কোথাও হুমকি, কোথাও হামলা, কোথাও অবজ্ঞা, কোথাও বা একটু সহমর্মিতা — এসব কিছু সাথে নিয়েই গত আগস্ট মাস থেকে মিড-ডে-মিল রন্ধনকর্মীরা রাজ্যের বিভিন্ন ব্লকে বিক্ষোভ-ডেপুটেশনে সামিল হচ্ছেন। গত ৭-৮ জুলাই কলকাতায় বিক্ষোভ অবস্থানের মধ্যে দিয়ে রন্ধনকর্মীরা রাজ্যবাসীর কাছে একথা তুলে ধরেছেন যে — কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারই গরীবের শিক্ষার প্রতি চরম অবহেলার নীতি নিয়ে চলেছেন। মিড-ডে-মিলের বরাদ্দ কমিয়ে গোটা প্রকল্পকেই দায়সাড়া করছেন। যারফলে, বহু সংগ্রামে অর্জিত শিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯ আজ সরকারীভাবেই লঙ্ঘিত। স্কুলছুট বেড়ে যাওয়া, বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রমিক সবই এরফল। দেশের কিছু রাজ্য সরকার নিজস্ব তহবিল ব্যয়ে কিছুটা দায়িত্ব নিলেও পশ্চিমবঙ্গ সম্পূর্ণ উদাসীন। রাজ্য সরকার আর্থিক অভাবের কথা বললেও, কর্মীদের দাবিকেই তারা অস্বীকার করছে। সরকারের হামলাকারী কর্মীরা বলছে, “অনেক দিয়েছে, আর কত দেবে?” কিন্তু, একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে গত ১০ বছর কর্মীরা একই ভাতায় কাজ করছেন।
গত ২০ বছর কাজ করেও আজও কর্মীদের অনিয়মত ভাতা, ছাঁটাইয়ের হুমকি, অমর্যাদা, ভবিষ্যত সুরক্ষাহীন কাজ করে যেতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের প্রায় ২.৫ লক্ষ কর্মী আজ আলোড়িত।
পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড-ডে-মিল) ইউনিয়ন কর্মীদের এই ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভকে তীব্র আন্দোলনের রূপ দিতে রাজ্য-জেলা শ্রম দফতরে দাবি তুলে ধরছে। একই সাথে ব্লকে ব্লকে ব্যাপক বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। মূলত: রন্ধনকর্মীদের পরিচয় পত্র, উৎসবকালিন অনুদান, ভাতা বৃদ্ধি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মাধ্যমে ভাতা দেওয়া, শ্রম দফতরের উদ্যোগে রন্ধনকর্মী কল্যাণ বোর্ড গঠন — এই দাবিগুলি নিয়েই হুগলী জেলার পোলবা-দাদপুর, পান্ডুয়ায় কর্মীরা বিক্ষোভে সামিল হন, হাওড়া জেলার বাগনানে স্মারকলিপি দেন। কলকাতা জেলার কর্মীরা জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদে দাবি পেশ করেন। নদীয়া জেলার হরিণঘাটা ব্লকের কর্মীরা সাধারণ সভায় মিলিত হয়ে স্মারকলিপি প্রদানের প্রস্তুতি নেন।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হাবরা-১ , হাবরা-২, দেগঙ্গা, বারাসত-২, গাইঘাটা প্রভৃতি ব্লকের রন্ধনকর্মীরা সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে দলে দলে ব্লকগুলিতে বিক্ষোভে সামিল হন। ব্লকস্তরে বিডিওদের পক্ষ থেকে সমস্ত দাবি পূরণের আশ্বাস না মিললেও, পরিচয় পত্র, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মাধ্যমে ভাতা দেওয়ার বিষয়ে সচেষ্ট হবার আশ্বাস পাওয়া যায়। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ এআইসিসিটিইউ’র উদ্যোগে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা যুগ্ম-শ্রম কমিশনারের কাছে গণস্মারকলিপি প্রদান হয়। তিনি দাবির প্রতি সহমত হয়ে রাজ্যস্তরে এই প্রকল্প কর্মীদের জন্য কল্যাণ বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করে, নিজ অর্থ ব্যয়ে দূরদূরান্ত থেকে কর্মীরা ব্লকগুলিতে জমায়েত হচ্ছেন। গ্রাম-শহরের প্রান্তিক কর্মীদের এই সংগ্রামী মেজাজ আন্দোলনকে আরো দীর্ঘ ও জোরদার করে তুলবে। আসন্ন উৎসব শেষে জেলায় জেলায় বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে রাজ্যজুড়ে এক ব্যাপক গণবিক্ষোভে সামিল হওয়ার জন্য কর্মীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ’লড়াইটা যেমন ভাতা বৃদ্ধি, শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি, ভবিষ্যত সুরক্ষার লড়াই, তেমনি গরীবের শিক্ষা বাঁচানোর লড়াইও বটে। তাই, এই লড়াইকে বাংলার সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের লড়াইতে পরিণত করার আহ্বান এই বিক্ষোভসভাগুলি থেকে রাখা হচ্ছে।
২০ সেপ্টেম্বর কলকাতা জেলা রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কলকাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারপার্সন কার্তিক চন্দ্র মান্নার কাছে এক স্মারকলিপি পেশ করা হয় — তাতে রন্ধনকর্মীদের মজুরি বৃদ্ধি, পরিচয়পত্র প্রদান, উৎসবকালীন ভাতা এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভাতা প্রদান সহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়।
পুজোয় কেটলি আর ভাঁড় জোগাড় করে চা বিক্রির পরামর্শ দিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বেচতে বললেন গরম তেলেভাজাও। কচুরিপানার ব্যাগ, শালপাতার থালা, কাশফুলের বালিশও তৈরি করে বেচার পরামর্শ দিলেন। বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত না হয়ে খড়্গপুরে শিল্পতালুকের সভামঞ্চ থেকে চাকরির নিয়োগপত্র প্রদানের যে সরকারি অনুষ্ঠান ছিল, সেখান থেকেই তিনি এই কথাগুলি বললেন। ইতিমধ্যে, কিছুদিন আগে, “উৎকর্ষ বাংলা”র বহু ঢাক পেটানো কর্মসূচিতে রাজ্যের কারিগরি শিক্ষায় কৃতি ছাত্রছাত্রীদের হাতে ‘চাকরির নিয়োগপত্র’ তুলে দেওয়ার উদ্যোগ শুরু করে রাজ্য সরকার। কিন্তু যে সমস্ত কর্মপ্রত্যাশী বিরাট আশা নিয়ে সেখানে হাজির হন তারা পরে বুঝলেন ওই নিয়োগপত্রটিই ভুয়ো! অনেকেই আবার এই ভুয়ো কাগজটি পান সময়সীমা পার হওয়ার পর। চাকরির ‘নিয়োগপত্র’ নামক আদতে যেটি তারা হাতে পান, সেটা ছিল প্রশিক্ষণের "অফার লেটার"। তবে, এখানেই গল্পের নটে গাছটি মুড়োলে হয়ত তবু মানরক্ষা হতো। কিন্তু দেখা গেল, গুজরাতের সুরেন্দ্রনগরে যে ফানফার্স্ট গ্লোবাল স্কিলার্স-এর সহযোগিতায় সুজুকি মোটর সংস্থায় দু’বছরের জন্য ‘ভেহিক্যাল টেকনিশিয়ান’ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা ওই অফার লেটারে বলা হয়েছে, সেই সংস্থার অধিকর্তাই জানিয়েছেন যে ওই চিঠিটাও ভুয়ো।
ইতিমধ্যে, প্রকাশিত কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান উন্মোচন করল আরেকটি তথ্য। দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে লগ্নি বাস্তবায়নের অঙ্কে প্রথম দশটি রাজ্যের মধ্যেও ঠাঁই হল না পশ্চিমবঙ্গের। তুমুল ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে অঢেল টাকা অকাতরে খরচের মাধ্যমে মমতা সরকার যে বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন সংগঠিত করে রাজ্যে অজস্র নতুন বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছিলেন, তা আজ ডাহা মিথ্যে হিসাবেই প্রমাণিত হল। দেখা যাচ্ছে, ২০২২-এর জুলাই পর্যন্ত এ রাজ্যে বিনিয়োগ হয়েছে গোটা দেশের মোট বিনিয়োগের মাত্র ০.৯ শতাংশ!
সর্বাঙ্গে নিয়োগ কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির হাজারো কেচ্ছার দগদগে ক্ষত আজ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের প্রধান চরিত্র লক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক মাস আগে, রাজ্যের রাজকোষ থেকে অঢেল টাকা খরচ করে, দেশের নানা প্রান্তের শিল্পমহল ও কর্পোরেট ঘরানাকে আমন্ত্রিত করে অনুষ্ঠিত রাজসূয় যজ্ঞটা যে স্রেফ ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়, তা আবার প্রমাণিত হল। শিল্প কর্পোরেট মহলকে মোদী সরকার অকাতরে কর ছাড় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও দেখা গেল নতুন শিল্প বিনিয়োগ হচ্ছে না, কারণ চলতে থাকা চরম আর্থিক সংকটের জন্য আমজনতা বিশেষ কেনাকাটা করছে না। তাই, নতুন বিনিয়োগে তারা মোটেই আগ্রহী নয়। আর, নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নে আমাদের রাজ্য যে কোন তিমিরে তলিয়ে গেছে, তা নতুন করে উল্লেখ করার আর প্রয়োজন নেই। নানা কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন করতে রাজ্যের যুবসমাজকে উৎসাহিত করে চলেছে রাজ্য সরকার। নানান আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে জেল-বন্দি অনুব্রতকে বীরের মর্যাদা দিয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান বুঝিয়ে দিলেন রাজ্যের শাসনতন্ত্র আজ কোন অতল অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত।
বামেদের “চোর ধরো, জেল ভরো” স্লোগান আজ বিজেপি আত্মসাৎ করে নিজেদের কোণঠাসা অবস্থাকে প্রাসঙ্গিক করার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দু’দিনে ৩ কোটি টাকা খরচ করে বিজেপি বিলাসবহুল বেদিক ভিলেজে “চিন্তন” শিবিরের পর ১১ কোটি ৭ লক্ষ টাকা খরচ করল তাদের নবান্ন অভিযানের অলীক কুনাট্যের পেছনে। কিন্তু রাজ্যবাসীর দৈনন্দিন জীবনে নেমে আসা চরম আর্থিক, সামাজিক সংকট, আন্দোলনরত কর্মপ্রত্যাশীদের নিয়োগ, মজুরি বৃদ্ধি প্রভৃতি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দাবিগুলো আজ ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে অবহেলার পুরু চাদরের নিচে।
আপাদমস্তক দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়া দল, সরকার ও তার তাবড় তাবড় নেতাদের বাঁচাতে মমতা এবার মোদীকে তোয়াজ করার রাস্তা বেছে নিল। নির্মম, নৃশংস ফ্যাসিবাদী শক্তি, যারা আজ দেশের রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিটি স্তম্ভকে অর্থহীন করে সংবিধানের একান্ত মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, সেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান কর্ণধার সম্পর্কে স্তুতি, ফ্যাসিবাদী শক্তিকে “বিভাজিত” করার মূঢ় আত্মঘাতী কৌশল এই রাজ্যে ফ্যাসিবাদের উত্থানের প্রশস্থ রাজপথ তৈরি করে দিচ্ছে। বিজেপির বিরুদ্ধে যে গণরায়কে সম্বল করে মমতা ফের রাজ্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, সেই রায়কে আজ দু’পায়ে মাড়িয়ে চরম জনবিরোধী এই শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বামপন্থীদেরই পথে নেমে দেখাতে হবে বিকল্প পথের ঠিকানা।
১৮ সেপ্টেম্বর রবিবার হুগলি জেলা সম্মেলন আয়োজিত হয় ব্যান্ডেল দুর্গা লজে। প্রীতিলতা-মাতঙ্গিনী-সাবিত্রী ফুলে-ফাতেমা শেখ সভাগৃহ এবং গৌরী লঙ্কেশ নামাঙ্কিত মঞ্চে। মহিলা সমিতির বিভিন্ন আন্দোলনের ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেত্রীদের ছবিতে সমগ্র হলটি সাজানো হয়।
শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানে সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন রাজ্য পর্যবেক্ষক চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী। শহীদবেদীতে মাল্যদানের পর অধিবেশন শুরু হয়। পাঁচজনের প্রেসিডিয়াম ও দু’জনের স্টেয়ারিং কমিটি সম্মেলন পরিচালনা করেন। ব্যান্ডেল মহিলা শাখার পক্ষ থেকে নন্দা ব্যানার্জী উপস্থিত প্রতিনিধিদের স্বাগত জানিয়ে সম্মেলনের সূচনা করেন। সম্মেলনে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন সতী সেন।
রাজ্য পর্যবেক্ষক চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী ও রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রানী দত্ত বর্তমান ভারতবর্ষে আরএসএস বিজেপি’র যে স্বৈরাচার চলছে সে বিষয়ে আলোচনা করেন। খসড়া প্রতিবেদন পাঠ করেন জেলা সম্পাদিকা শিপ্রা চ্যাটার্জি। পোলবা দাদপুর, ব্যান্ডেল, উত্তরপাড়া কোন্নগর, ধনিয়াখালি, পান্ডুয়া ব্লক সহ নতুন পুরনো কাজের অঞ্চল থেকে স্বাস্থ্যকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি ও মিড-ডে-মিল রন্ধনকর্মী, কৃষি শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মহিলা, শিক্ষিকা, ছাত্রী, গৃহবধূ সকলের উপস্থিতিতে হল ছিল পরিপূর্ণ। প্রায় ২১ জন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। এছাড়া পার্টির জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার সহ এআইকেএম, আয়ারলা, আইসা ও যুব সংগঠনের নেতৃত্ব বক্তব্য রাখেন। সম্পাদিকার জবাবী ভাষণের পর হাততালি দিয়ে প্রতিবেদন পাশ হয়। ৩৩ জনের কাউন্সিল, ১৯ জনের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। জেলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন শিপ্রা চট্টোপাধ্যায়, সহ-সম্পাদিকা অর্পিতা রায়, সভানেত্রী শোভা ব্যানার্জি, কার্যকরী সভানেত্রী চৈতালি সেন, সহ-সভানেত্রী সুদীপ্তা বসু।
শ্রীমতি অঞ্জনা ভৌমিকের কবিতা পাঠ ও আদিবাসী মহিলাদের নিজস্ব নাচ পরিবেশন এবং শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি হয়।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ বালি পার্টি অফিসে অনুষ্ঠিত হল আইসা’র দ্বিতীয় বালি-বেলুড় জোনাল সম্মেলন। শহীদবেদীতে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন আইসা রাজ্য সভাপতি নীলাশিস। শহীদবেদীতে মাল্যদান ও নীরবতা পালনের মাধ্যমে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। সম্মেলন পরিচালনার জন্য নন্দিনী ও স্নেহাকে নিয়ে সভাপতিমন্ডলী গঠিত হয়।
শহিদ কমরেড সূর্য সেন এবং কল্পনা দত্তের নামে নগরের নাম নামাঙ্কিত করা হয় এবং মঞ্চের নাম রাখা হয় বালি অঞ্চলের নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং ’৭০ দশকের শহীদ ছাত্র কমরেড অশোক বিশ্বাসের নামে।
সম্মেলন কক্ষে ৪০ জনের অধিক ছাত্রছাত্রী উপস্থিত ছিলেন। বালি-বেলুড় এলাকার প্রায় সমস্ত স্কুল এবং লালবাবা কলেজের ছাত্রছাত্রীরা উপস্থিত হয়েছিলেন। ছাত্রীদের উপস্থিতি ও বিতর্কে অংশগ্রহণ ছিলো চোখে পড়ার মতো। সাবলীলভাবে ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন। স্কুলের টয়লেট, লাইব্রেরী, ল্যাবরেটরি, লালবাবা কলেজে টিএমসিপি’র দৌরাত্ম্য সমস্ত কিছু নিয়ে চর্চা করেন উপস্থিত প্রতিনিধিরা। দ্রুত স্কুলগুলোতে ডেপুটেশন এবং লালবাবা কলেজে ইউনিট গঠনের কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষটি সম্মেলনে গৃহীত হয়।
আইসা হাওড়া জেলা সম্পাদক অঙ্কিত ও রাজ্য সভাপতি নীলাশিস সহজ সরল প্রাঞ্জলভাবে আইসা’র আন্দোলন এবং আগামী কাজের বিষয়ে আলোচনা করেন। সম্মেলনের জেলা পর্যবেক্ষক সৌভিক ও জেলা কমিটি সদস্য সঙ্কেত তাঁদের বক্তব্যে এলাকায় আইসা’কে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান। উৎসাহব্যঞ্জক পরিবেশে সম্মেলন শেষ হয়।
সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে ১৫ জনের জোনাল কমিটি নির্বাচিত করা হয়। নিবনির্বাচিত জোনাল কমিটির ৫০ শতাংশ ছাত্রী সদস্য যা প্রাথমিকভাবে এক ইতিবাচক সূচনা হিসাবে দেখছে আইসা হাওড়া জেলা কমিটি।
একদিকে বালি পুরসভা এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা লাগামছাড়া বেড়ে চলেছে অন্যদিকে বছরের পর বছর নির্বাচিত কোনও পুরো বোর্ড ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ চূড়ান্ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন সামান্য পুরো পরিষেবা পাওয়ার জন্যে।
এই পরিস্থিতি এলাকার দায়িত্বশীল ছাত্র সংগঠন হিসাবে আইসা ডেঙ্গু প্রতিরোধে এলাকায় সচেতনতা ও অপদার্থ পুরো প্রশাসনকে ধিক্কার জানিয়ে পোস্টারিং ও প্রচার মঙ্গলবার।
সংগঠনের স্থানীয় সাথীরা মাইকে সচেতনতার বার্তার সাথে সাথে জোড়া অশ্বত্থতলা স্কুল, বঙ্গশিশু বালিকা বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা ও গোস্বামী পাড়ায় ব্লিচিং পাউডার দিয়ে সাধ্যমতো ডেঙ্গু মোকাবিলার চেষ্টা করে।
অবিলম্বে বেহাল রাস্তা সংস্কারের দাবিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর হিন্দমোটরে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়েছিল। আজ সেই স্বাক্ষর সম্বলিত ডেপুটেশন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উত্তরপাড়া থানা এরিয়া কমিটির তরফ থেকে জমা দেওয়া হল উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভার চেয়ারম্যান দিলীপ যাদবের হাতে। চেয়ারম্যান পার্টি নেতৃত্বকে জানালেন যে এই সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ অর্থ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে অতি সম্প্রতি পৌরসভার হাতে এসে পৌঁছেছে তাই শারদোৎসবের আগে জরুরি ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো সংস্কারের কাজ করা হবে। কিছু কাজ অসমাপ্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যা পুজোর পরেই হবে। কিছু জায়গায় পাইপলাইন বসানোয় ত্রুটি থেকে যাওয়ার জন্য সেই কাজ পুনরায় করার দরকার। অর্থাৎ এই বিষয়ে পৌরসভার যথাযথ তদারকি ছিল না সেই কথাও ক্ষোভের সঙ্গে পুরপ্রধানকে বলেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। পুরপ্রধান যত দ্রুত ও পরিকল্পিতভাবে এই কাজ সমাপ্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পার্টি নেতৃত্ব জানিয়েছেন এই কাজের অগ্রগতির উপর দল অবশ্যই নজর রাখবে। অন্যথায় আবার রাস্তায় নামতে হবে।
টিটাগড় অঞ্চল তথা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল দুষ্কৃতিদের নানা তাণ্ডবের জন্য প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনামে আসে। কিন্তু গত শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর এই অঞ্চলের একটি স্কুলে ক্লাস চলাকালীন বোমাবাজির যে ঘটনা ঘটল তা নানা তাণ্ডবের মধ্যেও বিশেষভাবে ব্যতিক্রমী।
এদিন উত্তর ২৪ পরগণার টিটাগড়ের সাউথ স্টেশন রোডের ফ্রি ইন্ডিয়া হাই স্কুলে বোমাবাজি হয়। ক্লাস চলাকালীন তীব্র বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সাউথ স্টেশন রোডের ফ্রি ইন্ডিয়া হাই স্কুল। আতঙ্কে সিঁটিয়ে যান পড়ুয়া এবং শিক্ষকরা। পরে দেখা যায় স্কুলের ছাদে সিঁড়ির অংশে বিস্ফোরণ হয়েছে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় স্কুলের ছাদের একটি অংশ উড়েও যায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় টিটাগড় থানার পুলিশ। দেখা যায়, বিস্ফোরণের পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্প্লিন্টার। কে বা কারা এই বিস্ফোরণে যুক্ত, তা নিয়ে শুরু হয় তদন্ত।
ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ যে চারজনকে গ্রেফতার করেছে, তাঁদের মধ্যে একজন ওই স্কুলেরই প্রাক্তনী। পুলিশ সূত্রে খবর, জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, মজা করতে গিয়ে বোমা ছুড়েছিলেন স্কুলের ছাদে! যে চারজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, তাঁদের প্রত্যেকের বয়স ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। ধৃতদের নাম মহম্মদ আয়রন, শেখ বাবলু, মহম্মদ সাদিক এবং রোহন।
সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে পুলিশি জেরায় প্রত্যেকেই বোমাবাজির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে কাউকে আহত বা নিহতের উদ্দেশ্যে নয়, ‘খেলার ছলে’ বোমা ছুড়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ধৃতেরা। কিন্তু কোথায় পেলেন বোমা, কী কারণে বোমা ছুড়লেন, পুরনো রাগ নাকি অন্য কোনও কারণে বোমাবাজি তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। সেইসব কিছুই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানা গিয়েছে।
টিটাগড় অঞ্চল তথা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের দুষ্কৃতিরা রাজনৈতিক মদত ও পুলিশের একাংশের প্রশ্রয়েই যে তাদের অন্ধকার জগতের কাজকারবার চালিয়ে যায়, সেকথা ওয়াকিবহাল মহল জানেন। বছরের পর বছর একই ট্রাডিশন চলছে। আইন শৃঙ্খলার নিরিখে রাজ্য ও দেশের অন্যতম এই ‘ব্ল্যাক স্পট’টিতে খুন জখম বোমাবাজির ঘটনাগুলি ঘটার পর কিছুদিন সোরগোল চলে সংবাদ মাধ্যমে, তারপর আবার সব আগের মতোই চলতে থাকে। সরকার, পুলিশ প্রশাসন — কেউই স্থায়ী সমাধানে উৎসাহী নয়। এর কারণ এই দুষ্কৃতিতন্ত্র তাদের স্বার্থরক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়।
এইবারের ব্যতিক্রমী ঘটনার পরও এরকমই হবে বলে এলাকার মানুষ মনে করছেন। বোমা, গুলির শব্দর সঙ্গে সহবাস করতে করতে তারা এটাকেই তাদের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন। তারা মনে করেন পুলিশ, প্রশাসন, সরকার সব জেনেবুঝেই যেখানে দুষ্কৃতিদের মদত দেয়, তখন সাধারণ মানুষ নিতান্ত অসহায়। এখানকার রাজনীতিই লুম্পেনতন্ত্রর সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধে চলে। তাই ধৃতরা অক্লেশে বলতে পারে মজা দেখার জন্য তারা ক্লাস চলাকালীন স্কুলে বোমা ছুঁড়ে স্কুলের ছাদ উড়িয়ে দিয়েছে ও ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। বারুদের ওপর বসে আছে এই গোটা অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। পুলিশ প্রশাসন কবে তাদের উপযুক্ত কাজে নামবে?
সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির মেমারি ১নং ব্লক কমিটির পক্ষ থেকে বিডিও অফিসে ১৫ সেপ্টেম্বর এক গণডেপুটেশন দেওয়া হয়।
ডেপুটেশনের দাবি ছিল — ১০০ দিনের কাজ, বকেয়া মজুরি, আদিবাসী পাড়ায় শৌচগার, রাস্তা-আবাস যোজনার ঘর, পানীয় জল, তপশীলি জাতি/উপজাতিদের শংসাপত্র দিয়ে পেনশন দেওয়া ও ঘরে ঘরে বিনামূল্যে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা।
ডেপুটশনে নেতৃত্ব দেন আয়ারলার পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য সাধন কর্মকার। বিডিও অফিসে ডেপুটেশন চলাকালীন সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টি জেলা কমিটি সদস্য কুণাল বক্সী, এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আয়ারলার রাজ্য সভাপতি সজল পাল ও আরওয়াইএ-র জেলা সম্পাদক সুবীর মল্লিক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
লখিমপুর খেরি জেলা, উত্তর-প্রদেশের রাজধানী লখনোউ শহরের থেকে ১৪০ কিমি দূরের একটি গ্রাম। বিগত কয়েক বছরে লখিমপুর খেরির নাম সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমের আলোচনায় উঠে এসেছে। কৃষি বিল রদ করার দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের উপর গাড়ি চালিয়ে খুন, ২০২০ সালের আগস্টে শিশুদের ধর্ষন ও খুনের ঘটনায় বারবারই প্রকট হয়েছে মৌলবাদী যোগী আদিত্যনাথের হিন্দুত্ববাদী নৈরাজ্যের ছবি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর, দুই দলিত নাবালিকা মেয়ের ঝুলন্ত মৃতদেহ মেলে লখিমপুর জেলাতেই। ময়নাতদন্তের ফলে জানা যায়, মেরে ফেলার আগে, দুই বোনের উপর চলেছে যৌন নির্যাতন। ঠিক দুই বছর আগে, ১৪ সেপ্টেম্বরে হাথরাসে ১৯ বছরের এক দলিত তরুণীকে গন-ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছিল। উচ্চ-বর্ণের অপরাধীদের আড়াল করতে হাথরাসের নির্যাতিতার মা-বাবাকে কার্যত বন্দী করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল নির্যাততার মৃতদেহ। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে, উত্তর-প্রদেশের বিধান-সভা নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন, গৌতম বুদ্ধ নগর জেলার জেওয়ার গ্রামে বন্দুকের নলের মুখে গন-ধর্ষণ করা হয় একটি দলিত মেয়েকে। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে, ওই রাজ্যের গোন্ডা জেলা থেকে উদ্ধার হয় ১৭ বছর বয়সী এক দলিত মেয়ের মৃতদেহ। লখিমপুর খেরিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক গন-ধর্ষণ ও খুন নিছক সমাপতন নয় বরং যোগীর রাজত্বে সযত্নে লালিত ধর্ষণ-সংস্কৃতি ও ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারাবাহিকতার প্রমাণ।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো, ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে দলিত ও আদিবাসী মানুষদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ক্রমবর্ধমান। এই নির্যাতনের পরিসংখ্যানে দেশের শীর্ষে রয়েছে উত্তর-প্রদেশ রাজ্য। ভারতে দলিত ও নিপীড়িত জাতি, বর্গের মানুষের উপর হওয়া নির্যাতনের ২৫.৮২ শতাংশ ঘটে উত্তর-প্রদেশে। ২০১৯-২০২০ সালে দলিত মেয়েদের উপর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ৩.৪ শতাংশ। কিন্তু দলিত-অধিকার আন্দোলনের কর্মী ও আইনজীবীদের মতানুযায়ী বাস্তবের ছবিটা অনেকগুণ ভয়াবহ। আর্থ-সামাজিক সিঁড়িতে দলিত মেয়েদের ঠাঁই হয় সবার নিচে। জাতি ও লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে দ্বৈত শোষণের শিকার হন তারা। একদিকে উত্তর-প্রদেশে মেয়েদের উপর হওয়া অপরাধের চার্জশিটের সংখ্যা কমছে অন্যদিকে লিঙ্গ-ভিত্তিক নির্যাতনের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে উত্তর-প্রদেশ রাজ্য থেকে।
চূড়ান্ত কপট বিজেপির বিজেপির নেতা, মন্ত্রী ও বাছাই করা দালাল গোদী মিডিয়ার প্রতিনিধিরা লখিমপুরে সদ্য ঘটে যাওয়া গণ-ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের মৃত্যুদন্ডের দাবি করছে। অথচ, হাথরাসের নির্যাতনের খবর করার জন্য কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানসহ তিনজন সাংবাদিক দেশ-দ্রোহিতার অভিযোগে আজও জেলে বন্দী। হিন্দুত্ববাদের এই হিংস্র দ্বিচারিতার ধারাতেই বিলকিস বানোর গণ-ধর্ষণে দোষী স্যবস্ত হওয়ার পরেও বেকসুর খালাস করা হলো ১৪ জন ‘সংস্কারী’ উচ্চ-বর্ণের ধর্ষকদের। এভাবেই, জাত, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণী দেখে ধর্ষকদের বাছ-বিচারের ঘৃণ্য রাজনীতি চলছে। সামাজিক বৈষম্য ও শোষনের সংস্কৃতিকে সুরক্ষিত রেখে মদত দেওয়া হচ্ছে ধর্ষণে। নিপীড়িত মেয়েদের ন্যায় ও সমানাধিকারের লড়াইকে দুরমুশ করার জন্য চক্রান্ত চলছে অবিরত। ফ্যাসিবাদী শোষনের বহুমুখী জোটকে প্রতিহত করতে চাই নিপীড়িত মানুষের জোট। লখিমপুর খেরির মৃত নাবালিকা দুই দলিত মেয়ে, এই বাস্তবিক প্রয়োজনের কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
মাহসা আমিনি, ২২ বছর বয়সী ইরানি তরুণীর মৃত্যু হয়েছে ইরানের ‘নীতি পুলিশ’-দের নির্ধারিত পোশাক-বিধি উপেক্ষা করার অপরাধে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর, তেহরান যাওয়ার পথে ইরানের ‘নীতি-পুলিশ’রা আটক করে মাহসাকে। ইরানের মেয়েদের জন্য মৌলবাদী রাষ্ট্রের ঠিক করে দেওয়া পোশাক-বিধির পাঠ পড়াতে ও গুরুত্ব বোঝাতে তৈরি হয়েছে কুখ্যাত ডিটেনশন সেন্টার ‘ভোযারা’। আটক করার পর, মাহসাকে নিয়ে আসা হয় এই ডিটেনশন ক্যাম্পে। শালীনতার শিক্ষা হিসাবে মাহসার উপর চলে অকথ্য অত্যাচার। ১৬ সেপ্টেম্বর, মাহসা মারা যান। তার শরীরে আঘাতের দাগ স্পষ্ট। মারের চোটে, শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষত-বিক্ষত। ইরানের পুলিশ বলছে, মাহসা মারা গেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ক্ষমতায় আসার পর ইসলামপন্থী মৌলবাদীরা কঠোর ‘পোশাক-বিধি’ জারি করেছে সেই দেশের মেয়েদের উপর। ইরানের মেয়েরা সেই সময় থেকেই রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া পোশাক বিধির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন। ১২ জুলাই দিনটিকে ইরানের মৌলবাদী রাষ্ট্র-শক্তি ‘হিজাব ও সতীত্ব’ রক্ষার জাতীয় দিবস নামে পালন করে। এই বছর, ১২ জুলাই, ইরানের বিভিন্ন জায়গায়, জন-সমক্ষে সমবেত হয়ে মেয়েরা হিজাব খুলে প্রতিবাদ জানায় চুড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক নীতি-পুলিশের বিরুদ্ধে। এর ফলে তাদের উপর নেমে এসেছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। এককথায়, এই প্রতিবাদী মেয়েদের ‘উইচ-হান্ট’ করে কঠোর শাস্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে ইরানের সরকার।
মাহসার মৃত্যুর নিন্দা ও প্রতিবাদ বিশ্ব-জুড়ে চলছে। অনেকে বলছেন, “হিজাব কারোর পছন্দ হতে পারে না, মাহসার মৃত্যুই তার প্রমাণ”। না জনাব। বরং মানসার মৃত্যু দেখিয়ে দেয় মেয়েদের শরীর ও পোশাকের উপর বিধি-বিধান চাপানোর ভয়াবহতা। ঠিক যেভাবে, আমাদের দেশে, মেয়েদের হিজাব না পরার ফতোয়া চাপিয়ে দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র ও তাদের দোসর প্রতিষ্ঠানগুলি, একইভাবে ইরানের মৌলবাদী শাসকরা ঠিক করে দিচ্ছে মেয়েদের পোশাকবিধি। হিজাব জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যতটা অপরাধ ঠিক ততটাই অপরাধ হিজাব পরার অধিকার কেড়ে নেওয়া। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই, মেয়েদের শরীরের উপর হস্তক্ষেপ করছে রাষ্ট্র ও সমাজ।
আসলে, মেয়েদের স্বাধীনতাকে ভয় পান অনেকেই। এমনকি বিভিন্ন প্রগতিশীল মহিলা সমিতির আলাপ-আলোচনাতে, লিঙ্গসাম্যের আন্দোলনের পরিসরেও মেয়েদের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে “স্বেচ্ছাচারিতার” আশংকা প্রকাশ করতে দেখা যায় আন্দোলনের কর্মীদের। মেয়েদের বিশৃঙ্খলতায় চরাচর ভেসে যাওয়ার ভয়ে স্বাধীনতার সীমানা টানতে বসেন সমাজের মাতব্বরেরা। কখনো শালীনতা, কখনো রুচি, কখনো ভদ্রতা, কখনো পরিবারের সম্মানের নামে ব্যাক্তি মানুষের স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারের মাঝে সীমা টানে সমষ্টি, সমাজ, রাষ্ট্র। এই সীমারেখার কোপে, আজও কত মেয়ে কাজ থেকে বাড়ি ফিরতে দেরী হলে বরের হাতে অকথ্য মার খায়। পাড়ার দাদাদের টোন-টিটিকিরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মেয়ের স্পর্ধা দেখে পাড়ায় রটে – ‘এ মেয়ে বড়োই স্বেচ্ছাচারী’। সিগারেট খেলে শুনতে হয় সাবধানবাণী – ‘প্রজননের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে কিন্তু!’। ঠিক যতটা সীমা পর্যন্ত স্বাধীনতায় আঘাত লাগে না পারিবারিক মূল্যবোধে, টলে না পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো, আঁচড় পড়ে না জাতি-দম্ভে, ঠিক যতটা ফুলে-ফেঁপে ওঠে শাসকশ্রেণীর আচার, রুচি ও ভদ্রতার সংজ্ঞা – ঠিক সেইখানেই নির্ধারিত হয়ে যায় স্বাধীনতার সীমারেখা। দেশ, কাল, সময়, স্থান ভেদে এই সীমারেখা তৈরি করে নীতি-পুলিশরা।
মাহসার মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে হলে, পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা আর নীতি-পুলিশিকে হারাতে হলে, মেয়েদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে ভাবতে শিখুন। মেয়েদের ব্যাক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করা খুব সহজ,
– সম্প্রীতি মুখার্জী
রাজস্থানের ভিলওয়াড়া জেলার ২৪ বছরের এক যুবতীর জীবনে চরম অমর্যাদাকর ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঘটনাটা ঘটেছিল এ’বছরের মে মাসের ১১ তারিখে। কিন্তু এতদিন চাপা থাকলেও তার উন্মোচন ঘটল এ’মাসের, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের গোড়ায়। ঐ যুবতীর সেই আখ্যান গোটা নারী সম্প্রদায়ের কাছেই অবমাননার এক প্রতীক হওয়ায় আমরা এখানে সেই আখ্যানকে উপস্থাপিত করছি।
যুবতী সানসি উপজাতির এবং তার বিয়ে হয়েছিল ঐ জেলার বাগোরের এক যুবকের সঙ্গে। ঐ সানসি সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে এখনও চালু রয়েছে ‘কুকাডি প্রথা’র মতো নারীর পক্ষে চরম অসম্মানের এক সামাজিক রীতি। এই প্রথা আসলে নারীর কুমারীত্ব পরীক্ষা। বিয়ের পর স্বামী বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক মিলন করবেন এবং বিছানো সাদা কাপড়ে রক্তের দাগ লাগলে স্ত্রী পরীক্ষায় পাশ করবেন, অন্যথায় তিনি অক্ষতযোনির নারী নন বলে বিবেচিত হবেন। এক্ষেত্রে সেই যুবতী কুমারীত্বর পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেন না। এবং তারপর শুরু হল তাঁর ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন। ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে ঐ যুবতীকে বলতে শোনা যাচ্ছে — “বিকেলে চালানো ঐ আচার-অনুষ্ঠানে আমি পাশ করতে পারলাম না। এরপর গভীর রাত পর্যন্ত চর্চা চলল। ভয়ে আমি কোনো কথাই বলতে পারিনি। আমার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে মারধর করল।” ঘটনা হল, বিয়ের আগে স্থানীয় এক যুবক ঐ যুবতীকে ধর্ষণ করে এবং যুবতীর বাড়ির লোকজন তা নিয়ে থানায় এফআইআর’ও দায়ের করেছিলেন।
যুবতীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। তাতেই শ্বশুরবাড়ি ক্ষান্ত হল না, তারা যুবতীর বিরুদ্ধে খাপ পঞ্চায়েতে অভিযোগ জানালো। পঞ্চায়েত প্রথমে ১৮ মে বৈঠকে বসে এবং সেদিনের বৈঠকে যুবতীর পরিবারের সদস্যরা যুবতীর ধর্ষণের কথা এবং তা নিয়ে থানায় এফআইআর দায়ের সম্পর্কে পঞ্চায়েতের লোকজনদের অবহিত করেন। সেদিনের বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। পরে ৩১ মে আবার বৈঠক হয়, এবং সেদিন পঞ্চায়েত যুবতীর পরিবারের ওপর ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা চাপায়। এই জরিমানা আদায়ের জন্য যুবতীর স্বামীর পরিবার যুবতীর পরিবারের ওপর লাগাতার চাপ দিতে এবং নানান উৎপীড়ন চালাতে থাকে। উৎপীড়ন অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছলে যুবতীর পরিবার ৩ সেপ্টেম্বর তার স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর করেন। পুলিশ তদন্তে নামে, যুবতীর পরিবারের অভিযোগ সত্যি বলে দেখতে পায় এবং দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় যুবতীর শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে আইন বিরুদ্ধ দাবি মেটাতে নারীর ওপর জোরজবরদস্তি, জুলুমবাজির মাধ্যমে অর্থ আদায়, নারীর শালীনতার অসম্মান, ইত্যাদি। জেলা পুলিশের এক ডিএসপি সুরেন্দ্র কুমার জানিয়েছেন — যুবতীর শ্বশুর হলেন হেড কনস্টেবল এবং যুবতী যে ধর্ষিতা হয়েছিলেন সেকথা তিনি জানতেন। সেই ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও যুবতীকে কুমারীত্ব পরীক্ষার মধ্যে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং তাঁর চরম অবমাননা, নির্যাতন ও হয়রানি ঘটানো হয়েছিল। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে জরিমানা আরোপ করিয়ে সেই জরিমানা আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি ও উৎপীড়ন প্রক্রিয়াও চলেছিল পাঁচ মাস ধরে। এই ঘটনাকে ধরে জাতীয় নারী কমিশনও স্ত্রীর কুমারীত্ব পরীক্ষাকে পশ্চাদগামী, নারী বিদ্বেষী প্রথা বলে অভিহিত করেছেন, এবং তার মধ্যে দিয়ে নারীর বুনিয়াদি অধিকার ও মর্যাদা লঙ্ঘন হওয়ার কথাও বলেছেন।
একুশ শতকে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে যখন অনেক বড়-বড় কথা বলা হচ্ছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে নারীশক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন, তখনও কেন প্রতিদিনই নারীকে অশ্রদ্ধা, অসম্মান ও অপমানের মুখোমুখি হতে হবে? এবারের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণেও নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, “আমাদের আচরণ, সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনের যা কিছু নারীকে অপমানিত ও হীন প্রতিপন্ন করে, তারথেকে নিজেদের মুক্ত করার অঙ্গীকার কি আমরা করতে পারি না?” দেশে আজ এমনই এক পরিমণ্ডল বিরাজ করছে যাতে নানান নিপীড়ন ভোগ করা ও হীন প্রতিপন্ন হওয়াটাই নারীর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে নরেন্দ্র মোদীর ঐ বচন অসার বলেই দেখা দিচ্ছে। নরীর কুমারীত্ব পরীক্ষার মতো প্রথা কেন আজও সমাজে বিদ্যমান থাকবে? সেই পরীক্ষায় পাশ না করলেই কেন নারী ‘অপবিত্র’ বলে গণ্য হবে ও তার মূল্য কমে যাবে? এই প্রথার বিলোপের জন্য নারী ক্ষমতার আত্মঘোষণার সামনে অবরোধ তোলা, নারীকে অসমকক্ষ ও হীন প্রতিপন্ন করার পরিমণ্ডলটাকেই পাল্টানো দরকার। সেই লক্ষ্যে কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসন আন্তরিক সক্রিয়তা দেখাতে পারবে না কেন?
