সপ্তাহের প্রথম দিন, গত ১৭ অক্টোবর ২০১৪ সালের টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা অনশন-বিক্ষোভ শুরু করেন। সল্টলেক করুণাময়ীতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সামনে বিক্ষোভকারীরা ধর্ণায় বসেন৷ তারা সাফ জানায়, নিয়োগপত্র হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেকার যুবক-যুবতীরা এসে ভীড় করেছে কলকাতার বুকে। বেকার সমস্যা সমাধানে বরাবরই সরকার ব্যর্থ। টেট-এসএসসি চাকরিপ্রার্থীরা দিনের পর দিন চাকরির দাবিতে দফায় দফায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
আন্দোলনের তৃতীয় দিনে অর্থাৎ ১৯ অক্টোবর, আইসা এবং আরওয়াইএ-র পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল অবস্থান মঞ্চে যায় এবং সরাসরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। অনশনরত চাকরিপ্রার্থী পিয়ালি গুছাইত, নমিতা দাস অধিকারী, আমিনা সুলতানা, অচিন্ত্য ধারা বলেন নিজেদের সমস্যার কথা। এদের কারোর বাড়ি হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণা, কারোর বর্ধমান, কেউ বা থাকেন অন্য কোথাও। অথচ, পরিবারের ছবি সকলেরই প্রায় এক। মহিলারা কেউ সন্তানদের ফেলে এসে অবস্থান করছে, কেউ আবার সন্তানদের কোলে নিয়ে শহরের বুকে রাত কাটাচ্ছে। আর্থিক অনটনের কারণে অনেকেই টিউশন পড়িয়ে দিন গুজরান করে। কেউ অস্থায়ী ক্ষেত্রে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালায়। দেশের অন্যান্য যুবদের মতো এদেরও দু’বেলা অন্নসংস্থান ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। তাই আন্দোলনকারীরা সকলেই সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় শিক্ষকতার চাকরি চেয়ে অনশনে বসেন।
আন্দোলনে সামিল হওয়া সকল যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের ন্যায্য দাবিদাওয়াকে পূর্ণ সমর্থন জানায় আইসা-আরওয়াইএ।
পরদিন, অর্থাৎ ২০ অক্টোবর পুলিশবাহিনী রাতের অন্ধকারে এই বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা করে। পুরুষ পুলিশেরা মহিলা আন্দোলনকারীদের মারধোর করে। অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক তাদের অনশন ভেঙে দিয়ে আন্দোলনকারীদের তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করা হয়।
এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদে রাস্তায় নামে আইসা, আরওয়াইএ, পিডিএসএস, এপিডিআর সহ বিভিন্ন গণসংগঠন।
হাওড়া
মধ্যরাত্রে পুলিশী অভিযান ও আন্দোলনকারীদের রাতের অন্ধকারে গ্রেপ্তারের ঘটনার বিরুদ্ধে ২১ অক্টোবর হাওড়ার বাগনানে ও বালিতে জোড়া সভা ও পথ অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। বাগনানে আইসা, আয়ারলা এবং বালিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বালি-বেলুড় লোকাল কমিটি ও আইসা বালি-বেলুড় জোনালের যৌথ উদ্যোগে সংগঠিত হয় বিক্ষোভ কর্মসূচি।
হাওড়ার রামরাজাতলা, আড়ুপাড়া, জগৎবল্লভপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় এই ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে হয় পোস্টারিং।
হুগলী
চারিদিক দীপাবলির লাউডস্পিকারে মুখর, কোথাও কোথাও বড় করে পুজোপ্যান্ডেল উদ্বোধন চলছিল। তার মধ্যেও ২৩ অক্টোবর (রবিবার) সন্ধ্যায় হুগলিতে পথে নামলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উত্তরপাড়া থানা এরিয়ার কমরেডরা। উৎসবের পরিবেশেও যথেষ্ট সংগঠিত, উজ্জীবিত আর মুখর মিছিল চললো ২নং কলোনি বাজার থেকে হিন্দমোটর ইঁটখোলা মোড়, ধর্মতলা বাসস্টপেজ দিয়ে জিটি রোড পরিক্রমা করে কোন্নগর বাটা থেকে ক্রাইপার রোড হয়ে মনসাতলা ও মাস্টারপাড়া পেরিয়ে আবারও পার্টি অফিস। সল্টলেকের করুণাময়ী থেকে কয়েকদিন আগে গভীর রাতে অনশনরত যে টেট উত্তীর্ণ তরুণ-তরুণীদের তৃণমূল সরকারের পুলিশ জোর করে তুলে নিয়ে যায় কিম্বা গান্ধী মূর্তির নীচে বসে থেকে সব উৎসব তুচ্ছ করে যে এসএসসি চাকরীপ্রার্থীরা দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে প্রায় ৬০০ দিন কাটিয়ে ফেললো তারা আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরাই। এটা অনুভবে ছিল তাই নেমে পড়া গেল। উপস্থিত ছিলেন পার্টির জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার।
শিলিগুড়ি
জমি, আবাস, বকেয়া মজুরির দাবিতে, শিলিগুড়ি শহর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভয়াবহ ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যর্থ প্রশাসনের বিরুদ্ধে, তৃণমূলের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সল্টলেক করুনাময়ীতে অনশনকারীদের উপর পুলিশী হামলার বিরুদ্ধে, জিএন সাইবাবা সহ সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির দাবিতে আজ শিলিগুড়ি পোস্ট অফিসের সামনে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে দুপুর ৩টে থেকে ৫টা গণঅবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। এই গণঅবস্থানের উদ্যোক্তা সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও সারা ভারত গ্রামীণ ও কৃষিমজুর সমিতি। এই গণঅবস্থানে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু, সারা ভারত কিষাণ মহাসভার দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, সারা ভারত গ্রামীণ ও কৃষিমজুর সমিতির পক্ষে শ্যামল ভৌমিক, তিস্তা মহানন্দা ভূমিরক্ষা কমিটির নেতা কৃষ্ণপদ সিংহ প্রমুখ। সভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন মীরা চতুর্বেদী ও গৌতম চক্রবর্তী। গণঅবস্থান থেকে আগামী ১৪-১৫ নভেম্বর ২০২২ হুগলীর চন্দননগরে সারা ভারত গ্রামীণ শ্রমিক ও কৃষি মজুর সমিতির ৭ম সর্বভারতীয় সম্মেলন সফল করে তোলার আহ্বান জানানো হয়।
বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত তিনটে রিপোর্ট রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। সেই রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে শহরাঞ্চলের তুলনায় ভারতের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র লাফ দিয়ে বেড়েছে চারগুণ, যেখানে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন। আর এই রিপোর্টগুলো আবার দেখিয়ে দিল, স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে যে অমৃতকালের গন্তব্যে মোদীর ভারত এগিয়ে চলেছে তার প্রকৃত স্বরূপ কী? রিপোর্টগুলো থেকে প্রমাণিত, বহু ঢাক পেটানো দারিদ্র দূরীকরণের কর্মসূচি শুধু মন্থরই হয়নি, বরং তা অতিমারীর সময়কালে আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচক দেখাল, ১২১টি দেশের মধ্যে ভারত এ’বছর ছ’ধাপ নীচে নেমে ১০৭এ এসে দাঁড়িয়েছে। আর, ২৯.১ ক্ষুধা সূচকের স্কোর নিয়ে ভারত গুরুতর খাদ্য সংকটের দেশগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নিল। ভারতের বেশ কয়েক ধাপ নীচে নেমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণই হল ভারতের শিশু ‘ওয়েস্টিং’ হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি, ১৯.৩ শতাংশ, যার অর্থ, আমাদের দেশে শিশুদের ওজন তাদের উচ্চতার তুলনায় সবচেয়ে কম! শিশুদের অপুষ্ঠি বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের এক অন্যতম প্রধান মানদণ্ড। আর, মোট চারটের মধ্যে তিনটিই হল শিশুদের অপুষ্ঠি সংক্রান্ত বিষয়ক। ক্ষুধা সূচকের এই হার প্রমাণ করে পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয় করার সামর্থ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেই। সুষম আহারের জন্য যে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করা দরকার তা, বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুল্যতে এই অপুষ্ঠি জনিত সমস্যা আরও গুরুতর। ওই রাজ্যগুলো এমনকি ডিম খাওয়ার উপরও নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করায় মিড-ডে-মিলে বহু স্কুলে ডিম বন্ধ হয়ে যায়, ফলে গরিব শিশুরা পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই সমস্যার সাথে যুক্ত হল গ্রামীণ দারিদ্র, যা শহরাঞ্চলের তুলনায় চারগুণ বেশি!
আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাঙ্ক — ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার্ড প্রসপারিটি’। এই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, অতিমারী ও ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে নতুন করে ৭ কোটি মানুষকে ঠেলে নামিয়েছে চূড়ান্ত দারিদ্রসীমার নীচে। আর, তীব্র আর্থিক সংকোচনের দরুণ ভারত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। যদিও রিপোর্ট জানিয়েছে, ২০২০’র দারিদ্র সংক্রান্ত সম্পূর্ণ তথ্য এখনও চূড়ান্ত হয়নি, তবে প্রাথমিক তথ্য দেখায় দেশব্যাপী ৫.৬ কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্রের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এটাই প্রমাণ করে, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প ও বহু বিজ্ঞাপিত নিখরচায় খাদ্য সরবরাহের সরকারি দাবি আখেরে অতিমারীর সময় সাধারণ মানুষের বিরাট দুর্দশাকে বিন্দুমাত্র লাঘব করতে পারেনি।
দেশের গ্রামাঞ্চলে যখন এতো গভীর আর্থিক দুর্দশা, তখন নিদেন পক্ষে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে গ্রামীণ মানুষদের কাজ দিয়ে এই সংকট মোচনে কিছুটা উপশম ঘটানো যেত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ছ’মাসে (এপ্রিল-অক্টোবর ২০২২) প্রায় ১.৫ কোটি কর্মপ্রত্যাশী কাজের আবেদন জানানো সত্ত্বেও কাজ পাননি। বলা ভালো, তাঁদের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এমনকি ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২, এই দু’বছরে অতিমারীর প্রবল ঢেউ’এর মধ্যেও এবং কাজের বিরাট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কাজ প্রত্যাখ্যানের হার ছিল অস্বাভাবিক হারে বেশি। ২০২০-২১-এ প্রথম লকডাউনের ফলে সমস্ত কাজকর্ম যখন থমকে দাঁড়ায়, দু’পয়সা আয় করার জন্য সকলেই যখন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছিলেন, তখন ১৩.৩ কোটি মানুষ ১০০ দিনের কাজের জন্য নাম তোলেন। কিন্তু দেখা গেল, ১১.২ কোটি কর্মপ্রত্যাশীকে কাজ দিয়ে ২.১ কোটি মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া হল। ২০২১-২২’র দ্বিতীয় অতিমারীর মারাত্মক পর্বেও ১.৭৩ কোটি মানুষকে কাজ না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে, ইউএনডিপি এবং অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যান্ড হিউমান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’এর তৈরি করা ‘গ্লোবাল মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স ২০২২’ দুটো পর্যায়ে দারিদ্র হ্রাসের একটা তুলনামূলক পার্থক্য টেনেছে। এই দু’টো পর্ব হল — ২০০৫-০৬ এবং ২০১৫-১৬। প্রথম পর্বে দারিদ্র হ্রাস পাওয়ার হার দ্বিতীয় পর্বের তুলনায় অনেকটাই বেশি। তাই, দ্বিতীয় পর্বে, যা মোদী জমানাকে সূচিত করে, দারিদ্র কমার হার মন্থর হতে হতে ২২.৮ কোটি দরিদ্র জনসংখ্যায় এসে দাঁড়ায়, যা গোটা বিশ্বে সর্বাধিক! নির্মম বিরোধাভাস এটাই, গত কয়েক বছর রেকর্ড ফলন হওয়া সত্ত্বেও শহরের তুলনায় ভারতের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র প্রায় চারগুণ বেশি।
কর্পোরেট স্বার্থে দেশের গোটা কৃষি-ব্যবস্থাকে পরিচালিত করতে গিয়ে দেশের সুবিপুল জনসংখ্যার সর্বনাশ ডেকে আনল মোদী সরকার। সমগ্র কৃষি ক্ষেত্রকে ডোবাল নিকশ কালো আঁধারে। প্রায় বছরব্যাপী ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন মোদী সরকারকে কিছুটা পেছনে ঠেলতে সক্ষম হয়।
