আজকের দেশব্রতী : ০২ মার্চ ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
head

we-will-continue-to-strengthen-the-struggle

সিপিআই(এমএল)-এর একাদশ পার্টি কংগ্রেস: ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে এক আলোকবর্তিকা

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একাদশ পার্টি কংগ্রেস দেশের বুকে ফ্যাসিবাদী বিপর্যয়ের মুখে সার্বিক প্রতিরোধের এক আলোকবর্তিকা এবং বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিশা নির্দেশিকা হয়ে উঠেছে। গত ১৫-২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এই মহাধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে বিহারের রাজধানী পাটনায়। বিহারের বুকে নকশালবাড়ির ধারায় কৃষক আন্দোলন তার ভরকেন্দ্র খুঁজে পেয়েছে, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যার অস্তিত্ব ও অগ্রগতি অব্যাহত। যা কিছু প্রগতিশীল সমাজবাদী ধারা ও ঐতিহ্য তার সাথে একাত্মতা গড়ে তুলে সেখানে সামাজিক পরিবর্তনের লড়াই তীব্রতর হয়ে চলেছে। এই বুনিয়াদি কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের জাগরণের ভিত্তিতে জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে বাইরে থেকে অভূতপূর্ব হস্তক্ষেপের বার্তা এই পার্টি কংগ্রেস তুলে ধরেছে। দক্ষিণে কেরলের পরই এখন বিহারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বিধানসভার ভেতরে এবং মাঠে ময়দানের লড়াইয়ে দেশের মধ্যে বৃহত্তর বাম শক্তি। অপরদিকে ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপি হিন্দি বলয়কেই তাদের গৈরিক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র বানাতে চাইছে। সেই রণভূমিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিপিআই(এমএল) গড়ে তুলেছে জনতার প্রতিরোধ, বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির বৃহত্তর ঐক্য। এই প্রেক্ষাপটে আয়োজিত পার্টি কংগ্রেসের সমগ্র অনুষ্ঠানসূচি ছিল বহুমাত্রিক। শুরুতে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, পাটনার গান্ধী ময়দানে সংগঠিত হয় লক্ষাধিক মানুষের মহাসমাবেশ। যা সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, এমন কী সংবাদমাধ্যমগুলি যাকে লিবারেশন তথা ‘মালে’র বর্ধিত শক্তি রূপে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, উদ্বোধনী অধিবেশনে দেশের মূল ধারার সমস্ত বামপন্থী দলগুলির শীর্ষনেতৃত্ব অংশগ্রহণ করেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বামদলগুলির বোঝাপড়াকে রাজনৈতিকভাবে আরও উন্নত করে তোলার লক্ষ্যে এই অধিবেশন খুবই কার্যকরী হয়ে ওঠে।

১৬ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক অধিবেশন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলির পারস্পরিক সংহতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা তুলে ধরেছে। কংগ্রেসের দলিলে উল্লিখিত ‘ফ্যাসিবাদ যখন আরো একবার একটি আন্তর্জাতিক প্রবণতা হিসেবে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে’ ভারতীয় ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ‘আন্তর্জাতিক আবহ যথেষ্ট রণনৈতিক সমর্থন ও বৈধতা যোগাচ্ছে’ তখন এই অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

১৭ ফেব্রুয়ারি, অনুষ্ঠিত হয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ‘দেশ বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’ সেমিনার। যা সিপিআই(এমএল)-এর ইতিহাসে নতুন একটি বিষয়। সম্প্রতি বিহার বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘মহাগাঠবন্ধন’ বা বিজেপি বিরোধী দলগুলির আসন বোঝাপড়ার একটা অনুশীলন চলেছে। পরবর্তীতে বিহারের মাটিতে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সেটি আরও বর্ধিত হয় এবং কার্যকরী ভূমিকা নেয়। এ প্রসঙ্গে পার্টি কংগ্রেসের দলিলে উল্লেখ করা হয় “ফ্যাসিবাদী বিপর্যয় ও ধ্বংসের আবর্তথেকে দেশকে বাঁচানো বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ... এই কর্তব্য অবশ্যই সকল ধারার গণতান্ত্রিক শক্তি ও আদর্শের মধ্যে যতটা সম্ভব ব্যাপকতম ঐক্য ও সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে... আসন্ন নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজেপিকে দুর্বল করতে এবং মোদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সর্বভারতীয় স্তরে এবং প্রধান প্রধান রাজ্যগুলিতে একটি গতিশীল ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বিরোধীপক্ষ গঠন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ” এই রাজনৈতিক দিশায় প্রধানত বিহারের মাটিতে ঐক্য প্রক্রিয়ায় সাথে সংশ্লিষ্ট বিরোধী দলগুলিকেই সেমিনারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন বিরোধীদল কংগ্রেসের জাতীয় স্তরের নেতৃত্ব, আরজেডি, জেডিইউ নেতৃত্ব তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এবং উপমুখ্যমন্ত্রীগণ। বিজেপির বিরুদ্ধে আগামী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক সমঝোতা নিয়ে সকলে চর্চা করেন। সেখানে সিপিআই(এমএল)-এর প্রাসঙ্গিকতা ও বলিষ্ঠ ভূমিকা অত্যন্ত কার্যকরী রূপে সকলের কাছে সমাদৃত হয়। একে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল বিরোধী ঐক্যের এক অনুঘটক রূপেও তুলে ধরেন।

এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা আভ্যন্তরীণ আলাপ আলোচনার শেষপর্বে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “এই সেমিনারে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিরোধী নেতৃবৃন্দ নির্বাচনী বোঝাপড়া নিয়ে নিজেদের কৌশল প্রসঙ্গে পারস্পরিক বার্তালাপ করেছে, ওরা নিজেদের কাজ করেছে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এই প্রক্রিয়া থেকে আমরা বড় ধরনের কোনো সহায়তা পাব না। একমাত্র নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে আমরা যতটা মজবুত সংগঠন গড়ে তুলতে পেরেছি কেবলমাত্র সেই অনুপাতে আমরা সাফল্য পেয়েছি এবং আগামীতেও পেতে পারি।” এ’বিষয়ে পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক দলিলে বলা হয় — “বিরোধী দলগুলির যতটা সম্ভব সার্বিক ঐক্যকে স্বাগত জানানো, সহযোগিতা করা এবং যোগদান করার সাথে সাথে কমিউনিস্টের অবশ্যই রাজনৈতিক মতাদর্শগত স্বাধীনতা সম্পূর্ণত বজায় রাখতে ও প্রয়োগ করতে হবে, যাতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ও কার্য্যকর প্রতিরোধ জারি রাখা যায়। একথা আমাদের হিসবে রাখতে হবে যে বর্তমানে ভারতে যে বিরোধী ঐক্য গড়ে উঠেছে তো এখনো কোনো সাধারণ ফ্যাসি-বিরোধী চেতনা বা প্রতিশ্রুতি দ্বারা নির্ধারিত নয়, অনেক বিরোধী দল আরএসএস-এর বিরোধিতা করতে এবং এর বিবিধ মিথ্যা ও সন্ত্রাসের ভয়ংকর অভিযানকে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত নয়।... মোদী সরকারকে ভোটে হারিয়েই ফ্যাসিবাদকে নির্ধারকভাবে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। যা প্রয়োজন তা হল ফ্যাসিবাদের রাজনীতি ও মতাদর্শের এক জোরদার প্রত্যাখ্যান গড়ে তোলা যা তাকে ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজের প্রান্তে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে... একদম মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগতভাবে লড়তে হবে আমাদের।”

কমরেড দীপঙ্কর আরও বলেন, বিগত সময়কালে পার্টি বিভিন্ন ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এজন্য কোনো ব্যাক্তিগত চর্চা আমরা করিনি৷ যেকোনো সঙ্কট মোকাবিলায় সমগ্র পার্টি সংগঠনকে সচেতন ও সক্ষম করে তোলা, ব্যাপকতম জনগণের কাছে চলে যাওয়ার কর্মনীতি আমরা গ্রহণ করেছি। এভাবে লড়তে লড়তেই আমরা এগিয়ে চলেছি। পূঁজির ক্রমবর্ধমান শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে আমাদের প্রয়োজন সংখ্যার শক্তি। ব্যাপক শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের শক্তি। একে লাগাতার সংগঠিত করা, তাঁদের চেতনার বিকাশ ঘটানো, জীবন্ত গতিশীল গণকাজের ভিত্তিতে সংগঠন গড়ে তোলা — এ পথেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব। বড় বড় আন্দোলন আমরা গড়ে তুলছি, কিন্তু সেই অনুপাতে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির প্রশ্নে দুর্বলতা ঘাটতি আমাদের কাটিয়ে তুলতে হবে।

- জয়তু দেশমুখ

dipankar

dipankar-bhattacharya-was-re-electedপার্টি কংগ্রেসের শেষ দিনে ৭৬ জন সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ও ৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশন নির্বাচিত হয়। পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আরও একবার নির্বাচিত হলেন কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। গত আড়াই দশক ধরে তিনিই সাধারণ সম্পাদক আছেন। কমরেড রাজা বহুগুণা কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন।

কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য সদস্য কমরেডদের মধ্যে আছেন স্বদেশ ভট্টাচার্য, বিহার রাজ্য সম্পাদক কুনাল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, এআইসিসিটিইউ জাতীয় সচিব ভি শংকর ও জাতীয় সভানেত্রী তথা স্কিম ওয়ার্কারস ফেডারেশনের নেত্রী শশী যাদব, তামিলনাড়ু রাজ্য সম্পাদক আসাইতাম্বি, পুডুচেরি রাজ্য সম্পাদক এস বালাসুন্দরম, অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য সম্পাদক এন মুর্তি, সিপিআইএমএল বিহার বিধায়ক দলের নেতা মেহবুব আলম, আসাম রাজ্য সম্পাদক বিবেক দাস, প্রাক্তন জেএনএসইউ ও আইসা প্রেসিডেন্ট সুচেতা দে, উড়িষ্যার রাধাকান্ত শেঠি, কর্ণাটক রাজ্য সম্পাদক ক্লিফটন ডি রোজারিও।

কর্ণাটকের মৈত্রেয়ি কৃষ্ণান, উত্তরাখণ্ডের কৈলাশ পাণ্ডে ও ঈন্দ্রেশ মৈখুরি, প্রাক্তন ছাত্রনেত্রী ও বর্তমানের আশা শ্রমিক ইউনিয়নের নেত্রী স্বেতা রাজ, বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশনের নীরজ কুমার, রাজস্থানের ফারহাত বানো, আইপোয়া নেত্রী ইন্দ্রানী দত্ত, মঞ্জু প্রকাশ, কুমার পারভেজ, নবীন কুমার, প্রকাশ কুমার, সত্যদেব রাম (বর্তমান বিধায়ক) এবং আইসা সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ সৌরভ কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত নির্বাচিত হয়েছেন।

বিশিষ্ট সামাজিক ও আইন সংক্রান্ত আন্দোলনকর্মী/পেশাজীবীদের নিয়ে ‘লিঙ্গ ন্যায় সেল’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্টি কংগ্রেস, যে সেল পার্টির জেলা কমিটির বা তার উপর কোনো কমিটির সদস্যের বিরুদ্ধে যে কোনও মহিলার আনা যৌন হয়রানির অভিযোগ বিচার করে দেখবে। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় স্তরেই এরকম সেল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

১৯.০২.২০২৩-এর আলাপ-আলোচনার শেষে কংগ্রেস পার্টি সংগঠন সংক্রান্ত প্রতিবেদন গৃহীত করে এবং পার্টির সাধারণ কর্মসূচি ও পার্টি সংবিধানে আনা সংশোধনী পাস করে। কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের রিপোর্ট পেশ হয় এবং তারপর নির্বাচন সংগঠিত হয়।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ভারতের সংবিধান ও গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই শক্তিশালী করার কাজ চালিয়ে যাব আমরা।

school

bandonment-of-state-education

গভীর সংকটের বার্তা বহন করে নিয়ে এল এবারের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর দিনই পর্ষদ সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় একটি প্রেস মিটিং’এ জানালেন এ’বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে চার লক্ষ! প্রতিবছরই মাধ্যমিকের তুলনায় উচ্চমাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কম থাকে। এবার হল উলটপুরাণ। মাধ্যমিকে কম, পরীক্ষার্থী বেশি উচ্চমাধ্যমিকে। প্রথিতযশা, বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদরা বারবার সতর্ক করে বলেছিলেন যে, অতিমারী-জনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি হবে শিক্ষার সংকট। এক বছরের মধ্যে চার লক্ষ পরীক্ষার্থী খুইয়ে পশ্চিমবঙ্গ সেই ঘোর তিমিরকালের সঙ্কেত দিল। অতিমারীর সময়ে অনলাইন শিক্ষা যে অধিকাংশ শিশুর কাছে পৌঁছায়নি তার ভূরিভূরি প্রমাণ মেলা সত্ত্বেও কোনও বিকল্প ব্যবস্থা হয়নি। শিশুদের লাগাতার স্কুল-বিচ্ছিন্নতার পরিণাম নিয়ে শিক্ষক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে চারপাশে সেই সুপরামর্শ ঠোক্কর খেতে খেতে মাঠিতেই আছড়ে পড়ে। অবশেষে, শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসবাণী রাজ্যবাসী শুনলেন — এ’বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করবেন বিশেষজ্ঞরা।

শিক্ষা বঞ্চনার একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে আমাদের এই বঙ্গে। শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) — এর দৌড় যেহেতু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, তাই নবম-দশমে শিক্ষা বঞ্চনার চেহারাটা প্রকট হলেও তা নিয়ে নীরব রাজ্য সরকার। আজ রাজ্যের সাড়ে পনেরো হাজার শিশু শিক্ষাকেন্দ্র (প্রি-প্রাইমারী থেকে চতুর্থশ্রেণি) আর ১,৯০০ মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র (পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি) শেষ প্রহর গুনছে। এগুলোর দায় কে নেবে, তা নিয়ে চলছে ঠেলাঠেলি। ২০২০ সালে পঞ্চায়েত দপ্তর সেগুলোকে পাঠিয়েছিল শিক্ষা দপ্তরে — যাতে বঞ্চিত এই স্কুলগুলো ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে। দু’টো বছর চুপচাপ থেকে, হালে শিক্ষা দপ্তর সে ফাইল ফেরত পাঠিয়েছে। পঞ্চায়েতের অধীনে এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষাকেন্দ্র আজ যেন বেওয়ারিশ লাশ!

