২০২৩-২৪’র কেন্দ্রীয় বাজেট বিজেপির মার্কামারাই এক বাজেট, যাতে বড় বড় কথা বলা হয়েছে কিন্তু ইতিবাচক ফলাফল নিম্ন মানের। ২০১৪ থেকে যত বাজেট হয়েছে সেগুলোর প্রতিটিতেই কিছু নতুন চটকদার বুলি আনা হয়েছে, এবারের বাজেটে আমরা পাচ্ছি ‘সপ্তঋষি’কে যা আমাদের অমৃতকালের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত করছে। কিন্তু আমরা যদি ‘একনজরে বাজেট’এর দিকে তাকাই তবে তারমধ্যে দেখতে পাব সরকারের দেওয়া অতীতের সেই সমস্ত প্রতিশ্রুতিকে যেগুলোর কোনোটাই এখনও পূরণ হয়নি, যেমন, ‘সকলের জন্য বাড়ি’, ‘কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা’, ‘পরিকাঠামো ক্ষেত্রে পাঁচ বছরে এক লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ’, ‘২০২৪ সালের মধ্যে পাঁচ ট্রিলিয়নের অর্থনীতি করে তোলা’, ইত্যাদি।
২০২৩’র বাজেটে সিজিএসটি যত সংগ্ৰহ হবে বলে আনুমানিক হিসাব দেওয়া হয়েছে তা প্রত্যক্ষ কর্পোরেট করের চেয়ে বেশি। ধনী এবং সুবিধাভোগীদের ওপর কর চাপাতে সরকারের অনাগ্ৰহ এই বাজেটেও দেখা গেল, কেননা, ক্রমবর্ধমান বিপুল অসাম্যের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থশাস্ত্রীরা সম্পদ ও উত্তরাধিকারের ওপর করের পক্ষে জোরালো সওয়াল করলেও অর্থমন্ত্রী তা চালু করতে অস্বীকার করেছেন।
যুবকদের মধ্যে বেকারি ও আধা-বেকারি নিয়ে প্রবল ক্ষোভ থাকায় আশা করা গিয়েছিল যে সরকারি দপ্তরগুলির অথবা কেন্দ্র-চালিত প্রকল্লগুলির শূন্য পদগুলি পূরণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হবে, কিন্তু বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না।
রাস্তার সাধারণ জনগণ ও যুবকরা, কৃষক ও শিল্প শ্রমিকরা যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি সেগুলোর সমাধানের কোনো দিশা বাজেটে নেই। পণ্যের মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও বেকারির প্রশমনের কোনো পরিকল্পনা বাজেটে দেখা গেল না, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যগুলির জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে বাজেটে একটা শব্দের উল্লেখও হলো না। বিপরীতে দেখা গেল যে এফসিআই’কে দেয় খাদ্য ভর্তুকির সংশোধিত আনুমানিক পরিমাণ ২,১৪,৬৯৬ কোটিকে ছেঁটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১,৩৭,২০৭ কোটিতে; এনএফএসএ’এর অধীনের ভর্তুকিরও হ্রাস ঘটিয়ে ৭২,২৮৩ কোটি থেকে করা হয়েছে ৫৯,৯৭৩ কোটি। ইউরিয়ার জন্য প্রদেয় ভর্তুকি ১,৫৪,০৯৮ কোটি (সংশোধিত আনুমানিক পরিমাণ) থেকে নেমে এসেছে ১,৩১,১০০ কোটিতে। পুষ্টি-ভিত্তিক ভর্তুকিতেও কাটছাঁট করা হয়েছে। অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় প্রকল্প পিএমকিষাণ-এ বরাদ্দ করা হয়েছে ৬০,০০০ কোটি, যেখানে বর্তমান বছরে ঐ প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছিল ৬৮,০০০ কোটি।
শ্রমিকরা নিয়মিত কাজ না পাওয়ায় গ্রামাঞ্চল এখনও সংকটের কবলে, এ’সত্ত্বেও এ’বছরের সংশোধিত আনুমানিক পরিমাণের তুলনায় একশ দিনের কাজের বাজেটকে হ্রাস করে নামিয়ে আনা হয়েছে ৬০,০০০ কোটিতে।
উল্লেখ্য যে, সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য সামূহিক কর্মসূচিতে বরাদ্দ হয়েছে ৬১০ কোটি, যেখানে এ’বছরের অর্থবর্ষে ঐ খাতে বরাদ্দ হয়েছিল ১,৮১০ কোটি।
মূল্যস্ফীতির হার যথেষ্ট বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাজেটে সাধারণ জনগণের ব্যবহার্য পণ্যে অপ্রত্যক্ষ কর লাঘবের ব্যবস্থা করা হয়নি। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে জনগণ আয়কর ছাড়ের প্রত্যাশা করছিলেন তাঁদেরও আতান্তরের মধ্যে ফেলা হয়েছে, কেননা, যাঁরা নতুন আয়কর ব্যবস্থার মধ্যে যাবেন কেবলমাত্র তাঁরাই আয়কর ছাড়ের কিছু সুবিধা পাবেন। সরাসরি পাঁচ লক্ষ টাকা করমুক্ত হওয়ার যে প্রত্যাশা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমস্ত আয়কর দাতার ছিল, অর্থমন্ত্রীর কাছে তার কোনো অনুরণন হয়নি। অধিকন্তু, বেতনভোগী কর্মচারীদের এবার থেকে প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে অর্থ দিতে হবে, তাঁরা বাড়ি কেনা বা তৈরির জন্য ঋণ নিতে পারেন এবং চিকিৎসা বীমার প্রিমিয়াম দিতে পারেন, কিন্তু তারজন্য কর ছাড়ের কোনো সুবিধা তাঁরা আর পাবেন না।
বাজেট বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বরাদ্দ ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৭৯,০০০ কোটিরও বেশি করা হয়েছে বলে জোর দেওয়া হয়েছে। বাস্তব ঘটনা হলো ২০২১-২২ অর্থবর্ষে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯০,০২০ কোটি টাকা! এই মার্কামারা আর্থিক কারচুপিই শাসক দলের অর্থনৈতিক নীতি ও বাজেট তৈরির বিশেষ কসরত হয়ে উঠেছে।
জনগণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যয় করলে বাজেটে সুরাহার কোনো ব্যবস্থা নেই, কেননা, বরাদ্দ ততটুকুও বাড়ানো হয়নি যা মূল্যস্ফীতির ক্ষতিটুকু পূরণ করতে পারে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনী ব্যয়ে ১০ লক্ষ টাকা বৃদ্ধিকে সমস্ত সংকটের সুরাহা বলে চালানো হচ্ছে। জিডিপির ওপর নিম্নমুখী চাপ সামলানোর লক্ষ্যে মূলধনী ব্যয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দে ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি যে বহুবিধ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে তা ঘটবে বলে মনে হয় না।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, পণ্যের মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার, সুদের হার এবং স্তিমিত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মুনাফার সম্ভাব্যতার পরিমাণ থেকে সংকেত পেয়ে বেসরকারি মূলধনী ব্যয় বাস্তবে ঘটবে বলে মনে হয় না প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ এবং বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ওপর নির্ভরতার কারণে। প্রয়োজনটা ছিল স্থায়ী অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক ধারায় সমষ্টিগত চাহিদার বৃদ্ধিতে মদত প্রদান যেটা বাজেট দিতে পারেনি।
এ’সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এবং অর্থমন্ত্রীর ভাষণে দাবি করা হয়েছে যে অর্থনীতি অতিমারীর ধাক্কাকে কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবটা হলো এই যে, ধাক্কাটা সম্পূর্ণ রূপে কাটিয়ে ওঠা যায়নি, আবার এমন ধারায় তা হয়নি যাতে শ্রমিক, কৃষক এবং কঠোর পরিশ্রমকারী ভারতীয়দের কল্যাণ সুরক্ষিত হয়েছে। অতিমারীর সময় বিজেপি সরকার যে আপডা মাই অবসর মডেল গ্ৰহণ করে তা বেসরকারিকরণ, সরকারি সম্পদের বিক্রি এবং অর্থনৈতিক বোঝা সাধারণ জনগণের ঘাড়ে পাচার করার কারণে কোভিড বছরগুলোতে আয়ে সামঞ্জস্যহীন ফারাক ঘটিয়েছে। লকডাউন কালে পরিযায়ী শ্রমিক, দিনমজুর ও কৃষকদের দুর্দশা বাড়লেও মোদী সরকারের ঘনিষ্ঠ সাঙাতদের সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। অক্সফ্যাম’এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট দেখিয়েছে যে ভারতের সবচয়ে ধনী ব্যক্তিদের ৫ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের সম্পদের ৬০ শতাংশ আর একেবারে নীচের ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদ যদিও মোট জিএসটি’র ৬৪ শতাংশই আদায় করা হয় তাদের কাছ থেকে।
২০২১-২২ অর্থবর্ষের জিডিপি পরিসংখ্যান অতিমারী পূর্ববর্তী অর্থবছর ২০১৯-২০’র প্রায় সমান স্তরের। গতবছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় পূর্বাভাস ছিল যে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধি ঘটবে ৮ থেকে ৮.৫ শতাংশ হারে, কিন্তু এখন ঐ হার সংশোধিত করে হ্রাস করা হয়েছে ৭ শতাংশে। এই বৃদ্ধি আবার শুধু অর্থবর্ষ ২০১৯- ২০’র জিডিপির ভিত্তিতে যে বছর অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটেছিল ৪ শতাংশেরও কম হারে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে প্রকৃত বৃদ্ধির হার হবে ৬ থেকে ৬.৮ শতাংশ, আর নমিনাল জিডিপির আনুমানিক বৃদ্ধির হার হবে ১১ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার সাম্প্রতিক সময়ে লাগাতারভাবে ৬ শতাংশের বেশি হতে থাকায় স্ফীতিহ্রাসককে নিম্নসীমায় নির্ধারণ করা হয়েছে বলে মনে হয় যার ফলে জিডিপি বৃদ্ধির হারকে কিছুটা উৎকৃষ্টতর দেখাচ্ছে। বাস্তবে তার রূপায়ণ কি হয় তা যে কেউই দেখতে পাবেন। কিন্তু এই পরিসংখ্যানগুলোকে অতিরঞ্জিত বলেই গ্ৰহণ করতে হবে, কেননা নগদ সরবরাহ সম্ভবত নিয়ন্ত্রিত হবে, চলতি খাতে ঘাটতি বেড়ে যাবে, দুর্বল টাকা বৃহত্তর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যেখানে কর্মনীতির পরিমার্জনার অবকাশ সীমিত হবে এবং তা বিশেষভাবে হবে সরকারের হাত নয়া-উদারবাদী নীতির কাঠামোয় শৃঙ্খলিত থাকায় আর্থিক ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রিত করার চাপ থাকার কারণে যার আনুমানিক হার বেশ কিছুটা বেশি হয়ে হবে জিডিপির ৫.৯ শতাংশ।
৪৫ লক্ষ কোটি আয়তনের বাজেটের মধ্যে অতীতে নেওয়া ঋণের জন্য ১০.৮০ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ঋণ গুণতে হওয়ায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির জন্য আরও ঋণ নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে।
জনগণের প্রত্যাশা ছিল অর্থনৈতিক অসাম্যের প্রশমন হবে, জন পরিষেবাগুলোতে সরকারি ব্যয়ের বৃদ্ধি ঘটবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে এবং উচ্চ হারের মূল্যবৃদ্ধি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে — কিন্তু ২০২৩’র বাজেট এসবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
- সিপিআই(এমএল), কেন্দ্রীয় কমিটি
সমাজের প্রান্তিক ও অবদমিত আদিবাসী মানুষেরা কলকাতার বুকে সংগঠিত করল এক বিক্ষোভ সমাবেশ। তাঁদের নিজস্ব সংগঠন সারা বাংলা আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের আহ্বানে গত ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ধর্মতলায় অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত আদিবাসীরা অংশগ্রহণ করেন। কর্মসূচিতে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁদের কয়েকজনের হাতে ছিল প্রতিকী তীর-ধনুক। ধামসার তালে, স্লোগানে এবং গানের মধ্য দিয়ে সমাবেশ এবং শিয়ালদা ও হাওড়া স্টেশন থেকে আগত মিছিল হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত! সমাবেশ থেকে প্রধানত জমি ও কাজের অধিকারের দাবিতে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। নিপীড়িত শ্রেণী ও পরিচিতি সত্তা মিলেমিশে তুলে ধরে এক সংগ্রামী বার্তা। গণসংগীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়, বাবুনি মজুমদার ও আদিবাসী মহিলারা।
আজ যখন সারা দেশে জল-জঙ্গল-জমি সহ সমগ্র প্রাকৃতিক সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তখন সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন আদিবাসী সমাজ। এই রাজ্যে বনাঞ্চল থেকে গ্রাম শহর সর্বত্রই জমি মাফিয়া-সিন্ডিকেট চক্রের দাপট, সরকার প্রশাসনের মদতে আদিবাসীদের জমিগ্রাস করার প্রক্রিয়া বেড়ে চলেছে। যৎসামান্য কয়েকটি গালভরা সরকারি প্রকল্পকে সামনে রেখে আদিবাসী উন্নয়নের কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু ‘চুইয়ে পড়া’ ঐ ধরনের দু’চার ফোঁটা জল দিয়ে বাস্তবে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আদিবাসীদের জীবন জীবিকার ন্যায্য অধিকারগুলিকে। এই প্রেক্ষাপটে সীমাহীন বঞ্চনার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের এক জাগরণ এ’রাজ্যের বুকেও লক্ষ করা যাচ্ছে। এরসাথে সাযুজ্য রেখে এই সমাবেশ কর্মসূচি খুবই গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে।
