আজকের দেশব্রতী : ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati_8-sept-22

movement in response to the agricultural crisis

কৃষকের স্বাধীনতা,গণতন্ত্র ও অধিকারের দাবি তুলে ধরে সংগঠিত হল সারা ভারত কিষাণ মহাসভার নবম রাজ্য সম্মেলন। ৩০ আগস্ট লাঙল চিহ্ন সম্বলিত লাল পতাকায় সুসজ্জিত কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনে এই সম্মেলন স্থলের নামকরণ করা হয়েছিল খাদ্য আন্দোলনের শহীদ আনন্দ হাইতের নামে, নদীয়ার বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের নেতা বিমান বিশ্বাস সভাগৃহ ও সুবিমল সেনগুপ্ত নামাঙ্কিত মঞ্চে।

“কোম্পানিরাজ হঠাও” স্লোগান সামনে রেখে সম্মেলনের প্রস্তাবনায় বলা হয় কৃষি সংকটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কৃষকদের দুর্বার আন্দোলন শাসকদের মোক্ষম জবাব দিয়েছে, এ পথেই এগিয়ে যেতে হবে।

এ রাজ্যে অসমাপ্ত ভূমিসংস্কারের পরবর্তীতে ক্ষুদ্র কৃষক অর্থনীতির বিকাশে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই, বরং শুরু হয়েছে এক উল্টোযাত্রা। দলে দলে বর্গাদার পাট্টাদাররা উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। জমির প্রজাস্বত্বের একটা বড়ো ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে৷ কৃষি জমিতে চুক্তিচাষের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। কৃষি উৎপাদনে অবদান তাদের থাকে বড় আকারে, অথচ এই গরিব চুক্তি-চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় বা তাদের সরকারি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নে সরকারের কোনো দায় রাখছে না। কয়েকটি জেলায় এদের সংগঠিত করে আন্দোলনে উদ্যোগ নেওয়ার অভিজ্ঞতার চর্চা সম্মেলনে উঠে আসে। জোরের সাথে ওঠে এদের সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি।

কৃষকের ফসলের দামে লুঠের কারবার সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে শাসকদলের মদতপুষ্ট সিন্ডিকেট দালালরা, যাদের টিকি বাঁধা রয়েছে কোম্পানির কাছে। এর সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, চাষাবাদের ধরনে পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত তীব্র সংকট। কৃষি উৎপাদনের খরচ সীমাহীন বেড়ে চলেছে, অথচ কৃষকরা ফসলের লাভজনক দাম পাচ্ছে না। যেমন প্রতি কুইন্টাল ধানে ৬০০-৭০০ টাকা চলে যাচ্ছে ধানকল মালিক, দালাল, শাসকদলের মাতব্বরদের পকেটে! কৃষক আন্দোলনের যুক্ত মঞ্চের পক্ষ থেকে এ রাজ্যে কৃষি পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে একটি আইন তৈরির দাবি জানানো হয়েছিল। এজন্য খসড়া বিল তৈরি করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু রাজ্য সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। এই বিষয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলার গুরুত্ব সম্মেলনে উঠে আসে।

এ রাজ্যে ধানের পরই প্রধান অর্থকরী ফসল আলু। এছাড়া নানাবিধ সব্জি, যার চাষাবাদ সম্প্রতি বেড়ে চলেছে, রাজ্য সরকার এ সমস্ত ফসলের সরকারি দর নির্ধারণ, সরকারের পক্ষ থেকে কেনা এবং ন্যায্যমূল্যের দোকানের মাধ্যমে বিক্রি করার উদ্যোগ নিতে পারত। এ জন্য ‘সুফল বাংলা’ নামে সরকারি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেটাকে ক্রমশ প্রায় উঠিয়েই দেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে, পরিবহণের কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে চলেছে। এ জন্য ব্লকে ব্লকে কিষাণ মান্ডি বা নিয়ন্ত্রিত বাজার তৈরি করা ও বহুমুখী হিমঘর স্থাপন করার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তার কোনো সরকারি প্রচেষ্টাই নেই। এই সমস্ত ইস্যু নিয়ে জেলায় জেলায় কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ও কিষাণ মহাসভার উদ্যোগে বেশ কিছু প্রচার ও আলোড়ন মূলক কর্মসূচির প্রসঙ্গ সম্মেলনে উঠে আসে।

এ বছর পাট চাষিরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে চাষ করেছে। বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে পাট ভেজানোর জল না থাকায় পাটের গুণমান এবং দাম নেমে গেছে। এ বছর অনেক বেশি পরিমাণ জমিতে পাটচাষ হলেও উৎপাদন মার খেয়েছে। এ প্রশ্নে সরকার চাষিদের কোনোরকম সহায়তা করেনি। গ্রামীণ জলাশয়গুলিতে সরকারি উদ্যোগে পাম্পের জল সরবরাহ করে পাট ভেজানোর ব্যবস্থা করার দাবিতে জেলা ও ব্লক দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়, কিন্তু সরকার উপেক্ষা করে। বাজারে পাটের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে বড় ব্যাবসায়ীরা। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার হাত গুটিয়ে বসে আছে। পাটের এমএসপি হওয়া উচিত ৮ হাজার টাকা কুইন্টাল, অথচ কেন্দ্রীয় সরকারি ঘোষণা হল ৪ হাজার ৭০০ টাকা! এই প্রশ্নে আন্দোলন গড়ে তোলার কর্মসূচি সম্মেলন গ্রহণ করে।

রাজ্য সরকার সমবায়ের মাধ্যমে স্বল্প দামে সার বীজ সরবরাহ করে বিশেষত গরিব-মাঝারি চাষিদের কিছুটা সুরাহা করতে পারে, কিন্তু এ সমস্ত কিছু এখন বন্ধ। পুঁজিবাদী চাষে প্রয়োজনীয় উপাদান হল পুঁজি। এ প্রশ্নে সমবায় একটা ভুমিকা নিতে পারতো। কিন্তু কৃষি সমবায়গুলির কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নেই, সীমাহীন দুর্নীতির আখরা হয়ে উঠেছে। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এ রাজ্যে কোটি কোটি টাকার সমবায় দুর্নীতি ধরা পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সারের চোরাকারবার চলছে প্রকাশ্যে। খোলা বাজারে এমআরপি বা বস্তার উপর ছাপানো দামের থেকে ২০০/২৫০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। সরকারি মদতেই এসব ঘটে চলেছে। সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে তৃণমূল সরকারের আদৌ কোন পরিকল্পনা নেই। ভূপৃষ্ঠ সেচ – নদী থেকে জল উত্তোলন প্রকল্পগুলি অর্ধেক বন্ধ। বিগত ১০ বছরে সেচের নতুন কোনো প্রকল্প হয়নি। এ বছর ক্যানেলের জল সরবরাহ না করার ফলে বেশ কিছু এলাকায় বোরো চাষ মার খেয়েছে। জলাধারগুলি সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা নেই। কৃষি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ মাশুলে ভর্তুকির দাবি দীর্ঘদিন ধরে তুলে ধরা হলেও সরকার তাতে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। অথচ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সরকার কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যুতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছে। এ সমস্ত প্রশ্নে ব্লকে ব্লকে প্রশাসনের কাছে বিক্ষোভ ডেপুটেশন ও এলাকায় এলাকায় প্রচার কর্মসূচিতে ভালো সাড়া পাওয়ার কথা সম্মেলনে উঠে আসে।

কৃষকের আয়বৃদ্ধির যে কল্পকথা সরকার প্রচার করে চলেছে তার বাস্তবতা নিয়ে সম্মেলনে পর্যালোচনা করে বলা হয় কৃষি পরিবারগুলির মোট আয়ের কতটা চাষাবাদ থেকে আসছে? আর কতটাই বা পারিবারিক শ্রমের মাধ্যমে নানাবিধ পশুপালন থেকে আসছে? কিংবা পরিযায়ী হিসাবে ভিন্ন রাজ্যে বা দেশে কাজ করতে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের আয় থেকে আসছে! সাদা চোখে বিষয়টা বিবেচনা করলে সহজেই বোঝা যায় চাষাবাদে আদৌ লাভ হচ্ছে না। কৃষি কাজে নিয়োজিত অত্যধিক মাত্রায় পারিবারিক শ্রমশক্তির দাম কোনোরকমে উঠছে বলা যেতে পারে। “কৃষক বন্ধু” নামে যে যৎসামান্য পরিমান খয়রাতি সাহায্য চাষিদের দেওয়া হচ্ছে সেটা তাদের লোকসান বা বঞ্চনাকে আদৌ পূরণ করতে পারছে না বরং প্রকারান্তরে এটা প্রমাণিত হয় যে সরকার চাষির লোকসানকে একপ্রকার মান্যতা দিতে বাধ্য হচ্ছে।

 a message to build the farmers' movement

সম্মেলনের শুরুতে পতাকা উত্তোলন করে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন এআইকেএম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং। তিনি বলেন, কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিয়ে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আইনে বদল এনে ভারতবর্ষকে একটি ক্ষুধার সাম্রাজ্যে পরিণত করার লক্ষ্যে আনা নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিরোধ সংগ্রাম একটি সফলতা। পরবর্তীতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত আইন থেকে শুরু করে চাল, গম সহ আরো ৪টি শস্য থেকে ইথানল বানানোর ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া, নয়া বিদ্যুৎ আইন, লখিমপুর খেরী কৃষক হত্যাকান্ডের বিচার এ সমস্ত প্রশ্নে মোদী সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে আরো সংগঠিতভাবে আন্দোলনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। কৃষকরা ফ্যাসিস্ট সরকারকে উচিত শিক্ষা দেবে। পশ্চিমবাংলা সহ বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা – যেখানে এমএসপির দাবিতে সংগ্রামের সম্ভাবনা রয়েছে সেখানেই আমাদের কৃষক আন্দোলনের পরিকল্পনা নেওয়া ও নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়াস চালাতে হবে। সর্বোপরি মোদী সরকার জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কৃষক-জনগণের সম্মতির দিকটি বাতিল করে দিতে চাইছে যা নজরুল-চারু-রবীন্দ্রনাথের মাটি বাংলার বুকে কখনোই মেনে নেওয়া যায় না, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এটা করতে চাইলে তা চলতে দেওয়া যাবে না।

স্বাক্ষরকারী নাগরিকদের পক্ষ থেকে সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন কৃষ্ণনগরের মানবাধিকার কর্মী তাপস চক্রবর্তী। সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ নেতা বাসুদেব বসু, এ্যাপোয়ার ইন্দ্রাণী দত্ত, আয়ারলার বাবলু ব্যানার্জী, উপস্থিত ছিলেন আরওয়াইএ-র রণজয় সেনগুপ্ত, আইসার শুভাশীষ, সায়ন্তন প্রমুখ। বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে বার্তা পাঠান, কিষাণ সভার পক্ষ থেকে বার্তা পাঠান অমল হালদার।

সম্মেলনে রাজ্যের ১৭টি জেলা থেকে ২৩০ জন প্রতিনিধি ও ৫০ জন গণ-আন্দোলনের কর্মী পর্যবেক্ষক রূপে অংশগ্রহণ করেন। বিগত দিনে দিল্লীর বুকে কিষাণ আন্দোলনের সংহতিতে এবং এ রাজ্যের দাবিগুলি যুক্ত করে প্রচার, পথ অবরোধ, সমাবেশ প্রভৃতি সংগঠিত হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য রাাখেন সংগঠনের সহসভাপতি কার্তিক পাল। সম্মেলন থেকে তিনটি আশু কর্মসূচি গৃহীত হয়। আগামী ২৩-২৪ সেপ্টেম্বর বিহারে এআইকেএম এর জাতীয় সম্মেলনের নির্ধারিত কাজগুলি সম্পন্ন করা। ইতিমধ্যে রাজ্যে ৪০ হাজারের কিছু বেশি গণ সদস্য সংগ্রহ হয়েছে, আরও ১০ হাজার সদস্য সংগ্রহের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, ব্লকে ব্লকে কমিটি কাঠামো তৈরি করা, আসন্ন আয়ারলার জাতীয় সম্মেলনকে সফল করে তোলার কাজে সহযোগিতা করা, গ্রামে গ্রামে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি গড়ে তোলা, আন্দোলন ও প্রচারমূলক কর্মসূচি নেওয়া, সর্বোপরি, গ্রামসংসদ সভা ডেকে পঞ্চায়েতকে হিসাব ও জবাবদিহি করতে হবে এই দাবি তোলা।

বিগত দিনে বিভিন্ন জেলায় কৃষক ও গ্রামীণ মেহনতিদের দাবিতে নানাবিধ আন্দোলন ও প্রচার কর্মসূচির কথা সম্মেলনে উঠে আসে। যথা, রাস্তায় ফসল ফেলে পথ অবরোধ, পঞ্চায়েত ঘেরাও, ফসলের দাম নিয়ে কৃষকদের মধ্যে জনশুনানি, কৃষি দপ্তরে বিক্ষোভ ডেপুটেশনের ফলে সারের কালোবাজারী বন্ধ করতে বাধ্য করা, আদিবাসী জনগণের জমির অধিকারের দাবিতে এলাকায় গরিব মানুষকে সামিল করা, উচ্ছেদের বিরুদ্ধে পুনর্বাসনের দাবিতে আইন অমান্য, রাস্তা অবরোধ, বনের জমি থেকে উচ্ছেদ রুখে দিয়ে সরকারী প্রকল্পের অধিকার আদায় ইত্যাদি ইতিবাচক উদ্যোগগুলি নিয়ে পর্যালোচনা ও বিতর্ক সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। জেলা ও ব্লকে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা ও সচল রাখার প্রশ্ন দুর্বলতা, আরও বেশি সংখ্যক কৃষকদের জমায়েত করা, আলোড়নমূলক কর্মসূচি নেওয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঘাটতির প্রসঙ্গ উঠে আসে। বাড়ি বাড়ি গণসংযোগ অভিযানে মানুষের ভালো সাড়া পাওয়া গেছে বলে সকলেই বলেন। ১২ দফা দাবিসনদ গৃহীত হয়। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন নীতীশ রায়, বাবুনি মজুমদার। পরিশেষে ৫৮ জনের রাজ্য কাউন্সিল ও ২৭ জনের রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়। নবনির্বাচিত রাজ্য সভাপতি হন অন্নদা প্রসাদ ভট্টাচার্য, রাজ্য সম্পাদক জয়তু দেশমুখ ৷

agricultural crisis

এআইকেএম সম্মেলনে প্রতিনিধিরা যা বললেন

দেশের অন্নদাতা কৃষকেরা পাঞ্জাবের মাটিতে কিম্বা দিল্লী সীমান্তে, হরিয়ানা ও মিরাট-বুলন্দশহরে জীবন বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে নাকখত দিতে বাধ্য করেছেন। সেই লড়াইয়ের ঝাঁঝ পশ্চিমবাংলার মাটিতে এখনও তীব্র হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ক্ষোভের বারুদ বাংলার ক্ষেতে-খামারেও যে মজুত হয়ে চলেছে তারই কিছু ঝলক দেখা গেল কৃষ্ণনগরে এআইকেএম’এর সদ্য সমাপ্ত রাজ্য সম্মেলনে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রতিনিধিরা উগড়ে দিলেন তাঁদের রোষের কথা, চিহ্নিত করলেন আগামী লড়াইয়ের দাবি ও সম্ভাবনাকে।

নদীয়ার এক বর্ষীয়ান কৃষক নেতা বললেন, “পলাশী চিনিকলটি দীর্ঘ প্রায় দশ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। খৈতান গোষ্ঠী মিল চালাবে বলে হাজার হাজার বিঘা সরকারি জমি নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিল। এক সময় ওই সমস্ত জমিতে বহু কৃষক আখ চাষ করে মিলে সাপ্লাই করত। খৈতান গোষ্ঠী পালিয়ে যাওয়ায় বহু শ্রমিক যেমন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তেমনি কৃষকদের উচ্ছেদ করে শাসকদলের মদতে কৃষি জমিতে বিল্ডিং ও রিসর্ট তৈরি হচ্ছে।” তাঁর প্রস্তাব, হয় ওই জমিতে চিনি কল আবার চালু করতে হবে নতুবা হাজার হাজার বিঘা সরকারি জমিতে অন্যান্য কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন করা হোক।