– জয়ন্ত মিত্র
স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উদযাপনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ভাষনে মহিলাদের প্রতি সকলকে মানসিকতার পরিবর্তন করার আবেদন রাখেন। তিনি বলেন “আমাদের আচার-আচরণে এক বিকৃত মানসিকতা বাসা বেঁধেছে, আমরা হামেশাই মেয়েদের অপমান করে থাকি”। তিনি ২০১৪ সালেও প্রথম বার স্বাধীনতা দিবসের ভাষনের সময়েও বলেন, “এই সমস্ত ধর্ষণের ঘটনাগুলো যখন ঘটে তখন প্রত্যেক ভারতবাসীর মাথা হেঁট হয়ে যায়”। কিন্তু নির্মম বাস্তব এটাই যে, মোদীর গত আট বছরের শাসন কালে মহিলাদের উপর অত্যাচার ও হিংসার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে।
২০২০ ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। ওই বছরটা বাদ দিলে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২০২০ সালে, দেশব্যাপী লকডাউনের সময় মাসের পর মাস গোটা দেশ অচল থাকায় তথ্য সংগ্রহ করার কাজ বিঘ্নিত হয়। তাই, ওই বছরে মহিলাদের উপর অত্যাচার বা হিংসার ঘটনাগুলোর প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।
এনসিআরবি-র তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশের খাতায় যে ৬০ লক্ষ অপরাধের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে তার মধ্যে ৪২৮,২৭৮ অপরাধের ঘটনা মহিলা সম্পর্কিত। যা, ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত (অর্থাৎ ছ’বছরে) বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬.৩৫ শতাংশ হারে। এর মধ্যে ২০২১ এর বেশির ভাগ অপরাধমূলক ঘটনা হল অপহরণ, ধর্ষণ, গার্হস্থ্য হিংসা, পণ মৃত্যু ও শারীরিক আক্রমণ। আর, এই ব্যাপারেও সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশ রয়েছে এক নম্বরে। এর পর রয়েছে রাজস্থান (৪০,৭৩৮টি ঘটনা) আর তারপর মহারাষ্ট্র (৩৯,৫২৬)।
প্রতি বছর হাজারে হাজারে নারী ধর্ষণের ঘটনা বিশ্বের মধ্যে ভারতকে তুলে এনেছে অনেক উপরে। শুধু ধর্ষণ করেই অপরাধীরা ক্ষান্ত হয় না, সমাজ তাদের কলঙ্কিত করে, পুলিশ এমনকি বিচারব্যবস্থাও প্রায়ই আক্রান্ত নারীর নামে বদনাম চাপিয়ে দেয়।
গোটা দেশে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। ২০২১ সালে পুলিশের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে ১৩৭,৯৫৬টি কেস — অর্থাৎ প্রতি চার মিনিটে একটি করে ঘটনা। আর, ২০১৬ সালের পর থেকে এই বৃদ্ধি ২৭ শতাংশ! এটা যে কেবল আমাদের দেশেই ঘটছে তা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, দুনিয়া জুড়েই প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মহিলা এই গার্হস্থ্য হিংসার শিকার। আর, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, এ প্রশ্নে আত্মীয় পরিজনদের ও নীরব সম্মতি থাকে।
বেশ কিছুদিন আগে সরকার এক সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৪০ শতাংশ মহিলা ও ৩৮ শতাংশ পুরুষ মনে করে তার শ্বশুর - শ্বাশুরিকে অপমান করার জন্য, নিজের সন্তানদের প্রতি অবহেলার জন্য, অনুমতি না নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য, ঠিক মতো রান্না-বান্না না করা বা যৌন মিলনে অনিচ্ছা দেখানোর কারণে স্ত্রীকে পেটানোর হক পুরুষ/স্বামীর রয়েছে।
১৯৬১ সালে, সরকার আইনত পণ প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও আজ ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই প্রথা রমরমিয়ে চলে আসছে। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্কের এক তথ্য বলছে, গ্রামীণ ভারতে এখনো ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পণ প্রথা বহাল রয়েছে। পর্যাপ্ত পণ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে না আসায় নব বিবাহিত বধুর উপর নানা অত্যাচার চালানো হয় এমনকি পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনাগুলোকে রান্না ঘরে কাজ করতে গিয়ে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা বলেই চালানো হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার জন্মদিন উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন – নারী শক্তির উত্থান ঘটে গেছে। গত শতাব্দী থেকে এই শতাব্দীর মধ্যে “পঞ্চায়েত ভবন” থেকে “রাষ্ট্রপতি ভবন” পর্যন্ত নারী শক্তির পতাকা পত পত করে উড়ছে। কত সংখ্যক শৌচাগার মহিলাদের জন্য তার সরকার তৈরি করেছে, কত জন মহিলাকে উজ্জ্বালা যোজনায় রান্নার গ্যাস দেওয়া হয়েছে, তার ফিরিস্তি দিয়ে মোদী নারী শক্তির জাগরণের পরিমাপ করছেন। এই প্রবঞ্চনাকে ছিন্নভিন্ন করেই গোটা নারী শক্তিকেই প্রকৃত ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
– স্বপ্না চক্রবর্তী
প্রথাগত ভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সাবেক অর্থনীতিবিদেরা শাসক দলের সমালোচনায় খুব সহজেই হাতিয়ার করেন মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের ঊর্ধ্বগতিকে। এটা বহুদিনের প্রচলিত রীতি। সমালোচকেরা হয়তো আশা করেন, মূল্যবৃদ্ধি ও কর্মহীনতা যদি খুব সঙ্কটজনক জায়গায় পৌঁছে যায় তাহলে শাসকদলের জনপ্রিয়তা কমবে। এই কিছুদিন আগে যখন ক্রমাগত পেট্রল-ডিজেলের মূল্য বেড়েই চলছিল ও একইসঙ্গে টাকার অবমূল্যায়নও হচ্ছিল, অনেকেই ভেবেছিলেন আমাদের দেশেও শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু তা সচরাচর হওয়ার নয়, বাস্তবতা বরং অন্য কথা বলে, অন্য একটি দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চায়।
আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, আমাদের দেশ ও বিশ্ব এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির জগতে প্রবেশ করেছে; যাকে কেউ কেউ ‘গিগ অর্থনীতি’ বা ‘মেটাভার্স অর্থনীতি’ বলে চিহ্নিত করেছেন। বলাই বাহুল্য, আজ অর্থনীতির ভুবনে ডিজিটাল দুনিয়ার প্রধান আসন গ্রহণ ও তার পরিব্যাপ্তিকে অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা। স্পষ্টতই, এই নতুন অর্থনীতি দুটি বড়সড় পরিবর্তন সাধিত করেছে।
১) শ্রমের আঙ্গিকে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছে যেখানে শ্রমের নিযুক্তি হয়ে পড়েছে বহু গুনে অনিশ্চিত, স্বল্প সময়ের জন্য ও চুক্তিভিত্তিক।
২) আয়ের বহুধা পথ নির্মিত হয়েছে, যেখানে ডিজিটাল ভুবনের সহায়তায় আইনি-বেআইনি বিবিধ নকশায় এটাসেটা কিছু-না-কিছু রোজগার তেমন কষ্টকল্পিত নয় আর।
এমতাবস্থায়, কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির হারের ওঠানামায় বড় কিছু আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। এই হার উঠবে, উঠলে বিরোধীরা সোচ্চার হবেন যা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু এই হার যখন আবার নিম্নমুখি দেখাবে তখন তেমন বলারও কিছু থাকবে না। কিন্তু তা বলে, দারিদ্র্য, বিপন্নতা, অভাব-অনটন, শ্রমের শোষণ ও তার সামাজিক অনুষঙ্গ সব একেবারে মুছে গেছে, তা তো নয়। আসলে বলার কথা এই, রাজনৈতিক-অর্থনীতির এক সার্বিক পরিবর্তনের ফলে সমস্যার সুলুকসন্ধানটা করতে হবে অন্যতর দিকে। নয়তো এর নাগাল পাওয়া রীতিমতো দুষ্কর।
সম্প্রতি, ‘ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চ’এর একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, আমাদের দেশে সার্বিকভাবে মজুরি সংকোচন হয়েছে। অর্থাৎ, যে হারে গড় মজুরি বাড়ার কথা, তার থেকে কম হারে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আর্থিক বছরে যেখানে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.২ শতাংশ, তা ২০১৭ থেকে ২০২১’র মধ্যে নেমে দাঁড়িয়েছে ৫.৭ শতাংশে। এটা আরও দুর্ভাগ্যজনক যখন ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের প্রথম অর্ধে জাতীয় বৃদ্ধির হার ১৩.৫ শতাংশে পৌঁছেছে বলে সরকারের দাবি। তার মানে কি এই যে, জাতীয় বৃদ্ধির সুফল খেটেখাওয়া মানুষের ঘরে পৌঁছচ্ছে না! উপরন্তু, যা আরও উদ্বেগের ও গুরুত্বপূর্ণ, শহর এবং গ্রামে যেখানে মজুরি বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ২.৮ ও ৫.৫ শতাংশ, তা মুদ্রাস্ফীতিকে গণ্য করলে (যদিও জুলাই ২০২২’র শেষে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে) আসলে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে নেতিবাচক বৃদ্ধিতে — যথাক্রমে (-)৩.৭ ও (-)১.৬ শতাংশে। অর্থাৎ, মুদ্রাস্ফীতিকে গণ্য করলে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে। মানুষ আরও দরিদ্রতর হয়েছে। এখানেই বিপদের বীজটি লুকিয়ে আছে। গিগ অর্থনীতির এই হল ধরন, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শ্রমের আঙ্গিককে এমনভাবে পুনর্নিমিত করা হচ্ছে যে মজুরির হারে সার্বিক পতন ক্রমেই এক সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গোলকধাঁধাটা হল, কাজের নানা ধারা-উপধারা তৈরি হচ্ছে, প্রায় সকলেই কোনও না কোনও অথবা কিছু না কিছু কাজ জুটিয়ে নিতে পারছে স্বল্প সময়ের জন্য কিন্তু তাদের কাজের আঙ্গিকটা এমনভাবেই নির্মিত হচ্ছে যেখানে বহুক্ষণ শ্রম দিয়েও বিনিময়ে জুটছে সামান্য মজুরি। আর এই কাজের আঙ্গিক ও নির্দেশটা তৈরি করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগরিদম যা নৈর্ব্যক্তিক — স্মার্টফোন থেকে স্মার্টফোনে প্রবাহিত হয়ে মুনাফা ও মজুরির হারের পূর্ব-নির্দিষ্ট সূত্রকে বাস্তবায়িত করে। উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণের এ এক নতুন নকশা যাকে না বুঝতে পারলে আজকের শ্রম, শ্রমিক আন্দোলন ও মজুরি-দাসত্বকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা যাবে না।
বাস্তবতাটা দেখুন। সম্প্রতি বাগুইআটিতে দুই কিশোরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জানা গেল যে অতনু দে বলে ছেলেটি অভিযুক্ত খুনীকে একটি বাইকের জন্য ৫০,০০০ টাকা দিয়েছিল। সে ওই টাকা কোথা থেকে পেল? তদন্তে প্রকাশ, অতনু অনলাইন গেমিং’এ রীতিমতো পাকা খেলোয়াড় ছিল। বন্ধুদের কাছে নিজের গেমিং অ্যাকাউন্ট বিক্রি করেই তার টাকা জোগাড়। ডিজিটাল দুনিয়া এমনতর নানাবিধ আয়ের পথ খুলে দিয়েছে যা মানুষকে তাড়িত করছে নানারকম রোজগারে। এইরকম বহু উদাহরণ পেশ করা যায়। প্রশ্নটা হল, এই মরীচিকার পিছনে দৌড়লে কি সত্যিই সকলের হিল্লে হবে? একেবারেই নয়। কারণ, জুয়া বা লটারিতে যেমন সকলের জয় কাম্য নয় — সকলেই জিতে গেলে হারবে কে, আর যদি কেউ না হারে তাহলে লাভের টাকাটা আসবে কোথা থেকে — তেমনই ডিজিটাল দুনিয়ার নানাবিধ আয়ের পথ থেকে সকলের আয় সুনিশ্চিত নয়। কিন্তু সকলেই ভাববে, এবার আমার ‘ভাগ্যে’ বুঝি শিকে ছিঁড়বে। তাই সকলেই দৌড়বে, যেভাবে তৃষ্ণার্ত মানুষ মরীচিকার দিকে ছুটতে থাকে। আর যারা মজুরির বিনিময়ে শ্রম দিচ্ছেন, তাঁরা ভাববেন, আরও কিছুটা খেটে দিলে বাড়তি দু’পয়সা আসবে। যেমন, রাতবিরেতে ডেলিভারি বয় অথবা অ্যাপ-ক্যাবের চালক ভেবে নেন যে, অসময়ে কাজটা করে দিলে ইন্সেনটিভ’টা আরেকটু বেশি হবে।
