হাওড়ার শিবপুর ও হুগলির রিষড়া এলাকায় রামনবমীর শোভাযাত্রাকে ব্যবহার করে বিজেপি নেতাদের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে যে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গা হামলা চলে তার বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল) তৎক্ষণাৎ দ্রুত উদ্যোগ নেয়। আক্রান্ত এলাকায় মানুষের মাঝে প্রথম সুযোগেই গিয়ে পাশে দাঁড়ানো, তথ্যানুসন্ধান চালানো, কয়েকটি এলাকায় পথসভা করে সাধারণ মানুষের সামনে জোরালো আবেদন রাখা, হাওড়ায় জেলা পুলিশ কমিশনারেটে স্মারকলিপি প্রদান ইত্যাদি কর্মসূচি নেওয়া হয়। পরের ধাপে গত ৯ ও ১০ এপ্রিল যথাক্রমে হুগলি ও হাওড়ার ওই অঞ্চলগুলি পরিক্রমা করে সম্প্রীতির মহামিছিল সংগঠিত করা হয় রাজ্যের বিভিন্ন বামপন্থী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে। সিপিআই(এম), সিপিআই(এমএল), সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, এসইউসিআইসি, আরসিপিআই, এমএফবি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও বলশেভিক পার্টি – এই দশটি বামপন্থী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকসহ বহু সাধারণ মানুষ এই দুদিনের মিছিলে সামিল হন। রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ এই লালঝাণ্ডার মিছিলকে স্বাগত জানায়। অনেক জায়গায় মানুষ ছুটে এসে মিছিলে জল, চকলেট এমনকি ফুল দিয়েও সম্বর্ধনা জানায়। এই মিছিল যেমন সাধারণ মানুষের কাছে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা দিতে চাইছিল, তেমনি মানুষও বার্তা দিতে চাইছিল যে এই দাঙ্গা ও হানাহানির রাজনীতিকে তাঁরা মোটেই বরদাস্ত করতে চান না।
প্রথম দিন কোন্নগর থেকে মিছিল শুরুর সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক অভিজিত মজুমদার, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। শেষে উত্তরপাড়া গৌরি হলের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখা হয়। আরএসএস-বিজেপির দাঙ্গা উদ্যোগ ও তা রুখতে টিএমসি সরকারের পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতাকে নিশানা করে আওয়াজ ওঠে।
পুলিশ প্রথম থেকেই এই উদ্যোগ আটকাতে চেয়েছিল। আক্রান্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাসের এলাকাগুলি দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। শেষ মুহূর্তেও তারা মিছিলের রুট বদলাতে বাধ্য করে। দ্বিতীয় দিন হাওড়ায় সালকিয়া মোড়ে হঠাৎ মিছিলের গতিরোধ করে পুলিশ। কিন্তু মিছিলের জনতা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে দেয়। পুলিশ আরও বড় বাহিনী নামায়। মিছিলের সামনের অংশ ব্যারিকেড ভেঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সভাস্থলে পৌঁছে সভা করে, অন্য অংশ সালকিয়া মোড়েই রাস্তার ওপর অবস্থান ও সভা চালিয়ে যায়।
৯ এপ্রিল মিছিল শুরুর সময় সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক অভিজিত মজুমদার ও সিপিআই(এম) নেতা বিমান বসু সহ নেতৃবৃন্দ
৯ এপ্রিল বেলঘরিয়ায় দাঙ্গার বিরুদ্ধে শান্তি ও সম্প্রীতির আহ্বান নিয়ে বেলঘরিয়া ষ্টেশন চত্বর থেকে “গড়ো প্রতিরোধ, ধর্মের উস্কানি দিয়ে বিভেদ হিংসা ছড়ানোর বিরুদ্ধে” ব্যানারের তলে নাগরিক মিছিল সংগঠিত হয়। বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সদস্যরা ছাড়াও অনেক সাধারণ নাগরিক অংশগ্রহণ করেন। মিছিলের শুরুতে সংক্ষিপ্ত সভায় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং হিংসার বিরুদ্ধে এবং রুটি-রুজির দাবিতে বিভিন্ন বক্তা বক্তব্য রাখেন। সম্প্রীতির পক্ষে, মৌলবাদী হিংসার বিরুদ্ধে সব মানুষকে একজোট হওয়ার আহ্বান রাখা হয়।
রাজ্য সরকারি কর্মী আন্দোলন এবার নতুন এক পর্যায়ে পৌঁছাল। রাজ্যব্যাপী সফল ধর্মঘট, পেন-ডাউনের মাধ্যমে একদিনের অভূতপূর্ব রাজ্যব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি, আর এবার দিল্লিতে গিয়ে যন্তরমন্তরের সামনে দু’দিনের অবস্থান বিক্ষোভ ও রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান চলমান এই আন্দোলনকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেল, নিয়ে এলো সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে। বকেয়া ডিএ, সমস্ত সরকারি শূন্যপদে স্বচ্ছ নিয়োগ, অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ীকরণ — এই দাবির ভিত্তিতেই জারি রয়েছে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের এই দীর্ঘস্থায়ী লড়াই।
চরম উদ্ধত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই জাগ্রত কর্মচারী আন্দোলনকে মোকাবিলা করতে শুধুমাত্র প্রশাসনিক দমনেরই আশ্রয় নেননি, “চোর ডাকাত” বলে সমগ্র সরকারি কমর্চারীদেরই চরম অপমানে লাঞ্ছিত করেছেন, যার বিরুদ্ধে কর্মচারীদের অভূতপূর্ব প্রতিবাদের ধরণগুলো সামনে এলো। বেশ কিছুদিন আগে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের তরফ থেকে তাদের কুকুরের সাথে তুলনা রাজ্যের সমগ্র মানুষকে বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে দেয়। কতটা নীচে নামলে মুখ দিয়ে নিঃসৃত হতে পারে এমন শব্দবন্ধ! তার আগে আমরা দেখলাম, ধর্মঘটে অংশ নেওয়ায় হাজার হাজার কর্মীদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শনো নোটিশ ধরানো হয়েছে, পাঠানো হয়েছে যথেচ্ছ বদলির নোটিশ। ধর্মঘট করার আইনি অধিকার রাজ্য সরকারি কর্মীদের থাকলেও ধর্মঘটকে ভাঙতে বা ডায়াস নন, চাকুরির জীবন থেকে একদিন কেটে নেওয়া প্রভৃতি দমনমূলক পদক্ষেপ রাজ্য সরকারকে নিতে দেখা গেল। মোদীর শ্রম কোড-কে এইভাবে কার্যকর করল মমতা সরকার। যে কর্মীদের ছাড়া রাজ্য সরকারের একটা পা-ও নড়বে না, তাঁদের বিরুদ্ধে এমন নজিরবিহীন আক্রমণ কল্পনাই করা যায় না।
এর মূলে রয়েছে গণতন্ত্রের প্রতি মনোভাব। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথগুলোও মমতা সরকার কোনোদিনই বরদাস্ত করল না। আগেও দেখা গেছে, শ্রমিক কর্মচারীরা মোদী সরকারের বিরুদ্ধে, কেন্দ্রের আর্থিক-শিল্প নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে ধর্মঘট ডাকলে তার তুমুল বিরোধিতা করে ধর্মঘটকে ভাঙতে তৃণমূলী দুষ্কৃতিদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তাঁর সরকার ধর্মঘটে শ্রমদিবস নষ্ট একেবারেই বরদাস্ত করবে না। মমতার জমানায় ধর্মঘটে শ্রমদিবস নষ্টের পরিমাণ শূন্যে ঠেকলোও, সরকারি তথ্যই বলছে যে এর বিপরীতে লকআউট জনিত কারণে এ রাজ্যে শ্রমদিবস নষ্ট হয়েছে ১০০ শতাংশ! বুঝতে অসুবিধা হয়না, মমতা সরকারের শিল্প-শ্রম-নীতি কোন লক্ষ্যে পরিচালিত।
মোদী জমানার চরিত্রলক্ষণ হল গণতন্ত্রকে সার্বিকভাবে কন্ঠরুদ্ধ করা। যে কোনে স্বৈরশাসক গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা অবহেলা ও তার টুঁটি চেপে ধরেই নিজ নিজ শাসনতন্ত্রকে পরিচালনা করে। মোদীর বিরুদ্ধে অর্থবহ রাজনৈতিক বিকল্প বা জোট গড়ে তুলতে হলে, গৈরিক বাহিনীকে পরাস্ত করতে হলে গণতন্ত্রের প্রসার ও সেই অস্ত্রে জনগণকে সজ্জিত করাটা একান্ত প্রয়োজনীয়। শাসন ক্ষমতায় আসীন অ-বিজেপি সরকারগুলোকে এ প্রশ্নে স্পষ্ট পার্থক্য রেখা টানতে হবে। দেখা যাচ্ছে, এ রাজ্যে মমতা সরকারের গণতন্ত্রের প্রশ্ন, স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের বিপ্রতীপে যে নৈরাজ্য চলছে, তা সংঘ পরিবারকে ক্রমেই জায়গা করে দিচ্ছে। রামনবমীর মিছিলে সেই তান্ডব থেকে এরই প্রমাণ মেলে। রাজ্যের জাগ্রত ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনগুলো যে দাবির ভিত্তিতে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তা দমন করে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধির পথকেই তৈরি করছে মমতা সরকার।
বাংলার ইতিহাস এজন্য মমতাকে কোনেদিনই ক্ষমা করবে না।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও রাম নবমী দেশের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে বিদায় নিল। বাংলায় আগে রামনবমীর তেমন চল ছিল না, কিন্তু সাম্প্রতিককালে অন্য অনেক উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় উৎসবের মতো রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তীও বাংলার উৎসবের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। বারো মাসে তেরো পার্বণের রাজ্যে উৎসবের তালিকা দীর্ঘতর হলে কে আপত্তি করবে? প্রশ্নটা উৎসবের আধিক্য নিয়ে নয়, প্রশ্ন হল উৎসব কেন আনন্দের পরিবর্তে আতঙ্ক ছড়াবে?
এই আতঙ্কের উৎস অবশ্যই উৎসবের মধ্যে নিহিত নেই। বছর কয়েক আগেও মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই রামনবমী উদযাপিত হত। রাম নবমীর এই রূপান্তরণের সূত্রপাত সাড়ে তিন দশক আগে রাম মন্দির আন্দোলনের হাত ধরে। মর্যাদা পুরুষোত্তম রামকে প্রজাকল্যাণ ও সুশাসনের প্রতীক হিসেবে দেখা হত, স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধী রামরাজ্যকে আদর্শ সমাজের কল্পনা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। সত্য ও ত্যাগের সৌম্য প্রতিমূর্তি এই রামকে অযোধ্যা অভিযানের সময় থেকে পরিণত করা হয়েছে উগ্র হিন্দুত্বের আক্রমণাত্মক প্রতীকে। ২০১৪ তে মোদী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এই আক্রমণের তীব্রতা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে।
সামাজিক মাধ্যমে এবং ধার্মিক উৎসবের আয়োজনে আজ রাম এবং রামভক্ত হনুমান, উভয়েরই ক্রুদ্ধ চেহারা চোখে পড়ে। লঙ্কাদহন ও রাক্ষসনিধনের পুনরাবৃত্তির আহ্বানের সাথে আজ হনুমান জয়ন্তী পালিত হয়, ‘জয় সিয়া রাম’ বা ‘জয় রামজী কী’-র মতো পরম্পরাগত শুভেচ্ছা সম্বোধন আজ চাপা পড়ে যায় জয় শ্রী রাম রণহুঙ্কারে। একুশ শতকের আধুনিক ভারতে দেশের ভেতরে লঙ্কা ও রাক্ষস খোঁজার অর্থ বা পরিণতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এবার রামনবমীকে ঘিরে বহু জায়গায় হিন্দুরাষ্ট্রের ব্যানার দেখা গেছে। স্লোগান উঠেছে ‘হিন্দুস্তান মে় রহনা হোগা তো জয় শ্রী রাম কহনা হোগা’। ধার্মিক উৎসবের সীমানা পেরিয়ে আজ রামনবমী হয়ে উঠেছে হিন্দু রাষ্ট্রের আগমনবার্তা প্রচারের আগ্রাসী রাজনৈতিক অভিযান।
সংবিধানে ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বাংলার সমন্বয়ী মানবতাবাদী সংস্কৃতির বিপরীতে রামনবমীর নামে এই সংকীর্ণতা ও সহিংসতার তাণ্ডব নৃত্য যে চলতে পারে না এ কথা বাংলার সমাজ জীবনে অবশ্যই জোরের সাথে ঘোষণা করতে হবে। যত মত তত পথের উদারতাকে ছেড়ে কোনো এক মতকে চাপিয়ে দেওয়ার আগ্রাসী অভিযানকে অবশ্যই রুখে দিতে হবে। এক কথায়, ধর্মকে ফিরিয়ে দিতে হবে ধর্মের জায়গায়, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি থেকে আলাদা রাখতে হবে সমস্ত ধর্মকেই। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনাকে আজ অবশ্যই ধর্মথেকে আলাদা করতে হবে।
ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদকে মিশিয়ে ফেললে তার দুষ্পরিণাম কী হতে পারে সেই বিভীষিকা আমরা দেশভাগের সময় প্রত্যক্ষ করেছি। পঞ্চাশ বছর আগে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গড়ে ওঠাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ধর্ম আর দেশ এক নয়, ধর্মের পরিচিতি নিয়ে বা তার ভিত্তিতে দেশ চলতে পারে না। আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে ভারতে কেন সেই সর্বনাশকে আবার ডেকে আনা হবে?
