আজকের দেশব্রতী : ০৮ ডিসেম্বর ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati_08-Dec-22

Leave the hate

৬ ডিসেম্বর দেশে বহু মানুষ বহু গণতান্ত্রিক সংগঠন রাস্তায় নেমে স্মরণ করেছে ভারতের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জানক ও কলঙ্কিত ১৯৯২-এর দিনটিকে যেদিন বাবরি মসজাদক গুড়িয়ে দিয়ে ফ‍্যাসিবাদ ভারতে তার চূড়ান্ত জয়যাত্রার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। দেশজুড়ে মানুষ রাস্তায় নেমে অঙ্গীকার ব‍্যক্ত করেছে দেশে এই হিন্দুত্ববাদী‍ফ্যাসিবাদকে রুখে দাঁড়ানোর। কলকাতায় একটি নাগরিক পদযাত্রায় সামিল হয়েছিল বিভিন্ন গণসংগঠন। হাজরা মোড়ে এই পদযাত্রার শুরুতে বক্তব‍্য রাখতে গিয়ে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন যে ১৯৯১ সালের আগে পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর দিনটা ছিল ভারতে আম্বেদকরের প্রয়াণ দিবস। ১৯৯২ সালে এই দিনে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাটা নিছক একটা মসজিদের ওপরই আক্রমণ ছিল না, তা ছিল ভারতের সংবিধান, ভারতের গণতন্ত্র, ভারতের সমাজের সম্প্রীতির বুনট, ভারতের জনগণের আশা আকাঙ্খার ওপরেই এক চরম আঘাত। সর্বোচ্চ আদালত এই ধ্বংসকাণ্ডকে চরম অপরাধ বলে চিহ্নিত করেও শেষ পর্যন্ত সেই অপরাধীদের হাতেই সেই জায়গাটা তুলে দেয় – এই রায় দেশবাসীকে হতভম্ব করে দিয়েছিল বলে বিবৃত করেন দীপঙ্কর। বিজেপি-আরএসএস তখন হোক বা এখন কিভাবে সরকারী ক্ষমতা ও রাস্তার ঠ‍্যাঙাড়ে বাহিনীর সমন্বয় করে তার উল্লেখ করেন। গুজরাট ২০০২ গণহত‍্যা থেকে শুরু করে মুজফ্ফরনগর বা দিল্লি সহ সমস্ত গণহত‍্যার শিকারদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, আমাদের জেলবন্দী এক্টিভিস্ট শিক্ষক সাংবাদিকদের সকলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দীপঙ্কর আরও একবার আম্বেদকরের সেই অমোঘ সতর্কবাণী সামনে আনেন এবং সকলকে ফ‍্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে যেমনভাবে পারে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

save the constitution

পদযাত্রার শুরুতে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র তাঁর বক্তব‍্যে তুলে ধরেন সংবিধানের ওপর আক্রমণের নানা দিক। এরপর মেধা পাটকর তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব‍্যে জানান যে দেশের ৩০০টি জেলায় এই নফরৎ ছোড়ো, সংবিধান বাঁচাও অভিযান চলছে। সকলে সম্মিলিতভাবে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বানে সকলকে উদ্দীপ্ত করে হাজরা মোড় থেকে পদযাত্রাকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেন তিনি। শুরুতে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট প্রবীণ ব‍্যক্তিত্ব সমর বাগচি মহাশয়। ছিলেন কমরেড কার্তিক পাল। দক্ষিণ ও উত্তর বঙ্গের মৎস‍্যজীবী ফোরামের বহু সদস‍্য ব‍্যানার প্ল‍্যাকার্ডে সজ্জিত হয়ে পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন, উপকূল জুড়ে মেগাপ্রজেক্ট ও কর্পোরেট আগ্রাসনে বিপন্ন মৎস‍্যজীবীদের কথা উঠে আসে তাঁদের শ্লোগানে। মুসলমান ও শিখ সংখ‍্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কর্মী সমর্থকেরা ছিলেন। ছিলেন এনএপিএম ও বন্দীমুক্তি কমিটির সাথে যুক্ত বিভিন্ন কর্মী সমর্থক ও সংগঠকেরা। ধর্মতলা ওয়াই চ‍্যানেল পর্যন্ত পদযাত্রায় দু-একটি স্থানে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট ভাষণে ও চলতি পথে বিদ্বেষ ও হামলার বিপরীতে ভালোবাসা ও সংহতির কথা সহজ ভাষায় বলতে বলতে চলেন সুজাত ভদ্র। শ্লোগান তোলেন নৌশিন ও ফারহান সহ অন‍্যান‍্যরা।

ওয়াই চ‍্যানেলে সমাবেশিত হওয়ার পর অভীক সাহা, প্রদীপ চক্রবর্তী, মহম্মদ কামরুজ্জামান, নৌশিন বাবা খান সহ বিভিন্ন বক্তারা বক্তব‍্য রাখেন। বিসর্গ নাটকের দল একটি ছোট পথনাটিকা প্রদর্শন করে ‘কাগুজে বাঘ’-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বার্তা দেয়। মেধা পাটকর তাঁর ভাষণে পুনরায় সকলকে উজ্জীবীত করেন। তিনি বলেন, আমরা কাউকে ভয় পায় না, আর কাউকে ভয় পাওয়াই না। তিনি সামাজিক আন্দোলনে ফ‍্যাসিবিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানান। আগামি ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর শহীদ দিবসে দিল্লিতে জমায়েত হওয়ার আহ্বান রাখেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সেখানে আমন্ত্রিত। তিনি জানান যে শহীদ দিবসে সাইরেন বাজানোর যে সরকারী প্রথা ছিল তা বন্ধ করে দিয়েছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার ঘোষণা করে এদিনের কর্মসূচি সমাপ্ত হয়।

protest program against Babri demolition

হাওড়া

বালি জোড়া অশ্বত্থতলায় অনুষ্ঠিত হল পথসভা বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির উদ্যোগে।

কলকাতা

আজ কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বাবরি মসজিদ ধ্বংস সাধনের বিরুদ্ধে কালা দিবস পালিত হয়। পদ্মপুকুর পার্কসার্কাস এলাকায় একাধিক স্থানে সভা হয়, প্রচারপত্র বিলি বণ্টন করা হয়। যাদবপুর এলাকা কমিটির উদ্যোগে বেশ কয়েকটি স্থানে সভা সংগঠিত হয়েছে। বেহালার মুচিপাড়া মোড়ে, বাঁশদ্রোণীতে মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন বাজারে কয়েকটি গণতান্ত্রিক সংগঠন ও এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে সভা হয়। ৫ ডিসেম্বর ২০২২, গড়িয়া মোড়ে মোদীর কুশপুতুল পোড়ানো হয় গড়িয়া ব্রাঞ্চের তরফ থেকে।

জলপাইগুড়ি

জলপাইগুড়ি শহরে ডিবিসি রোড থেকে মিছিল বেরিয়ে সমাজ পাড়া মোড়ে শেষ হয় এবং সভা করা হয় ‘বৃহত্তর বাম ঐক্য’র পক্ষ থেকে। সিপিআই(এমএল) লিবরেশনের পক্ষ থেকে জেলা কমিটি সদস্য সুভাষ দত্ত সভাপতিত্ব করেন। উপস্থিত ছিলেন জেলা কমিটি সদস্য শ্যামল ভৌমিক, হিমাংশু মজুমদার, মুকুল চক্রবর্তী সহ শহরের অন্যান্য কমরেডরা।

শিলিগুড়ি

শিলিগুড়িতে সিপিআই(এমএল), সিপিআই(এম), আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক সহ বিভিন্ন বামপন্থী দলসমূহের যুক্ত মিছিল হয়। বাঘাযতীন পার্ক থেকে শুরু হওয়া এই মিছিল এয়ারভিউ মোড়ে সমাপ্ত হয়। মিছিলে সিপিআই(এমএল)-এর রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, রাজ্য কমিটির সদস্য বাসুদেব বসু, সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জীবেশ সরকার, দার্জিলিং জেলা সিপিআই(এম)-এর সম্পাদক সমন পাঠক প্রমুখ নেতৃত্ব দেন।

নদীয়া

ধুবুলিয়া নেতাজী পার্কে অনুষ্ঠিত হল এক প্রচারসভা। সভা থেকে বার্তা তুলে ধরা হয়, সভা থেকে ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস-এর বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন আনসারুল হক, সন্তু ভট্টাচার্য, অমিত মন্ডল, জয়তু দেশমুখ প্রমূখ।

Uncover the whale_0

তুমুল প্রতিবাদ প্রতিরোধের মুখে নিরেট প্রাণ স্পন্দনহীন অচলায়তনের জগদ্দল পাথর বোধহয় এবার একটু যেন নড়ে চড়ে উঠল। ইরান জানিয়েছে, মহিলাদের মাথায় হিজাব ঢাকার কয়েক দশক পুরাতন আইনকে শিথিল বা প্রত্যাহার করার কথা এবার তারা বিবেচনা করতে শুরু করেছে।

শারিয়াতি পোষাক বিধি ও নীতি পুলিশের বিরুদ্ধে ২২ বছরের তরুণী মাহশা আমিনি প্রথম জ্বালিয়েছিলেন বিদ্রোহের অনির্বাণ শিখা। এই ‘অপরাধে’ রাজরোষের শিকার হয়ে নিক্ষিপ্ত মাহশা পুলিশ হেফাজতে মারা (বা খুন হন) যান ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২। এরপর থেকেই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দাবানলের রূপ নিয়ে গোটা ইরান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদীরা নিজেদের মাথার হিজাব খুলে, জ্বালিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অসামান্য অসমসাহসী এক অধ্যায় ও নবজাগরণের সূচনা ঘটান। মাথার চুল কামিয়ে, তাকে পতাকা বানিয়ে প্রতিবাদকে নিয়ে যান অনন্য এক উচ্চতায়। সারা দুনিয়া এই প্রথম প্রত্যক্ষ করল আন্দোলনের এই অভিনব রূপ। আমিনির মৃত্যুর পর তেহেরানের অভিজাত উত্তরে মহিলারা হিজাব পরিত্যাগ করাটাকেই রেওয়াজে পরিণত করতে শুরু করেন। বিশ্বকাপ ফুটবলেও ইরানের জাতীয় ফুটবল দল জাতীয় সঙ্গীতের সময় মুখ বন্ধ রেখে ইরানের চলমান আন্দোলনের সাথে সংহতি জানাতে আরেকটি অনবদ্য প্রতিবাদের ধরনকে সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় করে তোলেন।

‘ইসলামী বিপ্লবের’ চারবছর পর, ১৯৮৩’র এপ্রিলে ক্ষমতাসীন সরকার মহিলাদের মাথা হিজাবে ঢেকে রাখার বাধ্যতামূলক আইন চাপিয়ে দেয়। কিন্তু এই বর্বর আইন আসার পর ক্রমাগত পরিবর্তিত দিনকালের সাথে পাল্লা দিতে দিতে মহিলাদের পোষাকেও আধুনিকতা আসতে শুরু করে। মহিলারাও অস্বীকার করতে শুরু করেন প্রচলিত আইনকে। কিন্তু এ’বছরের জুলাইয়ে এক চরম দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল সংগঠন ফের আইনকে কঠোরভাবে রূপায়ন করার জন্য সরকারের কাছে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। আবার, তীব্র আন্দোলনের পরিমন্ডলে সরকার বিরোধী গ্রুপগুলোও হিজাব আইন প্রত্যাহার ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সরকারের উপর চাপ দিতে থাকে। তিনদিন ধরে ইরান জুড়ে পালিত হল সর্বাত্মক ধর্মঘট ওই নীতি পুলিশীর বিরুদ্ধে।

এই প্রথম, ইসলামী ‘বিপ্লবী গার্ড’এর এক উচ্চপদস্থ অফিসার জানান, সাম্প্রতিক এই প্রতিবাদী বিক্ষোভে নিহত হয়েছেন ৩০০ নাগরিক। নরওয়ের অসলো’স্থিত মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে, দেশব্যাপী এই প্রতিবাদী বিক্ষোভে অন্ততপক্ষে ৪৫০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

ইরানের অ্যাটর্নি জেনারেল মহম্মদ জাফার মন্টাজেরি জানিয়েছেন, দেশের সংসদ ও বিচারবিভাগ একত্রে মিলে খতিয়ে দেখা শুরু করেছে এই আইনের কোন কোন দিক সংশোধন, বা পরিমার্জন করতে হবে, যে দু’টো সংস্থাই রয়েছে রক্ষণশীলদের খপ্পরে।

কিছুদিন ধরে চিনে কোভিড বিধি শিথিল করার দাবিতে তরুণ সম্প্রদায় ও সাধারণ মানুষের সরকার-বিরোধী প্রতিবাদ দুনিয়ার নজর কাড়ে। সাদা কাগজ নিয়ে এফোরপেপার বিক্ষোভ প্রতিবাদের এক নতুন রূপ ও ধরনকে সামনে নিয়ে এলো। খবরে প্রকাশ, এরফলে, চীন সরকারও বেশ কিছু শহরে কোভিডের কঠোর বিধি শিথিল করেছেন। ইরানে মহিলাদের চুল দিয়ে সুউচ্চ পতাকা, চীনে সাদা কাগজ বিক্ষোভ, বিশ্বকাপের ময়দানে জাতীয় সঙ্গীতের সময় নীরব নিরুচ্চার থাকা — সাম্প্রতিককালে গণআন্দোলনের, প্রতিবাদের এই নতুন জনপ্রিয় রূপগুলো সামনে এলো।

আশার কথা, মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের ঝিলিক উঁকি মারছে। নতুন আশা জাগিয়ে। তিমির অবগুণ্ঠন শেষে।

Hate-filled Electoral Discourse

হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাট বিধানসভা এবং দিল্লী পুরসভা নির্বাচনের ফলাফলের জন্য আমরা যখন অপেক্ষা করে আছি তখন এই নির্বাচনগুলোতে বিজেপির চালানো প্রচারের গভীরে দৃষ্টিপাত করলে তা শিক্ষামূলক হবে।