দক্ষিণবঙ্গের বাঁকুড়া, দুই মেদিনীপুর, পুরুলিয়া প্রভৃতি জেলায় বনাঞ্চলে বসবাসকারী বহু সংখ্যক আদিবাসীরা আজও তাঁদের দখলিকৃত বনাঞ্চলের জমির পাট্টা পায়নি। উত্তরবঙ্গেও দেখা যাবে একই চিত্র। সারা রাজ্যেই বহু সংখ্যক আদিবাসীরা কাগজে কলমে পাট্টা পেলেও খাস জমির দখল পায়নি। এছাড়া পাট্টায় জমির চরিত্র বনাঞ্চল থাকার কারণে তারা সরকারি প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। চাষাবাদ করেও আজ তাঁরা কৃষকের মর্যাদা পাচ্ছেন না। বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া প্রভৃতি জেলায় আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বিশেষ করে বর্গা রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার নানাবিধ চক্রান্ত চলছে। দেউচা-পাঁচামীতে আদানি কোম্পানিকে ডেকে এনে আদিবাসীদের ভিটে-মাটি কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। বিভিন্ন জেলায় আদিবাসীদের জমি অ-আদিবাসীদের নামে রেকর্ডকরে দেওয়া হচ্ছে। সমাবেশে আগত আদিবাসীরা এই ধরনের ক্ষোভ বিক্ষোভের কথা তুলে ধরেন।
১০০ দিনের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আদিবাসীরা কাজের সন্ধানে দূরদূরান্তে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। একবছর হয়ে গেল তারা কাজ করেও বকেয়া মজুরি পাননি। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাজিয়ার ফলে বঞ্চিত হচ্ছেন আদিবাসী কৃষি মজুররা।
এছাড়া আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দাবিগুলো উঠে আসে। যথা আদিবাসীদের চিরায়ত নাচের দলগুলির প্রাপ্য শিল্পী ভাতার দাবি। এছাড়া অলচিকি হরফে প্রয়োজনীয় পুস্তক না থাকা, আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত শূন্যপদে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ থাকা প্রভৃতি কারণে আদিবাসীদের শিক্ষা বিকাশের সরকারি ঘোষণা সম্পূর্ণ ফাঁকা প্রতিশ্রুতি বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। আদিবাসী হোস্টেলগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন — মেদিনীপুর বস্তি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতা তপন মুখার্জী, আদিবাসী সংগঠনের রাজ্য নেত্রী ময়না কিসকু, নদীয়ার আদিবাসী নেতা সন্যাসী ওঁরাও, বাঁকুড়ার মেটালা অঞ্চলের উপপ্রধান কবিতা মান্ডি, উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার আদিবাসী নেতা রামু সরেন, আয়ারলার বাবলু ব্যানার্জি, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের সভাপতি পাগান মুর্মু, সম্পাদক সুধীর মুর্মু, আয়ারলার রাজ্য সম্পাদক সজল অধিকারী, এআইকেএম’এর কার্তিক পাল।
সমগ্র সভা পরিচালনা করেন বাঁকুড়ার আদিবাসী নেতা রামনিবাস বাস্কে।
সমাবেশের প্রাক্কালে রাজ্য আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরে দশ দফা দাবি সম্মলিত স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। সুধীর মুর্মুর নেতৃত্বে ৫ জনের এক প্রতিনিধি দলের সাথে দপ্তরের সচিব সাক্ষাৎ করে দাবিগুলি শোনেন এবং সেগুলি বিবেচনার আশ্বাস দেন।
বেশ ক’দিন ধরে আদানি’র সাম্রাজ্য নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক দানা বেঁধে উঠল। কোভিড অতিমারীর সময়ে গোটা দেশ, বিশ্ব যখন বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত, তখন যে ক’টি অতিবৃহৎ সংস্থা দুনিয়া জুড়ে নিজেদের সম্পদ উল্কাগতিতে বাড়িয়েছিল, তাদের অন্যতম হল আদানি এন্টারপ্রাইজ। বিশ্বের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম ধনকুবের গৌতম আদানি’র বিরুদ্ধে শেয়ার দরে কারচুপি, আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ তুলেছে আমেরিকার লগ্নি সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ।
মোদীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতম বৃত্তের এই শিল্পপতি কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় পেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক ও বিমা প্রতিষ্ঠানগুলির অঢেল আর্থিক সাহায্য। ৩১ মার্চ ২০২২’র হিসাব দেখাচ্ছে, আদানির সমগ্র ঋণের বহর ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২.২ লক্ষ কোটি টাকা! এদিকে, এই সংস্থার মোট সম্পদের মূল্য অপেক্ষা ঋণ অনেক অনেক বেশি। এক বিরাট বুদবুদের উপর যেন টিকে রয়েছে আদানি’র আর্থিক সাম্রাজ্য, হঠাৎ ফেটে গেলে তা মারাত্মক আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনবে — ২০০৮’র সাব প্রাইম সংকট তারই ইঙ্গিতবাহী।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা এলআইসি গত কয়েক বছরের মধ্যে আদানি’র বিভিন্ন সংস্থায় ৭৪,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে — যার ফলে এলআইসি এখন এই সংস্থায় দ্বিতীয় বৃহত্তম শেয়ার হোল্ডার! আদানি পোর্ট ও এসইজেড, আদানি ট্রান্সমিশন, আদানি গ্রীন এনার্জি ও আদানি টোটাল গ্যাস লিঃ — এই সংস্থাগুলোতে এলআইসি’র রয়েছে যথাক্রমে ৯ শতাংশ, ৩.৭ শতাংশ, ১.৩ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ শেয়ার! আর, দেশীয় ব্যাঙ্কগুলো আদানি’র সংস্থায় বিনিয়োগ করেছে ৮০,০০০ কোটি টাকা — যারমধ্যে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর রয়েছে মাত্র ১.৪ শতাংশ ঋণ। আর, ব্যাঙ্কগুলোর কাছে আদানি’র সংস্থাগুলোর সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ হল ৩৮ শতাংশ!
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরই হুড়মুড়িয়ে আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ার মূল্যে পতন শুরু হয়। কিন্তু পরিহাস এটাই, ঠিক এই সময়েই এলআইসি ওই সংস্থায় আরো বেশি মূলধনের জোগান অব্যাহত রাখল, যা নিয়ে দেশজুড়ে নতুন আরেকটি বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালে সংসদে ফিরোজ গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী) তদানিন্তন নেহেরু সরকারের অর্থমন্ত্রী কৃষ্ণমাচারির বিরুদ্ধে মারাত্মক আর্থিক কেলেঙ্কারির এক অভিযোগ নিয়ে আসেন। ফিরোজ সংসদে নানা নথি পেশ করে জানান, হরিদাস মুন্দ্রা’র (যিনি ছিলেন কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ কলকাতার এক শিল্পপতি, স্টক মার্কেটের খেলোয়াড়) ছ’ছটা ডুবন্ত সংস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থা এলআইসি ১,২৬,৮৬,১০০ টাকার শেয়ার কিনেছে সেগুলোকে বাঁচাতে। কার্যত, এলআইসি’র বিনিয়োগ কমিটির পরামর্শ না নিয়েই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক চাপ দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবেই এই আর্থিক লেনদেন করে। এই অভিযোগের মুখে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়। এটা ছিল স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা। আজ প্রশ্ন উঠছে, আদানির শেয়ার হুড়মুড় করে নিচে নামতে থাকলেও এলআইসি কার নির্দেশে নতুন করে আবার ওই সংস্থায় ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করল? ২৪ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি — এই একসপ্তাহের মধ্যে আদানি সংস্থাগুলির লগ্নিকারীরা মোট ৫.৫৬ লক্ষ কোটি টাকার শেয়ার সম্পদ হারালেন। এলআইসি’র শেয়ার মূল্য কতটা নামল নিচে? শেয়ার বাজারের এক হিসাব বলছে, এলআইসি খুইয়েছে ৫৫,৭০০ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার সম্পদ।
হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের পাল্টা আদানি গোষ্ঠী ৪১৩ পাতার এক বিবৃতি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলো খন্ডন করতে মাঠে নেমেছে। তা পাওয়ার সাথে সাথেই হিন্ডেনবার্গ জবাব দিয়ে বলে, যে ৮৮টি প্রশ্ন তারা তোলেন, তারমধ্যে ৬২টিরই উত্তর এড়িয়ে গেছে আদানিরা। সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় হল, আদানিরা এতো বড় এক আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগের সুস্পষ্ট ও জুতসই প্রত্যুত্তর না দিয়ে এটাকে “ভারতের এবং দেশের স্বাধীনতা, অখন্ডতার উপরে আঘাত, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মান, ভারতের বৃদ্ধির উপর আক্রমণ” হিসাবে তা মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। শয়তানেরাই দেশপ্রেমকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে — এই প্রবাদ বাক্য আরেকবার প্রতিষ্ঠিত হল!
ফ্যাসিবাদের ভারতীয় সংস্করণের প্রধান চরিত্র লক্ষণ হল ‘জাতীয়তাবাদ’। যে জাতীয়তাবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ববাদের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। আর, মোদী-রাষ্ট্র-দেশ-দেশপ্রেম-সার্বভৌমত্ব আজ সব একই বন্ধনীতে একাকার ও সমার্থক হয়ে গেছে। এখন মোদীর সাথে জুড়ে গেল আদানি। চিত্রপটে অক্ষরেখাটি আজ পরিষ্কার — মোদী-আদানি-সরকার-রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর আঁতাত — যা নাকি দেশের আর্থিক বিকাশ ও বৃদ্ধির পথকে প্রশস্ত করছে! তাই, এই হাইব্রিড ‘জাতীয়তাবাদ’কে পুজো করতে হবে। তার বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তার গায়ে লাগানো যাবে না এক ফোঁটাও চুনকালি! আর এইভাবেই ক্রোনি পুঁজিবাদ মোদী ফ্যাসিবাদের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে যে আর্থিক রাজনৈতিক মতাদর্শগত শাসনতন্ত্র তৈরি করেছে তা ভারতবাসীর কাছে প্রধানতম রাজনৈতিক শত্রু হিসাবে আজ সামনে এসেছে। যাকে উৎখাত না করলে দেশ ও জাতির মুক্তি নেই।
বিবিসি তাদের তথ্যচিত্র ‘ইণ্ডিয়া : দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’এর প্রথম পর্বটি প্রদর্শিত করে গত ১৭ জানুয়ারি ২০২৩। এই তথ্যচিত্রে আলোকপাত করা হয়েছে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদীর সেই সময়ের ভূমিকার ওপর যখন গোধরায় ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের পর এক ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। ঐ তথ্যচিত্রটা ভারতে দেখানো হয়নি এবং মোদী সরকার অতি সত্ত্বর টুইটারকে বলে ঐ ভিডিওর টুইট ও লিংকগুলোকে নামিয়ে নিতে এবং ইউটিউব’কে নির্দেশ দেয় তারা যেন ঐ ভিডিও ও তার লিংকগুলোকে না তোলে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের এক মুখপাত্র ঐ তথ্যচিত্রকে এক বৈরি ভাবাপন্ন প্রচার বলে বর্ণনা করেন যা ঔপনিবেশিক মানসিকতা দ্বারা চালিত এক কলঙ্কিত ভাষ্যকে চালাতে চাইছে। ২০২১ সালের আইটি বিধির ১৬নং ধারার বলে জরুরি ক্ষমতার আশ্রয় নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোর মঞ্চে তথ্যচিত্রটি প্রদর্শিত না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
গুজরাটে ২০০২ সালে সংঘটিত গণহত্যায় সারা দুনিয়া মর্মাহত হয়েছিল। মানসিকভাবে আহত ভারত ২০০৪ সালে বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে অপসারিত করে, এবং ২০০৪’র নির্বাচনী ফলের পিছনে ২০০২’র গুজরাটের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত বিশ্বের অনেক দেশই তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকার করত এবং তা মূলত সেই সময়ের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ভূমিকার জন্য, যখন ঐ’রাজ্যে স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বেদনাবহ ও ভয়াবহ গণহত্যার অন্যতমটি সংঘটিত হয়েছিল। এটা ঠিকই যে সুপ্রিম কোর্ট এখন গুজরাট গণহত্যা সম্পর্কিত সমস্ত মামলারই ইতি ঘটিয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে মামলা চালানোর মতো কোনো তথ্যপ্রমাণ বাহ্যত পায়নি। এটাও ঘটনা যে মোদী ২০১৪ সাল থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রয়েছেন। কিন্তু তার মানে কি এই যে দুনিয়া ২০০২’র গুজরাট নিয়ে কোনো কথা আর বলতে পারবে না?
