আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী-ছাত্রদের জন্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন
film-screening
“অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাবো আশীর্বাদ … …”

২৮ এপ্রিল ২০২৩ আমরা সোদপুর, দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যাপীঠে ছাত্রীছাত্রদের জন্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেছিলাম। খুব প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে, সবাই জানিয়েছেন, আমরা সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা যখন আগরপাড়ায় জেলাসভায় ব্যস্ত ছিলাম, তখন আগের সিনেমা প্রদর্শনের সূত্র ধরে ব্যারাকপুর, নোনাচন্দনপুকুর উমাশশী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, অভিজিৎ ঘোষ মহাশয় বিদ্যালয়ে সিনেমা দেখানোর জন্য যোগাযোগ করেন। অনেক কৌতুহলের মধ্যে তিনি প্রশ্ন করেন, কেন এই উদ্যোগ। আমরা বলি, কোভিডে অতিমারীর সময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রীছাত্রদের শিক্ষা ও তাদের অবচেতন মন। আজ চারিদিকে মানুষে মানুষে হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভাজন বেড়েই চলেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ছাত্রীছাত্রদের মন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানারকম অনায্য কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রীছাত্রদের মন। মানুষ নিজেদের হাতেই গাছ-জঙ্গল কেটে, জল-বায়ু দূষণ করে, পুকুর ভরিয়ে, পাহাড় ফাটিয়ে ধ্বংস করছে পরিবেশকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রীছাত্রদের, শিশুদের মন‌। শিশুদের স্বপ্নের ডানা মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৭ মে ২০২৩ প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের ডাকে আমরা, মানে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সংগঠন ‘স্টিল এন্ড মুভি প্ল্যাটফর্ম’ ও ‘সিনেমা অফ রেজিস্ট্যান্স’এর কর্মীরা হাজির হই নির্দিষ্ট শিক্ষা অঙ্গনে। সমস্ত টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। প্রর্দশনের জন্য সবকিছু ব্যাবস্থা হয় ও ১৮ মে ২০২৩ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীছাত্রদের সিনেমা দেখানোর সিদ্ধান্ত হয়। আমরা জানাই, বিশ্বের বহু বিখ্যাত পরিচালকদের শিশু মনোপযোগী সিনেমা নিয়ে আমরা হাজির হবো।

আমরা ১৮ মে ২০২৩ সদলবলে সিনেমার ঝুলি নিয়ে যথা সময়ে হাজির হই। সবধরনের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো ঠিকঠাক করে, বেলা সাড়ে বারোটা থেকে ছাত্রীছাত্র, অভিভাবক, শিক্ষিকা-শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মচারীসহ একশো দর্শকদের সামনে সিনেমা দেখানোর ব্যাবস্থা হয়। প্রধান শিক্ষক মহাশয় আমাদের শুরু করতে বলেন। আমাদের অন্যতম কর্মী মৃত্যুঞ্জয় দে অনুষ্ঠানের ফটো তোলার কাজে ব্যাস্ত থাকেন। স্বস্তিকা সিনেমা স্ক্রিনিং’এর কাজে পেশাদারী মনোভাবে নিয়োজিত থাকেন। আমরা কারা, কেন আমরা স্কুলে স্কুলে সিনেমা দেখাই, এবিষয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সাগর চ্যাটার্জী। দেবলীনা পরিচালিত একটি ছোট্ট মিউজিক ভিডিও ‘ছবির মধ্যে ছবি’র গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। আমরা দেখাই, আব্বাস কিয়ারোস্তমির ‘টু সলুউসন ফর ওয়ান প্রবলেম’, সত্যজিৎ রায়ের ‘টু’, একতারা কালেকটিভের ‘চান্দা কে জুতে’, নর্ম্যান ম্যাকলারেনের ‘নেইবর্স’ এবং অশ্বিন কুমারের ‘লিটল টেরোরিস্ট’ প্রভৃতি পাঁচটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। অন্যতম সংগঠক মিতালি বিশ্বাস প্রতিটি সিনেমা সম্পর্কে ছাত্রীছাত্রদের সাথে একে একে ডেকে ডেকে সজীবতার সাথে প্রশ্ন করে বিস্তারিত কথা বলেন। তিনি ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান ছোট-বড়, উঁচু-নীচ, মেয়ে-ছেলে, গরিব-বড়লোক সমাজকে বিভাজিত করেছে, কলুষিত করেছে। অন্ধকারময় সমাজকে আলো দেখাতে নতুনভাবে গঠন করতে হবে। 

