৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইন্ডিয়া গেটের নব উদঘাটিত ‘কর্তব্যপথে’ ভাষণ দিয়ে বললেন যে, ‘রাজপথ’ (ইংরেজি কিংসওয়ের অনুবাদ) ছিল দাসত্বের প্রতীক। একইভাবে, গত সপ্তাহে ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ উদ্বোধনের সময় মোদী ভারতীয় নৌবাহিনীর নতুন পতাকা উন্মোচিত করলেন এতদিনকার সেন্ট জর্জ ক্রস চিহ্নটি তুলে দিয়ে পতাকায় নতুন প্রতীক বসিয়ে। এই ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে জানানো হয় যে ভারতের ঔপনিবেশিক অতীত থেকে সরে আসতেই এই পরিবর্তন।
রাজপথের নাম বদলে কর্তব্যপথ করে দেওয়ার দিনই অবশ্য মোদী সরকার ঔপনিবেশিকতা ও দাসত্বের প্রতীকের বিরুদ্ধে তার কর্তব্যের সব দায়দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলল। সরকারি বিবৃতিতে বলা হল যে ১১ সেপ্টেম্বর সারাদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে “প্রয়াত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সম্মানে”। এখানে প্রয়াত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিটি হলেন ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, এবং তাঁর অধিষ্ঠিত পদটি হল দুনিয়াজুড়ে শত শত বছরের ঔপনিবেশিক শোষণের, দাসত্বের আর লুন্ঠনের প্রতীক।
দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৫৩ সালে রানী হন। তিনি ছিলেন ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় পদে থাকা রাজতান্ত্রিক প্রধান বা মনার্ক। তিনি নিছক ঔপনিবেশিক যুগের অবশেষ রূপে ছিলেন না, বরং ১৯৫০ ও ৬০’র দশকে ব্রিটেন যখন দুনিয়ার দেশে দেশে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনগুলিকে নৃশংসভাবে দমন করছিল তখন সেই ঔপনিবেশিকতার এক সক্রিয় কর্ত্রী ছিলেন তিনি।
ভারতে ১৮৫৭-র বিপ্লবীদের গণহত্যা, বাংলার দুর্ভিক্ষ, জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা, ভগৎ সিংহ ও অন্যান্য বিপ্লবীদের ফাঁসি, ভারত ছাড়ো আন্দোলন সহ সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর দমনপীড়ন ইত্যাদি হল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের দ্বারা সংগঠিত মূল মূল ঔপনিবেশিক অপরাধের কতিপয় উদাহরণ। অর্থনীতিবিদ উৎসা পট্টনায়ক হিসেব কষে দেখিয়েছেন যে ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সালের সময়পর্বে ব্রিটেন ভারত থেকে ৪৫ ট্রিলিয়ন পাউন্ড চুরি করেছে।
এই রাজতন্ত্রকেই তো বরাবর এগিয়ে নিয়ে গেছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, কোনোরকম অনুশোচনা, ক্ষতিপূরণ বা ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়াই। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক জাতীয় পতাকাকে কীভাবে আমরা উপনিবেশিকতাবাদের সেই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সম্মানে অর্ধনমিত করতে পারি?
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়াল থেকে ভারত নিজেকে মুক্ত করার পরেও দুনিয়াজুড়ে আরও পাঁচ দশক ধরে অনেক দেশকে স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজত্বের হিংস্র অত্যাচার ও গণহত্যা মোকাবিলা করে। নিজের রাজত্বকালে উনি ১৯৫০’র কেনিয়ার মাউ মাউ স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার কাজ তদারকি করেছেন যেখানে বহু সহস্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ বিশ হাজারের ওপর মাউ মাউ সদস্যকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে হত্যা করে এবং এক বিপুল সংখ্যক মানুষকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠায়। এইসব ক্যাম্পের ধর্ষণ ও বীভৎস অত্যাচারের শিকারদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তাঁরা এখনও সুবিচারের জন্য লড়ে যাচ্ছেন।
রাণীর ভাবমূর্তি শ্বেতস্বচ্ছ রাখার এবং ঔপনিবেশিক অপরাধ থেকে তাঁকে বিযুক্ত দেখাতে আধুনিক ব্রিটেনের ‘খুঁটি’ হিসেবে প্রতীয়মান করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সিংহাসনে (সেখানে যিনিই অধিষ্ঠিত থাকুন না কেন) যে রক্ত লেগে আছে, যে রক্ত বছরের পর বছর ধরে দুনিয়া জুড়ে ঔপনিবেশিক হত্যা গণহত্যার মধ্য দিয়ে জমা হয়েছে, তা অত সহজে ধূয়ে ফেলা যাবে না।
এখন আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালন করছি (‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’) ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গৌরবময় সংগ্রামের প্রতি সম্মানে ও শ্রদ্ধায়। মোদী সরকার যেমনটা করবে বলছে সেভাবে আমাদের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার অর্থ আমাদের সেই স্বাধীনতা সংগ্রামকে অপমান করা, ঔপনিবেশিক শাসনের শেকল ছিঁড়ে দেশকে মুক্ত করতে যারা রক্ত দিয়েছেন সেইসব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চূড়ান্ত অপমান করা। এটা করার মাধ্যমে মোদী সরকার ঔপনিবেশিক শাসকের বিশ্বস্ত অনুগত সেবক হিসেবে নিজের চেহারাটা আরেকবার প্রকাশ করে দিল, ভগৎ সিং ‘ভূরে আংরেজ’ বলে চিহ্নিত করে যে বিষয়ে অনেক আগেই আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
- ১৩ সেপ্টেম্বর এম এল আপডেট থেকে
প্রসঙ্গ ডিএ মামলা : ২২ মে ২০২২, বিচারপতি হরিশ ট্যাণ্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তকে নিয়ে গঠিত কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এক গুরুত্বপূর্ণ আদেশে স্টেট অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ট্রাইবুনালের ২০১৮ সালের একটি আদেশ শুধু অনুমোদনই করলেন না, বরং পুনর্বিচনার জন্য আবেদনকারী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে সবক শেখানোর ঢঙে নির্দেশ দিলেন যে রায় ঘোষণার দিন থেকে তিন মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারি কর্মীদের প্রাপ্য ডিএ, বকেয়া সহ পরিশোধ করতে হবে। এই আদেশের প্রেক্ষাপট হল, একদিকে সরকারি কর্মীদের আইনত প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের চরম অনীহা, অন্যদিকে সরকারের অনিচ্ছুক হাত থেকে পাওনা মহার্ঘ ভাতা আদায়ের জন্য সরকারি কর্মী, প্রাইমারী শিক্ষক, বোর্ড-কর্পোরেশনের কর্মীদের আইনি ও রাস্তায় নাছোড় লড়াই; যুযুধান এই দু’পক্ষের খবরগুলো কাগজের শিরোনামে চলে আসছে বেশ কিছুদিন যাবত। স্টেট অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ট্রাইবুনালের ২০১৮’র আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্যে রাজ্য সরকার বর্তমানে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন জানায় ২০১৯ সালে।
ডিএ আন্দোলনের বিষয়টি জানা-বোঝার জন্য হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের পূর্ণাঙ্গ রায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। আদেশ অনুযায়ী
১) রাজ্য সরকারকে মহার্ঘভাতা (ডিএ) দিতে হবে ওয়েষ্ট বেঙ্গল সার্ভিসের পে অ্যাণ্ড অ্যালাওয়েন্সেস রুলস (রোপা) ২০০৯’র ব্যবস্থা ও ব্যাখ্যা অনুযায়ী।
২) সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্য ডিএ’র পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে সর্বভারতীয় গড় মূল্যসূচকের ভিত্তিতে এখন যা ৫৩৬তম বিন্দুতে অবস্থান করছে (১৯৮২’র মূল্য সূচক = ১০০ ধরে)। এই হিসেব অনুযায়ী একজন সরকারি কর্মীর মূল বেতনের ৩৪ শতাংশ ডিএ প্রাপ্য, ইতিমধ্যে পেয়েছেন ৩ শতাংশ, বকেয়া ৩১ শতাংশ। স্টেট অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ট্রাইবুনালও ২০১৮-এ অনুরূপ নির্দেশ জারি করেছিলেন। ডিভিশন বেঞ্চ আরও বলেন, শুধুমাত্র আইনি অধিকার হিসেবেই সরকারি কর্মচারীরা ডিএ পাবেন এমনটা নয়। তাঁরা ডিএ পাবেন সম্মানজনক জীবন যাপন এবং জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য, সংবিধানে উল্লিখিত ২১ নং ধারা অনুযায়ী, যা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত, সরকার পরিচালিত কাজগুলো রূপায়ণের ক্ষেত্রে প্রধান চালিকা শক্তি এঁরা; অধিকার থেকে এঁদের বঞ্চিত করা যায় না, এঁদের আইনি অধিকারকে একটু সম্মান জানান আপনারা; নির্ধারিত হারে ডিএ প্রদানের জন্য টাকার সংস্থান করুক সরকার; সরকারের টাকা নেই — এ যুক্তিতে সারবত্তা নেই। আমরা এই যুক্তি খারিজ করছি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তার অধীনস্থ কর্মচারীদের মধ্যেই বৈষম্যের নীতি নিয়ে চলে, সেই বামফ্রন্টের আমল থেকেই। যেমন, দিল্লী, চেন্নাইতে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন তথ্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্রগুলোয় পদস্থ কর্মীরা অন্য কিছু বিশেষ ভাতা ছাড়াও কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা পান। এপ্রসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে এই বৈষম্যমূলক নীতি সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের ১৪ নং ধারা, অর্থাৎ সমতার অধিকারকে খর্ব করছে। রাজ্য সরকার তার কর্মীদের কাজের বৈচিত্র্য অনুযায়ী বিশেষ ভাতা দিতেই পারে, কিন্তু ডিএ বিশেষ ভাতা নয়, এটা আইনি অধিকার। রাজ্য সরকার একই শ্রেণীভুক্ত কর্মীদের মধ্যে বিভাজন করছে যা অসাংবিধানিক। রাজ্য সরকার যদি এভাবে কর্মীদের আইনি দাবির প্রতি বধির থেকে যায় তবে সরকারের কাজকর্ম গুরুতরভাবে ব্যহত হতে পারে। সেক্ষেত্রে এই আদালত তাঁর চূড়ান্ত আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে এপ্রশ্নে রাজ্য সরকারকে বাধ্য করতে পারে।
ডিভিশন বেঞ্চের উক্ত আদেশ প্রচার হওয়ার পর স্বভাবতই প্রায় ৪০ বছরের অনাদায়ী দাবির হয়তো মিমাংসা হতে চলেছে বিচার ব্যবস্থার হস্তক্ষেপে। সরকারকে ডিভিশন বেঞ্চ ১৯ আগস্টের মধ্যে তাঁর নির্দেশ কার্যকর করতে বলেছিলেন। কিন্তু ১২ আগস্ট সরকার ওই বেঞ্চের কাছেই পুনরায় ২২ মে’র রায় পুনর্বিবেচনা করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। ডিভিশন বেঞ্চ আবেদনটি গ্রহণ করে মাত্র দু’দিনের শুনানিতে (২৫-২৬ আগস্ট ২০২২) সরকার পক্ষকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিলেন। তবে রায় দান কয়েকদিনের জন্য স্থগিত রাখলেন। এই কালক্ষেপকারী সর্বশেষ আবেদনে রাজ্য সরকার বলেছে, “ডিএ কর্মচারীর অধিকার নয়, সরকারের দয়ার দান”। সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি মহামান্য স্টেট অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ট্রাইবুনাল ২০১৮ সালেই খারিজ করেছে।
সম্প্রতি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করা এসবিএসটিসি’র কর্মীদের অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রেও সরকারের অস্বাভাবিক নিরবতা লক্ষ্য করে হাইকোর্ট কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে এবং পরিবহন সচিবকে কোর্টে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ জারি করে। হাইকোর্টের অন্য এক বেঞ্চের বিচারপতি রাজশেখর মান্থা মন্তব্য করেন, ডিএ’র টাকা কি বাদাম ভাজা খাওয়ার জন্য! রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের দুই সংস্থা — বিদ্যুৎ বণ্টনকারী সংস্থা এবং বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার প্রায় ২০,০০০ কর্মচারীর নতুন বেতন কাঠামোর নিরিখে প্রাপ্য ডিএ আটকে রাখে ওই পর্ষদ। হাইকোর্ট ডিএ’র টাকা গত ২৩ জুনের মধ্যে পাঁচটি কিস্তিতে মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। যথারীতি ওই আদেশ কার্যকর হয়নি। বিচারপতি জুন মাসের শেষে পর্ষদের কর্মকর্তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ওই উক্তিটি করেন, সঙ্গে সঙ্গে পর্ষদের তিনজন আধিকারিক, দুই জেনারেল ম্যানেজার ও চিফ ম্যানেজিং ডিরেক্টরদের মাইনে বন্ধের নির্দেশ দেন। উপরোক্ত তিনটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে রাজ্য সরকারের অধীন সর্বস্তরের কর্মীরা তাঁদের পাওনাগণ্ডা আদায়ের জন্য হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হচ্ছেন, হাইকোর্টও নজিরবিহীনভাবে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছেন। সম্প্রতি, সরকারি কর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন, বোর্ড-কর্পোরেশনের কর্মচারি, স্কুলের অশিক্ষক কর্মী ও প্রাইমারি-সেকেণ্ডারি স্কুলের শিক্ষকরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কলকাতায় দু’টি নজরকাড়া মিছিল সংগঠিত করেছেন। ৩০ আগস্ট রাজ্য সরকারি কর্মীরা দু’ঘণ্টার জন্যে কর্মবিরতি পালন করেছেন। লড়াইটা রাস্তায় নিয়ে আসা জরুরি, এটা তাঁরা উপলব্ধির স্তরে নিয়ে যেতে পারছেন।
- শান্তনু ভট্টাচার্য
