মোদি সরকার দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা, দেশের গণতন্ত্র, সংসদীয় ব্যবস্থা সহ সমস্ত কিছুর উপর যে সর্বাত্মক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তার বিরুদ্ধে আমরা জনগণের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। পাশাপাশি আমরা মনে করি বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক ঐক্য এবং নির্বাচনী বোঝাপড়া একান্ত প্রয়োজন। গত ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে দেখা গিয়েছে বিরোধী ঐক্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় চলে এলো, যদিও তার ভোট ও আসন সংখ্যা দুই-ই কমেছে।
আজ দেশে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে যেখানে শাসকদল নিজেই সংসদ অধিবেশন বানচাল করে দিচ্ছে যাতে আদানি প্রশ্নে কোনো যৌথ সংসদীয় কমিটি গড়ে উঠতে না পারে। রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ যেভাবে খারিজ করা হয়েছে সেটা সমগ্র বিরোধী শিবিরের উপর এক নজিরবিহীন হামলা যা কার্যত এক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। দেশের বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইন বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলছেন, এটা আদৌ কোনো অপরাধমূলক মানহানি সংক্রান্ত বিষয় নয়। যেভাবে দুই বছরের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে তার কোনো নজির আমাদের দেশে নেই। অথচ বিজেপির বহু নেতা ও মন্ত্রী নানান কুমন্তব্য করেও কোনেরকম শাস্তি পায়নি। তারা বক্তব্য শুরুই করেন নানা কুকথা দিয়ে। আগামী ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচন এবং বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এ হল বিরোধী শক্তির উপর এক সর্বাত্মক হামলা, যা জরুরি অবস্থার স্মৃতি তুলে ধরছে। এটা কেবল কংগ্রেসের কোনো দলীয় প্রশ্ন বা রাহুল গান্ধীর ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটা দেশের গণতন্ত্রের প্রশ্ন।
আজকে দেশে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে তা হল আদানি কোম্পানির কর্পোরেট জালিয়াতির প্রশ্ন। এটা হল সরকারের প্রশ্রয়ে এবং সৌজন্যে দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ এক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা। আমাদের দেশের ব্যাংক, বীমা ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চিত অর্থ ঝুঁকি নিয়ে আদানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই আদানি গোষ্ঠি খুবই সীমিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে থাকে, সারা দেশে যার সংখ্যা সাকুল্যে ২৩ হাজার মাত্র! এই বিপুল পরিমান টাকা যদি পরিশোধ না হয় তাহলে সেটা আমাদের দেশে ব্যাংকিং সংকট-আর্থিক সংকট-সাধারণ মানুষের জীবিকা ও মজুরি সংকট ডেকে আনবে। তাই এটা দেশের মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্নের সাথে জড়িত।
পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি বেশ কয়েকটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন চলছে যেমন ডিএ-র দাবিতে কর্মচারীদের আন্দোলন, নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং স্বচ্ছনিয়োগের দাবিতে ছাত্র যুবদের আন্দোলন প্রভৃতি। এই সমস্ত আন্দোলনগুলিকে আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাই। আজ ১০০ দিন কাজের প্রকল্পের উপর ত্রিফলা আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। এই খাতে বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিনে দু’বার ডিজিটাল হাজিরা এবং মজুরির সাথে আধার সংযোগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসবের পরিণতিতে আগামীদিনে কাজ করেও মজুরি না পাওয়ার সংকট তৈরি হবে।
পশ্চিমবাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন। আমরা চাই সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। বিগত দিনে এ রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামে প্রহসন দেখা গেছে। ব্যাপক এলাকায় বিরোধীদের মনোনয়ন পত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি। বর্তমান সময়কালে বাংলার গ্রামাঞ্চলে আলু চাষি, পেঁয়াজ চাষিরা ফসলের দাম না পেয়ে বঞ্চিত, কেন্দ্র-রাজ্য কাজিয়ার ফলে ১০০ দিনের কাজ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পে টাকা দেওয়া বন্ধ করে রেখেছে। এসবের পাশাপাশি এ রাজ্যের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণরোষ জন্ম নিয়েছে যা আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে। আমরা চাই মানুষ যেন মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার পায়। সেই অধিকারের দাবিতে আমরা আন্দোলন গড়ে তুলব। সমস্ত বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি, যারা এ রাজ্যে বঞ্চিত বর্গাদার, গ্রামীণ মজুর, ভাগ ও চুক্তি চাষি, গরিব মানুষের পক্ষে আছেন আমরা তাঁদের সকলের পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। জনগণের গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে এই ঐক্য জরুরি।
দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিরোধী দলগুলির শাসনে তাদের জনবিরোধী কার্যকলাপ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ফেটে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নীতি হল তাদের কোনও ছাড় নয়। কিন্তু গোটা দেশের প্রশ্নকে আমাদের অগ্রাধিকারে রাখতে হবে অন্যথায় রাজ্যের লড়াইগুলিও দুর্বল হবে। বিগত পাটনা পার্টি কংগ্রেসে আমরা এই লক্ষ্যে এক জাতীয় সেমিনার সংগঠিত করেছি। বিজেপি-বিরোধী সর্বাত্মক ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছি।
(২৬-২৭ মার্চ কলকাতায় কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে জারি করা বিবৃতি থেকে)
গত ২৩ মার্চ লোকসভার বিরোধী নেতা তথা কংগ্রেস দলের অন্যতম নেতা রাহুল গান্ধীকে ২০১৯ সালের নির্বাচন চলাকালীন একটি বক্তব্যের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের সাজা ঘোষণা করা হয়। অভূতপূর্বভাবে একদিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৪ মার্চ তাঁর লোকসভার সাংসদ পদ খারিজ করে দেন লোকসভার স্পিকার। এই সময়েই আমরা দেখেছি, দিল্লিতে ‘মোদী হঠাও দেশ বাঁচাও’ স্লোগান লেখা পোস্টার ছাপানোর অভিযোগে একশোর বেশি এফআইআর ও বেশ কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার করছে দিল্লি পুলিশ। বিবিসি’র ‘মোদী কোয়েশ্চেন’ তথ্যচিত্র প্রদর্শনের অভিযোগে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। দেশ জুড়ে মানুষের মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করে সমস্ত বিরোধী স্বরকে স্তব্ধ করতে কোনও কসুর করছে না ফ্যাসিস্ট মোদী সরকার।
২৫ মার্চ মৌলালি মোড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সিপিআই(এমএল) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড অভিজিৎ মজুমদার বলেন যে ঠিক যে সময়ে রাহুল গান্ধী বিরোধী নেতা হিসেবে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের মাধ্যমে সামনে আসা আদানির দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংসদে জোরালো সওয়াল করছেন তখনই এই আক্রমণ নামানো হল। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা যখন পুরনো পেনশন ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলন করছেন তখন মোদী সরকার ফরমান জারি করে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানানোর অধিকারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে। কাশ্মীরের প্রথিতযশা সাংবাদিক ইরফান মেহরাজকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করেছে এনআইএ। কন্নড় অভিনেতা চেতন কুমার কে একটি ‘হিন্দুত্ব’ সংক্রান্ত টুইটের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে কর্ণাটকের পুলিশ। অর্থাৎ যেন তেন প্রকারেণ মোদীর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত আওয়াজকে দমন করতে বদ্ধ পরিকর এই সরকার। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আজ আমাদের সবার কর্তব্য।
বিক্ষোভ সভার প্রধান বক্তা ছিলেন সিপিআই(এমএল) এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, রাহুল গান্ধীর সংসদের পদ খারিজ ভারতের গণতন্ত্রের উপরে এক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক যা নামিয়ে আনা হচ্ছে আইনি ও রাজনৈতিক – উভয় কৌশল প্রয়োগ করে। দিল্লির বুকে দাঙ্গা গণহত্যার সরাসরি প্ররোচনা দেওয়া বিজেপি নেতাদের ‘গোলি মারো’ স্লোগানের বিরুদ্ধে আদালতে গেলে আদালত সেই ‘নির্বাচনী ভাষণে’র মধ্যে কোন অপরাধ খুঁজে পায় না, কিন্তু বিরোধী দলের নেতাদের কণ্ঠ রোধ করার জন্য মানহানির মামলা এনে সর্বোচ্চ সাজা ঘোষণা করে দেওয়া হয় যাতে তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করে দেওয়া যায়। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ রোখার আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিরোধী মতকে দমন করতে, অথচ বিজেপির নেতা যারা খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের কোনো সাজা হচ্ছে না। সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক কাঠামোকে নস্যাৎ করে ভারতের রাজনৈতিক পরিসর, সংসদে, মিডিয়া সহ সর্বক্ষেত্রে আজ বিরোধী-শূন্য করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট আদানির কর্পোরেট জালিয়াতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্ক, এলআইসি সহ নানান ক্ষেত্রের সঙ্কটকেও সামনে নিয়ে এসেছে। এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেই আক্রমণ নামছে শুধু রাহুল গান্ধীর উপরেই নয়; ছাত্র, গবেষক, সাংবাদিক, অভিনেতা সবার উপরে। সুরাতের নিম্ন আদালতে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে এই রায় আসলে ২০২৪ এ নির্বাচনে বিরোধী শিবিরকে দুর্বল করে দেওয়ার চক্রান্ত। এই আইনি ও রাজনৈতিক ছকের বিরুদ্ধে আজ দরকার সার্বিক বিরোধী ঐক্যের। এই মুহূর্তে ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে চলমান সমস্ত রাস্তার আন্দোলনগুলির মধ্যে ঐক্য, বিরোধী দলগুলির সংযুক্ত প্রতিরোধ আজ সময়ের দাবি। সভায় অন্যন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কার্ত্তিক পাল, পার্থ ঘোষ, ইন্দ্রাণী দত্ত, অতনু চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু সহ আরও অনেকে। সভা পরিচালনা করেন কমরেড দিবাকর ভট্টাচার্য। বিক্ষোভসভায় শেষ বক্তা ছিলেন সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড সুচেতা দে। তিনি বলেন, রাহুল গান্ধীর সাজার মধ্যে দিয়ে আসলে দেশের প্রতিবাদী আন্দোলনরত মানুষদের বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে মোদী-অমিত শাহ ও তাদের আর্থিক মদতদাতা আদানি-আম্বানির বিরুদ্ধে কোন কথা বলা যাবে না। গণআন্দোলনের নেতাদের উপর ইউএপিএ’র মতো আইন প্রয়োগ করে তাদের দিনের পর দিন জেলে আটক করে রেখে, বিরোধী দলের নেতাদের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে আক্রমণের নিশানা বানানো হচ্ছে দেশ জুড়ে। দেশের গণতন্ত্র ও সংবিধানকে বাঁচাতে, দেশের মানুষ ও সম্পদকে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এটাই সময়। বিক্ষোভ সভা শেষ হয় মৌলালি মোড়ে ফ্যাসিস্ট নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল পোড়ানোর মধ্য দিয়ে। স্লোগান ওঠে, মোদী হটাও, দেশ বাঁচাও! গণতন্ত্র বাঁচাও দেশ বাঁচাও!
২৬ মার্চ হুগলির চকবাজারে সিপিআই(এমএল)’র পক্ষ থেকে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। দিনটা রবিবার হওয়ায় বাজারে ভিড় ছিল ভালোই। সভা শুরুর আগে প্রস্তুতির কাজ যখন চলছে সেই সময় মোদির কুশপুত্তলিকার সামনে বাজার করতে আসা একজন বাইক থামিয়ে বললো “মোদি নিপাত যাক”। স্থানীয় মানুষ জব্বারদা আমাদের সংগঠন করেন না, সভা চলাকালীন তিনি আমাদের পাতা চেয়ারে বসে থেকে বক্তব্য শুনলেন অনেকক্ষণ। পথ চলতি ও বাজার করতে আসা মানুষ উৎসাহভরে বক্তব্য শুনেছেন। সংগঠনের নির্মাণকর্মী, বাস শ্রমিক এবং মধ্যবিত্ত সাথীদের অংশগ্রহণও ছিল প্রাণবন্ত। পরিস্থিতি পার্টি কংগ্রেসে চিহ্নিত ফ্যাসিবাদের বিপদ ও তাকে মোকাবিলা করার কাজকে মূর্ত করে তোলে এবং কমরেডরাও তাতে সাড়া দেন। সভা চলাকালীন নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়, সমস্বরে স্লোগান ওঠে, “মোদী হঠাও, দেশ বাঁচাও”, “গণতন্ত্রের উপর ফ্যাসিবাদের সার্জিকাল আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঐক্য গড়ে তুলুন”। সভায় বক্তব্য রাখেন শ্যামল মজুমদার, সনৎ রায়চৌধুরী, সুদর্শন বসু ও ভিয়েৎ, সভাটির সঞ্চালনা করেন কল্যাণ সেন।
সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য জাতীয় কংগ্রেসের সম্পাদক মল্লিকার্জুন খড়গের কাছে পাঠানো এক লিখিত বার্তাতে বলেন,
“লোকসভা থেকে শ্রী রাহুল গান্ধীকে ডিসকোয়ালিফাই করার মর্মান্তিক ঘটনায় আমাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে এই চিঠি। ২০১৯ সালের প্রচারাভিযানের বক্তৃতার জন্য তাঁকে মানহানির ফৌজদারি মামলায় ফাঁসানো এবং গুজরাটের আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে তাঁর সাংসদ পদ ডিসকোয়ালিফাই করার এই ঘটনা ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর এক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ছাড়া আর কিছু নয়। মোদী-আদানি সম্পর্ক নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তুলে জবাব চাওয়ায় এবং আদানি কেলেঙ্কারির তদন্তে জেপিসি গঠনের জন্য বিরোধিরা জোরদার দাবি তোলায় মোদি সরকার প্রতিশোধমূলক আচরণ হিসেবে এটা করেছে।
আমরা এরকম সময়ে কংগ্রেসের সাথে আমাদের পূর্ণ সংহতি জ্ঞাপন করছি এবং গণতন্ত্রের উপর এই প্রতিহিংসার রাজনীতি তথা নির্লজ্জ আক্রমণের বিরুদ্ধে সমস্ত বিরোধী দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাবেশিত হওয়ার জন্য আরও একবার আবেদন জানাচ্ছি।”
রক্তচোষা শার্দূল যেন ওৎ পেতেই ছিল।
২০১৯-এ লোকসভা ভোটের প্রচারের সময় মোদী পদবি সংক্রান্ত রাহুলের মন্তব্যের দরুন যে মামলা হয়, তা ঝুলেই ছিল। আদানি মোদী-র সম্পর্ক নিয়ে রাহুল লোকসভায় যে বক্তৃতা দেন, তারপরই সেই চার বছর আগেকার ইস্যুটা যেন হঠাৎ প্রাণ ফিরে পেল। রাহুলের বক্তৃতা লোকসভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিলেন স্পিকার। আর ন’ দিনের মধ্যে সুরাতের আদালতে রাহুলের মামলা ‘ ফাস্ট ট্র্যাক-এ চলে যায়। কর্ণাটকে করা মন্তব্যে মানহানি মামলার বিচার হল গুজরাতের সুরাতে। আর, সুরাতের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট মানহানির ফৌজদারি মামলায় রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে দু’ বছরের কারাদন্ডের সাজা ঘোষণা করলেন। আর তার ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই লোকসভার সচিবালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেরলের ওয়েনাড়ের সাংসদ পদ খারিজ করে দিল। এবার শুরু হয়েছে পরবর্তী ঘুঁটির চালের প্রস্তুতি। নিজের পোষ মানা পা-চাটা ভৃত্য কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে আচমকা ওই সংসদীয় আসনে উপনির্বাচনের ঘোষণা! এইভাবে সমগ্র বিরোধী দলগুলোর কাছে কঠোর এক বার্তা দেওয়া – মোদী-বিরোধী যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে যেন তাঁরা তার পরিণতির কথা আগাম ভেবে রাখে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে নির্মম স্বৈরশাসক ইডি আমিনের কথা। তিনি বলেছিলন, “কে বলল আমার দেশে বাক স্বাধীনতা নেই! তবে বাকস্বাধীনতা প্রয়োগ করার পর তোমাদের স্বাধীনতা থাকবে কিনা তার গ্যারান্টি আমি দিতে পারবো না।” এদিকে, আলোচনা ছাড়াই পাস হল ফিনান্স বিল। আর সমস্ত বিতর্ক নির্বাসনে পাঠিয়ে পাস হল এবারের ৪৫,০৩,০৯৭ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব! অতিমারীর সুযোগে আমরা দেখেছিলাম, কিভাবে মোদী সরকার সংসদে একের পর এক বিলগুলোকে পাস করাল আলোচনা বিতর্ক ছাড়াই। গণতন্ত্রের সমস্ত ভড়ংকে ছিন্ন ভিন্ন করে।
পরের পর কিছু ঘটনা ঘটল গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। রাহুলের সাংসদ পদ খারিজের বিরুদ্ধে কংগ্রেস রাজঘাটে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিলে দিল্লি পুলিশ তা আটকে দেয়। দিল্লিতে কংগ্রেসের সদর দপ্তরের বাইরে ১৪৪ ধারা জারি হল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী, প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী জ্যাঁ দ্রেজ, রিচা সিং সহ আরও বেশ কয়েকজন কাজের অধিকার ও নরেগার উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নামিয়ে আনা হামলার বিরুদ্ধে কর্মসূচি নিলে, দিল্লি পুলিশ তা থামিয়ে কয়েকজনকে থানায় আটকে রাখে। “মোদী হঠাও - দেশ বাঁচাও” এই স্লোগানের পোস্টার দিল্লিতে দেখা দেওয়া মাত্র দিল্লি পুলিশ তুমুল সক্রিয়তা দেখিয়ে ১৪৪ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে দু’জন প্রেস মালিক সহ ছ’জনকে গ্রেপ্তার করে দু’হাজারের বেশি পোস্টার বাজেয়াপ্ত করে নেয়। বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি কর্মচারীরা পুরনো পেনসন স্কিম ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ এমনকি ধর্মঘটে সামিল হচ্ছেন। এর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি বিজ্ঞপ্তি জারি করে যে কোনো বিক্ষোভ, প্রতিবাদ করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসল।
দেশে একচক্ষু বিচারব্যবস্থার কাছে বিজেপি-কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের জন্য রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। নূপুর শর্মা, কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুরের চরম উস্কানিমূলক বিবৃতি বা ধর্ম সংসদের সেই সমস্ত গেরুয়াধারীরা খোলাখুলি সংখ্যালঘুদের গণ হত্যার আহ্বান জানালেও দেশের আইন তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে না। আইনমন্ত্রী বিচারব্যবস্থা ও কিছু বিচারপতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। বধির ভাবলেশহীন গোদী মিডিয়া ক্ষমতাকে তোষামোদ করতে নিজের গলায় স্বেচ্ছায় শেকল পড়েছে। গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠান, স্তম্ভ আজ অচল, অপ্রাসঙ্গিক। গভীর তমসাচ্ছন্ন আমাদের দেশ।
দেশবাসীর মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সংসদে প্রথম প্রবেশ করার আগে মোদী সাষ্ঠাঙ্গে প্রণিপাত করে বলেছিলেন এটা গণতন্ত্রের মন্দির!
