সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একাদশ পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে বিহারের পাটনাতে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ একটি গণজমায়েতের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হবে ও তারপর ১৬ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ চলবে প্রতিনিধি সম্মেলন। পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি ও কংগ্রেসের সামনে বিদ্যমান রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রশ্নগুলিকে নিয়ে ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার বিএমপিইউ হলে। এই আলোচনাসভার মুখ্য আলোচক ছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। প্রায় দেড় ঘণ্টার ভাষণে সাধারণ সম্পাদক সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে আলোচনা করেন এইবারের পার্টি কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় বিষয় — ফ্যাসিবাদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও তার মোকাবিলার দিকটি নিয়ে। জাতীয় পরিস্থিতি সংক্রান্ত চর্চা ছাড়াও আলোচনায় আসে আন্তর্জাতিক নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ, ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান, লাতিন আমেরিকায় গোলাপী জোয়ারের দ্বিতীয় তরঙ্গ, চিনের সাম্প্রতিক পার্টি কংগ্রেস ইত্যাদি। সাংগঠনিক বিষয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকও আলোচনায় উঠে আসে।
আলোচনার বিভিন্ন দিকগুলিকে আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করছি।
ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিকে ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন হিসেবে সিপিআই(এমএল) চিহ্নিত করেছে। ভারত রাষ্ট্রের পুরোপুরি ফ্যাসিবাদীকরণ হয়ে গেছে এটা বলা না গেলেও প্রবণতাটা সেদিকেই। এটা ক্রমেই বেশি বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। অনেকে ফ্যাসিবাদকে যান্ত্রিকভাবে দেখেন। হিটলারের সময় ষাট লক্ষ ইহুদি নিধনের মতো কিছু এখানে হচ্ছে কিনা, বিপর্যয় সেই স্তরে হলে তবে তাকে ফ্যাসিবাদ বলা যাবে — এভাবে দেখাটা যান্ত্রিকভাবে দেখা।
ফ্যাসিবাদের পরিপ্রেক্ষিতটা ভালোভাবে বোঝা দরকার। বুঝতে পারলে তবেই তার প্রতিরোধের রাস্তাটা বের করা সম্ভব হবে।
এটা মনে রাখতে হবে ফ্যাসিবাদ একটি আধুনিক প্রবণতা। উনিশশো কুড়ির দশকে ইতালিতে তার প্রথম উত্থান ও বিকাশ। ফ্যাসিবাদকে অতিরাষ্ট্রবাদ বলা যায়। রাষ্ট্র এখানে এমনভাবে জাঁকিয়ে বসে যে সে সমাজ ব্যক্তি সবকিছুকে তীব্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
পুঁজিবাদের প্রথম দিকে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে, সামন্তী অভিজাততন্ত্রর বিরুদ্ধে যে প্রগতিশীল চরিত্র ছিল ক্রমশ সেটা সে হারায়। সে বোঝে তার মুনাফার জায়গা সমাজতান্ত্রিক উত্থানের যুগে কমছে। ১৯১৭তে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও ১৯২২-এ ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান কাছাকাছি সময়ের ঘটনা। সমাজতন্ত্রের ভয় থেকে পুঁজিবাদীরা অনেকেই ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদকে মদত দিতে থাকেন।
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ১৯১৯-এ তৈরি হওয়ার পর থেকেই বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে নিবিড়ভাবে চর্চা করত। ইতালির ফ্যাসিবাদ নিয়েও সেখানে চর্চা হয় ও ফ্যাসিবাদকে দেখার প্রশ্নে সেখানে নানা মত ছিল। ইতালিতে গ্রামশি ফ্যাসিবাদের বিপদকে খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। তবে প্রথমে গ্রামশিরও মনে হয়েছিল ফ্যাসিবাদ কৃষিভিত্তিক বুর্জোয়াদের ব্যাপার। শিল্পভিত্তিক বুর্জোয়ারা এটা মানবে না এরকম একটা ধারণা গ্রামশি করেছিলেন। কিন্তু সেটা ইতালিতে হয়নি। পরে জার্মানিতেও তা হয়নি। গোটা শাসক শ্রেণি, কৃষিভিত্তিক বুর্জোয়া ও শিল্পক্ষেত্রের বুর্জোয়া সবাই ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদের পক্ষে দাঁড়ায়।
ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রকে কাজে লাগিয়ে হামলা করে কিন্তু ফ্যাসিবাদকে বিশ্লেষণ করার সময় মাথায় রাখতে হবে যে শুধু আক্রমণ আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদ এগোয়নি। নানা সামাজিক উন্মাদনাকে সে তার পক্ষে কাজে লাগায়। শুধু রাষ্ট্র দিয়ে ফ্যাসিবাদকে বোঝা যাবে না। সমাজ সংস্কৃতি দিয়েও তাকে বুঝতে হবে।
ফ্যাসিবাদের প্রথম তরঙ্গের সময়েই ভারতে আরএসএস’এর প্রতিষ্ঠা। ১৯২২-এ ইতালিতে মুসোলিনি ক্ষমতায় আসেন আর ভারতে আরএসএস’এর প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৫ সালে। আরএসএস’এর কাছে ভারত মানে হিন্দুর ভারত। হিন্দু সুপ্রিমেসি, সেনাবাহিনীর হিন্দুকরণ, হিন্দুদের সামরিকীকরণ — এগুলো আরএসএস শুরু থেকেই করতে চেয়েছিল। এই প্রথম তরঙ্গের কথা বাদ দিয়ে যেমন আজকের আরএসএস বা আজকের ফ্যাসিবাদকে বোঝা যাবে না, তেমনি শুধু সেকালের ইতালি বা জার্মানির অভিজ্ঞতা দিয়েও আজকের ভারতের ফ্যাসিবাদকে পুরোটা বোঝা যাবে না। এটা বুঝতে হলে গত তিরিশ বছরে বিশ্ব ও ভারতীয় রাজনীতির যাত্রাপথটা বুঝতে হবে।
সোভিয়েতের পতন, দক্ষিণপন্থার অভ্যুত্থান, বামপন্থার পেছনে হটা — এগুলো ফ্যাসিবাদের এই পর্বের বিকাশে বড় ভূমিকা রয়েছে নিয়েছে। এরসঙ্গেই রয়েছে নিও লিবারাল পুঁজিবাদ, যা খানিকটা চিন ছাড়া সর্বত্র প্রায় একই রকম দাপটে সামনে রয়েছে। এরসঙ্গে ভারতে রয়েছে বাবরি ভাঙা, গুজরাট দাঙ্গা সহ আগ্রাসী হিন্দুত্বর রাজনীতি। এই সবকিছুর সংমিশ্রণে মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছে ও তার শক্তি সংহত ও বৃদ্ধি করছে।
ভারতে নিও লিবারাল জমানা শুরুর পর বিভিন্ন পাবলিক সেক্টরের ওপর প্রথম হামলা নেমেছে। সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি — রেল, ব্যাংক, বীমা কর্মীরা এই হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করেছেন।। ক্রমশ দেখা গেল আক্রমণ নেমেছে কৃষকের ওপরও। আমাদের দেশে এখনো শ্রমিকের ওপর আক্রমণের চেয়ে কৃষকের ওপর আক্রমণ বেশি প্রভাব ফেলে। কৃষক আত্মহত্যা ও গুজরাট গণহত্যা ২০০৪-এ সরকার পরিবর্তনের পেছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিল।
২০০৪-এ ইউপিএ প্রতিষ্ঠিত হবার পর বেশ কিছু সংস্কার আনা হয়। অধিকারের পক্ষে কিছু কিছু আইন হল। কমন ম্যানের কথা হল। তবে অনেক রাজনৈতিক প্রশ্নে, গুজরাট দাঙ্গা ও আগ্রাসী হিন্দুত্বকে মোকাবিলার প্রশ্নে তেমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যেটুকু অর্থনৈতিক সংস্কার ইউপিএ করেছিল তা কর্পোরেট শক্তির পছন্দ হয়নি। ২০১৪-তে ভাইব্রান্ট গুজরাট স্লোগান সামনে রেখে মোদীকে কর্পোরেটরা ক্ষমতায় নিয়ে আসে।
অনেকে আজকের ফ্যাসিবাদ ও জরুরি অবস্থার সময়কার অবস্থার মধ্যে তুলনা করেন। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে দমনের দিক থেকে কিছু মিল থাকলেও কিছু মৌলিক ভিন্নতা আছে। স্বৈরতন্ত্র নিজেদের শাসনকে চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সমাজকে ওলোট পালট সে করে না। ফ্যাসিবাদ কিন্তু শাসনকে চাপানোর পাশাপাশি সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, মতাদর্শ সবকিছুকে পালটে নিজের মতো করে নিতে চায়। কমিউনিস্টরা যেমন পার্লামেন্টারি ও এক্সট্রা পার্লামেন্টারি স্ট্রাগেলের কথা বলে, ফ্যসিস্টরাও উল্টোদিক থেকে তাই করে। আইন কিছু করা হয়। আইনকে সামনে রেখে তাদের শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়ক এমন সামাজিক আন্দোলন তারা গড়ে তোলে। প্রতিবিপ্লব ও বিপ্লব অনেক সময় রূপের দিক থেকে একভাবে কাজ করে। তবে তাদের অন্তর্বস্তু সম্পূর্ণ বিপরীত।
ফ্যাসিবাদ ক্লান্ত হয়ে নিজে থেকে চলে যাবে এমন নয়। আমরা এর বিরুদ্ধে যতটা লড়তে পারব সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এটা বোঝা দরকার ফ্যাসিবাদকে বিপ্লবী বামেদের পক্ষে এককভাবে হারানো সম্ভব নয়। অনেকেই বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই সমস্ত প্রতিবাদ আংশিক প্রতিবাদ। কেউ আরএসএস’এর কথা বলে না। কেউ আদানি আম্বানির কথা বলতে রাজি নয়। এমনকি বামেদেরও এই নিয়ে মতৈক্য নেই। এই মুহূর্তের কেন্দ্রীয় প্রশ্ন ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা। এই নিয়ে মতের ও বোঝাপড়ার অমিল বলেই বাম ঐক্যের জায়গাটা দুর্বল হয়ে আছে।
নির্বাচন দিয়ে ফ্যাসিবাদকে হারানো যাবে কী যাবে না — এটা বড় প্রশ্ন নয়। এখানে ফ্যাসিবাদ নির্বাচনে জিতে জিতেই ক্ষমতায় থাকতে চাইছে এটা দেখা যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদকে হারাতে নির্বাচন, নির্বাচনের বাইরের লড়াই — যা যা করার আছে তা করতে হবে। আইনি দিক যতটা আছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এরই সঙ্গে আমাদের বড় আন্দোলনগুলোর মধ্যে থাকতে হবে এবং বিভিন্ন আন্দোলনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে।
আম্বেদকর বলেছিলেন ভারত হিন্দুরাজ হলে তার চেয়ে বড় বিপর্যয় আর হতে পারে না। এটা ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা লাঞ্ছিত দলিতদের অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে আম্বেদকর বলেছিলেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে মানুষকে বাঁচানোর কাজ করি। তারপর আক্রান্তকে রিলিফ দিতে চাই। তারপর পুনর্গঠনের প্রশ্নটা আসে। ভূমিকম্প বা ঝড় প্রতিরোধী নির্মাণের প্রযুক্তির কথা আসে। ফ্যাসিবাদের প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও পদ্ধতি ও পর্যায়গুলো এরকম। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা ও ফ্যাসিবাদের পুনরাবর্তনকে আটকানোর জন্য আরো উন্নত গণতন্ত্র তৈরির কথাটা আসে। শেষপর্যন্ত কথাটা জনগণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের প্রসঙ্গেও যায়।
আমদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে সার্বিক, সর্বাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী করতে হবে। এই প্রসঙ্গে অন্য বুর্জোয়া পার্টিগুলো তো বটেই, এমনকী বামপন্থী অন্যান্য দলের থেকেও আমাদের কিছু কিছু পার্থক্য থাকবে।
সাধারণ সম্পাদক জানান ভারতের ফ্যাসিবাদের নয় বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে তার মোকাবিলার রাস্তা নিয়ে কিছু কথা থাকবে দলিলে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনা প্রসঙ্গে সাধারণ সম্পাদক বলেন যে চিনে কতগুলো বিষয় বাড়ছে। দীর্ঘদিন তারা মূলত অর্থনীতি নিয়েই ভাবছিল। বিদেশ নিয়ে সে চুপ থেকে বাণিজ্যের প্রশ্নে সক্রিয় থাকত। এখান থেকে সরে চিনের বিদেশনীতির সক্রিয়তা এখন বাড়ছে। আমেরিকা ও ন্যাটো অক্ষের বিরুদ্ধে সে রাশিয়ার কাছাকাছি থাকার বার্তা দিচ্ছে। ভারতের কিছু কিছু জায়গাও সে দখল করছে বলে অভিযোগ। তার সম্প্রসারণবাদ দেখা যাচ্ছে।
চিনে সোশালিজম উইথ চাইনিজ ক্যারেক্টারিসটিক্স’কে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন দিয়ে বোঝার চেষ্টা রয়েছে। পার্টিতেও একসুরে সব বাঁধা, সাধারণ সম্পাদকের অন্তহীন ক্ষমতা এগুলো দেখা যাচ্ছে। চিনকে ক্যাপিটালিজম উইথ চাইনিজ রেক্টারিসটিক্স বলা যায়।
লাতিন আমেরিকায় বামেদের বিজয় আমাদের কাছে নানা দিক থেকে উৎসাহব্যঞ্জক। সেগুলোর কথা বিস্তারিতভাবে দলিলে থাকবে।
