ঠিক এই মুহূর্তে পরিবার ও সমাজে সাধারণ মেয়েরা কতটা অসহায়, বিপন্ন, নিরাপত্তাহীন? কী রকম হিংসার বাতাবরণে তাদের প্রাত্যহিক যাপন? তা নিয়ে আর আলাদা চর্চার প্রয়োজন নেই। প্রভাতী দৈনিক আর দূরদর্শনে দূরবাহিত হয়ে সেসব খবর রোজ, বছরভর, বছরের পর বছর মনের কোণে ক্রোধ জাগিয়ে তুলছে। জাতবর্ণ, সাম্প্রদায়িক হিংসা, লিঙ্গবৈষম্য – কমে তো নি, বরং লেলিহান হয়ে পুড়িয়ে মারছে গোটা দেশটাকে, বিশেষ করে গত প্রায় এক দশকের মোদী জমানায়। লালকেল্লায় চড়ে মোদী ‘নারী শক্তি’র যতই ‘বন্দনা’ করুন- সেটা অভিনেতা হিসেবে তার খ্যাতি বাড়ালেও, সেই বক্তব্য যে নিছক বাগাড়ম্বর তা আর বুঝতে বাকি নেই! তিনি, ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপারের কথায়, এক ‘সীমাবদ্ধ’, ‘সংকীর্ণ’ দেশের কথাই ভাবেন, ঘোষিত হিন্দুত্বের পথে দেশ পরিচালনা করেন ‘যা জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন তথা স্বাধীন ভারতের নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী’।
আবহমান কালের সামাজিক ব্যাধি – এই হিংসা ও নারীবিদ্বেষ যখন কোনও বিশেষ মতাদর্শের সওয়ার হয়ে, বিশেষ রাষ্ট্রিক উদ্দেশ্যে বিশেষ গতি পায়? যখন রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করে? এতকালের নারী আন্দোলনের সমস্ত অর্জনকে যখন নস্যাৎ করে গোটা সমাজকে পশ্চাদমুখী করতে চায়? মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করে?
আমরা দেখেছি সমান নাগরিকত্ব আন্দোলনে প্রতিবাদী ছাত্রী-গবেষক নাতাশা, দেবাঙ্গনা, সাফুরা জারগরদের কীভাবে মিথ্যা মামলায় ইউএপিএ-তে আটক রাখা হয়েছিল। বিজেপি’র আইটি সেল তথা নেতা-মন্ত্রীরা মহিলা প্রতিবাদীদের কীভাবে চরিত্র হনন থেকে শুরু করে লাগামহীনভাবে তাদের বিরুদ্ধে কুৎসিত মন্তব্য করে গেছে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় একইভাবে সুধা ভরদ্বাজ (সম্প্রতি গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় জামিন মিলেছে), সোমা সেন সহ অন্যান্য মানবাধিকার কর্মীকে দানবীয় আইনে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে। আটক রাখা হয়েছে আদিবাসী মহিলাদের, যারা নিজেরাই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা ধর্ষিত, নিগৃহীত, লুণ্ঠিত হয়েছেন।
মাত্র কিছু দিন আগে আমরা দেখেছি কীভাবে গুজরাট গণহত্যায় নিহত প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরির নিম্ন আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন শীর্ষ আদালতে খারিজ হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, আইনজীবী তিস্তা শেতলবাদকে ‘উস্কানি’ ও ‘মিথ্যা তথ্য’ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ও গ্রেপ্তার করা হল। মহিলা রাজনৈতিক মানবাধিকার কর্মী, সমাজ কর্মীদের (অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও) দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক রেখে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। অথচ সম্প্রতি ‘অমৃত মহোৎসব’ পালনের অঙ্গ হিসাবে যে ১১ জন পৃথিবীর সর্বকালের ঘৃণ্য, নৃশংস ধর্ষক-খুনীকে গুজরাট সরকার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মুক্তি দিয়েছে, তারা কারাভোগের থেকে বেশি সময় প্যারোলে ছুটি উপভোগ করেছে! তুচ্ছ কারণে মাসের পর মাস বাড়িতে কাটিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের প্রতি অসীম দয়াপরবশ হয়ে জেলে ফিরে আবার লম্বা ছুটির আবেদন করেছে।
সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় আমরা আরও উদ্বিগ্ন। দিল্লি হাইকোর্টের বিচারক প্রতিভা এম সিং ফিকি-র (এফআইসিসিআই) এক সভায় মহিলাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পোদ্যোগ, গণিতের ক্ষেত্রে ‘কী অদৃশ্য বাধা’র সম্মুখীন হতে হয় সে প্রসঙ্গে বলতে অনুরুদ্ধ হয়ে বলেন “আমাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘মনুস্মৃতি’ মহিলাদের আদর ও সম্মান দিয়েছে”। তিনি গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধান-রক্ষক হয়ে এমন কথা কী করে বলেন, তা নিয়ে বহু ব্যক্তি ও সংগঠন প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। এই গ্রন্থ বর্ণবৈষম্য তথা নারীর অবমাননা, সর্বপ্রকার অধিকার হরণের এক অভিশপ্ত দলিল। এর মতো নারীবিদ্বেষী-বর্ণবিদ্বেষী সংহিতা বুঝি দুটি নেই। মনুসংহিতায় নারীর প্রতি পুরুষকে যা যা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে তার অধিকাংশই বর্তমান ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাহলে, যার দায়িত্ব ন্যায় রক্ষকের, তিনি সেই বিশিষ্ট অবস্থান থেকে যদি সেই সংহিতার প্রশংসা করে সমাজের উদ্দেশে এমন একটি প্রতিক্রিয়াশীল নারীবিদ্বেষী বার্তা দেন, তা শুধু দুঃখের নয়, ভয়েরও।
সম্প্রতি কেরালার কোঝিকোড জেলার দায়রা আদালতের বিচারক এস কৃষ্ণকুমার লেখক-সমাজকর্মী সি চন্দ্রণের বিরুদ্ধে আনা দুই তরুণীর দুটি আলাদা যৌন হেনস্থার অভিযোগে অভিযুক্তকে আগাম জামিন মঞ্জুর করেছেন অদ্ভুত যুক্তিতে। প্রথম ক্ষেত্রে তিনি মন্তব্য করেছেন “ঘটনার দিন অভিযোগকারিণী খোলামেলা উত্তেজক পোশাক পরেছিলেন। তাই স্বভাবতই সেক্ষেত্রে ৩৫৪এ ধারায় আনা অভিযোগ গ্রাহ্য হতে পারে না।” এই নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সঙ্গত কারণেই। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তিনি জামিন মঞ্জুর করেছেন এই পর্যবক্ষেণের ভিত্তিতে, “যেহেতু অভিযুক্ত আগে থেকেই জানতেন অভিযোগকারিণী দলিত সম্প্রদায়ের, তাই তাকে স্পর্শ করার বিষয়টি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়”। ন্যায় রক্ষকের আসনে বসে এমন সংবিধানবিরোধী অসংবেদনশীল মন্তব্য! প্রসঙ্গত নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রাজস্থানের সরকারি কর্মী ভাঁওরী দেবীর ধর্ষণ মামলাতেও একই যুক্তিতে গুজ্জর সম্প্রদায়ের উঁচুজাতের পাঁচ ধর্ষককে বেকসুর খালাস দিয়েছিল আদালত। অথচ এনসিআরবি’র রিপোর্ট বলছে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন দলিত মহিলা ধর্ষণের শিকার হন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলির সমীক্ষা বলছে ৮০%-এর জন্য দায়ী উচ্চবর্ণ। এক বিচারকের এই নারীবিদ্বেষী জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য সমাজের কাছে কী বার্তা পৌঁছাবে?
দলিত কৃষক-মজদুর নেত্রী পরমজিৎ কাউর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কৃষক আন্দোলন শিখিয়েছে, পিতৃতন্ত্র ও জাতপাতের বৈষম্যের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়তে হয়-এই দুই বৈষম্যের (লিঙ্গ ও বর্ণ) বিরুদ্ধে সেটা হেনেছিল এক বিরাট আঘাত।
৭৫ বছর বয়সী ভারতকে অবশ্যই বিজেপি-আরএসএসের ক্ষমতার এই দাম্ভিক অপব্যবহার ও অবিচারকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে উঠে দাঁড়াতে হবে।
“ন্রেগা”য় (জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনে) মোদ্দা কথায় “একশো দিনের কাজের প্রকল্পে” নারী কেন্দ্রীক শ্রমদিবস সৃষ্টিতে আরও জোর দিতে সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েতরাজ মন্ত্রকের সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। তার জন্য কমিটির মতে, স্বনিযুক্তি প্রকল্পে, খামারে বা পশুপালনে নিয়োজিত নারী শ্রমকে ন্রেগার আওতায় গণ্য করা যেতে পারে। কমিটি আরও কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছে। যেমন, মূল্যবৃদ্ধির সূচক বৃদ্ধি অনুপাতে ন্রেগাশ্রমের মজুরিবৃদ্ধি দীর্ঘকাল যাবত অবহেলিত থাকছে, তার এবার নিস্পত্তি করা দরকার। ন্রেগায় মজুরি স্থির করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যভিত্তিক ও লিঙ্গগত বৈষম্য রয়েছে, তার সমাধান নিশ্চিত করা জরুরি। সেটা করতে এক অভিন্ন মজুরি কাঠামো স্থির করা উচিত, যা মানতে কেন্দ্র-রাজ্য সব তরফকেই বাধ্য থাকতে হবে। নারী মজুরদের কাজের এলাকায় তাদের পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের রাখারও সুপারিশ করেছে কমিটি, বলেছে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে স্বনিযুক্তি সদস্যাদের নিয়োগ করা যায়, যাদের কিনা ন্রেগায় শ্রম দেওয়া হিসাবেই এই কাজের নির্ধারিত মজুরি দিতে হবে।
ন্রেগায় কাজ বণ্টন সংক্রান্ত ঘোষিত বিশেষ একটা পলিসি হল, মোট শ্রমদিবসের এক-তৃতীয়াংশ কাজ দিতে হবে নারী-মজুরদের। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে নারীশ্রমের অংশগ্রহণ ছিল গড়ে ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে। নারীশ্রমের এই অংশ নেওয়ার ভাগ ২০১৮-১৯-এ মোট ২৬৭.৯৬ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে ছিল ৫৪.৫৯ শতাংশ, ২৯১৯-২০-তে ২৬৫.৩৫ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে ছিল ৫৪.৭৮শতাংশ, ২০২০-২১-এ ৩৮৯.০৯ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে ছিল ৫৩.১৯ শতাংশ, ২০২১-২২-এ ৩৬৩.০৪ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে ৫৪.৬৭ শতাংশ। আর, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে এখনাবধি সৃষ্ট ১৪১.৩৫ কোটি শ্রমদিবসের মধ্যে নারীশ্রমের অংশগ্রহণের ভাগ থেকেছে ৫৬.০৫ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে গত তিন বছরে এই ভাগটা ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে না গেলেও, কাছাকাছি ছিল। ২০২০-২১-এ ছিল ৪৫.০২, ২০২১- ২২-এ ৪৬.৬৯, ২০২২-২৩-এ ৪৮.১২ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানে জল মেশানো না থাকলে তো রীতিমতো ধর্তব্য। বুঝিয়ে দিচ্ছে সুযোগ দিলে ন্রেগায় শ্রম দেওয়ায় নারীশ্রম পুরুষশ্রমকে ছাপিয়ে যেতে পারে। তার আরও সম্প্রসারণের বা বৃদ্ধির সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা যাচ্ছে, সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সুপারিশ করা রিপোর্টে সেই ছাপ রয়েছে।
