দেশের স্কিম কর্মীরা, আশা-মিড ডে মিল-অঙ্গনওয়াড়ি ও অন্যান্য কর্মীরা নামমাত্র ভাতা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ও অমর্যাদাকর পরিবেশে দিনের পর দিন কাজ করে আসছেন। এআইসিসিটিইউ ভারতের স্কিম কর্মীদের মর্যাদা ও ন্যায়ের দাবিতে দেশব্যাপী প্রচার অভিযান শুরু করেছে, তাঁদের সাংবিধানিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি তুলে ধরেছে। এরই অঙ্গ হিসাবে, দিল্লীর বুকে, ২১ নভেম্বর ২০২২ সংসদ অভিযানের ডাক দেয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার স্কিম কর্মী এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে শামিল হন।
এআইসিসিটিইউ’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাজীব ডিমরি ওই সভায় বলেন, “স্কিম কর্মীদের আজ পর্যন্ত সরকারি কর্মীর মর্যাদা দেওয়া হল না। এটা গুরুতর অন্যায়। অবিলম্বে এর অবসান ঘটাতে হবে।”
সারা ভারত স্কিম কর্মী ফেডারেশনের জাতীয় আহ্বায়ক শশী যাদব বলেন “দৈনিক কাজের সময়সীমা নির্দিষ্ট করা উচিত, কর্মস্থলে যৌন হেনস্থা ঠেকাতে জেন্ডার সেল গঠন করা উচিত।”
স্বেতা রাজ, দিল্লী আশা কামগর ইউনিয়নের (এআইসিসিটিইউ) সাধারণ সম্পাদক আশা কর্মীদের যন্ত্রণা ও বিপন্নতার নানা দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছুদিন আগে ভারতের আশা কর্মীদের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য কাণ্ডারি’র সম্মানে ভূষিত করে। কিন্তু, এদের না আছে সম্মানজনক মজুরি, না আছে কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে তাঁরা প্রায়শই নানান হেনস্থার সম্মুখীন হন। অতিমারীর সময়ে নিজেদের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে অনেক আশা কর্মীর মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁদের পরিবারকে দেওয়া হয়নি ক্ষতিপূরণ।”
বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে যে দাবিগুলো উঠে আসে, তা হল –
বিশ্বাসঘাতক মোদী সরকার এবং তৃণমূল সরকারের বঞ্চনা ও প্রতারণার বিরুদ্ধে
ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন জয়ী হয়েছে। কিন্তু চলমান কৃষক সংগ্রাম জারি আছে। চরম মিথ্যাচার, ঘৃণাপ্রচার ও সন্ত্রাসের উপর নির্ভর করে মোদী সরকার যে কর্পোরেট ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন নামিয়ে এনেছে তার বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলন। জাতপাত, ধর্মীয় পরিচিতি, রাজনৈতিক দলীয় মতভেদের ঊর্ধ্বে উঠে অভূতপূর্ব কৃষক ঐক্য, তার সাথে গ্রামীণ গরীব মানুষের জোট, শ্রমিক শ্রেণী ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় সমর্থন সব মিলে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল গৈরিক ষড়যন্ত্রের জাল। জনশক্তির সেই জাগরণের কাছে উদ্ধত শাসক মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। স্থগিত রাখা হয়েছিল কর্পোরেট স্বার্থবাহী তিন কৃষি-আইন।
কিন্তু যে লিখিত প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে নজীরবিহীণ কৃষক আন্দোলন দিল্লীর রাজপথ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, প্রায় ১০ মাস হয়ে গেল তার কোনও দাবি সরকার আজও পূরণ করেনি। দিল্লীর কৃষক আন্দোলন চলাকালে ৯ ডিসেম্বর ২০২১ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কৃষি ও কৃষক কল্যান দপ্তরের সচিব সঞ্জয় আগরওয়াল এক চিঠির মাধ্যমে সংযুক্ত মোর্চার নেতৃবৃন্দকে আশ্বাস দেন কৃষক আন্দোলনের মূল মূল দাবিগুলি মেনে নেওয়া হবে। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে এক কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাতে সরকারের তল্পিবাহক এবং কৃষক আন্দোলন বিরোধিতা করা কয়েকটি তথাকথিত কিষাণ সংগঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রেখে কিষাণ মোর্চার প্রতীকী অংশগ্রহণের কথা জানানো হয়। কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ এই শঠতামূলক প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের লিখিত প্রতিশ্রুতি ছিল বিদ্যুৎ আইন ২০২২ সংশোধনী বিল আপাতত স্থগিত রাখা হবে। এটা নিয়ে কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করা হবে। কিন্তু দেখা গেল এই বিল লোকসভায় পেশ করে দেওয়া হল। ঋণমুক্তি নিয়ে সরকারের আদৌ কোনো ভাবনাই নেই। সরকার ক্রমশ এগিয়ে চলেছে খাদ্যনিরাপত্তাকে ধ্বংস করার পথে। এমএসপির সাথে যা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সম্প্রতি রেশনে গম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আইনি জটিলতায় বহু সংখ্যক গরিব মানুষকে গণবণ্টন থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের ভূখা মারার চক্রান্ত চলছে। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন না হওয়ার কারণে কৃষকরা চরম লোকসানে ঋণগ্রস্ত। দেশজুড়ে কৃষকের আত্মহত্যা বেড়ে চলেছে। ঘনঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন। সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। সার, বীজ, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, সেচ সহ কৃষি উপকরণের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কর্পোরেটদের জন্য লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মুকুব-কর ছাড়, অথচ কৃষকদের ভর্তুকি বা কৃষি পরিকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ ক্রমশ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ১০০ দিনের কাজ নেই, লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের মজুরি বকেয়া। বনাঞ্চল আইন পাল্টে দিয়ে আদিবাসী জনগণের অধিকার হরণ করে তাঁদের জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হচ্ছে।
এভাবে ঘুরপথে নয়া কৃষি-আইন চালু করার লক্ষ্যে মোদী সরকার এগিয়ে চলেছে।
এই বিশ্বাসঘাতকতার মুখোশ খুলে দিয়ে আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২২ দেশব্যাপী রাজভবন অভিযানের কর্মসূচি নিয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। দু’বছর আগে এই দিনেই কৃষক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। এদিন সারা দেশে সমস্ত রাজ্যের রাজধানীতে লক্ষ লক্ষ কৃষক, কৃষিমজুর, শ্রমজীবী মানুষ সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপালের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কৃষকদের বকেয়া দাবিগুলি পেশ করে হুশিয়ারী জানাবে। এই প্রক্রিয়ায় দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা সারা দেশ জুড়ে সংগঠিত করার প্রয়াস চালাবে পাঁচশোরও বেশি কিষাণ সংগঠনের সমন্বয়কারী মঞ্চ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। এর আগে বিভিন্ন সময়কালে কৃষক আন্দোলন রাজ্য, জেলা বা বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে, আলোড়ন সৃস্টি করেছে। কিন্তু এই প্রথম এক সাধারণ দাবিসনদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় স্তরে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সামনে এসেছে। কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ একে কৃষক আন্দোলনের এক পূনরুজ্জীবন বলে অভিহিত করছেন। কেন্দ্রীয় দাবিসনদের মধ্যে রয়েছে, এমএসপি গ্যারান্টি আইন, ঋণমুক্তি, কার্যকরী ফসল বীমা, বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার, মাসিক ৫ হাজার টাকা কৃষক পেনশন, লখিমপুর খেরীতে কৃষক হত্যাকারী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রের শাস্তি, কৃষক আন্দোলনের কর্মীদের ওপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, ৭৪০ জন শহীদ কৃষকদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা প্রভৃতি।
রাজভবন অভিযান কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধেও কৃষকদের দাবিগুলি তুলে ধরা হবে। এজন্য পৃথকভাবে এক স্মারকলিপি জমা দেওয়া হবে। কৃষি রাজ্য তালিকাভুক্ত, তাই এপ্রশ্নে রাজ্য সরকারের বড় দায় রয়েছে। কেন্দ্র ২৩টি ফসলের এমএসপি নির্ধারণ করে থাকে। এর বাইরে এই রাজ্যে বহু ধরনের ফসল উৎপাদন হয়, বিশেষত রাজ্যের আলু ও সব্জি চাষিরা কোনও সরকারি দর পায় না। পর্যাপ্ত হিমঘর না থাকায় প্রায় ৪০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়। গত ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য এমএসপি আইন চালু করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটা খসড়া বিল পাঠানো হয়। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোন হেলদোল নেই। ফসলের সরকারি ক্রয় বা বিপনন থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নেওয়ার কারণে রাজ্যে ধান পাট আলু সব্জি চাষিরা চরম লোকসানে। এদিকে গ্রামে কোনও কাজ নেই। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে মজুরদের কাজ জোটে বছরে ৩০/৩৫ দিন। দলে দলে গ্রামীণ যুব শক্তি বাইরে চলে যাচ্ছে। এরাজ্যে কোথাও সরকার নির্ধারিত মজুরি কার্যকর হয় না। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা সহ গ্রাম উন্নয়নের টাকা নিয়ে চলছে সীমাহীন দুর্নীতি-দলবাজি-প্রতারণা। কৃষিকাজে সহায়তায় সমবায়গুলি বা পঞ্চায়েতের কোনও ভূমিকা নেই। সরকারি উদ্যোগে সার বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চলছে খোলাখুলি সারের কালোবাজারি মজুতদারী। এই সমস্ত জ্বলন্ত ইস্যুগুলি রাজভবন অভিযানে তুলে ধরা হবে।
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর ২০২২ দলমত নির্বিশেষে দেশের সমস্ত লোকসভা সদস্যদের কাছে এই দাবিসনদ পৌছে দেওয়া হবে যাতে পার্লামেন্টের আগামী শীতকালীন অধিবেশনে তারা সেটি উত্থাপন করেন। দেশের অন্নদাতাদের জীবন-মরণের এই দাবিগুলি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটা কেবল কৃষক প্রশ্নই নয় এরসাথে দেশের খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এটা দেশের ব্যাপক জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের প্রশ্ন। তাই বিভিন্ন গণসংগঠন, গণতান্ত্রিক শক্তি ও ব্যাক্তিবর্গকে এই কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
দুয়ারে সরকারের চিল-চিৎকারেও চাপা দেওয়া গেল না ফের আলু চাষির আত্মহত্যার বেদনার্ত কাহিনী। অল্প দিনের ব্যবধানে রাজ্যের খাদ্যগোলা হিসাবে খ্যাত বর্ধমান জেলায় এক সপ্তাহের মধ্যে দু’দুজন আলুচাষির মৃত্যুর খবর এল। সুদ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পর দেনায় জর্জরিত আলু চাষি সঈদ আব্দুল মোমিন কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন। হঠাৎ খোলা বাজারে আলুর দাম হুহু করে নীচে নেমে যাওয়ায় আজ আলু ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত।
এই মরশুমে আলুর দাম সর্বনিম্নে ঠেকেছে — অতীতে যা কখনও ঘটেনি। প্রথম দিকে ৫০ কেজি বস্তা পিছু দাম ছিল ৮০০ টাকা, তার দাম কমতে কমতে এখন এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ টাকায়! নভেম্বরে যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ আলু হিমঘর থেকে খালাস হতো, এবার প্রায় ৫০ শতাংশেরও বেশি আলু এখনও মজুত রয়েছে হিমঘরে। আলুর দাম এতোই নিচে নেমেছে যে, চাষিরা আলু হিমঘর থেকে বার করছে না। সাধারণত, আলু হিমঘরে রাখার পর চাষি যে রসিদ পায়, সেটাই তারা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই সমস্ত মধ্যস্বত্বভোগীরা তখনই আলু হিমঘর থেকে বার করে বাজারে ছাড়ে যখন দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়। কিন্তু এবার প্রায় ৫০ শতাংশ আলু হিমঘরে মজুত থাকায় সেই সমস্ত মধ্যস্বত্বভোগীরা আলু চাষিদের কাছে থেকে রসিদ কিনছে না। এদিকে নতুন আলুও বাজারে উঠতে শুরু করেছে। ফলে, চাষিরাও পড়ল চরম বিপাকে। ধার দেনা করে চাষ করার পরও তা বিক্রি না হওয়ায় ঋণে জর্জর চাষি পরিত্রাণের পথ খুঁজতে আত্মঘাতী হচ্ছেন।
দুয়ারে সরকারের বিজ্ঞাপন এই সর্বনাশ থেকে চাষিদের বাঁচাতে পারছে না।
সঈদ আব্দুল তাঁর সাত বিঘা জমিতে আলু ফলায়, আর হিমঘরে জমা রাখে ২০০ বস্তা। অবশিষ্ট জমিতে তিনি আমন ধান রোপন করেন আর সুদ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৬ লক্ষ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু সেই আলু জমা রাখার পর যে রসিদ তিনি পেয়েছিলেন, তা কেনার লোক না পাওয়ায় ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। গতবছর থেকেই আলু চাষিদের বিঘা পিছু ৭০০ টাকা লোকসান হচ্ছে। খোলা বাজারে আলুর দাম ভীষণভাবে ওঠানামা করে। বাজারের অনিশ্চিয়তার এই নিয়তির উপরই নির্ভর করে চলেছে আলু চাষিদের ভবিতব্য।
এদিকে, রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে, ধান বিক্রি করতে হলে অনলাইনে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। এরাজ্যে সরকার ও তার প্রশাসনের সর্বাঙ্গে দুর্নীতির গভীর বিস্তারি শাখা প্রশাখায় কলেজ ভর্তি, আবাস যোজনা, নির্মাণ শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তিকরণ — সর্বত্র দুর্নীতির করাল গ্রাস, তা রুখতে পারেনি ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগীদের আগ্রাসী থাবা। এরফলে, প্রান্তিক চাষিদের নাম নথিভুক্তির জন্য একশ্রেণির দালাল গজিয়ে উঠবে, এমন আশঙ্কা বেশ কিছু মহল থেকে করা হচ্ছে। এই ফরমানের ফলে বাংলার অগুন্তি চাষির জমির নথি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ভোটার কার্ড ও আধার কার্ডের তথ্য একটি সরকারি দফতরে গচ্ছিত হবে। কালক্রমে এই সমস্ত তথ্য’র অপব্যবহার যে হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। রাজ্য সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করলেও মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা তার অধিকাংশটাকেই আত্মসাৎ করে ফেলে।
কৃষক সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের কাছে এমএসপি সহ বেশ কিছু প্রস্তাব কৃষকদের স্বার্থে পাঠিয়েছে। কিন্তু সেসব নিয়ে তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করার, তাদের পরামর্শ শোনার অবকাশ কোথায় মুখ্যমন্ত্রীর?
