আজকের দেশব্রতী : ১৩ অক্টোবর ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati_13-Oct-22

Delhi is vocal

কয়েকশ ছাত্রীছাত্র, টিচার, আন্দোলনকর্মী ও দিল্লীর সহনাগরিকেরা “ইন্ডিয়া বিহাইন্ড বারস্” প্রেস কনফারেন্সে সামিল হন। আন্দোলনকর্মী ও কারাবন্দীদের পরিবারের মানুষেরা সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন।

৮ অক্টোবর প্রবল বৃষ্টির মধ্যে নাগরিকেরা দিল্লী প্রেস ক্লাব উপছে হাজির হন ইউএপিএ, পিএসএ, এনআইএ ইত্যাদি আইনে কারারুদ্ধ রাজনৈতিক বন্দীদের সংহতিতে। এইসব বন্দীদের পরিবারের লোকজন বন্ধুদের সাথে নিয়ে টিচার ও এক্টিভিস্টরা একযোগে আওয়াজ তোলেন বিজেপি রাজত্বে গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে।

রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম কর্মী এবং খালিদ সাইফির স্ত্রী নার্গিস সাইফি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “উমর খালিদের ওপর যে অবিচার চালানো হচ্ছে তা দেশের ওপরই অবিচার। খালিদ তো দেশের সংবিধানের জন্যই লড়ছিলেন। বিজেপির বিদ্বেষে কারাবন্দী নাগরিকদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব”। সিপিআই (এমএল) সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “বিজেপির বিরুদ্ধে এই লড়াই স্বাধীনতা সংগ্রামের মাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ। এই ঘৃণা ও হিংসার শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে এক নতুন রাজনৈতিক চেতনায় আমাদের জাগ্রত হতে হবে।” দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং হানি বাবুর পার্টনার জেনি রোয়েনা ইউএপিএ-র বিরুদ্ধে বলেন, “আর কোনোভাবে মুখ বন্ধ না করতে পারলে তখন ওদের শাস্তি দেওয়ার হাতিয়ার হয় ইউএপিএ”।

রাজ্যসভার সাংসদ মনোজ ঝা বলেন, “আমি সংসদে হাজির ছিলাম যখন সংসদে ইউএপিএ পেশ করা হয়েছিল। তখন আমরা যা আশঙ্কা ও সমালোচনা ব্যক্ত করেছিলাম সেগুলি সবই বাস্তব হচ্ছে বর্তমানে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর নির্মম আক্রমণের মাধ্যমে”। আন্দোলনের কর্মী এবং জিএন সাইবাবার সহযোগী বসন্ত বলেন, “সাইবাবা বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন শারিরীক অসুস্থতায় ভুগছেন। নাগরিকদের প্রতি এই সরকারের ন্যূনতম দায়বদ্ধতা বা সহমর্মিতার বেসিক সেন্সটুকুও নেই”।

Civil society in Delhi is vocal

রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী এবং উমর খলিদের বন্ধু বনজ্যোৎস্না লাহিড়ি বলেন, “যেসব মামলা, সওয়াল বা আইনকে আমাদের উদ্ভট মনে হয় সেই সবকিছুকে এই একনায়ক সরকার স্বাভাবিক বিষয় করে তুলেছে”। প্রবীণ আইনজীবী কলিন গনজালভেস বলেন, “পৃথিবীতে কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই পুলিশ ও রাজনৈতিক শাসককে চরম ক্ষমতা দেয় না কে টেররিস্ট তা ঠিক করার। অধ্যাপক নন্দিনি সুন্দর বলেন, “এখন তো পুলিশই ঠিক করে দিচ্ছে দেশের বুদ্ধিজীবীরা কী লিখবেন না লিখবেন।’’

স্বাধীন সাংবাদিক নেহা দিক্ষিত বিচারবিভাগের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে বলেন, “নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতগুলির সম্পূর্ণ রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে, কোর্টের সিনিয়র আধিকারিকরাই এখন স্বাধীন সাংবাদিক ও এক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছে। এই সরকার এবং আরএসএস বিচারবিভাগের স্বাধীন চরিত্র ধ্বংস করে দিয়েছে”। দ্য ওয়্যায়ারের সিনিয়র এডিটর আরফা খানুম বলেন, “সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললে নির্যাতনের আশঙ্কা এখন সকলের মনে। ভয়কে এইভাবে স্বাভাবিক করে তোলার বিরুদ্ধে লড়তে হবে সাহস নিয়ে”।

ইউএপিএ, পিএসএ, এনআইএ, আফস্পা বাতিল কর। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্ত কর। সমস্ত বন্দীদের অবিলম্বে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা কর।

– আইসা-এআইএলএজে-আরওয়াইএ

Narmedh Yajna in Malbazar

গোটা রাজ্যকে অবর্ণনীয় বিষাদে আচ্ছন্ন করে মালবাজারের দশমীর সন্ধ্যা কেড়ে নিল তরতাজা আট আটটা প্রাণ! আহত হলেন আরও অনেকে। বাংলার পুজো ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর আহ্লাদে আটখানা নবান্নের রাজনৈতিক প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা যেন মর্তের বহু নির্মম বাস্তব থেকে নিজেদের অনেক দূরে সরিয়ে গগনবিহারী হয়েছিলেন। আর, তারই চুইয়ে পড়া রেশ স্থানীয় প্রশাসনকেও যেন গিলে খেল! আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে জেলা প্রশাসনের একাধিক গাফিলতি না থাকলে বোধহয় ঠেকানো যেত অতগুলো সহনাগরিকের মূল্যবান জীবন।

প্রকৃতি কি এতো বড় বিপদের কোনও আগাম পূর্বাভাস দেয়নি? মহালয়ার ঠিক আগের দিনই মাল নদীতে এসেছিল হড়পা বান যা ভাসিয়ে নিয়ে যায় অস্থায়ী বাঁধ, বাঁধ তৈরির কাজে পাথর তোলার জন্য নদীখাতে নামানো একটি ট্রাক। অবাক লাগে ফের সেখানেই বাঁধ তৈরি করা হল? কেন প্রশাসন অনুমতি দিল নদীর মাঝের চরে কাতারে কাতারে দর্শনার্থী এবং প্রতিমাবাহী পেল্লায় লরিগুলোকে যেতে? মালবাজারে তো নবমীর দিনেও বৃষ্টি হয়, এমনকি পাহাড়ে নিয়মিত বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। নবমীর বৃষ্টিতে জল বেড়ে যাওয়ায় পুরকর্মীদের দিনভর ঘাট তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিন্তির চাদরে মুড়ে দিন কাটান। কোনও ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়নি। সংবাদে প্রকাশ, মাত্র আটজন সিভিক ভলেন্টিয়ারের হাতে দড়ি দিয়ে নাকি পুরো ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল স্থানীয় প্রশাসন। আর এই মর্মান্তিক ট্রাজেডিকে যেন আকস্মিক দুর্বিপাক হিসাবে দায় ঝেড়ে ফেলতে প্রশাসনের কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, “মাল নদীতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, গত কুড়ি বছরের রেকর্ড এমন ঘটনা ঘটেনি”।

এই দুর্ঘটনার নেপথ্যে উঠে আসছে প্রকৃতিকে নির্মম ও বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করার কারণসমূহ। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সুবীর সরকার জানিয়েছেন হড়পা-প্রবণ এই নদীর আরও বিপদ বাড়িয়েছে অবৈধ ও অপরিকল্পিত নদীখনন বালি-পাথর তোলা, নির্বিচারে বসতি স্থাপন। ফলে, হড়পা বানে নদীস্রোতের গতিপথ আচমকা বদলে যায়। অন্য কোনও গতিপথ ধরে জল চলে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

এদিকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে চুপিসারে গৈরিক মতাদর্শ কী নির্লজ্জভাবে বাসা বেঁধে উঠছে, কলকাতার একটা পুজো তা বে-আব্রু করে দিল। হিন্দু মহাসভা কর্তৃক আয়োজিত রুবি পার্কের এই পুজোটিতে, পুলিশই জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছিল না। আর, সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল এই অনুমোদনহীন, বেআইনি পুজোতে মহিষাসুরের বদলে এমন একটা মূর্তিবসানো হয়েছিল, যার সাথে গান্ধীজির প্রকট সাদৃশ্য ছিল। রাজ্যের প্রায় সমস্ত বামপন্থী দল সহ অন্যন্য দল, সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকবৃন্দ এর তীব্র বিরোধিতা করেন। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনই এগিয়ে এলো হিন্দু মহাসভার আয়োজকদের পরিত্রাণ করতে। অসুরের মাথায় মুখে চুল দাড়ি গোঁফ দিয়ে গান্ধীজির চশমাটা খুলে ফেলতে, ও যে সাংবাদিক এনিয়ে টুইট করেছিলেন তাঁকে তা মুছে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হল। এই অপরাধসম অন্যায় প্রশয় পেল, আর বলাই বাহুল্য, পুলিশই জানিয়েছে, তারা যা করেছেন তা উপরের নির্দেশ অনুযায়ী। বিন্দুমাত্র অনুতাপহীন আয়োজকরা উল্টে ঘোষণা করেন যে গান্ধীকে তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র মনে করেন না, আর ওই ঘটনা পুরোপুরি কাকতালীয়, তাই তাঁরা একেবারেই দুঃখিত বা লজ্জিত নন।

বিদ্বেষের কারবারিদের এইভাবে ছাড় দিয়ে যে ঘৃণার চারাগাছকে সযত্নে লালন করা হল, তা অচিরেই বিষবৃক্ষ হয়ে ডালপালা বিস্তার লাভ করবে। আর, রাষ্ট্রক্ষমতাই এরজন্য পুরোপুরি দায়ী থাকবে।

কোথাও প্রশাসন নির্লিপ্ত, কোথাও অতি সক্রিয় হয়ে গেরুয়াবাহিনীকে মদত — আজ বাংলায় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিরাট ঘুণ ধরেছে।

রাজ্যের বামপন্থী গণতান্ত্রিক নাগরিকদেরই হাতে তুলে নিতে হবে নব নির্মাণের কর্মকান্ড।

Fighting Women of Iran

ইরানের নীতি পুলিশদের হাতে তথাকথিত ‘পোশাক বিধি’ লঙ্ঘনের জন্য মাহসা আমিনির হত্যা ইরানে প্রকৃত অর্থেই বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলেছে। ইরান জুড়ে অত্যাচারী ধর্মীয় শাসন এবং প্রাত্যহিক জীবনের ক্রমশ বেড়ে চলা দুর্দশার বিরুদ্ধে নারীসমাজ ও শ্রমজীবী মানুষের ক্রমপুঞ্জিত ক্রোধের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটেছে এই প্রতিবাদে। ইতিমধ্যে এই সরকার পঞ্চাশ জনেরও বেশি প্রতিবাদীকে হত্যা করছে বলে খরর পাওয়া গেছে, তবুও এই নৃশংস অত্যাচারের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে আরও ব্যাপক আকারে।

বাইশ বছরের কুর্নিশ তরুণী মাহসা আমিনি তার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য তেহরানে এসেছিলেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ইরানের কুখ্যাত নীতি পুলিশের ‘গাইডেন্স পেট্রল’ তাকে আটক করে, সঠিকভাবে হিজাব পরার পদ্ধতি শেখানোর জন্য ‘পুনর্শিক্ষা কেন্দ্রে’ পাঠায়। তার ভাই যখন তার জন্য থানায় অপেক্ষা করছিলেন, তার পরিবারকে জানানো হয় মাহসাকে হৃদযন্ত্রের সমস্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল এবং সেখানেই তিনি গত ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবৃতিতে ধরা পড়েছে যে তাকে জঘন্যভাবে হেনস্থা করা হয় ও নৃশংসভাবে মারধর করা হয়।

মাহসা আমিনির মৃত্যুসংবাদ ইরানের মহিলাদের ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা ক্রোধকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তারা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন, আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন ও জনগণের দাবি সনদের ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জিতে যুক্ত করেছেন অনুপ্রেরণা জাগানো প্রতিবাদের এক নতুন অধ্যায়। তাদের সমস্ত শ্লোগান — “জান, জান্দেগি, আজাদি (নারী, জীবন, স্বাধীনতা), ‘আজাদি, আজাদি, আজাদি’ (স্বাধীনতা স্বাধীনতা স্বাধীনতা) এবং ‘মা হামে, মাহসা হাস্তিম, বেজাং তা বেজাঙ্গিম’ (আমরা সবাই মাহসা, আমরা সবাই আছি এই একজোট লড়াইয়ে) গোটা বিশ্ব জুড়ে অনুরণিত হচ্ছে। তাদের নিজেদের চুল কেটে আন্দোলনের পতাকা হিসেবে উড্ডীন করার সাহসী কাজ আগামী বহু প্রজন্মের সৃজন প্রতিভাকে উদ্দীপ্ত করবে।

ইরান একটি বহু বৈচিত্র্যের দেশ, মাহসা আমিনির মর্মান্তিক মৃত্যু বিভিন্ন পরিবেশের মানুষকে তাদের সম্মিলিত দুঃখ, ক্রোধ আর প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে। ইরানী মহিলাদের ব্যক্তিগত জীবন ও রুচি-পছন্দের ওপর ধর্মীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে লড়াইকে এখন, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-পোষিত নজরদারি বাহিনীর সদস্য ও তাদের নৃশংস বর্বরতায় আন্দোলন দমনের চেষ্টার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদের আরও বড় তরঙ্গে ছড়িয়ে যেতে দেখছি। অতীতের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শনের মতো, ইরানী মহিলারাও আজ ধর্মীয় শাসনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তনের গভীর আন্দোলনের দিশারী হয়ে উঠেছেন। আর সেই জন্যই ইরানের সংগ্রামী মহিলা ও জনগণের লড়াইয়ের প্রতি আন্তর্জাতিক সংহতি প্রগাঢ় হয়ে উঠছে।