গত বছরের রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীতে ঘটে যাওয়া ব্যাপক হিংসার বিস্তারিত তথ্য সংকলিত করে এ বছর রামনবমীর আগে আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের উদ্যোগে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে দেখা যায় রামনবমীর শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে প্রশাসনিক গাফিলতি ও ব্যর্থতা হিংসার এক বড় কারণ। কিন্ত এবার আবার সেই একই ছবি দেখা গেল। রামনবমীর পরেও বিভিন্ন জায়গায় শোভাযাত্রার অনুমতি, অপর্যাপ্ত পুলিশী বন্দোবস্ত এবং পূর্বপরিকল্পিত হিংসা রোধে চূড়ান্ত ব্যর্থতা। নালন্দার বিহারশরিফে ঐতিহ্যবাহী আজিজিয়া মাদ্রাসা এবং সাড়ে চার হাজারের বেশি পুস্তক সংরক্ষণকারী লাইব্রেরি জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা রামনবমীর আড়ালে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
হিংসার আশঙ্কা থাকুক বা না থাকুক, কোন ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক, কিছু মৌলিক নীতি অবশ্যই সর্বত্র মেনে চলা উচিত। রামনবমীর শোভাযাত্রায় তরবারি বা কোনো আগ্নেয়াস্ত্র কেন ব্যবহৃত হবে? বুলডোজার নিয়ে কেন মিছিল চলবে? মিছিলকে কেন কোনো সংবেদনশীল এলাকা দিয়ে যেতে দেওয়া হবে? মিছিলে কেন উস্কানিমূলক এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা বর্ষণকারী স্লোগান, সঙ্গীত বা ভাষণ চলবে? সহিংসতা ও ঘৃণাবর্ষণের উপর নিষেধাজ্ঞার শর্তসাপেক্ষেই শোভাযাত্রার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। এই শর্ত যাতে পালিত হয় সে ব্যাপারে প্রশাসনকে কড়া নজর রাখতে হবে এবং শর্তলঙ্ঘন হলে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে অপরাধীদের শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আইনের শাসনে এই প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে কোনো শিথিলতার জায়গা থাকতে পারে না।
সমাজ ও প্রশাসনের ভূমিকার পাশাপাশি রাজনীতি, বিশেষ করে নির্বাচনের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও মেরুকরণের প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। হিন্দী ও ভোজপুরী ভাষার বিপ্লবী কবি গোরখ পান্ডে রচিত প্রায় চার দশক আগের একটি ছোট কবিতার শেষ কয়েকটি পংক্তি মনে আসছে। ইস বার দাঙ্গা বহুত বড়া থা/ খুব হুই থি/ খুন কী বারিশ/ অগলে সাল অচ্ছি হোগী/ ফসল/ মতদান কী - এ বছর দাঙ্গা ছিল অনেক বড়/ রক্তের বিপুল বর্ষণে/ আগামী বছর ঘরে উঠবে/ ক্ষেতভরা ভোটের ফসল। বিহারশরিফের আজিজিয়া মাদ্রাসার ধোঁয়া থামতে না থামতেই পাশের জেলা নওয়াদাতে গর্জে উঠলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কোনও রকম রাখঢাক না করেই সোজা বললেন – ‘লোকসভা নির্বাচনে বিহারের চল্লিশটি আসনই মোদীজীকে দিন আর পরের বছর বিধানসভায় বিজেপিকে দিন স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আমরা দাঙ্গাকারীদের উল্টে ঝুলিয়ে দেব।’
অমিত শাহের বক্তব্যের অর্থ খুবই স্পষ্ট। তথাকথিত ধর্মসংসদের মঞ্চ থেকে যেভাবে এর আগে মুসলিম জনগণের গণহত্যার ডাক দিতে আমরা শুনেছি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ঘুরিয়ে সেই কথাই বললেন। পাঠকের হয়তো স্মরণে থাকবে গুজরাত নির্বাচনে অমিত শাহ দাবি করেছিলেন গুজরাতে বিজেপি এবং রাজ্য সরকার দাঙ্গাকারীদের এমন শিক্ষা দিয়েছে যে রাজ্যে স্থায়ী শান্তি কায়েম হয়েছে। অমিত শাহের ভাষায় দাঙ্গাকারী কারা নিশ্চয়ই বুঝতে আমাদের অসুবিধে নেই। বিলকিস বানো ও তাঁর পরিবারের গণধর্ষণ ও গণহত্যার মামলায় যারা জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হয়েছিল তাদের তো স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে কারামুক্ত করে বীরোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই অমিত শাহের ভাষায় তারা দাঙ্গাকারী নয়। দাঙ্গাকারী, বিদেশী আক্রমণকারী, অনুপ্রবেশকারী, সন্ত্রাসবাদী থেকে শুরু করে উইপোকা, এই সমস্ত সাংকেতিক ভাষাই সংঘ পরিবারের অভিধানে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন উল্টে ঝুলিয়ে দেওয়ার কথা বলেন তখন আমাদের মনে সংবিধানসম্মত আইনের শাসনের ভরসা জেগে ওঠে না, চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুলিশী অত্যাচার, সাম্প্রদায়িক গণহত্যা এবং ভীড় হিংসার শিকার সহনাগরিকদের অসহায় চেহারা।
উৎসব যখন আতঙ্ক ছড়ায় আর সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ভোটের ভাষণ দেন তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না রামনবমীকে ঘিরে হিংসার ঘটনা আসলে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের এক গভীর অসুখের লক্ষণ। রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ এই অসুখ সারিয়ে সুস্থ হয়ে উঠুক, হিন্দুরাষ্ট্রের বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাক আম্বেদকারের সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত।
বর্তমানে দেশজুড়ে এবং রাজ্যব্যাপী গ্রামীণ গরিবদের জীবন-জীবিকা চিকিৎসা শিক্ষা সমস্ত দিক থেকেই সংকট বেড়ে চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার খাদ্য সুরক্ষার নিশ্চিত করার কথা বললে ও বাস্তবে ভোজ্য তেল-ডাল-সব্জি ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করার পরিবর্তে রেশনে যেটুকু চাল আটা দেওয়া হত তারও বরাদ্দ অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে। গ্রামীন গরিবদের কাজের অধিকারের প্রশ্নে একমাত্র আইন এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পের বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত ন্যুনতম মজুরি দৈনিক ৪২৯ টাকা হলেও কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ হয়েছে দৈনিক ২৩৭ টাকা। তারপর বলা হচ্ছে দিনে দুবার ডিজিটাল রিপোর্ট মানে কাজের শুরুতে একবার এনড্রয়েড ফোন থেকে ছবি সহ অনলাইনে রির্পোট পাঠাতে হবে। আবার কাজ শেষ হওয়ার সময় রির্পোট পাঠাতে হবে। আরও জঘন্যতম ঘটনা হল, বিগত দেড় বছর রাজ্য সরকারের দুর্নীতির অজুহাতে পশ্চিমবঙ্গের গরিবদের কেন্দ্রীয় সরকার কাজ এবং বকেয়া মজুরির আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। ২০২২ সালের মধ্যে সমস্ত গরিব মানুষকে পাকা বাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখনও সমস্ত গরিব মানুষ ঘর পেল না। এক্ষেত্রেও দুর্নীতির অজুহাতে গরিব মানুষকে বাস্তু ও ঘরের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। বারবার কেন্দ্রীয় সমীক্ষক দল ঘুরে গেলেও কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত লোককেও সাজা দেওয়া হল না। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গরিবদের গ্যাসের রান্না খাওয়ার স্বপ্ন ঘুমের মধ্যেই থেকে গেল। এখন আবার আধার লিংক-এর নামে কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যেক গরিব মানুষ থেকে ১০০০ টাকা জরিমানা আদায় করছে। তার উপর কাজের অভাব এবং দ্রব্যমুল্যবৃদ্ধির ফলে গরিবদের দুরবস্থা চরম মাত্রা নিয়েছে। এই অবস্থায় গরিব জনগণ দেশজুড়ে আন্দোলনে নামছে। আয়ারলার জাতীয় কমিটি আগামী ২৭ এপ্রিল ১০ দফা দাবিতে দেশজুড়ে ব্লকে ব্লকে বিক্ষোভ ডেপুটেশন ও রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ঠিক করেছে ২৭ এপ্রিল রাজ্য জুড়ে এই ১০ দফা দাবির সাথে সাথে রাজ্যে তৃণমুলের দুর্নীতি দলবাজি ও সংন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং অন্যান্য গরিবদের দাবি যুক্ত করে লিফলেট প্রচার ডেপুটেশন বিক্ষোভ ও রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি পাঠানো হবে।
২৭ এপ্রিল গ্রামীণ শ্রমিক বিক্ষোভ কর্মসূচির ১০ দফা দাবিসনদ
১) বুলডোজার রাজ নিপাত যাক! দশকের পর দশক জুড়ে যারা যে জমিতে বাস করছেন, তার বাস্তুপাট্টা দিতে হবে (দীর্ঘদিনের বসবাসের জমির বাস্তুপাট্টা দিতে হবে)। অবিধিবদ্ধ সকল জনবসতির সম্পূর্ণ সার্ভে করতে হবে এবং নতুন করে বাসগৃহ আইন প্রণয়ন করতে হবে। বিকল্প বন্দোবস্ত না করে কোনো বাসগৃহ উচ্ছেদ চলবে না। বাসগৃহের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
২) নূন্যতম মজুরির হারবৃদ্ধি করতে এবং এর কার্যকরী প্রয়োগে নির্দিষ্ট পরিকাঠামো সুনিশ্চিত কর। অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য ভারত সরকার ঘোষিত নূন্যতম মজুরি ৪২৯ টাকা এনআরইজিএর ন্যূনতম মজুরি হিসাবে ঘোষণা কর। কোনো রাজ্য সরকারই যাতে ৪২৯ টাকার কম মজুরি এনআরইজিএ তে না দিতে পারে, তা যে কোনো মূল্যে সুনিশ্চিত কর। এনআরইজিএ ডিজিটাল হাজিরা বন্ধ কর।
৩) ক্ষুধা সূচকে ভারতের শোচনীয় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য নিশ্চয়তা আইনকে শক্তিশালী কর। চাল, আটা, ডাল, তেল, সব্জি, চিনি, দুধ ইত্যাদি রেশন মাধ্যমে দিতে আইনি বন্দোবস্ত কর। এই সাংবিধানিক বিধির রাজনৈতিক অপব্যবহার বন্ধ কর।
৪) ৬০ বছর ঊর্ধ্ব প্রত্যেক বয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী মানুষ, মহিলাদের মাসিক ৩ হাজার টাকা পেনশন সুনিশ্চিত কর।
৫) প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার সহায়তা বৃদ্ধি করে ৫ লক্ষ টাকা করতে হবে এবং এই যোজনার দালালি ও আমলাতান্ত্রিক লুট বন্ধ কর।
৬) সকল দলিত ও দরিদ্র শ্রমজীবীর সরকারের থেকে নেওয়া এবং মহাজনী ঋণ মকুব করতে হবে। বিনা সুদে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রদান করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী সহ মাইক্রো ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলির সুদের হার কমাও। বলপূর্বক ঋণ আদায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা কর।
৭) সকল দলিত ও দরিদ্র সহ বিপিএল পরিবারের করোনা সময়কালের বিদ্যুৎ বিল মকুব কর। এই ধরনের সকল পরিবারকে বিনামূল্যে ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ দিতে হবে।
৮) মানুষ মারা মূল্যবৃদ্ধি রোধ কর। খাদ্যশস্য, ঔষধ সহ চিকিৎসা ব্যয়ের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি রোধ কর। দরিদ্র শ্রমিকদের জন্যও মহার্ঘ্য ভাতা চালু কর।
৯) শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বেসরকারিকরণ বন্ধ কর। দরিদ্র শ্রমজীবীদের জন্য উন্নতমানের শিক্ষা প্রদান সুনিশ্চিত কর। সকল ছাত্র-ছাত্রীর জন্য প্রতিটি স্তরে বৃত্তি প্রদান সুনিশ্চিত কর।
১০) দলিত, গরিব ও মহিলাদের উপর সামন্ত শক্তি সহ সামাজিক প্রাধান্যকারী শক্তির ক্রমবর্ধমান হামলা বন্ধ কর।
- সজল পাল
১১ দফা দাবিতে লম্বা সময় ধরে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিলেন মেদিনিপুর পুরসভার সাফাইকর্মীরা, অবশেষে আলোচনার প্রস্তাব এসেছে পৌরসভার চেয়ারম্যান কর্তৃক। গত ৬ এপ্রিল বোর্ড মিটিংয়ে, অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পদস্থ কর্তাদের সহিত মেদিনীপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সম্পাদক ও সভাপতিকেও আলোচনায় ডাকা হয়। এর পূর্বে কর্তৃপক্ষের ওপর সংগঠিত লড়াইয়ের চাপ বহাল রাখতে ও সাম্প্রতিক রামনবমীকে কেন্দ্র করে রাজ্যজুড়ে যে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও অশান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরং দল, তার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে সারা শহর পরিক্রমা করে ৫ তারিখে একটি দৃপ্ত মিছিল পৌরসভার সামনে জমায়েত করে।
মূল দাবি হল, সুডা (স্টেট আরবান ডেভেলপমেন্ট অথারিটি)-র অধীন সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টর কাজ করতে থাকা শ্রমিক এবং ফান্ড শ্রমিকদের সরকার ঘোষিত ৩৭৬ টাকা ন্যূনতম মজুরী চালু করতে হবে। এছাড়া মৃত কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের চাকুরি প্রদানসহ ইপিএফ-এর বেনিফিট প্রদান ও আরো বেশকিছু দাবীও করা হয়। ৫ এপ্রিল মিছিলের পর একটি স্ট্রাইক নোটিশ জমা করা হয়, এই মর্মে যে, আলোচনার মাধ্যমে যদি দাবি পূরণ না করে কোনো রকম ভাঁওতাবাজির চেষ্টা করেন চেয়ারম্যান, তবে তাদের রেহাই দেওয়া হবে না, পৌরসভা অবরুদ্ধ হবে।
সমগ্র কর্মসূচিটি নেতৃত্ব দেন কমরেড তপন মুখার্জী, শামিল হন বিষ্ণুপুরের সাফাই ইউনিয়নের সম্পাদক দিলবার খান, দিলীপ বাউরী সহ আরো সতেরো জন শ্রমিক। মহিলা শ্রমিকরাও বিষ্ণুপুর থেকে মেদিনিপুরের মিছিলে যোগ দেন নেতৃত্বে ছিলেন প্রগতিশীল মহিলা সমিতির কমরেড তিতাস।
- রিপোর্ট, ফারহান
গত ৪ এপ্রিল ২০২৩ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত এনআরএল ডেইলি বেসিস অ্যান্ড মান্থলি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দার্জিলিং জেলার ফাঁসীদেওয়া ব্লকের রাঙাপাণি স্থিত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নুমালিগড় তৈল শোধনাগারের শিলিগুড়ি টার্মিনালের সিনিয়র ম্যানেজারের কাছে শ্রমিক স্বার্থে ৮ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করে দাবিগুলির সপক্ষে দীর্ঘ সময় দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালানো হয়। মূখ্য দাবিগুলি হলো ২০০৩ সালে এনআরএল টার্মিনাল স্থাপনের জন্য উচ্ছেদকৃত কৃষিজীবিী পরিবারগুলি থেকে কমপক্ষে একজন সদস্যকে স্থায়ী চাকরি দিতে হবে, সমস্ত শূণ্যপদে অবিলম্বে স্থানীয় কর্মী নিয়োগ করতে হবে, দৈনিক ও মাসিক মজুরিতে কর্মরত শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ করতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত এই নুমালিগড় টার্মিনালে কর্মরত স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় সিডিউল অনুযায়ী ন্যায্য মজুরি দিতে হবে প্রভৃতি। শ্রমিক ও ভূমিহারাদের সম্মিলিত মিছিল ও ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন ইউনিয়নের সভাপতি সুরেন সিংহ, সম্পাদক বুলু সিংহ, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের নেতা অভিজিত মজুমদার, পবিত্র সিংহ, পঞ্চা বর্মণ, সন্তোষ বর্মন প্রমুখ। দাবি আদায়ে এনআরএল কর্তৃপক্ষকে তাদের সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে ইউনিয়নের কাছে পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে। ন্যায্য দাবি আদায়ে আগামীদিনে ইউনিয়নের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ‘সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়ন’ নয়া পেনশন নীতি (এনপিএস)-এর বিরুদ্ধে একটি কনভেনশন সংগঠিত করে গত ৫ এপ্রিল টিকিয়াপাড়া রেলওয়ে ইনস্টিটিউট হলে। কনভেনশনে ‘ইন্ডিয়ন রেলওয়ে এম্প্লয়িজ ফেডারেশন’-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড সর্বজিত সিং ও ‘ফ্রন্ট এগেনস্ট এনপিএস ইন রেলওয়ে’-এর সভাপতি কমরেড অমৃক সিং উপস্থিত ছিলেন। মোট ১৫০ জন রেলশ্রমিক, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এনপিএস আওতাভুক্ত, কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেন।
