আজকের দেশব্রতী : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-12-jan-202381 crores

নতুন বছর থেকেই মোদী সরকার ৮১ কোটি ভারতবাসীর মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল।

জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন ২০১৩ অনুসারে যাদের রেশন কার্ডরয়েছে, মাথাপিছু তারা পেতেন ৫ কেজি করে গম অথবা চাল। আর, অন্ত্যোদয় কার্ড যাদের রয়েছে, তারা পেতেন মাসে ৩৫ কেজি খাদ্য শস্য। খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী চাল ও গমের দাম হচ্ছে যথাক্রমে কেজি পিছু ৩ টাকা ও ২ টাকা। কোভিডকালীন নজিরবিহীন দুঃসময়ে, এপ্রিল ২০২০-তে, কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার অধীনে প্রত্যেকে ৫ কেজি করে নিঃশুল্ক খাদ্যশস্য পাবেন, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে ৫ কেজি করে ভর্তুকি যুক্ত খাদ্যদ্রব্যের সাথে। অর্থাৎ, প্রতি কার্ড হোল্ডারকে ২০২০’র এপ্রিল থেকে মাথা পিছু ১০ কেজি করে খাদ্য শস্য দেওয়া হতো (এর মধ্যে ৫ কেজি হল জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী ভর্তুকিতে আর বাকি ৫ কেজি প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার অধীনে নিঃশুল্কে)।

কিছুদিন আগে, ২০২২’র ২৩ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা এই নতুন বছরের ১ জানুয়ারি থেকে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর অর্থ হল, জানুয়ারি ২০২৩ থেকে রেশন প্রাপকদের বরাদ্দ অর্ধেক করা হল। চলতি মাথা পিছু ১০ কেজি’র (জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন ও প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা মিলিয়ে) বদলে তাঁরা শুধুমাত্র পাবেন মাথাপিছু ৫ কেজি (যা জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী প্রাপ্য)। যদিও, এই কঠোর সিদ্ধান্তকে গেলাতে কেন্দ্রীয় সরকার একটা চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে। সরকার জানিয়েছে, জানুয়ারি ২০২৩ থেকে শুরু করে এক বছরের জন্য জাতীয় খাদ্যসুরক্ষা আইন অনুসারে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হবে নিঃশুল্কে অর্থাৎ কেজি প্রতি ৩ টাকার বিনিময়ে চাল ও কেজি প্রতি ২ টাকার বিনিময়ে গমের মূল্যে ছাড় দেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় সরকার তার এই ঘোষণাকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, এই ঘোষণার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার বিরাট পরিমাণে বরাদ্দ রেশন কাটছাঁট করে ফেলল। দেখা যাচ্ছে, এরফলে মাথা পিছু সরকারের সাশ্রয় হচ্ছে মাসিক ১১ টাকা আর অন্যদিকে, যে ৫ কেজি খাদ্যশস্য ছেঁটে ফেলা হল, তা বাজার থেকে কিনতে চাল প্রতি কেজি বাবদ ১৫০-১৭৫ টাকা, আর গম প্রতি কেজি ৩০-৩৫ টাকা ব্যয় হবে। পাঁচজন সদস্য বিশিষ্ঠ পরিবারের এরফলে রেশন থেকে প্রাপ্ত খাদ্য সামগ্রির পরিমাণ বাজার থেকে ক্রয় করতে হলে খরচ হবে ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকা। এই পরিবারগুলো মাত্র ৫৫ টাকা সাশ্রয় করতে পারবে, তাই কোনোমতেই মোদীর এই নতুন ঘোষণাকে ঐতিহাসিক হিসাবে আখ্যা দেওয়া যায় না। এই পশ্চাদমুখী ঘোষণা এমন সময়ে করা হল যখন কেন্দ্রীয় সরকার আশঙ্কা করছে আবার একটি কোভিড-তরঙ্গ আসতে পারে, আর সে লক্ষ্যে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করার নির্দেশ আসতে শুরু করেছে।

জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন ও প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা হত-দরিদ্র বিপুল সংখ্যক শহুরে ও গ্রামীণ দিনমজুর, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিকদের পরিবারগুলোর জন্য মাথাপিছু ১০ কেজি করে খাদ্য নিশ্চয়তা সুনিশ্চিত করেছিল। কোভিডের সময়ে বিপুল সংখ্যক এই মানুষগুলো তাদের রুটি রুজি হারায়, আর এখনো পর্যন্ত সে দুরাবস্থা তারা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সরকারের এই ঘোষণা অগণন গরিব মানুষকে ঠেলে দেবে অথৈ জলে।

ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থার তরফ থেকে করা নানা অনুসন্ধান রিপোর্ট গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ছবি সামনে তুলে ধরেছে। ‘রাইট টু ফুড ক্যামপেন’এর তরফ থেকে যে সমীক্ষাগুলো করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রাক-কোভিডের তুলনায় পরবর্তীকালে সংখ্যা ও গুণগত দিক থেকে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। ওই সমস্ত সমীক্ষা দেখিয়েছে, উপরে উল্লিখিত দু’টি প্রকল্প মারাত্মক অতিমারীর সময়ে সেই সমস্ত মানুষদের কিছুটা সুরাহা দিতে পেরেছিল যাদের ছিল ওই রেশন কার্ড। কিন্তু এর বাইরে অগুন্তি মানুষ — যারা দুঃস্থ, সমাজের প্রান্তসীমায় নিক্ষিপ্ত, তার থেকে যাচ্ছেন এই রেশন ব্যবস্থার বাইরে। গত ১২ বছরের ও বেশি সময়কালে জনসংখ্যার অনেক বৃদ্ধি হলেও তাদের এই গণবণ্টন ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়নি। ২০১১ সালের সেন্সাসের পর জনসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধি হলেও সেই সমস্ত নাগরিকদের আনা হয়নি রেশন ব্যবস্থার অধীনে, কারণ তারপর আর সেন্সাস হয়নি। ২০২১’র জুনে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘিরে যে সমস্ত মামলাগুলো হয়েছিল, তখন সেগুলো নিষ্পত্তির সময় শীর্ষ আদালত স্পষ্টভাবেই জানায় যে যেহেতু বর্তমানে ২০১১’র সেন্সাসের ভিত্তিতে গণবন্টন ব্যবস্থার তালিকাটি রয়েছে, আর তারপর জনসংখ্যার বৃদ্ধি এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত নেই, তাই কেন্দ্রীয় সরকারকে নতুন করে তার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের ৯নং ধারা অনুযায়ী নথিভুক্ত করতে হবে গ্রামীণ ও শহরের প্রকৃত মানুষদের তালিকা। এই স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পিছিয়ে দিল ২০২১-কে ভিত্তি করে সেন্সাসের কাজ।

দেশের বহু গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন নাগরিক ও খাদ্য সুরক্ষা গ্যারান্টি ফোরামের বুদ্ধিজীবীরা দাবি তুলেছেন, অবিলম্বে ব্যাপকতম মানুষকে খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় এনে তাঁদের খাদ্য সুনিশ্চিত করা হোক। তাঁদের দেওয়া হোক মাথাপিছু ১০ কেজি করে খাদ্যশস্য, খাদ্য সামগ্রির তালিকা আরও প্রসারিত করে পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্যকেও তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হোক, ডাল, তেলও আসুক খাদ্য তালিকায়।

বিশ্ব ক্ষুধাসূচকে ক্রমেই নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে ভারতবর্ষ। নজিরবিহীন বেকারত্ব, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমে হ্রাসপ্রাপ্ত মজুরি প্রভৃতির চৌতরফা হামলায় বিপর্যস্থ দেশবাসী। দেশবাসীকে ঠিক মতো পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ব। এই দাবিতেই সোচ্চার হতে হবে।

(তথ্যসূত্র: নিউজ ক্লিক)

Editorial

রাজ্য শিক্ষা দপ্তর এক বিবৃতি মারফত ঘোষণা করেছে নতুন বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এ’রাজ্যের মিড-ডে-মিলে পুষ্টি বাড়াতে নিয়মিত ডিম, মুরগির মাংস বা মরসুমি ফল দেওয়া হবে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তারজন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হচ্ছে ৩৭১ কোটি ৯০ লক্ষ ৭৮ হাজার ৪০০ টাকা, অর্থাৎ সপ্তাহে বরাদ্দ পড়ুয়া পিছু ২০ টাকা। আর, দৈনিক পড়ুয়া পিছু বরাদ্দ বাড়ল ৩ টাকা ৩৩ পয়সা। প্রশ্ন উঠেছে, এই সামান্য টাকা বাড়ালে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ডিম, মুরগির মাংস বা মরসুমি ফল দেওয়া সম্ভব হবে কি?

এরাজ্যে যে বিপুল সংখ্যক মিড-ডে-মিল কর্মী বছরের পর বছর কাজ চালিয়ে আসছেন, যাঁদের বাদ দিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড চলতেই পারে না, তাঁদের ভাতা বৃদ্ধির জন্য কিন্তু বরাদ্দ হল না এক কানাকড়িও। পুজোর সময় রাজ্যের সমস্ত ক্লাবগুলো, পুজো কমিটিগুলোকে দরাজ হাতে তৃণমূল নেতৃ আর্থিক অনুদান বিতরণ করে থাকেন, কিন্তু মিড-ডে-মিল কর্মীদের জন্য নেই কোনো পুজো অনুদান, আজ পর্যন্ত একমাত্র এই রাজ্যে তাঁদের ভাতার বৃদ্ধি করা হলনা। কিন্তু, চারমাসের পুষ্টিকর খাদ্য জোগাতে এই বিপুল সংখ্যক কর্মীদের যে বাড়তি শ্রম দিতে হবে, সেই শ্রমের মূল্যের কোন দাম নেই রাজ্য সরকারের কাছে। অথচ, পঞ্চায়েত ভোটের আগে চারমাসের জন্য এই খুদকুঁড়ো বিতরণের ক্ষেত্রে রন্ধন কর্মীদের যে বড়ই প্রয়োজন! একইভাবে, আশা কর্মীদের গ্রামে গ্রামে নামানো হয়েছে আবাস যোজনার উপভোক্তাদের যাচাই করার কাজে। তাঁদের উপর হামলার খবরও সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। গ্রামীণ কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে, নানা ঝুঁকি নিয়ে এমন এক কাজে নামানো হল, যা তাঁদের বিধিবদ্ধ কাজ বা কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। এই সমস্ত কাজে আশা কর্মীদেরও বাড়তি কোন আর্থিক অনুদান দেওয়া হচ্ছে না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সমস্ত কাজের সাথে অহরহ যারা যুক্ত, যাঁদের ছাড়া স্তব্ধ হয়ে যাবে ওই সমস্ত পরিষেবা, তাঁদের শ্রমের কোনো মূল্য কোনো সরকারই দিচ্ছে না — না কেন্দ্র না রাজ্য। এটা রীতিমতো একটা অপরাধ!

এদিকে, শিক্ষা দপ্তরের নিয়োগ সংক্রান্ত যে দুর্নীতি বেশ কয়েক মাস ধরে রাজ্য রাজনীতিকে নাড়িয়ে দেয়, এবার যেন তারই হাত ধরে আবাস প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। পঞ্চায়েত ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই তুঙ্গে উঠছে রাজনৈতিক তৎপরতা। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার সংশোধিত তালিকা প্রকাশ হতেই ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল — দেখা গেল চোদ্দ লক্ষ এমন প্রাপকের খোঁজ রাজ্য সরকার পেয়েছে যারা অযোগ্য, আর যা মোট প্রাপকের এক-চতুর্থাংশ! ২০১৫ থেকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা শুরু হওয়ার পর থেকে এই প্রকল্প বাবদ বিস্তর দুর্নীতির রিপোর্ট বারবার বন্যা বেগে আছড়ে পড়তে শুরু করে। হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য বরাদ্দ সরকারি অর্থনিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। প্রকৃত প্রাপকদের কপালে শিকে ছিঁড়ল না, সেই অর্থে গ্রাম বাংলায় গজিয়ে উঠল চোখ ধাঁধানো বিরাট বিরাট অট্টালিকা, দোকান, ক্লাব আর যারা শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে রয়েছেন, তাঁরাই গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ অর্থ নিয়ে এই লুঠতরাজ চালিয়েছে।

এর দায়ভার রাজ্য প্রশাসন ও তৃণমূলের সর্বময়ী নেতৃ কেন নেবেন না — যার অনুপ্রেরণা ছাড়া একটা শৌচালয়ও এই রাজ্যে গড়ে ওঠে না? চরম দুর্নীতির যে খাল কেটে রেখেছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, তার মধ্যে দিয়েই কখনো কেন্দ্রীয় এজেন্সির কুমির, কখনো বা কেন্দ্রীয় দল এই রাজ্যে বাড়াবাড়ি রকমের হস্তক্ষেপ ঘটানোর নৈতিক বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে, চরম ফ্যাসিস্ট বিজেপি দলটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেন প্রধান কাণ্ডারি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আবাস যোজনার কাজে কতটা অগ্রগতি ঘটল তা সরেজমিনে দেখতে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের একটি দল রাজ্যে পা রেখেছে। বিভিন্ন জেলায় গ্রামে গ্রামে তারা পরিদর্শন শুরু করে দিয়েছেন। শুনছেন সরাসরি বঞ্চিত প্রতারিত মানুষের অভিযোগ। এমনকি কোথাও কোথাও বিরোধী দলের সাথেও দেখা করছে এই কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের দলটি।