তৃণমূলনেত্রীর নিদান, ‘কেষ্ট বেরিয়ে এলে “বীরের সম্বর্ধনা” দিতে হবে।’ কেষ্ট এখন হাজতে। গুজরাটে বিলকিস বানোর ধর্ষক ও খুনীরা জেল থেকে খালাস পেয়ে বেরিয়ে এলে তাদের বিজেপির নেতাদের নির্দেশে ‘বরণ’ করা হয় ফুলমালা দিয়ে, মিষ্টি বিলিয়ে, হিন্দুত্বের দাপট বুঝিয়ে দিতেই। এই দুই মনোভাবের মধ্যে লক্ষ্যণীয়ভাবে ধরা পড়ে এক বিচিত্র সাদৃশ্য, যদিও প্রতিতুলনায় তফাতও কিছু আছে। গুজরাটের খালাস প্রাপ্তরা ছিল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত, হিন্দুত্ববাদের পক্ষভুক্ত, দু'দশক আগে হিন্দু সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা সংগঠিত গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা চলাকালীন বিলকিস বানোর গণধর্ষক ও তার পরিবারের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা’দের খুনেবাহিনী। পক্ষান্তরে, এরাজ্যের তৃণমূলী ‘কেষ্ট’ এখন জেলখানায় বিচারাধীন, প্রচুর দুর্নীতি-কেলেঙ্কারীর অপরাধে জড়িত থাকা সন্দেহে। তার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গুণ্ডাবাহিনী আছে, এবং তার বিরুদ্ধে খুন-খারাবির অভিযোগও কম নয়। মাঝে দেখা গেল আরেক কান্ড — মঙ্গলকোটে এক দশক আগে দলবদ্ধভাবে খুন করার এক মামলায় ‘সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে’ সদলবলে ‘বেকসুর’ খালাস হয়ে গেলেন ‘কেষ্ট’! তিনি যে শাসক তৃণমূলের যাবতীয় অনৈতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক দুর্বৃত্তায়নে ও ক্ষমতা কায়েমে অশেষ গুণধর! এই কারণেই তিনি দলনেত্রীর এতো কাছের, তাঁকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রী এতো বেপরোয়া। মাস কয়েক আগে সংঘটিত হয় ঘরে লুকিয়ে থাকা লোকজনকে পুড়িয়ে মারার বগটুই ঘটনা, সেই ঘটনাক্রমেও নাম জড়ায় ‘কেষ্ট’র। তা ধামাচাপা দিতে মুখ্যমন্ত্রী অগত্যা বাধ্য হন কিছু ক্ষতিপূরণের ডালি হাতে ঘটনাস্থলে যেতে, সঙ্গে সেই ‘কেষ্ট’। গুজরাটের বদমায়েশদের জন্য রয়েছে শাসক বিজেপির খুল্লামখুল্লা মদত। এখানে ‘কেষ্ট’দের জন্য রয়েছে শাসক টিএমসির অপর্যাপ্ত ইন্ধন, নির্লজ্জ ওকালতি। এই ‘কেষ্ট’ পরিঘটনা মনে পড়ায় পাঁচ দশক আগেকার আরেক ‘কেষ্ট’ পরিঘটনাকে — ‘ফাটাকেষ্ট’ — যে কিনা কুখ্যাত হয়েছিল কলকাতায় বিপ্লবী যুব ও তরুণদের হত্যাভিযান চালিয়ে, তদানীন্তন কংগ্রেসী সিদ্ধার্থ রায়ের খুনে জমানায়। মমতা ব্যানার্জী কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেস বানালেও, গণআন্দোলন করে ক্ষমতায় এলেও, বরাবর মুখ্য প্রশাসক হিসাবে সিদ্ধার্থ রায়কে গুরু মেনে এসেছেন, এখনও ধ্যানজ্ঞানে মানেন, সম্ভবত সেখান থেকেও বেপরোয়াপ্রবণ হয়ে চলার রসদ পান ‘কেষ্ট’বাহিনী লালনে। সত্তর দশকে কাশীপুর-বরানগর গণহত্যা সংঘটিত করতে বাহানা করা হয়েছিল যে কংগ্রেসী নেতা নিহত হওয়ার ঘটনাকে, তার স্মরণ কর্মসূচি পালন করে মমতার দল। গত একদশকের বেশি সময় ধরে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি যোগে অপশাসন চালাচ্ছে মমতা সরকার। তারই অঙ্গ হল তাদের আজকের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, তার জন্যই সরকার-বহির্ভূত দমনযন্ত্র কায়েমে তৃণমূলের এতো ‘কেষ্ট’প্রবণ হওয়ার ধারা। তৃণমূলের ভিতরেও স্বার্থ সংঘাতের জেরে খুনোখুনি লেগে থাকে। অন্যদিকে তৃণমূলের বিরুদ্ধাচরণ করা আনিস খানের অস্বাভাবিক মৃত্যুরহস্যের আজও কোন কিনারা হল না, যার সাথে সন্দেহে জড়িয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ অফিসার ও এলাকার তৃণমূলের দাদাগিরি চালানো নেতাদের ভূমিকা। ঐ কেসের প্রধান সাক্ষী আনিসের এক ভাইয়ের ওপর আক্রমণ হল, যার সূত্র এখনও অধরা, থানা বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে না, সন্দেহের আঙ্গুল উঠছে তৃণমূলের দিকেই।
তৃণমূলের এই অপশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, জীবন-জীবিকার অধিকার ও দাবি আদায়ের দৈনন্দিন সংগ্রাম গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরী। বামপন্থী শক্তি পারে এই কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে। কিন্তু সেই চেষ্টায় এখনও বড় মাত্রায় দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতেই হবে, আরও চিন্তাশীল পরিকল্পিত তৎপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ-উদ্যোগ-গণউদ্যোগ, সক্রিয়তা ও গতিময়তার ধারায় রাজ্য রাজনীতিতে বামেদের হয়ে উঠতে হবে প্রধান বিরোধীপক্ষ।
কোনও অবস্থাতেই বিজেপির বিপদ বেড়ে চলার বিরুদ্ধতায় শিথিল হলে চলবে না। আর যেন ‘বিজেমূল তত্ত্বে’র ভূত চেপে না বসে। ওরা পশ্চিমবঙ্গে একুশের নির্বাচনে ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। কিন্তু হাল ছাড়ার নয়। তাই রাস্তা নিচ্ছে গণউন্মাদনা সৃষ্টি করে রাজ্য রাজনীতিতে চর্চায় থাকতে। নবান্ন অভিযানের নামে যা করল তাতে আন্দোলনের নামে বস্তুত হিংসাত্মক নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসের ফ্যাসিস্ট প্রকল্পেরই এক মহড়া দিল।
৬৮ দিন কারাগারে কাটিয়ে আহমেদাবাদের সবরমতি কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেন তিস্তা শেতলবাদ, গত ৩ সেপ্টেম্বর। তিস্তা ও আর বি শ্রীকুমার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন গুজরাট ২০০২ গণহত্যাকাণ্ডের শিকারদের ন্যায়বিচারের জন্য সক্রিয় থাকায়। এই গ্রেপ্তারি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছু ছিল না। তাঁকে জেল থেকে ছাড়া হল সুপ্রিম কোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করার পর। জামিনের মূল আবেদনটি অবশ্য গুজরাট হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায়।
এই বছরের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্ট তিস্তা শেতলবাদকে প্রতিশোধমূলকভাবে দণ্ডিত করার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল। গুজরাট’০২ গণহত্যাকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও অন্যান্যদের অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে জাকিয়া জাফরি ও তিস্তা শেতলবাদ যে মামলা চালাচ্ছিলেন তাকে খারিজ করে দিয়ে উল্টে সুপ্রিম কোর্ট, আক্ষরিক অর্থেই, তিস্তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক বিচারের পথ তৈরি করে। ন্যায়বিচারের জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় তিস্তাদের চালানো মোদী অ্যান্ড কোং’এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মামলাকে বিদ্বেষপূর্ণ বলে অভিহিত করে সুপ্রিম কোর্ট নিদান দেয় যে, যে সকল ব্যক্তি “বিচার প্রক্রিয়াকে এইভাবে অপব্যবহারের সাথে জড়িত, তাদের কাঠগড়ায় তুলতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।”
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের একদিনের মধ্যে, তিস্তা, আর বি শ্রীকুমার এবং সঞ্জীব ভাটের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি, মিথ্যা প্রমাণ দাখিল ইত্যাদি অভিযোগে এনে একটি ফৌজদারি মামলা নথিভুক্ত করা হয় এবং গুজরাট এন্টি-টেররিস্ট স্কোয়াড তৎক্ষণাৎ তিস্তাকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর মুম্বাইয়ের বাড়ি থেকে তাঁকে আহমেদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে তাঁকে পুলিশ হেফাজতে রাখেন এবং তারপর বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠান। দায়রা আদালত ৩০ জুলাই তিস্তার জামিনের আবেদন খারিজ করে দেয়। এরপর তিস্তা গুজরাট হাইকোর্টে যান। ৩ আগস্ট গুজরাট হাইকোর্টের সামনে যখন তাঁর বিষয়টি আসে, তখন নোটিশ জারি করা হয় এবং দেড়মাস পর, ১৯ সেপ্টেম্বর দিনটি, শুনানির দিন হিসেবে ধার্য করা হয়। এরপরই তিস্তা সুপ্রিম কোর্টে যান। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করে গত ২ সেপ্টেম্বর।
তিস্তা এই অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে কিছুটা স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার পেয়েছেন। একে স্বাগত। তিস্তার জন্য তা অনেকটা স্বস্তি। এবং মোদী-শাহের ঘৃণা ও মিথ্যা, প্রতিহিংসা ও ভীতি প্রদর্শনের শাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে সকল যোদ্ধার জন্যই এটা একটা বিজয়। কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ভারতে ক্রমাগত বেড়ে চলা রাজনৈতিক বন্দীসংখ্যার নিরিখে বিচার করলে এই আপাত স্বস্তিকে কেবলমাত্র এক ব্যতিক্রম হিসাবেই চিহ্নিত করা চলে। বিকে-১৫ (ভীমা কোরেগাঁওয়ের ১৫ বন্দী), সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মী, দলিত বুদ্ধিজীবী, আদিবাসী আন্দোলনের কর্মী, মুসলিম কর্মী, সাংবাদিক — এঁরা সকলেই বিজেপি-আরএসএস’এর প্রতিহিংসার রাজনীতির লক্ষ্যবস্তু হয়ে বছরের পর বছর জেলে বন্দী। ভিন্নমতের কণ্ঠকে এভাবে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখা ফ্যাসিবাদের ভারতীয় ব্র্যান্ডের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে। এই সকল বন্দীদের মুক্তির লড়াই গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের লড়াইয়ের অপরিহার্য অঙ্গ।
এদিকে, গত ৩০ আগস্ট, সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতম্বরা এবং উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সংঘ পরিবারের কিছু নেতাদের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে সম্পর্কিত যে অবমাননা মামলা চলছিল তা বন্ধ করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের এই বেঞ্চ প্রশ্ন তুলেছে, “মরা ঘোড়াকে চাবুক মেরে কী লাভ”! এবং একই সাথে আবার এ’কথাও স্বীকার করেছে যে, মামলাটি আগেই ফয়সালা না হওয়াটা ‘দুর্ভাগ্যজনক’; সুপ্রিম কোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ যেহেতু অযোধ্যা বিষয়ে একটি রায় ইতিপূর্বেই দিয়ে দিয়েছে তাই “এখন এই বিষয়ে আর কিছু টিঁকে নেই”।
এইভাবে জোর করে মামলা বন্ধ করে দেওয়া ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতির নিরিখে ধোপে টেকে না এবং অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আগের রায়ের নিরিখেও দাঁড়ায় না। প্রথমত, সুপ্রিম কোর্টের মনে রাখা উচিত যে অযোধ্যা রায়ে তারা বলেছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংস আইনের শাসনের একটি গুরুতর লঙ্ঘন। দ্বিতীয়ত, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার আগেই এই অবমাননা আবেদনটি দাখিল করা হয়েছিল এবং তখন এই মামলা মুলতুবি রেখে সুপ্রিম কোর্ট গুরুগম্ভীর আশ্বাস দিয়েছিল যে, প্রাচীন ওই সৌধগুলি সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের এই আশ্বাসবাণীর পরও, অবমাননার অভিযোগ আনা আবেদনটি মুলতুবি থাকাকালীনই, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে সুপ্রিম কোর্ট তার ২৪.১০.১৯৯৪ তারিখের রায়ে উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং’কে আদালতের আদেশ অমান্য করার জন্য অবমাননার দোষে দোষী সাব্যস্তও করে। এই রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে, উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং তার আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২’র ঘটনার সাথে সম্পর্কিত অবমাননার মামলার প্রক্রিয়া স্বতঃপ্রণোদিতভাবে শুরু করা হয়েছে এবং সেগুলি স্বাধীনভাবে ফয়সালা করা হবে। এই অবমাননার পিটিশনটি, যা ‘স্বাধীনভাবে ফয়সালা’ করার কথা ছিল, পরবর্তীতে ২০০০ সালে স্থগিত হওয়ার আগে, শুনানির জন্য একবারও তালিকাভুক্ত করা হয়নি। আর এখন তো মামলাটি পুরোপুরি বন্ধই করে দেওয়া হল।
একই দিনে, সুপ্রিম কোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ ২০০২ গুজরাট গণহত্যাকাণ্ড উদ্ভূত সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে মন্তব্য করে যে ওগুলো সময়ের সাথে সাথে ‘অকার্যকর’ হয়ে পড়েছে। বিচারাধীন মামলাগুলির মধ্যে রয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দায়ের করা স্থানান্তরের আবেদন, দাঙ্গার শিকারদের বিশেষ ছুটির আবেদন এবং ২০০৩-০৪ সালে ‘সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’ এনজিও’র দায়ের করা রিট পিটিশন, গুজরাট পুলিশের কাছ থেকে সিবিআই’এর কাছে তদন্ত হস্তান্তর করার আবেদন জানিয়ে। ঘটনাচক্রে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিল। দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের ‘আধুনিক নীরো’ বলে অভিহিত করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছিল যে, নিষ্পাপ শিশু এবং অসহায় নারীদের পুড়িয়ে মারার সময় এই আধুনিক নীরোরা অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল এবং “সম্ভবত চিন্তা করছিল কীভাবে অপরাধীদের বাঁচানো যায় বা সুরক্ষিত রাখা যায়”। সেই সুপ্রিম কোর্ট যে এখন এই দুটি বিষয়েরই কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল তা আদালতের বুনিয়াদি দায়িত্ব পরিত্যাগ করারই ন্যাক্কারজনক ভূমিকা প্রকাশ করে।
বেশ কয়েক বছর আগে, ২০০৪ সালে, প্রফেসর কে বালাগোপাল দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেছিলেন যে, “ডানপন্থী বাহিনী ক্ষমতা দখলের জন্য চক্রান্ত করছে”, এবং তারা আদালতকেও যথেষ্ট পরিমাণে দখল করেছে। তারপর থেকে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে এবং এখন আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর সরাসরি আক্রমণের সাক্ষী, বিশেষ করে নিয়োগের ক্ষেত্রে। এবং এরফলে বিচার বিভাগের রূপান্তর ঘটেছে। আইনি পণ্ডিত গৌতম ভাটিয়া এই রূপান্তরকে ‘নির্বাহী আদালত’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ নিছক কার্যনির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের অধীনস্থই নয়, বরং আদালতকে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে যা নিজেই “কার্যনির্বাহীর মতাদর্শের ধোঁয়াশা ছড়িয়ে দেবে, এবং বিশ্বের কাছে সেই মতাদর্শকে বিচারিকভাবে ঘোষিত সত্যের ঝলক হিসাবে প্রতিভাত করবে”। গণতন্ত্র টিঁকিয়ে রাখতে হলে আদালতের এই বিপর্যয়কর প্রবণতাকে উল্টোদিকে ঘোরাতে হবে এবং গণতন্ত্র রক্ষা করতে বিচার বিভাগের কার্যধারা ও সিদ্ধান্তগুলিকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলতে হবে।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২)
