কর্পোরেট ঘনিষ্ঠতাই হল ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্তির মর্মকথা
electoral-bond

ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প চালু হওয়ার সময়ই অনেকে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, রাজনৈতিক দলকে অর্থদানের এই মাধ্যমটা রাজনীতিতে কালো টাকার অনুপ্রবেশকে অনায়াস করে তুলবে, এর মধ্যে দিয়েই বড় বড় ব্যবসায়িক ঘরানাগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষভাবে শাসক দলগুলোর (কেন্দ্র ও রাজ্যের) অনীতিনিষ্ঠ সম্পর্কের বিকাশের পথ প্রশস্ত হবে। রাজনৈতিক দলকে অর্থ প্রদানের যে ধারা এই প্রকল্পে ছকা হলো, তারমধ্যেই রাজনীতিতে কালো টাকার প্রাধান্য বিস্তারের শর্তনিহিত রয়েছে বলে তাঁরা বললেন। এমনকি রিজার্ভব্যাঙ্ক এবং নির্বাচন কমিশনও সেসময় এই প্রকল্পে তাদের আপত্তির কথা মোদী সরকারকে জানিয়েছিল। কিন্তু মোদী সরকারের স্বেচ্ছাচারী ধারা কোনো প্রতিবাদকেই কানে তোলেনি। স্টেট ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট করা ব্রাঞ্চ থেকে ইলেক্টোরাল বন্ড কিনে কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি যত খুশি টাকা পছন্দের রাজনৈতিক দলকে দিতে পারেন। আর এই বন্ড কিনলে তাঁদের নাম ও ঠিকানা গোপন থাকবে, ফলে কে কোন দলকে কত টাকা দিলেন তা সাধারণ নাগরিকদের জানা সম্ভব হবে না, এমনকি, তথ্যের অধিকার আইনের বলেও অর্থদাতার নাম জানা অসম্ভব থেকে যাবে। শাসক দলকে ভালো পরিমাণ অর্থদিয়ে খুশি করে নিজেদের জন্য বিপুল পরিমাণ সুবিধা আদায় করে নেওয়ার এক সুবিধাজনক পন্থা হয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাছে দেখা দিয়েছে ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প। মোদী জমানায় পুষ্ট হয়ে ওঠা সাঙাতি পুঁজিবাদ যে দু’হাত ঢেলে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে অর্থ জোগাচ্ছে তা আজ প্রশ্নহীন বাস্তবতা। তবে, পশ্চিমবাংলার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরও কর্পোরেট আনুকূল্য যে যথেষ্ট মাত্রায় বর্ষিত হয়েছে, ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে প্রকাশিত তথ্য তার সাক্ষ্য বহন করছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে জাতীয় দলগুলোর মধ্যে বিজেপিই ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণের ১৯১৭ কোটি টাকার অর্থ পেয়েছিল, এর পরই দ্বিতীয় স্থান ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের, তাদের প্রাপ্তির পরিমাণ ছিল ৫৪৫.১৭ কোটি টাকা যা কংগ্রেসের প্রাপ্তি (৫৪১.২৭ কোটি) থেকেও বেশি। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কিছু কর্পোরেট সংস্থার ঘনিষ্ঠতা যে গাঢ় হয়ে উঠেছে, এই তথ্য থেকে তা বুঝে ওঠাটা একেবারেই কঠিন নয়।

মোদী সরকার ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরই ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা করে। মোদী সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রকল্প চালু করার কথা প্রকাশ করেন। তখনই বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কালো টাকার আধিপত্য কেমনভাবে কায়েম হতে পারে তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, নাম ঠিকানা গোপন রাখাটাকে হাতিয়ার করে অনেক স্বার্থান্বেষী সংস্থা ও ব্যক্তি শেল কোম্পানি খুলবে। শেল কোম্পানি হল ব্যবসা না করা শুধু সাইনবোর্ড থাকা কোম্পানি। এই সমস্ত কোম্পানির মাধ্যমে প্রকৃত পরিচয়কে গোপন রেখে ইলেক্টোরাল বন্ড কিনে পছন্দের রাজনৈতিক দলের কাছে টাকা পৌঁছে দেওয়াটা সহজ হবে। তবে শুধু শেল কোম্পানি নয়, ট্রাস্ট, হিন্দু আনডিভাইডেড ফ্যামিলি বা অন্য কোনো বিধিবদ্ধ সংস্থারও এইভাবে রাজনৈতিক দলের হাতে অর্থ তুলে দিতে অসুবিধা হবে না। রাজনৈতিক দলকে প্রভাবিত করতে বিদেশী সংস্থার কাছেও বন্ড এক সহজলভ্য উপায় হবে।