হিমাচল প্রদেশে যথেষ্ট মাত্রায় অভ্যন্তরীণ বিবাদের মুখোমুখি হয়ে মোদী খোলাখুলিভাবে নির্বাচকমণ্ডলীকে বললেন –প্রার্থী কে তা দেখার দরকার নেই, তাঁরা যেন তাঁকেই ভোট দেন। দিল্লী পুরসভার নির্বাচন মোদী সরকারের ক্ষমতার এক নির্লজ্জ চাল হয়েই দেখা দিল। কেন্দ্রীয় পদক্ষেপে আগের তিনটি কর্পোরেশনকে মিলিয়ে একটা করার মধ্যে দিয়ে পুর নিগমের পুনর্গঠন, ওয়ার্ডগুলোর সুপরিকল্পিত পুনর্বিন্যাস এবং সহসাই নির্বাচনী নির্ঘন্ট ঘোষণা করে গুজরাট নির্বাচনের সময়েই তার অনুষ্ঠান – এই গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই বিজেপির দুরভিসন্ধিমূলক কৌশলের এক নিদর্শন। আর গুজরাটে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে মিল দেখা গেল ২০০২-এর গণহত্যা-পরবর্তী পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সঙ্গে যখন নরেন্দ্র মোদী গোধরা-পরবর্তী গুজরাট গণহত্যাকে ‘গুজরাট গৌরবে’ পরিণত করেছিলেন।

২০০২-এর গুজরাট গণহত্যার দু-দশক পর আমরা অমিত শাহকে – যিনি বর্তমানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী – তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতায় ঐ গণহত্যাকে সমর্থন করতে দেখলাম। তিনি বললেন, দাঙ্গাকারীদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যার ফলে গুজরাটে ‘স্থায়ী শান্তির’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাঁর এই বক্তৃতা এল লাগাতার কয়েকটি বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্ত, প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সংকেতের পথ ধরে যেগুলো ইতিমধ্যেই ন্যায়বিচারের স্বার্থের যথেষ্ট হানি ঘটিয়েছিল। জাকিয়া জাফরির আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল; সত্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং ন্যায়বিচার চাওয়ার প্রয়াসের জন্য তিস্তা শিতলবাদ ও আর বি শ্রীকুমারকে জেলে পোরা হয়েছিল; বিলকিস বানো মামলায় ধর্ষণ ও হত্যায় দোষী সাব্যস্তদের ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে মুক্তি দেওয়া ও সংবর্ধিত করা হয়েছিল; গণহত্যায় এক দোষী সাব্যস্তর পরিবারের এক সদস্যকে নারোদা বিধানসভার বিজেপি প্রার্থী করা হয়েছিল, আর সুপ্রিম কোর্ট ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার সঙ্গে যোগ থাকা মামলাগুলোকে সমাপ্ত করে দিয়েছে, ২০০২-এর যে গুজরাট গণহত্যার নটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় তদন্ত করা ও মামলা চালানোর জন্য সুপ্রিম কোর্ট নিজেই একটা বিশেষ তদন্তকারী দল নিয়োগ করেছিল।

গণহত্যার মধ্যে দিয়ে গুজরাটে ‘স্থায়ী শান্তি’ প্রতিষ্ঠার অমিত শাহর দাবিকে শুধু ‘অতীতের একটা কীর্তির মহিমাকীর্তন’ রূপে দেখলেই হবে না, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে মিলিয়েও তাকে দেখতে হবে। সংঘ বাহিনী যেমন সারা ভারতেই ১৯৯২ সালের অযোধ্যার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়, ঠিক তেমনই এই ব্যাপারেও আমাদের সুস্পষ্ট থাকতে হবে যে, ‘স্থায়ী শান্তির’ গুজরাট সূত্রকেও তুলে ধরা হচ্ছে ‘সারা দেশের সুফলের’ জন্য! নরসিংহানন্দ-এর মতো ব্যক্তিরা রাখঢাক না করেই গণহত্যার ডাক দেন, আর বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ ও মোদীর মন্ত্রীরা সেটা করে থাকেন তাঁদের নিজস্ব ধারায়।

অমিত শাহ ‘দাঙ্গাকারীরা’ বলতে দাঙ্গার শিকার মানুষজনদের বুঝিয়েছেন আর ‘দাঙ্গাকারীদের উচিত শিক্ষা দেওয়া’টা ঠাণ্ডা মাথায় গণহত্যা ও ধর্ষণ সংঘটনের কথাই জানায়, এবং ‘স্থায়ী শান্তি’ হল সংঘের সেই সংকেতময় শব্দ যা আতঙ্ক সৃষ্ট নীরবতা এবং শ্মশানের গা-ছমছম করা শান্তির কথা বলে। আর এখন এটা একেবারেই পরিষ্কার যে নীরবতার এই বিধান দেওয়া হচ্ছে প্রতিটি বিরোধী মতের উদ্দেশ্যে, সত্য ও ন্যায়বিচার চাওয়া প্রতিটি ব্যক্তিকে ভীতিপ্রদর্শন করা ও নির্যাতনের শিকার করে তোলার জন্য।

অমিত শাহর ‘স্থায়ী শান্তি’ সূত্রর চেয়ে কোনো অংশেই কম জানান দেয় না চিত্রাভিনেতা ও পূর্বতন বিজেপি সাংসদ পরেশ রাওয়ালের গুজরাটের নির্বাচনী প্রচারে ‘মাছ রান্না করা’ নিয়ে সাংকেতিক রাজনৈতিক বার্তা। এক নির্বাচনী বক্তৃতায় রাওয়াল বললেন, গুজরাটিরা জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি এবং কর্মহীনতা সহ্য করতে পারে, কিন্তু তারা কখনই বাঙালিদের জন্য মাছ রান্না করবে না। বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ ওঠার পর রাওয়াল ‘বুঝিয়ে বললেন’ যে বাঙালি বলতে তিনি সলে রোহিঙ্গা ও বাঙলাদেশীদেরই বুঝিয়েছিলেন!

এটা ঘৃণা ও বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলে মূল্যস্ফীতি ও বেকারির বিরুদ্ধে জনগণের ক্রোধের মোকাবিলায় সংঘ-বিজেপির প্রয়োগ করা আখ্যানের একটা মার্কামারা দৃষ্টান্তকেই আমাদের সামনে তুলে ধরে, আর জনগণের মধ্যে বিরাজমান সমস্ত ধরনের প্রভেদের ওপর ভিত্তি করেই ঐ প্ররোচনা সৃষ্টি করা হয়, তা সে ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা বা সংস্কৃতি যে প্রভেদই হোক না কেন। আজকের গুজরাটে মোরবী সেতু ভেঙে পড়াটা যখন বিজেপির দুর্নীতিপরায়ণ ও নির্মম উদাসীন মডেলের প্রশাসনেরই এক গ্লানিময় প্রতীক হয়ে উঠেছে, শাহ ও রাওয়ালরা তখন প্রশ্নহীনভাবেই জানিয়ে দিচ্ছেন যে বিজেপি জনগণকে শুধু ঘৃণা, হিংসা ও প্রচারের চটকই উপহার দিতে পারে।

এছাড়া, মোদীর ব্যক্তি পূজাকে কেন্দ্র করে চলছে প্রচারের নিরবচ্ছিন্ন ঝড়। হিমাচল এবং গুজরাট দুই রাজ্যেই বিজেপির প্রচারের বিষয়বস্তু হয়েছে মোদীর নামে ভোট চাওয়া। এমনকি মোরবী সেতুর ভেঙে পড়াটাকেও বিজেপি সরকার মোদীর ঢক্কানিনাদিত মোরবী পরিদর্শনকে প্রচারের একটা বিষয় করে তোলে। নিজের ভোটদানকেও মোদী একটা রোড-শোর মাধ্যমে প্রচারের বিষয় করে তোলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে আদর্শ নির্বাচনী বিধিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়। আর বিজেপি যাতে নির্বাচনী বিধির প্রতিটি নাশকতা ও সেগুলিকে অগ্ৰাহ্য করা থেকে পার পেয়ে যায় তার জন্য ক্ষমতাসীন সরকার বাছাবাছা বশংবদ আমলাদের সন্দেহজনক পথে নির্বাচন কমিশনার রূপে নিয়োগ করে নির্বাচন কমিশনকেই নীরব দর্শকে পর্যবসিত করতে চায়।

এই নির্বাচনগুলোকে তাই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিজেদের সুবিধায় কাজে লাগানো ও সেগুলোকে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করার মোদী সরকারের ক্রমবর্ধমান মরিয়া প্রয়াসের সুস্পষ্ট বিপদসংকেত হিসাবেই দেখতে হবে। নিপীড়ন ও লুন্ঠনের এই রাজত্বের অবসান ঘটাতে নির্বাচনগুলোকে আমাদের পরিণত করতে হবে জনগণের শক্তিশালী আন্দোলনে, যেমনটা এখন ঘটছে লাতিন আমেরিকায়।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৬ ডিসেম্বর ২০২২)

Nadia District Conference

শ্রমজীবী মহিলাদের জীবন-জীবিকার জ্বলন্ত সমস্যাগুলি উঠে এলো সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নদীয়া জেলা সম্মেলনে। ৩০ নভেম্বর ২০২২ ধুবুলিয়াতে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ৪৫ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। গ্রামাঞ্চল, গঞ্জ ও শহর এলাকা থেকে বিড়ি শ্রমিক, মিড-ডে-মিল রন্ধনকর্মী, কৃষিজীবী মহিলারা সম্মেলনে অংশ নেন। আজকের সময়কালে মহিলাদের যে চরম শোষণ নিপীড়নের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, প্রধানত সেই বিষয়গুলি প্রতিনিধিরা তুলে ধরেন। উঠে আসে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিকারের তীব্র আকাঙ্খা। যেমন, বিড়ি শ্রমিকরা বলেন, তারা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরী পান না। হাজার পিছু মাত্র ১৭০ টাকা মজুরি! বিড়ি শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প যথা ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য অনুদান, গৃহ নির্মাণ অনুদান প্রভৃতি এই সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। মজুরি নির্ধারণে সরকারের শ্রম দপ্তরের কোনো ভূমিকা নেই। বারবার ব্লক দপ্তরে ডেপুটেশন দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। মিড-ডে-মিল রন্ধন কর্মীরা বলেন, সারা মাস কাজ করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে তারা যৎসামান্য ৩০০/৪০০ টাকা পান। তাদের শ্রমিক স্বীকৃতি বা শ্রমের ন্যূনতম মর্যাদাটুকুও নেই। নামেই স্বাস্থ্যসাথী কার্ড! বাস্তবে হাসপাতালে ভর্তি না হলে এই কার্ড থেকে চিকিৎসার কোনো সুযোগই নেই। গ্রামীণ গরিব মেহনতী মহিলাদের প্রতি বঞ্চনা, প্রতারণা ও সীমাহীন দুর্নীতির বিষয়গুলিও আলোচনায় উঠে আসে। এছাড়া মেয়েদের বাল্যবিবাহের ক্ষতিকারক দিকগুলি নিয়ে প্রচার করা, আজকের সময়ে মোবাইল অপরিহার্যতা থাকলেও তার বহু ধরনের খারাপ দিকগুলিও মেয়েদের মধ্যে প্রভাব ফেলছে। এ বিষয়েও সচেতনতা গড়ে তোলার উপর বক্তব্য আসে।

শুরুতে শহীদ স্মরণ ও মাল্যদানের পর প্রতিবেদন পেশ করা হয়। বক্তব্য রাখেন রাজ্য পর্যবেক্ষক ইন্দ্রাণী দত্ত। তিনি দেশজুড়ে চলা মহিলাদের উপর হিংসা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধের উজ্জ্বল দিকগুলি তুলে ধরেন। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল)-এর জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, এআইসিসিটিইউ’র জেলা সম্পাদক জীবন কবিরাজ। ১১ জনের জেলা কমিটি নির্বাচিত হয়৷ অপূ কবিরাজ সম্পাদিকা রূপে পুনর্নির্বাচিত হন। সভানেত্রী অনিমা মজুমদার। আগামীদিনে জেলার বিভিন্ন ব্লকে মহিলাদের সংগঠিত করা, সদস্য সংগ্রহ করা ও আসন্ন রাজ্য সম্মেলনকে সফল করে তোলার কর্মসূচি গৃহীত হয়। মহিলাদের নির্ভয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে, তাঁদের উপর নেমে আসা যেকোন হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধের শপথ নিয়ে সম্মেলন শেষ হয়।

District Workshop of AIPWA

গত ৩ ডিসেম্বর ২০২২ সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা শাখার উদ্যোগে জেলা ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হল বজবজ জেলা অফিসে। আলোচ্য বিষয় ছিল বর্তমান পরিস্থিতি ও নারী আন্দোলন। মহিলা সমিতির আসন্ন রাজ্য সন্মেলন আগামী ১৭ ডিসেম্বর ২০২২। তাকে ধরেই এই ওয়ার্কশপ। মহিলাদের সমানাধিকার, গণতন্ত্র, মর্যাদা, লিঙ্গবৈষম্য, গার্হস্থ্য হিংসা, মজুরি বৈষম্য এই বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়। এইসব বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন মহিলারা। ঘর থেকে বাহির পর্যন্ত মনুবাদের বিরুদ্ধে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হচ্ছে মেয়েদের। বক্তা ছিলেন মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা, পার্টির জেলা সম্পাদক ও বিভিন্ন ব্লকের নেত্রীরা। সমগ্ৰ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা।

worker strike in Medinipur sanitation workers

অস্থায়ী ও প্রকল্প শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে পথ দেখাচ্ছেন মেদিনীপুরের পৌর-সাফাইকর্মীরা। রাজ্য জুড়ে অস্থায়ী শ্রমিকদের দুদর্শা ক্রমবর্ধমান, চুক্তি শ্রমিকরাও তাদের বেতন সহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছেন। মেদিনীপুর পুরসভার সাফাইকর্মীরা পুরসভার অধীন সমস্ত প্রকার প্রকল্প শ্রমিক, ফান্ড শ্রমিক ও চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের ক্যাজুয়াল শ্রমিকে রূপান্তর, কর্তৃপক্ষের দ্বারা মজুরি হ্রাস সহ সাফাইকর্মীদের পরিবারের বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মে নিযুক্ত করা ও অন্যান্য দাবিতে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করে ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই। গত ২০২১ সালে মেদিনীপুর পুরসভা সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন এর নেতৃত্বে ৯ দিন টানা ধর্মঘট করে প্রকল্প কর্মী হোক কিম্বা ফান্ড শ্রমিক, সকলের জন্যই চালু হয়, দৈনিক ২২৬ টাকা নুন্যতম মজুরি। কিন্তু নবান্ন কর্তৃক এক চরম শ্রমিক স্বার্থে অনৈতিক আদেশ পাঠানো হয়, মেদিনীপুর পুরসভার চেয়ারম্যানকে। আদেশে বলা হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের বিধান অনুযায়ী ‘সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্পে নিযুক্ত থাকা শ্রমিকদের সর্বোচ্চ মজুরি ২০২ টাকা, তায় মেদিনীপুরের এই শ্রমিকদের ২২৬ টাকা মজুরি বাতিল করতে হবে। যার ফলস্বরূপ এই মাসের বেতন থেকে দৈনিক ২৪ টাকা করে কেটে মজুরি ৭২০ টাকা করে কমিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়। এরপর শুরু হয় কাজ বন্ধ রেখে সম্পূর্ণ পুরসভাকে অচল করে রাখা। টানা ৪ দিন এই ধর্মঘট চলার পর চিঠি করে ইউনিয়ন নেতৃত্বের সহিত আলোচনার প্রস্তাব দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। সেই মতো ৬ ডিসেম্বর সকালে পুরসভা অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হয় কিন্তু কাজে যোগ দেয়নি কোনো শ্রমিক। ঐদিন সন্ধ্যাড় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর সহ অন্যান্য আধিকারিকদের উপস্থিতিতে ইউনিয়ন আলোচনাতে অংশগ্রহণ করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যা নীচে দেওয়া হল —