২০২২ শেষ লগ্নে এসে উপস্থিত। নতুন বছর কি বার্তা, কী ধারাভাষ্য নিয়ে হাজির হবে তা এখনও অনাগত দিনের গর্ভে। তবে বর্তমানের মধ্যেই আগামীর এমন কিছু ইঙ্গিত রয়েছে যা যথেষ্ট উদ্বেগের, দুশ্চিন্তার। সামনের বছরে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ঘনিয়ে ওঠা বিরাট মন্দার কাঁপুনি ধরানো ইশারা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতো সংগঠন বড় ধরনের সামাজিক নৈরাজ্য বা অশান্তির সংকেত দিয়েছে। এই প্রথম, গত ১০০ বছরের মধ্যে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় ঋণাত্মকের ঘরে (-০.৯) নেমেছে। অগণন মানুষ দুনিয়া জুড়েই নতুন করে নিক্ষিপ্ত হয়েছে দারিদ্রসীমার নিচে। গভীর খাদ্য সংকটের কারণে অনেক দেশেই দুর্ভিক্ষের বিভীষিকা দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। জলবায়ু সংকট পরিবেশের উপরই শুধু নয়, নতুন করে শরণার্থী সৃষ্টি করেছে, তৈরি করেছে নতুন নতুন দ্বন্দ্ব, যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
মোদীর ফ্যাসিবাদী জমানা গোটা দেশকে ঠেলে নিয়ে গেছে জাহান্নামের উপান্তে। গণতন্ত্রের প্রসাধনী প্রতিষ্ঠানগুলো মোদীর ইশারা ও আদেশের উপর চলছে। এমনকি বিচারব্যবস্থাও। অবসরপ্রাপ্ত প্রখ্যাত বিচারপতি ফলি নরিম্যান সঠিকভাবেই বলেছিলেন, ভারতীয় রাষ্ট্রের সবচেয়ে দুর্বলতম স্তম্ভ হল বিচারব্যবস্থা, অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে যাকে কাজ করতে হয়। দেশের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার সংগঠন মোদীর আজ্ঞাবহ ভৃত্যের দল। ৮৪ বছরের পাদ্রী স্ট্যানস্বামিকে জেলে পুরতে কিভাবে তাঁর অজান্তে তাঁর কম্পিউটারে নানা আপত্তিজনক বেআইনি তথ্য ঢুকিয়ে ফাঁসানো হয়, তা আজ ফাঁস হয়ে গেছে। বিজেপির মহিলা সাংসদ কর্ণাটকে এক ভাষণে খোলাখুলিভাবেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আহ্বান রাখলেও সরকার, বিচারব্যবস্থা চোখ-কান বন্ধ রাখে। সামাজিক বিদ্বেষ সূচক, বিশ্ব ক্ষুধা সূচক, লিঙ্গ-বৈষম্য সূচক — সব ক্ষেত্রেই ভারত ক্রমেই নিচে গড়িয়ে পরছে। সামাজিক রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপন্ন করে তুললে যে তার অভিঘাত অর্থনীতির উপরও পড়ে, তা বিভিন্ন অর্থশাস্ত্রীরা বারংবার সতর্ক করলেও মোদী তা কর্ণপাত করেন না।
বাংলাকে নিজের তাঁবে আনতে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে অমিত-মোদী জুটির মরিয়া প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ সমুচিত প্রত্যুত্তর দেন। বিজেপি বিরোধী জনপ্রিয় জনমতের কাঁধে তৃতীয়বার চেপে রাজ্য ক্ষমতার মসনদে আসার পর মমতা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রকে উপেক্ষা করে, আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রাজ্য সরকার সমস্ত প্রশ্নেই ব্যর্থ। গোটা শিক্ষা দপ্তরই আজ জেলখানায়। নিয়োগ-আবাস-একশ দিনের কাজ — যেকোনো সংস্কার প্রকল্পের উপভোক্তাদের কাছ থেকে কাটমানি — এমন হাজারো দুর্নীতিতেই এই সরকার ধিক্কৃত, কলঙ্কিত। এর সুযোগ নিয়ে এরাজ্যে সিবিআই-ইডি’র মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলো এক ধরনের বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে। বিচারবিভাগ নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে খুবই সক্রিয়তা দেখালেও আজও আন্দোলনকারীদের নিয়োগ বিশ বাঁও জলে।
তৃণমূলী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী বামপন্থাই একমাত্র যোগ্য বিকল্প। তৃণমূলী শাসনকে উৎখাত করতে বিজেপির সাথে হাত মেলানোর বিজেমূল তত্ত্ব বিগত নির্বাচনে মানুষ প্রত্যাখান করলেও, বামফ্রন্টের মধ্যে প্রধান বামপন্থী দলটি ওই ধরনের জোটকে তাত্ত্বিক ভাবে খারিজ করলেও নিচুতলায় ওই প্রবণতা বেশ জোরালোভাবেই বইছে।
এর বিরুদ্ধে বামেদের শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থান নিতে হবে, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রাম বাংলায় প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। আর, তা করতে হলে গ্রামবাংলায় জীবন্ত ইস্যুকে সামনে রেখে একরোখা আন্দোলন, ব্যাপক প্রচার অভিযান আজ সময়ের দাবি। এখনো সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে বিজেপি অপ্রস্তুত। গ্রাম বাংলায় আজও তারা দুর্বল। তাই, আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বামপন্থীদেরই নতুন আরেক আরম্ভের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
সাম্প্রতিক অতীতে মোদী সরকারকে সুপ্রিম কোর্টের ওপর সমবেত আক্রমণ হানতে দেখা গেল। উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকর এবং কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজুজু পালা করে প্রকাশ্যেই বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধিক্কার হানলেন, আর উপরাষ্ট্রপতি ২০১৫ সালের জাতীয় বিচারক নিয়োগ কমিশন (এনজেএসি) আইন বাতিল করে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনা করেন, সুপ্রিম কোর্টের ঐ রায়কে ‘জনগণের রায়’এর অবমাননা বলে অভিহিত করেন। এর প্রত্যুত্তরে সুপ্রিম কোর্ট তার অসন্তোষ ব্যক্ত করে এবং অ্যাটর্নিজেনারেল আর ভেঙ্কটারামানিকে তিরস্কার করে বলে, তিনি যেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ঐ ধরনের মন্তব্য থেকে বিরত হওয়ার নির্দেশ দেন।
আক্রমণ হানার জন্য এই সময়টাকে কেন বেছে নেওয়া হল তা বুঝে ওঠাটা শক্ত নয়। ২০১৪ সালে ক্ষমতা দখলের পর সুপ্রিম কোর্টে এক নিরাপদ স্থায়িত্বকাল উপভোগের পরবর্তী পর্যায়ে মোদী সরকার এখন এই বিষয়ে সচেতন যে বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ভারতের নতুন প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন, যে পদে তিনি দু’বছর থাকবেন আর এই সময়কালে সুপ্রিম কোর্টে অন্তত ১৯ জন বিচারপতি নিয়োগ হবে। অন্য কারণটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে রিজুজুর তেমন রেখেঢেকে না করা এই আক্রমণ থেকে যেটাতে তিনি সুপ্রিম কোর্টকে জামিনের আবেদন বা জনস্বার্থ মামলা না শোনার জন্য হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। প্রসঙ্গত, জনস্বার্থ মামলাগুলো দায়ের হয় সংবিধানের ৩২নং ধারা অনুসারে যেটাকে আম্বেদকর “সংবিধানের আত্মা ও তার হৃদয় রূপে” অভিহিত করেন। এই আক্রমণ এল সুপ্রিম কোর্ট মহম্মদ জুবের, সিদ্দিক কাপ্পান, ভারভারা রাও ও আনন্দ তেলতুম্বডের মতো সাংবাদিক, লেখক ও বিরোধী মত পোষণকারী নাগরিকদের জামিন মঞ্জুর করার পরপরই।
প্রসঙ্গত, বিচারপতিদের নিয়োগের ব্যাপারে প্রাধান্য কার থাকবে তা নিয়ে শাসক ও বিচার বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্বের উৎস হালফিলের ঘটনার মধ্যে নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শাসকই ঠিক করত কারা বিচারপতি হবে। কিছু ছোটখাটো তর্কবিতর্ক চলার পর এই দ্বন্দ্ব চরম আকার নিল ১৯৭৩ সালে যখন ইন্দিরা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত প্রথার খেলাপ ঘটিয়ে এক বিচারপতির ওপরে থাকা তিন সহকর্মীকে ডিঙিয়ে পদমর্যাদায় চতুর্থ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি বানালেন। এরপর আবার ঘটল বিচারপতি এইচ আর খান্নার দমন যা স্পষ্টতই ছিল এডিএম জব্বলপুর মামলায় তাঁর বিরোধী মত প্রকাশের জন্য শাস্তি প্রদান। এই সমস্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপ বিচারপতিদের নিয়োগ এবং তাদের বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতার মধ্যে সুস্পষ্ট গাঁটছড়ার প্রতিষ্ঠা ঘটালো।
বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে শাসকের প্রাধান্য চলেছিল ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত যখন সুপ্রিম কোর্টরায় দিয়ে কলেজিয়াম ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। ক্ষমতায় আসার পর মোদী সরকার এনজেএসি প্রবর্তন করে বিচারপতি নিয়োগে প্রাধান্য ফিরে পেতে চেষ্টা করে, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টসেই আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করায় তা ব্যর্থ হয়। এখনও পর্যন্ত এক নমনীয় বিচারবিভাগের আনুকূল্য পাওয়ার পর মোদী সরকার এখন সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে বিরোধিতা বাড়িয়ে তুলেছে, বিশেষভাবে কলেজিয়ামের মনোনয়ন করা বিচারপতিদের নিয়োগকে বিজ্ঞাপিত করতে অস্বীকার করে।
মার্কস একবার লিখেছিলেন যে, “স্বাধীন বিচারপতি আমারও নয় আবার সরকারেরও নয়”। বিচারপতিদের শ্রেণী উৎসে যে তেমন কোনো পরিবর্তনই হয়নি তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই, এ’সত্ত্বেও নানান অধিকার বিষয়ে ব্যাখ্যায় সুস্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে, কখনও শাসক জমানার প্রত্যাশিত পথে, কখনও আবার তাদের বিরুদ্ধে। এরপরও এই বিষয় নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না যে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক জমানার কাছে কাঁটা হয়েই দেখা দিতে পারে। এমনকি জরুরি অবস্থার সময়ও যখন সুপ্রিম কোর্টের অধিকাংশ বিচারপতি শাসকের কাছে নতিস্বীকার করেছিল, সে সময়ও বিচারপতি এইচ আর খান্না এবং কয়েকটি হাইকোর্টের কিছু বিচারক সংবিধানের অনুকূলে রায় দিয়েছেন।
বর্তমান সন্ধিক্ষণ অবশ্য বিচারবিভাগের কাছে এমন একটা চ্যালেঞ্জ হাজির করছে যেটা আগে কখনও দেখা যায়নি। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদী সরকার আইনে উৎকট ভাবে হিন্দুত্বর ধারণা আনা সত্ত্বেও বিচারবিভাগ মোদী সরকারকে কোনো গুরুতর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়নি। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মধ্যে বিমুদ্রাকরণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের পুনর্বিন্যাস, সিএএ, ইলেক্টোরাল বন্ডস নিয়ে মামলার ফয়সালা আজও হয়নি। আইন বিশেষজ্ঞ গৌতম ভাটিয়ার কথায় এটা হল ‘বিচারবিভাগীয় পরিহার’ যখন আদালতগুলো সমস্যাসংকুল ও সময়-সংবেদী প্রশ্নের ফয়সালাকে এড়িয়ে যায় যা কার্যত সরকারের অনুকূলেই সিদ্ধান্ত হয়, কেননা, স্থিতাবস্থা বজায় থাকার মধ্যে দিয়ে সরকারই লাভবান হয়। এটা স্বাধীন বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের ধারণাকে বিচলিত করে।
প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরপরই মোদী সরকার রঞ্জন গগৈকে রাজ্যসভায় মনোনীত করে; মোদী সরকার আবার আইনে সংশোধনী আনে যাতে অরুণ মিশ্রকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন করা যায়। সুপ্রিম কোর্ট আবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন রায় দেয় যা শাসক জমানার রাজনৈতিক প্রকল্পের পক্ষে অনুকূল হয় যার মধ্যে রয়েছে বাবরি মসজিদ, কালো টাকা সাদা করা নিরোধক আইন এবং অতি সম্প্রতি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত রায়।
কোভিড মামলাগুলোর মধ্যে দিয়েই সম্ভবত এটা সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে ওঠে যখন সুপ্রিম কোর্ট সরকারের যথেচ্ছ দাবিকে মেনে নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা চেয়ে দায়ের করা জনস্বার্থ মামলাগুলোকে খারিজ করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোপাল গৌডা বলেছেন, “এডিএম জব্বলপুর মামলাকে আর সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন মুহূর্ত বলে স্মরণ করা হবে না। ঐ কলঙ্কটা এখন কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবারণযোগ্য সংকটে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া সাড়ার কবলে।” এমনকি নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি কুরেশিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদে উন্নীত হতে না দেওয়াটা মেনে নিয়ে শাসকের সিদ্ধান্তের কাছে নত হয়।
এসবের কোনোটাই কিন্তু কলেজিয়ামের বিচারপতি নিয়োগ সম্পর্কে ন্যায্য সমালোচনা, বিশেষভাবে স্বজনপোষণ এবং দলিত, আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী এবং ঐতিহাসিক ভাবে উৎপীড়িত অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব না থাকা নিয়ে সমালোচনার গুরুত্বকে একটুও হ্রাস করে না। মোদী সরকারের এই আক্রমণের মুখে পড়ে প্রতিনিধিত্ব এবং নিয়োগ স্বচ্ছতাকে সুনিশ্চিত করার দায়ভার সুপ্রিম কোর্টের ওপরই বর্তাচ্ছে।
বিচারবিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের একটা বুনিয়াদি বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহারিক গণতন্ত্রের কাছে পরম গুরুত্বের। আম্বেদকর সংবিধান সভায় ঘোষণা করেছিলেন যে, বিচারবিভাগের সেই স্বাধীনতাটুকু থাকতে হবে “যতটা প্রয়োজন ভীত না হয়ে বা পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে ন্যায়বিচার সম্পন্ন করার জন্য”। আমরা এটুকুই আশা করতে পারি যে, রাজনৈতিক শাসক এবং সজাগ প্রহরীর মধ্যে ফারাকটা যেন বিলুপ্ত হয়ে না যায়।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২০ ডিসেম্বর ২০২২)
এআইসিসিটিইউ’র ৫ম হুগলি জেলা সম্মেলন গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ চুঁচুড়ার আখনবাজার চৌবে লজে অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের প্রয়াত দুই বর্ষীয়ান সংগঠক জয়শ্রী টেক্সটাইলের কমরেড রামপিরীত সিং ও নির্মাণ শ্রমিক কমরেড সুসেন মিত্রের নামে যথাক্রমে সভাগৃহ ও মঞ্চ নামাঙ্কিত করা হয়। মিছিল সহযোগে প্রতিনিধিরা সম্মেলনস্থলে উপস্থিত হওয়ার পর, রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু রক্তপতাকা উত্তোলন করে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠান সাঙ্গ করে প্রতিনিধিরা সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করেন। উদ্বোধনী ভাষণে বাসুদেব বসু ও পরে রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী, বিসিএমএফ-এর রাজ্য সভাপতি নবেন্দু দাশগুপ্ত তাঁদের বক্তব্যে সাম্প্রতিককালে শ্রমিকদের ওপর সরকার ও মালিক শ্রেণীর বিভিন্ন হামলা নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা জুট শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকারের সংগ্রাম, আগামী বছরে অনুষ্ঠিতব্য রাজ্য সম্মেলনের কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করেন। জেলার অন্যতম জুট শ্রমিক নেতা কমরেড সুদর্শন প্রসাদ সিং’য়ের সেরিব্রাল স্ট্রোকে কোমায় চলে যাওয়ার পর সুস্থতার পথে এই সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার ঘটনাকে অভিনন্দিত করে অতনু চক্রবর্তী বলেন, এই ঘটনা যেন সংগঠনের লড়াকু মানসিকতার আরেক ছবি, উপস্থিত প্রতিনিধিরা এই পর্বে হাততালি দিয়ে কমরেড সুদর্শন প্রসাদ সিং ও তাঁর প্রিয় সংগঠন এআইসিসিটিইউ’কে অভিনন্দন জানায়। নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে আরও বক্তব্য রাখেন আইসা’র রাজ্য সভাপতি নিলাশিস বসু, মহিলা নেত্রী ও প্রকল্প শ্রমিক সংগঠক চৈতালী সেন, হাওড়ার জেলা সভাপতি দেবাব্রত ভক্ত, আয়ারলা ও আইসা’র হুগলি জেলা সংগঠক শেখ আনারুল ও অনুপম রায়। নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি প্রতিনিধিরাও তাঁদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, সুখ দুঃখের দিনলিপির বাস্তব প্রতিবেদন তুলে ধরেন। সংগঠনের মূল ভিত্তি জুট, নির্মাণ, টেক্সটাইল, মিড-ডে-মিল, পরিবহন (বাস) শ্রমিক ছাড়াও অসংগঠিত শিল্পের বেশ কিছু শ্রমিক এবং বিদ্যুত ও রেল শিল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন এমন কর্মচারীরাও হাজির হয়েছিলেন।
প্রায় ১৫০ জন প্রতিনধিদের মধ্যে মহিলাদের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রতিনিধিসংখ্যা ও তারমধ্যে ২০ শতাংশ মহিলা উপস্থিতির দুই মাপকাঠিই অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এই সফল সম্মেলন। জুট শিল্পের সমস্যার কথা যেমন পুরুষ শ্রমিকরা বলেছেন তেমনি বন্ধ জুট মিলের মহিলা শ্রমিক ও আত্মহত্যায় বাধ্য হওয়া শ্রমিকের মায়ের আর্তিশোনা গেছে। শোনা গেছে স্বল্প মজুরির মিড-ডে-মিল প্রকল্পের রন্ধনকর্মীর দুঃখের বারোমাস্যা, নির্মাণ শ্রমিক কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়া রুটের বাস শ্রমিকদের অসহায়তার কথা। সম্মেলন স্থির করে এই সমস্ত শ্রমিকদের দাবি নিয়ে আগামী মার্চ মাসে এক দাবিসনদ প্রস্তুত করে এক শ্রমিক জমায়েতের মাধ্যমে তিরিশ হাজার সই সম্বলিত স্মারকলিপি জেলা শাসককে দেওয়া হবে। সম্মেলনে গণসঙ্গীত গেয়ে শোনান প্রশান্ত নাথ। শ্রমকোড বাতিল, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একাদশ পার্টি সম্মেলনকে সফল করে তুলতে তার বার্তাকে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দেবার মতো প্রস্তাবনা গৃহীত হয়। সম্মেলনে ১৫ জনের কার্যকরী কমিটি সহ ২৭ জনের কাউন্সিল গঠিত হয় যার সম্পাদক হিসেবে বটকৃষ্ণ দাস পুণরায় নির্বাচিত হন। সকলে মিলে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গেয়ে সম্মেলন শেষ হয়, সম্মেলন শেষে রাজ্য ও জেলা নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে লালঝান্ডার এক মিছিল শ্রমিকদের দাবিগুলোর পাশাপাশি নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সফল পরীক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমর্থনে স্লোগান তুলে সম্মেলন স্থল থেকে চুঁচুড়ার ঐতিহ্যশালী স্থান ঘড়ির মোড় পর্যন্ত পরিক্রমা করে।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত ১৪ ডিসেম্বরের মিটিং-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাতজন পড়ুয়াকে একবছরের জন্য সাসপেন্ড করেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার অপরাধে অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্যকে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর স্বৈরাচারী মনোভাবকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়ে পড়ুয়ারা দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিজস্ব ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছে। পড়ুয়ারা জানিয়েছেন, আন্দোলনকে দমন করতেই এই সাসপেনশনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত শিক্ষাঙ্গনে ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস-এর ছায়া দেখতে চায় না বর্তমান ছাত্রসমাজ। কলকাতার বুকে বিশ্বভারতী প্রেসের সামনে গত ২৮ ডিসেম্বর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতজন পড়ুয়াকে সাসপেন্ড ও একজন অধ্যাপককে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানিয়ে আইসা, পিডিএসএফ, আরএসএফ-সহ অন্যান্য গণসংগঠনের উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ সভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় আইসা থেকে বক্তব্য রাখেন আইসা কলকাতা জেলার সম্পাদক সৌমেন্দু মিত্র, পিডিএসএফ-এর পক্ষ থেকে শ্রেয়া দে, আরএসএফ-এর পক্ষ থেকে তথাগত রায়চৌধুরী ও অন্যান্যরা। বিক্ষোভকারীরা বিশ্বভারতীতে আন্দোলনরত প্রতিবাদী পড়ুয়াদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানায়। বক্তারা এই সভা থেকে নিজেদের বক্তব্যের মাধ্যমে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, ফ্যাসিস্ট বিজেপির শাসনাধীনে প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে যেন-তেন-প্রকারেণ দমিয়ে দেওয়ার চক্রান্তকে রুখে দিতে ছাত্রসমাজ প্রস্তুত। তাই আগামীদিনে অগণতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের ওপর যতবার আক্রমণ নামবে, ততবার সকলকে একজোট হয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই জারি রাখতে হবে।
বিপ্লবী যুব এ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক রনজয় সেনগুপ্ত এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, নবান্নে আজ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চাকুরি প্রার্থীদের ৯টি সংগঠনের যুক্ত মঞ্চের পক্ষথেকে স্মারকলিপি প্রদান ও সাক্ষাতের কর্মসূচি ছিল। নবান্নের অদূরে কাজিপাড়ায় চাকুরি প্রার্থীরা জমায়েত হয়েছিল। পুলিশ আচমকা তাদের ঘিরে ফেলে গ্রেফতার করে। গ্রেপ্তার হওয়া চাকুরি প্রার্থীদের সংখ্যা ও কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা এখন ও স্পষ্ট নয়। আমরা পুলিশের এই আচরণের তীব্র বিরোধিতা করছি। ঘোষিত প্রতিনিধি ডেপুটেশন কর্মসূচি থেকেও গ্রেপ্তার! এই ধরনের অগণতান্ত্রিক আচরণের আমরা তীব্র বিরোধিতা করি। আমরা দাবি করি, মুখ্যমন্ত্রী অবিলম্বে গান্ধী মুর্তির পাদদেশে ও মাতঙ্গিনী মুর্তির পাশে চাকুরি প্রার্থীদের অবস্থানে আন্দোলনরত চাকুরি প্রার্থীদের কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলুন এবং দুর্নীতির কারণে বঞ্চিতদের অবিলম্বে নিয়োগ দিন।
হুগলির ধনেখালিতে প্রশাসনিক মদতে আদিবাসী বর্গাদার উচ্ছেদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশন নেতৃত্বের বিরুদ্ধেদেওয়া মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবিতে ২২ ডিসেম্বর ২০২২ বালিখাল শ্রীকৃষ্ণ হলের সামনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন তপন ঘোষ, অঙ্কিত মজুমদার ও নীলাশিস বসু। কর্মসূচিটি সঞ্চালনা করেন সুদর্শন গাঙ্গুলী। সভা শেষে কিছুক্ষণের প্রতিকী রাস্তা অবরোধ করা হয় পার্টি নেতৃত্বের ওপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে।
মধ্যপ্রদেশ জুড়ে ৩২,০০০ কন্ট্রাক্ট স্বাস্থ্য কর্মীরা ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে শুরু করেছেন অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘট। কোভিড অতিমারী যুজতে বিভিন্ন রাজ্যগুলো যখন প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে, তখন এই ধর্মঘট বেশ বিপাকেই ফেলল রাজ্য সরকারকে। এই বিপুল সংখ্যক ঠিকা কর্মীরাই কোভিডকালীন পর্বে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রেখেছিলেন।
নিয়মিতকরণের দাবিতে এই ধর্মঘট ইতিমধ্যেই ৫২টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর ও বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে।
ধর্মঘটীদের মধ্যে রয়েছেন ডাক্তার, নিচুতলার সহায়ক কর্মী। গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতেও এই ধর্মঘটের ভালোই প্রভাব পড়েছে।
ধর্মঘটিরা বেশ কিছু অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। দাঁত দিয়ে খড় কামড়ানো, স্থানীয় বিধায়কের সামনে ঝাড়ু দেওয়া, ঠিকা শ্রমিকের এক মৃতদেহ খড় দিয়ে বানিয়ে শব যাত্রা করা প্রভৃতি। দিন কয়েক আগে, রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ঘেরাও করার সময়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে কোমরে দড়ি বাঁধা হয়, যা ধর্মঘটিদের আরো ক্ষিপ্ত করে তুলেছে।
৩২,০০০ কন্ট্রাক্ট কর্মীর নিয়মিতকরণের পাশাপাশি ইতিমধ্যে যাদের ছাঁটাই করা হয়েছে, তাদের পুনর্বহাল, যে সমস্ত কাজগুলো বাইরের এজেন্সির কাছে পাচার করা হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনার দাবি ও রয়েছে। ইতিমধ্যে ৯ দফা আলাপ আলোচনা হওয়া সত্ত্বেও সমাধানের কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।
ধর্মঘটীদের বক্তব্য, ২০১৩ সালে সরকার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার একটাও পালন করেনি।
(সূত্র: দ্য হিন্দু, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২)
শুধুমাত্র পশ্চিমবাংলাই নয়, মনরেগার টাকা কেন্দ্রীয় সরকার বকেয়া রেখেছে ১৮টি রাজ্যের। এই প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি চলছে এই অভিযোগে মোদী সরকার প্রায় একবছর ধরে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন ‘মনরেগা’র টাকা আটকে রেখেছে। খুব সম্প্রতি, সরকারি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, শুধুমাত্র এরাজ্যই নয়, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ১৮টি রাজ্যের কাছে কেন্দ্র ১০০ দিন প্রকল্পের প্রাপ্য ন্যায্য মজুরির ৪,৭০০ কোটি টাকা ও ১৯টি রাজ্যের কাছে মেটিরিয়াল খরচ বাবদ ৫,৪৫০ টাকা বকেয়া রেখেছে। এদিকে, চলতি অর্থবছর শেষ হতে বাকি রয়েছে মাত্র তিন মাস!
