সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ‘‘রাজভবন চলো’’ কর্মসূচিতে গত ২৬ নভেম্বর দেশের প্রায় সমস্ত রাজ্যের রাজধানীতে লক্ষ লক্ষ কৃষকের মিছিল ও সমাবেশ সংগঠিত হল। কলকাতার ধর্মতলায় অনুষ্ঠিত হল হাজার হাজার কৃষকের মিছিল ও সভা। এই দিন কৃষক বিরোধী বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকরা রাস্তায় নেমে আসেন। কেন্দ্রীয় শাসক দলের কৃষক বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রত্যেক রাজ্যের রাজ্যপালদের মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হয়। দিল্লীর ঐতিহাসিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নতুন পর্যায়ে সারা দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ কৃষক আন্দোলনে সামিল হলেন।
পশ্চিমবঙ্গে এদিন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বে বেশ কয়েক হাজার কৃষক দুপুর ১টায় শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশন থেকে মিছিল করে রানি রাসমণি রোডের দিকে রওনা দেন। দুপুর ২টো নাগাদ রানী রাসমণি রোডে শুরু হয় এসকেএম-এর জনসভা। সভা সঞ্চালনা করেন কার্তিক পাল। বক্তব্য রাখেন, অমল হালদার, সুভাষ নস্কর, অভীক সাহা, সমীর পূততুণ্ড, অনুরাধা দেব, অনুরাধা তলোয়ার, জয়তু দেশমুখ, গোপাল বিশ্বাস, ফরিদ মোল্লা, শৈলেন মিশ্র, নিরাপদ সরকার, রাম বচ্চন প্রমুখ। কৃষকদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ না করলে মোদি-শাহ সরকারকে চরম পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে বলে এদিন মোর্চার তরফে প্রায় প্রত্যেক বক্তাই তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে উল্লেখ করেন। একইভাবে রাজ্য সরকারের প্রতিও হুঁশিয়ারি দেন কৃষক নেতারা। তারা বলেন, “রাজ্যের কৃষকেরা, সাধারণ মানুষেরা শান্তিতে নেই অথচ নেতারা শান্তিকুঞ্জ আর শান্তিনিকেতন নামে তাদের বাসভবনে শান্তিসুখ পেতে চাইছেন। এমনটা চলবে না, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার আইন বা এমএসপি আইনের যে খসড়া প্রস্তাব জমা দিয়েছিল রাজ্য সরকারের কাছে, ঐ খসড়ার ভিত্তিতে অবিলম্বে আইন প্রণয়ন করতে হবে রাজ্য সরকারকে। এছাড়াও সারের কালোবাজারি বন্ধ করা সহ যে সমস্ত দাবিগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো পূরণ করা না হলে কেন্দ্রের মতো রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকরা জোড়ালো আন্দোলনের পথে এগিয়ে যাবে। ১০০ দিনের কাজ ও বকেয়া পরিশোধের দাবী তুলে ধরে নেতৃবৃন্দ বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্যের কাজিয়ায় ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ গরিব মেহনতি মানুষ। তাই দুই সরকারের কাছেই আমাদের দাবি কাজ দাও মজুরি দাও। ফসলের সরকারি ক্রয় আর গণবন্টন বা খাদ্য সুরক্ষা এগুলি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তাই সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সামিল হতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের মাধ্যমে এরাজ্যের সরকারের কাছে দাবি তোলা হয়:
প্রতিনিধি দলে ছিলেন সজল অধিকারী, ভক্তরাম পান, প্রবীর মিশ্র, সজল অধিকারী, বেছু দলুই, আব্দুর রউফ।
চণ্ডীগড়, লখনৌ, পাটনা, তিরুবনন্তপুরম, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, ভোপাল, জয়পুর এবং অন্যান্য রাজ্যের রাজধানীতে লক্ষাধিক লোকের বিশাল জমায়েত দেখা গেছে। সারা ভারত থেকে তথ্যের ছবি এবং ভিডিও যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, এসকেএম অনুমান করে যে ৫০ লক্ষের বেশি কৃষক আজ দেশের রাস্তায় নেমে এসেছেন। কৃষকদের সমস্ত দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই সম্মিলিত সংগ্রাম চলবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি তোলা হয় –
স্মরণ করা যেতে পারে যে ২৬ নভেম্বর তারিখটি ভারতে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এদিন আমাদের সংবিধান দিবস। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বরে এসকেএম ঐতিহাসিক ‘‘দিল্লি চলো’’ আন্দোলন শুরু করেছিল, যা বিশ্বের দীর্ঘতম এবং বৃহত্তম কৃষক আন্দোলনে পরিণত হয় এবং কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য কর্পোরেট-রাজনীতিক আঁতাতের বিরুদ্ধে কৃষকদের গৌরবময় বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়। আজ দেশব্যাপী ‘‘রাজভবন চলো কর্মসূচি’’ কৃষক আন্দোলনের পরবর্তী পর্বের সূচনা করল৷
‘‘রাজভবন চলো’’ কর্মসূচির সাফল্যের জন্য সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য তথা সারা দেশের সমস্ত কৃষক, ক্ষেতমজুর, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, মহিলা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের অভিনন্দন জানায় এবং দেশব্যাপী সবাইকে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে যোগদান করতে আবেদন জানায়।
সংবিধানের স্পিরিট ও মূল্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ কতটা জরুরি ও বিশাল মাত্রার হয়ে উঠেছে, ২০২২’র সংবিধান দিবস তাকে আরও একবার সামনে নিয়ে এল। দুটো ভরসা-জাগানো নিদর্শন আমরা দেখলাম। যার একটাতে জেলে প্রায় এক হাজার দিন কাটানোর পর অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বডে তাঁর জামিন লাভের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ জারির এনআইএ’র প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে জেল থেকে জামিনে মুক্তি লাভ করলেন। আর দ্বিতীয় ঘটনায় আমরা কৃষিকে রক্ষা এবং তাদের উৎপাদিত সমস্ত শস্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির অধিকার রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কৃষকদের সারা দেশে আন্দোলনে শামিল হতে দেখলাম। ‘আমরা ভারতের জনগণ’ — ন্যায় ও গণতন্ত্র লাভের লক্ষ্যে এই আত্মঘোষণাই হল আধুনিক ভারতের প্রকৃত সাংবিধানিক স্পিরিট।
তবে, জনগণ গণতন্ত্র রক্ষায় আত্মঘোষণা করলেও সংবিধান বর্তমানের সরকার ও সংঘ বাহিনীর হাতে লাগাতার আক্রমণের মুখে পড়ছে। সংবিধান-ভিত্তিক শাসনের কেন্দ্রে থাকা প্রশাসন বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা ও কার্যধারার বিভাজনের নীতিকে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর সততাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে এক উন্মত্ত স্বেচ্ছাচারী প্রশাসনিক বিভাগ, এবং তা করছে সংবিধানের বিপর্যয় ঘটাতে ও বিরোধিতা-মুক্ত একদলীয় শাসন চাপিয়ে দিতে।
সুপ্রিম কোর্ট তাদের সাম্প্রতিক কিছু পর্যবেক্ষণে প্রশাসনের লাগামহীন স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক আলাপ আলোচনা বা সংসদীয় অনুমোদন ছাড়াই যে বিমুদ্রাকরণ করা হয়েছিল, তার ছ’বছর পর সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে সে সম্পর্কে চলা শুনানিতে সরকারের পাশকাটানো জবাব সুস্পষ্টরূপে দেখিয়ে দিচ্ছে যে বিচার বিভাগীয় কোনো অনুসন্ধিৎসায় তারা কতটা শঙ্কিত। তথাকথিত দুর্বল অংশের কোটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের খণ্ডিত রায়ে সংখ্যালঘু অভিমত ঐ কোটাকে সংবিধানের স্পিরিটের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন রূপে অভিহিত করেছে।
সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে চলা শুনানিতে নির্বাচন কমিশনকে পথভ্রষ্ট করা ও তার প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার অবনতি ঘটানোর সরকারের অভিপ্রায় উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। এই বিষয় নিয়ে আবেদনের শুনানি যখন চলছিল, সরকার সে সময়ই চূড়ান্ত ধৃষ্টতা দেখিয়ে বিতর্কিত পদক্ষেপে এক নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করে। সরকার ভোটাধিকারের সাংবিধানিক মর্যাদা নিয়েও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে বিতর্ক বাধায়; সরকার বলে যে এটা আইন বলে বিধিবদ্ধ অধিকার, আর সুপ্রিম কোর্ট এর প্রত্যুত্তরে সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে যে, অনধিকারের মাপকাঠিকে সম্প্রসারিত করে জনগণকে ভোটদান থেকে বিরত করতে তারা পারে না। ভোটাধিকারকে সাংবিধানিক অধিকারের বদলে আইনি অধিকার রূপে গণ্য করার এই প্রয়াস নাগরিকদের কোনো অংশকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রস্তাবনা কিনা, তা অবশ্য কেউ নির্দষ্ট ভাবে বলতে পারবেন না।
বম্বে হাইকোর্ট পণ্ডিত ব্যক্তি ও লেখক আনন্দ তেলতুম্বডের জামিন মঞ্জুর করলে তার বিরুদ্ধে এনআইএ’র আবেদন জানানোটা মোদী সরকারের মানবাধিকারের চরম অবমাননারই আর একটা নিদর্শন হয়ে দেখা দিচ্ছে। চাইলেই বিরোধী মতের ধারক যেকোনো ব্যক্তিকে মামলায় জড়িয়ে জেলে পুরতে এনআইএ ও ইউএপিএ মোদী সরকারের হাতে এক সুবিধাজনক জুড়ি হয়ে উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে এক ভিডিও বৈঠকে মোদী সম্প্রতি ‘কলম-চালিত নকশালদের’ বিরুদ্ধে যে মন্তব্য করেছেন তাতে আরও অনেক বিরোধী মতের নাগরিকদের গ্ৰেপ্তারির ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। আদালত যেখানে বিবেক সম্পন্ন বন্দিদের বেকসুর খালাস দিচ্ছে বা তাদের জামিন মঞ্জুর করছে, সংঘ বাহিনী ও মোদী সরকার তখন বিবেকবান বন্দিদের মুক্তির দাবি জানানোয় ন্যায়বিচার-প্রয়াসীদেরও মামলায় জড়িত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত সংবিধান দিবসের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মু তাঁর বক্তব্যের শেষে স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্যে ভারতীয় জেলগুলোর গাদাগাদি অবস্থা ও সেখানে বন্দিদের দশার দিকে বিচার বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যে বন্দিরা বিশেষভাবে এসছে প্রতিকূল সামাজিক পৃষ্ঠভূমি থেকে এবং বছরের পর বছর জেলে পচছে।
প্রণালীবদ্ধ ভাবে সংবিধানের স্পিরিট ও বীক্ষার ক্ষয় ঘটানোয় সংবিধানের ওপর আক্রমনই আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আমরা কখনই বিস্মৃত হতে পারি না যে, আরএসএস শুধু যে স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনো অবদান রাখেনি তাই নয়, স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে উদ্ভূত সংবিধান ও তেরঙা জাতীয় পতাকাকেও তারা অনুমোদন করেনি, বিপরীতে তারা মনুস্মৃতিকেই ভারতের সংবিধান এবং গেরুয়া ঝান্ডাকে জাতীয় পতাকা করার পক্ষে খোলাখুলি মত পোষণ করেছিল। বিজেপি এখন ক্ষমতায় থাকায় তারা নিজেদের স্বাধীনতা আন্দোলন, সংবিধান ও জাতীয় পতাকার চ্যাম্পিয়ন রূপে জাহির করতে চায়, তবে সেটা শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের এবং সংবিধানের স্পিরিট ও বীক্ষার নিরন্তর বিকৃতি সাধনের মধ্যে দিয়েই। অধিকারের চেয়ে কর্তব্যের ওপর অগ্ৰাধিকার প্রদান করে মোদী সংবিধানের ভোল পাল্টানোর এই প্রয়াসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সংবিধান দিবসে তাঁর বক্তৃতায় মোদী আগামী পঁচিশ বছরকে কর্তব্যকাল বা কর্তব্যের যুগ রূপে ব্যাখ্যা করতে সক্রিয় হন।
মোদী ভারতকে গণতন্ত্রের জননী বলে অভিহিত করেছেন; তাঁর এই নবাবিষ্কৃত বুলির অনুসরণে সরকার এখন ইতিহাস গবেষণার ভারতীয় কাউন্সিলের প্রকাশ করা একটা ধারণাগত নোটকে কেন্দ্র করে এক সুসমন্বিত প্রচার নামিয়েছে যে নোটে ভারতের সংবিধানকে ‘হিন্দু রাজনৈতিক তত্ত্বের’, ‘২০০০ বছরের নানান বিজাতীয় সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীর আগ্ৰাসনের মুখে হিন্দু সংস্কৃতি ও সভ্যতার’ ফসল বলে গণ্য করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান যে উপনিবেশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন এবং প্রতিষ্ঠানিক জাতিগত স্তরবিন্যাস ও লিঙ্গগত অবিচারকে ছিন্ন করে সামাজিক ন্যায় ও সমতার অন্বেষণ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, এই নোট, উদ্ভবের সেই প্রকৃত প্রক্রিয়া ও পরিপ্রেক্ষিতটাকেই ধৃষ্টতার সঙ্গে নাকচ করে। এটা আম্বেদকরের সংবিধানকে ওলটপালট করে দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। মোদী সরকারের হাতে খেলার বস্তুতে পর্যবসিত হওয়া থেকে সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৯ নভেম্বর ২০২২)
রাজ্যের আর্থিক উন্নয়নের আষাঢ়ে গপ্পো শোনালেন রাজ্য মন্ত্রীসভার শিল্পমন্ত্রী শশী পাঁজা। দিল্লীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় রাজ্যের আর্থিক সমৃদ্ধি ও চমকপ্রদ বৃদ্ধির রঙিন ছবির এক বিজ্ঞাপন সেখানে তিনি সযত্নে ফেরি করেছেন। তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন ২০২২-২৩-এ রাজ্যের জিডিপি ২২১.৩৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে যা ২০১০-১১’র সাপেক্ষে প্রায় ৩.৭ গুণ বৃদ্ধি! মন্ত্রী জানিয়েছেন, এটা জাতীয় জিডিপি’তে ৫.৮ শতাংশ অবদান রাখবে, আর রাজ্যের জিডিপি ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে সিএজিআর’এর (কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট) ১১.৫৪ শতাংশ হারে। সিএজিআর হল একটা সূচক যা দেখায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিনিয়োগকৃত পুঁজি প্রতিবছরে কতটা বৃদ্ধি পেল।
গল্পের এখানেই শেষ নয়। তিনি জানিয়েছেন, এফডিআই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের প্রথম দশটা রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবাংলাও রয়েছে, যেখানে অক্টোবর ২০১৯ থেকে ২০২২’র মার্চ পর্যন্ত এফডিআই বিনিয়োগের পরিমাণ ১,০৩৪ মিলিয়ন ডলার। অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, দক্ষ ও প্রতিভাবান মানবসম্পদে সমৃদ্ধ এই রাজ্যটিতে গত দশ বছর ধরে একটিও ধর্মঘট না হওয়ায় ধর্মঘটে শ্রমদিবস পন্ড হওয়ার সংখ্যা শূন্য হয়েছে। এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা খনি দেওচা-পাঁচামী তৈরি করছে অবিশ্বাস্য রকমের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সুযোগ। আর ২৫,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ভিত্তিতে তাজপুরের গভীর বন্দর তৈরি করবে সরাসরি ২৫,০০০ ও অপ্রত্যক্ষ ভাবে ১ লক্ষ কাজের সম্ভাবনা!