সাফুরা জারগরকে নিশ্চয় মনে আছে। মোদী সরকারের বানানো সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশের নানা অংশেই যে জোরালো প্রতিবাদ উঠেছিল, রাজধানী দিল্লীতে সেই প্রতিবাদের পুরোভাগে ছিলেন সাফুরা জারগর। তারপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানো হল এবং দাঙ্গার তদন্তে কারচুপি ঘটিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে সাফুরাকেও মিথ্যাভাবে ফাঁসিয়ে ইউএপিএ লাগিয়ে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল ঐ বছরের এপ্রিলে। তিনি তখন অন্তঃসত্ত্বা এবং সেই অবস্থাতেই কয়েক মাস জেলে কাটাতে হয়েছিল। সেই সাফুরা এখন আবার সংবাদের শিরোনামে এলেন তাঁর প্রতি জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বৈরী মনোভাব প্রসূত বৈষম্যের কারণে। সাফুরা সমাজতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণার জন্য জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে গবেষণার কাজ শেষ না হওয়ায় তিনি থিসিস জমা করতে পারেননি, এবং তা করার জন্য আর একটু সময় চান। সেই সময় তাঁকে দেওয়া হলনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিভুক্ত গবেষক হিসাবে তাঁর নাম বাতিল করে দেওয়া হল।
প্রশ্নটা এখন অতএব হল — গবেষণা কাজ শেষ করার জন্য সাফুরাকে আর একটু সময় দেওয়া কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব ছিল না? পাঁচটা সিমেস্টারের সময়কালের মধ্যে গবেষণার কাজ সমাপ্ত করার কথা। কিন্তু কোভিডের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গবেষণা কাজও ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়েছিল। এবং সেই কারণে ইউজিসি ‘কোভিড এক্সটেনশন’ বা কোভিডের কারণে অতিরিক্ত কয়েকটা সিমেস্টারের সময় দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছিল। কিন্তু সাফুরার জন্য একটা সিমেস্টার বা ছ’মাসের মেয়াদ বৃদ্ধির পর আর সময় বাড়ানো হল না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৬ আগস্ট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানালো — যাঁর অধীনে সাফুরা গবেষণা করছিলেন, সেই কুলবিন্দার কাউর জানিয়েছেন যে, গবেষণা কাজে তাঁর ‘অগ্ৰগতি অসন্তোষজনক’। এছাড়া, গবেষণার নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার আগে সাফুরা নারী স্কলার হিসাবে সময় বৃদ্ধির আবেদন জানাননি।
অতএব, তাঁর নথিভুক্তি বাতিল করা হবে বলে ৮ এপ্রিল ই’মেলে তাঁকে যা জানানো হয়েছিল, কর্তৃপক্ষ সেই পথেই গেলেন। সাফুরা জারগরের প্রতি এই প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব দেখানো ও এমফিল ডিগ্ৰি লাভ থেকে তাকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে জামিয়া মিলিয়া ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত বহু বিদ্বজ্জনও কর্তৃপক্ষের নেওয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। এর জবাবে জামিয়া মিলিয়া কর্তৃপক্ষ সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের শেষে এক বিবৃতিতে জানায় যে, তাঁরা ‘মানবতার’ খাতিরে সাফুরাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলেন যেটা সাফুরা গ্ৰহণ করেননি — “কোভিডের জন্য সময় সম্প্রসারণ কালে ও তারপরেও তাঁকে নারী স্কলার হিসাবে সময় সম্প্রসারণের আবেদন করতে বলা হয়েছিল যাতে সে তার গবেষণা শেষ করে সেটা জমা করতে পারে। কিন্তু সে সুপারভাইজার ও আরএসি’র (রেজিস্ট্রেশন আপিল কমিটি) এই পরামর্শে কান দেয়নি এবং নির্ধারিত সর্বোচ্চ সময়ের মধ্যে নারী স্কলার হিসাবে আবেদন জমা করেনি।” কর্তৃপক্ষের এই বিবৃতি কিন্তু তাদের দুরভিসন্ধিকে আড়াল করতে পারবে না। কর্তৃপক্ষ এই ধরনের কথাবার্তা বলছেন বলে সাফুরা ৩১ আগস্ট এক ওয়েব সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “সময় সম্প্রসারণের আমার আবেদনকে আট মাস ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত আমাকে সুস্পষ্টরূপে কিছু জানানো হয়নি।… ২০২১’র ডিসেম্বরে আমি কোভিডের জন্য সময় বাড়ানোর আর একটা আবেদন জমা দিই, যেটার সময় মাত্র দু’মাস বাড়িয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হয়।… ওরা যে অজুহাতগুলো দিচ্ছে, আমি মনে করি তার পিছনে ওরা চায় আমি আমার নথিভুক্তিকে বাতিল করে গবেষণার কাজ ছেড়ে দিই।” যে কর্তৃপক্ষ সময় সম্প্রসারণের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লোক-দেখানো ভড়ং করে মাত্র দু’মাস সময় সম্প্রসারণ করেন, দীর্ঘ আট মাস ধরে আবেদনকে ঝুলিয়ে রাখেন, ‘মানবিকতার’ অনুসারী হওয়ার তাঁদের বচন এক কপট আখ্যান বলেই প্রতিভাত হচ্ছে।
সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে যে ছাপে সাফুরার পরিচিতিকে দাগানো হল, তাকে স্থায়ী করে রাখাটাই এই জমানার নিয়ম হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে বৈশিষ্ট্য আজকের কেন্দ্রীয় শাসকদের ট্রেড মার্ক হয়ে উঠেছে, জামিয়া কর্তৃপক্ষও নিজেদের তার অংশিদার করে তুলেছেন। নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি জমানায় কোনো প্রতিষ্ঠানেরই যেমন নিরপেক্ষতার লেশমাত্র নেই, জামিয়া কর্তৃপক্ষও সেই ধারারই অনুসারী মাত্র। ফলে, সাফুরাদের হতে হয় বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। এই জমানায় নারীদের প্রতিদিনই যে বেইজ্জতি, মর্যাদা হানি, লাঞ্ছনা, ন্যায়বিচারের বঞ্চনার মুখে পড়তে হচ্ছে তা নারী শক্তির বাস্তবায়নের নরেন্দ্র মোদীর প্রতিশ্রুতিকে উপহাস করে চলেছে। নারী শক্তির আত্মঘোষণায় রাষ্ট্রের সহায়তা বর্জিত হয়ে, নরেন্দ্র মোদীর ছলনাকে অতিক্রম করে নারীদের নিজেদেরই আত্মপ্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে হচ্ছে। দিল্লী দাঙ্গার তদন্তে সাফুরা জারগরদের স্বীকারোক্তি বলে যে রিপোর্টে পুলিশ তাদের সই করতে বলেছিল, লক্ষণীয় সাহসিকতার সাক্ষর রেখে সাফুরা জারগর, দেবাঙ্গনা কলিতা ও নাতাশা নারোয়াল তাতে লিখেছিলেন, “সই করতে অস্বীকার করছি”। এমফিল সম্পূর্ণ করা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরও সাফুরা আজ বলছেন, “ওরা আমার মন ভাঙলেও মনোবলকে ভাঙতে পারবে না”। সাফুরা জারগরের নির্ভীকতা ও আত্মপ্রত্যয়কে সেলাম!
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্মেলন উপলক্ষ্যে বিহারে গত ৮ সেপ্টেম্বর ফুলওয়ারি শরিফে আয়োজিত সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী নাগরিক কনভেনশনে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ট শক্তিকে কেবলমাত্র সরকারি ক্ষমতা থেকে অপসারিত করাই যথেষ্ট নয় বরং তাকে জনসমাজেও নির্মূল করতে হবে। বিহার যে পথ দেখাচ্ছে সেই পথ অনুসরণ করলে আমরা অবশ্যই ২০২৪-এ বিজেপি শাসনের বিপর্যয় থেকে দেশকে মুক্ত করতে সমর্থ হব। সিপিআই(এমএল) নেতৃত্ব ছাড়াও মহাগঠবন্ধনের বিভিন্ন নেতানেত্রীরা নাগরিক কনভেনশনে সামিল হয়েছিলেন। তাঁরা সকলে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সার্বিক লড়াই গড়ে তোলার ও বিজেপিকে পরাস্ত করার অঙ্গীকার করেন। দীপঙ্কর ভট্টাচার্য আরও বলেন, বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সাথে সদর্থক আলোচনা হয়েছে। একদিকে বিরোধী দলগুলির জোট এবং অন্যদিকে রাস্তার আন্দোলনে বিভিন্ন অংশের জনগণের ঐক্য — এই দ্বিমুখী বিরোধী ঐক্য নিশ্চিত করলে ২০২৪ সালে আমরা অবশ্যই বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে সমর্থ হব।
বিজেপি বলে বেড়াচ্ছে, বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রীর মুখ কে হবে? আমরা বলব, সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোটাররা সাংসদদের নির্বাচিত করবেন, সেখান থেকেই উঠে আসবে প্রধানমন্ত্রীর মুখ। মূল বিষয় হল বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ট শক্তির গ্রাস থেকে দেশের গণত্রন্ত্র ও সংবিধানকে রক্ষা করা, যে বিজেপি দেশের সব সম্পদকে আদানি আর আম্বানিদের কাছে বেচে দিচ্ছে। দীপঙ্কর বুলডোজার রাজ, কর্মনিযুক্তি, শিক্ষা, এমএসপি, এনএআরইজিএ ইত্যাদি প্রশ্নে বর্তমান সরকারকে পূর্বতন সরকারের সাথে পার্থক্যরেখা স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কেবল সিবিআই হানার বিরুদ্ধে কথা বললেই হবে না, এনআইএ হানার বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলতে হবে বলে মন্তব্য করেন। দলিত ও মুসলমানদের নিশানা বানিয়ে যে অত্যাচার চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জোরালো আহ্বান ওঠে কনভেনশন থেকে।
বিহারের বিভিন্ন জেলায় পিএফআই ও এসডিপিআই দলের কর্মীসমর্থকদের বিরুদ্ধে এনআইএ-র অভিযানকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন সিপিআই(এমএল)-র বিহার রাজ্য সম্পাদক কুনাল। তিনি বলেন, বিজেপি মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে চায় তাঁদের সন্ত্রাসবাদী ছাপ্পা দিয়ে এবং সেই লক্ষ্যে কেন্দ্রের আদেশে এনআইএ এই অভিযান চালাচ্ছে। এই সবই করা হচ্ছে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে জয় হাসিল করার উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটাতে। ফুলওয়ারি শরিফ পরিঘটনায় ফুলওয়ারি শরিফ তথা সমগ্র মুসলমান সমাজকে বদনাম করতে কীভাবে নির্দোষ ব্যক্তিদের নিশানা বানানো হয়েছে তা খুবই স্পষ্ট। এটা বরদাস্ত করা যায় না। এনআইএ স্থানীয় প্রশাসনকে খবর না দিয়েই হঠাৎ হঠাৎ অভিযান চালাচ্ছে যা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। বিহার সরকারকে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এনআইএ অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ খাড়া করতে হবে।
সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য গত ১১ সেপ্টেম্বর ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তথা ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার কার্যনির্বাহী সভাপতি শ্রী হেমন্ত সরেনের সাথে রাঁচিতে তাঁর বাসগৃহে দেখা করেন। তাঁর সাথে ছিলেন দলের ঝাড়খণ্ড রাজ্য সম্পাদক মনোজ ভক্ত ও বিধায়ক বিনোদ সিংহ। আলোচনা কেন্দ্রীভূত ছিল মূলত রাজ্যের খরা পরিস্থিতি, এনআরইজিএ-র বকেয়া মজুরি, নেতারহাট ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জ প্রত্যাহার, বনাধিকার আইন জোরদার করা, রেশন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা ইত্যাদি। রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে রাজভবনের মধ্যে দিয়ে বিজেপি যে ষড়যন্ত্র রচনা করেছে সে সম্পর্কেও আলোচনা হয়। আলোচনা হয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর বিজেপির আক্রমণের বিরুদ্ধে এবং বিরোধী নেতা ও আন্দোলনকর্মীদের ওপর ধারাবাহিক হামলার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রসঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন রাজ্যের বিভিন্ন জ্বলন্ত ইস্যুতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। মোদী সরকারের জনবিরোধী কাজকর্মের বিরুদ্ধে জেএমএম ও বাম দলগুলির একসাথে কাজ করার বিষয়েও জোর দেন তিনি।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার ১৪ সেপ্টেম্বর এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, ‘‘জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শক্তিশালী করেই বামপন্থী শক্তিকে প্রধান বিরোধীপক্ষ হয়ে উঠতে হবে।’’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ১৩ সেপ্টেম্বর সারাদিন ধরে রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করল তৃণমূল সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে কলকাতা ও হাওড়া সহ রাজ্য জুড়ে বিজেপির নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস। নবান্ন অভিযানের নামে হতোদ্যম হয়ে পড়া সংগঠনকে চাঙ্গা করতেই বিজেপির এই অভিযান। একদিকে সরকার পক্ষের জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, পুলিশের লাঠি আর অন্যদিকে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস সৃষ্টির সমস্ত উপকরণ নিয়ে উপস্থিত বিজেপি বাহিনী। বিজেপির নবান্ন অভিযান জনজীবনের কোনও মৌলিক প্রশ্নের সমাধানের লক্ষ্যে ছিল না।
তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং কর্মসংস্থান ও গণতন্ত্রের দাবিতে শক্তিশালী গণ আন্দোলন বামপন্থীদেরই গড়ে তুলতে হবে।
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত জনবিরোধী, গণতন্ত্র বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেই বামপন্থী শক্তিকে প্রধান বিরোধী পক্ষ হয়ে উঠতে হবে।
নকশালবাড়ি অঞ্চলের হাতিঘিষা গ্রাম পঞ্চায়েতের হোচাইমল্লিক জোতে বাবুলাল বিশ্বকর্মকারের ৫৪তম শহীদ দিবস পালিত হয়। ১৯৬৮ সালে ৮ সেপ্টেম্বর বাবুলাল বিশ্বকর্মকারকে পুলিশ হত্যা করে। শহীদ দিবসে বিভিন্ন নকশালপন্থী গোষ্ঠী — নকশালবাড়ি আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী শান্তি মুন্ডা, সুনীতি বিশ্বকর্মকার প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ সহ জেলা নেতৃবৃন্দ থাকেন। শরৎ সিংহ বাবুলাল বিশ্বকর্মকারকে নিয়ে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। সভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু ও সংগ্রামী শ্রমিক কৃষক মঞ্চের রতন দে প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা নাথুরাম বিশ্বাস।
