আজকের দেশব্রতী : ৫ ডিসেম্বর ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-05-jan-23

৩-৯ জানুয়ারি ২০২৩, শিক্ষা ও রোজগার অধিকার অভিযানে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি

সাবিত্রীবাই ও ফাতিমা শেখ আমাদের প্রথম শিক্ষিকা। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াইয়ের প্রতীক তাঁরা। ঊনবিংশ শতকের সামগ্রিক শিক্ষা বিস্তার আন্দোলনে তাঁরা অনন্য, ব্যতিক্রমী। মূলধারার ইতিহাসে নামজাদা সব সমাজ সংস্কারকদের শিক্ষা আন্দোলন যখন উচ্চবর্ণের লছমন রেখার গণ্ডিতে ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন দলিত সমাজের মেয়েদের মাঝে আধুনিক শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তুলেছেন সাবিত্রীবাই ফুলে ও ফাতিমা শেখ। ১৮৩১ সালের ৩ জানুয়ারি সাবিত্রী ও ৯ জানুয়ারি ফাতিমা জন্মগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের সমস্তরকম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আক্রমণ মোকাবিলা করে তাঁরা মহারষ্ট্রের পুণে শহর ও তার আসপাশে সাফল্যের সাথে গড়ে তুলেছিলেন মেয়েদের জন্য একের পর এক আধুনিক স্কুল। পড়ানো ছাড়াও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী জোগাড় করার কাজটা করতেন ফাতিমা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একেকটা পরিবারের লোকজনকে ধের্য‍্য ধরে বোঝাতেন মেয়েদের পড়াশোনা করার গুরুত্ব। নারীমুক্তি ও ব্রাহ্মণ‍্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে ফাতিমা শেখ এবং সাবিত্রীবাই হয়ে উঠেছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধা।

সাবিত্রীবাই ফুলে ছিলেন ভারতের প্রথম নারীবাদী সমাজ-বিপ্লবী। পিতৃতান্ত্রিক লছমনরেখা অতিক্রম করে লেখাপড়া শেখা, শিক্ষকতার ট্রেনিং নিয়ে মেয়েদের জন‍্য আধুনিক স্কুল খোলা, মাথা তুলে দাঁড়ানোর লক্ষ‍্যে মেয়েদের নিজস্ব গণসংগঠন গড়ে তোলা, ব্রাহ্মণ‍্যবাদী বিবাহ প্রথাকে চ‍্যালেঞ্জ জানানো, ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবাদের তথাকথিত অবৈধ সন্তানদের জন‍্য সেফ হোম তৈরি করা ও বিধবাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ‍্যে ধর্মঘট সংগঠিত করা, সমস্ত ধরনের পিতৃতান্ত্রিক প্রথা ও ঐতিহ‍্যকে সমাজে ও নিজের জীবনে চ‍্যালেঞ্জ জানানো — ঊনবিংশ শতকের মধ‍্যভাগে এইসব তিনি করে গেছেন সারাটা জীবন ধরে, সমস্ত রকম প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করে। তাঁর কাছে শিক্ষা আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্য প্রণোদিত। বহু কবিতায় বহুবার তিনি এই উদ্দেশ‍্য ব‍্যক্ত করে আহ্বান রেখেছেন, “ইংরেজি শেখো জাতের বিনাশ করতে”, অথবা বলছেন, “জাগো, ওঠো এবং শিক্ষিত হও, নিজেকে মুক্ত কর — ঐতিহ‍্য প্রথা গুঁড়িয়ে দাও”। তাঁদের শিক্ষণ পদ্ধতির মূল কথা ছিল স্বায়ত্ততা অর্জন। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোটা তাঁর কাছে ছিল জাতের বিনাশ ও নারীমুক্তি আন্দোলনের হাতিয়ার। জাতের বিনাশ ঘটানোর আহ্বান তিনিই প্রথম রেখেছিলেন এবং জাতব‍্যবস্থার অবসানের প্রশ্নকে নারীমুক্তির প্রশ্নের সাথে অবিচ্ছেদ‍্যভাবে তিনিই প্রথম বুঝেছিলেন। তাঁর সারা জীবনের সমস্ত কার্যকলাপে এই মৌলিক দিশা প্রকাশ পেয়েছে। সারা জীবন তিনি প্রত‍্যক্ষ এক্টিভিজমে যুক্ত ছিলেন। জাতব‍্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন‍্য তৃণমূল স্তরে সংগঠন গড়ার কাজ করেছেন তিনি। আবার, সত‍্যসোধক সম্মেলনে সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ব‍্যক্তিগতকে রাজনৈতিক, আর মানবমুক্তির লড়াইকে ব‍্যক্তিগত করে তোলার যে কল্পনাতীত দৃঢ়তা সাবিত্রীবাইয়ের যাপনে দেখা যায় তা যে কোনও যুগের বিপ্লবীর কাছে অনুকরণের বিষয় হয়ে থাকবে। গণআন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে জীবনের শুরুতে গৃহত‍্যাগ করে পথে এসে দাঁড়াতে ভয় পাননি। তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ফাতিমা শেখ ও তাঁর দাদা উসমান শেখ। তেমনি মহামারি আক্রান্ত মানুষের সেবায় সর্বস্ব দিয়ে মৃত‍্যুবরণও করেছেন সাবিত্রী। ব্রাহ্মণ‍্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার রোষে ভিনজাতের প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল যখন মব-লিঞ্চ হয়ে যাচ্ছিল তখন সেই উন্মত্ত ভিড়ের মাঝে একাই ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই যুগলকে অনার কিলিঙের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আবার, পুণে শহরের ব্রাহ্মণদের সর্বাত্মক প্রতিরোধকে মোকাবিলা করে পুরোহিতবিহীন ‘সত‍্যসোধক বিবাহ’ সম্পন্ন করেছেন আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে। ব্রাহ্মণ বিধবা ও তাঁদের সন্তানদের জন‍্য সেফ হোম যেমন বানিয়েছেন, তেমনই এরকম এক ‘অবৈধ’ অনাথ সন্তানকে নিজেরা অফিসিয়ালি দত্তকও নিয়েছেন। তাঁর এই সন্তানের বিবাহও দিয়েছেন সত‍্যসোধক পথে এবং বিবাহের পূর্বেই হবু পুত্রবধুকে বাড়িতে এনে রেখেছেন বর-কনের পারস্পরিক সম্মতি যাচাই করে নিতে। জ‍্যোতিবার মৃত‍্যুর পর শেষকৃত‍্যের লোকাচার নিজের হাতে সম্পন্ন করেছেন ব্রাহ্মণ‍্য পরিবারতন্ত্রকে চ‍্যালেঞ্জ জানিয়ে। ভারতের বর্তমান বাস্তবতাতে সাবিত্রী ও ফাতিমাদের জীবন ও সংগ্রামের কথা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত অভিঘাত নিয়ে হাজির হয়।

দুই শতক পেরিয়ে আজ ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র নতুন করে নৃশংস চেহারা নিচ্ছে ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। পিতৃতান্ত্রিক শক্তিগুলির কাছে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার হাতিয়ার হলো ‘ধর্ম ও সংস্কৃতি’। এদের নেতৃত্বে ‘সম্মান’ ও ‘সংস্কার’এর নামে মেয়েদের হত্যা করা হচ্ছে, পণের জন্য হত্যা করা হচ্ছে, গৃহহিংসা ও ধর্ষণ প্রকাশ্যেই উৎসাহিত হচ্ছে, দেবদাসী প্রথা মহিমান্বিত হচ্ছে। শিক্ষা, বিয়ে, চাকরি বা জীবনে বাঁচার ক্ষেত্রেও মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও সিদ্ধান্তকে সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এই শক্তিগুলি। মেয়েদের নিজেদের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার বা নাগরিক হওয়ার অধিকার দাবি করলে এই শক্তিগুলির ‘ধর্মবোধ’ হুমকির মুখে পড়ে এবং এই আহত মেকী ধর্ম-বোধকে নারীর উপর হিংসার কারণ হিসাবে দেখানো হয়।

১৪৬টি দেশের মধ্যে লিঙ্গবৈষম্যের বিশ্বতালিকায় ভারত এখন ১৩৫ নম্বরে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে, যেখানে, বিজেপি ক্ষমতায় আসীন, সেখানে আইন পরিবর্তন করে মেয়েদের নিজেদের জীবনযাপনের অধিকার বিলুপ্ত করা হচ্ছে এবং ন্যায্যতা পাচ্ছে মনুস্মৃতি। মনুর এই বিধান অনুযায়ী, দলিত ও নারীদের সর্বদা পরাধীন থাকতে হবে। তাই বিজেপির অধীনে থাকা সরকারেরা যখন বাবা আশারাম, রামরহিমের মতো প্রমাণিত ধর্ষক এবং বিলকিস বানোর গণধর্ষক বিজেপি নেতাদের সুরক্ষা দেয়, সাজা মকুব করে, নির্বাচনী প্রচারে এদের আশীর্বাদ ও সহযোগীতা চায়, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকে না, বরং এই আচরণই বিজেপি-আরএসএসের মতো শক্তিদের জন্য স্বাভাবিক। এই সরকার একদিকে স্কুল-কলেজে মাথায় স্কার্ফ পরা মুসলিম মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে তাদের পড়াশোনার অধিকার কেড়ে নেয়, অন্যদিকে বিলকিস বানোর ধর্ষকদেরকে ‘সংস্কৃতিবান ব্রাহ্মণ’ আখ্যা দিয়ে জেল থেকে মুক্তি দেয়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, আদালতে গার্হস্থ হিংসার অমীমাংশিত কেসের ঘটনা ৪ লক্ষের বেশি। ২০২০ সালে ভারতে ধর্ষকদের সাজা দেওয়া হয়েছে মাত্র ২৭ শতাংশ। অভিযোগ জানাতেই পারেননি এমন মহিলাদের সংখ্যা অসংখ্য। অন্যদিকে, ইউনিয়ন বাজেট ২০২১’র প্রস্তাবনার সময় দেখা গেলো, বিজেপি সরকার মেয়ে শিশুদের শিক্ষার জন্য বরাদ্দ বাজেটের থেকে ৯৯ শতাংশ তহবিল ছেঁটে ফেলেছে। উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের জন্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করা বা বৃত্তি বাড়ানোর বদলে ‘নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রকে বেসরকারী ও পশ্চাদপদ সংস্থাগুলির হাতে তুলে দিচ্ছে বিজেপি সরকার। যার ফলে, গরিব, খেটে খাওয়া, নিপীড়িত অংশের মেয়েরা পড়াশোনার প্রাঙ্গন থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হবে এবং সম্পূর্ণ শিক্ষাদানই হয়ে পড়বে নারী-শুদ্র-সংখ্যালঘু বিদ্বেষী ভাবধারার শিকার। সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রচলিত মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বৃত্তি, যার সাহায্যে বহু মুসলিম ও সংখ্যালঘু মেয়েরা উচ্চশিক্ষা করার সুযোগ ও সুবিধা পেত, সেটিকে বিনা আলোচনায় বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতে ১০০ জনে ৩০ জনের বেশি নারী আজও নিরক্ষর। মাত্র ৪১ শতাংশ ছাত্রীই মাত্র ১০ বছর ও তারও কম বছর স্কুলে টিঁকে থাকতে পারছে। কোভিডের পর কত সংখ্যক ছাত্রী যে স্কুল-ছাড়া হয়েছে তার হিসাব পাওয়া দুষ্কর। ভারতের সমগ্র শ্রমশক্তিতে মেয়েদের যোগদান এখনও ২০ শতাংশ ছুঁতে পারেনি। এবং এর সিংহভাগটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে বেতন বৈষম্য প্রকট।

বর্তমান ভারতে, নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতার সামগ্রিক এই সংকটের মধ্যে, বিজেপির মহিলানেত্রী সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুর হিন্দুদের বাড়িতে ধারালো অস্ত্র রাখার এবং হিন্দুদের ‘শত্রু’দের শিরচ্ছেদ করার জন্য উস্কানিমূলক প্রচার চালাচ্ছে। এরা হিন্দু এবং মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রাচীর তৈরি করতে চায়। এই বিভেদকামী রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদের, চিনে নিতে হবে বিভাজনের মাধ্যমে নারীকে বন্দী করার ফ্যাসিবাদী কৌশলকে। এই লড়াইয়ে আমাদের পাথেয় সাবিত্রী ও ফাতিমার বিপ্লবী বন্ধুত্বের ঐতিহ্য। এই দুই নারীকে স্মরণ করা আবশ্যক, যারা প্রায় দুশো বছর আগে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দৃষ্টান্ত কায়েম করে, জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মহিলাদের শিক্ষা ও সমতার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন।

আসুন আমরা ৩ জানুয়ারী ২০২৩ সাবিত্রীবাইয়ের জন্মদিন থেকে ৯ জানুয়ারী ২০২৩ ফাতিমা শেখের জন্মদিন পর্যন্ত একটি প্রচারাভিযান চালিয়ে এই দুই ভারতীয় নারীর বিপ্লবী উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাই, পিতৃতন্ত্র ও মনুবাদের দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য আমাদের সংগ্রামকে তীব্র করি এবং শিক্ষা ও সমতার অধিকার দাবি করি।

জাত-ধর্মে ভাগ হব না! শিক্ষা ও সাম্যের জন্য লড়ে যাব! 

আমাদের দাবিগুলি হল,

(১) কেজি থেকে পিজি পর্যন্ত মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা চাই।             
(২) প্রতিটি পঞ্চায়েতে একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং প্রতিটি ব্লকে একটি কলেজ তৈরি করতে হবে যাতে দেশের প্রতিটি মেয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে।             
(৩) শিক্ষার বেসরকারীকরণ বন্ধ কর।             
(৪) সমস্ত মেয়ের কর্মসংস্থান চাই।             
(৫) স্কুল পাঠ্যক্রমে সাবিত্রীবাই ফুলে ও ফাতিমা শেখের জীবনসংগ্রাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

Destruction

বম্ব সাইক্লোন!

