প্রতিবেদন
কাশ্মীর দখলের লক্ষ্যে ছকা হল আর একটা কৌশল
to capture Kashmir

গত ১৭ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার হৃদেশ কুমার সিং সাংবাদিকদের সামনে বললেন — যাঁরা নানান কাজে এখন জম্মু ও কাশ্মীরে বাস করছেন, অন্য রাজ্যের বাসিন্দা হলেও কাশ্মীরে নিয়োজিত রয়েছেন, তাঁরা জম্মু ও কাশ্মীরের ভোটার তালিকায় নাম তুলে সেখানে ভোট দিতে পারবেন। কমিশনের কথায়, “ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য ডোমিসাইল সার্টিফিকেট লাগবে না। জম্মু ও কাশ্মীরে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানরাও ভোটার তালিকায় নাম লেখাতে পারবেন। এছাড়া, বাইরে থেকে আসা চাকরিজীবী, পড়ুয়ারাও ভোট দিতে পারবেন।” ভোটার তালিকায় বহিরাগতদের অন্তর্ভুক্তির এই সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের জনগণের কাছে, কাশ্মীরের প্রধান দলগুলোর কাছে পিছনের দরজা দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচনকে প্রভাবিত করা এবং কাশ্মীরের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার হরণের নকশা বলেই প্রতিভাত হল। ফলে, কাশ্মীরে এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ উঠল। এর মোকাবিলায় জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানালো “এটা কায়েমি স্বার্থের দ্বারা বাস্তব তথ্যের ভ্রান্তিজনক উপস্থাপনা। ভোটার তালিকার এই পরিমার্জনা জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বর্তমান বাসিন্দাদের নিয়েই হবে এবং ভোটার সংখ্যার বৃদ্ধি তাদের নিয়েই হবে যাদের বয়স ২০২২’র ১ অক্টোবর বা তার আগে ১৮ বছর হবে।” বয়স ১৮ বছর হলে ভোটার তালিকায় নাম তোলাটা সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের নিয়ম এবং জম্মু ও কাশ্মীর তার ব্যতিক্রম হতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, জম্মু ও কাশ্মীরে কর্মরত বহিরাগতরাও ভোটার রূপে ভোটার তালিকায় নাম তুলতে পারবেন বলে মুখ্য নির্বাচনী অফিসার যা বললেন, প্রশাসনের দেওয়া বিজ্ঞাপনে কি তাকে নাকোচ করা হল? যাবতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টগুলোকে কায়েমি স্বার্থের হাতে ‘গুজব ছড়ানো’ বলে অভিহিত করা হলেও তার সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অস্বীকৃতি কিন্তু সরকারি বিজ্ঞাপনে ধরা পড়ল না। জম্মু ও কাশ্মীরের ‘বর্তমান বাসিন্দারাই’ তালিকায় স্থান পাবেন বলে যা বলা হল, সেই বাসিন্দারা যে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা, বিজ্ঞাপন তাকে সংশয়হীন করল না। বিপরীতে, জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসনের ঐ বিজ্ঞাপনের মধ্যেই যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল তার আভাস মিলল কয়েক দিন পর প্রকাশিত আর একটা সংবাদে। ঐ সংবাদ জানালো, ভোটার তালিকায় নাম ছিল এমন যে সমস্ত হিন্দু-শিখ পরিবার ৯০’র দশকে উপত্যকা ছেড়েছিলেন, তাঁরাও জম্মু ও কাশ্মীরের আসন্ন নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। এই বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৫ আগস্ট প্রকাশিত এক রিপোর্টের অংশবিশেষ প্রাসঙ্গিক বলে এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে, “বিজেপির দাবি ১৯৯০ সালে নথিভুক্ত রয়েছেন এমন ৬২ হাজার পরিবার উপত্যকা ছেড়েছিলেন। আজ তাঁদের জনসংখ্যা ২.২০ লক্ষ। তাঁদের মধ্যে ১.৮০ লক্ষের বয়স ১৮’র বেশি। এদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের শরণার্থী এলাকার ভোটার কার্ড ছেড়ে কাশ্মীরে নিজেদের অতীত ঠিকানায় ভোটার তালিকায় নাম তোলার আবেদন জানাবেন, তাঁরাই ভোটার হিসাবে গণ্য হবেন। কমিশন জানিয়েছে, ওই ভোটাররা যেখানে রয়েছেন, সেখানেই একাধিক ভোট কেন্দ্র তৈরি করা হবে। দিল্লীতে যেমন জম্মু-কাশ্মীর ভবন, কাপাসেরা, শালিমার গার্ডেন এলাকায় ভোটকেন্দ্র গড়া হবে।”

