গ্রামে মাঠে কাজ নেই। অন্য কাজও সবার জুটছে না। অথচ গত প্রায় এক বছর ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। কেন্দ্র-রাজ্য একে অপরের ঘাড়ে দায় ঠেলছে। যারা এক বছর আগে কাজ করেছিলেন, তারা তাদের টাকা এখনও পাননি। সামগ্রিকভাবে, মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের এই বাজারে গরিব মানুষের বিরুদ্ধে এ যেন যুদ্ধ ঘোষণা। প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন, বসিরহাট-১ ব্লকের গরিব মানুষ সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি এবং সারা ভারত কিষাণ মহাসভা। গত ৪ নভেম্বর ২০২২ স্থানীয় টাউন হল মাঠে সমাবেশিত হয়ে এক দৃপ্ত মিছিল শহরের রাস্তায় স্লোগান তুলল, “কেন্দ্র-রাজ্য বুঝি না — কাজ চাই, কাজ দাও; কাজ করেছি মজুরি দাও”, কৃষকের ফসল উৎপাদন খরচের দেড়গুণ গ্যারান্টি আইন করতে হবে, ভাগ ও লিজ চাষিদের সরকারী স্বীকৃতি ও সাহায্য দাও, ব্লকের খারাপ রাস্তা সংস্কার করো, সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা-দুর্নীতিগ্রস্ত-সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের শাস্তি দাও, বিজেপি সরকারের গরিব বিরোধী নীতি রুখে দাও প্রভৃতি।
মিছিল ব্লক দফতরে পৌঁছে শুরু হয় বিক্ষোভ সভা। দেবব্রত বিশ্বাস দাবিসমূহ ব্যাখ্যা করে বলেন, গরিব মানুষের সাথে এক চরম বিশ্বাসঘাতকতা করছে যেমন মোদী সরকার, তেমনি পঞ্চায়েত থেকে রাজ্যস্তর পর্যন্ত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রাজ্য সরকার আজ আর কোনও দায় নিচ্ছে না, বকেয়া মজুরি কেন্দ্র দিচ্ছে না বলে দায় সারছে। এছাড়াও, যেখানে রাজ্য সরকারের ঘোষিত অদক্ষ মজুরের ন্যুনতম মজুরি ৩২২ টাকা, সেখানে কেন ২২৩ টাকায় ১০০ দিনের কাজ করানো হচ্ছে?
এআইএআরএলএ জেলানেতা অজয় বসাক উপস্থিত বিক্ষোভকারীদের জোরদার আন্দোলনের প্রস্তুতি নেবার আহ্বান রাখেন। কাজ ও বকেয়া মজুরি দ্রুত না পেলে আগামীতে প্রশাসনিক দফতর ঘেরাও করার ডাক দেন।
সভা থেকে ৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল — দেবব্রত বিশ্বাসের নেতৃত্বে নুর ইসলাম মোল্লা, রবিউল মোল্লা ও আবুল কালাম শেখ — দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি নিয়ে বিডিও’র নিকট ডেপুটেশন দিতে যান। এনআরইজিএ প্রকল্পে কাজ ও বকেয়া মজুরির দাবি ছাড়াও, সমস্ত ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে মানুষকে বার্ধক্য ভাতা ও বিধবাদের বিধবা ভাতা দিতে হবে এবং কমপক্ষে ৩,০০০ টাকা করতে হবে, তফসিলি- আদিবাসী-ওবিসি’দের শংসাপত্রের হয়রানি বন্ধ, রাস্তা সংস্কার, আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল, কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন, কৃষিতে বিদ্যুতে ছাড় প্রভৃতি ১৩ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক স্থানীয় সমস্যা গলি দ্রুত সমাধানের এবং অন্যান্য দাবিগুলি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানোর আশ্বাস দেন।
ডেপুটেশন-বিক্ষোভ সভা পরিচালনা করেন বাবুনি মজুমদার।
৪ নভেম্বর যুব-ছাত্র অধিকার মঞ্চের পক্ষ থেকে আয়োজিত গণকনভেনশনে উপস্থিত হন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, আইসা, আইপোয়া, আইলাজ, আরওয়াইএ, গণসংস্কৃতি পরিষদ এবং অন্যান্য গণসংগঠনের নেতৃত্ব৷ ধর্মতলায় গান্ধী মূর্তির পাদদেশে স্কুল সার্ভিস কমিশনের চাকরিপ্রার্থীদের অবস্থান মঞ্চে এইদিন উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, পার্থ ঘোষ, এআইসিসিটিইউ-এর পক্ষ থেকে অতনু চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু, আইসা-র পক্ষ থেকে স্বর্ণেন্দু মিত্র, শুভাশীষ দাস, আইলাজ-এর পক্ষ থেকে দিবাকর ভট্টাচার্য, আরওয়াই-এর পক্ষ থেকে রণজয় সেনগুপ্ত, আইপোয়া-র নেত্রী ইন্দ্রাণী দত্ত ও অন্যান্যরা। কনভেনশনের শুরুতে খসড়া পাঠ করেন এই আন্দোলনের প্রথম সারির নেত্রী রাজশ্রী দাস। লিবারেশনের নেতা কার্তিক পাল আন্দোলনকারীদের কৃষক আন্দোলনের হার না মানা লড়াইয়ের কথা মনে করিয়ে দেন৷ এআইসিসিটিইউ-র কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী বলেন, “শুধুমাত্র এসএসসি নয়, কলকাতার বুকে টেট, প্রাইমারী, আপার-প্রাইমারী, গ্রুপ-ডি প্রভৃতি বিভিন্ন সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে আসছে। দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন মঞ্চের সাথে যুক্ত হয়ে আন্দোলন করছে। আজ এমন এক সময় এসেছে, যখন ক্ষমতাসীন শাসকের সঙ্গে এই অসম লড়াইতে জিততে হলে সমস্ত মঞ্চের বিক্ষোভকারীদের একত্রিত হয়ে বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের রাস্তায় এগোতে হবে। এছাড়া অন্য পথ নেই।”
মাতঙ্গিনী হাজরার পাদদেশেও অবস্থান করছেন বহু চাকরিপ্রার্থী। গোটা রাজ্যে বেকার যুবক-যুবতীদের হাঁ-হুতাশ দেখেও মুখ্যমন্ত্রী নীরব কেন, এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বক্তারা। লিবারেশনের যুব সংগঠন আরওয়াইএ-এর রাজ্য সভাপতি অপূর্ব ঘোষ বলেন, “দুর্নীতি যখন হয়েছে, নেতা-মন্ত্রীদের অবশ্যই জেলে পুড়তে হবে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হল, যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ কোথায়? চাকরি কোথায়?” আজকে যে ছাত্রছাত্রীরা সরকারি স্কুলগুলোতে পড়ছে, তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ত্রিয়াশা। সাদা খাতা জমা দিয়ে পাশ করা শিক্ষকদের থেকে ছেলেমেয়েরা কতটা কী শিখবে, সেক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের অশিক্ষার দায় কে নেবে — এই প্রশ্নগুলো রেখেছে ছাত্র সংগঠন আইসা-র প্রতিনিধিরা। ওইদিন আইপোয়ার রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত এসএসসি আন্দোলনে যুক্ত মহিলাদের ঘরে-বাইরের সংগ্রামকে কুর্নিশ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সম্পাদক নীতীশ রায় সভার শুরুতে গণসঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। সভা সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন যুব-ছাত্র অধিকার মঞ্চের সংগঠক সজল দে।
এছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট গণআন্দোলনের নেত্রী বোলান গঙ্গোপাধ্যায়, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার, মাসুম আখতার, আলতাব হোসেন, অভিনেতা বাদশা মৈত্র, দেবদূত ঘোষ, সিপিআই(এম)-এর নেতা সুজন চক্রবর্তী, তন্ময় ভট্টাচার্য এবং অন্যান্য গণসংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন, আইনজীবী সংগঠন, ছাত্র-যুব সংগঠন, মহিলা সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। পরিশেষে বক্তব্য রাখেন যুব-ছাত্র অধিকার মঞ্চের সভাপতি মইদুল ইসলাম। নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনকে আরও জোরালো করার অঙ্গীকার করেন মইদুল।
৭ নভেম্বর ২০২২
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের বৈধতা বহাল রাখার সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের সিদ্ধান্তটি দুর্ভাগ্যজনক। এই সিদ্ধান্ত আমাদের সংবিধানে বিধৃত মূল চেতনার বিরুদ্ধে। ভারতের সংবিধানে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে সংরক্ষণের বিধান নেই। আমাদের সংবিধান অনুসারে সংরক্ষণের একমাত্র ভিত্তি হল সামাজিক, শিক্ষাগত ও ঐতিহাসিক অনগ্রসরতা।
প্রথম যখন ইডব্লিউএস সংরক্ষণ আনা হয় তখনও সিপিআই(এমএল) তার বিরোধিতা করেছিল এবং ভবিষ্যতেও এরকম বিধানের বিরোধিতা করবে।
একদিকে, যখন সামাজিকভাবে বঞ্চিত অংশগুলির সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে, তখন আদালত তৃণমূল স্তরের তথ্যের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নানা শর্তের অবতারণা করে সেই পদক্ষেপকে ন্যায্যতা দেয়। অন্যদিকে, সামাজিকভাবে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অংশগুলির সুবিধার্থে আনা এই সংরক্ষণের বিধানটিকে আদালত ন্যায্যতা দিচ্ছে জমিনী বাস্তবতা যাচাই না করেই। তদুপরি, এই ১০ শতাংশ ইডব্লিউএস রিজার্ভেশনের উপার্জন-সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে বার্ষিক ৮ লক্ষ টাকা, যা অর্থনৈতিকভাবে অনেক দুর্বল অংশকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে বাধ্য।
সিপিআই(এমএল) সুপ্রিম কোর্টের একটি বৃহত্তর সাংবিধানিক বেঞ্চ দ্বারা এই সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনা করার দাবি জানাচ্ছে।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল)
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী আচমকাই নোটবন্দী ঘোষণা করে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটগুলোকে বাতিল করে দিলেন। তারপর অতিক্রান্ত হল ছ’ছটা বছর। সন্ত্রাসবাদ, অর্থনীতিতে কালো টাকার রমরমাকে রোধ করতে এবং শেষ বিচারে দুর্নীতি ঠেকাতে ওই বিধ্বংসী টোটকা সমগ্র দেশবাসীকে চরম বিপদে ফেলে, দেশের অর্থনীতির উপরই বিরাট আঘাত হেনেছিল। দেশের অর্থনীতির উপর নগদ টাকা প্রচলনের নির্ভরতা কমিয়ে ক্রমে ক্রমে ডিজিটাল লেনদেনের দিকেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ছিল সরকারের আরেকটা ঘোষিত লক্ষ্য।
পরিহাস এটাই, রিজার্ভব্যাঙ্কের প্রকাশিত তথ্য জানাচ্ছে, এবছর ২১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশবাসীর কাছে নগদ টাকার জোগান নোটবন্দীর ছ’বছর পর ৭১.৮৪ শতাংশ হারে বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০.৮৮ লক্ষ কোটি টাকায়! সহজ কথায়, অর্থনীতিতে নগদ টাকা জোগানের পরিমাণ ব্যাপকহারে কমিয়ে অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে অন্যতম ঘোষিত লক্ষ্য ছিল নোটবন্দীর, তা পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পরেছে শীর্ষব্যাঙ্কের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী। নোটবন্দীর ঠিক আগে, ৪ নভেম্বর ২০১৬-তে, রিজার্ভব্যাঙ্ক জানায়, বাজারে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ১৭.৭ লক্ষ কোটি টাকা, যা এখন এক লাফে বেড়েছে ৩০.৮৮ লক্ষ কোটি টাকায়। নোটবন্দী শুরুর সময়ে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে দেশবাসীকে যা শোনানো হয়, পরবর্তীতে দ্রুতই বদলে যেতে থাকে গোল পোস্ট। লেনদেনে নগদের জোগান ব্যাপক মাত্রায় কমিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনের উপর জোর দেওয়া হতে থাকে। কিন্তু, আজ এটা স্পষ্ট, ওই লক্ষ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী জঁ দ্রেজ বলেছিলেন, ছুটন্ত এক গাড়ির টায়ারে গুলি করে থামিয়ে দেওয়ার সামিল ছিল নোটবন্দী। ভারতের সচল অর্থনীতিকে আচমকাই থামিয়ে দিয়ে বিরাট সর্বনাশ ডেকে আনল মোদীর নোটবন্দী। আর তারপর থেকে ভারতীয় অর্থনীতি চলে গেল রাহুগ্রাসের কবলে।