অর্থাৎ, যে কেউ যে কোনও কাজে ঢুকে যা হোক কিছু রোজগার করছে। কিন্তু সমস্যাটা হল, কাজের উপযুক্ত পারিশ্রমিক সে পাচ্ছে না। অন্যভাবে বললে, সে যা আয় করছে, তা দিয়ে সংসার চলছেনা। উপরন্তু, তার কাজেরও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতি তাকে বলছে, যখন ইচ্ছে কাজ করো, কিন্তু যত বেশি কাজ করবে তত বেশি মজুরি পাবে। আপেক্ষিকভাবে, বেশি কাজে মোট মজুরিটা বেশি হচ্ছে কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির হার অথবা মজুরির ভাগটা ক্রমশই মুনাফার সঙ্গে আনুপাতিক হিসাবে কমে যাচ্ছে। সহজ করে বললে, নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে।
সাবেক মজুরদের ক্ষেত্রেও মজুরির এই অধোগতি যে বাস্তব, তা স্পষ্ট হবে ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র (এনসিআরবি) সাম্প্রতিক তথ্য থেকেও। বলছে, ২০২১ সালে আমাদের দেশে প্রতি চারটি আত্মহননের মধ্যে একজন হলেন দিনমজুর। ২০২১ সালে নথিবদ্ধ ১.৬ লক্ষ আত্মহত্যার মধ্যে দিনমজুরদের সংখ্যা ছিল ৪২,০০৪। মোট আত্মহননের ঘটনায় দিনমজুরদের আত্মহননের অনুপাত ২০১৪ সালে ছিল ১২ শতাংশ যা ২০২১ সালে ২৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, গায়ে-গতরে খাটা দিনমজুরদের কাজ বহুলাংশে কমে এসেছে, ফলে, চাহিদার থেকে তাদের জোগান বেড়ে যাওয়ায় মজুরি কমে গেছে, বাজারে ঋণের বোঝা বেড়েছে এবং সর্বোপরি আয়ের নিরিখে খাদ্যদ্রব্যের প্রকৃত দাম অধিক হয়ে ওঠায় সেই বিপন্ন, বিপর্যস্ত জীবন থেকে ‘বাঁচার জন্যই’ তাদের উত্তরোত্তর আত্মহননের পথ বেছে নিতে হচ্ছে। এঁরা মূলত নির্মাণ শিল্প ও অন্যান্য গৃহভিত্তিক কাজে এতদিন নিযুক্ত হয়ে এসেছেন। ফ্ল্যাটবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাইওয়ে ও অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণে এইসব মজুরদের প্রচুর চাহিদা ছিল। আজকাল এইসব ক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারে কাজের সে জোয়ার নেই, উপরন্তু, নানারকম আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি এসে পড়ায় দিনমজুরদের চাহিদা অনেকটা পড়ে গেছে। এদের পরের প্রজন্ম বা যারা এখনও অল্পবয়সী — তাঁরা হয়তো নতুনতর ডিজিটাল কাজের জন্য নিজেদের তৈরি করে নিচ্ছেন যাদের একটা অংশকে উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে প্ল্যাটফর্ম সংস্থাগুলি নতুন বাজার তৈরি ও ধরার চেষ্টা করছে।
সবটা মিলিয়ে শ্রম ও শ্রমের বাজার আজ একদিকে স্বল্প আয়ের অভিঘাতে বিপর্যস্ত, অন্যদিকে এক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুনতর পরিসরে প্রসারিত। আমরা জানি, প্রকৃত মজুরির পরিমাণ যত কম হবে, মুনাফার হার তত বেশি হবে। বিবর্তনটা এই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে শ্রমের একটা বড় অংশকে যেমন প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহযোগী হিসেবে মনুষ্যশ্রমের দামও আপেক্ষিক বিচারে কমে আসছে। সামগ্রিকভাবে সাবেক ও নতুন — সব ধরনের শ্রমের মূল্যেই অধোগতি আজকের প্রখর বাস্তবতা। এই কঠোর প্রবণতাকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তাই আজকের চর্চার কেন্দ্রে থাকা উচিত।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
ডোল বা খয়রাতির বিরুদ্ধে প্রচার ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম প্রিয় অস্ত্র। কেবল তাই নয়, ভর্তুকি ও খয়রাতি উভয়ের বিরুদ্ধেই বিজেপি খড়্গহস্ত। ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থক সদস্যরা প্রত্যক্ষ কর দেননা এটা কোনো সমীক্ষা ছাড়াই বলা যেতে পারে, কিন্তু পার্টির প্রচার-প্রোপাগান্ডায় করের টাকায় ভর্তুকি বা খয়রাতি দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি করা হয়ে থাকে, সেই জনমতের প্রভাব এমন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, যে প্রাপক ভর্তুকি বা খয়রাতি নিচ্ছেন ভেবে লজ্জা পেতে পারেন, তিনি যেন পরগাছা। সেই প্রচারের মাধ্যমে খয়রাতির বিষয়টিকে এতটাই আপাত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা গেছে যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১৩ সালের সুব্রহ্মনিয়াম বালাজি বনাম তামিলনাড়ু রাজ্য সরকারের মামলায় দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার জন্য ৩ জন বিচারকের বেঞ্চের সামনে পেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পূর্বোক্ত মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায় ছিল যে, নির্বাচনের সময়ে, জয়ী হলে বিবিধ আর্থিক সুবিধা বা ভোগ্যপণ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দুর্নীতি হিসেবে সাব্যস্ত হবে না। ওই রায় পুনর্বিবেচনা করা হবে।
মূলত, প্রধানমন্ত্রী মোদীর দেশের রাজনীতির শব্দভান্ডারে নবতম সংযোজন ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’র তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোদীজির মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। ঘুঁটি যথাবিহিত সাজানো হয়েছিল, বিজেপির একজন কর্মকর্তা শীর্ষ আদালতে খয়রাতি বা ‘ফ্রিবি’র বিরুদ্ধে মামলা ঠুকলেন। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ সেই মামলা শুনলেন, মন্তব্য করলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য শুনতে চাইলেন, ভর্তুকি ও ‘ফ্রিবি’র মধ্যে পার্থক্য টানার জন্য কোনো কমিটি করা যায় কিনা তা নিয়ে কথা বললেন ও সবশেষে তিনজন বিচারকের বেঞ্চের কাছে মামলাটি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
মোদীজির ‘রেউড়ি’ ভাষণের আগেই এব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক একধাপ অগ্রসর হয়েছিল। জুন মাসের ব্যাঙ্কের বুলেটিনে, ‘রাজ্যের আর্থিক ঝুঁকি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে ভরতুকি (সাবসিডি) ও খয়রাতি (ফ্রিবি)র মধ্যে তফাৎ করতে চেষ্টা করে বলে যে, দু’টির মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ নেই, তবুও ভর্তুকি বলতে বোঝায় যা অর্থনৈতিক লাভ দেয় যেমন গণবন্টন, কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের জন্য সহায়তা। অন্যদিকে ফ্রিবি বলতে বোঝায়, বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, পরিবহণ, জল, কৃষিঋণ মকুব ইত্যাদি। একইসঙ্গে ওই নিবন্ধে রাজ্যগুলির ২০২২-২৩ সালের বাজেটে অনুরূপ ফ্রিবির উপরে খরচার তথ্য সঙ্কলন করা হয়। চিন্তার বিষয় হল, যে সমস্ত প্রকল্পগুলিকে ওই ফ্রিবির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলির বেশিরভাগই কৃষক, শিশু, মহিলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অগ্রগতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে, কী ধরনের অর্থনীতির ভাবনা ওই নিবন্ধে প্রতিফলিত হচ্ছে, কল্যাণমূলক অর্থনীতি না পরিপূর্ণ মুক্ত অর্থনীতি?
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বেশ কিছু রাজ্যের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। রাজ্যগুলির ফ্রিবি দেওয়া নিয়ে, বা ঋণ-জিএসডিপি (মোট রাজ্যের আভ্যন্তরীণ উৎপাদন) অনুপাত নিয়ে। রাজ্যগুলি ১ লক্ষ কোটি টাকার উপরে অনুরূপ খয়রাতিতে ব্যয় করছে। ফলে রাজ্যগুলির স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়ছে। কিন্তু গত ৫ বছরে যে ১০ লক্ষ কোটি টাকার উপরে ঋণ মকুব করেছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলি সেটা খুব বিবেচ্য নয়। কেবলমাত্র ১০ জন বৃহৎ ঋণখেলাপির খেলাপের পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মেহুলভাইও রয়েছে, যার খেলাপ ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
কথায় বলে যার নাম চালভাজা তারই নাম মুড়ি। তেমনি ভরতুকি, খয়রাতি, সাবসিডি বা ফ্রিবি এগুলির মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ করা যায়না। যেটা বলা যায় সেটা হল, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনটা কাঙ্খিত, কোনটা অনাবশ্যক, এটুকুই। তথাপি, নব উদারনীতির চরম ভারতীয় প্রবক্তা বিজেপি প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম দিয়ে এমন ধারণা সৃষ্টিতে খানিকটা সক্ষম হয়েছে যে, ভর্তুকি ও খয়রাতি বিষয়টিই অর্থনীতির পক্ষে বিষ। এরাজ্যের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকতো এরাজ্যের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকায় খয়রাতিকে নিম্নস্তরের ভারসাম্যের ফাঁদ হিসেবেই চিহ্নিত করলেন। লেখার ধরণ দেখে মনে হয় তিনি বিজেপি সমর্থক। ওদিকে তার প্রিয় দল দেশে তুমুল অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রাস্তায় হাঁটছেন বলে প্রচার করছে, আর বিদগ্ধ অধ্যাপক নিম্নস্তরের ভারসাম্যের ফাঁদ (লো লেভেল ইকুইলিব্রিয়াম ট্র্যাপ)-এর গল্প ফাঁদছেন।
ভর্তুকি বা খয়রাতি তদর্থে আয় বা সম্পদ পুনর্বন্টনের একটি উপায়, সাধারণত ধনীর আয় বা সম্পদের উপর কর বসিয়ে তা সকলের মধ্যে (ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে) বেঁটে দিলেও আয়ের পুনর্বন্টন হয়, ধনীর আয় বা সম্পদ কমে, গরিবের বাড়ে। যেমন সকলের জন্য গণবন্টনে খাদ্যশস্য যথেষ্ট পরিমাণে দিলে কালোবাজারে শস্য বিক্রির কোনো অবকাশ থাকে না। কেননা, সকলেই সেই শস্য যথেষ্ট পরিমাণে পায় বলে কেনার লোক থাকবে না। অন্যদিকে যে ধনী মানুষটির ওই সাধারণের জন্য খাদ্যশস্য ভক্ষণের ইচ্ছে থাকবে না তিনি বাজার থেকে ‘উৎকৃষ্ট’ মানের শস্য কিনতেই পারেন। কিন্তু সরকার তা না করে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য গণবন্টন বা রেশনের বন্দোবস্ত করায়, ওই বন্টনের আওতা থেকে অনেকে বাদ চলে যায় যাদের সস্তায় শস্যের প্রয়োজন রয়েছে, তাঁরা কালোবাজার থেকে ওই শস্য কেনেন। নির্দিষ্ট আয়ের উপরের লোকেদের গণবন্টনের আওতা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য সরকার কম রাজস্বের বা রাজস্বকে অন্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যবহারের যুক্তি দেখায়। আদতে সরকার ও শাসক দল তাদের পৃষ্ঠপোষক ধনী কর্পোরেট বা ব্যক্তিদের উপরে কর না চাপানোর জন্যই এমনটা করে থাকে। আর তারজন্য ভর্তুকি বা খয়রাতির বিরুদ্ধে ক্রমাগত জনমত তৈরি করে থাকে, সেই জনমত গড়ার কাজে শীর্ষ আদালতকেও টেনে আনা হল। আজ খয়রাতির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বন্ধ করা গেলে কাল আদালতের মাধ্যমে শিক্ষা স্বাস্থ্য গণবন্টন সর্বত্র ভর্তুকিও বন্ধ করা যাবে, বন্ধ করা যাবে কৃষিতে সার ভর্তুকি, কৃষকদের ও নিম্ন বিদ্যুত উপভোক্তাদের বিদ্যুতে ভর্তুকি। বন্ধ করা হবে বিনামূল্যে পানীয় জলের সুবিধে, কন্যাশ্রী বা সবুজসাথীর মতো প্রকল্প।