নদীয়ারই আর এক কৃষক বলেন, “চরমহৎপুর এলাকায় এক সময় পার্টি ও কৃষক সমিতি নদীচরের ৪০০ বিঘা জমি উদ্ধার করে গরিবদের বসতি স্থাপন করেছিলেন ও ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করেছিলেন। বাম আমলেই ওই জমি গ্রাস করার জন্য মাফিয়ারা সক্রিয় হয়। তৃণমূল আমলে তারা বসতি উচ্ছেদ করে দেয়। ভূমিহীন কৃষকদের চাষ করা জমির ধান তারা কেটে নিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। একজন কৃষক শহীদ হন। ওই জমি পুনরুদ্ধার ও গরিব কৃষকদের নামে রেকর্ড করানোর আইনি লড়াই চললেও জমি মাফিয়াদের তাড়িয়ে দিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এআইকেএম-কে দৃঢ়পণ উদ্যোগ নিতে হবে।”

পূর্ব বর্ধমান ও ঝাড়গ্রামের একাধিক প্রতিনিধি নদী ও খাল সংস্কারের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, “মজা নদীগুলি জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করলে নদীগুলির নাব্যতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে বর্ষায় বন্যা পরিস্থিতির হাত থেকে গ্রামগুলিকে যেমন বাঁচানো যাবে তেমনি খরার সময় সেচের ব্যবস্থাও সহজ হবে।” তাঁরা নির্দিষ্ট দাবি তোলেন, “অবিলম্বে অচল আরএলআই-এর পাম্পগুলিকে সচল করার জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে”।

বাঁকুড়া ও দার্জিলিং’এর প্রতিনিধিরা ফরেস্ট ল্যান্ডে (বনের জমি) যেসব আদিবাসীরা দীর্ঘদিন চাষ আবাদ করছেন তাদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র বন্ধ করে, তাদের পাট্টা দেওয়ার জন্য সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা রাজ্য সরকার কর্তৃক সস্তায় সার ও বীজ সরবরাহের দাবিও তুলে ধরেন।

মুর্শিদাবাদের এক প্রতিনিধি জানান, “আদানি গোষ্ঠী বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের বরাত পেয়েছে। এজন্য ফরাক্কা এলাকায় অতি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুতের টাওয়ার বসানো হচ্ছে। বহু গাছ কাটা পড়ছে। অনেককে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। আম, লিচু, ফলের বাগান সহ উদ্যান চাষ এই এলাকায় বিপর্যস্ত হচ্ছে।” এভাবে ওই এলাকায় কৃষক ও কৃষিজীবী মানুষের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার গুরুত্ব তিনি তুলে ধরেন।

হুগলীর এক গরিব আদিবাসী কৃষক চুক্তি চাষিদের সরকারি স্বীকৃতির দাবি জানালেন। তিনি বললেন, “ভূমিহীন গরিব চাষি জমির মালিকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল দেওয়ার শর্তে জমি ঠিকায় চাষ করেন। জমির মালিক একদিকে গরিবের কাছ থেকে ‘ভূমি খাজনা’ আদায় করে অন্যদিকে সরকারের ঘর থেকে ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের টাকা থেকে শুরু করে কৃষি ঋণের সুযোগ — সবই ভোগ করেন। সুতরাং গরিব ঠিকা চাষিকেও কৃষক হিসেবে নথিভুক্ত করে সরকারি ঋণ ও অর্থ সাহায্যের সুযোগ দিতে হবে।”

পূর্ব মেদিনীপুরের এক মৎস্যচাষি বলেন, “সরকার মৎস্যজীবীদের জন্য নানা সাহায্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার লক্ষ লক্ষ মৎস্যচাষির এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।” তিনি বলেন, “মৎস্যচাষিদের সস্তায় ঋণদান সহ একপ্রস্থ দাবিতে এআইকেএম’এর বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন”।

সবশেষে নদীয়ার এক প্রতিনিধি বলেন, “করতে হবে নয়, আমরা করেছি। তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা লাগাতার রুখে দাঁড়িয়েছি।” তুমুল হর্ষধ্বনির মাঝে তিনি ঘোষণা করেন, “গায়ের জোরে একদিন টিএমসি যে পঞ্চায়েতের দখল নিয়েছিল, এবার কৃষকদের মিলিত প্রতিরোধের ফলে সেই পঞ্চায়েত আবার লড়াকু জনগণ পুনরুদ্ধার করবে।” বলা বাহুল্য, এই প্রত্যয়ই ছিল সম্মেলনের সার নির্যাস।

- মুকুল কুমার

suicide 2020-2021 india

এনসিআরবি রিপোর্ট বলেছে ভারতে আত্মহত্যা ২০২০ ও ২০২১ পরপর দু’বছর বেড়েছে। প্রাক-কোভিড ২০১৯ সালের তুলনায় তার পরের দু’বছর আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি আড়াল করা যাচ্ছে না। আত্মহত্যার তথ্য ২০১৯-এ প্রাক-কোভিড বছরে ছিল ১ লক্ষ ৩৯ হাজার, পরের দু’বছরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ লক্ষ ৫৩ হাজার (২০২০) ও ১ লক্ষ ৬৪ হাজার (২০২১)। বেড়েছে ১৮ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা “হু” মন্তব্য করেছে ভারতে ১৯৬৭ সালের পর থেকে আত্মহত্যার এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড। ২০২০-২১-এ দু’বছরে এদেশে কোভিডে মৃত্যুর হিসাবও ছিল ভয়াবহ, প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষের মতো, যদিও তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব কোনদিন জানা যাবে না। কারণ সেভাবে তথ্য সংরক্ষিত করা হয়নি। তাছাড়া চাষিদের আত্মহত্যার ঘটনা ২০২০-তে ছিল ৫৭৭৯, ২০২১-এ ৫৩১৮, ২০২০-র তুলনায় ২০২১-এ কিছুটা হ্রাস পায়; কিন্তু সংখ্যাটা মোটেই নগণ্য নয়। কৃষিমজুর আত্মহত্যার সংখ্যা ২০২০-তে ছিল ৫০৯৮, ২০২১-এ দাঁড়ায় ৫৫৬৩, অর্থাৎ বেড়ে যায়। চাষি ও মজুর শ্রেণীর আত্মহত্যার যোগফল রীতিমতো উদ্বেগজনক। এরপরে রয়েছে স্বনিযুক্ত ও ক্ষুদে ব্যাপারী বর্গ, আত্মহত্যায় যাদের ভাগ ১২.০৩ শতাংশ, তারপরে ছাত্ররা, যাদের ভাগ ৮ শতাংশ।

শাসকশ্রেণীর প্রধান প্রতিনিধি মোদী সরকার আত্মহত্যার এই প্রবণতা বৃদ্ধির প্রবাহকে কোভিড ও কোভিড পরবর্তী নিষ্ঠুর আর্থ-সামাজিক কারণের প্রতিফল বলে স্বীকার করতে চায় না। আজও স্বীকার করে না যে সরকারপক্ষের চূড়ান্ত দায়িত্বহীন আচরণই ঐ হাজার হাজার মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অন্যতম মূল কারণ। তাই তাদের নিয়ন্ত্রিত এনসিআরবি উপরোক্ত তথ্য-পরিসংখ্যানকে উল্লেখ করেছে নিছক ‘দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও আত্মহত্যা’ উপশিরোনামে। কিন্তু কিছু অন্যান্য কারণ থাকলেও এর মূল কারণ থেকেছে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক দুর্দশায় – যে দুর্দশার কারণ হল জীবিকার সংকট, কর্মহীনতা, বেকারির জ্বালা, ঋণগ্রস্ততা; সব মিলে কূলকিনারা না পাওয়া সংকটাগ্রস্ত অবস্থা, যা কোনো দিশা না পেয়ে ডেকে আনে এমন এক অবসাদ যেখান থেকে ফেরা আর হয়ে ওঠে না। এর সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে মজুর ও চাষি শ্রেণী। আমাদের দেশে এখন শুধু সমস্ত নেতিবাচক দিকেই রেকর্ড হয়ে চলেছে। সার্বিক বেকারিতে সাড়ে চার দশকের রেকর্ড, চাষিদের উৎপাদন ও আয় সংকট, কৃষি থেকে পরিযায়ী সব ধরনের মজুরদের জীবিকা লোপাট ও মজুরি বঞ্চনা, ছাত্রসমাজের কাছে কর্মসংস্থানের অন্ধকার ভবিষ্যৎ, চাকরি বিক্রি হওয়ার সংকট, এখনও ব্যাপক অসংগঠিত ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার হতে না পারা – সব অংশে সবধরনের সংকটের রেকর্ড বেড়ে চলেছে।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহজী বলেছেন, ‘দেশের স্বার্থে’ বিজেপির আরও কয়েক দশক ক্ষমতার মসনদে থাকা দরকার! প্রধানমন্ত্রী মোদীজী বোঝাতে চাইছেন, স্বাধীনতার শতবর্ষের মধ্যে ভারত সমৃদ্ধির সেরা দেশ হয়ে উঠবে এবং বিজেপি সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিশা ও নেতৃত্ব দিচ্ছে! আর, নাগরিক জনতার প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দিচ্ছে বিজেপির মসনদে থাকার পরিণামে দেশ ক্রমশ বিপজ্জনক পাকচক্রে পর্যবসিত হচ্ছে, তারই এক নিকৃষ্টতর নির্দিষ্ট প্রকাশ হল আত্মহত্যার উপর্যূপরি পরিঘটনা বৃদ্ধি।

Meeting in Delhi

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এবং বিহারের মুখ‍্যমন্ত্রী দিল্লিতে সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। দেশে বিজেপির বুলডোজার রাজকে প্রতিহত করতে অবিলম্বে এক ব‍্যাপক ভিত্তিক ও গতিশীল ঐক‍্য গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দুই নেতৃত্ব আলোচনা করেন। বিহারের কিছু জ্বলন্ত ইস্যুও আলোচনায় উঠে আসে। বানোয়াট মামলায় জেলে পুরে রাখা রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন‍্য জরুরি ভিত্তিতে ঐক‍্যবদ্ধ উদ‍্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন তুলে ধরেন সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক।

বিহারে একটি অ-বিজেপি সরকার গঠন সঠিক দিকে একটা ধাপ এগোনো। বিজেপির ষড়যন্ত্রমূলক ও বিপর্যয়ের রাজনীতির বিপদ থেকে দেশকে রক্ষা করার দিশায়। এবং সংবিধান ও গণতন্ত্রের ওপর হামলার বিরুদ্ধে যে সকল শক্তি লড়ছে তাদের মাঝে নতুন আশা এনেছে। বিহারের জনতার প্রয়োজন ও প্রত‍্যাশা পূরণে সমন্বিত প্রচেষ্টা নেওয়া এবং গণতন্ত্র ও ভারত বাঁচাতে বিরোধীপক্ষের ঐক‍্যের এজেণ্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর দুই নেতৃত্বই জোর দেন।

সিপিআই(এমএল) দিল্লি রাজ‍্য সম্পাদক রবি রাই, এআইসিসাটিইউ সাধারণ সম্পাদক রাজীব ডিমরি ও এআইকেএম জাতীয় সম্পাদক পুরুষোত্তম শর্মা কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সাথে উপস্থিত ছিলেন। নীতীশ কুমারের সাথে ছিলেন বিহারের মন্ত্রী সঞ্জয় কুমার ঝা।

meeting of the Central Committee

বিজয়ওয়াড়ার এম বি বিজ্ঞানা কেন্দ্রমে গত ২৫-২৭ আগস্ট ২০২২ সিপিআই(এমএল) লিবারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। শুরুতে শহীদ ও প্রয়াত কমরেড ও অন্যান্য লড়াইয়ের সাথীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় — ভোজপুরের কমরেড কামতা প্রসাদ, বৈজনাথ প্রসাদ ও তাঁর পুত্র অজিত কুমার যাঁরা গত ১০ মে সামন্তী গুণ্ডাদের দ্বারা খুন হন, কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য অরূপ সেনগুপ্ত (দিনাজী), যিনি ১৯৮০’র দশকে চীনে যাওয়া পার্টির প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন, রাকেশ দিবাকর, ভোজপুরের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিক্ষক রাজেশ, তামিলনাড়ু রাজ্য কমিটির প্রাক্তন ও ত্রিচি জেলা লিডিং টিমের বর্তমান সদস্য মহেন্দ্রন, ঐ রাজ্যেরই মাণিকম, পুডুচেরীর ধাতচিনামুর্তি, ত্রিপুরার অনন্ত সুন্দরী জামাতিয়া ও হীরাবালা নাথ, কার্বি আংলঙয়ের সিং কিলিং, মোহেন বে ও রাজেন রংপি, দিল্লীর বালিচরণ রাম, শিলিগুড়ি লোকাল কমিটির সম্পাদক মোজাম্মেল হক, ১৯৭০ দশকের প্রথমার্ধে উঠে আসা নকশালপন্থী বর্ষীয়ান নেতা লেবাচাঁদ টুডু, পূর্ব চম্পারণের চৌরাদানোর জামুন পাসোয়ান, কৈমুরের বালিরাম প্রসাদ, নওয়াদার (আরা) দেবানন্দ প্রসাদ, ভোজপুরের রামনিহাল গুঞ্জন, আরওয়ালের নাগিয়া দেবী, ঝাড়খণ্ডের রামগড়ের সোহরাই বেদিয়া ও রামজী সিং, উত্তরপ্রদেশের বাবুরাম কুশোয়াহা ও ছাঙ্গুর গোন্দ, প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা ও কেন্দ্রাপাড়া জেলা কমিটির সদস্য অঞ্চল গিরি, ওড়িশায় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ভূতপূর্ব রাজ্য সম্পাদক ও তিনবারের সাংসদ শিবাজী পট্টনায়ক, সাতের দশকের প্রথমার্ধ থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বর্ষীয়ান সংগঠক শ্রীধর মিশ্র, বর্ষীয়ান কৃষক নেতা ও ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নে চৌধুরী মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের সহযোদ্ধা গুলাম মহম্মদ জৌলা, বিহারের প্রাক্তন বিধায়ক রামদেব ভার্মা যিনি ২০২০তে এই পার্টিতে যোগ দেন, কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সদস্য ও জনসংস্কৃতি মঞ্চের অসম রাজ্য সভাপতি হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর, অসমের ডঃ আব্দুল আজিজ আহমেদ, ইতিহাসবিদ দেবব্রত ব্যানার্জী, ১০ এপ্রিল ২০২২ ত্রিকুটে (দেওঘর) রোপওয়ে দুর্ঘটনায় নিহত মানুষজন, ১৫ মে ২০২২ দিল্লীর মানডাকা কারখানায় নিহত ২৭ জন শ্রমিক — এঁদের সকলের স্মৃতিতে নিবেদন করা হয়। দ্বিতীয় দিনে বৈঠক শুরুর সময়ে কমরেড বি বি পাণ্ডের প্রথম প্রয়াণ বার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে নীরবতা পালন করা হয়।