  • (১) ৫১৮ জন SWM শ্রমিক সহ সকল শ্রমিকের জন্যই ২২৬ টাকা করে নুন্যতম মজুরি দেওয়া হবে।
  • (২) প্রকল্প কর্মীদের মধ্যে যারা পাঁচ বছরের অধীন কর্মরত তাদের সকলকে পুরসভার অধীনস্থ ক্যাজুয়াল শ্রমিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
  • (৩) চুক্তিবদ্ধ শ্রম প্রথার অবসান ঘটানো হবে। সাড়ে তিনশোর অধীক সকল শ্রমিককেই পুরসভার অধীন ক্যাজুয়াল শ্রমিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
  • (৪) নতুন ভাবে আরো ৫০ জন মহিলা শ্রমিককে নিযুক্ত করা হবে কাজে।
  • (৫) বেতন বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয় পৌর-কর্তৃপক্ষের দ্বারা। এই কমিটির রেজুলেশন ইউনিয়নের হাতে দিতে হবে, এবং ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কমিটির কাজকর্মকে নজরে রাখা হবে।

এআইসিসিটিইউ রাজ্য নেতা ও মেদিনীপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক কমরেড তপন মুখার্জী জানান, “সাফাইকর্মীদের নেতৃত্বে আসলে সমস্ত অস্থায়ী ও চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াই চলছে। সাফাইকর্মীদের এই নেতৃত্ব প্রদানকারী ভূমিকাকে শাসক দলের নেতারা কখনও ‘গুণ্ডামো’, কখনও ‘হাঙ্গামা’ বলে কালিমালিপ্ত করতে সদা সচেষ্ট রয়েছেন এমনকি অশালীন মন্তব্যও করা হচ্ছে কাউন্সিলরদের তরফ থেকে, এই প্রথম সারির কোভিড যোদ্ধা বা ফ্রন্টলাইনারদের প্রতি। সমস্ত অপমান ও অবমাননার জবার সাফাইকর্মীরা ঝাড়ু হাতেই সংগ্রামের ধারাই ফিরিয়ে দিয়েছেন, তায় সকল শ্রমিককে জানাই লড়াকু অভিনন্দন।”

Protest demanding pension-gratuity

ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্টের প্রায় ২ সহস্রাধিক কর্মীর পেনসন এবং শ্রমিক সমবায়ের টাকা প্রদান, চুক্তিপ্রথা বাতিল করে ওড়িশা সরকারের ন্যায় সকল কর্মীদের স্থায়ীকরণ, ত্রিপাক্ষিক চুক্তি কার্যকরী করা ও ছাঁটাই কর্মীদের কাজে পুনর্বহালের দাবিতে বিক্ষোভ অবস্থান এবং শ্রমমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন।

৭ ডিসেম্বর বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের সামনে (বিবাদী বাগ) বিক্ষোভ অবস্থান হয়। বিক্ষোভ সভায় কর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এই সভায় বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সভাস্থল থেকে ৬ জনের প্রতিনিধি দল শ্রমমন্ত্রী শ্রী মলয় ঘটকের কাছে ডেপুটেশন দেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক দিবাকর ভট্টাচার্য, নবেন্দু দাসগুপ্ত, পেনশন এসোসিয়েশনের নেতা মধুসূদন চক্রবর্তী, পার্থ সারথি দাস, কলকাতা ট্রাম কোম্পানি ইউনিয়ন নেতা আয়ুব আলী সর্দার, তুহিন কয়াল।

শ্রম মন্ত্রী মাননীয় মলয় ঘটক কর্মীদের পেনশন, সমবায়ের টাকা প্রদান ও ত্রিপাক্ষিক চুক্তি কার্যকর করে ছাঁটাই শ্রমিকদের পুনর্বহালের প্রতিশ্রুতি দেন।

Press Statement _Agartala, 30 November 2022

চড়িলাম বাজারে ও ব্লক অফিসে সিপিআই(এম) দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল। পুলিশের বৈধ অনুমতি নিয়ে বাজারে পার্টি অফিসের সামনে রাজনৈতিক সভার কাজ শুরু হয়েছিল। সভা চলাকালীন পুলিশের সামনে বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতিকারীরা অবৈধভাবে জমায়েত হয়ে সিপিআই(এম)-এর জমায়েতকে লক্ষ্য করে ইট বৃষ্টি, বোমাবাজি করে। লাঠি ও সশস্ত্র অবস্থায় সিপিআই(এম) কর্মীদের উপর হামলা করে। বিধায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী ভানুলাল সাহার উপর প্রাণঘাতী হামলা করে। তাতে বিধায়ক সহ অনেক কর্মী-সমর্থক আহত হয়। গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় শহীদ মিঞাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। কোনোরকম দুঃখ প্রকাশ না করে উপমুখ্যমন্ত্রী এই সন্ত্রাসী হামলাকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন করেছেন ও একে বৈধতা দিয়েছেন। যা কোনও গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ মেনে নিতে পারেন না। আর এতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, শহীদ মিঞার খুনীদের তিনি প্রকাশ্যে মদত দিচ্ছেন যাতে আইনানুযায়ী কেউই বিচার না পায়।

তাই, চড়িলাম বাজারে সিপিআই(এম)-এর রাজনৈতিক কর্মসূচির উপর বিজেপির দ্বারা পরিকল্পিতভাবে হামলার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানায় সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি। বিধায়ক সহ আহত কর্মীদের উপর হামলাকারীদের ও শহীদ মিঞার হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করার দাবি জানায়। এই ঘটনায় উপমুখ্যমন্ত্রীর বেআইনি উস্কানিমূলক মন্তব্য ও অপরাধীদের আড়াল করার ষড়যন্ত্রের তীব্র বিরোধিতা করছে সিপিআই(এমএল)। আইনানুযায়ী সুষ্ঠু ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানায়। নিহত ও আহতদের শোক ও বিক্ষোভকে তীব্রতর প্রতিরোধে পরিণত করার জন্য গণতন্ত্র প্রিয় জনগণের কাছে আহ্বান রাখছে।

- পার্থ কর্মকার, রাজ্য সম্পাদক, সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি

11th West Bengal State Conference

ভারতের নারী আন্দোলনের অন্যতম শরিক হয়ে পশ্চিমবাংলায় প্রগতিশীল মহিলা সমিতি তার যাত্রাপথের চার দশক অতিক্রম করেছে।

দেশজুড়ে নেমে আসা ফ্যাসিস্ট মোদী সরকারের দানবীয় অত্যাচার ও দেশের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিভূমিকে বিরাট আঘাত হেনে হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মোদীর চক্রান্তের বিরদ্ধে দেশ আজ এক সম্মিলিত প্রতিরোধের অপেক্ষায়। এই সময়েই ইরান থেকে ভারতের নারীরা তাদের স্বাধিকারের প্রশ্নে, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরূদ্ধে পুরুষতন্ত্র ও মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক সরকারের বিরুদ্ধে “জান, জিন্দেগি ও আজাদী” (নারী, জীবন, মুক্তি) শ্লোগানে স্পন্দিত। কাজ, মজুরি, অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য সরকারের অপশাসন ও সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে এই বাংলার মহিলারাও পথে নামছেন। এইরকম এক প্রেক্ষিতে কলকাতার মৌলালি যুবকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ১১তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন।

সম্মেলন উপলক্ষে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ অহল্যার নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে কলকাতাকে। দেশের ফ্যাসিস্ট শক্তির হাতে নিহত কর্ণাটকের নির্ভীক সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে স্মরণ করে সভাগৃহকে তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। আর মঞ্চ নামাঙ্কিত করা হয়েছে মহিলা সমিতির প্রয়াত লড়াকু নেত্রী কমরেড কণা সরকারের নামে।

সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে তখন সারা দেশ এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি। মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছোঁয়া। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সমস্ত সম্পদ দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে জলের দরে বেচে দিচ্ছে। ভয়াবহ সন্ত্রাসের এক বাতাবরণ তৈরি করে এবং দেশের নাগরিকদের বেনাগরিক করার হুমকি দিয়ে অধিকারহীন অসহায় প্রজা বানানোর চক্রান্ত চালাচ্ছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি। দেশজোড়া অর্থনৈতিক সংকট ও বিপন্নতায় সব থেকে বেশি বিপন্ন আমরা নারীরা। দেশের নারীদের জীবন-জীবিকা ও মর্যাদা আজ আক্রান্ত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের ১৪৬টা দেশের মধ্যে লিঙ্গ-বিভেদের নির্দেশিকায় ভারত ১৩৫তম স্থানে রয়েছে। দেশের সরকার ভারতে লিঙ্গ-বিভেদের এই দুর্দশা নিয়ে কোনোরকম মুখ খুলছে না।

ভারতের নারীরা যে মুখ্য বৈষম্যের মুখোমুখি তার অন্যতম শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর কাজের বেহাল অবস্থা। বিশ্ব বৈষম্যের রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ভারতের মেয়েরা অতিমারী ও লকডাউনের সময় সবথেকে বেশি ঝামেলায় পড়েছেন। পুরুষ কর্মীদের তুলনায় মহিলা কর্মীদের কাজ থেকে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে ৫ গুণ বেশি। আবার লকডাউন উঠে গেলে কাজ ফিরে পেয়েছেন মাত্র ৫৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকাংশই কাজ ফিরে পাননি। শ্রমের বাজার থেকে উৎখাত হয়ে ঘরে থাকতে তাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। মোদী সরকার কাজ হারা শ্রমিক ও মহিলাদের কোনো সুরাহা তো করতেই পারেনি। বরং শ্রমকোড লাগু করে, কাজের সময় বাড়িয়ে কর্মনিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা, যৌনহেনস্তা থেকে সুরক্ষিত থাকার সমস্ত ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা। গ্রামাঞ্চলেও কাজ নেই। মনরেগা প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ অর্থ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে গ্রামীণ গরিব মানুষ ও মহিলারা আরো সমস্যায় পড়েছেন। কোটি কোটি অভাবী মহিলা আজও ঋণের জালে জর্জরিত। তাই গ্রাম ও শহর থেকে মহিলাদের কাজের ও মজুরির দাবি উঠে আসছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রী, গর্ভবতী মহিলা, অনগ্রসর জাতি ও ট্রান্সজেন্ডার মেয়েরা।

এই সময়েই নারীর স্বায়ত্বতা ও সমতার প্রশ্নও কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদী ও জনবিরোধী সরকারের হাতে চূড়ান্তভাবে বিপন্ন। নারীর স্বাধীকার হরণ করা হচ্ছে ‘পরিবার’ ও ‘সম্মান রক্ষা’র নাম করে। নারীর স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও শ্লোগানকে তারা ভয় পায়। তারা চায় মেয়েরা ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংঘ নির্দেশিত সংজ্ঞা নিরবে মেনে চলুক। তারা চায় মেয়েরা কুসংস্কার এবং অবৈজ্ঞানিক আচার বিচারে আবদ্ধ থাকুক। শিক্ষাকে আজ এত মহার্ঘ করে দেওয়া হচ্ছে যাতে নিম্নবিত্ত ও গরিব ঘরের ছাত্র ছাত্রীরা তার নাগাল না পায় এবং শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে।

মোদী সরকার একদিকে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ বলে — অন্যদিকে ধর্ষণকারীদের পক্ষে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করে কাঠুয়ায়, হাথরাসে। সবই করা হয় ভারত মাতার জয়ধ্বনি দিয়ে। গুজরাটে গণহত্যা ও দাঙ্গার সময় নিজের তিন বছরের শিশু কন্যাসহ পরিবারের সাতজনকে হারিয়ে, নিজে গণধর্ষিতা হয়েও অনমনীয় দৃঢ়তায় আট বছরের দীর্ঘ লড়াই জিতে নিয়ে বিলকিস বানো দোষীদের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন। আর এবছরে ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ গুজরাটের বিজেপি সরকার পালন করল, ঐ গণধর্ষণকারীদের জেল থেকে মুক্ত করে, ফুলের মালায় বীরের সম্বর্ধনা দিয়ে। ৭৫ বছরের স্বাধীনতা দিবসে এই অপরাধীদের মুক্তির খবর শুধু বিলকিস নয়, দেশজুড়েই নারীর ন্যায় বিচারের দাবিকে নস্যাৎ করে মোদী সরকারের নারী-বিরোধী রূপ আরো একবার জঘন্যভাবে প্রকাশিত হল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা ভারতের জনগণের বিভিন্ন অংশের উল্লেখযোগ্য লড়াই প্রত্যক্ষ করেছি। গুজরাটে উনায় দলিত জনতার নিপীড়ন বিরোধী জাগরণ, নাগরিকত্ব আইনের বৈষম্যমূলক সংশোধনীর বিরুদ্ধে মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শাহীনবাগ আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন, যা কৃষিতে কর্পোরেট রাজ কায়েমের লক্ষ্যে বানানো তিনটে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে মোদী সরকারকে। এই আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে ছিলেন নারীরা কৃষাণীরাই। দেশের নারীরাই সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে আইন নাগরিকত্ব সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র-বিরোধী এক ধারণার প্রবর্তন করে দেশের সংবিধানটাকেই ওলটপালোট করে দিতে তৎপর।

