আবারও রামনবমীর উৎসবটি রাজ্যের পর রাজ্যে মুসলিম বিরোধী সহিংসতা এবং ভাঙচুরের পরিঘটনায় পর্যবসিত হল। বিজেপি-শাসিত মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ এবং নির্বাচনাসন্ন কর্ণাটকের পাশাপাশি বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মতো অ-বিজেপি রাজ্যগুলি থেকে সহিংসতার বড় বড় ঘটনার খবর এসেছে। যে উৎসবগুলি শান্তি, সম্প্রীতি ও আনন্দের পরিবেশে উদযাপন করার কথা তা ক্রমবর্ধমান হারে ভাঙচুর ও সহিংসতার রঙ্গমঞ্চে পর্যবসিত হচ্ছে, মূলত ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমান জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে নিশানা করে।
গত বছর রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তীতে ব্যাপক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজ ও আইনজীবীদের একটি সমষ্টি অত্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিংসার প্যাটার্নটা অধ্যয়ন করেছিল এবং “রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীর সময় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা — জিঘাংসার শেকড় — ধর্মীয় শোভাযাত্রাকে হাতিয়ার বানানো (এপ্রিল ২০২২)” শিরোনামে ১৭৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। কোথাও কোথাও প্রশাসনিক যোগসাজশের নির্লজ্জ কিছু উদাহরণ বাদে এই প্রতিবেদনে সবচেয়ে সাধারণ যে প্রশাসনিক ত্রুটিকে এরকম সহিংস ঘটনা ঘটার সাধারণ সহযোগ প্রদায়ি হিসেবে চিহ্নিত করে তা হল মসজিদের কাছাকাছি এবং প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে দিয়ে তরোয়াল উঁচিয়ে ঘৃণাপূর্ণ শ্লোগান, গান ও ভাষণসহ রামনবমী মিছিল করার অনুমতি দেওয়া। প্যাটার্নটি এই বছর আবারও কার্যকর হতে দেখা গেল, এবং আরও ব্যাপকভাবে, রামনবমীকে বেশ কয়েক দিনব্যাপী প্রলম্বিত উৎসবে পরিণত করার অনুমোদনের মাধ্যমে। বিহারশরিফে (নালন্দা, বিহার) আজিজিয়া মাদ্রাসা ও লাইব্রেরির মর্মান্তিক ধ্বংসসাধন এবং রিষড়ার (হুগলি জেলা, পশ্চিমবঙ্গ) সহিংসতার মতো ভাঙচুর ও সহিংসতার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বাস্তবে রামনবমী শেষ হয়ে যাওয়ার পরে।
আজিজিয়া মাদ্রাসা ও লাইব্রেরিকে টার্গেট করে ধ্বংস করার বিষয়টি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। ১১০ বছরের পুরোনো মাদ্রাসাটি পাটনার প্রবাদপ্রতীম খুদা বকশ লাইব্রেরির পরেই সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি ছিল। অনেক দুর্লভ বই সহ লাইব্রেরির ৪,৫০০ প্রাচীন গ্রন্থের সমগ্র সংগ্রহটি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। বিখ্যাত সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ বিবি সোঘরা তাঁর স্বামী মৌলভী আব্দুল আজিজের স্মরণে এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজিজ ১৮৫৭ সালের সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের জন্য তাঁর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পাশাপাশি এটি একটি মডেল মাদ্রাসা হিসাবেও সমুজ্জ্বল ছিল যেখানে পাঁচ শতাধিক ছেলে ও মেয়েকে আধুনিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। মাদ্রাসাগুলিকে সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণের জায়গা হিসাবে কলঙ্কলেপন সংঘ ব্রিগেডের ইসলামফোবিক প্রচারের কেন্দ্রে আছে এবং আজিজিয়া মাদ্রাসার ধ্বংস এই মাদ্রাসা-বিরোধী প্রচারকে একটি নতুন স্তরে নিয়ে গেল।
ধর্মীয় উৎসবের ক্রমবর্ধমান সশস্ত্রকরণ ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী উন্মত্ততা ও আগ্রাসনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। সব রকম উপায়ে এই নকশা বানচাল করা প্রয়োজন। আইনের শাসনের সাংবিধানিক কাঠামোকে ফ্যাসিবাদী সহিংসতার সক্রিয় যন্ত্রে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের এই বিষাক্ত বিস্তারকে মোকাবেলা করার জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যুক্তি ও সম্প্রীতির কণ্ঠকে প্রসারিত করতে হবে আমাদের। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই ফ্যাসিবাদী ছককে পরাস্ত করতে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সাংবিধানিক দিশাকে অবিচল রাখতে জনপ্রিয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সংকল্প জাগ্রত করতে হবে।
অনেক বছর আগে বিপ্লবী কবি গোরখ পাণ্ডে ভবিষ্যদ্বাণীর মতো এই লাইনগুলি লিখেছিলেন: ইস বার দাঙ্গা বহুৎ বড়া থা/খুব হুই থি/ খুন কি বারিশ/আগলে সাল আচ্ছি হোগি/ফসল/ মতদান কি (এবার দাঙ্গা বেশ ভালো হয়েছে/ অনেক রক্ত ঝড়েছে বৃষ্টির মতো/আগামী বছরটা খুব ভালো যাবে/বাম্পার ফলন হবে ভোটে)। আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বারংবার এটা ঘটতে দেখেছি। গুজরাটে ২০০২ সালের গণহত্যা বিজেপি-র জন্য ধারাবাহিক নির্বাচনী জয়ের ভিত্তিভূমিতে পরিণত হয়েছে। এমনকি বিশ বছর পরেও অমিত শাহ সাম্প্রতিক গুজরাট নির্বাচনে সেই গণহত্যাকে ‘দাঙ্গাকারীদের জন্য একটি উপযুক্ত শিক্ষা, স্থায়ী শান্তির চাবিকাঠি’ হিসাবে আবাহন করেছিলেন। ২০১৩ সালের মুজাফফরনগর হত্যা ২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির নজরকাড়া নির্বাচনী প্রদর্শনের পথ পাকা করেছিল।
এই বছরের রামনবমী সহিংসতার পিছনে বিজেপির নির্বাচনী ছককে ভেঙে বোঝার জন্য যদি আমাদের কোনও সূত্রের প্রয়োজন হয় তবে তা অমিত শাহ-ই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে সরবরাহ করে দিয়েছেন। বিহারশরিফে সহিংসতার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে (অন্যান্য বেশ কয়েকটি জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা সতর্ক নাগরিকদের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ করা সম্ভব হয়) অমিত শাহ নিকটবর্তী নওয়াদা জেলায় একটি সভা থেকে গলা উঁচিয়ে নির্বাচনী আহ্বান জারি করেন: ‘২০২৪এ ৪০টা লোকসভা আসনের সবক’টা আমাদের দিয়ে মোদীজিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনুন আর ২০২৫ এর বিধানসভা নির্বাচনে আমাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিন, আমরা সমস্ত দাঙ্গাবাজদের উল্টো করে ঝুলিয়ে দেব!’ বিহার সম্ভবত এত স্পষ্টভাবে গণহত্যার হুমকি এবং এরকম সরাসরি সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার ভিত্তিতে ভোটের আহ্বান আগে কখনও শোনেনি। বিহার ১৯৯০ সালে আডবানির দাঙ্গারথ থামিয়ে দিয়েছিল, ২০০৪ সালের ভোটে বিহার নির্ধারকভাবে ভোট দিয়েছিল ২০০২ গুজরাট গণহত্যার পর কেন্দ্রে আসীন বিজেপি সরকারকে পরাজিত করার জন্য, সম্প্রতি ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণ বিহার সিপিআই(এমএল) এবং তার জোটের অংশীদার আরজেডিকে অপ্রতিরোধ্যভাবে ভোট দেয় এবং সামন্তসাম্প্রদায়িক সহিংসতার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে। সংঘ-বিজেপির সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের অভিযানকে পর্যুদস্ত করতে বিহারের এই সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী উত্তরাধিকারকে আবার জোরদার করতে হবে এবং “গণতন্ত্র বাঁচাও, ভারত বাঁচাও” অভিযান এগিয়ে নিয়ে যেতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ৪ এপ্রিল ২০২৩)
সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল বেশ আগে থেকেই। তলে তলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছিল, রামনবমীকে কেন্দ্র করেই ফের আগুন জ্বালানো হবে, ছড়ানো হবে সাম্প্রদায়িক হিংসা। দেখা গেল, দু-একটা রাজ্যে নয়, মুহূর্তের মধ্যে আট থেকে দশটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল সাম্প্রদায়িক হানাহানি। আর, বেশ পরিকল্পিতভাবেই। সর্বত্র একই ছবি। মিছিলে অস্ত্রের ঝনঝনানি, হাতে গৈরিক পতাকা ও গেরুয়া বর্ণের পোষাকে সজ্জিত অংশগ্রহণকারীরা, ডিজে-র কানঝালাপালা করা তারস্বরে গান ও উন্মত্ততা, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অশালীন, হুমকি মেশানো কদর্য উক্তির মিশেলে হিন্দুরাষ্ট্রের জয়গান। ধর্মীয় মিছিলের মুখোস ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ল দাঙ্গাবাজদের হিংস্র নখ দাঁত। কোথাও কোথাও মসজিদ পুড়ল, কোনো কোনো মসজিদের উপরে উঠে বেঁধে দেওয়া হল গৈরিক পতাকা। এ রাজ্যে বিজেপি-আরএসএস নেতাকর্মীদের পাশাপাশি তৃণমূলী নেতাদেরও বেশ উৎসাহজনক উপস্থিতি নাগরিকদের গোচরে এল। দেশের প্রধানমন্ত্রী নীরব থেকেই গোটা ঘটনাকে বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন। এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে প্রশমিত করার বদলে বিহারে “দাঙ্গাবাজদের উলটো ঝুলিয়ে শাস্তি দেওয়ার হুমকি” দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বিজেপি শাসিত রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রতি চোখ বন্ধ রেখে কেবলমাত্র দুষলেন অবিজেপি রাজ্যগুলোকে।
বেশ কয়েকবছর ধরেই চলছে এই ঘৃণ্য খেলা। এ রাজ্যে হিংসার মানচিত্র ক্রমে হাওড়া ছাড়িয়ে হুগলিতে ঢুকে পড়ল। হুগলির রিষড়ায় বিজেপির এক ডাকাবুকো নেতার উপস্থিতি ও ইন্ধনে শুরু হল এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, যা এখনো প্রশমিত হয়নি। সেই নেতার বিরুদ্ধে মমতার প্রশাসন এখনও পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করল না। তৃণমূলী নেতাদের উপস্থিতির কারণে “অনুমতি না নেওয়া” এই সমস্ত শোভাযাত্রা পুলিশ প্রশাসনের কাছে এক ধরনের বৈধতা পেয়ে যায়। ঠিক যেমন, দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে, সংঘ বাহিনীর গুন্ডারা পুলিশকে সরাসরি প্রশ্ন করেছে, “হিন্দুর দেশে হিন্দুরা মিছিল করবে, তার জন্য অনুমতি নিতে হবে কেন”? সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টে দেখা গেল গুজরাটে মাথায় “জয় শ্রীরাম” গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা কয়েকজন তরুণ পুলিশকে দাঁড় করিয়ে সরাসরি হুমকি দিয়ে বলছে, “আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আবার ২০০২ হয়ে যাবে”। খবরে প্রকাশ, আতঙ্কিত মুসলিম সম্প্রদায় ক্রমেই নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। সমাজের উচ্চবিত্ত স্তরে আসীন নাগরিকও ক্রমেই এই সাম্প্রদায়িক বৃত্তের মধ্যে চলে এসে পরোক্ষে মদত দিচ্ছে এই সাম্প্রদায়িক হিংসার। দেখা গেল, দিল্লির নয়ডা অঞ্চলে বহুতল আবাসনে দীর্ঘদিন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করলেও, এবার সেখানে শোনা গেল উল্টো সুর। হিন্দু আবাসিকরা পুলিশ প্রশাসনের কাছে নালিশ করে জানিয়েছে, তাঁদের আবাসন চত্বরের অদুরে রমজানের প্রার্থনা যেন অবিলম্বে বন্ধ করা হয়।
এই হল ফ্যাসিবাদ। সে শুধু দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ভেতর থেকেই কুক্ষিগত করে না, সে তার চিন্তা মতাদর্শে গোটা সমাজকে গ্রাস করে, বশ করানোর চেষ্টা করে, তার যুক্তির পক্ষে টেনে নেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের। বিপদ এখানেই। দেশের অভ্যন্তরে যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ হিসাবে দাগিয়ে দেয় এক “অপর”-কে, আর সেই “অপর” ধুয়ে মুছে সাফ করলেই আকাঙ্ক্ষিত অমৃতকালের নাকি অভ্যুদ্বয় ঘটবে সব গ্লানির অবসান ঘটিয়ে!
