স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তির এক সপ্তাহ আগে, ২০২২ এর ৯ আগস্ট দেশবাসী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ৮০ তম বর্ষপূর্তি স্মরণ করছে। ব্রিটিশ শাসকদের ভারত ছাড়ো ডাক দেওয়ার পরে মুম্বইয়ে দলের সর্বভারতীয় অধিবেশন থেকে কংগ্রেস নেতৃত্বকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু এই আন্দোলনের আহ্বান দেশের বহু জায়গায় গণ জাগরণ উস্কে দেয় এবং চার চারটি স্থানে সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা হয় – উত্তরপ্রদেশের বালিয়া, বাংলার তমলুক, ওড়িশার তালচের ও মহারাষ্ট্রের সাতারায়। সাতারার সমান্তরাল সরকারটি ১৯৪৭ অবধি টিকে ছিল, ফলত এই সরকারটিই ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন আর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দেশ ছাড়ার ঘটনার ঐতিহাসিক যোগসূত্র।
এত কিছুর পরেও ভারতবর্ষ আজ ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাসের মুখোমুখি। আজ দেশের শাসনক্ষমতা এমন এক শক্তির হাতে যার পূর্বসূরীরা যে কেবল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দূরে সরে থেকেছিল তাই নয় বরং তারা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের দিনগুলো থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের মদত দিয়েছে। ২০১৪ সালে ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার আওয়াজ তুলে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসে। আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দম্ভের সাথে পঞ্চাশ বছর যাবৎ ভারতে বিজেপির শাসন চলার কথা বলছেন এবং বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা বলছেন যে, বিজেপিই দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল। বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলিকে একের পর এক দুর্বল করে ফেলে দেওয়ার খেলা চলছে, বিরোধী দলগুলির অফিস পুলিশ দিয়ে ঘিরে তল্লাশি অভিযান চালানো হচ্ছে এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের মাধ্যমে বিরোধী নেতৃত্বকে অবিরাম হেনস্থা করা চলছে।
স্বাধীন ভারতে যখন সংবিধান ও জাতীয় পতাকা গৃহীত হয় তখন আরএসএস স্পষ্টতই এই দুটি বিষয়কে খারিজ করে দেয় এবং মনুস্মৃতিকে দেশের গঠনবিধি ও গেরুয়া পতাকাকে ভারতের জাতীয় পতাকা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে প্ররোচনা দিয়েছিল। স্বাধীন ও আধুনিক ভারতবর্ষ গঠনের সাংবিধানিক দিকনির্দেশের বিরুদ্ধে কেবল মতাদর্শগত বিতর্কেই আটকে থাকেনি আরএসএস, বরং সদ্যোজাত সাধারণতন্ত্রকে দুর্বল ও পথভ্রষ্ট করার লক্ষ্যে সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা চালিয়েছিল তারা। গান্ধী হত্যা ছিল এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অপরিহার্য অংশ। ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারী ঘোষিতভাবে সংবিধান কার্যকর করার এক মাস আগেই ১৯৪৯-এর ২২ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে অযোধ্যায় আরেকটা ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা ঘটে, যখন বাবরি মসজিদে গোপনে রামের একটি বিগ্রহ স্থাপন হয় অযোধ্যা সিটি ম্যাজিস্ট্রেট গুরু দত্ত সিং ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে কে নায়ারের সহযোগিতায়, যারা পরবর্তীতে ভারতীয় জনসংঘের পতাকাতলে এসে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন, যে সংঘ হল আজকের বিজেপির সাংগঠনিক পূর্বসূরী।
ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের কথা স্মরণযোগ্য এই কারণে যে, গান্ধীর হত্যার প্রেক্ষাপটে তিনি আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ভারত সরকারের জারি করা বিবৃতিতে সাফ জানানো হয় যে, দেশকে বিপদে ফেলা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো শক্তিগুলোকে সমূলে উৎখাতের লক্ষ্যেই ঐ নিষিদ্ধকরণ জরুরি ছিল। শ্যামাপ্রসাদ ও গোলওয়ালকরকে লেখা চিঠিতে প্যাটেল আরএসএসের ছড়ানো সাম্প্রদায়িক বিষের কথা উল্লেখ করেন যার বিধ্বংসী পরিণতিতে গান্ধী সহ বহু মানুষের প্রাণহানি হয়। দেশের সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে আরএসএস মেনে নেওয়ার কথা লিখিতভাবে জানানোর পরে ঘটনাচক্রে ১৯৪৯-এর ১১ জুলাই এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করা হয় যে, আরএসএস তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সবরকম হিংসা ও গুপ্ত অভিসন্ধি পরিত্যাগ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা ওঠার পরে যথারীতি আরএসএস তার আগের পথেই ফিরে যায় যার মূল্য চোকাতে বহু মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেশকে চলতে হয়।
আজ ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তির মুহূর্তকে মোদী সরকার ইতিহাস বিকৃত করার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিখ্যাত চরিত্রগুলোকে আত্মসাৎ করার এক বড় মওকা হিসাবে কাজে লাগাতে চাইছে। জাতীয় পতাকাকে একটি ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করতে পতাকা সংক্রান্ত আইনকানুন পরিবর্তন করেছে, ফলস্বরূপ জাতীয় পতাকা এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক গরিমা হারাতে চলেছে, যে ইতিহাস ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা ব্রিটেনের কাপড় কলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার ফলে শেষ হতে বসা ভারতের হাতে চালানো সমৃদ্ধ তাঁতশিল্পের পুনরুদ্ধার ও দেশীয় শিল্পের স্বনির্ভরতার লড়াইয়ের চিহ্ন। মোদী সরকার আজাদী শব্দটির প্রকৃত অন্তর্নিহিত অর্থকেও নস্যাৎ করছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদী শব্দটির অর্থ শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এটার অর্থ ছিল সমস্ত রকম সামাজিক বাধা ও শোষণ থেকে মুক্তি। “আমরা ভারতের জনগণ” – বিষয়টি আসলে ব্রিটিশ ও অন্যান্য রাজত্বের অধীনে থাকা প্রজা থেকে স্বাধীন দেশের সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীন নাগরিক হয়ে ওঠার ব্যঞ্জনা। আজ দেশবাসীর সমস্ত স্বাধীনতা যেন শাসকের কাছে বন্ধক রাখা আছে। সত্য বলার জন্য, ন্যায়বিচার চাওয়ার জন্য, অধিকার দাবি করার জন্য নাগরিকদের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। দেশভাগের বিভীষিকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরেও ভারত তার নির্দিষ্ট সামাজিক গঠনের বৈচিত্র্য ও মিশ্র সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে এগিয়ে চলার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আজ সেই সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার সাংবিধানিক লক্ষ্য ও প্রতিজ্ঞার উল্টোপথে গিয়ে আরএসএসের শতাব্দীপ্রাচীন লক্ষ্য ফ্যাসিবাদী হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের বাস্তবিক কাজকর্ম জোরকদমে চলছে।
‘আমরা ভারতের জনগণ’ এই দীর্ঘস্থায়ী প্রচারাভিযানের অংশ হিসাবে আমরা ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি পালন করছি, তাই ৯-১৫ আগস্ট সপ্তাহব্যাপী বিশেষ প্রচার সংগঠিত করে আসুন আমরা পুনরায় মহান শহীদদের স্বপ্নের দেশ গড়ার শপথ নিই। *আমরা ভারতের জনগণ, আমাদের লক্ষ্য একটাই – স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষা করা!*
-- কেন্দ্রীয় কমিটি
সিপিআই(এমএল)লিবারেশন
কেন্দ্রে আসীন মোদী সরকার ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে আজাদী কি অমৃত মহোৎসবের নামে দেশজোড়া এক উগ্র জাতিয়তাবাদী উন্মাদনা তৈরি করতে উদ্যত। অসংখ্য শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র, যুব, মহিলাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামের সূত্রে অর্জিত দেশের স্বাধীনতার অন্যতম প্রতীক তেরঙ্গা ঝান্ডাকে বিজেপি সরকার আত্মসাৎ করে ভারতীয় সংবিধান সম্মত সমস্ত মৌলিক অধিকারগুলিকে ধারাবাহিকভাবে নস্যাৎ করে চলেছে। পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করা আরএসএস ‘ভারত মাতা’র নামে জয়ধ্বনি দিয়ে গেরুয়া পতাকাকে তাদের স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃত করার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি-আরএসএস।
দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবিধানের উপর এই সার্বিক হামলার মোকাবিলায় সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সমস্ত স্তরের কর্মীবাহিনী সজাগ, সতর্ক ও সক্রিয় হয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ৯ আগস্টের আহ্বান ও ১৫ আগস্টের অঙ্গীকারপত্র প্রকাশ্যে পাঠ করে প্রতিরোধী কর্মসূচিকে রাস্তায় সংগঠিত করবে।
ঘরে ঘরে জাতীয় পতাকা তোলার ফরমান জারি করে মোদী সরকার দেশের গরিব মানুষের উপর আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের হেনস্থা করা এমনকি শারীরিক হামলা নামিয়ে আনার চক্রান্ত করছে। আমরা বিনামূল্যে পতাকা সরবরাহের দাবি সম্বলিত চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছি, পাশাপাশি মোদী সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারের পাল্টা প্রচারের কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। আমাদের কর্মসূচিগুলিতে জাতীয় পতাকা থাকবে, লাল পতাকা থাকবে। প্রতিটি জেলায় ও ব্লকে কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
* ভগত সিং, ক্ষুুদিরাম, মাতঙ্গিনী হাজরার স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে চলো।
* সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলো।
* দেশের সাংবিধানিক ভিত্তির উপর ফ্যাসিষ্ট হামলার বিরুদ্ধে এক হও।
* আমাদের দেশের মিশ্র সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির সপক্ষে এক হও।
* নাগরিকদের ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় এক হও।
* স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে আজও কোটি কোটি মানুষ অনাহার অর্ধাহারে কেন জবাব দাও।
* কৃষি ও কৃষকের অধিকার খর্ব করে অন্নদাতাদের কর্পোরেটের গোলামে পরিনত করা চলবে না।
* শ্রম আইনের অধিকার কেড়ে নিয়ে শ্রমিককে ক্রীতদাসে পরিণত করা চলবে না।
* নারীর নির্ভয় স্বাধীনতার দাবিতে সর্বস্তরের মানুষ এক হও।
* শিক্ষা ও কাজের অধিকারের দাবিতে এক হও।
অগত্যা রাজ্য বিজেপি সম্পাদকের কথা থেকে বোঝা গেল এখানে ওরা অপেক্ষায় থাকছেন “মহারাষ্ট্র মডেল” প্রয়োগের, যার জন্য প্রত্যাশায় থাকতে হচ্ছে শাসক তৃণমূলের ভেতর থেকে কোন এক ‘শিন্ডে’-র আত্মপ্রকাশ ঘটে কিনা, যার উপর নির্ভর করে ভিতর থেকে ভাঙন ঘটিয়ে মমতা সরকারের পতন ত্বরান্বিত করাতে পারা যাবে। এরাজ্যের যেন তেন প্রকারে দখল নেওয়ার উদ্দেশ্যে তৃণমূলকে ভেতর থেকে ভাঙার অপচেষ্টা বিজেপি এর আগেও চালিয়েছে। প্রথমে মুকুল রায়কে পুঁজি করে কিছু উল্লেখযোগ্য ভাঙন ঘটাতে সফল হয়, তবে সেসব হাসিল করতে পেরে উঠেছিল বিগত পঞ্চায়েত ও পৌরসভা নির্বাচনের আগে-পরে। অর্থাৎ, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ও পৌরসভার স্তর পর্যন্ত ক্ষমতার দখল পেতে। তারপরে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে ভাঙতে, টক্কর দিতে বিজেপির আরও সুবিধা হয় শুভেন্দুকে পেয়ে যাওয়ায়। তাতে আবারও কিছু ভাঙন ধরাতে সক্ষম হয় বিধায়ক ও সাংসদ স্তরে। কিন্তু যাবতীয় সমস্ত হীন কৌশল চালিয়েও বিজেপিকে বাংলায় ক্ষমতার দখল পাওয়া থেকে বহু দূরেই থেকে যেতে হয়েছে। তবু নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরপর বিজেপি ফের পুনরুত্থান ঘটানোর চেষ্টা চালায়। কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে রাজ্যের কিছু পরিচিত মন্ত্রীকে ঝটিতি গ্রেপ্তার করে মামলা ঠুকে পরিস্থিতি ঘোরানোর কসরত করে। কিন্তু সফল হয়নি। কাজেই বিজেপি রাজ্য সম্পাদকের অতি সাম্প্রতিক ‘মহারাষ্ট্র মডেল’ প্রয়োগের প্রসঙ্গ উত্থাপন কোনো বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত গলাবাজি নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সুপরিকল্পিত। এই উদ্দেশ্যে আবার হুমকি দিতে শুরু করেছে। কেন্দ্রের মদতে ও আদালতের আদেশে কেন্দ্রীয় এজেন্সির একের পর এক হানাদারীকে বিজেপি তার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। এইসব অভিযান থেকে ফায়দা তুলতে প্রচারে মরীয়া হচ্ছে। নিশানা করছে বিরোধীপক্ষের দল শাসিত রাজ্যগুলিকে। কোথাও সফল হচ্ছে, কোথাওবা সুবিধা করে উঠতে পারছে না, কোথাও আবার ব্যুমেরাং হচ্ছে, যেমন এনডিএ-র শাসক জোটের অ-বিজেপি পক্ষকে সাঁড়াশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে বিহারে।
পশ্চিমবাংলায় শাসক তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়া থেকে আগাগোড়া চালিয়ে আসছে যথেচ্ছ দুর্নীতি। সম্প্রতি পুরানো এক জনস্বার্থ মামলা সূত্রে কলকাতা উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি সমন্বয়ে এক ডিভিশন বেঞ্চ এক বিচিত্র আদেশ দিয়েছে তৃণমূলের সাংসদ-বিধায়ক সহ একগুচ্ছ নেতাদের আয়ের সঙ্গে সম্পত্তির অসঙ্গতি খতিয়ে দেখতে! বিচিত্র এই যে বিস্ময়করভাবে এই মামলায় ইডি-কে যুক্ত করেছে! মানুষের দাবি আছে এইসব অভিযোগের স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার হোক, ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায় পাক, দোষীরা শাস্তি পাক। কিন্তু সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করার যুক্তিও রয়েছে। কারণ, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি যেখানে কোন অংশে কম দুর্নীতি অভিযুক্ত নয়, তবু সেখানে কখনও ইডি-সিবিআই মার্কা কেন্দ্রীয় এজেন্সি নিয়োগ করা হয়না। এখানেও নারদ কেলেঙ্কারীতে অন্যতম অভিযুক্ত, অধুনা বিজেপি বিধায়ক দলনেতা, শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে কোনো কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তের নামগন্ধ নেই! তাই এইসব পক্ষপাতিত্বের মধ্যে উন্মোচিত হয়ে যায় বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সেটা হল, কোনো বিরোধীপক্ষকে কোনও ক্ষমতায় থাকতে না দেওয়া। এটা ফ্যসিবাদেরই লক্ষণ।
তৃণমূলও ক্ষমতায় থাকার দাপট বোঝাতে এক সময়ে বামেদের ও কংগ্রেসের হাতে থাকা বহু পঞ্চায়েত ও পৌর ক্ষমতা জোরজবরদস্তি ভাঙিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছিল। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে তান্ডব চালিয়েছিল। তার প্রাপ্য রাজনৈতিক শাস্তি অবশ্যই সময়ের সাথে সাথে বুঝিয়ে দিতে হবে, এবং সেটা করতে হবে নতুন চিন্তায় নতুন আশাবাদ জাগিয়ে তুলে, লড়াইয়ের ঢেউ তুলে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করে – বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে। তার সুযোগ কখনই বিজেপিকে নিতে দেওয়া যায় না, কারণ বিজেপি একটা ফ্যাসিবাদী দল, মত্ত হয়েছে ঔপনিবেশিক দখলদার শাসকের মতো একের পর একের রাজ্য দখল করতে, সংবিধান-গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করে দেশটাকে বিরোধীশূন্য প্রজাদাসত্বের হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে।
ভারতের ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী সংগ্রাম অথবা স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক দীর্ঘস্থায়ী ও বহুবিচিত্র অধ্যায়। এটি যেন অযুত সংগ্রামের বুননে তৈরি এক নকশীকাঁথা যা এক আধুনিক ভারতের অন্বেষণকে গভীরতর ও সমৃদ্ধ করেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ও বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন আশু দাবি ও প্রেক্ষিতগুলি — যেমন জমিদারি ও মহাজনীর বিরুদ্ধে, স্থানীয় রাজাদের বিরুদ্ধে, জাতি ও লিঙ্গ ভিত্তিক অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে, এবং ভাষাগত অধিকার ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য সংগ্রাম — সব সংযুক্ত হয়ে গেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভরবেগ ও চিত্রপটের সঙ্গে। বিভিন্ন ধরনের সমাবেশ আর বিভিন্ন পদ্ধতির সংগ্রাম, যেগুলির নেতৃত্ব দিয়েছেন গান্ধীবাদী ও আম্বেদকরপন্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন মত ও পথের কমিউনিস্ট ও সমাজবাদীরা — এই সবগুলিকেই মিলিতভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান আখ্যানের বহুবিচিত্র বর্ণময় তটভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কী অদ্ভুত পরিহাস, যে শাখাটি স্বাধীনতা সংগ্রামে লক্ষণীয় ভাবে অনুপস্থিত ছিল, আর এখন হিন্দু আধিপত্যকামিতার ভিত্তিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা তৈরির নিজস্ব প্রকল্পে ব্যস্ত, তারাই আজ ভারত শাসন করছে, যখন দেশ স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকী উদযাপন করছে!