বিজেপি বস্তুত এটা সুস্পষ্ট করে দিয়েছে যে গুজরাট গণহত্যাই তাদের গুজরাট মডেলের কেন্দ্রীয় উপাদান ছিল। অমিত শাহ ২০২২ সালে বলেছিলেন ঐ গণহত্যা কিভাবে গুজরাটে ‘স্থায়ী শান্তি’ সুনিশ্চিত করেছিল এবং বিলকিস বানোকে ধর্ষণের ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার জন্য যারা সাজা পেয়েছিল জেল থেকে তাদের মুক্তি দিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে বিজেপি ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীকেই বেছে নিয়েছিল। আমাদের কাছে তাই ২০০২’র গুজরাটকে তার রক্তস্নাত আখ্যান-সহ সবিস্তারে মনে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। বিবিসির তথ্যচিত্র ঠিক এটাই করেছে এবং আমাদের জানিয়েছে যে ২০০২ সালে ব্রিটিশ হাইকমিশনের চালানো এক নিজস্ব তদন্তের রিপোর্ট জাতি বিশুদ্ধকরণের সমস্ত লক্ষণের সন্ধান পেয়েছিল এবং নরেন্দ্র মোদীকে সরাসরি দায়ী করেছিল। বিবিসি তথ্যচিত্র নিয়ে মোদী সরকার রুষ্ট প্রতিক্রিয়া দেখানোর পর সে সময়ের ব্রিটিশ সচিব জ্যাক স্ট্র করণ থাপারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঐ রিপোর্টের সত্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ক্যারাভান পত্রিকা ঐ রিপোর্টের পুরোটাই প্রকাশ করেছে এবং রিপোর্টে গোধরাকে অজুহাত করে চালানো গুজরাট গণহত্যাকে এক পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণ বলে বলা হয়েছে।
তথ্যচিত্রের একটা শক্তিশালী বিষয় হলো যে তাতে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীর একটা সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যাতে তাঁকে সাক্ষাৎ গ্ৰহণকারীর দিকে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে অবজ্ঞাসূচকভাবে বলতে শোনা যাচ্ছে যে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ চমৎকার কাজ করেছে। সেটা ছিল মোদীর প্রথম দিককার সময় যখন তিনি মিডিয়ার সঙ্গে কথাবার্তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কলাটিকে রপ্ত করে উঠতে পারেননি। ঘটনা হলো, ঐ সাক্ষাৎকারে মোদী একমাত্র যে ‘আত্মসমালোচনাটা’ করেন তা হলো তাঁর সরকার মিডিয়াকে খুব ভালোভাবে সামলাতে পারেনি। সে সময় মিডিয়ার ওপর বিজেপির পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল না, আর গুজরাট গণহত্যার সত্যিটাকে তাই চাপা দেওয়া যায়নি। আমরা খুব ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি যে কেন্দ্রের মোদী সরকার কেন নজরদার মিডিয়ার মুখোমুখি আর যাতে হতে না হয় সেটা সুনিশ্চিত করাটাকেই তাদের পছন্দের একটা বিষয় করে তুলল। মূল ধারার মিডিয়ার মোদী সরকারের মুখপাত্রে পরিণত হয়ে পড়ার এই রূপান্তরণ এবং সমালোচনামূলক প্রশ্ন তুলতে পারে এমন সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর পর্বকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলাটা হলো দুটো ‘সংশোধনমূলক শিক্ষা’ যেগুলো নরেন্দ্র মোদী ২০০২’র গুজরাটের ঘটনার সময় মিডিয়াকে সামলানোর কবুল করা ব্যর্থতা থেকে নিয়েছিলেন।
এই সেদিনই আমরা দেখলাম মোদী সরকার কিভাবে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রটায় মদত দিতে ও তাকে প্রচারের এক অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগাতে উঠেপড়ে লাগল। আর এখন তারা বিবিসির তথ্যচিত্রটাকে প্রচারের উদ্যোগ বলে খারিজ করছে আর ভারতে সামাজিক মাধ্যমের মঞ্চগুলোতে সেটির প্রদর্শন বন্ধ করতে জরুরি অবস্থার আশ্রয় নিচ্ছে! এ’সত্ত্বেও ভারতের জনগণ যদি ইন্টারনেটে বা তাঁদের ডিজিটাল যন্ত্রে ঐ তথ্যচিত্র দেখেন, সরকার সেক্ষেত্রে তার ক্ষমতার জোরে দেখা বন্ধ করতে চাইছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা তথ্যচিত্রটির প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে সেটি দেখতে চাইলে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করা হয় এবং এবিভিপি হিংসা নামায়। আর তথ্যচিত্রটা যেহেতু বিবিসিতে দেখানো হয় মোদী সরকার সেটাকে তাই উপনিবেশবাদী মানসিকতা দ্বারা চালিত বলে অভিহিত করছে, যদিও সরকার নিজে ক্রমেই বেশি করে সেভাবেই শাসন করছে যেভাবে ঔপনিবেশিক শাসকরা করত, প্রতিটি বিরোধিতাকে দমন করতে এবং নাগরিকদের সমস্ত স্বাধীনতাকে খর্বকরতে প্রয়োগ করা হত দানবীয় আইনগুলোকে।
গণহত্যার অপরাধকে কখনই ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব নয়। সত্যিটা সবসময় ফিরে এসে সংঘটকদের হানা দেবে। সেন্সরশিপের ‘জরুরি ক্ষমতা’ একটা তথ্যচিত্রের প্রদর্শন সাময়িকভাবে বন্ধ করতে পারে, কিন্তু তা কখনই সত্যিটাকে চিরদিন চেপে রাখতে পারবে না।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩)
(আসন্ন একাদশতম পার্টি কংগ্রেসের এই রাজনৈতিক খসড়া প্রস্তাবনা প্রকাশ করা হল। — সম্পাদকমণ্ডলী)
১) বর্তমানে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামো এবং ভারতীয় জনগণের জীবিকা ও অধিকারগুলির উপর ঘনীভূত আক্রমণের এক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে চলেছি যার সাথে যুক্ত হয়েছে ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহের উপর অপরিসীম কর্পোরেট লুণ্ঠন। তিন দশক আগে যে দুই যুগ্ম গতিপথ উন্মুক্ত হয়েছিল — যার একটি হ’ল উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ ও বিশ্বায়নের এক নয়া উদারনৈতিক নীতিমালা, আর অন্যটি হ’ল আগ্রাসী হিন্দুত্ব বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে হিন্দুশ্রেষ্ঠত্ববাদের দ্বারা পুনঃসংজ্ঞায়িত করা — একত্রে মিশে গিয়ে ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে এবং সেই থেকে সরকার প্রণালীবদ্ধভাবে এই দ্বিফলা কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে চলেছে। ২০১৯এ মোদী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর এই অভিযান রীতিমতো গতি লাভ করেছে এবং সামনেই ২০২৪’র নির্বাচন এবং ২০২৫এ আরএসএসের শতবর্ষের মুখে আমরা এই বিপদের ভয়াবহ মাত্রার বৃদ্ধির সম্মুখীন।
২) সংবিধানের মূল মর্মবস্তু ও কাঠামোকে অগ্রাহ্য করে সন্দেহজনক পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেই হোক অথবা সংসদীয় বা বিচারবিভাগীয় যাচাই প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে গিয়ে প্রশাসনিক আদেশ জারির মাধ্যমেই হোক — সংবিধানের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ নামানো হয়েছে। ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত সবকটি মূল সংজ্ঞা — সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক — ধারাবাহিকভাবে লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে। প্রতিবেশি দেশগুলি থেকে আসা অভিবাসীদের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে পৃথকীকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে নাগরিকত্বের সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ইডব্লিউএস (আর্থিকভাবে দুর্বল অংশ) সংশোধনীতে সমাজের আর্থিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য তথাকথিত সংরক্ষণের আওতা থেকে এসসি/ এসটি/ওবিসিদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ৩৭০ ধারা বাতিল এবং জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা অবলুপ্তি জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণকে ঐতিহ্যবাহী সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে যা রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পর্যবসিত করার এক অশুভ সংকেত। ইন্দো-বাংলাদেশ ও ইন্দো-পাকিস্তান সীমান্তের ৫০ কিলোমিটার আভ্যন্তরীণ এলাকার মধ্যে বিএসএফকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির নিজস্ব এক্তিয়ারকে অস্বীকার করে, যা আসলে যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারের মধ্যে বড়সড় অন্তর্ঘাত।
৩) শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পৃথক পৃথক ক্ষমতার এক্তিয়ার এবং কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন আমাদের সাধারণতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামোর প্রধান অঙ্গ। মোদী জমানায়, শাসন বিভাগ ক্রমাগত আইনসভা ও বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে গ্রাস করছে। সরকার নিয়ম করে অধ্যাদেশ জারি করছে এবং সংসদে কোনো আলোচনা ও নিরীক্ষণ বাদ দিয়েই বিল পাশ করা হচ্ছে। যে নির্লজ্জতার সাথে বিধায়কদের কেনা হচ্ছে, সরকারগুলিকে ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে এবং অ-বিজেপি দল দ্বারা চালিত রাজ্য সরকারগুলিকে অকার্যকরী ও অস্থিতিশীল করার জন্য রাজ্যপালের দপ্তরগুলিকে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা সংবিধানের মধ্যে অন্তর্ঘাত সৃষ্টির আর এক বিপজ্জনক সংকেত। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ও কেন্দ্রীয় (সরকারী) চাকরির ভর্তি, নিয়োগ ও আধিকারিকদের মোতায়েন করার ক্ষেত্র ও প্রক্রিয়ার যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিসরে অনুপ্রবেশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে, রাজ্যগুলিকে অসুবিধায় ফেলে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। জিএসটির মাধ্যমে রাজস্বের কেন্দ্রীভবন রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ভারতের নির্বাচন কমিশনকে পছন্দসই আমলাদের দ্বারা কুক্ষিগত করা এবং সেনাবাহিনীকে অগ্নিপথ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্গঠন করার ঘটনায় সরকারের অভিপ্রায় খুবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যা থেকে বলাই যায় যে সে এবার বিচার বিভাগীয় নিয়োগের ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ জারি করতে চায়। আইনমন্ত্রী তো সংসদ কক্ষে দাঁড়িয়ে জামিনের আবেদন গ্রহণ ও জনস্বার্থ মামলায় সম্মতিদানের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন।
৪) ক্ষমতার বল্গাহীন কেন্দ্রীভবন কার্যত সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থাকে মার্কিন ধাঁচের রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ক্ষমতার প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল — এই ত্রয়ীকে নিয়ে যেন গঠিত হয়েছে মোদী সরকারের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণের রণনৈতিক কেন্দ্র। নোটবন্দি ও জিএসটি থেকে লকডাউন ও কৃষিকানুন সমূহ — এ’রকম বহু উদাহরণ আছে যেখানে দেখা যায় কোনো রকম প্রতিষ্ঠানগত আলোচনা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ঘোষণা করেছেন। জম্মু ও কাশ্মীরের বেলায়, অমিত শাহ তাঁর আকস্মিক ঘোষণার দ্বারা সংসদকে চমকে দিয়ে রাজ্যটির সাংবিধানিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন এবং রাজ্যের মর্যাদা হরণ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে বিভাজিত করে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে অবনমিত করেন। অগ্নিপথ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সর্বোচ্চ প্রধান যিনি সৈন্যদের চাকরি ও নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ন করে, তার পরিবর্তে স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা বর্জিত স্বল্পকালীন চুক্তির ভিত্তিতে অস্থায়ী সৈনিক নিয়োগের ভাবনার বিরোধিতা করেছিলেন — দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু ঘটার পর, লকডাউনের সুযোগ নিয়ে সরকার এই প্রকল্পটি (অগ্নিপথ) ঘোষণা করেছিল। মোদীর নিজের কথাতেই, সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তরিত করার জন্য এই সমস্ত পদক্ষেপই ছিল সরকারের রণনীতির অঙ্গ।
৫) বিজেপি কর্তৃক সংবিধান অবমাননাকে প্রায়শই সংবিধান উদযাপনের মোড়কে আড়াল করা হয়। ২০১৫ থেকে, মোদী সরকার সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিনটিকে সংবিধান দিবস হিসাবে উদযাপন করে চলেছে আর এই সুযোগে সে আমাদের সংবিধানের মূল্যবোধ ও দিশার সম্পূর্ণ বিপরীতে তার (নিজস্ব) সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার চালায়। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীকে ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ বলে উদযাপনের পর, সরকার ২০৪৭ সাল পর্যন্ত আগামী পঁচিশ বছরকে অমৃতকাল বলে চিহ্নিত করেছে আর নরেন্দ্র মোদী তাকে কর্তব্যকাল বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন — যেখানে নাগরিকদের কর্তব্য হবে সাংবিধানিক অধিকারগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া। ভারতকে গণতন্ত্রের জননী বলে চিত্রিত করে ২০২২এ সংবিধান দিবস পালন করা হয় এবং এতদুপলক্ষ্যে চর্চার জন্য যে নোট প্রচারিত হয় সেখানে ভারতীয় গণতন্ত্রকে এক প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার দ্যোতক বলে বর্ণনা করা হয়, আর এভাবে ভারতের জাত প্রথার যে বাস্তবতা তাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। অথচ এই জাতপ্রথাকেই সমস্ত প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারকরা সামাজিক দাসত্ব বলে চিহ্নিত করেছেন আর ব্যক্ত করেছেন যে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতার বিষময় প্রভাব ভারতীয় সমাজের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। বিপরীতে মোদী সরকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা ও বহু ধর্মীয় ভারতীয় সমাজের বর্ণময় সমন্বয়কে আড়াল করে হিন্দুত্বের একমাত্রিক চিত্র হাজির করে চলেছে।