কিন্তু পাশাপাশি প্রবলভাবে দেখা দিচ্ছে এর সমস্ত সম্ভাবনা সংকোচনের শঙ্কাও। কারণ, খোদ কেন্দ্রের মোদী সরকার এই কর্মসংস্থান নিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে তুলছে। প্রথমত, এর ২০২২-২৩ বাৎসরিক কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, ধরা হয়েছে ৭৩,০০০ কোটি টাকা। বিগত ২০২১-২২ বাৎসরিকে সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ ছিল ৯৮,০০০ কোটি টাকা। এবছরের জন্য যে বরাদ্দ ধার্য হয়েছে তার থেকে আবার ১৮,৩৫০ কোটি টাকা মেটাতে হবে গত বছরের বকেয়া মজুরি বাবদ। তার মানে, কার্যত বরাদ্দ তহবিল কমে ঠেকেছে ৫৪,৬৫০ কোটি টাকায়। ফলে গতবারের তুলনায় কাজ করানো হবে ২৫শতাংশ কম ব্যয়ে। ভাঁড়ারের সংকোচন প্রক্রিয়া এমনই যে, ফি-বছর মাত্র সাত মাসের মধ্য বরাদ্দের ৯০শতাংশ অর্থ ফুরিয়ে যায়। মূল্যবৃদ্ধির ক্রমাগত সূচক বৃদ্ধি মাথায় রেখে মাথাপিছু যদি ন্যূনতম মজুরি ধরতে হয় একটু মানানসই, তাহলে জব কার্ডধারীর মোট যা সংখ্যা তাতে তাদের সবাইকে কাজ দিতে হলে মোট বরাদ্দ টাকায় মাথাপিছু কাজের সুযোগ দেওয়া সম্ভব বছরে মাত্র ১৫- ১৬ দিন। এর বেশি শ্রমদিবস তৈরি করতে হলে মাস্টার রোলে জল মেশাতে হবে, কাজ না করিয়েও ‘করানো হয়েছে’ দেখাতে হবে, মজুরিমান নিকৃষ্টতর স্তরে রাখতে হবে, মাসের পর মাস, পরের বছর পর্যন্ত মজুরি বকেয়া রাখতে হবে। কার্যত এই রীতিনীতিই চলে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকার কোপ মারে মোট বরাদ্দে, আর সেটা আরও পরের পর কোপ খায় রাজ্য স্তর থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত সব প্রশাসনিক পরিচালনায়। রাজ্যে রাজ্যে রয়েছে মজুরি বৈষম্য – দক্ষ ও অদক্ষ শ্রম ও লিঙ্গগত শ্রম ভেদে। ৩৪টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ২১টি রাজ্যে মজুরি বেড়েছে ৫শতাংশেরও কম, ১০টি রাজ্যে মজুরি বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশের ওপর। কয়েকটি রাজ্যে কোনোভাবেই মজুরি বাড়েনি। সর্বোচ্চ মজুরি বেড়েছে ৭.১৪ শতাংশ এবং গোয়ায়, গত বছরের ২৯৪ টাকা থেকে এবছর হয়েছে ৩১৫ টাকা; মজুরি সবচেয়ে কম বেড়েছে ১.৭৭ শতাংশ এবং মেঘালয়ে, ২২৬ টাকা থেকে হয়েছে ২৩০ টাকা। সবচেয়ে বেশি মজুরি হার রয়েছে ৫টি রাজ্যে – হরিয়ানা (৩৩১ টাকা), গোয়া (৩১৫ টাকা), কেরালা (৩১১ টাকা), কর্ণাটক (৩০৯ টাকা), আন্দামান ও নিকোবর (৩০৮ টাকা)। সবচেয়ে কম মজুরি হার রয়েছে ৬টি রাজ্যে – ত্রিপুরা (২১২ টাকা), বিহার ও ঝাড়খন্ড (২১০ টাকা), ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ (২০৪ টাকা)।
কেন্দ্রের বরাদ্দ বড় মাত্রাতেই ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। যে প্রকল্পের ঘোষিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল, চাহিদা ভিত্তিক কর্মসংস্থানের, তার পরিণতি করে দেওয়া হচ্ছে বরাদ্দ ভিত্তিক কোটার শ্রমদিবস। তাই রাজ্য রাজ্যে মজুরি বৈষম্য প্রকটভাবেই থাকছে, আর, কোনও রাজ্যেই ন্যূনতম সম্মানজনক মজুরিমান নেই। প্রকল্প গোটানোর নতুন নতুন ফন্দি আঁটতে মোদী সরকার অতি সক্রিয়। তার জন্য বাহানা করছে বিশেষ করে বিরোধীদল শাসিত রাজ্যে চলা ‘ন্রেগা দুর্নীতি’কে। ওইসব রাজ্যে নামিয়েছে দুর্নীতি ধরার অভিযান। ইডি-সিবিআই হানার মতো কেন্দ্রের আলাদা ‘দুর্নীতি-দমন দল’ দেশের ১২টি রাজ্যের ১১৫টি জেলায় হানাদারি চালাচ্ছে। দুর্নীতি যে নেই তা নয়, কথা হল, দুর্নীতির উন্মোচন হোক প্রকল্পের স্বাস্থ্য ফেরানোর সদিচ্ছা থেকে। কিন্তু মোদী সরকার সে বান্দা নয়। কেন্দ্রের মতিগতি বুঝিয়ে দিচ্ছে ন্রেগাকে শুকিয়ে মারাই নিশানা। এর বিরুদ্ধে তাই চাই গরিব জনতার চ্যালেঞ্জ, চাই সংগঠিত আন্দোলন।
“হর ঘর তিরাঙ্গা”। ১৩-১৫ আগস্ট ঘরে ঘরে তেরঙ্গা পতাকা তোলার জন্য মোদী সরকার এই আহ্বান করেছিল। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীর বহুল প্রচারিত ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর আনুষ্ঠানিক উদযাপনের সর্বোচ্চ বিন্দু হওয়ার কথা ছিল এই আহ্বান। প্রভাবশালী মিডিয়া যখন এই অভিযান এবং লাল কেল্লার অলিন্দ থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর একাদিক্রমে নবম স্বাধীনতাদিবস-ভাষণের উচ্চকিত প্রচারে নিমগ্ন ছিল তখন রাজস্থান এবং গুজরাট থেকে ভেসে আসা দুটি খবর আজকের ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্দেশ দিয়ে গেল।
রাজস্থানের জালোর জেলার সুরানা গ্রামের সরস্বতী বিদ্যামন্দির স্কুলের ৯ বছর বয়সী এক দলিত শিশু ইন্দ্র মেঘওয়ালকে গত ২০জুলাই ‘উচ্চবর্ণের’ জন্য ‘সংরক্ষিত’ পাত্র থেকে জল খাওয়ার অভিযোগে শিক্ষক চৈল সিং নির্মমভাবে মারধর করে এবং সেই আঘাতে ১৩ আগস্ট ইন্দ্র মারা যায়। এর দুই দিন পরে, যখন নরেন্দ্র মোদী ভারতের উন্নয়নের জন্য নারী শক্তিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন এবং মহিলাদের প্রতি যে কোনও অবমাননার জন্য শূন্য সহনশীলতার নীতির কথা বলছিলেন, তখন গুজরাটের বিজেপি সরকার এগারোজন কুখ্যাত অপরাধীকে মুক্তি দিচ্ছে যাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল গুজরাটের গোধরা-পরবর্তী গণহত্যায় বিলকিস বানোকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও তাঁর তিন বছরের মেয়ে সহ তাঁর পরিবারের চৌদ্দজন সদস্যকে হত্যা করার অপরাধে। গোধরার বিজেপি বিধায়কসহ একগুচ্ছ বিজেপি নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি এই মুক্তির সুপারিশ করে। সুপারিশে দোষীদের ‘সু-সংস্কার সম্পন্ন ব্রাহ্মণ পুরুষ’ হিসাবে প্রত্যয়িত করা হয়।
জাতবর্ণের নিপীড়ন নিবারণের লক্ষ্যে এই ধরনের অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি নিশেষ আইন থাকা সত্বেও জাতবর্ণের নিপীড়ন স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতকে সর্বদা তাড়া করে ফিরেছে। এখন যা ঘটছে তা হল দলিতবিরোধী সহিংসতার ক্রমবৃদ্ধি। সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনীর অভূতপূর্ব রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রেক্ষাপটে প্রভাবশালী সবর্ণ গোষ্ঠীগুলির মধ্যে যে অধিকারবোধ ও রক্ষাকবচ পাওয়ার নিশ্চিন্তি জন্মেছে তার ফলেই দলিত-বিরোধী সহিংসতার এই ক্রমবৃদ্ধি। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে, ঘৃণামূলক অপরাধ অবশ্যই বিজেপির হিন্দু আধিপত্যবাদী রাজনীতির একটি কেন্দ্রীয় উপাদান এবং আমরা গত তিন দশকে বিজেপির উত্থানের পর থেকে, বিশেষত কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পর থেকে এই ধরনের অপরাধের মাত্রা ও তার তীব্রতার উত্তরোত্তর উদ্বেগজনক বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি। অপরাধ আকছার ঘটলেও দোষী সাব্যস্ত হওয়া বিরল। বিলকিস বানো মামলাটি এমনই একটি বিরল মামলা যেখানে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে চলা সিবিআই তদন্তের ফলশ্রুতিতে মহারাষ্ট্রের ট্রায়াল কোর্টের বিচারে আসামীরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল এবং ২০১৭ সালের মে মাসে বোম্বে হাইকোর্ট ও তার পর ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট সেই বিচারের রায়কে বহাল রেখেছিল।
সাজা মকুবের এই আদেশ দেওয়া হয়েছে ১৯৯২ সালের নীতির ভিত্তিতে। ১৯৯২-এর এই নীতি ২০১৪ সালে পরিবর্তন করা হয়েছিল। ডিসেম্বর ২০১২’র দিল্লীর ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলনের ফলে ধর্ষণ-বিরোধী আইন আপডেট করে সাজা মকুবের সুযোগ থেকে ধর্ষণের অপরাধীদের বাদ দেওয়ার নীতি এসেছিল। গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে এবং অতি সম্প্রতি ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে মোদী সরকার কর্তৃক ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা নীতিতে বিশেষভাবে ধর্ষণ বা হত্যার মতো জঘন্য অপরাধে দণ্ডিত আসামীদের এ ধরনের ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ বাদ দেওয়া আছে। যেহেতু বিচার মহারাষ্ট্রে হয়েছিল, তাই মহারাষ্ট্র সরকারের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল এবং যেহেতু তদন্তটি সিবিআই করেছিল, তাই কেন্দ্র সরকারের সম্মতিও প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ, সমস্ত বিদ্যমান সরকারি নীতি ও বিচার-নির্দেশিকার নিরিখে দেখলে সাজা মকুবের আদেশটি ধোঁপে টেকে না।
বিলকিস বানো মামলা গুজরাট গণহত্যার সাথে জড়িত মামলাগুলির মধ্যে অন্যতম বিরল একটি মামলা যেখানে খানিক সুবিচার পাওয়া গেছিল। গণহত্যা সংগঠিত হওয়ার সময় বিলকিসের বয়স ছিল মাত্র ঊনিশ বছর এবং পুরো পরিবারের সাথে নিরাপত্তার খোঁজে যখন তাঁরা পালাচ্ছিলেন তখন তাঁদের ওপর আক্রমণ হয়। তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন এবং তাঁকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর মৃত ভেবে ফেলে গিয়েছিল দুস্কৃতিরা। তাঁর মা, বোন এবং তিন বছরের মেয়ে সহ তাঁর পরিবারের ১৪ জন সদস্যকে হামলাকারীরা হত্যা করেছিল, হামলাকারীরা ছিল তাঁর নিজের এলাকারই লোক। বিলকিস সেই আগাত ও আতঙ্ক থেকে বেঁচে ফেরে এবং দৃষ্টান্তমূলক সাহস ও দৃঢ়তার সাথে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে কিছুটা ন্যায়বিচার অর্জন করতে পেরেছিল। যেদিন স্বাধীন ভারত পঁচাত্তরে পরিণত হল সেদিনই এই জঘন্য অপরাধের অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পষ্টতই একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ যার উদ্দেশ্য সমস্ত ন্যায় বিচার প্রত্যাশীদের কাছে এক হিমশীতল বার্তা পাঠানো এবং একইসাথে ধর্ষক-ও-ঠ্যাঙাড়ে স্কোয়াডগুলিকে আরও উত্সাহিত করা যারা মোদির এই নয়া ভারতে প্রকাশ্যে এই ধরনের হুমকি দেয় ও এরকম অপরাধ সংগঠিত করে। জাকিয়া জাফরির আবেদন খারিজ হওয়া এবং তিস্তা শেতলবাদের প্রতিশোধমূলক গ্রেপ্তারির সাথে সাথে বিলকিস বানো রায়ের এই প্রত্যাহার বিশ্বকে জানান দিচ্ছে যে ভারত এখন সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের গুজরাট মডেল দ্বারা শাসিত হচ্ছে যেখানে গণহত্যার নৃশংস অপরাধীরা উপভোগ করবে লাগামহীন ক্ষমতা ও দায়মুক্তি।
৭৫ বছর বয়সী ভারতকে অবশ্যই ক্ষমতার এই দাম্ভিক অপব্যবহার ও অবিচারকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধভাবে উঠে দাঁড়াতে হবে এবং কোনো বিলম্ব ছাড়াই এই মকুবনামা প্রত্যাহার করার জন্য আরও জোর দিতে হবে। গুজরাটে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মালা পরিয়ে মিষ্টি খাওয়ানোর দৃশ্য এবং রাজস্থানে ৯ বছর বয়সী ইন্দ্র মেঘওয়ালের হত্যাকারীর সমর্থনে জমায়েত খুব স্পষ্টভাবেই দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে ফ্যাসিবাদী শাসন কেবল নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষের ওপর ক্রমাগত ভয়ঙ্কর সহিংসতাই চালিয়ে যায় না, অধিকন্ত সেই সহিংসতাকে বৈধতা দেয় ও উদযাপন করে। এই ফ্যাসিবাদী সহিংসতার কবল থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য জনগণের সুসমন্বিত এক গণআন্দোলন গড়ে তোলা ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে আমাদের সামনে সবচেয়ে জরুরি কাজ।
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৩ আগস্ট ২০২২
অবিলম্বে ‘একশো দিনের কাজ’ চালু করা সহ পাঁচদফা দাবিতে পান্ডুয়ায় বিডিও গণডেপুটেশন দেওয়া হয় গত ১৮ আগস্ট সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পান্ডুয়া ব্লক কমিটির উদ্যোগে। ডেপুটেশনে ব্লকের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেশকিছু সংগ্রামী নারী-পুরুষ অংশ নেন। পাঁচজনের এক প্রতিনিধিদল বিডিওর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। স্মারকলিপিতে পাঁচটি দাবি তুলে ধরা হয়।
