রাশিয়ায় প্রায় পাঁচশো বছর ধরে, তৃতীয় ইভানের (১৪৪০-১৫০৫ সাল) আমল থেকেই চালু ছিল জারের শাসন। দেশের অধিকাংশ ভূমি এবং সম্পদ জার, তার পরিবার ও অনুচরদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। আর কোটি কোটি জনসাধারণ বাস করত উপযুক্ত শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য, বিশ্রাম বিহীন অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে।
জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের (১৮৫৫ থেকে ১৮৮১) আমলের আগে থেকেই রাশিয়া একের পর এক কৃষক বিদ্রোহে আলোড়িত হচ্ছিল। ছাত্র-যুব এবং জনগণের প্রগতিশীল অংশ সামন্ততন্ত্র এবং জার শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল এবং তা প্রায়শই ব্যক্তিহত্যার পথ বেছে নিত। জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ ও ঘৃণার বাতাবরণে ভরা রাশিয়ায় লেনিন বেড়ে উঠছিলেন। লেনিন অবশ্য নারদনিকদের ব্যক্তিহত্যার পথ একেবারেই সমর্থন করেননি। তিনি মার্কসবাদের এক স্বতন্ত্র পথে জারতন্ত্রের অবসানের কথা ভেবেছিলেন, যা বলশেভিক মতবাদ হিসেবে বিখ্যাত।
রাশিয়ায় জার-বিরোধী আন্দোলন সেই উত্তুঙ্গ পর্বে নানা মতবাদ পরস্পরের সাথে বিতর্কের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। কখনো কখনো তারা পরস্পরের কাছাকাছি আসছিল, আবার তীক্ষ্ণ বিতর্ক কখনো কখনো তাদের পরস্পর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় জারের নিয়ন্ত্রণাধীন পার্লামেন্ট বা দ্যুমা প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে রাশিয়ায়। এগুলির মধ্যে চরম জার সমর্থক বা জারিস্টরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল মধ্যপন্থী অক্টোব্রিস্টরা, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাদেতরা। আর ছিল জার শাসনের বিরোধী নারোদনিকদের উত্তরসূরী সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারী (SR) এবং রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি (RSDLP) যা কালক্রমে লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক ও মার্তভের নেতৃত্বাধীন মেনশেভিক দুভাগে ভাগ হয়ে যায়।
রাশিয়ায় ১৯১৭ র নভেম্বর বিপ্লবের বারো বছর আগে ১৯০৫ সালে যে বড়সড় বিপ্লব হয় এবং তার ফলেই রাশিয়ায় জার বাধ্য হন জনগণের ভোটাধিকারে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমুলক একটি সংসদীয় ব্যবস্থা (রাশিয়ান দ্যুমা) প্রবর্তন করতে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরেই প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে পিছু হটার একটা পর্ব শুরু হয়। ইউরোপের বিভিন্ন সমাজ গণতান্ত্রিক দলগুলো নিজ নিজ দেশের যুদ্ধ-স্বার্থ তথা জাতীয় বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে যায়, কেননা শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন দল নিজ নিজ দেশের পুঁজির স্বার্থে পরস্পরের শত্রুশিবিরে দাঁড়িয়ে যায়। দেশ বিদেশের প্রতিকুল স্রোত এবং অজস্র ধরপাকড় অত্যাচার নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েও বলশেভিকরা তাদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থানে অটুট থাকে। লেনিনের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কর। তিনি বললেন অপর দেশের যে সমস্ত মজুরি-দাসেরা আমাদের ভাই তাদের বিরুদ্ধে নয়, অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরতে হবে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে। বলশেভিকরা যুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই দৃঢ়ভাবে এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা করে যে শান্তির আহ্বান রাখে তা রাশিয়ার বুকে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। যুদ্ধের ফ্রন্টে পরাজয়, ধ্বংস ও দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে উদঘাটিত হয়ে উঠল জারতন্ত্রের পচন।
১৯১৭-র প্রথম থেকেই পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। রক্তাক্ত রবিবারের বার্ষিকী পালনের দিনটিতে পেত্রোগাদ, মস্কো, বাকু, নিজনি সহ রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বিরাট বিরাট মিছিল হয়। দিন দিন বেড়ে উঠতে থাকে শ্রমিকদের বিক্ষোভ আন্দোলন। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বলশেভিক পার্টির আহ্বানে রাশিয়ার শ্রমিকেরা একটি রাজনৈতিক সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই আহ্বান অভূতপূর্ব সাফল্যলাভ করে এবং এতে যোগ দেয় দুই লক্ষের বেশি শ্রমিক নারী-পুরুষ। রাষ্ট্রীয় দুমার প্রতিনিধিরা জারের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে সিংহাসন ত্যাগ করতে বলে। সেনাবাহিনীর থেকে কোনও আশ্বাস না পেয়ে জার দ্বিতীয় নিকোলাস পালিয়ে যান। জার স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়। রাশিয়ায় সম্পন্ন হয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। জারতন্ত্রের উচ্ছেদের সাথে সাথেই শুরু হয় সাময়িক বিপ্লবী সরকার গঠন, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, আট ঘণ্টার কর্মদিবসের প্রবর্তন, জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্তকরণ ও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি।
বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে দেখা দেয় শ্রমিক ও সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলি। এই সোভিয়েতগুলিতে মেনশেভিক এবং এসআর বা সোশালিস্ট রিভোলিউশনারীরাও ছিল। তাদের অবস্থানগত দৌর্বল্যের সুযোগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দখল নিতে পারে বুর্জোয়ারাই। রাশিয়ায় এক দ্বৈত ক্ষমতার সৃষ্টি হয়। সাময়িক কেন্দ্রীয় সরকারের বুর্জোয়া আধিপত্য এবং এলাকায় এলাকায় সোভিয়েতগুলির ক্ষমতার মধ্যে দিয়ে প্রলেতারিয়েত ও কৃষকদের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক শক্তির আধিপত্য। বিপ্লবের ফলে দেশে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। স্বৈরতন্ত্রের অবসান হল। ঘোষিত হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্র প্রকাশ, সভা সমাবেশ ইত্যাদির স্বাধীনতা।
জারতন্ত্রের পতনের পর যে বুর্জোয়া সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় তা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিলেও যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিল না। লেনিন এই পরিস্থিতিতে বলশেভিকদের কার্যপ্রণালী নির্ধারণের জন্য বিকশিত ও বিকাশমান দিকগুলির বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন বিপ্লবের প্রথম পর্যায়টিই কেবল সমাপ্ত হয়েছে এবং তার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা গেছে বুর্জোয়াদের হাতে। তিনি স্লোগান তুললেন সোভিয়েতগুলির হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দেবার জন্য। ‘এপ্রিল থিসিস’ নামে বিখ্যাত রচনায় এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও প্রয়োজনীয়তা হাজির করেন লেনিন। বলেন ক্ষমতা যাওয়া চাই শ্রমিক শ্রেণি ও গরিব কৃষকের হাতে। সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে, সাময়িক সরকারকে কোনও সমর্থন নয় – এই রণধ্বনি তিনি স্থির করেন। তিনি বোঝালেন কেবল সোভিয়েতগুলির রাজই পারে জনগণের জন্য শান্তি, কৃষকদের জমি এবং ক্ষুধিতদের রুটি দিতে।
কার্নিলভের বাহিনীর প্রতিবিপ্লবী সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শ্রমিক জনগণের সংগ্রামে বলশেভিকরা নেতৃত্ব দেয়। কয়েকদিনের মধ্যেই কার্নিলভ বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। এই বিজয়ের মধ্যে দিয়ে জনগণের ব্যাপক অংশ সবেগে বাঁক নিতে শুরু করল বলশেভিকদের দিকে। সোভিয়েতগুলির পুনঃনির্বাচনে বলশেভিকরা পেতে থাকল অধিকাংশ ভোট। পেত্রোগ্রাদ, মস্কো সহ দেশের অধিকাংশ গুরূত্বপূর্ণ সোভিয়েত হয়ে উঠল বলশেভিক।
পেত্রোগ্রাদ দখল ও বিপ্লবের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রচনা করা হয়। সেই অনুযায়ী ৭ নভেম্বর সকালে অভ্যুত্থানকারীদের দখলে যায় টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ভবন, রেডিও স্টেশন। নেভার ওপরের সব রেলসেতু, রেল স্টেশন এবং রাজধানীর অতি গুরূত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান। ৭-৮ নভেম্বর ১৯১৭ মধ্যরাত্রের পর অভ্যুত্থানীদের হাতে এলো প্রধান ডাকঘর, নিকলায়ভস্কি স্টেশন আর বিদ্যুৎ স্টেশন। সকালে নৌ-বহরের নাবিকরা দখল করল রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক। ৮টায় দখল হল ওয়ারশ স্টেশন। যুদ্ধ জাহাজ ‘অরোরা’ এসে দাঁড়াল শীতপ্রসাদে কামান দাগার আওতার মধ্যে। সকালের মধ্যেই পেত্রোগ্রাদ শহর চলে এলো অভ্যুত্থানকারীদের হাতে। ৮ নভেম্বর ১৯১৭ সকালে সামরিক বৈপ্লবিক কমিটি গ্রহণ করল লেনিনের আবেদন – রাশিয়ার নাগরিকদের প্রতি সেখানেই ঘোষিত হল সাময়িক সরকারের উচ্ছেদ ঘটেছে।
‘আরোরা’ থেকে শীত প্রাসাদে গোলাবর্ষণ শুরু হল, সাময়িক সরকারের প্রধানমন্ত্রী কেরেনস্কির পালিয়ে গেলেন। রাত ১০টা ৪০ মিনিট সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ভরা জোয়ারে স্মোলনিতে শ্রমিক ও সৈনিকদের দ্বিতীয় সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেসের উদ্বোধন হল। ৯ নভেম্বর ১৯১৭ রাত ২টা ১০ সাময়িক সরকারের মন্ত্রীরা গ্রেপ্তার হলেন। ১০ নভেম্বর ১৯১৭ ভোর ৫টা ১৫ মিনিট শেষ হল সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেস। ঘোষিত হল শান্তির ডিক্রি, ভূমির ডিক্রি, বলা হল – অবিলম্বে জমির ওপর জমিদারি মালিকানা উচ্ছেদ হবে। গঠিত হল বিশ্বের প্রথম শ্রমিক-কৃষকের সরকার, জন কমিশার পরিষদ। লেনিন নির্বাচিত হলেন তার প্রধান। জন্ম হল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের। পেত্রোগ্রাদের পর মস্কো সহ রাশিয়ার অন্যান্য শহর ও অঞ্চল ক্রমশ বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে।
বিভিন্ন ডিক্রি জারি করে জনগণের দীর্ঘকালীন দাবি দাওয়াগুলির সমাধানের কাজ শুরু হয় সরকার প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই। জমি, শান্তি ও রুটির শ্লোগানে বলশেভিকরা জনগণকে সংগঠিত করেছিল। নতুন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল জমি ও শান্তির জন্য ডিক্রি জারি করা। ‘শান্তির ডিক্রি’র মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য অবিলম্বে শান্তি আলোচনা শুরুর ডাক দেওয়া হয়। ‘জমির ডিক্রি’র মাধ্যমে খোদ কৃষককে জমির ওপর অধিকার প্রদান করা হয়। এরপর একে একে জারি করা অন্যান্য ডিক্রিগুলো ছিল আট ঘণ্টা শ্রমসময়, শ্রমিকদের হাতে কারখানার নিয়ন্ত্রণ, শ্রেণিভেদ ও সামাজিক মর্যাদাভেদ নিষিদ্ধকরণ, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, সেনাবাহিনীতে কর্মরত সমস্ত সেনার সমান অধিকার প্রদান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, অবৈতনিক চিকিত্সা ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের নতুন ইউনিয়ন গঠন ইত্যাদি সম্পর্কিত।
প্রথম কয়েক বছর অবশ্য বলশেভিক সরকারের সামনে নানা ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক চ্যালেঞ্জ আসতে থাকে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল, যেমন মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভেলিউশনারিরা শান্তির লক্ষ্যে অপরিহার্য ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তির মারাত্মক বিরোধিতা করে। বলশেভিকদের মধ্যেও বুখারিনের নেতৃত্বে রেড কমিউনিস্টরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। অবশেষে জার্মানির সঙ্গে শান্তিচুক্তি হলেও বলশেভিকদের দীর্ঘস্থায়ী স্বস্তি মেলেনি। তবে অনেক জায়গাতে তাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। ১৯১৮ থেকে ১৯২০ অবধি পরের তিন বছরে শ্বেতরক্ষী বাহিনী ও বিদেশী হানাদারদের বিরুদ্ধেও বলশেভিক সরকার ও লাল ফৌজকে রক্তাক্ত কঠিন লড়াইতে সামিল হতে হয়েছিল। সেই লড়াইয়ের সাফল্য শুধু সামরিক সাফল্য ছিল না। তা অর্জিত হয়েছিল শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী অর্জন ও শ্রেণিসংগ্রামের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দিশার মধ্যে দিয়ে।
রুশ বিপ্লব ছিল খাঁটি গণবিপ্লব। বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিলোপ ঘটল এর মধ্য দিয়ে। মানব ইতিহাসে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হল প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব, স্থাপিত হল শ্রমিক কৃষকের রাষ্ট্র। নভেম্বর বিপ্লব শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক ক্ষমতা বদল ছিল না। রাশিয়ার জনগণের জীবনে এক গভীর সামাজিক অর্থনৈতিক রদবদল সূচিত করলো এই বিপ্লব, শুরু হল দেশের বৈপ্লবিক পুনঃনির্মাণ – নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সূত্রপাত হল। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে শুরু হল সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের নতুন যুগ। শুধু রাশিয়া নয়, বিশ্বের প্রতিটি কোণায় কোণায় তার উজ্জ্বল রশ্মি ছড়িয়ে পড়ল। সারা পৃথিবীর শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ ও বিবেকী বুদ্ধিজীবীরা এর প্রেরণায় উদ্বেল হলেন। দেশে দেশে সূচিত হল নতুন স্বপ্নের পৃথিবী গড়ার লড়াই।
– সৌভিক ঘোষাল