কী কেন্দ্র কী রাজ্য — উভয় সরকারগুলো আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের সংকীর্ণ স্বার্থে চালিত। তাই, ঠিক ভোটের মুখে আবাস সমস্যা, বা মিড-ডে-মিলে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিয়ে তড়িঘড়ি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হচ্ছে। আর, মিড-ডে-মিলে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজনীতা যেন মাত্র চারমাস! নির্বাচনের পরই তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। কী নিলর্জ্জভাবেই না রাজ্য সরকার এই কর্মসূচি ফেরি করতে নেমেছে।

চারমাসের এই খুদকুঁড়ো পঞ্চায়েত ভোটের বৈতরণী পার করতে কতটা সহায় হবে, তার জবাব মিলবে আগামীদিনে।

Anti-Fascist Resistance

নতুন বছরের আগমন সাধারণত নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ ও নতুন অঙ্গীকার করার সময়। মোদী সরকার এটাকে অবশ্য পুরোনো প্রতিশ্রুতিগুলোকে ঝেড়ে ফেলা এবং নতুন সময়সীমা সহ নতুন লক্ষ্য হাজির করার সময় বলেই মনে করে।

২০১৪ সালের জয়যুক্ত নির্বাচনী প্রচারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোকে অল্পকাল পরেই জুমলা বলে পরিত্যাগ করা হয়। সেগুলো ছিল কালোটাকা ফিরিয়ে আনা, পেট্রল এবং সাধারণের উপভোগের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য হ্রাস এবং মার্কিন ডলারের সাপেক্ষে টাকাকে শক্তিশালী করে তোলার মতো বিজেপির ইউপিএ-বিরোধী প্রচারের বিষয়ের ওপর ভিত্তি করা মূলত আর্থিক প্রতিশ্রুতি। ভারত যখন গণপিটুনির ঘটনা এবং সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠানের ফ্যাসিবাদী নকশার অন্যান্য মার্কামারা উপসর্গগুলো সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠছিল, এই জমানা তখন নরেন্দ্র মোদীর পরিচালনাধীনে এক নতুন ভারতের এক রাজসিক বীক্ষাকে তুলে ধরল, যার সূচনা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে ২০২২ সালে। বলা হয়েছিল, নতুন ভারতে প্রতিটি ভারতবাসীর মাথায় ছাদ থাকবে এবং প্রতিটি বাড়িতে থাকবে বাথরুম আর ২৪ ঘন্টার বিদ্যুৎ সরবরাহ ও নলবাহিত জল সুনিশ্চিত করা হবে। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে তাদের আয় দ্বিগুণ হওয়ার আশ্বাস কৃষকদের দেওয়া হয়েছিল।

এখন ২০২২ সাল শেষ হয়ে গেছে। আমাদের বলা হচ্ছে, সুনিশ্চিতভাবেই ভারতের রূপান্তরণ ঘটেছে আর নরেন্দ্র মোদী হয়ে উঠেছেন নতুন ভারতের নতুন পিতা। এবং সরকারের ভাষ্য সরে গেছে নতুন লক্ষ্যমাত্রা ও নতুন সময়সীমার দিকে। উদাহরণস্বরূপ, পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি হওয়া থেকে ভারত এখনও অনেক দূরে রয়েছে, কিন্তু আদানি ও আম্বানিরা আমাদের বলে চলেছেন যে ভারত ২০৫০ সালের মধ্যে ৩০ বা ৪০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হয়ে উঠবে! যে ক্ষুব্ধ কৃষকরা শষ্যের ন্যায্য মূল্যের প্রতিশ্রুত অধিকার আদায়ের জন্য এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়নি, কিন্তু সরকার কৃষি বাজেটের হ্রাস ঘটাচ্ছে আর সারের দাম বাড়াচ্ছে। ঢাক পেটানো বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পকে বাস্তব জীবনে বলতে গেলে ভুলে যাওয়াই হয়েছে, আর তাণ্ডবে মাতা বুলডোজার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে মানুষকে উচ্ছেদ করছে।

দীর্ঘ প্রতিশ্রুত বুলেট ট্রেনের আবির্ভাব এখনও ঘটেনি, কিন্তু সাড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ও রাজনৈতিক সমাবেশ ঘটিয়ে বন্দে ভারত ট্রেনগুলোকে চালু করা হচ্ছে। গতি এবং পরিষেবার দিক থেকে এই নতুন ট্রেনগুলোর অনেকগুলোই ১৯৮৮ সালে চালু করা শতাব্দী ট্রেনগুলোর সঙ্গে তুলনীয় নয় এবং দুর্ঘটনায় পড়ার জন্য ট্রেনগুলো প্রায়শই খবর হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে, গুরুত্ব এখন সাধারণ জনগণের জন্য সস্তা ও নিরাপদ রেল যাত্রা থেকে সরে গিয়ে পড়ছে ধনীদের প্রমোদভ্রমণের ওপর, আর পশ্চাদপদ ও দূরবর্তী অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করার তুলনায় জোর পড়ছে বড় বড় শহর ও পর্যটনের গন্তব্যস্থলগুলোকে সুবিধা দানের ওপর। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে গৃহ নির্মাণ ও পরিবহণ, প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই সরকারি নীতি চালিত হচ্ছে ধনীদের অগ্ৰাধিকারের ওপর ভিত্তি করে, আর সাধারণ জনগণকে তথাকথিত খয়রাতি সংস্কৃতির অযোগ্য দানগ্ৰাহী জ্ঞান করে অপমানিত ও বঞ্চিত করা হচ্ছে।

নতুন আখ্যানে লক্ষ্যে পৌঁছানোর সময়সীমাকে পাল্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ২০৪৭ সালে, যেটা হলো ভারতের স্বাধীনতার শতবার্ষিকী। শতবার্ষিকীর সঙ্গে আমাদের সংযোগের যে সিকি শতক সামনে রয়েছে সেই সময়কালকে অভিহিত করা হয়েছে ‘অমৃত কাল’ রূপে আর নরেন্দ্র মোদী এই গোটা পর্যায়ের জন্য ‘কর্তব্য’কেই কেন্দ্রীয় বিষয় করতে চান। তাঁর ২০২২’র ১৫ আগস্টের ভাষণে যে পাঁচটা অঙ্গীকার উল্লিখত হয়েছে সেগুলোর মূল বিষয় হল জাতীয় অস্মিতা, ঐক্য, আনুগত্য ও কর্তব্য। এই ভাষ্যে লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত জনগণের অধিকার এবং সরকারের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে কোনো ধারণা। সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য সরকারের ধারণাকে পাল্টে তার স্থানে নিয়ে আসা হচ্ছে সর্বোচ্চ নেতার শাসনাধীন নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রের ধারণাকে যে নেতার অভিপ্রায়ই হলো আইন। বিমুদ্রাকরণ চরম বিপর্যয়কর আঘাত হানা এবং ঘোষিত কোনো লক্ষ্য পূরণেই প্রকট ব্যর্থতার নজির রেখে যাওয়ার ছ’বছর পর সুপ্রিম কোর্ট তাতে যে ‘বৈধতা’ প্রদান করল তা এই স্বৈরতন্ত্রকে আগামী দিনগুলোতে সংবিধান এবং নাগরিকদের অধিকারের ওপর আরো আক্রমণ হানতেই স্পর্ধিত করবে।

মোদী সরকারের কাছে ২০২৩ হয়ে উঠবে ২০২৪’র অতীব গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের সূচনা মঞ্চ। এবছরে নটা রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যারমধ্যে চারটে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে (ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম), দুটো দক্ষিণে (কর্নাটক ও তেলেঙ্গানা) এবং তিনটে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে (ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান)। মোদী সরকারের কাছে যে কোনো অনুষ্ঠানই হল নির্বাচনী প্রচারের উপলক্ষ আর ২০২৪ এগিয়ে আসায় একটা বছর আমাদের চড়া প্রচার এবং তীব্র ঘৃণাবর্ষী প্রচারাভিযানের মুখোমুখি হতে হবে। জি-২০ গোষ্ঠীর সভাপতিত্বের ভার ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে ভারতের হাতে আসায় মোদীর নেতৃত্বাধীনে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভারতের তথাকথিত উত্থান নিয়ে নিজেদের পিঠ চাপড়ানো সোচ্চার প্রচারও অনেক দেখা যাবে। জি-২০ শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে দিল্লীতে (৯-১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩), এবং তার আগে সারা দেশের ৫৬টা স্থানে ২০০টা প্রস্তুতিমূলক ও অনুপূরক বৈঠক হবে যার অর্থ হলো একবছর ধরে বৈশ্বিক সম্মেলনগুলো চলতে থাকা।

জি-২০ শীর্ষবৈঠকে সব সময়ই বিশ্বায়নবিরোধী প্রতিবাদ দেখা গেছে। ভারতে জি-২০ বৈঠকগুলো জাতীয় অস্মিতা জাহির করার মঞ্চ হতে পারে না, শাসক দলের একতরফা সুবিধা অর্জনের কথা তো ওঠেই না; ভারতের জাগ্ৰত জনমতের কাছে তাকে হতে হবে কর্পোরেট লালসা ও মুনাফার জন্য লুণ্ঠনের বিপরীতে জনগণের অধিকারের আত্মঘোষণার এবং জনস্বাস্থ্য, পরিবেশের সুরক্ষা ও জলবায়ুর প্রতি সুবিচারের লক্ষ্যে বৈশ্বিক সংহতিকে সম্প্রসারিত করার উপলক্ষ। আমাদের, ভারতের জনগণকে গণতন্ত্রের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং প্রতিটি ফ্রন্টে ফ্যাসিবাদী চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে ২০২৩-কে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৩ জানুয়ারি ২০২৩)

eviction of 50,000

নতুন বছরের শুরুতেই উত্তরাখন্ডের হলদোয়ানি হঠাৎ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠল। ওইদিন প্রভাতী সংবাদমাধ্যমগুলো বিরাট বিরাট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানাল, উত্তর-পূর্ব রেল ঘোষণা করেছে, হলদোয়ানি রেলস্টেশনের কাছে বনভুলপুরা এলাকার এই জমিতে বসবাসরত প্রায় ৫০,০০০ মানুষকে তাঁদের “অবৈধ” বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হবে এক সপ্তাহের মধ্যে। শুধু উচ্ছেদই নয়, এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার যাবতীয় ব্যয় বহন করতে হবে “অবৈধ” বসবাসকারীদের !

এই ঘোষণা বিরাট এলাকা জুড়ে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়। দ্বিপ্রহরের নামাজ পাঠের পর বিশাল সংখ্যক মানুষ, যাদের মধ্যে বেশির ভাগই মহিলা, হলদোওয়ানি রেল স্টেশনের চারপাশে জড়ো হতে শুরু করেন বিক্ষোভ দেখাতে। রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, এই উচ্ছেদ শুরু হবে ৮ জানুয়ারি থেকে।

এক দীর্ঘ ও জটিল আইনি লড়াইয়ের শেষে হাই কোর্ট গত মাসে আদেশ দেয়, সমস্ত “জবর দখলকারীদের” অবিলম্বে উচ্ছদ করতে হবে। ২০১৬-১৭ তে রেল ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে নাকি এক সমীক্ষা চালানো হয়, আর সমীক্ষার শেষে জানানো হয় মোট ৪,৩৬৫টি “জবরদখল বস্তি” রয়েছে। যদিও বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছেন, বংশ পরম্পরায় তাঁরা এখানে বসবাস করছেন।

প্রায় ২.২ কিলোমিটার জুড়ে ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি বস্তির পাশাপাশি রয়েছে তিনটি সরকারি স্কুল, ১১টি বেসরকারি স্কুল, দু’টি ইন্টার কলেজ, ১২ টা মাদ্রাসা, ১০ টি মসজিদ, একটি সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও একটি মন্দির। ১৯৭০ থেকে রয়েছে নিকাশি ব্যবস্থাও। বলাই বাহুল্য, এই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাটির বসবাসকারীদের উচ্ছেদের পেছনে রয়েছে সাম্প্রদায়িক ছক। আর, বলাই বাহুল্য, এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে রীতিমতো সাম্প্রদায়িক প্রচার চালানো হচ্ছিল।

প্রশ্ন উঠেছে, গোটা অঞ্চলটাই যদি রেলের হয়, তবে এতোগুলো মসজিদ, সরকারি স্কুল, প্রাইভেট স্কুল (সব মিলিয়ে যেখানে রয়েছে প্রায় ২,৫০০ র বেশি ছাত্র) সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে উঠল কিভাবে? কিভাবেই বা এতোদিন ধরে সেগুলো তাদের কাজ চালিয়ে গেল? এই জমির কিছুটা সরকার লিজে দিয়েছিল। এখন প্রশ্ন, জমি রেলের হলে সেটি লিজে দেওয়া যায় নাকি? এ ব্যাপারে এখনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

বসবাসকারীরা এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে মামলা ঠোকে। ৫ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, এই উচ্ছেদ বন্ধ রাখতে হবে। ৫০,০০০ মানুষকে রাতারাতি উচ্ছেদ করা যাবে না। এই ঘটনাটাকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার উপর সুপ্রিম কোর্টজোর দিয়েছে। আদালত আরও বলেছে, কিভাবে এই বিপুল সংখ্যক মানুষগুলোর পুনর্বাসন দেওয়া যায়, ওই অঞ্চলের নানান স্তর ও পেশার সাথে যুক্ত বাসিন্দাদের অধিকারগুলোকে ও কিভাবে রক্ষা করা যায়, সে সব নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা নিতে হবে রেল কর্তৃপক্ষকে। ফের এই মামলার শুনানি হবে ৭ ফেব্রুয়ারি।