১) বন্ধ হয়ে থাকা এনআরইজিএ’র কাজ পুনরায় চালু করতে হবে এবং কোন অজুহাতেই ঘোষিত মজুরির চেয়ে কম মজুরি দেওয়া চলবেনা। পরিবারভিত্তিক নয়, ব্যক্তিভিত্তিক জবকার্ড দিতে হবে।
২) সরকারি আবাসন প্রকল্পে ঘরের জন্য যাদের নাম অনুমোদিত হয়েছে তাদের নামের তালিকা জনসমক্ষে, খোলা জায়গায় প্রকাশ করতে হবে। জীর্ন হয়ে পড়া ঘর ইটের হলেও (তা সে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি বা কোনও এক সময়ে সরকারি অর্থে নির্মিত — যাই হোক না কেন) উপযুক্ত তদন্ত সাপেক্ষে, আবেদনকারীকে প্রকল্পের সুযোগ দিতে হবে।
৩) ‘খাদ্য সুরক্ষা’র প্রশ্নে, দাবি করা হয়, পরিবার পিছু বিনামূল্যে মাসিক ৩৫ কিলো খাদ্যশস্য সহ সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। আধার সংযুক্তি না হওয়ার কারণে কোনও ব্যক্তিকে রেশন থেকে বঞ্চিত করা চলবে না।
৪) সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে ‘বিধবা ভাতা’ পাওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান বিধিতে ৪০ বছরের কম বয়সী কোনও বিধবা এই ভাতা পান না। এই বিধির বিরোধিতা করে দাবি জানানো হয়, একজন বিধবা যে বয়সেরই হ’ন না কেন, আবেদন জানালে, তাঁকে ভাতা দিতেই হবে।
৫) ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচি যখন চলেনা তখনও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি (বিভিন্ন ভাতা থেকে এসসি/এসটি কার্ডদেওয়া পর্যন্ত) সাধারণ প্রশাসনিক দপ্তর মারফত সচল রাখতে হবে।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দাবির (‘একশো দিনের কাজ’ ফের চালু করা) প্রশ্নেই বিডিও তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন, “এটি কেন্দ্রীয় প্রকল্প। কেন্দ্র শ্রম বাজেটে যতদিন অর্থ বরাদ্দ না করছে ততদিন এই কাজ পুনরায় চালু করা সম্ভব নয়।” তিনি জানান, এই কারণেই নতুন জবকার্ড দেওয়া বন্ধ রয়েছে। ‘আবাসনের’ ক্ষেত্রে আমাদের দাবিকে নীতিগতভাবে সমর্থন জানিয়েও তিনি বলেন, “নতুন প্রকল্পে (‘আবাস প্লাস প্রকল্প’) কারা ঘর পেতে পারেন তা নিয়ে সমীক্ষা চলছে। এই সমীক্ষায় উপভোক্তাদের তালিকা প্রস্তুত করা সময় সাপেক্ষ।” তিনি আশ্বাস দেন, আধার সংযুক্তির সমস্যা হলেও কোন মানুষ রেশন থেকে বঞ্চিত হবেন না। ‘বিধবা ভাতা’ প্রসঙ্গে স্মারকলিপিতে তুলে ধরা দাবিকে তিনি পূর্ণ সমর্থন জানান এবং বলেন, বিষয়টির প্রতি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। তিনি নিশ্চিত করেন, “বিভিন্ন প্রয়োজনে, বিডিও অফিসে এলে মানুষ নিয়মিত পরিষেবা পাবে”।
প্রতিনিধি দলে ছিলেন শিপ্রা চ্যাটার্জি, দিবস মালিক, বিনয় দাস, মহম্মদ ইউসুফ মন্ডল ও মুকুল কুমার।
দেশের রাষ্ট্রপতি এখন আদিবাসী। বাঁকুড়া জেলার সভাপতি আদিবাসী। বাঁকুড়া থেকে অন্যতম রাজ্যের মন্ত্রী আদিবাসী তবুও আদিবাসীরা তাদের বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত। বহু লড়াইয়ের ফলে ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় আইন হয় যে বনের জমিতে চাষাবাদ করা আদিবাসীদের জমির পাট্টা দেওয়া হবে। কিন্তু আইন হলেও সরকারের গড়িমসির কারনে আজও বহু মানুষ পাট্টা পায়নি। অসংখ্য অধিকার আদায়ে আদিবাসী ও বনবাসীরা জোট বাঁধছে বাঁকুড়া শহরে মিছিল ও ডেপুটেশন সরল সাধারণ গরিব আদিবাসীরা জানেনই না যে তাঁদের বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে চাষ করে আসা জমিটার মালিক তারা নয়। তার জন্য পাট্টা নামক একটি কাগজ দরকার। কাগজের জন্য সরকার বাহাদুরের কাছে আবেদন করতে হবে। ভাগ্যবান কিছু মানুষ পাট্টা পেলেও তাদের আবার পরচা নেই। পরচার জন্য বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে বার বার গেলেও কোন এক অদৃশ্য কারণে পরচা হয়নি। আবার সামান্য কিছু পরচা হলেও জমির শ্রেণী চরিত্র জঙ্গল লেখা থাকার দরুন সরকারের বহুল প্রচারিত ‘কৃষক বন্ধু’-র মতো সরকারী সাহায্য বা কিষান মান্ডিতে সরকারি দরে ধান বিক্রিই বলুন বা অন্য সহযোগিতা সব কিছু থেকেই সাধারণ আদিবাসী কৃষক বঞ্চিত। সরকারি অফিসাররা নাকি আদিবাসীদের এই সমস্যার কথা জানেনই না। যদিও আদিবাসীদের জেলা সভাধিপতি আছেন, মন্ত্রী আছেন। মাঝে মাঝে তারা মাঠে ধান লাগানোর ছবি ফেসবুকে শেয়ারও করেন।
পাট্টা-পরচা দুরের কথা কেন্দ্র সরকার এখন বনাধিকার আইন বদলে দিয়ে আদিবাসী ও বনবাসীদের উচ্ছেদের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। রাজ্যের দেউচা-পাচামী বা অযোধ্যা পাহাড়ের মতো আমাদের বাঁকুড়া জেলাতেও কোথাও কোথাও উচ্ছেদের নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এই সব বঞ্চনার বিরুদ্ধে গত ২২ আগস্ট জেলার কয়েকটি ব্লক থেকে তিন শতাধিক আদিবাসী ও বনবাসী তামলিবান্ধ ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের ব্যানারে সুসজ্জিত মিছিল করে নিজেদের ভাষায় স্লোগান দিতে দিতে জেলা শাসক ও জেলা বনাধিকারিককে স্মারকলিপি প্রদান করে। এর আগে ও পরে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। পথসভায় বক্তব্য রাখেন সংগঠনের জেলা নেতা সুধীর মুর্মু, রামনিবাস বাস্কে সহ সোমনাথ বাস্কে, রবি মুর্মু, চন্দ্র কান্ত মুর্মু। লড়াইয়ের গান গেয়ে শোনান গান বৈদ্যনাথ।এই কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির সদস্য ফারহান হোসেন খান এবং জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জি বলেন আমাদের সংগঠন আদিবাসীদের এই বঞ্চনা ও উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সব সময় পাশে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
বক্তারা বলেন, আজ জেলা প্রশাসন আমাদের আবেদন গ্রহণ না করে বিএলআরও অফিসে আবেদন জমা করতে বললেন। আগামী কাল থেকে গঙ্গাজল ঘাঁটি ব্লক থেকে এই কাজ শুরু করব আমরা। সকলেই মিলিতভাবে একসাথে গিয়ে বিএলআরও-তে জমা করা হবে। প্রশাসনকে একমাস সময় দেওয়া হবে। এর মধ্যে যদি সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে দূর্গাপূজার পরপরই আরো বেশি মানুষকে সমাবেশিত করে বাঁকুড়া শহরের ঢোকার রাস্তাগুলো অবরোধ করে দিয়ে শহরকে অচল করে দেওয়া হবে। কারণ এই সরকার শুধু জমি থেকেই আমাদের বঞ্চিত করছেন তা না, আজ ৬ মাস ধরে আমাদের ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ করিয়ে মজুরি দেয়নি। বলছে তাদের নাকি পয়সা নেই। অথচ দুর্গাপূজা কমিটি গুলোকে অনুদান দিতে এবং বাড়িয়ে দিতে টাকার অভাব নেই। তাই অবরোধের দিন আমরা আর প্রসাসনের কাছে আসবো না। প্রশাসনকে তিনতলা থেকে নেমে রাস্তায় আমাদের কাছে এসে দাঁড়াতে হবে। এটা করতে গেলে চাই মজবুত সংগঠন। তাই নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে।
এর পরদিন ২৩ আগস্ট শখানেক মানুষের উপস্থিতিতে গঙ্গাজল ঘাঁটি ব্লকে ২৫০’র বেশি আবেদন জমা দেওয়া হয়। ঠিক হয়েছে সংগঠনকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে আগামী ২৩ ভাদ্র ওখানে বেশি বেশি মানুষের জমায়েত করে আলোচনার মাধ্যমে একটি কার্যকরী ব্লক কমিটি গঠন করা হবে।
গত ৯ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় আদিবাসী বনবাসী অধিকার পদযাত্রার ডাক দেয় বনাধিকার ও প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী মহাসভা। মূলত এই অভিযানকে সামনে রেখেই মহাসভার পথচলা শুরু। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এই সচেতনতা অভিযান চলে। ১৫ আগষ্টের পরও অনেক জেলা এই পদিযাত্রা চালিয়ে যায়। বাঁকুড়া জেলায় তপন সর্দার সহ কয়েকজনের নেতৃত্বে এই অভিযান চলে। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে, বিভিন্ন রাজ্যে আদিবাসীদের জমি ও অরণ্য উন্নয়নের নামে লুট করা হচ্ছে। বাঁকুড়া জেলাতেও এটা ঘটছে। গ্রামসভার অনুমতি ছাড়াই জমি নিয়ে নেওয়া হয়। অরণ্যের ওপর আদিবাসীদের অধিকারের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৬এর বনাধিকার আইন এবং আদিবাসী এলাকায় স্বায়ত্ত্বতার জন্য ১৯৯৬-এর পেসা আইন আছে। কিন্তু আদিবাসীদের মধ্যে এই আইনগুলি সম্পর্কেতেমন সচেতনতা নাই। সেই কারণেই এই আধিকার পদযাত্রা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। গ্রামে গ্রামে এই পদযাত্রা চালিয়ে সকল্কে এই দুটি আইন ও অন্যান্য অধিকার বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করা হয়। তপন সর্দার আরও বলেন যে, এখন আদিবাসীদের মধ্যে পড়ালেখা করা মানুষের সংখ্যা একটু বেড়েছে এবং আদিবাসীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের অনেক সংগঠন গড়ে উঠছে। যে সব সংগঠন এই অধিকার নিয়ে লড়াই করতে চায় তাদের বিভিন্নভাবে জোটবদ্ধ হতে হবে। পুরুলিয়া জেলার নেতা সুপেন হেম্ব্রম বলেন, আইনিও অনুযায়ি আদিবাসীদের অধিকার আছে, আইনগুলি আদিবাসীদের শক্তি দিয়েছে নিজের জমি বাঁচানোর। কিন্তু আইন প্রয়োগের বিষয়ে আমরা উদ্যোগি না হওয়ায় আমাদের বিভিন্নভাবে বোকা বানানো হয়। ঝাড়গ্রামের সংগঠক রাজিব বাস্কে বলেন, আফসোসের কথা হল আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই আমাদের অধিকার রক্ষা করার জন্য কিছু করে না। তার জন্য আমাদের নিজেদের জাগরণ দরকার। সম্প্রতি পরিবেশ সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন এনে আদিবাসীদের ক্ষতি করা হয়েছে এবং এখন বনসংরক্ষণের নামে আমাদের অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে কেন্দ্র সরকার।
শ্রম দপ্তরের ত্রিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী ১৪জন ছাঁটাই শ্রমিক সহ তিন শতাধিক ছাঁটাই শ্রমিককে কাজে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে এবং রাষ্ট্রীয় পরিবহন শিল্পকে কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে এআইসিসিটিউ-এর পক্ষ থেকে ধর্মতলায় লেনিন মূর্তির সামনে আজ অবস্থান ও পথসভা সংগঠিত করা হয়। এই সভায় বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ-এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড বাসুদেব বোস, রাজ্য সভাপতি কমরেড অতনু চক্রবর্তী, কলকাতা জেলার সম্পাদক কমরেড দিবাকর ভট্টাচার্য, অল ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের গৌরাঙ্গ সেন, তুহিন কয়াল, নন-পেনশন অ্যাসোসিয়েশনএর পক্ষ থেকে মধুসূদন চক্রবর্তী প্রমুখ। সভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক কমরেড নীতীশ রায়। অবসরপ্রাপ্ত সকল কর্মীদের বকেয়া টাকা, গ্র্যাচুইটি ও পেনশনের দাবিতে শ্রমিকেরা এই সভায় সোচ্চার হন। বিগত পরিবহনমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর আমলে শুধুমাত্র ট্রাম কোম্পানির প্রায় সাড়ে চারশো কাঠা জমি মাত্র আড়াইশো টাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়৷ সেই টাকা পরিবহন শিল্পের পুনরজ্জীবনের জন্য খরচ করা হল না। সভা থেকে বক্তারা প্রশ্ন তুলেছেন, সেই টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হল রাজ্যের মানুষের কাছে আজও অজানা কেন!