ধর্মান্ধরা এবং মার্কিনপন্থী মাতব্বররা অবশ্য মাহসা আমিনির মৃত্যু ও তার ফলশ্রুতিতে ইরানের উত্তাল প্রতিবাদকে নিজেদের ইসলাম ভীতির ভাষ্য ও ইরানে রাজত্ব পরিবর্তনের শোরগোলকে ব্যাপক করে তোলার উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে উঠে পড়ে লেগেছে। সেই সব শক্তি যারা ভারতে মহিলাদের হিজাব পরার জন্য নির্যাতন ও হেনস্থা করে, তারা ইরানের প্রতিবাদী মহিলাদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছে। হিজাবটা কোনও ব্যাপার নয় — বিষয়টা হল মহিলাদের ওপর ‘পোশাক বিধি’কে চাপিয়ে দেওয়ার স্বৈরতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক জুলুম। ইরান বা আফগানিস্তানের মহিলাদের পূর্ণ অধিকার আছে সেই পোশাকবিধিকে প্রত্যাখ্যান করার যা হিজাব বা সেটা পরার বিশেষ ধরনকে বাধ্যতামূলক করে, তেমনই ভারতেও মহিলাদের একইরকম অধিকার আছে যে কোনও বৈষম্যমূলক হুকুমকে অগ্রাহ্য করার যা তাদের হিজাব পরার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে।

Women of Iran

নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের সংগ্রাম ফ্যাসিস্ট-আধিপত্যের অধীনে থাকা ভারতে যেমন জরুরি তেমনই জরুরি ধর্মীয় শাসনাধীন ইরান বা এমনকি গণতন্ত্রের স্বঘোষিত রক্ষক এবং রপ্তানিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই হোক, যেখানে মহিলাদের আবার একবার লড়তে হচ্ছে গর্ভপাতের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ফিরে পেতে। আজ ইরানের লড়াইটা যদি হয় ধর্মীয় শাসনের কবলমুক্ত গণতন্ত্রের জন্য, আমাদের মনে রাখতে হবে আধুনিক ইরানের প্রগতির ধারাকে বিশেষ বিশেষ সন্ধিক্ষণের সংকটকালে কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ পিছিয়ে দিয়েছে।

১৯৫০-এর দশকের শুরুতে ইরান সিআইএ — পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুত্থান ‘অপারেশন এজেএএক্স’-এর শিকার হয়েছিল যার উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মহম্মদ মোসাদ্দেঘ সরকারকে ফেলে দিয়ে ইরানকে পাহলভী রাজবংশের রাজতন্ত্রের শাসনের অধীন করা। মোসাদ্দেঘকে উৎখাত করা হয়েছিল তার প্রগতিশীল রাজনীতি, বিশেষ করে তার ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণের সাহসী পদক্ষেপের জন্য।

১৯৭৯-এর বিপ্লব শেষ পর্যন্ত হস্তগত হয়েছিল ধর্মতন্ত্র (থিয়োক্রেটিক)-এর শক্তির দ্বারা। উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে এক ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করা। কিন্তু বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে আয়াতোল্লা খোমেইনি-কবলিত ইরান পাহলভী যুগের মার্কিনপন্থী ইজরায়েলপন্থী নীতিতে ফিরে যায়নি। আমরা যদি ইরানের গণতন্ত্রপ্রেমী আন্দোলনকারীদের কথা কান পেতে শুনি তাহলে বুঝতে পারব কীভাবে ইরানকে মার্কিন মঞ্জুরি এবং মার্কিন-ইজরায়েল অক্ষের সর্বক্ষণের নিশানায় রাখা আসলে ইরানের অত্যাচারী শাসককে আভ্যন্তরীণ সমর্থন লাভের জন্য প্রচার চালাতে ও তার উৎপীড়নের শাসনকে বৈধতা দিতে সাহায্য করছে।

ইসলামিক বিশ্বে মহিলাদের অধিকার ও গণতন্ত্রের নামে আমেরিকার অশুভ নীতির প্রভাব কতটা সর্বনাশা হতে পারে তার আরেকটি নিদর্শন হল আফগানিস্তান — কয়েক দশকের সামরিক দখলদারির পর তালিবানদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে মাত্র কিছু দিন আগে আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়েছে।

ভারতবর্ষেও, আমরা খুব ভালো করেই জানি কীভাবে সঙ্ঘ পরিবার মুসলিম মহিলাদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করে নিজেদের নারীবিদ্বেষ ও ধর্মান্ধতাকে আড়াল করার চেষ্টা করে চলেছে। তিন তালাক এবং এখন হিজাবের বিরুদ্ধে তাদের প্রচারকে, মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়নের বিষয়ে তারা কতটা ‘ভাবিত’ তার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সমান নাগরিকত্বের জন্য শাহীনবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর মুসলিম মহিলাদের প্রতি তাদের আসল মনোভাব একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিদ্বেষমূলক মিথ্যা, বুল্লি বাই-এর মতো বিষাক্ত অ্যাপের মাধ্যমে অন লাইনে লাঞ্ছনা এবং ডিজিটাল নিগ্রহ থেকে শুরু করে দানবীয় আইনে জেলে পোরা ও প্রতিহিংসামূলক বুলডোজার আক্রমণ – সব কিছুর মধ্যে মুসলিম আন্দোলনকারী মহিলারা সঙ্ঘ বাহিনীর নির্যাতনমূলক ও চরম ঘৃণার ধারাবাহিক প্রচারের চূড়ান্ত নিশানায় নিজেদের দেখতে পাচ্ছেন। জাকিয়া জাফরির পুনর্বিবেচনার আবেদনকে ঘৃণা ও অবজ্ঞায় খারিজ করা, সহ-আবেদনকারী তিস্তা শেতলবাদের প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার এবং বিলকিস বানো মামলায় ধর্ষক ও খুনিদের নির্লজ্জভাবে সংবর্ধনা দেওয়ার ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে মুসলিম নারীদের ন্যায় চাওয়ার অধিকারকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করা হচ্ছে।

পূর্ণ অধিকারসমূহ ও ধর্মতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রামরত ইরানের মহিলাদের প্রতি আমাদের উষ্ণ ও নিঃশর্ত সমর্থন জানাতে হবে। আমরা কোনও রকম পশ্চিমী হস্তক্ষেপ ছাড়াই ইরানের জনগণের নিজেদের পথ নিজেরাই নির্ধারণ করার অধিকারকেও পূর্ণ সমর্থন জানাই। পিতৃতন্ত্র ও নারী বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই সামাজিক রূপান্তরের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই লড়াইকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য প্রতিটি সংগ্রামে শক্তির মহান উৎস হিসাবেই দেখতে হবে। ইরানের সংগ্রামী মহিলারা বিজয়ী হোন!

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২)

communal tension in Mominpur

১২ অক্টোবর সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কলকাতা জেলা কমিটির একটি প্রতিনিধি দল মোমিনপুর ময়ূরভঞ্জ সংলগ্ন এলাকা পরিদর্শন করে। এখানে কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া স্থানীয় একটি বিবাদকে কেন্দ্র করে রাজ্য জুড়ে বিজেপি-সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক প্রচার ও দাঙ্গার প্ররোচনা দেওয়া চলছে।

আজ অকুস্থলে গিয়ে দেখা গেল অঞ্চলে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন, মোড় থেকে ব্যারিকেড করা, জারি আছে ১৪৪ ধারা। সকাল ১০টা পর্যন্ত দোকান বাজারের জন্য ব্যারিকেড খোলা থাকছে, তারপরেই যাতায়াত প্রায় নিষেধ। বস্তুত ব্যারিকেডের এইপারেও দেখা গেল বেশিরভাগ দোকান পাটের ঝাঁপ বন্ধ, খোলা নেই চায়ের দোকান। আশেপাশের ছোট দোকানদার, পথচলতি এলাকার মানুষ, ফল বিক্রেতাদের সাথে কথায় জানা গেল, কয়েকদিন আগে নবীদিবসের একটি পতাকা লাগানো ও ছিঁড়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে বচসা ও গন্ডগোলের সৃষ্টি হয় স্থানীয় ডোম ও মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মধ্যে। এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও বিজেপির প্রভাব রয়েছে। বচসাকে কেন্দ্র করে এলাকায় ও বাইরে বিজেপি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও হিংসা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে এই কথাও অঞ্চলের আশেপাশের মানুষেরা বলেন। এমনকি বিদ্বেষের আবহাওয়া ছড়িয়ে এলাকায় নিম্নবর্ণের মানুষদের এই ধরনের বিবাদ ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করে নেওয়া হচ্ছে বলেও কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান।

তাঁরা আরো বলেন যে অঞ্চলে এখন ব্যাপক পুলিশবাহিনী থাকছে এবং এই মুহূর্তে কোনো অশান্তির পরিস্থিতি নেই। বস্তুত যত জনের সাথে কথা হয়, তাঁদের প্রত্যেকের কথা থেকে বারবার উঠে আসে এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে সহাবস্থানের কথা। একে অন্যের উৎসবে শরিক হওয়া, সাংস্কৃতিক আদান প্রদান এই অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্য। কোনো রকম অশান্তির পরিবেশ তাঁরা কেউই চান না এবং স্থানীয় একটি বিবাদকে কেন্দ্র করে হিংসা, অপপ্রচার ও রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টার বিরোধিতা করেন সবাই। প্রতিনিধি দলে ছিলেন অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, বাবুন চ্যাটার্জী ও মধুরিমা বক্সী।

Women's association conference

বিষ্ণুপুরে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির প্রথম লোকাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ। সম্মেলনের শুরুতে সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য কমিটি পর্যবেক্ষক চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী। কোভিডকালে প্রয়াত সাথী এবং নারী আন্দোলনের শহীদ কমরেডদের স্মরণ করে সম্মেলন শুরু হয়। সাফাইকর্মী, পরিচারিকা, আয়া, আইসিডিএস কর্মী, ১০০ দিনের কাজ এই সমস্ত ক্ষেত্র থেকে প্রায় ৩০ জন মহিলাদের নিয়ে সম্মেলন হয়। সম্মেলনে আগত প্রত্যেক মহিলার খসড়ার ওপর আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান এবং নিজেদের কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা এই সম্মেলনকে সমৃদ্ধ করেছে।

মহিলাদের বক্তব্যের মধ্যে উঠে আসে তাদের ওপর ঘটে চলা পারিবারিক হিংসার কথা। শ্রমজীবী মহিলারা বাইরে কাজ করে বাড়ি ফিরেও হিংসাত্মক পারিবারিক হামলার শিকার হচ্ছেন, কখনও স্বামীর হাতে, কখনও ছেলের হাতে। অন্যদিকে যে মহিলারা পরিচারিকার কাজ করেন, তাঁরা বলেন ঘর-মালিকরা তাঁদের মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেয় না এবং বাড়ির কোনো জিনিস হারিয়ে গেলে, পরিচারিকাকে সন্দেহ করে চোর বলে অসম্মান করার ঘটনাও ঘটছে। আইসিডিএস কর্মীদের সাম্মানিক মজুরি নেই, এমনকি কাজ করতে করতে কোনোরকম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের সুরক্ষাও নেই। অন্যদিকে যে মহিলারা হাসপাতালে আয়া হিসাবে নিযুক্ত আছেন, তাদের নেই নির্দিষ্ট দৈনিক মজুরি। নেই কাজের কোনো স্থায়ীকরণ। উপরন্তু নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সময় ধরে কাজ করানো হচ্ছে।

সাফাইকর্মী মহিলারা বলেন, অনেক আন্দোলনের ফলে তারা মাতৃত্বকালীন তিনমাস ছুটি আদায় করতে পেরেছেন। আগামী রাজ্য সম্মেলনকে সামনে রেখে আরো সদস্য বাড়ানো ও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলিতে আরো নিবিড় অনুশীলন গড়ে তোলার অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়। ১১ জনের নতুন লোকাল কমিটি গঠন করা হয়, যাঁর সভাপতি হন সন্ধ্যা মাদ্রাজি এবং সম্পাদক হন তিতাস।

Bauria Jute Unit

গত ২ অক্টোবর ২০২২ বেঙ্গল চটকল মজদুর ফেডারেশনের বাউরিয়া জুটমিল (হাওড়া) ইউনিটের সাধারণ সভা জুটমিল সংলগ্ন শ্রমিক ক্যান্টিনে, সনৎ বাবু মঞ্চে সকাল ১১টা থেকে অনুষ্ঠিত হয়। শহীদ বেদীতে মাল্যদানের মধ্যে দিয়ে সাধারণ সভা শুরু হয়। প্রথমে মাল্যদান করেন এআইসিসিটিইউ’র সর্বভারতীয় উপসভাপতি এন এন ব্যানার্জী। এরপর একে একে এআইসিসিটিইউ’র হাওড়া জেলা সভাপতি দেবব্রত ভক্ত, জেলা এআইসিসিটিইউ সদস্য পার্থ ব্যানার্জী, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হাওড়া জেলা সদস্য রতন দত্ত, বিসিএমএফ বাউরিয়া জুটমিল ইউনিটের সম্পাদক মহঃ ইসরাফিল সহ বাউরিয়া জুটমিলের অন্যান্য কমরেডরা।

উদ্বোধনী ভাষণে এন এন ব্যানার্জী জুট শ্রমিকদের দাবি আদায়ের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে কারখানার সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানান।

উপস্থিত কমরেডরা জুটমিলের বিভিন্ন সমস্যা ও ম্যানেজমেন্টের স্বেচ্ছাচারিতা এবং তার সামনে অন্যান্য ইউনিয়নগুলির আপোসকামী ভুমিকার উল্লেখ করেন।

দেবব্রত ভক্ত মহিলা ও ঠিকা শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন। পার্থ ব্যানার্জী শ্রমিকশ্রেণীকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভাজন করার চক্রান্তকে রুখে দেওয়ার আহ্বান জানান। রতন দত্ত মহিলা শ্রমিকদের সংগঠনে নিয়ে আসার জন্য এবং শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে সোচ্চার হবার জন্য বলেন।

সাধারণ সভা ১৫ জনের কমিটি নির্বাচিত করে, যার সম্পাদক হন মহঃ ইসরাফিল ও সভাপতি হন দেবব্রত ভক্ত।

সমাপ্তি ভাষণে এন এন ব্যানার্জী শ্রমিক আন্দোলনে জুট শ্রমিকদের ঐতিহাসিক ভুমিকার কথা স্মরণ করিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তির দ্বারা শ্রমিকশ্রেণীর উপর নামিয়ে আনা হামলার বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন।

সম্মেলনে যুব শ্রমিকদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।

বাউরিয়া জুটমিলে আগামীদিনে দৃঢ় সংগঠন গড়ে তোলার শপথ নিয়ে সাধারণ সভা সমাপ্ত হয়।

Peace Against War

বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (ডব্লিউএফটিইউ)-র ৭৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন উপলক্ষে কলকাতায় সিটুর শ্রমিক ভবন হলে ডব্লিউএফটিইউ-র অন্তর্ভুক্ত বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলির এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী, সিটুর অনাদি সাহু, এআইটিইউসি-র লীনা চ্যাটার্জি, ইউটিইউসি-র দীপক সাহা, এআইইউটিইউসি-র অশোক দাস সহ ব্যাঙ্ক, বিএসএনএল নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সভায় সভাপতিমন্ডলীতে থাকেন এআইসিসিটিইউ-র রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু।

huge fine on gig companies

স্পেন সরকার বিরাট জরিমানা করল ডেলিভারি হিরো-র স্থানীয় ব্যবসায়িক সংস্থা গ্লোভো-কে। জরিমানার পরিমাণ – ৭৯ মিলিয়ন ইউরো বা ৭৮ মিলিয়ন ডলার!