এ রাজ্যে, ২০১৪’র আগে, সংঘ বাহিনীর এমন দাপট লক্ষ্য করা যায়নি। রামনবমীর মিছিলের এই লাম্পট্য, হিংস্রতা, অশান্তি বাঁধাবার পরিকল্পিত ছক বাংলার নাগরিক সমাজ দেখেনি। বামপন্থী রাজনীতি ক্রমে ক্রমে দুর্বল হওয়া, হিন্দুত্ববাদীদের সাথে টক্কর দেওয়ার নামে তাদেরই মাঠে নরম হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়িয়ে তৃণমূলীদের সংঘ পরিবারের বেঁধে দেওয়া নিয়মে খেলতে যাওয়া, “আরএসএস ভালো, বিজেপি খারাপ” মমতার এই মতাদর্শগত প্রশ্রয়, গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করা, সরকার ও প্রশসনের সর্বাঙ্গে দুর্নীতির দগদগে ঘা — সংঘ পরিবারের বৃদ্ধি বিকাশের উর্বর জমি প্রস্তুত করেছে। রাজ্যে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন। ২০২৪-এ দেশের সাধারণ নির্বাচন। তারই প্রাক্কালে মেরুকরণের রাজনীতি ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে। বিদ্বেষ, হিংসা ঘৃণা ভাষণের পালে বাতাস বইয়ে জনগণের অত্যন্ত আশু ও জীবন্ত দাবিগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্যকে প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে এনেই পার হতে হবে বিষের এই বিষাদ সিন্ধু। জনগণের দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণা, প্রতিদিন অর্জিত অধিকারগুলো যেভাবে খোয়াতে শুরু করেছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েই এই প্রতিক্রিয়াকে মোকাবিলা করতে হবে।
বিরোধী পক্ষের ওপর মোদী সরকারের উন্মত্ত অভিযান সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল যুদ্ধের মাত্রা অর্জন করেছে। বিরোধীরা আদানি কেলেঙ্কারির তদন্তে এক যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি তুলতে শুরু করলে এবং রাহুল গান্ধী মোদী-আদানি গাঁটছড়া নিয়ে প্রশ্ন তুললে বিরোধীদের নিশানা বানাতে প্রতিহিংসাপরায়ণ মোদী সরকার ক্রোধোন্মত্ত হয়ে উঠল। রাহুল গান্ধির বক্তৃতা থেকে সমালোচনামূলক সমস্ত অংশ বাদ দেওয়া হলো, এবং রাহুল গান্ধি লন্ডনে গিয়ে যে মন্তব্য করেননি তার জন্য রাহুল গান্ধিকে ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি তুলে শাসক দল সংসদের পরবর্তী সমস্ত কার্যকলাপকে বন্ধ করে দিল। ইতিমধ্যে গুজরাট হাইকোর্ট রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে জারি হওয়া ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের মানহানির মামলায় যে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল, গত ২১ ফেব্রুয়ারি তা তুলে নিল এবং ২৩ মার্চ রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে দু-বছর কারাদণ্ডের সাজা দিল। পরদিনই লোকসভার সচিবালয় তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করে দিল।
যে দ্রুততার সঙ্গে গোটা নকশাটায় রূপ দেওয়া হল তাকে একমাত্র সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। যে ধারায় মামলাটা এগিয়েছে তার চক্রান্তমূলক প্রকৃতিও প্রশ্নাতীত। অপরাধমূলক সম্মানহানির মামলাটা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে, কেননা, অভিযোগকারী মোদী পদবিধারী সবারই সম্মানহানি হয়েছে বলে মামলাটা দায়ের করেছেন, যদিও সরাসরি সম্মানে আঘাত লেগেছে এমন ব্যক্তিরাই সাধারণত অপরাধসম মানহানির মামলা দায়ের করে থাকেন। এই মামলাটার প্রহেলিকাময় একটা আখ্যান হল এই যে, অভিযোগকারী নিজেই যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকার আর্জি জানিয়ে ২০২২-এর মার্চ মাসে গুজরাট হাইকোর্ট থেকে মামলায় স্থগিতাদেশ নেন। সেই একই অভিযোগকারী আবার রহস্যজনকভাবে ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে মামলাটা পুনরায় চালু করার আবেদন জানালেন এবং এক মাসের মধ্যেই শুনানি শেষ হয়ে সাজা ঘোষণা হয়ে গেল।
অপরাধসম মানহানির মামলায় সর্বোচ্চ সাজার পরিমাণ হল দু-বছরের কারাদণ্ড এবং সুরাটের আদালত সেই সর্বোচ্চ দু-বছরের সাজাই দিয়েছে। সাজা প্রাপ্তির পর নির্বাচিত প্রতিনিধির সদস্যপদ খারিজ করার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সাজা হল দু-বছরের কারাদণ্ড। রাহুল গান্ধীর সদস্যপদ খারিজের ব্যাপারটা একটা ‘অবিসংবাদী ব্যাপার’ হয়ে উঠলেও সাজা ঘোষণার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে লোকসভার সচিবালয় যে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তাঁর সদস্যপদ খারিজ করল তাতে প্রতিষ্ঠিত কোনো রীতিরই তোয়াক্কা করা হল না। লোকসভার প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক পিডিপি আচার্য জানিয়েছেন, সদস্যপদ খারিজের এই ধরনের সিদ্ধান্তের ঘোষণার বিশেষ অধিকার রয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপতির, লোকসভার স্পিকারের তা নেই। রাহুল গান্ধীর সাজাপ্রাপ্তির অন্য তাৎপর্যটা হল তিনি আট বছর আর কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। অবশ্য, উচ্চতর কোনো আদালত রাহুল গান্ধীর সাজাপ্রাপ্তিতে স্থগিতাদেশ দিলে বর্তমান লোকসভা থেকে রাহুল গান্ধীর সদস্যপদ খারিজ হওয়া বা নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর অনধিকার বাতিল হয়ে যেতে পারে। আইনি প্রতিকার চেয়ে আবেদনের জন্য সুরাটের আদালত রাহুল গান্ধীকে ৩০ দিনের যে সময়সীমা মঞ্জুর করেছে সবার দৃষ্টি এখন সেই দিকেই নিবদ্ধ হবে; তবে, এক্ষেত্রে সংশয়হীনভাবেই যা ধরা পড়ছে তা হল বিজেপির এই আইনের নিজেদের পছন্দমতো ব্যবহার — তাদের নিজেদের নেতাদের সাজাপ্রাপ্তি হলে এই আইন ব্যবহার হচ্ছে সুরাক্ষাদায়ী ধারায়, আর বিরোধীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে প্রতিহিংসার চরিতার্থতায়।
উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট এবং কর্নাটকের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যে সাজাপ্রাপ্ত বিধায়ক ও মন্ত্রীরা সাজাপ্রাপ্তির পরবর্তী পর্যায়ের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে উচ্চতর আদালতের কাছ থেকে দণ্ডের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সরকারি পদ ধরে রেখেছেন। গুজরাটে মোদী মন্ত্রীসভার জলসম্পদ মন্ত্রী বাবু বোখিরিয়া অবৈধ খননকার্য চালানোর অভিযোগে ২০১৩ সালে তিন বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হলেও ঐ পদে অবস্থান করতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি সাজাপ্রাপ্তিতে স্থগিতাদেশ লাভ করেন এবং শেষমেষ অপরাধ থেকে বেকসুর খালাস পান। এর বিপরীতে লাক্ষাদ্বীপের সাংসদ মহম্মদ ফইজল খুনের চেষ্টার অভিযোগে ২০২৩-এর জানুয়ারিতে সাজাপ্রাপ্ত হলে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তাঁর সদস্যপদ খারিজ করা হয়। কেরল হাইকোর্ট অবিলম্বে সাজার ঐ নির্দেশে স্থগিতাদেশ জারি করে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঐ কেন্দ্রের উপনির্বাচন অনুষ্ঠান স্থগিতে নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করলেও লোকসভা সচিবালয় তাঁর সদস্যপদ ফিরিয়ে দিতে প্রথমে অস্বীকার করে এবং অনেক পরে ২৯ মার্চ তাঁকে সাংসদ পদে পুনর্বহাল করে।
রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ হওয়াটাকে বিজেপি আইনের নিজের পথে চলাবলে চালাতে চাইলেও তা প্রশ্নাতীতভাবেই সত্যের অপলাপ। এই সাজাকে ওবিসি অস্মিতার প্রতিপাদন বলে জাহির করার বিজেপির আখ্যানও একই ধরনের ছলনাময়। পলাতক ব্যবসায়ী নীরব মোদী ও ললিত মোদীদের ওবিসির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। যে দলটা সংরক্ষণ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটাতে ও তার সংকোচনে সার্বিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের এবং জাতি ভিত্তিক গণনার বিরোধিতা করে এসসি/ এসটি/ওবিসিদের সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে চলেছে, এবং হরবকত বিরোধী পক্ষের ওবিসি নেতাদের অবমাননা ঘটাচ্ছে, তারাই এখন কংগ্রেস ও সমস্ত বিরোধী পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার নিগ্ৰহে ওবিসি-দরদের সংকেত দিতে চাইছে।
ফন্দি এঁটে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ করাটা আসলে হলো মোদী সরকারের পক্ষে বিপুলাকায় আদানি কেলেঙ্কারি থেকে ওঠা প্রশ্নগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার এবং ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে বিরোধী পক্ষ ও জনগণের কন্ঠকে স্তব্ধ করার এক মরিয়া প্রয়াস। এই অভিসন্ধি যাতে মোদী সরকারকেই পাল্টা ধাক্কা দিতে পারে সেটাই আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে। এটা ইতিমধ্যেই বাস্তব ক্ষেত্রে বিস্তৃত স্তরে বিরোধী ঐক্যের সক্রিয় হওয়া এবং জনগণের মধ্যে বৃহত্তর সচেতনতা জেগে ওঠার সংকেত দিয়েছে। আদানি কেলেঙ্কারিকে শুধু এক বিপুলাকায় কর্পোরেট জালিয়াতি হিসাবে দেখলেই হবে না, এটা সর্বাগ্রে হল মোদী-আদানি গাঁটছড়ার মধ্যে দিয়ে কর্পোরেট ক্ষেত্রের ভারতীয় গণতন্ত্র ও অর্থনীতিকে হাতিয়ে নেওয়ার একটা বাস্তব ঘটনা, যে গাঁটছড়া তৈরি হয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও সম্পদের এক হাতে জমাট বাঁধার ঘনিষ্ঠ অংশীদারির মধ্যে দিয়ে। আদানি কেলেঙ্কারিকে আমাদের বেসরকারিকরণ ও কর্মসংস্থান নষ্ট হওয়ার আজকের দিনের জরুরি ইস্যুগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এবং করপোরেট লুট ও গণ বঞ্চনার বাস্তবতাকে তুলে ধরে বিজেপির জাতীয়তাবাদ ও উন্নয়নের মেকি ভাষ্যের উন্মোচন ঘটাতে হবে। জনগণের গণতান্ত্রিক অভীপ্সার কাছে স্বৈরাচারীর হামলাবাজির ছকের নত হওয়াকে অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ মার্চ ২০২৩)
সদ্য সমাপ্ত একাদশতম পার্টি কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ২৬ ও ২৭ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। কমরেড স্বদেশ ভট্টাচার্য, ধীরেন্দ্র ঝা, চন্দ্রমোহন, গীতা মণ্ডল এবং সুচেতা দে-র সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের সভাপতিমন্ডলী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সভা শুরুতেই সেই কমরেডদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে যাঁদের আমরা একাদশতম পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে গত এক মাসে হারিয়েছি। আরারিয়ার রাধা দেবী এবং পূর্ণিয়ার রসিকলাল মুর্মু সহ যারা ১৫ ফেব্রুয়ারি পাটনার সমাবেশে যোগদানের পরে ফেরার সময় দুর্ঘটনায় মারা যান, কর্ণাটকের দুই স্যানিটেশন কর্মী সারিয়াপ্পা এবং মাইলাপ্পা যারা নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করে মারা যান, প্রখ্যাত হিন্দি কবি, অনুবাদক এবং সম্পাদক সুরেশ সলিল, প্রখ্যাত সাংবাদিক হরিশ চন্দোলা, আইসি কুমার, বিহারের প্রাক্তন আমলা এবং প্রাক্তন মুখ্য সচিব আইসি কুমার, পশ্চিম চম্পারণে জোখান মিয়াঁ এবং হকিক মিয়া, কুর্থার কৃষ্ণ মাঝি এবং বেয়াল বিন্দ উপেন্দ্র মির্ধা, যিনি বিহারে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, দীপচাঁদ সাহ, মুজাফফরপুর, দারভাঙ্গার তেতারি দেবী (অনিতা দেবী), যিনি ১০ ফেব্রুয়ারি হেফাজতে পুলিশের মারধরে নিহত হন, ডাঃ ওমপ্রকাশ গুপ্ত, গোপালগঞ্জ, ঘনশ্যাম মাঝি এবং ফুলওয়ারি শরীফের কাল্লু মাঞ্জি, মুন্না সিং, পুনপুনের মুখল পাসওয়ান, লালন পাসওয়ান এবং রামপ্রারুয়ার সুদামা পাসওয়ান, বিক্রম, মাহাউদ্দিন আনসারি, শ্রীরাম রাম, শিব কুমারী দেবী, বিজয় সিং, ধর্মেন্দ্র রাম এবং ভোজপুর জেলার আমির চাঁদ, পার্বতী জঙ্গী, বিন্দুখট্ট, উত্তরাখণ্ড এবং বিজেপি শাসিত আসামে সাম্প্রতিক ভুয়ো এনকাউন্টারের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা।
কেন্দ্রীয় কমিটির আলোচনা এবং সিদ্ধান্তগুলি সংক্ষিপ্ত আকারে দেওয়া হল — রাহুল গান্ধীর অপসারণ: রাহুল গান্ধীকে তার লোকসভার সদস্যপদ এবং আট বছরের জন্য কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে অযোগ্য ঘোষণা বিরোধী শক্তি এবং ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর ওপর একটি মরিয়া সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। আদানি কেলেঙ্কারি এবং আদানি-মোদি সম্পর্ক – যা আদানিকে এত বড় কর্পোরেট জালিয়াতি করতে এবং ভারতের পরিকাঠামোগুলোর উপর প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে সক্ষম করেছিল — তা নিয়ে একটি যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্তের জন্য বিরোধীদের জোরালো দাবির কারণেই এই আক্রমণ। এই পরিঘটনাটি বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধে গণ-ক্ষোভ তীব্র করা এবং বিরোধী দলগুলির মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য ও সমন্বয় তৈরি করার ক্ষেত্রে একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে। এই দিকে ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।