অনেকেই লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে বিত্তবান পরিবারের মহিলাদের টাকা নেওয়ার কথা বলে উপহাস করেন, তাদের মাথায় থাকে না বিত্তবানরা পেলেও ওই প্রকল্পে বিপুল সংখ্যক মহিলার কাছে ওই মাসিক ৫০০ বা ১,০০০ টাকা কতটা কাঙ্খিত! যেখানে দাবি হওয়া উচিত ওই খয়রাতির পরিমাণ আরো বাড়ানোর জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, সেখানে প্রকল্পটিকেই নিন্দামন্দ করার অর্থ হয় না। বিজেপির যে কর্মকর্তা খয়রাতি বন্ধের জন্য মামলা করেছেন তিনি উদাহরণ হিসেবে ১০০ দিনের কাজের উল্লেখ করে বলেছেন যে, ওই প্রকল্পে কোনো কাজ হয় না, শ্রমিকরা আড্ডা মারে বা মোবাইলে খেলতে থাকে, ফলে টাকা নষ্ট হয় ও কাজের অভ্যেস চলে যায়। বোঝাই যাচ্ছে যে ১০০ দিনের কাজও বিজেপি তুলে দিতে চাইছে। খয়রাতি কাজের স্পৃহাকে নষ্ট করে বলে যে যুক্তি দেওয়া হয়, সেটিও অবান্তর। যদি সরকার সকলের জন্য উচিত পারিশ্রমিকে কাজের বন্দোবস্ত করতে পারে তাহলে তো ওই মাসিক ৫০০ টাকার খয়রাতি দেওয়ার বা নেওয়ার প্রশ্নই থাকে না। সকলের জন্য কাজ, অন্যথায় যথোচিত বেকার ভাতা তো দাবি হওয়া উচিত। যে বিজেপি সরকার ক্রমাগত বেকারি বাড়াচ্ছে তারাই আবার খয়রাতি বন্ধ করার বন্দোবস্ত করে কর্মহীনদের আরো ফ্যাসাদে ফেলতে চাইছে।
খয়রাতি বা ভর্তুকির অর্থ সংস্থানে সরকারগুলির উপর কত চাপ পড়ে এবং দেশ ও রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য তাতে কত বিপন্ন হয় ভেবে যে সমস্ত গুণীজন চিন্তামগ্ন তাদের জ্ঞাতার্থে জানানো যেতে পারে, কেবল বিবিধ করছাড়ের মধ্য দিয়ে ২০১৯-২০ সালে কোম্পানিগুলিকে ১,৮৪,০০০ কোটি টাকার সুবিধে (খয়রাতি!) দেওয়া হয়েছিল। যারা কোম্পানির মালিকরা মেধা ও শ্রমের দ্বারা মুনাফা করে বলে কর বাড়ানোর বিরুদ্ধে, তাদের জানা উচিত বেশিরভাগ কোম্পানির মালিকরাই পূর্বপুরুষের সম্পত্তির উপরে ভর করে মুনাফা করে। বাণিজ্য শুরু করার ক্ষেত্রে সমান সুবিধে (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) বজায় রাখতে তাদের উচিত পূর্বপুরুষের অগাধ সম্পত্তির উপর কর দেওয়া। ধনীদের উচিত বার্ষিক সম্পদ কর দেওয়া। ১ শতাংশ সর্বোচ্চ ধনীর সম্পদে ২ শতাংশ হারে কর বসালে বছরে ৭.৫ লক্ষ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে। যদি পূর্বপুরুষের থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তির উপরে কর বসানো হয়, তাহলেও প্রায় ২০ লক্ষ কোটি টাকা পাওয়া যেতে পারে। এইসব কর বসানো নিয়ে শীর্ষ আদালতে মামলা, সরকারের বক্তব্য ও আদালতের বেঞ্চ কবে গঠিত হয় সেটাই দেখার।
- অমিত দাশগুপ্ত
জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) দ্বারা সম্প্রতি প্রকাশিত ২০২১-২২'র মানব উন্নয়ন রিপোর্ট (এইচডিআর, ২০২১-২২) অনুযায়ী সামগ্রিক মানব উন্নয়ন সূচকের (এইচডিআই) নিরিখে বিশ্বক্রমপর্যায়ে ভারতের অবস্থান ২০২০ সালের ১৩১তম থেকে ২০২১ সালে ১৩২-এ নেমে এসেছে। কেবল তাই নয়, মানব উন্নয়ন সূচকের মান ০.৬৪২ থেকে কমে ০.৬৩৩এ নেমে এসেছে। শতাংশের হিসেবে ওই হ্রাস ১.৪০ শতাংশ। সমগ্র বিশ্বকে ধরলে ওই সূচক ০.৭৩৫ থেকে কমে ০.৭৩২ হয়েছে, কিন্তু সেই হ্রাস শতাংশের হিসেবে অনেক কম, ০.৪ শতাংশ। ২০১৮’র মানব উন্নয়ন সূচক ছিল ভারতের ০.৬৪৫, বিশ্বের ০.৭৩৬। ফলে এক্ষেত্রে বিশ্বের হ্রাস ০.৫ শতাংশ, তুলনামূলকভাবে ভারতের হ্রাস অনেক বেশি, ১.৯ শতাংশ। আঞ্চলিক সূচকের দিক থেকে দেখা যাচ্ছে যে মানব উন্নয়ন সূচকের সর্বাধিক হ্রাস ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়াতে, ০.৯ শতাংশ, এবং এরজন্য অন্যতম দায়ী ভারতের সূচকের হ্রাস, ১.৪ শতাংশ যা অন্যসব দক্ষিণ এশিয় দেশ, এমনকি আফগানিস্থানের (১ শতাংশ হ্রাস) থেকেও খারাপ। যদিও মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে পাকিস্তানের অবস্থান ভারতের অনেক নিচে (১৬১তম) তবুও লক্ষণীয় যে, ২০২০'র তুলনায় পাকিস্তানের সূচক ০.৫৪৩ থেকে ২০২১এ ০.১৮ শতাংশ বেড়ে ০.৫৪৪ হয়েছে। মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, চিন, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মত প্রতিবেশি দেশগুলিতে মানব উন্নয়ন সূচক বেড়েছে, নেপাল (০.৩ শতাংশ হ্রাস), ভূটান (০.৩ শতাংশ হ্রাস), ও আফগানিস্থানের (১ শতাংশ হ্রাস) মতো প্রতিবেশি দেশে তা কমেছে, তবে ভারতের মতো কোথাও কমেনি। ফলে কোভিডের বাহানা দেওয়াটা সহজলভ্য হলেও যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
২০১৮ সালের মানব উন্নয়ন রিপোর্ট থেকে যদি শুরু করা যায় তাহলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালের সূচকের মান ভারতের ক্ষেত্রে ০.৬৪৫ (বিশ্ব ০.৭৩৬, বাংলাদেশ ০.৬৩৫); ২০১৯ সালে ভারত ০.৬৪৫ (বিশ্ব ০.৭৩৯, বাংলাদেশ ০.৬৪৪); ২০২০ সালে ভারত ০.৬৪২ (বিশ্ব ০.৭৩৫, বাংলাদেশ ০.৬৫৫); ২০২১ সালে ভারত ০.৬৩৩ (বিশ্ব ০.৭৩২, বাংলাদেশ ০.৬৬১)। ফলে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন বেড়েছে ৪.১ শতাংশ, বিশ্ব পর্যায়ে তা কমেছে ০.৫ শতাংশ ও ভারতে তা কমেছে ১.৯ শতাংশ। তুলনাটা বাংলাদেশের সঙ্গে করা দরকার কারণ অমিত শাহ থেকে শুরু করে অমিত মালব্য, শুভেন্দু অধিকারী পর্যন্ত সমস্ত বিজেপি কার্যকর্তাই বাংলাদেশী কথাটাকে গালিগালাজে রূপান্তর করতে চেয়েছেন, অমিত শাহ তো একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশীদের উঁইপোকা বলেছেন। ওরা সত্যিকে ভয় পান, তাই নিজেদের দেশের মানব উন্নয়ন যে তাদের সময়কালে তেমনভাবে বাড়ছে না, বরং গত ৩ বছরে দ্রুতলয়ে কমেছে তা স্বীকার করতে চান না।
নিচে দেওয়া তালিকা দু'টির প্রথমটিতে ভারত ও বাংলাদেশের একটি তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সূচক বৃদ্ধির হার ভারতের থেকে অনেকটাই বেশি ছিল; ২০০০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ভারতের হার বাংলাদেশের থেকে খানিকটা বেশি থাকলেও ২০১৫ থেকে ২০১৯ বা ২০১৯ থেকে ২০২১ (সামগ্রিকে ২০১৫ থেকে ২০২১) এই সময়কালে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচক ভারতের কয়েক গুণ; এমনকি ২০১৯ থেকে ২০২১ এই দু'বছরে ভারতের ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট ঋণাত্মক, বাংলাদেশে তা যথেষ্ট ভালো, কোভিড সময়কালের নিরিখে।
দ্বিতীয় তালিকাটিতে প্রতিবেশি ৪টি দেশের বিভিন্ন সময়কালে বার্ষিক সূচক বৃদ্ধির হারকে দেখা হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত, যেটি মূলত: ইউপিএ সরকারের সময়কাল, ভারতের ওই সূচক বৃদ্ধির হার ৪টি দেশের মধ্যে যথেষ্ট বেশি। ২০০০ থেকে ২০১০ এই সময়কালেও তা চিনের তুলনায় সামান্য কম, কিন্তু অন্য দু'টি দেশের তুলনায় বেশি। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০২১, মোদী-শাহ শাসনে মানব উন্নয়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সূচক বৃদ্ধির বার্ষিক হার প্রায় শূন্যে পর্যবসিত হয়েছে ও তা পাকিস্তানের থেকেও কমে গিয়েছে। এক্ষেত্রেও ‘কোভিডের সময়কালের’ বাহানা টেঁকে না কারণ কোভিড পূর্ববর্তী ২০১৫ থেকে ২০১৯ এই মোদী-শাহীতেও ওই সূচকের বার্ষিক বৃদ্ধির গড় হার ১৯৯০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়কালের যেকোনো সময়ের বার্ষিক বৃদ্ধির হারের থেকে অনেক কম। ভারতের উন্নয়ন নিয়ে, আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় দেশের অবস্থান নিয়ে গর্ব করার কোনো কারণ এই সূচকের গতিপ্রকৃতি প্রদান করছেনা। ২০১৫ থেকে ২০২১'র মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে ভারতের অবস্থান খারাপ হয়েছে, ক্রমপর্যায় ১ বিন্দু কমেছে, কিন্তু চিনের ক্রমপর্যায় ১৯ বিন্দু বেড়েছে, বাংলাদেশের বেড়েছে ১১ বিন্দু। এক্ষেত্রে পাকিস্তান ও ভারত ভাইভাই।
তালিকা-১: ভারত ও বাংলাদেশের ৩ দশকের মানব উন্নয়ন সূচকের চলন
(বন্ধনীর মধ্যে সংখ্যাগুলি পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি বা হ্রাসের হার, শতাংশে)
তালিকা-২: ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও চিনের বিভিন্ন সময়কালে মানব উন্নয়ন সূচকের বার্ষিক বৃদ্ধির হার
স্পট লাইটের আলোয় থাকতে, প্রচার আর চর্চায় ভাসতে তিনি বড্ড পছন্দ করেন। জাঁকজমক আড়ম্বরও তার বিশেষ প্রিয় — কথায়, কাজে, সাজে! আর হবেই বা না কেন! আধুনিক ‘রাজা-রাজড়া’রা যে তার প্রাণসখা! এ হেন তিনি যে তার বাহাত্তরের জন্মদিনটিতেও একেবারে নিজস্ব ঢং-এ আত্মপ্রচারের ঢাকে কাঠি দেবেন-সে আর বিচিত্র কী! যা তিনি বরাবর করে থাকেন। যেমন, এই ‘দুর্ভাগা’ দেশে, তার আগে আর কেউ আসেনি যে দেশটাকে এক কদম এগিয়ে দেবে! তার পাদস্পর্শেই তো দেশের ‘অহল্যার শাপমুক্তি’ হল, ইত্যাদি ইত্যাদি। তো এবারের চমকটা একেবারে অন্যরকম। হিংস্র এবং ক্ষিপ্রতম ৮টি চিতা শাবককে (১৯৫২ সালে যে চিতাকে তৎকালীন সরকার ‘অবলুপ্ত’ ঘোষণা করেছিল) সাতটি দশক পরে ভারতের জঙ্গলে ফিরিয়ে দিলেন! সেই রাজকীয় অতিথিরা নামিবিয়ার জঙ্গল থেকে ‘অ্যাকশন অ্যাভিয়েশন’-এর বিশেষ বোয়িং ৭৪৭ চার্টার্ড জাম্বো জেটে চড়ে ৩০ ঘন্টার ধকল সয়ে ‘মঙ্গলমতো’ এসে পৌঁছানোর পর বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী তাদের মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় অরণ্যে ছেড়ে দিয়ে তার রাজকীয় জন্মদিন পালন করলেন!
ধন্দ লাগছে তার একটা কথায়। বলেছেন — বন্যপ্রাণী ও ব্যবসা এক খাতেই বইতে পারে। অর্থাৎ মূল লক্ষ্য পর্যটন ব্যবসা, বন্যপ্রাণীর সমৃদ্ধি ও জঙ্গলের ভারসাম্য নয়! ওটা নেহাত কথার কথা! সত্যিই তো, এই বিভ্রম কেন, যেখানে ভারতীয় অরণ্যকে বনবহির্ভূত ব্যবহারের নিরঙ্কুশ অধিকার কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বন সংরক্ষণ বিধি-২০২২ আনা হয়েছে? শেষ পর্যন্ত চিতাশুদ্ধু বনটা প্রাণসখাদের হাতে তুলে দেবেন না তো? যাক সে কথা।
আসল কথা হল, তিনি ভুলে গেলেন যে, দেশবাসীর এখন দরকার ভাতের, রুটির, রুজির-চিতার নয়! কারণ তার সরকারের ‘জনগণকে শোষণ করে কর্পোরেট তোষণ’ নীতির সৌজন্যে মানুষ আজ কর্মহীন, অন্নহীন। আকাশ ছোঁওয়া মূল্যবৃদ্ধির চাপে জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। গত ৪৫ বছরে বেকারত্বের সর্বোচ্চ হারে যুবসমাজ উদভ্রান্ত।
তিনি আমজনতাকে ঠিক চেনেন না, তাই তাদের প্রয়োজনটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। যতই তিনি বলুন ‘আমি তোমাদেরই লোক’ — আসলে তিনি বিলাস-বৈভবের গজদন্তমিনারবাসী। অপরিচ্ছন্ন গরিব গুরবো মানুষগুলোর সংস্পর্শ তিনি এড়িয়েই চলেন। শুধু নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি একদা ‘চায়ে-ওয়ালা’! স্বভাব অভিনেতা তো! তিনি ‘উৎপেতে’ সাংবাদিকদেরও বিরক্তিভরে এড়িয়ে চলেন। তার অতি বড় শত্রুও এমন অপবাদ দেবে না যে তিনি কোন জাতীয় বিপর্যয়ে মুক্তকচ্ছ হয়ে দুর্গতদের পাশে ছুটে গেছেন কিংবা কোনদিন কোন সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছেন, সরকারের খামতি স্বীকার করেছেন। সেই সময়টা তিনি ‘মৌনীবাবা’ হয়ে থাকেন। দেশে উচ্চবর্ণের হাতে দলিত, আদিবাসী নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনে, দলিত বালক হত্যায় তিনি আশ্চর্য নীরব থাকেন। দুর্জনেরা অবশ্য বলে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে তার এই বাকসংযম হারিয়ে তিনি নাকি বড় উচ্ছল হয়ে পড়েন! প্রোটোকল ভেঙেই। যাক সে কথা। আসলে দেশের মানুষ বলতে তিনি বোঝেন আদানি, আম্বানি, মেহুলভাইদের। তাদের জন্যে ‘আচ্ছে দিন’ তো এনে দিয়েছেন!