সরকারি জমিতে বসবাসকারী মানুষ ও রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব আমাদের মতো একটা দেশে দীর্ঘ পুরাতন। রাষ্ট্র চায় বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করে সেই দখলি জমি পুনরুদ্ধার করতে, আর এটাকেই কেন্দ্র করেই চলে সংঘাত ও লড়াই। মূল সমস্যা হল, বিপুল সংখ্যক মানুষকে সরকার আজ পর্যন্ত আবাস, মাথার উপর নিশ্চিত পাকাপোক্ত ছাদ দিতে পারেনি। আশ্রয়ের অধিকার সরকার দেয় না। একান্ত বাধ্য হয়ে গৃহহীন, আশ্রয়চ্যুত মানুষ সরকারি জায়গায় বসবাস করতে থাকেন। দ্বন্দ্বের এই জায়গায়টা সমাধান না হলে বারবার তা মাথা তুলবে। ভারতের আদালতগুলো ও বিভিন্ন সময়ে রায় দিয়েছে যে উচ্ছেদ করার আগে বসবাসরত মানুষদের পুনর্বাসন দেওয়াটা আবশ্যক।

যাই হোক, শীর্ষ আদালতের রায় অগনিত মানুষকে স্বস্থি দিয়েছে, প্রবল শীতের কামড়ে যারা উচ্ছেদের বিভীষিকায় দিন গুনছিলেন।

initiative of AIPWA

সাবিত্রী বাই ফুলে আর ফাতিমা শেখের জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে, ভারতবর্ষে নারী শিক্ষা বিস্তারে তাঁদের বিপ্লবী ভুমিকাকে স্মরণে রেখে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির উদ্যোগে ৩-৯ জানুয়ারি ২০২৩ ‘জাত ধর্মেভাগ হবো না শিক্ষা ও সাম্যের জন্য লড়ে যাবো’ — এই স্লোগানকে সামনে রেখে সারা দেশে শিক্ষা- অধিকার অভিযান চালানো হয়। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলাতেও এই কর্মসুচি পালিত হয়।

কলকাতা

৯ জানুয়ারী কলকাতার রাজাবাজার অঞ্চলে আইসিডিএস কর্মীদের পক্ষ থেকে সাবিত্রী বাঈ ফুলে এবং ফতেমা শেখের স্মরণে এক আলোচনা সভা পালন করা হল। এই দুই মহিয়সী নারী সারাজীবন ধরে সমাজের পিতৃতন্ত্র এবং জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। এখানে উপস্থিত ছিলেন ২৫ জন মেয়ে। পার্টির তরফ থেকে উপস্থিত ছিলেন শাহিদা বেগম, রমা রায়, ছন্দিতা ব্যানার্জী, সোনি খাতুন, শবনম এজাজ প্রমুখ। সাবিত্রী বাঈ ফুলে এবং ফতেমা শেখের জীবন নিয়ে আলোচনা করেন শীলা দে সরকার।

একই দিনে সার্ভে পার্কের অম্বুজাতে ফাতিমা শেখ ও সাবিত্রী বাঈ ফুলের জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে বিস্তর আলোচনা সভা হল। সভায় মোট ২০ জন মহিলা সদস্য উপস্থিত ছিলেন, প্রত্যেক মহিলা আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনা ৩টে থেকে ৬টা পর্যন্ত চলে। শুরুতে এক মিনিট নীরবতা দিয়ে আলোচনা এগোতে থাকলে তনুশ্রী বিশ্বাস, সুমিত্রা রায়, সাবিত্রী নাইয়া, সুজাতা জানা, শ্যামলী, শিখা, তিথি বক্তব্য রাখেন। সবশেষে ৫ জনের কমিটি তৈরি হল। কিছু কর্মসূচিও ঠিক হয়। এরপর গান, নাচের মধ্যে দিয়ে সভা শেষ হয়।

হাওড়া

হাওড়া জেলার কামারডাঙ্গায় সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির উদ্যোগে নারী শিক্ষার পথিকৃৎ সাবিত্রী বাই ফুলে এবং ফাতিমা শেখের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। সভার শুরুতে মহিলা সমিতির মাল্যদান ও মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানান জেলা কমিটির সদস্যা সবিতা কোলে। উপস্থিত সকল কমরেড মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুষমা মুখার্জী, অন্নেষা দলুই এবং আমাদের ছোট্ট সাথী শ্রাবনী শেখ। নারী শিক্ষার পথিকৃৎ সাবিত্রী বাই ফুলে এবং ফাতিমা শেখ জীবন মরণপণ করে মহিলাদের মধ্যে স্থায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন সেই সম্পর্কে আলোকপাত করে মূল্যবান বক্তব্য রাখেন জেলা কমিটির সম্পাদিকা কল্যাণী গোস্বামী।

উত্তর ২৪ পরগণা

আইপোয়ার উদ্যোগে হালিশহর সাংস্কৃতিক সংস্থার ঘরে ৪০ জন মহিলাদের উপস্থিতে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন কার্মিকিস্কু, রেবা সর্দার এবং অর্চনা ঘটক। সভায় সংগীত পরিবেশন করেন কার্মী কিস্কু, সুনিতা সরেন, মমতা টুডু, মেহুলী চক্রবর্তী ও রীনা মিস্ত্রী।

সভাটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে যখন সভায় উপস্থিত অনেকেই ছোটবেলা থেকে তাঁদের নিজেদের জাত বা ধর্ম বা অর্থনৈতিক কারণে সমাজে যে যে বৈষম্যের সন্মুখীন হয়েছে সেই নিয়ে বক্তব্য রাখেন। কার্মী কিস্কু, রেজিয়া, রীনা মিস্ত্রী ও জেলা কমিটির সদস্য মিঠু চক্রবর্তী নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। এমনকি সুদুর বকখালি থেকে বেড়াতে আসা রমা মন্ডল তার গ্রামে সমুদ্রের উপর বেঁচে থাকা পরিবারগুলোর যুবক-যুবতীদের কোনো কাজ নেই, কাজ করলেও মজুরি নেই, গরিবদের কর্মসংস্থানের কথা কেউ ভাবে না সেই নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। রন্ধনকর্মী নমিতা ভদ্র রন্ধন কর্মীদের মজুরি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে টালবাহানা এবং তারা যে অবহেলার শিকার সেই নিয়ে আলোকপাত করেন এবং বলেন লাল পতাকার তলাতেই মহিলাদের আন্দোলনকে সংগঠিত করতে হবে।

সভার মূল বক্তা ছিলেন আইপোয়া রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত। তিনি প্রাচীন কাল থেকে মেয়েদের অবস্থান, মনুবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে মেয়েদের অধিকারের লড়াই এবং বর্তমানে বিজেপি আরএসএস কিভাবে মেয়েদের, বিশেষ করে দলিত নারীদের অধিকারেরের উপর হামলা নামিয়ে আনছে সেই নিয়ে এক শিক্ষামূলক বক্তব্য রাখেন। জেলা সভাপতি অর্চনা ঘটক সাবিত্রী বাই ফুলে ও ফাতিমা শেখের জীবনী এবং এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের সময়ে তাদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কেন দরকার সেই নিয়ে বলেন।

সভা পরিচালনা করতে করতে জেলা সম্পাদিকা মিতালি বিশ্বাস তুলে ধরেন ইতিহাসের বিভিন্ন মহিয়সী নারীদের কথা, যারা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নানা বাধা ভেঙে এগিয়ে এসেছেন এবং সাবিত্রী-ফাতিমা-রোকেয়ার মত সাহসী নারীরা জাত ধর্মের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে মেয়েদের শিক্ষার যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আজ জাত ধর্মের বিভাজন করে সেই শিক্ষার অধিকারকে কেড়ে নিতে চাইছে বিজেপি সরকার। এর বিরুদ্ধে শিক্ষা ও সাম্যের অধিকারের জন্য এক সংঘবদ্ধ লড়াই গড়ে তুলতে আইপোয়ার সদস্যপদ বাড়াতে হবে এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে সেই বার্তা সভা থেকে উঠে আসে। হালিশহর অঞ্চলের পার্টির কর্মীদের সহযোগিতায় ও আয়োজনে আলোচনা সভাটি হয়।

দক্ষিণ ২৪ পরগণা

মহিলা সমিতির বজবজ শাখা কমিটির নেতৃত্বে বজবজ জেলা অফিসে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ফাতিমা সেখ ও সাবিত্রী বাই ফুলের জন্ম শতবার্ষিকী নিয়ে। নারী শিক্ষার পথিকৃৎ এবং, মহিলাদের মধ্যে স্থায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার সাথে এখনকার ফ্যাসিবাদী সরকারের চিন্তায় মহিলাদের ঘর বন্দী করার চেষ্টা চালাচ্ছে সেটাও ব্যাখ্যা করা হয়। এই আলোচনায় অংশ নেন দেবযানী, অঞ্জনা মাল, মমতাজ বেগম, কল্পনা মন্ডল ও ছাত্রী অনিন্দিতা।

হুগলি

সাবিত্রী ও ফতিমার সঙ্গে বাংলায় নারী শিক্ষার আরেক পথিকৃৎ রোকেয়ার ছবিও রাখা হয়েছিল। সভায় উপস্থিত অধিকাংশই ছিলেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য ও রন্ধনকর্মী।

সভার শুরুতে সাবিত্রী, ফাতিমা, রোকেয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাঁদের অবদানের কথা উল্লেখ করে চৈতালি সেন বলেন, আজীবন মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বৈষম্য, অপমান, নিপীড়নের শিকার। আবার কর্মসূত্রে তাঁদের অনেকেই শ্রমিক। সেখানে মালিক এবং সরকারের বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হতে হয় তাঁদেরই। এই দুটো সত্তাই তো সমান সত্য, দুয়ে মিলেই নারী শ্রমিক। তাই নারী আন্দোলন এবং শ্রমজীবী আন্দোলন দু’টোকে সমন্বয় করে এগিয়ে চালতে হবে আমাদের।

জেলা সম্পাদিকা শিপ্রা চ্যাটাজী, মনুবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে সঙ্গে আজ নারীবিদ্বেষী ফ্যাসিস্ট বিজেপি আরএসএস’এর বিরুদ্ধে কেন লড়াই জোরদার করতে হবে তা বুঝিয়ে বলেন।

সাবিত্রী, ফাতিমার জাত, ধর্মবিরোধিতার রেশ টেনে সাবিয়া খাতুন বলেন, আমি মুসলিম পরিবারের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বাইরে বেরিয়ে উপার্জন করি। হিন্দুদের সঙ্গে আমার মেলামেশা ভালোই আছে। সেই পরিবারের ছেলেদের ভাইফোঁটা দিই, তাঁরাও খুশি মনে তা গ্রহণ করেন। আমি জাত ধর্ম মানি না, শুধু জানি সব মানুষের রক্তের রং লাল।

রুমা আহিরী নিজের জীবনযুদ্ধের কথা বলেন। কম বয়সে বিয়ের পর তিনি শ্বশুরবাড়ির বন্ধন অগ্রাহ্য করে মাধ্যমিক পাস করেছেন। আগে ছিলেন মিড-ডে-মিল কর্মী এখন আইসিডিএস পরীক্ষায় পাশ করে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী (সহায়িকা) হয়েছেন। এখনও তাঁর প্রতিদিনের লড়াই অব্যাহত। এই প্রেরণাদায়ক কাহিনী মন দিয়ে সকলে শোনেন। আদিবাসীদের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং নিজের এলাকায় মেয়েদের সম্মান রক্ষার্থে প্রতিবাদে মুখর হন ময়না কিস্কু।

বেলুন গ্রামের সংগঠক কল্পনা মালিক ও চাঁপা মালিক সভা পরিচালনা করেন। তাঁরা বলেন, আমরা সবে মহিলা সমিতিতে যোগ দিয়েছি। সমিতি আমাদের সমস্যা আমাদের অধিকারের কথা সবার সামনে জোর গলায় বলার সুযোগ করে দিয়েছে, আন্দোলনের পথ দেখিয়েছে। সভাস্থলেই গঠিত হলো সমিতির বেলুন শাখা। সকলেই নিজের নিজের এলাকায় ফিরলেন উৎসাহ নিয়ে।

একই দিনে বলাগড়ের সায়রা গ্রামে স্মরণ দিবস পালিত হয়। সাবিত্রী ও ফাতিমার শিক্ষা আজও কেন প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে আলোচনা করেন জেলা সভানেত্রী শোভা ব্যানার্জী ও জেলা সদস্যা হেনা সুলতানা।

cooks union

২০১৩ সাল থেকে কেন্দ্র বা রাজ্য কেউই রন্ধন কর্মীদের মজুরি বাড়ায়নি। বিভিন্ন রাজ্য নিজস্ব তহবিল ব্যয় করে কিছু মজুরি বাড়ালেও পশ্চিমবঙ্গ সম্পূর্ণ উদাসীন। যত অভাব গরীব মানুষের খাটুনির দাম দিতে। গত ৪ বছর ধরে জেলায় রাজ্যে বিক্ষোভ, ডেপুটেশন দিয়েও দাবি আদায় হচ্ছে না।

রন্ধন কর্মীরাও থেমে যেতে রাজি নন। আরো উন্নত সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে ব্লকস্তরের সম্মেলনগুলিতে জোট বাঁধছেন। ২৭ ডিসেম্বর উত্তর ২৪ পরগণার হাবড়া ২নং ব্লকের সম্মেলনে এবং গত ১ জানুয়ারি গাইঘাটা ব্লক সম্মেলনে শত শত কর্মী হাজির হয়ে ঘোষণা করলেন লড়াইয়ের কথা।

সরকারি কাজে সরকারি শ্রমিকের স্বীকৃতি, ন্যুনতম মজুরি, ১২ মাসের মজুরি, ভবিষ্যত সুরক্ষা প্রভৃতি দাবি নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা সকলে বলেন।

