আজকের দেশব্রতী : ২৩ মার্চ ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
23 march deshabratiKisan Mahapanchayat in delhi

আবারও রাজধানীর রাজপথে কৃষকরা! ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে এই প্রথম রাজধানী দিল্লীর বুকে কৃষকদের সমাবেশিত হওয়ার অধিকার মেনে নিতে বাধ্য হল কেন্দ্রের মোদী সরকার। গত ২০ মার্চ ২০২৩ দিল্লীর রামলীলা ময়দানে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (এসকেএম) এক বিশাল কিষাণ মহাপঞ্চায়েতের আয়োজন করে। এই সমাবেশ থেকে দেশের কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেটদের দখলদারীর বিরুদ্ধে ব্যাপকতর প্রতিবাদ গড়ে তুলতে সারা দেশ জুড়ে সম্মেলন, সেমিনার, মিছিল, সভা প্রভৃতি সংগঠিত করার আহ্বান জানানো হয়। এসকেএম কৃষকদের সমস্ত বকেয়া দাবিগুলি পূরণ করতে এবং অবিলম্বে এমএসপি গ্যারান্টি আইন কার্যকর করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করে।

মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয় এসকেএম সারা দেশে বৃহৎ পরিসরে কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের রাজ্য সম্মেলন আয়োজন করবে। সর্বভারতীয় কিষাণ সংগ্রাম যাত্রা শুরু করা হবে এবং কৃষকদের দাবিতে সাধারণ মানুষকেও ঐক্যবদ্ধ করা হবে। বিভিন্ন বক্তারা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে কৃষিক্ষেত্র, কৃষিজমি, বনভূমি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ কেড়ে নেওয়া এবং কর্পোরেট মুনাফাখোরদের কাছে বিক্রি করার জন্য ঋণগ্রস্ত মোদী সরকারের তীব্র বিরোধিতা করেন। কিষাণ মহাসভার সভাপতি রুলদু সিং মানসা, কিষাণ সভার বিজু কৃষ্ণন, বিকেইউ’এর রাকেশ টিকাইত, বিকেইউ (উগ্রাহার) যোগেন্দর উগ্রাহন, নর্মদা বাঁচাও’এর মেধা পাটকর, কিষাণ সংগ্রাম সমিতির ডাঃ সুনিলাম, কৃষক নেতা সত্যবান, সুরেশ কাউথ, সত্যশোধক সভাকক্ষের সভাপতি ড. মহাপঞ্চায়েতে, শ্রমিক কৃষক সংগঠনের কিশোর ধামালে, সুভাষ কাকুস্তে, তরাই কিষাণ সংগঠনের তেজেন্দর বির্ক, ভূমি বাঁচাও সমিতির তরাইয়ের নেতা বাজওয়া সহ ৫০ জনেরও বেশি বক্তা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি বলা হয় এই প্রতিবাদের লক্ষবস্তু হবে কেন্দ্রীয় সরকারের কিষাণ বিরোধী নীতি। মঞ্চ পরিচালনা করেন কিষাণ মহাসভার পুরুষোত্তম শর্মা, বিকেইউ ঢাকোন্ডার জগমোহন, কিষাণ খেত মজদুর সভার রবিন্দর পাতিয়ালা সহ ৯ সদস্যের কমিটি।

কিষান মহাপঞ্চায়েত চলা কালে এসকেএম’এর ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল কৃষিভবনে গিয়ে কেন্দ্রীয় কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রীর সাথে দেখা করে এবং তাঁর কাছে দু’টি স্মারকলিপি জমা দেয়। এসকেএম এবং কৃষিমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়। কৃষকদের অমীমাংসিত ও জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার এসকেএম-এর সাথে ধারাবাহিকভাবে আলোচনায় বসতে রাজি আছে বলে মন্ত্রী জানান। যদিও তিনি সুকৌশলে এমএসপি গ্যারান্টি আইনের প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যান। এসকেএম কৃষিমন্ত্রীকে জানান যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হয়, এসকেএম আরও দুর্বার বিক্ষোভ ও আন্দোলনের ঘোষণা করবে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন — ভেঙ্কাইয়া- অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা, ডাঃ সুনিলাম- কিষাণ সংগ্রাম সমিতি, প্রেম সিং গেহলাওয়াত- সারা ভারত কিষাণ মহাসভা, মিঃ ভি ভেঙ্কটারামাইয়া- অল ইন্ডিয়া কিষাণ মজদুর সভা, সুরেশ কোথ- ভারতীয় কিষাণ শ্রমিক ইউনিয়ন, যুধবীর সিং- ভারতীয় কৃষক ইউনিয়ন, হান্নান মোল্লা- অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা, মিস্টার বুটা সিং বুর্জগিল- ভারতীয় কৃষক ইউনিয়ন (ডাকুন্ডা), জোগিন্দর সিং উগ্রাহান- ভারতীয় কৃষক ইউনিয়ন (উগ্রাহান), সত্যওয়ান- অল ইন্ডিয়া কৃষক ফার্মার্সলেবার অর্গানাইজেশন, অভীক সাহা- জয় কিষাণ আন্দোলন, দর্শন পাল- বিপ্লবী কৃষক ইউনিয়ন, মনজিৎ রায়- ভারতীয় কৃষক ইউনিয়ন (দোয়াবা), হরিন্দর লাখোয়াল- ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন (লাখোয়াল), সাতনাম সিং বাহরু প্রমুখ।

এর আগে ১৯ মার্চ দিল্লীর প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন কৃষক নেতারা। এতে কিষাণ সভার হান্নান মোল্লা, কিষাণ মহাসভার রাজারাম সিং, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটকর, জয় কিষাণ আন্দোলনের অভিক সাহা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।

এই কিষাণ মহাপঞ্চায়েতে সারা ভারত কিষাণ মহাসভার অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী। কিষাণ মহাসভার ব্যানারে হাজার হাজার কৃষক পতাকা, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড হাতে সুসজ্জিতভাবে অংশগ্রহণ করেন। পাঞ্জাব, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড থেকে কিষাণ মহাসভার বিশিষ্ট নেতাদের নেতৃত্বে ব্যাপক কৃষক অংশগ্রহণ করেন।

remunerative-prices-for-crops

আমন ধান ও আলু, পেঁয়াজ উৎপাদনকরার পরও তার উপযুক্ত মূল্য মিলছে না। ঋণ করে চাষাবাদ করার পর ঋণ শোধ করতে মরিয়া কৃষকরা সহায়ক মূল্য না পেয়ে তা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারি স্তরে এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থ গ্রহণ না করায় কৃষকদের অভাবের সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণীর দালাল ও মুনাফোলোভী গোষ্ঠি। তারা সস্তাদরে ফসল কিনে তা মজুত করছে অধিক মুনাফার লোভে। এই অভাবী বিক্রি বন্ধ করতে অবিলম্বে সরকারি স্তরে লাভজনক সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে কৃষকদের কাছ থেকে ধান আলু পেঁয়াজ কেনার ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন ব্লকে মিছিল ও ডেপুটেশন সংগঠিত করে সিপিআইএমএল ও তার কৃষক সংগঠন এআইকেএম।

হুগলীর ব্লকে ব্লকে কৃষকদের মিছিল বিক্ষোভ ও পথ অবরোধ

প্রধান দুই অর্থকরী ফসল আলু ও পেঁয়াজের উপযুক্ত দর না মেলায় কৃষকরা যখন দিশাহারা তখন হুগলী জেলার বিভিন্ন ব্লকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে পথে নামল কিষাণ মহাসভা (এআইকেএম)। ৯ মার্চ বিকেলে পান্ডুয়া ব্লকের খন্যানে সরকার কর্তৃক ১২০০ টাকা কুইন্টাল দরে আলু কেনা ও কৃষকদের সমবায় ঋণ মকুবের দাবিতে জিটি রোড অবরোধ করা হয়। দীর্ঘক্ষণের অবরোধে যানজট সৃষ্টি হলেও উপস্থিত জনতা এই আন্দোলনকে সোৎসাহে সমর্থন জানান। পরদিন ১০ মার্চ কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি (আয়ারলা)’র উদ্যোগে বলাগড় ব্লকের মহিপালপুর হাটতলায় পথ অবরোধ করা হয়। অবরোধস্থল থেকে দাবি ওঠে, সরকারকে ১৫০০ টাকা কুইন্টাল দরে পেঁয়াজ কিনতে হবে। হাটবার হওয়ার কারণে বহু সাধারণ কৃষক এই অবরোধ কর্মসূচিতে স্বেচ্ছায় সামিল হয়ে যান। অবরোধ কর্মসূচিগুলি থেকে উজ্জীবিত কর্মীবাহিনী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ২০ মার্চ পান্ডুয়া কৃষি দপ্তর অভিযান করেন। সহকারী কৃষি অধিকর্তার (এডিএ) নিকট সাত দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপিতে, আলুর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ১২০০ টাকা কুইন্টাল দাবি করার সাথে সাথে হিমঘরে মজুত আলুর ২৫℅ সরকারী প্রস্তাব মতো যা ১৫℅) কৃষকদের থেকে ক্রয় করারও দাবি জানানো হয়। কৃষকদের সমবায় ঋণ মকুব, সার, বীজ, কীটনাশক সহ কৃষিতে ব্যবহৃত ডিজেল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, এ রাজ্যেই উন্নত মানের আলুবীজ পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদনেরও দাবি জানানো হয়।

এ ছাড়াও স্মারকলিপিতে, ষাট বছর ঊর্ধ্ব সমস্ত গরিব ও ক্ষুদ্র কৃষককে মাসিক কমপক্ষে ৫০০০ টাকা পেনশন প্রদান, সমস্ত ভাগচাষি, গরিব লিজ ও ঠিকা চাষিদেরও কৃষকবন্ধু প্রকল্পের আওতায় আনা এবং শস্যহানির ক্ষেত্রে মৌজাভিত্তিক ক্ষতির পরিমাণ মূল্যায়ন করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়। এডিএ স্মারকলিপিতে দাবিগুলির সাথে সহমত প্রকাশ করেন। তাঁর সাথে আলোচনার সময় এক অদ্ভুত তথ্য উঠে আসে। জানা যায়, কৃষক পেনশনের জন্য ২০১৮-১৯ সালের পর থেকে আর কোনও কৃষকের কাছ থেকে আবেদন পত্র জমা নেওয়ার জন্য নূতন নির্দেশিকা জারি হয়নি। ২০১৮-১৯ এর সর্বশেষ সরকারি নির্দেশিকায় পান্ডুয়া ব্লকে নূতন মাত্র সত্তর জন বয়স্ক কৃষককে পেনশন দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এডিএ’র “হাত পা বাঁধা থাকায়” এর পর থেকে অতিরিক্ত আর কোনও কৃষককে পেনশন দেওয়া হচ্ছে না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এডিএ দপ্তর অভিযানে অনেক গ্রামীণ মহিলা অংশ নেন।

নদীয়া জেলার কৃষক বিক্ষোভের রিপোর্ট

নদীয়া জেলায় সারা ভারত কিষাণ মহাসভার পক্ষ থেকে ১৭ মার্চ বৃষ্টির মধ্যেও নাকাশীপাড়া ব্লকের এডিএ ও বিডিও দপ্তরে ডেপুটেশন হয়। দাবিগুল ছিল :

  • শিলাবৃষ্টিতে কৃষিতে প্রাকৃতিক বিপর্যস্ত ব্লক হিসাবে নাকাশিপাড়াকে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করতে হবে। মাঠে মাঠে তদন্ত করে প্রতিটি কৃষকের ফসলের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিশেষ করে বিল্লগ্রাম মৌজায় করালির মাঠে সরেজমিন তদন্ত করতে হবে।

  • সেচে ব্যবহৃত ডিজেল ও বিদ্যুতের মূল্য কমাতে হবে, সারের কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে। কৃষি-বীজ, সার কীটনাশক ন্যায্য মূল্যে সমবায়ের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। ভাগ-চাষি, লিজ-চাষিদের সরকারি সহায়ক মূল্য পেতে কিষান ক্রেডিট কার্ড দিতে হবে। মৌজাভিত্তিক গ্রামে গ্রামে কৃষকের ধান ক্রয় করতে হবে। কিলো প্রতি ১২ টাকা দরে আলু ও ১৫ টাকা দরে পেঁয়াজ ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

  • এছাড়াও এলাকার বিশেষ দাবি ছিল বিডিও দপ্তরে আদিবাসীদের জমির অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, শালিগ্রাম পশ্চিম পাড়ায় আইসিডিএস ঘর নির্মাণ ও রাস্তা সংস্কার প্রভৃতি।

শুরুতে ডেপুটেশন নেওয়ার ব্যাপারে কৃষি অধিকর্তা সময় দিতে নারাজ হওয়ায় তীব্র বিতর্ক হয়। শেষে তিনি নিজের ত্রুটি স্বীকার করে নেন। বলেন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে শিলাবৃষ্টির বিপর্যয় কতটা কী জানা যাবে, এজন্য তিনি উপরিস্তরে জানাবেন। উল্লিখিত করালির মাঠ দন্ত করবেন। ভাগ-চাষি ও লিজ-চাষিদের কিষান ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে তিনি জানান। এজন্য একটা গণস্বাক্ষর সহ দরখাস্ত দিতে বলেন।

অবিরাম বৃষ্টির ফাঁকে গত ২০ মার্চ ধুবুলিয়া ব্লক দপ্তরে এআইকেএম ও আয়ারলার প্রতিনিধি ডেপুটেশন দেওয়া হয়।

কৃষকদের সাধারণ দাবিগুলি ছাড়াও ব্লকের নির্দিস্ট ইস্যুগুলি তুলে ধরা হয়। যথা অভাবী বিক্রির পর এখন অধিকাংশ চাষির ঘরে ধান নেই, অথচ কিষাণ মান্ডিতে ব্যবসায়ীরা লরি লরি ধান বিক্রি করে চলেছে কিভাবে? এ বিষয়ে অবিলম্বে বিডিওকে তদন্ত করতে হবে, চাষিদের স্বার্থে প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে একটা দালাল চক্র কাজ করছে বলে বিডিও মেনে নিলেন। এছাড়া সমবায়গুলিকে কার্যকরী করে তোলা সহ কৃষকদের অন্যান্য দাবিগুলি তুলে ধরা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারের যে কাজ চলছে তাতে চুড়ান্ত অনিয়ম ও নিম্নমান সম্পর্কে নির্দিষ্ট অভিযোগগুলি জানানো হয়। ১০০ দিনের কাজ বা বকেয়া সম্পর্কে বিডিও জানালেন কেন্দ্র টাকা না দিলে এগুলির কোনোরকম সুরাহা হবে না। এ সমস্ত প্রশ্নে এলাকায় এলাকায় প্রচারকে তীব্র করে তোলা হবে বলে প্রতিনিধিরা ঘোষণা করেন। উপরোক্ত কর্মসূচির প্রতিনিধি দলে ছিলেন, কৃষ্ণ প্রামানিক, দিলীপ ঘোয, আনসারুল হক, অমিত মন্ডল, সালেমা বিবি, জয়তু দেশমুখ প্রমুখ।