রাজ্যে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা। তার সাথে মৃত্যুও। কলকাতার গন্ডি পেরিয়ে ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়ছে শহরতলীতে, একের পর এক জেলায়। শিলিগুড়ি, মুর্শিদাবাদও এসে পড়েছে এই মানচিত্রের অধীনে। স্বাস্থ্য দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বছরে ডেঙ্গির প্রকোপ আগের সমস্ত রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গেছে। কলকাতা পুরসভার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এবারের ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা গত পাঁচ বছরে সর্বাধিক। ২৫ অক্টোবরের আগের সপ্তাহে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ৩,০০০ পার হয়েছে। এবার আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছে গেছে ৪৫,০০০’র কাছাকাছি। এরমধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পুলিশ কর্মী, গর্ভবতী মা, অল্পবয়স্ক শিশু — কেউ বাদ যায়নি। রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৯’র প্রথম ২৬ সপ্তাহে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১,০৩৭। ২০২০ এবং ২০২১-এ এই সংখ্যাটা ছিল যথাক্রমে ৬১৯ ও ২৭৩। কিন্তু এ’বছরের প্রথম ২৬ সপ্তাহে এই সংখ্যাটা লাফ দিয়ে বেড়েছে ১,৭৫১-তে। খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে রোগীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতির কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। কলকাতার বেশ কিছু ওয়ার্ডে প্রায় ঘরে ঘরে ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়েছে। এরকম অবস্থায় আজ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী কোনো বিবৃতি দিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তা মোকাবিলার কোনো বার্তা দেননি। নাগরিকদের আশ্বস্থ করার জন্য চোখে পড়ার মতো কোনো অর্থবহ পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গেল না।
ঝাঁ চকচকে বেসরকারি ব্যয়বহুল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের আধিক্য যে মৌলিক স্বাস্থ্য সঙ্কটকে সামাল দিতে পারেনা তা অতিমারীর থাবা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। অতিমারী এই শিক্ষা দিয়েছিল, একেবারে তৃণমূল স্তরে, ওয়ার্ড ভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা ও একই সাথে সদা সতর্ক নজরদারি রাখার উপর রাজ্য সরকার ও পৌর সভাগুলোকে প্রাথমিক নজর দিতে হবে। কিন্তু সেই শিক্ষা নেওয়া হয়নি। রাজ্য সরকার ও পৌর প্রশাসনের নির্লিপ্তি, অপরাধসম অবহেলার সুযোগ নিয়ে ক্রমে ক্রমে মশাবাহিত এই রোগটি গুটি গুটি পায়ে আজ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ল তা উক্ত ওই দু’টি প্রতিষ্ঠানের চরম ব্যর্থতাকেই দেখিয়ে দেয়। নানান জেলায় উঠছে গাফিলতির অভিযোগ। শিলিগুড়ি শহরে ডেঙ্গি মোকাবিলায় প্রশাসনিক স্তরে খামতির কথা কিছুদিন আগেই বলেন উত্তরবঙ্গের বিশেষ জনস্বাস্থ্য আধিকারিক। এই গোটা ঘটনা দেখিয়ে দেয়, নাগরিকদের একান্ত অপরিহার্য মৌলিক স্বাস্থ্য পরিষেবা, মশাবাহিত রোগ ঠেকাতে প্রাথমিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বজায় রাখতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো আমলই দিল না।
মশাবাহিত রোগগুলি আমাদের রাজ্যে বারে বারে মাথা চাড়া দিয়ে গোটা স্বাস্থ্য কাঠামোর দেউলিয়ে স্বরূপকে উলঙ্গ করে দিচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা মেরামত করা হল না। এব্যাপারে রাজ্য সরকারের কোন অগ্রাধিকারই কোনো দিন চোখে পড়ল না।
বেহাল রাজ্যের অর্থনীতি, গোটা ব্যবস্থায় আপাদমস্তক দুর্নীতির দগদগে ঘা, অপরাধী রাজনীতিবিদদের নিবিড় আঁতাত, রাজ্যে তৃণমূল শাসিত সরকারের প্রকৃত চেহারাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। একান্ত ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়াকে শুধু উপেক্ষা নয়, তাকে পুলিশ প্রশাসনের দুরমুশ দিয়ে দমন করার একের পর এক স্বৈরাচারী পদক্ষেপ রাজ্যবাসী দেখেছে। নাগরিকদের জীবন রক্ষার মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার পালনের কর্তব্য থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত স্খলিত এই রাজ্য সরকার ও তার অধীনে পরিচালিত পুর প্রশাসন।
নাগরিকদের একান্ত মৌলিক স্বাস্থ্যের অধিকারকে রক্ষা করা যে সরকারের দায়িত্ব তা আরো একবার জোরের সাথে পুনর্ঘোষণা করার সময় এসেছে।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
২০২৪’র সাধারণ নির্বাচনের আর যখন দু’বছরও বাকি নেই এবং অর্থনীতির যখন উত্তরোত্তর অবনমন ঘটছে, মোদী সরকার তখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নন্দ ঘোষ বানানোর পরীক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য কৌশলকে মরিয়াভাবে কাজে লাগিয়ে সাধারণ ভারতবাসীর সামনে থাকা জ্বলন্ত ইস্যুগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ঘোরাতে চাইছে — যে ইস্যুগুলো হলো পণ্যের মূল্যস্ফীতি, কাজের লোপ পাওয়া এবং ক্রমেই কমতে থাকা আয়। জুলাই মাসে বিহারের ফুলওয়ারি ও অন্যান্য স্থানে এনআইএ’র হানাদারি, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপনের দিন গুজরাটে বিলকিস বানো মামলায় ধর্ষণ ও খুনে সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তিদান ও সংবর্ধনা জ্ঞাপন, এখন আবার পিএফআই ও তার সাথে সংযুক্ত সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, এসবই আমাদের জানাচ্ছে যে সামনের নির্বাচনগুলির জন্য সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী কিভাবে নিজেদের প্রস্তুত করছে — যে নির্বাচনগুলো হলো এ’বছরের শেষে হতে চলা গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন, ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের অতি গুরুত্বপূর্ণ লড়াই।
২০০২’র গোধরা-পরবর্তী গুজরাট গণহত্যার পথ ধরে মোদী তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বের নিন্দাকে গুজরাটের পরিচিতি ও সম্মানের ওপর আক্রমণ বলেই বর্ণনা করেছিলেন এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ‘গুজরাট গৌরব’কেই তাঁর নির্বাচনের অবলম্বন করে তুলেছিলেন। দু’দশক আগে শক্তিগুলোর ভাবসাম্য এবং মূল ধারার মিডিয়ায় চর্চার প্রকৃতিও একেবারেই আলাদা ছিল — মোদী গুজরাটে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেও বাজপেয়ী ও আদবানি উচ্চগ্ৰামের ‘ভারত উদয়’ প্রচার চালানো সত্ত্বেও গুজরাটের মূল্য তাঁদের দিতে হয়েছিল। কৃষকদের আত্মহত্যা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশার উদ্বেগজনক বাস্তব পরিস্থিতি বাদে গুজরাট গণহত্যাও বাজপেয়ী-আদবানি যুগের অবসানের পিছনে অন্যতম মূল কারণ হয়ে উঠেছিল।
মোদী অবশ্য গুজরাটের মধ্যে ভারতের বড় বড় কর্পোরেটদের আনুগত্যমূলক সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হলেন যারা ‘প্রাণবন্ত গুজরাট’এর পতাকাতলে তাঁর চারপাশে সমাবেশিত হতে থাকল। রাষ্ট্রের ক্ষমতা — যা হল অবাধ ক্ষমতার অধিকারী এক প্রশাসক চালিত পুলিশ রাষ্ট্র — সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ এবং কর্পোরেট স্বার্থের সমন্বয়কে সম্পূর্ণ করে তাকে এক বজ্রদৃঢ় মুষ্টিতে পরিণত করল। এখন সর্বভারতীয় স্তরে গুজরাট মডেলের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হচ্ছে আরএসএস’এর আশীর্বাদপুষ্ট সর্বোচ্চ নেতার নিরবিচ্ছিন্ন শাসনকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এই সর্বোচ্চ নেতা এবং হিন্দু সম্প্রদায় আর দেশ হিসাবে ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠা তথাকথিত বিপদই এই নকশার কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে রয়েছে।
১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঘোষিত জরুরি অবস্থা কালে আমরা একটা শ্লোগান শুনেছিলাম যাতে ভারতবর্ষ ও তৎকালীন সর্বোচ্চ নেত্রী ইন্দিরাকে সমার্থক করে তোলা হয়েছিল। এখন ঐ সমার্থকতাকে একটু বাড়িয়ে তার মাঝে হিন্দু পরিচিতিকে ঢোকানো হচ্ছে, কেননা, আজকের নেতা ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ নামেও পরিচিত। এই জমানা এবং তার কদর্য রাজনীতি ও তার বিপর্যয়কর ফলাফলের সমালোচকদের নিয়মিতভাবেই একই সাথে দেশদ্রোহী এবং হিন্দু-বিরোধী বা হিন্দু-বিদ্বেষী হিসাবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এটা অবশ্য আসছে সঙ্ঘ বাহিনীর ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা থেকে। সরকার লাগাতারভাবে হয় বহিরাগত আর না হয় অভ্যন্তরীণ বিপদের কথা বলে চলেছে এবং সরকার বিরোধী মত পোষণ করা নাগরিকদের অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসাবে বিভিন্ন বর্গে ভাগ করা হচ্ছে। ‘শহুরে নকশাল’ নিয়ে গলাবাজি ইতিমধ্যেই ভারতের সর্বাপেক্ষা সক্রিয় মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের গ্ৰেপ্তারি এবং এমনকি হেফাজতে মৃত্যুতেও পরিণতি লাভ করেছে। আর এখন পিএফআই ও তারসাথে সংযুক্ত সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্বিচার ডাইনি খোঁজের নতুন পর্যায়ের সূচনাকে দেখিয়ে দিচ্ছে।
জরুরি অবস্থার সময় ভারতের সংবাদ জগতের ওপর সেন্সারশিপ চাপানো হয়েছিল এবং বিভিন্ন ধারার বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বড় অংশ ও সমাজ আন্দোলনের কর্মীদের জেলে পোরা হয়েছিল। আর তাই গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার একটা মূল শ্লোগানে পরিণত হয়েছিল এবং তার প্রয়োজনীয়তাও ব্যাপকতর স্তরে অনুভূত হয়েছিল। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং স্বৈরাচারী সরকারের পরাজয় আবার রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দান এবং ১৯৭৪’র রেল ধর্মঘটে বরখাস্ত হওয়া কর্মীদের পুনর্নিয়োগের উদ্দীপনাময় প্রচারের জন্ম দিল। এখন কিন্তু মূল ধারার মিডিয়ার বড় অংশই বর্তমান সরকারের সক্রিয় প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে এবং বন্দি বানানোর অভিযান সীমাবদ্ধ রয়েছে প্রধানত পার্টি-বহির্ভূত কর্মীদের মধ্যে; এর ব্যতিক্রম অবশ্য হলো জম্মু ও কাশ্মীর যেখানে ৩৭০ ধারা নিষ্ক্রিয় করার পর গোটা রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকেই হয় জেলে পোরা হয়েছিল আর না হয় গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল।
এরমধ্যেই হয়ত আংশিক ব্যাখ্যা রয়েছে যে কেন ডাইনি-খোঁজ অভিযানের অবসান এবং বিবেকসম্পন্ন বন্দিদের মুক্তির দাবি এখনও সংসদীয় বিরোধী পক্ষের কেন্দ্রীয় দাবি হয়ে ওঠেনি। আগেকার এই ভ্রান্ত ধারণাটারও অস্তিত্ব এখনও রয়েছে যে, শুধু অর্থনীতিতে গুরুত্ব আরোপ করলেই বিরোধী পক্ষের চলে যাবে। নরসিমা রাওয়ের এই বিশিষ্ট ধারণাটা ছিল যে, বাজার বিজেপির সাম্প্রদায়িক এজেণ্ডাকে চুপসে দেবে; কিন্তু মোদী পরিঘটনার উত্থান, বাজার মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সংগতিপূর্ণ হওয়ার উঁচু হারকেও দেখিয়ে দিয়েছে। অতি জরুরি এই প্রয়োজনীয়তার প্রতি সজাগ হয়ে উঠে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে তাদের এজেণ্ডার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় করে তোলার সময় ভারতের রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের কাছে সমুপস্থিত। বিজেপি যখন সংবিধানের বিপর্যয় ঘটিয়ে ভারতকে বিরোধী মুক্ত একদলীয় রাষ্ট্র কাঠামোয় পরিণত করতে বদ্ধ পরিকর, বিরোধী পক্ষকে তখন দ্বিধাকে ছুঁড়ে ফেলে গণতন্ত্র ও সংবিধানের রক্ষায় উঠে দাঁড়াতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গণতান্ত্রিক এজেণ্ডাকে মুলতবি রাখা বা কাটছাঁট করা একবারেই চলবে না।
‘ওরা’ বসে আছে। হাতে হাত রেখে। কলকাতা ময়দানে গান্ধীমূর্তির পাশে, কেউ বা মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তিকে ঘিরে। ওরা এসেছে বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বর্ধমান পূর্ব ও পশ্চিম জেলা থেকে। শুধু দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিই নয়। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি — জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দুই দিনাজপুরের শহর ও শহরতলীর মুখগুলোকেও আপনি দেখতে পাবেন। গোটা রাজ্য থেকে ওরা এসেছে। ওরা একটা মিথ্যা প্রচারকে সকলের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে — তরুণ প্রজন্ম আন্দোলন করতে জানে, দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে নিতে জানে এবং পারে। কোন দমন-পীড়ন ওদের দমিয়ে দিতে পারে না। অক্টোবর মাসের ২০ তারিখ গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ওরা সম্মিলিত ভাবে জানিয়ে দিল ন্যায়সংগত আন্দোলন চলবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, ন্যায্য প্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে লড়াই জারি থাকবে।
সরকারি নিয়োগে দুর্নীতির কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে ওদেরই বন্ধু, অতনু মিস্ত্রি, রাঘো সিং, সুমন চক্রবর্তীরা। মৃত্যুর আগে ওরা বলেছিল, দাবি আদায়ে লড়াই চালিয়ে যেতে। লড়াই ওরা চালিয়ে যাবে শেষ যোগ্য প্রার্থীর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত।
আন্দোলন কবে শুরু হল
দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত হয়ে যোগ্য মেধাবী টেট পাস প্রার্থীরা আন্দোলন করছে ২০১৬ সাল থেকে। লড়াইটা দুর্নীতির কারণে বঞ্চনার বিরুদ্ধে। ইন্টারভিউ দেওয়া বা না দেওয়ার জন্য নয়। এই প্রচার আসলে সরকারি চক্রান্ত আর মিডিয়ার একাংশের কারসাজি। ২০১১ সাল থেকে তথাকথিত মা-মাটি-মানুষের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত যত নিয়োগ হয়েছে সবক্ষেত্রেই চলেছে লক্ষ লক্ষ টাকার খেলা, হয়েছে লাগাম ছাড়া দুর্নীতি — তা সে নবম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত এসএসসি শিক্ষক নিয়োগ হোক বা কর্মশিক্ষা, শারীর শিক্ষা শিক্ষক নিয়োগ বা এসএসসি গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি বা রাজ্য গ্রুপ-ডি থেকে শুরু করে অঙ্গনওয়ারী কর্মী বা কন্ট্রাকচুয়াল নিয়োগ, যাই হোক না কেন সর্বত্র লাগামছাড়া দুর্নীতি। এযাবৎকালে সরকারি নিয়োগে যে লাগাম ছাড়া দুর্নীতি হয়েছে তার সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে প্রাইমারি নিয়োগে দুর্নীতি। চূড়ান্ত পর্যায়ের এই দুর্নীতির শিকার ‘প্রাইমারি নট ইনক্লুডেড’ নতুন এক শব্দ।