২০১৬-১৭-তে ভারতের বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৩ শতাংশ। তারপর ক্রমাগত তা নিচে গড়াতে শুরু করে — পরের বছরগুলোতে যথাক্রমে ৬.৯ শতাংশ, ৬.৬ শতাংশ, ৪.৮ শতাংশ এবং -৬.৬ শতাংশ হারে এসে দাঁড়ায়। এইভাবে নিচুতে অর্থনীতির ধারাবাহিকভাবে নেমে যাওয়া স্বাধীনতার পরবর্তীকালে আগে কখনও দেখা যায়নি। এরই পাশাপাশি ভারতের বেকারত্বের হার এখন রীতিমতো উদ্বেগজনক। সম্প্রতি আইএলও’র সংগৃহীত তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক ভারতীয় তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের যে ছবি হাজির করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে ভারত ঢুকে পরেছে অস্থিরতায় ভোগা পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সারিতে। আমাদের দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছরের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৮.৩। যেখানে ইরান-মিশর-সিরিয়ার হার হল যথাক্রমে ২৭.২, ২৪.৩ এবং ২৬.২ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় তা আরো অনেক বেশি খারাপ। বেশিরভাগ এশিয়ার দেশ যেমন ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে এই হার যথাক্রমে ১৬, ১৫.৬ এবং ১৪.৭ শতাংশ।
দেশের অর্থনীতি বিরাজমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ নিরপেক্ষভাবে যে বিকাশ লাভ করতে পারে না তা আজ এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। গণতান্ত্রিক পরিমন্ডল সংকুচিত হলে, দেশের অভ্যন্তরে নানান প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হলে, চাপা সন্ত্রাস, ভয়ভীতি ও পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতি প্রাধান্য বিস্তার করলে আর্থিক বিকাশ গতিরুদ্ধ হয়।
আমাদের দেশ আজ এমনই এক পরিবেশের মধ্য দিয়ে চলেছে। চরম লজ্জার বিষয় হল, ভারতীয় তরুণদের বেকারত্বের হাল আজ ইরান, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া’র থেকেও খারাপ। নোটবন্দী থেকে শুরু হয়েছিল এই অধঃপাতের অভিমুখে অর্থনীতির যাত্রা। তারপর জিএসটি, কোভিড মরার উপর খাঁড়ার ঘা এনে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিল। ঘুরে দাঁড়ানোর সংকল্প না নিয়ে মোদী জমানা এই সর্বনাশা অবস্থাকেই গৌরবান্বিত করছে, ক্রমাগত ভারতীয় টাকার অবমূল্যায়নকে উপেক্ষা করে বলছে, “টাকার দাম কমছে না, আসলে ডলার শক্তিশালী হচ্ছে”।
ভারতের আজ চরম দুর্দিন। বিপর্যয় ও সর্বনাশের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।
যদিও নরেন্দ্র মোদী ভোটমুখী গুজরাটের ভোটারদের বিশাল বিনিয়োগ আর বিপুল উন্নয়নের স্বপ্নের ইন্দ্রজালে সম্মোহিত করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন, মোরবীতে ব্রিটিশ আমলের ঝুলন্ত সেতু ভেঙে কমপক্ষে ১৩৪ জনের মৃত্যুবহু ঢক্কানিনাদিত গুজরাট মডেলের কঙ্কালসার চেহারাটা একেবারে স্পষ্ট করে দিল। মোরবী সেতুর মর্মান্তিক বিপর্যয়ের যে বিশদ ছবি উঠে এসেছে তা খুব জঘন্য ধাঁচের শাসনের দিকেই আঙুল তুলছে — সম্পূর্ণ অদক্ষ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। মোরবীর দেওয়াল ঘড়ি তৈরির কোম্পানি ‘ওরেভা’কে দেওয়া হয়েছিল শতাব্দী-প্রাচীন ঝুলন্ত সেতুটির মেরামতি ও রক্ষণাবক্ষেণের কন্ট্রাক্ট। খবরে প্রকাশ, ঐ কন্ট্রাক্ট যার বৈধতা ছিল ২০৩৭ পর্যন্ত এবং যেটি কোম্পানিটিকে সেতু ব্যবহারকারী জনসাধারণের থেকে অর্থ আদায়ের জন্যে অনুমতি দিয়েছিল, সেটি কোনও প্রকাশ্য টেন্ডার ছাড়াই চূড়ান্ত হয়েছিল। কোম্পানি দাবি করেছিল দু’কোটি টাকা খরচ করে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সেতু মেরামতির কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। আর শুধু যেন বিপর্যয়কে ডেকে আনার জন্যেই, সেতুটি নির্বাচনের আগে তাড়াহুড়ো করে খুলে দেওয়া হল। সরকারি ভাষ্যে ভেঙে পড়ার কারণ হিসেবে সেতুর ওপর মাত্রাতিরিক্ত ভীড়কে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে নগদ পয়সা দিয়ে টিকিট কাটার পর মানুষকে সেতুতে উঠতে দেওয়া হয়েছে।
ছ’বছর আগে কলকাতায় যখন একটি নির্মীয়মান ফ্লাইওভারের একাংশ ভেঙে পড়েছিল, সেই বিপর্যয়কে নির্বাচনী ইস্যু বানাতে নরেন্দ্র মোদী এক মুহূর্ত দেরী করেননি। তিনি বলেছিলেন, ঐ বিপর্যয় নাকি পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতিগ্রস্ত অপশাসন থেকে বাঁচানো এবং বিজেপি’কে ক্ষমতায় আনার উদ্দেশ্যে স্বয়ং ভগবানের ‘বার্তা’! এখন কি তিনি মোরবীর সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনাকে বিজেপি’র দুর্নীতিগ্রস্ত ক্রোনি শাসন থেকে গুজরাটকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ‘দৈববাণী’ বলে মেনে নেবেন? গুজরাটের বেশিরভাগ বাণিজ্যিক গ্রুপের মতো ‘ওরেভা’ গ্রুপও মোদী-শাহ যুগলের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ এবং সেতু ভেঙে পড়ার পর করা এফআইআর-এ ইতিমধ্যেই কোম্পানিটিকে কেসের চৌহদ্দির বাইরে রাখা হয়েছে। এরপর যেটা হয়, বিপর্যয়ের শিকার মানুষজনকে সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে এবং একেবারে নিচুতলার কয়েকজন কর্মীকে শাস্তি দিয়ে কেসটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এবং প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যেই মোরবী সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনাটিকে জনপরিসরের চর্চা থেকে মুছে ফেলেছে।
মোদীর নির্বাচনী প্রচারে ‘উন্নয়নের’ স্বপ্ন সবসময়েই বোনা হয় ঘৃণা ও মিথ্যার সুতোয়। গুজরাটে এবার ঘৃণাবর্ষী প্রচারের সরাসরি লক্ষ্য শুধু মুসলিমরাই নন, শহুরে নকশালরাও। আরও একবার নর্মদা নদী প্রকল্পকে গুজরাটের গর্ব ও কল্যাণের সমৃদ্ধ উৎসের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে মোদী মেধা পাটকরকে ‘শহুরে নকশাল’ বলে দোষারোপ করেছেন। মেধা নাকি উচ্ছেদের বিষয়টিকে সামনে এনে উন্নয়নকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন! সংসদে দাঁড়িয়ে ভাষণে মোদী ‘আন্দোলনজীবী’ বলে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন, আর তারই রেশ টেনে সম্প্রতি তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীদের ‘মগজে ঝড় তোলা’ অধিবেশনের ভিডিও কনফারেন্সের ভাষণে কলমজীবী নকশালদের নির্মূল করার প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরলেন। সংবিধান ও বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা, ন্যায় ও মানবাধিকার, পরিবেশ রক্ষা, বাস্তুচ্যুত ও অধিকার হারানো মানুষদের পুনর্বাসন — গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গোটা বিষয়টিকেই ‘শহুরে নকশালবাদ’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে ইউএপিএ বা ঐ ধরনের দানবীয় আইন দিয়ে তার ‘মোকাবিলা’ করার জন্য।
যে সরকার জনসাধারণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ ও আইনের শাসনের নীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরায় সম্পূর্ণ ব্যর্থতা তথা বিশ্বাসঘাতকতাকে আড়াল করতে এইরকম ফ্যাসিস্ট আক্রমণ লেলিয়ে দেয়, সেখানে বিরোধীদের কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত? এক দশক আগে, ইউপিএ সরকারের শেষের বছরগুলিতে দুর্নীতি ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে গণসংগ্রামের পটভূমিতে দিল্লীতে আম আদমি দলের উত্থান হয়। দিল্লীর সঙ্গে, এই দল এখন পাঞ্জাবেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত; খবরে প্রকাশ, গুজরাটেও উল্লেখযোগ্য সাড়া ফেলতে পেরেছে। বিলকিস বানোকে যারা ধর্ষণ করেছিল, তার পরিবারের সদস্যদের যারা হত্যা করেছিল, সেই ধর্ষক-খুনীদের দেশের ৭৫তম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে মুক্তি দিয়ে বীরের সম্বর্ধনা দেওয়া; হরিয়ানার ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে, ধর্ষণ-অভিযুক্ত কুখ্যাত রাম রহিমকে ৪০ দিনের প্যারোলে মুক্তি দেওয়া-এ সবের বিরুদ্ধে দলটির কী প্রতিক্রিয়া?
ঐ প্রশ্নের একেবারে সুনির্দিষ্ট উত্তর নিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি বলছেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির জন্যে ভারতের চাই হিন্দু দেবদেবীদের আশীর্বাদ! আর সেটা পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় নাকি প্রচলিত ভারতীয় মুদ্রার নোটে সমৃদ্ধির স্বীকৃত দেবী লক্ষ্মী এবং মুস্কিল-আসান সিদ্ধিদাতা জ্ঞানের দেবতা গণেশের ছবি ছাপানো! এই একটা সুপারিশেই কেজরিওয়াল পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে ভগৎ সিং এবং আম্বেদকরের প্রতি মৌখিক শ্রদ্ধা জানালেও তিনি বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তিবাদকে বিদায় জানিয়ে তমসাচ্ছন্ন জ্ঞান-বিরোধী কুসংস্কারকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত! মোদী সরকারকে তার চরম অপদার্থতা এবং বিভাজনমূলক ঘৃণাভরা মতাদর্শের জন্য দায়ী করার পরিবর্তে তিনি অদ্ভুত হাস্যকর ভাবনা ও ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক আবেগময় আবেদনের খেলায় নেমে মোদীকে হারাতে চাইছেন! এই রাজনৈতিক লাইনকে কখনও কখনও নরম হিন্দুত্ব বলে অভিহিত করা হয় ও গণ আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতার দোহাই দিয়ে তার ওকালতি করার চেষ্টা হয়। শুধু তাই নয়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী ও তাঁর ধর্মীয় নানা প্রবচন ও রূপকধর্মী উপমার উদাহরণ টেনে ঐ নরম হিন্দুত্বকে যুক্তিগ্রাহ্য বৈধতা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়।
রাজনীতিতে এই কৌশল নেওয়ার ব্যাপারে কেজরিওয়াল যে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রথম, তা মোটেই নয়। কেজরিওয়ালের মত রাজীব গান্ধীও ভারতীয় রাজনীতিতে একটি পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক ভাবমূর্তি নিয়ে উঠে এসেছিলেন। আর সেই সঙ্গে তার ছিল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকা একবিংশ শতাব্দীর ভারত সম্পর্কে এক বিচক্ষণ দূরদর্শী ভাবনা। ১৯৮৪-তে তিনি, ভারতে আজ পর্যন্ত বৃহত্তম সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পন্ন একটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন। বিজেপি’র সেই সময়ে লোকসভায় আসন সংখ্যা কমে হয় মাত্র দুই। কিন্তু এখন তাকে মনে পড়ে কার্যত বিজেপি’র একজন উৎসাহদাতা হিসেবেই — প্রথমত শাহ বানো রায়ে তার অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ এবং তারপর অযোধ্যায় তার মধ্যপন্থী ভূমিকা। এমনকি এখনও কিছু কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধীকে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের আসল স্থপতি বলে দাবিও করে থাকেন! হিন্দুত্বের মল্লভূমে নেমে কেজরিওয়ালের মোদীকে পরাস্ত করার চেষ্টা — ঐ একই পরিণতি তার জন্যেও ডেকে আনবে।
আসলে বিজেপি’র নির্বাচনী সাফল্যের কারণ ‘ধর্মভীরুতার প্রতি আবেদন’ নয়। ঘৃণাভরা মুসলিমবিরোধী উন্মত্ততায় মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার আর এই সংখ্যাগুরুবাদকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বলে দাবি করার ক্ষমতাই হল বিজেপি’র ঐ সাফল্যের চাবিকাঠি! আর এই ঘৃণা ও আগ্রাসনের চোখে চোখ রেখে লড়ে তাকে পরাস্ত করতে পারে সামাজিক ও মতাদর্শগত প্রতিস্পর্ধী এক চূড়ান্ত সমাবেশ; ঐ ঘৃণাকে, প্রতিযোগিতা বা সহযোগিতার মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে নয়! অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির জন্য নোটের ওপর ধর্মীয় প্রতীক ছড়িয়ে দেওয়া, তাও আবার পিছনের দেওয়ালে আধুনিক ভারতের মহত্তম দুই স্বপ্নদ্রষ্টার ছবি ঝুলিয়ে — আধুনিক ভারতের ব্রতের প্রতি অতীতের কেজরিওয়ালের বিশ্বাসঘাতকতার মুহূর্ত হিসেবেই মানুষের মনে থাকবে!
