আজকের দেশব্রতী : ১৮ মে ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-18-may-23election result of karnatakabjp-did-not-get-permission

জনবিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের সমস্ত চক্রান্তকে ব্যর্থ করে তাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার জন্য সিপিআই(এমএল), কর্নাটকের জনগণকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’কে পরাস্ত করতে কর্নাটকের সাধারণ জনগণের এই গণরায় এক পূর্বাভাস হয়ে উঠুক।

বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি, তাদের পরিচালিত রাজ্য সরকারের নজিরবিহীন দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি, জীবনযাপনের ক্রমবর্ধমান খরচ, কৃষক ও শ্রমিক বিরোধী আইন, ভেঙে পড়া পরিকাঠামো, আকাশছোঁয়া বেকারত্ব, রাজ্যের পঙ্গু অর্থনীতি, মহিলাদের উপর, তাঁদের স্বাধীনতার উপর সহিংস নির্যাতন-নিপীড়ন, ক্রমবর্ধমান জাতিগত অত্যাচার, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কর্নাটকের জনতা গণরায় দিয়েছে।

স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী রাজ্যজুড়ে বিজেপির বিভিন্ন রোড-শো ও জনসভায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বিজেপির এই পরাজয় দেখিয়ে দিল যে ‘মোদী’ ব্র‍্যান্ডটি অবিনশ্বর নয়। অন্যদিকে ঠুটোঁ জগন্নাথের মতো বসে থাকা নির্বাচন কমিশন ঘৃণাভরা বক্তৃতা, এমনকি নির্বাচনী প্রচার শেষ হওয়ার পরের পর্বে ও নানা আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে নীরব থেকে রাজ্যের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলিকে অবজ্ঞা করেছে।

এই নির্বাচনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুধাকর সহ বর্তমান বিজেপি সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছে। কর্নাটকে কোভিড-১৯ সঙ্কটের সময় বিজেপি সরকারের চরম অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ উঠে আসে। শিক্ষামন্ত্রী বি সি নাগেশ, যিনি অন্যায়ভাবে হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, মুসলিম মহিলা শিক্ষার্থীদের অপমানিত করেছিলেন এবং তাঁদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, তিনিও পরাজিত হয়েছেন। বিজেপির জাতীয় সম্পাদক সি টি রবির পরাজয় কর্নাটকের জনগণের বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতির প্রত্যাখানকেই দেখিয়ে দেয়।

কেআরপুরা এবং কানাকাগিরি নির্বাচনী এলাকায় সিপিআই(এমএল) প্রচুর কাজ করা সত্ত্বেও, পার্টি প্রত্যাশিত ফল পায়নি। আগামীদিনে এই বিষয়ে পার্টি প্রয়োজনীয় পর্যালোচনা এবং সংশোধন করবে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, বিজেপির ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে জনগণের দাবির পাশে দাঁড়াবে। পাশাপাশি, নবনির্বাচিত সরকার যাতে জনগণের মতামত মেনে চলে এবং তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে তারজন্য সোচ্চার হবে।

“বিজেপি হারাও, কর্নাটক বাঁচাও” এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিজেপি’কে ভোটে হারানোর জন্য এবং দুটি নির্বাচনী এলাকায় আমাদের ভোট দেওয়ার জন্য সিপিআই(এমএল) কর্নাটকের জনগণকে ধন্যবাদ জানায়। এছাড়াও বাহুতভা কর্নাটক, এডেলু কর্নাটক ও অন্যান্য সুশীল সমাজ সংস্থা ও এই কয়েক মাস ধরে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং অসংখ্য সেক্টর নির্দিষ্ট রিপোর্ট কার্ডের মাধ্যমে বিজেপির জনবিরোধী নীতিগুলি প্রকাশ করেছেন যা বিজেপির পরাজয়ে সাহায্য করেছে, সেইসকল বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও কুর্নিশ জানাই।

আমরা এখন ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মিজোরাম, রাজস্থান এবং তেলেঙ্গানার জনগণের দিকে তাকিয়ে আছি, যেখানে আগামী কয়েক মাসে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে। আশা করা যায়, কর্নাটকের মতো গোটা দেশজুড়ে মানুষ ভোট দেবেন বিজেপির জনবিরোধী ও ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশের গণতন্ত্র ও ভারতীয় সংবিধানকে বাঁচাতে।

- কর্নাটক রাজ্য কমিটি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন

crushing-karnataka-is-an-exaggeration-of-modimodi's-invincibility

কর্নাটক নির্বাচনের ফলাফলে যে বার্তাটা ভারতের পরিবর্তনকামী জনগণের কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে পৌঁছালো তা হলো — নরেন্দ্র মোদী অপরাজেয় নন। যেকোনো নির্বাচনে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে গুরুত্বহীন করে তুলে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের সবচেয়ে বড় প্রচারক করে তোলা এবং নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যের কৃতিত্বকে মোদী-শাহদের অর্পণ করাটাই ২০১৪’র পর থেকে বিজেপির রীতি হয়ে উঠেছে। এবারের কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারের কার্যকলাপকে আলোচনায় না এনে এবং রাজ্য নেতৃত্বকে উপেক্ষণীয় করে তুলে নরেন্দ্র মোদীই হয়ে উঠলেন বিজেপির প্রচারের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। এবং প্রচারে নেমে মোদী বিজেপির জন্য ভোটও চাইলেন নিজের নামেই। ছ’মাস আগে হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনেও আমরা নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে মোদীকে প্রত্যাখ্যাত হতে দেখেছিলাম, তবে, এবারের কর্নাটকে প্রত্যাখ্যানটা এল আরও বড় আকারে এবং নির্ধারক নিহিতার্থের মধ্যে দিয়ে।

কর্নাটক নির্বাচনে মোদী যেমন মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন, অন্য কোনো নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায়নি। এবং তা বোধহয় রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে প্রবল বিজেপি-বিরোধী হাওয়া আঁচ করেই। নির্বাচন কমিশন কর্নাটকের নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে ২৯ মার্চ আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১০ মে। গত কয়েক মাসে তিনি নয় নয় করে ১২ বার কর্নাটক সফর করেছেন এবং যেটা অন্য কোথাও হয়নি কর্নাটকের ক্ষেত্রে সেটাও ঘটেছে, তিনি সেখানে রাত্রি যাপনও করেছেন। আর, নির্বাচন যত এগিয়েছে প্রচারের মাত্রাকেও তিনি বাড়িয়ে তুলেছেন, এবং প্রচারের শেষ পর্বে ২৯ এপ্রিল থেকে ৮ মে তিনি তিনটে থেকে চারটে করে জনসভা এবং রোড-শো করেছেন। একেবারে ২১টি জনসভা এবং তার সঙ্গে ছ’টি রোড-শো নিয়ে ছিল তাঁর প্রচারের ব্যাপ্তি, এবং একটি রোড-শো একেবারে ২৬ কিমি লম্বা ছিল বলে কথিত। উন্নয়ন নামক প্রকল্পের ঘোষণা ও উদ্বোধন এবং তার সাথে হিন্দুত্ববাদী ও সংখ্যালঘু-বিরোধী রাজনীতির মিশ্রণে মেরুকরণ ঘটানোর যে কৌশল মোদী নিয়ে থাকেন, কর্নাটকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কর্নাটকে গিয়ে তিনি হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’এর হেলিকপ্টার ফ্যাক্টরি দেশের কাছে উৎসর্গ করেছেন, শিবামোগা বিমানবন্দরের উদ্বোধন করেছেন, মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট, এক্সপ্রেসওয়ে, ব্যাঘ্র প্রকল্পকে চালু করেছেন। কোথাও আবার কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ঘোষণাও করেছেন, যেমন, ইয়াদগিরি জেলার হুনসাগর তালুকে ৪২২৩ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। তবে, মোদী ও বিজেপির প্রচারে জোর সবচেয়ে বেশি ছিল তাদের মার্কামারা সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলোর ওপর। এবার আমরা নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে মেরুকরণ ঘটানোর লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদী থেকে অন্যান্য বিজেপি নেতৃবৃন্দ যে সংখ্যাগুরুবাদী ও সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলোকে প্রচারের জোরালো ইস্যু করে তুললেন, সেগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে ঘৃণা ও হিংসার কারবারি বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার কথা ঘোষণা করায় মোদী তার মধ্যে মেরুকরণের এক অস্ত্রকে খুঁজে পেলেন। তিনি বজরং দলের সঙ্গে বজরংবলীকে (হনুমান দেবতা) একাকার করে তুললেন এবং বললেন, “বুথে গিয়ে যখন বোতাম টিপবেন ‘জয় বজরংবলী’ বলে (কংগ্রেসকে) শাস্তি দেবেন।” ‘কাশ্মীর ফাইলস’ গোত্রের আর একটা ছবি সুদীপ্ত সেন পরিচালিত ‘কেরালা স্টোরি’ মুক্তি পায় কর্নাটক নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে, ৫ মে। ছবিটি মুসলিম যুবকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর বিজেপির দুরভিসন্ধিমূলক ইস্যু লাভ-জিহাদ’এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, এবং বিজেপি ও আরএসএস অতি তৎপরতার সঙ্গে ছবিটির প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে। মোদী তাঁর প্রচারে কেরালা স্টোরির উল্লেখ করলেন, ছবিতে বর্ণিত পার্শ্ববর্তী রাজ্য কেরলের নারীদের ধর্মান্তরিত করে আইএসআইএস’এর কাছে পাঠিয়ে তাদের কাজে লাগানোর প্রসঙ্গ টেনে হিন্দু ভোটের মেরুকরণে প্রয়াসী হলেন। মেরুকরণ ঘটানোর লক্ষ্যেই কর্নাটকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম নারীদের হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল যা নির্বাচনী প্রচারের একটা ইস্যু হয়ে ওঠে। হালাল ব্র্যান্ডের মাংসও মুসলিম-বিরোধী প্রচারের অঙ্গ হয়। মুসলিম ওবিসি’দের জন্য নির্দিষ্ট ৪ শতাংশ কোটাকে বাতিল করাটাও (যার বৈধতা এখন আদালতের বিবেচ্য) হিন্দুত্ববাদী আবেগকে উস্কিয়ে তোলার একটা উপায় হয়ে উঠল। টিপু সুলতানও পরিণত হলেন হিন্দু ভোট সংহত করার এক মাধ্যমে। প্রকৃত ইতিহাস আমাদের জানায়, টিপু সুলতান ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করার সময়ই ব্রিটিশদের হাতে নিহত হন। কিন্তু কর্নাটকে টিপুর মতো মুসলিম সম্রাটকেও ঘৃণায় ভাসানো হল এবং ভোক্কালিগা জাতের ভোট বিজেপির পক্ষে টানার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে প্রচার করা হল যে, ব্রিটিশদের হাতে নয়, টিপু সুলতান নিহত হয়েছিলেন ভোক্কালিগা জাতের দুই ব্যক্তির হাতে! কর্নাটকে প্রচারে নেমে মোদীর চেষ্টাই ছিল বিজেপি শাসনের পরিণামে রাজ্যের নিকৃষ্ট বাস্তব পরিস্থিতি থেকে জনগণের নজরকে ঘোরানো; রান্নার গ্যাস-পেট্রল-ডিজেল-অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি, বেকারির মতো ইস্যুগুলো থেকে ভাবনাকে সরিয়ে কর্নাটকের জনগণ যেন সংখ্যাগুরুবাদী চিন্তাতেই আবিষ্ট থাকেন। এছাড়া, দুর্নীতিও কর্নাটকের নির্বাচনে একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল, বাসবরাজ বোম্বাইয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ৪০ শতাংশ কমিশনের সরকার বলেই জনগণের মনে গেঁথে গিয়েছিল। কোনো ঠিকাদারের বিল পাশ করাতে গেলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে ৪০ শতাংশ কমিশন প্রদান ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। এক ঠিকাদার ৪০ শতাংশ কমিশন দিতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন এবং সেই ঘটনায় বিজেপির এক বিধায়ক গ্রেপ্তারও হন। দুর্নীতির এই ব্যাপকতা সত্ত্বেও মোদী তা নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি; ফলে, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই ও ইডিকে লেলিয়ে দিয়ে নিজেকে দুর্নীতি দমনের প্রাণপুরুষ রূপে জাহির করার জন্য যে কসরতের ওপর তিনি ভর করে চলেছেন, কর্নাটকে তা আরও একবার কপট ও অসার বলেই প্রতিপাদিত হলো।

বিজেপি-বিরোধী হওয়া এতটাই প্রবল ছিল যে বাসবরাজ বোম্বাই সরকারের একেবারে ১২ জন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। পরাজিতদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী বি সি নাগেশ যিনি ছিলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করার মূল হোতা। আর এটাও এক প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা যে, কংগ্রেস-জেডিএস ভেঙ্গে বিজেপিতে গিয়ে সরকারের মন্ত্রী হওয়া বিধায়কদেরও কর্নাটকের জনগণ ভালো চোখে দেখেননি। তাঁদের অনেকেই পরাজিত হয়েছেন এবং সেই তালিকায় রয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে সুধাকর, পরিবহণমন্ত্রী বি শ্রীরামুলু, আইনমন্ত্রী জে সি মধুস্বামী, ক্ষুদ্রশিল্পমন্ত্রী এম টি বি নাগরাজ, কৃষিমন্ত্রী বি সি পাতিল। আসন প্রাপ্তির দিক থেকে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে ফারাক (১৩৫ বনাম ৬৬) এতটাই হয়েছে যে, ‘প্ল্যান বি’কে সক্রিয় করার কোনো অবকাশ বিজেপির কাছে থাকেনি। ‘প্ল্যান বি’ আসলে বিধায়ক কিনে বা ভাঙ্গিয়া এনে নিজেদের সরকার গড়া, যে খেলাটায় বিজেপি সিদ্ধহস্ত এবং যেটা তারা ২০১৯ সালে কর্নাটকে খেলেছিল, এবং বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হলে যে কৌশলের প্রয়োগে তারা প্রস্তুতও ছিল। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ, হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং ১৬ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে প্রচারে নামিয়েও এবং একবছর আগে মুখ্যমন্ত্রী বদল করে ও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেশকিছু নতুন মুখ এনেও কর্নাটকের জনগণের এই প্রবল বিজেপি-বিরোধী মনোভাবে কোনো বদল আনা যায়নি।