গণতন্ত্রকে কন্ঠরুদ্ধ করে কবরে পাঠানোর আয়োজন সেদিনই তিনি শুরু করেছিলেন, আর সাষ্ঠাঙ্গে প্রণিপাত ছিল যেন আগাম শব সাধনা!
প্রচুর ঢাকঢোল পেটানো ‘গুজরাট মডেল’-এর নকশা ক্রমশই আরও কৌতুহলোদ্দীপক হয়ে উঠছে। এবং ২০২৩-এর শুরু থেকে তার গতিধারায় যে বাঁকগুলো এসেছে সেগুলোকে চাঞ্চল্যকর বললে বেশি বলা হয় না।
বছরের শুরুটা হল বেশ নাটকীয়ভাবে, বিবিসির দুই পর্বের তথ্যচিত্র ‘দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’ সামনে আসার মধ্যে দিয়ে। মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বে গুজরাটে গোধরা-পরবর্তী মুসলিম গণহত্যার আখ্যান বিবিসি-র মতো বিশ্বস্তরের মূলধারার মিডিয়ামঞ্চে পুনরায় প্রদর্শিত হওয়ায় কুড়ি বছর আগের ব্যাপক বিস্তৃত স্মৃতি আবার জেগে ওঠে। কুড়ি বছর আগে যখন ভারতের মিডিয়া আজকের মত গোদি মিডিয়ায় পর্যবসিত হয়নি তখন যেসব ঘটনা বহুল প্রচারিত হয়েছিল সেসব আবার জনস্মৃতিতে জেগে ওঠে। তাছাড়া, তথ্যচিত্রটি এতদিন অজানা আরেকটা বিষয়কেও প্রকাশ করে। ব্রিটিশ হাইকমিশন সেই সময় ঐ গণহত্যার তদন্ত করেছিল। এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলা সুপরিকল্পিত হিংস্র অভিযানে নরেন্দ্র মোদীকেই সরাসরি দায়ী বলে জানতে পেরেছিল সেই তদন্ত। আর এই গণহত্যার ধরনের মধ্যে একটি সম্প্রদায়কে নিকেশ করে দেওয়ার সমস্ত বৈশিষ্ট্যই উপস্থিত ছিল। ব্রিটিশ সরকারের তৎকালীন বিদেশ সচিব জ্যাক স্ট্রও এই বিষয়টা সত্যি বলে জানিয়েছেন। তথ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সে সময় নরেন্দ্র মোদী কেবল আক্ষেপ করছেন ‘মিডিয়াকে ঠিকঠাক সামলাতে না পারার’ জন্য, এবং মিডিয়াকে ঠিকঠাক সামলানো বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন কুড়ি বছর বাদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি তা পরিষ্কার করে দিলেন যখন তিনি ভারতের তথ্য প্রযুক্তি আইনের অধীনে জরুরি অবস্থার আশ্রয় নিয়ে ভারতের সমাজমাধ্যমে ঐ ভিডিও দেখানো নিষিদ্ধ করলেন এবং তারপর বিবিসির দিল্লী ও মুম্বই অফিসে আয়কর দপ্তরকে দিয়ে তল্লাশি অভিযান চালালেন।
বিবিসি প্রদর্শিত তথ্যচিত্র যদি গোটা দুনিয়ার সামনে মোদী সরকারের প্রকৃত চরিত্রকে উন্মোচিত করে দিয়ে থাকে, তবে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টও আদানি সাম্রাজ্যে এক অর্থনৈতিক ধ্বস নামায়। আদানি গোষ্ঠীর নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে ‘ভারতের গর্বের’ সঙ্গে একাকার করে তোলার প্রচেষ্টা এবং হিন্ডেনবার্গরিপোর্টকে ভারত-বিরোধী ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করাটা ভারতের জনমতের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পায়নি। আর বাস্তবে যেটা হয়েছে তা হল, আদানি কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত চালাতে একগুঁয়েভাবে অস্বীকার করে চলাটা জনগণের নজরকে আরও টেনে নিয়ে গিয়েছে আদানি কেলেঙ্কারির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টির দিকে — আদানি ও মোদীর সাটগাঁটের বাস্তব চিত্রের দিকে। গুজরাট মডেলের দুটো স্তম্ভ — বেলাগাম গণহত্যার রাজনীতি এবং অবাধ কর্পোরেট জালিয়াতি ও লুণ্ঠন — এমনভাবে উন্মোচিত হয়েছে ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে যা আগে কখনও হয়নি।
এখন আবার গুজরাট মডেলের স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো তৃতীয় এক মাত্রার সন্ধান আমরা পেলাম। এই তৃতীয় দিকটি মূর্তরূপ পেয়েছে কিরণ জগদীশভাই পটেলের মধ্যে যাকে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে এক ঠগবাজ হিসাবে। গত কয়েক মাসে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অতিরিক্ত ডাইরেক্টরের ছদ্ম পরিচয়ে জেড-প্লাস নিরাপত্তা নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা অঞ্চল বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করেন! সমাজমাধ্যমে তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে স্পষ্টতই জানা যাচ্ছে যে, বিজেপির সঙ্গে এবং ২০১৪ ও ২০১৯-এ মোদীর নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন এবং তিনি দাবি করেন যে, চরম সামরিক সজ্জায় সজ্জিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে ‘উন্নয়ন ও পর্যটনকে’ গতিশীল করে তিনি কাশ্মীরে মোদীর আরাধ্য কাজকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
যে সরকার মিথ্যা দাবির মধ্যে দিয়ে জনগণকে প্রতারিত করায় সবিশেষ দক্ষতা অর্জন করে, মিথ্যাচার উন্মোচিত হয়ে পড়লে যারা নির্লজ্জভাবে ‘জুমলা’ বলে খারিজ করে দেয়, আদানি কেলেঙ্কারির মতো বিশালাকায় কর্পোরেট জালিয়াতি নিয়ে যারা মুখ বুজে থাকে, সেই সরকার যে কিরণ পটেল আখ্যান নিয়েও টুঁ-শব্দটি করবে না তা স্পষ্ট। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এই ধরনের বড় মাপের বিচ্যুতি বা আরও ক্ষতিকারক ঘটনা থেকে যে প্রশ্নগুলো উঠে আসছে সেগুলো অবশ্যই উত্তর দাবি করে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অফিসারের মিথ্যা পরিচয় নেওয়াটা গুজরাটের এক ঠগবাজের পক্ষে স্বাভাবিক ফন্দি হতে পারে, কিন্তু কে তাকে জেড-প্লাস নিরাপত্তা দিল এবং তাও আবার জম্মু ও কাশ্মীরের মতো রাজ্যে? হয় ব্যবস্থাটা এতই নিষ্ফলা যে, কোনো একটা নাম নিয়েই এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগ থাকার ছলনা করেই যে কেউ এরকম ধাপ্পা দিতে পারে। আর সেটাই যদি উত্তর হয় তবে তথাকথিত রণনৈতিক গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে মোদী সরকার যে লম্বাচওড়া দাবি করে থাকে তা কালো টাকা ধ্বংসের জন্যই নোটবন্দী করার দাবির মতো নির্জলা মিথ্যা। অন্যথায় আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, কিরণ পটেল রাষ্ট্রের সুগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। এই অভিযোগও উঠেছে যে, কিরণ পটেলকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় সে সময় তার দুই সঙ্গিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ঘটা পুলওয়ামার বিস্ফোরণ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য কোনো উত্তর আমরা এখনও পাইনি। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক ভর্তি একটা গাড়ি কী করে উচ্চ নিরাপত্তার একটা কনভয়ে আক্রমণ চালিয়ে চল্লিশ জন সিআরপিএফ জওয়ানকে হত্যা করতে পারল? পুলওয়ামা আক্রমণ থেকে উঠে আসা প্রশ্নগুলোর মতোই আমরা জানতে পারিনি যে, সন্ত্রাসবাদী বলে কথিতদের পার করার সময় গ্রেপ্তার হওয়া ডিএসপি দাবিন্দার সিংকে কেন ভারতীয় রাষ্ট্র শুধু চাকরি থেকে বরখাস্ত করেই ছেড়ে দিল। কাশ্মীর এখন পুরোদস্তুর কেন্দ্রশাসিত এবং প্রবল রূপে সামরিক সজ্জায় সজ্জিত অঞ্চল এবং দাবিন্দার সিং আখ্যান বা কিরণ পটেল বৃত্তান্তর মতো গুরুতর গোয়েন্দা গাফিলতি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিচ্যুতির দায় সরাসরি বর্তায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ওপরই। আর একটা উদ্বেগজনক এবং একই ধরনের কদর্য ঘটনা এই মুহূর্তে পাঞ্জাবে ঘনিয়ে উঠছে অমৃতপাল সিংকে কেন্দ্র করে, পাঞ্জাবে যার উত্থানকে অনেকেই ভিন্দ্রানওয়ালের পরিঘটনার পুনরাবৃত্তি হিসাবেই দেখতে পাচ্ছেন। কিরণ পটেলের ঘটনার ক্ষেত্রে তার সঙ্গীদের ছেড়ে দেওয়া হয়, আর অমৃতপাল সিং ঘটনার ক্ষেত্রে তার সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে যদিও তিনি নিজে গ্রেপ্তারি এড়াতে সক্ষম হয়েছেন। অমৃতপাল সিং-এর দ্রুত উত্থান ঘটছে দীপ সিধুর উত্তরাধিকারী হিসাবে। এই দীপ সিধু হলেন পাঞ্জাবের এক অভিনেতা যিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রচার করেন এবং কৃষক আন্দোলন চলার সময় ২০২১ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে লাল কেল্লায় ঘটা হিংসার ঘটনায় এক মূল অভিযুক্ত এবং পরে যিনি মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় রহস্যজনকভাবে মারা যান। অমৃতপাল সিং-এর উত্থানের ঘটনাকে পাঞ্জাবে ব্যাপকতর স্তরেই বিশ্বাস করা হচ্ছে ১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশকের স্মৃতি-উদ্রেককারী সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে রাজ্যটাকে ঠেলে দেওয়ার বৃহত্তর দুরভিসন্ধির অংশ রূপে যে পর্বে পাঞ্জাব খালিস্তানী সন্ত্রাসবাদ এবং রাষ্ট্রের নামানো বিচার-বহির্ভূত সন্ত্রাস ও নিপীড়নের দ্বিমুখী আক্রমণে টলমল করছিল।
‘গুজরাট মডেল’-এর পাক যখন খুলে চলেছে এবং ভারত মোদী-আদানি গাঁটছড়ার বিপর্যয়কর অর্থনীতি ও রাজনীতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠছে, সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান তখন স্পষ্টতই মরিয়া হয়ে উঠে প্রতিটি চ্যুতি রেখাকে কাজে লাগিয়ে নিয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব ও বিভাজনকে গভীরতর করতে চাইছে, এবং ভারতকে আরও একনায়কতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনার লক্ষ্যে তারা সবকিছুই করবে। সজাগ থেকে বিক্ষিপ্ত বা বিভাজিত হতে অস্বীকার করা জনগণের শক্তিশালী ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনই এই দুরভিসন্ধিকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হবে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২১ মার্চ ২০২৩)
ভারতের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য রাজনীতিতে দুর্নীতি মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসেবে উঠে আসে। এই প্রশ্নে সরকারের পতন হতে বা কখনও কখনও কিছু নেতা মন্ত্রীকে জেলে যেতেও আমরা দেখেছি। কিন্ত দুর্নীতির বহর কমেনি, বাড়তেই থেকেছে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতির হিমালয়যাত্রা অধ্যায়ের সেই গল্পের মতো। দুধে জল মেশানো আটকানোর জন্য পরিদর্শকের সংখ্যা যত বাড়ছে, দুধের রঙ তত ঘোলা থেকে স্বচ্ছনীল হয়ে উঠছে। অবশেষে গোয়ালা বলতে বাধ্য হল যে পরিদর্শকের সংখ্যা আরও বাড়লে পরে দুধের মধ্যে এবার শামুক, ঝিনুক, চিংড়িমাছের প্রাদুর্ভাব ঘটার সমূহ সম্ভাবনা।
আশির দশকের শেষভাগে বোফর্স কেলেঙ্কারিকে ঘিরে ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটে যায়। রাজীব গান্ধীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাসম্পন্ন সরকারকে পরাজিত করে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং অকংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উঠে আসেন। তখন কথা উঠেছিল উঁচুতলার দুর্নীতি এবং বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কেনাবেচার ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে আটকাতে হবে। কিন্ত সেদিনের বোফর্সতোপ থেকে আজকের রাফেল বিমান – দুর্নীতির সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। কিছু নতুনত্ব অবশ্যই যুক্ত হয়েছে। দুর্নীতির পরিমাণগত মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ, আর দুর্নীতি সংক্রান্ত বহু খবর সামনে চলে এলেও ক্ষমতাশালী আজ এতই শক্তিমান যে সরকার এবং কোর্টের মধ্যে বন্ধ খামে কথা চলে, জনগণ কিছুই জানতে পারে না আর সরকারের গায়ে আঁচড়ও লাগে না।