৬) ১৯৯০’র দশকে বিজেপি প্রথম যখন জাতীয় স্তরের কোয়ালিশন গঠন করে, তখন সে তার তিন বিতর্কিত কর্মসূচিকে — রামমন্দির, ৩৭০ ধারা ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মুলতুবি রাখতে সম্মত হয়। আজ বিজেপি তার এই কর্মসূচিকে কেবল বাস্তবায়িত করতেই ব্যস্ত তা নয়, সে তাকে সুচারুরূপে প্রসারিত করে চলেছে। সর্বোচ্চ আদালত বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে সংবিধান লঙ্ঘনের জঘন্য ঘটনা বলে আখ্যা দেওয়ার পরও সুপ্রীম কোর্ট (মসজিদ) ধ্বংসকারীদের হাতেই বিতর্কিত জমিকে তুলে দিয়েছে আর ২০২৪’র নির্বাচনের আগে মন্দির উদঘাটন কাজ অপেক্ষা করে রয়েছে। ১৯৯১-তে যে আইন প্রণয়ন করে কোনো উপাসনালয়ের চরিত্র বা এক্তিয়ার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ১৫ আগস্ট ১৯৪৭-কে ‘কাট অফ’ তারিখ (ভিত্তিবর্ষ) বলে ঘোষণা করা হয় (এই আইনে অযোধ্যাকে ব্যতিক্রম হিসাবে দেখানো হয়) — সেই আইনকে বিজেপি বাতিল করতে চায় যাতে বিভিন্ন মসজিদ ও ইসলামী স্থাপত্যকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করার সংঘ পরিবারের উদ্যোগকে বৈধ করে তোলা যায়। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে এই প্রকল্প রূপায়নের উদ্দেশ্যে যথেচ্ছাচার চালানো হচ্ছে আর সংঘবাহিনীর গুন্ডাদল লাগাতার হামলা নামিয়ে আনছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা, ধর্মান্তরকরণ ও পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, মাংস বিক্রি ও গোমাংস ভক্ষণ বন্ধ করা, প্রকাশ্যে ধর্ম প্রার্থনায় বিধিনিষেধ আরোপ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও সংঘী ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী কর্তৃক গণপিটুনি ও বাছাই করে হিংসা ছড়ানোর হাজারো ঘটনা দেখা যাচ্ছে। ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া, গণহারে গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে আটক, এনকাউন্টার হত্যা হয়ে চলেছে যেখানে পরিবর্তিত আইনে এসব বৈধ হয়ে ওঠে এবং ন্যায্যতা লাভ করে। এ’ধরনের আক্রমণ শুধুমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরই নেমে আসছে না, পরন্তু অন্যান্য সম্প্রদায় সহ দলিত, আদিবাসী ও মহিলাদের উপরও যথেষ্ট মাত্রায় নেমে আসছে।
৭) সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক অংশগুলির উপর আক্রমণের সাথে সাথে বিরোধী কণ্ঠস্বর ও গণআন্দোলন সমূহের উপরও বাছাই করে ধারাবাহিক আক্রমণ চালানো হচ্ছে এবং সংসদীয় ক্ষেত্রে বিরোধিতাকে অবৈধ বলে দেখানোর অপচেষ্টাও ক্রমবর্ধমান। ঔপনিবেশিক যুগের কায়দায় এই জমানায় নাগরিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা আনা হচ্ছে এবং কোনো বিচার বা জামিন ছাড়া দীর্ঘদিন তাঁদের জেলে বন্দি রাখা হচ্ছে। ভীমা-কোরেগাঁও এবং দিল্লী দাঙ্গার মামলাগুলিতে নির্যাতনের এই ছবি সুপরিষ্ফুট যেখানে নানা সন্দেহজনক উপায়ে মিথ্যা বৈদ্যুতিন ‘সাক্ষী’ জোগাড়, রাষ্ট্রদ্রোহের ও সন্ত্রাসবাদের মিথ্যা মামলা দায়ের থেকে শুরু করে ইউএপিএ, এনএসএ এবং রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের মতো দানবীয় আইনে প্রতিবাদীদের ঘিরে ফেলা হয়। আমরা দেখেছি, ফাদার স্ট্যানস্বামীকে, যিনি হাজার হাজার আদিবাসী যুবককে মিথ্যা অভিযোগে দীর্ঘদিন কারাবন্দি রাখার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন এবং ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের মুখ হয়ে উঠছিলেন বলে শহীদের মৃত্যু বরণ করতে হয়। ভারতের মধ্যে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে অবদমিত রাখার এই ঘটনা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের উপরও প্রযোজ্য হচ্ছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত যারাই মোদী সরকারের সমালোচনা করছেন এবং ভারতে গণতন্ত্র রক্ষার সপক্ষে কাজ করছেন তাদেরই ওসিআই (বিদেশস্থ ভারতীয় নাগরিক) মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বিভেদমূলক ও বিভাজন সৃষ্টিকারী নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে শাহিনবাগের মতো শক্তিশালী গণআন্দোলন কিম্বা কৃষিকে কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে চিত্রিত করার অপচেষ্টা হয়েছে এবং আন্দোলনগুলির উপর গণহিংসা চাপিয়ে সেগুলিকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার জন্য আন্দোলনজীবী, শহুরে নকশাল বা ‘কলমধারী নকশাল’ শব্দবন্ধ প্রয়োগ করেছেন।
৮) কোনো প্রতিষ্ঠানগত নজরদারি না থাকায় এবং যথেচ্ছ অর্থক্ষমতার জোরে বিজেপি এখন বিধায়ক কেনাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে আর এভাবে অ-বিজেপি সরকারগুলিকে ফেলে দেওয়ার লক্ষ্যপূরণও তাদের সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে। কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র হ’ল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে বিধায়ক কিনে সরকার পাল্টে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যপালের দপ্তর ও সিবিআই, ইডি, এনআইএ ইত্যাদি কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে কাজে লাগিয়ে কদর্যভাবে অ-বিজেপি সরকারগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করা ও তাদের স্থিতিশীলতা ভাঙ্গার চেষ্টা হচ্ছে। ২০১৪-তে ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারতের’ যে অভিযান বিজেপি শুরু করেছিল এখন তা বিরোধীমুক্ত গণতন্ত্রের ভাষ্য হয়ে উঠেছে আর তারা এখন প্রকাশ্যেই একদলীয় রাষ্ট্রের ওকালতি করছে যেখানে বিজেপি সারাদেশে তাদের আধিপত্য কায়েম করে আগামী পঞ্চাশ বছর অবধি দেশ শাসন করতে চায়।
৯) নাগরিকদের কড়া নজরদারিতে রাখা ও সর্বগ্রাসী এক ভয় ও নিয়ন্ত্রণের পরিবেশ কায়েমের মধ্য দিয়ে মোদী জমানা ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি ও পরিষেবার আর্থিক ও নিয়ন্ত্রণভার বাছাই করা কিছু কর্পোরেট গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিচ্ছে। বেসরকারীকরণ এখন রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তিকে খোলাখুলি বেচে দেওয়া অথবা প্রায় চিরস্থায়ী লিজে দেওয়ায় পর্যবসিত হয়েছে — যাকে অলস পড়ে থাকা সম্পদ থেকে অর্থ উপার্জন বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। নোটবন্দির মতো মানিটাইজেশন পাইপলাইনও এক ভয়ংকর ধারণা, যার দ্বারা জনগণের অর্থ ও শ্রমে অর্জিত রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করা হচ্ছে। বেসরকারীকরণের প্রবক্তারা বেসরকারীকরণকে বাড়তি দক্ষতা ও বিকাশের পথ বলে যুক্তি দিচ্ছে, বাস্তব কিন্তু তাদের মনগড়া যুক্তি ও বিভ্রান্তিকর প্রচারকে চপেটাঘাত করছে। আমরা এখন সহজেই দেখতে পাই, ক্রমবর্ধমান বেসরকারীকরণ কেবল গণহারে বেকারত্ব, দারিদ্র্য আর প্রবল বৈষম্যেরই জন্ম দিচ্ছে। বেসরকারীকরণ উচ্চশিক্ষাকে মহার্ঘ করে তুলেছে আর ভালো মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা গরিব এমনকি মধ্যবিত্তদেরও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবেই উপরের দিকে পৌঁছানোর সামাজিক গতি রুদ্ধ হচ্ছে এবং প্রধানত ব্রাহ্মণপ্রধান সামাজিক উচ্চকোটির লোকরাই আরও বেশি সুবিধা ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ পাচ্ছে।
১০) মোদী জমানায় ক্রোনি পুঁজিকে যেভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে তার ফলে ধনী দরিদ্রের মধ্যকার ব্যবধান নিদারুণভাবে বেড়ে চলেছে। মোদী জমানায় ভারতে ডলার বিলিয়নারের (অর্বুদপতি) সংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২২ অতিমারীর এই দু’বছরে বিলিয়নারের তালিকায় নতুন ৬৪টি নাম যুক্ত হয়েছে। আর্থিক পুনর্বণ্টন ও সমতা আনার জন্য কর ব্যবস্থাকে ব্যবহার করার পরিবর্তে সরকার এটাকে গরিবদের লুণ্ঠন করে ধনীদের পুষ্ট করার উপায় হিসাবে ব্যবহার করছে। ভারতে কোনো সম্পদ কর বা উত্তরাধিকার করের সংস্থান নেই, কর্পোরেট কর ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা হচ্ছে, বেশি বেশি করছাড় দেওয়া বা কর ব্যবস্থাকে এড়ানোর সুবিধা তো রয়েইছে। পরিসংখ্যান বলছে, মোট সংগৃহীত জিএসটির দুই তৃতীয়াংশ আসে ভারতীয় জনগণের নিচের তলার অংশ থেকে, এক তৃতীয়াংশ পরবর্তী ৪০ শতাংশ মানুষ থেকে আর মাত্র তিন থেকে চার শতাংশ আসে ভারতীয় সমাজের চূড়ায় বসবাসকারী দশ শতাংশ লোকদের থেকে।
১১) বিমুদ্রাকরণ যদি আমাদের দেশব্যাপী মোদী জমানার নির্বিকার ও বিপর্যয়কর চরিত্রের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে থাকে, তাহলে কোভিড১৯ অতিমারীর দীর্ঘ সময়ে আমরা মানবসম্পদের যন্ত্রণাবিধুর সেই একই স্বাদ পেয়েছি। অতিমারীর শুরুর দিনগুলিতে, ভাইরাস মোকাবিলার নামে সরকারকে যাবতীয় শঠতাপূর্ণ ও যুক্তিহীন ধারণা ফেরি করতে দেখেছি। কোনো পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়া আচমকা লকডাউন ঘোষণা সারা দেশকে এক মানবিক সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দেয়। পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবার পরিজনকেই সবথেকে বেশি আঘাত সইতে হয়। পায়ে হেঁটে তাদের শত শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে এবং পথে ও তথাকথিত কোয়ারান্টাইন সেন্টারগুলিতে তাদের অশেষ দুর্ভোগ ও অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। লক্ষ লক্ষ পরিবার খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য চরম দুর্গতির মুখে পড়ে। লকডাউন হ’ল স্পষ্টতই এক দমনমূলক ও বিপর্যয়কর পদক্ষেপ। বহু দেশই এই পদক্ষেপ নিয়েছে সাময়িক এক ব্যবস্থা হিসেবে যাতে করে ভাইরাস সংক্রমণের গতিকে কমানো যায় এবং পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে তোলার জন্য অনেকটা সময় পাওয়া যায়। ভারতে লকডাউনকেই অন্তিম উপায় (end in itself) ধরে নিয়ে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয় — যার লক্ষ্য ছিল বিধিনিয়মের নাগপাশে মানুষকে বেঁধে ফেলা ও জনগণকে বশীভূত করা। অপ্রতুল ও যথেষ্ট সাজসরঞ্জাম বিহীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা ব্যাপক মাত্রার সংকট মোকাবিলায় ছিল নিদারুণ অপ্রস্তুত অবস্থায়। অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়, ঠিক সময়ে ও পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ না হওয়ায় যে ব্যাপক হারে মৃত্যু ও বিভীষিকা নেমে আসে তাকে যথার্থভাবে রোধ করার পরিবর্তে, বাস্তব পরিস্থিতিকে গোপন করার জন্য অভূতপূর্ব মাত্রায় প্রচার চালানো হয় এবং ব্যর্থ শাসককেই পরিত্রাতা হিসাবে মেলে ধরা হয়।
১২) নির্বিচারে যে বেসরকারীকরণ এবং চরম উন্নাসিক, অবিবেচক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকার পরিচালনা দেশকে নিম্নমুখী আর্থ-সামাজিক পাকচক্রের দিকে নিরন্তর ঠেলে নিয়ে চলেছে যার প্রতিফলন হ’ল বিশ্বের তুলনামূলক সবকটি সূচকের নিরিখে ভারতের অবস্থা ক্রমশ নিচের দিকে চলে যাওয়া। অনগ্রসরতা ও বঞ্চনার ফলে ভারতীয় জনগণের সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তারজন্য বর্তমান শাসকরা কেবলই অতীতের উপর দোষারোপ করে এবং পঁচাত্তর বছর তথাকথিত কোনো কাজ না হওয়াকেই দায়ী করে, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির একটাও কেন পূরণ হল না সেই চরম ব্যর্থতার প্রশ্নে তারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। ২০২২’র মধ্যে বিদ্যুৎ, শৌচালয়, পানীয় জলের নিশ্চয়তা সহ সকলের জন্য ঘরের প্রতিশ্রুতি, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতেও, আগের মতোই অধরা থেকে গেছে। বর্তমান জমানা এখন গোলপোস্টকে সরিয়ে ২০৪৭-এ নিয়ে গেছে, আর ভারতের জনগণকে বিশ্বের দরবারে গল্পকথার মতো উত্থানের কাহিনী শোনাতে এক প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে যা ক্রমেই উত্তুঙ্গ হবে এ’বছরের শেষে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০’র শিখর সম্মেলনকে সামনে রেখে। পরিহাসের যা তা হ’ল, সরকার যত বিশ্বের আঙিনায় বিশ্বগুরু হিসেবে নতুন ভারতের গীত শোনাচ্ছে ততই বেশি বেশি সংখ্যায় ধনী ও সুবিধাভোগী ভারতীয়রা আমেরিকা ও পশ্চিমী দুনিয়ার উন্নত দেশগুলিতে চলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে, বেশি বেশি সংখ্যায় শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভারতীয়রা নিপীড়নমূলক ও কষ্টকর কাজ এবং বিভেদমূলক অভিবাসী আইনের ঝুঁকি নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে জীবিকার সন্ধানে পশ্চিম ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে পাড়ি দিচ্ছেন। মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন এমন ভারতীয়দের সংখ্যা ১.৫ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।
১৩) যে সমাজে রয়েছে চরম সামাজিক অসাম্য সেখানে উপরের দিকে সামাজিক গতি সঞ্চারের একমাত্র উপায় যে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান তা আবারও ধনীদের জন্যই সংরক্ষিত হচ্ছে। সরকার চালনায় অভিজাতমুখী প্রবণতা প্রতিদিন নগ্নভাবে ফুটে উঠছে। যে প্রধানমন্ত্রী গরিবের প্রয়োজন ও অধিকারগুলিকে এবং সাধারণ মানুষের চাহিদাকে ‘মাগনা খাওয়ানোর রেওয়াজ’ বলে ব্যঙ্গ করেন তিনিই আবার বন্দে ভারত ট্রেনগুলি এবং অতীব বিলাসবহুল প্রমোদতরী গঙ্গাবিলাসকে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে দেখিয়ে ঝান্ডা নেড়ে উদ্বোধন করছেন। সরকারী নীতি ও শাসন প্রণালীর নির্লজ্জ ধনীঘেঁষা অভিঘাত, যার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের প্রয়োজন ও আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি চরম অবহেলা এবং জনগণের জীবনে বেড়ে চলা অনিশ্চয়তা, বঞ্চনা ও অবমাননা সমাজে প্রবল হতাশা ও শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এই হতাশাকে কাজে লাগানোর জন্য সংঘ বাহিনী ঘৃণা, মিথ্যাচার ও হিংসার নিখুঁত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। যুব সম্প্রদায় ও মহিলাদের মধ্যে, বিশেষত সমাজের নিপীড়িত ও বঞ্চিত অংশের মধ্যে সংঘ বাহিনীর লাগাতার অনুপ্রবেশ উৎকণ্ঠার কারণ এবং সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে একে প্রতিহত করতে হবে।
১৪) সংকটের গভীরতা, সংবিধানের উপর চলমান নির্লজ্জ আক্রমণ এবং ধর্মনিরপেক্ষ নীতিমালা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ভিন্নমত পোষণের অধিকারসমূহের ভয়াবহ ক্ষয়প্রাপ্তি শক্তিশালী প্রতিবাদ ও গণআন্দোলনের জন্ম দিচ্ছে। সিএএ বিরোধী প্রবল প্রতিবাদসমূহ বিশেষত সেখানে মুসলিম মহিলাদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ এবং দিল্লী সীমানায় ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন হ’ল দুই ঊর্ধবিন্দু যা সমগ্র ভারতজুড়ে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে শক্তি ও প্রেরণা জুগিয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসকদের পথ অনুসরণ করে সরকার এই আন্দোলনগুলি দমন করার জন্য পাশবিক নিপীড়ন চালিয়েছে এবং ইজরাইল থেকে আমদানি করা স্পাইওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। কিন্তু যে সাহস ও সংকল্প নিয়ে নিগৃহীত সমাজকর্মীরা অত্যাচারের মোকাবিলা করেছেন তা ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে তীক্ষ্মতর করতে সকলের মনোবলকে উত্তুঙ্গ ও মজবুত করে তুলেছে।