পাঞ্জাবের পরিস্থিতি : সিসি পাঞ্জাবের চলমান পরিস্থিতি বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যেখানে অমৃতপাল সিংকে গ্রেপ্তার করার নামে, কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্র এবং রাজ্যের নাগরিকদের স্বাধীনতা খর্ব করছে। একজন জঙ্গি শিখ প্রচারক এবং খালিস্তান দাবির চ্যাম্পিয়ন হিসেবে অমৃতপাল সিংয়ের রহস্যময় উত্থান এবং রূপান্তরের গোটা পরিঘটনাটি পাঞ্জাবের কৃষকদের আন্দোলনকে অসম্মানিত ও বিপথগামী করা এবং রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশকে বিষিয়ে দেওয়ার একটি রাজনৈতিক নকশা বলেই মনে হয়। পাঞ্জাবের পরিস্থিতি অপারেশন ব্লুস্টার পরবর্তী দিনগুলির অস্থিরতা এবং সহিংসতার দীর্ঘ সময়ের দিকে ফিরে যেন না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। পাঞ্জাবের আর্থ-সামাজিক অবস্থা একটি দীর্ঘস্থায়ী কৃষি সংকট, বেকারত্ব এবং যুবকদের সুযোগ সুবিধার নানা অভাবের কারণে এমনিতেই বেশ খারাপ। কংগ্রেস এবং আকালিদের আধিপত্যের বিকল্প সন্ধানের জায়গা থেকেই আপ এর উত্থান হয়েছিল, তবে ভগবন্ত সিং মান সরকারের প্রতি মোহভঙ্গের নানা লক্ষণ ইতিমধ্যেই সামনে আসতে শুরু করেছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও সামাজিক বিভাজন বাড়ানো এবং রাজ্যে সংঘ-বিজেপি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য আরএসএস এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। এই বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। গ্রামীণ শ্রমিকদের আন্দোলন এবং কৃষকদের কর্পোরেট বিরোধী দাবির মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক এজেন্ডা বিকশিত হয়েছে তা আমাদের সাহসের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং পাঞ্জাবকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী প্রতিরোধের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
ত্রিপুরা নির্বাচন এবং তার পরে : বিজেপি ত্রিপুরাতে তার ভোট শেয়ার এবং আসন সংখ্যার উল্লেখযোগ্য পতন সত্ত্বেও ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। বাম-কংগ্রেস জোট এবং টিপরা মোথার মধ্যে ভোটের বিভাজন বিজেপিকে ক্ষমতায় ফিরে আসতে সাহায্য করেছিল। আমরা মাত্র একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি এবং আমাদের ভোটে উৎসাহজনক বৃদ্ধি হয়েছে। যদিও নির্বাচন অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তীকালে পরিস্থিতি বদলেছে এবং বিরোধীদের ওপর হিংসাত্মক আক্রমণ হয়েছে। তৃণমূল স্তরে সংগ্রামী বিরোধী শক্তি হিসেবে আমাদের ভূমিকা ও উদ্যোগ অব্যাহত রেখে পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করার দিকে আমাদের আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার।
কর্ণাটক নির্বাচন : আমাদের কাজের প্রধান ক্ষেত্রগুলিতে আমাদের কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত। অন্যান্য বাম শক্তির সাথে নির্বাচনী বোঝাপড়ার সম্ভাবনাগুলি খুঁজে দেখা দরকার। বিজেপিকে পরাজিত করার জন্য একটি জোরালো প্রচার অভিযান আমাদের চালাতে হবে।
পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস : এই ২২ এপ্রিল আমরা পার্টি প্রতিষ্ঠার ৫৪তম বার্ষিকী পালন করব। এই দিনে আমাদের প্রতিটি পার্টিশাখায় দলীয় পতাকা উত্তোলন করে শাখা বৈঠক করতে হবে। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্য, জেলা এবং এলাকা/ব্লক কমিটিগুলিকে নিতে হবে। প্রতিটি রাজ্য কমিটিকে শাখা বৈঠকের রিপোর্ট, বৈঠকে উপস্থিতির হিসাব সংগ্রহ করতে হবে এবং কেন্দ্রীয় কমিটিকে তার একটি সারসংক্ষেপ পাঠাতে হবে। জেলা/ব্লক কমিটির সদস্যদের শাখার বৈঠকগুলি সফল করার চেষ্টা চালাতে হবে এবং কয়েকটি শাখা বৈঠকে উপস্থিত হতে হবে। একাদশ কংগ্রেসের রিপোর্টটি সমস্ত ভাষায় একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রচার করা দরকার। একাদশতম পার্টি কংগ্রেস এবং তার পরে — একাদশতম কংগ্রেসের সফল সমাপ্তি পার্টি জুড়ে অনেক আশা এবং উদ্দীপনা তৈরি করেছে৷ আমাদের এখন একে পার্টি সংগঠন শক্তিশালী করা, কমিটি পদ্ধতির কার্যকারিতার মান বাড়ানো, পার্টি কাজের শৈলী উন্নত করা এবং সমগ্র পার্টির মতাদর্শগত-রাজনৈতিক স্তরকে বিকশিত করার দিকে চালিত করতে হবে। পার্টি কংগ্রেসের বার্তা ও উপলব্ধিকে প্রতিটি শাখায় নিয়ে যেতে হবে। পার্টি মুখপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং পর্যালোচনাগুলি ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করা দরকার। কংগ্রেসে গৃহীত পার্টির দলিলগুলি শীঘ্রই চূড়ান্ত করা হবে এবং তারপর পার্টিজুড়ে এগুলি অধ্যয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। পার্টি কংগ্রেসের সাফল্যের চাবিকাঠি হল বিহারে পার্টির সহজাত শক্তি এবং আজকের সংকটময় সময়ে আমাদের পার্টি লাইনের প্রাণশক্তি। পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে এবং পার্টির ভূমিকা বাড়াতে আমাদের অনুশীলনের বিভিন্ন দিকগুলির দ্বান্দ্বিক সমন্বয়ের বিষয়টি পুরো পার্টিকে উপলব্ধি করতে হবে। সেগুলি হল —
১) পার্টির নিজস্ব ভূমিকার পাশাপাশি গণসংগ্রাম ও নির্বাচনী হস্তক্ষেপ — উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক সম্ভাব্য ঐক্যের চেষ্টা করা,
২) তৃণমূল স্তরে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করা, সাহসী রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া এবং বিপ্লবী সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি,
৩) শ্রেণি ও শ্রেণি সংগ্রামের বুনিয়াদী বিষয়ে দৃঢ় থেকেই বিভিন্ন পরিচিতি সত্তা ও সামাজিক/ সাংস্কৃতিক বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন,
৪) মূল শক্তির জায়গাগুলোতে ব্যাপক ও গভীর গণকাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে ও নতুন নতুন অঞ্চলে পার্টি প্রসার ও প্রভাব বৃদ্ধির দিকে নজর রাখা,
৫) আন্দোলন, প্রচার, শিক্ষা এবং সংগঠনকে একটি সমন্বিত এবং আন্তঃসম্পর্কিত বিষয় হিসেবে দেখা,
৬) যৌথ পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান এবং ব্যক্তির দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা,
৭) সংগঠনের বিস্তারের পাশাপাশি মতাদর্শগত-রাজনৈতিকভাবে একীকরণ।
পার্টি পলিটব্যুরো: কেন্দ্রীয় কমিটি একটি ১৭ সদস্যের পলিটব্যুরো নির্বাচন করেছে। এর সদস্যরা হলেন - কমরেড স্বদেশ ভট্টাচার্য, কুনাল, ধীরেন্দ্র ঝা, অমর, রাজারাম সিং, মীনা তেওয়ারি, শশী যাদব, মনোজ ভক্ত, জনার্দন, বিনোদ সিং, কার্তিক পাল, অভিজিৎ মজুমদার, ভি শঙ্কর, রামজি রাই, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সঞ্জয় শর্মা, রবি রাই।
পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত দলিল এপ্রিলের শেষে প্রকাশ করা হবে।
নদীয়ায় লাভ জিহাদের ধুয়ো তুলে নারী স্বাধীনতা তথা দলিত পরিবারের ওপর হামলা এবং রাজ্যে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে আইপোয়া প্রতিবাদ সভা সংগঠিত করে গত ৪ এপ্রিল। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি (আইপোয়া)র ইন্দ্রাণী দত্ত, অর্চনা ঘটক, কাজল দত্ত, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, মিতালি বিশ্বাস ছাড়াও আমন্ত্রিত বক্তারা ছিলেন — নিখিল বঙ্গ মহিলা সঙ্ঘের সর্বানী ভট্টাচার্য, নারী চেতনা সংগঠনের সঞ্চিতা মুখার্জী, আইসার অঙ্কিত মজুমদার, গানে কথায় প্রতিবাদ মূর্ত করেন নীতীশ রায়, সুষমা মুখার্জী ও মীরা চতুর্বেদী, সঞ্চালনা করেন কল্যাণী গোস্বামী। একদিকে বিজেপির রাজত্বে দেশজুড়ে আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, ১১৫০ টাকার গ্যাস, আর্থিক সংকটে দুর্বিসহ জনজীবন, অন্যদিকে তীব্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে সুপরিকল্পিতভাবে খেটেখাওয়া মানুষের মধ্যে বিভেদ ও হানাহানি তৈরি করা — আরএসএস-বিজেপির এই রাজনীতিকে জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে উন্মোচিত করেন বক্তারা। এরাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাকে তীব্র ধিক্কার জানানো হয়। নদীয়ার ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপই এখনও নেয়নি পুলিশ। অন্যদিকে রিষড়ার ঘটনা স্পষ্টতই দেখিয়ে দিচ্ছে যে পুলিশের গাফিলতি আরএসএস-এর দাঙ্গাবাহিনীকে সুযোগ যুগিয়েছে। আইপোয়ার পক্ষ থেকে নদীয়ার আক্রান্ত পরিবারের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয় সভা থেকে।
৩০ মার্চ রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে হাওড়া জেলার শিবপুর কাজীপাড়া পিএম বস্তি সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বারা চালিত বজরং দল রামসেবা সমিতি এবং জেলার বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা পুলিশের নির্ধারিত রুট পাল্টিয়ে কাজীপাড়ার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে রামনবমীর শোভাযাত্রার নামে লাঠি, তরবারি, লোহার রড এমনকি বুলডোজার নিয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক স্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকে।
রমজান মাস চলায় রোজা ভাঙার সময় যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা রোজা ভাঙছে সেই সময় এই শোভাযাত্রার নামে মিছিল এবং সেখান থেকে উস্কানিমূলক মন্তব্যের ফলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। আরএসএস-এর সুনির্দিষ্ট প্ল্যানিং এবং জেলা পুলিশ প্রশাসনের চরম ব্যর্থতার ফলে ৩০ ও ৩১ মার্চ ২ দিন ধরে হাওড়া জেলার বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি হুগলি জেলার রিষড়া সহ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আগুন ছড়াতে থাকে। ঘটনার পরের দিনই সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি কাজীপাড়া শিবপুর বস্তি সহ বিভিন্ন এলাকায় তথ্য সংগ্রহ করতে এবং স্থানীয় এলাকার মানুষজনের সাথে কথা বলতে যান। তাঁর তথ্য এবং রিপোর্টের ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ক্ষণিকের উত্তেজনা বসে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং অত্যন্ত সুনিপুণভাবে জেলার শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে জেলার পরিবেশকে কলুষিত করার একটি সুচিন্তিত প্ল্যানিং যা বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের মস্তিষ্কপ্রসূত। এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিপরীতে জেলায় শান্তি শৃঙ্খলা এবং সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য বজায় রাখার জন্য সিপিআই(এমএল) লিবারেশন হাওড়া জেলা কমিটি ৩ এপ্রিল সারা জেলা ব্যাপী সম্প্রীতি দিবস পালনের ডাক দেয়। ৩ এপ্রিল হাওড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় পোস্টারিং, সভা এবং সম্প্রীতির কর্মসূচি নেওয়া হয়।
বালি গ্রামাঞ্চলের সাথীরা জেলায় সম্প্রীতির বার্তা তুলে ধরতে এবং বিজেপি আরএসএস-কে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করার আহ্বান নিয়ে পথসভা পরিচালনা করেন। একই সাথে বালি বেলুড় লোকাল কমিটির উদ্যোগে সন্ধ্যায় বালি বাজারে পথসভার আয়োজন করা হয়। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক কমরেড বাসুদেব বসু। এছাড়াও মধ্য হাওড়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে হালদারপাড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিরুদ্ধে শান্তি এবং সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে পথসভা অনুষ্ঠিত হয় সেইখানে উপস্থিত ছিলেন পার্টির হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্তসহ স্থানীয় সাথীরা। আড়ুপাড়া কামারডাঙ্গা লোকাল কমিটির উদ্যোগে কামারডাঙ্গার বস্তি অঞ্চলে পোস্টারিং হয় এবং এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের মুহূর্তে সম্প্রীতি এবং সৌহার্দের বার্তা তুলে ধরা হয়। ৩ এপ্রিলই সকালে চার দফা দাবি নিয়ে স্মারকলিপি জমা দিতে পার্টির জেলা কমিটির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল হাওড়া পুলিশ কমিশনারের দপ্তরে যায়। কিন্তু মহাবীর জয়ন্তী উপলক্ষে রাজ্য সরকারের দেওয়া ছুটির কারণে কমিশনার দপ্তরে সেই দিন কোনো পদস্থ কর্তা উপস্থিত ছিলেন না। পার্টি জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্তের সাথে ডিসিপি হেডকোয়ার্টারের ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় এবং ডেপুটেশনের পরবর্তী দিন স্থির হয়। ইতিমধ্যে সংঘর্ষের এলাকাগুলোতে প্রশাসন কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি থাকায় জেলার সংগঠিত প্রতিনিধি টিম এলাকায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধি টিম ওই এলাকায় গিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে এবং পরবর্তী সময় জেলা শাসকের কাছে সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটি স্মারকলিপি জমা দেওয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। হাওড়া জেলায় বারবারই আরএসএস-বিজেপি শিবিরের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি এবং সংঘর্ষের আবহাওয়া তৈরির প্রচেষ্টা থেকেছে। এর মোকাবিলায় পার্টির হাওড়া জেলা কমিটি সহ সমস্ত গণসংগঠন এবং গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সামাজিক শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিরোধের পাল্টা মজবুত ব্যারিকেড তৈরির জন্য পার্টি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