রাজ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটিও গভীর সমস্যায় জর্জরিত। রাজ্যে ভাষাশিক্ষা প্রসারের অবিসংবাদী অবদান রাখার জন্য রাজ্যের নামী দু’দুটো বিশ্ববিদ্যালয় মহীয়সী মুখ্যমন্ত্রীকে ডিলিট’এর সম্মানে ভূষিত করল (এর পেছনে কতটা সংকীর্ণ প্রাপ্তিযোগের স্বার্থ আর কতটা শিক্ষা প্রসারের স্বার্থ, তা নিয়ে বিতর্ক চলুক)। কিন্তু প্রকৃত বাস্তব — কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় সহ রাজ্যের ন’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্যনেই। অস্থায়ী উপাচার্যের মেয়াদ ফুরিয়েছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও আলিপুরদুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য শুরু থেকেই কার্যভার হাতে নিয়েছিলেন দার্জিলিং হিল বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এখন অভিভাবকহীন। ঝাড়গ্রামে সাধু রামচাঁদ মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদ সবে শেষ হল। স্থায়ী উপাচার্য না থাকায় অতল সমস্যায় পড়েছে এ’রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বহু ঢাক ঢোল পিটিয়ে গড়ে তোলা অন্য দু’তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়।

গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ ক্ষেত্রের হাতে তুলে দিতে প্রকট ভাবে চলছে সরকারী আয়োজন — সর্বময়ীর অনুপ্রেরণায়। জরাজীর্ণ স্কুল বিল্ডিং, অব্যবহারযোগ্য শৌচালয়, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, ভাঙাচোরা আসবাব, শিক্ষা অধিকার আইন মোতাবেক যে দূরত্বের মধ্যে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার কথা তা অমান্য করা, ছাত্র-শিক্ষকের বৈধ অনুপাতকে দলন করা, শিক্ষার পঠন পাঠনকে চূড়ান্ত অবহেলার দিকে ঠেলে দেওয়া — আর এ সমস্ত কিছুর যোগফল হল — সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার বিসর্জন — বেসরকারি শিক্ষা ক্ষেত্রের আবাহন।

এই সংগঠিত সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজ্যবাসীকে রুখে দাঁড়াতেই হবে।

deputy-chief-minister-of-delhi-manish-sisodia

গণতন্ত্রের উপর আরো একবার ঔদ্ধত্যপূর্ণ হামলা বেসরকারি শিক্ষার আবাহনে রাষ্ট্রীয় শিক্ষার বিসর্জন নামিয়ে আনলো মোদী সরকার, প্রতিহিংসার রাজনীতি চরিতার্থ করতে তারা আবারও সিবিআই এবং ইডি’র মতো প্রতিষ্ঠান দুটিকে ব্যবহার করল। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরে দিল্লীর উপ-মুখ্যমন্ত্রী, মণীশ সিসোদিয়াকে তথাকথিত অসহযোগিতার নিতান্ত ক্ষীণ অজুহাতে কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থা সিবিআই গ্রেপ্তার করল।

দিল্লী পৌর নির্বাচনে পরাজিত এবং যেন তেন প্রকারেন মেয়র পদ দখল করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মোদী-শাহ সরকার এখন কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির প্রয়োগে এই অনৈতিক অপব্যবহারের আশ্রয় নিয়েছে। এই সময়টাতে একদিকে যখন সমগ্র বিশ্ব আদানি কেলেঙ্কারির বিষয়ে মোদী সরকারের অস্বাভাবিক মৌনতা ও পর্বতপ্রমাণ কর্পোরেট জালিয়াতির তদন্তে অস্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তখন অপরদিকে সরকার বিরোধীদের আতঙ্কিত করার মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সিপিআই(এমএল) রাজধানী অঞ্চলের নির্বাচিত উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়ার গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা করছে। আমরা দিল্লীর নাগরিকদের তথা বৃহত্তর ভারতের জনগণকে, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির অপব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং গণতন্ত্রের ওপর হামলা নামিয়ে আনার বিজেপির এই নির্লজ্জ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠতে আহ্বান জানাচ্ছি।

সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে               
সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

income-tax-department-search-at-bbc

নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে বিবিসির তৈরি তথ্যচিত্র “ইণ্ডিয়া : দ্য মোদী কোয়েশ্চেন”এর ভারতে প্রদর্শন মোদী সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। তথ্যচিত্রটির সমস্ত অনলাইন লিঙ্ককে তুলে নেওয়া, তথ্যচিত্র নিয়ে করা সমস্ত টুইটগুলোকে মুছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বিজেপি নেতৃবৃন্দ এবং মোদী সরকারের মন্ত্রীরা এই তথ্যচিত্র এবং তার সাথে আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক কার্যকলাপ এবং কারচুপির মাধ্যমে গোষ্ঠীর সংস্থাগুলোর শেয়ারের দামকে উঁচুতে তোলা সম্পর্কে ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’-এর রিপোর্টকে মোদী-বিরোধী চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই মোদী সরকারের বিবিসি-বিরোধী সক্রিয়তা থেমে থাকল না। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ আয়কর দপ্তরের অফিসাররা বিবিসির মুম্বই ও দিল্লী অফিসে হানা দিলেন। টানা তিনদিন (৬০ ঘণ্টারও বেশি) ধরে চলল সেই তল্লাশি। ঐ হানাদারিকে আয়কর দপ্তরের পক্ষে কর ফাঁকির তদন্তে শুধুই ‘সমীক্ষা’ বলে চালানো হলেও সেটা যে বিবিসিকে শিক্ষা দেওয়ারই অভিযান এবং তারসঙ্গে যে মোদী সম্পর্কে বিবিসির তৈরি তথ্যচিত্রের যোগ রয়েছে, তা নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষকেরই বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না। আয়কর দপ্তরের অফিসাররা বিবিসি অফিসে কর্মরত কর্মীদের ফোন ও ল্যাপটপের দখল নিয়ে নেন, কর্মীদের অফিসে আটকে রাখেন, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন বলেও অভিযোগ। কাজের এই ধারাটা ‘সমীক্ষার’ সঙ্গে একেবারেই মেলে না।

এই হানাদারির পর খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে — মোদী সরকার কেন বিবিসি কার্যালয়ে আয়কর দপ্তরকে পাঠালো? ঐ পদক্ষেপের পিছনে কোন অভিসন্ধি সক্রিয় হয়েছিল? ভারতের প্রাধান্যকারী সংবাদ মাধ্যমকে ‘গোদি মিডিয়া’ বা সরকারের বশংবদ সংবাদ মাধ্যমে পরিণত করার পর মোদী সরকার সম্ভবত মনে করছে যে, বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোও তাদের অনুগত হবে, তাদের পছন্দের তথ্য ও সংবাদ পরিবেশনের মধ্যেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত রাখবে। কিন্তু দুনিয়া বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও নেতার বশবর্তী হয় না, এবং মোদী সরকার ও আরএসএস’এর ক্ষেত্রেও তা হওয়ার নয়। বিবিসি দপ্তরে আয়কর দপ্তরের অভিযানের পর বিশ্বের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমগুলি ঐ পদক্ষেপের বিরোধিতায় তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ঐ প্রতিক্রিয়ার কয়েকটির দিকে তাকানো যাক।

বিবিসি’র মুম্বই ও দিল্লী কার্যালয়ে আয়কর দপ্তরের তল্লাশি সম্পর্কে দ্য নিউ ইয়র্কটাইমস তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, “মোদীর অধীনস্থ ভারতীয় কর্তৃপক্ষসমূহ প্রায়ই স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার গোষ্ঠী ও চিন্তাবিদদের বিরুদ্ধে এই ধরনের তল্লাশি চালিয়েছে, যেটাকে আন্দোলনের কর্মীরা বলে থাকেন অর্থ সংস্থানের উৎসগুলোকে নিশানা বানিয়ে হয়রানি ঘটিয়ে সমালোচনামূলক কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা।” দ্য টাইমস পত্রিকার প্রতিক্রিয়া হয়েছে এই রকম — “করপোরেশনটির উপর হামলার মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদীর ভারত গণতান্ত্রিক রীতি থেকে আরও বিচ্যুত হয়েছে।” আর, দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা আয়কর দপ্তরের তল্লাশিকে সরকারের আক্রোশের প্রকাশ বলতেও দ্বিধা করেনি — “এই সপ্তাহে দিল্লী ও মুম্বই অফিসে একাধিক দিন ধরে তল্লাশি দেখা গেল করপোরেশনটির বিরুদ্ধে সরকারের হম্বিতম্বি এবং দাঙ্গায় তাঁর ভূমিকা ও মুসলিমদের প্রতি তাঁর আচরণ নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রকে নিষিদ্ধ করার কয়েক সপ্তাহ পর। কর্তৃপক্ষ বলছেন এটা গতানুগতিক কাজ। তবে, ভারতে অনেকেই এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, বাঁধাধরা আমলাতান্ত্রিক কার্যপদ্ধতির পরিবর্তে এটা প্রতিহিংসার চরিতার্থতা বলেই দেখাচ্ছে।” ভারতের এডিটার্স গিল্ডও তল্লাশির নিন্দায় বলেছে, “আয়কর দপ্তরের সমীক্ষা সরকারি সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে সরকারের নীতি বা শাসক প্রতিষ্ঠানের সমালোচনামূলক সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে চোখ রাঙানো প্রবণতার ধারাবাহিকতার সঙ্গে সুসংগত বলেই দেখা যাচ্ছে।”

বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলো এইভাবে সুস্পষ্ট রূপে জানিয়ে দিয়েছে এবং ভারতের পর্যবেক্ষকদেরও এই ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ নেই যে, বিবিসি কার্যালয়ে আয়কর দপ্তরের তল্লাশি কখনই বাঁধাধরা কাজ ছিল না। তা ছিল মোদীর সমালোচনা করে তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য বিবিসিকে শিক্ষা দেওয়ারই এক উদ্যোগ। এছাড়া, নিজের ৫৬ ইঞ্চি ছাতি নিয়ে মোদীর অহমিকা অপরিমিত, সেই প্রশস্ত ছাতিও বিবিসির বিরুদ্ধে হুমকির আস্ফালনে তাঁকে প্ররোচিত করে থাকবে। বিজেপি নেতারা বলছেন যে, সুপ্রিম কোর্ট যখন গুজরাট গণহত্যার সমস্ত দায় থেকে মোদীকে অব্যাহতি দিয়েছে, তখন সেই আখ্যানকে আবার উস্কিয়ে তোলার কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সব রায়ই কি ন্যায় বিচারকে প্রতিপন্ন করে? সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে সমালোচনা কি একেবারেই বিরল ঘটনা? সুপ্রিম কোর্টের প্রথিতযশা এক আইনজীবী সম্প্রতি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে এখনে এমন কিছু আইনজীবী আছেন যাঁরা ঐ পদের যোগ্য নন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাই কি সে কথা জানান দেননি? স্মরণ করুন ২০১৮’র জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলনের কথা, যেদিন তাঁরা সরকারকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সংবেদনশীল মামলাগুলো বিচারপতি অরুণ মিশ্রর কাছে পাঠানোর জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। স্মরণ করুন একদা বিচারপতি রঞ্জন গগৈ’এর কথা, যাঁর নেতৃত্বে অযোধ্যা মামলার রায় হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে গেছে এবং যিনি অবসর নেওয়ার পরপরই বিজেপি তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসাবে মনোনীত করার ব্যবস্থা করে। বিচার করুন এ’বছরের ৪ জানুয়ারি অবসর নেওয়া বিচারপতি আব্দুল নাজিরকে ১২ ফেব্রুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল রূপে পুরস্কৃত করার কথা। আব্দুল নাজির ছিলেন অযোধ্যা মামলার বেঞ্চের অন্যতম বিচারপতি, যে মামলার রায়ে আরএসএস’এর হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের জমিকে রাম মন্দির বানানোর জন্য হিন্দুত্ববাদীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই বিচারপতিরা রায় দিলে সেই সমস্ত রায় নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না? বিজেপি চাইলেও সবচেয়ে বেদনাময় ও ভয়াবহ গণহত্যার অন্যতম ২০০২’র গুজরাটে মুসলিম সম্প্রদায়ের নিধনকে কি আমরা ভুলে যাব? ভুলে যাওয়া কি আদৌ উচিৎ? এই জন্যই বিজেপি নির্মিত তথ্যচিত্রের এত আকর্ষণ, সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও যে তথ্যচিত্র দেখতে জনগণের উৎসাহে ও আগ্ৰহে একেবারেই ভাটা নেই। আর, এই প্রশ্নটাও সংগতভাবেই ওঠে যে, আয়কর দপ্তরের তল্লাশির পিছনে অন্যতম যে উদ্দ্যেশ্য মোদী সরকারের ছিল তা কি পূরণ হয়েছে? বিবিসি কি মোদী সরকারের হাবভাবে খুব সন্ত্রস্ত হয়ে গেছে? বিবিসি’র ডাইরেক্টর জেনারেল টিম ডেভি জানিয়েছেন, “ভীত না হয়ে বা পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে সংবাদ পরিবেশনের আমাদের সামর্থ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না।” বিবিসি অতএব জানিয়ে দিল, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন থেকে কোনো কিছুই তাদের নিবৃত্ত করতে পারবে না। ভারতেও যেমন বিভিন্ন সংবাদপত্রের অফিসে আয়কর দপ্তরের হানাদারি সত্ত্বেও গোদি মিডিয়ার পাশাপাশি ছোটো হলেও সংবাদ মাধ্যমের একটা অংশ নির্ভিক সংবাদ পরিবেশনের পথে অবিচল রয়েছে। আর একটা বিষয়ও এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। মোদী সরকারের কাছে অনভিপ্রেত হলেও দুনিয়ার দেশগুলোর কাছে মোদী সরকারের গণতান্ত্রিক নিষ্ঠার স্বরূপ আগাগোড়া উন্মোচিত হয়ে গেল। ভারত এবার জি-২০র সভাপতি হওয়ায় ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত হল জি-২০ গোষ্ঠীর অর্থমন্ত্রীদের বৈঠক। তাঁরা যেমন মোদীকে নিয়ে বিবিসি নির্মিত তথ্যচিত্রকে জানলেন, তেমনি ঐ তথ্যচিত্রের বদলা স্বরূপ ভারতে বিবিসির কার্যালয়ে আয়কর দপ্তরের তল্লাশি সম্পর্কেও অবহিত হলেন। তাঁরা আরও জ্ঞাত হলেন যথেষ্ট চর্চিত এই অভিমত সম্পর্কে যে, যারা ভারত থেকে ঔপনিবেশিক শাসকদের দূর করতে কোনো অবদানই রাখেনি, তারাই মোদী ও সংঘ পরিবার সম্পর্কে যেকোনো সমালোচনাকে ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা প্রসূত’ বলে লাগিয়ে দিতে উন্মুখ। মোদী এখন এই প্রচারে সোচ্চার হন যে, ভারত হল ‘গণতন্ত্রের জননী’। সেই জননী বিশ্বের দরবারে জুলুমবাজ রূপেই প্রতিভাত হলেন!

- জয়দীপ মিত্র

international-women's-day

নারীর স্বার্থবিরোধী কর্পোরেট হিন্দুত্ব হিংসার উপর আঘাত হানো!