পরিসংখ্যানের এই সমস্ত শুষ্ক তথ্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে প্রকৃত সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলো।
জিডিপি’র অঙ্ক যে প্রকৃত আর্থিক বৃদ্ধির সূচক নয়, তা একবাক্যে এখন সমস্ত অর্থনীতিবিদরাই স্বীকার করেন। ভারতে জিডিপি’র চোখ ধাঁধানো বৃদ্ধির বছরগুলোতেই হুহু করে বেড়েছে বেকারি, দারিদ্র, চরম আর্থিক বৈষম্য। গুজরাট হল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সম্প্রতি প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ‘হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিসটিক্স অফ ইন্ডিয়ান স্টেটস’ কুড়িটি রাজ্যের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত ১১ বছরে এরাজ্যে দারিদ্র বেড়েছে। কাজের খোঁজে রাজ্য ছেড়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা যে কি বিপুল পরিমাণ, তা লকডাউনের সময়ে চোখে আঙুল তুলে দেখাল। সাম্প্রতিক তথ্য এটাও দেখাচ্ছে যে বর্ধমান-হুগলির মতো উন্নত কৃষি-অঞ্চল থেকেও দলে দলে মজুর অন্য রাজ্যে কাজ ও উন্নত মজুরির সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছে। মাননীয় মন্ত্রীর দাবি মেনে নিলেও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই আর্থিক বৃদ্ধি কেন কর্মসংস্থানের সুযোগ এনে দিল না, কেন অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পুরুষ ক্ষেতমজুরদের দৈনিক মজুরিতে এরাজ্য আছে ১৩ নম্বরে। কোভিডের সময়ে এরাজ্যে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের ৯৩ শতাংশই কাজ খুইয়ে ফিরে আসেন, প্রতীচী ট্রাস্টের এক সমীক্ষা থেকে তা বেরিয়ে আসে। ধর্মঘটে শ্রমদিবস খোয়ানো শূন্য হলেও নতুন নতুন কল কারখানা গড়ে উঠল না, রাজ্য সরকার কাগজে কলমে নয়া শ্রমকোড রূপায়ন না করেও সর্বত্র শ্রমের ইনফর্মালকরণ করেছে। ডিএ’র মতো আইনসিদ্ধ অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। বিপুল অর্থের বিনিময়ে শিক্ষকদের বেআইনী নিয়োগ এ’রাজ্যের পুতি গন্ধময় রাজনৈতিক পরিমন্ডলকে প্রতিবিম্বিত করে।
গত কয়েক দশক ধরে গুজরাটের নীট রাজ্য জিডিপি ৯ শতাংশের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করেছে। রাজ্যের আয় ও আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও গুজরাট দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলোর সাপেক্ষে প্রথম সারির মধ্যেই পড়ে। কর্মসংস্থানের দিক থেকেও ওই রাজ্য অনেক এগিয়ে থাকলেও মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে গুজরাট অনেক নীচে। নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি গুজরাটে এরাজ্য থেকেও নীচে। নতুন নতুন যে বিনিয়োগের কথা শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, সেখানে ওই সমস্ত উদ্যোগগুলো যে গড়ে উঠবে বিপুল সংখ্যায় শ্রমের ইনফর্মালকরণ ঘটিয়ে, তা তাঁর প্রদত্ত বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট।
উন্নয়নী এই গল্পের নটে গাছটা কি মুড়োবে গুজরাট মডেলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে? অনাগত দিনগুলোই দেবে তার উত্তর।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তিন দশক পূরণ হবে ২০২২’র ৬ ডিসেম্বর। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর রাতে মসজিদের ভেতর চুপিসারে রামলালার মূর্তি বসানোর মাধ্যমে যে টাইম বোমা স্থাপিত হয়েছিল, সেটাই ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের শেষ বেলায় প্রকাশ্য দিবালোকে বিস্ফারিত হল যখন উপস্থিত বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের উৎসাহদানের প্রক্রিয়ায় এক দাঙ্গাবাজ জনতা মসজিদটাকে ধূলিসাৎ করল। আজকের ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের উত্থানের অনুসন্ধানে ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা কখনও নির্দিষ্ট কোনো মুহূর্তকে চিহ্নিত করতে আগ্রহী হলে সেই মুহূর্তটা তর্কাতীতভাবেই হবে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদের ধ্বংস। সেই ধ্বংসের পর থেকে ভারতে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। এক একটা দিন যাচ্ছে আর আমরা আরও সঠিক ভাবে বুঝতে পারছি যে, সংঘ-বিজেপি গোষ্ঠীর অযোধ্যা অভিযান ষোড়শ শতকের একটা মসজিদের ধ্বংস অথবা রামের পৌরাণিক জন্মভূমি বলে বিশ্বাস করা স্থানে চমকপ্রদ মন্দির নির্মাণের কোনো ব্যাপার ছিল না; সেটা ছিল ভারতের আসল ধারণাকে এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেওয়ার উদ্যোগ।
মসজিদ ধ্বংসের আগে এবং এমনকি পরেও আধিপত্যকারী ধারণাটা ছিল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অযোধ্যা বিবাদের একটা সমাধান খুঁজে বার করা অথবা বিচার বিভাগের রায়কে মেনে নেওয়া। বিজেপি এরপর এই যুক্তিতে আদালতের রায়ের ধারণাকে মানতে অস্বীকার করল যে, ‘বিশ্বাসের’ বিষয়কে আইনি এক্তিয়ারের অধীন করা যাবে না। এটা অতএব বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয় যে, ধ্বংসের কর্মকাণ্ডটা এই প্রেক্ষিত থেকেই চালিত হয়েছিল, সেটা ছিল বিবাদের প্রেক্ষাপটটাকেই পাল্টে দেওয়ার পরিকল্পিত চক্রান্তমূলক কাজ। এর সিকি শতকেরও কিছু বেশি সময়ের পর বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার সময় সুপ্রিম কোর্ট কার্যত ধ্বংস-পরবর্তী পটভূমিকেই মান্যতা দিল, এবং সেটা তারা করল ধ্বংসের কাজটাকে আইনের শোচনীয় লঙ্ঘন বলে অভিহিত করার পরও যারা মসজিদটাকে ধূলিসাৎ করেছিল তাদের হাতেই ‘বিতর্কিত জমির’ মালিকানা তুলে দিয়ে। ধ্বংসকারীরা যা চেয়েছিল তারা তা পেল, আর ন্যায়বিচারের প্রত্যাশীরা পেল মসজিদ নির্মাণের জন্য পাঁচ একর বিকল্প জমির ‘ক্ষতিপূরণসুলভ’ প্রস্তাব। এর প্রায় তিনবছর পর সুপ্রিম কোর্ট এই ঘোষণা করে ধ্বংসকাণ্ড থেকে জারি হওয়া সমস্ত মামলাকে সমাপ্ত করে দিল যে, ঐ ইস্যুটার আর কোনও অস্তিত্বই নেই!
বিচার বিভাগের বাইরে নাগরিক সমাজের অনেক ব্যক্তিও এই আশা পোষণ করেছিলেন যে, বিতর্কিত জমি মন্দির নির্মাণের জন্য দিয়ে দিলে তা বিবাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ নিষ্পত্তি ঘটাবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পুনর্মিলনের পথ প্রশস্ত করবে। সংসদ ১৯৯১ সালে যে আইন পাশ করেছিল তার থেকে বিশেষভাবে বাদ রাখা হয়েছিল অযোধ্যাকে, আর অন্য সমস্ত উপাসনা স্থলের যে চরিত্র স্বাধীনতার সময় ছিল তাকে অপরিবর্তিত রাখার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সংঘ বাহিনী অবশ্য তাদের ভবিষ্যৎ মতলবকে গোপন করার কোনও চেষ্টা করল না — আর মাত্র দুটো স্থানের উল্লেখ করলে বলতে হয়, অযোধ্যার ছাঁচে ফেলার জন্য তাদের কাছে অপেক্ষা করছিল কাশী ও মথুরা। ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে রাম মন্দির উদ্বোধনের পরিস্থিতি নির্দিষ্ট হয়ে থাকার পাশাপাশি আমরা কাশী ও মথুরা নিয়ে লড়াইকে তীব্রতর করে তোলার উদ্যোগও দেখতে পাচ্ছি। অযোধ্যার ছাঁচ অনুসরণ করে সংঘ আদালতে মামলা ঠোকার সাথে বাস্তব ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সমাবেশকে সংযুক্ত করে আবারও এক দ্বিমুখী কৌশলের প্রয়োগ ঘটাচ্ছ।
মসজিদগুলোকে মন্দিরে পরিণত করার অভিপ্রায়ে সেগুলোর ওপর আরও আক্রমণ নামানোকে সক্ষম করতে আইনি পরিসর তৈরির লক্ষ্যে বিজেপি ১৯৯১ সালের উপাসনা স্থল আইনের আইনসিদ্ধতাকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে মোদী সরকারের জবাব জানতে চাওয়ায় এই আইনের ভবিষ্যত কী হতে যাচ্ছে — যে আইনটাকে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা রায় দিতে গিয়েও সমর্থন জানিয়েছিল — তা এখন কেউই বলতে পারবেন না। উত্তরপ্রদেশে কাশী ও মথুরার মতো সংঘবাহিনী মহিশুরের কাছে শ্রীরঙ্গপতনার জামিয়া মসজিদকেও নিশানা বানিয়েছে যেটা ছিল ১৭৯৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে টিপু সুলতানের যুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থল। মুসলিম শাসকদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মোগল ও মোগল-পরবর্তী যুগের সুপরিচিত কয়েকটি স্মৃতিসৌধকেও — যেগুলোর মধ্যে বিশ্বখ্যাত হেরিটেজ কেন্দ্র তাজমহল ও কুতবমিনারও রয়েছে — সংঘবাহিনী নিশানা বানাচ্ছে ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে এবং সারা ভারতকে গেরুয়া রঙে রাঙাতে।
অযোধ্যা বিতর্কের গোটা পথটা আমাদের এই সুস্পষ্ট শিক্ষা দিয়েছে যে সংঘবাহিনীর চালিয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক আগ্ৰাসনের সঙ্গে কোনও বোঝাপড়া হতে পারে না। বিজেপি আমাদের রামায়ণ ও মহাভারতের পৌরাণিক অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তারা ভারতের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর বুলডোজার চালিয়ে তাকে আরএসএস লালিত গেরুয়া রঙে ছোপানো সমরূপী বস্তুতে পরিণত করতে চায়। ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী থেকে দৈনন্দিন সংস্কৃতি ও রন্ধনবিদ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে সমস্ত ইসলামিক চিহ্নকেই মুছে দেওয়াটাই তাদের অভিপ্রায়। আরএসএস’এর প্রচার করা তথাকথিত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ আরএসএস ধারার হিন্দুত্ব বা হিন্দু আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়া ভিন্ন অন্য কিছু নয়, যে আধিপত্য আবার মুসলিম সম্পর্কিত সমস্ত কিছুকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার মধ্যেই থেমে থাকবে না; মনুস্মৃতিতে ব্যক্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চাপিয়ে দিতে সম্যক প্রচেষ্টা তা চালাবে, যে মনুস্মৃতিকে আরএসএস ভারতের আদি ও অকৃত্রিম সংবিধান রূপে তুলে ধরেছিল। মনুস্মৃতি-অনুপ্রাণিত সমরূপতা আনার আরএসএস’এর প্রচেষ্টা ভারতের বৈচিত্র্যের ওপর এবং হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের মনগড়া গণ্ডিবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে বহু বিচিত্র চিত্রের মহাদেশীয় মাত্রার যে সমাহার হল ভারতবর্ষ তার ওপর চালানো এক সার্বিক যুদ্ধ। ২০২২’র ৬ ডিসেম্বর আবার বাবাসাহেব আম্বেদকরের মৃত্যুর ৬৬তম বার্ষিকী পূর্ণ হবে, যিনি ছিলেন ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য নির্ধারিত কমিটির চেয়ারম্যান এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম আইন ও বিচার মন্ত্রী। ভবিষ্যতকে দেখতে পাওয়ার দূরদৃষ্টি নিয়ে তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, “হিন্দুরাজ বাস্তব ঘটনা হয়ে উঠলে তা, সন্দেহাতীতভাবেই, এই দেশের কাছে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হয়ে দেখা দেবে।” তাঁর মৃত্যুর দু’মাস আগে আম্বেদকর হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে পাঁচ লক্ষ অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্ৰহণ করেন। আর সেটা তিনি করেছিলেন আরএসএস’এর সদর দফতর নাগপুরে অশোকা বিজয়াদশমীর দিন, যেদিন মহান অশোক যুদ্ধ ও হিংসাকে পরিত্যাগ করে শান্তি ও সমতার স্থাপনে বৌদ্ধ ধর্মকে গ্ৰহণ করেন, আর সেদিনটাকেই আরএসএস তাদের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে বেছে নেয় এবং অস্ত্র ও হিংসার আরাধনার মধ্যে দিয়ে উদযাপন করে। বিজেপি আজ নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ধর্ম অনুসরণের সংবিধান প্রদত্ত অধিকারটাকেই খর্ব করতে চাইছে। যে বিপর্যয় সম্পর্কে আম্বেদকর আমাদের সতর্ক করেছিলেন সেটাই আজ প্রকট হয়ে উঠেছে; আর চ্যালেঞ্জটা তাই হল এই বিপর্যয় সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি থেকে ভারতকে মুক্ত করা এবং সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তুলে হিন্দুত্বর বুলডোজারকে প্রতিহত করা।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২২ নভেম্বর ২০২২)
