প্রতিস্পর্ধার এক অনির্বাণ দীপশিখা
flame-of-rivalry

২৪ মে ১৯৬৭-তে বড় ঝরুজোতে শুরু হয় এক আলোড়ন তোলা অধ্যায়ের। পুলিশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে কিষাণসভার নেতৃত্বে সেখানে তখন সমাবেশিত হয়ে রয়েছেন কৃষক আন্দোলনকারীরা। চা বাগানের শ্রমিকেরা। যাদের বেশিরভাগই ছিলেন আদিবাসী ও রাজবংশী। পুলিশ বারবার এই সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু সফল হচ্ছিল না। সোনাম ওয়াংদি নামের এক অত্যাচারী পুলিশ অফিসার দলবল নিয়ে জোর করে সমাবেশ ভাঙতে আসলে তার দিকে ছুটে আসে আদিবাসীদের বিষাক্ত তীর। সোনাম ওয়াংদির প্রাণ যায় কৃষক শ্রমিক আদিবাসী প্রতিরোধে।

২৫ মে ১৯৬৭-তে সোনাম ওয়াংদির মৃত্যুর প্রেক্ষিতে পুলিশী অভিযান শুরু হয়। কিন্তু পুলিশকে কৃষক শ্রমিক আদিবাসী জনতা ঘিরে ফেলে। পুলিশ তাদের হাতে পায়ে ধরলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই অবকাশে পালিয়ে গিয়ে তারা গুলি চালায় দূর থেকে। গুলিতে আটজন কৃষক রমণী, দুজন শিশু ও এক কিশোরের মৃত্যু হয়। শহীদেরা ছিলেন ধনেশ্বরী দেবী, সীমাশ্বরী মল্লিক, নয়নশ্বরী মল্লিক, মুরুবালা বর্মন, সোনামতি সিং, ফুলমতি দেবী, সামসরি সৈবানি, গাউদ্রাউ সৈবানি, খরসিংহ মল্লিক এবং দুটি শিশু, যাদের নাম জানা যায়নি।

এরপর আন্দোলনের ঝড়ের মধ্যে দিয়ে, রাষ্ট্র ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বিকল্প ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ বাজি রেখে নামা আন্দোলনের সূত্রে অপরিচিত একটি ছোট্ট এলাকা নকশালবাড়ি অচিরেই দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত হয়ে গেল একটি আন্দোলনের সূত্রে। কিন্তু নকশালবাড়ি আজ কোনও এলাকার বা নির্দিষ্ট আন্দোলনের নাম নয়। প্রতিস্পর্ধার, লড়াইয়ের নাম হয়ে উঠেছে। দেশের যেখানেই কৃষক শ্রমিক ছাত্র দলিত আদিবাসীরা লড়ছেন, নারীরা লড়ছেন — সেখানেই আমরা নকশালবাড়িকে খুঁজে পাই।

শাসকের চোখে ইতিহাসকে দেখার যে চোখ তাকে নকশালবাড়ি বদলে দিয়েছিল। আন্দোলনের চোখে, লড়াই সংগ্রামের চোখে ইতিহাসকে দেখতে বলেছিল নকশালবাড়ি। তেভাগা তেলেঙ্গানার ধারায় দেশপ্রেমের নতুন ধারণা দিয়েছিল নকশালবাড়ি। রাষ্ট্রবাদ যেভাবে ভারতমাতার জয় বলে, সমরাস্ত্রের প্রদর্শন আর খোলা তলোয়ার নিয়ে মিছিল করে দেশভক্তির কথা বলে সেখানে জনগণ আর তাদের অধিকারের কথা নেই। নকশালবাড়ি জনগণের মুক্তির যে গান তৈরি করেছিল “মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি”, সেখানে দেশপ্রেমকে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তির সঙ্গে সমীকৃত করার কথা ছিল। নকশালবাড়ির এই আদর্শই আমাদের প্রেরণা, যা শাসকদের বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে, আঘাত করে।