সভার শুরুতে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড সর্বজিত সিং। একে একে উপস্থিত সকল প্রতিনিধি শহীদ বেদীতে মাল্যার্পণ করেন। শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ইউনিয়নের হাওড়া শাখার সম্পাদক কমরেড অপু ঘোষ।
টিকিয়াপাড়া কার শেডে কর্মরতা মহিলা শ্রমিক ও মজদুর ইউনিয়নের সদস্যা সঞ্চিতা চন্দ ও রেখা বিশ্বাস গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। ফেডারেশনের সাম্মানিক সভাপতি কমরেড রবি সেন প্রদীপ জ্বালিয়ে কনভেনশনের সূচনা করেন।
কনভেনশনে উদ্বোধনী ভাষণ দেন মজদুর ইউনিয়নের সভাপতি, প্রবীন রেল শ্রমিক নেতা এন এন ব্যানার্জী। তিনি তাঁর বক্তব্যে রেল শ্রমিকের উপর ফ্যাসিবাদী হামলার বিবরণ দেন। তিনি এনপিএস সংশোধন করে রেল শ্রমিকের বিক্ষোভ প্রশমিত করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে ও ওপিএস চালু করার লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান রাখেন। কমরেড সর্বজিত সিং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ও সমস্ত অ-স্বীকৃত ইউনিয়নের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রেল বেসরকারিকরণ ও এনপিএস-এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তোলার আহ্বান রাখেন। ফ্রন্টের সভাপতি কমরেড অমৃক সিং ফেডারেশনের নেতৃত্বে দক্ষিণ পূর্ব রেলে এনপিএস বিরোধী ফ্রন্টের সংগঠন গড়ে আন্দোলন তীব্র করার আহ্বান রাখেন। তিনি এনপিএস সংশোধন করার ফিনান্স সেক্রেটারি দ্বারা বিশেষ কমিটি গঠনের চক্রান্ত ব্যাখ্যা করেন এবং ২০২৪ এর সাধারণ নির্বাচনের আগে ওপিএস-এর জন্য লড়াইকে তীব্রতর করার আহ্বান রাখেন। অল ইন্ডিয়া লোকো রানিং স্টাফ এ্যসোসিয়েশন-এর প্রতিনিধি সৌমেন মহাপাত্রর উদ্যোগকে স্বাগত জানান ও এনপিএস-এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার করেন। এআইসিসিটিইউ হাওড়া জেলা কমিটির সভাপতি কমরেড দেবব্রত ভক্ত কনভেনশন কে সম্বোধিত করেন ও এনপিএস বিরোধী আন্দোলনে এআইসিসিটিইউ এর সক্রিয় সংহতি জ্ঞাপন করেন।
মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কমরেড শুভাশীষ বাগচী এনপিএস-এর বিরুদ্ধে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের জিএম দপ্তরে আগামী ১১ জুলাই বিক্ষোভ অবস্থানের প্রস্তাব রাখেন ও ৫০০ জন রেলশ্রমিককে উক্ত কর্মসূচিতে সামিল করার লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করেন। মজদুর ইউনিয়নের খড়্গপুর ডিভিশনের কোঅর্ডিনেটর কমরেড স্নেহাশীষ চট্টোপাধ্যায় উক্ত প্রস্তাবের উপর বিশদ ব্যাখ্যা রেখে তাকে সমর্থন করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
কমরেড এন এন ব্যানার্জী, রাখহরি মহাপাত্র, এ রহমান, কে পি দত্ত, সঞ্চিতাচন্দ ও দেবজ্যোতি দেবনাথকে নিয়ে গঠিত সভাপতি মন্ডলী সমগ্র সভাটি পরিচালনা করেন।
উদ্দীপনাময় স্লোগানের মধ্যে দিয়ে উপস্থিত শ্রমিক কর্মচারীর মধ্যে নতুন উৎসাহ সঞ্চারিত করে কনভেনশনটি পরিসমাপ্ত হয়।
গত ৫ এপ্রিল বুধবার, কলকাতা ট্রাম কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত সকল কর্মীদের জন্য পেনশন, শ্রমিক সমবায়ের (ইসিসিএস) বকেয়া টাকা প্রদান, ত্রিপাক্ষিক চুক্তি কার্যকর করে ১৪ জন ছাঁটাই কর্মীকে পুনর্বহাল ও চুক্তিভিত্তিক সকল শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের দাবিতে পরিবহন ভবন অভিযান করা হয়। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযানকে মাঝ রাস্তায় বাঁধা দেওয়া হলে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ সভা শুরু হয়। সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে শুরু এই অভিযানে পাঁচ শতাধিক ট্রাম কোম্পানির কর্মীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন।
পরিবহন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচীব এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সচিবের মাধ্যমে মন্ত্রী এবং এমডি-র উদ্দেশ্যে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। দুই সচিব ও মন্ত্রী এবং এমডি-র সাথে দ্রুত বৈঠকের এবং সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন।
২ এপ্রিল (রবিবার) হিন্দমোটর নন্দনকাননের ‘জ্যোতি’ অনুষ্ঠান ভবনে সংগঠিত হল সিপিআই(এমএল)-এর তৃতীয় উত্তরপাড়া থানা এরিয়া সম্মেলন। এই কর্মসূচির জন্য ভবন সংলগ্ন বেশ কিছুটা এলাকা লাল পতাকা, চাইনিজ, ব্যানার ইত্যাদিতে সুসজ্জিত ছিল। ভবন ও মঞ্চ নামাঙ্কিত হয় বিহারের ভোজপুরের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সংগঠক ও পার্টি পুনর্গঠনের অন্যতম কারিগর কমরেড অরূপ সেনগুপ্ত তথা দীনাজী ও রিষড়া জয়শ্রী টেক্সটাইল কারখানার শ্রমিক নেতা চথা এই অঞ্চলের পার্টি গঠনের অন্যতম সংগঠক কমরেড রামপিরীত সিং -এর নামে। সম্মেলনে জেলা কমিটির পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কমরেড চৈতালী সেন, তিনিই সম্মেলনের শুরুতে পতাকা উত্তোলন করেন এবং তিনি সহ উপস্থিত সকল কমরেড শহীদ বেদীতে মাল্যদান করে ও নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সম্মেলনের মূল পর্বের সূচনায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন কমরেড রবি শুর। এরপর পর্যবেক্ষকের সম্ভাষণ হয় এবং তারপরে বিদায়ী কমিটির তরফ থেকে সম্পাদক কমরেড প্রদীপ সরকার খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন। এই প্রতিবেদনের উপর আলোচনায় মোট ১৫ জন প্রতিনিধি অংশ নেন, যার মধ্যে ৪ জন মহিলা, ১ জন ছাত্র, ২ জন যুব ও বাকিরা নির্মাণ সহ বিভিন্ন শ্রমিক। বক্তব্য রাখেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড পার্থ ঘোষ ও হুগলি জেলা সম্পাদক কমরেড প্রবীর হালদার। উপস্থিত ছিলেন পার্টির শুভানুধ্যায়ী তথা সাংবাদিক ও অধিকার আন্দোলনের সংগঠক রূপম চট্টোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন মোট ৮৫ জন সদস্য, যাঁদের মধ্যে ছিলেন কয়েজন প্রবীণতম ও অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া কমরেডরাও; তাঁদেরকে কমিটির উদ্যোগে বাড়িতে গিয়ে নিয়ে আসা হয়। জবাবী ভাষণের পরে প্রতিবেদনটা কিছু সংযোজন সহ গৃহীত হয়। সর্বশেষ ১৩ সদস্যের নতুন এরিয়া কমিটি গঠিত হয় এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন কমরেড অপূর্ব ঘোষ। নবগঠিত এরিয়া কমিটির সদস্যরা হলেন – প্রদীপ সরকার, স্বপন মজুমদার, পূর্ণিমা সিংহ রায়, সুজয় দে, সৌরভ রায়, ভোলানাথ দে, গজানন সাহা, বিশ্বজিৎ দাস, তন্ময় চন্দ, সুদীপ্তা বসু, পঞ্চানন নন্দী, পরিমল দাস ও অপূর্ব ঘোষ।
গত ৭ এপ্রিল শুক্রবার সিপিআই(এমএল) বজবজ-পূজালী লোকাল কমিটির ২-য় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল মনোরঞ্জন নস্কর সভাগৃহে। সুদেশ মন্ডল ও সুকুমার বক্সি মঞ্চে। রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন বর্ষীয়ান কমরেড মোহন মন্ডল। মাল্যদান ও শহীদ স্মরণ পর্বশেষ করে, কমরেড কাজল দত্ত ও মোহন মন্ডলের সভাপতিত্বে সমগ্র সম্মেলন পরিচালিত হয়। উদ্বোধনী ভাষণে জেলা সম্পাদক কমরেড কিশোর সরকার বলেন বজবজ শহর পার্টি কমিটি রাষ্ট্রশক্তি ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হামলার বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলা এবং সেই লড়াইয়ের চারপাশে সমাজের মানুষকে সামিল করার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। যা এই বিশাল অঞ্চলজুড়ে পার্টির মর্যদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই ঐতিহ্যকে ধরেই বর্তমানের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমাজকে সামিল করার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে। সাথে সাথে রাজ্য সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের মুখোস উন্মোচন করতে হবে। কমরেড দিলীপ পাল বলেন তৃণমূলকে একটুও ছাড় না দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পার্টি কংগ্রেসের সাফল্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। উপস্থিত প্রতিনিধিরা তাদের মূল্যবান মতামত তুলে ধরেন। পার্টি কমিটির কিছু দুর্বলতা তুলে ধরার সাথে সাথে পার্টিকে বড় করে তোলার জন্য মতামত রাখেন। বিদায়ী সম্পাদক কমরেড অঞ্জন ঘোষের জবাবি ভাষনের পর সংশোধিত প্রতিবেদন গৃহীত হয়। শেষে ৯ জনের কমিটি নির্বাচিত হয়। কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন সর্বকনিষ্ঠ কমরেড সেখ সাবির রাজা। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে সম্মেলন শেষ হয়।
চলার পথে গণসাংস্কৃতিক সংস্থার পরিচালনায় বিপ্লবী যুব এ্যাসোসিয়েশন ও পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সহযোগিতায় শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিং-এর ৯২তম শহীদ দিবস উপলক্ষে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হল চড়িয়াল চিলড্রেন্স পার্কে। “চলার পথের” সূচনা সঙ্গীতের পর বক্তব্য রাখেন “বিপ্লবী যুব এ্যাসোসিয়েশনের” রাজ্য সম্পাদক রনজয় সেনগুপ্ত, সুদূর আসাম থেকে ছুটে আসা লোকশিল্পী বলিন্দ্র সাইকিয়া থেকে শুরু করে “পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের” কেন্দ্রীয় গানের দল, কোলকাতা ছাত্রছাত্রীদের নাটকের দল “আসমান-জমিন”, ছাত্র সংগঠন “আইসা”-র গানের দল, বজবজের “নৃত্যাঞ্জলী” সংস্থা, বাচিক শিল্পী মৌসুমি সরকার, পায়েল দাস, বৃষ্টি মন্ডল ও খুদে শিল্পীরা তাদের শিল্প কলার মধ্য দিয়ে ভগৎ সিংএর স্বপ্নের ভারত গড়ে তোলার শপথ নেন।
এছাড়া বজবজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থা ও ব্যাস্ত চড়িয়াল চত্তরের স্থানীয় বাসিন্দা, পথ চলতি মানুষজন এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সু্ষ্ঠভাবে পরিচালনা করেন দেবাশিস মিত্র ও অঞ্জন ঘোষ।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে লেখা হনুমান জন্মবৃত্তান্ত পোস্ট দেওয়ায় বহরমপুরের ‘ঝড়’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রাবন্ধিক চন্দ্রপ্রকাশের গ্রেপ্তারকে তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানান মুর্শিদাবাদ জেলা পার্টি সম্পাদক রাজীব রায়। এরাজ্যের পুলিশ ক্রমাগত হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে। জাতীয় সঙ্গীত অবমাননার অভিযোগে দুজন ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করার ঘটনাও নিন্দাযোগ্য। একদিকে দেশের সম্প্রীতি সৌহার্দ্য সহাবস্থানের সংস্কৃতিকে কলুষিত করে দেশের ঐক্যকে ভেতর থেকে টুকরো টুকরো করছে, অন্যদিকে মানুষের স্বাভাবিক অভিব্যক্তির ওপর হামলা চালাচ্ছে। রাণাঘাটের ‘সৃজক’ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা নিরুপম ভট্টাচার্যের উপরও অনুরূপ হামলা হল। নাটক বন্ধ করে হনুমান পূজা করতে হবে –এই হুমকিসহ সন্ত্রাস চালানো হল তাঁর ওপর। অথচ পুলিশ এক্ষেত্রে তাঁর অভিযোগ জমা নিতেই প্রথমে অস্বীকার করে। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে সম্পাদক সরিৎ চক্রবর্তী ও নবান্ন পত্রিকার সম্পাদক নীতীশ রায় বিবৃতিতে ধিক্কারসহ জানিয়েছেন, লুম্পেন-সন্ত্রাস-ধর্মীয় উন্মাদনার অশুভ সংস্কৃতি রাজ্যে ফ্যাসিবাদের উর্বর জমি তৈরি করছে।
দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকেরা তিনটি মূল দাবি নিয়ে আন্দোলন ধর্না চালাচ্ছেন। অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী ন্যায্য ডিএ, সমস্ত ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগের মাধ্যমে শূন্য পদ পূরণ ও সরকারি ক্ষেত্রে চাকুরিরত অস্থায়ীদের স্থায়ীকরণ। ধর্নার পাশাপাশি অনেকদিন অনশনও করেছিলেন কয়েকজন। শেষপর্যন্ত রাজ্যপালের অনুরোধে অনশন তুলে নিলেও অবস্থান আন্দোলন বজায় থাকে। রাজ্যপালের চেষ্টা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের তরফে কেউ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেননি। বরং নানা ঘৃণ্য মন্তব্য করেছেন। আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দেয় কলকাতা পুরসভার মেয়র থেকে মুখ্যমন্ত্রীর করা এইসব কুৎসিৎ মন্তব্য। ১০ মার্চ ধর্মঘট-এর বিপুল সাফল্যের পর ৩০ মার্চের মিছিল ও শহীদ মিনার সমাবেশ জনপ্লাবনে ভরে ওঠে। সমস্ত বিরোধী দল এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ায়। রাজ্যের পাশাপাশি জাতীয় স্তরেও এই আন্দোলনের বার্তাকে নিয়ে যাবার উদ্যোগ গৃহীত হয়। সেই সূত্রেই ঠিক হয় ১০ ও ১১ এপ্রিল এই দুদিন দিল্লির যন্তর মন্তর চত্বরে ধর্নায় বসবেন আন্দোলনের নেতৃত্ব। সোমবার, ১০ মার্চ সকাল ১১টা থেকে দিল্লির যন্তর মন্তরে ডিএ-র দাবিতে ধর্নায় বসেন সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের প্রায় ৫০০ সদস্য। দু’দিনের এই ধর্না কর্মসূচি চলাকালীন আন্দোলনকারীদের তরফে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের কাছে ডেপুটেশন দেওয়ার কথাও রয়েছে।
দিল্লির ধর্না থেকে আন্দোলনকারীরা ফেরার পর তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের শীর্ষ স্তরের আমলাদের বৈঠক করতে হবে বলে জানিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। এর আগে কলকাতা হাইকোর্ট এর ডি এ সংক্রান্ত মামলায় কর্মচারিদের পক্ষে দেওয়া রায়কে না মেনে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে রাজ্য সরকার। সেখানে শুনানি এখনো শুরু হয়নি। এখন দেখার আলোচনায় বসার জন্য কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে রাজ্য সরকার মেনে নেয় না উচ্চ আদালতে এর বিরুদ্ধেও আপিল করে।
ব্লিঙ্কইট কোম্পানির নাকি মুনাফা হচ্ছে না! তাই গরম পড়তেই উত্তর কলকাতার কলকাতায় ডেলিভারি বয়দের কমিশন ডেলিভারি প্রতি ২৫ টাকা থেকে কমিয়ে করে দেওয়া হয়েছে ১৫ টাকা। কিন্তু ওদের পেট কী ভাবে চলবে? তাই চিনার পার্কের হাবে কর্মরত নিউটাউন, কেষ্টপুরের ডেলিভারি বয়রা স্ট্রাইক করেছে। আর তাতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ব্লিঙ্কইট কোম্পানি প্রায় ২০০ কর্মীকে বসিয়ে দিয়েছে! বলা যায় ছাঁটাই করেছে। এবার সরাসরি তাদের পেটে আঘাত।
কর্মীদের এই আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে অন্য এলাকার ডেলিভারি বয়রা। তারা দাবি তুলেছে, বসিয়ে দেওয়া কর্মীদের অবিলম্বে নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু কোম্পানি বলছে ওরা ২৫ টাকার আইডি সিস্টেম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। এখন নতুন চুক্তি করতে হবে ১৫ টাকায় ডেলিভারি। রাজি আছে? আর যদি একান্তই ২৫ টাকাই পেতে হয় তাহলে এই গরমে বাইক চালিয়ে অনেক দূরে ডেলিভারি করতে হবে।
কিন্তু দিন রাত ছুটে বেড়ানো আধুনিক এই রানাররা জানেন, দূরের ডেলিভারি মানেই দিনের টার্গেট পূরণ করতে না পারা। ফলে কাটা যাবে কমিশন। হাতে কিছুই থাকবে না!