বোফর্সের পর জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে দুর্নীতি আবার বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দেয় এক দশক আগে। ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় দফায় কয়লা ও টেলিকম কেলেঙ্কারি, দিল্লীর বুকে কমনওয়েল্থ গেমস কেলেঙ্কারি বিরাট ঝড় তুলে দেয়। দুর্নীতি রোধে জনলোকপাল আইন প্রণয়নের প্রশ্ন তুলে দিল্লীতে নতুন পার্টিবানিয়ে ক্ষমতায় চলে আসেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আর কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে সকলের ব্যাঙ্কে পনেরো লক্ষ টাকা ঢোকানোর স্বপ্ন দেখিয়ে দেশের মসনদে গদিয়ান হন নরেন্দ্র মোদী। কেজরিওয়ালের আপ এখন দিল্লী পেরিয়ে পাঞ্জাবেও রাজ্য সরকারের চালকের আসনে। কিন্ত জনলোকপালের আজও দেখা মেলেনি। আর কালো টাকা ধরার নামে নোট বাতিল করা মোদী সরকার এখন ইলেকটোরাল বন্ড চালু করে কালো টাকাকে সাদা করার নতুন পথ খুলে দিয়েছে। তাছাড়া দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাজনেতাদের জন্য রাতারাতি দায়মুক্ত হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ হল দলবদল করে বিজেপিতে নাম লেখানো।
বিভিন্ন রাজ্যের রাজনীতিতেও দুর্নীতির প্রশ্নে কখনও সরকার পরিবর্তন হতে, কখনও মুখ্যমন্ত্রী সমেত বিভিন্ন মন্ত্রীদের জেলে যেতে আমরা দেখেছি। তামিলনাড়ুতে জয়াললিতা থেকে হরিয়ানাতে ওম প্রকাশ চৌটালা, বিহারে লালুপ্রসাদ যাদব থেকে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালে পার্থ চট্টোপাধ্যায় – জেলে যাওয়া নেতা মন্ত্রীদের তালিকা খুব ছোট নয়। কিন্তু পরীক্ষার ফল প্রকাশ থেকে মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি থেকে যে কোনো চাকরিতে নিয়োগ – রাজ্যে রাজ্যে দুর্নীতির বহর বেড়েই চলেছে।
আসলে দুর্নীতি নিছক নৈতিক সমস্যা নয়, এর সমাধানও নিছক নীতিশিক্ষার মধ্যে নিহিত নেই। একটা খুব সত্যি কথা আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে শুনে আসছি – ক্ষমতা দুর্নীতি আনে, চরম ক্ষমতা আনে চরম দুর্নীতি। অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা মানেই অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি। আজ দুর্নীতির সমস্যা আসলে এই অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার সমস্যা। ক্ষমতার খেলা কোনে দুর্নীতির ঘটনাকে বড় করে তোলে, আর অনেক ঘটনাকে অবলীলাক্রমে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে এত দুর্নীতির মধ্যেও বোধহয় একমাত্র স্বস্তির ব্যাপার হল এ রাজ্যে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার নেই। তাই কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতে ক্ষমতার খানিকটা নিয়ন্ত্রিত ভারসাম্যের সৌজন্যে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক যুব-ছাত্র আন্দোলনের কিছু ফল দেখা যাচ্ছে।
এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি দেখা যাবে ডাবল ইঞ্জিন শাসিত রাজ্য মধ্যপ্রদেশে। ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে ন্যায় বিচার হওয়ার পরিবর্তে সাক্ষী, কেলেঙ্কারি উন্মোচনকারী ও সাংবাদিক সহ পঞ্চাশ জনের বেশি মানুষের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু ঘটেছে। বিহারে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির জের এখনও চলছে, কিন্তু মধ্যপ্রদেশে এর চেয়ে বহুগুণ বড় শিশুখাদ্য কেলেঙ্কারির কোনো তদন্ত নেই। ডাবল ইঞ্জিন সরকার মানেই অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা আর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা মানেই বেলাগাম দুর্নীতি এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের বেলাগাম দাপট।
নব্বই দশকের গোড়ায় যখন বাজারকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা চালু হয় তখন বলা হয়েছিল বাজার দুর্নীতিকে কম করবে। অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ মানে লাইসেন্স-কোটা-পারমিট রাজ আর তার মানেই দুর্নীতি। মুক্ত বাজার এনে দেবে দুর্নীতি মুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন। সেই বাজারসর্বস্ব অর্থনীতির তিন দশক আমরা পেরিয়ে এসেছি। দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসনের দেখা কিন্তু মেলেনি, এসেছে আদানি-আম্বানি কোম্পানি রাজ। ইংরেজিতে বলে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। বাংলা করা যেতে পারে দোসর পুঁজিবাদ। এখানে মোদীর হাত ধরে আদানি উঠে আসে, আদানির বিমানে মোদীর নির্বাচনের প্রচার চলে। সরকারের সৌজন্যে স্টেট ব্যাঙ্কের টাকায় আদানি অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাখনি কেনে, আবার সরকারেরই ফরমানে আদানি সেই অস্ট্রেলিয়ার কয়লা ভারতের বিদ্যুৎ কোম্পানিকে বিক্রি করে।
দু-হাজার ষোল সালের নভেম্বরে তুঘলকি ফরমান জারি করে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বাতিল করার সময়ও বলা হয়েছিল এবার কালো টাকা ও দুর্নীতির অবসান ঘটবে। কিন্ত এক হাজারের বদলে এলো দু হাজারের নোট। আর আজ যখন ইডি তল্লাশি চালিয়ে বিভিন্ন বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকার নোট উদ্ধার করছে এবং টেলিভিশনে তার ধারা বিবরণী ও প্রদর্শনী চলছে, তখন এটা স্পষ্ট যে নোটবাতিলের খেলায় আর যাই হোক কালো টাকা বা দুর্নীতির গায়ে সামান্য আঁচড়টুকুও লাগেনি।
দুর্নীতিবলতে আমাদের নজর সাধারণত চলে যায় বড় টাকার অঙ্কের দিকে। দু-একজন নেতা বা ব্যক্তিচরিত্রকে ঘিরে কিছুদিনের জন্য সংবাদমাধ্যম রীতিমত মেতে ওঠে, আমাদের মাতিয়ে রাখে। সময়ের গতিতে অন্য গল্প চলে আসে, দুর্নীতির কাহিনী আবার পর্দার আড়ালে চলে যায়। আর মূল ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নটি তো সবসময়ই অবহেলিত থেকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতির প্রসঙ্গ ধরা যাক। নিয়োগ দুর্নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার যুবক-যুবতীর দীর্ঘদিনের হার-না-মানা জেদ ও লড়াইয়ের ফলেই হাইকোর্টের রায়ে তদন্ত ও তল্লাশি, আর তার জের ধরেই টেলিভিশনে নোটের ছবি, বিচারপতির সাক্ষাৎকার। কিন্ত নিয়োগের কী হবে? সেই প্রশ্ন নিছকই আন্দোলনকারী ও তাদের কিছু সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রশ্ন হিসেবে থেকে যাচ্ছে।
উপরতলার দুর্নীতি বা বড় অঙ্কের দুর্নীতির পাশাপাশি ছড়িয়ে আছে দৈনন্দিন দুর্নীতির অসংখ্য উদাহরণ। খনন, ব্যবসা, সরকারী দফতর, পঞ্চায়েত কাঠামো, থানা, আদালত, শিক্ষা, চিকিৎসা – প্রায় সর্বত্র কম-বেশি দুর্নীতির উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। উপরতলার দুর্নীতির উৎস ক্ষমতার অপব্যবহার, নীচুতলার এই দুর্নীতির উৎস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের অধিকারহীনতা ও বিপন্নতা। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যাকে অবৈধ খনন হিসেবে চিহ্নিত করি একটু ভালো করে খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে তা আসলে এক সমান্তরাল খনন ব্যবস্থা যার এক প্রান্তে রয়েছে পুলিশ-প্রশাসন-পুঁজির মালিকের অসাধু চক্র আর অন্য প্রান্তে জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা নিরাপত্তাহীন শ্রমিক। এই দুই প্রান্তকে কি একই দুর্নীতির অংশীদার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়?
ক্ষমতার অপব্যবহারকে সবসময় আর্থিক উপার্জনের মাপকাঠিতে দেখলেও ঠিক হবে না। সাংবিধানিক সংস্থার সঠিক সংবিধানসম্মত পরিচালনা এবং রাষ্ট্রক্ষমতার ন্যায়সঙ্গত বিভাজন ও ভারসাম্য নির্ধারণ হল গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আজ যেভাবে বিচারবিভাগ ও সংসদীয় প্রণালীর উপর কার্যনির্বাহী শক্তি বা সরকারের নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে গণতন্ত্রের ভিত্তি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। যখন প্রধান বিচারপতি অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দিয়ে অবসর নেওয়ার পরই রাজ্যসভায় সদস্য হিসেবে মনোনীত হন বা একজন কার্যরত আমলাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর পদ থেকে ‘স্বেচ্ছা অবসর’ প্রদান করে নির্বাচন কমিশনে নিযুক্ত করা হয় তখন তাকে একমাত্র রাজনৈতিক দুর্নীতি হিসেবেই চিহ্নিত করা যেতে পারে।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও বেলাগাম হয়ে ওঠার প্রবৃত্তিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং জনগণের ব্যাপক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সকলের জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করে সর্বস্তরে স্বচ্ছ প্রশাসনকে সুনিশ্চিত করা – দুর্নীতি নিরসনের এটাই প্রকৃত রাস্তা। এককথায় বলতে গেলে গণতন্ত্র সম্প্রসারণের পথেই দুর্নীতির অপসারণ সম্ভব ও কাম্য।
(লেখাটি পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।)
শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিংয়ের ৯৩ তম শহীদ দিবসে আইসা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির উদ্যোগে মিন্টো পার্কে ভগৎ সিংয়ের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়।
২৩ মার্চ, ভাগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরুর মতো বীর যোদ্ধাদের শহীদ দিবস। যারা এই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বার্থে আত্মবলিদান দিয়েছিলেন। পাশাপাশি দিনটি বিপ্লবী কবি পাশ-এর শহীদ দিবস। তাঁদের এই বলিদানের কথা মাথায় রেখে, তাঁদের স্বপ্নের ভারত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের আরও জোরদার আন্দোলনের পথে এগিয়ে যেতে হবে। গোটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়ার স্বার্থে বিজেপি সরকার লাগু করতে চলেছে নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০ যা সরাসরি শিক্ষাকে গৈরিকীকরণ ও বেসরকারীকরণের লক্ষ্যে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষের যে নৈতিক অধিকার, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-বাসস্থানের অধিকার সুনিশ্চিত করতে এবং সর্বোপরি দেশের গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে এই ফ্যাসিস্ট বিজেপি, আরএসএস-কে মুছে ফেলতে শপথ নিতে হবে।
যাদবপুর ইউনিভার্সিটি আর্টস ইউনিটের পক্ষ থেকে শহীদ বেদীতে মাল্যদান এবং এক পথসভার আয়োজন করা হয়। সভাটি সূচনা করেন তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের গবেষক কমরেড রুদ্র প্রভাকর দাস, সভাটি সঞ্চালনা করেন কমরেড বর্ষা। এই সভায় আইসার পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কমরেড আকাশ। নয়া দিশার পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কমরেড সংকল্প। এসএফআই-এর পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখে কমরেড অগ্নিভ। ডিএসএফ আর্টসের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কমরেড রাজদীপ। এআইডিএসও-এর পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কমরেড শেখ আখতার আলি। এই সভায় বক্তব্য রাখেন যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সিএল ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তনী কমরেড নবকুমার বিশ্বাস। সভায় বিপ্লবী কবি পাশের একটি কবিতা পাঠ করেন কমরেড ইপিল এবং সভা শেষ করা হয় একটি গানের মাধ্যমে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। লড়াই আরো দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘজীবী হোক।
- ত্রিয়াশা
লিবারেশনের রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে ২৯ মার্চ এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়,
আন্দোলনরত সরকারি কর্মচারীদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর স্বৈরাচারী ও কুৎসিত মন্তব্যের নিন্দা ও ধিক্কার।
আজ মুখ্যমন্ত্রী সংবিধান প্রণেতা আম্বেদকরের মর্মর মূর্তির পাদদেশে ধর্নায় বসেছেন। অথচ প্রায় ৭০০ দিনের কাছাকাছি ন্যায্য নিয়োগের দাবিতে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের সাথে দেখা করার সময়ও তিনি পাননি। আর আজ ধর্ণারত শিক্ষক ও সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তিনি কুৎসিত মন্তব্য করেন!