এই বকেয়া ৪,৭০০ কোটি টাকার মধ্যে বাংলার বকেয়াই হল ২,৭৪৮ কোটি টাকা। এই টাকার অঙ্কটাকে পাশে সরিয়ে রাখলে দেখা যাবে, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ১৭টি রাজ্যকে এই খাতে বকেয়া ২,০০০ কোটি টাকা দিলনা কেন্দ্রীয় সরকার। এই তালিকার মধ্যে রয়েছে নাগাল্যান্ডও, যার বকেয়া ১৯২ কোটি টাকা। আর, নাগাল্যান্ডে সরকার ঘোষিত মজুরি হল দৈনিক ২১৬ টাকা — যার অর্থ ৮ লক্ষ কর্মদিবসের মজুরিও ওই রাজ্য এখনও প্রদান করতে পারল না।
অন্যান্য রাজ্যে বকেয়ার পরিমাণ হল — উত্তরপ্রদেশ ২৮৪ কোটি টাকা, বিহার ২৮৭ কোটি টাকা, ঝাড়খন্ড ২৬৩ কোটি টাকা, তামিলনাড়ু ১৭৩ কোটি টাকা। এদিকে আইন বলছে, ১৫ দিনের মধ্যেই বকেয়া টাকা প্রদান করতে হবে।
শুধুমাত্র মজুরি বকেয়া নয়, ১৯টি রাজ্যের কাছে মেটিরিয়াল বাবদ কেন্দ্র বকেয়া রেখেছে ৫,৪৫০ কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি বকেয়া রয়েছে এই রাজ্যে।
এই প্রকল্পটি গুটিয়ে ফেলার পরিকল্পনা ছিল মোদী সরকারের। ধারাবাহিকভাবে এই খাতে বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁট করেই গলা টিপে মেরে ফেতে চাইছে কেন্দ্র।
(সূত্র: দ্য হিন্দু, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২)
স্পেন সংসদের নিম্নকক্ষ এই আইনের অনুমোদন দিল যে এরপর থেকে ১৬ বছরের ঊর্ধ্বে যে কেউ তার আইনি জেন্ডারকে বদলাতে পারবে কোনো ধরনের মেডিকাল সুপারিশ ছাড়াই।
মধ্য-বাম জোট সরকারের পক্ষ থেকে যে আইন পাস করানো হল, তাতে বলা হয়েছে, ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে কেউ যদি নিজের জেন্ডার বদলাতে চায়, তবে অভিভাবক বা আইনি অভিভাবকের অনুমোদন দরকার, আর ১২ থেকে ১৩ বছরের কেউ এই বদল ঘটাতে চাইলে বিচারপতির অনুমোদন নিতে হবে।
এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে বিরাট উল্লম্ফন!
ব্রিটেনের কয়েক হাজার অ্যাম্বুলেন্স চালক ২১ ডিসেম্বর ২০২২ পালন করলেন একদিনের সর্বাত্মক ধর্মঘট। নিরুপায় হয়ে সরকার জনগণের কাছে আবেদন রেখেছে অপ্রয়োজনে, মদ্যপ অবস্থায়, বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালানো থেকে যেন ব্রিটেনবাসী নিজেদের বিরত রাখেন, কারণ দুর্ঘটনা ঘটলে অ্যাম্বুলেন্স, স্বাস্থ্যকর্মী, বা যারা জরুরি পরিষেবার সাথে যুক্ত, তাদের পাওয়া যাবে না। বিগত তিন দশকে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে এটা বৃহত্তম কর্মবিরতি।
ইউনিয়ন জানিয়েছে, মুমূর্ষু বা বিপন্ন রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা তারা অব্যাহত রাখবেন, কিন্তু সরকার জানিয়েছে প্রত্যেকের জন্য অ্যাম্বুলেন্স নিশ্চিত করার মতো অবস্থা নেই।
জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার মেডিকাল ডিরেক্টর জানান, বছর শেষ ও বড়দিনের এই সপ্তাহান্তে সকলেই আনন্দ ফুর্তি করেন, মদ্যপানও অতিরিক্ত হয় অনেকের ক্ষেত্রে। ওই অবস্থায় গাড়ি চালালে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায় আর তা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরও বাড়তি চাপ তৈরি করে। তাই নিজেদের সংযত রাখার আবেদন সরকারিভাবেই করা হয়েছে।
এই নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে, ১০.৭ শতাংশ হারে। তাই, তাঁদের বেতনে বড় ধরনের বৃদ্ধি ঘটানোর দাবি তারা তুলেছেন। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের বক্তব্য বেশি বেতন বাড়ালে তা মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেবে।
অ্যাম্বুলেন্স চালকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ আবার তারা একদিনের জন্য কর্মবিরতি পালন করবেন। বড়দিনের এই উৎসব মরশুমের মধ্যেই রেল কর্মী, পাসপোর্ট অফিসার, ডাক কর্মীরাও কর্মবিরতি পালন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন।
রাষ্ট্রীয় পরিবহণ শিল্প নিয়ে একদিন পশ্চিমবাংলার মানুষের গর্ব ছিল। উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গের শহর তথা রাজ্যের প্রত্যন্ত শহরতলির মানুষের ভরসা ছিল রাষ্ট্রীয় পরিবহণ। আজ আর সেই ভরসা নেই। একসময় এই শিল্পের কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা, আইনি অধিকার বা শিল্পের বিস্তারের যে বিষয়গুলি ছিল আজ তার কোনোটাই নেই। এই শিল্পকে রুগ্ন করা এবং রাজ্যে প্রাইভেট পরিবহণ মালিকদের রমরমা ব্যবসার সুবিধা করে দেওয়ার সূচনা হয়েছিল বামফ্রন্টের আমল থেকেই, স্থায়ী কর্মী নিয়োগের পরিবর্তে অস্থায়ী, কন্ট্রাক্ট প্রথা চালু করা। কম পয়সায় স্থায়ী কর্মীদের মতো খাটিয়ে নেওয়া। আইন অনুযায়ী মজুরি, ওভারটাইম, গ্র্যাচুইটি, বোনাস, ছুটি না দেওয়ার শুরু সেই সময় থেকেই। রুট ফ্রাঞ্চাইজির মাধ্যমে ব্যক্তি মালিকদের হাতে লাভজনক রুট তুলে দেওয়া। প্রাইভেট বাসের মালিকদের লাভ করানোর জন্য লাভজনক রুট থেকে রাষ্ট্রীয় পরিবহনের বাস বন্ধ করে দেওয়া, ইত্যাদি।
কফিনের শেষ পেরেকটা পুঁতে দিল মা-মাটি-মানুষের সরকার। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু হল ঠিকা প্রথার মাধ্যমে লাগামহীন শ্রমিক নিয়োগ। সরকারী সংস্থায় চাকরি দেওয়ার নামে গ্রামগঞ্জ থেকে মুলত পূর্বমেদিনীপুর থেকে গরিব কৃষক ঘরের বেকার যুবকদের (শোনা যায় মোটা টাকার বিনিময়ে) ঠিকাদারের (ফ্রাঞ্চাইজি) অধিনে নিয়োগ করা শুরু হল। শোনা যায় এইসব ঠিকাদাররা সরকারি আমলা এবং শাসক দলের ঘনিষ্ট। বর্তমানে এই সংস্থায় স্থায়ী শ্রমিকের চাইতে অস্থায়ী, কন্ট্রাক্ট ঠিকা শ্রমিকেরা সংখ্যায় বেশি। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকার বহু মূল্যবান জমি বেচে দেওয়া হল জলের দরে। প্রায় সাড়ে চারশো কাঠা জমি বেচে দেওয়া হল মাত্র আড়াই হাজার কোটি টাকায়। জমি বেচার সময় বলা হয়েছিল পরিবহন শিল্প রুগ্নতায় ভুগছে তাই জমি বেচার টাকা শিল্পের পুনর্গঠনের কাজে ব্যায় করা হবে। আমরা দেখলাম এই টাকা শিল্পের পুনর্গঠনে ব্যবহার করা হল না। এই টাকা কোন খাতে ব্যায় হল তাও জানা গেল না। ধীরে ধীরে পাঁচটি সংস্থাকে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি সংস্থাকে (সিটিসি, সিএসটিসি, ডবলুবিএসটিসি বা ভুতল) একত্র করে ডবলুবিটিসি (ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন) নামে নিগম বানানো হয়েছে। স্থায়ী নিয়োগ বন্ধ। অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিকদের চাকরি তথা সামাজিক নিরাপত্তা বলে কিছুই নেই। সীমাহীন শোষণের সাথে প্রয়োজন মতো নিয়োগ, প্রয়োজন মত ছাঁটাই চলছে। পরিবেশ দূষণের অজুহাতে টাটা কম্পানির সাথে গোপন চুক্তিতে প্রায় তিন শতাধিক ব্যাটারি চালিত বাস আনা হয়েছে। জানা যাচ্ছে আগামীদিনে এই বাসগুলি চালানোর জন্য টাটা কোম্পানির অধিনে ঠিকাদার মারফৎ শ্রমিকরা কাজ করবেন, সংস্থা এরপর থেকে আর কোনও শ্রমিকের দায়িত্ব নেবে না। এক কথায় এই শিল্পকে ধ্বংস করার এক বিশাল ষড়যন্ত্র চলছে।
২০০১ সালে বামফ্রন্ট সরকারের এবং সিআইটিইউ নেতৃত্বের ভ্রান্ত নীতির কারণে আজ প্রায় সহস্রাধিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা পেনসনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত বহু শ্রমিক ‘শ্রমিক সমবায়ে’ তাঁদের নিজেদের গচ্ছিত টাকা ফেরত পাননি। বহু শ্রমিক বামফ্রন্ট আমলে ১০/১৫ বছর লাগাতার অস্থায়ী শ্রমিক হিসাবে স্থায়ী শ্রমিকদের ন্যায় কাজ করেছিলেন, পরবর্তীতে এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে ১০২৪ জন স্থায়ী শ্রমিক হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৩/৪ বছর পর যারা অবসর নিয়েছেন তাঁরা কেউ গ্র্যাচুইটির টাকা পাননি। ২০১৯ সালে এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে কন্ট্রাক্ট, ঠিকা শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে ২ হাজার টাকা বেতন বৃদ্ধি এবং ১,৬০০ টাকা বোনাস আদায় করা সম্ভব হয়েছিল।
