একাদশ পার্টি কংগ্রেসের আন্তর্জাতিক সংহতি অধিবেশন পর্বে উপস্থিত ছিলেন ভেলিজুয়েলা, নেপাল, ইউক্রেন, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিস্তিন, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে আগত অতিথিগণ। বিভিন্ন ভগ্নিপ্রতিম সংগঠনগুলি ভারতে চলমান জনগণের সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তাঁরা এক জনগণতান্ত্রিক ও বহুজাতিক বিশ্ব গড়ে তোলার কথা বলেন এবং সেই কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংহতির কথা বলেন।
‘ইউক্রেনিয় আন্তর্জাতিক সংহতি’-র সদস্য সোটসিয়ালনি রুখ উল্লেখ করেন যে তাঁরা পুতিনের নেতৃত্বে চলা “বিরাট রুশ আধিপত্যবাদ”-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করছেন কারণ তা ইউক্রেনে রুশ সার্বভৌমত্ব প্রসার প্রশ্নে লেনিনের গৃহীত অবস্থানের ঘোর বিরোধী। রুখ বলেন যে পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রাম এক উন্নত ও শোষণমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলবে। তিনি ইউক্রেনের জণগনের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সিপিআই(এম-এল)-কে ধন্যবাদ জানান।
নেপালের সিপিএন (ইউনিফায়েড সোশ্যালিস্ট) এর পক্ষ থেকে ঝালা নাথ খানাল উল্লেখ করেন, ১৯৭০ সাল থেকেই নেপালের কমিউনিস্ট দল এবং সিপিআই(এমএল)-এর মধ্যে দীর্ঘ সম্পর্কের ইতিহাসের কথা। সেইসময়, কমরেড বিনোদ মিশ্র নেপালের সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কেবল তাই নয়, তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁদের ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসেও। তিনি বলেন, বর্তমানে নেপাল বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যদিও সেখানে এখন কমিউনিস্ট দলগুলি একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছে এবং নির্বাচনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছে, তবুও ডানপন্থী দলগুলি তাদের রাজনৈতিক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে অনুপ্রবেশ করেই চলেছে। তারা রাজতন্ত্রের দিনগুলি ফিরিয়ে আনতে চায়। তিনি আরও বলেন, “আমরা নেপালে সংসদের ভিতরে এবং বাইরে দু’জায়গাতেই বহুমাত্রিক শ্রেণী সংগ্রাম শুরু করেছি। এইসময় আমাদের কাছে ডানপন্থী শক্তি ও তাদের প্রভাবিত সামাজিক উপাদানগুলির মোকাবিলা করতে বামপন্থি সরকার এবং বামপন্থি ঐক্য গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’
ভেনিজুয়েলার সংযুক্ত সমাজতান্ত্রিক পার্টির রামোন অগাস্টো সংহতি প্রকাশ করে বলেন, “জনগণের ঐক্যের প্রবর্তক কমান্ডার হুগো শ্যাভেজের দেশ থেকে তিনি এসেছেন। সামাজিক উন্নয়ন আনতে, চলমান যেকোনো ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে সংহতি স্থাপন করতে হবে। সমাজে পরিপুরুক শক্তি তৈরি করতে হবে।” তিনি বিশ্বাস করেন, এইভাবেই আমরা একটি বহুমুখী বিশ্ব গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবো, যেখানে শান্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চয়তা পাবে।
এছাড়াও সংহতি বার্তা পাঠ করেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে সাইফুল হক, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষ থেকে বজলুর রসিদ, সোশ্যালিস্ট অ্যালায়েন্সের (অস্ট্রেলিয়া) পক্ষ থেকে স্যাম ওয়েনরাইট, সাউথ এশিয়া সলিডারিটির (যুক্তরাজ্য) পক্ষ থেকে সরবজিৎ জোহল। অপূর্বা গৌতম বক্তব্য রাখেন বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাংশনস মুভমেন্ট (বিডিএস) এর পক্ষ থেকে।
কিউবার রাষ্ট্রদুত আলেজান্দ্রো সিমানকাস মারিন, এমএলপিডি জার্মানি, কমিউনিস্ট পার্টি অফ সোয়াজিল্যান্ড, পারটিদো কমিউনিস্টা একুএটোরিআনো, পারটিদো মাংগাগাওয়া (লেবার পার্টি ফিলিপাইন্স), ইউনিয়ন অফ সাইপ্রাইটস (সাইপ্রাস), লাও পিপলস রেভলিউসানারি পার্টি (লাওস) – পার্টি কংগ্রেসে তাদের সংহতি বার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং তা অধিবেশনে পাঠ করা হয়।
বহু সংগঠনই সিপিআই(এম-এল)-এর ১১তম পার্টি কংগ্রেসকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন – আফগানিস্তানের বামপন্থী পার্টি, ইরানের কমিউনিস্ট পার্টি, আর্জেন্টিনার কমিউনিস্ট পার্টি এবং ল্যান্ডলেস পিপলস মুভমেন্ট (নামিবিয়া)। এছাড়াও, বিডিএস আন্দোলনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা (ফিলিস্তিন) ওমর বারঘোতি, শ্রীলঙ্কার আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী স্বস্তিকা আরেলিঙ্গাম, মালয়েশিয়ার সোশ্যালিস্ট পার্টির মহাসচিব শিবরাজন অরুমুগান, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন সেক্রেটারি আরনাউ পিকিউ, কাটালোনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও পাকিস্তানের আওয়ামী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি আখতার হুসেইন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে নিজেদের সংশ্লিষ্ট বক্তব্য ও সংহতি বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
একের পর এক এক শিশুমৃত্যুর সাক্ষী থাকল আমাদের রাজ্য। বেসরকারি সূত্রের খবর, গত ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে মৃত শিশুর সংখ্যা ১০৩, যাদের মধ্যে অনেকেই অ্যাডিনো ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল। এদিকে, রাজ্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, এখন পর্যন্ত ১৯ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৩ জনেরই নাকি কো-মর্বিডিটি ছিল! সেই কো-মর্বিডিটির শব্দবন্ধ – যা দিয়ে মৃত্যুর বাড়তে থাকা সংখ্যাকে অনায়াসেই ব্যাখ্যা করা যায় স্বাস্থ্য আমলাদের তরফ থেকে।
মর্মান্তিক এই শিশুমৃত্যুর অনন্ত মিছিল যখন রাজ্যবাসীকে ক্ষুব্ধ, যন্ত্রণাবিদ্ধ করে তুলছে, সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী ঘটা করে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানালেন যে দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই, পাঁচ হাজার শয্যা ও ছ’শো ডাক্তার নিয়ে রাজ্য সরকার এই বিপদ মোকাবিলায় নাকি প্রস্তুত! এদিকে, প্রতিদিন সংবাদে প্রকাশ, সঙ্কটাপন্ন, শ্বাসকষ্টে কাতর শিশুদের অভিভাবকেরা হন্যে হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছেন একের পর এক হাসপাতালে, জেলা হাসপাতালগুলোর পর্যাপ্ত পরিকাঠামো ও স্পেশালিষ্ট ডাক্তার – স্বাস্থ্যকর্মী না থাকায় রেফার করে দেওয়া হচ্ছে কলকাতার বি সি রায় হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ফলে, যা হবার তাই হল – হাতে গোনা কয়েকটি বিশেষ শিশু হাসপাতালে উপচে পড়া ভিড়কে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে রাজ্যের শিশু চিকিৎসা পরিকাঠামো। ব্লকে ব্লকে স্বাস্থ্য কেন্দ্র, জেলা হাসপাতালগুলোকে সমস্ত দিক থেকে পরিপুষ্ট ও মজবুত করার পরিবর্তে কয়েকটি সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের কুমির ছানা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতা নির্ভরতা থেকে আজও রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা মুক্ত হতে পারল না।
কোভিড অতিমারী চোখে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম দেউলিয়েপনা। তারপরও বারে বারে মশা বাহিত রোগের দাপট রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরাট বিরাট ফাঁক ফোকরগুলো নিয়মিত ব্যবধানে বেআব্রু করে দেয়। গত বছরই আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ডেঙ্গিতে কত মানুষের মৃত্যু। ক্ষমতার অলিন্দে যারা রয়েছেন, তারা কোনোদিনই দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নিহিত সমস্যার পাকাপোক্ত সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিল না। তার বদলে নানা সময়ে পরিসংখ্যানের ধুম্রজালে আসল সমস্যাকেই ঠেলে দিয়েছে পেছনে। ফি-বছর কোনো না কোনো রোগের দাপটে নাজেহাল হতে দেখা যায় রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সমস্যা সমাধানের জন্য আস্থাবর্ধক কোনো পদক্ষেপ ও নীতি প্রণয়ন দেখা যাচ্ছে না। রাজ্য বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে সন্তোষজনক বিনিয়োগ নেই। রোগ প্রতিরোধ, গণ স্বাস্থ্য সচেতনতা, রাজ্য পুরসভা থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা – উপর থেকে নীচ পর্যন্ত গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মজবুত করার কোনো নীতি আজ পর্যন্ত দেখা গেল না। বারবার দেখা যাচ্ছে, কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে প্রশাসনিক পদ্ধতিতে নিছক প্রয়োজনবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার তার মোকাবিলার চেষ্টা করছে, কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে না। শিশুরা ভাইরাসের সংক্রমণে বারবার বিপন্নতার সম্মুখীন হবে, এই সতর্কবার্তা কোভিড অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর থেকেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দিয়ে আসছেন। সেই বিপদ দেরিতে এলেও যথাযথ আগাম ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে এতগুলো শিশু মৃত্যু রোধ করা গেল না।
রাজ্যের সমগ্র সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা এখন অস্তাচলের পথে। ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধুঁকছে। দেশের সর্বাপেক্ষা ঋণ গ্রস্থ রাজ্য আমাদের এই বাংলা কর্মহীনতা, বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরছে। সামাজিক প্রকল্প খাতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে এই সরকার কেড়ে নিচ্ছে মানুষের একান্ত মজুরির অধিকার। সামাজিক সুরক্ষা খাতের অধিকার।
বিপন্ন এই বাংলায় বামপন্থীদের রুখে দাঁড়াতে হবে।
ভোট শেয়ার এবং আসন সংখ্যা কমে যাওয়া সত্ত্বেও বিজেপি ত্রিপুরায় ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। গুজরাট ও উত্তরাখণ্ডের মতো ত্রিপুরাতেও নির্বাচনের এক বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তনের মাধ্যমে বিজেপি সরকার বিরোধী ক্ষোভের দিকটি অনেকাংশে হালকা করে দিতে সক্ষম হয়। ত্রিপুরার আদিবাসীদের মধ্যে ভালো মাত্রার জনসমর্থন ভোগ করা একটি আঞ্চলিক দল হিসেবে ‘তিপরা মোথা’-র ক্রমাগত উত্থান ত্রিপুরা নির্বাচনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিপরা মোথার উত্থান অবশ্য ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ত্রিমুখী করে দিয়ে বিজেপির কাছে সরকার বাঁচনোর সবচেয়ে বড় সহযোগিতা হিসেবে হাজির হয়। মোথার নিজের জয়ের সংখ্যা যদিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু তা প্রাক-নির্বাচনী প্রত্যাশা এবং অনুমানের তুলনায় কম। তারপরও এক ডজনেরও বেশি অ-আদিবাসী আসনে সিপিআই(এম)-কংগ্রেস জোট এবং তিপরা মোথা এবং কিছুটা কম মাত্রায় হলেও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে অ-বিজেপি ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া বিজেপির পক্ষে কাজ করে।
সিপিআই(এমএল) স্বতন্ত্রভাবে মাত্র একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং বেশিরভাগ আসনে বাম-কংগ্রেস জোটকে এবং বাছাই করা কয়েকটি আদিবাসী আসনে মোথাকে সমর্থন দিয়েছিল। কমরেড পার্থ কর্মকার, সিপিআই(এমএল)-এর একমাত্র প্রার্থী, উদয়পুর জেলার রাধাকিশোরপুর আসনে ১,০০০-এর বেশি ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন।