আসলে এখানে শুধু ২০১৪ সালের আবেদনকারীরাই নেই, ২০১২ সালে অর্থাৎ প্রথম টেট পরীক্ষায় যারা পাস করতে পারেনি, ওই একই সালের আবেদনের ভিত্তিতে পাওয়া এডমিট কার্ড অর্থাৎ ২০১২ সালের এডমিট কার্ডেই পরীক্ষা দেয় ২০১৪ সালের আবেদনকারীদের সাথে। রেজাল্ট বেরোয় ২০১৬ সালে। যারা টেট পরীক্ষায় অর্থাৎ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতায় পাস করে তারাই আজকের ‘প্রাইমারি নট ইনক্লুডেড ২০১৪’। সরকার ঘোষণা করে এই টেট পাশ ছেলেমেয়েদের মধ্য থেকে ৪২,০০০ শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। যথারীতি নিয়োগ শুরু হয় কিন্তু সরকার পক্ষ থেকে কোন মেরিট প্যানেল লিস্ট প্রকাশ করা হয়নি। প্রত্যেক ক্যান্ডিডেট তার রোল নাম্বার এবং জন্ম তারিখ দিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে কেবলমাত্র জানতে পারে সংশ্লিষ্ট ক্যান্ডিডেট কোয়ালিফায়েড অর্থাৎ শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবে অথবা নট কোয়ালিফায়েড অর্থাৎ শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হতে পারবে না।
২০১১ সাল থেকে যতগুলো নিয়োগ সরকার করেছে তার প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে এবং সেটা দুর্নীতি করে নিয়োগ করার জন্যই। প্রায় সবক্ষেত্রেই মেরিট প্যানেল প্রকাশ করা হয়নি, অর্থাৎ মোট কতজন চাকরিপ্রার্থী নিয়োগ করছে, তাদের নাম, তাদের আগের ব্যক্তি কে? পরের ব্যক্তি কে? কত নম্বর পেয়ে কেউ সিলেক্ট হয়েছে? আর যে সিলেক্ট হতে পারেনি সে কত নম্বর পেয়েছে? জেনারেলের জন্য কত কাট-অফ পর্যন্ত নামা হয়েছে? ক্যাটাগরির ক্যান্ডিডেটদের জন্য কত কাট-অফ রাখা হয়েছে অর্থাৎ একটা মেরিট প্যানেল প্রকাশিত হলে যে যে বিষয়গুলো সিলেক্ট নট-সিলেক্ট সমস্ত ক্যান্ডিডেটদের কাছে পরিষ্কার হতে পারত সেরকম কিছুই করা হয়নি। এমনকি অনুপস্থিত এবং নন জয়নিং সিটগুলো পরে কী হল। কাদের নিয়োগ দেওয়া হলো, সেই সব সাধারণ বিষয়গুলোও আরটিআই করার পরও সরকার পক্ষ থেকে জানানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। এমনকি কারা কারা ওয়েটিং ক্যান্ডিডেট হিসেবে আছে তারও কোনো লিস্ট আজ পর্যন্ত প্রকাশ করেনি আর এখনতো আরো পরিষ্কার হয়ে গেছে ইন্টারভিউয়ের নম্বর পেন্সিলে দেওয়া হয়েছিল। কেন দেওয়া হয়েছিল এটা বোঝার ক্ষমতা আশা করি সকলের আছে। এটাও আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে সাদা খাতা জমা দিয়েও চাকরি পাওয়া যায়, এমনকি ১৭ বছর বয়সীকেও চাকরিতে জয়েন করানোর নিদর্শন আছে। যাই হোক ২০১৪ অর্থাৎ দ্বিতীয় টেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল প্রায় ২৩ লক্ষ ছেলেমেয়ে। ২০১৬ সালে যখন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হল তখন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অবাক হয়ে টিভির পর্দায় শুনল দক্ষিণ ২৪ পরগণার চেয়ারপার্সন সুরঞ্জনা দাসের অডিও ভয়েস — এটা মাথায় রাখবেন, চাকরি কিন্তু পেয়েছে দলের ছেলেরাই। দেখলো ব্রাত্য বসুর মজাদার ভাষণ — দলের ছেলেদেরই চাকরি দিয়েছি, কিন্তু কিভাবে দিয়েছি সেটা বলবোনা। দল করো চাকরি পাবে বা কালনার বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুন্ডু স্বগর্বে বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করলেন, প্রাইমারিতে ১২ জনকে চাকরি দিয়েছি, যদিও পরে অর্থাৎ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে জয়েন করে ঘোষণা করল ১২ জন নয়, ৬৮ জনকে চাকরি দিয়েছি। আসলে চাকরিটা দলের লোককেও দেয়নি। দিয়েছে বড় লোক বাপের অযোগ্য ছেলেমেয়েদের — ‘টাকা দাও, চাকরি নাও’ সকলের জন্য সমান দর, তাতে তুমি কোন দল করো দেখা হবে না। প্রথম দিকে রেট ছিল ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা, পরে সেটা বেড়ে ১০ থেকে ১২ লক্ষ টাকা হয়। মুড়ি মুড়কির মতো পয়সার বিনিময়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটা এমএলএ-এমপি এবং নেতাকে কোটা দেওয়া হয়েছে আর সেই সমস্ত এমএলএ-এমপি এবং নেতাদের এজেন্টরা বুথে বুথে ঘুরে পয়সাওয়ালা বাপের অযোগ্য ছেলেমেয়েদের খুঁজে খুঁজে বের করে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছে। এ এক অকল্পনীয় দুর্নীতি এবং তা হয়েছে খুল্লাম খুল্লা। যোগ্য ছেলেমেয়েদের ইন্টারভিউ নেওয়া হল কিন্তু টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হল অযোগ্য ছেলেমেয়েদের। শুরু হল আন্দোলন।
প্রতিশ্রুতি ও জুমলা
নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন এবং ভোটের কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করলেন, ২০১৪ সালের টেট পাসদের থেকে ২০,০০০ শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। ১৬,৫০০ এখনই নিয়োগ হবে আর বাকিটা অর্থাৎ ৩,৫০০ ধাপে ধাপে নিয়োগ করা হবে। সেখানেও সমানতালে চলল দুর্নীতি। আবারও ২০১৪ সালের টেট পাশরা ইন্টারভিউ দিল, আবারও অযোগ্যরা টাকার বিনিময়ে পেল চাকরি। এই ১৬,৫০০ কাকে নিয়োগ দেওয়া হল, কিভাবে নিয়োগ দেওয়া হল — দেবা ন জানন্তি। কেউ জানে না। পরে আরটিআই মারফৎ জানা গেল ১৬,৫০০ নিয়োগ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে আরো কম। ৩,৯২৯টি আসনে এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি (আসলে নিয়োগ দেওয়া হয়নি নয়, এমএলএ-এমপি নেতাদের এজেন্টরা যোগ্য পয়সাওয়ালা অযোগ্য ক্যান্ডিডেট জোগাড় করতে পারেনি)। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী এবং ১৬,৫০০ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ৩,৫০০ এবং ৩,৯২৯ এই সিটের যোগ্য দাবিদার ২০১৪ সালের ‘প্রাইমারি নট ইনক্লুডেড’রা। তারা আজও চাকরি পায়নি তাদের একটাই অপরাধ শত চেষ্টা করেও এদের বাদ দেওয়া যায়নি (কিছু কিছু ছেলেমেয়ের মেধা এমন পর্যায়ে থাকে যাদের কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যায় না তাই দেখা যাচ্ছে এই ছেলেমেয়েদের প্রায় সবাই একাধিক সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ করে বসে আছে।) তারা টেট পাস করেছে কিন্তু টাকা দিতে পারেনি।
লড়তে লড়তে তাদের হাতে এসেছে অনেক তথ্য প্রমাণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছুটে গেছে আদালতে, দুর্নীতির যে সমস্ত অকাট্য প্রমাণ তাদের হাতে এসেছে তার কয়েকটি হল,
তাই, নন-ইনক্লুডেডরা আজ দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত। দুর্নীতি যদি একটু কম হত, এরা সবাই আজ চাকরি করত এবং ৩,৫০০ ও ৩৯,২৯টি সিটের এরাই আসল হকদার। এই হকের লড়াই লড়তে গিয়ে ২০১৬ সাল থেকে বারবার আক্রান্ত, অপমানিত ও পুলিশের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। অবশেষে শহীদ মিনার ময়দানে কোর্টের পারমিশন নিয়ে মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির সামনে তাদের অবস্থান শুরু করে। অবস্থান চলাকালীন বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের সাথে তারা সমস্যা সমাধানের জন্য বারবার আবেদন জানায়। কিন্তু সরকার বা পর্ষদের পক্ষ থেকে সমাধান তো দুর অস্ত তাদের আন্দোলনকে কোনোরকম মান্যতা দিতেই রাজি হয়নি। পরিবর্তে বিজ্ঞপ্তি জারি করে ৩,৫০০ প্লাস ৩,৯২৯’র সাথে আরো কিছু সিট যোগ করে ১১,০০০ সিটে নিয়োগের কথা ঘোষণা করে এবং ২০১৭ অর্থাৎ টেটের তৃতীয় ব্যাচের সাথে তাদের ও ইন্টারভিউয়ের জন্য আবেদন করতে বলে, এটা আসলে সরকার তার নিজের মুখ রক্ষার জন্য আবারও প্রতারণার ফাঁদ পাতলো। ২০১৪ নট ইনক্লুডেড’এর সামনে এবং সুকৌশলে ২০১৭ ব্যাচের সাথে তাদের মুখোমুখি লড়াইয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। ২০১৭ এখনো এই দুর্নীতির তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি। কারণ তারা এখনো একবারও ইন্টারভিউ দেয়নি, তাদের টেট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোয় ২০২২’র জানুয়ারি মাসে। কিন্তু ২০১৪ তাদের অভিজ্ঞতায় বুঝেছে আবার ইন্টারভিউ, আবার প্রতারণা (ন্যাড়া কবার বেলতলায় যাবে)। তাছাড়া ২০১৪ ও ২০১৭’র মধ্যে তথাকথিত একাডেমিক কোয়ালিফিকেশনের কারণে ২০১৭, ২০১৪’র চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে আছে এবং ২০১৪ সালে যারা আবেদন করেছিল তাদের প্রায় সকলের বয়স ৪০ অথবা ৪০ প্লাস। তাই এটা তাদের কাছে মরণ-বাঁচন লড়াই এবং তাদের এই পরিণতির জন্য দায়ী সরকারের দুর্নীতি এবং সরকারের নিয়োগ বিমুখিণতা। তাই এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। যখন বিভিন্নভাবে সরকার তাদের চাকরি পাওয়ার সমস্ত রাস্তাই বন্ধ করে দিতে চাইল তখন তারা বাধ্য হয়ে করুণাময়ীতে শুরু করল অনশন কর্মসূচি। তারপর রাতের অন্ধকারে পুলিশ কিভাবে তাদের আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল, তা সকলের কাছে পরিষ্কার। এই দুর্নীতির দায়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জেলে, প্রাক্তন পর্ষদ সভাপতিও জেলে, আর জেলে যাওয়ার কথাতো দুর্নীতির অন্যতম পান্ডা শুভেন্দু অধিকারীর। জেলে যাওয়ার কথা শঙ্কুদেব পান্ডা, বিশ্বজিৎ কুন্ডু সহ তৃণমূলের (দলছুট) বড় বড় নেতাদের। তার পরিবর্তে এই স্বৈরাচারী শাসক তার দুর্নীতিকে চাপা দিতে আজ পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করে জেলে পাঠাচ্ছে পশ্চিমবাংলার গরিব বাড়ির মেধাবী যোগ্য ছেলেমেয়েদের। দুর্নীতি করে এই সমস্ত বেকার ছেলেমেয়েদের জীবনের স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করেছে এই সরকার। নিয়োগ বন্ধ রেখে তাদের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে আট আটটা বছর। তারা আশা করেছিল এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু সরকার তাদের ন্যায্য দাবির কোনো মান্যতা তো দিতেই চায়নি, কোনো রকম আলোচনায় না গিয়ে স্বৈরাচারী শাসকের মতো নখ দাঁত বার করে তাদের ন্যায্য চাকরি ফিরে পাওয়ার সমস্ত আশাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে তাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর কত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলে তবে সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে! এগুলোতো আত্মহত্যা নয়! এগুলো খুন, ঠান্ডা মাথায় খুন, আর সরকার এই খুন করছে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য। এই সরকার আর দুর্নীতি, একে অপরের পরিপূরকে পরিণত হয়েছে। তাই আজ আর বসে থাকা নয়। এই অমানবিক নির্লজ্জ সরকারের বিরুদ্ধে আসুন সকলে গর্জে উঠি — আন্দোলনকারীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। সম্মিলিত কন্ঠে আওয়াজ তুলি “দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের অবিলম্বে নিয়োগ দাও। বেঁচে থাকার অধিকার ফিরিয়ে দাও”।
- সজল দে
২০ অক্টোবর ২০২২ তারিখে টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্যানেলভুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং এসএসসি (নবম-দ্বাদশ) এসএসসি (গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি) রাজ্য গ্রুপ-ডি, আপার প্রাইমারি, মাদ্রাসা, কলেজ সার্ভিস সহ মেধা তালিকাভুক্ত সকল চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগের দাবিতে ৩১ অক্টোবর ২০২২ প্রতিবাদ ও সংহতি সভা হয় যাদবপুর ৮বি কফি হাউসের সামনে।
সভায় বক্তব্য রাখেন আন্দোলনরত সংগঠন আপার প্রাইমারি চাকরি প্রার্থীবৃন্দ’র পক্ষে পরিতোষ রায়, ২০১৪ প্রাইমারি টেট পাশ ট্রেন্ড নট ইনক্লুডেড একতা মঞ্চ’র পক্ষে পিয়ালী গুচ্ছাইত, যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চ (নবম-দশম)’র পক্ষে সঞ্চিতা শর্মা প্রমুখ।
পিইউসিএল-র পক্ষে মানবাধিকার কর্মী ডাঃ বিনায়ক সেন, অম্লান ভট্টাচার্য, অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী অল ইণ্ডিয়া লইয়ারর্স ফর জাস্টিস (এআইএলএজে)-র পক্ষে আইনজীবী অভিজিৎ দত্ত, দিবাকর ভট্টাচার্য, মালা সেন চৌধুরী, পার্থ ব্যানার্জী, অল ইণ্ডিয়া লইয়ারর্স ইউনিয়ন (এআইএলইউ)-র পক্ষে আইনজীবী স্বরূপ পাল আইসার পক্ষে আকাশ গুপ্ত, আরওয়াইএ-র পক্ষে সজল দে এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মানস ঘোষ বক্তব্য রাখেন। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের পক্ষে নীতীশ রায় ও বাবুনি মজুমদার সঙ্গীত পরিবেশন করেন। মাননীয় কৌশিক সেন এবং বোলান গঙ্গোপাধ্যায়ের পাঠানো বার্তা পড়ে শোনানো হয়।
প্রত্যেক বক্তাই পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানান এবং দ্রুত নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
২০১৬ সালে এসএলএসটি পরীক্ষায় সফল অথচ বঞ্চিত প্রার্থীদের গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ৫৯৮ দিনের অবস্থান-বিক্ষোভের পাশে দাঁড়ালেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির এক প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলের সাথে তাঁদের আন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলে। চলমান আন্দোলনের পাশে সর্বাত্মকভাবে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি তাঁরা করেন।
এখন জোর খবর ‘শিবিরে জমির পাট্টা’! রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে ‘দুয়ারে সরকার’ শিবির থেকে জমির পাট্টা দেওয়া হবে। অসংখ্য গরিব মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি তথা আন্দোলনের চাপে সরকার এমন পরিকল্পনা নিতে বাধ্য হয়েছে। যদিও সামনে পঞ্চায়েত ভোট, সেটাও ভীষণ বালাই! কিন্তু প্রশ্ন হলো এ’রাজ্যে তৃণমূলের রাজত্বে লক্ষ লক্ষ পাট্টাদার বর্গাদার যে উচ্ছেদ হয়ে গেলো সেটা নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ কোথায়?