এই গভীর তমসাকে ছিন্ন ভিন্ন করার লক্ষ্যেই আজ এগিয়ে আসতে হবে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের পিছিয়ে পড়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০২০ সালে ১০৭টা দেশের মধ্যে ৯৪তম স্থান থেকে ২০২১ সালে ভারতের স্থান সাত ধাপ নেমে ১১৬টা দেশের মধ্যে হয়েছিল ১০১ এবং সর্বশেষ ২০২২’র সূচকে আরও ছ’ধাপ নেমে ১২১টা দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে ১০৭তম স্থানে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তান ছাড়া অন্য সব পড়শি দেশই তালিকায় ভারতের চেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বে সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ হিসাবে চীন এখনও ভারতের চেয়ে সামান্য এগিয়ে রয়েছে এবং বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে চীন অনেক এগিয়ে রয়েছে সেরা ১৭টা দেশের মধ্যে। অন্যভাবে বললে, চীনে ক্ষুধার প্রকোপ যথেষ্ট কম বলে গণ্য হলেও ভারতে তা যথেষ্ট গুরুতর বলেই বিবেচিত হচ্ছে। ভারতে শিশুদের ওয়েস্টিং হার (উচ্চতার তুলনায় ওজন কম হওয়া) — যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের তীব্র অপুষ্টিকে দেখায় — বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
মোদী সরকার ক্ষুধার মোকাবিলা করছে সর্বসাধারণের থেকে এর চর্চাকে নির্বাসিত করে এবং বিশ্ব ক্ষুধা সূচককে পশ্চিমের এক ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে। এক দশক আগে সঙ্ঘবাহিনী এবং মূল ধারার মিডিয়া মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার দাম কমা নিয়ে প্রচুর রোষ বর্ষণ করত। পেট্রল, রান্নার গ্যাস এবং জনসাধারণের আহার্য প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখন আকাশ ছুঁয়েছে আর ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম প্রতিদিনই কমছে, এবং ডলার প্রতি টাকার বিনিময় মূল্য ১০০ হতে আর সামান্যই বাকি রয়েছে। দশ বছর আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টাকার বিনিময় মূল্যের পতনকে দুর্বল সরকার এবং অর্থনৈতিক বে-বন্দোবস্তর চরম লক্ষণ বলে মন্তব্য করতেন। আর আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদী টাকার মূল্যের বিরামহীন পতন নিয়ে কানে তালা ধরানো মৌনতা অবলম্বন করেছেন আর অর্থমন্ত্রী এটাকে ব্যাখ্যা করছেন ডলারের শক্তি বৃদ্ধি হিসাবে! উদ্বেগজনক ক্ষুধা, পণ্যের তীব্র মূল্যস্ফীতি, টাকার মূল্যের ক্রমান্বয়ী ক্ষয় বা কর্মসংস্থান লোপ পাওয়ার বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর পরিবর্তে মোদী তাঁর শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে ‘ব্যবসা করার সহসাধ্যতা’র রূপকথা নিয়ে ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন। ঐ সূচকটাকে বিশ্বব্যাঙ্ক ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে পরিত্যাগ করেছে, কারণ, ঐ সূচকের অবস্থান নির্ণয়ে কিভাবে কারচুপি ঘটানো হয়েছে, এক নিরপেক্ষ অডিট তাকে উন্মোচিত করে দিয়েছিল।
সঙ্ঘবাহিনী খুব ভালো করেই জানে যে, মিথ্যা ছড়িয়ে এবং ঘৃণা চাউর করার মধ্যে দিয়েই তারা নির্বাচন জিততে পারে। হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাটের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে আমরা তাই ঘৃণা প্রচারের ওপর নতুন করে জোর পড়তে দেখছি। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিকে আমরা তার কর্ণাটক পরীক্ষাগারে হিজাব নিষিদ্ধকরণের পরীক্ষানিরীক্ষাকে পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে দেখেছিলাম। হিজাব নিষিদ্ধকরণ বিষয়টার ফয়সালা এখনও সুপ্রিম কোর্টে গড়িয়ে চললেও দিল্লী এবং জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের সঙ্ঘবাহিনীর নেতারা আরও একবার ঘৃণা উগরে চলেছেন, তাঁরা মুসলিমদের বয়কট করা থেকে সরাসরি গণহত্যা পর্যন্ত বিস্তৃত নির্যাতনের বিধান দিয়ে চলেছেন। আর, যে গুজরাটে মেরুকরণ শুরু হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী দিবসে, সেখানে নবরাত্রি উৎসব ও তার সাথে চলা গর্বা উৎসবে মেরুকরণকে তীব্র করে তোলা হল বেছে-বেছে মুসলিমদের উৎসব থেকে বাদ দেওয়া এবং সর্বসমক্ষে তাদের অবমাননা ঘটানো ও প্রহারের মধ্যে দিয়ে। এখন এটা সরকারিভাবেই নথিবদ্ধ যে, ১৫ আগস্ট বিলকিস বানো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষক ও খুনীদের মুক্তিতে অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, এবং তা করা হয়েছিল সিবিআই ও বিশেষ বিচারকের পরামর্শকে অগ্ৰাহ্য করে এবং ঐ মন্ত্রকেরই ঘোষণা করা মার্জনা নীতির বিপরীতে গিয়ে যে নীতি ধর্ষণ ও খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছিল।
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও ঘৃণার অভিযানকে তীব্রতর করে তুলেছে প্রবল শত্রুতা বোধ ও প্রতিশোধের রাষ্ট্রীয় মতবাদ। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের উল্লেখযোগ্য মন্তব্য ছিল এই যে, নাগরিক সমাজই হল একেবারে হালফিলের যুদ্ধের সীমানা। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যম, বিচারবিভাগ, এনজিও-সমূহ বা রাজনৈতিক দলগুলোর মতো প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার ধারণাকে জাতীয় ঐক্য ও নিরাপত্তার প্রতি সম্ভাবনাময় বিপদ বলে অভিহিত করে রাষ্ট্রের এই মতবাদকে এক নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রের এই শত্রুতার মতবাদ প্রশাসনকে চালিত করছে সরকার বিরোধী মত পোষণকারী নাগরিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার মামলা দায়ের করে তাদের উপর দানবীয় আইন চাপিয়ে বছরের পর জেলে আটক রাখতে, আর সর্বোচ্চ আদালত ৯০ শতাংশ শারীরিক অক্ষমতার হুইল চেয়ার বাহিত অধ্যাপকের মুক্তিকে এই যুক্তিতে বাতিল করছে যে, সন্ত্রাসবাদ বা মাওবাদে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে মগজই হল সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক অঙ্গ। ঘৃণার পেশাদার প্রচারকরা যখন অবাধে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে, তখন ঘৃণার বিরুদ্ধাচারণ করা উমর খলিদের মতো সমাজ আন্দোলনের কর্মীর জামিনের আবেদন এই বলে খারিজ করা হচ্ছে যে তার “কোনো যোগ্যতা নেই”।
ঘৃণা, মিথ্যাচার ও ভয়ের এই সার্বিক আবহে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান কী আদৌ সম্ভব? আমাদের মনে হচ্ছে যে, আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা ভাবি সেটা নির্বাচন কমিশন আর চায় না। বাস্তব পরিস্থিতিতে ভোটার তালিকাকে প্রণালীবদ্ধভাবে আধার কার্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যদিও আমাদের বলে চলেছে যে, এই সংযুক্তিকরণ একেবারেই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত বিষয় এবং আধারের বিশদ তথ্য না দিলে কোনো বর্তমান বা প্রত্যাশী ভোটারকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। বিজেপি এখন গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে নির্বাচনের আগে প্রকল্প চালু ও কর ছাড়ের কথা ঘোষণা করে চলেছে, আর নির্বাচন কমিশন আদর্শ নির্বাচন বিধিকে সংশোধন করে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইস্তাহারকে অর্থনৈতিক সাধ্যতা যাচাইয়ের অধীন করার প্রস্তাব করছে। নির্বাচন কমিশন এইভাবে নিজেকে রাজনৈতিক সেন্সারশিপের ক্ষমতার অধিকারী করে তুলতে চাইছে যা বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্পিরিটেরই বিপর্যয় ঘটাবে।
এছাড়াও, নির্বাচন কমিশন গুজরাটে স্বতন্ত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে যার ফলে ঐ সমস্ত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও শিল্প গোষ্ঠীসমূহ তাদের অধীনস্থ শ্রমিকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে নজরদারী চালাতে এবং যে শ্রমিকরা ভোট দেবে না তাদের নাম প্রকাশ করে অপদস্থ করতে পারবে! ভয় ও দাক্ষিণ্য মুক্ত অবাধ নির্বাচনের বদলে আমরা এমন একটা ব্যবস্থার উন্মোচন ঘটতে দেখছি যাতে আধার-ভোটার তালিকা সংযুক্তিকরণ এবং নির্বাচনে অংশগ্ৰহণ বিষয়ে কর্পোরেট নজরদারীর মাধ্যমে ভোটারদের হুমকি ও কড়া নজরের অধীন করে তোলা হবে। উল্লেখ নিষ্প্রোয়জন যে, ‘অংশগ্ৰহণে নজরদারী’ থেকে ভোটারের পছন্দকে প্রভাবিত ও নির্দেশিত করা এবং ফলকে নির্ধারিত করার মধ্যে দূরত্ব সামান্যই। রাষ্ট্র এইভাবে যখন সংসদীয় গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করার হুমকি দিচ্ছে, তখন নাগরিকদেরই সজাগ থেকে নির্বাচনী ক্ষেত্রকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে এবং জনগণের ইস্যু, সংগ্ৰাম ও অধিকারগুলোকে তুলে ধরে তাকে প্রাণবন্ত করে তুলে ঐ ফ্যাসিস্ত চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিতে হবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৮ অক্টোবর ২০২২)
নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিষয়ে আদর্শ নির্বাচন বিধিতে ভারতের নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত সংশোধনীর প্রশ্নে সিপিআই(এমএল)-এর পাঠানো উত্তর
এটা আমাদের সুবিবেচিত মতামত যে ০৪-০৪-২০২২ তারিখে ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক 437/6/ Manifesto/ECI/INST/FUNCT/MCC/2015নং পত্রের মাধ্যমে জারি করা প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি আইনসিদ্ধ নয় এবং এগুলি প্রকৃতিগতভাবে অগণতান্ত্রিক।
একদম শুরুতেই আমরা আপনার নজরে আনতে চাই যে ভারতীয় সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে ভোটার তালিকা তৈরির নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতা ও দায়িত্ব ভারতের নির্বাচন কমিশনের উপর অর্পিত। সংবাদ মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে (No power to check parties, governments from promising freebies: ECI to SC, Indian Express, April 9, 2022) যে, ECI নিজেই সুপ্রিম কোর্টে তার দাখিল করা হলফনামায় এই সাংবিধানিক প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছে (অশ্বিনী কুমার উপাধ্যায় বনাম ভারতের ইউনিয়ন মামলা)।
ECI দ্বারা জমা দেওয়া হলফনামা থেকে উদ্ধৃতি। “নির্বাচনের আগে বা পরে বিনামূল্যে কিছু দেওয়ার যে কোনও প্রতিশ্রুতি/বণ্টন সংশ্লিষ্ট দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং সেই প্রতিশ্রুত নীতিগুলি আর্থিকভাবে কার্যকর কিনা বা সেগুলি রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে কিনা সে প্রশ্ন রাজ্যের ভোটারদের বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়৷ বিজয়ী দল সরকার গঠন করে রাজ্যে কোন নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তা ভারতের নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আইনে সেরকম কোনও প্রবিধান ছাড়াই তা করলে সেটা হবে ক্ষমতার ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করা।”
এই ধরনের কোনো ক্ষমতা না থাকার কথা স্বীকার করা সত্ত্বেও ECI দ্বারা নির্ধারিত প্রফর্মাটি সেই ক্ষমতার সীমা অতিক্রমের কাজটাই করছে। এটা লাগু হলে রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের নিজস্ব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বিশদ পরিকল্পনা প্রদান করতে হবে, সুবিধাপ্রাপকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এবং প্রতিশ্রুত রূপায়নে প্রয়োজনীয় আর্থিক সঙ্গতির উৎস ও পদ্ধতি বিশদে নির্ধারণ করতে হবে। এরকম প্রফর্মা চালু হলে তা ক্ষমতাসীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী ইশতেহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার অযাচিত ক্ষমতা দেবে যা বাস্তবে নির্বাচনকেই নিয়ন্ত্রিত করার নামান্তর।
