সারাটা পৃথীবি জুড়ে পালিত হয় মে দিবস। এবারের মে দিবসে বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে। ভারতে যেমন শ্রমিক-বিরোধী চার শ্রম-কোডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়, ফ্রান্সে পেনশন সংস্কার, সারা ইউরোপ জুড়ে প্রকৃত মজুরির ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ আছড়ে পড়ে।
এশিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ায় কোরিয়ান কনফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়ন্স সিউল নগরে এক মিছিল সংগঠিত করে। অপরদিকে, ফেডারেশন অফ কোরিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন্স এদিনই সংগঠিত করে জাতীয় শ্রমিক কংগ্রেস, যেখানে অংশ নেন ৩০,০০০-এর উপর শ্রমিক। ক্ষমতাসীন সরকার যেভাবে ইউনিয়নকে দুর্বল করার পদক্ষেপ নিয়েছে, যে সমস্ত শ্রম-বিরোধী সংস্কার কর্মসূচি নামিয়েছে, তার বিরুদ্ধে সকলেই সোচ্চার হন। ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন দাবি জানিয়েছে, শ্রম-বিরোধী সংস্কার বাতিল করা হোক, বৃদ্ধি করা হোক ন্যূনতম মজুরি। বিডাল মিঞ্জোক নামে এক খাবার সরবরাহকারী অ্যাপের শ্রমিকরা সংস্থার সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখান তাদের দেয় ডেলিভারির মজুরি বাড়ানোর দাবিতে। তারা জানান, ব্যাপক মূল্যস্ফীতি হওয়া সত্ত্বেও গত ন'বছর ধরে তাদের মজুরি এক পয়সাও বাড়েনি।
ইন্দোনেশিয়া
৩২টি ট্রেড ইউনিয়নকে নিয়ে গঠিত কনফেডারেশন অফ ইন্দোনেশিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন্স জাকার্তায় বিশাল এক সমাবেশ করে, যাতে আনুমানিক ৫০,০০০ মানুষ সামিল হন। তাঁরা জাতীয় স্মারকের সামনে জমায়েত হয়ে সাংবিধানিক কোর্টের দিকে মিছিল করে সভা করেন। সেখানে দাবি তোলা হয়, শ্রম-বিরোধী আইন বাতিল করার।
ফিলিপাইন্স
ম্যানিলায় প্রায় ৬,০০০ বিক্ষোভকারী ১৪টি শ্রমিক ইউনিয়নের অধীনে সমাবেশিত হন। কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের নিয়মিতকরণ, বেতন বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি দাবিতে তারা সোচ্চার হন। ফেডারেশন অফ ফ্রি ওয়ার্কার্স এর ৩,০০০-এর অধিক শ্রমিক, পার্টিডো মাঙ্গাগাওয়া, পাবলিক সার্ভিস ইন্টারন্যাশনাল এবং নির্মাণ শিল্পের মহিলা শ্রমিকরা বিক্ষোভে সামিল হন। সম্প্রচার শিল্পের শ্রমিক কর্মচারীরা দেশের সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিক্ষোভ জামায়েত করে ঠিকা প্রথা অবসানের দাবিতে সোচ্চার হন।
বিভিন্ন শ্রমিক গ্রুপ মেন্ডিওলাতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখান উন্নত মজুরি, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, শ্রমিকদের উপর নানাবিধ নামিয়ে আনা হামলার বিরুদ্ধে।
জাপান
রাজধানী টোকিও-তে হাজারে হাজারে শ্রমজীবী মানুষ সমবেত হয়ে মজুরি বৃদ্ধির দাবি তোলেন। দেশের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আম জনতার উপর করের বোঝা চাপানোর বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হন। একই সাথে শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতি কল্পে ও কল্যাণকর প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির দাবি ও জানানো হয়।
কাম্বোডিয়া
নোম পেন-এ বহু শ্রমিক বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের ব্যানারে সমবেত হয়ে উন্নত বেতন কাঠামো ও কর্মক্ষেত্রে উন্নত কাজের পরিবেশ গড়ে তোলার দাবি তোলেন। ক্যাম্বোডিয়ান কনফেডারেশন অফ ইউনিয়ন্স এবং ক্যাম্বোডিয়ান অ্যালায়েন্স অফ ট্রেড ইউনিয়ন্স যুক্তভাবে এক বিশাল মিছিল করে।
তাইওয়ান
তাইপে-তে সরকারি হাসপাতাল, বিমা কর্মীরা বেতন বৃদ্ধি ও উন্নত কাজের পরিবেশের দাবিতে বিক্ষোভ সংগঠিত করেন।
লেবানন
বেইরুটে কয়েক হাজার শ্রমিক কমিউনিষ্ট পার্টি ও অন্য পেশাগত সংগঠনের নেতৃত্বে নানা শ্রেণিগত দাবিতে বিক্ষোভ দেখায়।
পাকিস্থান
দেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণ দেখিয়ে বেশ কিছু শহরে মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও লাহোর, পেশোয়ার, কারাচিতে শ্রমিক ইউনিয়গুলো নানা দাবিতে বিক্ষোভ দেখায়।
ইউরোপ
প্যারিস এখন যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ফ্রান্সে প্রায় ৩০০টি ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে বিপুল সংখ্যক বিক্ষোভকারী প্রধানমন্ত্রী মাঁকর’র পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদে উত্তাল। প্যারিসে আশি হাজার থেকে একলাখ মানুষ পয়লা মে বিক্ষোভে সামিল হন। বিক্ষোভকারীদের সনাক্ত করতে সরকার ড্রোন উড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বিক্ষোভকারীরাও ড্রোন থেকে নিজেদের আড়াল করতে আশ্রয় নেয় ছাতার তলায়। বিশাল বিপুল জনস্রোত কালো ছাতার সমুদ্রের তলে যেন ঢাকা পড়ে যায়। বিমান কর্মীরাও উড়ান বন্ধ রেখে সামিল হয়ে পড়েন এই বিক্ষোভ সমাবেশে।
এদিকে ব্রাজিল সরকার মে দিবসের সম্মানে পয়লা মে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এই বৃদ্ধি কম হলেও বিগত ছ’বছরে এই প্রথম মূল্যস্ফীতির উপর এই মজুরি বৃদ্ধি ঘোষণা করা হল।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গৌরি লঙ্কেশ নিউজ)
আর জীবনের জন্য, ভালোবাসার জন্য এই অন্তহীন পথচলার শ্বাশত শপথ নিয়ে এবারের মে দিবস আবার নতুন শিখরে উঠল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বজুড়ে এবার মে দিবসে হাজার হাজার শ্রমিক আরও একবার নিজেদের শ্রেণিগত আত্মপ্রকাশ ঘটিয়ে কর্পোরেট ও দেশে দেশে শাসকবর্গের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী দিয়ে জানান দিলেন — লড়াই আজ রাস্তায় নেমে এসেছে। প্রতিরোধ হবে। শাসকের আইনকে করা হবে অস্বীকার।
এদিকে, এই অভূতপূর্ব শ্রেণি উত্থানের ভাষাকে যারা পড়তে পারে না, কর্পোরেট স্বার্থবাহী প্রচার মাধ্যমের কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র এই মে দিবসেই মোদী সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, জনসংখ্যায় চিনকে টপকে যাওয়ার পর এবার চিন থেকে সরে আসতে চাওয়া উৎপাদন শিল্পগুলোকে এদেশে আকর্ষণ করতে শ্রম আইনকে আরও শিথিল করা হোক। ইতিমধ্যে, অ্যাপেল ও তার সরবরাহকারী ফক্সকন্, শ্রমিকদের নির্মম দমনে ইতিমধ্যেই দুনিয়া জুড়ে কুখ্যাতি কুড়োনো এই তাইওয়ান সংস্থাটি যাতে কর্ণাটকে পা রাখতে পারে তারজন্য ওই রাজ্যে শ্রম আইনকে শিথিল করা হচ্ছে। ১২ ঘণ্টার শ্রম দিবস, নাইট শিফটে মহিলা কর্মীদের নিয়োগ, ঢালাও কন্ট্রাক্ট শ্রমিক নিয়োগ, ন্যূনতম মজুরি আইনকে প্রায় তুলেই দেওয়া প্রভৃতি শর্তে নিয়োগকর্তাকে এই বিজেপি শাসিত রাজ্য দিচ্ছে অবাধ ছাড়। তামিলনাড়ুও এই লক্ষ্যে সেই রাজ্যের ফ্যাক্টরি আইনকে শিথিল করে। সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের তীব্র প্রতিরোধে তামিলনাড়ু সরকার তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
ভারতে ৬ কোটি ৩ লক্ষ শিল্প সংস্থার মধ্যে মাত্র ১০ লক্ষ শিল্প সংস্থা ভারতের বর্তমান শ্রম আইনের অধীনে রয়েছে। বাকি সংস্থাগুলো ছোট মাঝারি, যেখানে বিপুল সংখ্যক ইনফর্মাল শ্রমিক, প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মরত। ২০১৯’র ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টেই বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, ভারত ২০৪৭এ স্বাধীনতার শতবর্ষে পা রাখবে। তারমধ্যে বিশ্বের মধ্যম বর্গীয় অর্থনৈতিক দেশে নিজেকে রূপান্তরিত করতে হলে স্বনিযুক্ত বা ইনফর্মাল নয়, তাকে আরো বেশি সংগঠিত ক্ষেত্রে, নিয়মিত ধরনের বেতনভুক কাজ সৃষ্টি করতে হবে। এদিকে, ক্ষুদ্র এই সংগঠিত শ্রমিকদেরও সমস্ত শ্রম আইনের বাইরে বার করার সওয়াল করে আসছে দেশি বিদেশি কর্পোরেট, তাদের আজ্ঞাবহ সংবাদ মাধ্যম ও মোদী সরকার। যার পরিণতিতে আনা হল কর্পোরেট স্বার্থবাহী চারটে শ্রমকোড। শ্রমিকদের উচ্চহারে বেতন বা মজুরি যে কর্পোরেট জগতে লোকসান ডেকে আনছে, বাস্তব ঘটনা তা নয়। ১৯৯৫-৯৬ পর্যন্ত প্রকৃত মজুরি কিছুটা বাড়লেও তারপরের ১৪ বছর (২০১১-১২) প্রকৃত মজুরি একেবারেই থমকে দাঁড়ায়। অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন গত আট বছরে প্রকৃত মজুরির কোনো বৃদ্ধি হয়নি। প্রকৃত মজুরির বৃদ্ধিকে রুখতে কঠোর শ্রম আইন দরকার, যা শিল্প মহলকে আকৃষ্ট করবে এই যুক্তি যে নেহাতই অসাঢ় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কোভিডের সময়ে একাধিক বিজেপি শাসিত রাজ্য যখন শ্রম কানুনকে আপাদমস্তক সংস্কার করার জন্য উদ্যত হয়, তখন উইপ্রো’র কর্ণধার আজিম প্রেমজি ইকনমিক টাইমসে এক উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেন যা হৈচৈ ফেলে দেয় শিল্প মহলে। তিনি বলেন, “বিগত বেশ কয়েক দশক যাবত ভারতের শ্রম কানুনগুলো বদলাতে বদলাতে তার নখ দাঁত হারিয়েছে। এগুলো এখন আর শিল্প মহলের কাছে মাথা ব্যথার কারণ নয়। আবার, সামাজিক সুরক্ষার রক্ষা কবচগুলো এতটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে যে তা অগণন ইনফর্মাল শ্রমিকদের বিপন্নতা অনেক বাড়িয়েছে। ছিঁটেফোটা যে সমস্ত কানুন রয়েছে, তা তুলে দিলে শিল্প ও আর্থিক বিকাশের অনুকূলে তা যাবে না।”
কিন্তু, ক্ষমতাদর্পী অন্ধ ফ্যাসিস্ট রাজ আজ মরিয়া। যে পাথর সে তার মাথার উপর তুলেছে, তাই অচিরে পড়বে নিজের উপর — ইতিহাস বার বার সেই সাক্ষ্য দেয়। অনাগত দিন তারই অপেক্ষায়।
মে দিবস ২০২৩ :
১ মে ২০২৩-এ ভারতবর্ষে মে দিবস উদযাপনের শতবর্ষ পূরণ হতে চলেছে। দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময়সীমা নির্ধারণের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৮৮৬ সালে মে দিবস পালন শুরু হয়েছিল। ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোতে হে-মার্কেট হত্যাকাণ্ডের পর আন্দোলনের গতি আরও বৃদ্ধি পায়৷ ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বদের একটা বড় অংশকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলে আন্তর্জাতিক স্তরে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম আরও তীব্রতর হয়। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে, জার শাসনাধীন রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণী বিশ্বে সর্বপ্রথম বিপ্লব সংঘটিত করে। এরপরই শ্রমিকশ্রেণীর জাগরণের তরঙ্গ ঔপনিবেশিক ভারতে এসে পৌঁছায়। ১৯২০ সালে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস গঠিত হয় এবং ১৯২৩ সালে এম সিঙ্গারাভেলারের নেতৃত্বে চেন্নাইতে প্রথম মে দিবস উদযাপিত হয়।
যেহেতু আমরা ভারতে মে দিবস উদযাপনের শতবর্ষ পালন করছি, আমাদের অবশ্যই ভারতের শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। একইসাথে, শ্রমিকের সামাজিক মুক্তি এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার অধিকারকেও সুনিশ্চিত করতে হবে। এ’কথা অনস্বীকার্য যে, কমিউনিস্ট আন্দোলন শ্রমিকশ্রেণীর দাবির ভিত্তিতে সুসংগঠিত ও প্রসারিত হয়েছিল। তবে শুধু কমিউনিস্টরাই নন, স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক বিশিষ্ট নেতা ছিলেন যাঁরা শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগতিতে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখেছিলেন। লালা লাজপত রায়, চিত্তরঞ্জন দাস, জওহরলাল নেহেরু এবং সুভাষচন্দ্র বসুর মতো প্রখ্যাত কংগ্রেসী নেতারা সকলেই বিভিন্ন সময়ে এআইটিইউসি’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে জ্যোতিরাও ফুলের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, নারায়ণ লোখান্ডে, জাতিগত নিপীড়ন এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দ্বিমুখী যুদ্ধের পাশাপাশি মহারাষ্ট্রে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিলেন।
আজ একদিকে যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যে অধিকারগুলি ছিনিয়ে নিয়েছিলাম — ভারতীয় সাধারণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, আইনের শাসনের সাংবিধানিক কাঠামো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উপর ভিত্তি করা সামাজিক কাঠামো এবং অন্যান্য নাগরিক অধিকার — সেই সবকিছু আজ ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে, শ্রমিকশ্রেণীর আদায়কৃত অধিকারগুলিও পরিকল্পিতভাবে খর্ব করা হচ্ছে। কর্পোরেট স্বার্থবাহী তিনটি কৃষি আইন কৃষকেরা বাতিল করতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু চারটি শ্রমকোড, যেগুলি পূর্ববর্তী শ্রম আইন এবং শ্রমিকের অধিকারগুলির বেশিরভাগকে প্রতিস্থাপিত করবে, তা এখনও ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর মাথার উপরে বিপদের খাঁড়া হয়ে ঝুলছে। স্পষ্টতই, আগামীদিনে শ্রমিকশ্রেণীকে কৃষকদের মতো কঠোর লড়াই করতে হবে এবং ঔপনিবেশিক যুগের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মতো এই লড়াইগুলোকেও গণতন্ত্রের জন্য বৃহত্তর লড়াইয়ে রূপ দিতে হবে।
মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও মর্যাদার গৌরবময় ইতিহাস। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ শ্রমিক কিছু মৌলিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। চাকরির নিরাপত্তা, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, সম কাজে সম মজুরি সহ জীবিকা নির্বাহ এবং সামাজিক নিরাপত্তা — শ্রমিকশ্রেণীর মর্যাদা ও ঐক্যের প্রধান চারটি ভিত্তি। ভারতীয় শ্রমিকদের বেশিরভাগই আজ এই সমস্ত মৌলিক অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিপজ্জনক কাজ, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্র, সংকটাপন্ন জীবনযাপন এবং বাড়তি কাজের জন্য নামমাত্র বেতন — এইসব এখন ভারতের লক্ষ লক্ষ চুক্তি-কর্মী, ইনফর্মাল সেক্টরের কর্মী, সাফাই কর্মী, স্কিম কর্মী এবং ডেলিভারি কর্মী যারা দেশের পরিষেবা এবং ডিজিটাল অর্থনীতির বৃহৎ অংশ পরিচালনা করেন তাঁদের কাজ ও জীবনযাপনের শর্ত হয়ে উঠেছে।
ভারতের বৈচিত্র্যময় শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণী ঐক্যের বন্ধনকে শক্তিশালী করার জন্য শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকে অবশ্যই নিরাপত্তাহীনতা, অসম্মান ও অসমতার এই মৌলিক ধারাগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। ভারতের বিক্ষিপ্ত এবং বিভক্ত শ্রমিকদের একটি সর্বভারতীয় শ্রেণী হিসেবে গড়ে তুলতে আরও কিছু বিভাজনের দেয়ালকেও ভাঙতে হবে। ‘জাত’, যাকে আম্বেদকর ‘শ্রমিকদের বিভাজন’ ব্যবস্থা হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই জাত ব্যবস্থা আজও শ্রমিকশ্রেণীকে খণ্ডিত করে চলেছে। এক সচেতন ও ধারাবাহিক জাত-বিরোধী দিশাই শ্রেণী ঐক্য গড়ে তুলতে এবং জাত-ভিত্তিক নিপীড়ন ও সামাজিক বর্জন কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক কুসংস্কার এবং প্রতিকূল বৈষম্যের শিকার, সরাসরি সামাজিক বর্জন ও হয়রানির ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্র একই রকম ভূমিকা পালন করে। শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যকে অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতা ও ভাষাগত বিভেদ এবং স্থানীয় শ্রমিক ও বহিরাগতদের মধ্যে বিরোধ কাটিয়ে উঠতে হবে।
ন’বছরের মোদী শাসনে ভারতের অর্থনীতি, সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মোদী সরকার এবং সঙ্ঘ বাহিনীর দ্বারা নিরন্তর যে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ নেমেছে, শ্রমিক আন্দোলন তার সাক্ষী। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আর মাত্র এক বছর বাকি আছে। ২০২৩ সালের মে দিবস বার্তা দিচ্ছে, ভারতীয় সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং ভারত ও ভারতীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে নামতে হবে।
- এমএল আপডেট, সম্পাদকীয়, ২-৮ মে ২০২৩
রাজ্যজুড়ে প্রায় সর্বত্রই পালিত হল মহান মে দিবস। সকাল থেকেই বিভিন্ন জেলা, কলে কারখানার গেটে, রিক্সা অটো টোটো স্ট্যান্ডে, জনবহুল রাস্তার মোড়ে, চা বাগিচায়, ইউনিয়ন অফিসগুলোতে এআইসিসিটিইউ, সিপিআই(এমএল) পালন করল এই মহান দিনটি। রাজ্য পার্টির সদর দপ্তরেও ট্রেড ইউনিয়ন ও পার্টির নেতৃবৃন্দ পতাকা উত্তোলন করেন।
কলকাতায় প্রতিবছরের মতো (ব্যতিক্রম শুধু ছিল কোভিড কালের দু’টো বছর) এবারও বামপন্থী কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর যুক্ত জনসভা সংগঠিত হল শহিদ মিনার পাদদেশে। ব্যানার ফেস্টুনে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত শহিদ মিনারের সভার শুরুতে সিটুর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু যুক্ত আহ্বান পত্রটি পাঠ করেন।
প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়, এ’বছর ভারতে মে দিবসের শততম বর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। প্রথম এদেশে, ১৯২৩ সালে, এম সিঙ্গারাভেলু চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচে লাল পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। বিশ্বজুড়ে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ তাঁদের চাকরি, মজুরি, কাজের শর্তাবলী, অর্জিত অধিকার এবং কষ্টার্জিত মৌলিক অধিকারের ওপর শাসক শ্রেণির আক্রমণের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালাচ্ছেন, তার প্রতি সংগ্রামী সংহতি জানানো হয়। জনগণের জীবন-জীবিকার উপর নেমে আসা ক্রমবর্ধমান দুর্দশা, তীব্র বেকারত্ব, সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থহীন করে ফেলা, আদানির সাথে সরকার ও রাষ্ট্রের গভীর আঁতাত, নানা এজেন্সি দিয়ে বিরোধীদের হয়রানি প্রভৃতির পাশাপাশি শ্রমিকদের সমস্ত অর্জিত অধিকারগুলো হরণ করা আর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়ে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরানোর আরএসএস-বিজেপির চক্রান্তকে উন্মোচিত করা হয়। মোদী সরকারকে পরাস্ত করে দেশ ও গণতন্ত্রকে বাঁচানোর আবেদন রাখা হয় এই সম্মিলিত মঞ্চের পক্ষ থেকে।
প্রস্তাবনার পক্ষে বক্তব্য রাখেন সিটু’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন, ইউটিইউসি’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অশোক ঘোষ, এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
৩০ জানুয়ারি ২০২৩-এ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর যুক্ত কনভেনশনে গৃহীত কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করতে এবং আগামী ৯ আগস্ট কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ডাকে কলকাতায় রাণী রাসমনি রোডে যে মহাধর্ণা হবে তাকে সর্বাত্মকভাবে সফল করার আহ্বান এই সভা থেকে রাখা হয়।
ভারতে মে দিবস পালনের শতবর্ষে হুগলি জেলার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিকদের উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়। উৎসবমুখর শ্রমিকদের নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মধ্যে মে দিবসের তাৎপর্য অনুধাবন করা, আজকের কঠিন সময় পেড়িয়ে যেতে লড়াই ও মে দিবসের শহিদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলার শপথ গ্রহণ ছিল প্রধান দিক। এঙ্গাস জুট শিল্পের শ্রমিকেরা বিসিএমএফের ব্যানারে মিল গেটে কর্মসূচি পালন করেন। জমজমাট মিল গেটে লাল পতাকা উত্তোলন, শহিদ স্মরণ সহ সমগ্র কর্মসূচি উপস্থিত মেহনতি মানুষদের নজর কাড়ে! জয়শ্রী টেক্সটাইলের কর্মসূচিও ছিল রঙিন ও প্রাণবন্ত। কারখানার গেট সংলগ্ন তারের বেড়াজাল ভরে উঠেছিল লাল পতাকায়। গোটা কর্মসূচিতে ইউনিয়নের সাধারণ সদস্য ও তরুণ প্রজন্মের সংগঠকদের উৎসাহ অনুভূত হয়। হিন্দমোটর ইটখোলা মোড়ে নির্মাণ শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দিনটি উদযাপিত হয়। এখানে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন মহিলা নির্মাণ শ্রমিক কমরেড মঞ্জু ওঁরাও। কোন্নগর চলচ্চিত্রম মোড়ে যথাযথ মর্যাদায় দিনটি পালন করা হয়। অসংগঠিত শ্রমিক ও স্থানীয় পার্টি কর্মীরা এখানে উপস্থিত ছিলেন। চুঁচুড়ায় কাজ হারানো পরিবহন শ্রমিকেরা রক্ত পতাকার সামনে আগামী লড়াইয়ের শপথ নেন। প্রত্যেক বছরের মতো এবছরেও অসংগঠিত শ্রমিক অধ্যূষিত জিটি রোড সংলগ্ন ব্যান্ডেল নেতাজি পার্কে মে দিবসের কর্মসূচি পালিত হয়, এখানে পতাকা উত্তোলন করেন নির্মাণ শ্রমিক গোপাল পাল। হুগলির গ্রামাঞ্চলে পান্ডুয়া ব্লকের বৈঁচি ও ইলছোবায় গ্রামীণ মেহনতি মানুষদের উপস্থিতিতে পার্টির পক্ষ থেকে মে দিবস উদযাপিত হয়।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর বিষ্ণুপুর পৌরসভার সামনে মে দিবসে শহীদ স্মরণ ও রক্ত পতাকা উত্তোলন হ’ল।
বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন ও এআইসিসিটিইউ’র উদ্যোগে পৌরসভার সামনে প্রায় দুই শতাধিক সাফাইকর্মীরা উপস্থিত থেকে মহান মে দিবসে শহীদ স্মরণ ও রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলন করেছেন বর্ষীয়ান (৬০ ঊর্ধ্ব), এখনও কর্মরত সাফাই মজদুর কমরেড নেপাল বাউরী।
১ মে সমস্ত দপ্তরে ছুটি, কিন্তু পৌর সাফাইকর্মীদের ছুটি নেই। তারা বেরিয়ে পরেছে শহরকে আবর্জনামুক্ত করতে। এই সাফাইকর্মীরাই যখন নিজেদের দাবি আদায়ের লড়াইয়ে একদিনের ধর্মঘটে কাজ বন্ধ করেছিল, তার পরের মাসে প্রত্যেকের বেতনের থেকে একদিনের টাকা কেটে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তায় সরকার ঘোষিত দৈনিক ৩৭৬ টাকা মজুরি চালুর দাবিতে, পিএফ-পেনশন চালুর দাবিতে এবং শ্রমিক হিসাবে ন্যয্য মর্যাদার দাবিতে সর্বোপরি পুঁজিবাদের শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের লড়াই, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে শ্রমিক ঐক্য দৃঢ় করার অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়। আগামীতে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের লড়াই আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানান বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সম্পাদক দিলবার খান।
কলকাতায় যাদবপুর-ঢাকুরিয়া আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে ৩ জায়গায় (গাঙ্গুলি পুকুর, গড়ফা, সুপার মার্কেট) এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটি কন্ট্রাক্ট কর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মে দিবস উদযাপন করা হয়।
বাঘাযতিন-গড়িয়া-বাশঁদ্রোণী আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে ২ জায়গায় (সূর্য সেন মেট্রো, গড়িয়া) মে দিবস উদযাপন করা হয়।
কালীঘাটে ১ জায়গায় মে দিবস উদযাপন করা হয়।
পূর্ব-মধ্য কলকাতা আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে ২ জায়গায় (বিরসূল হাটে মাইক সহযোগে সভা হয় এবং মৌলালী সদর দপ্তরের সামনে) মে দিবস উদযাপন করা হয়।
বেহালা আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে ৩ জায়গায় রবীন্দ্র নগর, সরশুনা, কালীতলায় মে দিবস উদযাপন করা হয়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মে দিবস
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদবপুর ও সল্টলেক দুই ক্যাম্পাসেই ‘যাদবপুর ইউনিভার্সিটি কনট্রাক্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’ পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মে দিবস উদযাপন করে। চুক্তিবদ্ধ কর্মচারীরা শপথ নেন কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম-কোড এবং অমানবিক চুক্তিপ্রথা বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার। যাদবপুর ৮বি এলাকায় কর্মচারিদের মিছিল শ্রমিকের দাবিগুলি তুলে ধরে।
বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম কামারহাটি আগরপাড়া জুট মিল ইউনিয়ন কার্যালয়, কাঁকিনাড়া জুট মিল, গৌরীপুর কার্যালয়, নৈহাটি জুট মিল কার্যালয় ইত্যাদি জায়গায় সুসংগঠিতভাবে মে দিবস পালন করে। লাল পতাকা উড়িয়ে, শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে, শ্রমিকেরা মিছিল করেন আগরপাড়া ও নৈহাটিতে। আগরপাড়ায় পার্টির শ্রমিক ফ্রন্টের বর্ষীয়ান নেতা তথা পাটকল ইউনিয়নের সভাপতি নবেন্দু দাশগুপ্ত পতাকা তোলেন, বক্তব্য রাখেন ইউনিয়ন সম্পাদক মাজাহার খান। নৈহাটিতে ইউনিয়ন সম্পাদক মহম্মদ জহিম পতাকা উত্তোলন করেন, পার্টির জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। মিছিলগুলিতে ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান। বসিরহাটে নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন, শিবদাসপু্রে ইটভাটা শ্রমিক ইউনিয়ন, হালিশহর, আইআরইএফ কাঁচরাপাড়া ইউনিয়ন বিভিন্ন স্থানে মে দিবসের কর্মসূচি সংগঠিত করে। পার্টির পক্ষ থেকে অশোকনগর, রাজারহাট ও বেলঘরিয়ায় কর্মসূচি হয়।