ভারতের সংবিধান বেঁচে থাকার অধিকার ও প্রতিবাদ করার অধিকারকে মৌলিক অধিকার স্বীকার করেছে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে শুরু করে ন্যায় সংগত মজুরি, কর্মক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, প্রতিবাদ করার অধিকার বহু লড়াই আন্দোলনের অর্জিত ফসল।
ধিক্কারের বিষয় সংবিধান প্রণেতার মর্মর মূর্তির পাদদেশে বসেই মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনরত ডিএ, শূন্যপদে ন্যায় সংগত নিয়োগ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সরকারি ও সরকার-পোষিত কর্মচারীদের আন্দোলনকে কুৎসিত ভাষায় চোর ডাকাতের আন্দোলন বলে তারস্বরে গালাগালি দিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও স্বৈরতান্ত্রিক মন্তব্যকে বাংলার গণতান্ত্রিক মানুষ নীরবে মেনে নেবেন না।
গত রবিবার ২৬ মার্চ তিলজলা থানা এলাকায় একটি ৭ বছরের শিশু কন্যাকে অপহরণ করে যৌন নির্যাতন চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরে এলাকার মানুষজন ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতর পক্ষ থেকে রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত, সহকারী সম্পাদিকা চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, মিতালি বিশ্বাস এবং প্রতিবিধান পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য মধুরিমা বক্সী সোমবার ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্যাতিতার পরিবারের সাথে দেখা করতে চাইলে পুলিশের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হন। তিলজলা থানার ওসি বলেন ফরেন্সিক বিভাগ থেকে তদন্ত করতে এসেছেন তাই এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। যে পাড়ায় ঘটনাটি ঘটেছে সেইখানে মূলত শ্রমিক মানুষের বাস। গলির মধ্যে একদম গা ঘেঁষাাঘেসি করে বাড়িগুলো রয়েছে। অঞ্চলের মধ্যে এক গভীর নিস্তব্ধতা। সেইখানেই কয়েকজন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় শিশুটি নিখোঁজ হবার দু-ঘণ্টা পর পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তক্ষুনি পুলিশ এসে পৌঁছায়নি। এলাকায় লোকের মতে ঠিক সময়ে পুলিশ এসে পৌঁছালে হয়তো মেয়েটিকে বাঁচানো যেতে পারতো। শিশুটি যে ফ্ল্যাটে থাকে সেই ফ্ল্যাটের একতলায় অভিযুক্ত অলোক কুমার মেয়েটিকে মাথায় আঘাত করে, স্ক্রু ডাইভারের মতো কিছু জিনিস দিয়ে শিশুটির মাথায় ফুটো করে, হাত পা, মুখ বেঁধে বস্তায় পুরে রেখে দিয়েছিল। মেয়েটির সারা গায়ে নানান আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ঘটনার সাথে তান্ত্রিক যোগাযোগ নিয়ে ধন্ধ তৈরি হয়েছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনাকে আড়াল করার জন্য তান্ত্রিকের নাম নেওয়া হচ্ছে সেই কথাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এলাকার লোকের সাহায্য নিয়েই অভিযুক্তকে ধরা হয়। ওইসময় এলাকার মানুষের সাথে পুলিশের খন্ডযুদ্ধ বাধে। মৃতা শিশুটির বডি পোস্টমর্টেম করে এলাকায় না নিয়ে পরিবারকে সাথে নিয়ে পুলিশের আলাদা করে জ্বালিয়ে দেওয়াতেও লোকের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। থানার ওসি মহিলা সমিতির টিমকে জানান এখন এই ঘটনার তদন্ত করছেন লালবাজার হোমিসাইড বিভাগ। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান রাজ্যের মন্ত্রী জাভেদ খান। এবং খুব সহজেই ফরেনসিক তদন্ত চলাকালীন তিনি পরিবারের সাথে দেখা করতে চলে যান। সেইখানেই প্রেসের সামনেই মহিলা সমিতির টিম ওসিকে উদ্দেশ করে বলেন আমাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না অথচ মন্ত্রী কী করে ঢোকার অনুমতি পায়। এরপর ওসি বাধ্য হয়ে মৃত শিশুটির বাবার সাথে টিমের দেখা করিয়ে দেন। সন্তান হারানো শোকার্তবাবা জানান তাঁরা গরিব মানুষ, তিনি তাঁর মেয়ের খুনির কঠিন শাস্তি চান। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়েছে। এবং মেয়েটির উপর যৌন নির্যাতন হয়েছে কিনা তার তথ্য প্রকাশ্যে আনা হোক এবং পকসো আইনে তার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা হোক।
২০০২ সালে বিলকিস বানোর গণধর্ষন ঘটানায় যে ১১ জন অপরাধীর সাজা হয়েছিল, আর গত বছর গুজরাট সরকার যাদের মুক্তি দিল কারাগার থেকে, তাদের মধ্যে একজন অপরাধীকে দেখা গেল সরকারি অনুষ্ঠানে বিজেপির সাংসদের সাথে একই মঞ্চ ভাগ করে নিতে। বিজেপি সাংসদ যশবন্ত সিং ভাবর ও তার বিধায়ক ভাই শৈলেশ ওই কুখ্যাত অপরাধীর সাথে সরকারি অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে আসীন ছিলেন। যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী শৈলেশ ভাটকে বেশ খোশ মেজাজে ওই সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় যার আয়োজন করে গুজরাট জল বণ্টন ও সাফাই বোর্ডের পক্ষ থেকে দাহোড জেলার কারমাদি গ্রামে। দেখা গেল দাগী আসামী প্রথম সারিতে আসীন বিজেপি সাংসদ ও সিংভাদ তালুকের পঞ্চায়েত সভাপতির মাঝখানে বসে রয়েছে। মঞ্চের পেছনে ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী ভুপেন্দ্র পটেলের বিশাল ছবি।
হাওড়া জেলার বাগনানের জানা পাড়ায় হাওড়া জেলার সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি এবং এ আইসিসিটিইউ অনুমোদিত হাওড়া জেলার পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের যৌথ ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় একটি প্রাণবন্ত আলোচনাসভার মধ্য দিয়ে। সভায় সভাপতিত্ব করেন কমরেড অঞ্জনা মন্ডল, সুষমা মুখার্জী, কমরেড সবিতা কোলে। সভার সূচনা হয় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা কমরেড কল্যাণী গোস্বামীর মূল্যবান বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুষমা মুখার্জী ও মাধব মুখার্জী। অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ট্রেড ইউনিয়নের হাওড়া জেলা সম্পাদক কমরেড পার্থ ব্যানার্জী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য রাখেন হাওড়া জেলা নেত্রী সুষমা মুখার্জী এবং সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ কৃষি মজুর সমিতির হাওড়া জেলার এবং রাজ্য কমিটির দায়িত্বশীল কমরেড নবীন সামন্ত। সভায় উপস্থিত ছিলেন হাওড়া জেলা মহিলা সমিতির সভানেত্রী কমরেড সেরিনা শেখ। রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের রাজ্য সভানেত্রী কমরেড মীনা পালের বক্তব্য খুবই উৎসাহী করে আলোচনায় উপস্থিত সকল কমরেডদের। এই বৈঠকে মিড-ডে-মিল রন্ধনকর্মীরা তাঁদের কঠিন পরিশ্রমের কথা এবং সামান্য মজুরি, সরকার থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার কথা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেন। ছোট্ট সাথী মৌসুমী শেখ মধুর কন্ঠে সঙ্গীত পরিবেশন করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন ৩৯ জন। সভায় কয়েকটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এবং জেলা সম্পাদিকার সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেস্টারের উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে শুরু করে, ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ নামক বিবিসির ডকুমেন্টারি (ভারতে যা কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ ছিল) ও মোদীর ঘনিষ্ঠ দোসর তথা শিল্পপতি গৌতম আদানীর ব্যাপক জালিয়াতির পর্দা ফাঁস হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ব্রিটেনের বামপন্থীদের কাছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রকৃত চেহারা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। তাঁরা সচেতন হয়েছেন একাধারে, মোদী সরকারের চরম হিন্দু আধিপত্যবাদি শাসন, চূড়ান্ত মুসলিম-বিরোধিতা এবং হিংসাত্মক ও দমনমূলক প্রকৃতি সম্পর্কে। তৎসত্ত্বেও, ব্রিটেনের স্বল্প সংখ্যক মানুষই ভারতের বামপন্থীদের কার্যকলাপ নিয়ে ভাবিত ও জড়িত হচ্ছেন। আমরা প্রত্যেকেই জানি, আন্তর্জাতিকতার জন্যে বাম আন্দোলন ও দলগুলির মধ্যে সমন্বয় ও সংহতি স্থাপন অপরিহার্য।
সাউথ এশিয়ান সলিডারিটি গ্রূপ (মূলত ব্রিটিশ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়) দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসীদের সংগ্রামকে সমর্থন জানায়। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার বিপ্লবী বামপন্থী ও বহুমুখী প্রাণবন্ত জনআন্দোলনের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে চাই। গণতন্ত্রের জন্য, ফ্যাসিবাদকে রোখার জন্য সংগ্রামের দাবিগুলিকে সম্প্রসারিত করতে চাই।
আমাদের মধ্যে কয়েকজন ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের পাটনা শহরে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ১১তম পার্টি কংগ্রেসে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই সম্মেলন ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকার তথা মোদী সরকারের শাসনকে প্রতিহত করার দিকনির্দেশক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তাঁদের সম্মেলনের আলোচ্য বিষয়ে ‘প্রতিরোধের’ সংজ্ঞা কেবলমাত্র শ্রমিকদের সংগ্রাম কিংবা বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলির প্রচলিত কার্যকলাপের সাথে জড়িত নয়। সেখানে গুরুত্ব পায় একাধারে জাতপাত বিরোধী সংগ্রাম, পিতৃতন্ত্র বিরোধী লড়াই এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদ বিরোধী সংগ্রাম। বর্তমান ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন বিজেপির ব্রাহ্মণ্যবাদী মুসলিম-বিরোধী মতাদর্শ ও হিন্দু আধিপত্যবাদী সংগঠনগুলির চালানো নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিতে এগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
ভারতের বৈচিত্র্যময় বাম পরিসরের মধ্যে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন এক ভিন্ন ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা আন্তর্ভৌম মাওবাদীদের সশস্ত্র আন্দোলন থেকে পৃথক। অন্যদিকে তা, বর্তমানে মূলত দক্ষিণ ভারত ভিত্তিক সিপিআই(এম)’র সংসদীয় রাজনৈতিক কৌশলের থেকেও পৃথক ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, আমরা দেখেছি উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগের চেষ্টায় কিভাবে পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের সিপিএম সরকার মুখ থুবড়ে পড়ে।
বর্তমান ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধে সিপিআই(এমএল) উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। কারণস্বরূপ, দুটি বিষয় খুবই নজরকাড়া – প্রথমত, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে আন্দোলনগুলি আজও চিরন্তন তার কেন্দ্রবিন্দুতে অগ্রণী ভূমিকায় থেকেছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের বৃহৎ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারে (এটি ভারতের ‘হিন্দি-বেল্টের’ আওতায় থাকা অন্যতম একটি রাজ্য, যাকে বিজেপির সরকার হিন্দু আধিপত্যবাদের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করে) বিধানসভায় (স্বল্পসংখ্যক হলেও গুরুত্বপূর্ণ) ১২টি আসনে প্রতিনিধিত্ব করে। বিহারে তারা বামদলগুলির মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বিহার নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধী মহাজোটে যুক্ত হয়ে, বিহারের মসনদে মোদী সরকারকে ক্ষমতা বিস্তারে বাধ সাধতে সচেষ্ট হয়েছে।
বিহারের রাজধানী পাটনায় সিপিআই(এমএল)’র পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল, বিহার। সেই বিহারের মাটিতেই কান পাতলে বৈপ্লবিক ইতিহাসের কথা ধ্বনিত হয়। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি হিসেবে থেকেছে বিহার। ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলনের জন্ম এখান থেকেই, এই মাটিতেই সম্প্রসারিত হয়েছিল ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে ৭০ দশক জোড়া বিপ্লবী নকশালবাড়ি আন্দোলন। যা ঝড় তুলেছিল গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। যে উত্থানকে নির্মমভাবে চূর্ণ করেছিল দমনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। পুনরায় ভূমিহীন, দলিত এবং অন্যান্য নিপীড়িত জাতির ভূমি-মজুরি-মর্যাদা-অধিকারের জন্য গণরাজনৈতিক সংগ্রামের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৮০ দশকে রাম নরেশ রামের মতন দলিত নেতারা বিহারের আন্দোলনের রূপরেখা গড়ে তোলেন।
সিপিআই(এমএল) পার্টি আত্মগোপনে থাকালীন সময়ে সফলভাবে বহু এলাকায় জমিদারদের (এই জমিদারদের নিজেস্ব ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী ছিল যা ছিল হিন্দু আধিপত্যবাদী শক্তি দ্বারা সমর্থনপুষ্ট) মোকাবিলা করেছিল। পরবর্তীতে তারা জমি পুনর্বণ্টন, কৃষি-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, যৌন হিংস্রতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। উচ্চবর্ণের জমিদাররা প্রান্তিক জাতের মানুষদের নিপীড়ন করা তাদের জন্মগত অধিকার বলে মনে করতেন। এই আন্দোলন তার অবসান ঘটিয়েছে, অবসান ঘটিয়েছে ভোটকেন্দ্রের উপর জমিদারদের দমনপীড়ন ও একাধিপত্যের।
একই সময়ে পার্টি গ্রামীণ ও শহুরে শ্রমিক, কৃষক, মহিলা ও ছাত্রদের উন্মুক্ত গণসংগঠন গড়ে তোলার উপর ক্রমবর্ধমান সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে। ১৯৯২ সালে পার্টি নিজেই মাঠে নেমে গ্রামীণ কৃষক, নিপীড়িত জাতিগুলির মধ্যে তাদের ভিত্তি এবং সমর্থন বজায় রেখে এবং সুপরিচিত ছাত্র সংগঠন আইসা, মহিলা সংগঠন আইপয়া, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এআইসিসিটিইউ এবং আয়ারলার মতো গ্রামীণ শ্রমিকদের সংগঠন শক্তিশালী করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থে।
