কর্ণাটক রায় ২০২৩ : বার্তা এবং শিক্ষা
messages-and-lessons

কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এক মধুর বিস্ময় হয়ে উঠেছিল, এমনকি তাদের কাছেও যারা বিজেপির পরাজয়ই আশা করেছিলেন। কর্ণাটক রায়ের তাৎপর্য নিহিত আছে, কংগ্রেসের জয় ও বিজেপির পরাজয়ের বিশালত্বে এবং বিজয় অর্জনের পরিস্থিতিতে।

কর্ণাটক ছিল মোদী জমানার বিপুল ঢক্কানিনাদিত ‘ডবল ইঞ্জিন’ মডেলগুলির একটি। বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্যটি গেরুয়া বাহিনীর ধ্বংসাত্মক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর এক আদর্শ গবেষণাগার এবং ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির দক্ষিণী রঙ্গালয় হিসেবে সঙ্ঘের প্রশিক্ষণাধীনে রয়েছে। তীব্র সাম্প্রদায়িক উল্লাসধ্বনি আর তার সঙ্গে শ্রোতাদের তাতিয়ে তোলার জন্যে নরেন্দ্র মোদীর বারংবার বজরংবলীর জয়ধ্বনি উচ্চারণ — সব মিলে বিজেপির নির্বাচনী প্রচার সত্যিই হয়ে উঠেছিল অনায়াস জয়ের লক্ষ্যে এক ঝটিকা অভিযান। ‘গোদী মিডিয়ার’ চ্যানেলগুলো আমাদের বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল, বজরংবলীর জয়ধ্বনি আর মোদীর রোড-শো প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সব চিহ্ন মুছে সাফ করে, নির্বাচনটাকে একেবারে সন্দেহাতীতভাবে বিজেপির অনুকূলে নিয়ে যাবে।

গোটা নির্বাচনী মরশুম জুড়ে ভোট বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষা এবং অবশ্যই বুথ ফেরত সমীক্ষা অন্য গল্পই শুনিয়ে এসেছে। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং দুর্নীতি, নির্বাচনী ইস্যু হিসাবে জনপরিসরের চর্চায় সবচেয়ে সামনে উঠে এসেছে। উন্নয়ন নিয়ে বিজেপির লম্বা চওড়া সব দাবিকে নস্যাৎ করে সমীক্ষাগুলোতে গরিব মেহনতি মানুষের বাড়তে থাকা ক্রোধই ধরা পড়েছে। টিকিট বিতরণ নিয়ে বিজেপিতে বড় মাপের বিদ্রোহ, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রীসহ বেশ কিছু হাই-প্রোফাইল বিজেপি নেতার দল ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া এবং দুর্নীতিগ্রস্ত এক ক্ষুব্ধ মন্ত্রীকে শান্ত করতে মোদীর ব্যক্তিগত ফোন — সবকিছুই এই ধারণাকে পোক্ত করেছে যে বিজেপি হারতে চলেছে।

ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে, একমাত্র বেঙ্গালুরু ছাড়া কর্ণাটকের সব অঞ্চলেই বিজেপি আসন হারিয়েছে। বিজেপির তীব্র তীক্ষ্ণ উচ্চগ্রামের সাম্প্রদায়িক প্রচার সত্ত্বেও, এমনকি কর্ণাটকের উপকূল অঞ্চলেও ভোট এবং আসন দুই-ই কমেছে, যেটি সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণপ্রবণ অঞ্চল। বিজেপির ভোট-শেয়ার মোটামুটি একই আছে যেমনটা ২০১৮-তে ছিল — ৩৬ শতাংশের আশেপাশে। কিন্তু একটু তীক্ষ্ণ নজরে দেখলে ধরা পড়বে বিজেপির ভোট অনেকটাই কমেছে যেটা খানিক পুষিয়ে দিয়েছে বেঙ্গালুরু এবং মহীশূর অঞ্চলে বিজেপির পাওয়া বাড়তি ভোট। বিপরীতে, কংগ্রেসের অর্জিত সাফল্য কিন্তু সব অঞ্চল ও বিভিন্ন সামাজিক বর্গের মধ্যে একইরকম, বিশেষ করে তারা উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়েছে তফসিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া বর্গ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, মহিলা এবং গ্রামীণ ও মফঃস্বলের যুব সমাজের ভোটারদের।

বিজেপির কর্ণাটক বিপর্যয়কে নিছক একটি রাজ্যের সরকার পরিবর্তনের প্রথাগত নকশার নিশ্চিত স্বীকৃতি হিসেবে দেখলে হবে না। বস্তুত, দলটি, অনেক রাজ্য যেখানে এটি তথাকথিত ‘প্রতিষ্ঠান-মুখী’ হাওয়ার সওয়ার বলে জাঁক করে বলে থাকে, সেখানে নিজেই এই নকশা পাল্টেছে বলে দাবি করে। যদিও প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যভিত্তিক একটা নির্দিষ্ট প্রেক্ষিত থাকে, অতি-কেন্দ্রিকতা ও ব্যক্তিপূজার মোদী জমানায় বিজেপির ছকে প্রতিটি নির্বাচন হয়ে ওঠে ২০১৪ পরবর্তী মোদী জমানার ভোট। কর্ণাটকে, এই নির্বাচনে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ ব্রাত্য রেখে গোটা নির্বাচনী প্রচারের সরাসরি দায়িত্ব নিয়েছিলেন মোদী-শাহ-নাড্ডা ত্রয়ী এবং কড়া হিন্দুত্বের আইকন যোগী আদিত্যনাথ অথবা হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তাই কর্ণাটকের রায়কে, ২০২৪’র বিরাট লড়াইকে সামনে রেখে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে কোনোমতেই বিচ্ছিন্ন করে দেখা যাবে না।

