সমাজের সবচেয়ে অবহেলিতদের অধিকার ছিনিয়ে আনতে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন
marginalized-in-society

বিশ্বায়ন, উদারিকরণ, বেসরকারিকরণের পথ বেয়ে আজ দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে। ফ্যাসিবাদী এই আক্রমণে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম সময়, মজুরি, চাকুরির নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি হামলা হচ্ছে। সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর ৯৪ শতাংশ যে অসংগঠিত অংশ তারা যেন আজ ক্রমশ নেই জগতের মানুষ হয়ে পড়ছে। এরা কোনো একটা নিদির্ষ্ট পেশায় যুক্ত থাকতে পাড়ছে না। সব সময় একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। কাজের সন্ধানে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে। তাতেও দুবেলা গ্রাসাচ্ছাদন হচ্ছে না ফলে ভারত ক্ষুধার সূচকে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। জঁ-দ্রেজের কথায় নির্মাণ শিল্প শ্রমিকদের মজুরি নেগেটিভ পর্যায় চলে গেছে। অমর্ত সেন একটি নিবন্ধে যখন লেখেন দিনের উজ্জ্বল আলো ক্ষুদার্ত শিশুর কাছে আরো ভয়ঙ্কর। ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ব্যস্ততম সারাদিন কিভাবে যাপন করবে। এ কথাগুলো শুনলে ভেতরটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

সমগ্র শ্রমিকশ্রেণির এই ৯৪ শতাংশ, যা ক্রমবিকাশমান অর্থাৎ সংগঠিত ক্ষেত্রে অসংগঠিত অংশ তৈরি করা। শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে শাসকশ্রেণীর নানা গবেষণা চলছে। এদের মধ্যেই ফ্যাসিবাদের প্রভাব বৃদ্ধি হয়ে চলেছে। নানা রঙ্গের সরকার নানা রূপের সামাজিক প্রকল্পের ললিপপ ঝুলিয়ে নিজেদের অনুকূলে কিভাবে টানা যায় তারই খেলা চলছে। এই প্রকল্পের কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। সরকারের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। সরকার পরিবর্তন হলে, সামাজিক প্রকল্পগুলোও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। নয়া অর্থনীতির এটাই দস্তুর। সমস্ত ন্যায্য অধিকার কেড়ে নাও, দয়ার ওপর নির্ভরশীল সামান্য সামাজিক প্রকল্প চালু করো।

বর্তমানে দেশজুড়ে নির্মাণকান্ড চলছে। চাষ থেকে লাভ না পেয়ে এবং পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাওয়ায় শহরতলীর পঞ্চায়েত অঞ্চলের জমিগুলোর প্রতি প্রমোটারদের নজর বেশি পড়ছে। বিশেষ করে আরো বেশি মুনাফার জন্য শহর ছেড়ে পঞ্চায়েত অঞ্চলে ব্যাপক জমির লুঠ চলছে। বেআইনিভাবে জল প্রভাহকে বন্ধ করে চাষের জমিকে বাস্তু জমিতে পরিণত করা চলছে। নগরায়ন ক্রমবিকাশমান। এরসাথে বহুমূল্যবান জমি শহরাঞ্চলে হকার ও বস্তি উচ্ছেদের জন্য বুলডোজার রাজ চলছে। যদিও শহরে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকায় এই কাজে মন্থর গতি।

নির্মাণ শিল্প করোনাকালে সামান্য ধাক্কায় ছিল। এখনো ঠিক আগের পর্যায়ে ফিরে আসেনি। তা সত্ত্বেও উন্নয়নের প্রতীক হিসাবে দেশজুড়ে ছ-চার লেনের চওড়া সড়কপথ, রেললাইন, হাইরাইজ বিল্ডিং, শপিংমল, ফ্লাইওভার, ব্রীজ, বিমানবন্দর, নানারকম বিনোদন ক্ষেত্র, বেসরকারি হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ নানা রকম ঝলমলে নির্মাণকান্ড চলছে। তার সাথে চলছে নিজেদের থাকার জন্য ব্যাক্তিগত ছোট-মাঝারি বাড়ি এবং গ্রাম শহরে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা সরকারি প্রকল্প। অসংগঠিত শ্রমিকদের ৯৪ শতাংশের সবচেয়ে বড় অংশ এই নির্মাণ কাজে যুক্ত। তারা গ্রাম শহরে ছড়িয়ে আছে। বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলে বিরাজ করে। গ্রামাঞ্চলের সমস্ত শ্রমশক্তিকে চাষাবাদ ধরে রাখতে পাড়ছে না তাই দলে দলে মানুষ শহরের অভিমুখে যাত্রা করছে কাজের সন্ধানে। এদের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এদের ভালো মাত্রায় সংগঠিত করে কর্মক্ষেত্রে আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে বা যেটুকু সামাজিক সুরক্ষা টিঁকে আছে তাকে আদায় করতে হলে গ্রাম শহরের সংগঠক ও পার্টি কমিটিগুলোকে বড় উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এদের একটা বড় অংশই গ্রাম থেকে শহরে বড় বড় নির্মাণ শিল্পে যুক্ত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে এদের জেলখানার মতো ব্যারাকে রেখে দেওয়া হয়। সেখানে মস্তান-প্রমোটার-প্রশাসনের এক অশুভ শক্তির জোড়ালো উপস্থিত থাকায় এবং বেশিরভাগ শ্রমিক বহিরাগত হওয়ায় সংগঠিত হওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তাই তাদের বাসস্থানে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন। এদের ধরেই পঞ্চায়েত/পৌরসভা/নগরনিগম অঞ্চলে বড় বড় নির্মাণ শিল্পে আন্দোলন গড়ে তোলার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