২০২০-২১ করোনাকাল এবং ম্যানেজমেন্ট ও শাসক দলের সন্ত্রাসের কারণে ইউনিয়ন কার্যকলাপ প্রায় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় চলে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাসক দল তৃণমূল ইউনিয়নের সদস্যরা বিভিন্ন দাবিতে সিটিসি (ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি) সংস্থায় কর্মবিরতি শুরু করেছিলেন। দু’দিনের মাথায় তৃণমূলের গুন্ডা দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে আন্দোলন ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং ১৪ জনকে ছাঁটাই করা হয়। এই ছাঁটাই শ্রমিকদের নিয়ে এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে শ্রম দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করা হয়। ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয় শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু আজও ম্যানেজমেন্ট এবং শাসক দলের মর্যাদা রক্ষার তাগিদে ১৪ জনকে কাজে ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। যা নিয়ে পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া চালু আছে। গত দুর্গা পুজোর আগে এসবিএসটিসি’র (সাউথ বেঙ্গল ষ্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন) তৃণমূল ইউনিয়নের সদস্যরা তৃণমূলের ঝাণ্ডা এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ছবি গলায় ঝুলিয়ে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। এবারও সেই একই ঘটনার সাক্ষী হলেন পশ্চিমবাংলার শ্রমিকরা। হলদিয়া, দুর্গাপুর, দিঘা, মেদিনীপুর ডিপোর আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর তৃণমূলের গুণ্ডারা হামলা চালালো আর রাজ্য সরকারের পুলিস বেধড়ক লাঠি চার্জ করে দিঘা ডিপোর চারজন তৃণমূল ইউনিয়নের নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলা (হত্যার উদ্দ্যেশে পুলিশকে আক্রমণ) দিয়ে ১৪ দিনের জন্য জেলে পাঠিয়ে দিল। জামিন নিয়ে জেলের বাইরে আসার পর আজও সেই মামলা চলছে। চারজনকেই অন্য ডিপোয় বদলি করা হয়েছে। কর্মীরা সন্ত্রস্ত।
ইতিমধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা যাঁরা এতদিন সিপিএম এবং তৃণমূলের ইউনিয়নের সাথে ছিলেন তাঁরা তাঁদের পেনশন এবং শ্রমিক সমবায়ের টাকা ফেরতের দাবিতে সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বিগত দিনে এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে শ্রমিকদের আন্দোলনের ইতিহাস তাঁরা জানেন। তাই তাঁরা যোগাযোগ করার পর এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে ‘ডবলুবিটিসি নন পেনশনার্স এন্ড পেনশনার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন’ ব্যানারের তলায় প্রায় তিন শতাধিক কর্মীকে সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছে। এই এসোসিয়েশন এবং সংস্থার এআইসিসিটিইউ’র রেজিস্টার্ড শ্রমিক ইউনিয়ন যৌথভাবে কর্মসূচি চালাচ্ছে। পরিবহণ মন্ত্রী, শ্রমমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন কর্মসূচি এবং সিটিসি’র নোনাপুকুর ওয়ার্কশপ গেটে জঙ্গি বিক্ষোভ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দাবিগুলিকে সামনে আনা গেছে। সংস্থার কর্তৃপক্ষ, সরকারের কাছে বিষয়টিকে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে। পরিবহণ শিল্পের কর্মীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করা গেছে। এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন ‘বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম’, ‘অল ইন্ডিয়াল’ইয়ার্স এসোসিয়েশন ফর জাস্টিস’, ‘পিইউসিএল’, ‘পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ’, পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধন কর্মী ইউনিয়ন ইত্যাদি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
কর্মরত স্থায়ী, কন্ট্রাক্ট ও ঠিকা শ্রমিকদের সাথে নতুন করে যোগাযোগ গড়ে উঠছে। যে সকল দাবিগুলিকে সামনে আনা হচ্ছে তা নিম্নরূপ।
১) অবসরপ্রাপ্ত সকল কর্মীকে পেনশন দিতে হবে।
২) অবসরপ্রাপ্ত সকল শ্রমিকের ‘শ্রমিক সমবায়ে’ নিজেদের গচ্ছিত টাকা ফেরত দিতে হবে।
৩) ‘শ্রমিক সমবায়’ থেকে প্রতি বছর ডিভিডেন্ট দিতে হবে। যা বিগত ৩/৪ বছর যাবত বন্ধ রয়েছে।
৪) শ্রমিকদের বকেয়া ডিএ দিতে হবে।
৫) চুক্তিপ্রথা বাতিল করে ওড়িশা সরকারের ন্যায় সকল কন্ট্রাক্ট, ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ করতে হবে।
৬) সংস্থার জমি বিক্রির টাকার হিসাব দিতে হবে। আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে।
৭) ত্রিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী ১৪ জন ছাঁটাই শ্রমিককে কাজে পুনর্বহাল করতে হবে।
৮) করোনাকালে যে শ্রমিকরা কাজ করেছিলেন তাঁদের ছাঁটাই প্রত্যাহার করতে হবে।
৯) রাষ্ট্রীয় পরিবহণ শিল্পকে বেসরকারিকরণ করা চলবে না।
১০) শ্রমিকদের উপর কাজের বোঝা চাপানো চলবে না।
১১) আইন অনুযায়ী ওভারটাইমের পয়সা দিতে হবে। শ্রমিকদের সুচিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে।
১২) বেআইনি বদলি বন্ধ করতে হবে। শ্রমিকের বাড়ির কাছের ডিপোয় কাজ দিতে হবে।
১৩) দুর্নীতিগ্রস্ত ম্যানেজমেন্টের শাস্তি চাই।
১৪) কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমকোড লাগু করা চলবে না।
এই সমস্ত দাবিকে সামনে রেখে রাজ্যের পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার কর্মীদের মধ্যে প্রচারকে ব্যাপক মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা চলছে। আগামীদিনে রাজ্য ভিত্তিক প্রচারের মধ্য দিয়ে সকল কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বকে নিয়ে কনভেনশন করা, পরিবহণ দপ্তর, মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর নবান্ন অভিযান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে বৃহত্তর পরিধিতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কারণ শ্রমিকদের দাবিগুলি আজ যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তেমন এই রাজ্যে অবসরের পর পেনসন না পাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা (পরিবহণ শিল্পের বাইরেও) বহু সহস্রাধিক। পেনশনের সুবিধা না পাওয়ায় অনেক কর্মী অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন, এমনকি সুচিকিৎসা ও পথ্যের অভাবে অনেকে মারাও গেছেন।
তাই আসুন, পরিবহণ শিল্পকে বাঁচাতে এবং শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় পশ্চিমবাংলার মাটিতে আগামী নতুন বছরে এক নয়া ইতিহাসের সূচনা করি।।
- দিবাকর ভট্টাচার্য
দুনিয়া জুড়ে গভীর আর্থিক সংকটের বার্তা নিয়ে আসছে নতুন বছর। খুব সম্প্রতি বিশ্বব্যাঙ্ক বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০২২ সাল জুড়েই বিরাট অনিশ্চয়তা নিয়ে চলার পর বৈশ্বিক অর্থনীতি আবার হোঁচট খেয়ে আরও বেশি মন্থরতার শিকার হয়েছে। অতিমারির ছোবলে ক্ষতবিক্ষত শিক্ষাব্যবস্থা, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির প্রবল দাপট, ভেঙে পড়া জোগান শৃঙ্খল ও অন্যান্য সমস্যায় জর্জরিত ক্ষতবিক্ষত বিশ্বঅর্থনীতি।
বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট জানিয়েছে, ১৯৭০ সালের পর মন্দা পরবর্তী যে পুনরুর্জীবন শুরু হয় মন্থর গতিতে, এবারের পুনরুর্জীবন তার থেকেও অনেক বেশি ধীর গতি সম্পন্ন। দুনিয়া জুড়েই উপভোক্তাদের ভরসা এতটাই তলানিতে যে, এর আগে যতগুলো বিশ্বব্যাপী মন্দা এসেছিল, এবার তা অনেক গুণ বেশি। আর বিশ্বব্যাপী যে তিনটি সর্ববৃহৎ অর্থনীতি রয়েছে — মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও ইউরো জোন — তাদের দিনের পর দিন গতিভঙ্গ হচ্ছে। গভীর উদ্বেগ নিয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনীতির উপর সামান্যতম আঘাত নেমে আসলেই তা গভীর মন্দার কবলে ঠেলে দেবে।
বিশ্বব্যাঙ্কের আরও কয়েকটি পর্যবেক্ষণ
ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চহারে মূল্যস্ফীতি, জোগান শৃঙ্খলের বিপর্যয়, বিশ্বজুড়েই আর্থিক গতিভঙ্গ — এই সবকিছুর সম্মিলিত প্রভাবে সার ও অন্যান্য কৃষি ক্ষেত্রের আনুষঙ্গিক ইনপুট ও পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে দুনিয়াব্যাপী ২০২২ সালে নিদারুণ খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
বিগত কয়েক দশক ধরে বৈশ্বিক দারিদ্র কমাতে নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছিল, কোভিড তার উপর বিরাট আঘাত নামিয়েছে। নানা দেশে এর প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন।
এর পাশাপাশি, গতবছর জুড়েই উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সংকট আরো ঘোরালো হয়ে উঠেছে। বিশ্বের অন্তত ৬০ শতাংশ দরিদ্রতম দেশের ঋণ সংকট সেই সমস্ত দেশগুলোকে গভীর খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে।
অতিমারী ও রিয়াল এস্টেটের নানা সংকট দেখে বিশ্বব্যাঙ্ক চিনের বৃদ্ধির আগেকার অনুমান কমিয়ে দিয়েছে। সামনের বছরের জুন মাসে তাদের ৪.৩ শতাংশের অনুমানকে কমিয়ে ২.৭ শতাংশ করেছে। পাশাপাশি আগামী বছরের জন্য ৮.১ শতাংশের আনুমানিক বৃদ্ধিকে কমিয়ে ৪.৩ শতাংশ করেছে।
২০২২’র শেষে, আলোচ্য রিপোর্ট জানিয়েছে, ৬৮ কোটি ৫ লক্ষ মানুষ নিক্ষিপ্ত হবে চরমতম দারিদ্রের কবলে।
আইএমএফ অক্টোবরেই জানিয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনীতির এক তৃতীয়াংশের ও বেশি বিরাট সংকোচনের মুখে পড়বে আর, ২০২৩-এ বিশ্ব জিডিপি দুই শতাংশেরও কম হারে অত্যন্ত মন্থর গতিতে বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে ২৫ শতাংশ।
ভারতের অর্থনীতির সামনে কী সমস্যাগুলো থাকছে?