রাজ্যে কৃষি সংকটের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকলে আগামীতে ঘনিয়ে ওঠা প্রলয় যে বন্ধ হবে না, তা আমাদের সর্বোজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রীর জানা উচিত।
হিমাচল প্রদেশ, দিল্লী এবং গুজরাতের নির্বাচনী মরশুম হাজির হয়েছে আরও একবার। পরবর্তী বিধানসভা ও সরকার গঠনের জন্য হিমাচল প্রদেশের ভোট ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, দিল্লীর পুনর্গঠিত পুরসভা নিগম নির্বাচিত করতে ভোট গ্ৰহণ হবে ৪ ডিসেম্বর ২০২২ আর গুজরাত বিধানসভার নির্বাচন দু’দফায় অনুষ্ঠিত হবে ১ ও ৫ ডিসেম্বর ২০২২। তাদের শাসনে চলা চূড়ান্তরূপের কলঙ্কিত ও অকর্মন্য জমানাগুলোর রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠে বিজেপি আরও একবার মোদীকে দিয়ে চড়া মাত্রার প্রচারের ওপরই অবলম্বন করছে, এবং তাঁর দিক থেকে মোদীও জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচারকে তীব্রতর করে তুলতে নির্ভর করছেন তাঁর অনুগত ‘গোদি মিডিয়ার’ উপরই। আর এই প্রচার নির্বাচক মণ্ডলীর কাছে ক্রমেই আরও বেশি অপমানজনক এবং ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থার ভবিষ্যতের কাছে আশঙ্কাজনক হয়ে দেখা দিচ্ছে।
গুজরাতে মোরবি সেতুর ভেঙ্গে পড়াটা রাজ্যে বিজেপির দীর্ঘকালের শাসনের দুর্নীতিপরায়ণ এবং অবহেলাকারী চরিত্রকে সম্পূর্ণরূপে উন্মোচিত করে দিয়েছে, যে শাসনকে সংঘের প্রচার যন্ত্র তথাকথিত ‘উন্নয়নের গুজরাট মডেল ও সুশাসন’ রূপে ঢাক পিঠিয়েছে। গোদি মিডিয়া আনুগত্যের বশবর্তী হয়ে এই কেলেঙ্কারিটাকে আড়াল করে গেছে, আর তার বিপরীতে মোদীর মোরবি হাসপাতাল পরিদর্শনকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশন করেছে যেটাও আবার ছিল মোদীর নিজেকে জাহির করার এক নির্লজ্জ প্রয়াস। এর আগেও প্রচারের এক অপকীর্তির মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছিল যখন মোদীর এক ভুয়ো স্কুল পরিদর্শনের জালি ভিডিও তুলে ধরা হয়েছিল। আর প্রচারের এই ধারাটাকেই এখন নিয়ম করে তোলা হয়েছে, গুজরাত এবং হিমাচল উভয় রাজ্যেই এমন ভিডিওকে ভাইরাল করা হয়েছে যাতে দেখানো হয়েছে যে অ্যাম্বুলেন্সকে এগিয়ে যেতে দেওয়ার জন্যে মোদীর কনভয় দাঁড়িয়ে পড়ছে।
স্বৈরাচারী শাসককে সদয় ও পরদুঃখকাতর নেতা রূপে তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রচারের এই ঝড় কিন্তু মোদীর অঢেল প্রচার ক্ষুধাকে তৃপ্ত করতে পারে না। তিনি তাই আহত-সত্তার তাস খেলছেন এবং নিজের কদর বৃদ্ধি ও নিজেকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে নতুন-নতুন সুযোগ উদ্ভাবন করছেন। বিমুদ্রাকরণকে যুক্তিসম্মতভাবেই এতাবৎকালের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জালিয়াতি ও রাজনৈতিক চটকদারি বলা যায়; এই বিমুদ্রাকরণের ষষ্ঠ বার্ষিকী পূর্তিতে সাধারণ ভারতীয় জনগণ যখন স্মরণ করছিলেন তাঁদের ভোগ করতে হওয়া বিপুল যন্ত্রণা ও ক্ষতির আর ভারতকে চোকাতে হওয়া বিশাল অর্থনৈতিক মূল্যের মতো বিষয়কে, মোদী তখন আমাদের শোনাচ্ছিলেন যে, তাঁর সরকার কীভাবে প্রচারের চেয়ে সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ওপরই অগ্ৰাধিকার দিয়েছিল! আত্মমগ্ন ‘ক্যামেরাজীবী’ যে মোদী মাকে দেখতে গেলে বা মন্দির পরিদর্শনে গেলেও ছবি তোলার লোকেদের সঙ্গে নিয়ে যান এবং যিনি তাঁর ও তাঁর নিকটতম বস্তু ক্যামেরার মধ্যে চলে আসা যে কাউকে অভ্যাসবশত ঠেলে সরিয়ে দেন, সেই মোদীর কাছ থেকে আসা এইসব বিষয়ের চেয়ে অসত্য আর কিছু কী হতে পারে?
মোদী আর একবার আমাদের বলেছিলেন, কীভাবে তিনি তাঁর দিকে নিত্যই ধেয়ে আসা প্রচুর গালাগালিকে সহ্য করে তাদের পুষ্টিকর খাদ্যে পরিণত করতে শিখেছিলেন! এই কথাটা বলছেন এমন এক নেতা যিনি একেবারেই মৃদু সমালোচনাকেও সহ্য করতে অপারগ হওয়ার কুখ্যাতি অর্জন করেছেন, যিনি বিরোধী মত পোষণকারীদের জেলে পুরেছেন, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় যাঁর নেতৃত্বাধীনে সংঘটিত গুজরাত গণহত্যা সম্পর্কিত একটিমাত্র অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকার মাঝপথে ছেড়ে যাওয়ার কুখ্যাতি অর্জন করেছেন এবং ইতিহাসে ভারতের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী রূপে নথিবদ্ধ হবেন, যিনি যথার্থ কোনো সাংবাদিক সম্মেলন করেননি, শুধুই চিহ্নিত গোডি মিডিয়ার সাংবাদিকদের আগেই নির্ধারণ করে রাখা সাক্ষাৎকারে অনুমোদন দিয়েছেন! মাঝে-মাঝেই তাঁর জীবনকে বিপন্ন করে তোলা ষড়যন্ত্রের অভিযোগের উদ্ভাবন থেকে তথাকথিত ‘প্রাতিষ্ঠানিক অভিজাতদের’ ঘটানো ‘অবমাননার’ অভিযোগ আর এখন আবার দৈনন্দিন গালাগালির গালগল্প — মোদী এইভাবে আহত-সত্তার তাসটাকে নিখুঁতভাবেই খেলছেন।
হিমাচল প্রদেশে বিজেপি অভ্যন্তরীণ বিবাদে জর্জরিত, সঙ্ঘ-বিজেপি হাই-কম্যান্ডের সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিরিশটারও বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। এক বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রতি নরেন্দ্র মোদীর ফোনে আবেদন জানানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে মোদী প্রকাশ্যেই শ্রোতৃমণ্ডলীকে বলেন যে, বিধায়করা বিবেচ্য নয়, পদ্মর বোতাম টিপে জনগণকে মোদীকেই ভোট দিতে হবে। ক্ষমতার তামাম কেন্দ্রীকরণ এবং লাগামহীন ব্যক্তি পূজোর রাজনীতি এরচেয়ে প্রকটিত আর হতে পারে না।
জাতীয়তাবাদী উন্মাদনাকে উস্কিয়ে তুলে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্রতায় পর্যবসিত করে দৈনন্দিন জীবনের জরুরি ইস্যুগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টিকে বিক্ষিপ্ত করতে গোদি মিডিয়া তাদের চেষ্টায় কোনো খামতি রাখছে না। টি-২০ বিশ্বকাপ গোদি মিডিয়ার কাছে হয়ে উঠেছিল নিজেদের নিম্নতম স্তরে নামিয়ে আনার একটা সুযোগ! লিগ পর্যায়ের খেলায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ বলে উত্তেজনাপূর্ণ বিজয় থেকে শুরু করে মিডিয়া ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফাইনাল এবং স্বপ্নের সেই ফাইনালে পাকিস্তানের ওপর ভারতের গৌরবজনক বিজয়ের পূর্বাভাস নিয়ে অতিরঞ্জনে মেতে ওঠে, এবং উগ্ৰ-জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক ভাবনাকে তীব্রতর করে তুলতে পাকিস্তান দলকে অভিহিত করা হয় ‘বাবর সেনা’ রূপে। একটা চ্যানেল আবার ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে সেমিফাইনালের আগে জ্যোতিষীদের একটা দলকে হাজির করে যাদের সবাই ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, উত্তেজনাপূর্ণ লড়াইয়ের পর ভারত বিজয়ী হবে। ইংল্যান্ড ভারতকে দশ উইকেটে হারানোয় ম্যাচটা অবশ্য একেবারেই একপেশে হয়ে ওঠে!