২০১৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় তিরিশ মাস বন্ধ থাকার পর গত ১ জানুয়ারি থেকে গোন্দলপাড়া জুটমিল আবার বন্ধ। এই সময় পর্বে ৬ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন, অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছেন ৩০ জন। শ্রমিক মহল্লায় নৈরাশ্য, প্রশাসনের দিক থেকেও মিল খোলার ব্যাপারে কোনো সদর্থক ভূমিকা নেই। গত ২৬ আগস্ট জিতেন্দ্র প্রসাদ রবিদাস নামের মাত্র ২৮ বছর বয়সের এক শ্রমিক আত্মহত্যা করে, তার দু’দিন আগেই মিলের শ্রমিক শেখর দাস চন্দননগর হাসপাতালে মারা যান। এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে এই দুই পরিবারের সাথে দেখা করতে যাওয়া হয়। সেই সময় প্রতিনিধিদল অসহায় শ্রমিক পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীতা অনুভব করেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর এআইসিসিটিইউ’র উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিশ্বজিৎ দে স্মৃতি শিক্ষা সহায়তা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে স্থানীয় মনসাতলা ক্লাবে এই দুই মৃত শ্রমিকদের পরিবার সহ এই রকম অসহায় বেশ কিছু শ্রমিক পরিবারের মহিলাদের হাতে শাড়ি ও অর্থ তুলে দেওয়া হয়। সেদিনের কর্মসূচিতে হাজির ছিল পাশের তেলিনিপাড়া অঞ্চলের ছাত্রীরা। ১২ সেপ্টেম্বর সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের এক প্রতিনিধিদল চন্দননগর এসডিও’র সাথে সাক্ষাৎ করে শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে, মিল খোলা ও মৃত শ্রমিক পরিবারগুলিকে আর্থিক অনুদানের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পৌরসভার সামনে সারা দিন ধরে অবস্থান আন্দোলন চলে সরকার নির্ধারিত পুজো অনুদান ৪৮০০ টাকা এবং দৈনিক মজুরি ৩৪২ টাকার দাবিতে। কর্তৃপক্ষকে আগাম জানান দিয়েই এদিনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। পৌরপিতা এদিন সকালেই কর্মচারিদের সামনে ঘোষণা করে দেন যে এবছর উল্লিখিত পুজো বোনাস দেওয়া হবে। সেই কথায় বিশ্বাস-ভরসা রেখে সারাদিনের অবস্থান কর্মসূচি কাটছাঁট করে ৩ ঘন্টার প্রতিবাদ সভা করা হয় এবং এই সভা থেকে নির্বাহি কর্মকর্তাকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। ইউনিয়নের সম্পাদক দিলবার খান পৌরপিতাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। সরকার নির্ধারিত সামান্য বোনাসটুকু থেকেও সাফাই কর্মচারিদের বঞ্চিত করা হয়েছে বরাবর। ধন্যবাদ জ্ঞাপনের সাথে সাথে দিলবার খান কর্তৃপক্ষকে সতর্কও করে দেন। তিনি বলেন, এই কথার খেলাপি করে পুজোর প্রাপ্য অনুদান না দিলে জরুরিভিত্তিতে পৌরসভা পরিস্কারের কাজ বন্ধ রাখা হবে, তার জন্য সম্পুর্ণভাবে দায়ী থাকবেন পৌরপিতা। এদিনের সভায় বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিউ রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু, জেলা সভাপতি বাবলু ব্যানার্জি, মেদিনীপুর পৌরসভার সংগ্রামী শ্রমিক নেতা তপন মুখার্জি, ইউনিয়নের সভাপতি ফারহান হোসেন খান সহ অন্যান্যরা। সকলেই বলেন, পুজো অনুদানের দাবি পৌরপিতা মেনেছেন তা ভালো, এবারে তাঁদের দল পরিচালিত সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ন্যূনতম দৈনিক ৩৪২ টাকা মজুরির স্বীকৃতি দিন। পৌরসভার জীবনযাত্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিপজ্জনক দৈনন্দিন কাজটা যারা করছেন সেই সাফাই মজুররা সরকার ঘোষিত ন্যুনতম মজুরি পাচ্ছে না কেন? এছাড়া প্রত্যেক মজদুরকে পরিচয়পত্র, পিএফ, স্থায়ীকরণ, শূন্যপদে মজদুরদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের নিয়োগের অগ্রাধিকার ইত্যাদি দাবি উঠে আসে। মজুরদের এই আন্দোলন কলকাতায় চাকরির দাবিতে ৫০০ দিনের অধিক অবস্থানে থাকা যুবছাত্রছাত্রী বা জবকার্ডে কাজ করেও গত ডিসেম্বর মাস থেকে মজুরি না পাওয়া গ্রামাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মেহনতি মানুষের সংগ্রামের সাথে এক সূত্রে গাঁথা বলে জানিয়েছেন ফারহান হোসেন খান।
“এইখানে মেয়েরা প্রচণ্ড ভয়ে থাকি, সন্ধ্যের মধ্যেই দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে যাই। অনেক সময় মাঝ রাতে দরজায় টোকা দেয় গুণ্ডারা, প্রত্যেকদিন রাতে ঘুমানোর সময় ছুরি ও দা নিয়ে শুতে যাই” — জানালেন টিটাগড় ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কয়লাডিপু শ্রমিক মহল্লার এক মহিলা।
বহুদিন ধরেই এরকম আতঙ্কে বাস করছেন এই ওয়ার্ডের শ্রমিকমহল্লার বাসিন্দারা। এইখানেই গত ৭ তারিখ ১৯ বছরের এক কিশোরীকে বাড়ির সামনে থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়েছে।
১১ সেপ্টেম্বর সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি’র (আইপোয়া) উত্তর ২৪ পরগণা জেলা এবং অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ‘আইসা’র পক্ষ থেকে টিটাগড় গণধর্ষণ কাণ্ডে নির্যাতিতার পরিবারের সাথে দেখা করা হয়। আইপোয়া’র পক্ষ থেকে ছিলেন অর্চনা ঘটক, মিতালি, তিথি, সাধনা ও জোৎস্নাদি এবং আইসা’র সুরত্ন। নির্যাতিতার মা প্রতিনিধিদলকে জানান ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যেবেলা তাঁর মেয়ে বাড়ি থেকে দু’হাত দূরত্বে শিবমন্দিরে দাদুর পাশে বসে মোবাইল দেখছিল। এইসময় ৪ জন দুস্কৃতী এসে ওর মোবাইল কেড়ে নেয়, মেয়েটি ফোন নিতে তাদের পিছনে দৌড়ালে তাকে মন্দিরের পাশেই জে পি চৌধুরীর টিটাগড় ওয়াগন লিমিটেডের জঙ্গলাকীর্ণ জমিতে টেনে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। দাদু ভয়ে চিৎকার করলে পাড়ার লোকেরা কেউ এগিয়ে আসেনি। মা ছুটে এলে একজন দুষ্কৃতি মাকে জানায়, “তোমার মেয়ে ঠিক আছে, ঘরে চলে যাও”। পরে তারা মেয়েটিকে মাঠে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরদিন ৮ তারিখ সকালে পুলিশে অভিযোগ জানানো হলে দু’দিনের মধ্যে ৪ জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। মেয়েটির মেডিকো-লিগ্যাল করা হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মেয়েটি মানসিক ট্রমার মধ্যে রয়েছে, তাই তারসাথে প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ সম্ভব হয়নি।
৫নং ওয়ার্ডের এই অঞ্চলে বহুদিন ধরে দুষ্কৃতিদের কার্যকলাপ চলে। জে পি চৌধুরী টিটাগড় ওয়াগনের কারখানার জমিতে সন্ধ্যে হতেই মদ সাট্টা জুয়ার আসর বসে। মহল্লাতে কেউ কোনও প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। রাস্তায় আলো নেই বললেই চলে। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলের কাউন্সিলরের ভাই থাকায় বোঝাই যাচ্ছে এই দুষ্কৃতি কার্যকলাপে শাসক দলের প্রত্যক্ষ্য মদত রয়েছে। নির্যাতিতার পরিবার আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ওই মহল্লার ঘরে ঘরে আতঙ্ক। বাসিন্দারা জানান পুলিস প্রশাসন সব জানে, কিন্তু কেউ কিচ্ছু করেনি। ঘটনার পরে পুরসভা থেকে কারখানার জমির জঙ্গল সাফ করা হলেও, সেই মাঠে খুবই সামান্য আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো মহল্লা জুড়ে এক গা ছমছমে ভাব। দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে নির্যাতিতার পরিবারের লড়াইয়ের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে আসা হয়।
তারপর আইপোয়া ও আইসা’র পক্ষ থেকে টিটাগড় থানায় ডেপুটেশন দিতে যাওয়া হয়। প্রথমে প্রতিনিধি দলকে থানায় ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। তারপর কিছু কথা কাটাকাটির পর আইপোয়া’র পক্ষ থেকে মিতালি বিশ্বাস, অর্চনা ঘটক এবং আইসা’র পক্ষ থেকে সুরত্ন এবং স্থানীয় অধিবাসী সিউজী থানায় কর্তব্যরত সেকেন্ড অফিসারের সঙ্গে দেখা করেন। ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়ে দ্রুত চার্জশিট দিয়ে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি, এলাকায় পুলিশি নজরদারি বাড়ানো এবং অবিলম্বে মদ, সাট্টা, জুয়ার আসর বন্ধ করার আবেদন জানিয়ে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। পুলিশ আধিকারিক জানান, বর্তমানে নাকি মহল্লাতে সিভিল ড্রেসে পুলিশ মোতায়েন করা আছে, কিন্তু আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে কাউকেই দেখতে পাইনি। ডেপুটেশনে দাবি করা হয়েছে — গণধর্ষণের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত উপযুক্ত চার্জশিট দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ধর্ষিতা কিশোরীর এবং তার পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশকে নিতে হবে। এলাকায় নিয়মিত পুলিশি টহলদারি দিতে হবে। মদ-জুয়া-সাট্টার আসর বন্ধ করতে হবে এবং অঞ্চলের জঙ্গল পরিষ্কার রাখতে হবে। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে, সিসি টিভি বসাতে হবে। এলাকার মেয়েদের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্থানীয় থানাকে নিতে হবে।
বেঙ্গালুরু শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা জলে ডুবে গেছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে ওই অঞ্চলে। বৃষ্টির ধরণে বদল দেখা গেছে। হঠাৎ করে এমন আকাশভাঙা বৃষ্টি আগে কখনও দেখেনি বেঙ্গালুরু। বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। জল আটকে প্লাবিত হয়ে ভারতের ‘আইটি হাব’ হাবুডুবু খাচ্ছে। বৃষ্টি কমে আসার পরও জল বেরোতে পারছে না। জল বেরোতে না পারার পেছনে, বলাই বাহুল্য, সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত নগরায়ন দায়ি। আর এই অস্বাভাবিক বর্ষণের পেছনে আছে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও বায়ুদূষণ। বাতাসে ভাসমান বড় কণার (এয়ারোসল) পরিমাণ বেড়ে গেলে বাতাসের জলীয় বাষ্প জমে মেঘ হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায় এবং অতি অল্প সময়ে অনেকটা বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা বেড়ে গেলে জলের বাষ্পীভবনও বেড়ে যায়। ভারত মহাসাগরের পৃষ্ঠদেশের গড় উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মার্চ মাসে প্রকাশিত আইপিসিসি রিপোর্ট পৃথিবীর বিভিন্ন শহরগুলিতে আসন্ন প্লাবন সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। বিশেষত ভারত সহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশের শহর জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানোর জন্য মোটেই প্রস্তুত নয়।
ভারতের ‘আইটি হাব’ বেঙ্গালুরুর এই অতিবৃষ্টি ও প্লাবনের খবর মিডিয়াতে এসেছে। যদিও বড় বড় গেটওয়ালা কোটি টাকার বাড়িতে ঢুকে পড়া জল আর রাস্তায় হাবুডুবু খাওয়া দামি মোটর গাড়ির ছবিই মিডিয়াতে বেশি বেশি তুলে ধরা হয়েছে। গরিব শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত বসতিগুলো শ্রেণীবৈষম্যের সমাজে ঐতিহাসিকভাবে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাগুলিতেই গড়ে ওঠে, নিকাশী ব্যবস্থা যেখানে আরও অপ্রতুল। বিপর্যয়ের সিংহভাগ দুর্ভোগ এদেরকে পোহাতে হয়, তাদের অনেককেই সর্বস্ব খোয়াতে হয়। খবরে তা তেমন আসে না। কেনই বা পূর্বসতর্কতা থাকা সত্ত্বেও বেঙ্গালুরুকে এভাবে ভেসে যেতে হল তার প্রেক্ষাপট নিয়েও মূলধারার সংবাদ পরিবেশনে কোনও চর্চা থাকে না।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসে হাজির হয়েছে যা খবরের কাগজ বা চ্যানেলে তেমন চর্চায় নেই। পাকিস্তানে অভূতপর্ব বন্যা। পাকিস্তানের তিনভাগের এক ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। সবচেয়ে তীব্র ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সিন্ধ ও বালুচিস্তান প্রদেশে। এছাড়া আছে খাইবার পাখতুনখয়া, গিলগিট-বাল্টিস্তান, পাঞ্জাব ও আজাদ কাশ্মীর প্রদেশ। ১৪ জুন থেকে শুরু হওয়া প্রবল বর্ষণ ও প্লাবনে এখনও পর্যন্ত ১,৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে ৪৯৯ জন শিশু। আহত আরও বহু। ৬ লক্ষের কাছাকাছি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও বহুগুণ। ৭.৫ লক্ষ গবাদি পশু মারা গেছে। ৬.৫ হাজার কিমি রাস্তা, ২৬৯টি ব্রীজ, ১৭.৫ হাজার স্কুল ও বিরাট পরিমাণ কৃষিক্ষেত্র ধ্বংস হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তানে এই মাত্রার বন্যা আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব এবং জলবায়ু সংকটের বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একদিকে ভারত মহাসাগরের উষ্ণতা বেড়ে অতিরিক্ত বর্ষণ, অন্যদিকে গিলগিট-বাল্টিস্তানের হিমবাহ গলে যাওয়া। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব। এবং এই প্রভাব সীমান্তের কাঁটাতার মানে না। বিশেষত পাকিস্তান ও ভারত একই ভৌগলিক অঞ্চলের অন্তর্গত। পাকিস্তানের এই বন্যা জলবায়ু সংকটের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বিস্তারিত চর্চা হওয়া দরকার। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২.১ শতাংশ পাকিস্তানে বসবাস করে, আর মোট কার্বন নিঃসরণের ১ শতাংশ পাকিস্তানের অর্থনীতি থেকে আসে। কিন্তু মাথাপিছু নিঃসরণের হিসেবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় কম নিঃসরণ ঘটালেও বিপর্যয়ের ধাক্কা বড় হয়ে নেমে আসছে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতেই। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় মুনাফার তাড়না সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয় বলেই বিশ্ব আজ এই সংকটে। আর সব সংকটের মতো পরিবেশ সংকটের বোঝাও সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলির ওপরই এসে পড়ে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলার প্রশ্ন তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণী প্রশ্ন।