শুধু ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির উত্থান ও আধিপত্যরই তিন শতকের বেশি দীর্ঘ এক ইতিহাস আছে- সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকে পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক কাজকর্ম বাড়িয়ে তোলা ও আধিপত্যের জাল ছড়িয়ে দেওয়ার পর্ব, তারপর চলেছে এক শতাব্দীব্যাপী কোম্পানি শাসন (১৭৫৭- ১৮৫৮); আর ব্রিটিশ রাজশক্তির প্রত্যক্ষ শাসনের চূড়ান্ত পর্ব হল ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। নিষ্ঠুর লুণ্ঠন ও অপহরণ থেকে অত্যাচার ও কৌশলে বশে আনার প্রাতিষ্ঠানিক রাজত্ব। ঔপনিবেশিক শাসনের এই গতিপথে প্রথম নথিভুক্ত বিদ্রোহ ১৭৮৪ সালে তিলকা মাঝির নেতৃত্বে আদিবাসী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে চলেছে নিরন্তর প্রতিরোধ আর থেকে থেকেই ঘটেছে বিদ্রোহ। প্রতিরোধের এই গোটা ইতিহাসকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে মান্যতা দিতে হবে।
১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধ এবং ১৭৬৪’র বক্সার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতে কোম্পানির শাসন বেশ ভালোরকম সুসংহত হয়। এরপর শাসকরা চায় এই শাসনকে আরও চাঙ্গা করার লক্ষ্যে এক বাধ্য জমিদার শ্রেণী তৈরি করতে যা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা কর্নওয়ালিস কোড নামে পরিচিত। কিন্তু এই চেপে বসা ঔপনিবেশিকতা ও জমিদারি, তার সঙ্গী নিষ্ঠুর মহাজনী জুলুম গ্রামীণ জনতার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে, কৃষকদের বিশেষ করে আদিবাসীদের ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। বিদ্রোহের আগুন মাঝে মধ্যেই জ্বলে উঠছিল আর সেটাই এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছালো ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল হুল এবং ১৮৫৭-তে মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। এর পর ব্রিটিশ রাজশক্তি শুধু তার প্রত্যক্ষ শাসন কায়েম করেই ক্ষান্ত থাকল না, তার রণকৌশলেও বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এল।
১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহ দু'টি কারণে ব্রিটিশ শাসককে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম বিভেদ এবং খণ্ডিত ভারতীয় জনসমাজের ব্রিটিশ প্রত্যাশার বিপরীতে, ১৮৫৭’র জাতীয় গণজাগরণ এক মহত্তম সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিল যেখানে হিন্দু ও মুসলিম সৈন্যরা, কৃষকরা, ব্যবসায়ীরা, এমনকি অভিজাত বর্গও বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে হাত মিলিয়েছিলেন। ১৮৫৭’র পর, ব্রিটিশ শাসক তাই ‘ভাগ করে শাসন করো’-কে তাদের ঘোষিত নীলনকশা হিসেবে গ্রহণ করে এবং দেশীয় রাজ্যগুলিকে বিশ্বস্ত মিত্রশক্তিতে উন্নীত করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এই ‘ভাগ করে শাসন করো’ – কৌশলকে মোকাবিলার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনে অবশ্য ‘ঐক্যবদ্ধ হও, প্রতিরোধ করো’ – এই নীতিকে বিকশিত করার চেষ্টা চলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই চরম কষ্টের দেশভাগ আর তার সঙ্গী বিপুল রক্তস্নান, বাধ্যতামূলক দেশান্তর, ধ্বংস আর ক্ষতিকে রোখা যায়নি। ‘ভাগ করে শাসন করো’ কৌশল তখন পরিণত হয়েছে তার অন্তিম রূপে – ‘দেশভাগ করে, পালাও’।
আরএসএস, যে সংগঠন বর্তমানে বিজেপি’র মাধ্যমে ভারত শাসন করছে আর নিজের মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে শাসকের মতাদর্শ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে, তারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে ‘দেশভাগের’ যন্ত্রণার আখ্যানে পরিণত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আজ তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত নেতাদের, বীরদের আত্মসাৎ করে নিজেদের দরকার মতো কাজে লাগানোর ধান্দাবাজি করছে, কয়েকজনকে আবার বিকৃত করে তাদের কালিমালিপ্ত করছে। এসব আসলে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই দিগগজ আরএসএস এবং হিন্দুত্বের অন্যান্য প্রবক্তাদের আসল ভূমিকার হীন বাস্তব চেহারাটা চাপা দেওয়ার একটা ধূর্ত কূটকৌশল। হিন্দুত্ব লবি তখন স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে সরে ছিল। তাদের প্রধান আইকন সাভারকরের এখন সবচেয়ে বেশি পরিচিতি তার ব্রিটিশ শাসকের কাছে মার্জনা ভিক্ষার আধ ডজন চিঠির জন্যে! আরএসএস তখন মুসোলিনি ও হিটলারের প্রতি ভক্তি গদগদ। গোলওয়ালকর লিখেছিলেন, ‘জাতির পবিত্রতা ও গৌরব’-এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হিটলারের ‘নাজি জার্মানি’ মডেল অনুসরণ করলে ভারতের কতটা লাভ হবে! সাভারকর তখন হিন্দু ভারতের মডেলকে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর যেখানে হিন্দুরা, ব্যাপকার্থে যারা ভারতে জন্মগ্রহণ করেছে এবং ভারতে উদ্ভুত কোন ধর্মের অনুসারী, তারাই সমস্ত রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে শাসন ও পরিচালনা করবে।
ভারতের দেশভাগে আরএসএস-এর জবাব হল, এক অখণ্ড ভারতের পুনর্গঠন, যার অন্তর্ভুক্ত হবে শুধু ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশই নয় — যে তিনটি দেশ তৈরি হয়েছে ১৯৪৭-এর পরে; সেই অখণ্ড ভারতে উত্তর-পশ্চিমে থাকবে আফগানিস্তান, উত্তর-পূর্বে থাকবে মায়ানমার, দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা এবং উত্তরে নেপাল, ভূটান এবং তিব্বত। এটাকে পুনর্মিলনের ইচ্ছার (যেমন জার্মানির পুনর্মিলনের ইচ্ছা বা কোরিয়ার পুনর্মিলনের ইচ্ছা) সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না! এটা খুব স্পষ্টভাবে একটি সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্যবাদী স্বপ্ন (যেমন পুতিনের ‘বৃহত্তর রাশিয়া’ যা ইউরেশীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে থাকবে)। আরএসএস-এর ওকালতির অখণ্ড ভারতের কোনো ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ছিল না। এটা কাল্পনিক অতীতের অলীক গৌরবের এক উপস্থাপনা যা বর্তমানের সমস্যা ও দুর্দশা থেকে মানুষের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে এক বিষাক্ত স্বপ্নের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গালগল্পের মাধ্যমে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিগত পঁচাত্তর বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হিসাবে রয়েছে। বাংলাদেশেরও বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। তিনটি দেশের অতীত অভিজ্ঞতায় অনেক মিল আছে। তাদের সাধারণ স্বার্থও আছে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একটি কনফেডারেশন, এবং বর্তমানের সুপ্ত ও প্রায় বিলুপ্ত এসএএআরসি (সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন)’র থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতার আরও প্রাণবন্ত ও সক্রিয় একটি কাঠামো গড়ে তোলার কথা ভাবতেই পারে। কিন্তু আরএসএস-এর অখণ্ড ভারতের কল্পনা দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করা আর ভারতকে তার সব প্রতিবেশীদের থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ব্যবস্থাপত্র ছাড়া আর কিছুই নয়! অতীতের অবিভক্ত ভারতকে পুনরুদ্ধারের কথা ভুলে যান, ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে একজাতীয় ও নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ভিত্তিতে সংজ্ঞা দেওয়ার যেকোন রকম চেষ্টা শুধু ভারতের বর্তমান জাতীয় ঐক্যকেই বিপন্ন করবে। তবুও যদি সংবিধান-প্রতিশ্রুত অধিকারের ব্যাপ্তি, গণতন্ত্রের গভীরতা এবং সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার ধারাবাহিকতা ও পরম্পরা এবং সার্বিক ন্যায় রক্ষায় সংবিধানে যথেষ্ট সংস্থান না থাকে, তার প্রস্তাবনা একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মৌলিক চেতনাকে প্রজ্ঞাপিত করেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের বিজয়ের পর এবং আরও সুসংবদ্ধভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার ফলাফলের প্রেক্ষিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী ফ্যাসি-বিরোধী গণজাগরণের অংশ হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির ভারত থেকে নিষ্ক্রমণ এবং ১৯৪৯-এ নতুন চিনের উদয় বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বের রাজনৈতিক চিত্রপটকে একেবারে নাটকীয়ভাবে পাল্টে দিয়েছিল। পরিবর্তিত এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে শুরু হয়েছিল আধুনিক ভারতের অভিযাত্রা। আজ, সেই ঐতিহাসিক ‘নিয়তি-অভিসার’-এর পঁচাত্তর বছর পর, ভারতীয় পরিক্রমা সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিমুখে এক উল্টো পথে চালিত হচ্ছে। এটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতায় আসা এবং ২০১৯’এ তার বিজয়ী প্রত্যাবর্তন সঙ্ঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠানের শক্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তার জোরেই তারা ভারতের রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিগুলি পুনর্লিখনে তৎপর হয়ে উঠেছে। আর তাদের এই নতুন ব্যবস্থায় শাসক অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে আইন পরিষদ ও বিচার ব্যবস্থার ওপর আধিপত্য করছে। আর সংবিধানের বিধিগুলি নিয়ে প্রকাশ্যেই চলছে ক্রূর বিদ্রুপ আর অবজ্ঞার উদ্ধত প্রদর্শন। রাষ্ট্র এবং নাগরিকত্বকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার ধারণাটি পরিত্যক্ত হচ্ছে। এক নতুন সংসদ ভবনে গণতন্ত্রকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে নিয়ন্ত্রণের কঠিন নাগপাশে আবদ্ধ করার এক সময়-কয়েদে যেখানে সমালোচনা ও বিরোধিতার মৌলিক প্রকাশকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। ‘জরুরি অবস্থা’ যদি গণতন্ত্রকে দমিয়ে রাখা ও সাময়িকভাবে খারিজ করার এক নথিবদ্ধ অভিজ্ঞতা হয় যার মধ্য দিয়ে অতীতে ভারতকে যেতে হয়েছে, এখন আমরা এক স্থায়ী জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি। পুরোনো জরুরি অবস্থার শুধু একটা নিপীড়নমূলক অবস্থা ছিল। আর আজ তার নতুন ‘অবতার’ হাজির হয়েছে শাসককে বাহবা-দেওয়া এক ‘গোদী মিডিয়া’ এবং খুনী স্কোয়াডগুলোকে সঙ্গী করে যারা পথে পথে হিংস্র বিনোদন উদযাপন করছে।
স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকী মোদী সরকারকে তাদের নিজেদের অ্যাজেন্ডার প্রয়োজনে ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে বিকৃত করার ও নতুন করে লেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা, ভারতীয় জনগণ, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে অবশ্যই আবার ফিরে দেখব মুক্তি ও সাম্যের স্বপ্নকে নতুন করে জ্বালিয়ে তুলতে, যাতে ক্রমশ বেড়ে চলা ফ্যাসিস্ট আক্রমণকে আমরা প্রত্যাঘাত হানতে পারি!