কৃষক আন্দোলনকারীরা ছাড়াও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার বেসরকারিকরণের বিরূদ্ধে, ক্যাম্পাস গণতন্ত্র বা মোদীরাজের বিরূদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছেন। দেশজুড়ে বিভিন্ন গণআন্দোলনকারী কর্মী ও নেতৃত্বকে বিভিন্ন অজুহাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ্যাডভোকেট তিস্তা শীতলবাদের মতো সমাজকর্মী বা নাতাশা, গুলফিসা, সাফুরা, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেনের মতো আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার কেস দিয়ে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে। প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করতে এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে দেশজুড়ে।

এই সর্বব্যাপী ভয়ের পরিবেশের বিরূদ্ধে নারী সমাজের ঐক্য ও নারীর নির্ভয় স্বাধীনতার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংগঠনকে প্রস্তুত করাও আসন্ন সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

এরাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে জনতার রায়ে ক্ষমতায় আসীন তৃণমূল সরকার। এখানেও চলছে সর্বত্র দুর্নীতি গুন্ডামি তোলাবাজি, নৈরাজ্য, নারীনির্যাতন, খুন, গণহত্যা ও সন্ত্রাস। চলছে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন, পুলিশী নিপীড়ন।

এরাজ্যে সব থেকে বেশি আলোচিত বিষয় হল নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি। দুর্নীতিতে যুক্ত থেকেছে প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের আমলারা, এমনকি স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীকেও জেলা ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু চাকুরি প্রার্থীদের মূল দাবি — সমস্ত যোগ্য চাকুরি পর্থিরা এখনো চাকুরী পাননি।

এসএসসি, টেট সহ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা (যাদের অনেকেই মহিলা) আজ নিজেদের ন্যায্য চাকরির দাবিতে কলকাতার রাজপথে। ১০০, ২০০ বা ৬০০ দিন ধরে রোদ, বৃষ্টি, শীতকে উপেক্ষা করে পুলিশের লাঠি, জল কামান, গ্রেফতারী সহ্য করে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছন তালিকাভুক্ত যোগ্য চাকুরি প্রার্থীরা।

সারা দেশের মতো রাজ্যেও অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি, সম-কাজে সম-মজুরির দাবিগুলি অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। আশা অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল কর্মীরা যৎসামান্য ভাতায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের ভাতাবৃদ্ধি ও সরকারি কর্মীর স্বীকৃতির দাবিকে কোনো সরকারই কর্ণপাত করছেন না। আবার গৃহ-সহায়িকা, বিড়ি শ্রমিক বা জরি শিল্পের শ্রমিক সহ বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, অবসর ভাতা ও শ্রমিকের স্বীকৃতি দানে রাজ্য সরকারের কোনো সদিচ্ছাই নেই।

মুখ্যমন্ত্রী থেকে গোটা পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে একের পর এক।

সরকারের বহুল প্রচারিত কন্যাশ্রী প্রকল্প এরাজ্যে বাল্যবিবাহ রুখতে পারেনি। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে’র যৎসামান্য সহায়তা দিয়ে মহিলাদের স্থায়ী কাজ ও ন্যায্য মজুরির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বাস্তবে এগুলো মহিলাদের আর্থিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারেনি। নারী ও শিশুর কল্যাণ ও স্বাস্থ্যখাতে এই সরকারের ব্যয় বাড়েনি। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এই কার্ড নিয়েও চলছে দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের বিভিন্ন রোগে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেগুলো কাজে লাগে না।

এছাড়া মেয়েদের স্বাস্থ্য, পুষ্টির বিষয়টিও রাজ্যে চরমভাবে অবহেলিত। আজ সরকারের হোমগুলিতে কমেছে মেয়েদের নিরাপত্তা, বেড়েছে হোমগুলি থেকে নারী ও শিশু পাচার। নারী ও শিশু পাচার, কর্মহীনতা, ঘরে-বাইরে হিংসা, বাল্যবিবাহ সবেতেই বাংলা শীর্ষে। নারী নিগ্রহের বিভিন্ন ঘটনায় অপরাধীরা এরাজ্যে শাসক দলের মদত পাচ্ছে। হাঁসখালিতে ধর্ষিতা ও মৃতা মেয়েটির সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর কুরুচিকর মন্তব্য সমাজে অপরাধীদের এবং ধর্ষণ সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে।

এই নারী বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট বিজেপির বিরুদ্ধে দেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে আজ, একই সাথেই রাজ্য সরকারের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির প্রতিবাদে এরাজ্যে ও গণতন্ত্র, প্রগতি ও নারী মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে নারী আন্দোলনের অগ্রণী কর্মীদের।

- ইন্দ্রাণী দত্ত

join forces and move forward

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ শাখার ১১তম রাজ্য সম্মেলন আগামী ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ অনুষ্ঠিত হতে চলেছ। কথা হবে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে, আজকের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পুরনো ও নতুন সংগ্রাম ও সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে।

সম্মেলনের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। দুনিয়াজুড়ে আজ মেয়েদের ওপর শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন হরেক রূপে বেড়ে চলেছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। ইরানের মেয়েরা হিজাব বাধ্যতামূলকভাবে ও ঠিকমতো পরার ব্যাপারে নীতি-পুলিশের হিংস্র খবরদারির বিরুদ্ধে এমনই জোরদার সংগ্রাম গড়ে তুললেন যাতে পিতৃতান্ত্রিক মৌলবাদী শাসকেরা পিছু হটে নীতি পুলিশ ব্যাপারটাকেই তুলে দিতে বাধ্য হল। তাঁদের এই প্রাথমিক জয় আমাদের উৎসাহিত করেছে। এদেশে আবার হিজাব পরলে স্কুল-কলেজে ঢুকতেই দেবে না বলে হাঁক পেড়েছে ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তি। এভাবে স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই আরো ছড়িয়ে দিতে হবে। সোচ্চার হতে হবে নির্লজ্জ বিজেপি’র বিরুদ্ধে, যারা নারীদেহ-লোলুপ ভন্ডবাবা রামরহিমকে জেল থেকে চল্লিশ দিনের জন্য ছাড়িয়ে আনে নিজেদের নির্বাচনী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। সেই বিজেপি, যারা বিলকিস বানোর ধর্ষণকারী ও তার আত্মীয়দের হত্যাকারী নরপিশাচদের সাজা মকুব করেই ক্ষান্ত হয় না, তাদের মহান বীরের সম্মান দেয়। চরম নারী বিদ্বেষী প্রকৃতই গণশত্রু এই শাসকের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর সংগ্রামে বাংলার মেয়েরা যে সামনের সারিতেই রয়েছেন, তার প্রমাণ গত বিধানসভা নির্বাচনেই দেখা গেছে। আগামী সম্মেলনের মর্মবাণীও হবে — ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করো, গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত কর।

‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ — গত বিধানসভা নির্বাচনে স্লোগান তুলেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। হ্যাঁ, বাংলার মেয়েরা উজাড় করে ভোট দিয়েছেন বাংলার মেয়েকেই। তবে তা শুধুমাত্র ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বা ‘রূপশ্রী’র মতো নানা প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার তাগিদে নয়। তাঁদের ভোট ছিল ফ্যাসিস্ট বিজেপির নারী-বিদ্বেষী, জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মেয়েদের রাজনৈতিক চেতনার ভোট। অর্থাৎ, “নো ভোট টু বিজেপি”র ডাকে সাড়া দিয়েছেন তাঁরাও। কিন্তু ‘বাংলার মেয়ে’ আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বাংলার মেয়েদের কী দিয়েছেন, কী দিচ্ছেন?

তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অপশাসন ও পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির পাপের বোঝা চেপেছে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যুবতী-যুবকদের ওপর। এর প্রতিবাদে এবং কাজের দাবিতে তাঁদের দীর্ঘ আন্দোলনের ওপর লাগাতার চলেছে, এখনো চলছে বর্বর পুলিশি অত্যাচার। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা উত্তরপ্রদেশের মতো এরাজ্যেও প্রায় দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একুশ শতকেও মেয়েরা পণপ্রথার বলি হচ্ছেন, বধূ নির্যাতন ও অ্যাসিড হামলায় শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট, ২০২১)। আর এসব ন্যক্কারজনক ঘটনায় বহু ক্ষেত্রেই শাসকদলের নেতা, কর্মী ও মস্তানরা জড়িত থাকছে। কন্যাশ্রী প্রকল্প সত্ত্বেও নাবালিকা বিয়ে অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ প্রশাসনও উদাসীন। ঘরেবাইরে মেয়েদের উপর হিংসার ঘটনায় নির্যাতিতারা যাতে দ্রুত ন্যায়বিচার পান সেজন্য পুলিশমন্ত্রী ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গঠন সহ যেসব প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন তা স্রেফ ‘জুমলা’ বলে প্রমাণিত হয়েছে।

গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবার, বিশেষত: গর্ভবতী মা ও শিশু চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল খুব খারাপ। সেদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোনো নজরই নেই।

লকডাউন পর্যায়ে গরিব ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে না পারার দরুণ মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলোর দ্বারা প্রতিদিন অসম্মানের শিকার হচ্ছেন। স্বনির্ভরতার নামে মেয়েদের নানা প্রকল্পের কাজে কম পারিশ্রমিকে কাজে লাগানো হয়। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল রন্ধন কর্মীদের দিনভর খাটিয়ে নিচ্ছে অথচ তাঁদের আইন মাফিক ন্যূনতম মজুরিটুকুও দেওয়া হয় না, স্থায়ীকরণ, শ্রমিকের স্বীকৃতি তো দূরের কথা। কর্মসংস্থানের নামে এঁদের সঙ্গে চলছে ধোঁকাবাজি। আমাদের মনে রাখতে হবে, কর্মসংস্থান মানুষকে শুধুমাত্র স্বনির্ভরতা দেয় না, নিজস্ব পরিচয়ও গড়ে দেয়। সেই কর্মজগত থেকেই মেয়েদের ক্রমশ সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘অক্সফাম’এর সমীক্ষা ‘দ্য ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট ২০২০’ বলছে, শিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতায় মেয়েরা যেখানে পুরুষের সমকক্ষ, সেখানেও মেয়েদের অগ্রগতি রোধ করা হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পাল্লা দিয়ে হরেক নামে নানা প্রকল্প চালু করেছে, তাতেও কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভারতের অন্তত দু’কোটি মহিলা কর্মজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন। এতে মহিলাদের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ সংরক্ষণের আইন যাতে পুরোপুরি কার্যকর হয় সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক মঞ্চে মেয়েদের সমান ও সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীমুক্তির লড়াই এগিয়ে যেতে পারে না। মেয়েদের ক্ষমতায়ন মুখ্যমন্ত্রীও মুখে বলেন, কিন্তু আমরা জানি কিভাবে ক্ষমতা দখলের স্বার্থে শাসক দল বিগত নির্বাচনে অন্যান্য পার্টির মহিলা প্রার্থীদের ওপর জঘন্য সন্ত্রাস চালিয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেস এবার গুন্ডামি আরো বাড়াবে। বিজেপিও বোমাবাজি থেকে শুরু করে মদ ও টাকা দিয়ে ভোট কেনা পর্যন্ত কোনো কিছুই বাকি রাখবে না। সবরকম চাপ ও সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্যে ও স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার জন্য মেয়েদের সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। বিধানসভার মতো পঞ্চায়েতে ভোটেও ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে রুখে দিতে হবে।

নারীর কর্মসংস্থান, ক্ষমতায়ন ও শঙ্কাহীন স্বাধীনতা এবং সকলের জন্য অবাধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে চলো — এটাই হোক আসন্ন সম্মেলনের সংগ্রামী আহ্বান।

- চৈতালি সেন

digital divide emerged

২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই’র সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে ‘ইন্ডিয়া ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ : ডিজিটাল ডিভাইড’ তৈরি করেছে অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া। সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের রিপোর্টও। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ডিজিটাল প্রযুক্তির সুফল বেশিরভাগটাই পৌঁছাচ্ছে পুরুষ, শহুরে নাগরিক, উচ্চশ্রেণি এবং আর্থিকভাবে সম্পন্ন মানুষ এবং পরিবারের কাছে। যেমন, সারা দেশে পুরুষদের মধ্যে ৬১ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহার করলেও, মাত্র ৩১ শতাংশ মহিলার হাতে তা পৌঁছেছে। তারা ইন্টারনেটও পুরুষদের তুলনায় কম ব্যবহার করেন। সাধারণ শ্রেণির মানুষদের মধ্যে ৮ শতাংশের বাড়িতে কম্পিউটার রয়েছে। আর তফসিলি জাতি ও জনজাতির ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ২ এবং ১ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে কম্পিউটার ব্যবহারের উপরে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে অতিমারীও।

রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, করোনার আগে গ্রামের ৩ শতাংশ নাগরিকের কম্পিউটার ছিল। তিন ঢেউ পার করে তা এখন নেমেছে ১ শতাংশে। উল্টো দিকে, শহরাঞ্চলের ৮ শতাংশ মানুষের বাড়িতে তা রয়েছে। এই প্রযুক্তির সুবিধা না পাওয়ার সঙ্গে আর্থিক অবস্থার যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে, তাও স্পষ্ট হয়েছে রিপোর্টে। স্থায়ী চাকরি করা বেতনভুক নাগরিকদের মধ্যে ৯৫ শতাংশের মোবাইল ফোন আছে। কর্মহীনদের মধ্যে তা ৫০ শতাংশ।

(তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা)

India got the worst seat

বিশ্বের দরবারে এবার ভারত দখল করে নিল একনম্বর স্থান। শ্রেষ্ঠত্বের নয়। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসা ছড়ানো ক্রমাঙ্কনের ভিত্তিতে যে তালিকাটি তৈরি হয়েছে সেই সূচকে ভারত রয়েছে সবার উপরে।

কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন’স্থিত ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পিউ রিসার্চ সেন্টার’ এক প্রতিবেদন সামনে আনল। এই সংস্থাটি ১৯৮টি দেশের উপর সমীক্ষা চালিয়ে জানাচ্ছে যে সামাজিক বিদ্বেষ সূচক বা সোশ্যাল হস্টিলিটি ইন্ডেক্সে (এসএইচআই) ভারত রয়েছে এক নম্বরে! ১৯৮টি দেশের মধ্যে ১১টি দেশে ওই সূচক ‘অত্যন্ত বেশি’ বলে একই বন্ধনীভুক্ত করা হয়েছে, আর, ভাবা যায়, আফগানিস্থান, সোমালিয়া, পাকিস্থান, সিরিয়া ইরাকের মতো দেশগুলোকে টপকে ভারত চলে এসেছে এক নম্বরে! উল্লেখিত দেশগুলোর স্থান ওই ১১’র মধ্যে যথাক্রমে ৩-৬-৭-১০-১১। কোভিডের সময়ে অতিমারীর নানান বিধি নিষেধের পর্যায়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা বিরাট মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও, করোনা জিহাদ হ্যান্ডেলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়।

“২০২২ সালে ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিবেশটা মোটেই ভালো নেই। এই বছরে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, বেশ কিছু রাজ্য ও স্থানীয় স্তরে এমন সমস্ত আইন-রাজনীতি-ধর্মান্তরকরণ-গো হত্যা-ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্য বিবাহ সংক্রান্ত প্রশ্নে মুসলিম, শিখ, ক্রিশ্চান, দলিত, আদিবাসীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে যা ওই সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাটভাবেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারটি সমালোচনামূলক স্বরকে লাগাতারভাবে কন্ঠরুদ্ধ করছে, বিশেষ করে তা যদি কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। আর, যারা সেই সমস্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হয়ে কথা বলছেন তাঁদের উপর চলছে নজরদারি, নানাভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে, ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরদোর ও সম্পত্তি, অবাধ যাতায়াতে দেয়াল তোলা হচ্ছে, আটক করা হচ্ছে ইউএপিএ’র মতো দানবীয় আইনে। অসমে এনআরসি রূপায়ণ করার যে প্রক্রিয়া জারি আছে, তাতে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন কারণ ২০১৯’র নাগরিকত্ব আইন তাঁদের সমস্ত সুরক্ষাই কেড়ে নিয়েছে। সব মিলিয়ে, সরকারের এই সমস্ত পলিসি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়িয়েছে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরো অনেক চওড়া করে দিয়েছে। হিংসা-মৃত্যু-যৌন নির্যাতন, সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া, ধর্মস্থান ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া, যথেচ্ছ গ্রেপ্তার হয়রানি, অনলাইনের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তপশীলি জাতি ও আদিবাসীদের সামাজিক বয়কট যেন একটা দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

এই কথাগুলো দেশের বিরোধী দলের নয়। কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে এক সমীক্ষা ‘রিলিজিয়াস ফ্রিডম ইন ইন্ডিয়া’ (ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা)। প্রকাশ করেছে ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআইআরএফ) — ভারত নিয়ে কান্ট্রি আপডেট। ২০২১-২২ সালে ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা কেমন ছিল, ভারত সরকার যে সমস্ত নীতি অনুসরণ করে চলেছে তার একটা মূল্যায়ন করেছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি। রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে উদঘাটিত করা হয়েছে ভারতের মতো বহুমাত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান যখন ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার করেছে, তখন তাকে রীতিমতো লঙ্ঘন করে ভারত সরকার কিভাবে চরম বিভেদমূলক দমননীতিকেই তার শাসনতন্ত্রের অঙ্গ করে ফেলেছে। নাগরিক সমাজ, প্রতিবাদী স্বরকে কণ্ঠরুদ্ধ করতে কিভাবে দমনের রাস্তা বেছে নিয়েছে।

সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছে উল্লিখিত রিপোর্ট। বলা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার দল বিজেপি’র সাথে গলায় গলায় জড়িয়ে থাকা আরএসএস সংগঠন হল এক আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, যারা খোলাখুলিভাবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার বুনিয়াদকে ভেঙ্গে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তুলতে উদ্যত, আর সেই লক্ষ্যেই সমস্ত রাজনৈতিক নীতিমালাকে পরিচালিত করা হচ্ছে।” উক্ত ফোরাম ২০২১ সালেই তার আরেকটা রিপোর্টে আরএসএস’কে এক আধা-সামরিক বাহিনী হিসাবে চিহ্নিত করে, যারা কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আদর্শকে উদ্বাহু সমর্থন করে আসছে। এবছরের ১৯ অক্টোবর, ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্র সংঘের মহাসচিব গুটেরাস ভারত সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তাও উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, “মানবাধিকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসাবে ভারতের দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্বের মানবাধিকারকে সংহত করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সহ প্রতিটি ব্যক্তি নাগরিকের অধিকারকে সুরক্ষিত ও বিকশিত করা। মূল ধারায় অন্তর্ভুক্তিকরণের পাশাপাশি সমাজে বিবিধ সাংস্কৃতিক-বহুধর্ম-বহুবর্ণের যে অপরিসীম অবদান রয়েছে তাকে স্বীকৃতি দিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘৃণা ভাষণকে নির্দ্বিধায় নিন্দা করতে হবে। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, ছাত্র ও শিক্ষাব্রতীদের অধিকার ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে।”

সুশীল সমাজ, বিরোধী কন্ঠস্বর, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা যারাই এই সরকারের নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন তাদের উপরই নেমে এসেছে দমন পীড়নের খাঁড়া। ইউএপিএ সহ নানা দানবীয় আইনের বিভিন্ন ধারায় আটক করা, নজরদারি চালানো, প্রভৃতি কাজগুলো ২০২২ থেকেই এই সরকার লাগাতার ভাবে চালিয়ে এসেছে বলে উক্ত রিপোর্ট উল্লেখ করেছে। ২০১৮ সালে অল্ট নিউজের জুবেইরকে ছোট্ট একটা টুইটের জন্য গ্রেপ্তার করা হল এই অজুহাতে যে তা নাকি হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত দিয়েছে। অথচ, বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মা মুসলিমদের ধর্মীয় গুরু মহম্মদ সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তিজনক ও কুরুচিকর মন্তব্য করার পর দেশজুড়ে তীব্র অশান্তি সৃষ্টি হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিদ্দিক কাপ্পান, তিস্তা শেতলবাদ, ফাদার স্ট্যানস্বামী, উমর খালিদ থেকে শুরু করে নানা অছিলায় মোদী সরকার যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তার উল্লেখ রয়েছে এই রিপোর্টে। আর জেলের ভেতরেও বন্দিদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করার জন্য ফাদার স্ট্যানস্বামীর মৃত্যুর জন্যও ভারত সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রান্তে বুলডোজার চালিয়ে সংখ্যালঘু মানুষদের বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমতি সাপেক্ষে বিলকিস বানোর গণধর্ষক খুনে ও দাগি আসামীদের ১৫ আগস্ট ২০২২ জেল থেকে মুক্তি দেওয়া, সিএএ ও এনআরসি’র মাধ্যমে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণের নাগরিকত্ব বাতিলের চক্রান্ত শুরু করা, সংগঠিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনলাইন প্রচারের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জনগণের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও হিংসা ছড়ানো, এমনকি এই ঘৃণ্য কাজে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ মদতের উল্লেখও রয়েছে। উক্ত ফোরাম জানিয়েছে যে মুসলিম, ক্রিশ্চান, দলিতদের উপর হিংসা ও ভয়ভীতি ছড়ানোর হাতিয়ার হিসাবে হিন্দুত্ববাদীরা ওই সমস্ত সম্প্রদায়ের উপর যৌন অত্যাচার, এমনকি ধর্ষণকেও যে হাতিয়ার বানিয়েছে, তার অনেক রিপোর্ট তাদের কাছে এসেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তারা জানিয়েছে, ‘ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট ডেসিগনেট’ ভারতকে ‘কান্ট্রি অফ পার্টিকুলার কন্সার্ন’ (বিশেষ উদ্বেগজনক দেশ) হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ হিংসা ছড়ানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যেভাবে পক্ষ অবলম্বন করছে, তার বিরুদ্ধে গোটা রিপোর্ট তীব্র সমালোচনা করেছে।

সমস্ত ধরনের নেতিবাচক, পশ্চাদমুখী অনুন্নয়ন ও গণতন্ত্রহীনতার ক্ষেত্রে জগতসভায় ভারত নিকৃষ্টতম আসন দখল করে নিয়েছে। এ আমাদের লজ্জা। গোটা দেশ ও জাতির লজ্জা।

- অতনু চক্রবর্তী

brutal exploitation

দারিদ্র্য ক্ষুধা বৈষম্যের পৃথিবীকে আরও বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত করে গেছে কোভিড। সঙ্গে সঙ্গত করে চলেছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ যুদ্ধ আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাণঘাতী ঝাপ্টা। আর এসবের সহজ শিকার যে দরিদ্র অসহায় মানুষ সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার মধ্যে আবার সবচেয়ে নির্যাতিত নারী ও শিশু।

কিন্তু কোভিড-উত্তর নয়া উদারবাদী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার হিংস্রতার যে ছবি সম্প্রতি সামনে এসেছে তা হয়তো অনেকেরই জানা ছিল না। পিতৃতান্ত্রিক শোষণকে এমন নিষ্ঠুর এবং নৃশংসভাবে হাতিয়ার করে নারী ও কিশোরীদের রক্ত ঘাম মাখা শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে ভাঙা কোমর সোজা করার মরিয়া চেষ্টাটা লিঙ্গভিত্তিক উৎপীড়নকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। আধুনিক বিশ্বের শাসকদের সেই নির্মম অমানবিকতার দলিল তুলে ধরেছে অক্সফ্যাম তার ‘অ্যাসল্ট অব অস্টারিটি’ (ব্যয়সংকোচের হামলা) শীর্ষক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার অতিমারীতে তলিয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে টেনে তোলা এবং লাফিয়ে বেড়ে চলা মূল্যস্তরকে বাগে আনতে ব্যয়সংকোচের আশ্রয় নিয়েছে। এবং তার অব্যর্থ কোপটা পড়েছে গণ পরিষেবার ওপর। শিক্ষা স্বাস্থ্য পুষ্টি জল সরবরাহ পরিবহন সামাজিক সুরক্ষা, মা ও শিশুর পুষ্টি ও পরিচর্যা – সমস্ত ক্ষেত্রে পরিষেবা ছেঁটে দেওয়া হচ্ছে, ভর্তুকি তুলে দেওয়া হচ্ছে খরচ কমানোর জন্য। আর তার আঘাতটা সরাসরি গিয়ে পড়ছে মহিলা কিশোরী ও সামাজিক লিঙ্গ বৃত্তের বাইরে থাকা (non-binary) মানুষদের ওপর, যারা এই পরিষেবাগুলির ওপর একান্ত নির্ভরশীল ছিলেন। বিশেষ করে গরিব নিম্নবর্ণের প্রান্তিক মহিলা ও কিশোরীরা। তাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে চরমতম দারিদ্র্য, ঝুঁকি, অনাহার, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও অকাল মৃত্যুর দিকে। কোভিড-উত্তর অর্থনীতির উদ্ধারের রাস্তা তৈরি হচ্ছে মহিলা ও বালিকাদের জীবন, ঘর্মাক্ত শ্রম ও নিরাপত্তাকে দলিত মথিত পিষ্ট করে। এ কথা বলেছেন অক্সফ্যাম জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড জেন্ডার রাইটস্-এর প্রধান অমৃতা হার্সি। রিপোর্টে এই প্রক্রিয়াকে “স্ল্যাশ অ্যান্ড বার্ন” পদ্ধতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে – নতুন কৃষির জন্যে গাছ পালা কেটে পুড়িয়ে দাও! এই অত্যাবশ্যক পরিষেবা ছাঁটাইয়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব নারী ও বালিকাদের দেহ মন অনুভূতি ও সংবেদনশীলতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

২০২০-র চেয়ে ২০২১-এ অনেক বেশি মহিলা কাজ হারিয়েছেন। ২০১৯-২০২২-এর মধ্যে মহিলারা বিজ্ঞাপিত কর্মসংস্থানের মাত্র ২১% এ নিয়োজিত হতে পেরেছেন, তা ও তার মধ্যে অনেকগুলোই আগের চেয়ে বেশি শোষণমূলক ও বিপজ্জনক। পরিচর্যার দায়িত্ব পালনে ২০২০ তে মহিলাদের পারিশ্রমিকবিহীন অতিরিক্ত ৫.১২ বিলিয়ন ঘন্টা শ্রম করতে হয়েছে।

প্রতি বছর বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে পৃথিবী জুড়ে ৮০০০০০ মহিলা ও বালিকার মৃত্যু ঘটে। জল সরবরাহ পরিষেবার কাটতির জন্য মহিলাদের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। শুধু জল সংগ্রহের জন্য মেয়েদের অন্তত ২০০০ লক্ষ ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হবে। মূল্যবৃদ্ধির এই ভয়াবহ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলে খাদ্য সংগ্রহও দুরূহ হয়ে পড়বে।

লকডাউনের সময় বাজেট বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের জন্য অন্তত ৮৫% দেশ তাদের অত্যাবশ্যক জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ায় মহিলা ও বালিকাদের আরও বেশি লিঙ্গ-হিংসার শিকার হতে হচ্ছে। গত বছরে প্রতি ১০ জনে ১ জন নিজের পরিজনের দ্বারা যৌন অত্যাচার ও শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছে। ২০২৩-এ পৃথিবীর অন্তত ৮৫% মানুষ এই ব্যয়সংকোচ পদক্ষেপের কবলে পড়বেন। স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো তাদের মিলিত সামরিক ব্যয়ের মাত্র ২% ব্যয় করলে, ১৩২টি দেশে ব্যক্তিগত স্তরে লিঙ্গভিত্তিক হিংসা বন্ধ হতে পারে।

মহিলারা অত্যাবশ্যক পরিষেবা, সামাজিক সুরক্ষা ও পরিকাঠামোগত সুবিধা ছাঁটাইয়ের দরুণ শাঁখের করাতের মত দু’বার যন্ত্রণাবিদ্ধ হচ্ছেন। প্রথমত সরাসরি-চাকরি খোওয়ানো, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির চাপ; দ্বিতীয়ত পরোক্ষ ভাবে সমাজের ‘শক অ্যাবজর্বার’ হিসেবে — রাষ্ট্র যখন বিবেকশূন্য হয়ে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে, এই মহিলাদের, বালিকাদের তখন কোনক্রমে নিজেকে এবং পরিবারকে টিঁকিয়ে রাখার দায় শীর্ণ, দুর্বল কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে। কারণ আবহমান কাল ধরে সাংসারিক প্রাত্যহিকতার খুঁটিনাটি তাদেরই দেখতে হয়। নিজে ক্ষুধার্ত থেকেও সকলের খাবারের সংস্থান করতে হয়, সকলের যত্ন করতে হয়। আরও একটু বিশদে বলি-এই আকাশ ছোঁয়া দাম আর পৃথিবীর ক্ষুধার্ত মানুষের ৬০% এর বেশি মহিলা ও বালিকারাই — এই তথ্য আইএমএফ-এর অজানা নয়। তবু এই সংস্থা চোখ কান বুজে ৯টি দেশকে (যার মধ্যে ক্যামেরুন, সেনেগাল, সুরিনামও রয়েছে) ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স চালু করতে বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছে। আর সেগুলো খাদ্যসহ অত্যাবশ্যক পণ্যের ওপর!