বিগত শতাব্দী জুড়ে, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, অর্থাৎ, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে, নারীর আত্মঘোষণাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে। এই দিনটি নারীর অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামের প্রতীক। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম থেকে শক্তি নিয়ে, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন নারীরা এই দিনটিকে সামনে রেখে জীবিকা, সমতা ও ন্যায়ের দাবিতে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শানিয়েছেন।

বিশ্বজুড়ে, ফ্যাসিবাদের উত্থানের সাথে ইতিহাসের চাকা আজ পিছন দিকে ঘুরছে। বহু রক্ত আর ঘাম দিয়ে আদায় করা ৮ ঘণ্টার কাজের অধিকারের উদযাপন, যা পরে সাম্যবাদী আন্দোলন দ্বারা নামাঙ্কিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে, আজ ফ্যাসিবাদ আর কর্পোরেট শক্তিদের যোগসাজগে চাপিয়ে দেওয়া লেবার কোডের দ্বারা লঙ্ঘিত। সমকাজে সমমজুরি (যা কর্মক্ষেত্রে, লিঙ্গভিত্তিক সমতা নিশ্চিত করার জন্য আশু প্রয়োজন) লাগু করার বদলে, লেবার কোডের বিধান, মজুরির বৈষ্যম্যকে প্রকট করছে। বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়া (যেমন, এন্ড্রোয়েড ফোনের মাধ্যমে প্রত্যেকদিন ডিজিটাল এটেন্ডেন্স নিশ্চিত করা) বাধ্যতামূলক বানিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে, অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত বৃহৎ অংশের মেয়েদের মনরেগা প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ পাওয়ার সুযোগকে দুর্লভ করে দেওয়া হয়েছে, যদিও মনরেগা প্রকল্পের উদ্দ্যেশ্য গ্রামীন গরিব, খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য জীবিকা নিশ্চিত করা। ভারত জুড়ে, লাখ, লাখ মেয়ে, মিড-মে মিল, আশা, অঙ্গনওয়ারী কর্মী হিসাবে, বিভিন্ন সরকারী স্কিমের আওতায় কাজ করছে এবং প্রত্যহ সমাজের উন্নতির জন্য শ্রম দিচ্ছে। অথচ, এদের পারিশ্রমিক হিসাবে এদের হাতে ঠেকানো হচ্ছে নামমাত্র টাকা। সরকারী কর্মী হিসাবে স্বীকৃতিও পাচ্ছে না এরা, যার ফলে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছে। এরাই সেই শ্রমিক, যারা কোভিড মহামারীর সময় নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে, তৃণমূল স্তরে, স্বাস্থ্য পরিষেবা, ভ্যাকসিনেশন পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছিলো। স্যানিটাইজেশন কর্মীদের মধ্যে একটি বৃহৎ অংশই নিপীড়িত জাতির মেয়েরা। এরা পৌরসভার আওতায় দেশের রাস্তা-ঘাট পরিষ্কারের কাজ করে, কিন্তু মোদীর ‘স্বচ্ছ-ভারতে’ এদের নূন্যতম মজুরি ও কাজের স্থায়ীকরণ আজও নিশ্চিত নয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেমন, পোশাক রপ্তানি বা ইলেক্ট্রনিক পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলিতে, মেয়েরা চুড়ান্তভাবে শোষিত হয় এবং সবচেয়ে কম মজুরি পায়। কাজের জায়গায়, শৌচালয়, ক্রেস, মাতৃত্বকালীন ছুটির মতো বুনিয়াদি অধিকারগুলি পান না তারা। সম্প্রতি, মাসিক ঋতুস্রাবের সময় ছুটির জন্য, পড়ুয়া ও শ্রমজীবী মহিলারা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল, কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে, নীতি- নির্ধারকদের দিকে সিদ্ধান্তটি ঠেলে দিয়েছে। আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, মন্দা ও জিএসটির ভারে, গরিব মানুষদের জীবন খাদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে গরিব মেয়েরা, যাদের ভাগে পড়ছে সবচেয়ে কম মজুরি ও অসুরক্ষিত জীবিকাগুলি।

অন্যদিকে, বহু আন্দোলনের ফলে অর্জিত মেয়েদের স্বায়ত্বতা ও স্বাধীনতার অধিকারগুলির উপর হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির ক্রমাগত আক্রমন চালাচ্ছে, কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের লজ্জা যে, বিলকিস বানোকে গর্ভবতী অবস্থায় ধর্ষণ করে, তার সামনেই, তার পরিবারের ১৪ জন সদস্য ও তিন বছরের শিশুকে গুজরাত গণহত্যার সময় খুন করার পর, প্রমাণিত গণধর্ষক ও খুনীদের, ‘সংস্কারী’ ব্যবহারের নামে বেকসুর খালাস করা হচ্ছে, ফুল, মালা, মিস্টি দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হচ্ছে।

ধর্ম পালনের সংবিধান স্বীকৃত অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। কর্ণাটকে হিজাব পরিহিতা পড়ুয়াদের উপর আক্রমণ, ইউনিফর্ম সিভিল কোডের নামে মৌলবাদী হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা, প্রকাশ্যে আজান দেওয়ার উপর বিধিনিষেধ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য প্রকাশ্য মিছিল, সমাবেশ, দিল্লী, উত্তরপ্রদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া, গরু-পাচার রোখার নামে স্ব-ঘোষিত গো-রক্ষকদের দ্বারা মুসলিম যুবকদের জ্বালিয়ে, পিটিয়ে মেরে ফেলা ও ভিডিও তুলে সগর্বে এই হত্যার প্রচার – এসবই ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ফ্যাসিবাদী মোদী সরকারের আগ্রাসনের নমুনা।

বর্তমান ভারতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আঘাত, নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে। কিছু সাম্প্রতিক উদাহরণ, “ভারত : মোদী প্রশ্ন” নামের বিবিসির তথ্যচিত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা, জনপ্রিয় লোকগায়িকা নেহা সিং রাঠোরকে উত্তরপ্রদেশে বুলডোজার-রাজের সমালোচনা করে ‘ইউপি মে কা বা’ (অর্থাৎ “ইউপি-তে কী চলছে) গান গাওয়ার জন্য পুলিশের নোটিশ ও হয়রানি, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের হুমকি, দেশদ্রোহের দায়ে জেলে ভরা। সনাতন ধর্মের ধ্বজাধারীদের ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিবিদ্বেষের আক্রমনের মুখে সবচেয়ে বেশি পড়ছে ভারতের মেয়েরা। যেমন, সম্প্রতি ১৪ই ফেব্রুয়ারি, প্রেম দিবসকে, গরু জড়িয়ে ধরার দিবস ঘোষণা করেছিল ভারতের অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার বোর্ড। মেয়েদের শরীর নিয়ন্ত্রনে নীতি-পুলিশি উত্তরোত্তর বাড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও পরিবার জুড়ে। মেয়েদের স্বায়ত্ততার অধিকার আজ চরম বিপন্ন।

বিগত ৪০ বছর ধরে, ভারতের নারী-আন্দোলন চেষ্টা করছে মেয়েদের উপর সামাজিক হিংসাকে প্রতিহত করার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ও বিভিন্ন ধরনে এই হিংসা হয়ে থাকে। যেমন, বাড়িতে, কাজের ক্ষেত্রে বা রাস্তায়। বিভিন্ন আইন আসা সত্ত্বেও, এই হিংসাকে প্রতিহত করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ভারতের গণতন্ত্র চুড়ান্তভাবে ব্যার্থ তার নাগরিকদের, বিশেষ করে, মেয়েদের সুরক্ষা দিতে। প্রতিটি সামাজিক ক্ষেত্র, যেমন, ধর্মীয়, শিক্ষাঙ্গন, কর্মক্ষেত্র, বিনোদন জগত, প্রতিটি জায়গায়, মেয়েদের আক্রমনের নিশানা বানানো হচ্ছে। দীর্ঘ ৪০ বছর পরেও ভারতে শ্রদ্ধা কাপুরের হত্যার মতো নির্মম ঘটনা ঘটছে। দিল্লীতে নির্ভয়া কাণ্ডের পর মেয়েদের উপর হিংসা বন্ধ করার জন্য ভার্মা কমিটির দেওয়া সুপারিশগুলি আজও লাগু হয়নি। যেমন, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট, সবকটি সংগঠিত ও অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে যৌন-হেনস্থা বন্ধ করার জন্য হেনস্থা-বিরোধী কমিটির মতো ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। সবকটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যেমন, বিচার বিভাগ, আইনসভা, মিডিয়া হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর পিতৃতান্ত্রিক ফতোয়া জারি করার কাজ করছে। কারণ, বর্তমান সময়, মৌলবাদী ফ্যাসিস্টদের অমৃতকাল!

আসুন, আমরা একত্রিত হই, কর্পোরেট হিন্দুত্ব আঁতাতের ফ্যাসিবাদী হিংসার বিরুদ্ধে সংগঠিত হই।

আমাদের দাবি,             
১। সমকাজে সমমজুরি চাই             
২। স্থায়ী কাজ চাই, আশা, অঙ্গনওয়ারী, মিড-ডে-মিল, স্যানিটাইজেশন, রন্ধন কর্মীসহ সমস্ত শ্রমজীবী মেয়েদের জন্য ন্যুনতম মজুরি চাই             
৩। মনরেগা প্রকল্পের আওতায়, বছরে ২০০ দিনের কাজ ও কাজের আবেদন করার জন্য সুবিধাজনক প্রক্রিয়া চাই              
৪। বিলকিস বানোর জন্য ন্যায় চাই             
৫। প্রতিটি জেলায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গঠন করা চাই             
৬। সংগঠিত ও অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্থা বিরোধী কমিটি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গ সচেতনতামূলক সেল চাই

ফ্যাসিবাদ, পিতৃতন্ত্র, ধর্মীয় মৌলবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও কর্পোরেট-হিন্দুত্ববাদের আঁতাতের বিরুদ্ধে লড়ো!             
সাম্যকে আপন করো!

21st-february-in-halisahar

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের ৭২ বছরে, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের অন্যতম সংগঠন হালিসহর সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রতি বছরের মতো এবারেও ২১শে ফেব্রুয়ারি এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংগঠিত করে। এদিন সন্ধ‍্যায় অনুষ্ঠানটি হয় সংস্থার সভাঘরে। শুরুতে শহীদ বেদীতে ফুলমালা শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শ্রী সুবিকাশ মিস্ত্রী সংকলিত ‘বাংলা প্রবাদ প্রবচনের সমাহৃতি’ নামক পুস্তকটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। সংকলক তাঁর এই কাজটি সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং তীর্থঙ্কর চন্দ, সন্দীপ রায়, প্রিয় গোপাল বিশ্বাস ও সাগর চ্যাটার্জী পুস্তিকাটি সকলের সামনে তুলে ধরেন। এরপর তীর্থঙ্কর চন্দ মহাশয় ‘ভাষার রাজনীতি ও রাজনীতির ভাষা’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় সহজ সরল ভাষায় বিষয়ের ওপর গভীর আলোকপাত করেন। সন্দীপ রায় তাঁর নিজের লেখা গল্প পড়ে শোনান। তুষার ও শাম্ব বাংলা ভাষাকে স্মরণ করে এক অনবদ্য আবৃত্তি পরিবেশন করেন। অসিত আচার্য বাংলা ভাষাকে হৃদয়ে লালন করে ছোট্ট পরিসরে এক অসাধারণ দৃশ্যায়ণ পরিবেশন করেন। স্বাগতা ও তাঁর দলের আবৃত্তি উপস্থাপনা সকলকে মোহিত করে। রীতা কুন্ডুর আবৃত্তি এক অন্য মাত্রা এনে দেয়। সংস্থার পক্ষ থেকে সংগীত পরিবেশন করা হয়। হালিসহর বিজ্ঞান পরিষদ রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে। সংস্থার ঘরকে উপযুক্ত অলঙ্কৃত করেছিলেন বিশ্বজিৎ পান, অর্নব চক্রবর্তী ও আকাশ চট্টোপাধ্যায়।

এই সুন্দর অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অর্ণব চক্রবর্তী, স্বগতা মল্লিক ও রণজয়।

- সাগর চট্টোপাধ্যায়

struggle-against-fascism ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সিপিআই(এমএল)-এর একাদশ পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধি সম্মেলনের প্রথম দিন সম্মেলনকক্ষের ভেতরে দেশের বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে শুরু হয় উদ্বোধনী পর্ব। সভাপতিত্ব করেন কমরেড স্বদেশ ভট্টাচার্য এবং পরিচালনা করেন কমরেড মীনা তেওয়ারি। উপস্থিত ছিলেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (সিপিআইএমএল), জি দেবরাজন (ফরওয়ার্ড ব্লক), মনোজ ভট্টাচার্য (আরএসপি), অরূপ চ্যাটার্জী (এমসিসি), পল্লব সেনগুপ্ত (সিপিআই), মহম্মদ সেলিম (সিপিআইএম), ভীমরাও বানসোর (লাল নিশান পার্টি), কিশোর ধামালে (সত্যসাধক কমিউনিস্ট পার্টি), মঙ্গতরাম পাসলা (আরএমপিআই)। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নেপালের ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট (ইউএমএল) পাটির সহ সভাপতি ঈশ্বর পোখরেল, বিশিষ্ট অধ্যাপক ওপি জয়সওয়াল প্রমুখরা।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁর বক্তব্যে বলেন যে এখনো অবধি আমাদের পার্টির সবচেয়ে বড় পার্টি কংগ্রেস এটা। আমরা দেখেছি আমাদের পার্টি শুধু নয়, গোটা বিহারের জনগণেরই এই সম্মেলন নিয়ে আগ্রহ ও উৎসাহ আছে। এজন্য বিহারের জনগণকে ধন্যবাদ। নেপালের ইউএমএল ও আমাদের দেশের বামপন্থী বিভিন্ন পার্টির নেতৃত্ব আমাদের মঞ্চে এসেছেন। তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আগ্রাসী পুঁজিবাদ ও জলবায়ু সঙ্কট গোটা বিশ্বকেই আক্রমণ শানাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে সংগ্রামী জনগণের ঐক্য প্রয়োজনীয়। ২০১৪ থেকে আমাদের দেশ মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদের একের পর এক নিদর্শন দেখছে। সাম্প্রতিকটি সদ্য দেখা গেল বিবিসি’র গুজরাট দাঙ্গা কেন্দ্রিক তথ্যচিত্র নিয়ে। আইটি আইন দিয়ে তার প্রদর্শন আটকানো হল। তারপরেই ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের রেইড হল দিল্লীর বিবিসি অফিসে। সরকার ক্রমশ বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আমাদের দেশে সামাজিক বৈষম্য তো আছেই। আর্থিক বৈষম্য ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। এর প্রতিকারে ট্যাক্স ব্যবস্থার রদবদল দরকার ছিল। গরিবকে সবচেয়ে বেশি ট্যাক্স দিতে হয়। এবারের বাজেটেও সব ছাড় বড়লোকদেরই বেশি করে মিলল। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যা হচ্ছে তাকে আটকানোর জন্য একদিকে আক্রমণ অন্যদিকে ঘৃণার চাষ বাড়াচ্ছে সরকার। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শাসন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিচার ব্যবস্থাকে দখল করার চেষ্টা হচ্ছে।

সম্পত্তির ঘনীভবন, শাসনের ঘনীভবন দেখা যাচ্ছে। একজোট হয়ে লড়লে ২০২৪-এ মোদী সরকারকে হারানো যাবে হয়ত। কিন্তু আরএসএস যে ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশের ওপর তার বিরুদ্ধে লম্বা লড়াই দরকার। এই লম্বা ও সবচেয়ে শক্তিশালী লড়াইয়ের জন্য বাম ঐক্য খুব জরুরি। বামেরা ঐক্যবদ্ধভাবে শক্তিশালী লড়াই শুরু করলে তা সরকার বদলের প্রেরণা দিতে পারে। বুনিয়াদী মানুষের লড়াই-ই ওপরের লড়াইকে শক্তি দিতে পারে। আমাদের সম্মেলন এই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়েই চর্চা করতে চলেছে। ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত বোঝাপড়া ও তার বিরুদ্ধে লড়াই এবং জলবায়ু আন্দোলনের বিষয় নিয়ে আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে চর্চা করব সম্মেলনে। বুনিয়াদী মানুষের সমস্ত আন্দোলন নিয়ে চর্চা হবে। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদ থেকে দেশকে মুক্ত করার সংকল্প গ্রহণের সম্মেলন এটা।