সম্পাদকীয়
লিবারেশন, আগস্ট ২০২২
বিজেপিকেই ভারতের একমাত্র রাজনৈতিক ভবিষ্যত হিসেবে ঘোষণার উদ্দেশ্যে ৩০-৩১ জুলাই পাটনাতে সঙ্ঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান এক বিশাল জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। ইতিমধ্যেই অমিত শাহ বিভিন্ন সময়ে গর্ব করে বলেছেন যে আগামী ৪ দশক বিজেপিই ভারত শাসন করবে।
এটা বিজেপির মিত্রদের জন্য জবরদস্ত ইঙ্গিত ছিল এবং আজকের বিহারের উদ্ভুত দেখিযে দিয়েছে যে নীতীশ কুমার সেই ইঙ্গিতকে সঠিক অনুধাবন করেছেন। দেরিতে হলেও নীতীশ কুমারের বিজেপির থেকে সরে আসার ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী লিবারেশন সহ মহাগাঠবন্ধনের একটি অ-বিজেপি সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত বিহারে পরিবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। আশা করা যায় যে রাজ্যপাল বিহার বিধানসভার পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে স্বীকার করে একটি অ-বিজেপি সরকারকে দায়িত্ব নেওয়ার অনুমোদন দেবেন।
বিহারে শাসন ক্ষমতার উপরে ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে সঙ্ঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান রাজ্যকে তাদের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট নীতির পরীক্ষাগারে রূপান্তরিত করেছিল। বিহারে যোগী আদিত্যনাথের ইউপি মডেলের বুলডোজার রাজের অনুকরণ করার উৎসাহ জোরালো হয়ে উঠেছিল সাম্প্রতিক ইউপি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতা ধরে রাখার পর থেকে। বিধানসভার ভিআইপি বিধায়কদের বিজেপির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া ও ভিআইপি দলের মন্ত্রীকে বিহার মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দেওয়া ছিল বিহারকে আরেকটি ইউপি-তে রূপান্তরিত করার দিকে প্রথম ধাপ।
মহারাষ্ট্র সরকারকে ফেলে দেওয়া ও ঝাড়খন্ডে অনুরূপ সরকার ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বিহারে ক্ষমতা থেকে বিজেপির অপসারণ একটি যথাযথ বিপরীত ইঙ্গিত বহন করেছে। কিন্তু প্রকৃত পরিবর্তন ঘটাতে হবে বিহারের মাটিতে।
সমস্ত ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা ও ভারতকে একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার বিজেপির ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শক্তির বিস্তৃত ও অধিক কার্যকরী সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসকে বিহার অবশ্যই উদ্বুদ্ধ করবে। সমস্ত ফ্রন্টে ও সারা দেশ জুড়ে প্রতিরোধ তীব্রতর হোক। এক অ-বিজেপি সরকারের দিকে বিহারের পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বিজেপির ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনাকে পর্যুদস্ত করতে এবং বিহারের জনগণের জন্য উন্নত মান আদায় করতে বিহারের সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে তার ভূমিকা আরো বাড়িয়ে তুলবে।
– দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
নকশালবাড়ি ধারার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রধান রূপকার কমরেড চারু মজুমদারের বিপ্লবী চেতনা প্রতিষ্ঠাকারী অন্যতম বিপ্লবী নেতা ছিলেন কমরেড সরোজ দত্ত, তিনি ‘শশাঙ্ক’ নামেও বহুল পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে পার্টি নেতা, কবি, সাংবাদিক, অনুবাদক ও ক্ষুরধার লেখক। এবছর ৫ আগস্ট তাঁর ৫১তম শহীদ বার্ষিকী। তাঁর বিপ্লবী কণ্ঠস্বর সে সময় ভারতীয় শাসকদের কাছে বড় বিপন্নতা সৃষ্টি করেছিল। তাই, ১৯৭১ সালের ৪-৫ আগস্টের মাঝরাতে গোয়েন্দা পুলিশের দল দক্ষিণ কলকাতার রাজা বসন্ত রায় রোডের এক অধ্যাপকের বাড়ির গোপন আশ্রয়স্থল থেকে সরোজ দত্তকে গ্রেপ্তার করার পরে শেষরাতে কলকাতা ময়দানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। সেটা ছিল একইসাথে সত্তর দশকের ক্রান্তিকাল এবং বিপরীত দিক থেকে কংগ্রেসী জমানার শ্বেতসন্ত্রাস নামিয়ে আনার সময়কাল। ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্রের নির্দেশে বাংলার সুবেদার সিদ্ধার্থ রায়ের খুনে গোয়েন্দারা সরোজ দত্তকে হত্যা করলেও কোনওদিন প্রকাশ্যে তার সত্যতা স্বীকার করেনি। সেই থেকে বীরপ্রতীম সরোজ দত্ত পুলিশের ফাইলে আজও ‘নিখোঁজ’! এ নিয়ে বহু লেখা, প্রচারপত্র, পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৯৮ সালে কার্জন পার্কে তাঁর আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের পক্ষ থেকে। তারপর থেকে প্রত্যেক বছর সেখানে শহীদ স্মরণ কর্মসূচি নেওয়া হয়ে আসছে। এবারও ৫ আগস্ট শহীদ দিবসে ধর্মতলায় কার্জন (সুরেন্দ্রাথ) পার্কে সরোজ দত্ত’র আবক্ষ মূর্তির সামনে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের কর্মসূচি আয়োজন করে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ, আইসা, আইপোয়া, আরওয়াইএ সহ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা। মাল্যদান করেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সরিৎ চক্রবর্তী এবং দেবাশীষ চক্রবর্তী। মাল্যদান করেন আইসা, আরওয়াইএ, আইপোয়া, এআইসিসিটিইউ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সহ উপস্থিত সকল সাথী। সরোজ দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনাসহ সরোজ দত্ত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বোস। সবশেষে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের শিল্পী সাথীদের উদ্দীপিত গণসঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে স্মরণসভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
এছাড়া কার্জন পার্কের সরোজ দত্তের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যার্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ‘সম্প্রীতি মনন’ পত্রিকার পক্ষ থেকে অমিত দাশগুপ্ত ও সুমন সেনগুপ্ত।
এদিন বিভিন্ন জেলায়ও বিপ্লবী নেতা সরোজ দত্তের শহীদ দিবসে স্মরণ কর্মসূচি পালন করা হয়।
৫০০ দিনেরও বেশি অতিক্রান্ত, ন্যায্য নিয়োগের দাবিতে খোলা আকাশের নীচে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন এসএসসি পরীক্ষা উত্তীর্ণ যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা। ৫ আগস্ট কার্জন পার্কে কমিউনিস্ট বিপ্লবী সরোজ দত্ত শহীদ স্মরণ বার্ষিকী পালনের পরে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ, আরওয়াইএ, এআইএসএ, এআইপিডব্লিউএ, এআইসিসিটিইউ, এআইএলএজ এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সদস্যরা স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে ধর্ণা আন্দোলনের প্রতি সংহতির বার্তা নিয়ে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের অবস্থান স্থলে যান। ‘লড়াই করো লড়াই করো যত দিন না বিজয়ী হও’ গণসঙ্গীতের মাধ্যমে হকের দাবিতে আন্দোলনকারী এসএসসি চাকরি প্রার্থীদের অদম্য লড়াইকে কুর্ণিশ জানান পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক সরিৎ চক্রবর্তী সহ বাবুনি মজুমদার, প্রণব মুখার্জি ও সাথীরা। সমস্ত প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে রাজপথে অবস্থান আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সাথীদের সেলাম জানিয়ে আন্দোলনের পাশে শেষ অবধি থাকার অঙ্গীকার নিয়ে বক্তব্য রাখেন আইসার নীলাশিস বসু, এআইসিসিটিইউ’র বাসুদেব বসু, এআইপিডব্লিউ’র কাজল দত্ত, সিপিআই(এমএল) কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী, এআইএলএজ’এর রাজ্য সম্পাদক দিবাকর ভট্টাচার্য, গণসংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি দেবাশীষ চক্রবর্তী, মানবাধিকার আন্দোলনের বর্ষীয়ান সংগঠক অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী, মধুরিমা বক্সী সহ অন্যান্যরা। সভা পরিচালনা করেন আরওয়াইএ’র রাজ্য সম্পাদক রণজয় সেনগুপ্ত। বক্তারা বলেন, এই আন্দোলন সারা দেশের বুকে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রোদ, ঝড়, জল উপেক্ষা করে এই নাছোড়বান্দা লড়াইয়ের ফলেই আজ নিয়োগ দুর্নীতির স্বরূপ প্রকাশ্যে এসেছে। আর তাই এখন একটাই দাবি, কোনও টালবাহানা বা গোপন আলোচনা নয়, সমস্ত শূন্যপদে অবিলম্বে সকল যোগ্য তথা বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগ করতে হবে, নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত করে বঞ্চিতদের ন্যায় দিতে হবে। আন্দোলনের সমর্থনে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, গণকনভেনশন সহ বিভিন্ন প্রস্তাব উঠে আসে আলোচনা থেকে। নিয়োগের ন্যায্য দাবি না মানা হলে আরও বৃহত্তর লড়াইয়ে সর্বতোভাবে আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার বার্তা দেওয়া হয়।
গত ৫ আগস্ট ও ৬ আগস্ট প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালায় শাসক দল টিএমসির ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসী বাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের লেখা ব্যানার পুড়িয়ে ফেলে তারা। শুধু প্রেসিডেন্সিতে নয়, কলেজস্ট্রিট চত্তর জুড়ে হামলা চালায় এই সন্ত্রাসবাহিনী। প্রেসিডেন্সির মেইন গেট আটকে চলে হামলা। পড়ুয়াদের মারধরের হুমকি দেওয়া হয়, মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। এইখানেই থেমে থাকেনি ওরা, রাস্তায় প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের উপর চলে শারীরিক নির্যাতন। এই হামলার প্রতিবাদে ৬ আগস্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসা ইউনিটের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ নং গেটের সামনে এক প্রতিবাদ সভা আয়োজন করা হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন ইউনিটের সদস্য আকাশ গুপ্তা এবং রাজীব হালদার। সভাটি সঞ্চালনা করেন বর্ষা বড়াল।
এরপর টিএমসির এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্সির সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে এক প্রতিবাদী নাগরিক মিছিলের ডাক দেওয়া হয় ৮ আগস্ট। গর্জে ওঠে সমস্ত পড়ুয়াসমাজ। রাজপথের দখল নেয় শয়ে শয়ে পড়ুয়া। বিভিন্ন কলেজ, ইউনিভার্সিটির পড়ুয়ারা এই মিছিলে পা মেলান। স্লোগানে স্লোগানে কেঁপে ওঠে কলেজ পাড়া। মিছিল শুরু হয় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং শেষ হয় শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে। মিছিল জানান দেয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বা কলেজপাড়া কোনও সন্ত্রাসীদের হাতে ছেড়ে দেবে না ছাত্রছাত্রীরা। শিক্ষাক্ষেত্রে শাসকের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে কোনও মূল্যে প্রতিরোধ খাড়া করা হবে।
৯ আগস্ট আইসার ৩২তম প্রতিষ্ঠা দিবসে বালির কৈলাস ব্যানার্জী লেনের শহীদ বেদীতে পালিত হয় সংগঠিত শিক্ষার্থী আন্দোলনের সমস্ত শহীদদের উদ্দেশ্যে স্মরণ কর্মসূচি। পতাকা উত্তোলন ও সংক্ষিপ্ত সভার মধ্যে দিয়ে কর্মসূচি শেষ হয়। এই কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন আইসার রাজ্য সভাপতি নীলাসিস বসু ও হাওড়া জেলা সম্পাদক অঙ্কিত সহ জেলার ছাত্রযুব নেতৃত্ব। পাশাপাশি বালি গ্রামাঞ্চলে সন্ধ্যায় দূর্গাপুরে শহীদ-স্মরণ কর্মসূচি পালিত হয়। বিজেপি ভারত ছাড়ো এই আহ্বানের কর্মসূচিতে, শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন পার্থসারথী মিত্র। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন দীপক চক্রবর্তী। ৯ আগস্টেই মধ্য হাওড়ার ৭০ দশকে শহীদ হন ছাত্র শক্তি রায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে পার্টির মধ্য হাওড়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে হালদার পাড়া শহীদ বেদীর সামনে পথসভা ও শহীদ শক্তি রায় স্মরণ কর্মসূচি।
বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত সহ পার্টির বিভিন্ন নেতৃত্ব।
ঐতিহাসিক এই ৯ আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনার দিন এবং বিশ্ব আদিবাসী দিবস। এই বিশেষ দিনেই ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস ও তার আহ্বানকে সামনে রেখে প্রগতিশীল নাগরিক উদ্যোগ (বালি)-র উদ্যোগে স্থানীয় আশুতোষ গ্রন্থাগারে সন্ধ্যায়। আয়োজিত হয়েছিল একটি আলোচনা সভার। বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্য ডা: পার্থ ঘোষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড: মৃন্ময় প্রামাণিক; সভার সূচনা করেন এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষক মোহন হালদার। অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয় চারাগাছ প্রদানের মধ্য দিয়ে। উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন অমিতাভ ব্যানার্জী। আবৃত্তি পরিবেশন করেন ছাত্রী স্নেহা চক্রবর্তী। সমগ্র আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন প্রগতিশীল নাগরিক উদ্যোগ (বালি)-র আহ্বায়ক অমিতাভ ব্যানার্জী।
এই আলোচনা সভায় ডঃ মৃন্ময় প্রামাণিক তার সুপরিণত ভঙ্গিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্ত্যজ (দলিত)দের মহান ভূমিকা ও আত্মত্যাগের ইতিহাসকে আজকের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের দলিত বর্গের বিশেষত নারীদের আত্মত্যাগ ও গণ অভ্যুত্থানের মহান আদর্শকে প্রাঞ্জলভাবে রাখেন।
আলোচনাসভার অন্যতম বক্তা ডাঃ পার্থ ঘোষ শারীরিক অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে তাঁর অসাধারণ বাচনভঙ্গিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও তাতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের বিশ্বাসঘাতকতাকে অত্যন্ত সহজভাবে তুলে ধরেন। বর্তমানে স্বাধীনতা ৭৫-এর মর্মবস্তু এবং তাতে বামপন্থীদের ভূমিকার কথা তিনি উল্লেখ করেন।
দুই বক্তার ঋদ্ধ বক্তব্য ও উপস্থাপনায় শ্রোতারা সমৃদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
ঐতিহাসিক এই ৯ আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনার দিন এবং বিশ্ব আদিবাসী দিবস। এই বিশেষ দিনেই ভারতের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস ও তার আহ্বানকে সামনে রেখে প্রগতিশীল নাগরিক উদ্যোগ (বালি)-র উদ্যোগে স্থানীয় আশুতোষ গ্রন্থাগারে সন্ধ্যায়। আয়োজিত হয়েছিল একটি আলোচনা সভার। বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্য ডা: পার্থ ঘোষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড: মৃন্ময় প্রামাণিক; সভার সূচনা করেন এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষক মোহন হালদার। অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয় চারাগাছ প্রদানের মধ্য দিয়ে। উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন অমিতাভ ব্যানার্জী। আবৃত্তি পরিবেশন করেন ছাত্রী স্মেহা চক্রবর্তী। সমগ্র আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন প্রগতিশীল নাগরিক উদ্যোগ (বালি)-র আহ্বায়ক অমিতাভ ব্যানার্জী।