লিঙ্গসাম্যের ব্যাপারে সরকারগুলো এত নির্বিকার যে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যের অর্ধেকও তারা যোগাড় করতে পারেনি।

document of brutal exploitation

নিও লিবারাল বিশ্ব অর্থনীতির আধিপত্য এ সব কিছুর মূলে যা প্রগাঢ়ভাবে পিতৃতান্ত্রিক। এই ব্যবস্থার নির্দেশিত তথাকথিত ‘ব্যয়সংকোচ’ নীতি আদৌ অনিবার্য বা অপরিহার্য নয়। ১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে কর্পোরেশনকে সমর্থন দেওয়ার জন্য। বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হচ্ছে। আর এই ক্ষমতাবানদের স্বার্থে আর্থিক নীতি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সমাজের দুর্বলতম প্রান্তিক মানুষদের থেকে সমর্থন কেড়ে নেওয়া হল। তাদের একান্ত প্রয়োজনগুলি নাকচ করে শোষণের জোয়াল কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হল। বাজার-চালিত বিশ্বায়নে কম মজুরি ও শ্রম আইন ও বিধিগুলির অবসান ঘটিয়ে পণ্যায়িত নারী শ্রমকে শোষণের রাস্তা পাকা করা হল। তাই এই ব্যয়সংকোচ পদ্ধতি একাধারে শ্রেণি ও লিঙ্গ সংক্রান্ত প্রশ্ন। এটি শুধু লিঙ্গভিত্তিক একটি পদ্ধতিই নয়, লিঙ্গভিত্তিক একটি প্রক্রিয়াও বটে কারণ এটি মহিলাদের প্রাত্যহিক জীবনে তাদের আয়, তাদের পরিচর্যার দায়িত্ব, স্বাস্থ্য-জল-পরিবহন ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার সুযোগ নেওয়ার সক্ষমতা এবং বাড়িতে কাজের জায়গায় রাস্তায় তাদের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও যৌন-শারীরিক নিগ্রহ থেকে স্বাধীনতা – সবকিছু কেই প্রভাবিত করে চলেছে।

এই হিংস্র, অযৌক্তিক যৌন-বৈষম্যবাদী, বর্ণবিদ্বেষী পদ্ধতিটি পুরোনো ঔপনিবেশিকতারই উত্তরাধিকার। তার সঙ্গে বলি, লিঙ্গভিত্তিক হিংসা শুধু বাড়িতে রাস্তা ঘাটে আর কাজের জায়গায় সীমাবদ্ধ রইলো না, ম্যাক্রোইকোনমিক পলিসি ডিসিশনেও তার আগ্রাসী থাবা অক্সফ্যামের এই রিপোর্ট তুলে ধরেছে। মেয়েদের আরও দুর্দশা দারিদ্র্য অস্বাস্থ্য ও অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে ব্যয়সংকোচ নীতির অন্তর্নিহিত হিংসা নিজেকে উন্মোচিত করেছে।

অক্সফ্যাম রিপোর্ট সব দেশের সরকারের কাছে তদারকিতে ব্যয়সংকোচ বন্ধ করে বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করতে বলেছে। যেমন নারীসহায়ক বাজেট (ফেমিনিস্ট বাজেট) ও ধনীদের সম্পদের ওপর প্রগতিশীল হারে কর বসাতে বলেছে। বিশ্বের বিলিয়নিয়ার ট্রিলিয়নিয়ারদের উপর সম্পদ কর বসালেই এক ট্রিলিয়ন ইউএসডি-র বেশি অর্থ সংগৃহীত হতে পারে যা ২০২৩-এ ৫৪% দেশ অত্যাবশ্যক পরিষেবা তুলে দিয়ে সাশ্রয় করতে চাইছে। কর থেকে সংগৃহীত অর্থ সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা ও জনপরিষেবায় বিনিয়োগ করতে পরামর্শ দিয়েছে এই রিপোর্ট। তাছাড়াও, নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও মহিলা, বালিকা ও সামাজিক লিঙ্গ বৃত্তের বাইরে থাকা মানুষদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনগুলি মাথায় রাখতে বলেছে এই রিপোর্ট।

এই রিপোর্টে আইএমএফ-কেও যন্ত্রণাদায়ক ব্যর্থ সমস্ত ব্যয়সংকোচ পদক্ষেপ বন্ধ করতে এবং চালু ঋণ প্রকল্পগুলি থেকে ব্যয়সংকোচ মূলক সমস্ত শর্ত প্রত্যাহার করে নিতে বলেছে। পরিশেষে অক্সফ্যাম রিপোর্টের বার্তাটি তুলে ধরি: “উই নিড টু এন্ড অস্টারিটি। দিস রিপোর্ট ইজ অ্যা বোল্ড কল টুয়ার্ডস ভিশনিং অ্যা নিউ অ্যান্ড অ্যাকশনেবল গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডার দ্যাট ইজ রুটেড ইন পিভোটাল প্রিন্সিপ্লস অব রিডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিস ফর অল” আমার ভারত বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্যের তালিকায় ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম। তাই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন আমরাও!

সূত্র: দি অ্যাসল্ট অব অস্টারিটি
(অক্সফ্যাম রিপোর্ট)
নিউজক্লিক, ২৫ নভেম্বর ২০২২

-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

Kashmir Files

ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল — ১৯৩৩ সালে নাৎসি জমানায় লেনি রিফেনস্থাল নির্মিত তথ্যচিত্রটির দুটি বিষয় আজও আলোচনার দাবি রাখে। বিষয়গুলি হল — জন সংযোগের ক্ষেত্রে উপযোগী মাধ্যম হিসেবে সিনেমার প্রতি ফ্যাসিবাদীদের ঝোঁক এবং প্রচার অর্থাৎ প্রোপাগান্ডার জন্য নির্মিত হলেও সেই সিনেমার স্বতন্ত্র ভাষ্য তৈরির ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্থাৎ শৈল্পিক গুনমানের জায়গা থেকে উতরে যাওয়া। যুগ যুগ ধরে এই আধারেই অন্যান্য বিভিন্ন দেশের বহু ছবি আমাদের সামনে এসেছে, রাজনৈতিক ভাবে সমস্যাজনক হয়েও ভালো সিনেমা হিসেবে নাম লিখিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে একুশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকায় নির্মিত এরকম বহু ছবির নামই এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় যারা সাম্যবাদের প্রতি এবং নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে সোভিয়েতের প্রতি গভীর বিদ্বেষ নিপুণ দক্ষতায় সুক্ষভাবে মানুষের মনে গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিবেক অগ্নিহোত্রী নির্মিত কাশ্মীর ফাইলস অবশ্য এই ক্ষেত্রে ডাহা ফেল করেছে। বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের মিছিল-মিটিংয়ের আলোচনায় উঠে আসা মিথ্যাচারকে বড় পর্দায় তুলে ধরা, হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডের ইতিহাস বিকৃতিগুলোকে সিনেমার চরিত্রদের মুখে সংলাপ আকারে দিয়ে দেওয়া আর কাশ্মীরী পন্ডিতদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সমস্ত মুসলিম ধর্মের মানুষকে সন্ত্রাসের অবতার বানিয়ে দেওয়া ছাড়া এই সিনেমার নতুন কিছুই দেওয়ার নেই। সোজা ভাষায় বলতে গেলে এটি একটি প্রচারমূলক অর্থাৎ প্রোপাগান্ডা ছবি যেটি শৈল্পিক এবং মানবিক কোনো ধরনের চিন্তাভাবনাকেই প্রশ্রয় দেয় না। অবশ্য সংঘ ব্রিগেডের দিক থেকে এটা প্রথম প্রচেষ্টা নয় — গত ৮ বছরে অর্থাৎ বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতবর্ষে নির্মিত বেশ অনেকগুলি ছবিই ধর্মান্ধতার মতাদর্শকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কাশ্মীর ফাইলসের সাথে বাকি ছবিগুলির পার্থক্য একটাই — এই ছবিটি বক্স অফিসে হিট করেছে, বহু মানুষ দেখেছেন, প্রযোজকের ঘরেও বেশ অনেক টাকাই ঢুকেছে। অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার জন্য কাঠখড়ও কম পোড়াতে হয়নি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে এই ছবির প্রচারে নেমে আসতে হয়েছে, অধিকাংশ বিজেপি শাসিত রাজ্যে ট্যাক্স মকুব করে দেওয়া হয়েছে। এই সবের মধ্যিখানে চাপা পড়ে গেছে কাশ্মীরের প্রকৃত ইতিহাস। নব্বইয়ের দশকের সন্ত্রাসের বাতাবরণে যারা দিনের পর দিন আতঙ্কে সময় কাটিয়েছেন তাদের কোনো ধর্ম নেই। তারা হিন্দু, মুসলিম, শিখ, এমনকি যারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস রাখেন না — তারা প্রত্যেকেই মৌলবাদের, রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের শিকার। উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতবর্ষের তরফে যে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়নি উপরন্তু বিজেপি আসার পর কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে স্বেচ্ছাচার বৃদ্ধি পেয়েছে এই নির্মম সত্যিটা চেপে যাওয়ার জন্যই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কাশ্মীর ফাইলসকে। নইলে যে ৩৭০ ধারা তুলে দিলে কাশ্মীরের সকল সমস্যা ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা ছিল অন্তত অমিত শাহর দাবি অনুযায়ী, সেই ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার পর প্রায় বছর খানেক ধরে কাশ্মীরে ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখতে হত না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ, বিজেপির এককালীন জোটসঙ্গী মেহবুবা মুফতিকে দীর্ঘকাল যাবত ঘরবন্দী করে রাখতে হত না। কাশ্মীর ফাইলস ছবিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে যথাযথ উদ্দ্যেশ্য সাধনের জন্য নির্মিত হয়েছে এবং মুক্তি পেয়েছে — আপনি এই কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন অথচ সোজাসুজি, সবার সামনে বলতে পারবেন না। বললে আপনাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগাল করা হবে, খুনের হুমকি দেওয়া হবে, এমনকি আপনার নামে মিথ্যে মামলাও হতে পারে। ছবির পরিচালক অভিমান করে চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিতে পারেন — এই ছবিতে মিথ্যে কথা বলা হয়েছে প্রমাণ করতে পারলে তিনি ছবি বানানো ছেড়ে দেবেন। বিবেক অগ্নিহোত্রী আর কোনো দিন সিনেমা তৈরি করবেন না এই কথাটা আপামর সিনেমা-প্রেমীদের কাছে সুখবর হলেও এতে লাভের লাভ কিছুই হবে না কারণ দেশে, অন্তত এখনও পর্যন্ত, বিজেপি ঘনিষ্ঠ পরিচালকের অভাব নেই।

পরিচালকের কথা থেকেই এত কথার সূত্রপাত। নাদাভ লাপিড — ইজরায়েলের চিত্র পরিচালক। সম্প্রতি ভারতবর্ষে এসেছিলেন ৫৩তম আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবের বিচারক হিসেবে। মঞ্চে তিনি যখন উঠলেন তখন সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন বিজেপি সরকারের মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, ইজরায়েলের দূতাবাসের প্রধান সহ আরও অনেকে। কোনোরকম রাখঢাক না রেখেই লাপিড সরাসরি আক্রমণ করলেন ছবিটিকে। বুঝিয়ে দিলেন এই ছবির পরতে পরতে হয়েছে ঘৃণার চাষ। প্রশ্ন তুললেন একটি আন্তর্জাতিক চলচিত্র হিসেবে এই ধরনের নিম্নমানের ছবির মনোনয়ন পাওয়াকে নিয়েও। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার জোর করে ছবিটিকে ফেস্টিভালে জায়গা করে দিয়েছে। এই ছবি নিয়ে মাতামাতি হওয়া শুধুমাত্র বিদ্বেষের রাজনীতিকেই প্রশ্রয় দেয়, শিল্প এবং সমাজের প্রতি এই ছবির বিশেষ দায়িত্ব নেই। লাপিড জানতেন এই কথাগুলো বললে তিনি অনেকেরই চক্ষুশূল হবেন। তবে আপোষের পথে তিনি যে হাঁটবেন না একথা বলাই বাহুল্য। অতীতে বিভিন্ন সময় নিজের দেশের সরকারকে নানান প্রশ্নে আক্রমণ করেছেন লাপিড। ইজরায়েল কর্তৃক প্যালেস্টাইন দখল প্রসঙ্গে, পারমাণবিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বহুবার ইজরায়েল প্রশাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন তিনি। মঞ্চে উঠে তিনি গোয়ার সমুদ্র সৈকত, খাবার নিয়ে দু-চার কথা বলে, উদ্যোক্তাদের গুণগান করে নেমে যাবেন এই আশা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষের লোকজন করে থাকলে বলতে হয় তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছিলেন। লাপিড নতুন কোনো কথা বলেননি, সেটাই বলেছেন যেটা এই দেশের সমস্ত ধর্ম নিরপেক্ষ প্রগতিশীল মানুষরা কাশ্মীর ফাইলসকে নিয়ে ভেবেছেন। তাই হাজার আক্রমণ সহ্য করার পরেও লাপিডের এই বিষয়ে কোনো অনুশোচনা নেই। থাকার কথাও নয় কারণ সত্যিটা যতই তিক্ত হোক কাউকে না কাউকে বলতেই হত, বলতে হয়।