নিজেদের আর্থিক শক্তিকে প্রবল করে তোলা ও সাঙাতি কর্পোরেটদের পোষণ করার যে অভিপ্রায়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার বন্ড প্রকল্প চালু করেছিল, তার বাস্তবায়নের বিপর্যয়কর ফল ভারতের জনগণ প্রত্যক্ষ করে চলেছেন। ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে অনুসন্ধান চালানোর সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস সংস্থা জানিয়েছে, ২০১৮’র মার্চথেকে শুরু করে ২০২২’র নভেম্বর পর্যন্ত ২৩ দফায় স্টেট ব্যাঙ্ক ২০,৪৭৪টা বন্ডের মাধ্যমে ১১,৪৬৭ টাকার কিছু বেশি ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি করেছে যারমধ্যে বিজেপির প্রাপ্তি ৫৭ শতাংশের মতো। তবে, পশ্চিমবাংলার শাসকদল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি কর্পোরেটদের অনুরাগ বাড়ার সাথে সাথে বন্ড থেকে তাদের প্রাপ্তিও বেড়ে চলে। বন্ড থেকে ২০১৯ ও ২০২০ সালে তৃণমূলের প্রাপ্তি ছিল যথাক্রমে ৯৭ ও ১০০ কোটি টাকা। তবে, ২০২১-২২ সালে বন্ড থেকে তৃণমূলের প্রাপ্তিতে আকস্মিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে নীতিগত কোনো আপত্তি না থাকায় তৃণমূল এটাকে তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি বলেই মনে করে। তাদের ক্ষোভ শুধু এটুকুই যে, বিজেপি বন্ড থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পেলেও তৃণমূল তাদের তুলনায় পাচ্ছে অনেক কম। মমতা ব্যানার্জি গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০২২’র নভেম্বরে বলেন, “বিজেপি প্রতিটা নির্বাচনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে। এত টাকা আসে কোথা থেকে? গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনের আগে ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি আবার শুরু হয়েছে। প্রত্যেকটা দলই বন্ড গ্ৰহণ করে কেননা সেটা বৈধ। কিন্তু নির্বাচন এলেই বিজেপি কোটি কোটি টাকা সংগ্ৰহ করে।” মমতা ব্যানার্জি যখন এই কথা বলছিলেন, তখন ২০২১-২২ অর্থবর্ষে বন্ড থেকে তাঁর দলের প্রাপ্তির পরিমাণ তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন এমন মনে করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বন্ড থেকে ২০২০-২১ বর্ষে তাঁর দলের প্রাপ্তি ছিল ৭৪.৪১ কোটি, এক বছরেই সেই প্রাপ্তি ৭ গুণ বেড়ে ৫৪৫ কোটির বেশি হল, তার ব্যাখ্যা কী হবে? কর্পোরেট দাক্ষিণ্য ছাড়া এই পরিমাণ অর্থ তৃণমূলের ঘরে জমা হওয়া সম্ভব ছিল না। ইলেক্টোরাল বন্ড বিভিন্ন মূল্যের হয় — ১০০০ টাকা থেকে শুরু করে ১ কোটি টাকার যা হলো সর্বোচ্চ মূল্যের। আজ পর্যন্ত যত বন্ড বিক্রি হয়েছে তারমধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যের বন্ডের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, ১১,৪৬৭ কোটির মধ্যে ১০,৭৭৪ কোটির বন্ডই ১ কোটি মূল্যের। কর্পোরেট সংস্থা ছাড়া অন্য কারও পক্ষেই বা ১ কোটি টাকার বন্ড কেনার সামর্থ্য থাকবে। বন্ডের মাধ্যমে রাজনীতিতে কালো টাকা ঢোকার পথ হাট করে খুলে যাওয়া, গোপন ও রহস্যজনক উৎস থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অর্থচলে আসা, কর্পোরেট আধিপত্য বিস্তারের পথ সুগম হওয়া, অর্থদাতার পরিচয় সাধারণ জনগণের কাছে গোপন রেখে রাজনীতিতে অর্থ আমদানিকে অস্বচ্ছ করা — ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে এই ধরনের নীতিগত কোনো আপত্তি মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে কোনোদিন শোনা যায়নি। আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা দলটার তাই কর্পোরেট ঘনিষ্ঠতাকে গাঢ় করা এবং কর্পোরেটদের থেকে অর্থপ্রাপ্তি নিয়ে কোনো ছুঁতমার্গ নেই। পশ্চিমবাংলায় তাজপুর সমুদ্র বন্দর, দেওচা-পাঁচামী কয়লা প্রকল্প ও অন্য কয়েকটি প্রকল্পে গৌতম আদানির আগ্ৰহ প্রকাশ এবং আগামী এক দশকে এই রাজ্যে ১০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি, ২০২২’র বাংলা বিশ্ব বাণিজ্য শীর্ষবৈঠকে দেশি-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির মধ্যে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্পোরেট ঘনিষ্ঠতা গাঢ়তর হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে অর্থ প্রাপ্তির দিক থেকে তৃণমূলের স্থান কেন বিজেপির পরই দ্বিতীয় হল, তাদের সামগ্রিক আয়ের ৯৭ শতাংশই কেন ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে এল, তার অনুধাবনে তাই কোনো বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হয় না।

খণ্ড-30
সংখ্যা-7