আইএমএফ সামনের বছরের জন্য ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির যে অনুমান আগে করেছিল, তা কমিয়ে ৬.৮ শতাংশ করেছে। আগে তারা অনুমান করে বৃদ্ধির হার হবে ৭.৪ শতাংশ হারে। এই নিয়ে তৃতীয়বার আইএমএফ তাদের অনুমানিক বৃদ্ধির সংশোধন করল। আর, ২০২৪-এ তা আরো শ্লথ হয়ে দাঁড়াবে ৬.১ শতাংশ হারে।
এদিকে, রিজার্ভব্যাঙ্কের মনিটারি পলিসি কমিটির সদস্য জয়ন্ত আর ভার্মা ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির সম্ভাবনার পথে নিজের উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, “ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি খুবই ভঙ্গুর ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে”। তার অভিমত, দেশীয় অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে চারটি ইঞ্জিন — রপ্তানি, সরকারি ব্যয়, মুলধনী বা ক্যাপিটাল বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিগত ভোগব্যয়। যেহেতু বিশ্বব্যাপী মন্থর আর্থিক পরিমন্ডলে রপ্তানি কখনই বৃদ্ধির মুখ্য পরিচালক হতে পারেনা, সরকারও রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করার মতো অবস্থায় নেই নানান বাধ্যবাধকতার জন্য, মুলধনী বিনিয়োগ ও ব্যক্তিগত ভোগব্যয় এখনও গতি পায়নি, অর্থাৎ চারটে ইঞ্জিনই বেশ কিছু সমস্যার মুখে পড়ে আর্থিক বনিয়াদের ভিত্তিকেই ভঙ্গুর করে দিয়েছে। ক্ষমতার অলিন্দে পোষ মানা অর্থনীতিবিদরা কান ঝালাপালা করা প্রচার চালিয়ে বলছেন যে বিশ্বের বৃহৎ অর্থব্যবস্থার তুলনায় ভারতের অর্থনৈতিক বনিয়াদ নাকি অনেক মজবুত। ভারতের শেয়ার বাজারে বিপুল পরিমাণে আন্তর্জাতিক প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি প্রবেশ করে দেশের শেয়ার সূচককে বাড়িয়ে দেওয়ার যে ঢাক পিটিয়ে তারা ভারতের আর্থিক উজ্জীবনের গালগপ্পো শোনাচ্ছিলেন, দিন কয়েক আগে দেশের শেয়ার বাজারে হঠাৎ বিরাট ধ্বস নেমে নিফটিকে ১৭,৯০০’র নিচে নামিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে কেড়ে নিল ৭ লক্ষ কোটি টাকা! যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো কোভিড কালীন ও কোভিড পরবর্তী ঝড়ঝাপ্টা সামাল দিতে সক্ষম হয়, রিজার্ভব্যাঙ্ক জানাল যে ২০২৩-এ তার সামনে বড় ধরনের সংকট আসছে।
২০২২-২৩-এ আর্থিক বৃদ্ধির যে আশা করা হয়েছিল, প্রকৃত বৃদ্ধির পরিমাণ তার থেকে কম হবে বলে অনুমান। গত অর্থবর্ষের তুলনায় এই অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে উৎপাদন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে ৪.৩ শতাংশ হারে। উৎপাদন ও খনি — এই দু’টি ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে যেগুলো শ্রম নিবিড় শিল্প, আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে রপ্তানি হ্রাস, অত্যন্ত উচ্চহারে মূল্যস্ফীতি, ইনপুটের মূল্য বৃদ্ধি, যা দেশের আনুমানিক বৃদ্ধির হারকে টেনে নিচে নামিয়েছে। গ্রামীণ উদ্বৃত্ত শ্রমকে এই উৎপাদন ক্ষেত্রে স্থান করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যে সুযোগ থাকে, তা বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। সরকারি তথ্যই তা কবুল করেছে। কোভিড হানা দেওয়ার আগে থেকে ভারতের মন্থর আর্থিক বৃদ্ধি এখনও বহাল রয়েছে, আম জনতার ক্রয় ক্ষমতা সংকুচিত হওয়ায় বাজারে চাহিদার যে নাছোড় অভাব তৈরি হয়েছে, এই ধুঁকে ধুঁকে চলা আর্থিক পরিমন্ডলে বিনিয়োগকারীরাও নতুন বিনিয়োগ করছে না। রেকর্ডবেকারত্ব অর্থনীতির সংকটকে দিনের পর দিন আরও ঘোরালো করে তুলেছে। বিশ্ব জুড়েই ২০২২-এ থমকে যাওয়া আর্থিক বৃদ্ধি, ২০২৩এ দুনিয়ায় নেমে আসা আর্থিক মন্দার সম্ভাবনা ঋণ ব্যবসার উপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
দেশীয় অর্থনীতির আকাশে তাই অনিশ্চয়তার নিকষ কালো মেঘ। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাবধানবাণী আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো অনবরত দিয়ে চলেছে। নতুন বছর তাই অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হচ্ছে ভারতীয় বামপন্থীদের কাছে।
- অতনু চক্রবর্তী
সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনে (আফস্পা) বলীয়ান হয়ে ভারতীয় সেনারা যে অসংখ্য নারকীয় হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সংঘটিত করেছে, সেই ইতিহাসে সর্বশেষ আখ্যানটা যুক্ত হল গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ জম্মু ও কাশ্মীরের রাজৌরিতে। সেনার গুলিতে নিহত হলেন দুই যুবক সুরেন্দ্র কুমার ও কমল কিশোর, আর গুরুতর রূপে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা অনিল কুমার। নিহত দুই যুবকই রাজৌরির ফালিয়ানার মুরাদপুর গ্ৰামের বাসিন্দা। নিহতরা সেনা শিবিরের ক্যান্টিনে মালবাহকের কাজ করতেন। শুক্রবার সকালে কাজে যোগ দিতেই তাঁরা সেনা শিবিরের দিকে যাচ্ছিলেন, আর সে সময়েই সকাল ৬টা ১৫ মিনিট নাগাদ সেনা শিবিরের আলফা গেটে প্রহরারত সেনা জওয়ান গুলি চালিয়ে দু’জনকে হত্যা ও একজনকে গুরুতর রূপে আহত করে।
যেকোনো সংঘটিত অপরাধের পর সেনাবাহিনী যে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। গুলিচালনার ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা সেনার গুলিতেই ঐ যুবকদের নিহত হতে দেখলেও সেনারা বলল যে, ঐ দুই যুবক জঙ্গিদের গুলিতেই নিহত হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে সেনা নিপীড়নের যেকোনো ঘটনাতেই সেনারা সাধারণত বিজেপির সমর্থন পেয়ে থাকে। ব্যাপক সংখ্যাধিক ঘটনাতেই নিহত হয় মুসলিম যুবকরা, আর বিজেপি তাই সেনাদের বিরোধিতা করার কোনো তাগিদ অনুভব করে না। কাঠুয়ায় যাযাবর সম্প্রদায়ের ৮ বছরের নাবালিকার ধর্ষণের ঘটনার কথা স্মরণ করুন। ধর্ষকদের সমর্থনে হিন্দু একতা মঞ্চ শুধু মিছিলই সংগঠিত করেনি, রাজ্য সরকারে থাকা বিজেপির দুই মন্ত্রীও ধর্ষকদের সমর্থনে বক্তব্য রেখেছিলেন, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে পুলিশি পদক্ষেপকে ‘জঙ্গলরাজ’ বলে অভিহিত করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। পরিস্থিতির চাপে সেই বিজেপিও এবার সেনার বিরুদ্ধাচারণে বাধ্য হয়েছে। নিহত যুবকরা স্থানীয় অঞ্চলের বাসিন্দা যেটি বিজেপির প্রভাবান্বিত এলাকা বলেই সবাই জানে, এবং স্থানীয় জনগণের প্রবল সেনা-বিরোধী মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সেনার হত্যাকাণ্ডের পক্ষে দাঁড়ালে সমর্থন ভিত্তির ভিন্ন মুখে ঘুড়ে গিয়ে নির্বাচনে প্রতিকূল প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। নিহত দুই যুবকই ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের। জম্মু ও কাশ্মীরের বিজেপির তফশিলি জাতি মোর্চার সহ-সভাপতি গারু সানেহি বললেন, “সেনারা বলছে যে এই দুই যুবককে মেরেছে জঙ্গিরা; আমি তাদের এই প্রশ্নটা করতে চাই যে তাদের কথাটা যদি সত্যিই হয় তাহলে তারা কেন তল্লাশি ও ঘেরাও অভিযান শুরু করল না? ওরা মিথ্যা কথা বলছে। ওরা সারা দিনে একবারও শিবির থেকে বেরোয়নি।” প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সাথে বিজেপি নেতা বক্তব্যও জঙ্গিদের গুলিতে দুই যুবকের নিহত হওয়ার সেনা বিবৃতিকে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করছে, সেনা জওয়ানের গুলিতে যুবক দ্বয়ের নিহত হওয়া নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ আর থাকছে না।
সেনার গুলিতে যুবকরা নিহত হওয়ার পর স্থানীয় জনগণ যথারীতি প্রতিবাদে নামেন। জম্মু-পুঞ্চ সড়ক অবরোধ চলে সাত ঘণ্টা ধরে। সেনা পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদে অংশ নেন তাঁদের মধ্যে অনেক প্রাক্তন সেনা কর্মীও ছিলেন। বিক্ষুব্ধ জনতা সেনা শিবির লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে থাকে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যাওয়া পুলিশ বাহিনীও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অপারগ হয়। প্রতিবাদরত জনগণ দোষী সেনাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ ও কাজের দাবিকে তুলে ধরে। প্রাপ্ত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ রাতে দুই যুবকের হত্যার তদন্তে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছে, এবং সিট’এর রিপোর্ট হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে পারে কিনা, এবং সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে হত্যাকারী যথাযোগ্য শাস্তি পায় কিনা তা দেখার জন্য নিহতদের পরিবার অবশ্যই সাগ্ৰহে অপেক্ষা করবে।
যদি বলা হয় যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে জম্মু ও কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রে সেনা নির্মমতার সমস্ত ঘটনায় উৎস হয়ে থেকেছে সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন বা আফস্পা, তবে সেই অভিমতকে অতিশয়োক্তি হিসাবে খারিজ করার খুব একটা ভিত্তি থাকতে পারে না। আসাম রাইফেলসের হাতে মনোরমার হত্যা সহ অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে; একবছর আগে ২০২১’র ডিসেম্বরের গোড়ায় সেনারা নাগাল্যান্ডের মন জেলার ওটিং গ্ৰামে ১৭ জন নিরপরাধ কয়লা শ্রমিক ও গ্ৰামবাসীদের হত্যা করে; গোটা জম্মু ও কাশ্মীর এখন সেনাদের বুটের তলায়, সেনা নির্মমতায় সেখানের কত পরিববার ধ্বংস হয়ে গেছে, উধাও হয়ে যাওয়া অসংখ্য যুবকের মা-বাবার হাহাকারে উপেক্ষা ও অমানবিকতাই রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া হয়ে দেখা দেয়, কত অঘোষিত কবরস্থানে চোখের আড়ালে রাখার চেষ্টা হয় রাষ্ট্রীয় পৈশাচিকতাকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেনা উৎপীড়নের প্রতিটি ঘটনার পরই আফস্পার বিদ্যমানতা প্রশ্নের মুখে পড়ে, তার বাতিলের দাবি ওঠে। এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের আলোচনাতেও কোনো কোনো দেশ ভারতকে আফস্পা বাতিলের পরামর্শ দেয়। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মূর্তিমান প্রতিভূ আফস্পাকে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পরিহাস কি চলতেই থাকবে?