আমরা বিহারে পৌঁছাই পার্টি কংগ্রেস শুরুর একদিন আগে, যোগ দিই সিপিআই(এমএল) আয়োজিত “ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ কর, গণতন্ত্র বাঁচাও” স্লোগানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা একটি গণসমাবেশে।
রাস্তাগুলো মাইলের পর মাইল লাল পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে। কাস্তে-হাতুড়ির কমিউনিস্ট চিহ্ন দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। জানতে পারি, পুলিশি হয়রানি এড়াতে রাস্তায় এসব আয়োজন সেরে ফেলতে হয়েছে ভোররাতের মধ্যেই। ভোরের আলোতে আকাশ রাঙিয়ে ওঠার সাথে সাথে পাটনার মাটিতে ভিড় জমতে থাকে মানুষের। তাঁরা মূলত গ্রামীণ দরিদ্র মজদুর-মহিলা, কৃষি শ্রমিক, ক্ষুদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র শিল্পের শ্রমিক, স্কুল ও কলেজের ছাত্র এবং বেকার যুবক। তাঁরা কেউ এসেছেন ট্রেনে, সাইকেলে এবং অনেকে পায়ে হেঁটে।
সমাবেশ স্থলে রাত্রিযাপনের জন্য তাঁদের জিনিসপত্রের পাশাপাশি তাঁরা লাল পতাকা ও ব্যানার এনেছিলেন। তাঁদের মেজাজ ছিল, তাঁদের নিজস্ব দল, মা-লে-এর জন্য শহরের স্থান দাবি করার। সিপিআই(এমএল) বিহারে ‘মা-লে’ নামে পরিচিত।
ইতিমধ্যে ভেনিজুয়েলা, বাংলাদেশ, নেপাল এবং অস্ট্রেলিয়া, ভারতে অবস্থিত ইউক্রেনীয় সমাজতন্ত্রী এবং অন্যান্যদের সাথে অন্যান্য আন্তর্জাতিক অতিথিদের সমাগম শুরু হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের অতিথিদের ভিসা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং শ্রীলঙ্কা থেকে আসা অতিথিরাও সমস্যায় পড়েছিলেন, তাই তাঁরা প্যালেস্টাইন এবং কিউবার আমন্ত্রিতদের মতোই ভিডিওর মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
সমাবেশের দিন, বিস্তীর্ণ গান্ধী ময়দান আনুমানিক ১,৫০,০০০ লোকে পরিপূর্ণ ছিল। বক্তাদের ডাকে, তাঁদের দৃপ্ত কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি সহজে পরাজিত হবে এমন কোনো বিভ্রমের মধ্যে কেউ নেই। কিন্তু এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং জয়ী হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে একটি প্রচন্ড তৎপর ও শক্তিশালী শক্তি।
বক্তাদের কথায় উঠে আসে একাধারে, ভারতের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, বিজেপি সরকারের তীব্র মুসলিম ও খ্রিস্টান বিরোধী উন্মাদনা, দলিত নিপীড়িত বর্ণের মানুষদের উপর হামলা, পিতৃতান্ত্রিকতা ও দমনমূলক রাষ্ট্রীয় আক্রমণ ও খর্ব হওয়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা।
তাঁরা মোদির কুখ্যাত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করেন যা দেশের মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়। বিজেপি সরকার ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে, যে ধারা কার্যকরভাবে কাশ্মীরকে ভারতের সাথে সংযুক্ত রেখেছিল। এই ধারা বিলোপের মাধ্যমে কাশ্মীরের এতদিনকার সীমিত স্বায়ত্তশাসনটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়। নতুন শ্রম-কোড নিয়ে এসেছে মোদি সরকার যা শ্রমিকদের অধিকারকে পদদলিত করছে। বক্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পার্টির বিহার বিধানসভার জনপ্রিয় বিধায়করা। তাঁরা প্রায় সকলেই নিপীড়িত জাতি বা মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্গত এবং পার্টির তৃণমূল স্তরের কাজে অভিজ্ঞ। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শশী যাদব। তিনি স্কিম ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের নেতা যা হাজার হাজার নারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন, যারা ‘স্বেচ্ছাসেবক’ স্বাস্থ্যকর্মী, স্কুলের রন্ধনকর্মী এবং ক্রেশকর্মী হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাঁরা লড়াই চালাচ্ছেন সরকারি কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতির জন্য। উপস্থিত ছিলেন গণ-ভিত্তিক মহিলা সংগঠন ও অল-ইন্ডিয়া প্রগ্রেসিভ উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মীনা তেওয়ারি। তিনি মহিলাদের প্রতি আহ্বান জানান, আন্তঃধর্মীয় বিবাহকে অপরাধী করার নতুন আইন এবং মুসলিম ও দলিত মহিলাদের ধর্ষকদের প্রকাশ্যে অভিনন্দিত করার রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার।
সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় স্মরণ করিয়ে দেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং-এর কথা। তাঁকে ব্রিটিশদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। তিনি ‘বাদামী বর্ণের সাহেবদের’ বিষয়ে সতর্ক করে গিয়েছিলেন যারা সাদা সাহেবদের খালি করা চেয়ার অধিগ্রহণ করতে উদ্যত। প্রকৃতপক্ষে আজ সেটাই বাস্তব হয়েছে, কারণ এরাই আদানির মতো কর্পোরেটদের হাতে অভূতপূর্বভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। তিনি বলেন, ‘প্রকৃত গণতন্ত্রের রাস্তা সেই গ্রাম থেকে শুরু হয় যেখান থেকে মানুষ সমাবেশে এসেছেন এবং সবচেয়ে নিপীড়িত ও শোষিতদের দাবিতেই তা ধ্বনিত হয়।’
পরের দিন, প্রায় ১,৭০০ জন প্রতিনিধি মধ্য পাটনায় উপস্থিত হয়। তাঁরা কেউ এসেছেন উত্তরে হিমাচল কিংবা দক্ষিণে পন্ডিচেরি থেকে। কেউ কেউ কেরালা, পূর্বে কার্বি অ্যাংলং, আসাম থেকে, পশ্চিমে মহারাষ্ট্র থেকে। প্রাথমিক সেশনের পরে আগত অতিথিদের স্বাগত জানানো হয় একটি প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রতিনিধিরা বিভিন্ন খসড়া প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনার কাজ শুরু করেন। প্রথম নজরে ভয়ঙ্করভাবে দীর্ঘবলে মনে হলেও, পরে আলোচনা আকর্ষণীয় এবং উদ্দীপক রূপ ধারণ করে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে মতবিরোধ এবং বিতর্ক চলে। প্রতিনিধিরা হিন্দি বা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য রাখেন। অনুবাদকদের একটি দল অসাধারণ গতি এবং দক্ষতার সাথে কাজ করে প্রতিনিধিদের বক্তব্য ইংরেজি এবং হিন্দি উভয় ভাষাতেই প্রয়োজনমতো রূপপ্রদান করেছিলেন।
কর্ণাটকের একজন মহিলা স্যানিটেশন কর্মী ও ইউনিয়ন নেত্রী সাম্প্রতিক কিছু অনুপ্রেরণাদায়ক বিজয়ের বর্ণনা করেন৷ হিমালয়ের কোলের উত্তরাখণ্ড রাজ্য থেকে আগত একজন প্রবীণ পরিবেশবাদী এবং পার্টি কর্মী বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং পরিবেশগত ধ্বংসের ভয়ঙ্কর প্রভাব সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। যে প্রভাব সম্প্রতি একটি ঐতিহাসিক শহরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে ফেলেছে এবং ফাটল ও ধ্বসে বাড়িঘর এবং জমি ডুবে গেছে। দিল্লির একজন তরুণ মহিলা ছাত্রকর্মী পার্টিকে এলজিবিটিকিউ+ বিষয়গুলিতে আরও বেশি কিছু করার আহ্বান জানায়৷ অন্যরা ক্ষুদ্র-অর্থায়ন স্কিমগুলির দ্বারা সৃষ্ট ঋণের বিরুদ্ধে চলমান সম্মিলিত আয়োজন নিয়ে আলোচনা করেন। কেউ বা আবার জলবায়ু ন্যায়ের আন্দোলনকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
এই সম্মেলনের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল মোদি সরকারকে ফ্যাসিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা। মোদি শাসন কেবল ‘স্বৈরাচারী’ নয় কারণ এটি ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং মুসোলিনির ব্ল্যাকশার্টের আদলে তৈরি প্রকাশ্যভাবে ফ্যাসিবাদী একটি ক্যাডার-ভিত্তিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং-সেবক সংঘের(আরএসএস) অন্তর্গত এবং জবাবাধীন। তাবড় তাবড় হিন্দু আধিপত্যবাদী নেতারা খোলাখুলিভাবে তাদের প্রশংসা করেন এবং ভারতে হিটলার এবং নাৎসিদের অনুকরণে ফ্যাসিবাদ স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন। হিন্দুত্ববাদ প্রচারের স্বার্থে ব্যবহৃত ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ শব্দবন্ধটি একটি ভুল ধারণা, ঠিক যেমন ভাবে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের কোনো চিহ্ন মেলে না। বৈশ্বিক কর্পোরেট পুঁজি ও চলমান কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। এর পাশাপাশি সরকারের নিও-লিবারাল নীতি দেশটিকে ধীরে ধীরে বিদেশী কিংবা ভারতীয় পুঁজিপতিদের হাতে বেচে দিচ্ছে।
সম্মেলনে যোগ দিতে উপস্থিত ছিলেন, বিশিষ্ট লেখিকা অরুন্ধতী রায়। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে এই সময়ে সকল জাতপাত বিরোধী ও পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনগুলির একত্রিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা। তিনি বলেন, “বর্তমানে চারজন দ্বারা আমাদের দেশ ভারতবর্ষ পরিচালিত হচ্ছে : দু’জন দেশকে বিক্রি করছে (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ), আর দু’জন পুঁজির বিনিময়ে কিনছে : আম্বানি ও আদানি”। বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদী হিসেবে শ্রেণিকরণ করা কেবল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন নয়: আগামী দিনের কৌশল পরিকল্পনার জন্যও অপরিহার্য। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে, ফ্যাসিবাদী শক্তির মোকাবিলায় সম্ভাব্য বিরোধী জোট গঠন করা প্রয়োজন, যার মধ্যে বিগত দিনের প্রতিপক্ষরাও থাকতে পারে।
বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যে ফাঁক থেকে গেলেও, সাম্প্রতিককালে গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলি একে একে বিপন্ন হচ্ছে: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচারবিভাগ, ভোটাধিকার। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে বিরোধিদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। মোদীকে নির্বাচনে পরাজিত করতে হলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তথাপি এই সম্মেলন একদিকে ভারত ও বিশ্বব্যাপী উগ্র দক্ষিণপন্থী দলগুলির সাথে দীর্ঘলড়াইয়ের আহ্বান দেয়। অন্যদিকে, সিপিআই(এমএল)’র একাদশ পার্টি কংগ্রেস ডাক পাঠায় এক আমূল পরিবর্তনের : রাজনৈতিক ও সামাজিক দুই ক্ষেত্রেই। এই সম্মেললে প্রতিনিধিরা এই স্বপ্নকেই কীভাবে বাস্তবায়িত করবে তার পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা করেন।
labourhub.com.uk-তে প্রকাশিত।
ছবি প্রতিবেদকের।
ভাষান্তর: অনন্যা চক্রবর্তী
প্রথমেই মনে পড়ে গেল। সুকুমার বাবুর কথা, অর্থাৎ হযবরল-এর লেখক সুকুমার রায় এর কথা। হযবরল এর একটা অংশ উল্লেখ না করে শুরু করতে পারছি না।
“....প্যাঁচা একবার ঘোলা ঘোলা চোখ করে চারদিকে তাকিয়েই তক্ষনি আবার চোখ বুজে বলল, ‘নালিশ বাতলাও’।
বলতেই কুমিরটা অনেক কষ্টে কাঁদো কাঁদো মুখ করে চোখের মধ্যে নখ দিয়ে খিমচিয়ে পাঁচ ছয় ফোঁটা জল বার করে ফেলল। তারপর সর্দিবসা মোটা গলায় বলতে লাগল, ‘ধর্মাবতার হুজুর! এটা মানহানির মোকদ্দমা। সুতরাং প্রথমেই বুঝতে হবে মান কাকে বলে। মান মানে কচু। কচু অতি উপাদেয় জিনিস। কচু অনেক প্রকার, যথা – মানকচু, ওলকচু, কান্দাকচু, পানিকচু, শঙ্খকচু ইত্যাদি। কচুগাছের মূলকে কচু বলে, সুতরাং বিষয়টা একেবারে মূল পর্যন্ত যাওয়া দরকার।............”
একদম ঠিক, আমাদেরও একেবারে মূল পর্যন্ত যাওয়া দরকার। কোথা থেকে শুরু হোল? কে মানহানি করল? কার মানহানি হল? যাদের মানহানি হল তারা মানহানীর মামলা না করে কেই বা মামলা করল? পরিণতি কী হল? এই পরিণতি দেওয়ার উদ্দেশ্যই বা কী?
প্রথমত, ঘটনার সূত্রপাত কর্নাটকের লোকসভা নির্বাচনের আগে ২০১৯ সালের ১৩ এপ্রিলে কোলার-এর এক জনসভায় রাহুল গান্ধীর বক্তৃতার একটা অংশ নিয়ে। সেটা ছিল – “আচ্ছা, একটা ছোট প্রশ্ন। এই সবার নাম। এইসব চোরেদের নাম। মোদী মোদী মোদী কি করে হল? নীরব মোদী, ললিত মোদী, নরেন্দ্র মোদী। আরও একটু খোঁজ করলে দেখা যাবে আরো অনেক মোদী বেরিয়ে পড়বে।”
দ্বিতীয়ত, রাহুল গান্ধী যাদের নাম উচ্চারণ করেছিল তারা কেউ কিন্তু মানহানীর মামলা করলেন না। দেখা গেল, এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে গুজরাটের প্রাক্তন মন্ত্রী, বিজেপি বিধায়ক পূর্ণেশ মোদী ১৯ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে গুজরাটের নিম্ন আদালত সুরাট আদালতের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এ এন দাভের এজলাসে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৯, ৫০০ ধারায় একটা ফৌজদারি মানহানীর মামলা রুজু করলেন।
রাহুল গান্ধী ২৪ জুন ২০২১ তারিখে আদালতে ব্যক্তিগত ভাবে হাজির হয়ে নিজের বক্তব্যকে নথিভুক্ত করেছিলেন। এরপর অভিযোগকারী ২০২২ সালের মার্চ মাসে আদালতে আবেদন জানায় যাতে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে পুনরায় সামনস জারি করা হোক। বিচারক সেই আবেদন খারিজ করে দেন এবং দ্রুত আর্গুমেন্ট শুরু করার নির্দেশ দেন।
এক অদ্ভুত বিষয় আমরা লক্ষ্য করলাম। অভিযোগকারী এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি যাতে না হয় তারজন্য তড়িঘড়ি গুজরাট হাইকোর্টে গিয়ে নিজের করা মামলার উপর স্থগিতাদেশের আবেদন করলেন এবং ২০২২ সালের ৭ মার্চ স্থগিতাদেশ পেয়েও গেলেন! সাধারণভাবে যেটা দেখা যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি উচ্চ আদালতে যায় স্থগিতাদেশ পেতে। এখানে দেখা গেল অভিযোগকারী নিজের করা মামলার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ আনতে ছুটলেন!