বর্তমানে ইজরায়েলের সাথে ভারতবর্ষের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে বিপাকে পড়েছেন দুই দেশের প্রধানরাই। লাপিডের বক্তব্যের পর তড়িঘড়ি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য নেমে ইজরায়েল দূতাবাসের প্রধান লাপিডকে তিরস্কার করেছেন। বলেছেন লাপিড দ্বিতীয় বিশযুদ্ধে হওয়া ইহুদী নিধনের ঘটনায় ফ্যাসিবাদীদের পক্ষে। তিনি কি জানেন যেই ফ্যাসিবাদী শক্তি নিয়ে কথা হচ্ছে সেই হিটলার-মুসোলিনির রাজনীতিতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ – যারাই এখন অলিখিতভাবে ভারতবর্ষকে চালাচ্ছেন, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সমস্ত উচ্চ স্তরের নেতারা এই সংঘেরই সদস্য। জানলে নিশ্চয়ই এই ধরনের রাজনৈতিকভাবে ভোঁতা উপমা ব্যবহার করে লাপিডকে আক্রমণ করতেননা। মাঠে নেমে পড়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের দালাল বাহিনীও। লাপিডকে ভারত বিরোধী আখ্যা দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে কুৎসিত ভাষায়। অনেকটা কৃষক আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের পক্ষ নেওয়া বিখ্যাত গায়িকা রিহানাকে আক্রমণ করার মতো। তবে লাপিডের পক্ষে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয় — ঘটনার দিন থেকে আজ পর্যন্ত বহু মানুষ তাকে ইমেইল করে, মেসেজ করে সাধুবাদ জানিয়েছেন। স্বরা ভাস্কর, প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী সহ অনেকেই তার পক্ষ নিয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়েছেন ফেস্টিভালের অন্যান্য বিচারকরাও — তারা জানিয়েছেন লাপিডের বক্তব্যে কোনো ধরনের মিথ্যাচার নেই, কাশ্মীর ফাইলস আদতেই একটি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে নির্মিত ছবি। একটা খারাপ ছবি নিয়ে এতগুলো কথা বলার কারণ একটাই — দিনের শেষে যত মানুষই ছবিটা দেখুক বা বাণিজ্যিকভাবে ছবিটা যতটা সফলই হোক না কেন আদতে জনপ্রিয় জিনিস যদি সমাজের স্বার্থে বিপদজনক হয় তবে সেটা নিয়ে সর্বসমক্ষে বলা দরকার, সমালোচনা করা দরকার। তার জন্য কাশ্মীরী পন্ডিতদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয় না, তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে হয় না। এখনও যারা সবটা জেনে-বুঝেও নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করছেন তাদের জন্য লাপিডের বক্তব্য অনেকটা শিক্ষণীয় — শিক্ষা এটাই নিতে হবে যে বিজেপি মানেই দাঙ্গাবাজ, বিবেক অগ্নিহোত্রী মানেই দালাল আর কাশ্মীর ফাইলস হল গিয়ে একটি নিম্নমানের ছবি — এই কথাটা জোর গলায় বলতে হয়। হাজারটা মিথ্যে, নীরবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সত্যিটা বলা যায় এখনও।...

– সৌমেন্দু মিত্র

Lachit Barfukan

লাচিত বরফুকন ছিলেন আসামের এক সেনানায়ক। ২০২২ সালে তাঁর জন্মের চারশো বছর হল। চার শতাব্দী আগের এই সমরনায়ককে নিয়ে ইদানীং বিশেষ করে সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে নানা অনুষ্ঠান ও আলোচনাসভা আয়োজিত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে লাচিত কে ছিলেন, কী তাঁর কীর্তি সেই নিয়ে এই লেখায় যেমন আমরা কথা বলতে চাইবো, তেমনি বুঝতে চাইবো বিজেপি ঠিক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে লাচিত বরফুকনকে নিয়ে সংস্কৃতির রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নেমে পড়েছে। এও দেখার চেষ্টা করব লাচিত কী কেবল এই ভাষ্যে বা দৃষ্টিকোণেই ব্যাখ্যাত হতে পারেন, না কী অন্য আঙ্গিক থেকেও তাঁর জীবন ও কাজকে দেখা যায়, যে দেখা আবার সংঘ ও বিজেপির চলমান রাজনীতিকে বিপদে ফেলতে পারে।

সেইসব প্রসঙ্গে যাবার আগে দেখে নেওয়া যাক লাচিতের জীবন ও কর্মের কিছু তথ্য। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়কালেই লাচিতের জীবন নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য বই বেরিয়েছিল। এসকে ভুঁইয়া লিখিত Lachit Barphukan and His Times নামের সেই বই আমাদের জানাচ্ছে যে লাচিত ছিলেন ছেঙ-কালুক মছাই নামের একজন তাই-অহোম পাদ্রীর চতুর্থ পুত্র। তিনি শৈশব কৈশোরে সামরিক ও অসামরিক দু’ধরনের শিক্ষাতেই শিক্ষিত হন। তারপর অহোম রাজা সুসেনফার অধীনে সেনাপ্রধান (অথবা ‘ফু-কান’)-এর দায়িত্ব পালন করেন।

লাচিত বরফুকনের প্রকৃত নাম ছিল লাচিত লাও। অহোম সাম্রাজ্যে প্রধান সেনাপতিকে বরফুকন উপাধি দেওয়া হত। লাচিত প্রথমে ‘ঘোড়া বরুয়া’ উপাধি পেয়েছিলেন কারণ তিনি প্রথম অবস্থায় দুর্দান্ত ঘোড়া বশে নিপুণ ছিলেন। তারপর তিনি দুলীয়া বরবরুয়া, শিমুলগুরীয়া ফুকন, দোলাকাষরীয়া ফুকন ইত্যাদি উপাধি পান, যেগুলি বিভিন্ন সমর কুশলতার কারণে দেওয়া হত। অবশেষে তিনি অহোমের রাজা চক্রধ্বজ সিংহ কর্তৃক ‘বরফুকন’ উপাধি পেয়েছিলেন। অহোম রাজা সুসেনফার সরাইঘাট যুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে লাচিত বরফুকনকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি লাচিতকে উপহারস্বরূপ স্বর্ণ তরোয়াল (অহোম ভাষায় হেং দাং) ও পারম্পরিক বস্ত্র প্রদান করেছিলেন।

সরাইঘাট যুদ্ধই লাচিতের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি। সমরনায়ক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রতি লাচিতের নিষ্ঠার প্রমাণ হিসেবে একটি কাহিনী বিখ্যাত হয়ে আছে। সেই কাহিনী অনুসারে সরাইঘাট যুদ্ধের সময় লাচিত মোগলদের বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে অহোম সেনাদের একটি উঁচু দেওয়াল নির্মাণ করার আদেশ দিয়েছিলেন। লাচিতের মামা এই দেওয়াল নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু তিনি অলস মনোভাবের জন্য সঠিক সময়ে দেওয়াল নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি। নির্মাণের কাজ অসম্পূর্ণ দেখে লাচিত মামার শিরশ্ছেদ করেন। মামার শিরশ্ছেদ করার সময় লাচিতের উক্তি ছিল ‘দেশতকৈ মোমাই ডাঙর না হয়’, অর্থাৎ জন্মভূমির প্রতি কর্তব্যর থেকে মামার স্থান জীবনে বড় নয়।

সরাইঘাট যুদ্ধ হয়েছিল মোগল বাহিনী ও অহোম বাহিনীর মধ্যে। অহোম সেনাপতি ছিলেন লাচিত বরফুকন আর মোগল সেনাপতি ছিলেন রাম সিংহ। অহোম সেনার তুলনায় মোগল সেনারা বেশি শক্তিশালী ছিল কিন্তু গোরিলা যুদ্ধ কৌশলের ফলে মোগলেরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। মোগলেরা ৩০,০০০ সৈন্য, ১৫০০০ ধনুর্বিদ, ১৮,০০০ ঘোড়া, ১০০০ অধিক কামান ও বিশাল নৌকা নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এই বিরাট মোগল সেনার তুলনায় নিজেদের অনেক দুর্বল দেখে অহোম সেনারা জয়লাভের আশা বাদ দিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করেছিল। নিজ সেনাকে পিছোতে দেখে সেনাপতি লাচিত বরফুকন বলেছিলেন, “তোমরা যদি পিছিয়ে যেতে চাও, যাও। কিন্তু স্বর্গদেও আমাকে আদেশ করেছেন, আমি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লড়ব। তোমরা স্বর্গদেওকে বলবে আমি জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি। লাচিতের এই কথা অহোম সেনার মধ্যে উত্তেজনা জাগায় ও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে তারা মোগল সেনাকে পরাস্ত করে।

লাচিত আসামের বীর নায়ক। কিন্তু সংঘ পরিবার লাচিতের চারশো বছর পূর্তিতে তাঁকে নিয়ে আসামে ও জাতীয় স্তরে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁদের কাছে লাচিত এমন এক ভারতীয় সেনানায়ক, যিনি মোগল তথা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়ে তাঁদের পরাস্ত করেছিলেন। শিবাজীর মতোই সপ্তদশ শতকের এই সমরনায়ককেও তাঁরা নিজেদের মতাদর্শে ঝাড়াই বাছাই করে নিজেদের সুবিধেমতো পেশ করতে চায়। শিবাজীর অন্যতর পরিচয় তুলে ধরে সংঘর ইতিহাসভিত্তিক রাজনীতির পর্দা যিনি ছিন্নভিন্ন করেছিলেন সেই গোবিন্দ পানসারেকে খুন হতে হয়েছে কয়েক বছর আগে। কিন্তু তাতে পানসারের লেখা বই ‘কে ছিলেন শিবাজী’ বইটির প্রচার প্রসারকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। তেমনি লাচিত বরফুকনকে যতই সংঘ পরিবার মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুর যুদ্ধের একমাত্রিক ন্যারেটিভে আটকে রাখতে চাক, এই তথ্য কি চেপে দেওয়া সম্ভব যে মোগল সেনাপতির বিরুদ্ধে লাচিতের নেতৃত্বে অহোমের বাহিনী লড়েছিল সেই মোগল সেনাপতির নাম ছিল রাম সিংহ, যিনি ছিলেন আদতে এক হিন্দু যোদ্ধাই? এই তথ্যও কি চোখ এড়িয়ে যাওয়ার যে লাচিত ছিলেন একজন তাই-অহোম পাদ্রীর পুত্র এবং জন্মসূত্রেই একজন খ্রিস্টান?

সর্বোপরি লাচিত ও অহোম রাজার যুদ্ধ প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন কিনা উঠতে পারে যে লাচিত ও অহমের সেনা তথা মানুষের মোগল বিরোধী এই যুদ্ধ দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক সায়ত্তশাসনের তরফে এক জোরালো সংগ্রাম ছিল? বস্তুতপক্ষে লাচিত বরফুকনের ইতিহাস ও বীরত্ব আজকের দিনে বিজেপির তরফে চালানো অতিকেন্দ্রিক শাসন ও একঢালা হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্থান প্রকল্পেরই মূর্ত প্রতিবাদ। কেন্দ্রীয় দমনের বিরুদ্ধে আজকের সংবিধানসম্মত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে লড়াই, সেই লড়াইয়ের একজন প্রেরণাদাতা হিসেবে লাচিতের ইতিহাসকে পড়া সম্ভব।

বিজেপি ও সংঘ পরিবার তাদের মতো করে ইতিহাসকে গড়েপিঠে নিতে চায়। তাদের ভূমিপুত্র ও বহিরাগতর প্রকল্পে খাপ খাওয়ানোর জন্য কখনো তাঁরা মান্য ইতিহাসকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, সেই ইতিহাসের বিশ্ববিখ্যাত অধ্যাপক ও গ্রন্থাবলীকে আক্রমণ করে, অন্যদিকে নিজেদের ভাষ্যসম্মত মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে। তারা তাই ইন্দো ইউরোপীয়দের এদেশে আগমনের ভাষাতাত্ত্বিক ও অন্যান্য প্রমাণগুলি মানে না, বলতে থাকে আর্যরা এদেশেরই আদিম অধিবাসী এবং এখান থেকেই তাঁরা বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিলেন। বৈদিক সভ্যতাকে তারা মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে চায় প্রাক বৈদিক হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে। সিন্ধু সভ্যতাকে বেদ উল্লিখিত সরস্বতী নদীর সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে তাকে ডাকে সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতা বলে। আর্যদের ভূমিপুত্র হিসেবে ঘোষণা করে তারা বাইরে থেকে আসা অন্যান্যদের বিশেষ করে তুর্কি, আফগান, ইরানীয় ও আরবীয় মুসলিমদের আগ্রাসনকারী হিসেবে দেগে দিতে চায়। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে এক কাতারে বসাতে চায় সুলতানি ও মোগল শাসকদের। ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ লুন্ঠন ও সম্পদ পাচারের সঙ্গে সুলতানি বা মোগল শাসকদের এদেশের মানুষ হয়ে থেকে যাওয়ার ও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এদেশের সংস্কৃতিতে নানা উপাদান যুক্ত করে তাকে সমৃদ্ধ করার বিরাট পার্থক্যকে তারা মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে নস্যাৎ করতে চায়।

মুসলিম মাত্রকেই তারা সন্দেহের চোখে দেখার কথা বলে আর প্রচার করে এই দেশ তাদের জন্মভূমি হলেও পুণ্যভূমি নয়, সেটা তাদের কাছে আরব দেশ। এই কারণে মুসলিমদের ভারতের সাচ্চা নাগরিক বলে সংঘ মানতে চায় না। এই জায়গা থেকেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধা ও শহীদ টিপু সুলতানকে তারা নায়ক হিসেবে দেখার বদলে এক খলনায়ক হিসেবে বিশ্লেষণ করে। ইতিহাসের বস্তুবাদী ও নিরপেক্ষ বিচার তাদের উদ্দেশ্য তো নয়ই, বরং ইতিহাসকে বিকৃত করে ও একপেশেভাবে প্রকাশ করে তাকে নিজেদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত উদ্দেশ্যে কাজে লাগানোই তাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য থেকেই তারা লাচিত বরফুকনকে আজ ব্যবহার করে নিতে চাইছে। সংঘ ও বিজেপির সংস্কৃতির রাজনীতি নিয়ে আমাদের বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।