কর্নাটকে বিজেপি বিধ্বস্ত হওয়ায় দক্ষিণের রাজ্যগুলো থেকে সংসদীয় আসন বৃদ্ধির তার অভিপ্রায় সুনিশ্চিতভাবেই ধাক্কা খেল। কিন্তু এই প্রশ্নটা এখন সবার মনেই উঁকি দিচ্ছে যে, দক্ষিণের রাজ্যের এই ফল উত্তরের রাজ্যগুলোতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে? এ’বছরের শেষে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা, মেঘালয়ে যে বিধানসভা নির্বাচন এবং তারপর ২০২৪ সালে যে সাধারণ নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনগুলোতেও কি বিজেপিকে রোখা যাবে? ২০১৯’র সাধারণ নির্বাচনের আগে কংগ্রেস রাজস্থান-ছত্তিশগড়-মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হলেও ঐ রাজ্যগুলো থেকে ব্যাপক সংখ্যাধিক আসনই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল। কেউ কেউ অতএব বলতেই পারেন যে, কর্নাটকের ফলাফলের তাৎপর্যকে বেশি বাড়িয়ে না দেখাটাই প্রাসঙ্গিক হবে। কিন্তু কর্নাটকের ফলাফল থেকে এটা বেরিয়ে এসেছে যে, বিজেপির বিদ্বেষ-বিভাজন সৃষ্টির ফাঁদে পা না দিয়ে বেকারি, মূল্যস্ফীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো বুনিয়াদি ইস্যুগুলোর প্রতি অবিচল থাকলে জনগণ তাতে অবশ্যই সাড়া দেন। এবং ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের অঙ্গীকারকে অনমনীয় করাটাও বিজেপি প্রতিরোধের অবশ্য শর্ত। তবে, কিছু-কিছু কংগ্রেসি নেতা নরম হিন্দুত্বর প্রতি যে আসক্তি এখনও দেখিয়ে চলেছেন, পরিণামে তা বিজেপির কাছে মওকা হয়েই উঠতে পারে। বিজেপির পরাজয়ের প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে এবং বিরোধী ঐক্যকে অভঙ্গুর করতে পারলে নরেন্দ্র মোদীর অপরাজেয়তাকে পর্যুদস্ত করার সম্ভাবনা একেবারেই অকল্পনীয় নয়।

primary-teachersnot-care-about-death

ক্যাঙ্গারু কোর্ট নয়, কলকাতা হাইকোর্টের একক বেঞ্চ নজিরবিহীন এক রায়দানের মাধ্যমে ৩৬,০০০ প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল করে দিল। ভূ-ভারতে আগে কখনও কোন রাজ্যে বা কোন আদালত এমন রায় দিয়েছে বলে জানা নেই। খবরে প্রকাশ, স্কুল শিক্ষা পর্ষদ এই রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে মামলা ঠুকবেন। সেই রায়দান কি হবে তা আশু ভবিষ্যতের গর্ভেই নিহিত।

নিয়োগ পদ্ধতিতে অনিয়মের অভিযোগে নিয়োগ বাতিল হওয়া এই বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষকের ভবিষ্যতে নেমে এল ঘোর অনিশ্চয়তার ঘন কালো মেঘ। আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে তাঁদের চাকরি যাচ্ছেনা, আগামী চারমাস পর্যন্ত তাঁদের ধড়ে প্রাণ রেখে দেওয়া হল, কোপ পড়ল বেতনের উপর। সেই চারমাস তাঁরা বেতন পাবেন পার্শ্ব-শিক্ষকদের হারে। কম বেতনে, শিক্ষা জগতে, এইভাবে ইনফর্মাল বা ‘ঠিকা’ শিক্ষকদের নিয়োগ করার চরম অন্যায়কে প্রকারন্তরে আদালত স্বীকৃতি দিয়ে বসল। আদালতের একক বেঞ্চ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদকে নির্দেশ দিল, তিনমাসের মধ্যে নতুন করে ওই ৩৬,০০০ পদে অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট সহ ইন্টারভিউ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয়া নিয়োগ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। বাতিল হওয়া ৩৬,০০০ শিক্ষক নতুন এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন। ইন্টারভিউয়ে পাশ করলে, নতুন নিয়োগ তালিকায় শিকে ছিঁড়লে সেই শিক্ষকেরা আবার ফেরত পাবেন তাঁদের চাকরি।

বিচিত্র এই রায়দানের পর রাজ্যে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন মুখ্যমন্ত্রী এই বিপুল বহরের চাকরি খোয়ানোর পেছনে ডিএ’র ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দায়ী করলেন। পূর্বে যে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ‘চোর ডাকাত’ বলে চরম অশালীন, আপত্তিজনক মন্তব্য করে নিজের রুচিশীলতা সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন, এবার সেই জনপ্রিয় চলমান আন্দোলনকে চরম অন্যায়ভাবে কাঠগড়ায় তোলার এক হাস্যকর প্রয়াস চালালেন। ন্যায়সঙ্গত নিয়োগ, ডিএ সহ সমস্ত সরকারি শূন্যপদ পূরণ করা, ঠিকা সহ ক্যাজুয়াল প্রথার অবসানের দাবিতে যে দুটি আন্দোলনকে কিছুতেই দমন করা যাচ্ছে না, যে আন্দোলন দুটি রাজ্য সরকারের আপাদমস্তক ঘৃণ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত দগদগে চেহারাকে টেনে সবার সামনে উন্মোচিত করল, তাঁর প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যই প্রমাণ করে এই সরকার কতটা আজ বেকায়দায় পড়েছে। আর, নিয়োগ পদ্ধতিতে অনিয়মের অভিযোগে ৩৬,০০০ শিক্ষককেই পরোক্ষে দুর্নীতিগ্রস্থের তালিকায় ফেলে আদালতের একক বেঞ্চ কার্যত মুখ্যমন্ত্রীর ‘চোর ডাকাত’ মন্তব্যের পক্ষেই রায় দিয়ে দিল। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষকদের মধ্যে কত শতাংশ নির্দোষ, তার আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগই দেওয়া হল না। প্রমাণ ছাড়াই, সবাইকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসাবে দাগিয়ে ফের নতুন করে অগ্নিপরীক্ষায় ঠেলে দেওয়া হল। যে নিয়োগ পদ্ধতির অনিয়মের জন্য পর্ষদের হোমড়া চোমড়া সহ গোটা প্রশাসনিক যন্ত্রটা দায়ী, তারা শাস্তিদানের বৃত্তের বাইরে থেকে গেল। গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তিলে তিলে বেসরকারি খেলোয়াড়দের কাছে তা সঁপে দেওয়ার এই যে সরকারি পৃষ্টপোষকতার উদ্যোগ, তাদের দিকে আঙুল না তুলে, নিজের সরকারের নিদারুণ ব্যর্থতার জন্য রাজ্যবাসীর কাছে মার্জনা না চেয়ে দুর্নীতির সাথে নির্লজ্জ সমঝোতা করে বসলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

৩৬,০০০ শিক্ষকের গলায় আদালত পরিয়ে দিল ম্যানিলা রজ্জুর রশি। মৃত্যু পরোয়ানাও ঘোষণা করে দেওয়া হল। তবে বিলম্বিত লয়ে। তিনমাস পর কতজনের পায়ের তল থেকে পাটাতনটি সরিয়ে কেড়ে নেওয়া হবে অমূল্য প্রাণ, তার করুণতম পরিণতির দিকে কী বাংলা তাকিয়ে থাকবে, নিঃশব্দে, নীরবে প্রতিবাদহীন হয়ে?

BJP-ruled-manipurBJP-ruled-manipur

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ কর্ণাটকে ভোট প্রচারে গিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছিলেন, কংগ্রেস জিতলেই নাকি দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে। আর বিজেপি-শাসিত মণিপুরেই বিস্ফোরণ ঘটলো ভয়ঙ্কর এক জাতি হিংসার, যার মধ্যে এক সুপরিকল্পিত দাঙ্গার সমস্ত চিহ্ন বর্তমান। কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোকে বলে থাকে ‘ডবল ইঞ্জিনের সরকার’। সেই ডবল ইঞ্জিন-চালিত মণিপুরে, কেন্দ্রীয় সরকার ৩৫৫ ধারার সাহায্যে ক্ষমতা হাতে নিয়ে ‘দেখামাত্র গুলি’র নির্দেশ জারি করেছে যেখানে মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে বলে খবর; হিংসা ছড়িয়ে যাচ্ছে রাজ্য রাজধানী ইম্ফল সহ পাহাড়ী অঞ্চল থেকে উপত্যকায়। এমনকি শীর্ষস্থানীয় উপজাতি আধিকারিক এবং নেতারাও গণরোষের আঁচ থেকে রেহাই পাননি। বেশ কয়েকটি চার্চ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। অনতি অতীতে রাজ্যটিতে তুলনামূলকভাবে যে স্থিতি বিরাজ করছিল, নির্মমভাবে তা খান খান হয়ে গেল।

হিংসা-দীর্ণ মণিপুর থেকে যে খবর আসছে, তা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করছে যে এটা শুধু আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার ব্যাপার নয়, সেখানে মণিপুরের সংবেদনশীল সূক্ষ্ম সামাজিক কাঠামোয় ধরা পড়েছে অনেক গভীর ফাটল। সাম্প্রতিক পর্যায়ের হিংসার পিছনে অব্যবহিত কারণ হল মণিপুর হাইকোর্টের এক নির্দেশ, যেখানে রাজ্য সরকারকে মেইতেই জনগোষ্ঠীর উপজাতি তালিকাভুক্তির আবেদনকে সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের এই আদেশ এখন সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। শীর্ষ আদালতের এক মৌখিক মন্তব্যে জানানো হয়েছে, কোনো জনগোষ্ঠীর উপজাতি তালিকাভুক্তির সুপারিশ করা কোনো হাইকোর্টের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু এটা খুব পরিষ্কার যে কেবল এই একটি বিষয় এমন ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহের জন্ম দিতে পারে না, আগাম কোনো পরিকল্পিত প্রস্তুতি ছাড়া। আর সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ অবশ্যই আমাদের মণিপুরের অন্তর্নিহিত পরিস্থিতির দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করে। এমনকি বিজেপির উপজাতি জনগোষ্ঠী থেকে আসা বিধায়করাও জাতিগত নির্মূলীকরণ ও উৎখাতের অভিযান লাগাতার চালিয়ে যাওয়ার জন্য বীরেন্দ্র সিং সরকারকে দোষারোপ করছেন।

মেইতেই, যারা সর্বাংশে মণিপুরের প্রভাবশালী সম্প্রদায়, তাদের উপজাতি তালিকাভুক্তির দাবি স্বভাবতই কুকি, নাগা, মিজো এবং মণিপুরের অন্যান্য উপজাতির মানুষদের ক্ষুব্ধ করেছে। মেইতেই’দের উপজাতির মর্যাদা তাদের শুধু শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী করবে না, এই ভূখণ্ডে তাদের জমির অধিকারও দেবে যা বর্তমানে উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত। ঘটনা হল, উপজাতি সম্প্রদায়ের জমিগুলিকে সরকার সংরক্ষিত অথবা সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করায় উপজাতি মানুষজন তাদের জমির ঐতিহ্য ও পরম্পরাগত দখলীসত্ত্ব থেকে ইতিমধ্যেই বঞ্চিত হয়েছেন। হিল এরিয়া কমিটি, যেগুলির হাতে পাহাড়ী অঞ্চলের প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকার কথা, তাদের থেকে ক্রমাগত ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

মণিপুরের উপজাতি সম্প্রদায়ের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও ক্রোধ নতুন করে বাড়িয়ে তুলেছে আরেকটি বিষয় — বিজেপি লাগাতার মণিপুরের জন্য অসম ধাঁচের এনআরসি’র কথা বলে চলেছে এবং মায়ানমারে প্রতিকূল পরিস্থিতির তাড়নায় যে উপজাতীয় শরণার্থীরা, পাশেই মণিপুরের পাহাড়ী অঞ্চলে উপজাতি সম্প্রদায়ের বসতিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। কুকিরা এবং মণিপুরের অন্যান্য উপজাতির মানুষেরা সীমান্তের ওপারে মায়ানমারে তাদের স্বজাতির মানুষদের সঙ্গে গোষ্ঠীগত বন্ধনে ও গভীর আত্মীয়তায় আবদ্ধ। তাই মণিপুরের বিজেপি সরকার যখন এই শরণার্থীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক নীতি নিয়েছে, মণিপুরের উপজাতি সম্প্রদায় যে তাদের অসহায় ভাই-বোনেদের প্রতি গভীর সহানুভূতি বোধ করবেন সেটাই স্বাভাবিক। মণিপুরে চার্চের ওপর আক্রমণে দেশের অন্যত্র সঙ্ঘ বাহিনীর খ্রিস্টান-বিরোধী, ধর্মান্তর-বিরোধী আগ্রাসী প্রচারের ছায়া স্পষ্ট। এই ঘটনায়, মণিপুরের উপজাতিদের বিচ্ছিন্ন ও প্রান্তিক করে তুলে ‘নিজ ভূমে পরবাসী’ তথা বহিষ্কার করার বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল।

বিজেপি দাবি করে তারা উত্তর পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে দায়বদ্ধ। আসলে তারা ‘অসমের রাজনীতি’র বর্মে নিজেদের সুরক্ষিত করে ফেলেছে — যে রাজনীতি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আর ‘পরিচয়কে’ নিজেদের ইচ্ছে ও প্রয়োজন মতো কাজে লাগানোর কারসাজির এক চতুর সমন্বয়। অসমের পর, দলটি দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে ত্রিপুরা ও মণিপুরে। মণিপুরে দলটির বিস্তার ঘটেছে প্রাথমিকভাবে উপত্যকাবাসী মেইতেই’দের মধ্যে। তবে বিজেপি তার বহুল ঢক্কানিনাদিত ‘পাহাড় চলো ২.০’ প্রচারাভিযানের আড়ালে উপজাতি সংযোগ প্রসারের নীতি অনুসরণের ছলনা করে চলেছে। জাতি হিংসার সাম্প্রতিক ভয়াবহতা উত্তর পূর্বাঞ্চল নিয়ে বিজেপির অশুভ ষড়যন্ত্রকে সম্পূর্ণ উন্মোচিত করে ফেলেছে। উপজাতি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং সাংবিধানিক অধিকার ও আশা আকাঙ্ক্ষার সুরক্ষা হচ্ছে উত্তর পূর্বাঞ্চলের শান্তি গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মূল শর্ত। আর বিজেপির হিন্দত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের অ্যাজেন্ডা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের জাতিসত্তাগুলির সূক্ষ্ম বুনটের গভীর অনুভূতিপ্রবণ উজ্জ্বল বহুবর্ণ সমাহারের উচ্ছল প্রাণময়তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে, উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির আগ্রাসী অ্যাজেন্ডা এবং ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের অশনি সংকেত আমাদের বুঝে নিতে হবে।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৯-১৫ মে ২০২৩

naxalbari-peasant-uprisingpeasant-uprising
গ্রামবাংলার কৃষিনির্ভর পরিবারগুলির সর্বহারাকরণ রুখতে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলুন

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিগড় থেকে মুক্ত ভারতে শাসকশ্রেণী স্বাধীনতাপ্রাপ্তীর দুই দশক পরে শ্রমজীবী নাগরিকের কাছে সমঅধিকার, সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতিভঙ্গের এক কলঙ্কজনক নজির তুলে ধরেছিল। বিগত শতাব্দর ৪’এর দশকে বাংলার বুকে সাম্রাজ্যবাদী সরকার ও সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকেরা ফসলের তেভাগার দাবি নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। তার অব্যবহিত পরে দক্ষিণের তেলেঙ্গানায় সামন্তী নিজামশাহীর বিরুদ্ধে আবারও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কৃষকেরা নারী, পুরুষ নির্বিশেষে গেরিলা যুদ্ধে নেমেছিল। নেহেরু সরকারের দেশের সম্পদ সৃষ্টিকারী কৃষক জনতার উপর নির্মম দমনপীড়নের স্বরূপ সেদিন উন্মোচিত হয়েছিল সংগ্রামের সুবাদে। পাঁচের দশকজুড়ে বাংলার বুকে উদ্বাস্তু আন্দোলন, ট্রামশ্রমিকদের লড়াই, শিক্ষকদের উন্নত মজুরি ও মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন, সর্বোপরি জমিদারী বিলোপ আইনের সূত্রে জোতদার-জমিদারদের সিলিং বহির্ভূত বেনামী জমি দখলের আহ্বান কংগ্রেসী সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনতার বৃহদাংশের, বিশেষ করে গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের প্রত্যক্ষ বিদ্রোহে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল।

ব্রিটিশ ভারতে ১৮৫৫’র সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭এ উর্দিপরা কৃষকদের মহাবিদ্রোহ, ১৮৬০’র নীল বিদ্রোহ, ১৮৯৯-১৯০০ সালের মুন্ডা বিদ্রোহের উত্তরাধিকারে সম্পৃক্ত সংগ্রামী কৃষকেরা গান্ধীর প্রবচন না মেনে চৌরিচৌরায় বিদ্রোহী চেতনাকে ব্যক্ত করেছিল বিপুল তেজে।

ভারতের ইতিহাস কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস। ৬’এর দশকে নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, ফাঁসিদেওয়ায় ৬০ হাজার কৃষক জোতদারদের সামন্তী শোষণের অবসান ঘটাতে ও পুঁজিপতি-পরস্ত ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে জমির নিরঙ্কুশ অধিকার, মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের স্পর্ধা নিয়ে উত্তরের মাঠে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। অগণ্য শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে ১৯৬৭-৭৭’র এই বিপ্লবী দশকের অভিঘাতে এই বাংলায় ভূমিহীন ও গরিব কৃষকের স্বার্থে ভূমিসংস্কারের কর্মসূচিকে আংশিকভাবে রূপায়িত করতে বাধ্য হয়েছিল পরবর্তী বামফ্রন্ট সরকার।

নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রাম ভারতের কৃষি অর্থনীতিকে যেমন জনমুখি করে তুলেছিল, তেমনি ইতিহাস চর্চায় নিম্নবর্গের শ্রমজীবী জনতার ভূমিকাকে মান্যতায় প্রতিষ্ঠা করেছিল।

আজ নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রামের পাঁচ দশক পেরিয়ে এসে গ্রামবাংলার কৃষিজীবী পরিবারগুলি সার, বীজ, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, ফসলের অভাবী বিক্রি, ভাগচাষিদের অধিকারচ্যূতি, লীজ চাষিদের সরকারী ঋণ, কিষাণ ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি না পাওয়া, সেচের সুবিধা না পাওয়া, কৃষি সমবায়গুলির দুর্নীতি ও অকার্যকারিতার মুখে গ্রামীণ সর্বহারায় পরিণত হয়ে চলেছে। সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা জানাচ্ছে বাংলার গ্রামাঞ্চলে কৃষিতে স্বনিযুক্ত পরিবারগুলি সমগ্র গ্রামীণ সমাজের মাত্র ২৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাম শাসনকালের শেষপর্বে জমি থেকে অধিকারচ্যূত পরিবারের সংখ্যা ৪০-৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৬০-৬৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ জবকার্ডধারী শ্রমজীবি জনতা, যাদের বছরে ১০০ দিনের কাজ মোদী সরকারের সৌজন্যে দেশজুড়ে ১৭ দিনে পর্যবসিত হয়েছে, বরাদ্দ ছাঁটাই হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আর বাংলার জবকার্ডধারী শ্রমিকেরা বিগত ১৫ মাস ধরে তাঁদের কষ্টার্জিত ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে।

মোদী সরকারের উদ্যোগে কৃষিজমির অধিকার, কৃষিজাত ফসলের উৎপাদন, বণ্টন ও বিপণনকে পুরোপুরি আদানি- আম্বানি পরিচালিত কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়ার কৃষিনীতি কৃষকদের মাটি কামড়ানো প্রতিরোধের মুখে প্রতিহত হয়েছে। তবু দেশজুড়ে কৃষিজাত ফসলের ন্যূনতম সরকারী সহায়কমূল্য বা কৃষিউপকরণের মূল্যহ্রাসের কোন নীতি প্রণয়নে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোন আগ্রহ নেই। বরং তৃণমূল সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শাসকদলের গ্রামীণ প্রতিনিধিদের দ্বারা মজুরি লুট, জবকার্ডের অপব্যবহার, আবাস প্রকল্পে বরাদ্দ তহবিল তছরূপ, দলীয় ও পুলিশী সন্ত্রাস ইত্যাদি গ্রামীণ সমাজকে অপশাসনের অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছে। ভারতীয় সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে মমতা শাসনে সম্পূর্ণত দলীয় ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে কুক্ষিগত করে রাখা হচ্ছে।

পাঁচদশক পূর্বের কৃষক সংগ্রামের উজ্জ্বল পরম্পরায় বিপ্লবী কৃষক চেতনাকে আবার নতুন করে বাংলার গ্রামে গ্রামে জীবন, জীবিকা ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হবে। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে পাখির চোখ করে পার্টি ও গণসংগঠনের সমগ্র কর্মীবাহিনীকে আগামী দিনগুলিতে গ্রামবাংলার প্রতিটি জেলায় নিবিড় গ্রামভিত্তিক কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

কমরেডগণ, আসুন ১০ মে থেকে ১০ জুন অবধি এআইকেএম ও আইয়ারলা’র রাজ্য কমিটি দ্বারা সূচিত কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে গ্রামের ঘরে ঘরে সমীক্ষা ও প্রচার, কৃষক ও গ্রামীণ মজুরদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিপুল সংখ্যায় জনসমাবেশ ঘটিয়ে পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিসে ধর্ণা-ঘেরাও, কৃষিমন্ত্রক ও রাজ্যপালের কাছে জনমুখি বিকল্প কৃষিনীতি প্রণয়ন ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে শোষণ, শাসনমুক্ত জনমুখিকরণের লক্ষ্যে দাবিসনদ পেশ — ইত্যাদি আলোড়নধর্মী কর্মসূচিগুলিকে সফল করে তুলি।

২৫ মে ‘নকশালবাড়ি দিবস’ উদযাপন এবারে হয়ে উঠুক পার্টির পলিটব্যুরো নির্দেশিত ২৮ জুলাই অবধি পার্টি ব্রাঞ্চ ও লোকাল কমিটিগুলির সশক্তিকরণের মাধ্যমে নিরন্তর গণসংযোগ ও কৃষিজীবী জনতার বিপ্লবী দিশায় অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার গণসংগ্রামের শপথী সূত্রপাত।

- অভিজিৎ মজুমদার

political-terror-in-dhubuliaprotest-rally

ধুবুলিয়ার বুকে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশকে বিনষ্ট করে গুন্ডামী ও রক্তপাত ঘটালো তৃণমূল আশ্রিত জমির দালালরা। প্রায় ৪০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত সিপিআই(এমএল) অফিসের জমিকে দখল করার চক্রান্ত করলো ওদের এক পঞ্চায়েত সদস্য। গত ১১ মে দেশবন্ধুনগরে অফিসের জমিতে ঐ সদস্য ও তার দলবল বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশ করে, পার্টি এবং পার্টির নেতার নামে অকথ্য গালিগালাজ করে, ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দেয়। এমনকি প্রাণে মেরে ফেলার শাসানি দেয়। জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় ফয়সালা করবে ল্যান্ড ডিপার্টমেন্ট, তাতে পঞ্চায়েতের কোনো ভূমিকা নেই। এই প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদ জানালে পার্টির এক সমর্থকের উপর সে আক্রমণ করে। তাঁর নাক ফাটিয়ে দেয়, ফলে রক্ত ঝড়তে থাকে। অফিসের সামনে এই ঘটনা দেখে উপস্থিত কর্মীরা ছুটে গিয়ে প্রতিরোধ করে দুষ্কৃতিদের তাড়া করলে সে পালিয়ে যায়। এইভাবে ধুবুলিয়ার বুকে প্রকাশ্য দিবালোকে তৃণমূলের নজিরবিহীন গুন্ডামী ও সন্ত্রাস দেখা গেল। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়।

ঐ পঞ্চায়েত সদস্য এবং তার সাকরেদরা একজন ব্যক্তিকে ভুয়ো জমির মালিক বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পার্টি অফিসের পার্শ্ববর্তী জমি দখল করার চক্রান্ত করছে। অথচ ঐ জমিতে সিপিআই(এমএল)-এর অধিকার সামাজিকভাবে স্বীকৃত। পার্টি এই জায়গায় আমের বাগান দীর্ঘ কয়েকদশক ধরে পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছে। ধুবুলিয়ার মানুষ জানে যে এয়ারফিল্ড ও আরআর ডিপার্টমেন্টের জমিতে রেকর্ড হয় না। ফলে ভূয়া রেকর্ড করার কারণে ইতিপূর্বে ঐ ব্যক্তির মিথ্যা মামলা হাইকোর্টে খারিজ হয়ে গেছে। বেশ কয়েকবার ১৪৪ ধারা দায়ের করার পর সেগুলিও উঠে গেছে। আইন আদালতে সে কোন রায় পায়নি। বেগতিক বুঝে গায়ের জোরে ওরা জমি দখলের চক্রান্ত করছে।

সারা রাজ্যে তৃণমূলের দুর্নীতি যখন একেবারে খোলাখুলি হয়ে পড়ছে তখন তাঁদের আশ্রিত জমির দালালরা ধুবুলিয়ার বুকে বেআইনি দখলদারির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ ধুবুলিয়ায় সরকারী জায়গায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অফিস রয়েছে। এখানে পারস্পরিক সহনশীলতার এক পরিবেশ বজায় আছে। তাকে ওরা ধ্বংস করতে চাইছে। ক্ষমতার জোরে এই সন্ত্রাস ও পার্টি অফিসের জমি দখলের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সেই দিনই পার্টির পক্ষ থেকে স্থানীয় নেতাজী পার্কে বিক্ষোভ সভা সংগঠিত হয়। প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি জানানো হয় অবিলম্বে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এর পরদিন ধুবুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রচার কর্মসূচি চালানো হয়।

হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ধিক্কার এবং পার্টির প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে ব্যাপক মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সমগ্র এলাকা জুড়ে নিবিড় প্রচার এবং বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

memorandum-seeking-compensationgas-accident-in-nadia

গত ২৯ এপ্রিল ২০২৩ নদীয়া জেলার হরিণঘাটা ব্লকের উত্তর দত্তপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রন্ধনকর্মী অনিতা মন্ডল (৫৭) বিদ্যালয়ে গ্যাস দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হন। চিকিৎসার পরও তিনি গত ৭ মে প্রয়াত হন। পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের জেলা ও রাজ্য নেতৃত্ব খবর পেয়েই ছুটে যান ইউনিয়নের এই অগ্রণী সৈনিকের পরিবারের পাশে। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সহ ১০ জনের এক প্রতিনিধি দল ১৫ মে ব্লক আধিকারিকের সাথে সাক্ষাৎ করে মৃতার পরিবারের জন্য ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। একই সাথে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ও যথাযথ প্রশিক্ষণের দাবি করেন। রাজ্য নেত্রী জয়শ্রী দাস, জেলা নেতা অমিতাভ রায়, বিশ্বজিৎ বিশ্বাস ও স্থানীয় নেত্রী পারুল সরকার সহ অন্যান্যরা দ্রুত এই ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তোলেন। বিডিও প্রতিনিধিদলকে সাধ্যমত সব ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। দাবি আদায়ে দৃঢ় নেতৃবৃন্দ দ্রুত নদীয়া জেলাশাসকের কাছেও স্মারকলিপি দেবেন।

bishnupur-satgachia-local-conferencesatgachia-local-conference

গত ৭ মে ২০২৩, ২০তম বিষ্ণুপুর সাতগাছিয়া লোকাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কমরেড ওয়ারিশ খান নগর (বাখরাহাট) ও কমরেড মানকু মুর্মু মঞ্চে (বাখরাহাট অঃপ্রাঃ বিদ্যালয়)।

সম্মেলনের শুরুতে শহীদ স্মরণ কর্মসূচিতে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার। শহীদবেদীতে মাল্যদান করেন জেলা সদস্যা ও সম্মেলনের পর্যবেক্ষক কাজল দত্ত, দিলীপ পাল‌, শুভদীপ পাল, রমিশা বিবি, নুরজাহান বিবি, পূর্ণিমা হালদার সহ আরো অনেকে। এরপর সম্মেলন শুরু হয়। বক্তব্য রাখেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার। এরপর খসড়া প্রতিবেদন পাঠ করেন বিদায়ী লোকাল কমিটির সম্পাদক নিখিলেশ পাল। খসড়া প্রতিবেদনের উপর বক্তব্যের পর সংশোধন সংযোজনের পর খসড়া গৃহীত হয়। সম্মেলন থেকে ১২ জনের কমিটি নির্বাচিত হয়। সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন নিখিলেশ পাল। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে সম্মেলন শেষ হয়।

the-session-of-saotali-educationeducation-was-held-in-pandua

‘ভূরকৌ ইপিল’। ভোরের তারা — শুকতারা। ১৪ মে, পান্ডুয়ার তিন্না আদিবাসী পাড়ায় এই নামেই শুরু হল নতুন পাঠশালা — সাঁওতালি শিক্ষার আসর। আম, কাঁঠাল, যজ্ঞডুমুরের গাছের ছায়াঘন মুক্তাঙ্গনে পাঠশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্টজনেরা, বিশেষতঃ আদিবাসী সমাজের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রেমী মানুষ। অনুষ্ঠানের আনুপূর্বিক কাহিনী বলার আগে, প্রাসঙ্গিক কয়েকটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন।