আসুন আগে আমরা একটা বিষয় স্পষ্ট করে নিই যে, দেশের দুর্দশাগ্রস্ত জনতাকে তাৎক্ষণিক ত্রাণ দেওয়ার এবং জনসংখ্যার বঞ্চিত ও প্রান্তিক অংশগুলির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাকে উন্নত করার প্রয়োজনীয় কল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলিকে ‘দান-খয়রাতি’ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করব। ‘দান-খয়রাতি’ বলে যদি কিছুকে চিহ্নিত করতে হয় তাহলে প্রকৃতপক্ষে বড় বড় কর্পোরেট ও অতি ধনীদের দেওয়া কর ছাড় ও কর ছুটি, সস্তা ঋণ, ঋণের ছাড়পত্র বা ঋণ মকুব, সরকারি সম্পত্তি বেচে এবং বিভিন্ন উপায়ে প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রভূত সুবিধা লোটা ইত্যাদিকে চিহ্নিত করতে হবে।
এই ধরনের ‘দান-খয়রাতি’ সরকারী কোষাগারের উপর এক বিশাল বোঝা। এই প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর সরকারি কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। ২০২০-২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটদের আয়কর, আবগারি ও শুল্ক মকুব করে দিয়ে অতি ধনীদের ৫,৫১,০০০ কোটি টাকা লুট দিয়েছে। তার আগের বছর লুটের পরিমাণ ছিল ৫,০০,৮২৩ কোটি টাকা। আর ২০০৫-০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হিসেব করলে সে লুট মোট ৪২ ট্রিলিয়ন টাকারও বেশি।
আমাদের সংবিধান ভারতের জনগণের কাছে সমতা ও সার্বিক সুবিচারের এক মহান অঙ্গীকার করেছে। মৌলিক অধিকার ছাড়াও, আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার প্রতি নির্দেশমূলক নীতিমালার একটি বিভাগ রয়েছে যা প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারের নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করার কথা। তা না করে প্রস্তাবিত সংশোধনী এবং নির্ধারিত প্রফর্মাটি নির্বাচনী ইশতেহারকে চলতি বাজেট বরাদ্দের অধীনস্থ করতে চায় যে বাজেট জনগণকে সর্বজনীন খাদ্য নিরাপত্তা, আশ্রয়ের অধিকার বা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে নিদারুণ ব্যর্থ। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর আমরা বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচকে ১২২টি দেশের মধ্যে ভারতকে ১০৭তম স্থানে দেখতে পাচ্ছি।
সমগ্র নীতি-নির্ধারণ ও বাজেট অনুশীলনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত অগ্রাধিকারগুলিকে পুনর্বিন্যস্ত করা ও প্রয়োজনীয় সংস্থানগুলিকে একত্রিত করা এবং আমাদের জনগণের মৌলিক অধিকার ও তাদের সর্বোত্তম কল্যাণ নিশ্চিত করতে সেগুলিকে যথাযথ উপায়ে ব্যবহার করা। জনগণ রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের ট্র্যাক রেকর্ডের ভিত্তিতে বিচার করবে, বিশেষত ভোট দিয়ে যাদের ক্ষমতায় আনা হয়েছে তাদের কাছে জবাবদিহি চাইবে। রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরির স্বাধীনতার উপর আমলাতান্ত্রিক যথাস্থিতিবাদী যাচাই-বাছাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রগতিকে এবং জনগণের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপায় এই নির্বাচনী গণতন্ত্রকে এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির গতিশীলতা ও ভূমিকাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
তাই আমরা প্রস্তাবিত সংশোধনীটিকে পত্রপাঠ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছি এবং সাংবিধানিক এখতিয়ার উল্লঙ্ঘন করে, ECI’এর নিজস্ব বিবৃতিকে লঙ্ঘন করে এই রকম অযৌক্তিক একটি প্রবিধান ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অতিরেক সম্পন্ন একটি ধারণা চালু করা থেকে বিরত থাকতে ECI’কে অনুরোধ করছি।
সিজিটি’র নেতৃত্বে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও মজুরি ক্ষয়ের বিরুদ্ধে সমগ্র ফ্রান্স জুড়ে সর্বস্তরের শ্রমিক ও পেশাভিত্তিক কর্মীদের সংগ্রাম যা ১৮ অক্টোবর ২০২২ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের রূপ নিল, আমরা, অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ট্রেড ইউনিয়ন্স সেই আন্দোলনকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন ও সংহতি জানাচ্ছি। ধর্মঘটি সংগ্রামরত শ্রমিকদের ধর্মঘট ভেঙে কাজে যোগ দিতে ফরাসি সরকারের জবরদস্তি করার চরম অগণতান্ত্রিক, আইন বহির্ভূত পদক্ষেপকে আমরা তীব্র ভাষায় নিন্দা ও বিরোধিতা করছি।
কোভিডের সময়কাল থেকেই আমরা বিশ্বজুড়েই দেখছি সরকারগুলো কর্পোরেশনগুলোর সাথে গাঁঠছড়া বেঁধে শ্রমিক শ্রেণির বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত অধিকারগুলি হরণ করে নিচ্ছে। আর্থিক সংকটের গালগপ্পো শুনিয়ে সরকার ও কর্পোরেশনগুলো সারা দুনিয়াজুড়েই মজুরি সংকোচন ও নির্বিচারে ছাঁটাই’এর অভিযান শুরু করেছে। অন্যদিকে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও দৈনন্দিন জীবনধারণ এতই ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে যে সমগ্র বিশ্বেই শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকায় নেমে এসেছে এক বিপর্যয়কারী প্রভাব।
ভারতবর্ষেও আমরা লক্ষ্য করছি, অতি দক্ষিণপন্থী মোদী সরকার, শ্রমিক কৃষকদের অধিকারকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। নয়া শ্রমকোড, রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ, বৃহৎ বেসরকারি কর্পোরেশনগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে জনগণের জাগ্রত সংগ্রামগুলোর উপর নির্মম দমন প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। ভারতে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন সরকারের ওই সমস্ত শ্রমিক বিরোধী পদক্ষেপগুলোকে অবিচলভাবে প্রতিরোধ করে চলেছে।
বিত্তশালী ও ক্ষমতাবানেরা দুনিয়াজুড়েই অতিমারীর সংকটকে নিজেদের সুযোগে পরিণত করতে উন্মত্ত গতিতে জনবিরোধী নয়া উদারবাদী সংস্কারগুলোকে রূপায়িত করছে।
আমরা ফ্রান্সের শ্রমিকশ্রেণিকে, সিজিটি’র সমস্ত কর্মী বাহিনীকে রাষ্ট্রপতি এমানুল মাঁকর’এর শ্রমিকশ্রেণি বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সাধারণ ধর্মঘট সফল করার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। ফ্রান্সের এই ধর্মঘটের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের চলমান আন্দোলন নিশ্চিতভাবেই শ্রমিক শ্রেণিকে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যেতে উদ্বুদ্ধ করবে।
আমরা তাদের স্থান ছেড়ে দেব না। শ্রমিকশ্রেণি ও মেহনতি মানুষেরাই নিজেদের ঘাম রক্তে এই পৃথিবীকে গড়ে তুলেছেন। সারা দুনিয়াজুড়ে ধর্মঘটের পাশাপাশি প্রত্যক্ষ রাস্তার লড়াই এই বার্তাই এনে দিচ্ছে যে শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা বিপন্নকারী কোনও পদক্ষেপকেই বরদাস্ত করা হবে না, তার বিরুদ্ধে চলবে নিরন্তর লড়াই।
দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য দীর্ঘজীবী হোক।
ভারত ও ফ্রান্সের শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য দীর্ঘজীবী হোক।
মজবুত হোক সংগ্রামী সংহতি।
- রাজিভ ডিমরি, সাধারণ সম্পাদক, এআইসিসিটিইউ
কুমারঘাটে মন্ত্রীপুত্রের ভাড়া করা বাড়িতে সংগঠিত গণধর্ষণের শিকার কিশোরীর প্রতি ন্যায়বিচার, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মন্ত্রী ভগবান দাসকে সাময়িকভাবে নিলম্বিত করতে হবে
১৯ অক্টোবর সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি এক প্রেস বিবৃতিতে জানান — ঊনকোটি জেলার কুমারঘাটে মন্ত্রী ভগবান দাসের পুত্রের ভাড়া করা বাড়িতে ১৫ বছরের এক কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়। মন্ত্রীপুত্র ও ঘনিষ্ঠ একাধিক ৪/৫ জন এই গণধর্ষণ কাণ্ডের সাথে যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্তরা একটি তিনতলা বাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁকে গণধর্ষণ করে। পরে পুলিশ ধর্ষিতা কিশোরীকে উদ্ধার করে। জবানবন্দিতেই উঠে আসে অভিযুক্তদের নাম। এক্ষেত্রে মন্ত্রীপুত্রের নাম মূল অভিযুক্ত হিসেবে উঠে এসেছে বলে খবরে প্রকাশ। কিন্তু পুলিশ মন্ত্রীপুত্রকে গ্রেপ্তার করছে না। গণধর্ষণে ব্যবহৃত ভাড়া করা বাড়িটিকে সিল করেছে ও একটি গাড়ি হেফাজতে নিয়েছে। গাড়ির চালক, একজন মহিলা ও একজন মূল অভিযুক্ত সহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু শাসক দল বিজেপি ও পুলিশ কর্তৃক মূল অভিযুক্তকে আড়াল করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ ইতিমধ্যে মূল অভিযুক্ত নাকি দিল্লীতে আত্মগোপন করেছে বলে সংবাদ। অথচ পুলিশ নিশ্চুপ। কারণ রাজ্য মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তরের মন্ত্রী ভগবান দাস নিজের পুত্রকে বাঁচানোর জন্য দলীয় ও প্রশাসনিক ক্ষমতাকে খোলাখুলিভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। কিন্তু নিজের মন্ত্রীসভার সদস্যের পুত্রের এই গণধর্ষণ কাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠার পর থেকে রাজ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অদ্ভুতভাবে নীরব। মুখ খুলছেন না। এটাই মুখ্যমন্ত্রীর সুশাসনের আসল নমুনা। সুশাসন তাই আজ দু-শাসনের নামান্তর। তাই কুমারঘাট মহকুমার মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। মূল অভিযুক্তদের ও মন্ত্রীপুত্রের গ্রেপ্তারের দাবিতে থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
বিজেপি’র শাসনকালে এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কারণ গত সাড়ে চার বছরে রাজ্যে ৪৬০টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ৩৬৩ জন মেয়ে আজও নিখোঁজ রয়েছে। রাজ্য মহিলা কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ। কন্যা ও নারীদের কোনো নিরাপত্তা নেই। আইনের শাসন বিপন্ন। বিজেপি মুখে বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’এর কথা বলে। কাজে ঠিক তার উল্টো। যেমনটা আমরা উত্তরপ্রদেশে যোগীর রাজ্যে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২০১৯-এ উন্নাও ধর্ষণকান্ডে ও আক্রান্তের পিতা, মাসি সহ তিনজন স্বাক্ষীকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিধায়ক কুলদীপ সিং সিঙ্গার, সম্প্রতি উত্তরাখন্ডে আমরা বিজেপির নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী বিনোদ আর্যের পুত্র পুলকিৎ আর্য কর্তৃক অঙ্কিতা গণধর্ষণ ও হত্যার সমস্ত তথ্য প্রমাণ লোপাট করা ও গুজরাটের বিলকিস বানুর গণধর্ষণকারীদের মাঝপথে কারাদণ্ড মুকুব করার বেলায় দেখেছি। গত বিধানসভার অধিবেশনে রাজ্য আইনমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ গোমতী ডেয়ারি চেয়ারম্যান কর্তৃক ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। কিন্তু আইনমন্ত্রী তা ধামাচাপা দিতে বলপ্রয়োগ করেন। যাতে করে বিজেপির নারীদের প্রতি মধ্যযুগীয় পিতৃতান্ত্রিক, মনুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণিত হয়।
তাই আমাদের দাবি কুমারঘাট গণধর্ষণ কান্ডে আক্রান্ত কিশোরী ও তাঁর পরিবারকে ন্যায়বিচার দিতে নিরপেক্ষ, চাপমুক্ত ও সুষ্ঠু তদন্তের সুযোগ দিতে হবে। তারজন্য প্রভাবশালী ব্যক্তি ও মন্ত্রী ভগবান দাসকে সাময়িকভাবে নিলম্বিত করতে হবে। এই প্রশ্নে রাজ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে নীরবতা ভেঙে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মূল অভিযুক্ত সহ মন্ত্রীপুত্র ঘনিষ্ঠ সব অভিযুক্তদের আর দেরী না করে গ্রেপ্তার করতে হবে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ অবাধ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আর ভার্মা কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ধর্ষিতা কিশোরীর উপযুক্তভাবে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এই কাজ একমাত্র সুশাসনেই সম্ভব। একথা ২০১২-তে নির্ভয়া কাণ্ডের পরে গঠিত ভার্মা কমিশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভার্মা তাঁর রিপোর্ট প্রকাশ ও সুপারিশ করতে গিয়ে বলেছিলেন।