- জয়দীপ মিত্র
এবছর বিশ্বজুড়ে অসময়ে তীব্র বৃষ্টি, দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনকেই কারণ হিসেবে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। এ আলোচনাই এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে মূল আলোচ্যসূচি হয়ে উঠেছিল। গরিব ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর চাপে শেষপর্যন্ত মিশরের শার্ম আল শেখে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশকে সহায়তা দিয়ে হয় ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ চুক্তি।
তীব্র বৃষ্টি এবং হিমবাহ গলে সৃষ্ট জল পাকিস্তানে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা নিয়ে আসে। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এ বন্যা পাকিস্তানের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে; মারা পড়ে ১৭৩৯ জন, ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এমনিতেই অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত পাকিস্তান সরকারকে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্বারস্থ হতে হয় আন্তর্জাতিক মহলের।
কেবল আফ্রিকাতেই বন্যা এবছর দুই হাজারের মতো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে নাইজেরিয়ায়, ছয় শতাধিক। বন্যার কারণে দেশটিতে কলেরার প্রাদুর্ভাবও দেখা দেয়, তাতে মৃত্যু হয় আরও ৬৪ জনের।
জুলাইয়ে ভারতের অমরনাথে মেঘ ভেঙে বৃষ্টিতে সৃষ্ট হঠাৎ বৃষ্টিতে অন্তত ১৬ জন নিহত হন। মে মাসে শুরু হওয়া উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যায় ৩০০’র বেশি মানুষ মারা যান। ক্ষতিগ্রস্ত হন দুই দেশের প্রায় কোটিখানেক মানুষ। মে-জুনে ব্রাসিলের উত্তর-পূর্বে বন্যা-ভূমিধসে শতাধিক নিহত হয়। জুনে আসামের শিলচরে মনুষ্যসৃষ্ট বন্যাও কেড়ে নেয় ২০০’র বেশি মানুষের প্রাণ।
মে, জুলাই, আগস্টে আফগানিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় মারা যান ৬৭০ জন। ব্রাজিলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রিউ দি জানেইরুর পিত্রোপোলিসে তীব্র বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা, ভূমিধস কেড়ে নেয় ৩৬৫ জনের প্রাণ। মে’তে ব্রাজিলের রিসিফের বন্যায় মারা যান আরও ১০৬ জন। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চলে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির মূল্য। দাঁড়ায় ৫০০ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার। জুলাইয়ের শেষদিকে ইরানে ৩১টি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়া বন্যা কেড়ে নেয় আরও ৯৫ জনের প্রাণ।
জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়াবহ বন্যায় মৃত্যু ৪ হাজারে কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তীব্র বৃষ্টিকেই মূলত এই বন্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে জুলাই-আগস্টের বন্যায় প্রাণ হারিয়েছে ৪৪ জন। এবছর বন্যা হয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো মরুপ্রধান দেশেও।
চলতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ অংশে ভয়াবহ তাপদাহের দেখা মেলে, সেসময় ওই অঞ্চলের তাপমাত্রা মধ্যপ্রাচ্যের তাপমাত্রাকে অতিক্রম করে পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ অঞ্চলে।
উত্তর আমেরিকায় মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাপদাহ শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। এবছর চীনেও জুন-আগস্টে ভয়াবহ তাপদাহ দেখা যায়। জুন থেকে আগস্টে একাধিক তাপদাহে ইউরোপ দেখে বিপুল সংখ্যক মৃত্যু। জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্তুগালে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়।
তাপদাহের কারণে ভারত ১৯০১ সালের পর এবছরই সবচেয়ে উষ্ণ মার্চ মাস পেয়েছে। কাছাকাছি সময়ে পাকিস্তানের নওয়াবশাহ শহরের তাপমাত্রা ছোঁয় ৪৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি। পাকিস্তানের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শেরি রেহমান সেসময় বছরটিকে ‘বসন্তবিহীন’ বছর বলে অভিহিত করেন। তাপদাহ মে’র প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কেবল সরকারি হিসাবেই দেশ দু’টির ৯০ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।
জুনের শেষদিক থেকে জাপানে তাপদাহ শুরু হয়। শেষ হয় আগস্টে। তাপদাহের কারণে দেশটিতে ১৫ হাজারের বেশি লোককে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ইউরোপ চলতি বছর ৫০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে খরা দেখেছে; খরা ভুগিয়েছে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোকেও।
আফগানিস্তানে এবছর ৩টি ভূমিকম্প হয়েছে। এরমধ্যে জুনে খোস্তে ভূমিকম্পে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ যায়। বাকি দুই কম্পন কেড়ে নিয়েছে আরও প্রায় অর্ধশত প্রাণ। নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমা জাভায় ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে মৃত্যু হয় ৩৩৪ জনের। চীনের সিচুয়ানে ভূমিকম্পে মারা গেছে ১০০’র কাছাকাছি মানুষ।
এবছর পাপুয়া নিউগিনি, মেক্সিকো, জাপান, টোঙ্গা, পেরু, ফিলিপিন্স, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ভানুয়াতু, নিউ কালাদোনিয়া ও ফিজিতে ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প দেখা গেলেও এগুলোতে খুব বেশি প্রাণহানি হয়নি।
কলম্বিয়ায় ডিসেম্বরে ভূমিধসে প্রাণ যায় ৩৩ জনের। জানুয়ারিতে ব্রাজিলে পাহাড় থেকে ধসে পড়া পাথর লেকে ঘুরে বেড়ানো পর্যটকবাহী নৌকায় পড়লে নিহত হয় ১০ জন।
প্রায় ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে জানুয়ারির শেষদিন ও ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন ইকুয়েডরে একাধিক ভূমিধসে প্রাণ যায় প্রায় ৩০ জনের। জুনে ভারতের মণিপুরে ভূমিধসে মৃত্যু হয় ৫৮ জনের।
ঘূর্ণিঝড় আনা জানুয়ারিতে মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালাউয়ি, জিম্বাবুয়ে ও জাম্বিয়ার ১৪২ জনের প্রাণ নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় বাতসিরাই কেড়ে নিয়েছে মাদাগাস্কারের শতাধিক বাসিন্দাকে। মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক ও মালাউয়িতে ঘূর্ণিঝড় গোম্বের কারণে মৃত্যু হয়েছে ৭২ জনের। এপ্রিলে ফিলিপিন্সে আঘাত হানা মেগি নেয় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণ।
ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় তাণ্ডব চালানোয় নোরু’তে ৪০ জনের প্রাণ গেছে। একই মাসে দক্ষিণ আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ইয়ানে মৃত্যু হয়েছে দেড় শতাধিক মানুষের।
পরের মাসে মধ্য ও উত্তর আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় দ্বীপের বেশ কয়েকটি দ্বীপদেশকে ভোগানো ঘূর্ণিঝড় জুলিয়ায় প্রাণ যায় ৯১ জনের। অক্টোবরে ফিলিপিন্সে নালগায়ে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ গেছে ১৬৪ জনের।
এবছর যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপের পাশাপাশি আফ্রিকার মরক্কো, এশিয়ার কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া, পাকিস্তান ও রাশিয়ার সাইবেরিয়ার লাখ লাখ একর জমি পুড়ে গিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশে দেশে বজ্রপাতের পরিমাণও বাড়ছে। এবছর কেবল ভারতেই বজ্রপাতে ৯০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
২০২২’র এই সমস্ত বিপর্যয় বুঝিয়ে দিচ্ছে যে পরিবেশের সঙ্কট সভ্যতার সঙ্কট ডেকে আনছে৷ এই সঙ্কটের পেছনে আছে মুনাফালোভী পরিবেশ অসচেতন নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা। বিশ্বজুড়ে যে পরিবেশ আন্দোলন দেখা যাচ্ছে তা এক বিকল্প নীতির অনুসন্ধান জরুরি মনে করছে। আমাদের পরিবেশ আন্দোলনের বিষয়গুলিকে আত্মস্থ করা, তাতে সামিল হওয়া ও তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে আরো আন্তরিক ও উদ্যমী হতে হবে।
- সৌভিক ঘোষাল
রোজ রাতে ৮২ কোটি বেশি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় ঘুমোতে যান। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম-এর পরিসংখ্যান থেকে বেরিয়ে এসেছে এই ভয়ঙ্কর ছবি। অতিমারীর দু’বছর দুনিয়াকে দাঁড় করিয়েছে প্রবল ক্ষুধার সামনে — ২০১৯ সালে, অতিমারী আরম্ভ হওয়ার অব্যবহিত আগে, গোটা দুনিয়ায় সাড়ে তেরো কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার তীব্র অভাবে ভুগতেন; বর্তমানে সংখ্যাটি তার প্রায় তিন গুণ, সাড়ে চৌত্রিশ কোটি। ৪৯টি দেশে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুর্ভিক্ষের খাদের কিনারে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এই বিপুল ক্ষুধার যে কারণগুলি নির্দেশ করেছে, তার প্রথমটি যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অশান্তি; দ্বিতীয়টি বিশ্ব উষ্ণায়ন; তৃতীয় কোভিড অতিমারী; এবং চতুর্থ কারণ হল খাদ্যপণ্যের বর্ধিত দাম। এ বছর খাদ্যের জোগান কমেছে, উৎপাদন ও ব্যাহত হয়েছে — কিন্তু মূলত ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এই সঙ্কটকে তীব্রতর করেছ।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সঙ্কটের ফলে সারের দাম বেড়েছে বিপুলভাবে, জ্বালানির খরচ বাড়ায় পরিবহন ব্যয় ও বেড়েছে — ফলে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রুশইউক্রেন যুদ্ধ ও খাদ্যের বাজারে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ২৭ শতাংশ আসত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ভুট্টা, সূর্যমুখী ফুলের বীজ ইত্যাদির জোগানও প্রবল ভাবে ব্যাহত হয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি কার্যত নিশ্চিত করেছে যে, আগামী অর্থবর্ষেও এই সঙ্কট বজায় থাকবে। পাশাপাশি রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব — বর্ধিত তাপপ্রবাহ, বন্যা এবং খরার ফলে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ দুই থেকে ছয় শতাংশ অবধি কমতে পারে। অন্য একটি গবেষণা বলছে, ১৯৬৪ থেকে ১৯৯০ অবধি সময়কালে জলবায়ুগত কারণে যেখানে বছরে গড়ে ২.২ শতাংশ খাদ্যশস্য নষ্ট হত, ১৯৯১ থেকে ২০১৫ অবধি সময়কালে সেখানে বছরে গড়ে নষ্ট হয়েছে ৭.৬ শতাংশ ফসল। এছাড়াও, কোভিড-লকডাউনের ফলে আন্তর্জাতিক জোগান শৃঙ্খল বিপর্যস্থ হওয়ার প্রভাব পড়েছে খাদ্যশস্যের জোগানে, এবং ফলস্বরূপ দামে।
এই বিপুল ক্ষুধা স্বভাবতই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়েছে। গত মে মাসে ইরানে গমের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিপুল বিক্ষোভ হয়েছিল। আফ্রিকার বহু দেশ খাদ্যের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের রপ্তানির উপর বিপুল ভাবে নির্ভরশীল — সেই দেশগুলোতে ও জনরোষ ক্রমে বিপজ্জনক আকার ধারণ করছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য অনতিঅতীতের উদাহরণ টেনেছে। টাকার অভাবে ২০১৫ সালে সংগঠনটি সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের জন্য খাবারের জোগান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হওয়ার পরই ইউরোপের ইতিহাসে বৃহত্তম উদ্বাস্তু সঙ্কট তৈরি হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের মত, যে অনুন্নত দেশগুলিতে খাদ্যসঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে, তাদের যদি সেই সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার মতো সামর্থ্য জোগানো না যায়, তবে আবার উদ্বাস্তু সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। নিয়তির কি বিচিত্র পরিহাস! মানব সভ্যতার ইতিহাসে একবিংশ শতাব্দীর মতো সমৃদ্ধ সময় আগে কখনও আসেনি। অথচ, সেই সময়েই বিশ্বের প্রতি দশজন মানুষের মধ্যে একজনকে অভুক্ত অবস্থায় রাত কাটাতে হচ্ছে, নিছক খাদ্যভাব মানুষকে দেশান্তরি হতে বাধ্য করবে বলে আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে! এই বৈশ্বিক সমস্যার আশু সমাধানের জন্য সব দেশকে এক সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে, টাকার সংস্থান করতে হবে।