তাই তিনি খোঁজ রাখেননি — অপরিকল্পিত চার ঘন্টার নোটিশের লকডাউনে কত অন্তঃসত্ত্বা, শিশুকে তিনি শ’ শ’ মাইল হাঁটতে বাধ্য করেছিলেন; পথ চলার নাছোড় ক্লান্তিতে রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়া শ্রমিকদের ছিন্নভিন্ন দেহগুলোর পাশে তাদের পরম যত্নের রুটিগুলো রক্তে ভিজে পড়েছিল; অক্সিজেনের অভাবে কতজন হতভাগ্যের প্রাণ গিয়েছিল; কীভাবে উপযুক্ত সৎকারের সম্মানটুকু না দিয়ে হাজার হাজার লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খবর রাখেননি, কত শিশু অনাথ হয়েছিল, কীভাবেই বা তারা বেঁচে আছে। একটা প্রজন্ম কৈশোরের প্রাপ্য শিক্ষা থেকে কীভাবে বঞ্চিত হল যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব শুধু তাদের নয়, দেশকেও বইতে হবে। তেমনই জানার দরকার মনে করেননি শিক্ষিত বেকার যারা সরকারি দপ্তর, ব্যাঙ্ক, রেল, বিমা, প্রতিরক্ষাশিল্প, সেনাবাহিনীতে চাকরির আশা নিয়ে এগিয়েছিল, তাঁর কর্পোরেট তোষণে কীভাবে তাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল! তিনি খবর রাখেন না কত ছেলেমেয়ে মিড-ডে-মিল-এর আশায় খালি পেটে স্কুলে চলে আসে। (কয়েক দিন আগে লাভপুরের এক স্কুলে ১৭ জন ছাত্রী প্রার্থনার লাইনে একে একে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক জানান ওরা প্রত্যেকে রক্তাল্পতায় ভুগছে। মিড-ডে-মিলের খাবার খাবে বলে বাড়ি থেকে কেউ খেয়ে আসেনি, আসে না। ওরা এত দুর্বল যে একজনকে সংজ্ঞা হারাতে দেখে বাকিরাও অসুস্থ হয়ে পড়ে।)
২০৩০-এর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার দিবাস্বপ্নে মশগুল তিনি ভাবার দরকারই মনে করেননি কীভাবে তার সরকারের ভ্রান্ত আর্থিক নীতি করোনাকালে গরিবকে আরও গরিব আর ধনীকে আরও ধনী করে ফারাকটা আসমান জমিন করে তুলেছে। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ এক বিরাট জুমলা হয়ে তাকেই ব্যঙ্গ করছে! ভারতে যখন ৮৪% পরিবারের আয় কমে গেছে, বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ ৬% ও ১০% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন ধনকুবেরের তালিকায় আরও ৪০ জনের নাম যুক্ত হয়েছে! দেশের ধনীতম ৯৮ জনের সম্পত্তির পরিমাণ দেশের দরিদ্রতম সাড়ে ৫৫ কোটি মানুষের সম্পদের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ১% মানুষের হাতে ৫৮% সম্পদ জমা হয়েছে! তিনি ভেবেও দেখেননি ৯৮ জন ধনকুবেরের সম্পত্তির ওপর মাত্র ৪% কর বসালে ১৭ বছর মিড-ডে-মিল প্রকল্প মসৃণভাবে চালিয়ে নেওয়া যেত। আরও ১% কর বসালে স্কুল শিক্ষা চমৎকার এগিয়ে যেত। কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকাগুলো চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও জলসরবরাহের জন্য যা ব্যয় করে (মোট ২০৮১৬৬ কোটি টাকা) তা শুধু মুকেশ আম্বানির ব্যক্তিগত সম্পত্তির থেকেও কম! দেশে মূলত বেকারত্ব ও আর্থিক কারণে অবসাদে আত্মহত্যা বেড়েছে ৭.১৭% এবং দিনমজুরদের মধ্যেই সেই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে (২০২০-২১-এ)। এই ‘অশ্লীল’ বৈষম্য যে অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে, তা কি তার অজানা?
ইদানীং বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাকে ‘নারীশক্তি’র জয়গান গাইতে শোনা যাচ্ছে। জন্মদিনেও। আসলে কয়েকটি রাজ্যে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে মহিলা ভোটাররা বিপুল সংখ্যায় বিজেপি’কে বিমুখ করেছিলেন সেটা যেমন মাথাব্যথা, তেমনি সমান নাগরিকত্ব ও কৃষক আন্দোলনে মহিলারা বুঝিয়ে ছেড়েছেন ‘নারীশক্তি’ কাকে বলে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন তো অনেক দূরের কথা, তার সরকার নারীর নিরাপত্তা কতটা সুনিশ্চিত করতে পেরেছে?
গোটা দেশে নারী নির্যাতন ক্রমবর্ধমান। ২০২০-২০২১-এর মধ্যে নারীর প্রতি অপরাধ বেড়েছে ১৫.৩%। দিল্লিতে বেড়েছে ৪০%। ঐ সময়ে দিল্লিতে প্রতিদিন গড়ে ২ জন নাবালিকা ধর্ষিতা হয়েছে। দিল্লি তার সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পুলিশের আওতায়। নির্যাতনের শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশে।
ধর্ষণে শীর্ষে আছে রাজস্থান। তার পর বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ। গোটা দেশে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনায় মাত্র ০.১% -এর ক্ষেত্রে ৪৯৮এ ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। অর্থাৎ বহু ঘটনাই প্রশাসনে নথিভুক্ত হয় না।
সমাজে যে তীব্র লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে তা নারী-পুরুষের আয়-বৈষম্যের জন্য ৯৮% দায়ী। সম্প্রতি অক্সফ্যাম রিপোর্ট ২০২২ সে কথাই বলেছে। শিক্ষাগত সমান যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক কুসংস্কার ও চাকরিদাতার সংকীর্ণ মনোভাবের শিকার হন চাকরি প্রার্থী মহিলারা। এই বৈষম্য দূর করতে তার সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
নারীর ক্ষমতায়নের জন্য চাই নারীর স্বাধীন স্বচ্ছ দৃঢ় যুক্তিবোধ যা তাকে অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে দেবে। অথচ তার সরকার তো স্বাধীন চিন্তার, সমাজমনস্ক প্রতিবাদী নারীদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে জেলে আটকে রেখে কণ্ঠরোধ করতে চায়! সমান নাগরিকত্ব আন্দোলনে, ভীমা কোরেগাঁও মামলায়, জাকিয়া জাফরির মামলায় তার হাতে নাতে প্রমাণ আছে। তাহলে ঐ ‘নারীশক্তির বন্দনা’ তথা ‘ক্ষমতায়ন’টাও আরেকটা জুমলা?
তিনি মূল্যবোধ তথা পরম্পরার কথাও বলেছেন। ভারত সেই মূল্যবোধেই বিশ্বাস করে যা সহস্র বছরের প্রাচীন বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে পরম যত্নে লালন করে এসেছে। আধুনিক ভারত সেই পরম্পরাকেই বরণ করতে চায় যাকে তার সংবিধান ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। যা জাত পাতের ঊর্ধ্বে অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য এবং বিজ্ঞাননির্ভর সমাজ প্রগতিতে বিশ্বাসী। যা মনে করে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’!
মোদী এবং তার আরএসএস-বিজেপি'র মূল্যবোধ ও পরম্পরার ধারণা আধুনিক ভারত খারিজ করে।
পরিসংখ্যান: অক্সফ্যাম রিপোর্ট ২০২২
এন সি আর বি রিপোর্ট ২০২২
– জয়ন্তী দাশগুপ্ত
(পেরিয়ারের জন্মদিন ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর। এই দিনটিকে মনে রেখে সেপ্টেম্বর মাসের দু’টি সংখ্যা জুড়ে আমরা পেরিয়ার সম্পর্কিত এই নিবন্ধটি প্রকাশ করছি। এটি প্রথম পর্ব। – সম্পাদকমণ্ডলী)
বিংশ শতাব্দীতে যে কয়েকজন যুক্তিবাদী সমাজ সংস্কারক ও চিন্তক জন্মেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম এরোড ভেঙ্কাটাপ্পা রামাস্বামী নায়কার। তার জন্ম ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ুর এরোডে। শুধু সমাজ সংস্কারই নয় একইসঙ্গে তিনি ছিলেন সমস্ত রকম আর্থসামাজিক বৈষম্যের প্রবল বিরোধী একজন অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রকৃত বিচারে সেই সময়ে অন্যান্য যে সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আমরা পাই তাদের মধ্যে সবথেকে স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ চিন্তাভাবনা ছিল রামাস্বামীর। যেভাবে ওই সময় দাঁড়িয়ে তিনি ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদ বর্ণ ব্যবস্থা এবং সরাসরি ধর্ম এবং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য রেখেছেন তা ভারতে যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের ধারায় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। পারিবারিক সূত্রে রামাস্বামীর পরিবার ছিল বৈষ্ণব হিন্দু পরিবার। তারা ছিলেন বালিয়া নাইডু সম্প্রদায়ের মানুষ। বালিয়া নাইডুরা বৈশ্য অথবা শূদ্রদের মধ্যে থাকা উচ্চ সম্প্রদায়। রামাস্বামীর বাবার নাম ভেঙ্কাটাপ্পা নায়কর মায়ের নাম চিন্নাতায়াম্মা। প্রথমদিকে পরিবারে যথেষ্ট দারিদ্র থাকলেও পরবর্তীকালে রামাস্বামীর বাবা নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। প্রথাগত পড়াশুনায় তার একেবারেই মন ছিল না, বছর দু’য়েক তিনি স্কুলে যান কিন্তু তারমধ্যেই তার সংবেদনশীল মন লক্ষ্য করেছিল স্কুলে হিন্দু এবং মুসলিম ছাত্রদের পৃথক জায়গায় জল খাওয়ার ব্যবস্থা। তবে এবিষয়ে তখন থেকেই রামাস্বামী প্রচলিত কোন নিয়ম কানুন মানতেন না। বাড়িতেও তাকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেওয়া হতো না। এইসব নানা কারণে তার বাবা তাকে মাত্র বারো বছর বয়সেই ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন সেখানে কিন্তু তিনি নিজেকে সফল হিসেবেই প্রমাণ করেন। রামাস্বামী তার বাল্যকাল সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, “শেষ পর্যন্ত আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হলো ও আমাকে দোকানে বসিয়ে দেওয়া হল। সেখানে আমার কাজ ছিল ভর্তি বস্তায় ঠিকানা লেখা ও পণ্যের নিলাম ডাকা।” রামাস্বামীর পৈত্রিক বাড়িতে ধর্ম কর্মের যথেষ্ট চর্চা ছিল, এমনকি এরোডের বিভিন্ন মন্দিরেও তাদের পরিবার থেকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হতো। তা সত্ত্বেও রামাস্বামীর মনে প্রথম থেকেই ধর্মীয় আচার-আচরণ সম্পর্কে একটা বিরূপতা জন্মেছিল। তিনি নিজেই বলছেন, “আমার ফাঁকা সময় পুরানের ওপর তর্ক করে কাটতো। আমাদের ঘরে সাধু সন্ন্যাসী পন্ডিত পুরোহিতদের অনেক সম্মান করা হতো। কিন্তু আমি তাদের একেবারেই পছন্দ করতাম না। এইজন্যেই তারা যা বলতেন আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সেসবের বিরোধিতা ও উপহাস করতাম।” রামাস্বামীর এই পরিবার বিরোধী এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবের কারণ খুঁজতে হলে আমাদের একটু দেখে নিতে হবে সেই সময়ের দক্ষিণ ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং রামায়ণ-মহাভারত সহ হিন্দু পুরাণের একটি বিকল্প ব্যাখ্যা, সেই সময় দক্ষিণ ভারতের বুদ্ধিজীবী সমাজে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠছিল। মাদ্রাজ সেকুলার সোসাইটির সদস্যরা ঘোষণা করলেন রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী প্রকৃতপক্ষে উত্তর ভারত থেকে আসা বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে বসবাসকারী মূল নিবাসীদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের কাহিনী উত্তর ভারতের মানুষেরা রাক্ষস অসুর ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দের মধ্যে দিয়ে দ্রাবিড়দের হেয় করার পাশাপাশি নিজেদের উচ্চবর্ণজাত বলে দাবি করে এবং একইসঙ্গে তাদের ওপর সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করে। মাদ্রাজ সেকুলার সোসাইটি নামে একটি সংগঠন এই ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ বছর ধরে নিরন্তর লড়াই জারি রেখেছিল। এই সময়কালে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলি ছিল সূর্যদয়ম, পঞ্চমা, সুগিরদোবসনি, দ্রাবিড় কোকিলাম, তামিল কলম ইত্যাদি। এই পত্রিকাগুলির লক্ষ্য ছিল শূদ্রাতিশূদ্রদের সচেতন করা, হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথাকে নাকচ করা, ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করা এবং মনুর অনুশাসনগুলিকে অস্বীকার করা।