সংগঠনের জেলানেত্রী সুলেখা বর্ধন এবং রাজ্য সম্পাদিকা জয়শ্রী দাস তাদের বক্তব্যে বলেন, “আমাদের শক্তি সংগঠন। আমরা আজ মর্যাদার সাথে যতটা অধিকার আদায় করেছি তার সবই সংগঠনের জোরে। অতএব, সংগঠনকে আরো শক্ত করতে হবে।’’ এআইসিসিটিইউ জেলা সভাপতি নারায়ণ দে এবং সম্পাদক নবেন্দু দাশগুপ্ত এই সম্মেলনগুলিতে উপস্থিত হয়ে বলেন, মোদী সরকার গরীব মানুষের বেঁচে থাকার সব সুযোগ ধীরে ধীরে কেড়ে নিচ্ছে। গরিবের শিক্ষাটাও কেড়ে নিতে চাইছে। মিড-ডে-মিলের বরাদ্দ কমাচ্ছে। অন্যদিকে রাজ্য সরকার কেন্দ্রের অজুহাত দিয়ে তার দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য প্রকল্প কর্মী, মেহনতি মানুষদের সাথে নিয়ে বৃহৎ জোট গড়ে তুলতে হবে। যারাই আমাদের দাবির সাথে একমত হবেন, সকলকে সাথে নিয়েই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

সম্মেলন থেকে হাবড়া ২নং ব্লকের ১৫ জনের কমিটি গঠন হয়। সভানেত্রী হন টুম্পা দাস ও সম্পাদিকা রুমা রায়। গাইঘাটা ব্লকে ১৯ জনের কমিটি গঠন হয়। সভাপতি হন সঞ্জীব চক্রবর্তী ও সম্পাদিকা মনিকা দেবনাথ।

Awas Yojana

এখন প্রবল শীতেও গ্রামবাংলা উত্তপ্ত! আবাস তালিকা নিয়ে চলছে তুমুল আলোড়ন। রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় — শোনা যাচ্ছে কেন্দ্র রাজ্য চাপান উতোর। কেন্দ্র রাজ্য দুই সরকারই গরিব মানুষের বাস্তু ও আবাসের অধিকার হরণের জন্য দায়ী। জনকল্যানমুখী যতটুকু ছিটেফোঁটা প্রকল্প রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার তাতে বরাদ্দ লাগাতার কমিয়ে চলেছে। বাস্তুহীনদের বাস্তু দেওয়ার কোনো কথাই আর শোনা যায় না। এরাজ্যে আবাসের যে তালিকা তৈরি হয়েছিলো তার মাত্র সিকিভাগ অনুমোদিত হয়েছে। নানারকম অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করে গরিবদের বাদ দেওয়ার চক্রান্ত করা হয়েছে। যেমন এখন একটি পরিবারে একটাই জবকার্ড, অথচ পরিবারের সদস্যরা পৃথকভাবে বসবাস করছেন৷ কিন্তু ঐ জবকার্ডে মাত্র একবারই আবাসের সুযোগ পাওয়া যাবে। এরফলে বহু সংখ্যক গরিবরা বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। তালিকা তৈরি বা সমীক্ষা করার প্রশ্নে রাজ্য সরকার চুড়ান্ত অনিয়ম, দুর্নীতি ও তোলাবাজি করেছে এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো পঞ্চায়েতে জনগণের অংশগ্রহণ, গ্রামসভা বৈঠক করে আবাস যোজনার উপভোক্তা তালিকা তৈরি করার আইনি নির্দেশিকা লাটে তোলা হল কেন? এর পরিবর্তে কায়েম করা হচ্ছে এক ধরনের পুলিশী রাজ! ঘরের তালিকায় তদন্ত করবে পুলিশ! রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এমন নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। মূল কথা হলো আবাস তালিকার সরেজমিন তদন্তের নামে বিস্তর জলঘোলা হওয়ার পর চুড়ান্ত তালিকা তৈরি করলো কে? দোতলা বাড়ি পাকা ঘর, শাসক দলের লোকেদের নাম রয়েছে। অথচ যারা পাটকাঠির বেড়া, টালি বা টিনের ছাদের নীচে বাস করছে তাদের নাম কাটা গেছে বা আদৌ নামই নেই! এমনটা হল কেন?

এই প্রশ্ন তুলে ধরে গত ৬ জানুয়ারি নদীয়া ধুবুলিয়ার সোনাতলা মোড়ে আয়োজিত বিক্ষোভসভায় পার্টির নেতৃবৃন্দ বলেন, পঞ্চায়েত প্রধান সই করে তালিকা পাঠিয়েছে! ব্লকের আধিকারিক সেটাকেই চুড়ান্ত করেছে। তাই পঞ্চায়েতকেই যাবতীয় অনিয়মের দায় নিতে হবে। পেছনে রয়েছে শাসক দলের মাতব্বররা! নিয়ম বিধি অনুযায়ী গ্রাম সংসদ সভা হয়নি। গ্রামের মানুষের উপস্থিতিতে সাধারণ সভায় রেজ্যুলিউশন করা হয়নি! এসব হলে দুর্নীতি অনিয়ম কিছুটা হলেও কম হতো। কিন্তু সবটাই হয়েছে কাগজে কলমে। লোকচক্ষুর অন্তরালে! তাই প্রধানকেই জবাবদিহি করতে হবে। আমরা পঞ্চায়েতে যাবো। আওয়াজ তুলবো জনগণের পঞ্চায়েত ফিরিয়ে দাও। এখন আবাস দুর্নীতি নিয়ে গলাবাজী করছে বিজেপি। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্টদের সেই সুযোগ করে দিলো কে? তাই সভা থেকে স্লোগান উঠলো গ্রামের মানুষ জোট বাঁধো। গণতন্ত্র রক্ষায় গরিব মানুষের জীবন-জীবিকার আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলো।

ধুবুলিয়ার নওপাড়া অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামে সংগঠিত হয়েছে লাগাতার প্রচার অভিযান। চরমহতপুর গ্রামে প্রচারসভায় উঠে এসেছে চরের জমির লড়াইয়ের কথা। এই জমির অধিকার রক্ষা আন্দোলন করতে গিয়ে ২০১৪ সালে তৃণমূল আশ্রিত সমাজ বিরোধীদের হাতে খুন হয়ে যান কমরেড ইউসুফ মোল্লা। ন’বছর হয়ে গেলো, প্রায় ৪০০ বিঘা চরের সেই জমি আজও অনাবাদী পড়ে রয়েছে। এতগুলো বছর ধরে খাস জমি চিহ্নিত করে বিলিবণ্টন করার কোন প্রচেষ্টা তৃণমূল সরকার করেনি। জমির আন্দোলনের শক্তি তথা নকশালপন্থীরা যাতে এগিয়ে যেতে না পারে, ওরা সেই চক্রান্ত করছে। কিন্তু না, জমির অধিকারের লড়াই সিপিআই(এমএল) চালিয়ে যাবে। দ্রুতই সংগঠিত হবে মহকুমা শাসকের কার্যালয়ে বিক্ষোভ। প্রচারসভা থেকে নেতৃবৃন্দ সেই ঘোষণা করলেন। তারা আরও বলেন, আবাস দুর্নীতি তৃণমূলের রাজত্বে গণতন্ত্রকে কবর দিয়েছে। পঞ্চায়েতে জনগণের অধিকারকে শেষ করে দিয়েছে। আবাসের দাবিতে দলে দলে বঞ্চিত মানুষেরা পঞ্চায়েতে বা ব্লক দপ্তরে ছুটে বেড়াচ্ছে। এতেই প্রমাণিত হচ্ছে তৃণমূলের সংস্কার মূলক প্রকল্পগুলি কতটা শূন্যগর্ভ! গরিব মানুষের সংকট কতখানি তীব্র।

এছাড়াও পাথরাদহ, কালীনগর গ্রামে পৃথক ভাবে প্রচারসভা সংগঠিত হয়। ১০০ দিনের কাজ, মান্ডিগুলিতে ধানকেনায় চাষীদের বঞ্চনার প্রশ্নগুলি তুলে ধরা হয়। ব্যাপক মানুষ সভাগুলিতে অংশ নেন, সহমর্মিতা জানান। প্রচার সভাগুলিতে বক্তব্য রাখেন অমিত মন্ডল, ঠান্ডু শেখ, কলম বিশ্বাস, সন্ত ভট্টাচার্য, সালেমা বিবি, আনসারুল হক, কৃষ্ণ প্রামানিক ও জয়তু দেশমুখ। সঞ্চালনা সইদুল মোল্লা।

ধুবুলিয়ার নওপাড়া অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামে চলছে লাগাতার প্রচার অভিযান। ৯ জানুয়ারি চরমহতপুর গ্রামে প্রচার সভায় উঠে এলো চরের জমির লড়াইয়ের কথা। এই জমির অধিকার রক্ষা আন্দোলন করতে গিয়ে ২০১৪ সালে তৃণমূল আশ্রিত সমাজ বিরোধীদের হাতে খুন হয়ে যান কমরেড ইউসুফ মোল্লা। নয় বছর হয়ে গেল, প্রায় ৪০০ বিঘা চরের সেই জমি আজও অনাবাদী পড়ে রয়েছে। এতগুলো বছর ধরে খাস জমি চিহ্নিত করে বিলিবণ্টন করার কোনো প্রচেষ্টা তৃণমূল সরকার করেনি। জমির আন্দোলনের শক্তি তথা নকশালপন্থীরা যাতে এগিয়ে যেতে না পারে, ওরা সেই চক্রান্ত করছে। কিন্তু না, জমির অধিকারের লড়াই সিপিআই(এমএল) চালিয়ে যাবে। দ্রুতই সংগঠিত হবে মহকুমা শাসকের কার্যালয়ে বিক্ষোভ। প্রচারসভা থেকে নেতৃবৃন্দ সেই ঘোষণা করলেন।

তারা আরও বলেন, আবাস দুর্নীতি তৃণমূলের রাজত্বে গণতন্ত্রকে কবর দিয়েছে। পঞ্চায়েতে জনগণের অধিকারকে শেষ করে দিয়েছে। আবাসের দাবিতে দলে দলে বঞ্চিত মানুষেরা পঞ্চায়েতে বা ব্লক দপ্তরে ছুটে বেড়াচ্ছে। এতেই প্রমাণিত হচ্ছে তৃণমূলের সংস্কার মূলক প্রকল্পগুলি কতটা শূন্যগর্ভ! গরিব মানুষের সংকট কতখানি তীব্র। প্রচার সভায় বক্তব্য রাখেন অমিত মন্ডল, ঠান্ডু শেখ, কলম বিশ্বাস, সালেমা বিবি, আনসারুল হক ও জয়তু দেশমুখ। সঞ্চালনা করেন চরমহতপুরের নেতা সইদুল মোল্লা।

against BJP

সিপিআই(এমএল) ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকার এক প্রেস বিবৃতিতে জানান — সারা রাজ্যে ও উদয়পুরে শাসক বিজেপির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিরোধী দলের লাগাতার কর্মসূচি চলছে। ফলে জনগণ ক্রমশ ভয়মুক্ত হয়ে রাস্তার লড়াইয়ে বেশি করে সামিল হচ্ছেন। আবার বিরোধীরা সমস্ত বাঁধা অতিক্রম করে জোটের বার্তা দিয়েছে। তা দেখে বিজেপির নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। গতকাল, ৩ জানুয়ারি পালাটানা ও খিলপাড়াতে দু’টি পদযাত্রা করেছে বামেরা। তাতে শত শত মানুষ অংশ নিয়েছে। আজ জামজুরী রাজধরনগরে সিপিআই(এম)-এর কর্মসূচি উপলক্ষে রাস্তায় দলীয় পতাকা লাগানো হয়। তাই বিরোধীদের আটকাতে হতাশাগ্রস্ত বিজেপি নেতা-কর্মীরা গতকাল সন্ধ্যা-রাতে কারকাকড়াবন থানাধীন জামজুরী রাজধরনগর গ্রামে ফ্যাসিবাদী কায়দায় আক্রমণ সংগঠিত করেছে। আনুমানিক রাত ৮টায় রাজধরনগরের স্থায়ী বাসিন্দা নবীকুল ইসলাম তাঁর নিজ দোকানে একা বসে ছিলেন। তখন বিজেপির বাইক বাহিনী তাঁর দোকানে ঢুকে হামলা করে। তিনি আহত হন। তাঁর মাথায় আঘাত লাগে। বাইক ভাংচুর করা হয়। তাঁকে একা পেয়ে মারতে দেখে এলাকার মানুষ বাইক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ফলে দু’পক্ষের মধ্যে মারামারি ও ভাংচুর হয়। তাতে ঘটনাস্থলের পাশাপাশি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর গ্রামের বাড়িতে আসা গাড়িতেও ভাংচুর হয়। আর তখন আরএসএস ও বিজেপি, স্থানীয় ও বহিরাগতদের এনে জমায়েত করে। নবিকুল ইসলামের দোকান, মোটরবাইক, একটি চা দোকান সহ আরো কয়েকটি দোকান জ্বালিয়ে দেয়। অগ্নি নির্বাপক গাড়ি ও কর্মীদের আগুন নেভাতে বাঁধা দেয়। মিশ্র বসতি এলাকায় সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও উস্কানিমূলক শ্লোগান দিয়ে জনগণকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। পুলিশের সামনেই সব বেআইনি কার্যকলাপ চলতে থাকে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার ফলে বিজেপিকে বহিরাগতদের জমায়েত করে আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। যার ফলে এলাকায় ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে আতঙ্ক ও ভয়ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। পরে চাপের মুখে ও উপায় না দেখে কেন্দ্রীয় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার ফলে বিরোধীদের ও সাধারণ জনগণের জীবন সম্পত্তির আর ক্ষতি হয়নি ও ঘটনা আর বেশিদূর গড়ায়নি। বিজেপির নির্দেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একাংশ সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম পরের ঘটনাটিকে নিয়ে মিথ্যাচার করে ও গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রচার করা হয়। ঘটনার জন্য বিরোধী সিপিআই(এম) দলকে ও নেতাদের দায়ী করা হয়। পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও উস্কানি দেওয়া হয়। এই ঘটনার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র দেখা যায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পরে বাইকবাহিনী রাত ১০টায় শহরে জগন্নাথ চৌমুহনীতে সিপিআই(এম)-এর একটি অফিসঘর ভেঙে সবকিছু বাইরে এনে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয়। সারারাত ব্যাপী বাইকবাহিনী তান্ডব চালায়। যাতে করে জনগণ ভয়মুক্ত হতে না পারে। অথচ এদিকে একই দিনে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান আছে জানতে পেরে সিপিআই(এম) তার কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করে।