এই আলোচনা সভায় ডঃ মৃন্ময় প্রামাণিক তার সুপরিণত ভঙ্গিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্ত্যজ (দলিত)দের মহান ভূমিকা ও আত্মত্যাগের ইতিহাসকে আজকের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের দলিত বর্গের বিশেষত নারীদের আত্মত্যাগ ও গণ অভ্যুত্থানের মহান আদর্শকে প্রাঞ্জলভাবে রাখেন।
আলোচনাসভার অন্যতম বক্তা ডাঃ পার্থ ঘোষ শারীরিক অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে তাঁর অসাধারণ বাচনভঙ্গিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও তাতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের বিশ্বাসঘাতকতাকে অত্যন্ত সহজভাবে তুলে ধরেন। বর্তমানে স্বাধীনতা ৭৫-এর মর্মবস্তু এবং তাতে বামপন্থীদের ভূমিকার কথা তিনি উল্লেখ করেন। দুই বক্তার ঋদ্ধ বক্তব্য ও উপস্থাপনায় শ্রোতারা সমৃদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
আসানসোল
রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগে চরম দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পশ্চিম বর্ধমানের উখড়া হাটতলা নেতাজী মূর্তির সামনে, আসানসোল কোর্টের কাছে ঘড়ি মোড়, রূপনারায়ণপুর ডাবর মোড় বাসস্ট্যান্ড ও চিত্তরঞ্জন আমলাদহী বাজারে প্রতিবাদী সভা সংগঠিত হয়। সভার মূল দাবি তোলা হয় শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতিগ্রস্ত সমস্ত মন্ত্রী, নেতা ও আধিকারিক আমলাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
হাওড়া
এসএসসি কর্মপ্রার্থীদের নিয়োগ ও নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে হাওড়া জেলার বালি পুরসভার সামনে ৫ আগস্ট সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিক্ষোভসভা সংগঠিত হয়। তারপর পুরসভার সামনে জি টি রোড অবরোধ করা হয়। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কুশপুতুল দাহ করা হয়। এই বিক্ষোভ অবরোধ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন আইসা রাজ্য সভাপতি নীলাশিস বসু, সিপিআই(এমএল) বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির সম্পাদক দিলীপ ঘোষ, কল্যাণী গোস্বামী সহ আইসার সাথীরা। মধ্য হাওড়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে হালদার পাড়ায় এসএসসি দুর্নীতির বিরুদ্ধে দোষীদের শাস্তির দাবিতে এবং সমস্ত নিয়োগ প্রার্থীদের চাকরির দাবিতে পথসভা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন নীলাশিস বসু, সিপিআই(এমএল) জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, রাজ্য কমিটি সদস্য পরিতোষ ব্যানার্জী। বিক্ষোভসভা শেষে মধ্য হাওড়ার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস রোডের হালদার পাড়া মোড়ে অবরোধ করা হয়।
শিলিগুড়ি
রাজ্যে এসএসসি-প্রাইমারী টেটে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের কঠোর শাস্তি, মুখ্যমন্ত্রীর জবাবদিহি ও মেধা তালিকাভুক্ত যোগ্য প্রার্থীদের অবিলম্বে নিয়োগপত্র দেওয়ার দাবিতে শিলিগুড়ি শহরে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের এক বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত হয়। মিছিল হিলকার্ট রোড ও সেবক রোড পরিক্রমা করে হাসমি চক মোড়ে এসে শেষ হয়। মিছিলের শেষে বক্তব্য রাখেন রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু। মিছিলে নেতৃত্ব দেন রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। মিছিলে আরও ছিলেন পবিত্র সিংহ, পুলক গাঙ্গুলি, শরৎ সিংহ, পৈসাঞ্জু সিংহ, মুক্তি সরকার, শ্বাশ্বতী সেনগুপ্ত, বর্ষীয়ান নেত্রী গৌরী দে প্রমুখ।
নদীয়া
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি উন্মোচিত হয়ে পড়ার ঘটনাবলী রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে চলমান সীমাহীন দুর্নীতির প্রশ্নগুলিকে একেবারে সামনে তুলে নিয়ে এসেছে। ১০০ দিনের প্রকল্প, আবাস যোজনা, রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদি সংস্কারমূলক কাজের ক্ষেত্রে মানুষের চোখের সামনে চুরি দুর্নীতি চলতি ভাষায় যাকে বলে ‘গা সওয়া’ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে, মানুষ প্রতিটি প্রশ্নে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছেন। অপর দিকে চাষাবাদের এই ভরা মরসুমেও বৃষ্টির অভাবে পাটচাষ চরম সংকটে। পাট ভেজানোর জন্য প্রয়োজনীয় জল সরবরাহের প্রশ্নে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। এই প্রেক্ষাপটে নদীয়ার বিভিন্ন স্থানে পার্টির পক্ষ থেকে প্রচার কর্মসূচি সংগঠিত হয়। ব্যাপক মানুষের সাড়া মেলে। দুর্নীতি রোধ করার উপায় হলো গণতদারকী বা স্বচ্ছতা। প্রচারে এই বিষয়টিকেও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়। টিএমসির দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের নাম করে বিজেপি যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করছে তা উন্মোচিত করে এবং তাঁদের দুর্নীতির শিরোমনি চরিত্রকে তুলে ধরে বক্তব্য রাখা হয়।
গত ২৪ জুলাই ধুবুলিয়ার নেতাজী পার্কে এক প্রতিবাদ সভা করা হয়। ২৮ জুলাই জেলা সদর কৃষ্ণনগর অফিসে চারু মজুমদারের শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানের পর মিছিল করে শহরের পোস্ট অফিস মোড়ে এক প্রচারসভা সংগঠিত হয়। এতে শহরের মানবাধিকার কর্মীরাও অংশগ্রহণ করেন। ৪ আগস্ট ধুবুলিয়া বটতলা বাজার, পলতা মোড় ও রেলবাজার এলাকায় প্রচার সভা করা হয়। ব্যাপক মানুষ ভীড় করে সভাগুলি শোনেন। বহু মানুষ এগিয়ে এসে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া, সমস্তরকম বেআইনী নিয়োগগুলিকে তদন্ত করে বাতিল করা, সমস্ত শূণ্য পদে শিক্ষক নিয়োগ করা প্রভৃতি বিষয়গুলি মানুষ জানায়। ৫ আগস্ট নবদ্বীপ শহরে প্রাচীন মায়াপুর বাজারে এক প্রচারসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৭ আগস্ট বেথুয়াডহরী স্ট্যাচুর মোড়ে আরওয়াইএ এবং পার্টির পক্ষ থেকে এক বিক্ষোভ সভাকে কেন্দ্র করে এলাকায় এক উত্তেজনাময় পরিস্থিতির সৃস্টি হয়। আচমকাই এক ব্যক্তি মাইক কেড়ে নিয়ে জয় শ্রীরাম স্লোগান শুরু করে। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত পার্টি কর্মীরা তাকে পাকড়াও করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এরপর দীর্ঘ প্রচার সভা সংঘটিত হয়। সম্প্রতি ওই এলাকায় একটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের প্রচার সভায় বিজেপির হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজ ভূমিকাকেও উন্মোচিত করে বক্তব্য রাখা হয় যা এলাকায় ভালো সাড়া ফেলেছে। এই কর্মসূচিগুলিতে পার্টির রাজ্য ও জেলা নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
ধনেখালি, বলাগড়, পোলবা দাদপুর ব্লক
গণসংযোগ অভিযান অন্তর্বস্তুতে জনমুখী কোনো সংগঠনের শিকড়ে ফেরার অভিযান। পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে, পরিস্থিতিকে বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার নিতে।
পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা। গ্রামীণ দরিদ্ররা, তপশিলি জাতি-আদিবাসী, মেহনতিরা এই রাজ্যে সাম্প্রতিক অতীতেও বারবার জীবন-জীবিকা-গণতন্ত্রের স্বার্থে, উঠে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে সুস্পষ্ট রায় দিতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁদের এই জীবনযুদ্ধের সাথে সুগভীর সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হতে হবে আমাদের। সে চেষ্টা পার্টি নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছে। গণসম্পর্ক অভিযান তারই এক আন্তরিক প্রচেষ্টা।
আগামী ৬/৮ মাসের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন। সাধারণ মানুষ কি এবারও অবাধ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত থাকবেন? গত শতকের ৮০’র দশক থেকেই এখানে গ্রাম বাংলার মানুষের বৃহদাংশ বিরোধী মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছেন।
কীভাবে এই শ্বাসরোধকারী গ্রামীণ জীবনের মধ্যেই আসন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব?
৩/৪ মাস আগেও ধনেখালিতে আমাদের সাথীরা ভাবতেই পারছিলেন না, চলমান অগণতান্ত্রিক পরিবেশে কিভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ঘটানো সম্ভব! বিগত মে মাস থেকে ‘গ্রামে চলো, পাড়ায় চলো, ঘরে-ঘরে চলো’ অভিযান চালানোর মধ্য দিয়ে আজ তাঁরা অন্তত কয়েকটি পকেট দেখতে পাচ্ছেন, যেখান থেকে আগামীর যুদ্ধকে কেন্দ্রীভূত করা যায়। এখানেই গণসংযোগের প্রাপ্তি।
এখনও পর্যন্ত ধনেখালিতে কমবেশি ৫ হাজার সদস্য সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে। সংগ্রহে নেমেছেন ২৫/২৬ জন। এদের মধ্যে কেউ ২/৩ দিন, কেউবা ৮/১০ দিন, কেউ কেউ আরও বেশি ১৫/১৬ দিন। নামা হয়েছে ৫টি পয়েন্ট থেকে। ৩ মাস অতিবাহিত ইতিমধ্যে। ঋণমুক্তি, ১০০ দিনের কাজ, বর্গা উচ্ছেদ, আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের নিরবচ্ছিন্ন স্থানীয় গণআন্দোলনগুলি সংগঠিত করে; পার্টি ব্রাঞ্চ থেকে লোকাল কমিটি ব্যবস্থা, এরিয়া কমিটি ব্যবস্থার বৈঠক, বিভিন্ন গণসংগঠনের কমিটির বৈঠকগুলি নিয়মিত করার সাথে সাথে এই তিনমাসে ২০/২১ দিন সংগঠিত করা হয়েছে ‘পাড়ায় চলো’ কর্মসূচি। গণসংযোগের মূল লক্ষ্য গ্রামীণ মেহনতি, তপশিলি জাতি, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দরিদ্র মানুষেরা। এঁদের মধ্যে কাজ কেন্দ্রীভূত করেই ধনেখালিতে সংগঠকরা রাজনৈতিকভাবে উঠে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। সংশ্লিষ্ট গণসংগঠনের নেতৃত্ব ছাড়াও পার্টি ব্রাঞ্চ ব্যবস্থাও আন্তরিকভাবেই এগিয়ে যেতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই পর্যায়ে নেতৃত্বে আছেন শৈলেন মাজি, সত্যজিৎ মালিক, শ্যামাপদ শীটরা। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন রূপা শীট, অমিয় দাস, শ্রাবনী মালিক, সোমা রায়, সজল দে, জয়দেব বাগ, সম্রাট মাহেলি প্রমুখ।
জেলায় এই কাজে আন্তরিক রাজনৈতিক তাগিদ অনুভব হয় বর্ধমান জেলা লাগোয়া বলাগড় ব্লকের কর্মীদের মধ্যেও। ইতিমধ্যে সেখানে অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন কমবেশি ২৫/২৬ জন। এঁদের অধিকাংশ নবাগত। গুপ্তিপাড়া, কামারপাড়া, মহীপালপুর, বাকুলিয়া, এক্তারপুরের কয়েকটি পয়েন্ট থেকে চলছে এই অভিযান। এখানে মহিলা সংগঠকদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশই আদিবাসী সমাজভুক্ত আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাঁদের সাথে আমাদের সংযোগ স্থাপন হয়েছিল। কেউ বা ঋণমুক্তি আন্দোলনের ফসল। গণসংযোগ অভিযান এখানে মেহনতি জনগণের মধ্যে পার্টিকে যেমন পরিচিতই করছে, তেমনি পার্টি ব্যবস্থার বিকাশেও এই অভিযান উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠছে। কৃষিমজুর সমিতির জেলা সংগঠক সেখ আনারুলের নেতৃত্বে পরিচালিত এই নিবিড় অভিযানের অন্যতম সহযোদ্ধা কমরেড হেনা সুলতানা, শোভা ব্যানার্জীরা। দিগড়ে গ্রামে ৪ দিন অভিযান চলে। ৬০ পরিবারের ২৫০ জন সদস্যভুক্ত হন। অভিযানে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ ছিল ১৮ জনের। এই প্রক্রিয়াতেই মুখ্যত গরিব কৃষকদের গ্রাম কুলগাছিতে বাড়ি বাড়ি সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়। এক্তারপুর ডুমুরপাড়ের ৩২ মেহনতি পরিবারের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সংগঠন। এভাবেই মালঞ্চ কিংবা বৈরি বা ইলামপুর কিংবা সায়রা বা বাতনা — মেহনতি পরিবারের দুয়ারে কড়া নেড়েছে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির সদস্যভুক্তি এখনও পর্যন্ত তিন হাজার। কৃষক সমিতির জন্য এক হাজার। ভালো একটি অংশকে বোঝানো সম্ভব হয়েছে যে আজকের পরিস্থিতিতে কৃষিমজুর, মেহনতিদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষায় কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির মতো শ্রেণী সংগঠনের প্রয়োজন কতটা গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়াতেই সামনে এসেছেন বৈদ্যনাথ হেমব্রম, পঙ্কজ বিশ্বাস, বালক হাঁসদা, পঙ্কজ টুডুর মতো মেহনতি পরিবার থেকে উঠে আসা সংগঠকরা। এই মাসের শেষে, আগামী ২৮ আগস্ট এখানে কামারপাড়ায় আয়ারলা জেলা সম্মেলন হতে যাচ্ছে। গত ৮ আগস্ট বলাগড় ব্লকদপ্তর ও ভূমিদপ্তরে আয়ারলা সংগঠিত করল বিক্ষোভ-ডেপুটেশন কর্মসূচি। গণসংযোগ অভিযানের মধ্য দিয়ে উঠে আসা মেহনতিদের জীবন-জীবিকার প্রশ্নগুলি নিয়ে; ১০০ দিনের কাজ, বকেয়া মজুরি, আবাস যোজনা কিংবা বাস্তু পাট্টা দাবি করে। বর্গা অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
পোলবা-দাদপুর ব্লকে এই অভিযান একটু দেরিতে শুরু হলেও এখানকার দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এখন গণসংযোগকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করছেন। আয়ারলা রাজ্য কমিটি সদস্য গোপাল রায় এবং পাগান মুর্মুর উদ্যোগে এগিয়ে চলেছে অভিযান। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন শুভাশিস চ্যাটার্জী, তপন বটব্যাল, সাধন মাল, অজিত শেঠ, রবীন রায় সহ সংগঠক ও কর্মীরা। পার্টির জেলা কমিটি সদস্য ভিয়েত ব্যানার্জী আমনান অঞ্চলের বরুনানপাড়া এলাকায় গণসংযোগ অভিযানে একাধিক বার অংশগ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে এখানে ২ হাজারের বেশি সদস্য সংগ্রহ সম্ভব হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় গোস্বামী মালিপাড়া অঞ্চলের ৩/৪টি বুথে এবং বরুনানপাড়া এলাকার ৩টি বুথে আমাদের সংগঠন বিকল্প এক রাজনৈতিক কেন্দ্র রূপে জনমনে উপস্থাপিত হওয়ার প্রচেষ্টা জারি রেখেছে।
এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে কর্মহীনতা ও মূল্যবৃদ্ধির এই অস্বাভাবিক সময়ে মমতা সরকারের লক্ষ্মীর ভান্ডারের রাজনীতি ক্রমশ বড় আকারেই গতিশীলতা হারাচ্ছে। বিশেষত ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনাকে কেন্দ্র করে মানুষের অসন্তোষ বাড়ছে। ঋণগ্রস্ততায় ত্রাহিত্রাহি রব তুলছেন মেহনতিরা।
জমির প্রশ্ন, বর্গা অধিকার রক্ষা, লিজচাষে অধিকার রক্ষা, আবাস যোজনা, ভিটের কাগজ, জমির কাগজ,স্বা স্থ্য, শিক্ষা — এসবই আজ মেহনতিদের জীবন-জীবিকার জ্বলন্ত প্রশ্ন। বাড়ছে ক্ষমতাবানদের জুলুমবাজি।
এমনই একটা সময় গ্রামের মধ্যে মেহনতিদের বিকল্প রাজনীতি তুলে ধরার সময়। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গ্রামে গ্রামে নিয়মিতভাবে ঝাণ্ডা কাঁধে আমাদের সংগঠকদের নিয়মিত চলাফেরা একদিকে জনমনে চেপে বসা ভয়ের বাতাবরণ কাটাতে যেমন সক্ষম হচ্ছে, তেমনি এক বিকল্প রাজনৈতিক কেন্দ্র রূপে আমাদের সংগঠন অত্যাচারিত জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সহায়ক হচ্ছে।