নাগাল্যান্ডে, বিজেপি এনডিপিপি-র নেতৃত্বাধীন শাসক জোটের ছোট শরিক হিসাবেই রয়ে গেছে। আর মেঘালয়ে মাত্র দুইজন বিধায়ক নিয়ে বিজেপি রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় পুনঃপ্রবেশ করতে এনপিপির সাথে তার জোট পুনঃনব করে নিয়েছে। বিজেপি এইভাবে ২০২৩ সালের প্রথম দফার বিধানসভা নির্বাচনে উত্তর-পূর্বের তিনটি রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হল।
ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং নাগাল্যান্ড নির্বাচনের ফলাফলে কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবনের লক্ষণ খুব সামন্যই নজরে এলেও, দলটি মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গে উপনির্বাচনে সংশ্লিষ্ট শাসকদলগুলির দীর্ঘদিনের দখলে থাকা দুটো গুরুত্বপূর্ণ আসন ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। মহারাষ্ট্রে এনসিপি এবং উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী ২৮ বছর ধরে বিজেপির দখলে থাকা কসবা পেঠ কেন্দ্রে জয়লাভ করে, যা শিন্দে-ফড়নবিস শাসনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় ক্ষোভকেই দেখিয়ে দেয়। তামিলনাড়ুর ইরোড আসনটি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ধরে রাখতে সক্ষম হলেও কংগ্রেস ঝাড়খণ্ডের রামগড় উপনির্বাচনে হেরেছে বিজেপি-মিত্র আজসু-র কাছে।
পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থেকে কংগ্রেস প্রার্থীর বিজয় বিজেপির ক্রমাগত পতনের একটি স্বস্তিকর দিকের প্রতিফলন এবং বিধানসভা অঙ্গনে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রধান বিরোধী হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে এবং সাগরদিঘির এই জয় নিশ্চয়ই জনগণের চলমান জনপ্রিয় আন্দোলনগুলিকে উৎসাহিত করবে। একমাত্র অ-বিজেপি বিরোধী বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকি, যিনি সম্প্রতি পুলিশের হাতে লাঞ্চিত ও গ্রেফতার হয়েছিলেন, গতকাল জামিন পেয়েছেন। এই তরুণ মুসলিম বিধায়কের সাথে পুলিশের অবমাননাকর আচরণের বিরুদ্ধে সাগরদিঘির নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতিবাদস্বরূপ ক্ষমতাসীন তৃণমূলের পরাজয় ঘটানো এবং রাজ্য বিধানসভায় অ-বিজেপি বিরোধীর সংখ্যা বৃদ্ধি আশ্বস্ত করে।
বিধানসভা এবং উপ-নির্বাচনের ফলাফলগুলি আবারও আমাদের ২০২৪ সালের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে অ-বিজেপি বিরোধীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাল – নির্বাচনে কার্যকরী বিরোধী ঐক্য, শক্তিশালী আন্দোলন এবং ভূমিস্তরে জনপ্রিয় আত্মঘোষণার মেলবন্ধন অবশ্যই ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে পারে। পাটনায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একাদশ পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে, সিপিআই(এমএল) এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তার সমস্ত শক্তি ও অক্লান্ত শ্রম নিয়োগ করবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
সিপি আইএমএল লিবারেশন দার্জিলিং জেলা কমিটির সম্পাদক পবিত্র সিংহ এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন,
বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকে নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থানের বিপ্লবস্পন্দনে সমগ্র ভারত আন্দোলিত হয়েছিল। সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বিকৃত পুঁজিবাদ থেকে শোষণমুক্তির মহাকাব্য নির্মাণের মাধ্যমে এই কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিকতা সারা বিশ্বে আজও গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়।
১৯৬৭ সালের ২৫ মে প্রসাদুজোত ও বেঙ্গাইজোতের সংযোগস্থলে পুলিশী দমনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কৃষাণীদের দৃপ্ত মিছিলের ওপর পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী বিনা প্ররোচনায় গুলি চালিয়ে দু’টি কোলের শিশু সহ ১১ জনকে হত্যা করে। এই নির্মম হত্যাকান্ডের পরবর্তীতে আন্দোলনের মর্মবস্তু সমগ্র দেশের বিপ্লবীদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধে সমাবেশিত করে।
‘৬৭র এই রাষ্ট্রীয় বধ্যভূমিতে বেঙ্গাইজোত প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন মাঠে পরবর্তীতে নির্মিত শহীদ স্মারক ও মূর্তিগুলি দেশ, বিদেশের বামপন্থী মানুষের কাছে পরিচিত ও বন্দিত।
আমরা আজ (৮ মার্চ, ২০২৩) সকালে জানতে পেরেছি যে গতকাল রাতের অন্ধকারে কিছু দুষ্কৃতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মহামতি লেনিনের মূর্তিটিকে ভেঙে বিকৃত করেছে।
আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ২০১৮ সালে ত্রিপুরা রাজ্যে ক্ষমতায় এসে বিজেপি ও আরএসএস আগরতলা সহ অন্যত্র সর্বপ্রথমে লেনিনের মূর্তিভাঙা যজ্ঞে সামিল হয়। দেশজুড়ে এই হামলার প্রতিবাদ হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে নকশালবাড়ি ব্লকে দক্ষিণপন্থী ও ফ্যাসিবাদী শক্তির তৎপরতা বেড়েছে।
আমরা মনে করি লেনিনের মূর্তিকে বিকৃত করার পেছনে এহেন মতাদর্শের প্রত্যক্ষ সমর্থন রয়েছে। এটি কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়।
আমরা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পক্ষে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা করি ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে এই মূর্তি বিকৃতির জন্য দায়ি দুষ্কৃতিদের গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তি দাবি করি।
সকাল সকাল আমরা বেরিয়ে পরলাম গান্ধী ময়দানের উদ্দেশে। পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে পাটনা যাওয়া। খবর আসছিল আগের দিন থেকে লোক আসা শুরু হয়েছে। ময়দানে গিয়ে যখন পৌঁছালাম চারিদিকে মানুষের মেলা বসে গেছে। কেউ কেউ রান্না করে খাচ্ছেন। কেউবা নিজেদের খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। কেউ বা কিনে খাবার খাচ্ছেন। পার্টি থেকে কোনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়নি, জনগণ নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করেছেন।
পার্টি থেকে সমাবেশ স্থলে সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখান থেকে ক্রমাগত প্রচার চলছে। কয়েক হাজার মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়ে নিজেদের লোকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। যেদিকেই তাকাই হাজার হাজার মানুষ লাল ঝান্ডা নিয়ে চলেছেন। মঞ্চ থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঘন ঘন শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছে। গ্রামের মানুষের ঢল নেমেছে পাটনা শহরে। মেট্রোরেলের কাজ চলছে, রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা, কুছ পরোয়া নেই! মানুষ হেঁটে চলেছেন গান্ধী ময়দানে ‘মালে’-র সমাবেশে। মাঝমাঠে এসে বসলাম, সূর্য তখন মাথার উপরে, এতো লোকের মাঝে সূর্যের তাপও লঘু হয়ে যায়। হঠাৎ নজরে এলো মঞ্চের সামনে বেশ কিছু মহিলা পুরুষ সাদা টুপি পড়ে বসে আছেন। কৌতূহল নিয়ে সামনে গিয়ে দেখলাম ওরা সাদা কাগজে বিভিন্ন দাবি লেখা টুপি পড়ে প্রচার করছেন।
সভা শুরুর আগে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মঞ্চে নিজেদের কার্যক্রম উপস্থাপন করে চলেছে। পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্যরা ও বিহারের বর্ষীয়ান সব নেতারাই মঞ্চে তখন উপস্থিত। কমরেড ধীরেন ঝা সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষ থেকে সভা পরিচালনা করেন। প্রথম বক্তা ছিলেন বিহার রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড কুণাল। কমরেড কুণাল বলেন গান্ধী ময়দানের এই সমাবেশ বিজেপি বিরোধী লড়াইকে আরও শক্তি যোগাবে। তিনি জানান বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য মহাগঠবন্ধন সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত পার্টি নিয়েছিল, এই সিদ্ধান্ত ছিল বাস্তব সম্মত। তা সত্ত্বেও বিহার সরকারের কাছে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলাদের যে দাবিগুলো উঠে আসছে পার্টি সেই সব লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দ্বিতীয় বক্তা কমরেড মঞ্জু প্রকাশ ‘গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ প্রস্তাব সভায় পেশ করেন। এরপর একে একে বক্তারা তাঁদের বক্তব্য রাখেন। আইসা’র সাধারণ সম্পাদক বিধায়ক কমরেড সন্দীপ সৌরভ, আরওয়াইএ সভাপতি বিধায়ক কমরেড মনোজ মঞ্জিল, স্কীম ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সর্বভারতীয় সমন্বয় কমিটি ও সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির বিহার রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড শশী যাদব, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঝাড়খণ্ড বিধানসভার বিধায়ক কমরেড বিনোদ সিং, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বিহার বিধানসভায় পার্টির বিধায়ক দলের নেতা কমরেড মেহবুব আলম, উত্তরাখণ্ড রাজ্য কমিটির সদস্য ও ‘যোশীমঠ বাঁচাও’ আন্দোলনের সংগঠক কমরেড ইন্দ্রেশ মৈখুরি, এআইএআরএলএ-র সর্বভারতীয় সভাপতি বিধায়ক কমরেড সত্যদেও রাম, সারাভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি সম্পাদিকা কমরেড মীনা তেওয়ারি, এআইএআরএলএ-র বিহার রাজ্য সভাপতি বিধায়ক কমরেড বীরেন্দ্র গুপ্তা এবং এআইকেএম-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজারাম সিং। সর্বশেষ ও মুখ্য বক্তা পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপাঙ্কর ভট্টাচার্য।
তিনি গান্ধী ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি ইঞ্চিতে লড়াইয়ের আহ্বান জানান। পার্টির পতাকাতলে যে গরিব মানুষরা ঐক্যবদ্ধ লাড়াই চালাচ্ছেন তা তুলে ধরেন। তিনি তীব্র ভাষায় বিজেপি সরকারকে অক্রমণ করে বলেন দেশের প্রতিটি মানুষকে সংবিধান, গণতন্ত্র ও দেশ বাঁচানোর সংগ্রামে সামিল হতে হবে। আমাদের উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে। তিনি আরও বলেন প্রতিটি গরীব মানুষকে খাদ্যের সুরক্ষা, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, মনরেগা প্রকল্পে সহায়তা বৃদ্ধি ইত্যাদির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের অধিকারের জন্য, দেশ বিক্রি ও হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্তের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার এবং আরএসএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে সংকল্প নিতে হবে। সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পর সভার পরিচালক কমরেড ধীরেন ঝা সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেন।