ধর্মান্ধতা, ঘৃণা ও মিথ্যাচারের এই মাতামাতির মধ্যে আমরা এটুক আশা করতে পারি যে, হিমাচল প্রদেশ, গুজরাত ও দিল্লীর ক্ষুব্ধ জনগণ এই খেলাটাকে ধরে ফেলতে পারবেন এবং বিজেপির অপশাসনের অবসান ঘটাতে নিজেদের ভোটকে সফলভাবে প্রয়োগ করবেন।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৫ নভেম্বর ২০২২)
২০ নভেম্বর এআইসিসিটিইউ’র পঞ্চম উত্তর ২৪ পরগণা সম্মেলন। সম্মেলন স্থল : বোকে হল, নৈহাটি। পতাকা উত্তোলন করে এআইসিসিটিইউ’র ৫ম উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্মেলনের সূচনা করেন বর্ষীয়ান নেতা কমরেড নারায়ণ দে।
সম্মেলনের শুরুতে পর্যবেক্ষক এবং এআইসিসিটিইউ রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু বলেন, এই প্রথম দেশবাসী তথা শ্রমজীবী মানুষের ওপর একযোগে রাজনৈতিক, আর্থিক, আইনগত এবং শারীরিক হামলা চালানো হচ্ছে। আর সেটা চালাচ্ছে ফ্যাসিবাদী আরএসএস-বিজেপি সরকার। এই হামলাকে রুখতে হলে প্রথমে নিজেদের কারখানা ইউনিটগুলিকে শক্তিশালী করতে হবে। কমরেড বসু বলেন, লেবার কোডের মাধ্যমে যেমন সংগঠনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তেমনই ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতি ছড়িয়ে শ্রমিক-ঐক্য ভাঙার চেষ্টা চলছে। ১৯২১’র তৃতীয়বারের তৃণমূল সরকারও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারকে সংকুচিত করে চলেছে। রাজ্যের শ্রমনিবিড় দু’টি শিল্প — চা-বাগান ও চটকলে দীর্ঘদিন মজুরি-ভাতা নিয়ে কোন ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়নি। তিনি আরও বলেন, সংগঠনের বিস্তার ও ট্রেড ইউনিয়ন কাজের বৈচিত্র্যে বিশিষ্ট জেলা উত্তর ২৪ পরগণা। এখানে মিড-ডে-মিলের সংগঠন ও জমায়েত ক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে ভালো। তিনি জানান আগামী ২১ নভেম্বর দিল্লীর যন্তর মন্তরে প্রকল্পকর্মী ফেডারেশনের সদস্যরা সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে ধর্ণায় বসছেন। সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
এরপর ঘড়ি ধরে চলা সম্মেলনের ঠাসবুনোট কর্মসূচির ছোট্ট ফ্রেমে যেন ঐ পর্যবেক্ষণের বাস্তব প্রতিচ্ছবিই ধরা পড়েছে ঘুরে ফিরে। বর্ষীয়ান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ওমপ্রকাশ রাজভর হিন্দিতে এবং বিদায়ী জেলা সম্পাদক নবেন্দু দাশগুপ্ত বাংলায় প্রতিবেদন পাঠের পর একুশ জন প্রতিনিধি তার ওপর বক্তব্য রাখেন। তারআগে উত্তর ২৪ পরগণা সিপিআই(এমএল)-এর জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত সম্মেলনের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সংগঠনের গণতান্ত্রিক পরিসর, যা একটি বিপ্লবী সংগঠনের আত্মাস্বরূপ, তাকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে শক্তি বাড়িয়ে এআইসিসিটিইউ, সংগঠনের নিচ থেকে উপর সমস্ত স্তরের ভাবনায় কাজে মেলবন্ধন ঘটিয়ে, বিভিন্ন শিল্পের বিভিন্ন ধারার সংগ্রামের মধ্যে যোগসূত্রের মাধ্যমে একমুখী এক বলিষ্ঠ লড়াই গড়ে তুলে শ্রমিকদের উপর হামলার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তিনি বিপন্ন চটশিল্প, শ্রমিক ও একই সঙ্গে সঙ্কটে থাকা পাটচাষিদের সমস্যা প্রতিকারে ‘জুট বাঁচাও, জুট শ্রমিক বাঁচাও’ আন্দোলনকে তীব্র করতে আবেদন করেন। মিড-ডে-মিল আন্দোলনে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরামের সব বক্তাই জুট মিল শ্রমিকদের মজুরি চুক্তি না হওয়ার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দৈনিক ১,০০০ টাকা মজুরির দাবিও জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন মজুরি বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষা ও শ্রমিকের মর্যাদা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়াও ১২ মাসের কাজে ১০ মাসের ভাতা, ছাত্র পিছু অনেক কম রন্ধনকর্মী নিয়োগ, ৬০ বছর হলেই অবসরকলীন কোনও প্রাপ্য ছাড়াই বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে — এসব নানা সমস্যার কথা উঠে আসে।
ইটভাটা ইউনিয়নের নেতা দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলেন, সরকারি নীতির ফলে বেশিরভাগ ইটভাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইউনিয়ন প্রতিবছর সম্মানজনক মজুরি চুক্তি করতে সফল হয়েছে। কিন্তু সঙ্কট বাড়ছে উৎপাদন সামগ্রীর অভাবে। মাটি নেই, কয়লা নেই, বালি তোলা বন্ধ। মাটির ইটের জায়গা নিচ্ছে কর্পোরেটদের সিমেন্ট ইট। দু’একটা ভাটায় উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে সমস্যা রয়েছে।
নির্মাণ ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা অনুমোদিত সরকারি সুবিধাগুলো পুনরায় লাগু করা ও মজুরি বৃদ্ধির সংগ্রাম গড়ে তোলার আবেদন করেন। একদিকে মানুষের আর্থিক সমস্যার জন্য নির্মাণের কাজ কমে গেছে। অন্যদিকে সরকারি সব সুযোগ সুবিধা বন্ধ। নিয়মগুলোর জটিলতা বেড়েছে। ফলে সংগঠনকে টিঁকিয়ে রাখা ও বাড়ানো এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাশীপুর জিএন্ডএস (পার্মানেন্ট) ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রতিনিধি বলেন, ২০১৯ সালে প্রতিরক্ষা শিল্পকে ‘কর্পোরেশন’ করার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ৫ দিনের ধর্মঘটকে এআইসিসিটিইউ সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিল। এই প্রসঙ্গে প্রতিরক্ষা শিল্পের অন্যান্য সরকার স্বীকৃত ইউনিয়নের ভূমিকা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রদপ্তর দানবীয় এডসা আইন একবছরের জন্য চালু করেছিল, কিন্তু এখনও তা জারি আছে। ‘ওপেন ব্যালট’ মেম্বারশিপে লড়াকু ছোট ইউনিয়নগুলো স্বীকৃতি পাচ্ছে না ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি হতে পারছে না। তিনি আরও বলেন কর্তৃপক্ষ বলপূর্বক উৎপাদন ভিত্তিক মজুরি এবং আউটসোর্সিং’এর দিকে ঝুঁকছে, চলছে জবরেট কার্টেলমে্ন্টে সবের তীব্র বিরোধিতা করতে হবে।
ইস্টার্ন রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (এআইসিসিটিইউ ভুক্ত) প্রতিনিধি বলেন, সংগঠিত ও অসংগঠিত শিল্পের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সংগ্রামের মধ্যে মেলবন্ধন গড়ে তুলতে হবে। স্বাাধীনতার আগে রেল শ্রমিকরা চা, চট, বস্ত্র ইত্যাদি শিল্পের সংগ্রামের পাশে থেকেছেন। ১০ বছর পর কেন সম্মেলন হচ্ছে তার কারণ খুঁজতে হবে। রাজনীতিকরণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী থেকে দক্ষ সংগঠক গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। বিপন্ন পরিবেশ ও কর্মহীনতার জন্য সমাজে বেড়ে চলা অপরাধ নিয়ে ভাবতে হবে। বেসরকারিকরণ শুধুমাত্র রেলে নয়, সরকারি সব প্রতিষ্ঠানে হছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং ও ঠিকাদারি প্রথা চলছে। রেলের প্রতিটি বিভাগে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ হয়েছে, এর সংখ্যা ৮ লক্ষের মতো হবে। নৈহাটি, কাঁচড়াপাড়া ওয়ার্কশপে ঠিকা শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
সব শেষে বিদায়ী সম্পাদক বলেন সম্মেলনে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ক্ষেত্র থেকে উপস্থিত ছিলেন ১১৯ জন প্রতিনিধি। তিনি বলেন শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নের উপর যে হামলা নেমেছে তার বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীন কর্মসূচির পাশাপাশি যৌথ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। এছাড়াও ১৫টি দাবির কথা উল্লেখ করে, নিজের নিজের ক্ষেত্রে এই দাবিগুলো নিয়ে সোচ্চার হওয়ার জন্য আবেদন করেন।
পঞ্চম উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্মেলনে গৃহীত দাবিসমূহ।
১) কেন্দ্রীয় সরকার চার শ্রমকোড বাতিল কর।
২) রাজ্য সরকারের শ্রম কোড রুলস তৈরি করা চলবে না।
৩) ব্যাঙ্ক, রেল, প্রতিরক্ষা, বিএসএনএল সহ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে বেসরকারিকরণ করা বন্ধ কর।
৪) প্রতিরক্ষা শিল্পে দানবীয় ইডিএসএ বাতিল কর।
৫) রাজ্য সরকারি পরিবহনে ফ্রাঞ্চাইজি, ঠিকা প্রথা বাতিল কর।
৬) মিড-ডে-মিল কর্মীদের সরকারি কর্মী হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
৭) নির্মাণ ও পরিবহন শ্রমিকদের প্রকল্প কাটছাঁট করা চলবে না।
৮) সব সংগঠিত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে।
৯) মহিলা, পুরুষ সবাইকে সম কাজে সম বেতন দিতে হবে।
১০) কর্মস্থলে মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আইসিসি গঠন করতে হবে।
১১) অবিলম্বে চটকলের দাবি সনদের মীমাংসা করতে হবে।
১২) স্কুল নিয়োগে অভিযুক্তদের শাস্তি দাও, যোগ্যদের চাকরি দাও।
১৩) অবিলম্বে জুটমিল সহ বন্ধ কারখানা খোলা এবং মজুরি সহ সব ধরনের বকেয়া পরিশোধ করতে হবে।
১৪) অবিলম্বে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বর্ধিত ডিএ দিতে হবে।
১৫) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলুন।
সর্বসম্মতিতে নির্বাচিত ৫৩ জনের কাউন্সিল, ২৭ জনের কার্যকরী কমিটি এবং ১৪ জনের কার্যনির্বাহী কমিটি রাজ্য পর্যবেক্ষক ঘোষণা করেন। এরপর শ্লোগানের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
গত ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হল এআইসিসিটিইউ’র নবম কলকাতা জেলা সম্মেলন। সম্মেলনের সভাগৃহের নামকরণ হয় প্রয়াত পরিবহন কর্মী তপন সাউ’এর নামে, এবং মঞ্চের নামকরণ হয় প্রয়াত মিড-ডে-মিল কর্মী ভারতী ঘোষের নামে। সভার শুরুতে শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী সহ অন্যান্য প্রতিনিধিরা। রাজ্য সভাপতি ও পর্যবেক্ষক অতনু চক্রবর্তী ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইপোয়া’র পক্ষ থেকে চন্দ্রস্মিতা চৌধুরী এবং আইসা’র শুভাশিস।
এছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলা। স্কিম ওয়ার্কার ছিলেন ১১ জন (তাঁরা সকলেই মহিলা)। পরিচারিকা ২ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৮ জন, ডবলুবিটিসি নন পেনশনার্স এন্ড পেনশনার্স এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ৪ জন, হোসিয়ারীর পক্ষ থেকে ৪ জন, গ্যাস ১ জন। এছাড়াও ডবলুবিটিসি’র স্থায়ী শ্রমিকদের ইউনিয়ন থেকে ৫ জন, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির কন্ট্রাক্ট কর্মী ছিলেন ৩ জন, রিক্সা ২ জন। হকার ছিলেন ৫ জন, জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ১ জন, প্রেস শ্রমিক ১ জন এবং ১ জন উবের চালক। এবং বাকি সবাই বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংগঠকরা। উপরিউক্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা শ্রমিকগণ এবং তাঁদের সংগঠকদের মোট সংখ্যা ছিল ৭৫ জন। যাঁর মধ্যে ১৯ জন ছিলেন মহিলা। অর্থাৎ মোট জন্যসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশ মহিলা কর্মজীবী উপস্থিত ছিলেন সভায়। এছাড়াও এই সভায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরাও উপস্থিত ছিলেন।
এই সভা শুরু হয় রাজ্য সভাপতির বক্তব্য দিয়ে। তিনি দাবি রাখেন, কাতারে ফিফা বিশ্বকাপে কাজ করতে গিয়ে যেসব ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে, ভারত সরকার যেন তাঁদের নামগুলি পেশ করে এবং তাঁদের পরিবারগুলিকে যেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়। এছাড়াও তিনি বলেন, বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক ক্রমে ক্রমেই কমানো হচ্ছে। ক্যাজুয়াল কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। আগামীদিনের যে লেবার কোড লকডাউনের সময় পাশ হয়, তাতে স্থায়ী শ্রমিকদের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, মালিক পক্ষ শ্রমিককে যে কোনো মাইনের বিনিময়ে নিয়োগ করতে পারে। ট্রেড ইউনিয়নের কিচ্ছু বলার থাকবে না। অর্থাৎ কর্পোরেটদের হাতে ইন্ডাস্ট্রিগুলিকে তুলে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, লকডাউন চলাকালীন এইসব ইন্ডাস্ট্রিগুলির রোজগার লক্ষ কোটি কোটি টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে শ্রমিকদের অবস্থা ব্যাপকভাবে দারিদ্রসীমার নিচে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। বহু স্থায়ী কর্মচারীরা চাকরি হারিয়েছেন। তাই এর বিরুদ্ধে মানুষকে আরও সোচ্চার হতে হবে। লড়াই তো চলছে, এই লড়াই’এর প্রথম স্তরে যাঁরা লড়াই করছেন তাঁরা হলেন, স্কিম ওয়ার্কাররা (মিড-ডে-মিল, অঙ্গনওয়াড়ি এবং আশা)। এরপরে আছেন, সাফাই কর্মীরা। এবং তিন নম্বর হল কন্ট্রাক্ট ক্যাজুয়াল কর্মীরা। ফলত, এই তিনটি স্তরকে এক করার দায়িত্ব এআইসিসিটিইউ’র। মানুষের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ায় মানুষকে তাঁদের বাসস্থানে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এছাড়া আগে মানুষের কর্মক্ষেত্রগুলিতে দুর্ঘটনা ঘটতো এখন কর্মক্ষেত্রের পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় রাস্তা এমনকী বাড়িতেও (গিগ ওয়ার্কার ও প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার) যে দুর্ঘটনা ঘটছে, সরকারকে সেগুলোকে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা হিসাবে গণ্য কর্যে হবে। এই গিগ এবং প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কাররাও ইউনিয়ন করা শুরু করেছেন, তাই এই নতুন ক্ষেত্রটিকে জোর দিতে হবে। এছাড়াও সরকারি কর্মচারী যাঁরা পেনশন পাননি তাঁদের জন্যও নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