আজ নদীয়া জেলার ধুবুলিয়ার ভূমি দপ্তরে এই দাবিতেই সংগঠিত হল এক বিক্ষোভ ডেপুটেশন। ব্লক ভূমি আধিকারিকের কথায় বোঝা গেলো এ’বিষয়ে সরকারী নীতির অভিমুখটা কী! তিনি স্পস্টই জানালেন, জমির দখল যার তার নামেই পাট্টা হবে, পুরানো পাট্টা বাতিল হবে। বিভাগীয় এনকোয়ারী করার পর বর্তমান দখলদারকে পাট্টা প্রাপকের তথাকথিত ‘মানদণ্ড’ পূরণ করতে হবে! বলা বাহুল্য তৃণমূলের রাজত্বে ক্ষমতার দাপটকেই শেষ কথা বলে চাপিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তেমনটাই চলছে। এভাবে উচ্ছেদকে বৈধ করে তোলা হচ্ছে। ধুবুলিয়ার নওপাড়া ২নং অঞ্চলে সোনাতলা গ্রামের ৮ জন পাট্টাদার ও বেশ কয়েকজন বর্গাদার উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ডেপুটেশনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা সোচ্চার হন। চাপের মুখে বিএলএলআরও বিষয়টি পূনর্বিবেচনার আশ্বাস দিলেন। বোঝা গেল জমির অধিকার লড়েই নিতে হবে।
গতবছর এক জেলা প্রশাসনিক বৈঠকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছিলেন “ভূমি দপ্তর ঘুঘুর বাসা”! ভূমিদপ্তরের অবৈধ কাজকারবারে ভুক্তভোগী গ্রামীণ মানুষের ক্ষোভকে অভিভাবক সুলভ কায়দায় কিছুটা প্রশমিত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। ঘুঘুর বাসা ভাঙ্গার কোনো সদর্থক পদক্ষেপ আদৌ দেখা যায়নি। ধুবুলিয়ায় কৃষ্ণনগর ২নং ব্লকে ভূমি দপ্তরের দুর্নীতির বিভিন্ন ঘটনাবলীতে দেখা যাচ্ছে, রিফিউজি দপ্তরের জমি রায়তি সম্পত্তি দেখিয়ে রেকর্ড করে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া জমির রেকর্ড করার ক্ষেত্রে দালালি ঘুষের অবৈধ কারবার, মিস কেস বলে চিহ্নিত করে বছরের পর বছর মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে, চলছে ঘুষ দালালির অবৈধ কাজ। শাসক দলের নেতা-জমির দালাল-সরকারী কর্তাদের অশুভ চক্র এই অপকর্মে যুক্ত। এসব নিয়ে কয়েকটি তথ্য তুলে ধরলে বিএলএলআরও সেগুলি নিয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ জানানোর কথা বলেন। অবৈধ রেকর্ড কিভাবে হল এনিয়ে ইতিপূর্বেই একটা আরটিআই করা হয়েছিল। আগামী ১০ দিনের মধ্যে তিনি তার জবাব দেবেন বলে জানালেন। পরিশেষে বিভিন্ন দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলার বার্তা দিয়ে স্লোগানে মিছিলে ধুবুলিয়ায় জোড়ালো প্রচার করা হল। কমসূচিতে অংশ নেন পার্টির ধুবুলিয়া এলাকা কমিটির সদস্য সাইদুল মোল্লা, আনসারুল হক, ঠান্ডু সেখ, কলম বিশ্বাস, সুব্রত রায়, বেলা নন্দী, যুব সংগঠক অমিত মন্ডল, জেলা কমিটি সদস্য কৃষ্ণ প্রামানিক, সম্পাদক জয়তু দেশমুখ প্রমূখ।
রেল হকারদের উপর জিআরপি’র অত্যাচারের বিরুদ্ধে গত ২৮ অক্টোবর ২০২২ কাটোয়া স্টেশন চত্তরে রেল হকারদের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। রেল পুলিশ দপ্তরের সামনে রুখে দাঁড়ানো মেজাজে কয়েকশত হকার ও মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণে এই কর্মসূচি ছিলো যথেষ্ট উদ্দীপনাময়। উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ নদীয়া জেলা কমিটির সদস্য ও ব্যান্ডেল কাটোয়া সংগ্রামী রেল হকার ইউনিয়নের সভাপতি পরীক্ষিত পাল, পশ্চিমবঙ্গ রেল হকার্স ইউনিয়ন (সিআইটিইউ) সভাপতি অলকেশ দাস, রাজ্য সম্পাদক নেপালদেব ভট্টাচার্য্য, সিপিআই(এমএল) নদীয়া জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, জেলা সদস্য দেবাশীষ সরকার সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ।
বক্তারা বলেন, এই আক্রমণ কেবলমাত্র মুস্টিমেয় কয়েকজন হকারের উপরেই নয়, এটা সমস্ত রেল হকারদের উপর, গণতান্ত্রিক শক্তির উপর হামলা। রেল হকারদের বৈধ লাইসেন্সের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে। এ লড়াই কেন্দ্রীয় সরকারের উদারনীতি, রেল বেসরকারিকরণের নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত, যা আরও ব্যাপকমাত্রায় গড়ে উঠছে। রেলের যাত্রীসাধারণের দৈনন্দিন চাহিদার সাথে রেল হকারদের জীবিকা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত ও স্বনির্ভর এই রেল হকারদের জীবন জীবিকার উপর রেল পুলিশের হামলার বিরুদ্ধে এবং রেলকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। রেল বেসরকারীকরণ পলিসির অঙ্গ হিসাবে শহরতলীর রেল যাত্রীদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের দায়িত্ব ক্যাটারার কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। সেই সব কোম্পানির কাছে মোটা টাকা দিয়ে সাধারণ হকারদের হকারী করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। কখনওবা বলা হচ্ছে ফাইন হিসাবে প্রতিদিন পুলিশকে টাকা দিয়ে হকারদের কাজ করতে হবে। এ হল এক ধরনের তোলাবাজি, এ’রাজ্যের শাসকদলের হকার ইউনিয়ন নিজেদের কায়েমী স্বার্থে এর ওকালতি করে চলেছে। প্রতিবাদ সভায় বামপন্থী নেতৃবৃন্দ এগুলিকে নস্যাৎ করেন। হকারী পেশাকে অসম্মান করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। তারা বলেন সর্বস্তরের মেহনতি মানুষ ও সাধারণ যাত্রীরা হকারদের জীবিকা রক্ষার জন্য ন্যয়সঙ্গত প্রতিবাদের পাশে রয়েছে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায় কাটেয়া-ব্যাণ্ডেল রেল-হকারদের উপর রেল পুলিশের অত্যাচার ও জুলুমবাজি নিত্যদিনের ঘটনা। গত ২২ অক্টোবর ২০২২ নবদ্বীপ ধাম-মালদা টাউন এক্সপ্রেস নবদ্বীপ থেকে ভোর ৪:৪৫টার সময় ছেড়ে ৫:২০ নাগাদ কাটোয়া স্টেশনে পৌঁছায়। ট্রেন থেকে জনৈক দুই রেল হকারকে কাটোয়ার রেল পুলিশ ধরে আটকে রাখে। এই খবর পেয়ে বেশকিছু হকার ঘটনাস্থলে ছুটে যায় এবং ধৃত দুই হকারকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। রেল পুলিশ তাদের কথায় কর্ণপাত না করে গালিগালাজ করতে থাকে, জেলে আটকে রাখার হুমকি দেয়। রেল-হকাররা জানায় তাদের দুই সাথীকে না ছাড়লে তারা ধর্ণায় বসবে। তখন রেল পুলিশ বেশ কয়েকজন হকারকে গ্রেপ্তার করে। লাঠি চার্জ করে বাকিদের হঠিয়ে দেয়। সকলের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। তাদের বৈদ্যুতিক লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি মারা হয়, এমনকি রেল পুলিশ বুট দিয়েও লাথি মারে। মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তেরো জন রেল পুলিশ হিংস্র ও অমানবিক অত্যাচার চালায়। রেল পুলিশের বড়বাবু গালাগাল দিয়ে হকারদের উদ্দেশ্যে বলে “ট্রেনটা তোদের বাপের নয়, ট্রেনে হকারি করা চলবে না, ভিক্ষা করে খা। যদি তোর বাপের জায়গা জমি থাকে তাতে গিয়ে করে খা। ট্রেনে হকারি করবি না।” এরপর রেল পুলিশ এক হকারের পকেটে রিভলভার গুঁজে দেয় এবং এক মহিলা পুলিশকে বলে পোষাক ছিঁড়তে। এতে করে তাদেরকে অভিযুক্ত করে ফাঁসানো হবে যে হকাররা শ্লীলতাহানি করেছে এবং রেল-পুলিশের উপর আক্রমণ করেছে।
এরপর ধৃতদের থেকে ৩,৩০০ টাকা জরিমানা হিসাবে নেওয়া হয়, কোনোরকম কোনো রসিদ না দিয়েই। পুলিশ জানায় হকারদের নামে কেস দেওয়া হবে। এরপর মেডিকেলের জন্য রেল পুলিশ ঐ হকারদের নিয়ে যায় এবং ভয় দেখিয়ে বলা হয় তাদের যে মারধর করা হয়েছে সেটা তারা যেন না বলে। বললে জেলে পাঠানো হবে। মেডিকেল হওয়ার পর তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ব্যান্ডেল কাটোয়া সংগ্রামী রেল হকার ইউনিয়নের সম্পাদক সুবল দেবনাথ বলেন, “সরকার আমাদের স্থায়ী কাজ দিতে পারেনি। চুরি, অসৎ উপায় অবলম্বন না করে আমরা ট্রেনে ফেরি করি। রেল পুলিশ আমাদের কাছে টাকা দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে বিভিন্ন কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। রাজ্যে তেমন কোনো শিল্প কারখানাও নেই। রেল আমাদের কর্মসংস্থানের ও রুটি-রুজির একটা জায়গা। সেটাকেও যদি সরকার কেড়ে নেয় আমরা বাঁচবো কি করে! তাই পেটের লড়াইয়ে আমরা এক হয়ে পথে নেমেছি”।
গ্রামকে না চিনলে ভারতকে চেনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। গ্রামীণ মেহনতিদের সংঘবদ্ধ লড়াইয়ের স্ফূলিঙ্গই দাবানল হয়ে একসময় ছড়িয়ে পড়েছিলো ভারত জুড়ে। সত্তরের দশক মুক্তির দশক হয়ে ওঠার সেই স্বপ্নপথের যাত্রী হতে চারু মজুমদার ডাক দিয়েছিলেন “শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে একাত্ম হও”।
বর্তমান সময়ে যখন গ্রামীণ ভারতের দুর্বিষহ অবস্থা ক্রমবর্ধমান, গ্রামগুলোর যাত্রা শহরমুখী, গ্রামীণ অর্থনীতি ধু্ঁকতে ধুঁকতে তলানিতে, এই সময়েই গ্রামীণ মেহনতিদের সর্বভারতীয় সম্মেলন হবে হুগলির চন্দননগরে। এটা নিছক কোনও গণসংগঠনের সম্মেলন নয়, এই সম্মেলন নিঃসন্দেহে ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের সবথেকে বড় জনভিত্তিকে আরো সংগঠিত করার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। এই প্রয়াশের অংশ হিসাবে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ডাক ছিল চলো আরেকবার ফিরি শ্রেণীর কাছে। পার্টির সমস্ত অংশের সংগঠকদের পাখির চোখ হোক গ্রামীণ মেহনতিদের সংগঠিত করার এই প্রচেষ্টা। পশ্চিমবঙ্গেও এই কাজেই পার্টির সর্বস্তরের কর্মীরা সামিল। সেই পদাতিক বাহিনীতে সামিল হয়েছে পার্টি আধারে থাকা ছাত্রছাত্রীরাও।
হাওড়া জেলার গ্রামীণ কাজের ক্ষেত্র বাগনান ১ ও ২নং ব্লকে জেলার ছাত্র-ছাত্রীরা সামিল হয়েছে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির অভিযানে। নিছক ওপর থেকে আসা কর্মসূচি হিসাবে নয়, আরো কাছ থেকে শিকড়কে চিনে নেওয়ার প্রত্যয়েই এই সামিল হওয়া। তাদের সামিল হওয়ার উন্মাদনাতে গ্রামীণ কমরেডরাও নতুন করে উৎসাহিত হয়েছেন।
খুব ধীরে শুরু হলেও গতি পেতে থাকে হাওড়া জেলায় আয়ারলার অভিযান। শুরুর দিকেই এই অভিযান চলাকালীন প্রাণনাশের হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তারপরেও চেনা ছক ভাঙার প্রচেষ্টা অব্যাহত থেকেছে কমরেডদের। ছাত্রছাত্রীরা সেই প্রচেষ্টায় নিজেরাও সামিল হয়েছে।
বাগনান ২নং ব্লকের বিভিন্ন গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে গ্রামীণ শ্রমজীবি জনতার নিত্যদিনের সমস্যাকে তারা জানাবোঝার চেষ্টা করেছে। একশো দিনের কাজের বকেয়া মজুরি না পাওয়ার যন্ত্রণা, গ্রামে কাজ না পেয়ে বেকার যুবকদের ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার যন্ত্রণার শরিক হওয়ার চেষ্টা করেছে ওরাও। বাড়ি ভেঙে পড়ছে কিন্তু আবাস যোজনার ঘর নেই, একশো দিনের কাজ বন্ধ, রাজ্যের সমস্ত গ্রামগুলোর প্রতিচ্ছবির থেকে আলাদা নয় হাওড়া জেলার অবস্থাও। আর এই ভয়াবহ সংকটকে আরো সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হলো ছাত্র-ছাত্রীদেরও। নিজেদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গেই বৃহত্তর জনতার দাবির মেলবন্ধন না হলে, নিজেদের দাবিও পূরণ হবে না। এই চেতনা আরো দৃঢ় হয়েছে।
অর্থ সংগ্রহ, গ্রামে গ্রামে ঘোরার মধ্যে নিজেদের নতুনভাবে শেখা-জানা-বোঝার এক দিগন্ত খুলে গেল ছাত্রছাত্রীদের সামনেও। শ্রেণিই সবথেকে বড়ো শিক্ষক। তাই শ্রেণির মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়া, তাদের লড়ইয়ে শরিক হওয়ার এই অভিযান জারি থাকবে।
২ নভেম্বর প্রথম হাওড়ার টিকিয়াপাড়ায় রেলওয়ে ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠিত হল এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত আইআরইএফ-এর তত্ত্বাবধানে হাওড়া-খড়গপুর ডিভিশনের সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের প্রথম দ্বিবার্ষিক সম্মেলন। উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইইউ নেতা ও হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, রেল কর্মচারী আন্দোলনের বর্ষীয়ান সংগঠক এন এন ব্যানার্জী সহ অন্যান্যরা।
গুজরাটের মোরবী শহরে মচ্ছু নদীর উপর ঝুলন্ত সেতু ভেঙে পড়ে যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ৩০ অক্টোবর ২০২২ সন্ধ্যায় ঘটল তা আরও একবার সরকার-কর্পোরেট গাঁটছড়ার মধ্যে নিহিত বিপর্যয়ের বিপুল সম্ভাবনাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ঐ সেতু একেবারে মাঝ বরাবর ভেঙে পড়ল মেরামতি সম্পন্ন হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যেই এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী তাতে প্রাণ গেল ৪৭ জন শিশু ও বহু নারী-সহ ১৩৫ জনের। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে — সেতুর মেরামতি কি যথাযোগ্য হয়েছিল? যে সংস্থা সেতু মেরামতির দায়িত্ব পেয়েছিল, সেই কাজে তাদের পারদর্শিতা বিচার করেই কি মোরবী পুরসভার সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছিল? সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য সেতু খুলে দিতে গিয়ে কি জনপ্রিয়তাবাদ প্রাধান্য পেয়েছিল এবং জনসুরক্ষা উপেক্ষিত হয়েছিল? দুর্ঘটনার পর রাজ্য প্রশাসন কি চুনোপুঁটিদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে উঠেপড়ে লেগেছে?