আমরা আশ্চর্যের সাথে আরও লক্ষ্য করলাম ইতিমধ্যে রাহুল গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে আদানীর কী সম্পর্ক এবং ২০ হাজার কোটি টাকা সম্পর্কে জানানোর জন্য সোচ্চার হলেন তখন দেখা গেল পূর্ণেশ মোদী নিজেই গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে আবার গুজরাট হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ বাতিল করার আবেদন করলেন। আবেদনে জানালেন পর্যাপ্ত নথি ট্রায়াল কোর্টে এসে যাওয়ার পরেও বিচারে বিলম্ব করা হচ্ছে। হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ বাতিল করল এবং বিচারের দ্রুত নিষ্পত্তির আদেশ দিল।
আমরা এটাও দেখলাম ইতিমধ্যে সুরাট আদালতের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটও বদল হয়ে গেল। নতুন চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এইচ ভারমার বেঞ্চে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখেই মামলা শুরু হয়ে গেল। ৮ মার্চ ২০২৩ তারিখে শুনানির সময় রাহুল গান্ধীর আইনজীবী জানালেনও রাহুল গান্ধী নিরব মোদী, ললিত মোদী, নরেন্দ্র মোদীর নাম বলেছেন পূর্ণেশ মোদীর নাম বলেননি তাই পূর্ণেশ মোদীর কোনো অধিকারই নেই রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার বা মামলা করার। অভিযোগকারীর পক্ষের যুক্তি ছিল রাহুল গান্ধী সমস্ত মোদী পদবির সম্প্রদায়ের মানহানি করেছেন। তাই তার নাম না করলেও তার অধিকার আছে মোদী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মানহানির মামলা করার।
এক সপ্তাহের মধ্যে শুনানি শেষ হল। বিচারপতি জানালেন বিচারের রায় জানানো হবে। অবশেষে গত ২৩ মার্চ ২০২৩ তারিখে সুরাট আদালতের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এইচ ভারমা রায় ঘোষণা করে জানালেন – ১৮৬০ সালের ভারতীয় দন্ডবিধির ৪৯৯ এবং ৫০০ ধারার ফৌজদারি মানহানি মামলায় সাংসদ রাহুল গান্ধী দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সেকারণে রাহুল গান্ধীর ২ বছরের জেল এবং ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হল। এর সাথে সাথে এটাও জানালেন তাঁর আদেশ ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রইল ইতিমধ্যে রাহুল গান্ধী উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন।
আমরা দেখলাম ২৪ মার্চ ২০২৩ তারিখে ভারতীয় সংবিধানের ১০২(১)-ই অনুচ্ছেদ এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইন (১৯৫১)-র ৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ করলেন লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা। যে আইনে উল্লেখ আছে যদি কোনো সাংসদ বা বিধায়ক দোষী সাব্যস্ত হয় এবং শাস্তিস্বরূপ দু-বছর বা তার অধিক জেল হয় তাহলে তার সাংসদ বা বিধায়ক পদ খারিজ করা হবে।
এটা নতুন কিছু না এর আগেও এরকম সিদ্ধান্ত লোকসভা বা বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভায় নেওয়া হয়েছে। যেমন –
১) আজম খান - সমাজবাদী পার্টির নেতা আজম খানের বিধায়ক পদ উত্তর প্রদেশের বিধানসভা খারিজ করা হয়। ২০১৯ সালের এক বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জেরে কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে ৩ বছরের সাজা শোনায়। এরপর ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে তাঁর সেই পদ খারিজ হয়।
২) অনিল কুমার সাহানি - ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে বিহারের আরজেডি বিধায়ক অনিল কুমার সাহানির বিধায়ক পদ খারিজ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতারণার মামলা।
৩) জয়ললিতা : এআইএডিএমকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জয়ললিতার ২০১৪ সালে তামিলনাড়ু বিধানসভার বিধায়ক পদ খারিজ করা হয়। বেনামি সম্পত্তি মামলায় তাঁর ৪ বছরের জেলের সাজা কোর্ট ঘোষণা করে, তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করার পর। এরপরই তৎকালীন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাকে প্রশাসনের নেত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয় ও বিধায়ক পদ থেকে সরে যেতে হয়।
৪) পি পি মহম্মদ ফয়জল - লাক্ষাদ্বীপের সাংসদ পিপি মহম্মদ ফয়জল এক খুনের চেষ্টার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন ও তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় কোর্ট। এনসিপি নেতা ফয়জলেরও সাংসদ পদ খারিজ হয়। ২৫ জানুয়ারি কেরল হাইকোর্ট এই এই মামলায় স্থগিতাদেশ দেয়। তারপরও লোকসভা তার সাংসদপদ ফেরায়নি। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিলে ২৯ মার্চ আদেশ দেয় অবিলম্বে তার সাংসদ পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। সেই অনুযায়ী তিনি পদ ফিরে পান।
৫) বিক্রম সিং সাহানি - বিজেপির বিধায়ক বিক্রম সিং সাহানির যোগীরাজ্য উত্তর প্রদেশের বিধায়ক পদ থেকে খারিজ হয়। ২০১৩ সালের মুজাফ্ফরনগর দাঙ্গার মামলায় অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত হন। তাঁকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেয় কোর্ট। পরে তাঁরা বিধায়ক পদ খারিজ হয়।
৬) প্রদীপ চৌধুরী - ২০২১ সালে হরিয়ানা বিধানসভা থেকে বিধায়ক পদ খারিজ হয় কংগ্রেসের বিধায়ক প্রদীপ চৌধুরীর। এক মারধরের ঘটনায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন তিন বছরের কারাদণ্ডের সাজা পান।
৭) কুলদীপ সেনগার - হাইভোল্টেজ এক মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন কুলদীপ সেনগার। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল ও তিনি দোষী প্রমাণিত হন। এরপরই বিজেপির এই বিধায়কের যোগীরাজ্য উত্তর প্রদেশে ২০২০ সালে বিধানসভার বিধায়ক পদ খারিজ করা হয়।
৮) আবদুল্লাহ আজম খান - ১৫ বছর পুরনো এক মামলায় উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা আবদুল্লা আজম খান ২ বছরের কারাদণ্ডের সাজা পান। তারপর তাঁর বিধায়ক পদ খারিজ করা হয়। এবারও রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানি মামলা চালানোর পক্রিয়া, পরিণতি এবং লোকসভার স্পিকারের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে নিয়ে এলো।
সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন মামলার রায় এবং নির্দেশিকা এক্ষেত্রে মানা হয়নি। যেমন –
১) অভিযোগকারীর (পূর্ণেশ মোদি) নাম রাহুল গান্ধী বলেননি। যাদের নাম তিনি বলেছেন তারা কেউ মানহানির মামলা করেননি। তাহলে পূর্ণেশ মোদির কোনো অধিকার আছে কি রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার?
২) রাহুল গান্ধী তিনজনের নাম এবং তাদের পদবি সম্পর্কে বলেছেন, মোদি পদবির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। ফলে অভিযোগ খুব নির্দিষ্ট নয়।
৩) রাহুল গান্ধী থাকেন দিল্লির ঠিকানায়। বক্তব্য রেখেছেন কর্নাটকে মানহানির মামলা হল গুজরাটের সুরাট আদালতে। আদালতের এক্তিয়ার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
৪) এই ধরনের মামলা শুরু করার আগে যে পর্যাপ্ত ইনকোয়ারি বা সাক্ষী সাবুদের প্রক্রিয়ার বিষয় আছে তা ম্যাজিস্ট্রেট মেনে ছিলেন কি?
৫) আাদালত দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি ঘোষণার সাথে সাথেই তা ৩০ দিনের জন্য যখন স্থগিতাদেশ দিলেন তাহলে লোকসভার স্পিকারের কি তাকে মান্যতা দেওয়া উচিত ছিল না?
৬) সুরাত আদালত যে রায় ঘোষণা করল তা লোকসভার স্পিকারকে অফিসিয়ালি জানিয়েছিল কিনা?
৭) আরটিক্যাল ১০২(১) অনুযায়ী ভারতের রাষ্ট্রপতির অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কিনা?
৮) রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনের মত নিয়েছিলেন কিনা?
৯) সুপ্রিম কোর্টের গাইড লাইনে এটাও স্পষ্ট বলা আছে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে যদি অভিযুক্ত উচ্চ আদালতে না যান তাহলে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন কার্যকরী করা যেতে পারে। এমনকি অভিযুক্ত উচ্চ আদালতে যাওয়ার পর তার বিচার যদি তিন মাস সময়সীমা অতিক্রমও করে তাহলেও তার সাংসদ বা বিধায়ক পদ খারিজ করা যাবে না।
এরকম বহু প্রশ্নের উত্তর আজ ভারতবর্ষের জনগণ পেতে চাইছে। তাই আমরা দেখলাম অপরাধ ঘৃণ্য বা গুরুতর না হলে জনপ্রতিনিধিদের পদ খারিজ না করার আর্জি জানিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হল। মামলাটি করলেন কেরলের এক সমাজকর্মী আভা মুরলীধরন।
রাহুল নিজে তাঁর বিরুদ্ধে সুরত আদালতের রায় কিংবা সাংসদ পদ খারিজের বিরুদ্ধে এখনও কোনও পদক্ষেপ করেননি। উচ্চতর আদালতে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনও জানাননি। তার আগেই আইনের সংশোধন চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে।
মামলাকারীর বক্তব্য, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন (১৯৫১)-এর ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সংশোধন প্রয়োজন। জনগণ দ্বারা নির্বাচিত কোনও প্রতিনিধির সাংসদ বা বিধায়ক পদ এভাবে খারিজ করে দেওয়া স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচায়ক। আদালতে এই আইনকে সংবিধান-বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। মামলাকারী এ-ও জানিয়েছেন, যে কোনও অপরাধেই জনপ্রতিনিধির পদ খারিজ করে দেওয়া আসলে ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিপন্থী। সাংসদ পদ খারিজের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় পর্যালোচনা করা হয়, তা জানতে চেয়েও জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জনস্বার্থ মামলায় বলা হয়েছে, কোনও সাংসদের পদ খারিজ করার আগে অভিযুক্তের ভূমিকা, মামলার প্রকৃতি, নৈতিকতা সহ একাধিক বিষয় পর্যালোচনা করা উচিত। শীর্ষ আদালতে দাখিল করা আবেদনে বলা হয়েছে, “৮(৩) ধারার ব্যবহার করে সাংসদ পদ খারিজের নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের মিথ্যা রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণ করছে। এরফলে জনপ্রতিনিধিত্বের যে গণতান্ত্রিক কাঠামো রয়েছে, তাতে সরাসরি আঘাত করা হচ্ছে। এরফলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।”
জনস্বার্থ মামলার আর্জিতে আরও বলা হয়েছে, “রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যথেচ্ছভাবে এই আইন ব্যবহার করছে। সাংসদদের অপরাধ যাই-ই হোক না কেন, অপরাধের প্রকৃতি, তা কতটা গুরুতর, সেই সমস্ত বিষয় পর্যালোচনা না করেই সাংসদ পদ খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে। এটি সাধারণ ন্যায়বিচারের বিরোধী, কারণ একাধিক ক্ষেত্রেই শাস্তির রায় পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের অধীনে কী কী শর্তে সাংসদের পদ খারিজ করা হয়, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য আবেদন করা হয়েছে। পরিশেষে এটা বলাই যায় লোকসভার ঠাণ্ডা ঘরে বিরোধী কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে পূর্ব পরিকল্পিত, উদ্দেশ্যমূলক এই মামলা। এমনকি বিচারালয়গুলিকে শাসকের নিয়ন্ত্রণে আনার এক নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করা হল।
তাই আবার সুকুমার রায়ের হযবরল-এর একটা অংশ দিয়েই এই প্রবন্ধ শেষ করলাম – “.... শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি মোকদ্দমার কিছু জান?’ হিজিবিজ্বিজ্ বলল, ‘তা আর জানিনে? একজন নালিশ করে, তার একজন উকিল থাকে, আর একজনকে আসাম থেকে নিয়ে আসে, তাকে বলে আসামী, তারও একজন উকিল থাকে। এক একদিকে দশজন করে সাক্ষী থাকে। আর একজন জজ থাকে, সে বসে বসে ঘুমোয়।’ প্যাঁচা বলল, কক্ষনো আমি ঘুমোচ্ছি না, আমার চোখে ব্যারাম আছে তাই চোখ বুজে আছি’। হিজিবিজ্বিজ্ বলল, আরও অনেক জজ দেখেছি, তাদের সক্কলেরই চোখে ব্যারাম।’ বলেই সে ফ্যাক্ ফ্যাক্ করে ভয়ানক হাসতে লাগল।”
– দিবাকর ভট্টাচার্য
হিন্দুত্বের উন্মোচনে গ্রেপ্তার
কন্নড় চলচ্চিত্রাভিনেতা ও সক্রিয় সমাজকর্মী চেতন কুমারকে গত ২১ মার্চ তাঁর বেঙ্গালুরুর বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে গ্রেপ্তার করে আদালতে তুলে ১৪ দিনের জেল হেফাজতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর ‘অপরাধ’, তিনি সমাজ-মাধ্যমে টুইট করেছিলেন, “হিন্দুত্ব নির্মিত হয়েছে মিথ্যাচারের ওপর।” বছর ৪০-এর এই অভিনেতাকে বিগত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরও একবার সমস্যায় পড়তে হয়েছিল কর্ণাটক হাইকোর্টের এক বিচারপতির বিরুদ্ধে মন্তব্য করার কারণে। সেবারও তাঁকে গ্রেপ্তার করে ৬ দিন কারাগারে থাকতে বাধ্য করা হয়।
(টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া ২২ মার্চ’২৩)
দিল্লী পুলিশের দৌরাত্ম্য
কয়েকদিন ধরে দিল্লী পুলিশ মানহানি করার দায়ে ১৫৯টি এফআইআর করেছে। এর মধ্যে ৪০টি এফআইআর হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করে পোস্টার লাগানোর অভিযোগে। পোস্টারে প্রকাশক ও মুদ্রকের কোনো পরিচিতি ছিল না। পুলিশ কিন্তু ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে মামলা দিয়েছে। পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছে, এই অভিযান চালিয়ে ২০০০-এরও বেশি পোস্টার তুলে ফেলা হয়েছে। এইসমস্ত পোস্টার লাগানো হয়েছিল রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, হস্টেল ও অন্যান্য জায়গায়। গ্রেপ্তারি অভিযানের শিকার হওয়ার মধ্যে একজন হলেন শ্রমজীবী, যিনি ডিডিইউ মার্গ দিয়ে ভ্যানে করে অর্ডারি পোস্টার সাপ্লাই দিতে যাচ্ছিলেন। বাদবাকি ১১০টি এফআইআর করা হয় সাধারণ অভিযোগে। দিল্লী পুলিশের বিশেষ শাখা হুমকি দিয়েছে এই ধরনের অভিযান চালিয়েই যাবে।
(টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া ২৩ মার্চ’ ২৩)
ইডি’র ডিরেক্টরের মেয়াদবৃদ্ধি বেআইনিভাবে
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যেভাবে আইনের সংশোধনী এনে ইডি’র বর্তমান ডিরেক্টেরের চাকরির মেয়াদকাল আরও এক দফা বাড়ানো হল এবং এই পরিবর্দ্ধন যে তিন-তিনবার করা হল, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। এইভাবে হস্তক্ষেপ করা এহেন তদন্ত অনুসন্ধানকারী সংস্থার স্বতন্ত্রতা ও একীকৃত অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে আপস করাই সাব্যস্ত হয়। এই অভিযোগ সুপ্রীম কোর্টে দায়ের করেছেন এক প্রবীণ আইনজীবী কে বি বিশ্বনাথন। তিনি তিন সদস্যের এক ডিভিশন বেঞ্চে তাঁর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানান, এ্যাপেক্স কোর্ট থেকে গত কয়েক বছর ধরে পুলিশী ক্ষমতার সংস্কার তথা এজেন্সীগুলোকে সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখার বিষয়ে বিভিন্ন রায় বেরিয়েছে। তাই সরকারের তরফে আবার এমন কিছু সংশোধনী নিয়ে আসা হচ্ছে যার প্রয়োগে আইনের শাসন ঠিক বিধিসম্মত হবে না, বরং ঘটবে তার অপব্যবহার। যেমন, সরকারের প্রিয়পাত্রদের মেয়াদ বাড়বে। এটা বেআইনি এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় লঙ্ঘন করার সমার্থক।
(টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া ২৪ মার্চ’২৩)
গুজরাটে দু’বছরে হেফাজতে মৃত্যু ১৮৯ জনের
গুজরাটে ২০২১ ও ২০২২ পরপর দু’বছরে হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ১৮৯ জনের। এই তথ্য উল্লেখ করে ২৪ মার্চ’ ২০২৩ গুজরাট বিধানসভায় বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিরোধী দলের জনৈক কংগ্রেস বিধায়ক। তথ্যের সঠিকতা এমনই যে তা আর অস্বীকার করা রাজ্যের বিজেপি সরকারের দিক থেকে সম্ভব হয়নি। সরকারপক্ষ প্রত্যুত্তরে বলে, ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ২০২১ সালে, বাকি ৮৯ জনের ২০২২ সালে। এর মধ্যে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের হেফাজতে, ১৫৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে জেল হেফাজতে। বিজেপি সরকারের তরফে গৃহীত পদক্ষেপ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত পুলিশ ও কারা অফিসাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এফআইআর করা হয়েছে, বিভাগীয় তদন্ত চলছে, সাসপেনশন অর্ডার সহ শাস্তিমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ করা হয়েছে। অন্যদিকে মৃতদের পরিবার প্রতি ১৭ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ করা হয়েছে।
(টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া ২৫ মার্চ’২৩)
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানি
ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে উৎপাদনসামগ্রী তৈরিতে অংশগ্রহণে অনুমোদন দেওয়া বিদেশী কোম্পানির সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৪৪। এ খবর ২৪ মার্চ সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে জানানো হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। জানিয়েছেন অধঃস্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অজয় ভাট। তিনি এটাও বলেছেন, ‘সরকার বিগত বছরগুলিতে বহু পলিসিগত উদ্যোগ ও সংস্কারসাধনের ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে দেশে দেশজ নকশা, তার মান উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে উৎসাহ নিয়ে আসা যায়, এবং তার ফলে আমদানি নির্ভরতা কমে।’ ভারতে প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনে অংশ নিতে ঠিক কত বিদেশী কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ সেটা বোঝাতেই কোম্পানির মোট সংখ্যা উল্লেখ করেছেন।
(টাইমস অফ ইন্ডিয়া ২৫ মার্চ’২৩)
ওষুধের দাম বাড়বে ফের
এপ্রিল মাস থেকেই আবার একগুচ্ছ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম বাড়তে চলেছে। এর তালিকায় রাখা হয়েছে পেইনকিলার, অ্যান্টি-ইনফেকটিভ, অ্যান্টিবায়োটিক, কার্ডিয়াক ড্রাগস্ জাতীয় ওষুধ। এই মূল্যবৃদ্ধি প্রভাব ফেলবে মুদ্রাস্ফীতির গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। ভারত সরকার ইতিমধ্যেই ওষুধ তৈরির কোম্পানিগুলোকে সংকেত জানিয়ে দিয়েছে পাইকারি মূল্য সূচকে পরিবর্তন উল্লেখ করে দিতে। ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিকাল প্রাইসিং অথরিটি সেই অনুমোদনের কথা জানিয়ে দিয়েছে, এবং মূল্যবৃদ্ধি হবে ১২ শতাংশের মতো।
(টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া ২৮ মার্চ’২৩)
গত ২০ মার্চ ফ্রান্সের সংসদের নিম্নকক্ষে রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল মাকোঁর সরকারের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব মাত্র নয় ভোটের জন্য পরাজিত হল। বহু বিতর্কিত পেনশন-সংস্কারের বিরুদ্ধে এই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল। ২৭৮ সদস্য অনাস্থার পক্ষে ভোট দেন, প্রয়োজন ছিল ২৮৭ ভোট। এই প্রস্তাব যদি পাস হতো তাহলে প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ বর্নের সরকারকে পদত্যাগ করতে হতো, যদিও মাকোঁ রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকতেন। অল্পের জন্য তাঁর সরকার বেঁচে গেলেও মাকোঁ অদম্য। তিনি বলে দিয়েছেন সরকারে কোনও অদলবদল হবে না, নতুন করে নির্বাচন হবে না, পেনশন-সংস্কারের ওপর কোনও গণভোটও হবে না। এর অর্থ এই সংস্কার আইন হয়ে গেল, যদি না মাকোঁ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটা রদ করেন। আন্দোলনকারীরা কিন্তু এই সংস্কারগুলি রদের দাবিতে অনড় যা এই সরকারের অপসারণ ছাড়া এখন কোনওভাবেই সম্ভব নয়। অতএব ভবিষ্যৎ দিনগুলি ফ্রান্সে যে অগ্নিগর্ভ হবে তা বলাই বাহুল্য।
এতো বিতর্কিত পেনশন-সংস্কার আদপে কী? এর ফলে ২০৩০ এর মধ্যে অবসরের বয়স ৬২ থেকে ৬৪ করা হবে। এই লক্ষ্যে প্রতি বছর অবসরের বয়স তিন মাস করে বাড়ানো হবে। এছাড়া পুরো পেনশন পেতে হলে ৪৩ বছর চাকরি করতে হবে। একই সঙ্গে ৬৭ বছর হচ্ছে চাকরি বা কাজের সর্বোচ্চ বয়স। সরকারের যুক্তি গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে দেশে বরিষ্ঠ নাগরিকের সংখ্যা বাড়ছে (ফ্রান্সে গড় আয়ু ৮২.১৮, ভারতে ৭০.১৫) এবং সেই কারণে পেনশন বিল ঊর্ধ্বমুখি। তাদের আরও দাবি পেনশন তহবিল প্রায় দেউলিয়া এবং সংস্কার নাহলে নাকি পেনশন কাঠামো ভেঙে পড়বে।
আন্দোলনকারীরা বলছেন পেনশন তহবিল দেউলিয়া এই কথাটা মিথ্যা। যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে তাও অতিরঞ্জিত। দীর্ঘমেয়াদে যদিবা তহবিলে ঘাটতি দেখা যায় তা ধনীদের ওপর সম্পদ কর বৃদ্ধি করে পূরণ করা যেতে পারে কিংবা পেনশন ব্যবস্থাকে মুদ্রাস্ফীতি থেকে বিযুক্ত করা যেতে পারে। তাঁরা এও বলছেন যে চাকুরিজীবীদের মাইনে থেকে প্রতি মাসে কিছু অধিক অর্থকেটে নেওয়া যেতে পারে। একটি যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলছেন যাঁদের আয়ু কম, যাঁরা ছোটোখাটো কাজ করেন, ক্যাজুয়াল বা বদলির কাজ, এবং যাঁরা অধিক মেহনতি কাজ করেন তাঁরা এই সংস্কার দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অধিক পরিশ্রমের ফলে এঁরা বেশি অসুস্থ হন, চাকরির মোট সময়সীমাও কম হয়, যার ফলে এঁদের পেনশন কম হবে। নারী শ্রমিক কর্মচারীরাও এই সংস্কারের ফলে অধিক বঞ্চিত হবেন। বর্তমানে চালু ব্যবস্থাতেই তাঁরা পুরুষদের থেকে ৪০% পেনশন কম পান। এই প্রকট বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে। মহিলাদের পরিবারের কারণে অনেক বেশি ছুটি নিতে হয়, অন্তঃসত্ত্বাকালীন ছুটি তো আছেই। একই কারণে তাঁরা পার্ট-টাইম কাজ করেন, এর ফলে তাঁদের বেশি বছর চাকরি করতে হয়।
যুব সংগঠনগুলি অবসরের বয়স কমিয়ে ৬০ করার দাবি জানিয়েছে। তাঁদের অন্য দাবিগুলি হল : ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা; অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বাজারদর স্থিতিশীল করা; পরিবেশ রক্ষার্থে বিনিয়োগ করা; বিভিন্ন গণ-পরিষেবা যেমন যাতায়াত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদিতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো। মাকোঁর আনা সংস্কারের তীব্র বিরোধিতা করে ‘ইয়ং কম্যুনিস্ট মুভমেন্ট অব ফ্রান্স’ বলছে, মাকোঁর উদ্দেশ্য পরিস্কার, তিনি যুবদের বেকার রাখতে চান, বয়স্কদের খাটিয়ে মারতে চান।
ফ্রান্সের একটি ওয়েবসাইট ইকোনমিস্ট ডট কম বলছে পেনশন সংস্কারকারীদের কাজ গ্রিক পুরাণের সিসিফাসের চেয়ে দুরূহ — যতই তাঁরা পাথরটা ওপরে ঠেলে তুলতে চায়, ততোই সেটা গড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৫ সালে প্রবল বিক্ষোভের কারণে তৎকালীন জাক্ শিরাক সরকার পেনশন কাঠামোয় পরিবর্তন মুলতুবি রাখতে বাধ্য হয়। ২০১০-এ নিকোলাস সারকোজি অনেক চেষ্টা করে অবসরের বয়স ৬০ থেকে ৬২ করতে সক্ষম হন। ২০১৭ সালে প্রথমবার রাষ্ট্রপতি হবার পর মাকোঁ সংস্কার লাগু করার চেষ্টা করেন কিন্তু মানুষের প্রবল বিরোধীতা এবং কোভিড অতিমারীর কারণে তা মুলতুবি রাখতে বাধ্য হন। এই বছরের জানুয়ারি মাসে আবার সংস্কারের প্রস্তাব ঘোষণা হয়। কয়েক দিনের মধ্যে বিরোধী শ্রমিক সংগঠনগুলি, কম্যুনিস্ট পার্টি, গ্রিন পার্টি, অন্যান্য বাম দল, এমনকি দক্ষিণপন্থী দলগুলির একাংশ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। পুরো দেশজুড়ে ধর্মঘট হয়, প্যারিসে কয়েক লাখ মানুষের বিপুল সমাবেশ হয়।
আন্দোলনের তীব্রতা রাষ্ট্রপতিকে ভীত করে। গত বছরের নির্বাচনে তাঁর রেনেসাঁ পার্টি ন্যাশানাল এসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। সংসদে ভোটাভুটিতে হেরে যাওয়ার ভয়ে মাকোঁ সংবিধানের বিতর্কিত ধারা ৪৯.৩ প্রয়োগ করেন। এই ধারা সরকারকে বিনা ভোটে আইন প্রণয়ন করার অধিকার দেয়। একই সাথে অভিনবভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনারও অধিকার দেয়। আমরা দেখেছি সরকার এই অনাস্থা প্রস্তাব কোনও রকমে উতরে যায়। কিন্তু তাদের যে ভোটাভুটি এড়িয়ে, বিতর্কিত ধারা প্রয়োগ করে আইন প্রণয়ন করতে হয়েছে, এটাই সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে। অনেকের মতামত সংসদকে এড়িয়ে সংবিধানের বিশেষ ধারা প্রয়োগের অর্থ আমরা গণতন্ত্র নয় রাজতন্ত্রে আছি!
গত বৃহস্পতিবার দেশজুড়ে আবার একদফা ধর্মঘট পালিত হয়। এছাড়া লাগাতার বিক্ষোভ সমাবেশ তো চলছেই। সাফাই কর্মচারীদের ধর্মঘটের কারণে সারা প্যারিস জুড়ে আবর্জনার স্তূপ দাউদাউ করে জ্বলছে। বহু স্কুল কলেজ বন্ধ। কিছু জায়গায় বিমানবন্দরে যাওয়ার রাস্তা অবরোধ করে দেওয়া হয়েছে, উড়ান বাতিল হচ্ছে। মানুষ বেপরোয়া। এমনিতে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা ইউরোপে জিনিসপত্রের দাম, বিশেষ করে জ্বালানির দাম, ঊর্ধ্বমুখি। মুদ্রাস্ফীতিও বাড়ছে। মনে করা হচ্ছে অন্তত ৭০% লোক এই পেনশন-রিফর্মের বিরুদ্ধে। অবস্থা এতটাই খারাপ যে ব্রিটেনের রাজা চার্লসের সৌজন্য সফর বাতিল করতে হয়েছে। মাকোঁ তবু অনমনীয়, তিনি ঘোষণা করেছেন যে এই বছরের শেষের দিকে নতুন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে।
বাগাড়ম্বর করলেও মাকোঁর অবস্থা কিন্তু স্বস্তিদায়ক নয়। মাত্র দু-বছর আগে ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনে ফ্রান্স উত্তাল হয়েছে। তখন মাকোঁর সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, দ্বিতীয় বার নির্বাচিত হবার পরে সেটা কিন্তু আর নেই। যতদিন এগিয়েছে তিনি উদ্ধত, ধনীদের প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছেন। ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন তাঁর সরকারের জনবিরোধী চরিত্র আরও পরিস্কার করে দেয়। ঐ আন্দোলনে অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া ছাড়া, রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিও ছিল যা মাকোঁ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই এই আন্দোলন পেনশন-রিফর্ম বিরোধী হলেও, মানুষের ক্ষোভের শিকড় আরও গভীরে। তাঁদের আন্দোলন মাকোঁর সামগ্রিক জমানার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠছে। মানুষ প্রশ্ন করছেন সমস্ত ক্ষমতা প্যারিসে কুক্ষিগত থাকবে কেন? এটা লক্ষণীয় যে ২০১৭-তে মাকোঁ যে বার প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন তখন তাঁর প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি প্রায় ধরাশায়ী হয়ে যায়। দেশের মানুষের মধ্যে তিনি নতুন আশার সঞ্চার করেন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তিনি কর্পোরেটদের কর লাঘব করেন, শিল্পপতিদের স্বার্থে শ্রম আইনে রদবদল করেন। ধীরে ধীরে তাঁর ভাবমূর্তি ম্লান হয় এবং তিনি ধনীদের প্রেসিডেন্ট হিসাবেই জনমানসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। দ্বিতীয় বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করলেও সংসদে তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারেনি। যেটা আশঙ্কার সেটা হচ্ছে মাকোঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস মারিন লা পেন এবং তাঁর চরম দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশানাল র্যালির উত্থানের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। আপাতত মারিন লা পেনের অবস্থান ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের! তিনি বলেছেন মাকোঁ এই অবস্থা সৃষ্টি করেছেন, তাঁকেই এর সমাধান করতে হবে। আবার একই সঙ্গে বলছেন, ফ্রান্স জঙ্গি ইউনিয়ানবাজির শিকার। অন্যদিকে সিজিটি ও সিএফডিটির মতো বাম ও অতিবাম ট্রেড ইউনিয়নগুলি এই আন্দোলনের মূল শক্তি। এই আন্দোলন মাকোঁর শেষের শুরু হতে পারে এবং রাজনৈতিক দলগুলির নতুন শক্তি-বিন্যাসের সূচনা করতে পারে।
– সোমনাথ গুহ
বিচার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার নেতানিয়াহু সরকারের যে প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইজরায়েলের জনগণ গত তিন মাস ধরে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিলেন, তার কাছে সরকারকে আপাতত নত হতে হল। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টকে নেতানিয়াহু ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করেন। গ্যালান্ট প্রতিবাদরত জনগণের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, ইজরায়েলে বর্তমানে যা চলছে তা “রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি সুস্পষ্ট এবং আশু এবং মূর্ত বিপদ – আমি এর অংশিদার হতে পারব না। “ যে সরকার বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে প্রস্তাব এনেছে, সেই সরকারের মন্ত্রীরই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটা সরকারের পক্ষে ইতিবাচক কোনো বার্তা হতে পারে না। কাজেই, মন্ত্রীকে ছাঁটাই করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেতানিয়াহুর কাছে ছিল না। তবে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করাটা চলমান আন্দোলনে প্রভূত ঘৃতাহুতির সঞ্চার করল – আন্দোলন প্রবলতর হয়ে উঠে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। জনগণ বিভিন্ন স্থানেই রাস্তা অবরোধ করলেন, কোথাও কোথাও অগ্নি সংযোগ করাও হল, সরকারি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রইল, দেশের সর্ববৃহৎ কর্মী সংগঠন ধর্মঘটের ডাক দেওয়ায় স্বাস্থ্য পরিষেবা, পরিবহণ, ব্যাঙ্ক, বিমান পরিবহন ক্ষেত্রে কাজ ভালো মাত্রায় ব্যাহত হল, মলগুলো বন্ধ রইল। বিশ্বের দেশগুলোতে ইজরায়েলি দূতাবাসের কর্মীরাও সরকার বিরোধী প্রতিবাদে অংশ নিলেন। অর্থনীতি পর্যুদস্ত হল। ইজরায়েলি সংসদ নেসেট ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বাড়ির সামনে প্রতিবাদরত জনগণের ঢল নামল। প্রকশিত একটা সংবাদ জানিয়েছে, সমাবেশের ব্যাপকতা ও জনগণের রুদ্র মূর্তি দেখে নেতানিয়াহু নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদ পরিস্থিতির সমস্ত দিক বিবেচনা করে নেতানিয়াহু অবশেষে জানালেন, “আমি অবিলম্বে বিচার ব্যবস্থা সংস্কার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার কথা বলছি। “