তারপর একে একে বক্তব্য রাখেন শ্রমজীবী কিছু মানুষ। তাঁরা নিজেদের অসুবিধের কথা উল্লেখ করেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বক্তার বক্তব্য আলোচনা করা হল। মিড-ডে-মিল কর্মী বাণী রায় বলেন, তাঁদের মাইনে বাড়াতে হবে। ৫০ টাকা প্রতিদিন। কী করে সম্ভব আজকের দিনে ওই কটা টাকা দিয়ে? দীর্ঘ ৯ বছর যাবৎ তাঁরা ওই একই মজুরিতে কাজ করে চলেছেন। তাই তিনি কথা দিয়েছেন এই সংগঠনের সঙ্গে তিনি আছেন। যখনই কোথাও ডাকা হবে, তিনি আসবেন। এরপর আইসিডিএস কর্মী ছন্দিতা ব্যানার্জী বলেন, তাঁদের কোনো ছুটি নেই। ওই কটা টাকা সম্মানী হিসেবে দিয়ে কিছু হয় না। কিন্তু তিনি আশা রেখেছেন ভালো কিছুর জন্য। এবং তিনি একটি গান শোনান তাঁর বক্তৃতা শেষে। পরিবহন শ্রমিক গৌরাঙ্গ সেন বলেন, মানুষের অনেক দাবি আছে। এবং এই দাবি রাখতে গেলে নিজেকে খুব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হবে। নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে। নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা পথ বাতলে দেবেন, এবং সেই মতো এগিয়ে গিয়ে লড়তে হবে। সবাইকে সংঘবদ্ধ হয়ে লড়তে হবে। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জয় ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার শ্রমিক, শম্ভু মন্ডল। তিনি বলেন, কারখানা থেকে ভিআরএস দিয়ে ছাটাই করার বিরুদ্ধে তাঁরা লড়াই লড়েন, মাত্র ১৪-১৫ জন শ্রমিক ছিলেন। কিন্তু শেষমেশ তাঁরা জয়লাভ করে। এবং এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে তাঁরা জিতেছেন। এবং তাই তাঁরা চেষ্টা করছেন সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর। এবং তিনি চান এই রকম সম্মেলন আরও হোক, এবং তিনি তাতে যোগদানে ইচ্ছুক। এরপর হকার ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শাহাবুদ্দিন বলেন, হকারদের ওপর যেভাবে পুলিশ অত্যাচার চালাচ্ছে, এর বিরুদ্ধে সবাইকে এক হয়ে লড়তে হবে। ২০-২৫ বছর ধরে তাঁদের এই লড়াই চলছে। তিনি এইসব সমস্যার থেকে মুক্তি চান। মিথিলেশ সিং উবের ড্রাইভার বলেন, সরকারি হোক বা বেসরকারি শ্রমিক সকলকে একসাথে মিলে লড়াই লড়তে হবে। এবং ধীরে ধীরে তিনি ট্রেড ইউনিয়নের কাজ শিখতে চান। এবং আরও অনেকে এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত ও আলোচনা করেন।
এই আলোচনার পর এআইসিসিটিইউ থেকে যে দাবিগুলি রাখা হয়, তা হল –
ক) সকলকে সংগঠিত করা।
খ) আগামী জাতীয় সম্মেলনের (সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ২০২৩) আগে কলকাতা জেলায় ৬০০০ সদস্য সংগ্রহ।
গ) কলকাতা জেলায় নূন্যতম ৩০ জনকে এআইসিসিটিইউ’র ক্যাডার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
ঘ) ইতিমধ্যে যে কয়েকটি জায়গা কাজের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে সেগুলির প্রতি জেলা কমিটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই আলোচনার শেষে ৫৬ জন ত্রিস্তরীয় সদস্য, ২৬ জন কার্যনিবাহী সদস্য এবং ১৩ জন অফিস বিয়ারার বা কার্যনির্বাহক সদস্য নির্বাচন করা হয়।
- অবন্তী ভট্টাচার্য
গত ৯-১০ নভেম্বর ২০২২ রাঁচির পুরনো বিধানসভা হলে ২ দিন ব্যাপি অল ইন্ডিয়া কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। শহীদদের স্মরণ করার পর, ঝাড়খন্ডের জনজাতির গণসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। উদ্বোধনী ভাষণ রাখেন এআইসিসিটিইউ’র সর্বভারতীয় সম্পাদক রাজীব ডিমরী। কর্মশালায় মোট ৫টি পেপার রাখা হয় –
এই পেপারগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। গ্রুপ ডিসকাশন হয় যা বিশেষ উল্লেখজনক।
ভারতবর্ষে নির্মাণ শিল্প একটি শ্রম-নিবিড় শিল্প যেখানে প্রায় ৪ কোটি নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিক দেশের জিডিপি অর্জনে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। ২০১৬ সালে আমাদের দেশে ১৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা হয়েছে। এবং আশা করা হচ্ছে আগামী ১০ বছরে ৮-১০ শতাংশ হারে এই শিল্পের বিকাশ হবে। নির্মাণ শিল্প মূলত দু’টি ভাগে বিভক্ত —(১) পরিকাঠামো, (২) রিয়েল এস্টেট। এই শিল্পে এখন দেশী-বিদেশী কর্পোরেটরা প্রবেশ করেছে। কিছু উদাহরণ — যেমন এলঅ্যান্ডটি, ডিএলএফ, এসএএফএএল, এসএভিভিওয়াই, এএফসিওএনএস। বিদেশি সংস্থার মধ্যে বিইসিএইচটিএএল (মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র), হুন্ডাই (জাপান), মিৎসুই (জাপান), ওবাইশি (জাপান), স্যান্ডেসা (সুইডেন), টারফেল হাউস (ইউকে), দুবাই পোর্ট ওয়ার্ল্ড। এছাড়াও আরো অনেক বড় বড় কোম্পানি এই শিল্পে যুক্ত আছে এবং রেডিমিক্স কোম্পানি গড়ে উঠেছে। যেখানে লক্ষ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিক কাজ করে, তাদের মধ্যে বড় সংখ্যক নির্মাণ শ্রমিক হল পরিযায়ী শ্রমিক। বড় বড় নির্মাণ শিল্পে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু ও স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ যেন এক মৃত্যু উপত্যকা। আইএলও’র রির্পোট অনুযায়ী এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রতিবছর এক লাখে ১২.৭ জন নির্মাণ শ্রমিক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এছাড়াও পেশাগত রোগে প্রতি বছরে লক্ষ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিক মারা যায় কর্তৃপক্ষের নির্মম অবহেলার জন্য। এদের থেকে কোনো সংগ্রামী ইউনিয়ন কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। যাই হোক, আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা হল, ১৯৯৬ সালে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য দুটো আইন হওয়ার পর তাঁদের অধিকার অর্জনে সংগঠিত করতে থাকি যারা মূলত স্বনিয়োজিত বা ছোট নির্মাণকাজে যুক্ত থাকতেন। পরবর্তীতে, ক্রমশ সামাজিক সুরক্ষা প্রদান হ্রাস পেতে পেতে ও সমস্ত কিছু অনলাইনে চালু হওয়ায় ইউনিয়নের ভূমিকা কমতে থাকে। বর্তমানে শ্রমিকদের কাছে ইউনিয়ন সামাজিক সুরক্ষা আদায়ের মাধ্যম (এজেন্ট) হিসাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের নেতাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে একমাত্র নির্মাণ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা আদায় করার জন্য ফর্ম ফিলাপ করা ও সরকারি দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা। সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি, অনলাইন চালু হওয়া ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার খর্ব হয়ে পড়ায় নির্মাণ শ্রমিকদের জমায়েত কমতে শুরু করেছে। শ্রেণী-চেতনা ও শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে উঠছে না।
বর্তমানে ৪টি লেবার কোড হওয়ার পর যে যে পরিবর্তন এসেছে তাকে অনুধাবন করতে না পারলে পুরনো ধারায় কাজের অনুশীলন থাকলে ইউনিয়নে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না ও গতিরুদ্ধতায় পড়ে যাবে। নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদে নথিভুক্ত ৪ কোটি নির্মাণ শ্রমিক সহ সমগ্র শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার ১৫টি আইন ছিল তা কেন্দ্রীয় সরকার ১টি লেবার কোডে অন্তর্ভুক্ত করছে। সামাজিক সুরক্ষা ২০২০ পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কাজের অবস্থার কোড ২০২০, নির্মাণ শ্রমিকদের আইন ১৯৯৬ ও সেস আইনের ওপর বড় ধরনের আঘাত নামিয়ে এনেছে। সামাজিক সুরক্ষা এবং পেশাগত সুরক্ষা, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের অবস্থার কোডে ধারা-১ ও সামাজিক সুরক্ষা কোড নির্মাণ শ্রমিকের সংজ্ঞা নির্ধারণে ভ্রম তৈরি করেছে। আগে ছিল, যে শ্রমিক বছরে ৯০ দিন নির্মাণ কাজে যুক্ত থাকবে তাকেই নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। বর্তমান কোডে বলা হচ্ছে, যে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে ১০ জনের কম শ্রমিক কাজ করবে তাদের নির্মাণ শ্রমিক নয়, অসংগঠিত শ্রমিক হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। এছাড়াও নানাভাবে নির্মাণ শ্রমিকদের অসংগঠিত শ্রমিককে পরিণত করার নানা ফাঁকফোকর বর্তমান কোডে আছে। সুতরাং বর্তমান কোড অনুযায়ী যারা নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে নির্ধারিত হবেন তারাই নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ থেকে সামাজিক সুরক্ষা পাবে। ফলে আমাদের কাজের ৯০ শতাংশ নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের ই-শ্রম একটি নোডাল এজেন্সি মারফত সমস্ত সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করার কথা বলে, বিভিন্ন আইন মোতাবেক নির্মিত বোর্ডগুলো যেমন — নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ, বিড়ি সহ অন্যান্য বোর্ডকে অকার্যকর করতে চাইছে। বোর্ডগুলোতে গচ্ছিত হাজার হাজার কোটি টাকা শেয়ার মার্কেট বা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রদান করে কর্পোরেটদের শক্তি যোগাতে চাইছে। সামাজিক সুরক্ষার দায় মালিক ও সরকার কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে বিমা কোম্পানির হাতে তুলে দিতে চাইছে। শ্রমিকরা পয়সা না দিতে পারলে সামাজিক সুরক্ষা পাবে না। যখন বোর্ড’ই থাকবে না তখন সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকরা অনথিভুক্ত হয়ে পড়বে। সামাজিক সুরক্ষা পাওয়া অন্তরায় হয়ে যাবে। সুতরাং ই-শ্রমে আমাদের নির্মাণ শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করাটা একটা আবশ্যিক কাজ হয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে ১০ নভেম্বর ২০২২ দেশব্রতী পত্রিকায় এআইসিসিটিইউ’র সর্বভারতীয় সভাপতি ভি শংকরের লেখাটা সমস্ত সংগঠকদের অবশ্যই পাঠ করে নিতে হবে।
বর্তমানে ফ্যাসিষ্ট বিজেপি সরকার যখন ৪টি লেবার কোড মারফত শ্রমিকদের অধিকার হরণে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এপ্রশ্নের জেলা ও ব্লক কমিটিগুলোকে শক্তিশালী ও নিয়মিতকরণ করতে হবে। জিডিপি বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে বড় বড় নির্মাণ শিল্প মূল শিল্প হিসাবে দেখা যাচ্ছে। সুতরাং শ্রমিকদের অধিকার হরণে কেন্দ্রীয় সরকারের যে ভয়ংকর আক্রমণ শ্রমিকদের উপর নামিয়ে এনেছে তাকে মোকাবিলা করতে আমাদের ইউনিয়নের কাজকেও বড় বড় নির্মাণ শিল্পে মনোনিবেশ করতেই হবে। কাজটা কঠিন কিন্তু এই কাজটা আজকের সময় আবশ্যিক। ই-শ্রমের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার যখন সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিককে প্রায় ১২৬ ধরনের শ্রমকে একটা প্ল্যাটফর্মে আনতে চাইছে, তখন আমাদেরও নয়া ফোরাম তৈরি করে সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে হবে। সামাজিক সুরক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করা ও সরকার ও মালিকদের দায় নিতে বাধ্য করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্মাণ শ্রমিকদের আইনি অধিকার ও নির্মাণ শ্রমিকদের নতুনভাবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা রচিত হচ্ছে সে ব্যাপারে নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠকদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করতে রাজ্যস্তরেও উপরোক্ত ৫টি পেপার নিয়ে ওয়ার্কশপ (কর্মশালা) সংগঠিত করতে হবে। আসুন, পুরনো শক্তির উপর ভর করে নতুন দিশায় পথ চলা শুরু করি। শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তুলেই সমানাধিকার, সামাজিক সুরক্ষা, মর্যাদা, সম্মানজনক মজুরি আদায় করতে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ফ্যাসিষ্ট সরকারকে উৎখাত করার কাজ সুনিশ্চিত করে তুলি।
- কিশোর সরকার, সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও অন্যান্য নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন
১৫ নভেম্বর বিরসা মুণ্ডা জন্মজয়ন্তিতে বামনী ঝর্ণা ভ্রমণক্ষেত্রে প্রবেশপথের কাছে জমায়েত হয়েছিলেন শত শত গ্রামবাসী। তাঁরা ফিরে নিতে চান বনভূমির ওপর তাঁদের অধিকার। এই অধিকার আইনসিদ্ধ। ২০০৬ সালের বনাধিকার স্বীকৃতি আইন বনসম্পদের ওপর বন ও বনসংলগ্ন গ্রামগুলির আদিবাসী ও অন্যান্য পরম্পরাগত অধিবাসীদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকার স্বীকার করেছে এবং এই অধিকার বাস্তবায়িত করার কথা বলেছে। তাঁদের যাপন জীবন-জীবিকা এই পাহাড় অরণ্য ঝোরার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। বরুয়াজারা, দুলগুবেড়া, বাঁধঘুটা গ্রামের মানুষেরা গ্রামসভা গঠন করে এই আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কর্মসূচি নিয়েছেন। তাঁরা এই ঝর্ণা অরণ্য ও পাহাড়কে বাঁচিয়ে রাখতে চান। বাঁচাতে চান এক মেগা প্রজেক্টের গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে। বিরসা মুণ্ডা জন্মজয়ন্তিতে তাঁরা সমষ্টিগত বনাধিকার ঘোষণা করতে বামনী ঝর্ণার প্রবেশপথে একটি বোর্ড লাগিয়ে দেন। পুরুলিয়া জেলার বাঘমুণ্ডি ফরেস্ট রেঞ্জের সরকারি সাইনবোর্ডের নিচে তাঁরা এই বোর্ডটি টাঙিয়ে দেন। ভ্রমণপিপাসু মানুষকে স্বাগত জানিয়ে এই বোর্ডে তাঁরা বামনী ঝর্ণাকে ‘গ্রামসভা পরিচালিত দর্শনীয় স্থান’ বলে বর্ণনা করেন।