সেতু মেরামতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ এবং বিজেপির অতি কাছের ওরেভা গোষ্ঠীকে। আমেদাবাদ পশ্চিম সংসদীয় ক্ষেত্রের বিজেপি সাংসদ কিরীট সোলাঙ্কি এই গোষ্ঠীর কর্ণধার জয়সুখভাই প্যাটেলকে ‘নব নক্ষত্র সম্মানে’ ভূষিত করেন। প্রাপ্ত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, কোনো দরপত্র না ডেকেই ঐ মেরামতির ভার ওরেভা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ঐ গোষ্ঠী পরিচিত অজন্তা ব্র্যান্ডের দেওয়াল ঘড়ি নির্মাণের জন্য; এবং ই-বাইক, ইলেক্ট্রিক বাল্ব, ক্যালকুলেটার ও মশা মারার রেকেট তৈরিও গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সেতু সারাইয়ের মতো প্রযুক্তিগত কর্মকুশলতা তাদের থাকার কোনো প্রমাণ সামনে আসেনি। যাঁরা এই গোষ্ঠীর হাতে ১৪০ বছরেরও বেশি পুরনো সেতুর মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার তুলে দিলেন, তাঁরাও কি এই ধরনের কাজে তাদের দক্ষতা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন? গোষ্ঠীর কর্ণধার জয়সুখভাই প্যাটেল বলেছিলেন, সেতুর ১০০ শতাংশ সংস্কার হয়েছে। এবং এমন মেরামতি তাঁরা করেছেন যে, সেতুকে অনায়াসে আরও ১৫ বছর ব্যবহার করা যাবে। আর এখন এই অভিযোগ উঠেছে যে, ১৪৪ বছরের পুরনো সেতুর জংধরা কেবলগুলোকে রং করে সেগুলোর ভোল পাল্টানোর চেষ্টা হয়েছে। প্রকৃতই কোনো মেরামতির বদলে ওপর-ওপর রঙের প্রলেপ দিয়ে রূপের বাহার আনার জন্যই কি সেতু মাঝ বরাবর ভেঙে পড়ল? গুজরাটের বিজেপি সরকার পাঁচ সদস্যের যে বিশেষ তদন্তকারী দল গড়েছে, তারা কি এই অভিযোগের সত্যতার অনুসন্ধানে আন্তরিক হবে?
এই সেতুর মালিকানা মোরবী পুরসভার এবং ওরেভা গোষ্ঠীর সঙ্গে মোরবী পুরসভার চুক্তির মধ্যেই সম্ভবত বিপর্যয়ের বীজ নিহিত ছিল। পুরসভার সঙ্গে ওরেভা গোষ্ঠীর এই চুক্তি হয় যে, সেতু সারাই এবং তাতে নবরূপ দানের সমস্ত খরচ ওরেভা গোষ্ঠীই বহন করবে। বিনিময়ে তারা সেতুতে প্রবেশের টিকিট বিক্রি করে সেতু সারাই ও তার রক্ষণাবেক্ষণের খরচ তুলবে। টিকিট প্রতি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১৫ টাকা এবং ১২ বছরের কম বয়সীদের জন্য ১০ টাকা করে এবং টিকিটের দাম প্রতি বছর দু’টাকা বৃদ্ধির অনুমতি তারা পেয়েছিল (এই বরাতটা অবশ্য পায় ওরেভার পারিবারিক সংস্থা অজন্তা ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাইভেট লিমিটেড)। সেতু ভেঙে পড়ার দিন ওরেভার পক্ষে ১৭ টাকা মূল্যের সাড়ে ছশোর মতো টিকিট বিক্রি করা হয়েছিল বলে সংবাদ বেরিয়েছে। জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য ২৬ অক্টোবর ২০২২ সেতু খুলে দেওয়ার আগে ওরেভার কর্ণধার জয়সুখভাই প্যাটেল জানান — সেতুতে নবরূপ দানে তাঁরা দু’কোটি টাকা খরচ করেছেন! তাহলে, ৭৬৫ ফুট দীর্ঘ এবং ৪.৬ ফুট চওড়া ১৪৪ বছরের পুরনো, জংধরা কেবল যুক্ত সেতুর মেরামতির খরচ মাত্র দু’কোটি! জয়সুখভাই প্যাটেল আরও জানান, মেরামতির কাজে তাঁরা বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করেছেন এবং ‘বিশেষজ্ঞ সংস্থার’ নির্দিষ্ট করা উপকরণ তৈরি করিয়ে সেগুলো সারাইয়ের কাজে লাগিয়েছেন। সেগুলোর ব্যয়ও নিশ্চয় ঐ দু’কোটির মধ্যে রয়েছে। এই সমস্ত বিষয় সারাইয়ের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন না তুলে পারেনা। এবং জংধরা কেবল ঘষে-মেজে রং করার অভিযোগের সত্যতার আভাসও দেয়।
সারাইয়ের জন্য সেতু মার্চ মাস থেকে বন্ধ ছিল। মেরামতি শুরুর সময় বলা হয়েছিল সেতু আট থেকে বারো মাস বন্ধ থাকবে। কিন্তু সারাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময় শেষ হওয়ার আগেই সেতুকে খুলে দেওয়া হল। এই খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ওরেভা গোষ্ঠীর নিজের না এর পিছনে প্রশাসনের চাপ কাজ করেছিল তা জানতে পারাটা একরকম অসম্ভব। তবে, সেতু খোলা হয়েছিল গুজরাটি নববর্ষের দিন। দেওয়ালি উৎসবের সময় চলছিল এবং সামনে ছিল ছট পুজো। আর গুজরাট বিধানসভার নির্বাচন তো রয়েইছে। এই আবহে জনগণের কাছে আকর্ষণীয় সেতুতে প্রবেশ ও ঘুড়ে বেড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার তাড়নার কাছে কি অবহেলিত হল জন সুরক্ষা?
এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে গুজরাত রাজ্য সরকার এবং মোরবী পুরসভার মধ্যে একটু বাদানুবাদ দেখা গেল, যদিও দুটোই বিজেপি শাসিত। মোরবী পুরসভার প্রধান অফিসার সন্দীসসিন জালা বলেছেন, “২৬ অক্টোবর ঐ কোম্পানি (ওরেভা) আমাদের না জানিয়েই সেতুর উদ্বোধন করে। ওরা জনসাধারণের জন্য সেতু সারাইয়ের আগে আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি।” তিনি আরও জানিয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে নেওয়া সেতুর কোনো ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’ও ছিলনা, এবং সেতু উদ্বোধনের সময় পুরসভার কোনো অফিসারও উপস্থিত ছিলেন না। আর গুজরাতের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা নীতিন প্যাটেলের কথায়, “সেতুর সংস্কার ও উদ্বোধন করিয়েছেন মোরবীর পুর কর্তৃপক্ষ। এতে গুজরাত সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিলনা।” জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনায় এবং প্রবল চাপের মুখে বিজেপির সবাই দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে। জনগণের কাছে এই প্রয়াস কতটা আমল পাবে তা অবশ্যই কৌতূহলের বিষয়। তবে, গুজরাট নির্বাচনে এই দুর্ঘটনার একটা প্রভাব যে পড়বে তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না।
১৯৯০’র দশকের গোড়ায় নরসিমা রাওয়ের কংগ্ৰেসি জমানায় চালু হওয়া নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি অর্থনীতিতে কর্পোরেট আধিপত্যের পথ প্রশস্ত করে। আর নরেন্দ্র মোদী গুজরাটে এই নীতিকে এক উচ্চতর মাত্রায় নিয়ে গিয়ে রাজনীতি-কর্পোরেট সখ্যতাকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেন। অর্থনীতির এই ধারায় কর্পোরেটদের ফুলেফেঁপে ওঠার সঙ্গে রাজনীতিবিদদেরও আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কর্পোরেট তোষণ ও কর্পোরেটদের হাতে আর্থিক-প্রাকৃতিক সম্পদের সমর্পণের পথে দুর্নীতির বৃদ্ধিও অমোঘ হয়ে ওঠে। এই ‘গুজরাট মডেল’কেই নরেন্দ্র মোদী আজ সর্বভারতীয় স্তরে প্রয়োগ করছেন। রবিবার, অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর ২০২২ সন্ধ্যায় সেতু ভেঙে পড়লেও নরেন্দ্র মোদী তার পরপরই দুর্ঘটনাস্থল ও আহতদের দেখতে হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় পাননি। ‘কর্তব্য’ পালনের নামে গুজরাট নির্বাচনের আগে প্রকল্পগুলোর শিলান্যাস করে গিয়েছেন, গুজরাতে নির্বাচনের দিন ঘোষণায় বিলম্ব ঘটিয়ে যে ‘কর্তব্য’ করার সুযোগ নির্বাচন কমিশন তাঁকে করে দিয়েছে। পরে, মঙ্গলবার ১ নভেম্বর ২০২২ বিকেলে তিনি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং বেছে নেওয়া কয়েকজন আহত মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে তিনি প্রশাসনিক আধিকারিকদের বলেন যে, সমস্ত দিক থেকে তদন্ত করে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করতে এবং তার থেকে ‘শিক্ষা’ নিতে হবে। তবে, এই দুর্ঘটনা সর্বাগ্ৰে এই বিষয়টাকেই সামনে আনছে যে, প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। তাহলে, গ্ৰেপ্তার হওয়া ন’জনের মধ্যে শুধু দু’জন ম্যানেজার, দু’জন শ্রমিক, তিনজন নিরাপত্তা কর্মী এবং দুজন টিকিট বিক্রেতা কেন? সেতু মেরামতির দায়িত্ব পাওয়া ওরেভা গোষ্ঠীর কর্ণধারের নাম দায়ের হওয়া এফআইআর থেকে বাদ গেল কেন? তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে। তাঁকে খুঁজে বের করাটা কি প্রশাসনিক দায়িত্ব বলে নির্ধারিত হবেনা? বিজেপির কোন্ নেতার নির্দেশে দরপত্র ছাড়াই ওরেভা গোষ্ঠীর হাতে মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল, তার অনুসন্ধানও অত্যন্ত জরুরী। এবং অপরিহার্য যে ‘শিক্ষা’কে এই দুর্ঘটনা তুলে ধরছে তা হলো, সর্বভারতীয় স্তরে প্রয়োগ হতে থাকা ‘গুজরাট মডেল’কে বিলকুল বিদায় জানাতে হবে। আর তারজন্য যে এই মডেলের পৃষ্ঠপোষক ও প্রয়োগ কর্তাদের উৎখাতই সর্বাগ্ৰে প্রয়োজন তার উল্লেখ বোধকরি নিষ্প্রোয়জন।
- জয়দীপ মিত্র
২৭ অক্টোবর ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সমস্ত রাজ্যসরকারগুলিকে নিয়ে দেশের নিরাপত্তা বিষয়ক একটি মিটিং ডাকেন। ব্যাপারটা যতটা সাধারণ এক আমলাতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে বিষয়টা ঠিক ততটা সহজ সরল নয়। কেন্দ্রে চলছে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার। তার উদ্দেশ্যগুলি সম্পুর্ণ অন্যরকম। কারণ এদের সাথে সঙ্ঘ পরিবার সরাসরি যুক্ত ও তাদের পরামর্শেই চলে কেন্দ্রের এই ফ্যাসিস্ট সরকার।
২০২৪তে বিজেপি জয়যুক্ত হলে সাইবার ক্রাইম, চোরাচালান, নারী পাচার, মাদক পাচার ইত্যাদি অপরাধের তদন্তভার রাজ্যের এক্তিয়ার থেকে এনআইএ’র কাছে চলে যাবে। প্রতিটি রাজ্যে কার্যালয় খুলবে এনআইএ। এমনটাই এই মিটিং’এ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। প্রয়োজনে নতুন আইন এনে এই পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে। শুধু তাই নয় মোদী সরকার এও বলেছে যে “দেশে যেভাবে এক রেশন কার্ড, এক বিদ্যুতের গ্রিড রয়েছে, তেমনই একটি পুলিশ উর্দি দেওয়া হোক সব রাজ্যের পুলিশকে। সব রাজ্যের জন্য এক ধরনের উর্দির কথা ভাবতে পারে রাজ্যগুলি।” এইভাবে পোষাককে সামনে রেখে আগামী দিনে গোটা দেশের জন্য একটা কেন্দ্রীভূত পুলিশ বাহিনী গঠনের বিষয়টি বেশ আঁটঘাট বেঁধে ভাসিয়ে দিলেন মোদী। এটা অনেকটা হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর আদলে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে একটা বাহিনী গঠনের মতো শুনতে লাগছে।
নিজের যুক্তির পক্ষে শান দিতে মোদী আরও এগিয়ে গিয়ে বলেছেন যে ইতিমধ্যেই সারা দেশের জন্য এক রেশন কার্ড তৈরি হয়েছে। দেশবাসীর জন্য তৈরি হয়েছে একই ধাঁচের স্বাস্থ্য কার্ড। পাশাপাশি গোটা দেশে এক ভাষা, একই সঙ্গে বিধানসভা-লোকসভা নির্বাচন চালুর প্রশ্নে তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি নেতৃত্ব।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত হানতে চাইছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি। রাজ্য সরকারগুলির কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি। সংবিধান অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্যের হাতে থাকলেও সন্ত্রাস, মাদক, দেশবিরোধী কার্যকলাপ, সাইবার অপরাধের মতো ঘটনায় কেন্দ্র যে রাজ্যের অধিকারের বাইরে গিয়ে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবে, তা অমিত শাহ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেই ফেলেন। ২০২৪’র মধ্যে সবকটি রাজ্যে এনআইএ’র দপ্তর খোলা হবে বলে জানিয়েছেন অমিত শাহ। এইভাবে ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোটাই বদলে দিতে চাইছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার। এনআইএ রাজ্যের সব ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ করবে। দেখা গেল, লক্ষ্মীপুজোর দিন কলকাতায় হওয়া মোমিনপুরের গোষ্ঠী সংঘর্ষ, বেশ কিছুদিন আগে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বত্তুরে হওয়া গাড়ি বিস্ফোরণের তদন্তের ভার নিয়েছে এনআইএ। এগুলোই প্রমাণ করে রাজ্যে যে কোনো স্পর্শকাতর ঘটনাই এখন এনআইএ বা সিবিআই’র হাতে তুলে দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে।