সিপিআই(এমএল) মনে করে বিরোধীদের ক্রমবর্ধমান লাগাতার কর্মসূচি ও জোটের বার্তায় আতঙ্কিত বিজেপি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পরিকল্পিতভাবে এই ধরনের আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। জনগণও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তাই রাজধরনগর গ্রামে বামপন্থী কর্মী নবীকুল ইসলামের উপর বিজেপির এই ফ্যাসিবাদী কায়দায় আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি। এলাকায় শান্তি, সম্প্রীতি ও জনগণের জীবন সম্পত্তি রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়। নীচুতলায় গ্রামে গ্রামে ও পাড়ায় পাড়ায় বিরোধী দলের কর্মীদের মধ্যে ঐক্যকে আরও জোরদার করার আহ্বান জানায়। বিরোধী জোট ও জনগণের মধ্যে আরও একাত্মতা শক্তিশালী করার আহ্বান জানায়।

Gauhati High Court

হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য যে ফ্যাসিবাদকে আজ ভারতে প্রয়োগ করে চলেছে তার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে বুলডোজার। ‘জবরদখল মুক্ত করা’কে অছিলা করে সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি-সম্পত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার যে হাতিয়ার যোগী আদিত্যনাথ তাঁর রাজ্য উত্তরপ্রদেশে প্রয়োগ করেছেন, সেই বুলডোজার ক্রমে বিজেপির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিং চৌহান থেকে দিল্লীর পূর্ববর্তী পুরশাসক এবং পরে আসামের হিমন্ত বিশ্বশর্মাও মতাদর্শগত প্রতিহিংসার চরিতার্থতায় বুলডোজারের ওপর ভর করেন। গতবছরের ২২ মে আসামের নগাঁও’এর পুলিশ ও প্রশাসন বুলডোজার চালিয়ে সংখ্যালঘুদের পাঁচটা বাড়ি ধূলিসাৎ করে। কিন্তু মুসলিমদের বাড়ি ভেঙে দেওয়ার সেই পদক্ষেপ সম্প্রতি ধিক্কৃত হল গৌহাটি হাইকোর্টে। গত ৩ জানুয়ারির এক নির্দেশে বিচারপতি আর এম ছায়া ও সৌমিত্র সইকিয়ার ডিভিশন বেঞ্চ পুলিশ-প্রশাসনের ঐ পদক্ষেপকে ‘অবৈধ’ বলে অভিহিত করেন। বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, “বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা” নগাঁওয়ের এসপি’কে কে দিয়েছিল? যাদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে ‘যথাযোগ্য ব্যবস্থা’ নেওয়ার নির্দেশও আদালত রাজ্য সরকারকে দিয়েছে।

সংখ্যালঘুদের ঐ বাড়ি ভাঙা আসলে ছিল পুলিশের প্রতিহিংসার চরিতার্থতা। যে ঘটনার সূত্রে পুলিশ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে তা ছিল এইরকম। গতবছর ২০ মে রাতে মাছ বিক্রেতা সফিকুল ইসলাম যাচ্ছিলেন শিবসাগর জেলায়। নগাঁও জেলার বাটাড্রাবা থানার পুলিশ তাঁকে ধরে ১০,০০০ টাকা ও তাঁর কাছে থাকা কিছু জিনিস ঘুঁষ চায়। সফিকুলের স্ত্রী খবর পেয়ে থানায় যান এবং টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করবেন বলেন। ইতিমধ্যে স্ত্রীর সামনেই থানার পুলিশ সফিকুলকে মারতে থাকে এবং তাঁর অবস্থা গুরুতর হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। পুলিশি হেফাজতে নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যুর এই ঘটনায় জনগণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে থানায় অগ্নিসংযোগ করে। এরপর বদলা নিতে আসরে নামেন নগাঁওয়ের এসপি, ২১ জনকে গ্ৰেপ্তার করে নিপীড়ন চালানো হয় এবং বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়ি মাটিতে মেশানো হয়।

৩ জানুয়ারির রায়ের আগে এই মামলার শুনানি চলার সময় গত বছরের ১৭ নভেম্বর হাইকোর্ট নগাঁওয়ের পুলিশকে তিরস্কৃত করে বলেছিল, “আইজি, ডিআইজি বা অন্য যে কেউই সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হোক না কেন, তাদের সবাইকেই আইনের ব্যাপ্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। পুলিশ বিভাগের প্রধান বলেই তারা কারুর বাড়ি ধ্বংস করতে পারে না। এটা অনুমতি পেলে এদেশে কেউই নিরাপদে থাকতে পারবেনা।” পুলিশের বাড়াবাড়ি এইভাবে বিচার বিভাগের ভর্ৎসনার মুখে পড়েছিল।

এই পুলিশি নির্মমতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংগঠনও প্রতিবাদ সংগঠিত করে। গতবছরের ২ ডিসেম্বর সদৌ অসম গ্ৰামীণ শ্রমিক সংস্থা বুলডোজার রাজ এবং বাটাড্রাবা পুলিশের সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে ধর্না সংগঠিত করে। ঐ ধর্নায় হাইডুবি শিবির বস্তি, জামাই বস্তি ও ডোমারাগুড়ি লালুং গাঁওয়ের শত শত মানুষ যোগ দেন। এঁরা সবাই আসাম সরকারের সংখ্যালঘু- বিরোধী অভিযানে ক্ষতিগ্ৰস্ত মানুষ। ঐ সংস্থা নগাঁও জেলার জেলা শাসকের মাধ্যমে রাজ্যপালের কাছে পাঁচ দফা দাবি সম্বলিত একটা স্মারকলিপি পাঠায়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, (ক) আসাম সরকার বাটাড্রাবায় জমি জবরদখল হওয়ার তথাকথিত যে দাবি করেছে, গুয়াহাটি হাইকোর্টে কর্মরত কোনো বিচারপতিকে দিয়ে তার তদন্ত করতে হবে এবং তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনতে হবে। (খ) জমি সম্পর্কিত আসামের আইন লঙ্ঘনের জন্য নগাঁও জেলা প্রশাসনকে দায়ী করতে হবে। (গ) উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন ও যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। (ঘ) ভারতীয় সংবিধানের ২১নং ধারার প্রয়োগ ঘটাতে হবে, ইত্যাদি।

স্থানীয় প্রশাসন উচ্ছেদের যে নোটিসগুলো পাঠিয়েছে, সদৌ অসম গ্ৰামীণ শ্রমিক সংস্থা সেগুলোকে বাংলাভাষী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অভিযানের অঙ্গ বলে ধিক্কার জানিয়েছে। সেদিনের প্রতিবাদ সভায় আয়ারলা এবং সিপিআই(এমএল)-এর বক্তারাও সমবেত জনগণের সামনে বক্তব্য রাখেন।

গৌহাটি হাইকোর্টের ৩ জানুয়ারির রায়ের পর রাজ্য সরকার আদালতকে জানিয়েছে যে, বুলডোজার দিয়ে ঘর ভাঙার তদন্তে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং আদালতের নির্দেশের ১৫ দিনের মধ্যে দোষী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরআগে সুপ্রিম কোর্ট ঘরবাড়ি ভাঙা থেকে বুলডোজারকে থামিয়েছিল, এবার গৌহাটি হাইকোর্টও বিজেপির বুলডোজার অনুরাগে ধাক্কা দিল।

march to Kolkata on January 31

আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে — জল জমি জঙ্গল থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সারা দেশের আদিবাসী জনগণের জান কবুল লড়াইয়ের ফলে ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আইন এনে দখলিকৃত বনের জমিতে আদিবাসীদের পাট্টা দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু হাজার হাজার আদিবাসীরা আজও পাট্টা পেল না। স্বল্প সংখ্যক যারা পাট্টা পেয়েছে তাদের পরচা নেই। কিছু মানুষ পরচা পেলেও তাতে শ্রেণীচরিত্র জঙ্গল লেখার কারণে কৃষক বন্ধু প্রকল্প, সরকারি দরে ধান বিক্রি প্রভৃতি সমস্ত রকম অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত।

কেবল বনাঞ্চলে নয়, সর্বত্রই আদিবাসী মানুষদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। জমির রেকর্ড, বর্গা রেকর্ডথাকা স্বত্বেও তাদের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। শাসক দলের মদতপুষ্ট কায়েমী স্বার্থান্বেষী চক্র ভূমি দপ্তর ও প্রশাসনের সহযোগিতায় এই অবৈধ কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে আদিবাসী জনগণ দিকে দিকে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। উন্নয়নের নামে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে, দেউচা পাচামীতে, অযোধ্যা পাহাড়ে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা রক্ষার স্বার্থে মরণপণ লড়াই চলছে। ১০০ দিনের প্রকল্পে এক বছর ধরে কোনো কাজ নাই, বকেয়া মজুরি নাই। রেশনে খাদ্য সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আদিবাসী মানুষেরা ভাষা-সংস্কৃতি বিকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত।

মা মাটি মানুষের নামে তৃণমূল সরকার আদিবাসী জনগণের প্রতি সীমাহীন বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে। আদিবাসী কল্যান দপ্তরকে অকেজো করে রাখা হয়েছে। আদিবাসী ছাত্র ছাত্রীদের স্টাইপেন্ড, হস্টেলের সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে তাঁদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত চাকুরীতে নিয়োগ বন্ধ, অনেক ক্ষেত্রে সেখানে অ আদিবাসীদের নিয়োগ করা চলছে। নামেই অলচিকি হরফে শিক্ষা চালু করার কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক বা শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে না। তৃণমূল সরকারের এই প্রতারণার বিরুদ্ধে ক্ষোভকে কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি। যারা সারা দেশে আদিবাসীদের প্রতি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

তাই আসুন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এই ভন্ডামী ও প্রতারণার বিরুদ্ধে জোট বাঁধুন। দিকে দিকে আদিবাসী জাগরণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হোন, সমস্ত সংগ্রামী শক্তির সাথে সংহতিকে এগিয়ে নিয়ে চলুন।

এছাড়াও দাবি তোলা হয়েছে — বনের জমিতে পাট্টা-পর্চার অধিকার, ১০০ দিনের কাজ, বকেয়া মজুরি ও ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশের দাবিতে — আগামী ৩১ জানুয়ারি কলকাতায় সমাবেশ ও রাজ্যের মন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন কর্মসূচিকে সফল করে তুলুন।

নতুন বছরের শুরুতেই দেশের শীর্ষ আদালতের ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ অল্প অল্প করে শুকোতে থাকা ঘায়ে আঁচড় কেটে নুনের ছিটে দিল, ৬ বছর আগের নোট বাতিল ও তৎপরবর্তী যন্ত্রণাকে নরেন্দ্র মোদী ও তার দলবলের কাছে উপভোগ্য করে তুলল নোট বাতিলকে সংবিধানসম্মত বলে রায় দান করে। এখনো বাড়ির দেরাজে পড়ে থাকা ১০০০ টাকার নোটটা জানান দেয় এই নির্মম রাষ্ট্রের কাছে আমরা কতটা অসহায়, জানিয়ে দেয় যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো অছিলায় আমাদের সম্পদ, সম্মান, আয় করার অধিকারকে লুঠ করে নিতে পারে এই ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার; এবং শীর্ষ আদালতের ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের ৪ জন বিচারপতি অবলীলাক্রমে বলে দিলেন যে তা করতে পারে অনায়াসে ‘সংবিধান সম্মত’ ভাবে। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর অবিবেচকের মত ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দেশের চালু নোটের ৮৬ শতাংশকে অকার্যকরী করে তোলার মধ্য দিয়ে যে ‘একুশে’ আইনের সূত্রপাত ঘটানো হয়েছিল তাকে বৈধতা দিয়ে শীর্ষ আদালতের ৪ জন বিচারপতি নোট বদলানোর বা টাকা তোলা লাইনে দাঁড়িয়ে মারা যাওয়া ১৭৩ জন নাগরিককে আরেকবার হত্যা করলেন। তাঁরা তৎকালীন সময়ে কাজ হারানো অসংগঠিত ক্ষেত্রের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন এদেশ ধনীর দেশ, ছবি তোলার জন্য নবতিপর বৃদ্ধা মাকে এটিএম’এর লাইনে দাঁড় করিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে টিটকিরি মারা প্রধানমন্ত্রীর রাজত্ব এটা।

নোট বাতিলের বৈধতার সপক্ষে পাতার পর পাতা রায় লেখা হয়েছে, পাতার সংখ্যা ২৫৮। তাতে সহমত হয়েছেন বিচারপতি নাজির, গাভাই, বোপান্না ও রামাসুব্রমনিয়াম। নোট বাতিলকে সংবিধান বিরোধী বলে ১৩০ পাতার রায় লিখেছেন বিচারপতি নাগারত্না। দুটি লেখাকে পড়ে যেকোনো বিবেচক যুক্তিবাদী মানুষের মনে হবে যে, দ্বিতীয়টি অনেক যুক্তিসঙ্গত।