১৯২৯ সালের ২৮ জুন কলকাতার রোকেয়া সাখাওয়াত স্কুলে একটি চিঠি এলো। এক অভিভাবক স্কুল কর্তৃপক্ষকে নালিশ জানিয়ে লেখেন, স্কুলবাস তাঁর গলির ভেতর যায় না বলে তাঁর মেয়েকে বোরখা পরে ‘চাকরানীর’ সঙ্গে হেঁটে বাড়ি আসতে হয়। গতকাল এক ব্যক্তির চায়ের পাত্রের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তাঁর মেয়ে হীরার কাপড় নষ্ট হয়েছে। ঘটনার তদন্তের পর রোকেয়া লিখলেন – ‘অনুসন্ধানে জানিলাম হীরার বোরখায় চক্ষু নাই। … অন্য মেয়েরা বলিল, তাহারা গাড়ি হইতে দেখে মামা (চাকরানী) প্রায় হীরাকে কোলের নিকট লইয়া হাঁটাইয়া লইয়া যায়। বোরখায় চক্ষু না থাকায় হীরা ঠিকমতো হাঁটিতে পারে না – সেদিন একটা বিড়ালের গায়ে পড়িয়া গিয়াছিল – কখনও হোঁচট খায়। গতকল্য হীরাই সে চায়ের পাত্রবাহী লোকের গায়ে ধাক্কা দিয়া তাহার চা ফেলিয়া দিয়াছে। দেখুন দেখি, হীরার বয়স ৯ বৎসর — এতটুকু বালিকাকে “অন্ধ বোরখা” পরিয়া পথ চলিতে হইবে! ইহা না করিলে অবরোধের সম্মান রক্ষা হয় না!’ (রোকেয়া : ‘অবরোধবাসিনী’ তের)। স্কুলের ‘মোটর’ বাসে মেয়েদের যাতায়াত করা নিয়েও রোকেয়া হুমকি চিঠি পান। সমাজের পর্দা রক্ষার চাপে প্রায় ‘Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ)’ স্কুলবাসে ছাত্রীদের নিয়ে আসা হতো। এতে বাচ্চারা অসুস্থ হতে শুরু করলো, ভয়ে জ্ঞান হারালো। তাই বাসের দুপাশের দুটো ‘খড়খড়ি’ নামিয়ে তার ওপর পর্দা দেওয়া হলো। এরফলে অপরাধী সাব্যস্ত হলো স্কুল কর্তৃপক্ষ। কারণ পর্দা বাতাসে উড়ে গাড়িকে বেপর্দা করেছে। এরকম বেপর্দা গাড়িতে মেয়েদের যাতায়াত করালে উর্দু দৈনিকে স্কুলের নামে কুৎসা রটনা করে মেয়েদের স্কুলে আসা বন্ধ করার কথা জানিয়ে কড়া চিঠি পাঠান মৌলবাদী সমাজরক্ষকগণ। অবরোধ-বন্দিনীদের আগুন-সেঁকা জীবনের জ্বালাযন্ত্রণাকে নিজ বক্ষে ধারণ করে ‘অবরোধবাসিনী’-র সাতচল্লিশ নাম্বার পর্বে রোকেয়া লেখেন — “কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে, কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নসীন ঘরে!” মৌলবাদীদের তর্জন-গর্জনে রোকেয়ার লড়াই কিন্তু থেমে যায়নি। নানাপথে বিস্তার পেয়েছে। সাহসী কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেছেন — ‘ভগিনী তোমরা দেখিতেছ এই ধর্মশাস্ত্রগুলি পুরুষ রচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পাও, কোনও স্ত্রী মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতে। ধর্মগ্রন্থ সমূহ ঈশ্বর প্রেরিত বা ঈশ্বরাদিষ্ট নহে। ...ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।’ (রোকেয়া : ‘অলঙ্কার না Badge of Slavery’)। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ইরানের পুলিশি হেফাজতে বাইশ বছরের তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। মাহশা আমিনির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ঠিকমতো হিজাব পরেননি। তাঁর চুল দেখা যাচ্ছিল। ইসলামি পোশাক নিয়ম মেনে পরছে কি না তা দেখার দায়িত্বে থাকা নীতি-পুলিশরা তাই মাহশাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে দেয় বলেই ইরানের জনগণের দাবি। রোকেয়ার সময়কে (১৮৮০-১৯৩২) অনেকটা পার করে এসেও একই বাস্তবতায় আগুন জ্বলে বুকে। দেশ ভিন্ন। কিন্তু গাজোয়ারি কর্তৃত্ব, অন্ধ জবরদস্তি অভিন্ন। আমার দেশের মেয়েরাও কি এখন আরও বেশি করে ‘My choice’ বলে পুরুষের তৈরি দৃষ্টিভঙ্গিতে ঢুকে যাচ্ছে না? মাহশা আমিনির মৃত্যু ইরানবাসীদের ক্ষোভের আগুনকে স্ফুলিঙ্গের মতো কাঁটাতারের বেড়া ছাড়িয়ে, ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীর নানাপ্রান্তে। আমি আন্দোলিত হয়েও অসহায়। মহিলা কলেজের ক্লাসরুমে কয়েকটি দলে বিভক্ত ছাত্রীদের নিচুস্বরের কথায় কাজ দিয়েছি। হিজাব পরা ছাত্রী জানালো সে বন্ধুদের সব কথা শুনতে পাচ্ছে না। তার জন্যই বন্ধুরা ঘরের দরজা আটকে দিয়ে হিজাবের কানের কাছের অংশটুকু একটু আলগা করে নিতে বলল। সে অনড়। কথা শুনতে না পাওয়ার জন্য যদি ক্লাসের কাজে যুক্ত না হতে হয় সেটা মেনে নেবে কিন্তু হিজাব একটুও কান থেকে সরাবে না। আমাদের নিশ্চয় মনে আছে কর্ণাটকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হিজাব বিতর্ক? তারমধ্যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে সেটা সত্য। তবু পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেখানে। তারা পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনল হিজাব পরে ঢুকতে পারবে না। সেই মুহূর্তে জানিয়ে দিল, পরীক্ষা ছাড়তে হয় ছাড়ব কিন্তু হিজাব ছাড়ব না। অন্ধ অহংকারে পিতৃতান্ত্রিক ভাবনায় লালিত মেয়েরা নিজের ক্ষতি কি বোঝে না? নিজের মাথা, চুল, চোখ, মুখ হাত, পা কোন যুক্তিতে অতিরিক্ত ঢাকনায় মুড়িয়ে রাখতে হবে? তবে সচেতন মেয়েরা বুঝতে পারছেন বস্ত্রখণ্ডে মুড়ে দিয়ে তাঁদের শরীরকে অসম্মান করা পুরুষদের অভিসন্ধি, তাঁরা প্রতিবাদে-প্রতিরোধে উত্তাল হয়ে উঠেছেন।
‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতা’ বিপ্লবী শ্লোগানে উত্তাল মাহশা আমিনির দেশ। রাস্তায় নেমে চুল কেটে, চুলের পতাকা উড়িয়ে, হিজাব পুড়িয়ে প্রতিবাদ করছেন ইরানের মহিলারা। ইরান থেকে আফগানিস্তান একই শ্লোগান। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ তালিবানদের ভয়ংকর রূপকে উপেক্ষা করে কিছু মহিলা ইরানের দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে এই শ্লোগান দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে গুলি চালিয়ে তালিবানরা এই সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করে। তালিবানি শাসনের আফগানিস্তানে আগুন জ্বালাতে চাওয়া মহিলাদের কুর্নিশ। ১৬ সেপ্টেম্বরের পর থেকে চলা বিক্ষোভে ইরানে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৮৩ (সূত্র : প্রথম আলো ডেস্ক, বাংলাদেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২)। বিক্ষোভকারীদের দাঙ্গাবাজ তকমা দিয়েছে সে দেশের প্রশাসন। তাঁদের অবাধে গ্রেপ্তার করা চলছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আন্দোলনের গতিবেগ। ইরানের বহু শহরের রাজপথে আগুন জ্বালিয়েছেন তাঁরা। সরকার ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করে বিক্ষুব্ধ মানুষের খবর চাপা দিতে চাইলেও তা দ্বিগুণ তেজে দেশের সীমানা দ্রুত অতিক্রম করছে। পিতৃতন্ত্রের চাপে, মৌলবাদের নির্যাতনে দমবন্ধ অবস্থায় হাঁপিয়ে পড়া মহিলারা বন্দুকের নলকে তাচ্ছিল্য করে আজ প্রাণ বাজি রাখছেন। প্রশাসনের অত্যাচার, চোখের সামনে লুটিয়ে পড়া সহযোদ্ধা, লড়াইকে আরও চাঙ্গা রাখছে। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বার্তা ইরানের বর্ডার ছেড়ে ঢুকে পড়েছে বহু দেশে। অপরদিকে বহুসংখ্যক মহিলা আপাদমস্তক নিজেকে মুড়ে বোরখা-হিজাবের পক্ষ নিয়ে মিছিল করছেন। মৌলবাদের চাপে বা পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টি-লালনে তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন হিজাব বিরোধীদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করে ধর্মীয় সুরের বাতাস বইয়ে দেবেন বলে। পিতৃতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে, পিতৃতান্ত্রিক ভাবনার মহিলাদের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে, প্রশাসনের দমন-পীড়নে আন্দোলনের আগুন চাপা পড়তেও পারে কিন্তু ছাইচাপা আগুন বারবার জ্বলে উঠবে। পুঁজিবাদের মদতপুষ্ট মৌলবাদের বাড়-বাড়ন্ত রুখতে, নারী শরীর নিয়ে কুৎসিত ভাবনা পদদলিত করতে আজ পুড়ছে বোরখা, পুড়ছে হিজাব, উড়ছে চুল। এই আগুন একেবারে নিভে যাওয়ার নয়। ওই শোনা যায় ইরানে বিপ্লবী পদযাত্রার পদধ্বনি। আমার দেশে, আমার বাংলার বোরখা-হিজাব পরিহিত প্রিয় নারীদের কানে কি সেই ধ্বনি পৌঁছাচ্ছে না?
আফ্রোজা খাতুন
(ঋণস্বীকার : দোঁহা ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত)
“যে কোনো নারীর ন্যায়বিচারের লড়াই এভাবে কী শেষ হতে পারে? আমি আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আস্থা রেখেছিলাম। আমি সিস্টেমের ওপর আস্থা রেখেছিলাম এবং আমি আমার ট্রমা নিয়ে ধীরে ধীরে বাঁচতে শিখছিলাম। এই দোষীদের মুক্তি আমার কাছ থেকে শান্তি কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে ন্যায়বিচারের প্রতি আমার বিশ্বাস।”
“আমার দুঃখ আর ভেঙে পড়া বিশ্বাস একা আমার জন্য নয়, আমার সাথে সেইসব মেয়ের কথা ভেবেও, যারা ন্যায়ের জন্য কোর্টে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।”
— নিজের ১১ জন ধর্ষকের মুক্তির রায়ের খবরে বিলকিস বানোর মন্তব্য
আজাদির ৭৫তম বার্ষিকীর দেশজোড়া উৎসবের সময় গুজরাট হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যায় বিলকিস বানোর গণধর্ষন ও বানোর পরিবারের ৭ জনকে হত্যা করার অপরাধে ১১ জন আসামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মাফ হয়। ২০০৮ সালে স্পেশাল সেন্ট্রাল বুর্যো অফ ইনভেস্টিগেশন ‘সিবিআই’এর কোর্টে অভিযুক্ত ১১ জনের দোষ প্রমাণিত হয় ও যাবজ্জীবনের সাজা হয়। পরে ২০১৭ সালে বোম্বে হাইকোর্ট এই রায়কে মান্যতা দেয়। তদন্ত চলাকালীন বিলকিস, তার পরিবার ও সাক্ষীদের প্রাণহানির হুমকির মুখে পড়তে হলেও ন্যায়বিচারের উপর আস্থা রেখে বিলকিস নিজের লড়াই চালিয়ে গেছেন।
বিলকিস বানোর সাথে কী ঘটেছিল?
আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা। গুজরাটের দাহোড জেলার রাধিকাপুরের বাসিন্দা বিলকিস বানো তখন ২১-এর তরুণী। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বকরি-ঈদের সময় রাধিকাপুরে আগুন জ্বলছিল। হিংসার আগুন। চারিদিকে হিংসার আগুনে লুট হচ্ছিল বিলকিসদের ঘর, দুয়ার, নিরাপত্তা। নিবিড় চারকোণের মায়া ছেড়ে, প্রাণ বাঁচাতে ৫ মাসের অন্তসত্ত্বা বিলকিস তার ৩ বছরের মেয়ে সালেহার হাত ধরে, ১৫ জন আত্মীয়ের সাথে গ্রাম ছেড়ে পালাতে শুরু করলেন। ৩ মার্চ ২০০২, এসে পৌঁছালেন চাপ্পারওয়াড গ্রামে। চার্জশীট অনুযায়ী, ২০-৩০ জন ধারালো অস্ত্র (কুঠার, তলোয়ার), লাঠি ইত্যাদি নিয়ে বিলকিস ও তার আত্মীয়দের উপর হামলা করে। এই ২০-৩০ জন হামলাকারীর মধ্যে ১১ জন পরবর্তীতে দোষী প্রমাণিত হয়। এই হামলার ফলে রাধিকাপুর গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা ১৭ জন মুসলিম মানুষের মধ্যে বিলকিস, একজন পুরুষ ও একটি বাচ্চা প্রাণে বাঁচেন। ৭ জনের মৃতদেহ পরে উদ্ধার হলেও বাকিদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সিবিআই’এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বেশ কিছু মৃতের ধর দেহ থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে চিনতে না পারা যায়। বিলকিস, বিলকিসের মা, বোন ও আরো দুই মহিলার উপর চলে নৃশংস ধর্ষণ। যশবন্তবাই নাই, গোবিন্দভাই নাই, নরেশ কুমার মরধিয়া অন্তসত্ত্বা বিলকিসকে ধর্ষণ করে। শৈলেশ ভাট তিন বছরের সালেহাকে পাথরে আছাড় মেরে খুন করে। এই তিনজন ছাড়াও, রাধেশ্যাম শাহ, বিপিন কুমার যোশী, কেশরবাই, প্রদীপ, বাকাবাই ভোহানিয়া, রাজুভাই সোনি, মিতেশ ভাট আর রমেশ চন্দনার সক্রিয় উপস্থিতিতে এই হিংসার তাণ্ডব চলে। এদের প্রত্যেকেই বিজেপি ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী দলগুলির সদস্য।
সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা কীভাবে ছাড়া পেল?