স্পেনের শ্রমমন্ত্রী ওলান্ডা ডিয়াজ্ অভিযোগ করেছেন, ওই সংস্থাটি শ্রম আইনকে লঙ্ঘন করেছে। গ্লোভো ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত লিখিত চুক্তির ভিত্তিতে ডেলিভারি কর্মীদের নিয়োগ করেনি, শ্রম-আইন মোতাবেক সামাজিক সুরক্ষা ও অন্যান্য খাতে বিধিবদ্ধ তহবিলের টাকা জমা দেয়নি।

আমাদের দেশে মোদী যখন বিভিন্ন সংস্থায় লেবার ইন্সপেক্টারদের সরাসরি হাজির হয়ে নথিপত্র পরীক্ষা করার আগেকার আইন বাতিল করল “সহজে ব্যবসা করার শর্তে” তখন স্পেনের ইন্সপেক্টারের অনুসন্ধানে ধরা পড়ল নানা জাল জুয়াচুরি করে ওই সংস্থাটি গিগ শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে কিভাবে বঞ্চিত করেছে।

স্পেন হল ইউরোপের প্রথম দেশ, যেখানে গিগ শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার্থে আইন পাশ হয়। যে আইনবলে ঘোষণা করা হয় যে গিগ শ্রমিকদের লিখিত চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা, সবেতন ছুটি সহ আরো বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এই মর্মে গত বছর আগস্ট মাসে এই আইন লাগু হয়। সেই আইন লঙ্ঘিত হওয়ায় স্পেন সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করল।

Regarding India's current juncture

-- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

ভারতবর্ষের সংসদীয় গণতন্ত্র যে প্রকৃত অর্থেই সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী বিপর্যয়ের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে ব্যাপারে দেশের আরো বেশি বেশি মানুষ ও ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে সারা পৃথিবীর আগ্রহী পর্যবেক্ষকরা একমত হচ্ছেন। এটা ঠিক যে, ফ্যাসিবাদ শব্দটা সবাই ব্যবহার করছেন না। বহু লেখক ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দক্ষিণপন্থী জনমোহিনীবাদ, কর্তৃত্ববাদ, নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র, জাতবর্ণ ভিত্তিক গণতন্ত্র ইত্যাদি নানাবিধ শব্দ ব্যবহার করে চলেছেন। ধারণাগত স্পষ্টতার জন্য সিপিআই(এমএল) সামগ্রিকভাবে ফ্যাসিবাদ শব্দটার ব্যবহারই সঠিক মনে করছে। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থার সময়ে যখন স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্রের জায়গা দখল করে ফেলেছিল সেই ব্যতিক্রমী সময়টুকু বাদ দিলে ভারতবর্ষ দীর্ঘ সাত দশক ধরে সংসদীয় গণতন্ত্রের অব্যাহত যাত্রার মধ্যে দিয়ে চলেছে, কিন্তু বর্তমান সময়টা এক অঘোষিত অথচ আরোব্যাপক ও স্থায়ী জরুরি অবস্থা হিসাবে বেশি রকম অনুভূত হচ্ছে। ’৭০ দশকের জরুরি অবস্থা মূলত রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষের উপর আগ্রাসী রাষ্ট্রীয় দখলদারি এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো ছেঁটে ফেলার অভিযান ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পর্যায়ে ভারতের বৈচিত্র্য ও নানা ভাষা, নানা ধর্মের সামাজিক বিন্যাস মারাত্মক আঘাতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী আক্রমণ

তিন দশক আগের অযোধ্যা নিয়ে রক্তস্নাত রথযাত্রার দিনগুলো থেকে আমরা ধারাবাহিকভাবে এই পরিস্থিতি গড়ে উঠতে দেখছি। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে আমরা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের উত্থানের নির্দিষ্ট লক্ষণ বা পূর্বাভাস হিসাবে চিহ্নিত করেছিলাম, যা ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার ঘটনায় অত্যন্ত সঠিক চিহ্নিতকরণ বলেই প্রতিপন্ন হয়। নরেন্দ্র মোদীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য কর্পোরেটদের চিল-চিৎকার ফ্যাসিবাদের আরো একটা অভ্রান্ত লক্ষণকে সামনে নিয়ে আসে — সর্বোচ্চ নেতার ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটদের চূড়ান্ত আনুগত্য। ২০১৪ থেকে ভারতীয় ফ্যাসিবাদের অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো উদ্বেগজনক ও বেপরোয়াভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।

ফ্যাসিবাদ তার ভারতীয় বৈশিষ্ট্যে শাসনবিভাগ, আইনসভা ও বিচারবিভাগের ক্ষমতা ও বিভাজনকে ওলটপালট করে দিয়ে শাসনবিভাগের চরম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে; সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির মদতপুষ্ট অ-রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর দ্বারা নামিয়ে আনা পরিকল্পিত মুসলিম-বিরোধী দমনপীড়ন, পথে-ঘাটে যত্রতত্র জাতিবিদ্বেষী ও নারীবিদ্বেষী হিংসা ও বাড়তে থাকা গুণ্ডাগিরি; ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলির অধিকারকে ধূলিসাৎ করে ক্ষমতার চরম কেন্দ্রীকরণ এবং রাষ্ট্রীয় মদতে লাগামছাড়া কর্পোরেট লুটপাটের ফলে যাবতীয় সম্পদ মাত্র কয়েকটা ব্যবসায়িক গোষ্ঠী/পরিবারের কুক্ষিগত করে ফেলা; সংঘ বাহিনীর আইটি সেল ও শাসকের পোষ্য মূলধারার কুখ্যাত গোদি মিডিয়ার মিশেলে জনমানসে বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার সম্ভাব্য সবরকম উপায়কে কাজে লাগিয়ে পাইকারি হারে শাসকের স্বৈরাচারী কাজের ও বক্তব্যের সপক্ষে জনমত তৈরি করিয়ে নেওয়া; নিষ্ঠুর দমনের বিভিন্ন দানবীয় আইন প্রয়োগ করে ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতিমালা ও আইনের শাসন ধ্বংস করে যে কোনো ভিন্নমতকে নির্যাতন চালিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া, ভয়াবহ সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করা এবং নাগরিকদের প্রতি মুহূর্তে বেনাগরিক করার হুমকি দিয়ে আধিকার সম্পন্ন নাগরিককে ক্রমাগত রাজতন্ত্র বা ঔপনিবেশিক শাসনের কায়দায় অসহায় প্রজা বানিয়ে ফেলা — এই সবকিছুই ফ্যাসিবাদের লক্ষণ।

ভারতীয় ফ্যাসিবাদের চালিকাশক্তি হল আরএসএস

মোদী জমানা নিছক একটি কর্তৃত্ববাদী জমানা নয় বরং পুরদস্তুর ফ্যাসিবাদি জমানা — আর এই গুণগত পার্থক্যের কেন্দ্রে রয়েছে আরএসএস, আর এই নতুন জমানার গঠন ও পরিচালনার কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রয়েছে আরএসএস। আমাদের একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে বিশ্বের ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের প্রথম আস্ফালন অর্থাৎ ইতালিতে মুসোলিনির শাসন এবং তার অব্যবহিত পরেই জার্মানিতে হিটলারের পুরোদস্তুর ফ্যাসিবাদী প্রকল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ১৯২৫ সালে আরএসএসের জন্ম হয়। বাইরে থেকে আমদানি করা এই মতাদর্শকে ভারত-ইতিহাসের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান বিশেষত ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতবর্ণের শোষণব্যবস্থা, পুরুষতন্ত্র ও বিষাক্ত মুসলিম-বিদ্বেষী ঘৃণার সঙ্গে মিশিয়ে আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যে ধারণা দাঁড়িয়ে রয়েছে সাভারকরের প্রণীত হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের উপর।

মুসোলিনি ও হিটলারের ক্ষেত্রে ক্ষমতায় উত্থান আর তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পতন খুব দ্রুত গতিতে ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু ভারতে ফ্যাসিবাদের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসতে সময় লেগেছে অনেক বেশি। হিটলার জমানা থেকে শেখা উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ, সমাবেশিত করার কায়দাকানুন ও গণহত্যার নীল নকশার সঙ্গে খবরদারি ও নজরদারি চালানোর ডিজিটাল যুগের কলাকৌশল মিশে আজকের ভারতীয় ফ্যাসিবাদ সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফ্যাসিবাদী জমানা। হিন্দু-আধিপত্যকামী উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মার্কিন তাঁবেদারি করা বিদেশ নীতির মিশ্রণের মাধ্যমে এই জমানা একই সঙ্গে আভ্যন্তরীণ সমর্থন ও পশ্চিমী দুনিয়ার অনুমোদন হাসিল করে নিতে চায়। বিরাট বাজারের প্রতি বৈশ্বিক পুঁজির আকর্ষণ, বৈশ্বিক পুঁজির সঙ্গে ভারতের কর্পোরেট পুঁজির ক্রমবর্ধমান গাঁটছড়া এবং আমেরিকা ও ইজরায়েলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে ভারতের রাজনৈতিক ভূমিকার সুবাদে মোদী সরকার তার বিদেশ নীতিকে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে।

অবশ্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী লবির সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব ও আপেক্ষিক স্বায়ত্ত্বতা বজায় রাখার রাস্তা খোলা রাখতে ভারত ব্রিকস ও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনেরও সদস্য হয়ে রয়েছে যেগুলোর মধ্যে রাশিয়া এবং চীনও আছে, কিন্তু ট্রাম্প, নেতানিয়াহু ও বরিস জনসনের মতো রাষ্ট্রনেতা যারা তিনজনই ঘটনাচক্রে এখন মসনদ থেকে উৎখাত হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে মোদীর ব্যক্তিগত দহরম-মহরম মোদী সরকারের বিদেশনীতির মূল দিশা ও জোরটা ঠিকই দেখিয়ে দেয়। ২০০২’র গুজরাট গণহত্যার পরে একটা দীর্ঘ সময় ধরে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডসহ পাশ্চাত্যের বহু দেশ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মোদীকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদের বাড়তে থাকা উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী আজ মার্কিন আধিপত্যে থাকা পশ্চিমী দুনিয়ার আশীর্বাদধন্য ট্রাম্পের শাসনকাল শেষ হয়ে গেলেও আমেরিকার মোদী জমানার সখ্যতা আজও অব্যাহত।

আরএসএস ও তার নানাবিধ নেটওয়ার্কের আগ্রাসী ভূমিকায় ক্রমশ তার হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের সুদূরপ্রসারী অভিসন্ধি ফুটে উঠছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংসসাধন, ঢাকঢোল পিটিয়ে রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট ও বেলাগাম অরাষ্ট্রীয় গণহত্যাকারী বাহিনীর ব্যবহার, অনুগত কর্পোরেটদের সমর্থন এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নীতিগত সহযোগিতা — এই চারটি বিষয় হল মোদী জমানার ফ্যাসিবাদী অনুশীলনের দুরন্ত অগ্রগতির চাবিকাঠি। বিজেপি ২০১৪-তে ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারতের’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আর ধাপে ধাপে এগিয়ে আজ তারা ভারতকে এক বিরোধীমুক্ত শাসনতন্ত্রে পরিণত করার পথে। একদিকে যখন বিজেপি সভাপতি বলছে যে, দেশে একটাই মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে আর তা হল বিজেপি, ঠিক তখনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বড়াই করে বলছে যে, আগামী পঞ্চাশ বছর ধরে বিজেপিই দেশ শাসন করবে।

ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে কমিউনিস্টদের ভূমিকা

ভারত নিশ্চিতভাবেই ফ্যাসিবাদের এই বিপদের বিরুদ্ধে জেগে উঠছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের জনগণের বিভিন্ন অংশের উল্লেখযোগ্য লড়াই আন্দোলন চোখে পড়েছে। রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার প্রতিবাদে হওয়া ছাত্র আন্দোলন, গুজরাটের ঊনায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে দলিত জনতার পুনর্জাগরণ থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইনের বৈষম্যমূলক ও বিভেদকামী সংশোধনীর প্রতিবাদে মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা উত্তাল শাহীনবাগ আন্দোলন এবং বছরভর চলা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন — মোদী সরকারকে কৃষিব্যবস্থায় কর্পোরেট দখলদারির লক্ষ্যে বানানো তিনটে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে; ঘৃণা, ত্রাস ও তীব্র দমনপীড়নকে অগ্রাহ্য করে এমন একগুচ্ছ শক্তিশালী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লড়াই আমরা গড়ে উঠতে দেখেছি। জনগণের প্রতিবাদ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর চলতে থাকা সর্বাত্মক আক্রমণের ফ্যাসিবাদী স্টীম রোলারই বিরোধী ঐক্য গঠনের গতিশীল প্রক্রিয়াকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেছে। কিন্তু বিরোধীদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশই আরএসএস ও তার বিদ্বেষমূলক প্রচার ও হিংসার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত, বরং তারা কেবল মোদী সরকারের বিরোধিতাতেই আটকে রয়েছে। সরকারের বিরোধিতার প্রশ্নেও রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন, নাগরিকদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরোধ এবং বেসরকারীকরণের নীতি বাতিল করে জনকল্যাণের দিকে আর্থিক নীতির মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া — এই প্রশ্নটিকে একটা বড় সংখ্যক বিরোধীরা এখনও তাদের ধর্তব্যের মধ্যে রাখছে না।

এই জায়গাতেই সবচেয়ে দৃঢ়পণ, সর্বাত্মক ও সুদূরপ্রসারী প্রতিরোধ এবং ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার জন্য দীর্ঘস্থায়ী লড়াইকে শক্তি যোগানোর কাজটায় বিপ্লবী কমিউনিস্টদের ভূমিকা জোরালো করতে হবে। মাঠে ময়দানের লড়াই তৈরি করা, চলমান লড়াইকে সহযোগিতা করা ও টিকিয়ে রাখার কাজ এবং ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোকে গদিচ্যুত করার লক্ষ্যে সংসদীয় বিরোধীদের ঐক্য ও গতিশীলতা গড়ে তুলতে সমস্ত শক্তি জড়ো করার কাজটাই করতে হবে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের। ফ্যাসিবাদিরা ইতিমধ্যেই যতটা শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে, ভারতের গণতন্ত্র এবং অগ্রগতিকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে, তাতে বোঝা যায় ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের দায়িত্ব কতটা দীর্ঘস্থায়ী। আম্বেদকরের ভাষায়, যদি আমরা হিন্দুরাষ্ট্রকে ভারতের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসাবে দেখি তাহলে আমাদের প্রত্যুত্তর কেবল তাৎক্ষণিক দুর্যোগ মোকাবিলার মানসিকতা নিয়ে উদ্ধার ও ত্রাণকাজে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, বরং দেশকে পুনর্গঠন করার চ্যালেঞ্জটাও নিতে হবে।

গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আম্বেদকর ভারতের সংবিধানের যাত্রাপথের দ্বন্দ্বগুলোকে চিহ্নিত করেছেন — ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের প্রেক্ষিতে শুধুমাত্র ভোটের সমানাধিকারের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পরত ও তার নীচে চাপা থাকা অগণতান্ত্রিক জমির মধ্যেকার বিরোধাভাস। ফ্যাসিবাদের জবাব নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করা ও তৃণমূলস্তর অবধি পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেই, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের মোড়কের সঙ্গে অগণতান্ত্রিক ভিত্তিভূমির অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসনে গণতন্ত্রকে সমাজের আরও সুসঙ্গত ও গভীর করে তোলার মধ্যেই। ঐতিহাসিকভাবে এটাই ছিল সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন ও অঙ্গীকার। আর একশো বছর আগে সমাজতন্ত্রের এই স্বপ্নকে রুখে দেওয়া ও চুরমার করার উদ্দেশ্যেই ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল। ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসাবে গড়ে তোলার সাংবিধানিক ঘোষণাকে বাস্তবায়নের মধ্যেই আজকের ভারতের বেড়ে চলা ফ্যাসিবাদের আসল উত্তর রয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট : গভীরতর সংকট, কর্তৃত্ববাদ ও যুদ্ধ

ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে যে, ভারতের এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণ ঘনীভূত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের সহায়ক পরিবেশে। বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের গভীর ও সুদূরপ্রসারী সংকটের বর্তমান পর্যায় হল দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের এই সহায়ক পরিবেশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোভিড-১৯ অতিমারীর ব্যাপক আঘাত। একদিকে যখন সৌদি আরব ও ইজরায়েলের দ্বারা ইয়েমেন ও প্যালেস্টাইনের উপর আক্রমণ অব্যাহত, যখন চীনকে নিশানা বানিয়ে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলার নিত্যনতুন পথ খুঁজে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তখনই ২০২২-র ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। যুদ্ধ পরিস্থিতি উস্কে দিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার এই আগ্রাসনকে সিপিআই(এমএল) স্পষ্টভাবেই বিরোধিতা করেছে এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে শান্তি ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে। আমরা রাশিয়ান জাত্যাভিমান এবং তার ইউরেশীয় সম্প্রসারণবাদেরও নিন্দা করেছি, যে সম্প্রসারণবাদী ভাষ্য এটা বলে যে, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ইউক্রেন হল রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ইউক্রেনের সার্বভৌম অস্তিত্বের অধিকার স্বীকার করাটা আসলে লেনিনের ‘ভুল’ ছিল এবং সেই ভুল এখন সংশোধন করা দরকার।

ন্যাটোর পূর্বাভিমুখী সম্প্রসারণকে যুদ্ধের যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে যুদ্ধের অপরিহার্যতা প্রমাণ করার রুশ তর্ক আমরা মানি না, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, এই যুদ্ধে যখন ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই রক্তাক্ত হচ্ছে এবং বিশ্বের একটা বড় অংশের মানুষকে এর জন্য খুব চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এই যুদ্ধে সরাসরি না জড়িয়েও সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে। ঠান্ডা যুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে ও সোভিয়েত পরবর্তী পৃথিবীতে ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে আমেরিকা ন্যাটোকে বারংবার হাতিয়ার বানিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং ওয়ারশ চুক্তির অবলুপ্তির পরে ন্যাটোকে টিকিয়ে রাখারই কোনও যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু ন্যাটোকে ভেঙে দেওয়ার পরিবর্তে আমেরিকা ন্যাটোর সদস্য দেশের সংখ্যা প্রতিষ্ঠাকালের ১২ থেকে আজ ৩০-এ নিয়ে গিয়েছে। এই সম্প্রসারণ যে কেবলমাত্র রাশিয়ার কথা বা চীনের সঙ্গে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান মিত্রতার কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে তা নয়, এটা হয়েছে সমান্তরাল শক্তি হিসাবে ইওরোপের উঠে আসার রাস্তা বন্ধ করার উদ্দেশ্যেও। এমনকি আজ ইউক্রেনকে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাহায্য করার কথা বলেও আমেরিকা ও কর্পোরেট পুঁজি ইউক্রেনে অর্থনৈতিক উপনিবেশ গড়ে তুলতে ব্যস্ত, যার ফলে দেশটার বড় পরিমাণ ভূখণ্ড, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা ও শিল্প কর্পোরেটদের হাতে চলে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রম আইন লঙ্ঘন ও ধ্বংসের খেলা চলছে। রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি বিরাট পরিমাণে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির পক্ষে প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন, নিউইয়র্কের শেয়ার কেনাবেচার বাজারে তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘অ্যাডভান্টেজ ইউক্রেন’।

ইসলামবিদ্বেষী ‘স্বাধীনতা রক্ষার অভিযান’ বা তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের পরে আমেরিকা এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঠান্ডা যুদ্ধের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চাইছে। একদল মার্কিনপন্থী তাত্ত্বিক ও প্রচারক ইতিমধ্যেই রাশিয়া-চীন সখ্যতাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জার্মানি-ইতালি-জাপান আঁতাতের মতো মূল বিপদ বলে চিহ্নিত করতে শুরু করেছে এবং এই নবগঠিত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক জোট গঠনের পক্ষে ওকালতি করছেন। সংকট জর্জরিত ক্ষয়িষ্ণু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী অপরাধগুলো ধামাচাপা দিয়ে একমেরু বিশ্বে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্যকে বজায় রাখতে নিজেকে বিশ্বের গণতন্ত্রের স্বঘোষিত চ্যাম্পিয়ন হিসাবে তুলে ধরতে চায়। কিন্তু আমেরিকা কি বিশ্বজনীন গণতন্ত্র রপ্তানির রক্তাক্ত ও কলঙ্কজনক অধ্যায়টা ভুলে গিয়েছে !

international context

আমেরিকান একমেরু বিশ্বের পরিবর্তে চাই বহুমেরু বিশ্ব প্রয়োজন

বিশ্বের ক্ষমতাধর শক্তিগুলোর অভ্যন্তরীণ চরিত্র যেমনই হোক না কেন, নয়া উদার অর্থনীতি বাতিল করা এবং সামাজিক রূপান্তর ও রাজনৈতিক উত্তরণের পথ অনুসন্ধানে বিশ্বব্যাপী লড়াই সংগঠিত করার জন্য প্রগতিশীল শক্তিগুলোর পক্ষে বহুমেরু বিশ্ব সবসময় অনুকূল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল বিংশ শতকের গোড়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্মই দেয়নি, এটা নভেম্বর বিপ্লবকেও ত্বরান্বিত করেছিল যা সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিকে সাম্রাজ্যবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। নানারকম অভ্যন্তরীণ বিচ্যুতি ও অবক্ষয় সত্ত্বেও, সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই পরিসমাপ্তি চলমান উপনিবেশ বিরোধী ও বিপ্লবী লড়াইগুলোর পক্ষে জয়ের আবহ রচনা করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। পরবর্তী দশকগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন অভ্যন্তরীণ সমস্যায় গতিরুদ্ধতায় ভুগলেও এবং পরাক্রমশালী শক্তি হয়ে ওঠার দ্বন্দ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক অসম্ভব অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফাঁদে আটকে পড়লেও আমেরিকান কর্তৃত্বের প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসাবে এর অস্তিত্ব তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশ ও শক্তিকে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে এবং সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণে উত্তীর্ণ হতে সহযোগিতা করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমাদের পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও এর এক উল্লেখযোগ্য নজির।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ওয়ারশ চুক্তির পতনের পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র মহাশক্তি হিসেবে বিরাজ করছিল এবং বেশ কিছু সময় ধরে মনে হচ্ছিল দুনিয়াটা যেন একমেরু বিশ্বে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণপন্থী তাত্ত্বিকদের বিজয় উল্লাসে ফুকুয়ামা তাঁর ‘দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ (ইতিহাসের শেষ ও শেষ মানব) গ্রন্থে উদার গণতন্ত্রের সর্বজনীন রাজত্বকে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত রূপ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অন্যদিকে স্যামুয়েল হান্টিংটন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নতুন ‘শত্রু’র প্রয়োজনীয়তাকে মান্যতা দিয়ে এই নতুন যুগকে মতাদর্শগত সংঘর্ষের স্নায়ু-যুদ্ধের বাস্তবতার পরিবর্তে ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। হান্টিংটন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমকে কেন্দ্রে রেখে তাঁর বিভাজন রেখাগুলি আঁকছিলেন, ঠিক তখন রুশ রাজনৈতিক দার্শনিক ও বিশ্লেষক আলেকজান্ডার ডুগিন রাশিয়া ও ইউরেশিয়াকে পশ্চিমা আধিপত্যের চূড়ান্ত উত্তর হিসাবে কল্পনা করে ভবিষ্যৎ বিশ্বের কথা ভাবছিলেন।

আজ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরে, ফুকুয়ামা একে ‘ইতিহাসের শেষের শেষ’ বলে অভিহিত করছেন, আর, টিমোথি স্নাইডার এবং অ্যান অ্যাপেলবামের মতো আমেরিকান ইতিহাসবিদরা বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে মার্কিন নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে সামরিকসহ যে কোনও প্রয়োজনীয় উপায়ে স্বৈরাচারী শাসনকে পরাস্ত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি এই কাজটাই করে থাকে বলে বরাবর দাবি করে আসছে না? বিশেষ করে যুদ্ধোত্তর বিশ্বে? সরাসরি আক্রমণ ও দখলদারির যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে দেশে দেশে নির্বাচিত ও ক্ষমতাসীন সরকারকে ফেলে দিয়ে পুতুল শাসককে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক, দমনমূলক, প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের পথ প্রশস্ত করার মার্কিন ইতিহাস আমরা ভুলে যাইনি। ইন্দোনেশিয়া এবং চিলি থেকে শুরু করে ইরাক, লিবিয়া এবং আফগানিস্তানের মতো সাম্প্রতিক ঘটনা পর্যন্ত, ‘গণতন্ত্র রক্ষা বা গণতন্ত্র রপ্তানির’ নামে বিশ্বজুড়ে মার্কিন হস্তক্ষেপের নৃশংস সহিংসতা আর ধারাবাহিক ধ্বংসলীলার আমরা সাক্ষী।

তাই সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসকে একটি একরৈখিক বৈশ্বিক আখ্যান বা সোজাসাপ্টা গণতন্ত্র-বনাম-স্বৈরাচার বাইনারিতে পর্যবসিত করে দেওয়া চলে না। আমরা চাই ইউক্রেন সফলভাবে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করুক, রাশিয়ার জনগণ পুতিন শাসনের অলিগার্কি ও নৃশংস দমনপীড়ন কাটিয়ে উঠুক এবং চীনের জনগণ, তাদের বিপর্যস্ত সংখ্যালঘুরা সহ সকলে, অনেক বেশি আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা অর্জন করুক। কিন্তু আমাদের এ’কথাও স্বীকার করতে হবে যে, রাশিয়া ও চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মার্কিন কৌশলের পেছনে মোটেই এরকম কোনও সদিচ্ছা কাজ করছে না, বরং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য রক্ষা করা এবং বিশ্বকে বহুমেরু হওয়া থেকে বিরত রাখাই ওদের উদ্দেশ্য। ইউক্রেনেই আজ বিশ্বের একমাত্র যুদ্ধ চলছে এমনটাও নয়, যদিও বিশ্বব্যাপী মিডিয়া অন্যান্য সংঘাত ও যুদ্ধগুলিকে ঢেকে দিয়েছে বা দৃশ্যপট থেকে মুছে দিয়েছে। সমস্ত যুদ্ধেরই নিজস্ব কারণ ও প্রেক্ষাপট রয়েছে, একটি যুদ্ধের সমাধান হলেই তা অন্য যুদ্ধকে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করবে এমন নয়। আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের প্রতিটি অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র খর্ব করা ও দমনের প্রতিটি ঘটনার বিরুদ্ধে শান্তি, ন্যায় ও গণতন্ত্রের শক্তিকে সর্বত্র সোচ্চার হতে হবে।

