র দীপঙ্করের প্রাইমারী স্কুলের থেকে শুরু করে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের সহপাঠী বন্ধুবান্ধবেরা, এলাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক, ব্যাঙ্ক কর্মচারী থেকে শুরু করে মাসীমার গুণমুগ্ধ অসংখ্য মানুষেরা, পার্টি কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। ছিলেন বিশিষ্ট গায়িকা মৌসুমী ভৌমিক, তিনি কীর্তন সঙ্গীতের বিরহ বিষাদের মুর্চ্ছনা পরিবেশন করেন। এছাড়াও জাগরণের সংগীত পরিবেশন করেন মেহুলী চক্রবর্তী, মীরা চতুর্বেদী, নীতীশ রায়। সঞ্চালনায় ছিলেন নাতনী শর্মিষ্ঠা। দীর্ঘদিন মাসীমার পরিবারে একাত্ম হয়ে, নিত্যানন্দ ঘোষ সুরটা বেঁধে দেন তাঁর আন্তরিক উচ্চারণ দিয়ে। তাই তিনি ঘটনাবহুল জীবনের প্রাথমিক পর্ব নিয়ে শুরু করলেন।

মাসীমার জন্ম হয় এখনকার বাংলাদেশের বগুড়া শহরে। ১৯৫০এ তাঁরা বালুরঘাটে চলে আসেন। মেসোমশাই এনএফ রেলে কাজ করতেন। আলিপুরদুয়ার থেকে গৌহাটি ছিল তাঁর এক্তিয়ার। কমরেড দীপঙ্করের জন্ম হয় অসমের গৌহাটিতে। মাসীমার দাদু বেনারসে ন্যায়রত্ন করে বৃন্দাবনে আশ্রম স্থাপন করেন। ১৯৮৪ সালে এক মামার উদ্যোগে সুভাষগ্রামে বাড়ি পত্তন হয়। তারপর থেকে নিত্যানন্দ সংসারেরই একজন হয়ে ওঠেন। নিত্যানন্দের কথায়, মাসীমা দেশভাগের তিক্ততাকে অতিক্রম করে জাতিবিদ্বেষ ও সংস্কারের সংকীর্ণতাকে অনায়াসে ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। ওদিকে পুত্র দীপঙ্কর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ক্লাস এইটে ভর্তি হলেন। উচ্চ মাধ্যমিকে শীর্ষস্থান অধিকার করে আইএসআই’তে এমস্টাট করে পার্টির হোল টাইমের হলেন। মাসীমা তাঁকে কোন বাঁধা দেননি। প্রতিষ্ঠিত উপার্জন থেকে অনিশ্চয়তার জীবন। অন্যদিকে, মাসীমা কিন্তু নিজ সংসারে কাজের মেয়ে সাবিত্রীর দুই ছেলেকে শিক্ষিত করে বড় করে তুলছেন। মেসোমশাই ২০০৭-এ ক্যান্সারে মারা গেলেন। সেই কঠিন সময়ে নিত্যানন্দ মাসীমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কমরেডরা বাড়িতে এলে মাসীমা সবাইকে আদর যত্ন করতেন। জাতপাতের বিচার কোনদিন করেননি। অথচ পুজো আচ্চা করতেন। ধার্মিক ছিলেন। প্রতিবেশীদের জন্য যতটা পারতেন করতেন। সামান্য পেনশন পাওয়া সত্ত্বেও ছোট বাচ্চাদের জন্মদিনে বই উপহার দিতেন। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, লীলা মজুমদার ইত্যাদি, সাপ্লাই দিতেন নিত্যানন্দ। কে কী পড়ছে বা পড়ছে না, সব খবর রাখতেন। অগ্রণী মানুষের যা করার দরকার তাই করতেন। পার্টির কাগজপত্র, বিশেষ করে ছেলের লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। আজকালের শব্দজব্দ নিয়মিত করতেন। শ্রুতিধরও ছিলেন। একবার নিত্যানন্দ গাঙ্গুলিবাগানের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন, মাসীমা প্রায় জোর খাটান যে তাঁকে সুভাষগ্রামে এসে থাকতে হবে। প্রায় দত্তক সন্তানের মত।