পুর্ববর্ধমান জেলায় আলু ও পেঁয়াজের লাভজনক দামের দাবিতে আন্দোলন

এবছর আলু ও পেঁয়াজের দাম মরশুমের প্রথম থেকেই খুব কম দামে চাষিরা দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। যত দিন এগোচ্ছে দাম আরও কমতে থাকে। পোখরাজ আলু ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কুইন্টাল বিক্রি হতে থাকে। জ্যোতি আলু ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা কুইন্টাল দামে বিক্রি হতে থাকে। যা উৎপাদন খরচের থেকেও কম। কৃষকরা লোকসানের ফলে দুরবস্থায় পড়ে। তার উপর ঋণের দায়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘঠতে থাকে। এই অবস্থায় টিএমসি সরকার ৬৫০ টাকা কুইন্টাল দামে ১০ লক্ষ টন আলু সংগ্রহ করার বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করল। যার বিরুদ্ধে ১৫ মার্চ কালনা-কাটোয়া রোডের কালনা শহর সংলগ্ন বৈদ্দীপুর মোড়ে শতাধিক লোকের জমায়েতে রাস্তায় আলু রেখে ১ ঘন্টার মতো রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। পুলিশী হস্তক্ষেপে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। ২০ মার্চ রাজ্যব্যাপী কর্মসুচির অংশ হিসাবে কালনা ২নং, মন্তেশ্বর, গলসী ও পুর্বস্থলী ২নং ব্লকে ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। রাজ্যভিত্তিক দাবির সাথে সাথে স্থানীয় দাবি যুক্ত করে বিডিওকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। এবং বিডিও মারফত ১০ দফা দাবিতে কৃষিমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হয়। এই আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক সলিল দত্ত, এআইকেএম নেতা রফিকুল ইসলাম, আয়ারলার নেতা আনসারুল আমান মন্ডল, মোজাম্মেল হক, শিবু সাঁতরা, হরেকৃষ্ণ ঘোষ ও সজল পাল সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

ওন্দায় সব্জিহাটে কিষাণ মহাসভার মিছিল

অভাবী ফসল বিক্রির ক্ষতিপূরণ ও সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে চাষিদের থেকে সবরকম ফসল কেনার দাবি সহ একাধিক দাবিতে ২১ মার্চ ২০২৩, ওন্দার ব্লক এডিও অফিস ঘেরাও এর ডাক দিয়েছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কৃষক সংগঠন সারা ভারত কিষাণ মহাসভা। এই কর্মসূচিকে সফল করার লক্ষ্যে ১৮ মার্চ সকালে নিকুঞ্জপুরের হাটে মিছিল করা হয় ও চাষিদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর নিমিত্তে দাবিগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয় সংগঠনের নেতা বৈদনাথ চীনা ও পার্টির জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জীর নেতৃত্বে।

federalism

যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদকে ক্রমে ক্রমে নির্বাসনে পাঠিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নিরঙ্কুশ তাঁবে রাজ্যগুলোকে নিয়ে আসা হল মোদী ফ্যাসিবাদের এক চরিত্রলক্ষণ, যা মোদীর শাসনতন্ত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আর, এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মোদী সরকারের হাতে রাজ্যপাল পদটি সম্প্রতি বিরাট এক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকটি অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে রাজ্যপালদের ভূমিকা নির্লজ্জ ও খোলাখুলিভাবে প্রমাণ করল যে এই সাংবিধানিক পদটি আজ কেন্দ্রীয় সরকারের কদর্য এক ক্রীড়নকে অধঃপতিত হয়েছে। অনেকগুলো অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে, যেমন, পঞ্জাব-মহারাষ্ট্র-কেরল-তামিলনাড়ু-তেলেঙ্গানা-পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড-দিল্লী প্রভৃতিতে আমরা দেখেছি রাজ্যপাল কতটা নিচে নেমে কেন্দ্রের পক্ষাবলম্বন করেছে।

কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে। মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল ভগত সিং কোশিয়ারি ২০২২-এ উদ্ধব ঠাকরেকে বিধানসভার ফ্লোরে আস্থাভোটের মাধ্যমে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের ফরমান দেন, যার পরিণতিতে উদ্ধব সরকারের পতন হয়। এই ঘটনাকে তীব্র সমালোচনা করে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি বলেন, “শাসক পার্টির অভ্যন্তরে বিক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়েছে এই যুক্তিতে রাজ্যপাল তার সাংবিধানিক পদকে অপব্যবহার করে যদি আস্থা ভোটের নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তবে তা গণতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে আর আইনত নির্বাচিত এক কার্যকরী সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে।... রাজ্যপালদের এমন কোনও ক্ষেত্রে প্রবেশ করা ঠিক হবে না, যা কোনও এক সরকারের পতনকে ডেকে আনে।” কিছুদিন আগে দেখা গেল, তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল আর এন রবি হঠাৎ হিন্দুত্ববাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ব্যাখ্যা করে সেখান থেকে তামিল জনগণকে শিক্ষা নেওয়ার উপদেশ দিলেন।

দিল্লীর মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের নির্বাচনে আপ জয়ী হয়। কিন্তু নির্বাচনের পর মেয়র পদটি নিজেদের দখলে রাখতে মরিয়া বিজেপি দিল্লীর রাজ্যপালকে ময়দানে নামায়। গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে, দু’কান কাটা এই রাজ্যপাল তাঁর মনোনীত ১০ জনকে মেয়র নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেন। শীর্ষ আদালত তৎক্ষণাৎ ওই নির্দেশকে খারিজ করে জানায়, মনোনীত কোনো সদস্য মেয়র নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, আর দিল্লীর মেয়রের বিরাট গুরুত্ব থাকায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে, যে নির্বাচন দিল্লীর রাজ্যপাল ভি কে সাক্সেনা এর আগে তিন তিনবার স্থগিত করে দেন।

রাজ্যপালের ক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক বিতর্ক হয়। ১৮৫৮-তে ভারত যখন উপনিবেশ ছিল, সেই সময় ব্রিটিশরা আঞ্চলিক রাজ্যপালদের নিয়োগ করত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের এজেন্ট হিসাবে, তারা তখন ছিলেন গভর্নর জেনারেলদের নিয়ন্ত্রণে, কাজ করতেন তাদের নির্দেশ অনুসারে। আজ বিজেপি সেই ঔপনিবেশিক ধারাকেই ফিরিয়ে আনল, যে বিজেপি সমস্ত প্রশ্নে ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য থেকে ভারতকে মুক্ত করার বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।

ব্রিটিশ তৈরি সংবিধানে রাজ্যপালের ক্ষমতা নিয়ে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ায় সংবিধান সভায় অনেক বিতর্ক হয়। সেই বিতর্ক চলাকালীন আম্বেদকর ৩১ মে ১৯৪৯-এ স্পষ্ট ভাবেই ঘোষণা করেন, “সংবিধান রাজ্যপালকে এমন কোনও দায়িত্ব বা কাজ দেয়নি যা তিনি নিজের ইচ্ছেমতো করতে পারেন। তার পদটি আলঙ্কারিক, ক্ষমতা খুবই সীমিত ও নামমাত্র। তাঁর শুধু কিছু কর্তব্য রয়েছে, আর নতুন সংবিধান অনুযায়ী, তা তিনি পালন করবেন মন্ত্রীসভার পরামর্শ মেনে।” পরবর্তীতে একাধিক রায়ে শীর্ষ আদালত বলেছে, “নিজের বিচার বিবেচনা ও বিচক্ষণতা অনুযায়ী রাজ্যপালের পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রটিও খুবই সীমিত। এই সীমিত ক্ষেত্রেও তিনি নিজের খেয়ালখুশি মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। সেই সিদ্ধান্তের পেছনে থাকবে যথেষ্ট যুক্তি, সতর্কতার সাথে তা পরিচালিত হবে, আর তা নিতে হবে সৎ উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে।”

বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের পকেটে পুরতে বিজেপি-আরএসএস বাহিনী নগ্নভাবেই মাঠে নেমেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীশ ধনকড়। মহারাষ্টের রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে শীর্ষ আদালত তীব্র সমালোচনা করার পর বিজেপির ট্রোল বাহিনী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কুৎসা, হুমকি, কুভাষণের বন্যা বইয়ে দেয়, যার বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছে। আর গোটা ঘটনাক্রমে নীরব প্রধানমন্ত্রী। আজ ভারতের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে কত বিপন্ন, কতটা আক্রান্ত তা এই সমস্ত ঘটনাই প্রমাণ করে।

বিপন্ন দেশ, আক্রান্ত মানবতা, ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ মানবাধিকার। মোদীর শাসনতন্ত্র আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি আজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে অধঃপাতের অতলে।

modi-regime

ত্রিপুরায় অল্প ব্যবধানে ক্ষমতা ধরে রাখার পর মোদী সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে এক সার্বিক আক্রমণ নামিয়েছে, এবং সেটা তারা করছে রাস্তার ক্ষমতা, প্রচার ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভয়াবহ সমন্বয় ঘটিয়ে যেটা এই ফ্যাসিবাদী জমানার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। ত্রিপুরায় মোটামুটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পর সংঘ বাহিনী রাজ্যে নতুন করে সন্ত্রাস, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও হিংসার এক রাজত্ব নামিয়েছে, তারা বিরোধী দলগুলো, তাদের ভোটার এবং এমনকি সন্ত্রাস কবলিত রাজ্যটা পরিদর্শনে যাওয়া বাম ও কংগ্রেসের বিধায়ক ও সাংসদদের নিয়ে গঠিত তথ্যানুসন্ধানী দলের ওপরও আক্রমণ হানছে। এরই সাথে রাজ্য বিধানসভায় প্রধান অ-বিজেপি দল হিসাবে উঠে আসা আঞ্চলিক দল টিপ্রা মোথার বিরোধিতার ধারকে ভোঁতা করে দিতে মোদী সরকার ঐ দলের দাবির ‘সাংবিধানিক সমাধান’ খুঁজে পেতে এক মধ্যস্থতাকারীকে নিয়োগ করতেও সম্মত হয়েছে।

মেঘালয়ে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকারের শরিক থাকা বিজেপি ঐ সরকারকে সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিপরায়ণদের অন্যতম বলে অভিযুক্ত করার পর আলাদাভাবে নির্বচনে লড়ে। নির্বাচনে বিজেপি মাত্র দুটো আসনেই জয়লাভ করতে পারে, এবং নির্বাচন শেষ হওয়ার পর বিজেপি ঐ সরকারের শরিক হওয়ার জন্য সেই এনপিপি-র সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে। তরুণ গগৈ নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারে গুরুত্বের দিক থেকে দু-নম্বরে থাকা হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিরুদ্ধে বিজেপির আনা দুর্নীতির অভিযোগকে আমরা ভুলে যাইনি। হিমন্ত বিশ্বশর্মা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর সাংবাদিকরা তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের কথা অমিত শাহকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন এবং নির্লজ্জভাবে সাংবাদিকদের বলেন যে ঐ প্রশ্ন ওঠানো উচিত নয়! হিমন্ত বিশ্বশর্মা আজ শুধু আসামের বর্তমান বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি-নেতৃত্বাধীন উত্তর-পূর্বাঞ্চল গণতান্ত্রিক জোটের প্রধানই নন, তিনি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সংঘ বাহিনীর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বর্শা মুখ।

দুর্নীতি এবং অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত যে কোনো নেতার পক্ষে বিজেপিতে যোগদানই সবচেয়ে ফলপ্রসূ বীমা প্রকল্প হয়ে উঠেছে। বস্তুত, বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতা প্রকাশ্যেই যে কোনো কেন্দ্রীয় সংস্থার দ্বারাই তদন্ত থেকে তাঁদের অব্যাহতির বড়াই করে থাকেন। কর্নাটকে এক ক্ষমতাশালী বিজেপি বিধায়কের ছেলের অফিসে তল্লাশি চালানোর জন্য লোকায়ুক্ত কর্মীরা চাপ প্রয়োগ করেন, এবং ঐ তল্লাশি থেকে নগদ ছ-কোটি টাকা পাওয়া যায়। মধ্যপ্রদেশে তদন্তে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলেও লোকায়ুক্তকে অকেজো করে রাখা হচ্ছে, কেননা, অভিযোগ খাড়া করার কোনো অনুমতি সরকার দিচ্ছে না। বিজেপি এইভাবে যখন দুর্নীতিপরায়ণদের কাছে অবিসংবাদী আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে, মোদী সরকার তখন ইডি ও সিবিআই-এর মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে বিরোধীদের তাড়া করছে, যে সংস্থাগুলো এখন তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার চরিতার্থতায় সরকারের পুরোদস্তুর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই, বিশেষভাবে যারা ক্ষমতায় রয়েছে, মোদী সরকারের এই প্রতিহিংসাপরায়ণ ও নিগ্ৰহের ঔদ্ধত্যপূর্ণ অভিযানের ধাক্কার মুখে পড়ছে।

২০২৪-এর নির্বাচনের আগে মোদী সরকার বিহারের রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। ২০১৫ সালে বিজেপিকে যখন নীতীশ কুমারের জেডিইউ-র সমর্থন ছাড়াই বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল, তাদের মোট আসনসংখ্যা কমে গিয়ে ৫৩-তে দাঁড়িয়েছিল। এরপর সরকার আরজেডি নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে জেডিইউ-আরজেডি জোটকে ভেঙে দিতে সমর্থ হয় এবং নতুন করে জোট বাঁধা বিজেপি-জেডিইউ-এলজেপি নেতৃত্ব ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিহারে বিপুলভাবে জয়ী হয়। জেডিইউ ২০২২ সালে পুনরায় আরজেডি-বাম-কংগ্রেস মহাজোটে যোগ দেওয়ায় বিহারের এই জোটকে ভাঙ্গার জন্য বিজেপি মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের ত্রিমুখী রণনীতির লক্ষ্য হল সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলা, জোটকে কালিমালিপ্ত করা এবং দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করে এবং নতুন মিত্রদের টেনে নিয়ে বিজেপির অনুকূলে রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসকে রূপায়িত করা। লালু প্রসাদ যাদবের গোটা পরিবারকে নিশানা বানাতে পুরনো মামলাগুলোকে পুনরায় চালু করা হয়েছে। এমনকি পাটনায় জাল ভিডিও তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে এই ভূয়ো আখ্যান বানানোর চেষ্টা হয়েছে যে তামিলনাড়ুতে বিহারী শ্রমিকদের মারধর এবং এমনকি হত্যা করাও হচ্ছে, যদিও বিহারে শাসক জোট এবং তামিলনাড়ুর শাসক দলের মধ্যে সখ্যতা রয়েছে।