গত ২ এপ্রিল, ২০২৩ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উত্তরপাড়া এলাকা সম্মেলন চলাকালীন সন্ধ্যায় খবর আসে, রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এরপরে ৩ এপ্রিল সকালে পার্টির হুগলি জেলা ও উত্তরপাড়া থানা এরিয়া কমিটির সদস্য সৌরভ, কোন্নগর লোকাল কমিটির সদস্য বিনোদ কুমার সিং (যিনি বর্তমানে রিষড়ার বাসিন্দা) ও পার্টির শুভানুধ্যায়ী সাংবাদিক রূপম চট্টোপাধ্যায় এলাকায় গিয়ে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ করেন।
জিটি রোড ধরে শ্রীরামপুর অভিমুখে যাওয়ার পথে রিষড়ার ওয়েলিংটন জুটমিলের কাছে সন্ধ্যাবাজার মোড়ে পুলিশ পিকেটিং। এলাকায় জারি রয়েছে ১৪৪ ধারা। সন্ধ্যাবাজার মোড় থেকে বাম দিকে ঢুকছে এনএসরোড, যেখান থেকেই শুরু হয়েছিল গতকালের ‘রামনবমী মিছিল’ রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা ইটের টুকরো। মহল্লাটা অবাঙালি হিন্দু অধ্যুষিত, রয়েছে রামসীতা মন্দির, যুবক সংঘ ক্লাব। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের বক্তব্য, মিছিল বেরোনোর আগে থেকেই জড়ো হওয়া লোকজনের নিজেদের মধ্যেই বেশ কিছু ছোটখাটো উত্তেজনা, ঝামেলা চলছিল। এরপরে মিছিল বেরিয়ে জিটি রোড ধরে মাহেশের দিকে এগোনোর পথে পড়ে একটি মসজিদ, যেটি ‘বড় মসজিদ’ নামে পরিচিত। মূল ঘটনা সেখানেই ঘটে। আমাদের তথ্যানুসন্ধানী দল এনএস রোড থেকে মহল্লার মধ্যে দিয়ে পৌঁছায় পার্শ্ববর্তী মুসলিম জনবসতি অধ্যুষিত আরকে রোডে। এই দুটি সমান্তরাল রোডই রিষড়া স্টেশন থেকে জিটি রোডের সংযোগকারী পথ। আরকে রোডের যে প্রান্ত জিটি রোডে মিশছে সেদিকেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইটের টুকরো, ভাঙা কাচ ভালো পরিমাণে চোখে পড়ল। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে একাধিক জনের সঙ্গে কথা বলে মোটের উপর যা বোঝা গেছে—গত কয়েক বছর ধরেই ঐ এলাকায় রামনবমীর মিছিল হয়, তবে সেই মিছিল সন্ধ্যার নমাজের আগেই মসজিদ চত্বর পেরিয়ে যায়। কিন্তু সেই মিছিল এবার বিকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে প্রায় ২০ মিনিট ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। মসজিদে নমাজের জন্য মানুষজন কিছু সমবেত হয়েছিলেন। পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতি ও তৎপরতা প্রাথমিকভাবে যথেষ্ট পরিমাণ হালকা ধরনের ছিল। যেখানে গত বছর মসজিদের সামনে দিয়ে মিছিল যাওয়ার সময়ে রীতিমতো রাস্তার ধারে ব্যারিকেড করে মিছিল পার করা হয়েছিল সেখানে এ’বছর তেমন কিছু ছিল না এবং অল্প সংখ্যক কয়েকজন পুলিশকর্মী মসজিদের সামনে মোতায়েন ছিলেন, যাদের অধিকাংশই গণ্ডগোলের সময়ে ভালো রকম আহত হন। প্রথমত রামনবমীর দু’দিন পরেও বিভিন্ন এলাকায় উন্মত্ত মিছিল বাংলার পরিচিত দৃশ্যের মধ্যে একেবারেই পড়ে না। কারণস্বরূপ শোনা যায় যে, সম্ভবত রামনবমীর দিন প্রশাসনের কাছে সব এলাকায় পর্যাপ্ত বাহিনী না থাকার কারণ দেখিয়ে দু’দিন পরে মিছিলের অনুমতি দেওয়া হয় ওখানে। কিন্তু প্রশাসনের কাছে নাকি এমন কোনো খবর ছিলই না যে, মিছিলে দিলীপ ঘোষ সহ বিজেপি নেতারা থাকতে পারেন। আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক পতাকাবিহীন এই ধর্মীয় মিছিলে সরাসরি বিজেপির উচ্চস্তরের নেতৃত্বের উপস্থিতিই এবার উত্তেজনা বাড়ানোর জমি তৈরি করেছে পরিকল্পিতভাবে, এটাই বহু মানুষের অভিযোগ। বেশ কিছু ডিজে বক্স বাজছিল মিছিল থেকে, যেগুলো বন্ধ রাখার জন্য নমাজের সময়ে মসজিদে জড়ো হওয়া মানুষজন প্রশাসনকে অনুরোধ করেন, কিন্তু সেই ব্যাপারেও প্রশাসনের তৎপরতায় ঢিলেঢালা মনোভাব দেখা যায়। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে মিছিল যখন মসজিদের সামনে দাঁড়িয়েছিল তখন মিছিলের শেষাংশের কিছু লোকজন গেরুয়া ঝাণ্ডা নিয়ে মসজিদেও ঢোকার চেষ্টা করে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করলেন, তবে তাতে বাধা পায় তারা। বেশিরভাগ ছিল বহিরাগত। বচসা শুরু হলে মসজিদ লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ে মিছিলের শেষভাগ থেকে কেউ, যার ঘায়ে আহত হন মসজিদের প্রধান মৌলবি সাহেব, তাঁর মাথা ফাটে। এরপরেই পরিস্থিতি ব্যাপক অশান্ত হয়ে ওঠে এবং সন্ধ্যা বাজারের দিক থেকে কয়েকটি বোমাবাজির শব্দ আসে বলেও কেউ কেউ জানালেন। কয়েকটি দোকানপাটে ভাঙচুরের কথা শোনা গেল যার সাক্ষ্য দিচ্ছে রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইটপাথরের টুকরো।
হেস্টিংস জুটমিলের গেটের কাছে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা কিছু পোড়া জিনিসের টুকরো দেখে জিজ্ঞাসা করায় জানা গেল দু’একটা বাইকে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। মিছিলের সামনে পিছনে পুলিশ ও রাফের উপস্থিতি ছিল তবে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। বেশি রাতের দিকে ১৪৪ ধারা ঘোষণা করা হয়। এলাকার থমথমে পরিবেশে বেশ কয়েকজন ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, এই এলাকায় বহু বছর ধরেই হিন্দু-মুসলিম মানুষ মিলেমিশে বাস করেন। মসজিদের কমিটি, পুজোর কমিটি দুইয়ের মধ্যেই উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন এবং মহরমের মিছিল যায় শান্তিপূর্ণভাবে। আর রামনবমীর মিছিল যে কয়েক বছর হচ্ছে তাতে সৌহার্দ্যের পরিবেশ বজায় রাখতে মসজিদে থাকা মানুষজনও সহযোগিতা করেন, কিন্তু এবার রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্যেই মিছিলকে ইচ্ছাকৃতভাবে মসজিদের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড় করানো হয় এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে ঝামেলা হয়, যে বিষয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন এবার গোড়া থেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ভিতরের দিকের বাটা গলি থেকেও গণ্ডগোলের খবর আসে। সন্ধ্যার পর থেকে শ্রীরামপুর লোকসভার টিএমসি সাংসদ কল্যাণ ব্যানার্জী ও রিষড়া পুরসভার চেয়ারম্যানকে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। কিন্তু কিছু মানুষ প্রশ্ন তুললেন যে, জনপ্রতিনিধি হিসাবে তাঁরা শুরু থেকেই কেন মিছিলটিকে শান্তিপূর্ণভাবে এলাকা পার করানোর দায়িত্ব নিয়ে উপস্থিত থাকলেন না? পুলিশ-প্রশাসন উপস্থিত থাকলেও শুরুর দিকে যেন অনেকটাই উদাসীন ও অপ্রস্তুত ভাব লক্ষ্য করা যায় তাদের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গের জায়গায় জায়গায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করার সুযোগ সংঘ বাহিনী কেন পাচ্ছে এটাই ক্রমশ অনিবার্যভাবে জ্বলন্ত প্রশ্ন হয়ে উঠছে।
উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে নাগরিকদের কাছে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে এবং গোলমালের সূত্রপাত ঘটানো ও দফায় দফায় উস্কানি দিয়ে চলা আরএসএস-বিজেপি নেতাদের গ্রেফতারের দাবিতে এবং গোটা ঘটনায় এলাকার তৃণমূল কংগ্রেসের ‘জনপ্রতিনিধি’দের দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকাকে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কোন্নগরের বড় এলাকা জুড়ে পদযাত্রা সংগঠিত করে।
- সৌরভ
রেলে শুরু হওয়া বেসরকারিকরণে বলি হচ্ছেন রেল কর্মচারী, রেল যাত্রী ও দীর্ঘদিন রেলে পণ্য বিক্রি করে যারা জীবনধারণ করেন সেই হকারেরা। রেলে উন্নয়নের নামে রেলের সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, রেলের জমি তুলে দেওয়া হচ্ছে ধনী বণিককুলের হাতে, উচ্ছেদ করা হচ্ছে হকার এবং গরিব মানুষদের। মডেল স্টেশন, উন্নয়ন ইত্যাদি গালভরা শব্দের আড়ালে দেশের সম্পদ বেঁচে দেবার খেলা চালাচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ তথা কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি হাওড়া-ব্যান্ডেল শাখার চন্দননগর স্টেশনে রেলের জমি বেসরকারীকরণের স্বার্থেদোকান উচ্ছেদের এক নোটিশ জারি করে রেল কর্তৃপক্ষ, ৩ এপ্রিল দোকান উচ্ছেদের দিন ধার্য করা হয়। খবরটি জানার সাথে সাথে স্থানীয় এআইসিসিটিইউর সংগঠকরা উচ্ছেদের মুখে পড়া দোকানদার ও হকারদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং স্টেশন চত্বরে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে পোস্টারিং করা হয়। রেলের জমি বেসরকারিকরণের স্বার্থে এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে এআইসিসিটিইউর পক্ষ থেকে ৩১ মার্চ চন্দননগর স্টেশনে বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উচ্ছেদের মুখে পড়া হকাররা এই বিক্ষোভ সভায় যোগ দেন ও তাঁদের যন্ত্রনার কথা তুলে ধরেন। সভায় বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু, জেলা নেতা প্রবীর হালদার, সুদর্শন বসু, ছোট দোকানদার প্রণতী সাহা, বটকৃষ্ণ দাস, কৌস্তভ সাহা প্রমুখ, গণ সংগীত গেয়ে শোনান গণসংস্কৃতি পরিষদের স্থানীয় কর্মী নারায়ণ দাস। এই উচ্ছেদ ও রেলের বেসরকারিকরণ রুখতে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান রাখা হয়। রেলের বেসরকারিকরণ রুখতে এই কর্মসূচিকে সংহতি জানিয়ে ইস্টার্ন রেলওয়ে মেনস ইউনিয়ন ও এসসি অ্যান্ড এসটি রেলওয়ে এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশনের পাঠানো বার্তা সভায় পাঠ করা হয়।
যুবক ইউসুফ মোল্লা শহীদ হয়েছিল এই নওপাড়া অঞ্চলে, জমির অধিকার রক্ষা আন্দোলনের ময়দানে। তাঁর প্রতি এবং অন্যান্য সমস্ত শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংগঠিত হলো নওপাড়া আঞ্চলিক যুব সম্মেলন, গত ৩০ মার্চ সোনাতলা পূর্বপাড়া জয় গড়াইয়ের মোড়ে।
“কিছু নতুন মুখ আজকের এই সম্মেলনে দেখা যাচ্ছে। আরও নতুন শক্তিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে” সম্মেলনে বললেন, সোনাতলার যুব কর্মী হজরত। খুবই উৎসাহের সাথে তিনি এ কথা বলেন। গোটা অঞ্চলের শতাধিক যুব ও পার্টি কর্মীর উপস্থিতিতে যুব সম্মেলন হয়ে ওঠেছিল খুবই প্রাণবন্ত!
লড়াকু মেজাজে এলাকার গণআন্দোলনের সংগঠক আনসারুল হক বলেন, “সারা রাজ্য জুড়ে এবং এই এলাকায় তৃণমূল যে সীমাহীন দুর্নীতি করেছে তার খবরাখবর মানুষের কাছে পরিষ্কার! এর প্রতিবাদে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ালে দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক দলের পান্ডারা সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, ৭০ দশকে দলে দলে ছাত্র-যুবরা কংগ্রেসী শাসনের অত্যাচারকে মোকাবিলা করে নকশালবাড়ি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই এলাকাতেও বহু যুবশক্তি এগিয়ে এসেছিল, লড়াইয়ের ময়দানে অনেকে শহীদের মৃত্যু বরণ করেছেন। হাজার হাজার বিঘা জমি গরিব মানুষের মধ্যে বিলিবণ্টন করা হয়েছে। আজকের দিনেও লড়াইয়ের সেই মানসিকতা নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।
এছাড়া যুব সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন আরওয়াইএ রাজ্য নেতা সজল দে, রণজয় সেনগুপ্ত, অমিত মন্ডল, সন্তু ভট্টাচার্য, আব্বাস সেখ, ছাত্র নেতা ঋতম মাজি প্রমূখ।
সম্মেলন থেকে ২৫ জনের এক আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয়। আব্বাস সেখ সম্পাদক ও ঝন্টু হাজরা সভাপতি নির্বাচিত হয়। শেষে শতাধিক কর্মীর এক দৃপ্ত মিছিল গ্রাম পরিক্রমা করে সোনাতলা মোড়ে এসে শেষ হয়। সেখানে আয়োজিত প্রচারসভায় বক্তব্য রাখেন পার্টি ও যুব নেতৃবৃন্দ।
বিপ্লবী যুব সংগঠন এবং সিপিআই(এমএল)-এর উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। এই প্রক্রিয়ায় পরবর্তীকালে ছাত্র-যুব অধিকার মঞ্চ গড়ে ওঠে। দীর্ঘ ৭৫০ দিন ধরে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা উপেক্ষা করে সরকারের দমন পীড়ন সবকিছু মোকাবিলা করে আন্দোলন চলছে, যাতে যুক্ত রয়েছেন গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা। এই আন্দোলন হয়েছে বলেই আজ তৃণমূলের দুর্নীতি এতটা খোলাখুলি মানুষের কাছে উঠে এসেছে।
আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের রাজনৈতিক সংগ্রামে যুব কর্মীদের সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে কর্মসূচি শেষ হয়। সিপিআই(এমএল)’র পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন লোকাল সম্পাদক ঠান্ডু সেখ, জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ সহ অন্যান্যরা।