সমাবেশে অংশ নেওয়া মানুষ কাতারে কাতারে পাটনার রাজপথ ধরে এগিয়ে চলেছেন স্টেশনের দিকে লাল ঝান্ডার লহর তুলে। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। এছাড়াও মানুষ এসেছিলেন সরকারি বেসরকারি পরিবহনে, লড়ি, ম্যাটাডোর, বাস, ট্রাক্টর বিভিন্ন পরিবহন ভাড়া করে। সূর্য ক্রমশ পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, মাঠে ধুলো উড়ছে, স্বেচ্ছাসেবকরা মিছিলের জনতাকে নিজেদের জেলা ও গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য সাহায্য করছেন। এক সময় ময়দানে জনতার কলরব শেষ হয়, প্রতিনিধিরা নিজেদের আস্তানায় ফিরে আসেন। এতো বড় সুশৃঙ্খল জমায়েত ও তার সাথে পার্টি কংগ্রেসের দায়িত্ব বিহারের পার্টি কমরেডরা যে ভাবে সফল করে তুলেছেন তার জন্য তাদের লাল সেলাম অবশ্যই প্রাপ্য। দুদিন বাদে দুঃসংবাদ আসে সমাবেশ থেকে ফেরার পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে আরারিয়ার কমরেড রাধাদেবী (৬০) ও টেম্পোর ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে পূর্ণিয়ার রসিদ লাল মুর্মুর (৪৫)। প্রয়াত কমরেডদের লাল সেলাম। এই দুঃখজনক দুর্ঘটনা ছাড়া আর সব কিছুই ছিল পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল।
সিপিআই(এমএল)-এর এতো বিশাল ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সমাবেশ পার্টি কংগ্রেসকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম পরবর্তী দুদিনে, বিভিন্ন বামপন্থী দল ও অবিজেপি বিরোধী দলগুলো এবং বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে। সেখানে বিভিন্ন বক্তারা উল্লেখ করেন হিন্দি বলয়ে ‘মালে’ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সমাবেশ শেষ হল এক নতুন আশা ও প্রত্যয় জাগিয়ে।
ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশনের একাদশ পার্টি কংগ্রেস প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে পাঁচ দিন ধরে চলার পর শেষ হল পাটনা শহরে। আমি প্রথম দুদিন আমন্ত্রিত ছিলাম খোলা অধিবেশনে। আমার যাতায়াতের টিকিটও কেটে দিয়েছিল ছাত্রফ্রন্টের আইসার ছেলেমেয়েরা, যারা আমাকে দেশব্রতী এবং লিবারেশন দেন বাড়িতে পৌঁছে। মূল গল্পটা সেখানে নয়। কেন জীবনের সায়াহ্নে এসে আমি প্রাক্তন জীবনে কোনো পার্টির একটা কংগ্রেসেও হাজির না থেকে শেষমেশ এই কংগ্রেসে যেতে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম? এর পেছনে যে দু-তিনটে প্রধান কারণ কাজ করছিল তা হল, ভয় এবং মিথ্যার জঘন্য শাসনের অবসান হোক এবং জনগণের স্তরে এক ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য যেন গড়ে ওঠে যাতে প্রজাতন্ত্রের শর্ত এবং ঘোষণা অধিকার অর্জনের মধ্য দিয়ে সমতা, স্বাধীনতা ও সংহতির ভেতর দিয়ে আমরা খুঁজে পাই। যা পার্টি দলিলগুলি পাঠ করে আমি বুঝতে পেরেছি ঘৃণা ও ভয়কে প্রত্যাখ্যানের শব্দে। দ্বিতীয়টি হল বর্জিত রাজনীতির বদলে অন্তর্ভুক্ত রাজনীতির অনুশীলন। মুসলিম ও দলিত রাজনীতির অন্তর্ভুক্তি আম্বেদকর চর্চার মাধ্যমে। লিবারেশনে পেয়েছি দুটি বিপরীত গতিপথের ইতিহাস চর্চা। আম্বেদকর এবং আরএসএস। আম্বেদকরের ধম্মচক্র প্রবর্তন নিঃসন্দেহে ছিল মুক্তি, সমতা এবং সংহতির দ্যোতক, যার প্রতিফলন গত বছর দেখলাম ২২টি শপথ দিল্লিতে হাজার কণ্ঠে উচ্চারণের ভেতর দিয়ে। অন্যদিকে, আরএসএস-এর সামরিক এবং পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তি হল ঘৃণা, হিংসা এবং নিপীড়ন।
এই দুটো বিষয় ছাড়াও একটি তৃতীয় কারণও কাজ করেছিল পাটনা কংগ্রেসে আসার। তা ছিল যৌথ কর্মসূচিতে আমার অংশগ্রহণ। ২০২১-এর পশ্চিমবাংলা নির্বাচনে আমরা একটি স্লোগান নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেই। নো ভোট টু বিজেপি। সেই সময়টাও আমাকে তৈরি করে লিবারেশনের কাছে আসতে। অতি সম্প্রতি মেধা পাটকরের আহবানে “ঘৃণা বিদ্বেষ ছাড়ো এবং সংবিধান বাঁচাও” যাত্রা মিছিলেও আর একবার কাছে আসার সুযোগ পাই। এ ছাড়াও অতীতে মব লিঞ্চিংএর সময় প্রতিটি জঘন্য হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে আহুত লিবারেশনের মিছিলে একসাথে হাত এবং আওয়াজ তোলার সুযোগ ঘটে। প্রিয় লেখক অরুন্ধতী রায়ও পার্টি কংগ্রেসে এসে শুধু সাফল্য কামনা করেছেন তাই নয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে লিবারেশনের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জনপ্রিয় ভাষায় বলেছেন, চার জন লোক ভারত চালাচ্ছেন। দুজন বিক্রি করছেন আর দুজন কিনছেন। রেল, এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে কি নয়, খনি থেকে বন্দর পর্যন্ত। লিবারেশন জাতভেদ বিনাশের সংগ্রাম এবং শ্রেণী – উভয় সংগ্রাম একপেশে না হয়ে একই সাথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এসব বলেন তিনি। আমার আশাবাদ তাঁরই সঙ্গে এক সুরে বাঁধা হয়ে গেল।
এবার আসি বিনোদ মিশ্র নগর (পাটনা) আসার ইতিবৃত্ত নিয়ে। কেমনভাবে যৌথ ভ্রমণ হয়। যার মধ্যে চিরপুরাতন সুর মিশে রয়েছে। ছোট বয়েস থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির আবহাওয়ায় পালিত হবার জন্য যৌথ জীবনের প্রতি এক প্রবল ও তীব্র আকর্ষণ ছিল বরাবর। মনে আছে স্ট্যান স্বামী যখন মিথ্যে মামলায় গ্রেফতার হয়ে তালোজা জেলে বন্দী হয়েছিলেন তখন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তা নিয়ে কভার করেছিল, তালোজা জেল ইজ ব্রিমিং উইথ হিউমানিটি। মানবতা ভাসিয়ে দিয়েছে তালোজা জেলকে। আর ১৪ ফেব্রুয়ারি জনশতাব্দী এক্সপ্রেস যেন ভালবাসার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। দরদী নীতু, দেশোয়ালি বাবুন, নাটুকে শেখর, মরমী বাবুনের দাদা বউদি, আইসার স্বর্নেন্দু, অনন্যা, রণজয়, পরে সায়ন, শীলা, প্রাচীন ইন্দ্রানী এমনকি দীর্ঘ দিন পরে দেখা কমরেড বরেনের মেয়ে অবন্তী, অত্যন্ত সিরিয়াস অতনু, দিবাকর, সিনিয়ার চৌধুরিদা, কে নয়? প্রত্যেকে পরস্পরের দিকে সাহায্যের হাত এগিয়ে দিচ্ছে। সে রুটি-সব্জির গ্রাস বা জলের বোতল যাই হোক না কেন। শোয়ার জায়গা ঠিক করে দেয়া, টুথ ব্রাশে একটুকু পেস্ট এগিয়ে দেয়া সবগুলি সহমর্মিতার অমুল্য নিদর্শন। আসার দিন সকালে ট্রেন, ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়া। অবন্তী পরে মন ছোঁয়া লেখা লিখেছে। সেই ছোট্ট মেয়েটা। সে লিখেছিল, এই যাত্রা খুব গুরুত্বপূর্ণ, ভালবাসার ও খুব নিজের। তার বাবার রাজনৈতিক বন্ধু, সহকর্মী বা কমরেড তাকে মনে রেখে দিয়েছেন। এই সব কাকু জেঠু, পিসি সবার মধ্যেই সে তার বাবাকে দেখছে। তাই পাটনার মতো অচেনা এক শহরে অনায়াসে সে ঘোরাফেরা করেছে। কত কি জানার, কত কি শেখার, কত মানুষ চেনার মাধ্যমে সে তার বাবাকে অনুভব করেছে।
সংক্ষেপে পার্টি কংগ্রেস থেকে পাওয়া শিক্ষার সার আলোচনা এই রকম –
১) ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের সমস্ত সদর্থক পদক্ষেপ পার্টি নেতৃত্ব নিয়েছেন। যার প্রমাণ হল কংগ্রেস ও বাম সহ সমস্ত সংসদীয় বিরোধী নেতাদের সক্রিয় ভুমিকা। পাটনা কংগ্রেস-এর পর সমস্ত নির্বাচনের ফল থেকে কিছুটা ইতিবাচক দিক উঠে এসেছে।
২) গান্ধী ময়দানে প্রকাশ্য সমাবেশে লাখ দেড়েক লোক হয়েছিল। কমরেডরা বললেন এটা নাকি স্বাভাবিক জমায়েত। যত কর্মী ছিলেন তাঁদের শৃঙ্খলা প্রশংসনীয়। কোথাও কোনো অসহিষ্ণুতা না থাকা প্রশংসার যোগ্য। জন আন্দোলন এবং প্রতিরোধ একসাথে চলে।
৩) বিহারে স্বাভাবিকভাবেই পার্টির শ্রেণী ভিত্তি এবং বর্ণ ভিত্তি এক। পশ্চিম বাংলায়ও এইদিকটা দেখার অবকাশ আছে। দিকে দিকে দেশব্রতী ও লিবারেশন পাঠচক্র গড়ে উঠতে পারে। নতুন সদস্যদের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঘাটতি দূর করার ব্যাপারে সহায়ক। কংগ্রেস আশাতিরিক্ত প্রাপ্তি দিয়েছে। দায়িত্ব একসাথে।
– অসিত রায়
পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত কলকাতা ও তার আশেপাশে গত মাদুয়েকের ভেতর অ্যাডিনো ভাইরাসের সংক্রমণে প্রায় একশো শিশু মারা যাওয়ার পর ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এই শিশু মৃত্যুর সংখ্যা রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাডিনো ভাইরাসও করোনার মতোই একটি ‘রেসপিরেটরি ভাইরাস’, অর্থাৎ যা শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। এর উপসর্গগুলোও অনেকটা কোভিডের মতোই – এবং এটিও অত্যন্ত ছোঁয়াচে বা সংক্রামক।
অ্যাডিনো ভাইরাস কোনও নতুন ভাইরাস নয় ঠিকই, কিন্তু এ বছর তার প্রকোপ যে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি – কলকাতায় সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতাও সে কথাই বলছে।
আরও চিন্তার কথা হল, অ্যাডিনো ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন চার থেকে ছয়-সাত বছর বয়সী (প্রাক-স্কুল পর্যায়ের) শিশুরা, যাদের সার্বিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম। অনেক বাচ্চাকে হাসপাতালে দিনের পর দিন ভেন্টিলেটরেও রাখতে হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য দাবি করছে তারা অ্যাডিনো ভাইরাস প্রতিরোধে সব হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে এবং পরিস্থিতি এখনও ততটা উদ্বেগজনক হয়ে ওঠেনি। তবে কলকাতারই সুপরিচিত বি সি রায় শিশু হাসপাতালে গতকালও (রবিবার) সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে সাতটি শিশু মারা যাওয়ার পর অ্যাডিনো ভাইরাস নিয়ে ভয় যথারীতি আরও দানা বেঁধেছে।
অ্যাডিনো ভাইরাস কতটা ভয়ের এই প্রশ্নের উত্তরে কলকাতার সুপরিচিত শিশু চিকিৎসক দ্বৈপায়ন ঘটক জানিয়েছেন, অ্যাডিনো ভাইরাস তাদের কাছে কোনও অচেনা ভাইরাস নয় ঠিকই, কিন্তু এ বছর যে কোনও কারণেই হোক অ্যাডিনোতে সংক্রমণের ঘটনা অনেক বেশি ঘটছে। “এর উপসর্গগুলো শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশি-জ্বর বা ফ্লু-র মতোই, অর্থাৎ অন্য যে কোনও রেসপিরেটরি ভাইরাসের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে মাল্টিসিস্টেম ইনভলভমেন্ট হয়ে পেটব্যথা, পাতলা পায়খানা, গায়ে-হাত-পায়ে খুব ব্যথা কিংবা চোখে কনজাংটিভাইটিস হওয়ার মতো ঘটনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটা ঠিক যে বাচ্চাদের অনেকের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকারই হচ্ছে না। কিন্তু যাদের হচ্ছে, তাদের কারও কারও ক্ষেত্রে এটা বেশ খারাপ মোড় নিচ্ছে। অনেকেই আবার খুব লম্বা সময় ধরে আক্রান্ত থাকছে। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলোতে এখন পরীক্ষার মরশুম চলছে। এই সময় বাচ্চার জ্বর হলেও বাবা-মারা চান না তাদের স্কুল মিস হোক, অনেক সময় প্যারাসিটামল দিয়েও তারা জোর করে বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়ে দেন। এতে করেই অ্যাডিনো ভাইরাসের বিস্তার হুট করে আরও বেড়ে গেছে বলে আমাদের পর্যবেক্ষণ” বলেছেন ড. ঘটক।
তবে একই গোত্রের ভাইরাস কোভিড-১৯ সাম্প্রতিককালে যেরকম ত্রাহি ত্রাহি রব ফেলে দিয়েছিল, অ্যাডিনো ভাইরাস ততটা প্রাণঘাতী বা বিধ্বংসী হবে না বলেই কলকাতার বেশির ভাগ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ এখনও আশাবাদী।
তবে অ্যাডিনো ভাইরাসে শুধু বাচ্চারাই আক্রান্ত হচ্ছেন, বিষয়টা তেমন নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনও বয়সীরাই অ্যাডিনো ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন – কিন্তু ঠিক কোভিডের মতোই এখানেও শিশু ও বয়স্কদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এই ভাইরাসের মোকাবিলার ক্ষেত্রে আর একটি উদ্বেগের বিষয় হল, বাজারে অ্যাডিনো ভাইরাসের প্রতিরোধের জন্য কোনও টিকা চালু নেই।
দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, হায়দ্রাবাদ ভিত্তিক সংস্থা ভারত বায়োটেক ২০১৮ তে অ্যাডিনো ভাইরাসের টিকা তৈরির কাজ শুরু করেছিল – কিন্তু এর মধ্যে তারা কোভিড মোকাবিলায় ‘কোভ্যাক্সিন’ উৎপাদনে হাত দেওয়ায় সে প্রক্রিয়া থমকে যায়।
সরকার কী করছে?