জাতীয় অগ্রাধিকার এবং আন্তর্জাতিকতাবাদী অঙ্গীকারের সমন্বয়

এইখানে আমরা, কমিউনিস্ট বা আরও সাধারণ অর্থেভারতের সমস্ত ধারার গণতান্ত্রিক শক্তি ভারতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রাথমিকতার বাধ্যতামূলক প্রশ্নে এসে পড়ি। কমিউনিজম একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী মতাদর্শ ও আন্তর্জাতিক আন্দোলন হওয়ায় কমিউনিস্ট হিসেবে আমাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক ভূমিকাকে ক্রমাগত সমন্বিত করে চলতে হবে যেখানে আমরা আমাদের জাতীয় ভূমিকার সাথে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরি। সমন্বয়ের এই কাজের কথা আমরা যত সহজে বলি, বাস্তবে তা করে তোলা অতটা সহজ হয় না, এবং বিগত একশ বছর ধরে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস এরকম বেশ কয়েকটি উদাহরণের সাক্ষী হয়ে রয়েছে যেখানে এই প্রশ্নেই ভুল বা বিপর্যয় হয়েছে।

এই চ্যালেঞ্জকে সঠিকভাবে বুঝতে চাইলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল ভিত্তিগুলিতে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। কমিউনিস্ট ইশতেহারটি অবশ্যই এক সর্বাত্মক আহ্বানের সাথে শেষ হয়েছিল যেখানে দুনিয়ার শ্রমিকদের বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে পরাজিত করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে সবকিছুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে নিজেকে সর্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে জীবনের প্রতিটি দিককে পণ্যে পরিণত করাকে ইশতেহারে পুঁজির অন্তর্নিহিত প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। শ্রমিক শ্রেণীকেও তাই বিশ্বব্যাপী চিন্তার আধারে কাজ করা উচিত। একই সঙ্গে, ইশতেহারে এই বিষয়েও অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল যে, প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্রে পুঁজিকে সিংহাসনচ্যুত করে জাতির স্বার্থ ও পরিচয় নির্ধারণের ক্ষমতা পুঁজির হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া এবং নিজেকেই জাতি হিসেবে ঘোষণা করা সেই জাতি-রাষ্ট্রের সর্বহারা শ্রেণীর কর্তব্য। অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, জাতির অভ্যন্তরে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণীকে তার স্বাধীন আত্মপ্রকাশ ঘটাতে হবে। কমিউনিস্ট ইশতেহারের এই মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নভেম্বর বিপ্লবের বিজয়ের মাধ্যমে জাতীয় সীমানার মধ্যে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা প্রথমবার বাস্তবায়িত হয়েছিল।

শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি সমাজতান্ত্রিক/কমিউনিস্ট আন্দোলনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মাত্রা এবং কাজগুলিকে একত্রিত করার এই চ্যালেঞ্জ টানাপোড়েনের মুখোমুখি হয়েছিল। প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতির বার্তা ও চেতনা ছড়িয়ে দেয় এবং নৈরাজ্যবাদী ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে প্রধান প্রধান মতাদর্শগত পার্থক্যরেখাগুলিকে চিহ্নিত করে প্রতিযোগী জাতীয়তাবাদ এবং প্রথম আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের চাপে ‘সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক’ নামক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকটি ভেঙে পড়ে। ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ নামক তৃতীয় আন্তর্জাতিকটি বিজয়ী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছে এবং উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম থেকে শুরু করে উদার গণতন্ত্রে সংসদীয় সংগ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই নতুন কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ছড়িয়ে পড়তে ও আকার নিতে সাহায্য করেছে, আর ফ্যাসিবাদরূপে আসা চরম প্রতিক্রিয়াকে মোকাবিলা করতে সহযোগিতা করেছে।

চীন এবং ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপরীত অভিজ্ঞতা কিন্তু জাতীয় পরিস্থিতির মূল্যে আন্তর্জাতিককে অগ্রাধিকার দেওয়ার সমস্যাকেও দেখিয়ে দেয়। চীনের কমিউনিস্ট আন্দোলন আন্তর্জাতিক কেন্দ্রীয় নির্দেশনামা অগ্রাহ্য করে নিজস্ব গতিপথ তৈরি করতে সফল হয়েছিল। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে জাতীয় আন্দোলনের দাবি ও জাতীয় বাস্তবতার জটিলতার সাথে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের দিকনির্দেশনার সমন্বয় সাধনে আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম। সমস্যাটি সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির দ্বারা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার পর এই বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে কমিউনিস্ট মূল্যায়ন ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ থেকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়। ভারতের নিজস্ব উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের অগ্রগতিকে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হওয়ার কৌশলগত ত্রুটির ফলে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলন সাময়িক ধাক্কা খায়। আমাদের নিজেদের সিপিআই(এমএল) আন্দোলনেও, প্রধানত কৃষি-প্রধান ও পশ্চাৎপদ সমাজে বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে, চীনা বিপ্লবের বিজয় থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার চেষ্টা করার সময় আমরা ভুল করে এমন স্লোগান এনে ফেলেছিলাম যা আমাদের পার্টি ও আন্দোলনকে চীনের বশংবদ অনুকরণ হিসাবে প্রতিভাত করেছিল এবং ভারতীয় বাস্তবতায় আমাদের স্বাধীন ভূমিকাকে খাটো করে দিয়েছিল।

আজ ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে পরাস্ত করার জন্য সর্বোত্তম অবদান রাখার ঐতিহাসিক দায়িত্বের মুখোমুখি। বিশ্বজুড়ে গভীর এবং দীর্ঘায়িত অর্থনৈতিক মন্দা, কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়ের মুখে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও সমস্ত প্রগতিশীল শক্তির কাছ থেকে একটি সমন্বিত শক্তিশালী প্রত্যুত্তর দাবি করে। বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীল শক্তিকে সকল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, স্বৈরাচারী শক্তিকে তাদের নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে প্রতিহত করতে হবে এবং একবিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াইকে তীব্রতর করতে হবে।

Panchayat Elections

পঞ্চায়েত নিয়ে বাংলার মানুষের বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্বশাসিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এখন আর নেই। কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে তা উপর থেকে পরিচালিত হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক চর্চা চলে কিন্তু জনগণ তার কিছুই পায় না। পঞ্চায়েতগুলি এখন শাসকদলের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। স্বজন-পোষন এবং শাসকের মর্জিতে তা পরিচালিত হয়। গ্রাম সংসদ অর্থাৎ জনগণের মতামত সংগ্রহ করার প্রথা উঠে গেছে। এলাকায় উন্নয়ন বা পরিকল্পনা কী রকম হতে পারে সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণই করতে পারে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচিত সদস্যরাও তা জানতে পারেন না। বেশকিছু জেলায় পঞ্চায়েতে ১০০ দিনের কাজের মজুরি আজও বকেয়া, আবাস, বিভিন্ন ধরনের ভাতা নিয়ে দুর্নীতি বেশ চর্চিত হয়ে আছে। রাজনীতিগতভাবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি সামনে এসেছে। এই রকম অবস্থায় সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। কাজেই আমাদের সেই কাজে অবিলম্বে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ইতিমধ্যেই নির্বাচনের জন্য, আসনের জন্য ভাগবিন্যাসের কাজ শেষ হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন তার প্রস্তুতি কাজ চালাচ্ছে। কাজেই আমাদের স্বাধীনভাবে লড়াইয়ের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। কাদের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা জোট হবে না ভেবে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি সর্বপরি পঞ্চায়েত দখল এবং আসনগুলিতে সদস্যদের জয় নিশ্চিত করতে, এখন থেকে আসনগুলি বাছাই করতে হবে। সেই অনুযায়ী গণসম্পর্ক অভিযান এবং আন্দোলন বিকাশের সাথে সাথে প্রার্থী নির্ণয় করা জরুরি। পঞ্চায়েত যেগুলি সহজে করতে পারে বা করা উচিত তা আনতে হবে প্রচারের আলোতে। তৃণমূল কংগ্রেস শাসনে দুয়ারে সরকার, দুয়ারে রেশন প্রভৃতি বিভিন্ন আওয়াজ সব সময় শোনা যায়। কিন্তু নিজের গ্রামে নিজেদের পঞ্চায়েত বাইরের হয়ে গেছে কেন? কিছু মাতব্বর সবকিছু কুক্ষিগত করে নিয়েছে। আমার আপনার অধিকার কেড়ে নিয়েছে মা-মাটি-মানুষের কথা বলে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দেয়, কোনও সরকার বা কোনও মন্ত্রী নিজের পকেট থেকে কিছুই দেয় না। তাই এখন থেকে জোরের সাথে নিজের অধিকার বুঝে নিতে হবে।

(১) ১০০ দিনের কাজকে কৃষকদের ফসল উৎপাদন কাজে লাগানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে মধ্য ও দরিদ্র কৃষকদের সহযোগিতা করতে পারে।

(২) গ্রামে গ্রামে সরকারী দামে ফসল ক্রয়ের ক্যাম্প গঠনের দায়িত্ব নিতে পারে। যাতে সঠিক মূল্যে ফসল বিক্রি করতে পারে। কৃষকদের অভাবি অবস্থায় কম পয়সায় ফড়েদের কাছে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই অবস্থা থেকে কৃষকদের পঞ্চায়েতের উদ্যোগে সমবায়ের মাধ্যমে ফসল বিক্রির ব্যবস্থা করে কৃষকদের সাহায্য করতে পারে।

(৩) কৃষকদের স্বার্থে গঠিত সমবায় সমিতিগুলি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে, আর, তা বিশেষভাবে ব্লক ও জেলা পরিষদকে নজর দিতে হবে। সার, বীজ, কীটনাশক এবং কৃষি কাজের জন্য কম সুদে সমবায় ঋণ সরবরাহ করতে হবে। সমবায়গুলিতে ধনী ও গ্রামীণ ব্যবসায়ীদের আধিপত্য কমিয়ে মধ্য ও গরিব কৃষকদের জায়গা করে দিতে হবে। বাংলার সমস্ত সমবায়গুলিতে নতুন করে নির্বাচন করতে হবে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমবায় চাই।

(৪) পঞ্চায়েতগুলিতে নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদের ক্ষমতা কমিয়ে আমলাদের ক্ষমতাবৃদ্ধি করানো হচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা অধিষ্ঠিত করা হচ্ছে। গ্রাম সংসদ ব্যবস্থা, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে পঞ্চায়েত পরিচালনা তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কাজেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাতে শাসকদের দাপাদাপি বেড়ে চলছে। গ্রামীণ কৃষক, কৃষি মজুর ও সাধারণ জনগনের নিজস্ব ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে কৃষক সহ সমস্ত জনগণের অংশীদারি বাড়াতে কৃষিমজুর ও কৃষক সংগঠনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

(৫) খোলামুখ কয়লাখনির, বা গ্রামের জনগণের জমি অধিগ্রহণ করে বিদেশি কোম্পানির ও কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে। এই ধরনের কাজে পঞ্চায়েতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জমি অধিগ্রহণের নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চায়েতের মতামত নিতে হবে। আমলা ও শাসক পার্টির মতামতকে জনগণের মতামত বলা যাবে না। রাজ্য সরকারকে জনগণের মতামত নিশ্চিত করতে হবে।

(৬) আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই সমস্ত দাবি পূরণ করার জন্য আমাদের কৃষিমজুর ও গ্রামীণ মজুর, কৃষক এবং গ্রামীণ জেলা পার্টি সংগঠনকে ভূমিকা নিতে হবে।

বাংলার রাজনীতি ঘটনাবহুল হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ধরনের ইস্যুতে সরকার বিরোধী ক্ষোভ বাড়ছে। ছাত্র যুব আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে। সরকারি চাকরির দাবিদাওয়া নিয়ে কর্মপ্রত্যাশীরা প্রায় ৬০০ দিন রাস্তায় অবস্থানে বসে রয়েছেন। বধির সরকার কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি। হাইকোর্ট সিবিআই এবং কেন্দ্রীয় সরকার ইডিকে দায়িত্ব দিয়ে দায়মুক্ত হয়েছে। মেধাবী চাকরি প্রার্থীদের আমলা ও মন্ত্রীদের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নজিরবিহীন দুর্নীতির ছবি সামনে এসেছে। শুধু এই চাকরি নয়, ১০০ দিনের কাজে, পঞ্চায়েতে বিভিন্ন ধরনের সরকারি কাজে একই অবস্থা চলছে।

এই ধরনের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বাংলার গ্রামাঞ্চলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাজনৈতিক আন্দোলন জরুরি হয়ে পরেছে। নিজের ভোট নিজে দিন এবং পঞ্চায়েতে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য ব্লকে ব্লকে রাজনৈতিক প্রচার শুরু করা দরকার।

তৃণমুল কংগ্রেস ২০১৮ সালের মতো রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইবে। আমাদের তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জনমত গড়ে তুলতে এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। ইতিমধ্যে বিজেপি ২০২৪’র লোকসভাকে মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। গ্রামে গ্রামে বিজেপি যাতে হিংসাত্বক ও বিভেদমূলক কার্যকলাপ করতে না পারে সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে। আমাদের কিছু বন্ধু তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজেপির সাথে অলিখিতভাবে আসন সমঝোতা করে বসে। যা সম্প্রতি শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা দেখলাম। লোকাল রাজনীতি করতে গিয়ে নীতি ও কৌশল নিয়ে নজর রাখতে হবে। এই ধরনের সুবিধাবাদী রাজনীতি আত্মহত্যার সামিল। তাই, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজেদের স্বাধীন অবস্থানকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বাম গণতান্ত্রিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়া এখন থেকেই শুরু করা দরকার।