৪ এপ্রিল পোলবা দাদপুর ব্লকের রন্ধনকর্মীরা “পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড-ডে-মিল) ইউনিয়ন”-এর ব্যানারে ডেপুটেশন দেন। কয়েক মাস ধরে পোলবা-দাদপুর ব্লকের রন্ধনকর্মীদের মধ্যে আশঙ্কা দানা বাঁধছিল। কারণ স্কুল মাস্টাররা তাঁদের গোষ্ঠীর আইডি নাম্বার নিয়েছেন আবার বেশ কিছু স্কুলে গোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও গোষ্ঠী করতে বলেছেন কিন্তু কোনো কারণ জানাননি তাঁরা। “উৎকর্ষ বাংলা প্রকল্পে” রান্নার ট্রেনিংয়ে উত্তীর্ণ বেশ কিছু কর্মীর জেলা প্রশাসন থেকে বিডিও-তে পাঠানো সার্টিফিকেটে বাবার নাম ভুল থাকায় তাঁদের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। যেহেতু কর্মক্ষেত্রে তাঁদের কোনো স্বীকৃতি নেই তাই তাঁরা এই সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আবার এই প্রকল্পের আধিকারিক বলেছেন, ভবিষ্যতে এই সার্টিফিকেট কাজে লাগতে পারে। তাই বিডিওর কাছে দরখাস্ত করে আবেদন জানানো হয়, দ্রুত নির্ভুল সাটিফিকেট ও ট্রেনিং বাবদ তাদের প্রাপ্য ৫০০ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিডিও জানান, তিনি এই দাবি পূরণ করার চেষ্টা করবেন। তিনি আরও বলেন, রাজ্য সরকার গোষ্ঠী করার ওপর জোর দিয়েছে সেজন্য আইডি নাম্বার নেওয়া হয়েছে এবং কোন স্কুলে নতুন করে গোষ্ঠী করার কোনো বাধ্যতা নেই সুতরাং চিন্তার কোনো কারণ নেই। ছাত্রর অভাবে যে স্কুল বন্ধ হয়েছে এবং পাশের স্কুল চালু আছে সেখানে মিড-ডে-মিল রন্ধন কর্মী নিয়োগের বিধি অনুযায়ী বন্ধ স্কুলের কর্মীকে নিয়োগ করা হবে, এ রকম একজন কর্মীর দরখাস্ত জমা দেওয়া হয়। এছাড়া দাবি রাখা হয়, ভাতা বৃদ্ধি, দশ মাস নয় বারো মাস ভাতা এবং উৎসবে বোনাস দিতে হবে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন জেলা ইউনিয়ন সভানেত্রী চৈতালি সেন সহ ছয় জন রন্ধনকর্মী। এই আন্দোলনে রন্ধন কর্মীদের মধ্যে বেশ লড়াকু মেজাজ লক্ষ্য করা যায়।
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট যে বোমাগুচ্ছ গত ২৪ জানুয়ারি ফাটালো তা শুধু নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হেনে তাকে ঘায়েল করেই থেমে যায়নি, সেই প্রতিঘাতে আরও অনেকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে — যার মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু ব্যবসায়ী সংস্থা আর শেয়ার বাজারের ছোটোখাটো খেলোয়াড়দের — এবং তা বিনিয়োগ ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই একেবারে ঝড় বইয়ে দিয়েছে।
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট যে প্রধানতম বিষয়টিকে উদ্ঘাটন করলে তা হচ্ছে, বিশ্বে কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দেশগুলিতে অবস্থিত নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানি শুধুমাত্র আদানি গোষ্ঠীর স্টকে বিনিয়োগ করছে। আর দেখা যাচ্ছে যে এইসব কোম্পানিগুলোর টিঁকি বাঁধা আছে বা শেষ নিয়ন্ত্রণের দড়িটা ধরা আছে গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানির হাতে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এইসব বিনিয়োগ ভারতের শেয়ার আইন লঙ্ঘন করেছে চোরা পথে[১] , বিনিয়োগ করা হয়েছে কিছু “সম্পর্কিত পার্টির” মাধ্যমে। কোম্পানির নিজস্ব শেয়ার হোল্ডারদের বাইরের শেয়ারের পরিমাণ কমপক্ষে ২৫ শতাংশ রাখার বিধি ওরা এইভাবে লঙ্ঘন করে। কর-স্বর্গের ‘শেল কোম্পানিগুলোর’[২] মধ্যে শেয়ার লেনদেন — যা ‘রাউন্ড ট্রিপিং’[৩] নামে পরিচিত — আদানি গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মূল্য নির্ধারণকে কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেয়। এছাড়া, সম্পদভিত্তির মাত্রাতিরিক্ত মূল্যায়ন জাহির করে আদানি গোষ্ঠী নিজেদের বিশ্বের অন্যতম ধনী, সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকা, এবং তাই স্পষ্টতই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিসাবে তুলে ধরে শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ইজরায়েল ও অস্ট্রেলিয়ায় বহুসংখ্যক পরিকাঠামো নির্মাণের বরাত কুক্ষিগত করে। এরই পাশাপাশি, অত্যধিক দাম চড়ানো শেয়ারগুলোকে বন্ধক রেখে তারা ভারতীয় এবং বিদেশী ঋণদাতাদের কাছ থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ঋণ পেতেও সমর্থ হয়, শেয়ারমূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে না দেখালে যে ঋণ পাওয়া সম্ভব হতো না।
এইভাবেই গড়ে উঠেছিল ভারতের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ কর্পোরেট সাম্রাজ্যটি। ভারতের দোর্দণ্ড প্রতাপ রাজনীতিবিদ ব্যক্তিটির সাথে হাত মিলিয়ে লুকোছাপা আর জালিয়াতি ভরা, ভ্রষ্ট এই ব্যবসায়ী মডেলটির মধ্যে যে বিরাট ঝুঁকি ও টানাপোরেন নিহিত ছিল তা আজ হোক বা কাল বিস্ফোরণে ফেটে পড়তই, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট দূর থেকে এই ডিনামাইট বাক্সের ডিটোনেটরের কাজটা করে দিল।
রিপোর্ট প্রকাশ হতে না হতেই মুহুর্তে শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠী মুখ থুবড়ে পড়ল, কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যে ধ্বস নামল। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার ঠিক আগে আদানি গোষ্ঠীর সম্পদের মূল্যায়ন ১০ লক্ষ কোটি টাকা পেরিয়ে গিয়েছিল; এখন তা কমে এসেছে ৩ লক্ষ কোটি টাকারও নীচে। এর ফলে ফোর্বসের ধনী তালিকায় থাকা সর্বোচ্চ ২০ জন ধনীর মধ্যে থেকে আদানি ছিটকে গেছেন, যে তালিকায় একসময় তাঁর স্থান ছিল বিশ্বের মধ্যে তিন নম্বরে এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থানে। আদানি গোষ্ঠীর অগ্ৰগণ্য কোম্পানি আদানি এন্টারপ্রাইজেসকে ‘ফলো-অন পাবলিক অফার’ বা এফপিওর মাধ্যমে তোলা (এফপিও হল স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত কোম্পানির দ্বারা অতিরিক্ত শেয়ার বাজারে ছাড়া) ২০,০০০ কোটি টাকা ফিরিয়ে দিতে হয়, এবং তা সম্ভবত এফপিওর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের চাপে। বিদেশে আদানির কয়েকটা প্রকল্প হয় বাতিল হয়ে গেছে অথবা আটকে রয়েছে। ঋণের কিছু অংশ নির্ধারিত সময়ের আগেই শোধ করা-সহ সংকট সামাল দেওয়ার কয়েকটি পদক্ষেপ, এবং এলআইসি, ব্যাঙ্ক অব বরোদার মতো রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোর সহায়তা এবং হয়ত বা তাঁর কিছু ব্যবসায়ীক যোগাযোগ এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তায় কয়েকটা কোম্পানির শেয়ার মূল্যে কিছুটা পুনরুদ্ধার ঘটে, তবে সেগুলো এখনও নড়বড়ে অবস্থাতেই রয়েছে।
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট এই অভিযোগে মোদী সরকারকেও কাঠগড়ায় তোলে যে, কারচুপির কদর্য এই কৌশল “সক্ষম হতে পেরেছে লগ্নি সংক্রান্ত নজরদারি কার্যত অস্তিত্বহীন থাকার জন্য।” রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, “তাঁর বিরুদ্ধে যারা প্রশ্ন তুলছে তাঁদের তাড়া করার জন্য আদানি তাঁর বিপুল ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সরকার এবং নিয়ন্ত্রকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন”, আর তাই সাংবাদিক, নাগরিক এবং এমনকি রাজনীতিবিদরাও “প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের ভয়ে মুখ খুলতে ভয় পেতেন”।
হিন্ডেনবার্গ এইভাবে প্রশংসনীয় পেশাদারি দক্ষতায় আর্থিক অপরাধে সরাসরি যুক্ত অতিবৃহৎ কর্পোরেট এবং তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক তথা দোসর ও সহযোগী — উভয়কেই ধাক্কা দিতে পেরেছে। ধুরন্ধর মোদী অবশ্য আমেরিকার এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি (তিনি জানতেন যে সেটা করলে অকাট্য অভিযোগগুলোর দিকেই জনগণের দৃষ্টি আরও আকৃষ্ট হবে), কিন্তু সংসদের ভিতরে ও বাইরে তিনি বিরোধীপক্ষের প্রতি ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ চালিয়ে গেছেন, বলাই বাহুল্য তা নজর ঘোরানোর কৌশল।
আদানির কাছে কোনো বিকল্প ছিল না, কেননা লগ্নিকারীদের বাজিয়ে দেখা ও আশ্বস্ত করার প্রয়োজন তাঁর ছিল। এই ক্ষেত্রে, সাফাই দেওয়ার মুখ যখন আর নাই তখন পাল্টা আক্রমণই একমাত্র প্রতিরক্ষা। আর তাই উদ্ধত আদানি দেরি না করে ৪৩৭ পৃষ্ঠার এক রোষকষায়িত প্রত্যুত্তর পাঠালেন (কলেবরে যা হিন্ডেনবার্গের সংক্ষিপ্ত রিপোর্টটির চার গুণেরও বেশি) যাতে যথারীতি ওদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্ৰহণের আদানি মার্কা হুমকিও রইল। মার্কিন মুলুকের চ্যালেঞ্জারের কাছ থেকে সঙ্গে সঙ্গেই এল মুখের মতো জবাব : “আমরা রিপোর্টপেশ করার ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও আদানি আমাদের তোলা মৌলিক ইস্যুগুলোর একটারও জবাব দেননি। এর বিপরীতে প্রত্যাশিতভাবেই আদানি হম্বিতম্বি ও হুমকির আশ্রয় নিয়েছেন।… আমাদের ১০৬ পাতার, ৩২,০০০ শব্দের রিপোর্টকে — যেখানে ৭২০টা উদ্ধৃতি রয়েছে এবং যা দু-বছর ধরে তৈরি হয়েছে — আদানি “গবেষণালব্ধ নয়” বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমেরিকার ও ভারতের আইনের প্রাসঙ্গিক বিধানগুলো খতিয়ে দেখছেন।… আমরা এটাকে স্বাগত জানাই।… আদানি যদি সত্যিই আন্তরিক হন তবে তাঁকে আমেরিকাতেও মামলা করতে হবে যেখান থেকে আমরা কাজ চালাই। প্রয়োজনীয় নথিপত্রের একটা লম্বা তালিকা আমাদের কাছে আছে যেগুলো আমরা আইনি উদঘাটন প্রক্রিয়া চললে দাবি করতে পারব।” (নজরটান আমাদের)
স্পষ্টতই এক দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান। কিন্তু তা গ্ৰহণ করে মামলা দায়ের করতে এগিয়ে যাওয়ার হিম্মত আদানি দেখাতে পারেননি, যদিও রবি নায়ার ও পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার মতো সত্যনিষ্ঠ কর্মী-সাংবাদিক এবং ইপিডব্লিউ ও দ্য ওয়্যার-এর মতো পত্রিকার বিরুদ্ধে আদানি নিয়মিতভাবেই তা করে থাকে, লম্বা সময় ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া, অনেকগুলো শহরে ছড়ানো, ব্যয়বহুল আইনি লড়াই লড়ার মতো প্রতিপত্তি ও আর্থিক ক্ষমতা যাদের নেই তাদের বিরুদ্ধে। মামলাবাজ, বিদ্বেষপরায়ণ ধনকুবেরটি বুঝলেন যে, এবার তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছেন। কাজেই, গুজরাটের সিংহরাজ তৎক্ষণাৎ লেজ গুটিয়ে মেকি দেশপ্রেমের আশ্রয় নিলেন। তাঁর গুরুর অনুসরণে তিনি রিপোর্টটাকে ‘ভারতের ওপর এক সুপরিকল্পিত আক্রমণ’ এবং ‘ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা, সততা ও গুণমানের’ ওপরও আক্রমণ বলে অভিহিত করে জনমানসে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া উস্কিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন। সেই কবে ১৭৭৫ সালে স্যামুয়েল জনসনের করা সেই বিখ্যাত উক্তিটি আছেনা, সংকীর্ণদেশপ্রেম হল “দুর্জনদের শেষ আশ্রয়”।
এই ঐকতানে গলা মেলানোর জন্য মোদীভক্তদের এবং আদানি অনুগতদের তড়িঘড়ি সমাবেশিত করা হল। “ভারত আদানির পাশে দাঁড়াচ্ছে” এবং “ভারতের আইএনসিএস আদানিকে সমর্থন করছে” হ্যাশট্যাগ সমাজমাধ্যমে ট্রেণ্ডিং করতে উঠে পড়ে লেগে গেল। তবে, বিশ্বাসযোগ্য কোনও ছাপা কি ডিজিটাল মিডিয়ায় এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটির সমর্থনে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো লেখাপত্তর আসতে দেখা গেল না। বিপরীতে, খ্যাতনামা পত্রিকা এবং ডিজিটাল মঞ্চগুলোয় একের পর এক নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হতে লাগল যেগুলোতে হিন্ডেনবার্গ-এর উন্মোচনের সত্যতা প্রতিপাদিত হল, ঐ উন্মোচনকে আরো বিস্তৃত করা হল এবং বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্তও টানা হল।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল হিন্ডেনবার্গ-এর কিছু দাবিকে স্বতন্ত্রভাবে সমর্থন করে। তারা ট্রাস্টলিঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল নামে মরিশাসস্থিত একটা কোম্পানির সঙ্গে বিনোদ আদানির যোগ দেখতে পায়। এই কোম্পানিটা আবার মরিশাসের আরো দুটো কোম্পানিকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে। ব্লুমবার্গও জানায় যে, বিনোদ আদানি ও তাঁর স্ত্রী রঞ্জনাবেন আদানি ‘এন্ডিভার ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট’ সংস্থার মূল সুবিধা প্রাপক মালিক হিসাবে তালিকাভুক্ত। মরিশাসের এই কোম্পানিটাকে আদানি গোষ্ঠী এর আগে ব্যবহার করেছিল সুইজারল্যান্ডের হলসিমএর কাছ থেকে অম্বুজা সিমেন্টস ও এসিসি-কে অধিগ্ৰহণ করতে। এরপর ফোর্বস প্রকাশিত এক নিবন্ধে জানানো হলো বিদেশে চালানো এতদিন অপ্রকাশিত কিছু লেনদেনের কথা যেগুলোর সাথে বিনোদ আদানি যুক্ত[৪] এবং যেগুলো ‘আদানি গোষ্ঠীকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত’।