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ১ নভেম্বর ২০২২)
মেমারী ১নং ব্লকের নিমো অফিসে সকাল ১১টার সময় সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলন স্থান নামকরণ হয় কণা সরকার নগর, শ্যামাপ্রসাদ সভাগৃহ ও নবকুমার বাগদী মঞ্চ। শহীদবেদীতে মাল্যদান ও শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। পতাকা উত্তোলন ও শহীদ বেদীতে মাল্যদানের সুচনা করেন আয়ারলার রাজ্য পর্যবেক্ষক রাজ্য কমিটির সদস্য গোপাল রায়। সম্মেলন পরিচালনার জন্য বিদায়ী জেলা সম্পাদক আনসারুল আমন মন্ডলের প্রস্তাবে মোজাম্মেল হক, সমীর হাজরা ও তৃণাঞ্জন বক্সীকে সভাপতিমন্ডলী নির্বাচন করা হয়। সভাপতিমন্ডলীর আহবানে পর্যবেক্ষক গোপাল রায় প্রথমে বক্তব্য রাখেন। তিনি রাজ্য তথা দেশের গ্রামীণ মজুরদের জীবন জীবিকার সংকট ও কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের বঞ্চনা, নির্যাতনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন এবং ব্যাপক মেহনতি জনগনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহবান জানান। প্রতিবেদন পাঠ করেন বিদায়ী সম্পাদক আনসারুল আমন মন্ডল। বিভিন্ন ব্লকের কর্মীরা বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য রাখেন এআইকেএম-র রাজ্য সভাপতি অন্নদা প্রসাদ ভট্টাচার্য। বক্তব্য রাখেন আয়ারলার রাজ্য সভাপতি সজল পাল। বক্তারা গ্রামীণ মজুরদের আন্দোলনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সমস্যা তুলে ধরেন ও গণসংযোগ অভিযানের অভিজ্ঞতা এবং আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে জোরালো হস্তক্ষেপের উপর জোর দেন। তারপর বিদায়ী সম্পাদক আনসারুল আমান মন্ডল জবাবী ভাষন দেন। প্রতিবেদন সর্বসন্মতিতে পাশ হয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পূর্ববর্ধমান জেলা সম্পাদক সলিল দত্ত এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন প্রস্তাব গ্রহণ করে আয়ারলার আসন্ন ১৪-১৫ নভেম্বর হুগলী জেলার চন্দননগর রবীন্দ্র ভবনে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সম্মেলন সফল করার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে সমস্ত রকম সন্ত্রাস মোকাবিলা করে জনগণের জীবন-জীবিকার দাবিগুলোকে অগ্রাধিকারে রাখার মাধ্যমে জোরাল হস্তক্ষেপ করে ব্যাপক সংখ্যক প্রার্থী দিয়ে প্রচারে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেবে।
শেষে ২৫ জনের জেলা কাউন্সিল ও ১১ জনের নতুন জেলা কমিটি নির্বাচন করা হয়। আনসারুল আমন মন্ডল পুনরায় জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন ও মোজাম্মেল হক জেলা সভাপতি নির্বাচিত হন। সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে সভাপতিমন্ডলী সম্মেলনের সফল সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
আসন্ন আয়ারলা’র জাতীয় সম্মেলনের প্রাক্কালে জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের রাজারহাটে এক প্রচারসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু, আয়ারলা’র জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক শ্যামল ভৌমিক, জলপাইগুড়ি জেলা পার্টি সদস্য প্রদীপ দেবগুপ্ত, মুকুল চক্রবর্তী প্রমুখ।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরি নির্ণায়নের চারটি ক্ষেত্রীয় মাপকাঠি রয়েছে। এই চারটি ক্ষেত্র হল কৃষিক্ষেত্র, উদ্যানপালন ক্ষেত্র, নির্মাণশিল্প ক্ষেত্র এবং অন্যান্য অকৃষি ক্ষেত্র। রিজার্ভব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একমাত্র উদ্যানপালন ক্ষেত্র ছাড়া বাকি তিন ক্ষেত্রীয় মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম।
সম্প্রতি ‘Handbook of Statistics on Indian States, ২০২০-২১’ নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রিজার্ভব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। রিপোর্টে শেষ আর্থিক বছর ২০২০-২১ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণের উপর বিশদ পরিসংখ্যান দেওয়া আছে। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০- ২১ আর্থিক বছরে উদ্যানপালনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ৩৩৫.৭০ টাকা৷ যা জাতীয় গড় ৩০৯.১০ টাকার তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ছিল ৩৩৯.১০ টাকা। অর্থাৎ ২০২০-২১ আর্থিক বছরে জাতীয় গড়ের থেকে এগিয়ে থাকলেও পরিমাণটি এর আগের আর্থিক বছরের তুলনায় কমেছে।
২০২০-২১ আর্থিক বছরে কৃষি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ২৮৮.৬০ টাকা৷ যা জাতীয় গড় ৩০৯.৯০ টাকার তুলনায় বেশ কিছুটা কম। যদিও ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে দৈনিক মজুরির পরিমাণ ছিল ২৬৭.৫০ টাকা। এইক্ষেত্রে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বামশাসিত রাজ্য কেরালাতে, যেখানে দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ৭০৬.৫০ টাকা।
নির্মাণশিল্পর ক্ষেত্রে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ৩০০.২০ টাকা৷ যা জাতীয় গড় ৩৪০.৭০ টাকার তুলনায় বেশ কিছুটা কম। যদিও এই ক্ষেত্রে দৈনিক মজুরির পরিমাণ এর আগের ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে দৈনিক মজুরির পরিমাণ ছিল ২৯০.৫০ টাকা। এইক্ষেত্রেও গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি কেরালাতে৷ যেখানে দৈনিক মজুরির পরিমাণ হল ৮২৯.৭০ টাকা।
অন্যান্য অকৃষি ক্ষেত্রে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ ৩০৫.৮০ টাকা৷ যা জাতীয় গড় ৩১৫.৩০ টাকার তুলনায় কিছুটা কম। যদিও ২০২০-২১ আর্থিক বছরে এই ক্ষেত্রে দৈনিক মজুরির পরিমাণ এর আগের ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ২০১৯- ২০ আর্থিক বছরে দৈনিক মজুরি ছিল ২৯১.১০ টাকা। অন্যান্য অকৃষি ক্ষেত্রেও গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দৈনিক মজুরির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি কেরালাতে ৬৭৭.৬০ টাকা।
এই প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ কুণাল বোস বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রতি কৃষিজমির মালিকদের হাতে জমির পরিমাণ এতটাই কম, চাষ করে কৃষি শ্রমিকদের বেতন দেবার মতো পর্যাপ্ত টাকা তাঁদের হাতে থাকে না। ঠিক সেই কারণেই এই রাজ্যে কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এত কম। আর ঠিক একই কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ঠিক করে হচ্ছে না। তাই অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন অকৃষি ক্ষেত্র এবং নির্মাণশিল্প ক্ষেত্রেও গ্রামীণ বাংলায় দৈনিক মজুরি কম। রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতির পক্ষে যা খুবই উদ্বেগজনক বিষয়৷’’
অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ নীলাঞ্জন দে বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিশেষভাবে সচেষ্ট হতে হবে যাতে গ্রামীণ বাংলার এই বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি, জাতীয় গড়ের অন্তত কিছুটা কাছাকাছি আনা যায়। কৃষি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে সরকার এর আগে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়নি। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কয়েক বছরের মধ্যেই এর সুফল আমরা দেখতে পাই৷’’
প্রাক্তন সাংবাদিক এবং অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ শান্তনু সান্যাল বলেন, ‘‘কৃষি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে যেটা প্রাথমিক দরকার সেটা হল সরকারের নিয়মিত তদারকি। সেই নিয়মিত তদারকি না থাকলে ন্যূনতম মজুরিও নিশ্চিত হবে না৷ সেইসঙ্গে কৃষি শ্রমিকদের জীবনের মানোন্নয়ন না হলে কৃষির উন্নতি হবেনা এবং বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশও হবে না৷’’
(এই লেখাটির পরিসংখ্যানগুলি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট ও প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।)
২০ নভেম্বর ২০২২ থেকে কাতারে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া কর্মকান্ড — বিশ্বকাপ ফুটবল। এই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ, আর তারজন্য নির্মিত হয়েছে আটখানা পেল্লাই স্টেডিয়াম। চোখ ধাঁধানো ঝলমলে এই সমস্ত অনবদ্য বিস্ময়কর স্থাপত্য কাতারের যাযাবর অতীত, সেই দেশের সংস্কৃতি ও জীবন যাপনকে প্রতিবিম্বিত করেছে — ৬০,০০০ আসন বিশিষ্ঠ অল বায়ত স্টেডিয়াম, যেখানে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী পর্ব, সেটি হল আরেকটি বিস্ময়কর সৃষ্টি, যা গড়ে তোলা হয়েছে সেই দেশের যাযাবরদের তাঁবুর ধাঁচে।
অঢেল অর্থ বিনিয়োগে যেন রূপকথার স্বপ্নপুরিতে জেগে উঠেছে এই মরু প্রান্তর। কিন্তু, এই বিশাল বিত্ত বৈভব, মায়াবি রাজ্যে জেগে ওঠা কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের গোটা কর্মকান্ডের নেপথ্যে যে অমানবিক শোষণ, নিপীড়ন ও বর্বর বঞ্চনার মর্মান্তিক কাহিনী চাপা পড়ে রয়েছে, তাকে দিনের আলোয় উদঘাটিত করল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক অন্তর্তদন্ত। এই গোটা কর্মকান্ডে নিয়োজিত ভারতের যে সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা সেখানে কাজ করতে গিয়েছিলেন, যাদের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে নির্মিত হয়েছে সেই সমস্ত অলৌকিক স্থাপত্য, তাঁদের মধ্যে অনেকেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এক কানাকড়িও ক্ষতিপূরণ তাঁরা পাননি। ঘিঞ্জি অস্বাস্থ্যকর ঝুপড়িতে, প্রচন্ড তাপপ্রবাহে, ৫০ ডিগ্রির উপর তাপমাত্রায়, তাঁদের কাজ করতে হতো দীর্ঘদীর্ঘ সময় ধরে। চরম ঝুঁকি নিয়ে নির্মাণ কাজে কর্মরত অবস্থায় অনেকের প্রাণহানি ঘটেছে। অত্যন্ত প্রতিকূল আবহাওয়া ও পরিবেশে অমানুষিক পরিশ্রম করতে গিয়ে মারা গেছেন আরও বেশ কয়েকজন।
এদিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রলুব্ধ করতে কত রঙিন স্বপ্ন, কত লোভনীয় কাজের শর্তাবলি ফেরি করেছিল কাতারের সেই কোম্পানি, যারা বিশ্বকাপ ফুটবলে নির্মাণ কাজের বরাত পেয়েছিল। কী কী দেবার কথা তারা বলেছিল?
আট ঘন্টার শিফট, কাজের চাপ থাকলে দু’ঘন্টার ওভারটাইম, নিয়মিত কাজের দিনগুলোতে নির্ধারিত শ্রমঘন্টার বেশি কাজ করলে মজুরির ১২৫ শতাংশ দেওয়া হবে, আর সপ্তাহ শেষে ১৫০ শতাংশ। মেডিকাল কার্ড সহ যাতায়াত ও থাকার খাওয়ার নিশ্চিত ব্যবস্থা। প্রথম দু’বছরে ২১ দিনের সবেতন ছুটি যা তারপর দ্বিগুণ করা হবে। দু’বছরের শেষে দোহা থেকে সেই শ্রমিকের যেখানে বাসস্থান, তার নিকটস্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ফেরার বিমান টিকিট। যে মজুরি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, তা হল ১২,০০০ কাতারি রিয়াল বা প্রায় ২৭,০০০ টাকা। যারা যারা ওই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই ভারতের গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা, গ্রামে কাজের অভাবে বেকারত্বের জ্বালায় ভিন্ দেশে পাড়ি দিয়েছেন কাজের সন্ধানে।
কিন্তু কাজের শেষে যারাদেশে ফিরে এসেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা তিক্ত। প্রবঞ্চনাময় ওই চুক্তির কোন শর্তই মানেনি কন্ট্রাক্টর সংস্থাটি। কর্মরত অবস্থায় বা কাতারে থাকাকালীন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ বা বিমার প্রশ্নে পুরোপুরি নীরব ওই সংস্থাগুলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বিশ্বকাপ ফুটবল সংগঠিত করতে যে সংস্থাটি দায়বদ্ধ, সেই সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লিগাসি প্রায় তিন বছর আগেই নিয়োগকর্তাদের জানায় সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য জীবন বিমা করতে হবে, মৃত্যু হলে কোথায় ও কী কারণে তা হয়েছে তা বাছবিচার না করে তাঁদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ যেন সুনিশ্চিত করা হয়।
কিন্তু, দেখা গেল, ওই মরু প্রান্তরকে আন্তর্জাতিক ফুটবল কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার পর বিহার, পাঞ্জাব, তেলেঙ্গানা থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে এলেন, অনেকেই শেষ পর্যন্ত কফিন বন্দি হয়ে! আট মাস ধরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এই পরিঘটনার অন্তর্তদন্ত করতে গিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেছে সরকারি নথি, সাক্ষাৎকার নিয়েছে কন্ট্রাক্টরদের যারা সেখানে শ্রমিকদের নিয়োগ করেছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের কল্যাণে যারা কাজ করেন সেই সংস্থাগুলোর, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন স্তরের সরকারি আধিকারিকদের সাথে। তথ্য জানার অধিকার আইন প্রয়োগ করে সেই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করেন, যারা কাতারে কর্মরত অবস্থায় মারা যান। পত্রিকার পক্ষ থেকে এমন ৯টি পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হয়, কয়েকটি পরিবারের সাথে তাঁদের ঘরে গিয়ে। সাংবাদিকরা সেখানে প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই পরিবারগুলোর অবর্ণনীয় দারিদ্র, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর পর গোটা পরিবার ডুবে গেছে চরম আর্থিক সংকটে। তাঁদের প্রত্যেকের একটা সাধারণ অভিযোগ — কর্মরত অবস্থায় যাদের মৃত্যু হয়েছে, নিয়োগকর্তারা তাঁদের পরিবারকে দেয়নি এক কানাকড়িও ক্ষতিপূরণ। এই ৯ জন শ্রমিকের মধ্যে তিনজনের বয়স ৩০’এর নিচে, তারমধ্যে একজনের বয়স তো মাত্র ২২, ছ’জনের বয়স ৫০’এর কম। যারা যারা মারা গেছেন, তাঁদের কোন শারীরিক অসুস্থতা ছিলনা, আর সেই শংসাপত্র কাজে যোগ দেওয়ার সময় নিয়োগকর্তার কাছে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু নিয়োগকর্তা এই সমস্ত মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে ঘোষণা করে, দেয়নি কোন ক্ষতিপূরণ। মৃত্যুর খবরও পরিবারকে দেওয়া হয়নি। পরিবারগুলো তাঁদের আপনজনের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে যারা সেখানে কাজ করতে গেছিলেন।