বিচারপতি নাগারত্নার মতে, রিজার্ভব্যাঙ্ক আইনের ২৬(২) ধারা অনুসারে রিজার্ভব্যাঙ্ক মনে করলে কোনো মূল্যের নোটের কোনো এক বা একাধিক শ্রেণী’কে (সিরিজ) বাতিল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার সেই সুপারিশ মানতে পারে নাও পারে। যদি কেন্দ্রীয় সরকার তা মেনে নেয় তাহলে সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেই সিরিজের নোটগুলিকে বাতিল ঘোষণা করতে পারে। তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সমস্ত সিরিজের নোট বাতিলের সুপারিশ করার ক্ষমতা বা অধিকার নেই। কারণ রিজার্ভব্যাঙ্কের সুপারিশ মূলত দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য, আর্থিক নীতিকে মাথায় রেখেই হতে পারে। তাই রিজার্ভব্যাঙ্ককে সমস্ত মূল্যের সমস্ত সিরিজের নোট বাতিলের সুপারিশের যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সমস্ত মূল্যের সমস্ত নোট বা যেকোনো মূল্যের যেকোনো নোট বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে। তবে তা রিজার্ভব্যাঙ্ক আইনের ২৬(২) ধারা অনুসারে নয়, সংবিধানের সপ্তম তফশিলের ১নং তালিকার ৩৬তম দাখিলা (এন্ট্রি) অনুসারে। কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের দায়ীত্ব অনেক ব্যাপক, কেবল দেশের আর্থিক স্বাস্থ্য নয়, দেশের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক প্রভৃতি। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজনে সমস্ত নোট বাতিল করতে পারে। কিন্তু তা করতে হবে সংসদে আইন পাশ করে যার আগে রাষ্ট্রপতি দ্বারা অর্ডিন্যান্স জারি করা যেতেও পারে নাও পারে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার নোট বাতিলের প্রক্রিয়ার সূচনা করবে, রিজার্ভব্যাঙ্কের কাছে মত চাইতে পারে, কিন্তু রিজার্ভব্যাঙ্কের মত মানার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে এমনটা করা যাবে না। ফলে নোট বাতিলের ভাবনার সূত্রপাত যদি নরেন্দ্র মোদী করে থাকেন তাহলে কেবল গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে তা করা সংবিধান সম্মত ছিল না। কিন্তু তাই করা হয়েছে, যা নোটবাতিলকে অসাংবিধানিক করে তুলেছে।

কিন্তু অন্য ৪ বিচারপতির মতে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইনের ২৬(২) ধারা মেনে সরকার রিজার্ভব্যাঙ্কের সুপারিশ অনুযায়ী ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার সব নোট বাতিল করে কোনো ভুল করেনি। অবশ্যই তাঁদের রায় সরকারের দিকে পক্ষপাতদুষ্ট। প্রথমত, ২৬(২) ধারায় সকল সিরিজের নোট বাতিলের কথা বলা হয়নি, যদিও যেকোনো সিরিজকে সকল সিরিজ বলে ব্যখ্যা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু ঘটনা অনুযায়ী ৭ নভেম্বর ২০১৬ সরকারের তরফ থেকে রিজার্ভব্যাঙ্কের কাছে নোট বাতিল সংক্রান্ত সুপারিশ যায়, ৮ নভেম্বর ২০১৬ রিজার্ভব্যাঙ্কের কেন্দ্রীয় পর্ষদ সেই সুপারিশকে মান্যতা দিয়ে সরকারের কাছে পাঠায় এবং ক্যাবিনেট নোট বাতিলে শিলমোহর লাগায়। গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এই ঘটনা পরম্পরা দেখিয়ে দেয় যে, রিজার্ভব্যাঙ্ক আইনের ২৬(২) ধারা মেনে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মোটেই নোট বাতিলের সুপারিশ করেনি। ফলে ওই ২৬(২) ধারা প্রয়োগ সংবিধান সম্মত নয়, যা বিচারপতি নাগারত্না অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। প্রয়োজন ছিল সংসদে আলোচনার, যা প্রায় কোনো জটিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই করতে নারাজ মোদী সরকার।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যেটিকে বিচারপতি নাগারত্না উল্লেখ করেছেন, সরকারের হলফনামা ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হলফনামার মধ্যে ফারাক। সরকারের তরফে বলা হয়েছে যে, কালো টাকা, জাল টাকা ও বেআইনি অর্থ সরবরাহকে বন্ধের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কেন্দ্রীয় পর্ষদ ৮ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সুপারিশ করেছে। ওদিকে রিজার্ভব্যাঙ্কের হলফনামায় বলা হয়েছে যে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ (ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন) ও বৈদ্যুতিন উপায়ে লেনদেনকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সুপারিশ করা হচ্ছে। ফলে সরকার কিংবা রিজার্ভব্যাঙ্ক শীর্ষ আদালতের সামনে হলফনামা দিয়ে অসত্য বলছে। এতদসত্ত্বেও দেশের শীর্ষ আদালতের ৪ জন বিচারপতি সরকারের কোনো ত্রুটি দেখতে পাননি।

উপরের আইনি চাপান-উতোর অবশ্যই খুব উপভোগ্য নয়। নোট বাতিল সংবিধান সম্মত কিনা তা নিয়ে আমজনতার মাথাব্যথা নেই। যারা নোট বাতিলের সরাসরি আঘাতে দিনের পর দিন অভুক্ত অর্ধভুক্ত ছিলেন, সেই অটোচালক,  রিক্সাচালক, অতি ছোট ব্যবসায়ী, তাদের অনেকেই ভেবেছিলেন এটি নরেন্দ্র মোদীর মাস্টারস্ট্রোক, দেশের সব কালো টাকা হস্তগত করে সকলকে ১৫ লক্ষ না হোক কয়েক লক্ষ করে টাকা দেবেন তিনি। কিন্তু যখন সব টাকাই ব্যাঙ্কে ফিরেছে তখন তাঁরা আশাহত হলেও ধর্মের জিগির তুলে তাঁদের ভুলিয়ে রাখা গিয়েছে। লকডাউনে যারা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে, যাদের প্রিয়জন অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে তাঁদের বিদ্রুপ করে আদালতে হলফনামা দেওয়া হয়েছে এই বলে যে, অক্সিজেনের অভাবে কোভিডে একজনও মারা যায়নি। কোভিড টিকার শংসাপত্রে মোদীজির ছবি ছাপতে ভুল হয়নি, কিন্তু কোভিড টিকাকরণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিষয়ে আদালতে হলফনামা দেওয়া হয়েছে যে টিকা বাধ্যতামূলক ছিল না, সকলে স্বেচ্ছায় টিকা নিয়েছেন। আদালত তা মেনেও নিয়েছে। ফলে সরকারি হলফনামা হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নোটবাতিলের পরে দেশে নগদ টাকার পরিমাণ গত ৬ বছরে ৭১ শতাংশ বেড়েছে, যতই অনলাইন ও ইউপিআই লেনদেনের গুণগান করাহোক, এখনো গরিব ও সাধারণ মানুষের কাছে নগদই লেনদেনের উপায়। কালো টাকার কোনো হদিশ নোট বাতিল দিতে না পারলেও, রাজ্যের মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ পাত্রীর ঘর থেকে ৫০ কোটি টাকার নগদ উদ্ধার হচ্ছে। বিজেপি গত কয়েক বছরে ৩০০’র বেশি বিধায়ক ও সাংসদকে কিনেছে, নিশ্চয়ই ব্যাঙ্কের মাধ্যমে লেনদেন করে নয়। নোট বাতিলের অভিঘাতে বহু অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পাততাড়ি গুটিয়েছেন, তাঁদের কোমর ভেঙে গিয়েছিল, আজও তা সোজা হয়নি। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে জিএসটি ও তারপরে মারণাত্মক লকডাউন। কোনো কিছুতেই শীর্ষ আদালত কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে বলা যায়না। ফলে নোট বাতিলের মামলার রায় কি অযোধ্যা মামলার রায়ের মতই পূর্বনির্ধারিত ছিল না? তা সত্বেও বিচারপতি নাগারত্নার বলিষ্ঠ অবস্থান অন্ধকারের মধ্যে বিদ্যুতরেখা হিসেবে আশা জাগায়, যদিও তিনি নোট বাতিলের সামাজিক অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ফলাফল লাভক্ষতি নিয়ে কিছুই বলেননি।

- অমিত দাশগুপ্ত 

Narendra Modi govt cannot deny

জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদার বিলোপ ঘটিয়ে ২০১৯’র আগস্টে যখন রাজ্যটাকে দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হলো, ৩৭০ ও ৩৫এ ধারার বিলোপ ঘটানো হলো, কেন্দ্র সরকারের মতে সেই পদক্ষেপে নাকি জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ ‘খুশি’ হয়েছিল। আর সেই ‘খুশি’র নিদর্শন হিসাবে জনগণ দেখেছিলেন প্রায় সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে গৃহবন্দী করা হয়েছে, ইন্টারনেট সহ সংযোগের সমস্ত মাধ্যমকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। সেই পদক্ষেপের লক্ষ্য হিসাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জঙ্গি কার্যকলাপের দমনকে তুলে ধরা হয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন বছর পর আজ দেখা যাচ্ছে সেনাপীড়ন জনগণের ঘাড়ে আরো জোরালো হয়ে চেপে বসেছে, সেখানে একরকম সামরিক শাসনই চলছে; গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন, জঙ্গিরা তাদের সন্ত্রাসের স্বাক্ষর রেখে চলেছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দাবি প্রতিদিনই প্রহসনে পরিণত হচ্ছে, আর জম্মুতে পুনর্বাসনের কাশ্মীরী পণ্ডিতদের দাবিতেও কোনো ছেদ পড়ছে না। এরই ধারাবাহিকতায় এখন আবার সামনে আসছে বৈষম্যের অভিযোগ, যে বৈষম্য চালিত হচ্ছে জাত ও ধর্মকে কেন্দ্র করে, ভুক্তভোগীদের মতে যার শুরু হয়েছে রাজ্য মর্যাদা হরণের পর লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বকলমে বিজেপি শাসনের পথে।

কাশ্মীরী পণ্ডিতরা যদি জঙ্গি হামলার শিকার হয়ে থাকেন তবে মুসলিমরাও জঙ্গি হামলার শিকার কম হননি। কাশ্মীর পুলিশই সম্প্রতি জানিয়েছে যে, জঙ্গি হামলায় হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের নিহত হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু প্রশাসন প্রদত্ত অনুদানের ক্ষেত্রে মুসলমানরা এবং এমনকি হিন্দু দলিতরাও ব্রাহ্মণদের তুলনায় অনুদান পাচ্ছেন অনেক কম। গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ রাজৌরিতে সেনা শিবিরের বাইরে নিহত হলেন দুই দলিত যুবক সুরেন্দ্র কুমার ও কমল কিশোর, যারা সেনা ক্যান্টিনে মাল বাহকের কাজ করত। ঐ দুই দলিত যুবক জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হয়েছে বলে সেনারা চালাতে চাইলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন ঐ দুই দলিত যুবক নিহত হয়েছে প্রহরারত সেনার গুলিতেই। এমনকি বিজেপির নেতৃবৃন্দও দুই যুবকের হত্যায় সেনা সদস্যকেই দায়ী করেছেন। দুই যুবক নিহত হওয়ার পর ডেপুটি কমিশনার বিকাশ কুন্দল ঘোষণা করেন, নিহতদের পরিবারের সদস্যদের এক লক্ষ টাকা করে অনুদান ও সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। পরদিন লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা আরও পাঁচ লক্ষ টাকা করে অনুদান প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু নিহতদের পরিবারের সদস্যরা কি কাজ পাবে? প্রশাসনের চালিয়ে যাওয়া বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে সন্দিহান নিহত দলিত যুবক সুরেন্দ্র কুমারের ভাই কোশল বিশ্ব। তিনি জানিয়েছেন, “আমরা টাকা পেয়েছি, কিন্তু কাজ পাইনি। কাজ পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ডাংরির ঘটনায় এলজি সাহাব নিজে অর্থ ও কাজের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।” অর্থাৎ, ডাংরির হত্যাকাণ্ডে (যার প্রসঙ্গে একটু পরে আসা হবে) লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা নিজে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আর তাঁদের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি যেহেতু এসেছে ডেপুটি কমিশনারের কাছ থেকে, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের সম্ভাবনা তাই ক্ষীণ বলে মনে হয়েছে সেনার গুলিতে নিহত দলিত যুবকের ভাইয়ের কাছে।

জঙ্গিদের আক্রমণে কাশ্মীরের বহু মুসলিম নিহত হলেও প্রশাসনের সদাশয়তা তাদের প্রতি তেমন বর্ষিত হয়না। জঙ্গিদের হাতে নিহত কাশ্মীরী পণ্ডিত অজয় পণ্ডিতিয়ার পরিবার পেয়েছে ২০ লক্ষ টাকার অনুদান। নিহত ব্যক্তি কাশ্মীরী পণ্ডিত হওয়ায় প্রশাসন টাকার থলি উজাড় করতে একটুও দ্বিধা করেনি। জঙ্গিদের হাতে নিহত বিজেপির কিষাণ মোর্চার কুলগাম সভাপতি গুলাম রসুল দরের পরিবার প্রশাসনের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু পায়নি। তার ছেলে আরশাদ আহমেদ দরের কাছে বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে এবং তাদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বঞ্চনার যে প্রকাশ সে ঘটিয়েছে তাকে অন্যায্য বলে মনে করার কোনো কারণ থাকতে পারেনা — “ওরা (অজয় পণ্ডিতিয়ার পরিবার) পণ্ডিত বলে পেয়েছে আর আমরা পাইনি। আমার বাবা অনেক বছর বিজেপির সঙ্গে ছিলেন, কিন্তু সেটা কোনো কাজে দেয়নি। আমরা শুধু প্রতিশ্রুতিই পেয়েছি।” আরশাদ আরো জানিয়েছেন, তারা রেডক্রসের কাছ থেকে এক লাখ টাকা পেলেও সরকার তাদের কোনো অনুদান দেয়নি। জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন সব সম্প্রদায়ের নাগরিককে সমান চোখে দেখে না, সেই বোধ বৈষম্যের শিকার মুসলিমদের মধ্যে যথেষ্ট মাত্রায় রয়েছে এবং সর্ব জম্মু ও কাশ্মীর পঞ্চায়েত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান শফিক মিরের মুসলিমদের ক্ষেত্রে বঞ্চনার অভিযোগ তাই অত্যন্ত সঙ্গত হয়েই দেখা দেয় — “কেউ কেউ এক লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছে, অন্যরা কিছুই পায়নি। ওদের ধর্মের জন্যই সম্ভবত ওদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হয়েছে।”