ইজরায়েলের বর্তমান সরকার যে ইজরায়েলের গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দক্ষিণপন্থী সরকার তা ভাষ্যকাররা জানাচ্ছেন এবং আজকের দেশব্রতীর ১৬ মার্চ সংখ্যার প্রতিবেদনেও সেই অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। এই সরকারের চোখে ইজরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট হলো দক্ষিণপন্থী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পথে এক বৈরিভাবাপন্ন প্রতিবন্ধক। আর তাই সেই আদালতের ডানা ছাঁটার লক্ষ্যে সরকার প্রস্তাবিত আইনের অভিপ্রায় হল –
(১) সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ কমিটিতে সরকার মনোনীত প্রতিনিধিদের সংখ্যাকে বাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টে সরকার অনুগত বিচারপতির সংখ্যাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ করে তোলা। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি মনোনয়নের কমিটির সদস্য সংখ্যা নয় – দুই মন্ত্রী ও সংসদের দুই সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট ও দুই বিচারপতি এবং আইনজীবীদের থেকে মনোনীত দুজন। প্রস্তাবিত নতুন কমিটির সংখ্যা হবে এগার যাতে সরকারের বেছে নেওয়া প্রতিনিধিই হবে সাত জন, ফলে সরকার অনুগত বিচারপতিদের সর্বোচ্চ আদালতে পাঠাতে অসুবিধা হবে না।
(২) সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে সীমিত করে আদালতের ওপর শাসক কর্তৃত্বকে কায়েম করা।
(৩) সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ/রায়কে খারিজ করা। ইজরায়েলি সংসদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১২০ – এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬১ জন সাংসদ তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায়কে খারিজ করে দিতে পারবেন।
প্রতিবাদের সংগঠকদের মতে সরকারের পেশ করা এই প্রস্তাব সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদদের সমর্থনে পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে তা গণতন্ত্রের কফিনেই পেরেক পুঁতবে, একনায়কতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হবে। সরকার-বিরোধী এই আন্দোলনে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর এক অংশের সমর্থনও ভালো মাত্রায় রয়েছে বলে দেখা গেছে। রিজার্ভিস্ট বা সংরক্ষিত সেনারা ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরাও মনে করছে, সুপ্রিম কোর্টের হাতে সরকারি নির্দেশের যথার্থতার বিচার ক্ষমতা না থাকলে সরকারের স্বেচ্ছাচারী নির্দেশের বলে তাদের অবৈধ কাজে বাধ্য করা হবে। আর তাই তারা আদালতের ক্ষমতা খর্বের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে।
এই প্রতিবেদনের শুরুতেই ‘আপাতত’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে এবং তা এই জন্যই যে নেতানিয়াহু বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের তাঁদের প্রস্তাব বাতিল করেননি, কিছু সময়ের জন্য স্থগিত করেছেন মাত্র। মে মাসের গোড়ায় সংসদের অধিবেশন পুনরায় শুরু হলে এই প্রস্তাবকে আইনে পরিণত করার চেষ্টা আবার হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সরকার-বিরোধী এই আন্দোলন ইজরায়েলি সমাজের মধ্যে বিভিন্ন ধারা ও বিভাজনকেও প্রকট করে তুলেছে। ইজরায়েলি সমাজে একটা কট্টর দক্ষিণপন্থী অংশ রয়েছে যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ও সমাজে ইহুদি ধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব, দখলিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলি বসতি স্থাপনে সুপ্রিম কোর্টের অসম্মতিকে অবাঞ্ছিত বাধা বলে মনে করে, আদালতকে তাদের অভিপ্রেত জায়নবাদী জীবনধারার পথে এক অনাবশ্যক অন্তরায় বলে মনে করে। আবার, এর বিপরীতে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক ধারাও রয়েছে যা উচ্চ জাতীয়তাবাদী ধারাকে প্রত্যাখ্যান করে ইজরায়েলি সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। ইজরায়েলি সংসদের আসন বিন্যাসের মধ্যেও এই বিভাজন প্রতিফলিত – ১২০ সদস্য বিশিষ্ট সংসদে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর লিকুড পার্টির সদস্য সংখ্যা মাত্র ৩২, এবং অন্যান্য চরম দক্ষিণপন্থী সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে শাসক পক্ষে রয়েছে মাত্র ৬৪ জন সাংসদ, সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে যা মাত্র ৩ বেশি। কোনে পক্ষেই গরিষ্ঠতা তেমন বেশি না হওয়ায় বারবারই সরকারের পতন ঘটে – গত চার বছরে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে পাঁচ পাঁচবার! নেতানিয়াহু সরকারের প্রস্তাবকে স্থগিত করায় আন্দোলন এখনকার মতো স্তিমিত হবে। কিন্তু সেটা কি ঝড়ের আগের স্তব্ধতা হয়ে দেখা দেবে? সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবকে আইনে পরিণত করার চেষ্টা পুনরায় হলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন কি আবার মাথাচাড়া দেবে? সে সম্ভাবনাকে একেবারে খারিজ করা যায় না। প্রতিবাদের এক সংগঠক যেমন বলেছেন, “সাময়িকভাবে স্থগিত করাটাই যথেষ্ট নয়, এবং নেসেটে (ইজরায়েলি সংসদ) আইনটা বাতিল না হলে জাতীয় স্তরে প্রতিবাদ তীব্র হতে থাকবে।” ভারতেও আজ যখন বিচার বিভাগকে কব্জা করার ফ্যাসিবাদী প্রচেষ্টা সক্রিয় ও সচল রয়েছে, তখন ইজরায়েলের জনগণের প্রতিবাদ আন্দোলন থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেওয়ার, অনুপ্রাণিত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ উপস্থিত।
– জয়দীপ মিত্র
২৩ মার্চ শিয়ালদার বিএমপিইইউ হলে প্রয়াত প্রথিতযশা সাংবাদিক শংকর রায়ের স্মরণ সভা পালিত হল। গত ২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিন তিনি প্রয়াত হন। এই সভায় বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অনাথবন্ধু দে, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, শোভনলাল দত্ত গুপ্ত, সিজিসিআরআই থেকে দীপ্তেন ভট্টাচার্য, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ।
শংকর রায় যদিও পেশাগতভাবে ছিলেন একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিক, পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন পরোপকারী মানুষ এবং সঙ্গী। সাথে গান বাজনার প্রতি ছিল তাঁর ভালোলাগা এবং সেই কথাই উঠে আসে, অনুষ্ঠানের প্রথম বক্তা অধ্যাপক তুষার মজুমদারের বক্তব্যে। তিনি জানান তাঁর সাথে শংকর রায়ের সম্পর্ক কতটা আন্তরিক ছিল। পাশাপাশি কীভাবে তিনি বিভিন্ন ক্লাসিকাল ঘরানার সংগীত সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করতেন। শংকর রায় ছিলেন সাংস্কৃতিক মনস্ক ব্যক্তিত্ব।শংকর রায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তিনি একটি উচ্চাঙ্গ সংগীতও পরিবেশন করেন।এরপর দিগন্ত বলয়-এর সম্পাদক বরুণ দাস শোক প্রস্তাব পাঠ করে শোনান। তাঁর পরবর্তী বক্তা ছিলেন, কফিহাউসের কনজুমার কো-অপারেটিভের সভাপতি অনাথবন্ধু দে। তিনি জানান যে, কতটা মানবিক এবং আন্তরিক ছিল তাঁর ব্যবহার। তিনি শুধু শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, বিচক্ষণতার দিক থেকেই নয়, মানবিকতার দিক থেকেও তিনি ছিলেন একজন সম্পূর্ণ মানুষ। অনাথ বাবুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন, তাঁর পুত্রবধূ অমৃতা রায়। অমৃতা দেবীর পর বক্তব্য রাখেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক তথা মার্ক্সিয় চর্চাকারী শোভনলাল দত্ত গুপ্ত। তিনি জানান যে, তাঁর সাথে শংকর রায়ের আলাপ ১৯৬৫ সালে, ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকার প্রকাশনার সময়। তারপর ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর সাথে শংকর বাবুর আলাপচারিতা হয় মার্ক্সবাদ নিয়ে আলোচনার সূত্রে। শোভনবাবু জানান যে, মার্ক্সবাদ নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে শংকর বাবুর হয়তো মনে হয়েছিল যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চিনে যেসব ঘটনাগুলি ঘটে সেগুলি ছিল মানবতাবাদ বিরোধী, এবং এই সূত্র ধরেই তিনি মার্ক্সবাদের ভিন্ন ঘরানা নিয়ে আরও চর্চা এবং আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এরপর শংকর রায়ের পুত্র যুধাজিৎ রায় দুটি রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন। এবং তাঁর পরেই সভার মূল বক্তা কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বর্তমানের মার্ক্সিয় চর্চা নিয়ে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। তিনি শংকর রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন কীভাবে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর সাথে শংকর রায়ের সম্পর্ক ছিল। তিনি মনে করেন যে শংকর রায় নিজেই মার্ক্সবাদ চর্চার একটি ঘরানা। তবে মার্ক্সবাদ নিয়ে তাঁর সাথে শংকর রায়ের খুব বেশি কথা না হলেও মার্ক্সবাদ অনুশীলন এবং অনুশীলনের তত্বের মিল নিয়ে তাঁরা আলোচনা করতেন। তাঁর সাথে শংকর রায়ের আলাপ ১৯৯৫ সালে একটি ওয়ার্কশপে। রাজনৈতিক দিক থেকে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও শংকর রায় একজন উদারমনস্ক মানুষ ছিলেন তার প্রমাণ মেলে বহু জায়গায়। কমরেড দীপঙ্কর তাঁর আলোচনার প্রসঙ্গে চিনের বর্তমান সমাজতন্ত্রের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, পুঁজির বিরুদ্ধে যে লড়াই করতে আমাদের মার্ক্সের কমিউনিস্ট ইস্তাহারেই ফিরে যেতে হবে। আর সাধারণ মানুষ বা সংখ্যাকে, মার্ক্সের কথায়, যদি এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহলে আমরা সেই সংখ্যা নিয়ে পুঁজির মতো একটা কন্সেন্ট্রেটেড পাওয়ারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব। দীপঙ্কর বলেন, রুশ বিপ্লবের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে পতন ঘটে তা কখনোই মার্কিন কোনো আক্রমণের জন্য ঘটেনি বরং নিজে থেকেই যেন এটি খসে পড়ল। তাতে কোনো প্রাণ ছিল না। তিনি আরও বলেন যে, যেদিন সমাজতন্ত্র গণতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে তখনই হয়তো আমরা পুঁজিবাদের বিরোধাভাসে তাকে সমৃদ্ধশালী একটি সমাজতন্ত্রের কথা বলতে পারবো। অর্থাৎ কোনো একটি সমাজে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার যাত্রা শুরু করতে হয় সমকালীন সময়ে যা কিছু বিদ্যমান, তার কাছে যা ইতিহাস দিয়েছে বা সেই সমাজটি যা কিছু পেয়েছে তা নিয়েই গড়তে হবে। ফলে যেকোনো সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য যে জিনিসগুলো রয়েছে সেটা সেই সময়ের সেই যুগের সেই ইতিহাস প্রদত্ত উপাদান নিয়ে তখনকার মতো সর্বোচ্চ মানের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবং তা অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য, যা মার্ক্সের কথায় নির্মম সমালোচনা নামে পরিচিত। এর দুটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগে বলা হয়েছে যে, যে সমালোচনায় সেই সমাজ ভয় পাবে না, এবং তাকে অনেক মূল্য দিতে হবে তার জন্য। এবং দ্বিতীয় ভাগটি আরও মারাত্মক। সেটি হল, সমালোচনা থেকে যে উপসংহার বা পরিশেষ আসবে সেটাকেও যদি সমালোচনা করা হয় সেই সমালোচনাটিকেও গ্রহণ করে বেরিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ আত্মসমালোচনাও যদি করা যায় তাহলে তা নিশ্চয়ই একটি উন্নতির দিক। নতুন যুগের মার্ক্সিয় চর্চা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, আজ আমরা যেখান থেকে মার্ক্সকে দেখি সেই সমাজতন্ত্রের একটি সীমাবদ্ধতা আছে, সেখানে হয়তো আমরা পুঁজিবাদকে টেক্কা দিয়েছি কিন্তু উৎপাদনের যে দিকটা আছে, সেটা অনেকটাই পুঁজিবাদের সাথে যুক্ত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, প্রকৃতি বা জলবায়ু সেই দিক থেকে এই জিনিসটা সম্মতি দিচ্ছে না। এবং সেই দিক থেকে মার্ক্সকে চর্চা করা প্রয়োজন। মার্ক্স নিজে সবসময় প্রকৃতির সাথে পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত থাকতে, কথোপকথন করার কথা বলেছেন। হয়তো নতুন মার্ক্সবাদ চর্চাকারীরা নিজেদের আর মার্ক্সিস্ট বলবেন না তাঁরা হয়তো নিজেদের মার্ক্সিয়লজিস্ট বলে পরিচয় দেবেন। শেষে শংকর রায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, শংকর রায়ের মতো এইরকম মানুষ খুব কম যিনি মার্ক্স চর্চাতেও সক্রিয়, জনস্বার্থতেও সক্রিয় ছিলেন। তাই অনেক খারাপের মধ্যেও যেন মানুষ তাঁর নিজের স্বপ্ন দেখতে না ছাড়েন। মানুষ যদি নিজের স্বপ্নগুলোকে হারিয়ে ফেলে তা খুবই বিপজ্জনক। এবং এটিই মার্ক্সবাদের বুনিয়াদি কথা, যা হয়তো শংকর রায় নিজেও মানতেন। তাই ব্যাখ্যা অনুশীলন, পর্যালোচনা এসবের মধ্যে দিয়েও মার্ক্সবাদ নিয়ে চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। এবং মানুষের সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে হবে। তা মানবতাবাদ নিয়েও যদি কথা হয় তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। তবে, বর্তমানে পুঁজিবাদ মানবতাবাদকে দাসে পরিণত করেছে। তাই এই পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানবতাবাদের লড়াই হয়, এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। কারণ পুঁজিবাদের ভিতরে মানবতাবাদের জন্ম হতে পারে না। বর্তমানের এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে শংকর রায়ের ঘরানাকে অনুসরণ করতে পারি সেই চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি তিনি যেভাবে হাসি মুখে সকলের সাথে মিশতেন সেই চেষ্টাও করতে হবে। এরপর অধ্যাপিকা দীপিকা দত্ত, দীপ্তেন ভট্টাচার্য, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
খুবই ভাবগম্ভীর পরিবেশে এই স্মরণ সভা হয়, যার সঞ্চালনা করেন নিত্যানন্দ ঘোষ। এআইসিসিটিইউ, উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া, দিগন্ত বলয়-এর যুক্ত উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানটি সংগঠিত হয়।
– অবন্তী ভট্টাচার্য
=== 000 ===