‘দিল্লী নগর আশ্রয় উন্নতি বোর্ড’এর রুলসে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে, ২০১৫ সালের আগে থেকে যারা বস্তিগুলিতে বসবাস করছেন তাঁদের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে কোনওরকম উচ্ছেদ করা যাবে না। তথাপি বস্তির শ্রমজীবীদের উচ্ছেদ করাটা দিল্লী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ‘ডিডিএ’র নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বড়লোকের স্বার্থে ‘উন্নয়ন’ নীতিতে যত খুশি জমি নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমন এক সময়ে এই জমি গ্রাস চলছে যখন জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি ও পরিবেশ-প্রকৃতি ক্ষয়ের কারণে জমি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। গ্রাম থেকে শহরে জমি ও জীবিকা থেকে শ্রমিক শ্রেণীর উচ্ছেদ, কোনওরকম পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই, অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠেছে।
শহর ও আধাশহর গঞ্জে প্রতিদিন জনসংখ্যা বাড়ছে এবং এইসব জায়গায় আবাসের অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। দিল্লীতে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনের সময় খুব প্রতিশ্রুতি দেয় ‘জাঁহা ঝুগ্গি, ওঁহা মকান’ শ্লোগান তুলে। কিন্তু তা আর কখনই বাস্তবায়িত হয় না।
রাজধানী দিল্লীতে বস্তিবাসীদের অধিকার সংগঠিত করতে এআইসিসিটিইউ ও আইসা সহ কিছু গণসংগঠন ও নাগরিক সংগঠন ধারাবাহিক লড়াই গড়ে তুলেছে। জাহাঙ্গিরপুরি ও ধোবিঘাট বস্তিতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করে বুলডোজার থামিয়ে দেওয়া গেছিল। গত ৬ সেপ্টেম্বর যন্তরমন্তরের রাস্তায় এক যৌথ প্রতিবাদে সামিল হয় বিভিন্ন বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন, গণসংগঠন ও নাগরিক সংগঠন। গত কয়েকমাসে মোদী সরকারের বুলডোজার রাজ রাজধানি শহরের যে সমস্ত শ্রমিক বস্তিতে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে সেই সমস্ত জায়গা থেকে মানুষেরা এসেছিলেন। ধোবিঘাট ঝুগ্গি অধিকার মঞ্চের কনভেনর বিবি আখতারি বলেন, ভোটের আগে ‘জাঁহা ঝুগ্গি, ওঁহা মকান’ বলা হয়েছিল আর এখন মকান তো দূরের কথা মাথা গোঁজার একটা ঝুপড়িও রাখতে দিচ্ছে না, জল বন্ধ করে দিচ্ছে, লাইট বন্ধ করে দিচ্ছে, বুলডোজার চালিয়ে সব গুঁড়িয়ে দিচ্ছে; আমরা বিগত তিন বছর ধরে আদালতে শুনানি দিয়ে যাচ্ছি, প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু সরকারের কানে যাচ্ছে না।
যন্তরমন্তরের এই যৌথ প্রতিবাদসভা থেকে আহ্বান রাখা হয় সমস্ত বিপন্ন বস্তিবাসী মানুষকে সংগঠিত করে বুলডোজার রাজের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ও শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার।
অ-বিজেপি দল শাসিত রাজ্যগুলোতে এবং বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডি-আয়কর দপ্তরের অভিযান যখন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে, এবং বিরোধী দলগুলোকে দুর্নীতির প্রতিভূ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা নরেন্দ্র মোদী চালিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই মধ্যপ্রদেশে রাজ্য সরকারকে জড়িয়ে দুর্নীতির এক বড় ঘটনার উন্মোচন ঘটল। মধ্যপ্রদেশে শাসন ক্ষমতায় এখন বিজেপি এবং যে নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর এই দুর্নীতির কেন্দ্রে রয়েছে বলে অভিযোগ, সেই দপ্তরের দায়িত্বে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। মধ্যপ্রদেশ সরকার নারী ও শিশুদের পুষ্টি সাধনের লক্ষ্যে একটা প্রকল্প চালায় যার নাম হল ‘টেক হোম রেশন’ যা হল বিনামূল্যে রেশন সরবরাহ। সম্প্রতি ঐ রাজ্যের অডিটর জেনারেলের পেশ করা ৩৬ পাতার গোপন রিপোর্টের একটা কপি ফাঁস হয়ে সংবাদ মাধ্যমে চলে আসে এবং রিপোর্টে ঐ রেশন প্রকল্পকে ধরে শত-শত কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের সুবিধা প্রাপকদের সংখ্যাকে বাড়িয়ে দেখানো, রেশন পরিবহণের প্রমাণ হিসাবে জাল নথি পেশ করা, রেশন বিলির পরিমাণকে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে বেশি করে দেখানো — বিভিন্ন স্তরেই দুর্নীতির অকাট্য সাক্ষ্য বহন করছে রাজ্যের অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের রিপোর্ট।
এই রেশন প্রকল্পের সুবিধা পায় তিন বর্গের শিশু ও নারীরা — ৬ মাস থেকে ৩ বছরের শিশুরা, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও স্তন্যদায়ী মায়েরা এবং স্কুলের পড়া ছেড়ে দেওয়া ১১ থেকে ১৪ বছরের কিশোরীরা। সব মিলিয়ে প্রকল্পে নথিভুক্তদের সংখ্যা ৪৯.৫৮ লক্ষ — শিশু ৩৪.৬৯ লক্ষ, বয়স্ক নারী ১৪.২৫ লক্ষ এবং পড়া ছেড়ে দেওয়া কিশোরী ০.৬৪ লক্ষ। অডিটর এদের ২৪ শতাংশ বা ১২ লক্ষকে নিয়ে তদন্ত চালানোর উল্লেখ করেছেন এবং তাতেই দুর্নীতির ঐ বহর ধরা পড়ে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে — স্কুলশিক্ষা দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী স্কুলে পড়া ছেড়ে দেওয়া কিশোরীর সংখ্যা ২০১৮-১৯ বর্ষে ছিল ৯ হাজার। কিন্তু নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের দেওয়া হিসাব অনুসারে ঐ কিশোরীদের সংখ্যা হল ৩৬.০৮ লক্ষ! কিসের ভিত্তিতে এই সংখ্যায় পৌঁছানো হল তা দফতর জানাতে পারেনি, কেননা, এরজন্য কোনো সমীক্ষাই করা হয়নি। অডিটর জেনারেলের রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছে, রাজ্যের ৮টি জেলার ৪৯টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে স্কুলে পড়া ছেড়ে দেওয়া কিশোরী নথিভুক্ত হয়েছিল ৩ জন। কিন্তু নারী ও শিশু কল্যাণ দফতর নথিভুক্ত কিশোরীদের সংখ্যাটাকে ৬৩,৭৪৮ বলে দেখায় এবং ২০১৮ থেকে ২০২১’র মধ্যে ২৯,১০৪ জনকে রেশন সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানায়। সহায়তা প্রাপকদের সংখ্যাকে যত বেশি করা যাবে, রেশন সরবরাহের পরিমাণ পাল্লা দিয়ে বাড়বে এবং বেড়ে চলবে টাকা নয়ছয়ের খেলা!
শিশু, নারী ও কিশোরীদের যে রেশন সরবরাহ করা হয় তা উৎপাদনের জন্য রাজ্যে ৬টা কারখানা আছে — বাদি, ধর, মাণ্ডলা, রেওয়া, সাগর ও শিবপুরি এলাকায়। এই কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা যত এবং যে পরিমাণ উৎপাদনের অনুমতি তাদের রয়েছে উৎপাদন দেখানো হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এই কারখানাগুলো থেকে রেশন সরবরাহ দেখানো হয়েছে ৮২১ মেট্রিক টন যেটা তাদের উৎপাদন ক্ষমতার অনেকটাই অতিরিক্ত। কারখানাগুলোতে যত কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে এবং তারজন্যে যে বিদ্যুৎ খরচ হয়েছে তার ভিত্তিতে কতটা রেশন উৎপন্ন হওয়া সম্ভব তার একটা পরিমাণও বার করা গেছে। এই দুয়ের ব্যবধান, অর্থাৎ, যতটা উৎপাদন সম্ভব তার চেয়ে অতিরিক্ত দেখানোর পরিমাণের মূল্য হল একেবারে ৫৮ কোটি টাকা!
আটটি জেলার রেশন প্রাপ্তি ও সরবরাহ নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে এবং তাতে দেখা গেছে, ঐ জেলাগুলোর শিশু উন্নয়ন প্রকল্পের অফিসাররা পেয়েছেন ৯৭,০০০ মেট্রিক টন রেশন, কিন্তু সরবরাহ করেছেন ৮৬,০০০ মেট্রিক টন। বাকি ১১,০০০ মেট্রিক টন রেশন কোথায় গেল? গুদামে সেগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং হারিয়ে যাওয়া এই রেশনের মূল্য ৬২.৭২ কোটি টাকা। এই রেশন প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব অশোক সাহা। প্রাপ্ত রেশনের পরিমাণ ও সরবরাহের মধ্যে ১১,০০০ মেট্রিক টনের এই ব্যবধানকে তিনি ‘কেরানির লেখার ভুল’ বলে অভিহিত করেছেন। হারিয়ে যাওয়া রেশনের এরচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে!
এছাড়া, ছ’টা কারখানা থেকে পাঠানো রেশন পরিবহনকারী গাড়িগুলোর নথি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেগুলোর মাল পরিবহণের ক্ষমতা নেই। অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট বলছে, “গাড়িগুলোর তথ্যভিত্তি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যে ট্রাকগুলো ব্যবহার করা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে সেগুলো আসলে নথিভুক্ত রয়েছে মোটর সাইকেল, মোটর গাড়ি, অটো বা ট্যাঙ্কার হিসাবে, অথবা সেগুলো ছিল অস্তিত্বহীন ট্রাক।” যে সমস্ত চালানে রেশন পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেক চালান জাল বলেও প্রমাণিত হয়েছে!
মধ্যপ্রদেশের এই রেশন দুর্নীতির সঙ্গে অবিভক্ত বিহারে ঘটা পশুখাদ্য কলেঙ্কারির বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিল রয়েছে। ঐ দুর্নীতিতে স্কুটার পুলিশ ভ্যান, ট্যাঙ্কারে গরু-মোষ বহন করা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছিল। রেশন কেলেঙ্কারিতেও মোটর সাইকেল, মোটর গাড়ি, ট্যাঙ্কারকে রেশনের পরিবাহক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পশুখাদ্য কলেঙ্কারির মতো রেশন কেলেঙ্কারিতেও কোটি-কোটি টাকার মাল সরবরাহ দেখাতে জাল চালান ব্যবহার করা হয়েছে। পশুখাদ্য দুর্নীতিতে সিবিআই আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালু যাদব কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বলে শিবরাজ সিং চৌহান কি সিবিআই-ইডি’র ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবেন? নরেন্দ্র মোদী জমানায় কেন্দ্রে এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যসমূহে দুর্নীতিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হলেও একেবারে চেপে রাখা যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের প্রজ্ঞায় রাফাল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের আওতার বাইরেই থেকেছে, এমনকি, এই বিষয়ে ফ্রান্সে নতুন তথ্যের উন্মোচনও সুপ্রিম কোর্টের কাছে গুরুত্ব পায়নি; হাজার-হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্ক লুটেরারা অবাধে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারলেও বিজেপি তার দায় নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছে; পিএম কেয়ার ফাণ্ডের অর্থের ব্যবহারও প্রশ্নহীন থাকেনি; ইলেক্টোরাল বণ্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের মধ্যেও দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক থাকার আওয়াজ জোরালো হয়ে উঠেছে; উত্তরপ্রদেশ-হরিয়ানা-কর্নাটকের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্য থেকে সরকারি স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সেগুলো তদন্তের আওতায় আসার গুরুত্ব পায়নি; মধ্যপ্রদেশের রেশন দুর্নীতির পরিণতিও কি একই হবে? করদাতাদের টাকাকে নয়ছয় করা এবং যাদের কল্যাণে রেশন প্রকল্প চালানো, তাদের বঞ্চনার শিকার করে তোলাটা কল্যাণ প্রকল্পকে প্রহসনে পরিণত করা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এই দুর্নীতির তদন্ত সিবিআই’এর হাতে তুলে দিতে হবে এবং তদন্তকে প্রভাবশালীর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য শিবরাজ সিং চৌহানকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে।
এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত বিহার রাজ্য আঞ্চলিক পৌরনিগম শ্রমিক মহাসঙ্ঘ এবং বিহার আঞ্চলিক যৌথ শ্রমিক সংঘর্ষ মোর্চা গত ২৭ আগস্ট থেকে রাজ্যব্যাপী এক অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। যে সমস্ত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এই ধর্মঘট, সেগুলি হল –
১) দৈনিক/ঠিকা কর্মীদের নিয়মিতকরণ।
২) সমকাজে সমবেতন।
৩) ঠিকা ব্যবস্থার বিলোপ।
৪) কর্তব্যরত অবস্থায় কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে তার ওপর নির্ভরশীলদের সহানুভূতির ভিত্তিতে চাকরি।
৫) পরিচয়পত্র চালু করা।
৬) ইপিএফ ও ইএসআই সুবিধা।
৭) সরকারি কর্মচারীদের মতো অবসরকালীন সুবিধা, পেনশন, নিয়মিত কর্মীদের এসিপি বা পদোন্নতি নিশ্চিতকরণ।
৮) ৭ম বেতন কমিশনের পর্যালোচনা।
৯) ৫ম ও ৬ষ্ঠ বেতন কমিশনের সংশোধন থেকে বকেয়া বেতন।
১০) বেতন থেকে কেটে নেওয়া পিএফের টাকা কর্মীদের একাউন্টে জমা করা।
এআইসিসিটিইউ’র বিহার শাখার যুগ্মসচিব মুকেশ মুক্ত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং ধর্মঘটের জন্য রাজ্য সরকারকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, দৈনিক/ঠিকা সাফাই ও জল সরবরাহ কর্মীরা ১৫ বছর ধরে পৌর নিগমগুলিতে কাজ করে আসছেন। নিয়মানুযায়ী তাদের ২৪০ দিন পর নিয়মিত করার কথা, কিন্তু সরকার তাদের নিয়মিত কর্মী হিসেবে ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়েছে, শুধু তাই নয়, তাদের কাজের সুযোগ শেষ করে দিয়ে তা অন্য ঠিকেদার সংস্থায় দিয়ে দিচ্ছে। ফলে এই শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ। এই শ্রমিকেরাই শহরকে জঞ্জালমুক্ত করে শহরবাসীকে নারকীয় অবস্থা থেকে উদ্ধার করে এবং গোটা শহরে জল সরবরাহ করে। এমনকি কোভিডকালেও তারা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাগরিকদের জন্য এই পরিষেবা চালিয়ে গেছে। তারফলে অনেক শ্রমিক কোভিডে প্রাণ হারিয়েছেন। তারা বছরের পর বছর ধরে লাগাতার তাদের দাবিগুলি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন, কিন্তু তাদের কথায় কোনো কর্ণপাত করেনি সরকার।