বাঘমুণ্ডি ফরেস্ট রেঞ্জের অফিসার গ্রামসভাকে বেআইনি বলে সাব্যস্ত করে, কর্মসূচিতে বাধা দেয় এবং গ্রামসভার সংগঠক আদিবাসী নেতাদের ১১ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করে। তিনি আদিবাসীদের প্রতি জাতিবিদ্বেষী কটূক্তিও করেন বলে অভিযোগ।
অযোধ্যা অরণ্যপাহাড়ের গ্রামবাসীদের এই লড়াই ২০১৭ সাল থেকে দানা বাঁধতে শুরু করে। তাঁদের জীবন-জীবিকার ভিত্তি এই অরণ্য পাহাড় ঝর্ণার ওপর প্রত্যক্ষ আগ্রাসন অবশ্য তারও এক দশক আগে নেমে এসেছিল। ২০০৮ সালে পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট (পিপিএসপি) উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে বয়ে চলা পাহাড়ি ঝোরা বামনী নদীকে বেঁধে দেয় এই প্রকল্প। ২,৯৫৩ কোটি টাকা খরচে জাপানি কোম্পানিকে দিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হয়। সাতটি টিলার বারোশ একর বনভূমি তথা সাড়ে তিন লক্ষ বৃক্ষ বিলুপ্ত হয়। গ্রামবাসীরা প্রথমে বিরোধ করেছিলেন, কিন্তু প্রতিরোধ দানা বাঁধেনি। তৎকালীন সরকার তাঁদের বুঝিয়েছিল যে এই প্রকল্পের ফলে তাঁদেরও অনেক উন্নতি হবে। বলেছিল, পিপিএসপি’র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত সব গ্রাম বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পাবে, যুবকেরা চাকরি পাবে, জলাধারের জলে চাষবাসের চেহারাও বদলে যাবে। বলাই বাহুল্য, স্থানীয় কারোরই চাকরি হয়নি। প্রকল্পে সঞ্চিত বিদ্যুৎশক্তি চলে যায় আরামবাগ ও রাঁচি শহরে। বামনীর জলধারায় পুষ্ট চাষ ঝাড় খেয়েছে। ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজন প্রকল্পে যে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো হয়েছে তা মাটির জলতলকে আরও শুকিয়ে দিয়েছে। প্রকল্পের নির্মাণকাজে বিশাল পরিমান জমির উপরিতলের মাটি চলে গেছে। সবুজ এলাকা রুক্ষভূমিতে পর্যবসিত হয়েছে। হাতির পাল খাবারের সন্ধানে নেমে আসছে সমতলের গ্রামগুলিতে। আর বামনী নদীবাঁধ পিকনিক স্পট হয়ে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য গৃহপালিত ও অন্যান্য জীবকুলের মারাত্মক ক্ষতি করছে। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে চলতে চলতেই ২০১৫ সালে যখন আরও একটি প্রকল্প এসে হাজির হয় তখন প্রতিরোধ গড়তে তৎপর হন গ্রামবাসীরা। ‘ঠুড়গা পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট’ বা টিপিএসপি। এবং সেখানেই শেষ নয়, লাইনে আছে আরও দুইটি পিএসপি কাঠালজল পিএসপি এবং বান্দু পিএসপি।
বামনী ঝোরার পিপিএসপি থেকে ঠুড়গা নদীর টিপিএসপি-র দূরত্ব মাত্র আড়াই-তিন কিলোমিটার। সব মিলিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের এই চারটা প্রকল্পের বিধ্বংসী প্রভাব যে কতটা বিপর্যয় তৈরি করবে তা জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই আঁচ করতে পারছেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু সরকার প্রকল্প নিয়েছে গ্রামবাসীদের সাথে আলোচনা না করেই। বনাধিকার আইন অনুযায়ী এই অরণ্যকে অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন আদিবাসী গ্রামগুলির সমস্টিগত সাধারণ সম্পত্তি হিসাবে মান্যতা দেওয়ার কথা। বনভূমিতে যে কোনও প্রকল্প ছাড়পত্র পেতে গ্রামগুলির গ্রামসভা ডেকে গ্রামের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত ৫০ শতাংশের অনুমোদন দরকার এবং সম্মতিদাতাদের ন্যুনতম এক তৃতিয়াংশ হতে হবে মহিলা। বলাই বাহুল্য, সরকার এসব কিছুই করেনি। গ্রামবাসীরা এই আইনকে হাতিয়ার করে লড়াইয়ের আশায় বুক বাঁধে। ২০১৮ সালে কলকাতা হাইকোর্টে গ্রামবাসীদের করা মামলায় সরকার ১৭টি গ্রামের মধ্যে মাত্র দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতের (গ্রামসভা নয়) ‘অনুমোদন’ দেখাতে পারে যার মধ্যে ১৬০০ জনসংখ্যার আযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে মাত্র ২৪ জনের স্বাক্ষর ছিল, বাঘমুণ্ডির ক্ষেত্রে কোনও স্বাক্ষরই ছিল না। হাইকোর্ট গ্রামবাসীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে টিপিএসপি স্থগিত রাখার আদেশ দেয়। সরকার ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানায়। আদিবাসী নেতৃত্ব গ্রামে গ্রামে গ্রামসভা গঠনের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যায়। বড় বড় জমায়েত করে বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও প্রতিবাদপত্র জমা দেওয়া চলে। প্রতি পদে পদেই পুলিশী নিপীড়নের শিকার হতে হয় আন্দোলনকর্মী তথা আদিবাসী নেতাদের। এমনকি গ্রামে গ্রামে ‘জনসচেতনতা অভিযান’ কর্মসূচির সংগঠকদের বিরুদ্ধেও করোনাকালীন বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে কেস দেওয়া হয়।
বামনী ঝোরা রিক্লেইম করার কর্মসূচি বনাধিকার ও পরিবেশ-অধিকার আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করল। বনাধিকার আইন অনুযায়ী অল্পস্বল্প মাত্রায় কিছু জমির ওপর ব্যক্তিগত দাবিকে মেনে নিলেও সমস্টিগত দাবি মানার উদাহরণ একেবারে নাই বললেই চলে। বনাধিকার আইন পাস হওয়ার পর এরাজ্যের সরকার যখন ২০০৮ সালে রুলস তৈরি করে তখনই তারা তৎকালীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ‘গ্রাম সংসদ’কেই ‘গ্রামসভা’ হিসেবে অভিহিত করেছিল যা বনাধিকার আইনে বর্ণিত গ্রামসভার ধারণাকে নাকচ করে দেওয়ার সামিল। গ্রামসভাকে হাতিয়ার করে আদিবাসী-বনবাসীদের স্বায়ত্ত্বতার লড়াই গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। সমষ্টিগত বনাধিকারের দাবিও তেমন আর সামনে আসতে দেখা যায়নি। এবং আদিবাসীদের প্রতি যে জাতিবিদ্বেষী অবমাননাকর মন্তব্য বাঘমুণ্ডির ফরেস্ট অফিসার করেছেন তা আসলে আদিবাসী-বনগ্রামবাসীদের প্রতি এই অফিসার শ্রেণীর সাধারণ মনবোভাব এবং তা দেখিয়ে দেয় যে আইন থাকলেও সমষ্টিগত বনাধিকার বাস্তবে লাগু করা কতটা কঠিন। বাঘমুণ্ডির ফরেস্ট অফিসার সম্ভবত ২০০৮’র রুলস মাথায় রেখে গ্রামসভাকেই বেআইনি বলে দেগে দিয়েছেন। অন্যদিকে এরাজ্যে অসংখ্য আদিবাসী মানুষের বসবাস থাকা সত্ত্বেও কোনও আদিবাসী এলাকা পঞ্চম তপশিলভুক্ত নেই। অযোধ্যা পাহাড়ের গ্রামবাসীদের গ্রামসভা গঠন আন্দোলন এবং গ্রামসভাগুলির পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট বনভূমি, পাহাড় ও ঝর্ণাকে ফিরিয়ে নিতে এই দৃঢ় আত্মঘোষণা বিরসা মুণ্ডার তোলা শ্লোগানকে আবারও জীবন্ত করে দিয়েছে।
আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে, ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২২-২৩-২৪ তারিখে কলকাতার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের (ঊষা সেলাই মেশিন) কারখানার সামনে জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড মজদুর ইউনিয়নের পক্ষে এআইসিসিটিইউ-র নেতা প্রয়াত কমরেড নরেন পাইন সমেত ৪ জন সদস্য অনশন ও অবস্থান করেছিল। তাঁরা কারখানার জমি বিক্রি করার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ওই অনশন চালাচ্ছিল। তখন রাজ্যে প্রবল প্রতাপশালী বামফ্রন্ট সরকার, শিল্প পুনগর্ঠনমন্ত্রী শ্রমিক নেতা মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি সিটুর সহসভাপতিও ছিলেন। ঊষা কারখানার সিটু ইউনিয়নও তখন প্রায় একচেটিয়া প্রতিপত্তিশালী। যতদূর মনে পড়ছে এলাকার সিপিআই(এম) নেতা ও সিটু নেতা বিমল চ্যাটার্জী কারখানার ব্যাপারে শেষ কথা, কারখানার শ্রমিকদের ভিতর থেকে নেতা ছিলেন পেলব রায়চৌধুরী। মজদুর ইউনিয়েনের সম্পাদক ছিলেন কমরেড মন্টু ঘোষ। কারখানার জমি বিক্রির ব্যাপারে মালিকপক্ষ (সিদ্ধার্থ শ্রীরাম) বামফ্রন্ট সরকার তথা সিটুর গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গেছে। মালিকের বক্তব্য ছিল সমস্ত শ্রমিককে রেখে দেওয়া হবে, তবে তাঁদের স্থানান্তরিত করা হবে বাঁশদ্রোনীর ঊষা ফ্যান কারখানায়। কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেছে। প্রকল্প জমা পড়ে গেছে। বিআইএফআর-এও কথাবার্তা হয়েছে। ওই জমি বিক্রির থেকে পাওয়া টাকায় জয় ইঞ্জিনিয়ারিং-কে পুনরুজ্জীবিত করা হবে।
সর্ব শক্তিশালী সিটু ও বামফ্রন্ট সরকার মেনে নিলেও, এআইসিসিটিইউ-র অন্তর্ভুক্ত জয় এঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড মজদুর ইউনিয়ন মানতে রাজি নয়। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন, কারখানা স্থানান্তর করার পরে জমি বিক্রির টাকায় মালিক শ্রমিকদের বহাল রেখে কাজকর্ম চালু রাখবে এমনটা নয়। দ্বিতীয়ত, জমি বিক্রির টাকা কারখানায় নিয়োজিত হবে তেমনটাও নয়। তৃতীয়ত, জমি বিক্রির থেকে প্রাপ্তব্য অর্থের যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে ওই এলাকায় জমির দাম তার কয়েকগুণ, এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল কারখানায় নিয়োজিত আড়াইশত ক্যাজুয়াল শ্রমিকের কী হবে? যখন মজদুর ইউনিয়ন অনশনে বসতে যাচ্ছে তখন থেকেই সিটু চরম বিরোধিতা শুরু করে। বলতে থাকে নকশালরা কারখানার পুনরুজ্জীবনে বাধা দিচ্ছে ও অনশনকে তারা জোর করে তুলে দেবে। সমস্ত রকম বিরোধিতা সত্বেও অনশন চালু হয়, চলতেও থাকে।
অনশনের দ্বিতীয় দিনে মালিকপক্ষ ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হয়। ১২৬ জন ক্যাজুয়াল শ্রমিককে তাৎক্ষণিক স্থায়ী করার চুক্তি হয়, ও বাদবাকি শ্রমিককে পরবর্তীতে স্থায়ী করার কথা বলা হয়। মজদুর ইউনিয়ন যদিও আশঙ্কায় ছিল যে জমি বিক্রির পরে মালিকপক্ষ কথা রাখবে না এবং ফ্যান কারখানাকেও গুটিয়ে নেবে। তবুও সাধারণ শ্রমিকদের শঙ্কিত করার জন্য সিটুর প্রচার, জমি বিক্রি না হলে মালিক কারখানাকে ব্ন্ধ করে দেবে, শ্রমিকরা কাজ হারাবে, তাছাড়া মালিক তো ক্যাজয়াল শ্রমিকদের স্থায়ী করার দাবি অনেকটাই মেনে নিয়েছে, সার্বিক বিরোধিতা করা সম্ভব হয়নি। যাই হোক, আলোচনা ও চুক্তির প্রেক্ষিতে অনশন তুলে নেওয়া হয়।
কারখানার জমি সমেত শ্রমিক কোয়ার্টারগুলির জমি বিক্রি হয়ে যায়। এখন সেখানে সাউথ সিটি মল ও আবাসন। বড়লোকের বসত ও বিনোদনের জায়গা। শ্রমিকরা ঊষা কারখানায় কিছু দিনের জন্য নিয়োজিত হয়। বছর ৪-৫ যেতে না যেতেই মজদুর ইউনিয়নে আশঙ্কা সত্যিতে পরিণত হয়। কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প নামক শ্রমিক ছাঁটাইএর কাজ শুরু করে। প্রায় তেমন কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই অতি অল্প কিছু শ্রমিককে কাজে বহাল রেখে বাকি সকলকেই স্বেচ্ছাবসর নিতে বাধ্য করা হয়। আনাোয়ার শাহ রোডের কারখানা থেকে আসা প্রায় সকলেই স্বেচ্ছাবসরের তালিকায় থাকে। নামে স্বেচ্ছাবসর হলেও, যদি তালিকায় থাকা কেউ তা না নেয়ে তাহলে তাকে কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। একদিকে কোনো ধরনের মজুরি না পাওয়া, অপরদিকে বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছাবসর নিলে এককালীন কিছু টাকা, পিএফ ও গ্রাচুইটির টাকা পাওয়ার ভাবনা থেকে অধিকাংশ তালিকায় থাকা শ্রমিক স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করে।
এতদসত্বেও মজদুর ইউনিয়ম ভুক্ত ও সিটু ইউনিয়ন ভুক্ত কতিপয় শ্রমিক হার মানেনি, স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করেনি। কর্তৃপক্ষের অন্যায় ছাটাইএর বিরুদ্ধে শ্রম ট্রাইবুনালে যান। ২০০৩ সালের ১ আগস্ট থেকে তাদের ছাটাই করা হয়। ১৯ বছর পরে গত ১০ নভেম্বর শ্রম ট্রাইবুনাল রায় দিয়েছে যে যে ১০ জন শ্রমিক এখনো জীবিত রয়েছেন তাঁদের ১ আগস্ট ২০০৩ থেকে পুনর্নিয়োজিত করতে হবে, এবং গত ১৯ বছরের সমস্ত মজুরি ও সুবিধে দিতে হবে। যারা মারা গিয়েছেন তাঁদের প্রয়াণের দিন পর্যন্ত প্রাপ্য মজুরি ও সুবিধে তাঁদের উত্তরাধিকারীদের দিতে হবে। এসব ৬০ দিনের মধ্য কোম্পানিকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মজদুর ইউনিয়েনের সেদিনের লড়াই কত যথার্থ ছিল কর্তৃপক্ষের আচরণ তা প্রমাণ করেছে। বামফ্রন্ট সরকার যে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ তাও পরিষ্কার। অপরদিকে সরকারের লেজুড়বৃত্তি করা সিটু আদতে মালিকের স্বার্থ দেখতেই পারদর্শী তাও জয় ইঞ্জিনিয়ারিংএর ঘটনায় খোলামেলা হয়েছে।
তথাপি, কয়েকজন লড়াকু শ্রমিক নিজেদের অধিকার বুঝে নেওযার জন্য শত প্রলোভন ও অভাব সত্বেও লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন ১৯ বছরের বেশি সময় ধরে সেটা এক ঘন মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎরেখা। তাঁদের জানাই কুর্নিশ।
দেশজুড়ে আজ ঘরে বাইরে মেয়েদের ওপর যৌন হেনস্থা, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণধর্ষণ, নৃশংস হত্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সর্বগ্রাসী সামাজিক সংকট ও নৈরাজ্য এবং সর্বোপরি মনুবাদী নারী-বিদ্বেষী আরএসএস বিজেপির শাসন এর জন্য মূলত দায়ী। আমরা মেয়েরা প্রতিরোধ আন্দোলনও গড়ে তুলছি নানাভাবে। যেমন, শাহিনবাগ আন্দোলন। কিন্তু সমস্ত বামপন্থী প্রগতিশীল নারী সংগঠনগুলো আগের মতো একজোট হয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারছি কই?