ইডির চালানো তল্লাশি অভিযানগুলোর মধ্যে দিয়ে সরকার দুর্নীতি-বিরোধী জেহাদের এমন এক নজরকাড়া দৃশ্য সৃষ্টি করতে চাইছে যা অনেকটাই ২০১৬’র নভেম্বরের বিমুদ্রাকরণের মতো যেটাকে কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে চালানো হয়েছিল। এই তল্লাশি অভিযানগুলো ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং প্রায়শই দেখা যায় যে, ইডি তল্লাশির ফলাফল নিয়ে কোনো সরকারি বিবৃতি না দিলেও মিডিয়া অনুল্লেখিত ‘সূত্র’কে উদ্ধৃত করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার সত্যতা যাচাই না করা দাবির ভিত্তিতে দুর্নীতি সম্পর্কে একটা ধারণা সৃষ্টি করে। সংসদে সরকারের নিজের স্বীকারোক্তিই জানিয়েছে, ২০২২-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত ইডি অর্থ নয়ছয়ের যে ৫৪২২টি মামলা চালিয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৯৯২টির ক্ষেত্রে চার্জশিট পেশ হয়েছে এবং মাত্র ২৩ জন অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। স্পষ্টতই, ইডির সক্রিয়তার লক্ষ্য অনেকটাই হল প্রচারের মধ্যে দিয়ে কৌশলে জনগণের ধারণাকে প্রভাবিত করা, রাজনৈতিক দিক থেকে সরকারের বিরোধীদের হুমকি দেওয়া ও কালিমালিপ্ত করা এবং মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়া। এই বিষয়টার উল্লেখও যথেষ্ট শিক্ষাপ্রদ যে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মতো ইডিও পরিচালিত হচ্ছে বেছে নেওয়া এক আমলার দ্বারা। সরকার ২০২১-এর নভেম্বরে আইন সংশোধন করে ইডি ও সিবিআই প্রধানের জন্য নির্ধারিত দু-বছরের সময়কালকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করে এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে লঙ্ঘন করে ইডির বর্তমান প্রধান সঞ্জয় মিশ্রের কার্যকালের মেয়াদ রেকর্ড সংখ্যক তিন বার বৃদ্ধি করে।

মোদী সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণ ও নিপীড়নমূলক শাসনধারাকে অঘোষিত জরুরি অবস্থা বলে বর্ণনা করাটা আর যথেষ্ট নয়। এটা লাগামছাড়া জরুরি অবস্থা এবং ভারতের জনগণ ও বিরোধী পক্ষ এতে যদি রাশ টানতে না পারে তবে স্বৈরাচারী শাসন উদ্ধত রূপে প্রকট হওয়ার দিকে চলে যাবে। ১৯৭০-এর দশকে জরুরি অবস্থা থেকে অব্যাহতি পেয়ে এগিয়ে যাওয়ার সম্বল ভারতের ছিল। ২০২০-র দশকে ভারতকে আবার জনগণের সেই গণতান্ত্রিক দৃঢ়তাকে জাগিয়ে তুলে ও তার আত্মপ্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী বিনাশকে রুখে দিতে হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৪ মার্চ ২০২৩)

 

shivdaspur

১৫ মার্চ ২০২৩, এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ‘শিবদাসপুর ইটভাটা মজদুর ইউনিয়ন’ এবং ‘শিবদাসপুর ব্রীক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’এর সাথে দ্বিপাক্ষিক মজুরি চুক্তি সম্পন্ন হল। মিছিল, মিটিং, ডেপুটেশন ও কয়েক দফা আলোচনার পর ৪ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এছাড়াও জ্বালানির জন্যে সপ্তাহে ১৫ টাকা বেড়েছে। এই মজুরি চুক্তির মেয়াদ এক বছর। বর্তমানে যে ৮টা ইটভাটা চালু আছে, সেই ভাটার সব শ্রমিকরাই এই চুক্তির আওতায় আসবেন। মজুরি নির্ধারণ করতে দ্বিপাক্ষিক মিটিং’এ উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ জেলা সম্পাদক নবেন্দু দাশগুপ্ত, মজদুর ইউনিয়ন সম্পাদক সেখ আব্দুল মোফেজ, সেখ সওকত আলি, নারায়ণ রায়, রামু সোরেন, স্নেহাশিস চক্রবর্তী প্রমুখ। ইউনিয়ন প্রতিনিধি এবং শিবদাসপুর ব্রীক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক নারায়ণ সিং ও অশোক সিং চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

নৈহাটি শিবদাসপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে ১৬টা ইটভাটা ছিল, এখন ৮টা ইটভাটা চালু আছে। নোটবন্দী, জিএসটি এবং ন্যাশানাল গ্রীন ট্রাইব্যুনালের ভাটা সংক্রান্ত কয়েকটি নির্দেশিকা ইটভাটায় সঙ্কটকে গভীর করে তুলেছে। এছাড়াও আছে মাটির অভাব। ইটের উৎপাদন খরচ বহুগুণ বেড়েছে, জিএসটি বেড়ে ১২ শতাংশ হয়েছে। কয়লার দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই অনুযায়ী ইট বিক্রির বাজার নেই। সরকারি আবাসন প্রকল্পে জটিলতাও ইটের বাজারে সংকট তৈরি করেছে। বড় বড় আবাসন শিল্পে লাল ইট খুব কম ব্যবহার হচ্ছে। আর্থিকভাবে কঠিন এক পরিস্থিতিতে মজুরি বৃদ্ধির হার কত হতে হবে তা নিয়ে সংশয় ছিল। যাই হোক ভাটার সঙ্কট, সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন, সবকিছু মাথায় রেখে শ্রমিকদের অংশগ্রহণে ইউনিয়ন সম্মানজনক মজুরি চুক্তি করতে পেরেছে।

ভাটায় দু’ধরনের শ্রমিক আছেন — স্থানীয় ও প্রবাসী। প্রবাসী শ্রমিকরা ঝাড়খণ্ড থেকে আসেন। এদেরকে ঠিকাদাররা চুক্তির ভিত্তিতে নিয়ে আসেন। এদের মধ্যে মহিলা ও পুরুষ সব ধরনের শ্রমিকই আছেন। স্থানীয় শ্রমিকরা মজুরি কেউ মাস হিসাবে পান, কেউবা ফুরনে পান। মাসে কেউ চারটে বা তিনটে ছুটি পায়। ইটভাটায় ৬ মাসের মরসুমি ব্যবসা চলে। তাই বছরের ছুটিও কম। শ্রমিকরা ছুটি পান — ১ জানুয়ারি, দোল/হোলি, মে দিবস, ঈদ এবং পৌষ সংক্রান্তিতে।

৪ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধিতে মজুরি বিন্যাস যে রকম হল — প্রতি মাসে বোঝাই মিস্ত্রি পাবেন জ্বালানি সহ মাসে ১৫,৮৬৪ টাকা। মাটি ফেলারা পাবেন প্রতি মাসে জ্বালানি সহ ১৪,৯৮২ টাকা। অন্যান্য বিভাগের শ্রমিকদেরও ৪ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধি হবে। যেমন — পাথেরা, টপ বাহক, মুখ কাটা, ফায়ারম্যান, কয়লাম্যান, রাবিশম্যান, রেজা, কাঁচা টিকিট, পাকা টিকিট, ড্রাইভার, মুন্সী, দারোয়ান, টিকিট কাটা এবং অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত ডেলি লেবার সবাই এই চুক্তির দ্বারা উপকৃত হবেন।

ইটভাটা শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। ইউনিয়নের দাবিসনদে ইএসআই, পিএফ ও পেনশনের কথার উল্লেখ আছে। তবে বড় ধরনের আন্দোলন ছাড়া তা কার্যকরী করা যাবে না। এরজন্য মালিক ও সরকার উভয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য প্রস্তুতি চলছে।

municipal-sanitation-workers

মেদিনীপুর পুরসভার ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধারাবাহিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট বড় অনেক জয় অর্জন করেছে। বাঁকুড়া পুরসভার ইউনিয়নও পুরনো, নতুন করে সেখানে আন্দোলন দানা বাঁধছে। বিষ্ণুপুর পুরসভার সাফাই কর্মচারি ইউনিয়ন সেই তুলনায় অনেক নতুন। গত দুতিন বছরে জোরালো সংগ্রামী মেজাজের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ছোট ছোট জয় ও ধাপে ধাপে শক্তিশালী ঐক্য অর্জন করেছে। এই আন্দোলন অন্যান্যদের মধ্যেও নতুন উৎসাহ সঞ্চার করেছে। বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের তিনটি ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা গত ১৯ মার্চ বিষ্ণুপুরে ইউনিয়নের অফিসে একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে এই পুরসভাগুলির শ্রমিকদের অবস্থা, আন্দোলন ও দাবি সম্পর্কে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় ও বিস্তারিত চর্চা করেন এবং গুরুত্বপূর্ণসিদ্ধান্ত গ্রহন করে। প্রথমত, পৌর জীবনের অপরিহার্য ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিষেবা দিয়েও সাফাইকর্মীরা চরম অন্যায়ের শিকার। সরকার ঘোষিত ন্যূনতম দৈনিক মজুরি কেউ পায় না, এবং বিভিন্ন পুরসভা বিভিন্ন কায়দায় শ্রমিকদের অধিকার হরণ করে চলেছে। রাজ্য সরকারের নির্দেশিকায় পুরসভার সাফাইকর্মীদের অদক্ষ, আংশিক দক্ষ ও দক্ষ এই তিন ক্যাটেগরিতে চিহ্নিত করে তাদের জন্য যথাক্রমে ৩৭৬ টাকা, ৪১৪ টাকা ও ৪৫৫ টাকা দৈনিক মজুরি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পুরসভাগুলো নির্লজ্জভাবে শোষণ ও প্রবঞ্চনা চালিয়ে যাচ্ছে। বিষ্ণুপুর পুরসভায় কর্মীরা সর্বোচ্চ দৈনিক মজুরি পান ২১০ টাকা। বাঁকুড়া ২৯০ টাকা ও মেদিনীপুর ৩০০ টাকা। দ্বিতীয়ত, কোথাও ইএসআই নেই। ইপিএফ কোথাও আছে কোথাও নেই, থাকলেও শ্রমিকেরা তার বেনিফিট পান না। তৃতীয়ত, শূন্যপদগুলি ফাঁকাই রেখে দেওয়া হয়, মৃত কর্মীর পরিবারের নিযুক্তিও হয় না। অস্থায়িরা বহু বছর কাজ করলেও তাদের স্থায়িকরণ বা নিয়মিতকরণ হয় না। এইসব আর্থিক প্রবঞ্চনা ও অধিকার হরণের মাধ্যমে সমাজে জাতগত অবজ্ঞা ও নিপীড়নের পরিস্থিতি চালিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া বৈঠকের আলোচনায় উঠে আসে, সুডা (স্টেট আরবান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) এসডব্লিউএম (সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট)-এর নামে ধাপে ধাপে এই শ্রমিকদের পেশা থেকেই বহিস্কার করে দেওয়ার পথে রয়েছে।

বাঁকুড়ার ইউনিয়নের ভাস্কর সিংহ ও সর্বানী সিংহ, বিষ্ণুপুরের দিলবার খান ও ফারহান হোসেন খান, মেদিনীপুরের তপন মুখার্জী প্রমুখ নেতৃত্ব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সোনামুখী পুরসভার সাফাইকর্মীরা কাজ করেও তিন মাস বেতন পাননি। বর্তমানে তাঁরা প্রশাসনের চাপ উপেক্ষা করে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষ্ণুপুর বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন সোনামুখীতে এক প্রতিনিধিদল শ্রমিক বসতিতে মিটিং করে আসেন। এখানে জোরালো কোনও ইউনিয়ন নেই, দীর্ঘ প্রবঞ্চনায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দলিত শ্রমিকেরা স্বতস্ফুর্তভাবে লড়াই চালাচ্ছেন। বিষ্ণুপুর বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত হয় আরও বিভিন্ন পুরসভার সাফাইকর্মীদের সাথে সংযোগ গড়ে তুলে জোটবদ্ধ হওয়ার এবং আগামিতে বৃহত্তর কেন্দ্রীয় কর্মসূচি গ্রহণের।

the-battle-of-charmatpur

জলঙ্গী নদীর চরের জমিতে গরিবের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছে চরমতপুর। সেখানে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসকের হামলা মোকাবিলা করেছে। শহীদ হয়েছে কমরেড ইউসুফ মোল্লা। ২১ মার্চ তাঁর শহীদ দিবস। প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলো সে লড়াই চলছে আজও। “মা মাটি মানুষের” সরকার সেই উর্বরা মাটিকে বছরের পর বছর পতিত ফেলে রেখেছে। মানুষকে করে রেখেছে বঞ্চিত। বর্তমানে শাসকের চক্রান্ত মোকাবিলা করে তাঁদের মুখোষ খুলে দিয়ে মানুষ এখন আবার নতুন করে সংগঠিত হচ্ছেন।

jamalpur-region-work-meeting

বজবজ গ্রামাঞ্চলে নিশ্চিন্তপুর পঞ্চায়েতে ২নং লিডিং টিমের অন্তর্গত জামালপুর অঞ্চলে গত ১৬ মার্চ ২০২৩ কর্মী বৈঠক হয়। সেখানে আলোচনা হয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। আসন চিহ্নিত করা। এরজন্য বুথস্তরে গণসংগঠনের সদস্যদের সামিল করে গণভিতকে প্রসারিত করা।

১৮ মার্চ ২০২৩ নিশ্চিন্তপুর পঞ্চায়েত ১নং লোকাল কমিটির ১৩তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বজবজে জেলা পার্টি অফিসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপস্থিতি কিছু কম হয়। শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠান হওয়ার পর, সম্মেলন কক্ষে সম্মেলন পরিচালনার জন্য ৩ জনের সভাপতিমন্ডলী আশুতোষ মালিক, অঞ্জনা বিশ্বাস, নির্মল দলুইকে নিয়ে গঠিত হয়। জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, দিলীপ পাল, কাজল দত্ত ও ইন্দ্রজিৎ দত্ত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। সম্মেলনের শুরু ও শেষে আজকের পরিস্থিতি অনুযায়ী গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন সাবির রাজা। সম্মলনের মধ্যদিয়ে ১১ জনের লোকাল কমিটি ও দেবযানী গোস্বামীকে পুনরায় সম্পাদিকা নির্বাচিত করা হয়।

গত ১২ মার্চ ২০২৩ জেলা মিটিং’এর আহ্বান ছিল লোকাল সম্মেলনগুলোতে ১০০ শতাংশ পার্টি সদস্যদের সামিল করা। এবং বুথে বুথে গণজমায়েত করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া।