সম্প্রতি, রাধেশ্যাম শাহের নেতৃত্বে ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা ক্ষমার জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানায়। এই আবেদনের ভিত্তিতে ১৩ মে ২০২২ সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে তাদের ক্ষমার নীতির উপর ভিত্তি করে এই আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আদেশ দেয় এই যুক্তিতে, যে দোষীরা গুজরাটের অধিবাসী তাই গুজরাট সরকার এই বিষয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। ক্ষমার আবেদন নিয়ে ভেবে দেখতে গুজরাট সরকার একটি কমিটি তৈরি করে। গোধরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুজল মায়াত্রার নেতৃত্বে বিজেপি বিধায়ক সিকে রাওলজি, সুমন চৌহান, গোধরা পুরসভার প্রাক্তন উপদেষ্টা ও বিজেপি কর্মী মুরলী মুলচান্দানী এবং বিজেপির মহিলা শাখার সদস্য স্নেহাবেহেন ভাটিয়াকে নিয়ে গড়ে তোলা পাঁচ সদস্যের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে ১১ জন গণধর্ষণকারী ও খুনীর মুক্তির পক্ষে মতামত দেয়। গুজরাট সরকার ‘সু-সংস্কার’, ‘ভদ্র ব্যবহারের’ জন্য এই অপরাধীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মকুব করার ঘোষণা করে। ১৫ আগস্ট ২০২২, স্বাধীনতা দিবসের দিন মুক্তি পায় উক্ত ১১ জন। মালা, মিষ্টি নিয়ে তাদের বরণ করে উৎসবে মাতে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতন দলগুলি। সেইদিন থেকে বন্দী হয়েছে বিলকিসের স্বাধীনতা। পরিবারকে নিয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে বেরাচ্ছেন বিলকিস। ধর্ষকের আজাদী আর ধর্ষিতার দমন — আজকের ভারতের বাস্তবতা।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মীরা, গুজরাট সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। প্রত্যুত্তরে, সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারকে নোটিশ জারি করে জনস্বার্থ মামলায় ওঠা প্রশ্নের বিষয় তাদের উত্তর জানতে চায়। নোটিশের উত্তরে গুজরাট সরকার জানায় যে, তারা বিলকিস বানো মামলায় ১১ জন আসামিকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ তারা “১৪ বছরের বেশি কারাগারে সাজা কাটাচ্ছে এবং এই সময় তাদের আচরণ ‘ভালো’ বলে প্রমাণিত হয়েছিল এবং অমিত শাহের নেতৃত্বে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও এই সিদ্ধান্তে সম্মতি/অনুমোদন জানিয়েছিল।” গুজরাট সরকারের হলফনামা থেকে আরো জানা যায় যে, সিবিআই’এর বিশেষ অপরাধ শাখা, বৃহত্তর বোম্বের সিভিল সেশনস কোর্ট, এই ১১ জন অপরাধীর মুক্তির বিপক্ষে মত দিয়েছিল। গোধরা সাব-জেলের সুপারিনটেন্ডেন্টের চিঠির উত্তরে, সিবিআই আধিকারিক বলেছিলেন যে অপরাধটি “জঘন্য এবং গুরুতর” তাই অপরাধীদের “মুক্তি দেওয়া যাবেনা এবং তাদের প্রতি কোনও প্রকার ছাড় দেওয়া যাবে না”। প্রসঙ্গত, এই ১১ জন অপরাধী কারাবাসে কাটানো ১৪ বছরের মধ্যে নূন্যতম ৯০০ দিক এবং সর্বাধিক ১,৫০০ দিন প্যারোলে জেলের বাইরে মুক্ত জীবন কাটিয়েছে। ২০২০ সালে প্যারোলে কাটানো সময়ের মধ্যে, ১১ জন আসামীর মধ্যে অন্যতম মিতেশ ভাটের বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডোবিধি ৩৫৪ ধারায় যৌন হেনস্থার অভিযোগ দায়ের হয়। কিন্তু এই তথ্যকে ১১ জন সাজাপ্রাপ্ত গণধর্ষণকারীর মুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুজরাট সরকার মান্যতা দেয়নি।
সম্প্রতি ধর্ষক ও খুনি গুরমিত রামরহিমকে প্যারোলে মুক্তি দিয়েছে হরিয়ানার সরকার। ২০২২ সালের মধ্যে এই নিয়ে ৩ বার প্যারোলে মুক্তি পেল রামরহিম। মুক্তি পাওয়ার পরেই, উত্তরপ্রদেশে রামরহিমের ডাকা ‘সৎসঙ্গ’ সভায় উপস্থিত হয়েছিল বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা। হরিয়ানায় আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে রামরহিমকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া বিজেপির ঘৃণ্য নির্বাচনী প্রচারের অঙ্গ। একইভাবে, গুজরাটে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ধর্মীয় বিদ্বেষকে ধুয়ো দিয়ে নির্বাচনী ফসল তোলার লক্ষে গুজরাট সরকারের এহেন সিদ্ধান্ত, এমনটা মনে করছেন অনেকেই।
বিজেপির উদ্দ্যেশ্য কী?
শুধুমাত্র নির্বাচন জিতে সরকারি ক্ষমতায় আসা নয়, বিজেপি-আরএসএস’এর লক্ষ্য ভারতের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের স্তম্ভগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট করে দেওয়া। বিচারব্যাবস্থা, আইন ও নীতিপ্রণয়ন, সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমের স্বয়ংক্রিয়তাকে দুরমুশ করে, কার্যনির্বাহকদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসে হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র গড়ে তোলাই এদের সাচ্চা উদ্দেশ্য। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে রামমন্দির বানানো, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চাপিয়ে দেওয়া, মানবধিকার কর্মীদের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগ করে জেলের মধ্যে পচিয়ে মারার চক্রান্ত থেকে বিলকিস বানোর আসামিদের সাজা মুকুব করা — এসবই ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের বিভিন্ন কর্মসূচি। আজাদীর অমৃতকালে, ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকার একদিকে নারীশক্তির স্তোতবাক্য বলে অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক হিংসার নিকৃষ্টতম প্রদশর্নকারীদের বেকসুর খালাস করে আদপে বার্তা দিতে চায় এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যত ভারতের। যে ভারতে মুসলিম নারীর ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষার অস্তিত্ব নেই, যে ভারতে ধর্মের নামে ধর্ষণকে উদযাপন করা যায়, যে ভারতে স্বাধীনতার মানে শুধুই ধনী, ব্রাহ্মণ, পুরুষদের স্বাধীনতা। এহেন, সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতের সংবিধান ও গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা বর্তমানে আশু প্রয়োজন। বিলকিস বানোর ন্যায়ের জন্য লড়াই একা বিলকিসের লড়াই নয় — এ লড়াই ভারতের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের টিকে থাকার লড়াই, ধর্ম-নিরপেক্ষতা বাঁচিয়ে রাখার লড়াই, নারীর স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই, নীপিড়িত মানুষের ক্ষমতা দখলের লড়াই, সাম্যবাদের স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়ার লড়াই — এ লড়াই জিততে হবে।
- সম্প্রীতি
( দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’এর ১৭ অক্টোবর ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত বর্তমান নিবন্ধে লেখকের এক বিশেষ উদ্বেগ ধরা পড়েছে ফ্যাসিস্ট মোদী সরকার-অনুমোদিত মুসলিম পীড়ন নিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী মহলের নীরবতায়। বিষয়টি আমাদের কাছে চর্চাযোগ্য মনে হওয়ায় পাঠকদের কাছে তার অনুবাদ তুলে ধরা হল। শিরোনাম আমাদের — সম্পাদকমণ্ডলী )
গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট একটা মামলা গ্রহণ করেছিল যেটা একটা বড় রাজনৈতিক বিতর্ক হয়ে উঠল: হিজাব! গত ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটক ক্লাসরুমে মেয়েদের হিজাব পরে ঢোকা নিষিদ্ধ করেছিল — স্বভাবতই এতে মুসলিমরা রুষ্ট এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা উল্লসিত হয়েছিল। শেষোক্তরা (হিন্দুত্ববাদীরা) রাজ্যের এই পদক্ষেপকে, ভারতে তাদের ধারাবাহিক মুসলিম-বিরোধী প্রচার অভিযানের আরেকটি সাফল্য হিসেবেই দেখেছিল।
শেষ পর্যন্ত আদালতের সিদ্ধান্ত দেখিয়ে দিল, ঠিক কীভাবে ভারতের ধর্মীয় দৃশ্যপটের মেরুকরণ ঘটে গেল। প্যানেলের এক বিচারপতি ঘোষণা করলেন মাথায় কাপড় দেওয়াটা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার; আরেকজন মূলত সমস্যাটি খারিজ করলেন এই বলে যে হিজাব ইসলামে ‘অত্যাবশ্যক’ নয়।
কিন্তু ভারতীয় মুসলিমরা, যেন সমস্যাটা আদপে নেই এমনটা মানবেন কী করে! ভারতে মুসলিম মেয়েরা লড়ছে — ঠিক যেভাবে ইরানে তাদের সহযোদ্ধারা — তাদের নিজেদের শর্তে নিজেদের পছন্দমতো পোশাক পরার এবং বাঁচার মৌলিক অধিকারের জন্য।
এই ধরনের লাঞ্ছনা, নিগ্রহ যে অবিরাম ঘটেই চলেছে, তা আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না, যদিও আন্তর্জাতিক মহলে কিছু মানুষ ব্যাপারটা উপেক্ষা করেই চলেছেন। ভারতের রাস্তায় আজ হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তরোয়াল আস্ফালন করে চলেছে, মসজিদের বাইরে প্ররোচনামূলক শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে মুসলিমদের উপর দলবদ্ধ আক্রমণের ভিডিও শেয়ার এখন নেহাত মামুলি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম ছাত্রছাত্রী এবং আন্দোলনকারীরা দেখেছেন, যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রশাসন কর্তৃপক্ষ কীভাবে তাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে — স্রেফ অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার প্রতিশোধ হিসেবে। সংবাদ সংস্থার স্ক্রোল থেকে সম্প্রতি জানা যাচ্ছে, বহু মুসলিম ‘ক্রমবর্ধমান সংখ্যাগুরুবাদের’ জন্য ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
ঠিক এই মাসেই, ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নিশানা করে আক্রমণের একের পর এক ঘটনা ঘটেছে।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে, বিদার শহরে এক উচ্ছৃঙ্খল জনতা অভব্যের মতো জোর করে এক ঐতিহ্যবাহী মসজিদে ঢুকে হিন্দুদের কোনও অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে থাকে। এরপর একটি উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ভিডিও ভাইরাল হয় যেখানে দেখা যাচ্ছে ল্যাম্পপোস্টে কয়েকজন মুসলিম পুরুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে; তারা নাকি একটি হিন্দু উৎসবে অনধিকার প্রবেশ করে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। সাদা পোশাকে পুলিশই নাকি যখন ওদের মারধর করছিল, উল্লসিত জনতা জাতীয়তাবাদী শ্লোগান দিতে দিতে নাচানাচি করছিল। গত মাসে একই রকম আরেকটি ঘটনায় একদল মানুষ অতি দক্ষিণপন্থী বজরঙ দলের সঙ্গে একজোট হয়ে মুসলিম ছেলেদের প্রচণ্ড মারধর করে কারণ তারা নাকি হিন্দুদের নবরাত্রি উৎসবে যোগ দিয়ে হিন্দু মেয়েদের ফুঁসলানোর চেষ্টা করছিল।
উগ্রবাদীরা অবশ্যই নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করছে, আর কেন করছে সেটা অনুমান করা মোটেই কঠিন নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ক্ষমতার তুঙ্গে রয়েছেন। স্বাধীন মিডিয়ার বিরুদ্ধে তার খড়্গহস্ত হয়ে ওঠা এবং ভারতের সমস্ত প্রতিষ্ঠানে তার ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)র ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এই আমূল পরিবর্তনের উগ্র প্রক্রিয়াকে প্রত্যাঘাত হানার সামাজিক ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে।
তার পার্টি সদস্যরা ইতিমধ্যে এই আগুনে ইন্ধন যুগিয়ে চলেছেন। বিজেপি’র এক বর্তমান সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর সম্প্রতি বলে ফেললেন — মুসলিমদের হিন্দু উৎসবে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়! শ্রীমতী ঠাকুর এক মসজিদের কাছে বোমা বিস্ফোরণের এক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিচারাধীন, যে ঘটনায় ছ’জনের মৃত্যু হয়েছিল। আট বছর জেলে কাটিয়ে জামিন পেয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। আরেকজন বিজেপি বিধায়ক সম্প্রতি মুসলিমদের ব্যবসাকে ‘সম্পূর্ণ বয়কটের’ ডাক দিয়েছিলেন, সোল্লাসে জনতা প্রবল করতালি দিয়ে তাকে সমর্থন করেছিল।
যেসব ভারতীয়ের সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অনুগামী আছে তাদের অন্যতম, মোদী। কিন্তু তিনি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করতে বা তাদের বিরুদ্ধে হিংসা বন্ধ করার জন্য কোন আহ্বান জানাননি। অথবা তার সাংসদ-বিধায়কদের কখনও সেইসব ভাষণের জন্য প্রকাশ্যে কড়া নিন্দা করেননি যেগুলো ভারতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে আরও ইন্ধন যোগাচ্ছে।