মুকেশ মুক্ত বলেন, মহাসঙ্ঘের উদ্যোগে অনেকগুলি পৌরনিগম শ্রমিক সংগঠনের একটি যৌথফ্রন্ট গঠিত হয়েছে এবং কয়েক দফায় আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, কিন্তু তবুও সরকার নীরবই থেকেছে। ১৩ আগস্ট পাটনায় মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের সামনে এক বিশাল বিক্ষোভ সংঘটিত হয়, কিন্তু তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি এবং কোনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ডাকও দেওয়া হয়নি, ফলত শ্রমিকরা ২৭ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
আগামীদিনে ভাগলপুর সহ রাজ্যজুড়ে পৌর কর্মীদের ধর্মঘট দেখা যেতে পারে। দাবি পূরণ না হলে ধর্মঘট হবেই। ধর্মঘট শ্রমিকদের অধিকার, এরফলে যে প্রভাব পড়বে তার জন্য রাজ্য সরকার দায়ী থাকবে। এআইসিসিটিইউ দাবি করছে, অনতিবিলম্বে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ডাক দিতে হবে এবং ধর্মঘটের সমাপ্তি হবে শ্রমিকদের দাবি পূরণ হওয়ার পর।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো একবার এবিভিপি’র গুন্ডামি চলল। ২২ আগস্ট, এবিভিপি নামধারী গুন্ডারা অ্যাড ব্লকের স্কলারশিপ অ্যান্ড প্রজেক্ট (এসঅ্যান্ডপি) বিভাগে ঢুকে কর্মরত কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান সংক্রান্ত ফাইলগুলো এলোপাথারি ছুড়তে শুরু করে, কম্পিউটার ভাঙচুর করে এবং শিক্ষার্থীদের বৃত্তির ফর্মগুলো দলামোচড়া করে ছিঁড়ে ফেলে কাগজের টুকরোয় পরিণত করে! আরও বদমায়েশীর ব্যাপার হল, এবিভিপি এই অভিযোগের বিরোধিতা করে বলেছে যে তারা মোটেই এসব করেনি, তারা কেবল ছাত্রদের স্কলারশিপ দাবি করতে গিয়েছিল। কিন্তু এভাবে তারা যতই নিজেদের অপকর্ম অস্বীকার করার অপচেষ্টা চালাক, নথিপত্র নষ্ট করে ফেলাটা এবিভিপি’র ছাত্র-বিরোধী মনোভাবকে প্রকাশ করে দিল। বোঝা যাচ্ছে যে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি যাতে দিতে না হয় তার জন্যে জেএনইউ প্রশাসনের সঙ্গে এদের গোপন যোগসাজশ রয়েছে।
এসঅ্যান্ডপি বিভাগের কর্মীদের বৃত্তি অনুমোদন করার ক্ষমতা নেই। ফেলোশিপ অনুমোদন তো ভাইস চ্যান্সেলর এবং ফিনান্স অফিসারের দায়িত্ব। এসঅ্যান্ডপি সেকশনে দু’বছর আগে ছিল ১৮ জন কর্মী, এখন মাত্র ৬ জন। ফেলোশিপ দ্রুত বিতরণ নিশ্চিত করার জন্য কর্মী সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন, কর্মীর অভাবে অতিরিক্ত পরিশ্রমকারী কর্মীদের হয়রানি ও তাদের ওপর হামলা তো সমাধান নয়! সাধারণ কর্মীদের উপর এবিভিপি’র হামলা আসলে জেএনইউ’র ক্ষমতাধারী মাথাদের আড়াল করার নাটক। সংসদে শ্রী আব্দুল ওয়াহাবের উত্থাপিত একটি প্রশ্নের উত্তরে, এটি প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, জেএনইউ’কে প্রদত্ত অনুদান ক্রমাগত হ্রাস করা হয়েছে। ২০২১-২২ আর্থিক বছরে অনুদান বাবদ মঞ্জুর করা হয়েছে মাত্র ৭ কোটি টাকা, যেখানে তাদের ২০১৭-১৮ সালে শুধু পরিকাঠামো খাতে মঞ্জুর করা হয়েছিল ৩০ কোটি টাকা। অনুদান কেন এতো হ্রাস করা হল, কেন্দ্রীয় সরকার কেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের প্রয়োজনীয় আর্থিক অনুদান দিচ্ছে না, এবিভিপি কেন্দ্রীয় সরকারকে কেন সেই প্রশ্ন করছে না? জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সরকার উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ করবে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অর্থের ব্যবস্থা নিজেদের করে নিতে বলা হয়েছে। আর এই সরকারি অর্থ বরাদ্দ ছাঁটার অর্থ হল ছাত্রদের স্কলারশিপ হ্রাস এবং ফি বৃদ্ধি! এবিভিপি কেন এই অনুদান হ্রাস তথা কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করছেনা? উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার পতন কেবল জেএনইউ’তে নয়, জাতীয় স্তরেও দৃশ্যমান সিইউইটি এবং নেট পরীক্ষা পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে ইউজিসি এবং এনটিএ। সিইউইটি-ইউজি পরীক্ষা এখন এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে, কারণ প্রতিটি শিফটে বারবার একই সমস্যা উদ্ভুত হয়েছে আর তারফলে পরীক্ষা বাতিল কিংবা স্থগিত হয়েছে। নেট পরীক্ষা বারবার পেছোচ্ছে। এমনকি জেএনইউ’র পিএইচডি প্রবেশিকা পরীক্ষার কোনো খবর নেই, যা এনটিএ’র পরিচালনায় হওয়ার কথা। সব মিলিয়ে এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলিতে অযোগ্য লোকেদের বসানোর ফলে এক চিরস্থায়ী অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।
৩০ আগষ্ট থেকে ৫ আগষ্ট নিবিড় প্রচারাভিযানে মূল মূল যে দাবি মানুষের মাঝে তুলে ধরা হয় তা হল, বিলকিস বানোর ধর্ষক ও গণহত্যাকারী দলের সাজা মকুবের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার কর, দলিত ছাত্র ইন্দ্র মেঘওয়ালকে মারধর করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিল যে শিক্ষক তাকে কঠোর শাস্তি দাও, সীতাপুর হরগাঁওয়ে দলিতদের ওপর আক্রমণকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার কর এবং আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই মিথ্যা কেস দেওয়া পুলিশ অফিসারদের শাস্তি দাও, সীতাপুর জেলার পার্টি সেক্রেটরি অর্জুন লাল সহ সকলকে মুক্তি দাও।
এই সমস্ত দাবি তুলে ধরে ব্লক, তহশিল ও জেলা স্তরে প্রতিবাদসভা, মিছিল, ধরণা, জমায়েত সংগঠিত হয় এবং রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হয়।
উত্তরপ্রদেশ হায়ার এডুকেশন সার্ভিস কমিশনে ব্যাপক দুর্নীতি। চাকরির আবেদনকারীরা গত ৫ সেপ্টেম্বর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখায় এবং রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করে। নিয়োগ দুর্নীতির অবসান, যুবসমাজের জন্য কর্মনিযুক্তি এবং যোগী আদিত্যনাথ সরকারের কাছে দায়বদ্ধতার দাবি তোলেন বিক্ষোভকারী যুবরা।
রাধাকৃষ্ণাণ কমিশন (১৯৪৮), মুদালিয়র কমিশন (১৯৫২), কোঠারি কমিশন (১৯৬৪) সহ স্বাধীনতার পর থেকে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে ভারতে। রচিত হয়েছে বেশ কয়েকটি জাতীয় শিক্ষানীতি — যেমন ১৯৬৮’র শিক্ষানীতি, ১৯৮৬’র শিক্ষানীতি। শিক্ষানীতিগুলির মধ্যে সাম্প্রতিকতমটি হল জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০। এই শিক্ষানীতির নানা দিক নিয়ে এখানে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করব। খতিয়ে দেখার চেষ্টা করব বিদ্যালয় শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়ে কী কী নিদান দিচ্ছে এই নতুন শিক্ষানীতি। কোন কোন ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তনের কথা বলছে। সেই পরিবর্তনের ফল কী হতে পারে?
শুরু করা দরকার বিদ্যালয় শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনা দিয়েই। জাতীয় শিক্ষানীতির আলোচনায় বিস্তারিতভাবে যাওয়ার আগে বর্তমানে স্কুলশিক্ষা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, বিশেষ করে সরকারী স্কুলশিক্ষা, সে সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক।
সরকারী স্কুলগুলোতে যাঁরা পড়ান, বা এর হালহকিকৎ কাছ থেকে প্রতিদিন দেখেন, তাঁরা সাধারণভাবে কয়েকটা সমস্যা লকডাউন পরবর্তী সময়ে লক্ষ করছেন। সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর মান সাধারণভাবে অনেক নেমে গেছে। এর আগেও, মানে লকডাউন বা কোভিড ২০২০তে আসার আগেও সরকারী স্কুলের শিক্ষার মান তেমন ভালো ছিল না।
অনেকদিন ধরেই মধ্যবিত্ত অভিভাবক অভিভাবিকারা তাদের সন্তানদের সরকারী স্কুলগুলো থেকে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। ভিড় বাড়ছিল বেসরকারী ইংরাজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে। সরকারী স্কুলগুলোতে, বিশেষ করে শহর ও শহরতলীতে ভর্তি হচ্ছিল একেবারে গরীব প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা। তারা অধিকাংশই ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার। বাড়িতে বাবা মা হয় পড়াশুনো জানেন না বা সামান্য জানেন।
প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক স্কুল পেরিয়ে যখন মাধ্যমিক স্তরে আসল, তখন দেখা গেল তারা অনেকে নিজের নামটুকুও ঠিকমত লিখতে পারে না। দু’চার লাইন বাংলাও ঠিকমতো পড়তে পারে না।
২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইন পাশ হবার পর থেকেই আর ফেল প্রথা নেই। যারা ক্লাস ওয়ানে স্কুলে নাম নথিভুক্ত করল তাদের অনেকে কিছু না শিখেই বা সামান্য শিখে ক্লাস নাইন অবধি চলে আসতে পারল।
কেউ কেউ ফেল প্রথাকে দোষারোপ করলেন। সরকারও লকডাউনের ঠিক আগে নীতি বদলে কয়েকটি ক্লাসে ফেল প্রথা ফিরিয়ে এনে বলতে চাইলেন যে ফেল প্রথা তুলে দেওয়া ভুল হয়েছিল। তা সংশোধন করা হল।
এখন প্রশ্ন হল ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনা কি আবার খানিক পিছিয়ে যাওয়া নয়? আবারো অসংখ্য ছেলেমেয়েকে ড্রপ আউটের দিকে ঠেলে দেওয়া নয়? ছাত্রছাত্রীদের ফেল করার দায় কেবল তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়? রেমেডিয়াল ক্লাসের মাধ্যমে যোগ্যতামান না পেরোনো ছাত্রছাত্রীদের পরবর্তী ক্লাসের উপযোগী করে নেওয়ার কথাটি কেন কার্যত প্রায় সর্বত্রই থেকে গেল খাতায় কলমে, কেন তার কোনও বাস্তব প্রয়োগ থাকল না — তা নিয়ে কোনও সমীক্ষা বা পর্যালোচনা কিন্তু হল না। এইভাবে সরকার ও শিক্ষা প্রশাসন তাদের নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলে সব দায়টাই চাপিয়ে দিলেন শিশু-কিশোর ছাত্রছাত্রীদের ওপর।
সরকারী শিক্ষার এই যে দৈন্য দশা নিয়ে কথা যে তেমন হয় না তার একটা কারণ শহর শহরতলীর ‘ভোকাল সেকশান’ যাদের বলা হয়, তাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখন আর সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে সেভাবে পড়েই না বা অতি সামান্য সংখ্যায় পড়ে। অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকেরা মূলত দিনমজুর বা পরিচারিকা বা এই ধরনের নিম্ন আয়ের পেশার সঙ্গে যুক্ত। নানা কারনেই তারা শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষত বা ক্ষতি নিয়ে কথা বলার জায়গায় সেভাবে নেই।
পড়াশুনো শেখা ও শেখানোর ব্যাপারটা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে তার আলোচনাই যথাযথভাবে হয় না। সমাজ করে না, সরকার করে না, এমনকি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোও সেভাবে করে না।
শিক্ষার মান নিয়ে ঘনিয়ে আসা এই অন্ধকারের মধ্যেই এল কোভিড ও লকডাউন। স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ রইলো। তারফলে পড়াশুনোর মান চলে গেল আরো নিচে। এই ক্ষতি কতটা গভীর ও ব্যাপক তা জানার জন্য দরকার ছিল একটি ব্যাপক সমীক্ষার। কিছুদিন আগে অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ জঁ দ্রেজ’এর নেতৃত্বে এইরকম একটি সমীক্ষা হয়েছে। তার রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে।
অগস্ট ২০২১-এ এই সমীক্ষাটি চালানো হয় ভারতের ১৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জুড়ে। তারমধ্যে আছে অসম, বিহার, চণ্ডীগড়, দিল্লী, গুজরাট, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ।
রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ২৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এই পর্বে নিয়মিত পড়াশুনো করেছে। ৩৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশুনো চলেছে অনিয়মিতভাবে। আর ৩৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পড়াশুনোর সম্পূর্ণ বাইরে থেকেছে।
সমীক্ষকরা দেখেছেন ৫০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কয়েকটি শব্দও একটানা পড়তে পারছে না। অভিভাবকরাও জানিয়েছেন যে তাদের সন্তানদের অনেকেই এই সময় পড়া ও লেখার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে কবে আবার স্কুল খুলবে, তারা তাদের সন্তানদের আবার স্কুলে পাঠিয়ে পড়াশুনোর সুযোগ করে দিতে পারবেন। কারণ অনলাইন শিক্ষার সুযোগ তাদের সন্তানদের পক্ষে সেভাবে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে শহুরে এলাকায় ২৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী নিয়মিত অনলাইন ক্লাসের সুবিধে নিতে পেরেছে। গ্রামীণ এলাকায় পেরেছে মাত্র ৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। স্মার্টফোন না থাকাটা এর একটা কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। যে সমস্ত পরিবারের স্মার্টফোন আছে, শহুরে এলাকায় সেই সব ঘরের ছাত্রছাত্রীদের ৩১ শতাংশ নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করেছে। গ্রামীণ এলাকায় করেছে স্মার্টফোন থাকা পরিবারের মাত্র ১৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। এর কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে স্মার্টফোন মূলত পরিবারের রোজগেরে সদস্য সঙ্গে নিয়ে কাজে চলে যান, ফলে অনলাইন ক্লাসের সময় ছাত্রছাত্রীরা তা ব্যবহার করে উঠতে পারে না। সমীক্ষা রিপোর্ট জানিয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর নিজেদের স্মার্টফোন আছে। স্মার্টফোনের সমস্যা ছাড়াও অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে দুর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থা ও ইন্টারনেটের ডেটা-প্যাক কেনার ক্ষমতার অভাব। শহুরে এলাকার মাত্র ২৩ শতাংশ অভিভাবক মনে করেছেন তাদের সন্তানরা ঠিকমতো অনলাইন ক্লাস করতে পেরেছে। গ্রামীণ এলাকায় এটা মাত্র ৮ শতাংশ।