প্রাক স্বাধীনতা যুগে ব্রিটিশ প্রভুদের একান্ত অনুগত জমিদারদের নিষ্ঠুর শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকদের অসংখ্য ছোট বড় বিদ্রোহ কৃষকদের সংগ্রামী চেতনা ও ঐক্যকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। যারফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাংলার কৃষকরা বিশেষত ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকরা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। আর কমিউনিস্ট পার্টির সান্নিধ্যে আসার পর বাংলার গরিব ভাগচাষি ও দরিদ্র কৃষকদের আন্দোলন নয়া ইতিহাস রচনা করে। ঐতিহাসিক সেই তেভাগা আন্দোলন আজও আমাদের ধ্রুবতারার মতো পথ চিনিয়ে দেয়। স্বাধীনতা উত্তরকালেও ভূমিহীন, গরিব ও ক্ষুদ্র কৃষকদের নেতৃত্বে খাস ও বেনামি জমি উদ্ধারের ছোট বড় সংগ্রামগুলি বৃদ্ধি পেয়ে এক সময় তীব্র বিষ্ফোরণ ঘটায়, সৃষ্টি হয় নকশালবাড়ির বিপ্লবী কৃষক অভ্যুত্থান। এ ইতিহাস মোটামুটি আমাদের সকলেরই জানা। এ’কথাও আমরা জানি, রাষ্ট্রবিরোধী একের পর এক ব্যাপক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তিই হল কৃষকদের সংগ্রামী জাগরণ বা অগণিত সংগ্রামী কৃষক।

কিন্তু বৃহৎ কৃষক সমাজের গঠন তো একমাত্রিক নয়। কৃষকদের মধ্যে রয়েছে নানা স্তর ও বিভিন্ন বর্গ। এক কথায়, পশ্চিমবাংলার কৃষক সমাজ অত্যন্ত বর্ণময়। আক্ষরিক অর্থেই, কৃষকদের এক বড় অংশের মধ্যেই রয়েছে বর্ণভেদ। উচ্চবর্ণের কৃষকরা অধিকাংশই ধনী ও সচ্ছল। নিম্নবর্ণের ক্ষুদ্র কৃষকরাই হাল চাষ করে আমাদের খাদ্য জোগান। আর তাঁদেরও নিচের ধাপে রয়েছেন দলিতরা — যাদের অধিকাংশই ভূমিহীন কৃষিমজুর, ঠিকা প্রথায় যারা মরশুম ভিত্তিতে ফসল চাষও করে থাকেন। সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের অধিকাংশই কৃষিজীবী। তাঁদের নিচের স্তরের অংশগুলি আর দলিত সম্প্রদায়ের ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক ও খেতমজুররাই সমস্ত কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্রভূমিতে থেকেছেন। আর এদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামের সামনের সারিতে থেকেছেন লক্ষ লক্ষ আদিবাসী কৃষক ও কৃষিমজুর। আমাদের পার্টির গণভিত্তি মূলত দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এই গ্রামীণ গরিবদের দ্বারাই পুষ্ট হয়েছে। আমাদের অগ্রণী, সংগঠক কমরেডরা দশকের পর দশক ধরে এদের মধ্যে পড়ে থেকেই কাজ করেন। তাঁদের জীবনচর্যা, লোক উৎসব, পালা পার্বণের সঙ্গে কমরেডরা নিজেদের অনেকাংশেই জড়িয়ে নিয়েছেন। তবু এই একাত্ম হওয়ার পথে আজও অনেক ফাঁক থেকে গেছে। যেমন আমরা বাংলায় কথা বলি। কিন্তু আদিবাসীদের ভাষা, সাঁওতালি ভাষা আমরা খুব কম জনেই জানি। একসাথে মিছিলে হাঁটি, মিটিংয়ে যাচ্ছি। তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষায় কথা বলছেন। আমরা প্রায় কিছুই বুঝছি না। মনে হয়, “এত কাছে, তবু বহু দূরে”। এই বেড়া ভাঙ্গবার জন্যই আমরা সাঁওতালি শিক্ষার পাঠশালা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই। এরফলে তাঁদের সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগ যেমন বাড়বে তেমনই বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে সাঁওতালি সাহিত্য-সংস্কৃতিরও আত্মীয়তা গড়ে উঠবে আরও সাবলীলভাবে।

বেলা সাড়ে এগারোটা। পাঠশালা আরম্ভের ঘোষিত সময় পার হয়ে যাচ্ছে। সাঁওতালি ভাষায় পঠন পাঠনের মুখ্য সঞ্চালক, বিভিন্ন ভাষায় সুপণ্ডিত অসিত বরণ রায় কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। কী দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত? ঠিক তখনই দেখা গেল, পার্শ্ববর্তী আদিবাসী ক্লাব থেকে বেঞ্চ বয়ে নিয়ে আসছেন এক যুবক। তিনি আর কেউ নন, স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক শ্রী উদয় মান্ডি স্বয়ং। চেয়ার, বেঞ্চ সাজাতে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল অয়ন্তিকা, আদিত্য, অনীতা, নন্দিতা, পৃথ্বিরাজের মতো আদিবাসী কিশোর কিশোরীরা। অসিতদার মুখে হাসি ফুটল। তাঁর সঙ্গে আসা ফরাসি কবি বের্নার সিন্তেজও চনমনে হয়ে উঠলেন। ক্রমে ক্রমে উপস্থিত হলেন আমাদের দুই মাননীয় অতিথি তথা শিক্ষক শ্রী লক্ষ্মণ হাঁসদা ও শ্রী দাশু মান্ডি। এসে পৌঁছলেন আয়ারলা’র দুই সুপরিচিত নেতা সজল অধিকারী ও নিরঞ্জন বাগ। এসে হাজির এআইকেএম নেতা বিনোদ আহির সহ আরও কয়েকজন। আজ অবশ্য তাঁরা কেবল কৃষিশ্রমিক নেতা বা কৃষক নেতা নন। তাঁরা আজ নতুন পাঠশালার শিক্ষার্থী। বেলা ঠিক বারোটায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠশালার সূচনা ঘটালেন আদিবাসী নেত্রী ময়না কিসকু। ইতিমধ্যে কুলিপুকুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার অনেক আদিবাসী মহিলাও এই নতুন পাঠশালার উদ্বোধনপর্বে উৎসাহ দিতে এসে পড়েছেন। অসিতদা শুরু করলেন, “নোয়া দ চেত্ কানা? (এটা কী?) অয়ন্তিকা, অনীতা, নন্দিতা — তিন আদিবাসী কিশোরী উত্তর দিল, “নোয়া দ বাহা দারে কানা” (এটা ফুল গাছ)। প্রকৃতির পাঠশালায় গাছগাছালি, প্রাণীদের দেখিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতে থাকল। ছাত্রছাত্রীরা সব খাতায় লিখে নিচ্ছেন। এক থেকে দশ অবধি সাঁওতালি ভাষায় সংখ্যা গোনাও শেখা হল। সবাই অত্যন্ত খুশী। অতিথি শিক্ষক লক্ষ্মণ হাঁসদা, দাশু মান্ডিরাও মাঝে মাঝে এই অনুশীলনে অংশ নিলেন। বেলা প্রায় দুটোয় প্রথম দিনের পাঠ শেষ হল। কেউ কেউ দাবি তুললেন, অলচিকিটাও শেখাতে হবে। আশ্বাস দেওয়া হল, ভবিষ্যতে সেটাও হবে। সকলে অঙ্গীকার করলেন, “সপ্তাহে একদিন করে এই ক্লাস চলতে থাকবে। তিন্না আদিবাসী পাড়ায় এই স্কুল যেমন চলতে থাকবে তেমনি অন্যত্রও ‘ভূরকৌ ইপিল’এর শাখা খোলা হবে।”

- মুকুল কুমার

medical-diploma-coursenew-capital-market
জনমত সংগ্রহ হোক

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে কয়েক দিন আগে জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার ৩ বছরের মেডিকেল ডিপ্লোমা কোর্স চালু করার চিন্তাভাবনা করছে। রাজ্যে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ডাক্তারের অভাব আছে (ডিমান্ড সাপ্লাই ডারসাম্যের অভাব), তা পূরণ করতেই এই সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আরো জানিয়েছেন, এজন্য ১৪ জনের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তাদের একমাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যদের বিশেষত্ব কি, এবং তাদের বিবেচ্য বিষয়, সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পদ্ধতি, জনগণের মতামত সংগ্রহের পদ্ধতি প্রকরণ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানানো হয়নি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে, বিশেষত ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিষয়টির ভালমন্দ নিয়ে চর্চার পরিবর্তে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে মমতা সরকার এইসব ভাবনা ও পরিকল্পনা করছে। আকাশে বাতাসে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব প্রশ্ন নস্যাৎ না করেও আমরা প্রধানত মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনা নিয়ে আলোচনার উপর জোর দেব। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্য থেকে এই প্রসঙ্গে যে মতামতগুলো উঠে এসেছে, তাও বিবেচনায় রাখব। সমস্যা হল, পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন বা পরিকল্পনা এখনও হাজির না করায় আমাদের মতামত চূড়ান্ত করার জন্য আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

এই প্রসঙ্গে ২০০৯ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার প্রায় একই ধরনের একটি প্রস্তাব হাজির করেছিল এবং একটা আইনও পাশ করেছিল (ওয়েস্ট বেঙ্গল রুরাল হেলথ রেগুলেটরি অথরিটি এ্যক্ট, ২০০৯) । কিন্তু সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লালগড় আন্দোলনের চাপে নড়বড়ে (লেম ডাক) সরকার ঐ আইনকে কার্যকরী করার বিশেষ কোন উদ্যোগ নিতে পারেনি। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এমনকি দলের মধ্যে এবং বামফ্রন্টের শরিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য না থাকায় ঐ ভাবনা ও আইনকে কার্যকরী করতে পারেনি। রাজ্যের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সুপ্রিমো সহ ছোট বড় নেতা ঐ আইন ও পরিকল্পনাকে প্রতারণামূলক বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন। তারপর ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল, ১২ বছর এই নিয়ে বিশেষ কিছু চর্চা হয়েছে বলে জানা যায় না। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেয়ালে নীল-সাদা বিপ্লব নিয়ে কিছু কথা হয়েছে, পূর্বতন সরকারের রাজত্বে রাজ্যের কলেজ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর যে অবস্থা ছিল, তার কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা এই নিয়ে কিছু তর্ক বিতর্ক হলেও ঐ আইনটি কার্যকরী করার কোনো কথাবার্তা হয়নি। ফলে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের রিপোর্টের উপরেই আমাদের আপাতত নির্ভর করতে হচ্ছে।

‘হোয়ার টু পুট দি নাইফ’, শল্য চিকিৎসা বইয়ের প্রথম পাতায় পেয়ে যাবেন এই নজরকাড়া উদ্ধৃতিটি। অস্ত্রোপচারের জন্য হাতের ছুরিটা ঠিক কোথায় বসাতে হবে, এটা নির্ধারণ করাটাই একজন শল্য চিকিৎসকের দক্ষতার মাপকাঠি। একইভাবে হাতের স্টেথোস্কোপটা ঠিক কোথায় বসাব, একজন চিকিৎসককে সেটাই নির্দিষ্ট করতে হয়। গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকের অভাব, কথাটা ঠিক বলে ধরে নিলে প্রশ্ন উঠবে — কেন অভাব? অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে যথোপযুক্ত/মোটামুটি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় শয্যা, ওষুধপত্র, রোগীর পথ্য, পানীয় জল ইত্যাদি প্রভৃতি মোটামুটি ঠিক আছে, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য লোকবল ও ব্যবস্থা আছে, প্রসূতি মায়ের ডেলিভারি ব্যবস্থা, প্রতিষেধক ও চেক-আপ ব্যবস্থা আছে। শুধু পাশ করা ডাক্তারের অভাব। কেন অভাব? দুটো সহজ উত্তর!

১) পাশ করা ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চায় না, অথবা        
২) এত পাশ করা ডাক্তার কোথায় পাওয়া যাবে?