চিদাম্বরমের লেখা পেরিয়ার রামাস্বামীর জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায় ১৯০৪ সালে একদিন তিনি বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। তারপর গঙ্গা নদীর তীরে তীর্থস্থান কাশিতে পৌঁছোন। সেই সময় তার দারিদ্র্য এমন চরমে ছিল যে প্রায় অনাহারে তাকে দিন কাটাতে হচ্ছিল। একদিন বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয় এমন একটি ধর্মশালায় খেতে গেলেন। কিন্তু শুধুমাত্র শূদ্র আর আব্রাহ্মণ বলে তাকে খেতে দেওয়া হল না। এই সময়ে শুধু জাতিগত কারণে এবং দ্রাবিড় বলে নানা রকম লাঞ্ছনা তার মনে ব্রাহ্মণদের প্রতি অত্যন্ত অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়। তিনি এর কারণ খুঁজতে থাকেন। কাশীর এই অভিজ্ঞতা তাকে পরবর্তী জীবনে চলার সঠিক দিশা দেখায়। তিনি এরোডে ফিরে আসেন এবং পারিবারিক ব্যবসার সমস্ত দায়িত্ব নেন। এই সময়েই এরোডের দুইজন যুক্তিবাদী ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ক গবেষক মারুথাইয়া পিরালাই এবং কৈবল্য সামিয়ার তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। ১৯৬০ সাল থেকে ই ভি রামস্বামী কংগ্রেসের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হন ১৯১৫-তে দ্রাবিড় অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সি সংকরানের লেখা ‘অব্রাহ্মণের চিঠি’ নামে একটি বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে এই কাগজের কর্মীদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের আক্রমণ নেমে আসার তীব্র প্রতিবাদ করেন ই ভি রামাস্বামী। ১৯১৭-তে মন্টেগু চেমসফোর্ড কমিটি যখন ভারতে সাংবিধানিক শাসন কাঠামো সংস্কার করার জন্য বিভিন্ন অংশের ভারতীয় প্রতিনিধিদের কাছে বক্তব্য জানতে চাইলেন তখন জাস্টিন পার্টির এই কমিটির কাছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষণ দাবি করে। ১৯১৭ সেপ্টেম্বর মাসে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কংগ্রেসের অব্রাহ্মণ দ্রাবিড় নেতারা ‘মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি অ্যাসোসিয়েশন’ তৈরি করলে তাতে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন ই ভি রামাস্বামী। এরপর পর পর ঘটে যাওয়া রাওলাট আইন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এসবের প্রতিবাদে এরোড পৌরসভার চেয়ারম্যানের পথ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে তিনি সেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু নানান ঘটনায় তিনি এই উপলব্ধিতে পৌঁছোন, কংগ্রেস মূলত উত্তর ভারতীয় উচ্চবর্ণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি রাজনৈতিক দল। যারা কখনো জাতপাত বিলোপের বিষয়ে এবং শূদ্র এবং শুদ্রাতিশূদ্রদের উন্নয়নের ব্যাপারে কিছুমাত্র ভূমিকা নেবেনা। সেইজন্যেই তার সম্পাদিত কুদি আরাসু পত্রিকায় তিনি স্পষ্টভাবে বলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে তিনটি ভয়ানক শত্রুকে নিকেশ করা দরকার। প্রথম কংগ্রেস দল যেটা একটা ব্রাহ্মণ ও বেনিয়া দল, দ্বিতীয় জাতপাত যুক্ত হিন্দুধর্ম, আর তৃতীয় ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। গান্ধী সম্পর্কেও তিনি খুব তাড়াতাড়ি মোহমুক্ত হন। বুঝতে পারেন মহাত্মা গান্ধীও জাতীয়তাবাদের নামে উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদকে তামিলদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। এবং আদৌ তিনি বর্ণাশ্রম প্রথাভিত্তিক ধর্মটি বিলুপ্ত হন এটা একেবারেই চান না। এরপরে রামাস্বামী রাজনৈতিক আন্দোলন ছেড়ে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে থাকেন। এখানে রামাস্বামী চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে একটা একটা প্রশ্ন আমাদের মনে দানা বাঁধে। এতটা স্পষ্ট রাজনৈতিক চিন্তা এবং দূরদর্শিতা থাকা সত্ত্বেও কোনো রাজনৈতিক বীক্ষা ছাড়া যে সমাজ সংস্কার আন্দোলন সফল হতে পারে না এটা কেন তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন না। তবে অতি দ্রুতই এই সীমাবদ্ধতা তিনি কাটিয়ে ওঠেন এবং ১৯২৫’র নভেম্বরে কংগ্রেস পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে এসে তিনি সংগঠিত করেন তার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কার আন্দোলন সুয়ামারিদাইকাম বা আত্মমর্যাদা আন্দোলন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য তিনি প্রচার করতে থাকেন তার সম্পাদিত কুদি আরাসু পত্রিকায়।
রামাস্বামী সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে যুক্ত না হলেও রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তিনি কমিউনিস্টদের খুব কাছেই ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা এম সিঙ্গারাভ্যালু নিয়মিতভাবে আত্মমর্যাদা লীগের মুখপাত্র কুদি আরাসুতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতেন। এইসব নিবন্ধ পড়ে রামাস্বামী মার্কসের দ্বান্দিক বস্তুবাদ, বিজ্ঞান, কমিউনিস্টদের লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং এরপরেই সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক কাজকর্ম নিজের চোখে দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রামাস্বামীর সোভিয়েত সফর তার মনে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর প্রভাব ফেলে। এরপর তিনি বার্লিনে যান এবং সেখানে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার এইসব কার্যক্রম থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে তিনি তার আগেকার যে সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে আত্মমর্যাদা লিগকে সীমাবদ্ধ রাখার ধারণা থেকে সরে এসেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিপ্লব ছাড়া এবং সমাজের আমূল পরিবর্তন ছাড়া উপর উপর কিছু সংস্কার সাধনের মধ্যে দিয়ে জাতপাত ব্যবস্থার বিলোপ এবং শ্রমিক কৃষকের প্রকৃত শৃঙ্খল মুক্তি সম্ভব নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিশ্বভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর রামাস্বামী একটি নতুন প্রগতিশীল কর্মসূচি হাজির করলেন যা এরোড কর্মসূচি হিসেবে বিখ্যাত। এখানেই তিনি সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন এবং আত্মমর্যাদা লীগের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি হয়।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত)
- সুমনা সেনগুপ্ত
অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক নিতাই বসু তাঁর বই ‘অশীতিপর চোখে ফিরে দেখা কমিউনিস্ট জীবন’ বইতে একটা অসাধারণ ঘটনার উল্লেখ করেছেন। নিতাই বসু তখন বঙ্গবাসী কলেজে পড়ছেন। ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নিতাই বসু সহ একদল ছাত্র ১৪৪ ধারা ভেঙে আটক হলেন। পরেরদিন দেখা গেল ছাত্রদের সমর্থনে আদালতে মামলা লড়ছেন বঙ্গবাসী কলেজেরই তৎকালীন কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ল্যাডলীমোহন মিত্র। আদালত রায় দিল ৫০ টাকা করে জরিমানা দিলে সবাই ছাড়া পাবে। কিন্তু ছাত্ররা অস্বীকার করলো; তারা কোনও ভুল করেনি, সুতরাং জরিমানা দেবে না; তারা জেলেই থাকবে। তৎকালীন বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যক্ষ প্রশান্ত বসু তখন মাথাপিছু ৫০ টাকা করে দিয়ে ছাত্রদের ছাড়িয়ে আনতে বললেন ল্যাডলীমোহনকে। ছাত্ররা যখন জানতে পারলো যে অধ্যক্ষ এই কাজ করেছেন, তারা একযোগে অধ্যক্ষকে বললো “আপনি আমাদের ছাড়ালেন কেন? আমরা তো দোষ করিনি, আমরা কেন টাকা দেবো?” সেদিন চমৎকার একটা উত্তর দিয়েছিলেন প্রশান্ত বসু — “তোমরা তো জরিমানা দাওনি। কলেজ টাকা দিয়েছে। কলেজে ছাত্ররা না এলে কলেজের তো কষ্ট হয়, তাই কলেজ তোমাদের ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে”। আজকে এসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার এই স্বাধিকারকে, তার এই মননকে লাটে তোলার পসার সাজিয়ে বসে আছে। ছাত্রছাত্রীরা না এলে কলেজের আর এখন দুঃখ হয় না। এখন দেশজুড়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এখন ব্যস্ত শাসকদের তোয়াজ করতে। আর ছাত্রছাত্রীরা ক্রমাগত ব্রাত্য হচ্ছেন শিক্ষাঙ্গন থেকে।
সাম্প্রতিক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাবলী আরও একবার তার প্রমাণ দিল। ছাত্রছাত্রীদের বর্তমানে যে অনলাইন পরীক্ষার দাবির আন্দোলন, সেই দাবি নিয়ে সমাজ কার্যত বিভক্ত। এই দাবি নিয়ে প্রভূত বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু সেই বিতর্কের সমাধান কি পুলিশ দিয়ে হবে! এটাই কি জেএনইউ থেকে বিশ্বভারতী হয়ে সিইউ দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে! কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে আন্দোলন করতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতা আছে, ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবিদাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের ভিতরে জানাতে পারবে না। মূল ফাটকের বাইরে তাদের থাকতে হয়; আর তৎপরবর্তীতে মঞ্চে অবতীর্ণ হন উর্দিধারিরা, বাকিটা সবাই জানেন। এই ট্র্যাডিশনকেই প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে দেশজুড়ে তামাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই প্রশ্ন — বিশ্ববিদ্যালয় কার? ছাত্রছাত্রীদের ছাড়া কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও অস্তিত্ব আছে? নাকি শাসক-কর্তৃপক্ষ আর তাঁবেদারদের রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠবে শিক্ষাঙ্গন! ‘আইডিয়া অব ইউনিভার্সিটি’ নিয়ে এই চর্চা আজ দেশজুড়ে।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফাটক ভিতর থেকে লোহার পাত দিয়ে অনির্দিষ্টকালীন বন্ধ করা হয়েছে। কার ইচ্ছায়, কার পরামর্শে তা আমাদের মতো নিন্দুকেরা জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বুনিয়াদি অবধারণাকে নস্যাৎ করে এই ছক দেশজুড়েই চলছে। ছাত্রছাত্রী ব্যতিরেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান — এক কল্পনাতীত কাঁঠালের আমসত্ব ছাড়া কিছুই নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমাগত হয়ে উঠছে জেলখানার প্রতিরূপ। পরিচয়পত্র দেখিয়ে তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার অনুমতি মিলবে, এই ফরমান আদতে কি একটা নির্দিষ্ট অংশের সুবিধার্থেই বলবৎ করা হচ্ছে! ভাবুন তো মা-বাবা যদি তাঁদের জাতক-জাতিকার ওপর এহেন ফরমান আরোপ করে যে বাড়িতে ঢোকার সময় জন্ম পরিচয়পত্র দেখানো আবশ্যিক! সেটা কি বাঞ্ছনীয় হবে! বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করে থাকে যে ছাত্রছাত্রীরা তাদের ওপর প্রতিনিয়ত ফরমান আরোপ করা কি আদতে মগজে কার্ফু জারির প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করারই ছক নয়! আলোচনা-বিতর্ক-ঋজুতার পাঠের উন্মুক্ত তপোবন হবে বিশ্ববিদ্যালয়, এটাই তো কাম্য ছিলো। শুধুমাত্র পাঠ্যবই আর ঝুরি ঝুরি নাম্বারের ইঁদুর দৌড়ের আস্তাকুঁড় হবে না সেটা! যৌথতা আর মানুষ হওয়ার পাঠই হবে পাথেয়; অথচ শুধুই বিচ্ছিন্ন করো, একাকিত্বকে বিজ্ঞাপিত করো আর মোসাহেবির মুন্সিয়ানা দেখাও, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবধারণাকে চুরমার করার এই প্রকল্পকে আজকের দিনে খারিজ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রশান্ত বসু-ল্যাডলীমোহনদের ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করাটা আজ সময়ের দাবি। নাহলে আগামী প্রজন্মের কাছে চির অপরাধী হয়ে যাবো আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্রাধিকার ছাত্রছাত্রীদের, তাদের ঠিক ভুলের ইঁটের গাঁথনিতেই তৈরি প্রকাণ্ড ওই ভবনগুলো, তাদের জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয় তাদের পুলিশের লাঠির মুখে ঠেলে দেওয়া! এই সহজ সত্যটা যত দ্রুত আমরা আয়ত্ব করতে পারবো, সমাজটা বেঁচে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় বহুত্বের ধারক-বাহক। অথচ আজ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে একমুখী-এককেন্দ্রিক শাসক সংস্কৃতির ভারে ন্যুব্জ। এই ন্যুব্জতাই তার প্রসারতাকে করেছে খণ্ডিত, অবদমিত। আজ সে বহুমতকে সহ্য করতে রাজী নয়, ভিন্নমতে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে। ক্ষমতার আস্ফালনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘদিন ছাত্রসংসদ নির্বাচন না করে একদলীয় একাধিপত্য ক্যাম্পাস গণতান্ত্রিকতার নির্যাসকে ধ্বংস করতে উন্মুখ। এই পরিবেশ আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আদৌ বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে আর এদেশে! নাকি সবটাই হয়ে উঠবে শাসকের মগজধোলাই যন্ত্র! নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিও এই লক্ষেই প্রকল্পিত হয়েছে। শাসক সংস্কৃতির বিপ্রতীপে তাই প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বুনিয়াদি অবধারণাকে তুলে ধরা। ‘দেবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবেনা ফিরে’ — জ্ঞানচর্চা ও চর্যার এই আদানপ্রদানের ভিত্তি দৃঢ় হোক। যৌথ অংশগ্রহণেই স্বার্থক হবে শিক্ষাঙ্গনের গণতান্ত্রিক পরিসর। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক কবিগুরুর সেই অমোঘ আহ্বাণের বাস্তবায়ন —
“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি”।
– নীলাশীষ বসু