election commission in kashmir

জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচনে বিজেপির সুবিধালাভের লক্ষ্যে আর একটা কৌশলের অবলম্বন এরআগে আমরা দেখেছি। ডিলিমিটেশন কমিশনকে দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটানো হল। দেখা গেল, ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে (তারপর কোনো জনগণনা আর হয়নি) জম্মু অঞ্চলের জনসংখ্যা (৫৩,৫০,৮১১, তৎকালীন রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৪২.৮৯ শতাংশ) কাশ্মীর উপত্যকার জনসংখ্যার (৬৮,৮৮,৪৭৫, মোট জনসংখ্যার ৫৪.৯৩ শতাংশ) তুলনায় যথেষ্ট কম হলেও ডিলিমিটেশন কমিশন জম্মুর আসন সংখ্যাকে ৩৭ থেকে ৬টা বাড়িয়ে করল ৪৩, আর কাশ্মীর উপত্যকার আসন সংখ্যা মাত্র ১টা বেড়ে ৪৬ থেকে ৪৭ হল। জম্মুতে হিন্দু জনসংখ্যার প্রাধান্য, এবং সেখানে বিজেপির প্রভাবই অন্যদলের চেয়ে বেশি। জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি যে ২৫টা আসন পেয়েছিল তার সবকটাই এসেছিল জম্মু অঞ্চল থেকে। অতএব, জম্মু অঞ্চলে আসন বেশি বাড়লে সেগুলো বিজেপির ঝুলিতে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ডিলিমিটেশন কমিশনের সদস্যরা সেটা জানতেন না তা নয়, আর তাই জনসংখ্যার বিচারকে গুরুত্বহীন করে ডিলিমিটেশন কমিশন এই লক্ষ্যেই নিজেদের চালিত করল। কাশ্মীর উপত্যকার তুলনায় জম্মুর আসন সংখ্যাকে ছ’গুণ বাড়ানো এবং এখন আবার বহিরাগতদের জম্মু ও কাশ্মীরের ভোটার তালিকায় নাম ঢোকানোর দুরভিসন্ধি একটা বিষয়কেই প্রতিপন্ন করছে — জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচনে বিজয় হাসিলের জন্য সেখানকার নির্বাচকমণ্ডলীর ওপর আস্থা বিজেপির এবং নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের নেই। আজ সিবিআই, ইডি ও আয়কর দপ্তরের মতো ডিলিমিটেশন কমিশন এবং নির্বাচন কমিশনও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে বিজেপির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং বিরোধী পক্ষকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যেই কাজ করছে। জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে দুই কমিশনের সিদ্ধান্তের সমালোচনায় পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি বলেছেন, “নির্বাচনে রিগিং করা হয় কখনও নির্বাচন চলার সময়, কখনও তার পরে, যেমনটা আমরা মহারাষ্ট্র সহ কয়েকটা রাজ্যে দেখেছি। ইডির মতো সংস্থাগুলোকে এই ধরনের রিগিং’এর কাজে লাগানো হচ্ছে।” জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ডিলিমিটেশন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তগুলো কারচুপি তথা রিগিং’এরই নামান্তর।

পিডিপি-বিজেপি জোট সরকারের ওপর থেকে বিজেপি ২০১৮’র ১৯ জুন সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় চার বছরেরও বেশি সময় ধরে জম্মু ও কাশ্মীরে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই। এরপর এল ২০১৯’র ৫ আগস্টের সেই বিপর্যয়কর দিন, যেদিন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা হরণ করে তাকে দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হল, ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলের মধ্যে দিয়ে কাশ্মীরের বিশেষ ব্যবস্থা ও অধিকারগুলোর বিলোপ ঘটানো হল। এছাড়া, জম্মু ও কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ চরিত্রকে পাল্টানোটাও বিজেপির কাছে এক গুরুত্বের এজেন্ডা। এখানে কখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তার কোনো স্থিরতা নেই। আবার, নির্বাচন হলেই জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। এসবের বিরুদ্ধে দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ লড়াইটাই যে জরুরি তার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তার সংকেত কোথায়? সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিরোধী ঐক্যের চেহারা যেমন, জম্মু ও কাশ্মীরের প্রধান দলগুলোর ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম বলে দেখা যাচ্ছে। গুলাম নবি আজাদ কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে কাশ্মীরে নতুন দল গড়ার কথা বলেছেন। সেই দল নির্বাচনে লড়লে বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে বিজেপিরই সুবিধা হবে। পাঁচটা দলের যে গুপকর জোট কাশ্মীরের বিরুদ্ধে সংঘটিত সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়ার কথা বলেছিল, তাদের ঐক্যও এখন নড়বড় করছে। ন্যাশনাল কনফারেন্স সভাপতি ওমর আবদুল্লা গুপকর জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং আসন্ন নির্বাচনে ৯০টা আসনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বললেন। পরে অবশ্য তাঁর বাবা ফারুক আবদুল্লা বললেন যে, ঐ জোট কখনই গুটিয়ে যাবে না। আমাদের দেশের নেতারা আর কবে ফ্যাসিবাদের বিপদকে যথাযথ মাত্রায় অনুধাবন করে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে নিজেদের সমর্পিত করবেন?

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-29
সংখ্যা-34