এবার আসা যাক জম্মুর রাজৌরির ডাংরিতে ঘটা জঙ্গি আক্রমণের ঘটনায়। নতুন বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি জঙ্গিরা ডাংরি এলাকায় একটা বাড়ি লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালায় যাতে পাঁচজন নিহত হন। পরদিন জঙ্গিদের রাখা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় এক শিশু ও এক কিশোর। এই নিহতরা সবাই ছিল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা নিহত প্রতিটি পরিবারের জন্য দশ লক্ষ টাকা অনুদান ও সরকারি কাজের লিখিত প্রতিশ্রুতি দেন। নিহতদের ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোর এই প্রাপ্তির প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ না হয়েও প্রশাসনের অসম আচরণ দৃষ্টির বাইরে থাকে না। এসসি, এসটি এবং ওবিসি সংগঠনগুলোর সারা ভারত কনফেডারেশনের জম্মু ও কাশ্মীরের সভাপতি আর কে কালসোত্রা তাই বলতে বাধ্য হন, “তোমরা জীবিতকালে জনগণকে সমান চোখে দেখোনি, অন্ততপক্ষে মৃত্যুতে সমান বলে গণ্য করো। ডাংরিতে নিহতদের জন্য ১০ লক্ষ টাকা ও কাজ, কিন্তু রাজৌরিতে নিহতদের জন্য মাত্র ৫ লক্ষ টাকা।” রাজৌরিতে সেনার গুলিতে নিহতরা দলিত সম্প্রদায়ের যুবক ছিল। অতএব, জঙ্গিদের গুলিতে মুসলিম ও দলিতরা নিহত হলেও তাদের বিষম চোখে দেখতে প্রশাসনের ভুল হয় না।

জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা এবং ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বিলোপের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল জঙ্গি দমন, কিন্তু সরকার তাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জঙ্গিরা কাশ্মীরী পণ্ডিতদের সঙ্গে অন্যান্য হিন্দু, শিখ ও মুসলিমদের হত্যা করে চলেছে এবং নাগরিক জীবন রক্ষায় নিজেদের অক্ষমতাকে আড়াল করার সরকারের কোনো যুক্তিই আর বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। তবে, জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হরণের সঙ্গে একটা অঘোষিত লক্ষ্যও ছিল, আর সেটা হলো বিজেপির নিজের মার্কামারা চিন্তাধারার, ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন ও বিদ্বেষের ভিত্তিতে জম্মু ও কাশ্মীরকে শাসন করা। ওপরে অনুদানের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যকে আমরা দেখলাম তা এই ভাবধারারই অনুসারী। ‘কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্র নিয়ে নরেন্দ্র মোদী থেকে গোটা বিজেপি নেতৃত্ব যে উন্মাদনার সৃষ্টি করলেন, তার পিছনেও কাজ করেছে বিদ্বেষ ও বিভাজনের এই মানসিক প্রবণতা। ঐ চলচ্চিত্রে পণ্ডিত-বিরোধী হিংসায় মুসলিমদের জঙ্গি সহযোগী বলে দেখানোটা শুধু প্রকৃত তথ্যের বিকৃতি সাধনই নয়, হিন্দুত্ববাদী মুসলিম বিদ্বেষের ছাঁচে ঢেলেই তার নির্মাণ হয়েছে। তবে, ঐ চলচ্চিত্রকে বিজেপি তাদের মুসলিম বৈরিতার প্রচারের অবলম্বন করলেও তা কাশ্মীরী পণ্ডিতদের বিপন্নতাকেই বাড়িয়েছে। আর কাশ্মীরের জনগণ নিজভূমিতে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, বঞ্চনা ও অবমাননার শিকার হচ্ছেন, প্রশাসনের দলনে ও জঙ্গিদের জুলুমে। রাজ্যপালই জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধি বলে ৩৭০ ধারার যে বিলোপ ঘটানো হয়েছিল তা সংবিধানসম্মত ও ন্যায়সংগত ছিল কিনা, সেই মামলা আজ পর্যন্ত শোনার সময় করে উঠতে পারলনা সুপ্রিম কোর্ট। এবং বিচার অমীমাংসিত রেখে মোদী সরকারেরই সুবিধা করে চলেছে সর্বোচ্চ আদালত। জম্মু ও কাশ্মীরে এই মুহূর্তে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের হাতেই চলছে তার শাসন। কাজেই, জঙ্গি সক্রিয়তায় রাশ টানতে না পারা, নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া, জনগণের ওপর সামরিক পীড়ন চাপিয়ে দেওয়া ও তাদের অধিকার হরণের দায়ও মোদী সরকারের ওপরই বর্তায়, হাজারো যুক্তিতেও তা খণ্ডনীয় নয়। এই দায়ের যুক্তিসংগত পরিণাম যা হওয়া উচিৎ, বিজেপিকে তার মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে ভারতের জনগণকেই।

Brazil_Horrific Fascist Attack

ব্রাজিলে ৩০ অক্টোবরের নির্বাচনে পরাজিত পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো এই মুহূর্তে ব্রাজিলে নেই। মাত্র দিনকয়েক আগেই তিনি ব্রাজিল থেকে আমেরিকায় গিয়ে ফ্লোরিডায় রয়েছেন। কিন্তু সেটা তার সমর্থকদের কাছে ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তাণ্ডব চালাতে, নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করার অভিযানে নামতে কোনো বাধা হল না। গত রবিবার ৮ জানুয়ারি কয়েক হাজার বোলসোনারো সমর্থক তুমুল তাণ্ডব চালালো ব্রাজিলের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের মূল কেন্দ্র থ্রি পাওয়ার্স স্কোয়ারে — যেখান রয়েছে সংসদ, প্রেসিডেন্ট ভবন ও সুপ্রিম কোর্ট। কয়েক ঘন্টার জন্য এই ভবনগুলোর দখল চলে গিয়েছিল উগ্ৰ দক্ষিণপন্থী বোলসোনারোর লুম্পেন সমর্থক বাহিনীর দখলে।

নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই বোলসোনারো প্রচার চালাচ্ছিলেন যে, নির্বাচনে তাঁকে কারচুপি করে হারানো হয়েছে, লুলা জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচনী বিজয়কে হাতিয়ে নিয়েছেন। পরাজয়ের পর কয়েক মাস ধরে সমাজ মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে এবং প্রথাগত পথে জনমত গড়ার প্রক্রিয়ায় দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে তিনি উত্তেজনাপ্রবণ করে তুলছিলেন। তাঁর সমর্থকরা লুলার বিজয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং বোলসোনারোকে আবার প্রেসিডেন্ট করার দাবি জানিয়ে পথে নেমেছিল, সমাবেশ সংগঠিত করছিল। বোলসোনারো ব্রাজিল ছেড়ে আমেরিকা যাওয়ার আগে পর্যন্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কারচুপির ধুয়ো তোলায় প্ররোচনা দিয়ে গেছেন এবং উন্মাদনা সৃষ্টিতে ইন্ধন জুগিয়েছেন। এরই পরিণামে লুলার বিজয়ের পর কয়েকবারই বোলসোনারোর সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে, তারা সরকারি গাড়িতে আগুন ধরায় এবং সহিংস বিক্ষোভ চালিয়ে যায়। তারা এমনকি এই দাবিও জানিয়েছিল যে, সামরিক বাহিনী পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করুক এবং ১ জানুয়ারি দেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠান থেকে লুলাকে আটকাক। এই সমস্ত কিছুই চরম মাত্রায় পৌঁছে পরিণতি লাভ করল ৮ জানুয়ারির ফ্যাসিস্ত হামলায়। নির্বাচনী ফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে রাজধানী ব্রাসিলিয়ার সেনা শিবিরের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে থাকছিল বোলসোনারোর সমর্থকরা। কয়েক হাজার সমর্থক সেখান থেকে কয়েক কিমি রাস্তা পায়ে হেঁটে স্লোগান দিতে দিতে চড়াও হয় সংসদ ও প্রেসিডেন্ট ভবনে, সুপ্রিম কোর্টে। প্রকাশিত সংবাদ থেকে এটাও জানা গেছে যে অন্তত ১০০টা বাসে ৪০০০’র মতো সমর্থক থ্রি পাওয়ার্স স্কোয়ারে নামে। এইসব সমর্থক ব্রাজিলের পতাকা গায়ে জড়িয়ে দাবি করতে থাকে — দেশ ও দেশের সংসদ তাদের, বোলসোনারোই হবেন দেশের রাষ্ট্রপতি। সামরিক বাহিনীকেও তাদের অভিযানের সঙ্গি হওয়ার আহ্বান জানায়। ভবনগুলোর জানলা-দরজা তারা ভাঙে, আসবাবপত্র তছনছ করে, জিনিসপত্র লুটপাটে মাতে, কোথাও কোথাও আগুনও লাগায়। ভবনগুলোর ছাদে উঠে সেখানে দাপিয়ে বেড়ায়।

সেদিন রবিবার হওয়ায় সংসদে কোনো কাজ হচ্ছিল না এবং হামলাকারী বাহিনী প্রথম দিকে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে কোনো বাধার মুখে পড়েনি। পরে অবশ্য পুলিশ তাদের প্রতিরোধ করে, রবারের বুলেট চালিয়ে, মরিচগুঁড়া ছড়িয়ে, কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে। সেনা সদর বাইরে তৈরি তাদের শিবিরগুলোকেও ভেঙে দেওয়া হয়। অবশেষে সেনাবাহিনী এসে হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে ভবনগুলোর দখল নেয়। হামলা চলার এক ঘণ্টা পর প্রেসিডেন্ট লুলা অভ্যুত্থানের এই প্রচেষ্টাকে নিন্দা করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, “ঐ সমস্ত যে মানুষদের আমরা ফ্যাসিস্ত বলি, রাজনীতিতে যা কিছু ঘৃণ্য তার প্রতিনিধি যারা, তারা সরকারি ভবনে হামলা চালিয়েছে, ওরা কংগ্ৰেসে আক্রমণ হেনেছে, সুপ্রিম কোর্টে হামলা করেছে। যথার্থ দুর্বৃত্ত হওয়ায় সামনে যা কিছু পেয়েছে সব ধ্বংস করেছে। আমি বিশ্বাস করি নিরাপত্তায় ঘাটতি ছিল। আর আমি আপনাদের বলছি, যারা এই কাজ করেছে তাদের সবাইকে খুঁজে বার করে শাস্তি দেওয়া হবে। ওরা দেখবে যে গণতন্ত্র যেমন স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার দেয়, তেমনি গণতন্ত্র এই দাবিও জানায় যে জনগণ যেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মান করে।” প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী প্রায় ১৫০০ হামলাকারীকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে এবং হামলায় যুক্ত অন্যান্যদের সন্ধান চলছে। বোলসোনারো ব্রাজিলে দীর্ঘকাল চলা সামরিক শাসনের (ব্রাজিল সামরিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে চার দশকের কাছাকাছি সময় আগে) মহিমাকীর্তন করে থাকেন। কাজেই, সামরিক শাসনের প্রত্যাবর্তনের বিপদ সম্পর্কে লুলাকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে, এবং তা এই কারণেও জরুরি হয়ে উঠেছে যে বোলসোনারোর সমর্থকদের তাণ্ডবে সামরিক বাহিনীর এক অংশের সমর্থন থাকার সংবাদও সামনে এসেছে। ব্রাজিলের ঘটনা দেখিয়ে দিল যে, সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও যথেষ্ট দুর্বল, এবং সেগুলোকে শক্তিশালী করে তোলাটাও হবে লুলার অন্যতম এজেন্ডা। অতএব, লুলার সামনের রাস্তা যে যথেষ্ট কন্টকাকীর্ণ তা যে কেউই অনুধাবন করতে পারবেন।