প্রয়োজনীয় সংখ্যায় ডাক্তার তো তৈরি করা যাচ্ছে না। প্রথম কারণ সম্পর্কে বলা হয়, হেলথসেন্টারগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, ওষুধপত্র, নার্স ইত্যাদির‌ অভাব, এমনকি চিকিৎসকের বাসস্থান সমস্যা ইত্যাদি আছে। কেন অভাব? জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়ার সময় ৩/৪ বছরের জন্য গ্রামে সার্ভিস দেওয়ার বন্ড নেওয়া হোক। গ্রামে একটানা ৩/৪ বছর সার্ভিস দিলে পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সে ভর্তির সময় অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া হবে। এসব তো চালু করার কথা ছিল। হোলো না কেন? এখানেই মূল প্রশ্নটা জড়িয়ে আছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসক যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, বাকিগুলোর অভাব ডাক্তার পাঠিয়ে মেটানো যাবেনা। চিকিৎসা পিরামিডের শীর্ষে ডাক্তার রাখলেই চিকিৎসা পরিষেবা বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। এখানেই উঠে আসে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ ও তার rational ব্যবহারের প্রশ্ন।

১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনগুলো থেকে যত স্বাস্থ্য ক‌মিশন হয়েছে, তার প্রত্যেকটি গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা ও তার উপর নজর দেওয়ার কথা বলেছে। স্বাস্থ্য যে মাত্রায় বেসরকারি পুঁজি ও তার মুনাফার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে, ততই এই গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রাথমিকতা হারিয়ে গেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, ৫ বছরের এমবিবিএস কোর্স ছেটে কেটে ৩ বছরের কোর্সে ডাক্তার/হাফ ডাক্তার তৈরি করে গ্রামাঞ্চলে পাঠানো যেতেই পারে। কিন্তু প্রয়োজনীয় হাতে কলমে ট্রেনিং ছাড়া (ইন্টার্ন/হাউসস্টাফ শিপ) প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব/যুক্তিযূক্ত হবে কি? একটা চটজলদি উত্তর অবশ্য আছে। দেশ ও রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে তো নগ্নপদ ডাক্তাররাই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে, তাহলে ৩ বছরের কোর্স করে কেন করতে পারবে না? যুক্তিটাকে যদি একটু উল্টো দিক থেকে দেখা যায়, তাহলে তো বলতেই হয়, ৩ বছরের শিক্ষাই যদি যথেষ্ট হয়, তবে আর ৫ বছর সময় নষ্ট না করে গ্রামের জন্য তিন বছরের ডাক্তার তৈরি করা যাক। কিন্তু এরাইবা কেন নার্সিংহোম/হাসপাতালগুলোতে এই রুরাল হেলথকেয়ার প্রোভাইডার সার্টিফিকেট হাতে নিয়েই চিকিৎসায় যুক্ত হবেন। সবই আশঙ্কা। এই সার্টিফিকেট হাতে নিয়েই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে যে চিকিৎসা ব্যবস্থা চলবে, তা ‘রেফারাল সিস্টেম’কে আরও শক্তিশালী করবে। টারশিয়ারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ভিড় এখনই উপচে পড়ছে। আরও পড়বে।

এই আশঙ্কা আরো দৃঢ় হয়েছিল, ২০০৯ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল রুরাল হেলথ রেগুলেটরি অথরিটি এ্যক্ট ২০০৯’র ৮নং ধারার ২নং উপধারায় নজর দিয়ে। দেখা যাবে, ৩ বছরের জন্য মেডিকেল সার্ভিস প্রোভাইডার (সহজ ভাষায়, গ্রামীণ চিকিৎসক) তৈরির এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দায়িত্ব দ্রুত চলে যাবে প্রাইভেট পুঁজির হাতে। যেভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা কোর্সের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইভেট পুঁজির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ৩ বছরের ডাক্তার তৈরির নতুন বাজার খুলে যাবে। ২০০৯ সালের ঐ বিল/আইনের বিরুদ্ধে এটাই ছিল একটা বড় আপত্তি। অবশ্য ২০০৯ সালের ঐ আইনে স্পষ্ট বলা আছে (১৭নং ধারার ৪নং উপধারা), রুরাল হেলথ প্রাকটিশনার্শরা নামের আগে কিংবা পরে ডক্টর বা ডাঃ লিখতে পারবেন না। অবশ্য বর্তমান সরকার এখনও কোন আইনের প্রস্তাব রাখেনি বা পুরানো আইন অনুসরণ করবে একথাও জানায়নি। পুঁজির দৌরাত্ম্যে ইন্ডিয়া আর ভারতকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না। মুনাফালোভি লগ্নিপুঁজি চিকিৎসা ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামকে আলাদা বিন্যস্ত করে দিয়েছে। এমডি, এমআরসিপি, এফআরসিএস শহরের মানুষের জন্য আর ট্রেনিং প্রাপ্ত কোয়াক কিংবা ৩ বছরের ডাক্তারবাবু গ্রামের মানুষদের জন্য। গ্রাম ও শহরের বুনিয়াদি দ্বন্দ্ব সমাধানের কথা মার্কস বলেছিলেন, আগ্রাসী পুঁজি তার বিপরীতে আমাদের হাঁটতে বলছে। চিকিৎসক মহলে এবং বৃহত্তর সমাজে এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একে সংগঠিত করতে হবে। স্বাস্থ্যের মতো সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না।

- পার্থ ঘোষ

anarchy-in-the-education-sectoreducation-sector-of-the-state
৩৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল ঘোষণা

সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত প্রায় ৭ বছর ধরে নিয়োজিত ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি বাতিল ঘোষণা হল। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, অনিয়ম প্রভৃতি নিয়ে গত কয়েকবছর ধরেই মামলা, তদন্ত, নগদ উদ্ধার, জেল জরিমানা সবই চলছে। রাজ্যের মন্ত্রী, আমলা, নেতা জেলবন্দি। শেষ পদক্ষেপ হল, গোটা নিয়োগটাই প্রায় বাতিল।

কিন্তু, মামলায় বঞ্চিত ও সরকারপক্ষ সকলের কথা শোনা হয়েছে। চাকরি প্রাপকদের কথা কি শোনা হল? একথা কেউই বলতে পারেননা যে, বাতিল সমস্ত শিক্ষকই অযোগ্য বা বেআইনি পথে চাকরি পেয়েছেন?

তাহলে, শাস্তি ঘোষণার আগে এমনকি ফাঁসির আসামির কথা যদি শোনা যায়, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথা কেন শোনা হল না?       
প্রথমত, সংরক্ষণ বিধি যদি না মানা হয় তবে বঞ্চিতদের থেকে বর্তমান শূন্যপদে সেই নিয়োগ হতেই পারত।

দ্বিতীয়ত, অপ্রশিক্ষিত নিয়োগকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা কমিশন (NCERT) স্বীকৃতি দিয়েই তো ২০১৬ সালে নির্দেশ জারি করে ২০১৯ পর্যন্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ চাকুরীরত শিক্ষকদের দেওয়া হয়। বর্তমানে কর্মরত কোনো শিক্ষকই অপ্রশিক্ষিত নেই।

তৃতীয়ত, যারা সব যোগ্যতার ঊর্ধে শুধু দুর্নীতির যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন, তাদের বিছিন্ন করে বরখাস্ত করা যেতই। এবং সেটা রাজ্য সরকারের ঘোষিত নিয়োগ মাপকাঠির বিচারেই করা যেত।

বিরাট সংখ্যক শিক্ষক যারা বৈধভাবে সরকারি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে চাকরি পেয়েছেন, তারা কেন হয়রানির শিকার হবেন?

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যা কিছু বেনিয়ম তার দায় শিক্ষা দফতরকে বহন করতে হবে। একথা বলার চেষ্টা হচ্ছে, বর্তমান শিক্ষকদের নতুন করে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে, নয়তো ছাঁটাই। এটা নিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন। কর্মচারীর গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ। কোনো নতুন শর্তের দ্বারা পুরোনো শর্ত বাতিল করা যায় না। তাহলে, যেকোনো কর্মরত সরকারী কর্মচারীর নিয়োগ প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে বর্তমানে তাকে পুনরায় যোগ্যতা প্রমাণের পরীক্ষা দিতে হতে পারে। যেটা ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে বাধ্য।

প্রশ্নটা চাকুরিরত শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রতি দয়াদাক্ষিণ্য নয়, তাদের আইনি, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন। এই প্রশ্নেই আইনি ও রাস্তার লড়াই করে রাজ্যের শিক্ষক সমাজকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

রাজ্যের সামগ্রিক সরকারি শিক্ষা-কাঠামো এক সংকটের মধ্যে। ইতিমধ্যেই ৮৭০২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় তুলে দেবার কথা শোনা যাচ্ছে। এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় দেখা গেল, ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। এই পরিণতির উৎস কোথায়? দীর্ঘদিন বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, পরিকাঠামোর অভাব ছাড়াও বাংলার শ্রমজীবীদের ভয়ঙ্কর আর্থিক সংকট অন্যতম। রাজ্য সরকারের সিলেবাস কমিটি যেখানে শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষকের সুপারিশ করে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের ৩০:১ অনুপাত কিভাবে রাজ্য মেনে নেয়? এই অনুপাত হতে পারে সর্বোচ্চ ক্ষেত্রে। কিন্তু, বিদ্যালয়গুলোতে নূন্যতম শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষক ছাড়া চলতে পারে?

এই নীতিমালা পূরণ করতে হলেই রাজ্যের বর্তমান প্রশিক্ষিত বড় অংশ নিয়োগ হতে পারে।

নিয়োগ প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা কেবল পদ্ধতিগত নয়, দৃষ্টিভঙ্গিগত। রাজ্যের সামগ্রিক বিদ্যালয় শিক্ষাকে জনমুখী করতে যে আন্তরিক উদ্যোগ প্রয়োজন তারই সংকট। কেবল ৬০০ টাকার জুতো, জামা দিয়ে স্কুলছুট যে ঠেকানো সম্ভব নয় তা আমরা দেখছি।

পরিশেষে, বর্তমান শিক্ষক ছাঁটাই এক সামগ্রিক সরকারি শিক্ষা সংকট হিসাবেই দেখতে হবে। শিক্ষার অধিকার, শিক্ষকের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে আসুন জোট বাঁধি।

- অজয় বসাক

threatened-by-technologythreatened-by-technology

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা শব্দবন্ধটা বেশ অদ্ভুতুড়ে। মনে হয় বুদ্ধি তো বুদ্ধিই সেটার আবার আসল নকল কী! কিন্তু মানুষ তো সাধারণ জীব নয়, অপার তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা। দীর্ঘদিনের বিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত তার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, উৎকর্ষতা, গভীরতা অভুতপূর্ব ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটা পর্যায়ে এসে সেই বুদ্ধি সে যন্ত্রে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছে। এই যন্ত্র যখন মানুষের মতো বুদ্ধি প্রদর্শন করতে শুরু করে কিংবা মানুষের বুদ্ধি থেকে তার পৃথকীকরণ করা যায় না, তখন সেটাকে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বলে। এই বুদ্ধি মানুষের বুদ্ধির চেয়ে বহুগুণ দ্রুত, পরিমাণগত ভাবে অনেক বেশি কাজ করতে পারে, যদিও উৎকর্ষতা আরও বেশি কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। একজন রেডিওলজিস্ট যেখানে ১০,০০০ প্লেট এক্সরে পরীক্ষা করতে পারে, সেখানে যন্ত্র করতে পারে সেটার অন্তত দশগুণ। যন্ত্র ক্লান্তিহীন এবং এর স্মৃতিশক্তি বিস্ময়কর, বিপুল পরিমাণে তথ্য সঠিক ও নির্ভুলভাবে মনে রাখতে পারে এবং চটজলদি তা পুনরুদ্ধার করতে পারে। এখন যন্ত্র কথা বুঝতে পারে, মুখ চিনতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে, অনুবাদ করতে পারে (যদিও তা এখনো ত্রুটিমুক্ত তা বলা যায় না), মানুষের সহায়তা ছাড়া অনেক কাজ করতে পারে। মানুষের বুদ্ধির সাথে মেশিনের বুদ্ধি যুক্ত হওয়ার কারণে আমাদের চারিপাশ অতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, জীবন ও জীবিকার এক আমূল এবং অপরিবর্তনীয় রূপান্তর ঘটছে।

কম্পিউটারের সাথে আমাদের পরিচয় হয় নব্বই দশকে। মাত্র দশ বছরের মধ্যে আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারে সড়গড় হয়ে উঠি। সেখান থেকে মাত্র পনেরো বছরে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার জগতে আমাদের প্রবেশ। মাত্র তিরিশ বছরে প্রযুক্তির এই উল্লম্ফন বিস্ময়কর! অথচ সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম সাড়ে পাঁচ হাজার বছর যন্ত্রের সাথে মানুষের পরিচয় ছিল নগণ্য, তখন যাবতীয় কর্মকান্ড হতো দৈহিক শ্রমের মাধ্যমে। আঠেরোশো শতাব্দীতে এলো বাষ্পশক্তি, একশো বছর বাদে বিদ্যুৎ। এই দুইয়ের আবিষ্কারকে যথাক্রমে বলা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু এবং তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সূত্রপাত। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগ শুরু। প্রযুক্তি এখন উল্কার গতিতে এগিয়ে চলেছে। এখন তা রৈখিক গতির পরিবর্তে দৃষ্টান্তমূলক (exponential) গতিতে ধাবমান যারফলে প্রযুক্তির এক বিস্ফোরণ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। 

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে কাজ করছে? ধরা যাক মোবাইলে গুগলে গিয়ে নিজের নাম লিখছি। পঞ্চম অক্ষরে মোবাইল আমাকে চিনে ফেললো, পুরো নাম স্ক্রিনে চলে এলো, একটা স্পেস দিলে পদবিও চলে এলো। একই সাথে পাশে আমার ইমেল ঠিকানাও এসে গেল। অর্থাৎ মেশিন আমার নাম, পদবি, ঠিকানা মনে রেখেছে, প্রাথমিক কিছু ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র তা জানিয়ে দিচ্ছে। ধরা যাক অ্যামাজন থেকে আমি ফেলুদার বই কিনেছি। পরের দিন থেকে ফেসবুক খুললেই দেখা গেল ফেলুদার বিভিন্ন বইয়ের বিজ্ঞাপন আমার দিকে ধেয়ে আসছে — ফেলুদা সমগ্র, ফেলুদা একাদশ, কলকাতায় ফেলুদা ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ মেশিন আমার পছন্দ জেনে গেছে এবং আরও বইয়ের জানান দিয়ে আমাকে প্রলুব্ধ করছে। কিংবা গড়িয়াহাটের কোনো দোকান থেকে আমি জকির টি-শার্ট কিনে ডেবিট কার্ডে পয়সা দিয়েছি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নানা ব্র্যান্ডের টি-শার্ট দেখিয়ে মেশিন আমাকে নাজেহাল করে দেবে। পাশাপাশি দেখাচ্ছে গুগল-পে (অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থা যা দিয়ে টাকাপয়সা লেনদেন করা যায়, বিভিন্ন বিল মেটানো যায়) দিয়ে যদি আমি দাম দিতাম তাহলে আমি ১০ শতাংশ ছাড় পেতাম। এই ছাড়ের লোভে আমি গুগল-পে ব্যবহার শুরু করব। এইভাবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা নানা পণ্যে প্রলুব্ধ করে আমাকে ভোগবাদে নিমজ্জিত করবে, অনলাইন পেমেন্টে আমাকে জড়িয়ে দিয়ে আমার অর্থনৈতিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটার ওপর নজরদারি করবে।

কিন্তু মানুষের জীবিকা, কাজের, ব্যবসার কী ক্ষতি করছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা? আমি আগে পাড়ার দোকান থেকে বই কিনতাম। কোনো বই না পেলে দোকানি আমাকে কলেজ স্ট্রিট থেকে সেই বই এনে দিতেন। এখন কে আর এই গরমে ঠেঙিয়ে বাইরে বেরোবে? তার চেয়ে ঠাণ্ডা ঘরে বসে মোবাইলে টেপাটেপি করে অ্যামাজনে অর্ডার দিয়ে দিলাম। দু’দিনে বই পৌঁছে গেল, একেবারে হাতেগরম! এই করে পাড়ার বইয়ের দোকান উঠে গেল। পাড়ার মুদির দোকানগুলো ধুঁকছে। বহু বাড়ির মাসের বাজার হয় এখন বিগ বাস্কেট বা ব্লিঙ্কেট (অনলাইন মুদিখানা) থেকে। বাড়িতে হঠাৎ দশ-বারো জন লোক খাবে, কে আবার বাজার করতে যাবে? লিসিয়াসকে ফোন করে মাছ মাংস বলে দাও, ব্লিঙ্কেটকে বলে মশলা আনাজপাতি আনিয়ে নাও। কী সুবিধা! আমরা খলবল করে উঠি। খেয়াল করি না এই ‘সুবিধার’ কারণে কতো ব্যবসা, রুটিরুজি তলিয়ে গেল। নাকের ডগায় এটিএম থাকার কারণে এবং অ্যাপের মাধ্যমে কেনাকাটা অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কারণে বাড়িতে এখন ক্যাশ পয়সা কমই থাকে। এক যুবক বাড়িতে টিভির কেবলের পয়সা নিতে আসে কিন্তু ক্যাশ না থাকার ফলে তাকে বারবার ফিরে যেতে হয়। তাকে একদিন বললাম গুগল-পে দিয়ে টাকা ট্র্যান্সফার করে দেব। তার মুখটা শুকিয়ে গেল। বলল, আরও কয়েকজন এরকম বলছে, তাহলে তো দাদা আমার কাজটা আর থাকবে না!