চাকরি নেই। বেকারত্বের তীব্র জ্বালা। তাই কম মজুরিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রমে বাধ্য হয় এইসব ডেলিভারি বয়রা। সেখানেও আজ নামছে নিত্যনতুন আঘাত। সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার। আর দরকার এই নতুন বিকশিত ক্ষেত্রটিতে জোরদার ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক আন্দোলন। ডেলিভারি বয়রাও বুঝতে পারছেন এছাড়া পথ নেই। নতুন ক্ষেত্রে নতুন ধরনের শ্রমিক আন্দোলন বিকাশের পরিসর তৈরি হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকার এক ধাক্কায় নরেগা প্রকল্পের বাজেট বরাদ্দ ২০২৩-২৪ এর আর্থিক বছরের জন্য ২১.৬৬ শতাংশ ছেঁটে দিয়েছে যা গত পাঁচ আর্থিক বছরে সর্বনিম্ন। নরেগার বাজেটে এই বরাদ্দ কমার ফলে তা নেমে এসেছে প্রাক কোভিডকালীন পর্যায়ে। ঘোর কোভিডকালে, দেশব্যাপী লকডাউনের সময় কাজ খোয়ানো অগণিত পরিযায়ী শ্রমিক গ্রামের নিজ নিজ ঘরে ফিরে এই ১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে দিন গুজরান করেন। এই প্রকল্পটি তখন হয়ে উঠেছিল ডুবন্ত মানুষের কাছে বেঁচেবর্তে থাকার শেষ খড়কুটো। যেভাবে এই প্রকল্পের বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁট করা হয়েছে তাতে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করেছে। রিপোর্ট জানিয়েছে, “নরেগার গুরুত্ব ও ভূমিকা অতিমারীর সময়ে খুব ভালোভাবেই সামনে আসে। গভীর দু:সময়ে এই প্রকল্পটি আশার আলো হয়ে ওঠে। এই প্রকল্পের গুরুত্ব বুঝেই তারপর ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ এর সংশোধিত বাজেটে বা রিভাইসড এস্টিমেটে এই খাতে তহবিল অনেক বৃদ্ধি করা হয় — ৬১,৫০০ কোটি থেকে ১,১১,৫০০ কোটি টাকায়, আর ৭৩,০০০ কোটি থেকে ৯৯,১১৭.৫৩ কোটি টাকা যাতে অতিমারীর সময়ে বর্ধিত চাহিদাকে সামাল দেওয়া যায়।
সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি জানিয়েছে, “নরেগার তহবিলকে সংকুচিত করার যুক্তি কমিটির কাছে বোধগম্য নয়। যেহেতু এই প্রকল্পের যথোপযুক্ত রূপায়ণ খুবই জরুরি, তাই কমিটি জোরালোভাবেই মনে করে, যেভাবে এই খাতে বাজেটবরাদ্দ হ্রাস করা হল, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক আবার নতুন করে পুনর্বিবেচনা করে দেখুক”।
সংসদীয় কমিটি মজুরির হার বাড়ানোর জন্যও জোরালো সওয়াল করেছে। সারা দেশের জন্য সমহারে এই মজুরি চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি, কর্মদিবস বাড়ানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে পশ্চিমবাংলার জন্যবরাদ্দ ২০২৩-২৪এর অর্থবর্ষের তহবিল বন্ধ রাখা হচ্ছে। উক্ত প্রকল্পের ২৭ নং ধারা বলে এই সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। নীচুতলায় এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, এই অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম ২০২১’র ডিসেম্বরে ওই আইনের ধারায় সমস্ত বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়।
এখনো পর্যন্ত পশ্চিমবাংলা কেন্দ্রের কাছ থেকে পায় ৭,৫০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে বকেয়া মজুরির পরিমাণই হল ২,৭৪৪ কোটি টাকা। যে সমস্ত মজুররা এই প্রকল্পের অধীনে কাজ করেছিলেন তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য মজুরি আজ পর্যন্ত পেলেন না।
পশ্চিমবাংলা হল দেশের একমাত্র রাজ্য যেখানে ওই ধারা প্রয়োগ করে সমস্ত তহবিল আটকে রাখা হয়েছে।
তথ্য সূত্র : দ্য হিন্দু, মার্চ ২০, ২০২৩
আরও একটা কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়ে গেল। আদানির সাথে ভারত সরকারের গভীর আঁতাতের আরও একটি তথ্য প্রকাশ করল স্ক্রোল ডট ইন, দ্য ওয়্যার, বিজনেস টুডে সহ বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম।
ভারত সরকারের তরফ থেকে কয়লা নিলাম কান্ডে আদানির হাতে তুলে দেওয়া হলো চার চারটে কয়লা ব্লক, একেবারে জলের দরে! এর মধ্যে মহারাষ্ট্রের উত্তর পশ্চিম মাধেরিতে কয়লা ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়ায় মাত্র একজন “প্রতিযোগী” ছিল — ক্যাভিল মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেড। আর তাকে শিখন্ডি হিসাবে সামনে রেখে আদানি পকেটে পুরে নিল পশ্চিম মাধেরির কয়লা খনি, একেবারে জলের দরে।
কে এই ক্যাভিল মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেড?
এরা হল এডিকর্প এন্টারপ্রাইজের প্রধান প্রোমোটার, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট দেখিয়েছে, এই ছোট্ট ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থাটিকে আদানি ব্যবহার করত নিজের সংস্থাগুলোতে মূলধন পাচার করার কাজে।
বিভিন্ন নথি থেকে দেখা গেছে, এই ক্যাভিল মাইনিং আর এডিকর্প-এর ঠিকানা একই, আমেদাবাদে। আর, উভয়ের প্রোমোটার একজনই — যার নাম উৎকর্ষ শাহ। এই ব্যক্তি হলেন গৌতম আদানির বিশেষ বন্ধু। দীর্ঘদিন এদের বন্ধুত্ব ছিল গলায় গলায়।
ক্যাভিল মাইনিং খুবই এক আনকোরা গোছের সংস্থা, যার নেই কয়লা খনি সংক্রান্ত ছিঁটে ফোটা অভিজ্ঞতা। এই সংস্থাটি আদানি-র এমএইচ ন্যাচারাল রিসোর্স প্রাইভেট লিমিটেডএর সাথে মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুরের ২০০ মিলিয়ন কয়লা ব্লকের জন্য নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়!!
ক্যাভিল মাইনিংকে আসরে নামানো হয় এই কারণে, যাতে উত্তর পশ্চিম মাধেরির কয়লা ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়াটি ভেস্তে না যায়। নিয়ম হল, নিলাম প্রক্রিয়ায় একমাত্র আদানি থাকলে সেই প্রক্রিয়াটি বাতিল করা হোত। কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রকের নিয়মানুযায়ী, একদম প্রথম দিকে অন্তত পক্ষে যদি দু’টো সংস্থা নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়, তবেই বাণিজ্যিক কয়লা ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।
এ নিয়ে অতীতে কয়লা ব্লক নিলামের প্রক্রিয়াটি যে ভাবে হয়, তাতে ক্যাগ (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটার জেনারেল) রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, “নিলামে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে প্রতিযোগিতার রাস্তাকে এড়াতে।” ২০১৫ তে প্রথম দু’টো কয়লা ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়ার অডিট রিপোর্টে ক্যাগ জানায়, নিজেদেরই একাধিক সাবসিয়াডিরিকে নিলামে সামিল করিয়ে প্রতিযোগিতার রাস্তা বন্ধ করার পাশাপাশি বিক্রয় মূল্যকে অনেক নীচে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এর ফলে বিরাট অপচয় ও লোকসান হচ্ছে জাতীয় সম্পদের। পরবর্তীতে, কয়লা মন্ত্রক নিলামের নিয়ম কানুনের ফাঁক ফোকরগুলোকে বন্ধ করতে সাবসিডিয়ারি ও জয়েন্ট ভেঞ্চারগুলোকে অখন্ড অংশগ্রহণকারী হিসাবে গণ্য করতে শুরু করে।
কিন্তু, ২০২১ এর পর থেকে কয়লা মন্ত্রক মনে করতে শুরু করল যে কয়লার নিলাম প্রক্রিয়ায় তেমন খরিদ্দার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অনেক কয়লা খনির নিলাম প্রক্রিয়ায় একটাও নাকি খরিদ্দার পাওয়া যায়নি। এর পর কয়লা মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নেয়, তিনটের বদলে দু’টো সংস্থা নিলাম প্রক্রিয়ায় অংশ নিলে তা শুরু করা যাবে। যদিও বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট ভিন্ন সুপারিশ করে। বিশেষজ্ঞ কমিটি জানায়, প্রথম পর্বে তিনের কম যোগ্য অংশগ্রহণকারী থাকলে গোটা নিলাম প্রক্রিয়াকেই বাতিল করতে হবে।
দেখা গেল, কয়লা ব্লক নিলামের প্রক্রিয়ায় তেমন সাড়া না পাওয়া গেলেও ২০২২-এর নভেম্বরে কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক ১৪১টা কয়লা খনি নিলামের সিদ্ধান্ত নিল — যা ছিল এ যাবতকালে বৃহত্তম বাণিজ্যিক কয়লা ব্লক নিলামের ঘটনা।
কিন্তু দেখা গেল, ৩৬টি কয়লা ব্লকের জন্য মাত্র ৯৬টি সংস্থা নিলামে অংশ নিয়ে দর হাঁকল, অর্থাৎ একটা খনি পিছু তিনজন নিলামদার। ৯ মার্চযখন গোটা নিলাম প্রক্রিয়া শেষ হল তখন দেখা গেল মাত্র ২৯টি খনির সফলভাবে নিলাম হয়েছে। একসাথে অনেকগুলো কয়লা খনি একসঙ্গে নিলামে তুলে দেওয়ার এই যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, এর ফলে প্রতিযোগিতা মার খায়।
ক্যাভিল মাইনিং যে আদানি-র এক ছায়া সংস্থা তার অনেক প্রমাণ মিলেছে। কেন্দ্রীয় কর্পোরেট মন্ত্রকের কাছে যে নথি রয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ২৪ এপ্রিল, ২০২২-এ এই সংস্থাটি আমেদাবাদে নথিভুক্ত হয়। এই সংস্থার ৮০ শতাংশ মূলধন এসেছে উৎকর্ষ শাহ-র কাছ থেকে, যা তাঁকে ওই সংস্থার নিয়ন্ত্রক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই উৎকর্ষ শাহ এডিকর্প-এর ৮০ শতাংশ শেয়ার নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি মারা যাবার আগে পর্যন্ত এডি-হেরিটেজ গ্রুপের কর্ণধার ছিলেন। আর, এই সংস্থার ওয়েবসাইটে বলাই আছে যে “এটি বিশ্বাসযোগ্য এক রিয়াল এস্টেট ডেভেলপর”। পিতার মৃত্যুর পর তার পুত্র আদর্শ শাহ এডিকর্প ও ক্যাভিল-এর কর্ণধার হন। এডিকর্প ও ক্যাভিল একই পরিবারের দু’টি সংস্থা। ইকনমিক টাইমস্-কে দেওয়া ২০১৩’র এক সাক্ষাৎকারে গৌতম আদানি উৎকর্ষ শাহ-কে “বিগত ৩০ বছরের বন্ধু” হিসাবে বর্ণনা করেন।
যতদিন যাচ্ছে, ততই নতুন নতুন কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে আসছে। মোদী সরকারের সাথে আদানি-র যোগসাজশের নানা তথ্য দেখিয়ে দেয় সমস্ত দিক থেকে এই শিল্প গোষ্ঠীকে সরকার সমস্ত দিক দিয়ে মদত দিয়েছিল।
- অতনু চক্রবর্তী
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আদানির বিভিন্ন সংস্থায় শেয়ার মূল্য হুহু করে নিচের দিকে নামলেও রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা এলআইসি-র কিন্তু তাতে কোনো হেলদোল নেই। এই মার্চ ত্রৈমাসিকে এলআইসি আদানি-র সংস্থায় ৩৫৭,৫০০ শেয়ার কিনেছে! মজার ব্যাপার এটাই যে নিফটি পর্যন্ত আদানি কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্য এই ত্রৈমাসিকে কমিয়েছে প্রায় অর্ধেক। আর, ওই পরিমাণ শেয়ার কেনার পর এলআইসি-র শেয়ার যা ডিসেম্বরে ছিল ৪.২৩ শতাংশ, তা মার্চের শেষে বেড়ে দাঁড়াল ৪.২৬ শতাংশে।
মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারীরা, যারা এই শেয়ার বাজারের উপর সবসময়ে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলে, তারা কিন্তু আদানির সংস্থাগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ায়নি। বরং আদানির সংস্থায় মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩১ থেকে কমে ২৭-এ নেমে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কোন বাধ্যতায়, কার নির্দেশে এলআইসি এই বিনিয়োগ করল? সংশ্লিষ্ট মহল এব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছে।
( সূত্র : ইকনমিক টাইমস্ –১১ এপ্রিল, ২০২৩)