মূল মূল গৃহীত বিষয়গুলি হল —

১) সম্প্রতি রাজস্থানের একটি সরস্বতী বিদ্যামন্দিরে ‘জাতপাতের বিধিনিষেধ’ লঙ্ঘন করে দলিতদের জন্য নিষিদ্ধ পাত্র থেকে জল পান করার জন্য ৯ বছর বয়সী দলিত শিশু ইন্দ্র মেঘওয়ালকে একজন শিক্ষক নির্মমভাবে পিটিয়ে খুন করেছে এবং ২০০২’র গণহত্যার সময়ে বিলকিস বানোকে ধর্ষণ ও তাঁর পরিবারকে হত্যার অপরাধীদেরকে গুজরাট সরকার ছেড়ে দিয়েছে। এই দু’টি ঘটনায় কেন্দ্রীয় কমিটি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছে। কেন্দ্রীয় কমিটি ইন্দ্র মেঘওয়ালের হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠিন শাস্তি এবং সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন অন্তর ঘটে চলা রোহিত ভেমুলা থেকে ইন্দ্র মেঘওয়ালের মর্মান্তিক প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার মত সমস্ত দলিত-বিরোধী বিভাজন সম্পূর্ণরূপে নিকেশ করার দাবি জানাচ্ছে। বিলকিস বানোর ঘটনায় দোষীদের খালাস করার সিদ্ধান্তও প্রত্যাহারের দাবি করছে। এহসান জাফরি সহ গুলবার্গ সোসাইটির ঘটনার শিকার অন্যান্যদের ন্যায়বিচারের দাবিতে জাকিয়া জাফরির দাখিল করা পিটিশন খারিজ হয়ে যাওয়া ও তিস্তা শেতলবাদের গ্রেপ্তারির ঘটনার পরপরই বিলকিসের ধর্ষক ও তাঁর পরিবারের খুনে অভিযুক্তদের পুরস্কৃত করা হল। গুজরাট গণহত্যার সমস্ত চক্রীদের বেকসুর খালাস ও জামিনে মুক্তি এবং পুলিশ ও গোয়েন্দা আধিকারিক সঞ্জীব ভাট, আর বি শ্রীকুমার, মানবাধিকার কর্মী তিস্তা শেতলাবাদের মতো ন্যায়ের পক্ষে থাকা লড়াকু মানুষদের উপর নিপীড়ন ও গ্রেফতারি আসলে গুজরাট গণহত্যার ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে পদ্ধতিগতভাবে উলটোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ও নস্যাৎ করে দেওয়ার প্রয়াস। জাতপাতের নিপীড়ন ও ন্যায়বিচারকে হত্যা করার এইসব ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্তের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় কমিটি দেশজুড়ে শক্তিশালী প্রতিবাদের আহ্বান জানাচ্ছে।

২) বিহারের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিকাশ নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনা করেছে। বিহার রাজ্য কমিটি সঠিকভাবেই এই অবিজেপি সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এই সরকারকে কিছু ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি গ্রহণের ও তা বাস্তবায়নে তদারকির জন্য একটি সমন্বয়কারী কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। নতুন সরকারের তরফে অবশ্যই সমস্তরকম সাম্প্রদায়িক হিংসা ও জাতিগত নিপীড়নকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করে বিজেপি মডেলের শাসন প্রণালীকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা এবং নাগরিক সমাজ ও গণআন্দোলনগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। এই নতুন পরিস্থিতিতে একদিকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে ঘনীভূত করতে আর অন্যদিকে জনগণের কাছে রাখা সমস্ত প্রতিশ্রুতি পালনে এবং জনকল্যাণ ও মানুষের মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলোর উন্নততর বিলিবণ্টনের জন্য নতুন সরকারের উপর লাগাতার গণচাপ জারি রাখতে গোটা পার্টিকে চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হবে।

৩) লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি ও গণহারে বেকারত্ব জনগণের একটা বড় অংশকে গভীর সংকটে এনে ফেলেছে। সংঘ-বিজেপি শিবির এই গণক্ষোভকে তীব্র রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ দিয়ে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলোকে নড়বড়ে করে ফেলে দেওয়ার খেলা চলছে এবং ইডি, সিবিআই সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নিগ্রহ করার যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মহারাষ্ট্রের সরকার ফেলা ও বিহারের ক্ষমতা হারানোর পরে মোদী-শাহ জমানা ঝাড়খণ্ডের ক্ষমতা হাতাতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই প্রেক্ষিতে বিজেপির ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনমুখী উদ্যোগ অনেক বাড়িয়ে তোলা দরকার। একইসঙ্গে অবিজেপি দল শাসিত রাজ্যগুলোতেও জনগণের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোতেও আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিক্রিয়া জানানো প্রয়োজন। তৃণমূলস্তরে আমাদের পদক্ষেপ এবং গণপ্রতিবাদ ও আন্দোলনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টাই বিরোধী ঐক্যকে দানা বাঁধানোর ও জনগণের মধ্যে ২০২৪’র নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করার তাগিদ বাড়ানোর চাবিকাঠি হতে পারে। বিজেপির সর্বাত্মক বিরোধিতায় আমাদের সোচ্চার থাকা এবং জ্বলন্ত ইস্যগুলোতে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদই বিহারের রাজনৈতিক পালাবদলে ও বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সহায়ক হয়েছে।

৪) অন্যান্য লড়াকু শক্তি ও ভিন্ন স্বরের পাশাপাশি আমাদের কমরেডরাও বাড়তে থাকা দমনপীড়ন ও প্রতিহিংসার মুখোমুখি হচ্ছেন। পার্টির উত্তরপ্রদেশ রাজ্য কমিটির সদস্য ও ঐ রাজ্যের সীতাপুর জেলা পরিষদ সদস্য অর্জুন লাল তাঁর জেলা পরিষদ ক্ষেত্রের দলিত মানুষদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি করায় পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের মুখে পড়েছেন এবং বর্তমানে জেলে রয়েছেন। কর্ণাটক রাজ্য কমিটির সদস্য ও কোপ্পাল জেলা সম্পাদক সান্না হনুমান্থাও একটি খুনের মিথ্যা মামলায় জেলবন্দী রয়েছেন। অগ্নিপথ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হন বিহার রাজ্য কমিটির নবনির্বাচিত সদস্য তারিক আনোয়ার, তিনি সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটি কমরেডদের উপর এই নিপীড়নের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তাঁদের নিঃশর্ত মুক্তি ও সমস্ত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে।

৫) পাঞ্জাব, অসম, রাজস্থান, ওড়িশা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, পুডুচেরী ও পার্বত্য পার্টি কমিটির আসন্ন রাজ্য সম্মেলন এবং আরওয়াইএ, সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলা’র সর্বভারতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি রিপোর্ট পর্যালোচনা করেছে।

৬) পাটনায় আসন্ন একাদশ পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি বিষয়েও কেন্দ্রীয় কমিটি আলোচনা করেছে।

৭) কেন্দ্রীয় কমিটি দুঃখের সাথে কমরেড কবিতা কৃষ্ণানের অনুরোধে সম্মত হয়েছে। তিনি অনুরোধ করেন যে, তাঁকে পার্টি থেকে অব‍্যাহতি দেওয়া হোক যাতে তিনি স্বাধীনভাবে কিছু রাজনৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন, যে প্রশ্নগুলিকে তিনি সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন। পার্টিতে তাঁর দীর্ঘকাল সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সময়কালে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তাকে কেন্দ্রীয় কমিটি সমাদর করে এবং প্রত‍্যাশা করে যে আগামী দিনগুলিতে ভারতে গণতন্ত্র, ন‍্যায় ও সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে তিনি অবদান রেখে চলবেন।

৮) পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপত্র লিবারেশনের সম্পাদকমণ্ডলীর পুনর্গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে এই বোর্ডে সদস্যরা হলেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, অরিন্দম সেন, সঞ্জয় শর্মা, ভি শঙ্কর, ক্লিফটন ডি রোজারিও, সুচেতা দে ও অজিত পাটিল।

gouri_lankesh

সত্য, ন্যায় ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের শহীদ গৌরি লঙ্কেশ

৫ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর পঞ্চম শহীদ দিবস । ২০১৭ সালে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ঘাতকেরা। ফ্যাসিস্টদের গ্রাস থেকে ভারতের সংবিধান ও গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াইয়ে চিরপ্রেরণা হয়ে থাকবেন গৌরি লঙ্কেশ।

Lal Salam

ভদ্রেশ্বর তেলিনিপাড়ায় গঠিত হল এআইএসএ’র ইউনিট। যুগ্ম-সম্পাদিকা হলেন গুলশন আরা ও সাবানা খাতুন, সভাপতি শাহিন খাতুন।

২০২০-তে কোভিড লকডাউনের মধ্যেই হুগলি শিল্পাঞ্চলের নর্থ শ্যামনগর ও গোঁদলপাড়া জুটমিলের শ্রমিক কোয়ার্টার মহল্লাগুলোকে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর ল্যাবরেটরি বানিয়েছিল আরএসএস-বিজেপি। লকেট চ্যাটার্জী, অর্জুন সিং’রা বিজেপির গুন্ডাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদতদাতা হিসাবে একের পর এক সংখ্যালঘু শ্রমিক বসতি ভেঙে-চুরে, জ্বালিয়ে ছারখার করেছিল। আজ সেই ডিগবাজি বিশারদ দাঙ্গাবাজ অর্জুন ফের তৃণমূলে। এই তৃণমূল নাকি সংখ্যালঘুদের দরদী? উচ্চারণ করতেও লজ্জা হয় না মমতা ব্যানার্জির। অর্জুন সিংদের মত নামানুষরা গাছের এডাল থেকে ওডাল লাফাতে পারে। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ তার ঘামের জাত পাল্টায় না, তাতে কেবল মানুষের গন্ধটাই পাওয়া যায়। দাঙ্গার আগুনে সেদিন বইখাতা সহ মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের এডমিট কার্ড পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল তরান্নুম, সাহানা, তমান্নাদের, ভবিষ্যতের সবচেয়ে প্রথম ভিতটাই নড়ে গিয়েছিল। তাদের মহল্লার মানুষের পাশে দাঁড়াতে সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এআইএসএ, এআইসিসিটিইউ ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশন।

লকডাউনের মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল সাধারণ মানুষের জন্য। আইসা’র সাথীরা তারমধ্যেই পুলিশ, টিকিট চেকারদের সঙ্গে এই কামরা থেকে ঐ কামরায় লুকোচুরি খেলতে খেলতে বর্ধমান পৌঁছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের অফিসে পৌঁছে বার করে এনেছিল ডুপ্লিকেট এডমিট কার্ড, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, যাতে ওরা পরীক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারে। যদিও কোভিড পরিস্থিতির জটিলতা বাড়ায় সে পরীক্ষা আর হয়নি। এরপরে তাদের শিক্ষাসামগ্রী খাতা, পেন, ব্যাগ, জুতো, মহল্লার ছোট-বড় সব বয়সের মানুষের জন্যেই সাধ্যমত কিছু পোষাক পরিধান নিয়ে মহল্লায় নেমেছিল আইসা’র গোটা রাজ্য কমিটি। একবার সাহায্যের আবেদন করতেই গোটা রাজ্য থেকে আর্থিক সহযোগিতার অকুণ্ঠ হাত বাড়িয়েছিলেন সেদিন অজস্র কমরেড, বন্ধু ও সাধারণ মানুষ। শুধু কিছু জিনিসপত্রের সাহায্য নয়, দাঙ্গা পীড়িত মানুষের ন্যায়বিচারের দাবিতে সেদিন ভদ্রেশ্বর থানা, চন্দননগর এসডিও কোথায় না দৌড়েছিলেন শ্রমিক সংগঠনের সাথীরা। তৃণমূলের কোনো বড়-মেজো-সেজো নেতাকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। সেদিন তৃণমূলের একটা পার্টি অফিসও অবশ্য দাঙ্গাবাজ বাহিনীর হাতে ভাঙা পড়েছিল, কিন্তু কর্মীরা ছিল কোথায়? নিজের গা বাঁচাচ্ছিল নাকি আরো বড় কিছু পাওয়ার আশায় অর্জুন সিংয়ের মতোই পদ্মফুল খুঁজছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর লেখা রয়েছে আক্রান্ত মানুষের মনে। তাই আইসার হুগলি জেলার সংগঠক সৌরভ ইউনিট গঠনের সভায় আরও সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানাতেই ভরে উঠলো ঘর, ছড়িয়ে গেল বিশ্বাসের আর ভালোবাসার সুবাস। কথা হয়ে গেল নভেম্বরে ক্ষেতমজুরদের সর্বভারতীয় সম্মেলনে যতজন সম্ভব একসাথে ভলান্টিয়ার হওয়ার। মিটিং শেষ করে বেরোনোর সময়ে চমকে দিয়ে কমরেড রেশম, তবাস্যুমরা বলল, “দাদা একবার লাল সালাম হো যায়ে”। পাড়া মুখর করে ‘লাল সালাম’ শ্লোগানে মুষ্টিবদ্ধ হল এক ঝাঁক হাত।

Conference of AIARLA

৪ সেপ্টেম্বর বজবজ জেলা অফিসে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির দক্ষিণ ২৪ পরগণা ১ম জেলা সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিনিধি ছিলেন ৭৯ জন। ৪ জনের প্রেসিডিয়ামে ছিলেন ইন্দ্রজিৎ দত্ত, দেবযানী গোস্বামী, মমতাজ বিবি ও অনুপ সর্দার। শহীদ স্মরণের পর সম্মেলনের খসড়া প্রতিবেদন পাঠ করা হয়। এরপর রাজ্য পর্যবেক্ষক অজয় বসাকের বক্তব্যে, ১০০ দিনের কাজের বকেয়া মজুরি, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম ৩২৩ টাকা মজুরি লীজচাষি ও অনথীভুক্ত ভাগচাষির পরিচয় পত্র ও সরকারি সুযোগ দেওয়া, সর্বোপরি গরিব মানুষদের মর্যাদা দেওয়া, সংগঠনকে শক্তিশালী করে পঞ্চায়েত ও ব্লকে দাবি নিয়ে ডেপুটেশন দেওয়ার কথা উচ্চারিত হয়। খসড়ার উপর বক্তব্য রাখেন ১৪ জন। সবার প্রায় একই কথা — ১০০ দিনের কাজ, বকেয়া মজুরি, আবাস যোজনায় ঘর, প্রতিটি মানুষের হাতে জবকার্ড চাই। আয়ারলা সংগঠন সেই ৩১ মে করন্দা কৃষিমজুর গণহত্যার শহীদ দিবস থেকে জনসংযোগ অভিযান চালিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এখনো পর্যন্ত ৬,১০০ সদস্য সংগ্রহ করেছে। তিনটি ব্লকের মধ্যে কাছ চলছে। ঠাকুরপুকুর-মহেশতলা ব্লক, বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া ১ নম্বর ব্লক ও বজবজ ১ নম্বর ব্লকে। তৃণমূল সরকার বলছে প্রায় সব কাজ সারা হয়ে গেছে, কিন্তু এই ব্লকগুলোতে জনসংযোগ অভিযানে গিয়ে দেখা যাচ্ছে দরিদ্র মানুষের করুণ অবস্থা। তাসত্ত্বেও এই জমায়েত সম্ভব হয়েছে। এই সন্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত কিষাণ মহাসভার জেলা সম্পাদক দিলীপ পাল, সিপিআই(এমএল) জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা কাজল দত্ত, আরওয়াইএ-এআইসিসিটিইউ ও শহর লোকাল কমিটির সম্পাদকেরা।

১৩ জনের নতুন কমিটি গঠিত হয়। সম্পাদক নির্বাচিত হন ইন্দ্রজিৎ দত্ত ও সভানেত্রী হন দেবযানী গোস্বামী। নব নির্বাচিত সম্পাদক বলেন, আগামী দিনে আরও কাজের ক্ষেত্র বাড়িয়ে বড় ধরনের আন্দোলনে নামতে হবে। সামনে জাতীয় সন্মেলনের সদস্য ও দেয় অর্থ পূরণ করতে সংগঠনকে এগিয়ে যেতে হবে। সামনের বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে যাতে গরিব মেহনতি মানুষেরা দাঁড়াতে পারেন তার চেষ্টা চালাতে হবে এবং সব আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে গরিব মেহনতি মানুষের স্বার্থে। ডিসেম্বরে রাজ্য সন্মেলনের আগে মনরেগা মজদুর ইউনিয়ন গঠনের সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। আশাব্যাঞ্জক পরিকল্পনা নিয়ে সন্মেলনের কাজ শেষ হয়।