“আমার স্বামীর মৃত্যু সংবাদ ওখানকার নিয়োগকর্তার কাছ থেকে আমি পাইনি”, বলেন সবিতা কুমার, যার স্বামী অখিলেশ বিহারের সিওয়ানে সাল্লাপুর গ্রামের বাসিন্দা। “আমরা তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি আমাদেরই গ্রামের এক পারিবারিক বন্ধু মারফত, যার এক নিকট পরিচিত কাতারে কর্মরত”। দোহার সন্নিকটে ভূগর্ভস্থ এক পাইপ লাগানোর সময় আচমকা ধ্বস নামে, আর অখিলেশ মাটি চাপা পড়ে মারা যায়। অখিলেশের সাথে সেই দিনেই একই জায়গায় মারা যান আরেকজন শ্রমিক, ৩২ বছরের জগন সুরুকান্তি, তেলেঙ্গানার মল্লারপুর গ্রামের বাসিন্দা। ক্রন্দনরত অবস্থায় তাঁর পিতা রাজা রেড্ডি (৫৯) বলেন, “সম্পূর্ণ সুস্থ শরীর নিয়ে আমার ছেলে সেখানে কাজ করতে গেছিল। কিন্তু ফিরে এল তাঁর দেহ, বাক্সবন্দি হয়ে।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ন’টি নিয়োগকর্তার মধ্যে আটজনের হদিশ পায়। মৃতের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতজন কোন উত্তর দেয়নি। আরেকজনকে ই-মেল বা ফোনে ধরতে পারা যায়নি। এদিকে, কাতারের সরকারি সংস্থা, সুপ্রিম কমিটি ফর ডেলিভারি অ্যান্ড লেগ্যাসি, যাদের উপর এই বিশ্বকাপ ফুটবল সংগঠিত করার ভার পড়েছে, তাঁরা জানিয়েছে, “এই গোটা কর্মকান্ডে সারা পৃথিবী থেকে আগত কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র তিনজনের মৃত্যু হয়েছে কাজ করতে গিয়ে, আর ৩৭ জন শ্রমিক মারা গেছেন অন্যান্য কারণে — সরাসরি কাজের সাথে যার নেই কোনও সম্পর্ক।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাতারে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের কাছে তথ্য জানার অধিকার আইনের ভিত্তিতে জানতে চায়, কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল দায়িত্ব পাওয়া থেকে সেখানে যে সমস্ত কর্মকাণ্ড শুরু হয়, তাতে কতজন ভারতীয় শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। ভারতীয় দূতাবাস মে ২০২২-এ লিখিত উত্তরে জানায়, “দোহায় ভারতীয় দূতাবাসের কাছে এই সংক্রান্ত কোনও তথ্য নেই”।
যে ন’জন শ্রমিক বা তাঁদের পরিবারের সাথে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস যোগাযোগ করতে পেরেছিল, তাঁদের নাম সহ পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের কাছে এক প্রশ্নপত্র পাঠানো হয় পত্রিকার পক্ষ থেকে। কিন্তু তার কোনও উত্তর দেয়নি।
বিশ্বকাপ ফুটবলের আন্তর্জাতিক গভর্নিং বডি ফিফা’র কাছে উক্ত ন’জন মৃত শ্রমিকের বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়ে মতামত চাইলে তারাও নীরব থাকে। পরে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস গত মে মাসে এক সংবাদ মারফত জানায়, ফিফার সভাপতি গিয়ানি ইনফান্টিনো নাকি বলেছেন, এই গোটা নির্মাণপর্বে মাত্র তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
লোকসভার রেকর্ড দেখাচ্ছে, গত তিন বছরে, ২০২০ থেকে ২০২২’র জুলাই পর্যন্ত ভারত থেকে কাতারে মোট ৭২,১১৪ জন শ্রমিক গেছিলেন। আর, বিদেশ মন্ত্রকের পেশ করা তথ্য হল, ২০১১ থেকে ২০২২’র মে পর্যন্ত ৩,৩১৩ জন ভারতীয় নাগরিক কাতারে প্রাণ হারিয়েছেন।
হিউমান রাইটস্ ওয়াচ রিপোর্টের মতে, কাতারের শ্রমকানুন এমনই যে একমাত্র কর্মস্থলে বা কাজ করার সময়ে মৃত্যু হলে পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ পাবে। আর, পরিবারগুলোর পক্ষে তা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’র ক্ষেত্রে পোস্ট মর্টেম করার প্রয়োজন হয় না। তাই প্রায় সব মৃত্যুর ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা জানিয়েছে, ‘হৃদরোগে মৃত্যু’ হয়েছে, আর শুধুমাত্র বকেয়া মজুরি পরিবারের কাছে পাঠিয়েই হাত ধুয়ে ফেলেছে। অবাক করার বিষয় হল, সেখানে সরকার বা অন্য কোনও স্বাধীন নিরপেক্ষ সংস্থা/ সামাজিক সংগঠনের তরফ থেকে এমন কোনও তদন্ত অনুসন্ধান হল না যে কেন এতোগুলো মানুষ ‘হৃদরোগ’ বা ‘স্বাভাবিক কারণে’ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।
বারবার ফিরে ফিরে আসে এই একই মর্মান্তিক অধ্যায়। বঞ্চনা, উপেক্ষা, প্রবঞ্চনার অমানবিক কাহিনী। আর, উপরে বর্ণিত রিপোর্ট থেকেই দেখা যাচ্ছে, এই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রশ্নে ভারতীয় দূতাবাস থেকে শুরু করে সমস্ত প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা, ওই দেশের সরকার কি হিমশীতল সহানুভূতিহীন অসংবেদি মনোভাব পোষণ করে চলছে। অতীতে ভারতে অনুষ্ঠিত এশিয়াডের সময়েও নির্মাণকান্ডের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের অশেষ যন্ত্রণা, বঞ্চনার মর্মন্তুদ কাহিনী সামনে আসে। কিন্তু, ক্রীড়া অনুষ্ঠান সাঙ্গ হয়, অপূর্ব সমস্ত নির্মাণকল্প থেকে যায় অন্তরালে অস্ফুট আর্তনাদের বোবা কান্না নিয়ে!
- অতনু চক্রবর্তী
(এআইসিসিটিইউ’র অনলাইন মাসিক পত্রিকা ওয়ার্কার্স রেজিস্ট্যানস্’এর অক্টোবর ২০২২ সংখ্যায় এই লেখাটি প্রকাশিত হয়। লেখক সুচেতা দে। লেখাটির গুরুত্ব বুঝে তার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করা হল — সম্পাদকমন্ডলী দেশব্রতী)
ভারতে জনপরিসরে মহিলাদের অংশগ্রহণে একটা ভারী অদ্ভুত প্যাটার্ন ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। সুরক্ষিত চাকরিতে ভারতীয় মহিলাদের অংশগ্রহণ ও নিয়োগ ক্রমশ কমছে। যদিও বিগত কয়েক দশক ধরে মহিলারা নিজেদের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে সামাজিক পুঁজি অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন, প্রতিটি স্তরে পিতৃতান্ত্রিক দাসত্ববন্ধনকে প্রতিস্পর্ধাভরে উপেক্ষা করে। সাধারণত সামাজিক পুঁজি একজন মানুষের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক অবদান রাখে; কিন্তু ভারতে মহিলাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছে ঠিক উল্টো।
সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় যারা ব্রতী তাদের জন্য বিষয়টি বিশেষ উদ্বেগের। ঐ সমাজ মেয়েদের, জীবনের বিভিন্ন রণভূমিতে এগিয়ে যেতে কখন বাধা দেয় না।
সম্প্রতি প্রকাশিত অক্সফ্যামের রিপোর্টেশ্রমের বাজারে বৈষম্য, বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর অতিমারীর প্রভাব, কৃষি ঋণ বাজারে জাতি-বৈষম্য এবং রোগী-পরিচর্যায় পার্থক্যের বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা রয়েছো। এই সমীক্ষায় বৈষম্যের বিভিন্ন ধরণকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে; আর সেজন্য ২০০৪-০৫ থেকে ২০১৯-২০’র এক বিস্তৃত সময় জুড়ে ভারত সরকার প্রচারিত এনএসএস এবং পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে সহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য পরিসংখ্যানের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে, এই সমীক্ষায় তুলে ধরা বৈষম্যের বহুমুখী প্রকাশের মধ্য থেকে শ্রম বাজারে জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের দিকটায় আমরা নজর দেব। গ্রাম-শহরে কর্মসংস্থান ও মজুরি বিষয়ে থাকবে আমাদের বিশেষ আলোকসম্পাত।
আসুন, প্রথমে দেখে নেওয়া যাক শহরাঞ্চলে নিয়মিত কাজে নিয়োগের ব্যাপারটা। সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০১৯-২০তে তফসিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৩৭.৫ শতাংশ নিয়মিত অথবা বেতনভিত্তিক কর্মসংস্থানে নিয়োজিত ছিলেন। এই সময়ে ঐ দুই সম্প্রদায়ের বাইরের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৪১.৩ শতাংশ ঐ ধরণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ নিয়মিত বা বেতনভিত্তিক কাজে তফসিলি ও উপজাতি সম্প্রদায় ও তার বাইরের কর্মক্ষম জনসংখ্যার নিযুক্তির শতকরা হারে ফারাক ছিল ৩.৮ শতাংশ। ঐ সময়ের পরিসংখ্যান আবার দেখিয়ে দেয় এক্ষেত্রে মুসলিম ও অ-মুসলিম কর্মক্ষম জনসংখ্যার নিযুক্তির মধ্যে পার্থক্য ছিল ৭.৮ শতাংশ — নিয়মিত কাজে অ-মুসলিম জনসংখ্যার নিযুক্তির হার ছিল বেশি।
এই পর্যায়ে ঐ কাজে পুরুষ ও মহিলার নিযুক্তির হারের ফারাকটা সবচেয়ে চোখে পড়ার মত। ২০১৯-২০-তে নিয়মিত বা বেতনভিত্তিক কাজে পুরুষ ও মহিলার নিযুক্তির হারে ফারাক ছিল ৪১ শতাংশ!
ইন্ডিয়া ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট : ২০২২’র সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ
অক্সফ্যাম সমীক্ষায় কর্মসংস্থান তথা মজুরির এই পার্থক্যের কারণ বোঝা যাবে। বোঝা যাবে অর্জিত মানসিক সম্পদ (এনডাওমেন্ট)-এর ফারাকের পটভূমি এবং বৈষম্য থেকে। জাতি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, মানসিক সম্পদের ফারাক কর্মসংস্থানের পার্থক্যের কারণকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়। বৈষম্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশাল লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়।
সমীক্ষা থেকে যা বোঝা গেছে, যদি অর্জিত মানসিক সম্পদকে সামাজিক মূলধনের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সমীক্ষাবলছে — মহিলাদের অর্জিত সামাজিক মূলধন তাদের বেতনভিত্তিক কাজে নিযুক্তিকে খুব সামান্যই প্রভাবিত করতে পারে। অক্সফ্যামের সমীক্ষা আরও জানাচ্ছে যে বেতনভিত্তিক কাজে লিঙ্গবৈষম্য জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীভেদে তেমন কিছুই পাল্টায় না। গ্রামাঞ্চলে নিয়মিত কাজে নিযুক্তির স্তরে তফসিলি-উপজাতি এবং মহিলাদের প্রতি বঞ্চনা শহরাঞ্চলের থেকে বেশি। গ্রামাঞ্চলে যেমন, মহিলাদের অর্জিত সামাজিক মূলধনের তাৎপর্য খুবই কম তাদের নিয়মিত কাজে নিযুক্তির ক্ষেত্রে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে সাধারণত পরিবারের কর্তা পুরুষটির শিক্ষার মান মহিলাটির থেকে বেশি হওয়ায় পুরুষটির তুলনায় মহিলাটির নিয়মিত কাজে নিযুক্তির সুযোগটাও কম। এখান থেকে স্পষ্ট যে আজকের ভারতবর্ষেও মহিলাদের নিয়মিত কাজে যোগদানের ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক রীতি নীতি ও সংস্কার কতটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
যদিও নিয়মিত কাজ ও স্বনিযুক্তির একটা সামগ্রিক বিশ্লেষণ থেকে সমীক্ষায় আবারও গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে যে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের অর্জিত সামাজিক মূলধনের তাৎপর্য তাদের আয়ের ক্ষেত্রে খুবই সামান্য, তবে তফসিলি জাতি ও উপজাতি এবং মুসলিম জনসংখ্যার ক্ষেত্রে তাদের অর্জিত সামাজিক মূলধনের প্রভাব তাদের আয়ের উপর অপেক্ষাকৃত বেশি।
শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া : বিরল এবং স্ববিরোধী এক কাণ্ড
মর্যাদাপূর্ণ জীবন পেতে হলে চাই সামাজিক গতিশীলতা। আর সেটা পেতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল শিক্ষিত হওয়া এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থান খুঁজে নেওয়া। লিঙ্গের প্রশ্নে বিষয়টা দেখতে গেলে, ২০০০’র দশকের গোড়া থেকে ভারতে যে প্রবণতাগুলো দেখা গেছে, তা শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক গতিশীলতা নিয়ে অদ্ভুত প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার (লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট ‘এলএফপিআর’) একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সূচক কারণ এটি বলে দেয় কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার মধ্যে থেকে ঠিক কতজন চাকরি খুঁজছেন। মহিলাদের কর্মীবাহিনীতে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা সমাজ পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণদ্যোতক (মার্কার), যেহেতু তারা ঐতিহাসিক ভাবেই ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থাকেন। ভারতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০০’র দশকের গোড়া থেকে মহিলাদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ক্রমশ কমছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘের ২০১৪’র এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে — ১৯৯৯-২০০০-এ মহিলাদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৩৪.১ শতাংশ; সেটাই কমে ২৭.২ শতাংশ হয়েছে ২০১১-১২-তে। এই দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে দেখা যাচ্ছে না, বরং সেখানে এই হার ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ভারতীয় মহিলারা ২০০৪-০৫ থেকে ২০১৭-১৮’র মধ্যে শিক্ষার স্তরে লিঙ্গবৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন; কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই একই সময়ে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য ক্রমশ বেড়েছে!
ঘরের চার দেওয়ালের গণ্ডি পেরিয়ে, উপার্জন করে স্বনির্ভর হওয়া — নৈব নৈব চ
উপরি-উল্লিখিত প্রবণতাগুলো থেকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণবিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে; এমন গুরুত্বপূর্ণ যা বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মহিলারা লড়েছেন সম্মিলিত এবং একক লড়াই, শিক্ষার আঙিনায় পৌঁছাতে যার দুয়ার তাদের জন্য রুদ্ধ ছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-রীতির দোহাই দিয়ে। বহু বছরের সংগ্রামের পর যখন ভারতীয় নারীরা চূড়ান্ত ভাবে শিক্ষাসহ কিছু সামাজিক পুঁজি অর্জনে লিঙ্গবৈষম্যকে দূরে ঠেলতে সক্ষম হলেন, তখনও রইলেন সেই শৃঙ্খলিতই!
শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারে প্রায় একই রকম লিঙ্গবৈষম্য রয়েছে সমস্ত জাতি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর এটা দুরপনেয় যদিও মহিলারা যথেষ্ট পরিমাণে সামাজিক পুঁজি অর্জন করতে পেরেছেন। কাজের লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের পিতৃতান্ত্রিক প্রথা এত শক্তিশালী, নারীকে ঘরে বেঁধে রাখার সামাজিক আচার অনুষ্ঠান এত কঠোর যে, যেসব মহিলা কিছু বস্তুগত অর্জনে সক্ষম হয়েছেন তাদেরও সেই বাধা ভেঙে বেরিয়ে আসতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
শিক্ষার সমস্ত স্তরে ও শাখায় মহিলাদের আরও বেশি অংশগ্রহণের জন্য যেমন লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, তেমনই সমাজ পরিবর্তনের চালিকাশক্তিগুলিকে এই সত্য মানতে হবে যে সংগ্রামকে কর্মস্থল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে।
গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, মর্যাদাপূর্ণ কাজ পাওয়ার সমস্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের কাজে যেতে বাধা দিয়ে ঘরে আটকে রাখা চলবে না।
আমাদের, সরকারকে এই সত্যটা স্বীকার করতে এবং মহিলাদের ঘরের চার দেওয়ালের বাধা ভেঙে কর্মীবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রোৎসাহন দিতে বাধ্য করতে হবে। আগামী কালের ভারত কেবলমাত্র তখনই গড়ে উঠতে পারে যখন নারীকে গার্হস্থ্য গণ্ডির মধ্যে একলা বন্দি রাখার বহু যুগের জীর্ণ প্রাচীন প্রথা-আচার-অনুষ্ঠান-সংস্কারকে আমরা উপড়ে ফেলতে পারব!
- অনুবাদক, জয়ন্তী দাশগুপ্ত
বর্তমান সময় বিশ্বের সর্বত্র গিগ ইকোনমির বৃদ্ধি ঘটছে। রাইড শেয়ারিং, ই-কমার্স, অনলাইন মার্কেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অ্যাপভিত্তিক নানা কাজে যুক্ত হচ্ছেন দেশের তরুণরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে গিগ অর্থনীতির দিক থেকে ভারত এবং বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। প্রযুক্তির ব্যাবহার, স্বল্প সময়ে পরিষেবা পাওয়ার অভ্যাস, জীবনযাত্রার গতির বৃদ্ধি মানবসভ্যতাকে যন্ত্র নির্ভরশীল করে তুলছে। এই সমস্ত কিছুর অন্তরালে অবিরত পরিশ্রম করা কর্মচারীদের জীবন-জীবিকা-ভবিষ্যৎ নিয়ে সমাজ তথা সরকার উদাসীন। এমতাবস্থায়, সাম্প্রতিককালে নিউজিল্যান্ডে বিশ্বখ্যাত কোম্পানি উবের বনাম চার কর্মচারীর মামলার রায় এক নয়া মোড় সৃষ্টি করেছে।
জুলিয়ান আং, নুরেদ্দিন আব্দুরহমান, প্রাফুল বিল রামা এবং মে’ওল কেইল — চারজন ইটিউ এবং ফার্স্ট ইউনিয়নের মাধ্যমে উবের কোম্পানিকে আদালতে নিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকাকর্মীর বদলে কর্মচারী হিসেবে সম্পূর্ণ পরিচয় লাভের জন্য। দেশের কর্মসংস্থান আদালত এই চারজন কর্মচারীর পক্ষে যুগান্তকারী রায় দেয়, যে তারা কোম্পানির কর্মচারী এবং স্বাধীন ঠিকাদার নয়। চালকরা নিজস্ব ব্যবসা চালাচ্ছেন না এবং তারা কার্যকরভাবে উবেরের কর্মচারী হিসেবেই কাজ করছেন বলেই রায় দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ক্রিস্টিনা ইঙ্গলিস। তার মতে, “উবারই একমাত্র দল যে ব্যবসা চালাচ্ছে। এই কোম্পানিই, বিপনন, মুল্য নির্ধারণ, রাইডার, রেস্তোরাঁ এবং ভোজনকারীদের দেওয়া পরিষেবার শর্তাবলী ও প্রকৃতি নির্ধারণের দায়িত্বে রয়েছে।” উবের কোম্পানি এই রায়ের বিরুদ্ধে অবিলম্বে অ্যাপিল করবে বলে ঘোষণা করেছে, যা নিউজিল্যান্ডের কর্মসংস্থান আইনের অধীনে চালকের ন্যূনতম মজুরি, কাজের সময়, ছুটির বেতন, অসুস্থ অবস্থায় ছুটি, অন্যায্য বরখাস্তকে চ্যালেঞ্জ করার অধিকারের বিরুদ্ধে।
ভারতবর্ষে করোনাকালীন সময়ে চাকরির বাজার যত সঙ্কুচিত হয়েছে ততই মানুষের পেটের দায়ে ও কাজের খোঁজে গিগ কাজের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কাজের ক্ষেত্রে, শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদণ্ড খুবই স্বল্প। জানতে হয় অ্যানড্রয়েড ফোনের ব্যবহার। এই কাজের পরিসর যত বড়, ততটাই অধিক সংখ্যায় তৈরি হচ্ছে সস্তার শ্রমিক। একাধিক সময়, সুইগি-জোম্যাটো-উবের তথা অন্যান্য কোম্পানির কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন অসুবিধা নিয়ে সরব হতে দেখা গিয়েছে। গিগ ওয়ার্কারদের কোম্পানির কর্মচারীর পরিচয় দেওয়া হয় না। তাদেরকে ফ্রিলান্সার হিসেবে কাজে নিযুক্ত করা হয়। পুঁজির সঞ্চয়ন ও মুনাফা বৃদ্ধির হারকে বজায় রাখতে সারপ্লাস ভ্যালু বা উদবৃত্ত মূল্যকে ক্রমাগত বাড়িয়ে চলতেই হয়। পারিবারিক যূথবদ্ধতাকে গ্রাস করে পুঁজি। কম খরচে বেশি পরিমাণ শ্রমিক তৈরির ছকে আসে প্রযুক্তি। কোনো কারখানা স্থাপন ছাড়া, নতুন পণ্য উৎপাদন ছাড়াও কেবল মাত্র প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধম্যে অ্যাপনির্ভর মার্কেটিং ও সার্ভিসে বিপুল বেকার বাহিনীকে মুষ্টিমেয় মজুরির বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ প্রদান করা হচ্ছে।
পুঁজির বিকাশের যুগে স্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিক এবং কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিভাজন তো ছিলই। উদার অর্থনীতির যুগে কল-কারখানা, শিল্পসংস্থা নানান জায়গায় ছোট ছোট আকারে ছড়িয়ে পড়ায় উদ্ভব হল পরিযায়ী শ্রমিকদের। তবুও এই অংশের একটা শ্রমিক পরিচয় (আইডেন্টিটি অফ লেবার) ছিল কোন-না-কোন উৎপাদনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে। কিন্তু গিগ ওয়ার্কাররা উৎপাদনের জগতে সরাসরি যুক্ত না থাকায় শ্রমিক পরিচয় ঘুচিয়ে কেবলমাত্র কর্মীবাহিনী হিসেবে চিহ্নিত হল। শ্রমিক নয় বলেই তাদের জন্য শ্রমকোডের কোন বালাই নেই; নেই সংগঠন করার অধিকার। কাজের নিশ্চয়তা ও চাকরি শেষে আর্থিক নিরাপত্তা — এইসব প্রশ্ন তোলা মানা। বরং প্রযুক্তির সাহায্যে সার্ভিলেন্সের মাধ্যমে এইসব কর্মীদের কাজের ওপর নজরদারি বাড়ানো হল। ঠিক সময়ে গরমাগরম খাবার খদ্দেরদের কাছে পৌঁছেছে কিনা, সঠিক সময়ে যাত্রীকে গাড়িতে তোলা — নামানো হচ্ছে কিনা, ইত্যাদি সব অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল বা কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগল। নিরাপত্তাহীনতা তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
কার্ল মার্ক্স পুঁজির নিজস্ব দ্বন্দ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণদিক তুলে আনার সময় বলেছিলেন, “শ্রমিক সংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি পুঁজির সঞ্চয়নের প্রয়োজনকে মেটাতে পারে না, অথচ এ সংখ্যা সবসময় সেই প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত, এটাই হলো পুঁজির গতিবিধির সহজাত দ্বন্দ্ব। পুঁজি চায় অধিকতর সংখ্যায় যুবক শ্রমিক, স্বল্পতর বয়স্ক শ্রমিক। পুঁজির দ্বারা শ্রমশক্তির ব্যবহার এত দ্রুত যে, জীবনের অর্ধেক পার হলেই শ্রমিক প্রায় তার গোটা জীবনীশক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলে। ফলে সে ওই অতিরিক্তদের দলে পড়ে যায়।”
আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ভারতের গিগ অর্থনীতি প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে যেখানে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান এই গিগ অর্থনীতিতে হচ্ছে, তা বেড়ে হবে ২.৪০ কোটি। আর আগামী আট থেকে দশ বছরের মধ্যেই প্রায় নয় কোটি মানুষ এই অর্থনীতির মধ্যেই কর্মসংস্থান পাবেন, কারণ মূলধারার অর্থনীতি আরও সঙ্কুচিত হবে ও সুরক্ষিত কর্মসংস্থান অতীতের বস্তুতে পরিণত হবে। ভারতের ক্ষেত্রেও ৪৮ শতাংশ গিগ কর্মী হল ১৯-২৫ বছর বয়সী নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, যাদের কাছে স্থায়ী চাকরির সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। আর এইক্ষেত্রে মহিলাদের সংখ্যা ২৮ শতাংশের আশেপাশে। যে সুদূর ভবিষ্যতের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি, তাতে শরীর-স্বাস্থ্যর তোয়াক্কা না করে কেবল দৌড়তে হবে। নাহলে পেটের দায়ে থেমে যাবে জীবনের স্পন্দন, মানবস্পন্দনকে কি চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে এনে ফেলছে এই গিগ ইকোনমি।
সরকার বারবার করে বলে চলেছে — গিগ প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক কর্মচারীদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চারটি শ্রম কোডের মধ্যে ‘সামাজিক সুরক্ষা আইন ২০২০’তে গিগ ওয়ার্কারদের সুরক্ষার নিদান দেওয়া আছে, যদিও তার নির্দেশনামার বাস্তব রূপরেখাই বানানো হয়নি। বিশ্বব্যাপী যে ঘৃণ্য পরিকল্পনা চলছে তার বিরুধে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ডের ঘটনা মার্কনির্দেশক। শ্রমিকের শ্রেণীর পরিচয় মুছে ফেলার যে চেষ্টা ক্রমাগতভাবে পুঁজিবাদী সংস্থাগুলি করে চলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা মজবুত হয়ে উঠবে। আজকে সমস্ত ঠিকা, পরিযায়ী ও প্ল্যাটফর্ম জগতের কর্মীদের নিয়ে সংগঠিত লড়াই গড়ে তুলতে হবে।
- অন্যন্যা
(এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় এআইসিসিটিইউ’র ফেব্রুয়ারি ২০২২ অনলাইন পত্রিকা ওয়ার্কার্স রেজিস্ট্যানস্’এ। লেখক উক্ত সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি ভি শংকর। অনুদিত এই লেখাটি এখানে প্রকাশ করা হল। — সম্পাদকমন্ডলী, দেশব্রতী)
২০২০’র প্রথম দিকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় মোদী সরকার গোটা দেশে যখন আচমকা লকডাউন ঘোষণা করল, তখন হাজারে হাজারে অসহায় দিগভ্রান্ত পরিযায়ী শ্রমিকেরা কয়েকশো কিলোমিটার পথ উজিয়ে নিজ নিজ বাসভূমে ফিরে আসার এক মরিয়া প্রচেষ্টা করেন। সরকারের কাছে যখন এই সমস্ত শ্রমিকদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়, সরকার তখন বলে যে তাদের কাছে এব্যাপারে কোনোই তথ্য নেই। সরকারের এই নির্লিপ্তির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তীব্র ক্ষোভকে সামাল দিতে মোদী সরকার দেশের সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে এক তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে ই-শ্রম পোর্টাল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল। এখন বোঝা যাচ্ছে, এই পোর্টাল তৈরি করে সমস্ত ধরনের কল্যাণ বোর্ডকে অবলুপ্ত করাটাই মোদী সরকারের আসল উদ্দেশ্য।
এখন পর্যন্ত ঘোষিত সুবিধা এটাই যে, ই-শ্রম পোর্টালে নথীভুক্ত অসংগঠিত শ্রমিকরা মৃত্যুকালে বা শারীরিকভাবে চিরদিনের জন্য অক্ষম হয়ে পড়লে ২ লক্ষ টাকা এবং আংশিক অঙ্গহানির জন্য ১ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ পাবেন। সরকারের বিভিন্ন মহল ও শ্রম মন্ত্রকের আধিকারিকগণ এই পোর্টাল সম্পর্কে হরেক ধরনের মিথ্যার বেসাতি নিয়ে হাজির হয়েছেন। যেমন, আমাদের শোনানো হচ্ছে এই ই-শ্রম পোর্টাল নাকি ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ’ করে দেবে, “এই পোর্টালে নথীভুক্ত হলে অনেক ধরনের সুযোগ সুবিধা পাওয়ার সিংহদরজা খুলে যাবে” আর এর হাত ধরেই প্রবেশ করা যাবে মোদীর স্বপ্নের জগতে।
ই-শ্রম পোর্টাল ডাহা এক মিথ্যার জাল বুনেছে। বলা হচ্ছে, এই পোর্টালে নথীভুক্তদের নানা সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পগুলোর অধীনে নিয়ে আসা হবে। যেমন — রেশন ব্যবস্থা, আয়ুষ্মান ভারতের অধীনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা — যা ইতিমধ্যেই কার্যকর রয়েছে। এটা প্রচার করা হচ্ছে, এই পোর্টাল নাকি কর্মসংস্থানের প্রকল্পগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন, নরেগা বা পিএমইজিপি (ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহদানের জন্য যেটা রয়েছে)।
কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত পুস্তিকায় ই-শ্রমের আসল উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সমস্ত ধরনের অসংগঠিত শ্রমিকদের তথ্য ভান্ডারই হয়ে উঠবে এই ই-শ্রম পোর্টাল। নির্মাণপরিযায়ী শ্রমিক থেকে শুরু করে গিগ ও প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক, হকার, গৃহ সহায়িকা বা পরিচারিকা, কৃষি শ্রমিক, নরেগার সাথে যুক্ত শ্রমিক, আশা-অঙ্গনওয়াড়ি-মিড ডে মিল কর্মী — সকলেই এর আওতায় আসতে পারবেন। ইতিমধ্যে এই পোর্টাল তার পরিধি আরো প্রসারিত করে ১২৬টি পেশাকে এরমধ্যে নিয়ে এসেছে। এখনো পর্যন্ত আওতাভুক্ত হয়নি এমন অন্যান্য পেশাকেও এরমধ্যে নিয়ে আসা যাবে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, নানান কল্যাণকর বোর্ডের কাছে ইতিমধ্যেই যে সমস্ত তথ্য গচ্ছিত রয়েছে, সেগুলো আবার সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরথেকেই এটা স্পষ্ট যে, শুধুমাত্র আগেকার তথ্যই নয়, বোর্ডগুলোকেও অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা হল।
যেকোনও অসংগঠিত শ্রমিক, যার বয়স ১৬- ৫৯’র মধ্যে, যিনি পিএফ-ইএসআই বা সরকারের অন্য কোনও পেনশন প্রকল্পের আওতায় নেই, ই-শ্রম পোর্টালে নাম নথীভুক্ত করতে পারেন। যেকোনও গৃহশ্রম ভিত্তিক কর্মী, স্বনিযুক্ত, অথবা অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরি প্রাপ্ত শ্রমিক এই পোর্টালে নথীভুক্ত হতে পারেন। ‘সংগঠিত ক্ষেত্রে’ কর্মরত শ্রমিক যার পিএফ-ইএসআই বা পেনশন নেই, তাকেও অসংগঠিত শ্রমিক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। পোর্টালে ‘অসংগঠিত শ্রমিক’দের এই সংজ্ঞা নিয়োগকর্তাকে এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল তার সংস্থায় কর্মরত কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষার দায় থেকে ঝেড়ে ফেলতে। এমনকি কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদেরও সমস্ত দায় থেকে নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলতে ই-শ্রম পোর্টাল একটা রাস্তা বাৎলে দিল। এই পোর্টাল ঘোষণা করেছে, ক্লারা (কন্ট্রাক্ট লেবার রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবোলিশন অ্যাক্ট, ১৯৭০) অধীনেই সে কাজ করছে, এমনকি ওই সমস্ত আইনের বাধ্যবাধকতা থেকে যেকোন সময়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বেরিয়ে আসার সুযোগও রেখে দিয়েছে এই পোর্টাল। সে নিজের উদ্দেশ্যকেও গোপন রাখেনি। পোর্টাল জানিয়েছে, নিয়োগকর্তা সম্পর্কেকোন তথ্য সে সংগ্রহ করবে না, করবে শুধুমাত্র শ্রমিকদের। এই তথ্য ভান্ডার তৈরি করার পথেও রয়েছে অনেক অন্তরায়। নথীভুক্তির জন্য যেগুলো অবশ্য প্রয়োজন, তা হল আধার কার্ড, আধার কার্ডের সাথে মোবাইল ফোনের নম্বর লিঙ্ক করানো, আইএফএসসি কোড সহ সেভিংস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নম্বর। বেশিরভাগ অসংগঠিত শ্রমিকদের মোবাইল আধারের সাথে লিঙ্ক করা নেই। আর, এটাই নথীভুক্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে থাকছে। সরকার বায়োমেট্রিকস’এর মাধ্যমে নথীভুক্তির যে কথা বলছে, তার ক্ষেত্রেও ইতিমধ্যে এসেছে অনেক বদল, যা এই পর্যায়ে পোর্টালে আপডেট করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, এই পোর্টাল জানিয়েছে, অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য যে সমস্ত সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পগুলো রয়েছে যা শ্রমমন্ত্রক সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর মাধ্যমে কার্যকরী হয়, সেই সমস্ত প্রকল্পগুলো এরপর থেকে ই-শ্রম পোর্টালের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হবে। তাহলে এটাই দাঁড়াচ্ছে, এরপর থেকে ই-শ্রম হল একমাত্র কার্যকরী পোর্টাল যার মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ সুবিধা অসংগঠিত শ্রমিকরা পাবেন, তাদের বোর্ড থাকুক বা না থাকুক। এর অর্থ হল, অন্যান্য সমস্ত বোর্ডগুলো এই প্রক্রিয়ায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। শ্রমমন্ত্রক থেকে প্রকাশিত পুস্তিকায় বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে এই পোর্টালের মাধ্যমেই সমস্ত সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ সুবিধাগুলো শ্রমিকরা পাবেন — সেটা অতিমারি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে সরকারের তরফ থেকে দেওয়া বিভিন্ন সাহায্য বা সুযোগ সুবিধাগুলোও।
তৃতীয়ত, কল্যাণ প্রকল্প এবং বোর্ডবা সামাজিক সুরক্ষা কোড কোথাও এটা উল্লেখ করেনি যে, বিভিন্ন কল্যাণ বোর্ডের হাতে যে কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে, তার ভবিষ্যৎ কি হবে। বোঝাই যাচ্ছে এরপর বিভিন্ন বোর্ডের হাতে গচ্ছিত কোটি কোটি টাকা লুঠ হয়ে যাবে। পিএফ-ইএসআই’র কাছে যে বিপুল টাকা রয়েছে, তার উপরও থাবা বসানোর আশঙ্কা নানান মহল থেকে করা হচ্ছে। বোর্ডগুলোর হাতে জনগণের যে টাকা গচ্ছিত রয়েছে, সেই তহবিলকে বেসরকারি বিমা সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত করতে ‘ফান্ড ম্যানেজমেন্ট’এর পরিকল্পনা সরকারের তরফ থেকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরেকটা বড় অভিযোগ সামনে আসছে, তা হল, এতদিন নানান কল্যাণমূলক বোর্ডযে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসতো, এখন ই-শ্রম হল এমন এক মাধ্যম যার সাহায্যে এই সমস্ত কিছুর উপর এবার কোপ পড়বে। আমরা সকলেই জানি বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ আইন হচ্ছে অন্যতম এক উন্নত আইন, যার বাসস্থান প্রকল্পটি বেশ ভালো। কিন্তু গত চার বছর ধরে মোদী সরকার এই আইনকে ঠান্ডা ঘরে নিক্ষিপ্ত করেছে। নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ বোর্ড’এর তহবিল তছরূপ করা হচ্ছে। সেই তহবিলের টাকা রাজ্যের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নানান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। অভিযোগ উঠেছে, কর্ণাটকের শ্রম কমিশনার শ্রম দপ্তরের সমস্ত শ্রম আধিকারিককে দামি ইনোভা গাড়ি উপহার দিয়েছেন। নির্মাণ বোর্ডে গচ্ছিত বিপুল তহবিল তছরূপ করেই এই অপকর্মটি করা হয়েছে। আরেকটা উদাহরণ হল সেস সংগ্রহের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া। নতুন আইনে ৫০ লক্ষ বা তার কম মূল্যের নির্মাণ কাজে সেস মুকুব করা হয়েছে।
নতুন সামাজিক সুরক্ষার ধারণা, যা সামাজিক সুরক্ষা কোডের মাধ্যমে হাজির করানো হচ্ছে, তা সরকার ও নিয়োগকর্তাকে স্বাস্থ্যবিমা (ইএসআই), অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা (পিএফ), গ্রাচুইটি, বাসস্থান ও সন্তানদের শিক্ষার দায় থেকে পুরোপুরি মুক্ত করেছে। নতুন কোড হরেক কল্যাণ বোর্ডগুলোকে বিমা কোম্পানি ও অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে বোঝাপড়া করিয়ে দেওয়ার সংস্থায় অধঃপতিত করেছে। একজন অসংগঠিত শ্রমিক ঠিক ততটাই সুবিধা পেতে পারেন যতটা পরিমাণে তিনি বিমা সংস্থার কাছে সেই বাবদ প্রিমিয়াম জমা করছেন। অর্থাৎ, সরকার বা নিয়োগকর্তার কাঁধ থেকে সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের পুরো দায়ভার এবার চালান করে দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের কাঁধে। ই-শ্রম পোর্টাল হল সেই লক্ষ্যেই প্রথম পদক্ষেপ।
ই-শ্রম পোর্টালের নেপথ্য রাজনীতি আমাদের কাছে এখন পরিষ্কার। কিন্তু তাই বলে সরকারের কাছ থেকে ছিটেফোঁটা যেটুকু সুবিধা শ্রমিকরা পেতে পারেন, সেখান থেকে তাদের আটকানো অনুচিত হবে। অনেক রাজ্যেই আমাদের কাজ অসংগঠিত শ্রমিকদের যে অংশের মধ্যে রয়েছে, সেই অংশটি কল্যাণ বোর্ডের সুযোগ সুবিধা পান না। সেই সমস্ত শ্রমিকদের ই-শ্রম পোর্টালে নথীভুক্ত করতে আমাদের অবশ্যই সাহায্য করতে হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সামাজিক সুরক্ষার দায় থেকে সরকার ও নিয়োগকর্তা নিজেকে যেভাবে সরিয়ে নিচ্ছে, সেটা আমরা সমালোচনা বা উদঘাটন করবনা। যদি ই-শ্রম পোর্টালটি শ্রমিকদের বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেওয়ার আরো একটি বাড়তি পোর্টাল হিসাবে সামনে আসতো, তবে তা নিয়ে আমাদের বিরোধিতা থাকত না। কিন্তু, তা হচ্ছে বর্তমানের বোর্ড, প্রকল্প ও সুযোগ সুবিধাগুলোকে বাতিল করেই।
সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলো লাগাতার দাবি জানিয়ে আসছে, সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি সরকার ও নিয়োগকর্তার একান্ত দায়বদ্ধতার মধ্যেই পড়ে। সামাজিক সুরক্ষা কোনও দয়া প্রদর্শনের বিষয় নয়। ঘন্টার পর ঘন্টা নিজেদের ঘাম-শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিকরা কোম্পানি, সমাজ ও সরকারের জন্য যে আত্মত্যাগ করে থাকেন, সামাজিক সুরক্ষা হল তারই এক স্বীকৃতি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল, সমস্ত বিদ্যমান সুযোগগুলোকে রক্ষা করে তার পরিধিকে প্রসারিত করে সমস্ত শ্রমিকদের তার আওতায় নিয়ে আসা। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের অধীনে নিয়ে আসতে হবে সমস্ত ধরনের কল্যাণকর ইস্যু — স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পিএফগ্রাচুইটি-পেনশন-অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা ও বাসস্থানের মতো বিষয়গুলোকে।
কমন সার্ভিস সেন্টার মারফত নথীভুক্তি সবচেয়ে বেশি — ১৪.৪ কোটি।
বিশ্বের ক্ষুদার্থ দেশগুলির মধ্যে বর্তমানে ভারতের স্থান ১০৭ নম্বরে। কোভিড পর্যায়ে মানুষ দেখেছে দেশ ও বিশ্বজুড়ে ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্র, মৃত্যু, হাহাকার। এই অবস্থার সুপরিবর্তন আনতে কেন্দ্রীয় সরকার গতবছর ও চলতি বছরের বাজেটে বৃদ্ধি করেছে স্বাস্থ্যখাতে বিলগ্নিকরণও। গত দু’বছরে রাজ্য সরকারও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে বৃদ্ধি করেছে বিলগ্নি।
বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকে শান্তিনিকেতন পৌরসভা সহ রয়েছে নয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত। কোপাই নদী পেরিয়ে কসবা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বিদ্যাধরপুর, গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষই চাষাবাদের উপর নির্ভরশীল। গ্রামের সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বর্তমানে ভ্যাক্সিনের দ্বিতীয় ডোজ ও বুস্টার দেওয়ার কাজ চলছে। সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কমিউনিটি হেল্থ অফিসার (সিএইচও) সম্পা দে জানান, “বিদ্যাধরপুর সংলগ্ন ৬টি গ্রামের মানুষ এই সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। অতীতে গর্ভবতী মহিলা, প্রসূতি মহিলাদের জন্য চালু হয়েছিল সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রটি। বর্তমানে পোলিও, টীকাকরণ, ৩০ বছরের উপর সকলের প্রেসার, ক্যান্সারের স্ক্রিনিংও করা হচ্ছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র।” গ্রামে-গ্রামে চলছে সর্বশিক্ষা অভিযান, কোয়েতপুকুর আদিবাসী গ্রামে অঙ্গনওয়ারী কর্মী লক্ষ্মীমণি কিস্কোর সেন্টারে বর্তমানে ২০ জন শিক্ষার্থী। গ্রামে ০-৬ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা এরচেয়ে বহু বেশি তবুও এত কম সংখ্যক শিশুতে এই জনকল্যাণ মূলক প্রকল্পগুলো সীমাবদ্ধ কেন তা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। বাঁধ নবগ্রাম হাইস্কুল, আশাদুল্লাপুর আদিবাসী প্রাইমারি স্কুলে নিয়ম করেই চলছে দুপুরের মিড-ডে-মিল। দুপুরের ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতে খুশি বাঁধ নবগ্রাম হাইস্কুলের ক্লাস ৮’র শুভ লোহার ও তার বন্ধুরা।