শ্রেণীর রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকের মুখোমুখি। নিচতলায় আমাদের রাজনৈতিক সচলতা বিজেপির জমি দখলের সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
গণতন্ত্রের লড়াই এক সুপরিকল্পিত, লাগাতার লড়াই।
জনগণের জীবন-জীবিকার লড়াই এক কষ্টসাধ্য, প্রতিদিনকার লড়াই।
গণসংযোগ অভিযান সেই কাজেই আমাদের নিয়োজিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
- সজল অধিকারী
চাই আরও ঐক্যবদ্ধতা
২৮ জুলাই কলকাতার মিছিলে যোগ দিতে ট্রেনে উঠেছি বেশ কয়েকজন কর্মী-সমর্থক। ট্রেনের মধ্যেই ‘তেভাগা নকশালবাড়ি চারু মজুমদার’ পুস্তিকাটির সঙ্গে দেশব্রতী পত্রিকাও বিক্রি করলাম খান কতক। কর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে দাম মিটিয়ে দিলেন। একজন কমরেড পয়সা দিতে গড়িমসি করছিলেন। মিছিল শুরু হওয়ার আগে শিয়ালদহ স্টেশনে পয়সা চাইতেই কমরেডটি পকেট থেকে একগোছা নোট বার করে আমার হাতে দিলেন। তাঁকে বলা হয়, “বই আর পত্রিকার দাম মিলে ৩৫ টাকা। আপনি এতো টাকা দিচ্ছেন কেন?” কমরেড বললেন, “পত্রিকার দাম পরে দিচ্ছি। আগে এআইকেএমের সদস্য হওয়ার টাকাটা নিন।” আদিবাসী ঘর থেকে উঠে আসা এই কমরেডটি সবে কয়েক মাস আমাদের পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের গ্রামে সঙ্গে আমাদের এক পুরনো পার্টি সদস্য — মাত্র দুজনে মিলে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। পার্টি ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার এ এক অমূল্য নজির। পান্ডুয়া ব্লকে গণসংযোগ অভিযান যদিও রয়েছে খুবই প্রাথমিক স্তরে তবুও গতানুগতিকতার বৃত্তকে ভেঙ্গে এমন তরতাজা কর্মীদের উঠে আসা, নিঃসন্দেহে, অন্যদেরও প্রেরণা জোগায়। পান্ডুয়ায় ‘জনসংযোগ কর্মসূচি’ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ৩১ মে, করন্দা দিবসে। একটি গ্রামের আদিবাসী পল্লীতে সকাল থেকে ‘আয়ারলা’র সদস্য সংগ্রহ হয়। বিকেলে হয় পথসভা। অন্য দুই পঞ্চায়েতে, যেখানে আমাদের ভালো গণসমর্থন আছে, এমন দু’টি গ্রামেও প্রায় একই সময়ে এই কাজ চলতে থাকে। বাস্তবে একটি গ্রামে কেবল একদিনই কর্মীরা পথে নেমেছিলেন। পরে দীর্ঘসময় তাঁরা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন। তবুও ওই যে ৩০-৩২টি খেতমজুর পরিবারের কাছে তাঁরা আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন, তারই অভিঘাতে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ওই গ্রামে খেতমজুর ধর্মঘট হয় এবং মজুরি বৃদ্ধি ঘটে। অন্য গ্রামটিতে একটানা কয়েকদিন কর্মীরা গ্রামীণ মেহনতিদের পাড়াগুলিতে পৌঁছে প্রথম পর্যায়ে ৫০০ সদস্য সংগ্রহ করেছেন। চাষের মরশুমের ব্যস্ততায় এই কাজ সাময়িক ব্যাহত হলেও, কর্মীরা এখন গ্রামটির বাকি অংশেও পৌঁছানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন।
জেলার বলাগড় ও ধনেখালি ব্লকে গণসংযোগ অভিযানের চমৎকার সাফল্যের খবরে উজ্জীবিত হয়ে পান্ডুয়ার অপর তিনটি গ্রামে জুলাই মাসের মাঝামাঝি এই কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়া হয়। এরমধ্যে পাশাপাশি দুটি গ্রামে (যদিও দুটিই পৃথক পৃথক পঞ্চায়েতের অধীন) প্রতিটি গরিব পরিবারের কাছে পৌঁছানোর লাগাতার প্রচেষ্টা চলছে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা প্রয়োজন। একদিকে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক অন্যদিকে কৃষিমজুর। এদের সমস্যা ও চাহিদাগুলির মধ্যে যেমন সাদৃশ্য আছে তেমন পার্থক্যও আছে যথেষ্ট। সে কারণেই একদিকে এআইকেএম অন্যদিকে আয়ারলা — দু’টি সংগঠনেরই সদস্য সংগ্রহ চলছে। কর্মীর সংখ্যাবেশি নয়। ফলে প্রচারের সময়, পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। জুলাই মাসে আয়ারলার কাজেবেশি জোর দিয়েও, মাঝে মধ্যে এআইকেএমের সদস্যও করা হয়েছে। দু’টি কাজকে মেলানো সহজ নয়। তবুও স্থির হয়েছে, আগস্ট মাস জুড়ে এআইকেএমের কাজকেই অগ্রাধিকারে রাখা হবে। এই বোঝাপড়ায় ফসল উঠছে মন্দ নয়। দুটি গ্রামে আয়ারলার সদস্য হয়েছেন ৯৭৫ জন এবং কৃষক সংগঠনের সদস্য হয়েছেন ৪০০’র কিছুবেশি। অপর গ্রামটিতে খেতমজুর সদস্য হয়েছেন ১৭০ জন।
মানুষের উৎসাহ : শাসক দলগুলির বিরুদ্ধে গণআক্রোশ
গঞ্জ লাগোয়া একটি গ্রামে একটি গরিব বস্তি। এই বস্তিবাসীরা বছর পঞ্চাশ আগে এক ধনী ব্যক্তির বেশ কয়েক বিঘে পতিত জমিতে বাস করতেন। পরে ওই ব্যক্তি তাদের লম্বা এক ফালি জায়গায় সার সার ইটের ‘খুপরি’ ঘর তৈরি করে দিয়ে বাকি জায়গার দখল নেয়। সেই সব ইটের ঘর(?) এখন বসবাসের অযোগ্য। তাদের আবাসন সমস্যা নিয়ে বিডিও’র কাছে দরবার করা হবে। এই খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে লোকের মুখে মুখে। অন্য পাড়ার মানুষ এসেও আমাদের কর্মীদের ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের বাড়িতে। তুলে ধরছেন তাঁদের সমস্যার কথা। গ্রামে আমাদেরও ঘর হবে তো? আমার বিধবা ভাতাটা কীভাবে পাব বল তো? কর্মীরা উত্তর দেওয়ার আগেই, পাড়ার মেয়েরা উচ্ছল হয়ে বলে দিচ্ছেন, “সবাই মিলে বিডিও অফিস চলো”। আমাদের দীর্ঘদিনের কাজের এলাকা — এমন একটি গ্রামের একটি পাড়ায় অনেকদিন যাওয়া হয়নি। এবার সেখানে যেতেই, প্রায় গোটা পাড়ার গরিব মানুষ জড়ো হয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিলেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ওই গ্রামে টুকটাক বিজেপিও আছে। কিন্তু মানুষের চোখ মুখের ভাষা স্পষ্ট : পারবে, কেবল তোমরাই সব জঞ্জাল মুক্ত করতে।
প্রচেষ্টা চলছে। পান্ডুয়া ব্লকে আপাতত ১,৭০০ খেতমজুর সদস্য ও ৫০০ কৃষক সংগঠনের সদস্য হয়েছেন। শহরের কর্মীরাও গ্রামের কর্মীদের পাশে আসতে শুরু করেছেন। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা, স্বৈরাচার ও দুর্নীতিকে রুখে দেওয়ার দিশাকে কর্মীবাহিনীর সামনে ঠিক ঠিক বোঝানো গেলে গণসংযোগ অভিযানে নিশ্চিত গতি আসবে আগের থেকে বড় মাত্রায়।
- মুকুল কুমার
জলাশয়গুলিতে সরকারী উদ্যোগে পাম্পের জল সরবরাহের দাবি।
এই শ্রাবণেও বৈশাখের খরতাপ! নদীয়ার পাট চাষিরা সীমাহীন সংকটে। বৃষ্টিপাতের অভাবে ফলন কমে গেছে। এখন পাট ভেজানোর জল নেই। পুকুর-ডোবা প্রভৃতি জলাশয়গুলিতে পর্যাপ্ত জল নেই। যে কয়েকটি সীমিত পুকুর বা জলাশয় রয়েছে তাতে চলছে “সিরিয়াল”। অর্থাৎ সময় হয়ে গেলেও পাট কাটা যাচ্ছে না। লাইন অনুযায়ী একের পর এক চাষি “সিরিয়াল” মেনে পাট ভেজানোর সুযোগ পাবে৷ কে আগে সুযোগ পাবে তা নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা – বিশৃঙ্খলা। পঞ্চায়েত বা ব্লকের কৃষি দপ্তর হাতগুটিয়ে বসে আছে। এমনটাই এখন নদীয়া জেলার গ্রামাঞ্চলের চিত্র।
এই পরিস্থিতিতে সরকারী উদ্যোগে গ্রামের জলাশয়গুলোতে পাম্পের জল সরবরাহের দাবি তুলে ধরে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও তাদের কৃষক সংগঠন। গত ২৭ জুলাই এআইকেএম-এর পক্ষ থেকে এই মর্মে জেলাশাসকের দপ্তরে দাবিপত্র পেশ করা হয়। জেলাশাসক সেটাকে ব্লক আধিকারিকের কাছে সুপারিশ আকারে পাঠিয়ে দেয়।
এ বিষয়ে গত ৮ জুলাই কালীগঞ্জ ব্লকের বিডিওর কাছে ডেপুটেশনে দেয় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, সারা ভারত কিষাণ মহাসভা, ও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ। বিডিও তাঁদের আশ্বাস দেন, নির্দিষ্ট জলাশয় চিহ্নিত করে আবেদন জানালে এবং নিকটবর্তী আরএলআই বা পাম্প থাকলে সেগুলির সাহায্যে সরকারি খরচে জল সরবরাহ করা হবে। এ বিষয়ে ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চাষিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে ধরে সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে গ্রামাঞ্চলে মাইক প্রচার করে জানানো হয়।
৫ আগষ্ট বিপ্লবী কবি-সাংবাদিক সরোজ দত্তের ৫১তম শহীদ দিবসে এই প্রবাদপ্রতিম রাজনৈতিক নেতাকে স্মরণ করে মহকুমাশাসকের দপ্তরেই শহীদবেদীতে মাল্যদান করে জনগণের একগুচ্ছ দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি দেয় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিষ্ণুপুর লোকাল কমিটির সদস্যরা। গত একমাস ধরে বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে সমীক্ষা করেন তাঁরা। সমীক্ষার সময় পাড়ার লোকজনের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান এই অভিযানের ইতিবাচক দিক।
দাবিগুলো হল, রেশন কার্ডের সাথে আধার লিঙ্কের নামে কোনো গরিব মানুষের নাম বাদ দেওয়া চলবে না। বস্তিবাসী মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের শৌচকর্মের জন্য প্রতি বস্তিতে শৌচাগার নির্মাণ করতে হবে। বস্তিগুলির মধ্যে ছোট ছোট জলাশয় সংস্কার করে পাড় বাঁধাই সহ নিকাশি নালার সংস্কার করতে হবে। এছাড়া সাফাই কর্মীদের সরকার নির্ধারিত নুন্যতম মজুরি ও পুজো অনুদান দিতে হবে। অবিলম্বে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দুর্নীতির দ্রুত তদন্ত সহ বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে হবে।
ঐ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিষ্ণুপুর লোকাল কমিটির সদস্য দিলবার খান, সম্পাদক তিতাস গুপ্ত, রাজ্য কমিটি সদস্য ফারহান হোসেন খান প্রমুখ।
৫ আগস্ট হুগলির পান্ডুয়ায় বিডিও’র কাছে পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী (মিড-ডে-মিল) রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে গণডেপুটেশন দেওয়া হয়। এজন্য স্থানীয় রন্ধনকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেরা প্রচার করে নতুন নতুন স্কুলের কর্মীদের সামিল করেন। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য ব্যস্ত থাকায় বিডিও রন্ধন কর্মীদের বেশি সময় দিতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, আমি কি করতে পারি বলুন। উত্তরে বলা হয়, রন্ধনকর্মীদের দিয়ে স্কুলের শৌচালয় পরিষ্কার করানো হয়, যদিও সেটা তাঁদের কাজের মধ্যে পড়ে না, তাও আবার বিনা পারিশ্রমিকে। তার ওপর আছে ছাঁটাইয়ের হুমকি। এসব বন্ধ করতে হবে। স্কুলে রান্নার জন্য ড্রেস দিতে হবে এবং ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে রন্ধন কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য চেষ্টা করবেন। ভাতা বৃদ্ধি, সরকারি কর্মচারির স্বীকৃতি সহ পাঁচ দফা দাবি সম্পর্কে বলেন এগুলো ওপরে পাঠিয়ে দেবেন।
উৎসাহী কর্মীরা ব্যানার, প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে শ্নোগান দিতে দিতে মিছিল করে কর্মসূচি সমাপ্ত করেন। গোটা কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন ছবি টুডু, সম্বরি হাঁসদা, মমতাজ, সরস্বতী বেসরা, ময়না সরেন ও জেলা সভানেত্রী চৈতালি সেন।
সমস্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিঙ্গ সাম্যের লড়াইকে জোরদার কর
৭ই আগস্ট নারী স্বাধীনতা হরণকারী আরএসএস- বিজেপিকে পরাস্ত করুন-তৃণমূলের রাজত্বে দুর্নীতি, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোট বাঁধুন- এই স্লোগানকে সামনে রেখে খড়দহের রবীন্দ্রনাথ কমিউনিটি হলে ১০০ জন মহিলা প্রতিনিধির উপস্থিতিতে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ৭ম জেলা সম্মেলন সংগঠিত হল।
সম্মেলন মঞ্চের নামকরণ করা হয়েছিলো নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত রোকেয়ার নামে। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রাজ্য পর্যবেক্ষক কাজল দত্ত, আইপোয়ার রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত, এবং শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী কমরেড মীনা পাল।
শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও শহীদ-স্মরণের পর মেহুলি চক্রবর্তীর ‘এই আকাশে আমার মুক্তি’ গানের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে পরিচালনা করেন বিদায়ী জেলা সভাপতি জয়শ্রী দাস। শুরুতেই বিদায়ী রাজ্য সম্পাদিকা খসড়া প্রতিবেদন পড়ে শোনান। তিনি বলেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশজুড়ে যেভাবে সাধারণ মানুষের উপর হামলা নামিয়ে আনছে, একদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরির বেহাল অবস্থা অন্যদিকে চারিদিকে শুধু ঘৃণা বিদ্বেষের হাওয়া, এই রাজ্যেও দুর্নীতি-খুন-সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-তোলাবাজির পাশাপাশি বেড়েছে নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা। এর বিরুদ্ধে আইপোয়ার জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার কর্মসূচি, এবং মেয়েদের সমানাধিকার, স্বাধীনতার দাবিতে সংগঠনকে মজবুত করে তোলাই এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য।
পর্যবেক্ষক কাজল দত্ত তার বক্তব্যে রাখেন কিভাবে ১০০ দিনের কাজ থেকে শিক্ষা-চাকরি সমস্ত ক্ষেত্রে মেয়েদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
মীনা পাল বলেন, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের ধর্মের নানা বেড়ি পরিয়ে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি করে রাখতে চায়, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়ে আসছে মেয়েরা।
এরপর প্রতিনিধিরা নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। মিড ডে মিলের নেত্রী সুলেখা মন্ডল বলেন পরিবারের ভিতরে এবং কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে যেতে হয়।
শিখা গুহ রায়, বর্ষীয়ান কমরেড মৈত্রেয়ী বিশ্বাস, পুস্প দাস, রেজিয়া বিবি সহ অন্যান্য প্রতিনিধিদের বক্তব্য থেকে ১০০ দিনের কাজের মজুরি না পাওয়া, মিড ডে মিলের কর্মীদের প্রতি বঞ্চনা,অসম্মান, এবং পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে মেয়েদের দৈনন্দিন লড়াইয়ের কথা উঠে আসে।
সম্মেলনে আইপোয়ার রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত বলেন কেন্দ্র ওব্রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। সেনাবাহিনী থেকে ব্যাংক সর্বত্র চুক্তিভিত্তিক চাকরি দেবার কথা বলছে। তার বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চারিত হচ্ছে। অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে যুবক সম্প্রদায় পথে নেমেছে। ধর্মতলায় ৫০০ দিনের বেশি চলছে এসএসসি চাকরি প্রার্থীদের ধর্না। আমাদের মহিলা সংগঠন তাদের পাশে থেকে লড়াই করেছে। কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদী সরকার মেয়েদের সব অধিকার কেড়ে নিতে চায়, এরা বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়া আমাদের আশু কর্তব্য।