১৫) জনগণের অসন্তোষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া এবং গণআন্দোলনগুলির প্রবল চাপ রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ক্ষেত্রেও অনুভূত হচ্ছে। শাসক এনডিএ জোটের মধ্যে মতবিরোধের লক্ষণও প্রকাশ পাচ্ছে — যেখানে তার সবচেয়ে পুরানো তিন মিত্র আকালি দল, শিবসেনা ও জেডিইউ জোট ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অকালি দল কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জোট ছেড়েছে, শিবসেনা অ-বিজেপি জোট গঠনের জন্য কংগ্রেস ও এনসিপির সাথে হাত মেলায় এবং (শিব)সেনার মধ্যে বিজেপি ভাঙ্গন ঘটিয়ে রাজ্যটিতে ক্ষমতা হস্তগত করতে সফল হওয়ার আগে পর্যন্ত আড়াই বছর সরকার পরিচালনা করে। আর নীতীশ কুমার ২০২২’র আগস্টে আবার এনডিএ ত্যাগ করেছেন এবং ক্ষমতা থেকে বিজেপিকে হটাতে আরজেডি, কংগ্রেস ও বামদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছেন। পাঁচবছর আগে নীতীশ কুমার যেভাবে আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর স্বল্পকালীন জোট ভেঙ্গে এনডিএতে ফিরে গিয়েছিলেন, এক অর্থে, এটা যেন সেই ঘটনারই উল্টো চিত্র।
১৬) সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলির মধ্যে আমরা শক্তিশালী বিজেপি-বিরোধী গণরায় দেখেছি ঝাড়খণ্ডে ২০১৯-এ, পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এ এবং অতি সম্প্রতি ডিসেম্বরে হিমাচল প্রদেশে। তামিলনাড়ু, কেরল ও পঞ্জাবে — যে সমস্ত জায়গায় বিজেপির কেবেদিনই তেমন নির্বাচনী উপস্থিতি ছিল না — সে খুবই খারাপ ফল করেছে। কিন্তু বিজেপি প্রভূত সাফল্য পেয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছে। বস্তুত, সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস কোনো আসন জিততে না পারায়, বিধানসভার পরিসরে বাম সমর্থিত একমাত্র আইএসএফ বিধায়ক বাদ দিলে, বিজেপিই হয়ে উঠেছে একমাত্র বিরোধী পক্ষ। পঞ্জাবে আপের সাফল্যের পর গুজরাটেও সে যথেষ্ট ভালো ফল করেছে — যেখানে ভালো পরিমাণে ভোট পাওয়া এবং কয়েকটি আসনলাভ তাকে জাতীয় দলের স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। বিজেপির সর্বাত্মক অপকৌশল সত্বেও, দিল্লী পৌরসভা নির্বাচনে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।
১৭) বিভিন্ন রাজ্যে পরাজিত হওয়া সত্বেও, বিজেপি এখন সর্বভারতীয় স্তরে সামগ্রিক আধিপত্যের এক উচ্চ সোপানে পৌঁছেছে। জাতীয় স্তরে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস — কী ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে, কী আসন সংখ্যার বিচারে — সর্বকালীন নিঁচু জায়গায় নেমে এসেছে। কিছু আঞ্চলিক দল যদিও বিজেপি থেকে তাদের দূরত্ব বজায় রেখেছে, তাদের অল্প কয়েকটিই কেবল সরাসরি বিরোধী ভূমিকা পালন করছে। উড়িষ্যায় বিজেডির মতো দল অথবা অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআরসিপি হ’ল, আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে যারা মুখ্য সমস্ত প্রশ্নেই বিজেপির সঙ্গে থাকে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রধানত কংগ্রেসকে দুর্বল করে বেড়ে ওঠা আপ বস্তুগতভাবেই এখন যে জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে তাকে বিজেপির সাথেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। কিন্তু সে নরম হিন্দুত্বের এক প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে হাজির করে, সে প্রতিযোগী হিসেবে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাইছে বিজেপিরই তৈরি করা ভাষাতে (term)। আর পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি চালিত সরকার বা তেলেঙ্গানায় টিআরএস (এখন হয়েছে বিআরএস) মোদী জমানার বিরুদ্ধে খুবই সরব হলেও দুর্নীতি ও অপশাসনে কালিমালিপ্ত। অধিকাংশ পরিচিতি ভিত্তিক দল কোনো মতাদর্শগত অবস্থান নেয় না এবং সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব ফেলে এমন গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত প্রশ্নে নীরব থেকে যায় এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং পরিচিতিকে আত্মসাৎ করার জন্য বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতির মুখে তারা নতিস্বীকার করে (vulnerable)। উত্তরপ্রদেশে বিএসপির দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্তি, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের মুখে মতাদর্শরহিত পরিচিতি রাজনীতির নতিস্বীকারের এটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
১৮) এটি আমাদের বোঝা প্রয়োজন, দক্ষিণপন্থা ঘেঁষা নীতি পরিবর্তন ও হিন্দুত্বের সাধারণ ধারণার অস্তিত্ব থেকে গত তিন দশকে বিজেপিই লাভবান হয়েছে। এই বড়মাত্রায় সহমত হওয়া ও নয়া উদারবাদী নীতিগুলির দীর্ঘ অনুসরণ এবং হিন্দুশ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতির নিরবচ্ছিন্নতা, পার্থক্যরেখাকে প্রায়ই ঝাপসা করে দেয় এবং বিরোধীপক্ষ নির্বাক থেকে যায়। বিজেপি যদি লাগামহীন কর্পোরেট লুণ্ঠনের সঙ্গে আক্রমণাত্মক হিন্দুত্বের সমন্বয় ঘটায় এবং এই সমন্বয়কে পাশবিক রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও নগ্ন বিচারবিভাগ বহির্ভুত হিংসার দ্বারা দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় তাহলে এই ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের প্রতি বিরোধিতাকে সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ভারতের দিশার প্রতি ধারাবাহিক ও সাহসী দায়বদ্ধতার দ্বারাই চালিত হতে হবে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্তব্য হ’ল, আধুনিক ভারত গড়ার এই জটিল সন্ধিক্ষণে এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নির্বাহ করা।
১৯) দুর্ভাগ্যক্রমে, যখন বিজেপি তার উচ্চতার শীর্ষে পৌঁছেছে, সেই সময় বাম শিবিরের নির্বাচনী শক্তির বিশাল ক্ষয় ঘটেছে। যদিও নির্বাচনী শক্তির ক্ষয়ের দ্বারা বামদের কোনোভাবেই মতাদর্শগত- রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া অথবা সেকেলে হয়ে যাওয়াকে সূচিত করে না। বামেদের বিধায়ক ও সাংসদ সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাওয়াটা প্রায় সবটাই ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) নেতৃত্বে চালিত সরকারগুলির পতনের জন্য এবং এর নিজস্ব কিছু নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতও আছে। চৌত্রিশ বছরের শাসনকালে জমা হওয়া প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মুখে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) তার নিজের নির্বাচনী (গণ)ভিত্তি থেকে ভীষণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যা আরও প্রকট হয় তার বড় বড় নীতিগত ভুল বিশেষত কর্পোরেটমুখী আর্থিক নীতি গ্রহণ, জোর করে কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও ক্ষমতার দম্ভের কারণে। অবশেষে সে পরিস্থিতির এমন এক ফাঁদে জড়িয়ে যায় যেখানে রাজনৈতিক দৃশ্যপট ক্রমাগত শাসক টিএমসি এবং আগ্রাসী ও উত্থানমুখী বিজেপির মধ্যে মেরুকৃত হয়ে পড়ে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে স্বীকার ও মোকাবিলা না করতে পারার ব্যর্থতা ও বিশেষত ত্রিপুরায় আশ্চর্য্যজনকভাবে বিজেপির কাছে ক্ষমতা হারানোর পরও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের প্রতি তার আত্মঘাতী ঔদাসীন্য বিষয়টিকে আরও শোচনীয় করে তোলে। কিন্তু একই সময়ে সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বামরা কেরল ও তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে ভালো ফল করার পাশাপাশি বিহারে সিপিআই(এমএল)-এর জোরালো নির্বাচনী উত্থান, পরিস্থিতির দাবিগুলির সাপেক্ষে বামেদের পুনরুত্থানের নতুন সম্ভাবনাগুলিকে উন্মুক্ত করেছে।
২০) আধুনিক ভারতের ঠিক এই অভূতপূর্ব জটিল সন্ধিক্ষণে সিপিআই(এমএল) এবং বাম আন্দোলনকে অবশ্যই তাদের অগ্রাধিকারগুলিকে রূপায়িত করতে হবে। পশ্চাদমুখী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ফ্যাসিবাদী অ্যাজেন্ডার সাহসী, ধারাবাহিক ও ধৈর্যশীল উপায়ে মতাদর্শগত প্রতিরোধ গড়ে তোলা; জনগণের অবিচল ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে শক্তিশালী ও দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ; এবং সিপিআই(এমএল) ও বামেদের রাজনৈতিক উত্থান ও অগ্রগতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ব্যাপকতম সম্ভাব্য মতাদর্শগত-রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও নির্বাচনী সমঝোতা গড়ে তোলা — এই অভিমুখে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে আমাদের দৃঢ়পণ হতে হবে। ভারতের ত্রি-স্তরীয় রাজনৈতিক কাঠামোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে একটি সমতল রাজনৈতিক (flattened) চারণভূমি গড়ে তোলা — যেখানে বিজেপি সমগ্র ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাবে — এমন এক ফ্যাসিবাদী আক্রমণের জন্য যতই আতঙ্ক ছড়ানো হোক, পরিস্থিতির প্রতিটি দাবি ও প্রতিটি স্তরে সাড়া দেওয়ার জন্য আমাদের সক্রিয় থাকতে হবে। পঞ্চায়েত ও পুরসভা পরিচালনার ক্ষেত্রগুলিতে প্রায় সর্বত্রই মানুষকে সীমাহীন দুর্নীতি এবং সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরিস্থিতিতে সকলের জন্য শিক্ষা ও কাজ এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়টি প্রায় সমস্ত রাজ্যে যুবসমাজের নিকট গভীর উৎকণ্ঠার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, জাতিগত ও লিঙ্গ উৎপীড়ন, অবিচার ও প্রশাসনিক নির্লিপ্ততার দৃষ্টান্ত সারা দেশেই প্রচলিত ব্যাধি হয়ে উঠেছে। সংঘ বাহিনীর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ মোকাবিলার প্রধান লক্ষ্যকে বিস্মৃত না হয়েও, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামের মূলবিন্দু (focus) আমাদের দাবি জানাচ্ছে, জনগণের স্বার্থকে আমাদের ঊর্ধে তুলে ধরতে হবে ও এ’প্রশ্নে প্রতি ক্ষেত্রে তাদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে।
জোশীমঠের সামনে এখন অস্তিত্বের সংকট — পাহাড়ের বুকে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে এখানকার বাসিন্দাদের। প্রতিদিনই আরো বেশি সংখ্যক বাড়ি, রাস্তাতে ফাটল ধরা পড়ছে। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর একটা প্রতিবেদনে ধরা পড়েছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা। ইসরো আগেই জানিয়েছিল যে, ২০২২’র এপ্রিল থেকে সাত মাসে জোশীমঠের মাটি বসেছিল ৯ সেন্টিমিটার। এখন এটা স্পষ্ট যে, সেই রিপোর্ট উত্তরাখণ্ডের ও কেন্দ্রের শাসকদের কাছে কোনো গুরুত্বই পায়নি। আর ২০২২’র ২৭ ডিসেম্বরের পর পরিস্থিতি আরও সংকটজনক হয়ে ওঠে। ইসরো জানায়, ২০২২’র ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩’র ৮ জানুয়ারি মাত্র এই ১২ দিনেই জোশীমঠের মাটি বসে যায় ৫.৪ সেন্টিমিটার (জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কতৃপক্ষের নির্দেশে ইসরো সেই রিপোর্ট অবশ্য তাদের ওয়েবসাইট থেকে তুলে নেয়)। নিরাপদ নয় বলে অন্তত ১৭টা বহুতল ও হোটেল ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়েছে, কমপক্ষে ৮৭০টা বাড়িতে ফাটল ধরা পড়েছে, বসবাসের পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত বলে নির্দেশিত হয়েছে ১৮১টা বাড়ি এবং চূড়ান্ত বিপন্ন ২৫টা পরিবারের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সরকারের ঠিক করে দেওয়া আশ্রয় শিবিরে। সেখানেও মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই, উত্তরাখণ্ডের তীব্র ঠাণ্ডা-বৃষ্টি-তুষারপাতের অসহনীয় পরিস্থিতিতে দিন কাটাতে হচ্ছে।
উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখণ্ড তৈরি হয় ২০০০ সালে। নতুন রাজ্যের এই গঠনই শাসকদের কাছে হয়ে ওঠে প্রকৃতিকে লুন্ঠনের, কর্পোরেট লালসা পূরণের এক লাইসেন্স। সেই ১৯৭৬ সাল থেকেই বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবিদরা সতর্ককরে আসছেন যে জোশীমঠকে মাটির নীচে বসে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে উন্নয়ন ভাবনাকে পাল্টাতে হবে, বাড়িঘর ও রাস্তার যথেচ্ছ নির্মাণে লাগাম পরাতে হবে, প্রকৃতির সংবেদনশীলতার সহমর্মি হতে হবে। কিন্তু এইসব সতর্কীকরণকে উপেক্ষা করে চলতে থাকে অপরিণামদর্শী নির্মাণ, উত্তরাখণ্ডের বাইরের কর্পোরেট সংস্থাগুলোও ঐ রাজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘উন্নয়নের’ ফসল কুড়োতে। উত্তরাখণ্ডের সৃষ্টির সময় নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিলেন না, কিন্তু তিনি কেন্দ্রে আসার পর প্রকৃতির ওপর পীড়ন এবং ‘উন্নয়নে’ কর্পোরেট হানাদারির মাত্রা অনেক গুণ বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০০০ সালে রাজ্য গঠনের সময় উত্তরাখণ্ডের রাস্তার নেটওয়ার্কছিল ৮,০০০ কিলোমিটার, এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০,০০০ কিলোমিটারে! নরেন্দ্র মোদী বদ্রিনাথ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনেত্রী, হিন্দুধর্মের এই চার বিশিষ্ট দেবালয়কে পারস্পরিক ভাবে সংযোজিত করার চারধাম প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ২০১৬’র ২৭ ডিসেম্বর। প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯০০ কিলোমিটারের বেশি জাতীয় সড়কের এই প্রকল্পের পিছনে শুধুই উন্নয়ন ভাবনা কাজ করেছিল, তারমধ্যে হিন্দুভাবধারাকে তুষ্ট করে ভোটলাভের অভিপ্রায় ছিল না — এটাকে আজ কেউই সত্যি বলে মানতে চাইবেন না। প্রসঙ্গত, সরকার পরিবেশবিদ রবি চোপরাকে চারধাম সংযোগকারী প্রকল্পের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির চেয়ারম্যান করেছিল, তিনি এই প্রকল্পকে হিমালয়ের ওপর হামলা বলে অভিহিত করে ২০২২’র ফেব্রুয়ারিতে ঐ কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। উত্তরাখণ্ডে হড়পা বানের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। রাজ্য গঠনের আগে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯’র মধ্যে বড় ধরনের হড়পা বান হয়েছিল মাত্র চারটে। পরবর্তী এক দশকে (২০০২ থেকে ২০১২) ঐ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২২। হড়পা বানের এই আধিক্যের পিছনে কারণ হিসাবে থাকছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের যথেচ্ছ নির্মাণ, যে নির্মাণের জন্যই ২০১৩’র বন্যা যা উত্তরাখণ্ডে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘনিয়ে তোলে, তাতে মারা যায় ৬,০০০ মানুষ এবং তারসাথে অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতিও হয়। রবি চোপরার নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের রিপোর্টে ২৩টা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে বন্ধ করার পরামর্শদিয়েছিল, সেই পরামর্শেকান দেওয়া হয়নি। আজকের জোশীমঠ বিপর্যয়ের পিছনেও স্থানীয় জনগণ তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে দায়ী করেন যথেষ্ট দীর্ঘসুড়ঙ্গ খননের জন্য। সূচনার সময় স্থানীয় জনগণ এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় সেখান থেকে ২৫০ কিমি দূরে দেরাদুনে এবং নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় এনটিপিসি’কে যারা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পেই অভিজ্ঞ। বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দা রিতু শাহ বলেছেন, “সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। ওরা দেবদেবীর ওপর নির্ভর করছে। বাস্তব ঘটনা এটাই যে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, সুড়ঙ্গ খনন ও রোপওয়ে জোশীমঠের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। কোন সরকার এসব করেছে তা আমরা জানি না, কিন্তু আমরা এটা জানি যে বর্তমান সরকার আমাদের নিয়ে ছেলেখেলা করছে।”