- আনন্দবাজার পত্রিকা ১৩ ডিসেম্বর ২০২২
জানুয়ারি
সার্বিয়ান টেনিস খেলোয়াড় নোভাক জোকোভিচের ভিসা বাতিল করে, অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে খেলার আগেই তাকে নির্বাসিত করে অস্ট্রেলিয়া — কারণ জোকোভিচের কোভিড-১৯’র টিকা দেওয়া ছিল না।
বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী ও গায়ক পন্ডিত বিরজু মহারাজ ৮৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে একটি শূকর থেকে একজন মনুষ্য রোগীর মধ্যে প্রথম সফল হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট ঘটে।
ফেব্রুয়ারি
রাশিয়া ইউক্রেনকে ‘অসামরিকীকরণ এবং ডি-নাজিফাই’ করার জন্য আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধ এখনও চলছে।
ভারত তার সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই শিল্পীকে হারায় — গায়িকা লতা মঙ্গেশকর (৯২ বছর), যাকে আদর করে ‘ইন্ডিয়াস্ নাইটিংগেল’ বলা হয় এবং সঙ্গীত গায়ক ও পরিচালক বাপ্পি লাহিড়ী (৬৯ বছর) যাকে বলা হয় ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পের ‘ডিস্কো কিং’।
কিংবদন্তি বাঙালি গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
মার্চ
কর্ণাটক হিজাব মামলা: স্কুলে হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে হাইকোর্ট বলেছে যে হিজাব একটি অপরিহার্য ধর্মীয় অনুশীলন নয়।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে তৃণমূল কংগ্রেসের এক রাজনীতিবিদকে খুনের ঘটনায় আটজনকে পুড়িয়ে মারা হয়।
এপ্রিল
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে রাশিয়াকে ৯৩-২৪ ভোটে বহিষ্কার করা হয়। ভারত সহ ৫৮টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
মে
বিজ্ঞানীরা স্যাগিটারাস A* নামের একটি ব্ল্যাক হোলের চিত্র প্রথম উন্মোচন করে, যেটির অবস্থান আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে ৷
ভারতীয় গায়ক কে কে, ৫৩ বছর বয়সে, কলকাতায় একটি লাইভ কনসার্টের পরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন।
জুন
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, এহসান জাফরির স্ত্রীর বিশেষ তদন্ত কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে দায়ের করা আবেদন, খারিজ করে দেয়। এই বিশেষ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ডে নরেন্দ্র মোদী এবং অন্য ৬৩ জনের বিরুদ্ধে মামলায় সবাইকেই নিষ্কৃতি দেওয়া হয়।
পাকিস্তানে বন্যায় ব্যাপক ধ্বংস ও সর্বনাশ হয়েছে, ১৭৩৯’র বেশি মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। এই বন্যা অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এবং এতে ক্ষতির পরিমাণ $১৪.৯ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে।
এবারের গ্রীষ্মকাল ছিল ৫০০ বছরের মধ্যে ইউরোপের সবচেয়ে খারাপ খরা, এতে মহাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ চরম তাপ সংকটের সম্মুখীন হয়।
জুলাই
প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ভূপিন্দর সিং ৮২ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
সিনিয়ার টিএমসি নেতা এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তার সহযোগী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে এসএসসি কেলেঙ্কারিতে কলকাতা থেকে ইডি গ্রেপ্তার করে।
শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভকারীরা — যারা মার্চথেকে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের জন্য বিক্ষোভ করছিল — কলম্বোতে রাষ্ট্রপতির বাড়ি দখল করে।
জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে জাপানের নারা শহরে জনসমক্ষে ভাষণ দেওয়ার সময় খুন হন।
দ্রৌপদী মুর্মু ভারতের ১৫তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দ্রৌপদী মুর্মু হলেন সর্বকনিষ্ঠ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এবং এই পদে অধিষ্ঠিত প্রথম আদিবাসী মহিলা।
আগস্ট
আদালতের নির্দেশ অনুসারে নয়ডায় সুপারটেক টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলা হয়।
সেপ্টেম্বর
রাহুল গান্ধী কন্যাকুমারী থেকে তাঁর ৩৭৫১ কিলোমিটারের দীর্ঘ ‘ভারত জোড়া যাত্রা’ শুরু করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কট্টরপন্থী ইসলামিক সংগঠন ‘পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া’ এবং দেশজুড়ে এর আটটি শাখা সংগঠনকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে।
প্রখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় নরেশ কুমার ৯৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
ইউনাইটেড কিংডমের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৯৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানে ব্যাপক নাগরিক অস্থিরতা ও বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। আমিনিকে ইরানের নীতিপুলিশ বাধ্যতামূলক হিজাব আইন লঙ্ঘনের জন্য গ্রেপ্তার করে এবং হেফাজতেই আমিনির মৃত্যু হয়।
অক্টোবর
এবছর ভারতে চালু হয়েছে ৫জি। এখনও সারা দেশে পরিষেবা চালু হয়নি। অনুমান, আগামী বছরের মধ্যে বেশিরভাগ কাজ সম্পন্ন হবে।
সমাজবাদী পার্টির নেতা ও রাজনীতিবিদ মুলায়ম সিং যাদব ৮২ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
বিশিষ্ঠ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ওআরএস-এর উদ্ভাবক দিলীপ মহলানবিস ৮৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
ব্রাজিলের সাধারণ নির্বাচনে, বামপন্থী লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বর্তমানের জাইর বলসোনারোকে পরাজিত করে বিজয়ী হন।
গুজরাটে একটি ঝুলন্ত সেতু ভেঙ্গে পড়ে অন্তত ১৪১ জনের মৃত্যু হয়।
বিশ্বের জনসংখ্যা ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটিতে পৌঁছেছে।
প্রথম ব্রিটিশ এশিয়ান হিসেবে ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন।
নভেম্বর
টেক জায়েন্টদের পরপর ছাঁটাইয়ের ঘোষণায় শুধুমাত্র ২০২২ সালেই এক লাখেরও বেশি মানুষকে ছাঁটাই করা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল টুইটার (৪৪০০), মেটা (১১০০০) এবং অ্যামাজন (১০০০০)।
২০২২ সালের জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন, জলবায়ু বিপর্যয়ের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলির জন্য ক্ষতির তহবিল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ডিসেম্বর
ভারত ১ ডিসেম্বর ২০২২, পরবর্তী এক বছরের জন্য জি-২০’র সভাপতিত্ব গ্রহণ করে।
২ মাসেরও বেশি ব্যাপক বিক্ষোভের পর, যেখানে ২০০’র বেশি প্রাণ হারিয়েছেন, ইরান তার নীতিপুলিশকে বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বছরের শেষ দিকে ২৭ ডিসেম্বর আমেরিকার বুকে জলবায়ু সঙ্কটের নির্দশন দেখা গেল ‘বম্ব সাইক্লোন’-এ। মৃত্যু হল প্রায় ৬০ জনের। অসংখ্য ক্ষয়ক্ষতির মুখে জনসাধারণ।
উত্তরবঙ্গের জলঢাকা নদীতে এসে মিলেছে মুজনাই নদী। যার ফেলে আসা নাম মানসাই। তবে সময়ের জাঁতাকলে পড়েও মুজনাই কিন্ত মানসাই হয়েই থেকে গেছে সেখানকার মানুষদের কাছে, বলা ভালো উত্তরবঙ্গের মানুষদের কাছে। মানসাইয়ের পাড় ঘেঁষে তৈরি হয়েছে জনপদ। মানসাইয়ের সাথে সখ্য তৈরি করেও তাকে ছেড়ে সেই জনপদের বাইরের পৃথিবীর উদ্দেশে পা বাড়িয়েছে অনেকেই। সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের স্মৃতি আগলে মানসাই আপন গতিতে বয়ে চলছে। আবহমান কালের হিসেব দেওয়ার দায় কী তার আছে! সমস্ত নদীর আত্মকথাই তো তাই! কিন্তু সদ্য যৌবনের ডাকে সাড়া দেওয়া মানোর তো এতকিছু জানার কথাই না! নদীর মতোই উচ্ছল বহমানতা নিয়ে সেতো দিব্য ছিল। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মানোর দেখার আকাশটা তখন শরতের মতোই মেঘহীন। মানো স্বপ্ন দেখতো নিজের মতো করে বাঁচার। তির-তির করে বয়ে চলা মানসাইয়ের জলে পা ডুবিয়ে সে যখন বন্ধুদের সঙ্গে খুশিতে মেতে উঠতো, মাতিয়ে রাখতো সকলকে, তার সেই উচ্ছ্বাসের অনুরণনকে বুক দিয়ে আগলে রাখতো মানসাই। মানোর স্বপ্ন, ভালোলাগা, খারাপ লাগা, নীরব অভিমানের অন্যতম সাক্ষী মানোর আদরের মানসাই। আসলে আজকের সমাজেও কত মেয়েই তো স্বপ্ন দেখে। অন্যরকমভাবে গোছাতে চায় নিজেকে। কিন্তু স্বপ্ন দেখা আর তাকে টিঁকিয়ে রাখার মধ্যে যে হাজার যোজন দূরত্ব! সেই দূরত্ব অতিক্রম করার আগেই, দিন প্রতিদিন পলি জমতে জমতে স্বপ্নের মৃত্যু বা অপমৃত্যু ঘটে। সময়ের আগেই চলার গতি শ্লথ হয়ে আসে কত, কত মেয়ের। তাদের খবর কে রাখে। মানোর সাথেও তাই হল। বিয়ে ঠিক করেছিল পরিবার। কিন্তু মানোর দিকে বরাবরই নজর সমাজের নিকৃষ্ট মানুষের। তারা তুলে নিয়ে যায় মানোকে। তাদের হিংস্রতার শিকার হয় মানো। মানো মন থেকে মেনে না নিলেও পারিবারিক চাপ, সমাজের চাপের কাছে আপাত দৃষ্টিতে হেরে যায়। গ্রামের এক প্রভাবশালীকে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু মানোরা তো হেরে গিয়েও জিতে যাওয়ার দলে। তাই বিয়ের পর নৌকা করে যাওয়ার সময় সে নৌকা থেকে মানসাইয়ের জলে ঝাঁপ দেয়। আপাতদৃষ্টিতে গল্পের ট্রাজিক শেষটা এখানে হলেও মানসাই যেভাবে মানোর শরীরের সাথে সাথে তার মানসিক ক্ষতের জায়গাটিতেও কোমল পরশ বুলিয়ে দিয়ে, তাকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চেয়েছে — তীব্র জলরাশির ঝাপটায় ধুয়ে দিতে চেয়েছে জীবনক্ষত, গল্প বোধহয় সেখান থেকেই বাঁক নেয় নতুন দিকে।
কিছু অবধারিত জিজ্ঞাসা নিয়ে দর্শকরা হল ছাড়েন। মনে থেকে যায় মানসাইকে ঘিরে তৈরি হওয়া প্রশ্ন — এত জানে তবু নদী কথা বলে না... কেন বলে না...
এই জিজ্ঞাসা হয়তো জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলেন গল্পকার অতনু দাস। যিনি এই মানসাইয়ের পাড়েরই ছেলে। তার জীবনের অনেকটা সময় আবর্তিত হয়েছে মানসাইয়ের তীর ধরে গড়ে ওঠা বিরামহীন জনপদের সঙ্গে। তাই তার এই গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে মানসাই। কিন্তু বাস্তব তো কাউকে রেয়াত করে না। তাই লকডাউনের কদর্যতায় অতনু দাস যখন হতোদ্যম তখন শিলিগুড়ির মানুষ, অভিজিৎ দাস, সুরকার রজত বিশ্বাসরা দায়িত্ব তুলে নেন নিজেদের কাঁধে। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণতা পেতে শুরু করে যৌথ স্বপ্ন। তিস্তা বুড়ির গান, ভাওয়াইয়ার সুরে রাজবংশী সমাজের একটুকরো চালচিত্রের ছবি দিন রাত এক করে এঁকে ফেলেন অভিজিৎ দাস, রজত বিশ্বাসরা। ছোট্ট, ছোট্ট মিউজিক স্কোরে আনন্দ, বিষাদ চিহ্ন নিপুণ হাতে এঁকে দেন। কখনও তাতে বাঁশি হাতে যোগ্য সঙ্গত করেন পরেশ রায়। কখনও অন্য কেউ। পায়েল মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ে মানোকে নিশ্চিত মনে থেকে যাবে অনেক, অনেকদিন। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী কৃষ্টি, সংস্কৃতির কথক চুরানব্বই মিনিটের এই সিনেমাটি ইতিমধ্যেই দেখানো হয়েছে ২৮তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে। এছাড়াও কেরল ও বাংলাদেশের দু’টি চলচ্চিত্র উৎসবেও জায়গা করে নিয়েছে ‘মানসাই’। এখন শুধু একটাই চাওয়া — মানসাই ফিরে পাক নতুন গতিপথ — তার আলোতে উদ্ভাসিত হোক উত্তরের জনপদ। জন ডেনভারের গানে, গানে মানসাই ছেড়ে আসা সকলে যেন অন্তত একবার গেয়ে ওঠে, “সেখানেই আমাকে নিয়ে যাও, একবার যেখান থেকে শুরু করেছিলাম। মানসাই!”
- শাশ্বতী
== 000 ==