উইকিপিডিয়া প্রকাশিত মাসিক অনলাইন পত্রিকা সাইনপোস্ট থেকে বেরোলো কৌতূহল জাগানো আরও এক কাহিনি। আদানির সাথে যুক্ত একাউন্ট থেকে — যে অ্যাকাউন্টগুলোর বেশ কয়েকটা চালাতো আদানি গোষ্ঠীর কর্মীরা — উইকিপিডিয়ার কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা উইকিপিডিয়া দেখতে পেয়েছে। এভাবে আদানি গোষ্ঠী সম্বন্ধে উইকিপিডিয়ায় বিধৃত তথ্যাবলিতে কারচুপি করত আদানিরা। ঐ নিবন্ধে বলা হয়েছে, “৪০টারও বেশি… সকপাপেট বা বেতনে লালিত কিন্তু অঘোষিত সম্পাদক… উইকিপিডিয়ায় দেওয়া (আদানি গোষ্ঠী সম্পর্কে) নিবন্ধের অ-নিরপেক্ষ পিআর ভাষ্য দিয়ে উইকিপিডিয়ার পাঠকদের প্রতারিত করার চেষ্টা করে।” তারা অনেকেই “বেশ কয়েকটি নিবন্ধ এডিট করে… এবং পক্ষপাতদুষ্ট কনটেন্ট বা অতিরঞ্জিত প্রশস্তি ভরে দেয়”।
টাইম পত্রিকা ২০২৩-এর ৯ ফেব্রুয়ারি “আদানি গোষ্ঠীর সমস্যাগুলো কেন সারা ভারতেই অনুরণিত হবে” শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশ করে এবং তাতে একটা জুতসই ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন উপশিরোনামও থাকে: ঐ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী শুধু সুবৃহৎই নয়; দেশের বৃদ্ধির মডেলের অন্তর্নিহিত টানাপোড়েনকেও তা মূর্ত করে। বিলিয়ন ডলার সম্পদের অধিকারী ও বিনিয়োগকারী এবং ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশেনস-এর প্রতিষ্ঠাতা জর্জ সোরোস বলেন, মোদী এবং আদানি “ঘনিষ্ঠ মিত্র; তাঁদের নিয়তি পরস্পরের সঙ্গে জড়িত” আর তাই এই ইস্যুটা “ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ওপর মোদীর নাগপাশকে যথেষ্ট মাত্রায় দুর্বল করে তুলবে”। তিনি আরও বলেন, এটা ভারতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার সূত্রপাত ঘটাতে পারে, যার ফলে শেষমেশ দেশের গণতান্ত্রিক পুনরুজ্জীবনের পথ প্রশস্ত হবে। তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ভারত সরকার মাত্রাতিরিক্ত বৈরি প্রতিক্রিয়া দেখালো। অবশ্য ভারতের শাসকরা সবেতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছিল।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লগ্নি বিষয়ের অধ্যাপক অশ্বথ দামোদরণ এক বিশদ ও ক্ষুরধার বিশ্লেষণ উপস্থাপিত করেন। ‘মানি কন্ট্রোল’ পত্রিকার ২০২৩-এর ১ মার্চ সংখ্যায় শুভম রাজের তোলা রিপোর্টে যেমন বলা হয়েছে, “মূল্যায়ণ গুরু অশ্বথ দামোদরণ বলেছেন যে, সামগ্রিকভাবে আদানি গোষ্ঠী এবং বিশেষভাবে আদানি এন্টারপ্রাইজেস-এর প্রচুর ঋণ রয়েছে…
“উঁচু মাত্রার এই ঋণ গোষ্ঠীর ভালো করার চেয়ে ক্ষতি করেছে বেশি, একটি ব্লগে ২৭ ফেব্রুয়ারি এক পোস্টে অধ্যাপক এই কথা বলেছেন।
“আদানি গোষ্ঠীর সমবেতভাবে যত ঋণ থাকার কথা তার তিন গুণ ঋণ আছে…
“সত্যি বলতে কি, আদানির ঋণ নেওয়াটা সম্পদ বৃদ্ধির দিক থেকে কোনো সাহায্যই করে না, করলেও তা যৎসামান্য (যদি না সেই ঋণ সরকার বা কোনো অসতর্ক ব্যাঙ্ক অথবা গ্রীন বন্ড হোল্ডার বা অন্য কেউ অতিরিক্ত সুবিধাজনক শর্তে দিয়ে থাকে…
“একটা বর্ধিষ্ণু সংস্থার বৃদ্ধিতে অর্থ জোগানের জন্য পুঁজির প্রয়োজন, আর সেই পুঁজিকে আসতে হবে শেয়ার ছেড়ে অথবা ঋণের মাধ্যমে।… নিয়ন্ত্রণই যদি কোম্পানির পরিচালকদের অভিপ্রায় হয়ে থাকে তবে তারা সাধারণের কাছে শেয়ার ছাড়ার চেয়ে ঋণ গ্ৰহণকেই বেছে নিতে পারে, এমনকি যদি তা অর্থ সংগ্রহের খরচা বাড়িয়ে দেয় বা বিনিয়োগ থেকে শেষ পর্যন্ত লাভের কড়ি কিছুই মিলবে না এমন একটা ঝুঁকিও সৃষ্টি করে।”
দামোদরণ আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি যোগায়। একচেটিয়া কারবারিরা কেন প্রায়শই অত্যধিক ঋণ নিতে পছন্দ করে, এবং কেন এটা জেনেও করে যে শেয়ার ছাড়ার চেয়েও এটা আরও ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ, এমনকি শেয়ারের জন্য জনসাধারণের মধ্যে উচ্চ মাত্রার দাবি থাকলেও ঋণ নেয়? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হল : নিয়ন্ত্রণের, চূড়ান্ত ব্যক্তিগত এবং পরিবারগত নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা। ঠিক যেমন রাজনীতিতে কোনো স্বৈরাচারী শাসক সব সময় ব্যক্তিগত/পরিবারগত/ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর প্রাধান্যকেই সব কিছুর ওপর স্থান দেয়।
আর এভাবেই অতি-ধনীদের হাতে আয় ও সম্পদের কেন্দ্রীভবন এবং এক ক্ষুদ্র চক্রের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন (শেষমেশ এক স্বৈরাচারী নেতার হাতে) এক সাথেই চলে। আদানি ও আম্বানিদের মতো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নির্মাণ মূলত হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপক বেসরকারিকরণ, বাজারের ওপর একচেটিয়া দখল কায়েম এবং প্রতিযোগিতাকে দমিয়ে রাখার ভিত্তিতে — এর পরিণামেই ২০২১ সালে মাত্র ১ শতাংশ ভারতীয় দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশের মালিক হয়ে যায় (যা যুক্তরাষ্ট্রের ৩২ শতাংশের চেয়ে অনেকটাই বেশি), যেমনটা জানিয়েছে অক্সফ্যাম-এর একটা রিপোর্ট। এই চরম অসাম্যের সঙ্গেই আসছে গণতন্ত্রের বিপুল ক্ষয় (হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে শাসক দলের অস্বীকার করার ধৃষ্টতাটার দিকেই শুধু তাকান), সীমাহীন দুর্নীতি এবং জনগণের অপরিমেয় দুর্ভোগ। এর কয়েকটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত নীচে তুলে ধরা হচ্ছে।
ইউপিএ-র সময়কার ‘কোলগেট’ কেলেঙ্কারি নিশ্চয় মনে আছে। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালের এক রায়ে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর জন্য বরাদ্দ হওয়া ২০৪টি কয়লা ব্লককে বাতিল করে, যে কোম্পানিগুলো আবার ঐ লাভজনক ব্যবসাটাকে গোপন চুক্তির মাধ্যমে অপ্রকাশিত দামে বেসরকারি সংস্থাগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছিল। ঐ বছরই ক্ষমতায় বসে মোদী সরকার কয়লা খননের জন্য একটা পরিচ্ছন্ন, স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এর বিপরীতে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের বলে নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়ে ও তার নিজের সিদ্ধান্তের বলে বেশকিছু বেসরকারি সংস্থাকে প্রতিবন্ধকতায় ফেলে মোদী সরকার ছত্তিসগড় ও রাজস্থানের খনিতে আদানি গোষ্ঠীকে খননকার্য চালিয়ে যেতে দেয়। এটা তারা করে গোপন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও কারচুপির এক জটিল জাল তৈরি করে (উদাহরণস্বরূপ, আইন, বিধি ও রীতিতে পরিবর্তন এনে বা নতুন সংস্থান জুড়ে।)[৫]
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন ঘোষণার ঠিক ১২ দিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি মোদী সরকার ঝাড়খণ্ডে আদানির এমন একটা প্রকল্প গড়ে ওঠার সমস্ত বাধাকে দূর করলেন যেটা হল ভারতের প্রথম স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ প্রকল্প যা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মর্যাদা ও বিপুল সুবিধা পাবে (আয়করের ক্ষেত্রে প্রথম পাঁচ বছর ১০০ শতাংশ বাদ, দ্রুত ছাড়পত্র লাভ, করপোরেট কর, আমদানি শুল্ক, জিএসটি ইত্যাদির ছাড়ের সুবিধা)। এটাকে সফল করতে বাণিজ্য মন্ত্রক সে বছরের গোড়ায় বিদ্যুৎ সংক্রান্ত চালিকা নীতিতে সংশোধন আনে। অপরদিকে, বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশকে দিতে হবে অত্যন্ত চড়া দাম, কেননা, দু-পক্ষের মধ্যে হওয়া চুক্তিটি ছিল বাজে রকম বৈষম্যপূর্ণ। বাংলাদেশের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন্দর সংরক্ষণের সদস্য-সম্পাদক ও অর্থনীতিবিদ এবং গণ বুদ্ধিজীবী, সম্পাদক ও রাজনৈতিক কর্মী অধ্যাপক আনু মহম্মদ দ্ব্যর্থহীনভাবেই এটা বলেছেন, “কোনো আলাপ-আলোচনাই ছিল না। আদানি শর্তদেয় আর রাজনৈতিক লাভের জন্য বাংলাদেশ সেগুলো মেনে নেয়।” আদানির পিছনে মোদীর হাত এখানে সুস্পষ্ট রূপেই ধরা পড়ছে।
আদানি প্রকল্পের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। অন্য একটা প্রতিবেশী দেশেও এই জঘন্য ধরনের আধা-উপনিবেশবাদী শোষণ আখ্যানের পুনরাবৃত্তি দেখা গেল। গত বছর জুন মাসে শ্রীলঙ্কায় দেখা গিয়েছিল “আদানিকে থামাও” প্রতিবাদ। শ্রীলঙ্কার সিলোন ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম এম সি ফার্ডিনান্ডো সংসদীয় এক প্যানেলকে যখন জানান যে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে তাঁকে বলেছেন যে মান্নার-এর বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়ার জন্য মোদী তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন, তখনই ঐ প্রতিবাদ ঘটে। পরবর্তীতে ফার্ডিনান্ডো স্পষ্টতই চাপের মুখে তাঁর বিবৃতি প্রত্যাহার করে নিয়ে পদত্যাগ করেন।
এই লেখা যখন ছাপার জন্য পাঠানো হচ্ছে দেশের সঙ্গে প্রতারণা তখন আরও কদর্য হয়ে উঠছে। হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ইতিমধ্যেই জানিয়েছে যে, তিনটে অর্থ তহবিল বর্তনীচক্রের লেনদেনে এবং আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের কারচুপিতে যুক্ত ছিল, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে এলারা ক্যাপিটাল পরিচালিত ফাটকা অর্থ তহবিল এলারা ইন্ডিয়া অপরচুনিটিজ ফান্ড। এই বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্র আরও বিশদ তথ্য দিয়েছে। এলারা ও তার সাথে আদানি ডিফেন্স হল বেঙ্গালুরুর প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সম্পর্কিত একটা কোম্পানি আলফা ডিজাইন টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড-এর (এডিটিপিএল) প্রমোটার। এই এডিটিপিএল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) এবং প্রতিরক্ষা উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থার (ডিআরডিও) সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৫৯০ কোটি টাকার বরাত পেয়েছে। এর সংকেতগুলো ভয়াবহ। সন্দেহজনক একটা বিদেশী সংস্থা যখন ডিআরডিও এবং ইসরোর মত সংবেদনশীল কার্যকলাপে প্রবেশাধিকার পায়, সে ক্ষেত্রে ভারতের নিরাপত্তাকে সংকটাপন্ন করে তোলার ঝুঁকি কি থাকে না?
বিপুলাকায় এই কেলেঙ্কারির যথাযথ তদন্ত চালানোর পরিবর্তে সরকার তদন্তকে প্রতিহত বা বানচাল করতেই কোমর বেঁধেছে। সুপ্রিম কোর্ট যে তদন্ত প্যানেল গড়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই, কিন্তু সেই প্যানেলের কাজ তো হবে কেবল বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা; হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ যে বুনিয়াদি প্রশ্নটা তুলেছে, এই কেলেঙ্কারির পিছনে মোদী-আদানি গাঁটছড়া কাজ করেছে কি না, সেটা এই প্যানেলের বিচার্যই নয়। সুতরাং দায়টা বর্তাচ্ছে আমাদের ওপর, ভারতীয় জনগণের ওপর। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে শুধু এই কেলেঙ্কারির জন্যই নয়, গোটা দেশের পক্ষে ভীষণ বিপর্যয়কর স্যাঙাতি পুঁজিবাদের উত্থানের জন্যও জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে হবে।
বিদ্যুৎ গতিতে আদানির উত্থানের ব্যাখ্যা কি হতে পারে? এর উত্তরের সূত্র রয়েছে স্যাঙাতি পুঁজিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির মধ্যে যা হল অবক্ষয়ী একচেটিয়া পুঁজিবাদের এক চরম হানিকর ও ধ্বংসাত্মক রূপ, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন যেটাকে পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরের অর্থনৈতিক মর্মবস্তু বলে অভিহিত করেছিলেন, ভারতে যেটা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায় মোদীর তত্ত্বাবধানে। কলঙ্কজনক এই আখ্যানের তিনটে সুস্পষ্ট পর্যায় রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে।
২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গায় গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদীর ভূমিকার জন্য ভারতের বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই দেশে ও বিদেশে মোদীর নিন্দায় গলা মেলান। এটা একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, কেননা, সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য সামাজিক ইস্যুতে তাদের ব্যক্তিগত মতামত যাই হোক না কেন, ব্যবসাদার হওয়ায় আইন ও শৃঙ্খলার শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিই সব সময় তাদের কাছে কাম্য ছিল। তখন হীরে ও রত্নের নামগোত্রহীন ব্যবসায়ী গৌতম আদানি নিজের ব্যবসায়ী জীবনে উন্নতির লক্ষ্যে এই সুযোগকে সুচতুরভাবে কাজে লাগালেন। উঠতি ধনকুবের মুকেশ আম্বানি-সহ অন্যান্য গুজরাটি ব্যবসায়ীদের নিয়ে তিনি ২০০৩-এর নবরাত্রি উৎসবের সময় গুজরাট সরকারকে প্রথম ‘প্রাণোচ্ছল গুজরাট : বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের শীর্ষবৈঠক’ সংগঠনে সহায়তা করলেন। এই শীর্ষবৈঠক দু-বছর অন্তর নিয়মিত অনুষ্ঠান হয়ে উঠল এবং মোদীকে সহায়তা করল রক্তেরাঙা হাতের শাসক হিসেবে প্রতিভাত হওয়ার বদলে আধুনিক অর্থনৈতিক প্রগতির মুখ হিসাবে – ‘গুজরাট মডেল’-এর রূপকার হিসাবে – নতুন রূপে নিজেকে জাহির করতে। ইত্যবসরে, অন্যান্যদের মধ্যে আদানিকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছাড় মঞ্জুর করা হলো যা তাঁর সম্পদ ও মর্যাদাকে দ্রুত বহুগুণ বাড়িয়ে তুলল।