- কার্তিক পাল

Extension of Protection

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ দিনটি ভারতের নারীদের কাছে অবশ্যই একটি খুশির দিন। আদালত আর হাসপাতালের মধ্যে ছুটোছুটি করার থেকে মুক্তি পেয়েছে তারা। ২৫ বছরের অবিবাহিতা গর্ভবতী মেয়েটির লড়াইকে মান্যতা দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। তিন বিচারপতির বেঞ্চ, এর অন্যতম ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় তাদের যুগান্তকারী রায় প্রসঙ্গে বলেন, “গর্ভপাত আইন সবার জন্য। সে মহিলা বিবাহিত হোক কী অবিবাহিতই হোক।” এ আইন একক নারীদের জন্যও, বলে ঘোষিত হল। ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কেও গর্ভপাত আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হল। আর এভাবেই প্রজন্ম বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৃহত্তর অধিকারের পথে আরও একটি মাইলফলক নির্মিত হল মনুবাদী পথে অগ্রসরমান ভারতবর্ষের মাটিতে। এটা হঠাৎ কোনো বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরে ভারতে যে প্রগতিশীল চিন্তার ও আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রবাহ চলেছে এ তারও এক অর্জন। এই দিনটিকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথা হু ‘আন্তর্জাতিক নিরাপদ গর্ভপাত দিবস’ রূপে উদযাপন করছে। আর তা করতে গিয়ে হু বলছে, “গর্ভপাত একটি স্বাস্থ্যসেবা আর স্বাস্থ্য হল একটি মানবিক অধিকার”। এই মানবিক অধিকার পেলো সমগ্র ভারতীয় নারীসমাজের কিছু খণ্ডিত অংশ। বাকি পথ কিন্তু এখনও অনেক দূর।

গর্ভপাতের আইনি স্বীকৃতিতে ভারত কিন্তু যথেষ্ট পিছিয়েই ছিল। তিউনিসিয়া একটি মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৫৬ সালে ফরাসিদের হাত থেকে স্বাধীন হবার পরই নতুন শাসক নারী ও পুরুষের সমানাধিকার ঘোষণা করে। সেই সাল থেকেই গর্ভপাতের অধিকার অর্জন করে সে দেশের নারীরা। আর ভারতে তা বৈধতা পায় ১৯৭১ সালে, স্বাধীনতার ২৪ বছর পর। তাও কিছু শর্ত সাপেক্ষে। তারপর এই সংযোজন করতে সময় লেগে গেলো আরও ৫০টা বছর। ভারতের গর্ভপাত আইনটির নাম ‘মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি’। এখানে ৫টি বিষয় সুনির্দিষ্ট করা আছে।

(১) কার গর্ভপাত করা হবে।
(২) গর্ভপাতের কারণ।
(৩) গর্ভস্থ ভ্রূণের বয়স।
(৪) কে বা কারা এই অস্ত্রপচার করতে পারবেন।
(৫) কোথায় অস্ত্রপচার হবে।

এর সাথে বিশেষ কিছু ব্যতিক্রমের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এখনও আইনটি পূর্ণতা পায়নি বলে অনেকেই মনে করছেন।

বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সঠিকভাবেই বলেছেন, “আইন কোনো অনড় বিষয় নয়। সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনের সাথে তা পরিবর্তিত হয়।” বর্তমানে ভারতীয় সমাজব্যবস্থা কিছুটা হলেও তার সংরক্ষণশীলতাকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। যৌন জীবনযাপনের ছাড়পত্র যোগাড় করতে বিবাহের বাধ্যবাধকতাকেও অনেকে অস্বীকার করছে। নিজের শরীরের উপর সবার আগে অধিকার শুধু নারীর — এটাও ক্রমশ স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। এখন গর্ভধারণের নিয়ন্তা হবে কেবল মাত্র নারী, পুরুষ নয়। সেই অর্থে স্বামীও নয়। পরিবারের অন্য কেউ তো নয়ই। বর্তমানে বহু মহিলারাই একক জীবন বেছে নিচ্ছে। তবে তাদের অনেকেরই পুরুষ বন্ধু থাকতে পারে। অনেকে লিভ-ইন করেন। আর এসব ছাড়াও যৌন জীবনে অনেক ছেলেমেয়েই বিয়ের আগেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। এসবের সংখ্যা তত বেশি নয়। যত বেশি ভাবনাচিন্তা না করে আবেগের বসে বা কখনও নেশার ঘোরে অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে যাওয়া। স্বামী-স্ত্রীর বিছানাতেও স্ত্রীর নিজস্ব পরিসরের স্বীকৃতি মিলেছে। যার উল্লঙ্ঘনের অর্থ ‘ধর্ষণ’। আর ভারতীয় সমাজে ধর্ষণ মহামারীর কোনো কার্যকরী প্রতিষেধক আজও তৈরি করা যায়নি। এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ঘটে যেতে পারে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ।

গর্ভপাতের প্রধান কারণ এই অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ। জাতিপুঞ্জ বলছে এই অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের শিকার মূলত ১৯ বছরের কম অবিবাহিত কিশোরীরা। এরা আবার বেশিরভাগই দরিদ্র, সংখ্যালঘু ও বিপন্ন জনগোষ্ঠী পরিবারের। অনেক সময় পড়াশুনো বা কাজের জন্য বা দারিদ্র্যের কারণে কোনো আত্মীয়র বাড়িতে, হোস্টেলে বা বাবুদের বাড়িতে থাকে। যেখানে সুরক্ষা হতে পারে নিম্নমানের। পরিবারে অশান্তির কারণেও সন্তানরা বাবামায়ের দেখভাল থেকে উপেক্ষিত হয়ে অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ভারতে একক নারীর সংখ্যাও কম নয়। ২১ শতাংশ বা ৭০ মিলিয়ন। এরমধ্যে রয়েছে অবিবাহিত, বিবাহ-বিচ্ছিন্না, পৃথক থাকা ও বিধবা মহিলারা। স্বেচ্ছায় অবিবাহিত নারী সমাজের ১ শতাংশ। এদের বেশিরভাগকেই যৌন সন্ত্রাসের নানান রূপের সাথে মোকাবিলা করতে হয়। কখনো হেরেও যায়। ফলশ্রুতিতে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ।

২০১৫-তে ভারতে ১.৫৬ কোটি মহিলার গর্ভপাত করা হয়েছে। এর ৭৮ শতাংশ অর্থাৎ ১.২৩ কোটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আওতায়ই আসেনি, জানাচ্ছে ল্যানসেট পত্রিকা। এর সমর্থন পাওয়া যায় জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সার্ভে থেকে। এখানে বলা হচ্ছে গর্ভপাত হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২১ শতাংশ, বাড়িতে ২৬.২ শতাংশ আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (বৈধ স্থান কিনা স্পষ্ট নয়) ৫২.৮ শতাংশ। এই সার্ভে থেকে জানা যাচ্ছে যে গর্ভপাতের ৫৩ শতাংশ স্বীকৃত ডাক্তার দ্বারা করা হয়। বাকি সব সহায়ক নার্স, মিডওয়াইফ বা দাইদের দ্বারা সম্পন্ন হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর তার ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে জানাচ্ছে মোট গর্ভপাতের ৫৬ শতাংশই অসুরক্ষিত। আসলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হলে গর্ভপাত কমেনা বরং বাড়ে অসুরক্ষিত অস্বাস্থ্যকর বিপজ্জনক গর্ভপাত। ভারতে এই বিপজ্জনক গর্ভপাত থেকে মৃত্যুর হার মোট মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর ৪৭ শতাংশ। তাহলে এই মেয়েরা সংবিধানের ২১ ধারা যেখানে ‘জীবন’এর অধিকার ঘোষিত আছে তা থেকে বঞ্চিত হল না? আইনকে আরও মুক্ত হতে হবে।

এই সংযোজন ভারতীয় গর্ভপাত আইনটিকে এখনও সম্পূর্ণ করতে পারেনি। এলজিবিটিকিউ ও নাবালিকারা এখনও এই অধিকারের বাইরে আছে।

অবিবাহিতা বা একক নারীকে গর্ভপাত আইনের শর্ত মানতে হবে। কেনো? এই মুহূর্তে পৃথিবীর ৭৩টি দেশ যখন শর্তহীনভাবে গর্ভপাতের অধিকার ভোগ করছে। সেই দেশগুলির কয়েকটি তো ঘরের পাশেই। যেমন নেপাল, চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তান, তাজাকিস্তান, ভিয়েতনাম ইত্যাদি। তারা এই নতুন সংযোজনকে পুরুষতান্ত্রিক ও ক্ষতিগ্রস্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হয়েছে বলে মনে করছেন। গর্ভস্থ সন্তানের বয়স ২৪ সপ্তাহের বেশি হয়ে গেলে মেডিকেল বোর্ডের মতামত ও অস্ত্রপচারে ২ জন ডাক্তারের উপস্থিতি — এই বাধ্যকতাই বা কেনো? কারণ ভারতে ডাক্তারের অভাব আছে। ভারতের ৬৬ শতাংশ মানুষ যখন গ্রামে বাস করে তখন সেখানে ৭০ শতাংশ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের অভাব। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে মেডিকেল বোর্ডে থাকতে হবে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, রেডিওলজিস্ট ও সোনোলজিস্টকেও। এত ডাক্তার কোথায় ভারতে? তাছাড়া অস্বাভাবিক শিশুর ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমা টানা যায় না। তবুও সেক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ড বসাতে হবে কেনো? একটি স্বাভাবিক শিশু জন্মের পূর্ব মুহূর্তেও গর্ভের ভিতরে মারা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ড ছাড়াই অস্ত্রপচার করা হয়। এক্লামশিয়া এমন একটি গর্ভজনিত অসুখ যেখানে শিশুকে মা’র শরীর থেকে বের না করলে মায়ের মৃত্যুর সমুহ সম্ভাবনা। সেখানেও বোর্ড ছাড়াই এমনকি জুনিয়র ডাক্তারাই শিশুর প্রসব করাচ্ছে। বাকি রইল আর্থ-সামাজিক বিষয়। ধরা যাক একটি মেয়ে গর্ভবতী হল। তার আরও দু’টো ভাই বোন আছে। মা সবজি বিক্রি করে, বাবা অটো চালায়। এখন যদি তার গর্ভপাত না করে সন্তান হয়, বাচ্চাটিকে সে কীভাবে মানুষ করবে? কেউ কি মেয়েটিকে ভালোবাসবে? বিয়ে করবে? ভাইবোনদের ভবিষ্যৎ কী হবে?

শিশুটির ভবিষ্যৎই বা কী হবে? বাকি জীবনটা তো নরক হয়ে যাবে মেয়েটির। তার থেকে ভালো নয় কি গর্ভপাত করা? এরজন্য বোর্ডের খুব কি প্রয়োজন? কিন্তু একটা ব্যাপার অবশ্যই ভাববার। সেটা হল নিরাপদ গর্ভপাত। বিশেষ ক্ষেত্র যেমন নাবালিকা বা মহিলার কোনো জটিল অসুখে বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে।

নিরাপদ গর্ভপাতের লক্ষ্যে হু এই ২০২২ সালে তার নির্দেশিকার যে আপডেট প্রকাশ করেছে তারও লক্ষ্য আইনি চিকিৎসা ও পুলিশি বিষয়গুলো যতদূর পারা যায় সরল করে অতি দ্রুত গর্ভপাত করা। অনেক দেশ তো আইন উঠিয়েই দিয়েছে। হু আরও বলেছে, এক্ষেত্রে শুধু চিকিৎসাগতভাবে নিরাপদ হলেই হবে না, যে মেয়েরা গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখানো, কোনো রকম অপবাদ না দেওয়া ও প্রয়োজনীয় গর্ভপাতের পিল, তথ্য ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। সব মিলিয়ে এক বিস্তারিত প্যাকেজ ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে হু। যারমধ্যে পড়বে যৌনতা বিষয়ে শিক্ষা, জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী সরবরাহ, গর্ভপাত করার জটিলতামুক্ত নীতি ও নিরাপদ গর্ভপাত পরিষেবার বিস্তার।

অনেকে বলতে পারেন এরফলে গর্ভপাতে তথা যৌনকর্মে উৎসাহিত করা হচ্ছে। হু’এর পর্যবেক্ষণকেই দেখা যাক। হু বলছে যে, যেসব দেশে গর্ভপাতের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেখানে ১০টির মধ্যে মাত্র একটিই নিরাপদ গর্ভপাত হয়েছে। আর যেখানে কোনো আইনি বাধা নেই সেখানে ১০টির মধ্যে ৯টিই নিরাপদে হয়েছে। এটা গর্ভপাতকে প্রশ্রয় দেওয়া নয়, সুরক্ষার অধিকারকে প্রসারিত করা। আর যারা এখনও গর্ভপাতের অধিকারকে খর্ব করার পক্ষে, তারা মার্কিন মুলুকে একবার উঁকি দিয়ে দেখতে পারেন।