চেন্নাইয়ের এন্নোর বন্দরের কাছে সমুদ্র উপকুলে আদানি কোম্পানি বেআইনিভাবে ভোজ্য তেলের ট্যাঙ্ক গুদাম বানিয়েছিল। আদানিদের এই বেআইনি ও উপকূলের পরিবেশ ধ্বংসকারী ব্যবসার বিরুদ্ধে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের মাঝে কর্মরত একটি সংস্থা জাতীয় সবুজ আদালতে মামলা করে। ২০২০ সালে জাতীয় সবুজ আদালত আদানির এই কাঠামো নির্মাণকে সম্পূর্ণ বেআইনি বলে রায় দেয়, কোম্পানিকে কাঠামো সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেয় এবং ২৫ লক্ষ টাকা জরিমানা জমা দিতে বলে।
এখানে গায়ের জোরে ট্যাঙ্কগুদাম বানিয়েছে ওরা। দেশের আইনের তোয়াক্কা না করে। ‘উপকুল নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল নির্দেশিকা ২০১১’ অনুযায়ি সমুদ্র উপকুলে এরকম নির্মাণ নিষিদ্ধ। কিন্তু আদানিরা দেশের আইন মানে না। এমনকি, কোনও রকম অনুমতি নেওয়ারও দরকার বোধ করে না। কোনওরকম সরকারি অনুমতি ছাড়াই ট্যাঙ্ক ও পাপলাইন বানাতে শুরু করে দেয়। ২০১৫ সালে। কেন্দ্রে তখন নরেন্দ্র মোদির সরকার এসেছে। মোদি সরকার বিভিন্নভাবে অবৈধ সুবিধা দেয় আদানি গোষ্ঠিকে। ২০১৯ সালে মোদি সরকার এমনকি ‘উপকূল নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল’ নির্দেশিকা বদলে দিয়ে আদানির এই হিউজ ট্যাঙ্কগুলিকে ‘বৈধ’ অনুমতি দেয়। কিন্তু জাতীয় সবুজ আদালত একে সম্পূর্ণ বেআইনি বলে।
জাতীয় সবুজ আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে আদানি কোম্পানি সুপ্রিম কোর্টে দরবার করে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সুপ্রিম কোর্ট সবুজ আদালতের রায়কেই বহাল রেখে আদানিদের ট্যাঙ্ক গুদাম ভেঙে সরিয়ে দেওয়ার আদেশ দিয়েছে। এই রায়ের দশ দিন আগে ২৪ জানুয়ারি হিনডেনবার্গ রিসার্চ প্রকাশিত হয় যা আদানি কোম্পানির সমস্ত রকম ব্যবসার নেটওয়ার্কে চলা জালিয়াতি, প্রতারণা ও আর্থিক তছরুপকেও সামনে এনেছে। মোদি ও আদানি দোসর। কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বসে মোদি দেশের স্বার্থ বেচে দিচ্ছে। মোদির পৃষ্ঠপোষকতায় আদানিরা অবাধে লুটপাট চালাচ্ছে। দেশের খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা বেড়েই চলেছে।
গত ৩১ মার্চ, মাদ্রাজ আইআইটি-র রিসার্চ স্কলার শচীন কুমার আত্মহত্যা করেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়ে মাদ্রাজ আইআইটি-তে শচীন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করছিল। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার আগে শচীন হোয়াটসঅ্যাপ স্টোরিতে লিখেছিল – “নট গুড এনাফ, আই অ্যাম সরি”।
সম্প্রতি রাজ্য সভায় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে আইআইটি-তে ৩৩ জন পড়ুয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ভারতের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্রদের আত্মহত্যার হার অবিরত বেড়ে চলেছে। রেকর্ড অনুযায়ী, আইআইটি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (এনআইটি) এবং দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম)-এ ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ৬১ জন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের রিপোর্টে সরকারকে জানানো হয়, ২০১৪-২০২১ সালের মধ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১২২ জন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। যাদের মধ্যে ২৪ জন তফশিলি জাতি (এসসি)’র, ৩ জন তপশিলি উপজাতি (এসটি)’র এবং ৪১ জন অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (ওবিসি)’র অন্তর্গত।
গত ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখ, বম্বে আইআইটি’র আটতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে, প্রথম বর্ষের দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্র দর্শন সোলাঙ্কি৷ দর্শনের বাবা পেশায় মুচি এবং মা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। অভাবের সংসার থেকে আসা এই আঠারো বছর বয়সী ছেলেটিই তার বংশে প্রথম উচ্চশিক্ষার দিকে এগোতে পেরেছিল। দুঃখজনক বিষয়, এত বড় নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই তাকে জাতিবৈষম্যের শিকার হতে হয়। তাকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হত যে, সে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি থেকে এসে উঁচুজাতের পাতে ভাগ বসিয়েছে। তিন মাস ধরে সহপাঠী, শিক্ষক ও অন্যান্যরা তাকে নানা জায়গায়, নানা উপায় বিচ্ছিন্ন করেছে।
সাধারণত নিয়মানুযায়ী ভারতবর্ষের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০% আসন তফশিলি জাতি(এসসি)’র জন্য সংরক্ষিত থাকে। স্বাধীনতা- পরবর্তী সময় থেকে এ’দেশে সংরক্ষণের নীতি প্রণয়ন হয়। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানা হয় না। প্রাচীন সময় থেকে অনগ্রসর শ্রেণি শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই প্রগতিশীল সমাজে তাদের আরও বেশি করে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসার জন্যই সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। অপরদিকে, সাধারণ শ্রেণির বেশিরভাগ জনগণ মনে করে, সংরক্ষণ ব্যবস্থার ফলে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তবে এই ক্ষোভ ভিত্তিহীন এবং কিছুক্ষেত্রে এই বিভাজনের মনোভাব শাসকশ্রেণির কাছে টোপের মতো। যুগ যুগ ধরে উঁচু শ্রেণির ব্রাহ্মণদের কাছে একমাত্র শিক্ষার সুযোগ ছিল। সমতা ফেরাতে সংরক্ষণ আবশ্যক বৈকি!
২০১৫-২০১৯ সালের মধ্যে ১১টি আইআইটি’র ২৬টি বিভাগ থেকে একজনও তপশিলি উপজাতির ছাত্র গবেষণার সুযোগ পায়নি। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা- দলিত পড়ুয়াদের সাথে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমবেশি বৈষম্যমূলক বিভিন্ন আচরণ করা হয়ে থাকে। সংরক্ষণের জন্য অনগ্রসরদের রোজদিন বিদ্রুপ করা হয়। এদের কখনও ইচ্ছাকৃত পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া হয়, ভয় দেখানো হয়, একাকীত্ব আর হীনমন্যতায় ভুগতে বাধ্য করা হয়।
২০১৪ সালে আইআইটি বোম্বের গবেষণারত ছাত্র অনিকেত অম্ভোরে আত্মহত্যা করে। পরিবারের তরফে অভিযোগ জানানো হয়, ক্যাম্পাসের ভেতর অনিকেতকে তীব্র অপমান ও লাঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে। ২০১৬ সালে হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটির আরেকজন দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলা মৃত্যুর আগে নিজের সুইসাইড নোটে লিখে রেখে যায়, “আমার জন্ম কেবল একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা।” রোহিতের মৃত্যুর পর জাতীয় স্তরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে৷ দিকে দিকে প্রতিবাদ সংগঠিত হতে থাকে। ২০১৯ সালে মাদ্রাজ আইআইটি-তে ইন্টিগ্রেটেড মাস্টার্স কোর্স করতে এসে আত্মহত্যা করে ফাতিমা লতিফ। ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে ইন্টারনাল পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া হয়। ২০১৯ সালেই, ডাক্তারি পড়ুয়া পায়েল তাদভির জাতিবৈষম্যমূলক আচরণের কারণে আত্মহত্যা করে। সহপাঠীরা তার সঙ্গে অত্যন্ত অবমাননাকর আচরণ করত। কর্তৃপক্ষকে জানানো সত্ত্বেও কোনও পদক্ষেপ তারা নেয়নি। এমনকি, আজও রোহিত, অনিকেত, ফাতিমা, পায়েলের হত্যার কোনও সঠিক তদন্ত হয়নি। সুবিচার পায়নি এদের পরিবার। পায়েল, রোহিত এরা সকলেই ছিল দর্শনের মতো বংশের প্রথম উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থী। সীমিত অর্থ ব্যয় করে অভাবের ঘরে বেড়ে ওঠা ছাত্ররা এত বৈষম্য, কটুকথা, দুর্ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে! এদের প্রত্যেকের জীবনের সমস্ত স্বপ্ন কেড়ে নিল তার শ্রেণি। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে বলুন! দলিত কবি নামদেও ধাসাল লিখেছিলেন – “রাত্রির দু’হাতের ভেতর আমার জন্মের মুহূর্ত!” এই কবিতা পড়ে মনে হয় কবি এখানে যেন প্রতিটা দলিত ছাত্রের কথা বলেন, তাঁদের জন্মের প্রতি যে ক্ষোভ, যে আক্ষেপ এই সমাজে দৈনন্দিনের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে তৈরী হয়, তার কথা বলেন!
২০২১ সালে শিক্ষামন্ত্রীর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০১৬-২০২১ সাল পর্যন্ত, প্রথম সারির সাতটি আইআইটি’তে স্নাতক স্তরে ড্রপ আউট হয়েছে সংরক্ষণের আওতাভুক্ত ৬৩% পড়ুয়া। স্কলারশিপের টাকা অনিয়মিত হওয়ার দরুন আর্থিক অনটনের কারণে বহু দলিত, আদিবাসী, মুসলিম ছাত্র পড়াশোনায় ইতি টেনেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও কেন পড়ুয়ারা দেশের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে? কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এর কোনও সদুত্তর নেই। উপরন্তু তারা এহেন বিষয় নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। ভারতের তেরঙ্গা পতাকার গায়ে মিথ্যে রাংতা জড়িয়ে, তার সাথে স্রেফ একটা ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’-এর কনসেপ্ট জুড়ে দিতে পারলেই হল!
শচীন কুমার বা দর্শন সোলাঙ্কির ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাদের মৃত্যুর কারণ – গলায় দড়ি দেওয়া, ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়া, নাকি নিয়মিত মানসিক নির্যাতন, সামাজিক চাপ?- এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আশা করি আমাদের কারোর কোনও দ্বিধা থাকবে না। আমরা সবাই জানি, কোনদিকে পাল্লা ভারী! ছাত্ররা আত্মহত্যা করবে আর উদাসীন-অসংবেদনশীল কর্তৃপক্ষ কেবল তাদের জন্য শোকসভার আয়োজন করবে – এমনটা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর ছাত্র সংগঠন আইসা দীর্ঘদিন ধরে সমস্ত ক্যাম্পাসে রোহিত অ্যাক্ট ও এসসি-এসটি সেল চালু করার দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষকে একজোট হয়ে লড়তে হবে। রোহিতের জন্য, ফতিমার জন্য, পায়েলের জন্য, দর্শনের জন্য, শচীনের জন্য, প্রতিটা অন্যায়ের জন্য রাস্তায় নামতে হবে।
২০২০ সালে, লকডাউনের মরশুমে নয়া শিক্ষানীতির খসড়া পেশ করল কেন্দ্রীয় সরকার। গোটা দেশ জুড়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। শিক্ষক, অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ - সকলেই এই শিক্ষানীতিকে বিভাজনের নীতি ব’লে দাগিয়ে দিল। আজ যখন সেই শিক্ষানীতি লাগু হতে যাচ্ছে, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে, এই নয়া শিক্ষানীতিতে ‘সংরক্ষণ’ নিয়ে একটি বাক্যও লেখা নেই৷ অতএব, সংরক্ষণ আগামীদিনে কেবল সংবিধানের বিষয়বস্তু হয়ে থেকে যাবে। নিশ্চুপে নিভৃতে এই অনাচার এখনও মেনে নিলে মোদী-শাহর হিটলারি শাসনে সুদিন আনবে কারা? সাম্যের গান গাইবে কারা? আজ যখন একলব্যের শুধু আঙুল নয়, গোটা শরীরটাকেই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে ফেলা হচ্ছে, তখন একবার ভেবে দেখুন, আপনি নিজে গেরুয়াবাহিনীর ফ্যাসিস্ট শাসনে কতখানি নিরাপদ, আপনার ভবিষ্যৎ কতখানি সুনিশ্চিত?