দার্জিলিং জেলার রাঙ্গাপানি রেল ইয়ার্ডে ‘দার্জিলিং জেলা সংগ্রামী মুটিয়া মজদুর ইউনিয়ন’ ও ‘এনআরএল ইউনিয়ন’-এর পক্ষ থেকে মে দিবসে পতাকা উত্তোলন, পুষ্প অর্পণ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মে দিবসের এই কর্মসূচিতে সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক অভিজিত মজুমদার ও দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ সহ শরৎ সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, পঞ্চা বর্মন, ইউনিয়ন নেতা বুলু সিংহ, সুরেন দাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মে দিবসের কর্মসূচিতে ভালো সংখ্যক শ্রমজীবী মহিলার অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। রাজ্য সম্পাদক তাঁর বক্তব্যে মে দিবসের বর্তমান তাৎপর্য তুলে ধরে আরএসএস-বিজেপির ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র করার আহ্বান জানান।
ভারতবর্ষের মে দিবস পালনের ১০০ বছরে দাঁড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে গ্রামীণ মজুরদের জোর দিতে হচ্ছে ১০০ দিনের কাজের দাবিতে আন্দোলন। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর ও গ্রামীণ মজুরদের কাজের অধিকারের প্রশ্নে কোনো আইন নেই। তাঁত, রেশম, কাঁসা-পিতল সহ বিভিন্ন ধরনের কুটীর শিল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কৃষি অলাভজনক থাকাতে কৃষিতেও কাজের সংকট। লক্ষ লক্ষ বেকার গ্রামীণ মজুর কাজের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্য ও বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। ৮ ঘণ্টার দাবি ও মজুরির দাবিতে লড়াইয়ের চেয়েও বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ পাওয়ার লড়াইটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। অনেক আন্দোলনের ফলেই এমজিএনআরইজিএ আইন তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ মজুরদের বছরে ১০০ দিন কাজ পাওয়ার একমাত্র আইনি অধিকার। আর এই আইনটাও তুলে দিতে চাইছে কেন্দ্রের শাসকরা। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় দুই বছর কাজ দেওয়াই হচ্ছে না। তাই শ্রমিক ঐক্য ও সংহতি, কাজ এবং মজুরির দাবির সাথে সাথে ১০০ দিনের কাজের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে ঐতিহাসিক মে দিবসের শত বার্ষিকী। জেলায় কালনা ২নং ব্লকের আগ্রদহ বাজার ও বৈদ্যপুর বাসস্ট্যন্ডে, মেমারী ১নং ব্লকের নিমো অফিসে, মন্তেশ্বরের কুসুমগ্রাম বাজারে, জামালপুর ব্লকের আজাপুর বাজারে, পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া অফিসে ও গলসীতে মে দিবস পালন করা হয়।
গত ২৭ এপ্রিল চা-শ্রমিকদের জমির পাট্টার দাবিতে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সে সমস্ত ব্লকে বিএলআরও দপ্তরে চা-শ্রমিকদের যুক্ত মঞ্চ ‘জয়েন্ট ফোরাম’এর পক্ষ থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ সংগঠিত হয়। রাজ্য সরকার ‘লিজ হোল্ড’ জমিকে ‘ফ্রি হোল্ড’এর নামে বাগানে বসবাসকারী চা-শ্রমিক পরিবারদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। ফ্রি হোল্ডের নামে কর্পোরেটদের হাতে জমি তুলে দিতে চাইছে। টি-ট্যুরিজমের নামে অবাধে রিসর্ট খোলা হবে। জমির অধিকারের দাবিতে সমস্ত বাগানে আদিবাসীরা আওয়াজ তুলেছে “জন জন নাড়া হ্যায়, ইয়ে জমিন হামারা হ্যায়”। এই দাবি নিয়ে দার্জিলিং জেলার মাটিগাড়া, নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি ব্লকের বিএলআরও দপ্তরে ও ঘোষপুকুর আরআই অফিসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে বিভিন্ন ব্লকে জয়েন্ট ফোরামের প্রতিনিধি দল ডেপুটেশন দেন। ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন ও বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ’র পক্ষে অভিজিত মজুমদার ও বাসুদেব বসু, সিটুর পক্ষে সমন পাঠক, গৌতম ঘোষ, সুদীপ দত্ত প্রমুখ। ট্রেড ইউনিয়নের এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পার্টির জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, জেলা সদস্য শরৎ সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, বন্ধু বেক, সুমন্তী এক্কা সহ এআইসিসিটিইউ’র অন্তর্ভুক্ত তরাই সংগ্রামী চা-শ্রমিক ইউনিয়নের চা-শ্রমিকেরা অংশগ্রহণ করেন।
রাম নবমী হোক কিংবা নাবালিকার মৃত্যু, পশ্চিম বাংলায় এখন যেকোনো ঘটনায় সাম্প্রদায়িক রঙ লাগিয়ে বিজেপি-আরএসএস দাঙ্গা লাগানোর চক্রান্ত চালাচ্ছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির বিদ্বেষ সৃষ্টি ও দাঙ্গা বাঁধানোর ঘৃণ্য রাজনীতির মোকাবিলায় হুগলিতে এক সম্প্রীতি যাত্রার আয়োজন করেছিল সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি। নারীদের ওপর ঘটে চলা ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ-হত্যায় পুলিশ ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। পোলবা ব্লকের আলিনগরে এক সংক্ষিপ্ত সভা করে এই সম্প্রীতি যাত্রা ১০ কিলোমিটার পথ পেড়িয়ে চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ে এসে শেষ হয়। এরপর সংগঠনের এক প্রতিনিধি দল জেলা শাসক ও পুলিশ কমিশনার (চন্দননগর)-এর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রতিরোধে পুলিশ প্রশাসনকে আরো সক্রিয় ও কার্যকরী ভূমিকা নেওয়ার দাবি তোলার পাশাপাশি মিড-ডে-মিলের রন্ধন কর্মীদের বিভিন্ন সরকারি বঞ্চনা রোধে জেলা শাসকের হস্তক্ষেপের দাবি জানানো হয়। রাজ্যনেত্রী চৈতালী সেন ও জেলা সম্পাদিকা শিপ্রা চ্যাটার্জী সহ গ্রামীণ মেহনতি মহিলারা এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।
দুর্নীতির বাহানায় পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ শ্রমিকের হকের মজুরি আটকে রেখেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, আর এরাজ্যের বিজেপি সভাপতি বলছে গ্রামের মানুষের মধ্যে না কী একশ দিনের কাজের চাহিদা তেমন আর নেই। এই প্রসঙ্গে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি গত ২ মে এক বিবৃতি জারি করে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে ধিক্কার জানিয়েছে। তাঁরা সকলের কাছে আবেদন জানিয়েছেন বিজেপির এই মানুষকে বোকা বানানোর শয়তানি রাজনীতিকে ধিক্কার জানাতে। বিবৃতিতে ‘সুকান্তবাবু’কে ধিক্কার জানিয়ে গ্রামীণ শ্রমিকেরা বলেছেন,
কাজটাই তো তুলে দিচ্ছেন, বন্ধ রেখে। তো, মানুষ কাজের চাহিদা জানাবে কোনো ভরসায়!
গ্রামে কাজ নেই, কারণ কৃষি ধুঁকছে। ধুঁকছে সরকারের নীতির কারণে।
কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগের অভাবে এবং মোদী সরকার কৃষিজাত পণ্যে বাজারদামের গ্যারান্টি আইন না করার কারণে কৃষি ধুঁকছে। ফলে গ্রামে কাজ নেই।
গরিব, মেহনতি মানুষ ১০০ দিনের কাজের উপর ভরসা করে এ ক’বছর টিঁকে ছিল।
এখন আইন মোতাবেক ১০০ দিন কাজের সেই অধিকারও কেড়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে ‘আদানি কোম্পানির দাস’ মোদী সরকার। ১০০ দিনের বদলে মোদী টাকা বরাদ্দ করেছে মাত্র ১৭ দিনের। কাজের আইন এমনভাবে বদলে দিয়েছে, (দিনে ২ বার ডিজিটাল হাজিরা, মাটি কাটার নিয়ম এমনভাবে বদল যাতে বেশি কাজ না করানো যায় ইত্যাদি) যাতে কাজ কমে যায়।
আইন মোতাবেক যে মজুরি ১৫ দিনের মধ্যে দিতে হবে, সেই মজুরি পশ্চিমবঙ্গে আপনারা বকেয়া রেখেছেন ১৫ মাস। এই রাজ্যে গরিবদের নতুন এনআরইজিএ কাজও আপনারা বন্ধ রেখেছেন ১৫ মাস!
আপনারা এটাও ভুলে যান যে এই কাজ আপনার বা মোদীর পয়সায় চলে না। চলে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায়!
এরাজ্যে, এ রাজ্যই বা বলি কেন, সারা দেশেই ১০০ দিনের কাজ নিয়ে দুর্নীতি চলছে। পশ্চিমবঙ্গে হয়তো বেশিই চলছে। আমরা প্রত্যেক দুর্নীতিগ্রস্তের শাস্তি চাই। সরকারি প্রকল্পে পাইপয়সার হিসাব চাই। তা সুনিশ্চিত করুন।
কিন্তু কাজ বন্ধ হবে কেন?
এরফলে ক্ষতিগ্রস্ত তো গরিব মানুষ। এই প্রকল্পে যারা দুর্নীতি করেছে তেমন ক’জন দুর্নীতিগ্রস্তকে জেলে পুরেছে মোদী সরকার?
তা না করে দুর্নীতির বাহানায় আইনের ২৭ ধারা প্রয়োগ করে পশ্চিমবঙ্গে কাজটাই তুলে দিচ্ছেন আপনারা! চাইছিলেন অনেক দিন থেকেই। নরেন্দ্র মোদী তো সেই ১৪ সালে দিল্লীর ক্ষমতায় বসেই আওয়াজ তোলেন যে ১০০ দিনের কাজ আসলে অপচয়! এই আইন তুলে দিতে হবে!
মনে পরে সুকান্তবাবু?
কাজ বন্ধ হলে ক্ষতি কার? মেহনতি মানুষের। গ্রামের গরিবদের।
গরিবদের আইনি অধিকার কেড়ে নিতে ১০০ দিনের কাজ নিয়ে মোদী সরকারের এই জঘন্য ষড়যন্ত্রকে আড়াল করতে আপনি, বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, এখন সাংবাদিক বৈঠকে বলছেন, ১০০ দিনের কাজের চাহিদাই নেই?
অধ্যাপক মশাই, এবার আদানি-আম্বানিদের সেবাদাসত্ব একটু কম করে একবার একটু মাটিতে নেমে গ্রামের কর্মহীন মেহনতি মানুষটাকে জিজ্ঞাসা করুন, ১০০ দিনের কাজ তার কতটা দরকার! জিজ্ঞাসা করুন দেশগ্রামে কাজের অভাবে অসংখ্য মেহনতি, এমনকি ছোট ছোট ছেলেরাও বাইরের রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে কিনা? উত্তরটা পেয়ে যাবেন!
১০০ দিনের কাজের আইন ধীরে ধীরে কেড়ে নিতে চাইছেন! আজ নাহোক কাল, উত্তর নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন।
সুকান্তবাবু, সাধারণ মানুষকে বোকা ভাববেন না, যে যা বোঝাবেন তাই বুঝবে। মানুষকে আণ্ডার এস্টিমেট করবেন না। মানুষ সব বোঝে।
একারণেই গত ২৭ এপ্রিল ২০২৩ সারা ভারত জুড়ে কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির নেতৃত্বে কোনায় কোনায় আওয়াজ উঠেছে, “১০০ দিনের কাজ ফিরিয়ে দাও; ১০০ নয়, এবার ২০০ দিনের কাজ দাও; ৬০০ টাকা মজুরি দাও”।
৩ মে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, অল ইন্ডিয়া রেভল্যুশনারি উইমেন্স অর্গানাইজেশন, ফেমিনিস্টস ইন রেজিস্ট্যান্স, মহিলা স্বরাজ, শ্রমজীবী নারী মঞ্চ, শ্রমজিবী মহিলা সমিতি, নারী চেতনা সংগঠন মিলে শিশু সুরক্ষা কমিশনের সাথে দেখা করে ডেপুটেশন জমা দেওয়া হয়। দীর্ঘক্ষণ রাজ্যের শিশু নির্যাতন এবং কালিয়াগঞ্জ-কালিয়াচকের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ডেপুটেশন শেষে ছোট মিছিল করে উল্টোডাঙ্গা স্টেশন পর্যন্ত আসা হয়। এবং খুব অল্প সময়ের জন্য রাস্তা অবরোধ করে স্লোগান দেওয়া হয়।
শিশু সুরক্ষা কমিশন জানায় যে তাঁদের তদন্তে জানা গেছে যে স্থানীয় যুবকটির সাথে কিশোরির ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে বাড়ির লোকেদের অমত ছিল। তাঁরা ওকে মারধোরও করে। সেদিন মেয়েটি ছেলেটিকে দেখা করতে বলে। এদিকে ছেলেটির বাবাও ছেলেটিকে আটকে রেখেছিলো, ছেলেটি লুকিয়ে ২০ কিমি পথ হেঁটে যখন মেয়েটির সাথে দেখা করতে আসে ততক্ষণে মেয়েটি বিষ খেয়ে ফেলেছে। ছেলেটি সারারাত মেয়েটিকে ধরে পুকুরপাড়ে বসে ছিল। সকাল হতে বাড়ি যায়। বাবা আর ছেলে গিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করে।
সবাই সেই সময় বলতে থাকে মেয়েটির গণধর্ষণ হয়েছে। মেয়েটির রাজবংশী পরিবার মৃতদেহ নিয়ে চারিদিকে আগুন লাগিয়ে গোল করে বসে থাকে। তখন পুলিশ এসে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে ফেলে। কমিশন পুলিশের এই আচরণকে সমালোচনা করে। শিশু সুরক্ষা কমিশন তাঁদের এই তদন্তের রিপোর্ট দিলেও, অদ্ভুত বিষয় হল, সালিশি সভার ভূমিকা অস্বীকার করে। তারা বলে মুসলিম ছেলেটির বাবা পঞ্চায়েতে গিয়েছিল, ছেলেটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর। তখন মেয়েটির পরিবারকেও ডেকে পাঠানো হয়। তারা ভাবে ছেলেমেয়ে জুটি বোধহয় পালিয়ে গেছে।
ডেপুটেশনের পক্ষ থেকে বলা হয় গ্রামে গ্রামে এই নিয়ে সচেতনতা ক্যাম্প করার উদ্যোগ নিক কমিশন। তারা সেখানে বাল্য বিবাহ রোখার জন্য চাইল্ড কমিশন কী করছে সেই নিয়ে আমাদের বলতে থাকেন। আলোচনা দীর্ঘক্ষণ চলার পর তাঁরা জানান কোথাও কোনরকম শিশু নির্যাতন বা থানায় রিপোর্ট না নিতে চাইলে আমরা যেন তাঁদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করি। আর কালিয়াগঞ্জ ঘটনাকে তারা নজরে রাখছেন। বর্তমানে মুসলিম ছেলেটি নামে সব দোষ চাপিয় পক্সো মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
বকেয়া ডিএ, শূন্যপদে স্বচ্ছ নিয়োগ এবং অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ীকরণের দাবিতে আগামী ৬ মে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের ডাকে কলকাতার মহামিছিল সফল করার আহ্বান জানিয়ে ৩ মে মৌলালী মোড়ে প্রোগ্রেসিভ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (পিটিএবি)’র প্রচার সভা আয়োজিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের মঞ্চের প্রতিনিধিরা।
সভা থেকে দাবি ওঠে :
কোনো টালবাহানা নয়, সব পক্ষকে নিয়ে আইনি জটিলতা কাটিয়ে দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের অবিলম্বে নিয়োগ দাও!
শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার নয়া শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিল কর!
সমস্ত অস্থায়ী কর্মীদের বেতন কাঠামো সহ পূর্ণ সরকারি কর্মীর মর্যাদা চাই!
ডিএ দয়ার দান নয়, ডিএ আমাদের অধিকার! অবিলম্বে সমস্ত বকেয়া ডিএ দাও!
সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা বাঁচাতে সমস্ত মানুষ এক হও!
দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত সমস্ত প্রাক্তন ও বর্তমান নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের গ্রেফতার কর!
দীর্ঘ দিন ধরে মেদিনীপুরের পৌর সাফাইকর্মীরা রাজ্য সরকার ঘোষিত ৩৭৬ টাকা দৈনিক মজুরি চালু সহ ইপিএফ-এর বেনিফিট, কর্মরত অবস্থায় মৃত কর্মচারীদের পরিবারের সদস্য/সদস্যাদের নিযুক্তির দাবি ও বহু শূণ্যপদ পূরণ সহ ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কোনো সুরাহা না পাওয়ার কারণে ৫ এপ্রিল তিনশত শ্রমিকের মিছিল করে স্ট্রাইক নোটিশ জমা করা হয়। ২৬ এপ্রিল সকাল থেকে সবধরনের শ্রমিক কর্মচারীরা মিলে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেন। চাপে পড়ে চেয়ারম্যান তড়িঘড়ি বিকাল চারটে থেকে মিটিং ডাকেন, ইউনিয়ন নেতৃত্বের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছাতে। তা সত্ত্বেও আন্দোলনের মেজাজ অটুট রেখে সমস্ত আউটডোর কাজ বন্ধ থাকে এই দিন বেলা ১০.৩০ টা পর্যন্ত। সাফাইকর্মীদের সমর্থন করে কাজ বন্ধ রাখেন বিদ্যুৎ, জনস্বাস্থ্য ও জল-কল বিভাগের শ্রমিকরাও। বুধবার রাত্রি সাড়ে নয়টা পর্যন্ত লম্বা আলোচনার মাধ্যমে বেশ কিছু দাবি মেনে নেওয়া ও বেতন বৃদ্ধির লিখিত আশ্বাস পাওয়ার পর ২৭ তারিখ অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আবার কাজকর্ম স্বাভাবিক অবস্থায় চালু করে দেন সাফাইকর্মীরা। চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত অন্যান্য সকল পদাধিকারীর থেকে লিখিত চুক্তির মাধ্যমে যে সকল আশ্বাস মিলেছে তা নিম্নরূপ –
১। মেদিনীপুর পৌরসভাতে ৭০০-র কাছাকাছি স্কিমকর্মী আছেন। কেন্দ্রীয় সরকার এঁদেরর মাত্র ২০২ টাকা দৈনিক বেতন ঘোষণা করেছে, যদিও ইতিমধ্যে এঁরা ২০২১ সালের ধর্মঘটের পর পৌরসভা কর্তৃক ২৪ টাকা অনুদানসহ মোট ২২৬ টাকা বেতন পাচ্ছেন। এই বেতনের মান বৃদ্ধি করে ৩৭৬ টাকা করার প্রচেষ্টা করা হবে আগামী ২ মাসের মধ্যে মেদিনীপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে আলোচনার মধ্যে দিয়েই এবং প্রতি মাসের বেতন ১০-১২ তারিখের মধ্যে শ্রমিকদের মিটিয়ে দিতে হবে।
২। মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের দ্রুততার সাথে পেনশন চালু করতে হবে, পরিবারের ১ জনকে কাজে নিযুক্তি দিতে হবে।
৩। এর সাথে সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পে আরো ১০ জন মহিলা ও ৫ জন শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের লেবার সুপারভাইজার পদে নিযুক্ত করা হবে।
৪। পাঁচ বছরের ওপর কর্মরত শ্রমিকদের কনসলিডেটেড পে করা হবে। যাঁরা চুক্তি ভিত্তিক ও অস্থায়ী কাজ করছিলেন তাঁদের এরপর থেকে মাস্টার রোল ও কনসলিডেটেড বেতন চালুর ব্যাবস্থা করা হবে।
৫। সাফাইকর্মীদের কোয়ার্টার ও বাসস্থান এলাকার সংস্কার করা হবে এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তোলা হবে।
৬। কুড়ি বছরের ঊর্ধ্বে যারা কাজ করছেন তাঁদের কিছুদিন আগে বেতন বৃদ্ধি হয়েছিল, আবারো বেতন বাড়ানো হবে।
৭। ওয়েস্ট বেঙ্গল আর্বান এমপ্লয়মেন্ট স্কিম ফান্ডের অধীনে ৭ বৎসরের অধিক যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের মাস্টার রোলের স্ট্যাটাস অনুযায়ী বেতন দেওয়া হবে, এবং ১০ বৎসরের ঊর্ধ্বে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের কনসলিডেটেড পেমেন্ট স্ট্যাটাস অনুযায়ী বেতন দেওয়া হবে।
সমগ্র আন্দোলনের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দেন সুরেশ পুতলা, মনা মূখি, শঙ্কর বেহারা, বাবু নিমাই, কুসুম ভূঁইয়া, দিবাকর মূর্দিঙ্গা, সজনী বেহারা, দূর্গা মূখি, খুঁকু পুতলা, রবীন্দ্র কল্যাণ, নগেন্দ্র নায়েক, সুশান্ত বেহারা প্রমূখরা।
রিপোর্ট - ফারহান
২৮ এপ্রিল ২০২৩ অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে এআইসিসিটিইউ রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বরা এবং বরিষ্ঠ নেতা অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
বিরসূল হাট ইউনিয়নের ৯৩ জন হকার ছাড়াও যাদবপুর ও শিয়ালদহ অঞ্চলের কয়েকজন হকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের শুরুতে বিগত দিনে যে সকল হকার সাথী ও সহনাগরিকরা প্রয়াত হয়েছেন এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণে অতনু চক্রবর্তী বর্তমান ভারতবর্ষের পরিস্থিতি, রাজ্য পরিস্থিতি এবং বিরসূল হাট ইউনিয়নের লড়াইয়ের ইতিহাস ও আগামী কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রাখেন। এরপর ইউনিয়ন সভাপতি দিবাকর ভট্টাচার্য্য ভারতবর্ষের শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে বিপথগামী করতে বিজেপি-আরএসএস-এর বিভাজনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকা এবং পদ্মপুকুর অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখার আহ্বান জানান। আগামীদিনে কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী অবিলম্বে হকারদের লাইসেন্স, পরিচয় পত্র দেওয়া এবং বিদ্যাসাগর মঞ্চের মার্কেট কমপ্লেক্সে হকারদের স্টল দেওয়ার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ফিরোজ খান (গুড্ডু), মহম্মদ শাহাবুদ্দিন, মহম্মদ সিরাজ, মহম্মদ দৌলত, মহম্মদ মনসুর, মহম্মদ জাফর সহ কয়েকজন হকার নেতৃত্ব। বক্তারা হকারদের দাবি সহ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এছাড়াও হকারদের অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ লড়াইয়ে এআইসিসিটিইউ এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের অবদান এবং প্রয়াত কমরেড বিভাস বোসের (বুড়োদা) অবদানের কথা বার বার উল্লেখ করেন।
মে মাস’কে আন্দোলনের মাস হিসাবে চিহ্নিত করা, মে দিবসের শতবর্ষে বড় জমায়েত, ‘বিজেপি হঠাও-দেশ বাঁচাও’ স্লোগানসহ ইউনিয়নের দাবিগুলিকে তুলে ধরা, ১০ মে’র মধ্যে সদস্যদের বকেয়া চাঁদা (ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত) জমা করা এবং ইউনিয়ন সদস্যদের নামের তালিকা প্রস্তত করা, হকারদের দাবি নিয়ে এলাকায় বড় সভা করা, কলকাতা কর্পোরেশন অভিযান সংগঠিত করে মেয়রের কাছে দাবি সনদ পেশ করা, এন্টালি এবং বেনিয়াপুকুর থানায় মিছিল করে দাবি সনদ দেওয়া ইত্যাদি সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
পরিশেষে ৪১ জনের কাউন্সিল, ২১ জনের কার্যকরী কমিটি গঠন হয়। দিবাকর ভট্টাচার্য্য - সভাপতি, অশোক সেনগুপ্ত - কার্যকরী সভাপতি, মহম্মদ জাফর, মহম্মদ আমিন, মহম্মদ কলিম, মহম্মদ মনসুর, মহম্মদ রহমান, মহম্মদ ফিরোজ খান (গুড্ডু), মহম্মদ সামসের প্রমূখ সহ সভাপতি, মহম্মদ সামিম – সাধারণ সম্পাদক, মহম্মদ রুস্তম, মহম্মদ শাহাবুদ্দিন, খোকন ঘোষ, মহম্মদ সাদ্দার, মহম্মদ সিরাজ প্রমূখ সহ সম্পাদক এবং মহম্মদ সিরাজ কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।
অত্যন্ত প্রাণবন্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে এবং আগামী দিনে দাবি আদায়ের শপথ নিয়ে সম্মেলন কর্মসূচি সমাপ্ত হয়।
- অশোক সেনগুপ্ত, বিরসূল হাট লেদার হকার্স ইউনিয়ন এবং কলকাতা ষ্ট্রীট হকার্স ফেডারেশনের পক্ষে
যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মহিলা কুস্তিগিররা অবশেষে প্রাথমিক সাফল্য পেলেন গত শুক্রবার ২৮ এপ্রিল, যা এল কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর বিরুদ্ধে দিল্লী পুলিশের দুটো এফআইআর দায়েরের মধ্যে দিয়ে। রাজধানী দিল্লীর যন্তরমন্তরে সমবেত হয়ে দ্বিতীয় দফার আন্দোলন মহিলা কুস্তিগিররা শুরু করেছিলেন ২৩ এপ্রিল। তার আগে গত ২১ এপ্রিল কনট প্লেস থানায় এক নাবালিকা-সহ সাত মহিলা কুস্তিগির কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দায়ের করেন। ন্যায়বিচার লাভের দাবিতে অনড় থেকে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টেরও শরণাপন্ন হন। কুস্তিগিরদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় এবং পিএস নরসিমার বেঞ্চ জরুরি ভিত্তিতে মামলাটির শুনানি গ্ৰহণ করে বললেন, “দেশের প্রতিনিধিত্ত করা কুস্তিগিররা যৌন হেনস্তার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। আদালত এই আবেদন এড়িয়ে যেতে পারে না।” সুপ্রিম কোর্টের এই হস্তক্ষেপের পরিণতিতেই এলো ঐ এফআইআর দ্বয়।
এবার আমরা একটু ফিরে তাকাই প্রথম পর্বের আন্দোলনের দিকে। মহিলা কুস্তিগিররা কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর বিরুদ্ধে যৌন নিগ্ৰহের অভিযোগ এনে আন্দোলন শুরু করেন এ’বছরের ১৮ জানুয়ারি। সেদিন ৩০ জন মহিলা কুস্তিগির যন্তরমন্তরে সমবেত হয়ে বললেন, কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর হাতে তাঁদের শুধু যৌন নিগ্ৰহই ঘটছে না, তাঁদের মানসিক চাপ ও যন্ত্রণাও তীব্র হয়ে উঠছে এবং তাঁরা খুনের হুমকিও পাচ্ছেন। এই মহিলা কুস্তিগিরদের মধ্যে ছিলেন সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগট, সরিতা মোর, সঙ্গীতা ফোগট, সুনিতা মালিক ও অন্যান্যরা। এদের বেশ কয়েকজনই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়, অলিম্পকসের মতো ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মঞ্চে পদক লাভ করে ভারতকে গৌরবান্বিত করেছেন, ক্রীড়া ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। কুস্তি ফেডারেশনের প্রধানের যৌন নিগ্ৰহের কৌশলকে উন্মোচিত করে বিনেশ ফোগট সাংবাদিকদের সামনে বললেন, “এই যৌন নিগ্ৰহ প্রতিদিন ঘটছে। প্রশিক্ষণ শিবির কেন সংগঠিত হয় লক্ষ্ণৌতে? এর কারণ, সেখানে সিং’এর নিজের একটা বাড়ি আছে এবং সেখানে মেয়েগুলোর কাছ থেকে সুযোগ নেওয়াটা সুবিধাজনক।”
কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ নাগরিক সমাজের কাছ থেকে ক্রমেই আরো বেশি সমর্থন লাভ করতে লাগল এবং একটা জাতীয় ইস্যু হয়ে উঠল। নরেন্দ্র মোদীর সরকার বুঝল, বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং’কে কেন্দ্র করে কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ চলতে থাকলে তাদের মুখোশ খুলতে থাকবে, বিপদ বেড়ে চলবে। এই প্রতিবাদ থামাতে কিছু একটা করা দরকার। আসরে নামলেন “গোলি মারো”, মন্তব্য খ্যাত ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। তিনি বললেন, মহিলা কুস্তিগিরদের অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য একটা কমিটি গঠন করা হবে, এবং কমিটি চার সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। তিনি আরও জানালেন, কমিটি যতদিন না রিপোর্ট দিচ্ছে ততদিন ব্রিজভূষণ কুস্তি ফেডারেশনের প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে কুস্তিগিররা ২০ জানুয়ারি তাঁদের প্রতিবাদ স্থগিত করলেন এবং মন্ত্রীর তৈরি ওভারসাইট কমিটির রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন।