বহু বড় বড় অনেক শিল্পের জিয়নকাঠি এই নির্মাণ শিল্প। তাই নির্মাণশিল্পে ১০০ শতাংশ বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশের অনুমতি দেওয়া, ব্যাঙ্কের সুদ কমানো সহ নানা ছাড় চালু করা হয়েছে। এই নির্মাণশিল্পের সাথে যে বিশাল শ্রমশক্তি যুক্ত আছে বা প্রয়োজন তাদের আন্দোলনের চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৬ সালে একটা আইন, বিধি ও রাজ্যে রাজ্যে বিধি তৈরি করে। সেই আইনি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক সুরক্ষা আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী নির্মাণ শ্রমিকরা সংগঠিত হতে থাকে, আন্দোলন গড়ে ওঠে, নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে কেস চলতে থাকে, পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটির রির্পোট পেশ করতে হতো।

সংগঠিত হওয়া এই শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত করতে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ, হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত তহবিল লুঠ করা ও কাদের নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে আইনের অধীনে আসবে তার পরিবর্তন ঘটানো হল (সামাজিক সুরক্ষা পয়সা দিয়ে কেনার কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পনা রচনা করেছে), মোদী সরকার দ্বারা রচিত নয়া ৪টি লেবার কোডে। যেহেতু সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠিত প্রতিবাদের ফলে ৪টি লেবার কোড বাস্তবায়নে সরকার কিছুটা পিছুপা, ঠিক এই সময় নির্মাণ সহ অসংগঠিত শ্রমিকদের দাবি আদায়ে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে গ্রামীণ নির্মাণ শ্রমিক থেকে বৃহৎ নির্মাণ শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করা চলবে না, বিএমএসএসওয়াই ফর্মে ট্রেড ইউনিয়নের স্বাক্ষর করার অধিকার দিতে হবে। নির্মাণ শ্রমিকদের নথিভভুক্তিকরণের জন্য পুরণ করা নথি ব্লকে জমা নিতে হবে। অন্যথায় ব্লকস্তরে (IMW) নুন্যতম মজুরি পরিদর্শকদের নির্মাণ শ্রমিকদের নথিভুক্তিকরণের অনুমোদন প্রদান করতে ই-ডিস্ট্রিক্ট আইডি পাশওয়ার্ড (e-district ID password) দিতে হবে, উৎসব ভাতা চালু করা সহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা বজায় রাখা, সারা বছর কাজের গ্যারান্টি, ন্যায্য মজুরি (দৈনিক নুন্যতম মজুরি দ্বিগুণ করে সরকারকে ঘোষণা করত হবে) কোনো অজুহাতে পেনশন প্রাপকদের অধিকার হরণ করা চলবে না, নুন্যতম পেনশন ৩ হাজার টাকা করতে হবে। বিভিন্ন দাবিতে ব্লকে নুন্যতম মজুরি পরিদর্শক (IMW), সহ শ্রমাধক্ষ্য ‘ALC’র নিকট দাবি সনদ পেশ করে সমাজের সবচেয়ে নীচুতলার, সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার সুবিশাল অংশকে সংগঠিত করার কাজে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে সরকারি ভাবে নথিভুক্ত হওয়ার যে সুবিধা আছে তাকে কাজে লাগাতে হবে যেমন — ই-ডিস্ট্রিক্ট, বিএমএসএসওয়াই এবং ই-শ্রমে (ইতিমধ্যে ই-শ্রমে ২৮ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকের নাম নথিভুক্ত হয়েছে, উত্তরপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি নথিভুক্ত হয়েছে)। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে এই ২৮ কোটি শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। নাম নথিভুক্তি করার উদ্যোগের সাথে সাথে সদস্য সংগ্রহ চলুক। ২০-৩০ হাজার সদস্য সংগ্রহ করে আগামী ৮-৯ জুলাই ২০২৩ তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে AICWF’র সর্বভারতীয় সম্মেলন সফল করার মধ্যদিয়ে একগুচ্ছ দাবি সনদ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ নেওয়া হোক। সমাজের সবচেয়ে নীচুতলার সর্ববৃহৎ অংশ, শোষিত এই মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই শাসকশ্রেণীর ভিত্তিভূমিকে কাঁপিয়ে দেবে। তাই আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজে নামি। জয়ী হোই।

- কিশোর সরকার

খণ্ড-30
সংখ্যা-16