শিলিগুড়ি
২৬ নভেম্বর ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের স্মরণে ও সংবিধান বাঁচাও দিবসে শিলিগুড়ি সংলগ্ন কাওয়াখালি মোড়ে মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার উদ্যোক্তা ছিল কাওয়াখালি-পোড়াঝাড় ভূমি রক্ষা কমিটি, তিস্তা-মহানন্দা সেচ প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কমিটি, রাঙ্গালীভিটা বাস্তুহারা কমিটি। সভার আগে কাওয়াখালি ধর্ণামঞ্চ ও কাওয়াখালি প্রাইমারী স্কুল থেকে দু’টি মিছিল বেরোয়। সারা ভারত কিষাণ মহাসভা, আয়ারলা, এআইকেকেএমএস প্রভৃতি সংগঠনগুলির নেতৃত্বে মিছিল সংগঠিত হয়। মিছিলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা অংশগ্রহণ করে। বিহার থেকে আগত বলরামপুরের বিধায়ক মেহবুব আলম মিছিলে সামিল হন। সভায় সভাপতিত্ব করেন সারা ভারত কিষাণ মহাসভার দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ। বক্তব্য রাখেন পোড়াঝাড়-কাওয়াখালি ভূমি রক্ষা কমিটির পক্ষে স্বপ্না পাইন, তিস্তা-মহানন্দা ভুমি রক্ষা কমিটির পক্ষে কৃষ্ণপদ সিংহ, রাঙ্গালীভিটা বাস্তুহারা কমিটির পক্ষে সুদেব ধর, এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু, মাটিগাড়া-নকশালবাড়ীর প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক শঙ্কর মালাকার, এআইকেকেএমএস’এর পক্ষে অমল রায়, এআইকেএমএস’এর পক্ষে পবিত্র রায়, এআইকেএস’এর পক্ষে গৌর বৈদ্য, ইউসিআরসি’র পক্ষে পরেশ সরকার। সভার মূল বক্তা ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিহার বিধানসভার বিধায়ক মেহবুব আলম। আশপাশের বহু মানুষ মেহবুব আলমের বক্তব্য শোনার জন্য ভিড় করেন। তিনি তীব্র ভাষায় বিজেপির দেশ বিক্রির বিরুদ্ধে ও তৃণমূলের দূর্ণীতি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। সভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন গণআন্দোলনের কর্মী দীপক চক্রবর্তী ও মীরা চতুর্বেদী।
২৭ নভেম্বর ২০২২ এআইসিসিটিইউ হাওড়া জেলার ৪র্থ সম্মেলন রাজেন্দ্র গুপ্তা নগর (হাওড়া), দীপক দাস, বিমল পাড়ুই সভাগৃহ (যোগেশ চন্দ্র গার্লস হাই স্কুল) ও সনৎ ঘোষ, শ্যামলাল সিনহা মঞ্চে সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন হল।
সম্মেলনের শুরুতে পতাকা উত্তোলন করে শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন জেলার বর্ষীয়ান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা তপন ঘোষ। এরপর একে একে সম্মেলনের পর্যবেক্ষক এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু, এআইসিসিটিইউ রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী, এআইসিসিটিইউ হাওড়া জেলা সভাপতি দেবব্রত ভক্ত, প্রবীণ রেল শ্রমিক নেতা এন এন ব্যানার্জী, দক্ষিণ পূর্ব রেল মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শুভাশীষ বাগচী, এআইসিসিটিইউ রাজ্য কমিটির সদস্য মীনা পাল, কল্যাণী গোস্বামী ও প্রবীর হালদার, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন হাওড়া জেলা কমিটির পক্ষে নীলাশিস বসু প্রমুখ শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন। এছাড়াও আয়ারলা ও আইসা’র নেতৃত্ব শহীদ বেদিতে মাল্যদান করেন।
এরপর সম্মেলনের মূল কাজ শুরু হয়। এন এন ব্যানার্জী, কল্যাণী গোস্বামী, তপন ঘোষ ও কিশোর রজককে নিয়ে গঠিত সভাপতিমন্ডলী সভার কাজ পরিচালনা করেন। প্রণব মন্ডল ও কার্তিক পান্ডে স্টিয়ারিং কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সম্মেলন উদ্বোধন করেন এআইসিসিটিইউ রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী। তিনি শ্রমিক শ্রেণীর উপর নামিয়ে আনা দেশজোড়া হামলার কথা বলেন ও এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার জন্য দৃঢ় সংগঠন গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন এআইসিসিটিইউ জেলা সভাপতি দেবব্রত ভক্ত। মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতির পর প্রতিনিধি সম্মেলন শুরু হয়। জুট, মিড-ডে-মিল, নির্মাণ, রেল ঠিকা শ্রমিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের কমরেডরা বক্তব্য রাখেন ও নিজ নিজ ক্ষেত্রের সমস্যাগুলি তুলে ধরেন ও তার বিরুদ্ধে ইউনিয়নের উদ্যোগগুলির উল্লেখ করেন। কর্মরত ছাত্র হিসেবে সুদর্শন গাঙ্গুলি বক্তব্য রাখেন ও কর্মরত ছাত্রদের, যাদের অনেকেই আবার গিগ শ্রমিক, এছাড়াও ট্রেনিংয়ের নামে বিনা পারিশ্রমিকে মাসের পর মাস অনেক ছাত্রছাত্রীকে বিভিন্ন কোম্পানিতে খাটানো হয়। এদের নিয়ে পৃথক মঞ্চ সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন সুদর্শন। গৃহ সহায়িকাদের সংগঠিত করার জন্য এআইসিসিটিইউ হাওড়া জেলার নবতম উদ্যোগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন রেণু বেরা। অতিথি বক্তা হিসেবে মীনা পাল নিবিড় অনুশীলনের ওপর জোর দেন। নবেন্দু দাশগুপ্ত কেন্দ্র সরকারের শ্রমিক বিরোধী ভুমিকার পাশাপাশি রাজ্য সরকারের দ্বিচারিতার উল্লেখ করেন। এছাড়াও শুভাশীষ বাগচী (দক্ষিণ পূর্ব রেল মজদুর ইউনিয়ন), নবীন চন্দ্র সামন্ত (আয়ারলা), সেরিনা শেখ (আইপোয়া), শৌভিক বনিক (আইসা) বক্তব্য রাখেন। সিপিআই(এমএল) হাওড়া জেলা কমিটির তরফ থেকে নীলাশিস বসু সম্মেলনকে সম্বোধিত করে বলেন অসংঘঠিত শ্রমিকদের আরো বেশি সংগঠিত করার ওপর জোর দিতে হবে। আসন্ন পার্টি কংগ্রেসের বার্তাও জেলার শ্রমজীবী মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আহ্বাণ জানান তিনি। সম্মেলনের পর্যবেক্ষক বাসুদেব বসু তাঁর ভাষণে শ্রমকোড সহ কেন্দ্র সরকারের বিভিন্ন শ্রমিক বিরোধী ষড়যন্ত্রের ব্যাখ্যা করেন এবং এর বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এআইসিসিটিইউ হাওড়া জেলার অন্যতম স্থপতি রঘুপতি গাঙ্গুলি সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে যে বার্তা পাঠান তা পাঠ করে শোনানো হয়।
জবাবী ভাষনে এআইসিসিটিইউ হাওড়া জেলার সভাপতি দেবব্রত ভক্ত হাওড়া জেলার অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন।
সম্মেলন ৩১ জনের কাউন্সিল ও ১৫ জনের কার্যকারী সমিতি নির্বাচিত করে যার সভাপতি নির্বাচিত হন দেবব্রত ভক্ত এবং সম্পাদক পার্থ ব্যানার্জী। সম্মেলনে ৮১ জন উপস্থিত ছিলেন যার মধ্যে ২৭ জন মহিলা।
হাওড়া জেলায় এআইসিসিটিইউ-কে পোক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার শপথ নিয়ে সম্মেলন সমাপ্ত হয়।
সিপিআই(এম-এল)-এর জম্মু জেলা সম্মেলন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হলো গত ১৩ নভেম্বর। সুখবিন্দার সিং নাট তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ঐ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক রূপে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজিব ডিমরি। প্রকাশ্য অধিবেশনে প্রতিনিধি ও অতিথিদের স্বাগত জানান কমরেড নির্দোষ উপ্পল। তিনি তাঁর বক্তব্যে জম্মু ও কাশ্মীরে পার্টি কাজকে বিবৃত করেন এবং তার সাথে জাতীয় পরিস্থিতির ব্যাখ্যাও রাখেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুখদর্শন নাটও উপস্থিত প্রতিনিধিবৃন্দ ও অতিথিদের সম্বর্ধিত করেন ও তাঁর বক্তব্য রাখেন। উপত্যকা ছেড়ে চলে যাওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রতিনিধি হিসাবে প্রকাশ্য অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন সুভম কল। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, বিজেপির দ্বিমুখী নীতি উপত্যকার জনগণের, বিশেষভাবে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের ক্ষতিসাধনই করছে। তিনি কাশ্মীর সম্পর্কে সিপিআই(এম-এল) গৃহীত অবস্থানকে সমর্থন করেন এবং আশা পোষণ করেন যে, সিপিআই(এম-এল) কাশ্মীরী জনগণের ন্যায়বিচার লাভ ও তাদের সমস্যাগুলির সমাধানের উদ্যোগে সক্রিয় থাকবে। নেচার হিউম্যান সেন্ট্রাল লোক লহর সংগঠনের নেতা কমরেড রূপচাঁদ তাঁর বক্তব্যে পরিবেশ সম্পর্কে সিপিআই(এম-এল)-এর নেওয়া অবস্থানের প্রশংসা করেন এবং সিপিআই(এম-এল)-এর সঙ্গে একসাথে কাজ করার আগ্ৰহ প্রকাশ করেন। জম্মুর অনেক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা সম্মেলনকে অভিনন্দিত করে বার্তা দিয়েছেন। প্রতিনিধি অধিবেশনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট পেশ করেন কমরেড সুভাষ মেহেতা, আর সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন কমরেড সুনিল সালিয়ান। কমরেড সুনিল সালিয়ান জম্মু ও কাশ্মীরের অন্যান্য জেলা, বিশেষভাবে সাম্বা, উধমপুর, রিয়াসি, কিসতাওয়াদ ও শ্রীনগরে দলের সাংগঠনিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিনিধিদের অবহিত করেন।
কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কমরেড রাজিব ডিমরি তাঁর বক্তব্যে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী শক্তিশালী রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্ৰহণের আবেদন রাখেন এবং সিপিআই(এম-এল)-এর আসন্ন পার্টি কংগ্ৰেসকে সার্বিক ভাবে সফল করে তোলার আহ্বান জানান।
সম্মেলন নয় সদস্যের এক জেলা কমিটি নির্বাচিত করে এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন সুভাষ মেহেতা। সম্মেলন যে সমস্ত বিষয়ে প্রস্তাব গ্ৰহণ করে সেগুলো হলো বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক, যুবক ও সাধারণ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা; সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্ৰামকে তীব্রতর করে তোলা; জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া ও নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা; রাজ্যের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বিকাশ ঘটানো; রাজ্যের জনগণের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের রক্ষায় সংগ্ৰামকে তীব্রতর করে তুলতে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল এবং সংগঠনগুলোকে একটি মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করা; রাজ্যে প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় ও রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই সমস্ত প্রস্তাব গ্ৰহণের পর সম্মেলনের সফল সমাপ্তি ঘটে।
২২ নভেম্বর ২০২২ খাবার পরিবহণ সংস্থা স্যুইগির ডেলিভারি বয়দের এক বড় জমায়েত হয় কলকাতায় স্যুইগির মূল অফিস সল্টলেক শৈল টাওয়ারের সামনে। এই জমায়েত থেকে স্যুইগি ডেলভারি বয়দের এক প্রতিনিধি দল স্যুইগি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করেন ও তাদের দাবি দাওয়া পেশ করেন।
পুজোর আগে স্যুইগির বেশ কয়েকটি জোন নিজেদের দাবি নিয়ে স্ট্রাইক করেছিল। ডেলিভারি রাইডারদের প্রধান দাবি ছিল ৩৫ টাকা বেস পে আর কিলোমিটার পিছু ১০ টাকা দিতে হবে। পুজোর উৎসবের মুখে স্ট্রাইক তুলে নেওয়ার অনুরোধ করে কোম্পানি জানিয়েছিল ৩০ অক্টোবরের মধ্যে কিছু সুরাহার ব্যবস্থা তারা করবে। কিন্তু প্রতিশ্রুত সময় অতিক্রান্ত হবার পরও স্যুইগি কর্তৃপক্ষের তরফে এই দাবি নিয়ে কোনও সাড়াশব্দ করা হয়নি। কোম্পানির কাছে বারবার যোগাযোগ করা হলেও উত্তর পাননি স্যুইগি ডেলিভারি বয়দের সংগঠন। বাধ্য হয়ে ২২ নভেম্বর ২০২২ স্যুইগির ডেলিভারি শ্রমিকরা স্যুইগি অফিস (সল্টলেক শৈল টাওয়ার) অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন।