হঠাৎ ভেসে ওঠা এই শব্দবন্ধ বিরাট এক বিভীষিকার হাড় হিম করা চিত্রকল্প সামনে তুলে ধরল। ২০১৯-এ শেষবার এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেখা মেলে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আবার ২০২২’র বর্ষশেষে আমেরিকা ও কানাডার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করে যেভাবে আছড়ে পড়ল এই তুষার ঝড় তা চোখে আঙুল তুলে দেখাল বিশ্ব উষ্ণায়ন আজ কত বড় বিপদ হয়ে আমাদের দোরগোড়ায় নাড়া দিচ্ছে, জলবায়ু সংকটের মাত্রা ও গভীরতা সম্পর্কে এখনও উদাসীন শাসক ও পরিবেশ ধ্বংসকারী অতিমুনাফালোভীদের ঝুঁটি ধরে টান মারল সজোরে।

বর্ষশেষের উৎসব মরশুমে যখন পাশ্চাত্যের এই দেশগুলো মেতে ওঠে, ঠিক সেই সময়ে বম্ব সাইক্লোনের ছোবল বিপর্যস্থ করে দিল আমারিকা ও কানাডার বিরাট এক এলাকাকে, ২৫ কোটির ও বেশি মানুষ প্রকৃতির এই উন্মত্ত রোষে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্থ। তীব্র তুষার ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়েছে শহর থেকে গ্রাম, কনকনে ঠান্ডা ও ঝড়ের প্রভাবে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০’র মতো মানুষ — যার প্রভাব পড়েছে তিন হাজারের ও বেশি কিলোমিটার জুড়ে। বাফেলো শহরটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রায় দু’লক্ষ মানুষ ওই প্রবল ঠাণ্ডায় বিদ্যুৎ হীন হয়ে দিন কাটিয়েছেন। পুরু বরফের চাদরের তলায় অসংখ্য গাড়ি চাপা পড়েছে। আবাহবিদরা ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়নকে দায়ী করে জানাচ্ছেন, অদূর ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্যোগ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র তাপপ্রবাহ ইতিমধ্যেই গত ৩০ বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতির বহু লক্ষ কোটি ডলারের লোকসান ঘটিয়েছে। আর এর মাশুল সবচেয়ে বেশি দিতে হয়েছে গরিব দেশগুলোকে। এরফলে আরও চওড়া হয়েছে আর্থিক অসাম্য। ডার্কমাউথ কলেজের এক অধ্যাপক জাস্টিন মানকিন তাঁর এক গবেষণা পত্রে দেখিয়েছেন (যা প্রকাশিত হয়েছে প্রখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্স অ্যাডভ্যান্স’এ) প্রকৃতিকে ধ্বংস করার উন্মত্ত এই ট্রাজেডি ডেকে এনেছে বিরাট আর্থিক বৈষম্য। ১৯৯২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তাপপ্রবাহের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে মূল্য চোকাতে হয়েছে ১৬ লক্ষ কোটি ডলার! এরফলে একদিকে ধনী দেশগুলো যেমন হারিয়েছে তাদের বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপি’র ১.৫ শতাংশ, তেমনি তারথেকে অনেক বেশি খুইয়েছে গরিব দেশগুলো। তাদের বার্ষিক মাথা পিছু জিডিপি’র ৬.৭ শতাংশ লোকসান হয়েছে। এর প্রধান কারণই হল, তুলনামূলক গরিব দেশগুলো ট্রপিক বা ক্রান্তিরেখার কাছাকাছি অবস্থিত, আর তাই এই দেশগুলো সহজেই তাপপ্রবাহের শিকার হয়।

হালে, রাষ্ট্রসংঘ এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ৩৪ হাজার উদ্ভিদ, ৫,২০০ পশুদের প্রজাতি, প্রতি ৮’এর মধ্যে একটি করে পক্ষীদের প্রজাতি আজ বিলুপ্তির পথে! যে বনভূমি গোটা বিশ্বের জীব-বৈচিত্র‍্যকে, ভারসাম্যকে বজায় রাখে, সেই আদি বনাঞ্চলের ৪৫ শতাংশই আজ বিলুপ্ত। মুনাফার লালসায় নির্মম, বোধ-বিচারহীনভাবেই বনাঞ্চলকে কেটে সাফ করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপর্যয়কারী প্রভাব আজ সর্বব্যাপী। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ঝড়-ঝঞ্ঝা, অনাবৃষ্টি, খরা-বন্যা, জীব-বৈচিত্রের উপর সর্বনাশা প্রভাব ও তাদের ক্রম অবলুপ্তি, ফসল উৎপাদনে নেমে আসা সংকট, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নতুন নতুন বিপদ, নেমে আসা অভাব ও প্রতিস্থাপন — এমন বহুমাত্রিক বিপদ ও সংকটের আবর্তে আবিশ্ব।

এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াতেই হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে। আমাদের ধরিত্রি, গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার স্বার্থে।

Freedom and Rights

বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ অতিমারী শুরু হওয়ার তিনবছর পরও দুনিয়া তার বিপর্যয়কর পরিণাম থেকে মুক্ত হতে পারেনি। প্রসঙ্গত, অন্য কোথাও নয়, যেখানে এই অতিমারীর উৎপত্তি হয়েছিল সেই চিনই এই ভাইরাসঘটিত অতিমারীর প্রাদুর্ভাবের প্রতিক্রিয়া ভোগ করে চলেছে; এবং অতিমারী নিয়ন্ত্রণের নামে রাষ্ট্রের দমনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপকবিস্তৃত সামাজিক প্রতিবাদও সেখানে দেখা গেছে। দুনিয়ার বাকি অংশে কোভিড-১৯ এখন পিছনে চলে গেলেও জনগণের ব্যাপক অংশ অতিমারী সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবনতি, বিশেষভাবে কাজের বিপুল অবলুপ্তি এবং মজুরি হ্রাসের আঘাতে টলমল করছে। এবং রাশিয়ার গর্হিত ইউক্রেন আক্রমণের পরিণামে ইউরোপ এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যাওয়ায় ঐ অর্থনৈতিক ধাক্কা প্রবলতর হয়ে উঠেছে।

যুদ্ধ দশ মাস চলার পরও তার শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভিত্তিক আগেকার শীতল যুদ্ধের পরিমণ্ডলের পুনরুজ্জীবন আমরা দেখতে পাচ্ছি, এবং দুনিয়াকে আরও একবার পারমাণবিক ফয়সালার কিনারে নিয়ে আসা হচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সংকট ও অধোগতির মধ্যে ইউরোপের রাজনীতি বড় আকারে দক্ষিণ মুখে ঘুরেছে যেখানে বেশকিছু দেশে নয়া-ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর দ্রুত উদ্বেগজনক উত্থান দেখা গেছে। লাতিন আমেরিকায় অবশ্য সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বেশকিছু নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী সরকারগুলোকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে, যারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ব্রাজিলে স্বৈরাচারী বোলসোনারোর পরাজয়।

এশিয়ায় আমাদের ঘরের কাছে এক শক্তিশালী গণঅভ্যুত্থান শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে জমানাকে ক্ষমতাচ্যুত করে, আর ইরানে পোশাক বিধির লঙ্ঘনের অভিযোগে তথাকথিত ‘নীতি পুলিশের’ হাতে মাহসা আমিনির হত্যার পর মহিলাদের নেতৃত্বাধীন সাহসী প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে। ইরানের নারীদের শক্তিশালী প্রতিবাদ ইরানের ধর্মতান্ত্রিক শাসকদের নামানো নিপীড়নকে অগ্ৰাহ্য করে এক দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনে বিকাশ লাভ করেছে। ইমরান খান সরকারের পতনের পর পাকিস্তান আরও একবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কবলে পড়েছে, যে পতনের কারণ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সম্ভবত ছিল ইমরান খানের মার্কিন-বিরোধী বুলিতে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক কর্তাদের অসন্তোষ।

ভারতে ২০২২ সাল গভীরতর অর্থনৈতিক সংকট এবং ফ্যাসিবাদী আক্রমণের ক্রমবিস্তারের বছর হয়েই দেখা দিয়েছে। পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড নির্বাচনের আগে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সুনিশ্চিত করার যে প্রতিশ্রুতি আন্দোলনরত কৃষকদের দেওয়া হয়েছিল, সরকার নির্লজ্জভাবে তার খেলাপ করেছে। সরকার প্রথমে শ্রম আইনগুলোকে আরও ফলদায়ী করার নামে শ্রমিকদের অধিকারগুলোকে অস্বীকার করে এবং প্রতারণাময় নতুন পেনশন প্রকল্পের মাধ্যমে শ্রমিক ও কর্মচারীদের সামাজিক নিরাপত্তাকে প্রহসনে পরিণত করে; এরপর সেনাবাহিনীতে যোগদান করা যুবকদের পঁচাত্তর শতাংশের সেনাবাহিনীর কাজকে চার বছরের চুক্তি কাজে পরিণত করে কাজের নিরাপত্তার ধারণায় চরম আঘাত হানে। এখন আবার বেশি করে শোনা যাচ্ছে স্থায়ী কাজগুলোকে সরিয়ে সেগুলোর স্থানে ব্যাপক আকারে অস্থায়ী চুক্তির কাজ নিয়ে এসে এই অগ্নিবীর মডেলেরই ঢালাও পুনরাবৃত্তির কথা।

সাধারণ জনগণ যখন মূল্যস্ফীতি, কাজের বিলোপ ঘটা এবং আয় হ্রাসের পরিণামে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে, সরকার তখন এই জ্বলন্ত ইস্যুগুলোকে সাধারণের আলোচনা থেকে নির্বাসিত করতে পণ করেছে। সংঘ বাহিনীর কর্নাটক পরীক্ষাগার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারকে তীব্রতর করে তুলতে হিজাব পরিধানকে নিষিদ্ধ করে। ‘কাশ্মীরী ফাইলস’ ছবিটিকে কেন্দ্র করে সরকার চালিত সুপরিকল্পিত প্রচারের ওপর ভর করে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের দুরবস্থাকে চরম বিদ্বেষময় ও আবেগতাড়িত সাম্প্রদায়িক সমাবেশ ঘটানোর আরো একটা সম্ভাবনাময় অস্ত্রে পরিণত করা হয়। বিধ্বংস করা বাবরি মসজিদ স্থলে রাম মন্দির নির্মাণের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে স্পর্ধিত হয়ে — যে বিধ্বংসকে সুপ্রিম কোর্ট ঐ একই রায়ে আইনের শাসনের সাংবিধানিক কাঠামোর শোচনীয় লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছিল — বিজেপি এখন ১৯৯১ সালের আইনকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, যে আইন ধর্মীয় উপাসনাস্থলগুলোর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের সময়কার চরিত্রকে অলঙ্ঘনীয় ও চূড়ান্ত বলে গণ্য করার মধ্যে দিয়ে সেগুলো নিয়ে বিবাদে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল।

বিরোধী মতে লাগাম পরানোর সরকারি প্রচেষ্টায় তাল মেলাতে ভারতের ধনীতম কর্পোরেট গোষ্ঠী এখন বিশিষ্ট টিভি চ্যানেল অধিগ্ৰহণ করেছে, যে চ্যানেল ‘গোদি মিডিয়া’র বাঁধাধরা কাজের তোয়াক্কা না করে ভারতীয় জনগণের সামনে থাকা জ্বলন্ত ইস্যুগুলোকে তুলে ধরত। মূলধারার মিডিয়া এইভাবে মোটামুটি বশংবদ মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে যা সরকারের পাইকারি হারে বিকৃত তথ্যের প্রচার ও মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার অভিযানের দোসর হয়ে উঠেছে। যে রভিশ কুমার ছিলেন ভারতের হিন্দি টেলিভিশনের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাংবাদিক, যিনি জীবিকা ও স্বাধীনতার কেন্দ্রীয় ইস্যুগুলোকে তুলে ধরে ঘৃণা ও মিথ্যাচারের ফ্যাসিবাদী প্রচারের মোকাবিলায় নামতেন, সেই রভিশ কুমার মূলধারার টেলিভিশন মাধ্যমকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয়েছেন। ভয় এবং জোরজবরদস্তি কণ্ঠ স্তব্ধ করার এই সর্বগ্ৰাসী পরিমণ্ডল সত্ত্বেও নির্বাচনী ক্ষেত্রে জনগণের কণ্ঠস্বরের অনুরণন এখনও শোনা যায়, যেমনটা অতিসম্প্রতি আমরা দেখলাম হিমাচলের নির্বাচনে; বিচার বিভাগও মাঝেমধ্যে সরকারকে তিরস্কার করে ও তার বুলডোজারকে থামিয়ে দেয়, যেমনটা আমরা দেখলাম আনন্দ তেলতুম্বডের জামিন মঞ্জুরির ক্ষেত্রে এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়োগের শুনানির সময় মন্তব্যের মধ্যে। সরকার এখন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এমনকি সংসদ ভবনের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনাও করলেন জামিনের আবেদনের শুনানি গ্ৰহণ এবং জনস্বার্থ মামলাগুলি শোনার জন্য।

লড়াইয়ের সীমারেখা অত্যন্ত সুস্পষ্ট রূপে টানা হয়ে গেছে। ভারত যখন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ৭৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর জন্য প্রস্তুত হবে, ভারতের জনগণকে তখন তাদের সমস্ত শক্তি ও সাহসিকতাকে সংহত করে স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের সাংবিধানিক ঘোষণার তাৎপর্যের অনুসারী প্রজাতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ঘটাতে হবে। ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি আমাদের আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারতের সিংহদুয়ার রূপে সংবিধানকে দিয়েছিল, এখন স্বাধীনতার দ্বিতীয় লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে — ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হয়ে — আমাদের একে রক্ষা করতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২)

protested against the attack

বেলেঘাটায় পূর্ব কলকাতা ‘বিদূষক’ নাট্যমণ্ডলীর ওপর গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ টিএমসির স্থানীয় নেতা হম্বতম্বি ও হামলা চালায়। এখানে রাসমেলা প্রাঙ্গণে ২৪-২৫ ডিসেম্বর দু’দিনের নাট্য উৎসব আয়োজন করেছিল বিদূষক। সমস্ত প্রস্তুতিই সম্পন্ন হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সাধারণ মানুষের সহযোগিতায়। কিন্তু টিএমসির ‘কেক উৎসব’ আছে তাই এলাকায় অন্য কোনও কার্যকলাপ চালানো যাবে না — এই কথা বলে টিএমসির স্থানীয় নেতারা হামলা চালায়। নাট্যকর্মী অমিত সাহা সহ কয়েকজনকে মারধোর করা হয়। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলার নাট্যকর্মী ও অভিনয় জগতের কর্মীদের মধ্যে থেকে অত্যন্ত দ্রুত, সময়োচিত ও আশাপ্রদ প্রতিবাদ উঠে আসতে দেখা গেল। প্রতিবাদের চাপে টিএমসির বিভিন্ন উচ্চতর স্তরের নেতারা প্রকাশ্যে ‘ভুল’ স্বীকার করেন এবং হামলাকারী স্থানীয় নেতাও শেষ পর্যন্ত নাট্যদলের কাছে ভুল স্বীকার করে মার্জনা চেয়েছে।