শেষ বক্তা মিতালি বিশ্বাস বলেন কোভিড কালে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন শ্রমজীবি নারী, যৌন কর্মী ও ট্রান্সজেন্ডার মেয়েরা. কিন্তু রোকেয়া থেকে প্রিতীলতা আমাদের শিক্ষা দেয় মেয়েরা অন্যায় বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জানে। আজ পর্যন্ত যা আইন হয়েছে মেয়েরা লড়াই করেই পেয়েছে। শাহীনবাগ থেকে দেউচা পাচামি সর্বত্র মেয়েরা লড়াইয়ের সামনের সারিতে। আগামীদিনেও আমাদের এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মেয়েদের অধিকারের উপর যে মৌলবাদী ও রাষ্ট্রীয় হামলা নেমে আসছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে জোরদার করতে, এবং এই রাজ্যে তৃনমূলের শাসনে যে ব্যপক দুর্নীতি , ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ঘটছে তার বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে, নারী শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, সম্মানজনক মজুরির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করার শপথ নেয় জেলা সম্মেলন কক্ষ।
জেলা সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতভাবে ৩১ জনের জেলা কাউন্সিল বডি ও ৭ জনের জেলা কমিটি তৈরি হয়। এবং সভানেত্রী পদে অর্চনা ঘটক, সম্পাদক পদে মিতালী বিশ্বাস ও কোষাধ্যক্ষ হিসাবে তিথি দত্ত নির্বাচিত হন।
যৌথ হকার মঞ্চের ডাকে দু’দিন ব্যাপী ৩-৪ আগস্ট অবস্থান হয় কলকাতা করপোরেশন অফিসের পাশে। ৩ তারিখ শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্নার কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। শেষদিন ৪ আগস্ট সমাবেশ হয়। সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্ব বক্তব্য রাখেন। বিশেষ বক্তা ছিলেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। এছাড়া বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ’র পক্ষে দিবাকর ভট্টাচার্য, আইএনটিইউসি’র পক্ষে অসিত দাস, টিইউসিসি’র পক্ষে প্রবীর ব্যানার্জি, এআইটিইউসি’র পক্ষে সঞ্জীব ব্যানার্জি প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন নিলকমল চক্রবর্তী (সিআইটিইউ)। সভায় উপস্থিত ছিলেন হকার সংগঠন বীরসূলহাট লেদার হকার্স ইউনিয়ন ও কলকাতা হকার্স ফেডারেশনের নেতা মহঃ রুস্তম, মহঃ সাহাবুদ্দিন, মহঃ কলিম, মহঃ সনু, সাদ্দার; অশোক সেনগুপ্ত, শীলা দে সরকার, স্বপন রায় চৌধুরী, সুনীল মন্ডল, খোকন ঘোষ প্রমুখ।
মূল যে দাবিগুলি তোলা হয়,
১) অবিলম্বে কেন্দ্রীয় হকার আইন চালু করতে হবে,
২) হকারদের লাইসেন্স ও সচিত্র পরিচয়পত্র দিতে হবে,
৩) টাউন ভেন্ডিং কমিটি গঠন করতে হবে,
৪) পুলিশ ও সমাজবিরোধীদের জুলুম বন্ধ করতে হবে,
৫) রাজ্য সরকারকে উৎসবের সময় কমপক্ষে ২,০০০ টাকা অনুদান দিতে হবে,
৭) হকাররা যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ১০,০০০ টাকা ঋণ পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিক মোদী সরকারের তল্পিবাহক না হলে সরকারের রোষে পড়াটা অবধারিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীর থেকে উত্তরপ্রদেশ থেকে জাতীয় রাজধানী দিল্লী, হেন রাজ্য নেই যেখানে সরকারের অন্যায় ও অপকীর্তি নিয়ে লেখালেখি করা সাংবাদিকরা সরকারের রক্তচক্ষুকে এড়াতে পেরেছেন। এরকমই এক সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান যিনি সরকারের সাম্প্রদায়িক বৈরিতাকে তুলে ধরে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোয় এক বছর দশ মাসেরও বেশি সময় ধরে জেলে রয়েছেন। তাঁর ওপর অভিযোগের বোঝা ক্রমেই আরও বেশি করে চেপে বসছে এবং আদালতের বিচারপতিরা তাঁর জামিন খারিজ করে চলেছেন।
ঠাকুর সম্প্রদায়ের যুবকদের হাতে হাথরসে দলিত তরুণীর ধর্ষণ ও মৃত্যুতে উদ্ভুত পরিস্থিতির খবর করতে হাথরস যাচ্ছিলেন কাপ্পান। কিন্তু ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর যোগী সরকারের পুলিশ তাঁকে মথুরায় গ্ৰেপ্তার করে এবং গাড়িতে থাকা তাঁর আরও তিন সঙ্গীকে — যাদের মধ্যে কেউ-কেউ বুঝিবা মুসলিম সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার সদস্য ছিলেন — জেলে পোরে। কাপ্পান কেরলের সাংবাদিক এবং কেরলের ইউনিয়ন অব ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস সংগঠনের দিল্লী শাখার সম্পাদক। তিনি যে তাঁর প্রতিবেদনগুলোতে সরকারের সংখ্যালঘু বিদ্বেষী মনোভাবকে ফাঁস করে দিতেন এবং মুসলিম বিরোধী অনাচারগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেন সে খবর সরকার এবং বিজেপির কাছে অজানা ছিল না। আর তাই হাথরস যাওয়ার পথে তাঁকে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হল যে, তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর জন্যই হাথরস যাচ্ছিলেন। পরে আরও অভিযোগ এনে বলা হয়, তিনি সন্ত্রাসবাদী কাজের জন্য অর্থ জোগাড় করছিলেন, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরিতা উস্কিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। ক্রমে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ইউএপিএ’র ধারা তাঁর ওপর চেপেছে এবং বিচারপতিরা তাঁর জামিন মঞ্জুরি থেকে হাত গুটিয়ে রাখলেন।
মথুরার আদালত ২০২১ সালের জুলাই মাসে কাপ্পানের জামিনের আবেদন খারিজ করেছিল। এবার আবার এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্ণৌ বেঞ্চের বিচারপতি কিসান পাহাল গত ৪ আগস্ট তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করলেন। আর তা করতে গিয়ে চার্জশিটে উল্লিখিত অভিযোগগুলোকে অমোঘ সত্য বলে জ্ঞান করলেন, অভিযোগগুলো কতটা যথার্থ তার বিচারে গেলেনই না। বিচারপতি তাঁর রায়ে বললেন, “আবেদনকারীর নিজের সমর্থনে করা একজন সাংবাদিক হওয়া এবং পেশার কাজের জন্যই হাথরসের অকুস্থলে যাওয়ার দাবি খারিজ হয়ে যাচ্ছে চার্জশিটে বিধৃত অভিযোগের প্রমাণ থেকে এবং তাঁর সঙ্গে গ্ৰেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের পরিচিতি থেকে।” এইভাবে কাপ্পানের মুসলিম পরিচিতি এবং পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার (পিএফআই) অনুষঙ্গকে প্রশাসন যেমন কাপ্পানের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগের মূল ভিত্তি করছে, আদালতও কাপ্পানের জামিনের আবেদন খারিজ করতে গিয়ে ঐ বিষয়টাকেই তাদের অবস্থানের কেন্দ্রীয় যুক্তি হিসাবে দাঁড় করাচ্ছে। কাপ্পানের সঙ্গে গাড়িতে থাকা সহযাত্রীরা পিএফআই’এর সদস্য হতে পারেন, কিন্তু সেটা তো সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের যোগের প্রমাণ হতে পারে না। পিএফআই রাষ্ট্রের মুসলিম বৈরিতা নিয়ে লড়াই করে ঠিকই, কিন্তু সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে তাদের যোগের কোনো তথ্য ও প্রমাণ নেই এবং সেটা কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়, তাছাড়া কাপ্পান নিজেও পিএফআই’এর সদস্য নন। এইভাবে একটা ভিত্তিহীন বিষয়কেই প্রশাসন কাপ্পানের বিরুদ্ধে তাদের অস্ত্র করেছে এবং আদালতও তারসঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করছে। মথুরা আদালতে কাপ্পানের হয়ে সওয়াল করা আইনজীবী মধুবন দত্ত চৌধুরী বলেছেন, “তিনি পিএফআই’এর সদস্য বলে প্রমাণ না থাকলেও, যে সংগঠনটা নিষিদ্ধ নয় — গোটা মামলাটাকেই দাঁড় করানো হয়েছে তাঁর পিএফআই সদস্য হওয়ার তথাকথিত পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে।”
ভারত ‘রেজিলিয়েন্ট ডেমোক্র্যাসিস স্টেটমেন্ট ২০২২’এ স্বাক্ষর করে গণতন্ত্রের প্রতি পৃষ্ঠপোষণের কথা জাহির করতে চেয়েছে বিশ্বের দরবারে। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সংবাদ জগতের উপর নেমেছে অভূতপূর্ব আক্রমণ — প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখে ফেলাটা অপরাধ হয়ে উঠছে, সত্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাটা প্রশাসনের শীর্ষস্তরে অনধিকার চর্চা বলে গণ্য হচ্ছে, সরকারের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করালে স্পর্ধা বলে বিবেচিত হচ্ছে, সরকার হুইসিল ব্লোয়ারদের তার বৈরি বলে জ্ঞান করছে। গোডি মিডিয়ার পাশে দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যমকে সরকার দুশমন বলেই সাব্যস্ত করছে। সংবাদ জগতের বিশ্বসূচকে ভারতের স্থান ক্রমেই আরও নিম্নগামী হয়ে ১৮০টা দেশের মধ্যে ১৫০তম যে হয়েছে, তা একেবারে অমূলক নয়। কেরল ইউনিয়ন অব ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস সংগঠনে কাপ্পানের সহকর্মীরা বলেছেন, তাঁরা কাপ্পানের জামিনের জন্য এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাবেন। কিন্তু মহম্মদ জুবেরের জামিন পাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি কি ঘটবে? বিচার বিভাগের বর্তমান হালচাল তাতে খুব একটা ভরসা জোগায় না।
সুপ্রীম কোর্টে বিচারপতি সঞ্জয় কিসাণ কাউল ও এমএম সুন্দ্রেশের ডিভিশন বেঞ্চ কোনো এক বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে গত ১১ জুলাই বলেন, তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে দিয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করে হাজতে বন্দী করে রাখা বন্ধ করা হোক। এই ধরণের গ্রেপ্তারি বস্তুত ঔপনিবেশিক মানসিক গড়ন ও পুলিশী রাষ্ট্র চলনকেই প্রতিফলিত করে। এই অনভিপ্রেত অতিসক্রিয়তা থামাতে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ করা হোক। তাছাড়া আগাম জামিন বা হেফাজতে থাকা অবস্থায় জামিন পাওয়া যাতে সহজ হয়, নতুন আইনে সেটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
বিচারপতি দুজন আরও বলেন, দেশের কারাগারগুলো বিচারাধীন বন্দীদের ভিড়ে গাদাগাদি হয়ে থাকছে। সমীক্ষা-পরিসংখ্যান বলছে, বন্দীদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি বিচারাধীন বন্দী। এদের অধিকাংশই কোনও মারাত্মক অপরাধী নন, দোষী সাব্যস্ত হলে বড়জোর পাঁচ-সাত বছর বা তার কম সাজা হলেও হতে পারে। এদের জেলবন্দী করে রাখার কোনও দরকার নেই, জামিনে রেখে বিচার চালানো যেতে পারে। এরা সব কেবল হতদরিদ্র নয়, অশিক্ষার শিকার, এদের মধ্যে মহিলা বন্দী রয়েছেন বেশ বড় সংখ্যায়। এরা হয়ত নানা কারণে নানা অপরাধ করে থাকবেন, কিন্তু এরা দেশের পক্ষে আদৌ বিপজ্জনক নন, এদের এভাবে বন্দী করে রাখা ঔপনিবেশিক আমলে ভারত শাসনের জুলুমকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। তাই এইসমস্ত বিচারাধীন বন্দীদের কারাগারের বাইরে জীবন কাটাতে দেওয়া হোক, সেই মতো আইন প্রণয়ন করা হোক।
(জাতিসঙ্ঘ ৯ আগস্টকে ‘বিশ্বের আদিবাসী জনগণের আন্তর্জাতিক দিবস’ বা জনপ্রিয় ভাষায় ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে ২০০৭ সালে, যদিও জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক স্তরে আদিবাসী জনগোষ্ঠিগুলির সম্মেলন শুরু হয়েছিল ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এ’বছর জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব আদিবাসী দিবসে চর্চার মূল বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেছে ‘ঐতিহ্যগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও প্রসারে আদিবাসী মহিলাদের ভূমিকা’। এই বিষয়বস্তুর ওপর চর্চার পটভূমি হিসেবে পড়ুন জাতিসঙ্ঘ প্রকাশিত প্রচারপত্রটির ভাষান্তর।)
আদিবাসী নারীরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মেরুদন্ড। বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্যগত জ্ঞানের সংরক্ষণ ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাঁরা। প্রাকৃতিক সম্পদের তত্ত্বাবধান ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের রক্ষণাবেক্ষণে তাঁরা যৌথভাবে ও সম্প্রদায়গতভাবে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেন। অনেক আদিবাসী মহিলা ভূমি ও এলাকা রক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের সম্মিলিত অধিকারের পক্ষে ওকালতি করছেন।
আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানের তাৎপর্য ব্যাপকভাবে স্বীকৃত, “আধুনিক বিজ্ঞানের বয়স অনেক কম। আধুনিক বিজ্ঞান বিকাশের অনেক আগে থেকে আদিবাসীরাই বিকশিত করেছে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় তা জানার উপায় এবং বেঁচে থাকার অর্থ, উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধ।” আদিবাসীদের উপর প্রস্তুত বিশেষ প্রতিবেদনটি ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ শব্দটির ব্যাখ্যায় ঐতিহ্যগত জ্ঞানকে সমসাময়িক ও গতিশীল হিসেবে এবং অন্যান্য ধরনের জ্ঞানের সমান মূল্যের বলে বর্ণনা করেছে।
জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) এবং অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞান পরিষদ (আইসিএসইউ)-এর যৌথ সহযোগিতায় প্রস্তুত আন্তর্জাতিক পরামর্শমালায় বলা হয়েছে, “প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়ার ইতিহাসে থাকা জনগণের জানাবোঝা, অনুশীলন, উপস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে ক্রমপ্রসারিত জ্ঞানই হল ঐতিহ্যগত জ্ঞান। বোধ, ব্যাখ্যা ও অর্থসৃষ্টির এই সুপরিশীলিত ধারা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যে সংস্কৃতির জটিল বুনটে গাঁথা থাকে ভাষা, নামকরণ ও শ্রেণীবিন্যাস ব্যবস্থা, সম্পদ ব্যবহারের প্রায়োগিক রূপ, আচারবিচার, আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি।”
যাই হোক, আদিবাসী মহিলারা তাঁদের সম্প্রদায়ে উপার্জনকারী, তত্ত্বাবধায়ক, জ্ঞান রক্ষাকারী, নেতা এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, তাঁরা প্রায়শই লিঙ্গ, শ্রেণী, জাতিগত এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে বহুস্তরীয় বৈষম্যের শিকার হন। তাঁদের স্বনিয়ন্ত্রণ, স্বশাসন এবং সম্পদ ও পাবারিক ভূসম্পত্তির ওপর তাঁদের অধিকার বহু শতাব্দী ধরে লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে।
সামান্য মাত্রায় হলেও কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে কিছু সম্প্রদায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসী নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। স্থানীয় ও জাতীয় স্তরে অনেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এবং তাঁদের জমি, তাঁদের সংস্কৃতি ও তাঁদের সম্প্রদায়কে রক্ষায় সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন। তবে, প্রকৃত বাস্তবতা হল, আদিবাসী মহিলারা একদমই কম প্রতিনিধিত্বে আছেন, তাঁদের হয়ে অন্যদের নেওয়া সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় তাঁদেরই, এবং বহুবিধ বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার বারবার তাঁদেরই হতে হয়।