তখন রাজ্যে যারা শাসক ছিলেন তারাও ভেবেছিলেন যে সদ্য ক্ষমতায় আসা সরকারের স্থায়ীত্বটাই মূল প্রশ্ন। তারাও নকশালবাড়িকে দমন করতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ শাসনের শেষে কৃষক আন্দোলনের জোয়ারেই তাদের উৎখাত হতে হয়। আবার যে তৃণমূল সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সূত্রে ক্ষমতায় এলো, তারাও ভাঙরে কৃষক আন্দোলনের কড়া চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে ক্ষমতায় ফেরার পর মোদী সরকার যে সর্বনাশা কৃষি বিল আনেন, সংসদ তাকে রুখতে না পারলেও কৃষক আন্দোলনের মাটিই তাকে আটকে দেয়। বিপুল গরিষ্ঠতার সরকার বাধ্য হয় আইন প্রত্যাহারে। কৃষকের আন্দোলন, জমির আকাঙ্ক্ষার লড়াই নকশালবাড়ির প্রেরণা ও মর্মবস্তু, যা আজও ভীষণভাবেই প্রাসঙ্গিক।

an-unquenchable-flame

নকশালবাড়ি আন্দোলনের মর্মবস্তু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পার্টির প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক কমরেড বিনোদ মিশ্র এই দেশব্রতীর পাতাতেই কলম ধরে যা লিখেছিলেন তা আজ আর একবার স্মরণ করা যাক।

“নকশালবাড়ির প্রকৃত তাৎপর্য বলতে কী বোঝায়? নকশালবাড়ির অর্থ বুনিয়াদী কৃষক জনগণের জাগরণ। সশস্ত্র কিছু স্কোয়াড দিয়ে এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত কিছু কার্যকলাপ বা কিডন্যাপের মতো চমকপ্রদ এ্যাকশন করে বেড়ানো নয়। তার অর্থ কলকাতা, দিল্লী, বোম্বেতে কফিহাউসে বসে বড় বড় বিপ্লবী বুলি আওড়ানোও নয়। নিজেদের ব্যর্থতাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী আমাদের যতই গালাগালি দিয়ে বেড়াক না কেন, সত্য এটাই যে নকশালবাড়ির ধারায় এই কৃষক জাগরণ একমাত্র ঘটছে বিহারেই এবং আমাদের পার্টিই রয়েছে তার সামনের সারিতে।

নকশালবাড়ির অর্থ এই কৃষক জাগরণের ভিত্তিতে জাতীয় রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন। স্থানীয় ভিত্তিতে কৃষকের কিছু অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া পূরণের মানেই কিন্তু নকশালবাড়ি নয়। পাহাড়ে-জঙ্গলে গিয়ে ‘লাল সেনা ও ঘাঁটি এলাকা’ গড়ে যারা বিকল্প রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তাদের সকলেই ব্যর্থ হয়েছেন। এখন সেখানে রাজনীতি বন্দুক চালাচ্ছে না, উল্টে বন্দুকই রাজনীতি চালাচ্ছে।

নকশালবাড়ি মার্কসবাদ বনাম সংশোধনবাদ, সশস্ত্র সংগ্রাম বনাম সংসদীয় পথের মধ্যকার কোনো বিমূর্ত সংগ্রামের সাফল্য নয়। পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদ কিন্তু তাই ভাবে। কাজেই সে মনে করে বিপ্লবী ভাবাবেগ দিয়ে ও কিছু মৌলিক মার্কসবাদী সূত্র দিয়ে যখন খুশি, যেখানে খুশি নকশালবাড়ি গড়ে তোলা সম্ভব। যাবতীয় নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ, তদজনিত হতাশা এবং অবশেষে উল্টো পথে যাত্রা — যার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে — এসবের পিছনে বিপ্লব সম্পর্কে মধ্যবিত্তের সেই কল্পনাবিলাসই কাজ করে।

নকশালবাড়ির শিকড় রয়েছে ভারতের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে, তার পেছনে আছে দীর্ঘ কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস, তেভাগা-তেলেঙ্গানার ধারাবাহিকতা। আছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই বিপরীতমুখী কৌশলগত লাইনের মধ্যকার দীর্ঘ সংগ্রামের প্রক্রিয়া। একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যার পরিণতি ঘটেছিল নকশালবাড়ির বিদ্রোহে। নকশালবাড়িকে বুঝতে হলে এসবই বুঝতে হবে।

মেহনতি কৃষক জনগণের জাগরণের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা হবে নাকি বুর্জোয়াদের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্তফ্রন্টের স্বার্থে কৃষক জনগণের উদ্যোগকে স্তিমিত করা হবে — এই দুই বিপরীতমুখী কৌশলের লড়াই দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল। ১৯৬৭ সালের বিশেষ এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই এই লড়াই তার চরম বিন্দুতে পৌঁছায় — যখন ক্ষমতাসীন যুক্তফ্রন্ট সরকার কৃষক আন্দোলনের ঢেউকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা এগিয়ে যান এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে।