বিদূষক নাট্যদলের কর্মীরা এই অন্যায় মুখ বুজে মেনে নিতে চাননি, তাঁরাই প্রথম রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। সামাজিক গণমাধ্যমে ঘটনাটিকে তুলে ধরার সাথে সাথে তাঁরা বাংলার বেশ কয়েক শত নাট্যগোষ্ঠীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন এবং ফুলবাগান সুকান্ত মঞ্চের সামনে ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ এক প্রতিবাদসভার ডাক দেন। ক্ষমতার দম্ভের বিরুদ্ধে, সুস্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ বজায় রাখার দাবিতে পথে নামার আহ্বান জানিয়ে তাঁরা প্রচারপত্রে লেখেন, “ব্রিটিশদের সময়ে নীল দর্পন নাটক নিষিদ্ধ করা, সত্তর দশকে নাটক প্রদর্শনের সময় নিহত হন প্রবীর দত্ত, তারপর পশুখামার, উইংকেল টুইংকেল’এর ওপর হামলা — এই ধারা আজও অব্যাহত।… আমরা প্রত্যয়ের সাথে বলতে চাই যে আবারও আমাদের নাট্যচর্চা তথা সংস্কৃতির প্রবাহমান ধারাকে পুষ্ট করে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।” বস্তুত পূর্বতন সরকারের আমলে এই বেলেঘাটার কাদাপাড়াতেই বিদুষকের রিহার্সাল রুম কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং পথনাটক করতে গিয়ে তৎকালীন শাসকদলের হাতে আক্রান্তও হতে হয়েছিল। স্বাধীন নাট্যচর্চা, সংস্কৃতি চর্চা ও মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে সকলকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাজ্যজুড়ে মুক্ত পরিবেশের দাবি তোলা হয় প্রচারপত্রে। বিদূষক নাট্যদলের অন্যতম কর্মী তথা সিপিআই(এমএল) সদস্য শুভ মাইতি জানিয়েছেন, সুকান্ত মঞ্চের সামনে প্রতিবাদ সভা ভালো সাড়া ফেলে। শুরুতে যে পুলিশ কোনও কথা শুনতেই রাজি ছিল না, তারাই জিডি নেয়। প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মী এবং গণতন্ত্র প্রিয় মানুষজন। বক্তব্য রাখেন বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, সুজাত ভদ্র, বিশিষ্ট অভিনেতা দীপক হালদার, নাট্যকার তীর্থঙ্কর চন্দ এবং আরো অনেকে। উপস্থিত ছিলেন পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, সায়ন, নৃত্যশিল্পী এবং অভিনেত্রী শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য সহ আরো অনেকে। সভা থেকে তৈরি হওয়া দাবিপত্রে প্রায় ১৫০ জন সম্মতি জানিয়ে সই করেন।

অভিনেতা এবং পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য তাঁর প্রতিবাদ লিখিতভাবে বিদুষককে পাঠিয়েছেন এবং সামাজিক মাধ্যমে তা ব্যক্ত করেছেন। অভিনেতা কৌশিক সেন ও ঋদ্ধি সেনও প্রতিবাদ প্রকাশ্যে আনেন। তাঁদের এই প্রতিবাদগুলি সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে, সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। ঋদ্ধি লেখেন, “শিল্পীরা এগিয়ে আসুক, দেখা যাক কত জনের গায়ে হাত তুলবে তৃণমূলের লুম্পেন গুণ্ডাবাহিনী”। অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ব্যাপক ছড়িয়ে পড়া প্রতিবাদপত্রে তিনি লেখেন, “আমাদের যেন এসে বেদম মার দেওয়া হয়, যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়… ভোট রাজনীতিতে কাজে আসে না, এমন শিল্পীদের মেরে ঠাণ্ডা করে দেওয়া হচ্ছে… আমার পরের অভিনয় ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, রবীন্দ্রসদন মঞ্চে, এসে মেরে যান। আমি প্রতিবাদ করছি এটা জেনেই যে এই প্রতিবাদ ব্যর্থ হবে”।

কলকাতার বাইরেও বারাকপুর, বহরমপুর সহ বিভিন্ন স্থানে নাট্যগোষ্ঠী প্রতিবাদে পথে নামে। বিদূষক নাট্যগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে জারী করা সর্বশেষ বিবৃতিতে সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়েছে যে, শাসকদলের পক্ষ থেকে ভুল স্বীকার করে নেওয়া পদক্ষেপসমূহকে তাঁরা স্বাগত জানাচ্ছেন এবং আগামি ১৪-১৫ জানুয়ারি ২০২৩ বেলেঘাটা রাসমেলা মঞ্চেই তাঁদের নাট্যোৎসব হবে। তাঁরা এই বিবৃতিতে প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, “ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের কোথাও সংস্কৃতি চর্চাকে বাধা দেবার প্রচেষ্টা হলে আমরা প্রতিবাদে সামিল হব”।

Gujarat model

“মহিলাদের সবচেয়ে নিরাপদ রাজ্য হল গুজরাট”। সদ্য সমাপ্ত গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে এই কান ঝালাপালা করা বিজেপির স্লোগান ওই রাজ্যের আকাশ বাতাসকে মুখরিত করেছিল। কিন্তু, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ লোকসভায় পেশ করা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট সেই দাবিকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পেশ করা ওই রিপোর্ট জানাল, গড়ে প্রতি মাসে ৪৫ জন মহিলা গুজরাটে ধর্ষিতা হন, ৬ জনেরও বেশি মহিলা আক্রান্ত হন অ্যাসিড ছোঁড়া হামলায়, আর বছরে ২৬০ মহিলা খুন হন। ২০১৮-২০২১ পর্যন্ত গুজরাটে ২,১৫৬ জন মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন, পেশ করা ওই রিপোর্ট অনুযায়ী।

গড়ে প্রতিবছর, গুজরাটে ৫৫০ ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত হয়, আর প্রতিবছর মহিলাদের উপর হামলা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে। ৩,৭৬২ জন মহিলা গত চার বছরে হামলার শিকার হন, আর গড়ে প্রতি মাসে ১০০ মহিলা এই হামলার মুখে পড়েন।

শুধু তাই নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট থেকে এটাও জানা যাচ্ছে যে, ওই রাজ্যে প্রতিবছর গণধর্ষণ কাণ্ডের নারকীয় ঘটনা বেড়েই চলেছে। ২০১৮ সালে যেখানে গণধর্ষণের ৮টি ঘটনা ঘটে, সেখানে ২০২১এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭। গত চার বছরে ৫৬টি গণধর্ষণের ঘটনা প্রশাসনের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে।

এই না হলে গুজরাট মডেল!

pensioners in Tripura

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকার এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, দীর্ঘদিন ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে সরকার ৫৮ মাস পরে নির্বাচনের মাত্র দু’মাস আগে সরকারি শিক্ষক, কর্মচারী, পেনশনভোগীদের জন্য ১২ শতাংশ ডিএ ও একাংশ অনিয়মিত কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করেছে। যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোট কেনা ও ভোটের দাদন বিলি ছাড়া আর কিছুই নয়। রাজ্যের ইতিহাসে অন্যান্য সরকারের সময়ে কেউ এমন অসম্মানজনক আচরণ করেনি। রাজ্যের সরকারি শিক্ষক, কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা আর কখনো এমন অসম্মানজনক ব্যবহারের শিকার হয়নি। তাছাড়া এরপরেও ১৮ শতাংশ ডিএ বকেয়া থাকবে। যেখানে অসহনীয় ও আকাশছোঁয়া ভোগ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির বাজারে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের এমন বিরাট বৈষম্য আর দেখা যায়নি। এ হিসাব রাজ্যের সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীরা ভালভাবেই জানেন ও বোঝেন। কিন্তু সমগ্র শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষক, আশা কর্মী, অঙ্গনোয়াড়ি কর্মী, রেগা কর্মী ও রেগা শ্রমিকদের সম হারে কোনও বেতন ও মজুরি বৃদ্ধি করা হয়নি। অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধির বাজারে এভাবে প্রকল্প শ্রমিকদের, রেগা শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হয়েছে। যা এক বিরাট বৈষম্য তৈরি করেছে ও কোনভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না।

তাছাড়া গত ৫৮ মাসে রাজ্যে ৩৮ হাজার শূন্যপদ পূরণ করা হয়নি। কোনও স্থায়ী নিয়োগ নেই। সারা দেশে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব ত্রিপুরায়। জাতীয় গড় যেখানে ৮.৭ শতাংশ। ত্রিপুরায় বেকারত্বের হার সেখানে ১৪.৫ শতাংশ। গত ৫৮ মাসে ২০,১৩৮ জন সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা কমেছে। অর্থাৎ এই ২০,১৩৮টি পদ অবলুপ্ত করা হয়েছে। উল্টো এই সরকার আউটসোর্সিং করে ঠিকা প্রথায় সরকারি পদে নিয়োগ করছে। তাঁরা অধিকাংশ নিয়মিত বেতন পান না। আসলে এরা সরকারি পদে নিয়োগ ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে দিতে চায়। বেসরকারি কোম্পানি রাজ কায়েম করতে চায়। এখন ভোটের মুখে প্রতিষ্ঠান বিরোধী বিক্ষোভ ধামাচাপা দিতে দাদন হিসেবে ডিএ ও বেতন বৃদ্ধির পদক্ষেপ। তাই আমরা সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি রাজ্য সরকারের এই চরম বৈষম্যমূলক নীতির বিরোধিতা করার পাশাপাশি সমহারে সবার নিয়মিত ও স্থায়ীভাবে বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানায়। সব অংশের জনগণকে এই সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে স্থায়ী নিয়োগ, সমহারে বেতন ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়।

Ainti-Fascist Resistance

(আসন্ন একাদশতম পার্টি কংগ্রেসের এই রাজনৈতিক খসড়া প্রস্তাবনা প্রকাশ করা হল। — সম্পাদকমণ্ডলী)

১) নরেন্দ্র মোদী সরকার এখন আট বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়। মোদী সরকারের প্রথম মেয়াদটি ছিল সেই সময়ের দিনগুলিতে যা ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে এক প্রাথমিক হুঁশিয়ারি, আর দ্বিতীয় মেয়াদটি হল তীব্র গতিতে বেড়ে চলা এক সুসমন্বিত বহুমুখী আক্রমণের সময়কাল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে অজিত ডোভাল — এই জুটির মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্র এক অভূতপূর্বভাবে দমনমূলক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাষ্ট্র হিসেবে উঠে এসেছে। শাসকের ছাড়পত্র ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে উৎসাহিত বিভিন্ন ব্যক্তিগত সেনা ও ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী এবং এক তাণ্ডবকারী রাষ্ট্রের নাগপাশে ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্র আজ ছটফট করছে। জাতীয়তাবাদের নামে নিরবচ্ছিন্ন রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং ‘আভ্যন্তরীণ শত্রু’ তকমা দিয়ে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী রাষ্ট্র-সমর্থিত সন্ত্রাস ও অত্যাচারের এই সমন্বয় ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত। ভারতে এই ফ্যাসিবাদ নিজেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক হিন্দু আধিপত্যবাদ বা ‘হিন্দুত্ব’র ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত জাতীয়তাবাদ হিসেবে তুলে ধরে।

২) আরএসএস বরাবরই আদর্শগতভাবে ফ্যাসিবাদী। ফ্যাসিবাদী এজেন্ডা কার্যকর করার আরএসএসের সক্ষমতা নির্ভর করে কতটা ক্ষমতা সে অর্জন করেছে তার ওপর — রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং রাস্তার ক্ষমতা উভয়ের উপরই। নিরন্তর ঘৃণা, মিথ্যা ও গুজব ছড়ানো এবং মূল মূল প্রতিষ্ঠানগুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ ও ভেতর থেকে তাদের বদলে দেওয়ার নিরলস অভিযান চালিয়ে ওরা ওদের প্রায় এক শতাব্দীর বিগত জীবনজুড়ে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। রাম মন্দির অভিযান ছিল তার উত্থানের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক পর্যায় যা উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। রথযাত্রার উন্মাদনায় চড়ে বিজেপির এই উত্থানকে আমরা সেই সময়েই সঠিকভাবে চিহ্নিত করে বলেছিলাম যে, এটা নিছক সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ বা ধর্মান্ধতা নয় বরং সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ। কারণ আমরা সেই অভিযানকে দেখেছিলাম ভারতের পরিচিতির নতুন সংজ্ঞা নির্মাণের প্রচেষ্টা হিসেবে এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রের কাঠামো খর্ব করার চেষ্টা হিসাবে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে শুরু করে ২০০২ সালে গুজরাটে গোধরা-পরবর্তী গণহত্যা সংগঠিত করা পর্যন্ত এই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ বিস্তার ও প্রভাব তখন প্রত্যক্ষ করেছি আমরা।

৩) এই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ পর্যায়ক্রমিক উন্মাদনা তৈরি করেছিল। আবার, চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে এবং তার স্বরূপ ব্যাপকভাবে উন্মোচিত হয়ে গিয়ে সে পর্যায়ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। গুজরাট ২০০২’র পর ২০০৪ সালে এনডিএ ভারতের ক্ষমতা হারায়। গুজরাট গণহত্যা নরেন্দ্র মোদীকে আন্তর্জাতিক অভিযোগের মুখে দাঁড় করিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল। সেই পরিস্থিতিতে কর্পোরেট ইন্ডিয়া ‘ভাইব্রেন্ট গুজরাট’এর ব্যানার সামনে এনে নরেন্দ্র মোদীর পাশে সমাবেশিত হয়। কর্পোরেট শক্তির এই অনুগত সমর্থন ওদের বিপুল শক্তি যুগিয়ে বিরাট গতি দেয় এবং ২০১৪ সালে সংঘ-বাহিনীর প্রচারাভিযানকে ক্ষমতা হাসিলের দিকে নিয়ে যায়। তারপর থেকে আম্বানি গোষ্ঠী এবং দ্রুত উঠে আসা আদানি গোষ্ঠীর (যার সাথে টাটারাও এগিয়ে আসছে তাদের হারানো জমির অনেক অংশ পুনরুদ্ধার করে) নেতৃত্বে সংঘ বাহিনীর সাথে কর্পোরেট ভারতের জোট আঁটোসাঁটো হতে হতে এখন দেশে তাণ্ডবলীলার বুলডোজারে পরিণত হয়েছে যেখানে কর্পোরেট ভারত বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখার জন্য অর্থ ঢালছে আর বিনিময়ে বিজেপি একের পর এক আইন প্রণয়ন করে সমস্ত সম্পদকে — মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ, সরকারি লগ্নিভাণ্ডার ও সরকারি পরিকাঠামো — গুটিকয় কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিচ্ছে। স্পষ্টতই, কর্পোরেট লুণ্ঠন এবং ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং একে অপরকে পুষ্ট করে চলে।