চলতি বছরের শুরু থেকেই কলকাতা ও তার আশেপাশে অ্যাডিনো ভাইরাস আঘাত হানতে শুরু করে। জানুয়ারি মাস থেকে শুরু করে গত মাসদুয়েকের ভেতর কম পক্ষে ৯৬টি শিশু অ্যাডিনোতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পটভূমিতে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও। গত ২ মার্চ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অ্যাডিনো ভাইরাস মোকাবিলায় জরুরি বৈঠকও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এর পরই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলোতে অ্যাডিনো ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিশেষ ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী জানান, জেলা ও মফস্বল শহরের হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারা যেন অ্যাডিনো আক্রান্ত কেসগুলো কলকাতার হাসপাতালে ‘রেফার’ না-করে (পাঠিয়ে না দিয়ে) সেখানেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। দরকারে ‘টেলিমেডিসিন’ পদ্ধতিতে জেলার হাসপাতালগুলিও যাতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পেতে পারে, সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
রাজ্য সরকার আরও আশা করছে, আগামী দেড়-দু’সপ্তাহের মধ্যে ভালো মতো গরম পড়ে গেলে অ্যাডিনো ভাইরাসের প্রকোপ এমনিতেই কমে আসবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জারি করা প্রেস বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, “বর্তমান সংক্রমণটি আদতে মরসুমি অসুখই। গত দু’বছর এই সময়ে দেদার দাপিয়েছিল করোনা। এ বছর তাকে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে অ্যাডিনো ভাইরাস-সহ কিছু ভাইরাস।” “তবে মহামারি পরিস্থিতি আদৌ তৈরি হয়নি। বরং আশার কথা, ভাইরাসের দাপট কমে আসছে” বলেও জানানো হয়েছে ওই বিবৃতিতে।
[ বিভিন্ন সংবাদপত্রের তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি ]
-- সৌভিক ঘোষাল
কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতির নির্দেশে রাজ্যে শিক্ষা দপ্তর সম্প্রতি ৮,২০৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে যাদের বর্তমান ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৩০ জনের কম। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মাত্র ৭ দিনের মধ্যে শিক্ষা দফতর এই তালিকা প্রকাশ করেছে এবং বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে তা প্রচার করা হচ্ছে। যদিও, এ সম্পর্কে কোনো নির্দেশিকা ও পদক্ষেপ নেবার কথা বলা হয়নি।
ইতিমধ্যে, গত ১০ বছরে রাজ্যের ৭০১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় তুলে দেওয়া হয়েছে।
২০১২ সালে রাজ্যে বিদ্যালয় ছিল ৭৪,৭১৭টি। ২০২২ সালে ৬৯,৬৯৯টি। অর্থাৎ, বর্তমান তালিকা যোগ করলে তুলে দেওয়া স্কুলের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫,২২৫টি। ২০% স্কুল (২০১২ সালের নিরিখে)। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কি গত ১০ বছরে এই হারে কমেছে? উল্লেখযোগ্যভাবে ইতিমধ্যেই বিদ্যালয় তুলে দেবার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন জোনের ১৩টি ব্লকের ১১৯২টি স্কুল। পশ্চিম মেদিনীপুর আদিবাসী প্রধান এলাকার ১০৪৭টি স্কুল। পূর্ব মেদিনীপুরের ৮৬৮ টি স্কুল।
কেবল শহরাঞ্চলেই নয়, রাজ্যের সেই সব প্রান্তিক জনগোষ্টির এলাকায় দীর্ঘ বছর পর্যাপ্ত বা প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ না করে, পরিকাঠামো উন্নত না করে ছাত্রদের বিদ্যালয় ছুট করা বা বেসরকারি বিদ্যালয়ে চলে যেতে বাধ্য করা হল। শিশুশ্রমকেও কার্যত বর্তমানে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। বহু নন ফরমাল সেক্টরে ঢালাও শিশু শ্রম নিয়োগ চলছে। আর এখন “নয়া শিক্ষানীতি ২০০৯”-কে শিখন্ডি হিসাবে কাজে লাগিয়ে বিদ্যালয়গুলিকে তুলে দেবার চক্রান্ত চলছে। যেখানে নয়া শিক্ষানীতি অনুযায়ী ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৩০:১। যদিও রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সিলেবাস কমিটির সুপারিশ ছিল, শ্রেণী ভিত্তিক শিক্ষক। দীর্ঘ সময় ধরে ‘পরিকল্পিত হত্যা করে মৃত ঘোষণা’ করার কাজ হাতে নিতে চলেছে রাজ্য সরকার। যার পরিণাম প্রচুর উদবৃত্ত শিক্ষক, নতুন নিয়োগ বন্ধ। প্রান্তিক ও দরিদ্র, আদিবাসী, তফসিলি, জনজাতির সন্তানদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা। যাদের টাকা থাকবে, তারা বেসরকারি স্কুলে পড়বে। এ হল কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতি রূপায়ণের নীল নকশা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামোন্নয়ন সমস্ত প্রশ্নেই বাংলার সরকার কেন্দ্রের নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে শুধু ভোটস্বার্থে দিল্লিবিরোধী ভাষণ দিচ্ছেন।
এই সমস্ত বিদ্যালয়গুলিকে হয়তো বা নিকটবর্তী কোনো স্কুলের সাথে যোগ করা হতে পারে। কিন্তু, তার ফলাফল, ঐ সব শিশুরা দূর দুরান্তে পড়তে যাবে না। লেখাপড়াই ছেড়ে দেবে। কেননা, তাদের পিতামাতার সময় নেই হাত ধরে স্কুলে দেওয়া-নেওয়া করবে। সে কারণেই, নিয়মানুযায়ী, প্রাথমিক স্কুল ছাত্রদের বাড়ির ১ কিমির মধ্যে হওয়ার নির্দেশ আছে।
উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্তরেও এর প্রস্তুতি চলছে। নিয়োগের জন্য চাকুরী প্রার্থীরা রাস্তায়, আর সরকার বিদ্যালয়ই তুলে দেবার কাজে ব্যস্ত।
যখন আমাদের সামনে দিল্লীর রাজ্য সরকারের (কেন্দ্রের নিয়) শিক্ষা দফতর মডেল তৈরি করে দেখালো, কিভাবে সরকারি স্কুলগুলিকে গুণমানে উন্নত করে বেসরকারি স্কুলের থেকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার দেখাতে চলেছেন কিভাবে সরকারি বিদ্যালয়ের ঝাপ বন্ধ করে দিতে হয়।
রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ, শিক্ষক, অভিভাবক সকলের মিলিত প্রতিরোধে এই প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে হবে।
ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ সোচ্চার হতে শুরু করেছেন। সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিটি ব্যক্তি, সংগঠনকে গ্রাম ও ওয়ার্ড স্তরে ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, অধিবাসীদের নিয়ে জনমত গঠন করে “বিদ্যালয় বাঁচাও” কমিটি গঠন করা দরকার। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষা দফতরকেই বিদ্যালয় বাঁচানোতে দায়বদ্ধ করতে হবে। জেলা বা রাজ্য স্তরেও “সরকারী শিক্ষা বাঁচাও” কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
জেলাওয়ারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তালিকা (৩০ জনের নীচে ছাত্র ছাত্রী)
আলিপুর দুয়ার - ১৬২টি, বাঁকুড়া - ৮৮৬, উঃ২৪ পরগণা - ৫৫০, বীরভূম - ৩২১, কোচবিহার - ১৪৮, দক্ষিণ দিনাজপুর - ২২৩, দার্জিলিং - ৫১৯, হুগলী - ৪১৪, হাওড়া - ২৭৮, জলপাইগুড়ি - ২১৮, ঝাড়গ্রাম - ৪৭৯, কালিম্পং - ২১৫, কলকাতা - ৫৩২, মালদহ - ১৩৭, মুর্শিদাবাদ - ২২৭, নদীয়া - ২৫০, প: মেদিনীপুর - ৬৯৬, পূর্ব বর্ধমান - ৩৩৮, পূর্ব মেদিনীপুর - ৩৬৯, পুরুলিয়া - ৬৯৪, শিলিগুড়ি - ৯৭, দ: ২৪ পরগণা - ৩৯১, উঃ দিনাজপুর - ৭৩ ।
– অজয় বসাক
নিজস্ব সংবাদদাতা: বারাসাত: যশোর রোডের ৩৫৬ টি গাছ কাটার সুপ্রিম কোর্টের অনুমতিতে অখুশি পরিবেশ কর্মীরা। রেলওয়ে ওভার ব্রিজ তৈরির প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্ট শতাব্দী প্রাচীন গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছে সম্প্রতি। রায়ের বিশ্লেষণ ও আগামী কর্মসূচি ঠিক করে নিতে গত ৫ মার্চ বারাসতের যুগল ভবনে যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটির সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বারাসত এপিডিআর ২০১৫ সাল থেকে ঐতিহাসিক যশোর রোডের গাছ বাঁচানোর দাবী তুলতে শুরু করে। এরপর ২০১৭ থেকে মুলত ছাত্র যুব সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ পথে নামে। শতাব্দী প্রাচীন গাছ বাঁচানোর জন্য লাগাতার লড়াই আন্দোলন গড়ে ওঠে। কলকাতা হাইকোর্ট গাছ কাটায় স্থগিতাদেশের রায় দেয়। আন্দোলনকারীদের মত, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর যে হতাশা তৈরি হয়েছিল জনমানসে, বারাসাতের সভা তার বিরুদ্ধে মুখর হতে অক্সিজেন যোগালো। সভার শুরুতে আন্দোলনকারীদের পক্ষে আন্দোলনের ঘটনা ক্রম তুলে ধরা হয়। কেমনভাবে পুলিশ ও স্থানীয় মস্তান বাহীনি এবং কাঠ-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে পথে নেমে মানুষ শতাব্দী প্রাচীন গাছগুলিকে রক্ষা করে এসেছিলেন। এরপর সভায় উপস্থিত বিভিন্ন পরিবেশ ও অধিকার আন্দোলনের কর্মী নেতৃত্ব একে একে এই বিশ্লেষণ ও শতাব্দী প্রাচীন গাছ বাঁচিয়ে রাখতে মত দেন। ভারতীয় সংবিধান ও বিশ্ব জুড়ে পরিবেশ বর্তমান সমস্যার কথা উল্লেখ করে আন্দোলন জোরদার করার উৎসাহ দেন। এবং আগামীদিনে বিভিন্ন আন্দোলনের কর্মীরা শতাব্দী প্রাচীন গাছ বাঁচাতে সক্রিয় ভূমিকায় থাকবেন সেই অঙ্গিকার করেন। আন্তর্জাতিক সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে উঠে আসে বিকল্প পথের কথা। প্রশ্ন ওঠে আন্তর্জাতিক সীমান্তে অত্যধিক গাড়ির চলাচল যেখানে সেখানে দিন-রাত কেন সীমান্ত খোলা থাকবে না? যেমনটা অন্যত্র হয়ে থাকে। কলকাতা হাইকোর্টের বিশেষজ্ঞ কমিটি যে গাছগুলিকে হেরিটেজ বলে উল্লেখ করেছেন সেই গাছ কাটার অনুমতিতে সুপ্রিম কোর্টের সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিচার করার অবকাশ ছিল। সভায় বিভিন্ন কর্মসূচির প্রস্তাব আসে। বিভিন্ন আন্দোলনের কর্মী ও পরিবেশ সংবেদী মানুষের কাছে ঐতিহ্য মন্ডিত এইসব গাছ ও পথ দেখতে আসার আহ্বান জানানো হবে। ভারতের গাছ বাঁচানোর আন্দোলনের অন্যতম, ‘চিপকো আন্দোলন দিবস’ পালিত হয়ে আসছে ২৬ মার্চ। তাকে স্মরণ করে কলকাতাতে সাংবাদিক সম্মেলন ও মানব বন্ধনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ঐদিনের সাধারণ সভায়।
মমতা ব্যানার্জি সম্পর্কে, আইনজীবী ও নাগরিক আন্দোলনের শরিক কৌস্তভ বাগচির সংবাদমাধ্যমে চাউর করা সাম্প্রতিক বক্তব্য অত্যন্ত আপত্তিকর। রাজনীতির জগতে নারীর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও পন্থা আলোচিত হওয়ার বদলে, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে চর্চা করা, বিবাহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জীবন সম্পর্কিত তথ্য ফাঁস করার হুমকি, মাতৃত্ব সংক্রান্ত টিপ্পনী, আদতে নীতি-পুলিশির প্রবণতা ও লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য সম্পর্কে অসচেতনতার দিকনির্দেশ করে। এই ধরনের পিতৃতান্ত্রিক ঝোঁকের সমালোচনা না করে নিরবে মেনে নেওয়া, মহিলাদের রাজনৈতিক জগতে আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে বলে আমরা মনে করি। তাই আমরা দাবি করি রাজনৈতিক জগতে, নারীদের উপর নীতি-পুলিশি ও চরিত্রহনন করার উদ্দ্যেশ্যে এই ধরনের মন্তব্য অবিলম্বে বন্ধ হোক। রাজনৈতিক জগতের পুরুষালী আস্ফালন অবিলম্বে বন্ধ হোক। কৌস্তভ বাগচিকে অবিলম্বে ক্ষমা চাইতে হবে।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি (AIPWA)