Progressive Women's Association

৪ সেপ্টেম্বর সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ৭ম হাওড়া জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় মধ্য হাওড়ার ঘোষপাড়া এলাকায়। পতাকা উত্তোলন করেন সমিতির নেত্রী সবিতা কোলে, শহীদদের স্মরণে মাল্যদান ও নীরবতা পালন করা হয়। শুরুতে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সুষমা মুখার্জী ও মাধব মুখার্জী। সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী। চন্দ্রাস্মিতা এবং রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রানী দত্তের বক্তব্য সম্মেলনকে প্রাণবন্ত করে। বক্তব্য রাখেন এআইএসএ’র হাওড়া জেলা সম্পাদক অঙ্কিত মজুমদার। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত তাঁর বক্তব্যে আশা প্রকাশ করেন যে আগামী দিনে সমিতি আরও শক্তিশালী হবে। সম্মেলনে আগত প্রতিনিধি সংখ্যা ছিল ষাটের ঊর্ধ্বে। উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৫ জন তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। সবশেষে ২৯ জন কাউন্সিল মেম্বার এবং ৯ জন একজিকিউটিভ মেম্বার নির্বাচিত হন। সমিতির সভানেত্রী নির্বাচিত হন সেরিনা সেখ, সহ-সভানেত্রী সবিতা কোলে, সম্পাদিকা পুনর্নির্বাচিত হন কল্যাণী গোস্বামী এবং সহ-সম্পাদিকা সুষমা মুখার্জি। অর্থ দপ্তরের দায়িত্বশীল নির্বাচিত হন অঞ্জনা মন্ডল। সম্মেলনের উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো। আগামী দিনে সমিতিকে শক্তিশালী করার সংকল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি হয়।

hundred days work and wages

গত ৩০ আগস্ট, কৃষিমজুর ও গ্রামীণ মজুরদের সংগঠন আয়ারলা’র পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল বিহারের রাজস্ব ও ভূমি সংস্কারক মন্ত্রী কুমার মেহেতা ও গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রী শ্রবণ কুমারের সাথে দেখা করে স্মারকলিপি দেয়। আয়ারলা সম্পাদক ধীরেন্দ্র ঝা বলেন, বিহারে জমির অভাব বা ভূমিহীনতা হল অন্যতম প্রধান সমস্যা। জন্মহার বৃদ্ধির কারণে বিহারের বহু মানুষ ঘরহীন-ভূমিহীন৷ পূর্বতন সরকারের আমলে যাদের কাছে বসত-ভিটার কাগজপত্র ছিল, তাদেরও নিজেদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এধরনের যথেচ্ছাচারের মাধ্যমে জনগণকে জমি-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

ভূমি সংস্কার মন্ত্রীকে প্রতিনিধিরা বলেন, সরকারি জমিতে বসবাসকারি গরিব মানুষের প্রত্যেকের ওপর সঠিক সমীক্ষা প্রয়োজন। সরকারকেই দায়িত্ব নিয়ে এরজন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। এই সমীক্ষায় সমাজের বুদ্ধিজীবী অংশ, দলিত, শ্রমিক ও গরিব শ্রেণী এবং গবেষকদের মধ্যে থেকে প্রতিনিধিদের রাখতে হবে। এদের সকলের উপস্থিতিতে সমগ্র সমীক্ষাটি চলবে। স্থান সমীক্ষায় আয়ারলা সর্বোতভাবে যুক্ত থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। যাদের কাছে জমির পাট্টা আছে, তাদের কোনওভাবেই উচ্ছেদ করা যাবে না — এই বিষয়টা সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে, একইসাথে এইসমস্ত পাট্টা বাতিলের ষড়যন্ত্র করা চলবে না। বেসরকারি জমিতে তৈরি বস্তিগুলো উচ্ছেদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হবে। অনেক গ্রাম পঞ্চায়েত এখন শহরের কর্পোরেশনের অংশ হয়েছে এবং অনেক ছোট চটি-বাজারকে পৌরসভার চেহারা দেওয়া হয়েছে। তাই শহরাঞ্চলেও বাসস্থানের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি বরাদ্দ করা প্রয়োজন। আদালতের একতরফা রায় রুখতে পাট্টাসহ জমি দখলকারীদের আইনি সহায়তা প্রদান করতে হবে।

গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রীর কাছে যেসমস্ত দাবি আয়ারলা নেতৃত্ব তুলে ধরেন, সেগুলো হল — খরার পরিপ্রেক্ষিতে এমএনআরইজিএ প্রকল্পের কাজ ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করতে হবে, এইবছর এই প্রকল্পের কাজ ১০০ দিন চালাতে হবে, প্রকল্পে নূন্যতম মজুরি বৃদ্ধি করতে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, প্রকল্পে কাজ দেয়না — এমন কর্মকর্তাদের বেতন থেকে বেকার ভাতা সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রকল্পের তদারকি করার কাউন্সিল গঠন করতে হবে, প্রয়োজনমতো কাজ ও সাপ্তাহিক অর্থ প্রদান সুনিশ্চিত করতে হবে, বিহার সরকারকে এই প্রকল্পের মজুরির সাথে ২৫ টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে, খাল-নদী-পুকুর-বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও সংস্কার করাকে প্রকল্পের কাজের সাথে যুক্ত করতে হবে, ৬০ বছরের বেশি বয়সী প্রকল্প কর্মীদের ৩০,০০০ টাকা বেতন সুনিশ্চিত করতে হবে।

আগামীদিনে আয়ারলা বিহার জুড়ে ‘দরিদ্র পুনর্বাসন’ অভিযান করবে।

protests in Kerala

কেরলের রাজধানী তিরুবনন্তপুরমের ২০ কিমি দক্ষিণে ভিজিনযাম শহরে নির্মীয়মান সমুদ্র বন্দরের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদ তীব্রতর হয়ে উঠছে। বন্দরটি নির্মাণ করছে আদানি গোষ্ঠী। এই বন্দর নির্মাণের পরিণামে বেশ কয়েকটা সৈকত বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বহু ঘর সমুদ্র গর্ভে তলিয়ে গেছে, বহু জেলের জীবিকা ধ্বংস হয়েছে, এফসিআই’এর পড়ে থাকা গুদামকে ত্রাণ শিবিরে পরিণত করে সেখানে ঘর হারানো মানুষদের রাখা হয়েছে। বন্দরটি নির্মাণের কাজ অবিলম্বে বন্ধের এবং পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দাবি এতটাই জোরালো হচ্ছে যে তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কেরলের সিপিএম নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষতিগ্ৰস্ত মৎসজীবী ও উপকূলবাসীদের কিছু দাবি মেনে নিলেও বন্দর নির্মাণ বন্ধের দাবি কখনই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে।

বন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়া সচল হয় ২০১৫ সালে, যে বছরের আগস্ট মাসে ওমান চাণ্ডির কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে আদানি ভিজিনযাম পোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড’এর ৭,৫২৫ কোটি টাকার পিপিপি মডেলের চুক্তি হয়। ঐ বছরের ডিসেম্বরেই শুরু হয় বন্দর নির্মাণের কাজ এবং কাজ শেষ হয়ে বন্দর চালু হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালে। কিন্তু নানা কারণে নির্মাণ কাজ গতি লাভ করেনি এবং আনুমানিক হিসাব হল নির্মাণ কাজ অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু কাজ যতটা এগিয়েছে তাতেই সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাস করা মানুষদের জীবন-জীবিকায় ক্ষতির প্রভাব যথেষ্ট বলে সুস্পষ্ট হয়েছে। সৈকত-গ্ৰাম-ঘরবাড়ি সমুদ্র গর্ভে চলে যাওয়ার কারণ বলে চিহ্নিত হচ্ছে ব্রেকওয়াটার’এর নির্মাণ। ব্রেকওয়াটার হল সমুদ্রের ঢেউ’এর আঘাত থেকে জাহাজগুলোকে রক্ষার জন্য সমুদ্র বক্ষে নির্মিত পাথরের প্রাচীর (যার নির্মাণ কিছুটা হয়েছে এবং কিছুটা নির্মাণ এখনও বাকি)। এই প্রাচীরের নির্মাণ সমুদ্র স্রোত এবং বায়ু প্রবাহের ধারাকে পাল্টে অনেক বেশি গতিশীল করেছে এবং সমুদ্রের ঢেউ অনেক বেগবান হয়ে আছড়ে পড়ে সৈকতের বেলাভূমি এবং ঘরবাড়ির সলিল সমাধি ঘটাচ্ছে। জেলেরা জীবিকা হারাচ্ছেন এবং ঢেউয়ের তীব্রতায় মৎসজীবীদের নৌকা উল্টে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। বন্দর নির্মাণ থেকে ঘটা বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়ে স্থানীয় জনগণ এবছরের ১৬ আগস্ট থেকে সংগঠিত প্রতিবাদ শুরু করেছেন (অবশ্য, প্রকল্প উপকূলের মানুষের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চলেছে আঁচ করে কেউ-কেউ শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে এসেছেন, যেমন, এনজিও ‘কোস্টাল ওয়াচ’)। তাঁরা দিন-রাত ধর্ণা সংগঠিত করেছেন, বন্দরস্থল ঘেরাও করেছেন, আদানির কুশপুতুল পুড়িয়েছেন, বন্দর নির্মাণের কাজ বন্ধের দাবিকে জোরদার করেছেন। এইসব প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছে ল্যাটিন ক্যাথলিক চার্চ। প্রতিবাদ তীব্রতা লাভ করায় বিজয়ন সরকার প্রতিবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিবাদীরা সরকারের কাছে যে দাবিগুলো রেখেছেন সেগুলো হল –

  • ১) পরিবেশের ওপর বন্দর নির্মাণের প্রভাব নিয়ে নতুন সমীক্ষা করতে হবে এবং সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত নির্মাণ কাজকে বন্ধ রাখতে হবে।
  • ২) ক্ষতিগ্ৰস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ৩) সমুদ্র উপকূলের ক্ষয় রোধে ফলদায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • ৪) ঝড়ঝাপটার সম্ভাবনায় যে দিনগুলোতে মাছ ধরতে যাওয়া বারণ থাকবে, সেই দিনগুলোর জন্য জেলেদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
  • ৫) মাছ ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়া জেলেদের পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
  • ৬) ভর্তুকিতে যথেষ্ট পরিমাণ কেরোসিন দিতে হবে।
  • ৭) সমুদ্রবক্ষে খননের ফলে তিরুবনন্তপুরম জেলার মুথালাপ্পোঝি মাছ ধরার বন্দরটির ক্ষতি হচ্ছে এবং তার সুরক্ষার ফলদায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় সরকার এক নম্বর দাবিটি মানা, অর্থাৎ, বন্দর নির্মাণের কাজ বন্ধ করা কখনোই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন বলেছেন, “ভিজিনযাম বন্দরের নির্মাণ কাজ বন্ধের বিবেচনা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। কাজ করতে গেলে সমস্যা আসবে। এই ধরনের প্রকল্পে ঐরকম সমস্যা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ঐ সমস্যাগুলোর মোকাবিলায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটাই আসল ব্যাপার।” সমস্যাটাকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এবং উপকূলের মানুষের ক্ষয়ক্ষতিকে তার যথার্থ মাত্রায় অনুধাবন করার পরিবর্তে বিজয়ন সরকারের দেওয়া কিছু সহায়তাকে গ্ৰহণ করে আন্দোলনরত জনগণকে সন্তুষ্ট থাকার কথা বললেন। এছাড়া, ছ’নম্বর দাবি, অর্থাৎ, ভর্তুকিতে কেরোসিন তেল দেওয়ার দাবি মানতেও সরকার অস্বীকার করেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জেলেরা যে নৌকোয় সমুদ্রে মাছ ধরতে যান, সেই সমস্ত নৌকোর ইঞ্জিন কেরোসিন তেলে চলে। কেরল সরকার মৎসজীবী নৌকোর মালিককে ৯৩ টাকা লিটার দরে প্রতি মাসে ১২০ লিটার কেরোসিন দেয়। কিন্তু মৎসজীবীদের দাবি, তামিলনাড়ুর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সরকারকে ২৫ টাকা লিটার দরে ৩০০ লিটার কেরোসিন নৌকোর মালিককে প্রতি মাসে দিতে হবে। কিন্তু তামিলনাড়ুর দৃষ্টান্ত অনুসরণের কোনো আগ্ৰহ বিজয়ন সরকার দেখায়নি।

কেরল সরকারের মৎসমন্ত্রী ভি আবদুরাহিমান ১৯ আগস্ট আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, যাঁরা ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন, সরকার ওনাম উৎসব শুরুর আগে (আগস্টের শেষে যার শুরু) তাঁদের ভাড়াবাড়িতে স্থানান্তরিত করবে এবং ভাড়ার জন্য প্রতি পরিবারকে মাসে ১৫,০০০ টাকা করে দেওয়া হবে। কিন্তু পরে সরকার সেই প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে এসে ভাড়ার পরিমাণকে ১৫,০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩,০০০ টাকা করে। আন্দোলনকারীরা এটা মানতে অস্বীকার করেছেন। এছাড়া, বিজয়ন সরকারের মন্ত্রীসভার সাবকমিটি ২২ আগস্ট সিদ্ধান্ত নেয় যে, সরকার ১০ একর জমি নির্দিষ্ট করে তাতে ৩,০০০ ফ্ল্যাট বানাবে এবং সেই সব ফ্ল্যাটে বন্দর নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে। সরকার এই প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করে তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে।

ভিজিনযাম বন্দর প্রকল্প পরিবেশের ওপর, বিশেষভাবে উপকূল অঞ্চলের জনগণের জীবন-জীবিকার ওপর কী প্রভাব সৃষ্টি করবে তার একটা মূল্যায়ন বন্দর নির্মাণ শুরুর আগেই হয়েছিল। এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ও আর্থিক বলে বলীয়ান শিল্পপতি আদানি অনায়াসেই পরিবেশের ছাড়পত্র পেয়ে যান। আজ যখন প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হচ্ছে, ব্রেকওয়াটার বা সমুদ্রবক্ষে প্রাচীর নির্মাণের ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ আর থাকছেনা, তখনও পরিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে নতুন করে মূল্যায়নে কি নির্মাতা আদানি, কি সরকার কেউই রাজি নয়। সহায়-সম্বলহীন দরিদ্র জেলেদের, উপকূলবাসীর যন্ত্রণা ও অস্তিত্ব সংকট নিয়ে ভাবনাচিন্তা এখন বিলাসিতা বলেই বিবেচ্য হয়। সরকার এবং আদানি বলবে — এটা ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প যা মানুষের জীবনধারাকে পাল্টে দেবে, প্রকল্প হবে উন্নতির দূত। আর ঘরবাড়ি হারিয়ে বসতভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া, উন্নয়নের নিমিত্তে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া মানুষরা রাষ্ট্রের চোখে অকিঞ্চিৎকর-অধিকারহীন-উপেক্ষণীয় বলেই গণ্য হতে থাকবেন!

mid day
শুরু হল উত্তর ২৪ পরগণা জেলা রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের ব্লক ডেপুটেশন কর্মসূচী। ৭ সেপ্টেম্বর হাবরা ১ নং বিডিও দফতরে।
leader arrested in Nadia

সিঙ্গুর আন্দোলনের দৌলতে ক্ষমতায় যাওয়া তৃণমূল সরকার সেই আন্দোলনের সময়কালে দায়ের করা মিথ্যা মামলা আজও প্রত্যাহার করেনি! সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটির সদস্য জীবন কবিরাজ ২০০৮ সালে সিঙ্গুর আন্দোলনের সমর্থনে বাংলা বনধের প্রচার করার সময় তাহেরপুরে বামফ্রন্টের হামলার সন্মুখীন হয়েছিলেন। পুলিশ তাঁকে এবং আরও কয়েকজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা মামলা দেয়। পরবর্তী কালে তৃণমূল সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই সব মিথ্যা মামলা তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু গত ২৯ আগস্ট রাতে জীবন কবিরাজকে তাঁর তাহেরপুরের বাসগৃহ থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে রানাঘাট আদালতে নিয়ে যায়। পরদিন তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন তীব্র বিরোধিতা করছে তৃণমূল সরকারের এই দ্বিচারিতার, এবং দাবি জানাচ্ছে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন করার জন্য দায়ের করা সমস্ত মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করার। গণতন্ত্রের কথা বলে ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের স্বৈরাচারী আচরণ আজ প্রকট হয়ে উঠেছে। গণআন্দোলনের উপর পুলিশী হামলা, এমনকি বিভিন্ন প্রচারমূলক কর্মসূচিতেও নেতৃত্ব ও কর্মীদের উপর মিথ্যা মামলা দায়ের করে ধারাবাহিকভাবে হয়রানি চালিয়ে যাওয়া নিয়মিত বিষয় হয়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর এই হামলার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে প্রতিবাদে প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।

moral education

বাগুইআটির দু’টি কিশোরকে অপহরণ করে খুন করা হল। তেরো দিন পর দেহ উদ্ধার হল। এতগুলো দিন পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকলে কেন? কেনই বা দুটি কিশোরকে এমন নৃশংসতার বলি হতে হল? সামাজিক অপরাধ লাফিয়ে বেড়ে চলেছে-প্রশাসনের ঔদাসীন্যে, কখনও প্রচ্ছন্ন মদতে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় প্রশাসন নিশ্চয়ই তার দায় এড়াতে পারে না। তেমনই দায়ী সেইসব দুনীর্তিগ্রস্ত সমাজ অভিভাবকরা যারা এই আবহ তৈরি করেছেন।  

ঘটনাসূত্রে যা জানা যাচ্ছে, মূলে ছিল একটি বাইক কেনার ব্যাপার। এই ‘বাইক’ আরও কত তরুণের যে প্রাণ হরণ করবে! বলা যায় না, মাননীয়া হয়তো এবার সাইকেলের বদলে বাইক দেওয়াও চালু করতে পারেন। সব দিচ্ছেন তিনি, শুধু শিক্ষক ছাড়া যিনি ‘শিক্ষা’ বিতরণ করবেন। শিক্ষা তো মাননীয়ার বিতরণযোগ্য নয়! কিন্তু শিক্ষকদের তো তিনি রাস্তায় বসিয়ে রেখেছেন! আদালত চত্বরে পাঠিয়েছেন! শিক্ষাঙ্গন তাই ‘শিক্ষা’শূন্য। ছাত্ররা সেখানে কী করে? কী করা সম্ভব?