৪) সঠিকভাবেই আমরা বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের উত্থানের প্রথম সুনির্দিষ্ট লক্ষণ হিসেবে দেখেছিলাম এবং এই ক্রমবর্ধমান হুমকির বিরুদ্ধে একটি টেকসই মতাদর্শগত-রাজনৈতিক প্রচারাভিযান শুরু করেছিলাম। রাঁচি পার্টি কংগ্রেসে আমরা যথাযথ মনোযোগ দিয়েছিলাম, নরেন্দ্র মোদীকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আনার ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট কোলাহলের বিশ্লেষণে; মনোযোগ দিয়েছিলাম কীভাবে এই কর্পোরেট সমর্থনপুষ্ট দুর্নীতি ও বংশ-নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির বিপরীতে বহুপ্রতীক্ষিত সৎ বিকল্প তথা উন্নয়নের প্রতিমূর্তি হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তির নতুন মোড়ক নির্মাণ করে ফ্যাসিবাদকে নতুন নতুন সামাজিক ও ভৌগোলিক পরিসরে ঢুকে পড়ার রাস্তা খুলে দিচ্ছিল। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে আমরা যখন মানসাতে আমাদের দশম পার্টি কংগ্রেস আয়োজন করছি ততদিনে কেন্দ্রে মোদী সরকারের প্রায় চার বছর শাসনের অভিজ্ঞতা আমরা অতিক্রম করে এসেছি। বামপন্থীদের একটি নির্দিষ্ট অংশ সহ ভারতের বেশিরভাগ বিরোধী দল তখন পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে কোনও উদ্বেগজনক বাস্তবতা হিসাবে স্বীকার করেনি, যাকে সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে প্রতিরোধ করাটা দরকার। লাগামহীন ক্রোনি পুঁজিবাদ, তীব্রতর হতে থাকা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং সংবিধানের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণগুলিকে আলাদা আলাদাভাবে স্বীকার করা হলেও এই প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যগুলি যুক্ত হয়ে যে ফ্যাসিবাদের ভারতীয় সংস্করণ প্রসারিত হচ্ছে। তার ক্রমবর্ধমান শক্তি ও নির্বাচনী সাফল্যের সম্প্রসারণ যে ভারতে এক অভূতপূর্ব বিপর্যয় ঘটিয়ে আধুনিক সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে ভারতের ধারণা ও অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে তা তাঁরা চিহ্নিত করতে চাননি। বামপন্থীদের একাংশ ‘কর্তৃত্ববাদ’ শব্দটির বাইরে বেরোতে অস্বীকার করে। আদতে এই শব্দটা দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের হাজির করা বিপদের মাত্রা ও প্রকৃতি মোটেই প্রতিফলিত করা যায় না।

৫) এই মতাদর্শগত বিভ্রান্তি অব্যাহত ছিল এমনকি যখন উত্তর-পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা, উত্তরে উত্তরপ্রদেশ এবং দক্ষিণে কর্ণাটকের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলিকেও বিজেপি পকেটে পুরে ফেলল এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে নেতৃস্থানীয় বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হল আর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার ক্ষমতা দখলের তোড়জোড় শুরু করল তখন পর্যন্ত। কেন্দ্রে বা কিছু রাজ্যে শাসন চালাচ্ছে আবার অন্য কিছু রাজ্যে বিরোধী দল হিসাবে কাজ করছে এমন ‘যেমনটা সবসময় হয়ে আসছে’ তেমন ধারার আর পাঁচটা শাসক শ্রেণীর দলের মতোই একটা দল হিসেবে বিজেপিকে দেখার তীক্ষ্ণ বৈপরীত্যে আমরা আমাদের মানসা কংগ্রেসে মোদী শাসনকে ফ্যাসিবাদী শাসন হিসাবে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করি এবং এই দ্রুত জমাট হতে থাকা ফ্যাসিবাদ ও তার ক্রমবর্ধমান হামলার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধের আহ্বান জানাই। আমরা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ গণসংগ্রামের মাধ্যমে মোদী শাসনের আক্রমণাত্মক বিরোধিতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার উপর এবং বিজেপি-বিরোধী ভোটের বিভাজন আটকাতে বিরোধী দলগুলির মধ্যে ব্যাপক-ভিত্তিক নির্বাচনী সমন্বয়ের সম্ভাবনাগুলি অন্বেষণ করার উপর জোর দিয়েছি। আজ, আমরা এমন এক ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করছি যা হল — আক্রমণাত্মক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদের প্রতি আনুগত্য, সংবিধান ও গণতন্ত্রকে ভেঙে ফেলা, যেকোনো আদর্শিক ভিন্নমতের ওপর লাগাতার নিপীড়ন এবং বিশেষ করে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং দলিতদের ওপর সহিংসতা চালানোর বেসরকারি অধিকার হিন্দু আধিপত্যবাদী সংগঠনগুলির হাতে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি জাতব্যবস্থা ও পিতৃতন্ত্রের বেড়ে চলা আগ্রাসন। মোদী শাসন এবং সংঘ ব্রিগেডের ফ্যাসিবাদী আক্রমণের ক্রমবৃদ্ধির সাথে সাথে একে এক অঘোষিত কিন্তু সর্বব্যাপী ও স্থায়ী জরুরি অবস্থা হিসাবে উপলপব্ধি করার পরিধিও বিস্তৃত হচ্ছে এবং গণবিরোধিতার সম্ভাবনাও বাড়ছে। আমাদের এই সম্ভাবনাকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী প্রতিরোধের শক্তিশালী স্রোতে পরিণত করতে হবে।

৬) একটি তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শগত-রাজনৈতিক প্রবণতা এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলন হিসাবে ফ্যাসিবাদ বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভিত্তি লাভ করতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয় এবং ইউএসএসআর আকারে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল এ বিশ্ব। আর তার পাঁচ বছর পরে ইতালিতে প্রথম ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থানও প্রত্যক্ষ করে দুনিয়া। ইতালির পরে ফ্যাসিবাদ ইউরোপের দুটি প্রধান দেশ স্পেন ও জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করতে সফল হয় এবং সমগ্র ইউরোপ জুড়ে সমাজতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও মানবিক আবেদনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রবণতা হিসাবে ফ্যাসিবাদ আবির্ভূত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ভারতসহ এশিয়ায় এই প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ভারতে ফ্যাসিবাদ অনুরণন তুলেছিল হিন্দুত্বের আদর্শের মধ্যে, যার মূল ভিত্তি ছিল — হিন্দুদের সাথে মুসলিম ‘হানাদারদের’ এক অবিরাম সংঘাত হিসেবে ভারতের ইতিহাসকে ১৮৫৭ পরবর্তীকালের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পুনর্লিখন প্রক্রিয়া এবং আরএসএস সংগঠন।

৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্য শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি বিশ্বব্যাপী সামরিক মহরায় পরিণত হয় যা ইতালি এবং জার্মানির ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটায় এবং ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ও আন্দোলনেকে আন্তর্জাতিক স্তরে পরাজিত ও চরম ধিক্কৃত করে দেয়। ফ্যাসিবাদের এই সামরিক পরাজয় যদিও বিশ্বযুদ্ধের নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও গতিপথের ফসল ছিল, তথাপি ফ্যাসিবাদকে বোঝার এবং প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতাগুলি আজকের ভারতীয় ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় প্রাসঙ্গিক আকর হিসেবে আছে।

৮) ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আলোচনা ১৯২০’র দশকের গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রাধান্য লাভ করেছিল। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিপদের গভীরতা সঠিকভাবে বুঝতে লেগেছিল আরও কিছুটা সময়। আন্তোনিও গ্রামসি ১৯২০ সালে ইতালিতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে পেশ করা প্রতিবেদনে ইতালিতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার উত্থানের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এবং দুই বছর পরে যখন মুসোলিনি বাস্তবে ক্ষমতা দখল করল তখন তিনি এটিকে মোটেই এক ক্ষণস্থায়ী পর্যায় হিসাবে দেখেননি। তবুও, তাঁর প্রাথমিক মূল্যায়নে তিনি ইতালীয় ফ্যাসিবাদকে কৃষিভিত্তিক বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন এবং ভাবতে পারেননি যে শিল্প বুর্জোয়ারাও মুসোলিনির চারপাশে সমাবেশিত হবে। ১৯২৩ সালের জুন মাসে কমিন্টার্নের কার্যনির্বাহী কমিটির তৃতীয় প্লেনামে ক্লারা জেটকিন উপস্থাপিত ফ্যাসিবাদের উপর প্রথম কমিন্টার্ন রিপোর্ট ফ্যাসিবাদের ব্যাপক সামাজিক প্রভাবের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং স্পষ্ট করে যে “কেবলমাত্র সামরিক উপায়ে একে পরাজিত করা যায় না… একদম মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ভাবেও অবশ্যই লড়তে হবে আমাদের”। নির্দিষ্ট পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে প্রতিটি দেশে ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য স্বীকার করে নিয়েও রিপোর্টটি ফ্যাসিবাদের নিম্নলিখিত দুটি অপরিহার্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে : “একটি জাল বিপ্লবী কর্মসূচি, যা অত্যন্ত চতুরতায় ব্যাপক বিস্তৃত সামাজের জনগণের মেজাজ, আগ্রহ ও চাহিদার সাথে নিজেকে যুক্ত করে; এবং নৃশংস ও সহিংস সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করে”।

৯) ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ঐতিহাসিক সপ্তম তথা শেষ কংগ্রেসে এসে অবশেষে এক সার্বিক বিশ্লেষণ ও সিরিয়াস কৌশলগত দিশা উঠে আসে। বুলগেরিয় কমিউনিস্ট নেতা জর্জি দিমিত্রভ, যিনি নাৎসি আদালতে বিখ্যাত লিপজিগ ট্রায়ালে নিজে সওয়াল করে নিজেকে রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগানোর মিথ্যা অভিযোগ থেকে রক্ষা করে বেকসুর খালাস করতে পেরেছিলেন, তাঁর পেশ করা প্রতিবেদনে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকে লগ্নিপুঁজির সবচেয়ে কট্টর সাম্রাজ্যবাদী, সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশের প্রকাশ্য সন্ত্রাসী একনায়কত্ব হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন। তাঁর প্রতিবেদনটি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সতর্ক করে বলেছিল যে, ফ্যাসিবাদী শাসন ক্ষমতাতে আসার বিষয়টিকে একটি বুর্জোয়া সরকার গিয়ে আরেকটি বুর্জোয়া সরকার আসার মতো স্বাভাবিক বিষয় হিসাবে দেখলে খুব ভুল হয়ে যাবে। বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদী ধারণা ও ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানকে উপেক্ষা করার ভুলের বিরুদ্ধেও সতর্ক করেছিল প্রতিবেদনটি। দিমিত্রভের প্রতিবেদনটি ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রাথমিক পর্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং ফ্যাসিবাদের অধীনে রাষ্ট্র ও শাসনের প্রকৃতি কেমন তার উপর বেশি মনোযোগ দিয়েছে। নাৎসি প্রকল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় যে ছিল বিষাক্ত ইহুদি বিদ্বেষ সে সম্পর্কে প্রথম থেকেই সামনে আসা লক্ষণগুলির দিকে তথা আগ্রাসি সমাবেশ ও গণআন্দোলন হিসেবে ফ্যাসিবাদের বিবিধ বৈশিষ্ট্যের দিকে দিমিট্রভের প্রতিবেদনটি যথেষ্ট মনোযোগ দেয়নি।

১০) ১৯৪৫ সালে হিটলারের পরাজয়ের পরই কেবল হলোকাস্টের অত্যাশ্চর্য মাত্রা এবং ভয়াবহতা সম্পর্কে দুনিয়া জানতে পেরেছিল, যে হলোকাস্টে অন্তত ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়। গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে দমন ও বিরোধী কণ্ঠকে নিস্তব্ধ করে দেওয়াটা ‘অভ্যন্তরীণ শত্রুদের’ (ইহুদি, যাযাবর জিপসি, কমিউনিস্ট ও সমকামীরা হল নাৎসি জার্মানিতে রাষ্ট্রের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিতদের অন্যতম) সম্পূর্ণ নিকেশ করে দেওয়ার ভয়ঙ্কর প্রচারণা চালানোর রাস্তা সহজতর করে দিয়েছিল। নাৎসি শাসনে জার্মানির অভিজ্ঞতা ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি করেছিল এবং সারা বিশ্বে ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি পরাজিত ও ধিক্কৃত হয়ে পেছনে চলে গিয়েছিল। ভারতেও, আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রান্তিক শক্তি হিসেবেই ছিল, এবং দেশভাগের দগদগে ক্ষত থেকে যাওয়া সত্ত্বেও, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আরএসএস খুব বেশি জায়গা করতে পারেনি। কারণ, ভারত তার সংসদীয় গণতন্ত্রের নতুন পাওয়া সাংবিধানিক কাঠামো নিয়েই এগোয়। আরএসএস সংবিধান ও জাতীয় পতাকার বিরোধিতা করেছিল, আর গান্ধীহত্যা ছিল সদ্যজাত প্রজাতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করে দেওয়ার এক সুস্পষ্ট প্রচেষ্টা। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডটি আরএসএসকে সাংগঠনিক মতাদর্শগতভাবে বিচ্ছিন্ন ও কুখ্যাত করে তোলে। ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ থেকে জুলাই ১৯৪৯ পর্যন্ত আরএসএসকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল, “ঘৃণা ও অমঙ্গলের যে শক্তিটি জাতিকে বিপন্ন করছে” তা নির্মূল করতে। কিন্তু এখন পিছনে ফিরে তাকালে আমরা স্বাধীনতা-পরবর্তী গভীর বিচ্ছিন্নতার পরবর্তীকালে অনেক ঐতিহাসিক মোড় দেখতে পাই যেখানে রাষ্ট্র ও শাসক কংগ্রেস, আর তার ফলে অন্যান্য অ-বিজেপি ক্ষমতাসীন দলগুলিও, আরএসএস ও তার অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে — ভারতীয় জনসঙ্ঘ ও তার উত্তরসূরী ভারতীয় জনতা পার্টিকে — সকল অপকর্ম তথা মৌলিক সাংবিধানিক নিয়মনীতির চরম লঙ্ঘন সত্ত্বেও, নাদানের মতো ছাড় দিয়ে দিয়ে তাদের বৈধতা ও শক্তি অর্জন করে নাটকীয়ভাবে প্রত্যাবর্তনে সমর্থ করে তুলেছে, বিশেষত অযোধ্যা আন্দোলন ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়পর্ব থেকে।

১১) ১৯২০ ও ১৯৪০’র দশকের মতো ফ্যাসিবাদ এখন আরও একবার একটি আন্তর্জাতিক প্রবণতা হিসাবে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। পূর্ববর্তী শতাব্দীর প্রথমার্ধে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হওয়া মহামন্দার পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট ও হতাশা থেকে উদ্ভুত উগ্র জিগির ও নৈরাজ্যবাদের আবহাওয়ায়। ইউরোপ জুড়ে সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ার ‘বিপদও’ অনেক দেশে বুর্জোয়াদের ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত করেছিল। আজ আবারও বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ গভীর সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে নিমজ্জিত এবং যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদ ঘনীভূতকরণ তথা বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে খর্ব করার মাধ্যমে তারা এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিশ শতকের পর্বের মতোই বর্তমান পর্বেও বিভিন্ন দেশের ফ্যাসিবাদ সেই দেশের সুনির্দিষ্ট জাতীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ি রূপ পরিগ্রহ করতে বাধ্য। ভারতীয় পরিঘটনাটি বিশেষভাবে অনন্য হয়ে উঠেছে এক শতাব্দী ধরে ফ্যাসিবাদী প্রকল্পকে লালন-পালন করে আসা আরএসএস’এর কেন্দ্রীয় ভূমিকার কারণে। ভারতে ফ্যাসিবাদের উত্থান প্রাথমিকভাবে ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিকাশের দ্বারাই চালিত হয়েছে বটে কিন্তু বর্তমান আন্তর্জাতিক আবহ তাকে যথেষ্ট স্ট্র্যাটেজিক সমর্থন ও বৈধতা যোগাচ্ছে।