ঈশ্বর পোখরাল (ইউএমএল, নেপাল) বলেন নেপালে এখন কোনও দলের একক গরিষ্ঠতা নেই। আমরা নেপালের সবচেয়ে সামনের দল হিসেবে সামনে এসেছি। জনতার রায়কে মর্যাদা দিতে আমরা বাম ঐক্য গঠনের চেষ্টা করেছি এবং তার মধ্যে দিয়ে সরকারকে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছি। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ও তাদের ন্যায্য সুযোগ সুবিধা প্রদানের চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। সমৃদ্ধ নেপাল, সুখী নেপাল গঠনই আমাদের লক্ষ্য। সংবিধান সভার মাধ্যমে নেপাল তার সংবিধান পেয়েছে। জনগণকে তার দেওয়া আশ্বাসগুলি রূপায়ণ ও পালনে আমরা বদ্ধ পরিকর।

পল্লব সেনগুপ্ত (সিপিআই) বলেন গোটা বিশ্ব জুড়েই আগ্রাসী পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের থাবা দেখা যাচ্ছে। পরিবেশের সঙ্কট প্রতিদিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এইরকম একটা সময়েই আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরেই ফ্যাসিবাদের আক্রমণ বাড়ছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা কমছে। বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষীগত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। দক্ষিণপন্থী ও অতি দক্ষিণপন্থীরা ছায়াযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। মনুবাদী আরএসএস’এর আক্রমণের সামনে দলিত, আদিবাসী, নারী ও সমাজের নানা অংশ বিপদের সম্মুখীন। আমি আপনাদের খসড়া দলিল পড়েছি ও এরসঙ্গে একমত। বামেরা যদিও প্রাণপণে লড়াই করছে তবুও ফ্যাসিবাদকে হারাতে সেটাই যথেষ্ট নয়। ফ্যাসিবাদকে হারাতে বামেদের অন্যান্য শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। আমরা মনে করি ভারতে কমিউনিস্ট ঐক্য সময়ের দাবি। আমরা আশা করি সিপিআই(এমএল) তার শক্তি বাড়াবে এবং বাম ঐক্যকে শক্তিশালী করবে। হো চি মিন’এর কথা দিয়ে শেষ করব। বড় ঐক্য বড় সাফল্যের সূত্র।

মহম্মদ সেলিম (সিপিআইএম) বলেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর ফ্যাসিস্ট আরএসএস দ্বারা এখন দেশ শাসিত হচ্ছে। মোদী সরকার স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিস্ট আক্রমণ নামিয়ে আনছে। হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শকে ধ্বংস করতে চাইছে। সংবিধান ও জনগণের মৌলিক অধিকারের ওপর আক্রমণ শানাচ্ছে। চারটি শ্রমকোডের মধ্যে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির ওপর তারা আক্রমণ নামিয়েছে। তিনটি কৃষি আইনের মধ্যে দিয়ে কৃষি ও কৃষকের ওপর আক্রমণ নামানোর চেষ্টা করেছিল।

সাম্প্রতিক বাজেটে মনরেগার বরাদ্দ কমেছে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নানারকম আক্রমণ নামছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই হামলা বেশি। মনুবাদি আক্রমণ নামছে মহিলাদের ওপর, দলিত আদিবাসীদের ওপর। নব্য উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই চলছে। সিএএ আইনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণী শ্রমকোডের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক লড়াই এই আইন বাতিলে সরকারকে বাধ্য করেছে। সমস্ত ধরনের বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

অরূপ চ্যাটার্জী (এমসিসি) বলেন যে সমস্ত প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা সহ সর্বত্র আরএসএস’এর চিন্তাধারার লোককে বসানোর চেষ্টা করছে মোদী সরকার। গোটা দেশকে এই বিচারধারার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এর বিরুদ্ধে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আমি আশা করি গোটা দেশে একটি দলে সব বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হবেন।

মনোজ ভট্টাচার্য (আরএসপি) বলেন আমি হিন্দিতে ততটা সড়গড় নই। তবু হিন্দিতে বলার চেষ্টা করছি। হিন্দির বিরুদ্ধে আমরা কেউ’ই নই। কিন্তু হিন্দি হিন্দুস্থানকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। হিন্দিকে গোটা দেশে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ইতিহাসকে নতুন করে লেখার চেষ্টা চলছে। ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। জনগণের সঙ্গে শাসকের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। শুধু বাম ঐক্য বড় কথা নয়। বড় কথা জনতার ঐক্য। জনতার ঐক্য ভাষণের মধ্যে দিয়ে হয় না। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে হয়। বামেরা জনগণের ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে পারেন। হিন্দুদের মধ্যে ৩৫৩৯ সম্প্রদায় আছে। এই ভিন্নতাকে মোদী-শাহরা মানতে চায় না। তাদের হিন্দুত্বের ধারণায় তারা সবকিছুকে একরঙা দেখতে চায়।

জি দেবরাজন (ফরওয়ার্ড ব্লক) বলেন যে সম্পত্তির সমানাধিকারের কথা ছেড়ে দেওয়া যাক, সামান্য কিছু অধিকারও দেশের গরিব মেহনতি মানুষ পাচ্ছে না। অথচ সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা যুক্ত করা আছে। আছে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, যার ওপর প্রতিদিন আক্রমণ নামছে। এইসবের বিরুদ্ধে বামেদের লড়াইতে আমাদের খামতিগুলি খতিয়ে দেখতে হবে। সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে লাল ঝাণ্ডার তলায় শ্রমিকরা লড়ছে। নির্বাচনের ময়দানে তাদের ভোট বামেরা পাচ্ছে না। বামেদের নিজেদের মধ্যে ঐক্যের অভাবও একটা সমস্যা। চেষ্টা করতে হবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হবার। আমাদের জাতীয় সম্মেলনও আসন্ন। সেখানেও আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে আন্তরিকভাবে চর্চা করব।

ভীমরাও বানসোর (লাল নিশান পার্টি) বলেন বিজেপি মূলত হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে শাসনে টিঁকে থাকে। সেই বিভাজনের নকশাকে ধ্বংস করতে হবে বামপন্থীদের।

মঙ্গতরাম পাসলা (আরএমপিআই) বলেন যে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে শুধু নয়, স্বাধীনতার পরেও জনগণের আন্দোলনের স্বার্থে সবচেয়ে বেশি আত্ম বলিদান বামপন্থীরাই করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বামপন্থীদের দুর্বলতা কেন, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। কমিউনিস্ট আন্দোলন কীভাবে এগোবে সে বিষয়ে চর্চার সঙ্গেই বামপন্থীদের দুর্বলতা নিয়ে চর্চার প্রশ্নটি জড়িত। সমস্ত বামপন্থী দলের একসঙ্গে বসে এই নিয়ে গভীর চর্চা দরকার।

রুটি-রুজির লড়াই করতেই হবে। কিন্তু তা যেন অর্থনীতিবাদে আটকে না যায় সেটা বামেদের দেখতে হবে। রাজনীতিকরণ খুব জরুরি একটা কাজ, যেখানে কিছু সমস্যা থেকে যাচ্ছে।

গোটা দেশে সব বামপন্থী দল মিলে একটি সম্মেলন করা হোক — এই আমার অনুরোধ। দেশের সামনে যে বড় সঙ্কট তার মোকাবিলার পথ একসঙ্গে বসে ঠিক করা হোক।

ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলনের বার্তা রেখে উদ্বোধনী পর্বটি সমাপ্ত হয়।

women-in-party-congresses একাদশ পার্টি কংগ্রেসে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও দেশ-বিদেশের অতিথিদের মধ্যে মহিলাদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। অরুন্ধতী রায়ের মতো প্রখ্যাত লেখিকা ফ্যাসিস্ট-রাজ বিরোধী লড়াই ও সিপিআই(এমএল)-এর পার্টি কংগ্রেসের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করেন। ফ্যাসিবাদকে রুখতে জাতপাত বিরোধী লড়াই ও পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইকে একসাথে চালাতে হবে বলে তিনি মত দেন।

পার্টি ও মহিলা আন্দোলনের নেত্রীদের মধ্যে কমরড মিনা তেওয়ারি, কমরেড শশী যাদব, কমরেড সুচেতা, অধ্যাপিকা ভারতী এস কুমার, ডঃ রতি রাও মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন ১৪ শতাংশ। এসেছিলেন মধ্যবিত্ত, গ্রামীণ কৃষিমজুর, আশা, মিড-ডে-মিল কর্মী, অঙ্গনওয়ারী কর্মী, শিক্ষিকা, ছাত্রী, গবেষক এবং আদিবাসী, সংখ্যালঘু, দলিত ও অন্যান্য অংশের অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী, স্তর, বর্গের মহিলারা। বিভিন্ন বয়সের প্রতিনিধিরা ছাড়া এক ঝাঁক তরুণ প্রজন্মের মেয়েরা মঞ্চে এবং সম্মেলনের বিভিন্ন কাজে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে বা অনুবাদকের কাজে যে নিরলস পরিশ্রম করেন তা সত্যিই উল্লেখযোগ্য। মঞ্চে, প্রেসিডিয়ামের কাজেও মহিলাদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছিল সন্তোষজনক।

বক্তব্য ছাড়াও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে সঙ্গীতে, নৃত্যে পারদর্শিতার সাথে অংশ নিয়ে মহিলা সাথীরা মহাধিবেশনকে এক বিশেষ মাত্রা দিতে সাহায্য করেছেন। মীরা চতুর্বেদির গাওয়া ‘স্বপ্ন দেখো না’ শ্রোতাদের আবিষ্ট করে, আবার বাংলার মেয়েদের সমবেত কণ্ঠে নারী মুক্তি, শোষণ মুক্তির গান সম্মেলনকে উদ্দীপ্ত করে। জয়শ্রী দাস ও সাথীদের ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি’ সঙ্গীতের নৃত্য পরিবেশন উৎসাহ ব্যঞ্জক।

বাংলা, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের মহিলা সাথীদের আদিবাসী নৃত্য ‘গাও ছোড়োগ নেহি, জঙ্গল ছোড়োগ নেহি’ কিংবা কারো ‘জোহার’ স্লোগানে উঠে আসে জাতিসত্ত্বার দৃঢ় প্রত্যয় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ার আবাহন। আবার কারো ভাষ্যে উঠে এসেছে ফ্যাসিবাদের সাংস্কৃতিক প্রচার অভিযানের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সাংস্কৃতিক বিকল্প গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা।

সমাজের বিভিন্ন নিপীড়িত অংশ থেকে উঠে আসা নারীদের বক্তব্যে ছিল বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারীদের আত্মঘোষণার সংশ্লেষ, কেউ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর লড়াই’এর উল্লেখ করেছেন। কলকাতার ছাত্রী ত্রিয়াশা শহরে, জনবসতিতে জনশিক্ষার উদ্যোগের মাধ্যমে সংগঠনের বিস্তার এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার প্রয়াসের কথা বলেছেন। কেউ বা প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের লড়াইকে কমিউনিস্ট ধারার আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরেন।

বর্তমান সময়ে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল পার্টি কংগ্রেসে।

দেশজুড়ে বিভিন্ন লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তা সে মজুরির দাবিতেই হোক, জমির লড়াই’এই হোক, পিতৃতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধেই হোক, নারীর উপর চেপে বসা দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-অসাম্যের বিরুদ্ধে মহিলাদের অধিকার, হক ও মর্যাদার দাবিতে সমাজে, ঘরে বাইরে, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র মেয়েদের এগিয়ে আসার প্রবণতা ও সচেতন অগ্রগতি আরো সুনির্দিষ্টভাবে পাটি কংগ্রেসের অধিবেশনের বিভিন্ন পর্বে পরিলক্ষিত হল।

শুধু বাইরের জগতে কথায়, ভাষণে প্রগতিশীল কথাবার্তা নয়, ব্যক্তি জীবনেও কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও রাজনীতির অনুশীলন, লিঙ্গ রাজনীতির বিরুদ্ধে, নারীর প্রতি মর্যাদা ও পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা পরিহার করার আকাঙ্খা ও আহ্বান বিভিন্ন মহিলা কমরেডের বক্তব্যে তাদের অভিজ্ঞতায় উঠে আসে। ব্যক্তিগত জীবন ও বৃহত্তর রাজনীতি এই দুই পরিসরের মধ্যে একটা সংহতি তৈরি করতে হবে বলে কেউ কেউ মত দেন।

সমাজে মহিলাদের উপর যে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাগুলো টিঁকে আছে শোষণভিত্তিক ব্যবস্থাগুলোর উপর — অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক ও সংস্কৃতিকভাবে তার বিরুদ্ধে একমাত্রিকভাবে নয়, শুধু লিঙ্গভিত্তিক দিক থেকেই নয়, সামগ্রিক ভাবেই শ্রেণী, জাত, বর্ণ, লিঙ্গভিত্তিক লড়াইয়ের এক সোচ্চার কণ্ঠস্বর এবারের পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত মহিলা প্রতিনিধি ও অতিথিরা তুলে ধরলেন।

তৃণমূল স্তরে যে মহিলা কমরেডরা কাজ করছেন — গ্রাম পঞ্চায়ত স্তরে লড়ছেন বা জেলা পরিষদে নির্বাচনে লড়ছেন, তাদের লড়তে হয় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তারা মোদী/বিজেপির মতো শক্তিকে মেয়েদের অধিকার ও স্বাধীনতার বিরোধী, চূড়ান্ত ক্ষতিকারক এক শক্তি হিসাবে প্রত্যহিক ও জীবন্ত অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করেন। তাদের বক্তব্যে সেই জীবন্ত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি তারা এই পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে তুলে ধরেন।

জমির লড়াই যে মহিলাদের লড়াইয়ের অন্যতম ক্ষেত্র তা উঠে আসে ঝাড়খণ্ডের সাথী কুসুম কুমারীর কথায়। তাদের এলাকায় উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের মানুষদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের জমির লড়াইয়ের ফলে গরিব মানুষ, জনমজুররা (এতে মহিলাদের অংশগ্রহণ যথেষ্ঠ মাত্রায়) নিজেদের জন্য কিছু জমি সংরক্ষণ করতে পেরেছিলেন, আজ উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের মানুষরা সেই জমি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, এবং এতে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত থাকায় ওই উচ্চবর্ণের মানুষদের সহযোগিতা করছে এবং তারফলে মহিলারা তাদের হকের জমি হারাচ্ছেন।

বিজেপি আরএসএস যে মতাদর্শ মেনে চলে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুবাদি চিন্তা চেতনা অনুযায়ী তারা পরিবারের মেয়েদের জমির অধিকার বা হক মেনে নেয় না। এমনকি হিন্দু আইন অনুসারে মহিলারা জমির আইনি অধিকার পেলেও কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ খুব কম। বরং মহিলাদের হাতে যাতে কোনও জমি না যায় তার চেষ্টা চলে পরিবারতন্ত্রের মধ্যেই। যেমন কোনও মহিলার স্বামী মারা গেলে তার সাথে ওই পরিবারের অন্য পুরুষের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় আজও। এই জোর জুলুম চলে, যাতে ওই জমি পরিবারের পুরুষদের মধ্যেই থেকে যায়। দরিদ্র গ্রামীণ মজুর, দলিত এবং মহিলাদের জমির অধিকার আজ মূল স্তরের পার্টি ও নারী আন্দোলনের এজেন্ডা হয়ে উঠছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