সিপিআইএমএল রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতা, সরকারী নিয়োগে স্বচ্ছতা, স্বচ্ছতার সঙ্গে শূণ্যপদে যোগ্য প্রার্থীদের স্থায়ী নিয়োগ, অস্থায়ী কর্মীদের নিয়মিতকরণ, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-যোগ্য পদপ্রার্থীদের অবিলম্বে নিয়োগের দাবিতে চলমান ন্যায়সঙ্গত গণআন্দোলনের শরিক হোন।
সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ আহুত আগামী ১০ মার্চ ধর্মঘটকে সর্বাত্মকভাবে সফল করে তুলুন।
রাজ্য সরকারের শ্রমিক কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা বকেয়া ডিএ মেটানো, স্বচ্ছতার সঙ্গে শূণ্যপদে স্থায়ী নিয়োগ ও অস্থায়ী কর্মচারীদের নিয়মিতকরণের ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ধর্ণা- অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি, অর্থলালসা ও পরোক্ষ সন্ত্রাসের মাধ্যমে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণত বিপর্যস্ত করে তোলার বিরুদ্ধে ও অবিলম্বে যোগ্য শিক্ষক/ শিক্ষাকর্মী পদপ্রার্থীদের স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগের দাবিতে গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিবাদী কর্মপ্রার্থীরা সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মাটি কামড়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরকারী কর্মচারীদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতা যে দান নয়, অধিকার – এই বিষয়টি নতুন করে আদালতের মান্যতা পাওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, নেতারা ন্যায্য আন্দোলনকে ভেঙে দিতে পুলিশ দিয়ে হামলা হুমকি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, সরকারী ও অসরকারী ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমশক্তির মধ্যে বিভাজনের ঘৃণ্য প্রচারে রত।
নরেন্দ্র মোদীর অতি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানি এখন শুধু ছলচাতুরীর মাধ্যমে নিজেদের সংস্থাগুলির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে তোলা ও ব্যবসার হিসাব-নিকাশে কারচুপির অভিযোগেই অভিযুক্ত নন, দুর্বল ও দরিদ্র প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর অলাভজনক ও অন্যায্য চুক্তি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগও তাদের তাড়া করছে। সম্প্রতি আদানি গোষ্ঠীর একটা সংস্থা থেকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ আমদানি সংক্রান্ত একটা চুক্তি চলে এল বিশ্লেষণ ও তীব্র চর্চার কেন্দ্রে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে গৌতম আদানি গোষ্ঠীর সংস্থা আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড)-এর ২০১৭ সালে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলায় আদানি গোষ্ঠী নির্মিত ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত সমস্ত বিদ্যুৎ ২৫ বছর ধরে কিনতে বাধ্য থাকবে বাংলাদেশ। সম্প্রতি ঐ চুক্তির সম্পূর্ণ বয়ানটি প্রকাশ্যে এসেছে এবং চুক্তির শর্তগুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের একটা অংশের মতে এই চুক্তি শুধু "অত্যধিক ব্যয়বহুল" এবং “অলঙ্ঘনীয়ই” নয়, তা “অপ্রয়োজনীয় এবং অন্যায্যও” বটে। চুক্তি বাতিলের দাবি তাই জোরালোভাবে উঠেছে বাংলাদেশে। প্রসঙ্গত, চুক্তি ২০১৭ সালে সম্পাদিত হলেও এবছরের মার্চ মাস থেকে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিদ্যুৎ আমদানির কথা।
ঐ চুক্তি অনুযায়ী যে প্রক্রিয়ায় বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হবে, তার মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশের প্রভূত ক্ষতির বিনিময়ে আদানির সুবিপুল মুনাফা অর্জনের নিশ্চয়তা। বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের প্রধান মাধ্যম হবে কয়লার দাম। আদানি গোষ্ঠী কয়লার যে দাম দেখাবে, সেটাই হবে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের প্রধান ভিত্তি। ভারতের কয়লা খনিতে উৎপাদিত তুলনামূলক কম দামের কয়লা ঝাড়খন্ডের গোড্ডা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে ব্যবহৃত হবে না। ঐ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হবে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কয়লা। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতে কয়লা ব্যবসার বৃহত্তম সংস্থা হল আদানিদের সংস্থা আদানি এন্টারপ্রাইজেস আর বিদেশে আদানির কয়লা খনি রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়। সেখান থেকে কয়লা এসে ভিড়বে ভারতের সমুদ্র বন্দরে যার পরিচালন ভারও আদানিদের হাতে। তারপর সেখান থেকে ৭০০ কিমি রেলে পরিবাহিত হয়ে কয়লা আসবে ঝাড়খন্ডের গোড্ডায়। সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য তৈরি হবে ট্রান্সমিশন লাইন এবং তার মধ্যে দিয়ে পরিবাহিত হয়ে বিদ্যুৎ পৌঁছবে বাংলাদেশ সীমান্তে এবং তারপর সঞ্চারিত হবে বাংলাদেশে। কয়লা আমদানি থেকে ট্রান্সমিশন লাইন তৈরি এবং তার সাথে পরিবহণের সমস্ত খরচ ও মুনাফা যুক্ত করে বিলের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছ থেকে দাম আদায় করবে আদানির সংস্থা। কয়লার সর্বোচ্চ দাম কত হতে পারে তার উল্লেখ অন্যান্য চুক্তিতে থাকে। কিন্তু আদানির সংস্থার সঙ্গে হওয়া চুক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দামের এমন কোনো উল্লেখ চুক্তিতে নেই। কয়লার দাম যত বাড়বে (এবং এখন তা বর্ধমান) সেই অনুযায়ী বাজার দরে নির্ধারিত হয়ে বিদ্যুতের মূল্য বেড়ে চলবে।
এছাড়া, চুক্তির শর্ত অনুসারে ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎ প্রবাহ ধরে রাখার ক্ষমতার জন্য খরচও বিপিডিবি-কে বহন করতে হবে। এর ব্যয় বছরে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার, বিশেষজ্ঞদের ধারণায় যে হার যথেষ্ট বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে কত ঘন্টা কাজ হল, কত ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন হল বা উৎপাদন আদৌ হল কিনা, ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের ক্ষেত্রে তা বিবেচ্য হবে না। অর্থাৎ, যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার কথা চুক্তিতে বলা আছে তা বাংলাদেশকে ২৫ বছর ধরে দিয়ে যেতে হবে, এমনকি কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না হলেও বিপিডিবি তা দিতে বাধ্য থাকবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোনো যন্ত্র খারাপ হলে, রাজনৈতিক কারণে প্ল্যান্টের কোনো ক্ষতি হলে, উৎপাদন ব্যহত হলে তার মেরামতির ব্যয়ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বোর্ডকে বহন করতে হবে। উল্লেখ নিষ্প্রোয়জন যে, মেরামতি ও সংস্কারের এই ব্যয় আদানিদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ব্যয়কে বাড়িয়েই চলবে। প্রাথমিক আনুমানিক হিসাবে আদানিদের সংস্থা থেকে বিদ্যুৎ আমদানির মূল্য ইউনিট প্রতি ৮.৭১ টাকা হবে বলে ধরা হয়েছিল, কয়লার দাম ও আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় সেই দামই এখন ইউনিট প্রতি ১৭ টাকা বা এমনকি ২৪ টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর সম্মিলিত ফল বিপিডিবি-র অর্থ তহবিল এবং বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ।
আদানি এবং বিপিডিবি-র মধ্যে চুক্তি আর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকেও সামনে নিয়ে আসছে – বাংলাদেশ নিজে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং ভারতের অন্যান্য স্থান থেকে যে বিদ্যুৎ আমদানি করে থাকে তার পরও কি আরও বিদ্যুৎ আমদানির প্রয়োজন বাংলাদেশের রয়েছে? বাংলাদেশ থেকে এ বছরের জানুয়ারি মাসে পাওয়া তথ্য বলছে – বাংলাদেশের উৎপাদন ক্ষমতা হল ২২৭০০ মেগাওয়াট, এবং আরও কিছু কেন্দ্র নির্মীয়মান অবস্থায় রয়েছে এবং সেগুলির নির্মাণ সম্পন্ন হলে আগামী চার বছরে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে আরও ১৩০০০ মেগাওয়াট। এটা অবশ্য ঠিকই যে এই পরিপূর্ণ ক্ষমতার রূপায়ণ বাস্তবে ঘটে না, তবে, সেটাকে হিসেবে নিয়েও শেষমেশ যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় সেটাও কম নয়। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছে ২০২২-এর এপ্রিল মাসে, ১৪৭৮২ মেগাওয়াট। প্রয়োজন অনুসারে গরমের সময় বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় ১৩০০০ মেগাওয়াট, এবং শীতের সময় কম প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন নেমে আসে ৯০০০-১০০০০ মেগাওয়াটে। আর বাংলাদেশ ভারত থেকে এখন আমদানি করে ১১৬০ মেগাওয়াট। এর পরও কি আরও বিদ্যুৎ আমদানির প্রয়োজন বাংলাদেশের রয়েছে? প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আমদানির পরিণামে বাংলাদেশের কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কি অনাবশ্যক হয়ে পড়ে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে না? এই ধরনের প্রশ্ন বাংলাদেশে মাথাচাড়া দেওয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ধাক্কা খাবে না তা বুক ঠুকে বলা যাবে না। বাংলাদেশের এক বিশেষজ্ঞ এবং উপভোক্তা সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান সামসুল আলম বলেছেন, “দু-দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে বিপর্যয় ঘটানোর সম্ভাবনা এই চুক্তির রয়েছে।… ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে আমাদের সরকারি কর্তাব্যক্তিরা বৈষম্যপূর্ণ এক চুক্তিতে সায় দিয়েছেন, যার মধ্যে দিয়ে এক বেসরকারি সংস্থাকে তার মুনাফাবাজির অভিপ্রায় পূরণে সহায়তা করা হয়েছে এবং তা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐ স্বত্বাধিকারীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য।”