আর একই সময়ে, বহির্বিশ্বের ভারতীয় মুসলিম বা অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ানোর কোনও ইচ্ছা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। বিশ্ব নেতারা আপাতভাবে চীন ও রাশিয়াকে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারটিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তারা বুঝতে পারছেন না যে তাদের এই ‘স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সুবিধাজনক অজ্ঞতা’ ভারতে ২,২০০ লক্ষ ভারতীয় মুসলমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র-অনুমোদিত হিংসাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক হিংসা যা নাকি ভারতে সৃষ্ট, তার হাত যে কত লম্বা তার জ্বলন্ত উদাহরণ সম্প্রতি ব্রিটেন তুলে ধরেছে। গত মাসে লিসেস্টার শহরে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। একটি বিবিসি-অনুসন্ধানে ধরা পড়ে যে ভুল খবর থেকে এই হিংসা জ্বলে উঠেছিল, সেই ফুলকিটা কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিল ভারতে সামাজিক মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে! এই বিচ্যুতিগুলো মার্কিন মুলুকে বর্তমান : আগস্টে নিউ জার্সিতে ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময়ে অত্যন্ত বিতর্কিতভাবে একটি নির্মাণ সরঞ্জামকে দেখানো হচ্ছিল যা ভারতে মুসলিমদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া বুলডোজারের সদৃশ।
ভারতে বেড়ে ওঠা ঘৃণা ও বিভাজন তার সীমান্তেই যে থেমে থাকবে না সেটাই মনে করিয়ে দেওয়ার বার্তা এটা। এই মাসে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর এক বিবৃতিতে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। মোদী সরকার তবুও মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সমস্ত সমালোচনাকে সরকারের দুর্নাম করার অপচেষ্টা বলে কঠিন বিদ্রূপ করেছে।
ভারতে ক্রমবর্ধমান অন্যায়ের মুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বের এই নীরবতা আমাকে প্রাচীন ঈজিপ্টের এক প্রবাদ মনে পড়িয়ে দিল, “হে ফারাও, কে তোমাকে এমন অত্যাচারী শাসক করে তুলল?” সে উত্তর দিল “কেউ আমাকে থামায়নি”।
ভারতের এই ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উগ্রতাকে বিশ্ব ক্রমাগত উপেক্ষা করে চলেছে।
- রাণা আইয়ুব
(অনুবাদক : জয়ন্তী দাশগুপ্ত)
সম্প্রতি ওপেক প্লাসের অপরিশোধিত তেল উৎপাদন হ্রাসের (প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল) সিদ্ধান্তের খবর আমাদের অনেকের চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই। এ সিদ্ধান্তকে শুধু তেলের ভবিষ্যৎ মূল্যবৃদ্ধি বা হ্রাসের প্রেক্ষাপটে দেখলে ভুল হবে; এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। সে বিশেষণে যাওয়ার আগে আমাদের জানা প্রেক্ষাপটটা সংক্ষেপে একটু বলে নিই।
একটা বৈশ্বিক মন্দা অনিবার্য, এটা নিয়ে এখন বিতর্কনেই প্রায়। বিতর্ক হচ্ছে মন্দাটির স্থায়িত্ব এবং এর তীব্রতা কতটা হবে, সেটা নিয়ে। মন্দা শুরু হয়ে গেলে সব সংকটের মধ্যে একটা আশার কথা বিশ্ববাসীর জন্য থাকতে পারত। সেটা হচ্ছে মন্দায় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ হয়ে যাওয়ার কারণে তেল-গ্যাসের মতো প্রাথমিক জ্বালানির চাহিদা কমে যাওয়া। প্রাথমিক জ্বালানির চাহিদা কমে যাওয়া মানে এর দাম কমা। আর জ্বালানির দাম কমার সূত্রে অন্য সব পণ্য-সেবার উৎপাদন মূল্য ও পরিবহন খরচ কমলে বিশ্বব্যাপী চলা ভয়ংকর মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসার কথা।
বিশ্বে তেল রপ্তানিকারক ১৩টি দেশের সংগঠন ওপেক কাজ করছে ১৯৬০ সাল থেকেই। সংগঠনটি তখন থেকেই বিশ্বে তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি ও কমানোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তেলের মূল্যের ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সংগঠনটি আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে ২০১৬ সালে, যখন এরসঙ্গে আরও ১২টি তেল উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশ যুক্ত হয়ে তৈরি হয় ওপেক প্লাস। এরমধ্যে আমাদের এ আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ওপেক প্লাসের সদস্য দেশটির নাম রাশিয়া। পুরো সংগঠনে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব।
এ’দেশের প্রভাবেই সংগঠনটির অনেক সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। তাই পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই ইউরোপ খুব চেষ্টা করেছে যাতে সৌদি আরবকে খুশি করে বিশ্বব্যাপী তেলের সরবরাহ বাড়িয়ে তেলের দাম কমিয়ে আনা যায়।
সরবরাহ বাড়িয়ে তেলের দাম কমানো গেলে অনেক সুবিধা হতে পারত। করোনার কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি এবং সাপ্লাই চেইনের ভঙ্গুরতার কারণে সারা পৃথিবীতে যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, সেটার লাগাম টেনে ধরা যেত। এরসঙ্গে জড়িত ছিল আরও একটা খুব বড় ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও। তেলের দাম কমিয়ে আনা গেলে সেটা রাশিয়ার অর্থনীতিতে একটা বড় চাপ তৈরি করত, যা যুদ্ধকে অর্থায়ন করতে পুতিনকে সমস্যায় ফেলত।
একটা তথ্য জেনে রাখলে আমরাবুঝব, তেলের দাম কমলে রাশিয়া কতটা বিপদে পড়তে পারত। রাশিয়া বর্তমানে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মূল্য ছাড়ে চীন ও ভারতের কাছে বিরাট পরিমাণ তেল বিক্রি করছে। এভাবে তেল বিক্রি করে মোটামুটি লাভ করার জন্য অপরিশোধিত তেলের প্রতি ব্যারেলের মূল্য ১০০ ডলারের আশপাশে থাকা রাশিয়ার জন্য জরুরি। কারণ, তাতে রাশিয়া ৬০ ডলারের মতো মূল্যে এই তেল রপ্তানি করতে পারবে।
উৎপাদনগত পদ্ধতির জটিলতা, দুর্নীতি ইত্যাদি মিলিয়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে রাশিয়ার খরচ ৪৫ ডলারের মতো। অর্থাৎ তেলের দাম যদি ৬০ থেকে ৭০ ডলারের দিকে চলে আসে, তাহলে এক-তৃতীয়াংশ ডিসকাউন্ট দিয়ে রাশিয়ার পক্ষে লাভ করা আর সম্ভব হবেনা। অর্থাৎ তেলের সরবরাহ বাড়িয়ে এর মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো গেলে সেটা রাশিয়ার ওপর প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করত।
সৌদি আরবের ডি-ফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানকে রাজি করানোর জন্য পশ্চিমা দেশগুলো খুব দীর্ঘ চেষ্টা করেছে। ইউক্রেন আগ্রাসনের পর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সৌদি আরবে গিয়ে এমবিএসের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। এরপর গেছেন অন্য নেতারাও। ফ্রান্স তাঁকে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়ে অনেক আদর-আপ্যায়ন করেছিল। অল্প কিছুদিন আগে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সফরটি, বলা বাহুল্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের।
পরিবারের ভেতরে একধরনের রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এমবিএস ক্রাউন প্রিন্স হয়ে যাওয়ার পর থেকেই নানা দেশে অস্বস্তি ছিল। এরপর তাঁর কিছু কাজ সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে প্রচণ্ড সমালোচনা তৈরি করে। ইয়েমেন আক্রমণ করে অসংখ্য বেসামরিক মানুষকে হতাহত করা এবং সেখানে একটা দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করার জন্য তিনি সমালোচিত হয়েছেন, হচ্ছেন এখনো। সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ এবং রাজপরিবারের অনেক বিব্রতকর গোপন তথ্য ফাঁসকারী জামাল খাসোগিকে তুরস্কে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে হত্যা করার পর এমবিএস বিশ্বব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন।
সে সময় জো বাইডেনের ক্ষমতায় ছিলেন না, কিন্তু এ ঘটনায় তিনি তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও বাইডেন এমবিএসের প্রতি তাঁর বিরক্তি লুকাননি। কিন্তু সব রকম সমালোচনার ঝুঁকি মাথায় রেখে বাইডেন গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। মুহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ফিস্ট বাম্প করেছিলেন প্রকাশ্যে এবং বৈঠক করেছিলেন। মুখে নানা কূটনৈতিক বচন থাকলেও বৈঠকটি যে ছিল বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহ বৃদ্ধির এক মরিয়া চেষ্টা, সেটা কাউকে আর বলে দিতে হয়নি।
নিজ দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয় তো আছেই, জ্বালানি তেলের অতি উচ্চ মূল্যজনিত বৈশ্বিক সংকট যতটুকু কমানো সম্ভব, সে চেষ্টা তিনি করেছেন। আর সর্বোপরি রাশিয়াকে সংকটে ফেলার অতি গুরুত্বপূর্ণলক্ষ্য তো ছিলই। কিন্তু বৃথা গেল সব চেষ্টা।
সৌদি আরবের হাতে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কৌশলগত পণ্যটির নিয়ন্ত্রণ। তাই সৌদি আরব ভাবছে, এ পণ্যের অধিকার তাকে যাচ্ছেতাই করার ক্ষমতা দেয়। সৌদি আরব জানে তেলের সরবরাহ কমিয়ে ফেলার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলো স্বল্প মেয়াদে কোনোভাবেই কার্যকর হবে না।
আমেরিকা নিজের কৌশলগত রিজার্ভ থেকে তেল বাজারে ছাড়ছে, যা মোটেও টেকসই পদ্ধতি নয়। এছাড়া ভেনেজুয়েলার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার শর্তে ভেনেজুয়েলার তেল বাজারে আনার চেষ্টা হচ্ছে। বিশ্বের তেলের অন্যতম সর্বোচ্চ রিজার্ভ থাকা একটি দেশ হলেও দীর্ঘদিন বসে থাকার কারণে ভেনেজুয়েলার তেল উৎপাদন এবং সরবরাহ অবকাঠামো একেবারেই ভঙ্গুর হয়ে আছে। সেগুলো ঠিকঠাক করে উত্তোলন করে বাজারে সরবরাহ করতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবেই।
সার্বিক পরিস্থিতিতে এমবিএসের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটিকে যৌক্তিকভাবেই রাশিয়ার জয় হিসেবে দেখছেন সবাই। এটা ঠিক আছে, কিন্তু আমার বিশ্বাস, সৌদি আরব আমেরিকার পক্ষ না নেওয়ার পেছনে আছে অন্য কারণও।
বলা বাহুল্য, সৌদি আরবের আচরণে মার্কিন রাজনৈতিক মহল (বিশেষ করে ডেমোক্রেটিক) প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। তাঁরা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছেন। বাইডেন নিজেও তেমন কথা বলেছেন। অ্যান্টিট্রাস্ট অবস্থান দেখিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ওপেককে চাপ দেওয়া, ওপেক ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা, সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা থেকে নিজেদের সরিয়ে আনাসহ নানা রকম পদক্ষেপের আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, বোধগম্য কারণেই আরেকটা অপশন প্রকাশ্যে আলোচনা করা হচ্ছে না। সেটা হচ্ছে এমবিএস-কে ক্ষমতাচ্যুত করা।
এমবিএস-এর সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল জ্যারেড কুশনারের। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাই কুশনার ট্রাম্প প্রশাসনে অফিশিয়ালিই ছিলেন, কিন্তু তাঁর অলিখিত ক্ষমতা ছিল তারচেয়ে ঢের বেশি। এমবিএস অসাধারণ নিরাপদ সময় কাটিয়েছিলেন ট্রাম্পের সময়ে। যে খাসোগিকে নিয়ে ইউরোপের অনেক দেশ কিংবা বাইডেন তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, তখন ট্রাম্প প্রশাসন এ জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে ছিল অনেকটা নমনীয়।
শুধু সেটা নয়, বিখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ট্রাম্পের শাসনকাল নিয়ে তাঁর লেখা বই ‘রেইজ’এ দাবি করেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা কাঠামোর প্রচণ্ড চাপ থেকে এমবিএস-কে বাঁচিয়েছিলেন।
এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প যদি আবার জিতে আসেন, তাহলে সেটাই হবে এমবিএস-এর মতো শাসকদের জন্য কৌশলগতভাবে অনেক বেশি সুবিধাজনক। তাই নভেম্বরে আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাইডেনকে বিপদে ফেলে তাঁর সমর্থন কমানোর মাধ্যমে নির্বাচনে ট্রাম্পকে নিয়ে আসার একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে এ পদক্ষেপের পেছনে।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে এমবিএস সৌদির অতি প্রভাবশালী ধর্মীয় গুরুদের বিরুদ্ধে গিয়ে নানা রকম সংস্কার আনছেন, যা প্রবীণদের অনেককে ক্ষুব্ধ করলেও খুশি করছে তরুণদের। তাই আমার অনুমান, সেখানে একটা শক্তিশালী গণআন্দোলনের পরিস্থিতি নেই। কিন্তু মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ক্রাউন প্রিন্সের পদ থেকে সরিয়ে নিজে ক্ষমতা নেওয়ার পথে রাজপরিবারের অনেক সদস্যকে আটক করা থেকে শুরু করে, মোটা আর্থিক জরিমানাসহ নানা রকম নিপীড়নের ইতিহাস আছে।