– সৌভিক

protests in China

গত সপ্তাহে চীনের বহু মানুষ সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামে। একের পর এক শহরে এবং বিশ্ববিদ‍্যালয়ে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনে দেশব‍্যাপী এমন প্রতিবাদ এই প্রথম। মাত্র কিছুদিন আগেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চীনে এই পার্টির একদলীয় শাসন চলে। পার্টি এবং পার্টিনেতাই দেশের নেতা। এবারও শি জিনপিং পার্টির সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। পরপর তৃতীয়বারের জন‍্য তিনি ক্ষমতায় এলেন। জাতীয় মহাসম্মেলনের পর দেশের মানুষ ভেবেছিলেন একটু স্বস্তি পাবেন অত‍্যন্ত কড়াকড়ির হাত থেকে। চীনে কোভিডবিধির কড়াকড়িতে মানুষ অতিষ্ঠ। তৃতীয়বারের জন‍্য জিরো কোভিড নীতি নিয়েছে শি জিনপিং সরকার। যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে অত‍্যন্ত অনিশ্চিত ও হয়রান করে তুলেছে। এরই মধ‍্যে এক আবাসনে আগুন লেগে ১০ জনের মৃত‍্যু হলে তাকে এই সরকারী নীতির ফল হিসেবেই দেখে মানুষ এবং মানুষের বুকের ধিকিধিকি আগুন বিক্ষোভ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো।

গোটা বিশ্বই মহামারির ধাক্কা সয়েছে, কিন্তু চীনের মানুষের মতো এত বাধ‍্য ও অনুগত বোধহয় আর কেউ ছিল না নিজ নিজ দেশের কোভিড বিধির প্রতি। কোভিড মোকাবিলায়, সংক্রমণ ও মৃত‍্যুর সংখ‍্যার নিরিখে অন্ততপক্ষে, বিশ্বে অনেকটাই এগিয়ে থেকেছে বৃহত্তম জনতার দেশ চীন। কিন্তু সবশেষে এসে দেখা যাচ্ছে প্রায় সারা দুনিয়া এই ভাইরাসটিকে শরীরে ধাতস্থ করে নিয়ে মহামারী থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও চীন এখনও পারল না। আবার লকডাউন। চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী তথা নাগরিকের সর্বস্ব নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রে লকডাউন বাস্তবে চরম পুলিশী নিপীড়নের রূপ নেয়। চীনের কোথাও কোনও হাউসিং কমপ্লেক্সে একজন সংক্রমিত হলে সমগ্র হাউসিং সম্পূর্ণ বন্ধ, সংক্রমিতর সমস্ত নিকটাত্মিয়কে জোর করে কেন্দ্রীয় কোয়ারান্টাইন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এরকম একটি কোয়ারান্টাইন বাস দুর্ঘটনায় পড়ে ২৭ জনের মৃত‍্যু হয়। এরকম বেশ কিছু মিসহ‍্যাপ খবর হয়। উরুমকির যে আবাসনে আগুন লেগে ১০ জন পুড়ে মরল, সেই আবাসন গত ১০০ দিন ধরে লকডাউন ছিল। ঝেংঝাউ প্রদেশে আইফোনের ফক্সকম এসইজেড ও সাংহাই’এ আইকিয়া স্টোর থেকে শ্রমিকদের দলে দলে পালিয়ে আসা ও পুলিশের সাথে সংঘাত আমাদের দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা মনে করিয়ে দেবে। এসবই চীনের যুবসমাজের নজরে আসে। বেজিং’এ প্রতি দু’দিন অন্তর লাইনে দাঁড়িয়ে কোভিড টেস্ট করাতে হয় সকলকে। টেস্টের রেজাল্ট আসবে কিউআর কোডের মাধ‍্যমে অ‍্যাপে। চীনের নাগরিকদের জীবন এখন এই কিউআর কোড তথা অ‍্যাপ দ্বারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। শহরে বা কোনও অফিস ইত‍্যাদিতে কেউ ঢুকতে পারবে কিনা তা সম্পূর্ণত অ‍্যাপ দ্বারা ঠিক হয় এবং নিজের মোবাইলে অ‍্যাপ ইনস্টল না করা অপরাধ। লকডাউনের এসব ইমিডিয়েট হয়রানি, অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কার সাথে মিশে গেছে আর্থিক সমস‍্যা। চীনে বেকারত্ব ২০ শতাংশ ছুঁয়েছে। বর্তমান প্রতিবাদ সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে কলেজগুলিতে। সামনে আছে যুবসমাজ। সমস্ত কিছু ছাপিয়ে গণতন্ত্রের প্রশ্ন উঁকিঝুকি মারছে।

চীনের সরকার এখন পাঁচ হাজার বছরের চীনা সভ‍্যতার তত্ত্ব সামনে এনেছে। ‘সভ‍্যতার সংঘাত’ তত্ত্ব কাউন্টার করতে ‘সভ‍্যতাগুলির মধ‍্যে দেওয়া নেওয়া’ তত্ত্বের কথা বলছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, প্রাচীন সভ‍্যতার দাবিদার ও ব‍্যাখ‍্যাকার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে এটা আসলে দেশের অভ‍্যন্তরে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সর্বজনীন দাবিকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দেওয়ার কৌশল। ভারত, রাশিয়া ও অন‍্য কিছু রাষ্ট্রের বর্তমান শাসকদের মুখেও একই ধরনের তত্ত্ব শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে কন‍্যাভ্রূণ হত‍্যার প্র‍্যাক্টিস ভারতীয় ও চীনা সমাজে এখনও অত‍্যন্ত জোরালো।

“আপনারা জানেন আমি কী বলতে চাইছি” — কেবল এই কথাগুলি লেখা প্ল‍্যাকার্ড তুলে ধরে একা এক যুবক যদি দাঁড়িয়ে পড়ে জনবহুল কোনও প্রকাশ‍্য স্থানে, আর পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, আর সেই বার্তা হুহু করে ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিকে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে, তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না যে একই আগুন অনেকের বুকে ধিকিধিকি জ্বলছে অনেকদিন। সমস্ত প্রতিবাদগুলোতে তরুণ প্রজন্ম যখন কিচ্ছু না লেখা সাদা কাগজ তুলে ধরে তখন তার নিঃশব্দ ধ্বনি বুকে বুকে জমে থাকা পাথরে পাথরে প্রতিধ্বনিত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ে আলোর গতিতে। আপাতত এই আগুন স্তিমিত হয়ে গেলেও চীনের মহান জনতার বুকে যে অভিমানের পাথর জমছে তা দেখিয়ে দিয়ে গেল।

– মলয় তেওয়ারী

hum jike kya kare

গত ২ ডিসেম্বর ২০২২ রতন (অশোক) বিশ্বাস (৬৮) আগাম কোনো খবর না দিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন। গতকাল সন্ধ্যায় রোজকার মতো কামারহাটির শ্রমিক মহল্লায় গিয়েছিলেন। শ্রমিকদের এবং তাদের পরিজনদের সাথে দেখা করে জেলা অফিসে আসেন। সাগর দত্ত হাসপাতালে তৃণমূলী লুম্পেনদের দাদাগিরি, বিশ্বকাপ ফুটবল, গুজরাট নির্বাচন — এসব নিয়ে চর্চায় স্বাভাবিক ছন্দেই অংশ নিয়ে রাত সাড়ে ন’টায় বাড়ির দিকে হাঁটা দেন। শারীরিক কোনো অসুবিধার কথাও বলেননি, আমাদের নজরেও পড়েনি। পরের দিন সকাল ৮টা নাগাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়।

দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে অনেকের মতো রতন বিশ্বাসের বাবা তেজেন্দ্র লাল বিশ্বাস (প্রয়াত) বেলঘরিয়া, আনন্দগড়, দেশপ্রিয় নগর উদ্বাস্তু পল্লীতে আশ্রয় নেন। জীবিকার তাগিদে ইণ্ডিয়া পটারিতে শ্রমিকের কাজে যুক্ত হন। মা লীলাবতী বিশ্বাস (প্রয়াতা) গৃহবধূ ছিলেন। রতন অকৃতদার। বর্তমানে আছেন অকাল বিধবা এক বোন। আর আছে পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু ও পার্টি কমরেডরা। রতন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বাংলার বাইরে ও বাংলায় বেশ কিছু কারখানায় ফাউন্ড্রিতে চাকুরি করেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়, কোথাও বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। ব্যতিক্রম এইচডিসি, ডানকুনি। সেখানে বহু বছর কাজ করেছেন। শ্রমিকদের কাছের মানুষ ছিলেন, সেক্ষেত্রে পদাধিকার কখনও বড় হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না, একসময় কাজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। এমনকি ফ্যাক্টরি থেকে নিজের পাওনাগুলির জন্যেও আর কারখানা মুখো হননি। অন্যায়ের প্রতিবাদ তার স্বভাবেই ছিল, স্থান-কাল-পাত্র মাথায় থাকতো না। চাকরি ছাড়ার পর রাজনীতি ও সংগঠনের কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেললেন। সাগরদত্ত হাসপাতাল বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ও বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৫ সালে পার্টির পূর্ণ সদস্য হন। পার্টির ছোট বড় যেকোনো কর্মসূচিতে রতন থাকতেন। ঝাণ্ডা, ব্যানার লাগানো, খোলা, বয়ে নিয়ে আসা রতনের স্বাভাবিক কাজ ছিল। নিজেই করতেন, কারও নির্দেশ বা অনুরোধে নয়। চাকরি ছাড়ার পর তীব্র অভাব অনুচর হয়ে দাঁড়ায়। কিন্ত তা সত্ত্বেও পার্টি সদস্য হিসেবে আর্থিক দায় বহনে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। আগামী পার্টি কংগ্রেসের ন্যূনতম দেয় ২০ টাকাও তিনি দিয়ে গেছেন।

১৯৭০ সাল থেকেই নকশালবাড়ি রাজনীতির সমর্থক হিসাবে কিছু সক্রিয়তা ছিল। ফলে কংগ্রেসীরা ও পুলিশ বিভিন্ন সময় তাকে হয়রানি করেছে। রতন সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ ছিলেন, নাটক, গান, নতুন নতুন বই নিয়ে চর্চা তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল (পরের দিকে অর্থ ও সময়ের অভাবে যা অনেকটাই ব্যাহত হয়েছিল)। বহু গানের লিরিক ছিল মুখস্থ। বই কিংবা খবরের কাগজ মন দিয়ে পড়তেন। দেশব্রতীও খুব খুঁটিয়ে পড়তেন। সব সময় চেষ্টা করতেন মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে।

মনুবাদের কট্টর বিরোধী রতনের তৃণমূল সরকারের কার্যকলাপ নিয়ে ছিল উষ্মা। ওদের কাজ ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে জমি করে দিচ্ছে বলে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন। বামপন্থীদের ঐক্য চাইতেন। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা হতাশ ছিলেন।

ছিন্নমূল হয়ে এই দেশে আসার যন্ত্রণা ওঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। পার্টিতে আর্থিকভাবে বা অন্যভাবে পিছিয়ে থাকা কমরেডদের সাহায্যের জন্যে সব সময় চেষ্টা করতেন। দেশে মুসলমান সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে যেভাবে অপমানিত হতে হচ্ছে তা সহ্য করতে পারতেন না। বিশ্বাস করতেন, সংখ্যাগুরুদের কাজ সংখ্যালঘুকে আশ্বস্ত করা। সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকে বছরের পর বছর বিনা ছেদে কামারহাটি সংখ্যালঘু শ্রমিক অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। এমনকি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মহিলাদের কাছেও পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন। বোরখা পরিহিতা ঐ মহিলারা শিশু কোলে পার্টি অফিসে এসে চোখের জলে তাঁকে শেষ বিদায় জানিয়ে গেছেন। একজন জানালেন, “অনেকেই আমাদের ওখানে যান, কিন্তু রতনদা আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে গেছিল”। কামারহাটি ও বেলঘরিয়ার মধ্যে সেতু ছিলেন কমরেড রতন। শেষ দিন কামারহাটি বিসিএমএফ ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে সবাইকে চা, লেট্টি খাওয়ান। বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে গেয়ে ওঠেন “যব দিল হি টুট গয়া/ হাম জিকে কেয়া করে” শ্রমিক কমরেডরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এই গান কেন গাইছেন?” রতন স্বভাবসিদ্ধ হাসিটি হেসেছিলেন। কিন্তু এই গান যে মনের অতল গভীর থেকে উঠে এসেছিল সেটা কাউকে বুঝতে দেননি।

রতনের সদা হাস্যময় মুখ, প্রাণখোলা হাসি হারিয়ে গেল চিরতরে। কমরেড রতনের মতো একজন কমিউনিস্ট গুণাবলী সম্পন্ন অ্যাক্টিভিস্ট বেলঘরিয়া পার্টি কমিটিকে অনেক কিছু শিখিয়ে গেলেন। জেলা পার্টি কার্যালয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু, পার্টির উত্তর ২৪ পরগণা জেলার দুই প্রবীণ সদস্য নারায়ণ দে ও সুজিত ঘোষ। আর ছিলেন স্থানীয় পার্টির সদস্য, সমর্থক ও প্রতিবেশীরা। অন্তিম যাত্রা শেষে সগর দত্ত হাসপাতালে কমরেড রতনের ইচ্ছানুযায়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে তাঁর দেহ চিকিৎসকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কমরেড রতন বিশ্বাস লাল সেলাম।

In memory of Comrade Mokched Mistry

৬ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে প্রয়াত হলেন সুন্দরবন অঞ্চলে পার্টির সংগঠক কমরেড মোকছেদ মিস্ত্রী। ছাত্রাবস্তাতেই মোকছেদ বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং সুন্দরবন অঞ্চলের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের নজরে আসেন। বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের খিদে তাঁকে সিপিআই(এমএল) রাজনীতিতেতে টেনে নিয়ে আসে। আইপিএফ স্থাপনের পর তিনি একজন প্রকৃত গণ নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটান। তার উদ্যোগে হাসনাবাদ অঞ্চলে মোটরভ্যান ইউনিয়ন গড়ে ওঠে এবং এআইসিসিটিইউ-র অন্তর্ভুক্ত হয়। এলাকায় বিড়ি শ্রমিকদের সংগঠিত করা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালে রন্ধন কর্মীদের সংগঠিত করার বিষয়ে তিনি সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে রাজ্য কমিটির সদস্য মীনা পাল এবং অর্চনা ঘটক প্রয়াত তাঁর পরিবারের সদস্যদের সংগে মিলিত হতে হাসনাবাদ কালিতলা অঞ্চলের বাড়ীতে যান এবং প্রয়াত নেতার স্ত্রী পার্টি সদস্য হালিমা বিবিকে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। পার্টির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটি কমরেড মোকছেদ মিস্ত্রীর আকষ্মিক প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করে।

=== 0 ===

খণ্ড-29
সংখ্যা-47