বুথে সাধারণ সভা করা, সেখান থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের শক্তি সঞ্চয় ও প্রার্থী বাছাই করার কর্মসূচি গ্রহণ করার শপথ নিয়ে সম্মেলন শেষ হয়।

ulinary-workers-union

শাসক দলের হামলা, হয়রানি মোকাবিলা করেই সংগঠিত হচ্ছেন দেগঙ্গা ব্লকের রন্ধন কর্মীরা। ২০১৬ সাল থেকেই দেগঙ্গা ব্লকের কর্মীরা পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের পতাকাতলে সমাবেশিত হতে শুরু করেন। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে গ্রামাঞ্চলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করে। যার ফল, বিদ্যালয়গুলিতে যুক্ত পুরোনো রন্ধনকর্মীদের তাড়িয়ে নতুন কর্মী নিয়োগের চেষ্টা। ইউনিয়নের কর্মীরা এক দীর্ঘ লড়াইয়ে তাকে প্রতিহত করেন। একইভাবে, ইউনিয়নের সভায় হামলা, বিডিও দফতরে ডেপুটেশনে হামলা — প্রভৃতি মোকাবিলা করেই জেলা, রাজ্য প্রতিটি কর্মসূচিতে কর্মীরা সামিল হন।

উত্তর ২৪ পরগণা জেলা জুড়ে ব্লক সম্মেলনগুলির অঙ্গ হিসাবে গত ১৯ মার্চ ২০২৩ দেগঙ্গা ব্লকের কর্মীরা মিলিত হলেন ব্লক সম্মেলনে। প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে অগ্রণী কর্মীরা বারাসাত বিবেক সংঘ হলে মিলিত হলেন।

সম্মেলনকে সম্বোধন করে এআইসিসিটিইউ জেলা সম্পাদক রন্ধনকর্মীদের আন্দোলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সারা দেশেই শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার উপর আক্রমণ নামিয়েছে। গরিবের শিক্ষাও কেড়ে নিতে চাইছে। আপনাদের লড়াই মজুরি, স্বীকৃতি, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার সাথে শিক্ষা বাঁচাতেও আন্দোলন করতে হবে।” ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদিকা জয়শ্রী দাস বলেন, “আমরা আজ যেটুকু সাফল্য পেয়েছি, সবই সংগঠনের জোরে। তাই সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। ব্লকের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে হবে।” আইসা’র রাজ্য নেতা স্বর্ণেন্দু মিত্র সংহতি জানিয়ে বলেন, “আমরা শিক্ষা বাঁচাতে যে লড়াই শুরু করেছি, আপনাদের লড়াইও সেই লক্ষ্যেই। আগামীদিনে ছাত্ররা মিলিত ভাবেই লড়াই গড়ে তুলবে।”

এআইসিসিটিইউ জেলা নেতা সুজিত ঘোষের সভাপতিত্বে সম্মেলনে কর্মীরা যেমন সমস্যার কথা বলেন, তেমনি সাফল্য ও অঙ্গীকারের কোথাও বলেন।

সম্মেলন থেকে ১৫ সদস্যের ব্লক কমিটি গঠন হয়। সভাপতি ও সম্পাদিকা নির্বাচিত হন যথাক্রমে সুজিত ঘোষ ও লিলুফা বিবি।

ব্লকের সমস্ত স্কুলে সংগঠন গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে সম্মেলন সমাপ্ত হয়।

polba-dadpur

লাকডাউনের আগে পরে হুগলির পোলবা দাদপুর ব্লকের রন্ধনকর্মীদের রান্নার ট্রেনিং হয়েছিল বিডিওতে। সরকার থেকে ঘোষণা ছিল ট্রেনিং প্রাপ্তদের সার্টিফিকেট ও ৫০০ করে টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু বহু দিন হল এদের কোনও কিছু দেওয়া হচ্ছিল না। পূজোর আগে বিডিও ঘেরাও করা হয়। অবশেষে জানুয়ারিতে সার্টিফিকেট আসে, ফেব্রুয়ারিতে ইউনিয়নের মাধ্যমে ৪১০ জনকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। ১৭ মার্চ বিডিও অফিসে আরও ১০৫ জনকে সার্টিফিকেট দেওয়া হল, বকেয়া ৫০০ টাকাও দ্রুত মিটিয়ে দেওয়ার কথা।

women's-day-celebrations

বর্তমান সময়ে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের যোগদানের আশা ও উচ্চাকাঙ্খা নবরূপে পরিলক্ষিত হচ্ছে। নারীরা শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা কর্মগত যোগ্যতা কোনোদিক থেকেই আর পিছিয়ে নেই। তদসত্ত্বেও, দেশে নারী শ্রমশক্তি ভিন্ন চিত্র বর্ণনা করে। সমাজের দ্রুত ও তীব্র পরিবর্তনে এক বিপরীতধর্মী বাস্তব উঠে আসছে। নতুন প্রজন্ম অনেক বেশি অগ্রণী হলেও, তাদের কর্মক্ষেত্রের সংজ্ঞা আলাদা। কোভিড অতিমারীর ফলে, কাজ হারিয়েছে কয়েক হাজারেরও বেশি মহিলা শ্রমিক। উক্ত এই সময়েই, ভারতীয় সমাজে কাজের ক্ষেত্রে নজির সৃষ্টি করেছে প্রযুক্তিবিদ্যা। ক্রমশ প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং সমানুপাতে কর্মক্ষেত্র থেকে বিরতি নিতে হচ্ছে প্রাক্তন প্রজন্মকে। প্রযুক্তির বিকাশ ও নির্ভরশীলতাকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা উচিত তা অন্য প্রসঙ্গ হলেও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।

ভারতের বৃহত্তর চিত্রটি ভিন্ন। ভারতের অর্থনীতি ১৯৯০ সাল থেকে বৃদ্ধি পেয়ে থাকলেও, সেখানে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ১৯৯০ সালে ৩০ শতাংশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশে। গত ১৫ বছরে, নারীশ্রমের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার সময় এই পতন বিশেষভাবে তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে ৩২ শতাংশ থেকে ২০২১ সালের মধ্যেই ব্যবধান পৌঁছেছে ১৯ শতাংশে। মজার বিষয় হল, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে ২০২২ সাল অনুসারে, ভারতে নারী ও পুরুষ শিক্ষাক্ষেত্রে সমান সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে এই খাদ প্রশস্ত হয়। ২০২২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে, স্পষ্টভাবে দেখানো হয় — শিক্ষাক্ষেত্রে নারীরা ০.৯৬১ স্কোর অর্জন করলেও, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে তা নেমে আসে ০.৩৫০-তে।

পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজ এবং স্বতন্ত্র নারীদের মাঝের ব্যবধানটা অনেকটা হাতে আঁকা ছবি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে এডিট করা চিত্রর মধ্যের পার্থক্যের মতন। ২০২২ সালে গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ১৪৬টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩৫ নম্বর স্থানটি আলো করে রয়েছে, ভারতীয়দের কাছে বর্তমান সান্তনার বিষয় এইটুকুই আমাদের দেশে ‘আচ্ছে দিন’ আসছে কারণ আমরা ২০২১ সালের থেকে পাঁচটি স্থানে উন্নতি লাভ করেছি। এই পরিণতির কারণ, গুরুত্ব বিচার করতে হলে ঘুরে আসতে হবে একটু ইতিহাস থেকে। প্রথমে এই পরিস্থিতির কারণগুলি খোঁজা যাক। খুব সহজ উদাহরণে, কৃষকের সংজ্ঞা ও কৃষাণির সংজ্ঞা। আমাদের সমাজে একজন পুরুষ কৃষিকাজে যেভাবে সুস্পষ্ট ভুমিকা রাখেন মহিলাদের ছবিটি সেখানে বড়ই আবছা। ছোটবেলা থেকে আমরা কৃষকের ছবি দেখি, আঁকি আর মহিলাকে কেবলই তার সহায়ক হিসেবে দেখি। মহিলা ধানের বীজ পোঁতেন, ধান ছাটাইয়ের কাজ করেন কিন্তু লাঙ্গল কিংবা ট্র্যাঙ্কর চালিয়ে সে কাজ করে না। হয়তো, তার কায়িক শ্রমের ক্ষমতা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে বলেই। তবে কৃষিক্ষেত্রে মহিলাদের অবদান ও ভূমিকা তারা নিজেরাই স্পষ্ট করে দিয়েছেন সদ্য হয়ে যাওয়া বিজেপি সরকারের কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনে। সুদূর পাঞ্জাবের গ্রাম থেকে পুরুষদের পাশাপাশি তারাও একইভাবে ট্র্যাকটার চালিয়ে আন্দোলনে সব ফেলে অংশ নিয়েছেন। মহিলাদের ব্যবসা শুরু কিংবা কৃষিক্ষেত্রে যে পুঁজির প্রয়োজন হয়, তা সহজে মেলে না। কর্মসংস্থানে, আজও ভারতে নারীদের সামগ্রিকভাবে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। যার চরম পরিণতি দেখা গিয়েছে লকডাউনে। নারীপুরুষ উভয়কেই কর্মক্ষেত্রে ছাঁটাইয়ের সম্মুখীন হতে হলেও, সংখ্যায় নারীরা এগিয়ে।

ঐতিহাসিকভাবে আন্দোলন চলেছে সমকাজে সমমজুরির তবুও কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া বিশ্বব্যাপী মহিলারা এখনো পুরুষদের তুলনায় ২০ শতাংশ কম আয় করেন। এই ব্যবধান বর্তমান প্রজন্মের নারীদের অকৃষি কাজে নিযুক্ত হতে কারণ যোগায়। নারীরা যুক্ত এমন সমস্ত ধরনের কাজের (অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, রান্নার কাজ, পরিষ্কার, শিশুর যত্ন, বয়স্কদের যত্ন ইত্যাদি) গণনা করে দেখা গেছে একজন মহিলার কাজের দিনটি অতন্ত দীর্ঘ এবং কঠোর পরিশ্রমের। ঘর-বাইরে মিলিয়ে একজন মহিলা সর্বাধিক ৯১ ঘণ্টা কাজ করেন, অর্থাৎ দিনে ১৩ ঘণ্টা। চাকুরীজীবী হোক কিংবা গৃহবধূ এমন মহিলার, সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টার কম কাজ করেন এমন মহিলার সংখ্যা খুবই নগণ্য। এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত বোধ করার বিষয়টি তো রয়েইছে।

এপ্রসঙ্গে, সামাজিক বিধিনিষেধের ভার এড়িয়ে চলে গেলে খুব ভুল করা হবে। সন্তানের জন্ম, ঘর চালানো, বয়স্কদের সেবা সুশ্রুসা করা, বাড়ির চলমানতার দায় নেওয়া এই সব বিষয়েই আমাদের সমাজ নারীদের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা একাধারে, সময়ের গতির সাথে নিয়মে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, একজন মহিলা বহিরজগতে কোনো পেশায় যুক্ত তা দিয়েও বিচার করা হয় তার চরিত্র ও সে ঠিক কতটা সম্মান পাওয়ার যোগ্য! তার পাশাপাশি চলে, একজন মহিলার উপার্জন করা অর্থের ব্যবহার নিয়ে তর্ক। পিতৃতান্ত্রিকতা, পুরুষদের মধ্যে চাষ করে ভঙ্গুর অহংয়ের, যা একজনের মহিলার উপার্জিত অর্থে জীবনযাত্রা চালাতে বাধা দেয়। সমাজ, একজন মহিলার উপার্জিত অর্থকে এমন করেই আলাদা করে রাখার চেষ্টায় উন্মত্ত থাকে যেন কাজ করাটা তার কাছে কেবল ইচ্ছেপূরণ করা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পরবর্তী সময়ে, আমাদের এই দ্বন্দ্বগুলি অবশ্যই মনে রাখতে হবে। নারী দিবসের ইতিহাস আজ ১৫০ বছর অতিক্রান্ত। নারীরা যে গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলিকে লক্ষ্য করে বছরের পর বছর আন্দোলন করে, ইতিহাসে একটি দিন নিজেদের নামে লিখে নিয়েছেন আজ ভারতে সেই দিকগুলিই আবার নজর কাড়ছে। সময়ের সাথে ভারতীয় সমাজে ব্যতিক্রমের সংখ্যা বাড়লেও, মনে রাখতে হবে ব্যতিক্রম উদাহরণ-অনুপ্রেরণা হতে পারে। বাস্তব নয়। ভারতের মাটিতে আজ ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদ একই সময় তাদের দানবীয় রূপ নিয়ে প্রকট হচ্ছে। ফ্যাসিবাদি বিজেপি সরকারের মহিলাদের বাইনারিতে ফেলার প্রবণতাকে ভেঙ্গে ফেলতেই হবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, মহিলাদের যে সংগঠন চালায় তার নাম ‘দূর্গা বাহিনী’। এই সংগঠনে, একজন মহিলাকে যেভাবে ছোট থেকে শেখানো হয় যে সে ‘দূর্গার রুপ’ অর্থাৎ দশভুজা। মহিলাকে দেবীরুপে দেখা সমাজের খুব পুরনো ধারা, তদসত্ত্বেও একই দেশে ধর্ষিত হতে হয় শয়ে শয়ে মহিলাদের, নির্যাতিত হতে হয় রোজ প্রতিনিয়ত। শুধু বহিজগতে নয়, অন্দরমহলেও। আমাদের মনে থেকেই যাবে, ভারতের ইতিহাসে, আসিফার কথা, দিল্লী নির্ভয়ার কথা, উন্নাওয়ের কথা। উগ্র হিন্দুত্ববাদ সমাজকে যে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখায় তা কখনোই প্রান্তিক মানুষের নয়। সেই সমাজের উচ্চস্তরে থাকবে, কেবল হিন্দুরাই, হিন্দু- পুরুষেরা। পদদলিত হবে সকল প্রান্তিক বর্গের মানুষ — দলিত, মহিলা, আদিবাসী সকলে।

মহিলাদের দশভুজা আখ্যা দিয়ে আসলে তাকে তার ন্যায্য শ্রমের দাম থেকে বঞ্চিত করা হয়। একজন মহিলা ঘর চালানোর কাজে যে দৈনিক শ্রম প্রদান করেন, তার নেই কোনো আর্থিক সুরক্ষা। পুরুষরা তার হাতে ‘হাত খরচ’ হিসেবে তুলে দেন সামান্য কিছু অর্থ। কর্মরত মহিলাদের সকল সময়ে বাড়ির যেকোনো অবনতির জন্য দায়ের শিকার হতে হয়। যেন একজন মহিলার এটা জন্মগত দায়! পুরুষের এতে কোনো ভুমিকাই নেই। আর রইল পরে, সন্তান জন্ম দেওয়া ও তার লালন পালন করা। এ প্রসঙ্গেও সেই একই গল্প, অবিরত। ফ্যাসিবাদি সরকার মহিলাদের যে যৎসামান্য অগ্রগতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে দেখায়, উলটোদিকে মহিলাদের নিয়ে তাদের আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই আজ ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময়ে বিলকিস বানোর ধর্ষণের দোষীদের প্রজাতন্ত্র দিবসে মুক্ত করে দেওয়া হয়।

মহিলাদের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি আজ বারংবার এক হয়ে যাচ্ছে। সে সময় মহিলারা লেবার কোডের জন্য তীক্ষ্ণ লড়াই চালিয়েছিলেন। আজও ভারতের বিজেপি সরকার কর্মক্ষেত্রে যে নতুন লেবার কোড নিয়ে আসছেন, তাতে থাকবে না কোনো নির্দিষ্ট কাজের সময়। অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের যে দাপট বেড়ে চলেছে, তাতে কী এটা বোঝা খুব শক্ত — যে এই শ্রমকোড সরকারের পুঁজিপতিদের বৈধভাবে সাহায্য করা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। পুঁজিবাদ ও তাদের মালিকরা যে কখনোই শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলে না, ভাবেও না, এরজন্য বিশ্বের ইতিহাস কী যথেষ্ট নয়?