মাননীয়া শিক্ষক দিবসে ছাত্রদের 'নীতি শিক্ষা' দেওয়ার কথা বলেছেন। সেজন্য আলাদা ক্লাস, পাঠ্যসূচি আর তা নির্ধারণের জন্য ‘বিশেষজ্ঞ’দের নিয়ে একটা কমিটি গড়ার নির্দেশও দিয়েছেন।

বিদ্যালয়ে ‘নীতিশিক্ষা’ তো ভালোকথা। কিন্তু যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ দুর্নীতি, দৌরাত্ম্য, অসাধুতা পাকাপোক্ত ঠাঁই করে নিয়েছে, দলীয় রাজনীতি আর প্রশাসনের সৌজন্যে সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সদিচ্ছা’ কতটা ফলপ্রসূ হবে? অনেক স্কুলে মিড ডে মিল নিয়েও দুর্নীতি চলছে। খানাখন্দ ভরা রাস্তায় নিত্য দুর্ঘটনা। ১০০ দিনের কাজের নামে অনেক ক্ষেত্রেই কাজ হচ্ছে না। পয়সা দিয়ে জব কার্ড কিনতে হচ্ছে। ‘বাংলার বাড়ি’ নিয়েও দুর্নীতি। যাদের দরকার তারা পাচ্ছেন না। যাদের আছে তারাই প্রভাবশালী নেতার আত্মীয় পরিজন হওয়ার সুবাদে পেয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতির সামাজিকীকরণ হয়ে গেছে – লুটে নাও! দু'দিন বৈ তো নয়! আর উপার্জনের রাস্তাই বা কোথায়? সরকারি নিয়োগ বন্ধ। কল কারখানা বন্ধ। শ্রমিক-পীড়ক নয়া শ্রমকোড কারখানার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। টোটো অটো এখন বেকারদের পেটের ভাত জোটাচ্ছে। সেখানেও হ্যাপা অনেক। ছোট ব্যবসা করবে! ট্রেড লাইসেন্স ফী কতগুণ বেড়েছে দ্যাখো! দুর্নীতিময় সমাজের দেহে পারার মতো বিষ ফুটে বেরোচ্ছে – বাড়ছে নানা সামাজিক অপরাধ। তারই বলি ঐ কিশোর দ'টি। এই অপরাধ প্রবণতাকে আরও ইন্ধন যোগাচ্ছে অঢেল মদের যোগান, সরকারের সদিচ্ছা ও ব্যবস্থাপনায়। সরকার এখন দেশি মদের ৩০০ মিলি লিটারের বোতল বাজারে ছাড়ার কথা ভাবছে – গরিব মানুষের ‘সুবিধার্থে’! আহা! এটাও তো একরকম জনসেবা! ভুখাপেটে দেদার মদ গিল আচ্ছাসে মা মেয়ে-বৌ, শিশু সন্তানকে পেটাও! এই জন্যেই না এনসিআরবি এবার পশ্চিমবঙ্গকে গার্হস্থ্য হিংসায় একেবারে শীর্ষে ঠাঁই দিয়েছে!

এ তো গেল সাধারণের কথা। ও দিকে সমাজের অসাধারণ, মহামান্য মন্ত্রী আমলা নেতারা যে সব পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির অতুলনীয় কীর্তি গড়ে রেখেছেন, তা আজকের ‘স্বপনকুমার’দের আগামী পঞ্চাশ বছর ধরে রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের খোরাক যোগাবে। আর গোদী মিডিয়ার সান্ধ্য চণ্ডীমণ্ডপের আসর তো জমিয়েই চলেছে যারা ভুলেও কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ডাকাতি’র কথা বলে না। না, একটা শব্দও তারা খরচ করে না সুধা ভরদ্বাজ, তিস্তা শেতলবাদ বা বিলকিস বানোর জন্যে!

তাহলে! খবরের কাগজ, মিডিয়া, রাস্তায় ঘাটে জটলায় এই সব মুচমুচে কেচ্ছ-কেলেংকারির কথা শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে দুর্নীতির বিষবাষ্পের মধ্যে যারা বড় হয়ে উঠছে – তাদের মুখ্যমন্ত্রী কী নীতিশিক্ষার পাঠ পড়াবেন? এতদিন চোখ বুজে থেকে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দিয়ে যে বিষবৃক্ষ বড় করে তুলেছেন আজ তাকে নির্মূল করবেন কীভাবে! তার শিকড় যে বহুদূর ছড়িয়েছে।

constitution in Chile was rejected

চিলির প্রস্তাবিত প্রগতিশীল সংবিধান একটি গণভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করেছেন দেশটির নাগরিকরা। পাস হলে এ জাতীয় সনদ হোত বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল সংবিধান। বিবিসি সহ বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম চিলি ইলেক্টোরাল সার্ভিসের তথ্য অনুসারে জানিয়েছে যে ৬২ শতাংশ ভোটার প্রস্তাবিত সংবিধান প্রত্যাখ্যান করেছেন। পক্ষে ভোট পড়েছে ৩৮ শতাংশ। প্রস্তাবিত এই সংবিধানের পক্ষে ছিলেন বামপন্থী প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিচ।

সংবিধানের ৩৮৮টি অনুচ্ছেদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিস্তৃত সামাজিক অধিকার, বর্ধিত পরিবেশ বিধিমালা ও সরকারের ওপর সমাজকল্যাণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ব্যাপকতর দায়িত্ব। এতে লিঙ্গসমতা ও আদিবাসী প্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিষয়টিও প্রস্তাব করা হয়েছিল। সবচেয়ে প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত রাজধানী সান্তিয়াগো এবং তার পৌর এলাকাসহ চিলির সব প্রদেশেই প্রস্তাবিত সংবিধান প্রত্যাখ্যাত হয়।

the return of Francis Fukuyama

– ফিল হ্যার্স

১৯৮৯-৯১ সালে বার্লিন দেওয়ালের পতন ও স্তালিনবাদী রাষ্ট্রগুলির ধ্বসের পর ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘোষণা করে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা আন্তর্জাতিক খ্যাতির শীর্ষে চলে আসেন। ইতিহাসের সমাপ্তি মানে ফুকুয়ামা বোঝাতে চেয়েছিলেন, পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক ব্যবস্থা ও মতাদর্শের মধ্যেকার সংঘাতের সমাপ্তি। এবং উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের বিজয় যা ক্রমাগত আধিপত্যকারী ব্যবস্থা হিসেবে উঠে আসবে।

১৯৬০’র পর থেকে কার্ল পপারের মতো দক্ষিণপন্থী দার্শনিকেরা অভিযোগ তোলেন যে মার্ক্সবাদ ও বামপন্থী ‘ইতিহাসবাদ’ সমাজ বিকাশের গতির মধ্যে অন্তর্নিহিত এক অন্তিম অবস্থা বা শেষ সীমার কথা বলে যা হল সমাজতন্ত্র। ফুকুয়ামা তাঁর নিজস্ব ইতিহাসবাদ সামনে আনলেন, একেবারে বিদ্যমান বাস্তব এক ইতিহাসবাদ, যেখানে মানব ইতিহাসের শেষ সীমা হল যতটা সম্ভব ত্রুটিমুক্ত উদার গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ।

১৯৮৯ সালের পর এই থিসিস ভেঙে পড়ল। ইসলামিজমের উদ্ভব, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ, চীনের উত্থান এবং অতি-দক্ষিণপন্থী জনমোহিনী আন্দোলনের জমানার(ক্রিপিং ক্যাপিটালিজম) উত্থান দেখিয়ে দিল যে, উদার গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ সুদূরপরাহত; উদার গণতন্ত্র বহুবিধ শত্রুর আক্রমণের সম্মুখীন, হোয়াইট হাউসের জনমোহিনী ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের আক্রমণ তার মধ্যে কম কিছু না।

এখন ফুকুয়ামা বলতে চাইছেন, এইসব দুর্ভাগ্যজনক খিঁটমিটের পর ইতিহাস আবার নিজের ট্র্যাকে পড়েছে। ‘আমেরিকান পারপাস’ নামক ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধে দুইটি পয়েন্টে আলোচনা করে তিনি তাঁর এই নতুন তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। একটা হল, ইউক্রেইন যুদ্ধ ও তার সম্ভাব্য নাটকীয় প্রভাব সম্পর্কে এক আনুমানিক মূল্যায়ন। দ্বিতীয়টি হল, কীভাবে বিশ্ব ইতিহাস এবারে উদার গণতন্ত্রের অভিমুখে ঘুরে যাবে তার এক সামগ্রিক বিশ্লেষণ।

যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে ফুকুয়ামা বলছেন যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন ও রুশ আর্মি আটকে গেছে। এগোতেও পারছে না, পিছোতেও পারছে না। এটা হল অবশ্যম্ভাবি পরাজয়ের পূর্বলক্ষণ, এবং খুব দ্রুতই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। যুদ্ধের ফলাফল প্রসঙ্গে ফুকুয়ামার এই দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত অভিমত দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ যুদ্ধ সম্পর্কে খবরাখবর যা আসছে তার বেশিরভাগটাই আসলে প্রচার; সরাসরি পেন্টাগন বা ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রক থেকে সংবাদ মাধ্যমে ছড়ানো প্রচার।

দ্বিতীয়ত, বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সংঘাতকে ফুকুয়ামা “উদার গণতন্ত্র বনাম তার স্বৈরতান্ত্রিক শত্রুর” সংঘাত হিসেবে সুস্পষ্ট প্রকাশিত হতে দেখছেন। এই স্বৈরতান্ত্রিক শত্রুর তালিকায়, বলাই বাহুল্য, অন্তর্ভুক্ত আছে দক্ষিণপন্থী জনমোহিনী রাশিয়া এবং বহুদিনের পুরনো প্রধান শত্রু চীন। যারা যারা এতদিন পুটিনের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে বা তাঁর প্রশংসা করেছে — মূলত অতি দক্ষিণপন্থী মানুষেরা — তাদের সকলের এবার মানসম্মান বাঁচানোই দায় হবে এবং কর্তৃত্ব ধাক্কার মুখে পড়বে। এঁদের মধ্যে আছেন ইতালির মাতিও সালভানি, হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান, ফ্রান্সের মারিঁ লা পেন (ফুকুয়ামা অবশ্য ব্রিটেনের নাইজেল ফারাগের নামটাও নিতে পারতেন)।

দক্ষিণপন্থী অনলাইন জার্নালে পরপর একগুচ্ছ সাক্ষাৎকারে ফুকুয়ামা বলেন, ইউক্রেইনের ওপর আগ্রাসন এক “নৈতিক স্পষ্টতা” তৈরি করেছে। এটা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এডভান্টেজকে দেখিয়ে দিচ্ছে যা কি না “স্বৈরতান্ত্রিক নয়, একনায়কতন্ত্র নয়, জনগণকে হত্যা করে না, এবং তা তার প্রতিবেশি দেশে আগ্রাসন চালায় না”। বলাই বাহুল্য এই তত্ত্বের অন্তর্নিহিত মিথ্যাচার খুবই প্রকট। কিন্তু পশ্চিমা দেশে ও তার বাইরেও যে বিরাটাকার প্রচারণা চলছে তার কেন্দ্রে আছে এই তত্ত্ব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সঙ্গীসাথিদের শুরু করা ডজন কয়েক যুদ্ধ যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে — কোরিয়া ও ভিয়েতনামে প্রত্যক্ষভাবে, আর আফগানিস্তান, নিকারাগুয়া ও এল সালভাদরে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়ে নিজে পেছন থেকে যুদ্ধ চালিয়ে — তা বেমালুম ভুলে যাওয়া হল। এ বড় অদ্ভুত ব্যাপার। ইরাক ও আফগানিস্তান তো ঘটেছে বিগত ২০ বছরের মধ্যেই। ২০০৭-৮ এর পতন ও তা থেকে উদ্ভূত কৃচ্ছসাধন চাপিয়ে দেওয়া এবং তাকে ঘিরে উথালপাতাল, যার মধ্যে ২০১০’র আরব বসন্তও পড়বে, যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট প্রকাশ করল সেটাও এই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

ফুকুয়ামার তত্ত্বে এটাই কেন্দ্রীয় দুর্বলতা। এই তত্ত্বে কেবলমাত্র শাসনের বাহ্যিক ধরনকেই হিসেবের মধ্যে আনা হয়েছে। কিন্তু তার ভেতরের যেসব অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন উদার গণতন্ত্রকে অচলাবস্থায় এনে ফেলেছে সেগুলিকে আর আলোচনায় আনা হয়নি।

২০০৭-৮ সালের পর থেকে ফ্যাসিবাদ ও চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটেছে উদার গণতন্ত্রের অভ্যন্তর থেকেই, বাইরে তৈরি হওয়া কোনও চাপের ফলে নয়। জীবন-জীবিকার মানের তীব্র অধঃপতনের ফলে যে চরম হতাশার জন্ম হয় তা জনতাকে চরমপন্থী রাজনীতি সমর্থনের দিকে ঠেলে দেয়। বামেদের পরাজিত ও দুর্বল হয়ে যাওয়া আর অতি দক্ষিণপন্থীদের প্রতি পুঁজিপতি শাসকশ্রেণির একাংশের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে অতি দক্ষিণপন্থীরা শ্রমজীবীদের সবচেয়ে পশ্চাদপদ অংশের কাছে ও মধ্যবিত্তদের কাছে আবেদন রাখে অভিবাসন-বিরোধী জাতিবাদের ভিত্তিতে।

ইউক্রেইনে পুটিনের পরাজয় কীভাবে এক নতুন গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের ফুল ফোটাবে সে বিষয়ে ফুকুয়ামার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে ইউক্রেইন যুদ্ধে ন্যাটোর প্রচারণার সাথে খাপেখাপ মিলে যায় : পূর্ব ইউরোপে অস্ত্র ও সৈন্য ঢেলে দেওয়া হচ্ছে “গণতন্ত্র রক্ষা করতে”। এটা মতাদর্শগত ধোঁয়াশার জাল ছড়ানো ও পশ্চিমা জনমত উসকে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়, যার আড়ালে ব্যাপক সামরিকিকরণের নতুন ঢেউ তোলার প্রস্তুতি চলছে।

অনেক রাজনীতিবিদ ও অনেক মিডিয়া ইউক্রেইনে “আরও শক্তিশালী অস্ত্র” প্রেরণের দাবি তুলছে যা রাশিয়া ও ন্যাটো বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের দ্বার খুলে দেবে। এই যুদ্ধ প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেইনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রক্ষা করার যুদ্ধ। কিন্তু এই প্রকৃত উদ্দেশ্য ছাপিয়ে কখন যে তা অন্য রূপ নেবে তা জানতে পারবেন না (ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘মিশন ক্রিপ’)। এই বিপদের জোরালো সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। এ’কথা পরিষ্কার যে ডানপন্থী রাজনীতির অনেকে এই যুদ্ধকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত করতে চায়, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে।