গ্রামগুলিতে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডও হয়েছে বহু মানুষের, বিনামূল্যে চিকিৎসাও হয়েছে বহু মানুষের জানালেন বাঁধ নবগ্রামের হাইস্কুল লাগোয়া মুদী দোকানের মালিক ভবতারণ পাল, চাষি আশিষ পাল অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে জানালেন “পরিবারে কারুর বড় কিছু হলে সেই ছুটতে হয় ১৩ কিলোমিটার দূরে সিয়ান হসপিটালে, খুব এমার্জেন্সি বা চেনাশোনা না থাকলে বিশ্বভারতীর পিএম হসপিটালে চিকিৎসা হয় না সবার, বেশি সুযোগ সুবিধাই ছাত্রছাত্রী বা বিশ্বভারতীর স্টাফদের জন্য। আবার এও ঠিক, পিএম হসপিটালেও সব চিকিৎসা হয় এমনটা নয়। গ্রামে সরকারি বা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও খুব একটা সচ্ছল নয় তাই প্রায়শই ভোগান্তিতে পরতে হয় আশেপাশের গ্রামের মানুষদের।”
শ্রীচন্দ্রপুর রেশন অফিসের মালিক নবকুমার ঘোষের থেকে প্রতি মাসে রেশন পায় ৬৭৬টি পরিবার। RKSY1, RKSY2, PHH, AYY কার্ডে সকলেই পাচ্ছেন নিয়মমতো রেশন। তবে নবকুমার বাবুর ক্ষোভ একটাই “আশেপাশে গ্রাম যেমন বিদ্যাধরপুর আদিবাসী পাড়া, কোয়েত পুকুর আদিবাসী পাড়া এবং গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির কিছু কিছু পাড়ায় ৯০ শতাংশ আদিবাসী পরিবারে নেই কেন্দ্রীর সরকারের NFSA কার্ড। ফলে তার সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।”
এই অসম বন্টন ও থেকে যাওয়া ভুলগুলোই হয়তো বিশ্ব দরবারে ভারতের স্থানকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। যা শুধু বোলপুর শান্তিনিকেতন ব্লকের কিছু গ্রামেই নয়, সারা দেশেরই ভিন্ন ভিন্ন স্থানে।
- অমিতাভ বিশ্বাস
কেরলে কর্পোরেট স্বার্থের সুরক্ষায় একই মঞ্চে মিলিত হলো সিপিএম আর বিজেপি। রাজ্য রাজধানী তিরুবনন্তপুরমের ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে ভিজিনজামে আদানি যে সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছেন, সেই প্রকল্প উপকূলবর্তী জনগণের ব্যাপক সংখ্যকের জীবন ও জীবিকায় প্রভূত বিপর্যয় ঘটানোয় তাঁরা ঐ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ স্থগিত করার দাবিতে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। আর ঐ আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে ল্যাটিন ক্যাথলিক চার্চ। তাঁদের প্রতিবাদ আন্দোলন ১০০ দিন পেরিয়ে গেছে এবং আন্দোলনের পরিণামে বন্দর নির্মাণের কাজ একরকম স্থগিত হয়েই রয়েছে। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকারের চালানো বিভিন্ন কৌশল এবং তাদের পুলিশ বাহিনী স্থানীয় জনগণ এবং মৎসজীবীদের আন্দোলনের পথ পরিত্যাগে সম্মত করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা বন্দর প্রকল্প থেকে ক্ষতিগ্ৰস্ত জনগণের বিরুদ্ধে পাল্টা সমাবেশের কর্মসূচিতে সামিল হলেন। সেই সমাবেশ থেকে আন্দোলনরত জনগণকে একরকম চোখ রাঙানি দিয়ে বলা হলো যে, আদানির বন্দর নির্মাণের পথ প্রতিবন্ধকতা মুক্ত না হলে রাষ্ট্র এবং প্রতিক্রিয়ার শক্তি একযোগে সেই বাধার মোকাবিলায় নামবে।
বন্দর নির্মাণ সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রতিবাদরত জনগণের বিরুদ্ধে ঐ পাল্টা সমাবেশ সংগঠিত হলো ১ নভেম্বর ২০২২। সমাবেশ সংগঠিত হল ‘ভিজিনজাম বন্দর সুরক্ষার কাউন্সিল’এর পতাকাতলে। সেদিনের কর্মসূচির অন্যতম কার্যক্রম ছিল ১৫ কিলোমিটারের লং মার্চ এবং তাতে অন্যান্যদের সঙ্গে অংশ নিয়েছিল সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্ৰেসের প্রতিনিধিবৃন্দ (২০১৫ সালে বন্দর নির্মাণের চুক্তি সম্পাদনের সময় কেরলে ক্ষমতায় ছিল কংগ্ৰেস)। সেদিনের পদযাত্রা থেকে আন্দোলনকারী মৎসজীবীদের বিরুদ্ধে শ্লোগান উঠল, নেতৃত্বদায়ী চার্চের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হলো, ক্ষতিগ্ৰস্ত জনগণ যে ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছেন সেগুলো নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করা হল না, যেকোনো মূল্যে বন্দর নির্মাণ সমাধার আওয়াজ সোচ্চারে ঘোষিত হল। লং মার্চেসিপিএমের তিরুবনন্তপুরম জেলা সভাপতি আনাভুর নাগাপ্পান এবং ঐ জেলার বিজেপি সভাপতি ভিভি রাজেশ উভয়েই তাঁদের ভাষণে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্রোধের প্রকাশ ঘটালেন। বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগ থেকে দূরত্ব রচনার প্রচেষ্টায় সিপিএম নেতা নাগাপ্পান বললেন, “এই প্রতিবাদ সংগঠিত করেছেন ভিজিনজামের স্থানীয় মানুষ যাঁরা আন্দোলন নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা কয়েকটি সম্প্রদায় ভিত্তিক সংগঠন ছাড়াও সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন...।” অর্থাৎ, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া উপকূলের জনগণ ও মৎসজীবীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ‘প্রগতিশীল’ লং মার্চের সংগঠক ছিল স্থানীয় জনগণ, আমন্ত্রিত হয়ে তাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন মাত্র। নাগাপ্পান আরও জানিয়েছেন, বিজেপি যেহেতু ঐ কর্মসূচি সংগঠিত করেনি, তাই “বিজেপি অংশগ্ৰহণ করবে বলে জানলেও আমরা অংশ নিতাম”। সাধারণ মানুষের চোখে কিন্তু আদানি-পন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর নির্দিষ্ট অভিসন্ধি কেন্দ্রিক সম্মিলন ছাড়া লং মার্চের সংগঠক তথাকথিত ‘কাউন্সিল’এর গঠনকে কল্পনা করা একরকম অসম্ভব। আর লং মার্চে অংশ নেওয়া বিজেপি নেতা ভিভি রাজেশ কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি ক্ষতিগ্ৰস্ত জনগণের আন্দোলনের বিরুদ্ধেই তোপ দাগলেন, “আন্দোলনটা প্রকল্প বানচাল করারই প্রচেষ্টা। বিজেপি ঐ প্রকল্পে সার্বিক সমর্থন দেবে”। এইভাবে, ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া জনগণের আন্দোলনের বিরোধী অবস্থান সিপিএম ও বিজেপিকে একসূত্রে বাঁধল। আদানির কোনো প্রকল্প থেকে জনগণকে যত ক্ষতিই স্বীকার করতে হোক না কেন, বিজেপি যে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। আর সিপিএম’ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে কর্পোরেট স্বার্থর পক্ষে দাঁড়াতে কোনো দ্বিধা দেখালো না।
উপকূল অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ এবং মৎসজীবীরা বিপন্নতার যে বৃত্তান্তকে তুলে ধরেছেন, রাষ্ট্র কি তার প্রতি সমব্যথী হয়ে সাড়া দিতে পারে না? বন্দরের নির্মাণ যে হাজার হাজার মৎসজীবীর জীবিকাকে ধ্বংস করেছে, উপকূলের তটভূমি সমুদ্র গ্ৰাসে বিলীন হওয়ায় শত-শত বসতবাড়ি যে সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে গেছে, বন্দর নির্মাণ পরিবেশের যে ক্ষতি করে চলেছে, তার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে কর্পোরেট সংস্থার পাশে দাঁড়ানোটাই কি সরকারের স্বাভাবিক রীতি হয়ে দেখা দেবে? নেতৃত্বদায়ী চার্চের মুখ্য ব্যক্তিত্ব ইউজিন এইচ পেরিইরা জানিয়েছেন, “প্রায় ৪০,০০০ মৎসজীবী তাঁদের জীবিকা হারালেও তা খতিয়ে দেখার কোনো প্রয়াসই রাষ্ট্র করেনি”। হাজার-হাজার মানুষের জীবিকা নষ্ট হয়ে যাওয়া, ঘরবাড়ি সমুদ্র গর্ভে হারিয়ে শত-শত পরিবারের এফসিআই’এর পরিত্যক্ত গুদামে থাকতে বাধ্য হওয়া, অনিশ্চিত ও উদ্বেগজনক ভবিষ্যত তাদের জীবনে চিরস্থায়ী হওয়া — এসবযে রাষ্ট্রের বিবেচনায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল তার পিছনে এই ধারণাই নির্ধারক হয়েছে যে, কর্পোরেট প্রকল্প জনগণের ক্ষতিসাধন করলেও তার রূপায়ণে সরকারকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে! এটা এখন প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা যে, উপকূলবাসীর জীবনে এত ক্ষতির কারণ মূলত বন্দর প্রকল্পে ব্রেকওয়াটার’এর নির্মাণ। এই ব্রেকওয়াটার হলো সমুদ্র বক্ষে নির্মিত পাথর প্রাচীর, জাহাজগুলোকে সমুদ্রের ঢেউয়ের আঘাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যেই যাকে তৈরি করা হচ্ছে। কী আদানি, কী বাম সরকার, কেউই এটার স্বীকৃতিতে রাজি নয়। ইউজিন এইচ পেরেইরার কথায়, “অনেক বিজ্ঞানী তাঁদের সমীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, ব্রেকওয়াটার’এর নির্মাণই সৈকত ক্ষয়ের কারণ। আদানি অনেক সংস্থাকে এনে আমাদের তোলা বিষয়গুলোকে ভুল প্রমাণ করতে চাইছে।...” আন্দোলনের নেতৃত্ব এই বিষয়টাকে খতিয়ে দেখার ওপর জোর দেওয়াতেই আদানি থেকে বিজেপি, সিপিএম আন্দোলনকারীদের বন্দর প্রকল্প এবং উন্নয়নের বিরোধী বলে দেগে দিচ্ছেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া জনগণ কিন্তু বলছেন যে, তাঁরা বন্দর প্রকল্প পরিত্যক্ত হওয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি। বন্দরের নির্মাণ পরিবেশের ক্ষতি করছে কিনা, সমুদ্র সৈকতের ধ্বংসসাধন করছে কিনা, তার অনুসন্ধানের জন্য এই বিষয়ে পারদর্শী সংস্থাকে নিয়োগ করা হোক। আর যতদিন ঐ সংস্থা সমীক্ষা শেষ করে রিপোর্ট না দিচ্ছে ততদিন বন্দর নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখা হোক। এই প্রস্তাবে সম্মত হতে সরকার একেবারেই নারাজ। আন্দোলনের নেতৃত্ব জানিয়েছেন, এই বিষয়টির সমীক্ষায় তাঁরা সাত সদস্যের এক কমিটি তৈরি করেছেন যারা তিন মাসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দেবে। সেই রিপোর্টে ব্রেকওয়াটার’এর নির্মাণের ফলাফল নিয়ে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য সমর্থিত হলে তাকে মেনে নেওয়ার মত মনের প্রসারতা কি বাম সরকার দেখাতে পারবে?
সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকার হয়তো ভেবেছিল যে, তারা নরমে-গরমে আন্দোলনের নেতৃত্বকে প্রতিবাদের পথ থেকে সরিয়ে দিতে সফল হবে। কিন্তু বিপর্যয়গ্ৰস্ত জনগণ আন্দোলনের পথে অবিচল থাকায় সিপিএম নিজেদের শুধু আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ হিসাবেই দাঁড় করালো না, তাদের কলঙ্কিত করতেও উঠেপড়ে লাগল। আন্দোলনকারী জনগণ এবং নেতৃত্বদায়ী চার্চের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঢল নামালো, যাতে সহযোগী হলো কিছু কর্পোরেট মিডিয়া। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হল যে, বন্দর নির্মাণকে বানচাল করতে তারা অবৈধ পথে জোগাড় করা ১১ কোটি টাকার বিদেশি অর্থকে কাজে লাগাচ্ছ; দাঙ্গা বাধানোর ভিত্তিহীন অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে তোলা হল; আরও বলল যে, আন্দোলনকারীরা এমন গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে যাদের ‘গোপন অভিসন্ধি’ রয়েছে। সেই অভিসন্ধিকে স্পষ্ট না করলেও আদানির বন্দর প্রকল্পের মধ্যে নিহিত উন্নয়নের বরবাদ হওয়ার সম্ভাবনাকেই সম্ভবত বুঝিয়েছেন। কেরলের ভিজিনজামে আদানির বন্দর প্রকল্প এইভাবে পরিস্থিতিতে দুটি বিকল্পকে তুলে ধরেছে — উপকূলবাসী ও মৎসজীবীরা কি চিরাচরিত পথে উপকূল কেন্দ্রিক জীবনধারাকে অনুসরণ করতে পারবেন, নাকি তাঁদের তথাকথিত উন্নয়নের নিমিত্তে উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে হব। আন্দোলনের ১০০ দিন পূর্ণ হওয়ার সময় মৎসজীবীরা ক্রোধে তাঁদের জীবিকার উপকরণ নৌকো ও জালে আগুন ধরিয়ে দেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক মহিলা সেদিন বলেন, “উপকূল না থাকলে আমাদের জীবনও থাকে না। আমরা আমাদের জীবিকার সরঞ্জামগুলোতেই আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি। বন্দরের সৃষ্টি হলে আমরা চিরদিনের মতো উপকূলকে হারিয়ে ফেলব।” বন্দর নির্মাণের পরিণামে উপকূলের ধ্বংস হওয়াকে প্রতিহত করে উপকূলবাসীদের কাছে তটভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা কি কেরলের সিপিএম নেতৃত্ব ভাবতে পারেন না? ফ্যাসিবাদকে রোখার জন্য আদানি, বিজেপি এবং উন্নয়নের চলতি মডেলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধটা একান্ত আবশ্যক — এটাও কি এক অপরিহার্য বামপন্থী বোধ নয়?