সাত সদস্যের ওভারসাইট কমিটি গঠন করা হল, কিন্তু কমিটির গঠন নিয়ে সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগট, বজরং পুনিয়ারা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কমিটির প্রধান করা হল খ্যাতনামা বক্সার মেরি কমকে যিনি ২০১৬ সালে বিজেপি মনোনীত রাজ্যসভার সদস্য হন। কমিটির আর এক সদস্য খেলরত্ন পুরস্কার প্রাপক যোগেশ্বর দত্ত ২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগ দেন এবং প্রকাশ্যেই ব্রিজভূষণের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন।
বিনেশ ফোগট’এর তুতো বোন ববিতা ফোগটকেও কমিটির সদস্য করা হয় যিনি হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কমিটিকে এইভাবে বিজেপি অনুগত লোকজন দিয়ে ভরানো হল যার উদ্দেশ্য পরিষ্কার — কমিটির রিপোর্ট যেন ব্রিজভূষণের অনুকূলে থাকে।
কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর পরিচিতি ও খ্যাতি কী ধরনের? তিনি ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ, উত্তরপ্রদেশের কাইসারগঞ্জ ক্ষেত্র থেকে বিজেপি সাংসদ এবং ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুস্তি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান হয়ে রয়েছেন। অনেকেই তাঁকে এক ‘মাফিয়া’ বলে জানেন এবং তাঁর দাপটের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেন না। কুস্তিগিরদের দায়ের করা অভিযোগ-সহ ওঁর বিরুদ্ধে ৪০টা মামলা রয়েছে — যেগুলোর মধ্যে অপরাধের প্রায় সব ধরনের অভিযোগই দেখা যায়। তিনি বাবরি মসজিদ ধ্বংসেও যুক্ত ছিলেন।
কলাম লেখক মুকুল কেশভন ৩০ এপ্রিলের দ্য টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রে ‘গ্রে সাইলেন্স’ শীর্ষক নিবন্ধে জানিয়েছেন, “গুলি করে এক ব্যক্তিকে হত্যার কথা তিনি টেলিভিশনেই স্বীকার করেছেন, সব ধরনের অভিযোগেই অভিযুক্ত হয়েছেন — ডাকাতি থেকে খুন পর্যন্ত। তাঁর সমর্থনে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা হলেন দিল্লী পুলিশ যারা সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ না করা পর্যন্ত এফআইআর দায়ের করেনি, রয়েছেন সলিসিটর জেনারেল, যিনি যথাযোগ্য প্রক্রিয়ার অজুহাতে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকে সমর্থন করেছেন এবং ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর যিনি ওভারসাইট কমিটির রিপোর্টের মধ্যে গোটা বিষয়টাকে চাপা দিয়েছেন যাদের রিপোর্ট এখনও প্রকাশ করা হয়নি।” আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবেচনাতেও মহিলা কুস্তিগিরদের সম্ভ্রম ও ইজ্জতের প্রতিষ্ঠা একেবারেই গুরুত্ব পেল না। গোটা ব্যাপারটায় নীরব থেকে তিনি জানিয়ে দিলেন, মহিলাদের ন্যায়বিচার লাভের চেয়ে ‘মাফিয়া’ চরিত্রের বিজেপি সাংসদের সুরক্ষাই তাঁর কাছে অধিকতর গুরুত্বের। সাক্ষী মালিক মোদীর এই মনোভাবকে কটাক্ষ করে বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদী স্যার বেটি বাঁচাও ও বেটি পড়াও’এর কথা বলেন এবং সবার ‘মন কী বাত’ শোনেন। তিনি কি আমাদের ‘মন কী বাত’ শুনতে পারেন না? আমরা পদক পেলে তিনি আমাদের তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান এবং আমাদের যথেষ্ট সম্মান দেখান ও নিজের মেয়ে বলে অভিহিত করেন।… আমাদের মন কী বাত শোনার জন্য তাঁর কাছে আমরা আবেদন জানাচ্ছি। কুস্তিগিরদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন কপিল দেব, বীরেন্দ্র সেহবাগ, নভজ্যোত সিং সিধু, মদনলাল, হরভজন সিং’এর মতো কিছু প্রাক্তন ক্রিকেটার। সমর্থন এসেছে অলিম্পিকে জ্যাভলিন ছোঁড়ায় স্বর্ণপদক প্রাপ্ত নীরজ চোপড়া এবং শুটিংয়ে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত অভিনব বিন্দ্রার কাছ থেকে। টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা, মহিলা হকি খেলোয়াড় রানি রামপাল এবং আরও কিছু ক্রীড়াবিদ কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল, বর্তমান ক্রিকেটারদের কেউই কুস্তিগিরদের ন্যায়বিচারের দাবির প্রতি সমর্থন জানানোটাকে কর্তব্য বলে মনে করতে পারেননি। বিনেশ ফোগট অত্যন্ত মর্মাহত হয়েই বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর ‘সাহস ওঁদের না থাকাটা’ তাঁকে ‘যন্ত্রণা’ দেয়। আমাদের কম বিস্মিত করে না ভারতীয় অলিম্পিক কমিটির সভাপতি পিটি ঊষার মন্তব্যও। নিজে মহিলা অ্যাথলিট হয়ে মহিলা কুস্তিগিরদের সম্মান-মর্যাদা রক্ষায় তিনি বিবেকী হতে পারলেন না। উল্টে কুস্তিগিরদের সমালোচনায় বললেন, “কুস্তিগিররা রাস্তায় নেমে যে প্রতিবাদ সংগঠিত করছেন সেটা শৃঙ্খলাহীনতার পরিচায়ক। এটা ভারতের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করছে।” পিটি ঊষার এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লী মহিলা কমিশনের প্রধান স্বাতী মালিওয়াল বলেছেন, “এইভাবেই শৈশবের নায়িকারা সম্মান হারান”। বিজেপি মন্ত্রীসভার সুপারিশে রাষ্ট্রপতি পিটি ঊষা এবং আরও তিনজনকে দক্ষিণের রাজ্যগুলো থেকে রাজ্যসভার সদস্য রূপে মনোনীত করেন, আর তার পিছনে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে প্রভাব বিস্তারের অভিপ্রায়ও বিজেপির ছিল। বিজেপি তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য করায় বিজেপি সাংসদের নষ্টামির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সৎসাহসটুকু তিনি দেখাতে পারলেন না।
যদি বলা হয়, অর্থ ও নামযশের মোহের কাছে করো কারো মনুষ্যত্ববোধ ও মানবপ্রীতিও বিকিয়ে যায় তবে বোধহয় খুব ভুল বলা হবে না।
দু’টো এফআইআর’এর পর দিল্লী পুলিশ কুস্তিগিরদের যন্তরমন্তরের প্রতিবাদ স্থল ছেড়ে যেতে বলেছে। ঐ স্থলের বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করা হয়েছে, জল ও খাবার সরবরাহকে আটকানো হয়েছে, মারধর করা হয়েছে ঐসব জিনিসের সরবরাহকারীদের। তবে কুস্তিগিররাও প্রতিবাদে অবিচল রয়েছেন। বজরং পুনিয়া বলেছেন, “ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে যাব, পুলিশ প্রশাসন আমাদের ওপর যত অত্যাচারই করুক না কেন।” আর বিনেশ ফোগটও বলেছেন, “এই লড়াইটা শুধু একটা এফআইআর দায়েরের জন্যই নয়। এই লড়াইটা ন্যায়বিচার পাওয়ার, ওকে শাস্তি দেওয়ার, ওকে জেলে পাঠানোর এবং ও যে সমস্ত পদ অধিকার করে রয়েছে সেগুলো থেকে অপসারিত করার লড়াই।” কুস্তিগিররা ভালো করেই জানেন তাঁদের প্রতিপক্ষ কতটা শক্তিধর। প্রবল প্রতাপসম্পন্ন এই ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে সাক্ষী মালিক-বিনেশ ফোগট-বজরং পুনিয়ারা নিজেদের ক্যারিয়ার বিপন্ন করেও লড়াই জারি রেখেছেন, ক্রীড়া মন্ত্রকের কপটাচার ও ছলচাতুরিকে উপেক্ষা করে, শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতিতে প্রতারিত না হয়ে ভয়ের বাতাবরণ ছিন্ন করে শাসকদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চলেছেন। বিরল দৃষ্টান্তের স্পর্ধিত এই সংগ্রামের সহস্র সেলামই প্রাপ্য!
- জয়দীপ মিত্র
উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ। রাজ্য রাজনীতির শিরোনাম হয়ে ওঠা এই এলাকায় সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলীর কেন্দ্র ছিল সাহেবঘাটা অঞ্চল ও বাজার। সেখান থেকে আধ কিলোমিটার দুরে এক নাবালিকার দুঃখজনক মৃত্যু নিয়ে রাজ্য রাজনীতি হয়ে উঠেছে তোলপাড়। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেলো বাজারে বেছে বেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর করা হয়েছিল, দুটিতে লাগানো হয়েছিল আগুন। সেগুলিকে মেরামত করে পুনরায় বাজার সচল হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটে লোকজন খুবই কম। মানুষ নানা আশংকার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু আজ ব্যাপক মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, আক্রান্ত দোকানদারদের অপরাধ কী ছিল? কেবল ধর্মীয় পরিচয়? পরস্পরের প্রতি ঘৃণাবিদ্বেষই কি আমাদের বাঁচার পথ? এই বাজারে প্রধানত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের দোকান। আর বাজারের ভেতরে পথের ধারে রকমারী জিনিসের দোকান নিয়ে যারা বসেছেন তাঁরা মূলত হিন্দু উদ্বাস্তু ও স্থানীয় রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ। গোটা এলাকাতেই রয়েছে এই ধরনের জনবিন্যাস। নাবালিকার মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে রাতারাতি মিথ্যা প্রচার করে গুজব রটিয়ে তাণ্ডব সৃষ্টি করে এদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ বিভাজন সৃষ্টির মরিয়া চেষ্টা করা হয়েছিল। তবুও এক সপ্তাহ পর এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো তাঁরা একে অপরের সাথে মিলে মিশে পাশাপাশি রয়েছেন। যেমন, পথে বসে ফল বিক্রেতা কালীদাস সরকার ঘটনাস্থলের কাছেই মনসুর সেখের বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে জানালেন, ঘটনার দিন আমি সারা রাত রাস্তায় পাহাড়া দিয়েছি। কদিন আগেই তো মনসুরের বাবা মারা গেছে। সে ছিল আমার বন্ধু লোক। তাই আমিই ওদের পরিবারটাকে আগলে রেখেছি। এভাবেই জ্বলজ্বল করে উঠলো আমাদের পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন। না, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় সীমিত সংখ্যক কিছু উগ্র জনগোষ্ঠীর কথা বাদ দিলে এটাই হয়ে উঠেছে এলাকার এক সাধারণ ছবি।
ঘটনা সম্পর্কে জানা গেল, কিশোরির মৃত্যুর ঠিক পরই বিজেপির নেতা সুকান্ত মজুমদার, দেবশ্রী চৌধুরীরা চটজলদি এলাকায় পৌঁছে যায়। এর সাথে জেলা ও স্থানীয় মাতব্বররা মিথ্যা প্রচার ও গুজব ছড়িয়ে লোকজন জড়ো করে সকলকে উত্তেজিত করতে শুরু করে। ওরা মৃতদেহ আটক করে রাখে। অনেকেই জানালেন পুলিশ যখন মরদেহ হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন জয় শ্রীরাম বাহিনী রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে মরদেহটিকে অশালীন অবস্থায় নিয়ে গেছে। সে সময় পুলিশের ভূমিকাও ছিলো নক্কারজনক। মরদেহকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া এক চরম অপরাধ যা কঠোর শাস্তির দাবি করে। এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি আরএসএস বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে দাঙ্গার পরিস্থিতি চরমে নিয়ে যায়। গোটা এলাকায় উভয় পক্ষই প্রস্তুত হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় প্রায় লাগে লাগে এমনই অবস্থা! যাই হোক বিষয়টা সে দিকে যায় না৷ তার দুদিন পরেই সংগঠিত হয় বিক্ষোভের নামে থানা আক্রমণের ঘটনা৷ বিজেপির পরিকল্পনা ছিল, রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে থানা আক্রমণ করছে – এই জাতীয় একটা জিগির ও ন্যারেটিভ তুলে ধরা। কিন্তু বাস্তব ঘটনাবলীর বিকাশ বিপরীত অভিমুখে এগিয়ে গেছে। থানা আক্রমণের ঘটনা সাধারণ মানুষ মোটেই মেনে নেয়নি। সেটা সর্বস্তরে নিন্দিত হয়েছে। বরং বিজেপির পরিকল্পনাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ওরা অনেকটাই রক্ষণাত্মক জায়গায় চলে গেছে। “গাবর সংঘ” (রাজবংশী ভাষায় গাবর অর্থ যুবক) নামক একটা সংগঠন বেশ কয়েক বছর ধরে তৈরি করে বিজেপি তার নামে কাজ চালাচ্ছে। থানায় হামলার প্রোগ্রাম ওরা এই ব্যানারে সংগঠিত করেছে।