১২) প্রথমে গণহত্যা এবং বিচারবহির্ভূত সন্ত্রাসের সুব্যবস্থিত ও ব্যাপক প্রয়োগের ভিত্তিতে গুজরাটে ক্ষমতা সুসংহত করে তারপর ২০১৪ সাল থেকে সেই গুজরাট মডেল দেশজুড়ে অনুকরণের নামে, মোদী শাসন গত দুই দশকে যেভাবে বিকশিত হয়েছে তার সাথে নাৎসি জার্মানির সাদৃশ্য কোনোভাবেই দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। মিলগুলি কেবল এই দুই শাসনের বাহ্যত স্পষ্ট হিটলার ও মোদী পার্সোনালিটি কাল্টের বিশিষ্ট ধরনের মধ্যে নয়, বা মিথ্যা প্রপাগাণ্ডার ব্লিটজক্রেগগুলির মধ্যেই নয়, বরং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে আদর্শ, রাজনীতি, আইন ও বিধান প্রণয়নে এই দুটি শাসনের কার্যকরী কাঠামোতে এই মিলগুলি নিহিত। নাৎসি জার্মানির অ্যান্টি-সেমেটিক অভিযান, যা হলোকাস্টের ভয়াবহতা এবং প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি নির্মূলকরণের দিকে পরিচালিত করেছিল, ছিল এক ভয়ঙ্কর প্রচারণার দ্বারা চালিত। এবং কুখ্যাত নুরেমবার্গ আইনের মতো নির্দিষ্ট নিশানায় আনা আইন জার্মান ইহুদিদের বহু অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের আইনগতভাবে ও সামাজিকভাবে দুর্বল অবস্থায় ফেলে দিয়ে জার্মান রাষ্ট্র ও হানাদার স্কোয়াড পরিচালিত নৃশংস আক্রমণ ও গণহত্যার শিকার বানিয়েছিল। এদেশেও আমরা একইরকম পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া গড়ে উঠতে দেখতে পাচ্ছি যা বেশ কয়েকটি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আইন এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায়কে নিশানা বানাচ্ছে তাঁদের জীবিকা (যেমন গবাদি পশুর ব্যবসা এবং মাংসের দোকানের ওপর নিষেধাজ্ঞা), ধর্মীয় স্বাধীনতা (ধর্মান্তরকরণ, মসজিদ ভেঙে ফেলা, হিজাব নিষিদ্ধকরণ, অন্য ধর্মে বিবাহকে অপরাধ হিসেবে চহ্নতকরণ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড, সর্বজনীন স্থানে প্রার্থনার উপর নিষেধাজ্ঞা), থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব (সিএএ স্পষ্টভাবে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য করে) ও অস্তিত্বের মৌলিক নিরাপত্তা (মুসলিমদের ঘরবাড়ি বুলডোজিং, মব-লিঞ্চিং, স্থানীয় মাত্রায় সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ঘটনার মধ্যে গণহত্যার উন্মুক্ত আহ্বান) সহ সমস্ত অধিকারের ওপর আক্রমণ চালিয়ে।

১৩) উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও, এখনও সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের অধীনে থেকে যাওয়া একটি পূর্ব-উপনিবেশ দেশের ফ্যাসিবাদ অনিবার্যভাবেই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ফ্যাসিবাদের তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হবে। বিশেষত আমাদের দেশের জনগণ বিশ্বপুঁজির দ্বারা এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত দেশীয় বিলিয়নেয়ার পুঁজিপতিদের দ্বারা অনবরত লুণ্ঠিত হচ্ছে। তাই এদেশে, ইউরোপের ফ্যাসিবাদের অভিজ্ঞতার বিপরীতে, যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে জাতির প্রধান অধিকারী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে তাদেরও কিন্তু বাস্তবে কোনও অর্থনৈতিক লাভের আশাই নেই। পরিবর্তে তাদের প্রতিদিন গিলতে হবে জাতির অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসাবে দেগে দেওয়া জনগণের ওপর চলা ক্রমবর্ধমান জিঘাংসার বীভৎসতা। তদুপরি, ফ্যাসিবাদের বর্তমান পর্যায়টি বিশ্বব্যাপী নব্য উদারনীতিবাদের প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হয়েছে যেখানে পুঁজি আক্রমণাত্মক এবং একের পর এক সঙ্কটের সম্মুখীন, যেখানে শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যা কিছু অর্জিত হয়েছিল সে সবই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং জনসাধারণের এক্তিয়ারে যেটুকু সম্পদ বেঁচেবর্তে ছিল সেগুলিও দখল করে নেওয়া হচ্ছে বেসরকারিকরণ, জমিগ্রাস ও পরিবেশ ধ্বংসের ব্যাপক বিধ্বংসী অভিযান চালিয়ে। এই ধরণের বিধ্বংসী অভিযান মোদীর ফ্যাসিবাদী শাসনের জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র হয়ে ওঠে, যে শাসন এইসব বিধ্বংসী প্রক্রিয়াগুলিকে আরও জোরালো গতি দেয়। এবং এই অভিযান মোদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় স্তরে আন্তর্জাতিক বিরোধিতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকেও অসম্ভব করে তোলে। ২০০২ সালের গণহত্যার পরে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদী আন্তর্জাতিক ময়দানে যৎসামান্য যেটুকু নিন্দার সম্মুখীন হয়েছিল তা এখন বদলে গেছে আন্তর্জাতিক ক্ষমতাতন্ত্র দ্বারা সহযোগিতা ও বৈধতা প্রদানের পথে।

১৪) ফ্যাসিবাদ কোন এক অভ্যন্তরীণ শত্রু খাড়া করে সেই শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যাপক উন্মাদনা জাগিয়ে তোলে; তাদের রাষ্ট্র, জাতি, সভ্যতা, সংস্কৃতি এমনকি জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যেরও সাধারণ শত্রু হিসেবে খাড়া করে এই উন্মাদনা জাগানো হয়। সেই লক্ষ্যে নিজেদেরকে একইসাথে ‘লাঞ্ছিত ও আক্রান্ত’ হিসেবে, আবার ‘গর্বিত ও প্রভুত্বকারী’ হিসেবে দাবি করে হট্টগোল ফেলে দেওয়া হয়। ক্রমাগত এক অতীত স্বর্ণযুগের কিংবদন্তী ও এক ভবিষ্যৎ স্বর্গসুখের আকাশকুসুম ফেরি করে চলা হয়। আজকের ভারতে এগুলো খুব সুপরিকল্পিত দক্ষতায় ঘটাতে দেখতে পাচ্ছি আমরা। সংঘ পরিবার মিথ্যা ইতিহাসকে প্রোমোট করে চলে বৈদিক যুগকে জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখর হিসাবে নিরন্তর মহিমান্বিত করে তুলতে এবং ভারতকে একটি সাংবিধানিক সাধারণতন্ত্রের বদলে ‘সভ্যতার সত্তা’ হিসাবে বেশি প্রজেক্ট করে। এবং ভারতকে শুধু আজকের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্যন্তই নয়, এমনকি পশ্চিমে আফগানিস্তান, দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা, উত্তরে তিব্বত, নেপাল ও ভুটান এবং পূর্বে মায়ানমার পর্যন্ত প্রসারিত এক ‘অখণ্ড ভারতে’ রূপান্তরিত করা এবং মোদীর ভাষায় যা ‘বিশ্বগুরু’ সেই সুপার পাওয়ার বানানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। হিটলার ফ্যাসিবাদকে ‘জাতীয় সমাজতন্ত্রের’ মডেল হিসাবে উপস্থাপন করার জন্য সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয় আবেদনকে ব্যবহার করে নিয়েছিলেন। আরএসএস এবং বিজেপি স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার মহান আবেদনকে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদকে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার একটি নতুন স্তর হিসাবে উপস্থাপন করছে। বিজেপির ‘আত্মনির্ভর ভারত’ বাগাড়ম্বরটিতে অবশ্য কোনও স্বদেশী অন্তর্বস্তু নেই, এটা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র নামে ভারতকে বিশ্বপুঁজির কাছে ভাড়া খাটাতে চায় মাত্র।

১৫) একইভাবে এরা উপনিবেশ-বিরোধী বাচনকে কর্পোরেট আধিপত্য বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নয় বরং ভারতের নিজস্ব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। ইসলাম-ভীতির বর্তমান বিশ্বের আবহের সাথে জুড়ে দিয়ে হিন্দুদের মনে মিথ্যা আতঙ্ক তৈরি করা হয় যে মুসলিম জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, অভিবাসন এবং অনুপ্রবেশের ফলে হিন্দুরা ভারতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। জার্মানির নাৎসি মডেল চেয়েছিল জাতিগতভাবে বিশুদ্ধ এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে, একটি জাতিগত সুখস্বপ্ন চাগিয়ে দিতে। তা করতে তারা দ্বিমুখি পদ্ধতি নিয়েছিল। একদিকে জিনগতভাবে রোগাক্রান্ত আর প্রতিবন্ধী তকমা দেওয়া মানুষ থেকে জার্মান জাতির নিষ্কৃতির লক্ষ্যে সুব্যবস্থিত গণহত্যা, গণনির্বীজকরণ ও ইউথানাশিয়ার (ব্যথাহীন মৃত্যু) মাধ্যমে কিছু জাতিকে একেবারে মুছে ফেলা এবং অন্যদিকে জার্মান জাতির তথাকথিত ‘জীনগত উন্নয়ন’ ঘটাতে এমনকি মানব প্রজনন প্রকৌশল (ইউজেনিক) প্রণয়ন। আজ ভারতেও অনুরূপ পরিকল্পিত গণহত্যা সংগঠিত করার, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানানোর ও নির্বীজকরণের রাষ্ট্র-অনুমোদীত আহ্বান নিয়মিত শোনা যাচ্ছে এবং এগুলো যে শীঘ্রই বাস্তবে পরিণত হতে পারে সেরকম ভয়ানক সংকেতও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মোদীর অধীনে ভারত নাৎসি জার্মানি ছাড়াও ইসরায়েলি মডেল থেকেও বহু কিছু নিচ্ছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নীতি ইসরায়েলের সামরিক মতবাদ এবং নজরদারি কৌশলগুলিকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে অনুকরণ করে এবং হিন্দুত্ব মতবাদ ইসরায়েলের ইহুদিবাদী আগ্রাসনের নীতির সাথে ঘনিষ্ঠ আদর্শগত সাদৃশ্য প্রদর্শন করে। ইসরায়েল যেমন তার ফিলিস্তিন-বিরোধী নীতির প্রতিটি সমালোচনার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার জন্য ইহুদি-বিদ্বেষের পুরনো ইতিহাসকে টেনে আনে, তেমনি মোদী শাসন এবং আরএসএস ‘হিন্দুফোবিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করেছে এবং সংঘ-ব্রিগেডের হিন্দু আধিপত্যবাদী প্রচারণার যেকোনও বিরোধিতাকে দমন করতে হিন্দু-বিদ্বেষের অভিযোগ আনতে শুরু করেছে।

১৬) ভয় এবং ঘৃণা, শিকার এবং শিকারির এই সমন্বয়কে ঘিরে জনমত তৈরি করার এক ব্যাপক বিস্তৃত কৌশল অনুসরণ করে সংঘ-বিজেপি বাহিনী। একদম শুরু থেকেই মোদী নিজেকে প্রতিষ্ঠা-বিরোধী ধর্মযোদ্ধা হিসাবে বিপণন করে এসেছেন, বঞ্চনা ও নিপীড়নে আরও অবনতির মুখে পড়া দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের বিশাল অংশের মধ্যে এক ক্ষোভের অনুভূতি জাগিয়ে। ভারতে দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনের সাথে বর্তমান স্থিতাবস্থার সমস্ত মন্দ দিককে তিনি অত্যন্ত চতুরতার সাথে যুক্ত করতে পেরেছেন, এবং আরও এগিয়ে, এই দীর্ঘ শাসনকে দুর্নীতি ও রাজবংশের রাজনীতির সাথে একাকার করে দেখিয়েছেন। ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’এর আহ্বান এই প্রতিষ্ঠা-বিরোধী মেজাজে ধরা দেয় এবং, এমনকি কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করার পরেও, তিনি লুটিয়েন দিল্লীর বিরুদ্ধে তাঁর কটাক্ষ বজায় রাখতে পারেন। যদিও তাঁর অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলি ক্রমশই জুমলা বা বাগাড়ম্বর হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠাতন্ত্রের চরিত্র নির্লজ্জ সাঁটগাঁট পুঁজিবাদ ও সংঘের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য রোপে ক্রমাগত স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে, তথাপি সমস্ত শ্রেণী ও স্তরের জনগণের এক উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও তাঁর এই প্রতিষ্ঠা-বিরোধী আবেদনে রোমাঞ্চিত।

১৭) ভায়োলেন্সে রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকারকে বেসরকারী ও বিচার বহির্ভূত ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর হাতে তুলে দিতে সংঘ-বিজেপির স্ট্র্যাটেজির কেন্দ্রে রয়েছে নেতার এই আবেদন। ইসলামোফোবিয়াকে, যা ভারতীয় মুসলমানদের এক ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ হিসাবে ক্রমাগত অপরায়নে ফ্যাসিবাদীদের ইন্ধন জোগায়, আরও শক্তিশালী ও দৃঢ়বদ্ধ করার চেষ্টা চলে সংঘ পরিবারের নতুন-আবিষ্কৃত কৌশল ‘সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং’এর মাধ্যমে। বিভিন্ন রাজ্যে প্রভাবশালী জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সামাজিক জোট গড়ে সংঘ ‘পিছড়ে বর্গ’র ভেক ধারণ করে নিজেদের মনুবাদী চেহারা মুখোশের আড়ালে নিয়ে যায়। ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট থেকে আসা একজন প্রধানমন্ত্রী, বা দলিত ও আদিবাসী পৃষ্ঠভূমি থেকে আসা রাষ্ট্রপতিরা আরএসএস-এর ব্রাহ্মণ্যবাদী অন্তর্বস্তুকে আড়াল করার লক্ষ্যে আজকের বিজেপির প্রচারের প্রধান ঘুঁটি হয়ে উঠেছে। সংঘ-বিজেপির বয়ান সদাসর্বদা সংবিধান, সুপ্রিম কোর্ট, আধুনিক ভারতের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং বুদ্ধিজীবীদের, বিশেষত একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের সমালোচক ধারাগুলিকে পশ্চিমা-প্রভাবিত এবং উচ্চকোটিবাদী বলে সমালোচনা করে আর নরেন্দ্র মোদী ও তার শাসনকে প্রতিষ্ঠা-বিরোধী চ্যালেঞ্জার হিসাবে প্রজেক্ট করে। ওরা বেশিরভাগ বিরোধী দলকে বংশ ও পরিবার-পরিচালিত উদ্যোগ হিসাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করে, কিন্তু মোদী সরকারের বিপুল ব্যায়ের নিজস্ব মডেলটা প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের সাম্রাজ্যের আদলেই তৈরি করা হচ্ছে যেখানে তাঁর ক্ষমতার কার্যকালকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে নিরন্তর দাম্ভিক নির্মাণ চলছে একের পর এক স্মারকের — নতুন পার্লামেন্ট ভবন থেকে শুরু করে একগুচ্ছ মূর্তি আর মন্দির।