নারী আন্দোলন সর্বদাই, সামাজিকভাবে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এসেছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নারীরাও আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে। দাবী তুলেছেন ‘খাদ্য-জমির অধিকার-শান্তির’। ১৯৮০ সালের মতন আজও ইরানের বুকে আন্দোলন গড়ে উঠেছে মেয়েদের স্বাধিকারের প্রশ্নে। সেই সময় ইরানের শাসকের বিরুদ্ধে মহিলারা পর্দা প্রথা বর্জনের মাধ্যমে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলন ব্যাপকতা পায় যখন, দুই শ্রেণীর মহিলা (একজন পর্দা পড়ে, একজন পর্দা ছেড়ে) যুক্ত হয়। তারা স্পষ্ট করে বলেন, মহিলারা কী পড়বে? তা তাদের একান্ত নিজের ইচ্ছায়। সেখানে রাষ্ট্র কোনো নিয়ম হানতে পারে না। আজ ইরানের মাহিসা আমিনের সঠিকভাবে পর্দাপ্রথা না মানার ঘটনা ও ভারতের কর্ণাটকের ছাত্রী মুস্কানের হিজাব পড়তে চাওয়ার অধিকারের লড়াই ইতিহাসকে জাগিয়ে তোলে। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদ যেমন হিজাব পড়ে আশাকে ধর্মীয় মোড়কে অসমতার কথা বলে ব্যাখা করতে চায়, ইরানের সরকার অগুনতি নারীকে মাহিসা আমিনের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চোখ রাঙ্গাতে উদ্দত হয়।

তাই, মহিলাদের ‘দশভুজা’ প্রমাণ করার চক্রান্তকে প্রতিহত করে, মানুষ হয়ে তার ন্যায্য অধিকারের লড়াইকে জোরদার করে তুলতে হবে। ‘আচ্ছে দিনের’ মিথ্যে প্রতিশ্রুতির পর্দা ফাঁস করে বেকারত্বের প্রসঙ্গে মহিলাদের দাবি আদায়ের লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীদের শিক্ষা অন্ন বাসস্থানের জন্য লড়ে যাওয়া সেই নামগুলির স্মরণে ও স্পর্ধায় তীক্ষ্ণ লড়াই গড়ে তুলতে হবে। লড়াই করে পাওয়া অধিকারকে লড়াই করেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মনুবাদি সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

- অনন্যা চক্রবর্তী

context-trinamool

তৃণমূল নেত্রী তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য চাঙ্গা করতে জরুরি তলব করে একপ্রস্থ আলোচনা সারলেন। বৈঠক থেকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে গ্রামগঞ্জে নেমে পড়তে হবে। ক্রমাগত বিক্ষোভ ও ধূমায়িত অসন্তোষের ঠ্যালায় দেওয়ালে এখনও পিঠ না ঠেকলেও দলের সামগ্রিক অবস্থা বেশ রক্ষণাত্মক। কারণ, এখন সবচেয়ে বেশি তাড়া করছে তৃণমূলের পঞ্চায়েত রাজত্বের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ-বিক্ষোভ। এর পিছনকার প্রধান প্রধান কারণ হল, ‘মনরেগা’ প্রকল্পে কাজ ও কাজের বিনিময়ে প্রাপ্য মজুরি না দেওয়ার প্রতারণা থেকে শুরু করে আবাস যোজনা প্রকল্পে স্বজনপোষণ ও কাটমানির দুর্নীতি। তার ওপর চাষাবাদে পুঁজি ও পরিকাঠামোগত সাহায্য-সহযোগিতা ব্যাপক অবহেলার শিকার হয়ে চলছে। কেন্দ্রের ‘পি এম কিষাণ’ এবং রাজ্যের ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পের মাত্র কয়েক হাজার টাকায় কী হয়! সামান্যই সংস্থান হয়। রাজ্য সরকার ওপর থেকে ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে’ ধান কেনার ঘোষণা করে খালাস। কিন্তু তা নিয়ে ব্লক প্রশাসন এবং ‘জোড়া ফুল’-এর পঞ্চায়েতবাবুদের সময়োচিত কোনও সক্রিয়তার দেখা মেলে না। চাষিকে তাই বাধ্য হয়ে ঋণ পরিশোধের জন্য এবং আরও পাঁচ রকমের অভাবের জ্বালা মেটাতে ফসল বেশিদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না, লোকসান হলেও বেচে দিতে হয়। বহু যোজন দূরের সরকারি মান্ডি পর্যন্ত যাওয়া হয়না। পরিবহণের খরচ বহনের ঝক্কি আছে, সময় অন্তর সেই খরচ বেড়ে চলার মাশুল গোনার ধকল আছে। মান্ডিতে কোনো উপায়ে ফসল নিয়ে গেলেই যে বেচে ফেরা যাবে, এমন নিশ্চয়তা থাকে না। কারণ, ফসল বিক্রির ‘স্লিপ’ নিয়ন্ত্রণ করে তৃণমূলের মদতপুষ্ট ফাটকা মধ্যস্বত্ব ভোগী দালালরা। এরাই মান্ডিতে গিয়ে সরাসরি ফসল বিক্রির ব্যাপারে চাষিকে নিরাশ করে, বিভিন্ন বাধাবিপত্তি সৃষ্টি করে। ফলে চাষি বাধ্য হয় সহায়ক মূল্য ছাড়াই গ্রামেই ফসল বিক্রি করে দিতে। সেই ফসল কেনা আর মান্ডিতে সরকারের সহায়ক মূল্যের বিনিময়ে বেচার সুযোগটা ভোগ করে শাসকদল করা দালালরা। এই পরিঘটনা ফি-বছরকার ব্যাপার। আর, একেই মমতা সরকার খাদ্যশস্য চাষির কাছ থেকে ‘দুয়ারে সংগ্রহ’ বা ‘মান্ডিতে সংগ্রহ’ হয় বলে প্রচার করে! এবছরও গ্রাম-গঞ্জে একই চিত্র প্রত্যক্ষ করা গেছে। এই অসাধু কারবারীদের সাথে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক প্রশাসন, থানা-পুলিশ মায় খোদ দলের নেতা, বিধায়ক সবপক্ষের সাটগাঁট রয়েছে; সবক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ চালায় তৃণমূলের দাদাগিরি ও তার ঘনিষ্ট স্যাঙাতচক্র।

আর, সম্প্রতি এর সাথে যোগ হয়েছে গত বছর থেকে ধরা পড়া শিক্ষাক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে নিয়োগ-নীতি সংক্রান্ত দুর্নীতি।

২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় চলে আসার পরের বছর থেকেই এপর্যন্ত রকমারি সংস্কার প্রকল্প প্রাপ্তির প্রশ্নে অবিরাম জমেছে অভিযোগের পাহাড়। শাসকদলের উপরিস্তরের নেতা-হোতা-মোড়ল-মাতব্বরদের সারদার চিটফান্ড প্রতারণা থেকে গোপনে আর্থিক সুবিধা লোটা, স্টিং অপারেশনে ধরা পড়া নারদ-এর পাতা ফাঁদে নগদে উৎকোচ গ্রহণ তৃণমূলকে প্রাথমিকভাবে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। লাখ-লাখ টাকার গোপন লেনদেনের পর্দা ফাঁস হয়েছে! এইসব দুর্নীতির চূড়ামনিদের অনেকে পরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন ও ২০২১-এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। মুখ-পিঠ বাঁচানোর নাটক সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। ২০২১-এ তৃণমূলকে ক্ষমতায় ফিরতে দেখে ওই ঘাঘু-ঘুঘুদের একগুচ্ছ ফের তৃণমূলে ফিরে আসেন। অবশ্য সবচেয়ে ডাকাবুকো নেতাটি যে সপরিবারে বিজেপিতেই রয়ে যান, সে প্রসঙ্গ আলাদা। এইসব অভিযোগের আজও বিচার সারা না হওয়ায়, অপরাধীরা শাস্তি না পাওয়ায়, মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে। তবু, তৃণমূলের সমানে দুর্নীতি-দলতন্ত্র চালিয়ে যাওয়ার দু’কান কাটা যোগসাজশ আর দুঃসাহস আরও বেড়েছে বৈ কমেনি।

তৃণমূল জমানায় শিক্ষাক্ষেত্রে সংগঠিত দুর্নীতিই এযাবৎ সম্ভবত সবচেয়ে বড় ঘোটালা। একদিকে টাকার অঙ্কে তো বটেই, এমনকি একদশক যাবত ব্যাপক জাল বিস্তার, দল ও মন্ত্রীসভার দু’নম্বর নেতা সহ বিভিন্ন স্তরের দাদা-নেতা ও তাদের জো-হুজুরে পরিণত হওয়া কর্তৃস্থানীয় শিক্ষা আধিকারিকদের জড়িত থাকার বহরের কারণে এহেন সুপরিকল্পিত দুর্নীতির মাত্রা নজিরবিহীন। এই দুর্নীতি অন্যদিকে গ্রামবাংলার যুব কর্মপ্রার্থী, গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সামাজিক সর্বজনীন সম্পদ ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থার যথেচ্ছ ক্ষতি করেছে। নিয়োগ বঞ্চনার শিকার হওয়া যোগ্য কর্মপ্রার্থীদের ও উৎকোচের বিনিময়ে নিয়োগ পেতে জমিজমা বেচে বা ঋণ করে টাকা দেওয়া বেকারদের বড় অংশই গ্রাম বাংলার। নিয়োগ দুর্নীতি থেকে কামিয়ে নেওয়া টাকায় জবরদস্তি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির নামমাত্র মূল্যে দখল নেওয়া, খাস জমি, ডোবা জমি, খেলার মাঠ, ক্লাবের জমি, পুকুর ভরাট করে বাগিয়ে নেওয়া জমির ব্যাপক অংশই গ্রামাঞ্চলে। এইসব কুকর্মে কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে পঞ্চায়েতী ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। বলাগড় ব্লকে তথ্যানুসন্ধানে তো সেই সত্যেরই উদঘাটন ক্রিয়া চলছে। এ হল দৃশ্যমান শিলাখন্ড মাত্র, কোথায় যে এর তল তা এখনও কারও জানা হয়নি। এসবের সামাজিক প্রতিক্রিয়ার জের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে পড়বেই।

তৃণমূলনেত্রীর পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে মাথাব্যথার একটা বিশেষ কারণ হল, পঞ্চায়েতের কাজের পরিকল্পনা ও হিসাবপত্র নিয়ে গণতদারকির পদ্ধতি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে গ্রামাঞ্চলের মানুষজন ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রচন্ড। দুর্নীতি সর্বত্র ছেয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী এরকম তর্জন-গর্জনও শুনিয়েছিলেন, ‘অনেক হয়েছে পঞ্চায়েতের ওপর সব দায়-দায়িত্ব দিয়ে! সেই কাজ এরপর থেকে করানো হবে সরাসরি ব্লক প্রশাসনকে দিয়ে।’ এটা ময়দানে প্রমাণ হয়েছে হাস্যকর ছলচাতুরী। জনগণের মনে তা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন থেকে গেছে। এইসব বিষয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিভাবে সামাল দেবে তৃণমূল? ক্ষমতাসীন হয়ে অতিনিস্ক্রিয়তা অথচ ক্ষমতার দখল পেতে অতিসক্রিয়তা কেন! এই স্ববিরোধিতার সমস্যা ও সমাধান বোঝাতে হিমসিম খেতে হবে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের কপাল ভাঁজের আরেকটি কারণ হল, দলের ক্ষমতার দাপট দেখানো কিভাবে কতটা সম্ভব করে তোলা যাবে! অর্থাৎ সন্ত্রাস চালিয়ে নির্বাচনের দখল নেওয়া কতটা পারা যাবে! গত ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে ত্রিস্তর মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসনের দখল নিয়েছিল। পরে নির্বাচনের দিন সামগ্রিক গরিষ্ঠতা ছিনিয়ে নিতে সন্ত্রাসকেই চূড়ান্ত অস্ত্র করেছিল, যার কেন্দ্রে স্থান দেওয়া হয়েছিল ‘অনুব্রত মডেল’কে। এ নিয়ে বিগত পাঁচ বছরে যথেষ্ট ধিক্কার শুনতে হয়েছে। এবারের নির্বাচনে অনুব্রতর ‘চড়াম চড়াম’, ‘খেলা হবে’, ‘ভয়ঙ্কর খেলা হব’ হুমকি শোনানোর উপায় নেই। এবার বরং ঐধরণের হুমকির স্বর শোনা যাচ্ছে বিধানসভায় কাঁথি নিবাসী বিজেপি নেতার গলায়। যাই হোক, অনুব্রতর অনুপস্থিতিতে রাজ্যজুড়ে বিকল্প সংহারমূর্তির মডেল কিভাবে দাঁড় করানো সম্ভব তার উপায় খোঁজার চিন্তা তৃণমূলনেত্রীকে দুর্ভাবনায় রাখবে। ইতিমধ্যে ‘দিদির দূতরা’ গ্রাম-গ্রামান্তরে ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ বোঝাতে গিয়ে যথেষ্ট ক্ষোভের সম্মুখীন হচ্ছেন। প্রতিশ্রুতির প্রতারণা, বৈষম্য, স্বজনপোষণ, আর্থিক নয়ছয়, তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘাতের ঘটনা ও প্রবণতার বিরুদ্ধে বাড়ছে গ্রামীণ জনতার বিক্ষোভ। এর প্রতিফলন আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে পড়বেই।