এই প্রশ্নটা মনে জাগছিল গত ১৮ অক্টোবর ঐতিহাসিক তেভাগার লড়াকু নেত্রী এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা নারী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কমরেড ইলা মিত্রের জন্মদিনে। ১৯৮০-৯০’র দশকের কথা। আমরা এরাজ্যে এবং জাতীয় স্তরে মূলত বামপন্থী ও কয়েকটি নারীবাদী সংগঠনের সঙ্গে একজোট হয়ে কত আন্দোলন গড়ে তুলেছি। আমাদের নেত্রী সার্বজনীন গীতাদির (গীতা দাস) ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেইসব সংগঠনের নেত্রীদের সঙ্গেও একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠে ছিল।
তখন বানতলা, মানিকচক, বিরাটি, ফুলবাগান ইত্যাদি অঞ্চলে নারী নির্যাতন ও গণধর্ষণের একের পর এক কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয়। এসবের প্রতিবাদে এবং সরকারের গা-ছাড়া মনোভাবের বিরুদ্ধে আমরা নিজেরা সংগ্রামে নেমে যৌথ আন্দোলনের আহ্বান জানাই। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি ছাড়া অন্যান্য বামপন্থী ও নারীবাদী মহিলা সংগঠন সকলেই এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।
আমি তখন প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা। আমি বয়সে বেশ খানিকটা কম হওয়ার জন্য ইলাদি আমাকে যেমন স্নেহ করতেন তেমনি সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। আমাদের সংগঠন ছোট হলেও তাকে সমান গুরুত্ব দিতেন। শুধু ইলাদি নয়, সেই সময়ে একইরকম ভালো ব্যবহার পেয়েছি গীতা মুখার্জী, গীতা সেনগুপ্ত, শেফালী ভট্টাচার্য, বিদ্যা মুন্সি, অপরাজিতা গোপী, কনক মুখার্জি, সাধনা চৌধুরী, মৃণালিনী দাশগুপ্তের মতো বিশিষ্ট নেত্রী এবং অন্যান্য মহিলা সংগঠনের নেত্রীদের কাছ থেকেও। ভালো মাত্রায় রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এঁদের সঙ্গে একসাথে চলতে কোন অসুবিধা হতনা।
আশির দশকে মহারাষ্ট্রের আদিবাসী নাবালিকা মথুরা পুলিশ হেফাজতে ধর্ষিত হন। যখন অভিযুক্ত পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ছাড়া পায় তখন নারীসমাজ সোচ্চার হয়। এক ঐতিহাসিক খোলা চিঠি যায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির কাছে। মহিলা আইনজীবীরা এতে স্বাক্ষর করেন।
আশি থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত ছিল নারী আন্দোলনের এক সুবর্ণ সময়। নারী ইস্যুগুলো প্রকৃত রাজনৈতিক আন্দোলনের ইস্যু হয়ে উঠেছিল। জনসমর্থনও ছিল, ফলে সরকার এবং প্রশাসনও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতো। একটা অন্যরকম রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি ছিল।
রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও, নারী আন্দোলনের প্রশ্নে সমস্ত সংগঠন একাত্ম এবং আন্তরিক ছিল।
আশির দশকে মথুরা ধর্ষণ মামলার রায়ের প্রতিবাদে, কলকাতায় শবর ছাত্রী চুনি কোটালের আত্মহত্যা, অর্চনা গুহর ওপর লকআপে অত্যাচারে মামলা, দেওরালায় সতীদাহ ঘটনা, রাঁচিতে পুলিশ কর্তৃক নাবালিকা ধর্ষণ, এরাজ্যে বিভিন্ন কারাগারে নিরাপত্তার অজুহাতে নিরাপরাধ বন্দিনীদের মামলা, বিজ্ঞাপনে নারী দেহ পণ্য করার বিরুদ্ধে, নাবালিকা পরিচারিকাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু, বধুহত্যা, পণপ্রথা ইত্যাদি ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে ওঠে।
নারীর দৈনন্দিন শোষণ নিপীড়নের বিষয়টি পার্টিতেও প্রাধান্য পাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে এবং বস্তি এলাকায় মহিলা সংগঠনও গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনগুলোতে পরে বহু এনজিও যুক্ত হয়। ফলে কর্মসূচিগুলোতে বহু মহিলার সমাবেশ যেমন ঘটতো তেমনি আন্দোলনের পরিধির বিস্তারও ঘটেছিল।
আরেকটি ঘটনা, সংসদে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের দাবিতে গীতাদি সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। তাই আমরা এই দাবিতে কর্মসূচিতে প্রধান বক্তা হিসেবে ওনাকে রেখেছিলাম। ফোন করে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এবং সঙ্গে এও জানিয়েছিলাম পথসভা হবে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে। সবটা জেনেই সাংসদ গীতাদি রাজি হয়েছিলেন, আসার জন্য কোনও গাড়িও পাঠাইনি। নিজেই যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাদের ব্যবস্থাপনায় ছিল কেবল গুটিকয়েক চেয়ার আর মাইক। খোলা আকাশের নিচে অন্ধকারে বেশ খুশি মনেই গীতাদি বক্তব্য রেখেছিলেন।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেতৃত্বে ১৯৯৭’র ৩০ এপ্রিল সংরক্ষণের দাবিতে পুলিশের লাঠি, জলকামাল উপেক্ষা করে প্রায় ৬,০০০ মহিলা সংসদ অভিযান করেন। এবং পরদিন প্রধানমন্ত্রীর হাতে এই দাবির সমর্থনে প্রায় দু’লক্ষের বেশি সই জমা দেওয়া হয়। এই দাবিতে ১ আগস্ট ‘প্রতিবাদ দিবসে’ কলকাতায় আইপোয়ার উদ্যোগে এক কনভেনশনে বামফ্রন্টের মহিলা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। আবার চার বাম দলের মহিলা সংগঠনের আয়োজনে ২০ আগস্ট ‘প্রতিবাদ দিবসে’ আইপোয়ার নেত্রীরা বক্তব্য রাখেন। এইভাবে সংরক্ষণ ইস্যুতে অন্য সব রাজনৈতিক মতপার্থক্য সরিয়ে রেখে মহিলা সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেমেছিল।
প্রাক্তন বিধায়ক অপরাজিতা গোপীর (ফরওয়ার্ড ব্লক ও অগ্রগামী মহিলা সংগঠনের নেত্রী) সাথেও আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার ছাপ পড়ে আমাদের কর্মসূচিতে ওনার বক্তব্যে মধ্যে।
১৯৯২’র ৩০ আগস্ট পাটনায় দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়া বিরোধী মহিলা কনভেনশনের মধ্যে দিয়ে আঠারোটি বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক মহিলা সংগঠন সরকারের আর্থিক নীতি ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে যৌথ ফোরাম গঠন করে। এর আদলে এরাজ্যেও একটি ফোরাম গঠনের লক্ষ্যে ১৯৯৩’র ফেব্রুয়ারিতে আমরা মৌলালীর বিএমপিইইউ হলে একটি কনভেনশনের আয়োজন করি। মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সারাদেশে বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মৌলবাদী মতাদর্শের উত্থানের বিরুদ্ধে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। কিন্তু অন্যান্য মহিলা সংগঠন আমাদের ডাকে সাড়া দিলেও যেমন পাটনায় সর্বভারতীয় কনভেনশনে তেমনি এরাজ্য ও গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী যৌথ আন্দোলনে যোগ দিতে অস্বীকার করে। এর বদলে তাঁরা তাঁদের পার্টির লাইন অনুসারে ‘গণতান্ত্রিক’ অর্থে জনতা দল এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ অর্থে কংগ্রেসের মহিলা সংগঠনকে নিয়ে চলেছিলেন।
মৌলালীর কনভেনশনে অপরাজিতাদি বলেছিলেন, পাটনা কনভেনশন থেকে যে জাতীয় স্তরে ফোরাম গড়া হয়েছে তেমনটি এরাজ্যে সম্ভব নয়, যতক্ষণ না গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির মতো বড় সংগঠনকে সামিল করানো যায়। ‘বড় সংগঠনের’ এই মনোভাবের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, দেশকে রক্ষা করতে গেলে আমাদের সকলকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতেই হবে।
সিপিআই এবং পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতির নেত্রী বিদ্যা মুন্সিও বলেন, রাজ্যের মূল বামপন্থী মহিলা সংগঠনের সঙ্গে এ’বিষয়ে আলাপ আলোচনার দ্বার খুলতে আমি এবং আমরা উদ্যোগ নেব। এসইউসিআই এবং মহিলা সাংস্কৃতিক সংঘ’র নেত্রী সাধনা চৌধুরী সহ অন্যেরাও যৌথ আন্দোলনের উপর জোর দেন।
পশ্চিমবাংলার প্রথম নারী কমিশনের সহ-সভানেত্রী ছিলেন গীতা সেনগুপ্ত। তিনি আরএসপি ও নিখিল বঙ্গ মহিলা সংঘের রাজ্যস্তরের নেত্রী। ওনার সঙ্গে সম্পর্কটা এরকমই ছিল যে, সকালে ফোন করেছি বিকেলে প্রোগ্রাম — তাতেও হাজির থেকেছেন। আন্তরিকতার এতটুকু খামতি তো ছিলই না, নিজের পদমর্যাদার জন্য কোনও দূরত্বও আমাদের সঙ্গে রাখতেন না।
সিদ্ধার্থ সরকারের অত্যাচারী পুলিশ অফিসার রুণু গুহনিয়োগীকে যখন জ্যোতিবাবুর সরকার প্রমোশন দিল তখন তার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন বামপন্থী মানুষজন। তার ‘সাদা আমি কালো আমি’ বই প্রকাশনার বিরুদ্ধে আমরা অর্থাৎ সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি রুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই আন্দোলনকে জোরদার করতে আমরা একটি কনভেনশনের আয়োজন করি। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি ছাড়া বামফ্রন্টের অন্যান্য শরিক মহিলা সংগঠনের নেত্রীরা এই প্রতিবাদে অংশ নিতে রাজি হয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির তৎকালীন সভানেত্রী কমরেড কনক মুখার্জির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ভালোই ছিল তাই ওনাকে ফোন করে বলেছিলাম, এই খুনি অফিসারের বিরুদ্ধে আমাদের একসাথে লড়তে হবে। কনকদি বলেছিলেন অবশ্যই, আমি তো চোখে দেখতে পাই না, কনভেনশনে যেতে পারবো না। তোমরা আমাদের অফিসে এসো চিঠি লিখে দেব। আমি আর গীতাদি (গীতা দাস) গিয়েছিলাম, আমাদের সামনেই একজন মহিলা কমরেডের সাহায্য নিয়ে রুণু গুহনিয়োগীর বইয়ের বিরোধিতা করে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন কনকদি। কনভেনশনে সেই চিঠি পড়া হল। সংবাদপত্রে যৌথ প্রতিবাদের সে খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়।
নারীবাদী লড়াকু নেত্রী মৈত্রেয়ী চ্যাটার্জির সঙ্গে আমাদের কিছু রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু একাত্মতার কোনও ঘাটতি ছিল না।
১৯৯৮ সালে ১৮ ডিসেম্বর পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড বিনোদ মিশ্র মারা যাওয়ার পর ‘প্রতিবিধান’ পত্রিকা ‘বিনোদ মিশ্র সংখ্যা’ প্রকাশ করে। মৈত্রেয়ীদি তাতে ‘বামপন্থা ও নারী আন্দোলন’ নামে একটি লেখা দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “১৯৮৩তে প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ডাকে সাড়া দিয়ে যে যৌথ মঞ্চ তৈরি হয় তার নামকরণ হয় ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চ’। রাজনৈতিক অরাজনৈতিক নারীবাদী সব ধরনের সংগঠনই ছিল। সচেতনা, মহিলা গবেষণা কেন্দ্রে, মহিলা পাঠাগার, মহিলা পাঠচক্র, লহরী নিয়ে মহিলা সমিতি যৌথ কর্মসূচি আরম্ভ করে। এরসঙ্গে পরে যুক্ত হয় ‘প্রতিবিধান’ পত্রিকা। ...”