১৮) ভারতের শাসনব্যবস্থার মডেলের মধ্যে থেকে যাওয়া ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার এবং ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দুর্বলতার মধ্য থেকেও ভারতীয় ফ্যাসিবাদ শক্তি আহরণ করে। ভগৎ সিং ঔপনিবেশিক যুগের সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তার কথা জোরের সাথে তুলে ধরেছিলেন। তিনি জনপ্রিয় ভাষায় বলেছিলেন যে, স্বাধীনতার অর্থ কখনই সাদা ইংরেজদের হাত থেকে বাদামী সাহেবদের হাতে ক্ষমতা যাওয়া হতে পারে না। ১৯৮০’র দশকের শেষভাগ থেকে বিজেপির চমকপ্রদ উত্থানের আগে কংগ্রেসের দীর্ঘায়িত শাসন ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির দুর্বলতার বিষয়টিকে সুরাহা করেনি, বিপরীতে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি করার সাংবিধানিক বিধানটি ব্যবহার করেছিলেন গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্থগিত রাখার উদ্দেশ্যে।

১৯) জরুরি অবস্থা স্বৈরাচারী শাসনের একটি ছাঁদ সরবরাহ করেছে যা মোদী সরকার তার ফ্যাসিবাদী সাধনায় নিখুঁত করে গড়ে তুলছে। এই ছাঁদ ভারতের বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা তথা আধিপত্য বিস্তারকারী কার্যনির্বাহী বিভাগের কাছে তার আত্মসমর্পণ করার প্রবণতাকে দেখিয়ে দিয়েছে। এই লীড অনুসরণ করে মোদী সরকার বিচারব্যবস্থার উপর সুব্যবস্থিতভাবে তার থাবা জোরালো করেছে এবং সমস্ত স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপ ও সংবিধানের চরম উল্লঙ্ঘনে বিচার বিভাগীয় অনুমোদন হাসিল করেছে। জরুরি অবস্থার সময়েও সংবাদ স্বাধীনতার চেতনা যথেষ্ট মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছিল, এবং সংবাদ মাধ্যমকে অনুগত রাখতে স্বৈরাচারী শাসককে প্রেস সেন্সরশিপ আরোপ করতে হয়েছিল। এরফলে অবশ্য জনরোষ আরোই বৃদ্ধি পেয়েছিল। আজ শাসকের অনুগত কর্পোরেট স্যাঙাতদের পূর্ণ সমর্থনে — যারা আজকের মূলধারার মিডিয়ার বৃহৎ অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলিকে — মোদী সরকার ও আরএসএস মিডিয়ার মৌলিক চরিত্রকেই বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং মিডিয়াকে সংকুচিত করে যেখানে এনে ফেলেছে তাকে জনপ্রিয় ভাষায় বলে ‘গোদি মিডিয়া’ বা ল্যাপডগ/এমবেডেড মিডিয়া। আর যেসব সাংবাদিক নিজেদের যথাযথভাবে কর্তব্য করে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়, এমনকি হত্যাও করা হয়।

২০) দেশের সামনে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ থ্রেটের ধূয়ো তুলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্ট কর্তৃক ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭১ সালের নির্বাচনে জেতা পদকে বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করাকেই, যে রায় সুপ্রিম কোর্ট দ্বারাও বহাল ছিল, এই থ্রেটের সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল। সেই সময় সরকারের সাথে দেশকে একাকার করার যুক্তি এবং সেই যুক্তিতে সরকার-বিরোধিতাকে দেশবিরোধী কাজ হিসেবে চিহ্নিত করাটাই ছিল জরুরি অবস্থার মূল কথা। জরুরি অবস্থা জারি করার সাথে সাথে প্রায় সমস্ত বিশিষ্ট বিরোধী নেতাকে এইভাবে জেলে পাঠানো হয়েছিল এবং নীতি প্রণয়ন ও তার প্রয়োগের মাধ্যমে অবাধে দেশ পরিচালনার জন্য সরকারকে সুযোগ করে দিতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা স্থগিত করা হয়েছিল। মোদী সরকার সেই যুক্তি ও ব্যাখ্যাকে প্রসারিত করেছে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও ইসলামোফোবিয়ার হাতিয়ার শানিয়ে। এখন মোদী সরকারের বিরোধিতা মানে তা একইসাথে ভারত-বিরোধী ও হিন্দু-বিরোধী হিসাবে ব্যাখ্যা হচ্ছে, আর কঠোর আইন, মিথ্যা মামলা, গালাগাল বাহিনী ও লিঞ্চিং স্কোয়াডে সুসজ্জিত সংঘব্রিগেড যে কোনও বিরোধিতাকে নিস্তব্ধ করে দিতে এক পূর্ণাঙ্গ মেসিনারি তৈরি করেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি নজরদারি ব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণ সহজতর করে এবং এই প্রযুক্তি ভিন্নমত পোষণকারী ও মানবাধিকার রক্ষকদের মিথ্যা দোষারোপ করার পাশাপাশি দরিদ্র ও প্রান্তিকদের সম্পদের নাগাল থেকে বাদ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়।

২১) জরুরি অবস্থা-পরবর্তী সময়ে মন্ডল কমিশনের সুপারিশের আংশিক প্রয়োগ এবং পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের কিছুটা সম্প্রসারণ প্রত্যক্ষ করা যায়। কিন্তু ১৯৯০’র দশকের গোড়ার দিকে নব্য-উদারনীতির কাঠামো গ্রহণের ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আবার বাড়তে শুরু করে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি ক্রমাগত ক্ষয়ের শিকার হয়। জমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ জোরপূর্বক অধিগ্রহণ এবং আদিবাসী ও কৃষকদের বাস্তুচ্যুত করা ও মাওবাদী তকমা দিয়ে অত্যাচার চালানো ওড়িশা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ডের মতো সম্পদ-সমৃদ্ধ অঞ্চলে দৈনন্দিন বিষয় হয়ে ওঠে। মোদী শাসন এই নয়া-উদারনীতিকে আক্রমণাত্মক আগ্রাসনের এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছে যার ফলে ব্যাপক বিস্থাপন ও অভূতপূর্ব মাত্রার বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্রমশ গভীর হওয়া আর্থিক দুরবস্থা ও অনিশ্চয়তায় জনগণ যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেও সংঘ বাহিনী জনগণের মরিয়া অবস্থাকেই হাতিয়ার বানিয়ে তাদের ক্ষোভকে সর্বগ্রাসী বিদ্বেষ অভিযানে ভাসিয়ে নিয়ে বিপথে চালিত করে। সংঘের প্রচারণা সমাজের গভীরে প্রোথিত নিয়তিবাদ ও অস্পষ্টতাবাদকে সুনিপুণভাবে ব্যবহার করে যাতে সমস্ত দুর্দশার জন্য জনগণ বর্তমান সরকার বাদে আর সবকিছুকেই দায়ি ও দোষারোপ করতে থাকে, আর কল্পিত এক হুমকির মুখে হিন্দু পরিচিতি রক্ষা করা ও হিন্দু আধিপত্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে মোদী সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে তুলে ধরে যার সামনে অন্য সব ইস্যু তুচ্ছ হয়ে যায়।

২২) ফ্যাসিবাদী বিপর্যয় ও ধ্বংসের এই আবর্ত থেকে ভারতকে বাঁচানো আজ বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই কর্তব্য অবশ্যই সকল ধারার গণতান্ত্রিক শক্তি ও আদর্শের মধ্যে যতটা সম্ভব ব্যাপকতম ঐক্য ও সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। সংবিধান ও স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকার রক্ষা করার এবং দেশ ও দেশের সম্পদ ও অবকাঠামোকে সরাসরি কর্পোরেট গ্রাসে চলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর আহ্বান হিসেবে ভারতে এই ঐক্য জনপ্রিয়ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সংবিধানকে সুরক্ষিত করতে এবং বেসরকারীকরণকে প্রতিহত করতে এক শক্তিশালী আন্দোলন উঠে এসেছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং কৃষি অর্থনীতি কর্পোরেট কোম্পানিগুলির কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে মোদী সরকারের চালের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় রূপে ও অভূতপূর্ব মাত্রায় এই একতা ও সংকল্প প্রতিফলিত হয়েছে। যে সাহসের সাথে নাগরিক সমাজের কর্মীরা ফ্যাসিবাদী শাসনের নিপীড়ন মোকাবিলা করছে আর যে ঐক্য ও দৃঢ়তা চলমান আন্দোলনগুলি প্রদর্শন করছে, বিপ্লবী কমিউনিস্টদেরকে সেই সাহস ও দৃঢ়তা একসাথে জুড়ে দেশের বিরোধীপক্ষকে শক্তি জোগানোর কাজ করতে হবে এবং সমস্ত ফ্রন্টে প্রতিরোধ জোরদার করতে হবে। নাগরিক সমাজ ও জনগণের আন্দোলনের তুলনায় বুর্জোয়া বিরোধীরা ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মুখে সাধারণত অনেকাংশে দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছে, বিশেষত অর্থলোভ এবং ব্ল্যাকমেল ও প্রতিহিংসার ভয়ের কারণে। ভারতের রাজনীতির মানচিত্রের বৈচিত্র্য এবং জটিলতা, কংগ্রেসের ক্রমাগত পতন, সর্বভারতীয় উপস্থিতি নিয়ে অন্য কোনও শক্তিশালী দলের উঠে না আসা — এইসবই বর্তমান সন্ধিক্ষণে বিজেপির জন্য সর্বভারতীয় স্তরে সহজ ময়দান যোগাচ্ছে। বিজেপি অবশ্যই বর্তমান পর্বের সবচেয়ে প্রাধান্যকারী দল, কিন্তু তারা যে মোটেই নির্বাচনে অজেয় বা অপ্রতিরোধ্য নয় তা বেশ কয়েকটি রাজ্যেই দেখা গেছে। আসন্ন নির্বাচনী লড়াইয়ে বিজেপিকে দুর্বল করতে এবং মোদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সর্বভারতীয় স্তরে এবং প্রধান প্রধান রাজ্যগুলিতে একটি গতিশীল ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বিরোধীপক্ষ গঠন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ভারত যখন ১৯৭৭ সালে স্বৈরাচারী ইন্দিরা শাসনকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল তখন জরুরি অবস্থা অলরেডি প্রত্যাহৃত হয়েছে। আর এখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার মধ্যে। ফলত ১৯৭৭’র তুলনায় ২০২৪ হবে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

২৩) এ’কথাও আমাদের হিসাবে রাখতে হবে যে বর্তমানে ভারতে যে বিরোধী ঐক্য গড়ে উঠছে তা এখনও কোনও সাধারণ ফ্যাসি-বিরোধী চেতনা বা প্রতিশ্রুতি দ্বারা নির্ধারিত নয়। যদিও বর্তমান শাসন আরএসএস’এর সংগঠনজাল থেকেই তার মূল শক্তি আহরণ করেছে তবু অনেক বিরোধী দল আরএসএস’এর বিরোধিতা করতে এবং এর বিবিধ ঘৃণা, মিথ্যা ও সন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর অভিযানকে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত নয়। অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে নয়া উদার আর্থিক নীতিমালা ও মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে এক বিস্তৃত ঐকমত্য রয়েছে। ভিন্ন মত পোষণকারী নাগরিক ও জনআন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থিতভাবে কঠোর আইন প্রয়োগ, রাষ্ট্রীয় দমন ও নিপীড়ণের প্রশ্নটিও বিরোধী ঐক্যের এজেণ্ডায় দৃষ্টিকটুভাবে উপেক্ষিত থেকে যায়। বিরোধী দলগুলির যততা সম্ভব সার্বিক ঐক্যকে স্বাগত জানানো, সহযোগিতা করা এবং যোগদান করার সাথে সাথে কমিউনিস্টদের অবশ্যই রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত স্বাধীনতা সম্পূর্ণত বজায় রাখতে ও প্রয়োগ করতে হবে যাতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ও কার্যকর প্রতিরোধ জারি রাখা যায়।

২৪) আমাদের তাই এ’কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে কেবল মোদী সরকারকে ভোটে হারিয়েই ফ্যাসিবাদকে নির্ধারকভাবে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। সংঘ বাহিনী ইতিমধ্যে যথেষ্ট ক্ষমতা অর্জন করেছে, একটি দুটি নির্বাচনে পরাস্ত হওয়াকে তারা ঠিক হজম করে নিতে পারবে। যা প্রয়োজন তা হল ফ্যাসিবাদের মতাদর্শ ও রাজনীতির এক জোরদার প্রত্যাখ্যান গড়ে তোলা যা একে আরেকবার ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজের প্রান্তে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে। যদিও নরেন্দ্র মোদী স্পষ্টতই এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছেন, বর্তমানে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপির ভোটও অনেকাংশে তিনিই ধরে রেখেছেন, এবং মোদী পার্সোনালিটি কাল্ট সংঘের আস্তাবলের অন্যান্য নেতাদের খাটো করে দিয়েছে, তথাপি এটাও লক্ষ্যণীয় যে সংঘ কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সব পর্বেই নেতৃত্বের এক লম্বা সারি যোগান দিয়ে গেছে। অবিচল গণতন্ত্র ও আমূল সামাজিক রূপান্তরের অগ্রবাহিনী হিসাবে কমিউনিস্টদের তাই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের উপযুক্ত জবাব দিতে এক দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বাত্মক প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আম্বেদকর সংবিধানকে একটি অগণতান্ত্রিক মাটির ওপর গণতন্ত্রের প্রলেপ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি জাতবর্ণ ব্যবস্থাকে আধুনিক ভারতের সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং সামাজিক সাম্য ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য এর সম্পূর্ণ বিনাশের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই কারণেই তিনি হিন্দুরাষ্ট্রকে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে বর্ণনা করেছিলেন যা থেকে ভারতকে রক্ষা করতে হবে। ভারতের নিপীড়নমূলক সামাজিক কাঠামোর মধ্যে নিহিত সবচেয়ে পশ্চাদপদ ধারণা, পশ্চাদপদ দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুশীলনগুলি, বিশেষত গভীরে প্রবিষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণপ্রথা ও পিতৃতন্ত্র ফ্যাসিবাদী আক্রমণে নিরন্তর ইন্ধন যুগিয়ে চলে এবং এই গণতন্ত্র-বিরোধী পরিবেশে তারা নতুন শক্তি ও বৈধতা লাভ করে। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে কমিউনিস্টদের অবশ্যই ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিটি প্রগতিশীল এবং পরিবর্তনকামী ধারাকে, বিশেষ করে জাতবর্ণ-বিরোধী ও পিতৃতন্ত্র-বিরোধী শক্তিশালী সংগ্রামগুলিকে, এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং ভারতীয় সমাজ ও ইতিহাসে সাম্য, যুক্তি ও বহুত্বের অনুসন্ধান করতে হবে।