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো রোপওয়েও নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়ন ভাবনায় জোরালোভাবেই ঠাঁই করে নিয়েছে। উত্তরাখণ্ডে রোপওয়ে প্রথম চালু হয় ১৯৯৪ সালে মূলায়ম সিং জমানায়, জোশীমঠ থেকে আউলি পর্যন্ত ৪.৫ কিমি দূরত্ব অতিক্রমের। সম্ভবত এর থেকেই প্রেরণা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ২০২২’র ২১ অক্টোবর দুটো রোপওয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন — পরিকল্পনা অনুযায়ী একটার দূরত্ব অতিক্রম করার কথা ছিল ১১ কিমি, রুদ্রপ্রয়াগ জেলার গৌরকুণ্ড থেকে কেদারনাথ, আর অন্যটার দূরত্ব অতিক্রম করার কথা ছিল ১৩ কিমি, চামোলি জেলার গোবিন্দঘাট থেকে হেমকুণ্ড সাহিব। নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, এই দুটো রোপওয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য অনেক দেশই তাঁর ওপর খুশি হবে। মূলায়ম জমানায় চালু হওয়া রোপওয়ে যে নরেন্দ্র মোদী পরিকল্পিত এই রোপওয়েগুলোর পাশে ম্লান হয়ে যেত তা বলাই বাহুল্য। তবে, স্থানীয় জনগণ রোপওয়ে সৃষ্ট ক্ষতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখানোয় মূলায়ম জমানার রোপওয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, এবং মোদীর মস্তিষ্ক প্রসূত রোপওয়েগুলোর চালু হওয়ার আশু সম্ভাবনাও একেবারেই ক্ষীণ।
উত্তরাখণ্ডের আজকের বিপর্যয়ে আদালতগুলোও তাদের দায়কে অস্বীকার করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট চারধাম প্রকল্পের অধীনস্থ রাস্তাকে চওড়া করার সরকারের আর্জিতে সায় দেয়, আরও বনভূমি ধ্বংস, পাহাড়ের মাঝে আরও বিটুমিন ও কংক্রিট জমা হওয়ার আয়োজনে সায় দেওয়ার এই রায়ে উপেক্ষিত থেকে যায় প্রকৃতির ক্ষতির সম্ভাবনার প্রতি সুবিচার। আর উত্তরাখণ্ডের হাইকোর্ট যেন বিজেপি সরকারের স্বার্থসিদ্ধিতেই ব্যস্ত। তারা যেমন হলদোয়ানির ৪,০০০ পরিবার বা ৫০,০০০ মানুষকে উৎখাতের এবং প্রয়োজনে সেনার সাহায্য নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল (সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তা অবশ্য স্থগিত হয়), তেমনি কিছু আবেদনকারীর আবেদনকে খারিজ করে তাদের ওপর জরিমানা আরোপও করেছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভয়াবহ হড়পা বানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর কিছু মানুষ সুরাহা চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। আবদনকারীদের মধ্যে ছিলেন চিপকো আন্দোলনের ধাত্রীভূমি রেনি গ্রামের বাসিন্দারা এবং জোশীমঠ বাঁচাও সংগ্রাম কমিটির নেতা ও সিপিআই(এমএল)-এর উত্তরাখণ্ড রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড অতুল সতি। আবেদনে তাঁরা জানান, তপোবন-বিষ্ণুগড় ও ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে এবং হেলাং-মারওয়ারি বাইপাসের নির্মাণকে অবিলম্বে স্থগিত করা হোক, এবং বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্ৰস্ত সমস্ত জনগণকে পুনর্বাসন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হোক। হাইকোর্ট সেই আবেদনকে শুধু খারিজই করেনি, আবেদনকারীদের কায়েমি স্বার্থের হাতের পুতুল বলে অভিহিত করে তাদের ওপর জরিমানাও চাপায়।
জোশীমঠের মর্মান্তিক বিপর্যয়ে সরকারের দায়িত্বজ্ঞানের অভাবই প্রকট হয়েছে। জনগণের দুর্দশার সুরাহা করার পরিবর্তে তাঁরা বেশি তৎপর হয়েছেন তথ্য ধামাচাপা দিতে, বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ঘোরাতে। জনগণও ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবিতে লাগাতার প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন। জোশীমঠের রাস্তার ধারে, দেওয়ালে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় সর্বত্রই পোস্টারে দেখা যাচ্ছে শ্লোগান — “এনটিপিসি গো ব্যাক”। গত ১৯ জানুয়ারি সিপিআই(এমএল)-এর ডাকে জোশীমঠের জনগণের অস্তিত্বের সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানাতে সারা রাজ্যে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। সিপিআই(এমএল) আটদফা দাবি জানিয়ে সরকারের কাছে এক স্মারকলিপি পাঠায়। ঐ দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটা হলো — জোশীমঠের জনগণের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারকে অবিলম্বে শুরু করতে হবে; তপোবনবিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এনটিপিসি যে সুড়ঙ্গ খনন করেছে সেটাই জোশীমঠের বিপর্যয়ের কারণ এবং তারজন্য এনটিপিসি’কে জরিমানা করতে হবে; নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নতুন জোশীমঠ শহর নির্মাণের জন্য কেন্দ্র সরকারকে উচ্চ পর্যায়ের উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তৈরি করতে হবে; হিমালয় অঞ্চলে পঞ্চেশ্বরের মতো বিশাল বাঁধ নির্মাণ চলবে না; হিমালয়ের সংবেদনশীল প্রকৃতিকে মাথায় রেখে জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী উন্নয়নের জন্য নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্ৰহণ করতে হবে। গত ২৭ জানুয়ারি ২০২৩ জোশীমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতির ডাকে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা ও এনটিপিসি’কে রাজ্য থেকে বহিষ্কারের দাবিতে ৫,০০০ জনগণ এক বিক্ষোভ মিছিলে শামিল হন। তপোবন ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করে বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে মিছিলে অংশগ্রহণকারী জনগণ সিংহের ওয়ার্ডের ভেদ ভেজাল মাঠে সমবেত হন এবং যেখানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
জোশীমঠের বিপর্যয় দেখিয়ে গেল, এটা মূলত সেই সব শাসকদেরই কর্মকাণ্ডেরই ফসল, যাদের কাছে দুর্নীতিপরায়ণ, কর্পোরেট লালসার চরিতার্থতা সর্বাধিক গুরুত্ব পায়, জনগণের দুর্দশায় যারা নির্বিকার থাকে এবং ভোগ করে লাগামহীন ক্ষমতা। প্রশাসন-কর্পোরেট গাঁটছড়া শুধু জোশীমঠ ও উত্তরাখণ্ডের জন্যই নয়, সারা ভারতের কাছেই বিপদ সংকেত বহন করছে। ভারতকে এই গাঁটছড়ার কব্জা থেকে বার করে আনতে হবে, আর তখনই উন্নয়ন ও গণতন্ত্র বিপর্যয়মুখী হওয়া থেকে মুক্ত হবে। উত্তরাখণ্ড যে লড়াইটা শুরু করেছে সেই লড়াই কর্পোরেট লোলুপতা ও স্বৈরাচারী প্রশাসনের শক্তিগুলোকে মুখের মতো জবাব দিক, সুস্থায়ী উন্নয়ন ও সংবেদনশীল গণতন্ত্রের লড়াইয়ে উদ্দীপনার সঞ্চার করুক।
আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ত্রিপুরায় ত্রয়োদশ বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উত্তর-পূর্বের মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বিধানসভা নির্বাচন হবে। ভোট গণনা হবে ২ মার্চ ২০২৩। নির্বাচনী নির্ঘন্ট ঘোষণার আগে ভারতের নির্বাচন কমিশনের তিনজনের পূর্ণাঙ্গ টিম রাজ্যের সর্বশেষ পরিবেশ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে দু’দিনের জন্য রাজ্যে সফর করে গেছেন। বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে কমিশনের প্রতিনিধিদের কাছে নির্বাচন অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও ভয়মুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত করার জন্য দাবি করা হয়। এই সরকারের রাজত্বে পঞ্চায়েত, নগর সংস্থা, লোকসভা, টিটিএডিসি’তেও গত জুন মাসে বিধানসভার ৪টি আসনে উপনির্বাচন গুন্ডাদল দিয়ে ভোট লুট করে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল, তা সবিস্তারে লিখিতভাবে তুলে ধরা হয়। যদিও টিটিএডিসি’র নির্বাচনে তিপ্রা মথার নেতৃত্বে তিপ্রাসা জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলে ১৮টি আসনে বিজেপিকে পরাজিত করেছিল। কমিশন এই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখেছে ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার আশ্বাস দিয়েছে। ইতিমধ্যে রাজ্য মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক হিংসা মুক্ত, জিরো পোল ভায়োলেন্স মিশন ঘোষণা করেছে। গত নির্বাচনে ৬০টি বিধানসভা কেন্দ্রের মোট ৩২২৮টি বুথের মধ্যে ৯২৯টিতে ভোট ৯২ শতাংশের কম পড়েছে। কমিশন ঐ ৯২৯টি বুথে প্রদত্ত ভোটের হার ৯২ শতাংশে বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কারণ ২০১৮’র আগে রাজ্যে যেকোনো ভোট উৎসবের মেজাজে হতো। ভোটের আগে ও পরে সামান্য কিছু হিংসার ঘটনা ছাড়া। কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যেতো। কিন্তু বিজেপির আমলে কেউ ভোট দিতে পারেনি। পাঁচ বছর ধরেই সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে। তাই এবারের সাধারণ নির্বাচনে ভোটদানের জন্য ভয়মুক্ত ও শান্তিপূর্ণপরিবেশ তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। ভোটদাতাদের কাছেও এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ বটে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ভোটদাতাদের একটাই প্রশ্ন, নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া যাবে কিনা? পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিরা ঘুরে যাওয়ার পরের দু’দিনের মধ্যে ৫৪টি হিংসার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচন ঘোষণার পরে কমিশনের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে খোদ মন্ত্রী বাহাদুরের নেতৃত্বে মজলিসপুরে বিরোধী দলের বাইক মিছিলে প্রাণঘাতী হামলা সংঘটিত হয়েছে। সূর্যমনিনগরে আরেক মন্ত্রী বাহাদুর, বিরোধীরা তার কেন্দ্রে প্রচার করতে এলে প্রকাশ্যে হাত-পা ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। দৈনিক পত্রিকায় এ’খবর প্রকাশিত হয়েছে। অথচ কমিশন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। প্রথম ঘটনায় শুধুমাত্র একজন মহকুমা পুলিশ অফিসার, দু’জন ওসিকে শাস্তি দিয়েছে। আরও কিছু অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার ও সিভিল অফিসারদের সরানোর দাবি উঠেছে। তাই, আমার ভোট, আমার অধিকার, আমার ভোট আমি যাকে খুশি তাকে দেব — এই দাবিতে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে বিরোধী দলগুলোর ডাকে আগরতলায় এক ঐতিহাসিক নাগরিকদের মহামিছিল সংগঠিত হয়েছে। সারা রাজ্যে অবাধ, ভয়মুক্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটদানের অধিকার সুনিশ্চিত করতে, কমিশনের জিরো পোল ভায়োলেন্স মিশন যাতে কথার কথা না হয়, তারজন্য রাজ্য মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। সিপিআই(এমএল) নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে ভোট লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এগিয়ে আসার আবেদন জানায়। এই নির্বাচনে যেকোন মূল্যে বিজেপিকে পরাস্ত করতে শপথ নিতে হবে। কারণ এরা আবার ক্ষমতায় ফিরে এলে নির্বাচনী গণতন্ত্রের কবর রচনা হবে।
২০১৮’র বিজেপির ভিশন ডকুমেন্ট এক প্রতারণার দলিল
২০১৮’র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কর্তৃক ভিশন ডকুমেন্টে ২৯৯টি প্রতিশ্রুতি ও ১০টি অ্যাকশন প্ল্যান রাখা হয়েছিল। গত পাঁচ বছরে তা ১০০ ভাগ মিথ্যা ও প্রতারণায় পর্যবসিত হয়েছে। ডাবল ইঞ্জিন আরও একটি বড়ো প্রতারণা। যেমন ক) প্রতি ঘরে একটি করে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাস্তবে ধোঁকা প্রমাণিত হয়েছে। একবছরের মধ্যে ৫০ হাজার শূণ্যপদ পূরণ করা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছিল। এখন বলছে এমন প্রতিশ্রুতি তারা দেয়নি। অথচ অ্যাকশন প্ল্যানে তা এক নম্বরে। গত ৫ বছরে ২০,১৩৮ জন সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা কমেছে। সরকারি শূণ্যপদ পূরণ না করে নির্বিচারে অবলুপ্ত করা হচ্ছে। ৭ লক্ষ বেকারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা ও অন্যান্য যোজনায় ৬ লক্ষাধিক নথিভুক্ত বেকারকে স্বনির্ভর দেখানো হয়েছে। ১৩ হাজার অশিক্ষক শূণ্যপদ বাতিল করে চাকুরীচ্যুত ১০,৩২৩ জন শিক্ষকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সরকার। চার বছরের মাথায় জেআরবিটি’র মাধ্যমে গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি পদে ইন্টারভিউ নেওয়ার পর সরকার চাকুরী ঝুলিয়ে রেখেছে। এইক্ষেত্রে ৪৯১০টি পদে সোয়া লক্ষ নথিভুক্ত উচ্চ ডিগ্রীধারি বেকাররা পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু সরকার ভয়ে ফলাফল প্রকাশ করে নিয়োগ করছে না। সিএমআইই’র মতে দেশে বেকারত্ব ৮.৭ শতাংশ। আর ত্রিপুরায় বেকারত্বের হার ১৫.৫ শতাংশ। দেশে ত্রিপুরা সবার উপরে। বেকার যুবকরা ক্ষোভে ফুঁসছেন। টিএসআর’এর দুটি রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ানে নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বঞ্চিত চাকুরী প্রার্থীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। তাদের ব্যাপক ধরপাকড় ও হেনস্থা করা হয়েছে। ডাবল ইঞ্জিন সরকারের প্রতিশ্রুতি ঘরে ঘরে চাকুরী নিয়ে বেকার যুবক ও তাদের পরিবারের লোকজন প্রতারিত হয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন। রাজ্যে বেকারত্ব এক বিস্ফোরক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
খ) স্নাতক স্তর পর্যন্ত মুক্ত নারীশিক্ষা : গত ৪ জানুয়ারি ২০২৩ প্রধানমন্ত্রী নিজে বিদ্যাজ্যোতি প্রকল্পের সূচনা করেন। যাতে ১০০টি সরকারি বিদ্যালয়কে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে ছাত্রছাত্রীদের হাজার টাকা ফি দিয়ে টাটাদের মতো এলিট স্কুলে পড়তে হবে। সম্পূর্ণ অবৈতনিক বিদ্যালয় শিক্ষাকে সরাসরি পণ্য করে তোলা হল। এরআগে ৯৬১টি বিদ্যালয়কে প্রয়োজনীয় ছাত্র সংখ্যা কম হওয়ায় চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। মিড-ডে-মিল প্রকল্প তুলে দেওয়া হয়, বেসরকারি এনজিও অক্ষয় ফাউন্ডেশনের হাতে। প্রি প্রাইমারী নার্সারি স্কুলে বিনামূল্যে পাঠ্যবই নেই, মিড-ডে-মিল নেই। শিক্ষক সমস্যা তীব্র। এক কথায় সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। এটাই হচ্ছে মুক্ত নারীশিক্ষার নমুনা।