নাবালিকার মৃত্যু নিয়ে একটি সম্প্রদায়ের মানুষকে বিশ্বাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ধর্ষণ হয়েছে। টার্গেট করা হয়েছে সংখ্যালঘুদের। সেই অনেকটা “ধর্মীয় স্থলে অমুকের মাংস” পাওয়া গেছে গোছের গুজব। যা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সুচারুভাবে প্রচার করা হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভিন্ন ধর্মে প্রেম বা বৈবাহিক সম্পর্ক রাখা যাবে না এই ফতোয়া জারি করে গ্রাম্য সালিশীর মাধ্যমে তৃণমূলের মাতব্বররা একটি মেয়ের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। তাঁকে অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিয়েছে। এটা অত্যন্ত বেআইনি অপরাধমূলক কাজ। যা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বাস্তব ঘটনা রূপে দেখা যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উঠে এসেছে সমগ্র ঘটনাবলীর পূর্ণাঙ্গ তদন্তর দাবি। অন্য সম্প্রদায়ের স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, আদৌ কোনো ধর্ষণ হয়নি। ঘটনা পরম্পরা তার সত্যতার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে মৃতদেহ নিয়ে পুলিশী বর্বরতা ও থানায় হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধ্যরাতে গ্রেপ্তারি ও গুলি চালিয়ে হত্যা প্রবল তৃণমূল বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে গত ৩০ এপ্রিল কালিয়াগঞ্জে পার্টি কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান পরিস্থিতির আলোচনায় উঠে এলো, সমগ্র এলাকায় এক সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। থানায় হামলার ঘটনায় এক সম্প্রদায়ের মানুষ পুলিশী ধরপাকড়ের আতংকে রয়েছে। নতুন করে কখন কোথায় হামলা আসবে সেই আশঙ্কায় রয়েছে অপর এক সম্প্রদায়। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ক্রমশই বুঝতে পারছে যে এই পরিস্থিতির জন্য বিজেপি ও তৃণমূল উভয়েই দায়ী। সব মিলিয়ে তৃতীয় শক্তির একটা পরিসর গড়ে উঠছে। এই দিশায় আমাদের নিজেদের শক্তিকে সংহত করা এবং আগামী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঘটনার তদন্ত, অপরাধী পুলিশের শাস্তি সহ জরুরি দাবিগুলি নিয়ে এবং সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের বিরুদ্ধে জেলা সদরে প্রচার ও প্রশাসনে ডেপুটেশন দেওয়া হবে, ১৪৪ ধারা উঠে গেলে সম্প্রীতি মিছিল করা হবে।
- জয়তু দেশমুখ
আমার পরিচয়, আমি একজন নামী কোম্পানির ডেলিভারি বয়। আমার জীবন কাহিনী হ’ল, প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পথ দুই চাকার বাইকে রানারের মতো পিঠে বোঝা ভরা ওষুধের ব্যাগ নিয়ে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে সময় মতো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব আমার। কারণ সবার সময়মত ওষুধ চাই, তা নাহলে রুগীরা যে মরে যাবে, ভাই। আমার খবর কারো কাছে নেই। আমার বোধহয় বাঁচারও অধিকার নেই। কেন না, আমি যখন ওষুধের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাইক চালাই তখন কেউ ফোন করে বলে, “আমার ওষুধ আগে দিও ভাই। ডাক্তারবাবু আমায় বলেছে দুপুর ১২টায় ওষুধটা খেতে, তাই।” আবার অন্য প্রান্ত থেকে কেউ ফোন করে বলে, “কোথায় তুমি? আমার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে এল। এখনও তুমি এলে না!” কেউ আবার ফোনে গালিগালাজ দিয়ে বলে, “আজ ঠিক ২টোর সময় ওষুধ না পেলে তোমার নামে কোম্পানির কাছে রিপোর্ট করব।” আমায় কথা বলার সময় দেয় না কেউ। আমার নেই কোনো খাওয়ার বা টিফিন করার সময় কারণ আমার কাঁধে মালিকের দেওয়া ওষুধ ভর্তি ব্যাগ যা সবাইকে সময়মতো পৌঁছে দেওয়া দায়িত্ব আমার। তবুও আমার মালিক বারবার বলে, “এই তো সামান্য কাজ কর।” বলার কারণ, আমাকে ২০০ টাকার বেশি মজুরি দেবে না, তাই। মালিকের ব্যবহার এমনই অদ্ভুত যে উনি চা বিস্কুট খাচ্ছেন অথচ ভুলেও আমাকে এক কাপ চা খাওয়ার কথা বলবেন না। আমার জীবনের এত ঝুঁকি অথচ আমার কোনো লাইফ ইনসিওরেন্স নেই। কারণ ওই যে বললাম, আমাদের কোনো বাঁচার অধিকার নেই। আমার ছোট্ট মেয়ে অলিভিয়া। এখনই তো আমার তার কথা ভাবার সময়। আজ আমি যদি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হই কেউ কখনো ভাববে না আমার ছোট্ট মেয়েটির কথা। এই পৃথিবীর কোথায় যে ঠাঁই হবে তার? অর্থাৎ জলে ভেসে গেলেও আমার ছোট্ট মেয়েটির কেউ খবর রাখবে না।
আমার একটাই দাবি। সমস্ত ডেলিভারি বয়দের (রানার) জন্য সরকার একটা আইন আনুক যাতে সমস্ত ডেলিভারি বয়’রা ন্যূনতম বেতন ও পথ দুর্ঘটনার জন্য লাইফ ইনসিওরেন্স পায়। আমার মতো যেন কাউকে মালিকের মুখ থেকে শুনতে না হয়, “এইতো সামান্য কাজ”। তবুও আর একবার বলি, আমি কিন্তু নামি ওষুধ কোম্পানির একজন ডেলিভারি বয়। সবার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, “কোনো ডেলিভারি বয়কে কেউ অবহেলা কোরো না। কেন না আমরা হয়ত কারো পিতা অথবা ভাই অথবা কোনো মায়ের সন্তান কিম্বা কারো স্বামী।”
- অপূর্ব কুমার ঘোষ
আজকের সময়টা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার, আজকের সময় ইন্টারনেটের, আজকের সময় প্রযুক্তির, কিন্তু তাও আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, রেডিও হচ্ছে এমন একটা মাধ্যম, যা দিয়ে আরও সরাসরি দেশের প্রান্তিকতম মানুষটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়। তাই তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর ‘মন কী বাত’ অনুষ্ঠান, যা প্রতি মাসের শেষ রবিবার সম্প্রচারিত হয় সকাল ১১টায়। এই অনুষ্ঠনটি আপাতত শততম পর্বে পড়ল। হয়তো অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা একটি পর্বও শোনেননি, কিন্তু তাও কেন্দ্রের শাসকদলের এই অনুষ্ঠান নিয়ে প্রচারে কোনও খামতি রাখতে চাননি। এবার তো ছিল শততম অনুষ্ঠান, তাই এবার প্রচারের মাত্রাও ছিল আরও অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় নেতা মন্ত্রীরা একমনে শুনছেন, তাঁদের একমেদ্বিতীয়ম নেতা নরেন্দ্র মোদী কী বলছেন, এই দৃশ্য টিভি চ্যানেল থেকে সামাজিক মাধ্যম সর্বত্র ছড়িয়েছে। যদিও এমন কিছু ছবিও এসেছে, যে আয়োজন করা সত্ত্বেও মানুষকে একত্রিত করে শোনানো যায়নি, কিন্তু তাতে কী, প্রচার এমনভাবে হয়েছে যেন ১৩০ কোটি মানুষ এই বক্তব্য শোনার জন্য মুখিয়ে আছেন।
নরেন্দ্র মোদী ভালো করে জানেন, কেন তিনি এই অনুষ্ঠান করছেন। তিনি তাঁর ভাবমূর্তিকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান, যে সেখানে তিনি প্রশ্নাতীত এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। প্রথমে জানা জরুরি, এই অনুষ্ঠানটিতে কী থাকে, যা শুনে এইরকম মনে হতে পারে? এই অনুষ্ঠানটি আসলে একটি মনোলগ, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী একাই কথা বলে যান, নানান বিষয় নিয়ে। কখনো তা তাঁর ছোটবেলার কথা, কীভাবে তিনি দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন, কীভাবে তাঁর মা, কাঠের আগুনে রান্না করতেন, তাঁদের চোখ দিয়ে জল পড়তো, সেই কষ্টের কথা। কেন কাঠের বা কয়লার উনুনের পরিবর্তে গ্যাসে রান্না করা উচিৎ? সেই জন্যেই সরকারের পক্ষ থেকে উজালা গ্যাসের সংযোগের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কেন ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে? কেন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো জরুরী এইরকম নানান বিষয়। এক একটি পর্বে এক একটি বিষয়। এমনিতে রাজনৈতিক বিষয় নয় কিন্তু সামাজিক বিষয় নিয়েই তিনি কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন এই অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে একজন শ্রোতাও যদি মনে করেন, এই তো আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী কত কষ্ট করে আজকে এই জায়গায় পৌঁছেছেন, তাঁর জীবনের সঙ্গে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রীর নিজের জীবনের তিনি সাদৃশ্য খুঁজে পান তাহলেই নরেন্দ্র মোদীর লাভ। কখনো তিনি হকির যাদুকর ধ্যানচাঁদের কথা বলেন, কখনো তিনি খেলাধুলায় জোর দেওয়ার কথা বলেন, ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ভয় কাটানোর কথা বলেন, মানুষ প্রভাবিত হতে থাকেন, আর ‘মন কী বাত’ সফল হতে থাকে। হয়তো দেখা যাবে, এই কথার বেশিরভাগই মিথ্যে, হয়তো কেন বেশিরভাগই মিথ্যে, কিন্তু তাঁর বলার ধরনে এমন একটা জাদু আছে, যে সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে প্রভাবিত হতে শুরু করেন।
আসলে তিনি জানেন, কীভাবে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হয় এবং কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করতে হয়। মিথ্যেকেও কীভাবে সাজিয়ে বলতে হয়, তা নরেন্দ্র মোদীর থেকে শিখতে হয়। যে সরকার বলে তাঁদের কাছে, দেশে কত পরিযায়ী শ্রমিক কাজ করেন, সে তথ্য নেই, সেই সরকারের প্রধান যদি মন কী বাত অনুষ্ঠানে সেই শ্রমিকদের দুর্দশার কথা বলেন, তখন কি তাকে কুমীরের কান্না ছাড়া আর কিছু বলা চলে? আজকে যে প্রধানমন্ত্রী দামী খাবার খান, দামী গাড়ি চড়েন, দামী বিমান কেনেন, সেই মানুষটির মুখে কি এই ধরনের কথা শোভা পায়? আসলে তিনিও জানেন, তিনি অভিনয় করছেন, তাঁর মধ্যে গরিব মানুষের প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই, তিনি এখন আদানি আম্বানির বন্ধু, কিন্তু তাও এই মন কী বাতের মাধ্যমে তিনি একটা সুখানুভূতির প্রভাব বিস্তার করতে চান, যা থাকলে খারাপ বিষয় নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠবে না। তাঁর সঙ্গে আদানির কী সম্পর্ক তা নিয়ে কথা উঠবে না।
আজকের মন কী বাত শুনতে শুনতে, যদি কোনও একজন ব্যক্তিও প্রভাবিত হয়ে যান, তাহলে সেটাই যে শাসকদলের লাভ, তা নরেন্দ্র মোদীও জানেন, বিজেপিও জানে, তাই তাঁরাও নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করেই এই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছেন। যদিও তাঁদের নেতা মন্ত্রীরা বলে থাকেন, এই অনুষ্ঠান রাজনৈতিক নয়, তবুও যা সামাজিক তা তো রাজনৈতিকও বটে। তিনি যখন ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ সংক্রান্ত কথা বলেন তাঁর অনুষ্ঠানে, তিনি নিশ্চিত মহিলাদের সমাজে প্রতিষ্ঠার কথাই বলেন, কিন্তু যখন এই প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থা বিষয়ে চুপ থাকেন, তখন কী মনে হয় না, তাঁর মন কী বাত আসলে মন কি ঝুট? প্রতিদিন একই মিথ্যে বলে গেলে একদিন সেই মিথ্যেও সত্যি বলে মনে হয়। যদি ইতিহাসে ফেরা যায়, তাহলে দেখা যাবে হিটলারের প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবেলসও এই রকম একটি রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে ইহুদি নিধনকে মান্যতা দিতেন। আজকে হয়তো নরেন্দ্র মোদী শুধুমাত্র ভালো ভালো কথা বলছেন, আগামীদিনে যে এই মাধ্যমটিই রাওয়ান্ডা রেডিও হয়ে উঠবে না, তা কি জোর দিয়ে বলা যায়? যেভাবে রাওয়ান্ডাতে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল, সেভাবে যদি এই মন কী বাত অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়, তখন কী হবে? আজকে দেশের নামী দামী চিত্রতারকারা এই অনুষ্ঠানের প্রশংসা করছেন, আগামীদিনে ঐ রকম কোনও ঘটনা ঘটলে তখন পারবেন তো তার বিরোধিতা করতে? যাঁরা আজকে দু’হাত তুলে এই অনুষ্ঠানের প্রশংসা করছেন, তখন বলতে পারবেন তো, এই মন কী বাত আসলে মন কি ঝুট ছিল? তখন মেরুদণ্ড সোজা থাকবে তো?