অবশ্য বিজেপি সরকার এটা অনেক দিন থেকেই করছে। কতগুলি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যেমন,
১) জিগনেশ মেবানীর গ্রেফতারি। জিগনেস আসামে মোদী বিরোধী কথা বলেন এবং তাকে আসামের পুলিশ গুজরাতে গিয়ে গ্রেফতার করে। গুজরাত সরকার বা গুজরাত পুলিশের কাছে কোনরকম অনুমতির নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।
২) পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী দিশা রবিকে কৃষক আন্দোলনের সময় দিল্লী পুলিশ ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন থানার কোনো অনুমতি নেয়নি। এমনকি দিশা রবির মা, কন্যার গ্রেপ্তার সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না।
এছাড়াও আমরা দেখেছি তিস্তাকে গুজরাট পুলিশ মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে। তিস্তা প্রতিবাদ করেন এবং তাদের বাধ্য করেন স্থানীয় সন্তাক্রুজ থানা থেকে ওয়ারেন্ট বার করতে। তিস্তা শিতলবাদের মত আইনজীবীর যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কতটা অসহায় বোধ করবে সেটা বোঝাই যায়।
আমরা এও দেখছি ইডি এবং সিবিআই’কে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোর উপর। অর্থাৎ যেখানে বিজেপি সোজা পথে সরকার গড়তে পারবে না সেখানেই তারা বিরোধী দলগুলোর উপর সিবিআই এবং ইডি’কে লেলিয়ে দিচ্ছে।
আমরা এও লক্ষ্য করে দেখেছি যে এনআইএ কিভাবে যখন তখন যেকোন রাজ্যে ঢুকে পড়ছে এবং সেখানকার সংখ্যালঘু এবং আদিবাসী মানুষদের গ্রেফতার করছে, হয়রানি করছে এবং সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিচ্ছে।
ভারতে মুসলমান পীড়ন, দলিত নিপীড়ন, নারী নির্যাতনকারীদের মুক্তি পাওয়াটা এখন এক নিয়মে দাঁড়িয়েছে। রাম-রহিমের মতো দাগি আসামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে যে শুধু প্যারোলে ছাড়া পাচ্ছে তাই নয়, ওই কুখ্যাত অপরাধীকে দেওয়া হচ্ছে জেড প্লাস নিরাপত্তার বলয়! আর, এবার মোদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে ‘চিন্তন শিবির’ সম্মেলনে কোনো রাখঢাক না করে খোলাখুলি বলেছেন “বন্দুক ধরে যে, সে যেমন মাওবাদী তেমনি যিনি লেখনীর মাধ্যমে মাওবাদকে উৎসাহ দেন, তিনিও মাওবাদী। দু’জনেই দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। তাই এঁদের চিহ্নিত করে ছেঁটে ফেলতে হবে।” আগেও আমরা দেখেছি সরকার বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে, কখনো ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘শহুরে নকশাল’ নাম দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আর অধিকার আন্দোলনের কর্মী, বুদ্ধিজীবী আর সাংবাদিকদের জেলে ঢুকিয়েছে, বিচারব্যবস্থাকে নিজের পকেটে পুরে বছরের পর বছর দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের জামিন না দিয়ে আটকে রেখেছে। এদিকে বিলকিস বানোর ধর্ষক ও খুনিদের জেল থেকে মুক্তি দিতে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সবুজ সংকেত দেয়। সরকার বিরোধিতাই এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেবারে অতি সহজে বিরোধীদের জেলে ঢোকাতেই এই আইন। দেশকে শিক্ষিত প্রতিস্পর্ধী প্রতিবাদী ব্যক্তিমুক্ত করা ফ্যাসিবাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তারমধ্যে এবার যুক্ত করতে হবে মুক্তবুদ্ধি মানুষদের আর মানুষ যাদের কথা শোনে তাদের নামগুলো। তাই দরকার এনআইএ ।
যে কোনো প্রতিবাদী, রাজনৈতিক বিরোধী এবং নিপীড়িত জাতিসত্তা এবং জনগোষ্ঠীগুলোকে মাথা তুলতে না দেওয়ার জন্যেই এই পরিকল্পনা।
সম্প্রতি সাইবাবার পুনর্বন্দীকরণে ‘বিচারক’ যেই বিপজ্জনক মস্তিষ্কেরই অমোঘ উক্তিটি করেছিলেন, আন্তোনিও গ্রামশ্চি’কে জেলে পোরার সময়ে সেই সময়কার ‘বিচারক’ বলেছিলো “আগামী কুড়ি বছর এই আওয়াজকে বাইরে বেরোতে দেওয়া যাবে না, দেশের নিরাপত্তার কারণে”। আর আজ, মোদীও সেই লেখনী সেই মস্তিষ্ককেই দেশের নিরাপত্তার পক্ষে সবচেয়ে বড় বিপদ বলে দাগিয়ে তাঁদের ‘ছেঁটে’ ফেলার ডাক দিলেন, যে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সমস্ত রাজ্যগুলোর মুখ্যসচিব, ডিজিপি, গোয়েন্দা বাহিনীর শীর্ষকর্তা, আধা সামরিক বাহিনীর ডিজিরাও। অর্থাৎ দেশে দেশে ফ্যাসিবাদ এবং স্তাবক বিচারকরা একই ভাষায় কথা বলে, একই সুরে গান গায়।
পুরো দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় শাসন চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। রাজ্য সরকারগুলির ক্ষমতা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। সংকুচিত করা হচ্ছে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। দেশকে শক্তিশালী করার বাহানায়, কেন্দ্রীয় শাসন সমস্ত ক্ষমতাকেই কুক্ষিগত করে নিরঙ্কুশ ফ্যাসিবাদী শাসনতন্ত্র কায়েম করার দিকে এগোলো আরও এক ধাপ।
আজকে এই ভয়ঙ্কর সময়ে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে পথে নামতে হবে (তাদের নিজেদের মধ্যে বিতর্কগুলো রেখেই) এবং সাথে সাথে বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে যতটা সম্ভব হাঁটতে হবে।
- অর্ণব মুখার্জি
দেশের বৃহত্তম আর্থিক বর্গ, কৃষি-শ্রমিকদের আর্থিক দুরাবস্থা দিনের পর দিন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সংখ্যায় প্রায় ১৪ কোটি এই বিপুল সামাজিক অংশটি সবচেয়ে দরিদ্র, সবচেয়ে কম আয় করে, কোনোক্রমে টিঁকে থাকতে বিভিন্ন সময়ে মরশুমি চরিত্রের নানান ধরনের কাজ করতে বাধ্য হন।
কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের সর্বশেষ তথ্য থেকে জানা যায়, গত পাঁচ বছরের পুরুষ কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে প্রতি বছরে মাত্র ১৫ টাকা করে, অর্থাৎ, বছরে ৬ শতাংশ হারে। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে বৃদ্ধি মাত্র ২৯ শতাংশ।
২০২২’র আগস্টে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, একজন পুরুষ কৃষি শ্রমিকের মজুরির হার দৈনিক ৩৪৩ টাকা। এদিকে, একই কাজে একজন মহিলা কৃষি শ্রমিক পান দৈনিক ২৭১ টাকা। অর্থাৎ, পুরুষের তুলনায় মহিলা শ্রমিকদের মজুরি ২০ শতাংশ কম।
এটা লক্ষণীয়, গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে কম মজুরির কাজগুলো করেন সামাজিক ভাবে সবচেয়ে নিপীড়িত সামাজিক স্তর তপশীলি জাতি ও উপজাতি অংশের মানুষেরা। মজুরির ক্ষেত্রে এই বৈষম্য দিনের পর দিন বজায় রয়েছে। প্রচণ্ড কম হারের এই অনিয়মিত মজুরি পাচ্ছেন দেশের বৃহত্তম অংশের মানুষ। বুঝতে অসুবিধে হয় না, দেশের অর্থনীতির আভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে, এই বিপুল সংখ্যাধিক্য জনসংখ্যার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো কতটা জরুরি, যা আমাদের আর্থিক নীতিকাররা আজ পর্যন্ত আমলই দিল না।
আজ পর্যন্ত এই বৃহত্তম নিপীড়িত সামাজিক স্তরটির জন্য আইনি সুরক্ষা, ভদ্রস্থ মজুরি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কাজের নিশ্চয়তা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে সরকার নীরব। এই দাবিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে আগামীর লড়াই।
এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত বেলারি জিলা খনি কর্মীকারা সংঘ ১১ অক্টোবর ২০২২ সান্দুর থেকে শুরু করে ৭০ কিলোমিটার পদযাত্রা ১৩ অক্টোবর ২০২২ বেলারিতে শেষ করে। তিন দিনের এই পদযাত্রা সংগঠিত হয়েছিল ২০১১ সালে খনিগুলো বন্ধ হওয়ার পর কাজ হারানো শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের দাবিকে জোরালোভাবে তুলে ধরতে। এক দশক ধরে শ্রমিকদের এই সংগ্ৰাম ন্যায্য অধিকার লাভের জন্য। পদযাত্রার সূচনা করেন সমাজ আন্দোলনের কর্মী মেধা পাটকার ও কন্নড় অভিনেতা চেতন অহিমসা।
তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে মেধা পাটকার পদযাত্রার গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেন, এই পদযাত্রা হল শ্রমিকদের জীবিকা, সমান অংশ, পরিবর্তন এবং ন্যায় লাভের জন্য। কর্পোরেটপন্থী এবং ‘জল, জমি জঙ্গল’এর বেসরকারিকরণে উদ্যত যে সরকার, সেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শ্রমিক শ্রেণী এবং কৃষকদের সংগ্ৰামকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং এটাও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে ভারতবর্ষ শ্রমিক এবং কৃষকদের শ্রমে গড়া। সরকারের নামানো সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন হল ধর্ম বা জাতপাতের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে বিভাজন ঘটতে না দেওয়া। তিনি আরও বলেন, সরকার বলছে যে তারা জনগণকে সবকিছু ন্যূনতম দেবে — ন্যূনতম মজুরি, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য; আমরা কিন্তু এটা গ্ৰহণ করব না, আমাদের চাই সমান অংশ। যা কিছুতে আমাদের ন্যায্য অধিকার তারজন্যই আমাদের সংগ্ৰাম, আমাদের লড়াইটা সংবিধানের বুনিয়াদি মূল্যকে রক্ষা করার জন্যও।
চেতন অহিমসা বলেন, ন্যায় লাভের একমাত্র উপায় হল সংগ্ৰাম, এবং এই বিষয়টাকে দেখিয়ে দিয়েছে কৃষক-বিরোধী আইন প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করা কৃষকদের সংগ্ৰাম। খনি শ্রমিক এবং তাদের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন তিনি ব্যক্ত করেন।
সান্দুর থেকে পদযাত্রার সূচনায় শ্রমিকরা জানান, জরিমানা হিসাবে যে ১৯,৪৪৩ কোটি টাকা আদায় হয়েছে তা শ্রমিকদেরই শ্রমের ফসল, এবং শ্রমিকরা তার ন্যায্য অংশ চায়। পদযাত্রা বহু গ্ৰাম পরিক্রমা করে এবং তাতে নারী, শিশু, প্রবীণ নাগরিকরা ভালো সংখ্যায় পদযাত্রায় অংশ নিয়ে শ্রমিকদের দাবিগুলোকে তুলে ধরেন। আর গ্ৰামের জনগণও শ্রমিকদের সংগ্ৰামে পরিপূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দেন।
পদযাত্রা ৭০ কিলোমিটার পূর্ণ করার পর ১৩ অক্টোবর বেলারির ডেপুটি কমিশনারের অফিসের বাইরে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি কতৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবিগুলোকে বিবেচনার আশ্বাস দেন এবং শ্রমিকদের জন্য বিশেষ পুনর্বাসন প্যাকেজের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন। শ্রমিকরা যে বিশেষ পুনর্বাসনের প্রস্তাব করেছেন তা নিয়ে আলোচনার জন্য বেলারির ডেপুটি কমিশনারের তত্ত্বাবধানে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রমিকদের অধিকারকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, এবং সরকারের উচিত অবিলম্বে উদ্যোগ নিয়ে খনি শ্রমিকদের প্রতি সংঘটিত ঐতিহাসিক অন্যায়ের সুবিচার করা। বেলারির খনি শ্রমিকদের এই সংগ্ৰাম ন্যায়, মর্যাদাপূর্ণ জীবন এবং সমান অংশের জন্য।