এ’কারণে রাজপরিবারের ভেতরেই এমবিএসের অনেক বিরুদ্ধাচারী আছেন। সেই অংশের সঙ্গে কাজ করে তাঁকে সরানোর একটা চেষ্টা হতে পারে মার্কিনদের দিক থেকে। চড়ের সবচেয়ে কার্যকর পাল্টা পদক্ষেপ হতে পারে এটাই।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পর বাইডেনের সঙ্গে এমবিএসের সমস্যা একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গেছে মনে হয়। তাই আপাতত এই দু’জনের মধ্যে একটা কাজের চলনসই সম্পর্ক থাকা সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। আর পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের পর সৌদির মতো দেশ পশ্চিমাদের সঙ্গে না থাকার বার্তা খুব স্পষ্ট। পশ্চিমারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে সেটা, বাইডেন তো পারছেনই। চড়টা খেয়েছেন তো তিনিই।
- জাহেদ উর রহমান
শিক্ষক, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (লেখাটি প্রথম আলো পত্রিকা থেকে গৃহীত)
পুরনো দাস ব্যবস্থা আধুনিকতম রূপে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ওখানে জোর করে কাজ করানো এখনও আইনসিদ্ধ। ইউএসএ-র গণতন্ত্র ও ব্যক্তি অধিকার নিয়ে বড় বড় কথা শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে দাসব্যবস্থা থেকে ওরা এখনও বেরোতে পারেনি। এই রাষ্ট্রটি গড়েই উঠেছিল ওই মহাদেশের আদি বাসিন্দাদের প্রায় সম্পূর্ণভাবে খতম করে দিয়ে আর আফ্রিকা ও এশিয়ার লক্ষলক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে নৃশংসভাবে কাজ করিয়ে। ক্রীতদাস প্রথাকে আধুনিক শিল্পবিপ্লবোত্তর সময়ে সংবিধান স্বীকৃতভাবে এত স্বাভাবিক অন্য কোনও দেশ বানিয়ে ফেলেনি। এক সময় ১৩তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটানো হয়। কিন্তু এই সংশোধনেও রেখে দেওয়া হয় কুৎসিত ফাঁক। সকলের জন্য দাসত্ব নিষিদ্ধ হলেও ওই সংশোধনীর আওতার বাইরে রাখা হয় সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের। অর্থাৎ শাস্তি হয়ে কারাগারে আছে যারা তাদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বিষয়টা যে কেবল আইনের ফাঁক হিসেবেই আছে তা নয়। ইউএস-র জেলখানাগুলি আসলে দাস ব্যবসার আধুনিকতম বৈধ রূপ হিসেবেই বিকশিত হয়েছে। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্র্য অনুযায়ি এর প্রধান শিকার অবধারিতভাবেই ওই দেশের কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকেরা।
এ বিষয়ে কিছু সমীক্ষা আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে প্রগতিশীল মানুষের অল্পবিস্তর প্রতিবাদও আছে। কিন্তু বাইরের জগতে তা খুব বেশি চর্চিত নয়। এই বছর জুন মাসে ওই দেশের শিকাগো ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগ একটি সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। খুব রেখেঢেকে মোলায়েম ভাষা ব্যবহার করেও যা উন্মোচিত হয়েছে তা মারাত্মক। সমীক্ষায় মূল মূল যে দিকগুলি উঠে এসেছে তা হল,
এই সমীক্ষার প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারাগার ব্যবস্থার ভণ্ডামি উন্মোচিত করে বলা হয়েছে যে, সংশোধনাগারের নামে আসলে মানুষের ন্যুনতম মর্যাদা ও মানবাধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়। দাবি করা হয়েছে যে ১৩তম সংবিধান সংশোধনীতে বিশেষ ব্যতিক্রমের যে ধারা আছে তা মুছে দিয়ে দাসপ্রথার সাংবিধানিক ভিত্তিকে পাকাপাকিভাবে অবলুপ্ত করা হোক।
– মলয় তেওয়ারী
ভারতীয় ব্যাঙ্কক্ষেত্রের সংকটগ্ৰস্ততার পিছনে অন্যতম বড় কারণ হয়ে রয়েছে ব্যাড লোন বা অপরিশোধিত ঋণ। একটু ঘুরিয়ে বা অন্য ভাষায় একেই বলা হয় ‘নন পারফর্মিং অ্যাসেট’ (এনপিএ) বা বাংলায় ‘অনুৎপাদক সম্পদ’। ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তোলা এই অপরিশোধিত ঋণ বা অনুৎপাদক সম্পদের ব্যাপকতর অংশেরই ভাগীদার হল বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থা। চাষীদের ও ছোটো-মাঝারি ব্যাবসায়ী সংস্থার নেওয়া ঋণও কখনও কখনও অপরিশোধিত থেকে যায়। তবে, সমগ্ৰ অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণে তার ভাগ সামান্যই এবং ব্যাঙ্কের কাছে তা উদ্বেগের কারণ হয় না। কিন্তু কালক্রমে — কর্পোরেট আধিপত্যের নয়া-উদারবাদী যুগে এবং বিশেষভাবে স্যাঙাতি পুঁজিবাদের মোদী জমানায় — ব্যাঙ্কসমূহের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ যেমন বিপুলতর আকার নেয়, অপরিশোধিত ঋণের বহরও ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে। আর এটাও এখানে উল্লেখ্য যে, কর্পোরেট সংস্থাগুলো যে সমস্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধে কোনো আগ্ৰহ দেখায় না (সব সময় অক্ষমতা থেকে নয়, অনেক ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সুপরিকল্পিতভাবে), তার ব্যাপক সংখ্যাধিকই রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্ক, এবং ঋণ অপরিশোধের আঁচ বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর গায়ে তেমন লাগে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোতে অপরিশোধিত ঋণের আখ্যানের অবতারণা এইজন্যই যে, মোদী জমানায় এর ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ নেই, এবং সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের চতুর্থ বৃহত্তম ব্যাঙ্ক কানাড়া ব্যাঙ্কের খাতা থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ মুছে দেওয়ার বৃত্তান্ত সামনে এসেছে। এবং মোদী জমানায় কর্পোরেট সংস্থাগুলো ঋণ পরিশোধে কতটা অনীহা হয়ে উঠেছে, এই উন্মোচন তাকেও নির্দেশিত করছে।
সজাগ নাগরিক মঞ্চ নামে সংস্থার প্রেসিডেন্ট বিবেক ভেলাঙ্কার তথ্যের অধিকার আইনের অধীনে কানাড়া ব্যাঙ্কের কাছ থেকে জানতে চান — গত এক দশকে বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থার নেওয়া কত ঋণ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। এর উত্তরে ব্যাঙ্ক তাঁকে জানায়, ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ বর্ষ পর্যন্ত কানাড়া ব্যাঙ্ক তাদের খাতা থেকে মুছেছে ১,২৯,০৮৮ কোটি টাকার ঋণ। কী বিপুল পরিমাণ এই অঙ্ক, এবং এই এক দশকের তিন বছর বাদে বাকি সাত বছরই মোদী জমানার! কিন্তু কারা সেই কর্পোরেট সংস্থা যাদের প্রত্যেকে কানাড়া ব্যাঙ্ক থেকে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়ে শোধ করেনি, যাদের নাম বিবেক ভেলাঙ্কার জানতে চেয়েছিলেন? অতিকায় এই অঙ্কের ঋণকে অপরিশোধিত রেখে ব্যাঙ্ককে তাদের খাতা থেকে মুছতে বাধ্য করাটা ব্যাঙ্ক অর্থের নির্ভেজাল লুট ছাড়া আর কিছু নয় এবং এটাও যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক যে ব্যাঙ্কও ঐ কর্পোরেটদের নাম প্রকাশে অনাগ্ৰহী। তথ্য প্রদানের সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক অফিসার জানিয়েছেন, তথ্যের অধিকার আইনের ৮(১)(জে) ধারা ব্যক্তিগত পরিসরের তথ্যের প্রকাশকে মঞ্জুর করেনা। অর্থাৎ, বড় আকারের ঋণ-খেলাপি কর্পোরেটদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু এটা কি প্রকৃতই আইনের বাধা, নাকি, আইনকে ছুতো করে ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছুক কর্পোরেটদের নাম প্রকাশে ব্যাঙ্ক কতৃপক্ষের অনীহা। বিবেক ভেলাঙ্কার প্রশ্ন তুলেছেন, “কোনো সাধারণ ঋণ গ্ৰহীতা ঋণ-খেলাপি হলে ঐ ব্যাঙ্কই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তার নাম এবং অন্যান্য তথ্য বিশদে প্রকাশ করে। ওরা তাহলে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করার ধারাকে ছুতো করে বড় ঋণ-খেলাপিদের নাম আড়াল করতে চাইছে কেন? সাধারণ ঋণ গ্ৰহীতাদের ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তিগত তথ্য আড়াল’এর ধারা প্রযুক্ত হয় না কেন?” ব্যাঙ্ক অর্থের কর্পোরেট লুটেরাদের পরিচয় দেশ জানতে চায় এবং ঋণ পরিশোধ না করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানার অধিকারও দেশের জনগণের রয়েছে। এই কর্পোরেট ঋণ গ্ৰহীতাদের অধিকাংশই শাসক দল ঘনিষ্ঠ (বিজয় মাল্য, ললিত মোদী, নীরব মোদী, মেহুল চোকসিদের কথা ভারতের জনগণের এত তারাতারি বিস্মৃত হওয়ার কোনো কারণ নেই) এবং এই অনুমানও অমূলক নয় যে, ব্যাঙ্ক ঋণের মাধ্যমে লুট করা টাকার একটা অংশ ইলেক্টোরাল বণ্ডের মাধ্যমে শাসক দলের তহবিলে পৌঁছে যায়। এই কর্পোরেট লুটেরাদের নাম প্রকাশ তাই অতি সঙ্গত এক দাবি।
অর্থনীতিতে ব্যাঙ্ক ঋণের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং অগ্ৰাধিকারের বিবেচনায় সেই ঋণের বণ্টন হলে তা অর্থনীতির বৃদ্ধি ও বিস্তারের সঙ্গে কর্মসংস্থানেরও উন্নতি ঘটাতে পারে। কিন্তু যে ক্ষেত্রে কাজের সংস্থান বেশি হয়, সেই কৃষি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের ক্ষুদ্র-মাঝারি উৎপাদক ও ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোর কাছে ব্যাঙ্ক ঋণ পৌঁছোয় সামান্যই। ব্যাঙ্ক ঋণের সিংহভাগই কব্জা করে কর্পোরেট সংস্থাগুলো যাদের অনেকেরই ঋণকে উৎপাদনের কাজে লাগানোর চেয়ে লুটের মাল করে তোলাতেই আগ্ৰহ থাকে বেশি। নরেন্দ্র মোদী জমানায় স্যাঙাতি পুঁজিবাদের সুবিধায় ঋণ পরিশোধের পুনর্বিন্যাস নামক একটা ব্যবস্থাও সক্রিয় হয় — যাতে ঋণ পরিশোধের সময়কালকেই শুধু বিলম্বিত করা হয়না, পরিশোধযোগ্য সুদের পরিমাণকেও হ্রাস করা হয়। এছাড়া, শাসক ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের ঋণ-খেলাপি হয়ে থাকাটাও যে এই জমানায় প্রভূত প্রশ্রয় পায় তার অবিসংবাদিতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। ফলে, ব্যাঙ্ক সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে, আর এই সংকটকেই আবার ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের অজুহাত করে তুলছেন নরেন্দ্র মোদী-নির্মলা সীতারামনরা। এইভাবে, ব্যাঙ্কের সংকট তৈরির জন্য যারা দায়ী, সেই কর্পোরেটদের হাতেই ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার নকশা ছকা হচ্ছে।
পরিসংখ্যানের বিচারে এনপিএ বা অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ এখন আগের তুলনায় কিছুটা ভালো — ২০২২’র মার্চে এনপিএ’র পরিমাণ ছিল ৫.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা (২০১৯ এবং ২০২১’র মার্চে যা ছিল যথাক্রমে ৭.৪০ ও ৬.১৭ লক্ষ কোটি টাকা) এবং এনপিএ নেমে এসেছে মোট প্রদত্ত ঋণের ৬ শতাংশের নীচে। এটা কি ঋণ পরিশোধের প্রতি কর্পোরেটদের অধিকতর দায়িত্বশীল হওয়ার পরিচয়কে দেখায়? বিষয়টা তা কিন্তু নয়। ব্যাঙ্কের খাতায় ঋণের ছবি আজ যদি কিছুটা সন্তোষজনক দেখায় তবে তার পিছনে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে ঋণ মুছে দেওয়ারও একটা ভূমিকা রয়েছে। ঋণ মুছে দিয়ে ঋণের পরিমাণকে খাতায় কম করে তোলাটাই ঋণের আয়তনে তুলনামূলক উৎকৃষ্টতা এনেছে। দীনেশ উন্নিকৃষ্ণণ মানি কন্ট্রোল ডট কম ওয়েবসাইটে তোলা এক নিবন্ধে বলেছেন, “এখন পর্যন্ত এনপিএ’র পরিসংখ্যানে যে উন্নতি দেখা যাচ্ছে তাতে সহায়ক হয়েছে বড় আকারের ঋণ মুছে দেওয়া, ঋণের প্রকৃত পুনরুদ্ধার নয়।” ব্যাঙ্কগুলো ২০১০ থেকে ২০২০’র মধ্যে ৮,৮৩,১৬৮ কোটি টাকার ঋণ তাদের খাতা থেকে মুছেছে, যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোর ভাগ ছিল ৬,৬৭,৩৪৮ কোটি টাকা বা মুছে দেওয়া ঋণের ৭৬ শতাংশ। নরেন্দ্র মোদীর পরিভাষায় এটাকে কি ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ বলা যাবে না? মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোর রিক্ত হয়ে ওঠার বিনিময়ে কর্পোরেটদের অর্থপুষ্টির এই আখ্যান ‘খয়রাতি’র আখ্যায় অভিহিত হতে পারবে না? নয়া-উদারবাদী জমানার শুরু থেকে গোটা রাষ্ট্রটাকেই যে কর্পোরেট লুটের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে, সেই ধারাকে পাল্টানোটা আজ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছে।
– জয়দীপ মিত্র