- সুমন সেনগুপ্ত
আজকের সময়টা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার, আজকের সময় ইন্টারনেটের, আজকের সময় প্রযুক্তির, কিন্তু তাও আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, রেডিও হচ্ছে এমন একটা মাধ্যম, যা দিয়ে আরও সরাসরি দেশের প্রান্তিকতম মানুষটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়। তাই তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর ‘মন কী বাত’ অনুষ্ঠান, যা প্রতি মাসের শেষ রবিবার সম্প্রচারিত হয় সকাল ১১টায়। এই অনুষ্ঠনটি আপাতত শততম পর্বে পড়ল। হয়তো অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা একটি পর্বও শোনেননি, কিন্তু তাও কেন্দ্রের শাসকদলের এই অনুষ্ঠান নিয়ে প্রচারে কোনও খামতি রাখতে চাননি। এবার তো ছিল শততম অনুষ্ঠান, তাই এবার প্রচারের মাত্রাও ছিল আরও অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় নেতা মন্ত্রীরা একমনে শুনছেন, তাঁদের একমেদ্বিতীয়ম নেতা নরেন্দ্র মোদী কী বলছেন, এই দৃশ্য টিভি চ্যানেল থেকে সামাজিক মাধ্যম সর্বত্র ছড়িয়েছে। যদিও এমন কিছু ছবিও এসেছে, যে আয়োজন করা সত্ত্বেও মানুষকে একত্রিত করে শোনানো যায়নি, কিন্তু তাতে কী, প্রচার এমনভাবে হয়েছে যেন ১৩০ কোটি মানুষ এই বক্তব্য শোনার জন্য মুখিয়ে আছেন।
নরেন্দ্র মোদী ভালো করে জানেন, কেন তিনি এই অনুষ্ঠান করছেন। তিনি তাঁর ভাবমূর্তিকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান, যে সেখানে তিনি প্রশ্নাতীত এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। প্রথমে জানা জরুরি, এই অনুষ্ঠানটিতে কী থাকে, যা শুনে এইরকম মনে হতে পারে? এই অনুষ্ঠানটি আসলে একটি মনোলগ, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী একাই কথা বলে যান, নানান বিষয় নিয়ে। কখনো তা তাঁর ছোটবেলার কথা, কীভাবে তিনি দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন, কীভাবে তাঁর মা, কাঠের আগুনে রান্না করতেন, তাঁদের চোখ দিয়ে জল পড়তো, সেই কষ্টের কথা। কেন কাঠের বা কয়লার উনুনের পরিবর্তে গ্যাসে রান্না করা উচিৎ? সেই জন্যেই সরকারের পক্ষ থেকে উজালা গ্যাসের সংযোগের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কেন ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে? কেন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো জরুরী এইরকম নানান বিষয়। এক একটি পর্বে এক একটি বিষয়। এমনিতে রাজনৈতিক বিষয় নয় কিন্তু সামাজিক বিষয় নিয়েই তিনি কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন এই অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে একজন শ্রোতাও যদি মনে করেন, এই তো আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী কত কষ্ট করে আজকে এই জায়গায় পৌঁছেছেন, তাঁর জীবনের সঙ্গে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রীর নিজের জীবনের তিনি সাদৃশ্য খুঁজে পান তাহলেই নরেন্দ্র মোদীর লাভ। কখনো তিনি হকির যাদুকর ধ্যানচাঁদের কথা বলেন, কখনো তিনি খেলাধুলায় জোর দেওয়ার কথা বলেন, ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ভয় কাটানোর কথা বলেন, মানুষ প্রভাবিত হতে থাকেন, আর ‘মন কী বাত’ সফল হতে থাকে। হয়তো দেখা যাবে, এই কথার বেশিরভাগই মিথ্যে, হয়তো কেন বেশিরভাগই মিথ্যে, কিন্তু তাঁর বলার ধরনে এমন একটা জাদু আছে, যে সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে প্রভাবিত হতে শুরু করেন।
আসলে তিনি জানেন, কীভাবে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হয় এবং কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করতে হয়। মিথ্যেকেও কীভাবে সাজিয়ে বলতে হয়, তা নরেন্দ্র মোদীর থেকে শিখতে হয়। যে সরকার বলে তাঁদের কাছে, দেশে কত পরিযায়ী শ্রমিক কাজ করেন, সে তথ্য নেই, সেই সরকারের প্রধান যদি মন কী বাত অনুষ্ঠানে সেই শ্রমিকদের দুর্দশার কথা বলেন, তখন কি তাকে কুমীরের কান্না ছাড়া আর কিছু বলা চলে? আজকে যে প্রধানমন্ত্রী দামী খাবার খান, দামী গাড়ি চড়েন, দামী বিমান কেনেন, সেই মানুষটির মুখে কি এই ধরনের কথা শোভা পায়? আসলে তিনিও জানেন, তিনি অভিনয় করছেন, তাঁর মধ্যে গরিব মানুষের প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই, তিনি এখন আদানি আম্বানির বন্ধু, কিন্তু তাও এই মন কী বাতের মাধ্যমে তিনি একটা সুখানুভূতির প্রভাব বিস্তার করতে চান, যা থাকলে খারাপ বিষয় নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠবে না। তাঁর সঙ্গে আদানির কী সম্পর্ক তা নিয়ে কথা উঠবে না।
আজকের মন কী বাত শুনতে শুনতে, যদি কোনও একজন ব্যক্তিও প্রভাবিত হয়ে যান, তাহলে সেটাই যে শাসকদলের লাভ, তা নরেন্দ্র মোদীও জানেন, বিজেপিও জানে, তাই তাঁরাও নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করেই এই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে চলেছেন। যদিও তাঁদের নেতা মন্ত্রীরা বলে থাকেন, এই অনুষ্ঠান রাজনৈতিক নয়, তবুও যা সামাজিক তা তো রাজনৈতিকও বটে। তিনি যখন ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ সংক্রান্ত কথা বলেন তাঁর অনুষ্ঠানে, তিনি নিশ্চিত মহিলাদের সমাজে প্রতিষ্ঠার কথাই বলেন, কিন্তু যখন এই প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থা বিষয়ে চুপ থাকেন, তখন কী মনে হয় না, তাঁর মন কী বাত আসলে মন কি ঝুট? প্রতিদিন একই মিথ্যে বলে গেলে একদিন সেই মিথ্যেও সত্যি বলে মনে হয়। যদি ইতিহাসে ফেরা যায়, তাহলে দেখা যাবে হিটলারের প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবেলসও এই রকম একটি রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে ইহুদি নিধনকে মান্যতা দিতেন। আজকে হয়তো নরেন্দ্র মোদী শুধুমাত্র ভালো ভালো কথা বলছেন, আগামীদিনে যে এই মাধ্যমটিই রাওয়ান্ডা রেডিও হয়ে উঠবে না, তা কি জোর দিয়ে বলা যায়? যেভাবে রাওয়ান্ডাতে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল, সেভাবে যদি এই মন কী বাত অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়, তখন কী হবে? আজকে দেশের নামী দামী চিত্রতারকারা এই অনুষ্ঠানের প্রশংসা করছেন, আগামীদিনে ঐ রকম কোনও ঘটনা ঘটলে তখন পারবেন তো তার বিরোধিতা করতে? যাঁরা আজকে দু’হাত তুলে এই অনুষ্ঠানের প্রশংসা করছেন, তখন বলতে পারবেন তো, এই মন কী বাত আসলে মন কি ঝুট ছিল? তখন মেরুদণ্ড সোজা থাকবে তো?
- সুমন সেনগুপ্ত
পরিকল্পনা করা হয়েছিল প্রবীণরা সরে দাঁড়িয়ে এগিয়ে দেবেন নবীনদের। আর হলও তাই।
গত ২৯শে এপ্রিল ক্রান্তি প্রেসের ‘লোকায়ত’ সভাঘরে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ এক ফ্যাসি-বিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সভার শুরুতে পরিষদের রাজ্য সম্পাদক সরিৎ চক্রবর্তী বলেন যে এই অনুষ্ঠান মূলত পরিষদের নিজস্ব এক মিলনসভা, যেখানে প্রবীণরা থাকলেও নবীনরাই পাবেন অগ্রাধিকার। আর এই সভা থেকে প্রাপ্ত ফসল নিয়ে পরিষদ রাজ্যজুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক অভিযান পরিচালনা করবে। সভার শুরুতে বালির ‘ইঙ্গিত’ তীব্র প্রতিবাদী স্বরে গেয়ে উঠলেন, “একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে, রাজার দোহাই দিয়ে, এযুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি, মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি...”। সভার সুর ও মেজাজ তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপর পরিষদের শিক্ষকসম ফ্যাসীবাদ বিরোধী ও এককালের গণনাট্য সংঘের শিল্পীসেনা শ্রী কঙ্কন ভট্টাচার্য মঞ্চে আসেন। তিনি এই মুহূর্তে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ফ্যাসিবাদের ঘনঘটা সম্পর্কে সচেতন করার পর বেশ কিছু গান পরিবেশন করেন তার চিরন্তন সাবলীল গায়কিতে। এরপর শোভনা নাথের পরিচালনায় পরিষদের মধ্যমগ্রাম শাখা বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাগুচ্ছ নিয়ে সমবেত আবৃত্তিতে “কালো রাত কাটে না, কাটে না এত ডাকি, রোদ্দুর এই পথে হাঁটে না...”র পর ভোরের পদধ্বনির আভাস রেখে উচ্চারিত হয়, “তুমি মাটির দিকে তাকাও... তুমি মানুষের হাত ধর...”। এরকম আরও অনেক। আমাদের নতুন তরুণ বন্ধু সায়ন রায় (ঋভু) পরিষদের মঞ্চে এই প্রথম গান শোনালেন। বিশ্বরূপ সাহা নজরুল দিয়ে শুরু করলেন, “এই শিকল পরার ছল মোদের... ওরা ভয় দেখিয়ে করছে শাসন, জয় দেখিয়ে নয়, সেই ভয়ের টুঁটি ধরব চেপে, করব তারে লয়...”। আর শেষ করলেন নীতীশ রায়ের ‘লালন’ দিয়ে। পরিষদের কার্যকরী সমিতির তরুণ সদস্য ও সঙ্গীত পরিচালক সায়ন বিশ্বাস অপূর্ব সাবলীলতায় মিলিয়েছেন “ওরে হল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল” ও আজকের যুদ্ধবাজদের সাবধান করে কবীরের “হোশিয়ার রহনা হ্যায়...”। গেয়েছেন এনআরসির বিরুদ্ধেও। তরুন তুর্কীর মত সপ্তক “ওরা”, “ফুট পাথের ছেলে” ইত্যাদি র্যাপ/ হিপহপ মিউজিকের ঝড়ে দরিদ্র মানুষের জীবনযন্ত্রণার ছবি আঁকলেন। তালে তাল দিল গোটা সভাঘর। কলেজ ছাত্রী নিরভিমানা দাসের “আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি মন বান্ধিবি কেমনে” গানটি ফ্যাসিবাদের মুখে যেন জোরালো এক চপেটাঘাত। মীরা চতুর্বেদী গাইলেন নীতীশ রায়ের গান, “জানি একদিন একদিন আসবে সুদিন, শুধতে হবে শত শহীদের ঋণ”। সাবির রাজা গানে গানে বললেন, “একই চাঁদ ওঠে রাসপূর্ণিমায়, একই চাঁদ ওঠে ঈদে/ একই সে বেদনা মাথা কুটে মরে, মন্দিরে মসজিদে...”। পরিষদেরই সংগঠক অভিজিৎ মণ্ডলের রচিত একটি গানও রাজা গাইলেন, “সব প্রহসন ব্যর্থ ওদের, ওরা দিশেহারা, তাই বিবেক ভুলে, ধর্ম নিয়ে দিচ্ছে মাথা চাড়া”।
অয়ন্তিকার গানে সব ধর্মের প্রতি মিলেমিশে থাকার আকুতি, “আমি মুসলমানের মেয়ে... আমি হিন্দুর সাথে মিশি, তারা আমারই তো মাসি-পিসি...” এমনকি শত্রুর বিপদে তাকেও সাহায্য করার হাত বাড়িয়ে দেয় এ গান। বালির ‘সংযোগ’ গাইল, “মানবো না এই বন্ধনে...”। বৃন্দগানে ‘কান্ডীর’এর “জালিম যাও যাও”এ “বেলা চাও চাও”এর সুর-মূর্ছনা মুহূর্তে মাতিয়ে দিল সভা। শেষে “বাইরে যখন হাজার হাজার লাল পতাকা” গানটি ধরে রাখল সভার বিপ্লবী মেজাজ। দু’টি স্বরচিত কবিতা পাঠ করলেন কবি প্রণব রায় ও কবি গোপাল শেঠিয়ার। সবশেষে অনুপ (বাবুনি) মজুমদারের সেই অনবদ্য কণ্ঠ। পরিষদের রাজ্য সম্পাদক সরিৎ চক্রবর্তীর সুরে তিনি গাইলেন, “গুনগুন চারিদিকে গুঞ্জন চলছে/ চারদিকে জাতপাত ভেদাভেদ আমাদের রক্তে হিংসার জাল আজ বুনছে... এসো শত্রুর জাল কেটে টুকরো করি/ মোরা সবাই মিলে আজ ঝাঁপিয়ে পড়ি/ মিথ্যার প্রলোভন উস্কানি ভুলে আজ/ প্রাণের ছন্দকে আজ স্বাধীন করি”। এভাবে চার ঘণ্টা জুড়ে নতুন, পুরনো ও আন্তর্জাতিক গানে সভাঘর ছিল পরিপূর্ণ। এককভাবে ও পরিষদের শাখা সংগঠনগুলিতেও নবীন মুখের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ছাত্রছাত্রীরাই উদ্যোগ নিয়ে সভাকক্ষ সাজিয়ে তুলেছিলেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে সংহতরূপে সঞ্চালনা করেন নীতীশ রায়। এই উপলক্ষে একটি ফোল্ডার প্রকাশ করা হয়। পরিষদের পক্ষ থেকে উপস্থিত সকলের জন্য ছিল চা জলখাবারের আয়োজন। তারুণ্যের উদ্দীপনা প্রাণিত করেছে গোটা সভাকে, যা আগামীদিনে আরও নতুন গান কবিতা নাটক আলেখ্য ইত্যাদি নিয়ে নতুন ও নবীন মুখের সমাবেশে বৃহত্তর কর্মসূচি নিতে সহায়ক হবে।
- বর্ণালী রায়
শতবর্ষ পূরণের কিছুদিন আগে চলে গেলেন বিশ শতকের ইতিহাস চর্চার অন্যতম স্তম্ভ অধ্যাপক রণজিৎ গুহ। অধ্যাপক গুহ এবং তাঁর সঙ্গীরা মিলে “নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা” নামে যে ইতিহাস রচনার ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন তার প্রভাব আমাদের দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও পৌঁছেছিল। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা যে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের বিপ্লবী রাজনীতি থেকে তার প্রেরণা সংগ্রহ করেছিল, সেকথা অধ্যাপক রনজিৎ গুহ নিজেই বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন।
ছাত্র অবস্থা থেকেই বাম এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন রণজিৎ গুহ। প্রেসিডেন্সি কলেজের বিশিষ্ট মার্কসবাদী অধ্যাপক সুশোভন সরকারের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। সে সময়েই রণজিৎ গুহ জড়িয়ে পরেন রাজনীতিতে। এম এ পাশ করার পর তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। জমিদারি শোষণ ও জনযুদ্ধের চরিত্র বিশ্লেষণ করেন। পার্টির কাজ নিয়েই তাঁকে যেতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে। সেখানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ অবধি ছিলেন তিনি। সদ্য বিপ্লবোত্তর চিনকে ১৯৪৯-এ স্বচক্ষে দেখার সুযোগও তাঁর হয়েছিল। দেশে ফিরে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা স্বাধীনতায় নিয়মিত লিখতে থাকেন। তবে ১৯৫৬ সালে স্তালিনের মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় ক্রুশ্চেভ ঘোষিত নিস্তালিকীরণের দিনগুলিতে সোভিয়েত রাশিয়া যখন হাঙ্গেরি আক্রমণ করল, সারা বিশ্বের নানা দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী নিজ নিজ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো থেকে সেইসময় সরে আসলেন। অধ্যাপক রণজিৎ গুহও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। কিছুদিন পড়ান বিদ্যাসাগর কলেজ, চন্দননগর কলেজ ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপরই তিনি পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যান।