এইদিন এআইসিসিটিউ-এর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় পরিবহন শিল্পের দুর্নীতির সিআইডি তদন্ত দাবি করে, শিল্পের সমস্যা এবং অন্যান্য দাবিসমূহ সূত্রায়িত করে লিখিত আকারে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জানানো হয়েছে।
- ত্রিয়াশা
পূর্ব বর্ধমান জেলার বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশন (আরওয়াইএ) দ্বিতীয় জেলা সম্মেলন সফল হল ২১ আগস্ট। কালনা থানার লড়াকু শহীদ আব্দুল হালিম এবং জগন্নাথ বিশ্বাস ও সমস্ত শহীদ বিপ্লবী কমিউনিস্টদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং কক্ষে বাবুনী মজুমদার ও মেঘনা মজুমদারের গণসঙ্গীতের পর সম্মলনের মূল অধিবেশন শুরু হয়। প্রেসিডিয়ামে ছিলেন হোসেন আহম্মদ, প্রদ্যুৎ ঘোষ ও নাসরিন খাতুন এবং স্টীয়ারিং কমিটিতে চাঁদু দে ও দিলোয়ার হোসেন। রাজ্য পর্যবেক্ষক ছিলেন সৈকত ভট্টাচার্য। মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন রণজয় সেনগুপ্ত, সজল কুমার দে, কার্তিক পাল, সলিল দত্ত, রফিকুল ইসলাম, সজল পাল, আনসারুল আমান মন্ডল (বাবু), এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সম্মেলনে আরওয়াইএ’র প্রতিনিধি ছিলেন ৭০ জন। খসড়া প্রতিবেদন পাঠ করেন বিদায়ী সম্পাদক সমির বসাক। প্রতিবেদনের উপর বক্তব্য রাখেন ১০ জন প্রতিনিধি এবং নাসরিন বক্তব্যের মধ্যে বলেন যে সরকারি স্কুলগুলো এক ধরনের বন্ধের মুখে অথবা বেসরকারিকরণের হাতে চলে যাচ্ছে। সরকারি স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকা একদম কম তার ফলে এমন অবস্থা। পূর্ব বর্ধমান জেলার সংগঠনের মধ্যে মহিলা কর্মী ও সদস্য সংখ্যা কম। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। আগামীদিনে জেলা কমিটিকে এই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন হোসেন। ভিন রাজ্যে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের এই রাজ্যে কাজের ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। তাদের কাজের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দাবি তুলতে হবে। কার্তিক পাল, সলিল দত্ত ও জেলার গুরুত্বপূর্ণ পার্টি ও গণনেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সরকারি নিয়োগে ও সরকারি প্রকল্পে লাগামছাড়া দুর্নীতি চলছে এই রাজ্যের মাটিতে। একশো দিনের কাজে চলছে দুর্নীতি, কাজ করে মিলছে না মজুরি। আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার যেভাবে সাধারণ সংখ্যালঘু মানুষের উপর ফ্যাসিষ্ট আক্রমণ নামিয়ে আনছে, কখনও ধর্মের নামে উস্কানি দিচ্ছে আবার কখনও বুলডোজার রাজ কায়েম করতে চাইছে। মোদী সরকার দু’কোটি বেকার যুবকদের কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, তার কিছুই হয়নি, উপরন্তু বহু মানুষের চাকরি গেছে, কাজ গেছে। ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প একটি অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক চাকরির বিষয় মাত্র।
এই অবস্থায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে আগামীদিনে যুব আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে।
প্রতি ব্লকে যতটা সম্ভব ছোট-বড়ো আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ১৬ জনকে নিয়ে নতুন জেলা কমিটি নির্বাচিত হয়। আগামীদিনে পূর্ব বর্ধমান জেলায় বিপ্লবী যুব অ্যাসোসিয়েশনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা নিয়ে সম্মেলনের পরিসমাপ্তি হয়। জেলা সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন যথাক্রমে সমীর বসাক ও আব্দুল হাকিম মল্লিক (সুবীর)।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের প্রচারে ঝাঁ ঝাঁ করল গোটা ভারতবর্ষ। একদিকে কেন্দ্রের মোদী সরকারের ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’, অন্যদিকে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বললেন, “মহিলাদের প্রতি সম্মান দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীশক্তির পাশে থাকা জরুরি।” অথচ, একইদিনে গুজরাটের বিজেপি সরকার তাঁবেদারদের দিয়ে বিলকিসের ১১ জন ধর্ষককে গোধরা জেল থেকে মুক্ত করালো। তারপর আবার আরএসএস’এর কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে এদের মাথায় তিলক কেটে, গলায় মালা পরিয়ে, মিষ্টিমুখ করিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। গুজরাটের বিজেপি বিধায়ক সি কে রাউলজি বলেছেন, “ওরা সকলেই ব্রাহ্মণ সন্তান। মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ।” অর্থাৎ গোটা ঘটনা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ করা বিজেপি-আরএসএস’এর কাছে প্রশংসার। ২২ আগস্ট, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তির ঘটনাকে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে উত্তর ২৪ পরগণার বেলঘরিয়ায় মহিলা সংগঠন আইপোয়া ও ছাত্র সংগঠন আইসা’র যৌথ উদ্যোগে প্রতিবাদীসভা সংগঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন আইপোয়ার মিতালি বিশ্বাস, অর্চনা ঘটক, তিথি সহ অন্যান্যরা। আইসার পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন ত্রিয়াশা লাহিড়ী ও সুরত্ন। আজকের দেশব্রতী’র পক্ষ থেকে বলেন সৌভিক ঘোষাল ও জয়ন্তী দাশগুপ্ত। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে বলেন শিবশংকর গুহ রায়।
আইপোয়া’র পক্ষ থেকে হাওড়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় বিলকিস বানোর অপরাধীদের মুক্ত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মোদী ও অমিত শাহ’দের ধিক্কার জানিয়ে পোস্টারিং করা হয়।
২০ আগস্ট আইসা, এআইপিএফ, বন্দীমুক্তি কমিটি, এপিসিআর, ফ্রেণ্ডস অব ডেমক্রেসি, জামায়াতে ইস্লামী হিন্দ সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের ডাকে কলকাতায় একাদেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে ধিক্কার সভা হয় দলিত ছাত্র ইন্দ্র মেঘওয়ালের হত্যা ও বিলকিস বানোর ধর্ষকদের শাস্তি মকুবের বিরুদ্ধে। এই সভায় অন্যান্যদের সাথে আইসার পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন অত্রি ভট্টাচার্য।
দিল্লী আবার সরগরম হল কিষাণ মহাপঞ্চায়েতের জমায়েতে। গত ২২ আগস্ট এরকমই সমাবেশের সাক্ষী থাকে দিল্লী, একইসাথে অবহিত হয় বাকি দেশ। চাষিরা সংগঠিত হয়েছিলেন বকেয়া দাবিগুচ্ছের সনদ নিয়ে। প্রায় ৬০টি চাষি সংগঠনের মিলিত ফোরাম “সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ডাক দিয়েছিল ওই দিনের কর্মসূচির। তাতে সাড়া দিয়ে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, কর্ণাটক, কেরালা থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কৃষক সামিল হন। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, লখিমপুর খেরী মামলার ন্যায়বিচার, কিষাণ আন্দোলনে ধৃত সাথী বন্দীদের মুক্তি, ২০২২-এর বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ও অগ্নিপথ প্রকল্প প্রত্যাহার করার দাবিতে সোচ্চার হন সংগ্রামী চাষি জনতা। মোদী সরকার দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করেনি, প্রতারণা করেছে। সরকার আন্দোলনের রাশ নিয়ন্ত্রণ করতে মধ্যস্থতাকারী একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি কৃষকদের স্বার্থে কিছুই করেনি। ওই কমিটির লোকেরা আরএসএস-বিজেপির। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার প্রতিনিধিরা মোদী সরকারের তৈরি কমিটিতে যায়নি। কৃষকরা ছেড়ে কথা বলবেন না। আট মাস পর এই জমায়েত মনে করা হচ্ছে আবার আন্দোলন শুরু করার মহড়া। পরবর্তী আলোড়ন তোলার পদক্ষেপ স্থির করতে আগামী অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকে মহাপঞ্চায়েত আবার জড়ো হতে পারে।
বরখা দত্ত
(শিরোনাম আমাদের। ভাষান্তরঃ অভিজিৎ বসু)
আমার এই বক্তব্য একজন মেয়ে হিসাবে অন্য সমস্ত মেয়েদের কাছে আমি রাখছি। সকলের কাছেই আমি কথাগুলো বলতে চাইছি।
কল্পনা করতে পারেন, আপনি পাঁচমাসের গর্ভবতী আর কিছু হিংস্র লোক আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, একে একে এসে আপনাকে ধর্ষণ করে যাচ্ছে? কখনো ভাবতে পারেন আপনাকে স্বচক্ষে ধর্ষিত হতে দেখার পর আপনার মাকেও ধর্ষিত হতে হচ্ছে এবং আপনাকে সে দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে হচ্ছে ! আর ঠিক এরপরই আপনার দুই বোনের ধর্ষিত হওয়ার পালা! যদি ভেবে থাকেন এটাই শেষ, তাহলে ভুল করবেন। কল্পনা করুন, আহত রক্তাক্ত অবস্থায় আপনি পড়ে আছেন — আপনার হাতখানা বদমাইশরা ভেঙে দিয়েছে — ঠিক তখনই আপনার তিন বছরের মেয়েটাকে ওরা পাথরে আছাড় মেরে মাথা ভেঙ্গে দিল! এরা কিন্তু কেউ আপনার অপরিচিত নয়, সবাই প্রতিবেশি। আপনার পরিবারের কাছে ওরা রোজ দুধ কিনতো! আর আপনি কিনা ভেবেছিলেন ওরা আপনার মিত্র!