- অনিমেষ চক্রবর্তী

electoral-bond

ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প চালু হওয়ার সময়ই অনেকে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, রাজনৈতিক দলকে অর্থদানের এই মাধ্যমটা রাজনীতিতে কালো টাকার অনুপ্রবেশকে অনায়াস করে তুলবে, এর মধ্যে দিয়েই বড় বড় ব্যবসায়িক ঘরানাগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষভাবে শাসক দলগুলোর (কেন্দ্র ও রাজ্যের) অনীতিনিষ্ঠ সম্পর্কের বিকাশের পথ প্রশস্ত হবে। রাজনৈতিক দলকে অর্থ প্রদানের যে ধারা এই প্রকল্পে ছকা হলো, তারমধ্যেই রাজনীতিতে কালো টাকার প্রাধান্য বিস্তারের শর্তনিহিত রয়েছে বলে তাঁরা বললেন। এমনকি রিজার্ভব্যাঙ্ক এবং নির্বাচন কমিশনও সেসময় এই প্রকল্পে তাদের আপত্তির কথা মোদী সরকারকে জানিয়েছিল। কিন্তু মোদী সরকারের স্বেচ্ছাচারী ধারা কোনো প্রতিবাদকেই কানে তোলেনি। স্টেট ব্যাঙ্কের নির্দিষ্ট করা ব্রাঞ্চ থেকে ইলেক্টোরাল বন্ড কিনে কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি যত খুশি টাকা পছন্দের রাজনৈতিক দলকে দিতে পারেন। আর এই বন্ড কিনলে তাঁদের নাম ও ঠিকানা গোপন থাকবে, ফলে কে কোন দলকে কত টাকা দিলেন তা সাধারণ নাগরিকদের জানা সম্ভব হবে না, এমনকি, তথ্যের অধিকার আইনের বলেও অর্থদাতার নাম জানা অসম্ভব থেকে যাবে। শাসক দলকে ভালো পরিমাণ অর্থদিয়ে খুশি করে নিজেদের জন্য বিপুল পরিমাণ সুবিধা আদায় করে নেওয়ার এক সুবিধাজনক পন্থা হয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাছে দেখা দিয়েছে ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প। মোদী জমানায় পুষ্ট হয়ে ওঠা সাঙাতি পুঁজিবাদ যে দু’হাত ঢেলে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে অর্থ জোগাচ্ছে তা আজ প্রশ্নহীন বাস্তবতা। তবে, পশ্চিমবাংলার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরও কর্পোরেট আনুকূল্য যে যথেষ্ট মাত্রায় বর্ষিত হয়েছে, ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে প্রকাশিত তথ্য তার সাক্ষ্য বহন করছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে জাতীয় দলগুলোর মধ্যে বিজেপিই ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণের ১৯১৭ কোটি টাকার অর্থ পেয়েছিল, এর পরই দ্বিতীয় স্থান ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের, তাদের প্রাপ্তির পরিমাণ ছিল ৫৪৫.১৭ কোটি টাকা যা কংগ্রেসের প্রাপ্তি (৫৪১.২৭ কোটি) থেকেও বেশি। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কিছু কর্পোরেট সংস্থার ঘনিষ্ঠতা যে গাঢ় হয়ে উঠেছে, এই তথ্য থেকে তা বুঝে ওঠাটা একেবারেই কঠিন নয়।

মোদী সরকার ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরই ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা করে। মোদী সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রকল্প চালু করার কথা প্রকাশ করেন। তখনই বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কালো টাকার আধিপত্য কেমনভাবে কায়েম হতে পারে তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, নাম ঠিকানা গোপন রাখাটাকে হাতিয়ার করে অনেক স্বার্থান্বেষী সংস্থা ও ব্যক্তি শেল কোম্পানি খুলবে। শেল কোম্পানি হল ব্যবসা না করা শুধু সাইনবোর্ড থাকা কোম্পানি। এই সমস্ত কোম্পানির মাধ্যমে প্রকৃত পরিচয়কে গোপন রেখে ইলেক্টোরাল বন্ড কিনে পছন্দের রাজনৈতিক দলের কাছে টাকা পৌঁছে দেওয়াটা সহজ হবে। তবে শুধু শেল কোম্পানি নয়, ট্রাস্ট, হিন্দু আনডিভাইডেড ফ্যামিলি বা অন্য কোনো বিধিবদ্ধ সংস্থারও এইভাবে রাজনৈতিক দলের হাতে অর্থ তুলে দিতে অসুবিধা হবে না। রাজনৈতিক দলকে প্রভাবিত করতে বিদেশী সংস্থার কাছেও বন্ড এক সহজলভ্য উপায় হবে।

নিজেদের আর্থিক শক্তিকে প্রবল করে তোলা ও সাঙাতি কর্পোরেটদের পোষণ করার যে অভিপ্রায়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার বন্ড প্রকল্প চালু করেছিল, তার বাস্তবায়নের বিপর্যয়কর ফল ভারতের জনগণ প্রত্যক্ষ করে চলেছেন। ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে অনুসন্ধান চালানোর সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস সংস্থা জানিয়েছে, ২০১৮’র মার্চথেকে শুরু করে ২০২২’র নভেম্বর পর্যন্ত ২৩ দফায় স্টেট ব্যাঙ্ক ২০,৪৭৪টা বন্ডের মাধ্যমে ১১,৪৬৭ টাকার কিছু বেশি ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি করেছে যারমধ্যে বিজেপির প্রাপ্তি ৫৭ শতাংশের মতো। তবে, পশ্চিমবাংলার শাসকদল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি কর্পোরেটদের অনুরাগ বাড়ার সাথে সাথে বন্ড থেকে তাদের প্রাপ্তিও বেড়ে চলে। বন্ড থেকে ২০১৯ ও ২০২০ সালে তৃণমূলের প্রাপ্তি ছিল যথাক্রমে ৯৭ ও ১০০ কোটি টাকা। তবে, ২০২১-২২ সালে বন্ড থেকে তৃণমূলের প্রাপ্তিতে আকস্মিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে নীতিগত কোনো আপত্তি না থাকায় তৃণমূল এটাকে তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি বলেই মনে করে। তাদের ক্ষোভ শুধু এটুকুই যে, বিজেপি বন্ড থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পেলেও তৃণমূল তাদের তুলনায় পাচ্ছে অনেক কম। মমতা ব্যানার্জি গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০২২’র নভেম্বরে বলেন, “বিজেপি প্রতিটা নির্বাচনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে। এত টাকা আসে কোথা থেকে? গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনের আগে ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি আবার শুরু হয়েছে। প্রত্যেকটা দলই বন্ড গ্ৰহণ করে কেননা সেটা বৈধ। কিন্তু নির্বাচন এলেই বিজেপি কোটি কোটি টাকা সংগ্ৰহ করে।” মমতা ব্যানার্জি যখন এই কথা বলছিলেন, তখন ২০২১-২২ অর্থবর্ষে বন্ড থেকে তাঁর দলের প্রাপ্তির পরিমাণ তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন এমন মনে করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বন্ড থেকে ২০২০-২১ বর্ষে তাঁর দলের প্রাপ্তি ছিল ৭৪.৪১ কোটি, এক বছরেই সেই প্রাপ্তি ৭ গুণ বেড়ে ৫৪৫ কোটির বেশি হল, তার ব্যাখ্যা কী হবে? কর্পোরেট দাক্ষিণ্য ছাড়া এই পরিমাণ অর্থ তৃণমূলের ঘরে জমা হওয়া সম্ভব ছিল না। ইলেক্টোরাল বন্ড বিভিন্ন মূল্যের হয় — ১০০০ টাকা থেকে শুরু করে ১ কোটি টাকার যা হলো সর্বোচ্চ মূল্যের। আজ পর্যন্ত যত বন্ড বিক্রি হয়েছে তারমধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যের বন্ডের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, ১১,৪৬৭ কোটির মধ্যে ১০,৭৭৪ কোটির বন্ডই ১ কোটি মূল্যের। কর্পোরেট সংস্থা ছাড়া অন্য কারও পক্ষেই বা ১ কোটি টাকার বন্ড কেনার সামর্থ্য থাকবে। বন্ডের মাধ্যমে রাজনীতিতে কালো টাকা ঢোকার পথ হাট করে খুলে যাওয়া, গোপন ও রহস্যজনক উৎস থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অর্থচলে আসা, কর্পোরেট আধিপত্য বিস্তারের পথ সুগম হওয়া, অর্থদাতার পরিচয় সাধারণ জনগণের কাছে গোপন রেখে রাজনীতিতে অর্থ আমদানিকে অস্বচ্ছ করা — ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে এই ধরনের নীতিগত কোনো আপত্তি মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে কোনোদিন শোনা যায়নি। আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা দলটার তাই কর্পোরেট ঘনিষ্ঠতাকে গাঢ় করা এবং কর্পোরেটদের থেকে অর্থপ্রাপ্তি নিয়ে কোনো ছুঁতমার্গ নেই। পশ্চিমবাংলায় তাজপুর সমুদ্র বন্দর, দেওচা-পাঁচামী কয়লা প্রকল্প ও অন্য কয়েকটি প্রকল্পে গৌতম আদানির আগ্ৰহ প্রকাশ এবং আগামী এক দশকে এই রাজ্যে ১০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি, ২০২২’র বাংলা বিশ্ব বাণিজ্য শীর্ষবৈঠকে দেশি-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতির মধ্যে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্পোরেট ঘনিষ্ঠতা গাঢ়তর হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে অর্থ প্রাপ্তির দিক থেকে তৃণমূলের স্থান কেন বিজেপির পরই দ্বিতীয় হল, তাদের সামগ্রিক আয়ের ৯৭ শতাংশই কেন ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে এল, তার অনুধাবনে তাই কোনো বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হয় না।

state-convention

গত ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ শ্রমিক কনভেনশনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ মার্চ ২০২৩ কলকাতায় শ্রমিক ভবনে রাজ্যস্তরের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহ, কর্মচারী সংগঠন সমূহ ও শিল্প ভিত্তিক ফেডারেশনগুলির আহ্বানে এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, কেন্দ্রের মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের শাসনে সমগ্র দেশের শ্রমিক, কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ সহ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা এক ভয়ংকর আক্রমণের মুখে। কর্পোরেটদের স্বার্থেদেশের শ্রম আইনসমূহ বাতিল করে শ্রমকোড তৈরি, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেলাগাম বেসরকারিকরণ, দেশের মানুষের সৃষ্টি করা জাতীয় সম্পদসমূহকে দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি, দেশের অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক লগ্নি পূঁজির কাছে বন্ধক রেখে দেশের সাধারণ মানুষের ও দেশের স্বনির্ভরতা, সার্বভৌমত্ব ও সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তুলেছে। এই সরকারের নীতি, যা দেশের অর্থনীতি এবং দেশের মানুষের ভয়ংকর বিপর্যয়ের কারণ, তা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য।

আরএসএস পরিচালিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও কর্পোরেটের অশুভ আঁতাতের প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত হল আদানি গোষ্ঠীর দুর্ণীতিকে ধামাচাপা দেবার কেন্দ্রীয় সরকারের নগ্ন প্রয়াস, হাজার হাজার কোটি টাকা স্টেট ব্যাঙ্ক ও এলআইসি’র লগ্নিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্বত্ত্বেও যৌথ সংসদীয় কমিটির তদন্তের বিরোধিতার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী মোদীর আশ্চর্যজনক নীরবতা।

বিগত ৯ বছরের বিজেপি শাসনে জীবন-জীবিকা ও মৌলিক অধিকারের উপর নামিয়ে আনা সরকারের নগ্ন আক্রমণে দেশের মানুষের দুর্দশা, যন্ত্রণা এবং দারিদ্র বেড়েছে অভাবনীয়ভাবে। কর্মচ্যুতি ও বেকারি আজ এক বিস্ফোরণের পর্যায়ে। পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস ও কেরোসিন সহ সমস্ত খাদ্যশস্য, ওষুধ এবং ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে চলেছে রকেট গতিতে, যা রোধ করার কোন উদ্যোগ সরকারের নেই। ফলে শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত মজুরি হ্রাস পাচ্ছে ব্যাপক হারে।

লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বন্ধ। কাজ হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। সরকারি চাকরিতে স্থায়ী পদ বিলোপ করা হয়েছে। নিয়োগ করা হচ্ছে ক্যাজুয়াল, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের যাদের ন্যূনতম বেতন, সামাজিক সুরক্ষা বা শ্রম আইনের কোনো অধিকার নেই।

সরকারের কর্পোরেটমুখী কৃষি-নীতির ফলে গত ৯ বছরে আত্মহত্যা করেছেন লক্ষাধিক ঋণগ্রস্ত কৃষক। ক্রাইম রেকর্ডব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালেই দৈনিক মজুরির শ্রমিকের আত্মহত্যার সংখ্যা প্রায় ৪১,০০০, যা কিনা দেশের ভয়ংকর সংকটের এক প্রতিফলন।

দেশের শ্রমজীবী মানুষ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে ৮ ঘণ্টা কাজের, ন্যূনতম বেতনের, সামাজিক নিরাপত্তার, ইউনিয়নে সংগঠিত হবার, যৌথ দর-কষাকষির অধিকারসমূহ আদায় করেছিল তা বাতিল করার লক্ষ্যে কর্পোরেট ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নিয়ে আনা হয়েছে ৪টি শ্রমকোড। যেকোন সময়ে তা লাগু করার পরিকল্পনা চলছে।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১। তা স্বত্বেও আইসিডিএস, মিড-ডে-মিল ইত্যাদি প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ বিপুলভাবে হ্রাস করা হয়েছে সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় বাজেটে। ৩১ শতাংশ ভর্তুকি কমানো হয়েছে খাদ্যের উপর থেকে। মনরেগা প্রকল্প, যা গ্রামীণ কর্মসংস্থানে কিছুটা সহায়তা করতে পেরেছিল, তার বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৩৩ শতাংশ। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে এক নয়া শিক্ষা নীতি চালু করেছে এই কেন্দ্রীয় সরকার। শুধু শিক্ষার বেসরকারীকরণ নয়, এর মধ্য দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে পাঠ্য বই এবং সিলেবাসকে হিন্দুত্ববাদী/মনুবাদী মতাদর্শে পরিবর্তিত করার। দেশের সাধারণ গরিব মানুষ ও কৃষকদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে, কর্পোরেটদের স্বার্থে পরিবর্তন করা হচ্ছে বিদ্যুৎ আইন। এই লক্ষ্যে নতুন বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২২ সংসদে পেশ করা হয়েছে।

লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী সহ বিরোধীদের সমালোচনার কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে মোদী সরকার ব্যবহার করছে ইডি, সিবিআই, এনআইএ’র মতো সংস্থা সহ দমনমূলক ইউএপিএ আইনকে। দেশজুড়ে ভয়-ভীতি এবং সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে।

শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যকে ভাঙতে সামপ্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই প্রেক্ষাপটে কনভেনশন থেকে শ্রমিক-বিরোধী, কৃষক-বিরোধী, দেশের মানুষের স্বার্থবিরোধী এবং দেশ বিরোধী কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সার্বিক ঐক্যবদ্ধ ও তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়।