নকশালবাড়ির পক্ষে আপোশ বা পশ্চাদপসরণ করা সম্ভবও ছিল না, উচিতও ছিল না, কারণ তা হয়ে উঠেছিল এক নতুন বিপ্লবী পথের অগ্রদূত। ইতিহাসে সর্বদাই প্রথম বিপ্লবী অভিযানগুলি চূড়ান্ত মীমাংসার দিকেই ধাবিত হয়ে থাকে এবং তাই তারা ইতিহাসও সৃষ্টি করে যায়। কৌশলগত দিকগুলির সমন্বয় সাধন করতে দুপা পিছনে সরে আসা ইত্যাদি ইত্যাদি সবই সংরক্ষিত থাকে পরবর্তী প্রচেষ্টাগুলির জন্যই।…

ইতিহাস যেমন কখনও নিজের অবিকল পুনরাবৃত্তি করে না, তেমনি একটি মহান আন্দোলনের পুনর্জন্মও তার পুরোনো রূপে আর হয় না। যে যুগে আমরা ভালোরকম অধিবিদ্যায় ভুগতাম, বছরের পর বছর পুরোনো রূপে ও পদ্ধতিতেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য কত চেষ্টাই না চালিয়েছি কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি।

কোনো সংগ্রামই সরলরেখায় চলে না। ঠিক সময়ে এগিয়ে গিয়ে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে আঘাত যেমন হানতে হয়, তেমনি প্রয়োজন হলে দুপা পেছনে সরে এসে নিজের শক্তিকে পুনর্গঠিত করতেও শিখতে হয়। যেকোনো আন্দোলন, সংগ্রাম বা যুদ্ধ এই উভয় দিককে নিয়ে গড়ে ওঠে। এই উভয় দিকের সঠিক সমন্বয় ঘটানোই হল নেতৃত্বের দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রমাণ।”

‘নকশালবাড়িঃ একাল ও সেকাল’ – বিনোদ মিশ্র (দেশব্রতী, সেপ্টেম্বর ১৯৯০ থেকে উদ্ধৃত)।

জরুরি অবস্থার পর নকশালবাড়ির রাজনীতি ও সংগঠন ধারণা এক বড় বাঁকের মুখোমুখি হয়েছিল। আমাদের পার্টিও গণসংগঠন বয়কট বা নির্বাচন বয়কটের পুরনো অবস্থান ছেড়ে নতুন সময়ে নতুন ধরনের রাজনীতির প্রয়োজনের ডাকে সাড়া দেয়। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েতের পতনের পর আবার এক নতুন সন্ধিক্ষণ আসে। পার্টির জন্য জরুরি হয়ে পড়ে গোপন সাংগঠনিক পর্ব ছেড়ে প্রকাশ্য রাজনীতির। আজকের নকশালবাড়ি রাজনীতি বা বিপ্লবী কমিউনিস্ট রাজনীতি আবারো এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। গোটা দেশে যখন ফ্যাসিবাদের বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তখন সমস্ত রকম পথ ও পদ্ধতিতে ফ্যাসিবাদের মোকাবিলাই আজকের বিপ্লবী রাজনীতির অন্যতম প্রধান কর্তব্য। আর এই রাজনীতি স্বাভাবিকভাবেই শত্রু মিত্রের সমীকরণকে নতুন করে হিসাব নিকাশ করার দাবি জানায়। এও এক যুদ্ধ পরিস্থিতি। সেখানে যুদ্ধের নিয়মেই শত্রু শিবিরকে যতখানি সম্ভব ছোট ও মিত্র শিবিরকে যতখানি সম্ভব বড় করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। রাস্তার লড়াই থেকে সংসদের লড়াই — সম্ভাব্য সমস্ত ধরনের পথে ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।

শেষ করা যাক কমরেড বিনোদ মিশ্রের উক্ত প্রবন্ধের শেষ কথাগুলি দিয়েই।

“হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭০’র দশকে যে নতুন ইতিহাস আমরা লিখতে গিয়েছিলাম, তা কি শুধু ইতিহাসই হয়ে থাকবে? অসাধারণ বীরত্ব, আত্মবলিদান, বেদনা ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা এক বেদনাদায়ক ইতিহাস হয়ে থাকবে? যা নিয়ে কবিরা কবিতা লিখবে, শিল্পীরা ছবি আঁকবে, গবেষকরা থিসিস রচনা করবে, বিপ্লবের শত্রুরা উপহাস করবে এবং আমরা মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান করে স্মৃতিমন্থন করব? না, তা আমরা হতে দিতে পারি না। বাংলার আকাশে বাতাসে আবারও প্রতিধ্বনিত হবে সেই চিরপরিচিত রণধ্বনি ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’। সেই দিনকে এগিয়ে আনার শপথই তো নিতে হবে আজকের দিনে।”

– সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-30
সংখ্যা-16