এই অভিযান বানচাল করার জন্য স্যুইগি কর্তৃপক্ষ সমস্ত চেষ্টাই করেছিল। থানায় থানায় স্যুইগি কর্তৃপক্ষের তরফে লোক পাঠানো, সংগঠকদের ভয় দেখানো — সবই চলেছে। সে সবে কাজ না হওয়ায় অভিযানের ঠিক আগে বেস পে বাড়িয়ে ২৫ টাকা করে কোম্পানি। কিন্তু, বেস পে বাড়ালেও ওয়েটিং টাইম পে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে আসলে রাইডারদের রোজগার কমিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়।
এইসব টালবাহানাতে না ভুলে ২২ নভেম্বর ২০২২ উত্তর কলকাতা ও দক্ষিণ কলকাতা মিলিয়ে ১০টি জোনের প্রায় ৩০০ শ্রমিক জড়ো হয়েছিলেন সল্টলেকের স্যুইগি ভবনের সামনে। ডেলিভারি শ্রমিকদের নাছোড়বান্দা মনোভাবে কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট ১০ জনের প্রতিনিধি দলের সাথে দেখা করেন।
প্রাথমিকভাবে ওয়েটিং টাইম পে চালু করার ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা করার কথা জানালেও, অন্য দাবিগুলোর বিষয়ে কলকাতার স্যুইগি ম্যানেজমেন্ট বাস্তবত জানিয়ে দেন যে তাদের হাতে কিছু নেই। সব আছে ব্যাঙ্গালোরের স্যুইগির হেড অফিসের নিয়ন্ত্রণে। সল্টলেকের স্যুইগি ভবনের কর্তৃপক্ষ আলোচনার সময়ে প্রথমে ডেপুটেশনের কপি অব্দি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল। অবশেষে রাইডাররা বাধ্য করেন কোম্পানির আধিকারিকদের দিয়ে তাদের দাবিসনদ গ্রহণ করাতে।
স্যুইগি শ্রমিকরা জানিয়েছেন যে তাঁরা নিজেদের সংগঠন গড়ে তুলবেন। প্রতি জোনের নিজস্ব কমিটি তৈরি হবে এবং জোনগুলোর সমন্বয়ের ভিত্তিতেই ঠিক হবে আগামী কর্মসূচি।
তাঁরা সামাজিক মাধ্যমে পেশ করা এক বিবৃতিতে কয়েকটি দাবিও তুলে ধরেছেন। সেগুলি হল,
১) বেস পে ৩৫ টাকা ও কিমি প্রতি ১০ টাকা দিতে হবে।
২) সাইকেল আইডি’দের প্রতি বঞ্চনা করা, তাদের তিন কিলোমিটারের বেশি অর্ডার দেওয়া চলবে না।
৩) ইন্সটামার্ট আইডি’দের বেস পে ২০ টাকা করতে হবে।
৪) গিগস সিস্টেম বন্ধ করতে হবে।
৫) স্বাস্থ্য বীমা, দুর্ঘটনা বীমার পদ্ধতি সরল করতে হবে।
৬) থার্ড পার্টিকে দিয়ে কাজ করিয়ে স্যুইগি রাইডারদের অর্ডার কমিয়ে দেওয়া চলবে না।
৭) সমস্ত ডেলিভারি রাইডারকে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রাপ্য অধিকার দিতে হবে।
ডেলিভারি অ্যাপের ভার্চুয়াল দুনিয়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শ্রমিকদের শোষণ ও শোষকদের সামনে নিয়ে আসার লড়াইটা কলকাতার স্যুইগি শ্রমিকরা শুরু করেছেন। স্যুইগি শ্রমিকদের এই লড়াই গত কয়েক বছরে গড়ে ওঠা ও দ্রুত বিকাশমান মোবাইল অ্যাপ ভিত্তিক নানা ব্যবসা, যাকে গিগ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বলে অভিহিত করা হয় — তার সমস্ত শ্রমিকদের নানা বঞ্চনার বিরুদ্ধে চলমান বৃহত্তর লড়াইয়েরই অংশ। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন এবং শ্রমিক সংগঠন এআইসিসিটিইউ সর্বতোভাবে এই আন্দোলন লড়াইয়ের পাশে থাকবে।
- সৌভিক ঘোষাল
এবারের গুজরাট নির্বাচন কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ নরেন্দ্র মোদীর কাছে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরো কুড়ি বছর। ২০০১ সালে ভূজে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরে গুজরাট যখন ত্রাণ এবং পুণর্গঠন নিয়ে নাজেহাল, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেল অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই সময়ে, লালকৃষ্ণ আদবানি, তাঁর সুযোগ্য শিষ্য, সংঘ পরিবারের বিশ্বস্ত নরেন্দ্র মোদীকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসান। যদিও তখন, নরেন্দ্র মোদীকে দেখে বোঝা যায়নি, এই মানুষটিই আগামী দিনে তিনবার মুখমন্ত্রী হয়ে, তারপরে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হবেন। তাহলে, কী এমন জাদুবলে এই কাজটি করলেন নরেন্দ্র মোদী, যার ফলে তাঁর প্রভাব এই পরিমাণে বৃদ্ধি পেল? আজকে যখন নির্বাচনী প্রচারে দাঁড়িয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এই গুজরাট বানিয়েছেন, তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে কি কোনও সারবত্তা আছে? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। যে গুজরাট, মহাত্মা গান্ধীর রাজ্য, সেই রাজ্যের মানুষের মধ্যে হিন্দু মুসলমানের বিভাজন, তিনিই করিয়েছেন। গুজরাট বলতে অনেকেই হয়তো গুজরাট মডেল, উন্নত রাস্তাঘাট, বড় বড় শিল্প বোঝেন, কিন্তু গুজরাট মানে যে দাঙ্গা, তা কি আমাদের মাথায় থাকে? কীভাবে গুজরাট হয়ে উঠলো হিন্দুত্ববাদের পরীক্ষাগার, তা নিয়ে বহু কথা হয়তো হয়েছে, বহু লেখাও হয়েছে, কিন্তু এই বিভাজনের রাজনীতিই যে আসল গুজরাট মডেল, তা ভুলে যদি শুধুমাত্র উন্নয়নের কথা বলা হয়, তাহলে কিন্তু ভুল হবে। পুরনো ইতিহাস হয়তো আজকের প্রজন্মের মনে নেই, কিন্তু তা মনে করে আগামীর পথ দেখাটাই বর্তমান সময়ের কাজ।
২০০১ সালে গুজরাটে তখন কংগ্রেস যথেষ্ট শক্তিশালী। সদ্য সদ্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। হঠাৎ, সমস্ত সমীকরণ বদলে গেল ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে। গোধরায়, সবরমতী এক্সপ্রেসে করসেবকেরা ফিরছিলেন। কে বা কারা, ওই ট্রেনের চারটে কামরায় আগুন লাগিয়ে দেয়, তা আজ অবধি জানা যায়নি, কিন্তু প্রায় ৬০ জন করসেবক সেদিন মারা গিয়েছিলেন ওই ঘটনায়। তারপর সারা গুজরাট জুড়ে শুরু হয় তান্ডব। বেছে বেছে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে শুরু হয় হত্যালীলা। খুন করা হয় অসংখ্য মানুষকে, যাঁদের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই সংগঠিত হত্যালীলায় সরকারী হিসেব অনুযায়ী মারা গিয়েছিলেন ১০৪৪ জন মানুষ, যার মধ্যে ৭৯০ জন মুসলমান এবং ২৫৪ জন হিন্দু। বেসরকারী হিসেব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা দু’হাজারের ওপরে। ধর্ষিতা হন অসংখ্য সংখ্যালঘু মানুষজন। নারকীয় এই ঘটনার বিবরণ, তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রায় রোজই এসেছে। অনেকে এই ঘটনাকে দাঙ্গা বললেও, সারা বিশ্বের বেশীরভাগ মানুষ আজও এই ঘটনাকে ‘সংগঠিত হত্যালীলা’ বলে থাকেন। অনেকেই বলে থাকেন, নরেন্দ্র মোদী সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাঁর প্রশাসনিক পদের অপব্যবহার করে ওই হত্যালীলা সংগঠিত হতে দিয়েছেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী অবধি নরেন্দ্র মোদীকে এই বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, তাঁর আচরণে ‘রাজধর্ম’ পালিত হচ্ছে না। সংসদে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বরখাস্তের দাবিতে আওয়াজ ওঠে, এমনকি এনডিএ সরকারের শরিকেরাও এই দাবিতে গুজরাট সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। চাপে পড়ে, নরেন্দ্র মোদী সহ সমস্ত মন্ত্রীসভা পদত্যাগপত্র দিয়ে দেন রাজ্যপালের কাছে। নির্বাচনও বেশি দূরে না থাকার কারণে, রাজ্যপাল সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। সেই সময়, কুড়ি বছর আগে এমনই এক নভেম্বরে নির্বাচন কমিশন গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণা করে দেন। অনেকে ভেবেছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আস্থা হারানো আদবানী-বাজপেয়ী এবং সংঘ পরিবার হয়তো আর মোদীকে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসেবে তুলে ধরতে চাইবেন না, কিন্তু কার্যত দেখা যায়, মোদীকে সামনে রেখেই বিজেপি এই নির্বাচনী লড়াইতে নামতে আগ্রহী এবং তার ফলও মেলে হাতেনাতে। যে বিভাজনের রাজনীতি নরেন্দ্র মোদী গুজরাটে ওই ২০০২ সালে করেছেন তার ফলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। ১৮২ আসনের মধ্যে ১২৭টি আসনে জয়লাভ করে বিজেপি।
আজকে ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, যিনি সেই সময়ে সেই গুজরাট গণহত্যার অন্যতম মূল একজন কারবারি ছিলেন, গুজরাট নির্বাচনে প্রচার করতে গিয়ে বলেছেন, যে তাঁরা ২০০২ সাল থেকে গুজরাটে স্থায়ী শান্তি এনে দিয়েছেন। যাঁরা দাঙ্গাকারী, তাঁদের শায়েস্তা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? গুজরাটে ঐ সংগঠিত গণহত্যার সময়ে যেভাবে হাজার হাজার সংখ্যালঘু মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল, যেভাবে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, যেভাবে তাঁদের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছিল, তা কি আমরা ভুলে গেছি? বিখ্যাত সাংবাদিক, রানা আয়ুবের ‘গুজরাট ফাইলস’ এই সমস্ত ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করেছিল সেই গণহত্যার পরে, যা পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। আজকে তাহলে কেন আবার সেই ঘটনাকে মানুষের স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনা হল? আসলে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ, অনেক আগে থেকেই এই বার্তা দিতে চেয়েছেন, যে ঐসব ভাইব্রান্ট গুজরাট বা গুজরাট মডেল দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে বোকা বানানো হবে, যাতে সারা দেশের মানুষ তাতে মজে থাকেন, কিন্তু গুজরাটের নির্বাচকদের বারেবারেই হিন্দু অস্মিতা জাগ্রত করেই তাঁদের জিততে হবে। গুজরাট গণহত্যা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার বললেই যে নামটি আমাদের প্রথম মনে পড়ে, তা হল, বিলকিস বানো, যিনি আজও জীবিত আছেন। যখন স্বাধীনতা দিবসের দিনে, তাঁর ধর্ষণকারীদের সাজা শেষ হওয়ার আগেই ‘ভাল ব্যবহারের’ কারণে মুক্তি দেওয়া হলো, সেদিনই বোঝা গিয়েছিল, বিজেপি এবারেও হিন্দু-মুসলমান তাস খেলতে চলেছে। গুজরাটের গোধরা বিধানসভার বর্তমান বিধায়ক, যিনি এই ধর্ষণকারীদের আগাম মুক্তির বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং তাঁরা মুক্তি পাওয়ার পরে বলেছিলেন, যে ওই অপরাধীরা আসলে ‘সংস্কারী ব্রাহ্মণ’, সেই চন্দ্র সিং রাউলজীকেই আবার বিজেপির প্রার্থী করা হবে কেন এবারের গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে? আসলে বিজেপি জানে, এই গুজরাটে তাঁদের যে বিভাজনের রাজনীতির শিকড় আছে, তা আজকে নয়, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে প্রোথিত হয়েছিল, তাই এবারও যদি তাঁদের জিততে হয়, যাঁর হাত ধরে তাঁদের জিততে হবে, তা নরেন্দ্র মোদীর হাত। যে হাত, যত ওপরে তুলে বিকাশের কথা বলুক না কেন, যে হাত বিভাজনের রাজনীতি করতে বিখ্যাত, যে কণ্ঠ থেকে যতই বলা হোক ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’, সেই হাতকেই আজ আবার বিজেপির প্রয়োজন।