“আইপিএফ এবং প্রগতিশীল মহিলা সমিতি যৌথভাবে ১৯৮৬ সালে কলকাতার ত্যাগরাজ হলে একটি বড় সম্মেলন করে। এখানে সব ধরনের নারী সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনে কানপুরের নারীবাদী সংগঠনের প্রতিনিধিরা মার্কসবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। আয়োজকদের তরফ থেকে কিন্তু তাঁদের বক্তব্য ধৈর্য্য সহকারে শোনা হয়। সম্মেলনের কোনও পর্বেই আয়োজকদের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, এমনকি সম্মেলনে আলোচনার নথি লেখার ভারও তাঁরা অন্য সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপর ন্যস্ত করেছিল। বামপন্থী রাজনীতিতে এই ধরনের উদারতা বিরল। এর কৃতিত্ব অনেকাংশেই প্রয়াত নেতা বিনোদ মিশ্রের প্রাপ্য। তিনিই প্রথম স্বপ্ন দেখেন সব ধরনের সংগঠনকে নিয়ে জঙ্গি কমিউনিস্ট নারী আন্দোলনের। ... ১৯৮৮’র ফেব্রুয়ারিতে পাটনায় যে সম্মেলন হয় সর্বভারতীয় স্তরে তা অভূতপূর্ব সারা জাগায়।
চল্লিশের দশক থেকে নব্বই দশকে অন্য কোন বামপন্থী রাজনৈতিক দল নারী আন্দোলন নিয়ে এই স্তরে ভাবেনি এবং এখনো ভাবে না। তাদের সংকীর্ণ এবং রক্ষণশীল মনোভাবের পাশে সিপিআই(এমএল)-এর দৃষ্টিভঙ্গি এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।”
মৈত্রেয়ীদি আসলে ছিলেন আমাদেরই একজন, ওনার প্রবন্ধের টুকরো থেকে একথা পরিষ্কার বোঝা যায়।
প্রতিবিধান পত্রিকা প্রকাশনা শুরু থেকে আমাদের সংগঠনের তিন চার জন সদস্য ছাড়াও বাইরের বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল বহু মানুষ যুক্ত ছিলেন। সকলেই জানতেন এই প্রকাশনা শেষ বিচারে সিপিআই(এমএল)-এর, কিন্তু তা নিয়ে এঁদের মধ্যে কোনও দ্বিধা কখনও দেখা যায়নি। অনেকেই পত্রিকা এবং মহিলা সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সামিল হতেন। বলা যায়, পত্রিকা অনেকটা সংগঠকের ভূমিকা পালন করতো।
ঐ সময়ে রাজ্য নারী কমিশনে আমরা স্থায়ী সদস্য না হলেও আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে কমিশনের বেশিরভাগ বৈঠকে ডাকা হতো। বিভিন্ন ইস্যুতে আমরাই বেশি সোচ্চার হতাম এবং অন্যান্য সংগঠনের সদস্যরাও তাতে আওয়াজ তুলতেন। এখানেও একটা যৌথতার পরিবেশ গড়ে ওঠে। কমিশনের পরবর্তী সভানেত্রী যশোধরা বাগচীর সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। এখনতো রাজ্যে নারী কমিশনের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না!
১৯৯৮ সালে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চ’ ভেঙে যায়। ২১ শতকের শুরুতে নতুন মঞ্চ ‘মৈত্রী’ গঠন হয়। এর ব্যানারে নারী ইস্যুতে সরকার বিরোধী বেশ কয়েকটি বড় কর্মসূচি পালিত হয়। নানা মতপার্থক্যের কারণে এই মঞ্চেরও আর বিশেষ ভূমিকা থাকল না।
তবে যৌথ আন্দোলনে ভাঁটার টান কিন্তু বেশি দিন থাকেনি। বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যজুড়ে সিপিএমের কর্মীবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড হামলা নামায়। বিভিন্ন অঞ্চলে সিপিএম করার অপরাধে মহিলারা শারীরিক নিপীড়ন, গণধর্ষণের শিকার হন। আইপোয়া’র পক্ষ থেকে আমরা তৃণমূল কংগ্রেসের ঘৃণ্য প্রতিশোধমূলক আচরণের প্রতিবাদে স্বাধীন কর্মসূচি নেওয়ার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতিসহ অন্যান্য বামপন্থী মহিলা সংগঠনকেও যৌথ কর্মসূচির জন্য আহ্বান জানাই। সকলেই এমনকি এই প্রথম গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতিও এতে সাড়া দেয়। যৌথভাবে হামলা কবলিত এলাকায় অনুসন্ধান এবং থানা ডেপুটেশন, রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি প্রদান, একটি যৌথ কনভেনশন ইত্যাদি কর্মসূচি চলতে থাকে। কিন্তু যৌথতার মধ্যেও গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেতৃত্বের মধ্যে নানা সংকীর্ণতা দেখা যায়। ফলে এই বৃহত্তর যৌথতা মূলত সিপিএমের ওপর দমনের ইস্যুতেই আটকে থাকে।
২০১২-১৩ সালে দিল্লীর নির্ভয়া কাণ্ড ও কামদুনির গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদে এক নতুন জোয়ারের সূত্রপাত হয়। ২০১৩ সালের ২১ জুন কামদুনির নির্মম ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতার মহামিছিল হয়। ব্যানার ছাড়াই বিভিন্ন নারী সংগঠনের কর্মীরা এতে যুক্ত হয়েছিলেন। যারা বাংলায় সরকার পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তাঁদের বিবেকেও নাড়া দিয়েছিল নতুন রাজ্য সরকারের ঘৃণ্য ভূমিকা। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর আরো একবার শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ পথে নেমেছিলেন। এই ব্যাপক বিস্তৃত আন্দোলনে প্রথম থেকেই আইপোয়ার ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। সবচাইতে বড় কথা, আন্দোলনের ময়দান থেকে কামদুনির গ্রাম্য মেয়ে বউ টুম্পা, মৌসুমী আন্দোলনের সুযোগ্য নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু মাটি থেকে উঠে আসা এই স্বতঃস্ফূর্ত সম্ভাবনাময় আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে সুসংগত পরিণত নেতৃত্বের প্রয়োজন তার অভাবে এ লড়াই ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসে।
সম্মিলিত সংগ্রাম এখনও হয় কিন্তু তাতে সেই জোশ নেই। তবে সে জন্য আমরা হা হুতাশ করি না, কারণ আমরা জানি অতীতকে একইভাবে ফিরিয়ে আনা যায় না। জোয়ার ভাটার মধ্যে দিয়ে আন্দোলনের নদী নিজের পথ তৈরি করে নেয় নতুন পরিস্থিতি অনুসারে। আজ সারা ভারতে কেবল নারী-হিংসার বিরুদ্ধে নয়, রুটি-রুজির জন্য এবং সমমর্যাদা সম অধিকার স্বাধীনতার দাবিতে মেয়েরা নতুন নতুন ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলছেন। রাজ্য এবং কেন্দ্রের শাসকরা যত নারীদের উপর নতুন রূপে শোষণ বঞ্চনা নামাচ্ছে ততই মহিলাদের বিভিন্ন অংশ বা স্তর (যেমন স্কিম ওয়ার্কার, মহিলা কৃষি শ্রমিক) নিজ নিজ ক্ষেত্রে সংগঠিত হচ্ছেন, রুখে দাঁড়াচ্ছেন। আমরা তাঁদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি, তাঁরাই আমাদের শক্তির উৎস।
একজোট হয়ে সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য আজও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং যাব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নিজেদের গণভিত ও স্বাধীন আন্দোলন বাড়িয়ে তুলেই আমরা পারবো যৌথ আন্দোলনেও নতুন প্রাণসঞ্চার করতে।
- চৈতালি সেন
শিলিগুড়ি মডেলের কথা সকলেরই মনে আছে। বছর ৪-৫ হয়ে গেছে রাজ্যের শাসনক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছে সিপিএম, বহুবচনে বামফ্রন্ট। হাঁপিয়ে উঠেছেন নেতা থেকে কর্মী। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। যাদের কাছে নীতি, আদর্শ, রাজনীতি, প্রভৃতি ততো গুরুত্বপূর্ণ নয়, তারা ২০১১ সালে দিন বদলের সাথে সাথে (বলা ভালো, ক্ষমতার হাত বদলের সাথে সাথে) সরাসরি ক্ষমতার সঙ্গে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন যুক্তিতে পরিচিত বহু মুখ সিপিএম/বামফ্রন্ট ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। হাওয়া মোরগের মতো কিছু আগে থেকেই তারা ‘পরিবর্তনের’ আভাস পেতে শুরু করেছিলেন, কেউ কেউ সামনে ও পেছন থেকে পরিবর্তনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিলেন। এদের কথা বাদ নিন। এই সমস্ত ‘বামপন্থী ক্যাডাররা’ ক্ষমতায় আসীন নতুন শাসক দলে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছেন। অন্যদিকে যারা আদর্শে বিশ্বাসী, জনগণের ভালোমন্দ যাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে তারা আরও কিছুদিন দিন বদলের আশায় অপেক্ষা করলেন। ভেবেছিলেন, তৃণমূল আর কতদিন? নীতি নেই, আদর্শ নেই, কর্মসূচি নেই, এ আর কতদিন টিকবে? বিরোধী দলের অবস্থান অনেকের কাছে অপরিচিত শব্দ। দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে কেউ কেউ ভেবে নিয়েছিলেন আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন।
২০১৫’র জুলাই আগস্ট মাসে শিলিগুড়ি পৌরসভা নির্বাচনে ‘শিলিগুড়ি মডেল’ ধৈর্য হারানো, বিশ্বাস হারানো বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের আদর্শচ্যুতির নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। বামফ্রন্টের বৈঠকে শরিক দলগুলোর প্রশ্ন ও ক্ষোভের মুখে সিপিএমের তিন নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র জানালেন, কংগ্রেস, বিজেপির সঙ্গে কোনো ধরনের অনীতিনিষ্ট জোটে সিপিএম অংশ নেবে না। অথচ সংবাদ আসতে শুরু করল মহকুমা পরিষদের কিছু আসনে (ফাঁসিদেওয়া ব্লকে) ক্ষমতাসীন শাসক দলের সন্ত্রাস, দুর্নীতি ইত্যাদি মোকাবিলায় বিজেপি প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়েছে সিপিএম। এমনকি এই খবরও আসলো দলের রাজ্য সম্পাদক প্রতিবাদে যৌথ জনসভায় অংশ নিতে অস্বীকার করেন। জেলা সম্পাদক জানালেন, “কেউ কথা শোনে না”! রাজনীতি যখন ক্ষমতার সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কে পরিণত হয়েছে, তখন ক্ষমতা থেকে দূরে সরে থাকার বিশুদ্ধতার কোনো অর্থ নেই। শিলিগুড়ি মডেল তাই দলের মধ্যে জায়গা করে নিল, তাই নয়, পুরো সময়ের জন্য পৌরসভায় কংগ্রেসের ৪ জন পৌর প্রতিনিধি পাশে থাকল। বিজেপির জনা দুয়েক পৌর প্রতিনিধি জানিয়ে দিল, অনাস্থা প্রস্তাব আসলে আমরা “সব দিক বিবেচনা করেই অবস্থান ঠিক করব”। শিলিগুড়ি পৌরসভা নির্বাচনের দিনে শাসকদলের সন্ত্রাস রুখতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছিল। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল শিলিগুড়ি মডেলের কার্যকারিতা। হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার অব্যর্থ কৌশল।
যে মডেলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল, দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল, দলের মধ্যে বিতর্ক ছিল, সেই মডেলই আরও বৃহত্তর পরিসরে — ২০১৬’র বিধানসভা নির্বাচন ও ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনে লক্ষ্য করা গেল। স্বাভাবিকভাবে কথার ফুলঝুড়িতে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা হল সেই আত্মঘাতী জোট রাজনীতিকে। শর্টকাট পথে ক্ষমতায় ফিরে আসার পথের ফলাফল সকলের জানা। না, এতেও লক্ষ্য পূরণ হয়নি। ফলাফল নিয়ে আলোচনার আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এই আত্মঘাতী রাজনীতি দলের কর্মীদের উৎসাহিত করার বদলে মতাদর্শের বিসর্জনকে আরও ত্বরান্বিত করল। বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করতে বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ট দলকে ভোট দিতে দ্বিধা করেননি তারা।
এরই অন্তিম পরিণতি দেখা গেল ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। শুধু দলের আসন সংখ্যা শূণ্যে নেমে এসেছে তাই নয়, দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে বামপন্থী গণভিত্তি গড়ে ওঠেছিল, একটা ভুল, আত্মঘাতী রাজনৈতিক লাইন ও কৌশল সেই গণভিত্তির স্থায়ী ক্ষয়ের জন্ম দিল।