ইউক্রেইনে যুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্য তাঁদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল লক্ষ্য রাশিয়ার চরম সামরিক পরাজয়, তাতে ইউক্রেইনের জনতাকে যত মূল্যই দিতে হোক না কেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়ার ওপর যে ‘স্যাংশন’ চাপানো হয়েছে তা সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের ভেতরের সংঘাতের অঙ্গ হিসেবে রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত নকশা। এই স্যাংশনরাজ রাশিয়ার জনতাকে বিপুল দারিদ্র্য ও দুর্দশায় ফেলবে। অর্থাৎ গুণাগার তো দিতেই হবে এবং তা রাশিয়ার জনতার মূল্যেই দিতে হবে। ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি দেখিয়েছেন যে ‘স্যাংশন’ যদি চাপাতে হয়ও তাহলে এই বিরাট ক্ষতি এড়িয়ে নির্দিষ্টভাবে কেবলমাত্র ধনকুবের গোষ্ঠিগুলিকে নিশানা করে আনা যেতে পারে যে ধনকুবের গোষ্ঠিগুলিকে রাশিয়ান আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সুরক্ষিত রাখে।

রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্য এইভাবে উঠেপড়ে লাগাটা বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির ফাটলগুলি স্পষ্ট করে দেয় যা বর্তমানে প্রাধান্য করছে। এটা মোটেই উদার গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের সংঘাত নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যেকার সংঘাত। যে সংঘাতে জড়িয়ে আছে রাশিয়া, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমন এক যুদ্ধ যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন এমনকি অস্ট্রেলিয়াকেও বিশ্বাস করে নিজের শিবিরে রাখতে পারে এবং অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন বহু ফ্রন্টে বহুভাবে হাত মেলায়।

গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের মতাদর্শ ফেরি করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির ওপর ভরসা রাখছে। আবার একইসঙ্গে তাদের স্বাধীন বৈদেশিক ও প্রতিরক্ষা নীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যকেও ক্রমাগত নাকচ করে চলছে। পুটিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিরাট সহযোগিতা করে দিয়েছে ন্যাটোকে পুনরায় শক্তিশালী করে নিতে এবং তার মাধ্যমে পশ্চিমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক একাধিপত্য নিশ্চিত করতে।

গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের মতাদর্শ খুব শক্তিশালী কারণ এ’কথা স্পষ্টতই সত্য যে পুটিনের রাশিয়া ও শি জিনপিঙের চীন বাস্তবে কঠোর একয়ায়কতন্ত্র যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা নির্মমভাবে দমন করা হয়। এই রাষ্ট্রগুলিতে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমালোচনা করার তেমন কোনও পরিসর নাই যতটা আমেরিকা বা ইউরোপে আছে। পশ্চিমে আছে পাহাড় প্রমাণ জাতিবাদ, সহিংসতা, নারীবিদ্বেষ এবং পশ্চিমের যথাস্থিতি বজায় রাখতে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলিতে নিজেদের দারিদ্র্য অংশত চালান করা, অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা, নৃশংস বোমা বর্ষণ, আক্রমণ — এক কথায় সাম্রাজ্যবাদের শিকার বানানো।

পশ্চিমের বিপুল অংশের জনতার কাছে সাম্রাজ্যবাদী হিংস্রতা ও শোষণকে লুকিয়ে রাখা হয় নিউজ বুলেটিনের ঠুলি আর বিনোদনের চশমা পরিয়ে। আউট অব সাইট, আউট অব মাইণ্ড। ইয়েমেনের নাগরিকদের ওপর নৃশংস বোমা ও তাতে ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা আর কতজনই বা জানে। কার্যত সমগ্র ব্রিটিশ নিউজ মিডিয়া ফুকুয়ামা-ন্যাটো মতাদর্শের পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এমনকি সামাজিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্নে ৠাডিক্যাল প্রবণতা রাখে যারা সেইসব নিউজ মিডিয়াও। এইভাবেই, যুদ্ধের মতো ক্রুশিয়াল প্রশ্নে, লিবারালিজম নিজ নিজ সাম্রাজ্যবাদের সাথে এক লাইনে খাড়া হয়ে যায়। ফিল ওক্স তাঁর সুন্দর গানটির মাধ্যমে এই বিষয়টি তুলে ধরেন, “লাভ মি, আই অ্যাম এ লিবারাল : হোয়েন ইট কামস টু টাইমস লাইক কোরিয়া, দেয়ার ইজ নো ওয়ান রেড, হোয়াইট অ্যান্ড ব্লু”।

টাইমস রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফুকুয়ামা দক্ষিণপন্থী বিদেশ নীতির প্রবক্তাদের পৃষ্ঠপোষণা করে বলেন যে, উদারনীতির শেষ যুদ্ধ চলবে চীনের সাথে। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো বিপুল অস্ত্র ও সেনা ঢেলে দিলেও পশ্চিমা দেশগুলির বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি হার্ডওয়ারের বৃহত্তম কাঠামো, প্রধানত নৌবাহিনীর, গড়ে তোলা হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে নিশানায় রেখেই।

স্বৈরতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যে বিশ্বসংঘাত, যেখানে পশ্চিমা দেশগুলি গণতন্ত্রের প্রতিনিধি — ফুকুয়ামার এই বুনিয়াদি তাত্ত্বিক অবস্থানের মহড়া প্রাক্তন ট্রটস্কিপন্থী ব্রিটিশ ভাষ্যকার পল মেসন আগেই একবার দিয়েছেন। মেসন ইউক্রেইনে ন্যাটোর দ্বিধাহীন সামরিক হস্তক্ষেপ দাবি করেন। তিনি বলেন, “সবরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিসর্জন দিয়ে ব্রিটেনকে অবশ্যই সামরিক খরচ আরও বাড়াতে হবে”। উদাহরণ হিসেবে, তিনি অভিযোগ তোলেন, বরিস জনসন সরকার তো “কেবলমাত্র” ৪৮টি এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার নিয়োগ করেছে বহু বিলিয়ন খরচের বিনিময়ে। মেসন এমনকি লেবার ফ্রন্ট বেঞ্চে অধিকতর অস্ত্র বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নে স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও চিৎকার করেন। মেসনের বিচারে, স্বৈরতন্ত্রের হাত থেকে নিস্তার পাবার তাড়নায় জনতার মধ্যে প্রো-ন্যটো প্রো-ইইউ সংস্কৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সে কারণেই পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো আছে। জনগণের মধ্যে এই ব্যাপ্ত চেতনা সম্পর্কে মেসনের বিশ্লেষনের মধ্যে নিশ্চয়ই খানিক সত্য আছে। কিন্তু ন্যটো পূর্ব ইউরোপে মোটেই কোনও স্বার্থশূন্য দয়ার সাগর হয়ে উপস্থিত নেই। আছে প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধবাজ অগ্রবাহিনী হিসেবে।

স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিপদের মুখে পড়তে পারে বা ইতিমধ্যেই সেরকম শাসনের মধ্যে আছে এমন জনতার মনে পশ্চিমী চেতনা থাকার প্রশ্নটা নতুন কিছু নয়। তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে গণতন্ত্রের দাবিতে প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীদের সমস্ত সংগ্রামী বামপন্থীরাই সমর্থন করেছিল, এবং তাঁদের অনেকেই ইন্টারন্যাশনাল গানটি গাইছিলেন। কিন্তু অন্য অনেকে আবার স্ট্যাচু অব লিবার্টির আদলে মূর্তিও বানিয়েছিল। আরও স্পষ্ট হয়, ১৯৮৯ সালে দুই জার্মানি এক হওয়ার দাবিতে পূর্ব জার্মানির লিপজিগ ও অন্যান্য শহরে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পশ্চিম পক্ষীয়, ইইউ পক্ষীয়, ন্যাটো পক্ষীয় মতাদর্শের জঙ্গি প্রিতিনিধিরা বিশাল সংখ্যায় ছিল, সম্পূর্ণ প্রাধান্যকারী অবস্থায় না থাকলেও ছিল। পশ্চিম জার্মানির শত শত ডানপন্থীরাও প্রতিবাদী মিছিলগুলিতে অংশ নিয়েছিল।

যখন ডেভ পেকার্সিও এবং আমি পশ্চিম জার্মানির সোশালিস্টদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তাঁরা কেন প্রতিবাদী মিছিলগুলিতে অংশ নিয়ে এক ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক জার্মানির শ্লোগান ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারলেন না, তখন তাঁরা সকলে একটাই জবাব দিয়েছিলেন, “সম্ভবই ছিল না, পাগল না কি, আমাদের ওরা জাস্ট ধোলাই দিত”। অথচ একটি নতুন ফোরামের মাধ্যমে আন্দোলন শুরু হয়েছিল যেখানে সোশালিস্ট ও চার্চের বিক্ষুব্ধরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর তা প্রান্তিক হয়ে যায় পশ্চিম জার্মানির সাথে ঐক্য, গণতন্ত্র ও ভোগ্য পণ্যের সম্মিলিত আকাঙ্খায় তৈরি হওয়া একের পর এক বিপুল জনজোয়ারের ঢেউয়ে।

ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ফলশ্রুতিতে পূর্ব জার্মানির অধিকাংশ মানুষ যা পেয়েছিল তা হল বেকারত্ব এবং সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিশুশিক্ষালয় ও অন্যান্য সামাজিক কল্যাণ প্রকল্পগুলির ধ্বসে পড়া। যেসব উৎসাহী তরুণ তরুণী পশ্চিম জার্মানিতে চলে যেতে পেরেছিল কেবল তারাই স্বল্প সময়ের জন্য বা পরবর্তী আরও কিছুদিন খানিকটা উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের সন্ধান পেয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলেছিল সেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের মতাদর্শছিল সেই অর্থে গণতন্ত্র বনাম কর্তৃত্ববাদী কমিউনিজমের দ্বন্দ্ব। এবং ১৯৬০’র মধ্যভাগ পর্যন্ত এই মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা ছিল সত্যিই খুব কঠিন। এই মতাদর্শ ভেঙে পড়েছিল পরমাণু অস্ত্রের চাপ, কিউবায় মার্কিন মিসাইল সংকট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং সর্বোপরি ভিয়েতনাম যুদ্ধে নাগরিকদের ওপর সংঘটিত গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে।

১৯৫০-৬০ সালের পরমাণু বোমা নিরস্ত্রীকরণ অভিযানের প্রভাবে ন্যাটোর প্রতি ঐকমত্য ভেঙে দিয়েছিল। এবং এইভাবে ভেঙে পড়েছিল সিআইএ’র সাংস্কৃতিক মুখপত্র ‘এনকাউন্টার’ প্রচারিত ডানপক্ষীয় মার্কিন লিবারালিজম।

ইউক্রেইনের আত্মরক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষ গ্রহণ থেকে বিচ্যুত হয়ে মেসনের বক্তব্য চীন ও রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বে পর্যবসিত হয়। এই অবস্থান বামপন্থীদের ওপর বিপুল চাপ তৈরি করতে চলেছে, ব্রিটেনে এবং সারা পৃথিবিতেই। যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে সংঘর্ষ হয় তখন আসল ‘উৎপীড়ক’ চিহ্নিত করা সত্যিই খুব চাপের হয়ে পড়ে, বিশেষত সেই উৎপীড়ক যদি কারও নিজের সাম্রাজ্যবাদকে লড়াই দেয়।

অগণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে “গণতান্ত্রিক” সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে সমর্থন দেওয়ার বিপদের দুটি দিক আছে। প্রথমত, এটা বিদ্যমান উদারনৈতিক পুঁজিবাদকে সুন্দর করে দেখায়, যেখানে বাস্তবে গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর চরম হামলা চলে এবং সকলের অজান্তে ফ্যাসিবাদের মাথা চাড়া দেওয়ার চাপ তৈরি হয়। ফুকুয়ামার বক্তব্য অসংগতির দোষে দুষ্ট হয় যখন তিনি বলেন যে, পুটিনের পতন অটোমেটিকালি ব্রাজিলের জাইর বোলসোনারো বা ইতালিতে মাত্তিও সালভানির লেগা পার্টির মতো কর্তৃত্ববাদী ডানপন্থীদেরও বিপদে ফেলবে। স্বল্প সময়ের হিসেবে এরকম হতেও পারে। কিন্তু যদি ২০২৪’র মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাব্লিকানরা জেতে, যার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, এবং যদি সেই ট্রাম্পই তাদের প্রার্থি হয়, তাহলে অতি-ডানপন্থী পপুলিস্টদের মতাদর্শগত পরাজয় খুবই স্বল্পস্থায়ি হবে। যাই ঘটুক না কেন, এটা একটুও স্পষ্ট নয় যে হাঙ্গেরিতে ওরবানের সমর্থকেরা বা ইটালিতে সালভানির সমর্থকেরা পুটিনের রাশিয়ার সাথে কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাবে কেন।

দ্বিতীয়ত, উদারনৈতিক পুঁজিবাদকে ব্যাক করা মানে ২০০৭-৮ থেকে এর যে সংকট চলছে তাকে উপেক্ষা করা। এই সংকট দ্রুতই আরও এক আর্থিক অতিমন্দার দিকে এগোচ্ছে এবং তা আবার কর্তৃত্ববাদী ডানপন্থাকে শক্তিশালী করবে; এবং একই সাথে, আমাদের আশা, শক্তিশালী করবে বিপ্লবী বামপন্থাকেও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ফুকুয়ামা টাইপের অবস্থানে মেসনের পতন মার্ক্সবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর বুনিয়াদি অবস্থানকেই বর্জন করার সামিল।

ইউক্রেইনের যুদ্ধ জাতীয় আত্মরক্ষার যুদ্ধ। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমশই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সংঘাতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ইউক্রেইনকে ডিফেন্ড করাটা যেন ন্যাটোর পক্ষ নিয়ে নেওয়া না হয়, অথবা তা যেন বামপন্থী দিশা থেকে ন্যাটোর সমালোচনা চালানো বন্ধ করা না হয়ে যায়, বা ইউরোপে ন্যাটোর আরও সামরিকিকরণের যুক্তি হয়ে না দাঁড়ায়।

‘লিঙ্কস ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল ফর সোশ্যালিস্ট রিনিউয়াল’ ম্যাগাজিনে জুন ২০২২ প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: মলয় তেওয়ারি। মতামত লেখকের। অরিজিনাল লেখাটি অনলাইনে পাওয়া যাবে –
https://internationalviewpoint.org/spip.php?article7681

GDP growth of 13 percent

সপ্তাহ খানেক আগে দেশের ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের অর্থনৈতিক কাজকর্ম সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রকাশ করা হয়েছে, যদিও ওই তথ্যাদি আনুমানিক ও তা বারতিনেক পাল্টাতে থাকে। তবুও মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি এবং মোট মূল্যযোগ বা জিভিএর পরিসংখ্যান দিয়ে মাপার চেষ্টা হয় যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দিক থেকে দেশ কতটা এগোলো বা পিছোলো। ওই জিডিপি বা জিভিএ জাতীয় আয়ের একটি পরিমাপ। যদিও জাতীয় আয় শেষ পর্যন্ত মাপা হয় নীট জাতীয় আয় বা নেট ন্যাশনাল ইনকাম বা এনএনআই দিয়ে। এমনটা নয় যে, ওইসব জিডিপি, জিভিএ বা এনএনআই ধারণাগুলি দেশের জনসাধারণের কাছে খুব বোধগম্য হয়, কিন্তু সেই ১৯৯১ সালের নরসিমহা রাও-মনমোহন সিং-চিদাম্বরমের কাঠামোগত সংস্কার বা নয়া আর্থিক নীতি গ্রহণের পর থেকে জিডিপি ও তার বৃদ্ধির হার নিয়ে ক্রমাগত ঢক্কানিনাদের মাধ্যমে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার পেটে স্বাস্থ্যকর খাদ্য, মাথায় ছাদ, পরণে বস্ত্র, হাসপাতালে শয্যা ও ওষুধ, বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকুক আর নাই থাকুক জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়লে দেশ এগিয়ে চলেছে ভেবে ফুর্তিতে ডগমগ হতে হয়।