যেদিন বিজেপি তাঁদের প্রার্থী ঘোষণা করেছিল এবং সেই তালিকাতে নারোদা পাটোয়ার মতো গণহত্যা, যাতে ৯৭ জন সংখ্যালঘু মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার অন্যতম কারবারি মনোজ কুকরানির কন্যা পায়েল কুকরানিকে প্রার্থী করা হয়েছিল, সেদিনই বোঝা গিয়েছিল, বিজেপি তাঁদের বিভাজনের রাজনীতি করেই এবারও জিততে চায় গুজরাটে। শুধু তাই নয়, প্যারোলে মুক্ত হয়ে মনোজ কুকরানি, তাঁর কন্যার হয়ে প্রচারও করছেন, যা সামাজিক মাধ্যম সহ নানান গণমাধ্যমে প্রচারিতও হয়েছে। এই বিধানসভায় কি মনোজ কুকরানি, মোদীর উন্নয়নের প্রচার করছেন, না যে বিভাজনের রাজনীতির শিক্ষা ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদী দিয়েছিলেন, তার প্রচারই করছেন? নারোদা পাটায়া থেকে পায়েল কুকরানিকে বা গোধরা থেকে চন্দ্র সিং রাউলজীকে প্রার্থী করার মধ্যে দিয়ে বিজেপি এই বার্তাই দিতে চেয়েছে, তাঁরা সংখ্যাগুরুর পক্ষেই আছে, তাঁদের কাছে সংখ্যালঘু মানে আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও ছিল, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, আজও তাই আছে। সুতরাং দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, যে ২০০২ সালে তাঁরা সেখানে শান্তি এনে দিয়েছেন, স্থায়ী শান্তি, তখন কি একবারও তাঁকে প্রশ্ন করা উচিৎ নয়, যে এই শান্তির মানে কী শ্মশানের শান্তি, যে শান্তির বাণীতে মিশে থাকে সংখ্যালঘু মানুষের চোখের জল, না ভূমিষ্ঠ হওয়া ভ্রূণের রক্ত? তবে শেষ করা যাক, সেই অশোক পারমারের কথা বলে, যাঁর মুখটা সেই গুজরাট গণহত্যার সময়ে আমরা চিনেছিলাম, হিংস্র, হিন্দুত্ববাদের মুখ হিসেবে, সেই অশোক পারমার এখন একটি জুতো সেলাইয়ের দোকান চালান। তিনি সারসত্যটি বলে দিয়েছেন, যে মোদী এবং অমিত শাহ তাঁদের ব্যবহার করে নিয়েছেন এবং সেই রাজ্যে সাধারণ মানুষের কোনও উন্নয়নই হয়নি। তাঁদের ব্যবহার করে হিন্দুত্ব রাজনীতির হয়তো জয় হয়েছে, কিন্তু তাঁরা যে তিমিরে থাকার সেই তিমিরেই আছেন। এবারের গুজরাটের নির্বাচনে কি সাধারণ মানুষ মোদী এবং অমিত শাহের এই ধাপ্পাবাজি ধরতে পেরে, গণতন্ত্রের পক্ষে তাঁদের ভোট দেবেন? তার উত্তর পেতে গেলে, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৮ ডিসেম্বর ২০২২ অবধি। বিজেপি জিতেও যদি যায়, যদি তাঁদের বিভাজনের রাজনীতি আবারও জয়ী হয়, তাও ইতিহাস সেই গণহত্যার কারবারিদের কোনোদিনই ক্ষমা করবে না।
- সুমন সেনগুপ্ত
“প্রতি ৩ জনের মধ্যে একজন ভারতীয় মেয়ে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর দ্বারা হিংসার শিকার।” (এনএফএইচএস-৫ সমীক্ষা)
“এই মেয়েদের মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ তাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের হিংসা থেকে বেরোনোর জন্য সাহায্য চেয়ে উঠতে পারেন।” (এনএফএইচএস-৪ সমীক্ষা)
“মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসার ৩,৫৭,৬৭১টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে ২০২১ সালে। এরমধ্যে ১,৩৭,৯৫৬টি ঘটনার অভিযুক্ত মহিলার বিবাহিত সঙ্গী বা আত্মীয়।” (এনসিআরবি ২০২১)
“২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে মেয়েদের উপর হওয়া হিংসার ৫০ শতাংশের বেশি ঘটনায় অপরাধী নিগৃহীতার অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা পরিবারের সদস্য।” (ইউএন সমীক্ষা)
সম্প্রতি শ্রদ্ধা ওয়াকার নামের এক ২৬ বছরের দিল্লী নিবাসী তরুণীকে হত্যা করে তার মৃতদেহকে কেটে কেটে ছড়িয়ে দিয়েছে শ্রদ্ধার অন্তরঙ্গ সঙ্গী আফতাব পুনাওয়ালা। এই ঘটনার নৃশংসতার চর্চা অলিগলি, গৃহকোণে ও ফোনের পর্দায় চলেছে। সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে ঘটনার বীভৎসতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের সাথে পরিচিত কমবেশি সকলেই। শ্রদ্ধার ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে ঘটনার তদন্ত দ্রুত শেষ করা ও অপরাধীর কঠোরতম শাস্তি সুনিশ্চিত করা আশু প্রয়োজন। কিন্তু, শ্রদ্ধার ন্যায়বিচারের জন্য এটুকু যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশে লাখো মেয়ে শ্রদ্ধার মতই অন্তরঙ্গ সাথী, পরিবার, পরিজনের দ্বারা হিংসার শিকার (এনসিআরবি ২০২১ তথ্যানুযায়ী)। ভারতে মেয়েদের উপর ঘটা হিংসার মোট ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষেত্রে অপরাধী নিপীড়িতার নিকটতম আত্মীয়, আর অপরাধের ঘটনাস্থল নিভৃত গৃহকোণ। প্রসঙ্গত, এই নভেম্বর মাসের ২১ তারিখ, উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে প্রিন্স যাদব নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে খুন করে, শরীর কুপিয়ে ফেলার অপরাধে। নভেম্বরের ১২ তারিখ, উত্তরপ্রদেশ নিবাসী, কুলদীপ সিং যাদব তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। দিল্লীতে, ৩৫ বছরের এক যুবক, তার ‘স্ত্রী’র সাথে মতবিরোধ হওয়ার কারণে, মহিলাকে গলা টিপে খুন করেছে। শ্রদ্ধার ঘটনাকে একটি বিরল, বিচ্ছিন্ন হিংসার মুহূর্ত হিসাবে না দেখে প্রয়োজন এই হিংসার সামগ্রিক বাস্তবতাকে বোঝা ও প্রতিহত করার রাস্তা খোঁজা।
অন্তরঙ্গ সম্পর্কে চুড়ান্ত হিংসা একদিনে ঘটেনা, বরং জীবনের রোজনামচায় মিশে থাকে হিংসাগুলি। ২০২০ সালে মুম্বইতে থাকাকালীন শ্রদ্ধা তার প্রতিবেশীর সাথে আফতাবের বিরুদ্ধে স্থানীয় তিলুঞ্জ থানায় অভিযোগ জানাতে গেছিলেন। দীর্ঘ ৬ মাস তার প্রেমিকের হাতে মার খাওয়ার পর শ্রদ্ধা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আফতাবের হাতে প্রাণ হারানোর আশংকার উল্লেখও ছিল তার অভিযোগপত্রে। কিছুদিন পর তিনি অভিযোগ তুলে নেন, থানায় লিখিত জমা দেন, “আমাদের মধ্যে আর কোনো ঝগড়া নেই”। এরপরেও শরীরে গুরুতর আঘাত নিয়ে শ্রদ্ধা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের কাছে আর কোনো অভিযোগ জমা পরেনি। শ্রদ্ধা ফিরে গিয়েছিলেন তার প্রেমিকের কাছে। অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার শিকার মানুষদের বারবার তাদের নিগ্রহকারীদের কাছে ফিরে যেতে দেখা যায়। অনেক সময় আইনের দারস্থ হওয়ার বদলে চুপ থাকার পন্থা বেছে নেন ভুক্তভুগীরা। এই ধরনের হিংসাকে প্রতিহত করার রাস্তা বড়োই জটিল, কারণ এক্ষেত্রে যে গায়ে হাত তোলে, সেই আদর করে, যে হুমকি দেয়, সে ক্ষমাও চায়, যে লাথি মারে, সে কাছেও ডাকে। বাংলায় একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে, “শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে।” এটি অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার সারকথা। সোহাগকে ঢাল করে, যার উপর হিংসা হয় তাকেই অপরাধবোধে ভোগানো হয়। শাসন ও ভালোবাসা শব্দ দুটি পরস্পর বিরোধী কিন্তু তার সহাবস্থানকেই স্বাভাবিক বলে চিনতে শিখি আমরা। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক বৈষম্যে ভর দিয়ে ভালোবাসার আঙিনায় বাসা বেঁধে থাকে হিংসা। ভালোবাসার থেকে হিংসাকে আলাদা করতে গিয়ে বারবার নিগৃহীতারা হোঁচট খায়, গুমড়ে মরে, সন্দেহ করে নিজের অভিজ্ঞতাকেই, জড়াতে থাকে হিংসার আবর্তে। সেই কারণে, পারিবারিক ও অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার বিভিন্ন ঘটনাকে যুগলের মধ্যে প্রেমের ঝগড়া, পারিবারিক কোন্দলের নাম দেওয়া হয়। অনেক সময়, বিবাহিত মেয়েরা হিংসার সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইলেও, তাদের পরিবার মানিয়ে নিতে বলে, কারণ ডিভোর্সী মেয়েদের সমাজ ‘ভালো’ চোখে দেখে না। আবার প্রগতিশীল সমাজে, নিগৃহীতা হিংসার সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাকে দুর্বল, নির্ভরশীল ইত্যাদি তকমা দেওয়া হয়। এই পন্থায় নিগৃহীতা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার বদলে হীনমন্যতায় ভোগেন। অনেকসময়, এই হীনমন্যতাবোধ থেকে বা অন্যের মতামতে আহত হওয়ার শঙ্কায়, নিগৃহীতা হিংসার ঘটনাগুলি লোকাতে থাকে।
এনএফএইচএস-৫ সমীক্ষায় অংশ নেওয়া মহিলাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ বলেছেন, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, যেমন, রান্নায় ভুল করলে, স্বামীর চাহিদামত যৌন পরিষেবা দিতে না পারলে, বাচ্চা ও পরিবারের যত্নে ত্রুটি হলে, মার খাওয়া স্বাভাবিক। তাই মার খেতে খেতে মরে গেলেও দোষ বর্তায় মৃত মেয়েটির আচরণের উপর। যেমন, শ্রদ্ধার হত্যার ঘটনার বিষয় মন্তব্য করতে গিয়ে, কৌশল কিশোর (আবাসন ও নগর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী), অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার দায় চাপিয়ে দেন সেই মেয়েদের উপর যারা বিয়ের বদলে ‘লিভ ইন’ সম্পর্ক বেছে নেন। সামাজিক মাধ্যমে শ্রদ্ধার হত্যার প্রসঙ্গে একের পর এক টুইট, পোস্ট, কমেন্টে তুলোধনা চলে শ্রদ্ধার চরিত্রের, কারণ তিনি ‘অন্য’ ধর্মের পুরুষের সাথে প্রেম করেছিলেন।
অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসা রুখতে করণীয়
১) অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসা, গৃহহিংসার ঘটনাকে আড়াল না করে, আপনার স্বজন পরিসরে হিংসার পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন, অবমাননাকর সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে নিগৃহীতাকে উৎসাহ দিন, পাশে থাকুন, যাতে প্রাণহানির আগে হিংসাকে থামানো সম্ভব হয়।
মনে রাখুন, অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসা/গৃহহিংসার ভুক্তভুগীরা অনেক সময় পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে যেতে চাননা। নিগ্রহকারীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে অনেক ভুক্তভুগীর দীর্ঘ সময় লাগে। এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি, নিগৃহীতার উপর নিজের মতামত না চাপিয়ে, তার কথা শোনা, যোগাযোগে থাকা, তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করা। এভাবে, নিগৃহীতা আপনাকে বিশ্বাস করে নিজের উপর হওয়া হিংসার বিষয় অবগত করবে৷ যে তথ্যের সাহায্যে, চুড়ান্ত হিংসা বা প্রাণহানি আটকানো যেতে পারে।
২) গৃহহিংসা ও অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার নিগৃহীতাদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, সরকারের হস্তক্ষেপ (যেমন সরকারী আশ্রয় কেন্দ্র, পরিষেবা) দাবি করুন।
এই মুহূর্তে, গৃহহিংসার নিপীড়ীতাদের জন্য সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও হেল্পলাইনগুলি টাকার অভাবে ধুঁকছে। গৃহহিংসা বিরোধী আইনের আওতায় নিয়োজিত গৃহহিংসা প্রতিরোধ বিষয়ক অফিসারের কাঁধে অনেক কেস সামলানোর দায়িত্ব, অথচ তাদের জরুরি প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো প্রদান করার প্রচেষ্টা নেই সরকারের তরফ থেকে। উপরন্তু, সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রগুলির পরিবেশ জেলের মত, যেখানে নিপীড়িতাদের সুরক্ষিত বোধ করানো, বা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করার বদলে বন্দী ও অপরাধীদের মতন আচরণ করা হয়।
৩) আন্ত-জাতি, আন্ত-ধর্মীয়, লিভ ইন সম্পর্কে থাকা মহিলাদের বিচ্ছিন্ন করবেন না। এই ধরণের সম্পর্কে হিংসার শিকার হওয়া মেয়েদের জন্য সাহায্য চাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারের কাছে এরা একঘরে হয়ে যান। এমনকি, পরিবারের রক্ষণশীল আচরণের কারণে অনেক মেয়েরা বিপদের কথা বলতে কুন্ঠা বোধ করেন, পরিবারের থেকে কলঙ্ক, আঘাত পাওয়ার ভয়।
৪) অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসা বিষয়টি নিয়ে জ্ঞাত হন, নিজ পরিসরে চর্চা করুন, সচেতনতা বাড়ান — কারণ এই মুহুর্তে বিশ্বজুড়ে মেয়েদের উপর সবচেয়ে বেশী হিংসা স্বজন, পরিজনের দ্বারা ঘটছে।
৫) ‘লাভজিহাদ’এর মতো সাম্প্রদায়িক প্রচারকে রুখে দিন, যা মেয়েদের উপর পারিবারিক ও সামাজিক হিংসার রাস্তা মজবুত করে।