বোলসোনারো এখন রয়েছেন ট্রাম্পের দেশে, যে ট্রাম্পের তিনি ঘনিষ্ঠ ও একান্ত অনুরাগী। তাঁর সমর্থকরা তাদের লক্ষ্যে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি শুধু এটুকুই বলেছেন যে ওরা ‘সীমানা ছাড়িয়ে গেছে’। ‘সীমানার’ মধ্যে থাকার পরামর্শতিনি কি তাদের দিয়েছিলেন? শান্তিপ্রিয়তা কি তাঁর নিজেরও অভিপ্রেত পথ? ট্রাম্পের প্ররোচনায় তাঁর সমর্থকদের ক্যাপিটল হিল আক্রমণের দৃষ্টান্ত কি তাঁর মধ্যে কোনও প্রেরণার সঞ্চার করেনি? ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বোলসোনারো সমর্থকদের হামলার পর প্রায় সমস্ত ভাষ্যকারই ২০২১’র ৬ জানুয়ারি আমেরিকার প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ট্রাম্প সমর্থকদের সহিংস আক্রমণের উল্লেখ করেছেন, দুই হামলার মধ্যে সাদৃশ্যকে স্মরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের বিজয়কে যেমন ট্রাম্প মানতে চাননি, একইভাবে ব্রাজিলের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থা লুলার বিজয়ে স্বীকৃতি দিলেও বোলসোনারো অভিযোগ করেছেন যে তাঁকে জালিয়াতি করে হারানো হয়েছে। পরাজয়কে মেনে নেওয়ার মানসিক প্রসারতা দেখাতে অক্ষম ট্রাম্প যেমন তাঁর সমর্থকদের ক্যাপিটল হিল আক্রমণে প্ররোচিত করেছিলেন, বোলসোনারোর সমর্থকরাও তাঁদের হতাশার প্রকাশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চড়াও হওয়ার পথকেই বেছে নিল। কেউ যদি বলেন যে, ট্রাম্পের দৃষ্টান্তকেই বোলসোনারো ও তাঁর সমর্থকরা অনুসরণীয় বলে মনে করেছেন তবে সেই যুক্তিকে একেবারে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

ব্রাসিলিয়ায় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণের পর বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের নেতারাই তার নিন্দায় বিবৃতি দিয়েছেন। ধিক্কারের সেই প্রকাশ অনেকের ক্ষেত্রে আন্তরিক হলেও এমন কেউ কেউ বিবৃতি দিয়েছেন যাঁরা নিজেরাই স্বৈরাচারী এবং গণতন্ত্রের অমর্যাদাই যাঁদের প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বোলসোনারোর সমর্থকদের হামলার নিন্দা করে টুইটে বলেছেন, “ব্রাসিলিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দাঙ্গা ও নাশকতার সংবাদে গভীর উদ্বিগ্ন। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে সকলেরই সম্মান করা উচিত। ব্রাজিলের সরকারি কতৃপক্ষকে আমরা সার্বিক সমর্থন জানাচ্ছি।” এখানে উল্লেখ্য যে, ট্রাম্প ও বোলসোনারো দু’জনেই মোদীর ঘনিষ্ঠ মিত্র। আমেরিকায় গিয়ে মোদী ট্রাম্পের প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ প্রকাশ করে এবং ট্রাম্পের সমর্থনে প্রচার চালিয়ে বলেছিলেন — “আব কি বার ট্রাম্প সরকার”। বোলসোনারোকে ২০২০’র প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং সেই আমন্ত্রণ গ্ৰহণ করে বোলসোনারো সে বছর প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃতও করেছিলেন। মোদী নিজেও কি ট্রাম্প, বোলসোনারোর ধারার অনুগামী নন? তিনি কি ক্রমান্বয়ে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দফারফা ঘটাচ্ছেন না, সংসদকে অবজ্ঞা করে কোনো আলোচনা ছাড়াই আইন পাশ করানো হচ্ছে না? বিরোধী দল ভাঙিয়ে, বিরোধী দলগুলোর বিধায়ক ও সাংসদদের কিনে নিয়ে মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, গোয়া, মনিপুর, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলোতে শাসন ক্ষমতা থেকে বিরোধী দলগুলোকে উৎখাত করে গণতন্ত্রকে রসাতলে পাঠানোটা কি নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠেনি? এই নরেন্দ্র মোদী যখন ‘গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে’ সম্মান করার কথা বলেন তখন তা পরিহাসের উদ্রেক না করে পারে না। ব্রাজিলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণ আমাদের কাছেও এক শিক্ষাকে হাজির করছে, আর তা হল, শাসকদের বুলিতে প্রতারিত না হয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষায় সচেতন ও অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।

- জয়দীপ মিত্র

Palestinians in fear

ইজরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টরপন্থী এবং গোঁড়া ধর্ম-ভিত্তিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব আরও সংঘাতময় হয়ে উঠবে বলে ইজরায়েলের ভেতর এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রবল শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা।

ইজরায়েলে নভেম্বরে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে উগ্র-দক্ষিণপন্থী দল রিলিজিয়াস জায়োনিজম অনেকগুলি আসনে জয়লাভ করেছে। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতাসীন জোটের দ্বিতীয় সবচেয়ে শক্তিশালী শরিক জোট এরাই।

নতুন মন্ত্রীপরিষদে জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রীর পদে নিয়োগ করা হয়েছে ইতামার বেনগ্যভিরকে। ইজরায়েল এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে পুলিশি ব্যবস্থার দায়িত্বও এখন এই পদের অধীনে আনা হয়েছে। এই বেন-গ্যভির হলেন চরম জাতীয়তাবাদী এবং ইহুদী-বসতি সমর্থক দল ওৎজমা ইয়েহুদিৎ’এর নেতা, যে দল আরববিরোধী এবং বৈষম্যমূলক নানা নীতির প্রচারক।

তরুণ জাতীয়তাবাদী ও ধর্মভিত্তিক এক গোষ্ঠী — যারা রাস্তায় বন্দুক হাতে আন্দোলনের সমর্থক, ‘আনুগত্যহীন’ আরবদের ইজরায়েল থেকে বের করে দেবার আহ্বানে মুখর এবং পাথর নিক্ষেপকারী ফিলিস্তিনিদের গুলি করার মতবাদে বিশ্বাসী — তাদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন এই ইতামার বেন-গ্যভির। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ইজরায়েলের পুলিশ বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকার সময় ইতামার বেন-গ্যভির আরব বিরোধী বর্ণবাদী আচরণের দায়ে এরআগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। গোঁড়া একটি প্রান্তিক গোষ্ঠীর নেতা থেকে দেশটির রাজনৈতিক মূলধারায় তার উত্থানকে অনেকেই ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতে একটি বিপজ্জনক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসাবে দেখছেন। বিশেষ করে, পশ্চিম তীরে ইতোমধ্যেই ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী যেভাবে ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযান চালাচ্ছে এবং সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের দিক থেকেও মারাত্মক হামলা যেভাবে বেড়েছে, সেই পটভূমিতে এই নির্বাচন ও বেন-গ্যভিরের দলের উত্থানকে মারাত্মক বিপদজনক এক বিষয় বলেই মনে করা হচ্ছে।

কিছুদিন আগে হেব্রনে, ১৬ বছরের একজন তরুণসহ দু’জন ফিলিস্তিনিকে শহরে প্রতিবাদ বিক্ষোভের সময় গুলি করে হত্যা করেছে ইজরায়েলি সৈন্যরা। ইজরায়েলি সেনাদের ওপর ছুরি নিয়ে হামলার অভিযোগ তুলে আরও দু’জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। একজন ফিলিস্তিনির চালানো বন্দুক হামলায় নিহত হয়েছে একজন ইজরায়েলি, যে ফিলিস্তিনিকে পরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা শুধু হেব্রনে নয়, আরো নানা জায়গায় চলছে এবং পরিস্থিতি ক্রমশ আরো উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। তবে হেব্রনেই এই সমস্ত ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে।

হেব্রন শহর হল তল্লাশি চৌকির শহর আর এর অধিকৃত এলাকা সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এখানে রয়েছে কয়েকশ ইজরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর ঘর, যারা বাস করে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় এবং পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে। তাদের ঘিরে বসবাস কয়েখ লাখ ফিলিস্তিনি, যাদের না আছে নিরাপত্তা সুরক্ষা, না আছে কোনও অধিকার। অনেকেই মনে করেন প্যালেস্টাইনি এই ভূখণ্ডে এটা ইজরায়েলি দখলদারির চরম নিদর্শন।

ঐতিহাসিক এই শহরের রাস্তায় চোখে পড়ে বেসামরিক মানুষের অনেক বসতবাড়ি আর দোকানপাটের দরজায় কুলুপ আঁটা সামরিক বেড়া। দেয়াল আর নজরদারি টাওয়ার দিয়ে সেগুলো ঘেরা। একসময় ফিলিস্তিনিদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এই এলাকায় এখন শুধু অনুমতি সাপেক্ষে ঢুকতে পারেন আগের বাসিন্দারা। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর যুক্তি এলাকাটিকে ‘নিষ্কলুষ’ রাখতে নিরাপত্তার প্রয়োজনেই এই ব্যবস্থা।

হেব্রন ইজরায়েলি কট্টর দক্ষিণপন্থীদের মূল রাজনৈতিক ঘাঁটি। সেখানে যেসব ইজরায়েলি বসতি নির্মাণ করে আছেন, তারা বেন-গ্যভির এবং আরেকজন উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক বেজালেল স্মটরিচের যৌথ নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতি নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন।

নির্বাচনের পরের কয়েক সপ্তাহ জুড়ে সেখানে তরুণ ইজরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরের ওপর হামলা চালিয়েছে। এমনকী ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের সমর্থনে সেখানে সফররত একজন বামপন্থী ইজরায়েলি অধিকার কর্মীকে মারধর করেছে একজন ইজরায়েলি সৈন্য। একজন সৈন্যকে দেখা যায় এক ভিডিও বার্তায় বেনগ্যভিরের প্রশংসা করে বলছেন, তিনিই এই এলাকাকে ঠাণ্ডা রাখার উপযুক্ত ব্যক্তি।

নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় যাদের ঘরবাড়ির ওপর হামলা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু মারখিয়া এবং তার প্রতিবেশি ইমাদ আবু শামসিয়েহ। তারা দু’জনেই গত কয়েক বছর ধরে ফিলিস্তিনি একটি মানবাধিকার সংগঠনের হয়ে কাজ করেছেন এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনাগুলো নথিবদ্ধ করেছেন। অনেকেই মনে করছেন সে কারণেই তাদের নিরাপত্তা নিয়ে এখন প্রবল ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

“এখানে দাঁড়িয়ে ইহুদি তরুণরা আমাদের দিকে পাগলের মত পাথর ছুঁড়েছে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে আমাদের অভিশাপ দিয়েছে, বর্ণবাদী মন্তব্য করেছে, বলেছে, ‘আরবরা মরুক’ বলেছে ‘বেরিয়ে যাও এখান থেকে। এসব ঘরবাড়ি আমাদের, আমরা সব কেড়ে নেব’,” বিবিসির প্রতিবেদককে বলেন আবু শামসিয়েহ।

তিনি বলছিলেন, বসতিস্থাপনকারীরা বিপুল সংখ্যায় এসেছিল। “আমার নিজের জন্য, স্ত্রীর জন্য আর বাচ্চাদের জন্য ভয় করছিল।”

বেন-গ্যভিরের প্রশংসা করে ভিডিও তোলা সৈনিককে পরে কয়েকদিনের জেল দেয়া হয়েছিল। তবে তার কারাবাস নিয়ে ইজরায়েলে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। জাতীয়তাবাদীরা যুক্তি দিয়েছেন সামরিক বাহিনীর নেতারা উদারপন্থীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে দেশের সুরক্ষায় নিবেদিত-প্রাণদের শাস্তি দিচ্ছেন।

ইজরায়েলি সমাজের ভেতর বিষয়টি নিয়ে বহুদিনের যে টানাপোড়েন রয়েছে অধিকৃত হেব্রনের পরিস্থিতি সেই চাপা আগুনকে আবার উস্কে দিয়েছে।

ইশাই ফ্লেইশার বসতি নির্মাণকারীদের অধিকারের পক্ষে। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন হেব্রনের ইহুদীদের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র হিসাবে। হেব্রন সফরে যাওয়া ইজরায়েলের শান্তিকামী কর্মীদের বিরুদ্ধে তার সমর্থকদের স্লোগান ছিল — তারা ‘বিশ্বাসঘাতক’।

অধিকৃত পশ্চিম তীরে থাকেন প্রায় ৩০ লক্ষ ফিলিস্তিনি। ইহুদীদের বসতি এলাকায় বাস করেন প্রায় পাঁচ লাখ ইজরায়েলি। ইহুদী বসতিতে বসবাসকারী সবাই আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ বলে বিবেচিত, যদিও ইজরায়েল তা মানে না।

দেশে বিদেশে ইজরায়েলের এই আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও ধ্বনিত হচ্ছে। এই এলাকায় জাতিসংঘের দূত টর ওয়েনেসল্যান্ড সেখানে ক্রমাগত বাড়তে থাকা হিংসার নিন্দা করেছেন। ইজরায়েলের বিদায়ী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গানৎজও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, বেন-গ্যভির দেশে আগুন জ্বালানোর ঝুঁকি তৈরি করছেন। তবে মার্কিন নীতির মদত বরাবরই ইজরায়েল পেয়ে থাকে এবং বিশ্বের নানা জায়গায় মার্কিনীরা নানা সময় হস্তক্ষেপ করলেও প্যালেস্টাইনের জমিতে ফিলিস্তিনিদের ওপর চলা আক্রমণ নিয়ে তারা বরাবরের মতো এখনো চুপ করে আছে। ভারতও মোদী জমানায় ক্রমশ বেশি বেশি করে ইজরায়েলের সঙ্গে নানা ধরনের রণনৈতিক ও অন্যান্য সমঝোতায় জড়িত হয়ে পড়ছে। এর কিছু প্রকাশ্য হলেও অনেক কিছুই গোপন। পেগাসাস নজরদারির সময়ে যা ভীষণভাবে সামনে এসেছিল। ইজরায়েলের তরফে প্যালিস্টিনীয়দের ওপর ক্রমাগত অন্যায় আক্রমণের ঘটনাগুলিতে প্রতিবাদের কোনও লক্ষণ ভারতের শাসকদের তরফে স্বাভাবিকভাবেই নেই। এই অবস্থায় ভারতের জনগণ, বিশেষত বাম ও গণতান্ত্রিক শিবিরের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে এইসমস্ত ঘটনাগুলিকে নিয়ে প্রতিবাদ জারি রাখার।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-30
সংখ্যা-2