পাশাপাশি এই রাজ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল সরকারের শ্রমিক-বিরোধী, কর্মচারী-বিরোধী ভূমিকা নগ্নভাবে আবার প্রকাশ পেয়েছে। তৃণমূল রাজত্বে ধর্মঘট বন্ধ করার মুখ্যমন্ত্রীর দম্ভোক্তি ও রাজ্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ডিএ’র দাবিতে গত ১০ মার্চের ধর্মঘটের বিরোধিতা, বেতন কাট, চাকুরিচ্ছেদের হুমকি, শ্রমিক কর্মচারী স্বার্থবিরোধী স্বৈরাচারী মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাস ও ট্রাম সংস্থার সরকারি জমি বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া এবং সম্প্রতি সরকারি জমিকে বেসরকারি জমি মাফিয়া ও প্রমোটরদের হাতে তুলে দিতে লিজ হোল্ডকে ফ্রি হোল্ড করে বিধান সভায় বিল পাশ করানো হয়েছে। এইভাবে সরকারের হাতে থাকা লক্ষ লক্ষ একর শিল্প, কৃষি, অকৃষি জমি, জলাশয়, জঙ্গল, বনাঞ্চলের জমিও বিক্রি করার ক্ষমতা হাতে নিতে চাইছে। এরফলে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ উচ্ছেদ হবে। এরসাথে রয়েছে সমস্ত বিভাগের সরকারি চাকরি বিক্রি, আবাস যোজনা সহ সমস্ত স্তরের ব্যাপক দুর্নীতি। যারমধ্যে যুক্ত রয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী, আমলাদের একাংশ, শাসকদলের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সহ শাসক দলের লোকেরা। প্রতিবাদ আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পুলিশ প্রশাসনকে নগ্নভাবে ব্যবহার করে দমন পীড়ন চলছে ও মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে প্রতিবাদীদের। এর বিরুদ্ধেও রাজ্যের শ্রমিক কর্মচারী আন্দোলনকে সোচ্চার হবার আহ্বান জানানো হয়েছে।

কনভেনশন থেকে সিদ্ধান্ত হয়,     
১) বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিক, সংগঠিত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মধ্যে দাবিগুলো নিয়ে নিবিড় ভাবে প্রচার করতে হবে। এরসাথে শিল্পভিত্তিক যুক্ত কর্মসূচি ও কনভেনশন অনুষ্ঠিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে, শ্রমকোড, বিদ্যুৎ বিল, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার সংগঠিত করতে হবে। সাথে সাথে রাজ্যের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী ও জনস্বার্থ বিরোধী নীতির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে।     
২) এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জেলাভিত্তিক যৌথ কনভেনশন অনুষ্ঠিত করতে হবে। (পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা হলে কর্মসূচির পরিবর্তন হবে)।     
৩) ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা রাজ্য জুড়ে পদযাত্রা/জাঠা/ সাইকেল র‍্যালী ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করতে হবে।     
৪) ৯-১০ আগস্ট ২০২৩ কলকাতায় রাণী রাসমনি রোডে শ্রমিকদের ‘মহাপড়াও’ ( মহাসমাবেশ) ও ধর্ণা অনুষ্ঠিত হবে।     
৫) একই সাথে রাজ্যে শ্রমিক কৃষক ঐক্যকে শক্তিশালী করতে যৌথ প্রচার/অবস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

এই কনভেনশনে সভাপতিমন্ডলীতে ছিলেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী, সিটুর রাজ্য সভাপতি সুভাষ মুখার্জী সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের রাজ্য নেতৃবৃন্দ প্রমুখ। কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু, সিটুর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু সহ অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়নের রাজ্য নেতৃত্ব প্রমুখ।

constitution-of-india

১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪৬তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটিকে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় যুক্ত করা হয়েছিল। সমাজতন্ত্র বলতে যেটা বোঝায় তাহল উৎপাদনের উপকরণের সামাজিক মালিকানা এবং উৎপাদিত দ্রব্যের সামাজিক বণ্টন। এটা আমাদের ভারতবর্ষে কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “আমাদের সমাজতন্ত্র আমাদের নিজস্ব রীতির সমাজতন্ত্র। যেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন মনে করব সেইসব ক্ষেত্রেই আমরা রাষ্ট্রীয়করণ করব। কেবল রাষ্ট্রীয়করণ করাই আমাদের রীতির সমাজতন্ত্র নয়।” রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প পরিচালনার সাথে সাথে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিল্প গড়ে তোলার বিষয়টিকেও মান্যতা দেওয়া হয়েছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রেখে সেই সম্পত্তি দেশের স্বার্থেব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম সব সম্পত্তি জাতীয়করণের পরিবর্তে ভারতে মিশ্র অর্থনীতির প্রবর্তন করা হয়েছিল।

ইতিপূর্বেই শিল্প সংস্থার জাতীয়করণ এবং নতুন নতুন রাষ্ট্রীয় শিল্প সংস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ভারতের অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্রের বীজ প্রোথিত করার সূচনা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি এবং পরবর্তীতে ইউনিট ট্রাষ্ট, ন্যাশনাল ইন্সিওরেন্স, জীবন বীমা ইত্যাদি জাতীয়করণ করা হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী ভারতবর্ষের দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ভারি শিল্পের। যারজন্য প্রয়োজন ছিল বৃহৎ পুঁজির। সে সময় ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থাগুলির পক্ষে সম্ভব ছিল না সে পুঁজি বিনিয়োগ করা। দেশবাসীর টাকায় সরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক পুঁজি-নিবিড় এবং শ্রম-নিবিড় রাষ্ট্রীয় শিল্প সংস্থা। যেমন রৌরকেল্লা, দূর্গাপুর, ভিলাই, বোকারোর মতো বড় বড় শিল্প। একই সাথে চলতে থাকে আঞ্চলিক উন্নয়ন, কর্ম সংস্থান, দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও অনুসারী শিল্পের বিস্তার। স্বাধীনতার পূর্বে কিছু রাষ্ট্রীয় শিল্প সংস্থা গড়ে উঠেছিল। যেমন অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি, পোর্টট্রাস্ট, অল ইন্ডিয়া রেডিও, পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাম, রেল ইত্যাদি। স্বাধীনতার পর প্রথম ও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় রাষ্ট্রের মালিকানাধীন শিল্প সংস্থা গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং এইসব ক্ষেত্রে সরকারি পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়। এই বিনিয়োগ শিল্পের পরিকাঠামো গড়ে তোলার উপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন ব্যাঙ্ক, বীমা, ইঞ্জিনিয়ারিং, সার, ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম, বিদ্যুৎ, কয়লা ইত্যাদি। আমরা দেখেছিলাম জাতীয়করণ ও রাষ্ট্রীয় শিল্প গড়ে তোলার দীর্ঘযাত্রায় ভারতের অর্থনীতি অনেকটাই স্বনির্ভরতা অর্জন করেছিল। রপ্তানির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বিশেষ ভুমিকা দেখা গেছে। যেমন হিন্দুস্থান মেশিন টুলস, স্টেট ট্রেডিং কর্পোরেশন, ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড, হিন্দুস্থান স্টিল লিমিটেড, মিনারেলস অ্যান্ড মেটালস ট্রেডিং কর্পোরেশন, ইত্যাদি। অপরদিকে বিদেশের উপর আমদানি নির্ভরতা কমাতে এক বিশাল অবদান দেখা গেছে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, হিন্দুস্থান অ্যান্টিবায়োটিকস লিমিটেড, অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশন, ইন্ডিয়ান ড্রাগস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থাগুলিকে। এই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বিশাল এক সম্ভার গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষে। এটা লক্ষ্যনীয় যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় যেখানে দেশে মাত্র ৫টা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ছিল তা পরবর্তীতে ২০১১ সালে ২৪৮টিতে পরিণত হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থার সংখ্যা হয়েছিল প্রায় সাড়ে সাতশটি।

১৯৯০ পরবর্তী ভারতের শাসকশ্রেণী ‘নয়া আর্থিক নীতি’ গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাস্ট্রীয় শিল্প সংস্থার উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং বিলগ্নীকরণ শুরু হল। সংস্থাগুলিতে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ কমিয়ে দেওয়া এবং শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ করে চুক্তি প্রথায় নিয়োগ চালু করা হল। যার নামকরণ করা হল ‘স্ট্রাকচারাল রি-এ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’। এই প্রক্রিয়া একদিকে ক্রমশ যেমন নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগকে তলানিতে নিয়ে গেছে তেমনি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে বি-রাষ্ট্রীয়করণ, বিলগ্নীকরণ বা চিরতরে বৃহৎ পুঁজিপতি বা কর্পোরেট সংস্থার কাছে বেঁচে দেওয়ার কর্মকান্ডকে ত্বরান্বিত করেছে। আমরা যদি বিগত প্রধানমন্ত্রীদের সময়কালে রাষ্ট্রীয় শিল্প সংস্থা গড়ে তোলা এবং বেঁচে দেওয়ার সংক্ষিপ্ত খতিয়ান দেখি তাহলে দেখব যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী, গড়ে তোলা, বেচে দেওয়া জহরলাল নেহেরু - ৩৩টি, ০; লাল বাহাদুর শাস্ত্রী - ৫টি, ০; ইন্দিরা গান্ধী - ৬৬টি, ০; মোরারজী দেশাই - ৯টি, ০; রাজীব গান্ধী - ১৬টি, ০; ভিপি সিং - ২টি, ০; পিভি নরসিমা রাও - ১৪টি, ০; আই কে গুজরাল - ৩টি, ০; অটল বিহারি বাজপেয়ী - ১৭টি, ৭টি; ডঃ মনমোহন সিং - ২৩টি, ৩টি, নরেন্দ্র মোদী - ০টি আর বেচে দিয়েছেন ২৩টি।

পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে রাস্ট্রীয় শিল্প সংস্থার অবগতির তীব্রতা। একইভাবে দেশের বিভিন্ন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও সরকারি মালিকানাধীন শিল্প সংস্থার প্রশ্নে এই নীতিকেই অনুসরণ করা হচ্ছে।

ভারতীয় অর্থনীতিকে বিদেশী পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র নামে বিদেশী পুঁজিকে আমন্ত্রণ জানানো, যৌথ উদ্যোগের নামে সরকারি শেয়ার কমিয়ে পুঁজিপতিদের হাতে সিংহভাগ শেয়ার হস্তান্তর করা, পিপিপি মডেল চালু করার মধ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে বেসরকারীকরণ এবং চিরকালের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়াটাই আজ মূল নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যাঙ্কিং সেক্টরগুলিকে পুনর্গঠনের নামে সংকুচিত করা হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের বোঝা আজ সাধারণ মানুষের উপর চাপানো হচ্ছে। অথচ বড় বড় পুঁজিপতি ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনোরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল না। ব্যাঙ্কশিল্প আজ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা বিগত দিনে দেখেছি আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় ভারতের আর্থিক ক্ষেত্রটি নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। বিদেশী পুঁজির অস্থিরতা বা বিদেশী পুঁজির আগ্রাসনের হাত থেকে ভারতীয় আর্থিক ক্ষেত্রকে রক্ষা করতে সার্বভৌম ভারত রাষ্ট্র যে সমস্ত রক্ষাকবচ ও বিধিনিষেধ চালু করেছিল সেগুলিকে দুর্বল করার মধ্য দিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে শুধু সমাজতান্ত্রিক উপাদানগুলিই লুপ্তপ্রায় হয়নি এর সাথে সাথে ভারতীয় অর্থনীতি আজ এক অত্যন্ত বিপদজনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের নামে বা আর্থিক সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে বিদেশী ঋণের বোঝা আজ আকাশ ছুঁতে চলেছে। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, ইন্টারন্যাশানাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশানাল ব্যাঙ্ক অফ রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের মতো সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে ভারত। ২০২০-২১ সালে ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে ১৯৭ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এই ঋণের টাকা শোধ করতে জনগণের উপর ক্রমশ বাড়বে করের বোঝা এবং বিক্রি করা হবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও সরকারি জমি।

জনগণের আয় নিম্নমুখী হওয়ার কারণে বিশাল এক আর্থিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ সালে দেশের ১ শতাংশ ধনকুবের হাতে ছিল দেশের ৪৯ শতাংশ সম্পদ। ২০১৫ সালে ৫৩ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে তা হয়েছে ৭০ শতাংশ।

এই আর্থিক বৈষম্য, জাতীয় সম্পদ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বিলোপ শেষ বিচারে ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে যে সমাজতান্ত্রিক মর্মবস্তু একদিন প্রোথিত হয়েছিল তার বীজ উৎপাটন ছাড়া আর কিছুই না। সময় থাকতে ভারতীয় জনগণকেই সজাগ হতে হবে যাতে ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক উপাদানগুলিকে রক্ষা করা যায়।

- দিবাকর ভট্টাচার্য্য

passed-a-year

রাশিয়া ২০২২-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের ওপর সামরিক আক্রমণ শুরু করার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধ এখনও থামেনি। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে রণনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাখমুট শহরে দু-পক্ষই মরণপণ লড়াই চালাচ্ছে। রুশ বাহিনীর পাশাপাশি তাদের ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গোষ্ঠীও সেখানে যথেষ্ট সক্রিয়। শহরটা দখলের জন্য রাশিয়ার ছোঁড়া একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র শহরটাকে বলতে গেলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, অল্প কিছু মানুষ বাদে সেখানকার সব জনগণই শহর ছেড়ে চলে গেছেন, শহর তিন দিক থেকে এখন রাশিয়ার ঘেরাওয়ের মুখে। ইউক্রেন বাখমুটে রাশিয়ার আক্রমণকে প্রতিহত করা এবং শত্রু পক্ষের প্রচুর সেনাকে নিহত করার দাবি জানালেও ভাষ্যকারদের মতে পরিস্থিতির বিকাশে বাখমুট হয়ত কিছু সময়ের মধ্যে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে এবং ইউক্রেন সেনাদের সেখান থেকে পশ্চাদপসরণ করতে হবে। তবে, শুধু পূবের ডনবাস অঞ্চলের বাখমুটই নয়, ইউক্রেনের রাজধানী কিভ, পূবের আর এক শহর নিপ্রো, দক্ষিণের বন্দর শহর ওডেসার ওপরও রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের সাক্ষর রেখে চলেছে। সারা দুনিয়ার সাধারণ, শান্তিকামী জনগণই আজ প্রশ্ন তুলছেন– এই যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? যুদ্ধের পরিণামে জ্বালানি, খাদ্য, সারের দাম বাড়ায় তাঁদের জীবন যে যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে, তার আশু অবসান কি হবে না? তবে, কিছুদিন আগেও যুদ্ধ শেষের কোনো লক্ষণ যেখানে দেখা যাচ্ছিল না, এখন পরিস্থিতিতে একটু বদল এসেছে বলে মনে হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই যেমন যুদ্ধ বন্ধের আকাঙ্খা তীব্র হচ্ছে, তার পাশাপাশি কিছু শান্তি প্রস্তাবও উঠে আসছে। শান্তি প্রস্তাব এসেছে রাশিয়ার মিত্র দেশ চীনের কাছ থেকে। এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি শিন ফিং এখন তিন দিনের সফরে ২০ মার্চ মস্কো গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করছেন।