প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালে প্রথমবার বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেন যে বাংলাদেশ কতৃপক্ষ যেন “বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিদ্যুৎ পরিবহণ ও বন্টনের ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর প্রবেশের পথ সহজসাধ্য করে।” বিদ্যুৎ উৎপাদনে যুক্ত ভারতীয় কোম্পানি বলতে আদানির কথা নিশ্চয় তাঁর মাথায় ছিল। গৌতম আদানি অনেক বারই নরেন্দ্র মোদীর বিদেশ সফরের সঙ্গী হয়েছেন এবং গৌতম আদানিকে বিদেশী প্রকল্পের বরাত পাইয়ে দেওয়ার তদবির নরেন্দ্র মোদী করেছেন বলেও শোনা যায়। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কাতেও বিদ্যুৎ প্রকল্প আদানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নরেন্দ্র মোদী শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টকে চাপ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। গত বছর, অর্থাৎ ২০২২-এর ১০ জুন শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট কমিটির সামনে তাঁর সাক্ষ্যে শ্রীলঙ্কা বিদ্যুৎ বোর্ডের চেয়ারম্যান এম এম সি ফার্দিনানন্দো যা বলেছিলেন তা এইভাবে উল্লিখিত হয়েছিল দ্য মর্নিং পোস্ট পত্রিকার ১২ জুন সংস্করণে – “ফার্দিনানন্দো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সম্পর্কিত পরলামেন্ট কমিটির সামনে শুক্রবার (১০ জুন) বলেন, মান্নারে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পে বরাত ভারতের আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছে যার পিছনে ছিল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের উপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চাপ।” এরপর শ্রীলঙ্কা ও ভারত সরকারের পক্ষে ঐ চাপের কথা অস্বীকার করা এবং ফার্দিনানন্দোর পক্ষেও “আবেগের” বশবর্তী হয়ে "মিথ্যা" বলার কথা উত্থাপন করে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেও “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চাপ”-এর কথা কিন্তু শ্রীলঙ্কার জনগণের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। আর গৌতম আদানির হাতে ঐ বিদ্যুৎ প্রকল্প তুলে দেওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কা “লক্ষ-লক্ষ ডলার” ক্ষতির মুখে পড়েছে বলেও শ্রীলঙ্কার ভাষ্যকাররা জানিয়ে ছিলেন। গৌতম আদানির প্রতি নরেন্দ্র মোদীর পৃষ্ঠপোষকতা এইভাবে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গৌতম আদানি গোষ্ঠীর এক সংস্থার সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিও বাংলাদেশের প্রভূত ক্ষতির বিনিময়ে গৌতম আদানিকে প্রদত্ত এক উপঢৌকন বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে। এবং ঐ চুক্তি রূপায়ণের পিছনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উমেদারির যে প্রসঙ্গ বাংলাদেশে উঠেছে তা একেবারে ভিত্তিহীন বলে খারিজ করার নয়।
-- জয়দীপ মিত্র
মুসলিম সমাজের ‘পসমন্দা’ অংশের কাছে বিজেপিকে পৌঁছানোর বিশেষ নিশানা বানাতে বলেছেন নরেন্দ্র মোদী। ‘পসমন্দা’ অর্থে, যারা সামাজিক দিক থেকে ওবিসি (আজলাফ) ও দলিত (আরজাল) এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে গরিব শ্রেণীর। এরাই এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যাগুরু অংশ, দেশের ২০ কোটি মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ৮৫-৮৬ শতাংশ। আর, মোট লোকসভা আসনের পাঁচভাগের একভাগ রয়েছে যে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে, ওই দুই রাজ্যে পসমন্দা জনতার বসবাস সবথেকে বেশী।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক মুসলিম ভোট প্রচন্ড বিক্ষুব্ধ অবস্থান থেকে বিজেপি-বিমুখ হতে পারে। তাছাড়া, সংখ্যালঘু অপর দুই অংশ — খ্রিষ্টান ও শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে, এমনকি সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও নানা ক্ষোভের কারণে বিজেপিকে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হতে পারে। মোদী সেই সম্ভাবনা আঁচ করে, সেই সেই অংশের ভিতর থেকে তা সামাল দেওয়ার প্রয়াস রাখার পাশাপাশি মুসলিম সমাজের 'পসমন্দা' অংশ থেকে ভোট আত্মসাৎ করার নয়া কৌশল নেওয়া দরকার মনে করছেন। এটা তাঁদের কাছে বিশেষ বাধ্যবাধকতা হয়ে পড়েছে। তাই যে ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অস্তিত্বকে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক প্রধান শত্রু বানিয়ে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের এতো আগ্রাসন, বাড়-বৃদ্ধি, আাধিপত্য বিস্তার, কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে শাসনক্ষমতা কায়েমের রমরমা; তা সত্ত্বেও গৈরিক সাম্প্রদায়িক শক্তি ’২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে বিশেষ নজর দিতে চাইছে একান্তই প্রয়োজনীয় মুসলিম ভোটে। এই লক্ষ্যে পসমন্দা অংশের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের কল্যাণকর প্রকল্প-সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার প্রচার নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হয়েছে। তার পরিকল্পনাও করা হয়ে গেছে। বিজেপির গতবছর জুলাইয়ে হায়দ্রাবাদে ও এবছর জানুয়ারিতে দিল্লীতে হওয়া পরপর দুটি জাতীয় কার্যনির্বাহী বৈঠকে সংশ্লিষ্ট পলিসি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ২০০টি জেলার ২২,০০০ গ্রামকে চিহ্নিত করে লক্ষ্যমাত্রায় রাখা হয়েছে। তার জন্য দলের নেতা-কর্মী, প্রচারক-সংগঠকদের নেমে পড়ার নির্দেশ জারী হয়েছে। এই কর্মসূচীর মানচিত্রে পশ্চিমবাংলার বেশ কিছু মুসলিম জনঅধ্যুষিত জেলা ধরা হয়েছে। যেসব রাজ্যে এবছর বিধানসভা নির্বাচন ও তার নিচের স্তরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন রয়েছে, যেমন এরাজ্যে আর ক'মাস পরে অনুষ্ঠিত হবে পঞ্চায়েত নির্বাচন; এইসমস্ত নির্বাচনে বিজেপি উপরোক্ত প্রচারকৌশলের প্রাথমিক মহড়া দিতে ও তার ফলাফল বুঝে নিতে চাইবে। মোদী এই নতুন কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোড়ন তোলার পয়লা নম্বর দায়িত্বে রেখেছেন নিজেকে। মোদীর জুড়ি হিসাবে থাকছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাছাড়া, তৃণমূলস্তরে আরএসএস-এর জালবিস্তারের দৌলতে মিলবে বিস্তর সাহায্য-সহযোগিতা। ইতিমধ্যেই ওপর থেকে তার সংকেত দিতে শুরু করেছেন খোদ আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের জাতীয় স্তরের মৌলানাদের একাংশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। এদেশে বসবাসের ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় না থাকার তথাকথিত আশ্বাস দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্যই হল, বিজেপির পসমন্দামুখী অভিযানের জন্য আবহ তৈরি করা। মোদী প্রথমত, মুসলিম ভোট বিভাজনের লক্ষ্যে কলকাঠি নেড়ে চলার পক্ষে; দ্বিতীয়ত, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ব্যাপক মুসলিম ভোট পাওয়ার প্রতি, তা সম্ভব না হলেও তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় সংখ্যালঘু ভোট পেতে মুখিয়ে, আর সেটাই পসমন্দা অংশের ভোটের খোঁজে তাঁকে আরও মরীয়া করে তুলছে। ভাগবত ও মোদীর বার্তার লক্ষ্য অভিন্ন — তারা চাইছেন গোটা আরএসএস-বিজেপিকে তাতাতে — প্রকল্পগুচ্ছের চাল দিয়ে পসমন্দা ভোট হাতাতে। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে মোদী স্বাধীনতা পাওয়ার পরবর্তী ভারত-ইতিহাসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। মন্তব্য করেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার এতো বছর বাদেও এহেন অংশের জনগণ গরিব ও পশ্চাদপদ থেকে গেছেন। সত্যিই তো তাই, এই শোচনীয় নির্মম বাস্তবতা শাসকশ্রেণীর কোনও ক্ষমতাসীন অংশই অস্বীকার করতে পারেনি, পারবে না। বিজেপি আমলের পক্ষেও এই প্রশ্নে সফলতা দাবি করা সম্ভব নয়। বরং, কেন্দ্রের দুদফা মোদী আমলে, রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি শাসনে ঐ গরিব-পশ্চাদপদরা সে তিমিরেই রয়ে গেছে। উপরন্তু সংবিধান প্রদত্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, সামাজিক সম্মান, মর্যাদা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশের দাবিতে আম জনতা নাছোড় হলে বেড়েছে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, পসমন্দারাও তার নানাভাবে শিকার হয়েছেন। এটা সাধারণভাবে সম্প্রদায় নির্বিশেষে অতি নির্মম সত্য, বিশেষভাবে মুসলিমদের ক্ষেত্রে আরও নিষ্ঠুর সত্য। এখন মোদী আশ্রয় নিচ্ছেন নতুন নতুন বাহানার। বলছেন, তাঁদের সরকার এই ‘জনকল্যাণ প্রকল্প’ উৎসর্গ করছে ‘স্বাধীনতা ৭৫’ উদযাপনের ‘অমৃতকালে’। বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এর রূপায়ণে আন্তরিক হবে, কোনও কার্পণ্য করবে না, দুর্নীতি করবে না, বৈষম্য চালাবে না! বলছেন, পসমন্দা বর্গের জন্য বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ‘সংরক্ষণের’ ব্যবস্থা করা হবে। মজার কথা হল, এটা পরের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগের বছর, তাই এবছর এখন থেকেই মোদী চাইছেন নতুন করে তাঁদের সরকারের ‘জনদরদী সংস্কারকের’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে।
কিন্তু যথেচ্ছ অবহেলা ও পীড়ন চালিয়ে আসার দুর্বিষহ পরিণাম মোদী-শাহরা ভোলাবেন ক করে? মানুষ তো দেখেছে বিজেপি জমানায় রাষ্ট্রীয় মদতে সাম্প্রদায়িক গণহত্যা ও সামাজিক উৎপীড়ন চালানোর ‘গুজরাট মডেল’, ঘৃণা-বিদ্বেষ-বিভাজন-বুলডোজার রাজের ‘উত্তরপ্রদেশ মডেল’, এনআরসি’র জাঁতাকলে বন্দীশিবিরে অন্তরীণ করে রাখার ‘আসাম মডেল’ ইত্যাদি ইত্যাদি! আর, ক্রমাগত গণতন্ত্র ধংস করা, সংবিধান অমান্য করার তান্ডবলীলা! এইসমস্ত অন্যায়-অত্যাচার বিশেষত সংখ্যালঘু মুসলিম জীবনে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে অপরাধী সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশ-প্রশাসন, শাসকদল ও সঙ্ঘী খুনে-গুন্ডা-স্যাঙাত-দাগীদের আঁতাত ক্ষমতার সন্ত্রাস চালিয়ে আসছে, আর সেসব নিয়ে উৎকট উল্লাস উপভোগ করে আসছে। সর্বস্তরে আদালতে বিচারের নামে চলছে প্রহসন। অপরাধীরা পায় ‘বেকসুর’ খালাস, ‘বীরের’ সম্বর্ধনা! বিপরীতে, বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে। হিন্দুত্ববাদী হিংসার বিরুদ্ধে ন্যায়ের সপক্ষে সওয়ালকারীদের নিরন্তর ভোগ করতে হয় হেনস্থা, নির্যাতন।
মোদী বলেছেন, উন্নয়নের জন্য চারই সদিচ্ছা এবং অর্থবরাদ্দ। মোদীর মুখে পসমন্দাদের প্রতি ‘সদিচ্ছা’ দাবি করা আসলে ভূয়ো উপলক্ষ মাত্র। এর সাথে বিচার করার থাকে বাজেটে সংখ্যালঘু খাতে আর্থিক বরাদ্দের বিষয়। নির্মম প্রহসনের মতোই চলতি কেন্দ্রীয় বাজেটে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ৩৮ শতাংশ। মাদ্রাসা শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে বিপুল। বিগত আর্থিক বছরে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক খাতে বরাদ্দ ছিল ৫০২০.৫০ কোটি টাকা। এবারের বরাদ্দের অঙ্ক ৩০৯৭.৬০ কোটি টাকা। মাদ্রাসা শিক্ষায় গতবার বরাদ্দ হয়েছিল ১৬০ কোটি টাকা, এবার বরাদ্দ হয়েছে ১০ কোটি টাকা মাত্র। বরাদ্দ কমানোর বিষয়ে দেখানো হয়েছে অতি চেনা অজুহাত, গতবারের খরচ না হওয়া উদ্বৃত্তের সাথে সাজুয্য রেখে এবারের বরাদ্দ মঞ্জুর হয়েছে! হিসাব মেলানো দূর অস্ত্, তবু তিনি মেলাবেন দাবি করবেন! তিনি অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী। কিভাবে মেলাবেন? তিনি যে সংসদে কোনও হিসাব কোনও কৈফিয়ৎ দিতে রাজি হন না।