পশ্চিমবাংলার মহিলাদের কয়েক জনের পক্ষে মিতালী বিশ্বাস পার্টিতে আরো মহিলাদের নিয়ে আসার প্রয়োজন, পার্টির অভ্যন্তরেও মহিলাদের আরো বেশি মাত্রায় সুযোগ, সহযোগিতা ও স্থান দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। মহিলাদের রাজনীতিকরণের ক্ষেত্রে পার্টিকে সামগ্রিকভাবে আরো মনোযোগী হতে আহ্বান জানান। পার্টির মধ্যে লিঙ্গসাম্যের জন্য প্রস্তাবিত লিঙ্গন্যায় সেলকে স্বাগত জানিয়ে তিনি এই সেলের কমরেডদের আরো বেশি সংবেদনশীল হওয়ার প্রয়োজন বলে মত দেন।

সামগ্রিকভাবে এবারের পার্টি কংগ্রেসে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি সচেতন, পরিপক্ক এবং উৎসাহব্যঞ্জক।

- ইন্দ্রানী দত্ত

ketan-flies   পার্টি কংগ্রেসে ছাত্র-যুবরা

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একাদশ পার্টি কংগ্রেস তার রাজনৈতিক ব্যাপ্তিতে বিগত সমস্ত পরিধীকেই ছাড়িয়ে গেছে। পাটনায় এক অভূতপূর্ব আয়োজন ভারতের বৃহত্তর রাজনৈতিক মহলেও যথেষ্ট আলোচিত বিষয়। প্রতিনিধি অধিবেশন ছাড়াও গান্ধী ময়দানের সমাবেশ, আন্তর্জাতিক সংহতির কনভেনশন, দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ‘সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’ কনভেনশন থেকে সমাজের বিভিন্ন অংশের মেধাজীবী-সমাজকর্মী-আন্দোলনের প্রতিনিধিদের এক সমন্বয় স্থল হয়ে উঠেছিল এই কংগ্রেস।

পার্টি গঠনের অর্ধশতক অতিক্রম করে ধারে ও ভারে একাদশ কংগ্রেস জানান দিল, দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিধিতে সিপিআই(এমএল) তার সম্পূর্ণ শক্তি নিয়েই ফ্যাসিবাদ রক্ষায় জানকবুল লড়াই করতে প্রস্তুত। এই পার্টি কংগ্রেস এটাও জানান দিল কৃষকের কাস্তে আর শ্রমিকের হাতুরী হয়ে ব্যারিকেডের সামনের সারিতে রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত আছে নবীন প্রজন্মও। শহীদদের স্বপ্নের ভারত গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে নবীন প্রজন্মের অংশগ্রহণ আরেকটা বড় পাওনা।

প্রায় সতেরোশো প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষকের মধ্যে নবীন প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছিল নতুন দরজা খুলে দিল যেন। সংখ্যাগত পরিসংখ্যানে প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষকের প্রায় ৯.২ শতাংশ ছিলেন নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা।

নতুনের প্রতিনিধিত্ব মানেই নতুন ধারণা আর নতুন জোয়ার। যা ছাই থেকে আবারও ফিনিক্স হয়ে উঠতে পারে। প্রতিনিধি অধিবেশনেও তার ছাপ স্পষ্ট দেখা গেলো। নবীন প্রজন্মের বহু প্রতিনিধিরা তাঁদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করলেন এবং কংগ্রেসের পরিচালনায় বড় ভূমিকা পালনেও তাঁদের অবদান কম অসীম। লিঙ্গ সাম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, জাতীয় পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, সমস্ত ক্ষেত্রেই অবাধ মতামত আদান-প্রদানের যে ময়দান, তাতে নবীন প্রজন্মের অংশগ্রহণকে কুর্ণিশ জানাচ্ছিলেন বিদেশ থেকে আগত অতিথিরাও। অনুবাদকের ভূমিকাতেও তাঁরাই ছিলেন সামনের সারিতে।

মাসাধিক কাল ব্যাপী পাঁচ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক দিনরাত পরিশ্রম করে গেছেন। এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীরও প্রধান খুঁটিও ছিলেন নবীন প্রজন্মের সাথীরাই। বিহারের গ্রাম-শহরের ছাত্র-যুব সাথীরা প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন যাতে আয়োজনে কোনও ত্রুটি না থাকে। এতো বৃহৎ ব্যবস্থাপণায় ত্রুটির লেশমাত্র অনুভব হতে দেননি তাঁরা। শুধুমাত্র কংগ্রেস নয়, ১৫ জানুয়ারী গান্ধী ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েতও ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জও সাথীরা নিয়েছেন উৎসাহের সঙ্গেই, এবং সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন সেই কাজ। ফলে কংগ্রেসের মঞ্চে তাঁদের সম্মান জানানোর কসুর করেনি পার্টিও। শেষ দিন মঞ্চে সমস্ত স্বেচ্ছাসেবকদের ডেকে সংবর্ধনা দেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।

বিহারের বুকেই পার্টির বারোজন বিধায়কের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশই ছাত্র-যুব আন্দোলনের অগ্রণী নেতৃত্ব। সেই মাটিতেও নব গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতেও নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আইসা’র সাধারণ সম্পাদক ও পালিগঞ্জের বিধায়ক সন্দীপ সৌরভ, আরওয়াইএ’র সাধারণ সম্পাদক নীরজ কুমার, ছাত্র আন্দোলন থেকে শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী হয়ে ওঠা শ্বেতা, আইসার প্রাক্তণ সর্বভারতীয় সভাপতি ইন্দ্রেশ মৈখুরী, যুব আন্দোলনের মুখ নবীন কুমাররা এবার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আগে থেকেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন আইসার প্রাক্তণ সর্বভারতীয় সভানেত্রী সুচেতা দে, আরওয়াইএ’র সভাপতি ও অগিগাঁও বিধানসভার বিধায়ক মনোজ মঞ্জিল, আইসার প্রাক্তণ সাধারণ সম্পাদক অভুদ্যয়, যুব নেতা রাজু যাদব প্রমুখরা। নতুনের জয়ধ্বনিও এইবারের পার্টি কংগ্রেসের সম্পদ।

- নীলাশিস বসু

save-the-democracy-meeting সিপিআই(এমএল)-এর একাদশ পার্টি কংগ্রেসের মূল বিষয়বস্তু ছিল ভারতের বর্তমান ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা। এরসঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সম্মেলনকক্ষে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়।

এই আলোচনাসভার আহ্বান ছিল গণতন্ত্র বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও। আলোচনাসভায় আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা সংযুক্ত জনতা দলের নেতা নীতীশ কুমার, বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা তেজস্বী যাদব, কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা সলমন খুরশিদ।

আলোচনাসভায় অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও নীতীশ কুমার, তেজস্বী যাদব ও সলমান খুরশিদ এসেছেন। সেজন্য ওনাদের ধন্যবাদ। আমাদের দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র সংকটে। এগুলো চলে গেলে দেশের আর কী থাকবে। এগুলো বাঁচানোর জন্য বড় জোট দরকার।

সত্তর দশকে গণতন্ত্রের জন্য যে সঙ্কট এসেছিল সেখানে বিহারে বড় আন্দোলন হয়েছিল। সেখান থেকেই নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ যাদবরা উঠে এসেছিলেন। একদিকে যখন জর্জ ফার্ন্ডান্ডেজের নেতৃত্বে লড়াই চলছিল, সেই সময়েই বিহারের গ্রামে সিপিআই(এমএল) লড়ছিল। আমাদের সাধারণ সম্পাদক জহর সেই লড়াইতে শহীদ হন।

আজকে সংসদে ও রাস্তায় বিজেপি ঘৃণা ও হিংসা ছড়াচ্ছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। কংগ্রেসের বড় র‍্যালি হয়েছে। আমাদের পার্টি কংগ্রেস হচ্ছে। মহাজোটের এক বড় জমায়েত আছে আগামী ২৫ তারিখ। বড় বড় লড়াই হয়েছে। শাহীনবাগে কৃষকেরা লড়েছেন।

আন্দোলনের জোট আর রাস্তার লড়াই মিলিয়ে ২০২৪-এ পরিবর্তন সম্ভব।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তাঁর বক্তব্যে বলেন যে আমাদের সঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর বহুদিনের সম্পর্ক। রাজনীতিতে নানা বদল হয়। যারা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন তারা দেশের স্বার্থে নয়, নিজেদের স্বার্থে চলেছেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা পার্টির ভেতরে কথা বলেছি। আমরা ঘোষণা করেছি দশ লাখ লোককে চাকরী দেবে সরকার। সব এলাকার উন্নতির চেষ্টা চলছে। একটি বড় যাত্রাতে বেরিয়েছিলাম। দেখে ভালো লাগল যে সরকার সব ধরনের মানুষের জন্য কাজ করছে এবং সব ধরনের মানুষ এতে খুশি। আমাদের নয়া সিদ্ধান্ত সবাইকে খুশি করেছে।

বিহারে আমরা তো যা করার করছি। গোটা দেশে যত বেশি সম্ভব দল এক হয়ে ২০২৪-এ যদি আমরা লড়তে পারি তাহলে জিততে পারব। স্বাধীনতার লড়াইকে পর্যন্ত এরা ভুলিয়ে দিচ্ছে। কাজের কাজ কিছু না করে তারা কেবল আত্মপ্রশংসা করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সময়ে দেশভাগ সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল। কিন্তু এখন অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চলছে প্রতিদিন।

অনেক দল একসঙ্গে লড়তে চাইছি। যত দ্রুত জোটের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা আসন সমঝোতা করতে পারব ততই ভালো। বিহারে তো আমরা একসঙ্গেই আছি। অন্যত্রও এটা করতে হবে। সিপিআই(এমএল)’কে আমরা শ্রদ্ধা করি। নিজের জন্য আমি কিছু চাই না। আমি চাই দেশের জন্য কাজ করতে। আগেও আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম এটা মনে রেখে আপনারাও এগিয়ে আসুন আবার। আপনারা যে পার্টি কংগ্রেসের জন্য পাটনাকে বেছেছেন এজন্য আপনাদের ধন্যবাদ।

বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব তাঁর বক্তব্যে বলেন যে আজকে যে স্লোগান রাখা হয়েছে সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও — এটাই আসল কথা। ব্যক্তি নয়, বিষয় নিয়ে কথা হোক — এটাই আমরা বলছি। গরিবী, দারিদ্র এসব নিয়ে কথা হবে না, কথা হবে বিদ্বেষ ও বিভাজন নিয়ে, ঘৃণা নিয়ে এটাই বিজেপি চায়। মনুস্মৃতির অনুপ্রেরণা নিয়ে লেখা গোলওয়ালকরের বাঞ্চ অব থটসকে এদেশের সংবিধান বানাতে চায় বিজেপি। বিজেপির বিরুদ্ধে গেলে আপনার চরিত্র হনন করা হবে, জেলে ঢোকানো হবে। আর বিজেপির সঙ্গে থাকলে আপনি রাজা হরিশচন্দ্র।

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা দেশের স্বার্থে নিয়েছেন। এজন্য তাঁকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। আমরা তো আঞ্চলিক দল। কংগ্রেস তো জাতীয় দল। বিজেপিকে হারাতে হলে একটি স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হবে। কংগ্রেসকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার যে কথা মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বলেছেন, সেটা খুব জরুরি কথা।

দেশে বিভিন্ন সরকারকে কিনে নেওয়া হচ্ছিল। বিজেপি যা করছিল তার বিপরীত ঘটনা বিহারে ঘটেছে। বদলটা টাকার জোরে এখানে হয়নি। হয়েছে নীতি আদর্শের জায়গা থেকে।

লালুজীর (তেজস্বী যাদবের পিতা তথা রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা ও বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের) কিডনি বদল হয়েছে। তাঁর তরফ থেকেও আমি আপনাদের শুভেচ্ছা জানাই।

বিজেপি বলে মুসলিমদের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া দরকার। আমরা বলতে চাই ভোটাধিকার বিজেপি বাবার সম্পত্তি নয় যে কেড়ে নেবে। এই দেশ বহুত্বের দেশ। সেটাই এই দেশের পরিচয়।

প্রবীণ কংগ্রেস নেতা সলমন খুরশিদ তাঁর বক্তব্যে ছিলেন শাণিত ও কৌতুকময়। তিনি উপস্থিত সকলকে তেজস্বী যাদবের লাল সেলাম জানানোর প্রসঙ্গটি দিয়ে তাঁর কথা শুরু করে বলেন যে তেজস্বী যাদব লাল সেলাম জানালেন। লালের মধ্যে বিপ্লবের ভাবনা আছে। আপনাদের পার্টি সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অসামান্য। দেশে গুজরাট মডেলের কথা হয়, আমি বিহার মডেলের কথা সব জায়গায় বলব। আপনারা যা চান কংগ্রেসও তা চায় বলে আমার মনে হয়।

রাহুল গান্ধীর যাত্রায় আপনারা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আপনাদের ধন্যবাদ। সেই যাত্রায় রাহুল গান্ধী ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালোবাসার কথা বলেছেন।

নীতীশ কুমার যা বলেছেন (কংগ্রেসকে জোট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার কথা) তা আমি যথাস্থানে পৌঁছে দেব। একজন উকিল হিসেবে উকিলের মতো জোটের পক্ষে ওকালতিও করব। জোটের ঘোষণা আমিও মনে করি জরুরি। এই ঘোষণা হলে তা অনেকের মনেই ভয় ধরিয়ে দেবে।

তামিলনাড়ুর সাংসদ ও বামপন্থী দলিত নেতা থল থিরুমাভালাভন বলেন ফ্যাসিবাদ সুনামির মতো ভারতের গণতন্ত্রের তটে আছড়ে পড়ে তাকে বিপর্যস্ত করেছে। একে প্রতিরোধ করতে হবে।

ফ্যাসিবাদ বিরোধী বৃহৎ জোট ও আন্দোলনের বার্তা দিয়ে সভা সমাপ্ত হয়। এই সভাকে ঘিরে সম্মেলনের প্রতিনিধি, অতিথি, পর্যবেক্ষক, সংবাদ মাধ্যম সকলের উৎসাহ উদ্দীপণাই ছিল চোখে পড়ার মতো।

mass-culture  ১৫ ফেব্রুয়ারী পাটনার গান্ধী ময়দান হয়ে উঠলো মানুষ আর পতাকার রক্তিম বিচ্ছুরনে লালে লালে লাল। শুধু গান্ধী ময়দান কেন সমগ্র পাটনা শহরটাই বদলে গেল বিনোদ মিশ্র নগরে। কমরেড বিনোদ মিশ্র নকশালবাড়ি আন্দোলনকে ধংসস্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতোই তুলে এনেছিলেন ধ্বংস আর হতাশা ভেদ করে। আজ তার নতুনভাবে গড়ে তোলা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন পল্লবিত রক্তিম বসন্তের নানা বর্ণের নানা শ্রেণীর নানান স্তরের শহীদের স্বপ্নের দেশ গড়ার ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল তরঙ্গরূপে।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একাদশ কংগ্রেসের প্রাক্কালে এই সমাবেশে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সহ দেশ বিদেশের বক্তব্য শুনতে জনসমূদ্র অধীর অপেক্ষায়। তার মাঝেই ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা ও গণতন্ত্রের জন্য লালে লাল সুসজ্জিত মঞ্চে শুরু হল বিহার পশ্চিমবঙ্গ অসম কার্বি কর্ণাটক অন্ধ্র উত্তরপ্রদেশ হিমাচল মহারাষ্ট্র পাঞ্জাবের শিল্পীদের গণসংগীত। অন্ধ্র ও ঝাড়খন্ডের শিল্পীদের নৃত্য।

