নারীদিবস উদযাপনের মাসে খুঁটিয়ে দেখা যাক শ্রমশক্তিতে তাদের অংশগ্রহণের অবস্থা
women's-day-celebrations

বর্তমান সময়ে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের যোগদানের আশা ও উচ্চাকাঙ্খা নবরূপে পরিলক্ষিত হচ্ছে। নারীরা শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা কর্মগত যোগ্যতা কোনোদিক থেকেই আর পিছিয়ে নেই। তদসত্ত্বেও, দেশে নারী শ্রমশক্তি ভিন্ন চিত্র বর্ণনা করে। সমাজের দ্রুত ও তীব্র পরিবর্তনে এক বিপরীতধর্মী বাস্তব উঠে আসছে। নতুন প্রজন্ম অনেক বেশি অগ্রণী হলেও, তাদের কর্মক্ষেত্রের সংজ্ঞা আলাদা। কোভিড অতিমারীর ফলে, কাজ হারিয়েছে কয়েক হাজারেরও বেশি মহিলা শ্রমিক। উক্ত এই সময়েই, ভারতীয় সমাজে কাজের ক্ষেত্রে নজির সৃষ্টি করেছে প্রযুক্তিবিদ্যা। ক্রমশ প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং সমানুপাতে কর্মক্ষেত্র থেকে বিরতি নিতে হচ্ছে প্রাক্তন প্রজন্মকে। প্রযুক্তির বিকাশ ও নির্ভরশীলতাকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা উচিত তা অন্য প্রসঙ্গ হলেও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।

ভারতের বৃহত্তর চিত্রটি ভিন্ন। ভারতের অর্থনীতি ১৯৯০ সাল থেকে বৃদ্ধি পেয়ে থাকলেও, সেখানে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ১৯৯০ সালে ৩০ শতাংশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশে। গত ১৫ বছরে, নারীশ্রমের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার সময় এই পতন বিশেষভাবে তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে ৩২ শতাংশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যেই ব্যবধান পৌঁছেছে ১৯ শতাংশে। মজার বিষয় হল, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে ২০২২ সাল অনুসারে, ভারতে নারী ও পুরুষ শিক্ষাক্ষেত্রে সমান সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে এই খাদ প্রশস্ত হয়। ২০২২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে, স্পষ্টভাবে দেখানো হয় — শিক্ষাক্ষেত্রে নারীরা ০.৯৬১ স্কোর অর্জন করলেও, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে তা নেমে আসে ০.৩৫০-তে।

পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজ এবং স্বতন্ত্র নারীদের মাঝের ব্যবধানটা অনেকটা হাতে আঁকা ছবি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে এডিট করা চিত্রর মধ্যের পার্থক্যের মতন। ২০২২ সালে গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩৫ নম্বর স্থানটি আলো করে রয়েছে, ভারতীয়দের কাছে বর্তমান সান্তনার বিষয় এইটুকুই আমাদের দেশে ‘আচ্ছে দিন’ আসছে কারণ আমরা ২০২১ সালের থেকে পাঁচটি স্থানে উন্নতি লাভ করেছি। এই পরিণতির কারণ, গুরুত্ব বিচার করতে হলে ঘুরে আসতে হবে একটু ইতিহাস থেকে। প্রথমে এই পরিস্থিতির কারণগুলি খোঁজা যাক। খুব সহজ উদাহরণে, কৃষকের সংজ্ঞা ও কৃষাণির সংজ্ঞা। আমাদের সমাজে একজন পুরুষ কৃষিকাজে যেভাবে সুস্পষ্ট ভুমিকা রাখেন মহিলাদের ছবিটি সেখানে বড়ই আবছা। ছোটবেলা থেকে আমরা কৃষকের ছবি দেখি, আঁকি আর মহিলাকে কেবলই তার সহায়ক হিসেবে দেখি। মহিলা ধানের বীজ পোঁতেন, ধান ছাটাইয়ের কাজ করেন কিন্তু লাঙ্গল কিংবা ট্র্যাঙ্কর চালিয়ে সে কাজ করে না। হয়তো, তার কায়িক শ্রমের ক্ষমতা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে বলেই। তবে কৃষিক্ষেত্রে মহিলাদের অবদান ও ভূমিকা তারা নিজেরাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন সদ্য হয়ে যাওয়া বিজেপি সরকারের কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনে। সুদূর পাঞ্জাবের গ্রাম থেকে পুরুষদের পাশাপাশি তারাও একইভাবে ট্র্যাকটার চালিয়ে আন্দোলনে সব ফেলে অংশ নিয়েছেন। মহিলাদের ব্যবসা শুরু কিংবা কৃষিক্ষেত্রে যে পুঁজির প্রয়োজন হয়, তা সহজে মেলে না। কর্মসংস্থানে, আজও ভারতে নারীদের সামগ্রিকভাবে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। যার চরম পরিণতি দেখা গিয়েছে লকডাউনে। নারীপুরুষ উভয়কেই কর্মক্ষেত্রে ছাঁটাইয়ের সম্মুখীন হতে হলেও, সংখ্যায় নারীরা এগিয়ে।