সম্প্রতি আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা, গুজরাত নির্বাচনের প্রচারে, শ্রদ্ধা ওয়াকারের হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে, লাভ জিহাদ বিরোধী আইন, অর্থাৎ, আন্ত-ধর্মীয় বিয়ে রুখতে আইন প্রণয়নের পক্ষে সওয়াল করেছেন। শ্রদ্ধার হত্যার ঘটনা চাউড় হওয়ার পর থেকেই ঘটনায় অভিযুক্তের ধর্ম-পরিচয়কে তুলে ধরে নিজেদের বিদ্বেষ ছড়ানোর কর্মসূচীতে হাওয়া দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেড। ‘লাভ জিহাদ’ অর্থাৎ আন্ত-ধর্মীয়, আন্ত-জাতি বিবাহের অপরাধীকরণের ডাক দিয়ে, বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ইউটিউব ভিডিও আপ্লোড করা হয়েছে। শুধুমাত্র একটি ঘটনাকে, ধর্মীয় পরিচয়ের নিরিখে বাছাই করে, তুলে ধরে আসলে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ও গৃহহিংসা জনিত ঘটনার আধিক্য, লাখো নিগৃহীতা ও সমাজের উপর এই ধরনের হিংসার প্রভাবকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। লাভ জিহাদের প্রচার আসলে মেয়েদের স্বনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাকে দুরমুশ করে সেই পিতৃতান্ত্রিক, মনুবাদী মানসিকতার হাত শক্ত করছে, যে মানসিকতা গৃহহিংসাকে টিকিয়ে রাখে।
পরিশেষে বলি, অন্তরঙ্গ হিংসা রোখা এবং সরকার ও আইন আদালতকে দায়বদ্ধ করার দায়িত্ব শুধুমাত্র নারী আন্দোলনের কর্মী বা নারীবাদীদের নয়, গণআন্দোলনের কর্মী, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সচেতন নাগরিক — প্রত্যেকের এই কর্মকান্ডে ভূমিকা নেওয়া আবশ্যক ও প্রয়োজনীয়। আসুন, অন্তরঙ্গ হিংসা রুখতে সক্রিয় হই আমরা কারণ, এই হিংসা যতটা ব্যাক্তিগত, ততটাই সামাজিক।
ঋণ স্বীকার :
১) কবিতা কৃষ্ণান, নারীবাদী রাজনৈতিক কর্মী, ফেসবুক পোস্ট
২) দ্য কুইন্ট, ইন্সটাগ্রাম পেজ
৩) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৯ নভেম্বর ২০২২, সম্পাদকীয়
শ্রমজীবী মানুষের এক উটকো বস্তি। বৃহত্তর কলকাতার উপকণ্ঠে এক মুমূর্ষু শিল্পাঞ্চলের এক প্রান্তে। প্রায়ই টানা হ্যাঁচড়া চলে। সরকারি জমি। কোনও প্রজেক্টের জন্যে নির্দিষ্ট। সেইখানে পেটের তাগিদে গ্রাম-ছাড়া মানুষেরা মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে।
আগে তো অনেক বড় বসতি ছিল। মস্ত দিঘিতে মাছ ধরে, বিশাল জমিতে চাষবাস করে ছানা-পোনা নিয়ে ভালোই কাটছিল গা ঘেঁষাঘেঁষি বেশ কয়েক ঘর হিন্দু মুসলমান পরিবারের। ক্রমশ টনক নড়ে সরকারি বাবুদের। তারও আগে শাসকের পোষা বাহুবলীদের। এরপর উঠে যাওয়ার জন্যে মিহি-মোটা হুমকি, বারে বারে। তারপর একদিন সত্যিই বিরাট পুলিশবাহিনী, লোক-লস্কর নিয়ে সরকারি বাবুরা এসে জমি জরীপ করে ঘিরে দিয়ে গেল। খানিকটা ছাড় থাকল, উঠে যাওয়ার ফরমানও থাকল। জমি ভরাট করতে মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা ফেলার লরি ঢুকতে লাগল। মরা কুকুর বেড়াল পর্যন্ত ফেলে যেতে লাগল। দুর্গন্ধে নাড়ি উল্টে আসে। চান করার পুকুরটার জল দূষিত হয়ে গেল। চুলকানি খোস পাঁচুড়া হতে লাগল। পুরো নরক! বিশেষ করে বর্ষাকালে। যাদের উপায় আছে, অন্য জায়গায় চলে গেল। হতদরিদ্র ক'টি মুসলিম পরিবার এক কোণে গাঁদি মেরে কোনোক্রমে পড়ে আছে। নাছোড় বান্দা পেটের টানে। ক্ষীণ আশাও আছে, সরকার যদি পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থা করে।
বস্তিটাকে পরিচারিকা পল্লী বললে খারাপ শোনায়, কিন্তু কার্যত মহিলারাই সেখানে সবচেয়ে গতিশীল, সক্রিয় অংশ। ঐ মহল্লায় খুব স্বাভাবিকভাবেই পুর তদারকিতে কোনো পানীয় জল সরবরাহ, নিকাশি ব্যবস্থা, আবর্জনা নিষ্কাশন বা শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। এই অত্যাবশ্যক পুর পরিষেবা না থাকার অসুবিধা আর কষ্ট মেয়েদেরই বেশি পোয়াতে হয়, বলাই বাহুল্য। উদয়াস্ত পরের বাড়ি খাটার ফাঁকে ফাঁকেই তাদের নিজেদের বেআব্রু শ্রীহীন গৃহস্থালিটাকেও গতিশীল রাখতে হয়। তারা বড় রাস্তা পেরিয়ে জল আনে, কাঠ কাটে, শেষ বাজারে ভ্যান থেকে সবজি, কখনও সখনও মাছ কেনে, চুলো ধরিয়ে রান্না করে। বাচ্চার নড়া ধরে টানতে টানতে ইশকুলে দিয়ে আসে। প্রাইভেট টিউটর খোঁজে, 'গার্জেন কল' হলে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে। কাজের বাড়ির টিভি-র খবরে কান রাখে। সরকারি প্রকল্পের খবর নেয়। কাগজপত্র যোগাড় করে, পুরুষ দের তাগাদা দেয়। মাঝে এনআরসি-র হিড়িক উঠল। হাড় হিম করা আতঙ্কে এদিক ওদিক দৌড়ে নাভিঃশ্বাস উঠল ভোটার কার্ড, আধার কার্ড যোগাড় করতে গিয়ে। মুস্কিল হল, উটকো বস্তির বেড়া-প্লাস্টিকের ঘরে দিন কাটানো মানুষগুলোর তো ঠিকানাই নেই! কারও কারও অবশ্য দেশের ঠিকানা আছে। সবাই প্রায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার মানুষ। এদিক ওদিক যাহোক করে নথি যোগাড় করতে কাল ঘাম ছুটল। তখনকার মতো বিপদ কাটলেও ভয়টা থেকেই গেল।
কন্যাশ্রীর জন্যে মেয়ের গার্জেন হয়ে টিপ ছাপ দিয়ে ব্যাঙ্কের বই খোলা — সে ও মায়েরা। এরপর খাদ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, দুয়ারে সরকারের জন্যে দেশে ফোন করে তারিখ জেনে কাজের বাড়ি থেকে ছুটি নিয়ে দেশে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো-সে ও মেয়েরা। মহল্লায় কারও কিছু হলে মেয়েরাই চেঁচামেচি করে লোকজন ডেকে হাসপাতালে পাঠায়। মহল্লায় বাহুবলীদের চেলা-শাগরেদদের আনাগোনা চলে। একটা ঘরে তারা চুরির মালপত্র রাখে, মদ গাঁজা খায়। মার পিট চেঁচামেচি করে, রাতভর হুল্লোড় করে মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। কখনও পুলিশ আসে। কিন্তু অপরাধীদের ধরে না, বরং কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাকেই তুলে নিয়ে যায়। কিছুদিন আগে এক ড্রাইভার ঝামেলা মেটাতে গিয়ে বেদম মার খেয়েছে দুষ্কৃতীদের হাতে। তারপর পুলিশ তাকেই ধরে নিয়ে গেছে। এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেয়েরা জোরালো প্রতিবাদ করতে না পারলেও, চুপ থাকেনি। মাঝখানে দু'একটি মেয়েও নিখোঁজ হয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুটলেও, লোকজন প্রকাশ্যে তেমন প্রতিবাদের সাহস পায় না। কারণ পুলিশকে পাশে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর উচ্ছেদের হুমকি। এসবের বিরুদ্ধে চোখ কান খোলা রেখেই চলতে হয় মেয়েদের। ছেলে মেয়েদের ঐ কুসংসর্গ থেকে আড়াল করার মরিয়া চেষ্টাও চালাতে হয়। বিশেষ করে ঘরে যার বাড়ন্ত গড়নের মেয়ে সেই মায়ের তো মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। কোনোরকমে ধার দেনা করে মেয়েকে পরের ঘরে না পাঠানো অবধি শান্তি নেই। এইজন্যে নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা বাড়ছে। বিয়ে দিয়েও আরেক সমস্যা। সেখানেও মেয়েকে লাঞ্ছনা গঞ্জনা মারধর সহ্য করতে হয়। ঝামেলা মেটাতে ক'দিন পর পর ছুটতে হয়।
পুরুষরা সংসার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। কেউ ভ্যান চালায়, কেউ ক্যাজুয়াল সাফাই কর্মী। কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরোনো আসবাব কিনে দোকানে বেচে। কেউ রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজ করে। কেউ গাড়ি চালায়। এছাড়া গাছ কাটা, ঘর ছাওয়া-যখন যেমন কাজ পাওয়া যায় করে। কেউ আবার কষ্টার্জিত পয়সা মদ আর জুয়ায় উড়িয়ে দেয়।
হাতের কাছে বড় হাসপাতালটা থাকায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা মেলে , কিন্তু নানা পরীক্ষা, ওষুধপত্র সব বাইরে থেকে নিজেদের খরচে ব্যবস্থা করতে হয়। কিছুদিন আগেও অবশ্য মিলতো। নানা অব্যবস্থা হাসপাতালে। ডাক্তার কম , কর্মী কম, মেশিন খারাপ — এসব অজুহাতে নাকাল হতে হয় লম্বা লাইনে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকা রোগীদের। সাধারণ মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেটও এখন অমিল। কথায় কথায় অন্য হাসপাতালে 'রেফার' করে, এদিকে নামে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। তবে গরিব মানুষের বিরাট ভরসা এই হাসপাতালই। বহু রোগের নিরাময়ও হচ্ছে ডাক্তারদের সুচিকিৎসায়।
লক্ষণীয় বিষয় হল, নিজেরা অধিকাংশই নিরক্ষর হলেও ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার দরজায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে মায়েদের ক্লান্তিহীন তৎপরতা। নিজেদের বিন্দু বিন্দু রক্ত-ঘামে অর্জিত পয়সা তারা 'প্রাইভেট' পড়াতে খরচা করে, অনেকাংশে হয়তো বৃথাই। জহুরা বিবির ছোট ছেলেটার এবার সাত ক্লাসে ওঠার কথা। কিন্তু তার পড়াশুনোর অবস্থা খুব খারাপ। হতাশ জহুরা বলে "ও কেলাসে উঠলেও আমি মাস্টারকে বলব আগের কেলাসেই রেখে দিতে। পেরাইভেট পড়ায় যে মাস্টার, সে বলেছে — ও কিছুই পারে না।" আগেও একবার পুরোনো ক্লাসেই রেখে দিয়েছিল। তবে হতাশ হলেও হাল ছাড়েনি। মাস কয়েক আগে নিজে গুরুতর অসুস্থ হয়েছিল। ওষুধ এখনও চলছে। ওষুধ, ছেলের প্রাইভেট পড়ার খরচে জোর দড়ি টানাটানি চলে। তবুও দু'টোই বজায় রাখতে হবে মনে করে দিনের পর দিন আলুভাতে ভাতই বেড়ে দিতে হয় বাড়ন্ত নাবালক ছেলে, সদ্য প্রসূতি বৌমাসহ সবার পাতে। ক্বচিৎ মাছ বা মাংস বা ডিম। অপুষ্টির কালো ছায়া পরিবার জুড়ে। মিড-ডে-মিল-এও তো শুধু ভাত সবজি। কখনও সয়াবিন। ডিম তো বহুদিন বন্ধ।
এত নেতির মধ্যে দু'একটা ঘটনা যেন গাঢ় অন্ধকারে এক রূপোলি ঝিলিক। জহুরার কাছে জানা গেল শুভঙ্কর বলে যে ছেলেটি ওদের ক'টা বাচ্চাকে পড়ায় সে নিজে এক কলেজ ছাত্র। ছেলের খোঁজ করতে একদিন এক মা দু'স্টপেজ দূরে শুভঙ্করের বাড়ি গিয়েছিল। সেও ঝুপড়ি ঘর। মাস্টারের মা তাকে এক কাপ চা না খাইয়ে ছাড়েনি। খুব কম বয়েসে স্বামী তাকে ছেড়ে আবার বিয়ে করে। নিরুপায় হয়ে যোগাড়ের কাজ ধরে ছেলেকে মানুষ করেছে। এখনও তাতেই পেট চলে। ছেলে ভোরে উঠে বাড়ি বাড়ি কাগজ দিয়ে, টিউশন পড়িয়ে কলেজ চলে যায়। ফেরার পথে রহিমদের পড়িয়ে বাড়ি ফেরে। কিন্তু জহুরারা এখনও পর্যন্ত একটা ভালো জায়গা তাকে দিতে পারেনি পড়ানোর জন্যে। একটা ভাঙাচোরা ঘরে মাস্টারের মোবাইলের টর্চের আলোয় পড়াশুনো চলেছে কিছদিন। অগত্যা মাস্টার নগদ তিন হাজার টাকা শামসুলকে দিয়ে বলেছিল ঘর বানিয়ে দিতে। লোকটার সব ভালো কিন্তু ভীষণ জুয়াড়ি। সব টাকা উড়িয়ে আরও টাকা চেয়ে নিয়েছে। ঘর এখনও হয়নি। অধীর আগ্রহে থাকা মায়েরা রোজই শামসুলকে বকাবকি করে, তাড়া লাগায়, "বেচারার রক্ত জল করা টাকাগুলো ফেরত দাও, নয়তো ঘর বানাও। আমাদের বাচ্চাদের ঠিকমতো পড়াশুনো হচ্ছে না।" সায়রার বর তিনটে বাচ্চা রেখে ওকে ছেড়ে আবার বিয়ে করেছে। পাশেই ঘর বানিয়ে নতুন বৌ নিয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই ঝগড়া ঝাঁটি হত। সায়রা পুরোনো বরকে মনে প্রাণে ঘেন্না করে। তার হুমকির জবাবে পাল্টা গলা চড়িয়ে বলেছে "তোর মত দু'নম্বরি কামাই না, সৎ পথে গতর খাটিয়ে খাই রে! আর ছেলেদের খাওয়াই পরাই। পড়াশুনোও শিখোবো। — আর আমার কিছু হলে, সবাইকে বলা আছে, তোকেও কেউ ছাড়বে না।" দাঁতে দাঁত চেপে সত্যিই তিনছেলেকেই ও পড়াচ্ছে।
আমিনার ছোট মেয়ে সালমার শ্বশুরবাড়ি বসিরহাটের গ্রামে। ওখানে বাড়িতেই প্রসব হয়। মানুষ বহুদূরের হাসপাতাল যায় না। সহজে যাবার উপায়ও নেই। শুনেই সন্তানসম্ভবা মেয়েকে আমিনা একরকম জোর করেই নিজের কাছে নিয়ে আসে। বেয়ানের রাগ আর বাঁকা কথাকে পাত্তা না দিয়েই। নিজের বড় ছেলটা বাড়িতে হওয়ায় তার জন্মের কোন কাগজ ছিল না। তাই নিয়ে কম ভুগতে হয়েছে! এনআরসি-র নামে ভয়ে ছেলেটা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। পরে বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে আধার কার্ড বানিয়েছে। তাছাড়া নাবালিকা মেয়ে, প্রথম প্রসব। বাড়িতে প্রসবের ঝুঁকি নেওয়া যায়? ঘরের কাছে এতবড় হাসপাতাল থাকতে? আমিনা হাসপাতালে মেয়ের কার্ড করিয়েছিল। সেদিন হাসতে হাসতে বললো, "পরের বাড়ি খেটে খাই, জমি জিরেত তো নেই। নাতনিকে তার নানির মত রূপোর বালা দিতে পারি নি। কিন্তু আসল জিনিষটা করিয়ে দিয়েচি, জন্ম সাট্টিফিকেট!"