১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে পাঁচ দিনের জন্য শুরু হওয়া প্রতিনিধি অধিবেশনেও আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকল গণসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখানেও পারস্পরিক আদান প্রদানের ভিত্তিতে অনুষ্ঠানগুলি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বিহারের হিরাবল, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ ও অসমের সাংস্কৃতিক কর্মীদের গান সম্মেলনের পরিবেশকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। বিহারের নির্মোহীজী ও লোকশিল্পী রাজুর গান অনেকদিন মনে থাকবে। পশ্চিমবংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক সরিৎ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে মানস প্রদীপ সরকার মাধব সুষমা মিতালি অনন্যা সায়ন অয়ন্তীকা মেঘনা সহ নবীন-প্রবীণদের সম্মিলিত গান পরিবেশনা শ্রোতাদের নজর কাড়তে সমর্থ হয়। এই সম্মিলিত গান পরিবেশনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন বাবুনী মজুমদার ও নীতীশ রায়। এই টিমকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে সাগর চ্যাটার্জীর ভূমিকা উল্লেখ না করলেই নয়। এছাড়াও পশ্চিমবাংলা থেকে জয়শ্রী দাসের হাজারো করতালির মধ্যে নৃত্য পরিবেশনা ও তাকে যথাযথ সঙ্গত করে রূপো আর সুমি, সায়ন ও মীরা চতুর্বেদীর গান, কুনাল বক্সী ও প্রদীপ ব্যানার্জীর আবৃত্তি শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় বর্ষা, সায়নি, সম্প্রীতি, মিতালি, চন্দ্রাস্মিতা সহ পশ্চিমবঙ্গের একঝাঁক তরুণী প্রতিনিধিদের সপ্রতিভ ও প্রাণবন্ত গান পরিবেশনা। বিভিন্ন প্রদেশের শিল্পীদের মিউজিক্যাল সহযোগীতায় পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের শিল্পীদের ভুমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। ঝাড়খন্ডের ঝুমুর নাচ আর অন্ধ্রের ঐতিহ্যবাহী বীরোচিত পার্টিজন সংস্কৃতির নমুনা হিসাবে নৃত্য সকলকে উজ্জীবিত করে। “বেখউফ আজাদী” গানের সাথে মহারাষ্ট্রের একজন মহিলা প্রতিনিধির নৃত্য পরিবেশনা ছিল উল্লেখযোগ্য। সন্তোষ ও বলিন্দ্রর পরিবেশনায় ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের “হাম দেখেঙ্গে” গান ও পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের “বুলডোজার” বা “জ্বল রহি” গান সমগ্র প্রতিনিধিদের উদ্বেলিত করে তোলে।

সম্মেলনের হলের বাইরে ধীরেশ গোস্বামীর তত্ত্বাবধানে ছিল বাংলা বই-এর স্টল। সহযোগিতায় দিলীপ দত্ত, প্রকাশ, সায়ন্তন। সেখানে সারাক্ষণ বাংলা ভাষার পাঠকের আনাগোনা। বিক্রিও বেশ ভালোই হয়েছে।

২০ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক সংগীতে শিল্পীদের সাথে সমস্ত প্রতিনিধিদের মিলিত কণ্ঠস্বরে ১১তম পার্টি কংগ্রেসের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। তারপরও অনেক রাত পর্যন্ত চলে গানে শ্লোগানে সম্মেলন স্থল পরিক্রমা। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার উচ্চকিত শপথ।

schools-will-be-closed  আলিপুরদুয়ার জেলা তথা পশ্চিমবঙ্গের গর্ব বক্সা পাহাড়ের মাথায় সবকটি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেল।

রাজ্যের ৮০০০’রও বেশি স্কুল বন্ধের খবর ফলাও করে বের হলেও কেউ খেয়ালই করলেন না যে ঐ দুর্গম পাহাড়ের মাথার স্কুলগুলি একই অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া যায় না। সম্প্রতি সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে যেখানে ৩০ বা তার কম শিক্ষার্থী রয়েছে সেগুলো বন্ধ করবার জন্য রাজ্য সরকারের তরফে একটি নোটিশ জারি করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে যেসব সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ৩০ বা তার কম সেইসব বিদ্যালয়গুলিকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই বন্ধ কেন? এর পেছনে গোপন রহস্য কী? সেগুলো নিয়ে আজ আর নাই বা বললাম, সে পরে হবে। আজ আসুন আমরা আমাদের ঐতিহ্যলালিত, ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত বক্সা পাহাড়ে ঘুরে আসি। বক্সায় আমরা যারাই গেছি তারা সান্তালাবাড়ি চিনি। সেই সান্তালাবাড়ি গ্রামের আগে যেখানে একমাত্র সরকারি বাস গিয়ে থামে সেই জায়গাটি হল ২৯ বস্তি। তারপর হেঁটে বা গাড়িতে সান্তালাবাড়ি গিয়ে মোমো খেয়ে আবার এগোনো শুরু হবে। এই সান্তালাবাড়ি আর একটি গ্রাম, তারপর সদরবাজার, ডারাগাওঁ, বক্সাফোর্ট, লাল বাংলা, তাসি গাওঁ। পুবের দিকে খাটালাইন হয়ে লেপচাখা, ওছলুম — ছবির মতো গ্রামগুলো। আবার পশ্চিমে চুনাভাটি, নামনা, সেওগাওঁ আর আদমা। এই গ্রামগুলো সবকটিই ফরেস্টের ভেতরে। তা সেখানে যারা থাকে তারাও তো জংলী তাই না! সেই গ্রামগুলোর জন্য অল্প কিছু বছর আগে বরাদ্দ হয়েছিল চারটি ছোট ছোট স্কুলের, তারমধ্যে প্রাথমিক ৩টি, আর একটি জুনিয়ার হাই স্কুল। আপনারা সকলেই জানেন গ্রামগুলো খুবই ছোট ছোট, জনসংখ্যা খুবই কম তাই স্বভাবতই ছাত্রসংখ্যাও কম। এবারে ছাত্র সংখ্যা ৩০’র নীচে হলে সেই স্কুল বন্ধ। তাই সবগুলো স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হল। তার নোটিশ এখনো সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে সবার হাতের মুঠোয়। তা বক্সা পাহাড়ের মাথায় নামনা, সেওগাওঁ, আদমাতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কি ৩০’র বেশি হওয়া সম্ভব? এই সহজ সরল প্রশ্নটি শিক্ষা দপ্তরের কর্তাদের মাথায় কি আসেনি? নাকি তারা ঐ দূর দুরান্তের স্কুলগুলির ঝামেলা(?) ঝেড়ে ফেলতেই চাইছেন? আর সবকটি স্কুলই বন্ধ করে দিতে হবে। হায় রে! যখন প্রতিটি শিশুর বিদ্যালয়ে পড়বার অধিকার ভারতের সংবিধান দিয়েছে, যখন সবাই চাইছেন সব শিশু বিদ্যালয়মুখী হোক, যখন শিশুদের একটি বেলার খাবার অন্তত নিশ্চিত করতে মিড-ডে-মিল চালু করা হয়েছে, তখন একটি বিস্তীর্ণ এলাকার সবকটি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হল। একবারও ভাবলেন না যে ঐ গ্রামগুলির শিশুদের অন্য কোনো বিকল্পই রইল না।

ফরেস্ট ভিলেজের মানুষজন যাদের ছাড়া ফরেস্টটাই থাকবে না, তাদের জন্য বনাধিকার আইন প্রস্তুত হয়েছে। যুক্ত হয়েছে ভারতের সংবিধানে। যদিও তাকে খর্ব করবার জন্যও উঠে পড়ে লেগেছে সরকার। তা ঐ বনের মানুষগুলো, ঐ জংলী(?) মানুষগুলো তাদের খাবার-দাবার কীভাবে পাবে, ন্যূনতম চিকিৎসা কীভাবে পাবে তার ব্যবস্থাই ছিল এই পাহাড়ের এক জ্বলন্ত সমস্যা, সেখানে এবার যুক্ত হল তাঁদের বাচ্চাগুলো পড়বার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হবে। আসলে কী সবটা মিলে একটা সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য? মানে সবদিকে থেকে বঞ্চিত করে রাখো যেন নিজেরাই জঙ্গল ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাহলেই অবাধে লুঠ করা যাবে জঙ্গল!! ‘বাঘ ছাড়া হবে’ সেই ভয় দেখিয়ে, ‘১০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে’ তার প্রলোভন দেখিয়েও যখন কাজ হল না তখন কি এ এক অভিনব পন্থা?

আর গত কয়েকদিনে কোনো মিডিয়াতেই স্থান পায় না এই স্কুলগুলির অবলুপ্তির কথা! এই চক্রান্ত কতটা গভীর! হাতে মারো ভাতে মারো, সব দিক থেকে মারো ঐ জংলীগুলোকে। এই চাইছেন!

৮০০ কিলোমিটার দূরের রাজধানীতে বসে এ নিয়ম করা খুব সহজ যে ৩০’র কম ছাত্র-ছাত্রীর স্কুলগুলিকে বন্ধ করে দাও। বাস্তব কঠিন সত্যটি তাদের বুঝতে অসুবিধে হতেও পারে, তাহলে স্থানীয় প্রশাসন! তারা একবারও ভাবলেন না? একটিবারও মনে হল না মানুষগুলি কী করবেন? কোথায় যাবেন? অথচ ভোটের সময় একদিন আগেই টিম পাঠিয়ে ভোট নেবার আশ্রয়স্থল ঐ স্কুলগুলির একটি। সত্যি কি বিচিত্র এই দেশ!

শিক্ষার অধিকার তো প্রতিটি শিশুরই আছে। তা এবার কোথায় যাবে শিশুগুলি? তাদের কি কোনও বিকল্প ব্যাবস্থা আছে ঐ পাহাড়ের মাথায়? তাহলে পড়া বন্ধ। শিক্ষা বন্ধ। মিডডে-মিল বন্ধ। থাক অশিক্ষিত হয়ে। এটাই কি চাইছেন প্রকারান্তরে! আমরা খুব গর্ব করি আমার জেলার, আমার রাজ্যের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যেবক্সা পাহাড় একটি। প্রতিবছর সেখানে হাজির হই ১৫ আগস্টের পতাকা ওড়াতে (সরকারি খরচে)! কোটি কোটি টাকা খরচ করে হেরিটেজ রিনোভেশনের নামে বক্সা পাহাড় নিয়ে ব্যবসার বুদ্ধি ঠিক জোগাড় হয়ে যায়। আর বাচ্চাগুলো পড়তে পারবে না, সেটা একবারও মাথায় আসে না? বাঃ কি বিচিত্র ভাবনা!

তপশিলী উপজাতির পশ্চিমবঙ্গের তালিকায় ভুটিয়া, শেরপা, টোটো, ডুকপা, টিবেটান, ইয়েলমো এক সারিতে আছে। তারমধ্যে ডুকপা জনজাতির সবচাইতে বেশি মানুষ বাস করেন এই বক্সা পাহাড়ে। সংখ্যায় তারা কত? ১০০০ বা তার আশেপাশে। এদের পাশে কি দাঁড়াবার কথা ছিল না? ওদের শিক্ষার ন্যূনতম ব্যাবস্থাটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হল। তাহলে স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা দপ্তর, আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর, অনগ্রসর শ্রেণি কল্যান দপ্তর কাদের কল্যানে? কী কাজে ব্যস্ত? পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা জেলায় কী হল তা আজকের বিষয় নয়? এই বক্সা পাহাড়ের বিষয়টি একটু অন্যভাবে দেখাই যেত। না তা হল না। ফরমান বেড়িয়ে গেল স্কুল বন্ধ।

এরপর আবার যখন বক্সা পাহাড়ে যাবেন স্ফুর্তি করতে তখন দাঁড়াতে পারবেন তো ঐ মানুষগুলোর সামনে? ওদের বাড়িতে আপনার জন্য রান্না করে দিতে বলতে লজ্জা করবে না? আপনার শিশুটির জন্য খাবার তৈরি করে দিতে বলবেন ওই না পড়তে পারা নিষ্পাপ শিশুদের? আজ একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এই প্রশ্নগুলিই করুন। যদি উত্তর পান…।

- লালসিং ভুজেল      
(প্রতিবেদক বক্সা জঙ্গল লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা এবং উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চের আহ্বায়ক)

satgaon-capital-crony-capitalism  একমাস হল আদানি’র শেয়ার মূল্যে কারচুপি নিয়ে দেশ উত্তাল। শেয়ার বাজারে শর্টসেলিং’এ বিশেষজ্ঞ আমেরিকার পুঁচকে একটি কোম্পানি হিন্ডেনবার্গবিশ্বের তৃতীয় ও এশিয়ার সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানির ঘুম কেড়ে নিয়েছে। উল্লেখযোগ্য, দাম কমে যাবে এই অনুমানের ভিত্তিতে উঁচু দাম থাকা শেয়ার বা বন্ডকে সেই উঁচু দামে বিক্রি করে দিয়ে দাম কমলে কিনে সেই বিক্রয়কে মিটিয়ে দিয়ে মুনাফা করতে চায় যারা তাদের শর্টসেলার বলে ও ওই পদ্ধতিকে শর্টসেলিং বলে। শেয়ার সমেত বিভিন্ন ফাটকা বাজারে শর্টসেলিং একটি বিধিসম্মত পদ্ধতি। শর্টসেলিং’এর বিপরীত হচ্ছে লং বাইয়িং। শেয়ার বাজারের যে কারবারি মনে করে যে একটি শেয়ারের দাম ভবিষ্যতে পড়ে যাবে তিনি শেয়ারটির শর্টসেলিং করেন, অপরদিকে যিনি মনে করেন শেয়ারটির দাম বাড়বে তিনি লং বাইয়িং’এ লিপ্ত হন। ফলে শেয়ার বাজারে শর্ট সেলিং থাকলেই লং বাইয়িং থাকবে।

তবে হিন্ডেনবার্গের মতো পেশাদার শর্ট সেলার অনেক ভেবেচিন্তে গবেষণা করে কোনো কোম্পানির আর্থিক লেনদেন, শেয়ারের কেনা-বেচার ধরন-ধারণ, শেয়ারের দামের গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি দেখে শুনে যদি বুঝতে পারে যে কোম্পানির শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে ও সেই দামস্ফীতির পিছনে যোগসাজশ রয়েছে তবেই ওই শেয়ারের শর্টসেলিং’এর ঝুঁকি নেয়। শর্টসেল করার পরে তারা সেই কোম্পানির ওই সমস্ত যোগসাজশ এবং কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত গবেষণা ও বিশ্লেষণলব্ধ তথ্য প্রকাশ করে যাতে বাজারে ওই শেয়ারের দামের বেলুন চুপসে যায়। ফলে শেয়ারের দাম কমে যায় ও হিন্ডেনবার্গ লাভ করতে সক্ষম হয়।