এবার ভাবুন, ১৭ বছর ধরে আপনি ন্যায়বিচারের জন্য দেশের আদালতগুলোতে মাথাকুটে মরেছেন! আর যেহেতু মামলা আপনার নিরাপত্তার জন্য ভিন রাজ্যে বদলি করা হয়েছিল, আপনাকে ছোটাছুটি করতে হয়েছে কুড়িগুণ বেশি! এরপর, যখন আপনি সবে ধ্বংসস্তুপ থেকে আবার উঠে দাঁড়াবার কথা ভাবছেন, ১১ জন ধর্ষককে রাজ্য প্রশাসনের আদেশে মেয়াদ শেষের আগেই জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হল। খুব ঘাগু নিস্পৃহ লোককেও কিন্তু এই ঘটনা একেবারে ব্যক্তিগত স্তরে গিয়ে আঘাত করবে। বিলকিস বানো আমার কাছে সেরকমই একটা ঘটনা।
২০ বছর আগের এক রাত্রে গোধরায় বিলকিসের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। কেরোসিনবাতির টিমটিমে আলোয় ত্রিপলের ছাউনির তলায় আরো অনেক মেয়ের সঙ্গে তাকে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল। এক বিধ্বস্ত শূন্যতার চাউনি ছিল তার চোখে, একটা ভাঙাচোরা অভিব্যক্তি — যেন কিছু একটা মরে গিয়েছে তার মধ্যে! বিলকিসের স্বামী ইয়াকুব আমাকে বললো, ১১ জনের মুক্তির খবর আর জেলের বাইরে তাদের মালা পরানো, মিষ্টি খাওয়ানোর সংবাদ পাওয়ার পর থেকে বিলকিস ওইরকম নিঃসাড় হয়ে গেছে। কোনো কথা বলছে না — একেবারে একা হয়ে গেছে!
আপনারা ভাবতেই পারেন বিলকিসের দুঃখের কাহিনী এখানেই শেষ। না, তা নয়! রাজ্যের যে কমিটি অভিযুক্তদের মুক্তির সুপারিশ করেছিল তাদেরই একজন, বিজেপি নেতা সি কে রাউলজি আমাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘মোজো স্টোরি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “অভিযুক্তরা সকলেই ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণরা খুব সংস্কারী হয়। জেলে ওরা নিশ্চয়ই খুব ভালো আচরণ করেছিল।” আমার সহকর্মীর নেওয়া এই সাক্ষাৎকারটি ভাইরাল হয়ে যাওয়াতে বিজেপির সমর্থকরা পর্যন্ত অস্বস্তিতে পড়েছিল।
এই সাক্ষাৎকার অবশ্য একটা জিনিস সংশয়াতীতভাবে প্রমাণ করেছে। কোনও শোধনপ্রক্রিয়ার বশে অভিযুক্ত ধর্ষকদের কারামুক্তি ঘটেনি। রাউলজি বলেছিল, “ক্রাইম কিয়া ইয়া নেহি কিয়া, পতা নেহি !” একটা অকথ্য নোংরা আইনি ভ্রষ্টাচারের খেলা চলছে! কারাদন্ডের মেয়াদ কমিয়ে মুক্তি দেবার যে নির্দেশিকা ২০২২’র গ্রীষ্মে দেওয়া হয়েছিল, তাতে পরিষ্কার বলা ছিল ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তরা এর আওতায় আসবে না। আইনজ্ঞদের মতে, গুজরাট সরকার যদি ১৯৯২’র আইন অনুযায়ী এই কর্মটি করে থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কোন ব্যক্তি কোন সরকারি স্তর থেকে এই অনুমতি দিয়েছিল সেটি রহস্যাবৃত। বিলকিস বানোর আইনজীবী শোভা গুপ্ত বছরের পর বছর ধরে ধর্ষিতাদের পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে তিনি বললেন তিনি একেবারে বিধ্বস্ত। বিলকিসকে মুখ দেখাতে পারছেন না! আমি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম বিলকিস এই রায়ের বিরুদ্ধে পিটিশন করবে কিনা, তিনি বললেন, “একজন মানুষের আর কত সাহস থাকতে পারে! এবার অন্য কেউ এসে লড়াই জারি রাখুক। সিবিআইয়ের উচিত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত . হস্তক্ষেপ করা!”
আমরা অবশ্য পুরো বিষয়টা উপেক্ষা করতেই পারি। ভাবতেই পারি যে সমস্যাটা আমাদের নয়। কিন্তু একজন মেয়ে হিসেবে আমার বলার যে এটা আমাদের সকলের সমস্যা।
শোভা গুপ্ত আমাকে বললেন, আরেকজন ধর্ষিতা এই খবর পেয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন তাঁর মামলাটি তিনি তুলে নেবেন কিনা।
যে হাল্লাবোল ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর উঠেছিল তার রেশ কী কিছু অবশিষ্ট নেই! ওই নোংরা লোকগুলোর কী বাকি জীবন জেলের মধ্যেই পচে মরা উচিত নয়! মেয়েদের সুবিচার পাওয়ার যে কোনও লড়াই কী এভাবেই শেষ হবে! এই সব প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই মিলে কতটা চেঁচাতে পারবো তার ওপর নির্ভর করছে।
তবে আসুন, আমরা চেঁচিয়ে আওয়াজ তুলি, সবকিছু নরক করে দিই !
চোর চোর রব উঠেছে দেশ জুড়ে। দুর্নীতি পাকড়াও করতে ৬ বছর আগে ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট বাতিল করা হয়েছিল। কালো টাকাও ধরা পড়েনি, কালো টাকার মালিকরাও বহাল তবিয়তে থেকে গেছে। বড় টাকার নোট বাতিল করে সব কালোকে ব্যাঙ্কে ঢুকিয়ে ফর্সা করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে সেগুলো সব ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে পার্থ, অর্পিতা, অনুব্রতদের ঘরে সেঁধিয়েছিল। ইডির ‘দক্ষ’ অফিসাররা সেসব বস্তাবন্দী নোটদের কারামুক্ত করছে, যেমনটা গুজরাট সরকার বিলকিস বানোকে ধর্ষণ ও তাঁর ৩ বছরের শিশুর হত্যাকারী ১১ জনকে রেহাই দিয়ে দায়মুক্ত করেছে, তেমনি। ওদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাধিক সোচ্চার দল ‘আপ’কেও কাঠগড়ায় তুলেছে সিবিআই, দিল্লীর উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ শিশোদিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়েছে আবগারি দুর্নীতির দায়ে। মনে রাখা দরকার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই’এর মেসিয়া ‘আন্না হাজারে’র ইন্ডিয়া এগেইনস্ট করাপশনের কালো টাকা, ২-জি দুর্নীতি, কয়লা দুর্নীতির বিরোধী লড়াই’এর বিভিন্ন সেনাপতিরা দুটি ভাগে ভাগ হয়েছে; বিজেপি ও আপ। বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বাবা রামদেব, বুজরুকির ওষুধ বানিয়ে হাজারো কোটি টাকা লুটেছেন, কোভিডে তার পৌষমাস হয়েছে। শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর’ও আছেন, যিনি যমুনার তটকে কলুষিত করেছিলেন। এছাড়া, কেজরিওয়াল গড়ে তুলেছে আপ, দখল করেছে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রীর তখত। আন্নাজি তার কাজ পুরো করে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে সটকে পড়েছেন। মাঝে মাঝে অনশনের হুমকি দিলেও সেটি আর করা হয়ে ওঠেনি। পছন্দের দল ক্ষমতায় থাকলে দুর্নীতি হলেও কী আর যায় আসে।
মহারাষ্ট্রে এনসিপি’র নবাব মালিক, শিবসেনার সঞ্জয় রাউত, কর্ণাটকে কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি ডিকে শিবকুমারদের ইডিকে দিয়ে জেলে পাঠানোর পরে এরাজ্যে পার্থ চ্যাটার্জীকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। সিবিআই কেষ্টকে হেফাজতে নিয়েছে, মনীশ শিশোদিয়াকেও নিতে চাইছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওদিকে বিলকিস বানুর ধর্ষক ও তাঁর তিন বছরের মেয়ের হত্যাকারীদের সাজা মকুব করে জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছে গুজরাট সরকার, তারা নাকি সচ্চরিত্তির ব্রাহ্মণ। শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে তো হবেই। বিজেপি করলে সাত খুন মাফ, গণধর্ষণ বা শিশু খুন তো তুচ্ছ ব্যাপার! এই যে, কাগজে মুড়ে শুভেন্দুকে নারদ মামলায় টাকা নিতে দেখা গেল, তাকে কি ধরা হয়েছে? ম্যাথু স্যামুয়েলের দেওয়া ওই টাকাটা পবিত্র ও আইনসঙ্গত ছিল! শুনছি বীরভূমের হাটে যে গরু বেচা হত, সেগুলি নাকি আসত রাজস্থান, হরিয়ানা থেকে। ওইসব রাজ্যে বিজেপি সরকার ছিল গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, রাজস্থানে পাল্টেছে তারপরে। গরু পাচার হচ্ছে জেনে বুঝেই সেসব পাঠানো হত। ওখানকার ‘প্রভাবশালী’দের কে ধরবে? না, ওরা বিজেপি, তাই গরু পাচারের সহযোগী হলেও ‘নির্দোষ’। বীরভূম থেকে গরু যেত মুর্শিদাবাদে, সেখান থেকে বাংলাদেশে, সীমান্ত পেরিয়ে। তেমনটাই জানতে পারা যাচ্ছে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত তৃণমূলের কোন নেতা মুর্শিদাবাদের দায়িত্বে ছিলেন? মুর্শিদাবাদের পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে বহরমপুর পুরসভা পর্যন্ত জোর করে তৃণমূলের ক্ষমতা দখল করার কারিগর সেই নেতাটির অনুমোদন ছাড়া মুর্শিদাবাদ থেকে গরু পাচার হোত? এমনটা বললে তো ঘোড়াও হাসবে। তাহলে সেই প্রাক্তন তৃণমূলী বর্তমান বিজেপি দলপতিকে কেন ধরা হচ্ছেনা? তিনিইতো সিবিআই’এর সঙ্গে সহযোগিতা করে বহু তথ্য দিতে পারবেন। কিন্তু, তিনি যে বিজেপির জামা পরে নিয়েছেন। আর কি ধরা যায়!