তা এই হল অবস্থা! প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষের জীবিকার ক্ষেত্রে চরম আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। প্রতিটি শিল্প বিপ্লবের ফলে দৈহিক শ্রমের ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। যন্ত্র বহু মানুষের কাজ কেড়ে নিয়েছে, মানুষ ক্ষিপ্ত হয়েছে, মেশিন ভাঙচুর করেছে। লুডাইতদের সম্পর্কে আমরা প্রত্যেকেই অবহিত, যাঁরা কাজ চলে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে কাপড়ের কল ভেঙে ফেলেছিল। এখন কী ধ্বংস করবে? গুগল-পে ধ্বংস করবে? সেটা তো অননুভবনীয়, ধরা ছোঁয়ার বাইরে, ইন্ট্যাঞ্জিবল! অ্যামাজন কোথা থেকে বই পাঠাচ্ছে? সেখানে গিয়ে হামলা করবে? কলকাতায় কি অফিস আছে তাদের? সেখানেই কি বই আছে, নাকি বহু শহরের গুদামে ছড়ানো?

লেখাটা লিখছি হঠাৎ মোবাইলে একটা খবর ভেসে উঠলো, অ্যামাজন ভারতে ৫০০ জন কর্মচারি ছাঁটাই (লে-অফ) করেছে। বিশ্বে ৯,০০০ ছাঁটাইয়ের এটা একটা অংশ মাত্র। একই সাথে কোম্পানি জানাচ্ছে যে এদের মধ্যে কিছু লোককে ‘রিলিজ’ করা হবে, বাকিদের ‘রিএসাইন’, অর্থাৎ অন্য কাজে যুক্ত করা হবে। একই বিবৃতিতে দু’রকম কথা! গত নভেম্বরে কোম্পানি ১৮,০০০ কর্মচারিকে ‘রিলিজ’ করার কথা ঘোষণা করেছিলো, যারমধ্যে ১,০০০ ভারতে। দৈত্যকায় কর্পোরেট কোম্পানিগুলোতে ছাঁটাইয়ের সুনামি শুরু হয়েছে। এলন মাস্ক ট্যুইটার কেনার পর ৭,৫০০ কর্মী বাহিনীর প্রায় ৫০ শতাংশ ছাঁটাই করে দিয়েছেন, সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করেছেন, দৈনিক বারো ঘণ্টা কাজ চালু করেছেন। মেটা ১১,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। এয়ারবিএনবি ২৫ শতাংশ, স্ন্যাপচ্যাট ২০ শতাংশ, উবের ১৪ শতাংশ কর্মী বিদায় করেছে। শুধুমাত্র টেক কোম্পানিগুলোতে ইতিমধ্যেই ৭৮০টির অধিক সংস্থায় ১,২০,০০০ কর্মীর চাকরি গেছে। কোম্পানিগুলি কারণ দেখাচ্ছে যে করোনাকালে টেক সংস্থাগুলির ব্যবসা বিপুল বিস্তার লাভ করায় প্রচুর কর্মী নিয়োগ করা হয়। মহামারী স্তিমিত হওয়ার পর ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ার কারণে এখন আর অতো কর্মীর প্রয়োজন নেই। সুতরাং ছাঁটাই। এটা অংশত সত্যি। আসল কারণ হচ্ছে প্রযুক্তির উল্লম্ফন। টেক কোম্পানিগুলিতে কাজের ব্যাপক রোবটিকরণের কারণে বহু কর্মী অতিরিক্ত হয়ে পড়েছে। পাঁচজন কর্মীর কাজ এখন একটা রোবট করে দিচ্ছে। কোম্পানি রোবটের জন্য একবার খরচ করছে, পাঁচ শ্রমিককে বাতিল করে দিচ্ছে। মজুরি, বোনাস, মেডিক্যাল ইত্যাদি দেওয়ার কোনো গল্প নেই, পিএফ-পেনশনের ঝামেলা নেই, মুনাফা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সমাজে অভুতপূর্ব অসাম্য তৈরি হচ্ছে। কিছু লোক বিশ্বের সর্বোত্তম ধনীদের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছে, বিপুল বিশাল সংখ্যক মানুষ হয় কাজ হারাচ্ছে, নয় নুন্যতম মজুরি পেয়ে কোনরকমে দিন গুজরান করছে। বিনিয়োগ কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতে ৩০ কোটি কাজ শ্রেফ হারিয়ে যাবে নয় সেগুলির মূল্য, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে।

‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ তাদের ফিউচার অফ জবস, ২০২৩ রিপোর্টে নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে যে ভীতি তৈরি হয়েছে সেটাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছে। তাও তাদের সমীক্ষায় যে কোম্পানিগুলি অংশগ্রহণ করেছে তাদের অর্ধেক মনে করে নতুন প্রযুক্তি কাজের বাজারে সদর্থক প্রভাব ফেলবে, বাকিরা মনে করে সেটা ক্ষতি করবে। জানা যাচ্ছে ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের ৩৪ শতাংশ এখন মেশিন দ্বারা হয়, যা ২০২৭এ ৪২ শতাংশ হবে। কাজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে যারফলে ১.৪ কোটি মানুষের চাকরি যাবে। অফিসকাছারির কর্মচারী, ক্যাশিয়ার, ডেটা অপারেটার, আধিকারিক, সেক্রেটারি ধরনের কাজ, আইনি পেশার নিম্নস্তরের কাজ সবচেয়ে বেশি বাতিল হবে। ২০২৭এ এঁদের কাজের সংখ্যা বিপুলভাবে হ্রাস পাবে — ২.৬ কোটি! ঐ বছরের মধ্যে ১০ জন শ্রমিকের মধ্যে ৬ জনকে ‘রিস্কিল’ অর্থাৎ নতুন করে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। হায় রে! আমাদের দেশে কাজ চলে যাওয়া শ্রমিকের তো নতুন করে দক্ষতা অর্জনের কোনো ব্যবস্থাই নেই।

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকরণ এবং প্রযুক্তির সব নবতর রূপের কারণে আমরা আজ একটা দুর্গম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। উৎপাদন শিল্প প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিকের কাজ চলে গেছে। পরিষেবা শিল্পে বহু কাজ নিঃশব্দে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে ব্যাংকে এখন হাতে গোনা কয়েকজনকে দিয়ে কাজ চালানো হয়। এতে কোনো প্রতিবাদ হয় না। কারণ মানুষের ঘরের কাছে এটিএম আছে, বিভিন্ন পেমেন্ট অ্যাপ আছে। এটা পরিস্কার, নতুন প্রযুক্তির কারণে স্থায়ী চাকরির দিন শেষ। এখন কাজ অস্থায়ী, এমনকি ক্ষণস্থায়ী। কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক, ইন্সিওরেন্স, এমনকি সরকারি অফিস খালি। রাস্তায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার কর্মীদের ভিড় বাড়ছে। জীবন বাজি ধরে, কাঁধে পেল্লাই ব্যাগ নিয়ে মধ্যরাতে রাজপথ দিয়ে বাইকে ছুটে যায় ডেলিভারি ওয়ার্কার। খাবারটা পৌঁছাতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে আগামীকাল তার আর কাজ থাকবে না। এটাই আজকের বাস্তব! এই নতুন যুগের জন্য চাই নতুন চিন্তা, মুক্ত চিন্তা, সাবেকি ধারণা বিবর্জিত সংগঠন ও নেতৃত্ব।

- সোমনাথ গুহ

the-country-going

    
সারা বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১ নম্বরে ঠাঁই হল ভারতের। ‘দ্য রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’এর এই সূচকে ২০২১ সালে ভারত ছিল ১৪২ নম্বরে, ২০২২ সালে ১৫০ নম্বরে। অর্থাৎ পরপর দু’বছর, বিশেষত গত একবছরে ১১ ধাপ নেমে গেল ভারত। এদেশে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হিংসা ও আইনের অপব্যবহারের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমেরও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ওঠার কথা উল্লেখ করে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স বলেছে, “প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ট ধনকুবেররা সংবাদমাধ্যম অধিগ্রহণ করায় বহুত্ববাদের ক্ষতি হয়েছে।” সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি ‘সমস্যাসঙ্কুল’ থেকে ‘খুব খারাপ’ হয়ে উঠেছে। এমনকি একাধিকবার সামরিক শাসন দেখে আসা পাকিস্তানও সাত ধাপ উঠে ১৫৭ নম্বরে রয়েছে। তালিকার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে, সবার নীচে উত্তর কোরিয়া।

(আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ মে ২০২৩)

country     
আগামী বছর লোকসভা ভোট। তার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিকে ‘অরাজনৈতিক’ মোড়কে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার কৌশল নিয়েছে বিজেপি। ‘বিশ্বগুরু’র পাশাপাশি তাঁকে ‘দেশের শিক্ষাগুরু’ হিসাবেও তুলে ধরতে অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের সামনে হাজির করা হবে। যাদের ভোটদানের বয়স হয়নি, দেশের সর্বোচ্চ আসন থেকে তাদের বার্তা দিলে তার যথেষ্ট প্রভাব অভিভাবকদের উপরে পড়বে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের প্রস্তুতি তুঙ্গে। চিঠির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক এবং ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট’এর পক্ষ থেকে এই বছরের মাঝামাঝি প্রকাশ করা হবে নতুন ক্যালেন্ডার। সেই ক্যালেন্ডারে প্রত্যেক মাসে থাকবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি সহ সংলাপের চিত্ররূপ। ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয়ে নীতিশিক্ষা দিতে দেখা যাবে প্রধানমন্ত্রীকে।

(আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ মে ২০২৩)

dalits-not-have-the-right-to-love75-years-of-independence

সম্প্রতি দলিত হিউম্যান রাইটস্ ডিফেন্ডার নেটওয়ার্ক (ডিএইচআরডিনেট) ও ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ উইমেন লিডারস্ (এনসিডবলিউএল) যৌথভাবে সাতটি রাজ্যে তৃণমূল স্তরে অনুসন্ধান ও সমীক্ষা করে অত্যন্ত উদ্বেগজনক তথ্য সামনে তুলে ধরেছেন। ওই সাতটি রাজ্য হল — হরিয়ানা, বিহার, গুজরাট, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র এবং উত্তরপ্রদেশ। ২০১২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত নানা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান চালিয়ে এমনটাই সামনে উঠে আসছে। দেখা যাচ্ছে, দলিতরাই সবচেয়ে বেশি শিকার ‘সম্মানার্থে হত্যার’ নির্মম, মর্মান্তিক ঘটনায়।

যে ২৪টি ঘটনা তারা অনুসন্ধান করেছেন, তারমধ্যে ২০টি ক্ষেত্রেই ছেলেটিকে হয় খুন করা হয়েছে, নতুবা পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়েছে। আর, এই সমস্ত ক্ষেত্রে অপরাধীরা হল যার সাথে সম্পর্ক ছিল, তাঁদের পরিবারের লোকজন। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নিহত বা গুরুতর আহত ব্যক্তিরা সকলেই তপশিলি জাতি ভুক্ত। উঁচু জাত থেকে আগত মহিলাদের সম্পর্ক বা বিয়ে ভাঙা, শিক্ষার জগত থেকে সরিয়ে নেওয়া, অপহরণ করে অজানা স্থানে নিয়ে চলে যাওয়া, হত্যা বা নির্মমভাবে পেটানোর ঘটনা ঘটেছে। যে দু’জন মহিলা খুন হয়েছেন, তাঁরা ছিলেন ওবিসি থেকে আগত, আর আরেকজন ছিলেন ডি নোটিফাইড ট্রাইবস্ কমিউনিটি থেকে।

এই সমস্ত ঘটনাই দেখিয়ে দিয়েছে, উঁচু জাতের যে সমস্ত মহিলা জাতপাতের বেড়া ভেঙে নিজেদের পছন্দসই জীবন সঙ্গী বেছেছেন তাঁদের রাখা হয়েছে কঠোর নজরদারির মধ্যে, তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ওই সমস্ত মহিলাদের গতিবিধির উপরও নানান নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সুখী গৃহকোণের আশায় তাঁরা পছন্দের জীবনসঙ্গীকে ঠিক করার ‘অপরাধে’ নিজের পরিবারের বা বৃহত্তর সম্প্রদায়ের নারী-বিদ্বেষী পুরুষদের কাছ থেকে নির্মম দমনের সম্মুখীন হয়েছেন।

হরিয়ানা

হরিয়ানায় সংগঠিত চারটি ঘটনা ওই রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে যা সংগঠিত হয় ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০২০ সালে। প্রতিটি ঘটনার এক সাধারণ যোগসূত্র রয়েছে — ভিন্ন জাতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নিদারুণ ঘৃণা উগড়ে দেওয়া হয়েছে।