যুদ্ধের এই এক বছরে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের বহু সেনা-সহ হাজার-হাজার অসামরিক জনগণ নিহত হয়েছেন, পরিকাঠামোর একটা বড় অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর ওপর রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ বিদ্যুৎ সংকটকে তীব্রতর করেছে। যুদ্ধ জনগণের জীবন-জীবিকায় বিপর্যয় ঘটানোয় যুদ্ধ শুরুর আগে ইউক্রেনে দারিদ্র সীমার নীচে থাকা জনগণের অংশ যেখানে ছিল মাত্র ২ শতাংশ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশে। ঘর-বাড়ি আবাসনের ওপর আক্রমণের পরিণামে দেশের এক-তৃতিয়াংশ জনগণ বাড়িঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। একটা হিসাব অনুসারে, ইউক্রেনের পরিকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৫০০ বিলিয়ন ডলার এবং অন্তত ১০০০০০ অসামরিক জনগণ নিহত হয়েছেন।

যুদ্ধ এত দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণ রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের শক্তিশালী প্রতিরোধ। রাশিয়া ভেবেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত ক্রাইমিয়া দখল তার পক্ষে যতটা অনায়াস হয়েছিল, এবারও দানেস্ক ও লুহানস্ক-সহ ডনবাস অঞ্চল দখল করে ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাশিয়ার শর্ত গেলাতে বাধ্য করতে পারবে। যে শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে--ইউক্রেনকে সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে; সংবিধান সংশোধন করে কোনো জোটে যোগদানের লক্ষ্য থেকে সরে আসতে হবে, অর্থাৎ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য হওয়া যাবে না; ২০১৪ সালে দখল হওয়া ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার এলাকা বলে স্বীকার করতে হবে; ডনবাস অঞ্চলের দানেস্ক ও লুহানস্কককে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকার করতে হবে। আর এটাও সবাই জানে যে, মূলত আমেরিকা ও ন্যাটো সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র নিয়েই ইউক্রেন তাদের প্রতিরোধ গড়েছে, রাশিয়ার যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে। রাশিয়ারও বহু, হয়ত বা লক্ষাধিক সেনা নিহত হয়েছে, প্রথম দিকে দখল করা কিছু স্থান থেকে রুশ বাহিনীকে হঠিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে ইউক্রেন বাহিনী।

ন্যাটোর পূবমুখী সম্প্রসারণ এবং রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ন্যাটোর সদস্য করাটা তাদের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হচ্ছে, এই উদ্বেগই রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে এসেছে এবং রাশিয়ার এই বিপদাভাসকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যে পনেরটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে তার তিনটি, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়াকে ন্যাটো সদস্য করা হয়েছে এবং জর্জিয়া-ইউক্রেন-সহ রুশ প্রতিবেশী আরও কিছু দেশকে সদস্য করার পরিকল্পনাও ন্যাটোর রয়েছে। অতএব, ঠাণ্ডা যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়েও আমেরিকা ও ন্যাটোর রুশ-বিরোধী বৈরিতায় কোনো যতি নেই। ন্যাটো সদস্যরা সেনা বাহিনী নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে না নামলেও তারা একভাবে এই যুদ্ধে শামিল হয়েছে এবং ন্যাটোর রুশ-বিরোধী সক্রিয়তাকেও গতি দেওয়া হয়েছে। ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল স্টলটেনবারগ সম্প্রতি তুরস্ক সফরে গেলেন যে দেশটি কিছুদিন আগেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখানে গিয়ে তুরস্কের বিপর্যয়, সেখানকার জনগণের দুরবস্থা তাঁর কাছে বিবেচনার তেমন বিষয় হলো না। তিনি গিয়ে তুরস্কের কাছে আবেদন জানালেন – তুরস্ক যেন সুইডেন ও নরওয়ের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার প্রস্তাবে তাদের আপত্তিকে প্রত্যাহার করে নেয়! ন্যাটোর সংবিধান অনুযায়ী নতুন কোনো দেশকে ন্যাটোর সদস্য হতে হলে সমস্ত সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন। তুরস্কের আপত্তিতে সুইডেন ও নরওয়ের সদস্যপদ আটকে যাচ্ছে, আর ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও স্টলটেনবারগের কাছে দুই দেশের ন্যাটো সদস্য হওয়ার লক্ষ্যে তুরস্কের সম্মতি আদায়ই সবচেয়ে গুরুত্ব পেল!

তবে, পশ্চিমের এই বৈরী মনোভাবকে ইউক্রেন আক্রমণের ন্যায়সঙ্গত কারণ হিসাবে পুতিন দেখাতে চাইলেও তাকে কখনই মেনে নেওয়া যায় না। আর পুতিন ইউক্রেন আক্রমণকে “বিশেষ সামরিক অভিযান” এবং ইউক্রেনের “সামরিকীকরণকে প্রতিহত করা” এবং ইউক্রেনকে “নাজি-মুক্ত” করা বলে চালাতে চাইলেও তা বিশ্বের জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এক পুরোদস্তুর যুদ্ধ এবং রুশ উগ্ৰজাতীয়তাবাদ দ্বারাই চালিত। ইউক্রেন রাশিয়ার নিরাপত্তার কাছে যত চ্যালেঞ্জেরই হোক, আলাপআলোচনার মাধ্যমে তার মোকাবিলাই হতো সংগত।

চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী ওয়াং ই রাশিয়া সফরে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে এক ১২ দফা শান্তি প্রস্তাব দেন। চীনের প্রস্তাবে যুদ্ধ স্থগিত করা এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনা শুরুর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “সমস্ত দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে সম্মান জানাতে হবে।” রাশিয়ার ওপর চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে তুলে নেওয়া এবং ঠাণ্ডা যুদ্ধের মানসিকতা প্রত্যাহারের কথাও প্রস্তাবে রয়েছে। পশ্চিমের দেশগুলোর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে, তারা যেন “ইউক্রেনের সংকটকে আর বাড়িয়ে না তোলে।” পশ্চিম দুনিয়া প্রত্যাশিতভাবেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেন বলেছেন, “রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন এই প্রস্তাবের প্রশংসা করেছেন, সে ক্ষেত্রে এর মধ্যে ভালো কি থাকতে পারে? এই পরিকল্পনার মধ্যে এমন কিছু আছে বলে আমি দেখতে পাইনি যা থেকে রাশিয়া ছাড়া অন্য কারো লাভ হতে পারে। “ অতএব, যুদ্ধ থামার ফলে রাশিয়ার লাভ হলে সেটা বাইডেনদের কাছে বাঞ্ছিত নয়। তবে, প্রস্তাব নিয়ে পশ্চিম দুনিয়ার বিরোধিতা থাকলেও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি প্রস্তাবে কিছুটা আগ্ৰহ দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “শি শিন ফিং-এর সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা আমার রয়েছে এবং আমি বিশ্বাস করি এটা (চীনের শান্তি প্রস্তাব) আমাদের দেশ এবং বিশ্বের নিরাপত্তার পক্ষে সুফলদায়ক হবে।” তবে, জেলেনেস্কি চীনের প্রস্তাবে এবং শি শিন ফিং-এর সঙ্গে আলোচনায় আগ্ৰহ দেখালেও আমেরিকা এবং ন্যাটোর যে প্রবল নিয়ন্ত্রণ তাঁর ওপর রয়েছে তার থেকে তিনি কতটা বেরিয়ে আসতে পারবেন তা অবশ্যই একেবারে ভিত্তিহীন আশঙ্কা নয়।

ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ইতিবাচক একটা বিষয় হল – আমেরিকা তার সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার বহু দেশকেই রুশ-বিরোধী অবস্থানে নিয়ে আসতে পারেনি। ঐ দেশগুলোর কেউই ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়া-ইয়েমেন নিয়ে আমেরিকার আগ্রাসি ভূমিকাকে বিস্মৃত হয়নি। আর ইউক্রেনে পশ্চিম দুনিয়ার প্রবল হস্তক্ষেপকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই বলে অভিহিত করার মধ্যে নিহিত কপটতাকে ধরে ফেলতেও তাদের অসুবিধা হচ্ছে না। বিপরীতে, দিনদিনই যুদ্ধ বন্ধের আকাঙ্খা বিভিন্ন দেশেই তীব্রতর হচ্ছে। যুদ্ধ থামানোর প্রবল আর্জি জার্মানির জনগণ জানালেন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের জার্মানির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অন্তত দশ হাজার মানুষ পথে নামলেন। বিক্ষোভকারীরা বললেন, জার্মান চ্যান্সেলরকে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করতে হবে। কারণ, “প্রতিদিন হাজার খানেক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। ক্রমশ তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।” জার্মানির জনগণ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তা আমাদের, বিশ্বের শান্তিকামী জনগণের কাছে অনুসরণীয় নজির হয়ে উঠুক। যুদ্ধ এক বছর পেরিয়েছে, আর নয় – এই আওয়াজ সোচ্চারে উঠুক দেশে-দেশে।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ শুরুর সময়ই শি শিন ফিং বলেছিলেন, যুদ্ধ সমস্যা সমাধানের কোনো পথ হতে পারে না। মস্কো গিয়েও শি বলেছেন – তাঁর মস্কো সফরের উদ্দেশ্য যুদ্ধ বন্ধ তথা শান্তি প্রক্রিয়ায় গতি দেওয়া। একই সময় ইউক্রেন সফররত জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদার উদ্দেশ্যেও তিনি বলেছেন, যুদ্ধ পরিস্থিতিকে তীব্রতর করে না তুলে জাপানের উচিত পরিস্থিতিকে প্রশমিত করা। শি শিন ফিং-এর সফর থেকে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সূত্র বেরিয়ে আসুক – এটাই পৃথিবীর শান্তিকামী জনগণের একান্ত কাম্য। যুদ্ধর বিপরীতে শান্তির পরিস্থিতিতেই যে দরিদ্র জনগণ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন, অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের দাম কমার প্রত্যাশা করতে পারেন।

- জয়দীপ মিত্র

strike-in-england

ইংল্যান্ড জুড়ে হাজারে হাজারে জুনিয়ার ডাক্তাররা ১৩ মার্চ ২০২৩ থেকে ধর্মঘটে পা বাড়ালেন। তিনদিন ধরে চলা তাঁদের এই ধর্মঘটের ফলে গোটা যুক্তরাজ্যে সরকার পোষিত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো অচল হয়ে পড়ে।

ডাক্তারদের ট্রেড ইউনিয়ন ব্রিটিশ মেডিকাল সংস্থা জানিয়েছে, ২০০৮’র পর থেকে জুনিয়ার ডাক্তারদের প্রকৃত বেতন হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে ২৬ শতাংশ। এদিকে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাজের অতিরিক্ত বোঝা, দীর্ঘায়িত হয়েছে রোগিদের সারি। মূল্যস্ফীতি সেখানে নাগালের বাইরে। জুনিয়ার ডাক্তাররা ঘন্টা প্রতি আয় করেন মাত্র ১৪.০৯ পাউন্ড বা ১৭ ডলার। ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জুনিয়ার ডাক্তাররা ২৬ শতাংশ, তাই এই ধর্মঘট ওখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিপর্যস্থ করে দিয়েছে।

সরকার সিনিয়ার ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীদের দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

কয়েকমাস আগে অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মী, নার্স-প্যারামেডিক্স, বর্ধিত বেতন ও উন্নত কাজের পরিবেশের দাবিতে ধর্মঘট করেন।

ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মেডিকাল ডাইরেক্টার জানিয়েছেন, জুনিয়ার ডাক্তারদের এই ধর্মঘট বিরাট প্রভাব ফেলেছে আর তা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “ধর্মঘটি ইউনিয়ন সরকারের সাথে সহযোগিতা করছে না, কোন আলাপ আলোচনায় বসছে না।” এদিকে, ধর্মঘটি ইউনিয়ন জানিয়েছে, মাসের পর মাস ধরে তাঁরা তাঁদের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। আর, এখন, বেশ কিছু পূর্বশর্ত আসছে আলোচনায় অংশ নেবার আগে।

ডাক্তারদের এই ধর্মঘটের পাশাপাশি আর কয়েকদিনের মধ্যে সেখানে শুরু হবে হাজারে হাজারে শিক্ষক ও সরকারি কর্মীদের ধর্মঘট। তাঁরা ঠিক করেছেন, যেদিন সরকার তার বাজেট পেশ করবে, সেদিন থেকেই শুরু হবে তাদের ধর্মঘট।

একের পর এক ধর্মঘটের ঢেউ গোটা ব্রিটেনকে বার বার অচল করে দিচ্ছে। এবছর জানুয়ারি মাসে সেখানে মুল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। গত নভেম্বরে ১১.১ শতাংশের তুলনায় তা কম হলেও বিগত ৪০ বছরে তা এখনও সর্বোচ্চ।

হাজারে হাজারে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মী, যাদের মধ্যে রয়েছেন ট্রেনের চালক, বিমানবন্দরে মালপত্র নামানো কর্মী, বর্ডার স্টাফ, বাস চালক, ডাক বিভাগের কর্মী — দলে দলে সকলেই কর্মবিরতি করেন বেতন বৃদ্ধির দাবিতে। ইউনিয়ন জানিয়েছে, সকলের বেতন, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেতন গত দশকে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ওখানে দৈনন্দিন জীবন ধারণের খরচ, খাদ্য ও বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম চলে গেছে নাগালের বাইরে। তীব্র আর্থিক সংকটে ত্রাহিত্রাহি অবস্থা শ্রমিক কর্মচারীদের। তাই ধর্মঘট ছাড়া তাঁদের সামনে আর কোন রাস্তা খোলা নেই।

arun-mukherjee-is-immortal

শহর থেকে গ্রামে চলো! দরিদ্র ভূমিহীন কৃষকের সাথে একাত্ম হও। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে নকশালবাড়ি সৃষ্টি করেছিল সম্পূর্ণ নতুন এই অনুশীলন। বামপন্থার গৌরবময় অধ্যায়। ৭০ দশকে হাজার হাজার যুবছাত্র গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। তাঁরা সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেছিলেন। মানুষকে দেখাতে পেরেছিলেন। এই বিপ্লবী অভিযানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শহীদ হয়েছিলেন কমরেড অরুন মুখার্জি, দুখীরাম রায়। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ নদীয়া জেলার ধর্মদা এলাকা থেকে পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে ঠান্ডা মাথায় তাঁদের হত্যা করা হয়। এই এলাকায় নির্মিত শহীদ বেদীতে লাল পতাকা উত্তোলন-মাল্যদান করে অনুষ্ঠিত হল স্মরণ অনুষ্ঠান। সেই অভিযান আজও চলছে। শহীদের স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের। গ্রামীণ গরিবদের মধ্যে সংগ্রামী ভিত্তি গড়ে তুলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করতে হবে। মোকাবিলা করতে হবে লুঠতন্ত্রকে। এই বার্তা তুলে ধরলো শহিদ স্মরণ কর্মসূচি।

=== 000 ===

খণ্ড-30
সংখ্যা-7