গত ২৮ জুন কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত মন্ত্রক ( এমওইএফএসিসি) বন (সংরক্ষণ) আইন ১৯৮০-র অধীনে বন (সংরক্ষণ) বিধি ২০২২ এনেছে। পূর্বতন বন (সংরক্ষণ) বিধি ২০০৩ ও পরবর্তী ২০০৪, ২০১৪ ও ২০১৭-র সমস্ত সংশোধনীকে প্রতিস্থাপিত করে এই নতুন বিধির বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। অরণ্যের জমিকে পরিবর্তিত করে যে কোন বন-বহির্ভূত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হলে, কোনো প্রকল্পের জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে সংরক্ষণের আওতার বাইরে আনতে, বনের জমি লিজ দিতে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা বিশেষ অনুমোদন প্রয়োজন হয় যা মূলত দুটি পর্যায়ে প্রদান করা হয়, যথা ‘নীতিগত’ (ইন প্রিন্সিপল) স্টেজ ওয়ান অনুমোদন এবং ‘চূড়ান্ত’ (ফাইনাল) বা স্টেজ টু অনুমোদন। এর জন্য একটি অ্যাডভাইজারি বা উপদেষ্টা কমিটি, প্রতিটি সমন্বিত আঞ্চলিক অফিসে (ইন্টিগ্রেটেড রিজিওনাল অফিস) আঞ্চলিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিটি (রিজিওনাল এম্পাওয়ারড কমিটি) এবং প্রকল্প স্ক্রিনিং কমিটি (রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্রশাসন দ্বারা তৈরি) গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত, প্রস্তাবগুলি বনাঞ্চলের আয়তনের উপর নির্ভর করে এমওইএফএসিসি-র আঞ্চলিক বা রাজ্য কার্যালয় দ্বারা পরিচালিত হত এবং উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে মন্ত্রক অনুমোদন দিত, এখন প্রক্রিয়াটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূলত বনবিভাগের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত হবে।
রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্রশাসনের কাছে অনলাইনে জমা দেওয়া প্রকল্পের প্রস্তাবকের আবেদন বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হবে যেমন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, জেলা কালেক্টর, বন সংরক্ষক, প্রধান বন সংরক্ষক এবং রাজ্য সরকার বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের প্রশাসনের নোডাল অফিসার, প্রকল্প স্ক্রিনিং কমিটি, এবং সমন্বিত আঞ্চলিক অফিস। লিনিয়ার প্রজেক্ট (যেমন রাস্তা, রেল লাইন, পাইপলাইন ইত্যাদি), ৪০ হেক্টর পর্যন্ত বনভূমি বা ০.৭ ক্যানোপি ঘনত্বের বনভূমির ব্যবহার হবে এমন সমস্ত প্রকল্পের প্রস্তাবকে ‘দ্রুত’ নীতিগত অনুমোদন দিতে ইন্টিগ্রেটেড রিজিওনাল অফিসে (৫ হেক্টর পর্যন্ত বনভূমির ক্ষেত্রে) অথবা আঞ্চলিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিটির (৫-৪০ হেক্টর) কাছে পাঠানো হবে। কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটির হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হবে শুধুমাত্র ডিরিজার্ভেশন (সংরক্ষিত বনাঞ্চলকে সংরক্ষণের আওতার বাইরে আনতে), ৫ হেক্টরের বেশি বনভূমিতে খনি, বনের জমি দখল এবং আইন লঙ্ঘন সম্পর্কিত প্রকল্পগুলির জন্য। উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশ বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় সরকার, ‘নীতিগত’ অনুমোদন দেবে এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্রশাসনের কাছে তা জানিয়ে দেবে। ‘নীতিগত’ অনুমোদন পাওয়ার পর প্রকল্পের মালিক ‘কম্পেনসেটরি লেভি’ বা ক্ষতিপূরণমূলক শুল্ক প্রদান করবেন এবং ‘কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন’ বা ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজনের জন্য চিহ্নিত জমি হস্তান্তর করবেন। এই সমস্ত প্রামাণ্য তথ্যের রিপোর্ট পাওয়ার পরে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পে ‘চূড়ান্ত’ অনুমোদন দেবে এবং রাজ্য সরকার ও প্রকল্পের মালিককে তা জানিয়ে দেবে। প্রকল্পের ছাড়পত্র দেওয়ার আগে বনাধিকার আইন, ২০০৬ অনুযায়ী আদিবাসী এবং বনবাসীদের কাছ থেকে সম্মতি নেওয়ার অত্যাবশ্যকীয় শর্তকে এই নতুন বন (সংরক্ষণ) বিধি সরাসরি লঙ্ঘন করছে। বহু লড়াই ও আন্দোলনের মাধ্যমে অরণ্যের উপরে আদিবাসী-বনবাসী জনজাতির ঐতিহাসিক অধিকারের বিষয়টি ২০০৬ সালে বনাধিকার আইনের (এফআরএ ২০০৬) মাধ্যমে স্বীকৃত হয়েছিল। এই আইন অনুযায়ী, বনাঞ্চলের জমির চরিত্র বদল করে যেকোনো প্রকল্প চালু করার আগে গ্রাম সভার মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের আদিবাসী-বনবাসীদের অনুমোদন নেওয়া ও তাঁদের সুনির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা বাধ্যতামূলক। প্রস্তাবিত বন (সংরক্ষণ) বিধির ৯.৬.খ(২)পয়েন্ট স্পষ্টভাবে) বলা হয়েছে যে,
“The State Government or Union territory Administration, as the case may be, after receiving the ‘Final’ approval of the Central Government, and after fulfilment and compliance of the provisions of all other Acts and rules made thereunder, as applicable including ensuring settlement of rights under the Scheduled Tribes and Other Traditional Forest Dwellers (Recognition of Forest Rights) Act, 2006 (No. 2 of 2007), shall issue order for diversion, assignment of lease or dereservation, as the case may be.”
অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পের ‘চূড়ান্ত’ অনুমোদন দিয়ে দেওয়ার পরের ধাপে ‘বনাধিকার আইন’ প্রয়োগের উল্লেখ করা হয়েছে যা শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কিছুই নয়। যেখানে আগে থেকেই বনভূমি ব্যবহার তথা গাছ কাটার ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হবে, ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজনের জন্য জমি এবং প্রকল্পের মালিকদের থেকে নেট প্রেজেন্ট ভ্যালুর সমপরিমাণ অর্থ জমা করা হয়ে যাবে, তার পরে আর কীভাবে আদিবাসীদের ন্যায্য দাবি এবং অধিকার আদায় করা সম্ভব? বন অধিকারের নিষ্পত্তি এবং প্রকল্পের জন্য গ্রাম সভার সম্মতি যা আগে যেকোনো ছাড়পত্র দেওয়ার পূর্বশর্ত ছিল, এই নতুন বিধি বস্তুত তাকে এক লোক দেখানো ভড়ং এ পরিণত করল যেখানে বনভূমি হস্তান্তরের জন্য ছাড়পত্র কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক থেকে প্রাক-অনুমোদিত। এই বিধির বিজ্ঞপ্তিতে একবারের জন্যও কোথাও ‘গ্রামসভা’-র উল্লেখ পর্যন্ত নেই। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার বনাধিকার আইন মেনে তফসিলি উপজাতি এবং বনভূমির পরম্পরাগত বাসিন্দাদের অধিকার এবং ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার দায়ভারও অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শুধুমাত্র রাজ্য সরকারগুলির উপর চাপিয়ে দিল। কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো ‘চূড়ান্ত’ অনুমোদন হাতে নিয়ে রাজ্য সরকারের একজন আমলাকে বনের অধিকারের নিষ্পত্তি করতে বলা এক প্রহসন ছাড়া আদপে আর কিছুই নয়। কোনও প্রকল্পের ছাড়পত্র তথা অরণ্য ধ্বংসের অনুমতি দেওয়ার আগে গ্রাম সভাকে বিস্তারিত অবহিত করে তাঁদের স্বাধীন মতামত নেওয়ার পরিবর্তে এই নতুন বিধি তাদের অপ্রাসঙ্গিক এবং ক্ষমতাহীন করে তুলবে এবং অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থান তথা কর্পোরেটদের জন্য পথ প্রশস্ত হবে।
মোদী সরকার বহু দিন ধরে ‘ব্যবসা করা সহজতর’ করার নামে ইআইএ থেকে এফআরএ পর্যন্ত একের পর এক পরিবেশ ও বন বিধিগুলির উপর আক্রমণ নামিয়ে সেগুলিকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা করে চলেছে। ই আইএ প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেওয়া, লিনিয়ার প্রকল্পগুলির জন্য গ্রামসভা থেকে এনওসি এড়াতে এফআরএ-র একাধিক বার উলঙ্ঘন, 'নীতিগত’ বা প্রাথমিক পর্যায়ের অনুমোদন দেওয়ার আগে এফআরএ-র আওতায় গ্রাম সভার সম্মতি নেওয়ার প্রক্রিয়া চালানোর বদল তাকে ‘চূড়ান্ত পর্যায়ের অনুমোদন’-এর দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো অজস্র উদাহরণ আমরা এর আগে দেখেছি। একদিকে বেশিরভাগ পরিবেশ আইনগুলিকে ফাস্ট ট্র্যাক ও গতিশীল করার নামে লঘু করে দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে আইন লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির মাত্রা ক্রমশ কমিয়ে শুধুমাত্র কিছু জরিমানার ব্যবস্থা রেখে কর্পোরেট স্বার্থে পরিবেশ বিধি ভঙ্গকে একধরনের মান্যতা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পোশাকি ‘কম্পেনসেটরি লেভি’ বা ক্ষতিপূরণমূলক শুল্কের বিনিময়ে লোপাট হয়ে যাচ্ছে বন ও বন সংলগ্ন ব্যাপক জীববৈচিত্র যার প্রকৃত ক্ষতিপূরণ অসম্ভব। এমনকি ক্ষতিপূরণমূলক বন সৃজনের জন্য প্রয়োজনীয় জমির সমানুপাতিক অর্থমূল্য বা নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু-র পরিমাণ সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ সত্বেও ২০০৯ সাল থেকে ১৩ বছর ধরে প্রায় একই রকম ছিল, অবশেষে ২০২২-এর জানুয়ারি মাসে তা সামান্য বাড়ানো হয়। ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজন তহবিল আইন, ২০১৬ ও নির্দিষ্ট সময় অন্তর এনপিভি বাড়ানোর নিশ্চয়তা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। কোনও বাধা ছাড়াই বেসরকারি মালিকানার কাছে বনভূমি হস্তান্তরের লক্ষ্যে প্রক্রিয়াটিকে কম সময়বহুল করতে নতুন বন (সংরক্ষণ) বিধিতে বিভিন্ন ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজন প্রকল্প রয়েছে যা ‘উন্নয়নের’ নামে কেটে, উপড়ে, পুড়িয়ে ধ্বংস করা শতাব্দী প্রাচীন অরণ্যকে প্রতিস্থাপন করতে বাস্তবে অপারগ। এই বিধির মূল উদ্দেশ্য অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার নয় বরং কর্পোরেট হাঙরদের জন্য বনভূমি সহজলভ্য করে তোলা। ২০০৬-এর বনাধিকার আইন পরিবেশ সম্পৃক্ত আদিবাসী ও বনবাসী জনজাতির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জীবন-জীবিকা পরিবেশের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে জঙ্গল সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক ইনক্লুসিভ ও সামূহিক কাঠামো তৈরি করেছিল। এই আইনের বলেই গ্রাম সভার সিদ্ধান্তে ও গ্রামবাসীদের ব্যাপক আন্দোলনে হিমাচলের কিন্নর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, নিয়ামগিরিতে বেদান্ত-র বক্সাইট মাইনিং, পসকো-র স্টিল প্রজেক্টকে পিছু হঠতে হয়েছিল। তাই এখন আনা হল এমন এক বিধি যা বনের জমি অধিগ্রহণের পথে অন্তরায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এই শক্তিশালী হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে জঙ্গলের ব্যাপক প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ পদার্থ লুঠ করে মুনাফা কামানোর জন্য আদানি, আম্বানি, জিন্দাল আর বেদান্তদের জমির জোগান দেবে।
বন (সংরক্ষণ) বিধি, ২০২২ আসন্ন অধিবেশনে লোকসভা এবং রাজ্যসভার সামনে রাখা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের আনা এই বেআইনি বিধি যা কর্পোরেট স্বার্থে গ্রামসভাকে গুরুত্বহীন বানিয়ে বনের অধিকার লঙ্ঘন করে বন ও আদিবাসীদের বিপন্ন করবে, আসুন সর্বজনীনভাবে সমস্ত স্তরে রাস্তায় নেমে এর বিরোধিতা করি। সংসদে এই বিধি বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হই।
-- মধুরিমা বক্সী
বামফ্রন্ট সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল তখনও রাজ্য সরকারি কর্মচারি সমেত শিক্ষক শিক্ষাকর্মী ও সরকার পোষিত বিভিন্ন সংস্থার কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) দেওয়া হত না, যদিও সরকার স্বীকার করেছিল যে ওইসব কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়া হবে। সমহারে ডিএ দেওয়া না হলেও কেন্দ্রিয় হারে ডিএ দেওযার দায় স্বীকার করত রাজ্য সরকার। যেমন ০১/০১/২০০৮-এ কেন্দ্রিয় সরকার ডিএ দিত ১২% হারে রাজ্য সরকারের ডিএর হার ছিল শূন্য। ০১/২০১১ তে কেন্দ্রিয় ডিএ ৫১%, রাজ্য সরকারের ডিএ ৩৬%। ফলে তফাৎ ছিল। কিন্তু সরকার বলত না, ডিএ কর্মচারীদের অধিকার নয়। বছরে দুবার ডিএ ঘোষণা করা হত। কখনো কখনো তিনবারও, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তফাৎ দূর করার চেষ্টায়। যেমন, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে তিনবার করে ডিএ ঘোষণা করা হয়েছিল। তাছাড়াও ডিএ ঘোষণার ক্ষেত্রে কিস্তিগুলি কেন্দ্রিয় হারকে অনুসরণ করত। যে কিস্তিগুলি বাকি আছে তার মধ্যে সব থেকে পুরোনোটাকে আগে ঘোষণা করা হত। অতএব, বলা যেত রাজ্যে কটি কিস্তি ডিএ বাকি আছে। যেমন বামফ্রন্ট সরকার যখন চলে যাচ্ছে সেই সময়ে দু কিস্তি ডিএ বাকি ছিল, ১০% ও ৬ %।
তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার আগে ডিএ নিয়ে প্রবল আন্দোলন করত। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরেই ভোল পাল্টাল। প্রথমে আগের নিয়মে ১০% ডিএ দিল ক্ষমতায় আসার প্রায় ৮ মাস বাদে, ০১/০১/২০১২ থেকে, সেটা ধরে ওই দিনে ডিএর তফাৎ দাঁড়িয়েছিল ২০%। পরবর্তী ডিএ দেওয়া হল ১ বছর বাদে, ৭%, যদিও সব থেকে পুরোনো কিস্তিটা ছিল ৬%। ফলে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ তো লাটে উঠে ছিলোই। এবার তাকে অনুসরণও গোল্লায় গেল। তবে ওই দিন, ০১/০১/২০১৩ তে তফাৎ দাঁড়াল ২৮%। পরের বছর ০১/০১/২০১৪ তে দেওয়া হল ৬%, কেন্দ্রীয় হারের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য না রেখে। তফাৎ দাঁড়াল ৪২%। ০১/০১/২০১৫ তে ৭% ডিএর ফলে তফাৎ ওই সময় বেড়ে হল ৪৮%। পরের বছর তফাৎ হল ৫০%। এভাবে যেটা দাঁড়ালো সেটি হল ডিএর ক্ষেত্রে সার্বিক খামখেয়ালিপনা। বছরে ২বার তো নয়ই কেবল একবার ঘোষণা হতে লাগল। সেটিও কোনো নিয়ম মেনে নয়, কেন ৬ বা ৭ বা ১০ শতাংশ তার কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই।
কেন্দ্রের সপ্তম বেতন কমিশন ও রাজ্যের ষষ্ঠ বেতন কমিশনের পরে কেন্দ্রীয় সরকারের ডিএ বাড়তে বাড়তে নতুন বেতনক্রমের ৩৮%-এ পৌঁছেছে। রাজ্য সরকারের কর্মচারিদের ক্ষেত্রে তা রয়ে গেছে ৩%-এ। ফলে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৫%। যা পূর্বতন পঞ্চম বেতন কমিশনের মূল বেতনের হিসেবে প্রায় ৯৩%। ফলে বামফ্রন্ট আমলের শেষে যে সর্বোচ্চ ঘাটতি ছিল ১৭% হিসেবে সেই পরিমাণ তৃণমূল সরকারের আমলে এখন ৫.৫ গুণ হয়েছে। কেবল তাই নয়, দ্রব্যমূল্য যখন হুহু করে বাড়ছে তখন গত ০১/০১/২০২১এর পরে কোনো ডিএ ঘোষণা হয়নি, গত ১৯-২০ মাসে।
অপরদিকে ২০১৬ থেকে চলা স্যাটে আবেদন, আদালতে মামলা, সিঙ্গল বেঞ্চ, ডিভিশন বেঞ্চ, স্যাট, পুনরায় আদালত এই টানাপোড়েনের পরে গত ২০ মে বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন রায় দেন যে তিনমাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দিতে হবে। সেই সময় সীমা শেষ হতে দিন দশেক বাকি আছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে কোনো নির্দেশ তো দূরের কথা উচ্চবাচ্যও নেই। আদালত বলেছেন যে, সম্মানজনক জীবন যাপনের জন্য ডিএ আবশ্যিক। কিন্তু বর্তমান সরকার যে, কর্মচারীদের সম্মান নিয়ে মাথা ঘামায় না তা তাদের আদালতের যুক্তি ও ক্রিয়াকলাপেই পরিস্কার। আদালতে রাজ্য সরকার বলেছিল, ডিএ কর্মচারিদের অধিকার নয়। তাহলে, সরকারের মতে ডিএ সরকার অনুগ্রহ করে দেয়। তেমনটা অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য। অনেক দিয়েছি। আর চাইবেন না। থাকলে তো দেব। এসব কথা প্রশাসনের শীর্ষে থাকা কারুর মুখে মানায় না। ওই ডিএর বন্দোবস্ত করা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নিয়ম মেনে কিস্তি হিসেব করে ডিএ দেওয়া, বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দেওয়া, এগুলোর জন্য আর্থিক পরিকল্পনা ও রসদ যোগাড় করাও তাঁর সরকারের কাজ। অবিলম্বে রাজ্য সরকারকে কর্মচারিদের পাওনা ডিএ দিতে হবে।