সব মনে রাখতে হবে।
পসমন্দাদের কাছে এইসব পাল্টা প্রচার নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
- অনিমেষ চক্রবর্তী
মাস পাঁচ-ছয় আগে এই পত্রিকাতেই পশ্চিমবঙ্গে পিএসসি কর্তৃক নিয়োগের ক্ষেত্রে গড়িমসি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতি বছর পিএসসির মাধ্যমে রাজ্য সরকারের করণিক নিয়োগ করার কথা। সেই প্রক্রিয়াকে এই সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক অবহেলা করছে। ওই নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএসসি-র ভূমিকাকে নাকচ করার উদ্দেশ্যে স্টাফ সিলেকশন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশন ২০১৬ সালে ক্লার্কশিপ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেয়। পরে তাদের অপারগতা বা সরকারের শুভবুদ্ধি উদয় হওয়ার দরুণ, যেটিই হোক, সেই নিয়োগ পিএসসি দ্বারাই করা হয়। তার পরে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলে দ্বিতীয়বার করণিক নিয়োগের জন্য। ৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সেই নিয়োগ সম্পূর্ণ হয়নি। বিদ্যালয় স্তরের নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অব্যবস্থা যে দুরবস্থার সৃষ্টি করেছে সে ব্যাপারে এরাজ্যের সকলেই ওয়াকিবহাল।
সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের জায়গাগুলি মূলত: হল সরাসরি সরকারি কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ- বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, পুলিশে, পুরসভা ও পঞ্চায়েতে নিযুক্ত কর্মী। এই সমস্ত নিয়োগকেই নিয়ম মেনে করার দায়িত্ব সরকারের। তার জন্য বিভিন্ন নিয়োগ কাঠামো বা কমিশন তৈরি করার কথা। তবে, ওইসব নিয়ম মেনে বিধিসম্মত নিয়োগ করা হয় নিয়মিত কর্মীদের। কিন্তু বর্তমান সরকার নিয়মিত কর্মী নিয়োগকে প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। সমস্ত রাজ্য সরকারি দফতরেই (তাই বা কেন, কেন্দ্রীয় সরকারি দফতরেও) অস্থায়ী ক্যাজুয়াল ও কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। যারা সরকারি অফিসে গিয়েছেন তাঁরা বেসরকারি সিকিউরিটি গার্ড অবশ্যই দেখেছেন, জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারতেন দফতরের বহু কর্মীই অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত; আর অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত সিভিক পুলিশ তো প্রতিদিন রাস্তায় দেখা যায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-বিদ্যালয়গুলিতেও সমস্ত স্তরে অনুরূপ অস্থায়ী কর্মী দিয়ে কাজ চালানো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে সরকার বেতন খাতে অর্থ বাঁচাচ্ছে, পরবর্তীতে পেনশন খাতেও অর্থ বাঁচানোর বন্দোবস্ত হচ্ছে।
নিয়োগের ক্ষেত্রে গড়িমসি, দুর্নীতি অব্যবস্থা তজ্জনিত আইন-আদালত, এবং শূন্যস্থান পূরণে অনীহার ফলে বিপুল সংখ্যক সরকারি পদ খালি রয়েছে। সংখ্যাটি ঠিক কত তা বলা দুষ্কর। সরকারও সে ব্যাপারের কোনো শ্বেতপত্র প্রকাশ করে হিসেব দিতে নারাজ, তবে সব মিলিয়ে তার সংখ্যা যতজন স্থায়ীভাবে নিযুক্ত আছেন তার থেকে বেশি হবে বলে আন্দাজ করা যায়। রাজ্য জুড়ে যখন কর্মপ্রার্থী যুবকেরা সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্তভাবে নিয়োগের জন্য রাস্তায় রয়েছেন দিনের পর দিন, অনশন করছেন তখন ওইসব শূন্যপদ পূরণ করার দাবিকে সমর্থন করতেই হবে।
ওই নিয়োগের ক্ষেত্রেই আনুষঙ্গিক যে বিষয়টি জরুরি হয়ে উঠেছে সেটি হল নিয়োগ দুর্নীতি। গত কয়েক মাসে এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে শাসক দলের সর্বস্তরেই নিয়োগ দুর্নীতি শিকড় গেড়েছে, শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। শত শত কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, নেতা-মন্ত্রীরা জড়িত রয়েছে। স্থায়ী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগের পরীক্ষা ইন্টারভিউ এসব হয়েছে, সেগুলির রেকর্ড থাকার কথা। ফলে সেক্ষেত্রে দুর্নীতি তদন্তের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। সেই দুর্নীতির পরিমাণ পাহাড় প্রমাণ। কিন্তু যে বিপুল সংখ্যক অস্থায়ী কর্মী নিয়োজিত হয়েছে সেই নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়নি একথা বিশ্বাস করা কেবল কঠিন নয়, অসম্ভব। দেশ ও রাজ্য জোড়া বিপুল কর্মহীনতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলি একটুও ভাবিত নয়, চাটনি খবর হিসেবে অনুব্রতর মেয়ে সুকন্যার মনমড়া থাকা, বা কুন্তলের বান্ধবী সোমাকে সিবিআইএর পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদে ডাকা বা পার্থের কতটা ওজন কমল তা নিয়েই পাতা ভরানো হয়।
ওই দুর্নীতির বিচারের পথ দিয়েই তৈরি করা হয় কর্ম সঙ্কোচনের বন্দোবস্ত। মহামান্য বিচারক অবলীলাক্রমে ছাত্র না থাকলে বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার নিদান দেন। শিক্ষা দফতরও অতিসক্রিয় হয়ে অনতিবিলম্বে ৮ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ের তালিকা তৈরি করেন যেখানে ছাত্র সংখ্যা ৩০এর কম। অন্যদিকে আরেকজন মহামান্য বিচারপতি অন্য মামলার সূত্রে ৭ জন ছাত্র থাকা বিদ্যালয়কে বন্ধ করার নির্দেশ দেন। যারা শিক্ষকতার দাবিতে রাস্তায় রয়েছেন তাঁরা বুঝতেও পারেন না ওই সমস্ত বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলেই অন্তত ৪০ হাজার পদ অবলুপ্ত হবে। তাছাড়া, রাজ্যের ছাত্র সংখ্যা বাড়লেও কেন বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র নেই, কেন বেসরকারি বিদ্যালয়গুলি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে সেই কারণ খোঁজার দায় মেসিয়া বিচারপতিরা নেন না। কারণ তাঁরাও উচ্চবিত্ত অভিজাত চিন্তার বাহক। ওই বিচারপতি সরকারি বিদ্যালয়গুলিকে বাঁচানোর জন্য, যা গরিব ঘরের শিশুদের পড়াশোনার জাযগা, নির্দেশ দিন না বিচারপতি সমেত সকল সরকারি বেতনভূক কর্মীদের সন্তানদের সরকারি বা সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে পড়ানোর। না, সেটি করা যাবে না, কোনো না কোনো আইনে আটকাবে নিশ্চিত; এমনকি সেই ধরনের আইন প্রণয়নের নিদানও মানীয় বিচারপতিরা দেবেন বলে মনে হয় না, কারণ তাঁদের প্রিভিলেজড সন্তানের প্রিভিলেজ নষ্ট যাবে যে। তাই দুর্নীতি দমনের বিচার পরিণত হয় কর্মী সঙ্কোচনের নিদানে। একেও তো রুখতে হবে।
এরাজ্যে এই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে রাজ্য সরকারি বেতন ও পেনশন প্রাপকদের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা (ডিএ) ও গত ২০০৯ সাল থেকে বকেয়া ডিএ প্রদান। বকেয়া ডিএ-র শুরুর সময় জুলাই, ২০০৯ সাল বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, কর্মচারীদের সারা ভারত ভোগ্যপণ্য মূল্য সূচক অনুযায়ী ডিএ দেওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারেরও গাফিলতি ছিল। এতদসত্বেও বামফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়ার বিষয়টি কখনো অস্বীকার করেনি। কিন্তু মমতা ব্যানার্জীর সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তৃণমূলের অবস্থান ছিল, “যে সরকার কর্মীদের ন্যায্য ডিএ দিতে পারে না তাদের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই”; আর ক্ষমতায় আসার পরে, ডিএ নিয়ে কর্মচারীদের আন্দোলন হল ‘ঘেউ ঘেউ’ করা, বা ‘ কী পেলে খুশি হবেন নন্দলালেরা’? বারম্বার টালবাহানা চলছে ডিএ ও বকেয়া ডিএ নিয়ে আদালতের রায় কার্যকর করা নিয়ে। কর্মচারীদের প্রাপ্য ডিএ থেকে বঞ্চিত রেখে রাজ্য সরকার সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনুদানের জন্য ব্যয়ের দোহাই যে দিতে পারে না তা হাইকোর্টের বিভিন্ন রায়ে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাজ্য সরকার কর্মচারীদের নিয়োগকারী। নিয়োগকারী নিয়োগের শর্ত মেনে নিয়োজিতকে বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা দিতে দায়বদ্ধ, আর্থিক সীমাবদ্ধতা সেই দায় থেকে তাকে মুক্তি দেয় না।
ডিএ দেওয়া হয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বলে। যে সরকারের আমলে সরকারি ভাড়ার হারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাস মালিকেরা বাসের ভাড়া ৪০-৬০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়ে কর্মীদের যাতায়াত দূর্মূল্য করে তোলে, জ্বালানি সমেত সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়তেই থাকে সেই সরকারের অপদার্থ মুখ্যমন্ত্রী তখন ডিএর দাবিতে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে ‘কী পেলে খুশি হবে নন্দলালেরা’ বলে হুঙ্কার ছাড়েন। হুমকি দেন পেনশন প্রাপকদের পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার, অসত্য কথা বলে। প্রকৃত তথ্য হল যে, বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যে ২০০৪ সালের ৩১ মার্চের পরে নিযুক্তদের সরকারি পেনশন প্রকল্প থেকে বিযুক্ত করে নতুন পেনশন প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে কর্মী ও নিয়োগকর্তা উভয়েই অর্থ প্রদান করে তহবিল তৈরি করবে ও অবসরের সময় সেই তহবিল ব্যবহার করে এ্যানুইটি পাবে পেনশন হিসেবে। কিন্তু ২০০৪ এর ৩১ মার্চে পর্যন্ত নিয়োজিত স্থায়ী কর্মচারীরা যথাবিহিত পেনশন পাচ্ছেন। ওদিকে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, অন্য রাজ্য পেনশন বন্ধ করে দিয়েছে, উনিও কি পেনশন বন্ধ করে দিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা বাঁচাবেন? এক অদ্ভুত অকর্মণ্য যুক্তিজালে নিজেকেই জড়াচ্ছে এই সরকার। কেউ যদি ট্রেনে উঠে, বাসে উঠে বলেন যে তাঁর পয়সা নেই তাই তিনি বিনা টিকিটে বা কম ভাড়ায় ট্রেনে বাসে চড়বেন তাহলে কি সেই যুক্তি মানা হবে? তাহলে দেওয়ার সঙ্গতি নেই এই বাহানা কীভাবে ন্যায্য প্রাপ্য ডিএ বা বকেয়া ডিএ দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? পরিসংখ্যানগত ভাবেও রাজ্য সরকারের পেনশন খাতে ব্যয় ২০২১-২২ থেকে কমতে শুরু করেছে। ২০২১-২২ সালে যা ছিল ২৬,৬৭৬ কোটি টাকা তা ২০২৩-২৪ সালের বাজেটে কমে দাঁড়িয়েছে ২৩, ৮৯৬ কোটি টাকা (১০.৪ শতাংশ হ্রাস)। বেতন খাতে বৃদ্ধির পরিমাণ দুবছরে সাকুল্যে ৮.৭ শতাংশ। যেকোনো নিয়োগকারী রাজ্য সরকারকেই কর্মীদের বেতনকে মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে বাড়াতে হবে। নতুবা সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার অধিকার থাকে না, যেমনটা মমতা ব্যানার্জী বিগত বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে বলেছিলেন।