যারা অনলাইন ক্লাস নিয়মিত বা মাঝেমাঝে করতে পেরেছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি ছাত্রছাত্রী সমীক্ষকদের জানিয়েছে যে তারা অনলাইন ক্লাস ভালোভাবে অনুসরণ করে পড়া বুঝে নিতে সক্ষম হয়নি। আর যারা অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি, তাদের অধিকাংশই নিজেরা বইপত্র খুলে এই পর্বে তেমন পড়াশুনো করেনি। যে সমস্ত পরিবার আর্থিকভাবে খানিকটা সক্ষম এবং সন্তানদের জন্য উপযুক্ত গৃহশিক্ষক বা গৃহশিক্ষিকার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন, সেই সমস্ত পরিবারের সন্তানরাই এই পর্বে খানিকটা নিয়মিত ও ভালোভাবে পড়াশুনো করতে পেরেছে বলে সমীক্ষকরা জেনেছেন।
এইরকম একটা সঙ্কটের পরিস্থিতিতে যে শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হচ্ছে তার কাছে সমাজ ও শিক্ষাজগতের কিছু বিশেষ দাবি থাকে। সেই দাবি রক্ষার দিকে কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি তেমন কোনও আগ্রহ দেখায়নি। বরং এমন কিছু সুপারিশ করেছে যা শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি হওয়া সামাজিক বিভাজনকে আরো বাড়িয়ে দেবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা ক্রমশ বিস্তারিত আলোচনার দিকে এগোব।
- সৌভিক ঘোষাল
বিরাট বিরাট ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে দ্বিচক্রযানে গোটা শহর জুড়ে নতুন প্রজন্মের এক তরুণ বাহিনীকে দিবারাত্র ছুটে বেড়ানোর দৃশ্য আজ শহর-শহরতলীর নাগরিকদের চোখে সয়ে গেছে। আড়ালে চলে যাচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক নামহীন-পরিচয়হীন আধুনিক ‘রানার’ গিগ শ্রমিকদের দৈনন্দিন যন্ত্রণাবিদ্ধ যাপনের কাহিনী। ভারতের ক্রম প্রসারমান গিগ-প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত এই নতুন প্রজন্ম এক নতুন ধরনের শ্রম সম্পর্ক সামনে এনেছে, যা নিয়ে এই প্রথম নীতি আয়োগ, কেন্দ্রীয় সরকারের থিংক ট্যাঙ্ক, সম্প্রতি এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, ‘ইন্ডিয়াস্ বুমিং গিগ অ্যান্ড প্ল্যাটফর্ম ইকনমি, পলিসি ব্রিফ’, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২০-২১ সালে গিগ শ্রমিকদের সংখ্যা ৭৭ লক্ষ থেকে বেড়ে ২০২৯-৩০ সালে ২.৩৫ কোটিতে পৌঁছাবে। বর্তমানে যে গিগ শ্রমিকরা গোটা শ্রমশক্তির ১.৫ শতাংশ, আগামী ২০৩০এ তা পৌঁছাবে ৪.১ শতাংশে, যা অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রে প্রসার লাভ করবে। এই অর্থনীতিতে দ্রুতই স্থান করে নিচ্ছেন মহিলা ও বিশেষভাবে সক্ষম মানুষেরা। তবে, যত দিন যাচ্ছে, ততই কমছে উচ্চস্তরের দক্ষতাসম্পন্ন কাজের ধরন — বর্তমানে ৪৭ শতাংশ কাজ রয়েছে মাঝারি দক্ষতাসম্পন্ন স্তরের, আর ২২ শতাংশ ও ৩১ শতাংশ কাজ হচ্ছে যথাক্রমে অতি-দক্ষতাসম্পন্ন ও নীচু স্তরের দক্ষতাসম্পন্ন কাজের ধরনের মধ্যে।
কিন্তু, ভারতের শ্রমবাজার বিচিত্র সমস্যা সামনে নিয়ে এলো। গত মার্চ মাসে, সিএমআইই দেখায়, দেশের শ্রমবাজারে শ্রমশক্তির হার যা ছিল, তা এপ্রিলে প্রায় ৮১ লক্ষ বৃদ্ধি পেল — যা তাদের দাবি অনুযায়ী, সাম্প্রতিককালে একমাসে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি! সিএমআইই’র মতে এই বৃদ্ধি হয়েছে সম্ভবত এই কারণে যে, শ্রমবাজারে যে শক্তিটা আগে যোগদান করেনি, তারা এপ্রিল মাসে ফিরে এসে যোগ দিয়েছে। কিন্তু, গিগ অর্থনীতির বাজার অতিরিক্ত এই নতুন শক্তিটার একটা অংশকে স্থান করে দিতে না পারায়, অর্থনীতির এই নতুন ক্ষেত্রটি শ্রমশক্তির সংকটে সম্মুখীন। দেখা গেল সুইগি, জোমাটো কর্মীর অভাবে কয়েকটা রাজ্যে কিছু কিছু এলাকায় তাদের ব্যবসা সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। ইতিমধ্যে মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ ও বেঙ্গালুরুতে লোকের অভাবে এই সংস্থাগুলো বেশ কিছু অপারেশন গুটিয়ে নিয়েছে। স্বল্প মজুরি, ক্রমে বেড়ে চলা জ্বালানির দাম, আর তারসাথে ইন্সেনটিভ না বাড়ানোর পেছনে নিয়োগকর্তার অনীহার কারণে এই ক্ষেত্রে কর্মীরা আকর্ষণ হারাচ্ছে।
আর, সম্ভবত এই কারণে নীতি আয়োগ এই শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কর্মীদের জন্য কল্যাণকর কিছু প্রকল্প নিতে সুপারিশ করেছে। নিরাপত্তাহীন এই কাজে ঠিক সময়ে মজুরি না পাওয়া, কর্মক্ষেত্রে নানা ঝুঁকি, শ্রমিক-নিয়োগকর্তার মধ্যে অস্পষ্ট শ্রম সম্পর্ক, প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের ‘স্বাধীন কন্ট্রাকটর’এর জামা পরিয়ে নানা আইনি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা প্রভৃতি সমস্যাগুলো নীতি আয়োগ’এর এই রিপোর্টে থাকলেও তার সমাধানের পথ বাৎলানো হয়নি। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই রিপোর্ট তৈরি করার প্রক্রিয়ায় একজন গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকের কাছে গিয়ে সরাসরি তাদের সমস্যা জানা বোঝার কোনও প্রচেষ্টাই নেয়নি নীতি আয়োগ।
এই রিপোর্ট বরং বলেছে, কাজের ধরনের এই ‘প্ল্যাটফর্মকরণের’ ফলস্বরূপ নতুন এক বর্গের কর্মী — প্ল্যাটফর্ম কর্মী — আত্মপ্রকাশ করেছে, “যারা সাবেক ইনফর্মাল-ফর্মাল শ্রমের বিদ্যমান পরিসরের বাইরে”। আর, এই বলে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে ‘শ্রমিক’ সংজ্ঞার বাইরেই পাঠিয়ে দিল ক্রমে সম্প্রসারনশীল এই নতুন অর্থনীতির সাথে যুক্ত কর্মীবাহিনীকে। নীতি আয়োগের উপদেশ, “একটা উপযুক্ত কাঠামো ভারতের দরকার, যা এইসমস্ত প্ল্যাটফর্ম যে নমনীয়তা বা ফ্লেক্সিবিলিটি নিয়ে এসেছে তারসাথে মানানসই সামাজিক সুরক্ষা যাতে কর্মীদের সে দিতে পারে”। আর, সেই সুরক্ষার মধ্যে তাদের প্রস্তাব, সবেতন মেডিকেল ছুটি, স্বাস্থ্যখাতে সুরক্ষার জন্য বিমা, পেশাগত ও কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত বিমা, অবসরকালীন ভাতা বা পেনশনের ব্যবস্থা। পাশাপাশি, অত্যন্ত কম মজুরিতে যে তারা কাজ করেন লম্বা সময় জুড়ে তা স্বীকার করে ‘ইন্সেনটিভ’ (পাঠকরা খেয়াল করবেন, ন্যূনতম মজুরির বিষয়টা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করা হয়নি) বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এই কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের অভিযোগ নিরসনের জন্য কোনও ব্যবস্থার সুপারিশ এই রিপোর্টে নেই। নানা ধরনের চৌর্যবৃত্তি ও অস্বচ্ছ অন্যায্য ব্যবসায়িক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে চলা এই সংস্থাগুলো কর্মীদের হরেক পদ্ধতিতে শোষণ করে।
কিছুদিন আগে দেখা গেল, বেঙ্গালুরুতে একটি শহরে একটা এলাকায় জোমাটো অ্যালগোরিদম’এর কারচুপি করে কর্মীদের কাজের নির্ধারিত সীমানা হঠাৎ বাড়িয়ে দিল। কর্মীদের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কাজ করার যে প্রচলিত নিয়ম ছিল, তারা হঠাৎ দেখলেন, অর্ডার আসছে ৪০ কিলোমিটার দূর থেকে। অর্থাৎ, তাদের ৪০ কিমি দূরে গিয়ে অর্ডার নেওয়া ও ডেলিভারি দিতে হচ্ছে। তীব্র প্রতিবাদ ও ঝটিকায় কাজ বন্ধ করার পর কর্তৃপক্ষ পিছু হটে।
এই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটিকে আর্থিক অনুদানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কর ছাড়, স্টার্টআপ’দের জন্য যে সরকারি অনুদান বরাদ্দ রয়েছে, তা সেই সংস্থাগুলোকে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে, যারা এক-তৃতীয়াংশ মহিলা ও বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের নিয়োগ করেছে।
তরুণ প্রজন্মের প্রাধান্য রয়েছে এই গিগ-প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতিতে। গত চার বছরে তরুণ কর্মীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে আটগুণ। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৪০ শতাংশ গিগ শ্রমিকদের বয়স ১৬-২৩ বছরের মধ্যে।
একটি সংস্থা ফ্লারিশ ভেঞ্চুরি গিগ-প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের উপর কোভিডকালীন পর্বে কী প্রভাব পড়েছে তার একটা সমীক্ষা চালায়। সেখানে তারা দেখিয়েছেন, কোভিডের থাবায় এই অর্থনীতির সাথে যুক্ত ৮৭ শতাংশ কর্মীর আয় কমে গেছে, তারা আয় করছেন বড়জোর মাসে ১৫ হাজার টাকা। ৮১ শতাংশ কর্মীর আয় অনেকটাই তলিয়ে গেছে। এমনিতেই ভারতের শ্রমবাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত কমে এসেছে, এই ক্ষেত্রেও তার প্রবল ছাপ রয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে চলা এই জগতে মহিলাদের অংশগ্রহণ অনেক কমে যাচ্ছে এই প্রযুক্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য।
এখনও পর্যন্ত গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের আইনি স্টেটাস অস্পষ্ট, ধোঁয়াশায় ভরা। মোদীর তৈরি করা কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি, ২০২০তে এদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করায় তারা সমস্ত ধরনের শ্রম আইনেরই বাইরে থেকে গেলেন। গিগ-প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের কোড এইভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে — “গিগ শ্রমিক হলেন এমনই এক ব্যক্তি, যারা সাবেক শ্রমিক-নিয়োগকর্তার সম্পর্কের বাইরে গিয়ে একধরনের কাজের সাথে যুক্ত যারা সেখান থেকে কিছু উপার্জন করেন।” একইভাবে, ‘প্ল্যাটফর্ম’ কাজকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে “কর্মী-নিয়োগকারী সাবেক সম্পর্কের বাইরে অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে কিছু নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে যারা পরিষেবা দিয়ে থাকেন”।
আজ দুনিয়া জুড়েই লড়াই করে গিগ-প্ল্যাটফর্ম কর্মীরা ‘শ্রমিক’ হিসাবে নিজেদের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সচেষ্ট। ইউরোপের বেশ কিছু দেশের আদালত গিগ শ্রমিকদের সপক্ষে এমন কিছু রায় দিয়েছেন যা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুক্তরাজ্যের শীর্ষ আদালত এই মর্মে রায় দিয়েছে এতদিন “স্বাধীন কন্ট্রাকটরের জামা পরিয়ে” গিগ কর্মীদের যেভাবে দেখানো হচ্ছিল তা অন্যায্য। এদের মধ্যে স্পষ্টতই রয়েছে শ্রমিক-নিয়োগকর্তার সম্পর্ক। অর্থাৎ, তারা শ্রমিক। তারা শ্রমিকদের সমস্ত অধিকার, ন্যূনতম মজুরি, সবেতন ছুটি প্রভৃতি পাবেন। স্পেন এই প্রথম আইন পাশ করে কৃত্রিম মেধাকে নিয়ন্ত্রিত করল, গিগ শ্রমিকদের ‘শ্রমিক’ হিসাবে ঘোষণা করল। ফ্রান্সও সেই পথেই হাঁটল। আর, ভারত উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করল।
এই নতুন আত্মপ্রকাশমান সামাজিক স্তরকে সংগঠিত করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে গোটা দেশ জুড়ে, বিভিন্ন সংগঠন মঞ্চ গঠন করে। আমাদেরও এই প্রশ্নে উদ্যোগ নিতে হবে।
- অতনু চক্রবর্তী
২০০১ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে গুজরাটের একটা ছোট কোম্পানি এক সাংবাদিককে ডেকে পাঠায় তাঁদের ব্যাঙ্গালোরের অফিসে। বলা হয় মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন সমস্ত গুজরাটবাসীর জন্য একটা চিপ লাগানো স্মার্টকার্ড তৈরি করতে, যারমধ্যে সেই ব্যক্তির সমস্ত তথ্য, মানে নাম, ঠিকানা, বয়স, রক্তের গ্রুপ ইত্যাদি থাকবে। এই কার্ডটি খুব তাড়াতাড়ি মানে আগামী দু’মাসের মধ্যে তৈরি করে ফেলতে হবে, সেইজন্যই এই মিটিং। তাঁরা সেই সাংবাদিককে আরও বলেন, গুজরাটের অফিসারেরাও দিনরাত এক করে কাজ করছেন। সরকারী সুযোগ-সুবিধা কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে এই কার্ডটির মাধ্যমে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে মোদী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং তারপর তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এই কাজটা শুরু হয়েছে। এটা তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প।
এর ঠিক তিন মাস পর গোধরায় ট্রেনে অগ্নিকান্ড। তার কিছুদিন পর থেকে শুরু হয়ে যায় ‘গুজরাট গণহত্যা’। কিছু কিছু জায়গায় তাণ্ডব চলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে। যে সমস্ত মিডিয়া এই বিষয়টা রিপোর্ট করেছে এবং যতগুলো তদন্ত কমিশন বসেছে প্রত্যেকেই বলেছে যে কীভাবে তালিকা ধরে ধরে মিলিয়ে, বাড়ি থেকে টেনে বার করে মারা হয়েছে। বাড়ি থেকে টেনে বের করে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং তারপর সেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে মুসলমানদের বাড়ির দরজায় ঢ্যাঁড়া চিহ্ন দেওয়া হয়, তার পরদিন সেই বাড়িগুলোকে ধরে ধরে আক্রমণ করা হয়। কিভাবে মানুষকে জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছে তা আমরা দেখেছি। বাকিটা ইতিহাস। যে স্মার্ট কার্ডগুলো জরুরি ভিত্তিতে বানানো হয়েছিল, সেগুলো এই দাঙ্গা এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা সেটা কি বুঝতে অসুবিধা হয় আজ?