- ত্রিয়াশা লাহিড়ী
“হিন্দুরাজ কায়েম হলে তা নিঃসন্দেহেই দেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হবে। স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতির পক্ষে তা বিপজ্জনক। গণতন্ত্রের সাথে বেমানান। যে কোনও মূল্যে হিন্দুরাজকে প্রতিহত করতে হবে।”
১৯৪৬ সালে ‘পাকিস্তান অর পার্টিসন অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে এই জরুরি সতর্কবার্তাটি ঘোষণা করেছিলেন বাবাসাহেব ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকর। তাঁর জন্ম ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল, প্রয়াত হয়েছেন ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচয়িতা হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। মহারাষ্ট্রের ‘অচ্ছুৎ’ পরিবারে জন্ম নিয়ে আমৃত্যু ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করেছেন। বুদ্ধ-কবীর-ফুলে ত্রয়ীকে নিজের শিক্ষক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি ছিলেন সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, আইন ও রাজনীতির শ্রেষ্ঠ ও অগ্রণী তাত্ত্বিক ও গণ আন্দোলনের নেতা, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত নির্মাণের আলোকবর্তিকা। যত দিন পেরিয়েছে ততই আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে তাঁর জীবন ও শিক্ষা। আমরা তাঁকে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই।
বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা থেকে নির্বাচিত হয়ে সংবিধানসভায় গেছিলেন। সংবিধানসভায় তিনি যাতে কোনওভাবেই যেতে না পারেন তার জন্য ক্ষমতাশীলরা অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। সেই সময়, বাংলার হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের নমশুদ্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের উদ্যোগে তিনি বাংলা থেকে নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনিই সংবিধান রচনায় নেতৃত্ব দেন। সংবিধান রচনায় সমাজের প্রান্ত থেকে উঠে আসা আরেক সোচ্চার প্রতিনিধি জয়পাল সিং মুণ্ডার নাম এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি আমরা।
বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর অনেকটা মিশরের গ্রেট পিরামিডের মতো। ভারতের সমাজ ও রাজনীতির সুগভীর বাস্তব সত্যগুলি বুকে ধারণ করে সকলের চোখের সামনে সবার ঊর্ধ্বে সমুজ্জ্বল খাড়া হয়ে আছেন অথচ তাঁকে যেন কেউ দেখতেই পাচ্ছিল না। যাদের বিরুদ্ধে, যে সমাজের বিরুদ্ধে, লড়তে লড়তে অনির্বান দীপশিখা হয়ে উঠেছেন তিনি, সেই হিন্দুত্ববাদীরা তাঁকে দুমড়ে মুচড়ে বিকৃত করে আত্মসাৎ করতে চেয়েছে। আরএসএস-বিজেপি তাঁকে এমনকি “আধুনিক মনু” বলে তুলে ধরেছে। বাস্তবে, মাহাড় সত্যাগ্রহ চালানোর সময় ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মনুস্মৃতি পোড়ানোর কর্মসূচি সংগঠিত করেছিলেন আম্বেদকর। এখনও এই মনুস্মৃতি দহন দিবস পালিত হয়। তিনি বলেছিলেন,
“মনুস্মৃতি দহন সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করা হয়েছিল। আমরা তা করেছিলাম কারণ আমরা ওটাকে অন্যায় অবিচারের প্রতীক বলে মনে করি যার অধীনে আমরা শত শত বছর ধরে নিপীড়িত হয়ে আসছি।”
তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “কাস্ট ইজ অ্যান্টিন্যাশনাল” কারণ তা এক জাতের সাথে অন্য জাতের হিংসা, দ্বেষ ও বৈরিতা তৈরি করে সমাজকে ভেতর থেকে টুকরো করে দেয়। তাঁর মতে, “হিন্দুনেশন” তাই এক অবাস্তব ধারণা।
জাতের বিনাশ তাঁর কাছে ভারতের ব্যাপক দলিত সাধারণ ও নারী সমাজের মুক্তির প্রাথমিক অপরিহার্য শর্ত। তাঁর অজস্র লেখায় হিন্দুত্ব/হিন্দুইজমকে তিনি আক্রমণ করেছেন মূলত নারীবাদী অবস্থান থেকে। একদিকে তিনি দেখাচ্ছেন, জাতব্যবস্থা নিছক শ্রমবিভাজন নয়, তা শ্রমিকেরও বিভাজন। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজের নির্দিষ্ট বাস্তবতায় শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্য অর্জন করতে হলে জাতব্যবস্থার মাধ্যমে চলা নিপীড়ণ ও বৈষম্যকে সবার আগে উপলব্ধি করতে হবে। এই অনুভবের মাধ্যমেই শ্রমিক শ্রেণী গতিময় সামাজিক সমাবেশ ঘটিয়ে জাতের বেড়াজাল ছিঁড়ে ফেলতে পারে। অন্যদিকে তিনি দেখছেন, নারীকে পরাধীন না রেখে, নারীর যৌন স্বায়ত্ততাকে হিংস্রভাবে দমন না করে এবং সেই দমনের মতাদর্শ সমাজে চালু না রেখে জাতব্যবস্থা গড়ে তোলা ও টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাই জাতের বিনাশের আরেক শর্ত হল নারীর নির্ভয় স্বাধীনতা।
বিবাহ ব্যবস্থাকে নারীর জন্য এক বন্ধনস্বরূপ হিসেবে বুঝতে ও বলতে তাঁর বাধেনি। সেই সময় দাঁড়িয়ে গর্ভনিরোধক চালু করার কথা বলেছেন, মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটিকে মান্যতা দিতে তীব্র ধৈর্যশীল তর্ক চালিয়েছেন, ভালোবাসার সম্মতির বয়সের প্রশ্নে মেয়েদের অধিকারের স্বপক্ষে লড়েছেন। হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার আইনসিদ্ধ করার জন্য তিনি ‘হিন্দুকোড বিল’ প্রণয়ন করতে চাইলে সংসদের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন। এবং শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। আম্বেদকর বড় বড় সমাবেশ করেছেন শুধু মহিলাদের নিয়ে যা ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসে অনন্য। এরকম এক সমাবেশে আম্বেদকর বলেছিলেন,
“আপনাদের সামনে বলার সুযোগ পাওয়ায় আমি খুশি। দলিত বর্গের অগ্রগতিতে আগ্রহী ব্যক্তির কাছে মহিলাদের এমন একটি সমাবেশ প্রত্যক্ষ করার থেকে সুখকর আর কিছু হতে পারেনা। আপনারা যে এমন বৃহৎ সংখ্যায় সমবেত হয়েছেন — প্রায় বিশ পঁচিশ হাজার — তা দশ বছর আগে ভাবা অসম্ভব ছিল। আমি নারী সংগঠনে গভীর আস্থাশীল। তাঁরা চাইলে সমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে যে কত কিছু করতে পারেন তা আমি জানি... যখন থেকে আমি দলিত বর্গের মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছি তখন থেকেই পুরুষের সাথে নারীদেরকে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। সেই কারণেই আমাদের সম্মেলনগুলিকে সর্বদাই মিশ্র সম্মেলন হিসেবে দেখতে পাবেন।... কোন সমাজে মেয়েদের কতটা অগ্রগতি ঘটেছে তা দিয়ে আমি সেই সমাজের অগ্রগতি পরিমাপ করি।... আপনার সন্তানদের পড়াশুনা করান।... তাদের মনে এই বিশ্বাস জাগান যে জীবনে মহৎ কার্যকরাই তাদের ভবিতব্য। তাদের মন থেকে সমস্ত হীনমন্যতা উপড়ে ফেলুন। বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না, বিয়ে একটি দায়।... সর্বোপরি প্রত্যেকটি বিবাহিত মেয়েকে তাঁর স্বামীর সামনে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে স্বামীর বন্ধু ও সমকক্ষ হিসেবে দাবি করতে এবং দাসী হতে অস্বীকার করতে সহযোগিতা করুন।”
স্ত্রী, ভ্রাতা, ভ্রাতৃবধুসহ পারিবারিক গ্রুপ ফটো। ‘পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল’ -নিছক ভাষণে নয়, যাপনেও। এমনকি বাড়ির পোষা কুকুরের বসার জায়গা থেকেও পরিবারে সম্পর্কের কাঠামোতে তাঁর অবস্থান বোঝা যায়।
“সমাজতন্ত্রীরা যদি সমাজতন্ত্রকে একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবে পরিণত করতে চান, তবে তাঁদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে সমাজ সংস্কারের সমস্যাটি মৌলিক এবং একে এড়িয়ে গিয়ে পরিত্রাণ পাবেন না”
‘জাতের বিনাশ’ নিবন্ধে ওপরের কথাগুলি বলেছিলেন আম্বেদকর। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একশ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার অভিজ্ঞতার পর বর্তমান ফ্যাসিবাদী বাস্তবতায় এই কথাগুলির মূল্য আমরা আরও বেশি অনুভব করতে পারছি। মতাদর্শগত স্তরে আম্বেদকর তাঁর সমগ্র লেখাপত্রে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার সাথে নিরন্তর কথোপকথনে ছিলেন। কার্ল মার্ক্স তাঁর ১৮৫৩ সালের ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধে জাতবর্ণ ব্যবস্থাকে “ভারতের অগ্রগতি ও ক্ষমতায়নের সবচেয়ে নির্ধারক প্রতিবন্ধক” হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। অন্যদিকে, আম্বেদকর কখনই এই ধারণাকে খারিজ করেননি যে ‘জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’। শ্রেণীকে সামাজিক ধর্মীয় দিকগুলি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ‘অর্থনৈতিক’ ক্যাটেগরি হিসাবে দেখার সংকীর্ণ ধারণাকে খারিজ করেছিলেন তিনি। জাতকে তিনি শ্রেণী হিসেবে বিবেচনা করে “জাত হল এক আবদ্ধ শ্রেণী” বলে বর্ণনা করেছেন।
১৯৩৬ সালে আম্বেদকরের প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিপেণ্ডেন্ট লেবার পার্টি’(আইএলপি)-র ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী ও পুঁজিবাদী সামাজিক কাঠামোকে আমূল বদলে দেওয়া’। বিপুল ভোটে জিতে ১৪ জন বিধায়কসহ বম্বে প্রদেশের বিধানসভায় ঢুকে আম্বেদকর প্রথমেই কোঙ্কন অঞ্চলে জমিদারী প্রথা বিলোপ করার আইন প্রস্তাব করেন। কোঙ্কন অঞ্চল থেকে বিশাল সংখ্যক কৃষককে সমাবেশিত করা হয় বম্বেতে। ২০,০০০-এর ওপর কৃষকের বম্বে শহর অভিমুখে এই যাত্রাকে অনেকেই স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় কৃষক সমাবেশ বলে বর্ণনা করেছেন। শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নিতে বিধানসভায় ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপ্যুট বিল’ আনা হলে তার বিরুদ্ধে কম্যুনিস্টদের সাথে মিলে বম্বের বস্ত্রশিল্পে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত করে আইএলপি।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে উন্মোচিত করে গেছেন তিনি স্বাধীনতাকালের উচ্ছ্বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে, যা আজকের বাস্তবতায় সহজ সত্য বলে প্রতিভাত হয়। সংবিধানসভার উপদেষ্টা কমিটির কাছে মৌলিক অধিকার প্রশ্নে এক স্মারকলিপিতে আম্বেদকর বলেন,
“দুর্ভাগ্যজনক যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এমন একটা নতুন মতবাদের জন্ম দিয়েছে যাকে বলা চলে, সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী সংখ্যালঘুর ওপর শাসন চালানোর ‘সংখ্যাগুরুর স্বর্গীয় অধীকার’। সংখ্যালঘুরা একটু ক্ষমতার ভাগ চাইলেই তা হয়ে যায় সাম্প্রদায়িকতা, আর সংখ্যাগুরুর হাতে সমস্তরকম ক্ষমতা একচেটিয়া করাকে বলা হয় জাতীয়তাবাদ।”
আম্বেদকরের কাছে গণতন্ত্রের অর্থ, “জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন”। গণতন্ত্র বলতে নিছক রাজনৈতিক গণতন্ত্র নয়, সামাজিক গণতন্ত্রের কথা বলেন তিনি, যার ভিত্তি হবে স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতি — এই তিনটি দিক পরস্পর অবিচ্ছেদ্য এবং একটির ব্যত্যয় হলে অন্যগুলিও ভেঙ্গে পড়ে।
“সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র কখনই সফল হতে পারে না। ... সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে সমতার চাহিদাকে আর কতদিন অস্বীকার করে চলব আমরা? এই সমতাকে অস্বীকার করে চলা মানে শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া।”
আম্বেদকর আমাদের যে বিপর্যয় সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন আজ তা ভয়ঙ্কর চেহারায় দেশের সামনে প্রকট। গণতন্ত্র ও সংবিধান বিপন্ন। দলিত, মহিলা, আদিবাসী, পিছড়ে বর্গ ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য যা যা অর্জনের স্বপ্ন আম্বেদকর-গুরুচাঁদ-জয়পাল-ভগৎ সিংহরা দিয়ে গেছিলেন তা আজ প্রতিদিন ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে মোদি-শাহর শাসন। দেশজুড়ে তাই আওয়াজ উঠেছে, ‘সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’। আমরা সর্বশক্তি দিয়ে এই লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাব। আম্বেদকর জয়ন্তীতে এই আমাদের অঙ্গীকার।
(হালিসহর সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রকাশিত প্রচারপত্র থেকে নেওয়া)
১৫ মার্চ দিনটিকে বিশ্বজুড়ে “ইসলামফোবিয়া প্রতিরোধ দিবস” হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়েছে ইউনাইটেড নেশনসের সাধরণ সভায়।
“ইসলামফোবিয়া হল মুসলমানদের প্রতি ভয়, সন্দেহ ও ঘৃণা যা বিভিন্ন রকম উসকানি, শত্রুতা ও অসহিষ্ণুতার দিকে চালিত করে। অনলাইন বা অফলাইনে মুসলমান বা না-মুসলমানদের বিরুদ্ধে বহুবিধ হুমকি, হেনস্থা, প্ররোচনা, ত্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক, মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তা কাঠামোবদ্ধ ও সাংস্কৃতিক রেসিজমে পরিণত হয়, মুসলমান পরিচয়ের সমস্ত চিহ্ন বা রূপকে তা আক্রমণের নিশানা বানায়।” ইসলামফোবিয়া অর্থাৎ ইসলামাতঙ্কের এই সংজ্ঞা দিয়েছে ইউনাইটেড নেশনস।
১৫ মার্চ দিনটিকে ইসলামাতঙ্ক প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গত বছর গৃহীত হয়েছিল। এবছর এই উপলক্ষে সাধারণ পরিষদের সভাকক্ষে আয়োজিত আলোচনায় এই প্রশ্নে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসে। মুসলমানদের ওপর ক্রমবর্ধমান দ্বেষ, ভেদ ও হিংসার পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন সকলে।