প্রাদেশিক একটা মডেলকে জাতীয় স্তরে খাপ খাওয়াতে গেলে যথেষ্ট উদ্ভাবনার প্রয়োজন। আরএসএস-এর পরিচালনায় ও সক্রিয় সমর্থনে মোদী এক আগ্রাসী হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণে জোর দিয়ে রাজনৈতিক ফ্রন্টে নেতৃত্ব দিলেন; আর আদানি, আম্বানি ও তাদের সম্প্রদায়ের হাতে অর্পণ করলেন অর্থনৈতিক এজেন্ডাটা: ‘জাতীয় সমৃদ্ধির’ পথ হল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলো-সহ বিদ্যমান সমস্ত কিছুর করপোরেটিকরণ। ২০১৮ সালে ভারত সরকারের একটা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বলে বিমানবন্দর পরিচালনায় পূর্ববর্তী কোনো অভিজ্ঞতা বর্জিত আদানিদের ছটা বিমানবন্দর পরিচালনার নিলামে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো এবং সেই নিলামে তারা সফলও হলেন। এই সিদ্ধান্ত আদানি গোষ্ঠীকে রাতারাতি দেশের অন্যতম বেসরকারি বৃহৎ বিমানবন্দর পরিচালকে পরিণত করল। আদানি দেশের বন্দর, সড়ক, রেল, জীবাশ্ম-জ্বালানি ও সবুজ বিদ্যুত ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক টেন্ডারে জয়ী হতে ও পরিকাঠামো প্রকল্পে বরাত পেতেও সফল হলেন। মোদী এটাকে ‘জাতির নির্মাণ’ বলে অভিহিত করলেন আর তার পর থেকে আদানিও প্রায়শই দেশপ্রেম ও লোকপ্রিয়তার রং চড়িয়ে এই মন্ত্র আউড়ে চলেছেন। আদানি এইভাবে তাঁর সম্প্রদায়ের অন্যান্যদের চেয়ে মোদীর মার্কামারা রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়ী মডেলের সমন্বয় ঘটাতে অনেক বেশি সফল হয়েছেন। আর এর মধ্যেই রয়েছে তাঁর অসামান্য সাফল্যের ভিত্তি।
গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় নির্বাচনের মোটামুটি এক বছর আগে এবং বিবিসির তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর পরবর্তী পর্যায়ে হিন্ডেনবার্গ-এর রিপোর্ট মোদী-আদানির আঁতাতবদ্ধ মডেলের প্রতি এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। ভারত ও বিশ্বের অথনীতিতে এখন যে জোরালো প্রতিকূল হাওয়া বইছে এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্র নতুনতর যে উন্মোচন ঘটিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই মডেলের সংকট আগামী মাসগুলোতে আরও জটিল হয়ে উঠবে বলেই মনে হয়।
টীকা:
১। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির প্রোমোটাররা যাতে শেয়ারের দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে তুলতে বা কমাতে না পারেন তার জন্য মোট শেয়ারের ৭৫ শতাংশের বেশি মালিকানা নিজেদের দখলে রাখার অধিকার তাঁদের নেই।
২) একটা শেল কোম্পানি হলো এমন এক সংস্থা যার ব্যবসায়ী সত্ত্বার একটা খোলস বা বহিরাবরণ রয়েছে, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে যা ফোঁপড়া — যার শুধু কাগুজে অস্তিত্বই রয়েছে, যার সত্যিকারের কোনো ব্যবসা নেই বা থাকলেও একেবারেই সামান্য।
৩) রাউন্ড ট্রিপিং এমন একটা পদ্ধতি যার মাধ্যমে অর্থ এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে গিয়ে প্রথম দেশটিতে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়। যে উদ্দেশ্যে তা করা হয় তা হলো কালো টাকাকে সাদা করা অথবা মরিশাসের মতো দেশে কর ছাড়/ ফাঁকির সুবিধা নেওয়া, যে দেশগুলোতে করের পরিমাণ খুব কম, কর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা খুবই শিথিল, ইত্যাদি। এছাড়া, এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে (আদানি গোষ্ঠী যার একটা নিদর্শন) যখন ঘুরপথে ফিরিয়ে আনা অর্থ ভারতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যকে বাড়িয়ে তুলতেও কাজে লাগানো হয়েছিল। এই সমস্ত কারণে ক্ষেত্র বিশেষে রিজার্ভ ব্যাংকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া ঐ ধরনের লেনদেন নিষিদ্ধ। তবে, ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় বসার পর সরকার নিয়োজিত এক উচ্চপর্যায়ের পরামর্শদাতা গোষ্ঠী বলে, “রাউন্ড ট্রিপিং-এর এই অন্তরায়টা দিয়ে একটা বৃহৎ ক্ষেত্রকে আর রুদ্ধ করা যাবে না যেমন যান দুর্ঘটনার ঝুঁকির কথা বলে একটা গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়ের নির্মাণকে বন্ধ করা যায় না”। ঐ গোষ্ঠী সুপারিশ করে, আইন সংশোধন করে রাউন্ড ট্রিপিং-এর বিষয়টাকে ভারতের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয় চালু করা হোক। এইভাবে, ব্যবসা করাকে সহজসাধ্য করার নামে আগের কঠোর ব্যবস্থার কিছুটা উদারিকরণ ঘটানো হয়েছিল।
৪) দীর্ঘ সময় ধরে আদানিরা তাদের গোষ্ঠীতে বিনোদ আদানির কোনো পদমর্যাদা থাকার কথা সরকারিভাবে অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু গত ১৭ মার্চ একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তারা জানায় যে, বিনোদ আদানি হলেন গোষ্ঠীর অন্যতম প্রমোটার।
৫) বিশদে জানবার জন্য দেখুন আলজাজিরায় ২০২৩-এর ১মার্চ প্রকাশিত শ্রী গিরেশ জালিহাল ও কুমারসম্ভবের লেখা নিবন্ধ মোদী সরকার আদানিকে এমন কয়লাচুক্তি মঞ্জুর করে যেটা তারা নিজেরাই ‘অসংগত’ বলে জানত।
– অরিন্দম সেন
(লিবারেশন, এপ্রিল ২০২৩ সংখ্যা থেকে)
( দেশজুড়ে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা আজ কতটা আক্রান্ত, বিপন্ন, তার উপর নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ৮ মার্চ এক অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার লেখা লিখেছেন কাশ্মীর টাইমস্-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন। এই লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র আলোড়ন ওঠে। বিজেপি-র প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ এটাকে ভারত বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসাবে দাগিয়ে হৈচৈ শুরু করে। আমরা এই লেখাটির গুরুত্ব বুঝে এখানে প্রকাশ করছি। — সম্পাদকমন্ডলী, দেশব্রতী। )
অক্টোবর ১৯, ২০২০’র সন্ধ্যে। শ্রীনগর শহরে ‘দি কাশ্মীর টাইমস্’ পত্রিকার অফিসে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররা দিনের কাজ শেষ করার তাড়ায় ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে, ঝড়ের বেগে অফিসে ঢুকলেন সরকারি কর্মকর্তারা, সঙ্গে পুলিশ। তারা প্রায় ঘাড় ধরে কর্মীদের বের করে দিয়ে, অফিসের দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। সেই তালা আজও ঝুলছে।
আমি জানি, এই হানা ছিল একটা শাস্তি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নীতি নিয়ে প্রশ্ন করার ধৃষ্টতার শাস্তি! এই সংবাদপত্রটি, আমি যার কার্যনির্বাহী সম্পাদক, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের এক স্বাধীন কণ্ঠস্বর হিসেবেই থেকেছে তার জন্মলগ্ন অর্থাৎ সেই ১৯৫৪ সাল থেকে। আমার বাবার হাতেই তার সূচনা হয়েছিল। তখন থেকে, যুদ্ধ ও সামরিক দখলদারির ঝড়ঝাপ্টার বেশ কয়েকটি দশকের দাপটের মধ্যেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিন্তু মোদিজীর আমলে তার সংকট ঘনিয়ে এল, আর বোধ হয় তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। মোদিজীর দমনমূলক মিডিয়া পলিসি কাশ্মীরী সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সংবাদসংস্থাগুলিকে সরকারি মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করার জন্য লাগাতার হুমকি দিয়ে আর আমাদের প্রায় ১৩০ লক্ষ মানুষের এই অঞ্চলে কার্যত তথ্যের এক বিরাট শূন্যতা তৈরি করে সেই ধ্বংসপর্ব চলছে।
এবার শ্রী মোদী এই বিপর্যয়ের মডেলটির অবিকল প্রতিরূপ জাতীয় স্তরে চালু করার জন্যে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তার উগ্র হিন্দু-জাতীয়তাবাদী পদক্ষেপ ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা ও হিংসাকে স্বাভাবিক ব্যাপার করে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, তা ইতিমধ্যেই সাংবাদিকদের নজরবন্দি ও কারারুদ্ধ করে, এবং সরকারের পছন্দসই খবরের জন্য সংবাদসংস্থাগুলির ওপর আক্রমণাত্মক কৌশল প্রয়োগ করে, ভারতের একদা-প্রাণোচ্ছল দুর্দমনীয় সংবাদমাধ্যমের ওপর ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি করে ফেলেছে। কিন্তু এই জানুয়ারিতে ডিজিটাল মিডিয়ার নির্দেশিকার যে খসড়া সংশোধনী চালু হয়েছে, তা আরও ভয়ঙ্কর, এবার সরকার তার অপছন্দের যে কোন প্রচারবস্তুকে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা পেয়ে গেল।
অন্যভাবে বলতে গেলে, বাকি ভারতের জন্যেও শেষপর্যন্ত হয়তো কাশ্মীরের মতো ভাগ্যই অপেক্ষা করছে।
গত ২০১৯-এ মোদী সরকার কাশ্মীর ভূখণ্ডের জনগণের থেকে কোন রায় না নিয়েই আচমকা তার স্বশাসনের মর্যাদা বাতিল করে দেয়, হাজার হাজার সেনা পাঠায় এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। এই শাট ডাউন প্রায় ছ’মাস স্থায়ী হয়েছিল। শ’য়ে শ’য়ে সাংবাদিকদের তখন ইন্টারনেটযুক্ত সরকার-নির্দিষ্ট একটা মাত্র সাইট থেকে রিপোর্ট পাঠানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৫ মিনিট সময়। তখন থেকে ইন্টারনেটের শ্লথ গতি দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে।
পরের বছর এমন বিধি লাগু করা হল যা সরকারি কর্মকর্তাদের সংবাদমাধ্যমের যে কোনো প্রচার্য বিষয়কে “ভুয়ো খবর, টুকলিবাজি এবং অনৈতিক বা দেশদ্রোহী” ছাপ্পা মারার আর সাংবাদিক ও প্রকাশন সংস্থাগুলিকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার দিয়ে দিল। এসব বিধির ঘোষিত লক্ষ্য নাকি “সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ মানকে উৎসাহিত করা” — কী নিদারুণ পরিহাস!
পুলিশ সাংবাদিকদের নিয়ম করে ডেকে পাঠায়, জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসানোর হুমকি দেয় — কখনও সেটা আয়কর লঙ্ঘন আবার কখনও সন্ত্রাসবাদ বা বিচ্ছিন্নতাবাদের ‘অভিযোগ’। বেশ কিছু বিশিষ্ট সাংবাদিক হয় আটক আছেন আর নয়তো জেল খাটছেন।
আমরা একটা ভয়ের বাতাবরণের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছি। ২০২১-এর শেষে, আমি এক তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম — সাজিদ গুল — নিজের রিপোর্টিং-এর জন্যে ওকে অনেক হেনস্থা সইতে হচ্ছিল। আমাকে ও বলেছিল, গ্রেপ্তারির ভয়ে প্রতিটা রাতে ও বাইরের পোশাক পরেই ঘুমোতে যায়, বিছানার পাশেই জুতো রেখে — যেটা কাশ্মীরে একেবারেই দস্তুর নয়; সেখানে জুতো খুলে বাইরে রেখে তবে ঘরে ঢোকাটাই রীতি। যে কোনো মুহূর্তে দৌড়ে পালানোর পথ খোলা রাখতেই ওকে এটা করতে হত। গত বছর জানুয়ারিতে ছেলেটি ধরা পড়ে যায়, আজ পর্যন্ত সে হেফাজতেই আছে। অনেক সাংবাদিক নিজেদের রিপোর্ট সেল্ফ সেন্সর করছেন, অনেকে ছেড়েই চলে গেছেন। গ্রেপ্তারি এড়াতে অনেকে বিদেশে পালিয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। ভারত সরকার, দেশ ছেড়ে যাওয়া আটকাতে অন্তত কুড়ি জন অন্য সাংবাদিককে ‘নো- ফ্লাই’ তালিকায় রেখে দিয়েছে (বিমান যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে)।
কাশ্মীরে সাংবাদিকতা সব সময়েই এক বিপন্নতার মধ্যে থেকেছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই এই পার্বত্য অঞ্চলকে নিজের বলে দাবি করে এসেছে। ফলে এটি দশকের পর দশক যুদ্ধ আর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে বিপর্যস্ত থেকেছে। সাংবাদিকরা তার মাঝখানে পড়ে গেছেন। সব সময়েই তাদের একদিকে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী আর অন্য দিকে জঙ্গিদের হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের মধ্যে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। এরা উভয়েই কীভাবে সংবাদ করা হবে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। কাশ্মীরে ১৯৯০ থেকে ২০১৮’র মধ্যে কম করে ১৯ জন সাংবাদিককে খুন করা হয়েছে। তবুও কাশ্মীরী সাংবাদিকতা শেষ হয়ে যায়নি, বরং নিজের বিকাশ ঘটিয়েছে। খবরের কাগজ আর নিউজ ওয়েবসাইটের সংখ্যা বেড়েছে, আর প্রতিভাবান তরুণ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি নতুন প্রজন্ম তাদের নতুন স্বচ্ছ দৃষ্টিতে কাশ্মীরের সমস্যাকে দেখেছে, তুলে এনেছে জনস্বার্থ সম্পর্কিত অনুপুঙ্খ-গবেষণানির্ভর নানা সাহসী প্রতিবেদন যা অনেক সময় সরকারকেও ছেড়ে কথা বলেনি।