- অশনি সাংকৃত্যায়ন

Adani's business empire

নরেন্দ্র মোদীর সবচেয়ে কাছের পুঁজিপতি গৌতম আদানির সম্পদ বৃদ্ধি ও বিশ্বের ধনীদের তালিকায় সর্বোচ্চদের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা এখন এক বড় খবর। গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি স্বল্প সময়ের জন্য দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তির মর্যাদা অর্জন করেন, পরে সম্পদের কিছু সংকোচন ঘটায় ধনী তালিকায় তাঁর স্থান দু’ধাপ নেমে আসে এবং সেপ্টেম্বরের শেষে তার সম্পদের পরিমাণ ১২৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ানোয় বিশ্বের ধনী তালিকায় তার স্থান এখন চতুর্থ। তার আগে রয়েছেন মার্কিন পুঁজিপতি ইলেক্ট্রিক গাড়ি টেলসার নির্মাতা কোম্পানির সিইও এলন মাস্ক (সম্পদের পরিমাণ ২৪০ বিলিয়ন ডলার), আর এক মার্কিন উদ্যোগপতি ও বৈদ্যুতিন বাণিজ্য সংস্থা অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বোজেস (সম্পদের পরিমাণ ১৩৮ বিলিয়ন ডলার) এবং ফরাসি ধনকুবের বার্নার্ড আরনল্ট (সম্পদের পরিমাণ ১২৯ বিলিয়ন ডলার)। এই সমস্ত গোষ্ঠীর মালিকানাধীন গোষ্ঠীগুলোর শেয়ার মূল্যের ওঠা-নামার জন্য সম্পদের পরিমাণে এবং ফলত ধনী তালিকায় স্থানের পরিবর্তন ঘটে। তবে, সম্পদ বৃদ্ধির দিক থেকে গৌতম আদানির উত্থান আক্ষরিক অর্থেই চোখ ধাঁধানো এবং এত অল্প সময়ে সম্পদের ঐ পরিমাণ বৃদ্ধি অন্য কোনো পুঁজিপতির ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায়নি। আর, গৌতম আদানির সম্পদ বৃদ্ধি ও বিশ্বের ধনী তালিকায় তাঁর স্থান নিয়ে মিডিয়ায় যতটা চর্চা হয়, সম্পদের ঐ বিপুল বৃদ্ধি যে চলতি ব্যবসার ভিত্তিকে কেন্দ্র করে সম্পন্ন হয়নি, তার প্রায় সবটাই যে ঋণ চালিত, সেই আলোচনায় মিডিয়ার তেমন আগ্ৰহ দেখা যায় না।

পড়তে-পড়তে কলেজ ছেড়ে দেওয়া গৌতম আদানি তাঁর ব্যবসা শুরু করেন ১৯৮৮ সালে, পণ্য কেনা-বেচার এক সংস্থা হিসাবে। নরেন্দ্র মোদী ২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁর ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে, গুজরাটের প্রশাসনিক শীর্ষে মোদীর অধিষ্ঠানের সঙ্গে আদানির বাণিজ্য বৃদ্ধির ধারাও অব্যাহত হয়। আর মোদী ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বাণিজ্য ক্ষেত্রে আদানির উত্থান ও সম্পদের বৃদ্ধি আক্ষরিক অর্থেই অভাবনীয় ধারায় ঘটতে থাকে। বিশ্বের বিলিয়োনেয়ার তালিকায় গৌতম আদানির স্থান প্রথমবারের মতো ঘটে ২০০৮ সালে, তখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯.৩ বিলিয়ন ডলার। তারপর ১৪ বছরে তাঁর সম্পদের বৃদ্ধি ঘটেছে প্রায় ১৪ গুণ। কোভিড শুরুর আগে ২০২০’র জানুয়ারিতে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার (এক বিলিয়ন হল ১০০ কোটি, আর ১ ডলার ভারতীয় মুদ্রায় এখন মোটামুটি ৮২ টাকা), কোভিড কালেও তাঁর সম্পদ বৃদ্ধিতে কোনো ছেদ পড়েনি। হ্যাঁ, কোভিড কালেও! বিশ্বব্যাঙ্কের অতি সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, করোনা কালে ৬.৫ কোটি ভারতীয় দারিদ্র সীমার নীচে তলিয়ে গেছেন। অর্থাৎ, কোভিড জীবিকার উৎসে বিপর্যয় ঘটানোয় দেশের জনগণের একটা অংশ যখন অবর্ণনীয় দুরবস্থায় পড়েছেন, তখনও আদানির সম্পদ বৃদ্ধি অপ্রতিহত ধারায় এগিয়ে গেছে। ২০২১ সালে তাঁর সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে ৪৯ বিলিয়ন ডলার (সপ্তাহে প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকা), আর এবছর, অর্থাৎ, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে তাঁর সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে একেবারে হতবাক করে দেওয়ার মতো ৬০.৯ বিলিয়ন ডলার। সম্পদের পরিমাণের দিক থেকে তিনি এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মুকেশ আম্বানিকে টপকে যান, এপ্রিলে ঢোকেন বিশ্বের শতকোটি বিলিয়োনেয়ার তালিকায় আর এখনতো বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে চতুর্থ। এই বৃদ্ধি অভাবনীয় এবং বিশ্বের অন্য কোনো উদ্যোগপতির ক্ষেত্রে তা ঘটতে দেখা যায়নি।

আদানির সম্পদের এই বৃদ্ধির পিছনে কারণ মূলত দুটো — তাঁর গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর শেয়ার মূল্যের বৃদ্ধি এবং নানান ব্যবসার অধিগ্ৰহণ ও নতুন-নতুন ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ। কোনো কোনো শেয়ার মূল্যের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ঘটেছে ১০০০ শতাংশের বেশি, যথা আদানি গ্ৰীন ও আদানি টোটাল গ্যাস; আবার ১৪০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি ঘটেছে আদানি এন্টারপ্রাইজেসের ক্ষেত্রে। বিশেষজ্ঞরা কিন্তু মনে করছেন, কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক ফলাফলের সঙ্গে শেয়ার মূল্যের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির তেমন সম্পর্ক নেই। আদানি পরিবারের হাতেই কোম্পানিগুলোর তিন-চতুর্থাংশ শেয়ার রয়েছে। এছাড়া, এমন কিছু বিদেশি সংস্থা থেকে বিনিয়োগ এসেছে যেগুলোর স্বচ্ছতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। মরিশাসের পোর্ট লুইসে একই ঠিকানায় অবস্থিত দেখানো কয়েকটি সংস্থাকে আদানির কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করতে দেখা গেছে এবং ঐ সংস্থাগুলোর কোনো ওয়েবসাইটও নেই। এই বিনিয়োগগুলো যথেষ্ট সন্দেহজনক বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে। পরিবারের হাতে শেয়ারের কেন্দ্রীভবনের ওপর ভিত্তি করে এবং অস্বচ্ছ ও সন্দেহজনক বিনিয়োগের মাধ্যমে সুকৌশলে শেয়ার মূল্যকে চড়ানোর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তবে, ২০২১ ও ২০২২ সালে বৃদ্ধির অন্যতম মূল কারণ হল নতুন-নতুন সংস্থার অধিগ্ৰহণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ। আদানি সাম্প্রতিক সময়ে যে সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন তা হল — কয়লা, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, সিমেন্ট, অ্যালুমিনিয়াম পরিশোধন, পেট্রোকেমিক্যালস, গ্যাস, ডাটা সেন্টার, সৌরবিদ্যুৎ, হাইওয়ে, প্রভৃতি। সম্প্রতি তাঁর অধিগৃহীত সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে অম্বুজা সিমেন্ট ও এসিসি, ছত্তিশগড়ের তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প ডিবি পাওয়ার, পশ্চিমবাংলায় তাজপুর সমুদ্রবন্দর তিনি নির্মাণ করবেন বলেও জানা গেছে, মিডিয়া ক্ষেত্রে এনডি টিভির অধিগ্ৰহণও তিনি সম্পন্ন করেছেন। বিদেশেও কিছু সংস্থা অধিগ্ৰহণেতিনি ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন, যারমধ্যে ইজরায়েলের হাইফা বন্দরও রয়েছে।

ব্যবসা থেকে অর্জিত লাভের বিনিয়োগের মাধ্যমে আদানির এই বৃদ্ধি ঘটেনি, বৃদ্ধির এই ফুলে-ফেঁপে ওঠার পিছনে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোর হাত উজাড় করা ঋণ। আদানি এক-একটা সংস্থা অধিগ্ৰহণ করেছেন, আর প্রধানমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ উদ্যোগপতির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা হাজার-হাজার কোটি টাকার ঋণ মুক্ত হস্তে দিতে একটুও দ্বিধা করেনি সরকারি ব্যাঙ্কগুলো। গত পাঁচ বছরে আদানির ঋণের পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২.২ ট্রিলিয়ন টাকা (১ ট্রিলিয়ন = ১ লক্ষ কোটি)। অর্থাৎ, আদানি গোষ্ঠির ঋণের পরিমাণ এখন ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। সম্প্রতি কিছু সংস্থা অধিগ্ৰহণ ও প্রকল্প নির্মাণের জন্য আদানির নেওয়া ঋণ হল এই রকম।

গঙ্গা হাইওয়ে প্রকল্পের জন্য ১০,২৩৮ কোটি টাকা (মীরাট থেকে প্রয়াগরাজ পর্যন্ত বিস্তৃত এক্সপ্রেসওয়ে); তামা পরিশোধন ব্যবসার জন্য ৬,০৭১ কোটি টাকা; নভি মুম্বইয়ে বিমানবন্দর তৈরির জন্য ১২,৭৭০ কোটি টাকা; অম্বুজা সিমেন্ট অধিগ্ৰহণের জন্য ৪১,০০০ কোটি টাকা; ছত্তিশগড়ে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ৮৭৯ মিলিয়ন ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় ৭,০০০ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া, অন্যান্য প্রকল্পের জন্য আরও ঋণ রয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জে আদানির যে সাতটা সংস্থা নথিবদ্ধ রয়েছে তারমধ্যে ছটির ঋণের পরিমাণ এই রকম।

Adani's business

সূত্র: হাও আদানি ক্রিয়েটেড এন এম্পায়ার অন এ পাইল অব ডেট, ৫ পয়সে ডট কম

আদানিদের ব্যালান্স শিট জানাচ্ছে, ২০২২’র মার্চে তাদের ব্যাঙ্ক ও ক্যাশ ব্যালান্স ছিল মাত্র ২৬,৯৮৯ কোটি টাকা। এসত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলো হাত উজাড় করে তাকে ঋণ দিয়েছে, তার প্রাপ্ত ঋণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোর অবদান ৯৫ শতাংশ, যারমধ্যে এসবিআই’এর অংশ আবার হল ৩০ শতাংশ। এক বছরে নীট ঋণের যে প্রায় ৫৪,০০০ কোটি টাকা বা ৪২ শতাংশের বৃদ্ধি, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলো তাদের ঋণহস্তকে লাগামহীন করা ছাড়া সেটা সম্ভব ছিল না।

গৌতম আদানি ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হওয়ার সঙ্গে এইভাবে হয়ে উঠেছেন সবচেয়ে ঋণী ব্যক্তি, এবং তার মতো ঋণের দায় থাকা উদ্যোগপতি বিশ্বে খুঁজে পাওয়াও ভার। আগ্ৰাসী ধারায় নিজের ব্যবসা সাম্রাজ্য গড়তে গিয়ে যে ঋণভার আদানি নিজের কাঁধে চাপালেন, তাকে সামলানো কি তার পক্ষে সম্ভব হবে? এক-আধ হাজার কোটি নয়, একেবারে দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণ পরিশোধ সামর্থ্যের সংকুলান কি তাঁর ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো থেকে হতে পারবে? নাকি, এই বিশাল ঋণ তারজন্য এক ঋণফাঁদ তৈরি করবে যার থেকে বেরিয়ে আসাটা দুঃসাধ্য হবে? আদানির ঋণ পরিস্থিতি এই প্রশ্নগুলোকে সঙ্গতভাবেই তুলে আনছে। আদানির ব্যবসা সাম্রাজ্যের বিস্তার একদিকে যেমন তার হাতে দেশের সম্পদের বিপুল মাত্রায় কেন্দ্রীভবন ঘটিয়েছে ও ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র ও মোদী সরকারের মদতপুষ্ট এই গোষ্ঠী হিন্দুত্ববাদ তথা ফ্যাসিবাদের সক্রিয় দোসরেও পরিণত হচ্ছে। গৌতম আদানির পর ভারতের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের একাদশ ধনী ব্যক্তির নাম হল মুকেশ আম্বানি। এই স্যাঙাতি কর্পোরেট মডেল যখন মোদী সরকারের কাছে অর্থনীতির এক বড় অবলম্বন হয়ে উঠছে, দেশের অর্থনীতির চেহারা তখন একেবারেই বিবর্ণ — রিজার্ভব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাসকে ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে চলেছে, দারিদ্র-বেকারি-অপুষ্টি বাড়ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্যস্ফীতি কোনো বাঁধ মানছে না, খাদ্য নিরাপত্তাকে শিকেয় তোলা হচ্ছে। সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক দুরবস্থা এতটাই সঙ্গিন যে আরএসএস’কেও দারিদ্র ও বেকারি নিয়ে কপট উদ্বেগ প্রকাশ করতে হচ্ছে। অতএব, দেশের অর্থনৈতিক অধোগতি এবং ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় আদানি-আম্বানি কর্পোরেট রাজের মূলোচ্ছেদ যে একান্ত আবশ্যক তার উল্লেখ বোধকরি নিষ্প্রোয়জন।

– জয়ন্ত মিত্র

on the other side

বাংলাদেশ বললেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির হয়ত মনে পড়ে শামসুর রহমান, আল মাহমুদ কিংবা নির্মলেন্দু গুণের কবিতা, হয়ত মনে পড়ে চিত্র পরিচালক তারিক মাসুদ কিংবা মরশেদুল ইসলামের নাম, মনে পড়তে পারে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেলাল চৌধুরী কিংবা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারদের চট্টগ্রামের কথা। এসবতো আছেই, কিন্তু এই প্রথমবার বাংলাদেশে গিয়ে মন জুড়িয়ে দিল সেখানকার মানুষজনেরা, তাদের মেহেমানি, আন্তরিকতা আর উষ্ণ ব্যবহার। দেশের কথাতো শেষ পর্যন্ত সেই দেশের মানুষদেরই কথা। এপার বাংলায় বসে শুনতে থাকা উড়ে আসা কথা পেড়িয়ে গিয়ে দেখলাম ভাষা, সংস্কৃতির অভিন্নতা, এক অদৃশ্য নৈকট্য যা কখনও কখনও দৃশ্যের তৃপ্তি দেয়।

সীমান্তবর্তী বাগেরহাট হয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের বাংলাদেশ ভ্রমণ। নিবেদিতা আমার এক সহকর্মীর ভাইঝি, দশম শ্রেণীর ছাত্রী, বাগেরহাট জেলার সাবোখালী গ্রামে বাস। বাংলাদেশে গিয়ে প্রথমে ওদের বাড়িতেই উঠেছিলাম, বাস থেকে নেমে ইজি বাইকে (আমাদের এখানকার টোটো) চেপে দুপাশে অসংখ্য পুকুর, বিল আর তার পাড়ের গোলপাতা গাছের ছায়া মাড়িয়ে যখন ওদের বাড়ি পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে নামছে। ইজি বাইক থেকে নামতেই আমার বয়স্ক জামাইবাবুর হাতটা চেপে ধরল, যেন কত দিনের পরিচিত, “ব্যাগগুলান আমারে দাও” বলে দিদির হাত ধরে পিছল উঠোন পার হয়ে নিয়ে গেলো ঘরে। পরের দিন ভোরে যখন ওর সাথে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছি, পথে যার সাথেই দেখা হয় আমাকে দেখিয়ে বলে, “ইন্ডিয়া থেকে আমার জ্যাঠা আইসে”। কে বলবে চব্বিশ ঘন্টা আগেও ও আমায় চিনতো না!