গ) রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৭ম বেতন কমিশন অনুসারে বকেয়া ন্যায্য পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার জনপ্রিয় প্রতিশ্রুতি সবচেয়ে বড় মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে। আংশিক পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র। অথচ এই রাজত্বে সরকারি কর্মচারীদের পেনশনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ১৮ শতাংশ ডিএ এখনো বকেয়া। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের মেডিক্যাল রিএমবার্সমেন্ট তুলে দেওয়া হয়েছে। সার্ভিস রুলস পরিবর্তন করে জোরপূর্বক অবসরে যেতে বাধ্য করতে আইনী বিধান তৈরি করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীরা যাতে আন্দোলন করতে ভয় পায় তারজন্য প্রথমদিকে আইনসভাতে এসমা তৈরি করে রাখা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় পরিসেবা ক্ষেত্রে নিযুক্ত ফায়ার সার্ভিস দপ্তরের কর্মীদের সভা সমিতি করা ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
ঘ) নূন্যতম মজুরি ৩৪০ টাকার প্রতিশ্রুতি রূপায়ন না করে গরিব অসহায় শ্রমজীবিদের ঠকাচ্ছে সরকার। ৩৪টি ভাতা প্রকল্পে ৪.১৯ লক্ষ সুফলভোগী থেকে অন্যায়ভাবে প্রায় এক লাখের উপর সুফলভোগীর নাম কেটে বাদ দিয়েছে। এদের বাদ দিয়ে ২০০০ টাকা করে ভাতা বাড়ানো হয়েছে। গরবের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন নূন্যতম মজুরি মাত্র ২১২ টাকা। মনরেগায় ২০২২-২৩তে রাজ্যে গড়ে মাত্র ৩৮ দিনের কাজ হয়েছে। কোন কোন এডিসি ভিলেজে ২৫ থেকে ২৮ দিন কাজ হয়েছে। সোস্যাল অডিট হয়নি। দুর্নীতি আর দুর্নীতি। দৈনিক ২১২ টাকার মজুরিও কেউ পায়নি। ১৯০ টাকার কম মজুরি এবং বকেয়া মজুরি পাহাড় প্রমাণ। মনরেগার কোটি কোটি টাকা লুট হয়েছে। পঞ্চায়েতে ও ব্লকে ব্লকে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। জিআরএস ও মনরেগা কর্মীদের নিয়মিত বেতন হচ্ছে না। বেতন ও মজুরি ছাড়া কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
ঙ) প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় সবার জন্য পাকা বাড়ির প্রতিশ্রুতি পালনে চতুর্থ বছরে এসে ১.৪৭ পরিবারকে প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া হয়েছে। লাভার্থী হিসাবে নির্বাচনে ফায়দা নেওয়া এর উদ্দেশ্য। সুফলভোগী নির্বাচন ও কিস্তির টাকা নিয়ে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সুফলভোগী নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে। বাজারে নির্মাণ সামগ্রীর দাম অগ্নিমূল্য। ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সবার পক্ষে ঘর নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। অনেক ক্ষেত্রেই অর্থের বিনিময়ে ঘর দেওয়া হচ্ছে।
চ) প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিপিএল পরিবারের সবাইকে স্বাস্থ্যবীমার অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। স্বাস্থ্যবীমার উদ্দেশ্যই হচ্ছে গণস্বাস্থ্যকে বীমামুখী ও বেসরকারিকরণ করা। এই সরকার, সরকারি হাসপাতালে করযোগ্য পরিষেবা চালু করেছে।
ছ) বিনামূল্যে পানীয় জল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি কার্যত শুল্কবৃদ্ধি, অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত জল সরবরাহে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জলের উৎস ও যোগান কমে আসছে। দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই।
জ) অনিয়মিত ও চুক্তিবদ্ধ সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের নিয়মিত করার প্রতিশ্রুতি কার্যত মিথ্যা প্রতারণায় পর্যবসিত হয়েছে। রাজ্যে ৪০ থেকে ৪৪ হাজার অনিয়মিত শ্রমিক কর্মচারী আছে। ঠিকা ও চুক্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে। সরকার নিযুক্ত ভার্মা কমিটি প্রথমেই গ্রুপ-ডি পদ অবলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। মিড-ডে-মিল কর্মী, বাগিচা ও উদ্যান শ্রমিক, হাসপাতালে আংশিক সময়ের কর্মী ও স্লিপ ওয়ার্কার, পাম্প অপারেটর, জিআরএস, স্বাস্থ্য মিশন, সমগ্র শিক্ষা, সাফাই কর্মী ও অনিয়মিত পুর শ্রমিক ও কর্মচারীদের নিয়মিত করার কোনও সুযোগ নেই। তাদের বারবার কর্মচ্যুতির আশঙ্কা ও ধমকের মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। আর চাকুরির শেষে তাদের খালি হাতে অবসরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।
তাছাড়া, রাজ্যে ৩৯১৫টি শ্রমজীবি মহিলাদের স্বসহায়ক দল নিজেরা আমানত হিসাবে ৩৩৬.৫৫ লক্ষ টাকা জমা করেছে এবং ব্যাংক হতে ৭০৪৯ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। এখানে সিডি রেসিও অত্যন্ত কম। অর্থাৎ ঋণ করে ভোগ ব্যয় নির্বাহ করছে শ্রমজীবি গরীব জনগণ। মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলির দলগত ভাবে চড়া সুদে সহজলভ্য ঋণদান একই চিত্র তুলে ধরে। এই ঋণদান কোনও বিনিয়োগ নয় যে তা মূলধন গঠন করবে। বরং তা প্রমাণ করে যে রাজ্যের সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ এবং রোজগার নেই বললেই চলে। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির বাজারে বেশি করে কর্মসংস্থান ও যথেষ্ট পরিমাণ মজুরি বৃদ্ধি হলে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা ও ভোগব্যয় বাড়তো ও অর্থব্যবস্থা সচল হতো। টুকটাক মজুরি বৃদ্ধি তাতে কোনও প্রভাব সৃষ্টি করেনি।
আরএসএস-বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদী, বিভেদমূলক, ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক রাজনৈতিক বিচারধারা এবং মোদীর আগ্রাসী রাজত্বে দেশে ও রাজ্যে গণতন্ত্রের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ নামানো হয়েছে। এই আক্রমণের পিছনে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বিশেষত আদানি-আম্বানিরা দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। আর তার বিনিময়ে মোদী সরকার দেশের সমস্ত জাতীয় সম্পদ, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ, রাষ্টায়ত্ত সংস্থাগুলোকে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা সহ সমস্ত সরকারি পরিষেবা ক্ষেত্রের অবাধে বেসরকারিকরণ করছে। স্থায়ী ও নিয়মিত চাকরি ও কর্মসংস্থানকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ক্রমশঃ নীচের দিকে নামছে। বিস্ফোরক অবস্থায় বেকারত্ব, অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমহ্রাসমান মজুরি এই চতুর্মুখী হামলায় বিপর্যস্ত দেশবাসী। অথচ ১ জানুয়ারি হতে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনে সুফলভোগীদের জন্য মাথাপিছু ৫ কেজি করে নিঃশুল্ক খাদ্যশষ্য বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে। চালের বরাদ্দ অর্ধেক হয়ে গেছে। কৃষি উপকরণ অগ্নিমূল্য। কিন্তু সমস্ত কৃষি ফসলের জন্য এমএসপি আইনের গ্যারান্টি আইন চালু করা হয়নি। সরকার কৃষকদের সাথে বেইমানী করেছে। কৃষকদের আয় বাড়েনি। মনরেগা ও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে প্রকল্পগুলিকে ধ্বংসের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। গ্রাম রোজগার সেবক, সমগ্র শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতনভাতা বৃদ্ধি করেনি। প্রত্যেক পরিবারের রোজগার ও আয় কমেছে। অভাবে আত্মহত্যা, সন্তান বিক্রির মতো ঘটনা ঘটেছে। অপরিকল্পিত বিধ্বংসী নোটবন্দি, জিএসটি খুচরা ব্যবসা বাণিজ্যে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এই জনবিরোধী নীতিগুলির প্রভাবে সারা দেশের সাথে আমাদের রাজ্যেও জনগণের জীবন-জীবিকার উপর বিপর্যয় নেমে এসেছে।
দ্বিতীয়ত, দেশের সংবিধান এই সরকারের হাতে লাগাতার আক্রমণের মুখে পড়েছে। সরকার বিরোধী মুক্ত একদলীয় শাসন চাপিয়ে দিতে চাইছে। তারজন্য প্রশাসন বিভাগ, আইনসভা ও সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সততা ও স্বাধীন সত্তাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। রাজ্যেও ২০১৮ থেকে লাগাতার বিরোধী দলের শত শত কার্যালয় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কর্মী ও নেতাদের উপর আক্রমণ, জীবনহানি, জীবিকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিধানসভাকে একদলীয় শাসনের হাতিয়ার করে তোলা হয়েছে। তাই সংবিধানের স্পিরিট ও মূল্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
তৃতীয়ত, সারা দেশে ও আমাদের রাজ্যে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের উপর সংঘ বাহিনী আক্রমণের ক্রমবিস্তার ঘটাচ্ছে। গতবছরে বাংলাদেশের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্যে পরিকল্পিতভাবে মসজিদের উপর আক্রমণ ও তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। উদয়পুর, কৈলাসহর ও ধর্মনগরে কিছু মিশ্র বসতি এলাকা বেছে বেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর জন্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো চেষ্টা করেছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরম্পরা ও ঐতিহ্য রাজ্যে এতটাই শক্তিশালী যে, সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। এখন ভোটের মুখে উদয়পুরে রাজধরনগর গ্রামে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে মিথ্যা হামলার ষড়যন্ত্র রচনা করে বিভাজন ও দাঙ্গার উস্কানি দেওয়া হয়। এমন বিভৎস ঘটনা উদয়পুরের উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ কেউ কখনো তাদের জীবনে দেখে নাই। এবার ভোটে এই বিভেদের ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিই বিজেপির একমাত্র ভরসা। তাই বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
চতুর্থত, সরকারি মদতে সন্ত্রাস অব্যাহত। আইনের শাসন বিপন্ন। এখন প্রায় প্রতিদিন প্রতিরাতে বিরোধী দলের কর্মীদের বাড়িঘর, দোকানে ভাঙচুর, আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পার্টি অফিস জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। গত ৫ বছরে ২৫ জন বামকর্মী খুন হয়েছেন। ২০১৮তে ফলাফল ঘোষণার পাঁচদিনের মধ্যে ৫ জন খুন হয়েছিলেন। গত ৫ বছরে সরকারের নির্দেশে ১৬৪টি পার্টি অফিস, ৩১টি গণসংগঠনের অফিস আইন প্রয়োগ করে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। আর গুন্ডা দিয়ে ২১০টি পার্টি অফিস, ১৬০টি গণসংগঠনের অফিস ভেঙ্গে দেয়। আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। উদয়পুরে সিপিআই(এমএল)-এর অফিস তিনবার ভাঙচুর করে ও আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করার চেষ্টা। কংগ্রেস দলের কয়েকটি অফিস, শ্রমিক ভবন ভাঙচুর করে। ৮টি জেলায় হাজার হাজার বাম কর্মীদের দৈহিকভাবে নির্যাতন করে। জীবিকা ও রোজগারের পথ বন্ধ করে দেয়। এতে করে জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। যাতে তারা অবাধে ভোট লুট করতে পারে। পঞ্চায়েত, নগর সংস্থা, লোকসভার নির্বাচনে ও সর্বোপরি বিধানসভার উপনির্বাচনে কোনটাতেই জনগণ ভোট দিতে পারেননি। ভোট লুট করা হয়েছে। তাই আইনের শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে, ভোটাধিকার রক্ষায় সংকল্প গ্রহণ করতে হবে।
পঞ্চমত, নারীদের উপর যৌন হিংসা, গণধর্ষণের পরে খুন, নাবালিকা অপহরণ, গার্হস্থ্য হিংসা ইত্যাদি অপরাধের ঘটনা বেড়েই চলেছে। বিজেপির নেতা, কর্মী ও খোদ মন্ত্রীর ঘরের ছেলেরা যুক্ত থাকার কারণে পুলিশ মামলা নিতে চায় না। কুমারঘাট, কমলপুর গণধর্ষণকান্ড তার প্রমাণ। কোন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়না। মহিলা কমিশনের কোনও ভূমিকা থাকে না। প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পায় না। জাতীয় ক্রাইম ব্যুরোর রেকর্ডেত্রিপুরা ভারতে ছোটো রাজ্য সত্ত্বেও প্রথম স্থান অধিকার করেছে। তাই সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে মনুবাদীদের পরাস্ত করতে হবে এবং নারী স্বাধীনতা ও নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
ষষ্ঠতঃ দেশের সংবিধান প্রদত্ত গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আজ আক্রান্ত। রাজ্যের অধিকার ও সমস্ত স্বশাসিত সংস্থাগুলোর অধিকার আজ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমনকি সমবায় সমিতির ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে কুক্ষিগত করা হয়েছে। তাই সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক স্তম্ভ স্বশাসিত সংস্থা টিটিএডিসি আজ আর্থিকভাবে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ভিলেজ কমিটির নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি। কাজ নেই, চাকরি নেই। এই সরকার বনাধিকার আইনে তিপ্রাসাদের কোনও বনভূমির পাট্টা দেয়নি। বরং সরকার আইনসভায় কৃষিজমি লিজ দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। যার ফলে সস্তায় কৃষিজমি কৃষকদের কাছ থেকে কোম্পানির কাছে হস্তান্তর হয়ে যাবে। জল-জমি- জঙ্গল হাতছাড়া হবে। জোট সঙ্গি আইপিএফটি’র তিপ্রাল্যান্ড’এর দাবি নিয়ে ও এডিসি’র উন্নতির জন্য ভিশন ডকুমেন্টে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বিজেপি সরকার। তাই ডাবল ইঞ্জিন সরকারের এই বিশ্বাসঘাতকতা ও বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে জনজাতি সমাজ সবার আগে পাহাড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সংবিধান সম্মত অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে সামনে তুলে ধরেছে। সিপিআই(এমএল) তিপ্রাসাদের আর্থ- সামাজিক-রাজনৈতিক, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতির সার্বিক উন্নতিকল্পে সংবিধান সংশোধন করে এডিসিকে পূর্ণাঙ্গ ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী করে তোলার দাবি জানায়। সংবিধানের মধ্যে এমন বিধান রয়েছে যার মাধ্যমে স্বশাসিত সংস্থাকে অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন করা যায়। আসামে কার্বিআংলং’এর জন্য ২৪৪এ ধারা মতো স্বশাসিত রাজ্যের বিধান রয়েছে। কিন্তু এই অটোনোমাস স্টেট’এর অধিকার এখনো কার্বি ও ডিমা হাসাও জনজাতিরা পায়নি। ত্রিপুরা স্বশাসিত জেলা পরিষদকে অধিক ক্ষমতাশালী করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তারজন্য দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কারণ ত্রিপুরা উপজাতি স্বশাসিত জেলা পরিষদের হাতে একটি প্রাইমারী স্কুল খোলার অধিকার নেই। এক কানি জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার ও হোমগার্ডনিয়োগ ও ভিলেজ কমিটিতে লাঠিধারি পুলিশ নিয়োগ করা সহ আরো অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ৩০টার মতো দপ্তর হস্তান্তর করা হয়নি। এটা সঠিক যে, গত ৪০ বছর ধরে সময়ের সাথে এডিসির হাতে আরো প্রয়োজনীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। দীর্ঘসত্তর বছর ধরে বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে সময়ের সাথে এডিসিকে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন করার প্রশ্নে সংবিধানের চৌহদ্দির মধ্যে থেকে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’এর দাবিকে বিচার করতে হবে। যেখানে এটা অত্যন্ত ভালো দিক যে, তিপ্রাসা ও অন্যান্য সব জাতিভুক্ত জনগণের সমানাধিকারের জন্য কথা বলছে ‘মথা’। তাই জাতি-উপজাতি ও সব অংশের জনগণের মধ্যে ঐক্যমতের ভিত্তিতে সময়ের সাথে সংবিধান সংশোধন করে এডিসিকে সর্বোচ্চ স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