এই ইতিহাস হয়তো অনেকের জানা, আবার অনেকের কাছে এই তথ্য হয়তো নতুন। এর পাশাপাশি, আরও একটা তথ্য দেওয়া যাক। ২০০৯ সালে ইউপিএ সরকার একটি প্রকল্প আনে, যে মানুষদের কোনও পরিচয়পত্র নেই, সেই মানুষদের জন্য একটি পরিচয়পত্র আনা হয় ‘আধার’। দেখা গিয়েছিল সেই সময়ে ০.০৩ শতাংশ মানুষদের জন্য এই প্রকল্প আনা জরুরি। তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, এই আধার নামক বিষয়টির কোনও গুরুত্ব নেই। তারপর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে, সেই নরেন্দ্র মোদীই ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে একজন মানুষের ফোন, ড্রাইভিং লাইসেন্স সহ সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধারকে যুক্ত করার কাজে জোর দেন। বলা হয়, সরকারী সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য আধার বাধ্যতামূলক। ১০০ দিনের কাজ বা গ্যাসের ভর্তুকি বা অন্য যেকোনো প্রকল্প, যার মাধ্যমে সরকারী টাকা একজন সাধারণ নাগরিকের ব্যাঙ্কে পৌঁছবে, তার অন্যতম চাবি হচ্ছে আধার। ধীরে ধীরে আধার প্রায় সমস্ত নাগরিকের সমস্ত পরিচয়পত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, এমনকি যেসব ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধা যুক্তও নয়, যেমন ব্যক্তিগত ট্যাক্স জমা দেওয়ার জন্য প্যান বা ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনেও আধারকে চাপ দিয়ে যুক্ত করা হয়। সর্বোচ্চ আদালত তাঁদের রায়ে যদিও বলেছেন, যে শুধুমাত্র সরকারি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্র ছাড়া আর অন্য কোনও কিছুতে আধারকে যুক্ত করা যাবে না, তা সত্ত্বেও এই সংযুক্তির কাজ করা হয়। এই মুহূর্তে আইন করে আধার এবং ভোটার কার্ডের সংযোগের কথা বলা হয়েছে। সংসদের দু’কক্ষে, প্রায় কোনও আলোচনা ছাড়াই এই আইনকে পাশ করানো হয়েছে। এই সময়ে যাঁরা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন, তাঁদের বেশিরভাগ মানুষই তাঁদের ব্যক্তিগত ফোন থেকে তা ব্যবহার করেন। সেখানে অনেকেই সরকারের সমালোচনা করে থাকেন। ফলে ফোনের সঙ্গে যদি আধার যুক্ত করা থাকে, এবং সেই মানুষটির বাসস্থানও যেহেতু আধারের ডেমোগ্রাফিক তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত আছে, তাই একজন মানুষকে চিহ্নিত করা এখন অত্যন্ত সোজা কাজ। তাঁদের উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিষ্কার, আধার দিয়ে একটি কেন্দ্রীভূত তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা, এবং ভোটের কার্ডকে তারসঙ্গে যুক্ত করে যাঁরা সরকার বিরোধী, বা যে সমস্ত মানুষ এই সরকারকে ভোট নাও দিতে পারে, তাঁদের বাদ দেওয়া। নির্বাচকদের ধর্ম এবং জাতি দেখে দেখে চিহ্নিত করে, তারপর তাঁদের বাদ দেওয়া হবে, এটা আজকে আর কষ্টকল্পনা নয়।
বেশ কিছুদিন আগে আরটিআই করা হয়েছিল ইউআইডিএআইকে, তাতে দুটি প্রশ্ন করা হয়।
১) আধার দিয়ে কি ঠিকানা, জন্মতারিখ প্রমাণ করা যাবে? বা আধার কি কোনও পরিচয় বহন করে?
২) সিআইডিআর বা যেখানে আধার তথ্য সুরক্ষিত থাকে বলে জানা গেছে সেখানে যদি কোনও একজনের বায়োমেট্রিক্স দিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, যে এটা কি সেই ব্যক্তি? তাহলে তাঁরা কি সেই ব্যক্তির আধার নম্বর বার করে আনতে পারে?
এই দুটো প্রশ্নের উত্তরেই তাঁরা জানিয়েছে যে তাঁরা বলতে পারেন না আধার কোনও পরিচয়পত্র কিনা। তাঁরা এটাও বলেন যে কোনওভাবেই এটা বলা সম্ভব নয়, যে কোনও একজন মানুষের আধার নম্বর তাঁর বায়োমেট্রিক্স’এর সঙ্গেই যুক্ত করা আছে। তাহলে কি দাঁড়ালো আধার কোনও পরিচয়পত্র নয়, এবং এরমধ্যে কোনও অনন্যতা নেই।
গত নির্বাচনে এই বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপ করা চালু হয়েছে, যাদের ভোটার লিস্টে নাম আছে কিন্তু ভোটার কার্ড নেই তাদের জন্য প্রথমবার অন্যান্য আরও দশটা পরিচয়পত্রের সঙ্গে আধারকেও মান্যতা দেওয়া হয়েছে। এতে কোথায় অসুবিধা? আধার কোনও পরিচয়পত্র নয় কারণ আধার মূলত তৈরি করা হয়েছে অন্তত দুটো প্রাথমিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে। দ্বিতীয়ত আধারে কারুর সই নেই আধার কারুর দ্বারা প্রত্যয়িত নয়, আধার ডেটাবেস পরীক্ষিত নয় তাহলে এটা কেন করা হল? যেখানে কত ভুয়ো আধার আছে তাই জানা নেই, সেখানে তা দিয়ে কি করে ভুয়ো ভোটার কার্ড বাতিল করা হবে? তাহলে কি এই ভুয়ো আধার দিয়ে ভোটকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে না আরও গভীর কোনও উদ্দেশ্য আছে?
আসলে, যদি সমস্ত তথ্য একটি কেন্দ্রীভুত জায়গায় আনা যায়, তাহলে যার হাতে এই তথ্য থাকবে, সে কি শুধু চিহ্নিত করে গণহত্যা করবে, না ভোট নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা সেই ঠিক করবে। একজন মানুষের সমস্ত তথ্য যদি এক জায়গায় আনা যায় এবং সেটা যদি একটি সংখ্যা হয় তাহলে সেই সংখ্যাকে মুছে ফেলা তো অত্যন্ত সাধারণ বিষয়। যদি খবর নেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের নির্বাচনের সময়ে ৩৮ লক্ষ এবং ২৩ লক্ষ মানুষের শুধু ডেমোগ্রাফিক তথ্য এবং বায়োমেট্রিক তথ্য দিয়ে তাঁদের ভোটার তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই আধার এবং ভোটার কার্ডের সংযোগের বিষয়টি যদি ছোট স্তরে এবং আঞ্চলিকভাবে প্রতিরোধ তৈরি করে আটকানো না যায়, তাহলে আগামীদিনে সমূহ বিপদ হবে। সেইখান থেকেই উদাহরণ তৈরি করে সারা রাজ্যব্যাপী এই আন্দোলন যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবেই রাষ্ট্রকে মানুষের শক্তি সম্পর্কে জানান দেওয়া সম্ভব।
- সুমন সেনগুপ্ত
চলে গেলেন জঁ লুক গোদার। সিনেমার অভিধান থেকে “প্রজ্ঞা” শব্দটা বিদায় নিল। সময় তাঁকে প্রজ্ঞা দিয়েছিল তাঁর তারুণ্য হরণ করতে পারেনি। প্রতিটি নতুন ছবিতে তিনি ছিলেন নতুন। প্রতিটি নতুন ছবিতে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছেন। নিরন্তর প্রশ্ন করেছেন ক্যাপিটালিজম নামের ব্যবস্থাটাকে। আর কেইবা পারবেন চলচ্চিত্রের সামান্য একটি টেকনিককে ইতিহাস ও দর্শনের আলোকে বিচার করতে। চিরকাল মনে থাকবে শট-কাউন্টার শট বিষয়ে তাঁর একটি ফিল্মের দৃশ্য। তিনি বলছেন শট কাউন্টার-শট আসলে শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের দু-জন প্রতিনিধিকে সমসত্ত্ব পদ্ধতিতে দেখায়, যা আসলে এক প্রকার প্রতারণা। তাঁর ব্যাখ্যা শেষ হয় আশ্চর্য এক উচ্চারণে, ইজরায়েল আর প্যালেস্টাইনের মধ্যে কোনো শট কাউন্টার শট হয় না। কারণ ইজরায়েল হল ফিকশন আর প্যালেস্টাইন ডকুমেন্টারি। চলচ্চিত্রের নেহাতৎই চলতি একটা কৌশলকে এভাবে ইতিহাস আর রাজনীতির আলোতে দেখা একমাত্র গোদারের পক্ষেই সম্ভব ছিল।
তিনি বিদায় নিলেন, সিনেমার সঙ্গে ছিন্ন হলো ইতিহাস ও দর্শনের সম্পর্ক। তরুণ গোদার এককালে লিখেছিলেন চলচ্চিত্র একটা জনমোহিনী মাধ্যম, যার নির্মাণ পুঁজির উপর নির্ভরশীল। তাকে দর্শন আর চিত্রকলার মহিমায় যিনি রূপান্তরিত করতে পারেন তিনিই প্রকৃত শিল্পী, ‘অত্যর’। গোদার সেই কাজটাই করার চেষ্টা করে গেছেন সারা জীবন ধরে। তার চলচ্চিত্র জীবনে তাই আমরা দেখতে পাই অনেকগুলি বাঁক। প্রথম জীবনে ব্রেথলেসের মতো কালজয়ী ছবি যিনি করেছেন তিনি সেই গরিমা নিয়েই সেলিব্রেটি হয়ে তিনি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু খ্যাতির চূড়ায় উঠে কিংবদন্তি হবার থেকে সমকাল তাঁকে অনেক বেশি করে টেনেছিল। মে ৬৮’র তারুণ্যের উৎসবে জঁ লুক গোদারকে তাই প্যারিস আমরা আশা করেছিল। তিনি ছিলেন। শুধু ছিলেন এই তথ্যটুকুই শেষ নয়। বন্ধু জঁ পিয়ের গরি(ন)কে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করলেন ‘জিগা ভের্তভ কালেক্টিভ’। সম্মিলিত প্রয়াসে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছা নিয়ে। শিল্পকর্ম ও রাজনীতিবোধকে বোধহয় তিনি কোনোদিন আলাদা করে ভাবেননি। তাই ইতিহাস আর সমকালকে আশ্চর্য প্রজ্ঞায় মেলাতে পেরেছেন বারবার। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, পুঁজিবাদ তার রূপ বদলেছে গোদারও নিজেকে বারবার ভেঙ্গেছেন, পরিবর্তন করেছেন কারণ তিনি মনে করতেন শিল্পীর দায়িত্ব তাঁর সময়কে বোঝা। শিল্পী যে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেন তা আসলে সমাজ ও ইতিহাসের দান। ব্যবস্থা’র ব্যবচ্ছেদ করা তার কর্তব্য। গোদারের ছবিতে অসম্ভব শাণিত যে সব সংলাপ আমরা শুনতে পাই তা আসলে ঐ ব্যবচ্ছেদের ফলাফল।
তাঁর শেষদিকের অন্যতম ছবি ‘গুডবাই ল্যাঙ্গুয়েজ’এর কথা বলা যায়। এটি একটি থ্রি-ডি ছবি। জটিল স্থানিক বিন্যাস দেখা যায় প্রতিটি শটেই। অনেকগুলি প্রশ্ন তিনি আর তর্ক তিনি হাজির করেন আমাদের সামনে। মানুষের ভাষা যেখানে শেষ হয় সেখানে কি প্রকৃতির ভাষা শুরু হয়? মানুষের ভাষার নিশ্চয়তা কি ডেকে আনে হিটলার আর হলোকস্টকে? ছবিতে উপস্থিত কুকুরটি যেন মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে এক যোগসূত্র রচনা করে। ছবিটি দেখলে মনে হয় এসব গভীর প্রশ্ন নিয়ে তিনি যেন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে এক আশ্চর্য সংলাপে লিপ্ত।
পরিণত, বৃদ্ধ গোদারকে আমার তরুণ গোদারের থেকে বেশি ভালো লাগতো। কারণ বুদ্ধিমানেরা যখন বুঝলেন সমাজতন্ত্র আর 'বাজারে' আগ্রহের বিষয় নয়, অতএব সরে পড়তে হবে, গোদার তখন একের পর এক ছবিতে সমাজতন্ত্রকে কনটেমপ্লেট করে গেছেন। অজ্ঞাতবাসে নিজেকে প্রচারের আলো থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন অনেকদিন, কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে, চলমান বর্তমানের সঙ্গে এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। পৃথিবীর শেষ সমাজতন্ত্রী আজ বিদায় নিলেন, মে ৬৮-এর প্রতি তাঁর অবিচল আস্থায় ছেদ পরেনি কোনোদিন। আজ তাঁর পথ চলা শেষ হল। তাঁর বিদায়ে চলচ্চিত্র অতি সাধারণ একটি মাধ্যমে পরিণত হল। তিনি গোদার বলেই বোধহয় নিজের মৃত্যুর স্থান আর কাল নিজেই রচনা করলেন। আমরা এতক্ষণে জেনে গেছি তিনি স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করলেন। তিনি তাঁর মত জানাতে কখনো ভয় পাননি। স্বাধীনতা শব্দটাকে তিনি সম্মান করতেন। মৃত্যুর মুহূর্তটাতেও পরাধীনতা মানলেন না। বিদায় জঁ লুক গোদার!
– মানস ঘোষ
MATTERMATTER