একটা ক্ষেত্রে দেখা যায়, উঁচু জাতের মহিলার পরিবারের ব্যক্তিরা নিজের ঘরের মহিলাকে খুন করার জন্য গুন্ডাদের ভাড়া করে। খুন হওয়ার পর তপশিলি জাতিভুক্ত ছেলেটি গা ঢাকা দেয় এই কারণে যে মেয়েটির পরিবার তাঁর বিরুদ্ধে মেয়েটিকে অপহরণ করে খুন করার অভিযোগ পুলিশের কাছে দায়ের করে। আরেকটি ক্ষেত্রে দেখা গেল, জাঠ পরিবারের মেয়েটিকে বিষ পান করতে বাধ্য করা হয়। তারপর গোপনে তার মৃতদেহের সৎকার করে দেয়।

সোনিপাতের খাড়াখোদায় গোটা দলিত পরিবারকে নিকেষ করা হয়। এই দলিত পরিবারের একটি ছেলের সাথে জাঠ পরিবারের মেয়েটির বিয়ে হয়। এদের চার বছর আগে বিয়ে হয়, তাঁদের তিন বছরের এক সন্তানও ছিল। ভাড়া করা গুন্ডাদের দিয়ে ছেলেটির পরিবারকে আক্রমণ করা হয়। তাতেই খুন হন ছেলেটি নিজে, তাঁর পিতা মাতা সহ তাঁর ভাই ও ভ্রাতৃবধু।

গুজরাট

২০১২ থেকে ২০১৯’র মধ্যে গুজরাটে সংগঠিত তিনটি ‘সম্মান হত্যা’র ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলগুলো হল — মেহসানা, গান্ধিধাম এবং ঊনা।

একটা ক্ষেত্রে এক দলিত ছেলের সাথে কোলি সম্প্রদায়ের মেয়ের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটি তাঁর পরিবার থেকে পালিয়ে এই দলিত ছেলেটির বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করে। এই কারণে, মেয়েটির পরিবারের লোকজন ছেলেটির বাড়িতে চড়াও হয়ে মেয়েটিকে জবরদস্থি বার করে ছেলেটিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে।

আমেদাবাদে, এক ২৫ বছরের দলিত যুবককে খুন করা হয়। খুন করে তাঁর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ উঁচু জাতের মেয়েটির পরিবারের লোকজন। পুলিশ জানায়, মেয়েটির পরিবারের লোকজনের সামনে এই খুনের ঘটনা ঘটে।

বিহার

মজফ্ফরপুর, ঢাকা, ও রোহতাসে তিনটি ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে একটি ক্ষেত্রে এক দলিত ছেলের সাথে ওবিসি থেকে আগত একটি মেয়ের সম্পর্ক হয়। ১৮ মাস সম্পর্ক থাকার পর তাঁরা গোপনে গুজরাটের এক মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে। তারপর বাড়ি ফিরে আসার পর মেয়েটির পরিবার এক গল্প ফাঁদে, পুলিশে নালিশ করে, ছেলেটি ভয়ে পালিয়ে যায়, মেয়েটি তীব্র মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়। এরপর পরিবারের লোকজন তাদের পছন্দসই এক ছেলের সাথে মেয়েটির বিয়ে দেয়।

এই ধরনের আরও ঘটনা ঘটেছে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে। ঘটনাক্রম প্রায় একই ধরনের। শুধু স্থান কাল পাত্রপাত্রী ভেদের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা। উল্লিখিত সংস্থাটি জানিয়েছে, এই ধরনের ঘটনা অনেক বেশি তলে তলে ঘটছে। কিন্তু তা প্রচারের আলোতে কমই আসছে। পুলিশ প্রশাসনও তা সংবাদমাধ্যমের সামনে আনতে চায়না নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য।

স্বাধীনতার অমৃতকালে এই মধ্যযুগীয় বর্বরতা রমরমিয়ে চলছে। বিজেপি-আরএসএসের নারী বিদ্বেষী মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ এই সমস্ত ঘটনার পালে হাওয়া লাগাতে অনেক বেশি সাহায্য করেছে।

(তথ্যসূত্রঃ নিউজ ক্লিক, ৩ এপ্রিল ২০২৩)

mrinal-Sen-birth-centenary-tributemrinal-Sen

(বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের জন্ম শতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখাটি আমরা প্রকাশ করছি। - সম্পাদকমণ্ডলী)

মৃণাল সেনের জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ মে, ওপার বাংলায়। কৈশোর কাটিয়ে চলে আসেন কোলকাতায়। স্কটিশ চার্চ কলেজ ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনো করেন পদার্থবিদ্যা নিয়ে। বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে থেকেছেন সেই সময় থেকেই, অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না।

চলচ্চিত্র নির্মাণ পর্বের আগে চলচ্চিত্র নিয়ে তাত্ত্বিক পড়াশুনো ও লেখালেখি শুরু করেছিলেন মৃণাল সেন। রুডলফ আর্নহেইমের ফিল্ম ‘এসথেটিকস’, নীলসনের সিনেমা ‘অ্যাজ এ গ্রাফিক আর্ট’এর মতো বই তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। নিয়মিত সিনেমা দেখতেন ফ্লিম সোসাইটিতে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ধারাকে এর মধ্যে দিয়ে তিনি আত্মীকরণ করেন। তবে তাঁর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব সম্ভবত ছিল ষাটের দশকে ফরাসী সিনেমার নিউ ওয়েভ ধারার। মনে রাখতে হবে সত্যজিতের সিনেমার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল চল্লিশের দশকের নিও রিয়ালিজমের। নিউ ওয়েভ তার দু’দশক পরের সিনেমা আন্দোলন।

মৃণাল সেনের প্রথম দিককার সিনেমায় আখ্যানের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, পরে সেখান থেকে তিনি সচেতনভাবেই খানিকটা সরে আসেন। জঁ লুক গোদারের সিনেমার মতই মৃণাল সেনের সত্তর দশকে নির্মিত বিখ্যাত সিনেমাগুলিতে ন্যারেটিভের ভাঙচুর আমরা দেখতে পাই। সত্তরের উতরোল দিনগুলির সঙ্গে এই চলচ্চিত্র টেকনিক চমৎকার খাপ খেয়েছিল। বস্তুতপক্ষে মৃণাল সেনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল সরাসরি পলিটিক্যাল সিনেমা বানানোর ঋজু সাহস এবং সিনেমার প্রকরণ নিয়ে অজস্র পরীক্ষা নিরীক্ষা।

১৯৫৫ সালে যখন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পাচ্ছে, সে সময়েই তাঁর প্রথম ছবি নির্মিত হয়, ‘রাতভোর’। ‘পথের পাঁচালী’র চূড়ান্ত সাফল্যের উল্টোদিকে এটিকে বেশ অসফল প্রয়াসই বলতে হয়। মৃণাল সেন নিজেই ছবিটিকে আখ্যাত করেন অত্যন্ত জঘন্য বলে। উল্লেখ করার মতো তথ্য হল এই সিনেমায় উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন, যদিও তিনি চলচ্চিত্র মহলে তখন উল্লেখযোগ্য কোনও ব্যক্তি হয়ে ওঠেননি।

১৯৫৯ সালে তৈরি হয় মৃণাল সেনের দ্বিতীয় সিনেমা ‘নীল আকাশের নীচে’। এক আন্তর্জাতিক আত্মীয়তাবোধ এই ছবিটির মূল প্রেরণা। ছবিটিতে আমরা দেখি এক চিনা ফেরিওয়ালাকে যে তার রুজিরুটির তাগিদে এদেশের সাথে নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে যায় এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শরিক হয়ে পড়ে।

ফেরিওয়ালা চরিত্রকে তার পরের ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) এও নিয়ে আসেন মৃণাল সেন। চিনা ফেরিওয়ালা এসেছিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। আর এই সিনেমার বাঙালি ফেরিওয়ালা চরিত্রটি আসে দুর্ভিক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। মৃণাল সেনের অত্যন্ত সাড়াজাগানো এই ছবিটি মূলত একটি পরিবারের গল্প। ফেরিওয়ালা, তার স্ত্রী ও তাদের জীবন সংকটের গল্প। একটি পরিবারের গল্পের মধ্যে দিয়ে দুর্ভিক্ষকালীন সমাজের সংকটিকে ভাষা দেন মৃণাল সেন।

১৯৬১-তে মৃণাল সেন তৈরি করেন ‘পুনশ্চ’ ছবিটি। পটভূমি সরে আসে গ্রাম থেকে শহরে। মধ্যবিত্ত এক পুরুষ নারীর, প্রেমিক প্রেমিকার এই গল্পে মৃণাল সেন দেখান পুরুষ প্রাধান্যের সমাজে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা কীভাবে খর্বিত হচ্ছে।

১৯৬২-তে পরের ছবি ‘অবশেষে’ নির্মিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, প্রেম, বিচ্ছেদের এই কমেডি ছবিটি তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি আগের ছবি পুনশ্চের মতোই।

১৯৬৪-তে পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের অবস্থা নিয়ে ‘প্রতিনিধি’ নামে আরেকটি ছবি তৈরি করেন মৃণাল সেন। মেয়েদের সামাজিক ভয়-ভীতি ভেঙে বেরিয়ে আসার ডাক রয়েছে এখানে।

১৯৬৫-তে মৃণাল সেন বানান ‘আকাশ কুসুম’। ছবির স্বপ্নবিলাসী নায়ক অজয় মধ্যবিত্তের বেড়া টপকে উচ্চবিত্ত হয়ে উঠতে চায় খুব দ্রুত। এজন্য বড়লোকের মেয়ের সাথে কৌশলী প্রেম সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে। অজয় চরিত্রটি নিয়ে পরিচালক কৌতুকই করেন ছবিতে। কৌশলী প্রেম স্বাভাবিকভাবেই সার্থকতা পায় না। ছবিটি শৈলীগত পরীক্ষা নিরীক্ষার কারণে আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৯৬৬ সালে কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর কাহিনী অবলল্বনে ওড়িয়া ভাষায় মৃণাল সেন তৈরি করেন ‘মাটির মানুষ’ ছবিটি। এর পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে স্থাপিত। ওড়িষ্যার এক কৃষক পরিবারে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা কীভাবে যৌথ সংসারে ভাঙন নিয়ে আসছে, জমির দ্বন্দ্ব কীভাবে পারিবারিক সম্পর্কে ছায়া ফেলছে সেটা এখানে অভিব্যক্ত হয়েছে। বড় ভাই নিজে জমির অধিকার ত্যাগ করে, কিন্তু তবু মানসিকতায় সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব আঁকড়ে থাকে। ছোটভাই না চাইলেও সম্পত্তির অধিকারী হয়। সেটা তার সামন্ততন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ের মানসিকতাকে দুর্বল করে না। কৃষক ও কৃষি প্রশ্নকে কেন্দ্রে রেখে নির্মিত এই সিনেমাটি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী নির্মাণ।

১৯৬৯ সালে বনফুলের কাহিনী অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় মৃণাল সেন তৈরি করেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘ভুবন সোম’। এই ছবির মুখ্য ভূমিকায় উৎপল দত্তের অসামান্য অভিনয় এবং এর শৈলীগত নিরীক্ষা একে একটি ক্লাসিকে পরিণত করেছে। অনেকে মনে করেন এই ছবিটির মধ্যে দিয়েই হিন্দি প্যারালাল ছবির ধারাটি জন্ম নেয়। ছবিতে রেলের জাঁদরেল অফিসার ভুবন সোম সৎ ও কর্মনিষ্ঠ মানুষ, ভিক্টোরীয় আদর্শবাদের প্রতিনিধি। নিজের ছেলেকেও তিনি নিজের সততা রক্ষার জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারেন। কিন্তু এই সমীহযোগ্য আদলটিকে এরপর মৃণাল সেন ভেঙে দেন। দেখা যায় ক্ষমতা তৃপ্তির জন্য দুর্নীতিকে তিনি প্রশ্রয় দিতে পারেন। রেলের রুটিন কাজের বাইরে গুজরাটে একবার পাখি শিকারে যান ভুবন সোম। সেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পটে এক নারীর লাবণ্যের শিকার হয়ে যান তিনি। সততা রক্ষার রুটিন ভেঙে সেই লাবণ্যময়ীর স্বামীর দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন।

১৯৬৯-এ রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে ‘ইচ্ছাপূরণ’ নামে এক শিশুচিত্র তৈরি করেন তিনি। এরপরেই শুরু হয় মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র নির্মাণ জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্বটি। আমরা পরপর তাঁর কাছ থেকে পাই ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭১), ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২), ‘পদাতিক’ (১৯৭৩), ‘কোরাস’ (১৯৭৪), ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯)। সত্তর দশকে তৈরি এই পাঁচটি ছবি মৃণাল সেনের সবচেয়ে আলোচিত ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম।

নিঃসন্দেহে সত্তর দশকের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বাস্তবতা মৃণাল সেনের এই নাগরিক ছবিগুলি নির্মাণের পেছনে মূল প্রেরণা হিসেবে সক্রিয় থেকেছে। একদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলন, মুক্তির দশক হিসেবে সত্তর দশককে দেখে ছাত্র যুবর প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি ভাবনাচিন্তা জীবনচর্যা, অন্যদিকে এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য নির্মম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, নাগরিক জীবনে অস্থিরতা এই দশকের কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য, যাকে মৃণাল সেন তাঁর এই পর্বের সিনেমায় নিয়ে আসেন।

‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে আমরা এক যুবককে দেখি যে চাকরির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। শেষমেষ দেখা যায় একটা স্যুট না থাকার জন্য তার চাকরিটা হল না। ভারতের নয়া শাসনও যে আধা ঔপনিবেশকতার পাঁকে পাঁকে জড়িয়ে আছে, সেই রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতার উপস্থাপণ ঘটে এখানে। ছবির শেষে ক্রুদ্ধ যুবকের ম্যানিকুইনের মূর্তি ভাঙা যেন সেই রাজনৈতিক মূর্তি ভাঙা আন্দোলনেরই দ্যোতক, যা ঔপনিবেশিকতার কাঠামো নির্মাণের সহযোগী দেশীয় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার নতুন মূল্যায়ন থেকে উঠে এসেছিল।

পরের ছবি ‘কলকাতা ৭১’ তিনটি আলাদা গল্প অবলম্বনে তৈরি। গল্প তিনটির লেখক যথাক্রমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল এবং সমরেশ বসু। গল্প তিনটির পটভূমি যথাক্রমে ১৯৩৩, ১৯৪৩ ও ১৯৫৩ সাল। প্রথম আখ্যানে এক বস্তিবাসী পরিবারের বর্ষার রাতে দুর্ভোগের ছবি, পরের গল্পে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক অনটনের কথা রয়েছে। তৃতীয় গল্পে পাই চালের চোরাচালানকারীদের কথা, যারা সব মূল্যবোধ পেছনে ফেলে যেভাবে হোক বেঁচে থাকতে চায়।