চেতনায় ঘা পড়ছে। সালমা, আমিনা, শবনমদের। কাজের জন্যে বাইরে বেরিয়ে তারা চলমান জীবন থেকে ঠোক্কর খেয়ে অনেক কিছু জানছে, বুঝছে, শিখছে। এখন তাদের কাছে খুব নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে পরিবার , সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে তাদের প্রাপ্য কী কী অধিকার-মর্যাদা, যা থেকে তারা আজও বঞ্চিত শুধু নয়, প্রতারিতও। সেটা নিয়ে চর্চা করার দায়িত্ব সঠিক রাজনৈতিক দিশা ও পরিকল্পনা সম্পন্ন নারী সংগঠনের। তারপর কীভাবে অধিকারের লড়াই লড়তে হবে, তারা নিজেরাই ঠিক করে নেবে। শাহীন বাগের দাদীরা যেমন লড়েছিলেন! কৃষাণীরা যেমন লড়েছিলেন! ইরানী মেয়েরা যেমন লড়ছেন!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
ফেব্রুয়ারি ২০২১-র পর প্রথমবার এই অক্টোবরে ভারতের পণ্যরপ্তানি বেশ খানিকটা সংকুচিত হল। গত বছরের ১৬.৭ শতাংশ হার থেকে কমে (এবং ২০২২-র সেপ্টেম্বরের ১৬ শতাংশ থেকে) তা ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রগুলোই মন্থরতার শিকার : ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য সামগ্রি, ওষুধ পত্র ও কেমিক্যাল, এবং শ্রম-নিবিড় রত্নালঙ্কার, টেক্সটাইল ও হ্যান্ডলুম। উৎপাদন শিল্পের মধ্যে একমাত্র বৈদ্যুতিন ক্ষেত্রে রপ্তানি বেড়েছে। আমদানির হার ৫.৭ শতাংশ, ফলে দেশের বাণিজ্যিক ঘাটতি ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে ও চওড়া হয়েছে; এখন দাঁড়িয়েছে ২৬.৯ বিলিয়ন ডলারে। এ নিয়ে পর পর চার মাস ধরে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ও বেশি বাণিজ্যিক ঘাটতি চলছে, এই জুলাইয়ে যা ৩০ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড ছুঁয়েছে। পেট্রোলিয়াম সহ অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানিতে সামান্য হ্রাস বুঝিয়ে দেয় যে দেশীয় বাজারে চাহিদার ঘাটতি রয়েছে। গত বছর বাণিজ্যিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৪.২ বিলিয়ন ডলার, যা এ বছরে এসে দাঁড়িয়েছে ১৭৫ বিলিয়ন ডলার! যত শীত এগিয়ে আসবে, ততই এনার্জি বা শক্তি মূল্যবৃদ্ধি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে, ফলে বাণিজ্য ঘাটতিতে লাগাম টানা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে ইস্পাতের রপ্তানি শুল্ক কমে যাওয়ায় অনেক বেশি আমদানি বেড়ে গেছে, বিপরীতে, ভীষণভাবে কমেছে ইঞ্জিনিয়ারিং সহ অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি। টাকার দাম দিনের পর দিন কমে যাওয়ায় আমদানি অনেক ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
এই সংকটকে কিভাবে দিল্লি সামাল দেবে তা এখন দেখার।
ধনপতি এলন মাস্ক কর্পোরেট জগতের এক বর্ণাঢ্য চরিত্র। তিনি খবরে থাকতে ভালোবাসেন, মাঝেমধ্যেই চমকপ্রদ সব প্রকল্প ঘোষণা করেন। তাঁর কোম্পানি টেসলার চালকহীন গাড়ি এখনো বিশবাঁও জলে, দু-দুবার ট্রায়াল রানে দুর্ঘটনা করেছে। প্রস্তাবিত সাইবার ট্রাক যা নাকি স্পোর্টস কার তুল্য আরামদায়ক ও ত্বরিতগতি সম্পন্ন এবং, যা মনে করা হচ্ছে পণ্য পরিবহনে নতুন যুগ সূচিত করবে, তা এখনো ভবিষ্যতের গর্ভে। আর মঙ্গল গ্রহে কলোনি স্থাপন করার প্রস্তাব ঘোষণা করে তিনি তো রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। এহেন মাস্ক যখন টুইটার ক্রয় করলেন, তখন টেক জগতে এমন এক কম্পন দেখা গেল যা অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এক আসন্ন বিশ্বজোড়া মন্দার নিশ্চিত পূর্বাভাস।
সমাজমাধ্যমের এই জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মটি তিনি ৪৪ বিলিয়ান ডলারে ক্রয় করেছেন যার জন্য তাঁকে বিপুল অঙ্ক ঋণ নিতে হয়েছে। তিনি তো বিশ্বের সবচেয়ে ধনশালী ব্যক্তি, হঠাৎ তাঁর টুইটার কেনার এই খামখেয়ালীপনা কেন? তাঁর নিজের কথায় উদ্দেশ্য মহৎ — বাকস্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা। যা অনুচ্চারিত, সর্বসমক্ষে অব্যক্ত তা হচ্ছে তাঁর অন্যান্য ব্যবসার প্রচারের একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। তিনি ক্রয় করার পর থেকেই সংস্থাটি সংকটে। বাকস্বাধীনতার বুকনি দিয়ে শুরুতে তিনি বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলেন। দুটি ঘটনা তাঁদের মধ্যে টুইটার সম্পর্কে অনীহা সৃষ্টি করল। প্রথমত তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটার অ্যাকাউন্টের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন। দ্বিতীয়ত ব্যবহারকারীদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করলেন, যা তথাকথিত ‘টুইটার ব্লু’ সার্ভিস বলা হচ্ছে। এরজন্য প্রতি মাসে ৮ ডলার করে মূল্য গুনতে হবে। মনে করা হচ্ছে এই দুটি কারণের ফলে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট ও ঘৃণা ভাষণের রমরমা বাড়বে। ইতিমধ্যেই যুদ্ধাস্ত্র-নির্মাণকারী লকহিড মার্টিন, জ্বালানির একচেটিয়া সংস্থা বিপির (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম) নামে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খোলা হয়ে গেছে। তাই প্রথমে আগ্রহ দেখালেও বিজ্ঞাপনকারীরা প্রমাদ গুণলেন, তাদের মধ্যে টুইটার সম্পর্কে সংশয় তৈরি হল। এরসাথে আছে বিপুল ঋণের চাপ, যারফলে সংস্থাটির সংকট আরও ঘনীভুত হল।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এলন মাস্ক প্রথাগত রাস্তাই ধরলেন — কর্মী সংকোচন, অর্থাৎ বাংলা ছাঁটাই, তিনমাসের মাইনে দিয়ে বিদায় করা, আর উপভোক্তাদের থেকে পয়সা আদায় করা। এরফলে ৭,৫০০ কর্মী বাহিনীর প্রায় ৫০ শতাংশ তিনি ছাঁটাই করে দিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে অতি উচ্চপদস্থ প্রযুক্তিবিদরাও রয়েছেন। যেটা দেখা গেল সংকটটা খালি টুইটারেই সীমাবদ্ধ নয়। মেটা যা ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটস-অ্যাপের মূল আধার, তারা ১১,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে, যা তাদের কর্মী সংখ্যার ১৩ শতাংশ। এছাড়া অ্যামাজন ১০,০০০ কর্মী, ক্রিপ্টো.কম তাদের কর্মী সংখ্যার ৩০ শতাংশ, এয়ারবিএনবি ২৫ শতাংশ, স্ন্যাপচ্যাট ২০ শতাংশ, উবের ১৪ শতাংশ, ইত্যাদি আরও অনেক সংস্থা ব্যাপক হারে কর্মী বিদায় করেছে। শুধুমাত্র সফটওয়্যার বা পরিষেবা ক্ষেত্রেই নয়, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ক্ষেত্রেও চাকরি চলে যাওয়ার করাল ছায়া। হিউলেট প্যাকার্ড আগামী তিন বছরে ৬০০০, হার্ড ড্রাইভ নির্মাণ সংস্থা সিগেট ৩০০০, ইন্টেল ২০ শতাংশ কর্মী কমাবে। অর্থনৈতিক সংকট অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়েছে। রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন কারণ বাড়ি কেনা ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এমনকি বাইজুস, যে কোম্পানির নাম ২০২০’র আগে কেউ শোনেনি, করোনাকালে যাদের উল্কার মতো উত্থান হয়েছে এবং বিশ্বকাপ ফুটবলের স্টেডিয়ামে যাদের বিজ্ঞাপন কাতার এয়ারওয়েজ, কোকাকোলার পাশে জ্বলজ্বল করছে, তারাও ২৫০০ কর্মী ছাঁটাই করছে। তাদের নাকি প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে যে কারণে তাদের খরচ কমাতে হবে।
জানা যাচ্ছে শুধুমাত্র টেক কোম্পানিগুলোতে ইতিমধ্যেই ৭৮০টির অধিক সংস্থায় ১,২০,০০০ কর্মী ছাঁটাই হয়ে গেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে এই বিপর্যয় প্রত্যাশিত ছিল। করোনাকালে টেক সংস্থাগুলির ব্যবসা বিপুল বিস্তার লাভ করে। লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষ কম্পিউটার ও অনলাইন পরিষেবার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। খাদ্য সরবরাহ সংস্থা স্যুইগি, জোম্যাটো এবং বাইজুসের মতো অনলাইন পড়াশুনার সংস্থার অভুতপূর্ব উত্থান ঘটে। অতিমারীর কারণে বাড়ি থেকে কাজ করার প্রথা চালু হয়। বলা হচ্ছে এক দশকে টেক সংস্থাগুলির ব্যবসা প্রায় ১১.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যে কারণে কোম্পানিগুলি প্রচুর কর্মী নিয়োগ করে। কম্পিউটার ও অন্যান্য হার্ডওয়্যারের বিক্রি বিপুল বৃদ্ধি পায়। এই দু’বছর সময়ে এই সংস্থাগুলি আশাতীত মুনাফা অর্জন করে যারফলে প্রায় প্রতিটি দেশে অভুতপূর্ব অসাম্য দেখা যায়। করোনা স্তিমিত হওয়ার পরেই বাজারে মন্দা দেখা যায়। পার্সোনাল কম্পিউটার, অনলাইন সার্ভিসের চাহিদা কমে যায় যারফলে চলতি আর্থিক বছরে এই সংস্থাগুলির ব্যবসা অধোমুখি।
এরসাথে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি। ডিজিটাল দুনিয়ার ওয়েব ২.০ থেকে ওয়েব ৩.০এ দ্রুত পরিচলন ঘটছে যা টেক কোম্পানিগুলিকে ভীত করে তুলেছে। ওয়েব ৩.০ এসে গেলে যাঁরা কনটেন্ট তৈরি করেন তাঁদের আর কোনও মধ্যস্থ (intermediate) সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। এতদিন আমি যদি কোনও বিষয়ের ওপর কোনও ভিডিও, পডকাস্ট ইত্যাদি নির্মাণ করি তবে তা ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর জন্য আমাকে এই ওয়েব দৈত্যদের সার্ভারের ওপর নির্ভর করতে হতো। এতে আমার কনটেন্ট বিকৃত বা পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ থাকত, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। নতুন ওয়েব জমানায় আমি সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছে যেতে পারছি, অন্যদের সার্ভারের ওপর আমাকে নির্ভর করতে হচ্ছে না। একইভাবে অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য আমাকে কোনও সরকারি বা বেসরকারি ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। ব্লকচেন প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভবের ফলে এই পরিসরটাও কনটেন্ট বিক্রেতার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। ওয়েব দৈত্যরা স্পষ্টতই বুঝতে পারছে যে এরফলে ডিজিটাল দুনিয়ায় তাদের আধিপত্য খর্ব হতে চলেছে। তাদের ব্যবসা হ্রাস পাবে, যে কারণে খরচ কমানোর জন্য তারা মরীয়া হয়ে উঠেছে। এছাড়া কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর থেকে অ্যালগরিদম (কম্পিউটারে কোনও সমস্যা সমাধানের গাণিতিক প্রক্রিয়া) নির্মাণে এখন মনুষ্য শ্রমের প্রয়োজন অনেক কমে গেছে। এটা এই ওয়েব কোম্পানিগুলিকে কর্মচারী ছাঁটাইয়ের আরও সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন অর্থনীতির রূপ প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। কাজের ক্ষেত্র, কাজের চরিত্র রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে, আজকের দক্ষ কর্মী আগামীকাল অদক্ষ হয়ে যাচ্ছেন, নতুন একদল কর্মী যাঁরা নতুন প্রযুক্তিতে সরগর তাঁরা উঠে আসছেন। এই টালমাটাল অবস্থায় কাজ, চাকরি, অর্থনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তা রীতিমতো অনিশ্চিত। এমনকি এই দানবাকৃতি ওয়েব সংস্থাগুলি আগামী দশকে টিকে থাকবে কিনা তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না।
আমাদের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ধনকুবেরদের খামখেয়ালিপনা ও প্রযুক্তির উল্লম্ফনের ফলে যেসব শ্রমিক/কর্মচারী/প্রযুক্তিবিদ নিত্যনতুন পরিবর্তিত অবস্থায় ‘বাতিল’ হিসাবে গণ্য হচ্ছেন তাঁদের কী হবে? তাঁদের বিকল্প জীবিকা, রুটিরুজি, কাজের কী ব্যবস্থা হবে? বিশ্বজুড়ে মেহনতি মানুষ আজ এই অনিশ্চিত, অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমাবেশিত হচ্ছেন। গত ২৫ নভেম্বর ২০২২ অ্যামাজন ওয়্যারহাউস কর্মীরা ভারত সহ তিরিশটি দেশে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তাঁদের দাবি কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের উন্নতি, কাজের নিরাপত্তা, শ্রমিকের অধিকার। তাঁরা মাসিক নুন্যতম ২৫,০০০ টাকা বেতন, আট ঘণ্টার কাজ, শ্রমিকদের বিশ্রামের জন্য আরামকক্ষ, শিশুদের জন্য কর্মক্ষেত্রে ক্রেশের ব্যবস্থা করার দাবি করেছেন। এই বিক্ষোভের মূল উদ্যোক্তা ‘মেক অ্যামাজন পে কোয়ালিশন’ যাঁদের অধীনে ৮০টি ট্রেড ইউনিয়ান, নাগরিক ও পরিবেশ সংগঠন রয়েছে। ভারতে ২৩টি শহরে ‘গিগ ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘হকার্স জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’ এই বিক্ষোভ সংঘটিত করেছে যাতে অ্যামাজন ছাড়াও স্যুইগি ও জম্যাটোর কর্মীরা অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া টেক কর্মীরা নানা ইউনিয়নে সমাবেশিত হচ্ছেন, যারমধ্যে অন্যতম ‘ইউনাইটেড টেক এন্ড আল্যায়েড ওয়ার্কার্স’। এঁরা অ্যামাজন, মেটা, গুগল, টুইটার ইত্যাদি অতিকায় টেক কোম্পানিগুলিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনার দাবি করছেন যাতে এদের ওপর কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করা যায়। প্রযুক্তির রূপান্তরের ফলে যেসব মানুষকে কর্মক্ষেত্রে ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে করা হচ্ছে তাঁদের কাজ, জীবিকা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এই অতিমুনাফা লোভী সংস্থাগুলিকে নিতে হবে। তারা এটা এড়িয়ে যেতে পারে না, এটা তাদের সামাজিক দায়িত্ব।
- সোমনাথ গুহ