এতটা পড়ে মনেই হতে পারে যে, হিন্ডেনবার্গের তো আদানির শেয়ারের দাম কমানোর পিছনে স্বার্থ রয়েছে, ফলে তারা ইচ্ছে করে চক্রান্ত করে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যাতে শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে সচেষ্ট হয় ও শেয়ারের দাম পড়ে যায়। তেমনটা যদি এতই সহজ হত তাহলে যেকোনো ব্যক্তি কারবারী শেয়ারের শর্টসেল করে একটি রিপোর্ট বানিয়ে বাজারে ছাড়ত ও মুনাফা করত এবং তা সমস্ত কোম্পানির শেয়ারের ক্ষেত্রেই করা যেত। কিন্তু তেমনটা হয় না, এবং হিন্ডেনবার্গও সমস্ত কোম্পানির শেয়ারে শর্ট সেল করে না। এই কাজটিতে হিন্ডেনবার্গ দক্ষতা অর্জন করেছে। তারা যদি অনুরূপ রিপোর্ট প্রকাশ করে তাহলে তার শক্ত ভিত, কারণ ও যুক্তি থাকে। বিনিয়োগকারী এবং শেয়ার বা বন্ডের বাজারের কারবারীরা তাতে বিশ্বাস করে। উপরন্তু, যদি কেবল ফাটকা মুনাফা করার জন্য হিন্ডেনবার্গ বা অন্য কেউ কোনো কোম্পানির বিষয়ে ওইরকম গুজব ছড়ায়, কোনো ভিত্তি ছাড়াই তাহলে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে মালিকগোষ্ঠী সেই গুজব রটনাকারীকে অসীম ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই হিন্ডেনবার্গ ভুয়ো খবর ও গুজব রটিয়েছে এমনটা প্রায় অসম্ভব।

আদানি গোষ্ঠীর দখলে ৭টি শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে ও আরো ৫৭৮টি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি তাদের দখলে রয়েছে। এছাড়াও এসিসি, গুজরাট অম্বুজা ও এনডিটিভি আদানি গোষ্ঠী দখলে এনেছে। কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ শেয়ার মালিকগোষ্ঠী নিজেদের হাতে রাখতে পারে। এর থেকে বেশি রাখা বেআইনি। অন্তত ২৫ শতাংশ শেয়ার মালিকগোষ্ঠি বহির্ভুত অন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে রাখার নিয়মটির মূল কারণ হল যাতে মালিক নিজেদের ইচ্ছেমতো শেয়ারের দাম বাড়াতে কমাতে না পারে। কিন্তু মরিশাস, সাইপ্রাসের মতো কর হীন দেশসমূহে নিজের পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক শেল কোম্পানি (শেল অর্থাৎ খোলস আছে কিন্তু আদতে কোম্পানিটি কোনো ব্যবসায়ই প্রায় করে না) খুলে তাদের মাধ্যমে আদানিগোষ্ঠি নিজেদের কোম্পানির শেয়ার নিজেরাই কিনেছে ও ৭৫ শতাংশের অনেক বেশি শেয়ার নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছে। অর্থাৎ নিজেদের অর্থ আদানিগোষ্ঠী নিজেদের শেয়ার কিনতেই ব্যবহার করেছে ঘুরপথে ওইসব শেল কোম্পানির মাধ্যমে। তারপরে ওইসব শেয়ার নিজেদের মধ্যে কেনাবেচা করে শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে নিজের বৈভব ও সম্পত্তিকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখিয়ে অতি অল্প সময়ে বিশ্বের তৃতীয় ধনী হয়ে উঠেছে। এই কৃত্রিম বিত্তের প্রভাবে দেশজোড়া তো বটেই বিশ্বজোড়া প্রভাবও বিস্তার করেছে। হাসিল করেছে অস্ট্রেলিয়ার কয়লাখনির মালিকানা, বাংলাদেশে বিদ্যুত যোগানের বরাত, শ্রীলঙ্কায় বন্দরের ও উইন্ডমিলের বরাত। অপরদিকে এদেশেও ৬টি বিমানবন্দর, ৮টি সমুদ্রবন্দর ও ৪টি টার্মিনাল, বিভিন্ন কয়লাখনির লিজ, জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎখনন, জ্বালনি গ্যাস সরবরাহ, ভোজ্য তেল, চাল-আটার ব্যবসা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পরিকাঠামো নির্মাণ প্রভৃতি বহুধরণের ব্যবসায়ের অধিকার সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছে। এছাড়া ৩০টির মতো দেশে বাণিজ্য বিস্তার করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্য সরকার তাদের রাজ্যে বিনিয়োগের জন্য আদানিকে চাইছে। এই যে আদানি আবাহন, এর মূলে রয়েছে আদানির বিপুল বৈভব, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগে যার পরিমাণ ছিল ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে আদানির নীট সম্পদের পরিমাণ ৩ লক্ষ কোটি টাকার নীচে নেমে এসেছে। কেবল শেয়ারের দাম কমার জন্যই এই পতন। ওই রিপোর্ট অন্যান্য বহু বিষয়ের পাশাপাশি আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের দামের সঙ্গে মুনাফার অনুপাতের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিল। দেখা গিয়েছে, আদানি গোষ্ঠির শেয়ার বনাম মুনাফা অনুপাত (প্রাইস আর্নিং রেশিও) অনুরূপ শিল্পগুলির গড়ের তুলনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩৫-৪০ গুণ বেশি। ফলে সামগ্রিকভাবে আদানির শেয়ারের গড়ে ৮৫ শতাংশ পতনের সম্ভাবনা আছে, বা আদানিগোষ্ঠীর শেয়ার স্বাভাবিকের তুলনায় গড়ে ৭ গুণ বেশি দামি। এই যে অতিরিক্ত দাম তার মূল কারণ আগে উল্লেখ করা নিজেদের শেয়ার নিজেরাই কুক্ষিগত রেখে নিজেদের মধ্যে কেনাবেচা করে দাম বাড়িয়ে তোলা। এই কাজটিকে বলা হয় রাউন্ড ট্রিপিং, যা বেআইনি।

এই শেয়ারের দামকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখানোর মাধ্যমে নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়ানোর কথা আগেই বলেছি। এছাড়াও আরেকটি কাজ করা হয়। ওই ফাপানো শেয়ারের দামের ভিত্তিতে বর্ধিত সম্পদকে ব্যবহার করে ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য সূত্র থেকে ঋণ নেওয়া হয়। ঋণের জন্য যে সম্পদ বন্ধক রাখা হয় তার দাম বেশি দেখালে বেশি ঋণ পাওয়া যায়। বাজারে আদানি গোষ্ঠির মোট দেনার পরিমাণ ২.২ লক্ষ কোটি টাকা। তারমধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা ভারতীয় ব্যাঙ্কের কাছে ও ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশি ব্যাঙ্কের কাছে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশের আগে আদানির সম্পদ ছিল ১০ লক্ষ কোটি টাকার মতো। যদি ওই রিপোর্ট অনুযায়ী শেয়ারের দামে ৮৫ শতাংশ পতন ঘটে তাহলে ওই সম্পদ ১.৫ লক্ষ কোটি টাকায় নেমে আসবে। ফলে ব্যাঙ্কের কাছে নেওয়া ঋণ, যা সম্পদের মাত্র ৬.৩ শতাংশ ছিল, তা সম্পদের ৪২ শতাংশে পরিণত হবে। দ্বিতীয়ত, সামগ্রিক ঋণ সম্পদের দেড় গুণ হবে। অর্থাৎ ব্যাঙ্ক ও অন্যন্য ঋণদাতাদের ঝুঁকি যতটা দেখানো হয়েছিল তার তুলনায় ৭ গুণ বেড়ে যাবে। তৃতীয়ত, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট কোম্পানি কর্তৃক প্রকাশিত মুনাফার ভিত্তিতেই ওই শেয়ারের দামের সঙ্গে মুনাফার অনুপাতের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছে। কিন্তু তারা আদানির হিসাবের বিষয়েও ইঙ্গিত করেছে। যে অডিটর আদানির মূল কোম্পানির অডিট করেছে তারা এতটাই ছোট যে আদানিগোষ্ঠী দ্বারা প্রস্তুত লাভক্ষতির হিসেবকে অগ্রাহ্য করা তাদের পক্ষে মুশকিল। অপরদিকে বড় যেসব অডিট সংস্থা আদানিগোষ্ঠীর কিছু কোম্পানির অডিট করেছে তারা ওই সব হিসেবকে সম্পূর্ণ সঠিক বলে মনে করেনি। সুতরাং মুনাফা দেখানোর ক্ষেত্রেও কোনো কারচুপি থাকতেই পারে। প্রসঙ্গক্রমে ২০০৮ সালে প্রকাশ পাওয়া সত্যম কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ্য। যেখানে মুনাফা অতিরিক্ত দেখিয়ে ও তাকে যাথার্থ দিতে অস্তিত্বহীন ফিক্সড ডিপোজিট দেখিয়ে ৭ হাজার কোটি টাকার কারচুপি করা হয়েছিল। ফলে ওই অতিরিক্ত মুনাফার ভিত্তিতে শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছিল এবং সেই অতিরিক্ত দামে শেয়ার বিক্রি করে সত্যম কম্পুটারের মালিক বি আর রাজু মুনাফা করেছিল।

এমনটা হতেই পারে যে, আদানি গোষ্ঠী যে ব্যবসায়িক অনুমানের ভিত্তিতে ব্যাঙ্ক বা অন্যান্যদের কাছে থেকে ঋণ করেছে তা মুনাফা প্রদানকারী, বা সেই অনুমান তৈরির ক্ষেত্রে কারচুপি করা হয়নি (যদিও এমন কারচুপির কারবারীরা তেমনটা করেননি এমনটা ভাবা কঠিন)। ফলে ওইসব ব্যবসায় লাভ করল এবং আদানি গোষ্ঠি ঋণখেলাপি হল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্নীতিটা লঘু হয়ে যায় না। কারণ, বর্ধিত শেয়ার দামের ভিত্তিতেই যে আর্থিক পেশী প্রদর্শিত হয়েছে তা আদানিদের বিভিন্ন বরাত পেতে বা বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, কয়লাখনি পেতে অগাধ সাহায্য করেছে। ওই ভুয়ো আর্থিক শক্তিই ব্যাঙ্কগুলিকে দেখিয়ে ঋণ পেয়েছে আদানি ও সেই ঋণ ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন পরিকাঠামোগত সম্পদ কুক্ষিগত করতে। ফলে ঋণ ফেরত দেওয়া বা না দেওয়া নিরপেক্ষভাবেই আদানি গোষ্ঠী বিপুল দুর্নীতি করেছে বলেই হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট থেকে মনে হচ্ছে। অপরদিকে এলআইসি নিজেদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে যাথার্থ প্রদানে তৎপর হয়ে বলেছিল যে তারা যে দামে আদানির শেয়ার কিনেছিল তার থেকে, শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ার পরেও, বর্তমান মূল্য বেশি। কিন্তু এখন কেনা দামের থেকে বাজার দাম কম। ফলে আদানির শেয়ারে এলআইসি’র লোকসান চলছে। এমনকি, আদানি এন্টারপ্রাইজ যে এফপিও’র মাধ্যমে বাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা তুলেছিল তাতেও এলআইসি বিনিয়োগ করেছিল যদিও সেই সময়ে বাজারে ওই শেয়ারের দাম এফপিও’র দামের থেকে অনেক কম ছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন করতে হয় যে, এলআইসি কেন আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হবে যে, ওটি এলআইসি’র নিজস্ব সিদ্ধান্ত কিন্তু আন্দাজ করা যায় কীভাবে মোদীজি ও আদানির ঘনিষ্টতা এলআইসি-কে অনুরূপ বিপুল বিনিয়োগে বাধ্য করেছে।

২০ হাজার কোটি টাকার এফপিও বাজার থেকে তোলার পরেও আদানি তা ফেরত দেবে বলে ঘোষণা করেছে। তার পরে পরেই আদানি গোষ্ঠী শেয়ার বন্ধক দিয়ে নেওয়া ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ সময়ের আগেই ফেরত দিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া বিদেশি ব্যাঙ্কের কাছে প্রদেয় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণও সময়ের আগেই ফেরত দেবার কথা ঘোষণা করেছে। এসবই নাকি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য করা হচ্ছে। এফপিও’র মাধ্যমে তোলা ২০ হাজার কোটি টাকা মূলত ঋণ শোধ করার জন্যই ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। তাহলে তা ফেরত দেওয়ার পরেও প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা শোধ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোন যাদুবলে? তাহলে কি ঋণ শোধের জন্য ওই ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যবহার করার কথা কোনো অর্থই বহন করে না। এই হেঁয়ালিটির উত্তর অন্য কোনো গবেষক দেবেন হয়তো।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট এছাড়াও এক গভীর রহস্যময় কেলেঙ্কারির দুনিয়ার সঙ্গে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর যোগসূত্রের দিকে ইঙ্গিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে গৌতম আদানির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সুবিদিত। অপরদিকে আদানি পরিবারের ব্যবসায়িক কারচুপি ও দু’নম্বরীর ইতিহাস যথেষ্টই প্রকট। আদানি এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, গৌতম আদানির ভাই রাজেশ আদানি পূর্বে দু’বার হিরের ব্যবসায়ে দু’নম্বরির জন্য গ্রেফতার হয়েছে। ডিরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ওই হিরে ব্যবসায়ে কারচুপিতে অন্যতম অভিযুক্ত, আদানির ভগ্নিপতি সমীর ভোরা অস্ট্রেলিয়ায় আদানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। গৌতম আদানির দাদা বিনোদ আদানি মরিশাস, সাইপ্রাসের শেল কোম্পানিগুলির অন্যতম সংগঠক। তারসঙ্গে চিনের নাগরিক অনুরূপ এক ধোঁয়াটে ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বিনোদ আদানির মেয়ের শ্বশুর হচ্ছে হিরে ব্যবসায়ে কারচুপি করে ব্যাঙ্কের টাকা তছরূপকারী দেশ থেকে পলাতক যতীন মেহতা। বিনোদ আদানির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে এদেশের বৃহত্তম শেয়ার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত কেতন পারেখের দেশ থেকে পলাতক হিসেব রক্ষক ধর্মেন্দ্র দোশির। সব মিলিয়ে আদানির শিল্প সাম্রাজ্যকে এক মাফিয়াতন্ত্র বলেই মনে হয়। সেই মাফিয়াতন্ত্রের সঙ্গে কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কোনো যোগাযোগই নেই?