মৃণাল সেনের কোলকাতা ট্রিলজির শেষ ছবিটি হল ‘পদাতিক’। তখন নকশালবাড়ির রাজনীতির প্রথম পর্বটি ধাক্কা খেয়ে গেছে। ছবিতে আমরা দেখি এক যুবককে যে গ্রেপ্তার হবার পর পুলিশের ভ্যান থেকে পালায়। আশ্রয় পায় এক পাঞ্জাবী মহিলার বাড়িতে। এখানে যুবকটির রাজনীতির ধরন নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়। গণসমাবেশের রাজনীতির প্রয়োজনিয়তাকে সে ক্রমশ উপলব্ধি করে।

পরবর্তী ‘কোরাস’ ছবিটিতে সিনেমার টেকনিক নিয়ে অনেক অভিনব পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন মৃণাল সেন। নিও রিয়ালিজম এবং ডকুমেন্টারি ছবির আঙ্গিককে এখানে মেলাতে চেয়েছেন তিনি। রূপকথার ঢঙে ছবিটি তৈরি হয়। দেবতাদের অধিপতি চাহিদার সমস্যার ব্যাপারটা বুঝে শয়ে শয়ে চাকরীর বন্দোবস্ত করেন, কিন্তু হাজারে হাজারে চাকরিপ্রার্থী জুটে যায়। অনেক মানুষ, অনেক মুখ, অনেক সমস্যা। ক্রমেই জনতার মোহভঙ্গ হয়। ক্যামেরাকে সরাসরি লক্ষ্য করে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার আঙ্গিককে এই সিনেমায় ব্যবহার করেছেন মৃণাল সেন।

১৯৭৬-এ হিন্দি ভাষায় ‘মৃগয়া’ ছবিটি তৈরি করেন তিনি। ‘ভুবন সোম’ আর মৃগয়ার মাঝে ১৯৭২ সালে সুবোধ ঘোষের গোত্রান্তর গল্প অবলম্বনে ‘এক আধুরী কাহানী’ নামেও একটি হিন্দি ছবি বানিয়েছিলেন মৃণাল সেন।

১৯৭৭ সালে প্রেমচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় তৈরি করেন ‘ওকা উরি কথা’। অত্যন্ত ব্যতিক্রমী বলে বিবেচিত এই সিনেমাটির নায়ক ভেঙ্কায়া একজন শ্রমিক। অভিজ্ঞতা দিয়ে সে বুঝতে পারে তারই শ্রমের মুনাফা লুটছে মালিক। যতই শোষণ বাড়ে, ততই ভেঙ্কায়া প্রতিবাদের নতুন নতুন পরিকল্পনা আঁটে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ শ্লেষ, সাময়িক সমঝোতা — সবই তার লড়াইয়ের কৌশল। কলকাতা ট্রিলজীতে উতরোল সমাজ রাজনীতির পটভূমিকায় এক ধরনের প্রত্যক্ষ পলিটিক্যাল সিনেমা বানান মৃণাল সেন। আর ‘ওকা উরি কথা’তে সমাজের কাঠামো বিন্যাসের মধ্যেকার রাজনীতিটাকে ধরে অন্য এক ধরনের ‘পলিটিক্যাল ডিসকোর্স সিনেমা’ নির্মাণের দিকে এগোন।

বাংলা সিনেমার জগতে আবার ফেরেন ‘পরশুরাম’ ছবির মধ্যে দিয়ে। একদল বস্তিবাসীর জীবনচিত্র নিয়ে তৈরি এই সিনেমা।

১৯৭৯-তে তৈরি মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’ সিনেমাটি একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের অফিস থেকে সময়ে বাড়ি না ফেরা নিয়ে উদ্বেগ দুশ্চিন্তার প্রেক্ষাপটে তৈরি। তখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেমেছে, কিন্তু অনিশ্চয়তা দুর্ভাবনার রেশ থেকে গেছে। তার সাথেই জড়িয়ে থেকেছে মানসিকতার ক্ষুদ্রতা, অসহায়তা, স্বার্থপরতা।

আশির দশকে তৈরি মৃণাল সেনের ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে ‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০), ‘চালচিত্র কলকাতা’ (১৯৮১) ‘খারিজ’ (১৯৮৩), ‘খণ্ডহর’ (১৯৮৪), ‘জেনেসিস’ (১৯৮৪), ‘একদিন আচানক’ (১৯৮৯)।

সোভিয়েত ভাঙনের পর উঠে আসা নতুন প্রশ্নচিহ্নগুলি নিয়ে তিনি বানালেন ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৯১)। সাদাত হাসান মান্টোর গল্প অবলম্বনে ১৯৯৩-এ তৈরি হল ‘অন্তরীণ’। ২০০২-এ বানান শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’। তখন তাঁর বয়স প্রায় আশি। এই ছবিটিও কায়রো ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা চলচ্চিত্রকারের পুরস্কার জিতে নেয়। এই ছবিটিতে আফসার আমেদের গল্প অবলম্বনে মৃণাল সেন দেখান গ্রাম জীবনের আটপৌরে সহজ জীবন ছন্দটিকে। নূরের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সাকিনা বিয়ে করে কৌশিককে। নূর এরপর মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসে বেশ ধনী হয়ে। অন্যদিকে কৌশিক সাকিনার অনটনের সংসার। নূর প্রাক্তন স্ত্রীর বর্তমান স্বামী কৌশিককে অনটনে সাহায্য সহযোগিতা করে, কোনও বিবাহ বিচ্ছেদের তিক্ততা মাঝখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় না। এই অনায়াস জীবনছন্দকে পরাবাস্তবের মতো করে নিয়ে আসা মৃণাল সেনের সিনেমার নতুন দিকচিহ্ন। আশি বছর বয়েসে নির্মিত শেষ সিনেমাতেও তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন সাফল্যের ছক মেনে নির্মাণ নয়, ছক ভাঙতে ভাঙতে অহরত নতুন পথের সন্ধানেই ছিল তাঁর সৃজনের মূল আগ্রহ।

মৃণাল সেন তাঁর ছবিতে একটানা গল্পবলার ন্যারেটিভ টেকনিককে বারবার ভেঙেছেন এবং সিনেমার ভাষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। বামপন্থী ভাবনাচিন্তায় বিশ্বাস রেখে তিনি নানা প্রশ্নে নিরন্তর খোঁজ চালিয়ে গিয়েছেন তাঁর ছবিতে। সত্তরের কলকাতা ট্রিলজীতে সময়ের ক্ষোভ যন্ত্রণাকে তুলে আনতে তিনি যেমন সফল, তেমনি ‘ভুবন সোম’এ সচেতনভাবে অ্যারিস্ট্রোকাট ব্যুরোক্রেসির চকচকে আদলটিকে ভেঙে ফেলতেও পারদর্শী। ‘একদিন প্রতিদিন’ বা ‘একদিন আচানক’এ যথাক্রমে এক যুবতী মেয়ে ও এক বৃদ্ধ অধ্যাপকের বাড়ি না ফেরা নিয়ে নানা কথা ভাবনার সূত্রে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সমস্যাগুলিকে তিনি উন্মোচিত করে দেন অনায়াস দক্ষতায়।

জীবৎকালেই বাংলা সিনেমা তথা সংস্কৃতি জগতের লিভিং লিজেন্ডে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। দেশবিদেশের চলচ্চিত্র জগতের নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন, বহুবার তাঁর বিভিন্ন ছবি নানা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। মস্কো, বার্লিন, কান, ভেনিস, শিকাগো, মন্ট্রিয়েল, কায়রো — সমস্ত বিখ্যাত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেই পুরস্কৃত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন ছবি। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের পাশাপাশি বাংলা সিনেমার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হিসেবে তিনি সমাদৃত হবেন দীর্ঘদিন।

- সৌভিক ঘোষাল

chanku-mahato-one-of-the-leaders-of-hull-rebellionmartyr's-day

১৫ মে চানকু মাহাতোর শহীদ দিবস। ১৮৫৬ সালের এই দিনে ব্রিটিশ কোম্পানিরাজ তাঁকে ফাঁসি দিয়েছিল। শহীদের মৃত‍্যু বরণ করেছিলেন ৪০ বছর বয়স্ক জননেতা চানকু মাহাতো। অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ‍্যের গোড্ডা জেলার রংমাটিয়া গ্রামে চানকুর জন্ম। শৈশবেই মাতৃহারা চানকু বাবার সাথে কৃষিকাজ করত। ব্রিটিশ কোম্পানির রাজত্ব তখন দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে গ্রাম গ্রামান্তরে, আর তার সাথে মহামারীর মতো ছড়াচ্ছে অত‍্যাচার নিপীড়ন লুন্ঠন, গ্রামীণ স্বশাসিত সমাজ ও সমষ্টিগত ভূমি-মালিকানা ব‍্যবস্থার ধ্বংসসাধন। ছোটবেলা থেকেই সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত হিসেবে পরিচিত চানকুর সজাগ দৃষ্টির সামনেই এসব ঘটে চলেছিল। চানকু বুঝতে পারছিল, বিদ্রোহই একমাত্র রাস্তা। ঠিক যেমন বুঝতে পারছিল আরও পূবের দিকে দামিন-ই-কোহ্’র সিধো-কানু-ফুলো-ঝানোরা। চানকু গ্রামে গ্রামে বৈঠক শুরু করে। গাঁয়ের খেটে খাওয়া কৃষক সমাজ একজোট হতে শুরু করে। চানকু মাহাতো শ্লোগান তোলে, “আপন মাটি, আপন দানা, পেট কাটি নাহি দিবহ খাজনা”। নিজের পেট কেটে কোম্পানির তফিল আর ভরব না, এই শস‍্য এই ভূমি আমাদের। গ্রামে গ্রামে জেগে ওঠে আদিবাসী যুবসমাজ। ১৮৫৩-৫৪ সালে রাজবীর সিংহ, বেজল সোরেন, ভাগীরথ মাঝি, হুঘলি মাহাতো, বুধু রায়, বলুয়া মাহাতো, রামা গোপ, চালো জোলহা, গান্দো, ইরদেব সিংহ প্রমুখ একসারি নেতৃত্বকে সাথে নিয়ে কোম্পানির সরকার ও জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন চানকু মাহাতো। এই সময়েই এসে যায় হুলের আহ্বান। ১৮৫৫’র ৩০ জুন ভগনাডিহির মাঠে মহাসমাবেশের ডাক। সমস্ত আন্দোলন হুলে এসে মেশে। সাঁওতাল, মাহাতো, বাউড়ি সহ সমস্ত জনজাতির মানুষ কোম্পানিরাজ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জেগে ওঠে। বহু বহু মানুষ প্রাণ দেন হুলে। যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন সিদো ও কানহু। চানকু মাহাতোও হয়ে ওঠেন হুলের অন‍্যতম নেতা। কোম্পানির পুলিশ খুঁজে বেড়ায় চানকুকে। চানকু গোপন বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরকম এক বৈঠকে পুলিশের ঘেরাওয়ের মুখে পড়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন সাথিদের তৎপরতায়। শেষে তাঁর নানিঘর বাড়েডিহ গ্রাম থেকে ধরা পড়েন চানকু। ১৫ মে ১৯৫৬ গোড্ডার রাজকাছারির কাছে কঝিয়া নদির তীরে ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হন চানকু। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রপথিক চানকু মাহাতোকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। তাঁদের লড়াইয়ের পথ বেয়ে যা কিছু অর্জন আমাদের ছিল তা আজ নতুন করে কোম্পানিরাজের গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। চানকুর “আপন মাটি, আপন দানা” আর বিরসার “আবোয়া দিশম, আবোয়া রাজ” শ্লোগান আজকের প্রেক্ষিতে নতুন করে প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত হয়ে উঠছে। আমরা আমাদের শহীদদের স্বপ্ন সফল করার সংগ্রাম চালিয়ে যাব।

in-memory-of:-comrade-shikha-saha

কমরেড শিখা সাহা দীর্ঘদিন কলকাতার বেহালা অঞ্চলে পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। বিগত বেশ কয়েক বছর তিনি শান্তিপুরে থাকতেন। তাঁর স্বামী রামপ্রসাদ দার আদি বাড়ি শান্তিপুরে। গত ২০২১ সালে সেখানেই শিখা আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে প্রয়াত হন। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে শান্তিপুর সায়েন্স ক্লাব এক স্মারক আলোচনা সভার আয়োজন করে। রামপ্রসাদদা ঐ সংস্থার একজন সংগঠক। শিখাও নানা কর্মসূচিতে অংশ নিতো। বিজ্ঞান চেতনা ও নারী সমাজ বিষয়ক এই আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখেন এ্যাপোয়ার নেত্রী ইন্দ্রাণী দত্ত,এবং অন্যান্য স্থানীয় বক্তারা। ভালো সংখ্যক মহিলারা সভায় অংশগ্রহণ করেন। শ্রমজীবী প্রকল্প কর্মীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। কমরেড শিখা সাহা লাল সেলাম।

haradhan-bagdi-passed-away

১৩ মে ২০২৩ মধ্যরাতে পুর্ব বর্ধমান জেলার গলসি ২নং ব্লকেরপার্টি সদস্য কমরেড হারাধন বাগ্দী হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৫০ বছর। তিনি রেখে গেলেন ২ পুত্র, ২ কন্যা ও স্ত্রী। মৃত্যু সংবাদ শুনে পার্টির রাজ্যকমিটি সদস্য মোজাম্মেল হক অন্যান্য কমরেডদের সাথে নিয়ে তাঁর বাড়ীতে যান এবং মরদেহে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কমরেড ৭০’র দশকের শেষের দিক থেকে বামপন্থী তথা কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত। তিনি সবসময় কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ২০২১ সালে কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের একটা অংশের কমরেডদের সঙ্গে নিয়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাথে যুক্ত হন এবং সরাসরি সদস্যপদ পান। তারপর থেকে তিনি পার্টির সমস্ত কর্মসুচীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। পার্টির রাজ্য সম্মেলন ও জেলা সম্মেলনে প্রতিনিধি ছিলেন। এলাকায় সংগঠনের গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা নিতেন। তাঁর মৃত্যুতে পার্টির বড় ক্ষতি হল। এলাকার কমরেডরা শোকাহত। পার্টির পুর্ব বর্ধমান জেলা কমিটি কমরেডের মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করছে এবং এলাকার কমরেড ও তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে।

কমরেড হারাধন বাগ্দী লাল সেলাম।

000 = 000

খণ্ড-30
সংখ্যা-15