গোটা গ্রামের মানুষ দেখা করতে এসেছিল আমাদের সাথে, এদেশ আর ওদেশের কথা চলছিল, তৃপ্তি বৌদি সবার জন্য নিয়ে আসছিল চিতৈপিঠে। ঢাকার আলম ভাইয়ের আতিথেয়তাও একই রকম। আলম ভাই ঢাকা নিবাসী, আমার এক সহকর্মীর মাসতুতো ভাই। যাওয়ার দু’দিন আগে ফোনে আলাপ করেছিলাম, আমাদের ঢাকা এবং কক্সবাজারের থাকার হোটেল, ঘোরার জন্য গাড়ি সমস্ত কিছুই ঠিক করে রেখেছিলেন উনি। ব্যবসায়ী মানুষ, ব্যস্ততার মধ্যেও দিনে বহুবার ফোন করে আমাদের সুবিধে অসুবিধের খোঁজ নিতেন। একদিন রাতে এসে নিয়ে গেলেন নৈশ আহারে, আমরা চারজনই স্বল্পাহারী কিন্তু আলমভাই সেসব শুনবে কেন, সে এটা সেটা দিয়ে যাবার জন্য বলতেই থাকে। বলা হয়নি, আমরা চারজন মানে আমি, আমার স্ত্রী, দিদি এবং জামাইবাবু শ্যামলদা। শ্যামলদা দেশভাগের পর বাহান্ন সালে ভারতে চলে যায়, বাবা ছিলেন ও দেশের একটি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক, সেই স্কুলেই শ্যামলদার ক্লাস ফোর অবধি পড়াশুনা। সেই স্কুল খোঁজার গল্পটিও চমকপ্রদ। গ্রামের নাম আর কিছু আবছা স্মৃতি সম্বল করে বেরিয়েছিলাম সেই জায়গার খোঁজে। যে গাড়িতে গেছি তার ড্রাইভার জুয়েলেরও যেন বাড়িটি খুঁজে পাওয়া খুব দরকার, একে তাকে জিজ্ঞেস করে চলেছে। অবশেষে যিনি মুশকিল আসান হিসেবে হাজির হলেন, একটা ওষুধের দোকানের মালিক সেই বিনয়বাবু এবং ভীড় করে আসা গ্রামের মানুষদের সহায়তায় খুঁজে পাওয়া গেলো ভিটে এবং স্কুলটিও। পুকুরের এক পাড়ে নাকি ছিল হিন্দুদের ঘর, অপর পাড়ে মুসলিমদের। সত্তর বছর পর দুই পাড়ের যাদের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করা হয়েছিল সেই মানুষগুলোই আর নেই, তৎকালীন ভিন্ন পাড়ের দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ মানুষগুলো খুঁজে দেয় ছেড়ে যাওয়া ভিটের সন্ধান। স্কুলে পৌঁছোলে বর্তমান প্রধান শিক্ষক হাত ধরে নিয়ে গেলেন তাঁর ঘরে, বহুক্ষণ ধরে আলাপচারিতা চললো, ইতিমধ্যে বিনয়বাবু ফোন করে স্ত্রীকে রাঁধতে বলে দিয়েছিলেন, লাউয়ের তরকারি, মাছের ঝোল দিয়ে ওনার বাড়িতেই মধ্যাহ্নভোজ সারা হল। বাহান্ন সালে যিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন তারই ছেলে ছিল ’৬৯ সালের গণআন্দোলনের তিন শদীদের অন্যতম শহীদ আসাদ। সাদিক রহমান জানান, তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) পার্টির প্রার্থীসভ্য, মৃত্যুর পরে তাকে মরণোত্তর সদস্যপদ দেওয়া হয়। যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে শুয়ে আছে আসাদ, সেই মাটিতে সেই স্বপ্ন আজওতো কেউ বুনে চলে!

Bengal is also on the other side

খুব মনে পড়ছে কক্সবাজারের সেই বাচ্চা তিনটে ছেলেমেয়ের কথা, ওরা ঝিনুকের তৈরি জিনিস বিক্রি করছিল, ওদের একজন আমার বৌকে সুন্দর একটা ঝিনুকের হার দিয়ে বললো, “আপু এটা তোমার জন্য, এটার জন্য কোনো পয়সা দিতে হবে না!” মনে পড়ছে ঢাকায় আমাদের সফরসঙ্গী নাসিমের কথা, রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্রসাদ কিনে এনে গাড়ি চালাতে চালাতে প্লাস্টিক ছিড়ে তা আমাদের খাওয়ায়, নিজেও খায়। নাসিমের গাড়ির ব্লুটুথের সাথে ইউটিউবের সংযোগ ঘটিয়ে ওর ফরমায়েশিতে এপার আর ওপার বাংলার শিল্পীদের গলায় গান শুনতে শুনতে আমরা দোয়েল চত্বর, পুরান পল্টন, শাহবাগ, রমনায় ঘুরেছি, শুনেছি শাহ আব্দুল করিমের নিজের গলায় গাওয়া “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” গানটি! আলমগীর ভাইয়ের কথাও বলি, চট্টগ্রামের এক ইজি বাইক চালক, এক মুখ দাড়ি, গোঁফ কামানো, সূর্য সেনের কথা জিজ্ঞেস করায়, বললো “জানি না”। তারপর যখন অস্ত্রাগার দখলের গল্প করলাম, বললো, “লেখাপড়া তো করিনি, অনেক কিছুই জানি না”, বললাম আজকের দিনেই প্রীতিলতা শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিল, সব শুনে সে নিয়ে চললো ইউরোপিয়ান ক্লাবে, প্রীতিলতার আবক্ষ মূর্তির সামনে আমাদের সবার ছবি তুলে দিল, নিয়ে গেল ডাঃ খাস্তগীর সরকারি গার্লস স্কুলে, এই স্কুলেই প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্ত সহপাঠী ছিল। প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতি শাহাদা আখতার স্কুলের এক কর্মচারীকে আমাদের স্কুলটি ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য বলে দিলেন, পরে এক তরুণ শিক্ষক যোগ দিলেন আমাদের সাথে। একটি দেওয়ালে দেখি কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও মৈত্রেয়ী দেবীকে নিয়ে এক ছাত্রীর আঁকা ও লেখা টানানো।

দেশভাগ অনেক কিছুই ছিনিয়ে নিয়েছে, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও পরে কমিউনিস্ট আন্দোলনে এমএল গ্ৰুপে যোগ দেওয়া আমার মামা চিকিৎসার কারণে এদেশে আসায় তবু আগে দেখা হয়েছিল কিন্তু এই পঞ্চান্ন বছরে এসে প্রথম দেখা পেলাম আমার মামাতো দিদির, প্রথম দেখা হলো আমার দুই বৌদি ও ভাইপোদের সাথে। বুঝেছি দেশভাগ অনেক কিছু কেড়ে নিতেও পারেনি। আলমগীর ভাই হৃদরোগের চিকিৎসা করাতে চেন্নাই যেতে চান, নাসিমের খুব ইচ্ছে দিল্লী, আগ্রা আর আজমীর শরিফে যাওয়ার, দুই সম্প্রদায়ের বহু আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই উপমহাদেশে। নাসিম আর আলমগীর ভাইকে আমার ফোন নম্বর দিয়ে এসেছি, এপারে এলে যোগাযোগ করার জন্য।

ঢাকার কুট্টিদের রসিকতা তো আমরা শুনেছি কিন্তু কুষ্টিয়ার কুলফি বিক্রেতাই বা কম যায় কিসে, শিলাইদহ কুঠিবাড়ি দেখে যখন বের হচ্ছি, লাইন দিয়ে বসে থাকা কুলফি বিক্রেতাদের একজন বললেন, “খেয়ে যান, নইলে রবি ঠাকুরকে কি জবাব দেবো, উনিতো রাগ করবেন!”

Bangladesh is on the other side_Bengal

ভুল হয়ে গেছে বিলকুল, অনেক কিছু ভাগ হয়ে গেলেও শুধু নজরুলই নন, ভাগ করা যায়নি অনেককেই। অনেক স্কুলের দেওয়ালে তাই আরও অনেকের সাথে রবীন্দ্র-নজরুল-মধু কবি আর সুকান্তের ছবি। নজরুলের সমাধির পাশে সমাধি দেখতে আসা মাস কমিউনিকেশনের তিন স্টুডেন্ট সামসুর, কানিজ ফাতেমা বৃষ্টি আর মিমি রেকর্ড করে নেয় শ্যামলদার কথা, ওদের অনুরোধে ঋতা গায় রবীন্দ্র সংগীত। শহিদ মিনারেও দুই বন্ধু অনীক আর ওহিদুলের সাথে আমরা একসাথে গেয়েছি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”!

টিএসএ চত্বরে এসে মনে হয়, আরে এতো আমাদের কলেজ স্ট্রিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও মনে হয় চেনা চেনা। দেওয়ালে কোনো এক ছাত্র সংগঠনের দেওয়াল লেখা — বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, তার পাশেই লেখা শাঁখের সুর আজানে যাচ্ছে মিশে, ধর্মান্ধ তোমার লালসা মিটবে কিসে। লালন সাঁইয়ের দেশে সংগীতের রাগের নামে মজনু ভাই তার ছেলের নাম ইমন রাখাতে আশ্চর্য হইনি, অবাক হই না যখন সে ছেলে বলে, “এখানে আমরা মিলেমিশে থাকি, আমরা রুখে দেবো যারা আমাদের ভাঙতে চায়!”

চিত্রা, আড়িয়াল খাঁ, মধুমতির বয়ে চলা, আকাশে দোয়েল আর শঙ্খচিল, রিকশাচালক, চায়ের দোকানের আড্ডা, বোরখা পড়া কিংবা না পড়া মেয়ের দল, শ্যামল সবুজ ধানক্ষেতে দুই বাংলাকে আলাদা করারতো আর জো থাকে না।

ফেরার পথে বেনাপোল সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে যখন লাইনে দাঁড়িয়ে, তখন দু’দিকে সীমান্ত রক্ষীদের কুচকাওয়াজ চলছে, আর তারমধ্যেই চলছে দু’দিকে যাতায়াতের জনস্রোত। মনে মনে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা বলে উঠি — “আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা/মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে, থাকুক গে পাহারা/দুয়োরে খিল, টান দিয়ে তাই খুলে দিলাম জানলা/ওপারে যে বাংলাদেশ, এপারেও সেই বাংলা।”

- ভিয়েত

Ramakrishna Bhattacharya

আমাদের সময়ের অন্যতম প্রধান পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ২ অক্টোবর ২০২২ সকালে প্রয়াত হয়েছেন। বাংলা মননচর্চার জগতে এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।

চার্বাক দর্শন নিয়ে, ভারতীয় বস্তুবাদী দর্শন নিয়ে তাঁর অসামান্য সব কাজ রয়েছে। এই কাজে অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সার্থক উত্তরসূরী ছিলেন তিনি। মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব, বের্টোল্ড ব্রেখটকে নিয়ে তিনি যেমন অসামান্য কাজ করেছেন, তেমনি করেছেন বিদ্যাসাগরকে নিয়ে।

কথাসাহিত্য ও ন্যারেটোলজি নিয়ে ইংরাজি সাহিত্যের এই প্রখ্যাত অধ্যাপকের কাজ অত্যন্ত মূল্যবান। পরশুরামের ছোটগল্প নিয়ে তাঁর বইগুলির কথা এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ ও বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য ও চিন্তাজগৎ নিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে।

কয়েক দশক আগে সুমিত সরকার লিখেছিলেন স্বদেশী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল নামে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে এক অসামান্য গ্রন্থ। বিপ্লবীরা অনেকেই এই সময়কে ধরেছেন তাঁদের স্মৃতিকথায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থের অভাবছিল। সেই অভাব দূর করেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। স্বদেশী আন্দোলন বা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে তাঁর অসামান্য গ্রন্থটি সারস্বত সাধনার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখালিখির সবচেয়ে বড় গুণ সহজ সরল উপস্থাপণ। নিজে অসাধারণ পণ্ডিত হলেও যা আত্তীকরণ করেছেন তাঁকে কখনো জটিলভাবে উপস্থাপণের রাস্তায় হাঁটেননি তিনি। লিখেছেন সাধারণ মানুষ, আন্দোলন সংগ্রামের অ্যাক্টিভিস্টরা যাতে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে — সেইটা মাথায় রেখে।

প্রথম যৌবনে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতৃত্বে ছিলেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ বহন না করলেও তিনি আমৃত্যু ছিলেন আপোসহীন মার্কসবাদী। তাঁর লেখালিখি মার্কসবাদের ছাত্রদের কাছে চিরন্তন সম্পদ হয়ে থেকে যাবে।

আমরা অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের প্রয়াণে গভীরভাবে শোকাহত।

== 000 ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-39