দুর্নীতিবিরোধী লড়াই’এর জার্সি গায়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদকে কায়েম করার চেষ্টা জারি আছে। এই ভারতে মূলধারার শক্তিশালী রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি করে, ঘুষ খায়, ধর্ষণ করে, খুন করে ও করায়, তোলা তোলে এগুলো মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। সেই দুর্নীতি ও ঘুষের সরাসরি আঘাত দেশের সমস্ত ধরণের মানুষের উপরে লাগে, ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই’এর মেসিয়া সেজে বিজেপি ভোট কুড়োতে ব্যস্ত। পিএম কেয়ারের টাকা, নির্বাচনি বন্ড, মহারাষ্ট্র-মধ্যপ্রদেশ-কর্ণাটকে বিধায়ক কিনে সরকার ফেলার দুর্নীতি জায়েজ; মাসাধিক সময় ৫০ জন মহারাষ্ট্রের বিধায়ককে গৌহাটিতে পাঁচতারা হোটেলে ভরণ পোষণ করানো একদম নীতিনিষ্ঠ। সেই বিজেপি নাকি দেশের দুর্নীতিরাজকে উৎখাত করবে, যেমনটা তৃণমূল কংগ্রেস করেছে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘অনিলায়ন’ নামক নিয়োগ দুর্নীতির অবসানের নামে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা জুড়ে ‘পার্থ’য়েনিয়ামের আগাছার জঙ্গল সৃষ্টি করে; যেমন মোদীজী নারীকে সম্মান দেন বিলকিস বানোর ধর্ষক ও তাঁর শিশুকন্যার হত্যাকারীদের সাজা মকুবে নীরব সম্মতি জানিয়ে।
গত এগারো বছরের তৃণমূল শাসন এটা জানিয়ে দিয়েছে তৃণমূল আর যাই করুক না কেন, দুর্নীতির বিষয়ে ‘আপস’ করবে না, দুর্নীতি করবেই করবে। খেয়াল করে দেখুন, ২০১৯ নির্বাচনের পরে ‘কাটমানি’ ফেরত দেওয়ার তৃণমূলী প্রক্রিয়া। এমন ভান যেন দুর্নীতিহীন রাজনীতি করবেন তারা। কিন্তু বিড়াল তপস্বী সাজলেও মাছ সে খাবেই। মাত্র ৩ বছর পরেই নিত্যনতুন দুর্নীতির ঢাকনা খুলছে। তবে, এটাও ভাবার, দুর্নীতি না করলে, তোলা না তুললে কেউ তৃণমূল করবে কেন? যাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো ইতিহাস নেই, আজাদীর দৃষ্টিভঙ্গী নেই, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-অংশ-সম্প্রদায়-স্তরের প্রতি আনুগত্য নেই, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কোনো নীতিগত দৃঢ় অবস্থান নেই, কোনো সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভাবনা নেই, তেমন দলের কর্মী সমর্থক নেতারা তোলা তুলবে না, ঘুষ খাবে না, সরকারি চাকরি পেতে বা দিতে অসদুপায় গ্রহণ করবে না — এমনটা তো হতে পারে না। বিরোধী তৃণমূল নেত্রীর ঘোষিত একমেবদ্বিতীয়ম কর্মসূচি ছিল সিপিআই(এম)-এর অপশাসনের ‘অবসান’ ঘটানো। অঘোষিত ছিল, তৃণমূলের ঘুষ-তোলাবাজির দুর্নীতিময় ‘সুশাসন’ চালু করা। রাজ্যে এখন সেটাই চলছে। সারদা-রোজভ্যালি-আইকোর-নারদটেট-এসএসসি-কয়লা পাচার-গরু পাচার একের পর এক দুর্নীতির উদঘাটন জানিয়ে দিচ্ছে যে, দুর্নীতি ছাড়া তৃণমূলের অস্তিত্বের অসম্ভবতা। কিন্তু, সময়টা এমনই ভয়ানক যে, এতদসত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিরোধী তৃণমূলকে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না।
- অমিত দাশগুপ্ত
৩ মার্চ রাঁচি শহরে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। দুমকা জেলার রামগড়ে একটি ৬ বছরের নাবালিকাকে ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত ৩ জনকে রাঁচির আদালত ফাঁসির আদেশ দেয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ চার্জশিট দাখিল করার মাত্র পাঁচদিনের মাথায় ধর্ষণে অভিযুক্ত অপরাধীদের চরম শাস্তি ঘোষণায় ও অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ এই শাস্তির সপক্ষে অনেকেই যেমন উচ্ছ্বসিত, আবার বেশ কিছু মানুষ এনিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, এতো তাড়াহুড়ো করে যেভাবে রায় দেওয়া হল তাতে কি আইনের সমস্ত কিছু অনুসৃত হয়েছে? প্রাণদণ্ড কি দেশে ধর্ষণের অপরাধকে কমাতে সাহায্য করেছে? নারী আন্দোলনের সাথে যুক্ত অনেক সংগঠকই মনে করছেন, সরকারের ঘাতক মনোবৃত্তি মহিলাদের জন্য আদৌ নিরাপদ নয়। প্রশ্ন উঠেছে, কিছু কিছু কোর্টের তরফ থেকে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে নির্মম শাস্তি দেওয়া সত্ত্বেও কি ধর্ষণ কমেছে? ফাঁসি কি ধর্ষণ রোখার প্রতিষেধক?
বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, নারী বা শিশুদের উপর বর্বোরচিত হিংসা, গণধর্ষণ, খুন, তারপর তথ্য প্রমাণ লোপাট করার পাশবিক হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে জনমত এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে তৎক্ষণাৎ ধর্ষকদের প্রাণদণ্ড দেওয়ার জোরালো দাবি ব্যাপকতা লাভ করে। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের মাধ্যমে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ক্রমেই ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবি হয়ে ওঠে। দেখা যাচ্ছে, আদালতগুলোর মধ্যেও এই ঘাতক মানসিকতা গ্রাস করছে। ২০১৮-১৯ সালে মধ্যপ্রদেশে অত্যন্ত অল্প সময়ের ব্যবধানে ৩৫ জন ধর্ষককে ফাঁসিতে ঝোলানোর কোর্টের আদেশ এই লক্ষণকেই প্রমাণ করে। এই ঘটনার পর ওই রাজ্যের পাবলিক প্রসিকিউশন’এর ডিআইজি রাজেন্দ্র কুমার বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করেন, “অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে এতজনকে চরম শাস্তি দেওয়াটা ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় একটা ইতিহাস তৈরি করেছে”।
অধিকাংশ নারী আন্দোলনের কর্মীরা মনে করেন, ফাঁসি ধর্ষণকে রুখতে পারে না। এনসিআরবি’র তথ্য বলছে, ভারতে এখন প্রতি ঘন্টায় দু’জন করে মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছেন। দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আদালতগুলো সর্বোচ্চ শাস্তি ঘোষণা করা সত্ত্বেও ধর্ষণকে রোখা গেল না। নারী আন্দোলনের কর্মীরা মনে করেন, রাজ্য সরকারগুলো ঘাতক মনোবৃত্তি নিয়ে চললে ধর্ষণ তো কমবেই না, নারীরাও নিরাপদে থাকতে পারবেন না।
দেশের আদালতগুলোর কাছে এখন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ যৌন হেনস্থার নানা ঘটনা বিচারাধীন। এরমধ্যে যদি মাত্র দুই শতাংশ মামলায় ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবে প্রতিবছর সরকার বা রাষ্ট্র কি ২,০০০ জন আসামীকে ফাঁসি দেবে? এই প্রশ্ন তুলেছেন সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চ’এর কর্মী রঞ্জনা কুমারী।
দেখা যাচ্ছে, ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ট্রায়াল কোর্টযে ৩০ শতাংশ ফাঁসির আদেশ দেয় তা পরবর্তীতে লঘু করে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়েছে। আরও ৬৫ শতাংশের অভিযোগ অনেকাংশেই লঘু করে দেওয়া হয়েছে। খুব সম্প্রতি গুজরাটে বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও তাঁর তিন বছরের কন্যা সহ পরিবারের সদস্যদের খুনে অভিযুক্ত ১১ জন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের গুজরাট সরকার শুধু মুক্তি দিল তাই নয়, সেই ঘৃণ্য অপরাধীর দল জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁদের সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি যে কত বড় ধোঁকা তা এই ঘটনাই দেখিয়ে দেয়। তথ্য এটাও দেখায় যে ট্রায়াল কোর্টে যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে (বা সেই আদেশ এখনও বহাল রয়েছে) তাদের অধিকাংশই সমাজের পিছিয়ে পড়া দুর্বল স্তর থেকে আগত, আর তাঁদের আর্থিক অবস্থা এতোই করুণ যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একজন আইনজীবীকেও তাঁরা নিজেদের মামলা লড়তে নিয়োগ করতে পারেন না।
বিচারপতি ভার্মা কমিটির রিপোর্টের উপর কাজ করেছেন আইনীবী শ্বেতাশ্রী মজুমদার। তিনি দেখিয়েছেন প্রতিবেশি দেশ, যেমন বাংলাদেশ-পাকিস্থান-আফগানিস্তানে ধর্ষণের মতো অপরাধে তারা সর্বোচ্চ শাস্তি, প্রাণদণ্ড দিয়ে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই দেশগুলোতে ধর্ষণ কমেনি।
এই মারাত্মক অপরাধকে ঠেকাতে হলে সার্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। একেবারে নিম্নস্তর থেকে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণজাগরণের পাশপাশি পুলিশ প্রশাসনকে এ প্রশ্নে সর্বোচ্চ সজাগতা তৎপরতা, এবং নানা সামাজিক সংগঠনকে এর বিরুদ্ধে পথে নামানোর বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
- স্বপ্না চক্রবর্তী
সেটা ছিল ১৯২০ সাল। চেন্নাই এর মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন স্থির করল যে সেখানকার একটি স্কুলের বাচ্চাদের তারা বিনামূল্যে টিফিন দেবে। কিছুদিন পর দ্য হিন্দু পত্রিকায় এই নিয়ে একটা রিপোর্টবেরোল। ১৭ নভেম্বর ১৯২০-র সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে এই উদ্যোগের ফলে স্কুলে আসার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
স্বাধীন ভারতে বাচ্চাদের বিনামূল্যে স্কুলে খাবার দেওয়ার সূচনা হয় তামিলনাড়ুতেই। সেটা ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষ। তখন মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী কামরাজ। তামিলনাড়ুর সরকার সিদ্ধান্ত নিল সমস্ত পঞ্চায়েত ও সরকার পরিচালিত প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হবে। সরকার ছাত্রপিছু নিজেরা দেড় আনা দিত। বাকি টাকার একটা অংশ স্থানীয় উদ্যোগে সংগৃহীত হত। আর একটা অংশ দিত কেয়ার নামের একটি মার্কিন এনজিও। ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টি ও স্কুলে উপস্থিতি দুটো বাড়ানোর ব্যাপারেই এই স্কিম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিল।
১৯৮২ সালে এম জি রামচন্দ্রন যখন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রাথমিক স্কুলের পাশাপাশি অঙ্গনওয়ারির ছাত্রছাত্রীদেরও বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা শুরু হল। ১৯৮৪ সালে তামিলনাড়ুর সমস্ত স্কুলকেই এর আওতায় নিয়ে আসা হল। ১৯৮৪ সালে এই স্কিম সীমিত পরিসরে শুরু হল কেরালাতেও। ক্রমশ সেখানে এর পরিসর বাড়ানো হল।
তামিলনাড়ুতে এই স্কিমের নামকরণ নিয়ে রাজনীতির জগতে কিছু বিতর্কও উঠল। এম জি রামচন্দ্রনের নামে এই প্রকল্পের নাম রাখায় কংগ্রেস আপত্তি তুলল। তারা বলল এর শুরুটা করেছিলেন কামরাজ। তাই এই প্রকল্পর সঙ্গে কামরাজের নামকেই যুক্ত করা দরকার। কিন্তু এডিএমকে এই দাবি মানল না।
পরে যাঁরা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন – করুণানিধি, জয়ললিতা বা স্ট্যালিন – সবাই এই স্কিমকে উন্নত করার ও বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। ২০২২ সালে মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন মিড ডে মিলের পাশাপাশি সমস্ত সরকারি স্কুলে বিনামূল্যে সকালের টিফিন বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন।
পাশের রাজ্য কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনরাই বিজয়ন সপ্তাহে দুদিন করে সমস্ত সরকারী স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ডিম ও দুধের বন্দোবস্ত করেছেন, যা রাজ্যজোড়া শিশুদের পুষ্টির বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
২০০২ সালের পর থেকে সারা ভারতের সমস্ত সরকারি স্কুলেই মিড ডে মিল স্কিম চলে। এখন এর নাম হয়েছে প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ। ২০১৩ সালে ভারতে যে খাদ্য নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করা হয়, মিড ডে মিল স্কিমকে তার মধ্যে নিয়ে আসা হয়। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারা এর আওতাভুক্ত। তবে এর পরিসরকে আরো বাড়িয়ে প্রাক প্রাথমিক স্তরের শিশু পড়ুয়াদেরও এর মধ্যে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় বারো লক্ষ সত্তর হাজার স্কুলের বারো কোটি শিশু মিড ডে মিল স্কিমের দ্বারা উপকৃত। কিন্তু যে টাকা বরাদ্দ করা হয়, এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে তা ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর জন্য একেবারেই যথেষ্ট নয় বলে নানা মহল থেকে বারবার অভিযোগ ওঠে। যারা রান্নার কাজ করেন তাদের সাম্মানিকও সামান্য।
এই স্কিমের সামগ্রিক ব্যয়ভারের ৬০ শতাংশ কেন্দ্রীয় সরকারের ও ৪০ শতাংশ রাজ্য সরকারের দেবার কথা। কিছু রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট বরাদ্দের পাশাপাশি অতিরিক্ত টাকার জোগান দিয়ে চেষ্টা করেন সমস্যা কিছুটা মেটানোর, খাবারের মান উন্নত করার, মিড ডে মিল কর্মীদের ভাতা বাড়ানোর। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে অনীহা দেখিয়ে চলেছেন। অনেক দাবি দাওয়ার পর এখন এই রাজ্যের মিড ডে মিল কর্মীদের ভাতা হাজার টাকা থেকে সামান্য বাড়িয়ে এখন দেড় হাজার টাকা করা হয়েছে। ভাতার অঙ্কটা আরো বেশ কিছুটা বাড়ানোর দাবিতে কর্মীরা প্রায়ই আন্দোলন ডেপুটেশন সহ নানা কর্মসূচিতে সামিল হন। কিন্তু সরকারি তরফে না দেখা যায় ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ, না দেখা যায় মিড ডে মিল স্কিমের খাবারের গুণমান বাড়ানোর জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর আয়োজন।
অথচ বাজারে শাক-সব্জি, তেল, মশলাপাতি, গ্যাস, পরিবহণের খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় মিড ডে মিলের খাবার তৈরির খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। মিড ডে মিল চালাতে সরকার যে টাকা দেয় তা দিয়ে মান বৃদ্ধি দূরে থাক, ছাত্রছাত্রীদের মুখে আর আগের মতো খাবারও তুলে দিতে পারছে না অনেক স্কুলই। নানা কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। খাবারের গুণমানের সঙ্গে সমঝোতা করতেও বাধ্য হচ্ছে অনেক স্কুল। খরচ কমাতে অনেক জায়গায় মিড ডে মিলে খাবারের পরিমাণ কমাতে হচ্ছে। একটু কমদামি সব্জি কিনে রান্না করা হচ্ছে। গ্যাসের বদলে কাঠ অথবা কয়লার উনুনও ব্যবহার হচ্ছে অনেক জায়গায়। সব থেকে বেশি সঙ্কটে পড়েছে ছোট স্কুলগুলো। বড় স্কুলে ছাত্রসংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের আর্থিক বরাদ্দ বেশি। সব ছাত্র প্রতিদিন স্কুলে আসে না। তাতে কিছুটা সুবিধা। ছাত্রসংখ্যা কম হওয়ায় ছোট স্কুলের সে সুযোগ নেই। সে জন্যে ছোট স্কুলগুলো মিড ডে মিল চালাতে বেশি পরিমাণে হিমসিম খাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে সরকার যাতে নজর দিতে বাধ্য হয়, তা নাগরিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বিষয় হওয়া দরকার।
- সৌভিক ঘোষাল
সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ১৮ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত বুলেটিন বিতর্কের ঝড় তুলেছে। ওই বুলেটিনে “প্রাইভেটাইজেশন অফ পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কস্ — অ্যান অলটেরনেটিভ পারস্পেক্টিভ” শীর্ষক নিবন্ধ যৌথভাবে লিখেছেন স্নেহাল এস হেরভাদকর, সোনালি গোয়েল এবং রিশুকা বনশল, যারা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কিং রিসার্চ ডিভিশন, ডিপার্টমেন্ট অফ ইকনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ, আরবিআই’র সাথে যুক্ত। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই শীর্ষ ব্যাঙ্কের তরফ থেকে তড়িঘড়ি করে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি মারফত জানানো হল যে ওই বক্তব্যগুলো লেখকদের নিজস্ব, আরবিআই’এর নয়।
কী আছে ওই লেখাটিতে?