২৫) ফ্যাসিবাদকে যদি এক বিরাট বিপর্যয়ের গাড্ডা হিসাবে দেখা হয়, যে গাড্ডায় ভারত পড়েছে, তাহলে অবশ্যই সেই গাড্ডা থেকে উদ্ধার করা এবং বিপর্যয়, ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পুনর্গঠন করা উভয়ই ফ্যাসি-বিরোধী প্রতিরোধের লক্ষ্য হতে হবে। ভারতের জাতি-নির্মাণ প্রক্রিয়ার দুর্বলতা ও অসঙ্গতি, সামন্তবাদী অবশেষ ও ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার এবং সাম্রাজ্যবাদী নক্সার সঙ্গে ভারতের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আপোশ ও যোগসাজশ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে ক্ষমতা দখল করতে এবং হিন্দুত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে পুনঃসংজ্ঞায়িত ও ভারতের শাসন ব্যবস্থাকে পুনর্নির্মিত করতে সক্ষম করে তুলেছে। আইনের শাসনের মূল বিষয়গুলি ইতিমধ্যেই একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে এবং এই ফ্যাসিবাদী শাসনের দীর্ঘায়িতকরণ এবং আরও গভীর শেকড় বিস্তার আধুনিক ভারতের সাংবিধানিক দিশা ও কাঠামোকেই বিপথগামী করবে। ফ্যাসিবাদের কবল থেকে ভারতকে উদ্ধার করতে এবং ভারতীয় জনগণের সমস্ত অংশের পূর্ণ সামাজিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিশ্চিত করে শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ভারতকে পুনর্গঠনের এক দীর্ঘ, ব্যাপকবিস্তৃত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিরোধের জন্য বিপ্লবী কমিউনিস্টদের অবশ্যই প্রস্তুত হতে হবে। সংবিধান বাঁচানোর শ্লোগানকে একটি প্রতিরক্ষামূলক স্লোগান বা স্থিতাবস্থার সমর্থন হিসাবে দেখা ঠিক হবে না। এই শ্লোগানের অর্থ হল সংবিধানের প্রস্তাবনায় দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলিকে বাস্তবায়িত করা। সেখানে ভারতকে একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং সমস্ত নাগরিককে স্বাধীনতা, সাম্য ও সংহতি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিসরে ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যখন ফ্যাসিবাদ ভারতকে ধ্বংস করার এবং আমাদের পিছন দিকে ঠেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী বিজয়ী প্রতিরোধ প্রজাতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করবে, জনগণের শক্তি ও উদ্যমকে অবারিত করে দেবে এবং ভারতকে বদলে দেবে এক অবিচল গণতন্ত্র তথা জনগণের ব্যাপকবিস্তৃত অধিকারের ঘাঁটিতে।

প্রিয় সাথী,

আমাদের পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী) আগামী ১৫-২০ ফেব্রুয়ারি সংগঠিত করতে চলেছে একাদশতম মহাসম্মেলন। সারা ভারত থেকে প্রায় হাজার দুয়েক প্রতিনিধি-পর্যবেক্ষক-অতিথির উপস্থিতিতে সংগঠিত হতে চলেছে এই মহাসম্মেলন। বিদেশ থেকেও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের প্রতিনিধিরা যোগ দেবেন।

আমাদের দেশ আজ বিরাট এক বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে। এই বিপন্ন সময়ে মোদী-শাহের আগ্রাসী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নীতিনিষ্ঠভাবে সর্বাত্মক প্রতিরোধের কৌশল তৈরি করতেই এই মহাসম্মেলন।

প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে আপনার কাছে আবেদন — এই কর্মকাণ্ডের পাশে দাঁড়ান, বাড়িয়ে দিন সাহায্য সহযোগিতার হাত। আপনার কোনও সাহায্যই ক্ষুদ্রে নয়, কোন সাহায্যই প্রয়োজনের অধিক নয়।

আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পাটনার গান্ধী ময়দানের মহতী সমাবেশে, ১৬ ফেব্রুয়ারি শ্রীকৃষ্ণ মোমোরিয়াল সভাঘরে প্রকাশ্য অধিবেশনে আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমাদের পাশে আপনার উজ্জ্বল উপস্থিতি এগিয়ে চলার পথকেই আরও প্রশস্ত করবে।

অভিনন্দন সহ      
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন      
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি

শাসক যদি হয় তালিবান, তবে নারীর অধিকারের বিপর্যয় অবশ্যই হবে এক অবিসংবাদী বাস্তবতা। সংশোধিত বা যুক্তির বলে নিয়ন্ত্রিত তালিবান আর সোনার পাথরবাটি একই ব্যাপার। এর আগের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবান জমানা নারী দমনকে যেমন তাদের মার্কামারা বৈশিষ্ট্য করে তুলেছিল, সেই স্বরূপকেই পুনরুজ্জীবিত করে তুলে নারীদের স্বাধীনতায়, তাদের অধিকারে, তাদের চলাফেরায় লাগাম পরাতে আবার তারা উঠেপড়ে লেগেছে। সম্প্রতি তালিবান সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রক এক নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছে যে, আফগান নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ। অর্থাৎ, তালিবান সরকারের বোধ এই যে, উচ্চশিক্ষা নারীদের পক্ষে এক অনাবশ্যক বিষয়। গত ২০ ডিসেম্বর ২০২২ তালিবান সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী নেদা মহম্মদ নাদিমের স্বাক্ষর করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হল, “পুনরায় বিজ্ঞপ্তি না দেওয়া পর্যন্ত নারীদের শিক্ষা মুলতুবি রাখার উল্লিখিত নির্দেশটি রূপায়ণের জন্য সকলকে জানানো হচ্ছে”। অথচ, তিনমাস আগেই অসংখ্য মেয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসেছিল, যারমধ্যে ধরা পড়েছিল শিক্ষায় আরো এগিয়ে যাওয়ার সংকেত। আফগান মেয়েদের পড়াশোনায় এই আগ্রহ, সামাজিক স্তরে উত্তরণের স্বপ্নকে সফল করতে শিক্ষাকে ভিত্তি করার এই উদ্যমই বোধকরি তালিবানি শাসকদের বিচলিত করে থাকবে। আর তাই পোশাক বিধি না মেনে মেয়েদের শিক্ষায়তনে যাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে জারি হল এই নিষেধাজ্ঞা, যদিও তা যে একটা ওজর মাত্র তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। তালিবানি জমানায় পছন্দের পোশাক পরার স্বাধীনতা মেয়েরা আগের তালিবানি জমানাতেও ভোগ করত না, আর তালিবান শাসকরা প্রশস্ত চিত্ত হয়ে তাদের দ্বিতীয় জমানাতেও মেয়েদের সে অধিকার দেয়নি। মেয়েদের কখনই পুরুষদের সমান হতে না দেওয়া, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখার দুরভিসন্ধি থেকেই তাদের উচ্চশিক্ষার ওপর এই তালিবানি কোপ।

একটু পিছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে আফগান সমাজে মেয়েরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করত, কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরে তাদের প্রভূত সক্রিয়তা ছিল, সমাজের এগিয়ে চলায় তাদের অবদান কম ছিল না। তালিবানরা ১৯৯৬ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় বসার আগে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬০ শতাংশই ছিলেন মহিলা। সমগ্ৰ স্কুল শিক্ষকদের ৭০ শতাংশও মহিলা বলে দেখা গিয়েছিল, সরকারি চাকুরেদের এক বড় অংশ, ৫০ শতাংশও ছিলেন মহিলা, আর ডাক্তারদের মধ্যেও মহিলারা ছিলেন ৪০ শতাংশের। বিদ্যালয়ে ২০০০ সালে পড়তে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যা যেখানে ছিল এক লক্ষর আশেপাশে, সেই সংখ্যাই দেড় বছর পূর্বে, তালিবান ২০২১’র আগস্টে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় বসার আগে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ লক্ষে। কিন্তু তালিবান ক্ষমতায় বসার পরই শিক্ষাকে আফগান নারীদের কাছে এক বাহুল্যের বিষয় করে তোলে। ২০২১’র সেপ্টেম্বরে স্কুল খুলে সেগুলোতে শুধু ছেলেদেরই যেতে দেওয়া হয়, মেয়েদের যাওয়া অনাবশ্যক বলে বিচার্য হয়। মেয়েদের জন্য ধার্য হয় প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা, তার ওপরের স্তরের শিক্ষা এবং তারসাথে কর্মক্ষেত্রকেও মেয়েদের অগ্রাধিকারে স্থান দেওয়া হয় না। শিক্ষার যেটুকু ব্যবস্থা মেয়েদের জন্য ছিল, তাতে বরাদ্দ হতো আলাদা শ্রেণীকক্ষ এবং নারী শিক্ষিকা ও বৃদ্ধ শিক্ষকরাই তাদের পড়াতে পারতেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী ও অসরকারি সংস্থাতে নারীদের কাজ করাও নিষিদ্ধ হয়েছে। আফগানিস্তানে অনেক এনজিও মূলত নারী কর্মীদের ওপর ভর করে তাদের কাজ চালাত। কিন্তু নারী কর্মীরা কাজে যেতে না পারায় এনজিও’গুলো যে পরিষেবা দিত তা প্রদান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি তিনটে বিদেশী এনজিও তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়ে এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, “আমরা আমাদের মহিলা কর্মী ছাড়া শিশু, নারী ও পুরুষদের কাছে সক্রিয়ভাবে পৌঁছতে পারছি না, আফগানিস্তানে যাদের সাহায্য অতীব প্রয়োজন”। প্রসঙ্গত, তালিবান জমানায় অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার নিয়েছে, কর্মসংস্থান বলতে তেমন কিছু নেই, আর এরই সাথে রমরমিয়ে চলে মাদক ব্যবসা। আফগান জনগণের এক বড় অংশকেই তাই নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার মানবিক সহায়তার ওপর। নারীদের কাজে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে এনজিও’দের কাজে তালা ঝুলিয়ে দেওয়াটা যে আদতে আফগান জনগণের ক্ষতিই ডেকে আনছে তা নিয়ে তালিবান শাসকদের বিন্দুমাত্র ব্যাকুলতা নেই।

শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র থেকে নির্বাসনের সাথে আরও অনেক বিধিনিষেধের নিগড়ে আফগান নারীদের বাঁধা হয়েছে। তারা একা বাইরে বেরোতে পারবে না, বাইরে যেতে গেলে পুরুষ অভিভাবক বা সঙ্গীর সাথে যেতে হবে। বাইরে বেরোতে হলে আপাদমস্তক ঢাকা দিয়ে বেরোতে হবে। উঁচু হিলের জুতো পরা যাবে না, জানলায় পরদা লাগাতে হবে যাতে মেয়েদের মুখ না দেখা যায়। প্রকাশ্যে জোরে কথা বলা বা মতামত প্রকাশ করা মেয়েদের পক্ষে বাঞ্ছনীয় নয়। খবরের কাগজ, বই, পত্রিকায় এবং এমনকি ঘরেও মেয়েদের ছবি প্রকাশ করা বা টাঙানো চলবে না। রেডিও, টিভি, প্রকাশ্য সমাবেশে তাদের দেখতে পাওয়া বা তাদের কণ্ঠ অন্যের কর্ণগোচর হওয়াটাও অনভিপ্রেত। সাইকেল, মোটর সাইকেল চাপাও তাদের জন্য নিষিদ্ধ। স্বাধীনতা ও অধিকার হীনতার আফগান নারীদের এই অস্তিত্ব আসলে ইসলামের রক্ষণশীল, সংস্কার বিমুখ তালিবানি ব্যাখ্যার অনুসারী।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়ার পরিণতিতে তালিবান ২০২১’র আগস্টে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় বসার সময় কিছুটা উদারবাদী হওয়ার, প্রশাসনে সংযম দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বলেছিল, নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত হবে, মানবাধিকার মর্যাদা পাবে। কিন্তু সে সময় তালিবানদের প্রতিশ্রুতিতে আফগান জনগণের এক বড় অংশই ভরসা রাখতে পারেননি‌। আমাদের মনে পড়ে যায় আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার কী হিড়িকই না সেসময় পড়েছিল। বাসে-ট্রেনে গাদাগাদি করে যাওয়ার মতো বিমানের ডানা থেকে মানুষের ঝুলে পড়ার দৃশ্যও সারা দুনিয়াকে বিচলিত করেছিল, বিস্মৃত হওয়ার নয় সেই ঝুলন্ত অবস্থা থেকে পড়ে গিয়ে অন্তত একজন ডাক্তার ও একজন ফুটবলারের মৃত্যুর কথা। নারীদের শিক্ষায় সংকোচনের থাবা, কর্মক্ষেত্রকে তাদের জন্য নিষিদ্ধ করে তোলাটা সুস্পষ্টরূপে দেখিয়ে দিল যে, তালিবানদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণরূপেই ছিল অন্তঃসারশূন্য।