এ’বছর জুন মাসে বিজ্ঞান গবেষণার সর্বাগ্রগণ্য পত্রিকা ‘নেচার’এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বন্যাপ্লাবিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করেছে। প্লাবনের সম্ভাব্য তীব্রতা এবং দারিদ্র্যের বাস্তব অবস্থা — এই দুই দিক একত্রে বিচার করে বিপদের ঝুঁকির মাত্রা নির্ণয় করা হয়েছে এই সমীক্ষায়। দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ১৮১ কোটি জনসংখ্যা, অর্থাৎ বিশ্ব জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ, উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছে। এরমধ্যে ১২৪ কোটির অবস্থান দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায়। বিশ্বের বন্যাকবলিত জনসংখ্যার ৮৯ শতাংশ নিম্ন ও মধ্য আয়সম্পন্ন দেশগুলির বাসিন্দা। সর্বোচ্চ বিপদসীমায় থাকা মানুষের মধ্যে ১৭ কোটি মানুষ চরম দরিদ্র ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে। এদের প্রায় অর্ধেক অংশ সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলের দেশবাসী।
মোট জনসংখ্যার নিরিখে ভারত ও চিনে সবচেয়ে বেশি মানুষ এই সর্বোচ্চ বিপদসীমায় আছে। যথাক্রমে ৩৯ কোটি ও ৩৯.৫ কোটি। এই হিসাবে শীর্ষে থাকা পাঁচটি দেশের বাকি তিনটি হল, বাংলাদেশ ৯.৪ কোটি, ইন্দোনেশিয়া ৭.৬ কোটি এবং পাকিস্তান ৭.২ কোটি মানুষ।
দু’টি দেশ আছে যাদের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছে, নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশ, যথাক্রমে ৫৯ শতাংশ ও ৫৮ শতাংশ। এই হিসাবে একদম শীর্ষে থাকা পাঁচটি দেশের বাকি তিনটি হল ভিয়েতনাম ৪৬ শতাংশ, মিশর ৪১ শতাংশ, মায়ানমার ৪০ শতাংশ। শীর্ষ ২০’র তালিকায় ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে নেদারল্যান্ডস ছাড়া আর দু’টি দেশ আছে, অস্ট্রিয়া ২৯ শতাংশ ও আলবানিয়া ২৮ শতাংশ।
এইসব পূর্বাভাস বাস্তব হয়ে নেমে আসবে হয়তো আরও বেশ কিছু বছর পর। কিন্তু ইতিমধ্যেই কোথাও কোথাও তা স্বাভাবিক পরিঘটনা হয়ে উঠছে। ভারতে বন্যার বিপদ অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই বিপদ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় আকারে সামনে চলে এসেছে পাকিস্তানে। সেখানে ২০১০ সালে ১৮ কোটি, গতবছর ১০ কোটি এবং এই বছরের চলতি বন্যায় ৩৩ কোটি মানুষ বন্যাবিধ্বস্ত। এ’বছর দেশটির এক তৃতীয়াংশ জলমগ্ন। বন্যা, খরা ও ঝড়ে ২০২১-২২ সালে বিশ্বজুড়ে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির মোট পরিমাণ ২০০১-২০২০ দুই দশকের গড় ক্ষতির পরিমাণের দু’গুণ হয়ে গেছে।
(ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদের ভয়াবহ দিনকালের কথা উঠে এসেছে তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি টিন ড্রাম উপন্যাসে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আজকের ভারতবর্ষের লড়াইকে মাথায় রেখে আমরা এই উপন্যাসকে ফিরে পড়তে চেয়েছি। - সম্পাদকমণ্ডলী)
গুন্টার গ্রাস সাহিত্যিক। পাশাপাশি তিনি ইতিহাসের এক অন্যতম আলোড়ন তোলা পর্বের অসামান্য ভাষ্যকার।
গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ উপন্যাসটি ইতিহাসের সবচেয়ে আলোড়ন তোলা পর্বগুলির একটি — দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে রচিত। কিন্তু বাইরের বড় বড় ঘটনা এর মূল বিষয়বস্তু নয়। সেই সব বড় ঘটনার অভিঘাতে কীভাবে জীবন, সমাজ, পরিবার, শহর বদলে যাচ্ছে তার অন্তরঙ্গ ভাষ্য তুলে ধরে ‘টিন ড্রাম’। ডানজিগ এমন এক শহর যেখানে কাশুভিয়ানরা ছিল, ছিল পোলরা এবং জার্মানরা। সেই বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক সামাজিক বিন্যাসটা নাজি জমানায় কীভাবে ছাড়খার হয়ে গেল এই উপন্যাস তার এক মর্মান্তিক ছবি রয়েছে। ইহুদী নির্যাতন ও হত্যা তথা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াবহতা পোল্যান্ড ও ডানজিগের এই পর্বের ইতিহাসের এক ভয়াবহ বাস্তবতা। কিন্তু সেই ভয়াবহতাকে দু’একটি অধ্যায়ে দু’একটি প্রেক্ষিতে কেবল আভাসিত করা হয়েছে৷ মার্কুসের দোকান ভাঙচুর ও তার আত্মহত্যা এরকম একটি দৃশ্যপট তৈরি করেছে৷ আর একটি উল্লেখ রয়েছে ডানজিগ থেকে যখন মারিয়া চলে যাচ্ছে অস্কার আর কুর্টকে নিয়ে। বলা হয়েছে, যে ট্রেনে তারা যাচ্ছে একদা সেই ট্রেনেই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে লোক পাঠানো হত।
একদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যদিকে ফ্যাসিবাদ-নাজিবাদ এবং এই দুই যুদ্ধমান শিবিরেরই সাধারণ শত্রু সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে পরস্পরের যে মহড়া নিয়েছে, তার সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রায় আট কোটি লোক এই যুদ্ধে মারা যায়। আহত, পরিবার স্বজন হারানো, নানাভাবে বিধ্বস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল অগণিত।
হিটলারের নাজি জার্মানি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় কারণ এবং যুদ্ধে সববৃহৎ ক্ষয়ক্ষতি যাদের হয়েছিল জার্মানি ছিল তার অন্যতম। ১৯৩৩এ হিটলারের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই জার্মানির ভেতরে নাজি-বিরোধী, ইহুদী, অশক্ত, ভিন্ন যৌনতার মানুষজনের ওপর মারাত্মক আঘাত নেমে আসে। পোল্যান্ড সহ নানা দেশের ইহুদীরা জার্মান আগ্রাসনের পর মারা যায় দলে দলে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ছিল কম করেও অর্ধকোটির কাছাকাছি। জার্মানি যুদ্ধ শেষ হবার পরেই দ্বিধাবিভক্ত হল। পূর্ব জার্মানি এল সোভিয়েত প্রভাবে আর পশ্চিম জার্মানির ওপর আধিপত্য থাকল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার। ক্রমশ দুই জার্মানিতেই শুরু হল পুনর্গঠন। আবার ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিকে পরস্পরের থেকে সরিয়ে রাখল অনেকটা দূরে। বার্লিনের দেওয়াল হয়ে উঠল ঠান্ডা যুদ্ধের অন্যতম প্রতীক। এই জটিলতা পেরোতে পেরোতেই জার্মানি ক্রমশ ফিরে তাকাল তার ভয়াবহ নাজি অতীতের দিকে। সাহিত্যে এর শুরুটা হল যুদ্ধোত্তর কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জার্মান উপন্যাস গুন্টার গ্রাসের ‘টিন ড্রাম’ দিয়ে।
১৯৫৯ সালে বইটি প্রকাশের পর তা নিয়ে নানা বিরূপ সমালোচনা কোথাও কোথাও হল বটে, কিন্তু অচিরেই সেটি পেয়ে গেল ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা। শুধু জার্মানিতে নয়, এর ইংরাজি অনুবাদ ইউরোপ আমেরিকা সহ সারা বিশ্বেই নজর কাড়ল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর ইংরাজি অনুবাদ বিক্রি হল চার লক্ষেরও বেশি এবং নিউ ইয়র্কটাইমস পত্রিকার বেস্ট সেলার লিস্টে এটি টানা তিন সপ্তাহ এক নম্বরে থাকল।
জার্মানি, পোল্যান্ড ও সংলগ্ন ইউরোপের বিশ শতকী ইতিহাস ‘টিন ড্রাম’এ বারবার এসেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নায়কের মা আগনেস বড় হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাহিনীর নায়ক অস্কার। আগনেস আর ইয়ানের প্রেমের প্রথম দিনগুলোয় ইয়ানের যুদ্ধে যাবার আশঙ্কা, যুদ্ধ শেষে আগনেস আর মাৎসেরাটের দাম্পত্যর দিনগুলোয় মন্দার ছায়াপাত আর তার বিরুদ্ধে লড়াই’এর ছবি রয়েছে।
১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় এলেন। পোল্যান্ড ও ডানজিগও বদলাতে শুরু করল। বড় বড় সমাবেশ ও মশাল মিছিল হতে থাকল নাজিদের। মাৎসেরাট পরিবর্তন বুঝে নিয়ে ১৯৩৪এ নাজি পার্টিতে যোগ দিল।
এই অংশ থেকেই টিন ড্রাম সমকালীন রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে প্রবলভাবে প্রবেশ করে। চরিত্র ও পরিবারের ভেতরের বদলগুলো দেখাতে শুরু করে। ক্রমশ মাৎসেরাট নাজি পার্টির উর্দিতে নিজেকে সজ্জিত করতে শুরু করল। একে একে কিনতে লাগল বিভিন্ন অংশ। প্রথমে সে কিনেছিল পার্টির ক্যাপটুপিটা। তারপর খাঁকি শার্ট, তারপর উঁচু বুট জুতো। এইভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মাৎসেরাট এসে গেল পুরোদস্তুর নাজি উর্দিতে। প্রতি রবিবার এই পোষাকে সজ্জিত হয়ে মাৎসেরাট নাজিদের শক্তি প্রদর্শনমূলক ড্রিল প্যারেডে অংশ নিত। মঞ্চ বেঁধে যে বড় বড় সমাবেশ হত নাজিদের, তার শুরুর দিনগুলোর কথা এখানে এসেছে বিস্তারিত অনুপুঙ্খে।
অস্কার তার ড্রাম নিয়ে এইসব নাজি সমাবেশে হাজির হত, সেখানে বাজাত এবং ক্রমশ তার বাজনা জনপ্রিয়তাও পেতে শুরু করে। তখন তার বয়েস বছর এগারো। বছর পাঁচেক, উনিশশো আটত্রিশ পর্যন্ত সে এইভাবে ডানজিগের নাজি সমাবেশগুলোতে নিয়মিত ড্রাম বাজিয়ে যেত।
অস্কারের জীবনের ভাঙচুর দিয়ে টিন ড্রাম উপন্যাসের প্রথম পর্বের সমাপ্তি। আর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ডানজিগের পোলিশ ডাকঘরের ওপর নেমে আসা ভয়াবহ আক্রমণের কথা দিয়ে। দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডানজিগের পোলিশ ডাকঘরের ওপর শুরু হল নাজি আক্রমণের অনুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। অস্কার তখন সেখানে গেছিল তার ড্রাম ঠিক করাতে। আর ডাকঘরের আধিকারিক হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিল ইয়ান ব্রনস্কি ও তার সহকর্মীরা। ইয়ান হয়ত ছিল পোলিশ আন্ডারগ্রাউন্ড রেজিস্ট্যান্স গ্রুপের এক সক্রিয় সদস্য, তবে গোপন বলেই অস্কারের তা জানার কথা নয়। কিন্তু পাঠক আখ্যান থেকে এরকম অনুমান করতে পারেন। বোমা বর্ষণে ইয়ান আহত ও রক্তাক্ত হয়, গুরুতর আহত কোবিয়েলাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কনরাডকে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। যুদ্ধ নেমে এসেছে বুঝতে পেরে তখন ইয়ানরা অপেক্ষা করতে থাকে ফরাসি আর ব্রিটিশদের সাহায্যের জন্য। অস্কার এই ঘটনার পরেই প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয় ও তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অনেকদিন থাকতে হয় তাকে। হাসপাতালে শুয়ে সে শুনতে পায় বোমা বিস্ফোরণের শব্দ। একদিন হঠাৎ খেয়াল করে সে তার ড্রামটার কথা অনেকদিন ভাবেনি। এই প্রথম অস্কার উপলব্ধি করে যে টিনের ড্রামের বাইরেও একটা অন্য বড় জগৎ রয়েছে। এই পর্বেই ইয়ান সহ যারা ডানজিগের পোলিশ ডাকঘরটা রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল, তাদের গুলি করে হত্যা করে নাজিরা। ক্রমশ রিক্ত ও নিঃসঙ্গ হতে থাকে অস্কার।
ডানজিগ ও গোটা বিশ্বে যখন বড় বড় ঘটনা ঘটছে তখনো টিন ড্রাম উপন্যাসে তার ন্যারেটিভ প্যাটার্নকে পরিবর্তন করেননি গুন্টার গ্রাস। নাজি জার্মানির আক্রমণে বিধ্বস্ত হওয়ার উচ্চকিত বর্ণনা দেননি। অস্কারের রোজকার জীবনযাপনের কথা বলতে বলতেই সেসবের আভাস দিয়ে গেছেন।
টিন ড্রাম উপন্যাসের তৃতীয় পর্বে মারিয়া ও অস্কারকে বিপ্রতীপে স্থাপণ করেন গুন্টার গ্রাস। মারিয়া যেখানে পশ্চিম জার্মানির পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় মিশে যেতে পারে ও নব্য বুর্জোয়া গোষ্ঠীতে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়, সেখানে থিতু হতে হতেও শেষপর্যন্ত এক গভীর মনস্তাপের মধ্যে বন্দী হয়ে যায় অস্কার। এক বেদনাবোধ ও আত্মধিক্কার থেকেই সে নিজেকে হত্যাকারী ভাবতে থাকে। বলতে থাকে তার বাবা, মা, কাকা, বান্ধবী — সবার হত্যাকারী সে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় আঠাশ বছর বয়সে এসে তার ঠাঁই হয় এক মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে। সেখানেই দু’বছর ধরে সে লেখে তার আত্মকথা। তার তিরিশ বছরের জন্মদিনে এসে সেই আত্মকথা ও টিন ড্রাম উপন্যাসের সমাপ্তি।
গুন্টার গ্রাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাজি জার্মানির দিনকাল সংশ্লিষ্ট উপন্যাস রচনার যে ধারাটি জার্মান সাহিত্যে শুরু করলেন, তা ধরে পরে আরো অনেকে লিখলেন বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে। ইউরেক বেকার, হাইনরিখ ব্যোল, বিলার্ড উম, হালবৎসেন, উভে ইয়নসন, উইবার ইয়াকব, পেটার ভাইস, ক্রিস্টা ভলভ প্রমুখের কথা এই প্রসঙ্গে মনে করা যায়।
– সৌভিক ঘোষাল
২২ অক্টোবর কলকাতার নাকতলায় এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত মিড-ডে-মিলের প্রয়াত (৪ অক্টোবর) কমরেড ভারতী ঘোষের স্মরণ সভা হয়। মিড-ডে-মিলের এই গ্ৰুপটি, যেখানে ভারতীদি যুক্ত ছিলেন, সেই গ্রুপটি চালান চন্দনা মুখার্জী, তিনি ও ভারতীদির সহকর্মী রীতা সেন, রীনা ঘোষ, রীতা ভৌমিক, লক্ষী দাস, শম্পা মজুমদার ভারতীদির স্মৃতি চারণ করেন। স্মরণসভায় মিড-ডে-মিলের কর্মী, এআইসিসিটিইউ আঞ্চলিক টীমের সদস্য এবং জেলা নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন।
==0==