উক্ত লেখায় লেখকেরা নানা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো অতি মুনাফার লক্ষ্যেই চালিত। কিন্তু, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো পুরোপুরি এই লক্ষ্যে নিজেদের পরিচালিত না করে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো বাজারের অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে, দুর্বল ব্যালেন্স শীট থাকা সত্ত্বেও কোভিড অতিমারির পরপর নেমে আসা ছোবলকে দক্ষতার সাথে ও খুব ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছে। হালে, ব্যাঙ্কগুলির যে বড় মাপের সংযুক্তিকরণ হল, তা লেখকদের মতে, ব্যাঙ্ক শিল্পকে এক মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে। সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাঙ্কিং সংস্কারের (যেমন, ন্যাশনাল অ্যাসেট রিকন্সট্রাকশন কোম্পানি লিঃ গঠনের) ফলে, লেখকদের অভিমত, ব্যালেন্স শীট থেকে অপরিশোধিত ঋণ মুছে ফেলতে সুবিধা হবে। তাঁরা মনে করেন, এরফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো আরো শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারবে। এরপর যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য তাঁরা করেছেন তা হল, “এই পৃষ্ঠভূমির উপর দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্কগুলোকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার যে বিরাট বড় সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তা ভালো করার বদলে বরং অনেক ক্ষতি ডেকে আনবে”। যদিও লেখক ত্রয়ী শেষ বিচারে বেসরকারিকরণের বিরোধিতা না করে বরং ধাপে ধাপে, আস্তে আস্তে করার পক্ষেই নিজেদের মত ব্যক্ত করেছেন।
ওই লেখায় তাঁরা দেখিয়েছেন, অতীতে নেমে আসা আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকটকালে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো থেকে আমানত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোতে চালান হয়েছে। যার অর্থ হল, আর্থিক সংকটের সময় বাজার বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর উপর নির্ভর করতে না পেরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকেই বেছে নিচ্ছে কারণ শেষোক্তদের পেছনে রয়েছে সরকারের গ্যারান্টি। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো উচ্চহারে সুদ দেওয়া সত্ত্বেও আমানত স্থানান্তরকরণের এই প্রবণতাকে রুখতে পারেনি।
প্রবন্ধটি আরও দেখিয়েছে, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো গ্রামাঞ্চল বা আধা শহরাঞ্চলে অনেক বেশি সংখ্যক শাখা খুলে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার অধীনে নিয়ে এসেছে, যার সাথে বেসরকারি ব্যাঙ্কের কোনও তুলনাই টানা যায় না। জুলাই ২০২২ পর্যন্ত গোটা দেশে ৪৫ কোটি মানুষকে ব্যাঙ্কের ছত্রছাওয়ায় নিয়ে আসা হয়েছে আর মোট ৭৮ শতাংশ অ্যাকাউন্টই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কে। গ্রামীণ ঋণ, পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের প্রশ্নে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলোর সাথে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর কোনও তুলনাই টানা যাবে না।
বোঝাই যাচ্ছে, কোনও ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যঙ্কগুলো কোনও ভূমিকাই পালন করেনি। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের পক্ষে গুপ্তা ও পানাগারিয়া, ২০২২এ একটি পলিসি প্রেসক্রিপশন করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমা দিয়েছেন। সেখানে স্টেট ব্যাঙ্ক বাদে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলোর বেসরকারিকরণের জোরালো সওয়াল করা হয়েছে, আর সেটাকে ভিত্তি করেই মোদী সরকার তৈরি করেছে ঢালাওভাবে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের দাওয়াই।
উল্লিখিত লেখাটিতে লেখকেরা দাবি করেছেন সর্বরোগহর দাওয়াই হিসাবে বেসরকারিকরণের এই টোটকার বিপরীতে তাঁরা তৈরি করেছেন এক বিকল্প পরিপ্রেক্ষিত।
নিজেদের অভিমত হিসাবে তা গণ্য না করার কথা বললেও বেশ গুরুত্ব দিয়েই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই প্রবন্ধটি ছাপিয়েছে নিজস্ব বুলেটিনে। বোঝাই যাচ্ছে, শীর্ষ ব্যাঙ্কের অন্দরেই রয়েছে এই বিতর্ক, প্রশ্ন।
- অতনু চক্রবর্তী
এবছর জানুয়ারি মাসের কর্ণাটকের বেলাগাভি জেলার রামদুর্গতালুকের তিনটি শিশু মিসলস রুবেলা বা হামের টিকা নেওয়ার পর মারা যায়, সেখানকার প্রজনন ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (আরসিএইচও) ঈশ্বরাপ্পা গোদ্দা স্বীকার করেছেন যে এই তিনজন শিশু নিশ্চিতভাবেই স্বাস্থ্যকর্মীদের অবহেলার শিকার, এবং যা প্রাথমিক টিকা নির্দেশিকা লঙ্ঘনকারী অপরাধ। এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টে একটি পিআইএল পর্যন্ত দাখিল হয়। এর আগের অন্যসব তথ্যের মধ্যে উল্লেখ্য ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে অন্ধ্র প্রদেশ (খাম্মাম জেলা) এবং গুজরাটের (ভদোদরা জেলা) শিশুদের উপর এইচপিভি ট্রায়ালের বিষয়টি, যার ফলে সাতজন শিশুর মৃত্যু হয়েছিল, ফলত দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় সরকারের টিকা ব্যবস্থায় ব্যর্থতা, অনিয়ম এবং দুর্নীতি উন্মোচিত হয়ে চলেছে।
প্রসঙ্গত ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে, বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা গুটিবসন্ত নির্মূলের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে অনেক আলোচনার পর, বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ (ডব্লুএইচএ) গুটিবসন্ত নির্মূল করার জন্য একটি প্রস্তাব পাস করে, যা আগামী বছরগুলিতে সমগ্র বিশ্বে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারগুলির এক্টিভিটির গতানুগতিক অভ্যাস বদলে দেয়। এর প্রভাবে ভারত সরকার ১৯৬২ নাগাদ ভারত পাক ও ভারত চীন যুদ্ধের আবহে ন্যাশনাল গুটিবসন্ত নির্মূল কর্মসূচি (এনএসইপি) শুরু করে, মূলত যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পরের তিন বছরের মধ্যে সফলভাবে সমগ্র জনসংখ্যাকে টিকা দেওয়া।
১৯৭৭ সালে ইমার্জেন্সির ঠিক পরে ভারতকে গুটিবসন্ত মুক্ত ঘোষণা করার সাথে সাথে, ভারত সরকার ১৯৭৮ সালে বিসিজি, ওপিভি, ডিপিটি এবং টাইফয়েড-প্যারাটাইফয়েড টিকা চালুর মাধ্যমে বর্ধিত বা এক্সপ্যান্ডেড প্রোগ্রাম অফ ইমিউনাইজেশন (ইপিআই) নামে জাতীয় স্তরের টিকাদান কর্মসূচি চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটাকে জাতীয় স্তরে প্রথম কেন্দ্রীয়ভাবে প্ল্যানড পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়।
এর পরেই ১৯৮৫ সালে, প্রোগ্রামটি ‘ইউনিভার্সাল ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম’ (ইউআইপি) হিসাবে সংশোধন ও পুনঃসজ্জিত করা হয়েছিল যাতে ১৯৮৯-৯০ সালের মধ্যে দেশের সমস্ত জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পর্যায়ক্রমে কাজ করার কথা ছিল। বহু বছর ধরে চালু থাকা সত্ত্বেও, ইউআইপি কেবলমাত্র প্রথম বছরে মাত্র ৬৫ শতাংশ শিশুকে সম্পূর্ণরূপে টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া তেমন কোনো সদর্থক উদাহরন পাওয়া যায় না।
মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মিশন ইন্দ্রধনু চালু হয়েছিল যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদের জন্য সমস্ত উপলব্ধ টিকা দিয়ে সম্পূর্ণ টিকাকরণ নিশ্চিত করা। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে টিকা বণ্টন ও প্রয়োগে মোদী সরকারের ব্যর্থতা প্রকাশ হওয়া স্বত্বেও মোদী সরকার এখন প্রচার করে যে তাদের সরকারে আসার আগে পূর্ণ টিকাকরণের কভারেজের বৃদ্ধি ছিল বছরে ১শতাংশ যা মিশন ইন্দ্রধনুর প্রথম দুটি ধাপের মাধ্যমে প্রতি বছর ৬.৭শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মোদী সরকারের দাবি মিশন ইন্দ্রধনুর চারটি পর্যায় ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিল এবং ২.৫৩ কোটিরও বেশি শিশু এবং ৬৮ লক্ষ গর্ভবতী মহিলাকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এবছর ফেব্রুয়ারি মাসে, সরকার আইএমআই-এর চতুর্থ পর্যায় চালু করে এবং টীকা প্রদানে ভারতের অভূতপুর্ব সাফল্য প্রচার করতে থাকে। কিন্তু সত্যি কথা হল যে ইউনিসেফ এবং ডব্লিউএইচও ভারত সরকারকে একটি সতর্ক বার্তা দিয়েছে কারণ দেখা গেছে ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী টিকা কভারেজ হ্রাস পেতে থাকে, ভারতে এই হ্রাসের মান বিশ্বে সর্বাধিক এবং সবথেকে বিপদজ্জনকভাবে চোখে পড়ার মতো, তথ্য অনুযায়ী ২৫ মিলিয়ন শিশু জীবনরক্ষাকারী টিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফের প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে প্রায় ৩০ বছরের মধ্যে শৈশবে টিকা দানের গ্যাপ সবচেয়ে বেশি মোদীর জমানাতেই।
২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস এবং পার্টুসিস (ডিটিপি) এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের তিনটি ডোজ গ্রহণকারী শিশুদের শতকরা হার ৫ শতাংশ পয়েন্ট কমে ৮১ শতাংশে নেমে এসেছে এবং শুধু ২০২১ সালেই নিয়মিত টিকাদানের হিসাবে আড়াই কোটি শিশু ডিটিপির এক বা একাধিক ডোজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক অপর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ভারতে ডিপথেরিয়া-টিটেনাস-পার্টুসিস (ডিটিপি) যৌথ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজটি টিকা না নেওয়া বা না পাওয়া শিশুদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এই সংখ্যা ২০১৯ সালের ১৪ লাখ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে ২৭ লাখে দাঁড়িয়েছে।
কাজেই মোদী সরকারের গাল ভরা আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রচারের প্রতিযোগিতায় থাকা রাজ্যসরকারী ট্র্যাপ এড়িয়ে টিকাব্যবস্থার ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে জনমত সংগঠিত করতে হবে আমাদের, কারন বিনামূল্যে ও নিঃশর্তে সময় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জীবনদায়ী টীকা পাওয়া নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার।
- সংগ্রাম মন্ডল
সারা ভারত কিষাণ মহাসভার নবম রাজ্য সম্মেলন
৩০-৩১ আগস্ট, ২০২২;