নারীর শিক্ষার ওপর তালিবান শাসকের চাপানো এই বঞ্চনাকে, নারীর স্বাধিকারের সার্বিক দমনকে আফগান নারীরা কিন্তু মুখ বুজে মেনে নেননি। রাজধানী কাবুলে রাস্তায় নেমে মেয়েরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন, উচ্চশিক্ষার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। বহু মহিলা ২২ ডিসেম্বর ২০২২ প্রতিবাদ জানাতে জানাতে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ চালায় ও গ্রেপ্তার করে। শিক্ষা থেকে নারীদের নির্বাসিত করার বিরুদ্ধে পুরুষ ছাত্ররাও প্রতিবাদে নামে এবং শিক্ষার অধিকার, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার নারীদের ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তারা পরীক্ষায় বসতে অস্বীকার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত নারীদের প্রতি সংহতি জানাতে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক লাইভ টিভি অনুষ্ঠানে তাঁর সমস্ত ডিপ্লোমা একে একে ছিঁড়ে ফেলে বলেন, “আজ থেকে এই ডিপ্লোমাগুলোর কোনো প্রয়োজন আমার নেই, কেননা, এই দেশে শিক্ষার আর কোনো স্থান নেই। আমার মা-বোনেরা পড়ার সুযোগ না পেলে আমার কাছে এই শিক্ষা গ্রহণযোগ্য নয়।” আপাত আধুনিক বহিরাবরণের আড়ালে তালিবানদের মনোজগতে বয়ে চলা চরম প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার উন্মোচন ঘটিয়ে জনৈক অধ্যাপিকা বলেছেন, “স্মার্টফোন, সমাজ মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট ও নামিদামি গাড়ি-সহ ওদের একটা পাল্টে যাওয়া গোষ্ঠী বলে মনে হতে পারে, তবে, ওরা কিন্তু সেই একই তালিবান যারা আমার শিক্ষায় বঞ্চনা ঘটিয়েছিল আর এখন আমার ছাত্রীদের ভবিষ্যত ধ্বংস করছে।” এইভাবে তালিবান-বিরোধী বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ আফগানিস্তানে দেখা যাচ্ছে। এই সমস্ত প্রতিবাদ ইরানে নীতি পুলিশের হাতে মাহসা আমিনির হত্যা থেকে জন্ম নেওয়া স্বৈরাচারী শাসক বিরোধী দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনের মতো প্রতিরোধে পরিণত হয়নি ঠিকই, তবে এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভগুলোর মধ্যে অবশ্যই রয়েছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের সংকেত। ইসলামের নাম নিয়ে যে আতঙ্কবাদী ও পৈশাচিক শক্তিগুলো এখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায়, বন্দুক ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় যারা কথা বলতে পারে না, তাদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে আফগান নারী-পুরুষদের পথে নামা অবশ্যই আশা জাগায়। সারা দুনিয়াতেই তালিবানি চিন্তাধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সমালোচনা জারি আছে, আর আমরাও এই মুহূর্তে আফগান নারীদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াচ্ছি, পূর্ণ সংহতি জ্ঞাপন করছি।

– জয়দীপ মিত্র

Comrade Bakul

১৯৭২ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের কোনও একটা দিনে আমাকে লালবাজার থেকে কোর্টে নিয়ে এসেছে। শিয়ালদহ কোর্ট লকআপের দোতালায় বকুলের সাথে দেখা হল। হাতের আঙুলের নখ দেখে বুঝলাম অকথ্য অত্যাচার হয়েছে ওর উপরে। আমরা কেস পার্টনার ছিলাম না, ঘটনা চক্রে আরও কয়েকটা তারিখ পড়ার পর আমরা দু’জনেই জামিনে ছাড়া পাই।

বহুদিন দেখা নেই বা দেখা করার তাগিদও ছিল না। একদিন আচমকা টিটাগড় স্টেশনে দেখা হল। জানালো ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসাবে ঢুকেছে। দল ভেঙে গেছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর ফের দেখা। রূপার মাধ্যমে আবার নতুন করে পার্টির সাথে যোগাযোগ হল।

অমল দ্রুত ২৮ জুলাই গোষ্ঠীর সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিল। নিজের বাসস্থান বেলঘরিয়ায় রাজনৈতিক কাজ শুরু করেছে। কয়েক মাসের মধ্যেই পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিনোদ মিশ্রের দেহরক্ষী হিসাবে কেন্দ্রীয় কাজে নিযুক্ত হল। পার্টির কাজ আন্তরিকভাবেই নিয়েছিল। পার্টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। পার্টির ভিতরে শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের সুত্রপাত হয়েছে। কমরেডরা নিজ নিজ কাঠামোয় রাজনৈতিক পর্যালোচনা ও মতামত রাখছেন। এই সময় অমলের মতামত দেওয়ার মতো কোনও সংগঠনিক কাঠামো ছিল না। ভিএম যেখানে যেতেন সঙ্গে থাকতো, মিটিংয়ের বাইরেই পাহাড়ায় থাকতে হোত। এই নিয়ে আক্ষেপ ছিল। মাঝে ভোজপুরে গেছিল। সেখানকার অবস্থা দেখে উৎসাহ বহুগুণ বেড়ে যায়।

গোপনীয়তার কারণে কে কোথায় যাচ্ছেন জানার রীতি ছিল না। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছিল। অমল ‘মা’কে জানিয়ে শিলিগুড়ি গেল। ঘটনার বিবরণ কাগজে প্রকাশিত হওয়ার পরই মাসীমা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।

সপ্তাখানেক পর সন্ধ্যার সময় রোজকারের মতো মাসীমা বারান্দায় বসে তাঁর সমবয়সীদের সামনে গীতা পাঠ করছেন। মাসীমার নজর পড়লো আমাদের দিকে। যারা বসে পাঠ শুনছিলেন তাদের তিনি চলে যেতে বলেন। মাসীমা আমাদের সামনে দুটো শব্দ প্রকাশ করলেন “নেই” আমি জানতাম এটাই ঘটবে। দ্বিতীয় কথা “তোমরা তাড়াতাড়ি চলে যাও”। অরিন্দম সেন আর আমি পা চালিয়ে হাটছি। স্পষ্ট শুনতে পারছিলাম সন্তানহারা মায়ের শব্দহীন বুকফাটা আর্তনাদ। এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, অমলের বাড়ির সাথে যোগাযোগ ক্ষীণ হতে হতে এক সময় আর থাকে না।

প্রায় ২০ বছর পর ৭ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে ভিএম অমলের মা-এর সাথে দেখা করতে আসেন। মাসীমা অশক্ত শরীরে ভিএম’এর মুখোমুখি। এতোদিন বাদে এলেন? আপনারা সবাই ভালো আছেন? রূপার সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল, ওর কুশল সংবাদ নিলেন। আমরা ৬ জন ছিলাম সবাইকে চা দিতে বলেন। এবার নিজের কথা শুরু করলেন।

আপনারা ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, ঘুরছেন শুধু আমার ছেলেটাই নেই। চোখ দুটো জলে ভরে গেছে, ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। অমলের কথা লিখতে গিয়ে মাসীমার কথাই লিখে ফেললাম। কত মাসীমারা তাদের প্রিয় সন্তানকে এভাবে হারিয়েছেন। এইসব স্নেহশীল মায়েদের দৃঢ়তা, সচেতনতা কমিউনিস্ট আন্দোলনে বড় সম্পদ হয়েই আছে। এক কঠিন রূঢ় বাস্তব রাজনৈতিক প্রশ্নের সম্মুখীন সাধারণ সম্পাদক। শহীদের মা প্রশ্ন করছেন। ভিএম নতমস্তকে মাসীমার কথা শুনছেন ও অনুধাবন করার চেষ্টা করছেন।

ভিএম খুব ধীরস্থির ও বিনয়ের সাথে মাসীমার কাছে সেই দিনের ঘটনা তুলে ধরেন। শেষে মাসীমা বলে ওঠেন, “হ্যাঁ আমি একজন শহীদ বিপ্লবীর মা, আমি গর্বিত’’। এক বিরল ঘটনার সাক্ষী হলাম।

পার্টি শুদ্ধিকরণের মধ্য দিয়ে গণসংগঠন ও আন্দোলনের দিকে ঝুঁকছে সেই সময় বড়পথু জোতে ঘটে গেল এই ভয়ঙ্কর ঘটনা। সকালে প্রথমেই অমলের পেটে গুলি লাগে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সিআরপি স্মোকবম্ব ছুঁড়ছে, চালায় আগুন ধরেছে। খুন্তি, শাবল হাতের কাছে যা পেয়েছে তা দিয়ে মাটির দেওয়াল ভেঙে পাশের ঘরে সব কমরেডরা আশ্রয় নিয়েছেন। সিআরপি’র ঘেরাওয়ের মুখে সবাই আটকে পড়েছেন। অমল মনস্থির করে ফেলেছে পার্টি নেতৃত্বকে বাঁচাতেই হবে। যেমন সিদ্ধান্ত তেমন কাজ। অমল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এক সিআরপি’র উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাইফেল কেড়ে নিয়ে ফায়ারিং শুরু করে দেয়, বাহিনীর তিনজনের মৃত্যু হয় ও কয়েকজন আহত হয়। এই সুযোগে আহত অবস্থায় ভিএম ও নিমু সিং হামাগুড়ি দিয়ে বাহিনীর নাগালের বাইরে চলে যায়। তপন চক্রবর্তী ও রতন সেন গ্রেপ্তার হলেন। সিআরপি কমাণ্ডার অমলকে স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁজরা করে দিল। বীরের মতো নিজের জীবন পার্টিকে উৎসর্গ করে শহীদ হল বকুল (অমল) সেন ২ জানুয়ারি ১৯৭৯। অমলের মৃত্যু আজও নাড়া দিয়ে যায়। 

কমরেড বকুল (অমল) লাল সেলাম।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত

Nirpen Majumdar passed away

প্রবীণ পার্টি সদস্য এবং রাজ্য সরকারী কর্মচারী আন্দোলনের বিশিষ্ট সংগঠক কমরেড নৃপেন মজুমদার, দীর্ঘ রোগভোগের পর ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০ বছর। ১৯৮৫ সালে তিনি পার্টির সংস্পর্শে আসার দিন থেকে আমৃত্যু পার্টির প্রতি অনুগত ছিলেন। অত্যন্ত রুচিশীল এই মানুষটি তাঁর সুমিষ্ট ব্যবহার ও বাচনভঙ্গী দিয়ে ভিন্নমতের লোকদেরও মন জয় করে নিতেন। রাজনৈতিক কাজের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জগতেও তাঁর ছিল অনায়াস বিচরণ। বহু নাটকে তিনি চমৎকার অভিনয় করেছেন। নৌ-চালনাতেও তিনি ছিলেন সুদক্ষ। কয়েকজন সতীর্থকে নিয়ে তাঁর হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত নৌকা চালিয়ে আসার রোমাঞ্চকর কাহিনী আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বর্ণময় চরিত্রের এই কমরেডের প্রয়াণে তাঁর জন্মস্থান নদীয়ার চাকদহে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

কমরেড নৃপেন মজুমদারের স্মৃতি চির অম্লান থাকবে।

কমরেড আনন্দ মোহন মৈত্র, সকলের প্রিয় আনন্দদা গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর তাঁর বড় ছেলে ও পরিবারের লোকজন বারাসাত হাসপাতালে ১ জানুয়ারি ২০২৩ রাতে ভর্তি করায়। পরের দিন চিকিৎসকদের চেষ্টা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো না থাকায় আরজিকর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার পরামর্শ দেন। সেইমতো ব্যবস্থা নেওয়ার সময়ই জানা যায় আনন্দদা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন ২ জানুয়ারি ২০২৩, ৭৭ বছর বয়সে। ইতিমধ্যেই স্থানীয় পার্টি কমরেডরা উপস্থিত হন এবং বারাসাত হাসপাতাল চত্ত্বরেই লাল পতাকা ও মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।

গত জুলাই মাসে তিনি তাঁর স্ত্রী এবং রাজনৈতিক সহকর্মী কমরেড বাসন্তী মৈত্রকে হারান। ছোট ছেলেও অকালে প্রয়াত হয়। এত বড় দুটো মানসিক আঘাত তাকে রোগ-প্রতিরোধে অশক্ত করে তুলেছিল।

কমরেড আনন্দ মৈত্র প্রতিরক্ষা শিল্পের আর্টিজান ট্রেনিং স্কুল থেকে পাশ করে শিল্প শ্রমিক হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন। কারখানায় শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দেন। পরে তিনি উপলব্ধি করেন যে শুধুমাত্র ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি নেই, তাই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকর্ষিত হন এবং পার্টি সদস্য হন এবং পার্টির বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। পার্টির প্রতি আনন্দদার ছিল অগাধ আস্থা। ইউনিয়নের মধ্যে ফ্র্যাকশনাল কাজে পার্টি মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার সাথে সাথে পার্টি গঠনের কাজকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শিল্প পার্টি গঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও কারখানার বাইরেও পার্টি কর্মসূচিতে হোক বা পার্টির কোনও দায়িত্ব পালনে কোনও দ্বিধা ছিল না। তা দিল্লীর কর্মসূচিতে হোক বা পার্টির ৫ম কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবক বা এআইসিসিটিইউ গঠন পর্বে মূখ্য ভূমিকা পালন করাই হোক। কলকাতা বা স্থানীয় এলাকায় পার্টি কর্মসূচিতে অংশ নিতেন সবসময়ই। তিনি ‘লালঝান্ডা’ পত্রিকা ছাপাবার কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ত্যাগ স্বীকারেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, একবার স্ত্রী’র গয়না বিক্রি করে টাকা দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

মানুষ হিসেবেও একজন সহজ সরল নিঃস্বার্থ দরদী মানুষ ছিলেন। কারও কোন বিপদে বা যেকোনও অসুবিধায় নিঃস্বার্থ ভাবে এগিয়ে যেতেন, এতে অনেক সময় নিজে অসুবিধার মধ্যেও পরতেন।

কমরেড চাকরি থেকে অবসরের পরে স্থানীয় পার্টি কাঠামোতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে সামিল হতে থকেন। শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও পার্টির প্রতি আস্থা ও ভালোবাসায় কোনও খাদ ছিল না। পার্টির মতাদর্শে দৃঢ় এবং আপোশহীন কমরেডকে হারানো পার্টির কাছে বড় ধাক্কা।

কমরেড আনন্দদা আমাদের মধ্যে অমর হয়ে থাকবেন।

Shrikant Ghosh passed away

২ জানুয়ারি ভোরবেলায় প্রয়াত হলেন শ্রীকান্ত ঘোষ (৭৩)। তিনি হৃদরোগে আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। কমরেড শ্রীকান্ত বাঁশদ্রোণী এলাকার বাসিন্দা। ওই অঞ্চলের ব্রাঞ্চের সাথে যুক্ত ছিলেন। ২৬ ডিসেম্বর বিএমপিইইউ হলে সাধারণ সম্পাদকের আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন। এবারই তিনি প্রার্থী সদস্য হন। তিনি সিপিআই(এম)-র সাথে যুক্ত ছিলেন। গতবছর মার্চ মাসে কলকাতা পার্টি জেলা সম্মেলন চলাকালীন তিনি নিজেই সম্মেলন স্থলে এসে যোগাযোগ করেন। তারপর থেকেই নিয়মিতভাবে পার্টির কর্মকান্ডে অংশ নিতেন। তিনি রেখে গেলেন তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র অবিবাহিত কন্যাকে।

কমরেড শ্রীকান্ত ঘোষ অমর রহে!

== 000 ==

খণ্ড-30
সংখ্যা-1