ঐতিহাসিকভাবে আন্দোলন চলেছে সমকাজে সমমজুরির তবুও কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া বিশ্বব্যাপী মহিলারা এখনো পুরুষদের তুলনায় ২০ শতাংশ কম আয় করেন। এই ব্যবধান বর্তমান প্রজন্মের নারীদের অকৃষি কাজে নিযুক্ত হতে কারণ যোগায়। নারীরা যুক্ত এমন সমস্ত ধরনের কাজের (অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, রান্নার কাজ, পরিষ্কার, শিশুর যত্ন, বয়স্কদের যত্ন ইত্যাদি) গণনা করে দেখা গেছে একজন মহিলার কাজের দিনটি অতন্ত দীর্ঘ এবং কঠোর পরিশ্রমের। ঘর-বাইরে মিলিয়ে একজন মহিলা সর্বাধিক ৯১ ঘণ্টা কাজ করেন, অর্থাৎ দিনে ১৩ ঘণ্টা। চাকুরীজীবী হোক কিংবা গৃহবধূ এমন মহিলার, সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টার কম কাজ করেন এমন মহিলার সংখ্যা খুবই নগণ্য। এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত বোধ করার বিষয়টি তো রয়েইছে।

এপ্রসঙ্গে, সামাজিক বিধিনিষেধের ভার এড়িয়ে চলে গেলে খুব ভুল করা হবে। সন্তানের জন্ম, ঘর চালানো, বয়স্কদের সেবা সুশ্রুসা করা, বাড়ির চলমানতার দায় নেওয়া এই সব বিষয়েই আমাদের সমাজ নারীদের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা একাধারে, সময়ের গতির সাথে নিয়মে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, একজন মহিলা বহিরজগতে কোনো পেশায় যুক্ত তা দিয়েও বিচার করা হয় তার চরিত্র ও সে ঠিক কতটা সম্মান পাওয়ার যোগ্য! তার পাশাপাশি চলে, একজন মহিলার উপার্জন করা অর্থের ব্যবহার নিয়ে তর্ক। পিতৃতান্ত্রিকতা, পুরুষদের মধ্যে চাষ করে ভঙ্গুর অহংয়ের, যা একজনের মহিলার উপার্জিত অর্থে জীবনযাত্রা চালাতে বাধা দেয়। সমাজ, একজন মহিলার উপার্জিত অর্থকে এমন করেই আলাদা করে রাখার চেষ্টায় উন্মত্ত থাকে যেন কাজ করাটা তার কাছে কেবল ইচ্ছেপূরণ করা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পরবর্তী সময়ে, আমাদের এই দ্বন্দ্বগুলি অবশ্যই মনে রাখতে হবে। নারী দিবসের ইতিহাস আজ ১৫০ বছর অতিক্রান্ত। নারীরা যে গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলিকে লক্ষ্য করে বছরের পর বছর আন্দোলন করে, ইতিহাসে একটি দিন নিজেদের নামে লিখে নিয়েছেন আজ ভারতে সেই দিকগুলিই আবার নজর কাড়ছে। সময়ের সাথে ভারতীয় সমাজে ব্যতিক্রমের সংখ্যা বাড়লেও, মনে রাখতে হবে ব্যতিক্রম উদাহরণ-অনুপ্রেরণা হতে পারে। বাস্তব নয়। ভারতের মাটিতে আজ ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদ একই সময় তাদের দানবীয় রূপ নিয়ে প্রকট হচ্ছে। ফ্যাসিবাদি বিজেপি সরকারের মহিলাদের বাইনারিতে ফেলার প্রবণতাকে ভেঙ্গে ফেলতেই হবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, মহিলাদের যে সংগঠন চালায় তার নাম ‘দূর্গা বাহিনী’। এই সংগঠনে, একজন মহিলাকে যেভাবে ছোট থেকে শেখানো হয় যে সে ‘দূর্গার রুপ’ অর্থাৎ দশভুজা। মহিলাকে দেবীরুপে দেখা সমাজের খুব পুরনো ধারা, তদসত্ত্বেও একই দেশে ধর্ষিত হতে হয় শয়ে শয়ে মহিলাদের, নির্যাতিত হতে হয় রোজ প্রতিনিয়ত। শুধু বহিজগতে নয়, অন্দরমহলেও। আমাদের মনে থেকেই যাবে, ভারতের ইতিহাসে, আসিফার কথা, দিল্লী নির্ভয়ার কথা, উন্নাওয়ের কথা। উগ্র হিন্দুত্ববাদ সমাজকে যে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখায় তা কখনোই প্রান্তিক মানুষের নয়। সেই সমাজের উচ্চস্তরে থাকবে, কেবল হিন্দুরাই, হিন্দু- পুরুষেরা। পদদলিত হবে সকল প্রান্তিক বর্গের মানুষ — দলিত, মহিলা, আদিবাসী সকলে।