আনন্দ হাইত নগর, বিমান বিশ্বাস সভাগৃহ, সুবিমল সেনগুপ্ত মঞ্চ, রবীন্দ্রভবন কৃষ্ণনগর
১) কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি রোধ করো
সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতি কৃষি উপকরণের দাম কমাতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে ন্যায্য দামে সেগুলি গরিব মধ্য চাষিদের সরবরাহ করতে হবে। সারের কালোবাজারী কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। বস্তার উপর ছাপা দাম থেকে বেশি দামে বিক্রি কঠোরভাবে বন্ধ করা ও একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে হবে।
২) ফসলের লাভজনক দর চাই
সমস্ত রকম ফসলের ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য গ্যারান্টি আইন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার চালু করতে হবে। উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে সরকারকে ফসল কিনতে হবে। ২৪০০ টাকা কুইঃ দরে ধান ও ৮ হাজার টাকা কুইঃ দরে পাট কিনতে হবে। এ রাজ্যে আলু পাট প্রভৃতি ফসল সঠিক সরকারি দরে গ্রামে ক্যাম্প করে সরকারকে প্রকৃত চাষিদের থেকে কিনতে হবে। স্বল্প খরচে ফসল সংরক্ষণের জন্য ব্লকে/পঞ্চায়েতে বহুমুখী হিমঘর তৈরি করতে হবে। সেগুলির নিয়ন্ত্রণে কৃষকের তদারকি চালু করতে হবে।
৩) চুক্তি চাষিদের স্বার্থ রক্ষা করো
সরকারি উদ্যোগে গরিব চুক্তিচাষিদের নথিভূক্ত করে তাদের সমস্ত সরকারি সুযোগ দিতে হবে। জমির কাগজ নেই এমন চুক্তিচাষিদের থেকে সরকারকে ফসল কিনতে হবে, এদের সমবায় সমিতির সদস্য করতে হবে।
৪) ভূমি সংস্কারের উল্টোযাত্রা রোধ করো, কৃষকের জমির অধিকার চাই
গরিব কৃষকদের সমস্ত দখলীকৃত খাস জমির পাট্টা/পরচা দিতে হবে। খাস বেনামী জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিবণ্টন করতে হবে। খাস জমির তালিকা কৃষক সংগঠনগুলিকে দিতে হবে। বর্গা উচ্ছেদ কঠোরভাবে বন্ধ করো। নতুন বর্গারেকর্ড করার কাজ চালু রাখতে হবে। বাসস্থান সংক্রান্ত হোমেস্টেড এ্যাক্ট কার্যকরী রাখতে হবে। ব্লক ভূমিদপ্তরে দুর্নীতি কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। জমির রেকর্ড, জরিপ ও নানাবিধ বিবাদ মীমাংসার কাজে দীর্ঘসূত্রিতা, দালালরাজ বন্ধ করতে হবে।
৫) সমবায়গুলি বাঁচাও
সমবায়গুলিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে গরিব মধ্যচাষিদের কমদামে সার বীজ কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। তাঁদের বিনা সূদে সহজ শর্তে কৃষিঋণ সরবরাহ করতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে ট্রাক্টর সহ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুযোগ গরিব মধ্য চাষিদের দিতে হবে। সমবায় ব্যাংকগুলিতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগের দায়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করতে হবে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নয়, সমবায় ব্যাংকগুলিকে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে।
৬) ভূপৃষ্ঠ সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলো, সমস্ত চাষের খেতে জল চাই
নদী, খাল, বিল প্রভৃতি জলাশয়গুলিকে সংস্কার করে ভূপৃষ্ঠ সেচের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সমস্ত বন্ধ আরএলআই-গুলিকে চালু করতে হবে ও নতুন করে স্থাপন করতে হবে। চাষের মরসুমে ক্যানেলে প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, জলাধারগুলিকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। জলাশয়গুলি ভরাট করে অবৈধ নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে হবে। শিল্পের নামে বা উন্নয়নের নামে কৃষি জমির চরিত্র বদল করা যাবে না। “জল ধরো, জল ভরো” প্রকল্পের ফলে চাষের কি উন্নতি হয়েছে তার বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করতে হবে।
৭) কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে কৃষিকাজকে যুক্ত করো
১০০ দিনের কাজকে কৃষি কাজের সাথে যুক্ত করতে হবে। ফসল রোপন ও কাটার কাজকে ১০০ দিনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ১০০ দিনের কাজে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে। গ্রামের জনগণের সাথে আলোচনা করে প্রকল্প প্রস্তুত করতে হবে, “এ্যানুয়াল এ্যাকশন প্ল্যান” জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে,সেগুলি ছাপিয়ে বিলি করতে হবে। প্রকল্পের অভাব – এই অজুহাতে কাজ বন্ধ রাখা চলবে না। কেন্দ্র রাজ্য বুঝি না অবিলম্বে বকেয়া মজুরি দিতে হবে।
৮) সার ও বীজের আমদানি নির্ভরতা বন্ধ করো
এ রাজ্যের সরকারি বীজখামারগুলিকে বন্ধ করে দেওয়া চলবে না। অবিলম্বে সরকারী উদ্যোগে দেশীয় বৈচিত্রমূলক বীজ তৈরি, সংরক্ষণ ও প্রয়োজন অনুসারে সরবরাহ করতে হবে। নিম্ন মানের সার আমদানি বন্ধ করো,ভর্তুকি দিয়ে ক্ষুদ্র কৃষকদের সার দিতে হবে। জৈব সার তৈরি ও ব্যবহারে সরকারকে সহায়তা করতে হবে।
৯) প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চাই
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। মৌজা ভিত্তিক নয়, চাষিদের জোত ভিত্তিক সমীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান, মালদহ-মুর্শিদাবাদে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সুন্দরবন বাঁচাও প্রকল্প অবিলম্বে কার্যকরী করতে হবে।
১০) কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুৎ ডিজেল সরবরাহ করো
এক টাকা ইউনিট দরে কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ করো, ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুৎ ও ডিজেল সরবরাহ করতে হবে।
১১) কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলো
জেলায় জেলায় কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে আখ ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের ভিত্তিতে শিল্প গড়ে তুলতে হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশে উপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে হবে।
১২) আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করো
আদিবাসীদের বনের জমির পাট্টা পরচা দিতে হবে, কোনোরকমভাবেই উচ্ছেদ করা চলবে না।
পাট্টা পেলেও পরচা হয়নি বা পরচা পেলেও জমির চরিত্রে জঙ্গল লেখা থাকার দরুণ সরকারী সাহায্য বা সরকারি দরে ধান বিক্রি করতে পারছে না, তাই অবিলম্বে পরচা দিতে হবে। বনাধিকার আইন বদলে দিয়ে আদিবাসীদের সম্মতি ছাড়া বনের জমি অন্য কাজে ব্যবহার করা চলবে না। দেউচা থেকে অয্যোধ্যা বা তিলাবনি – উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করে আদিবাসীদের উচ্ছেদ চলবে না। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পরিষদের কাজের রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।
১৩) চা শ্রমিকদের বাঁচাও – চাই উত্তর বঙ্গের সার্বিক উন্নয়ন
চা শ্রমিকদের বাস্তু জমির পাট্টা দিতে হবে। উত্তরবঙ্গের চাষের জমির রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে নদীগুলোর সংস্কার করতে হবে। তিস্তা সেচ প্রকল্পকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে রূপায়িত করতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। সেচ প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে।
১৪) বাগিচা চাষিরা সংকটে, তাঁদের পাশে দাঁড়াও
ফল ফুল সহ নানাবিধ বাগিচা চাষে সরকারকে উপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে হবে। বিশেষত এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র মধ্য চাষিদের পুঁজি ও বাজারজাতকরণের বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। রেশম চাষ, তাঁত শিল্পের পুনরুজ্জীবিত করতে সরকারকে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে। মৎসচাষিদের কেবল কার্ড দিলেই চলবে না, এদের জন্য ব্যাংক ও সমবায়ের ঋণ সহায়তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
-- এ আই কে এম
২০ আগস্ট শিলিগুড়ি কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম সভাঘরে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দার্জিলিং জেলার প্রয়াত নেতা কমরেড মোজাম্মেল হকের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন বামপন্থী দল, সামাজিক সংগঠনের উপস্থিতি ও উপচে পড়া ভীড় ছিল দেখবার মতো। এই জননেতার প্রতি পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ সহ জেলা কমিটির সদস্যবৃন্দ, জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক ভাস্কর দত্ত সহ জেলা নেতৃত্ব, আলিপুরদুয়ার জেলা সম্পাদক চঞ্চল দাস সহ জেলা নেতৃত্ব, বিভিন্ন বামপন্থী দল, গণসংগঠন ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। স্মরণসভা পরিচালনা করেন পুলক গাঙ্গুলি, শরৎ সিংহ ও গৌরী দে। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন রনজিৎ মুখার্জি ও মীরা চতুর্বেদী। শ্রদ্ধাঞ্জলি পাঠ করেন পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু। মোজাম্মেল হককে হারানোর বেদনা ব্যক্ত করে দীর্ঘদিনের পথ চলার সঙ্গীর বিভিন্ন গুণাবলী তুলে ধরেন অভিজিৎ মজুমদার। তিনি আজকের এই কঠিন সময়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জীবেশ সরকার, আরএসপি’র জেলানেতা বিকাশ সেন রায়, সিপিআই দার্জিলিং জেলা সম্পাদক অনিমেষ ব্যানার্জি, এসইউসিআই(সি) জেলা সম্পাদক গৌতম ভট্টাচার্য, সিটু সম্পাদক সমন পাঠক, ১২ জুলাই কমিটির মনোজ নাগ, বিরোধী নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক অধ্যাপক অজিত রায়, শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের সভাপতি রূপক দে সরকার, ব্লাড ডোনার্সফোরামের পীযুষ রায়, এপিডিআর সংগঠক অভিরঞ্জন ভাদুড়ী, নাট্যকার পলক চক্রবর্তী, নর্থবেঙ্গল টি এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের অভিজিৎ রায়, চা বাগান সংগ্রাম সমিতির শমীক চক্রবর্তী, লালিগুরাস সাংস্কৃতিক সংগঠনের শুভেন্দ্র তামাং, বিশিষ্ট সমাজসেবী শংকর পাল, পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য নব কুমার বিশ্বাস। সমস্ত বক্তারাই মোজাম্মেলের বিভিন্ন সময়ে যুক্ত আন্দোলনের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। সিপিআই(এমএল) নিউ ডেমোক্রেসী ও পিসিসিসিপিআই(এমএল) শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
== 00 ==