stand-out

তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দীপঙ্কর আফসোস করলেন, মাসীমা বেশি দ্রুত চলে গেলেন। পার্টি কংগ্রেস চলাকালীন অসুস্থতা ছিল। চলে যাবার পর তাঁর শূন্যতা এত ব্যাপকভাবে দেখা দিল যে তাঁর সম্পূর্ণতা কতটা প্রসারিত ছিল তা বোঝা যায়। ১৩ বছর বয়েস পর্যন্ত তিনি মা’কে পেয়েছেন। প্রথমে নরেন্দ্রপুর তারপর আইএসআই। মা’র স্নেহ সব সময়ই ছিল যা একান্ত ব্যক্তিগত, অথচ তাঁর মা ছিলেন ভীষণ সামাজিক। সমাজকে চিনতে পারার প্রথম পাঠ তিনি পান তাঁর মা’র কাছেই। সবাইকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। কিন্তু কখনই আঁকড়ে ধরতেন না, বরং এগিয়ে দিতেন। এটাই মা’র চরিত্রের বিশেষ দিক। তিনি বলেন, “মা’র মতো আমরাও কলকাতা ভাল চিনতাম না। ছুটিতে কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার আত্মীয়র বাড়ি বড়োজোর বহরমপুর। মা কিন্তু এককভাবে অসুস্থ বাবাকে অচেনা কলকাতায় থেকে তাঁকে সুস্থ করে নিয়ে গেছেন। এমনই কুশলতা ছিল তাঁর।” সুভাষগ্রামের প্রায় কেউ দীপঙ্করকে চিনতেন না। কিন্তু মাসীমাকে সবাই চিনতেন। পার্টির থেকে তিনি সান্মানিক সদস্যপদ পেয়েছিলেন, এতে তিনি বেজায় খুশি ছিলেন। কোভিড বা আম্ফানের সময় তাঁর নিয়মিত অবস্থান ছিল রাস্তার ধারের জানালা। জনে জনে পথ চলতি মানুষকে জিজ্ঞেস করছেন কার পরীক্ষা কবে, চাকরির কিছু হল কিনা, মেয়ের শরীর এখন কেমন ইত্যকার কথা। মাসীমা ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু তাঁর ধর্মে কোন আনুষ্ঠানিকতা থাকত না, না কোন বিদ্বেষ, না কোন তিক্ততা। এখন তো ঘৃণা আর বিদ্বেষ একটা ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। অথচ মাসীমা ছিলেন অত্যন্ত উদার। প্রয়োজনে তিনি সবার। কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা, কার নামে অল্প পেনশন থেকে এফডি করা, কাকা নীলুর মৃত্যুর পর নির্মল হৃদয়ের সমস্ত আবাসিকদের খাইয়ে দেওয়া কত কি? বলে শেষ করা যাবে না। অন্যদিকে মাসীমার ঔদার্য ছিল শিক্ষণীয়, জাতপাতের উর্ধ্বে।

অসুস্থতার সময়ে কত ছাত্রছাত্রী কমরেড তাঁর বিছানার পাশে রাতের পর রাত জেগে থেকেছেন। মৌসুমী সহ আর সবাই তাঁর টানেই ছুটে এসেছেন সভায়। যেভাবে তিনি জীবন ও মূল্যবোধ যাপন করে প্রকাশ করেছেন তাঁর থেকে পরের প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। মাত্র দু’তিন বার তামিলনাডু তিনি গেছেন কিন্তু তাঁর ভাষা না জানা কোনো ওয়াল হয়ে দাঁড়ায়নি। তারা বারবার মাসীমার খোঁজ নিতেন। এত ঘনিষ্ঠতা তাদের সাথে ভাবা যায় না। সেদিনের সভায় আরো এসেছিলেন এলাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক, ব্যাঙ্ক কর্মচারী থেকে শুরু করে দীপঙ্করের সহপাঠী প্রত্যেক স্তরের বন্ধুবান্ধবরা, মাসীমার গুণমুগ্ধ মানুষজন। পার্টি কর্মী, নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন বর্ণালী রায়, মীনা পাল ও সহপাঠী বন্ধুরা। মাঝে মাঝে সুরের ধারায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেন মেহুলী, মীরা চতুর্বেদী ও নীতীশ রায়। সকলেই মাসীমার জীবনের বিভিন্ন উজ্জ্বল দিকগুলি তুলে ধরেন। তাঁর আন্তরিকতা, একাত্মতা, ভালোবাসা, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ অনুরাগের কথাও বলেন। দীপঙ্কর মনে করিয়ে দেন, সকলকে আপন করে নেওয়া এবং অন্যের মধ্যে বেঁচে থাকার এক উজ্জ্বল নিদর্শন ছিলেন তিনি। এক কঠিন সময়ে এভাবেই আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তিনি। তাহলে কী তিনি ম্যাক্সিম গোর্কি’র কালজয়ী মা অথবা রবীন্দ্রনাথের সেই মা যাকে দেখে লিখেছিলেন,

তার চেয়ে মা আমি হব মেঘ 
তুমি যেন হবে আমার চাঁদ 
দুহাত দিয়ে ফেলব তোমায় ঢেকে 
আকাশ হবে এই আমাদের ছাদ।

কিংবা শামসুর রাহমানের মা’র মতো যিনি সব গান কাঠের সিন্দুকে বন্ধ করে রেখেছেন আজীবন, অথবা হুমায়ুন আজাদের মা’য়ের মতো ধানক্ষেতে বিছিয়ে আছেন আজো তাঁর অশ্রুবিন্দু গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত টলমল করে? অথবা সব মিলিয়ে? সেই আমাদের যৌথ মা?

- অসিত টুডু

===***===

খণ্ড-30
সংখ্যা-20