- জয়দীপ মিত্র
এই প্রতিবেদন রচনাকালে নভেম্বরের ৬ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, মিশরের পর্যটন নগরী শার্ম এলশেখে। এটি ২৭তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। প্রথমবার ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিন শহরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এটি হয়ে থাকে। এর আগের ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনটি হয়েছিল ২০২১ সালের নভেম্বরে, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে।
এই সম্মেলনের মূল কাজ হল বিশ্ব উষ্ণায়ন (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য সঙ্কটগুলির মোকাবিলা করার ব্যাপারে ১৯৭টি দেশ ও অঞ্চলকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা। প্রতিটি জলবায়ু সম্মেলনেই কিছু না কিছু নতুন বিষয় সামনে আসে। অতীতের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনগুলিতে সবমিলিয়ে প্রায় গোটা চব্বিশেক গুরুত্বপূর্ণবিষয় আলোচিত হয়েছে। প্রথম দিকে এই সম্মেলনগুলিতে আলোচনার মূল বিষয় ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাকে থামিয়ে বা কমিয়ে দেওয়া বা প্রশমন (মিটিগেশন) করার উপায়। কিন্তু দ্বিতীয় দশকে এসে আইপিসিসি চতুর্থ মূল্যায়ন রিপোর্ট পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় শুধু প্রশমন প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। এরপর থেকে আলোচনায় প্রশমনের পাশাপাশি গুরুত্ব পেল জলবায়ু অভিযোজন (অ্যাডাপটেশন)।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের নানা দেশই কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগী হচ্ছে না। বিশেষ করে উন্নত বা সম্পদশালী দেশগুলো এ’ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আবার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ঠিকমতো অভিযোজন করতে পারছে না। মূলত সম্পদের স্বল্পতা এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার এও দেখা যাচ্ছে যে পর্যাপ্ত পরিমাণে অভিযোজনের দিকে না এগনোয় কিছু অভিযোজন করার পরও তারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত সম্পদশালী দেশগুলোর জোট জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার দেশগুলোর অভিযোজনের জন্য এর আগে অ্যাডাপটেশন ফান্ড, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড ইত্যাদি নামে তহবিল তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুত অর্থের খুব সামান্যই দিয়েছে বিভিন্ন জলবায়ু তহবিলে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ থেকে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতিকে লস অ্যান্ড ড্যামেজ বলা হয়। যেমন ঘূর্ণিঝড়, খরা, তাপপ্রবাহ, মরুকরণ, লবণাক্ততা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি। সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও অর্থনীতি বহির্ভূত ক্ষয়ক্ষতি, যেমন পরিবেশ বা প্রতিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি, বাস্তুচ্যুতির কারণে সামাজিক ও মানসিক ক্ষতি — এসবই লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের মধ্যে পড়ে। ফেব্রুয়ারি ২০২২এ প্রকাশিত আইপিসিসি’র ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা ক্রমেই বেড়েছে। ফলে ধীরগতির দুর্যোগ, যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, মরুকরণ ইত্যাদিও বাড়বে। কৃষি, বনায়ন, মৎস্য, পর্যটনসহ বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো, সম্পদ ও সরবরাহব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অর্থনৈতিক ও অর্থনীতি বহির্ভূত ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন, জীবিকা ও খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বাস্তুচ্যুতি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হবে।
লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় প্রাপ্ত অর্থদিয়ে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মতামতের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করলে জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতিকে মোকাবিলা করা সহজ হবে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষকদের জন্য বিরূপ আবহাওয়ার ক্ষতি মোকাবিলায় শস্যবিমা, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিকাঠামো পুনর্নির্মাণ, জীবিকা পুনরুদ্ধার, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ সহায়তা ইত্যাদি সবই সম্ভব হবে লস অ্যান্ড ড্যামেজের ফান্ড থেকে। এমনকি এই লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড থেকে স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসন এবং নতুন জীবিকা অনুসন্ধানে সহায়তা করা যাবে।
বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করেই ২০০৭ সালে ১৩তম জলবায়ু সম্মেলনে বালি কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ আনুষ্ঠানিক আলোচনায় আসে। পরে ২০১০ সালে ১৬তম জলবায়ু আলোচনায় লস অ্যান্ড ড্যামেজের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে দোহায় ১৮তম জলবায়ু আলোচনায় ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় লস অ্যান্ড ড্যামেজের অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য আলোচনা হয়। তবে সত্যিকারের উদ্যোগটি ঘটে ২০১৩ সালের জলবায়ু আলোচনায়। সেখানে সব পক্ষ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা কমিয়ে আনা এবং বন্ধ করার জন্য ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম (ডব্লিউআইএম) ফর লস অ্যান্ড ড্যামেজ নামক একটি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে একমত হয়। আর ২০১৫ সালে ১৯তম জলবায়ু আলোচনায় প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৮এ লস অ্যান্ড ড্যামেজের আওতায় ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে পরিকল্পনার একটি কার্যকর ধারণা দিয়েছে। আমরাও অনেক আশাবাদী হয়ে উঠলাম। তবে পরের জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে কার্বন উদ্গিরণের জন্য দায়ী ধনী এবং সম্পদশালী দেশগুলো ক্ষয়ক্ষতির ঐতিহাসিক দায় তাদের ঘাড়ে আসতে পারে ভেবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের আলোচনা আর বেশি দূর এগোতে দেয়নি।
লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের বিষয়ে এযাবৎ দৃশ্যমান বড় কোনো অগ্রগতি না হলেও এই ইস্যু চলমান ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হবে। লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংকে একটি সুনির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্কের উদ্যোগে ৪০০’র বেশি সংগঠন গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে। এই সমস্ত দাবির কতটা পূরণ হয় ও এই সম্মেলন থেকে জলবায়ু সঙ্কটের সমাধানে কোন দিশা উঠে আসে, তাই নিয়ে পরিবেশবিদ থেকে সাধারণ মানুষের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।
- সৌভিক ঘোষাল
তিনি বিশ্বের এক নম্বর ধনকুবের। অঢেল তাঁর সম্পত্তি। প্রবল প্রতাপ ও দাপট। তিনি মাত্র ৫৫ বছর বয়সেই টেসলা, স্পেস এক্স, বোরিং কোম্পানি’র মতো দৈতাকৃতি সংস্থাগুলোর কর্ণধার হয়ে বসে রয়েছেন। তিনি এলন মাস্ক। চুয়াল্লিশ বিলিয়ন ডলারে তিনি এবার কিনে নিলেন টুইটার। আর, কেনার পর বেশ নাটকীয় মেজাজে হাতে একটা সিঙ্ক (বেসিন) নিয়ে সটান হাজির হলেন টুইটারের সান ফ্রান্সিসকোর সদর দপ্তরে। কেনার পরই শুরু করলেন দক্ষযজ্ঞ। নির্বিচার ছাঁটাই। প্রথমেই কোপ পড়ল ভারতীয় বংশোদ্ভূত টুইটারের সিইও পরাগ আগরওয়ালের উপর। তারপর সারা বিশ্বে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪,০০০ কর্মীকে ছাঁটাই করলেন। ভারতে দিল্লী-বেঙ্গালুরু-মুম্বাইস্থিত অফিসগুলোতে কোপ পড়ল ৯০ শতাংশ ভারতীয় কর্মীর উপর। সেই চির পুরাতন কর্পোরেট বাহানা — সংস্থার রুগ্ন স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার করতেই নাকি অনিবার্য এই ছাঁটাই’য়ের দাওয়াই। শোনা যাচ্ছে, এই সংস্থাটি কিনতে ব্যাঙ্কগুলোর কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ নিতে হয়েছে মাস্ক’কে। তখনই তিনি জানিয়েছিলেন, কর্মীসংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় কমিয়ে লাভজনক করার পদক্ষেপ তিনি নেবেন। ছাঁটাই’এর পর্ব সবে শুরু হয়েছে। এটা থামবে কোথায় তা আমরা কেউই জানি না।
কিছুদিন আগে তাঁর করা একটি টুইট থেকে জানা যাচ্ছে, টুইটার প্রতিদিন চার মিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সান্ত্বনা দেওয়ার ঢঙে সেই টুইটে যোগ করেছেন, যাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে তাদের তিন মাসের বিদায়ী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তার মতে এটা নাকি যা দেওয়ার কথা তারথেকে অনেক অনেক বেশি। লাভজনক করার লক্ষ্যে টুইটার এবার থেকে ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টের জন্য মাশুল ধার্য করার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। ভারতে তা এখনই লাগু না হলেও অদূর ভবিষ্যতে তা চালু হয়ে যাবে। এবার, টুইটারের পদাঙ্ক অনুসরণ করল ফেসবুকের পেরেন্ট সংস্থা মেটা। সেখানেও বিরাট সংখ্যক কর্মীকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। জানা গেল সংস্থার ১৩ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ হাজার কর্মীকে প্রথম পর্বে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে, আজ ইউরোপ দেখছে ধর্মঘটের ভূত। প্রায় সমস্ত ইউরোপীয় দেশগুলোতে সর্বস্তরের শ্রমিক কর্মচারীদের সর্বাত্বক ধর্মঘট জনজীবনকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। সংকটাপন্ন নয়া উদার অর্থনীতি গোলকধাঁধায় খাবি খেতে খেতে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে। আর, সেই সংকটের বোঝা চালান করা হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির ঘাড়ে।
অর্থনৈতিক উদারীকরণের যুগে সারা ভারতে (কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয়) বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিক কত শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন তার হিসাব কোনো রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমমন্ত্রকও দিতে পারবে বলে মনে হয় না। কোভিডও কি বিপুল মানুষের রুটি রুজি কেড়ে নিয়েছে, সে সম্পর্কে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা চালিয়েছে। আইএলও তার রিপোর্টে এ’সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করলেও ভারত সরকার আজও জানায়নি ঠিক কত শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন।
শোনা যাচ্ছে মাস্ক টুইটার অধিগ্রহণের আগেই টুইটার বিশাল কর্মী ছাঁটাই’এর একটা পরিকল্পনা করেছিল। এই কর্মী ছাঁটাই’এর ফলে নাকি টুইটার কোম্পানি প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার বা তার বেশি খরচ কমাতে পারত। অর্থাৎ লাভ করার অছিলায় এই ধরনের ছাঁটাই করা হচ্ছে।
সুতরাং ছাঁটাইয়ের আসল কারণ হল মুনাফা বাড়ানো। কত বাড়ানো? এর কোনো নির্দিষ্ট উত্তর নেই, কারণ মালিকের লোভের কোনো শেষ নেই। যেকোনো স্তরের কর্পোরেট কর্মচারীই জানেন, আজকাল পরের আর্থিক বর্ষের ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয় আগের বছরের মুনাফা অনুযায়ী। আগেরবারের চেয়ে বেশি মুনাফা না করা গেলেই হিসাবে ক্ষতি লেখা হয়। অর্থাৎ লাভ-ক্ষতির সংজ্ঞাই বদলে ফেলা হয়েছে পুঁজির হাঙরদের ক্ষিদে মেটানোর জন্য।
ইলন মাস্ক’এর মতো অতি বৃহৎ কর্পোরেট মালিকও নয়া উপনিবেশের ব্যবস্থার খেলোয়াড় মাত্র। এক সময়ের crowd funding’এর মহানায়ক (খান একাডেমিকে ৫ বিলিয়ন ডলার দিয়েছিল) এখন ৫০ শতাংশ লোক ছাঁটাই করছে, তৃতীয় বিশ্বের অফিসগুলো তুলে দিচ্ছে। যেগুলো দেখতে পাই না, তা হচ্ছে মাসিক ৮ ডলার দিয়ে কোনো তৃতীয় বিশ্বের গ্রাহক একাউন্ট কিনবেন না। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্ব এবার থেকে প্রথম বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে গেল। এদিককার খবর প্রথম বিশ্বের কাছে পৌঁছুবে না, উল্টোটাও হবে না।
এবার কর্পোরেট কোম্পানিগুলো শুরু করেছে কৃত্রিম মেধার প্রযুক্তি। যাতে কর্মচারী আরও কম লাগে অর্থাৎ অনেক কাজ একজন কি দু’জন কর্মচারী করে ফেলতে পারে এবং তারফলে মালিকপক্ষ আরও লাভ করতে পারে।
এটা শোনা যাচ্ছে মাস্কের আরেকটি সংস্থা টেসলার শেয়ারহোল্ডাররা সেই সংস্থা থেকে মাস্কের বার্ষিক বিপুল পে প্যাকেজ ৫,৬০০ কোটি ডলারের উপর প্রশ্ন তুলে মামলা দায়ের করেছে মার্কিন আদালতে।
“যে মুহূর্তে মেশিনারি একটি নির্দিষ্টি শিল্পশাখার শ্রমিকদের মুক্ত করে দেয়, সেই মুহূর্তে এই প্রতীক্ষমান কর্মপ্রার্থী মানুষগুলো ছড়িয়ে পড়ে কর্ম-সংস্থানের নতুন নতুন প্রবাহে এবং অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় অন্যান্য শাখায়। ইতোমধ্যে এই অতিক্রমণের কালে যে শ্রমিকেরা গোড়ায় বলি হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই উপোস করে থাকতে থাকতে শেষ হয়ে যায়” — কার্ল মার্ক্স
- অর্ণব মুখার্জী
== 0==