গত ২০১৪ সালের পর থেকে তো আর কথাই নেই জিডিপি দিয়েই কেবল দেশের অগ্রগতি মাপা শুরু হয়েছে। দেশ জোড়া অর্থনৈতিক বৈষম্য, নারী নিগ্রহের বৃদ্ধি, বেকারি, মুল্যস্ফীতি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার হ্রাস, সার্বিক গণতন্ত্রহীনতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন এসব চলতে থাকলেও জিডিপির পরিসংখ্যান প্রকাশিত হলেই বিজেপির আইটি সেল লাফিয়ে ঝাপিয়ে আমরা কত ভালো আছি, কত উন্নতি করেছি তা নিয়ে লাফালাফি করতে থাকে। এমনিতেই অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধি সাধারণ জনগণের উন্নয়নের কোনো মাপকাঠি নয়, দেশের ১০ শতাংশ মানুষের আয় বিপুল পরিমাণে বেড়ে দেশজোড়া বৈষম্য সৃ্ষ্টি করলেও জিডিপি বৃদ্ধি পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ দেশের কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেওয়া বয়স্ক নাগরিকদের কথা ভাবা যেতে পারে। এদের অনেকেই অবসরকালীন পাওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটির অর্থের উপরে পাওয়া সুদের উপর নির্ভর করে জীবননির্বাহ করেন। সেই সুদ গত ৮ বছরে ক্রমাগত কমেছে। ফলে তাদের আয় কমেছে চলতি টাকার অঙ্কে। অপরদিকে ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য প্রভৃতির মূল্যস্ফীতি ঘটেছে হুহু করে। সামগ্রিকে ওই বয়স্ক মানুষদের প্রকৃত আয় কমেছে, হযতো বা গত ৮ বছরে অর্ধেক হয়েছে। জিডপি বৃদ্ধি যতই ঘটুক না কেন, তাতে ওঁদের আয় সঙ্কুচিতই হয়েছে। একইভাবে এদেশের রাজ-অনুগ্রহে থাকা শিল্পপতি এশিয়ার ও পৃথিবীর তৃতীয় সম্পদশালী হলেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা বিপুল (মোটের ৯০ শতাংশ) জনসাধারণ নোট বাতিল ও জিএসটির ধাক্কায় দরিদ্রতর হয়েছেন। তাই জিডিপির বৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নতির বুদবুদ তৈরি করতে পারে কিন্তু তা একদিন ফাটবেই।

এতদসত্বেও যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে মোদী বাহিনী হৈচৈ লাগিয়ে দিয়েছে সেই পরিসংখ্যানের দিকে একটু বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিলেও বোঝা যাবে যে বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হারের মিথ কতটাই মিথ্যে। ২০২২-২৩-এর এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিক বা প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি বেড়েছে গত বছরের অনুরূপ ত্রৈমাসিকের তুলনায় ১৩.৫শতাংশ হারে; ২০২১-২২-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে অনুরূপ বৃদ্ধির হার ছিল ২০.১শতাংশ; ২০২০-২১ ত্রৈমাসিকে -২৩.৫শতাংশ (অর্থাৎ ওই ত্রৈমাসিকে তার আগের বছরের অনুরূপ ত্রৈমাসিকের তুলনায় জিডিপি ২৩.৫শতাংশ কম ছিল), ২০১৯-২০র প্রথম ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ছিল ৫.১শতাংশ। এসব হিসেবে খুব কিছু বোঝা যায় না। তবে ২০১৯-২০র প্রথম ত্রৈমাসিকে, যেটি করোনাহীন বছরের প্রথম ত্রৈমাসিক, মোট জিডিপি ছিল স্থির মূল্যে ৩৫.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। সেটি ২০২২-২৩-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে বেড়ে হয়েছে ৩৬.৮৫ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ অঙ্কের হিসেবে ৩ বছরে বেড়েছে বার্ষিক ১.৪শতাংশ হারে। ওই যে ১৩.৫শতাংশ হারে বৃদ্ধির কল্পকথা তা যে কত বড় মিথ্যে তা বোঝা যাচ্ছে এবারে। বৃদ্ধির হারটি আরো দুর্বিসহ হবে বিজেপির কাছে যদি স্থির মূল্যে মাথাপিছু জিডিপিকে হিসেব করা যায়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে জনসংখ্যা ছিল ১৩৩ কোটি, ২০২২ সালের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৭ কোটি। ফলে ২০১৯-২০ সালের মাথাপিছু জিডিপি (স্থির মূল্যে) ২৬,৬৮০ টাকা, যা ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ২৬,৯০০ টাকা। অর্থাৎ বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধির হার মাত্র ০.৩শতাংশ।

২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান

story of economic prosperity

পরিসংখ্যানের ছানবিন করতে করতে মনে পড়ছে যে, সম্পাদক মশাই সপ্তাহ দুয়েক আগে বলেছিলেন, এই যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, স্টেট ব্যাঙ্ক বলছে যে প্রথম ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ১৬ শতাংশের আশেপাশে থাকবে (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অনুমান করেছিল ১৬.২শতাংশ, স্টেট ব্যাঙ্কের অনুমান ছিল ১৫.৯শতাংশ) সেটা কীভাবে হবে? অর্থাৎ জিডিপি বৃদ্ধির যে অনুমান করা হযেছিল তার তুলনায় বৃদ্ধিতে ঘাটা হয়েছে ২.৫শতাংশের মত। তাই এই যে বৃদ্ধি সেটাতেও হ্রাস। কিন্তু যে বিজেপি মিথ্যা ছাড়া সত্য বলে না, তাদের সরকারকে বোঝাবে কে! অপরদিকে ২০২২-২৩ সালের সারা বছরের বৃদ্ধির হারের যে অনুমান ছিলে স্টেট ব্যাঙ্কের তাকেও ৭.৫শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৮শতাংশে নামিয়ে এনেছে তারা। মুডিজও নামিয়ে এনেছে ৮.৮শতাংশ থেকে ৭.৭শতাংশে, পরের বছরের অনুমান আরো কম, ৫.২শতাংশ। সিটি গ্রুপ বৃদ্ধির হারের অনুমানকে ৮শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৭শতাংশ করেছে। শিল্পোৎপাদনের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে আটটা মূল পরিকাঠামো শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে ৪.৫শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে আগামীতে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমার আশঙ্কা রয়েছে।

এসব তো গেল জিডিপি, শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির হ্রাসের কথা। সরকারের তথ্যে বেকারত্বের হার জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকের ৯.৫শতাংশ থেকে কমে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে ৭.৬শতাংশ হয়েছে। কিন্তু ওই সমীক্ষা অনুযায়ীই কর্মী-জনসংখ্যা অনুপাত ওই দুই ত্রৈমাসিকেই মোটামুটি একই রয়েছে। এর অর্থ হল, লোকে হতাশ হয়ে কাজ খোঁজাও ছেড়ে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে সিএমআইই (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনোমি)র পরিসংখ্যানে আগস্ট মাসে দেশে বেকারত্বের হার তার আগের মাসের ৬.৩শতাংশের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে ৮.৩শতাংশ হয়েছে। শহরাঞ্চলে তা ৯.৭শতাংশ, গ্রামে ৭.৬শতাংশ। আরো ভয়ানক হল যে, যুবকদের কর্ম সংস্থানের হার ২০২১-২২ অর্থবর্ষে গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে, ১০.৪শতাংশ; ২০১৬-১৭ সালে তা ছিল ২০.৯ শতাংশ।

ভারতের রফতানি কমেছে, আমদানি বেড়েছে। ফলে আগস্ট মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ২৮৬৮ কোটি ডলারের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিদেশি মুদ্রা ভান্ডার ৩০১ কোটি ডলার কমে আগস্টের শেষ সপ্তাহে দাঁড়িয়েছে ৫৬১০৪ কোটি ডলারে, তার আগের সপ্তাহে (১৯ আগস্ট শেষ হওয়া) তা তার আগের সপ্তাহের থেকে ৬৬৯ কোটি ডলার কমেছিল। ফলে ওই ভান্ডার ক্রমাগত কমছে। অর্থনৈতিক কাজকর্মের আরো কয়েকটি সূচকও দেশের অর্থনীতির সমস্যার দিকেই ইঙ্গিত করছে। ডিজেলের ব্যবহার ৪.৯শতাংশ কমে আগস্ট মাসে ৬১ লক্ষ টন হযেছে, রান্নার গ্যাসের বিক্রিও ১শতাংশ কমেছে। তবে পেট্রলের বিক্রি জুলাইএ ৫শতাংশ কমেছিল, আগস্টে হয়েছে ৫.৮১শতাংশ। কেন্দ্রের উৎপাদন শুল্ক সংগ্রহও জুলাই মাসে আগের মাসের তুলনায় ২৬শতাংশ কমেছে। আগস্ট মাসের জিএসটি সংগ্রহ জুলাইএর ১.৪৯ লক্ষ কোটি টাকার থেকে কমে ১.৪৩ লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে।

সব মিলিয়ে জিডিপির ১৩.৫শতাংশ বৃদ্ধিকে নিয়ে যে হৈচৈ করা হচ্ছে তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, বরং শঙ্কার কারণ আছে। কিন্তু আরএসএস-বিজেপির তো দেশের সঙ্কটেই আনন্দ। ওই যে কী যেন বলে না মোদীজী, সঙ্কটকে সুযোগে পরিণত করা। দেশের জনসাধারণের কাজ না থাকা, জিনিসপত্তরের দাম বাড়ার মতো সঙ্কটকে ওরা আদানির মুনাফার সুযোগে রূপান্তরিত করতেই আগ্রহী।

– অমিত দাশগুপ্ত

clown is Maa Bhabani

মহা আড়ম্বরে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে দুর্গাপুজোর প্রায় এক মাস আগে বাংলায় ঢাকের বাদ্যি বেজে গেল। চোখধাঁধানো এই জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে কত খরচ হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। ঠিক একদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু জানিয়ে দিয়েছেন যে রাজ্যের ভাঁড়ার শূন্য, অথচ ঐ মঞ্চ থেকেই ক্লাব-কমিটি প্রতি পুজোর অনুদান একলাফে ৫০০০০ থেকে ৬০০০০ টাকা করে দিয়েছেন, বিদ্যুতে ছাড় বাড়িয়ে দিয়েছেন ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ। বাঙালির সেরা উৎসব পুজোয় লোকে আনন্দে থাকুক, মনকে খুশি রাখুক, উন্মুক্ত রাখুক এটা কে না চায়, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কৃত্তিম এই আলোর নিচেই তো অন্ধকার। মিড-ডে-মিলের জন্য টাকা নেই, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির জন্য টাকা নেই, দীনদরিদ্র মানুষ কয়েক মাসে ধরে একশো দিনের কাজের টাকা পাননি, সরকারি কর্মীরা দীর্ঘ দিন ধরে মহার্ঘ ভাতা থেকে বঞ্চিত, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মীরা পেনশন পাচ্ছেন না, রোদ-ঝড়-জল, পুলিশ প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চাকরিপ্রার্থীরা বহু মাস ধরে আন্দোলনরত। তবুও মোচ্ছব চলছে, তিনি আশ্বস্ত করেছেন কুছ পরোয়া নেহি, মা দুর্গা ভাঁড়ার পূর্ণ করে দেবেন!

প্রকারান্তরে আমাদের এক বিভ্রমের মধ্যে, বালিতে মুখ গুঁজে দিন গুজরান করতে বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে উপরোক্ত সমস্ত সমস্যাগুলিই কেন্দ্রীয় সরকারের সৃষ্টি, রাজ্য সরকারের এখানে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। সবাই জানেন গত কেন্দ্রীয় বাজেটে আইসিডিএস, মিড-ডে-মিল, একশো দিনের কাজ ইত্যাদি সামাজিক প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটা বলাই কি যথেষ্ট? রাজ্য সরকারের কি কিছুই করণীয় নেই? পুজোর অনুদান বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু শিশুদের সুষম খাদ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না? প্রায় আড়াই বছর আগে মিড-ডে-মিলের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এরপরে আকাশছোঁয়া মুল্যবৃদ্ধি হলেও, রান্নার গ্যাসের দাম চড়চড় করে বাড়লেও বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। প্রাথমিক স্তরের বাচ্চাদের জন্য বরাদ্দ দিনপ্রতি ৪.৯৭টাকা, অথচ একটা ডিমের দামই ৬ টাকা। এর ফলে বাংলার স্কুলগুলিতে যেখানে আগে সপ্তাহে দুদিন ডিম দেওয়া হোত, এখন দেওয়া হয় একদিন। খাদ্যে তরকারি বলতে আলু, কদাচিৎ সোয়াবিন। প্রোটিনের পরিমাণ ২০ গ্রাম থেকে কমে ১০ গ্রাম হয়ে গেছে। রাজ্যের বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করলেই সরকারের একগুঁয়ে মন্তব্য, কেন্দ্র না বাড়ালে আমরা বাড়াবো না। শিক্ষকরা নিজেদের গ্যাঁট থেকে খরচ করে বাচ্চাদের খাইয়ে যাচ্ছেন, নাহলে বহু স্কুলে এই প্রকল্প বন্ধই হয়ে যেত।

অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির অবস্থা তো আরও খারাপ। কেন্দ্রীয় সরকার এদের নির্দয়ভাবে বঞ্চিত করছে। এদের আর্থিক বরাদ্দ শেষবার বাড়ানো হয়েছে অক্টোবর, ২০১৭তে। গত কয়েক বছর ধরে এঁরা ধারাবাহিক ভাবে কাজের স্থায়ীকরণ, মাসিক ভাতা বৃদ্ধি, শিশু ও মহিলাদের খাদ্যের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। কয়েক বছর ধরে এঁদের ভাতার কোনও বৃদ্ধি হয়নি। পশ্চিমবাংলায় একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী পান ৮২৫০ টাকা, তাঁর সহযোগী পান ৬৩০০ টাকা। এই সামান্য টাকা সত্ত্বেও এমনও বহু দৃষ্টান্ত আছে যেখানে কর্মীরা মহাজনের থেকে ধার নিয়ে কেন্দ্র চালু রেখেছেন, কিংবা গয়না বন্ধক রেখে পরিষেবা দিয়েছেন। বোঝাই যায় এইসব কেন্দ্রগুলিকে এখন চালু রাখাই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার জন্য বরাদ্দ দিনপ্রতি মাত্র ৯.৫০টাকা, ছয় মাস থেকে ছয় বছরের বাচ্চার জন্য বরাদ্দ সাকুল্যে ৮ টাকা! এতে কী হয়? কিন্তু তৃণমূল সরকারের এক গৎ, কেন্দ্র বরাদ্দ না বাড়ালে আমাদের কিছু করার নেই! পরিস্রুত পানীয় জলের অভাবে সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। গাঁও কানেকশনের একটি তথ্য অনুযায়ী বাংলায় মাত্র ৫.৭৯ শতাংশ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পরিস্রুত জল সরবরাহ হয় যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অত্যন্ত শোচনীয়। এর ফলে দূরদূরান্ত থেকে মহিলাদের জল বহন করে আনতে হয়। এই জল অনেক ক্ষেত্রেই অপরিষ্কার, অস্বাস্থ্যকর যা খাদ্যের গুণমানকে নষ্ট করে।

একশো দিনের কাজের প্রকল্পটি একটা গোলকধাঁধার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই খাতে কেন্দ্রের থেকে রাজ্যের কয়েক হাজার কোটি টাকা বকেয়া পাওনা আছে; কেন্দ্র এই টাকা দিতে নারাজ কারণ তাদের মতে এই প্রকল্পের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি; মাঝখান থেকে লক্ষাধিক দিনমজুর কয়েক মাসের পাওনা থেকে বঞ্চিত। কেন্দ্র এই প্রকল্পকে দুর্নীতিমুক্ত করবার জন্য নতুন নিদান দিয়েছেঃ প্রতিটি পঞ্চায়েতে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খুলতে হবে, যাতে স্থানীয় সাংসদ, বিধায়ক, প্রধান, সরকারি অফিসার সদস্য হবেন; নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে নিয়মিত অডিট করাতে হবে, উচ্চপদস্থ অফিসারদের দশটি কাজের জায়গায় পরিদর্শনে যেতে হবে ইত্যাদি। আজব সরকারি নির্দেশ! গ্রামবাংলায় বহু জায়গায় নেট কানেকশন নেই, অথবা দুর্বল বা অনিয়মিত, সেখানে সর্বত্র হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খুলতে বলা ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়ার শামিল! এছাড়া সর্ষের মধ্যেই তো ভূত! পঞ্চায়েত, রাজনৈতিক নেতা এবং আমলারাই এই প্রকল্পের দুর্নীতির মুলে, যার ফলে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রকল্পটিকে দুর্নীতিমুক্ত করার কোনও উদ্যোগ এখন অবধি রাজ্য সরকারের তরফ থেকে দেখা যায়নি।