এইসব বিষয় নিয়ে ছাত্রীছাত্ররাও ইতিবাচক অর্থে কথা বলতে শুরু করে। সংগঠক অশেষ চক্রবর্তী ও সাগর চ্যাটার্জী সিনেমা কেন শক্তিশালী মাধ্যম ও সিনেমা দেখানোর পর ছাত্রীছাত্রদের মনে কী কী অনুভুতি এনেছে, তা পারস্পরিক ছাত্রীছাত্রদের সাথে মুখোমুখি সংলাপে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী সোনালী নন্দী জানান, পরিবারের কারণে নাচ শেখা হল না। সোনালী অব্যক্ত যন্ত্রণায় কেঁদে ফেলেন। মিতালী ও স্বস্তিকা সোনালীকে শান্ত করে। তৃতীয় সিনেমা দেখানোর পর একটা টিফিন ব্রেক হয়। ব্রেকের পর দশম শ্রেণীর ছাত্রী প্রদীপ্তা বড়ুয়া ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটির সাথে নৃত্য পরিবেশন করেন। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী ফারহিন খাতুন, দশম শ্রেণীর ছাত্র অয়ন পাল, দেবজিৎ দত্ত, শুভম পাল, ছাত্রী ঈশা ঘোষ, পায়েল কর ও কৃষ্ণা মাহাতো বিভিন্ন ভাবে জানায় হিংসা, বিদ্বেষ, বিভাজন, অশান্তি এর একমাত্র বিকল্প ভালোবাসা দিয়ে জয় করা। তারা বলে ধর্মে-ধর্মে, জাতে-জাতে, বর্ণে-বর্ণে বিভেদ নয়, আমরা সবাই মানুষ। সমাজে নারী পুরুষে ভেদাভেদ আছে, এটাও ঠিক নয়, একথা তারা জানায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র, দেশ, রাজ্য এমনকি পাড়ায় পাড়ায় দূরত্ব ঘুচিয়ে, অভিন্ন মানসিকতা রাখার কথা তারা বলে। আমরা ‘হীরক রাজার দেশে’র একটা ছোট্ট অংশ দেখিয়ে শেষ করি। সবাই এক সাথে বলে, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’। আমরা ‘স্টীল এন্ড মুভি প্লাটফর্ম’ (পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সংগঠন) এবং ‘সিনেমা অফ রেজিস্ট্যান্স’ মিলিতভাবে ছাত্রীছাত্রদের জন্য একটা ফোল্ডার প্রকাশ করি এবং তা ছাত্রীছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করি। ছাত্র-ছাত্রীরা হাততালি দিয়ে বলে, এই ধরনের সিনেমা আবার হবে। প্রধান শিক্ষক ও সহশিক্ষকরা এবিষয়ে জানায়, তারা সহমত। আমাদের এই প্রক্রিয়ায় (প্রোজেক্টঃ সিনেমা ইন স্কুলস) স্বাধীন কল্পনার ডানায় উড়ে ছাত্রীছাত্ররা স্বপ্ন দেখুক নতুন পৃথিবীর। এই নতুন প্রজন্ম নতুন পরিবেশের রূপকারে উজ্জীবিত হোক। তাদের স্বপ্ন সত্যি হোক এই আশা নিয়ে, আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হয়। আপনাদের কাছে আবেদন, স্কুলে, পাড়ায়, শ্রমিক মহল্লায় প্রভৃতি স্থানে আমাদের নিয়ে চলুন। সিনেমার ডালি নিয়ে আমরা চলে যাবো আপনাদের কাছে।

খণ্ড-30
সংখ্যা-16