ডিএ বৃদ্ধির দাবিতে বৃহত্তর জনতার ঐক্য গড়ে তোলা আবশ্যিক হলেও একটি বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার, ঘোলা জলে মাছ ধরতে হাজির হয়েছেন যে বিরোধী দলনেতা তিনিও ডিএ না দেওয়ার জন্য দায় এড়াতে পারেন না। ২০১৬ সালে যখন ডিএ মামলা রুজু করেছিলেন কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ-এর নেতারা তখন মন্ত্রীসভায় ছিলেন আজকের বিরোধী দলনেতা। তিনি সেই সরকারের সঙ্গে ২০২১ সাল পর্যন্ত অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিলেন। আজ ডিএর দাবিতে আন্দোলন ও অনশনরত কর্মৱারীদের পাশে গিয়ে তিনি সেদিনের মমতা ব্যানার্জীর মতো মিথ্যে কথা বলছেন। এভাবেই ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসেও কেন্দ্রীয় সরকারী হারে বেতন বা ডিএ সেখানকার বিজেপি সরকার দেয় না। ওই নারদা মামলায় কাগজে মুড়ে টাকা নেওয়া বিজেপি নেতার মুখের উপর একথা বলার প্রয়োজন রয়েছে। একই রকমভাবে দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগের দাবিতে যে সমস্ত কর্মপ্রার্থীরা রাস্তায় রয়েছেন তাদের ওই নেতার মুখের উপর বলা উচিৎ ২০১১ সাল থেকে যখন নিয়োগ দুর্নীতিগুলি ঘটেছে, তখন তিনি কী করছিলেন, দুর্নীতির কতটা তাঁর কাছে পৌঁছেছে। তিনি যে টাকা নিতে দড় তা ওই নারদ ঘটনায় পরিষ্কার।
- অমিত দাশগুপ্ত
প্রবীণ সাংবাদিক, বিশিষ্ট মার্ক্স চর্চাকার, কবি, প্রাবন্ধিক, চিত্র সমালোচক ও একদা ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি (সিপিআই) সদস্য শ্রী শংকর রায়ের জীবনাবসান হল কলকাতার হাসপাতালে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। সংবাদ জগতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা শংকরদার অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল অফুরান। যে কোনও সংবেদনশীল ব্যক্তির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটলেই তিনি তাঁকে অদ্ভুতভাবে আপন করে নিতে পারতেন। বিশেষ করে জ্ঞান চর্চার জগতে যে কোনও তরুণ তাঁর বন্ধু হয়ে উঠতেন বয়সের সীমারেখা না মেনেই। অনুজপ্রতীম ওই সমস্ত বন্ধুদের সঙ্গে হয় যাদবপুর কফি হাউসে বা দূরভাষে যোগাযোগ রাখতেন। এবং এই বন্ধুদের সীমা কলকাতা ছাড়িয়ে সারা বাংলা, ভারতবর্ষ, এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান, বাংলাদেশ হয়ে বিদেশের বহু রাষ্ট্রে বিস্তৃত ছিল। দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার একদা সম্পাদক শ্রী সুনন্দ দত্ত রায়, ওই পত্রিকার কলামনিস্ট অদতি রায় ঘটক, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সাড়া জাগানো অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, আই পি এ পরচালক নিত্য চক্রবর্তী তাঁর বন্ধু ও স্বজন ছিলেন। শংকরদার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের যোগ প্রায় চার দশকের, প্রয়াত বন্ধু বরেন ভট্টাচার্যের মাধ্যমে। স্বপ্নাদির (দেব) সম্পাদনায় বন্ধু বরেন কাজ করত ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায়। স্বপ্নাদিরা ইংরেজি পত্রিকা ‘পয়েন্ট কাউন্টার পয়েন্ট’ দেবেশ রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশ করছিলেন ১৯৮৬ সাল থেকে, প্রতিক্ষণ অবশ্য ১৯৮৩ সাল থেকে বেরত। শংকরদা তখন ‘ক্যাপিটাল’ পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন। একদা কিংবদন্তী কমিউনিষ্ট নেতা জলি মোহন কলের সম্পাদনায় ‘ক্যাপিটাল’ প্রকাশিত হত। শংকরদার হাতও ধরেই স্টেটসম্যান পত্রিকার অত্যন্ত শক্তিশালী কলামনিস্ট ও সাংবাদিক অদিতি রায় ঘটক-এর উত্থান ‘ক্যাপিটাল’ পত্রিকায় কাজ করে। শংকরদা ‘পয়েন্ট কাউন্তার পয়েন্ট’-এও কাজ করেছেন। আরও কিছুটা পরে তিনি ‘বিজনেস অ্যাণ্ড পলিটিক্যাল অবজার্ভার’ (পরে ‘দ্য অবজার্ভার’)-এ কাজ করে অবসর নেন। কর্পোরেট সাংবাদিক হয়েও শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের হয়ে কাজ করে গিয়েছেন আজীবন। শ্রমজীবী মানুষের শোষণমুক্তির স্বপ্নে বিভোর শংকরদা নিজের, পরিবারের, সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কথা কখনও ভাবতেন না। প্রায় ছয় দশকের সাংবাদিকতার জীবন যার সূত্রপাত কালান্তর পত্রিকা দিয়ে। এক সময় ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির (সিপিআই) সদস্যপদও নিয়েছিলেন। একদা বঙ্গ সিপিআই সম্পাদক প্রাক্তন সাংসদ ডা. রণেন সেন-এর আপ্তসহায়ক হিসেবেও কাজ করেছেন। কাজ করেছেন রাজ্য সরকারের কৃষি পরিকল্পনা দফতরের গণনাকার হিসাবেও।
ভবানীপুরে জন্ম হলেও তাঁর আদি বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগর। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (ডি এল রায় নামেই যিনি সমধিক পরিচিত) বংশধর শংকরদার মামা ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সম্পাদক। ভবানীপুরের স্কুলে ম্যাট্রিকুলেশনের পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে থেকে আইএসসি ও ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে স্ট্যাটিস্টিক্স-এ ডিপ্লোমা নিয়ে উত্তীর্ণ হন। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি ‘ক্যাপিটাল’ পত্রিকায় যোগ দেন যার সম্পাদক ছিলেন কমিউনিষ্ট নেতা জলি মোহন কল। গত শতাব্দীর ছয়ের দশক থেকে প্রকাশিত নরহরি কবিরাজের সম্পাদনায় ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকার সঙ্গে তরুণ কর্মী হিসাবে তিনি ও তপন বন্দ্যোপাধ্যায় কাজ করেছেন। নানান বিষয়ে কলমকে শানিত করেছেন। দেশ বিদেশের বহু সাময়িক পত্রে লিখেছেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কর্মী সমর্থক ও নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকলেও তাঁর দল সিপিআই-এর প্রতিই দুর্বল ছিলেন এমনকি ২০০০ সালে দল ছেড়ে দেওয়ার পরেও। পরের দিকে কালান্তরে ছদ্মনামে লিখতেন। লিবারেশন (সিপিআইএমএল-এর মুখপত্র) ও আজকের দেশব্রতীতে লিখতেন।
জীবনের শেষ এক দশক নিবিড় মার্ক্স চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। এর প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক মার্ক্স চর্চাকার ও গবেষক এবং অধ্যাপক পরেশ চট্টোপাধ্যায়ের সংগে তাঁর নাড়ির যোগ থাকা, এছাড়াও প্রদীপ বকশির সসঙ্গেও তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল — যিনি এই মুহূর্তে পশ্চিমবাংলা তো বটেই সারা ভারতবর্ষের মধ্যে অন্যতম মার্ক্স চর্চাকার ও সমাজতাত্ত্বিক। কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক মার্চেলো মুস্তোর (মার্ক্স চর্চায় যার পৃথিবীর ২০টি ভাষায় বই প্রকাশিত) লেখা ‘অ্যানাদার মার্ক্স’ শংকরদা ‘অন্য এক মার্ক্স’ শিরোনামে অনুবাদ করেছেন যা উত্তর ২৪ পরগণার বাদুর আখর প্রকাশনা থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ প্রকাশিত। সম্প্রতি অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়ের মার্ক্স-এর উপর বাংলায় লেখা কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন যা অনুষ্টুপ থেকে ২০২৩-এর বইমেলায় প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর ও শৈবাল গুপ্তর সম্পাদনায় মার্ক্স-এর জন্মের দ্বিশত বর্ষ উপলক্ষে পাটনায় আদর (এশিয়ান ডেভেলাপমেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট) আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে ১৫টি গবেষণাপত্র ‘প্রোবিংস অ্যাণ্ড রি-প্রোবিংস, এসেজ ইন মার্ক্সিয়ান অ্যাওয়েকিং’ প্রকাশিত হয়েছে দিল্লির আকর প্রকাশনা সংস্থা থেকে ২০২১ সালে। কথা ছিল রবীন্দ্রনাথ ও মার্ক্স-এর উপর বই লেখার। নাগরিক মঞ্চের সম্পাদক নব দত্তের অনুরোধে ‘বিপন্ন পরিবেশ’ সম্পাদনা করেছিলেন। ফ্রন্টিয়ার, মেইনস্ট্রিম, দর্শনে মুক্তমন, সপ্তাহ, জনস্বার্থ বার্তা, শিস সহ বহু ছোট পত্রিকায় লিখেছেন। সমাজমাধ্যমেও সক্রিয় থেকেছেন। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, কাফিলা ডটকম ইত্যাদি ওয়েব পোর্টালেও লিখেছেন। শংকরদা চলে গেলেও তাঁর সৃষ্টই আমাদের পথের দিশারি হয়ে থাকবে। রেখে গেলেন স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধু, নাতনি, কন্যাসম সাবি সহ অসংখ্য গুণমুগ্ধদের।
- নিত্যানন্দ ঘোষ
নকশালবাড়ি রাজনীতির দীর্ঘদিনের সাথী, যাদবপুরের কমরেড অরুণ দাস (মেঘা) বিগত ৫ মার্চ দুপুর ১২.১০ মিনিটে ৭০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন। একটানা প্রায় ১৬ দিন এমআর বাঙুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ৭০ দশকে কমরেড আশু মজুমদারের নেতৃত্বে অনেক লড়াইয়ের সঙ্গী ছিলেন কমরেড মেঘা। ১৯৭২ সালে যাদবপুরের বাইরে পার্টি নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে আরও দু'ই কমরেডের সঙ্গে গ্রেফতার হন। ১ বছরের কারাবাসের পরে মুক্তি পেয়ে আইপিএফ গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হন। লিবারেশনের বিভিন্ন গণসংগঠন গঠনের প্রক্রিয়াতেও অগ্রণী ভুমিকা রাখেন। পার্টির গোপন অবস্থায় বহু নেতৃত্বের নিশ্চিত ও সুরক্ষিত শেল্টার ছিল কমরেড মেঘার বাড়ি। ইদানিং পার্টির দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ থাকলেও লিবারেশনের প্রতি ছিল অগাধ আস্থা। তাঁর প্রয়াণের খবর পেয়ে যাদবপুর-ঢাকুরিয়া লোকাল কমিটির সম্পাদক বাবুন চ্যাটার্জি, ১০৪(১) ব্রাঞ্চের নেতৃত্ব প্রণব মুখোপাধ্যায়, দিলীপ ঘোষ সহ অন্যান্যরা রক্ত পতাকা দিয়ে কমরেডকে শেষ বিদায় জানান। কমরেড মেঘা লাল সেলাম। কমরেড মেঘা অমর রহে।
যাদবপুর-ঢাকুরিয়া লোকাল কমিটি
উঃ দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ লোকাল কমিটি সদস্য কমরেড মকবুল হক গত ৭ মার্চ প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৫৫ বৎসর। এ দিন সকালে তাঁর আকস্মিক হার্ট এ্যাটাক হয়। তারপর রায়গঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে আসার কিছু সময় পরেই তিনি প্রয়াত হন। তিনি ৯০ এর দশকের শেষ পর্বে পার্টির সাথে যুক্ত হন। কালিয়াগঞ্জ ব্লকের সাহেবঘাটা এলাকার একজন লড়াকু পার্টি কর্মী এবং সমগ্র অঞ্চলে অত্যন্ত সুপরিচিত মানুষ ছিলেন। বেশ কয়েকবার আদিবাসীদের জমি দখলের লড়াই এবং বিভিন্ন স্থানীয় আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে জেলে থাকতে হয়েছিল। তাঁর ব্যাক্তিগত উদ্যোগে সাহেবঘাটা বাজারে একটি পার্টি অফিস তৈরি হয়। বিগত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এআইকেএম জাতীয় সম্মেলনে প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর প্রয়াণে উঃ দিনাজপুর জেলায় পার্টির বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল। কমরেড মকবুল হক লাল সেলাম।
=== 000 ===