- অমিত দাশগুপ্ত
‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ যখন শুরু হয়, তখন ইউরোপীয় রণাঙ্গনে সোভিয়েত রাশিয়া জার্মান আক্রমণের প্রেক্ষিতে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে এবং সমাজতন্ত্রের মাটিকে রক্ষার জন্য মরণপণ সংগ্রাম চালাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ বলে চিহ্নিত করে এবং ফ্যাসিবাদ নাজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ভূমিকা নেবার কথা বলে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর সোভিয়েত রাশিয়া উভয়েই তখন ফ্যাসিস্ট অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মতো ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে চলা আন্তর্জাতিক লড়াইকে দুর্বল করবে এবং তা গোটা দুনিয়ার ভবিষ্যতের পক্ষে ভয়াবহ হবে — এই বিশ্লেষণ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ থেকে দূরে সরে থাকে।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মতো আরো কিছু বামপন্থী দল — যেমন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বাধীন র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বিশ্বনাথ দুবে, শিশির রায়, প্রমোদ সেন, মনোরঞ্জন রায়, হাফিজ জালালউদ্দিন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক পার্টিও জনযুদ্ধ নীতির সমর্থক ছিল এবং তারাও ১৯৪২’র আন্দোলন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে অন্য অনেক বাম শক্তিই সক্রিয়ভাবে ১৯৪২’র ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনে’ সামিল হয়।
ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের আপসহীন শক্তি হিসেবে ১৯৪২’র আগে-পরে বরাবর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের জেল, মিথ্যা মামলা মোকদ্দমা ও অত্যাচার ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কমিউনিস্ট পার্টির সেই ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৪২ ছিল এক ব্যতিক্রম।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় রাজনীতির মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ১৯৪২এ কিছু দুর্বলতা থাকলেও বাংলার অন্যান্য বাম শক্তি এই আন্দোলনে সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দক্ষিণপন্থী শিবির ও প্রচার মাধ্যম গোটা স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের অসামান্য ভূমিকা বিষয়ে প্রায় নিশ্চুপ থেকে কেবল ১৯৪২’র অবস্থানকেই দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তেমনি এই ১৯৪২’র আন্দোলনেই কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্যান্য বামেদের সক্রিয় ভূমিকাকে আড়ালে রাখে।
সেই ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া, তার চর্চা ও প্রচার তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১) সোশালিস্ট পার্টির ভূমিকা
অবিভক্ত বাংলার বেশ কয়েকটি জেলায় সোশালিস্ট পার্টির সংগঠন ছিল। গুজরাতের সোশালিস্ট নেতা ছোটুভাই পুরানি বাংলায় গণআন্দোলনকে শক্তিশালী রূপ দিতে সোশালিস্ট সদস্য এবং কর্মীদের বোমা তৈরি ও অন্তর্ঘাতের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। বিশিষ্ট নেত্রী অরুণা আসফ আলিও কিছুদিন হাওড়া জেলার একটি গ্রামে আত্মগোপন করে থেকে রাজনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যান। সোশালিস্টদের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সফল অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্মগুলি চলতে থাকে। মেদিনীপুরে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ সবথেকে শক্তিশালী চেহারায় আত্মপ্রকাশ করেছিল। এইখানের সহিংস আন্দোলনে সোশালিস্ট পার্টির নেতা কর্মীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
২) ফরওয়ার্ড ব্লক নেতৃত্বের ভূমিকা
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় ফরওয়ার্ড ব্লক নিষিদ্ধ ছিল। দলের অনেক সদস্যই ছিলেন কারারুদ্ধ। তবে আত্মগোপন করে থাকা বহু কর্মী ও নেতা এই আন্দোলন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিশেষ করে মেদিনীপুরের গণসংগ্রামে তাঁদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ফরওয়ার্ড ব্লক নেতাদের মধ্যে ছিলেন জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, হেমচন্দ্র ঘোষ, সত্যরঞ্জন বক্সী, লীলা রায়, অনিল রায়, হেমন্ত বসু, পঞ্চানন চক্রবর্তী প্রমুখ। বিদেশ থেকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পাঠানো নির্দেশনা তাঁদের দিশা দিত, উদ্বুদ্ধ করত।
৩) রিভোলিউশনারি সোশালিস্ট পার্টি — আরএসপি’র ভূমিকা
আরএসপি তৈরি হয়েছিল বিপ্লবী দল ‘অনুশীলন সমিতি’ থেকে। অবিভক্ত বাংলার স্বরাষ্ট্র দপ্তরের গোপন প্রতিবেদনগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে কলকাতা, ঢাকা, ফরিদপুর, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন সহিংস চেহারা পেয়েছিল আরএসপি’র এইসব জায়গায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরুর আগেই এই দলের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু দলের অপেক্ষাকৃত তরুণেরা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। আরএসপি’র বহু কর্মী সমর্থক গ্রেপ্তার হন, নির্যাতন ভোগ করেন এবং শহীদ হন।
৪) রেভেলিউশনারি কমিউনিস্ট পার্টি বা আরসিপিআই’এর ভূমিকা
আরসিপিআই’র প্রধান নেতা ছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের তীব্র সমালোচক হলেও আরসিপিআই কমিউনিস্ট পার্টির জনযুদ্ধ কেন্দ্রিক ভাবনার প্রেক্ষিতে ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে সরে থাকার সিদ্ধান্তকে অন্যান্য বাম দলগুলির মতোই ভুল বলে মনে করেছিল। আরসিপিআই অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলেমিশে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আরসিপিআই তীব্র কংগ্রেস বিরোধী ছিল। তাও কংগ্রেস নেতৃত্বের ডাকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে কেন তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ তার ব্যাখ্যা দিয়ে আরসিপিআই নেতৃত্ব জানিয়েছিলেন যে ভারত ছাড়ো আন্দোলন জাতীয় কংগ্রেস আহূত হলেও তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণবিস্ফোরণের চেহারা পেয়েছে বলেই আরসিপিআই তাতে যোগ দিয়েছে। বিশেষ করে নদীয়া জেলায় আরসিপিআই’এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়।
৫) বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা বিএলপিআই
নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার ও তাঁর অনুগামীরা ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা ছিলেন ট্রটস্কিপন্থী চতুর্থ আন্তর্জাতিকের অংশ। বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টির জনযুদ্ধ তত্ত্বায়নের বিরোধী ছিল এবং তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করে। তাঁদের অভিমত ছিল বিশ্বযুদ্ধকে বিপ্লবী প্রয়োজনে ব্যবহার করা উচিত। জাতীয় কংগ্রেসের প্রবল বিরোধী হলেও আরসিপিআই’এর মতো তারাও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই দলটি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই বলশেভিক পার্টির মধ্যে ভাঙনের সূত্রে তৈরি হয়েছিল।
বলশেভিক পার্টিও কমিউনিস্ট পার্টির মতোই জনযুদ্ধ অবস্থান নেয় ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে। নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার ছিলেন বলশেভিক পার্টির অন্যতম নেতা। তিনি বলশেভিক পার্টির এই অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দিলে পার্টি তাঁকে বহিষ্কার করে। তখন তিনি বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া বা বিএলপিআই তৈরি করেন।
৬) কমিউনিস্ট কর্মীদের ভূমিকা
কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক লড়াইয়ের কারণে এই আন্দোলনে পার্টিগত সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকলেও অনেক কমিউনিস্ট কর্মী ব্যক্তিগতভাবে পার্টি সিদ্ধান্তের প্রতি সহমত ছিলেন না। অনেকেই সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।
সিপিআই’এর তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অরুণ বসু জানিয়েছেন তিনি ও প্রখ্যাত নেতা বঙ্কিম মুখার্জী এই আন্দোলন থেকে পার্টির দূরে থাকার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠের অবস্থান তাঁদের মতামত সে সময়ে খারিজ করে দিয়েছিল। ১৯৪৩’র মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছিল। ভবানী সেন’এর পেশ করা রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রতিবেদনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ‘সংগ্রামপন্থী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
পার্টির ওপরের স্তরের নেতারা সেভাবে এই আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই সক্রিয় হতে পারেননি। ১৯৪৩’র দুর্ভিক্ষের ত্রাণকার্যে তাঁরা সর্বতোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কমিউনিস্ট কর্মীরা কিন্তু বাংলার নানা জায়গায় ১৯৪২’র আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। জলপাইগুড়ি, বীরভূম, নদীয়া, ফরিদপুর, পাবনা ইত্যাদি জেলায় কমিউনিস্ট কর্মীদের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হবার কথা ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে। মালদহে কমিউনিস্ট কর্মীরা পিকেটিং ও বিক্ষোভে সামিল হন।
মেদিনীপুরে কমিউনিস্ট কর্মীরা ভালোমাত্রাতেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। এখানকার নেতৃবৃন্দের মধ্যে রবি মিত্র, ভূপাল পাণ্ডা, হরেন মিত্র আন্দোলনে যোগ দেন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বরিশালে বীরেন দাশগুপ্ত, নয়নারঞ্জন দাশগুপ্ত ও দিনাজপুরে শুচিন্দু চক্রবর্তীর মতো স্থানীয় স্তরের নেতারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
কমিউনিস্ট পার্টির মতো মুসলিম লীগও পার্টিগত সিদ্ধান্ত নিয়েই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেয়নি। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া অন্যান্য অনেক বামপন্থী দল যেমন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল ছিলেন, তেমনি কোনও কোনও মুসলিম সংগঠন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সামিল হবার কথা ঘোষণা করেন। এরমধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য জমিয়ত উল উলেমা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্টে তাঁদের সদস্যরা এই আন্দোলনে বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
- সৌভিক ঘোষাল
বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাদপ্রতীম যুগল কমরেড লেবাচাঁদ টুডু ও কুনি টুডু সহ আরো অনেক শহীদ কমরেডদের স্মরণে বৃষ্টি-বাদল মাথায় নিয়ে তিন শতাধিক মানুষের উপস্থিতিতে এক সমাবেশ হয় গোপীবল্লভপুরের কালাঝরিয়া মাঠে। মানুষের লড়াইয়ের লাল পতাকা উত্তোলন করেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল এবং আদিবাসী সমাজের অধিকার আন্দোলনের নিজস্ব সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন লেবাচাঁদ টুডুর দাদা ধর্মা টুডু। এরপর মঞ্চে রাখা লেবা চাঁদ টুডু, কুনি টুডু, সন্তোষ রাণা সহ তাঁদের সহযোদ্ধা প্রয়াত অন্যান্য কমরেডদের ছবিতে মাল্যদান করেন কার্তিক পাল, পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য তিতাস গুপ্ত, ফারহান হোসেন খান, তপন মুখার্জী, শৈলেন মাইতি, নবকুমার বিশ্বাস ও বাবলু ব্যানার্জি সহ সিপিআই(এমএল) পিসিসি-র শৈলেন ভট্টাচার্য, সারনা রিক্রিয়েশন ক্লাব সম্পাদক এবং সিপিআই(এম) ও ফরওয়ার্ড ব্লকের স্থানীয় নেতৃত্ব সহ এলাকার মানুষজন। নীরবতা পালনের পর শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন ঝাড়গ্রাম জেলায় পার্টির দায়ীত্বশীল কমরেড পিন্টু দে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে লেবাচাঁদ টুডু ও কুনি টুডুর স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখা হয়। পার্টির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কার্তিক পাল ও বাবলু ব্যানার্জি। তাঁরা বলেন, আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমিনের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করে দিতে চাইছে কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট সরকার। বনাধিকার আইনে সংশোধনের মাধ্যমেই বনের জমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এমনকি কর্পোরেটের হাতে বন-জঙ্গলকে তুলে দিয়ে সেখানে আদিবাসীদের চিরাচরিত ছাগল গরু চরানো এবং গাছের পাতা তোলার অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে, এতে মদত যোগাচ্ছে বিভিন্ন রঙের রাজ্য সরকার। তাই বর্তমানে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে সমস্ত ধরনের মানুষকে একত্রিত করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কমরেড লেবাচাঁদ টুডু গতবছর নভেম্বর মাসে আসানসোল কনভেনশনের মধ্য দিয়ে আমাদের পার্টিতে যোগ দেন। এবং আদিবাসীদের হাসা-ভাষা-লায় লাকচারের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চার কেন্দ্রীয় স্তরের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাই লেবাচাঁদ টুডু ও কুনি টুডুর যুগলবন্দীকে স্মরণ করার অর্থ এই যে, জল-জঙ্গল-জমিন রক্ষার লড়াইকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সাথে মিশিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই স্মরণসভায় উপস্থিত হয়ে নয়াগ্রাম বিধানসভার বিধায়ক চূড়ামণি মাহাতো বলেন, “গোপীবল্লভপুর সহ জঙ্গলমহলকে ভারতীয় রাজনীতির উপরমহলে তুলে এনেছিল লেবাচাঁদ টুডুদের আন্দোলন। তাঁকে স্মরণ করা মানে সরকারে কোন দল আছে তা বিবেচনা না করে বরং আদিবাসীদের অধিকারের দাবিতে একজোট হয়ে আন্দোলন সংগঠিত করা।”
এছাড়া বক্তব্য রাখেন সন্তোষ রাণার আত্মীয় শোভন পাল, সহযোদ্ধা শৈলেন ভট্টাচার্য, মোহন হাঁসদা, শম্ভু মাহাতো, ব্যাঙ্ক ইউনিয়নের নেতা নির্মল বারিক, সিপিআই(এম) ও ফরওয়ার্ড ব্লকের স্থানীয় নেতৃত্ব সহ অন্যান্যরা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন পৃথ্বীরঞ্জন দাশগুপ্ত (মেঘনাদ দা) এবং স্বর্ণলতা টুডু সহ নবকুমার বিশ্বাস। লেবাদাকে উদ্দেশ্য করে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন বেতার শিল্পী লখিরাম মুর্ম্মু ও জগদীশ প্রামাণিক। সমগ্র সভা পরিচালনা করেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য তপন মুখার্জী, সভাপতিত্ব করেন সারণা রিক্রিয়েশন ক্লাব সম্পাদক ভুবন সিং ও লক্ষণ টডু।
== 00 ==