অধ্যাপক রনজিৎ গুহ আবারো সক্রিয় রাজনীতির দিকে ঝুঁকলেন ৭০ এর দশকে। তিনি নিজেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং চারু মজুমদার তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে বিভিন্ন সূত্রে তাঁর এক নিবিড় সম্পর্কও তৈরি হয়। কথিত কিন্তু অলিপিবদ্ধ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে তিনি পার্টিকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতাও করেছিলেন। গোপন অবস্থায় এই কাজে যথেষ্ট ঝুঁকি ছিল বলাই বাহুল্য। এর নথিপত্র পাওয়াও তাই কঠিন। সিপিআই(এমএল) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও লিবারেশন পত্রিকার সম্পাদক সুনীতিকুমার ঘোষ বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ানোর সময় রণজিৎ গুহর সহকর্মী ছিলেন। এই যোগাযোগ সেই সময় সহায়ক হয়েছিল।
সিপিআই(এমএল) রাজনীতির প্রথম ধারাটি ভেতরের কিছু ভুলভ্রান্তি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে পড়ে দমিত হল, কিন্তু অধ্যাপক রনজিৎ গুহ এই রাজনীতি থেকেই খুঁজে পেলেন ইতিহাস চর্চার নতুন দৃষ্টিকোণ। তাঁর মনে হল ইতিহাস চর্চা মূলত উচ্চ বর্গর দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখা হয়েছে। দরকার নিম্নবর্গের দৃষ্টিতে ইতিহাস লেখা, যা সেভাবে এতাবৎ হয়নি। এই ভাবনা থেকেই নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা নামক একটি নতুন ধারার জন্ম দিলেন তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা। ইতালির মার্কসবাদী নেতা আন্তোনিও গ্রামশি মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট জমানায় জেলে থাকার সময় যে সব লেখালিখি করেছিলেন সেখানে তিনি বিশেষ প্রয়োজনে শাসকের দৃষ্টিকে আড়াল করার জন্য সাব অল্টার্ন শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু সামরিক অধস্থন বোঝানো এই সাব অল্টার্ন শব্দটির ব্যঞ্জনা গ্রামশির লেখায় শুধু প্রলেতারিয়েতের প্রতিশব্দ হিসেবেই সীমিত থাকেনি। এর সঙ্গে নিম্নবর্গের, বিশেষত কৃষকের সাংস্কৃতিক মনন ও মনস্তত্ত্বের দিকটিও যুক্ত হয়ে গেল। এই কাজে অধ্যাপক রণজিৎ গুহর বিশিষ্ট সহকারীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক গৌতম ভদ্র, অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী, অধ্যাপক জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে, অধ্যাপক শাহিদ আমিন, অধ্যাপিকা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখ। নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। ১৯৮৩ সালে হয় সাব অল্টার্ন স্টাডিজের প্রথম সম্মেলন। দু-দশকের মধ্যেই এর দশটি খণ্ড প্রকাশিত হয় আর ছটি সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। এতজন ইতিহাসবিদকে নিয়ে এই ধরনের সমবায়ী ও সমন্বয়ী একটা প্রকল্প কীভাবে সাফল্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চালানো সম্ভব হল সেই প্রসঙ্গে তিনি খানিক রসাভাষেই জানিয়েছিলেন যে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক হবার পূর্বতন অভিজ্ঞতা তাঁকে এই কাজে সাহায্য করেছে। সাব অল্টার্ন স্টাডিজের প্রথম পাঁচ ছটি খণ্ড বেরনোর পর অবশ্য একটা বড় বাঁকবদল করতে হয়। মূলত গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের তোলা কিছু প্রশ্নকে ধরে। নিম্নবর্গের স্বতন্ত্র চৈতন্য অন্বেষণের সেই সঙ্গত প্রশ্নের পর নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা মনযোগী হয় ইতিহাসে নিম্নবর্গের নির্মাণের প্রক্রিয়াগুলির বিশ্লেষণে।
অধ্যাপক রণজিৎ গুহর নিজস্ব বইপত্রের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাবো সেখানে অধ্যাপক রনজিৎ গুহ ভীষণভাবেই নজর দিয়েছেন কৃষক প্রশ্নের দিকে, জমির অধিকার এবং তার সুষম বণ্টনের দিকে। আমরা সবাই জানি যে কৃষক আন্দোলন এবং জমি আন্দোলন ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল।
রণজিৎ গুহ স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ার সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট। ছয় খণ্ডের সেই বিস্তারিত রিপোর্ট মন দিয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে উদ্ভূত প্রশ্নগুলি নিয়ে যান তাঁর মাস্টারমশাই নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের কাছে। সেই সময় প্রশ্নগুলির নিরসন হয়নি। এই প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখেই এরপর অনুসন্ধান চালিয়ে যান রণজিৎ গুহ। এর ভিত্তিতে লেখেন ‘এ রুল অফ প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’ (চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিকা নামে বাংলায় প্রকাশিত) নামে একটি ছোট কিন্তু বীজগর্ভ বই। ১৯৬৩ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত এই বইটিই তাঁর প্রথম বই। বঙ্কিমচন্দ্র যাকে বলেছিলেন ‘আধুনিক বাঙালি সমাজের ভিত্তি’ সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্মাণ কীভাবে হয়েছিল এই বইটিতে অধ্যাপক রণজিৎ গুহ সেইটা দেখান।
সমকালীন ইংলণ্ড যখন সামন্ততন্ত্র ও বাণিজ্য পুঁজিবাদ ভেঙে অবাধ পুঁজিবাদের দিকে এগোচ্ছিল, উপনিবেশের দুনিয়াতে তখন জমিদারি প্রথাকে চিরস্থায়ী করার মাধ্যমে সামন্ততন্ত্রের নক্সাকে আবারো বাংলার বুকে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করছিল ঔপনিবেশিক শাসক। ম্যাঞ্চেস্টারের বস্ত্রশিল্পের প্রসারের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে। এই ইতিহাস লিখতে গিয়ে শুধু বাংলা আর ব্রিটেনকে মেলান নি অধ্যাপক গুহ, গোটা দুনিয়ার রাজনীতির জগতে ও চিন্তার দুনিয়ায় যে পালাবদলের পর্ব চলছিল, তাকেও সামনে নিয়ে এসেছেন।
রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয়যাত্রা শুরু হলেও ১৭৬৪-র বক্সার যুদ্ধের পর থেকেই এদেশের ভূমি ব্যবস্থার ইতিহাসে বদল আসা শুরু হয়। প্রথম দশ বছরে পুরনো ব্যবস্থার ভাঙনের দিকটিই ছিল প্রধান। স্বাধীন চাষি আর কারিগরদের স্বার্থকে পদদলিত করে কোম্পানি প্রাধান্য দিতে শুরু করল ব্রিটেনে কাঁচামালের রপ্তানি আর শিল্পদ্রব্যের আমদানিকে। চাষি ও কারিগরদের অনেকেই ভূমিহীন গরিবে পরিণত হলেন। ১৭৭৬ সালে একদিকে মার্কিন উপনিবেশ হাতছাড়া হল ও অন্যদিকে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকারের বিরুদ্ধে মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে লেখা অ্যাডাম স্মিথের ম্যাগনাম ওপাস ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ প্রকাশিত হল। রণজিৎ গুহ দেখান একদিকে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার বজায় রাখার জন্য পুরনো সামন্তী শক্তি আর নতুন বুর্জোয়া শক্তি কীভাবে ইংলণ্ডের পার্লামেন্টে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করছে। এই বিতর্কে তখনো অবধি সামন্তীদের রাজনৈতিক শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি। এমনকী তাঁদের থেকে অর্থসাহায্য নিয়েই মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষের অনেককে, যেমন ১৭৮৪-র ভারত শাসন আইনের রচয়িতা পিটকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হয়েছিল ও মন্ত্রী পদে বসে সাহায্যের হিসেব মিটিয়ে দিতে কোম্পানির আমদানি করা চায়ের ওপর কর হ্রাস করতে হয়েছিল। তবে এতদ সত্ত্বেও ধীরে ধীরে বদল আসছিল। ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট থেকে পিটের ভারত শাসন আইন ১৮৭৪ পর্যন্ত আইনি সংস্কারে এর ছাপ রয়েছে। ভারতের নিয়ন্ত্রণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে থাকবে না ব্রিটিশ রাজের হাতে, তাই নিয়েও অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। মার্কিন উপনিবেশ হাতছাড়া হওয়া, ইঙ্গ ফরাসি দ্বন্দ্ব সহ নানা আন্তর্জাতিক ঘটনা কীভাবে তাতে প্রভাব ফেলেছিল সেই সবও রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামন্তী পুঁজিবাদী দ্বন্দ্বের রেশ এদেশের কোম্পানি শাসনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল, কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরদের মধ্যে এই সংক্রান্ত চিন্তা ও নীতির দ্বন্দ্ব কী ধরনের ছিল, তার এক বিস্তারিত আলোচনা রণজিৎ গুহ করেছেন। এই আলোচনা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপটের আখ্যানটিকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে। এই দ্বন্দ্বের একদিকে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস, অন্যদিকে ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। হেস্টিংস কোম্পানির অধীনেই এদেশের জমির মালিকানা রেখে ইজারাদারদের হাতে রাজস্বের ভার দেওয়ার নীতির পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ফিলিপ ফ্রান্সিসের মতো অবাধ পুঁজিবাদের বিকাশের পক্ষের লোকেদের মনে হয়েছিল জমির মালিকানা জমিদারদের হাতেই দিতে হবে। চিরস্থায়ী ভিত্তিতে জমির মালিকানা নিজেদের হাতে পেলে তবেই তারা কৃষির উন্নতির দিকে মনযোগী হবে। কৃষির উন্নতি হলে তবেই দেশের আর্থিক বিকাশ সম্ভব হবে। জমিদারদের ফিলিপ ফ্রান্সিস ও মুক্ত পুঁজির পক্ষে থাকা লোকেরা ধনী কৃষক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। বড় জমিদারী ভেঙে অনেক বেশি পরিমাণ জমিদার তথা ধনী কৃষক সৃষ্টি করার দিকেও তাঁদের আগ্রহ ছিল। প্রথম পাঁচশালা ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও রাজস্ব সংকটের প্রেক্ষিতে হেস্টিংসরাও বুঝতে পারছিলেন ইজারাদারী ব্যবস্থার অসাড়তা। ফলে নতুন এক বন্দোবস্তের দিকে তাঁরাও যেতে চাইছিলেন। জমির অধিকার জমিদার আর রায়তের মধ্যে কীভাবে বণ্টিত হবে এই নিয়ে ফিলিপ ফ্রান্সিস ও হেস্টিংসের মধ্যে স্পষ্ট মতভেদ ছিল। হেস্টিংস ও বারওয়েল চেয়েছিলেন রায়তের সঙ্গে বন্দোবস্ত। কিন্তু রায়ত ও জমিদার উভয়ের অধিকারের মধ্যে ফিলিপ ফ্রান্সিস পুঁজিবাদী কৃষক ও কৃষির বিকাশের স্বার্থে জমিদারের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর পক্ষেই দাঁড়ালেন। তবে রায়তের অধিকারের প্রশ্নে তার প্রজাসত্ত্ব ও পাট্টার গুরুত্ব ফ্রান্সিসকে মেনে নিতে হল। রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সঙ্কট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখান যে ফ্রান্সিস ভেবেছিলেন কৃষকের তুলনায় অঢেল জমি থাকায় কৃষক শ্রমশক্তি বেচার ক্ষেত্রে সুবিধেজনক অবস্থানে থাকবেন। কিন্তু পরবর্তীকালে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ও জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধির ফলে পরিস্থিতি উলটে যায় ও নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফজলুল হক মন্ত্রীসভা এই পরিপ্রেক্ষিতেই ফ্লাউড কমিশন গঠন করেন ও তার ছয় খণ্ডের বিস্তারিত রিপোর্ট পড়ার পরেই রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই ইতিহাস অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
অধ্যাপক রনজিৎ গুহ যখন ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনগুলির ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের পেছনে লুকিয়ে থাকা কৃষক চৈতন্য বা মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবছিলেন তখন আমরা বুঝতে পারি সেখানেও তাঁর কমিউনিস্ট শিকড়, নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং চারু মজুমদারের প্রতি তাঁর আগ্রহের প্রভাব পড়েছে। Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial Indiaবইটি ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটি মাইলস্টোন। এই বইতে মার্কসবাদের প্রচলিত ধারাটিকে মনে রেখেও ভারতীয় কৃষকের চৈতন্যকে বোঝার জন্য কিছু নতুন দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের প্রয়োজন বলে রণজিৎ গুহর মনে হয়েছিল। কারণ কৃষকের চেতনায় একইসঙ্গে সংঘাত ও সমন্বয়ের দুই বিপ্রতীপ সূত্র কাজ করে। কীভাবে ইতিহাসবিদ কৃষক চৈতন্যের এই জটিলতাকে ধারণ করবেন তার সমস্যাবলী নিয়ে এই বইতে নানা কথা তুলেছিলেন রণজিৎ গুহ। রণজিৎ গুহর ইংরাজিতে লেখা অন্যান্য বইপত্রের মধ্যে আছে History at the limit of world history, Dominance without Hegemony: History and Power in Colonial India, The Small Voice of History ইত্যাদি।
জীবনের শেষ তিন দশকে রণজিৎ গুহ মূলত লিখেছেন বাংলা ভাষাতেই। ইতিহাসের পরিধি ছাড়িয়ে সাহিত্য, দর্শন, বাঙালি মনীষার অবদানের নানা দিককে ছুঁতে চেয়েছে তাঁর লেখালিখি৷ তিনি মনে করলেন ইতিহাসকে কেবল শুষ্ক দলিল দস্তাবেজ থেকে বোঝার একদেশদর্শিতা থেকে সরতে হবে, সাহিত্যের সাহায্য ইতিহাস বোঝায় অপরিহার্য। রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যেমন লিখলেন, তেমনি লিখলেন জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণকে নিয়ে। বিশ্লেষণ করলেন সমর সেন, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসুর মতো তাঁর সমকালীন আধুনিক কবিদের রচনার।
সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী বলতে যা বোঝায় অধ্যাপক রণজিৎ গুহ ছিলেন তাই। অসামান্য মৌলিক চিন্তাশক্তির অধিকারী এক ইতিহাসবিদের পাশাপাশি সেই পরিচয়ও তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে।
- সৌভিক ঘোষাল
১ মে সকালে দার্জিলিং জেলার খড়িবাড়ি ব্লকের বিত্তানজোত গ্রামের দীর্ঘদিনের পার্টি সদস্যা কমরেড মানকু মুর্মু মাত্র ৫৫ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। নকশালবারি অভ্যুত্থানের অন্যতম যোদ্ধা কান্দ্রা মুর্মুর জীবনসঙ্গী ও সহযোদ্ধা ছিলেন কমরেড মানকু। মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্রই পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ সহ অন্যান্য জেলা সদস্যরা তাঁর শেষযাত্রায় উপস্থিত হন। পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল পার্টির পক্ষ থেকে শোকবার্তা জানিয়েছেন। লাল সেলাম কমরেড মানকু মুর্মু।
=== 0 ===