২০২৩’র শুরুতে সারা দেশে ফ্যাসি বিরোধী প্রতিরোধকে ঐক্যবদ্ধভাবে শক্তিশালী করার ডাক এসেছে। ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্বে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। ২০২৪এ আগ্রাসী মোদীকে পরাস্ত করতে হবে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ত্রিপুরায় বামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্যে এক ঐক্যমত্য গড়ে উঠেছে। গত পাঁচবছরে আরএসএস-বিজেপির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী, বিভাজনের রাজনৈতিক বিচারধারার প্রয়োগ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দল আইপিএফটি’র সাথে হিন্দুত্ববাদীদের জোট শাসনে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। রাজ্য রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে গেছে। জনজাতি তিপ্রাসাদের সাথে এই বিজেপি জোট সরকার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করে তিপ্রা মথার জন্ম হয়েছে। ২০২১’র এপ্রিলে টিটিএডিসিতে ২৮টির মধ্যে ১৮টি আসনে জয়লাভ করে তিপ্রা মথার উত্থান ঘটে। বিজেপির সাথে সমঝোতা না করার কারণে এডিসিকে বিজেপি সরকার সবদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ভিলেজ কমিটির নির্বাচন করতে দেয়নি। বিজেপির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিপ্রা মথার নেতৃত্বে পাহাড়ে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। ফলে বিরোধীদের জন্য রাজ্য রাজনীতিতে জায়গা বেড়েছে। তারপর রাজ্যের ইতিহাসে এই প্রথম শাসক দল ত্যাগ করে ২ জন মন্ত্রী ও ৬ জন এমএলএ সহ মোট ৮ জন পদত্যাগ করে বিরোধী দলে যোগ দিয়েছেন। ৪ জন তিপ্রা মথায় ও ৪ জন কংগ্রেস দলে যোগ দিয়েছেন। জাতীয় কংগ্রেস দল উঠে দাঁড়িয়ে বিজেপি বিরোধী লড়াই ও প্রতিরোধকে আরো শক্তিশালী করেছে। প্রতিষ্ঠান বিরোধী ক্ষোভ বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর মুখ পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠান বিরোধী ক্ষোভ বিক্ষোভকে হ্রাস করতে পারেনি। বিজেপি ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এখন জোট সঙ্গি আইপিএফটি’র নীচুতলায় কর্মীরা তিপ্রা মথায় মিশে যাচ্ছে। গত জুন মাসে ৪টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনে আমরা বাম, কংগ্রেস ও মথাকে সমর্থন করি। ফলাফলে আমাদের অবস্থান সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। জনগণ বিরোধীদের মধ্যে জোট গড়ে তোলার জন্য রায় দেয়। তখন থেকে উদ্যোগ নিলে জোট গঠনের প্রক্রিয়া আরো এগিয়ে যেতে পারতো। আমরা আন্তরিক, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, নীচুতলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত ও সংহত জোট চাই। না হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। উপনির্বাচনের পরে বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতি ও সন্ত্রাস প্রতিহত করে জনগণ আরো বেশি করে বাইরে বেড়িয়ে আসতে শুরু করে। এখন আরএসএস-বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য প্রস্তুত রাজ্যের সব অংশের জনগণ। আর জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছার প্রতিফলন হচ্ছে এই বিরোধী জোট। কোন প্রকার দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু দলীয় সংকীর্ণতার কারণে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ৩০ জানুয়ারি মনোয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত বড়ো দুই দল একে অপরের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছে। সিপিআই(এমএল)’কে একটি আসনও দেয়নি। নুন্যতম কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা ও তাদের দুর্বল করার রাজনৈতিক তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে জোট। শুধুমাত্র আসন সমঝোতা করার কথা হচ্ছে। আসন ভাগাভাগি নিয়ে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস দল নিজেদের মধ্যে দলীয় সংকীর্ণতার বেড়াজালে আটকে পড়েছে। তবুও চেষ্টা চলছে মিটমাট করার। আমরাও আশাবাদী যে জোট হবে। জনগণের বিশ্বাসের মধ্যে যাতে চিড় না ধরে। আস্থা বিশ্বাস যাতে নষ্ট না হয় তার চেষ্টা করতে হবে।
সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় মৌলবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতি মানবতার শত্রু এবং সভ্যতার শত্রু। এদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষে মানুষে ঐক্য জরুরি। আর ধর্ম, বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলে সংবিধান, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে এই ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। তারজন্য বিরোধীদের মধ্যে জোট আজ সময়ের দাবি। ২০২৩ হয়ে উঠেছে এই গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের মঞ্চ। তাই ফ্যাসিবাদী বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে জোটের পক্ষে সামিল হোন। ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করতে সর্বস্তরের লড়াইকে শক্তিশালী করুন। ৫৯টি আসনে বিজেপিকে হারাতে সক্ষম এমন শক্তিশালী বিরোধী ও জোটের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। ৩১, রাধাকিশোরপুর আসনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন প্রার্থী পার্থকর্মকারকে পতাকা তিন তারা চিহ্নে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন পার্টির সদস্য কমরেড অশোকতরু চক্রবর্তীর আকস্মিক প্রয়াণে আমরা গভীর শোকাহত। গত ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ রাতে ঘুমের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরনিদ্রায় চলে গেলেন আমাদের সকলের প্রিয় কমরেড অশোকতরু চক্রবর্তী। ৬৭ বছর বয়সে আকস্মিক ভাবেই থেমে গেল বর্ণময় জীবন সফর।
আত্মপ্রচার বিমুখ, অত্যন্ত সরল মনের মানুষ ছিলেন কমরেড অশোকতরু। আকাশবাণী রেডিওর একজন সাংবাদিক হিসাবে পরিচয় থাকলেও তিনি একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা, সুলেখক এবং কবি হিসাবেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তিনি প্রায় ১০টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এগুলির মধ্যে ‘ঢেঁরা’ তথ্যচিত্রটি বিএফজেএ পুরস্কার লাভ করে। তাঁর তথ্যচিত্রগুলিতে প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষের জীবন যন্ত্রণার দিকগুলিই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর লেখা গল্পে, কবিতায় কখনো দেখা গেছে লকডাউনে অভুক্ত পথশিশুর কান্নায় অসহায় মায়ের ভয়ঙ্কর আর্তনাদ, কখনো বা শ্রমজীবী মানুষের অজানা দুঃসহ জীবন কাহিনী। এক কথায় যা অসাধারণ।
তিনি কলকাতা প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে ঐ ক্লাবের কার্যকরী সমিতির সদস্য এবং সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। বামপন্থার প্রতি ছিল তাঁর অগাদ আস্থা। বর্তমানে তিনি সিপিআই(এমএল) লিবারেশন পার্টির সদস্য ছিলেন এবং পূর্ব-মধ্য কলকাতা লোকাল পার্টি কমিটির সদস্য ছিলেন। বিজেপি, আরএসএস বিরোধী প্রচার অভিযানের লক্ষ্যে সাম্প্রতিক গড়ে ওঠা ‘উই দ্যা পিপল অফ ইন্ডিয়া’ মঞ্চের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
৩০ জানুয়ারি বিকেলে প্রয়াত অশোকতরু চক্রবর্তীর স্ত্রী জানান, অশোক দেহ দানের ইচ্ছা প্রকাশ করত। সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে দেহ দান করা হয় সাগর দত্ত হাসপাতালে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর স্ত্রী সোমা চক্রবর্তী এবং তার ভাই সরিত ব্যানার্জী, কমরেড অশোকতরুর দাদা বৌদি, প্রতিবেশি সাংবাদিক বন্ধু অভিরূপ ব্যানার্জী এবং অরিজিৎ দত্ত, এলাকার বিভিন্ন মানুষ এবং মনোজ রায়, বাবু গুহ, অলোক পাল, মাজাহার খান, ছাত্র সুরন্ত দে, সায়ন্তন মিত্র। এছাড়াও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন শ্রীকান্ত লাহা, পূর্ব-মধ্য কলকাতা লোকাল কমিটির পক্ষে অশোক সেনগুপ্ত এবং পার্টি রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে দিবাকর ভট্টাচার্য। দেহ দানের সময় স্লোগান ওঠে, “কমরেড অশোকতরু তোমায় আমরা ভুলব না”।
কমরেড অশোকতরু অমর হয়ে থাকবেন তাঁর সৃষ্ট কবিতা, তথ্যচিত্র ও লেখনীর মধ্য দিয়ে।
কমরেড অশোকতরু লাল সেলাম।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হাওড়া জেলা কমিটি সদস্যা কমরেড রূপালী বাগ গত ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ বিকেল ৫টা নাগাদ উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে আকস্মিকভাবে প্রয়াত হন।
কমরেড রূপালী বাগ ২০১১ সাল থেকে আমাদের পার্টি ও হাওড়া জেলার আশা ইউনিয়নের সাথে যুক্ত থেকে সাহসের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেলায় আশা কর্মীদের সংগঠিত করায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি হাওড়া জেলা সংগ্রামী আশা কর্মী ইউনিয়নের সম্পাদিকার দায়িত্বেও থেকেছেন। তিনি রেখে গেলেন তার পুত্র, কন্যা ও স্বামীকে।
কমরেড রূপালী বাগের এই আকস্মিক অকাল প্রয়াণে সমগ্র হাওড়া জেলা পার্টি গভীরভাবে শোকাহত ও এই কঠিন সময়ে প্রয়াত কমরেডের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছে।
আমরা কমরেড রূপালী বাগের অসমাপ্ত কাজকে তার দেখানো পাথে সাহসের সাথে আগামীতে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। কমরেড রূপালী বাগ অমর রহে। কমরেড রূপালী বাগ লাল সেলাম।
সম্প্রতি প্রয়াত হলেন পার্টির বাঁকুড়া জেলা কমিটির বর্ষিয়ান সদস্য, শহরের অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যাক্তিত্ব কমরেড মলয় দুবে। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে মারণ রোগ ব্লাড ক্যানসারের সাথে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে অবশেষে গত ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ কলকাতার এক সরকারী হাসপাতালে তাঁর জীবনাবসান ঘটলো। এতো বড়ো এক কঠিন রোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত। জীবনের অন্তিম সময়ের কয়েকটা মাস বাদ দিলে সর্বদাই খুবই উদ্যমী মানুষ। পার্টিকে তিনি নিজের পরিবারের মতো আপন করে নিয়েছিলেন। বাঁকুড়া শহরে তাঁর বাড়ি ও সমগ্র পরিবার ছিল পার্টির সর্বস্তরের নেতৃত্ব ও কর্মীদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং নিশ্চিত আশ্রয়স্থল। ২০০১ সালে বাঁকুড়া জেলায় পার্টি সংগঠনে যখন এক সংকট দেখা দেয় তখন তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। দিনরাত এক করে গ্রামের হাটে মাঠে, কর্মীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সমগ্র পার্টি সংগঠনকে বিপ্লবী দিশায় ঐক্যবদ্ধ রাখার কাজে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সমগ্র কৃষক সংগ্রাম ও পার্টি সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর এই অবদান উল্লেখযোগ্য। ২০০৬ সালে তিনি পার্টির জেলা কমিটির সদস্য হন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জেলা পার্টির নানাবিধ দায়দায়িত্ব পালন করে গেছেন। অনেক কিছুই হয়তো তিনি করে উঠতে পারতেন না, কিন্তু যেকোনও সমস্যাকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে বলিষ্ঠ মানসিকতা ও সকলকে মনোবল যুগিয়ে যাওয়া ছিল তাঁর সহজাত। পার্টির নেতৃত্ব ও কর্মীদের প্রতি ঘনিষ্ঠতা বা আন্তরিকতায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয় মলয়দা।
৭০’র শেষপর্বে ও ৮০’র দশকে বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়। সেই সময়কালে শহরের যুগীপাড়া দোলতলা এলাকায় নকশালবাড়ি আন্দোলনের একটা গণভিত্তি গড়ে ওঠে। লাগোয়া এলাকায় থেকে তিনি তার সাথে যোগাযোগ রেখে চলতেন। পরবর্তীতে পার্টির সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাশাপাশি তাঁর নিজের পাঠক পাড়ায় অগ্রণী সংঘ ক্লাব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভুমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে গ্রামীণ ব্যংকের চাকরি পান। ১৯৯৬ সালে পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। গ্রামীণ ব্যাংক কর্মচারী আন্দোলনে একটি সতন্ত্র সংগ্রামী ধারা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি নেতৃত্বের সারিতে ছিলেন। পার্টির বিগত মানসা কংগ্রেসে প্রতিনিধি হয়েছিলেন। পার্টি ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি তাঁর গড়ে উঠেছিলো গভীর ভালোবাসা। জীবনের শেষ পর্যায়ে প্রবল শারীরিক অসুস্থ অবস্থাতেও হাসপাতালের বেডে শুয়ে তাঁর মুখে শোনা গিয়েছিলো স্লোগান — নকশালবাড়ি, চারু মজুমদার লাল সেলাম। পরিবার পরিজনদের বলে গিয়েছিলেন শেষযাত্রায় তাঁকে যেন লাল পতাকা দেওয়া হয়৷ গত ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ বাঁকুড়ায় তাঁর বাসভবনে শায়িত মরদেহে লাল পতাকা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান জেলার পার্টি নেতৃত্ব ও কর্মীবৃন্দ, পরিবার পরিজন, বাঁকুড়ার বিশিষ্ট বামপন্থী নেতৃবৃন্দ, ব্যাংক কর্মচারী আন্দোলনের নেতৃত্ব সহ এলাকার মানুষেরা।
কমরেড মলয় দুবে লাল সেলাম। তাঁর স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকবে।
==0==