২০২১ সালে বিপুল জনাদেশ নিয়ে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। আশা করা গিয়েছিল  মোচ্ছবের পরিবর্তে তারা বুনিয়াদি প্রকল্পগুলি আরও শক্তিশালী করার ওপর জোর দেবেন। কিন্তু তারা সস্তায় বাজিমাত করতে চান। তারা চমক দেখাতে পছন্দ করেন। জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের চেয়ে টাকাপয়সা ছড়িয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতেই তারা বেশি আগ্রহী।

– সোমনাথ গুহ

For whose interest has BSNL

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে শাসক দলের মন্ত্রী ও নেতাদের কি নিজেদের মালিক বলে মনে হয়? টেলিকম মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো গত ২৭ জুলাই বিএসএনএল’এর জন্য ১.৬৪ লক্ষ কোটি টাকার পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ ঘোষণা করার কয়েক দিন পরই বৈঠকে বসলেন বিএসএনএল পরিচালকদের সঙ্গে। সেই বৈঠকে তিনি বললেন, বিএসএনএল কর্মীদের ‘সরকারি চালচলন’ ছেড়ে ভালো করে কাজ করতে হবে, আর যারা কাজ করতে অস্বীকার করবে তাদের ভিআরএস নিতে বাধ্য করা হবে। (কেউ এখানে প্রশ্ন তুলতেই পারেন, মন্ত্রী যে ‘সরকারি চালচলন’এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন, সরকারে থেকে সেই চালচলনের ভাগীদার কি তিনি নিজেও নন?) এরপর বিজেপির কর্নাটকের সাংসদ অনন্ত হেগড়ে বিএসএনএল কর্মীদের দেশদ্রোহী পর্যন্ত বললেন। বিএসএনএল কর্মীদের উদ্দেশে বলা তাঁর কয়েকটা কথা ছিল এরকম — “আপনারা শুধু সরকারি কর্মীই নন, আপনারা দেশদ্রোহীও বটে”। বিএসএনএল’এর আজকের দুরবস্থার জন্য তার কর্মীদের দায়ী করার, তাদের বলির পাঁঠা বানানোর যে প্রয়াস টেলিকম মন্ত্রী এবং বিজেপি সাংসদ চালালেন তা যে প্রকৃত সত্যের পরিপন্থী সেটা দেখানোর চেষ্টাই আমরা এখানে করব। আর তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে যে মনোভাব প্রকাশ করলেন তা শ্রমিক সম্পর্কে মালিকের মনোভাবের অনুরূপ। যখন ইচ্ছা কর্মীদের অপমান করার, তাদের কর্মচ্যুত করার যে অধিকার মালিকের থাকে। এখান খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, অশ্বিনী বৈষ্ণো ও অনন্ত হেগড়ে কি বিএসএনএল’কে ঘিরে মোদী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত নন? বিএসএনএল আজ যে দুর্বিপাকগ্ৰস্ত, চিররুগ্ন অবস্থায়, তার পিছনে মোদী সরকারের ভূমিকাই কি নির্ধারক হয়নি? বিএসএনএল আজও যে ৪জি পরিষেবা চালু করতে পারলনা, সেটা কি বিএসএনএল’এর ওপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায্য সরকারি নির্দেশেরই পরিণাম নয়? অনন্ত হেগড়ে আমাদের আরও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, সরকার বিএসএনএল’কে অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়েছে। বিএসএনএল কর্মী ইউনিয়নের কথায় এটা সত্যের অপলাপ ছাড়া অন্য কিছু নয়। সরকার ২০১৯ সালে বিএসএনএল’এর জন্য যে পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল তার থেকে শুধু বিএসএনএল’এর ৭৯,০০০ কর্মীদের ভিআরএস প্রদানই সম্ভব হয়েছিল। আর সে সময় বিএসএনএল’কে দেওয়া ৪জি স্পেকট্রামের ভিত্তিতে বিএসএনএল ২০২০ সালের মার্চ মাসে ৪জি পরিষেবা চালুর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার লক্ষ্যে ৯,০০০ কোটি টাকার টেন্ডার ডাকল। এরপরই দেখা গেল টেলিকম ইকুইপমেন্ট এন্ড সার্ভিসেস প্রমোশন কাউন্সিল (টিইপিসি) সংস্থা বিএসএনএল’এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে যে, বিএসএনএল ‘ভারতে নির্মাণ কর’ নীতি লঙ্ঘন করছে। তারপরই বিএসএনএল’এর ৪জি পরিষেবা চালুর আকাঙ্খা শিকেয় উঠল, মোদী সরকার বিএসএনএল’এর টেন্ডার বাতিল করে দিল। ‘ভারতে নির্মাণ কর’ নীতি অনুসরণের কোনো দায় যখন জিও, এয়ারটেল, ভোডাফোনের মতো বেসরকারি টেলি সংস্থার ছিলনা, তখন এই নীতিকে মানা ও তার প্রয়োগের দায়ভার বর্তালো শুধু বিএসএনএল’এর ওপরই।

বিএসএনএল কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পি অভিমন্যু তখন বলেছিলেন, “সব বেসরকারি টেলি সংস্থাই যখন আন্তর্জাতিক বিক্রেতাদের কাছ থেকে বিশ্বমানের ৪জি যন্ত্রপাতি কিনছে, তখন দেশীয় বিক্রেতাদের থেকে যন্ত্রপাতি কিনতে শুধু বিএসএনএল’কেই বাধ্য করা হবে কেন? ভারতীয় বিক্রেতাদের নির্ভরযোগ্য ৪জি প্রযুক্তি নেই। তাছাড়া, বড় আকারের নেটওয়ার্ক সামলানোর অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। আর তাই ভারতীয় বিক্রেতাদের কাছ থেকে ৪জি যন্ত্রপাতি কিনতে বিএসএনএল’কে বাধ্য করাটা টেলি পরিষেবা দায়ী বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাপেক্ষে বিএসএনএল’কে সমমানের ক্রীড়াক্ষেত্র প্রদানে অস্বীকার করা। বিএসএনএল ইউনিয়নের মতে, টিইপিসি একটা ক্রীড়নক ছাড়া অন্য কিছু নয়, ৪জি যন্ত্রপাতি সংগ্ৰহ থেকে বিএসএনএল’কে আটকানোর জন্য কায়েমি স্বার্থগুলো যাকে ব্যবহার করছে।” আমরা অতএব দেখতে পাচ্ছি, রিলায়েন্স জিও, এয়ারটেল, ভোডাফোন আইডিয়ার মতো বেসরকারি টেলি সংস্থাগুলো যখন অবাধে নোকিয়া, এরিকসন, স্যামসাং’এর মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি কিনে ৪জি পরিষেবা চালিয়ে যাচ্ছে, বিএসএনএল’কে তখন অনির্ভরযোগ্য দেশীয় বিক্রেতার ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করা হচ্ছে। টিইপিসি’কে দিয়ে যে কাঁটা ২০১৯ সালে বিএসএনএল’এর পথে বিছোনো হয়েছিল তা আজও ছড়িয়ে রয়েছে। অশ্বিনী বৈষ্ণো এবং অনন্ত হেগড়ে কি বিএসএনএল’কে আটকে রাখার এই আখ্যান সম্পর্কে সত্যিই অবহিত নন?

বেসরকারি সংস্থাগুলোর ৪জি পরিষেবা দিতে থাকা এবং বিএসএনএল’কে ২জি’র মধ্যে আটকে রাখার ফল যা অনিবার্য ছিল তাই হল — বিএসএনএল’এর গ্ৰাহক ভিত্তি কমতে থাকল, রাজস্বের ক্রমান্বয়ী ক্ষয়ে সে চলে গেল ক্ষতির গ্ৰাসে। কয়েক বছর আগে ফিরে তাকালে দেখা যাবে ২০০৫ সালে টেলি বাজারে বিএসএনএল’এর অংশ ছিল ২১ শতাংশ, এয়ারটেল’এর ছিল বিএসএনএল’এর প্রায় সমান অংশ এবং রিলায়েন্স কমিউনিকেশন’এর অংশ ছিল এরচেয়ে সামান্য বেশি। কিন্তু বিএসএনএল’কে পশ্চাদবর্তী অবস্থানে ফেলে রাখায় গ্ৰাহকরা বিএসএনএল’এর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে থাকলেন। একটা হিসেব বলছে, গত পাঁচ বছরে উন্নত পরিষেবা পেতে বিএসএনএল ছেড়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোর দিকে ঝুঁকেছেন প্রায় দু’কোটি গ্ৰাহক এবং আজকের এই ২০২২ সালে টেলি বাজারে বিএসএনএল’এর অংশ মাত্র ১০ শতাংশ। জানানো হয়েছিল, এবছরের ১৫ আগস্ট বিএসএনএল ৪জি পরিষেবা শুরু করতে পারবে। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, এবছরেও তা হবে না, সামনের বছর হতে পারে। কারণ, ৪জি পরিষেবা শুরুর জন্য যে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তা এখনও সংগ্ৰহ হয়নি এবং যে দেশীয় বিক্রেতা টিসিএস বিএসএনএল’কে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে, সব যন্ত্রপাতির জোগাড় তারাও করে উঠতে পারেনি। পরিস্থিতির এমনই পরিহাস, বেসরকারি সংস্থাগুলো যখন ৫জি পরিষেবা চালু করার মুখে, তখনও বিএসএনএল’কে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে দেশীয় বিক্রেতার মুখের দিকে — কখন তাদের অনুগ্ৰহে বিএসএনএল’এর পক্ষে ৪জি পরিষেবা চালু করা সম্ভব হবে। এই ৪জি পরিষেবা শুরুর বিলম্বের কারণেই উন্নত টেলি পরিষেবা ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টির সুযোগ থেকে বিএসএনএল লাগাতার বঞ্চিত হয়ে চলেছে।

ভারতে ৪জি পরিষেবা চালু হয় ২০১২ সালে, ফলে, পুরো একটা দশক বিএসএনএল’কে বৈষম্যে জর্জরিত করে পিছিয়ে রাখা হল। এবং তা করা হল টেলিকম বাজারে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কর্তৃত্বকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যেই। বিএসএনএল’এর প্রতি প্রবল আক্রোশ থেকে অনন্ত হেগড়ে বলেছেন, “বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে আমরা একে (বিএসএনএল’কে) শেষ করে দিচ্ছি এবং বেসরকারি খেলোয়াড়দের তার স্থান দখল করতে দিচ্ছি”। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার প্রতি এই বৈর অভিপ্রায়, বেসরকারি সংস্থার স্বার্থ সিদ্ধির এই আকুলতাই বিএসএনএল’কে ঠেলে দিয়েছে বিপন্নতার অতলে, ফেলে রেখেছে জীবন্মৃত অবস্থায়। কিন্তু এটাই কি বিএসএনএল’এর অমোঘ নিয়তি হবে? টেলিকম বাজারে প্রবল উপস্থিতি থেকে তার আজকের এই নগন্য অস্তিত্বকেই কি আমরা মেনে নেব? রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের এই সংস্থাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধেই আমাদের বরং আওয়াজ ওঠাতে হবে — পুনরুজ্জীবন প্যাকেজের প্রতি সরকারকে আন্তরিক হতে হবে; বিএসএনএল’এর বিরুদ্ধে চালানো বৈষম্য ও বঞ্চনার ইতি ঘটিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমান সুযোগ বিএসএনএল’কেও দিতে হবে। আর সেটা করলে বিএসএনএল নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে লোকসানের ধারাকে অতিক্রম করে মুনাফার পথে অবশ্যই ফিরে আসতে পারবে।

- জয়দীপ মিত্র

Sheikh Mokshed Ali

৩১ অগস্ট ২০২২ প্রয়াত হলেন উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সিপিআই(এমএল) সদস্য শেখ মোকশেদ আলি। কমরেড মোকশেদ আশির দশকে নৈহাটির শিবদাসপুর অঞ্চলে পার্টির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত শিবদাসপুরের ইঁটভাটা ইউনিয়নের শ্রমিক ও সভাপতি হিসেবে তিনি শ্রমিক আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সিপিআই(এমএল)-এর হয়ে একবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হন ও মাত্র আঠারো ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত হন। এলাকার অত্যন্ত জনপ্রিয় মানুষ, দক্ষ পার্টি সংগঠক কমরেড মোকশেদ ৭৮ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। আমরা তাঁর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত।

কমরেড মোকশেদ লাল সেলাম।

In memory of Comrade Amal Bhattacharya

বর্ষীয়ান সিপিআই(এমএল) সদস্য কমরেড অমল কুমার ভট্টাচার্য, কাল্টুদা নামেই যিনি বেশি পরিচিত ছিলেন, গত ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তিনি রেখে গেছেন একমাত্র কন্যা, জামাতা, নাতনি সহ পার্টির সাথী-সহকর্মীদের। তাঁর প্রয়াণে কলকাতা পার্টি সংগঠন ও রাজ্য নেতৃবৃন্দ শোকপ্রকাশ করেছেন।

কমরেড কাল্টুদা সাফল্যের সাথে সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে স্বদেশী পিতার হাত ধরে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। কৈশোর এবং যৌবনে বক্সিং এবং ক্লাব সংগঠনের মাধ্যমে সমাজকর্মী হয়ে ওঠেন। তারপর আরসিপিআই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে বামপন্থী ও কমিউনিস্ট ঘরানায় প্রবেশ করেন। পেশাগতভাবে ছিলেন জেকেবিএম লিমিটেড কোম্পানির অ্যাকাউন্ট্যান্ট। কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে চাকরি খোয়াতে হয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে সিপিআই(এমএল) গঠনের সময়ে ভবানীপুর অঞ্চলে সংগঠন গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তারপর ১৯৭০-৭২’র রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আবহে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সাল নাগাদ এলাকায় ফিরে আসেন এবং সিবি বোট কোম্পানিতে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে যুক্ত হন। পরবর্তীতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পার্টিকে এলাকায় পুনর্গঠনের কাজে হাত লাগান এবং গণফ্রন্টের কাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। ভবানীপুর অঞ্চলে উনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পার্টিকর্মী এবং কিছুদিনের জন্য লোকাল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। তাঁর বাড়ি হয়ে উঠেছিল পার্টির গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকদের আশ্রয় ও মিটিং করার জায়গা। ১৯৯১ সালে পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং পার্টির পরিচিতির বিকাশের অঙ্গ হয়ে ওঠেন।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি বাসস্থান বদলের কারণে যাদবপুর অঞ্চলের পার্টি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে গরফা মণ্ডলপাড়া অঞ্চলে সংগঠনের কাজ শুরু করেন। এছাড়াও উনি বিভিন্ন সময় মহেশতলা-বজবজ সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। শেষের দু’দশক পুনরায় যাদবপুর অঞ্চলে পার্টির সাথে যুক্ত থেকে বিভিন্ন গণআন্দোলন ও পরিবেশ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যাদবপুর ঢাকুরিয়া অঞ্চলে স্থানীয় একটি ঝিল সংরক্ষণের দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পরিবেশ আন্দোলনে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। প্রমোটার-রাজনৈতিক নেতার দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় দশক ধরে জনগণকে সমাবেশিত করে পরিবেশ রক্ষার এই আন্দোলনে স্থানীয় মানুষের বিপুল সমর্থন নিশ্চিত করেছিলেন। সাধারণ মানুষের সাথে সহজে মিশে যাবার গুণাবলী নিয়ে পার্টি-অন্ত-প্রাণ এই মানুষটি ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকে কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন, সেই স্মৃতি আমাদের অনুপ্রেরণায় চিরস্থায়ী থাকবে।

কমরেড কাল্টুদা লাল সেলাম।

== 00 ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-35