মহিলাদের দশভুজা আখ্যা দিয়ে আসলে তাকে তার ন্যায্য শ্রমের দাম থেকে বঞ্চিত করা হয়। একজন মহিলা ঘর চালানোর কাজে যে দৈনিক শ্রম প্রদান করেন, তার নেই কোনো আর্থিক সুরক্ষা। পুরুষরা তার হাতে ‘হাত খরচ’ হিসেবে তুলে দেন সামান্য কিছু অর্থ। কর্মরত মহিলাদের সকল সময়ে বাড়ির যেকোনো অবনতির জন্য দায়ের শিকার হতে হয়। যেন একজন মহিলার এটা জন্মগত দায়! পুরুষের এতে কোনো ভুমিকাই নেই। আর রইল পরে, সন্তান জন্ম দেওয়া ও তার লালন পালন করা। এ প্রসঙ্গেও সেই একই গল্প, অবিরত। ফ্যাসিবাদি সরকার মহিলাদের যে যৎসামান্য অগ্রগতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে দেখায়, উলটোদিকে মহিলাদের নিয়ে তাদের আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই আজ ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময়ে বিলকিস বানোর ধর্ষণের দোষীদের প্রজাতন্ত্র দিবসে মুক্ত করে দেওয়া হয়।

মহিলাদের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি আজ বারংবার এক হয়ে যাচ্ছে। সে সময় মহিলারা লেবার কোডের জন্য তীক্ষ্ণ লড়াই চালিয়েছিলেন। আজও ভারতের বিজেপি সরকার কর্মক্ষেত্রে যে নতুন লেবার কোড নিয়ে আসছেন, তাতে থাকবে না কোনো নির্দিষ্ট কাজের সময়। অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের যে দাপট বেড়ে চলেছে, তাতে কী এটা বোঝা খুব শক্ত — যে এই শ্রমকোড সরকারের পুঁজিপতিদের বৈধভাবে সাহায্য করা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। পুঁজিবাদ ও তাদের মালিকরা যে কখনোই শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলে না, ভাবেও না, এরজন্য বিশ্বের ইতিহাস কী যথেষ্ট নয়?

নারী আন্দোলন সর্বদাই, সামাজিকভাবে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এসেছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নারীরাও আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে। দাবী তুলেছেন ‘খাদ্য-জমির অধিকার-শান্তির’। ১৯৮০ সালের মতন আজও ইরানের বুকে আন্দোলন গড়ে উঠেছে মেয়েদের স্বাধিকারের প্রশ্নে। সেই সময় ইরানের শাসকের বিরুদ্ধে মহিলারা পর্দা প্রথা বর্জনের মাধ্যমে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলন ব্যাপকতা পায় যখন, দুই শ্রেণীর মহিলা (একজন পর্দা পড়ে, একজন পর্দা ছেড়ে) যুক্ত হয়। তারা স্পষ্ট করে বলেন, মহিলারা কী পড়বে? তা তাদের একান্ত নিজের ইচ্ছায়। সেখানে রাষ্ট্র কোনো নিয়ম হানতে পারে না। আজ ইরানের মাহিসা আমিনের সঠিকভাবে পর্দাপ্রথা না মানার ঘটনা ও ভারতের কর্ণাটকের ছাত্রী মুস্কানের হিজাব পড়তে চাওয়ার অধিকারের লড়াই ইতিহাসকে জাগিয়ে তোলে। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদ যেমন হিজাব পড়ে আশাকে ধর্মীয় মোড়কে অসমতার কথা বলে ব্যাখা করতে চায়, ইরানের সরকার অগুনতি নারীকে মাহিসা আমিনের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চোখ রাঙ্গাতে উদ্দত হয়।

তাই, মহিলাদের ‘দশভুজা’ প্রমাণ করার চক্রান্তকে প্রতিহত করে, মানুষ হয়ে তার ন্যায্য অধিকারের লড়াইকে জোরদার করে তুলতে হবে। ‘আচ্ছে দিনের’ মিথ্যে প্রতিশ্রুতির পর্দা ফাঁস করে বেকারত্বের প্রসঙ্গে মহিলাদের দাবি আদায়ের লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীদের শিক্ষা অন্ন বাসস্থানের জন্য লড়ে যাওয়া সেই নামগুলির স্মরণে ও স্পর্ধায় তীক্ষ্ণ লড়াই গড়ে তুলতে হবে। লড়াই করে পাওয়া অধিকারকে লড়াই করেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মনুবাদি সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

- অনন্যা চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-7