১৫ মার্চ জাতিসঙ্ঘের আলোচনাসভার সহযোগি সংগঠক রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তান। সভায় পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী বিলাওল ভুট্টো জারদারি বলেন, ইসলাম শান্তি, সহিষ্ণুতা ও বহুত্বের ধর্ম। ইসলামফোবিয়া নতুন বিষয় নয়, তবে বর্তমানে তা এক বিষাদময় পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ৯/১১ ট্র্যাজেডির পর থেকে দুনিয়াজুড়ে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস অতিমারির মাত্রা নিয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়গুলিকে হিংসাত্বক ও বিপজ্জনক এক ধর্ম-বিশ্বসাসের ছাপ্পা দিয়ে একটি ব্যাখ্যান চালু করা ও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সভার সভাপতি সাবা কোরোসি বলেন, ইসলামাতঙ্ক আসলে ‘জেনোফোবিয়া’ অর্থাৎ অপর বা অচেনার প্রতি ভীতি থেকে উদ্ভূত হয় এবং তা বিভিন্নরূপ বৈষম্যমূলক অনুশীলনে প্রকাশিত হয়। যেমন, চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা, ঘৃণাভাষণ, গালাগাল এবং অন্য জনগণকে নিশানা বানানো। তিনি আরও বলেন, “এই ইসলামফোবিয়া বা অনুরূপ যে কোনও পরিঘটনাকে চ্যালেঞ্জ জানানো, অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, ধর্মীয় বা বিশ্বাসগত বিভেদ বৈষম্যকে ধিক্কার জানানো আমাদের সকলেরই দায়িত্ব।”
ইউএন সেক্রেটরি-জেনেরাল আন্তোনিও গুটেরেস বলেন, বিশ্ব জুড়ে প্রায় ২০০ কোটি মুসলমান, এই গ্রহের সব প্রান্ত থেকে আসা — “মানবতার বিপুল বৈচিত্র্যকে প্রকাশ করে”। অথচ প্রায়শই তাঁরা বিদ্বেষ ও সন্দেহের শিকার হন শুধুমাত্র তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে। এবং মুসলিম মহিলারা “তিনগুণ বৈষম্যের শিকার” হন লিঙ্গগত, জাতিগত ও ধর্মবিশ্বাসগত — এই তিন কারণে। জনগণের দুর্বল অংশকে নিশানা বানানো স্বেতাঙ্গ প্রভুত্ববাদী নয়া-নাৎসি মতাদর্শ ও জাত-জাতীয়তাবাদের বাড়বাড়ন্তের কারণে ঘৃণা-বিদ্বেষ হুহু করে বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, “বৈষম্য আমদের সকলকেই খাটো করে দেয়। এবং আমাদের সকলেরই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দররকার। এই মতান্ধতা আমরা চুপচাপ মেনে নিতে পারি না। ইন্টারনেটে এই বিদ্বেষ তো দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। যে কোনও পরিসরেই ইসলামফোবিয়া তার কদর্য মাথা চাড়া দিলে আমাদের উচিৎ সরাসরি তার সাথে সংঘাতে যাওয়া”।
আজকের সময়টা ফেক নিউজের, আজকের সময়টা ভুল পথে চালিত করবার, আজকের সময়টা পোষ্ট ট্রুথের। কখন কোন খবরে যে একজন ব্যক্তি মানুষ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে যাবেন, তা কেউই জোর গলায় বলতে পারবেন না। এই মিথ্যেকে কোনওভাবে সংজ্ঞায়িত না করা গেলেও, সরকারের তরফে কোনও একটি সংস্থাকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় তা চিহ্নিত করার, তাকে কি সঠিক পদ্ধতি বলা উচিৎ? কিন্তু মোদীর ভারতবর্ষে সেটিই হয়। আজকের সামাজিক মাধ্যমের যুগে যখন একটি মিথ্যে খবরের উৎস সন্ধান করা একটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ, তখন এই ধরনের একটি সরকারী নির্দেশ আসলে মানুষের বাকস্বাধীনতাই হরণ করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিছুদিন আগে, গুজরাট গণহত্যার ওপর বানানো বিবিসির তথ্যচিত্রটি কেন্দ্রীয় সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। নিষিদ্ধ ঘোষণার অর্থ, কোনও জায়গায় এই তথ্যচিত্রের প্রদর্শন করা যাবে না, কোনও সামাজিক মাধ্যমে এটি পোষ্ট করা যাবে না, ইত্যাদি নানান বাধা নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল ঐ তথ্যচিত্রটির ওপর। কেন্দ্রীয় সরকারের মনে হয়েছিল, এই তথ্যচিত্রের মধ্যে দিয়ে, আজকের দেশের প্রধানমন্ত্রী, যিনি সেই ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর ভাবমূর্তির ক্ষতি হতে পারে। ঐ তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছিল, যে গোধরা পরবর্তীতে যে সারা গুজরাটে ৭২ ঘণ্টা ধরে নরমেধ যজ্ঞ বা বলা ভালো মুসলমান নিধন হয়েছিল, তা বন্ধ করতে তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী কোনও উদ্যোগই গ্রহণ করেননি, উল্টে পুলিশকে নিস্ক্রিয় রেখে ঐ গুজরাট গণহত্যা হতে দিয়েছেন। ঐ তথ্যচিত্রে আরও একটি বিষয় ছিল, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নরেন্দ্র মোদীর একটি সাক্ষাৎকার দেখানো হয়েছিল, যাতে তিনি সোজাসুজি বলেছিলেন, গুজরাটের গণহত্যা চলাকালীন তিনি সংবাদসংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি বলেই, তাঁর এতো বদনাম হয়েছিল। যা তিনি সেই সাক্ষাৎকারে উহ্য রেখেছিলেন, এবার তিনি সংবাদমাধ্যমে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন করতে চান, তাই এবার তিনি তাঁর সমালোচকদের কোনও সুযোগ দিতে রাজি নন। শুধু সংবাদমাধ্যমই নয়, তিনি চান সামাজিক মাধ্যমেও যাতে তাঁর বিরুদ্ধে কোনওরকম আওয়াজ না ওঠে।
গত জানুয়ারী মাসে, ২০২১ সালের ইনফর্মেশন এবং টেকনোলজি অ্যাক্টে একটি সংশোধনী আনা হয়, তখন বলা হয়, সরকারি সংস্থা প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোই ঠিক করবে, কোন খবরটি সঠিক এবং কোন খবরটি মিথ্যে। তখনই ঠিক করা হয়েছিল, যদি পিআইবি কোনও খবরের সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে, তাহলে, সরকার ফেসবুক বা টুইটার বা ইউটিউবের মতো কিছু সামাজিক মাধ্যমে সেই খবর বা তথ্য সম্প্রচার করা যাবে না। যেহেতু এই ধরনের সামাজিক মাধ্যমের কোনও দায় নেই, কোন খবর সঠিক বা কোন খবর সত্যি তা বিচার করার, তাই এক্ষেত্রে পিআইবির সিদ্ধান্তকেই তাঁদের শিরোধার্য বলে ধরতে হবে। যদি এই সরকারি সংস্থার আপত্তি সত্ত্বেও তাঁরা সেই খবর বা তথ্যকে তাঁদের মাধ্যম দিয়ে প্রচারিত হতে সাহায্য করেন, তাহলে তাঁদের এই দেশে ব্যবসা করতে দেওয়া হবে কি না, তা সরকার ভেবে দেখবে। মানে ঘুরিয়ে হুমকি দেওয়াই হল যে আমাদের দেশে কাজ করতে হলে আমাদের নিয়ম মেনেই চলতে হবে।
এই কথাটা শুনে অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, সত্যিই তো ফেসবুক, টুইটারের মতো বহুজাতিক সংস্থা কেন আমাদের দেশের আইন মানবে না? কিন্তু বিষয়টা কি শুধু আইন মানাবা না মানার প্রশ্ন? নরেন্দ্র মোদী সরকার যে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমাজকর্মীর ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছেন, তা তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। না হলে, সিদ্দিক কাপ্পান বা অন্যান্য বহু সাংবাদিককে কেন দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়, কেন উমর খালিদের মতো ছাত্র সংগঠককে ইউএপিএর মতো ধারা দিয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় দিনের পর দিন? কেন বিশ্বের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের একেবারে নীচের দিকে? সাম্প্রতিক সময়ে আবার নতুন করে আরও একটি সংশোধনী আনা হয়েছে, ঐ ২০২১ সালের ইনফর্মেশন এবং টেকনোলজি অ্যাক্টটিতে, যাতে বলা হয়েছে, সরকার একটি নিজস্ব সংস্থা গড়বে, যা দিয়ে তাঁরাই ঠিক করবে কোনটা ভুয়ো খবর, কোনটা প্ররোচনামূলক খবর বা কোনটা মানুষকে বিপথে চালনাকারী খবর। জানুয়ারি মাসে যে সংশোধনী আনা হয়েছিল, তার সঙ্গে সাম্প্রতিকতম সংশোধনীটির একটাই ফারাক, এক্ষেত্রে শুধু প্রেস ইনফর্মেশন বুরোর কথা বলা হয়নি, অন্যান্য সমস্ত কিছু আগের আইন মতোই হবে। সরকার, নিজেই পুলিশ, নিজেই আইনজীবী আবার নিজেই বিচারক। সরকার যদি মনে করে কোনও খবর মিথ্যে, তাহলে আগামীদিনে সেই খবর প্রচারের অভিযোগে কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে, নিজেই তাঁর বিচার করে, শাস্তির বিধানও সরকারই করবে। সংবাদপত্রের ভাষায়, সরকার নিজেই একজন একচ্ছত্র সম্পাদক, যাঁর অনুমতি ছাড়া কোনও খবরই ছাপা হবে না।
ভারতের বাকস্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় হচ্ছে জরুরি অবস্থা। যদি খেয়াল করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, এই নরেন্দ্র মোদী সরকার সেই কলঙ্কময় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমালোচক, কিন্তু তাঁরা যা আইন করে করছেন, তা তো অঘোষিত জরুরি অবস্থা। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে যে কোনও ভুয়ো খবর, আজকের দিনে অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে পারে, কিন্তু তা বন্ধ করার নামে সরকারের হাতে যদি এই ধরনের ক্ষমতা চলে আসে, তাহলে তা নিয়ে কি শঙ্কিত হওয়া অন্যায়? যদিও কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক্স এবং ইনফর্মেশন টেকনোলজীর রাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজীব চন্দ্রশেখর বলেছেন, এই আইনের ফলে যদিও অনেকে আশঙ্কা করছেন, সরকারের হাতে আরও অনেক বেশি ক্ষমতা কুক্ষিগত হলো, কিন্তু তা নিয়ে ভাবনার কারণ নেই, সরকার বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। অর্থাৎ সরকারের আইন নিয়ে সমালোচনা করার অধিকারও সরকারেরই। দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি যখন বারংবার বলে চলেছেন, সংবাদমাধ্যম, দেশের গণতন্ত্র রক্ষার অন্যতম একটি স্তম্ভ, যখন বারংবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁদের রায় এবং বক্তব্যের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, সরকারের গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার প্রক্রিয়াকে তাঁরা ভালো চোখে দেখছেন না, তখন এই ধরনের একটি সংশোধনীর ফলে কি দেশের গণতন্ত্রই আবারও লুন্ঠিত হচ্ছে না? শিবঠাকুরের আপন দেশে কি সত্যিই আইন কানুন সর্বনেশে হল তবে?
- সুমন সেনগুপ্ত
সঙ্ঘীরা এখন বাঙালির নববর্ষকে তাদের মতাদর্শের খোপে কব্জা করতে চাইছে। তারা হঠাৎ আবিষ্কার করেছে যে বাংলা সনের প্রবর্তক গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, তোডরমল বা আকবর নন। তাঁদের যুক্তি হাস্যকর! তাঁরা বলছেন আকবর বা তোডরমল কখনো বাংলায় আসেননি, তাঁরা কী করে বাংলা সন চালু করবেন। একই যুক্তিতে বলা চলে কোনও মোঘল সম্রাট তো বাংলায় আসেননি, তাহলে কীভাবে বাংলা প্রায় ১৫০ বছর মোঘলদের অধীনে ছিল! সঙ্ঘীরা অবশ্য যুক্তি, প্রমাণ এসবের পরোয়া করে না। রাজস্থানের পাঠ্যপুস্তকে কোনও তথ্য, যুক্তি ছাড়াই আকবর ও রানা প্রতাপের হলদিঘাট যুদ্ধে রাজপুত রাজাই যে জয়ী ছিলেন এমনটাই দাবি করা হয়েছে। তথ্য, প্রমাণের তো কোনও দরকার নেই! জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে বিতর্কের সময় এক মহাগুরু তো বলেই দিয়েছেন যে বিশ্বাসই সব, হিন্দুরা যদি মনে করে যে মসজিদের তলায় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, সেটাই যথেষ্ট, কোনও প্রমাণের দরকার নেই।
বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইতিহাসের কাটাছেড়ার প্রক্রিয়া একশো বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ইতিহাস নিয়ে, বিশেষ করে তথাকথিত মুসলিম যুগ নিয়ে, সঙ্ঘীদের চিরকালই একটা সমস্যা আছে। ষাটের দশকের শুরুতে তাঁদের আদিপুরুষ এম এস গোলওয়ালকার ঘোষণা করেছিলেন যে দেশভাগের মুলে আসলে ঐ আটশো বছরের মুসলিম শাসন। তিনি আরও লিখছেন ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরেও আমরা দেখি আমাদের ইতিহাস তিন যুগে বিভক্ত – হিন্দু, মুসলিম, খ্রিশ্চান। এই বিষাক্ত তত্ত্ব অনুযায়ী এই দেশে হিন্দুরা মুসলিম ও খ্রিশ্চানদের সমগোত্রীয়। মনে রাখতে হবে ‘সেক্যুলার’ ও বামঘেঁষা ঐতিহাসিকরাও ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতের ইতিহাসের এই কৃত্তিম বিভাজনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল এভাবে ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতীয় জনগণের মধ্যে সুচতুরভাবে বিভাজন সৃষ্টি করছে, যা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। গোলওয়ালকার কিন্তু সমস্যাটাকে একেবারে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। তাঁর মতে (১) হিন্দুরা কখনই অন্য জনগোষ্ঠীর সমগোত্রীয় নন। তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ বইয়ে তিনি ‘উই’ বলতে বোঝাচ্ছেন হিন্দুদের যারা নাকি স্মরণাতীত কাল থেকে এই মাটির আপন সন্তান এবং যারা এই দেশের স্বাভাবিক মালিক। (২) আরও গুরুত্বপূর্ণ তিনি লিখছেন আদিকাল থেকে ভারতের সমগ্র ইতিহাস নিরবচ্ছিন্নভাবে হিন্দুদের মহান ইতিহাস। এই ইতিহাস কখনো অতি উজ্জ্বল যা হিন্দুদের স্বাধীনতার প্রতিফলন আবার তা কখনো জাতীয় মুক্তি ও সম্মান রক্ষার্থে বিদেশী হানাদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাহিনী।
সম্প্রতি এনসিইআরটি সিবিএসইর ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক থেকে নবম অধ্যায়, ‘কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলস, দ্যা মুঘল কোর্টস’ ছেঁটে ফেলেছে। প্রায় এক বছর আগে আহমেদাবাদের একটি সভায় আরএসএস ‘উই……’ বইটিতে সংখ্যালঘু সম্পর্কিত যে নিদান তা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত ৩০শে জুন পানিপতের সভায় তাঁরা জানায় যে দেশ গঠন প্রক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িক হিংসা অবধারিত। অতএব বুলডোজার রাজ, গোরক্ষকদের তান্ডব, মসজিদ আক্রমণ সবই আদপে নেশন-বিল্ডিং! আর দেশের প্রধানমন্ত্রী তো আওরংগজেবকে খলনায়ক বানানোর কাজ নিরন্তর করে চলেছেন। কখনো বলছেন প্রত্যেক আওরংগজেবের বিপরীতে আমাদের দেশে একজন শিবাজি আছেন; কখনো বলছেন মোঘল সম্রাট গুরু গোবিন্দ সিংয়ের সন্তানদের হত্যা করেছিলেন; কখনো বলছেন গুরু তেজ বাহাদুরকে হত্যা করে সম্রাট আমাদের ধর্মথেকে বিচ্যুত করতে পারেননি। যখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অতীতকে বিকৃত করে বর্তমানের কার্যকলাপকে যুক্তিগ্রাহ্য করছেন, তখন তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বা পিছিয়ে থাকেন কেন? বিগত বছরের জুন মাসে একটি বই উন্মোচন সভায় তিনি বুক বাজিয়ে বলেছেন, ইতিহাস পুনর্লিখন করতে কে আমাদের আটকাবে?