এমনটা হতেই পারে যে, আদানিগোষ্ঠীর শেয়ারের মূল্যের পতন থেমে গেল। এমনটা হতেই পারে যে, আদানিগোষ্ঠী তাদের ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করল। এমনিতেই সরকারি বদান্যতায় পরিকাঠামো শিল্পে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির সুযোগ আদানি পেতে চলেছে, অন্যান্য সুবিধে দানের মধ্য দিয়ে আদানিকে সহায়তা মোদীজি করতেই পারেন। ফলে এই সঙ্কট থেকে আদানি পরিত্রাণ পেতে পারে। কিন্তু তাসত্ত্বেও এমনটা বলা যাবে না যে শেয়ারের দামে কারচুপিতে আদানি নিষ্কলুস। আদানি-মোদী আঁতাত ও আদানির দুর্নীতির বিরুদ্ধে ওঠা শ্লোগান কোনোভাবেই ভুল বলে গণ্য হবেনা, কারণ আদানি গোষ্ঠির শেয়ার মূল্যে যে কারচুপি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট সামনে নিয়ে এসেছে তা সমস্ত আইন, হিসাবশাস্ত্র ও শেয়ার বাজারের মাপকাঠিতে সর্বৈব সঠিক।

- অমিত দাশগুপ্ত

progressive-society  গত ২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আয়োজিত একটি আলোচনা সভায় বিশিষ্ট শিল্পি ও শাসকদলের সমর্থক শ্রী শুভাপ্রসন্ন মহাশয় বাংলা ভাষায় প্রচলিত কয়েকটি শব্দের ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ তিনি ‘দাওয়াত’ ও ‘পানি’ শব্দদুটিকে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে ‘এইরকম’ শব্দের ব্যবহার বাংলা ভাষার শুধু ক্ষতি করে না – এগুলি ব্যবহৃত হয় সাম্প্রদায়িক কারণে; অর্থাৎ, এই শব্দগুলি যাঁরা ব্যবহার করেন – তাঁরা সাম্প্রদায়িক। উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তিনি যে পূর্বোক্ত শিল্পির বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন তা নয়। বরঞ্চ তিনি শিল্পির বক্তব্যের মৃদু বিরোধিতা করতে গিয়ে যা বলেছেন, তা মোটামুটি হল, – ও-দেশ (পড়তে হবে বাংলাদেশ) থেকে আসা মানুষেরা তো তাঁদের ভাষাতেই কথা বলবেন – সেই কথা বলবার অধিকার তাঁদের রয়েছে। পাঠক খেয়াল করবেন, শ্রী শুভাপ্রসন্ন কিন্তু বাংলা ভাষায় চাপিয়ে দেওয়া শব্দ বলতে যে-দুটি শব্দের উদাহরণ টেনেছেন, সেই শব্দগুলি মূলত এপার বাংলার মুসলমানদের কথ্য ভাষা। অধুনা হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেবার যে কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্র চলছে – তা নিয়ে তাঁকে একটা শব্দও খরচ করতে দেখা যায়নি। আবার তাঁর বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পরোক্ষভাবে বলে বসলেন, বাংলায় যারা ‘পানি’, ‘দাওয়াত’ শব্দগুলি ব্যবহার করেন, এপার বাংলার মুসলমানরা, আসলে ওদেশ থেকে অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে এসেছেন! শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অতি জনপ্রিয় নেত্রী। সারা বাংলা জুড়েই তাঁর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যায় না। ভাবতে অবাক লাগে তাঁর মতো একজন নেত্রী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, রাজনীতির কারণে প্রায় সারা বাংলায় যাঁর অগাধ যাতায়াত; তিনিও কি মনে করেন পশ্চিমবাংলার মুসলমানরা মূলত বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছেন? এ এক চরম বিড়ম্বনা আমাদের – পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের। আমাদের ছোটোবেলা থেকে যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, তা হল – আমরা বাঙালি না মুসলমান? মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরে প্রায় একই রকম প্রতিধ্বনি শোনা গেল।

এখন আসা যাক, শ্রীশুভাপ্রসন্নের বক্তব্যে আমাদের প্রগতিশীল সমাজ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাল?

বাংলার লেখকগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রায় কোনো প্রতিক্রিয়াই পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হল – কিন্তু তাতে লেখকগোষ্ঠীর তেমন হেলদোল পাওয়া গেল না। অবশ্য এটি আর বিস্মিত করে না। বাংলার লেখককূল সঠিক ভাবেই বুঝেছেন শুভাপ্রসন্নের সংশয় অদৌ ভাষা নিয়ে ছিল না। তিনি ভাষা নিয়ে মোটেও মন্তব্য করেননি। ভাষাকে কেন্দ্র করে তিনি শুধুমাত্র অপমান করতে চেয়েছেন পশ্চিমবাংলার ২৮ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে। মুসলমানদের অপমান করা এখন রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে। মুসলমানদের অপমান করে দিব্যি সমাজের জ্যাঠা হয়ে থাকা যায়। এতে কারো আপত্তি থাকে না। ফলে, যাঁদের পেশা বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে, তাঁরাও নির্দ্ধিধায় চুপ থেকে যেতে পারেন। অসচেতন মনেও অপরাধবোধ থাকে না তাঁদের।

কোনো রাজনৈতিক দল এটা নিয়ে সরব হয়নি। বামদলগুলো তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। যেন এটি একটি ছোটো ব্যাপার। যেন এটি কোনো ব্যাপারই নয়। যেন ‘এমন তো হয়েই থাকে’ গোছের অবস্থান তাদের।

তবে সবাই যে চুপ থেকেছেন – তা নয়। কিছু ব্যাক্তি মানুষ মূলত সামাজিক মাধ্যমে শ্রী শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যকে খারিজ করেছেন। শিল্পির বক্তব্যকে খারিজ করতে গিয়ে তাঁরা বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখা উদ্ধৃতি করেছেন, যেখানে তৎসম-তৎভব শব্দের সঙ্গে আরবি-ফারসি শব্দের প্রভূত ব্যবহার রয়েছে। কেউ আবার বাংলাভাষার ইতিহাসের দিকে গিয়েছেন। তাঁরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন, যে-ভাষা অন্য ভাষার শব্দকে সহজে আপন করে নিতে পেরেছে – সেই ভাষার উন্নতি তত দ্রুত ঘটেছে। একটি ভাষার ব্যাপ্তি নির্দ্ধারিত হয় অপর ভাষার সঙ্গে তার সহিষ্ণুতার সম্পর্কে। এখানে ছুৎমার্গ থাকলে ভাষা বস্তুত বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়। সেই ভাষা অচিরে ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।

যে-সকল ব্যাক্তি শ্রী শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। ভাষার নিরিখে তাঁদের যুক্তিগুলি বহুলপ্রচলিত এবং প্রামাণ্য হিসেবেও ধরে নেওয়া যেতে পারে। ফলে তাঁদের বিরোধিতাগুলি যে যুক্তিগ্রাহ্য তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে মনে প্রশ্ন জাগে পদ্ধতি নিয়ে। আমি তাঁদের অনুরোধ করব শ্রী শুভাপ্রসন্নের বক্তব্যের দিকে আরো একটু মনোনিবেশ করতে। খেয়াল করুন শ্রী শুভাপ্রসন্ন ভাষার শুদ্ধতা (এই ধারনাটাই অতি প্রতিক্রিয়াশীল) নিয়ে বলতে গিয়ে শুধু বাংলার মুসলমানদের কথ্য ভাষাকেই আক্রমণ করছেন। তিনি বাংলা ভাষায় প্রচলিত ইংরাজি, ফরাসি, পর্তুগিজ সহ অন্যান্য ভাষার শব্দের উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ, তাঁর মতে বাংলার মুসলমানরাই বাংলার ভাষাটিকে নষ্ট করছে। তিনি সরাসরি আক্রমণ করছেন এই বাংলায় বসবাসকারী মুসলমানদের। এই জিনিসটি তিনি বেশ কিছুকাল যাবতই করে আসছেন। এবং কখনোই তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হননি। অর্থাৎ, তাঁর বিরোধিতা করতে দরকার ছিল তাঁর সাম্প্রদায়িক মন-টিকে চিহ্নিত করা। আমরা সেটার দিকে বেশি নজর না দিয়ে চলে গেলাম ভাষাতত্ত্বের দিকে। অথচ শ্রী শুভাপ্রসন্ন ভাষাতত্ত্বের প্রশ্নটিই তোলেননি, প্রকৃতপক্ষে সেই যোগ্যতাও তাঁর নেই। তিনি একজন হিন্দুত্ববাদী, মুসলমান-বিদ্বেষী মানুষ। আমরা তাঁকে ভাষার তর্কে না গিয়ে, এইভাবে চিহ্নিত করে আমাদের বিরোধিতার সুর চড়াতে পারতাম। কিন্তু তা করলাম না।

কিছুদিন আগে হরিয়ানায় দুজন মুসলমানকে গাড়িতে আটকে রেখে পুড়িয়ে খুন করা হল। আমাদের ভারতবর্ষেই। এক্ষেত্রেও বাংলার নাগরিক সমাজকে প্রায় কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা গেল না। যেন ঘটনাটি আমাদের দেশে ঘটেনি। যেন ঘটনাটি দূরের কোনো দেশে ঘটেছে। যেন মৃত ব্যাক্তিদুটি আমাদের সহনাগরিক ছিল না।

তাহলে কি বাংলায় ‘প্রগতিশীল’ ধারনাটার মধ্যেই কিছু খুঁত রয়ে গিয়েছে। আমরা আর মুসলমান বিদ্বেষীদের চিনতে পারছি না? কিংবা চিনে ফেলেও না চেনার ভান করছি?

আপনারা যদি মনে করেন, হিন্দুত্ববাদ এক ধরনের ফ্যাসিবাদ, তাহলে মেনে নিন, শ্রী শুভাপ্রসন্নের মতো ব্যাক্তিরা সেই ফ্যাসিবাদের সহযোগী। আর যদি হিন্দুত্ববাদকে শত্রু হিসাবে না মনে হয় – তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। ভাষার ব্যবহার নিয়ে কোনো সেমিনারে আলোচনা করা যাবে তখন।

- সাদিক হোসেন

malay-dube গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পার্টির বাঁকুড়া জেলা কমিটির সদস্য কমরেড মলয় দুবের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হল বাঁকুড়া শহরে তাঁর বাসভবন সংলগ্ন পাঠকপাড়া অগ্রণী সংঘ ক্লাবে। উপস্থিত ছিলেন জেলার পার্টি কর্মীরা ও নেতৃত্ব, বিভিন্ন বামদলগুলির জেলা নেতৃবৃন্দ, ব্যাংক ইউনিয়নের নেতারা, এলাকার বিভিন্ন নাগরিকেরা, মলয়দার পরিবার পরিজন প্রমুখ। শুরুতে তাঁর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও নীরবতা পালন করার পর শোক প্রস্তাব পাঠ করেন শহরের পার্টিকর্মী রবিন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সঞ্চালনা করেন বাবলু ব্যানার্জী। প্রয়াত কমরেডের প্রতি শ্রদ্ধায় স্মৃতিচারণায় স্মরণসভা হয়ে ওঠে খুবই আবেগময়। মলয়দার ছাত্রজীবনে নকশালবাড়ি আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়া, তারপর জেলে যাওয়া, সেই সব দিনগুলির অশ্রুত নানান কাহিনী বক্তাদের কথায় উঠে আসে। ৭০ দশকের বিপ্লবী আদর্শের প্রতি সম্মান জানিয়ে মলয়দার বিশেষ গুণাবলী নিয়ে সকলেই বক্তব্য রাখেন। তাঁর সোজাসাপটা কথা বলা, আদর্শের প্রতি বলিষ্ঠতা, খোলামেলা মনন জগত, বিভিন্ন টালমাটাল সময়ে সংগ্রামী বামপন্থী চেতনা ধরে রাখা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ করেন। আজকের দিনে যখন মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে উঠছে তখন বামপন্থী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মলয়দাদের মতো মানুষরা কতটা প্রয়োজনীয় সকলেই তা তুলে ধরেন। তাঁর স্বপ্ন সফল করার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। বক্তব্য রাখেন পার্টির নেতৃত্ব কার্তিক পাল, বাসুদেব বসু, জয়তু দেশমুখ। সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক অজিত পতি, বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্কের রিটায়ার্ড এ্যাসোসিয়েসনের উদয় অধুর্য্য, সিপিআই জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ভাস্কর সিনহা, আরএসপির বর্ষিয়ান কমরেড গঙ্গাধর গোস্মামী, ফঃ বঃ এর পক্ষে বিশ্বজিৎ সিনহা, প্রয়াত কমরেড মলয় দুবের বাল্যবন্ধু এবং তাঁর ব্যাঙ্কের সহকর্মী ও তাঁর সাথে গ্রেপ্তার হওয়া বন্দন চ্যাটার্জী, বাঁকুড়া জেলার বিশিষ্ট পরিবেশবিদ শান্তব্রত সেন, বাঁকুড়া শহরের বিশিষ্ট চিকিৎসক অমিতাভ চট্টরাজ, অধ্যাপক আন্দোলনের নেতা প্রতীপ মুখার্জি, মলয় দুবের হাতে গড়া ক্লাব ‘পাঠকপাড়া অগ্রনী সংঘের’ সম্পাদক অশোক ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা তথা তাঁর কাকা মুক্তি দুবে প্রমুখ। বোম্বাই থেকে পার্টিনেতা শ্যাম গোহিল এবং পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য পার্থ ঘোষের প্রেরিত বার্তা পাঠ করে শোনানো হয়। গান গেয়ে শোনান বাবুনি মজুমদার ও মনিষীতা নন্দী ব্যানার্জি। সভায় উপস্থিত থেকে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান আইসার সায়ন্তন রায়, আয়ারলার দীনবন্ধু মাল, কিষাণ মহাসভার বৈদ্যনাথ চীনা, বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী মজদুর ইউনিয়নের পক্ষে দিলবার খান, এ্যাপোয়ার কল্পনা দেশমুখ, মলয় দুবের একমাত্র কন্যা মিতুল দুবে (রায়), স্ত্রী নমিতা দুবে সহ অন্যান্যরা।

memorial-meeting-in-ashoknagar
স্বজন বন্ধুদের উদ্যোগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অশোকনগরে অনুষ্ঠিত হলো এক স্মরণ সভা। এই দিন ছিল দুলাল আম্বুলির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এই উপলক্ষ্যে তিন নম্বর স্কীম কমিউনিটি হলে প্রথামাফিক সাংগঠনিক রীতির বাইরে আয়োজিত এই ঘরোয়া সভায় কথায় গানে স্মৃতিচারণে স্মরণ করা হল দুলাল আম্বুলি, দীপন সেনগুপ্ত, মিহির রায়চৌধুরী সহ অন্যান্যদের। যারা ৮০র দশকে নতুন পর্যায়ে সমাজ বদলের আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত করেছিল। অশোকনগরের বুকে নকশালবাড়ি আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার বহুমুখী কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এলাকায় ব্যাপক বিস্তৃত সাংস্কৃতিক সামাজিক প্রয়াস, উদ্বাস্তু মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সহ শ্রমজীবী মানুষের নানাবিধ আন্দোলনে সংগ্রামী বামপন্থার পতাকা নিয়ে সামিল হয়েছিল এক বিরাট সংখ্যক যুব শক্তি। একে সংগঠিত করার কাজে প্রয়াতদের বিশিষ্ট অবদানের কথা আলোচনায় উঠে এলো। তাঁদের অদম্য সংগ্রামী মনোবল, মানুষের সাথে একাত্মতা গড়ে তোলা, শহর ছাড়িয়ে গ্রামের মেহনতি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া – এইসব অনন্য ভূমিকার প্রসঙ্গ উপস্থিত সকলেই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করলেন যা আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে চিরকাল। সভায় সিপিআই(এমএল)-এর কর্মীরা ছাড়াও অংশগ্রহণ করেন দুলাল আম্বুলির কন্যা অন্বেষা, দীপন সেনগুপ্তের ভাই ধ্রুব প্রমূখ। সঞ্চালনা করেন বাবুনি মজুমদার।

=== 000 ===

খণ্ড-30
সংখ্যা-4