বাইশ কোটি লোক এবং বিশাল এক আয়তনের দেশ ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল সদ্য সামনে এসেছে। এই ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর বর্তমান রাষ্ট্রপতি বোলসেনারোকে পরাস্ত করে শ্রমিক দলের নেতা ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি লুলা বিজয়ী হয়েছেন। উভয়ের ভোটের ফারাক যদিও এক শতাংশ, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ফলাফলকে ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকা ও গোটা বিশ্বের বামপন্থী শিবির অত্যন্ত ইতিবাচক রায় হিসেবে দেখছে।
গত কয়েক বছরে সারা বিশ্বে যে সমস্ত চরম দক্ষিণপন্থী ও স্বৈরতন্ত্রী শাসকেরা শাসন করছিলেন, তাঁদের অনেকে — যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প, ইজরায়েলের নেতা বেঞ্জামিন নেতানায়াহু, ব্রিটেনের বরিস জনসন — নির্বাচনে হেরে পরাজিত হয়েছেন। তুরষ্কের এরদোগান, রাশিয়ার পুতিন, ভারতের নরেন্দ্র মোদীর মতো ক্ষমতায় আসীন ছিলেন ব্রাজিলের বোলসোনারোও। কয়েকদিন আগেই ইতালিতে অতি দক্ষিণপন্থী নিও ফ্যাসিস্ট শক্তি নির্বাচনে জয় পেয়েছে। দীর্ঘদিন পর চিলিতে দক্ষিণপন্থীদের হারিয়ে সত্তর দশকের আলেন্দের পর প্রথম জয় পেয়েছেন বামপন্থীরা, কিন্তু তাদের সংবিধান বদলের প্রস্তাব আবার গণভোটে বিপুলভাবে পরাস্ত হয়েছে। এই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রাজিলের নির্বাচনে কানঘেঁষে হলেও বামপন্থী লুলার জয় এবং বোলসেনারোর মতো অতি দক্ষিণপন্থীর পরাজয় একটি ইতিবাচক ঘটনা।
বোলসেনারোর যে সমস্ত নীতি তাঁর পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে তাঁর একটি নিঃসন্দেহে কোভিড অতিমারীর মোকাবিলায় তাঁর হঠকারী নীতি, যা ব্রাজিলে সাত লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। ট্রাম্পের পতনের পেছনেও অবিবেচক কোভিড নীতি অনেকখানি দায়ী ছিল বলে মনে করা হয়। বোলসেনারোর পতনের আর একটি কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে তাঁর অবিবেচক পরিবেশ নীতি। যেভাবে আমাজন অরণ্য তাঁর আমলে ধ্বংস করা হয়েছে, তা ব্রাজিলের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরেই পরিবেশ কর্মীদের কাছে গভীর দুশ্চিন্তার ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। লুলা তাঁর নির্বাচনী প্রচারে আমাজন জঙ্গলকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বোলসেনারো জমানায় যেভাবে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের প্রিয় নেতা লুলাকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে জেলে পাঠানো হয়েছিল, কিছুদিন আগে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট সেই রায়কে পক্ষপাতদুষ্ট ও অন্যায় বলে ঘোষণা করে ও লুলাকে সমস্ত অভিযোগ সহ কারাদণ্ড থেকে মুক্তি দেয়। এই ঘটনা নির্বাচকদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
লুলা ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকা ও বিশ্ব রাজনীতির অত্যন্ত পরিচিত মুখ। ২০০৩ সালে তিনি ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার ঢের আগেই তাঁর নাম সারা বিশ্বের বাম ও গণতান্ত্রিক মহলে বিশেষ পরিচিত ছিল শ্রমিক দলের প্রধান নেতা হিসেবে। আশির দশকে এই শ্রমিক দল যখন তৎকালীন ব্রাজিলের স্বৈরশাসনের মোকাবিলার লক্ষ্যে গড়ে উঠছিল, তখন তার অগ্রণী নেতাদের অন্যতম ছিলেন তরুণ ধাতুশ্রমিক নেতা লুলা দ্য সিলভা। শ্রমিক দল প্রথমদিকে বুর্জোয়াদের সঙ্গে জোট না করেই এগনোর নীতি নিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে বাস্তব পরিস্থিতির চাপে অতি দক্ষিণপন্থীদের মোকাবিলায় বুর্জোয়াদের একাংশের সঙ্গে জোট করে আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় স্তরে সরকার গঠনের পক্ষে নীতি পরিবর্তন করে তারা। ২০০২ সালের যে নির্বাচনে লুলা প্রথমবার বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন, সেই নির্বাচনেই উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করা হয় জোটসঙ্গী জোসে আলেনকারকে, যিনি ছিলেন এক বড় পুঁজিপতি। শ্রমিক ও ক্ষেত-মজদুরদের ভোট শ্রমিক দলের জন্য নিশ্চিতই ছিল, এই নির্বাচনী বোঝাপড়া বুর্জোয়া শ্রেণির একাংশের সঙ্গে সমঝোতা ও সমর্থনের ভিত্তি তৈরি করে এবং বহুদিন পর দক্ষিণপন্থীদের হারিয়ে ব্রাজিলের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন বামপন্থীরা।
সমঝোতার কারণে লুলার সেই সময়ের সরকারকে এমন কিছু নীতি নিয়ে চলতে হয়েছিল যা ছিল বাধ্যতামূলক আপোষ। নির্বাচনের আগেই লুলা সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্তমান কার্দাসো জমানার ব্যাঙ্কগুলির আধিপত্য নষ্ট হবেনা। নির্বাচনে জেতার পরে লুলা অর্থমন্ত্রী করেন অতি রক্ষণশীল পাওলচ্চিকে। কৃষিমন্ত্রী করা হয়েছিল জমিদার শ্রেণি বা ল্যাটিফুন্ডিয়ার মালিকদের থেকে। বড় জমিদারদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়ানোর জন্য জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করার বদলে হাত দিতে হয় আমাজন অরণ্যতে। বন কেটে জমি উদ্ধার করে তা কৃষির জন্য ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করা হয়। বোলসেনারো জমানার বিরুদ্ধে আমাজন ধ্বংসের অভিযোগের বিপরীতে লুলা এবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বটে, কিন্তু বাস্তবে ২০০৩ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর ২৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি এক বছরেই ধ্বংস করা হয়েছিল। সয়াবীন চাষ বৃদ্ধি, এশিয়া ও ইউরোপে মাংস রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য আমাজনের জঙ্গল কেটে সাফ করা হয়েছিল। আজকের বোলসেনারোর মতোই লুলা সম্পর্কেও পরিবেশ ধ্বংসর অভিযোগ ছিল এবং পরিবেশবিদেরা বলেছিলেন লুলা আমাজনকে হ্যামবার্গার ফ্যাক্টরিতে পরিণত করার দিকে এগোচ্ছেন। লুলা পেনশন আইন সংস্কার করে পেনশনের জন্য ন্যূনতম চাকরীর সময়সীমা বৃদ্ধি করার মতো নীতি নেওয়ায় বিখ্যাত লাতিন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ও বামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেমস পেত্রাস অভিযোগ করে বলেছিলেন যে লুলা সরকার শ্রমজীবীদের সমর্থন বন্ধক রেখে বুর্জোয়াদের সেবা করছেন।
লুলার সরকারের আমলে দারিদ্র ও বেকারত্ব বাড়ছিল, শ্রমশক্তির অর্ধেক চলে গিয়েছিল অসংগঠিত ক্ষেত্রে, মাদকের ব্যবহার ও অপরাধ মারাত্মকভাবে বেড়েছিল। পুলিশের ক্ষমতা বহুগুণ বাড়ানো হয়েছিল। লুলা এইবার ঠিক কী নীতিমালা নেবেন তা নির্বাচনী প্রচারে স্পষ্ট করেননি। আমাজন ধ্বংস বন্ধ করবেন আর সামাজিক ঐক্যের দিকে নজর দেবেন — এই ধরনের সাধারণ কিছু আশ্বাসবার্তাই দিয়েছেন কেবল। ব্রাজিলের সংসদে বামপন্থীরা এখনো সংখ্যালঘু, বোলসেনারোর দক্ষিণপন্থী দল ও মধ্যপন্থীদেরই সংসদের দুই কক্ষে পাল্লা ভারি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সারা বিশ্বের বামপন্থীরা এবারে লুলার বিজয়ের মধ্যে ইতিবাচক বার্তা পাচ্ছেন। তার কারণ বোলসেনারোর মতো অতি দক্ষিণপন্থীর পরাজয়। ২০১৮’র পর থেকে লাতিন আমেরিকার আটটি বড় দেশের সাতটিই – আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, পেরু, হন্ডুরাস, চিলি, ব্রাজিল যে বামপন্থীদের ক্ষমতায় নিয়ে এল — তার রাজনৈতিক মূল্যও কম নয়।
- সৌভিক ঘোষাল
ইউরোপে অতি দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটেছে এবং ঘটছে। যে সুইডেনকে এক সময় সমাজ গণতন্ত্রের ঘাঁটি বলে মনে করা হতো, সেখানে নয়া-নাজিদের মধ্যে শিকড় থাকা চরম বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতার বর্ণবাদী ও অভিবাসী-বিরোধী দল ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাটস’ সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। তারা পাঁচজন ভোটারের মধ্যে একজনের সমর্থন পায়, এবং নতুন যে দক্ষিণ ঝোঁকা জোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে তার কাছে এদের সংসদীয় সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই ধরনের স্বৈরাচারী দলগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পোল্যাণ্ড, হল্যাণ্ড, অস্ট্রিয়া, স্পেন ও সার্বিয়া এবং অবশ্যই হাঙ্গেরিতে ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি এসেছে। হাঙ্গেরিতে আবার চরম দক্ষিণপন্থী পুতিন সমর্থক প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান ও তাঁর ফিডেজ পার্টি ২০১০ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। এই দলগুলো উগ্ৰ-জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী মতাদর্শ এবং অভিবাসী-বিরোধী নীতি দ্বারা চালিত, এরা নারীদের এবং এলজিবিটিদের বিরুদ্ধে জেহাদ চালায় এবং বামেদের বিরুদ্ধেও আক্রমণ হানে (প্রায়শই ‘অভিজাতদের’ ষড়যন্ত্রর অভিযোগ এনে)।
ইতালিতে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল থেকে জানা যাচ্ছে, জর্জিয়া মেলোনিই মুসোলিনির পর ইতালির সবচেয়ে দক্ষিণপন্থী সরকারের নেত্রী হবেন বলে ঠিক হয়ে রয়েছে। তাঁর ফ্রাটেল্লি দ্যা ইতালিয়া দল (ইতালির ভাইয়েরা) সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে, এবং তারা এক নতুন দক্ষিণপন্থী জোট সরকার গড়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
নীচে যে সাক্ষাৎকারটি ছাপা হচ্ছে সেটি দিয়েছেন ডেভিড বর্ডার এবং সাক্ষাৎকারটি প্রথম বেরোয় ‘বাইলাইন টাইমস’ পত্রিকার এ’বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ সংস্করণে। ডেভিড বর্ডার ‘মুসোলিনির নাতি-নাতনিরা: এখনকার ইতালিতে ফ্যাসিবাদ’ নামক পুস্তকের রচয়িতা এবং এই সাক্ষাৎকারটিতে তিনি ইতালির নয়া চরম-দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দের ঐতিহাসিক শিকড় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।
প্রশ্ন: মেলোনি সম্পর্কে আপনি আমাদের কী জানাবেন?
ডেভিড বর্ডার: জর্জিয়া মেলোনি অনেক কম বয়স থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী হয়ে রয়েছেন। তিনি রোমের শ্রমিক শ্রেণী অধ্যুষিত একটি জেলা থেকে এসেছেন এবং ১৯৯২ সালে ইতালির সামাজিক আন্দোলন সংগঠনে (এমএসআই) যোগ দেন। এমএসআই হলো একটা নয়া-ফ্যাসিবাদী দল, ১৯৪৬ সালে যেটির প্রতিষ্ঠা করে পরাজিত ফ্যাসিস্ত সরকারের সদস্যরা। …এর একটা দীর্ঘ এবং প্রায়শই হিংসা অনুসরণের ইতিহাস রয়েছে।
যুদ্ধ পরবর্তী দশকগুলোতে এমএসআই বরাবরই একটা ছোটো দলই ছিল, তবে মেলোনি ইতালির রাজনীতির এক উথালপাথাল সময়ে ঐ সংগঠনে যোগ দেন এবং এমএসআই’তে তাঁর কর্মজীবন গড়ে নেন।
তিনি প্রথম দিকে রোমের কাউন্সিলর ছিলেন, তারপর এমপি হন, এবং মাত্র ২৯ বছর বয়সে চেম্বার অব ডেপুটিজ’এ তরুণতম ডেপুটি স্পিকার হন। তিনি সিলভিও বারলুসকোনির শেষ সরকারে এমন একটা সময়ে যুবামন্ত্রী হন যখন তাঁর ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী পর্যায়ের দলকে বৃহত্তর দক্ষিণপন্থী জোটে স্বাগত জানানো হয়।
অতএব দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৯০’র দশকেই পূর্বতন ফ্যাসিস্টরা ছোটো শরিক হিসাবে বারলুসকোনি সরকারে ছিলেন। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশেষভাবে যা দেখা গেছে তা হলো, পূর্বতন ফ্যাসিস্টরা-সহ ঐ সরকারের অধিকাংশ দক্ষিণপন্থী দল প্রাধান্যমূলক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। গত নির্বাচনী ফলাফল হলো ঐ প্রক্রিয়ার যথার্থই চরম মাত্রায় পৌঁছানো।
প্রশ্ন: মেলোনির দল কি এমএসআই’এর মতোই, যে দলে তিনি প্রথম যোগ দিয়েছিলেন?