২০১৪ থেকেই এই পুনর্লিখন শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে রাস্তা, স্থানের নাম পালটানো হয়েছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যের পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন করা হয়েছে। দিল্লির আওরংগজেব রোডের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। রাজস্থানের পরে মহারাষ্ট্রে ইতিহাস বইয়ে কাঁচি চালানো হয়েছে। ক্লাস সেভেন ও নাইনের পাঠ্যপুস্তকে আকবরের শাসনকাল মাত্র তিন লাইনে নামিয়ে আনা হয়েছে এবং মোঘল যুগ অনেকটাই ছেঁটে ফেলা হয়েছে। বিপরীতে ‘মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজি’কে প্রবলভাবে মহিমান্বিত করা হয়েছে। যুক্তি : ইতিহাসকে মহারাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়েছে। আরও সাঙ্ঘাতিক ক্লাস সেভেনের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের কভারে ভারতবর্ষের মানচিত্র জুড়ে গেরুয়া পতাকা। উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে তারা এনসিইআরটির নতুন পাঠ্যপুস্তকই অনুসরণ করবে।
শুধু যে ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে কাঁচি চালানো হয়েছে এমনটা নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানও সঙ্ঘীদের কোপে পড়েছে। ক্লাস টুয়েলভের বইয়ে জনপ্রিয় আন্দোলন সংক্রান্ত অধ্যায় যাতে সমাজবাদি ও কম্যুনিস্ট দলগুলো সম্পর্কে বিবরণ এবং স্বাধীনতা-উত্তর এক দলীয় শাসন সম্পর্কে আলোচনা আছে তা ব্যাপকভাবে সংশোধন করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য নক্সালবাড়িও এর মধ্যে পড়ে। এছাড়া ‘চ্যালেঞ্জেস অফ ডেমোক্রেসি’, ‘ডেমোক্রেসি এন্ড ডাইভারসিটি’ অধ্যায়গুলিও বাদ। এক বছর আগে মেধা পাটকারের নর্মদা আন্দোলন ও চিপকো মুভমেন্ট সহ আরও বেশ কিছু গণআন্দোলনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গুজরাট দাঙ্গা সংক্রান্ত বিবরণ সংশোধন করা হয়েছে। ‘গুজরাট দাঙ্গা দেখিয়ে দেয় যে সরকারি ব্যবস্থা সংকীর্ণ আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়’ এবং ‘ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার বিপদ সম্পর্কে গুজরাট আমাদের সতর্ক করেছে’ এই লাইনগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। বাজপেয়ীর ‘রাজধর্ম’ সম্পর্কিত বাণীও বাদ। এতেই শেষ নয়। সাহিত্যও সঙ্ঘীদের কোপে পড়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে ২০২১ এ মহাশ্বেতা দেবীর অমর, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী গল্প ‘দ্রৌপদী’ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এর পরিবর্তে লেখিকার অন্য কোনও গল্পও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একই সাথে তামিল দলিত লেখিকা বামা ফাউস্তিনা সুসাইরাজ এবং সুকির্থরানির লেখার ওপরেও কোপ পড়েছিল।
২০১৪ সালে আরএসএস ‘ভারতীয় শিক্ষা নীতি আয়োগ’ গঠন করে। এর দায়িত্বে ছিলেন দিননাথ বাটরা যিনি ততদিনে ওয়েন্ডি ডোনিগারের ‘দ্য হিন্দুস : এন অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি’ বইটি নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়ে শিরোনামে চলে এসেছিলেন। তিনি চাপ দিয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে এ.কে.রামানুজানের ‘থ্রী হান্ড্রেড রামায়ণস’ ছেঁটে ফেলতে বাধ্য করেন কারণ সংঘ পরিবারের মতে রামায়ণ একটিই এবং অবশ্যই সেটি তাদের দ্বারা স্বীকৃত। দিননাথ বাটরার বিখ্যাত/কুখ্যাত বই হচ্ছে, ‘দ্য এনেমিজ অফ ইন্ডিয়ানাইজেশন-দ্য চিল্ড্রেন অফ মার্ক্স, ম্যাকলে এন্ড মাদ্রাসা’। এতে তিনি বর্তমানে যে ইতিহাস পড়ান হয় তাতে ৪১টি ভুল খুঁজে পেয়েছেন। চারটি প্রধান ভুল হল : (১) আর্যরা বাইরে থেকে এসেছে এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রটনা কারণ হিন্দুরাই হচ্ছে এখানকার ভূমিপুত্র। (২) মহাকাব্যগুলিতে যে চমৎকার, তথাকথিত অলৌকিক ঘটনাগুলি বর্ণিত হয়েছে সেগুলি বাস্তব। এই ব্যাখ্যা থেকেই বলা হচ্ছে যে ইতিহাস আর মিথোলজি মূলত এক (৩) মুসলমানদের আক্রমণ ভারতের ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়। (৪) স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী এবং নেহুরুকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
পাঠ্যক্রমের ওপর সঙ্ঘীদের এই কালাপাহাড়ি আক্রমণে একটা পরিকল্পিত মতলব বোঝা যায়। প্রথমত যা কিছুই তাঁদের রাজনীতি, দর্শন, ধর্মীয় চিন্তা, আদর্শর বিরোধী সেটা তারা মুছে দিতে উদ্যত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া ২০১৪ থেকে শুরু হয়েছে এবং সেটার গতিবেগ যত দিন যাচ্ছে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত তারা মুসলিমদের ওপর আক্রমণ কেন্দ্রীভুত করেছে। মোঘলদের আক্রমণ করে, আওরংগজেবকে আক্রমণ করে তারা আসলে আজকের মুসলিম সম্প্রদায়কে সবক শেখাতে চাইছে। দেশের প্রধান সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর তাদের আক্রমণ বহুমুখী। রাস্তা, স্থানের নাম পরিবর্তন করে তারা জনজীবন থেকে সুলতান ও মোঘল আমলের চিহ্ন মুছে দিচ্ছে। ইতিহাস থেকে তাদের কীর্তিকলাপ মুছে দিচ্ছে। গোরক্ষকদের তান্ডব, বুলডোজার, প্রকাশ্য সভায় গণহত্যা, গণধর্ষণের হুমকি দিয়ে তারা মুসলিমদের সন্ত্রস্ত করে রাখছে। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। জীবনের সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের আধিপত্য মেনে নাও নচেৎ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে বাস কর। মুসলিমদের সম্পর্কে এটাই তো গুরুজি গোলওয়ালকারের নিদান ছিল। আরএসএসের একশো বছর পূর্তিতে এতেই তো তাদের মোক্ষলাভ হবে। গুরুজি তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে নাৎসি জার্মানি কী ভাবে ইহুদিদের টাইট দিয়েছে সেটা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি তো নিশ্চয়ই জানতেন ইহুদিরা ছিল জার্মানির জনসংখ্যার মাত্র ০.৭৫%, যেখানে মুসলিমরা আমাদের দেশে ১৪%।
- সোমনাথ গুহ
গত ১৬ মার্চের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নতুন উদ্যমে শুরু প্রতিবিধান পত্রিকা’ শীর্ষক লেখাটি পড়ে তারই সংযোজনায় নিজের কিছু স্মৃতি তুলে ধরার আগ্রহ হল।
সিপিআই(এমএল) পার্টির পরিচালনায় তিল তিল করে গড়ে ওঠা ‘প্রতিবিধান’ পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকেই আমার তার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ হয়েছিল। তখন যাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে পত্রিকার কাজ শুরু করেছিলাম তাদের অনেকেই আজ আর নেই। কেউ কেউ নানা কারণে আমাদের সংগঠন ছেড়ে চলে গেছেন। এটা আমার কাছে মর্মান্তিক দুঃখের। তাদের সবাইকে লাল সেলাম জানাই।
১৯৮০’র শুরুতে ‘প্রতিবিধান’-এর আত্মপ্রকাশ -মহিলাদের সংগঠিত করা আর বৃহত্তর নারী আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির লক্ষ্যে। পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা প্রথম অঙ্কুরিত হয় কমরেড বিনোদ মিশ্রের চিন্তায়। প্রথম উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ধূর্জটী প্রসাদ বক্সী, অনিমেষ চক্রবর্তী, সুদর্শন বসু, পরেশ ব্যানার্জি, বুলা ভরদ্বাজ (শিখা) প্রমুখ কমরেডরা। শর্মিষ্ঠা, স্বপ্নার বাড়িতে রাতের পর রাত প্রতিবিধান, মহিলা সংগঠন নিয়ে বৈঠক হত। নেতারাও থাকতেন।
পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন কমরেড বিনোদ মিশ্র। প্রথম সম্পাদিকা ছিলেন দেবযানী চট্টোপাধ্যায়। প্রকাশক ছিলাম আমি। পরবর্তীকালে পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন হয় ‘সমকালীন প্রতিবিধান’ নামে। উপদেষ্টামণ্ডলীতে ছিলেন বহু বিশিষ্ট মানুষ, তাঁরা শুধু অর্থ, লেখা বা পরামর্শদিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, তাঁদের অনেকেই নারী নির্যাতন, বধূহত্যা ও পুলিশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে (পত্রিকার উদ্যোগে) সামিল হতেন। পায়ে পা মিলিয়ে যেমন মিছিলে হাঁটতেন, তেমনই পথসভায় মাইক ধরে বক্তব্য রাখতেন। পরবর্তীতে প্রতিবিধান ‘নারীনির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চের’ সঙ্গে মিলিত ভাবে প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলেছে।
‘৭৯ সালে মথুরা রেপ কেস, অর্চনা-লতিকা গুহ-র ওপর রুণু গুহ নিয়োগীর বর্বর অত্যাচার, ৮০র দশকে পর পর ঘটে যাওয়া বধূহত্যার ঘটনার বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদ ঝলসে ওঠে প্রতিবিধানের পাতায়। কলকাতায় চলা বিভিন্ন মামলায় আমরা প্রতিবিধান-এর তরফ থেকে আদালতেও উপস্থিত থাকতাম। এ ছাড়া জীবন-সংগ্রাম নিয়ে লেখায় উঠে আসতো খনি, বিড়ি, জুতো, গেঞ্জি, অ্যাম্পুল কারখানার শ্রমিক বিশেষ করে মহিলা শ্রমিকদের, নার্সদের দৈনন্দিন লড়াইয়ের কথা। এর জন্য প্রতিবিধানের প্রতিনিধিরা ছুটে যেতেন আসানসোল, দুর্গাপুর, কৃষ্ণনগর, নদিয়া, হালিশহর, নৈহাটি, বনগাঁ, বরানগর... বরানগরে ছাইগাদায় কয়লা বাছতে গিয়ে একবার ধ্বস চাপা পড়ে মৃত্যু হয় কয়েক জন মহিলা ও শিশুর। সেই মর্মান্তিক প্রতিবেদন আমরা পত্রিকার পাতায় তুলে ধরেছিলাম।
এই সব সাক্ষাৎকার ও আন্দোলনের খবর সংগ্রহের কাজে গিয়ে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হোত। তার থেকে দুটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এরকমই এক কাজে একবার আমি আর দেবযানী দুর্গাপুর যাচ্ছি। ট্রেনে প্রচণ্ড ভীড়। দাঁড়িয়েই যাচ্ছি। বাইরে দাবদাহ চলছে। দুর্গাপুর স্টেশনে নেমে নির্দিষ্ট ঠিকানার উদ্দেশে হাঁটছি। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য। লু বইছে। গন্তব্যে পৌঁছে দেখি দরজায় তালা। অগত্যা সেখান থেকে গেলাম কৃষ্ণার কোয়ার্টার। সেখানেও তালা। চোখ মুখ জ্বালা করছে। ক্লান্ত পায়ে ফেরার ট্রেন ধরতে স্টেশনে গিয়ে শুনি, একটু আগেই কলকাতার ট্রেন চলে গেছে। এবার? নিরুপায় হয়ে চললাম দুর্গাপুরের পরের স্টেশন কালিপাহাড়, দেবযানীর বন্ধুর আস্তানায়। সেখানে গিয়ে শুনি সে সেখানে নেই। আবার স্টেশন। জানা গেল পরবর্তী কলকাতার ট্রেন ওখানে দাঁড়ায় না। চললাম আসানসোল – ওখান থেকেই হাওড়ার ট্রেন ধরতে হবে। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত ফেরার ট্রেনে উঠলাম যখন, রাতের অন্ধকার নেমেছে। জানলার ধারে জায়গাও পেলাম যা হোক। আসলে প্রচণ্ড গরমে ওখানকার লোক কলকাতায় চলে আসে-জানা ছিল না। তার চেয়ে বড় কথা – তখন মোবাইল ফোন ছিল না। এই জন্যে এত নাজেহাল হতে হল। আজ প্রযুক্তি আমাদের কত সহায়ক হয়েছে। যাই হোক, মধ্যরাতে হাওড়ায় পৌঁছে স্টেশনে রাত কটিয়ে যখন ভোরের বাস ধরছি তখন আমাদের দু’জনের আর কথা বলার অবস্থা ছিল না।
আরেকদিন। প্রতিবিধান নিয়ে কথা বলতে গেছি উলুবেড়িয়া কলেজের অধ্যাপিকার বাড়ি। ঘরে পা রাখতেই ভেতরের ঘর থেকে প্রবল সারমেয় – চিৎকার কানে এল। অধ্যাপিকা মৃদু হেসে বললেন – একটু বসুন। আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে চায়। ওদের নিয়ে আসি। আমরা হতভম্ব। মহিলা প্রায় বাঘের সাইজের পোষ্য দুটিকে নিয়ে এলেন। তারা এসেই আধ হাত লম্বা জিভ দিয়ে আমাদের আপাদমস্তক লেহন করে চুপচাপ চলে গেল। আমরা তখন বাক্যহারা। দেবযানীর রুমাল সারমেয়ের লালায় জব জব করছে। প্রতিবিধান আমাদের যে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে কত রকম অভিজ্ঞতায়।
তরুণ প্রজন্মের নতুন উদ্দীপনায় প্রতিবিধান আরও শাণিত হয়ে উঠুক, এগিয়ে চলুক দুর্বার গতিতে।
সংগ্রামী অভিনন্দন সহ
স্নিগ্ধা বসু
প্রয়াত হলেন নদীয়ার বিশিষ্ট নকশালপন্থী নেতা বর্ষীয়ান কমরেড চন্ডী সরকার। আমৃত্যু বিপ্লবী আদর্শের প্রতি তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ। নকশালবাড়ী আন্দোলনের সময়কাল থেকে কয়েকদশক ধরে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া, দীর্ঘ জেলজীবনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মোকাবিলা করা, সহজ সরল জীবন যাত্রা, সহকর্মী ও অসংখ্য মানুষের সাথে একাত্মতা গড়ে তুলে তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগর তথা নদীয়া জেলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় এক বিপ্লবী নেতা। পার্শ্ববর্তী মুর্শিদাবাদ জেলাতেও তিনি কাজ করেছিলেন। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূচনা পর্বেরেলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নদীয়া জেলায় বিপ্লবী কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই কর্মকান্ডে তাঁর সাথে আমাদের পার্টির বেশ কয়েকজন নেতৃত্বের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন অসমসাহসী, কর্মীদের প্রতি আন্তরিক, সারল্যে পরিপূর্ণ, দৃঢ়চেতা এক বিপ্লবী সংগঠক। পরবর্তীকালে জেল জীবনে মতাদর্শগত ভিন্নতা দেখা দেয়। তিনি কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পার্টি ইউনিটি গোষ্ঠীর নেতা হয়ে ওঠেন। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর বিভিন্ন মতপার্থক্য স্বত্বেও তিনি আমাদের সাথে যৌথ কার্যকলাপ, এমন কী যুক্তভাবে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়কালে তিনি সিপিআই(মাওবাদী) সংগঠনের নেতা হয়ে ওঠেন। এই সময়কালে পুনরায় জেলে বন্দী অবস্থায় তিনি আমাদের পার্টিনেতা বিমান বিশ্বাসকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিষয়ে এক চিঠি পাঠান। তাতে লেখেন,
“রাজনৈতিক মত ও পথ নিয়ে আজ আমাদের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবুও আমি মনে করি সেই পুরানো স্বপ্নকে আজও তুমি একই রকম আন্তরিক ভাবেবহন করে চলেছো... আজ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বন্দীমুক্তির দাবিতে বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলার প্রশ্নে তোমার সক্রিয় ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি। আমরাচাই নদীয়া জেলায় সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলুক, তুমি এ প্রশ্নে সক্রিয় ভূমিকা নাও, বাকি বন্ধুদের কাছে রাজনৈতিক বন্দীদের এই বার্তা পৌঁছে দাও”
ভিন্ন সংগঠনের নেতা হলেও কৃষ্ণনগর শহরে তাঁর বাড়িতে তিনি আমাদের পার্টির পত্রিকা নিয়মিত নিতেন, আমাদের বেশ কয়েকজন কর্মীদের সাথে সম্পর্করাাখতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তাঁকে বেশ কিছু দিন রোগশয্যায় থাকতে হয়েছে। গত ৫ এপ্রিল রাতে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে তিনি চির বিদায় নিলেন। বিপ্লবী নেতা কমরেড চন্ডী সরকারকে জানাই লাল সেলাম। তাঁর স্মৃতি অবিনশ্বর হয়ে থাকবে।
নদীয়া জেলা কমিটি
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
৬ এপ্রিল ২০২৩
=== 0 ===