রাষ্ট্রপুঞ্জের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন ২০২২ সালের ৬ থেকে ১৮ নভেম্বর মিশরের শার্ম এল-শেখ শহরে অনুষ্ঠিত করল জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ২৭তম সম্মেলন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অনুষ্ঠিত হওয়া এই সম্মেলন অভিহিত হয় কনফারেন্স অব পার্টিজ নামে এবং এবারের সম্মেলনটা ছিল কনফারেন্স অব পার্টিজ ২৭ (সিওপি ২৭)। সিওপি ২৭ এমন একটা সময় অনুষ্ঠিত হল যখন ২০২২ সালে পৃথিবীতে চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনায় যথেষ্ট মাত্রায় বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের বহু শহরে ভয়াবহ বন্যা ঘটল, ইউরোপে শতাব্দীর মধ্যে সবচয়ে বেশি তাপমাত্রার তাপপ্রবাহ বইল, আর এরমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলায় সহমত হতে রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা প্রকট হল। সিওপি ২৭ অনুষ্ঠিত হল ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির পৃষ্ঠভূমিতে যা আন্তর্জাতিক আলোচনায় সাধারণ কিন্তু পৃথকীকৃত দায়বদ্ধতাকে পরিহার করেছিল (গ্ৰিনহাউস গ্যাসের ঐতিহাসিক নিঃসরণের ওপর ভিত্তি করে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের ভারকে বণ্টন করা)। প্যারিস চুক্তিতে প্রবর্তিত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নিঃসরণ কর্মসূচির নয়া নীতির অর্থ হল সদস্য রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনভাবে নিঃসরণ হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দেবে যেটা এর আগে ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকল থেকে আলাদা, যে প্রটোকল অনুসারে নিঃসরণের আইনি দায়বদ্ধতা ছিল। ২০১৫ সাল থেকে দেখা গেছে, বাধ্যতামূলক হ্রাস থেকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হ্রাসে নীতির পরিবর্তন ঐতিহাসিকভাবে অধিক নিঃসরণকারীদের — শিল্পসমৃদ্ধ, উন্নত ও ধনী দেশগুলোকে — দায়বদ্ধতা থেকে ছাড় দেওয়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা যথেষ্ট কমজোরী হয়ে পড়েছে।
মিশরে সিওপি ২৭ : ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের ইস্যু
সিওপি ২৭’এর শুরুতে সম্মেলনের মূল এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত হল ‘ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের’ ইস্যুটা — যা হল জলবায়ু পরিবর্তন প্রসূত ক্ষতির জন্য দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রদান। একইভাবে অন্তর্ভুক্ত হল আরও একটা এজেন্ডা আর সেটা হল আগামী পাঁচ বছরে আবহাওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনাবলীর বিপদ সম্পর্কে ‘এই গ্ৰহের সবাইকে’ সতর্ক করা। এই এজেন্ডাটা ঢোকান রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব অ্যানটনিও গুটারেস যিনি এর আগের বছরগুলোতে দরিদ্র দেশগুলোর উদ্বেগকে অবজ্ঞা করার জন্য ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নেন। সমস্ত দেশের প্রতি সমবিচার করার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের প্রচেষ্টা যথেষ্ট মাত্রায় কালিমালিপ্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্ৰস্ত, বিশেষভাবে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতার মোকাবিলায় সর্বজনীন এজেন্ডার অনুপস্থিতির জন্য। ‘ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের’ ইস্যু এবং আবহাওয়ার চরম ও ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনাবলী সম্পর্কে সতর্ক করার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত ইস্যুকে অন্তর্ভুক্ত করে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন তার বিশ্বাসযোগ্যতার হানিকে হ্রাস করতে চেয়েছে। এর আগের সম্মেলনগুলোতে উন্নত দেশগুলো যে ক্ষতি সাধন করেছে, সিওপি ২৭ কি তার প্রতিবিধান করতে পারবে? জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান বিপদগুলোর মোকাবিলায় যথেষ্ট পদক্ষেপ কি নেওয়া হচ্ছে? জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ঘটা চরম প্রাকৃতিক ঘটানাগুলোর ফলে যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি হচ্ছে সে কথা বিচার করলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা সঠিক পথে এগোচ্ছ কিনা তা বলা শক্ত। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের বিশাল আকারের ভয়াবহ বন্যার কথা ধরা যাক। এই বন্যা হয়েছিল এ’বছরের জুন মাসে, তাতে মারা গিয়েছিল ১৭০০’র বেশি মানুষ যার মধ্যে প্রায় ৪০০ জন ছিল শিশু, আর লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছিল। ব্যাপক বিস্তৃত প্লাবনে মোট ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার এবং আমপান ভারত ও বাংলাদেশে যে ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছিল তার আনুমানিক পরিমাণ ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলার। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যে পরিমাণ গ্ৰিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে, তার তুলনায় তাদের ভোগ করা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ঐতিহাসিক চুক্তি না ঐতিহাসিক অন্যায়?
দু’সপ্তাহ ধরে চলা আলোচনায় কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্ৰগতি না হওয়ায় সিওপি ২৭ সমাপ্তির নির্দিষ্ট সময় পরও সম্প্রসারিত হয়। পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের সমাপ্তি ভাষণে সিওপি ২৭’এর সভাপতি সামেহ সৌকরি ‘ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ’ তহবিল নিয়ে দেশগুলো যে তাৎপর্যপূর্ণ ঐকমত্যে পৌঁছেছে তার উল্লেখ করেন। তহবিলের ধারণাটা এই উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছে যে তা বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় বিধ্বস্ত দেশগুলোর সুরাহা করার পথ প্রশস্ত করবে। তবে তহবিলের এই ধারণাটা শুধু ‘বিশেষভাবে ক্ষতিপ্রবণ দেশগুলোর’ জন্য, ফলে, সুরাহা পাওয়ার যোগ্য দেশগুলোর সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়ছে। সুযোগকে সীমিত করে তোলা হলেও নতুন এই তহবিল দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আশার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসবে, নাকি তাদের নিরাশ করবে? ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে হয় এটা ভবিষ্যতে বিতর্কেরই একটা বিষয় হয়ে উঠবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, গবেষণা বলছে যে গ্ৰিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করে নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বছরে প্রয়োজন হবে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। তবে, জলবায়ু তহবিলের অতীত রেকর্ড এবং তার সাথে দীর্ঘ সময়কালে ওঠা ইস্যুগুলোর দিকে তাকালে এই উপলব্ধি হয় যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রেরণের জন্য উন্নত দেশগুলোর ওপর দায়ভার চাপিয়ে নতুন তহবিল গঠনের সম্ভাবনা হতাশজনকই হবে। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু তহবিলে অর্থ প্রদানের দায়ভার বেসরকারি ক্ষেত্রগুলোর ওপর চাপানোর দিকে সংকেত দেওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ন্যায় কিভাবে অর্জিত হবে তা যথেষ্ট কৌতূহলের সৃষ্টি করে। একইভাবে, সিওপি সম্মেলনের শেষ দিন ১৮ নভেম্বর খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সমস্ত ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধাপে ধাপে তুলে দেওয়ার প্রস্তাবকে গ্ৰহণ করতে পারেনি। এই প্রস্তাব উত্থাপন করে ভারত এবং তাতে সমর্থন জানায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও অন্য কয়েকটি দেশ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটানাগুলোর প্রতিক্রিয়া বেড়ে চলায় সারা বিশ্বের কাছে এটা স্বীকার করে নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ যে, তেল ও কয়লা-সহ জীবাশ্ম জ্বালানিগুলোর মধ্যে গ্ৰিনহাউস গ্যাস আছে এবং পরিমণ্ডলে গ্ৰিনহাউস গ্যাসের জোগানে সেগুলো অবদান রাখে। এর পরিবর্তে সিওপি ২৭’এর চূড়ান্ত রিপোর্টের খসড়ায় গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তির পুনরাবৃত্তি করা হয় — “অপ্রতিহত তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পকে ‘ধাপে-ধাপে কমিয়ে আনা’ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অফলদায়ক ভর্তুকিকে ‘ধাপে-ধাপে বাতিল করা’ ও অপচয় রোধ করার পদক্ষেপকে ত্বরান্বিত করতে হবে।” এটা আবার জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে গ্ৰিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মোকাবিলার দায়ভার উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর ঘাড়ে পাচার করতে চায়। এটা দুঃখজনক যে, এবারের সিওপি ২৭-সহ রাষ্ট্রপুঞ্জের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনার ধারাটা এই বোধকেই শক্তিশালী করছে যে, প্রশমন ও খাপ খাওয়ানোর বোঝাটা দরিদ্রদেরই বহন করতে হবে।
জলবায়ু তহবিলের রাজনীতি এবং তহবিলে অর্থ জোগান প্রক্রিয়ার বেসরকারিকরণের আমেরিকার প্রয়াস
২০০৯ সালে কোপেনহাগেনে সিওপি ১৫ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তার লক্ষ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। উন্নত যে দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে অনেক বেশি গ্ৰিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে এসেছে তাদেরই এই তহবিলে অর্থ জোগানোর কথা ছিল। তবে, জলবায়ু তহবিলের বর্তমান অবস্থা একেবারেই শোচনীয়, কেননা, যে দেশগুলো তহবিলে অর্থ জোগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা হয় অর্থ চেপে রেখেছে, আর না হয় দায়কে এড়িয়ে গেছে। উন্নত দেশগুলো একদিকে জলবায়ু তহবিলে অর্থ দেয়নি, অন্যদিকে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি গ্ৰিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলোর অন্যতম তারা এখন জলবায়ু তহবিলে অর্থ জোগান প্রক্রিয়ায় বেসরকারিকরণের কথা বলছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন সিওপি ২৭ সম্মেলনে তাঁর বক্তৃতায় জলবায়ু তহবিলে অর্থ জোগানোর ভার বিনিয়োগের মাধ্যমে বেসরকারি ক্ষেত্রের ওপর ন্যস্ত করার অভিমত দিয়েছেন। এটা একেবারেই বিপর্যয়কর প্রস্তাব, কেননা এটা দেখাচ্ছে যে উন্নত দেশগুলো কোনো দায়ই ঘাড়ে নিতে চায় না এবং তারা বরাবর যা করে এসেছে সেটাই করতে চায়। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক চুক্তিতে কোনও বেসরকারি সংস্থাকে দায়বদ্ধ করা যাবেনা এবং জলবায়ুর জন্য অর্থ মুনাফা অর্জনের কোনও প্রকল্প নয়, তা অর্থ প্রদান, খাপ খাওয়ানো এবং লাঘব করার মাধ্যমে ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিবিধানের জন্য আবশ্যক। খরা, ঘুর্ণিঝড়, বন্যা ও অন্যান্য চরম প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর শুধু বৃদ্ধিই ঘটেনি, সেগুলো ধ্বংসাত্মক হয়ে দেখা দিচ্ছে এবং পৃথিবীর জলবায়ুর পরিপ্রেক্ষিতে স্থায়ী পরিঘটনা রূপে প্রতিপন্ন হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রাজিলের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বোলসোনারো ও অন্যান্য যে নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে প্রকৃতিকে আরও শোষণের কর্মনীতি নিয়েছিলেন, তাঁরা জনগণের রায়ে পরাজিত হয়েছেন। যে নরেন্দ্র মোদী অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়নি, মানুষের ঠাণ্ডা সহ্য করার ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, সেই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলো ঔদ্ধত্যের সঙ্গে পরিবেশ ও জলবায়ুর অনিষ্টকারী নীতি অনুসরণ করে চলেছে। উদাহরণ হিসাবে এখানে উল্লেখ করা যায়, বিজেপি নেতৃত্বাধীন মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার বাক্সওয়াহায় হীরা খনন প্রকল্পের জন্য আদিত্য বিরলা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন এসেল মাইনিং’কে দু’লাখেরও বেশি গাছ কাটার অনুমতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আর বন্যপ্রাণ স্ট্যান্ডিং কমিটির জাতীয় বোর্ড ডেহিং ফাটকি হাতি সংরক্ষিত বনের ৯৮.৫৯ হেক্টার জমি কয়লা প্রকল্পে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। ঐ বোর্ড খনন কাজের জন্য প্রস্তাবিত সালেকি সংরক্ষিত বনের ৫৭.২০ হেক্টার জমি ব্যবহারের অনুমোদন ইতিমধ্যেই দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় বিশ্বের নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতা কতটা অসার তা বারবারই উন্মোচিত হয়ে গেছে, তাঁরা ঐতিহাসিকভাবে অধিক নিঃসরণকারীদের দায়বদ্ধ করতে আগ্ৰহী হননি, অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটতে না দেওয়ার নীতির বিকাশ ঘটাতেও তাঁরা অক্ষম হয়েছেন। এখন আমরা যেমন দেখছি, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় সেই খণ্ড খণ্ড নীতি গ্ৰহণের দৃষ্টিভঙ্গি সংকটের সমাধানে সক্ষম হবে না, বিপরীতে তা বিশ্বের দরিদ্র, প্রান্তিক অবস্থানে থাকা ও অসহায় জনগণের জীবনকে সমস্যাসংকুল করে তুলবে।
– এন সাই বালাজি
(লিবারেশন, ডিসেম্বর ২০২২ সংখ্যা থেকে)
=== 000 ===