ডেভিড বর্ডার: হ্যাঁ এবং না। ১৯৯০’র দশকে এমএসআই তার নাম পাল্টে নতুন নাম রাখে অ্যালিয়ানজা ন্যাজিওনালে (জাতীয় স্তরের জোট) আর তারপর তারা বারলুসকোনির দলের (ফোর্জা ইতালিয়া) সঙ্গে মিশে যায়। সেই বছরগুলোতে তাদের নেতা জিয়ানফ্রাঙ্কো ফিনি ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তাদের কিছু দূরত্ব রচনা করার চেষ্টা করেন, যারমধ্যে নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্ৰহণ এবং হিংসা ও স্বৈরাচার পরিত্যাগের প্রতিশ্রুতিও থাকে।
ফিনি তাঁদের দলকে বারলুসকোনির দলের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার পর সেই সমস্ত লোকজন ২০১২ সালে ফ্রাটেল্লি দ্যা ইতালিয়া গঠন করেন যাঁরা মিশিয়ে দেওয়ার ঐ প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং পার্টি ঐতিহ্যের পুনপ্রতিষ্ঠার দাবিকে তুলে ধরেন। তাঁরা এমএসআই’এর লোগো তেরঙা অগ্নিশিখাকে গ্ৰহণ করেন এবং ফ্রাটেল্লি দ্যা ইতালিয়ার পতাকাতে এখনও এমএসআই’এর অগ্নিশিখা রয়েছে।
দল গঠিত হওয়ার পর গোড়ার দিকের বছরগুলোতে মেলোনি সেই সমস্ত ব্যক্তিদের ধিক্কৃত করার দিকে ঝোঁকেন যারা এরআগে নয়া-ফ্যাসিবাদী উত্তরাধিকারের অবসান ঘটিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: তাহলে, ফ্রাটেল্লি দ্যা ইতালিয়া ফ্যাসিবাদী ঐতিহ্যকেই ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে যার ওপর ভর করেই এমএসআই’এর বিকাশ ঘটেছিল?
ডেভিড বর্ডার: সঠিক কথা। জর্জিয়া মেলোনি প্রায়ই তাঁর রাজনৈতিক পূর্বপুরুষ হিসাবে জর্জিয়ো আলমিরান্তের কথা বলেন, যিনি ছিলেন এমএসআই’এর প্রতিষ্ঠাতা নেতা এবং ১৯৮৮ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে এর অতীত জীবনের অধিকাংশ সময়ে একে নেতৃত্ব দেন। আলমিরান্তে সরকারে (যুদ্ধের সময়কার ফ্যাসিবাদী সরকারে) অংশ নিয়েছিলেন; তিনি লা ডিফেসা ডেল্লা রাজ্জা (জাতি শ্রেষ্ঠত্বের সুরক্ষা) পত্রিকায় নিবন্ধ লেখেন যাতে তিনি খোলাখুলি জৈবিক বর্ণবাদী ধারণাগুলোর প্রবক্তা হয়ে ওঠেন।
মেলোনি ১৯৯২ সালে যখন এমএসআই’তে যোগদান করেন, তখন ঐ সংগঠনের প্রধান নেতা যাঁরা ছিলেন তাঁদের অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে (মুসোলিনির নেতৃত্বাধীন) নাজি কোলাবোরেশনিস্ট সোশ্যাল রিপাবলিক’এ যোগ দিয়েছিলেন।
অবশ্য, বিগত দশকগুলোতে যেভাবে তাঁরা সংগঠিত হয়ে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তাতে সেটাকে ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের সমগোত্রীয় বলা যাবেনা। উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অঙ্গীকার করেছেন, এবং মোটের উপর তাদের দলের বৃত্তে যে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো ছিল তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্রশ্ন: তবে, যে মহিলা এখন ইতালির নেত্রী হতে যাচ্ছেন তাঁর দল এবং মুসোলিনির মধ্যে প্রকৃতই এক ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে?
ডেভিড বর্ডার: একেবারে সঠিক কথা। আর, আমরা তো প্রায়ই এই ধরনের গালগল্প শুনতে পাই যে, “পার্টি তো অতীত থেকে সরে এসেছে, অতীত আর প্রাসঙ্গিক নয়, ইত্যাদি”। তবে তাঁর পার্টি প্রকৃতই যা বলছে তার দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন যে তারা যথেষ্ট পক্ষপাতিত্ব দেখায় এবং ফ্যাসিবাদের (মাত্র) আংশিক সমালোচনা করে।
উদাহরণস্বরূপ, প্রায় এক মাস আগে জর্জিয়া মেলোনি একটা ভিডিও পোস্ট করেন যাতে তিনি তাঁর দল ফ্যাসিবাদে আচ্ছন্ন হওয়ার অভিযোগকে খারিজ করতে চেয়েছেন। এরমধ্যে যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক ব্যাপারটা ছিল এই যে, ফ্যাসিবাদের সার্বিক বিরোধিতাকে এড়াতে তাঁর কেতাবি বুলির ব্যবহার। এটা করার একটা মার্কামারা উপায় হল ইতালির ১৯৩৮ সালের জাতিগত আইনের নিন্দা করা, যে আইনে জনজীবনে অংশগ্ৰহণ থেকে ইহুদি এবং অন্যান্য জাতির সংখ্যালঘুদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল … এবং আরও বলা যে ইহুদি নিধনযজ্ঞে অংশগ্ৰহণকে অবশ্যই ধিক্কার জানাতে হবে — কিন্তু সামগ্ৰিক ফ্যাসিবাদী অভিজ্ঞতার নিন্দা করা হবে না। এটা করার উদ্দেশ্য হল এই বিষয়টার আভাস দেওয়া যে, মুসোলিনি যখন হিটলারের নেতৃত্বে চলেছিলেন তখন তিনি পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন।
অন্যান্য চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলোর তুলনায় — যেমন ফ্রান্সের দল (মারি লা পেনের ন্যাশনাল রেলি) — এই দলটার তাই অনেক বেশি সংশয়হীন ফ্যাসিবাদী উত্তরাধিকার রয়েছে।
প্রশ্ন: মেলোনি কী লা পেনের মতো তাঁর আবেদনকে মূল ধারার করে তুলতে চেয়েছেন?
ডেভিড বর্ডার: তা চেয়েছেন, কিন্তু আংশিক ভাবে, তবে সেটা অত্যন্ত বৈপরীত্যপূর্ণ প্রক্রিয়া। মেলোনি জোরের সঙ্গে বলেছেন যে তিনি ইতালির আন্তর্জাতিক অবস্থানে হস্তক্ষেপ করবেন না, গুরুত্বের সঙ্গে বলেছেন যে তিনি রাশিয়া নয় ইউক্রেনকেই সমর্থন করেন, তিনি ন্যাটোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং তিনি ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বদলে তাতে পরিবর্তন আনতে চান।
এরই সাথে আমরা জর্জ সোরোস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়োনেয়ার মানবহিতৈষী) এবং বামেদের মতো ‘বিশ্বজনীনতাবাদীদের ষড়যন্ত্রর’ বিরুদ্ধে চালিত তীব্র বৈরিতাকেও দেখতে পাচ্ছি, যাদের বিরুদ্ধে ইতালির সমাজকে ধ্বংস করার অভিযোগ আনা হচ্ছে। মেলোনি প্রায়শই ‘বিশাল পরিবর্তন’ তত্ত্বের ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন যার মধ্যে দিয়ে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের সরিয়ে অভিবাসী ও মুসলিমদের আনার গোপন পরিকল্পনার কথা বলা হয়।
মেলোনির এমন অনেক নীতি রয়েছে যেগুলো অভিবাসী বিদ্বেষী এবং যেগুলোর মধ্যে নিপীড়নের অত্যন্ত অদ্ভুত ধরনের ও কঠোর পথের প্রস্তাব রয়েছে, যার একটা হল অভিবাসীদের নৌকাগুলোকে আটকাতে ভূমধ্যসাগরে নৌ অবরোধের আহ্বান। মেলোনি-সহ অতি দক্ষিণপন্থীদের আন্দোলন অন্যতম যে বিষয়টায় জোর দেয় তা হল তাঁরা অভিবাসীদের সন্তান-সন্ততিদের নাগরিকত্ব প্রদানের ধারণার বিরোধী, এমনকি তারা ইতালিতে জন্মালেও নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না। চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলি চালিত স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর কিছু ঘটনায় আমরা তাদের অ-ইউরোপীয় নাগরিকদের বিনামূল্যের খাবার দিতে অস্বীকার করতে দেখেছি, যদিও সেই সমস্ত শিশুরা ইতালিতেই জন্মেছে এবং এখানে থাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় তাদের নেই।
প্রশ্ন: ইহুদি-বিরোধী প্রচ্ছন্ন কোনো রাজনৈতিক বার্তাও কি রয়েছে?
ডেভিড বর্ডার: হ্যাঁ, তা রয়েছে, এবং দলের প্রচারে জর্জ সোরোস বেশি আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে আমরা এটা দেখতে পাচ্ছি। তারা এই দাবিটা করে থাকে যে সোরোসই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ‘জাতিগত প্রতিস্থাপন’এর পিছনে রয়েছেন এবং মেলোনি তাঁর একটা পোস্টে সোরোসকে ‘কুসীদজীবী’ বলে অভিহিত করেছেন — যে শব্দটায় শক্তিশালী (ইহুদি বিরোধী) ব্যঞ্জনা রয়েছে।
প্রশ্ন: এলজিবিটি সম্প্রদায় এবং নারীদের অধিকার সম্পর্কে তাদের ধারণা কী?
ডেভিড বর্ডার: মেলোনি বলেন যে, গর্ভপাতের যে অধিকার এখন রয়েছে তিনি সেটাকে বাতিল করতে চান না। কিন্তু তাঁর দলের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে তাঁরা গর্ভপাতের সুযোগ নেওয়াকে কঠিনতর করে তুলছেন, অবাস্তব নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক সপ্তাহের বাধ্যতামূলক সময়কাল-সহ সাত সপ্তাহের সীমা বেঁধে দিচ্ছেন।
ফ্রাটেল্লি দ্যা ইতালিয়ার একটা মার্কামারা বিষয় হলো ফাটকাবাজদের, অনলাইন সমাজমাধ্যমগুলোর দ্বারা, তাঁরা যেটাকে বলে থাকেন ‘অর্থের আন্তর্জাতিক প্রজাতন্ত্র’ তদের দ্বারা আমাদের পরিচিতির ধ্বংসসাধনের অভিযোগ, যাতে আনুগত্য বা শিকড় না থাকা খন্ডীকৃত নাগরিকদের অবয়বহীন জনসাধারণ তৈরি করা যায়।
এর বিরুদ্ধে তারা প্রথাগত, বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে মিলন হওয়া পরিবারের ধারণাকে তুলে ধরে। তারমধ্যে এলজিবিটি জনগণ সম্পর্কে অত্যন্ত রূঢ় ধারণা রয়েছে যাদের প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও শিকড়হীন বলে বর্ণনা করা হয় এবং যারা মনুষ্যোচিত বলে বিবেচিত হয়নি। এই দলের বিজয় সব ধরনের মনুষ্য বিদ্বেষী এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে উৎসাহজনক হয়ে দেখা দেবে।
প্রশ্ন: এটা কি তাহলে ইতালীয় ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তন?
ডেভিড বর্ডার: প্রতিটি নতুন দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীকে আমি কখনই ‘ফ্যাসিবাদের ফিরে আসা’ বলে অভিহিত করিনি; তবে, ফ্যাসিবাদে তাদের শিকড় এবং এই সমস্ত ধারণাকে গ্ৰহণ করার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে না পেলে আপনাকে একেবারেই দৃষ্টিহীন হতে হবে।
ইতালির সরকার যে সমস্ত নীতি অনুসরণ করছে সেগুলোকে ছাড়িয়ে মেলোনি যে উদাহরণ স্থাপন করছেন সেটা এবং রাষ্ট্র আজ যাদের নিয়ন্ত্রণে তারা এই সমস্ত ধারণার পৃষ্ঠপোষক হওয়াটা ইতালির সমাজে অত্যন্ত বিদ্বেষভাবাপন্ন পরিমন্ডলের জন্ম দেবে।
(লিবারেশন, নভেম্বর ২০২২ সংখ্যা থেকে)
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ১ নভেম্বর নিজের ডানকুনির বাসগৃহে প্রয়াত হলেন কমরেড কৌশিক ব্যানার্জী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। ছাত্র আন্দোলন থেকে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন সিপিআই(এমএল)-এর আন্দোলনে। প্রথমে কলকাতায় তারপরে বর্ধমান জেলায় তিনি পার্টি সংগঠনের কাজে যুক্ত ছিলেন। সুবক্তা হিসাবে কমরেড কৌশিক সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি গভীর শোক প্রকাশ করছেন। একইসাথে তাঁর পরিবার-পরিজন ও বন্ধু সাথীদের প্রতি আমরা সহমর্মিতা প্রকাশ করছি।
কমরেড কৌশিক ব্যানার্জী লাল সেলাম!
ধুবুলিয়ার পাথরাদহ গ্রামের কমরেড এলাহিবক্স সেখ ৩১ অক্টোবর ২০২২ বিকালে প্রয়াত হন। ’৭০ দশক থেকেই তিনি পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে পার্টির গুরুত্বপূর্ণ দায়দায়িত্ব পালন করে গেছেন, কৃষক সংগ্রামের ময়দানে সামনের সারিতে থেকেছেন। বেশ কিছুদিন ধরে গুরুতর অসুস্থতার কারণে তিনি পার্টির কাজ করতে পারতেন না, কিন্তু সারাটা জীবন পার্টির প্রতি তাঁর আস্থা ও বিশ্বাস অটুট ছিল। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে নওপাড়া অঞ্চলের পার্টি কর্মীরা তাঁর বাসগৃহে যান এবং তাঁর প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা জানান।
কমরেড এলাহি বক্স সেখ অমর রহে। তাঁকে জানাই লাল সেলাম।
==0==