শিলিগুড়ি পৌরসভা ও মহাকুমা পরিষদে যে মডেলের অনুশীলন ও পরিণতি আমরা দেখেছিলাম, এবার তারই অনুরূপ মডেল অনুশীলিত হচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার ও মহিষাদল রাধাকৃষ্ণ সমবায় নির্বাচনে। বেশ কিছুদিন ধরে সলতে পাকানো হচ্ছে। ‘চোর ধরো জেল ভরো’ আন্দোলন জনপ্রিয় হতেই বিজেপি ও সিপিএমের মধ্যে একটা তরজা শুরু হয়। এই শ্লোগানের জনক বা সৃষ্টিকর্তা কে? শ্লোগানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট। উভয় দলই চায় “দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মন্ত্রীদের” এবং সম্ভব হলে তৃণমূলী মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেপ্তার। শহুরে মধ্যবিত্ত, ছাত্র যুব ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় দাবি। বিশেষ করে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা আধিকারিকদের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি গণপ্রতিবাদ ও গণআন্দোলনে গতি দিয়েছে। একটা ফ্যাসিবাদী চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দলের উদ্যোগের সঙ্গে ফারাক টানার কঠিন কাজে মনোযোগ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন সিপিএম নেতৃত্বের কাছে ছিল না। যে বিজেপি নেতারা তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের অনেকেই তৃণমূলে থাকার সময় ঐ সমস্ত দুর্নীতিতে যুক্ত ছিল। দেশ ও রাজ্যের অন্যান্য বিজেপি নেতাদের কথাতো ছেড়েই দিলাম। এদের সঙ্গে ফারাক টানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না থাকায় বিজেপির পরিষদীয় নেতা অত্যন্ত সহজে বিজেপির নবান্ন অভিযানে সিপিএম কর্মীদের সামিল হওয়ার আহ্বান জানান, নীচুতলায় ‘নাগরিক ঐক্য’ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লম্বা চওড়া ভাষণ দিতে থাকেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি আরও কুৎসিত ভাষায় বলেই ফেললেন, বুড়ো বুড়ো কিছু নেতার সঙ্গ ছেড়ে বিজেপির নবান্ন অভিযানে সামিল হতে ছাত্র-যুবদের কাছে আহ্বান জানান। বিনা উদ্দেশ্যে নয় এই আহ্বান। ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের স্বার্থে বিজেপি ও সিপিএমের মধ্যে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ফারাকটা মুছে ফেলা। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আবহাওয়া গড়ে তোলার লক্ষ্যে শুরু হয়েছে মেদিনীপুর মডেলের অনুশীলন।
পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারের বহরমপুর সমবায় সমিতি নির্বাচনে বিজেপি সিপিএম জোট, ‘পশ্চিমবঙ্গ সমবায় বাঁচাও’ মঞ্চ গড়ে ৬৩টি আসনের সবকটিতে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীদের হারিয়ে দেয়। এই নজরকাড়া সংবাদ প্রকাশ্যে আসার পর সিপিএম নেতৃত্ব এই জোটকে সম্পূর্ণ ‘অরাজনৈতিক বোঝাপড়া’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালান। এরপর একই ঘটনা দেখা গেল, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের রাধাকৃষ্ণ সমবায় সমিতি নির্বাচনে। এই সমবায়ে ‘কৃষক সংঘর্ষ সমিতি’ গড়ে ৬২ আসনে বিজেপি এবং ১২ আসনে সিপিআই লড়াই করছে। এবার সিপিআই রাজ্য নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, “তারা কিছু জানেন না”। এই অরাজনৈতিক, অজানা জোট রাজনীতি কোন মতাদর্শ বহন করে চলেছে, তা বামপন্থী কর্মীদের বুঝে নিতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নন্দকুমারের ‘মডেল’ মহিষাদলে মুখ থুবড়ে পড়ল। তৃণমূল কংগ্রেস ৬৭+১ (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) আর অন্যদিকে জোট (সম্ভবত) ৭টি আসন পেয়েছে।
এভাবেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নিজেকে অরাজনৈতিক, দুর্নীতি বিরোধী, সহযোগী শক্তি হিসাবে তুলে ধরার ছলচাতুরি শুরু করেছে। শ্রমজীবী জনগণের বুনিয়াদি দাবিগুলোতে জোরালো গণআন্দোলন গড়ে তোলা, দেশ ও রাজ্যের জনবিরোধী সরকারগুলির সমস্ত জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে নীতিনিষ্ঠ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালানো ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। অন্যথায় ২০১৯’র নির্বাচনের মতো ২০২৪-এ শোনা যাবে রাম ছাড়া গতি নেই। ছাত্র যুব মহিলা সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের যে বামপন্থী কর্মীরা মেহনত করে পরিস্থিতি পরিবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছেন, একদল ক্ষমতালিপ্সু নেতার ভুল রাজনীতি তাকে ব্যর্থ করে দেবে? এখনি সতর্ক হওয়ার সময়।।
- পার্থ ঘোষ
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২। পুলিশি হেফাজতে কুর্দিশ তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে ইরানে। দেশের মহিলারা রাস্তায় নেমেছেন, লাগাতার বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীনভাবে বাঁচার এবং নিজের ইচ্ছামতো পোশাক পরার অধিকার আদায় করে নেবার জন্য তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ নিয়ে কোনও সরকারি হস্তক্ষেপ তারা মানতে রাজি না।
কিন্তু ইরানের সরকার ও প্রশাসন ইসলামের অনুশাসনের নামে এইসব অধিকার নারীদের দিতে কিছুতেই প্রস্তুত নন। তারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন যতই দেশের ভেতরে প্রতিবাদ হোক, যতই আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলোড়ন উঠুক, তারা কট্টর মৌলবাদী নীতি থেকে সরবেন না। তারা বিক্ষভকারীদের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে এখনও পর্যন্ত শতাধিক বিক্ষোভকারী প্রাণ হারালেও প্রতিবাদের আগুন নিভছে না।
ইরানের খ্যাতনামী শেফ মেহরশাদ শাহিদি সরকার-বিরোধী প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। নারী আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এজন্য শাহিদিকে পিটিয়ে খুন করে ইরানের রেভলিউশনারি গার্ড ফোর্স। হিজাব-বিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন শাহিদি। তখনই তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে হেফাজতে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। শাহিদি’র শেষকৃত্যের সময় প্রতিবাদে পথে নামেন হাজার হাজার মানুষ। ১৯ বছর বয়সেই দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিলেন শাহিদি। তাঁকে ইরানের ‘জেমি অলিভার’ বলা হত। আরক শহরে পথে নেমে প্রতিবাদের সময় তাঁকে তুলে নিয়ে যায় ইরানের নিরাপত্তারক্ষীরা। হেফাজতে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারে বলে অভিযোগ। জানা গিয়েছে, খুলিতে আঘাতের কারণে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। শাহিদি’র পরিবার অভিযোগ করে, তাদের ছেলের হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে বলার জন্য চাপ দিচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসন।
ইরানের প্রথম সারির অভিনেত্রী তারানেহ আলিদুস্তি হিজাব ছাড়া ছবি দিয়ে শোরগোল ফেলেন। দেশব্যাপী সরকার বিরোধী বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন জানাতেই এই পদক্ষেপ নেন। ইনস্টাগ্রামে একটি ছবি পোস্ট করেন তিনি। দেখা যাচ্ছে সেখানে কালো পোশাকে এলোচুলে দাঁড়িয়ে তারানেহ। হাতে সাদা পোস্টার, যাতে নীল কালি দিয়ে কুর্দি ভাষায় লেখা বিক্ষোভের স্লোগান, “নারী, জীবন, স্বাধীনতা”। ছবির ক্যাপশনে কবিতার আকারে অভিনেত্রী লেখেন, “তোমাদের চলে যাওয়া, গান গাওয়া পরিযায়ী পাখির ঢল — এসবে শেষ হয়ে যাবে না বিপ্লব।”
এইবার কাতার বিশ্বকাপের মঞ্চে ইরানের সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদে সামিল হলেন ইরানের ফুটবলাররা। ২১ নভেম্বর ২০২২ ইরানের প্রথম খেলা ছিল ইংল্যণ্ডের বিরুদ্ধে। সেই খেলায় তাঁরা জাতীয় সঙ্গীত না গেয়ে, জাতীয় সঙ্গীতের সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নীরবে সরব প্রতিবাদ জানালেন। খেলা শুরুর আগেই ইরানের অধিনায়ক আলিরেজা জাহানবকশ জানিয়েছিলেন, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে কিনা সেটা দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা। পরে জানা যায় ইরানের বেশিরভাগ ফুটবলারই জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়ার পক্ষে মত দেন। এই প্রতিবাদ গোটা বিশ্বেই আলোড়ন ফেলেছে। সমস্ত সংবাদমাধ্যমের খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে, স্টেডিয়ামে হাজির অনেক ইরানীয় সমর্থকও জাতীয় সঙ্গীতের সময় চুপ ছিলেন। এই প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে যথেষ্ট ঝুঁকি নিলেন ইরানের ফুটবলাররা। দেশে ফেরার পর তাঁদের শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। ইরানের ফুটবলাররাও তা জানেন। তবু যে তাঁরা এই সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন এজন্য তাঁদের কুর্ণিশ।
কাতার বিশ্বকাপের মঞ্চ প্রতিবাদের আরো কিছু নজির দেখছে। ইরানের মতো কাতারও একটি মৌলবাদী কট্টর ইসলামিক দেশ। সেইখানকার নানা প্রতিক্রিয়াশীল নিয়মকে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা দর্শকদের ওপর শেষ মুহূর্তে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে কাতার সরকার। তারা বলেছে মেয়েদের কাঁধ খোলা বা হাঁটু দেখানো পোশাক না পরতে। স্টেডিয়ামে মদ্যপান করা যাবে না বলেও ঘোষণা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে অনেকেই কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন। পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের কাউকে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। তারা ছাড়াও অনেক শিল্পী ও বিশিষ্ট মানুষ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন। তবে ইসলামিক দেশগুলোর অনেকেই কাতারের সঙ্গে তাদের পুরনো বিবাদ ভুলে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী মঞ্চে হাজির হয়েছে। সৌদির যুবরাজ ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন সলমন, মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান আব্দেল ফতাহ আল সিসি কাতারের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ তামিমের পাশেই ছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।
এর আগে বিশ্বকাপের মতো এত বড় কোনও প্রতিযোগিতা এই দেশে আয়োজিত হয়নি। মানবাধিকার রক্ষা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার সুনিশ্চিতকরণের দিক থেকে এই দেশটির রেকর্ড খুব একটা ভাল নয়। কাতারে সমকামী সম্পর্ক নিষিদ্ধ। কাতারে বিশ্বকাপের আয়োজনের খবর প্রকাশ্যে আসতেই তাই আয়োজকদের সিদ্ধান্ত নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল। তবে আলোচনা-সমালোচনার মুখে বিশ্বকাপ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, যে কোনও ধর্ম, যে কোনও যৌন চাহিদা কিংবা যে কোনও লিঙ্গের মানুষ বিশ্বকাপ দেখতে কাতারে আসতে পারবেন। বিশ্বকাপে সকলেই স্বাগত।
সেটা আবার একেবারেই পছন্দ হয়নি আল কায়দার মতো দুনিয়ার এক নম্বর জঙ্গী সংগঠনের। জঙ্গি সংগঠনটি বিশ্বের সমস্ত ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষকে এই বিশ্বকাপ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। কাতার বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে কট্টর ইসলামপন্থী এই জঙ্গি সংগঠনটির মূল অভিযোগ, ইসলামের নৈতিক বিধি লঙ্ঘন করছেন কর্তৃপক্ষ। মুসলিম দেশটিতে বিশ্বকাপের সুবাদে অনেক ‘অনৈতিক, সমকামী এবং দুর্নীতিবাজ মানুষ’ অবাধে প্রবেশ করছেন বলে দাবি তাদের। আল কায়দার অভিযোগ, বিশ্বকাপের মাধ্যমে কাতারের সংস্কৃতি, যাবতীয় ইসলামপন্থী রীতিনীতি ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছেন এক দল মানুষ। তাঁদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে এই জঙ্গি সংগঠন। কাতার বিশ্বকাপের মাধ্যমে আরবীয় মালভূমিতে নাস্তিকতার অনুপ্রবেশ ঘটছে বলেও দাবি আল কায়দার।
কাতারের সমকামিতা বিরোধী অবস্থানের জন্য ‘ওয়ান লাভ ব্যান্ড’, যা কিনা সমপ্রেমের প্রতীক — তা পরার কথা ছিল অনেক ফুটবলারের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কাতারের তরফে জারি হওয়া নানা অন্যায় ফতোয়া যেমন ফিফা মুখ বুজে মেনে নিয়েছে, তেমনি ফুটবলারদের এই ব্যান্ড পরার অনুমতিও দেয়নি। বলেছে এই ব্যান্ড পরে মাঠে নামলেই হলুদ কার্ড দেখানো হবে। কাতারের মতো একটি দেশকে ফিফা কেন বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো টুর্নামেন্ট আয়োজনের দায়িত্ব দিল, সেই প্রশ্ন ও নানা সন্দেহ আগেও উঠেছিল। সমালোচকেরা অনেকেই বলছেন যে বিপুল পরিমাণ কাতার ডলারের প্রলোভনে ফিফা কর্মকর্তারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
সব মিলিয়ে কাতার বিশ্বকাপ শুরু থেকেই নানা বিতর্কে জর্জরিত। চারিদিকে মৌলবাদের আস্ফালনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ইরানের ফুটবলারদের নজিরবিহীন প্রতিবাদ।
- সৌভিক ঘোষাল
== 000 ===