তাহলে, দেশ যখন বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের এবং ২০২৪’র নির্ণায়ক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, কর্ণাটক নির্বাচন থেকে কী প্রাপ্তি? তথাকথিত ‘মোদী ম্যাজিক’ এবং অমিত শাহের নির্বাচন পরিচালনার রণকৌশল ঘিরে তৈরি হওয়া বিজেপির নির্বাচনযন্ত্রের কল্পিত অপরাজেয়তার অতিকথা, উপকারভোগীদের তথাকথিত নতুন শ্রেণির আনুগত্যের লোককথা আর সঙ্ঘ বাহিনীর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের স্বতন্ত্র্যচিহ্নিত রণকৌশলের প্রাণঘাতী কার্যকারিতার অমোঘতা — সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে কর্ণাটকে। একথা বলার মানে এই নয় যে, কর্ণাটকের রায়ের অবিকল প্রতিরূপ অন্য রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বা এক বছরের মাথায় অনুষ্ঠেয় দেশের লোকসভা নির্বাচনে নিজে থেকেই তৈরি হয়ে যাবে; তবে কর্ণাটক অবশ্যই দেশ জুড়ে অনুরণন তৈরি করবে।

কর্ণাটকে কংগ্রেসের প্রচারে ছিল সুচিন্তিত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জোর, ছিল প্রাণবন্ততা। যথেষ্ট আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল; ‘ভারত জেড়ো যাত্রা’ শুধু কংগ্রেসের সংগঠনকেই উদ্দীপ্ত করেনি, বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আম জনতার আশা আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছার চেহারাটা তুলে ধরতে সহায়তা করেছে, যা কোনোভাবেই বিজেপির হাই-ভোল্টেজ প্রচারে দিশা বা মনোবল হারায়নি। বরং খানিকটা, দু’বছর আগে বাংলার ‘নো ভোট টু বিজেপি’র ধাঁচে কর্ণাটকেও প্রগতিশীল শক্তি ও নাগরিক সমাজের উদ্দীপ্ত প্রচার চোখে পড়েছে — ‘বহুত্ব কর্ণাটক’ (কর্ণাটক রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরার একটি প্রচার মঞ্চ) এবং ‘এড্ডেলু কর্ণাটক’ (বিজেপি এবং তার সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে পরাস্ত করার আহ্বান রেখে একটি সচেতনতা প্রচার অভিযান)-এর মতো মঞ্চের উদ্যেগে। এই প্রচার বিজেপিকে ভোটে হারানোর ইচ্ছাকে প্রবল সমর্থন ও উৎসাহ যুগিয়েছে। এই গণপ্রচার এমনকি নির্বাচন সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ অভিমতকেও প্রভাবিত করেছে এবং নির্বাচনের সব চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষাগুলির একটি তৈরি করে দিয়েছে।

এত বড় মাপের পরাজয়ে সঙ্ঘ বাহিনীর আঘাতটা বেশ গুরুতরই হয়েছে আর তাই আগামীদিনে তার আক্রমণ তীব্রতর হতে বাধ্য। কিন্তু কর্ণাটকের ফলাফল প্রতিটি গণতন্ত্রপ্রেমী নাগরিককে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা প্রতিটি আন্দোলনকে এবং সংবিধান ও সংসদীয় গণতন্ত্রের একেবারে বুনিয়াদি শর্তগুলোর ক্রমবর্ধমান বিপন্নতার প্রগাঢ় ভয়াবহতা নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন তথা প্রতিবাদী, বিরোধী রাজনীতির সেই সমস্ত শাখাও অনুপ্রাণিত হয়েছে। কর্ণাটক মোদী ভজনা এবং হিন্দুত্ববাদী প্রচারের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে দিয়েছে। কর্ণাটকে মোদীর নিজের কৃতকর্মের দায় অন্যের ওপর চাপানোর চিরাচরিত বদভ্যাস এবং মুহুর্মুহু বজরংবলীর জয়ধ্বনির আচ্ছামতো মুখ পুড়েছে। গণতান্ত্রিক বিরোধী শক্তির শঙ্কিত হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না, বরং তাদের বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে, মানুষের কল্যাণ ও অধিকারের জন্য অপরিহার্য শর্তগুলিকে আরো জোরে সঙ্গে তুলে ধরা এবং বহুত্ববাদী সমাজের সমন্বয়ে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আগামী ভারতের জন্য আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃঢ়পায়ে এগিয়ে যেতে হবে। কর্ণাটকে বিজেপির জোরালো হার সঙ্ঘ বাহিনী-বিজেপির ভয়, ঘৃণা আর ধ্বংসের রাজত্বের শেষের শুরু হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাক!

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৬-২২ মে ২০২৩

খণ্ড-30
সংখ্যা-16