কিন্তু আজ মোদী জমানায় সবটাই হারিয়ে গেছে। এই সরকারের উদ্দেশ্য হল কাশ্মীরে যে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী কণ্ঠস্বরকে যেমন, তেমনি যারা আপোস-মীমাংসা বা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির কথা বলে তাদেরও চুপ করিয়ে দেওয়া। কাশ্মীরী খবরের কাগজগুলো সরকারি বিজ্ঞাপন আর সংবাদমাধ্যমের ভর্তুকির ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল, আর সরকার এই সুযোগটা পুরোপুরি উশুল করে নেয় যাতে কাগজে যে কোন ঘটনার প্রশাসন-অনুমোদিত বিবরণটাই ছাপার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়। আজ ক’টি কাশ্মীরী সংবাদসংস্থা আর সরকারি নীতিকে প্রশ্ন করার সাহস রাখে! অনেকেই শুধুমাত্র ব্যবসায়ে টিঁকে থাকার জন্যে সরকারের উচ্চকণ্ঠ মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। আমার নিজের কাগজ কোনোমতে টিঁকে আছে। ২০১৯’এ আমি ইন্টারনেট শাট ডাউনকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করি। স্পষ্টতই প্রতিশোধ নিতে, সরকার আমাদের শ্রীনগরের অফিস সিল করে দেয়। আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই ছেড়ে চলে গেছেন, আমাদের কাজকর্মও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আজ, আমি যখন প্রস্তাব রাখলাম যে জনস্বার্থ সম্পর্কিত রিপোর্টিং-এর ক্ষেত্রে আমরা আক্রমণাত্মক অবস্থানে থাকব, কাউকে ছেড়ে কথা বলব না — আমাকে অতি সতর্ক, হাতে গোনা কর্মীদের প্রতিরোধের সামনেই পড়তে হল।
কাশ্মীরে এক তথ্যের শূন্যতা বিরাজ করছে — এই অঞ্চলে যা ঘটছে সে সম্পর্কে মানুষ যথেষ্ট তথ্য পাচ্ছেন না অথবা ভুল তথ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন — গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো চেপে যাওয়া হচ্ছে, গুরুত্বহীন করে বা সরকারের উদ্দেশ্যের উপযোগী করে বিকৃত করে প্রচার করা হচ্ছে।
২০২১’এ যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের এক শীর্ষব্যক্তিত্ব সৈয়দ আলি শাহ গিলানি মারা যান, কাশ্মীরে এই সংবাদ সম্প্রচারিত হয়নি অথবা খুব সংক্ষেপে প্রচার করা হয়েছিল। গত মাসে সরকার যখন কয়েক হাজার বাড়ি, কর্তৃপক্ষের মতে যেগুলো নাকি সরকারি জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত, ধূলিসাৎ (বুলডোজ) করার অভিযান শুরু করে, কাশ্মীরের একটি প্রথম সারির সংবাদসংস্থা তাকে অজ্ঞাতনামা “প্রভাবশালী জমি- হাঙরদের” বিরুদ্ধে ‘এক বলিষ্ঠ আঘাত’ বলে তাদের প্রচারে তুলে ধরেছিল। সেখানে আচমকা ঘর হারানো গরিব কাশ্মীরীদের বা সেই সব বাসিন্দা যারা মালিকানার বৈধ নথিপত্র আছে বলে দাবি করছিলেন তাদের সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি।
এক অসচেতন জনতা আর পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ, সমালোচনা ও দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত সরকার গণতন্ত্রের জন্য এক বিপদ। কিন্তু মোদীজী সারা ভারত জুড়ে এটারই পুনরাবৃত্তির অভিপ্রায় পোষণ করছেন। ডিজিটাল মাধ্যমের জাতীয় গাইডলাইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী যা গত জানুয়ারিতে প্রকাশ্যে এসেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে যেসববিধি আরোপিত হয়েছিল তার এক বিস্ময়কর সাদৃশ্য আছে। এর মাধ্যমে সরকারি ফ্যাক্ট চেকাররা অনলাইন কোনো প্রচার্য বিষয়কে “ভুয়ো বা মিথ্যা” তকমা দেওয়ার ক্ষমতা পেয়ে গেলেন। এই পরিবর্তনগুলো ঘোষণার পরই সরকার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সমালোচনামূলক বিবিসি’র তথ্যচিত্র “ইন্ডিয়া: দ্যা মোদী কোয়েশ্চেন”-এর লিঙ্ক বন্ধ করে দেওয়ার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলিকে আদেশ দেয়। পরে ভারতীয় আয়কর কর্মীরা ভারতে বিবিসি’র অফিসে তল্লাশী চালায়। ভারতে সমালোচনার কণ্ঠগুলিকে চাপে রাখার জন্য বারবার এইরকম হানাদারি চালানো হচ্ছে।
২০১৪-তে ক্ষমতায় আসার পর মিস্টার মোদী আদালত এবং অন্যান্য সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে তার ইচ্ছামতো পরিবর্তন করে ধারাবাহিকভাবে ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শগুলির অবনমন ঘটিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত টিঁকে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংবাদ মাধ্যম হল এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা ভারতের অধোগতিকে স্বৈরতন্ত্রের ঠিকানায় পৌঁছানোকে রুখে দিতে পারতো। কিন্তু মোদীজী তথ্য নিয়ন্ত্রণের ‘কাশ্মীর মডেলকে’ বাকি ভারতের জন্যেও চালু করতে সক্ষম হলেন, এতে শুধু সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাই নয়, ভারতের গণতন্ত্রেরও বিপদ ঘনিয়ে এল।
ভাষান্তর : জয়ন্তী দাশগুপ্ত
২০০৯ সালে এল শিক্ষার অধিকার আইন। আট থেকে চোদ্দ বছর পর্যন্ত সবার জন্য। ফেল থাকলো না ক্লাস এইট অবধি। স্কুলে ভর্তির জন্যও কোনও পরীক্ষা, মেধাতালিকা তৈরি করা ইত্যাদি বাদ দিয়ে দেওয়া হল।
এর ফলে নিঃসন্দেহে বেশ কয়েকটি সুবিধে হল। যে সমস্ত প্রান্তিক পরিবারের ছাত্র ছাত্রীরা আগে সাধারণভাবে স্কুলের চৌহদ্দিতে আসত না, বা এলেও খুব সামান্য দিন পর স্কুল ছুট হয়ে যেত, তারা স্কুলে থেকে গেল। অন্তত খাতায় কলমে থেকে গেল। কেউ কেউ পড়াশুনো সামান্য শিখলও মাঝে মাঝে স্কুলে এসে। আর ব্যতিক্রমী কয়েকজন অনেকদূর এগিয়ে গেল। আগেই চালু হয়েছিল মিড ডে মিল প্রকল্প। সেটাও প্রান্তিক পরিবারের কিছু ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে ধরে রাখতে সাহায্য করল।
কিন্তু এই যে সাফল্যটা, এর কিছু মূল্যও দিতে হল। কী ধরনের মূল্য? সরকারী স্কুলগুলি, বিশেষ করে শহর শহরতলীতে খুব দ্রুত মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে ব্রাত্য হয়ে গেল। অল্প কয়েকটি সরকারী স্কুল বাদ দিয়ে বাকিগুলিতে প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরাই কেবল ভর্তি হলেন। যাদের কিছু টাকা পয়সা আছে তারা বেসরকারী ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে চলে গেলেও সেই মাত্রায় সমস্যা ছিল না, যদি সরকারী স্কুলগুলোর গুণমান বজায় থাকত। তাহলে অভিভাবক অভিভাবিকা, এমনকী যারা আর্থিকভাবে বেশ সবল, তারাও ইচ্ছে হলে সরকারী স্কুলগুলোতে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারতেন। কিন্তু অবস্থা এমনই দাঁড়াল যে সরকারী স্কুলগুলো মূলত ৮০/৯০ শতাংশ এমন ছাত্রছাত্রীতে ভরে থাকল যাদের বইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ খুব ক্ষীণ বা সামান্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফেল প্রথা না থাকায় তারা পরের পর ক্লাসে উঠে যেতে থাকল। ফলে ক্লাসরুমে দেখা যেতে লাগল এমন সব ছেলেমেয়েকে যারা সেই ক্লাসের পড়া খুব সহজ করে বুঝিয়ে বললেও সেটা বোঝার জায়গায় থাকল না। সেই সঙ্গে স্কুলে খুব অনিয়মিত হওয়ায় পাঠের ধারাবাহিকতা থেকেও তারা থাকল বিচ্ছিন্ন।
গোটা বিষয়টিকে একটা সমস্যা, যার জরুরি সমাধান হিসেবে দেখা প্রয়োজন, সেইভাবে দেখা হল না। দেখা হল কেবল ওপর ওপর একটা ‘মানবিক সহনাভূতি’র সঙ্গে। আহা গরিব, বাড়িতে পড়াশুনোর পরিবেশ নেই, পড়বে কী করে’ – এই কথা বলে তাদেরও যে সুশিক্ষার একটা দরকার ছিল, সেটা কীভাবে তাদের দেওয়া যায়, সেটাকেই লঘু করে দেওয়া হল। তাদের প্রতি আপাত সহানুভূতি দেখিয়ে আসলে তাদের ক্ষতি করে দেওয়া হল মারাত্মকভাবে। দরকার ছিল তাদের প্রতি প্রকৃত সহানুভূতি। সেটা তাদের জন্য সুশিক্ষা নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়েই হতে পারত।
এরই সঙ্গে কিছু বাকপটু বুদ্ধিজীবী কিছু কিছু কথা তুলতে লাগলেন যা তাত্ত্বিকভাবে যতই মনোহর শোনাক, কার্যক্ষেত্রে একেবারেই অকার্যকরী। যেমন তারা বললেন ছাত্রকে ফেল করানো ঠিক নয়। কারণ ছাত্র যদি শিখতে না পারে তাহলে তা ছাত্রের নয়, শিক্ষকেরই ব্যর্থতা। সিস্টেমের সমস্যা আড়াল করে সব দায় শিক্ষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কথাটা শুনতে কারো কারো যতই ভালো লাগুক, ক্লাসঘরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যারা নিত্যদিন যান, তারা বাস্তবে জানেন কথাটার মধ্যে আর যাই থাক, বাস্তবতা নেই। সত্যকে আড়াল করার একটা চেষ্টা আছে। যে ছেলেটি বা মেয়েটি শিখতে পারছে নানা কারণেই, যে আগের নিচু ক্লাসগুলোতে পাশ না করে করে পরের পর উঁচু ক্লাসগুলোতে এসে বসেছে, তাকে যে উঁচু ক্লাসের পড়াটা শেখানো সম্ভব নয় – শিক্ষাবিজ্ঞানের এই অ আ ক খ ভুলে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। প্রথম বিশ্বের নানা দেশে যে মডেল চলে, তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক পরিবারে ছেয়ে থাকা দেশে বা রাজ্যে সেই মডেল কিছুতেই চলতে পারে না। আমাদের দেশ বা রাজ্যের সমস্যা আমাদের নিজস্ব। এখানকার পরিস্থিতি অনুযায়ীই এখানকার নীতিমালা স্থির করতে হবে।
আমাদের এখানে দিনের পর দিন সবচেয়ে অবহেলিত প্রাথমিক স্তরের স্কুলশিক্ষা। অথচ প্রাইমারি স্কুলশিক্ষার ওপরে মারাত্মক জোর না দিয়ে কিছুই করা যাবে না। কারণ সেটি ভিত তৈরির জায়গা। আমাদের এখানে প্রাইমারি স্কুলগুলোর অবস্থা দেখুন। পড়াশুনো অধিকাংশ জায়গাতে নামে মাত্র। পাশ ফেল প্রাইমারিতে বহুদিন ধরেই নেই। প্রাইমারিতে শুরুতেই ফেল থাকাটা হয়ত দরকারও নেই। কিছুটা সময় একটি শিশুকে নির্ভয়ভাবে স্কুলে খাপ খাওয়ানোর জন্য দেওয়াই উচিত। কিন্তু ক্লাস ফোর থেকে একটি ছেলেকে কেন প্রাইমারি পাশ সার্টিফিকেট দিয়ে হাইস্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, যে বাংলা বর্ণমালা ভালো চেনে না, যুক্ত অক্ষর পড়তে পারে না, একটি সহজ বাক্য পড়তে পারে না ? এইভাবে পাশের পরিসংখ্যান তৈরি করে লাভ কি ?
পশ্চিমবঙ্গের স্কুল শিক্ষার ভয়ানক চিত্রটি বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্ট থেকে উঠে এসেছে। কোভিডকালের আগেই ছিল নানা সঙ্কট। কোভিড ও দীর্ঘ লকডাউন তাকেই আরো মারাত্মক আকার দিয়েছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে এরকম অসংখ্য সরকারী স্কুল আছে যেখানে ক্লাস এইটের ছেলেমেয়েদের অনেকেই ঠিকমত একটা পাঠ্যবই রিডিং পড়তে পারে না। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সরকার বলে যাচ্ছেন শিক্ষার জন্য তারা কত কিছু করছেন। কন্যাশ্রী দিচ্ছেন, সবুজসাথী দিচ্ছেন, ট্যাবলেট/ স্মার্ট ফোন কেনার টাকা দিচ্ছেন, নানা স্কলারশিপ দিচ্ছেন, জামা কাপড় দিচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মূল সমস্যাটা সমাধানের জন্য যে কিছুই করে উঠতে পারছেন না, সেইটে হল সবচেয়ে বড় খামতির জায়গা।
অথচ চাইলে যে সরকারী স্কুল শিক্ষার হাল ফেরানো যায়, সেটা দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার করে দেখিয়েছেন। দেশের এক মেট্রো শহর দিল্লির সরকারী স্কুল শিক্ষা আর আর এক মেট্রো শহর কলকাতার সরকারী স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনা করলে আকাশ পাতালের বিরাট ফারাক চোখে পড়বে। এই তুলনা এও দেখিয়ে দেয় যে চাইলে অনেক কাজ সরকার করেই উঠতে পারতেন। প্রাইমারি শিক্ষার হাল ফেরানোর কাজটা তারা তো ভালোভাবে শুরুই করলেন না। এখন দেখা যাচ্ছে আমরা যাদের হাতে রাজ্য শাসনের দায় তুলে দিয়েছিলাম, তারা শিক্ষাক্ষেত্রকে উন্নত করা নয়, তার থেকে কীভাবে টাকা কামানো যায় তাতেই মন প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। নিয়োগ দুর্নীতি ক কোটি টাকার কে জানে, কত দূর তার শিকড় বাকড় ছড়ানো তা নিয়ে নিত্যনতুন নানা খবর শোনাচ্ছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো।
শিক্ষাবিদদের নয়, শিক্ষা নিয়ামক সংস্থাগুলির ঘরে এখন কেবল গোয়েন্দা পুলিশের যাতায়াত। শিক্ষাবিদেরা আলোচনাসভায় নয়, জেলের ভেতরে রয়েছেন তাদের পাপের শাস্তি নিয়ে। দুর্নীতির ফলে স্বাভাবিকভাবেই আদালতের দারস্থ হয়েছেন চাকুরী প্রার্থীরা। বন্ধ রয়েছে নতুন নিয়োগ। অসংখ্য স্কুল শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। পড়াশুনো বন্ধ হবার মুখে। একটি দল ও তার কিছু মাতব্বর পশ্চিমবঙ্গের কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎটা একেবারে নষ্ট করে দিল। শুধু তাই নয় শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ডকে এমনভাবে আঘাত করল, যে ঘুরে দাঁড়ানো হয়ে গেল খুব কঠিন।
এই অবস্থাকে চলতে দেওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গে সরকারী কর্মচারী ও শিক্ষকদের যে জীবিকাগত ন্যায্য আন্দোলন চলছে, স্বচ্ছ নিয়োগের দাবি নিয়ে যে আন্দোলন চলছে, সেই সব জরুরী আন্দোলনের পাশাপাশি দরকার এক সামগ্রিক শিক্ষা আন্দোলন। যে আন্দোলন ভেঙে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার হাল ফেরানোর কথাবলবে, সেই জন্য নাগরিক আন্দোলন তৈরির চেষ্টা করবে, শিক্ষা সংকটকে সমাজের সর্বস্তরে ‘টকিং পয়েন্ট’ করে তুলে সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায় – সেই চেষ্টা করবে। এই আন্দোলনকে কথা বলতে হবে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ সংক্রান্ত বিষয় সহ আরো নানা কিছু নিয়ে। সেই সব বিষয় নিয়ে আমরা পরের কয়েকটি লেখায় ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করব।
- সৌভিক ঘোষাল
=== 000 ===